অণু গল্প
-
অণুগল্প- কলাবউ
কলাবউ
– শক্তি পুরকাইতআয়নার সামনে দাঁড়ায় তাপসী। নিজেকে দেখে বার বার। শাড়ি পরতে ওকে বেশ মানাচ্ছে। নিজেকে যেন ‘কলাবউ – কলাবউ’ লাগে। সে শাড়িটা কোন রকমে পরে নেয়। ওর জন্য অপেক্ষা করছে গ্রামের অন্য মেয়েরা। সপ্তমীর সকালে ‘কলাবউ’ স্নান করানো দেখবে সে। প্রতি বছর ওর বাবা শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাবার জন্য গ্রামের এই শান্ত পরিবেশে তার নিজের বাড়িতে এসে পুজো ক’টা দিন কাটায়। আজ নয় বহু দিন ধরে পুজো মানে গ্রামে কাটানো। শহর থেকে গ্রামে পুজো কাটানোর মজাটাই অন্যরকম। কতদিন পর দেখা মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময়। তাপসীর বাবা এটা বেশ করতে পারে। সে শাড়িটা পরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে ‘কলাবউ’ স্নান করানো দেখতে যায়। তাপসী পিছন ফিরে দেখেনি, যে তার পিছু নিয়েছে ক’য়েকটা বোখাটে ছেলে। সে মেয়েদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করতে করতে চলে আসে। ওর সাথের মেয়েগুলোকে লক্ষ্য করে হেঁটে গেলেও সামন্য আড়াল হতে, কে যেন মুখে হাত চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। সে চিৎকার করতে পাচ্ছে না। এই গ্রামের সবাইকে সে চেনে না। শহরে থাকতে থাকতে গ্রামের সংস্কৃতি তার অজানা। তাপসীকে মুখে গামছা বেঁধে ধান জমির ভেতর নিয়ে আসে। একটা একটা বস্ত্র করে খুলে নগ্ন করে। তাপসী বলতে চেষ্টা করে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’ তার কথা যেন কেউ শুনতে চায় না। বরং হুমকি দেয় চিৎকার করলে গলা টিপে মেরে ফেলবে.. কাদা ধানজমির ভেতর তাপসীর নগ্ন বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের ঢ্যাম -কুড়া – কুড় আওয়াজ। মাইকে শোনা যাচ্ছে চণ্ডীপাঠ ‘ইয়া দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ। তাপসী কাদাজমি থেকে ওঠার চেষ্টা করে, পারে না। এতক্ষণে সবাই পালিয়েছে। সামান্য সামান্য এখনো নিশ্বাস পড়ছে। পায়ের আলতা ধুয়ে গিয়ে লাল হয়ে গেছে জল। সে ‘কলাবউ’ স্নান করানো দেখতে এসে নিজেই ‘কলাবউ’ হয়ে গেল।
-
অণুগল্প- ভাসানের শেষ পদধ্বনি
ভাসানের শেষ পদধ্বনি
– শক্তি পুরকাইতদূর থেকে ভেসে আসছে ঢ্যাম – কুড়া- কুড় ঢাকের বাদ্যি। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকারের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে দুগ্গা মাঈ কী জয়! সুমনাও পাড়ার মেয়ে-ঝিদের সঙ্গে রঙ খেলেছে আজ।
শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে তাকেও মুখে রঙ দিয়েছে। এত আনন্দের মধ্যেও সুমনা শুনতে পাচ্ছে, একটা বিষন্নতার সুর! একে- একে মঞ্চ থেকে প্রতিমা নামানো হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পর জলে পড়বে। আবার আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে একবছর পর। সুমনার মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। বেশ কিছুদিন ধরে অমলের সঙ্গে অশান্তি চলছিল। সেই অশান্তিটা আরো জোরালো হয়ে উঠল মেয়েটা হওয়ার পর। অমল কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ‘কন্যা সন্তান’ যেন অমলের কাছে একটা বড়ো বোঝা। সেই বোঝা যেন শেষ করে দিতে চায়! সুমনা, মা দুর্গাকে বিজয়ার প্রণাম করে, এক ছুটে ঘরে আসে। এক মাসের মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। দরজাটা কোনো রকমে খুলে সে বুকে করে নিয়ে অন্ধকারের ভিতর একা ছুটে চললো। এতক্ষণ প্রতিমা জলে ভাসছে। মাটির গা থেকে গলে পড়ছে মাটি। তবুও মুখটা বার বার ভেসে উঠছে সুমনার। সে আজ শুনতে পাচ্ছে ভাসানের শেষ পদধ্বনি। পায়ের শব্দগুলো যেন অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। ফাঁকা রেল লাইনের ধারে এসে দাঁড়ালো। তারপর এক ঝটকায় ঝোপের উপর নিজের কন্যাসন্তানকে ছুঁড়ে দিল। আর্তনাদ করে মেয়েটা কেঁদে উঠল মৃত্যুর কান্না। পিছনে না তাকিয়ে সুমনা ঘরের দিকে রওনা হল। জলভরা চোখে নিজের দুর্গাকে নিজের হাতে বিসর্জন দিল সে! -
অণুগল্প- হাসির ঝিলিক
হাসির ঝিলিক
– রাখী চক্রবর্তীসেদিন বাবার চায়ের কাপটা ভর্তি ছিল তখনও, বিছানাটাও ছিল পরিপাটি। আমি সেদিনও দেখি বাবার মুখে সেই অনাবিল হাসি। হঠাৎ থমকে গেল ঘড়ির কাঁটা, তখন সকাল ন’টা। মস্তিষ্কে রক্তক্ষারণ হচ্ছে আমার
মায়ের চোখের জল মোছানো, সাধ্যি নেই তো আমার। ধুপের গন্ধে ঘর ভরলো, কেউ বা আমার চোখের জল মুছলো। বাবা কিন্তু হাসি মুখে চির নিদ্রায় আছে সুখে। বাবার মুখের হাসির ঝিলিক তখনও ছিল, আজও আছে
বাবার ছবির দিকে তাই রোজ তাকিয়ে থাকি
বাবার নাকি অনেক কথা বলার আছে।** ****** ******* *******
আমার বাবা একজন ক্রিকেট প্রেমী মানুষ ছিলেন। ইন্ডিয়া টিমের খেলা মানে ভারতীয় দল যতক্ষণ না জিতছে ততক্ষণ চা ছাড়া অন্য কোন খাবার বাবা মুখে তুলবে না। যদি ইন্ডিয়া টিম হেরে যায় তাহলে সেই রাতের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল বাবার। মানে মুখে আর খাবার তুলবে না বাবা। ছোট্ট থেকে দেখে আসছি বাবার এই রকম ছেলে মানুষি।আমি যখন কলেজে পড়ি তখন থেকেই বাবা ও মাকে আমি চা বানিয়ে দিতাম। বাবার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছিল আমি চা না করে দিলে বাবা চা খাবে না। এই রকম একদিনে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে, রবিবার ছুটির দিন। বাবার বন্ধুরা খেলা দেখতে আসছে, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি, আমিও খেলা দেখতে বসে যাচ্ছি মাঝে মাঝে। তারপর খেলার বিরতির সময় সবাই চলে গেল। বাবা তখন একা একা খেলা দেখছে।
রাখী…এক কাপ চা দে তো। ইন্ডিয়াকে জিততে হবে তো ক্রিকেট ম্যাচে।
– দেখো বাবা এই নিয়ে ছয় কাপ দিলাম আর না ।
– দে না আর চাইব না।
আমি বেশ রেগেমেগে বললাম, ডাক্তার কাকু তোমাকে বেশি চা খেতে বারণ করেছে তাও আমি দিলাম। কিন্তু আর না।
– ঠিক আছে। ইন্ডিয়া হারলে আমি কিন্তু দায়ী না। যদি ইন্ডিয়া হারে, আমি কিন্তু কালও কিছু মুখে তুলব না। চা ছাড়া।
এই সময়ে নিখিল কাকু এসে হাজির। বাবার প্রিয় বন্ধু ।
রাখী মা, দুই কাপ চা করতো বেশ জমিয়ে খাই আর খেলা দেখি।
ব্যাস, ওমনি বাবার মুখে ছেয়ে গেল হাসির ঝিলিক। কতো কথা বলে দিল ঐ হাসি। যেন তৃপ্তির হাসি হাসলো বাবা। বোঝাতে চাইল, আমাকে তো না বললি কাকুকে তো আর না বলতে পারবি না।
আমি বাবাকে তো চা দিতে চাই না। কিন্তু কাকু কে তো দিতেই হবে। কাকুকে তো আর না বলতে পারব না।আজ যখন টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখি তখন বাবার ছবির দিকে তাকালেই সেই হাসির ঝিলিক দেখতে পাই।
সবই ঠিক আছে বাবার চায়ের কাপ, বাবার ঘর, বাবার ঘরের টিভি, বাবার ছবিতে সেই হাসি। শুধু আমিই বলতে পারিনা, বাবা তোমাকে আর চা দেবো না। -
অণুগল্প- হঠাৎ খুশী
হঠাৎ খুশী
– শিলাবৃষ্টিনগর কলকাতায় জন্ম রিনির, গ্রামবাংলার কিছুই দেখেনি সে। শম্পার জেদেই- তার মামারবাড়ীর দুর্গপূজো দেখতে বেরিয়ে পড়ল ছুটিতে।
একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। নাম সুবর্ণা। যেন তুলি দিয়ে আঁকা সে গ্রাম। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে বিকেলে রিনি, দু’পাশে সাদা ধবধবে কাশফুল, নীল আকাশে সাদা মেঘেদের আল্পনা। নদীর দুইধারে ছোট ছোট গ্রাম। প্রতিটা বাড়িতে শিউলির ঝরে পড়া যেন আগমনী গান। বেশ কয়েকটা পুকুরে পদ্ম শালুক জল থেকে মাথা তুলে যেন বলছে – আমি ফুটে গেছি। মাটির বাড়ীগুলোর দেওয়ালে সুন্দর আল্পনা! রিনি ভাবে কবিরা এইসব দেখেই বুঝি কবিতা গুলো লেখে। তার মনেও ছন্দ খেলে —
আজকে বুঝি জীবনতরণীতে-
হঠাৎ খুশী ঘনিয়ে আসে চিতে।ভালো লাগে তার এই গ্রামবাংলার নানান জীবন্ত ছবি। আর ভালো লেগে যায় একজনকে … যে আনমনে বাঁশী বাজায় বিকেলের অস্ত আলোয় নদীর ধারে বসে। সে সুর যেন সমস্ত আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়, আর রিনির সারা মন নাড়া দিয়ে যায় সে সুরের বিস্তার।
-
অণুগল্প- তালাক
তালাক
– শক্তি পুরকাইতসেই কবে ঘুম ঘোরে আব্দুল, বউ আনজুকে মুখের উপর বলে ফেলেছিল তালাক, তালাক, তালাক …! সে বুঝতে পারেনি রাগের মাথায় এমনটা হবে। বেশ কয়েকদিন সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। পারিবারিক একটা অশান্তির মধ্যে ছিল। ‘তালাক’ শব্দটা ওভাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবে কে জানতো! সকাল হতে বউ আনজু, ছেলে তানজিরকে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি উঠেছিল। কতবার আব্দুল, আনজুকে আনতে গিয়েছিল সে আসে নি। বরং মুখের উপর বলেছিল ‘তালাক দেবার সময় হুঁশ ছিল না!’ অনেকবার গ্রামে ওদের নিয়ে সালিশি সভা বসেছিল। কিন্তু ফল হল না। আনজু আর ওই সংসারে ফিরতে চায় না। যে মানুষটার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে ঘুমাতো না। ভাত মাখিয়ে গালে না দিলে খেত না। সে মানুষটা এমন দূরে সরে যাবে আনজু ভাবতে পারেনি। মাঝে মাঝে খবর আসে সে ঠিকঠাক বাড়ি ফেরে না। ফিরলেও মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি আসে। সে কোর্টে তার বিরুদ্ধে কেস করেছে। গ্রামের কেউ আনজুর পাশে এসে দাঁড়ল না। সে শরিয়ত বিরোধী কাজ করেছে। আজ সরকারের তিন তালাক বিল পাশ হওয়ায় সবার মুখে হাসি। সে আনন্দের মধ্যেও শুনতে পেল বেদনার সুর। ‘তালাক’ শুধু একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে না। একটি ফুলের মত সংসারও নষ্ট হয়। আনজু, ছেলে তানজিরকে কোলে নিয়ে কোর্টের সামনে এসে দাঁড়াল। ছল ছল চোখে আব্দুলের পথের দিকে চেয়ে থাকল সে।
-
অণু গল্প- আমার দূর্গা মা
আমার দূর্গা মা
-অঞ্জনা গোড়িয়াবাবলু এই গাঁয়ের ই দশ বছরের ছেলে। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের ড্রয়িং স্যারের কাছ থেকে সবে হাতে খড়ি আঁকার। বাড়িতে আঁকতে শেখানোর মতো ক্ষমতা বাবলুর বাবার নেই। তবু সে এই প্রথম আঁকতে বসেছে প্রতিযোগিতায়। পাড়ার শারদীয়া পূজায়। তাকে জিততেই হবে। বিজয়ী প্রতিযোগী দু’হাজার টাকা পুরস্কার পাবে। খুব দরকার টাকাটা। বাবা ভ্যান চালিয়ে কোনো মতে সংসার চালায়।
পুজায় নতুন পোশাক কিনে দেবার ক্ষমতা নেই। তাই এবছর বাবলু ঠিক করেছে যদি বিজয়ী হয়, ওই টাকায় পূজার পোশাক কিনে দেবে ভাই বোনের জন্য। মায়ের জন্য কিনবে আলতাপাড়ের শাড়ি আর আলতা সিঁদুর।সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। হাতে রং তুলি। ড্রয়িংপেপারটা এখনো ফাঁকা। টাইম দেওয়া হয়েছে দেড় ঘন্টা। আধঘন্টা আর বাকি। অঙ্কন প্রতিযোগিতা চলছে জোর কদমে। চারিদিকে লোক ভর্তি। বিচারক বিভাগ- “ক” কে মাতৃমূর্তির ছবি আঁকতে বলেছেন। সামনেই মা দশভুজার মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। সবাই মন দিয়ে একবার দেখছে আর আঁকছে। মায়ের ছবি, মা দুর্গার ছবি।
অংশ গ্রহণ করেছে প্রায় একশো জন। সুন্দর সুন্দর মাতৃমূর্তিতে ভরে গেছে সকলের ড্রয়িং পেপার। শুধু বাবলুর খাতাটি সাদা। বিচারক ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সকলের অঙ্কন। বাবলুর কাছে গিয়ে অবাক হয়ে বলল, একি বাবলু! কি করছ তুমি? তুমি মায়ের ছবি আঁকতে পারছো না? বাবলুর চোখ দু’টো লাল হয়ে গেল। ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপছে। আবার বলল, আর মাত্র আধঘন্টা বাকি বাবলু। তাড়াতাড়ি করো। সবার জন্য পুরস্কার আছে। যে সবার সেরা মায়ের ছবি আঁকতে পারবে, তার জন্য আছে ২ হাজার টাকার পুরস্কার। কিছু আঁকো বাবলু। বাবলুর কোনো কথায় কানে গেল না। কোনো একজন পাশ থেকে জানিয়ে দিল, স্যার ও বোবা। এসব কথা ও বুঝবে না। বিচারক মশাই আর কিছু বললেন না।
সময় পার হয়ে আসছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। সকল প্রতিযোগী নিজেদের নাম ঠিকানা লিখে জমা দিতে প্রস্তুত হয়েছে। ফাইনাল ঘন্টা পড়ার ঠিক আগে বাবলু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ।
বাকিরা কৌতুক হয়ে তাকিয়ে ওর দিকে। কি এঁকেছে দেখার জন্য। বিচারক চমকে গেল বাবলুর আঁকা দেখে। অপরূপ জীবন্ত এ কার ছবি? সবাই মা দুর্গার ছবি এঁকেছে। বাবলু এঁকেছে জন্মদাত্রী মায়ের মায়াময়ী রূপ। মাটির উনানে খড়কুটোর জ্বালানিতে রাঁধতে রাঁধতে স্তন পান করাচ্ছে এক দুখিনী মা। হাঁড়িতে ফুটছে গরম জল। থালা নিয়ে বসে আছে আরও দু’টো শিশু। খিদের তাড়নায় ছটপট করছে।
ছবিটি হাতে তুলে দিল বিচারকের হাতে। এই তার দুর্গা মা। জগৎ জননী দুখিনী মা। প্রতিনিয়ত লড়াই করছে ক্ষুধা নামক দানবের সঙ্গে। তাই মায়ের মুখটাই ভেসে উঠেছে আঁকার সময়। -
অণু গল্প- প্রথম দেখা
প্রথম দেখা
– সাহানা মন্ডলএকেবারে ছাপোষা মধ্যবিত্ত জীবন, কেউ কাউকে চিনত না।
হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় অচেনা অতিথির মতো এসে দাঁড়িয়েছিলো দরজায়।
সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে কানে ভেসে আসছিল দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ।
কে? কে ডাকছেন এতো বৃষ্টিতে!
প্রত্যুত্তরে ভেসে আসা উত্তর, আমি….. দয়া করে দরজা খুলুন।
হাতের প্রদীপ নামিয়ে রেখে দৌড়ে দরজায় গেল অনুসূয়া। দেখল বৃষ্টি ভেজা বলিষ্ঠ শরীর, সুঠাম, সুন্দর।
সৌজন্যতায় শুকনো তোয়ালে এগিয়ে দিলো হাতে।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল- বাড়িতে আর কে আছেন?
আমি আপনার দাদার বন্ধু শুভম। মুচকি হেসে চলে গেল অনুসূয়া পাশের ঘরে।
কিছুটা সময় পরে অনুসূয়া দেখে, শুভম আড় চোখে কি খুঁজছেন!!
জিজ্ঞাসা করল- “কি লাগবে আপনার? “
উত্তর এলো একটু চা দেবেন ভীষণ শীত করছে।
অনুসূয়া তার দাদার আলমারি থেকে এক সেট জামা প্যান্ট বার করে শুভমকে দেয়।
সম্পূর্ণ ভিজে গেছেন চেঞ্জ করুন জ্বর এসে যাবে। আমি চা নিয়ে আসছি….
অনুসূয়া আড় চোখে দেখতে লাগল শুভমকে।
হঠাৎ শুভমের চোখে পড়ে যায় সেটা।
ভীষণ লজ্জা পায় অনুসূয়া।
চা নিয়ে আর শুভমের সামনে যেতে পারে না,
পর্দার আড়াল থেকে হাত বাড়িয়ে বলে— “এই যে চা”
শুভম ডাকে অনুসূয়াকে। এসো ভিতরে এসো। ওভাবে দিচ্ছ কেন? এখনও অচেনা মনে হচ্ছে বুঝি?
অনুসূয়া বুকের ভেতর হালকা হয়ে গেল, উঠে চলে এলো পাশের ঘরে।
শুভম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুনতে পেল কলিং বেলের আওয়াজ।
অনুসূয়া.. কোথায় গেলে? কে ডাকছে? এসো দরজা খোল।
সাড়া না পেয়ে শুভম নিজেই দরজা খুলে দেখল তার বন্ধু অনুসূয়ার দাদা এসে গেছে।
কি রে কখন এলি? আর বলিস না ……তোর বাড়ি আসতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম।
তোর আলমারি থেকে অনুসূয়া এই সেটটা দিল, আমি চেঞ্জ করে পড়েছি।
অনুসূয়া পাশের ঘর থেকে সব কথা শুনছে আর আড় চোখে শুভমকে দেখছে।
কথাবার্তা শেষ। এবার শুভমের যাওয়ার পালা।
অনুসূয়া পাশের ঘর থেকে ছুটে এলো দরজায়- “আবার এসো কিন্তু ….” শুভম মুচকি হেসে চলে গেল।
অনুসূয়ার দাদা শুভমের বিয়ের কার্ডটা অনুসূয়ার হাতে দিয়ে বলল——– শুভম তোকেও যেতে বলে গেল। ওর বিয়েতে যাবি! -
অণুগল্প- রেসের ঘোড়া
রেসের ঘোড়া
-শক্তি পুরকাইতআগের মত আতাউল মোল্লার শরীরটাও ভাল নেই। ঘোড়া দৌড়ের কেরামতি তেমন দেখাতেও পারে না। তবুও প্রতিবছর ডাক পড়ে, মিলনীপুর ছাউনির মাঠে ঈদের মেলাতে। আতাউল মানে দর্শকদের উল্লাস। ছেলে-মেয়েরা ওই একটা দিন অপেক্ষা করে থাকে, তার খেলা দেখবে বলে। ঈদ কমিটির উদ্দ্যোক্তাদের বিশেষ অনুরোধে আবার সে ঘোড়াদৌড়ে অংশ নেবে। তাই সকাল থেকে ঘোড়াকে পরির্চ্চাতে ব্যস্ত। ঘোড়াকে স্নান করানো, ঘোড়ার গা মুছিয়ে দেওয়া। তারপর ভিন্ গাঁ পেরিয়ে প্রতিযোগীতার মাঠে। আতাউলের আজ সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। এর আগে কোনদিনও ঘটেনি। বুড়ো বয়সে সে কী আগের মত প্রথম হতে পারবে। প্রথম হলেই নগদ কুড়ি হাজার টাকা মিলবে। আল্লার কাছে সে কসম করে, হাসপাতালে ভর্তি ছেলেটাকে যেন সুস্থ করতে পারে । ঘোড়া নিয়ে মিলনীপুর ছাউনির মাঠে এসে দাঁড়ায়। সকালের রোদে সাদা ঘোড়ার গা যেন রুপোর ঝালরের মত চক চক করছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এ বছরও পুরস্কার সে নেবে। খেলার মাঠে যে-যার ঘোড়া নিয়ে দাঁড়ায়। আতাউল ঘোড়া দৌড়ের জন্যে প্রস্তুত হয়। বাঁশি বেজে ওঠে। বাঁশির শব্দ তার বুকের ভিতর কন্ কন্ করে ওঠে। একে একে ঘোড়া ছুটেছে, তির বেগে। আতাউল সবার আগে আগে ছুটেছে। সে দেখতে পেল ধুলোর মত কি যেন সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আতাউল কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ঘোড়া পা দু’টো মুড়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। মাঠের দর্শকের চিৎকার ভেসে আসছে। এতোক্ষণে সে বুঝতে পারল আর কোনদিনও প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারবে না। ঈদ কমিটির লোকেরা ছুটে গিয়ে ঘোড়ার মুখে জল দিল। ঘোড়ার ঘোলাটে চোখ তাকিয়ে থাকল খোলা আকাশের দিকে। মুহুর্তে শেষ নিঃশ্বাস পড়ল মাটিতে। আতাউল চিৎকার করে উঠল, রু-ক-সো -না! তুই চলে গেলি! আমি রেসের মাঠে কাকে নিয়ে ছুটবো? দূরে আতাউল শুনতে পেল, একমাত্র ছেলের কন্ঠস্বর ‘আব্বা আমি আগের মত হাঁটতে পারব তো। আগের মত রেসের মাঠে ছুটবো..’ তার দু’চোখ বেয়ে নেমে এল জল নয়, শেষ বিজয়ের অকৃত্রিম ইচ্ছা ।
-
অণু গল্প- শীতলপাটি
শীতলপাটি
– সুজিত চ্যাটার্জি
ঠাকুমা, ঠাকুমাই রয়ে গেল। কিছুতেই আপডেট করা গেল না।সেই রামপ্রসাদী, সেই কে.এল.সায়গল. সেই.. বোঝালেও বুঝবে না, ওসব এখন আর চলেনা। তাঁবাদি হয়ে গেছে।যেখানেই যাই ঠাকুমাকে বলে যাই। অভ্যেস। ঠাকুমা..পুরুলিয়া যাচ্ছি। দু’দিন পরে ফিরবো।ঠাকুমা ফোকলা। হেসে বললো-
যা, ঘুরে আয়, ভালো জায়গা।
যাচ্ছি অফিসের কাজে, ‘যা ঘুরে আয়’। কাজ আর ঘুরে বেড়ানো এক নয়, কে বোঝাবে!
-শোন ঘেঁটু, আসবার সময় একটা শেতলপাটি আনিস। খুব ভালো, সস্তা।
-কি হবে শীতলপাটি, কি কাজে লাগবে তোমার?
– গরমকালে পেতে শোবো, খুব আরাম।
-বোঝো ঠ্যালা। বলি, শীতলপাটি পাতবে কোথায়? শোওয়া তো খাটে, ডানলোপিলো গদিতে, এ. সি. চালিয়ে।
-ও, তবে থাক। অনেক দিনের ইচ্ছে কিনা তাই,
এইটা ইচ্ছে। আসলে আদ্দিকালের সখ। সেটা কিছুতেই ছাড়া যাবে না।বর্ধমানের নাম শুনলেই মনে পড়ে যাবে মিহিদানা সীতাভোগ। কৃষ্ণনগর হলে সরপুরিয়া। দেওঘর হলে প্যাঁড়া। অভ্যেস অভ্যেস। আদ্দিকালের ছাপোষা অভ্যেস।নাহ্, ঠাকুমাকে আধুনিকা করা অসম্ভব।পুরুলিয়া যাচ্ছি। রাতের ট্রেন। রিজার্ভড শোয়ার জায়গা। কি মাথায় ভূত চাপলো, ষ্টেশন থেকে একজন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটা হাওয়া বালিশ কিনে ফেললাম। মাথায় দিয়ে শোয়া যাবে। মনে মনে ইচ্ছেটা অনেক দিনের। চেপে রেখেছিলাম। ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে তাগড়াই বালিশ বানিয়ে , আরামে শুয়ে পরলাম। ট্রেন চলেছে আপন গতিতে, আপন লক্ষ্যে।হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠল। মায়ের ফোন। এত রাতে মায়ের ফোন কেন। মন কুগাইতে শুরু করেছে। নিশ্চয় খারাপ কিছু , নইলে…
সত্যিই তাই। একটু আগে ঠাকুমা মারা গেছে। ঘন্টা কয়েক আগের জলজ্যান্ত মানুষটা নেই। ভাবা যায়? হায়রে জীবন.. কি আর করা। বয়স তো কম হয়নি। প্রায় নব্বই। তবুও মন মানেনা। বড্ড আদরের, ভালবাসার, মায়ার ভরা আদ্দিকালের শেষ মানুষ আমার। চোখে তো জল আসবেই।
নতুন কেনা হাওয়া বালিশটা হাওয়া বেড়িয়ে গিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে। ফুটো ছিল নিশ্চয়ই। অনেক দিনের শখের জিনিস। হাওয়া হারিয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে।বিশ্বাসঘাতক।
পুরুলিয়া ক্যানসেল। ফিরে এলাম। ঠাকুমার শেষ যাত্রার সাথী হবো। শিয়ালদা থেকে একটা শীতলপাটি এনেছি। ঠাকুমার শেষ ইচ্ছে। শিয়ালদা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। ঠাকুমাকে আদ্দি প্রথায় দাহ করা হবে। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে নয়, কাঠে।
ঠাকুমার আদ্দিকালের দেহ পুড়ছে। পুড়ছে আদ্দিকালের প্রথায়। পুড়ছে আদ্দিকালের বিশ্বাসী শীতলপাটি। দাউদাউ করে। অহংকারী আপডেট মন, হুহু করে, যেন কানেকানে ফিসফিস করছে.. আদ্দিকালের জিনিস, বেইমানি করেনা, হাওয়া বালিশের মতন।
-
অণুগল্প- মা দোয়েল
মা দোয়েল
– শিলাবৃষ্টিঅনেক দিন আগের একটা ঘটনা — যা মনকে নাড়া দিয়েছিল খুব। একটা ছোট্ট মা দোয়েল পাখির মনছোঁয়া কাহিনী।আমাদের একতলা বাড়ির ছাদে সবসময় কারণে অকারণে যেতেই হত। সবচেয়ে বড় কথা বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে খোলাছাদ আমার এক নিরালা আস্তানা ছিল। সামনের বাড়ির পাঁচিলের ওধারে রক্তকরবীর গাছ কবে যেন অনেক বড় হয়ে গিয়ে আমাদের ছাদের সামনেই ডালপালা মেলে নিজের আনন্দে হাওয়ার তালে দোল খায়। আর সেই গাছের আনাচে কানাচে নেচে বেড়ায় দোয়েল, বুলবুলি, চড়াই পাখিরা। একদিন নজরে পড়ল গাছের ভেতরের দিকে গোপন ডালে – এক বুলবুলি মুখে করে শুকনো ঘাস বা খড় জাতীয় কিছু নিয়ে এসে বাসা বাঁধছে আর মাঝে মাঝে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। এরপর আমার কৌতুহলী চোখ ওই দিকেই চলে যেত। দু’ এক দিন পরে দেখলাম নীড় সম্পূর্ণ, আর দোয়েল পাখির দেহের অর্দ্ধাংশ সেই বাসায়। বেশ কয়েকবারই নজরে এল এই দৃশ্য। বুঝলাম ওখানে ওর ডিম আছে। কদিন পরে নজরে এল মুখে করে কিছু নিয়ে এসে ওই মা পাখিটা ছানাগুলোকে বোধহয় খাওয়াচ্ছে, তবে ছানাগুলোকে সেভাবে দেখতে পেতামনা। মন উসখুস করতো দেখার জন্য।
মাসটা বোধহয় বৈশাখ ছিল! বিকেল থেকে প্রবল ঝড়, আর তারপরে নামলো বৃষ্টি! চারিদিক তোলপাড়! লোডশেডিং, অন্ধকার! হঠাৎ মনে পড়ে গেল করবী গাছে দোয়েল ছানাগুলোর কথা! মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আহারে ছানাগুলো তো উড়তেও পারেনা। এই প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে ওরা মরেই গেল বোধহয়! তখনো বৃষ্টি কমেনি প্রবল কৌতুহল বশতঃ একটা ছাতা আর টর্চ নিয়ে ছাদে গেলাম, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার! হাওয়া! গাছটা প্রবল দুলছে। লক্ষ্য স্হির করে টর্চের আলো ফেললাম, যা দেখলাম
তা চমকের থেকেও আরো কিছু ছিল! মনে হয় বিস্ময়! আমি চমকে গেলাম, এও সম্ভব! দেখলাম,
মা দোয়েল পাখিটা তার ছোট্ট শরীর আর আরো ছোট্ট দুটো ডানা দিয়ে তার বাসার মুখটা বন্ধ রেখেছে। এই প্রবল ঝড়ের আঁচ বা বৃষ্টির জলের ঢল – সে তার সদ্যোজাত সন্তানদের লাগতে দেয়নি। অবাক হলাম। ভাবতে পারিনি ওই এক আঙুল একটা পাখির এত ক্ষমতা? নিজের ছানাগুলোকে বাঁচাতে এত বড় কালবৈশাখী নিজের ছোট্ট শরীরের দিয়ে বাধা দিয়েছে! চোখটা সেদিন শুকনো রাখতে পারিনি।
আমি নিজে একজন মা । লক্ষ হাজার মায়ের মধ্যেও সেই মা দোয়েল আমার চোখে শ্রেষ্ঠ মা। সেদিনের
সেই স্বর্গীয় দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা।