অণু গল্প
-
জানালা
জানালা
-রিতম কর
প্রত্যেক বাড়িতে বিশেষ একটা জানালা থাকে। না না,বিশেষ মানে আকারে বড়ো, সুন্দর সাজানো, মোটেই এরকম কিছু নয়। বাইরের মানুষের কাছে ওটা বাড়ির আর পাঁচটা জানালার মতোই খুব সাধারণ। কিন্তু বাড়ির ছেলেটার বা মেয়েটার কাছে ওই জায়গাটুকু বড্ড কাছের,বড্ড নিজের। কারণ জানালাটা অনেক গল্প জানে যে..! ছোটবেলায় মাকে লুকিয়ে দুধটুকু টুক করে বাইরে ফেলে দেওয়া বা বাইরের কৃষ্ণচূড়াটায় শালিক গুলোর কচাকচি শুনতে শুনতে শীতের ছোট্ট দুপুরটা পার করে ফেলা―ওটার পাশের ওই শ্যাওলা ধরা পাঁচিলটা টপকেই তো বন্ধুদের যত গোপন আনাগোনা।একটু বড় হতেই সামনের বাড়ির নীলাকেই নীলাঞ্জনা ভেবে- ‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি পে এক চাঁদ কা টুকরা রেহেতা হ্যায়…’। ক্লাস টেনে প্রেমে আছাড় খেয়ে প্রথম মন ভাঙার সাক্ষীও তো ছিল ওই জানালাটাই!
ছাদে গিয়ে মা বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়নি তো কি! গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি নিজেই এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেছে বারবার।পর্দার আড়ালে আলোর আনাগোনাটাকে মুঠোফোনে বন্দি করতে চেয়েছি কতবার। বাবা বকলে, মিষ্টি মেয়েটা রাগ করে বসে থেকেছে ওখানেই। ওখানেই গিটারে গানে, হেডফোন কানে কখনো হাসিয়েছে অনুপম, কখনো কাঁদিয়েছে অরিজিৎ। মাঝে মা একবার রাগ করে জানালাটা বন্ধ করতে বললেও হার মানতে হয়েছে জেদের কাছে।
বয়সের হিসাবে এখন বড় হয়েছি বেশ কিছুটা, তাও ওই দিকে মুখ করে পড়তে বসা, কবিতা লেখা, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সকালের প্রথম রোদ এসে ঘুম ভাঙানোটা একইরকম রয়ে গেছে ওই জানালাটার জন্য―হ্যাঁ ওই গল্প জানালাটা….বাড়িতে থাকা ওই আনমনা নিজস্ব জানালাটা…।।
-
মায়ের মন
মায়ের মন
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়বান্টি ফোন ধরেই বললো–বাবাই,আমরা পুজোয় কলকাতা যাচ্ছি…তুমি যাবে তো?
—না,রে সোনা,ছুটি নেই… পরেরবার ঠিক যাবো।
—আমি আর দুষ্টুমি করবো না।তুমি তাহলে তাড়াতাড়ি আসবে তো??
—তোর দুষ্টুমি আমার ভালোই লাগে সোনা। কাজের খুব চাপ।এরা ছাড়লেই দৌড়ে চলে যাব তোর কাছে।
পাশের ঘর থেকে রিয়া শুনছে…বান্টি তার বাবাই-এর সাথে কত্ত গল্প,আবদার,খুনসুটিতে মেতেছে।আর্য রোজ ভিডিও কল কোরে ছেলের সাথে একঘন্টা বকবক করবেই।প্রায় একবছর হয়ে গেলো ও বদলী নিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লীতে চলে গেছে।
কেমন আছে?কি করছে?কি খাচ্ছে?আমার কথা ভাবে?
দূর যা পারে করুক।আমার থেকে এত্ত ভালোবাসা নিয়ে এখন তা অন্যকে বিলোচ্ছে…আর এই আর্যই ওকে একদিন না দেখে থাকতেই পারতো না…রিয়ার দু’চোখ জলে ভরে উঠলো।ঠাকুরদালানে সবাই বসে… আড্ডা,গান,গল্প,মজা,হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।সবাই এসেছে…শুধু ছোটজামাই আর্য আসেনি বলে নীলাদেবীর মনটা খারাপ…আর্য একাই হুল্লোড়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখে ।
বান্টিকে বললেন—কি’রে বাবাকে আনলি না?
—বাবা তো দিল্লীতে।
—-কবে গেছে?
—ওই যে বড়দিনে সান্তাই তো বাবার হাত দিয়ে টেডিবিয়ারটা পাঠালো…ওটাকে জড়িয়েই তো আমি রোজ ঘুমোই।নীলাদেবী মনে মনে ভাবলেন—দশমাস!! কই আর্য বা রিয়া তো তাকে একথা জানায়নি।মনে একটু খটকা লাগলো।
ঘুমোবার আগে রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন—জানিস,সংসারে অনেক কুকথা, মন্দ ব্যবহার,অভাব অভিযোগ সামলে তোদের বড় করেছি।মানিয়ে নিয়েছি ভালোমন্দের সাথে,সংসারকে আঁকড়ে থেকেছি…ছেড়ে যাইনি কখনো।সংসারের ঝড়ঝাপটা সামলেও ভালো থাকার চেষ্টা করেছি শুধু তোদের হাসিমুখগুলো দেখবো বলেই।আর ভালোবাসলে সব পারা যায় রে।
—-তুমিই আমার দুগ্গামা…তুমি সব বোঝো… তাইতো তোমার কাছে এলে বড় শান্তি পাই মা।
পুজো কাটলো।আজ দশমী।”মা” এর বিদায়। ‘দুগ্গামা” সবাইকে ভালো রেখো সারাটাবছর।
রাতে আর্য বিজয়াদশমীর প্রণাম জানিয়ে ফোন করলো শ্বশুড়-শাশুড়িমাকে।
শাশুড়িমা অনুযোগ করলেন—এবার তুমি এলেনা বলে পুজোবাড়ি অন্ধকার।এরপরের বার কিন্তু সবার আগে তোমার আসা চাই।
—হ্যাঁ মা নিশ্চয়ই।রিয়া বোঝে এটাই মায়ের ভালোবাসার টান।আর এই টানেই আর্য ঠিক ফোন করেছে।
আর্যের বন্ধুত্ব,আর্যের ভালোবাসা সবসময় রিয়াকে ঘিরে থাকে।ওই যে রিয়ার একমাত্র friend, philosopher & guide….
রিয়া ভাবে–
মা হয়ে বান্টির হাসিমুখ দেখার জন্য একটু মানাতে পারবেনা?পারবেনা এই একবারের ভুলটাকে শুধরে দিতে??খানিকবাদেই আর্যের মেসেজ
“তুমি আর বান্টি আমার সবটুকু ভালোবাসা নিও।আমাকে বাদ দিয়ে পুজো তা’হলে ভালোই কাটালে বলো??”অনেকদিন বাদে রিয়া আজ রিপ্লাই দিলো—-“ভালো থেকো।আর পারলে সত্যি ভালোবেসো।”
-
অক্ষরের আলপনা
অক্ষরের আলপনা
-অনুশ্রী দাসছোট্ট রুমি যখন আমার কোল আলো করে এলো… সেই আলো সবার চোখে ছিল অন্ধকারের অমাবস্যা.. সবার মুখে কিছুটা বিরক্ত আর হতাশার কালো ছায়ায় মেয়েটাকে বুকে টেনে কান্না-হাসির দোটানায় মনে মনে বলেছিলাম ‘লক্ষ্মী এসেছে আমার ঘরে আমার আর চিন্তা কি..!?’
রুমির বাবার মিলের সামান্য আয়ে আমাদের সংসার চলতো কোনরকমে, নিজের না পাওয়া ইচ্ছেগুলোকে স্থির করে নিয়েছিলাম রুমির চোখেই দেখবো, আমার অচেনা অক্ষর জ্ঞানের জগতে রুমিকে বড় করেছি একটু করে.. কোনো শখ চর্চার ক্লাসে আমি রুমিকে পাঠাতে পারিনি কোনোদিন.. কিন্তু ও যে নরম গলা নিয়ে এসেছিল, সেই সুরে আমাদের ঘর ভরে থাকত… আমার চোখে জল আসত আনন্দে, পুজোর সময় পাড়ার স্টেজে ওর গলার গানে মুগ্ধ হয়ে যখন সবাইকে হাততালি দিতে দেখতাম…
আমার জ্ঞাতি জা,ননদদের দুধ ভাতে বেঁচে থাকা ছেলেদের চেয়ে রুমি যখন সাদা ডাল ভাত খেয়েও ওদের পেছনে রেখে সামনে এগিয়েছে তখন হিংসায় ওরা শুধু কন্যা দায়ের অর্থাভাবকে বড় করে দেখিয়ে রুমিকে আটকাতে চেয়েছে সমাজের বেড়ায়…আমাদের বাড়ন্ত সংসারের হাল, আমাদের পাশাপাশি রুমিও ধরেছিল ছোট্ট হাতে… ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের অ আ ক খ পড়িয়ে নিজের দরকারটা নিজেই মিটিয়েছে অনেক ছোট থেকেই…
এরকম হাজারও কাহিনী আছে ওর দু’চার পয়সার সৎ সংগ্রামের..আজ ছোট্ট রুমি অনেক বড় সরকারী অফিসার,অনেক বড় মানুষরাও সেলাম ঠোকে ওকে… আমাদের জামাই ও বড় অফিসে কাজ করে.. আর আমি আর রুমির বাবা এখন আর টালির ঘরে থাকি না…. আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাট আজ শহরের বুকে…
– শুভ জন্মদিন মা… তোমার জন্য দেখ কি এনেছি..
কাগজের ভাঁজ খুলে দেখি ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’..আমার জীবনের সব আশা মিটে গেছে, আমাকে প্রয়োজনের অনেক বেশি সুখ দিয়েছে রুমি.. কিন্তু আমার অনেক অনেক বই পড়তে পারার সুপ্ত স্বপ্নে , সোনার কাঠি ছুঁইয়ে অক্ষরের আলপনায় রুমি আমার জীবন আনন্দে সাজিয়ে দিয়েছে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা …
দূর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বল জ্বল করছে,চারিদিকে শাঁখের আওয়াজে কোজাগরীর আরাধনা… শিউলির হালকা গন্ধে তখন যেন আমি, আমার রক্ত মাংসের লক্ষ্মীকে ছুঁয়ে দেখছি…
-
বিসর্জন
বিসর্জন
-সঞ্জিত মণ্ডলশোভনা বাড়ির বড় বউ। যেমন স্নেহময়ী তেমনই সুন্দরী, মুখশ্রী যেন সত্যিকার দেবী প্রতিমার মতন। বছর দশেক আগে পাবনার জমিদার সোমেশ্বর চৌধুরীর সাথে বিয়ের পর সংসারের সর্বময় কর্তৃত্ব তারই হাতে। বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে শোভনাই রাণী। শোভনা এখনো সন্তানহীনা। এবার জমিদার বাড়ির পুজো একশ বছরে পড়বে। শহর থেকে মান্যগণ্য আর সাহেবসুবো অতিথিদের আমন্ত্রণ করা হবে। তাই বিশিষ্ট মৃৎশিল্পী রুদ্রমঙ্গলকে আনা হয়েছে। শিল্পীকে যেমন দেখতে তেমনি তার সুন্দর স্বাস্থ্য, তাকিয়েদেখার মতো। পুজোর তিন মাস আগে এসে সে ঠাকুর দালানে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। অপূর্ব তার কাজ, সবাই দিনে একবার হলেও উঁকি দিয়ে যায়, বড় বউও বাদ থাকেনা। এসে গেল সেই পূণ্য লগন, বোধনের দিনে হলো প্রতিমার আবরণ উন্মোচন। সবাই অবাক হলো, এতো জীবন্ত মমতায় উদ্ভাসিত প্রতিমার আনন ঠিক যেন বড়ো বউ শোভনার মুখের মতন। ক্রুদ্ধ জমিদার ঈশারায় ডেকে নেয় পালোয়ান বদনকে। মন্ত্রণাঘরে চলে নিভৃত কথন।রুদ্রমঙ্গলের গুম ঘরে হারিয়ে যাওয়ার কথা কাকপক্ষীতে টের না পেলেও শোভনার অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে, সে জানে তার গর্ভে মাস দুই হল সন্তান এসেছে। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় সে। পরদিন শোভনার ঠাকুরঝি সুমনা ভোরে নাইতে গেছিল খিড়কি পুকুরের স্নানের ঘাটে। নাওয়া হলো না, দৌড়ে এসে চীৎকার করে সবাইকে ডেকে জানালো ওগো, বড় বউদি আর নেইগো, দেখে এলুম খিড়কি পুকুরের জলে তার দেহ ভাসছে, একি করলে বউদি, বোধনেই যে তোমার বিসর্জন হয়ে গেলো।
-
মায়ের আঁচল
মায়ের আঁচল
– বিভূতি ভূষণ বিশ্বাসআরে বাপরে ১০ টা বেজে গেছে,সর্বনাশ করেছে ১০ টা থেকেই তো ডিউটি । তারা হুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম । কি আর করবো সব কাজই তো আমাকে করতে হয় । যাবার সময় মা ঠিকই বলে গিয়েছিলেন ” বাবা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিস” । কিন্তু মা মনের মতো মেয়ে তো পাইনা । কি করবো বলো । এই সব ভাবতে ভাবতে অফিসে রওনা দিলাম । ১০ মিনিট পায়ে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য । ওহ এখন তো গঙ্গা সাগরের মেলা চলছে । মনেই নেই কি করে মনে থাকবে আমরা যে স্টেশন মাস্টার দিনরাত সপ্তাহের নামও ভুলে যাই । শুধু ডিউটি আর ডিউটি ছাড়া কিছু বুঝিনা ।
লক্ষ্মীকান্ত পুরই তো গঙ্গাসাগরে যাবার মেইন স্টেশন । এই মাস দুই হলো আমার পোস্টিং হয়েছে । সিঁড়ি দিয়ে অফিসে উঠতেই দেখি এক ভদ্রমহিলা বসে আছে সিঁড়ির উপর । বয়স ৫০/৫৫ হবে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনি এখানে বসে কেন ? উনি যে কি ভাষায় কথা বল্লেন বুঝতেই পারলাম না । অগত্যা পাশ কাটিয়ে দু’তলায় আমার অফিসে চলে গেলাম । রাত আটটায় আমার ছুটি হলো তখনো দেখি উনি ওখানে ঠাঁই বসে আছেন আর ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন । জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ি কোথায় ? কি যে বল্ল বুজতেই পারলাম না অগত্যা পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম নিজের রেল- কোয়াটারে ।
অস্থির অস্থির লাগছে ঘুম আসছে না শুধু ঐ মহিলার কথা মনে পড়ছে অগত্যা স্টেশনে গিয়ে দেখি উনি এখনো ওখানেই বসে আছেন । জিজ্ঞাসা করলাম কিছু খাওয়া দাওয়া হয়েছে ? উনি হা করে চেয়ে রইলেন । অগত্যা ইশারা করে খাবার কথা জিজ্ঞাসা করলাম । এবার হাত নাড়িয়ে উত্তর দিলেন — ‘না’ । ইশারা করে আমি বললাম আমার সঙ্গে যেতে । উনি উঠে পড়লেন আমি একটা হাত ধরে আমার রেল-কোয়াটারে নিয়ে গেলাম ।
এখন উনি মায়ের মতো সব কাজ করেন কিন্তু দু জনের মধ্যে ইশারাতে কথা হয় । যেন দু জনাই বোবা । আমাকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হয় না । মাস খানেক পর এক দিন ভোরে কলিং বেল বেজে উঠলো দরজা খুলে দেখি পুলিশ ও দু জন অচেনা লোক । পুলিশ জিজ্ঞাসা করলেন ——- আপনি কি Mr.B.B.Biswas.
——- আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’।
পুলিস বললেন ——- আপনার ম্যাসেজ আমরা পেয়েছি । এনারা এনাদের মা কে হারিয়েছেন তাই দেখতে এসেছেন । এদিকে ভদ্রলোক মহিলাকে দেখে মা মা বলে কেঁদে ফেলে জড়িয়ে ধরলেন । ওনারা বললেন মা শুধু তামিল ভাষাই বোঝেন । খুবই কষ্ট হয়েছিল সে দিন উনাকে বিদায় দিতে । -
পেত্নীর আঁচড়
পেত্নীর আঁচড়
-রেহানা দেবনাথচাঁদনির আট বছরের মেয়ে সোনাই এর, পর একটি ছেলে হয়। শ্বশুর বাড়ির সবাই খুব খুশী কারণ ওদের বাড়িতে সবার মেয়ে এই প্রথম ছেলে হয়েছে। শাশুড়ি ও শ্বশুর মিলে ছেলের নাম রাখলো দীপ। সোনাইকে চাঁদনি, সৌমেন ও পরিবারের অন্য সবাই খুব ভালোবাসে। দীপ মাস ছয়েকের হবার পর থেকেই একটা বিপত্তি দেখা দিল! প্রতিদিন তার শরীরে অনেকটা লম্বা নখের আঁচড়ের দাগ দেখা গেল। বাড়ির সবাই খুব সাবধানে দীপকে কোলে নেয়। এতটা আঁচড় লাগার কোনো কারণও কেউ খুঁজে পেল না। তারপর থেকে বাচ্চাটির শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হলো না। প্রতিদিন হাতে, পায়ে, পেটে অথবা মুখে আঁচড়ের দাগ পড়তে থাকে।আত্মীয় স্বজনেরা প্রতিবেশীরা বলতে থাকে এই নিশ্চয় অশুভ আত্মার কাজ। সকলের পরামর্শে চাঁদনী ছেলেকে নিয়ে বাবা সদানন্দজীর কাছে গেলে, তিনি মন্ত্রশক্তির দ্বারা জানায় যে শাকচুন্নি পেত্নীর কান্ড। মোটা টাকার বিনিময়ে টোটকা, তাবিজ মন্ত্রপুত জল আরও কত কি দেয় কিন্তু তাতেও কিছু হয় না। পেত্নীর আঁচড়ের চিহ্ন বাড়তে থাকে। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা যে যেখানে বলেছে বাড়ির লোকেরা সেখানে ছুটেছে তবুও পেত্নীর আঁচড় থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে পারেনি। সব কিছু যখন ব্যর্থ হয়ে গেল তখন হঠাৎ একদিন চাঁদনি ঘুমন্ত ছেলের কাছে বসেছিল বাইরে একটা শব্দে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, কিছুটা যাবার পর তার মনে কি হলো সে ছেলের কাছে ফিরে এলো। ঘরে ঢুকে দেখে পেত্নী তার ছেলের মুখে আঁচড় বসাচ্ছে। চাঁদনিকে দেখতে পেয়ে ছুটে পালায় পাশের ঘরে। চাঁদনি প্রথমে হতভম্ভ হয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে পাশের ঘরে গিয়ে মেয়েকে শান্ত গলায় জিগ্যেস করে, সে কেন তার ভাইয়ের সঙ্গে এমন করছিল। তাতে সোনাই জানায় যে দীপ হবার আগে পরিবারের সকলে ওকে অনেক আদর করতো, ভালবাসতো কিন্তু দীপ হবার পর থেকেই ওকে নিয়ে মেতে থাকে ওকে কেউ কোলে নেয় না, আদর করে না, এমনকি মায়ের কাছেও থাকতে পারে না। সব কিছুর জন্য ও ভাইকে দোষী মনে করে শাস্তি দেয়।চাঁদনি বুঝতে পারে ছেলের শরীরের উপর আঁচড় দেখে তার কষ্ট সহজে বুঝতে পেরেছে কিন্তু তার মেয়ের মনের ভিতরে যে আঁচড় প্রতিনিয়ত সবাই মিলে কেটেছে তার কষ্ট কেউ বুঝতে পারে নি। তারপর থেকে সোনাইয়ের প্রতি আগের চেয়েও বেশি করে যত্ন শুরু করে আর তখন থেকে ছেলের শরীরে পেত্নীর আঁচড়ও আর পড়ে না।
-
ঈষাণ ও সায়নীর প্রেম
ঈষাণ ও সায়নীর প্রেম
-অজয় চৌবেআমার বিয়েতে এলে না কেনো? নিমন্ত্রিত এসেছিলো সবাই শুধু তুমিই যাওনি। আমার খুব রাগ হয়েছিলো ভেবেছিলাম আর কখনও কোনোদিন কথা বলবো না তোমার সাথে। ঈষাণ মুচকি হেসে মুখ ফিরে থাকা সায়নীকে বললো- তবে আজ এলে কেনো? রাগ করেই থাকতে পারতে দূরে। সায়নী এবার ভীষণ রেগে ঈষাণকে বললো- তোমার বাড়িতে এসে তোমার সাথে এভাবে দেখা করার জন্যে তুমি খুশী হওনি? ঈষাণ গম্ভীর মুখে বললো- না আমি খুশী হতে পারিনি কারণ আমি তোমাকে নিজের মতো করে কাছে পেতে চেয়েও কাছে পাইনি। সায়নী নিশ্চুপ। ঈষাণ বললো- আমি তোমার কাছে একবছরের মতো সময় চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার ছিলো ভীষণ তাড়া। সায়নী বললো- আমি কিন্তু তোমাকেও বলেছিলাম- চলো পালিয়ে বিয়ে করি কিন্তু তুমি বলেছিলে- চোরের মতো পালিয়ে বিয়ে করবো না। কাজটা পাকাপোক্ত হোক, বোনের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর ধুমধাম করে বিয়েটা করবো। ঈষাণ বললো-হুমম বলেছিলাম। সায়নী বললো -বাবা মা মোটা মাইনের ধনী পরিবারের সরকারি জামাইএর খোঁজ করছিলো এবং পেয়েও গেলো। ঈষাণ বললো- তুমিও তখন আমার প্রতি আর ভরসা রাখতে পারলে না? সায়নী বললো- ঠিক তাই কিন্তু বিয়ের একমাস পর আমার মনে হলো- আমি বোধহয় তোমার প্রতি ভীষণ অবিচার করেছি? ঈষাণ বললো- না তুমি মোটেও অবিচার করো নি, কারণ আমিও নিজেকে ভীষণ গুটিয়ে নিয়েছিলাম সেই সময়। বাবা মা জীবিত নেই, বোনটাকে বিয়ে দেওয়ার চাপ আর আমার কাজটাও সেরকম পাকাপোক্ত নয় তাই মনে হয়েছিলো- ঈশ্বর যখন যা করেন হয়তো ভালোই করেন। সায়নীর চোখে জল। ঈষাণ মুচকি হেসে সায়নীর চোখের জল মুছতে মুছতে বললো- পাগলী বিচ্ছেদে কখনও কোনোদিন প্রকৃত প্রেম ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়না। আমি হাজার চেষ্টা করেও তোমাকে ঘৃণা করতে পারিনি বরং নিজেকে গোপনে চুপিসারে দোষারোপ করেছি বহুবার। সায়নী বললো- কথা দাও তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। ঈষাণ বললো- কথা দিলাম তোমার কষ্টের সময় প্রাণপণ চেস্টা করবো পাশে গিয়ে দাঁড়াবার। নিজের অফুরান তোমার প্রতি ভালোবাসা নিংড়ে দিবো তোমাকে হাসিখুশী রাখতে কিন্তু ভুল করেও তোমার সুখের দিনে বারবার ডাকলেও আমাকে তুমি তোমার কাছে পাবে না। সায়নী বললো- সত্যি আমি ভীষণ খুশী এবং মুগ্ধ হলাম, তুমি এভাবেই নিজের মতো মাথাউঁচু করে জীবনের বাকি পথ হাঁটতে থাকো। আমিও কথা দিলাম তোমায়, আমার হৃদয়পুরে গোপনে চুপিসারে আমার প্রেমিকের আসনে তুমি শুধু তুমিই থাকবে বিরাজমান চিরদিন। আর কেও না।
-
নিষ্ঠুর সমাজ
নিষ্ঠুর সমাজ
-বিভূতি ভূষণ বিশ্বাসসেদিন বিকালে ফুটবল খেলার মাঠে আমরা পাঁচ ভাই বোন খেলা করছিলাম,আর মা পাশে শুয়ে ছিলো হঠাৎ একটি লোক ট্যাক্সি থকে নেমে আমাকে কোলে নিয়ে চম্পট। আমি তো কথা বলতে পারিনা তাই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ভাই বোন আর মা’র দিকে,আস্তে আস্তে সব অস্পষ্ট হয়ে গেলো। দুই চার দিন খুব কান্না করেছি। এখন দেখছি এখানেই ভালো আছি। সময় মতো খাওয়া দাওয়া সব কিছুই পাই, তবে সব থেকে ভালো লাগে প্রভুর এক মাত্র মেয়েকে ও সব সময় আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
যাই হোক ধীরে ধীরে শিশু কাল কৈশোর যৌবন সবই কেটে গেলো এখন শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, মাথা ঝিম ঝিম করে দাঁত শির শির করে প্রভুকে ছাড়া কাউকে আর চিনতে পারি না। হঠাৎ এক দিন মাথা খুব যন্ত্রণা করছিল বাড়ির মায়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের পথে । এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আমাকে দেখে দোকানদার গরম জল ছুঁড়ে মারলো। আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না ওকে কামড়ে দিলাম । সবাই হই হই করে পাগলা কুকুর পাগলা কুকুর বলে তাড়া করলো। কতো দূর আর পালাবো। বড় বড় লোহার রড নিয়ে সবাই আমাকে ঘিরে ফেললো এক জন মাথায় সজোরে মারলো। ভাগ্য ভালো মাথায় না লেগে সামনের ডান পায়ে লাগলো ।
তিন পা দিয়ে দৌড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। সপাটে আর একটা মারলো, সামনের বাঁ পাটাও গেলো । পিছনের দু’পাই ভরসা,মানুষ হলে দৌড়াতে পারতাম । ব্যকুল দৃষ্টিতে চেয়ে আছি কখন মাথায় শেষ আঘাতটা পড়বে। ভাবতে ভাবতে সজোরে মাথায় শেষ আঘাতটা পড়লো। ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। হঠাৎ কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দেখার চেষ্টা করলাম। আবছা দেখলাম এতো আমার প্রভু। প্রভুর কোলে মাথা রেখে নিষ্ঠুর সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় নিলাম।
-
অনুতপ্ত
অনুতপ্ত
-রাখী চক্রবর্তীযন্ত্রণা, ,,,যন্ত্রণা, ,,,বুঝলে গিন্নি ,বুকে হাত ভোলাতে ভোলাতে সোমনাথ বলছে রীতাকে।
“তোমার তো চিন্তা শেষ। তা যন্ত্রণা টা কিসের তাহলে “বেশ ব্যঙ্গের সুরে বলল কথাগুলো রীতা সোমনাথকে।
মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। অষ্ট মঙ্গলাতে মেয়ে জামাইকেে তো ভালোই দেখলাম। বেশ মিলমিশ ও আছে। ভাবনা তো আমাদের শেষ। নীলা আমাদের একমাত্র সন্তান, সুখে থাকবে, ব্যাস আর কি চাই।পথের কাঁটাকে অনেক বছর হল,,,,,,,,,
রীতা কেন আবার পুরানো কথা তুলছো। সব ভুলে যেতে চাই।
রীতা–ভুলব বললেই তো আর ভোলা যাবে না।আমাদের পাপের শাস্তি যেন আমাদের মেয়ে নীলা না পায়। তোমার সাথে পাপ কাজটাতে আমিও তো সামিল ছিলাম। হয়তো স্বামীর কাছে আদর্শ পত্নী হওয়ার জন্য।বাদ দাও,ও সব কথা। নতুন করে আবার কি হল?এতদিন তো কিছু বলোনি।
সোমনাথ ভেজা গলায় বলল,নীলাকে এতদিন আগলে রেখেছিলাম এখন ও স্বামীর ঘরে ভয়টা ওখানেই তো।আমি আমার কাজে অনুতপ্ত। দগ্ধে দগ্ধে মরছি রোজ।বেশ কিছু দিন ধরে অনামিকা আসছে আমার কাছে।বলছে ,বাঁচাও দাদা আমি বাঁচতে চাই। আমি সর্বদা আতঙ্কে থাকি। আমাদের পাপের শাস্তি যেন নীলা না পায়।
রীতা তাচ্ছিল্যর স্বরে বলল,আমি তোমাকে অনেক বার বলেছিলাম “মাথা খারাপ তোমার বোনের। গায়ে যখন আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেল ওকে তুমি বাঁচাও ।না তুমি বাঁচাতে গেলে না আমাকে যেতে দিলে। পাগলী বোন তোমার না হয় ভুল করেই ফেলল। তুমি তাকে বাঁচালে না। আমিও তো তোমার সাথে সমান দোষের ভাগীদার হয়ে গেলাম। আমি যদি তোমার কথা না শুনে ছুটে যেতাম তাহলে হয়তো,,,,তখন অবশ্য আমি ভয় পেয়েছিলাম সংসার হারানোর, তোমাকে হারানোর।আজ আমি অনুতপ্ত। রোজ ক্ষমা চাই আমি অনামিকার কাছে ।
সোমনাথ অনামিকার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলছে,”আমায় ক্ষমা করে দে বোন। নীলাকে বাঁচতে দে। ওর ক্ষতি করিস না। আজ আমিও অনতাপের দগ্ধ জ্বালায় জ্বলছি রে।সারা গা জ্বলছে রে সারা গা জ্বলছে। -
জন্তুম্যানড্যাডের মুখোশের আড়ালে
জন্তুম্যানড্যাডের মুখোশের আড়ালে
-অঞ্জলি দে নন্দী
একটি জন্তু-ম্যান, ড্যাড হল। শিশুটি হামাগুড়ি দিচ্ছে….. মেঝের ওপরে, কখন লুকিয়ে, ছুঁচ ফেলে রাখলো। মাটি খুবই ঈশ্বর নির্ভর! সদা সর্বদা ঈশ্বরকে বলে যে তিনি যেন তার পুত্রকে রক্ষা করেন। তাই, তার নজরে এলো, ঠিক সময়ে ছুঁচটি। আর একটু দেরী হলেই, ছেলের কচি হাতে গেঁথে যেতো। মা তুলে নিল। ছেলেটির হামাগুড়ির পথ থেকে।
এবার হামাগুড়ির পথে T V এর, ফোনের তার টানলো। শিশুটির পায়ে, হাতে, জড়িয়ে যেতে লাগলো। মাটি চেষ্টা করলো, ওগুলিকে ওপর দিয়ে টানার। কিন্তু তার ওপরে নির্যাতন করলো। তাই মাটি তা করতে পারলো না।
বাচ্চাটি ডাস্ট এলার্জির জন্য তখন চিকিৎসাধীন। ডাক্তার বলেছেন যে, ট্রিটমেন্ট করালে, কয়েক বছর পর, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। রাতে, একটি মশারীর মধ্যে, তিনজনে সুতো। এতো নিচু যে, হাঁটু মুড়লে, শুয়ে শুয়ে, মশারীর ওপরটা, হাঁটুতে ঠেকে যায়। কারেন্ট অফ হয়, রোজ রাতে, কয়েক ঘন্টা, নিয়মিত ভাবে। অনেক করে, পায়ে ধরে, বলা স্বত্বেও মশারীটিকে, কিছুতেই, উঁচু করতে দিল না। এরপর, উচ্চ শব্দে নাক ডাকা। বাচ্চা ছেলেটি, চমকে উঠে, কেঁদে উঠতো। মা, অনেক অনুনয় বিনয় করেও ড্যাডকে অন্য রুমে শোয়াতে পারলো না। বেশি জোর করলে, মায়ের হাত ঘুরিয়ে পিছন দিকে করে, চেপে ধরে রাখতো। মাটি বলতো, ” ছেড়ে দাও! আর বলবো না! লাগছে! ” আর এমন ঘুমোত যে, পাশ ফিরে যেই শুতো, মাটি বিছানা থেকে, নিছে পরে যেতো। আর শিশুটির গায়ে মোটা ভারী ড্যাড-এর পা-তোলা – সে স্বাস নিতে না পারায়, ছটপট করছে। মা পা সরিয়ে, ছেলেকে কোলে নিয়ে সারারাত জেগে কাটিয়ে দিতো। মাথায় মশারীর ছোঁয়ার জন্য, নিচু করেই থাকতো। হাতে হাতপাখা চলছে।
আর বাইরের পরিচিত সবার কাছে এমন বলতো, যেন পুত্র তার অতি প্রিয়। মাটি চুপ করে শুনতো। মুখ খুলেই অত্যাচার যে! ………