অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- এই মেঘ, এই রোদ্দুর

    এই মেঘ, এই রোদ্দুর
    -সুনির্মল বসু

     

     

    তিনি এইসবে ক্লাস টুয়েলভে নাটক পড়িয়ে এলেন, সবে এসে স্টাফ রুমে বসেছেন, তখন ছাত্রটি এলো,
    আমাকে বাংলা পড়াবেন, স্যার?
    -কোথায় বাড়ি?
    -পাশেই আদর্শ পল্লী,
    -ছুটির পর নিয়ে যেয়ো।
    এই স্কুলে শুধু নয়, এই‌ অঞ্চলে শিক্ষক হিসেবে অবিনাশবাবুর খুব নামডাক।একসময় তিনি এখানকারই ছাত্র ছিলেন। ভালো পড়ান, ভালো বলেন, ভালো লেখেন। কাগজে লেখা ছাপা হয়।
    ছুটির পর তিনি দেখলেন, সেই ছাত্রটি বাইরে ‌তার জন্য অপেক্ষায়। তিনি পড়ান অনেক, তবু, আরো পড়াতে চান। ভেবেছেন, সাহিত্যটাকে ভালোবাসতে‌ শেখাবেন সবাইকে।
    ও বাড়িতে যেতেই, ছাত্রের মা এগিয়ে এলেন,
    আসুন স্যার, আপনার নাম শুনি খুব, আপনি পড়ালে, নিশ্চিন্ত হতে পারি। কাগজে আপনার ‌লেখা পড়েছি,
    অবিনাশবাবু কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছেন না, তিনি ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতে পারছেন না।
    -আপনার জন্য চা আনছি। তিনি রান্নাঘরে গেলেন।
    অবিনাশবাবু ততক্ষণে অতীতে ফিরে গেছেন। বর্ষা কাল। প্রবল বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ। পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েরা নীল শাড়ি পরে স্কুলে যাচ্ছিল। সমীর বললো, জল ছেটাতে পারবি?
    অতি উৎসাহে সেদিনের ক্লাস টেনের অবিনাশ জল ছিটিয়েছিল, যা একটি মেয়ের‌ শাড়িতে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি স্কুলের হেড মাষ্টারের ঘরে।
    অসিত চ্যাটার্জী কড়া মানুষ। এক সপ্তাহ সাসপেন্ড,গারজিয়ান কল।
    আজ এত বছর বাদে, সেখানেই পড়াতে আসা।
    তিনি চা মিষ্টি দিলেন, তাঁর কবিতা ভদ্রমহিলা নিয়মিত পড়েন, ভালো লাগে, জানালেন।
    অবিনাশবাবুর মনে হলো, অতীতের ছোট ছোট চুল কাটা অবিনাশের সঙ্গে উনি বর্তমানের অবিনাশকে মেলাতে পারেন নি। তিনি শিক্ষক অবিনাশে মুগ্ধ।
    সুমিতকে পড়াচ্ছেন মাস তিনেক হলো।
    পড়ার পর কবিতা নিয়ে কথা হয়, ভদ্রমহিলা সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার ভক্ত। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর প্রিয় লেখক।
    বেশ আলাপী, পড়াশুনা আছে ওনার। অবিনাশবাবু রোজ ভাবেন, আজই বলবেন, বলা হয়না।
    অবশেষে একদিন বলেই ফেললেন, জানেন, আপনার জন্য আমি একদিন হেডস্যারের কাছে শাস্তি পেয়েছিলাম।
    -কি ব্যাপার বলুন তো? ভদ্রমহিলা বেমালুম ভুলে গেছেন, অথচ, অবিনাশ বাবু এতটুকু ভোলেন নি।
    অবিনাশবাবু ঘটনাটা বললেন, ভদ্রমহিলা হো হো করে হেসে উঠলেন।
    সেদিন ওভাবে পাগলের মতো আপনাদের স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছে নালিশ করাটা আমার ‌একেবারেই উচিত হয় নি। সত্যি কি ছেলেমানুষ ছিলাম, তখন আমরা।
    যাক, এতদিনের জমে থাকা মেঘ সরে গেছে, আকাশে এত আলো, এত রোদ্দুর।
    সুমিতকে ভালো করে সাহিত্য পড়াতে হবে, সাহিত্যকে ছড়িয়ে ‌দিতে হবে, সবার মধ্যে, অবিনাশ বাবু ভাবলেন। আর কোনো উদ্বেগ নেই, খোলা আকাশ আর আলোর নীচে অবিনাশবাবু হেঁটে চললেন।
    ভদ্রমহিলার কথা কানে‌ বাজছিল,
    সত্যি কি ছেলেমানুষ ছিলাম তখন আমরা।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সংগ্ৰাম

    সংগ্ৰাম
    -শম্পা সাহা

     

     

    “ধ‍্যাৎ ভাল্লাগে না। রোজ রোজ মাম্মাম এক খাবার দেয়। ধুর্!’

    ব্যাপ্তি ওর টিফিন বক্সটা বাড়ি ঢোকার আগে যে মোড়টা পরে সেই মোড়ের রাস্তায় রাখা ডাস্টবিনে উপুড় করে। তার আগে অবশ‍্য এদিক ওদিক দেখে। কেউ দেখছে না তো?

    ডাস্টবিনটা এমনিতেই উপচে পড়ছে। কিছু পড়লো ভেতরে। কয়েকটা আঙুর, আর একটা স‍্যান্ড উইচ গড়িয়ে গিয়ে পড়লো একটু দূরে।

    আসলে আজ অভিলাষার জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে চিকেন মোমোর প্যাকেট, কেক আর চকলেট দিয়েছে। ওর পাপা ইয়া বড় গাড়ি করে সব ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়েছে। এটাই ওদের স্কুলের রীতি। সবাই যে যার জন্মদিনে ট্রীট দেয়। ব‍্যাপ্তিও দিয়েছিল।

    ওকে বাসটা মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যাবার পর প্রায় দিনই এভাবে ও টিফিন বক্স উপুড় করে। আসলে ওর পাপা আর মাম্মাম দুজনেই ডাক্তার। তাই বিজি। ওকে বাসেই আসতে হয়। আর বাড়ি ঢুকেই সুরূপাদি ওকে খাওয়াতে বসবে। ও না খেলে সুরূপাদিকে মাম্মাম খুব বকে। তাছাড়া তিনমাস অন্তর অন্তর পাপা নিজে ওর ওয়েট চেক করে। তাই স্কুলে ফ্রেন্ডদের থেকে কিছু খেলে আর পেটে টিফিন খাবার জায়গাই থাকে না!

    ও কিছুদূর এগিয়ে যেতে দুটো নেড়ি কুকুর আর একটা মানুষের মধ্যে লড়াই শুরু হল। মানুষটা শুধু দেহাবয়বে মানুষের মত। এগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো স‍্যান্ড উইচের ওপর। বাঁ হাতে একটা ঢিল ছুঁড়ে দিল কালো কুকুরটার দিকে! মোক্ষম জায়গায় লেগেছে! বেশ বড় ঢিল! কেঁউ কেঁউ করে কালোটা পালাতে ঘেয়োটাও ওর পেছন পেছন দৌড় দিল। ওরা বুঝে গেছে এই অসম লড়াইয়ে ওদের জেতবার সম্ভাবনা নেই।

    চোখ বুজে, দাঁড়িগোঁফের জঙ্গলে ভরা মুখটা হাঁ করে একটা বিরাট কামড় মেরে চিবোতে থাকে মহার্ঘ্য খাবার আর অন‍্য হাত মাছি তাড়ায়।

    ব‍্যাপ্তি ততক্ষণে বাড়িতে পৌঁছে ফ্ল‍্যাটের বেল টিপেছে। ওর পেছনের সংগ্ৰাম ওর অজানাই!

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- ত্রাণ

    ত্রাণ
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    আমাদের পঞ্চম ত্রাণ যাত্রা আগামী কাল সকাল আটটায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আজ যাওয়া সম্ভব হয় নি।
    বেশ জোরে জোরে ঘোষণা করা হলো ক্লাবের সামনে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হলো বড়ো করে একটা ফেস্টুন বানাতে। যাতে কোথায় কোথায় ত্রাণ দেওয়া হলো সব উল্লেখ থাকবে। ক্লাবের নামটা বড়ো বড়ো করে লিখতে হবে। সবাই দেখুক, জানুক আমরা কোনো কিছুতে পিছিয়ে নেই। মানুষের পাশে আছি সব সময়।
    ক্লাবের সভাপতি নিরঞ্জনবাবু বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করে চলে গেলেন।
    আরও বললেন, ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য কালকে ত্রাণে থাকছে ত্রিপল, হাঁড়ি কড়াই আর কিছু শুকনো খাবার। সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতে হবে। সব নির্দেশ দিয়ে গেলেন ক্লাবের ছেলেদের।

    পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল এই গাঁয়ের’ই নবীন চাচা। মুখটা কাঁচুমাচু করে মাথা নিচু করে সব শুনছিল। হাতটা বাড়াতে গিয়েও থমকে গেলেন।
    পরের দিন যথাসময়ে ত্রাণের গাড়ি এসে হাজির। ফেস্টুনটা তৈরি। বেশ বড়ো বড়ো করে লেখা আছে ক্লাবের নাম। সভাপতির নাম। সবাই প্রস্তুত।
    পথ রোধ করে দাঁড়ালো নবীন চাচা। হাত জোড় করে বললো, বর্ষায় খড়ের চালটা নেমে গেছে। ঘর থেকে টপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তোমরা তো ত্রাণ দিতে যাচ্ছো। দেবে গো একটা ত্রিপল? আমার ঘরের জন্য। আর কিছু শুকনো খাবার। ছেলেটা সকাল থেকে না খেয়ে আছে। আমি বড়ো মুখ করে বলে এসেছি, তোর জন্য ক্লাব থেকে খাবার আনছি। দেবে গো সভাপতিবাবু?
    মুখটা বিরক্তির সুরে বললো, দেখতে পাচ্ছো, সব মাল রেডি হয়ে গেছে ইয়াস দূর্গত এলাকার জন্য। আর তোমার এখুনি বলার সময় হলো। এখুনি মিডিয়া আসবে খবর দিয়েছি। সংবাদ শিরোনামে আসবে আমাদের ত্রাণ প্রকল্পটি। এখন যাও তো বাপু। ত্রাণ দিয়ে ফিরে এসে দেখা যাবে। যদি বাঁচে তো, তোমার জন্য একটা ত্রির্পল ..
    থাক বাবু, তোমরা যাও। শুভ কাজে যাচ্ছো। আমার কাছে কিছু খুচরো পয়সা আছে যদি ওদের কাজে লাগে, নেবে গো ত্রাণের জন্য?
    আমাদের ঠিক চলে যাবে দুবেলা। আগে ওরা তো বাঁচুক। বলেই লুঙ্গির খুঁটে বাঁধা একটা টাকার বান্ডিল এগিয়ে দিল সভাপতির দিকে। অনেক দিন ধরে জমিয়ে ছিল ছেলের পড়ার জন্য। তাই শত অভাবেও এ-টাকা খরচ করে নি। আজ সেই টাকাই তুলে দিল ইয়াস কবলিত এলাকার ত্রাণের জন্য।
    ততক্ষণে মিডিয়া হাজির। সেখান থেকে কোনোক্রমে মাথা নত করে একপ্রকার ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চললো ত্রাণের গাড়ি।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- জীবনের রঙ

    জীবনের রঙ
    – তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

     

     

    এখনতো অখন্ড অবসর বিশ্বনাথবাবুর। রিটায়ার করেছেন বারো বছর হয়ে গেলো … বউ মিনতিও চলে গেছে পরপারে…তিন ‘বছর হয়ে গেলো। এখন তিনি বড় একা। মিনতি থাকতে তিনি বোঝেননি যে শান্তশিষ্ট পত্নী তার জীবনের কতটা জুড়ে ছিলেন। মিনতি কতটা মায়ার বন্ধনে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন।
    বিশ্বনাথবাবুর দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাইকেই লেখাপড়া শিখিয়েছেন…বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে হায়দ্রাবাদে থাকে পরিবার নিয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে মুম্বাইয়ে। একমাত্র ছোট ছেলেই কলকাতায় ওনার সাথে থাকে। ছোট ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি…বিশ্বনাথবাবুর সংসার।

    ছোট ছেলে বাবাকে বাজারদোকান করতে দেয় না, বলে সারাজীবন অনেক খাটলে, ছোটাছুটি করলে… এখন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে এত কাজ আর করতে হবে না। তুমি শুধু খাও-দাও, ঘুমাও আর বেড়িয়ে বেড়াও।

    বিশ্বনাথবাবু প্রথম প্রথম রিটায়ার করার পর অনেকটা সময় কীভাবে কাটাবেন বুঝতে পারতেন না। আগে দিনের একটা বড় অংশ অফিসেই কেটে যেত। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রাত হয়ে যেত। তারপর খাওয়াদাওয়া করে খবরের কাগজটা নিয়ে শুতে শুতেই ঘুম জড়িয়ে আসতো দু’চোখে। আবার ভোর হলেই উঠে দিনের নানা কাজ শুরু করতেন… সকাল সাত’টাতেই বেরিয়ে যেতেন… অনেক দূরের অফিস। বাড়ির লোকের সাথে ছুটির দিন ছাড়া কথা বলারই তেমন সময় পেতেন না।

    এখন ওনার হাতে অনন্ত সময় কিন্তু ওনার আশেপাশে সবাই ব্যস্ত… ছুটে চলেছে। একা একা বসেবসে কত চিন্তাভাবনা আসে মাথায়। কখনো কখনো ছোটবেলার কথা মনে করেন…কত গল্প…ছোট বৌমা সামনে থাকলে তাকেই বলেন তাঁর সোনাঝরা সবুজ দিনের কথা। অল্পবয়সে অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো… এখন পুরোনো পাড়া থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। ফোনে যোগাযোগ হয় তাদের সাথে। কিন্তু যেতে পারেন না।ছেলেমেয়েরাও রোজ দূর থেকে ফোন করে খবর নেয়। খুব দেখতে ইচ্ছে হয় ওদের।

    আর ছোটনাতি পড়াশুনো, কোচিং, গিটার ক্লাসের ব্যস্ততার ফাঁকে দাদুর কাছে এলেই দাদুর মন খুশী হয়ে যায়। নাতির প্রাণচঞ্চল ভালোবাসায় দাদুর মনে, জীবনের সবুজ রঙের ছোঁয়া লাগে। সতেজ হন তিনি। একমাত্র তখনই বাঁচতে ভারী ভালো লাগে তাঁর। নয়তো নানা অসুখবিসুখ আর বিয়োগব্যথায় বাঁচার ইচ্ছেটা কমে যাচ্ছে আজকাল।

    দুপুরে খাওয়ার পরে ইজিচেয়ারে এসে বসেন তিনি। তারপর বই, কাগজ পড়েন। একটু ঝিমুনি মত আসে তখন। তারপর বিকেলে খেলার সঙ্গী এলে দাবা খেলেন।

    আজ ইজিচেয়ারে আধশোয়া বিশ্বনাথবাবু।চোখদুটো বোজা। টেবিলে দাবার বোর্ডটা পাতা। সামনের চেয়ারটা ফাঁকা। রোজ বিকেলের খেলার সাথী বিজন আর কোনোদিনও আসবেনা…চলে গেছে চিরতরে। মনটা আজ বড্ড খারাপ। সন্ধ্যা হয়ে এল। ঘরে অন্ধকারের দীর্ঘ ছায়া। কে যেন ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলো–তাকিয়ে দেখেন ছোটনাতি প্রমিত।

    -দাদান, চলো এক দান হয়ে যাক্।
    -চলো,দাদুভাই।
    কাঁপা হাতে সাদা-কালো ঘুঁটিগুলোকে সাজাতে থাকেন বিশ্বনাথবাবু।।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- আত্মকথন

    আত্মকথন
    -সুনির্মল বসু

     

     

    মধ্যরাতে দুধেল জ্যোৎস্নায় পাহাড়ের খাঁজে চাঁদ দেখলে, তোমার কি কোনো চাঁদ মুখের কথা মনে পড়ে, বিগত পঞ্চাশটা বসন্ত পেরিয়ে আসার পর কারো জন্য বুকের বাঁ দিকে চিন চিন ব্যথা অনুভূত হয়, মধ্যরাতে কোনো নারীর কান্না কি তোমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়?
    সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক ছবির মতো নির্জন উপকূলে উদাস নীল সমুদ্রে আজো কি স্মৃতিতে ভাসে সেদিনের প্রিয় নায়িকা, এক লহমায় কলেজ ভার্সিটির দিনগুলো ভেসে যায়? কফি হাউস, বসন্ত কেবিন, বসুশ্রী সিনেমা, গড়িয়াহাট মোড়, কত সোনালী বিকেলের অর্থপূর্ণ ছায়াছবির কোলাজ,

    আমি তোমায় ভালোবাসি, অনন্যা,
    ভ্যাট, বাজে বোকো না,
    ওই দ্যাখো, রাস্তা পেরুচ্ছেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত,
    দেখছি তো, কবি রাস্তা পেরুলে, পথে সময়ের উতরোল ঢেউ ওঠে, ট্রাম লাইন পেরিয়ে, অজস্র জনতার ভিড়ে সময় হেঁটে যায়,
    মাঝে মাঝে অতীত বড় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, অমলেন্দু, আমি তো তোমাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম, তুমি তো আমায় ফিরিয়ে দিলে,
    পুরুষের অক্ষমতা তুমি বুঝবে না,আমাকে চলে যেতে হল, অনেক দূর,রাতের নিয়ন আলো, লেকের ধার, গোলপার্কের রাস্তায় কত স্মৃতি পড়ে আছে, যে নিজে থেকে হারায়, তাকে খুঁজে কি লাভ,
    খুঁজি না তো, নদীর ঢেউ সরে গেলে, তটরেখার পলিমাটি ভেসে ওঠে, যে দিনগুলো খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল, মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে,আমাকে আর তুমি কখনো খুঁজো না অমলেন্দু,
    অনন্যা, আমি কখনো তোমাকে খুঁজি না, কোনো কোনো দিন বিকেলে, অথবা, ভরা সন্ধ্যায় তুমি আমার স্মৃতির মধ্যে এসে পড়ো,
    স্মৃতি কি এতটাই পরাক্রমী,
    বোধহয়, নইলে পঞ্চাশ বছর তো কম সময় নয়,
    অমলেন্দু, সেসব দিন আমি আর মনে করতে চাই না,
    ভুলে যেতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু পারলাম কই,
    আমার জীবন যেন খোলাপাতা একটা বই,
    এভাবে মনে কষ্ট পুষে রাখলে বাঁচা যায় না,
    জানি, স্মৃতি এত নির্মম, তোমার সঙ্গে দেখা না হলে ভাল হত,
    তুমি দেখছি স্মৃতিতে বাঁচো, আমি উদাস আকাশে জনতার অরণ্যে ভাসি,
    সব কথা হয়েছে বলা, এভাবেই প্রতিদিন বাঁচি,
    এ এক একাকিত্বের খেলা, বয়ে যায় বেলা, পাহাড় থেকে সাগর, সাগর থেকে রাজপথ সে দিনের স্মৃতি নিয়ে সাক্ষী থেকে যায়,
    তুমি বড্ড অদ্ভুত,
    আমি স্বাভাবিক নই, স্বাভাবিক হলে, একটা গড়পড়তা জীবন খুঁজে পেতাম,
    দেখো না খুঁজে,
    তাঁকে আমি খুঁজি না কখনো, অনুক্ষণ নিজের মধ্যে খোঁড়াখুঁড়ি চলে, এভাবেই বেঁচে আছি বেঁচে থাকার ছলে, জীবন আমার অন্য কথা বলে,
    আজ যাই, অমলেন্দু, আমাকে ভুলে যেও, আমাকে মনে রেখো না,
    পারি না, সবার মত হতে পারলাম না, অনন্যা,
    বেশ, তুমি তোমার মতো হোও, আজ চলি,
    কী করে ভুলি সেদিনের কথাকলি,

    দুটি ভিন্ন পথে ওরা এগিয়ে যায়।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- প্রভু আমার প্রিয় ‌আমার

    প্রভু আমার প্রিয় ‌আমার
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    -“দাদু ও দাদু নীচে যাবে না?” ঠাকুরমশাই তো কখন এসে গেছে। পুজোও শুরু করে দিয়েছে, একটু পরেই আরতি হবে। ঠাম্মা তোমাকে নীচে যেতে বললো।”
    -“আমি যে এখানেই আরতি দেখতে বসে আছি দাদুভাই।”
    -“সে আবার কী, এখানে আবার কে আরতি করবে? কোন ঠাকুরের আরতি?”
    -“এখানে যে স্বয়ং প্রকৃতি আয়োজন করেছেন জগদীশ্বরের বন্দনায়। ওই দেখো পুবের আকাশ আলো করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বাতাসে ফুলের সুগন্ধ। এইসব আয়োজন কী শুধুই এমনি এমনি কোনও কিছুই বৃথা যায় না জেনো।”
    -“যাঃ , কী যে বলো না তুমি! দুটো কী এক হলো নাকি?”
    -“এক‌ই দাদুভাই। তফাৎ শুধু কে কেমন ভাবে দেখবে তার উপরে। ওখানে গৃহস্থের গৃহকোণে বিগ্রহের পায়ে আত্মনিবেদন, আর এখানে প্রকৃতির মাঝে অসীমের আরাধনা।”
    -“বা -রে,আরতি করতে তো কতো কিছু লাগে, যেমন পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ, আরও কতো কী। এখানে সেইসব ‌কোথায়?”
    -“এখানেও সব আয়োজন তৈরি। ঐ দেখো, পূর্ণিমার চাঁদে পঞ্চপ্রদীপের আলো, ফুলের সুবাসে ধূপধুনোর আয়োজন, হাওয়ায় নারকেল পাতারা চামর দোলায়।”
    -“আর মন্ত্র? মন্ত্র পড়বে কে?”
    -“কেন আমি।”
    -“তুমি মন্ত্র জানো?”
    -“জানি বৈকি। শোনো মনকে যা ত্রাণ করে, তাই হচ্ছে মন্ত্র। আমার ‌অবলম্বন শুধু কিছু গান, ঐ ভাষাতেই আমি আত্মনিবেদন করি, ওটাই আমার মন্ত্র।”
    -“দাদু, তোমার পাশে একটু বসি?”
    -“ইচ্ছে হলে বসবে বৈকি! যাও তাহলে ওপাশ থেকে ছোট টুলখানা টেনে নিয়ে এসে বসো।”
    অতঃপর সেই চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যায়, দাদু তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরলেন-“ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা, প্রভু তোমার পানে…”
    নীচ থেকে ভেসে আসা ধূপের গন্ধ আর ফুলের সুবাসে মাখামাখি হয়ে সেই সুর, পার্থিব সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিচ্ছিলো ঊর্ধ্বলোকে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- জীবনের চালচিত্র

    জীবনের চালচিত্র
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    তরুণ ফল বিক্রেতা ফটিক, ঠেলাগাড়িতে করে ফল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করে বেড়ায়। বেলা এখন প্রায় সাড়ে দশটা। নানান এলাকা ঘুরে, অবশেষে এই শুনশান পাড়াটিতে ঠেলা নিয়ে ঢুকে পড়লো সে। এদিককার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে অনেক বাঁধা খদ্দের আছে তার।
    এই এলাকায় বেশ কিছু সম্পন্ন মানুষের বসবাস। ফটিক সঠিক ওজনে, ন্যায্য দামে, টাটকা ফল বেচে বলে অনেকেই বাজার থেকে না কিনে তার‌ অপেক্ষাতেই বসে থাকেন। তাই ফটিক রোজ একবার করে এই পাড়াটা ঘুরেই যায়।
    আজ‌ও এই পাড়ায় ঢুকতেই সাদা রঙের ফ্ল্যাটবাড়িটার দিকে নজর চলে গেল। তিনতলার ‌বারান্দা থেকে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছেন বোসবাবু। তিনি একজন শাঁসালো খদ্দের, দু’ তিন দিন অন্তর‌ বিস্তর ফল কিনে থাকেন। ফটিক খুব খুশি হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
    তিনতলা থেকে নীচে নেমে এসে নেড়েচেড়ে ফলগুলো বাছাই করে রাখছিলেন বোসবাবু। তরমুজ, সবেদা, কলা, পেয়ারা বেছে বেছে একপাশে রেখেছেন, আর কী নেওয়া যায় ভাবছিলেন‌ তিনি। ওপাশের বটতলায় খেলা করা দুটি বাচ্চা, খেলা ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
    -“ও দাদু ঐ যে দেখো দেখো ওপাশে কতো আঙুর- সবুজ, কালো নেবে না?”
    -“আঙুর? কোথায় আঙুর? ওহ্ ঐ যে, হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঁচশো আঙুর‌ও দিয়ে দে তো” তারপর হঠাৎই খেয়াল পড়তেই বাচ্চাদুটিকে খেঁকিয়ে উঠলেন,”এ্যাই‌ তোরা এখানে কী করছিস রে? ভাগ্ এখান থেকে।”
    শিশুদুটি একটু সরে দাঁড়ালো কিন্তু চলে গেল না।
    ফটিক সবুজ রঙের ‌আঙুর ওজন করছে, অপেক্ষাকৃত ছোট বাচ্চাটি বলে উঠলো, “ও দাদু ঐ কালোগুলো নাও না, কী সুন্দর দেখতে!”
    না, তারা নিজেরা খাওয়ার কথা ভাবছিল না, তাদের ‌ইচ্ছেটুকু মর্যাদা পাচ্ছে, এইটুকু দেখলেই তারা খুশি, এটাও বুঝি তাদের খেলার‌ই অঙ্গ!
    বোসবাবু আবার খেঁকিয়ে ওঠার আগেই ফটিক ছোট এক থোলা কালো আঙুর তাদের হাতে তুলে দিতেই, অবাক বিস্ময়ে উৎফুল্ল বাচ্চাদুটি এক ছুট লাগালো ওই বটতলার পানে।
    ফটিক এবার মুখে মুখে হিসেব কষছে, শেষটায় সাড়ে পাঁচশো আঙুরের দাম ধরতেই, বোসবাবু রেগে উঠে বললেন, “এ্যাই দাঁড়া দাঁড়া, এতকাল ধরে ফল নিচ্ছি তোর কাছে, এখন আবার ঠকাতে শুরু করে দিলি!”
    -“কী ঠকালাম বাবু?”
    ওই বাচ্চাগুলোকে যে আঙুরের থোকাটা দিলি, তার দামটাও এখান থেকেই আদায় করছিস না রে? চাইলাম পাঁচশো আঙুর, দাম নিচ্ছিস সাড়ে পাঁচশোর?”
    মৃদু হেসে ফটিক আঙুরগুচ্ছ আবার পাল্লায় চাপিয়ে সঠিক ওজন বোসবাবুকে দেখিয়ে দিল। ইলেকট্রনিক ওজন যন্ত্র বরং ওপাশেই একটু ঝুঁকে আছে। বোসবাবুকে আশ্বস্ত করে ফটিক হেসে বললে, “খদ্দের ঠকানোর ব্যবসা আমি করি না বাবু। ওটুকু আমিই ওদের ভালোবেসে খেতে দিলাম।”
    বোসবাবু এবারে আশ্বস্ত হয়ে দাম মিটিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পিছন ফিরে বললেন, “এভাবে চললে তোর ব্যবসা তো লাটে উঠবে রে।”
    ফটিক হেসে বললে, “ওটুকু ক্ষতি আমার পুষিয়ে যাবে বাবু, ওদের হাসিমুখের দামে।”
    আজীবন পাইপয়সার হিসেব কষা বোসবাবুর ভ্রু’টা অবশ্য কোঁচকানোই রয়ে গেল! এইসব আবেগকে প্রশ্রয় দিলে ব্যবসা করে আর খেতে হয় না!
    আদ্যোপান্ত ঘটনাটির সাক্ষী, দোতলার বারান্দায় বসা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মুখে একটুকরো হাসি খেলা করে গেল। নিজের মনেই মৃদুস্বরে আবৃত্তি করলেন –
    ” যে ধনে হ‌ইয়া ধনী
    মণিরে মানো না মণি
    তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে।”
    এমন‌ই কতোশতো টুকরো টাকরা মুহূর্ত দিয়ে তৈরি হয় আমাদের জীবনের চালচিত্র, কখনও খেয়াল করি, আবার কখনও বা আনমনে ভেসে যায়, কালের স্রোতে, হারিয়ে যায় কালের গর্ভে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- চির পথের সাথী

    ‌ চির পথের সাথী
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    -“ঈশ্, কী যে বিচ্ছিরি লাগছে, এবারের পঁচিশে বৈশাখটা, কেমন মাঠে মারা গেল, বলো দাদু! না কোনও সেলিব্রেশন, না একটু গান বাজনা, কেবল‌ই মনখারাপ করে ঘরে বসে থাকো।”
    -“গান! সে তো তুমি ঘরে বসেও গাইতে পারো”।
    -“দূর্ আমি কি গাইতে পারি নাকি? সুর ভুল হয়ে যায়।
    -“তুমি তো অন্যকে শোনানোর জন্য গাইছো না, গাইবে নিজের জন্য, সেখানে তোমার মনের সুর‌ই আসল সুর। শুধু কথাগুলো ভালো করে বুঝে গেও, তাহলেই হবে।”
    -“ধুর কী যে বলো না! কোথায় সবাই মিলে মজা করে হৈ চৈ করবো, তা- না ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকো।”
    -“তা বটে, তোমাদের মজাটাই তো আসল, সেটাই তো ঠিক জমলো না।”
    -“তবেই বলো। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে দাদু, ছোটবেলায় আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন! একমাস ধরে সে কি আনন্দ, হৈ চৈ! স্কুল থেকে ফিরে কোন‌ওমতে নাকে মুখে গুঁজেই দে ছুট্ —রিহার্সালে। আবৃত্তি, গান নৃত্যনাট্য, আর‌ও কতো কী। তারপর রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনে কতো লোক, ফুল, মালা, আলো, হাততালি, আহা! কী যে আনন্দের দিন ছিলো সেসব।”
    -“হুম্”
    -“কী-ই তখন থেকে শুধু হুঁ হুঁ করেই যাচ্ছো। আচ্ছা তুমি সবসময় এতো কুল থাকো কী করে বলো তো? তুমিই তো বলো রবিঠাকুর তোমার জীবনের একমাত্র ঠাকুর! তাঁর জন্মদিনটা এইভাবে চলে গেল,খারাপ লাগছে না তোমার?
    -“না তো, আসলে আমার ঠাকুরের যে প্রতিদিন‌ই জন্মদিন।”
    -“কী যে হেঁয়ালি করো না তুমি! রোজ কার‌ও জন্মদিন হতে পারে নাকি?”
    -“পারে বৈকি। প্রতিদিন‌ই আমি যে তাঁকে নতুন রূপে পাই, আমার মনে তাঁর নিত্য নতুন উদ্ভাস।”
    -“বুঝলাম না ঠিক।”
    -“না বোঝার তো কিছু নেই দিদিভাই, তিনি রোজ আমার মননে নতুন ভাবে ধরা দেন, তাই তিনি নিত্য‌ই নূতন।”
    -“আর, তুমি যে বলো তিনিই তোমার একমাত্র ঠাকুর, মানুষ কখনও ঠাকুর হয় নাকি?”
    -“হয় বৈকি। একলা রাতের অন্ধকারে, মানুষ যখন নিজের সঙ্গে নিজে একা, সংসারের অকূল পাথারে দিশাহারা, তখন তিনিই তো এসে হাতখানি বাড়িয়ে দেন, একলা পথের সঙ্গী হতে।”
    -“আচ্ছা তিনি কি কেবল তোমারই ঠাকুর?”
    -“তেমন করে চাইলে তিনি সবার‌ই ঠাকুর, শুধু তাঁর মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করার অপেক্ষা।”
    -“পাবো কোথায় সেই মন্ত্র?”
    -“গীতবিতানের পাতায় পাতায়, তাঁর‌ই পূজার গানে।”
    -“দাদু একটা গান গাও না প্লিজ।”
    -“বেশ লাইটটা নিভিয়ে এসে বোসো, আমার সাথে গলা মেলাও।”
    -“আমার যে গলায় তেমন সুর নেই!”
    -তাতে কী, মনপ্রাণ ঢেলে গাইলে, সুর আপনি এসে ধরা দেবে তোমার প্রার্থনায়।”
    -“কোন গান দাদু?”
    -“চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না….”

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- ইনক্রিমেন্ট

    ইনক্রিমেন্ট
    -জয়তী মিত্র

    আজ বিমলবাবু খুব খুশি। তার আজ ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। ফলে মাইনে বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে। বিমল বাবু একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। একমাত্র ছেলে বাইরে পড়াশুনা করে। এখানে উনি আর ওনার গিন্নি থাকেন। গিন্নি সুলতা খুব জাঁদরেল আর মুখরা টাইপের মহিলা, তাই বিমোলবাবু গিন্নিকে একটু সমঝে চলেন।
    মাইনে বেড়েছে বলে খুশি হয়ে বিমল বাবু পাড়ার মোড়ের মাথা থেকে গরম কচুরি আর ছানার জিলিপি নিয়ে বাড়ি গেলেন। সুলতা কচুরি খেতে খুব পছন্দ করে।
    বাড়ীতে পা রাখতেই গিন্নির মুখ ঝামটা শুরু হলো- পাশের বাড়ির মনিকা আর রেনুদি এসেছিল। মনিকার স্বামী দীপক বাবু কি সুন্দর এক জোড়া ঝুমকো গড়িয়ে দিয়েছে মনিকাকে, আমাকে দেখিয়ে গেল। আর রেনুদির স্বামী দশ হাজার টাকা দিয়ে একটা আসাম সিল্ক কিনে দিয়েছে। সেটাও নিয়ে এসে দেখিয়ে গেল। আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল জিনিসগুলো দেখে। আর আমার পোড়া কপাল দেখো মিনসেটার হাত দিয়ে কিছু গলে না। খালি প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেয়- এই দেব, আর সেই দেব। দেবার বেলায় একটাই বুলি এখন টাকা নেই। সব চালাকি বুঝি, এত বছর সংসার করছি মানুষ চিনবো না। খালি মুখে মিষ্টি কথা বলে আমাকে দিয়ে কলুর বলদের মত সংসারের ঘানি টানিয়ে নিচ্ছে। ওরে বাবা! আজ আবার মন রাখতে কচুরি এনেছে, দেখো কি পিরিত, দেখলে গা জ্বলে যায়। আসল জিনিসের নাম নেই ভেবেছে খাবার জিনিস দিয়ে আমার মন ভোলাবে,আর আমি ভুলছি না।

    গিন্নির মুখে এই বাক্যবাণ শুনে চুপ করে খাবারের ঠোঙাটা টেবিলে রেখে বিমল বাবু ফ্রেশ হয়ে বিছানার ওপর বসে বললেন, এক কাপ চা দাও তো।
    সুলতা বললো, আমি এখন চা করতে পারবো না, একটু পরে দেব। আমার এখন অন্য কাজ আছে।
    বিমল বাবু মনে মনে হেসে ভাবলেন এক্ষুনি মাইনে বেড়েছে শুনলে দশ কাপ চা দেবে সুলতা। আমি চিনি না ওকে! কিছু পাবার সময় গলার সুর কি মিষ্টি হয়ে যায়।
    বিমল বাবু বললেন, সুলতা কাল রবিবার আমার সাথে একটু সোনার দোকানে যাবে, আমি একজোড়া সোনার দুল কিনে দেব তোমায়। আমার ইনক্রিমেন্ট হয়েছে।

    পাশের ঘর থেকে লাফ দিয়ে এসে বরের গলা জড়িয়ে ধরে আদরমাখা সুরে সুলতা বললো, রোজ রোজ চা খাও আজ তোমাকে কফি করে দিচ্ছি বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল সুলতা। বিমল বাবু ভাবলেন, যাক ওষুধে কাজ হয়েছে, এখন কফিটা তো আয়েস করে খাই তারপর কি দেব সেটা পরে দেখা যাবে।
    কফি হাতে নিয়ে এসে সুলতা বললো, আমাকে সোনা দিতে হবে না, তার থেকে বরং ঘুরতে নিয়ে চলো। দার্জিলিং চলো, সেই হানিমুনে একবার গেছিলাম। আর যাইনি। একটা পালাজো আর গাউন কিনেছি ওইগুলো পড়ে পাহাড়ে সুন্দর, সুন্দর ছবি তুলবো, মনিকা আর রেনুদি জ্বলে পুড়ে যাবে আমাকে দেখে। ওরা তো সাত জন্মে কোথাও যায় না। সব এক একটা কুয়োর ব্যাঙ কোথাকার।
    বিমল বাবু হেসে বললেন, তাই হবে, কাল টিকিট কাটব, সামনের মাসে ছেলে আসবে কদিনের ছুটিতে তিনজনে ঘুরে আসব। এখন যাও কচুরি যে ঠান্ডা হয়ে গেছে ওগুলো গরম করে নিয়ে আসো জমিয়ে খাই।
    সুলতা মুখে চওড়া হাসি এনে বললো, এক্ষুনি আনছি, দুজনে একসাথে খাব।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- বাঁশি

    বাঁশি
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    কালের নিয়মে পৃথিবীতে আবার এসেছে বসন্ত। বাতাসে লেগেছে নেশা। রিক্ত শাখায় নতুন কচি পাতার নাচন, ডালে ডালে নতুন কুঁড়ি। মানবচিত্তে লাগে দোলা। কিন্তু অচিনপুরের রাজামশাই মহা বিরক্ত। তিনি যে ঘোর বাস্তববাদী। এইসব কাজভোলানো মনমাতানো ফাল্গুনী হাওয়ার‌ ওপরে বেজায় চটা। ক্ষণে ক্ষণে মানুষকে উদাসী করে, তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনকে এলোমেলো করে দেওয়াই যেন দখিনা পবনের একমাত্র কাজ। আজকাল রোজ সভার কাজে পড়ছে বাধা। কোকিলের কুহুতানে সবাই উন্মনা। মন্ত্রীর ভাষণ মাঝপথে খেই হারায়, পন্ডিতের গণনায় হয়ে যায় ভুল, গৃহস্থ ভোলে নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম, আর সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো রাজামশায়ের দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামে ঘটছে ব্যাঘাত। এইভাবে সংসার চলে কী করে? অতঃপর উপায় খুঁজতে জরুরি বৈঠক বসলো।
    -“সমস্ত গাছপালা কেটে নির্মূল করে দাও, তাহলেই বন্ধ হবে বসন্ত বাতাসে কিশলয়ের মাতামাতি আর শাখান্তরালে কোকিলের কুহুতান।” বললে চাটুকারের দল।
    -“আরে না না, গাছপালা না থাকলে গুটি পোকা বাসা বাঁধে কী করে? আর তারাই যদি না থাকে রেশম তৈরী হবে কেমনে? রেশম বিনে‌ রাজপোশাক তো আর তৈরী হয় না!সবেগে টিকি নেড়ে বললে পন্ডিত।
    ঠিক বাৎ। তাহলে উপায়? রাজ্য জুড়ে গগনচুম্বী পাঁচিলের বন্দোবস্ত করা হোক, যাতে ঊর্ধপানে চেয়ে চেয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেলেও নীল আকাশ, মুক্ত বিহঙ্গ,ঋতু বদল, কিছুই নজরে না আসে। কাজ ভোলানো বসন্তসমীরণ, আর বখাটে কোকিল দুই-ই হবে জব্দ।
    ঠিক ঠিক ঠিক- রব উঠলো সভা মাঝে।
    -“দাঁড়ান মহারাজ কঠোর পাহারার বন্দোবস্ত করছি আমি। সেপাই শান্ত্রী দলবল নিয়ে স্বয়ং পাহারায় র‌ইলাম, আজ থেকে আকাশপানে চোখ তোলাই মানা। যতোদিন না পাঁচিল তৈরী হয় ততদিন এই ব্যবস্থাই লাগু হোক। অন্যথা হলেই গর্দান যাবে।” বললে সেনাপতি।
    সাধু সাধু রব তুললে মোসাহেবের দল।
    এতক্ষণ সভার এককোণে নীরব শ্রোতা হয়ে বসেছিল বিদূষক। এখন আপন বাঁশিটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
    -“একী চললে কোথায় হে বিদূষক? বসো বসো, সভার কাজ শেষ হয় নি এখনো।”
    -“এবার আমার বিদায় নেবার পালা।”
    -“বিনা অনুমতিতেই?”
    -“আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ। যিনি এই জগতের মহারাজাধিরাজ তিনিই যে স্বয়ং ডাক পাঠিয়েছেন। ওই শুনুন রাখালিয়া বাঁশিতে মেঠো সুরের আমন্ত্রণ। সে আহ্বান উপেক্ষা করি এমন সাধ্য ক‌ই! আপনার এই রুদ্ধদ্বার সভাকক্ষে, আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি চললাম।”
    -“প্রাণের ভয় নেই তোমার?”
    -“না মহারাজ! এক বিদূষক গেলে আর একজন আসবে, তারপর হয়তো অপর একজন। দুই হাত দিয়ে উতল হাওয়া রুখবেন এমন সাধ্য যে আপনার‌ও নেই রাজামশাই!”
    বিদূষক বাঁশিতে তান তুলে এগিয়ে গেল বাহিরপথে। তার বাঁশির সুরে উদাসী হলো গৃহস্থের মন। স্থলে জলে বনতলে লাগলো দোলা। সব ভয় ভাবনার হিসেব গেল গুলিয়ে। আবালবৃদ্ধবনিতা বেরিয়ে পড়লো পথে।
    সেই থেকে আজ অবধি, রাঙা পলাশ বিছানো পথে হেঁটে যায় মানুষ। বাঁশি বাজে, বেজেই চলে অনন্তকাল ধরে।

You cannot copy content of this page