অণু গল্প
-
অণু গল্প- চলমান সমাজ
চলমান সমাজ
-অমরেশ কুমাররাতের শহর, চারিদিকে আলোর ঝলকানি, প্রতিদিন রাজ শহর রাজকন্যার বিবাহের আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে নতুন নতুন রূপে। নীরু রাস্তা দিয়ে চুপিসারে হাঁটতে থাকে। ফুটপাথে চাদর গায়ে অগণিত মানুষ নিদ্রায় আছন্ন। কেউ বা একা, কেউ বা সন্তান বুকে নিয়ে। ঠিকানা আজ তাদের ফুটপাথ। কাল কোথায় থাকবে কেউ জানে না , তবে কোনো এক নতুন ফুটপাথ যে হবে তা নিশ্চয়। নীরু আরো এগিয়ে চলে… কোথাও যে এর শেষ নেই। শান্ত আলোক ধাঁধানো রাজ শহরের এ কি রূপ ! দিনের কোলাহলে বিশাল বিশাল অট্টালিকার বাবুদের দেখা নেই । সমাজ তো বিভাজিত দিনে- রাতে, নীরুর এ এক নিদারুণ বাস্তব উপলদ্ধি।
নীরু বাড়ি ফেরে ভোরের রাতে। সারাদিন কখনো কখনো দূরপাল্লার journey করে সারারাতও তার কাজের চাপেই কেটে যায় বিশ্রামের অবকাশ নেই। salesman এর কাজ; তাই চলমান সমাজের সাথে তার ক্রমাগত মানিয়ে নিতে হয়। হাজার হাজার মানুষের সমাগম, সবাই সবার জন্য ব্যস্ত ।
বাড়ি ফিরেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নীরু জিজ্ঞাসা করে কি নিয়ে ফিরলি নীরু ….?
প্রতিবিম্ব: বাস্তব উপলব্ধি।
নীরু আবেগ পূর্ণ হয়ে ভাবতে থাকে সারাদিনের কথা ….
প্রতিবিম্ব সেগুলি বলতে থাকে ,
“চলমান সমাজে চলতে গিয়ে
কখনো ভীড়ের চাপে হাঁটতে হয়,
কখনো বা, স্থির চোখে স্থির ভাবে তাকিয়ে
সমাজের গতি মাপতে হয়;
যেন, স্থির অবস্থায় অনুভব করতে হয়
হাঁটছি দেখো হাঁটছি আমি,
হাঁটছে দেহখানি–
বাস্তবতার পাথর ভেঙে
সমাজ চিনলে কতখানি ।
ঢেউ এর সমান তরঙ্গের ন্যায় মানুষগুলো ঘোরে
স্বপ্নগুলো মনের মাঝে,স্তরে স্তরে জমে;
কেউ বা ধাক্কা মারে বাহির হতে
কেউ বা, স্বপ্ন মাঝে স্তরের ফাঁকে
চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে।” -
অণু গল্প- সরস্বতী
সরস্বতী
-সঞ্জয় গায়েনবাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে এবছর দু’দিন। এক দৈনিক সংবাদপত্রের হেডলাইন। দেবী সরস্বতীর আরাধনার সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে এমনই লিখেছেন জনৈক সাংবাদিক। বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, পঞ্জিকা মতে সরস্বতীপুজো এবার দ্বিমতে৷ কেউ বলছেন, বুধবার পুজো। কারও মত, বৃহস্পতিবার। এরপর আরও কিছু শব্দ খরচ করে উপসংহারে গিয়ে তিনি লিখেছেন, এতে অবশ্য সরস্বতীপ্রেমীদের কোন অসুবিধা নেই। তারা বরং খুশি। তার কারণ হিসাবে তারা জানিয়েছেন, এতে দু’দিন ধরে প্রেম করা যাবে। আর এভাবেই বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে দু’দিন ধরে পালিত হবে।
সংবাদটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ করার পর রাগে সারা শরীর ঘিনিয়ে উঠল শাশ্বতের। এইভাবে দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে হাসি ঠাট্টা মজার মোড়কে পরিবেশন করে হিন্দুত্বকে অপমান করেছেন এই সংবাদপত্র। তার চেয়ে বড় কথা সাংবাদিকটি দ্বিমতের পুজো ব’লে নিজের মুর্খামীর পরিচয়ও দিয়েছেন। পরক্ষণেই মনে হল, ওনাকে দোষ দিয়ে কি লাভ? বহু পুরোহিতই তো এমন বিধান দিচ্ছেন। ভুল পঞ্জিকা দেখিয়ে বলছেন, দু’দিন ধরে পুজোর কথা। নিজস্ব স্বার্থে।
শাশ্বত তাই কিছু কমেন্ট না করে এড়িয়েই যাচ্ছিল। পরে ভাবল, না। এভাবে এড়িয়ে গিয়ে গিয়েই সনাতন ধর্মে বিশ্বাস তলানিতে ঠেকছে। অথচ সনাতন ধর্মের আচার বিচার সংস্কারের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে বিজ্ঞান জড়িয়ে।
শাশ্বত নিউজটার লিঙ্কে গিয়ে দেখে ইতিমধ্যেই খিল্লি করা শুরু করে দিয়েছে সবজান্তা ফেসবুকওয়ালারা। ও আর থাকতে পারে না। কমেন্টে গিয়ে লেখে, সরস্বতী পুজো দিবারম্ভের পুজো। তাই এবছর পঞ্চমী তিথির সময়কালের মধ্যে যেহেতু বৃহস্পতিবার দিবারম্ভ আছে, সেই হেতু পুজো হবে বৃহস্পতিবারের প্রত্যুষে। দ্বিমতের পুজো বলে যারা প্রচার করছেন তারা ভুল বলছেন। আর অন্যায় করছেন বিদ্যার দেবীকে প্রেমের দেবীর সঙ্গে তুলনীয়া করে তুলে… শাশ্বতের কলম এভাবেই এগিয়ে চলতে থাকে। আর মনের মধ্যে উচ্চারিত হতে থাকে, দেবীর অঞ্জলির মন্ত্র–
শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা
শ্বেতাম্বরা ধরা নিত্যা শ্বেত গন্ধানুলেপনা
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণা ধরা শুভ্রা শ্বেতাভরণভূষিতা….।
ঋনস্বীকার- জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় -
অণুগল্প- পিঞ্জরের আকাশ
পিঞ্জরের আকাশ
-রীণা চ্যাটার্জীআঁখি আর ঋক- ভালোবাসার দু’টি মন, এক আত্মা। অবশ্য আঁখির ছিল পাখির মন, উড়ু উড়ু ভাব। মোটে বিয়ের ফাঁদে পড়তে রাজি নয়। নিত্য নতুন অছিলায়, বাহানায়, খামখেয়ালীপনায় তাই ঋককে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আঁখিকে রাজী করাতে। ঋক বলেছিল আঁখিকে, ‘তুমি পাশে থেকে সাথ দিও, আমি সব লড়াই জিতে নেব.. সবকিছু। যেভাবে চাইবে সাজিয়ে দেব সব শুধু সাথে থেকো ..”
পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে দু’জনে বাসা বেঁধেছিল কাঁধে দায়িত্ব আর দু’ চোখে স্বপ্ন নিয়ে।
কর্মনিষ্ঠা আর সততার মূলধনে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করে ঋক ছুঁতে থাকলো এক একটা সাফল্যের সিঁড়ি। আর সেই সিঁড়ি ধরে অসীম ধৈর্য্য আর সহ্য নিয়ে অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো আঁখি সমস্ত প্রতিকূলতা আর সমালোচনা অগ্ৰাহ্য করে।
দিন যায়- সাফল্য যেমন আসে, দায়িত্ব- কর্তব্য তেমন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। হাসি মুখে দু’জনে মিটিয়ে চলে জীবন সংগ্রামের প্রতিটি লয়-ক্ষয়। আঁখি শুধু চেয়েছে ঋক ভালো থাকুক, সফল হোক প্রতিটি ক্ষেত্রে। নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলো কোনো এক অজানা সূত্রে মিশিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার কাছে। ঋক কথা রেখেছে, আঁখির সব দায়িত্ব নিজের করে নিয়েছে, তাছাড়াও অনেক অযাচিত দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে নির্দ্বিধায়। শুধু একটাই কথা, ‘তুমি থাকবে আমার বাম পাশে।’ যেমন লক্ষীদেবী থাকেন নারায়ণের পাশে। নারায়ণ বাঁধা থাকলে লক্ষী তো আপনিই ধরা দেন, ওদের সংসার যেন মর্ত্যের বৈকুণ্ঠ। মনের সমীকরণ ওদের বড়ো অদ্ভুত- এক সুরে বাজে সবসময়।
যেভাবে চেয়েছে ঋক, সেভাবেই পাশে থেকেছে। সাফল্যের সূর্য ছুঁয়ে আজ আঁখির সংসারে ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য।
যে আত্মীয়রা একদিন কৌতুহলী দৃষ্টি, আর অমানবিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো ওদের দিকে তাচ্ছিল্য আর ভ্রুকুটি দিয়ে। আজ তারা সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওদের ঐশ্বর্য, স্বচ্ছলতা, বৈভব বেশ আলোচিত বিষয়। আঁখি- ঋকের উদাহরণ দেয়, তারাই আজ নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে। অতীত ভুলে যাওয়া তো খুব সহজ। তাই আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়ন, সম্মান এখন ওদের কাছে ভীষণ সহজলভ্য।যাই হোক দিন এগিয়ে চলে, আঁখির সেই উড়ু উড়ু মনটা ঋকের সাথ দিতে দিতে শৃঙ্খল পরে নিয়েছে নিজের অজান্তেই। যে পাখিটা উড়তে চাইতো মনের আকাশে অনেক দূর খেয়াল খুশীতে, আজ তার বৈভবে পূর্ণ সোনার পিঞ্জরে। সবাই দেখে আঁখির সুখ।
কিন্তু সেই সোনার পিঞ্জরে আঁখির আকাশটা আজ ভীষণ ছোট- নাহ্ আঁখির মনপাখিটাও বুঝতে পারেনি ওর আকাশ কবেই শৃঙ্খলিত হয়ে গেছে। ও যে অভ্যাস করে নিয়েছে ধৈর্য্য আর সহ্যের। এখন মাঝে মাঝে শুধু হাঁফ ধরে আঁখির মনে- সেটা কি শুধুই ছোট্টো আকাশের জন্য! -
অণু গল্প- আজকের নেতাজী
আজকের নেতাজী
-অঞ্জনা গোড়িয়ামহান দেশের মহান নাগরিক। ২৩ সে জানুয়ারি নেতাজীর জন্মদিন।
একদিকে চলছে নেতাজীর মূর্তিতে মাল্যদান। পতাকা উত্তোলন। অন্যদিকে চলছে পিকনিক।চড়ুইভাতি।
মাছ, মাংস আর মদের আয়োজন।দারুন আনন্দ । হই হুল্লোড়। ক্লাব প্রাঙ্গণে। নেতাজীর জন্মদিন বলে কথা। বিশেষ একটা ছুটির দিন। হেলায় নষ্ট করা ঠিক নয়। পাকা রাস্তা দিয়ে চলেছে পিকনিক গাড়ি। ডিজে বক্স আর উগ্র নাচের গানে বেশ জমজমাট রাস্তা।
মিথ্যা বলব না যথাযথ সম্মান জানিয়ে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পালিত হলো নেতাজীর জন্মদিন।
আমি চলেছি স্কুলে। স্কুলের পালনীয় দিন, পালন করতে। নেতাজীর কথা শোনাতে। নেতাজীর কথা জানাতে। একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দিদিমনি দিদিমনি, সত্যি ই কি স্বাধীনতা এসেছে? স্বাধীনতা কি? আমরা কি স্বাধীন হয়েছি?
দেশ স্বাধীন হয়েছে। ঠিকই। আমরা এখনো স্বাধীন হই নি।অনেক প্রশ্নের ই উত্তর জানা নেই।
আমার মতো করে বুঝিয়ে দিলাম। তারপর লজেন্স বিস্কুট খাইয়ে বাড়ি ফেরার পথে রওনা দিলাম।তখন ও পিকনিক চলছে। নাচ গান বক্স মদ্যপানের মাধ্যমে জমে উঠেছে পিকনিক।
হঠাৎ দূর থেকে লক্ষ্য করলাম। পতাকার বাঁশ টা হেলে যাচ্ছে। এখুনি বুঝি গায়ে এসে পরবে ওদের। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
কোথা থেকে একটা ছোটো ছেলে ছুটে এসে,বাঁশটা ছোটো হাতে চেপে ধরল। সোজা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি দেখতে পেয়ে জোরে পা চালালাম। ছেলে টা কিছুতেই বাঁশ টাকে মাটিতে পড়তে দিল না।
এতক্ষণে টনক নড়ল ক্লাবের ছেলেদের। ছুটে এসে বাঁশটা ধরে পুঁতে দিল ভালো করে। ছোটো ছেলেটির নরম হাতদুটো লাল হয়ে গেছে। বাঁশের খোঁচায় সামান্য কেটে গেল।
কাছে এসে বললাম, তুমি বাঁশ টা চেপে ধরলে কেন? যদি তোমার গায়ে পড়ত?
ছেলেটা জোর গলায় বলল,আমাদের দেশের পতাকা কে কিছুতেই মাটিতে পড়তে দেব না। এতে মাতৃভূমিকে অসম্মান করা হয়। জাতীয় পতাকা আমাদের দেশ মাতার সম্মান।
মাটিতে ফেলতে নেই। স্কুলের স্যার বলেছে আজ।
ছেলেটিকে আদর করে বললাম, ভালো করে পড়াশোনা করো সোনা । তবে ই নেতাজীর মতো হতে পারবে।
মনে মনে স্যালুট করলাম আজকের নেতাজীকে। -
অণু গল্প- দাহ
দাহ
-শক্তি পুরকাইতঅরিত্র ভুলতে পারছে না, যে মা নেই। অফিসে ফোনটা আসায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সকালে মা’কে দেখে বেরিয়েছিল। আর নেই। তার চোখ ছল ছল করে ওঠে। অরিত্র কাঁদতে চেষ্টা করে, পারে না । বুকটা খালি করতে। সে এগিয়ে যায়। একটা একটা লাশ দেখতে দেখতে। পাশে ট্রাক, আ্যম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। সামনেই চোখ পড়ে যায় মা’কে দেখে। সবুজ তুলসী পাতা দিয়ে ঢাকা চোখ। বোন অনুষ্কা মা’কে জড়িয়ে ধরে হাউ – হাউ করে কাঁদছে। প্রথম সারিতে মা। কিছুক্ষণ পরে চলে যাবে আগুনে। তাই অপেক্ষা করছে কয়েকটা মিনিট। মা’কে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অরিত্র থাকতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে, মা- আ! তখনও বাইরে থেকে ভেসে আসছে শব্দটা — বলো হরি , হরি বোল্ …
-
অণু গল্প- কাটমানি
কাটমানি
– শক্তি পুরকাইত‘অকালে ভাতারের মাথাটা খেয়েছিস, এবার নিজের মেয়েটার মাথাটা খা, বারবার করে বললুম ওই লোকটার সাথে অত পিরিত করিস না, বুঝবি রে সময় হোক!’ উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে শাশুড়ির কথাগুলো শুনছিল মহুয়া। একবছর হল স্বামী নেই। মেয়েটা আট মাসের পেটে। সারা দিনটা মদ খেয়ে এসে মারধোর। বউ প্রতিবাদ করায় গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। সেই থেকে শাশুড়ির এত লাঞ্ছনা- গঞ্জনা শুনতে হয় মহুয়াকে। ঝাঁট দেওয়া থামিয়ে, মহুয়া শাশুড়িকে বলে- মা একটু চুপ করবে? এ সব শুনতে চাই না!
– কেন রে মুখপুড়ি সত্যি কথা বলছি গায়ে ফোসকা পড়ছে, থাক থাক! শাশুড়ি বিড় বিড় করতে করতে ঘাটের দিকে যায়। মহুয়া ভেজা কাঠগুলো রোদে দিয়ে উনান ধরায়। পিছনে দাঁড়িয়ে আভাষপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিজন ঠাকুর। তাকে অনেকে বিজন প্রধান বলে চেনে। গ্রামের গন্যমান্য লোক। তাই অন্যায় করলেও কেউ কিছু বলে না। সদ্য বিধবা মহুয়া পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে দাঁড়িয়ে বিজন ঠাকুর। অঞ্চল থেকে এ বছর মহুয়াও ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর পেয়েছে। কিছুটা ইট গাঁথলেও পুরোপুরি তুলতে পারেনি। আরও কিছু টাকার দরকার। সে প্রধানকে বলেছিল কিন্তু রাজি হয়নি। মহুয়ার যৌবনের প্রতি লোভ তার সে নিজেও জানে। আজ হঠাৎ স্বয়ং প্রধান সাহেব নিজেই হাজির। সে বসতে বলে। বিজন ঠাকুর শুধু একটা কথা বলে চলে যায় ‘রাতে আসবে কথা আছে ..’ মেয়েকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে, মহুয়া দরজা খুলে বাইরে বের হয়। শ্রাবণের আকাশ কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হওয়ায় পথঘাট শুনশান। সে দেখল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিজন ঠাকুর। চাঁদের আলোয় সামান্য মুখ দেখা গেলেও পুরোপুরি নয়। মহুয়া কাছে আসতেই বিজন ঠাকুর লোভ সামলাতে না পেরে জড়িয়ে ধরে। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তাকে হুমকি দেয় এ কথা বলে দিলে প্রাণে মেরে ফেলবে। সেই জন্যে চুপ করে থাকে মহুয়া। মৃত্যুর ভয় আর মেয়েকে বাঁচানোর আকুতি। তাকে চুপ করে থাকতে হয়। বিজন ঠাকুর বিবস্ত্র মহুয়ার উপর হিংস্র বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূর থেকে মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায় সে। মাটি থেকে উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। কোনরকমে টলতে টলতে বাড়ি আসে। সকাল হলে গ্রামের মানুষের কাছে মুখ দেখাবে কী করে! ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা দিতে না পেরে শেষে নিজের ইজ্জত দিয়ে কাটমানি দিল বিজন ঠাকুরকে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এ মুখ আর কাউকে দেখাবে না! ঘরের দরজা খুলে মেয়েকে বুকে নিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে অন্ধকারে ছুটে চলল, মহুয়া। -
অণু গল্প- সকালের স্বপ্ন
সকালের স্বপ্ন
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়আজ শম্পার ঘুম ভাঙে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। ঘুম ভেঙে মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়। সে পরিষ্কার মনে করতে পারে পুরো স্বপ্নটাকে।
ঘুমের মধ্যে সে দেখেছে এক মহাপুরুষকে। তাঁর দু’টি চোখ মায়াময়,ঋজু সবল দেহ। প্রসন্ন মুখে মৃদু হাসি নিয়ে সে হাত নাড়ছে মানুষের দিকে। সব মানুষ বিহ্বল, উত্তেজিত এই মানুষটির একটু ছোঁয়া পাবার জন্য।ওকে শুধু চোখের দেখা দেখতে পেয়ে তারা ধন্য।
এই মানুষটি তাদের নেতা। যার মনে কোনো মালিন্য নেই, পাপ নেই … চোখভরা স্বচ্ছতা, মনজুড়ে শুধু সাধারণ মানুষের ভালো করার চিন্তা। তারমধ্যে কোনো ভান নেই, প্রচার নেই… সবটাই আন্তরিক।
মানুষ জানে তাদের নেতা তাদের শুধুই ভালো চায়।ভালো চায় দেশের- দশের। তাই দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প আর অর্থনৈতিক উন্নতিই তাঁর লক্ষ্য। আর সেকাজই তিনি করে চলেন নিরলস ভাবে, নীরবে।
দেশে আজ একজনও গরীব মানুষ নেই। মাঠে মাঠে ফলছে সোনার ফসল। চাষী তার উপযুক্ত দাম পাচ্ছে।ফড়ে নেই, দালাল নেই। কতশত কলকারখানায় উন্নত যন্ত্রপাতিতে কাজ করছে শ্রমিকেরা। তাদের তৈরী দ্রব্য রপ্তানি হচ্ছে দেশে-বিদেশে। শ্রমিকেরা আজ তৃপ্ত… শ্রমের মর্যাদা পাচ্ছে তারা। উপযুক্ত বেতন তাদের জীবনকে সুনিশ্চিত করেছে। ৩৬৫ দিনই কলকারখানার চাকা ঘুরছে।
ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে।সর্বত্রই পড়াশুনোর সুন্দর পরিবেশ…শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাসেই যত্নশীল। ছাত্রছাত্রীদের বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয়না আলাদা টিউশন নেবার জন্য। সবাই আজ শিক্ষিত,সৎ।
দেশের যুবসমাজ তাদের অনুসরণ করার নেতাকে পেয়ে গেছে। তারা দিশা পেয়েছে। তাই তারা আজ উৎফুল্ল। সাত রঙের আবীর ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা আকাশে বাতাসে। শিক্ষা জীবন শেষ করে উজ্জ্বল চাকরী জীবনের হাতছানি তাদের সামনে।
ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে ধোঁয়াহীন গাড়ি চলেছে। কোথাও কোন শব্দ নেই। শহরবাসী শৃঙ্খলাপরায়ণ। রাস্তায় মিটিং নেই, মিছিল নেই, অবরোধ নেই…শান্তির বাতাবরণ।
হাসপাতালগুলো ঝকঝকে…রোগীরা যেন বেড়াতে এসেছে সেখানে ক’দিনের জন্য। কোন হয়রানি নেই…কারচুপি নেই। সুচিকিৎসা আছে শুধু…আর আছে ডাক্তারের চোখের কোনে ভরসা আর আশ্বস্ত রোগীর মুখে হাসি।
স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ নীরোগ থাকার লক্ষ্যে এগিয়েছে।কোন ভেজাল নেই খাবারে। বিষ নেই, রঙ নেই শাকসব্জী, ফলে। ভাগাড়ের মাংস এখানে বিক্রি হয়না। এখানে কেউ কাউকে ঠকায়না।
এখানে বাচ্চা চুরি হয়না। মেয়ে পাচার হয়না। কিডনি পাচার চক্র নেই।
মহান নেতা আর তার পারিষদেরা এমন সুস্থ, স্বচ্ছ, সুন্দর বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে যে এখানে চুরি নেই, জোচ্চুরি নেই। সিণ্ডিকেট নেই, মাস্তানিরাজ নেই, দালালচক্র নেই, ধর্ষণকারী নেই, মাফিয়ারাজ নেই, অপরাধ নেই, জেলহাজত নেই। সবজায়গায় সুস্থ সুন্দর সুখের হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে।
এ এমন এক দেশ হয়েছে যেখানে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষা-অশিক্ষা, জাতপাত, ধর্মের কোন ভেদাভেদ নেই, মানুষে মানুষে ঘৃণা নেই…শুধু ভালোবাসা আছে। আর আছে মানুষের মূল্যবোধ, সততা,সম্মান,চেতনা। মানুষের মানব সত্ত্বা বিকিয়ে যায়নি।
শম্পা ভাবে — স্বপ্নটা যদি সত্যি হতো!
-
অণু গল্প- কাটমানি
কাটমানি
-নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত
দ্বিপ্রাহরিক রান্নায় ব্যস্ত টুম্পা দাসের হঠাৎ মনে পড়লো ঘরে গুঁঁড়ো হলুদ বাড়ন্ত। তার বছর ছয়েকের মেয়ে হৃষিতা ছাড়া সেই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ নেই।টুম্পা আটপৌরে পোশাকে বাড়ির বাইরে যায় না।অর্পণ সাহার মুদিখানা খুব কাছেই, হৃষিতাদের খেলার মাঠের লাগোয়া।টুম্পা তাই হৃষিতার শরণ নিল।ডাকলো: হৃষি, একটু আয় তো মা! হৃষিতা আসতেই বললো, তোর অর্পণ কাকুর দোকান থেকে এক প্যাকেট হলুদ গুঁড়ো এনে দিতে পারবি?
:কেন পারবো না? আমি কি ছোটোটি আছি নাকি?
সে যে আর ছোটোটি নেই তার পাকা পাকা কথায় হরদম তার প্রমাণ মেলে।টুম্পা তাকে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললো : এই দশটাকার নোটটা অর্পণ কাকুকে দিয়ে বলবি এক প্যাকেট গুঁড়ো হলুদ দাও।কাকু দুটাকা ফেরৎ দেবে।
: জানি, জানি।অত বলতে হবেনা।আমি কি রিংকির মতো বাচ্চা নাকি? ওর কথা শুনে টুম্পা হাসে।
সে যে বাচ্চা নয় তা প্রমাণের জন্য সে বড়দের কথা গোগ্রাসে গেলে।সময় সুযোগ পেলে উগরে দেয়।ওর মা-বাবা যখন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তখন সে তাদের কথাগুলো যেন কান দিয়ে, ত্বক দিয়ে, সর্বসত্ত্বা দিয়ে শুষে নেবার চেষ্টা করে।
টুম্পা বলে, ঠিক আছে যা।ফেরৎ দুটাকা আবার মাঠে ফেলে আসিস নে যেন।
টাকা নিয়ে হৃষিতা এক ছুট।টুম্পা গেটের কাছে মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।হৃষিতার ফিরতে সময় বেশি লাগে না।হলুদের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে টুম্পা বলে: দুটাকা ফেরৎ দেয় নি?
: দিয়েছে তো?
:কোথায়? তোর হাতে তো দেখছি নে!হারিয়েছিস তো?
:না, হারাইনি।সত্যি বলছি।আমি কি একেবারে বাচ্চা নাকি?
: তা হলে! কী হল টাকাটা?
:ওটা তো কাট মানি মা। এই যে। বলে কোমরে গোঁজা একটা চকোলেট বের করে দেখায়।
টুম্পা তো তাজ্জব। -
অণু গল্প- মানুষ
মানুষ
-সঞ্চিতা. রায়“আমার মেয়ে ভাল হয়ে যাবে তো! ”
“আমি একজন চিকিৎসক, আমার কাজ রোগীকে সুস্থ করা। আমি তো চেষ্টা করবই, কিন্তু তার আগে বলুন আপনার ফর্সা মেয়েকে আমার মত শ্যামবর্ণার হাতে চিকিৎসা করাবেন কিনা?” ডাক্তার শুভা সেন মুখ তুললেন। এই এলাকায় তিনি ধন্বন্তরী চিকিৎসক। সবাই মনে করেন তাঁর কাছে গেলেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। কার্যক্ষেত্রেও অনেক ডাক্তার যে রোগীকে জবাব দিয়ে দেন, ডাক্তার শুভা সেন তাঁর চিকিৎসায় এই রুগীদের নতুন জীবন দেন। রজতাভ গুপ্ত চমকে উঠলেন। এ কাকে দেখছেন, ছোট বেলায় শুধুমাত্র কালো বলে যার সঙ্গে মিশতে চাইত না রজতাভ ওরফে রজত। মাধ্যমিক পর্যন্ত একই স্কুলে পড়ত রজতাভ ও শুভা। পরে শুভার বাবা বদলী হওয়ায় শুভারা অন্য জায়গায় চলে যায়। দশম শ্রেণীতে সরস্বতীপুজোর প্রসাদ বিতরণের দায়িত্বে ছিল শুভাদের গ্রুপ। শুভা রজতাভকে প্রসাদ দিতে এলে রজতাভ বলেছিল “কালঝ মেয়েদের কাছ থেকে আমি প্রসাদ বা খাবার নিই না..” শুভা খুব কষ্ট পায় মনে মনে। এক ব্যাচে পড়লেও রজত শুভাকে সবসময় এড়িয়ে যেত। পরবর্তীতে শুভা অন্য শহরে আসে, নিজেকে ক্রমাগত পড়াশোনায় উন্নত করে। জয়েন্টে চান্স পেয়ে কলকাতার সবচেয়ে নামী কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়ে। চিকিৎসাবিদ্যায় আরো উচ্চ ডিগ্রী লাভ করে। নামী চিকিৎসক হিসাবে খ্যাতি পায়। আর রজত বি.কম পাশ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দেয়। আজ তার মেয়ের কঠিন অসুখে সব ডাক্তার যখন নিরাশ তখনই সে শুভা সেনের নাম শোনে, ও আসে। জানতো না কে এই শুভা সেন।
“কি উত্তর দিলেন না যে, আপনার ফর্সা মেয়েকে আমার মত শ্যামবর্ণার হাতের ছোঁয়া পাওয়াতে বা ওষুধ খাওয়াতে আপত্তি আছে কিনা আগে ভেবে দেখুন, অসুবিধা হলে শহরের কোনো ফর্সা ডাক্তার খুঁজে নিন।”
“আমি ভুল করেছি, তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু আমার মেয়েটাকে বাঁচা..”“ভুল করছেন, আমি আপনার বন্ধু নই, কারণ মানুষকে যারা রূপ রঙ দিয়ে বিচার করে আমি আবার তাদেরকে বন্ধু বলে মনে করি না। আর হ্যাঁ, সহপাঠী ছিলাম বটে বন্ধু ছিলাম না। তবে এই শিশুটিকে আমি বাঁচাব, কারণ আমি চিকিৎসক, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে জানি, যতই আপনার মত মানুষরূপী অমানুষের মেয়ে হোক না কেন?”
রজতাভ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলো। হ্যাঁ, ডাক্তার শুভা সেনের চিকিৎসায় শিশুটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
-
অণু গল্প- পুতুলের বেদনা
পুতুলের বেদনা
-অঞ্জনা গোড়িয়াসেই কোন ছেলেবেলা থেকে গোষ্টমেলায় যেতাম। বাবার হাত শক্ত করে ধরে থাকতাম। যদি হারিয়ে যাই হাত ছিটকে। ছোট বেলা থেকেই ভীষণ ভয় আমার। সেই ভয় আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মেলায় গিয়ে কত কি দেখতাম। পুতুল নাচ, যাত্রা আরও কত কি! সব চেয়ে ভালো লাগতো, পুতুল নাচ দেখতে। কি সুন্দর সুন্দর পুতুল নাচ গান অভিনয় করে দেখাতো।
মনে মনে কত প্রশ্ন তখন। বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করে ছিলাম, বাবা এরা কি কথা বলতে পারে? হাঁটতে পারে ইচ্ছে মতো? আর নাচতে পারে সত্যি। আমার একটা এমন পুতুল কিনে দেবে গো? খেলবো।
বাবা বলেছিল,দূর বোকা। এরা পুতুল। কিচ্ছু করতে পারে না একা একা। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এদের চালক। যাকে বলে ডায়রেক্টর। যারা ইচ্ছেমতো সুতো ধরে নাচাবে। কথা বলাবে সবই। এরা ওই আকাশের ঘুড়ির মতো।
অনেক দূর আকাশে যেমন উড়তে পারে ঘুড়ি। কিন্তু লাটাই থাকে চালকের হাতে। ইচ্ছে মতো নিচে নামাতে ওঠাতে পারে। কিন্তু যদি একবার সুতো ছিঁড়ে যায় পাক খেয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়বে। ওঠার ক্ষমতাও নেই। এখানেই জীবনের ইতি। পুতুলগুলোর অবস্থাও তাই।সুতো কেটে দিলে মাটিতে আঁছড়ে পড়বে। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই।
বাবা একটা সুন্দর গল্প বলে ছিল।
কোনো এক পুতুল একটু বড় হতেই প্রতিবাদে গর্জে উঠল। এভাবে হাতের পুতুল হয়ে সারাজীবন থাকতে পারবে না।
পুতুলটা মনটাকে শক্ত করে মালিককে বলল, আমাদের মুক্ত করো। সুতোর বাঁধন ছিন্ন করে দাও। নিজে নাচ দেখাব।
মালিক বলল, তুই দেখাবি নাচ? দেখ পারিস কিনা? বড্ড বোকা তুই।
বলেই সুতো টাকে বাঁধন আলগা করে খুলে দিল। অমনি মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। ওঠার ক্ষমতা ছিল না। বারবার ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করল, কেন এমন প্রাণহীন অপদার্থ করে পাঠালে পৃথিবীতে? ইচ্ছে মতো কেন কিছু পারি না। পুতুলের বেদনা কারোর কানে পৌঁছালো না। আজও তাকে নাচ দেখিয়ে যেতে হয়। অভিনয় করে যেতে হয় অসংখ্য মানবতার সামনে।
আজ আবার দেখলাম আবার পুতুল নাচ। গোষ্ট মেলায়। সেই পুতুলটা, যার ছিল একটা স্বপ্ন। একটা করার ইচ্ছে । আমার দিকে তাকিয়ে আছে করুণ ভাবে। আর ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, তুমিও আমার মতো। পায়ে শিকল পরা পুতুল ।