অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- আনন্দধারা

    আনন্দধারা

    -অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

     

     

    প্রসব বেদনায় ছটপট করছে কমলা। ছোট ছেলেটা কাঁদছে । ভাত চায় ভাত। চালটা ফুটে উঠলেই হবে গরম ভাত । আর একটু ধৈর্য্য । নিজের যন্ত্রনাটুকু পেট চেপে ধরে আছে । বড়টা মাঠে । এখনো বাড়ি ফেরেনি । পোয়াতি গাভীটা ও কমলার করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে। রোদে শুয়ে এখন । সব ভাবনা কমলার ।
    কি করবে কমলা? আর যে সইতে পারছে না । বড় ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে হবে । খুঁজেই পাচ্ছে না । আরও একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে । ততক্ষনে খবর পেয়েছে পাড়ার দাইমা । হ্যালা,মাগী এবারেরটাকেও খাবি নাকি ? কি ভেবেছিস শুনি? চল্ আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ।
    -কি করব জ্যাঠি মা। সব একটু গুছিয়ে নিয়ে একাই চলে যাব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে । ঠিক সইতে পারব গো ।
    -খুব হয়েছে, কত করে বারণ করলাম, এবার ওষুধ খা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে শরীরটা ভালো করে দেখা । শুনলি না? মেয়ে নেবার বড্ড সখ তাই না?
    -না গো দাইমা, ওর বাপের মেয়ে নেওয়ার বড্ড সখ। দুটো ছেলে। এবার নিশ্চয় মেয়ে হবে। একটু কষ্ট হচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তাই না দাইমা?
    দাইমা, মুখ বাঁকিয়ে বললো, অভাবের সংসার তবু সখ ষোলোয়ানা ।
    কমলা হাসতে হাসতে বলল, বরকে বড্ড ভালোবাসি গো। আবদার করে মেয়ে চেয়েছে । আর আমি দেব না ?
    -আর যদি না হয়, কি করবি?
    -কত মান্যত করেছি গো দিদি । উপোষ ব্রত সব । ঠাকুর এবার ঠিক সহায় হবে গো।

    কমলা এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেডে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে অপেক্ষায় । একটা কান্নার রোল শোনার জন্য । দুই ছেলে কেঁদেই চলেছে মায়ের জন্য। গোধূলি লগ্নে শঙ্খ ধ্বনি বেজে উঠল । ঠিক তখনই শোনা গেল কান্নার আওয়াজ । আনন্দে আত্মহারা কমলার স্বামী।
    দাইমার কোলে কমলার মেয়ে । কিন্তু কমলা ? দাইমা চোখ মুছতে মুছতে মেয়েকে দেখিয়ে বলল, এই নে তোর লক্ষ্মী। লক্ষ্মী হারিয়ে লক্ষ্মী পেলি। খুশি তো?

    বরের চোখে আনন্দধারা ।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- আশির্বাদ

    আশির্বাদ
    অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

    হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। পাড়ার বৃদ্ধ বিষ্টু মাষ্টার। বাজারের ব্যাগটা শক্ত করে ধরলেন। তবু বয়স হয়েছে তো,মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। লাঠিটা ঠিকরে পড়ল দূরে। চশমার ফ্রেমটা গেল খুলে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিস। কত লোক। স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা পাশ দিয়েই ফিরছিল। কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। অদেখার ভান করে এগিয়ে গেল। স্যার, একবার ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু কি যেন ভেবে থেমে গেল।
    অন্যান্য যে যার কাজে ব্যস্ত।ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করলেন। কেউ একজন বাড়িয়ে দিল হাতটা। শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন স্যার। বৃদ্ধ স্যার একবার তাকাল ছেলেটার দিকে। চোখে চশমা নেই। বয়সের আড়ালে ঢাকা দৃষ্টি। ছেলেটা স্যারকে যত্ন করে তুলে ধরল। বাজার সামগ্রী ব্যাগে ভরে দিল। মাষ্টার মশাই বললেন, কে বাছা? ঠিক চিনতে পারছি না তো।
    সেই রকমই দুষ্টু হেসে বলল, স্যার আমায় চিনলে না? আমি আপনার ক্লাসের সেই বদমাশটা, বাদল। যার জ্বালাতনে সারা ক্লাস অতিষ্ঠ হয়ে যেত। যার জন্য আপনার কাছে কত বকুনি খেয়েছি। তা কি ভুলতে পারি?
    আমি সেই লাষ্ট বেঞ্চের লাষ্টবয় বাদল।
    মাষ্টার মশাই মনে করার চেষ্টা করলেন, মাথা মোটা একটা দুষ্টু ছেলে। সবার অপ্রিয় ছিল স্কুলে। বন্ধুদের সাথে মারামারি, গন্ডগোল এসব করতে ওস্তাদ।
    তাই যেদিন স্কুল থেকে বিদায় নিল বাদল, সব স্যারেরা একটু স্বস্তি পেয়েছিল।
    শুধু এই বিষ্টু স্যার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, বাদল এবার একটু মানুষ হও।
    বাদল মুচকি হেসে বলেছিল, আপনারা শান্তি পেলেন স্যার। আর জ্বালাতে আসব না।
    মাষ্টার মশায়ের আজ সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
    বাদল, শক্ত করে হাতটা ধরে স্যারের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল।
    স্যারও বাদলের হাতটা ধরে বলল, আবার এসো বাদল।
    বাদল মুচকি হেসে বলল, না স্যার,কথা দিয়েছিলাম আর জ্বালাতে আসব না। আজ বাধ্য হয়েই…তবে আপনি ডাকলে না বলতে পারব না স্যার।
    আপনার আশির্বাদ বিফলে গেছে সেকথা যাতে কেউ না বলে সেজন্য মানুষ হওয়ার একটু চেষ্টা করছি স্যার। আমি হতে পেরেছি কি স্যার?
    স্যার- চুপ হয়ে গেলেন। বাদল হাসতে হাসতে চলে গেল।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- উপহার

    উপহার
    অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

    ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ দু’হাতে দু’টো ঝোলা ব্যাগ নিয়ে শাড়ির দোকানে অপেক্ষায়। পকেটে হাত দিয়ে দেখেন সামান্য কিছু টাকা পড়ে আছে। কিছুতেই একটা শাড়ি কেনা যাবে না।
    মনোরমাকে প্রতি বছর এই দিনে একটা করে শাড়ি দেন। আজ হাতটা একেবারে খালি।
    দোকানদার বৃদ্ধের হাতে একটা শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল- গত দশ বছর ধরে আপনাকে দেখছি, এই দিনে শাড়ি কিনতে। শাড়িটি নিয়ে যান। সময় মতো শোধ দিয়ে দেবেন।
    কিন্তু উনি বাকিতে কিছুতেই নেবেন না। যদি না শোধ দিতে পারেন। তাই।
    নিজে হাতে যখন সংসার চালাতেন, হিসাব করেই সব কিছু সামলে নিতেন। এখন পুরো সংসারটা ছেলে বৌমার।
    তাছাড়া বয়স হয়েছে আর নিজের কাছে কিছুই থাকে না।
    টাকা চাইতে গেলেই অনেক অজুহাত আর একগুচ্ছ প্রশ্ন। কী হবে এই বয়সে টাকা? যা খেতে চাইবেন বলুন এনে দেব।
    বাজার করা, রেশন তোলা সব কাজ বৃদ্ধকে করতে হয়। ছেলে থাকে বিদেশে। তাই প্রথমে ভালোবেসে নিজেই বলেছিলেন, সব কাজ করব। কিন্তু এখন আর পেরে উঠছেন না। তবু না বলার উপায় নেই।

    বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলের বউ। বাজার নিয়ে বৃদ্ধকে ঢুকতে দেখে বৌমা গর্জে উঠলো। সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি, বাজার আনলে তবে ভাত চাপাবো। আর আপনি বাজারে আড্ডা দিচ্ছেন। এত দেরী হলো কেন শুনি?
    বৃদ্ধ সবে কিছু বলতে যাবে, সামনে এসে মুখে হাত চাপা দিল বৃদ্ধের স্ত্রী মনোরমা।
    অনেক বেলা হলো, এসো বাড়ির ভেতর এসো। এখনো টিফিন করোনি। পিত্তি পড়ে গেলে শরীর খারাপ করবে।
    বৌমা গজগজ করতে করতে বাজার নিয়ে চলে গেল।
    বৃদ্ধ মনোরমার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। আজ আর তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না গিন্নী। মনে আছে গিন্নী, আমাদের বড়খোকা আজকের দিনে নিজে হাতে… মনোরমা আর কিছু মনে রাখতে চায় না
    থামিয়ে দিল স্বামীকে। থাক না। এসব কথা আর শুনতে চাই না।
    মনোরমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, বুড়ি বয়সে এসে আর কিচ্ছু লাগবে না গো। এসো খাবে এসো।
    সন্ধ্যায় একজন ডেলিভারি বয় এসে একটা বাক্স দিয়ে গেল বৃদ্ধের হাতে।
    বাক্সটা খুলতেই দেখতে পেল বড়ো একটা কেক, মায়ের পছন্দের আলতা সিঁদূর আর লাল গরদের শাড়ি।
    একটা সুন্দর খামে লেখা আছে, “মা” আমি কিছু ভুলিনি এখনো। শুভ জন্মদিন
    মা। তোমার জন্মদিনের উপহার।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- অন্ধ তামস

    অন্ধ তামস
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হ‌ওয়ার সুবাদে অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলো সুনন্দ। প্রেস্, মিডিয়া, ফুলের তোড়া, মিষ্টির বাক্সের স্তূপ জমছে। আত্মীয়স্বজন, আবাসনের পরিচিত অপরিচিত‌ অনেক হাসি মুখ। কেউ বা চায় কাছে এসে হাত মেলাতে, আবার কেউ বা চায় পাশে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে আত্মীয়তা জাহির করতে। এই সব কিছুর মধ্যে, অসম্ভব জেনেও সুনন্দর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার অতি প্রিয় স্নেহময়ী এক বৃদ্ধাকে, এই আবাসনের‌ই পাঁচতলার বাসিন্দা, লোকে যাঁকে কোন‌ও অজানা কারণে, এই একা থাকা বৃদ্ধাটিকে স্রেফ কুসংস্কারের বশে, অপয়া বলে দাগিয়ে রেখেছে।
    তাঁকে এড়িয়ে চলতে সবাই সদা তৎপর। কোন‌ও আনন্দ আয়োজনে তাঁর ডাক পড়ে না, কোনও উৎসবে নেই তাঁর আমন্ত্রণ।শুভকাজে বের হবার সময় সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে পাছে লিফটে তাঁর মুখোমুখি হতে হয়!
    সুনন্দকেও তার মা সাবধান করে দিয়েছিলেন, স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো কোন‌ও রকম আলাপচারিতার বিরুদ্ধে, কিন্তু কে না জানে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানব চরিত্রের অমোঘ আকর্ষণের কথা! সুনন্দ‌ই বা তার ব্যতিক্রম হয় কী করে!
    সুনন্দর আজ আর মনেও পড়ে না, সেই কবে থেকে ওঁর সঙ্গে তার একটা অজানা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে, শিশু বয়সের কৌতূহলে আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি, মাঝে মধ্যে হাসি বিনিময়, তারপর সাহস করে তাঁর কাছে নিয়মিত আনাগোনা লুকিয়ে টুকটাক বাদাম তক্তি, টফি, চকোলেটের উপহার। এইসব‌ই কাছাকাছি এনে তাদের দুজনের মধ্যে অসমবয়সী বন্ধুত্বের একখানা সেতু গড়ে দিয়েছিল।
    সুনন্দ’র জন্য, প্রতিদিন উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকা স্বজনহীন বৃদ্ধাটির একক জীবনে সুনন্দ‌ই হলো একমাত্র প্রভাতকিরণ, আহ্লাদের আলো। এই লুকোচুরি খেলার গল্প, এখন‌ও পর্যন্ত, কেউ জানে না। তবে আজ সুনন্দ বড়ো হয়েছে। আজ‌ই সেই উপযুক্ত সময়, জনসমক্ষে সবকিছু জানানোর এবং একটা জোরালো প্রতিবাদের! হ্যাঁ আজ‌ই মিডিয়ার সামনে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়, কথা প্রসঙ্গে সুনন্দ অকম্পিত দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করবে, পয়া অপয়া বলে কিছু হয় না, প্রতিবারের মতো এবারেও ওঁকে প্রণাম করেই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল সুনন্দ এবং এজন্য তার পরীক্ষার ফলাফলের কোন‌ও রকম হেরফের আগেও হয়নি এবারেও নয়। আসলে হবার কথাও তো নয়, যে কোনও যুক্তিবাদী মন‌ই সেকথা স্বীকার করবে। ন‌ইলে শিক্ষার কী উদ্দেশ্য? কেবলই কি গোটাকতক সার্টিফিকেটের কাগজ সংগ্রহ করা!
    এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের কাছে, এই অন্ধ তমিস্রা কাটিয়ে, নতুন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠার। পারবে না সুনন্দ অন্তত একটি মনকেও যুক্তির আলোয় আলোকিত করতে?

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্ন গড়ে

    স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্ন গড়ে
    -নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

     

     

    ওরা এসে দাঁড়াল একফালি নাবাল জমিতে। মজা নদী ছিরামতীর কোল ঘেঁষে। নদীখাতে এখন আর জল বয়ে যায় না। যে যে পেরেছে যতটা পেরেছে দখল করে কেউ ধান, কেউ পাট লাগিয়েছে। ওদের কেনা ভূমিখণ্ড অবশ্য দখলের মালিন্যমুক্ত।ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ রায়তি জমি।
    নিভে যাওয়া স্বপ্নের প্রদীপে নতুন করে অগ্নি সংযোগ করে ওরা এলো। এলো আলোছায়ার মিতালির মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে।একে অপরের কোমরে হাত রেখে। এলো ঝর্ণার উদ্দামতায় আলপথের দু’পাশের ঝোপঝাড় লতাপাতা সবাইকে নন্দিত করতে করতে।
    ওদের একজন দিনু–অর্থাৎ দীননাথ দেবশর্মা, অন্যজন রিংকি দাস। এখন দাস পদবি খুইয়ে সেও দেবশর্মা। গৃহশিক্ষকতা দু’জনেরই পেশা।
    স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মিলিত উপার্জনে, নিজেদের সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে কিংবা সেই সাধ-আহ্লাদের টানে, নগদ সাড়ে চার লক্ষ টাকায় কেনা এই তিন শতক জমি বর্তমানে ওদের স্বর্গের সিঁড়ি হয়ে ছিরামতীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান করছে। আর হাজার দশেক টাকা জোগাড় করে এক হাফ নেতার হাতে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। মিলে যাবে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গৃহনির্মাণের টাকা। তৈরি হবে ওদের স্বপ্ননীড়।
    হ্যাঁ, স্বপ্ননীড়ই ওরা নাম দেবে বাড়িটার।ওরা ভুলে যাবে একাধিক স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা।
    দিনুকে ঘিরে প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল তার বাবা হরিচরণ।সেবারই দিনু দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। তাদেরই গ্রামের তিন তিনজন ছেলেমেয়ে তার কিছুদিন আগেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদে নিয়োগপত্র পায়। দোকান কর্মচারী হরিচরণ শুলুকসন্ধান করে জানতে পারে নেতাদের হাতে লাখ দশেক টাকা গুঁজে দিতে পারলে তার ছেলেও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকুরি পেতে পারে। আর চাকুরি মানে নিয়মিত মাস মাইনে। দিন এনে দিন খাওয়ার দিনের অবসান।
    বাজারের কাছাকাছি কাঠা তিনেক জমিতে বাড়ি ছিল হরিচরণের। বাড়ি বলতে মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া একটা টিনের চালা,তার বারান্দায় একটা খুপরি, খানিকটা তফাতে ছেঁড়াফারা পলিথিনের আচ্ছাদন দেয়া রান্নাঘর। জমিটা সাড়ে নয় লাখ টাকায় বিক্রি করে রেলের সরকারি জমিতে ঘর বেঁধেছিল সে। আর জমি বিক্রির টাকার সাথে স্ত্রীর কানের দুল বিক্রি করা টাকা যোগ করে দিয়ে এসেছিল এক এজেন্টের হাতে।তারপর অপেক্ষা আর দিন গোনা। অবশেষে ছেলেকে স্বপ্ন হস্তান্তর করে জগৎ সংসার থেকে হরিচরণের বিদায়। তার মাস দেড়েক পরেই বিদায় নেয় তার একান্ত অনুগামিনী স্ত্রী দিনুর মা-ও। একেবারে একা হয়ে যায় দিনু।সেই একাকীত্বের দিনগুলোতে দিনুর পাশে এসে দাঁড়ায় রিংকি।
    একক প্রচেষ্টায় কোনো স্বপ্নই পূরণ হবার নয় বুঝেই হয়তো ওরা জোট বেঁধেছিল। মিলিত চেষ্টায় মিলিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার তাগিদে। এককালে স্বপ্ন ছিল, ওদের মধ্যে যে কেউ একজন চাকুরি পেলেই ওরা বিয়ে করবে। এখন সে স্বপ্ন থিতিয়ে গেছে। এখন স্বপ্নে শুধু স্বপ্ননীড়।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সহযোগিতা

    সহযোগিতা
    -রাণা চ্যাটার্জী

     

    ঠেকে এসে একটু গল্প আড্ডা দিবি তা নয় গুম হয়ে কি এত ভাবছিস বলতো অয়ন! এত কিসের ভাবনা তোর?

    -না রে কিছু না বলে সিগারেটে টান দিতেই পুলক পাশ থেকে প্রশ্ন করে তুই কি ভাবছিস রে এতো, কাল তোর বাড়ি গিয়েও দেখছি কি সব কাগজ কলমে হিসেব আর ভেবেই চলছিস!

    পল্টু ফুট কেটে বললো, তবে চল সবাই মিলে আয়নক্স যাই, ফিল্ম দেখে পিৎজা খেয়ে ফিরবো। অয়ন না করিস না ভাই।

    -থাক না ওসব,পুজো আসছে হাতে টান আছে, এসব পরিকল্পনা না হয় অন্য একদিন হবে।
    -কি বলিস রে অয়ন তুই। দিল দরিয়া তোর কিনা অর্থের টান! আগে প্রায় দিন কম খাওয়াতিস তুই! এখন কি তবে প্রেমে ইনভেস্ট করছিস, এত চিন্তা মগ্ন!

    -না রে, পুজোর চার দিন কিছু ভিখারিকে ভিক্ষা করতে নিষেধ করেছি, ওদের নিয়ে আরো কিছু করার ইচ্ছা ছিল। ওদের সংখ্যাটা আর কিছু যদি বাড়াতে পারতাম খুশি হতাম কিন্তু আমি নিরুপায়।

    -কি ভাবনা তোর শুনি? ভিক্ষা করতে মানা করলে ওদের চলবে কি করে? পুজোর দিনগুলো ভিক্ষা করতে না দিয়ে তোর আমার কি লাভ মাথায় আসছে না। বলে মাথা চুলকে সুকান্ত থামতেই শান্ত গলায় অয়ন বললো, বলছি দাঁড়া বলে আর একটান দিয়ে সিগারেটের আগুনটা জুতোয় নিভিয়ে বসলো।

    তেমন বিরাট কিছু করিনি রে- পাড়ার একটা হোটেলে বলে দিয়েছি ওরা এলে যেন যত্ন করে খাওয়ায়, তাচ্ছিল্য না করে, খাবারের বিল মেটাবো আমি। দেখলাম চল্লিশ টাকা করে মিল হিসাবে পাঁচ জনের দুবেলার খাবারের দায়িত্ব নেবার আটশো টাকা হাত খরচায় জমেছে আমার।

    কি দারুণ ভাবনা রে বন্ধু! এত সুন্দর করে ভাবে কজন বল? তাহলে একটু একটু করে দায়িত্ব ভাগ করে নিলে এত অভাব অভিযোগ থাকে না রে।

    -হম রে ভীষণ মানসিক শান্তি। ওদের নির্ভেজাল হাসি আসলে আশীর্বাদ স্বরূপ।অল্প হলেও দায়িত্ব নিয়ে দেখ ভালো লাগবে। শুধু নিজে ঘুরবো-ঠাকুর দেখবো, পূজায় আনন্দ করবো, খাবো এসব না করে ওরাও কটা দিন একটু চিন্তা মুক্ত হয়ে ঠাকুর দেখুক।

    আমিও রাজি অয়ন। সামান্য টিউশানি করি তাই দুজনের দায়িত্ব নিতেই পারি। পল্টু বললো, আমিও নেব।

    -বাহ, এভাবেই আমার ভাবনা যদি ছড়িয়ে পড়ে, খুশিগুলো বাঁটোয়ারা করতে পারি তবেই আমার শপথের সার্থকতা। তোদেরও খুব ভালো হোক। কথা দিলাম বিবেক পরিশুদ্ধ হয়ে দারুণ কাটবে পূজা।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- বাবা, বেঁচে আছেন

    বাবা, বেঁচে আছেন
    -সুনির্মল বসু

     

     

    কথাটা প্রথম কোথায় কার কাছে শুনেছিলেন, আজ আর মনে করতে পারেন না, অথচ, কথাটা মনে ধরেছিল তাঁর, সেই থেকে লেখালেখির শুরু। কথাটা ছিল, প্রকাশ কি ঔর।
    মাটি কামড়ে পড়ে থেকে কবিতা লিখতো লোকটা। তাঁর ডায়েরি, খাতা ভরে যেত অজস্র লেখায়। আকাশের রঙ, নদীর ঢেউয়ের জল তরঙ্গ, অরণ্য পাখির গান, বন শিরীষের মর্মর ধ্বনি, সমুদ্রের দূরাগত ধ্বনি, লোকটার লেখায় উঠে আসতো। সংসারের প্রতি ক্ষেত্রে পরাজিত লোকটা পাতার পর পাতা অজস্র লিখে যেত। সবাই বলতো, লিখে কি হয়। কেউ কেউ বলতো, আপনার লেখায় বাস্তবতার ছোঁয়া নেই।
    একসময় লোকটার নিজের মনে হয়েছিল, সত্যি সত্যি লেখার জন্য তাঁর এই আত্মত্যাগের হয়তো কোনো মূল্য নেই। শুধু শুধু কালি কলমের অপব্যবহার। তবুও না লিখে উপায় ছিল না তাঁর, রক্তের মধ্যে সৃষ্টির নেশা জেগে থাকলে, বারবার লেখার টেবিলে ফিরে আসতে হয়, সেভাবেই প্রতিদিন সৃষ্টির নেশায় মগ্ন চৈতন্যে জেগে থেকেছেন তিনি।
    সংসারে অভাব ছিল, দারিদ্র প্রতিদিন সকালে দরোজায় এসে দাঁড়াতো, টালমাটাল সংসার, প্রতিদিনের জীবনধারণের গ্লানি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতো, এসব আপনার জন্য নয়।
    তাহলে লিখে লাভ কি, থেমে যাওয়াই ভালো।
    গগনদা বলেছিলেন, লিখে যা, কে কি বললো, তাকাস না, মহাকালের জন্য রেখে যা, কাল একদিন বিচার করবে।
    রাত জেগে তিনি লিখতেন, ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি লিখতেন। তাঁর মেয়ে লিপি তখন ছোট।
    সে প্রায়ই অনেকের মুখে শুনতে পেত, সংসারের প্রতিক্ষেত্রে তাঁর বাবার ব্যর্থতার কথা।
    আমাদের উনি তিনখান বাড়ি করেছেন, আপনি তো কিছুই করতে পারলেন না।
    বাবার এই ব্যর্থতা ছোটবেলায় লিপিকে কষ্ট দিত। বাবা আজ নেই। তাঁর কবিতার বইগুলো রয়েছে।

    লিপি এখন কলেজে পড়ে। আজ তাঁর বাবার জন্মদিন। আজ নানা জায়গায় তাঁর বাবার স্মরণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। লিপি আলমারি থেকে বাবার কবিতার বই বের করে পরম মমতায় কবিতা পড়ছে।
    চিরকাল শুনে এসেছে, বাবা একজন সংসারের ক্ষেত্রে ব্যর্থ মানুষ। আজ বড় হয়েছে লিপি। কে বলেছে, তাঁর বাবা পরাজিত মানুষ।
    কবিতার ছত্রে ছত্রে কত অনুভবের ঢেউ বয়ে গেছে, কী আশ্চর্য মায়া জগতের সন্ধান রয়ে গেছে এই সব কবিতায়। কম কথা বলা তাঁর বাবাটা কী এক আশ্চর্য মায়া জগতের সন্ধান পেয়েছিলেন সেদিন, কেউ তা জানতো না।
    লিপির চোখের জল ঝরে পড়ল বাবার কবিতা বইয়ের উপর। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছে, সারা জীবন তাঁর বাবা কিছু করতে পারেনি। আজ লিপি স্পষ্টতই অনুভব করতে পারছে, বাবা নেই বটে, অজস্র লেখার মধ্যে, অনুভূতির আলোড়নের মধ্যে
    তাঁর বাবা সেদিনের মতো আজও বড় বেশি করে বেঁচে আছেন।
    লিপি বাবার লেখার টেবিলের উপরে রাখা বাবার প্রতিকৃতির দিকে চাইলো।
    সেদিনের মতো বাবা যেন হেসে বললেন, মাগো, আমি কোথাও হারিয়ে যাই নি, হালকা উদাস হাওয়ার মতো আমি বারে বারে আসি, বারে বারে চলে যাই। আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- স্বাদ

    স্বাদ
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    -তুমি কি এবারেও যাচ্ছো?
    -হুম্ কাল ভোরে বেরোচ্ছি, তুমি আসবে নাকি ?
    -না বাবা, ওই গোটাকতক পিঠে, পায়েসের জন্যে অফিস কামাই করে, তোমার ওই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরের দেশে ছোটা আমার পোষায় না। আর তোমাকেও বাপু বলিহারি যাই! পিঠে খাবে তো এখানে বসেই খাও না, আজকাল তো এই শহরেই সব মেলে। পিঠের দোকান পিঠে পুলি উ‌ৎসব, এই শহরেই তো কতো আয়োজন। সেই সব তোমার নজরেও পড়ে না, না-কি!
    -তা ঠিক, সব‌ই নজরেও আসে, তবে কিনা ওখানকার পিঠের স্বাদ‌ই যে আলাদা।
    -পিঠে তো পিঠেই হয়, তার আবার এখান- ওখান কি?
    -উঁহু, উপকরণ এক হলেই কি স্বাদ এক হয়! ওখানকার নারকেলের পাকে মেশানো হয় ভালোবাসার গন্ধ, দুধের হাতায় থাকে মোলায়েম আদর। এখানে কোন দোকানে মিলবে সেসব?
    -তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি, সবেতেই কাব্য।
    -তেমন করে দেখতে গেলে জীবনটাই তো এক মহাকাব্য। আরে বাবা কাব্য কি আর আকাশ থেকে ঝরে পড়ে! ওটা যে মানুষের‌ই‌ শিকড়ের উপাখ্যান।
    পরদিন ভোরে সৌম্য তৈরি হয়ে বের হতে যাবে- পৌষালীও হাজির।
    -একী তুমি! তৈরী হয়ে এসেছো দেখছি, কোথায় চললে?
    -চলো তোমার সঙ্গে তোমার দেশে গিয়ে দেখেই আসি, কেমন করে পিঠে পায়েস তৈরী হয় সেখানে। পুলিপিঠের খামে কেমন করে ভালোবাসা ভরে দেন তোমার মা -ঠাম্মারা।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- প্রতিশ্রুতি

    প্রতিশ্রুতি
    -অনন্যা মুখার্জী

     

     

     

    বেলা দেবী সন্দীপকে বললেন, তুই বাবা আর মেয়ে পেলি না, শেষে একটা বিধবাকে আমায় পূত বধূ করে ঘরে তুলতে হবে? সন্দীপ বললো, কি বলছো মা? তুমিই তো বলতে, আজকাল এসব কিছু যায় আসে না, তোমার মহিলা সমিতির সভাতে কতবার তোমাকে মহিলাদের অগ্রগতির ওপর বক্তৃতা দিতে শুনেছি, আর তুমিই কি না আজ বলছো, আহির বিধবা বলে তাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না? সে কত বড় ডাক্তার, তাছাড়া সে আমায় ভালোবাসে, আমিও তাকে ভালোবাসি। সন্দীপের কাকুতি বেলা দেবী কর্ণ গোচর করলেন না। তিনি জানেন সন্দীপ মায়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার ছেলে নয়।
    এক বছরের মধ্যে বেলা দেবী সন্দীপের বিয়ে দিলেন। বৌমা স্কুলে পড়ান। পাড়া প্রতিবেশীদের প্রশংসা শুনে নিজের মনেই ভাবলেন, যাই হোক বাবা, দেখতে শুনতে আহিরের মত না হলেও, তার চলবে, এ মেয়ে তো আর বিধবা নয়।
    তিন বছর পর, বেলা দেবী রাজ্যের একটি নার্সিং হোমের বিছানায় শুয়ে ভাবেন, কি ভুল হলো তার এই জীবনে? তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর, একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূর কথায় তাকে একটি জরাজীর্ণ সরকারি হাসপাতালের বাইরে বসিয়ে দিয়ে গেলো? বেঁচে থেকে আর লাভ কি? চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই দেখতে পেলেন সামনে আহির। গলায় স্টেথোস্কোপ আর এক গোছা বেল ফুল হাতে সে বলে ওঠে, কি কাকিমা, তুমি না ভীষন বেল ফুল ভালোবাসতে? দেখো তোমার জন্য এনেছি। কই দেখি জিভটা দেখাও আমায়? ওকি কাঁদছো কেন? আজ থেকে তুমি আমার হাসপাতালে আমার কাছেই চিকিৎসাধীন থাকবে। সুস্থ হয়ে আবার সুন্দর করে বাঁচবে, তোমার মহিলা সমিতির কাজ এখনও অনেক বাকি। শাশুড়ি না হয় না হলে, আমার মা হয়েই থেকো।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সমর্পণ

    সমর্পণ
    -মানিক দাক্ষিত

     

     

    আমাকে নিয়ে সংসারে চরম অশান্তি। অশান্তির মূল কারণ ওর আর আমার সম্পর্ককে ঘিরে। মনে হচ্ছে সম্পর্কটাকে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। ইতি টানতে হবে। কিন্তু কিভাবে ইতি টানবো? ওর সাথে সম্পর্ক যে আমার বহুদিনের। ওকে ছাড়া যে আমি বাঁচতে পারবো না। উঠতে বসতে বাবার ধমক – “সামনে জয়েন্ট পরীক্ষা। ভালো চাওতো ওর সঙ্গ ছাড়ো। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোও। লক্ষ্যে পৌঁছাও।”

    অনেকবার চেষ্টা করেছি ওকে ছেড়ে একা থাকার। কিন্তু পারিনি। ওর দূর্নিবার আকর্ষণ আমাকে পাগল, মাতোয়ারা করে তোলে। আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের গভীর প্রত্যাশা। ওরা যা হতে পারেনি, আমাকে দিয়ে সেই ইচ্ছেটাকেই পূরণ করতে চায়। মস্ত বড় ডাক্তার। আর সেটা একমাত্র সম্ভব ওর সঙ্গ ত্যাগ করে কঠোরভাবে পড়াশুনোয় মনোনিবেশে।

    গতরাতে মায়ের সাথে বাবার তুমুল ঝগড়া বেধেছিল। আমাকে কেন্দ্র করেই। রাগের চোটে দেয়ালে কপাল ঠুকে মা রক্তারক্তি করেছে। রাতে জলটুকু স্পর্শ করেনি।

    সকালে উঠে অপরাধীর ন্যায় মায়ের কাছে মাথা নীচু করে দাঁড়াই। আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে মা। আমার ডানহাতটাকে নিয়ে নিজের মাথায় স্পর্শ করে বলে, “ওর সঙ্গ না ছাড়লে আমার মাথার দিব্যি তুই আমার…” মুখটা চেপে ধরি মায়ের।

    -ও-কথা মুখে এনো না মা। তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কথা দিলাম। আজ থেকেই ওর সঙ্গ ছাড়বো।

    জিনসের সামনের পকেট থেকে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী স্মার্ট ফোনটা তুলে দিলাম মায়ের হাতে।

You cannot copy content of this page