অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- আবাদের মাটি

    আবাদের মাটি
    শক্তি পুরকাইত

     

     

    খবরটা সুন্দরী কাকিমা’র কানে পৌঁছতে বেশীক্ষণ সময় লাগে নি। আবাদের মাটিতে আস্ত একটা কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অমল কাকা ছ’মাস নিখোঁজ। কোথাও খোঁজ পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষের ধারণা সুন্দরবনের ভেতরে কাঠ কাটতে গিয়ে হয় বাঘে খেয়েছে, নয় কুমীরে খেয়েছে। যারা এপার থেকে ওপারে যায় অনেকেই ফেরেনি। তাই এই গ্রামটা বিধবা গ্রাম বললেই চলে। গ্রামে পুরুষের তুলনায় বিধবারা বেশী। বাঘে খেলে অনেকে বলে মা বনবিবির কৃপা করেছে, তুলে নিয়েছে। কিন্তু তাদের পরিবারদের মুখে কে অন্ন তুলে দেবে? এই বিধবাদের যৌবনে চরম ভাঁটা পড়ে। নিজেরা কী ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এটাই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সুন্দরী কাকিমা’র ক্ষেত্রে অনেকটাই এই রকম। খবরটা কানে পৌঁচ্ছতেই আবাদের কাছেই গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই চুপ। গ্রামের এক’শ দিনের কাজ চলছিল। খবর পেয়ে স্থানীয় থানার পুলিশ এসেছে। সুন্দরী কাকিমা সবাইকে সরিয়ে দিয়ে কঙ্কালটার কাছে এসে দাঁড়ায়। মাটি খুঁড়তেই কঙ্কালটার সাথে পাওয়া যায় এক পাটি হাওয়াই চটি ও জামার টুকরো। সুন্দরী কাকিমা’র চিনতে ভুল হয়নি, কঙ্কালটা অমলকাকার নিশ্চিত। প্রায় একবছর ধরে চলছিল পারিবারিক একটা জমি নিয়ে খুড়তোতো ভাইদের সঙ্গে চরম বিবাদ। সেই বিবাদের জেরে হয়তো অমলকাকাকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। এতদিন পর তা প্রকাশ্যে বেরিয়ে এল। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। আবাদের মাটিতে কোলে তুলে সুন্দরী কাকিমা কঙ্কালটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছ ! গ্রামের মানুষ নির্বাক দর্শকের মত সে দিকে তাকিয়ে রইল। সাদা কঙ্কালটি আসলে হারিয়ে যাওয়া একটা নিরীহ মানুষ, অমলকাকা।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- আজব ‘আই কিউ’!

    আজব ‘আই কিউ’!

    -অমল দাস

     

    ফুরফুরে সকাল, হালকা শীতের আমেজ। পিঠে রোদের আরাম নিয়ে বন্ধুদের বিশ্বজোড়া গল্প। সিদ্ধান্ত থাকুক বা নাই থাকুক, সমাজে অভিযোগ কিন্তু ভুরিভুরি। এমন সময় পশ্চিমী হাওয়ার বেগে একবন্ধুর বাইক এসে থামল। তেলের ট্যাঙ্কিতে ভুঁড়িটা রেখে সমবেতদের কাছে নিবেদন রাখে ‘কেউ একটা বিড়ি দে’। এরা সকলেই বিড়িতুতো ফ্রেন্ড। তৃপ্তির সুখটানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে বলল– বুঝলি ভাই, সেই মেয়েটাকে আজ দেখলাম।

    যাকে লক্ষ্য করে বলা, সে হয়তো মনে মনে ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলো। নিরুপায়হীন হয়ে শেষে- কোন মেয়েটা রে…?

    -মনে নেই কয়েকবারই তো গল্প দিয়েছিলাম।

    -মনে থাকার কি কথা? চারিদিকে এতো জ্ঞান তাত্ত্বিকের নতুন নতুন বাণীর সাথে এতো পুরনো অনুৎপাদক কথা কেই বা মনে রাখে, রে…।

    -আরে.. যাকে প্রপোজ করেছিলাম একসময়, সেই মালটা। বলেছিলাম মনে নেই?

    বন্ধুটির ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের সুর– লে… বিয়ে করেছিস বাছা দশ বছর পার হয়ে গেল, এখনো মালে নজর? তা এককালে সে বস্তুটা তো মেয়ে ছিল! প্রপোজাল ফেলে দেওয়ার পর সেটা মাল হয়ে গেলো?

    -ওই আর কি! কথা ধরিস না বা*!

    – তা তোকে দেখলো? এখন কেমন লাগছে?

    – আর বলিস না! পুরো মাগি একাটা।

    – মানে?

    – আরে বিয়ে হয়নি এখনো, মাগি বলব না তো কি বলবো!

    – এটা কি কথা ভাই..? ছোট বেলায় মেয়েটা ভালো ছিল, তাই প্রপোজাল দিলি। সে না বলার পর মাল হলো। কোন কারণে দেখে মনে হল বিয়ে হয়নি, তাই সে মাগি? তা রাস্তায় অনেক বিবাহিত মহিলাকেই আজকাল বিয়ে হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই বলে সবাই…! লাজবাব তোর ‘আই কিউ’ ভাই!

    – ওই হল আরা কি….

    – না! এটা হলো না…    

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- মালতী

    মালতী

    -অমল দাস

     

     

    মালতীকে ছোট বয়সেই রমেশে এনেছিল। সেই থেকেই মালতী রমেশের চোখের মণি।তার সংসারে বৌ শ্যামলা আর বছর পাঁচের মেয়ে সম্প্রীতি।মালতী যখন এসেছে, তখন সম্প্রীতি ঘরে আসেনি।আলোর রশ্মি মালতীই এনেছিল।স্বামী-স্ত্রী দু’জনার সহচর্যে আদরে আহ্লাদে বেশ বেড়ে উঠেছে। শ্যামলা নিজের গর্ভজাতকে জন্ম দিলে দু’জন একই সাথে পালিত হতে থাকলো। একটা সময় দু-বছর পরপর খরা হওয়ার দরুন কৃষি ভালো হয়নি। খুব আর্থিক সংকটে দিন কাটাতে হয়। সেই বছর দু-একবার মালতীকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল রমেশ। পারেনি। যখনি মালতীর গলার দড়ি খুলে ক্রেতার হাতে দেওয়া হত, তখনই সে হাম্বা হাম্বা করে কান্না জুড়ে দিত। আর দু-চোখ জলে ভেসে যেত। রমেশ-শ্যামলা শেষমেশ অনটন মেনে নিয়েছিল। হেরে গিয়েছিল মালতীর আর্তনাদের কাছে।

    কিন্তু ঈশ্বরের কি নির্মম খেলা! তা না হলে রমেশের ফুটফুটে মেয়ে সম্প্রীতি কি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়? চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। গরিবের সে সম্বল কই। রাতে মালতীকে গোয়ালে খাবার দিতে দিতে চোখের জলে ফেলেছিল রমেশ। কিন্তু মালতীর নজর এড়াতে পারেনি। সে তার প্রভুর অন্তরের ব্যথা অনুভব করতে পেরেছিল। শুধু দুবার নিজের জিভ দিয়ে রমেশের চোখ মুছে দিয়েছিল নীরবে। রমেশের অসহায়তার কথা শুনে এক ক্রেতা সকালেই এসে হাজির। রমেশ আজ মালতীর দড়ি খুলতে গেলো না। ক্রেতার দেওয়া তিরিশ হাজার টাকা নিয়ে বসে রইল দাওয়ায়। শ্যামলাও নিশ্চুপ মেয়ের শয্যার পাশে। যখন একটু জ্ঞানে এলো, তখন রমেশ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় গোয়ালে– ‘তোমরা ওকে নিওনা! আমার যা হয় হবে। ওকে তোমরা নিওনা…’

    না! আজ আর তার কান্না শোনার কেউ নেই গোয়ালে।মালতী অনেক আগেই নতুন মালিকের সাথে চলে গেছে। শুধু আজ আর বিদায় কালে চোখের জলে হাম্বা স্বরে ডাকে নি…       

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সোহাগ

    সোহাগ

    -অমল দাস

     

     

     

    -বলছি এ বাড়িতে কেউ কি আছে, কথা শোনার মত? না কি আমি উপেক্ষিত? এই অনাহুতের দিকে একবার দেখলেতো উদ্ধার হই! শশাঙ্কবাবু রাগে সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে একবার এ ঘর একবার ও ঘর একবার ডাইনিং-এ পায়চারী করছেন।

    বৌমা শাশুড়ি রান্নাঘরে ব্যস্ত। শাশুড়ি সাড়া না দেওয়ায় বৌমা বলল- মা তুমি যাও, দেখো বাবা কি বলছে!

    -তুমি থামো শুভ্রা! ও মানুষটা সারাজীবন ওই রকমই করে গেলো আমার সাথে।কেন করছে বুঝিনা ভাবছো… বলতে বলতে এগিয়ে গেলো।

    কেতকীদেবী কর্তার ঘরে ঢুকে প্রশ্ন- কি, হয়েছে কি? সেই থেকে দেখি হুমড়ি-তুমড়ি করছো! লাজ-শরম কি খেয়েছ?

    -হ্যাঁ… সে তো বহুকাল আগে বাসী-বিয়ের জলের সাথে খেয়েছি। এ আর নতুন কি?

    -মানে! কি বলতে চাও?

    -আর কি! সত্তরটা বছর শেষ হয়ে গেলো তোমার সাথে…

    -মনে হয় জন্মেই একসাথে গাঁট বেঁধেছি…! কথা-বার্তা চিন্তা করে বলো না?

    -কেন? এতো দিন তো শুনতাম চিন্তা করতে হবে না, আমি স..ব সামলে নেবো। এখন আমার চিন্তা কিসের?

    – তা কেন? আমার দায়, আপনি তো অতিথি… বলি হুজ্জতিটা কিসের?

    -আমি মানুষটা জ্যান্ত আছি যে! খিদে পায় তো না কি?

    -মানে? আধাঘন্টাও হয়নি রুটি-তরকারি খেলে এরই মধ্যে… পেটে কি ইঁদুর ঢুকেছে?

    – মাথা গরম করোনা! রান্না ঘরে হচ্ছে কি? একটা সুস্বাদু গন্ধ এলো!

    -বুঝেছি! আগেই বুঝেছি এ কিসের যন্ত্রণা… 

    মুখভার করে রান্না ঘরে চলে যান কেতকীদেবী।

    বৌমা কৌতূহলী –কি হয়েছে মা?

    -কি আবার? খাই রোগ…! দাও! একবাটি পায়েস দাও… গন্ধ পৌঁছে গেছে নাকে!

    শশাঙ্কবাবু হাই-সুগারের রোগী। পায়েস পেয়ে খুবই আপ্লুত আবেগে- শোনো-না.. কেতকী রাগ করোনা! তুমি ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই। জানো তো কত ভালোবাসি…

    -হয়েছে! সোহাগে আর বাঁচি না…  

     

      

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- নবজাত

    নবজাত
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    কাজের মাসিকে বদলেছি কিছু মাস হলো। নতুন কাজের মাসি বেশি কথা বলে না। সব সময় মুখে অদ্ভুত বিষণ্ণতার ছাপ। কারণটা জানতে পারলাম মাসির মুখেই। কারণ জেনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। মাসির ধর্ষিতা মেয়ে নাকি মা হয়েছে। জন্ম দিয়েছে এক কন্যা শিশুকে। তারপর থেকেই শুরু হয় গ্রামের লোকেদের উৎপাত। সেই শিশুটিকে নাকি বিক্রি করে দিতে হবে। খদ্দেরও নাকি আছে। দাম রাখা হয়েছে কুড়ি হাজার। সেই শিশুটি পাপ। গ্রামে থাকলে গ্রামের অকল্যাণ হবে। তাই তাকে সেই গ্রাম থেকে চিরবিদায় দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। যদি শিশুটিকে গ্রাম থেকে বিদায় না করা হয়, তাহলে সমস্ত পরিবারকে সেই গ্রাম ত্যাগ করতে হবে। পরিবার বলতে মাসি, তার স্বামী এবং তার ধর্ষিতা মেয়ে। তাহলে সেই ছোট্ট শিশুটির ভবিষ্যৎ কী হবে? কোনও নিষিদ্ধ পল্লী? বড় হয়ে নিজের শরীর বেচে পেটের ভাত জোগাড় করতে হবে তাকে? তারপর হয়তো তার অজানা বাপ কোনও দিন নিজের মেয়ের শরীরের সাথে খেলা করবে? সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল আমার। মাসি চলে যাওয়ার পর সারা রাত চিন্তা করলাম। পরের দিন মাসির হাতে টাকার মোটা অংক গুঁজে দিয়ে বললাম – ‘তুমি গ্রাম ছেড়ে দাও। সেই শিশুর ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতে। তার ভবিষ্যৎ রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের।’

    সমাপ্ত।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- দরজা

    দরজা
    – শক্তি পুরকাইত

     

     

    ‘বাড়ি ফেরার সময় ছেলেটার জন্য দুধটা এনো?’ পাশের ঘর থেকে কমলিকার কর্কশ কন্ঠস্বর শুনতে শুনতে দয়াময়ের কান একেবারে ঝালাপালা। আগের মত যৌবনও নেই তার। পাশে শুলে কোন হুঁশ থাকে না।দয়াময় আদর করে গায়ে হাত দিলে বিরক্ত হয়ে ওঠে। যৌবন কী সব সময় মানুষের থাকে। এক সময় ভাঁটাও নামে। দয়াময় লোহা কোম্পানীতে কাজ করতে করতে কখন অল্প বয়সে বুড়ো হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না। দয়াময়ের যৌবনের প্রতি লালসা থাকলেও কমলিকার একেবারে নেই। যতদিন যাচ্ছে সে যেন পোড়া কাঠ হয়ে যাচ্ছে। তাই কমলিকার যে কোন কথায় বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। দয়াময় আজকাল এ পাড়াতে ও ঢোকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোকে দেখে মন টানে। এ মাসের মাইনে পেয়ে ভুলে গেছে যে তার বাড়িতে একটা সংসার আছে। মত্ত হয়ে ওঠে শরীরের প্রতি। ব্লাউজের হুক খুলতে গিয়ে দয়াময়ের দু’চোখে ভেসে ওঠে কমলিকার মুখ। ছেলেটার জন্যে দুধ নিয়ে গেলে তবে সে খেতে পাবে। ‘বাবা’ ডাক শুনতে পায় সে। নারী শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সে যেন একটা ভুল করে চলেছে। যে ভুলের কোন ক্ষমা নেই। বাড়িতে তার অপেক্ষা করছে একজনই মানুষ কমলিকা। সে বাড়ি ফিরলে দরজা খুলে দেবে। সে দাঁড়িয়ে দেখবে শুকিয়ে যাওয়া কমলিকার মুখ। দয়াময়ের দু’চোখ ছল ছল করে ওঠে। সে মনে মনে বলে ওঠে,’কমলিকা দরজা খুলে দাঁড়া, আমি আসছি’ কমলিকা ছাড়া এ দরজা কেউ খুলে দেবে না, তার। একটা দরজার জন্য সে চিরটাকাল অপেক্ষায় থাকবে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- কালি

    কালি
    – শক্তি পুরকাইত

     

    কালো পিস্তলটা কপালের এক কোনে এমন ভাবে ধরেছে কোন উত্তর করতে পারেনি, স্বাধীনতা সংগ্রামী অখিল জানা। দেশ স্বাধীনের পর আজও এই ভাবে বেঁচে থাকতে হবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ বছর তা নিজের চোখে দেখল। অনেকবার শাসিয়েও গেছে ‘শালা বুড়ো যদি ও পথে পা বাড়াস, তোর মৃত্যু নিশ্চিত’ এ কথাগুলো বলে চলে গেছে পাড়ার নেতা। এই জন্যে কী ব্রিটিশদের হাতে এত মার খেতে হয়েছে, এত জেল খাটতে হয়েছে! সে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন থেকে যেটুকু টাকা পায় নিজের সংসারটা কোনরকমে চলে। আজীবন সে অবিবাহিত অর্থাৎ বিয়ে করে নি। গ্রামের কোনো মানুষের বিপদ পড়লে সে এগিয়ে গিয়ে সবার আগে দাঁড়ায়। তাকে চেনে না, এমন কেউ নেই। সে একরকম গ্রামের ভগবান বললে চলে। সবাই তার কথা মানে। আগের মত শরীরে জোরও নেই। শরীরের জোর না থাকলেও প্রতিবাদ করতে ছাড়ে না। প্রতিবছর সে ভোটের লাইনে দাঁড়ায়। কিন্তু এ বছর তার সে আধিকারও নেই। সদানন্দ প্রাইমারী ইস্কুলে ভোটের লাইন পড়েছে। সে জানলা খুলে দেখে সবাই ভোট দিতে চলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী অখিল জানার মত অনেকে যেতে পারবে না। এ কোন দেশ! সে জানতে চায়? বার বার নিজের আঙুলের দিকে তাকায়। এ বছর প্রথম তার আঙুলে কালি লাগে নি। যে কালিতে দাঁড়িয়ে আছে একটা দেশ, একটা মানচিত্র।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- কালিপূজার রাত

    কালিপূজার রাত
    – পারমিতা চ্যাটার্জী

     

    শব্দের আাওয়াজটা যে মাঝে মাঝে শব্দভেদী অস্ত্রে পরিণত হচ্ছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ শ্রীময়ী আজ থেকে দশ বছর আগে পেয়েছিল। তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়, তার একমাত্র সন্তান- রাতুলকে। রাতুল ছোট্ট থেকে এই বাজির শব্দ সহ্য করতে পারতো না। কালীপুজার দিন সে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে একটা ঘরে খাটের ওপর বসে ঠকঠক করে কাঁপত। আর শ্রীময়ীও তাকে প্রাণপণ বুকে আঁকড়ে থাকত।সেবার কালিপূজার দিন ঠিক এমনই এক শব্দভেদী বাণের ভয়ংকর শব্দে রাতুলের হার্টফেল হয়ে যায়। তার তিন দিন আগেই তারা স্বামী স্ত্রী রাতুলকে নিয়ে সবে বাড়ি ফিরে এসেছে। সাঙ্ঘাতিক ম্যালিগন্যান্ট ম্যলেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় দশ দিন নার্সিংহোমে ছিল। ডাক্তার ঠিক মতে ধরতে না পারায় রোগ অনেকটা বেশিমাত্রায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। ব্রেইন অ্যাটাক করে ফেলেছিল। হার্টও খুব দূর্বল ছিল। আস্তে আস্তে সুস্থই হয়ে উঠছিল।

    আচমকা কালিপূজার দিল সকালে ঘটনাটা ঘটে গেল। তার বাড়ির নীচেই কয়েকটা ছেলে, কালি পটকা ফাটাচ্ছে। রাতুল চমকে চমকে উঠছিল। কারণ তার এই শব্দের ব্যাপারে আতঙ্ক দশ বছর বয়েসেও যায়নি।শ্রী বারান্দায় গিয়ে বলে এলো ছেলেগুলোকে, বাবা তোমরা একটু দূরে গিয়ে ফাটাও..আমার বাড়িতে খুবই অসুখ পেশেন্ট আছে। সবে নার্সিহোম থেকে নিয়ে এসেছি।
    ছেলেগুলো অবজ্ঞার ভঙ্গিতে তাকালো তার দিকে। সে ভালো করে দরজা বন্ধ করে রাতুলের দুধ আনতে রান্নাঘরে গেল। আর ওর স্বামী সুগত একটু বেরিয়েছিল। সেইসময় তার বাড়ির নীচেই দোদোমা নামে এক ভয়ংকর শব্দের বাজি আবার চকোলেট ব্যোম একসাথে ছেলেগুলো ফাটায়। তার মারাত্মক শব্দের আওয়াজে গোটা বাড়িটাই যেন কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠে শ্রীময়ীর প্রাণ, দৌড়ে চলে আসে রাতুলের ঘরে- দেখে রাতুল চোখ দু’টো বড়ো করে খুলে কেমন করে যেন শুয়ে আছে। তার ডাকে কোনো সাড়া দিচ্ছেনা। শ্রীময়ী পাগলের মতো চিৎকার করছে, ‘রাতুল…রাতুল’ বলে, না রাতুল আর সাড়া দেয়নি। কোনোদিনই সাড়া দিল না সে মায়ের কাতর ডাকে।ডাক্তার এসে জানালেন দুর্বল হার্ট নিতে পারেনি এই শব্দ..সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল হয়ে গেছে। আজ থেকে দশবছর আগে ঠিক এই দিনে তার কোল খালি হয়ে গিয়েছিল। আজও তারা স্বামী স্ত্রী দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে। এক অজানা ভয় এখনও তাদের তাড়া করে ফেরে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প -তিন কন্যা

    তিন কন্যা
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

    পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। ছটপট করছে আমিনা বিবি।মরোদটা বাড়ি ফিরেই লাথি মেরে ধাক্কা দিল দরজায়। ভাঙা কপাটটা আছড়ে পড়ল পায়ে। যন্ত্রণার ওপর যন্ত্রণা। ওমা গো, বলে চেঁচিয়ে উঠলো আমিনা।
    ছোট মেয়েটা আঙুল চুষে চুষে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঝতেই পারেনি সে। বড় মেয়েটা ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে। আর আমিনা নিজের যন্ত্রণা চেপে রেখে সকাল থেকে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। এখন আর পারছে না সইতে এ যন্ত্রণা। তার ওপর পায়ে দরজার আঘাত। আর কত সহ্য করবে বেচারিটা।
    জুয়া খেলে সব খুইয়ে ঘরে ফিরেছে মদ্যোটা। হাতের শেষ সম্বল চুড়িদু’খান খুলে নিয়েছিল জোর করে। বলে গিয়েছিল আজ হিঁদুদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। দেখবি ঠিক ঘরে লক্ষ্মী আনবো। একদম ভাবিস না।
    কাল তোকে ঠিক হাসপাতালে নিয়ে যাবো। সব বেদনা কমে যাবে। আজ রাতটা সহ্য করে থাক। সারা দিন পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে৷ কিছু পান্তা ছিল। তাই সকালে মেয়েদু’টি খেয়েছিল লঙ্কা মেখে।
    আবার একটা রাত। আবার একটা দিন। কাল যে কি করে দিন কাটবে আমিনা জানে না?
    আল্লার দয়ায় দু’টোকে খেয়ে পরে দিব্যি চলছিল। দু-দু’টো মেয়ে হওয়ায় বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকতো। তবু দিন চলে যেত কোনো ক্রমে।
    হঠাৎ কিছু দিন পর আবার আমিনার মাথা ঘোরা শুরু হলো। বমি বমি ভাব দেখে স্বামীর মনে খুশি আর ধরে না। পীর বাবার কাছে মানত ও করে এল দু’জনে। ছেলে হলে আবার আসবে আল্লাহর কাছে দয়া নিতে।
    আমিনাকে হেলথ সেন্টারে দেখাতে নিয়ে গেল। ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা করে জানিয়ে দিল, পেটে কোনো বাচ্ছা নেই। ঠিক মতো না খেয়ে খেয়ে পেটে পিত্তি জমেছে। হয় এপেন্ডিক্স হয়েছে নয় তো বড় কিছু হয়েছে। আল্টাসনোগ্রাফি না করলে জানা যাবে না। সেই দিন থেকে আমিনার বর আরও বিগড়ে গেল। টাকা রোজকারের জন্য যত রকমের খারাপ কাজ আছে, সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলো। নইলে এত টাকা আসবে কোথা থেকে? চিকিৎসা খরচই বা আসবে কি ভাবে? লোভ আরও বেড়ে গেল। আরও পাপ বাড়লো। নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বসান্ত হলো। একদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে বলল, বাড়িটুকুও বন্ধক দিয়েছি। জুয়া খেলার আর কিছুই নেই।
    কাল নিশ্চয় জিতব। অনেক টাকা আনব।
    আমিনা পাথর হয়ে গেল। ঘরহীন সহায় সম্বলহীন হয়ে আজ পুরোপুরি নিঃস্ব।
    ভোরের আলো জ্বলে উঠেছে। নীল আকাশ রামধনু রং এ রঙিন হয়েছে।
    ঘরের দরজা ভাঙা। কেউ নেই ঘরে।
    আমিনার মাতাল বরের নেশা এতক্ষণে কেটে গেছে। চারিদিকে খোঁজ করল। কেউ কোথাও নেই। কপাল চাপড়ে বসে পড়ল। কোথায় গেল ওরা?

    পুলিশ এসে খবর দিল, বড় রাস্তায় মোড়ে ট্রেন লাইনের পাশে তিনটি ট্রেনে কাটা লাশ পাওয়া গেছে।
    কতকটা আমিনার মতো। আর দু’টো মেয়ে।
    কে জানে কে? অন্ধকারে মাথাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল লাইনে। আর দু’টোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল রেলের সামনে…সব শান্ত। আর কেউ কাঁদবে না খিদেয়। কেউ যন্ত্রণায় ছটপট করবে না। শান্তিতে ঘুমাচ্ছে তিন কন্যা।

  • অণু গল্প

    গল্প- রাধার জিত

    রাধার জিত
    – সোহিনী সামন্ত

     

     

    দশ বছর হল রাধার বিয়ে হয়েছে। রাধার স্বামীকে কর্মক্ষেত্রের জন্য মাঝে মধ্যেই বাইরে যেতে হয়। তার বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। রাধার শাশুড়ি সেকেলে মনের মানুষ। রাধা আগে গান, নাচ শিখতে যেত। কিন্তু তাতে শাশুড়ির বড় আপত্তি। আর বাইরে কোন ছোট প্রোগ্রাম করলে তো রেগে যা না তাই বলেন।

    “কি গো বৌমা কোথায় গেলে? দুপুর তো বয়ে গেল কখন খেতে দেবে?” বলে উঠলেন মালিনী দেবী। মালিনী দেবী রাধার শাশুড়ি মা। রাধা একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, “এই তো যাচ্ছি মা, এখনি আমরা খেতে বসব..” যেই বলা সেই কাজ। রাধার রান্নার হাত বড় ভাল। মালিনী দেবীর তো খুব আনন্দ। ইলিশের ভাপা আর চিংড়ির মালাইকারী একেবারে জিভে জল নিয়ে এসেছে। রাধার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী হল তার শাশুড়িমা। তবে তার সাথে মনের মিল করা সম্ভব হয় না। উনি বউমার পছন্দ বুঝতে চান না। রাধা খেতে খেতে হঠাৎ বলে উঠল, “মা বলছি কি, আমার মা একবার ফোন করেছিল। যেতে বলেছে আমাকে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে যাব।”
    -“তা আর বলতে। তোমার আপন মা যখন ডেকেছে যেতে হবে বইকি। তবে বেশিদিন থাকা চলবে না। নাতি নাতনির ঝামেলা নেই সে বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ করে যদি ছেলে বাড়ী চলে আসে?”
    -“মা ও নিয়ে ভাবছেন কেন? ওঁর সাথে ফোনে কথা বলেই যাব।”
    -“ঠিক আছে। বেয়ানকে আমার শুবেচ্ছা ও প্রণাম জানিও।”
    -“হ্যাঁ, মা..”বলে রাধা নিজের বাড়ীর কাজে মগ্ন হয়ে গেল। কিছুদিন হল তার স্বামী রাকেশ একটা ফোন উপহার দিয়েছে।মোবাইলে নানা আঁকা ছবি দেখতে রাধার খুব ভাল লাগে। তার আঁকা শেখার খুব ইচ্ছে তবে শাশুড়িকে বললে ঝামেলা বাঁধিয়ে দেবে। তাই আর সাহস পায় না।

    বাপের বাড়ী যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে। মালিনী দেবীকে প্রণাম করে রাধা যাত্রা শুরু করে। পৌঁছিয়ে মা’কে দেখে নিজের আবেগ আর ধরে রাখতে পারে না।

    মাকে জড়িয়ে ধরে রাধা কাঁদতে থাকে। রাধার মা মৌসুমীদেবী বলেন, ‘কি হল রে এমন ফুঁপিয়ে কাঁদছিস কেন?”

    -“ভালো লাগে না। বড় একা লাগে মা। শাশুড়ি মা তো আমার সব স্বাধীনতা কেড়ে নিল।” ফুঁপিয়ে ওঠে রাধা।

    -“কি হয়েছে পরিষ্কার করে বল?”

    -“কি আর বলব– নাচ, গান, আঁকা কিছুই উনি পছন্দ করেন না”।

    -“উফ চল আর কান্নাকাটি করতে হবে না। ফ্রেশ হয়ে কিছু মুখে দিয়ে জিরিয়ে নে, তারপর কথা হবে”।
    বিকেল হতে রাধা বাজারে যায়। নিজের কিছু কেনাকাটা করে ফিরে আসে।
    মায়ের বিছানার কাছে বসে কি যেন ভাবতে থাকে।
    মৌসুমিদেবী বলেন, “শোন তোর সমস্যার সমাধান আমি করে দিচ্ছি। পাশের বাড়ীর মাণিক বড় আঁকার মাস্টারমশাই। তার সাথে কথা বলেছি। তুই সময় পেলে এখানে চলে আসবি। আমি মানিককে বলে রাখব, ও এসে তোকে আঁকা শিখিয়ে যাবে। টাকা পয়সার কথা চিন্তা করতে হবে না। আর তোর শাশুড়ি মাকে এ ব্যাপারে জানাতে হবে না।”

    মায়ের কথা শুনে রাধা যেন মনে শক্তি পেল। নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেল।

    এমন করেই দিন কাটতে লাগলো। মাঝে মাঝেই সে বাপের বাড়ী যেত, আঁকা শিখে আসতো। রাধার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল। একদিন সে বড় শিল্পী হবেই এমন স্বপ্ন সে দেখতে লাগল।

    কিছুদিন আঁকা শেখার পর মাণিক বাবু বললেন, “রাধা, আমাদের এখানে আঁকার প্রদর্শনী হবে, তুমি আঁকা দিও।”

    রাধার চোখে আনন্দে জল চলে এল। এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না।

    প্রদর্শনীর দিন চলে এল । রাধার তার আঁকা জমা দিয়েছে। সারি সারি কত ছবি লাগানো আছে। আজ রাধা এসেছে, কিন্তু সে একা আসেনি, সঙ্গে করে মা ও শাশুড়ি মা’কেও নিয়ে এসেছে। শাশুড়ি মা একদম আশ্চর্য হয়ে বলল, “কে মা আমাকে এত সুন্দর করে এঁকেছে? এতে তো তোমার নাম লেখা!! তুমি এত সুন্দর আঁকতে পারো। মুগ্ধ আমি মুগ্ধ। এবার থেকে তুমি আঁকা শিখবে; আমি কোন বাঁধা দেব না। অনেক বড় হও তুমি। অনেক আশীর্বাদ।”
    এই কথা শুনে রাধা কেঁদে ফেলল। আজ থেকে তার সুখের দিন যাপন শুরু হল।

You cannot copy content of this page