অণু গল্প
-
নিয়তি
নিয়তি
-বিভূতি ভূষন বিশ্বাসছোট্ট শহর, অলিগলি রাস্তা, মাঝে মধ্যে ফ্ল্যাট বাড়ি গজিয়ে উঠেছে দু’ একটা। নতুন নতুন কয়েকটা ফ্ল্যাট আশেপাশে তৈরি হচ্ছে। ভরসা নামক পাঁচতলা ফ্ল্যাটের নিচে স্কুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কখন মেয়ের প্রাইভেট পড়া শেষ হবে, ওকে নিয়ে ঘরে ফিরবো। ওর আসার দেরী দেখে স্কুটির উপরে বসে ফেসবুক ঘাটছি। হঠাৎ এক বৃদ্ধ বয়স ষাট সত্তর হবে, একটি ব্যাগ উপুড় করে বড় ড্রেনে কি যেন ফেলে দিয়ে দ্রুত ওখান থেকে চলে গেলেন। আমি ছাড়া ওখানে আর কেউ নেই, আমি মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে আড় চোখে দেখে নিলাম। বৃদ্ধ লোকটি চলে যেতেই আমি ড্রেনের কাছে গিয়ে দেখি একটি বিড়াল ড্রেনে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তড়িঘড়ি বিড়ালটিকে টেনে তুললাম কিন্তু বিড়ালটিকে দেখে মনে হলো ও অসুস্থ ও খুবই রোগা। ইতিমধ্যে মেয়ের পড়া শেষ ওকে নিয়ে রওনা দিয়েছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি বিড়ালটি আমাদের পিছনে পিছনে আসতে আসতে টলে পড়ে যাচ্ছে।
মেয়ে সব কথা শুনে বলল —– ওকে বাড়ি নিয়ে চলো বাপী ।
অগত্যা ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম। কিন্তু ও কিছু্ই খাচ্ছে না আর নাক দিয়ে রক্ত মতো কি সব পড়ছে। অনেক খুঁজে খুঁজে প্রাণী ডাক্তারের খোঁজ পেলাম। ডাক্তার বাবু বললেন এর ঠান্ডা লেগে এরকম হয়েছে। পর পর দু’দিন দু’টি করে ইনজেকশন দিলেন। ড্রফারে করে দুধ মুখে দিয়ে খাওয়াচ্ছিলাম এই ক’দিন, ডাক্তারের কথা মতো। কিন্তু ওর স্বাস্থ্যের কোনোও উন্নতি না হওয়াতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। পরের দিন আমি চেয়ারে বসে আছি ও এক লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে বসলো কিছুক্ষণ পরে দু’টো ঢেসকি দিয়ে চির বিদায় নিলো । আমার ঘরের পাসে ওকে কবর দিয়ে বললাম, তুমি চলে যাও বিড়াল জন্ম নিও না, মানব জন্ম নিয়ে আবার ফিরে এসো । -
বিশ্বাস
বিশ্বাস
-মানিক দাক্ষিতসন্ধ্যাবেলায় রতনের টি.ভি. সারাইয়ের দোকানে বসে গল্প করছি। হঠাত্ রায়বাবু রিক্সাতে কোলে একটা মাঝারি সাইজের কালার টিভি নিয়ে এসে হাজির। গলায় উদ্বিগ্ন আর দুশ্চিন্তার ছাপ।
“বাবা রতন, দেখোতো টিভিটা। চলতে চলতে হঠাত্ বন্ধ হয়ে গেল।”
রতনের ব্যবহার অমায়িক–যাকে বলে চমত্কার।চোখের নিমেষে গণশার চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা আনিয়ে রায়বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনি চা-টা খান, আমি দেখে নিচ্ছি। টিভিটা খুলে চোখ ছানা-বড়া করে রতন রায়বাবুর দিকে তাকাতেই রায়বাবু গভীর উত্কণ্ঠায় জিগ্যেস করেন, ‘কি হল রতন ?”
—“টিভিটার তো একেবারে দফা রফা হয়ে গেছে। অনেকগুলি পার্টস পুড়ে গেছে। অনেক টাকার ধাক্কা।”আমতা আমতা করে রায়বাবু টাকার অঙ্কটা জানতে চাইলে রতন চোখ বন্ধ করে হিসেব কষে বলে,”ধরে রাখুন হাজার দেড়েক। —তার বেশীও হতে পারে।”
রায়বাবু রতনের হাতদুটো চেপে ধরে করুণ মিনতি করে বলে, “আর বেশীটা করো না। ঐ দেড়হাজারের মধ্যেই রেখে দাও। বুঝতেই তো পারছো, পেন-
শানের ঐ টাকা থেকেই আমায় দিতে হবে। আমি ঘণ্টাখানেক পরে এসে টিভিটা নিয়ে যাব।”রতন লাফিয়ে ওঠে, বলেন কি –একঘণ্টা! আমার পাক্কা তিনটে দিন লেগে যাবে। আপনি তিনদিন পরে এসে নিয়ে যাবেন।”
রায়বাবু চলে গেলে রতন আমার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল মিশিয়ে বলে, “কি রে, কিছু বুঝলি?”
আমি ঘাড় নেড়ে না বলতেই রতন মুচকি হেসে বলে, “টিভিটার কিচ্ছু হয়নি। একটা ঝাল খুলে গেছে—কানেকশান পাচ্ছে না—দেখ!” –বলে নিমেষে ঝালটা লাগিয়ে সুইচটা অন করে টিভিটা চালিয়ে দিল।
আমি অবাক বিস্ময়ে রতনকে বললাম, “তা’লে রায়বাবুকে তুই যে বললি, অনেকগুলো পার্টস পুড়ে গেছে। দেড় হাজার টাকা লাগবে?”
রতন হো হো করে হেসে উঠল—“ওসব তুই বুঝবি না, এ-সব ব্যবসায়িক চাল।’
মনটা ভারী হয়ে গেল। ব্যবসায়িক চাল! লোক ঠকিয়ে কায়দা করে টাকা আদায় করা একরকম চিট! সোজা কথায় চিটিংবাজী।
বিষণ্ন মনে রতনকে বলি, “ভদ্রলোককে না ঘুরিয়ে টিভিটা তো দিয়ে দিতে পারতিস ?”
এবার রতন রীতিমত রেগে গিয়ে ভর্ৎসনার সুরে আমাকে বলে, “বেটা, তুই শুধু বোকা নস, মস্ত বড় একটা গাধা। এইজন্যে লেখাপড়া শিখেও জীবনে কিছুই করতে পারলি না! আবে ঢেঁড়স, টিভিটা যদি এক্ষুণি দিয়ে দিতাম, তাহলে টাকাটা ট্যাঁক থেকে বার করতে গায়ে লাগতো। আমায় চোর ভাবতো। বিশ্বাসটাই চলে যেত। তিন দিন পরে দিলে কি ভাববে জানিস ? ভাববে, টিভিটার পিছনে অনেক সময় দিয়েছি.……অনেক খেটেছি।”
মাথাটা ঝিনঝিন করে উঠল। বোকা আমিটা গাধার মত আস্তে আস্তে পা ফেলে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম।
-
আলাপ-আনন্দ
আলাপ-আনন্দ
-অমিত কুমার জানাকিছুক্ষণের মধ্যেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় মঞ্চে উঠবেন। আজ ‘কল্পসাহিত্য’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান উক্ত সাহিত্যিকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সকাল থেকেই অজয়ের মন ঐ সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপের জন্য অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষমান। কল্পসাহিত্য পত্রিকায় অষ্টাদশ বর্ষীয় অজয়ের লেখা একটি গল্প স্থান পেয়েছে এবং সেই সুবাদে সে আজ এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। অজয় সেই বাল্যকাল থেকেই ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের অনেক লেখা পড়েছে। আজ উনার সঙ্গে যদি একটু আলাপচারিতার সুযোগ পায় তাহলে সত্যিই তার মন অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক মঞ্চে পদার্পণ করলেন। সারা হলঘর হাততালিতে ভরে উঠল। মোবাইল ক্যামেরায় কত যে ছবি তোলা হল তার কোন হিসেব নেই। মুখোমুখি এহেন বিখ্যাত সাহিত্যিককে অজয় যেন খুশিতে ফেটে পড়লো। মঞ্চে ডেকে নেওয়া অনেক নতুন কবি, লেখকদের। বিশিষ্ট সাহিত্যিক তাদের হাতে তুলে দিলেন নিজের স্বাক্ষর করা শংসাপত্র। অজয়ের নামও ঘোষণা করা হলো। সে এই জগতে একেবারেই নতুন। ভয় মিশ্রিত উত্তেজনায় দুরদুর করে বুক কেঁপে উঠলো। সে ধীরগতিতে মঞ্চে আসীন হলো। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় তার হাতে তুলে দিলেন শংসাপত্র। অজয় তাঁকে বললো,-” আমি আপনার অনেক লেখা পড়েছি, আমি আপনার ভীষণ অনুগামী।”
প্রখ্যাত সাহিত্যিক অজয়কে সানন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অজয়ের অনুরোধে তার সাথে একটা সেলফিও তুললেন।
অনুষ্ঠানের শেষে বনভোজনের ব্যবস্থা ছিল। উক্ত সাহিত্যিক নিঃসংকোচে অজয়ের সাথে বসে পরম তৃপ্তিতে বনভোজন সারলেন। অজয়ের বহুদিনের দেখা স্বপ্ন আজ সত্যি হলো। তার চেয়েও যে ব্যাপারটা অজয়কে অভিভূত করলো তা হলো ঐ বিশিষ্ট সাহিত্যিকের নির্ভেজাল অমায়িক ব্যবহার। উনার সঙ্গে অন্তরের আলাপে সত্যিই অজয়ের মন অপার খুশিতে ভরে গেল। -
সুখের সংসার
সুখের সংসার
-রেহানা দেবনাথসাইরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! তার জন্মদাত্রী মা আজ তাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলছে! এই মায়ের ভরসায় এক বছর আগে দুই সন্তানের হাত ধরে পাঁচ বছরের সংসার স্বামীর ঘর ত্যাগ করেছিল। ফুলশয্যার দিন থেকেই ওমরের যৌন অত্যাচারের শিকার হয় সাইরা। সবাই বলেছিল তাকে ফুলশয্যায় রাত মেয়েদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকে! তারও স্মরণীয় হয়ে আছে বিভীষিকার রাত হিসেবে। সাইরা মনে মনে কত ভালোবাসার ছবি এঁকেছিল নতুন স্বামীকে নিয়ে কিন্তু ওমর ঘরে ঢুকেই নতুন বউয়ের সঙ্গে যে পৈশাচিক পদ্ধতিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, তাতে সাইরার সব ভালোবাসা স্বপ্নগুলো দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল!
তারপর থেকে প্রতিনিয়িত দিনে রাতে চলত ওমরের যৌন খিদে মেটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি তাতে সাইরার কোনো অজুহাত, আপত্তি চলত না!বাধা দিলে কপালে জুটত অকথ্য গালাগালি আর মারধোর।
ওমরের ওই একটা জিনিস ছাড়া আর সব কিছু ভালো ছিল। খেতে পরতে দেওয়া, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, সবার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার!
তাই সাইরা প্রথমদিকে লজ্জাবশত না বললেও পরে যখন দুই বৌদিদের কথাগুলো বললে তারা হেসে কথা গুলো উড়িয়ে দেয়। তারা বলেছিল সবদিক ভালো দেখলে তো আর চলে না জামাইতো সবদিক দিয়ে ভালো না হয় চাহিদাটা একটু বেশি তা মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মেছ যখন একটু সহ্য করে নিতে হবে।
তারপর থেকে আর কাউকে সে দুঃখের কথা বলে নি।
পাঁচ বছরের জীবনে দু’টি বাচ্ছার জন্ম দিয়েছে আর তিনবার গর্ভপাত হয়ে গেছে ওমরের যৌন খিদে মেটাতে গিয়ে। শরীরের গুপ্তাঙ্গে রোগে বাসা বেঁধেছে তবুও তার রেহাই নেই!
ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে এইভাবেই চলতে থাকলে খুব শিগগিরই সাইরার ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে তাতেও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ওমরের!
বাধ্য হয়ে সাইরা তার মাকে সমস্ত কিছু জানায় আর বাপের বাড়ি চলে আসে।মাস খানেক পর থেকেই দাদারা জোর করে স্বামীর কাছে ফিরে যাবার জন্য। আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীরা স্বামীছাড়া সুখের সংসার ভাঙা খারাপ মেয়ে বলে নিন্দে করে।
সাইরার দাদারা তার মাকে বলেছে ছেলেদের সুখের সংসারে থেকে যদি বাকিটা জীবন কাটাতে চাও তাহলে মেয়েকে ঘর থেকে বিদেয় করো !সেই কথা শুনে,
সাইরা কাঁদতে কাঁদতে দুই ছেলে মেয়ের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কোন পথ সে বেছে নেবে? একটি তার স্বামীর ঘর যাবার পথ যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে নারীদেহ খাদক অন্য আরেকটি অজানা পথ সেখানে ভালো মন্দ কি অপেক্ষা করে আছে সে জানে না… -
“বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো”
“বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো”
-তন্ময় সিংহ রায়এ গ্রহের উদ্ভিদ বড়োজোর আর ক’টা দিন তাকে অক্সিজেন দেবে! বিভিন্ন প্রসাধনীতে যে ত্বক একদিন ধরে রাখতো তার লাবণ্য, বেশ কয়েক বছর হোলো শেষ নিঃশ্বাসটাও ত্যাগ করেছে সেটা! অসংখ্য ভাঁজে সে হারিয়েছে তার স্বাভাবিক রুপ! শিরা ধমনীগুলো প্রতি মুহুর্তে উপেক্ষা করে তাকে(ত্বক)। যে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে ছিলো পরম মমতার কোমল স্পর্শ, সে ঝাপসা দৃষ্টি আজ চরম অনাদরে ও অবহেলায় ভাসে নোনাজলে!
আজ প্রায় বছর দেড়েক হোলো, প্রতিদিন বিকেল চারটে বাজলেই বুড়িটা জানালাটার লোহার রডগুলোকে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে ওই মাঠটার দিকে! কৌতুহলদীপ্ত জনা-তিনেক বৃদ্ধা মনের জানার প্রবল ইচ্ছাকে দমন করতে না পেরে অবশেষে একদিন বুড়িটা বলে বসে, তার একমাত্র আদরের সোনার টুকরো জীবন, তার ছোট্ট ছেলেটা নাকি ভীষণ চঞ্চল! কোথায় খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বিষম চোট পায়, রক্ত বেরোয় কেটে গিয়ে, কি করে বসে!… তাই প্রতিদিন খেলার সময়ে তিনি তাকে অস্পষ্ট নিষ্পলক দৃষ্টিতেও দুর্বল রেটিনায় বসিয়ে নাকি নজরবন্দী করে রাখেন।…….পরম মমতার এরূপ মর্মান্তিক প্রতিফলনে বিষ্ময়ে হতবাক চশমাবৃত ছ’টা দুর্বল চোখের অশ্রুগ্রন্থি নিঃসৃত করেছিলো কিছু সুপরিচিত বেদনাশ্রু!….বোঝানোর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম সত্বেও সে বুড়ি বোঝেনি যে তাঁর সোনার টুকরো ছেলে আজ প্রাপ্তবয়স্ক, এ পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন সে বোঝে, একটা বউ এনেছে ঘরে…. আর বউয়ের অপছন্দটা ছেলের কাছে আজ তাঁর (বুড়ির) চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।……মূল্যটাকে হীন করে অব্যবহৃত প্রাণহীন আসবাবপত্রের মতন তাঁকে(বুড়িকে ফেলে রেখে গেছে এই ঘরেই…. তাঁদের (অন্যান্য বৃদ্ধাদের) সাথে। তার শেষ জীবনের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া-পাওয়া, আশা, স্বপ্ন, ভরসা সবই তাচ্ছিল্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এই আবদ্ধ ইঁটের খাঁচায়। বুড়িটা বোঝেনি যে, আজ আর তার সোনার টুকরো ছেলেটা রাতে দুধের জন্যে ডুকরে কেঁদে ওঠেনা, তাকে আজ আর পরাতে হয়না যত্ন করে কাজল টিপ!… ছোট্ট আঙুলটা ধরে অতি যত্নে গুটি গুটি পায়ে সে আর মায়ের সাথে হাঁটেনা…..স্কুল থেকে এসেই ঝপাস করে ব্যাগটা ফেলে অভুক্ত মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আজ আর বলেনা….”মা খিদে পেয়েছে, ভাতটা মেখে খাইয়ে দাও”…… বুড়িটা বোঝেনি সে বোঝানো কথাগুলো।একদিন গহীন রাতে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে বুড়িটা চিৎকার করে বলে উঠলো “সোনা আমার, ওদিকে যাসনা বাবা… ওদিকে পুকুর আছে !”
…সেই জানালাটা তেমনি আছে, আছে দিগন্ত বিস্তৃত সেই খোলা মাঠটাও, কিন্তু শুষ্ক ত্বকের মমতা মাখানো দু’টো হাত বিকেল চারটে-তে আর কোনোদিনও ধরেনি লোহার রডগুলোকে সেদিন রাতের পর।।
-
শ্রীলেখার ভালোবাসা
শ্রীলেখার ভালোবাসা
– অঞ্জনা গোড়িয়াআজ শ্রীলেখার বিয়ে! সানাই বাজছে, আর একটু পরেই বিয়ের আসরে টুকটুকে শাড়ি পড়ে রাঙা হয়ে বসবে। নিশ্চয়ই লাল বেনারসী পড়বে, খুব সুন্দর দেখতে হবে আমার শ্রীলেখাকে। নীলয় একাকী বসে ভাবছে আর উদাসী হয়ে দেখছে নীল আকাশ। সারা দিন বাড়ি ফেরে নি। নীলয়ের মা খুঁজে খুঁজে পাগল।আমায় বললে, একবার দেখ্ না রে, ছেলেটা না খেয়ে একা কোথায় বসে আছে?
আমি ও চললাম খুঁজতে, হঠাৎ মনে হল, দেখি তো সেই জায়গায় যেখানে শ্রীলেখা আর আমার দাদা একসঙ্গে বসে কত সময় কাটিয়েছে, সেই কৃষ্ণচূড়ার তলায়। আমাকে একবার নিয়ে গিয়েছিল,বলেছিল, দেখ তো বোন, তোর বৌদিকে কেমন পছন্দ হয় কি না?
শ্রীলেখা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল, আমার তো ভারী পছন্দ, বললাম কবে আসছ বৌদি আমাদের বাড়ি? খুব মজা হবে তুমি এলে?
শ্রীলেখা বলেছিল, তোমার দাদা যেদিন নিয়ে যাবে সেদিনই আসব, সব কিছু ছেড়ে এক কাপড়ে।দিব্যি চলছিল দু’জনার ভালোবাসা ভালোলাগার দিনগুলি।
হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড়ের হাওয়ায় সব স্বপ্ন আশা ভালোবাসা তছনছ হয়ে গেল।
আমার নীলয়দার মা জানতে পেরেই দাদাকে কড়া আদেশ, ঐ ছোটজাতের মেয়ে যদি বাড়ি আনিস তো, আমার মরা মুখ দেখবি, হয় তুই থাকবি নয় তো আমিই চলে যাবো কোথাও। অনেক বুঝিয়ে ও রাজী করাতে পারল না। আসলে পুরানো একটা অশান্তি ছিল শ্রীরাধার বাবার সঙ্গে।
এদিকে শ্রীলেখার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল, হার্ট এ্যাটাক। কোনক্রমে সে যাত্রায় বেঁচে ফিরল বটে, মেয়েকে দিয়ে প্রতীজ্ঞা করিয়ে নিল, বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। শ্রীলেখা নীরবে ভালোবাসার বলি দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে। দু’জন আজ দু’প্রান্তে। দাদাকে বুঝিয়ে কোনমতে বাড়ি নিয়ে এলাম। তারপর কেমন যেন চুপচাপ, মুখে সেই হাসি নেই, দাড়ি গোঁফ কাটে না সময়ে।
এদিকে বিদায়কালে শ্রীলেখার চোখেও এক ফোঁটা জল নেই, থমথমে মুখে নিষ্ঠুর একটা দুরত্ব টেনে নিয়েছে সবার সঙ্গে। চলে গেল গাড়ি, সানাই স্তব্ধ।তারপর —
অষ্টমঙ্গলায় ফিরল শ্রীলেখা। হলুদতত্ত্বের মিষ্টি আর একটা লাল গোলাপ হাতে দিয়ে বলল, আমাকে, এটা তোমার দাদাকে দিও, আমার সুখের ঘরের সুখ মিষ্টি আর এই গোলাপটা ।
চোখদু’টি ছলছল করে উঠল, দাদাকে দেখাতেই আর চুপ থাকতে পারলনা দাদা। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, চিৎকার করে বলল, তুমি যখনই ফিরে আসবে আমার কাছে, আমি থাকব অপেক্ষা করে, তোমারই জন্য শুধু তোমারই জন্য। আমি ও বোকার মত শ্রীলেখাদিকে জানাতেই অট্টহাস্যে হেসে উঠল, আর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার দাদাটা এখনও বড্ড বোকা। পাগল একটা! -
অন্য ফুলশয্যা
অন্য ফুলশয্যা
-রাখী চক্রবর্তী“-রুপাকে আজ রুপকথার রানীর মতো সাজাব। রুপার গলায় রজনীগন্ধার মালা সবসময় আমি দেখতে চাই।” অফিসে বসে শুভময় সারাক্ষণ রুপার কথাই ভেবে চলেছে। ভাববে বাই না কেন। আজ যে ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী।
রুপার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে শুভময় নির্বাক হয়ে যায়। যত ভালোলাগা যতো ভালোবাসা সব রুপাকে ঘিরেই তো। রুপা ছাড়া আর যে কেউ নেই শুভময়ের।
অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে শুভময় বাড়ি এল।রুপাকে ঘণ্টার পর ঘন্টা সাজিয়ে যাচ্ছে শুভময়। খোঁপা করা, কাজল পড়ানো, পাউডার লাগানো এ সব তো আছেই। তার থেকে ও বেশি যেটা শুভময় রুপাকে প্রাণ ভরে দেখে যাচ্ছে। বেনারসি শাড়ি পড়ে রুপাকে যেন রুপকথার রানীর মতো লাগছে। এই রুপই তো দেখতে চেয়েছিল শুভময়। শুভময় রুপার নরম গালে আদর করতে করতে রুপার গলায় আলতো করে দু’টো হাত চেপে ধরল। রুপা এখন নির্বাক। শুধু চোখের ভাষায় বুঝাতে লাগল,”কি করছ!” শুভময়ের হাতের জোর বাড়তে লাগল আর বলতে থাকল,”রোজ দুপুরে কে পাঁচিল টপকে আসে? তুমি শুধু আমার।” এখন রুপা বুঝল কি হতে চলেছে। রুপার চোখ বেয়ে আসা জল শুভময়ের হাত দু’টোকে ভেজাতে পারল না।রুপার নিথর দেহ পড়ে আছে ফুলে ফুলে ঢাকা।শুভময়ের প্রাণ ছিল রুপা, কয়েক বছর পর জেল থেকে ফিরে শুভময় এক অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে।না খিদে না তৃষ্ণা আছে তার। ভালোবাসা, ভালোলাগা তাঁর জীবনকে স্পর্শ করেনা। রুপার ছবি দেখেই তার দিন রাত কেটে যায়। এইরকম এক দুপুর বেলায় ঝুপ করে একটা শব্দ শুনতে পেল শুভময়। বাইরে বেরিয়ে দেখে, একটা ছেলে পাঁচিল টপকে রুপার ঘরের দিকে আসছে। এই ছেলেটা, এই ছেলেটাকেই তো সে দেখেছিল।
—দিদি, দিদি কোথায় তুমি বলতে বলতে ছেলেটি রুপার ছবিতে ফুলের মালা দেখতে পেয়ে চমকে গেল।ছেলেটি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না আর শুভময় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
একি শুনছে শুভময়। অতনু রুপার পিসির ছেলে। রোজ দুপুরে খাবার খেতে আসত দিদির কাছে।নকশাল পার্টি করত সে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দিদির কাছে আসত। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরেই ছাড়ল।দিদির মৃত্যুর খবর সে জানল না।শুভময় ফুলশয্যার খাট সাজাচ্ছে। অনেক ফুল দিয়ে। নিজে পড়ল বিয়ের ধূতি। বিছানায় রাখা আছে রুপার ছবি। যে হাত দিয়ে রুপাকে সে শেষ করেছিল সেই হাত দিয়ে সে নিজেকে শেষ করল। ফুলশয্যার খাট সেদিন ও সাজানো ছিল।আজ ও সাজানো আছে, শুধু একটি ছবির ব্যাবধান।
-
যে যায় লঙ্কায়,সেই হয় রাবণ
যে যায় লঙ্কায়,সেই হয় রাবণ
-রেহানা দেবনাথরাজশ্রী কালো কাঁচ লাগানো গাড়ীতে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলেছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।তার গাড়ীর আগে পিছে পুলিশ সুরক্ষা বাহিনীর খান আটেক গাড়ী চলেছে।তার যাবার পথটি ফাঁকা !সে যে দেশের মন্ত্রী হয়েছে তাই সমস্ত দেশ ঘুরে জনগনের সুবিধা অসুবিধার কথা তাকে জানতে হবে, তাদের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে! শিল্পপতি ও বিত্তবানদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তাদের মন রাখতে।
রাজশ্রীর মনে পড়ে গেল যখন সে একজন সাধারণ মানুষ ছিল তখন ট্র্যাফিক জ্যাম করে কোনো মন্ত্রী গেলে তার উদ্দেশ্যে কত কটু কথা বলেছে নিজের অসুবিধার জন্য!পথ চলতি মানুষজনের, গাড়ি চালকের গালাগালি,উপদেশ নানা কথাও তার কানে ভেসে আসত।
আজও নিশ্চয় অনেক রাজশ্রী তার মতো ওই ভীড় থেকে একই কাজ করছে…কথাটা ভাবতেই রাজশ্রীর বিবেক তাকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে।মন্ত্রী হবার পরই সে চেষ্টা করেছিল সাধারণ মানুষের মত যাতায়াত করার কিন্তু বাধ সাধে অন্য মন্ত্রীরা।তারা এই সুযোগ সুবিধা ত্যাগ করতে পারবে না।
রাজশ্রী যে পলিটিশিয়ান তাই সে নিজেকে ওদের ছাঁচে গড়ে নেয়!না হলে মন্ত্রী থেকে সাধারণ নেত্রী তে ফিরে আসতে তার বেশী সময় লাগবে না!!তাতে না নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারবে না দশের!হঠাৎ গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল রাজশ্রী দেখতে পায় কিছু লোকজনকে পুলিশ লাঠিচার্জ করছে।কিছুক্ষণ পর সিকুরিটি অফিসার এসে জানায় পথ অবরোধের জন্য বিরোধীদলের চক্রান্তে লোকজন ঝামেলা করছে।আপনার নিরাপত্তার কারণে অন্য পথ দিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
চলন্ত গাড়ী থেকে রাজশ্রী দেখতে পেলো রাস্তায় ফেলে পুলিশ মারছে তাতে অনেকে চোট পাচ্ছে।রাজনৈতিক স্বার্থে এই ছোটো ছোটো সমস্যাগুলোকে দেখেও না দেখার ভান করার শিক্ষা দিয়েছে তার রাজনৈতিক গুরু, দলীয় সাথীরা ও নোংরা রাজনীতি তাই নিজের বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে নিজের লক্ষ্যের পথে চলে যায় রাজশ্রী। -
স্মোক লঙ
স্মোক লঙ
-কাজল দাস
সিগারেটটা ধরানো মাত্রই প্রতিদিনের মত আজও কানাই এসে হাজির। কি করে বোঝে আমার উপস্থিতি আমি জানি না। তাহলে কি ও কোনো গন্ধ পায়? এবার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে- “বাবা তারক নাথের চরনে সেবা লাগে, দেন বাবু, অন্ধ লোককে কিছু দেন।”
কিন্তু না, আজ- সে আমাকে এক অদ্ভুত কথা বলল- “বাবু সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি মন্দিরে দেবতা থাকে, প্রতিদিন তার পূজা হয়, কিন্তু দেখুন আমি কি অভাগা, তাকে দেখলামই না। আর আপনারা কত ভাগ্যবান।”- এই বলে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল- “আসি বাবু, ভগবান আপনার……”এই শহরে আমি চাকরির খোঁজে আসি, ঘরে মা আর অবিবাহিত ছোট বোন। একপ্রকার তারাই মুখ বুজে ভাতের যোগান দেয়। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে মায়ের তুলে দেওয়া রোজকার কুড়ি টাকায় আমার অকর্মন্য সময় ভালোই কাটে।
কানাই যেন প্রথম আজ আমাকে দেবতা দর্শন করিয়ে গেল। কিন্তু কি করে বোঝাই কানাইকে চোখ থাকলেও ভগবানকে সবাই দেখতে পায়না।
-
আমার মেয়ে….
আমার মেয়ে….
-বিশ্বদীপ মুখার্জীআমি নিজের মেয়ের হত্যা করিনি। আমি তো তাকে ভালবাসতাম। কাছে থাকলে কেউ ভালোবাসার মর্ম বোঝে না, বোঝে দূরে চলে গেলে। যত দিন সে আমার চোখের সামনে ছিল, চক্ষুশূল ছিল আমার। আমাদের মত লোকেদের বাড়িতে মেয়ে অভিশাপের দ্বিতীয় নাম। ভাগ্যের পরিহাস ভেবেই স্বীকার করেছিলাম মেয়েকে। আট বছর দাঁতে দাঁত চিপে তাকে মানুষ করেছি। কিন্তু আমার সদ্য জন্মানো ছেলে হয়ে গেল আমার নয়নের মণি। সেই অভিশপ্ত রাত আমার জীবনে নিয়ে এসেছিল এক রাশ অন্ধকার। মদ্যপ অবস্থায় নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলি, নিজের অপয়া মেয়ের ওপর করি সীমাহীন অত্যাচার। তাকে দূর করে দি আমি নিজের বাড়ি থেকে।
নেশা নামবার পর বুঝতে পেরেছিলাম নিজের ভুল। মনে পড়ল নিজের ছোট্টো মেয়ের ফুটফুটে চেহারা, তার নিস্পাপ মুখশ্রী। ঘৃণা হল নিজের ওপর, নিজের পুরুষত্বের ওপর। বহু খুঁজলাম নিজের মেয়েকে পেলাম না।
আমি রিক্সা চালাই। গরমের এক দুপুরে নিজের কুঁড়েতে খেতে এসেছিলাম। আমার নবজাত ছেলে অকারণ চিৎকার করছিল। আমার স্ত্রী আমার সাথে বার্তা বিনিময়ে পূর্নবিরাম লাগিয়েছিল। এক সংসারে থাকতে গেলে যতটুকু কথা না বললেই নয় সেটাই বলতো। হঠাৎ দরজার সামনে আমার এক সহজাত এসে দাঁড়ালো। আমায় বলল- ‘পাওয়া গেছে রে, তোর মেয়েকে পাওয়া গেছে।’
আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনেই উদগ্রীব হয়ে তাকালাম তার দিকে। আমাদের দৃষ্টিতে আনন্দ, উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার।
‘কোথায়?’ আমি খাবার ছেড়ে উঠে গেলাম।
‘দু’টি ভদ্রমহিলা নিয়ে এসেছে। তারা নাকি তোর মেয়েকে কোলকাতার এক রাস্তায় পেয়েছিল। তোর মেয়ে নিজের ঠিকানা বলতে পেরেছে।’ সে বলল।
আমার স্ত্রী ছুটে গেল রাস্তার পানে। পেছন-পেছন গেলাম আমি। রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়েছিল আমার মেয়ে। সাথে দুই ভদ্রমহিলা। আমার মেয়ে নিজের মাকে দেখে ছুটে আসছিল তার দিকে। কিন্তু নিয়তির লেখন পাল্টানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। সেই অভিশপ্ত রাতে নিজের মেয়েকে আমি বাড়ি থেকে বার করেছিলাম। আমার আত্মাভিমানী মেয়ে আর ফিরে এলো না নিজের বাপের বাড়ি। দ্রুতগামী ট্রাকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর রাস্তায় পড়েছিল আমায় মেয়ের নিথর নিস্প্রাণ দেহ। চিরবিদায় নিয়ে চলে গেল সে। আমি কন্যাদান করলাম তার মুখাগ্নি দিয়ে।সমাপ্ত ।