অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- তফাৎ ও ফারাক

    তফাৎ ও ফারাক
    -অতীশ দীপঙ্কর

     

     

    অনেক দিন পরে সেদিন হঠাৎ ছোটবেলার বন্ধু সোমেনের সঙ্গে দেখা হলো ট্রেনে। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছিস? বোস আমার পাশে।
    পাশে বসে বললো, একটা গাড়ি কেন, কতদিন আর ট্রেনে চেপে যাবি!
    বেশ গর্বিত ভাবে বললো, দেখ মাধ্যমিকের পর বুঝেছিলাম আমার আর লেখাপড়া হবে না, তাই আজ আমার তিনটে প্রাইভেট গাড়ি, ছেলের তিনটে বাইক, তার মধ্যে একটা আবার কিনে দিয়েছি তিন লক্ষ টাকা দিয়ে! নোট বাতিলের সময় আমার কোন অসুবিধে হয় নি! আমার সব টাকা তো মাটিতে ছড়িয়ে রেখেছি আর যেটুকু তা ওই ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে। আয়করের দেবতারা কোন ফুলে তুষ্ট আমি খুব ভালো জানি! তাই দেখ আমার কতগুলো বালি খাদ আছে, বিড়ির অতবড় ব্যাবসাও করেছি, অতগুলো ইট ভাটা চালাই সবাইকে কেমন ম্যানেজ করে! তোকে তখন কতবার বললাম ওসব ছাড়, আয় আমার সঙ্গে বালি খাদে লেগে পড়!
    আজ একটা ভাঙাচোরা মোটরসাইকেল ছাড়া তোর কিছুই নেই! কেরানিদের মত তোর জীবনের স্রোত বইছে কেমন! এ জগতে টাকাই সব! টাকার গরমে শিক্ষাকে চাপা দেওয়া যায় বুঝলি?
    তোদের মত শিক্ষিত মানুষ আর রাজনীতির লোকেরা আমায় কত তোষামোদ করে!
    আমি এতক্ষণ মন দিয়ে সোমেনের কথা শুনছিলাম। ওর বিস্তারিত তথ্য ও সংস্কৃতির ভার আমাকে একটুও অবাক করেনি। আমার বাল্য বন্ধু সে, তাই খুব ভালো চিনি ও জানি; তার থেকেও ভালো জানা ও চেনা আছে আজকের অধিকাংশ পরিচিতের চলার পথ। আমি বললাম, ফারাক আছে রে অনেকখানি, তুই একদিন ঠিক বুঝবি।
    হঠাৎ আমাদের স্টেশানে ট্রেনটি থামল, ও অফসাইডে নামতে চাইল, নামার আগে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, চল অফসাইডে নামি। আজকে ট্রেনটি অন্য প্লাটফর্মে দিয়েছে বলেই আমাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটি উল্টোদিক দিয়ে নামলে একটু তাড়াতাড়ি হয়।
    আমি বললাম, আমি কোনদিন অফসাইডে নামি নি, বুঝলি সোমেন তফাত খানিকটা ঠিক এখানেও।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- শেষ চিঠি

    শেষ চিঠি
    – শম্পা সাহা

     

     

    জানো তো, ক’দিন ধরে তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। আসলে যবে থেকে জানতে পেরেছি আমি আর বেশিদিন নেই, মানে ডাক্তার বলেছে!ডাক্তার বলেছে আমার নাকি হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, ওই তোমরা যাকে বল ভালভ্ ব্লক হয়ে যাওয়া। তাতে যা অবস্থা মাস দুই তিন বা তারও কম। এখন আমি লাইফ সাপোর্টে আছি, তাই চিঠি লিখতে পারছি না আর তোমার ফোন নাম্বার তো নেই। থাকলেও ফোন করতে পারতাম কিনা জানি না? কারণ তিন সন্তানের মা তার কোনো এক প্রাক্তন প্রেমিককে ফোন করবে আর তার সন্তানেরা সেটা মেনে নেবে, ভারতবর্ষ এখনো এতোটা আধুনিক হয়নি।
    হৃদযন্ত্র বিকল তো হবেই, এমন একটা অমনোযোগী, নিষ্ঠুর আর অহংকারী লোকের হাতে দিয়েছি বিকল তো হতেই হতো। এতো অযত্ন, তবু যে এতদিন কিভাবে একেবারে ছন্দবদ্ধ ভাবে চলে গেলো, এটাই আশ্চর্য! মাঝে মাঝে অবশ্য বিদ্রোহও করতো। তখন এই নাকে নল আর বুকে তার লাগিয়ে শুয়ে থাকতাম হাসপাতালের কেবিনে। আসলে যন্ত্রণা হত প্রচন্ড, “সবাই বলত কোলেস্টেরল জমেছে” তারা তো কেউ জানত না এই হৃদযন্ত্রের শুধু কাঠামোটি ছিল আমার কাছে প্রাণটা তো ছিল না কোনো দিনই। সে যাই হোক বেচারা হৃদয় অকারণেই দোষী হতো। জানো তো ডাক্তার যাই বলুক, আমি কিন্তু মরবো না এখন কারণ আমার যে একটা গোপন স্বপ্ন আছে, সেই কিশোরী বয়স থেকেই। যবে থেকে তোমার সঙ্গে আলাপ তবে থেকেই। তা
    তোমাকে বলিনি কোনোদিন, তুমি হাসবে বলে তবে আজ মনে হচ্ছে বললেই হতো। শুনে হাসবে না তো? আমার বড় ইচ্ছে এক শরৎ শেষের বর্ষণমুখর রাতে যে দিন সারারাত ধরে অঝোর বৃষ্টিতে চারিদিক সঁপসঁপে, তুমি আর আমি পাশাপাশি বসবো খোলা জানালার সামনে খাটের ওপর। তোমার কাঁধে থাকবে আমার মাথা, নাকে ভেসে আসবে তোমাদের উঠোনের ভেজা শিউলির গন্ধ, মাঝে মাঝে সামনের জানালার অর্ধেক ঢাকা পর্দা উড়বে আর সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো এসে পড়বে তোমার মুখের ওপর।
    অন্ধকার সেই রাতে আমরা কোনো কথা বলবো না, শুধু অনুভব করবো আমার পাশে তোমার থাকাটুকু। তোমার গায়ের মৃদু পুরুষালী গন্ধ আমাকে আশ্বস্ত করবে। তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়বো ধীরে ধীরে । জানতো ডাক্তার যতই বলুক, এ স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুতেই মরতে পারবো না, কিছুতেই না…
    “মা, মা, ও মা.. ডাক্তারবাবু দেখুন তো, মা কিছুতেই চোখ খুলছে না, এতো ডাকছি! ও মা মা… “

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- অন্য এক চকলেট দিবস

    অন্য এক চকলেট দিবস
    – সুদীপা ধর

     আজ সোহমের খুব আনন্দ। গার্লফ্রেন্ডের সাথে মান অভিমানটা বোধহয় আজকেই শেষ হবে। দেখা করতে বলেছে সোহম, শ্বেতাকে। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর শেষ পর্যন্ত রাজি হয় শ্বেতা। বিকেল সাড়ে চারটায় দেখা করার কথা আউট্রাম ঘাটে।

    ঝগড়াঝাঁটি হলেও সোহমকে শ্বেতা নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু অভিমানটা শ্বেতার একটু বেশি, বরাবর সোহমকেই ভাঙাতে হয়।

    খুব সেজেছে শ্বেতা। ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে সোহম তাকিয়ে আছে শ্বেতার দিকে,  কিন্তু গুরুগম্ভীর শ্বেতা তাকাচ্ছে না সোহমের দিকে। নদী বক্ষের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাই হোক সোহম ভালো করেই জানে এই মেয়ের অভিমান সহজে ভাঙে না, তাকেই ভাঙ্গাতে হবে। আলতো করে শ্বেতার হাত ধরে প্রথম কথা—

    “শ্বেতা আর কতদিন এইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? কথা বলবে না তো? ঠিক আছে চলে যাচ্ছি তাহলে।”

    ছলছল চোখে শ্বেতার জবাব “ঝগড়া করার সময় মনে থাকে না। আর এখন এত ভালোবাসা দেখাচ্ছ তুমি!”

    “ওরে আমার অভিমানী মেয়ে, হয়েছে বাবা আর ঝগড়া করবো না। চলো এবার ওখানে গিয়ে একটু বসি।”

    অদ্ভুত আনন্দে শ্বেতার মনটা ভরে যায়।  ও ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।  এই কদিন রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারে নি। যাইহোক অনেক কথা বলার পর সোহম এক বিরাট চকোলেটের বাক্স এগিয়ে দিল শ্বেতার হাতে।

    “শুভ চকলেট দিবস। নাও তোমার সমস্ত প্রিয় চকোলেট এরৎমধ্যে সাজিয়ে এনেছি। অভিযোগ করার সুযোগ আমি আর দেব না।”

    চকোলেট পেয়ে শ্বেতা হু হু করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল। থাকতে না পেরে সোহোম জড়িয়ে ধরলো শ্বেতাকে।

    অনেক দূর থেকে একটি ছেলে লক্ষ্য করছিল। কাছে এসে দু’টো ভিক্ষা চাইল সোহমের কাছে। আধময়লা,ছেঁড়া জামা, উস্কোখুস্কো চুল কিন্তু চোখ দু’টো মায়ায় ভরা। সোহম ওর দিকে  একশো টাকার একটা নোট বার করে দিলো। ছেলেটা পেয়ে খুব খুশি। চলে যাচ্ছিল হঠাৎ করে শ্বেতা ডাকলো —

    “এই শোন।  এদিকে আয় তো।”

    ভয়ার্ত চোখে গুটি গুটি পায়ে ছেলেটা হাজির হলো শ্বেতার সামনে।
    শ্বেতা বললো “আজকে কি দিন জানিস?”
    ছেলেটি বললো, “না”
    “চকলেট দিবস। বুঝেছিস।”
    ছেলেটি বললো, “দোকানে সাজানো থাকে দেখেছি। কি সুন্দর দেখতে। কিন্তু কোনোদিন খেতে পাইনি তো, তাই জানতেও পারিনি জিনিসটা কি?”
    শ্বেতা বললো, “তাইতো এটা তোর জন্য।”

    বিস্ফোরিত চোখে ছেলেটা একবার সোহম আর একবার শ্বেতাকে দেখছে। ও ভাবতেই পারছে না এই দুর্লভ বস্তুটা কোনোদিন ওর হাতে কেউ এভাবে দেবে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেটা চকলেটের বাক্সটা নিয়ে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি বলবে ছেলেটা নিজেই বুঝতে পারছিল না, কিছুক্ষণ পরে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো—

    “তোমরা যে ভীষণ ভালো দাদা দিদি” বলেই দৌড়ে চলে গেল।

    আজ এই দিনে অদ্ভুত এক আনন্দে আর গর্বে সোহমের বুকটা ভরে গেল শ্বেতার জন্য। শ্বেতার এইরূপ সোহম কোনদিন দেখে নি। বাচ্চা মেয়েটার অভিমানটাই খালি দেখেছে সোহম এতদিন,  কিন্তু তার ভেতরে যে এত বড় হৃদয় আর একটা বিরাট মন লুকিয়ে ছিল, সোহম আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলো । সোহম ভাবল ও তার চলার পথের জীবনসঙ্গিনীটিকে ঠিক বেচেছে। এক অদ্ভুত আনন্দে সোহম শ্বেতাকে বুকে টেনে নিলো।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- প্রতিবন্ধকতা

    প্রতিবন্ধকতা
    – উজ্জ্বল সামন্ত

     

     

    সৌভিক হুইল চেয়ারেই স্কুলে আসে। একটা রোড এক্সিডেন্টে ওর ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুদ্ধিমত্তা ও অন্যান্য অ্যাকটিভিটিতে ভীষণ ভালো, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। একবার স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস এর আগের দিন ওর এক বন্ধু ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল, সৌভিক, তুই কি ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’-এ নাম লেখাবি?

    উত্তরে সৌভিক বললো- না রে, আমি অংশ নিতে পারবো না কোনো ইভেন্টে।
    বন্ধু- কেন?
    সৌভিক- কয়েকটা ইভেন্টে স্যার আমাকে জাজ হতে বলেছেন, তাই।
    বন্ধুটি সৌভিকের কথাগুলো শুনে মাথা হেঁট করে দ্রুত চলে গেল…

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- দহন

    দহন
    – গৌতমী ভট্টাচার্য

     

     

    কিছুতেই মোবাইল ধরছে না অভীক–সমানে রিং হয়ে যাচ্ছে। মিমি যে কি করবে ভেবে কুল কিনারা করতে পারছে না। গতকাল প্রায় জোর করে অভীক বন্ধুদের সাথে আলাপ করাতে নিয়ে গেছিল মিমিকে। মিমির অনারে অভীকের বন্ধুরা হোটেলে ব্যাঙ্কোয়েট পার্টি দিয়েছিল। মিমির একদম এসব পার্টি ভালো লাগে না, সবে ক’দিন আগে মিমি আর অভীকের বিয়ে হয়েছে। ওদের নেগোসিয়েশন ম্যারেজ, ভালো করে দুজনের দুজনকে চেনাই হয় নি এখনো। অভীকের ইচ্ছেতেই পার্টিতে যাওয়া।

    হৈচৈ আড্ডা ভালোই চলছিল, অভীকের বন্ধু জয় জয়েন করলে পার্টির জোশ আরো বেড়ে গেল। সবাই মিলে মিমির সঙ্গে জয়ের আলাপ করাতে গেলে ওর মিষ্টি হাসির সঙ্গে নমস্কারের প্রত্যুত্তরে জয় হ্যান্ডসেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে মিমিও একটু থেমে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। হ্যান্ডসেকের মৃদু ঝাঁকুনিতে মুহুর্তের জন্য সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গের শিহরণ বয়ে গেছিল। মিমির গাল দু’টো লাল হয়ে যেতেই আড়চোখে অভীকের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোয়াল কঠিন হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে পার্টির আনন্দের তাল কেটে গেল। শরীর ভালো না লাগার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি ফিরে সেই যে পাশের ঘরে অভীক শুতে চলে গেল তারপর থেকে আর কোন কথা নেই। নতুন বৌ — সবাই বাঁকা চোখে তাকিয়ে বাঁকা কথা বলতে ছাড়ছে না। শাশুড়ি মা ইনিয়ে বিনিয়ে তার একমাত্র পেটপাতলা দুগ্ধপোষ্য মাতৃভক্ত পুত্রের কাছ থেকে আসল কথাটি জেনে নিয়েছেন। তা নাহলে তাকে অকারণে জ্ঞান বিতরণ করছেন কেন। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরপুরুষের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় বা তাদের স্পর্শ করা পাপ।

    মিমির ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাবতে কোথায় তার বিয়ে হলো — শুধু একটু স্পর্শ করাতেই, তাও অনিচ্ছায় অভীকের কাছে অস্পৃশ্য অচ্ছুৎ হয়ে গেল। এটুকুতেই চরিত্রের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায় আর বৌভাতের দিন যখন অভীকের প্রাক্তন প্রেমিকা ওর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে অভীকের সঙ্গে, শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল তখন তো একবারও ভাবে নি নতুন বৌয়ের মনে কষ্ট হতে পারে। অভীকের চোখে মুখে প্রাক্তনীর প্রতি মাখোমাখো ভাবে তো অভীকের মনটি সহজেই বোঝা গেছিল প্রেমিকার প্রতি গভীর অনুরক্ত সে। মনের মধ্যে বসত করে একজন আরেকজনের সঙ্গে সংসার। তখন তো অভীকের চরিত্রের পতন ঘটেনি। এও তো এক ধরনের নৈতিক চরিত্র পতন। একবারের ও জন্য তো ভাবে নি মিমির খারাপ লাগতে পারে। মিমির ভিতরটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে থাকলো অদ্ভুত এক দহন জ্বালায়।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- আয়না

    “আয়না”
    – উজ্জ্বল সামন্ত

     

     

    উষসী এককথায় প্যারাগন বিউটি। ওর রূপের ছটায় যে কেউ ক্রাশ খায়। এই রূপ একদিন কাল হল, এসিডের হামলায় ক্ষতবিক্ষত। প্লাস্টিক সার্জারির পর ডাক্তার মুখের ব্যান্ডেজ খুলবে। ইতস্ততঃ মুখে বলেন, ভেঙে পড়ো না..
    উষসী: আয়না নিয়ে আসতে বলে।
    ডাক্তার: কেন?
    উষসী : কতটা বদল হয়েছে দেখব …নিজের চোখে। ওরা অ্যাসিড বাল্ব ছুঁড়ে আমার মুখটা পুড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আমার মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। ওদের যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করব, সমাজের স্বার্থে, যাতে এই ঘৃণ্য কাজের পুনরাবৃত্তি না হয়…

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- বিয়ে বাড়ির সেকাল আর একাল

    বিয়ে বাড়ির সেকাল আর একাল
    – জয়তী মিত্র

     

     

    দাদু আজ বিয়ে বাড়ি যাবে না? ঠামমু তো সেই সকাল থেকে শাড়ি গহনা বার করে একদম রেডি। শুধু এবার গেলেই হয়। বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলে সবাই মিলে যাবো।

    না রে দাদু ভাই, এখনকার বিয়ে বাড়িগুলোতে কোনো প্রাণ নেই। কেমন যেনো মেকি। চারিদিকে খাবার সাজানো আছে। নিজে নাও আর খাও। অ্যাপায়ন করার কেউ নেই। দেখারও লোকজন নেই। সব আসছে নতুন বউকে উপহার দিচ্ছে, তারপর প্লেটে খাবার নিয়ে সব খেয়ে চলে যাচ্ছে।এখন খালি লোক দেখানো ব্যাপার বেশি। কে কত খাবারের স্টল দিল, কে কত খরচ করে বিয়ে বাড়ি সাজালো এই সব নিয়ে সব ব্যস্ত। অতিথিরা ঠিক মত খেল কিনা এইসব আর কেউ দেখে না। আর ওই বুফে সিস্টেমে খাওয়া আমার পোষাবে না। প্লেটে করে একটু একটু করে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া যায় নাকি? কিছু জায়গায় বসার ব্যাবস্থা থাকলেও সব জায়গায় থাকে না।
    এই তো সেদিন সেন বাবুর ছেলের বৌভাতে গিয়ে কি বিপদে পড়েছি জানিস, খাবার জায়গাটা খুব ছোট, একগাদা লোক সেখানে ভীড় করেছে। একজনের ঘাড়ের কাছে আর একজন, এইভাবে কি খাওয়া যায়? কোনরকমে একটা প্লেটে একটু খাবার নিয়ে কোনায় দাঁড়িয়ে খেয়ে সোজা সেখান থেকে বিদায় নিয়েছি। দু’ চারটে টেবিল পাতা ছিল, কিন্তু সেগুলো ভর্তি ছিল। আমার এখন বয়স হয়েছে, আর এইভাবে দাঁড়িয়ে খেতে পারি না। দাদুভাই তোমরা ঘুরে এসো, আমি যাবো না। দশ বছরের নাতি রণর তো মন খারাপ হয়ে গেলো দাদু যাবে না শুনে।

    রণ দাদুকে বললো- বাবার কাছে শুনেছি তুমি নাকি বিয়ে বাড়িতে খেতে খুব ভালোবাসতে। দাদু বললেন- সেকালের মানে আমাদের সময়কার বিয়ে বাড়ীতে কত আনন্দ হতো। সারাদিন বিয়ে বাড়িতে বিসমিল্লা খানের সানাই বাজত। বাড়ির উঠোনে, বাগানে বড়ো প্যান্ডেল হতো। কত খাওয়া দাওয়া হতো। ভাত, লম্বা বেগুন ভাজা, ঘি, ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, দই কাতলা, কচি পাঁঠার ঝোল, চাটনি, পাঁপড়, দই, রসগোল্লা, যে যত পারো খাও। চেয়ার, টেবিলে বসে জম্পেশ করে খাওয়া হতো। রসগোল্লা তো কম্পিটিশন করে খাওয়া হতো। জানিস দাদুভাই আমি একবার রসগোল্লার কম্পিটিশন এ জিতেছিলাম। বর যাত্রী গিয়েছিলাম বন্ধুর বিয়েতে। নতুন বউয়ের পিসতুতো দাদা, রসগোল্লা দিয়ে যাচ্ছে,আমি খেয়ে যাচ্ছি। বাজি লড়ে ছিলাম যে, তাই আর লজ্জা পাইনি। কি যে মজা হয়েছিল কি বলবো তোকে। আর বাড়ির প্রতিটা লোক কত অ্যাপায়ণ করলো। অনেকদিন মনে ছিল সেই বিয়ে বাড়ির কথা। তখনকার দিনে বিয়ে বাড়ি গেলে যে আপ্যায়ন পাওয়া যেত, এখন সেই জিনিস আর দেখা যায় না। অবশ্য এটাও ঠিক এখন লোকের হাতে সময় কম, বিয়ে বাড়ি এসে আগেকার দিনের মত থাকার ব্যাপারটাও এখন নেই,কাজ করার লোকের অভাব, তাই সবাই বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়ে দেয় কাজ উৎরে দেওয়ার। যখন যেমন, তখন তেমন আর কি?।
    নাও দাদু ভাই যাও তুমিও এইবার কোন পোশাক পরে যাবে সেটা ঠিক করে নাও, বিয়ে বাড়ি থেকে এসে আমাকে সব গল্প শুনিও কিন্তু।
    নিশ্চয় শোনাবো দাদু। যাই মা আমাকে ডাকছে। বাবার আসার সময় হলো। এইবার রেডি হতে হবে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- চড়

    চড়
    – শম্পা সাহা

    ‘ঠাস’ হঠাৎ একটা আচমকা শব্দ যেন গালে নয় আছড়ে পড়ল সবার মনের ওপর। বাঁ গালে হাত বুলাতে বুলাতে অবাক হয়ে অর্ক মায়ের দিকে তাকিয়ে। প্রদীপ বাবু বুঝতে পারেন না হঠাৎ কি হলো? অর্ক মায়ের বিরুদ্ধে কি একটা বলতে গিয়ে থমকে চুপ করে রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

    মনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের অংকের রাশভারী প্রধান শিক্ষিকা প্রভাবতী দেবী । যেমন ডাকসাইটে তেমনি দুর্দান্ত দিদিমণি। হেডমিস্ট্রেস, অফিসিয়াল কাজের চাপ বা মিড-ডে-মিল থাকলেও প্রতিদিন চেষ্টা করতেন একটা করে ক্লাস নেওয়ার। তাই ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কটা যেমন ভালো তেমনি তাদের কাছে জনপ্রিয়ও বটে। তবে শুধু রাগী বলে বা ভালো পড়ান বলে নয় প্রভাবতী একজন ছাত্রদরদী শিক্ষিকা বলে। এক ছেলে অর্ক আর মেয়ে অঙ্কিতা।

    বেশ চোখে চোখে মানুষ করেন ছেলেমেয়েদের। একটু নিয়মের নড়চড় নেই। বা রে! মানুষের মতো মানুষ হতে হবে না?
    প্রদীপ বাবু ভালো মানুষ গোত্রীয়, মাস্টার বটে কিন্তু বাংলার, বিষয়ের মতো নরম সরম, বৈষয়িক ব্যাপারে বীতস্পৃহ । একটু-আধটু লেখালেখিও করেন। নিজের বই পড়া আর লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত আর ব্যস্ত নিজের স্কুল নিয়ে । আসলে বউ এর দাপটে শশব্যস্ত।

    সবাই জানে অর্ক আর অঙ্কিতা খুব ভালো, যেমন পড়াশুনা তেমন আচার-আচরণে। হবে না?
    মা যেমন দাপুটে ! প্রভাবতী দেবীও ছেলের ভালো ব্যবহার আর ভালো রেজাল্টের ফলে, ছেলে মানুষের মত মানুষ হচ্ছে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ।

    অর্ক মা বলতে অজ্ঞান। সবে ক্লাস ইলেভেন সাইন্স। পাশের স্কুলে পড়ে। প্রভাবতী দেবী বছর তিনেক হলো মনোমোহিনীতে হেডমিস্ট্রেস হয়ে এসেছেন। তার আগে অবশ্য দূরে বারাসাত কলোনি স্কুলে ছিলেন ।

    বাড়ির কাছাকাছি স্কুল হলে যাতায়াতে অত সময় নষ্ট হবে না, ছেলে মেয়েকে আরো একটু সময় দেওয়া যাবে এই ভেবেই সহ শিক্ষিকা থেকে হেডমিস্ট্রেস হওয়া।

    অঙ্কিতা এখনও নরম মাটির দলা, মায়ের আঁচল ধরা। প্রভাবতী দেবী ছেলে গরবে গরবিনী । হবেন নাই বা কেন? অর্ক মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে আর রাজ্যে সপ্তদশ তাই শুধু প্রভাবতীই নয় অর্ককে নিয়ে পুরো পরিবারই গর্বিত।

    পড়তে বসে অঙ্কিতা হঠাৎই বলে উঠলো, “জানো মা, দাদা না আজ স্বাতী দিদির সঙ্গে ঝগড়া করছিলো”
    – “ঝগড়া?” প্রভাবতী অবাক, “স্বাতী কে?” প্রভাবতী দেবী একটু কৌতুহলী।
    -“স্বাতী দিদি আমাদের স্কুলে পড়ে, নাইনে।”
    -“দাদা ওর সঙ্গে ঝগড়া করছিলো কেন?”
    -“রোজ যখন স্কুলে যাই দাদা স্বাতী দিদির সঙ্গে কথা বলতে চায়, স্বাতী দিদি চায় না।”
    স্বাতী অঙ্কিতার স্কুলে পড়ে। প্রভাবতী পাশের স্কুলে ইচ্ছে করেই মেয়েকে দিয়েছেন, নিজের স্কুলে না দিয়ে। নিজের কাজের প্রভাব যদি মেয়ের উপর পড়ে।

    সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ডেকে পাঠান।
    “স্বাতী কে? তোমার সঙ্গে তার ঝগড়া হয় কেন?”
    – “ধুর, ও একটা বাজে মেয়ে।” ওর বাজে মেয়ে কথাটা উচ্চারণের ভঙ্গি দেখে প্রভাবতী অবাক । একট বয়সে ছোট মেয়ের সম্পর্কে ছেলের বাজে শব্দটা উচ্চারণ করার ভঙ্গি দেখে প্রভাবতী চমকে ওঠেন। অর্ক কবে এরকম বদলে গেল? কবে মানুষকে বিশেষ করে মেয়েদের সম্পর্কে এভাবে অবজ্ঞা করে কথা বলতে শিখলো? শুধু ছেলের রেজাল্ট আর মিষ্টি বুলিতে ভুলে ওর ভেতরের আমূল পরিবর্তনটাই প্রভাবতী বুঝতে পারেননি।

    রাগে দুঃখে যেন নিজের উপরই ক্ষেপে উঠলেন প্রভাবতী। ছেলেকে বললেন, “ভালো ভাবে কথা বলো, মনে রেখো তুমি একজন মেয়ের সম্পর্কে কথা বলছো।”
    -“যা বাব্বা! আমি আবার কি করলাম?”
    -“কিছু করনি, কিন্তু ভদ্রভাবে কথা বলো। আর তার সম্পর্কে তোমার এত বিরক্তি কেন?”

    অর্ক দু’হাত ছড়িয়ে কাঁধ নাচিয়ে বলে, “আরে ওই ফালতু মেয়েটা আমাকে ..”
    ব্যাস আর কথা শেষ করতে পারে না অর্ক। প্রভাবতীর চড়টা সজোরে এসে পড়ে ছেলের গালে।
    -“একটা মেয়েকে ফালতু বলার তুমি কে? এসব বিশেষণ বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলো..”

    অর্ক বোনের সামনে চড় খেয়ে হতভম্ব। প্রভাবতী ভাবছেন চড়টা মারলেন বটে, তবে মনে হয় যেন চড়টা আরো আগেই মারতে হত, তবে বেটার লেট দ্যান নেভার!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- যদি

    যদি
    -শম্পা সাহা

     

     

    আজকের ইন্টারভিউটা ফেল করলে কিছুতেই চলবে না। বয়স বাড়তে বাড়তে ত্রিশের কোটায়, প্রথমদিকে হাতে টিউশনের হাজার দশেক টাকা আসাতে প্রশান্ত ভেবেছিল চাকরীর চেষ্টা করার দরকার নেই, বাবার মাইনেটা ছিল। দিদির বিয়েটা বাবা থাকতেই দিয়ে গেছেন। সেজন্য অবশ্য মনে মনে বাবার প্রতি ও কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর ফ্যামিলি পেনশনটা থাকলেও তাতে সংসার চালানো একটু চাপের। তার ওপর বয়স বাড়ছে, সঙ্গীতা বারবার বিয়ের জন্য তাগাদা দেয়।টিউশনিটা ভবঘুরে জীবনের সাহারা হতে পারে, কিন্তু বিবাহিত জীবনের নয়। তবে থেকেই ও চাকরির জন্য মনোযোগী হয়ে ওঠে।
    ঠিক সকাল ন’টায় খেয়েদেয়ে, ইস্ত্রি করা ফরমাল পোশাকে পা বাড়ায় অফিসের দিকে। ইন্টারভিউটা বেলেঘাটা ফুলবাগান মোড়- এ বাটার শোরুম এর ওপরে, একটা ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির ডেস্ক জব, স্টার্টিং স্যালারি পনেরো হাজার দেবে। অ্যাড দেখে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লাই করেছে। এখন অনলাইনে খুব সুবিধে, সব ঘরে বসেই হয়ে যায়।
    বাসে উঠে একটা সিট পেয়ে বসে গেল প্রশান্ত। মৌলালী থেকে ফুলবাগান খুব বেশি হলে মিনিট চল্লিশেক। ক্যাবে অনেক ভাড়া আর দূরত্ব ও এমন কিছু নয়। ওর সামনেই শিয়ালদহ থেকে উঠলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে গ্রাম্য। হাতে একটা প্লাস্টিকের ঢাউস ব্যাগ, ভালো দাঁড়াতেও পারছেন না। ঝাঁকুনি দিলে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ওর ঘাড়ের উপর।
    হঠাৎই বাসটা বরফ কলের সামনে এসে দাঁড়াতে ভদ্রলোক উপুড় হয়ে পড়লেন প্রশান্তর ওপর। “একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান না” পোষাকের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে ও। ইন্টারভিউতে পোশাক একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু ভদ্রলোক উঠছেন না কেন? তাড়াতাড়ি ওনাকে বসিয়ে দেখে, নাঃ, শ্বাস চলছে, মারা যান নি। মুখে চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা হলেও চোখ খুললেন না। একবার তাকিয়ে আবার বুঁজে ফেললেন, বোঝা গেল প্রচন্ড যন্ত্রণাতে কষ্ট পাচ্ছেন, তার ছাপ মুখে চোখে স্পষ্ট।
    অফিস টাইম, সবাই সামান্য কৌতূহল, তারপর সহানুভূতি দেখিয়ে যে যার গন্তব্যে নেমে যেতে লাগল। মুখে অনেকেই বললো, “হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে” কিন্তু কেউ যেতে রাজি হল না। যেহেতু উনি প্রশান্তর গায়ের উপর পড়েছেন তাই দায় যেন ওর একার। প্রশান্ত দু’চারবার চিন্তিত মুখে ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর ত্রি কোণ পার্কের স্টপেজে ভদ্রলোককে পাঁজাকোলা করে নিয়ে নেমে গেল বাসস্ট্যান্ডের কাছের নার্সিংহোমে। ওর তখন মাথায় ঘুরছে, “বাবার তো এই বয়সই ছিল। ওনাকে যদি ট্রেনে স্ট্রোক হবার পর ঠিক সময়ে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যেত তাহলে হয়তো উনি আজও আমাদের মধ্যে থাকতেন।”

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সেলসম্যান

    সেলসম্যান
    -জয়তী মিত্র

     

     

    সারাদিন দরজায় দরজায় জিনিসপত্র বিক্রি করার পর একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো সৌরভ। চায়ে চুমুক দিতেই এক নিমেষে তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, এই পাড়াতেই তো রিমিদের বাড়ি ছিল। বহু বছর পর এই পাড়াতে এলাম। যদিও এই পাড়ায় আসার প্রথম অভিজ্ঞতা তার মোটেও ভালো নয়। এত বছর পরেও তার অপমানিত হবার স্মৃতি মনের গভীরে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
    রিমি আর সৌরভ দুজনে একই মাস্টার মহাশয়ের কাছে বাংলা পড়তে যেত। দুজনেই তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। এক জায়গায় পড়ার সুবাদে নোটস আদান প্রদান হতে হতে কখন যে দুজনে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিল, দুজনের কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। পড়াশুনার পাশাপাশি চলতে লাগলো চুটিয়ে প্রেম পর্ব। মাস্টার মহাশয়ের বাড়ির কিছু দূরে গঙ্গা নদীর পাড়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। সেখানে গিয়ে তারা মাঝে মধ্যে বসতো, কত রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতো। কত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতো। সৌরভ বলতো, দুজনে অনেকদূর পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। তখন আর বাড়ির লোকেরা আপত্তি করতে পারবে না।

    মানুষের সব আশা এক জীবনে বাস্তবায়িত হয় না। একদিন দুজনকে একসাথে দেখে রিমির দাদার এক বন্ধু রিমিদের বাড়িতে সব বলে দেয়। শুরু হয় রিমির ওপর নির্যাতন। রিমির বাবা ছিলেন খুব রক্ষণশীল প্রকৃতির, তার বাড়ির মেয়ে পথে ঘাটে ঘুরে প্রেম করে বেড়াচ্ছে এটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। রিমির বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন তিনি। রিমি তো প্রথম কদিন খুব কান্না কাটি করলো। সৌরভও মনে মনে খুব ভেঙে পড়লো।
    একদিন রিমির সাথে দেখা করার জন্য তার বাড়ির কাছে আসতেই রিমির দাদার নজরে পড়ে যায়। পাড়ার সকলের সামনে দুই গালে সপাটে চড় মারে সৌরভকে রিমির দাদা। চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সৌরভ ফিরে যায় নিজের বাড়িতে।
    তার পর বেশ কয়েক বছর পার হয়ে যায়। রিমির সাথে আর কোনোদিন দেখা হয় নি সৌরভের। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর নাকি রিমিকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল রিমির বাবা। এক বন্ধুর কাছে রিমির বিয়ের কথা শুনেছিল সৌরভ। সৌরভও বি এ পাশ করার পর রাতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতো আর দিনের বেলায় সেলসম্যানের কাজ করতো। সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতিও নিচ্ছিল।

    চা খাওয়া শেষ হলে দোকানের মালিককে রিমির কথা জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে বিয়ের এক বছরের মাথাতে পণ মেটাতে না পারায় পুড়িয়ে মারে রিমিকে।
    এই কথা শুনে সৌরভের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে। তার রিমিকে শেষ কালে পণের বলি হতে হল।
    একটা ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়ের জীবনটা অকালে ঝরে গেল!
    একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সৌরভ। 

You cannot copy content of this page