অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অন্য মা

    অন্য মা
    রিতম কর

    প্রাসাদপম হাওড়া স্টেশন থেকে কয়েকশো মিটারের দূরত্বে বস্তির মধ্যে ছোট্ট লখাই কে নিয়ে ছোট্ট জগৎ মিনতির।কেও জানেনা লখাই এর বাবার খবর,লখাই পেটে থাকার সময় রোজ রাতে ছাইপাশ গিলে এসে মারধোর করতো মিনতিকে।কিন্তু ছেলে বিয়োনোর পর হঠাৎ একদিন থেকে একদম হাফিস, কেও জানেনা লোকটার খবর।সেই থেকে দুঃখকেই বুকে তুলে নিয়েছে সে।আজ একটু বাড়তি ইনকাম হওয়ায় সামান্য মাংসের ঝোল ভাত দেখে ছ’বছরের লখাইএর মুখে যে নিষ্পাপ হাসি…ওহ,ওই হাসিটুকু দেখার জন্যই তো নিজের মতো করে সে খুঁজে নিয়েছে বাঁচার পথ।তাই সে দিনে লেবু বেচে আর রাতে খদ্দের এলে ফেরায় না।ইস্টিশন এর কয়েকজন কুলি মালবাহক তার বাঁধা।হোক পাপ…যখন খেতে না পেয়ে মরতে বসেছিলো তখন তো কোনো শালা খোঁজ নেয়নি।আর এসব এলাকায় কেও কারোর দিন গুজরানে নজর দেয় না।এতে নিজের ২৪বছরের শরীরটাও জুড়ালো আর পয়সাও হলো।দেহ এবং লেবু বেচেও যে ঝকঝকে টিন কেনা অসাধ্য,এক বাবুর দয়ায় সেটাও তো হয়েছে।লখাই এখন প্ল্যাটফর্মের ইস্কুলে যায়।কি এক এন.জি.ও না কি থেকে যেন ওদের ওখানে ফিরি তে পড়ায়,ওখানকার দিদিমনিরা বলে,লখাই এর মাথা ভালো,ওর কিছু একটা হবে।এই কিছু হওয়ার জন্যই তো এত কিছু ওর।এই পয়সাতেই তো সে লখাইকে পড়াতে পারছে,এক-দুটো জামাকাপড়।মাথায় লাগাবার একটু গন্ধ তেল,এক টুকরো সাবান….তাহলে তার দোষটা কিসের…সে খুব ভালো করেই বোঝে অন্যরা জীবন-যাপন করে আর তারা বেঁচে থাকে,আর সেই আবর্জনার স্তুপে বেঁচে থাকার মধ্যেও একমাত্র আলো তার ছোট্ট লখাই।

  • অণু গল্প

    আইস ক্রিম

    আইস ক্রিম
    – বিশ্বদীপ মুখার্জি

     

     

    স্টেশান- এর বাইরে বসে আছি। রৌদ্রের প্রচন্ড তাপে সমস্ত শরীর যেন ঝলসে যাচ্ছে। মন আর শরীর কোনোটাই ভাল নেই আজ। সকাল থেকে দুপুর হয় গেল, আয় তেমন কিছুই হলো না। মানুষের কৃপণতার বিষয় চিন্তা করে হাসিও পায় এবং কান্নাও পায়। তাঁদের আর দোষ দিয়ে লাভ কী? তাঁদের টাকা। কী ভাবে, কোথায় খরচ করবে, তাঁদের ব্যাপার। খারাপ তো আমার কপাল। নাতো ভাঙ্গা একটা বাটি হাতে নিয়ে বসে থাকতে হয়?
    যাই হোক। দেখলাম, একটা ট্যাক্সি থেকে তিন জন নামলো। স্বামী, স্ত্রী এবং একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে, জিনিস- পত্র নিয়ে তাঁরা আমার থেকে কিছু দূরে দাঁড়ালো। কিছু পাওয়ার আশায় আমি বাটি ঝাঁকালম।
    ‘গরীবকে কিছু দাও, বাবু।’
    স্বামী-স্ত্রী দু’ জনেই এমন ভাবে তাকালো যেন সাহায্য চেয়ে আমি বড় কোনো পাপ করে ফেলেছি। আমি বুঝে গেলাম, আশা করা বেকার। চুপচাপ বসে রইলাম। সামনে একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে ছোট্ট মেয়েটা আইসক্রিম খাওয়ার জেদ ধরলো। মা, বাবার কাছে প্রচুর অনুরোধ করেও লাভ হল না। আমার হাসি কিম্বা কান্না পায়নি। হলো রাগ। কৃপণতার শেষ সীমা তাহলে উলঙ্ঘন করলো তাঁরা? এমন কৃপণতা কোন কাজের, যেটা নিজের সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না? ছিঃ , এহেন মানুষের মুখ দেখলে হয়তো সারা দিনটাই খারাপ যাবে ।
    বাচ্চা মেয়ে টার কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখে মায়া হল আমার। উঠে গেলাম নিজের স্থান ত্যাগ করে। ভাঙ্গা বাটি থেকে দশ টাকার একটা নোট বার করে বাচ্চা মেয়েটার হাতে দিয়ে বললাম, ‘এতে যা হয় নিয়ে নাও মা। এর থেকে বেশি সামর্থ্য তো আমার নেই।’
    স্বামী-স্ত্রী দু’ জনেই হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হয়তো কন্ঠরোধ হয় গিয়েছিল তাঁদের। সারা দিনের মন খারাপটা চকিতে ভালোলাগাতে বদলে গেল। হৃদয়ে এক অদ্ভুত শান্তি পেলাম।
    আমি ভিখারী হতে পারি, কিন্তু কৃপণ নয়।

    সমাপ্ত ।

  • অণু গল্প

    প্রতিযোগিতা

    প্রতিযোগিতা
    -রেহানা দেবনাথ

     

     

    চলন্ত ট্রেনটা প্রতিদিনের মত দৌড়ে ধরতে গিয়ে পবন হাত ফসকে সজোরে প্লাটফর্মে পড়ে লাইনের দিকে গড়িয়ে পড়ে!তাকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে কিছুটা নিয়ে যাবার পর লোকজনের প্রচন্ড চিৎকারে ট্রেনটা গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে পবনের হৃদয়ের স্পন্দন ও ধীরে ধীরে কমতে থাকে! পবন শেষবারের মত চোখ বন্ধ করতে করতে শুনতে পায় মা বলছে “বাবু ট্রেন থামলে তবেই উঠবি, তাড়াহুড়ো করবি না”।

    বন্ধুরা বলছে –চল প্রতিযোগিতা করি! কে কত তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে চলন্ত ট্রেনে উঠতে পারি!!

    প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দৌড়ে বন্ধুদের চেয়ে আগে ট্রেন ধরাটা পবনের কাছে আনন্দ ওর নেশার মত লাগত! জেতার পর আনন্দ আর ধরতো না।
    ট্রেন যাত্রীদের অনুরোধ, বিদ্রুপ, কটাক্ষ, শাসন কোনোটাই তাদের প্রতিযোগিতাকে বন্ধ করতে পারে নি।

    স্কুল চ্যাম্পিয়ন কিশোর পবনের দৌড় প্রতিযোগিতা সাঙ্গ হয় চিরদিনের মত, সেদিন হেরে যাওয়ার জন্য!!

  • অণু গল্প

    পাহাড়ী ঝরণা

    পাহাড়ী ঝরণা
    -অণুশ্রী দাস

     

    কৃষ্ণদ্বাদশীর মেঘ খবর পাঠিয়েছিল পাহাড়ের বুকে দুঃখ জমেছে হাজার কিলো… পাইন, ফার, ওক্ নানা মাপের সিপাহী নজরদারীর ভাঁজে আজীবন বন্দি এক পাহাড়… গ্রীষ্মের দাবদাহে ঝলসে যাচ্ছে বসন্তের শেষ ছাপ টুকু… পাহাড় আবারও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে তার অভিশপ্ত জীবনে বেঁচে থাকার শেষ প্রাণটুকুও…

    অনেক যুগ আগেকার কথা,
    হেসে খেলে বয়ে চলা উচ্ছ্বসিত ঝরনার সাথে পাহাড়ের আলাপ হয়েছিল যৌবনের প্রথম প্রহরে… রুক্ষ পাহাড়ের বুকে এক দুটো ফুল ফোটানোর অজুহাতে কখন না জানি বসন্তকে এনে ঝরণা পাহাড়কে সাজিয়ে ছিল হলুদ সবুজের রংবাহারে, রাত্রিবেলা সবার চোখ এড়িয়ে বসুন্ধরার রাজকুমারী ঝরণা পাহাড়ী অভিসারে বেড়তো… সর্বহারা রিক্ত গগন চুম্বী পাহাড়ারের বুকে ঝরনা পেয়েছিল আমিত্বের আস্বাদ, তার কলকল্লোলে সুরে সমৃদ্ধ পাহাড়ের বেসামাল ভালোবাসায় তারা হয়ে উঠেছিল একে অপরের পরিপূরক…. দিন থেকে রাত, ষড়ঋতুর আবর্তনে, পাহাড়ী ঝরণার নিখাদ প্রেমের সুরে চতুর্দিক যখন উদ্ভাসিত তখন রাজকন্যার প্রেমের দুর্নামে বসুন্ধরার ক্রোধের সামনে এই সোহাগী সম্পর্ক এক লহমায় বিনাশ হল… রুক্ষ পাহাড় বন্দি হল হাজার সিপাহীর মাঝে আর ঝরণা সেও নিজেকে মিশিয়ে দিল ধরিত্রীর গহ্বরে… এখন পাহাড়ের বুক চিরে তির তির করে বয়ে চলে একফালি জলের ধারা… ঐ মিষ্টি জলের রসদে প্রতি বসন্তে ঠিক আগের মতো ফুল ফোটে পাখি আসে…. মনে হয় অভিশপ্ত পাহাড়ের মনে আবার ঝরণা শুরু করেছে মিষ্টি প্রেমের মান অভিমানের অধ্যায়… পাহাড়ও দুহাতে জড়িয়ে ধরতে চায় ঝরণাকে… কত জীবনের শুষ্ক কন্ঠ একবার ভিজিয়ে নিতে চায় প্রেমের পরশে… কিন্তু ঐ তির তির বয়ে চলা জলধারা, যার পায়ে রিণিঝিনি সুরের নুপূর বাঁধা, ওটা কোনো সাধারণ জলের ধারা নাকি সেই পাহাড় আর হারিয়ে যাওয়া ঝরণার সোহাগের শেষ চিহ্ন তা জানি না..

  • অণু গল্প

    “উপহার”

    উপহার
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    দিভাই তাড়াতাড়ি এসো। সবাই ফোঁটা নিয়ে নিল।আমার তো এখনও হলো না। মেসেজটা দিভাই-এর ফোনে দিয়েই অনি ঠাকুর ঘরে পাতা আসনে বসে পড়লো। অনির আর তর সইছে না কখন দিভাই-এর গিফটটা নিয়ে বন্ধুদের দেখাবে। অনি ক্লাস নাইনে পড়ে তবুও ছেলেমানুষির শেষ নেই। অনির একমাত্র দিভাই বিন্দু খুব বড়ো ঘরের বৌ। তার ওপর বিয়ের পর এই প্রথম ভাই ফোঁটা। কাজেই একটু উদ্দীপনা তো অনির থাকবেই।
    –ও মা দিভাই তো ফোনও করছে না। কখন মেসেজ দিলাম। ফোন করছি তুলছে না।

    অনির মা বলল,একটু ধৈর্য ধরে থাকো দিভাই এক্ষুনি চলে আসবে।
    -এই আমি বসেই রইলাম ভাই ফোঁটার আসনে। ফোঁটা নিয়ে তবেই উঠব ।
    মা হেসে বলল, “এই ভালো। আমি রান্না ঘরের কাজ সেরে নিই এই ফাঁকে। বিন্দু এসে গেলে তো হৈহৈ শুরু হয়ে যাবে।
    ঘড়িতে সকাল দশটা বাজে। অনি বাবু হয়ে বসে আছে ঠাকুর ঘরের মেঝেতে পাতা আসনে। সামনে থালাতে প্রদীপ, ধান, দুববো দেশলাই,ঘি দই। সব অনির মা সাজিয়ে রেখেছে। বিন্দু এসে শুধু মিষ্টির প্লেটটা সাজাবে।
    অনি চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে দিভাাই-এর প্রতীক্ষাতে ।
    ভাইয়া,,, ভাইয়া
    দিভাই কখন এলি
    -এই তো এখনি এলাম।
    মা মা দিভাই এসেছে ।
    -এই চুপ কর ভাইয়া। মাকে ডাকিস না। ফোঁটাটা আগে নিয়ে নে। মাকে সারপ্রাইজ দেবো।
    -ঠিক আছে দিভাই  “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, , ,,যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা “অনি দি ভাইকে প্রণাম করে তার আশীর্বাদ নিল। বিন্দু একটা হাতের রিং ভাইয়াকে দিয়ে বলল, “এইটা কোনদিন কাউকে দিবি না।আমরা আশীর্বাদ সবসময় তোর কাছে থাকবে ।খুব ভালো থাকিস ভাইয়া

    – “দিভাই কোথায় গেলি। এইমাত্র ঘরেতে তো ছিলিস। মা মা করে চিৎকার করে ডাকছে অনি। মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বলছে কি রে এত ডাকছিস কেন?কপালে ফোঁটা কে দিল?
    অনি কেঁদে কেঁদে বলছে দিভাই ফোঁটা দিয়েই চলে গেল।
    -দুর পাগল ছেলে তোর দিভাই এখনো আসেনি বুঝলি।এর মধ্যে অনির বাবা চিৎকার করে বলছে ওরা মেরে ফেলল আমাদের বিন্দুকে। পাড়ার সব লোকজন অনিদের বাড়িতে। পুলিশ ফোন করেছিল অনিদের বাড়িতে। কাল রাতে বিন্দুকে তার স্বামী আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। বিন্দু তার বাবার কাছ থেকে কোনও টাকা পয়সা চাইতে পারবে না এই ছিল তার অপরাধ।
    বিন্দুর মৃতদেহ এল। অনি ভাই ফোঁটার উপহার নিয়ে দিভাই-এর মৃতদেহের সামনে এসে বলল, “এসে আবার চলে গেলি কেন দিভাই? আর বললি না কেন যে এটাই তোর ভাইয়াকে দেওয়া শেষ উপহার।” ভাইয়ের কপালে ফোঁটাটা তখনও জ্বল জ্বল করছে চিতায় যখন অনির দিভাই দ্বিতীয় বার জ্বলছে।

  • অণু গল্প

    ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা

    ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
    -পারমিতা চ্যাটার্জী

     

     

    রুমির আজ মনটা বড়ো খারাপ — সবাই ভাইফোঁটা দিচ্ছে — ঘরে ঘরে বেজে উঠছে শঙ্খ উলুধ্বনি –।
    তার বাড়িতেও তার ননদরা এসেছে — তাদের ভাইকে ফোঁটা দিতে — সেই শুধু বঞ্চিত এই উৎসব থেকে–।
    অথচ তারও কিন্তু দাদা আছে– তার একমাত্র দাদা– কিন্তু সম্পর্কের ভাঙনে আজ সে বহুদূরে –।
    মনে মনে ভাবে — ” দাদা তোর কি আজকের দিনেও একবার মনে পড়েনা ছোট্ট বোনটাকে– ফিরে তাকাস কোনদিন ফেলে আসা সেই স্মৃতিমধুর দিনগুলোতে “–?
    – আমি এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই ভাইফোঁটার সেই উৎসব মুখর দিনগুলো –মনে পড়ে তোর? মামারা সবাই আসত হাতে মায়ের জন্য শাড়িতে প্যাকেট নিয়ে– আর আমি বায়না করতাম- কিছুতেই দাদাকে আমি খালি হাতে ফোঁটা নিতে দেবোনা– আমারও জামা চাই —
    আর তুই বলতিস– মা যে ভাইদের জন্য সব জামাকাপড় কিনেছে – তুই কেন আমায় খালি হাতে ফোঁটা দিবি–?
    – আমার বিয়ে হোক তবে তো দেব- মায়ের তো বিয়ে হয়েছে তাই দিচ্ছে –
    — তুই তখন হেসে আমায় আদর করে বলতিস– আমারও চাকরি হোক, তোকে খুব সুন্দর জামা কিনে দেব দেখিস– এবার শুধু চকোলেট নে–
    আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলতাম — ও তুই এখনও চাকরি করিস না রে দাদা? তুই বড়ে হ, দেখবি এত্তো বড়ো চাকরি করবি-
    — আর আমি তখন আমার বোনটিকে খুব সুন্দর জামা কিনে দেব–।
    কোথায় হারিয়ে ফেললাম বল তো আমরা সেই সোনার দিনগুলো –?
    কি করে তুই আমাকে এত ছোট মনের ভাবলি রে দাদা– এতদিনেও বোনকে চিনলি না ? বাবার বাড়িতে আমি অধিকার দেখাবো?– এ কথা আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি–।
    তুচ্ছ একটা বাড়ির জন্য সম্পর্কটাই ভেঙে দিলি?
    তুই জানিস না আমি আজও দেওয়ালে — তোর নামে ফোঁটা দিয়ে তবে জল খাই– ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দি আমার ভাইকে ফোঁটা। –
    এই অধিকার টা তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবিনা– যতদিন বাঁচব আমি দেওয়ালেই তোকে ফোঁটা দিয়ে যাবো–। যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস — জানি তুই খুব অসুস্থ- আমার জীবনও একটা সূতোয় ঝুলছে, যে কোন মুহূর্তে সুতোটা ছিঁড়ে যেতে পারে– তখনই সম্পর্কের সুতোটা সত্যি ছিঁড়ে যাবে– সেদিন আর দেওয়ালে ফোঁটা দেওয়ার জন্যেও কেউ থাকবেনা–।প্রার্থনা করি তুই সুস্থ হয়ে ওঠ–।
    আমি আমার আজকের দিনের কাজটা সারি– তোর নামে দেওয়ালে ফোঁটা দি– ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা —-।

  • অণু গল্প

    বুদ্ধি

    বুদ্ধি
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    বাড়ির ছোটো ছেলে আদরে আদরে বাঁদর হয়ে গেছে। পড়াশুনা কপালে জোটেনি কারণ মা যে জন্ম দিয়েই স্বর্গে চলে গেছে। বড়ো ভাই সে তো বিরাট বড়ো বিজ্ঞানী আমেরিকাতে থাকে। নিজেই আধ পাগল কারোর খোঁজ খবর নেবার সময় তার নেই। মেজো ছেলে Oxford বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। মেম বিয়ে করে সেখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছেন। মাঝে মধ্যে দু’ একটা চিঠি আসে সব ইংরেজিতে লেখা বোঝার উপায় নেই। বাবা যত্ন করে রেখে দেন আর সুযোগ পেলেই স্কুল মাস্টারকে দিয়ে পড়িয়ে নেন। চিঠিগুলো বাবার পকেটেই থাকে যেন অমূল্য সম্পদ।

    হঠাৎ এক দিন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বাবু বলেছেন অপারেশন করতে হবে লাখ দুই টাকা লাগবে। দাদাদের কাছে ফোন করলে কি সব ইংরেজীতে বলে ছোটো ভাইয়ের তা সহ্য হয় না। ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ঘরে কুড়িয়ে কাছিয়ে 13 হাজার টাকা হলো সবই 100 টাকার নোট। সব টাকা একটি বাক্সে ভরে। একটি বিজ্ঞাপন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিলো।
    “আমি একটি বাক্স ভর্তি কিছু টাকা পেয়েছি টাকার অঙ্ক দশ থেকে কুড়ি হাজারের মধ্যে। একশত টাকা জমা দিয়ে নাম লেখাতে হবে আর দুটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলেই সব টাকা তাঁর। প্রশ্ন দুটি হলো ১) কত টাকা? ২) কি কি নোট?

    যারা নাম লেখাতে ইচ্ছুক আগামী কাল হ্যাপি ক্লাবের মাঠে সকাল সাতটা থেকে নাম লেখানো শুরু। রেজাল্ট সন্ধ্যা ছয়টায়। পরের দিন মাঠে পৌঁছে চক্ষু চড়ক গাছ তিল ধরবার জায়গা নেই। ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে দেখি দশ লাখ জমা পড়ে গেছে। ছয়টা বাজতে বাজতে কুড়ি লাখে পৌঁছে গেলো।
    সন্ধ্যা সাতটায় রেজাল্ট বেরলো, মদন নামের এক জন পেয়েছে, মাইকে তার নাম ডাকা হচ্ছে মঞ্চে আসার জন্যে। একি ষোল সতের বছরের একটি ছেলে এসে বলল আমার নাম মদন। সবাই অবাক এই কিনা টাকার মালিক! বিশ্বাসই হচ্ছে না। সবাই চেপে ধরে বলল খোকা সত্যি করে বলো তো এই টাকা কি তোমার। এত লোক জন দেখে ও ঘাবড়ে গিয়ে সত্যি কথা বলে দিলো।  বাবু আমি হলাম পকেট মার। আচ্ছা, সে তো বুঝলাম। কিন্তু খোকা তুমি সঠিক উত্তর কি করে লিখলে? ও বলল- বাবু পকেটমারদের মধ্যে আমার রোল নম্বর তের হাজার আর আমার মালিক্, যা পকেট মারি করে নিয়ে আসি সব নিয়ে নেয়, আর আমাকে রোজ একশত টাকা করে দেয় আমি এসবই লিখেছি । মঞ্চে সবাই অবাক হয়ে গেলো ।

  • অণু গল্প

    সুপর্ণার নোবেল লাভ

    সুপর্ণার নোবেল লাভ
    -কুমার প্রণবেশ

     

     

    দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে সুপর্ণা পতিতুন্ডী আনীত হলেন যমরাজ সমীপে।
    যমরাজ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চিত্রগুপ্তের দিকে তাকাতেই, চিত্রগুপ্ত খাতার পাতায় চোখ বুলিয়ে গড়গড় করে বলে গেলেন–
    নাম– সুপর্ণা পতিতুন্ডী।
    পূর্বতন জীবিকা– ওকালতি (শুধুমাত্র বিচ্ছেদগত)।
    নিবাস– হলদিয়া।

    জীবিতকালে উল্লেখযোগ্য কাজ– ১৭৫৬৩ দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ, আর কিছু নয়।

    ধর্মরাজ বাঁ গালের নিচের দিকে একটু চুলকে নিলেন। পারিষদদের দিকে একটু তাকালেন। তারপরে বলে উঠলেন – “এ আবার কি কাজ। যাই হোক, ওহে পতিতুন্ডী, আপনার গুণকীর্তন একটু সবিস্তারে কহেন – আমরা সবাই শুনি, তারপর বিচার করব“।
    সুপর্ণা শুরু করলেন– “শুনুন মি লর্ড“।
    ধর্মরাজ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “ওসব যাবনিক ভাষা প্রয়োগ এখানে চলবে না“।
    “ঠিক আছে, শুনুন ধর্মাবতার –আমি হলদিয়া ল কলেজ থেকে ওকালতি পাশ করে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায়, গৃহে ভয়ংকর অশান্তির মধ্যে বাস করছিলাম ।বরটাও ছিল অকর্মার ঢেঁকি।তাই শেষমেষ অনেক ভেবে চিন্তে একটা মামলা নিলাম, এটাই আমার প্রথম সফল মামলা হল নিজের বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা। বিনা পারিশ্রমিকের মামলা। নিজেই উকীল– পারিশ্রমিক বিনা।
    পয়সা এল না বটে, কিন্তু খুব নাম ছড়িয়ে পড়ল। একের পর এক বিচ্ছেদ ঘটাতে লাগলাম। সে সব বিচ্ছেদের অদ্ভুত অদ্ভুত কারণ। স্বামীর নাক ডাকা, ঘামের আর বদ বায়ুর দুর্গন্ধ, মদের দুর্গন্ধ, পরকীয়া, মারধোর ইত্যাদি নানাবিধ কারণ। আবার স্ত্রীদের ঝগড়া, টিভির রিমোট নিয়ে গন্ডগোল, বাপের বাড়ীকে মাথায় তোলা, পরকীয়া ইত্যাদি নিয়েও মামলা চলেছে। আমার বিচ্ছেদ নিয়ে আমি মোট ১৭৫৬৪ টি মামলার সফল উকীল“।
    -“তা তোমার মামলার কারণ কি ছিল“।
    “কিছুই ছিল না হুজুর। আমরা দু’জনেই তো আলোচনা করে মামলা সাজিয়েছিলাম। জজ সাহেব এক কথায় বিচ্ছেদ দিয়ে দিল। তারপর থেকে আমাদের রমরমা। যদিও বেআইনি, তবুও আমরা একসঙ্গেই এতোকাল থেকেছি ধর্মাবতার“।

    “চিত্রগুপ্ত, এই মহিলা তো পৃথিবীর অনেক উপকার করেছেন। নোবেল সাহেবকে বলে ওকে একটা শান্তি পুরস্কারের বন্দোবস্ত করে দাও“।

  • অণু গল্প

    পুনর্মিলন ২

    পুনর্মিলন ২
    বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস

     

     

    তুমি আমার এক মাত্র পুত্র তোমার কথা শুনবো না তো কার কথা শুনবো!
    —— আসলে কি বাবা তোমার তো দিন রাত সব সমান। চোখ দুটো তো আর ভালোই হলো না তাই বলছিলাম ফ্লাটে থাকা যে কথা আর বৃদ্ধাশ্রমে থাকা একই কথা। তোমার নাতি বড় হয়েছে! রুমের অভাবে ওর পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। তাই বলছিলাম আর কি!

    পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আজ আমি বড়ই ক্লান্ত। তুমি স্বর্গে চলে গেছো ভালোই করেছ। নইলে এই কষ্ট সইতে পারতে না। তুমি জানো দেখতে না পেলে কি হবে এই বৃদ্ধাশ্রমে আমার কতো সহৃদয় বন্ধু হয়েছে। হৃদয়ের কল্পনায় সবাইকে দেখতে পাই। না না আমার কোনো দুঃখ কষ্ট নেই।

    ঐ যে ডাক্তার দিদিমণি আমার সব থেকে প্রিয় বান্ধবী। ও যত বারই আমার শরীর পরীক্ষা করে তত বারই আমার ছোট্ট বেলার কথা মনে পরে যায়। সেই খেলার মাঠ ফুট ফুটে চাঁদের মতো মেয়েটির হাত ধরে গোলা ছুট খেলা। জ্যোৎস্না রাতে লুকোচুরি খেলা সবই মনে পড়ে যায় ।

    ভালোলাগা,  ভালোবাসা হ্যাঁ আমি ওকে খুবই ভালোবাসতাম কোনো দিন বলতে পারিনি হয়তো ও আমার মনের কথা বুঝতো। হঠাৎ এক দিন ওরা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে কোথায় যে চলে গেলো। মনে মনে খুঁজেছি কউকে বলতে পারিনি পাছে দুর্নাম রটে যায় সেই ভয়ে।

    আজ মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। তবুও সেই ছোট্ট বেলার স্মৃতিগুলো ঘুরে ফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আবছা দেখতে পাচ্ছি চারি দিকে লোক জনের ভিড়। আমাকে সবাই দেখছে। কারা এরা কউকে চিনতে পারছি না। ভিড়ের মধ্য থেকে একটি মুখ ভেসে উঠল। ফুটফুটে সেই ছোট্ট মেয়েটি। না না এতো ডাক্তার দিদিমনি। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল। আমিই তোমার সেই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি “রিতা”

    ও আমার হাত দুটো চেপে ধরলো ওর চোখ থেকে যেন ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোর ধারা আমার বুকে পড়তে লাগলো ধীরে ধীরে সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে।

    —– তুমিই সেই রিতা?
    — হ্যাঁ আমিই সেই রিতা।
    একটি কালো পর্দা উপর থেকে ধীরে ধীরে চোখের উপর এসে পড়লো। চারি দিক সব অন্ধকার হয়ে গেলো।

  • অণু গল্প

    সুপ্ত ভাবনা

    সুপ্ত ভাবনা
    -পরিতোষ রায়

     

     

    সকাল থেকে রাত অবদি
    সারাদিন শুধু কাজ |
    তারই মধ্যে সময় পেলে
    গড়ি ছন্দের ভাব |
    ছন্দ আসে অনেক কিছুই
    পারিনা লিখিতে |
    লিখলে পরে সমাজ নেতারা
    করে দেবে একঘরে |
    বিদ্রোহ তো মনের মধ্যে
    সুপ্ত হয়ে আছে |
    ছন্দের মধ্যে কখনও তা
    পারিনা মেলাতে |
    এই কারনে সব ছেড়ে আজ
    লিখি প্রেমের গান |
    মন কোঠরে লুকিয়ে থাক
    বিদ্রোহীর নাম |

You cannot copy content of this page