অণু গল্প

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- এইতো হেথায়

    এইতো হেথায়
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    আসবো আসবো করে সেও আসেনি। যাবো যাবো করে এরও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ আমন্ত্রণ ছিল উভয় পক্ষেই। তবুও..
    আজ কথা আছে। আসবার। তার। কতদিন পর আজ অনেক আয়োজন। পরিপাটি সাজানো সারা বাড়ি। ও আসবে। বলেছে আসবে।
    নিজেকেও সাজিয়ে তুলেছে বেশ। সেই তার কথা মনে করে। তার ভাললাগাগুলোকে একটু একটু করে তুলে নিয়েছে তার সারা অঙ্গে। সোনা রঙের শাড়ীতে কালো আর লালচে আলপনা। শাড়ী ব্লাউজের ম্যাচিং। ঢেউ খেলানো কালো চুলের সাথে একাকার।
    মনে সাগরের উথাল পাথাল। দোতলার বারান্দায় মানি প্ল্যান্টের সবুজ পাতার আড়ালে বুলবুলি পাখির ব্যস্ত ওড়াউড়ি।
    ফাগুন হাওয়ায় বাসন্তী সিল্ক পর্দা গুলোর ওডিসি নৃত্যে ওডিকলোন সুবাস। ফ্রিজে আইসক্রিম রাখতে রাখতে মন ভেসে যায় দূরে । অনেক দূরের ফেলে আসা সময়ের কাছে।

    ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর সামনের রাস্তায়, ছুটন্ত সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। সওয়ার দুজনে। অনন্ত সুখে হারিয়ে যাওয়া। চৈত্রের সন্ধ্যায়। গলে যাওয়া আইসক্রিমের টসটসে ফোঁটায় ভিজে যাওয়া শাড়ির কোল, রুমাল দিয়ে মুছে দেবার ওর সে কি আপ্রাণ চেষ্টা। হেসে বাঁচিনে। ব্যগ্র চোখে হতাশ গলায় অপাপবিদ্ধ সরলতার পরশ মাখা প্রশ্ন, কী হবে?
    আবারও হেসে বাঁচিনে ।

    সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ও কি এলো?

    এখন ঘড়িতে ঠিক রাত দুটো বেজে সাত মিনিট।
    আতর জলে ডুবিয়ে রাখা বসরাই গোলাপ খানি, সে তুলে নিলো হাতে। পরম ভালবাসায় রেখে দিলো ওর হাসিমুখ ছবিটার পাশে । আইসক্রিমের পাত্রটাও সাজিয়ে রাখলো ওরই সামনে। তারপর তাকিয়ে রইলো খোলা দরজার দিকে।
    ও আসবে । নিশ্চয়ই আসবে। ও মিথ্যে বলে না। ও মিথ্যে বলতে জানে না। ও আসবে।
    রাত ঠিক দুটো বেজে সাত মিনিট। ওর প্লেনটা ঠিক এইসময়ই..মুহূর্তে আগুন। বিধ্বংসী সর্বগ্রাসী প্রলয় আগুন। সবশেষ। স্মৃতিটুকু ছাড়া।

    চোখের টসটসে ফোঁটায় ভিজে যাওয়া শাড়ির কোল। রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে ও ব্যগ্র চোখে অপাপবিদ্ধ সরলতার পরশ মাখা গলায় বললো, এইতো আমি, চেয়ে দ্যাখো। তোমার আমি।
    আবারও মুগ্ধ চোখে, হেসে বাঁচিনে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- ভোজন রসিক

    ভোজন রসিক
    – জয়তী মিত্র

     

     

    পাড়ার মোড়ের কাছে কালুদাকে দেখেই সঞ্জীব বললো, ‘আরে ও কালুদা ভালই হলো তোমার সাথে দেখা হয়ে, সামনের সপ্তাহে আমার ভাইপোর মুখে ভাত, তোমার আর বৌদির নিমন্ত্রন রইলো। কার্ডটা তুমি নাও, বৌদিকে আমি সময় করে বলে আসব। কালুদা বললো,’তোমাকে আর আসতে হবে না, আমি তোমার বৌদিকে বলে দেব।’ নিমন্ত্রণ পেয়ে কালুদা বেজায় খুশী।

    পাড়ার সবাই তাকে কালুদাই ডাকে। সুমিত নামটা সবাই ভুলে গেছে। গায়ের রং এমন কালো যে অন্ধকারে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একবার তো পাড়ার হারু অন্ধকারে কালুদাকে দেখে ভূত বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পুরো আবলুস কাঠের মতো গায়ের রং।
    নিমন্ত্রণ বাড়ি পেলে কালুদার মনটা আনন্দে ভরে যায়। রকমারী খাবারের পদগুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যখন বয়স কম ছিল তখন তো রীতিমতো খাবারের প্রতিযোগিতায় নামত কালুদা। তার ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া কেউ আটকাতে পারতো না।

    কালুদার ছোটো বেলা কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। কালু দা তখন কলেজে পড়ে। বন্ধুর এক দিদির বিয়েতে এক বালতি রসগোল্লা, কেজি দুই মাংস খেয়েছিল। সেই থেকে গ্রামের কোনো অনুষ্ঠান হলে শুধু কালুদর পেটরোগা বাবার নিমন্ত্রণ থাকত।

    এখন কালুদার বয়স ষাট। এই বয়সে এসেও নোলা যায়নি। কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রন পেলেই কালুদা বৌদিকে সাথে নিতেন না। নিজে বেশিরভাগ জায়গাতে একাই যাবার চেষ্টা করতেন। কারণ তাকে পাগলের মত খেতে দেখলে বৌদি যেভাবে চোখ পাকাতেন, তাতে তার কাপড়ে চোপড়ে হবার উপক্রম হতো। কালুদার বৌ ছিল খুব জাঁদরেল মহিলা। কালুদাকে সবসময় ধমকিয়ে, চমকিয়ে রাখতো। বৌকে খুব ভয় পেত কালুদা।
    এদিকে কালুদা বৌকে না জানিয়েই নিমন্ত্রণ বাড়ি হাজির। বৌদি সেদিন বাপের বাড়ি গিয়েছিল। বৌদি যখন বাড়ি থেকে ফিরলো, তখন দেখলো পাড়ার দু’টো ছেলে কালুদাকে রিকশায় চাপিয়ে বাড়ি নিয়ে আসছে। কালুদা নিমন্ত্রণ বাড়িতে এত খেয়েছে যে তার আর চলার ক্ষমতা নেই। বয়স যে অনেক বেড়ে গেছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।

    সব শুনে বৌদি বললো ‘কাল থেকে শুধু সেদ্ধ ভাত আর চারা মাছের ঝোল খাবে।’ বৌদির মুখে এইকথা শুনে কালুদার তখন চোখে জল।

    বেশ কদিন বৌয়ের তত্ত্বাবধানে ডায়েট মেনে কালুদার তো অবস্থা খারাপ। হাড়, জিরজিরে চেহারা হয়েছে। নিজেই নিজের দিকে তাকাতে পারছে না। ওদিকে বৌদি মাছ, মাংসের পদ রোজ খেয়ে যাচ্ছেন ইচ্ছা মত। সেদিন খাসির মাংসটা চেখে দেখতে চেয়েছিলেন কালুদা। বৌ এমন ধমকানি দিল ওনার খাবার ইচ্ছাটাই চলে গেলো।
    পরদিন কালুদার বৌ গিয়েছিল বোনের বাড়ি। ফ্রিজে ছিল আগের দিনের মাংস। কালুদাকে আর পায় কে? মাংসের বাটিটা বের করে কিছুক্ষণ ধরে আয়েশ করে মাংসটা সবটাই খেয়ে নিল কালুদা। বৌদি এসে মাংসের বাটি না পেয়ে কালুদাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছিল।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- পুঁই চিংড়ি

    পুঁই চিংড়ি
    -শম্পা সাহা

     

     

    রহমান চাচা অনেকক্ষণ ধরে বাজারের থলি হাতে ঘোরাঘুরি করছে কিন্তু কিছু কিনছে না। বার দুয়েক দোকানের সামনে দিয়ে খালি ব্যাগ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখে খলিল জিজ্ঞাসা করে, “ও চাচা ভালো নদীর চিংড়ি আছে, নিই যাও, নিই যাও। বেশি না, ষাট টাকা শ। এ দ্যাকো একোনো লড়তিছে।” তাকিয়ে দেখেন সত্যিই দু’ একটা চিংড়ি গায়ে সাদায় সবুজে ফুটি ফুটি পা বাগিয়ে ঝুড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রহমান চাচা, “না লাগবে না” বলে দূরে সরে যায়।
    এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে এক ফালি কুমড়ো কুড়ি টাকা দিয়ে নিয়েছে। এই লকডাউন কাটার পর যেমন লোকের রোজগার কমেছে তেমনি বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। বাবা! সবজি তো না যেন সোনা! আলুও নেয় হাফ কেজি, লঙ্কা পঞ্চাশ।
    ছেলেটা রাজমিস্ত্রি খাটে, রহমান নিজেও তাই। কিন্তু এই সময়ে সব কাম কাজ একেবারে বন্ধ, কি করে যে চলছে তা ওই জানে! “আল্লাহর যা ইচ্ছে!” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহমান চাচা।
    বেলা প্রায় একটা। এত দামি চিংড়ি কে কিনবে? তায় কোন ভোরে ধরা, একটু নরম হতে শুরু করেছে। খলিল চেঁচাতে থাকে, “চিংড়ি, চিংড়ি ,চিংড়ি, মাত্র এই কটা পড়ে আছে, চল্লিশ টাকা, চল্লিশ টাকা, চল্লিশ টাকা। নিয়ে যান, নিয়ে যান”, জলের ছিটে দিয়ে আরও একবার মাছগুলো নাড়াচাড়া করে। রহমান সামনে এসে দাঁড়ায়। “একশো চিংড়ি দে তো খলিল” খলিল অবাক হয়, কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। মেপে একশো পাল্লা থেকে ঢেলে দেয় রহমানের ঝোলায়।
    যাক বাবা একশো টাকার মধ্যেই সব হয়ে গেছে! পোয়াতি বৌমাটা সেই কবে থেকে চিংড়ি দিয়ে পুঁই শাক খেতে চেয়েছে । হাসিনাকে বলে এসেছে পুঁই ডাঁটা মাচা থেকে কেটে রাখতে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই হাসিনার সকালকার কাজ সারা হয়ে আখা ধরানো হয়ে গেছে।। তাড়াতাড়ি না গেলে মাছগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। প্রসন্ন মুখে দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালায় রহমান চাচা।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- এসো মা লক্ষ্মী

    এসো মা লক্ষ্মী
    – রাণা চ্যাটার্জী

     

     

    “আহ্ রথীন, এই তো ঠেকে এলি, আরেকটু আড্ডা দেই, বোস।”

    ‘নারে ভাই, উঠি-ভর সন্ধ্যায় পোয়াতি বউমা একা ঘরে আছে। সন্ধ্যা দেবো, সময়ে একটু ঔষধ, টিফিন যদি না দেই অসুস্থ বৌমাকে এই বুড়ো বয়সে পাপ হবে ভাই’ বলে উঠে দাঁড়ালো তাদের বন্ধু রথীন।

    রঞ্জন বললো, ‘কিন্তু বন্ধু রে তোরও তো বয়স বাড়ছে এতো চাপ নিস না রে।’

    ‘না না চাপ নয়, একটু শরীর চালনা আখেরে আমারই লাভ তাছাড়া ছেলেটা হাড়ভাঙা খাটুনি সেরে ফেরে সেই রাত এগারোটা। যতদিন পারি সংসারটাকে ঢাল হয়ে না হয় রক্ষা করি” বলে পরিতৃপ্তির হাসি হাসলো সত্তর ঊর্ধ বৃদ্ধ তাদের শুভাকাঙ্খী বন্ধু।

    বাল্যবন্ধু প্রভাত বললো, “তুই নমস্য রে, গিন্নি মারা গেলো এক বছরও হয়নি। এতখানি মনের জোরে যেভাবে সংসার বুকে আগলে, বৌমার খেয়াল রাখিস, প্রণাম তোকে।”

    চার পাঁচ জন বয়স্ক বন্ধু শীত হোক কি গ্রীষ্ম বা বর্ষা রেল পাড়ের এই বট তলায় চা দোকানের লাগোয়া বেদীটায় বসে ঘন্টা খানেক নানা আড্ডা গল্প গুজবে জীবনে বেঁচে থাকার রসদটুকু সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরে। এই চেনা ছবির খুব একটা অদলবদল হয়নি বিগত পঞ্চাশ বছরেও।লকডাউন তাদের মুষড়ে দিলেও পরস্পরকে তারা ফোনে যোগাযোগ রাখতো। প্রায়শই শোনা যায় একাকিত্ব ঘর বন্দি জীবন বাড়ির অনেক পৌঢ় সদস্য-সদস্যাদের প্রাণ কেড়েছে তবু এনাদের বাঁচার  ইচ্ছেটা অনেকখানি বাড়িয়েছে সুস্থ বন্ধুত্ব।’

    ‘আমার নাতনি হয়েছে’-উচ্ছাসে সবাইকে ফোনে জানিয়েছে রথীন। খুশিতে বলেই চলেছে ‘জানিস, বাচ্চাটার একদম গিন্নির মুখ বসানো’।

    চার প্রৌঢ় বন্ধু খুশিতে আজ রথীনের বাড়িতে নাতনি দেখতে হাজির। বহুদিন পর বৈকালিক আড্ডায় তারা বন্ধুর খুশির খবরে উৎফুল্ল।সকলকে দেখে খুশিতে ডগমগ রথীন, ‘দেখ দেখ আমার ঘর আলো করে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মীমা এসেছে।’

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- পুরুষ কার!

    পুরুষ কার!

    -জিৎ সাহ 

     

    (১)
    অভীকটা বড্ড আজব ধরনের একটা চরিত্র। মাথার ভেতর কি সব আজগুবি চিন্তা ভাবনা নিয়ে যে ঘুরে বেড়ায় তার ঠিক নেই। উৎপটাং সব কথাবার্তা। এই নিয়ে মাঝে মাঝেই নিজের বৌ থেকে বন্ধুবান্ধব সকলের কাছেই একটা জোকার জোকার ইমেজ তৈরি করে নিয়েছে। অবশ্যই নিজের অজান্তেই। এই ইমেজ টিমেজ নিয়ে তার বিশেষ হেলদোল দেখি না। যদিও ভেতরে ভেতরে সে বেশ রগচটা বলতে পারেন। সে নিজেও কিছুটা হলেও তার এ ধরনের ক্যারেকটার নিয়ে চিন্তিত।এই ভালো তো এই খারাপ। তার সত্বেও তার ঐ আজগুবি চিন্তা ভাবনা গুলো সকলকে একরকম মাতিয়ে রাখে। এই যেমন বন্ধুদের নিয়ে ফুচকা খেতে খেতে হঠাৎ তার মাথায় এল_আচ্ছা! এই ফুচকা তে জলের বদলে যদি মদ গেলে খাওয়া হত, তাহলে কেমন হতো, বলত?
    অথবা, র-টী বদলে মদের সাথে চায়ের লিকার বানিয়ে খেলে কেমন হয়!
    অথবা বৌ বাচ্চা নিয়ে খেতে বসেছে। হঠাৎ, আচ্ছা সজনে ডাটার আঁচার, শুটকি মাছের আঁচার, গুগলি পোস্ত আর মুড়ি, পটলের চাটনি, কচু পোস্ত-র মত আজগুবি সব রেসিপি। এই অশান্তি যে একটু আধটু হয় না তাই নয়। তবে তার ঐ পর্যন্তই…


    (২)
    ছেলেবেলায় ভাবতাম বিয়ে করব না। বিয়ে টিয়ে আবার কেউ করে নাকি! ওসব করলে মা’র থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। মা যখন কথায় কথায় বলত এবার দেখে শুনে অভি’র জন্য একটি ফুটফুটে বৌ এনে দেবো। তাই শুনে অভি’র সে কি রাগ। রেখে টেগে একধারে গিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকত।


    (৩)
    আজ সেই অভীক আর ছোট্টটি নেই। তবে তার উৎপটাং ভাবনা গুলোর বয়স কিন্তু একদমই বাড়েনি। তাছাড়া এই বিয়ের বাসর রাতে বৌকে নিয়ে এমন চিন্তা করে কেউ আনকম্ফোর্ট ফিল করে! বদ্ধ ঘরে সে আর তার নতুন বৌ। এছাড়া তৃতীয় প্রানীটি আর কেউ নেই, এমন সময় সেই জানি না চিনি না বৌ যদি রনচন্ডী রূপ ধারণ করে। যদি খড়গহস্ত হয়ে থাকে অ্যাটাক করে বসে। তার সঙ্গে আর ক’দিনের-ই বা পরিচয়!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- দীপা বলি

    দীপা বলি
    – সৃজিতা ধর

     

     

    গোটা বাড়িটা আলোয় সাজানো হচ্ছে। প্রতিটা ঘরের বাইরে দুটো‌ করে মোমবাতি জ্বালানো। চারিদিকে শুধুই আলো আর আলো। অন্ধকার চিরে যেন আলো‌ বেরিয়ে আসছে। কিন্তু নিজের ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে আছেন দীপা দেবী। ওনার এসব ভালো লাগছে না। হঠাৎ জোরে একটা আওয়াজ পেলেন। বারান্দায় গিয়ে দেখলেন আকাশে হাজার রঙের খেলা। ছোট ছোট বিন্দুর মত আলো গোটা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে বার বার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বছর ছাব্বিশ আগের কথা। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছেন আগের রঙিন দিনগুলোতে। তখন হয়তো এত আলোর সমাহার ছিল না… কিন্তু যেটা ছিল সেটা মনের ভেতরে কোনো অন্ধকার জমা হতে দিত না।
    বারান্দা থেকে আস্তে আস্তে ঘরে যাচ্ছেন উনি। লাঠির খট্ খট্ শব্দ এত বাজির আওয়াজে শোনা যাচ্ছে না। চোখের কোণে যে জলটা জমে আছে সেটা আলোর রোশনাইয়ে হারিয়ে গেছে।
    বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট একটা ঘরে থাকা দীপা দেবীর কাছে এটা যেন একটা সত্যিকারের দীপা বলি।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- তবু আনন্দ জাগে

    তবু আনন্দ জাগে
    – উজ্জ্বল সামন্ত

     

     

    বস্তির ছোট্ট মেয়েটি শিউলি (১২ বছর) রাস্তার ফুটপাতে ফুল, মালা, বেলপাতা নিয়ে বিক্রি করে বস্তির সামনের বড় রাস্তায়। শিউলির বাবা হকারি করত ট্রেনে। মহামারীর আতঙ্কে ছয় মাস হল সব বন্ধ। ওর বাবা দিন মজুরের কাজে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যায়। প্রায় দিন খালি হাতে ঘরে ফেরে লকডাউনে সেরকম কাজ কর্ম নেই। মা পাঁচজনের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো কিন্তু লকডাউনে তাও বন্ধ। শিউলির এখন ইস্কুল বন্ধ তাই ওর খুব মজা। সকাল হলেই পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন গাছের ফুল তুলে মালা গেঁথে বেরিয়ে পড়ে ওদের বস্তি থেকে বড় রাস্তার মোড়ে। হঠাৎ একদিন বিকেলে শিউলির মা ওকে ও ছোট্ট ভাইকে নিয়ে রাস্তার ধারে একটি বড় দোকানে যায়। দোকানে খুব ভিড়, ওদের পোশাক দেখে সিকিউরিটি ঢুকতে দেয় না। দোকানের মালিক ব্যাপারটি লক্ষ্য করে। লোক মারফত একটি শাড়ি, একটি ফ্রক, বাচ্চাটির জন্য একটি জামা দিয়ে পাঠায়। শিউলির মা আত্মাভিমানী। গরীব হতে পারে কিন্তু কারো কাছে কোনোদিন হাত পেতে কিছু নেয়নি। জিনিসগুলো ফিরিয়ে দেয়। এবার দোকানর মালিক ওদের ভেতরে ঢুকতে দেয়। কেনাকাটা করে দাম দিতে গেলে দোকানের মালিক খুব আশ্চর্য হয়ে ওদের তিনজনের দিকে তাকায়। শিউলির বাবা সন্ধ্যায় ফিরে নতুন জামা কাপড় দেখে চমকে যায়। তখন শিউলির মা শিউলির ফুল বিক্রি করে রোজগারের কথা জানায়। আনন্দর রোজগার সেরকম নেই, তাই ছোট্ট ছেলে, মেয়ের ও স্ত্রীর জন্য কিছু কেনাকাটা করতে পারেনি দুর্গোৎসবে। মেয়ে শিউলির এই কাজে আনন্দে দুচোখের কোণে কিছু চিকচিক করে…

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- শিক্ষার আলো

    শিক্ষার আলো
    – জয়তী মিত্র

     

     

    শোন লক্ষ্মী কাল থেকে বিল্টুকে কাজ করতে পাঠাবি, বুঝলি। অনেক হইছে তুর বেটার লিখাপড়া। ও সব লিখাপড়া বড়লোক বাবুদের জন্য বুঝলি, ও সব আমাদের মত দিন আনা, দিন খাওয়া লোকের জন্য লয় রে। কাল সকালে মোর সাথে বিল্টু যেন বাবুদের বাড়ি কাজে যায়। আট কেলাস অবধি পড়াশুনা করেছে,আর দরকার নাই রে। পেটের জ্বালা ওই বই-খাতা গুলান নিভাইতে পারবে নি রে।
    পরানের মুখের কথা শুনে লক্ষ্মীর মটকা গেল গরম হয়ে। লক্ষ্মী বললো,”মুই কত কষ্ট করে লোকের বাড়ি কাম করে, চেয়ে চিন্তে বিল্টুকে লিখাপড়া শিখাচ্ছি, আর তুই বাধা দিচ্ছিস। ওইসব অলক্ষুণে কথা একদম বলবিক লাই। আমাদের বিল্টু লিখাপড়া শিখে ওই বাবুদের মত চাকরি করবে, আর তুই বলছিস লিখাপড়া ছারান দিতে। মুই বেঁচে থাকতে এইসব হতে দিব লাই। আমার বল্টু অনেক কেলাস অবধি পড়াশুনা করবে। ওর জন্য আমি ঠিকা কাজ করার সাথে রান্নার কাজও লিয়েছি বাবুদের বাড়িতে। ওই মিত্র বাড়ির বউদিমনি আমাকে বুলেছে- লক্ষ্মী তোর ছেলের পড়াশুনার জন্য টাকা দেব, তুই ছেলেকে পড়া। বৌদি মনির কথাতে মুই অনেকটা ভরসা পেলাম রে।”
    বল্টু বলেছে রাতের বেলা আমাকে পড়াইবেক। মুইও লিখাপড়াটা শিখবো।
    পরান বলে, “তোর পোলা তোরে লিখাপড়া শিখাবে? ওই জন্য তোর আজকাল মুখে বুলি ফুটেছে। শোন লক্ষ্মী- এইসব লিখাপড়ার ভূতটা মাথা থেকে লাবিয়ে দে আর সংসারে মন দে।আজকাল কাজে কর্মে তোর মন নাই, সেদিন আধ পোড়া তরকারি দিলি, মুই কিছু বলিনি বটে, আর যদি এমন করিস পিটিয়ে তোর লিখাপড়ার ভূত তাড়াবো মনে রাখিস।”
    তারপর আস্তে, আস্তে বিল্টু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ পাশ করলো। ভোরবেলা উঠে পরান যখন কাজে বের হতো, লক্ষ্মী তখন ছেলের কাছে বসতো লিখাপড়া শিখতে।
    লক্ষ্মী এখন লিখতে,পড়তে সব পারে। বস্তির বাচ্চাগুলোকে বিকেলবেলায় লক্ষ্মী পড়ায়। স্বামী পরাণকেও লক্ষ্মী টিপ ছাপ দেবার বদলে সই করতে শিখিয়েছে। পরান এখন আর টিপ ছাপ দেয় না। বস্তির লোকেদের সামনে নিজের নামটা সই করতে পেরে নিজে গর্ববোধ করে লক্ষ্মীকে আদর করে বলে,”লক্ষ্মী লিখাপড়া শিখার যে আনন্দটা আছে আজ বুঝতে পেরেছি রে। তুই সত্যি আমার ঘরের লক্ষ্মী।” বস্তির বাচ্চাগুলোকে অক্ষর শিখিয়ে লক্ষ্মী আজ গর্বিত। এই বয়সে এসে লক্ষ্মী মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। ভবিষ্যতে আরো পড়াশোনা করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখছে লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর ছেলে আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। লক্ষ্মীর অনুপ্রেরণাতেই আজ বস্তির ছেলে মেয়েগুলো শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- মিড ডে মিল

    মিড ডে মিল
    –শম্পা সাহা

     

     

    ছোট্ট ভাইটা নাকের পোটা সারা মুখে মাখিয়ে কেঁদে যাচ্ছে, তাতে দু’ একটা মুড়িও লেগে আছে। চোখের জলে নাকের জলে একেবারে মাখামাখি।
    সবাই সকালবেলা মুড়ি খায় মোটা চালের মুড়ি, দু’ পাঁচ টাকায় পাওয়া যায়। এই এলাকার সবারই মুড়ি জোটে সহজে কিন্তু ভাত নয়। মুড়ির চাল দিয়ে দু’ একবার ভাত করে খাবার চেষ্টা করেছিল অনেকে, কিন্তু পেটে সয়নি, বিশেষ করে বাচ্চাগুলোর। তাই মুড়ি দিনে তিনবার, যদি ঘরে থাকে। ভাত রেশনের চালের, তাও যা পাওয়া যায় তাতে মাত্র একবারই হয় এই ছয়জনের সংসারে।
    সোনালী, নিজে মুড়ি জল দিয়ে খেয়ে স্কুল বেরোনোর সময় ভাইকে কাঁদতে দেখে মনটা খুব খারাপ হলো। বেচারা হাঁটতে পারে না, শুধু শুয়ে থাকে। আজ ভাতের বায়না ধরেছে সকাল-সকাল।
    মিড ডে মিলের থালাটা নিয়ে সোনালী একটু আড়ালে গিয়ে প্লাস্টিকের ভেতর গরমাগরম ভাত তরকারী ভরে দৌড়ে গিয়ে ব্যাগে রেখে আবার থালা নিয়ে লাইনে দাঁড়ালো।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- উপহার

    উপহার
    – সুদীপা ধর

     

     

     আজ আমার সমস্ত কথাগুলো বুক চাপা কান্নায় পরিণত হয়েছে। যে কান্নার কোনো আওয়াজ নেই। যে কান্না শুকিয়ে গেছে বুকের মধ্যে। আমার সঙ্গে ওই বীভৎস ঘটনাটা ঘটার পর দেবাদিত্য তুমি আমাকে একটু একটু করে আবার কথা শিখিয়েছিলে। আমি তো এক প্রকার নীরব হয়ে গেছিলাম। নীরব শব্দগুলো আমার এদিক ওদিক ডানা মেলতো। আর আজকে তুমি পারলে এই ঘটনা ঘটাতে।

     বছর পাঁচেক আগে যখন চার পাঁচ জন গণ-ধর্ষণ করে, ছিঁড়ে খেয়ে খালের ধারে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো তখন তুমি এসে আমায় উদ্ধার করলে, পরম আদরে পরম যত্নের সাথে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে আশ্রয় দিলে, এতো আদর, এতো ভালোবাসা আমি হয়তো কখনো পাইনি। তুমি আমার নতুন নাম রাখলে রাধিকা।  একটা মা যেমন একটা শিশুর যত্ন করে, দেবাদিত্য তেমনি তুমি আমার যন্ত্রণার জায়গায় ভালোবাসার প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিলে। স্বপ্নমাখা পৃথিবীটা আবার যেন ভালো লাগতে শুরু করল। তোমাকে আমি আমার মণিকোঠায় রাজপুত্র কল্পনা করে আমার যন্ত্রণার প্রলেপগুলো ভুলে যেতে বসেছিলাম। তোমাকে নিয়ে আমি নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।  তুমি যখন আমার ঘরের দিকে আসতে তখন তোমার সেই পায়ের শব্দে আমি ভ্রমরের গুঞ্জন পাখির কলরব শুনতে পেতাম। পাঁচটি বছর এই ভাবেই কেটে যেতে লাগলো সুখের গালিচায়।

     কিন্তু  বছর পাঁচেক পর একটা দিনে তুমি আমাকে একটি ছোট্ট উপহার দিলে। আমি খুব বোকা ছিলাম, তোমার মনের এইসব কথা, ইচ্ছা আমি  বুঝতেই পারিনি। সেই ধর্ষকগুলো আমাকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়েছিল, তুমি যে যন্ত্রণাটা দিলে সেটা মানসিক। এক কঠিন কুঠারাঘাত করলে আমার মনের আত্মাতে। সেদিন  জানলার ধারে বসে ভাবছিলাম আমি, আমাদের সম্পর্কের কথা, হঠাৎ তুমি রাধিকা বলে ডাকলে আর একজনের সাথে আলাপ করালে। যখন জিজ্ঞেস করলাম উক্ত ব্যক্তির পরিচয় কী, তুমি বললে আজ থেকে নাকি এর বাড়িতেই আমার নতুন ঠিকানা, যে কথাটা বললে তার আগে আমার মরণ কেন হল না, তুমি বললে এনার কাছে নাকি আমাকে বিক্রি করে দিয়েছো, কিছু বলতে পারলাম না, শুধু বললাম, এতদিনে একটুও ভালোবাসো নি? তুমি বললে, ভালোবাসায় তোমার নাকী ঘেন্না। তুমি যে নারীকে ভালোবেসে ছিলে সে নাকি তোমায় ছেড়ে চলে গেছে বিরাট এক ধনবানের কাছে। তোমার কাছে নাকি সব নারীই সমান।  কিছু আর বলতে পারলাম না, শুধু বললাম তোমাকে আমি মনে রাখব সারা জীবন, দগ্ধ হব প্রতি রাত তোমার দেওয়া এই উপহারের কাছে। যতদিন বাঁচবো তোমার দেওয়া এই উপহারটিকে যত্নে সাজিয়ে রাখবো বুকের মাঝে।

You cannot copy content of this page