অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- ভুল

    ভুল
    – তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

     

     

    অফিসের একটা কাজের ব্যাপারেই প্রথম ফোনে যোগাযোগ ওর সাথে। ফোনের সেই মিষ্টি গলাটা শুনতে শুনতে কখন যেন মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো। কারণে অকারণে কাজের অছিলায় ফোন করতে শুরু করলাম। ও হয়তো বুঝতো কিন্তু আমি ভাবতাম হয়তো বোঝেনি।

    তারপর সেই ফোনালাপ পেরিয়ে দেখা হলো একদিন। কবেকার সে’সব কথা- আমার অফিস কোলকাতায় আর ও অনেকটাই দূরে, সেই ব্যারাকপুর। তা-ও দেখা হতো, কথা হতো, তারপর ক’বে যেন আমার ঘরের চৌকাঠ পেরোলো ওর আলতা রাঙা পা।

    অনেক রঙীন আলো সারারাত জ্বলেও ভোরের দিকে ক্লান্ত তো হয়- নিভে তো যায় সেই আলো।
    সুন্দর সাজানো তটভূমিতে বালির ঝড়ও তো ওঠে? ঠিক তেমনি বাসা ভাঙা পাখির মত পড়ে রইলাম আমি। ও চলে গেলো ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে- সেই আলতা রাঙা পা রক্তে রাঙা হলো ।

    আমার দায়কে কিভাবে অস্বীকার করবো আমি? পারিনা- পারিনা তা। আমার এই বদমেজাজ, সন্দেহবাতিক মন, জেদ, নিজের কাজে ডুবে গিয়ে ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা।

    আজ পাঁচবছর- ডিভোর্সের পরে নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করেছি। পাল্টাতে চেষ্টা করেছি নিজেকে। মেডিটেশন করেছি, দীক্ষা নিয়েছি, শান্ত হয়েছি, বয়সের সাথে সাথে আজ কিছুটা পরিণতও হয়েছি।

    না, অন্য কোন মেয়েকে আর মনে ধরেনি।গল্প করেছি, কথা বলেছি ওদের সাথে-ওদের কেউ কেউ মায়া দেখিয়ে কাছে আসার চেষ্টাও করেছে কিন্তু আমি ব্যবধান বাড়িয়েছি। আমি কাউকে চাইনা। শুধু ওকে আমার ভীষণ দরকার- আমার মল্লিকাকে।

    কিন্তু ওর মত শান্তশিষ্ট, মিষ্টি, কোমল মনের মেয়ের সামনে আমি কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো?হয়তো ও ভালো আছে- হয়তো নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে ও। হয়তো আমাকে ভুলে গেছে, আমি তো খুব বাজে একটা মানুষ।

    আবার ফোনে ওর মিষ্টি গলাটা শোনার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। মোবাইলে ওর নম্বরে কল করলাম…বাজছে ফোনটা…ও’কি ধরবে না? ও কি আমাকে ক্ষমা করে দেবে না?

    কিছুক্ষণ রিং হবার পর ফোনের ওপার থেকে মোটা গলার এক পুরুষ কন্ঠ ফোনটা ধরলেন।
    কাকে চাই বলতে বল্লাম মল্লিকাকে একটু দিন না।
    বিস্ময়ভরা কন্ঠে লোকটি বললেন- মল্লিকা?
    না, সেইনামে এখানে কেউ থাকে না তো।

    আমি বললাম, কিন্তু এটাতো মল্লিকার নাম্বার।
    লোকটি গম্ভীর শব্দে ঈষৎ হেসে বললেন-স্যরি, রং নাম্বার…এটা আমার ফোন নাম্বার।দেখুন হয়তো ভুল টাইপ করেছেন কিংবা হয়তো সে ভুল নাম্বার দিয়েছে আপনাকে।

    ফোনটা কেটে দিলাম।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সোয়াপিং

    “সোয়াপিং “
    – উজ্জ্বল সামন্ত

     

     

    সোয়াপিং শব্দটার প্রায় সকলেই পরিচিত। Swapping (verb) যার বাংলা মানে দাঁড়ায় বদলা বদলি করা। অদল বদল /বিনিময় অনেক কিছুর হয়ে থাকে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী থেকে শুরু করে যেকোনো পণ্য কেনাবেচা মূল্যের বিনিময়ে । কিন্তু সম্পর্কের বিনিময়, তাই আবার হয় নাকি ! এটা ভাবলে ভুল হবে না আধুনিক সমাজে। এরকমই এক বাস্তব গল্পের শুরু হয়-

    ওরা দুজন স্কুলের বন্ধু । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একজন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ডিগ্রি নিয়ে কর্পোরেটে উচ্চপদে আসীন। মোটা মাস মাইনে সমাজের এলিট সম্প্রদায়ের একজন হয়ে উঠেছে অতীশ। দ্বিতীয় বন্ধু শিল্পী মানুষ। শিল্পই নেশা ও পেশা সোহমের।

    স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়াতে কারোর মধ্যে যোগাযোগ ছিল না। দুজনে আলাদা কলেজে পড়তো। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় অফিসের গাড়িতে সোহমের ধাক্কা লাগে। বন্ধুকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে যায় সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। সোহমকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে অনিশা দরজা খুললে স্বামীকে আহত অবস্থায় দেখে উদ্বিগ্ন হয়। অনিশা আধুনিকা পরমাসুন্দরী, ভাগ্যবশত ওর এক্স ফ্রেন্ড। ওর পীড়াপীড়িতে এক কাপ চা খেয়ে বাড়ি ফেরে। রাত্রে অনীশাকে মনে করে অতীশ । পরদিন ফোনে বন্ধুর খবর নেয় ও নিজের বিবাহ সংবাদ জানায়। সোহম ও স্ত্রীকে নিয়ে অতীশের বিয়েতে আসে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে। প্রায়ই যাতায়াত লেগেই থাকে সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়।

    কিছু মাস পর অতীশ প্রস্তাব দেয় সোহমকে যে ওয়াইফ সোয়াপিং এর। প্রথমে সোহম হেসে উড়িয়ে দেয়, অতীশের কথা সিরিয়াসলি নেয় না। অনীশার প্রতি আকর্ষণে বারবার প্রস্তাব দেয় অতীশ। সোহম অনীষাকে ব্যাপারটা জানায়। অনিশা কোন উত্তর দেয় না। হঠাৎই অনীশার একমাত্র ছেলের হার্ট ব্লক নিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়। বিপুুল অর্থ ব্যয়়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য সোহমের নেই।
    অদৃষ্ট বা নিয়তির পরিহাসে আত্মীয় স্বজনের কাছে সাহায্য না পেয়ে কোটিপতি বন্ধুর কাছে ধার নিয়ে ছেলেকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরে।

    দুই বন্ধু কিছু মাস পর বেড়াতে যায় পাহাড়ে নিজের পরিবার নিয়ে। হোটেলের ঘরে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে, চার বন্ধুর মদের ঠেকে আবার সেই কথা ওঠে। নেশার ঘোরে উভয় পক্ষ রাজি হয়ে গেলে ওয়াইফ সোয়াপিং এর কল্পনা বাস্তব রূপ নেয় । পরদিন সকালে সোহম আর অনীশা অতীশ ও তার স্ত্রী মলিনাকে না জানিয়ে স্টেশন থেকে তৎকাল টিকিট করে বাড়ি ফেরে।

    কিছু মাস কেউ কারো সঙ্গে দেখা হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবারে মদ্যপান কে বিলাসিতা ভাবা হয় সেখানে সোহম…! আত্মগ্লানিতে ভুগে মনে মনে দোষারোপ করতে থাকে নিজেকে । কেন সে রাজী হল, এই অসম্মান লজ্জাজনক ব্যাপারটায় !

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সব শেষ

    সব শেষ
    – রাণা চ্যাটার্জী

     

     

    “আরে চাচা মুঝে ড্রাইভ করনে দো না, আপকা নিঁদ আ গয়া”- খলিল দু’ চার বার অনুরোধ করলো ড্রাইভারের আসনে বসা বছর পঞ্চাশের তামিল ড্রাইভারকে। তামিলনাড়ুর নাম্বার প্লেটের বাসটা ত্রিশ জন পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে গত কাল ভোরে  বেরিয়েছে । একজন ড্রাইভার সঙ্গেই আছে, সে কাল প্রায় সারাদিন একাই চালিয়ে এতটাই কাহিল, রাতে ধুম জ্বর।

    ভোর চারটের সময় কোনো এক অজানা অচেনা জায়গায় হাই রোডের ধারে বাস থামলো। ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙতেই চাচা সকলকে নেমে ব্রাশ প্রাতকর্ম করার নির্দেশ দিতেই নজরে পড়ল একটা টহলরত ওড়িশা পুলিশের ভ্যান এসে খবরাখবর নিচ্ছে। দু’জন কনস্টেবল ফ্লাস্কের গরম চা, পাঁউরুটি, কলা প্রভৃতি দিয়ে দায়িত্ব পালনের দারুণ নজির রেখে গেল। বাসযাত্রীর প্রায় কুড়ি জনই নির্মীয়মান বহুতলের রাজমিস্ত্রি ও জোগাড়ে। বাকিরা চেন্নাইয়ের কাপড় কলের শ্রমিক। দীর্ঘ অপেক্ষা ও মানসিক বঞ্চনায় কেন্দ্র রাজ্য দড়ি টানাটানি শেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারায় শ্রমিকদের বাড়ি ফেরা আর কিছু ঘন্টার অপেক্ষা।

    চা খেয়ে ক্লান্তি সাময়িক কাটলেও আবার চোখ জুড়ে ড্রাইভার চাচার ঘুম নামতেই পেছনের সিটে বসা বছর কুড়ির খলিলের অনুরোধে সিট ছাড়লো চাচা। গ্রামের মোরাম রাস্তায় ট্রাক্টর চালানোয় অভ্যস্ত হাত আজ ভোরের শূন্য হাই রোডে স্পিড তুলতেই অসুস্থ ড্রাইভারটি হাঁ হাঁ করে সাবধান করে উঠলো, ক্লান্ত চাচা ঘুমিয়ে গেছে। খলিলের মনের মধ্যে বাড়ি ফেরার আনন্দ, ভাইপোর মুখ ভাসছে তার ওপর কাল ঈদ উৎসব পালন।

    হঠাৎ এক বিকট শব্দ-ধোঁয়ায় একাকার, কিচ্ছুটি চোখে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ এম্বুলেন্স স্থানীয় উদ্বিগ্ন লোকজনের ভিড় বাড়ছে, সবার মুখে চরম আফসোস। চাপ চাপ রক্তে এতগুলো মানুষের মৃত দেহে আচমকা বাতাস ভারী করেছে। একটা ভারী ডাম্পার সজোরে এসে ধাক্কা মেরেছে আশি স্পিডে ছোটা এই পরিযায়ীদের বাসটাকে। যে যেখানে খলিল, চাচা কেবিনে আর দু’জন সহ এতজন শ্রমিকের বেশির ভাগই স্পট ডেথ। বাকিদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভদ্রক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। বাড়ি ফেরার এত অপেক্ষা, বাসে করে এত দীর্ঘ যাত্রা, চাচাকে সাহায্য করতে যাওয়া সদ্য গোঁফ বেরুনো ছেলেটার কপালের দোষে কি যে হয়ে গেল । এতগুলো মানুষের বাড়ির লোকজনদের দুশ্চিন্তা যেন ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে গেল।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- পরম্পরা

    পরম্পরা
    – উজ্জ্বল সামন্ত

     

     

    এমন এক কাহিনী সমাজের চোখে প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া হয়তো কঠিন ।

    দেশের কোন এক সীমান্তের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা ও কন্যা তিন জনের সংসার। কন্যা একটু বড় হলে তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য দূরে পাঠানো হয়। বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ খুব কম কোনো এক অজানা কারণে। বাবা-মা তার সঙ্গে যোগাযোগ কম রাখেন। মাসে হয়তো একবার খবর আসে বাড়ি থেকে। মাসের প্রথম সপ্তাহে তার খরচের টাকা পৌছে যায়। সোহানা কারণ জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর পায় না, কেন সে বাড়ি প্রায়ই যেতে পারবে না।

    মেয়েটি সতীত্ব রেখেছে। কোন পুরুষের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক হয়নি। সে মানতেও পারেনা পর পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক, বিবাহের আগে। সোহানা স্বপ্ন দেখে স্বপ্নের পুরুষের। মনে মনে তার একটা চিত্র কল্পনা করে । ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে চিঠি আসে তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সোহানা বাড়ি ফেরে।

    পাত্রপক্ষ দেখতেও আসে। কন্যা যেন পণ্য সামগ্রী। তার রঙ ,রূপ, চেহারার যেন খোলাবাজারে নিলাম। অবশেষে মোটা পণে পাত্রপক্ষ রাজি হয়ে যায়। কোন মতে ধারদেনা করে করে বিবাহ নির্বিঘ্নে হয়। স্বপ্নের রাত্রে সোহানা ফুলশয্যার খাটে বসে অপেক্ষারত। আড়চোখে দেখে স্বামীর পরিবর্তে অন্য কেউ তার ঘোমটা নামিয়েছে।
    তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে।

    সোহানা প্রশ্ন করে: কে আপনি? এই ঘরে কেন এসেছেন?

    উত্তরে পুরোহিত জানায়: তোমার স্বামীর অনুরোধে বংশ পরম্পরা রক্ষার্থে আমি এই ঘরে এই মুহূর্তে।

    সোহানা তার স্বামীকে ডাকে। তখন তার স্বামী ঘরে আসে।
    সোহন: উত্তর দেয়, কুলো পুরোহিত সোহানার আজ রাতের সঙ্গী হয়েই কাটাবে। এটাই এই বংশের পরম্পরা। কূল পুরোহিত প্রথম ভোগের নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। বহু বছর ধরে এই পরম্পরা নাকি চলে আসছে।

    লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে সোহানার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে।

    তখন সোহানা প্রশ্ন করে: যদি তাদের পরিবারের কোন বিবাহিত নারীর স্বামী মারা যায়, তার জন্য কোন পরম্পরা আছে?
    সোহন: (তার স্বামী) চুপ করে থাকে। সোহানা প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।

    সোহানা দেয়ালে টাঙানো ছুরি বের করে পুরোহিত ও স্বামীকে আঘাত করে। রক্তে লাল হয়ে যায় ঘরের বারান্দা। নিজেকে আইনের হাতে তুলে দেয়। এভাবেই হয়তো একটা পরিবারের পরম্পরা শেষ করে নিজের আত্ম বলিদানে।

    সোহানা: পরম্পরা বংশের গর্বের হওয়া উচিত বলে তার মনে হয়, লজ্জা বা অপমানের নয়…

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- নাড়ির টান

    নাড়ির টান
      -রাণা চ্যাটার্জী

     

     

    “আমি কি ক্ষ্যাপা কালা যে ঘেরাটোপে রাখবি”- বলেই মুড়ির বাটিটা রেগে সরালেন মলিনা দেবী।

    স্বামীর মৃত্যুর পর, বড্ড চোখে রাখা শুরু করেছে ছেলে বউ। যতবার, মেয়ের বাড়ি গেছে, ওদের সন্দেহবাতিক মন, এই বুঝি মা,মেয়ে-নাতনিকে টাকা, গয়না বিলিয়ে দেবে!” শুধুই আশঙ্কার কালো মেঘ মনে।

    স্বামী প্রচুর গয়না বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ি, সম্পত্তি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সব ওনারই নামে।ইদানিং ‘মা অসুস্থ’,’মাথা খারাপ’,এসব রটনা  ছড়ানো হয়েছে নিজেদের স্বার্থে।

    বাবার তৈরি কারখানার মালিকও মা তাই, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছেলে টুবাই চঞ্চল হয়।”কি ব্যাপার মা, টিফিন করো নি, তুমি কাঁদছো”! সম্বিৎ ফিরলেও ফ্যাল ফ্যাল করে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে, চোখের জল মুছে জানালেন, “আজ মঙ্গলচণ্ডীর পূজা, গত বছরও তোর বাবা নিয়ে গেছিল,পুজো না দিয়ে খাই কি করে!” ওহ, এই ব্যাপার, দাঁড়াও রিকশা ডাকছি বলে, মোড়ের হারু রিকশাওয়ালাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় মন্দিরে যাবার।

    “আরে ও মাসিমা, এখানে নামছেন কেন, আপনার বাড়ি দূর আছে” বলে হারু যতই বলুক না কেন নাছোড়বান্দা উনি। “একটু আসছি দাঁড়া” বলে নেমে হাঁটতে লাগলেন। টুবাই বলে দিয়েছিল,”মায়ের মাথা খারাপ, হারু যেন কোন কিছুতে তর্ক না করে।” অগত্যা হারু চুপ করে রাস্তায় অপেক্ষা করে এই বুঝি মাসিমা ফিরবেন।

    দরমা ঠেলে এক জীর্ণ রং চটা বাড়িতে মলিনা দেবী ঢুকে হাঁকতেই, জন শূন্য উঠোন পেরিয়ে এক মধ্যবয়সী মহিলা এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। কত আপন জন যেন উভয়ে জড়িয়ে ধরল পরস্পরকে। মুহূর্তে এক অদ্ভুত আন্তরিকতায় দু’টি হৃদয় স্তব্ধ হলো।

    পূজার পুষ্প পরম স্নেহে কানীন সন্তানের মাথায় ছুঁইয়ে, প্রসাদ খাওয়ালেন মলিনা দেবী, পুরুষতন্ত্রের লাল চোখ এড়িয়ে। আবার ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, বড়লোক প্রতিষ্ঠিত প্রেমিকের মিথ্যা ভালোবাসার প্রলোভনের ফসল এই কন্যা। প্রথম সন্তানের প্রতি মায়ের এই নাড়ির টান আজও যে অমলিন তা মঙ্গলচণ্ডীর পূজার পুষ্পের ছোঁয়ায় পুনরায় প্রাণ সঞ্চারিত হলো। মায়ের অপার স্নেহ বরাবর সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকে, সমাজ সংসারের নানা বাধা প্রতিবন্ধকতা যতই প্রাচীর তৈরি করে, মা তো মা’ই হয়।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- বিকেলের আঁধার

    বিকেলের আঁধার

    -অমল দাস

     

     

    গত রাতে ফোনে কথা হয়েছিল আজ একটা ‘ফিনিসিং টাস্ক’ আছে। সেটা সম্পূর্ণ করে বিকেল বেলায় পাঁচটার মধ্যে দেখা করবে। সেই হেতু আজও অন্যান্য দিনের মত প্রত্যুষা নিউ মার্কেটের একটি অভিজাত রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অম্লানের জন্য অপেক্ষা করছে।

    অপেক্ষা যেন তার জীবনের ছায়া সঙ্গী এই সম্পর্কের মাঝে। দেখা করার প্রশ্নে তাকেই অপেক্ষা করতে হয়। বিয়ের কথা হলেও অপেক্ষা। এমনকি প্রেম নিবেদনের পর হ্যাঁ উত্তর শুনতেও এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অপেক্ষার এই দীর্ঘ সেতুর দৈর্ঘ্য আর কমেছে না তার জীবন থেকে।

    প্রত্যুষা একটি সংস্থায় চাকরি করে। অম্লান কিসের একটা ব্যবসা করে। মাঝেই মাঝেই ব্যবসার কাজে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কিন্তু কিসের ব্যবসা কবে কোন শহরে থাকে তা প্রত্যুষা জানে না। সময় হলে নাকি জানবে। প্রশ্ন জাগে, রাগ হয় কিন্তু নিষ্পাপ মুখের হাসিটা নিয়ে যখন দীর্ঘ দিন পর অম্লান এসে সামনে দাঁড়ায়, তখন সব প্রশ্নেরা, রাগ, অভিমান অদৃশ্য হয়ে যায় সেই হাসির আড়ালে।

    এই নিউমার্কেট চত্বরেই তাদের প্রথম আলাপ বছর কয়েক আগে। সেই আলাপ-ই আলপনা এঁকেছিল মনে। ক্ষণে ক্ষণে বাসা বাঁধারও স্বপ্ন দেখেছে চোখের নিস্পলক পাতায়। কিন্তু আত্মিক দূরত্বের কারণে আলপনার দাগ যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে চলেছে।

    হাতের মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই প্রত্যুষা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যত দেরি হোক আজ দেখা করেই বাড়ি ফিরবে। চরম সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে। তাতে সম্পর্ক না থাকে না থাকুক! কাঁদার হলে আগামী ছুটির দু’দিন বাড়িতেই একলা ঘরে কেঁদে নেবে। কিন্তু আর নয়… অনেক হয়েছে…

    এমন সময় একটি নিউজ চ্যানেলের খবরে চোখ আটকে যায়। আই.বি অফিসার অম্লান চ্যাটার্জী একটি সিক্রেট মিশনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, কোলকাতার মোমিনপুর এলাকায়। ছবিটা চোখে পড়তেই প্রত্যুষার চারিদিক আঁধার নেমে আসে। 

     

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- চানাচুর

    চানাচুর
    – সোমনাথ বেনিয়া

     

     

    খেলতে-খেলতে বাবার শরীরে মেয়ে অসাবধানতাবশত পেনসিলের শিষ ফুটিয়ে দেয় এবং সেই ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। বাবা মেয়ের এই কর্মকাণ্ডে ভয়ানক রেগে গিয়ে তাকে চড় মারতে উদ‍্যত হতেই মেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এদিকে মেয়ের কান্না শুনে মা ছুটে আসে এবং সমস্ত ব‍্যাপার শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে।
    এখন সেই বাবা বুঝলো দু-জন মিলে যদি মেয়ের উপর রাগ প্রকাশ করি তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সে এই পরিবেশকে হালকা করার জন‍্য মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বললো – ও তেমন কিছু হয়নি। খেলতে গেলে ওরম একটু লাগে।
    এই বলে সে হেসে ফেললো। তার হাসি দেখে মেয়ে হাসলো এবং মায়ের‌ও রাগ পড়ে গিয়ে ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এমন সময় সেই বাবা বলে, আমরা এখন চানাচুর, মুড়ি হলেই জমে যাবে।

    এই শুনে মা ও মেয়ে দু-জনে অবাক।

    তাদের অবাক হ‌ওয়া দেখে সে বলে- কী ভুল বললাম। এই দেখো আমার হাতের রক্ত যার স্বাদ টক। মেয়ের চোখের জল যার স্বাদ নোনতা। তোমার রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ যা আসলে ঝাল। আর আমাদের তিনজনের হাসি যা হলো মিষ্টি। সুতরাং চানাচুরের স্বাদ হলো কিনা …

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সরীরসৃপ

    সরীরসৃপ
    – অভিজিৎ আচার্য্য

     

     

    রোজ ঘুমাতে যাওয়ার আগে সাদা দেয়ালের উপর ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ফেলে দেখে নেয় মেয়েটা। ঘরের ভিতরে বসা দু’টো মোটকা টিকটিকির। ঘুমের ঘোরে গায়ে এসে পড়লেই হয়েছে। চারপাশ ভালো করে পরখ করে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

    অন্ধকার ঘরে জ্বলতে থাকে হালকা নীলচে আলো। অবিরাম ঘুরতে থাকে সিলিং ফ্যানের ব্লেড। টিউবের পাশে ঘাপটি দিয়ে বসে থাকে দুটো জীব। তারা বোঝে সময়। টিউবের আলো নিভে গেলে লকলকিয়ে ওঠে তাদের জিভ। আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে আসে দেয়াল বেয়ে। লালচে দু’ চোখে দেখতে থাকে শরীরের উপর খেলা করছে সরীরসৃপ।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- মনের উজানে সুজানা

    মনের উজানে সুজানা
    -শান্তনু ব্যানার্জী

     

     

    আকাশ পারিয়ালের অকাল প্রয়াণে মন নাচের স্কুলগুলো ধরে নেয়। বিয়ে করবে না বলেই দিয়েছে। রাতে এক ঘন্টার মতো ছাদে থাকে, সিগারেট টানে তারপর নেমে আসে। বর্ষায় একটা ছাতা। সারাদিনের কাজের পর এটুকুই বিনোদন। চারদিকে তাকিয়ে দেখা বা নিজের সাথে কথা বলা।
    বেশ দূরে একটা ছাদে একটা অবয়বকে নড়াচড়া করতে দেখত। দেখতে না পেলে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হতো।
    পূর্ণিমার রাতে একদিন লোডশেডিং। আলোছায়ায় গ্রিসীয় কিংবা মিশরীয় স্ফিংসের ছড়াছড়ি। একটু আনমনা হতেই মনের পাশে একটা অবয়ব এসে দাঁড়ালো। চাঁদনি রাতে প্রথম মন সুজানাকে সামনে থেকে দেখলো। বাড়ি ক্রোয়েশিয়ায়। প্রজেক্ট শেষ। কাল চলে যাচ্ছে ।
    হয়তো যোগাযোগটা ছিল ইথেরিয়াল।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- নেমকহারাম

    নেমকহারাম
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    -ও নাটার মা, ঘরে আছো নাকি?
    নাটার মা তখন সবে দুটো আলু আর দু’টাকা কিলো চাল ধুয়ে কাঠের জ্বালে হাঁড়ি চাপিয়েছে। সারা দিনরাতে, এটুকুই জোটে কোনও প্রকারে। হাঁক শুনে বেঁকে বেঁকে দরমার ফাটা দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো, চোখ কুঁচকে মদনের মুখের দিকে তাকিয়ে, বিরক্ত স্বরে খেঁকিয়ে উঠলো,
    – আরে এই হারামজাদা, তোকে হাজার বার বলেছি না.. আমাকে নাটার মা বলে ডাকবি না।
    মদন একটু থমকে গিয়ে বললো, – ও..হ্যাঁ, তা-ই তো…তারপরেই বললো, বেশ তা না হয় বলবো না, কিন্তু কী বলে ডাকবো বলো দেখি? এদ্দিনের অভ্যেস, ফস করে পালটে ফেলা যায়?
    নাটার মা তেজ বাড়িয়ে ময়লা থানের ছেঁড়া আঁচল কোমরে জড়াতে জড়াতে তিরিক্ষি হয়ে বললো,
    – যা মুখে আসবে তাই বলবি। যা খুশি তাই। ডাইনি রাক্ষসী পেত্নী, ঘাটের মরা যা খুশি বলে ডাকবি। একটু থেমে, প্রদোষ নিঃশ্বাসে বুক ভরে নিয়ে, গলায় কাঠিন্য এনে বললো, ‘যে সন্তান, বউ পেয়ে মাকে তাচ্ছিল্য করে, জঞ্জালের মতো ফেলে দিয়ে পালায়। ভুলেও একটা খবর পর্যন্ত নেয় না, তার নাম, মা ডাকের সঙ্গে জুড়ে দিসনি বাপ। পবিত্র মা ডাক নোংরা হয়ে যাবে। নেমকহারামের বিষে, বিষাক্ত হয়ে যাবে।’

You cannot copy content of this page