অণু গল্প
-
অণুগল্প- যে নদী হারায় স্রোত
যে নদী হারায় স্রোত
-সুনির্মল বসুআমি অনামিকা, আসল নামটা গোপনেই থাক, এই নামটাই ভালো, কী হবে আসল নামটা জেনে!
সারা দেশে আমার মতো কত দুঃখী মেয়ে আছে, যাদের রূপ নেই, ডিগ্রি নেই, বাপের পয়সা নেই। জীবনের সব ক্ষেত্রে হার যাদের ললাট লিখন, আমি তাদেরই একজন।
সুকল্যাণ দ্যাখো, কী বোকা আমি, একদিন তোমাকে নিঃশর্তে ভালোবেসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম। তোমার এম,এ পরীক্ষার আগে যখন রাত জেগে তুমি পড়তে, নকশা কাঁটা চাদর গায়ে আমি আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, তুমি না ঘুমোতে গেলে, আমি ঘুমোতে যেতে পারতাম না।
সুকল্যাণ, তুমি বলেছিলে, চাকরি পেলেই বিয়ে হবে আমাদের। চাকরি হচ্ছিল না তোমার, বাড়িতে আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়েছিল, আমি বেঁকে বসেছিলাম, বাবা মাকে জানিয়েছিলাম, আমাদের ভালোবাসার কথা,ওরা চুপ করে গেছিলেন। আমি যে জেদী, তা ওরা জানতেন।
কতদিন তখন তুমি আর আমি বনজ্যোৎস্নায়, অন্ধকারে হেঁটে গেছি, কৃষ্ণচূড়ার বন, রাজপথ, নদীর ধার আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী থেকেছে, ভবিষ্যৎ জীবনকে ঘিরে দুজনে একসঙ্গে কত স্বপ্ন দেখেছি।
তারপর একদিন শুনলাম, তোমার চাকরি হয়েছে, বিনিময়ে ওদের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।
বিয়ে হলো তোমাদের, তোমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলাম আমি।
শুনেছি গাড়ি, বাড়ি, সংসার, সব নিয়ে সুখী তুমি। ভালো..তবু, মায়াবী বিকেলগুলো, নদীর ধার, রাতের আকাশ কেন যে এত কাঁদায়!
ভরা নদী শুকিয়ে গেলে, মরুভূমি হয়ে যায়, চেয়ে চেয়ে দেখলাম। -
অণুগল্প- মেঘ ও রৌদ্র
মেঘ ও রৌদ্র
-সুমিতা দাশগুপ্তঅটো থেকে নেমে অশক্ত শরীরে খুচরো গুনে ভাড়া মেটাতে দেরী হচ্ছিলো বলে অত্যন্ত রুক্ষ ব্যবহার করলেন অটোওয়ালাটি। মনটা খারাপ হয়ে গেল অশীতিপর অবিনাশ বাবুর। বয়সের ভারে কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছেন ঠিকই কিন্তু সেইজন্য এতটাই অসৌজন্য কি পাওনা হয় মানুষের! বয়স বেড়েছে বলেই বোধহয় দিন দিন একটু বেশিই স্পর্শকাতর হয়ে পড়ছেন অবিনাশবাবু। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুটপাতের উপরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
অবিনাশবাবুর গন্তব্য রাস্তার ওপারে ব্যাঙ্কটি। অফিসটাইমের অনর্গল গাড়ির স্রোত পেরিয়ে ওপারে যেতেই পারছেন না, অনেকক্ষণ ধরে। কোনও ট্র্যাফিক সিগন্যালও নেই আশেপাশে। কতক্ষণে যে একটু ফাঁক পাওয়া যাবে কে জানে, মনে মনে একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন অবিনাশ বাবু, হঠাৎ নজরে এলো ওপার থেকে পান দোকানের তরুণ মালিকটি একছুটে রাস্তা পেরিয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একগাল হেসে তাকে আগলে ধরে বললো-“চলুন দাদু পার করিয়ে দিই আপনাকে।” আশ্চর্য ! এই ব্যস্ত সময়ে খদ্দেরের ভিড়ে কেমন করে সে খেয়াল করলো ,আধচেনা এই বৃদ্ধটিকে!
মনটা খুশিতে ভরে উঠলো অবিনাশ বাবুর। মানবিকতার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি তাহলে।
মানবজীবনে নিরন্তর চলছে এই মেঘ ও রৌদ্রের খেলা। -
অণুগল্প- আয়না
আয়না
– উজ্জ্বল সামন্তআয়নার সামনে ব্যক্তিটি উপস্থিত হয়েছেন। নিজের মনে কি যেন বিড়বিড় করছেন। যেন, ঠিক ও ভুল পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া চলছে। কখনো ব্যক্তিটি হাসছেন সদর্পে বুক ফুলিয়ে। আবার কখনো মুখ বিকৃত করে কিছু আড়াল করতে চাইছেন, বা মেনে নিতে অস্বীকার বা কুন্ঠিত বোধ করছেন, যখন আয়না চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কার কাছে? কেনই বা করছেন? লড়াইটা তো একান্তই ব্যক্তিগত। বিবেক এমনই এক অদৃশ্য আয়না, যার কাছে কোন কিছুই লুকানো যায় না। সত্যিই বোধহয় তাই! আমরা বোঝাতে ব্যস্ত, বুঝতে নয়।
-
অণু গল্প- আত্মজা
আত্মজা
– জয়তী মিত্রআজ রবিবার, তিন্নির কলেজ ছুটি। এমনিতেই ছুটির দিনগুলোতে ঘুম থেকে একটু দেরি করেই ওঠে। কিন্তু আজ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা লুচি আর আলুর দমের গন্ধে আর বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে না পেরে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বেশির ভাগ রবিবারগুলো তিন্নির পছন্দের জলখাবারই বানাতে হয় তিন্নির মা সুমিতা দেবীকে। তিন্নি মা’কে আদর করে বললো, “আজ আমার লুচি খেতেই ইচ্ছা করছিল মা। তুমি কি করে জানলে আমার মনের কথা?
তিন্নির মা সুমিতা দেবী বললেন,”মায়েরা সন্তানের সব কিছু বোঝে। যেদিন তুই মা হবি সেদিন তুইও বুঝবি।”
তিন্নিকে বুকে জড়িয়ে সুমিতা দেবী বললেন,”আজ তোকে তোর জীবনের একটা চরম সত্য কথা জানাবো মা, আজ তোর সব কিছু জানা দরকার। অনেকবার তোকে সব কথা জানাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ভয় পেয়েছিলাম, যদি তোকে হারিয়ে ফেলি, তাই তোকে নিয়ে তোদের বাড়ি ছেড়ে অনেকদূরে চলে এসেছিলাম আমি আর তোর বাবা। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না।”তিন্নি কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সুমিতা দেবী বলতে শুরু করলেন,”আজ থেকে কুড়ি বছর আগে তোর জন্ম এক বনেদী পরিবারে। তোর মা তোকে জন্ম দিয়েই মারা যান। তোর ঠাকুমা আর তোর বাবা তোকে নিতে অস্বীকার করে। তোর ঠাকুমা বললেন, একে তো হয়েছে মেয়ে তার ওপর জন্মেই মা’কে খেয়েছে এ মেয়েকে কে মানুষ করবে! তার থেকে ওকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আয়। তারপর তোকে তারা অনাথ আশ্রমে পাঠাবার কথা ভাবে। আমি তখন তোদের বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম।
দশ বছর আমার বিয়ে হয়ে গেলেও আমাদের কোনো সন্তান হয় নি। সমাজের কত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করেছি। বাঁজা অপবাদ শুনতে শুনতে আমার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই ভগবান হয়তো আমার কষ্টের কথা শুনেছিল। একটা সন্তান লাভের জন্য কত দেবতার কাছে যে মানত করছি সেটা বলাই বাহুল্য। তাই যখন দেখলাম তোকে আশ্রমে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে ঠিক তখন আমি আর তোর এই বাবা তোকে আইনি পদ্ধতিতে দত্তক নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কি বিচিত্র এই পৃথিবী, কেউ কত সাধনা করেও একটা সন্তান পায় না আর যারা সন্তান পায় তারা অবহেলায় তাকে দূরে সরিয়ে দেয়।।আমার মাতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করলো। তোকে পেয়ে আজ আমি সত্য ধন্য রে। তুই আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ। তুই শুধু আমার, আমার আত্মজা।” মায়ের মুখে তার জীবনের কাহিনী শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো তিন্নি। সুমিতা দেবীও তখন অঝোরে কাঁদছেন।
তিন্নি বললো,”তুমি আমার মা, আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি ছিলে তাই আমার জীবনটা এতো সুন্দর হয়েছে। না হলে আজ আমি কোথায় হারিয়ে যেতাম। আমার একটাই পরিচয় আমি তোমাদের মেয়ে, আর তোমরা আমার মা,বাবা। যারা আমাকে জন্মের পর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তাদের কথা নাই বা শুনলাম। তোমাদের মত মা, বাবা আছে বলে আজও পৃথিবীটা সুন্দর আছে।”
-চল মা এবার তুই খাবি চল, তোর বাবা পাড়ার মোড়ের মাথা থেকে গরম জিলিপি এনেছে, তুই যে খুব ভালবাসিস জিলিপি খেতে।
চোখের জল মুছিয়ে মেয়েকে তখন খাওয়াতে লাগলেন সুমিতা দেবী। -
অণুগল্প- গোপালের ভোগ
গোপালের ভোগ
– জয়তী মিত্রআজ মাঘী পূর্ণিমা। খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে সুমনা দেবী গোপালের ভোগ রান্নায় ব্যস্ত। খিচুড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, লাবড়া, চাটনি, পায়েস সব রান্না করে আজ তিনি তার আরাধ্য দেবতা গোপালের চরণে নিবেদন করবেন। তারই প্রস্তুতি চলছে সকাল থেকে। এত কাজ সব একা হাতে সামলান তিনি। ঠাকুরের কাজ একাই করতে পছন্দ করেন তিনি। আর তাছাড়া এই সময়ে তার একমাত্র ছেলে শুভ অফিসে যায়। নাতি স্কুলে যায়। বৌমা তাদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। শাশুড়ি মা’কে সাহায্য করার মতো সময় তার হাতে থাকে না। সুমনা দেবীর তাতে কোন আক্ষেপ নেই।
সারাদিনের বেশির ভাগ সময় তার ঠাকুর ঘরেই কাটে। তিনবেলা গোপালকে খাবার দেওয়া, তারপর বড়ো আসন জুড়ে তার অনেক ঠাকুর। তাদের নিত্য পূজো দিতেই দিনের অনেকটা সময় তার কেটে যায়। সংসারের দিকে তিনি নাক গলান না। ওটা বৌমার দায়িত্ব। আর তাতে বৌমা খুব খুশি। তার ওপরে খবরদারি করার কেউ নেই। তাই শাশুড়ি মায়ের সাথে তার সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই।
কিন্তু সুমনা দেবী মানুষটা খুব কৃপণ টাইপের। হাত দিয়ে তার সহজে কিছু গলে না। তার বৌমা আবার খুব দরাজ মনের। বাড়ীতে কাজের লোক থেকে ভিখিরি পর্যন্ত কেউ তার কাছে কিছু চেয়ে খালি হাতে ফেরত যায় না। কাজের মাসি তো বৌদিমনি অন্ত প্রাণ।
এই তো সেদিন কাজের মাসীর মেয়ের জন্মদিন গেল। বৌদি রুমি একটা বড়ো কেক আর চকলেট কিনে মাসীর মেয়ের জন্য পাঠালো। মাসী তো আনন্দে কেঁদে ফেললো তারপর রুমিকে অনেক আশীর্বাদ করলো।গোপালের ভোগ দিয়ে সুমিতা দেবী এক কাপ চা নিয়ে সবে বসেছে। বৌমা রুমি একটু কাজে বেড়িয়ে ছিল। ঠিক তখন দুটো বাচ্চা ছেলে গেটের সামনে এসে খাবার চাইলো। সুমনা দেবী ধমক দিয়ে ছেলে দুটোকে তাড়িয়ে দিয়ে বললো, “যা, কাজ করে খা গে, এখানে কোনো খাবার নেই। টাকা কি গাছে ফলে নাকি, বিদায় হ। একটু শান্তিতে চা খাব তার উপায় নেই। যত সব ভিখিরির দল। ছেলে দু’টো শুকনো মুখে চলে গেল।
তারপর ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন আসনে তার গোপাল নেই, সুমনা দেবী তো কাঁদতে লাগলেন, তার গোপাল কোথায় গেল? গোপাল তো কিছুই খেল না।
সুমনা দেবীর কান্না শুনে কাজের মাসী মলিনা বললো, “তোমার গোপাল তো তোমার কাছে খাবার চাইতে এসেছিল, তুমি তো তাড়িয়ে দিলে, তাই গোপাল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভগবান বিরাজ করে। ওই বাচ্চাদের মধ্যেই গোপাল ছিল, তুমি তাদের নাগাল পাওনি মাসিমা। গরীবের সেবা করলেই ভগবানের সেবা হয়। তোমার গোপাল আজ তোমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেল। এবার থেকে পারলে গরীব মানুষের জন্য কিছু করো, তাতেই তোমার গোপাল খুশি হবে।”
মলিনার কথা কতদূর কানে গেল কে জানে? সুমনা দেবী গোপালকে আসনে না দেখে তখনো কেঁদেই চলেছে। গোপাল কি তাহলে ভোগ গ্রহণ করলো না? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগলো সুমনা দেবীর মনে। -
অণু গল্প- মুক্তি
মুক্তি
– জয়তী মিত্রআমার ভুল শুধরে নেবার একটা সুযোগ আমাকে দাও তিথি আর এই জীবনে তোমাকে আমার থেকে আলাদা করবো না, কথা দিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আমার অন্যায়ের জন্য খুব লজ্জিত, তৃষার মোহে অন্ধ হয়ে আমি আমার নিজের চরম সর্বনাশ করেছি আর এমন হবে না, কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো রাহুল।
রাহুল আর তিথির এক বিয়ে বাড়ীতে আলাপ। তিথির বান্ধবী মিলির মাসতুতো দাদা রাহুল। মিলি সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট। অপরদিকে রাহুলও সুদর্শন, জিম করা পেটানো শরীর। প্রথম দেখাতেই দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে। তারপর ফোন নম্বর আদান, প্রদান হবার পর বছর খানেক চুটিয়ে প্রেম পর্ব চলে দুজনের। তারপর দুই বাড়ির উপস্থিতিতে দুজন সাত পাকে বাঁধা পড়ে।
রাহুল একটি বেসরকারি কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরী করতো, তিথি স্কুল শিক্ষিকা, দুজনের বিয়েতে কোনো বাড়ি থেকেই আপত্তি ছিল না।
বিয়ের পর বেশ সুখেই চলছিল তাদের জীবনযাত্রা। বিদেশে গিয়ে দুজনে হানিমুনও সেরে এসেছে। দুজন, দুজনকে একবারে চোখে হারাতো।
এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তিথির কপালে। বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই রাহুলের জীবনে প্রবেশ করে তৃষা। তৃষা রাহুলের কলিগ। আধুনিকা, সুন্দরী। ভীষণ গায়ে পড়া মেয়ে। সারাক্ষণ রাহুলের গায়ে এটুলির মত লেগে থাকতো। তার রূপে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে রাহুল।
ক্রমশ তিথির সাথে রাহুলের দূরত্ব বাড়তে থাকে। প্রায় দিন রাহুল দেরি করে বাড়ি ফেরে। তিথি জিজ্ঞাসা করলে দায় সারা উত্তর দেয়। তিথিকে আর আগের মত ভালবাসে না। তিথির সন্দেহ ক্রমশ বাড়তে থাকে। একদিন সকালে রাহুলের ফোনে মেসেজ এলো, ডার্লিং আজ তাহলে আমরা দুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি বলো, আমার গোছগাছ সব হয়ে গেছে, আমি রেডি, তাহলে তুমিও রেডি হয়ে চলে এসো, অফিসে দেখা হচ্ছে।
রাহুল তখন স্নান করতে গিয়েছিল। মেসেজটা দেখে তিথি চুপ করে রইলো, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলো না। রাহুল অফিস যাবার সময় বলে গেল দুদিন অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে। শুনে তিথির মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। রাহুল চলে যাবার পর কিছু জিনিস নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।
রাহুল ফিরে এসে তিথিকে নিতে এলো। তিথি আর রাহুলের কাছে ফিরে যেতে চাইলো না। তিথি যে সব জেনে গিয়ে ছিল সেটা রাহুল ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। তিথি মেসেজের সব কথা রাহুলকে জানিয়ে বললো, একজন প্রতারকের সাথে জীবন কাটানোর চাইতে একা থাকা অনেক ভালো। তোমার সাথে আর এক মুহূর্তও আমি থাকতে চাই না। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেব। আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম। এখন এসো, আমার কিছু কাজ আছে, বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল তিথি। দু’চোখে তিথির শ্রাবণের ধারা নামতে লাগল, বুকের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট তিথিকে দুমড়ে, -মুচড়ে দিতে লাগল। রাহুলকে যে তিথি ভীষণ ভালোবাসে। -
অণুগল্প- ঘোমটা
ঘোমটা
– শম্পা সাহানতুন বৌ দেখতে গ্রামের বৌ ঝি’রা ভিড় করেছে। চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের বৌ, আবার নাকি বিদেশী! তাই ভিড় যে দেখার মত তা বলাই বাহুল্য।
চৌধুরী গিণ্ণীও আজই ছেলের বৌ’কে প্রথম দেখবেন। ছেলে জানিয়ে ছিল বটে যে সে বিদেশী মেয়ে বিয়ে করতে চায়, ভিক্টোরিয়া না কি যেন নাম!
গিণ্ণী প্রথমে রাগ রাগ করলেও পরে মেনেও নিয়েছেন। বাব্বা, বিদেশী বৌমা বলে কথা! আশেপাশের দশ গাঁয়ে কাদের বাড়ি আছে বিদেশী বৌ? ছেলে বলেছে, এখন থেকে এখানেই থাকবে।
তবে এতো সহজে কি মানে, চৌধুরী বাড়ির লোকজন! সেদিন দিদি নাম্বার ওয়ান-এ দেখালো কেমন সুন্দর বিদেশী বৌ, ফর্সা টুকটুক করছে! তার মুখে আধো আধো বাংলা! আহা! আর ভিক্টোরিয়া নাম যখন তখন রানী ভিক্টোরিয়ার মতন সুন্দরী হবে!
বিদেশী বৌ গাড়ি থেকে নামলো। ওমা! শাড়ি পড়া! আবার ঘোমটা দেওয়া! রণ শিখিয়েছে নিশ্চয়ই। দেখি দেখি! মোটামুটি বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আর বৌ ঘাবড়ে গিয়ে ঘোমটা খুলে ড্যাবড্যাব করে দেখতো লাগলো চার পাশের লোকজন!
যেন বাজ পড়লো হঠাৎ। ফিসফিস, গুনগুন, চাপা হাসি, বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল! চৌধুরী গিণ্ণীর হাতের বরণ ডালা হাতেই রয়ে গেল, বরণের জন্য আর উঠলো না।
গিণ্ণীমা দাপাতে দাপাতে ফিরে চললেন বাড়ির ভেতর। নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে খিল দিলেন। বাইরে থেকে শোনা গেল চাপা কান্না আর গর্জন, “তুই এভাবে আমাদের ঠকালি?”
লোকজন বেশ স্থির, নড়তে চায় না। বড় বাড়ির এই রং তামাশা তো সহজে দেখা যায় না। গ্রাম্য জীবনে বেশ আলোড়ন ওঠার মত ঘটনা, বেশ কদিন রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে আলোচনার মত বিষয় পাওয়া গেছে!
রণ জানতো মা কালো একদম পছন্দ করে না, তবে এতোটা বাড়াবাড়িও আশা করেনি! এই জন্যই আগে থেকে বাড়িতে জানায় নি যে ভিক্টোরিয়া নাইজেরিয়ান, ওর কোনো ছবিও পাঠায়নি!
ভিক্টোরিয়াও বুঝতে পারছে না, হঠাৎ কি হল? “হোয়াই দে আর সো অফেন্ডড?” রণ তো বলেছিল, “এভরিথিং ইজ ওকে”!
রণ কি করে ভিক্টোরিয়া কে বলে, ওর গায়ের রং দেখার আগে পর্যন্ত, “এভরিথিং ওকে”- ই ছিল! কি করে বলে যে বিদেশী দুশো বছরের আগ্রাসন থেকে ওরা এখনো মুক্ত হতে পারেনি!
ভিক্টোরিয়ার মুখ থেকে ঘোমটা সরে যেন আমাদের নির্লজ্জ দাসত্বের মানসিকতাকে এক ঝটকায় বে-আব্রু করে দিল এক বিদেশীর সামনে।
-
অণু গল্প- ক্ষত
ক্ষত
-অমল দাস
বিকালের আলো রক্তিম আভা নিয়ে আত্মিকার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে আছে। যেন বিদায় কালের অনুমতি চাইছে। বসন্তের পাতা ঝরা-রা এলোমেলো ঝরে আছে আশেপাশে। কোকিলের যে কুহু শুনে একসময় মন হারিয়ে যেত; সে সুর আর আত্মিকার কানে ভাসে না। না-কি সেও কোনও বিরহে আর ডাকেনা! জানেনা। জানার আগ্রহ আর নেই নিস্তেজ শরীরে। অশোক গাছের নীচে এই বেদীটায় সে একাই বসে থাকে মন হারা হয়ে। ওর সাথে আজ আর কেউ নেই। কেউ আসেও না… কতগুলো উৎসুক মুখ প্রয়াশই আশেপাশে পেঁচার মত উড়তে থাকে রোজ -শিকারের আশায়। ডানা ঝাপটায় কিন্তু কাজ হয়না। আত্মিকার আত্মাকে তারা ধরতে পারেনা। যে প্রেম প্রস্তাবে ওরা বিদ্ধ করতে চায়, তা অনেক আগেই বুকে গেঁথে নিয়েছিল আত্মিকা। হর্ষের প্রস্তাবে। তারপর কত আনন্দ, কত সুখের দিন। এই আকাশ, বাতাস, ময়দানের সবুজ ঘাস নীরব সাক্ষী। সাক্ষী বিকেলের হাঁটতে আসা বয়স্কদের ভিড়। ওদের দিকে চেয়ে তাঁদের মৃদু-মৃদু হাসি ঠোঁট বেয়ে নেমে আসতো আশীর্বাদ নিয়ে। আজ আর আসে না। ওঁরা আসেন। সেই ঠোঁটে চেনা হাসি আসে না।
কোনো এক অভিশপ্ত দিনে সব হাসি মিশে গেছে মেঠো ধূলোয়। এই অশোক গাছটার নীচে এখানেই এক অন্ধকার বিকালে হঠাৎ কালো ঘন মেঘের বজ্রপাত ছিনিয়ে নিয়ে যায় হর্ষকে। মুষলধারার বৃষ্টি একাকী আত্মিকাকে সেদিন নির্মম ভাবে ভিজিয়েছিল আপাদমস্তক। অন্তরে বাহিরে আঘাতের শূল পুঁতেছিল উচ্ছৃঙ্খল হাওয়াদের চাবুকের ঘা। ফেরারি পথে বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায় সমস্ত অপরাধী দাগ।
পড়ে থকে নিথর হর্ষ আত্মিকার কোলে।
আজ কতগুলো দিন চলে গেছে। কত স্রোত বয়ে গেছে গঙ্গার জলে। আত্মিকার বিবর্ণ জীবনে রঙ লাগেনি আর বসন্ত-পলাশের। শুধু অন্ধকারে আসা আর যাওয়া স্মৃতির মেরু প্রদেশে।
যে বাদামওয়ালা রোজ ওদের কাছে এসে আবদার করতো ‘ও দিদি বাদাম নেবে? নাও-না।’
আত্মিকা একটা-ই চাইলে সে বলতো ‘তোমরা দুজনে একটা কি খাবে গো দিদি দুটোই নাও।’
আত্মিকা বলতো ‘দুটো নয় একটাই। কারণ আমরা দুজন নই আমরা এক’।
সেই বাদামওয়ালা আজ আর বাদাম নিয়ে হাঁকে না। মাথা নিচু করে হেঁটে যায় আত্মিকার পাশ দিয়ে। সেও জানে সে দিনের সেই ‘এক’ আজ ক্ষত। পশ্চিমে ঢুলে পড়া আলো এই ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে যায় শেষ বিকালে। আত্মিকার আঁচল ভরে ফেলে যায় এক পৃথিবী ধূসর গোধূলি।
-
অণু গল্প- ভাত ডে
ভাত ডে
– জয়তী মিত্রপাড়ার সবাই ওদের রকবাজ ছেলে বলেই জানে। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে সব বেকারের দল। বাপের হোটেলে খাচ্ছে আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই ছেলেগুলোই পাড়ার সকলের অপদে-বিপদে হাজির হয়।
এবার সরস্বতী পূজোতে বেশ ভালো রকম চাঁদা উঠেছিল। রাজু, সুনু, বুবাই, রনি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে পুজোর দায়িত্ব নিয়ে বেশ ভালোভাবেই পুজোর আয়োজন করে। রাজুর কাকা বাইরে চাকরী করে, অনেকদিন বাদে বাড়ি ফিরেছে, তার থেকে একটা মোটা টাকা চাঁদার আবদার করছে তার ভাইপো। কাকাও খুশি মনেই সেই আবদার রেখেছে। পাড়ার সব বাড়ীতে ঠাকুরের ভোগ প্রসাদ বিতরণ করেছে। পাড়ার,কাকু, কাকিমারা তাতে বেশ খুশী হয়েছে।
বেশ কিছু টাকা বাঁচিয়ে সবাই মিলে ঠিক করে খাল পাড়ের যে বস্তিটা আছে সেখানে একদিন গরীব মানুষগুলোকে খাওয়ানো হবে। মেরে কেটে সেখানে গোটা চল্লিশ জন লোক হবে।
একটা দিন গরীব মানুষগুলোকে ডিমের ঝোল আর ভাত খাওয়ালে খুব খুশি হবে বস্তির মানুষগুলো। ওরা তো ঠিক মত খেতে পায় না।
রাজু সকলের উদ্দেশ্যে বললো, শোন আজকাল কত ডে পালন করা হচ্ছে, যতসব বড়লোকি চাল, আর আমরা ভাত ডে পালন করে গরীবের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করি, ,চল সবাই বাজার করতে যেতে হবে।
তাদের আয়োজিত এই মহৎ উদ্দেশ্য দেখে পাড়ার সকলে খুশি হয়ে বেশ কিছু আরো টাকা দিল। ছেলের দল দ্বিগুণ উৎসাহে রান্নার তোড়জোড় করতে লাগল। তারপর বস্তিতে গিয়ে সবাইকে বসিয়ে ডিমের ঝোল, ভাত খাওয়াল। পাড়ার এক বয়স্কা ঠাকুমা মিষ্টির টাকা দিলেন। শেষ পাতে মিষ্টি পেয়ে বস্তির বাচ্চাগুলোর চোখে, মুখে খুশির ঝলক ছড়িয়ে পড়লো।
গরীব মানুষগুলো এক বেলা পেট ভরে খেতে পেয়ে দু’ হাত তুলে ছেলের দলকে আশীর্বাদ করলো।
পাড়ার সবাই ছেলেগুলোকে জড়িয়ে আদর করে বললো, তোরা আমাদের পাড়ার গর্ব, চিরকাল এমনি থাকিস তোরা।
‘ভাত ডে’ পালন করে গরীব মানুষ মানুষগুলোর একটা দিন খাওয়াতে পেরে ভীষণ আনন্দ পেল ছেলের দল। -
অণু গল্প- একাদশী
একাদশী
-রাখী চক্রবর্তীদীর্ঘ দশ বছর রোগে ভোগার পর দয়ানন্দ চৌধুরী মারা গেলেন। মৃত্যু কালে ওনার বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর। একমাত্র সন্তান বিনয়বাবু বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ খুব ভালো ভাবেই করেছেন। কোনো ত্রুটি নেই।
শ্রাদ্ধের দিন ও মৎস্যমুখীর দিন অনেক লোক খেয়েছে। এমনকি কুকুর বিড়ালরাও বাদ যায় নি। এই সব দেখে মানে বিনয়বাবুর পিতৃভক্তি দেখে
সামনের বাড়ির অলোক বাবু আপশোস করে ওনার স্ত্রী দীপাকে বললেন আমার বাবার কাজে পাঁচটা ব্রাহ্মণ খাইয়ে দায় সারলাম। বিনয় দেখিয়ে দিল। কাকে বলে পিতৃভক্তি।
দীপা বললো, খুব পিতৃভক্তি, দশ বছর ধরে দয়ানন্দ মেসোমশাই রোগে ভুগছিলেন একটা ডাক্তারও দেখায়নি তোমার বন্ধু বিনয়। না ওষুধপত্র, না ভালো পথ্য। কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন মেসোমশাই। ভগবান মুক্তি দিলেন ওনাকে।
মরার পর লোক দেখানো ভক্তি। আমরা বাবার জন্য অনেক করেছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে দু’ তিন ধরে লোক দেখানো লোক খাওয়াই নি। আর মাকেও যত্নে রেখেছি। যে মানুষটাকে বেঁচে থাকতে একটু ভালবাসা, একটু যত্ন, একটু খাবার দিতে পারল না- মৃত্যুর পর আদিখ্যেতা দেখানো।
বড় ছবি, ফুলমালা। যেন বাবা অন্ত প্রাণ, এবার মাসীমার কি দূরগতি হয় দেখো। খাটিয়ে খাটিয়ে না শেষ করে দেয় মাসীমাকে। অসীমারও তো মা আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা বিনয়বাবু কেন প্রতিবাদ করেন না।
অলোকবাবু- অশান্তির ভয়ে। এমন অনেক ছেলে আছে বৌকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মা বাবার মূল্যটুকু হারিয়ে ফেলে। বিনয় হয়তো পরিবারে শান্তি বজায় রাখতে চায়।
দীপা- বিনয়বাবুর মার আজ একাদশী। মাসীমাকে আমি ফল সাবু দিয়ে আসি।
দীপা ফল সাবু নিয়ে বিনয়বাবুর বাড়িতে গেল।গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল বিনয়বাবুর স্ত্রী অসীমা বলছে, আজ একাদশী মা। একবারই খাবার খাবেন। জল খেতে পারেন। তাতে কোনও পাপ হবে না। তবে সাবুমাখা সেই রাতেই খাবেন।
দীপা মাসীমার হাতে ফল সাবুর প্যাকেটটা দিয়ে বললো, খাবেন মাসীমা ।
অসীমা ফলের প্যাকেটটা নিয়ে বললো, দীপা এ সব আবার কেন?
বিনয়বাবু অসীমার দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
একমাস পর অসীমার মা ব্যাগপটরা নিয়ে মেয়ের বাড়ি হাজির।
জানিস তো অসীমা, বৌমা বড় জ্বালায়। আমি আর আধপেটা খেয়ে থাকতে পারবো না। এই বয়সে এতো পরিশ্রম করতে পারি না রে মা। আমি মরণ কাল পর্যন্ত তোর কাছেই থাকবো। মেয়ে কখনও খারাপ হয় না। ছেলে- ছেলের বৌ সব খারাপ হয়। বিনয় শাশুড়ির সব কথা শুনে অসীমাকে বললো, দাও বাজারের ব্যাগটা দাও।বাজার করে আনি। ওহ্ আর একটা কথা অসীমা, মনে আছে তো কাল কিন্তু একাদশী। ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রেখেছো তো! দুটো লাল দাগ।
বিনয়বাবু মুচকি হেসে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।