অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- তৃষ্ণা

    তৃষ্ণা
    – সোমনাথ বেনিয়া

     

     

    স্থান চেন্নাই। পুলক আর সুকান্ত গেছে রেলের পরীক্ষা দিতে। তারা যে হোটেলে উঠলো সেখানে পরিচয় হলো অবনীর সঙ্গে। অবনী থাকে সোদপুরে আর পুলক ও সুকান্ত বেলঘড়িয়ায়। ফলত প্রবাসে স্বজাতির লোক পেয়ে দু-পক্ষ‌ই আনন্দিত। নির্দিষ্ট দিনে তিনজনের পরীক্ষা হলো। কাকতালীয় ভাবে এক‌ই স্কুলে। ফলত একসঙ্গে যাওয়া, আশা এবং থাকায় তাদের মধ‍্যে সাময়িক ভালোলাগার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
    পরীক্ষার পরের দিন অবনীর বাড়ির ফেরার টিকিট। ওরা তার দু-দিন পরে ফিরবে। ফেরার রাতে অবনী ট্রেনে বসে আছে। সুকান্তর মন খারাপ না হলেও পুলক আর অবনীর মন কিছুটা উদাস হয়ে আছে। ক্ষণিকের ভালোলাগা অনেক সময় মায়া রেখে যায়। হঠাৎ অবনী বলে – আমাকে একটা জলের বোতল এনে দেবে।
    – হ‍্যাঁ বলেই পুলক দোকানের দিকে দৌড়ালো।
    জল আনতে পুলকের কিছুটা দেরি হচ্ছে দেখে সুকান্ত তাকে খুঁজতে বের হলো। ট্রেনের হর্ন বেজেছে। দেখা গেল পুলক হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে অবনীর হাতে জলের বোতল তুলে দিয়ে বললো – টাকা লাগবে না।
    এদিকে সুকান্ত এদিক-সেদিক ঘুরে পুলকে শেষে দেখতে পেয়ে ধমক লাগালো কারণ তারা সঙ্গে করে তাদের টিকিট আনেনি। যদি চেকার ধরতো! পুলক বুঝতে পারে। তবু তার আনন্দ যে সে অবনীর তৃষ্ণায় জল দিতে পেরেছে কিন্তু পুলকের চোখে-মুখে বিচ্ছেদের যে তৃষ্ণা জেগে আছে তা হয়ত সুকান্ত বুঝতে পারলো না …

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- দেওয়াল

    দেওয়াল
    – সোমনাথ বেনিয়া

     

     

    ছেলেটি একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কাজ করে। ইদানীং তার কাজের রিপোর্ট খারাপের দিকে যাচ্ছে কারণ তার জন্মগত শারীরিক ত্রুটির জন‍্য। বাইরে থেকে খুব একটা বোঝা না গেলেও সে মেরুদণ্ডের ডিফর্মেটিসে সব সময় একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। প্রথম-প্রথম এতটা শরীর খারাপ অনুভব করেনি কিন্তু যতদিন যাচ্ছে তার এই সমস‍্যা নানান অসুবিধ সৃষ্টি করছে। যেমন কোনো কিছুতে হেলান দিয়ে বসলে তার একটু আরাম হয়। কিন্তু সব সময় তা পাবে কোথায়। সহকর্মীদের সাথে গল্প করতে গেলে তাদের অনেকেই চেয়ার ছেড়ে দেয় বসার জন‍্য। কিন্তু বাসে-ট্রামে তো আর তা হবে না কারণ সে তো ফিজিক‍্যালি হ‍্যান্ডিক‍্যাপ্টড নয়। সমস‍্যা তো ভিতরে। কে বাইরে থেকে বুঝবে যতক্ষণ না বলা হয়। এখন লোকে অনেক চালাক হয়ে গেছে, বললে, বলবে – যেই বাসে উঠলো, অমনি শরীর খারাপ হয়ে গেল। সে আবার বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। ফলত কিছুটা ফাঁকা বাস দেখে উঠে, রাস্তা ভেঙে-ভেঙে বাড়িতে ফেরে। এতে ভালোই খরচ বাড়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে। কিন্তু তাকে এটা করতে হয় বাড়ির একমাত্র রোজগেরে বলে।
    একটা সময় দাঁড়ালো যে তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হলো। শারীরিক সমস‍্যায় তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। উর্দ্ধতন কতৃপক্ষ সব রকম চেষ্টা করেছিল যাতে চাকরিটা থাকে কিন্তু সে তো শয‍্যাশায়ী হয়ে পড়লো। এখন উপায়! সহকর্মী বন্ধুদের বলতো – আমার তো জন্মলগ্ন থেকেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে আছে। আর কী হবে? এখন সংসার চালাতে গিয়ে তার ব‌উকে কাজে নামতে হলো। কিন্তু তার ব‌উয়ের ভালো-ভালো সাজগোজ ও ঘন ঘন ফোন আসায় সে বুঝেছিল এখন শুধু শরীর নয়, নিজের মনটাও দেওয়ালে ঠেকে গেছে …

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- ফলন

    ফলন
    – প্রদীপ দে

     

     

    আকাশের মুখটা ভার। আবার বারিপাতও নেই। নামতা পড়ার মত মিডিয়ায় আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা ঘোষিত হয়েই চলেছে – সাবধান ওই বুঝি প্রলয় আসে! রোদ্দুর সকলেই চায়, কিন্তু সেও তো চায় নিস্তারিতে। নিয়মের ঘানি টেনে চলেন এক অশরীরী হর্তাকর্তা যাকে কেউ কোথাও কোনদিন দেখেনি।

    চাষা আবদুলেরও মুখ ভার। অকালের বারি তার ক্ষেতের দৈত্য! মাটির ভিতর থাকা তার চাষের আলুর অকাল প্রয়াণ প্রায়! ক্রোড়ের সন্তান মাতৃসম! হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুজরায়।
    মানত করে তার বিবি। দরগায় ছোটে, যদি হাওয়ারে ঘুরায়ে দেন তার প্রাণের আল্লা!

    এরকমই তো ঘটেছে এবার। বিবির তলার শরীর ভারী হলো। বিয়ের প্রায় দশবছর বাদ। অনেক মানতের পর দূর্যোগ প্রায় কেটে গেল। সবার কথা অমান্য করি আল্লা বুঝিবা তার বিবির শরীরে সেঁধিয়ে গেল। অসম্ভবকে সম্ভব করে বিবির পেট ভরে উঠলো, গরীবি ঘরের এক ছোট্ট কামনাকে স্বাগত জানাতে।

    আট মাস কেটেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বারবার সাবধান বাণী কানের গোড়ায় শুনিয়ে ছেড়েছে – দেখো বাপু একটু বুঝে শুনে চলো, প্রেথম পোয়াতি, একটু নজর দিও। নষ্ট যেন না হয়!

    আবদুল তার বিবি জাহানারার প্রতি ভালোই নজর দিত। নিজস্ব চাহিদাগুলোকে বিসর্জন পর্যন্ত দিয়ে দিল। ভয়ে স্ত্রীর সঙ্গে যৌনতার ইচ্ছে ভুলে যেত। তার একটিই মনোস্কামনা তাকে তাড়িত করতো তা হলো ঘরে বাইরে ক্ষেতের ফসল যেন ঘরে উঠে আসে।

    এইরকম পরিস্থিতিতে বারবার ঘোষণা, ঝড় -জলের আগাম পূর্বাভাস তার অশান্ত মনকে বড়ই বিচলিত করে তুললো। বাইরের ক্ষেত নিয়ে যখন দূর্যোগ তাকে পীড়ন করছে ঠিক তখনই ভিতরে বিপদ তাকে ছোবল বসালো।

    জাহানারা বিবি বাথরুমে পড়ে গেল। রক্তপাতের দরুণ গর্ভপাতের সম্ভাবনা প্রবল ভাবে দেখা দিল। হাকিম এলো, পরীক্ষণের পর দাওয়াই দিল। কিন্তু আশঙ্কা তীব্রতর হলো, যখন গর্ভস্থ শিশুর অস্তিত্ব নিরুপণ করা কষ্টকর হয়ে পড়লো। মহিলা প্রতিবেশীরা সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল, জান দিয়ে পারলে, সন্তানটিকে বাঁচা‌তে সচেষ্ট হলো।

    এদিকে কালোমেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। প্রচন্ডভাবে প্রকৃতি তার বায়ু ছোটাতে শুরু করলো – যার নাম ঝড়। বড় বড় গাছগুলো তাদের প্রচন্ড শক্তিতে সেই ঝড়ের সংগে লড়তে থাকলো। আবদুল এ অবধি ঠিক লড়াই চালাচ্ছিলো নিজের সঙ্গে, কিন্তু একেবারেই ভেঙ্গে পড়লো যখন তীব্র বায়ুর সঙ্গে বৃষ্টির সূচনা সূচিত হলো।

    বাইরে প্রকৃতি তার ধংস্বাত্মক লীলা খেলায় ব্যস্ত। ঝড় -জলে মাটি ধুয়ে গেল, আর আবদুলের বুকের পাঁজর যেন ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে থাকলো – ফসলের আলু তার আর ঘরে উঠবে না -এই আশঙ্কায়।

    ভিতরে তখন হাকিম আর মাসিদের আরো এক লড়াই চলতে থাকলো আবদুলের ফসলকে বাঁচানোর জন্য। আবদুল এতটাই অসহায় হয়ে পড়লো যে আল্লাহর কাছে মানত করার কথা মনেও এলো না।

     

  • অণু গল্প

    অণুগল্প – মনের গভীরে

    মনের গভীরে
    – শুক্লা রায় চৌধুরী

     

     

    গরম কফির মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে কুয়াশা ঘেরা পাহাড় দেখতে ভীষণ ভালো লাগছিলো রাইয়ের। কোলাহল বর্জিত এমন একটা নির্বাসন চাইছিল বহুদিন ধরেই।শুধু হাওয়ার আওয়াজ খেলে বেড়াচ্ছে সামনের পাহাড়ের ঢালগুলো বেয়ে, সাথে পাখির কিচিরমিচির। প্রাণ মন সব জুড়িয়ে যাচ্ছে। কত না বলা কথা আছে নিজেকে বলার; এখনই বলে নিতে হবে না হলে আবার ও চলে আসবে, কিছুই বলা হবে না তখন। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে সব চোখের সামনে ঘোলা হতে লাগলো? পাখির কুজন এখন হাহাকার হয়ে বিঁধছে কানে।উফঃ কি কষ্ট। মিশকালো অন্ধকারের পর্দাটা ছিঁড়ে আলো আসতে শুরু করছে। তার মানে আবার সেই কদর্য মানুষটা আসছে! ঠিক তাই ! সারা গায়ে রক্ত মেখে দাঁত বার করে হাসছে বিকাশ রোজের মত। এখনই ওই নোংরা হাতে আমাকে ছোঁবে। খুবলে খাবে আমাকে তিলে তিলে। তারপর আস্তে আস্তে মিশে যাবে আমার মধ্যে। আমি আর ও আলাদা থাকব না, এক হয়ে যাব রোজের মত।
    ‘ মিস দত্ত মিস দত্ত, তাকান। এই তো তাকাচ্ছে।’
    চোখ খুলে নিজেকে পাহাড়ের এক জঙ্গলে খুঁজে পেল রাই।
    “কেমন লাগছে এখন? আরে ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি বিকাশ নই, ডক্টর দাস। বিকাশ আপনার মনের তৈরি করা মানুষ ছাড়া কিছু না। আপনি এটা যত বুঝতে পারবেন ততো তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন।”
    কথার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই রাইয়ের খুব ক্লান্ত লাগছে রোজের মতই। ঘরে ফিরে লম্বা একটা ঘুম চাই ওর। কালকে আবার এই একই ঝড় বইবে। ডক্টর দাসের কথা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে কিন্তু বিকাশ যে আছে; রোজ আসে ওর কাছে সেটা কেউই বুঝবে না।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- আশার আলো

    আশার আলো
    – শিলাবৃষ্টি

     

     

    জীবনে আঘাত সইতে সইতে পাথর হয়ে গিয়েছিল সমরেশের মন। একদিন প্রায় ভেবেই নিয়েছিল- আত্মহত্যা করবে সে। এই শূণ্য সংসারে সে ভীষণ একা!

    রেললাইন ধরে এগিয়ে চলেছে সমরেশ , মন্থর তার গতি ; একটু পরেই সব শেষ হয়ে যাবে! হঠাৎ চোখ যায় পাশের বাঁশবনের দিকে। শেষ বিকেলের আলোয় কী অপূর্ব লাগছে! মাথা নেড়ে নেড়ে তারা যেন কিছু বলছে। মন চঞ্চল হয়, মাথার ওপরে সুনীল আকাশ … সাদা মেঘেরা যেন হাত নেড়ে তাকে ডাকছে। একঝাঁক পাখী ডানামেলে আকাশে উড়তে গিয়ে যেন তারই জন্য থমকে গেল। ওরা কী বুঝতে পারছে – সমরেশ এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে ?
    কিন্তু রেললাইনে ছোট্ট একটা বাছুর কী করছে? ওতো প’ড়ে গেছে! হাঁটতে পারছেনা বোধহয়! দূর পাল্লার একটা ট্রেন ছুটে আসছে বিকট শব্দে। হায় হায় ! বাছুরটাকে তো বাঁচতে হবে! সমরেশ ছুটতে লাগলো। বাছুরটাকে বাঁচাতেই হবে। কোনক্রমে টেনে তোলে সমরেশ ছোট্ট সাদা বাছুরটাকে। ট্রেনটা চলে গেল।
    সমরেশের এতক্ষণে খেয়াল হল – সে তো মরেনি ! বরং বাঁচিয়েছে আর একটা প্রাণকে।
    এই সুন্দর প্রকৃতির জন্য সে বাঁচবে, বাঁচবে ছোট্ট বাছুরটার জন্য !

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- চক্ষুদান

    চক্ষুদান
    – রাণা চ্যাটার্জী

     

     

    কি রে ভাই কাঁদছিস! আয় আমার কাছে বলে মৌ হাত বাড়িয়ে ভাই রণিতকে খোঁজার চেষ্টা করলো। ভাইয়ের ফোঁপানোর কান্না মোটেও ভুল শোনেনি সে যতই জন্মান্ধ হোক, ঘ্রাণ শক্তি তার প্রখর। মা ঘরে ঢুকে জানালো ভাই স্কুলের স্পোর্টসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বড়ো ট্রফি পেয়েছে। গোটা গ্রাম ঘুরে হিপ হিপ হুররে করে বাড়ি ফিরতেই কান্না দিদি তো দেখতে পাবে না তার এই উপহার। আহারে যে দিদি সকাল সন্ধ্যা তাকে উৎসাহ দেয় তার কিনা এত কষ্ট-এটা ভেবেই হাপুস নয়নে কান্না আসছে।

    মৌ জানে তাকে নিয়ে ভাইয়ের উদ্বেগের কথা। যখনই আক্ষেপ “ইস দিদি যদি দেখতে পেত “-প্রতিবারেই মৌ ভাইকে সান্ত্বনা দিয়েছে, “তুই বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে না হয় আমার চোখে আলো ফেরাবি।”

    আজ হঠাৎ সুযোগে হাসপাতালের বেডে উৎকন্ঠায় সারাদিন শুয়ে মৌ। চোখের জটিল অপারেশন তার সফল হয়েছে। এ এক দারুণ তৃপ্তির খবর। আজ কিনা সে প্রথম পৃথিবীর আলো, মা, বাবা,ভাইকে দেখবে! এ আনন্দানুভূতি কাউকে সত্যই বোঝানো দুস্কর।

    এতদিন শুধুই অন্ধকার চোখে ভালোবাসা, স্নেহের অনাবিল স্রোত, দারিদ্রতার পাঞ্জা লড়াই, তাচ্ছিল্য সব লিপিবদ্ধ আছে। বাবার মৃত্যু যেন তার ইচ্ছাতে আরো অন্ধকার আনে।

    আজ কড়া নাড়লো ইচ্ছেরা। এতগুলো বছরের অনুভূতি, স্পর্শ আক্ষেপ যেন এক লহমায় বানভাসি!

    বুট জুতোর আওয়াজ। তবে কি ডাক্তার কাকু এলেন, এই বুঝি আসবে শুভ মুহূর্ত “চোখ খোলো, তাকাও-বলো কাকে প্রথম দেখতে চাও?”

    বাপরে, ঝলমলে পৃথিবী, এত্ত সুন্দর! এতোকাল অন্ধকার জগতে বিচরণ, কল্পনায় এই আলোর জগৎ সম্পর্কে ভাবনা আর আজ আলোর দ্যুতি যে কি জোরালো তা দেখেই শিহরিত মৌ। একি মা উনি কে?কাঁদছেন এভাবে?

    অঝোর ধারায় এক মহিলা কেঁদেই চলেছেন তখনো। উদ্বিগ্ন মৌ, মা তুমি বলো উনি কাঁদছেন কেন?

    গর্ভধারিনী মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
    “উনি তোমার আর এক মা। দুর্ঘটনায় ওনার ছেলের মৃত্যু হলেও উনি এগিয়ে এসেছেন কারুর চোখে আলো ফেরাতে। ওনারই মৃত সন্তানের চক্ষুদানের আলোয় তুমি আজ উদ্ভাসিত।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সেল্ফি

    সেল্ফি

    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    “ও দিদি দাও না দুটো পয়সা”। ” ও দাদা, ও কাকু দুটো পয়সা দাও না গো।” হাতে ভিক্ষাপাত্র। পরনে নোংরা ছেঁড়া গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট। মাথায় জট পড়া উস্কোখুস্কো চুল। দু-তিন জন ছোটো ছেলে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আমাদের পথের দিকে। একটু অস্বস্তিই লাগছিল। ভালো পোশাক পরে স্নান সেরে ফিরছি সাগর থেকে। এবার পুজা দেওয়ার পালা।
    আমাকে দেখে আর একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা বলল, এদের জ্বালায় পথ চলার উপায়ই নেই। আসার সময় যদি কিছু চাল ডাল সঙ্গে নিতাম, বেশ হতো। খুচরো পয়সা এত পাই কোথায়? যদি মনে করে আনতাম খুব ভালো হতো। আমরা এসেছি সাগরে ডুব দিয়ে পূর্ণ অর্জন করতে। কপিল মুনির মন্দিরে পুজা দিতে।
    সেই সাগর পাড়ে দুটি সারি বসে বৃদ্ধ -বৃদ্ধা আর কচিকাঁচার দল। কারোর হাত -পা কাটা। কেউ অন্ধ, কেউবা বোবা।আবার কেউ স্বাভাবিক। বোঝার উপায় নেই সত্যিই কি এরা অসহায়? কেউ কি এদের দিয়ে ব্যবসা করছে। আমরা তার খোঁজ ও রাখি না অবশ্য।
    এই ভিক্ষুক দলেরই ওরা দুজন আমার একেবারে গায়ের কাছে। আঁচল টেনে দাঁড়িয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বাধ্য হয়ে কিছু খুচরো পয়সা বের করে হাতে দিতে যাবো। ঠিক তখনই দুজন কলকাতাবাসী মেমসাহেবকে দেখে ওরা ছুটে গেল।
    কি অদ্ভুত ব্যাপার। আমরা যাদের দেখে বিরক্ত বোধ করছিলাম। পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরছিল যাদের দুটো কচি হাত। তাদেরই কাছে টেনে নিলো ওরা। সেলফি তোলার জন্য। কি অনায়াসে মিশে গেল এদের সাথে। একমুখ হাসি ঠোঁটে মুখে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল সেল্ফি তুলতে।
    মাথার চুলটা ঠিক করে দিল মেমসাহেব। খুশিতে গদগদ হয়ে তাকিয়ে ক্যামেরার দিকে।
    তারপর ওদের ছবিখানি ক্যামেরায় দেখিয়ে বলল, (আধো আধো বাংলাতে) ইউ আর ভেরি বিউটিফুল চাইল্ড । তোমরা খুব সুন্দর আছো। ইউ আর নট গোয়িং স্কুল? ছেলে দুটি স্কুল কথাটা বুঝতে পেরে মাথা নুইয়ে নিল।
    মেম সাহেবরা কি বুঝল,জানি না।
    এদের হাতে একশ টাকার নোট দিয়ে, বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে বলল, দুজনে সেয়ার করে নিও চাইল্ড। ইউ আর গুড বয়। গুড বাই।
    হাত নাড়িয়ে চলে গেল। ছেলে গুলো নোটটা হাতে নিয়ে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে চলে গেল।আমাদের ধাক্কা দিয়ে। তবে ধাক্কাটা লাগল শরীরে নয় আমাদের বুকে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- মনুষ্যত্ব চাই

    মনুষ্যত্ব চাই
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

    মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে, পাল মশাই সবে একটু গা এলিয়ে দিয়েছেন বিছানায়। একটু ঝিমুনি ধরেছে, ঠিক তখনই একটা ফেরিওয়ালার বাজখাঁই হাঁকে সেটা চটকে গেল।
    অদ্ভুত ব্যাপার। কী হাঁকছে লোকটা? ভালো করে কান খাড়া করে ঝিমুনি কাটিয়ে শুনলেন, মনুষ্যত্ব চাই মনুষ্যত্ব….
    আরে, পাগল মনে হয়। তবুও মনে সংশয়। গিন্নিকে ডাকলেন, বলি, শুনছো.. একবার এদিকে আসবে..
    গিন্নি তখন টিভিতে সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। এখন সেই মোক্ষম সিনটা চলছে। বউকে জব্দ করতে, তার রান্না করা পায়েসে নুন মিশিয়ে দিচ্ছে শাশুড়ী। যাতে তার ছেলে, মানে ওই বউয়ের বর, সেই পায়েস খেয়ে যাচ্ছেতাই করে অশান্তি করে তার বউয়ের সঙ্গে। শুধু তাই নয়। বাড়ি শুদ্ধ লোকের মাঝে, বউয়ের মুখে ঝামা ঘসা হবে এবং ভবিষ্যতে কোনদিন যাতে ওই বউ আর রান্নাঘরে ঢুকতে না পারে, তার ব্যবস্থা পাকা করতে হবে।
    এইসময় বুড়ো ডাকে কেন? যত্তসব।
    দেখি কী হলো আবার, গজগজ করতে করতে গিন্নি এলেন।
    কি হলো কি। বেশ তো খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছিলে।
    পাল মশাই হতভম্ব হয়ে বললেন,
    হ্যাঁ গো, একটা পাগল মনেহয় বাড়িতে ঢুকে পরেছে!
    গিন্নির মাথায় আগুন জ্বলে গেল।
    বলি, ভীমরতি হয়েছে নাকি? কথা নেই বাত্তা নেই, বাড়িতে পাগল ঢুকে পরেছে? স্বপ্ন দেখলে না কি গো?
    না না,, নিজের কানে শুনলুম যে, পরিস্কার…
    কি শুনলে শুনি, বাড়িতে পাগল ঢুকে পরেছে? মাথাটা গেছে মনে হচ্ছে।
    না না, হাঁকছে..
    কে হাঁকছে! পাগল ?
    না না, মানে মনে হলো, মনুষ্যত্ব চাই, মনুষ্যত্ব
    গিন্নি চটাস করে নিজের কপালে চাপড় মেরে বললেন, হায় কপাল আমার, ওরে বাবা, মনুষ্যত্ব নয়। ফেরিওয়ালা চেঁচাচ্ছে । আমসত্ত্ব বিক্রি করছে।
    বলেই ফোকলা হাসির ছটা। হা হা হা..
    বলছে আমসত্ত্ব, উনি শুনছেন মনুষ্যত্ব, হা হা হা। ছেলে ফিরুক ওকে বলতে হবে, ভারী মজার কান্ড। ও বৌমা শুনে যাও তোমার শ্বশুরের কান্ড,
    গিন্নি হাসতে হাসতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
    পাল মশাই বালিশ হেলান দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন, তাইতো, সত্যিই তো.. মনুষ্যত্ব কি ফেরি করবার জিনিস। এতো পণ্য নয়। এযে ঈশ্বরের সর্বোচ্চ দান। মনুষ্যত্ব.. মনুষ্যত্ব।

    টিভি সিরিয়ালে এখন শাশুড়ী, বৌমার যত্নে রাঁধা পায়েসের বাটিতে নুন মেশাচ্ছে। সন্তর্পণে। লুকিয়ে। ধরা না পড়ে যায় শেষে। ধরা পড়লেই সর্বনাশ। মুখোশ খুলে যাবে। মনুষ্যত্বের মুখোশ।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- অভাগা

    অভাগা
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

    পরেশ বাবু তার মৃত্যুর আগে উইল করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর তার অগাধ সম্পত্তির মালিক সেই হবে , যে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা।
    এক আইনজীবী কে তিনি এই দায়িত্ব পালনের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন।
    আইনজীবী মহাশয় অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন কিন্তু উইলের শর্ত মোতাবেক কাউকেই তিনি মনোনীত করে উঠতে পারলেননা।

    একদিন তার সাত বছরের ছেলের কাছে গল্পের ছলে, তার এই না পেরে ওঠা কাজের কথাটি আক্ষেপের সুরে বললেন। সেখানে তখন তার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সমস্ত ব্যাপারটাই জানতেন এবং , এই নিয়ে তার মনেও কষ্ট ছিল এই কথা ভেবে যে,, একজন মৃত মানুষের শেষ ইচ্ছে তারা পূরণ করতে ব্যার্থ হতে চলেছেন।

    সাত বছরের ছোট্ট ছেলেটা সবটুকু শুনে আশ্চর্য হয়ে বললো, সেকি! এতো খুবই সহজ ব্যাপার বাবা। আমি এর উপায় বলে দিতে পারি , যদি আমাকে অনুমতি করো।
    ছোট্ট ছেলের মুখে এমন কথা শুনে , আইনজীবী এবং তার স্ত্রী যারপরনাই আশ্চর্য হয়ে বললো, তুই কী বলছিস জানিস ! একজন অভাগা চাই , পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা। তুই কেমন করে এর সমাধান করবি ? তুই এই জগতের কী জানিস , কতটুকু বুঝিস?
    ছোট্ট ছেলেটা একটা গোলাপ ফুলের ছবিতে লাল রঙের প্রলেপ দিতে দিতে বললো, শুনেছি আমার দাদু আর ঠাম্মা এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমাদের ভুলবোঝাবুঝির কারণে, আজ অব্দি তাদের দেখিনি। তারাও আমাকে দেখেননি। তাদের আদর ভালবাসা কিছুই পেলামনা। একটু চোখের দেখাও দেখলাম না। তারাও আমাকে দেখেননি। কিন্তু আমি জানি তারা আমার কথা খুব ভাবেন। মনে মনে আশীর্বাদও করেন নিশ্চয়ই। আমিও ওদের না দেখেও, মনে মনে খুব ভালবাসি। আমি জানি তোমরা আমাকে দাদু ঠাম্মার কাছে নিয়ে যাবেনা। আর আমি যখন ওদের কাছে যাবার মতো বড় হয়ে যাবো , তখন ওরা কেউ হয়তো আর থাকবেন না। আমারও দেখা হবেনা , কথা হবেনা , পাশে শুয়ে গল্প শোনা হবেনা , আঙুল ধরে বেড়াতে যাওয়া হবেনা , বুকে চেপে ধরে আদর পাওয়া হবেনা , আব্দার করে জ্বালাতন করা হবেনা , মাথায় হাত রেখে মানুষের মতো মানুষ হবার প্রেরণা পাওয়া হবেনা ।
    আমার চেয়ে অভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নেই বাবা।
    আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা।

    আইনজীবী আর তার স্ত্রী দুজন দুজনের দিকে তাকাতে গিয়েও চোখে চোখ মেলাতে পারলোনা। চেষ্টা করেও নিচু মাথা উঁচু করতে পারলোনা। তাদের মতো এমন অভাগা সন্তানের পিতামাতাও বোধকরি পৃথিবীতে দুটি নেই।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- মুক্ত ঝরা হাসি

    মুক্ত ঝরা হাসি
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

    ছেলেটি ছুটতে ছুটতে আসছে। তবু ধরা পড়ে গেল। একজন এসে হাত থেকে কেড়ে নিলো চপ মুড়ির প্যাকেট। চুরি করতে শিখেছিস এই বয়স থেকে। কি হবি বড়ো হয়ে চোর গুন্ডা মস্তান? বলেই হাত তুললো মারার জন্য। পিছন থেকে একজন ভদ্রলোক হাতটা চেপে ধরলো। এরা নিতান্তই বালক। কি বোঝে এসবের? শিশুর গায়ে হাত তুলছেন? ভদ্রলোক মাথা নিচু করে ফিরে গেল।
    এখন চলছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। সমস্ত কেন্দ্রগুলিতে অভিবভাবক, ছাত্র-ছাত্রীদের আপ্যায়নের জোর প্রস্তুতি। স্কুল গেটের বাইরে দেওয়া হচ্ছে জলের বোতল, পেন, গোলাপ ফুল,আর বিস্কুটের প্যাকেট। সঙ্গে তুলে নেওয়া হচ্ছে একটা করে ফোটো। সোস্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করার জন্য। সেই সঙ্গে আপ্যায়নের প্রমানপত্র হিসেবে। এক অভিনব প্রয়াস। অভিভাবকদের বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা।
    কোনো দিন ছোলা মুড়ি কোনো দিন চপ মুড়ি বা বাতাসা মুড়ির আয়োজন। আমরা অভিভাবকরা ভীষণ খুশি। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এমন আয়োজনের জন্য।
    রাস্তার দু’পাশে খেলা করছিল কিছু বালক। পরীক্ষা চলার কারণে সকালে স্কুল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময়টা খেলার সময়। সবাই লাইন দিয়ে জলের বোতল চপ মুড়ি নিচ্ছে দেখে ছুটতে ছুটতে এসে, লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদের দেখেই একজন বলে দিলো, দেখতে পাচ্ছো না এটা বড়োদের লাইন। তোমরা দাঁড়িয়েছ কেন লাইনে? মুখগুলো কেমন শুকনো হয়ে গেল। একজন সাহসী ছেলে বললো, বারে তাতে কি? আমাদের স্কুলের সামনে দিচ্ছো, আর আমরা পাবো না? আমরাও তো বড় হয়ে পরীক্ষা দেবো নাকি? সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। বাধ্য হয়ে মানসম্মানের খাতিরে প্রথম দিন সবাইকে একপ্যাকেট মুড়ি দেওয়া হলো। বলা হলো, কাল থেকে আর আসিস না কেমন।

    অবুঝ মনের ছেলেমানুষ বালক তো ওরা। খুব মজা পেলো। পরের দিন আবার এসে লাইন দিলো। আজ কড়াকড়ি পদক্ষেপ নিলো। কর্তৃপক্ষ লাইন থেকে ওদের বের করে দিলো। বললো, এভাবে রোজ রোজ দেওয়া যাবে না। বললাম তো এটা তোমাদের জন্য নয়। পরীক্ষার্থীর মা বাবাদের জন্য। কাঁচুমাচু হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা।
    টেবিলে সাজানো ছিল চপ মুড়ির ঠোঁঙা। ওদের মধ্যে থেকেই একটা ছেলে টেবিল থেকে একপ্যাকেট নিয়ে দৌড় দিলো।
    এ সেই ছেলেটা। মুখটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যার আজ সারাদিন ভাত জোটে নি । মা অসুস্থ। তবু পেন কারখানায় কাজে গেছে। সন্ধ্যায় রান্না করবে বলেছে। খুব খিদে পেয়েছিল, তাই। বলতে বলতে ছেলেটির চোখ ছলছল করে উঠলো। মাকে বলে দিও না কাকু। আর কোনো দিন এমন করবো না। মা জানলে খুব কষ্ট পাবে।
    ভদ্রলোক কাঁধে হাত রেখে বললো, এসো আমার সাথে।
    প্রত্যেকের জন্য একপ্যাকেট চপ মুড়ি খাওয়ালো, সঙ্গে জিলিপি। ভদ্রলোক অবশ্য এদের সাথে সেল্ফি তুলে সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন নি। তবে এরাই ফোনটা নিয়ে তাদের আদরের কাকুর সাথে সেল্ফি তুললো। নিজেদের ছবি দেখে বললো, আমাদের এক কপি করে ছবি দিতে হবে কাকু। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সবাই। যেন মুক্ত ঝরে পড়ছে ওদের হাসি থেকে।

You cannot copy content of this page