অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- নিজের সাথে দ্বন্দ্ব

    নিজের সাথে দ্বন্দ্ব
    – রেহানা দেবনাথ

     

    সমাজসেবী সুমিতা দেবী আজ নিজের ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন। আজ তার নিজের সঙ্গে নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে।পাশের বাড়িতে ষোলো বছরের ঝুমার বিয়ে চলছে চুপিসারে! সে কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরে ঝুমার মা মালতীকে ডেকে জিগ্যেস করতেই সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলে “দিদিমণি আমাকে ক্ষমা করবে এত কম বয়সে মেয়েটার বিয়ে দিতে চাই নি কিন্তু আমি নিরুপায়। জানোতো আমার স্বামী বদ্ধ মাতাল তাই সে যখন তখন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরের খিদে মেটানোর জন্য।তখন দেখে না একটাই ঘরের মধ্যে আরো চারটে বাচ্ছা রয়েছে যারা এগুলো দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটার শরীরে যৌবন আসতেই ও এগুলো দেখে বাইরে কোথাও কিছু করছে বলে আমার সন্দেহ হয় কারণ ওর মধ্যে মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পরিবর্তন ও আমি লক্ষ্য করেছি। তার জন্য ওকে বুঝিয়ে, বকে, মারধোর করেছি তবুও কোনো কিছু জানতে পারিনি। এমন কি ও স্কুলেও যায় না। তার উপর সপ্তাহ খানেক আগে দুপুরে আমি হঠাৎ লোকের বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরে দেখি ঝুমার সঙ্গে ওর বাবা খারাপ কাজ করছে।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না! স্বামীকে যে তাড়িয়ে দেব সেটাও উপায় নেই কারণ একা মেয়ে থাকলে শেয়াল কুকুরে আমাদের ছিঁড়ে খাবে!
    তিনদিন আগে জগা গুন্ডার ছেলে এসে বলে গেছে সে ঝুমাকে পছন্দ করে তাই ওর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করতে না হলে তুলে নিয়ে যাবে! তাই বাধ্য হয়ে আমার দাদার বন্ধুর ছেলের সাথে চুপিসারে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি!”

    সুমিতা দেবী চুপ করে সব শুনে অবাক হয়ে বললো “ওর আঠেরো এখনো হয় নি, শিশু বিবাহ আইনত অপরাধ। পুলিশকে জানিয়ে দিলে তোমরা সবাই জেলে যাবে তাই এই বিয়ে বন্ধ করো মালতী”।

    মালতী সুমিতা দেবীর পা দু’টি জড়িয়ে ধরে বলে এমন কাজ করবেন না দিদি “ওকে ঘরে রাখলে যে হয় ওর বাবার ভোগ্য হবে না হলে গুন্ডাদের দ্বারা ধর্ষিত হবে তার চেয়ে এটা ভালো নয় কি?”

    সুমিতাদেবী বললো “কোথাও খাওয়া পরার কাজে অথবা সরকারী হোমে ওকে রাখার ব্যবস্থা করলেই হয়!’
    মালতী উঠে দাঁড়িয়ে বলে “দিদি আপনি যে জায়গাগুলোর কথা বলছেন সে জায়গায় আমার সুন্দরী মেয়ে যদি নিরাপদ থাকবে বলে আপনি যদি দায়িত্ব নেন,তাহলে এই বিয়ে আমি বন্ধ করে দিতে পারি। কথাটা বলে মালতী চলে যায়।

    সেই থেকে সুমিতাদেবী নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করছে একবার ভাবছে পুলিশকে খবর দিয়ে বিয়েটা বন্ধ করে তার কাজের দায়িত্ব পালন করবে আরেকবার ভাবছে তারপর ভাবছে বিয়েটা বন্ধ করে দিলে সে কিভাবে অন্য আর সবার থেকে মেয়েটাকে বাঁচাবে!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- ক্ষমাহীন ভুল

    ক্ষমাহীন ভুল
    – বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

    হাসিটা সত্যি দেখার মতো, যেন মুক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি এক নম্বর প্লাটফর্মে আর আমি ওর সোজাসুজি দু’ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওর সৌন্দর্য্য উপভোগ করছি। মেয়েটির সঙ্গে একটি ছেলে আছে সম্ভবত ওর বয় ফ্রেন্ড হবে। ছেলেটি কতটা সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে জানিনা কারণ ওর হাতে একটা ঠোঙ্গায় পিস করা মুসাম্বি লেবু, দু’জনে একটা একটা লেবুর পিস মুখে পুরছে আর খেয়ে রেল লাইনের ভিতরে ছুঁড়ে ফেলছে । ওদের থেকে দশ হাত দূরে একটি ডাসবিন আছে তাতে না ফেলে রেল লাইনে ফেলা দেখে আমার মনে হচ্ছিল ডাসবিনটা নিয়ে রেল লাইনে মাঝে আমি দাঁড়িয়ে বলি হে সুন্দরী বালিকা লেবুর খোসা এতে ফেলুন।

    হঠাৎ আমার পাশের ওভার ব্রিজ দিয়ে মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক কানে হেড ফোন হাতে লম্বা মোবাইল নিয়ে দৌড়ে নেমে এলেন। পাশে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলেন কৃষ্ণনগর যাবার ট্রেন কখন আসবে। আমি বলতে যাবো তাঁর আগেই দোকানদার বললেন ওই এক নম্বর প্লাটফর্মে কৃষ্ণনগর লোকাল ঢুকছে, এটা দু’ নম্বর প্লাটফর্ম। ততক্ষণে ট্রেন সবে মাথা ঢুকিয়েছে প্লাটফর্মে। ভদ্রলোকটি ওভার ব্রিজ দিয়ে না গিয়ে নীচে দিয়ে এক দৌড়ে এক নম্বরে প্লাটফর্মে উঠতে গিয়ে লেবুর খোসায় পা পড়ে পিছলে গিয়ে এক নম্বর লাইনে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। সকলেই হৈ হৈ করে উঠলো। ততক্ষণে সব শেষ ট্রেনটি সেকেন্ডের মধ্যে বুকের উপর দিয়ে চলে গেলো। আমি বাক রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেনটি চলে যেতেই প্রচুর লোকজন ঘিরে মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। হ্যাঁ ওই ছেলেটিও মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, আর ওর বান্ধবী পাশে দাঁড়িয়ে ওকে নির্দেশ দিচ্ছে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তোলার জন্য।

    কিছুক্ষণ পরে রেল পুলিশ এসে দেহটিকে তুলে নিয়ে গেলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার গন্তব্যের গাড়ি ডাউন শন্তিপুর লোকাল ঢুকছে। অনেক কিছু বলার ছিলো কিন্তু কাউকে কিছু্ই বলতে পারলাম না। শুধু ভাবলাম এই ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলি সত্যি ক্ষমার অযোগ্য ।

  • অণু গল্প

    অনুগল্প- ভাত

    ভাত
    – শক্তি পুরকাইত

    দাদা শুনছ, একটু বাইরে আসবে প্রধান সাহেব ডেকেছে! দরজার বাইরে চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ভাতের থালা থেকে খেতে খেতে উঠে পড়ে আকাশ। মাখানো ভাতের থালা ঢাকা দিয়ে দরজা খোলে। রহিম, মেঘনাথ, সুরেশ দাঁড়িয়ে। সে জিজ্ঞাসা করে, এতরাতে প্রধানসাহেব কেন ডাকল? তারা বলল, কিছুই জানি না!
    আকাশের মনের ভিতর একটা সংশয় বাসা বাঁধতে থাকে। তবে কী পুরানো হিসেব- নিকেশ মিটিয়ে নিতে চায়! ওদের দাঁড়াতে বলে, আকাশ ঘরে ঢুকে বউ সঙ্গীতাকে বলে, দরজাটা ভেজিয়ে দিও আসতে রাত হবে। ছোট মেয়েটা কখন কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। একরত্তি মেয়েটাকে দেখলে মায়া হয়। সঙ্গীতা একা থাকে। কতবার বারণ করেছিল, বলেছিল রাজনীতি ছেড়ে দিতে। কে কার কথা শোনে! সঙ্গীতাও আর কিছু বলে না। শুধু স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে। আকাশ চলে যাওয়ায় সঙ্গীতা দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। সারারাত সঙ্গীতার দু’চোখের পাতা এক হয়নি। ভোরের আলো আধো আধো সবে ফুটেছে। সঙ্গীতার দু’চোখের পাতা জলে ভরা। সে মন খুলে কাঁদতে পারে না। স্বামীর না ফেরাই ভয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বিছানা থেকে উঠে বাড়ির উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর এঁটো বাসনগুলো বাইরে রেখে দেয়। আকাশের না খাওয়া ভাতগুলো থালায় যেমন ছিল, তেমনই আছে। শুধু মানুষটা নেই। দূরে পড়শিদের গুঞ্জন শোনা যায়। বড় রাস্তার ধারে কার একটা লাশ পাওয়া গেছে। শুনে সঙ্গীতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে কী করবে জানে না। মনকে ঠিক রাখতে পারে না। তবে কী আকাশের কিছু হয়েছে! এতক্ষণে সে বুঝল আকাশ আর এ পৃথিবীতে নেই। প্রধান-সাহেবের দলবল গতকাল রাতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আকাশকে খুন করেছে। সঙ্গীতা ঘরের বাঁশের খুঁটি ধরে বসে বসে কাঁদতে থাকে। সকালের সদ্য রোদে আকাশের মাখানো এঁটো ভাতগুলো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, কা -কা করে ডেকে যাওয়া এক ঝাঁক কাক। সঙ্গীতা দেখল কাক নয়, যেন হাসি মুখে আকাশ দাঁড়িয়ে। আর হাতের সরু সরু আঙুল থেকে ঝরে পড়ছে অজস্র সাদা সাদা ভাত।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- যাত্রা নাস্তি

    যাত্রা নাস্তি
    – সুজিত চ্যাটার্জি 

     

    বদ্রীনারায়ন থেকে হরিদ্বার ফিরবো। বাসের টিকিট আগেই নেওয়া ছিল। সপরিবার ভ্রমণ, তাই ব্যবস্থা পাকা রাখাই নিরাপদ।
    সকাল সাতটায় বাস ছাড়লো। বদ্রীনারায়নের নৈসর্গিক মায়াময় বিচিত্র শোভা আমৃত্যু থাকবে মননে, আর নিলাম আশীর্বাদ, জগৎ রক্ষাকারী শ্রীবিষ্ণু নারায়ণের কাছে।
    প্রায় বিশ কিলোমিটার যাবার পর হঠাৎই বাস দাঁড়িয়ে পড়লো। কি ব্যাপার ? বাস বিগড়েছে।
    ঘন্টা খানেক টানাহেঁচড়ার পরে জানলাম, এই বাস মেরামত করে রওনা দিতে আরও ঘন্টা তিনেক লাগবে।
    যাত্রা নাস্তি। আজকে আর কিছুতেই যাবো না।
    আমার পরিবারের প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞা সঞ্চারিত হলো আমার বাকি সদস্যদের মধ্যেও। সংখ্যায় তারা ভারী, সুতরাং গণতান্ত্রিক নিয়মে আমার সমস্ত নাস্তিকতা পরাজিত। পুনরায় বদ্রীনারায়নে ফিরে যাওয়াই সাব্যস্ত হলো।
    প্রায় বিশ কিলোমিটার পথ। ফিরতি গাড়ি চাই।
    এটা তো শহর নয়, পাহাড় । চাই বললেই মিলছে কোথায়। সপরিবারে পাহাড়ের ধুলো পাথরের ওপর লটবহর সমেত লাট খাচ্ছি , আর পথের পানে লোলুপ নয়নে চেয়ে আছি, ফিরতি গাড়ির চাতক আশায়।
    আরও ঘন্টা খানেক কেটে গেছে। যে কটা গাড়ি পেয়ে ছিলাম, তারা আমাদের পাত্তাই দেয় নি। সবেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। কেউ এমন দর হাঁকিয়েছে, অজ্ঞান হবার অবস্থা।
    এদিকে বাসের মেরামতি চলছে। নাস্তিক মন সাত্বিক হচ্ছে। হে বদ্রীনারায়ন, তাড়াতাড়ি বাস মেরামত করে দাও বাবা ।
    একটা জীপগাড়ি দেখতে পাচ্ছি। কাছে আসতে বুঝলাম পুলিশের জীপ। যা আছে কপালে। বুক চিতিয়ে গিরিশৃঙ্গ হয়ে দাঁড়ালাম সামনে। গাড়ি থামলো।
    সামনের সিটেই অফিসার ছিলেন। তাকে বললাম পুরো ব্যাপারটা। উনি শুনলেন , কিন্তু তার গাড়িতে আমাদের তুলতে তার নাকি আইনত বাধা আছে। উনি গন্তব্যে পৌঁছে অন্য গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
    আর ধৈর্য্য নেই। থাকার কথাও না। মেজাজ বিগড়ে গেল। বাঙালির মেজাজ বিগড়ে গেলে ইংরেজিতে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। গড়গড় করে ইংরেজি বেরুচ্ছে। পাল্লা দিয়ে চোখ হাত ধেইধেই করে নাচ্ছে।
    আজও আমাদের দেশে ইংরেজির কি বিশাল মাহাত্ম্য, আবারও হাতে হাতে টের পেলাম।
    অফিসার রাজি হলেন।
    সপরিবারে লটবহর সমেত পুলিশের জীপে চড়ে বিশ্বজয়ের নায়ক হয়ে, বদ্রীনারায়ন ফিরে এলাম।
    গল্পটা এখানেই শেষ করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু হলো না। নারায়ণের ইচ্ছা অন্য।
    পরদিন সকালে পুনরায় বাসে চাপলাম। সেখানেই শুনলাম খবরটা।
    কালকের সেই বাসটা যাত্রী সমেত খাদে পড়ে গেছে।
    আমার সমস্ত পরিবার একযোগে কপালে হাত তুলে সমস্বরে বললো, জয় বদ্রীনারায়ন।
    সেই আকুল করা ডাকে একটাই চাওয়া ছিল।
    রক্ষা করো। রাস্তাটুকু ভালোয় ভালোয় পার করে দাও ঠাকুর।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- রূপান্তরকামী

    রূপান্তরকামী
    -সঞ্জয় গায়েন

    -দু’ একটা কথা বলতে না বলতেই শরীরের কথায় চলে এলে! তোমরা পারো বটে।
    – আসলে…
    – আসল নকল সব বুঝি। প্রথম রিপুর তাড়নাও বুঝি।
    – না, দেখ আমি কিন্তু…
    – অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? স্পষ্ট বলো কামিনী কাঞ্চন পাবার লাগি জনম আমাদের।
    – বাহ্। তুমি বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পারো তো।
    – তা পারি। আসলে শিখতে হয়েছে। নইলে…
    – নইলে কি?
    – ওই যে ষড়রিপু। তোমরা ছেলেরা তো প্রথম রিপুর স্বাদ না পেলেই দ্বিতীয় রিপু প্রকাশ করো।
    – মানে!
    – আহা! যেন কিছুই জানে না।

    – সত্যি জানি না। তুমি বলো শুনি।
    – থাক আর জেনে লাভ নেই।

    – ও। বলবে না তো।
    – দেখলে তো এইটুকুতেই কেমন দ্বিতীয় রিপু প্রকাশ পেয়ে গেল। কিন্তু অমন রাগ যে ভাল নয়।
    – কি যে বলো! রাগ! তাও তোমার উপর! না গো। থাকতেই পারব না রাগ করে।
    – তাহলে কি পারবে? কি পারো তুমি? তোমরা? শুধু লোভ দেখাতে?
    – ছি! ছি! লোভ দেখাতে যাব কেন?
    – কারণ তোমার তৃতীয় রিপু।
    – প্লিজ। বিশ্বাস করো আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।
    – এই তো। পেরেছি। আমি পেরেছি।
    কি পেরেছো?

    – কেন তোমাকে মোহাচ্ছন্ন করতে। অবশ্য আমি জানতাম তোমার ভিতরের চতুর্থ রিপু এভাবেই প্রকাশিত হবে।
    – দেখ অত কিছু জানি না। শুধু এটুকু বুঝেছি এই মুহুর্তে সব কিছু তুমিময়। তুমি আমার…
    – মদের নেশার মতো। তাই তো।
    – নেশা! একে তুমি নেশা বলছ!
    – হ্যাঁ। নেশাই তো। তুমি অবশ্য পঞ্চম রিপুর তাড়না বলতে পারো।
    – আমি অন্য কিচ্ছু বলতে চাই না। শুধু তোমাকে পেতে চাই। না পেলে কিন্তু…
    – ষষ্ঠ রিপুর প্রকাশ ঘটাবে তাই তো। কিন্তু হিংসা (মাতসর্য) দিয়ে কি কিছু পাওয়া যায়। কি গো?
    – না গো। পাওয়া যায় না। ষড়রিপু দিয়ে কিচ্ছু পাওয়া যায় না। সেজন্যই তো তোমার কাছে এসেছি।
    – কিন্তু আমি …
    – তুমি যে কামের রূপান্তর ঘটাতে পারো। কারণ তুমি রূপান্তরকামী।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- ঘুংঘুর নদীর পানি

    ঘুংঘুর নদীর পানি
    – শক্তি পুরকাইত

     

    বর্ষা শেষ হতে চলল, আকাশে এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই। ঘুংঘুর নদী শুকিয়ে কাঠ। মাটি হাঁ হয়ে আছে। প্রতিবেশীদের চোখে জল। একফোঁটা বৃষ্টির জন্য মানুষের এমন হয়, সওকত মিঞা এ বছর তা সাক্ষী । প্রতিবেশীদের বিপদ পড়লে সে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, এটা নতুন নয়। আগা গোড়াই সে করে আসে। গ্রামে কেউ মারা গেলে একাই মাটি খোঁড়ে। আবার নিজেই মাটি দেয়। সওকত মিঞা ঘর থেকে বাইরে বের হয়। তারপর আকাশের দিকে তাকায় কোথাও এতটুকু মেঘ নেই। বৃষ্টি তো অনেক দূরে। গ্রামের যে কোন বিচার বা সালিশি সভায় ডাক পড়ে তার। ব্রহ্মপুত্র নদীর জলে পলি মাটি বয়ে আনতে আনতে আজ মানচিত্র থেকে ঘুংঘুর নদী নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। ঘুংঘুর নদী আর ঘুংঘুর নদী নেই। তবুও প্রতিবছর ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামলে প্রতিবেশীরা দেখত ঘুংঘুর নদীর আসল চেহারা। খড় কুটো পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু এ বছর তা সম্ভবনা খুবই কম। সওকত মিঞার অন্তর কেঁদে ওঠে। গ্রামের মানুষ গরমে হাঁস ফাঁস করছে। এই ভাবে গরম থাকলে গ্রাম উজার হয়ে যাবে। বাগানের শাক সবজি সব শুকিয়ে গেছে।মানুষ খাবে কী! সে যেন এ গ্রামের প্রাণপুরুষ। সকল দায় -দায়িত্ব সব তার। সেই জন্যে তার জন্ম। সওকত মিঞা, আগুন ঝরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘আল্লা এক পসলা পানি দিলি না, মানুষগুলা বাঁচবে কেমনে …’! বলতে বলতে তার মুখের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। কিছু বলতে চেষ্টা করে। পারে না। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে। শেষ নিঃশ্বাস পড়ে। প্রতিবেশীরা এসে দেখে সওকত মিঞা মারা গেছে। শেষ বিকেলে ঘুংঘুর নদীর চরে কবর খোঁড়া হয় তার। সওকত মিঞাকে কবরে তুলতেই গ্রামের মানুষ দেখল, আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি। এ বছর প্রথম বৃষ্টি। বৃষ্টি নামতেই ঘর থেকে ছেলে-বুড়ো সবাই বেরিয়ে আসে। বৃষ্টি ভেজার আনন্দ উপভোগ করে। আর ঘুংঘুর নদীও হাঁ হয়ে থাকা মাটিতে প্রাণ ফিরে পায়। ঘুংঘুর নদীর পানিতে বইতে থাকে গোটা গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ । গ্রামের অন্তরালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন সওকত মিঞা এ সব দেখছে …!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সুমনা

    সুমনা

    -সঞ্জয় গায়েন

     

    আমি তখন পনেরো। কদিন পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। এই অজুহাতে বন্ধুদের সঙ্গে দোল খেলতে গোষ্ঠতলার মাঠে যাই নি। দোতলায় ছাদে গিয়ে বইয়ে মুখ ঢেকে শুয়েছিলাম। অনির্বান কখন যে চুপিচুপি সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল। টের পাইনি । তুই এখানে লুকিয়ে… আর আমি সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজছি। বলেই মুখ থেকে বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সারা মুখে রঙ মাখিয়ে ওর হাত তখন আমার বুকের কাছে। আমার কি যে হল, বুঝতে পারলাম না। শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। অনি কি বুঝল কি জানি। বুক থেকে হাত না সরিয়েই আমার মুখের দিকে তাকালো। তারপর সিঁড়ির দিকে একবার তাকিয়েই আমাকে চিত করে শুইয়ে আমার উপর শুয়ে পড়ল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ঘষতে লাগল। কী ভয়ংকর এক ভাললাগা! ও গোঙাতে গোঙাতে আমাকে জাপটে ধরছিল। আমিও একটুও বাধা না দিয়ে চুপচাপ মেনে নিচ্ছিনাম। আর মনে মনে বলছিলাম, অনি এভাবে অ-নে-ক ক্ষণ আমাকে জড়িয়ে থাক। পিষে ফেল আমার শরীর।
    বেশ কিছুক্ষণ পর, ও জোরে শ্বাস নিল। ডানহাত দিয়ে ভেজা ঠোঁট মুছতে মুছতে আমাকে ছেড়ে দিল। মুখে জয়লাভের হাসি। সামান্য হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সুমন তোর শরীর রিয়ার থেকেও ভালো। আজ থেকে তোকে সুমনা বলে ডাকব।
    আমি এখন সত্যি সত্যি সুমনা হয়ে গিয়েছি। এস আর এস করে।
    কিন্তু অনির্বান আর আসে না। সুমনা বলে ডাকার জন্য।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প -মুক্তার মুক্তি

    মুক্তার মুক্তি
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

    কলেজের ডানপিটে,স্বাধীনচেতা, দাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। আজ সে কূলবধু।
    বধূর সাজে সজ্জিত এক লক্ষ্মীমন্ত বউ। ঘরের জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। দু’টি চঞ্চল নয়ন ছুটে যায় সেই মেয়েবেলায়। মায়ের শাড়ি লুকিয়ে পড়ে, বউ সাজা। বন্ধুদের সাথে বর -বউ খেলা। সিঁদুর পড়ে বউ সাজা। আর মায়ের বকা খাওয়া। বেশ ছিল দিনগুলি। বউ সাজতে ওর খুব ভালোলাগতো। ও তো জানতো না সত্যিকারের বউ হলে যে কি জ্বালা। স্কুল, কলেজে তার দুষ্টু বুদ্ধির জুড়ি মেলা ভার।
    বন্ধুদের সাথে কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমায় যাওয়ার কথা কি ভোলা যায়? কিংবা নদীর তীরে ঘাসের ওপর বসে কবিতা লেখা। গুন গুন করে গান গেয়ে ওঠা। নদীর বুকে নৌকায় ভেসে বেড়ানো। আজ সব স্বপ্নের মত লাগছে। কলেজটা ছিল ঠিক নদীর তীরে। তাই নদীর ছলাৎ ছলাৎ জলের ঢেউ দেখতে দেখতে মনেই থাকত না বাড়ি ফেরার কথা।
    পড়া শেষ হলো না তার। ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়ে বিয়ে হলো মুক্তার। মুক্তা সেজেগুজে দিব্যি বিয়ে করে নিল। তারপর তার হারিয়ে গেল অতীত। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মুক্তা। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। আজ সে অন্যের। অন্য এক পুরুষের। অন্য এক পরিবারের বউ।
    জানালার সামনেই এক শান্ত স্নিগ্ধ দীঘি আছে। সেই দীঘিতে ফুটন্ত শালুকগুলি মাথা দুলিয়ে ডাকছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে দীঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আঁচল ভরে শালুক তুলতে। ইচ্ছে করে শালুকের মালা গেঁথে গলায় পরতে। কবিতা লিখতে। আর আসে না কবিতা ওই বন্দী ঘরে। মনটা ফিরে যায় সেই ছোট বেলায়। সবই তার কল্পনা।
    সে যে স্বাধীন ভারতের বউ। বউদের এসব ঠিক মানায় না। স্বামীর কড়া আদেশ বাড়ি থেকে যখন তখন বাইরে যাওয়া যাবে না। যদি কোন দিন যেতে ইচ্ছে করে তো, স্বামীর সঙ্গেই যেতে হবে। ভালো আহার, দামী শাড়ি , দামী গহনায় ঢাকা পড়লো মুক্তার মন। তবু ঢাকা পড়ে না পরাধীনতার যন্ত্রনা।

    এক দিন ফোন এল তার। যার চোখে ছিল স্বপ্ন। বেঁচে থাকার শক্তি। স্বাধীনতার মন্ত্র। মুক্তির আহবান।
    মুক্তা আর পিছনে ফিরে তাকাল না।
    সবাই যখন ঘুমিয়ে। বন্ধ দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। সেইখানে মিলিত হলো ওরা। সেই নদীর তীরে আরও পাঁচ জন। কলেজের বন্ধু। যেখানে আগেও দেখা হতো সবার। আজ সে স্বাধীন। আজ যে স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করল। নদীর তীরে ঘাসের উপর গিয়ে বসল ওরা। মুক্তার কবিতার খাতাটা হাতে তুলে দিল। এক দিন ওর হাতেই তুলে দিয়ে ছিল মুক্তা। এই তোর স্বাধীনতা। ইচ্ছে মতো লেখ তোর মনের যন্ত্রনা। আমরা এখন আসি। হারিয়ে গেল ওরা।
    ঘুমটা ভেঙে গেল। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, জাতীয় পতাকা উড়ছে। ভেসে আসছে সেই গান,”বন্দেমাতরম “।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- ছায়া

    ছায়া
    – শক্তি পুরকাইত

    ‘অকালে মায়ের মাথাটা খেয়ে, আমার হয়েছে যত জ্বালা! বিশ্বরূপকে বার বার বলেছিলুম, এই মা মরা মেয়েটার মুখ চেয়ে একটা বিয়ে কর। আমার তো বয়েস হচ্ছে, ওকে কে দেখবে, কে মানুষ করবে!’ জানলার ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ ঠাকুমার কথাগুলো বার বার মনে করছিল, লীনা। ঠাকুমা ওকে বলতো তোকে বিয়ে দিয়েই তবে আমি দু’চোখের পাতা এক করবো। নইলে মরে গিয়ে শান্তি পাবো না, একবিন্দু। সকল সময় তোর সাথে সাথে ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াবো! ঠাকুমা, মারা গেছে মাস খেনেক আগে। তবু লীনার মনটা কেঁদে ওঠে, ঠাকুমার জন্যে। কিছুই তার ভাল লাগে না। উঠোনে পা রাখতে সে দেখতে পায়, ঠাকুমা এঁটো বাসনগুলো মাজছে। নিম গাছের শীতল হাওয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে, সাদা থানটা। ঠাকুমা ডাকছে- লীনা, এই লীনা! সে ছুটে গিয়ে, ঠাকুমাকে ছুঁতে চেষ্টা করে। পারে না। মূহুর্তে সে বুঝতে পারল, তিনি এ পৃথিবীতে নেই। লীনা ‘ঠাকুমা’ বলে কেঁদে উঠল আর এক বার ।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সহজিয়া

    সহজিয়া
    -সঞ্জয় গায়েন

    – সত্যি করে বলো তো আমাকে দেখে আগে মেয়ে বলে মনে হত?
    – হ্যাঁ।
    – নাঃ! তুমি মিথ্যে বলছ!
    – বা রে! শুধু শুধু মিথ্যে বলতে যাব কেন!
    – মেয়েদের মতো আমার তো কিচ্ছু ছিল না। শুধু মনে মনে আমি নারী ছিলাম। কিন্তু মনের অনুভব তো শরীরে থাকে না! তাহলে আমাকে দেখে মেয়ে মনে হত কি করে!
    – আমি তো বাইরেটা দেখি না। অন্তরের গভীরে…
    – সান্ত্বনা দিচ্ছ ! দিও না! আমি জানি পুরুষ নারীকে চেনে বুকের খাঁজ দেখে।
    – তাই বুঝি!
    – হুম।
    – সেজন্য বুঝি অমন সুডৌল স্তন তৈরি করেছো?
    – নাঃ! পুরুষকে সুখী করতে বা পুরুষ সঙ্গী পেতে এসব করি নি।
    – এবার তুমি মিথ্যে বলছ।
    – মোটেও না।
    – সত্যি বলছ তুমি চাও না একজন মনের মানুষ হোক?
    – তা চাইব না কেন?
    – তবে?
    – মনের মতো খুব কাছের একজন হোক সে তো চাই। কিন্তু সেই চাওয়া যেন শুধুই যৌনতার জন্য না হয়।
    – যদি তা হয়ও ক্ষতি কি? যৌনতার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ তো কাছে এসে ধরা দিতেই পারে।
    – কি বলছ তুমি! যৌনতা আবার কবে সৌন্দর্যের স্বীকৃতি পেল?
    – সৃষ্টির আদিকাল থেকে পেয়ে আসছে। শুধু…
    – শুধু কি?
    – শুধু এই আধুনিক যুগে এসে তাকে মোড়কে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করা হচ্ছে।
    – উফ্‌! অত ভারি ভারি কথা বুঝি না। সহজ করে বলো।
    – সহজ করেই তো বলছি, চলো আজ থেকে আমরা সহজিয়া হয়ে যাই।

You cannot copy content of this page