অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অনুগল্প- বাঁক

    বাঁক
    – শক্তি পুরকাইত

     

    বাঁশের তৈরি লম্বা একটা বাঁক। সহজেই বেঁকে যায় বলে নাম বাঁক। তার নিচে ঝুলতে থাকে দু-একটা মাটির ভাঁড়। ভাঁড়ে বাবা মহাদেবের মাথায় ঢালার জন্য নদী থেকে তুলে আনা জল। মধুশ্রী বাঁক কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ‘বোম্ – বোম্ – বোম্’ বলতে বলতে। সজিত নাসিংহোমে ভর্তি, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মুখে মধুশ্রী… মধুশ্রী নাম! মধুশ্রী হাঁটতে পারে না। তবুও কোনরকমে হাঁটছে সজিতের বাঁচার জন্য। অনেকটা পথ পেরিয়ে আসে মধুশ্রী। দূর থেকে দেখা যায় বাবা মহাদেবের ঐতিহ্যবাহী সাবেকী মন্দির। মন্দিরের গা বেয়ে নেমে গেছে ছোট ছোট বটের ঝুরি। সারা মন্দিরের পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে। মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে মধুশ্রী। কাঁধ থেকে ভারি বাঁকটা নামিয়ে রাখে। বাঁক থেকে খুলে আনে মাটির ভাঁড়, ভাঁড়ে জল । মন্দিরের পুরানো দরজাটা কোনরকমে খোলে সে। পিয়ালী ছুটতে ছুটতে খবর আনে, সজিত মারা গেছে! তখনও মন্দিরের বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে একটাই শব্দ বোম্– বোম্–তারকবোম্!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- স্বার্থপর

    স্বার্থপর
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

    পৃথিবীতে যে কত চরিত্রের যে প্রাণী আছে, তা নিজেরাই জানি না। নিজেদের সুবিধাটুকু ছাড়া আমরা কিছুই বুঝি না। আমিও তেমনই সুবিধাভোগী প্রাণী।সেদিন বিশেষ কাজে বাসে উঠে সল্টলেক যাচ্ছিলাম।
    অনেকটা পথ যেতে হবে। বাসে একটাও সিট খালি ছিল না। বেশির ভাগ রাস্তাটা দাঁড়িয়েই থাকতে হল। প্রচন্ড ভীড়। ঠেলাঠেলির মাঝেই শক্ত করে রডটা চেপে ধরলাম। আমার পাশেই এক মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। অল্প বয়সী কিছু মেয়েরাও ছিল পাশেই। যা হয় আর কি। ভিড় গাড়িতে পুরুষের কনুই এর ধাক্কা নয় তো কিছুটা স্পর্শ মেয়েদের অস্বস্তির কারণ।
    ভদ্রলোককে বারবার মেয়েগুলি বলল, ছেলেদের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে। তবু কিছুতেই গেল না।
    যখনই ব্রেক মারে, লোকটি মেয়েগুলির গায়ে ঢলে পড়ে। সিটে বসে থাকা এক মহিলা যা খুশি বলে গালাগালি করল। লজ্জা করে না তোমার। এভাবে ছোট ছোট মেয়েদের ধাক্কা মারছো। বাড়িতে মা বোন নেই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারো, বাসে ওঠো কেন?
    লোকটার দিকে চোখ পড়তেই মনে হল খুব অসুস্থ।
    কেমন চুপ করে মাথা নত করে আছে।
    হঠাৎ নিচে বসে পড়ল। ভিড় গাড়িতে এভাবে পড়ে যেতেই হইচই বেঁধে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলি ভয়ে সরে গেল। কেউ তুলতে এল না। আমার ব্যাগেই জলের বোতল ছিল। অগত্যা চোখে জলের ছিটে দিলাম। চোখটা খুলল। ততক্ষণে দু’টো ছেলে এসে ধরে তুলল। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। জ্বর অবস্থায় এই গরমে বাসে উঠে ছিল। খুব দুর্বল দেখাচ্ছে।
    আমি সিটে বসে থাকা সেই মহিলাকে বললাম, একটু সিটটা ছেড়ে দেবেন? উনি খুব অসুস্থ। গজগজ করতে করতে বলল, আপনি হলে ছাড়তেন সিট। যত সব বদমাইসি। খুব যে দরদ দেখছি। নিজের চেনাজানা বুঝি?
    এই হল ভদ্রসমাজ। পরের স্টপেজ এ একটা সিট খালি হলে ওনাকে বসতে বললাম। কিছুতেই রাজী হল না।
    ভদ্রতার খাতিরে বলল, আমি এখন ঠিক আছি। আপনি বসুন। একটু মাথাটা ঘুরে গিয়ে ছিল।অপমানিত হওয়ার চেয়ে, লেডিস সিটে না বসা’ই ভালো। মহিলা এলেই উঠে যেতে হবে।

    সত্যিই তাই। কিছুতেই বসলো না ভদ্রলোক। আমি বসে পড়লাম।
    একপাশে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর পুরুষদের দিকে সিট খালি হল।
    উনি বসতে গেলেন। পাশেই এক ভদ্রমহিলা বাচ্চা কোলে গাড়িতে উঠল।
    ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। বলল, বসুন। বাচ্চা কোলে কষ্ট হবে।
    নিঃশব্দে সিটটা ছেড়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল।
    সিটে বসে বাচ্চাটি মায়ের কোলে খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি দেখলাম, ভদ্রলোকের মুখে ও তৃপ্তির হাসি।

  • অণু গল্প

    অনুগল্প- আন্দোলন

    আন্দোলন
    -শক্তি পুরকাইত

     

    নাম- রেহেনা বিবি, বয়স- সাতাশ বছর। দ্বিতীয় লাশটার মুখ থেকে কাপড় সরায় সুতনু রায়। হরিদেব পুর থানায় মাস দু’য়েক আগে এসেছে। লাশটা দেখে চমকে ওঠে। বাচ্চাটা যে ভাবে পুড়েছে, তা ভাবা যায় না। চোখের সামনে দাউ -দাউ করে জ্বলছে গোটা বস্তি। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কেউ বাদ যায়নি। এ-ও ছুটেছে। কেউ সন্তান হারার শোকে কাতর। কেউ স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙে পড়ছে। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর ছায়া। এক-এক করে সাজানো কুড়িটা লাশ। মেহের আলিও খুঁজছে তার বউ-বাচ্চাকে। একদিন নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্নে সরকারের বিরুদ্ধে পা মিলিয়েছিল। কিন্তু তার বিনিময়ে এই পরিণাম। সে বুঝতে পারে নি, কে বা কারা এ কাজ করতে পারে! এ বছর ঈদে দেওয়া শাড়িটা দেখে চিনতে পারে বউটাকে। পাশে শোয়ানো ছোট মেয়েটা। পুড়ে যাওয়া মা ও মেয়ের নিথর দেহ। সারা শরীর আন্দোলন হতে থাকে তার। সে চিৎকার করে ওঠে, রে – হে – না! পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে যায়, মেহের আলিকে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- মশলা মুড়ি

    মশলা মুড়ি
    অঞ্জনা গোড়িয়া

     

    এই মুড়ি খাবে? মশলা মুড়ি!

    আমার মনের কথাটাই যেন বলে দিল। কি করে বুঝলো মশলা মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে পাশাপাশি বসে, লঞ্চে মুড়ি খেতে খেতে গল্প করতে করতে আর- না না আর কিছু নয়। ইস্ কি ভাবছি কত লোক বসে আছে না, এই লঞ্চে! আমি কি পারি একমুঠো মুড়ি ওকে খায়িয়ে দিতে? আমি কি পারি একটা হাত আমার হাতে রাখতে, শক্ত করে ধরে নদীর বুকে খুঁনসুটি করতে? কত দিন পরে দেখা, মিলিত হয়েছি একসাথে। শুধু দেখছি, কথা যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। ভেবে এসে ছিলাম কত কি বলব, করব, ইস সব কেমন গুলিয়ে গেল ওকে দেখে। সেই হাসি, প্রাণ খোলা কথা, সমাজ সেবার অঙ্গীকার অসহায় নারীর সহায়, বন্ধুকে আমি পেয়েছি নিজের করে। এ যে পরম সৌভাগ্য। তাতেই আমি ধন্য, আর কি চাই বলো? প্রচন্ড গরম হচ্ছিল লঞ্চে, ও ঘেমে যাচ্ছে, ভাবলাম মুছিয়ে দিই আঁচল দিয়ে, একটু পরশ তো পাবো, সেই বাঁধা! অন্যদের তাকান কৌতূহল দৃষ্টি যে আমার ওপর। ওই বলল- তুমি ঘেমে যাচ্ছো একটু নদীর দিকে ঘুরে দাঁড়াও।

    পাশাপাশি দু’জনে কত কাছে, তবু ছুঁতে পারি নি ওকে। ওর ঘ্রাণ আমার চোখে মুখে। আমি যেন এক অনাবিল সুখে আচ্ছন্ন। কতবার ভাবছি এই বুঝি হাতটা ধরে বলবে, এই আমায় ভালোবাসো? চার ইঞ্চির শর্ত যাক ঘুচে। এসো হাত ধরে বসি। পাগল একটা আমি, শুধু ভেবেই গেলাম, জানি ও কথা রাখবে, নিজে কোন দিন জোর করবে না। আমাকেই ধরা দিতে হবে । যখন ভাবনা শেষ ,তখন নদী লঞ্চ কিনারায়। এবার নামতে হবে। তাও ভাবলাম ও বুঝি হাতটা ধরেই নামিয়ে দেবে? কি বোকা বোকা লাগছে। লজ্জায় মরে যাই, এসব কি ভাবছি। মুড়ির ঠোঙাটা ভাসিয়ে দিলাম মাঝনদীতে দু’জনে । ওখানেই মিলিত হোক দুই ঠোঙার ভালোবাসা।

    -চলো গাড়ি দাঁড়িয়ে!

    বিদায়

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- জিয়নকাঠি

    জিয়নকাঠি
    -সঞ্জয় গায়েন

     

    পাঁচবছর অন্তর। পরিবর্তন প্রয়োজন। নইলে সেই একই মুখ। ভাল্লাগে না। একঘেয়েমি আসে। তাই সরকার নতুন মুখ পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সবার কাছে। আমাদের জীবনে এমনটা হলে মন্দ হয় না। প্রজ্ঞার একথা লেখার উদ্দেশ্য বুঝতে পারল না কৃষ্ণেন্দু। তাই ভ্রু কুঁচকে দু’চোখ নাচিয়ে ইশারা করল। মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল সে কিছু বুঝতে পারে নি। প্রজ্ঞা হাতের মুদ্রায় জানাল, পরে বলবে। দু’জনে আবার কমপিউটারের কী-বোর্ডে আঙুল চালানো শুরু করল। ওদের অফিসে কথা বলা নিয়ে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ বিধি চালু আছে। তাই কাজের ফাঁকে কিছু বলার ইচ্ছে হলে ওরা স্ক্রিনে লিখে জানিয়ে দেয়। ওদের চেয়ার পাশাপাশি। একে অপরের রিপ্লাই দেয়া-নেয়া করতে অসুবিধা হয় না। এভাবে সারাদিন কাজ করে ওরা। গল্পগুজবও সেরে নেয়। লাঞ্চব্রেকে কৃষ্ণেন্দু ধরল প্রজ্ঞাকে।
    -এবার বল্‌। পাঁচবছর অন্তর পরিবর্তন চাই মানে কি?
    প্রজ্ঞা বলল, সত্যি কৃশ তুই ব্যাকডেটেড রয়ে গেলি আজও। কথা বুঝে নিতে হয়। কিছু কিছু।
    – তোকে বারন করেছি, আমাকে কৃশ বলবি না। আমি কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণ যুক্ত ইন্দু। কৃষ্ণের সঙ্গে চন্দ্রের…
    – থামবি তুই। তোর পৌরাণিক গল্প শুনিয়ে আধঘন্টার লাঞ্চব্রেকটা বোর করে দিস না প্লিজ।
    – ওকে। বল্‌ কি বুঝে নিতে হবে?
    – শোন্‌ কলেজ লাইফে সুমন্তর সঙ্গে প্রেমটা পাঁচবছর হেভি এনজয় করেছি। তারপর পরস্পরের কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার ছিল না। শুধু শুধু একে অপরের দায় নিলে বোর হতাম। তাই বিয়ে করি নি আমরা। রঞ্জনকে বিয়ে করলাম। নতুন সাথী। নতুন রোমাঞ্চ। নতুন শিহরণ। কিন্তু বিয়ের ফিফথ্‌ অ্যানিভারসারি সেলিব্রেট করতে গিয়ে দু’জনেই ফিল করলাম আমাদের একঘেয়েমি এসেছে।
    – তাই রঞ্জনকে ডিভোর্স দিবি তাই তো? ভালো ল-ইয়ার চাই। খোঁজ নিয়ে কাল জানাবো।
    – না রে। ডিভোর্স করব না আমরা।
    – তাহলে?
    – সেটাই তো ভাবছি। তোর পৌরাণিক যুগে এর কোন সমাধান নেই?
    – পৌরাণিক যুগে দেবগণ বহুবিবাহ করতেন এই কারণে। কিন্তু তোরা মর্ডান লেডি। তোরা কি বহুবিবাহ মানবি?
    – ইয়েস মানব। তবে বহুবিবাহ নয়। বহুপ্রেম।
    – মানে!
    – রঞ্জনকে বলব, তুমি মেয়ে খুঁজে প্রেম করো। আমিও হ্যান্ডসাম কাউকে সার্চ করি। হেভি এনজয় হবে। থ্যাংক ইউ কৃশ। ইউ আর সো কিউট। যুগ যুগ জিও পুরাণকাব্য।
    কৃষ্ণেন্দু একেবারে থ। বিষ্মিত হয়ে বলে ওঠে, কি বলছিস তুই?
    – ইয়েস ডিয়ার। এ যুগে পরকীয়ায় আমাদের জিয়নকাঠি।

  • অণু গল্প

    অনুগল্প- ইছামতির কান্না

    ইছামতির কান্না
    -শক্তি পুরকাইত

     

    ‘কানাই, এ কানাই..’
    চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কানাই নৌকা বাইতে বাইতে ঘাটে আসে। সবুজ রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে পার্বতী। মাথার দু’পাশে চুল লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি। কানাই নৌকা বেঁধে দিয়ে উপরে ওঠে। সোজা গিয়ে পার্বতীর পিছনে এসে দাঁড়ায়।
    -‘বল,কী হয়েছে, অমন চিৎকার করছিস কেন? চল না, আজ নৌকা নিয়ে ঘুরতে যাই। না, আজ যাব না! মাছ ধরতে যাব। ঘরে একটা টাকা-পয়সা নেই। মাছ না ধরলে খাব কি?’
    পার্বতী একটু চুপ থাকে। তারপর বলে,
    ‘তোর কবে সময় হবে? আমি মরে গেলে!’
    -‘না রে পার্বতী, অন্য একদিন যাবো।’
    -‘তুই তো রোজ বলিস, অন্য একদিন! চল না … ! যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি! জানিস পার্বতী তোকে না আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ঠিক যেন আমার বউ।’
    -‘সত্যি বলছিস, কানাই। আর একবার বল। ঠিক তোর বউ।’
    পার্বতীর কথায় কেমন যেন হয়ে ওঠে সে। ভাবতে থাকে পার্বতীকে বিয়ে করলে কি করে খাওয়াবে। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে কোন দিন আর বাস্তবে মিলবে না। কানাই সামান্য একজন মাঝি। কোনো রকমে মা’কে নিয়ে সংসার চালায়। তাকে এসব বিয়ে-টিয়ে মানায় না। পার্বতী গা ঠেলা দেয়।
    -‘কী রে অমন করে কি দেখছিস?’
    – ‘না কিছু,না।’
    কানাই নৌকাটা খুলে পার্বতীকে ডাকে,
    -‘আয়! নৌকাতে বস। পার্বতী কানাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দেখতে থাকে কানাইয়ের পুরুষালি শরীর। কুঁকড়ানো চুল। কানাইকে যত দেখে পার্বতী বিভোর হয়ে যায়।
    -‘কি রে পার্বতী তোর বাড়ির লোক কিছু বলবে না? আমার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিস! বললে কী যায় আসে।সে আমি বুঝে নেবো। তোর কিছু হবে না।’
    -‘কানাই, এ কানাই তুই কোনদিন কাউকে ভালবেসেছিস?’
    -‘হ্যাঁ, কেন আমার মাকে, আমার গ্রামকে, নদীকে। ধ্যাৎ, ও ভালবাসা নয়।’
    -‘তবে কোন ভালবাসা?’
    -‘ধর, আমি তোকে ভালবাসি, তুই আমাকে।এই ভালবাসা। আচ্ছা কানাই, আমাকে কেমন লাগে?’
    কানাই উত্তর দেয় -‘খুব, খুব ভাল।’
    ইছামতির নৌকা বাইতে বাইতে বেলা পড়ে আসে। নদীর বুক চিরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। শুধু শোনা যায় জলের মধ্যে দাঁড় টানার শব্দ। ধীরে ধীরে কানাইয়ের নৌকা ঘরমুখো হয়। নদীর পাড়ে টিম টিম করে আলো জ্বলছে, কানাই নৌকা বাঁধে ঘাটে। পার্বতী চুপ করে থাকে।
    -‘ কি রে নৌকা থেকে নামবি না। আয়! নামতে ভয় করছে? আয়, আমার হাতে হাত রাখ।’
    পার্বতী নৌকা থেকে এক পা না-এক পা ফেলতে সোজা এসে পড়ে কানাইয়ের বুকে। তার নরম ছোঁয়ায় কানাইয়ের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। কানাই জীবনের প্রথম নারী স্পর্শ অনুভব করে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, দু’জন-দু’জনে।
    -‘ওঠ পার্বতী, কি করছিস!’ শাড়িটা ঠিক করে নে!পার্বতী উঠে দাঁড়ায়।
    দূরে গ্রামের লোকের হো হো শব্দ ভেসে আসে। ভয়ে সে জড়িয়ে ধরে কানাইকে। অন্ধকারে একটা লাঠি এসে পড়ে কানাইয়ের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে ভিজে যায়, শরীর। পার্বতীকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। ইছামতির জলে তখনও ভাসছে কানাইয়ের শরীর।

  • অণু গল্প

    অনু গল্প- তিয়াসের প্রেমে

    তিয়াসের প্রেমে
    -রঞ্জনা সেনগুপ্ত

     

    সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। আকাশেরও বুঝি বা আজ মন খারাপ, রজতের মতোই। গত কয়েকদিনের দমিয়ে রাখা মনখারাপটা যেন আজ আর কোনোভাবেই বাঁধ মানছে না। আজ রাতের ট্রেনেই রওনা হতে হবে কলকাতায়, রুপাই শহরটিকে চিরকালের মতো বিদায় জানিয়ে। শুধু রুপাই নয়, ছাড়তে হবে ওর তিয়াসকে, ওর ভালবাসার,আদরের তিয়াসকে। এই যন্ত্রণাই তো কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। এই রুপাই শহরে বদলি হয়ে আসা অবধি তিয়াসই তো ওর একমাত্র বান্ধবী। এমনিতেই রজত খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের, নিজের প্রয়োজনের কথাও কম বলে; তার উপরে এই শহরটিও ভীষণ শান্ত, লোকজনের বাস কম-ই। অফিস থেকে ফেরার পর তিয়াস ছাড়া আর কেউই তেমন নেই রজতের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এই সুন্দর ছবির মতো শহরটির আরও অনেক অনেক সুন্দর রূপসী নদী তিয়াস। নামটা শুনে ভেবেছিল ‘নদ’, কিন্তু ওকে দেখেই বুঝেছিল “এ নদী না হয়ে যায় না! এতো রূপ কোন পুরুষের হতে পারে না!” প্রথম দেখাতেই প্রেম। আর তারপরে এমন কোন দিন যায়নি যেদিন কি না রজত যায়নি ওর প্রেমিকার কাছে। তিয়াসের পাশে বসে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বিভোর হয়ে দেখেছে ওকে, ওকে ছুঁয়েছে, ওতে মাতাল হয়েছে। ওর রূপে কেমন যেন এক অদ্ভুত নেশা আছে; চোখে স্বপ্ন এঁকে দেয়, আর মনে ধরিয়ে দেয় জ্বালা! ওর পাশে বসে, ওকে ছুঁয়ে রজত বলতে থাকে, ওর সারাদিনের খুঁটিনাটি ঘটনার কথা, ওর বাড়ির কথা, ওর অতীতের কথা আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা। তিয়াস কখনও নিজের শরীরে দোলা দিয়ে সাড়া দেয়, আবার কখনও বা চুপচাপ শোনে। আজ ওর তিয়াসের কাছে বিদায় নেওয়ার পালা। শেষবারের মতো তিয়াসকে ছুঁতে চাইল রজত, নেমে পড়ল ওর বুকে। হঠাতই তিয়াস অস্থির হয়ে উঠল। রজত উঠতে চাইল পারে, কিন্তু পারল না। কে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে! তিয়াস আজ কিছুতেই ওর প্রেমিককে চলে যেতে দেবে না। ধীরে ধীরে রজতকে ও শরীরের ভিতরে প্রবেশ করাল পরম সুখে। ওকে রেখে নিল চিরদিনের জন্য, নিজের গভীরে, পরম তৃপ্তিতে। রজত শুধুই ওর, ওকে ছেড়ে কারও কাছে, কোনদিনও যেতে দেবে না তাকে; যদি মরণ দিয়ে বাঁধতে হয় তার প্রেমিককে, তবে তাই সই!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- বাংলার দুর্গা

    বাংলার দুর্গা
    – সঞ্জয় গায়েন

     

    এবার বৃষ্টি ভালো হয়েছে। জলাতেই বুক সমান জল। ধানগাছগুলো বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কোনোরকমে। খালেতে তো মাটির তল পাওয়া যাবে না। তাই সাঁতরে সাঁতরেই কলমী শাক তুলছে দুগ্‌গা। পীচরাস্তায় একটা কালো স্করপিও গাড়ী এসে দাঁড়ালো। হাঁটুর একটু নীচে পর্যন্ত ঝুল এমন প্যান্ট আর পাতলা গেঞ্জি পরা একটা লোক আর জিনস্‌ প্যান্ট ও হাফ হাতা জামা পরা একটি মেয়ে বাইরে এল। লোকটার সাথে ক্যামেরা। মেয়েটির হাতে মাইক্রোফোন।
    ও দিভাই, দিভাই… শুনছেন… মেয়েটি দুগ্‌গা কে ডাকছে।
    দুগ্‌গা মাথা তুলে তাকাতেই মেয়েটি আবার বলল, আমরা কলকাতা থেকে আসছি। টিভির জন্য ছবি তুলি। তোমার ছবি তুলবো।
    ও মা, সে কি কতা! গায়েতে বেলাউজ নেই! সব দেকা যাচ্চে। ওনারা এইচেন ছবি নিতে! দূর অ পোরামুকি! দুগ্‌গা খেদিয়ে দেয় ওদের।
    কিন্তু ওরাও সাত জায়গায় ঘোরা পার্টি। কোন্‌ রোগের কি ওষুধ ভালো করেই জানে।
    মেয়েটি হাসিমুখে বলে, ও দিভাই শুনবে তো। ছবি তুলতে দিলে পাঁচশো টাকা দেব।
    পরের মাসে। বাংলার দুর্গা প্রতিযোগিতায় ওই মেয়েটির তোলা ভিডিও ফার্স্ট হয়। টিভিতে দেখাচ্ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কারের চেক হাতে মেয়েটি ওর ছবি তৈরির গল্প শোনাচ্ছে। আর দুগ্‌গা নিজেকে টিভিতে দেখতে দেখতে গজগজ করতে থাকে, আসুক এবার। আবার বেলা পাঁচসো আর উনি পঞ্চাস হাজার। এমন করে কেউ কাউকে ঠকায়! সইবে নি কপালে!
    ওদিকে টিভিতে ঘোষণা করছিল যে সুন্দরী মেয়েটি সে বলে চলেছে,আপনারা দেখলেন হাংগার ফিগার কিভাবে শিল্পীর হাতে চমৎকার রূপ পায়! যাইহোক আজ এখানেই শেষ করতে হচ্ছে বাংলার দুর্গা প্রতিযোগিতার গ্রান্ড ফাইনাল। আবার দেখা হবে। অন্য কোন দিন। অন্য কোন অনুষ্ঠানে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- আজকের দূর্গা

    আজকের দূর্গা
    -শক্তি পুরকাইত

     

    কাঠের বোঝাটা মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দূর্গা লক্ষ্য করে কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। বেলা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। তাই সামান্য সামান্য অন্ধকার হওয়ায় দ্রুত পা চালাতে থাকে সে। গ্রামের মেয়ে-মদ্দরা ফিরে গেছে যে যার ঘরে। দূর্গাও ঘরমুখো। স্বামী একবছর হল ঘরছাড়া। পুলিশ আজও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দূর্গা পঞ্চায়াতের এক’শ দিনের কাজে নাম লিখিয়েছে। গ্রামের রাস্তার কাজ করে সংসার চালায়। ছায়াটা ক্রমশ আরো তার দিকে এগিয়ে আসছে। দূর্গা ভয় ভয় করে হাঁটতে থাকে। কাঠের বোঝা মাথায়। দূর্গা পড়ে যায়। রজতবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তার সুডৌল শরীর। সে এ পঞ্চায়েতের প্রধান। দূর্গার বুকের কাপড়টা মাটিতে পড়ে যা। রজতবাবু, দূর্গার বুকের কাপড়টা ধরে টানতে থাকে। দূর্গা চিৎকার করে ওঠে- ‘কাছে আসবি না শয়তান, ছেড়ে দে’! রজতবাবু কাপড়টা আরো জোরে জোরে টানতে থাকে। দূর্গার সমস্ত কাপড় খুলে পড়ে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে, ছেড়ে দে শয়তান, ছেড়ে দে…! দূর্গা কাঠের বোঝা থেকে কাটারি হাতে নিয়ে রণমূর্তি ধারণ করে। রজতবাবু তার হাতের কাটারিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সে এগিয়ে যায়। দূর্গা সঙ্গে সঙ্গে রজতবাবুর গলায় এক কোপ বসায়। রজতবাবু মাটিতে পড়ে যায়। দূর্গা আবার এক কোপ বসায়। কিছুক্ষণের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে যায় রজতবাবুর শরীর। দূর গাঁ থেকে ভেসে আসে, মা দূর্গার ঢাকের বাদ্যি । দূর্গা রক্তমাখা কাটারি হাতে নিয়ে থানার দিকে রওনা হয় ।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- নয়নতারা

    নয়নতারা
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

    নয়নতারার হাতে একগুচ্ছ বেলফুল। একবার নাকে শুঁকছে আর মালা গাঁথছে। বেল ফুলের মালা। মাথায় দেবে বলে না। আজ ও আসবে বলেছে। ওর অলিখিত স্বামী। সমাজে এখনো জানে না। আজো বুক ফুলিয়ে বলতে পারে নি ও বিবাহিত। মন্দিরে সিঁদুর রাঙিয়ে দিয়েছিল চন্দন। কোন উপায় ছিল না যে। সে দিনই তাকে যেতে হবে বিদেশ। ডাক্তারি পড়তে নয়। চিকিৎসা করাতে। নিজের জন্য নয়। বাকদত্মার জন্য। সত্যি খুব অবাক লাগছে। এক দিকে বাবার পছন্দ করা মেয়ে, অন্য দিকে ছোট বেলার নয়নতারা। খেলার সাথী মনের সাথী। তাকে যে কথা দিয়েছে জীবন সাথী করবে।

    চন্দন, বাবার একমাত্র ছেলে। বাবার মাথায় হাত রেখে কথা দিয়েছে বন্ধুর মেয়ে ময়নার সমস্ত দায়িত্ব নেবে। তাই তো এত দূর পাড়ি বাকদত্মাকে নিয়ে। ও জানেই না ব্রেন ক্যান্সার নিজের। অপারেশন করতেই হবে। স্বপ্ন দেখেছিল চন্দনকে নিয়ে। ওর বাবা হঠাৎ মারা যায়। পছন্দ করা পাত্রকেই মন দিয়েছে সে। চন্দন ভেবেছিল, ও সুস্থ হলেই সব বুঝিয়ে বলবে। হঠাৎই ময়না, এক মুঠো সিঁদুর হাতে চন্দনের সামনে। সিঁদুর পড়েই অপারেশন রুমে যাবে। আর যদি না ফিরতে পারে, তবু স্বামীর দেওয়া সিঁদুর পড়েই বিদায় নিতে চায় ময়না। আকাশ ভেঙে পড়ে চন্দনের মাথায়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে পড়িয়ে দিল সিঁদুর।
    অপারেশন সফল। দু’জনে ফিরছে বিদেশ থেকে। এ দিকে নয়নতারা অপেক্ষায়। অন্য দিকে ময়না। চন্দন কি করে দাঁড়াবে ওর সামনে? বিমান বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল।
    চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, দেখা পেল না।
    বাড়ি ফিরে চারিদিকে তাকাতেই বুঝতে পারল কারোর হাতের ছোঁয়া। বিছানায় বেল ফুল ছড়ানো। ফুলের গন্ধে সারা ঘর ভরে গেছে। চন্দন খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, নয়নতারা ফুলসজ্জার খাট সাজিয়েছে। নিজের স্বামীর জন্য। তার আর খোঁজ পেল না। নয়নতারা এখন এক অনাথ আশ্রমের সেবিকা। আনন্দে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিল চন্দনের ভালোবাসাকে সংগী করে।

You cannot copy content of this page