অণু গল্প
-
অণু গল্প- বোন
বোন
– শক্তি পুরকাইতজানলার আড়াল থেকে সেদিন শ্রুতি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল হাতে তালি দেওয়া। পাশের বাড়ির হরিপদ মন্ডলের ছেলেকে নাচাতে এসে সেই প্রথম দেখল ঢোল বাজিয়ে কেমন করে নাচতে হয়। গান গাইতে হয়। সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল মাসিদের রং ঢং দেখবে বলে। চোখে চোখ পড়তে ওর খবর নিয়ে যায়, ‘মেয়েটা কাদের বাড়ির!’ সে এক ছুটে ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে সারাটা রাত কেঁদেছিল। ইস্কুলে গেলে বন্ধুরাও রাগায় ‘মদ্দালি মেয়ে বলে ডাকে’। সেই থেকে ইস্কুলে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। লজ্জায় আর ইস্কুলে গেল না। পাড়ায় বাইরে বের হলে লোকে বলে ‘মুখ দেখাস না, কাজটা শুভ হবে না..’ এখন সে হাতে তালি দিতে পারে। ঢোল বাজিয়ে নাচতে পারে। গান গাইতে পারে। কোন কিছু অসুবিধা হয় না, তার। এই কয়েক মাসে কমলামাসি, গোপামাসিদের কাছে রপ্ত করে নিয়েছে। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী সব ভাবছিল, সে কোনদিনও মা হতে পারবে না। স্বামীর সংসার করতে পারবে না। আজ ভাইফোঁটা ঘরে ঘরে বাজছে শাঁখ। বোনেরা, তাদের দাদাদের ফোঁটা দিচ্ছে ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা’ বোন হয়ে সে কোনোদিনের জন্য দাদাকে আর ফোঁটা দিতে যেতে পারবে না। কমলামাসির কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সম্বিত ফেরে শ্রুতির। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নেয়। কমলামাসি বলে ওঠে, ‘মাগি, লোকে কী বলবে জানিস না, হিজরে হতে গেলে মাঝের মধ্যে একটু- আধটু কাপড়ও তুলতে হয়’ অরিন্দমের বোন সারাটা জীবন হিজরে হয়ে সমাজে বেঁচে থাকবে। কমলামাসি, গোপামাসিদের সঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে হেঁকে বলে যাবে, ‘ও দিদি তোমাদের ছেলে হল না, মেয়ে হল গো …’ !
-
অণু গল্প- স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ
স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ
– দেবস্মিতা ঘোষথার্ড পিরিয়ডের মাঝামাঝিই বৃষ্টি নামলো। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। এই সতের বছরের জীবনে অগুনতি বার বৃষ্টি শুরু হতে দেখা। তাও প্রথম জলের ফোঁটাটা নামতে দেখেই মনটায় খুশির ঢেউ ওঠে। যাই হোক এই সময়টাই ভৌতবিজ্ঞান চলে নানা ফিজিক্স চলে। আমার স্কুলটি শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, এখানে অনেক সতর্ক ভাবে থাকতে হয়। হঠাৎ যদি ভৌতবিজ্ঞান বা জীবনবিজ্ঞান বলে ফেলি তবে তো যাচ্ছেতাই অপ্রস্তুত হতে হবে। নাহ্, মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয় প্রায় দু’বছর শহরে এসেও আমার আধুনিক শহুরে হওয়া হলো না বোধহয়।
কথায় কথা বাড়ে। ফিজিক্স ক্লাসে জানলার দিকে তাকিয়ে আছি দেখলে ম্যাম খুব রেগে যাবেন। আর দেখবেই বাকি জানলা দিয়ে কারখানার ধূসর শেড আর উঁচু বাড়ি ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তবু অমাবস্যার চাঁদের মতো আকাশ দেখবো আশা করে প্রতিদিন জানলার পাশের জায়গাটার জন্য লড়াই করি। বাজে কথা ভাবা বন্ধ করে ক্লাসে মন দিলাম।
টিফিনের বেল বাজতেই বারান্দায় চলে এলাম। একটু কোনের দিকে ঘেঁষে কাঁচের জানলার সামনে দাঁড়ালাম। স্কুলের সামনের দিকটা দেখা যায়। সেই এক গাড়ি বাড়ি রাস্তা। তবু আকাশটা একটু বেশি দেখা যায় সেই ভাল।
বৃষ্টির হালকা ঝাপটা মুখে লাগতে চোখটা বন্ধ হয়ে এল। মনে পড়ে গেল পুরোনো স্কুলের কথা। বাংলা মাধ্যম। মফস্বল এলাকার একমাত্র মেয়েদের স্কুল।
বৃষ্টির সময় মনখারাপ হলে বারান্দায় দাঁড়াতাম। সামনের বিশাল মাঠ বৃষ্টির সময় ধূসর চাদরে ঢাকা পড়ত। বারান্দায় জল চলে আসত। দিদিমণিরাও আসত কাগজের নৌকা ভাসতে। কাঁঠাল গাছের পাতা থেকে টুপেটুপে জল পড়ত। সব মনে আছে, ভুলিনি কিছুই। আর মনে পড়ে রিমাকে। মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর অপেক্ষা করতাম কখন একটা খুব নরম হাত আমার কাঁধে আলতো চাপড় মারবে আর সেই চশমা পড়া মোটু মেয়েটা এসে বলবে , “কিরে দেবু একা একা কি করছিস”হঠাৎ কাঁধে একটা হাত। স্মৃতির জাল কেটে বেরিয়ে এলাম। “what are you doing here? Go back to your class. Break time is over.” ক্লাসের মনিটর।
“Wait, r u crying?” কৌতূহল রয়েছে তার চোখে সহানুভূতি নয়।
“No it’s just rain”
“Ohh. U know what I hate rain. So much germs n mess. Ok go back to class now.”ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই। তাও প্রার্থনা করলাম এই স্মৃতির ধ্বংসস্তুপ নিয়েই যেন বাঁচতে পারি। কোনোদিন যেন বলতে না হয় “i hate rain”. বৃষ্টির ঝাপটার সাথে মিশে যাওয়া চোখের জল মুছে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাই।
-
অণু গল্প – মাছি
অনুগল্প -মাছি
-শক্তি পুরকাইতঘোষালদের বাড়ি আবার একটা শোকের ছায়া এসে পড়লো। গোটা বাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ঘোষাল বুড়োর একমাত্র ছেলের ডেড বডিটা সবে এসে নামিয়ে দিয়ে গেল শববাহী কাঁচের গাড়ি। উঠোনে শোয়ানো সদ্য মর্গ থেকে আসা ছেলে সুদীপ ঘোষালের মৃতদেহ। এতদিনের আত্ম অহংকার সব ভেঙে চুরমার করে দিল তার। ছেলেকে নিয়ে এত গর্ব করা বোধহয় ভগবানও সহ্য করতে পারেনি। পোষ্ট মর্টেমের পর গোটা মুখটা শতছিন্ন। প্ল্যাস্টিক কাগজে মোড়া ডেড বডিটা। প্রতিবেশীদেরও চোখে জল বাগ মানতে পারেনি। সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! মানিক চাঁদ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সুদীপ ঘোষাল অল্প দিনে রাজনীতিতে এত দক্ষ হয়ে উঠবে কেউ জানতে পারেনি। তার মত সুবক্তা কলেজে খুবই কম আছে। দুই দলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে হাতাহাতি থেকে বোমা ছোঁড়াছুঁড়ি। পিছন থেকে একটা লাঠি এসে পড়ল সোজা সুদীপের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। সুদীপকে পড়ে থাকতে দেখে কলেজের অন্যান্য বন্ধুরা ধরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। মুখে জল দেয়। যতবার চোখ খুলতে চায় বন্ধ হয়ে আসে.. জ্ঞান আর ফেরে না। বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। ততক্ষণে কলেজ একেবারে শান্ত। পুলিশ এসেছিল। তেমন কাউকে ধরতে পারে নি। ডাক্তার সুদীপকে মৃত বলে জানিয়ে দিয়েছে। তার মৃত্যুতে কলেজের বন্ধুরাও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। সুদীপের মৃত্যু প্রমাণ করে দিল রাজনীতি শুধু দেশকে শেষ করে দেয় না, অনেক মায়ের কোলও খালি হয়। এ ঠাকুরের কাছে মানত করে, ও ঠাকুরের কাছে মানত করে শেষে যদিও সন্তান দিল তাও কেড়ে নিল। ভগবানের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সাদা কাপড়টা মুখ থেকে সরাতেই ঘোষাল বুড়ো ‘ও বাবা তুই চলে গেলি’ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। তখনও গাল থেকে গড়িয়ে পড়া গাঢ় রক্তের উপর বসে সমস্ত সম্পত্তির হিসেব- নিকেষ করছে কয়েকটা মাছি আর কিছু নয়।
-
অণু গল্প- অসমাপ্ত
অসমাপ্ত
-শিলাবৃষ্টিচোখে হাজার স্বপ্ন অরুণের। কিন্তু ব্যর্থতা পদে পদে। মা, বাবা, বোন তার মুখ চেয়ে দিন কাটাচ্ছে। জানে না অরুণ কিভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে! পার্টির লোকজন ধরে চাকরি তার মতো লাজুকের হবে না,
ইন্টারভিউ দিয়েই চলেছে কিন্তু কোথাও কোনো আলো দেখতে পায়না সে। টিউশনি করে কয়েকটা, বাবার সামান্য পেনশনে চলছে সংসার।
দীপা আর তার সম্পর্কটাও বন্ধুত্ব থেকে এগিয়ে গেছে। দীপার বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ দেখছে। কিছুই করার নেই। একে অন্য জাত, তার ওপরে বেকার ছেলেকে কেই বা কন্যা দান করবে!
হতাশা কুরে কুরে খায়। অরুণ মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে পড়ছে। দীপা পালিয়ে যেতে চায় কিন্তু অরুণের পক্ষে তাও সম্ভব নয়।
চোখের সামনে দীপার বিয়ে হয়ে গেল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিই বা করতে পেরেছে সে!অবশেষে প্রাইমারি স্কুলে চাকরিটা পেল অরুণ। মনটা তবু শান্ত হল না। দীপার বিয়ের আগে কেন সে চাকরিটা পেল না। এইসব চিন্তায় কষ্ট পায় সে। বছর দু’য়েক কেটে যায় ভালো মন্দে। বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু ভালোবাসাহীন বিয়ে অরুণ করতে চায় না। আরও কিছুদিন পরে.. প্রায় সন্ধ্যে হয় হয়। অরুণ স্কুল থেকে ফিরছে। প্রচন্ড মেঘ আকাশে। কালবৈশাখী ঝড় প্রায় শুরু হয়ে গেছে, পা চালায় অরুণ। কিন্তু পলাশ গাছটার পাশে সাদা শাড়ী পরে কে যেন দাঁড়িয়ে, এই সময় এখানে দাঁড়িয়ে আছে কে! চলে যেতে পারে না অরুণ, অস্বস্তি দানা বাঁধে। এগিয়ে যায়, “কে ওখানে? ঝড় এসে গেছে। কে ওখানে?”
মহিলা খুব ধীরে আত্মপ্রকাশ করে। সামনে এগিয়ে আসে। দীপা! চরম বিস্ময় অরুণের। আলো আঁধারিতে ঠিক বুঝতে পারে না অরুণ।
-“অরুণদা, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
-“অপেক্ষা? অপেক্ষা তুমি করতে পারোনি দীপা..” অরুণ না বলে পারে না কথাটা।
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে অরুণদা..”
-“কিন্তু ঝড়! বৃষ্টি শুরু হবে।”
– “হুম, তাই বল, বরাবর আশঙ্কাই করলে অরুণদা! চলো না ঐ নাটমন্দিরটায় একটু বসি, সেই আগের মতো”।
–“কেউ দেখলে কী ভাববে? তুমি পরস্ত্রী এখন”
– “অরুণদা! পরস্ত্রী ভেবে আমার দিকে এখনো ভালোভাবে তাকাওনি বুঝি? দেখ, আর আমি পরস্ত্রী নই, সব শেষ অরুণদা।”কী বলছে দীপা, বুঝতে কষ্ট হয়, ভাবতে আরও কষ্ট হয়। দীপা কী বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে! অন্ধকারে ভালোভাবে কিছু দেখতে পায়না অরুণ। নাট মন্দিরে বসে অনেক কথা বলে গেল দীপা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়েই দীপা বুঝেছিল তার স্বামী একজন গে, কোন মেয়ের প্রতি তার আকর্ষণ কোনদিন ছিলনা। সমস্ত আকর্ষণ এক পুরুষ বাল্যবন্ধুর ওপর। নাম-কান্তি, তার সঙ্গেই সারাদিন মেলামেশা।
বুঝতে পারেনি বাড়ির লোক, ভেবেছিল বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, সবটাই ভুল। তাই ডিভোর্স অনিবার্য, তার স্বামীও তাকে মুক্ত করতে চায়।
ফিরে এসেছে অবশেষে দীপা, কিন্তু অরুণ কি করবে।কেমন যেন সব ওলোট-পালোট লাগে, দীপা অনেক্ষণ নীরব হয়ে বসে থেকে বলে, ‘চলো অরুণদা, বৃষ্টি থেমে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে দীপা আরও বলে, “অরুণদা, তুমি খুব সমস্যায় পড়লে তাইনা? তুমি চিন্তা করোনা। না, গো আর বিয়ে করার মানসিকতা আমার হবে না। তুমি আমার পরম বন্ধু, তাই তোমাকে সবটাই জানাতে চেয়েছিলাম, জানালাম। আমায় একটা কাজ খুঁজে নিতে হবে। জীবনকে আমি ব্যস্ত করে তুলবো অরুণদা। তুমি শুধু বন্ধু হয়ে আমার পাশে থেকো, হাতটা ছেড়ে দিওনা কোনদিন…”
অরুণ দীপার ডানহাতটা ধরে বলে, “নিশ্চিন্ত হয়ে পথ চলো দীপা, এই অন্ধকার বন্ধুর পথে তোমায় আমি পড়ে যেতে দেবনা।” -
অণু গল্প- নীলা সবার জন্য নয়
নীলা সবার জন্য নয়
-সুস্মিতা ঘোষসারাবছর কার্নিশে জমে থাকা প্রেমগুলো পুজোতে যেন রঙ ফিরে পাই। কে জানে কেন? পুজো এলে বুঝি এই মনটাও ভালোবাসার সঙ্গী খোঁজে! একাকিত্বকে ভুলতে। এই সব আকাশ পাতাল ভাবছি, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো দৌড়ে গিয়ে ধরলাম, ফোনটা তখন খাটের উপর। নাম্বার উঠেছে বুঝতে পারলাম অচেনা কেউ। হ্যালো কে বলছেন, কাকে চাই, বললো তোমাকেই চাই ,অসভ্য বলে ফোনটা কেটে দিলাম। এই ভাবে দিনে সাত আট বার ঐ নাম্বার থেকে ফোন আসে আর কেটে যায়। এবার প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে ফোনটা ধরলাম কিছু মন্দ কথা বলবো বলে, ও পাশ থেকে মৃদুস্বরে বলে উঠলো থামো শান্ত হও আমি তোমাকে চিনি মনে হচ্ছে তুমি ভুলে গেছো। কপালে একটা টিপ পড়ো তোমায় ভারী মিষ্টি লাগে। আপনি কে? সময় এলে জানবে। আস্তে আস্তে কৌতুহল বাড়তে লাগলো, যে সে কে? কিন্তু কিছু বুঝতে পারলাম না। পরদিন আবার ফোনে বলে উঠলো শোনো এখনো কী লাল রঙটা পছন্দ করো নাকি অন্য রঙ? আচ্ছা এখনো কী কাজল পড়লে জল বের হয় নাকি বড় হয়ে গেছ তুমি!! কিছুটা অবাক হয়ে ভাবলাম ও কী করে এতো কথা জানে। ষষ্ঠী মায়ের বোধন শুরু হয়েছে সবাই মুগ্ধ হয়ে মায়ের সাজ দেখছি কে যেন একটা লাল গোলাপ পাশে রেখে গেছে খেয়াল করিনি তাতে লেখা এখনো কী চেনার বাকি আছে। সপ্তমীর সকাল আবার ফোনটা এলো কি গো ফাঁকিবাজ পুজোর জোগাড় করবে না আমি যে অপেক্ষায় আছি আজ ধরা দেব বলে। কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মন্ডপের দিকে ছুটে গেলাম কিন্তু কাউকে সেভাবে চেনা লাগছে না। মনটা উদাস হয়ে গেল। চেয়ার নিয়ে বসলাম কে যে মিষ্টি বলে ডেকে উঠলো, তাকাতেই এগিয়ে এলো চিনতে পারলে না বলেই নিজের ডান হাতের পাঞ্জাবির হাতটা গোটালো ,চোখ সামনে ভেসে উঠল ছোট বেলার স্মৃতি রেগে গিয়ে কাঁসার বাটি ছুড়ে মেরে ছিলাম নীলাভকে। হাতে চারটে সেলাই, লোমের ভেতর দিয়েও আজও সে দাগ চোখে পড়ছে পরিষ্কার। লজ্জায় কান দু’টো লাল হয়ে গেল। ও হাত দু’টো চেপে ধরে বললো ভেবে ছিলে চলে গেছি, আর ফিরব না। পাগলী জানো না “নীলা” সবার জন্য নয়।
-
অণু গল্প- লন্ঠন
লন্ঠন
– শক্তি পুরকাইতআঃ আর পারছি না, ছেড়ে দাও! ও এসে পড়বে, ছেড়ে দাও! তখনও অন্ধকার রাতের চাঁদের আলোয় ফর্সা নিটোল স্তনের উপর মুখ দিয়ে রনজয়। এই সুযোগ আর কখনো আসবে না। একুশের যৌবনপ্রবনা শিউলিকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। বুকের একখন্ড শাড়ির আঁচল নৌকার পাঠাতনে পড়ে আছে। ঘুমন্ত শরীর বার বার রনজয়ের হাতের সমস্ত আঙুল স্পর্শ করছিল। নদীর জলে ভেসে থাকা কাঠের নৌকা দু’টি শরীরের দোলনে বার বার দুলে উঠছে। শিউলির মুখের ভিতর ঠোঁট দিয়ে আয়তন মাপছিল সে। সারা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠছিল শিউলির। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল জল। কিসের জল, সে জানে না। জানতেও চায় না। রনজয়, শিউলির গলার কাছে ঠোঁট বোলায়। একের পর এক সারা শরীরে ঠোঁট রাখে। উরুতে নাভিতে পায়ের পাতায়। কী অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করে সে! মাস তিনেক রনজয়, সুকেশের নৌকায় কাজ করছে। শিউলি, সুকেশের বিবাহিত স্ত্রী। শিউলির স্বামীর প্রতি টান না থাকলেও সংসারের গন্ডিতে বাঁধা। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এ গন্ডি পেরিয়ে চলে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে! এত বছর বিয়ে হলেও সুকেশ, শিউলিকে খুশি করতে পারে নি। বিয়ের পর থেকে নৌকা- নদী। শিউলির মন কেমন উদাস। এক রত্তি মেয়েটার মুখে হাসি নেই। শিউলি বার বার বলেছিল একটা সন্তানের কথা। সুকেশ উপহার দিতে পারেনি। তাই তার মনে যন্ত্রণা বাসা বেঁধে আছে। পোয়াতি মেয়েদের দেখলে শিউলির হিংসে মা হবার। ভগবান, তার কথা কোনদিন শুনতে পায় না। যে দিন থেকে রনজয়, শিউলিদের নৌকায় কাজ করতে এল, সে দরজার আড়াল থেকে একপলক দেখেছিল সুঠাম শরীর কারগরি কৌশল। সে দিন রনজয়ের চোখের ভাষা পড়ে নিতে শিউলির এতটুকু অসুবিধে হয়নি। এতদিন হয়তো সেই ভাষা পড়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল শিউলি। সেই জন্যেই তো ভগবান পাঠিয়েছেন এমন সুপুরুষকে। সবই কপাল! শিউলি রোজ রান্না করে সুকেশ, রনজয়ের জন্যে ভাত নিয়ে যায়। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে রনজয়ের নদীর জলে ভেজা শরীর । মেয়েরা শুধু ভালবাসে নয়, দেখে গোপনে পুরুষের ভেজা শরীরও। সে গোপনে কখন রনজয়কে ভালবেসে ফেলেছিল নিজেও জানে না। আজ এই সুযোগেই দুইজন মিলিত হয়েছে। চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্নায় ঘামে ভেজা শিউলির নগ্ন শরীরের ভাষা রনজয় পড়ে নিয়েছে। নৌকার পাঠাতন দুলছে দু’টি শরীরের দোলনে। সাথে সাথে নৌকায় বাঁধা লন্ঠনটাও দুলছে। শ্রাবণের মেঘঘন আকাশ চেয়ে দেখছে পরকীয়া। শিউলি যেন অন্যায় করেছে। সে রনজয়কে বোঝাতে চেষ্টা করে, এ পাপ! ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকারে সুকেশের কন্ঠস্বর ভেসে আসে। শি – উ – লি! কন্ঠস্বর কানে আসতেই সে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে। শাড়ি ঠিক করে নেয়। ভয় জড়ানো চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নৌকায় দুলে ওঠা লন্ঠনের দিকে। যেন দু’টো শরীরের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়ে লন্ঠনটা।
-
অনুগল্প- ডাক
ডাক
-শক্তি পুরকাইতবিপ্লবী অমূল্য প্রামানিকের ফাঁসি হয়ে গেছে। দেবজিতের চোখে তার মুখটা বার বার ভেসে উঠছে।জেলের ভিতর সে ঘুমোতে পারে না। উস্ পাশ করে। এক- এক করে সব কয়েদিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ইস্কুল পড়া ছাত্র সে দিন পিস্তল হাতে নিয়ে ছুটে ছিল ইংরেজ সাহেবকে মারবে বলে। টার্গেট গুলি করা।
প্রথম গুলির শব্দ শুনেছিল সে। তারপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সে ধরা পড়েছে। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ছিল। দেবজিৎ জেলের ভিতর থাকতে থাকতে কখন সবার আপনজন হয়ে উঠেছিল, সে নিজেও জানে না। জেলার থেকে কারারক্ষী ওকে খুব ভালবাসে। চারিদিকে ভেসে আসছে দেশ মুক্তির গান। সে চিৎকার করে ওঠে, ব-ন্দে-মা-ত-র-ম্! তার চিৎকার শুনে কারারক্ষী ছুটে আসে। বুঝতে পারে, বিপ্লবীদের সঙ্গে আবার মারপিট বেঁধেছে! দেখে দেবজিতের স্থির চোখ দু’টো জেলের অন্ধকারে মিট মিট করছে। দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। জেলার কাল ওর ছুটি ঘোষণা করে গেছে। দীর্ঘ কয়েক বছর পর কারাবাস থেকে মুক্তি। দেখতে দেখতে কখন সকাল হয়ে গেছে সে জানতে পারেনি। আজ যে তার ছুটি। তাই ছুটির আনন্দটা অন্যরকম। তার সহযোদ্ধারা জিজ্ঞাসা করে, তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি, তোর সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না রে …! সে বলে আগে দেশকে মুক্ত করি, তারপর দেখা হবে ঠিক! সহযোদ্ধাদের চোখে জল দেখে সেও কেঁদে ওঠে। কারারক্ষী গেট খুলে দেয়। জেল থেকে ওর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে আসে। প্রথমে এসে তার নিজের জন্মভূমি গ্রামের মাটিতে পা রাখে। দেখে তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। কাকারা তাদের সব সম্পত্তি লিখে নিয়েছে। সে কার কাছে গিয়ে উঠবে। ভেবে পায় না। একজন পড়শি বলে ওঠে, ওরে স্বদেশী ডাকাত এসেছে, গ্রাম থেকে তাড়া ওকে! সে বুঝতে পারে বিপ্লবী মানে একজন স্বদেশী ডাকাত। তাই গ্রামের মানুষের কাছে সন্দেহ! বিপ্লবীদের ডাকের অপেক্ষা না করে আবার সে নেমে পড়ে দেশের কাজে।সে উপেক্ষিত মানুষের কাছে স্বদেশী ডাকাত নামে। জোরে একটা গুলির শব্দ শোনা যায়। অন্ধকারে গা ঢাকা দেয় দেবজিৎ। বিপ্লবী নয়, পালিয়ে যাওয়া একটা স্বদেশী ডাকাত। -
অণু গল্প- “রঙ”
রঙ
-অমল দাস
রবিবার ছুটির দিন একসাথে সবাই মিলে চায়ের টেবিলে। একসাথে সবাই মানে খুব বেশি নয়। মা, বাবা আর প্রভাংশু এই তিন জনের পরিবার। প্রভাংশু চায়ের কাপে হালকা মেজাজি চুমুক দিতেই মা দীর্ঘ দিনের সুপ্ত ইচ্ছা জাগিয়ে বাবার দিকে চেয়ে বলে ওঠে- এবার একটা মেয়ে-টেয়ে দেখো অংশুর জন্য!
প্রভাংশুর বাবা বলল- বেশতো দেখলেই হয়! আত্মীয় স্বজনদের খবর দিয়ে দাও তাহলে। তারপর প্রভাংশুরকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়- তা তুই কি বলিস? বা তোর কোন মতামত থাকলে বল।
প্রভাংশু মৃদু হেসে বলল- মতামতের আর কি আছে! তোমাদের যখন ইচ্ছা বা বিয়ে যখন একটা করতেই হবে, তবে দেখতে তো হবেই।
মা বলল- আমি তাহলে তোর মাসী, আর পিসিমাকে খবর দিয়ে রাখি? যদি তাদের পরিচিত কোন মেয়ে থেকে থাকে জানাশোনার মধ্যে।
বাবা বলল- সে তো বলবেই! তা অংশুর যদি কোন কেউ পছন্দে থাকে সেটাও আগে জেনে নাও।
প্রভাংশু স্বাভাবিক স্বরেই- না বাবা.. তেমন কেউ নেই! তবে চ্যটার্জী বাড়ির মেয়েটি দেয় কিনা খোঁজ নিয়ে দেখত পারো তোমরা!
মা একটা অবজ্ঞা মিশ্রিত সুরে বলল- কে? প্রিয়া না কি নাম সেই মেয়েটা?
-হ্যাঁ! মেয়েটি জানাশোনার মধ্যে ভালোই শুনেছি।
মা চোখ উঁচিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে উস্মা প্রকাশ করে বলল- না…. না… ওই মেয়ের সাথে তোর বিয়ে!
– কেন ও মেয়ের আবার কি হল? তুমি কিছু জানো না কি? বাবা জানতে চাইল।
– জানি বলতে মেয়ের গায়ের রঙ খুবই চাপা, অংশুর সাথে মানাবে না।
প্রভাংশু বলল- মা গায়ের রঙ আজকাল আর ম্যাটার নয়! মেয়েটা ভালো কি মন্দ সেটা দেখার। কারণ ভালোটার সাথে জীবন কাটবে রঙের সাথে নয়!
হালকা ধমক বা জোর খাটানো কণ্ঠে- তুই থাম! সরকারী চাকরি করছিস, তোর জন্য কোথায় একটা ফর্সা রূপসী মেয়ে আনবো ভাবছি! তা.. না….
– কতখানি ফর্সা মানেই কি মেয়ে ভালো? প্রভাংশুর প্রশ্ন।
এসবের মধ্যে বাবা আর সাড়া দিল না ঠোঁট দু’টো মুচকি হাসিতে উজ্জ্বল করে তুললো মজা নেওয়ার ভঙ্গিতে।
-তুই যাই বলিস! প্রিয়ার গায়ের রঙ আর তোর গায়ের রঙ মানাবেই না।
– মা…! পৃথিবীতে সব কি মর্জিমত মানিয়েই হয়? অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়। এই ধরোনা তোমার আর বাবার কথাই বলি! তোমাকে কি বাবার পাশে মানিয়ে ছিল, সেই চারহাত এক হওয়ার সময়?
বলতে বলতে চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে প্রভাংশু উঠে গেল। মা কোন সাড়া দিল না বা দিতে পারলো না। আর কিই বা বলবে কথাটা যে আক্ষরিক অর্থে সত্যি তা সে মরমে মরমে টের পেয়েছিল। একবার অংশুর বাবার মুখে নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে নিজেই মাথা নত করে বসে রইল অনেকক্ষণ এবং টেবিলের কাঁচের গ্লাসে নিজেরই প্রতিবিম্বের মধ্যে নতুন করে নিজেকে খোঁজার এক দীর্ঘ প্রয়াস চলতে লাগলো।
-
অণু গল্প -একাকিত্ব
একাকিত্ব
-সুজিত চ্যাটার্জিভোলেবাবা পার করেগা।
বাঁকের দুমাথায় দুটো জল ভর্তি কলসি টাঙানো। গনশা চলেছে বাবার মাথায় জল ঢালতে। শ্রাবণ মাস এলো, আর বাই উঠলো। উদোম পায়ে ছুট ছুট ছুট। কাটুক ফাটুক কুছ পরোয়া নেই। কদম কদম বাড়ায়ে চল। পুণ্যি পুণ্যি, বাবার মাথায় জল ঢাললেই অঢেল পুণ্যি। এতো পুণ্যি রাখবি কোথায় গনশা?গনশার বুড়ো বাপ সন্ধ্যে হলে এসে বসে মনসা তলায় । পাশে কেতোর ( কার্তিক) বাপ। সুখের গল্প নেই। তাকিয়ে থাকা আছে। জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা। স্মৃতি ছাড়া সম্বল বলতে কিছু নেই। হ্যাঁ আছে, আক্ষেপ। গনশা টা মানুষ হলো না। খোঁজ নেয় না একটুও। বাপ মা মলো না বাঁচলো। একটাই সন্তান তো। এখন ভাবে , একটা মেয়ে থাকলে ভালো হতো হয়তো। অন্তত খোঁজ খবরটা নিতো।
মেয়েরা মায়ের জাত কিনা।
হ্যাঁ , আরও আছে । ভয়। বড্ড ভয়। যদি অসুখ বিসুখ করে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। কিংবা গনসার মা …. কে কাকে দেখবে , চিকিৎসা, খরচ?
বড্ড ভয় , যদি মরে যাই , গনশার মাকে দেখবে কে?
মনসা তলায় সন্ধ্যারতি হচ্ছে। গনশার বাপ ঘোলাটে চোখে, কাঁপা হাত কপালে ঠেকিয়ে অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে , আমায় আগে নিও না ঠাকুর। তাহলে ওকে কে দেখবে । অসহায় একাকিত্ব, মৃত্যুর চেয়েও অন্ধকার। দয়াকর করুণাময় , গনশার মাকে নিয়ে নাও। আমি না হয় তার পিছু পিছু যাবো। শুধু এইটুকু দয়া করো।
ঈশ্বরের কাছে এমন প্রার্থনা কেউ জানাতে পারে , তা বোধকরি ঈশ্বরেরও অজানা।রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে হাজার হাজার গনশার দল।ভোলে বাবা পার করেগা।
গভীর রাত। দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। গনশার মা পঙ্গু । উঠে দাঁড়াতে পারে না। গনশার বাপ নেহাৎ অনিচ্ছায় দরজা খুলে দিলো। অবাক । একি তুমি? সামনে কেতোর বাপ। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। গলার স্বর আরও বেশি কাঁপছে।
ওরে, তোর ছেলে গনশা মরে গেছে রে।
জাগ হাঁড়ির মধ্যে প্রদীপের শিখা যেমন নিশ্চল অকম্পিত থাকে , গনশার বাপ তেমনই স্থির অবিচল রইলো।
মন্দিরের কাছে প্রবল ভীড়ের চাপে গনশা পড়ে যায়। তার গায়ের উপর দিয়ে চলে যায় হাজার হাজার পা। পায়ের তলায় চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে গনশা।
অন্ধকার ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা করুণ মেয়েলী স্বর ভেসে এলো ।
ওরে গনশা রে…মায়ের বুক ফাটা কান্না একাদশীর চাঁদও সহ্য করতে না পেরে , কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো।
কেঁদো না, গনশার মা । সে তো আমাদের কাছে বেঁচেই মরে ছিল। আজ না হয় সত্যিই মরে গেল।
ভোলে বাবা পার করে দিয়েছে গো , পার করে দিয়েছে।
হে ভোলানাথ , আমার শেষ ইচ্ছেটাও পুরণ করে দাও অমরনাথ। গনশার মাকে গনশার সঙ্গে মিলিয়ে দাও ঠাকুর মিলিয়ে দাও।
এখন আমরা তিন জনই বড়ো একলা , বড়ো একলা। -
অণুগল্প- গোড়ায় গলদ
গোড়ায় গলদ
– নৃপেন্দ্রনাথ মহন্তবহুূদিন পর চন্দ্রাণীর সাথে ইন্দ্রাণীর দেখা। দু’জনেই একদা সহপাঠী এবং বর্তমানে শিক্ষিকা। ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যালয়ে এবং জেলায়।
দু’জনই উচ্ছ্বসিত।
: কেমন আছিস রে চন্দ্রাণী? কেমন শুকিয়ে গেছিস মনে হচ্ছে! কোনো অসুখ-বিসুখ?
: না রে, আমার অসুখ-বিসুখ, জ্বরজারি বড় একটা হয় না। কিন্তু একসাথে সংসার আর চাকরির দাবি মেটাতে গিয়ে হাড়মাস কালি হয়ে গেল।
: সংসার! সে তো সবাইকে করতে হয়। আমাকেও তো রান্নাবান্না করে ছেলেকে নাইয়ে -খাইয়ে -পরিয়ে স্কুল পাঠিয়ে নাকে মুখে দুটো গুঁজে চাকরিতে আসতে হয়। তোর কাজের মাসি নেই?
:নেই আবার? কিন্তু তাকে দিয়ে ক’টা কাজ হয়? ঘর ঝেটোনো, ঘরমোছা, বাসনমাজা, মাঝেমধ্যে দু’একটা কাপড়কাচা –এর বাইরে তো সে কুটোটি ভেঙেও দু’খানা করবে না।আর সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়। সে কি কম কাজ! সকালের বিছানা-মশারি তোলা, চা বানানো, জলখাবার, ছেলের স্কুলের টিফিন, রান্নাবান্না, ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে তবে নিজের স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। আর সে স্কুলও তো আঠাশ কিলোমিটার দূরে ধ্যাদ্দেরা গোবিন্দপুরে।
: আর তোর উনি? উনি কী করেন?
: উনি থাকেন ওনার কাজ নিয়ে। একে তো দেরিতে ওঠেন। তারপর চা খেয়ে টয়লেট সেরে দাড়ি কামিয়ে স্নান করে ঠাকুরঘর। ওনাকে তো আবার ন’টার ট্রেন ধরে অফিসে যেতে হয়। কাজেই দম দেওয়া পুতুলের মতো আমাকেই…….
: সে তো তোর গোড়ায় গলদ। আমার কিন্তু এত সব করতে হয় না। বিছানা- মশারি তোলা, ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুম করানো, স্নান করানো, জামাজুতো পরানো, রান্নার জন্য সব্জি- তরকারি কেটে দেওয়া এসব কাজ ছেলের বাবাই করে। আমার ভাই খুব একটা অসুবিধে হয়না।
: সত্যি তুই ভাগ্যবতী। এমন বর ক’জনের হয়? কিন্তু তুই আমার গোড়ায় গলদের কথা বলছিলি না? কি গলদ রে?
: কেন, চাকুরে ছেলেকে বিয়ে করিস নি? আমার মতো বেকার ছেলেকে বিয়ে করলে তোকে এতো খাটতে…
: চলি রে, আমার বাস এসে গেছে। বলে হাঁটতে শুরু করে চন্দ্রাণী।