গল্প

গল্প- আড়িভাব

আড়িভাব
লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

দেখ সরি (সৌরশ্রী), এবার যদি তোর মামাবাড়ি হরিপাল না নিয়ে যাস তোর সাথে আড়ি কিন্তু। খানিক অভিমানী কন্ঠে বলল তনু (তনুশ্রী)। তনুকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করল মিঠু ও মৌলি।

সৌরশ্রী তনুর কথা শুনে বেশ কিছুটা মৃদু হাসি দিয়ে বললো, আড়ি তো আড়ি। ‘আড়ি আড়ি কাল যাবো বাড়ি ।পরশু যাবো ঘর। এক ঘটি জল নিয়ে মাথা ঠুকে মর।’

মিঠু আর মৌলির সঙ্গে তৎক্ষণাৎ অভিমান ভুলে তনুও গলা ছেড়ে বলতে লাগলো ছোট্ট বেলার অতি প্রিয় আড়িকে নিয়ে বানানো ওদের প্রচলিত ছড়াটা।

ছড়া শেষ করে চার জনে সেকি হাসি! মনেই হলো না ওদের কারোর বাতের ব্যথা, বা কারোর হাঁপানি আছে ।

এদের গগন ভেদী হাসির রোল শুনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সৌরশ্রীর একমাত্র নাতনি তিতলি। ছয়ে পা দিয়েছে মাস খানেক আগে ।মোবাইলে গেম বন্ধ করে সে চুপচাপ ঠাম্মীদের ছেলেবেলা রেকর্ড করতে লাগলো ওর মায়ের মোবাইলে।

সৌরশ্রীদের হাসি থামতেই তিতলি পাকা বুড়ির মতো বলে ওঠে, ঠাম্মী পাপা আজ অফিস থেকে ফিরলেই আমি পাপাকে বলে দেবো যে তোমার নামটা যেন লাফিং ক্লাস থেকে কাটিয়ে দেয়।

সৌরশ্রী ডান হাত বাড়িয়ে নাতনিকে কাছে ডাকল। তারপর আলিঙ্গন করে বলল, কেন এমন ডিসিশন নিল আমার তিতলি সোনা?

তিতলি বেশ গাম্ভীর্যের সাথে বলল, বলব না ।মাসে কতগুলো টাকা জলে যায় বলো তো। পাপা ভেবেছিল তুমি নাকি হাসতে ভুলে গিয়েছো। তাই তো ওখানে তোমাকে ভর্তি করে দিয়েছে। কিন্তু এই ভিডিওটা দেখলেই পাপা সব টের পাবে।

তনু কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে তুমি গিয়ে ভিডিওটা যাকে খুশি তাকে দেখাও। এখন আমরা গল্প করবো তুমি এসো।

সৌরশ্রী তাড়াতাড়ি তনুকে ধমক দিয়ে বলল, এই তনু। ছাড় না ছোট মেয়ের কথা।

মিঠুও সৌরশ্রীকে সমর্থন করে বলল, হ্যাঁ তনু তুই চুপ কর। আমরা ওদের ঘরের অতিথি মাত্র। আমরা চলে গেলে সৌরশ্রীকে ওর বৌমা কি ছেড়ে কথা বলবে ভাবছিস?

ইতিমধ্যে তিতলি সুড়সুড় করে ওর মা পিউ-এর কাছে হাজির। পিউ তার সুসজ্জিত মডিউলার কিচেনে শাশুড়ির অতিথিদের জন্য চা জলখাবারের ব্যবস্থা করছিল। পিউ যেন এ যুগের পারফেক্ট মহিলা। ঘর বাইরে দুটোই দক্ষতার সাথে সামলাতে পারে। পিউ একটি বেসরকারি স্কুলের ইংলিশের টিচার। সেই সুবাদে দুটো কোচিং সেন্টারে পড়াতেও যায়। তার ওপর আছে তিন তিনটে বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব। না না পিউ শুধুমাত্র তিতলিরই গর্ভধারিণী। কিন্তু তার শাশুড়ি মা হচ্ছে বয়ষ্ক বাচ্চা আর স্বামী হচ্ছে মাঝ বয়সী বাচ্চা ।প্রত্যেককে সব কিছু মুখের সামনে ধরে না দিলে তারা নাকি কিছুই করতে পারে না এই রকম কথা বলে বেড়ায় পিউ আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী এবং কলিগ ও বন্ধু বান্ধবদের মহলে।

সৌরশ্রী স্বামী হারার পর থেকে চারবেলা রান্নার দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়েছে। নিজে ইচ্ছে করে রান্না ঘরে ঢোকে না তা নয় কিন্তু। সৌরশ্রীর একমাত্র সন্তান সৌমেনই বারংবার বলে সৌরশ্রীর এতদিনের অভ্যাসটাতে এই তিন বছর হলো বিরতি টানতে পেরেছে ।

সৌমেন একজন কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসার। তার ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ার মতো। জীবনের সব দিকেই আছে তার পরিমিত বোধ। আবেগ অনুভূতিতেও সে হিসাবী ।পিউ এর প্রফেশনাল লাইফে যেমন সে হস্তক্ষেপ করে না আবার তাদের বৈবাহিক জীবনে পিউকে অতিরিক্ত ছড়ি ঘোরাতেও দেয় না।

পিউ-এর যত লম্ফ ঝম্ফ শুধুমাত্র শাশুড়ি মাতার কাছে। সৌরশ্রীও ভীষণ বুঝদার। সে বোঝে জেনারেশন গ্যাপ কথাটার মর্মার্থ। তাই খ্যামকা পিউ-এর সাথে ঝামেলায় জড়াতে যায় নি আজ পর্যন্ত। সৌরশ্রীর এই বুদ্ধিমত্তার কাছে পিউ সবসময়ই ক্লিন বোল্ড হয়। আর এটাই তার সবচেয়ে বেশি রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অতিথিদেরকে চা জলখাবার পরিবেশন করতে এসে, পিউ খানিক ঠেস দিয়ে বলল, মা আগামী দুই চার দিন আর লাফিং ক্লাসে গিয়ে কাজ নেই। মনে হচ্ছে সারা সপ্তাহের হাসি এই কয়েক মিনিটেই হয়ে গেল।

সৌরশ্রী একগাল হাসি দিয়ে বললো, পিউ তোমারা ছোটবেলাতে আড়ি ভাব খেলতে?

পিউ কিছু একটা কঠিন করে উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু ছোট্ বেলা শব্দটা শুনেই সেও কেমন অস্থির হয়ে উঠল নিজের ছেলেবেলার স্মৃতি চারণ করতে। কাঠের চেয়ারটা ডাইনিং হল থেকে টেনে এনে যোগ দিল ওদের শৈশবের আড্ডাতে।গলগল করে বলতে লাগলো পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড়ি ভাবের কতসব মজার গল্প। মাঝে মধ্যেই হাসির আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো ।তিতলি ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠল, তাহলে আমাকে কেন ঘর থেকে বের হতে দাও না মা।

তনুশ্রী এবার তিতলিকে কোলের কাছে টেনে এনে বলল, তিতলি সোনা এখনকার দিন কাল যে খুব খারাপ। মানুষের মধ্যে সরলতা অনেক কমে গেছে। পাড়ার লোকজন কেমন, বোঝা খুব কঠিন সোনা। মা তার স্কুলে যায়, পাপা অফিস যায়। ঠাম্মীর বয়স হয়েছে। তোমার পিছন পিছন দৌড়াতে পারবে না সবসময়। তাই তো তোমাকে ঘরে থাকতে হয়।

পিউ বলে উঠল, মা তিতলি বলছিল তোমরা কোথাও একটা যাওয়ার কথা বলছিলে?

তনু বলে উঠল, তোমার শাশুড়ি মায়ের মামাবাড়ি যাওয়ার কথা হচ্ছিল ।

পিউ চোখগুলো কপালে তুলে বলল, বলেন কি? সে তো অনেক দূর!

মিঠু বলে, হোক না দূর। শহরের মেকি ব্যস্ততা ছেড়ে যদি দু একটা দিন গ্রামের মাঠ ঘাট খেত খামারে হারিয়ে যাওয়া যায় তাতে তো কারোর কোনো অসুবিধা নেই।

পিউ কিছুক্ষণ চুপ রইল ।তারপর বলল, মা তাহলে কবে যাবেন বলুন? আমি আপনার ছেলেকে বলছি আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে।

সবার যাওয়ার আগ্রহ দেখে সৌরশ্রীর আনন্দ হলেও মনে মনে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠল। মুখে হাসি রেখে সেও সম্মতি জানালো মাত্র।

সৌমেন গ্যারেজে তার দুই চাকার বাহনকে রাখার সময় বেশ বুঝতে পারছিল যে আজ তাদের বাড়ির পরিবেশটা মেনগেটের পাশের মাধবীলতার সুগন্ধের আবিষ্ট। শুধু গন্ধে নয় মাধবীলতার রং-এ রঙিন হয়েছে তার মা ও বৌ এর মন। মা আর বৌ এর তাল মিলটা বেশ লাগছে সৌমেনের। অফিসের কাজের চাপ ভুলে সেও গুনগুন করতে করতে ডানহাতের তর্জনীতে বাইকের চাবিটাকে গোল গোল করে ঘোরাতে ঘোরাতে সৌরশ্রীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।

সৌমেনকে দেখা মাত্রই তিতলি ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। তারপর বললো, পাপা আমরা সবাই মিলে ঠাম্মার মামা বাড়ি যাবো। মায়ের সাথে ঠাম্মার আজ খুব ভাব হয়েছে।

সৌমেন একটা স্নেহের চুম্বন দিয়ে তিতলিকে বলল, তাই, এ তো দারুণ ব্যাপার।

পিউও গলায় খানিকটা মধু ঢেলে বলল, তুমি তো কোনোদিন বলো নি তোমাদের গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার এত সুন্দর একটা ব্যবস্থা আছে?

সৌমেন শুধুমাত্র হালকা একটু হাসি দিয়ে ওর রুমে চলে গেল। সৌমেনের পিছন পিছন পিউ ও তিতলিও বের হলো সৌরশ্রীর রুম থেকে।

তনুদের এবার যাওয়ার পালা। একটা আস্ত বিকাল যেন আনন্দের জোয়ার এনেছিল সৌরশ্রীর একঘেয়ে জীবনেতে। কথায় কথায় কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা থেকে রাত আটটা বেজে গেছে টের পায় নি ওরা কেউ।

যথারীতি তনু, মিঠু, মৌলিদের বাড়ি থেকে ফোন আসতে শুরু করে। সৌমেন ভিতরের ঘর থেকে তিতলিকে দিয়ে বলে পাঠায়, সে চেঞ্জ করে গাড়ি বের করছে। প্রত্যেককে তাদের বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসবে।

রাতে খাবার টেবিলে সৌমেন বলল, মা যাও না একবার তোমার বান্ধবীদের নিয়ে হরিপাল ঘুরে এসো। পিউ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আর আমরা মানে আমি আর তিতলি?

সৌরশ্রী বলে, যদি আমি যাই তাহলে তোমাদেরকেও নিয়ে যাবো বৌমা। কিন্তু ওখানে যাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে।

ভ্রু কুঁচকে সৌমেন বলল, সমস্যা?

হ্যাঁ রে। মামারা তো কেউই জীবিত নেই। আছে শুধু ছোট মামী। ওনারও বয়স হয়েছে। ওনার ছেলে বৌমার সাথে আমার সামান্যতম যোগাযোগও নেই। তার ওপর শুনেছি ওদের আর্থিক সঙ্গতিও তেমন নেই। আমরা এতগুলো মানুষ গেলে খরচাপাতি তো আছে ।

এটা তো ভাববার বিষয়। ঠিক আছে দুটো দিন ভেবে দেখি। কিছু সমাধান বেরিয়ে আসে কিনা। আসলে সম্পর্কের টানগুলো আলগা হতে হতে অবহেলায় ঝুলে পড়েছে বর্তমানে। এখন সম্বল বলতে শুধুমাত্র অতীতের সুখ স্মৃতি মাখা সোনালী শৈশব আর আমাদের কিশোরী জীবনে বাঁধন হারা কয়েকটা দিন।

সৌমেনের থেকেও বেশি ভাবনায় পড়েছে পিউ ।রাতে বালিশে মাথা রেখেও কিছুতেই ঘুম আসছে না।

পিউ এর অস্থিরতা সৌমেন টের পায়। পিউ- এর হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, কি ব্যাপার বল তো তোমার? এত কেন গ্রামে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছো?

পিউ বলে, জানো আমি ছোট্ট বেলায় থুরি কিশোরী বেলায় একবার গ্রামে গিয়েছিলাম আমার বড় পিসির বিয়েতে নিত কনে হয়ে। আজও মনে আছে বিকাল বেলায় চৈ চৈ করে হাঁসদের ডাক দিলেই তারা দল বেঁধে মাঝ পুকুর থেকে সাঁতরে পারে উঠে এলো। তারপর সোজা তাদের থাকার ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ত। পানকৌড়ি ডুব দেখে তো আমি সাপ সাপ করে চিৎকার করেছিলাম। পুকুর পাড়ের কাছে একটা বিরাট তেঁতুল গাছ ছিল দিদির শ্বশুরবাড়ি তে। সেটা তে একটা মাচা বাঁধা ছিল। সারা দুপুর আমি আর দিদির দেওর মানিক সেখানে বসে কত গল্প করে ছিলাম। সন্ধ্যা বেলায় ঝিঁঝিঁপোকার ডাকে কেমন যেন একটা মাদকতা ছিল। রাত্রি নটার মধ্যেই চোখ জুড়ে ঘুম এসে জড়িয়ে ধরত।রাতে লোডশেডিং হলেও পুকুর এর শীতল হাওয়া ভরিয়ে দিত ক্লান্ত শরীর। পিউ বলেই চলেছে। ত্রিশ বছর আগে গাঁ ঘরে কাটানো তার মাত্র দুটো দিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ।

সৌমেন এর ঘুম নেমে এসেছে চোখের পাতায়। আজ তার মনে সামান্যতম অশান্তির আঁচ নেই। তার মা আর বৌ এর মধ্যে আজ আড়ি নেই। কেবলই ভাব। শুধুমাত্র ছেলেবেলার সুখ স্মৃতিকে কেন্দ্র করে ।তারা দুজনে মিলে একটা সন্ধ্যা তো খুব আনন্দের সঙ্গে কাটিয়েছে। আজ আর শোবার আগে পিউ তার অভিযোগের খেরো খাতা নিয়ে বসল না। পিউকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সৌমেন বলল, তোমাদের শাশুড়ি বৌমার আড়ি ভাব খেলাটা কিন্তু দেখবার মতো। পিউ সৌমেনের বুকে মুখ গুঁজে প্রাণ ভরে ডিওটোরেন্ট- এর সুগন্ধের লম্বা ঘ্রাণ নিয়ে বলল, কি আশ্চর্য। আমাদের ঝগড়াটাই তোমার চোখে পড়ে সবসময়!

সৌমেন পিউ-এর ওষ্ঠ যুগলে দীর্ঘ একটা চুম্বনের বারিধারা বর্ষণ করে বলল, এত বছর পর তোমাদের ভাবটাও নজর কাড়লো ।

পাশের ঘর থেকে সৌরশ্রীর গল্প পাঠ কানে আসতে লাগল। রোজকার মতো আজও সে ছোট্ট তিতলিকে ঠাকুমার ঝুলি পড়ে শোনাচ্ছে ।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page