অণু গল্প

  • অণু গল্প

    শতঘনী

    শতঘনী
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    ছোট্ট থেকেই মার প্রতি সব অত্যাচার, অবিচার দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে পিতৃহারা বিশু।
    বাপের বাড়ি বেশ অবস্থাপন্ন, তাই দুই সন্তানকে নিয়ে সদ্য স্বামীহারা উমা বাপের ভিটেতে এসেছিল সন্তান দুটোকে মানুষ করবে বলে। তখন সিদু দুই বছরের আর বিশু তিন বছরের। তখন মায়ের কোলেই পিতার ছত্র ছায়া দেখেছিল ওই দুটি শিশু।

    উমা বেশি লেখা পড়া জানত না। নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করাতে বাপের বাড়ির লোকদের কাছে সে মৃত বললেই চলে। যা কিছু স্বামীর সম্পত্তি ছিল সব তারই চিকিৎসাতে ব্যায় হল। উমার শেষ সম্বল স্বামীর ভিটেটাকেও বিক্রি করতে হল তবুও শেষ রক্ষা করা গেল না।
    বাপের বাড়িতে উমা এখন “কাজের মেয়ে “হিসাবে পরিচিত। সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করে সে শুধুমাত্র ছেলে দুটোকে মানুষ করবে বলে।
    বিশু তার মায়ের প্রতি অত্যাচারের প্রতিটি চিত্র খণ্ড খণ্ড করে মনের খাতায় এঁকে রেখেছে। কারণ একদিন বিশু তার বড় মামাকে বলেছিল,মাকে দিয়ে সব কাজ করাও কেন? তাতে বড় মামা বিশুর মাকে পোড়া কাঠ দিয়ে হাতে মেরেছিল। বিশু বুঝে গেছে প্রতিবাদ করলেই মার ওপর অত্যাচারের মাত্রা ওরা বাড়িয়ে দেবে। তাই এখন সে বোবা।
    সময়ের অমোঘ নিয়মে ও মায়ের ইচ্ছা শক্তির জোরে বিশু এখন কলেজে পড়ে । সেদিন বড় মামা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাড়ির সবাইকে বলছে,পতাকা হাতে বিশুকে দেখলাম। উমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বললেন ,মিটিং মিছিল করে এ বাড়িতে থাকা যাবে না।বাড়িতে আরও বাচ্চারা আছে। সব নষ্ট হয়ে যাবে এ ছেলের জন্য ।
    রাস্তা দিয়ে বিশুর সাথে অগণিত মানুষ যাচ্ছে মিছিলে। বিশুর কন্ঠ এবার সোচ্চার প্রতিবাদে “হোক প্রতিবাদ; ;;;গর্জে উঠুক আকাশ, বাতাস পাহাড় পর্বত “। বিশুর মামা মামীরা ছাদে উঠে তার প্রতিবাদের মিছিল দেখছে। এ কোন বিশুকে তারা দেখছে।
    উমার চোখ চিকচিক করছে। উমা পেরেছে সন্তানকে মানুষ করতে। বিশু হোক সারা বিশ্বের প্রতিবাদের স্তবক ।আর কোন নিরীহ মানুষ মরবে না। বড় মামা বেগতিক দেখে উমাকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করতে যাবে সেই মূহুর্তে বিশু মার হাত ধরে বলল,এটা তোমার ও বাড়ি মা। আজ থেকে তুমি শুধু মা হয়ে থাকবে। কাজের মেয়ে হয়ে না।
    বিশু ছোট বেলায় পারেনি মার প্রতি অত্যাচারের শোধ নিতে। এখন সে বড় হয়েছে। মার অধিকার মাকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এবার বিশু চলল অন্য কোন মায়ের ঘর বসাতে। এইভাবে সে চলতে থাকবে জীবনভর

  • অণু গল্প

    কল্পনার অনুভব

    কল্পনার অনুভব

    -পলি ঘোষ

    হঠাতই চলে গেলাম অন্য এক পরিবেশে ঘুরতে ।চলে গেলাম একাই নিজের ঠিকানা খুঁজতে ।যেতে যেতে উঠে ও পড়লাম ট্রেনে ।ট্রেন যাচ্ছে আমি ও দুরন্ত গতিতে ট্রেনের কামরায় বন্দী হয়ে ছুটে চলেছি এক অজানার উদ্যেশ্য ।

    প্রায় দুদিন পর ট্রেন থামলো রাজধানী তে এসে ।নামলাম খুব ভোরে ।দারুণ লাগছিল রাজধানী তে এসে ।সেখান থেকে রওনা হলাম এক গাড়ি করে ।গাড়ি করে চলেছি সব কিছু দেখতে দেখতে ।খুব অপরূপ লাগছিল নানা রকমের দৃশ্য ।সব কিছুই আমি বন্দী করলাম নয়নের মনি কোঠায় ।

    প্রায় গাড়ি ছুটে চলেছে উত্তরা খন্ডের দিকে ।প্রায় উপস্তিত হলাম কাছাকাছি ।তার পর গাড়ি রেখে এক হোটেলে সেদিন রাত টা কাটালাম ।সেদিনই ভোরে আবার রওনা হলাম মহান উদ্যেশ্য কে সফল করার জন্য ।

    সব কিছু পিঠে নিয়ে এক টা লাঠি নিয়ে এগিয়ে গেলাম পাহাড়িয়া পথে ।সরু পথ ধরে চলতে লাগলাম খুব সাবধানে ।চলতে চলতে দেখলাম কত পাহাড়িয়া নানা রঙ্গের ফুল ।এক অপরূপ দেখতে লাগছিল। সব কিছু মনের ক্যানভাসে নয়নের মনি কোঠায় বন্দী করলাম ।কখনো মেঘ করে নেমে এলো ঝম ঝম করে বৃষ্টি ।কখনো দেখলাম আকাশ পরিষ্কার ।

    অবশেষে পৌঁছলাম মূল শিখায় ।কি অপরূপ যে লাগছিল নিজে ও বুজতে পড়ছিলাম না ।মনে হচ্ছিল র কখনো ফিরবো না ।আমি এখানেই থেকে যাবো ।শিবের সেবা করার জন্য ।

    মন্দিরে প্রবেশ করে আর ও অন্য অনভূতি জাগল মনে ।পূজো দিয়ে মনে বললাম জন্মই যদি তুমি দিলে সার্থক তবে কেনো করলে না ।আর ও কত প্রশ্ন করলাম মহাদেব কে ।আজ সব কিছুর উত্তর নিয়ে তবেই আমি ফিরবো ।না তোমার পায়ের কাছে মরবো ।

    সব কিছুর পরে উত্তর এলো ।হাওয়ায় ভেসে ভেসে ।ওরে পাগলি শোন তবে এখন ও যে তোর মর্তে অনেক কাজ আছে বাকি ।সেটুকু যে তোকেই পূরণ করতে হবে ।তবেই না তোর মুক্তি ।

    আর ও বলল কেউ কিছু পাবে বলে আসে না ।কর্ম করে যাঔ নিষ্ঠুর ভাবে ।ফল তুমি পাবেই পাবেই পাবেই ।এই বলে কে যেন চলে গেলো ।অট্টহাসি হেসে ।তার আমি উঠে দেখলাম উত্তরা খন্ডের মূল চূড়া যেনো আমায় ডাকছে হাতছানি দিয়ে ।

    এ এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার মনে ।

  • অণু গল্প

    অন্য পৃথিবী

    অন্য পৃথিবী
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    ধানবাদ ষ্টেশন থেকে 57 কিলোমিটার দূরে Parasnath Mandir (পারাস নাথ মন্দির ) এই তো সেদিন ঘুরে এলাম বিরাট বড় পাহাড়ের উপর মন্দির। পায়ে হেঁটেই উঠতে হয়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দোকান পাঠ আছে একটু বিশ্রাম করে নিতে পারেন। কৌতূহলের বিষয় হলো ওখানে জৈন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন। পুরুষেরা সবসময় নগ্ন থাকেন আর মেয়েরা সাদা থান কাপড় পরেন। নগ্নতা আমাদের সমাজে যেমন ভয়ঙ্কর ওদের সমাজে তেমনি সহজ সরল। নগ্নতার অর্থ এখানে সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। মন্দিরে যাবার পথে একটি দোকানে  কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পরলাম।

    হঠাৎ একটি বাচ্চা মেয়ে এসে কিছু পয়সা চাইল । দেখে মনে হলো খুবই গরীব। পর্যটকদের কাছ থেকে কিছু আদায় করা ওদের পেশা বলা যায়। ভিক্ষা শব্দটা এখানে না বলাই ভালো। কারণ ভিক্ষা শব্দের মানে ওরা বোঝে কিনা সন্দেহ আছে। আমি একটু মজা করেই মানি ব্যাগ থেকে 2000 টাকার একটি নোট বের করে, বাচ্চা মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলাম। নোটটি দেখে মেয়েটি যেন কারেন্টে শট খাবার মত পিছিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা শুকনো হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ও যেন বলতে চাইছে বাবু আমাদের দারিদ্রতা নিয়ে ব্যঙ্গ করো না॥

    তৎক্ষনাৎ আমি ওর সামনে 5,10,20,50,100, 500 এবং 2000 টাকার নোট দু হাতে করে ওর সামনে ধরে বললাম যেটা পছন্দ হয় নিয়ে নাও। ও আবার হেসে ফেলল । এ বারের হাসিটা যেন আমার প্রান জুড়িয়ে দিল। তারপর পাঁচ টাকার নোটটি নিয়ে নিল। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম 2000 টাকার নোটটি না নিয়ে,পাঁচ টাকার নোটটি নিলে কেন ?
    ও বলল —— বাবু ওটা নিয়ে ভাঙ্গাতে গেলেই সবাই ভাববে আমি চুরি করেছি।

    সত্যি তো এমন কথা এক বারও ভাবিনিতো। আমরাই তো সেই সভ্য সমাজের মানুষ যারা এই সব কথা ভেবে থাকি। দোকানদারকে সাক্ষী রেখে দু হাজার টাকার নোটটি ওকে দিয়ে দিলাম। ও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, সঙ্গে মুচকি হাসি দিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল।

  • অণু গল্প

    না

    না
    -মানিক দাক্ষিত

    সারাদিন অফিসে কলম পিষে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে চায়ে চুমুক দিয়েছি কিনা পাশের ঘর থেকে বিশ্রী রকমের একটা এলোপাথাড়ী ‘ধুপ-ধাপ’ শব্দ। সচকিতভাবে গিন্নির দিকে তাকাতেই ম্লান মুখে বলে, “নকুল বউটাকে পেটাচ্ছে। বেচারী বউটাকে কথায় কথায় মারে।

    –কান্নাকাটির তো আওয়াজ নাই?

    —লোকে শুনতে পাবে বলে বউটা আওয়াজ
    করে না। যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে।মটকা গরম হয়।

    পাশের ঘরে গিয়ে ধাক্কা মারতেই দরজা খুলে নকুল বেরিয়ে আসে। চোখ মুখ লাল। ঘরের এক কোণে বউটা জড়সড় হয়ে নি:শব্দে কাঁদছে। মুখ ফুলে গেছে। মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে।
    চীত্‍কার করে উঠলাম–“তুমি মানুষ, না জানোয়ার, বউটাকে এমনিভাবে মেরেছো? পুলিশ ডেকে তোমার এক্ষুণি একটা ব্যবস্থা করছি।
    আমার মুখের কাছে মুখ এনে নকুল ধীর শান্ত  গলায় তীর্যকভঙ্গীতে বলে, “কেন খামোকা আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন। যান, নিজের চরকায় তেল দিন।”
    রাগে অপমানে আমার গোটা শরীর কাঁপতে  লাগল। উদ্বিগ্নচিত্তে বউটা আমার দিকে এগিয়ে  এসে সলজ্জ ভঙ্গীতে মাথা নীচু করে দাঁড়ায়। বলে, “বাবু, থানায় খবর দেবেন না! “

    —“তোমাকে কি রোজই নকুল মারে? ”
    এদিক ওদিক দুদিকে মাথা নেড়ে বউটা উত্তর দেয়, “না”

    —-একটু আগে তোমায় নকুল মারছিল না!
    আবারও একই ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বউটা উত্তর দেয়, “না।”

    —তোমার মাথা ফাটলো কি করে?

    —বাথরুমে স্লিপকেটে পড়ে গিয়ে।

  • অণু গল্প

    বুকের মাঝে

    বুকের মাঝে
    -রমলা মুখার্জী

    আত্মীয়স্বজন আর অতিথিদের আগমনে উদিতির ছোট্ট বাড়িটা যেন সানাই-এর সুরের সাথে আনন্দে হাসছে। আজ যে তার মেয়ে ঝুলনের বিয়ে। প্রিয় বান্ধবীর মেয়ের বিয়েতে হিমিকাও দারুণ ব্যস্ত। অনেক কষ্টে সুমনের কাছ থেকে হিমিকা আজকের ছুটিটা আদায় করতে পেরেছে। অভিজ্ঞা বান্ধবীর ঘাড়ে বিয়ের প্রথাগত কাজকর্ম চাপিয়ে উদিতিও নিশ্চিন্ত। গত শ্রাবণেই তো হিমিকার মেয়ে খুশির বিয়ে হল। কত অশান্তি করেই না হোলো! খুশির পছন্দের আকাশ গরীব হলেও সৎ আর অনুভূতিপ্রবণ ছেলে। কিন্তু সুমন কিছুতেই বিয়েতে রাজি ছিল না। অর্থের দম্ভেই সুমন সব সময় ফুটছে,কারুর চাওয়া পাওয়াকে সে মূল্যই দেয় না। ঘর পোড়া গরু হিমিকা কিন্তু খুশিকে ভুল করতে দেয় নি।অনেক লড়াই করে সে খুশির আকাশ ছুঁয়েছে ।হঠাৎ হিমিকার চিন্তার সুতো কেটে যায় একজনের মিষ্টি ডাকে,
    -হিমু, আমায় চিনতে পারছ?
    -এই ডাক কি ভোলা যায়?
    অতীত স্মৃতিতে হারিয়ে যায় হিমিকা, বড় সরকারী অফিসার সুমনের সাথে হিমিকার বাবা যখন হিমিকার বিয়ে ঠিক করলেন তখন গানের শিক্ষক তপনকে প্রত্যাখ্যান করে অনেক সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে হিমিকা সুমনের গলায় মালা দিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সুমনের ভয়ঙ্কর মেজাজ সামলাতে সামলাতেই হিমিকার এতটা বছর কেটে গেছে ।

    -কি হল চুপ করে আছো কেন? সত্যিই কি চিনতে পার নি হিমু?
    -চিনতে পেরেছি গো, তুমি ছাড়া এত আপন করে আমাকে আর কে ডাকবে বল?
    -তুমি কি আর আগের মত গান কর? তোমার সুরেলা কন্ঠের সেই অসাধারণ গান কত দিন শুনিনি গো ।
    -আর গান, দিনরাত মেজাজী বরের ফাইফরমাস খাটতে খাটতেই দিন চলে যায় ।
    মনে পড়ে যায় হিমিকার তপনের সংগে নানান অনুষ্ঠানে গান করার কথা। কত পরিচিতি তখন হিমিকার,আর নন্দন চত্বরে তপনের সাথে কাটানো প্রেমের দিনগুলো…. সত্যিই সুখ যেন উপছে পড়ত। হিমিকার গাল বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা।
    -আমায় ক্ষমা করে দাও তপু ।
    -ক্ষমা কিসের হিমু। আমাকে সম্পূর্ণ করে বোঝার তোমার এই উপলব্ধি সেটাই তো আমার পরম প্রাপ্তি। দুজনেই দুজনের বুকের মাঝে আছি সেটাই বা কম কিসের বল?

  • অণু গল্প

    সিঙ্গাড়া

    সিঙ্গাড়া
    -সাত্বকী বসু 

     

     

    সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে সামনের দোকানটায় গরম গরম সিঙ্গাড়া যেন বার বার কাছে ডাকতে চাইছে অতনুকে।মেঘার হাতটা ধরে ওই দোকানের দিকে যেতেই মেঘা বলে উঠলো,
    -ওই তেলেভাজা নো ওয়ে বাবু।আমার এতদিনের ডায়েট ওই রাস্তার আজে বাজে খেলে পুরো মাঠে মারা যাবে।
    কিন্তু অতনু নাছোড়।অবশেষে দুজনে স্থির করলো দুটো কিনবে আধখানা মেঘা খাবে,আর বাকিটা অতনুকে খেতে হবে।

    দোকানের বেঞ্চটায় একটি বছর ষোলোর মেয়ে,পড়নে আধময়লা পোশাক,বসে সিঙ্গাড়া খাচ্ছে।বেশ তৃপ্তি করে।
    ওর বাপটা মিস্ত্রীর কাজ করে।অনেকদিন ধরে বায়না করছিল তাই আজ বাপ দশ টাকা দিয়েছে সিঙ্গাড়া খেতে।
    ও জানে মায়ের অসুখ,বাপটাকে মাসের মাইনের প্রায় পুরোটাই ওষুধ কিনতে হয়।
    তবু ও যে সিঙ্গাড়া খেতে বড্ড ভালোবাসে।
    খাওয়া শেষে জলের জগের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল মেয়েটা,
    আবার কবে সিঙ্গাড়া কপালে জুটবে কে জানে?তাই থাক যতটুকু সময় স্বাধটা জিভে লেগে থাকে,থাক!

  • অণু গল্প

    কমলার স্মৃতিচারণ

    কমলার স্মৃতিচারণ

    মৌসুমী সাহা মহালানাবীশ

     

     

    কুন্তল ছিল কমলার একমাত্র সন্তান,
    শৈশব থেকেই বাপ হারা ছেলেকে নিয়ে লড়াইটা ছিল কমলার!
    দিনের পর দিন বাবুদের বাড়ি ঘর মুছে,কাপড় কেচে,বাসন মেজে চলতো কমলার সংসার।
    পড়াশোনার প্রতি ভারি মনযোগ ছিল কুন্তলের।

    কমলা তা ভালোই বুঝতে পারতো—-
    তাইতো রাতের পর রাত জেগে,ঠোঙা বানিয়ে দিয়ে আসত কাক ডাকা ভোরে।
    কমলার জীবনের কষ্টের কাহিনীর অন্তর্গত ছিল কুন্তল, সবই ছিল তাকেই ঘিরে—–
    অভাবের সংসারে মা-ছেলের একটাই স্বপ্ন,
    একদিন এ আঁধার কাটিয়ে রবির কিরণ এসে পড়বে জানালার এপারে,
    তাদের স্পর্শ করে যাবে সোনালি রোদের ছটাক,,,,

    বহু বছর কেটে গেছে——
    আজ কমলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মা-ছেলের পুরোনো স্মৃতিচারণ করছে।

    আজ আর সংসারে অভাব নেই,
    কুন্তল আজ সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত,সে যে আজ বড়ো অফিসে চাকরি করে।
    আজ কুন্তল বিবাহিত,নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
    তবে এতটুকু শান্তি নেই,ওদের বিবাহিত জীবনে—–
    যত যুদ্ধ যেন বৃদ্ধা কমলাকে ঘিরে……
    পাশের ঘরে প্রতিনিয়ত ছেলে-বউ এর অশান্তি যে চরমে…
    শুনতে শুনতে কমলা দগ্ধে মরে!
    যুদ্ধ যে চলে পাশের ঘরে!
    আর যে সহ্য হয়না—-

    কি কাজে লাগে উনি আমার?
    কতোবার বলেছি,এসব দায়িত্ব আমি ঘাড়ে নিতে পারবনা…পারবনা…পারবনা…
    শুধু বসে বসে অন্নের ধ্বংস ছাড়া আর কি আছে ?

    রুনা তোমাকে কত্তো বার বলেছি! মা কে ওভাবে বলবেনা।
    তুমিতো জানো,মা কতো কষ্ট করে আমাকে বড়ো করেছে,
    মানুষ করেছে!

    সে তো সব্বাই করে কুন্তল,
    এটা তো ওনাদের দায়িত্ব…
    আলটিমেটলি,ওনারা তোমাকে জন্ম দিয়েছে।

    সেটাই তো বোঝাতে চাইছি রুনা….
    উনি আমাকে জন্ম দিয়েছে,উনি যে আমার মা!
    আমি ছাড়া কে দেখবে মাকে ?
    এটাও কি আমার দায়িত্ব না!!

    প্লিজ কুন্তল,
    এক্সকিউজ দিওনা…
    কালই আমি রনিতকে নিয়ে বাপির কাছে যাচ্ছি!

    রুনা…

    থাক,,,অনেক হয়েছে,
    তুমি থাকো তোমার বৃদ্ধা মা কে নিয়ে—–

    পাশের ঘর থেকে কমলা ছুটে এসে!
    বাবু!
    শুনেছি বৃদ্ধাশ্রমে নাকি আমার মতন অনেকে থাকেন,
    দেখনা বাবা!
    আমাকে একবার ওখানে রেখে আয় না!
    এমনিতেও সারাটাদিন একঘরে থাকতে আমারও ভালো লাগে না,
    শুনেছি ওখানে সবাই খুব ভালো থাকে!
    তুই নাহলে মাঝেমধ্যে গিয়ে একটু দেখে আসিস!!!

    মা তুমি শেষে বৃদ্ধাশ্রমে…

    তাতে কি হয়েছে বাবা!
    আমিতো তোমার হৃদয় থেকে দূরে যাচ্ছি না!
    এতো বছর তো আমরা একসাথেই ছিলাম,
    আজ একটু নিজের সংসারে মন দাও…..
    তুমি না বাবা হয়েছ,,,,
    মনের মতন করে সন্তান মানুষ করো,
    আমি যে আজ আছি ,কাল নেই…..
    ওদেরকে সাথে নিয়েই যে তোমাকে বাকিটা পথ চলতে হবে বাবা……!

    তবে তোমার বাকিটা পথ বুঝি ওই বৃদ্ধা আ….

    আমি জানি তুমি আমার লক্ষ্মী ছেলে!
    এবার আমার একটা ব্যবস্থা করো বাবা!
    যত তাড়াতাড়ি পারো…

    মা…..

    হ্যাঁ বাবা আমি সব সময়ই তোমার সাথে থাকবো!

    নীরবে চোখের জল মুছে ঘরে গেল কমলা!
    কুন্তলের বুকের হাহাকার বুঝি শুনতে পায়নি রুনা!

    সত্যিই এবার বুঝি বিদায় দেবার পালা—-
    এবার বুঝি সূর্য ডোবার পালা—-

  • অণু গল্প

    বিলুপ্তি

    বিলুপ্তি
    -সুদেষ্ণা সরকার

     

     

    ঋতুদের বাড়ির পাশের খালে একটা কুকুর মরে পড়ে আছে।কাল রাতেই হয়তো মরেছে, কি উৎকট গন্ধ বেরিয়েছে।কৌতূহলী লোকজন কারণ অনুসন্ধানে ব‍্যস্ত,কুকুরটার একটা পা ভেঙ্গেছে, রক্তটা শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে।সাত সকালে এই অনাসৃষ্টি কান্ডকারখানাতে অনেকেই বিরক্ত।পাড়ার ছেলেগুলো গভীর আলোচনাতে মগ্ন

    বাপাই এর মা নাকে কাপড় চাপা দিয়ে ব‍্যালকোনি থেকে চেঁচিয়ে বলল-“আরে করপোরেশনের লোকদের ডেকে এটার একটা ব‍্যবস্থা করতে পারছো না? উফফ!! যত উটকো ঝামেলা।

    দীপা কাকিমা থেকে ঋতুর মা সবাই বিরক্ত হয়ে উঠছে।সকালটা বুঝি তাদের নষ্ট হয়ে গেল।

    কিন্তু ঋতু কিছু বলছে না।মৃত কুকুরটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।জমাট বাঁধা রক্তগুলোর উপর মাছি ভন্ ভন্ করছে,হয়তো এক্ষুনি বেঁচে উঠে একরাশ কাঁচা তুলতুলে মাংসের উপর থাবা বসাবে।ভয়ে গা শিউরে উঠল ঋতুর।বিপ্লবের মতো মানুষেরা কাউকে মারতে ভয় পায়না।

    সাত সকালে একটা কুকুর মারা যাওয়াতে বুঝি এক মনোরম সকালটার বারোটা বাজতে পারে,কিন্তু কেউ হয়তো জানে না এই কুকুরটা মারা না গেলে পাশের বাড়ির মেয়েটাকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যেত না।

  • অণু গল্প

    দায়িত্ব

    দায়িত্ব

    -অমল দাস 

     

    -পীযুষ তুমি রেডি হয়ে থাকলে তুতান কে একটু খাইয়ে দাও।

    -কেন তুমি কি করছ…?

    -আমি শাড়িটা পরছি ।

    -তুমিই খাইয়ে দিও শাড়ি পরে , আমি বেরচ্ছি !

    -প্লিজ একটু খাইয়ে দাও , তোমার তো এখনো সময় হয় নি বেরনোর !

    -সময়টাও আজ কাল তুমিই বলে দেবে ?

    -প্লিজ রাগ করোনা! তুতান কে তৈরি করতে লেট হয়ে গেল , আমার শাড়িটা পরা হয়নি, আমিও তো বের হব।

    -একদিন লেট হলে কিছু হবেনা । তাছাড়া এমন কিছু দেরি হয়ও নি এখনো।

    -এভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাও কেন প্লিজ বলত আমায় ?

    -দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন এলো কোথা থেকে , তুতানকে খাওয়ানোর কাজটাও কি আজ থেকে আমাকে করতে হবে ?

    -আজ থেকে মানে ? আজ থেকে তো দূর , একদিনও করেছ ? বাবা তো সন্তানকে আদর করে কোলে তুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করে সেটাও আজ পর্যন্ত করেছ তুমি?

    -সোহিনী ! তুমি কি সকাল সকাল গলাবাজি করতে চাইছ না আমার কাঁধে দায়িত্ব ঝেরে ফেলতে চাইছ?

    -দায়িত্ব …..! দায়িত্বের কথা বলছ , সেটা তুমি করও নাকি, তুতানের স্নান , খাওয়ান ,স্কুল নিয়ে   যাওয়া নিয়ে আসা , অসুস্থ হলে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়া, সংসারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা কোনটা আজ পর্যন্ত করেছ , না আমি আজ পর্যন্ত বলেছি পীযুষ ?

    -দেখ সোহিনী ফালতু বাকবিতণ্ডা করে লাভ নেই আমি যা পারি করব তুমি তোমার দিকটা দেখ। তুতান কে মানুষ করার দায়িত্বও তোমার।

    -হ্যাঁ তাইতো দেখছি! সব রেসপন্সবিল্‌টি আমার তোমার কোন দায় নেই! ওকে জন্ম দিতে তোমার দায়িত্ব ছিল- পালনে  নেই, ও পরিচয়ে তোমার নাম পেল -ওর শিক্ষায় তুমি নেই। বাঃ.. রে…. ওকে জন্ম দিলাম দুজনে, সব দায় আমার সব নাম তোমার! একটা কথা শোন আমি কুন্তী নই আর তুতানও সূর্যের বর প্রাপ্ত সন্তান নয়। অতএব বাবার কর্তব্য তুমি ঝেরে ফেলতে পারনা।

    এই সবের মাঝেই ছোট্ট তুতান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে কিছুক্ষন পর বলে ওঠে , মা মা তুমি আমাকে দাও আমি একা একা খেয়ে নেব।

    =সমাপ্ত=

  • অণু গল্প

    গোলাপ বালা

    গোলাপ বালা

    -শিবানী গুপ্ত 

     

    রানাঘাট লোক্যাল ট্রেনটা চাকদহ স্টেশনে থামতেই আমি উৎসুক। আমার চঞ্চল চোখদুটো আতিঁপাতি খুঁজে ফেরে অতি সুকুমার লাবনীঢলঢলে একটি মুখ। যার আয়তচোখের কাচে জলের স্বচ্ছতা, বিশ্বের সরলতা যার মুখের পরতে পরতে পরিস্ফুট। এদিক -ওদিকে চোখদুটো সার্চলাইটের মতোচরকি কেটে চলেছে, শুধুমাত্র একখানি পেলব মুখশ্রী। কি ব্যাপার! কাউকে তো দেখছিনা! এমনতো হবার কথা না, খবর তো দিয়েছিলাম, আমার যাবার সংকেত দিয়ে, তবে! স্টেশনে গাড়িটা প্রতিদিন পাঁচমিনিটের জন্য থামে, সময়তো হয়ে এলো, এখুনি ট্রেনটা চাকদহ থেকে বেড়িয়ে যাবে। কেমন আঁকুপাকু করে ওঠে মনটা, তবেকি, কোন সমস্যা এসে পড়লো! তাইকি আসতে পারছে না? বলেছিলাম, আমি রানাঘাট লোক্যাল ধরে কৃষ্ণনগর যাবো, কখন যাবো তাও বলেছিলাম। শুধু ওকে একটিবার চোখের দেখা দেখবো বলেইনা এপথে আসা—- রেলে লাউডস্পীকারে ট্রেন ছাড়ার সংকেত ঘোষনা হচ্ছে——– একটা অস্থির উচাটনের ঢেউ, একটা অদ্ভুত কষ্টের তীব্র মোচড় টের পাচ্ছি বুকের ভেতর, নিরাশার বালুচরে কি তবে কোন মরুদ্যান নেই! আমি কি খুব বেশী প্রত্যাশা করে ফেলেছি! হয়তো, আমারই অবিমৃষ্যকারিতার ফলশ্রুতি—- ট্রেন হুঁইসেল দিল। বেপরোয়া গোয়ার্তুমিই করে বসলাম কি, এতোবেশী প্রত্যাশা করা কি সমুচিত হলো! একটা ঝাকুনী দিয়ে মন্থর গতিতে ট্রেন চলতে সুরু করতেই বেপরোয়া অবুঝ চোখদুটো বুঝি ঝাপসা হতে যাচ্ছিল — এ্যাই যে, শুনছেন?প্লিজ ,একটু শুনুন —— ট্রেনের গতি তখনও শ্লথ, প্ল্যাটফর্ম চত্বর পেরোয়নি, অতি চেনা সুরেলা কন্ঠের ডাকে চমকে ওঠে জানালার দিকে তাকাতেই মনটা ফুলেল সুবাসে বিভোর —-সোমা! তুমি! ছুটতে ছুটতেই হাত বাড়িয়ে দেয় সোমা—নাও,আজকের দিনে এরচাইতে বড়ো কিছুনেই, তাই, এটাই তোমাকে দিতে এলাম, ধরো —– আমার সমস্ত অন্তর আলোকময়। ।দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম অজান্তেই। ট্রেনের বেগ বাড়ার সাথে সাথেক্রমশঃ চারপাশে দৃশ্যাবলী, দোকানপাট, ঝুপরী, এমনকি সোমাও দৃষ্টিসীমার বাইরে —— এবার চোখ সেঁটে থাকে হাতের অঞ্জলিতে ধরে রাখা জিনিষটার দিকে,-একি! এতো টকটকে একটি লালগোলাপ! মুগ্ধতায় নিমেষে মনের আকাশে অনুরাগের রামধনু ঝলসে ওঠে, ওমা, তাইতো, আজতো গোলাপ দিবস! টকটকে লাল গোলাপের কবোষ্ণ নরম গালে আমার অনুরাগের চুম্বন এঁকে দিই পরম সোহাগে় এ যে আমার, একান্তই আমার গোলাপ বালা়।

You cannot copy content of this page