অনুবাদ
-
অনুবাদ- টোবা টেক সিং
টোবা টেক সিং (লেখক-সাদাত হাসান মান্টো)
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেনদেশভাগের পরে কেটে গেছে কয়েক বছর। এবার ভারত আর পাকিস্তান… দুদেশেরই সরকারের মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। দুদেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় তো হয়েছে এবার পাগলা গারদে যত পাগল রয়েছে তাদেরও বিনিময় করতে হবে। মানে ভারতের পাগলা গারদে যত মুসলিম পাগল আছে তাদের পাঠানো হবে পাকিস্তানে। আর পাকিস্তানের পাগলা গারদে যত হিন্দু আর শিখ রয়েছে তারা যাবে ভারতে।
এই প্রস্তাব কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার…পাগল বিনিময় হবেই। দু-দেশের হোমরাচোমরা অফিসাররা অনেক বৈঠক করলেন। অনেক কথা চালাচালি হল। তারপর কথা পাকা হল। পাগল বিনিময়ের দিনক্ষণও ঠিক করা হল। তবে যেসব মুসলিম পাগলের পরিবারের লোকজন ভারতে রয়ে গেছে তাদের সেখানেই রেখে দেওয়া হবে। আর বাকিদের নিয়ে যাওয়া হবে শরহদে। সেখানেই হবে বিনিময় । পাকিস্তানে আবার এই সমস্যা নেই। দেশভাগের সময় প্রায় সব হিন্দু আর শিখ পরিবারই ভারতে চলে গেছে। তাই হিন্দু আর শিখ পাগলদের সেখানে ধরে রাখার কোনো মানে হয় না।
এই খবর শুনে ভারতে কী ঝড় উঠেছিল জানা নেই, তবে এই খবর যখন লাহোরের পাগলা গারদে পৌঁছল তখন একেবারে হইচই পড়ে গেল। সবার মুখে এই ছাড়া আর কথা নেই। একজন মুসলিম পাগল ছিল সেখানে। সে আবার ‘জমিনদার’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। জ্বালাময়ী সব লেখা বেরোয় এই কাগজে। তা সেই লোককে জিগ্যেস করা হল… ‘পাকিস্তানটা কোথায়’? অনেক ভেবেচিন্তে…মাথা চুলকে সে বলে… ‘পাকিস্তান আসলে ভারতের মধ্যেই একটা জায়গা। এখানে ধারালো ক্ষুর তৈরি হয়’। তার জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনে বাহ্ বাহ্ করে সবাই।
একপাগল শিখ অন্য এক শিখকে পাকড়াও করে তার সমস্যার কথা জানায়… ‘সর্দারজি, আমাদের কেন ভারতে পাঠানো হচ্ছে? আমি তো ওখানকার ভাষা জানি না’।
দ্বিতীয়জন মুচকি হেসে বলে… ‘আমি কিন্তু হিন্দোস্তরাসের ভাষা জানি। মুখপোড়াগুলো এমন হামবড়া ভাব দেখায় যেন সবার মাথা কিনে নিয়েছে’।
একদিন এক মুসলিম পাগল স্নান করতে ঢুকে স্লোগান দেয় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। অতি উৎসাহে চেঁচাতে চেঁচাতে মাথা ঘুরে পড়ে মাটিতে। পরে তাকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
পাগলা গারদে যারা থাকে তারা সবাই যে পাগল এমনটা নয়। কেউ কেউ একেবারে স্বাভাবিক…আর পাঁচটা মানুষের মতোই। কিন্তু তারা সব খুনি-বদমাশ। ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে তাদের বাড়ির লোকজন অফিসারদের ঘুস দিয়ে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভারত কেন ভাগ হচ্ছে বা পাকিস্তান জিনিসটা আসলে কী সে বিষয়ে একটা ভাসাভাসা ধারণা তাদের রয়েছে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তাদের।
খবরের কাগজগুলোও কিছু বলছে না। রক্ষীদের কাছ থেকেও কিছু জানা যাচ্ছে না। কারণ কোনরকমে লিখতে পড়তে পারলেও এ বিষয়ে তারা একেবারে অজ্ঞ। তাদের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনেও কোনো লাভ হয়না। কেউ বলে মহম্মদ আলি জিন্না বলে একজন মানুষ আছেন। তাঁকে সবাই কায়েদ-এ-আজম বলে ডাকে। তিনি নাকি মুসলিমদের জন্য আলাদা একটা দেশ তৈরি করেছেন যার নাম পাকিস্তান।
কিন্তু পাকিস্তানটা ঠিক কোথায় তা কেউ জানে না। তাই পাগল আর আধা পাগলরা একটা ধন্দে পড়ে যায়। তারা এখন কোথায় আছে? ভারতে না পাকিস্তানে? তারা যদি ভারতে থাকে তাহলে পাকিস্তানটা ঠিক কোথায়? আর যদি পাকিস্তানেই তারাথাকে তাহলে যে দেশটা দুদিন আগে ভারত ছিল তা রাতারাতি কীভাবে পাকিস্তান হয়ে গেল!
সেদিন এক পাগল ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। ভারত-পাকিস্তান-পাকিস্তান-ভারত এই একঘেঁয়ে কচকচানি শুনতে শুনতে তার মাথায় সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। হাতের ঝাঁটা…বালতি ফেলে চোঁ চাঁ করে দৌড় লাগায়। তারপর চড়ে বসে এক গাছের ডালে। সেখানে বসেই ভারত-পাকিস্তানের নানা সমস্যা নিয়ে ঝাড়া দু-ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে যায়। রক্ষীরা চেঁচায়… ‘আরে নেমে আয়, নেমে আয় বলছি’। তাই শুনে সে পাগল আরো উঁচু একটা ডালে চড়ে বসে। রক্ষীরা আবার চেঁচায়… ‘নেমে আয় বলছি নাহলে কিন্তু শাস্তি হবে’। শাস্তিকে সে থোড়াই কেয়ার করে! সাফ সাফ সে জানিয়ে দেয়… ‘আমি ভারতেও থাকব না, আর পাকিস্তানেও নয়। আমি এই গাছের ডালেই থাকব’। অনেক বলে কয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত নীচে নামানো হয়। নেমেই সে তার হিন্দু আর শিখ বন্ধুদের জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। সে বুঝে গেছে এই বন্ধুরা তাকে ছেড়ে সব চলে যাবে ভারতে।
পাগলা গারদে ছিল এক মুসলিম রেডিও ইঞ্জিনিয়ার। এম এসসি ডিগ্রি আছে তার। বিশেষ কারো সঙ্গে মেশে টেসে না। দিনে একবার হাঁটতে বেরোয়। ভারত-পাকিস্তানের এই গল্প শুনতে শুনতে মাথায় ভূত চাপে তার। কাউকে বলা কওয়া নেই একদিন সব জামাকাপড় পুঁটলিতে ভরে সেটা এক রক্ষীর হাতে ধরিয়ে একদম উদোম গায়ে ছুট লাগায় বাগানে।
আরো একজন মুসলিম পাগল ছিল। বাড়ি তার চানিয়টে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এক একনিষ্ঠ কর্মী ছিল সে। এখানে ঢুকে দিনে পনেরো ষোল বার চানের বাতিক হল তার। এক দিন হঠাৎ করে সে চানটান বন্ধ করে দিল। আর দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করল সেই নাকি মহম্মদ আলি জিন্না…মানে কায়েদ-ই -আজম। তার দেখাদেখি এক শিখ পাগলও ঘোষণা করে দিল সে নাকি শিখদের নেতা মাস্টার তারা সিং। জেলের কর্তারা তো প্রমাদ গুনলেন। এবার একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বেঁধে যাবে না তো? তাই এই দুজনকে বিপজ্জনক ঘোষণা করে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল
লাহোরের একজন কমবয়সী হিন্দু উকিলও ছিল সেখানে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মাথাটা তার বিগড়েছে। তাকে যখন বলা হল অমৃতসর ভারতেই যাবে তখন সে আরো মুষড়ে পড়ল। তার প্রিয়তমা নাকি অমৃতসরেই থাকে। মাথা খারাপ হলে কি হবে প্রেমিকা কোথায় থাকে সেকথা সে ভোলেনি । বড়, ছোট, মেজ সব হিন্দু আর মুসলিম নেতাকে শাপশাপান্ত করে ছাড়ে সে। কারণ তারাই চক্রান্ত করে দেশটাকে দু-টুকরো করে দিয়েছে। এরাই তার প্রেমিকাকে হিন্দুস্তানি আর তাকে পাকিস্তানি করে ছেড়েছে।
এবার দুদেশের মধ্যে পাগল বিনিময়ের কথা যখন শোনা গেল তখন বন্ধুরা তো সবাই ছুটে এসে তাকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। সে এবার ভারতে যেতে পারবে…প্রেমিকার সঙ্গে মিলতে পারবে। কিন্তু সে এককথায় জানিয়ে দেয়, লাহোর ছেড়ে সেযাবে না। কেননা অমৃতসরে তার পসার জমবে না।
ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে দুজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাগলও ছিল। একদিন তারা জানতে পারল ইংরেজরা নাকি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই দেশ স্বাধীন হচ্ছে। এই কথা শুনে তারা জোর ধাক্কা খেল। সারা দুপুর ধরে একে অন্যের কানে কী যেন ফিসফিস করে গেল। তাদের একটাই চিন্তা স্বাধীনতার পরে এইঅ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ওয়ার্ডের কী হবে…সেটা কি উঠিয়ে দেওয়া হবে? এই ওয়ার্ড উঠে গেলে তাদের কি ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে নাকি ঐ ব্লাডি ইন্ডিয়ানগুলোর মতো চাপাটি খেয়ে থাকতে হবে?
এখানে আরো একজনও ছিল। এক শিখ। গত পনেরো বছর ধরে সে এখানেই রয়েছে। কোনো কথা বলেনা। আর বললে কতগুলো অদ্ভূত শব্দ বলে যায় যার মানে কেউ বুঝতে পারে না… ‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুং দি ডাল অফ দ্য লালটেইন’। রক্ষীরা বলে এই পনেরো বছরে সে চোখের পাতা এক করেনি। মাঝে মাঝে দেওয়ালে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। আর বাকি সময়টা সে দাঁড়িয়েই থাকে। এইজন্যই তার পা সবসময় ফুলে থাকে। তবে এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ইদানীং ভারত-পাকিস্তানের এই পাগল বিনিময়ের সব কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছে সে। এ ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাইলে গম্ভীর মুখে সে বলে… ‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ দ্য গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান’।
এখন আবার ‘গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান’ না বলে সে বলে ‘গভর্নমেন্ট অফ টোবা টেক সিং’। পাঞ্জাবের এক ছোট্ট শহর এই টোবা টেক সিং। সেখানেই নাকি তার বাড়ি। সে জনে জনে জিগ্যেস করে বেড়ায় এই টোবা টেক সিং কোন দেশে পড়বে। কিন্তু কেউ সদুত্তর দিতে পারে না। কারণ তারা নিজেরাই ঠিক জানে না এইটোবা টেক সিং-টা ভারতে না পাকিস্তানে।
কেউ কেউ অবশ্য এই রহস্যটার সমাধান করতে এসেছিল। কিন্তু শিয়ালকোটের কথা শুনে পিলে চমকে গেল। যে শিয়ালকোট এতদিন ভারতে ছিল তা কিনা পাকিস্তানে চলে এসেছে! তাহলে লাহোরের বেলাতেও এটা হতেই পারে। লাহোরও রাতারাতি একদিন পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকে যেতে পারে। আর এটাও তো হতে পারে যে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশটাই একদিন পাকিস্তান বনে গেল। আবার এই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ভারত, পাকিস্তান দুটো দেশই একদিন মুছে যে যাবে না সেকথাই বা কে বাজি রেখে বলতে পারে?
যাকগে সেসব কথা। এই বুড়ো মানুষটার মাথায় কোনো চুল নেই। যে কয়েকটা সাদা দাঁত এখনও টিকে রয়েছে সেগুলোও দাঁড়ির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এতে তাকে দেখতে লাগে কদাকার…বীভৎস।
তবে এমনি লোকটা নিরীহ…শান্ত। কারো ক্ষতি সে করে না। কারো সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি করতেও তাকে কেউ দেখেনি । পাগলা গারদের পুরোনো কর্মীরা বলে লোকটা নাকি টোবা টেক সিং-এর সম্পন্ন একজন জমিদার। হঠাৎ করেই মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। পরিবারের লোকেরা ওর হাত পা বেঁধে এখানে নিয়ে আসে। তাও নয় নয় করে আজ পনেরো বছর হয়ে গেল।
আগে মাসে একবার বাড়ির লোকেরা দেখা করতে আসত। কিন্তু পাঞ্জাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হওয়ার পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তার নাম আসলে বিষেণ সিং। কিন্তু সবাই তাকে টোবা টেক সিং-নামেই ডাকে। চেতন আর অচেতনের মাঝামাঝি ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকাই এখন তার নিয়তি। কিছু মনে রাখতে পারে না সে। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের সব হিসেব সে ভুলে গেছে । সে জানে না এটা কোন দিন…কোন সপ্তাহ…কোন মাস। এমনকি কত বছর সে এখানে বন্দি হয়ে রয়েছে তাও বলতে পারে না। তবে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা খুব প্রখর। সে ঠিক বুঝে যেত কবে তার সঙ্গে লোকে দেখা করতে আসবে। সেদিন সে সাবান মেখে,মাথায় তেল দিয়ে চান করত, তারপর ভালো করে চুল আঁচড়ে, কাচা জামা-কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে বসে থাকত। দেখা করতে যেই আসুক না কেন কারো সঙ্গেই সে কথা বলত না। শুধু মাঝে মাঝে মুখ থেকে বেরিয়ে যেত সেই বাঁধা বুলি… ‘‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুং দি ডাল অফ দ্য লালটেইন’।
সে যখন প্রথম এখানে আসে তখন বড়িতে একটা ছোট মেয়ে ছিল তার। সে এখন পনেরো বছরের ঝকঝকে তরুণী। মাঝে মাঝে সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত। বাবাকে এই অবস্থায় দেখে চোখের জলে ভেসে যেত সে। কিন্তু স্মৃতি-বিস্মৃতির যে জগতে তার বাবা থাকেসেখানে কাউকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় না। শত শত মুখের ভিড়ে সেও একটা মুখ। এর বেশি কিছু নয়।
ভারত, পাকিস্তানের এই মহৎ পরিকল্পনার কথা শুনে আবার তার পুরোনো অভ্যেসটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যাকে পায় তাকেই জিগ্যেস করে টোবা টেক সিং-টা ঠিক কোথায়। কেউ উত্তর দিতে পারে না। উত্তরটা যে কারোই জানা নেই।বাড়ির লোকজনের আসা-যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। মনে মনে সে ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনা। যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলে দিত কবে বাড়ির লোকজন আসবে সেটাও আস্তে আস্তে ভোঁতা হয়ে গেল।
বাড়ির সবার জন্য মন কেমন করে তার। বাড়ির লোকজনেরা যে জিনিসপত্র আনত…তাদের চোখে মুখে যে আন্তরিকতা ফুটে উঠত তা দেখার জন্য মন তার আকুল হয়ে থাকে। সে জানে বাড়ির লোকেরা তাকে ঠিক বলে দিত টোবা টেক সিং কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে? কেন জানিনা বার বার তার একটা কথাই মনে হয়যে বাড়ির লোকেরা বোধহয় টোবা-টেক-সিং-থেকেই আসে, আর তাকেও একদিন সেখানে নিয়ে যাবে।
একদিন আরেক পাগল তো মস্ত কাণ্ড করে বসে। সে নিজেকে ভগবান বলে চাউর করে দেয়। বিষেণ সিং-ও আসে ভগবানের শরণে। ভগবানের কাছে সে জানতে চায় টোবা-টেক-সিং জায়গাটা কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে? ভগবান মুচকি হেসে বলে… ‘ভারতেও নয়, পাকিস্তানেও নয়। আমরা এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ জারি করিনি’। কাকুতি মিনতি করে বিষেণ সিং… ‘হে ভগবান, তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করো…তাহলে আমার তো একটা হিল্লে হয়’। কিন্তু ভগবানের কানে কোন কথা যায় না। ভগবানের এখন অনেক জরুরি কাজ রয়েছে। রাগের চোটে বিষেণ সিং মুখঝামটা দিয়ে ওঠে… ‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ গুরুজি দা খালসা অ্যান্ড গুরুজি কি ফতেহ…জো বোলে সো নিহাল সৎ শ্রী আকাল’।
একটা কথা সে ভগবানকে বলতে চায়… ‘তুমি তো মুসলিম ভগবান…তাই আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না। তুমি যদি শিখ ভগবান হতে তাহলে এমন নিষ্ঠুর তুমি হতে পারতে না’।
পাগল বিনিময়ের দিন এগিয়ে আসে। এর মধ্যে টোবা-টেক-সিং- থেকে বিষেণ সিং-এর এক মুসলিম বন্ধু দেখা করতে আসে…পনেরো বছরে এই প্রথম। তাকে দেখামাত্রই বিষেণ সিং মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এক রক্ষী এসে তাকে বোঝায়… ‘ ইনি তো আপনার পুরোনো বন্ধু ফজল দীন। উনি এতদূর থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন’।
ফজল দীনের দিকে ভালো করে তাকায় বিষেণ সিং আর বিড়বিড়িয়ে কিছু বলতে চায়। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ফজল দীন বলেন… ‘অনেক দিন ধরেই এই খবরটা দেওয়ার জন্য আসব ভাবছিলাম। তোমার পরিবারের সবাই নিরাপদেই ভারতে চলে গেছে। আমি যতটুকু পারি ততটুকু সাহায্য করেছি। আর তোমার মেয়ে রূপ কাউর…সেও নিরাপদেই আছে ওখানে’।
বিষেণ সিং কোনও উত্তর করে না। ফজল দীন বলেই যান… ‘তুমি ভালো আছ কিনা সেটা তোমার বাড়ির লোক আমার কাছে জানতে চেয়েছে। আর কী বলি…আর কয়েক দিনের মধ্যে তুমিও ভারতে চলে যাবে। ভাই বলবীর সিং, ভাই ভাদহাওয়া সিং আর অমৃত কাউর বহেনকে আমার কথা বোলো। বলবীর ভাইকে বোলো যে আল্লার কৃপায় ফজল দীন ভালোই আছে। বলবীর ভাই যে দুটো বাদামি মোষ রেখে গিয়েছিলেন সে দুটোও ভালো আছে। দুটোতেই বাচ্চা দিয়েছে। তবে একটা বাচ্চা ছদিন পরেই মারা গেছে। ওদের বোলো যে ফজল ভাই সবসময় তোমাদের কথা মনে করে। ওদের চিঠি লিখতে বোলো…যদি আমি ওদের জন্য কিছু করতে পারি…ও আমি তোমার বাড়ি থেকে একটা দারুন জিনিস এনেছি’।
বন্ধুর কাছ থেকে উপহারটা নিয়ে এক রক্ষীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে জিগ্যেস করে… ‘টোবা টেক সিংটা কোথায়?’
‘কোথায় আবার…যেখানে ছিল সেখানেই আছে’।
‘ভারতে না পাকিস্তানে?’
‘ভারতে… না না পাকিস্তানে’।
আর কোন কথা না বলে বিড় বিড় করতে করতে হাঁটা লাগায় বিষেণ সিং…‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ দা পাকিস্তান অ্যান্ড হিন্দুস্তান দূর ফিত্তে মউন’।
এদিকে জোরকদমে চলে পাগল বিনিময়ের প্রস্তুতি। দুই দেশের মধ্যে যেসব পাগলের বিনিময় হবে তাদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। বিনিময়ের দিনও স্থির হয়ে যায়।
এক শীতের বিকেলে হিন্দু আর শিখ পাগলদের নিয়ে লাহোর থেকে বাস রওনা হয় ওয়াঘা সীমান্তের দিকে। বাসে রয়েছে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনি…সরকারি আধিকারিকরাও আছেন। ওয়াঘায়দুপক্ষের আধিকারিকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে নেন। দলিল-দস্তাবেজে সই সাবুদ হয়। এবার শুরু হল বিনিময়।
কিন্তু এবার শুরু হয় আসল খেল। বাস থেকে পাগলগুলোকে কিছুতেই নামানো যায় না। এক পাও নড়বে না তারা। অনেক বলে কয়ে যাদের নামানো হয় তারা উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কেউ কেউ তো আবার উদোম গায়ে নৃত্য শুরু করে দেয়। কিছুতেই জামাকাপড় পরানো যায় না তাদের। জোর করে জামা পরালে পরমুহূর্তেই তারা সেসব ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দেয়। কেউ আবার খিস্তিখেউড় করে…কেউ গান ধরে। কেউ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ভাসায়। এর সঙ্গে ওর মারামারি হাতাহাতি লেগে যায়।
সব মিলে একেবারে নরক গুলজার। মেয়ে পাগলগুলো আবার এক কাঠি ওপরে। তাদের চিৎকারচেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। বাইরে তখন কনকনে ঠান্ডা।
পাগলগুলো বুঝে পায় না এসব হচ্ছেটা কী? কেনই বা তাদের জোর করে বাসে চাপিয়ে এই অচেনা জায়গায় নিয়ে আসা হল? কেউ স্লোগান দেয়… ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’…আবার কেউ বলে ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।
এবার বিষেণ সিং-এর পালা।তাকে নাম জিগ্যেস করা হয়।কারণ রেজিস্টারে সব ঠিকঠাক লিখতে হবে। সে এসে ডেস্কের পেছনে বসা অফিসারকে শুধোয়… ‘টোবা-টেক-সিং-টা কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে?
‘পাকিস্তানে’… বিচ্ছিরিভাবে হেসে জবাব দেয় অফিসার।
বিষেণ সিং-কে আর পায় কে? সে ছুটে পালাতে যায় পাকিস্তানের দিকে। কিন্তু পাকিস্তানের রক্ষীরা তাকে চেপে ধরে সীমান্তের ওপারে ভারতের দিকে ঠেলে দিতে চায়। কিন্তু সে এক ইঞ্চিও নড়বে না… ‘এখানেই টোবা-টেক-সিং…উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ টোবা-টেক-সিং অ্যান্ড পাকিস্তান’।
সবাই মিলে তাকে কত বোঝায়… ‘শোন, টোবা-টেক-সিং ভারতে চলে গেছে। আর এখন না গেলেও খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবে’। কিন্তু কে শোনে কার কথা। রক্ষীরা ধাক্কা দেয়, কিন্তু সে এক পাও নড়েনা। শেষমেশ তারা হাল ছেড়ে দেয়।
ফোলা পা নিয়ে দুদেশের সীমান্তের মাঝে নো-ম্যানস ল্যান্ডে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে বিষেণ সিং।
রক্ষীরা আর তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। বেচারা একটা নিরীহ মানুষ! বিনিময়ের কাজ যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ ও ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকুক। কারো তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। রাত কাবার হয়ে আসে।
সূর্য ওঠার ঠিক আগেই কান্ডটা ঘটে যায়। বিষেণ সিং নামে যে মানুষটা আজ পনেরো বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে হঠাৎ আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দুদেশের অফিসাররা তড়িঘড়ি করে ছুটে যান।
মানুষটারদুপাশে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার একদিকে রয়েছে ভারত আর অন্যদিকে পাকিস্তান। আর দুপাশের বেড়ার মাঝখানেযে এক একফালি জমি রয়েছে তার কোনো নাম নেই। সেখানেই রয়েছে টোবা-টেক-সিং। -
অনুবাদ গল্প- তিথওয়ালের কুকুর
তিথওয়ালের কুকুর (লেখক- সাদাত হাসাত মান্টো)
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনারা একই জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে। কোন নড়ন চড়ন নেই। লড়াইয়েরও কোন বালাই নেই। খালি নাম-কা-ওয়াস্তে দিনে কয়েক রাউন্ড গোলাগুলি ছোঁড়া ছাড়া সৈন্যদেরও আর কোন কাজ নেই। আবহাওয়াও চমৎকার। আকাশ, বাতাস বুনো ফুলের গন্ধে মাতাল। প্রকৃতি চলেছে তার নিজের নিয়মে…নিজের খেয়ালে। পাহাড়ি এই এলাকার বড় বড় টিলার পেছনে গাছপালা, ঝোপঝাড়ের আড়ালে সৈন্যরা যে লুকিয়ে রয়েছে তা নিয়ে প্রকৃতির কোন মাথাব্যথা নেই। পাখিরা মনের আনন্দে গান গাইছে…যেমনটা তারা গেয়ে এসেছে বরাবর। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে চারিদিক। বাতাসে ভেসে আসে ভ্রমরের গুঞ্জন।
মাঝে মাঝে গোলাগুলির শব্দে ভয় পেয়ে পাখিগুলো ডানাঝাপটে উড়ে যায়…যেন বীণার তারে হঠাৎ করে বেসুর বেজেছে। সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে এল প্রায়। এখন না শীত, না গরম। শীত আর গ্রীষ্ম যেন নিজেদের মধ্যে একটা সন্ধি করে নিয়েছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যায়।
এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় হাঁপিয়ে উঠেছে সেনারা। মুখোমুখি যে দুটো পাহাড়ে দুপক্ষের সেনারা ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে সে পাহাড়দুটোও আবার সমান উঁচু। তাই কেউ কারো ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে না। কেউ কাউকে মাত দিতে পারছে না। নীচের উপত্যকায় সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলেছে পাহাড়ি নদী।
এই যুদ্ধে বিমানবাহিনীকে শামিল করা হয়নি। আর সেনাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, কামান কিছুই নেই…একেবারে নিধিরাম সর্দার। রাতে দুপকক্ষের সেনারাই আগুন জ্বালিয়ে বসে বিশ্রাম নেয়…গান গায়। এপাশের লোকেরা শুনতে পায় ওপাশের কথা।
এই সবে আজকের মতো চা-পর্ব শেষ হল। আগুনও প্রায় নিভে এসেছে। শিরশিরে বাতাস গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। বাতাসে ভেসে আসে পাইন ফলের গন্ধ।এই গন্ধ ভালোই লাগে। সেনারা এখন ঘুমে কাদা। শুধু ঘুমোয়নি জমাদার হরনাম সিং। আজ তার ওপর রাত পাহারার দায়িত্ব। ঘড়িতে দুটো বাজে। হরনাম গিয়ে গান্ডা সিং-কে ডেকে দেন। এবার গান্ডা সিং পাহারা দেবে।
ডিউটি শেষ। এবার ঘুমোতে যান হরনাম। কিন্তু ঘুম আসে না তার চোখে। ঘুমপরী কি তবে আকাশের মিটমিটে তারাদের মতোই অত দূরের মানুষ! গুনগুনিয়ে গান ধরে হরনাম…পাঞ্জাবি লোকগীতি…
‘ও নাগর, এক পাটি জুতো কিনে দে
চুমকি দেওয়া ঝলমলে জুতো কিনে দে
দরকারে তোর মোষ বেচে দে
কিন্তু আমায় জুতো কিনে দে
চুমকি দেওয়া ঝলমলে জুতো কিনে দে’
এবার বুকের ভেতরটা খুব হালকা লাগে। চোখে জল এসে যায়। তার গান শুনে একে একে সবার ঘুম ভেঙে যায়। বান্টা সিং-এর গলাটা খুব মিষ্টি। এখানে সেই সবচেয়ে ছোট। ‘হীর রঞ্ঝা’ থেকে একটা প্রেমের গান ধরে বান্টা। মিলন-বিরহের পাঞ্জাবি এই অমর গাথা শুনে বাতাসও ভারি হয়ে ওঠে। বিষাদের এই সুর হালকা কুয়াশার মতো ঢেকে দেয় গোটা চত্বর। ধূসর, নীরেট পাহাড়ও যেন এই সুরে গলে জল।
তাল কেটে যায় হঠাৎ। কোত্থেকে যেন একটা কুকুর ডেকে ওঠে! মাথা গরম হয়ে যায় জমাদার হরনাম সিং-এর… ‘এই কুত্তার বাচ্চাটা আবার কোত্থেকে উদয় হল!’
কুকুরটা আবার ডেকে ওঠে। এবার আরো কাছ থেকে। পাশের ঝোপে যেন একটা খস খস শব্দ শোনা যায়! পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে উঠে যায় বান্টা সিং। একটু পরেই সে ফিরে আসে। তার পেছন পেছন লেজ নাড়তে নাড়তে আসে সেই কুকুর। একেবারে পাতি একটা নেড়ি কুত্তা।
বান্টা সিং ঘোষণা করে দেয়… ‘এটাকে ওই ঝোপের আড়ালে খুঁজে পেলাম। ও বলল ওর নাকি ঝুন ঝুন’। হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই।
কুকুরটা এবার লেজ নাড়তে নাড়তে যায় হরনাম সিং-এর কাছে। হরনাম তার হাতের ঝোলাটা থেকে একটা বিস্কুট বের করে মাটিতে ছুঁড়ে দেন। কুকুরটা যেইনা খেতে যাবে অমনি বিস্কুটটা ছোঁ মেরে তুলে নেন তিনি … ‘রোসো বাবা রোসো। তুমি যে পাকিস্তানি কুকুর নও তার কী প্রমাণ’?
আবার তারা হো হো করে হেসে ওঠে। বান্টা সিং কুকুরটার পিঠ চাপড়ে দেয়… ‘জমাদার সাহেব ঝুন ঝুন কিন্তু হিন্দুস্তানি কুকুর’।
‘তাহলে প্রমাণ দাও’…কুকুরটাকে আদেশ করেন হরনাম সিং। কুকুরটা আবার লেজ নাড়ে।
‘সব কুকুরই লেজ নাড়তে পারে। এতে কিছু প্রমাণ হয়না’।
এবার বান্টা সিং বলে ওঠে… ‘ও বেচারি একটা উদ্বাস্তু… দেখছ না কেমন লেজ নাড়ছে’।
এবার হরনাম সিং আরো একটা বিস্কুট ছুঁড়ে দেন কুকুরটার দিকে। কিন্ত মাটিতে পড়ার আগেই সেটাকে তিনি লুফে নে্ন।
একজন সেনা মাঝখান থেকে বলে ওঠে… ‘সবাইকে এখন ঠিক করে নিতে হবে যে সে হিন্দুস্তানি না পাকিস্তানি। কুকুরদেরও’।
হরনাম সিং ঝোলা থেকে আবার একটা বিস্কুট বের করেন… ‘সব পাকিস্তানিকে গুলি করে মারা হবে। কুকুরও বাদ যাবে না’।
আরেকজন সেনা চেঁচিয়ে ওঠে… ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’।
ওদিকে কুকুরটা বিস্কুটে মুখ দিতে গিয়েও আর দেয়না। ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। লেজটাকে দু-পায়ের মধ্যে গুঁজে দিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। হেসে ফেলেন হরনাম সিং… ‘আরে নিজের দেশে এত ভয় কেন? এই নে বাবা আরেকটা বিস্কুট নে’।
রাত কেটে ভোর ভয়। আজকের সকালটা যেন বড্ড তাড়াতাড়ি হয়ে গেল! অন্ধকার ঘরে কেউ যেন হঠাৎ করে আলো জ্বালিয়ে ফেলেছে। তিথওয়ালের পাহাড়ে উপত্যকায় সকালের সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ে।
অনন্ত কাল ধরে এই যুদ্ধ চলছে। কে যে জিতছে তা কেউ জানে না। জমাদার সিং তার দূরবীণ দিয়ে এলাকাটাকে একবার জরিপ করে নেন। পাহাড়ের ওপাশ থেকে ধোঁয়া উঠছে। তারমানে ওরাও সকালের জলখাবারের আয়োজন করছে।
পাকিস্তানের সেনার সর্দার হিম্মত খান তাঁর ইয়া মোটা গোঁফে তা দিয়ে তিথওয়ালের ম্যাপ নিয়ে বসলেন। এবার এলাকাটাকে হাতের তালুর মতো চিনে নিতে হবে। তার পাশে বসে ওয়্যারলেস অপারেটর প্ল্যাটুন কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার কী করতে হবে না হবে তাপ্ল্যাটুন কমান্ডারই বলে দেবেন। একটু দূরে পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে বসির। রাইফেলটা তার সামনে পড়ে। সে একজন সামান্য সেনা। আরাম করে বসে গুনগুনিয়ে গান ধরে সে…
‘ও আমার চাঁদবদনী …ও আমার ফুলটুসি… রাতটা কোথায় কাটিয়ে এলি
রাতটা কোথায় কাটিয়ে এলি’?
গানে কথায় সে বেশ মজেছে। প্রতিটা শব্দ তাই কেটে কেটে বলে…তারপর গলাটা আরো চড়ায়। হঠাৎই চেঁচিয়ে ওঠেন সুবেদার হিম্মত খান… ‘কাল রাতে কোথায় ছিলি?’
কথাটা তিনিবসিরকে বলেনি। বলেছেন কুকুরটাকে। দিন কয়েক আগে ব্যাটা কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। ক্যাম্পে বেশ আয়েসেই ছিল। তারপর কাল রাতে হঠাৎ করে উবে গেল। এখন নষ্ট মেয়ের মতো ঘরে ফিরে এসেছে।
কুকুরটাকে দেখে বসির মজা পেয়ে আবার গান শুরু করে… ‘রাতটা কোথায় কাটিয়ে এলি? রাতটা কোথায় কাটিয়ে এলি?’ কুকুরটা শুধু লেজ নেড়েই যায়। সুবেদার হিম্মত সিং একটা নুড়ি ছুঁড়ে দেন কুকুরটার দিকে ‘ব্যাটা শুধু লেজ নাড়তেই পারে…গর্ধভ কোথাকার’।
বসির বলে…‘কিন্তু ওর গলায় ওটা কী?
একজন সেনা এসে কুকুরটার গলায় বাঁধা দড়িটা খুলে দেয়। দড়ির মধ্যে এক টুকরো কাগজ বাঁধা। কিন্তু কাগজে কী লেখা আছে সেটা পড়তে পারে না।
এবার এগিয়ে আসে বসির। অনেক কষ্টে সে লেখাটা সে উদ্ধার করে… ‘কাগজে লেখা আছে ঝুন ঝুন’।
সুবেদার হিম্মত খান তাঁর সেই অতিকায় গোঁফে তা দিয়ে বলেন… ‘ও বসিরে…আর কী লেখা আছে ওটায়?’
‘ হ্যাঁ স্যার আছে। লেখা আছে যে এটা হিন্দস্তানি কুত্তা’।
‘হনে হয় এটা একটা সংকেত। কিন্তু এর মানেটা কী?’…সুবেদার হিম্মত সিং ভেবে কূল কিনারা পান না।
গম্ভীর মুখে বসির জবাব দেয়… ‘এটা মনে হয় একটা গুপ্ত সংকেত’।
আরেক জন সেনা এবার বিজ্ঞের মতো মতো বলে… ‘ঐ ঝুন ঝুন-এর মধ্যেই সংকেতটা রয়েছে’।
বসির আবার ভালো করে লেখাটা পড়ে দেখে… ‘ঝুন ঝুন…এটা হিন্দুস্তানি কুত্তা’।
সুবেদার হিম্মত খান তক্ষুনি ওয়্যারলেসটা তুলে নিয়ে প্ল্যাটুন কমান্ডারকে আদ্যোপান্ত সব বলে যান… ‘কুকুরটা এসে জুটেছিল দিন কয়েক আগে। কাল রাতে সে উধাও হয়ে যায়। আবার সকালে ফিরে আসে’।
‘কী বলছটা কী?’…ওপার থেকে হুংকার দেন প্ল্যাটুন কমান্ডার।
সুবেদার হিম্মত খান আবার ম্যাপটা জরিপ করতে বসেন। তারপর সিগারেটের প্যাকেটটা ছিঁড়ে একটা ছোট টুকরো বের করে নেন… ‘বসির, এর ওপর লেখ… গুরুমুখীতে লিখবে কিন্তু। ওটাই শিখরা বোঝে…
‘কী লিখব স্যার?’
‘লেখ যে…
বসিরের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি খেলে যায়… ‘শুন শুন…হ্যাঁ এটাই ঠিক হবে। ওদের ঝুন ঝুন-এর জবাব হবে আমাদের শুন শুন’।
মাথা নাড়েন সুবেদার হিম্মত খান… ‘বাহ…বেড়ে বলেছ কিন্তু। কিন্তু তার সঙ্গে আরেকটা কথা লেখ যে… ‘এটা পাকিস্তানি কুত্তা’।
সুবেদার হিম্মত খান এবার কাগজটাকে বেঁধে দেন কুকুরটার গলায়… ‘যা ব্যাটা, এবার বাড়ির লোকজনের কাছে ফিরে যা’।
কুকুরটার দিকে এবার একটু খাবার ছুঁড়ে দেন তিনি… ‘কোন বেইমানি নয় কিন্তু, বেইমানির সাজা মৃত্যু’।
কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে খাবার খেয়ে যায়। তারপর, ভারতীয় সেনারা যেদিকে রয়েছে সেদিকে কুকুরের মুখটা ঘুরিয়ে এক ঠেলা দেন হিম্মত খান… ‘যা ব্যাটা, দুশমনদের এই সন্দেশ দিয়ে ফিরে আয়। এটাতোর কমান্ডারের নির্দেশ’।
কুকুরটা আবার লেজ নাড়ে। তারপর, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে উপত্যকার দিকে এগিয়ে যায়। দুটো পাহাড়ের মাঝে এই উপত্যকা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার সুবেদার হিম্মত খান রাইফেলটা তুলে শূন্যে গুলি চালান।
ভারতীয় সেনারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এত সকালে তো গোলাগুলি শুরু হয় না! জমাদার সিং এতক্ষণ বসে বসে ঢুলছিলেন। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন… ‘ওদের পালটা জবাব দাও’।
আধ ঘণ্টা ধরে দু পক্ষের গোলাগুলি চলে। সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই হয় না। শেষমেশ হরনাম সিং থামতে বলেন সেনাদের… ‘যথেষ্ট হয়েছে’। নিজের লম্বা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নেন। তারপর বান্টা সিং-কে ডেকে বলেন… ‘ঐ যে কুত্তাটা…কী যেন নাম? ঝুন ঝুন…সে গেলটা কোথায়?’
দার্শনিকের মতো মুখ করে বান্টা সিং বলে… ‘ঐ যে কথায় আছে না কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না’।
এমন সময় চেঁচিয়ে ওঠে এক সেনা… ‘ঐ তো সে আসছে’।
‘কে?’…কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না হরনাম সিং।
‘ঐ যে কুত্তাটা। কী যেন নাম ওর? হ্যাঁ…ঝুন ঝুন’।
‘সে ব্যাটা কী করছে?’
নিজের দূরবীণে চোখ রেখে জবাব দেয় সেই সেনা… ‘ও এদিকেই আসছে’।
তার হাত থেকে দূরবীণটা ছিনিয়ে নেন হরনাম সিং… ‘হ্যাঁ সেই বটে। কিন্তু ওর গলায় ওটা কী ঝুলছে? ও তো পাকিস্তানিদের পাহাড়ের দিক থেকে আসছে। শালা…শূয়োরের বাচ্চা!’
নিজের রাইফেলটা তুলে নিয়ে কুকুরটাকে তাক করে গুলি ছোঁড়েন হরনাম সিং। গুলি গিয়ে লাগে পাথরে। কুকুরটা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
খবর এসে পৌঁছয় সুবেদার হিম্মত খান-এর কানে। দূরবিণে চোখ দিয়ে দেখেন কুকুরটা পেছন ফিরে আবার তাঁর দিকেই দৌড়ে আসছে। তিনি চেঁচিয়ে বলেন, ‘যা ব্যাটা যা, সাহসীরা কখনো যুদ্ধ ছেড়ে পালায় না। যা তোর কাজ শেষ করে আয়’। কুকুরটাকে ভয় দেখাতে তিনিও গুলি ছোঁড়েন… কুকুরের কান ঘেঁসে বেরিয়ে যায়গুলিটা । ভয় পেয়ে কুকুরটা শূন্যে লাফিয়ে ওঠে। সুবেদার হিম্মত সিং আবার গুলি চালান। সেটা গিয়ে লাগে পাথরে।
কুকুরটাকে নিয়েই এবার মজার খেলায় মেতে ওঠে দুই পক্ষ। কুকুরটা ভয় পেয়ে এদিক ওদিক চক্কর কাটতে থাকে। আর সেটার অবস্থা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়েনহরনাম সিং আর হিম্মত খান । কুকুরটা এবার হরনামের দিকে ছুটে আসে। বাপ-মা তুলে গালি-গালাজ করে আবার তিনি গুলি ছোঁড়েন। গুলিটা গিয়ে লাগে কুকুরের পায়ে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে সে । পেছন ফিরে আবার সে হিম্মত খানের দিকে ছুটে যায়। ওদিক থেকেওআবার গুলি। কুকুরটাকে ভয় দেখাতে গুলি ছোঁড়েন হিম্মত খান… ‘ যা ব্যাটা যা…মনে সাহস আন…ও… পায়ে লেগেছে বুঝি? তাতে কী! শুধু নিজের কর্তব্য করে যা’। কুকুরটা আবার উলটো দিকে মুখ ঘুরে দাঁড়ায়। একটা পা তো গেছে। আরেকটা পা টেনে টেনে হরনাম সিং-এর দিকে এগিয়ে যায়। এবার রাইফেলটা তুলে একেবারে নিঁখুত লক্ষ্যে গুলি চালান হরনাম। কুকুরটার প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সুবেদার হিম্মত খান… ‘বেজম্মাটা আজ শহিদ হল’।
জমাদার হরনাম সিং-এর রাইফেলের নলটা এখনও তেতে রয়েছে। তার ওপর একবার হাত বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলেন… ‘ব্যাটা কুত্তার মতো মরেছে’! -
Is space exploration worth the expense? (মহাজাগতিক অনুসন্ধান কতোটা মূল্যবান?)
Is space exploration worth the expense?
(মহাজাগতিক অনুসন্ধান কতোটা মূল্যবান?)
-মেঘা ত্রিবেদী
Space exploration is an expensive investment. A very expensive one, in fact; info graphics shows that it costs nearly £15,000 per kilogram to launch an object into the Earth’s orbit.
In a financial climate of austerity, should we be ‘wasting’ money on what some consider to be a luxury? Should we be focusing on more down-to-Earth problems like climate change or world hunger and poverty, rather than parking yet another rover on Mars?
Of course those problems are very worthy ones that are in dire need of addressing, but who says space exploration can’t help with them?
Sunday, July 20, will mark 45 years since the United States put the first two astronauts safely on the moon. The cost for the Mercury, Gemini, and Apollo programs was more than $25 billion at the time—more like $110 billion in today’s world. The ensuing U.S. space efforts have cost an additional $196 billion for the shuttle and $50 billion for the space station.
That is a lot of money to consider. It could have gone into million other things that would have helped people here on Earth more directly.
But what we need to take into account is if we have the results to show. What really matters is what we’ve profited from the deal.
NASA’s total inflation-adjusted costs have been more than $900 billion since its creation in 1958 through 2014. Looking back, have we gotten our money’s worth from the investment? I dare say yes.
Almost every area of technology has benefited from space research. Clothes and vehicle interiors are more fire resistant because of research after the Apollo fire. Weather forecasting is much more accurate because of satellite monitoring. Monitoring from space can detect forest fires, oil spills, aquifer depletion, downed aircraft, etc. We have recently watched the World Cup matches from Brazil in near real-time via satellite feed. We can surf the Internet with laptop or tablet while flying in an airplane almost anywhere in the world. We are more connected than ever, both in our everyday activities and in emergency situations.
Medicine has been revolutionized by the space program. We learned to monitor orbiting astronauts—pioneering telemedicine and leading to unprecedented improvements in patient monitoring, in and out of hospitals. Research into astronaut bone calcium loss has led to better understanding and treatment of osteoporosis. Digital mammography is a direct application of space data reduction processes. Baby foods are more healthful because of astronaut food research.
The Apollo guidance computer was the great grandfather of the microcomputer. It weighed 70 pounds, required 55 watts of power, and had less than 40 KB of memory in a day when most computers weighed tons, filled rooms and needed their own air-conditioning systems. It had less capability than many of today’s electronic wristwatches, but it took us to the moon and back. Its descendants are today’s laptops, tablets, GPS receivers and cellphones. Today, the trend for such devices is to make them ever smaller, ever more capable—a trend driven by the space program.
There are few other public activities with such a sustained level of performance and impact. Why? Because the space race was a unique event in history. However, in order to remain relevant, NASA needs to have a driving focus—a mission. The space around Earth contains a huge number of asteroids. We are very much overdue, at least statistically, for a large asteroid to strike the planet. The last large asteroid killed off the dinosaurs 65 million years ago. Would protecting Earth and saving civilization be a sufficiently important mission?
The fundamental questions about our universe that space missions and telescopes are trying to answer are some of the most profound and difficult questions it is possible to ask. That forces us to think outside the box and craft new ways of doing things. Of course, it is almost always impossible to predict which exact benefits will come from answering these questions. But it is an untapped resource of possibly unlimited knowledge and power and is it really wise to not look into it, just because we might not hit gold every time?
(অনুবাদঃ রীণা চ্যাটার্জী)
মহাজাগতিক অনুসন্ধান আজকের দিনে উচ্চতম বিনিয়োগের মধ্যে অন্যতম আলোচিত এক বিষয়। বিশ্লেষণী তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর কক্ষপথে কোনো একটি বস্তু পাঠাতে প্রতি কিলোগ্ৰামে আনুমানিক প্রায় পনেরো হাজার পাউন্ড ব্যয় হয়।
বর্তমান আর্থিক সংকটকালীন পরিবেশে এই বিশেষ বিষয়ে বিনিয়োগ- কি বিলাসিতা? অপচয়? আমরা Mars-এ আরো একটি rover পার্ক করার জন্য ভাববো নাকি দারিদ্রতা দূরীকরণ সম্পর্কিত একটি আর্ধ সামাজিক বিষয় নজর দেবো?
অবশ্যই এটি একটি বড়ো প্রশ্ন, সমাধান করাও প্রয়োজন। কিন্তু এ কথাও তো জোর দিয়ে বলতে পারি না যে, মহাজাগতিক অনুসন্ধান আমাদের এই বিষয়ে ভবিষ্যতে কোনোদিন সাহায্য করবে না?
20th July রবিবার পঁয়তাল্লিশ বছর হলো যুক্তরাষ্ট্রের দুই মহাকাশচারী নিরাপদে চাঁদে পা রেখেছিলেন। Mercury, Gemini, আর Apollo program- এর জন্য সেই সময় এর বিনিয়োগ মূল্য ছিল পঁচিশ বিলিয়ন ডলার– আজকের নিরিখে যা একশো দশ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র shuttle- এর উপর একশো ছিয়ানব্বই বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। Space station- এর উপর পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।
অবশ্যই এই বিনিয়োগ মূল্য অত্যন্ত বেশী। এই মূল্যে বা এর থেকে কম মূল্যে সরাসরি আরো অনেক বেশী পীড়িত, অসহায়, ক্ষুধার্ত মানুষদের সাহায্য করা যেতে পারা যেত।
এই বিষয়টি থেকে আমাদের প্রাপ্তি সম্পর্কে ফলাফল যদি জানতে চাই, এর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ভেবে দেখা দরকার।1958 থেকে 2014 এই কয় বছরের মধ্যে NASA এর খাতে খরচ প্রায় নয়শো বিলিয়ন ডলারের বেশি। উঠে আসে একটি প্রশ্ন এই বিনিয়োগ মূল্য কি আমাদের কোনো সাহায্য করেছে? আমরা কি উপকৃত হয়েছি? আমার সমর্থন সম্পূর্ণ সদর্থক।
আজকের প্রযুক্তি বিভাগ সম্পূর্ণ ভাবে উপকৃত এই অনুসন্ধানের হাত ধরে। APOllO fire এর পরে আমাদের পরিধেয় বস্ত্র, পরিবহন ব্যবস্থা অগের থেকে অনেক বেশি অগ্নি প্রতিরোধী। স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ দ্বারা আবহাওয়া পূর্বাভাস দেওয়া সহজসাধ্য হয়েছে। মহাকাশ পর্যবেক্ষণ থেকে বনে আগুন, সমুদ্রের ওপর তেল ছড়ানোর দূষণ, জলস্তর হ্রাস, Bermuda triangle এ অহেতুক বিমান অন্তর্ধান প্রভৃতি আরো বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা সদ্য অনুষ্ঠিত ব্রাজিল থেকে বিশ্বকাপ প্রায় যথাযথ সময়ে দেখেছি। আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবায় আমরা উড়ন্ত অবস্থাতেও ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট দিয়ে ইন্টারনেট সার্ফ করতে পারি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, আপৎকালীন ব্যবস্থা উভয় পরিস্থিতিতেই আমরা অনেক বেশি সংযুক্ত ও সঙ্ঘবদ্ধ আগের থেকে।
মহাকাশ কর্মসূচির মাধ্যমে চিকিৎসা শাস্ত্রে বিপ্লব এসেছে। মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য মনিটারিং করার প্রয়াস থেকে টেলিমেডিসিন সেবার প্রচলন হয়েছে। যুগান্তকারী আবিষ্কার– চিকিৎসালয়ের ভেতর কিংবা বাইরে থেকেও রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। মহাকাশচারীদের হাড়ের ক্যালসিয়াম ক্ষতির অনুসন্ধানে অস্টিওপোরোসিস চিকিৎসা উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। মহাকাশচারীদের খাদ্য ফলে আমরা অনেক স্বাস্থ্যসম্মত শিশু আহারের সন্ধান পেয়েছি।
APOllO Guidane Computer আজকের ব্যবহৃত Microcomputer-এর পূর্বসূরি। এর ওজন সত্তর পাউন্ড, পঞ্চান্ন ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এবং চল্লিশ কিলোবাইটের কম মেমরি ছিল। এর জন্য প্রয়োজন হতো একটি নিজস্ব কক্ষ, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, বর্তমানে ব্যবহৃত Computer-এর প্রয়োজন এর তুলনায় নিতান্তই সাধারণ, কর্মক্ষমতা অনেক বেশি। কিন্তু APOllO Guidance Computer-এর হাত ধরেই আমাদের প্রথম সফল চন্দ্র অভিযান। মহাকাশ অনুসন্ধান কর্মসূচির তাগিদে আমরা পেয়েছি দৈনন্দিন অতি প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি। মহাকাশে ব্যবহারের প্রবণতায় যন্ত্রগুলো ক্রমে ক্রমে ছোট করা হয়েছে ফলে তা সাধারণ মানুষের আয়ত্তে এসেছে। নিত্যদিনকার যোগাযোগ করা অনায়সসাধ্য হয়েছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে মহাজাগতিক গবেষণা খুবই অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাও আজকের দুনিয়ায় গুরুত্ব পাওয়ার জন্য NASA- র একটি মিশন প্রয়োজন। পৃথিবীর চারপাশে বিপুল সংখ্যক গ্ৰহাণু রয়েছে। শেষ বৃহৎ গ্ৰহাণু পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরকে নিশ্চিহ্ন করেছিল। পৃথিবীকে রক্ষা করা, সভ্যতা সংরক্ষণ করা যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ মিশন নয় কি?
জীবন সম্পর্কে আমাদের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার আপ্রাণ চেষ্টা মহাকাশ মিশন ও টেলিস্কোপগুলো প্রতিনিয়ত করছে। জীবনের এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার জন্য আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। অবশ্যই সবসময় এই গবেষণার উপকারিতা বা সঠিক উত্তর সম্পর্কে নিশ্চয়তা থাকতে পারে না। কিন্তু এটি অজানাকে জানার এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। অজানাকে জানতে নিতে হবে একটু সাহসী পদক্ষেপ, অদূর ভবিষ্যতে ফল পেতেও পারি।
-
যা হারিয়ে যায়
যা হারিয়ে যায়
-থিওডোর ড্রেইসার(অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন)
এককালে ছিল রীতিমতো বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখন অবস্থা পড়তির দিকে। লোকজনের সংখ্যা কমতে কমতে এখন হাতেগোনা। সবচেয়ে কাছের শহর এখান থেকে প্রায় তিন মাইল। একটা বাড়ি থেকে পরের বাড়িটাই কমসে কম এক মাইল। আর মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু গম, ভুট্টার ক্ষেত আর বাদা জমি। চাষের মরসুম শেষ হয়ে গেলে জমিতে লাগানো হয় টিমোথি আর ক্লোভার ঘাস। তা দিয়ে গরু…ঘোড়ার জাবনা হয়।
এই গ্রামেই তাদের আস্তানা। তাদের বাড়ি কিছুটা কাঠের আর কিছুটা ইটের গাঁথনি। বাড়ির পুরোনো কাঠের অংশটা তৈরি করেছিলেন হেনরির বাবা। পরে নতুন যে অংশটা যোগ হয়েছে তার অবস্থাও তথৈবচ। বৃষ্টি বাদলা, ঝড় আর বরফে প্রায় ভেঙে পড়ে আরকি। কার্নিস প্রায় ধসে গিয়েছে। এখানে ফাটল ওখানে ফাটল। ফাটল দিয়ে জল পড়ে…ঘরে ঠান্ডা বাতাস ঢোকে। চারপাশের এলম, বাটারনাটের গাছের ছায়ায় বাড়িটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বাইরে দেখে মনে হয় গা ছমছমে নিশুত পুরী। রোদ ঢোকেনা বাড়িতে। সবসময় একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। বাড়ির এই নতুন অংশটা তৈরি করেছে হেনরি। তখন তার সবে একুশ। সদ্য বিয়ে করেছে। তাও দেখতে দেখতে আটচল্লিশ বছর কেটে গেল। বাড়িটার মতো বাড়ির আসবাবগুলোও লড়ঝরে। কোন আদ্যিকালের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও রয়ে গেছে ওগুলো। চেরি কাটের প্যাঁচানো পা আর গম্বুজওলা আলমারি আছে একখানা। চারদিকে ছত্রি লাগানো খাটও রয়েছে। সে খাটও ভেঙে চূরে গেছে এখানে ওখানে। কোন মান্ধাতার আমল থেকে যে এটা রয়েছে কে জানে! চেরি কাঠের টেবিলও রয়েছে একটা। বেশ লম্বা। শক্তপোক্ত। কিন্তু রঙ টং সবে চটে গেছে। টেবিলের কাছে গেলেই একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে আসে। মেঝেতে কার্পেট। ফীবি অ্যান যত্ন করে বানিয়েছিল ওটা। তার অবস্থা তো আরো করুণ। ছিঁড়ে খুড়ে একসা। ফীবি অ্যানের বানানো গোলাপী আর ছাই রঙা কার্পেটের এখন আর কোনো রঙ বোঝা যায় না। মারা যাওয়ার পনে…রো বছর আগে সে এটা বানিয়েছিল। কাঠের যে তাঁত যন্ত্রটা দিয়ে সে এটা বানিয়েছিল সেটা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভাঙ্গা রকিং চেয়ার, ইস্ত্রি—সেগুলোও অযত্নে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে ঘরের এককোণে। কোন আদ্যিকালের জিনিস এগুলো ভগবান জানেন। বাইরের দরজায় ফুল রাখার জন্য বানানো কাঠের বেঞ্চি, আরো সব ভাঙাচোরা জিনিস পত্র সব ডাঁই করে রাখা আছে পুব দিকের ঘরে। বাড়ির মূল অংশটার ওপর হেলে এসেছে এই ঘর। ভাঙাচোরা সব আসবাব, ছেঁড়া একটা কাপড়ের ঘোড়া, চেরি কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ফাটা একটা আয়না, টুপি রাখার র্যাকক, পুরোনো একখানা সেলাই মেশিন এ যুগের পক্ষে বড্ড বেমানান। ওই যেবার আংটা থেকে আয়নাটা পড়ে ভেঙে গেল তার তিন তিনদিন পরেই তো তাদের ছোট ছেলেটা মারা গেল। তার ওই টুপি রাখার র্যারকে এক সময় চকচকে পোর্সিলিনের আংটা ছিল। সেসব আর নেই। পুরোনো দিনের স্মৃতি সব।
বাড়ির পুব দিকের বাগানে মোটা গুঁড়িওলা সব আপেল গাছ। সেসব গাছ আর ফল দেয় না। গোড়াতে উই ধরে একদম ফোঁপরা করে দিয়েছে। গাছের ডালে সবজে সাদা ছত্রাক। ভরা চাঁদের রাতে এই পোকায় কাটা, ছাতা ধরা গাছগুলোকে দেখে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। ঘরের পাশে গোয়ালে আগে থাকত মুরগি, একটা কি দুটো ঘোড়া, গরু কয়েকটা শুয়োর। সে ঘরের ছাদেও ছত্রাকে ভর্তি। দেওয়ালের কালচে ছাই রঙের অবশিষ্ট আর কিছু নেই। ছত্রাক জমে জমে দেওয়ালগুলো একদম পিছল হয়ে গেছে। বাড়ির সামনের কাঠের বেড়াটার দশাও জরাজীর্ণ। টানলেই ক্যাঁচকোঁচ করে। বাড়ির চারপাশের বাঁশের বেড়াও ভেঙে পড়বে যে কোনো দিন। এ বাড়ির লোকগুলোর মতো বাড়ির জিনিসপত্র…আরো যা কিছু আছে সবেতেই জরা ধরেছে। বাড়ির বাসিন্দা বলতে তো মোটে দুজন হেনরি রেইফস্নেইডার আর তাঁর স্ত্রী ফীবি অ্যান।
বিয়ের পর এই এতকাল কেটে গেল এই বাড়িতে। তাও নয় নয় করে আটচল্লিশ বছর। আর হেনরির জম্ম কম্ম তো এই বাড়িতেই। তখন তার কতই বা বয়স। বাবা-মা বুড়ো হয়েছেন। ছেলেকে বললেন বিয়ে করতে। ছেলে তখন প্রথম প্রেমে পড়েছে। বাবা মার কথা শুনে সে বিয়ে করে বউ নিয়ে এল বাড়িতে। এতদিন বাবা-মায়ের সঙ্গেই দিন কেটেছে। তারপর বাড়িতে এল নতুন বউ। বিয়ের দশ বছর পর বাবা-মাও ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। পাঁচ ছেলে মেয়েকে নিয়ে তখন হেনরি আর ফীবির সংসার। বাচ্চারা তরতরিয়ে বাড়ছে। তখন থেকেই তাদের অবস্থা পড়ে এল। লোকে বলে তাঁদের নাকি সাত ছেলে মেয়ে হয়েছিল। তিন জন বাঁচেনি। আর যারা ছিল তারাও সব চলে গেল দূরে। এক মেয়ে চলে গেল কানসান। এক ছেলে গেল সিউক্স ফক্সে। তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আরেক ছেলে সোজা গেল ওয়াশিংটনে। আরেক মেয়ে কাছাকাছিই থেকে। মাঝে মাত্র পাঁচটা গ্রাম। কিন্তু সে নিজের সংসার নিয়ে এতই ব্যস্ত বাবা-মায়ের খবর নেওয়ার সময়ই হয় না। ঘর সংসারের হাজারো ঝামেলা…নিজেদের ব্যস্ততা নিয়ে তারা এতই দিশেহারা বাবা-মায়ের কথা আর মনে পড়ে না।
হেনরি রেইফস্নেইডার আর ফীবি নিপাট ভালো মানুষ। দুজনে দুজনকে নিয়ে দিব্যি আছেন তাঁরা। পাথরের ওপর জমে থাকা শ্যাওলার মতোই একে ওপরকে জড়িয়ে বেঁচে আছেন। শত বাধা-বিপত্তিতেও তারা তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেনি কোনো। বাইরের পৃথিবীতে কতকিছু ঘটে যায়। তাতে কিছু যায় আসে না তাঁদের। নিজেদের ভাঙাচোরা ঘরের কোণে নিজেদের নিয়েই দিন কেটে যায়। গম পাকলে তা কেটে ঝাড়াই করা… ভুট্টা বাদামী হয়ে এলে আবার তা বেছেবুছে রাখা… টিমোথি ঘাস বেশি লম্বা হয়ে গেলে কাটাকুটি করে খড়ের গোলা বানানো এসব কাজেই সাদাসিধে দুটো মানুষের দিন কেটে যায়। শীত এলে খেতের গম, ভুট্টা বেচার জন্য বাজারে নিয়ে যেতে হয়। তারপর থাকে কাঠ কাটা…ফায়ার প্লেসে আগুন দেওয়া, খাবার দাবার বানানো, ঘরের জিনিস পত্র একটু সারাই করা আর একটু এদিক ওদিক যাওয়া…এই নিয়েই তো তাদের জীবন। শীতে বরফ পড়ে, বর্ষা আসে… তারপর আসে রোদ ঝলমলে দিন…তাদের কাছে এসবের কোনো মানে নেই। তাদের জীবন বয়ে যায় একই খাতে। বাইরের জীবনের সবকিছু যেন কল্পনায় ভেসে আসা দৃশ্য… ওই দূর আকাশের মিটমিটে তারাটার মত…দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না…কিংবা দূরের খেত থেকে ভেসে আসা গরুর গলার ঘণ্টির মতোই ক্ষীণ।
হেনরি আর ফীবির ভালোবাসার অন্ত নেই। তাদের জীবনে ভালোবাসার মতো অন্য কিছু নেই। লতার মতো একে অপরকে জড়িয়েই কাটে তাদের দিন। হেনরির বয়স হয়েছে। ফীবি যখন মারা যায় তখনই হেনরির বয়স সত্তর। সারাক্ষণ খিট মিট করেই যাচ্ছেন। তার জলভরা ঘোলা চোখের দিকে তাকালে মায়া হয়। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছে। যা পরেন ঢলঢল করে। কেমন একটা বেখাপ্পা লাগে তাঁকে। জামা হাতের কাছে ছেঁড়া, প্যান্টটা হাটুতে ফাটা। জীবনে কোনোদিন কাচা হয়েছে বলে তো মনে হয়না। ফীবি অ্যানের চেহারাও প্যাকাটির মত…কোনো ছিরি ছাঁদ নেই। একটা কালো জামা আর একটা কালো টুপি…এর চেয়ে ভালো পোশাক নেই তাঁর কাছে।
সময় বয়ে যায়। একে অন্যকে নিয়ে তাঁরা বাঁচেন। দেখাশোনার তো আর কেউ নেই। বয়সের সঙ্গে হাত পায়ের জোর কমে গেছে। এখন তার তেমন কাজও করে ঊঠতে পারে না । পাঁচটা শুয়োরের মধ্যে চারটেই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন রয়েছে মোটে একটা…গায়ে বেশ গত্তি আছে শুয়োরটার। কাটলে ভালোই মাংস হবে। যে ঘোড়াটাকে হেনরি রেখে দিয়েছে সেটাও একেবারে দুবলা পাতলা…কমজোরি। ভারো করে খেটে টেতেও পায় না বোধহয়। ওটাকেও জম্মে স্নান টান করানো হয়না । খাঁচায় আগে কত মুরগি ছিল। বেজি, শেয়াল এসে সব ধরে নিয়ে গেছে। আর অবশিষ্ট যেগুলো ছিল সেগুলোও যত্নের অভাবে রোগে ভুগে মরেছে। আগের সেই সাজানো গোছানো বাগান এখন শুকিয়ে গেছে। আগে বাড়ির জানালা…দরজার সামনেটা ফুলে ফুলে সেজে থাকত। সে সেই কবেকার কথা। একজন বাগান জুড়ে শুধু বুনো ঝোপঝাড়। কর দিতে দিতে নাজেহাল অবস্থা বাড়ির কর্তার। করের ভার চেপে থাকা এই ভাঙাচোরা বাড়ির একটা উইলও অবশ্য তৈরি করা হয়েছিল…চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগ করে। ছেলে মেয়েরা কেউ অবশ্য এই ভাঙাচোরা বাড়ির ভাগ নিতে আসবে না। সেইজন্যই চার ভাগ করে এই উইল করা। এই বৃদ্ধ দম্পতি নিজেদের নিয়েই বেশ আছে। তবে হেনরির মাথার পোকাটা মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে। ছোটখাটো সামান্য বিষয় নিয়ে বাড়ি তোলপাড় করে দেয়… ‘ ফীবি, আমার ভুট্টা কাটার ছুরিটা কোথায়? আমার জিনিস পত্রে হাত দাও কেন বলো তো? কোনো জিনিস তো গুছিয়ে রাখতে পারো না’!
ফীবিও ছাড়ার পাত্র নয়। খসখসে খোনা গলায় সেও চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ আমাকে একদম মুখঝামটা দেবে না বলছি। তুমি যদি এমনই পাগলামি কর তাহলে কিন্তু যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব। তখন তোমার কী হাল হবে ভেবে দেখেছ? তোমার ছুরি যেখানে বরাবর থাকে সেখানেই আছে। ঐ তাকের ওপর। ওটার কি ডানা গজাবে নাকি? তবে তুমি যদি আলাদা কোথাও রেখে থাকো তাহলে আমার কিছু করার নেই’।
বউ যতই ভয় দেখাক না কেন হেনরি জানে ফীবি তাকে ছেড়ে আর কোথায় যাবে? আচ্ছা ফীবি যদি তার আগে মরে যায় তখন কী হবে। ভাবলেই ভয়ে কাঁটা হয়ে যায় সে। না না এমনটা হতে পারে না। এই একটা জিনিসকেই ভয় পায় সে। রাতের বেলায় চেয়ারের ওপর উঠে সে যখন পুরোনো ঘড়িটায় দম দেয় বা সামনের-পেছনের দরজাগুলোয় ঠিকমতো খিল আঁটা হল কিনা তা যখন দেখতে চায় তখন মনে মনে একটু আরাম পায়। যাক ফীবি তো এখানেই আছে। তার পাশে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে কেমন শুয়ে আছে দেখো। রাতে ঘুম না এলে বিছানায় সে যখন ছটফট করে তখন ফীবির ঘুম ভেঙে যায়… ‘ কিছু লাগবে তোমার? চুপ করে শুয়ে থাকো। অমন মুরগির মতো ছটফট করছ কেন?’
‘ আমার ঘুম আসছে না ফীবি’।
‘ তাহলে অমন ছটফট কোরো না। আমাকে ঘুমোতে দাও’।
ফীবির কথা শুনে সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। ঘুমে চোখটা বুজে আসে। বিছানায় শুয়ে ফীবি এক গেলাস জল চাইলে সে গজগজ করে বটে…কিন্তু সেইসঙ্গে একটা ভরসা পায়…আনন্দও পায়। যাক ফীবি তার কাছেই আছে। কোনো দিন আগে ঘুম ভেঙে যায় ফীবির। সেই আগেভাগে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে রাখে। হেনরি উঠে দেখে কাঠ কাটা হয়ে গেছে। সব তার হাতের সামনে। এভাবেই নিজেদের শান্তির নীড়ে হাতে হাতে কাজ করে দিন কেটে যায় তাদের।
দিন চলে যায়। এখন আর বাড়িতে বিশেষ লোকজন আসে না। কমসে কম এখানে দশ বর্গ মাইল জুড়ে সব লোকে তাদের চেনে। মি. আর মিসেস রেইফস্নেইডার। একবারে খাঁটি সৎ মানুষ। ধম্ম কম্মেও মতি আছে। কিন্তু এই বুড়ো বুড়ির কাছে এসে কেই বা আর আমোদ পাবে? আজকাল চিঠিপত্রও লিখতে ইচ্ছে করে না। কাউকে দিয়ে আর লেখানোও হয়না। তবু কালেভদ্রে পেরাম্বেটন গ্রাম থেকে মেয়ের দু একখানা চিঠি আসে। কখনো সখনো দু এক জন বন্ধুও আসে তত্ত্ব তালাশ করতে। সঙ্গে কলাটা, মুলোটা, কেক, হাঁস বা মুরগির রোস্ট নিয়ে আসে। সেও কদাচিৎ।
দেখতে দেখতে বয়স বাড়ে। এক বসন্তের দিনে অল্প জ্বর এল ফীবির। সামান্য জ্বর গিয়ে দাঁড়ালো ভয়াবহ অসুখে। এই বয়সে অসুখ হলে সহজে আর সারতে চায়না। দিনে দিনে বিছানায় মিশে যায় ফীবি। পাশের শহর সুইনারটনে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনে হেনরি। খবর পেয়ে চেনাশোনা লোকজনেরা আসে। তারাই রুগির সেবার ভার তুলে নেয়। সবে চেষ্টা ব্যর্থ করে সেদিন হিমেল বসন্তের রাতে চলে গেল ফীবি। ঘন কুয়াশার মধ্যে ফীবির সঙ্গে গোরস্থানে গেল হেনরি… একেবারে ভাঙ্গাচোরা একটা মানুষ। গোরস্থানটাও কেমন যেন ভূতুড়ে…বেখাপ্পা পাইন গাছ কটা দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু। পেম্বারটনে মেয়ের বাড়ি চলে যেতে পারত হেনরি…কিংবা মেয়েকেও তার বাড়িতে ডেকে পাঠাতে পারত। কিন্তু এই বয়সে সে আর কোনো ঝক্কি নিতে চায় না। এই জায়গাতেই থিতু হয়ে বসেছে সে। এখান থেকে নড়তে মন চায় না। বন্ধু বান্ধবেরাও তাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকার জন্য অনেক করে বলল। কিন্তু সে রাজি নয়। এ বাড়ির প্রতিটা ইট কাঠ পাথরের সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে গেছে সে। এই বয়সে সে আর ঠাঁইনাড়া হতে পারবে না। ফীবি যেখানে মাটির তলায় চিরঘুমে রয়েছে তার পাশাপাশি থাকতে পারলে মনে মনে শান্তি পাবে সে। একা একা থাকতে তার কোনো কষ্ট নেই। ছেলে মেয়েদের খবর দেওয়া হল। তারাও বাবাকে ডাকাডাকি করল। কিন্তু হেনরির সেই এক গোঁ। এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না । ফীবির চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন ডা.মরো। তাঁর সামনেও হেনরির সেই একই কথা… ‘ আমি একা চালিয়ে নিতে পারব। একটু আধটু রান্না বান্না তো জানি। সকালে আমার একটু কফি আর রুটি হলেই চলে যায়। আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমাকে শুধু নিজের মতো থাকতে দিন’। পাড়া প্রতিবেশিরা বলল তারা সময়ে সময়ে কফি, মাংস, পাঁউরুটি দিয়ে যাবে। এতে হেনরি রাজি। এ বাড়িতে তার একাই দিন কাটতে লাগল। অলস সময় যেন আর কাটে না। বসন্তের নরম রোদে মাঝে মাঝে গা ডুবিয়ে বসে। কত হাবিজাবি চিন্তা আসে মাথায়। একবার ভাবে সময় কাটানোর জন্য এবার একটু চাষবাসে মন দিলে হয়। অনেকদিন হল কিচ্ছু চাষ বাস হয়নি। এতে সময়টাও কাটবে। মনটাও অন্যদিকে ব্যস্ত থাকবে। বিকেল আর সন্ধেটায় সময়যেন আর কাটতে চায় না। এ বাড়ির প্রতিটা জিনিসে ফীবির হাতের ছোঁয়া। কিন্তু মানুষটা আর নেই। একটু একটু করে ফীবির সব জিনিসপত্র সে সরিয়ে ফেলেসে। ওগুলোর দিকে তাকালেই মনটা ভারি হয়ে যায়। রাতের বেলা লম্ফটা জ্বালিয়ে সে পুরোনো খবরের কাগজ পড়ে। বাইবেল পড়ে। অনেকদিন হল বাইবেলটা আর তাক থেকে নামানোই হয়নি। খুব ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ধম্ম কম্মেও মনে একটুও শান্তি পায় না সে। বেশির ভাগ সময়ই মুখটা দু হাতে চেপে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর শুধু ভাবে। কোথায় গেল ফীবি? যে কবে ফীবির কাছে যেতে পারবে? কবে?
অনেক কষ্ট করে সকালে একটু কফি বানায় রাতে একটু মাংস রোস্ট করে নেয়। কিন্তু আজকাল আর খিদে হয়না। খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। যে ছোট্ট ঘরটায় সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে বাইরে থেকে দেখে মনে হয়না যে সেখানে কেউ থাকে। বাড়িটার চাপাশে বিষাদের ছাপ। শোকতাপে কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা মাস। তারপর হঠাৎসবকিছু বদলে গেল।
রোজকার মতো সেদিন রাতেও সামনের আর পিছনের দরজাটা ভালো করে দেখে নিল হেনরি। দম দিল ঘড়িতে। লম্ফটা নিভিয়ে দিল। এই এত বছর ধরে যন্ত্রের মতো যা যা করেছে সব করে বিছানায় এল সে। ঘুমোয় সে আর কতটুকু! সারাক্ষণ তো ভেবেই যায়। বাইরে চাঁদের আলোর বন্যা। বাইরের বাগানে শ্যাওলা ঢাকা গাছের গুঁড়িগুলো যেন চক চক করছে। বিছানায় শুয়ে বাইরের জানালা দিয়ে সব দেখতে পাচ্ছে সে। গাছগুলোকে দেখে ছায়ামানব বলে ভ্রম হয়। পূবের জানালার জাফরি দিয়ে চাঁদের আলো মেঝেতে বিচিত্র আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে। ঘরের মান্ধাতার আমলের আসবাবগুলোর ওপরও আলো পড়েছে। বিছানার শুয়ে শুধু ফীবির কথাই ভেবে যায় হেনরি। সেই কম বয়সে তাদের ঘরকন্নার কথা…ছেলে মেয়েদের কথা। কেউ আর কাছে নেই তারা। যে যার মতো দূরে চলে গেছে। এই একলা ঘরে ফীবির স্মৃতি বুকে আঁকড়েই পড়ে রয়েছে সে। ঘরের অবস্থা একেবারে অগোছালো। কোনো যত্ন নেই। বিছানার চাদরটাও ময়লা হয়ে গেছে। কাচাকুচি মোটেই পারে না সে। কাচার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর চলে আসে । বাড়ির ছাদে ফাটল ধরেছে। জিনিসপত্র সব স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। এসব সারানোর দিকে তার কোনো মন নেই। সারাক্ষণ নিজের চিন্তাতেই সে বুঁদ। আলগোছে একদিক ওদিক হেঁটে এসে আবার নিজের চিন্তাতেই ডুবে যায় ।
সেদিন বারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে ছিল সে। দুটোতেই ঘুম ভেঙে গেল। চাঁদটা এখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। বসার ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে। রান্নাঘরটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলোয়। বাড়ির সব আসবাব…চেয়ার টেবিল…চেয়ারের মাথায় রাখা তার কোট…রান্নাঘরের আধখোলা দরজা… রুপোলি আলোয় সব যেন মায়াবী লাগে। এযেন আলো ছায়ার খেলা। খবরের কাগজের কাছে ওই লম্ফের পাশে…কে বসে ও? এ যে ফীবি! অবিকল ফীবি! ফীবি টেবিলটার ওপর মাথা ঝুঁকে বসে আছে। ফীবিকে এইভাবে বসে থাকতে সে কতদিন দেখেছে। চমকে ওঠে হেনরি। কে ওই ছায়ামূর্তি ! ফীবি নাকি ফীবির প্রেতাত্মা! জীবনে সে কোনোদিনো ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেনি। তাও আজ সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আধো আলোয়…ঐ ছায়া মূর্তির দিকেই ঠায় তাকিয়ে থাকে সে। মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। ঐ ছায়া মূর্তির কোনো নড়ন চড়ন নেই। বিছানা থেকে নিজের সরু লিকলিকে পা দুটো নামিয়ে ছায়ামূর্তির দিকে নিষ্পলক তাকিয়েই থাকে। এ কী সত্যিই ফীবি! ভূত, প্রেত, আত্মা, অশুভ লক্ষ্ণণ নিয়ে আগে প্রায়ই তাদের মধ্যে কথা হত। কিন্তু তারা দুজনেই এসবে বিশ্বাস করেনি কোনোদিন। তার বউ কোনো দিনও বিশ্বাসই করত না যে সে আত্মা হয়ে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এই জীবনের ওই পারে কী রয়েছে তা নিয়ে ফীবির কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিল না। সে শুধু ভাসাভাসা ভাবে জানত ওই পারে একটা স্বর্গের মতো কিছু একটা আছে। যারা সৎ, ভালো মানুষ তারা আর সেখান থেকে ফিরে আসে না। তবে সে এখানে কী করে এল! ওই তো টেবিলের ওপর মাথা ঝুঁকে বসে আসে সে। ওই তো তার কালো স্কার্ট…ছাই রঙা শাল। ওই তো তার আবছা অবয়বে আলো এসে পড়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে যায় হেনরির, গলা ছেড়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ফীবি…তুমি আবার ফিরে এসেছ?’সে অবয়ব আর নড়ে না। স্থির হয়ে বসে থাকে। হেনরি উঠে ওই ছায়াকে লক্ষ্য করে দরজার দিকে পা বাড়ায়। সে একটু এগোতেই যেন বাতাসে মিলিয়ে যায় সে ছায়া। ঘরে শুধু পড়ে থাকে ভাঙাচোরা, ঘুণ ধরা সব আসবাব…চেয়ারের হাতলে সেই পুরোনো কোট, কাগজপত্রের মাঝখানে ওই সেই লম্ফ…ঐ সেই আধখোলা দরজা। ফীবির কোনো লেশমাত্র নেই। নিজের মনেই বিড়বিড় করে যায় হেনরি… ‘ আচ্ছা ঠিক আছে…আমি হলফ করে বলতে পারি সে এসেছিল’। মনটা একটু শান্ত হতে মাথায় একনাগাড়ে বিলি কেটে যায় সে। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস আজ নাহয় ফীবি ধরা দেয়নি। তবে ফিরে সে আসবেই।আরেকদিন রাতেও সেই একই ঘটনা। তার চিন্তায় সারাক্ষণ ফীবি। বয়সকালে মাথায় কত রকমের চিন্তা যে আসে! বিছানার সবচেয়ে কাছের জানালা দিয়ে বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে। বাইরে ওই তো মুরগির খাঁচা, শুয়োরের খোয়াড়…ঠেলা গাড়ি রাখার ছাউনি। ভেজা মাটি থেকে আবছা ধোঁয়াউঠে যায়। ওর মধ্যেই আবার সে দেখতে পায় ফীবিকে। হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ঠিকই দেখেছে। রোদে পোড়া দিনের শেষে ঠান্ডা রাতে মাটি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। সেই নিঃশ্বাসই ধোঁয়ার পরত হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার আগে সাদা সাইপ্রেস গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ফীবি তো আগে কতবার রান্না ঘরের এঁটো কাঁটা…কুটনো কাটনা ফেলতে ওই রান্নাঘরের দরজা দিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে যেত। বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে হেনরি। মনে একটু সংশয়। আগের বারের মতো আবার সে চলে যাবে না তো? মন আজ তার বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ আত্মা বলে নিশ্চয় কিছু আছে। এই কথাটা এত দিনে তার বিশ্বাস হয়েছে। ফীবিও হয়তো তার ফেলে আসা সঙ্গীর কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে আহারে বেচারা হেনরি কীভাবে একা একা দিন কাটাচ্ছে! এত দিনের সঙ্গীর মায়া কাটাতে না পেরে সে হয়তো আবার ফিরে এসেছে। আর কী করতে পারে সে? নিজেকে আর কীভাবে সে প্রকাশ করতে পারে? হেনরির এত কষ্ট দেখে এইটুকু দয়া সে করবে না? হেনরি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। তপ্ত মাটির নিঃশ্বাস ধোঁয়া হয়ে কাঁপতে কাঁপতে সরে যায় ওই বেড়ার দিকে ।
এর পরের ঘটনা দশ দিন পরে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের ঘোরে আবার তার কাছে ফিরে আসে ফীবি। বিছানায় তার পাশে বসে মাথায় হাত রাখে ফীবি… ‘ আহা বেচারা হেনরি…নিজের কী দশা করেছে দেখো!’
ধড়ফড় করে উঠে বসে হেনরি। তাকে সে স্পষ্ট দেখেছে যে! ওই তো সে শোওয়ার ঘর থেকে বসার ঘরের দিকে চলে গেল। কালো আবছা মতো তার শরীর। তার শরীরের রেখা থেকে কেমন বিন্দু বিন্দু আলো ঠিকরে পড়ছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সে! এ কী সত্যি! বিছানা থেকে উঠে বরফ ঠান্ডা মেঝেতে অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করে দেয়। মনে মনে অনেক ভাবনা খেলা করে যায়। হ্যাঁ সে এবার সে নিশ্চিত ফীবি তার কাছেই ফিরে আসছে। সে ফীবির কথা সময় ভাবে আর ওপার থেকে ফীবি যদি বুঝতে পারে সে ছাড়া তার স্বামী কত অসহায় তাহলে সেকি না এসে পারবে? এতটুকু করুণা সে কি তার হেনরির ওপর করবে না? ফীবি নিশ্চয়ই তাকে বলে দেবে কী করতে হবে না হবে। রাতেই হয়তো ফীবি তার কাছে আসবে। তাতে তার একাকীত্ব তো অন্তত ঘুচবে। এই নির্জনবাস যে সহ্য হয় না আর।
একেতে এত বয়স…তার ওপর দুর্বল শরীর মনের ভ্রম হওয়াটা স্বাভাবিক। মনের বিকার থেকে কল্পনায় নানা দৃশ্য দেখতে শুরু করে সে। এই করে করে পুরো বদলে যায় মানুষটা। রাতের পর রাত সে জেগে থাকে ফীবির অপেক্ষায়। কখনো তার তার মনে হয় একটা আলোময় শরীর ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কখনো দিনের আলো নিভলে বাগানের মধ্যে ফীবিকে পায়চারি করতে দেখে। একদিন সকালে উঠে পাগল পাগল লাগে তার। এই একাকীত্বের বোঝা বয়ে বেড়ানো যে কী কষ্টের! এতদিনে সে ঠিক ধরতে পারেছে ফীবি আসলে কাছাকাছিই আছে…সে মরেনি। কেন যে তার এমনটা মনে হল সেটা অবশ্য বলা শক্ত। মাথাটা তার একদম গেছে। দিনরাত কল্পনার রাজ্যেই ডুবে থাকে সে। নিজের মনেই ফীবির সঙ্গে আবোল তাবোল ঝগড়া করে। খুব ধমক দেয় সে ফীবিকে…কেন তার তামাকের পাইপটা সরানো হয়েছে! কেন সেটা ঠিক জায়গায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে ফীবি চলে যায়। সে তো আগে মাঝেমাঝেই নিজের বরকে কপট রাগ দেখিয়ে বলত… ‘তুমি যদি এমন করো তাহলে আমি কিন্তু চলে যাব’! তার উত্তরে হেনরি বলত… ‘ ও ঠিক আমি তোমায় খুঁজে বের করে ফেলব’। ফীবিও কি কম যেত নাকি! সেও ঝাঁঝিয়ে বলে উঠত… ‘ আমি তোমায় ছেড়ে চলে গেলে কোত্থাও পাবে না তুমি আমায়। আমার এমন জায়গা জানা আছে যেখানে তুমি আমায় শত খুঁজেও পাবে না।
সেদিন সকালে উঠে আর আর কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না তার। ফায়ার প্লেসে আগুন দিতে ভুলে যায়…রোজকার মতো কফি বানিয়ে রুটি খেতেও আর মন চায় না। এখন মনে তার একটাই চিন্তা এই কাছাকাছির মধ্যে ফীবি কোথায় যেতে পারে? সে কোথায় গেছে একবার জানতে পারলেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসা যাবেখন। এই তো কিছুদিন আগেই ঘোড়াটাকে বেচে দিয়েছে সে। একা মানুষ। তার ওপর একটা ঘোড়া থাকা মানেই ঝক্কি। জামাকাপড় পরে মাথায় নরম কাপড়ের টুপিটা চাপিয়ে দরজার পেছনের আংটা থেকে বেতের প্যাঁচালো লাঠিখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। তার চোখে মুখে এখন নতুন উদ্যম…নতুন সংকল্প। ফীবিকে সে খুঁজে বের করবেই। কোথায় আর সে যেতে পারে। আশে পাশের কোনো পড়শির বাড়িতে হয়তো গিয়ে বসে আছে। ধুলোভরা পথে ছেঁড়াখোড়া জুতো নিয়ে থপথপিয়ে সে হেঁটে যায়। অনেক দিন চুল টুল কাটা হয়নি। আধপাকা চুল এখন ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। টুপির বাইরে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল বেরিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো দেবদূতের মাথার জ্যোতির্বলয়। সে হেঁটে যায় হার বাতাসে পতপত করে ওড়ে তার খাটো কোট। মুখ…চোখ…দুহাত একেভারে যে রক্তশূন্য…ফ্যাকাশে।
রাস্তায় ডজের সঙ্গে দেখা। ডজ এখানেই চাষবাস করে। গাড়িভর্তি গম নিয়ে সে চলেছে বাজারে। এতদিন বাদে রাস্তায় হেনরিকে দেখে ডজ তো অবাক…বউ মরার পর এই মানুষটা আর ঘর থেকেই বেরোয়নি। আজ আবার সে মানুষটা এত হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছেকোথায়?
‘ এই যে হেনরি এত সকাল সকাল চললে কোথায়?’
‘ তুমি কি ফীবিকে কোথাও দেখেছ?’…বুড়ো মানুষটার মুখে গভীর উদ্বেগ।
‘ কোন ফীবি?’…হেনরির বউ ফীবির কথা তো মাথাতেই আসেনি গোবেচারা ডজের।
‘ আমার বউ ফীবি। আর কার কথা বলব আমি শুনি?’…উস্কো খুস্কো চুল…এবড়ো খেবড়ো ভুরুর নীচে মানুষটার চোখদুটো বড় করুণ লাগে।
ডজ সাদাসিদে মানুষ। গোলগাল…মুখখানা রাঙামূলোর মতো। মনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই…সেও বোকার মতো বলে বসে… ‘হেনরি তুমি নিশ্চয়ই মস্করা করছ তাই না… তুমি কি সত্যিই তোমার বউয়ের কথা বলছ…সেতো কবে মরে ভূত…
হেনরির এখন মাথার ঠিক নেই। ডজের কথা শুনে চোটে লাল… ‘ না আজই সকালে ও বেরিয়েছে। আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম তাই টের পাইনি। ও বরাবর আমার আগে ঘুম থেকে উঠে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে। কাল রাতে একটু ঝগড়া হয়েছিল। তাই সে আজ রাগে চলে গেছে। তবে আমি ওকে ঠিক খুঁজে বের করব। ও নিশ্চয়ই মাটিল্ডা রেসের বাড়ি গেছে। ওখানে তো ও মাঝে মাঝে যায়’।
হনহনিয়ে হয়ে আবার হাঁটা দেয় সে। কোনোদিকে তাকায় না। বোকা চাষি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বুড়োর দিকে। নিজেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে… ‘ এ কী কাণ্ডরে বাবা! বুড়োর মাথাটা একদম গেছে। ঘরে একা থাকতে থাকতে বুড়ো কি পাগল হয়ে গেল নাকি? যাই হোক আমাকে ব্যাপারটা শেরিফকে জানাতে হবে’। এই বলে অতি আগ্রহে ঘোড়াটাকে সপাৎ করে মারে এক চাবুক… ‘ জলদি চল’।
এই গ্রামে লোক জন বিশেষ থাকে না। পথে আর আর কারো সঙ্গেই দেখা হল না। কখন যে সে তিন মাইল হেঁটে মাটিল্ডা রেসের বাড়ি পৌঁছে গেল নিজেই টের পেল না। ওই তো মাটিল্ডা রেসের বাড়ির সামনে সাদা বেড়াটা দেখা যাচ্ছে। পথে আরো কয়েকটা বাড়ি অবশ্য চোখে পড়েছে কিন্তু এদের কারো বাড়িতে ফীবি যেতে পারে বলে তার মনে হয়না। মাটিল্ডার সঙ্গেই ভালো ভাবসাব ছিল ফীবির। এলে সে এখানেই এসেছে। বেড়ার গেটটা খুলে ভারী হন্তদন্ত সে দরজায় এসে ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে তাকে দেখে মাটিল্ডাও বেশ অবাকই হয়… ‘ কী ব্যাপার মি.রেইফস্নাইডার? এখানে? এত সকাল সকাল? আর তর সয়না হেনরির ‘ ফীবি এখানে এসেছে’? প্রশ্ন শুনে মাটিল্ডার মতো শক্তপোক্ত মানুষেরও চোখ কপালে!
‘ কোন ফীবি? কীসের ফীবি? বুড়োর চোখ মুখের অবস্থা দেখে তার জানার খুব কৌতূহল হয়। ব্যাপারটা আসলে কী? একটু বাজিয়ে দেখতে হচ্ছে তো!
‘ অবশ্যই আমার ফীবি। আমার বউ ফীবি। আর কোন ফীবির কথা বলব বলে আপনার মনে হয়? ও কি এখানে রয়েছে?’
‘ হে ঈশ্বর! এ কেমনতরো কথা। আপনার এখন মাথার ঠিক নেই। আপনি এখন বসুন তো। একটু কফি টফি খান। আপনার বউ তো এখানে আসেনি। তাতে কী। আপনি ভেতরে এসে একটু বসুন। একটু পরেই আমি আপনার বউকে খুঁজে দেব। সে কোথায় যেতে পারে আমার জানা আছে’।
বুড়ো মানুষটার চোখে টলটলে জল। সে ভেতরে ঢোকে। মাটিল্ডা ভাবে কী চেহারা হয়েছে মানুষটার! শরীরের সবকটা হাড় যেন গুণে ফেলা যায়। চোখ মুখ ফ্যাকাশে। তার ওপরে অমন ঢলঢলে একটা প্যান্ট! তাকে দেখে নিজের বুড়ো বাপটার কথা মনে পড়ে যায় মাটিল্ডার। মানুষটা যখন টুপিটা খুলে হাঁটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়ে তখন খুব কষ্ট হয় তার। আহারে!
‘জানেন তো কাল রাতে আমাদের ওই একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। সেইজন্য সকালে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ফীবি’।
‘ হে ভগবান!’ নিজের মনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাটিল্ডা। এখন বাড়িতে কেঊ নেই যে তাকে এই কথাটা বলে নিজে একটু হাল্কা হওয়া যায়। তড়িঘড়ি রান্নাঘরে এসে নিজের মনেই বিড়বিড় করে সে… ‘মানুষটাকে দেখলে কষ্ট হয়। ওঁর একটু দেখাশোনা…যত্ন আত্তি করা দরকার। কবে বউ মরেছে। আর উনি এভাবে পাগলের মতো মাঠে ঘাটে ছুটে ছুটে বেড়াবেন। না, এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না’।
জলদি কফিটা বানিয়ে নেয় সে। বাড়ির তৈরি রুটি আর একটু মাখনও আনে। তার সবচেয়ে ভালো জ্যামটাও বের করে। আর দুটো ডিম সেদ্ধ করতেও বসিয়ে দেয়।
‘ কাকু আপনি এখন এখানে আসুন। জ্যাক বাড়ি ফিরে আসুক। আমি নিজে ওকে ফীবিকে খুঁজতে পাঠবো। আমার তো মনে হয় সইদের নিয়ে তিনি সুইনারটনদের বাড়িতেই গেছেন। যাই হোক না কেন আমারা ঠিক খুঁজে ফেলব। নিন এখন এখন একটু কফি আর রুটি খেয়ে নিন দেখি। বড্ড ধকল গেছে আপনার ওপর দিয়ে। সকাল সকাল এতদূর হেঁটে এসেছেন!’ মাটিল্ডা আসলে এটা ওটা বলে বুড়োকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। আগে তার মরদ জ্যাক ফিরুক ঘরে। তার সঙ্গে একটু আলাপ আলোচনা করে না হয় দেখা যাবে। আসলে শেরিফকে তো ব্যাপারটা জানাতে হবে। জ্যাককেই ওখানে পাঠাতে হবে। কেমন যেন মনটা আনচান করছে তার। সে ভাবে দু দিনের এই জীবনে কতকিছু যে ঘটে যেতে পারে আগে থেকে কে বলতে পারে! ওদিকে হেনরি তার ফ্যাকাসে হাত দিয়ে টুপিটায় হাত বুলোতে বুলোতে খাবার দাবারগুলো খেয়েই নেয়। বড় অন্যমনস্ক সে। ফীবিকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। ফীবি এখানে আসেনি। তাহলে কোথায় যেতে পারে সে! কার বাড়ি? ভাবতে ভাবতে স্মৃতির অতল থেকে হঠাৎ করে মুরেদের কথা মনে পড়ে যায়। আচ্ছা ও বাড়িতে কি ফীবি গেছে! সে বাড়ি এখান থেকে আবার এক মাইল। তাও আবার পুরো উলটো দিকে। এখানে অনেক্ষণ কেটে গেছে জ্যাকের জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। সে নিজেই তার বউকে খুঁজে বের করবে। তাকে যে যেতেই হবে। ফীবির মানভঞ্জন করতে হবে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে।
‘ না এবার আমায় যেতেই হবে’…ছটফট করে উঠে পড়ে হেনরি। নিজেই কেমন বেকুব বনে যায়… ‘এখানে তো ফীবি আসেনি। আমার মনে হয় ও মুরেদের ওখানেই গেছে। আমি আর দাঁড়াতে পারব না মিসেস রেস। বাড়িতেও মেলা কাজ পড়ে রয়েছে’।
মাটিল্ডার শত অনুরোধেও সে গলে না। বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। এখন বসন্তের গনগনে রোদ। মাটিতে বেতের লাঠিটা ঠক ঠক বুড়ো পথ চলেই যায়।
ঘণ্টা দুয়েকপর ফ্যাকাশে…হা ক্লান্ত মানুষটা এসে দাঁড়ায় মুরে-দের দরজায়। ঘামে ভেজা সারা শরীর ধুলোয় ভর্তি। এই রোদে তাতে পাঁচ মাইল হেঁটে ফেলেছে সে। মুর দম্পতিরও বয়স হয়েছে। মিসেস মুরের বয়সই তো ষাট হয়ে গেল। হেনরির প্রশ্ন শুনে তাঁদেরও ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। সত্যিই পাগল হয়ে গেছে মানুষটা। দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য তারাও অনেক পীড়াপীড়ি করেন । তার পর নাহয় সবাই মিলে ফীবিকে খুঁজবার জন্য কিছু একটা করা যায়। আসলে তাদের উদ্দেশ্যটা ছিল একটু অন্য। এই ফাঁকে পরে যদি ব্যাপারটা শেরিফের কানে তুলে রাখা যায়! এদের অনুরোধে একটু বসে হেনরি। আনমনে অল্প কিছু খেয়েও নেয়। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়। এখানে বসে থাকলে তার চলবে না। এবার তাকে অন্য কারো বাড়িতে খুঁজতে হবে। সে যত দূরই হোক না কেন! ফীবিকে ছাড়া তার চলবে না। তার এই চাওয়াই ক্ষ্যাপার মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় তাকে। সেদিন বটেই তার পরদিন…তারও পরদিন চলে এর ওর বাড়িতে তার এই ঘোরাঘুরি…আর সেই একই জিজ্ঞাসা ‘ ফীবি কি এসেছে এখানে?’
হেনরির যে সমাজে বাস সেখানে তার এই পাগলামি, উদ্ভট সব রকম সকম তো আর চলে না। হেনরি নাহয় কারো ক্ষতি করে না। তাকে দেখে লোকের কষ্টই হয়। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার প্রশ্ন শুনে লোকে অবাক হয়…তারপর এই অসহায় মানুষটার জন্য করুণা। গ্রামের শেরিফকে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে। এ রকম অবস্থায় যে কোনো লোককেই পাগলাগারদে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এই বুড়ো মানুষটার ব্যাপারটা একটূ আলাদা। তাকে অনেকে অনেকদিন ধরেই জানে। তারাও জানে গ্রামের পাগলা গারদের অবস্থা কী শোচনীয়! মানুষে থাকতে পারে না সেখানে। ভেতরে ঢুকলেই গা গুলিয়ে আসে। এই গ্রামের হত দরিদ্র অবস্থা। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন লড়াই করতে হয়…সেখানে পাগলা গারদের হাল ফেরানোর দিকে কে আর নজর দেয়? গ্রামের মাথারা তাই রায় দিলেন হেনরি তার নিজের মতোই থাকুক। লোকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে সারা দিনের ঘোরাঘুরির পরে সে বুড়ো মানুষটা রাতে ঠিক নিজের আস্তানাতেই ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে তন্ন তন্ন করে দেখে তার বউ ফিরে এসেছে কিনা। তার একা ঘরে সারারাত নিজের কল্পনার রাজ্যে ভাসতে ভাসতে আবার বেরিয়ে পড়ে পরের দিন সকালে। ফীবির খোঁজে। এমন একজন রোগা পাতলা শান্ত নিরীহ মানুষকে কি পাগলা গারদের অন্ধ কুঠরিতে বন্ধ করে রাখা যায়? মানুষটার বয়স হয়েছে। চুল গুলো একেবারে শনের নুড়ি। দোষের মধ্যে তিনি সবাইকে তাঁর বউয়ের খবর জিগ্যেস করে বেড়ান। সবাই তাকে অতি ভদ্র, সজ্জন বলেই যায় জানে। শুধু একটু প্রশ্ন করার জন্য তাঁর এতবড় শাস্তি হতে পারে না। তিনি নিজের মতোই থাকুন। তাঁর পুরোনো পরিচিতরা সবাই এই রায়ই দেয়। ও তো কারো কোনো ক্ষতি করতে যাচ্ছেনা। অনেকে আবার তাঁকে সাহায্য করবেও বলে। খাবার দাবার, পুরোনো জামা কাপড়, আর বেঁচে থাকতে গেলে আর যা যা কিছু লাগে…সেগুলো দেওয়ার কথা অনেকেই জানায়…বিশেষ করে খাবারটা।
দিন যায়। এখন সবাই মোটামুটি চিনে গেছে তাঁকে। মানুষটা কী জিগ্যেস করতে পারে সেটাও সবার জানা। তাই এখন হেনরিকে দেখলেই সবাই আগে ভাগেই উত্তর দিয়ে দেয়… ‘ না আমি তো তাকে দেখিনি’… ‘ হেনরি আজ তো ও আমাদের বাড়ি আসেনি’। প্রতিদিন সেই একই প্রশ্ন আর একই উত্তর।
বেশ কয়েক বছর ধরে চলে তার এই খোঁজ । রোদে জলে ধুলো কাদায় সে ঘুরে বেড়ায় পরিব্রাজকের মত…মনে শুধু একটাই প্রশ্ন। গ্রাম ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে যেখানে পারে সে চলে যায়। তবু শেষ হয়না তাঁর খোঁজ। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। শরীর ভেঙে পড়ে। পড়শিরা যতটা পারে সাহায্য করে। কোনোদিন সে খায়…কোনোদিন খায়না। সারাদিন শুধু হাঁটা। রাস্তা ধরে সে যত হাঁটতে থাকে কল্পনায় তত ছবি দেখতে পায়। এতদূর হেঁটে বাড়ি ফিরতে আর খুব কষ্ট হয়। এবার একটা উপায় বের করে ফেলে সে। একটা পোঁটলায় বাসন কোসন সব বেঁধে নেয়… কফির পুরোনো টিনের বড় কেটলি, টিনের একটা ছোট পেয়ালা, একটা ছুরি, কাঁটা চামচ, আর একটু নুন আর মরিচ। পোঁটলার মধ্যে একটা ফুটো করে দড়ি দিয়ে একটা থালা বেঁধে নেয়। এই থালাটা যখন তখন বের করে নেওয়া যাবে। বনে জঙ্গলে এটাকেই দিব্যি টেবিল হিসাবে চালিয়ে নেওয়া যাবে। এই জিনিসগুলো সঙ্গে থাকলে তাকে তার বাড়ি ফেরার ধকল নিতে হয় না। সে খায় পাখির মতো। এইটুকু খাবার যোগাড় করতে তার তেমন অসুবিধে হবে না। আর লোকের কাছ থেকে একটু খাবার চাইতে তার কোনো লজ্জা নেই। তার চুল বাড়তে বাড়তে কাঁধ ছুঁয়ে ফেলে। তার কালো টুপি রোদে পুড়ে একদন বাদামি। তার জামা কাপড় ছিঁড়ে ফর্দাফাই। সারা শরীর ধূলোময়।
আজ তিন বছর হয়ে গেল। সে শুধু খুঁজেই চলেছে। কত শত মাইল পথ যে সে হেঁটে ফেলেছে… কেউ জানে না। এত ঝড় জল তুষারপাতের মধ্যেও তার প্রাণটা কীভাবে টিকে রয়েছে সেটাও গ্রামের সাধারণ সাদাসিদে মানুষগুলোর মাথায় ঢোকে না। যেখানে সেখানে রাত কাটিয়ে দিতে পারে সে। খড়ের গাদায়…গোয়াল ঘরে গরু, বাছুর, শুয়োরের পাশে ঘেঁসাঘেঁসি করে দিব্যি সে ঘুমিয়ে পড়ে। পশুগুলোর গায়ের উষ্ণতায় সে একটু ওম পায়। এমন একটা নিরীহ, অসহায় মানুষকে দেখে পশুগুলোরও বোধহয় মায়া হয়। তারাও দিব্যি মেনে নেয় এই সহাবস্থান। ঝড়, জলের সময় কখনো সে আশ্রয় নেয় পাহাড়ের গুহায় বা কোনো বড় গাছের ছায়ায়। খড় বা ভুট্টা রাখার গোলাঘরেও মাঝে মাঝে তার আশ্রয় জুটে যায়।
দিনে দিনে তার মনের বিকার আরো বাড়ে। রোজ রোজ লোকের বাড়ি ঘুরে ঘুরে ‘না’ শুনতে এখন আর তার ভালো লাগে না। কোনো বাড়িতেই ফীবিকে সে খুঁজে পায়নি। কিন্তু ফীবি ঠিক কোথাও না কোথাও রয়েছে। তেমন করে ডাকলে সে শুনতে পাবে। লোকের বাড়ি ঘোরা ছেড়ে সে এখন সে ফীবির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে। এই শান্ত মাঠে ঘাটে…খাড়া পাহাড়ি অঞ্চলের ধাপে ধাপে গুমরে ওঠে তার বুকফাটা কান্না… ‘ ও… ফীবি…ও… ফীবি…!’ তার এই কান্না সবাই শুনে ফেলেছে। দূর দূরান্তের চাষি আর আর তাদের মুনিষরাও মানুষটাকে চিনে নিয়েছে… ‘ ঐ যে বেচারা রেইফস্নেইডার’।
এতদিনে কয়েক হাজার লোককে জিগ্যেস করা হয়ে গেছে। কয়েকশ বাড়িতে ঢুঁ মারা হয়ে গেছে। এবার আর কোনো বাড়িও চোখে পড়ে না। কোন রাস্তা ধরে সে যাবে তাও জানা নেই। বিশেষ করে চৌমাথা বা ছয় মাথার রাস্তাগুলিতে এসে তার মাথাটা একেবারে গুলিয়ে যায়। এবার সে কোনদিকে যাবে? এবার তার মাথায় আসে আরো উদ্ভট কল্পনা। ফীবীর আত্মা তাকে পথ দেখাবে… কিংবা প্রকৃতির কোনো শক্তি…হাওয়া… ঝড়…তাকে ঠিক ফীবির কাছে নিয়ে যাবে। সে এই ধরনের চৌমাথা বা ছয় মাথা রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে এসে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিজে তিনবার ঘুরে নেয়। তার পর দুবার ডেকে ওঠে … ‘ ও… ফীবি’। তারপর লাঠিটাকে সোজাসুজি ছুঁড়ে দেয়। লাঠিটা যে রাস্তায় গিয়ে পড়বে সেটা ধরে গেলেই ঠিক ফীবির দেখা মিলবে। কোনো দৈব শক্তি নিশ্চয়ই তাকে সঠিক রাস্তার খোঁজটা দেবে। এমনটাও হয়েছে সে রাস্তায় সে হাঁটা শুরু করেছিল ঘুরে ঘুরে আবার সেখানেই ফিরে এসেছে। কতদূর সে হেঁটেছে মনে মনে সেটাও ঠাওর করতে পারে না। তাই ফীবিকে আবার ডাক দেওয়ার আগে পুরো জায়গাটা সে তন্ন তন্ন করে খুঁজে নেয়। একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে তার মনে ফীবিকে সে ফিরে পাবেই। হাঁটতে হাঁটতে পা ক্ষত বিক্ষত হয়। ব্যাথায় পা টনটন করে। প্রখর রোদে সারা গা হাত জ্বলে যায়। সে হাত দিতে ভুরুর ঘাম ঝাড়ে। আবার প্রবল শীতের দিনে শরীর গরম রাখতে শুধু হাত ঘসে যায়।
অনেক সময় লাঠিটা গিয়ে সেই রাস্তার দিকেই পড়ে যেখান থেকে এই মাত্র ঘুরে এসেছে। মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে দার্শনিকের মতো ভাবে…ভাগ্যে কী লেখা আছে কেউ কি আর বলতে পারে। আবার সেই রাস্তা ধরে সে হাঁটতে শুরু করে।তিন চারটে গ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়ে গেছে তার। ছেলে বুড়ো এখন তাকে সবাই চেনে। সবাই তাকে দেখে আহা ঊহু করে। লোকের মুখে মুখে তার নাম ঘোরে।
গ্রিন কাউন্টির কাছে একটা ছোট্ট শহর আছে ওয়াটার্সভিল। ওখানে মানুষের বসতির মাইল চারেক দূরে একটা খাড়াই পাহাড় আছে। স্থানীয় লোকজনেরা বলে রেড ক্লিফ। লাল বেলে পাথপাথরের এই পাহাড়টা একশো একশো ফুট মতো উঁচু হবে। ভুট্টার ক্ষেত আর ফলের বাগানের মধ্যে প্রায় আধ মাইল জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই পাহাড়। পাহাড়ের ওপর ঘন গাছ গাছালি। উলটো দিকে পাহাড়ে ওঠার যে ঢালটা রয়েছে সেখানে কত গাছ…বীচ, হিকোরি অ্যাশআরো কত কী। এই গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে ফসলের গাড়ি চলাচলের চিহ্ন রয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে কোনো বড় গাছের নীচে বিছানা করে নেয় হেনরি। এটাই এখন তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। তারপর কোনো একটা গাছের নীছে আগুন জ্বালিয়ে মাংসটা একটু ভেজে নেয় বা ডিমটা সেদ্ধ করে নেয়। তারপর গাছের নীচেই শুয়ে পড়ে। এখন আর ঘুমও হয় না ভালো করে। ঘুম না এলে সে পায়চারি করে বেড়ায়। ঝিকিয়ে ওঠা চাঁদের আলো মুখে পড়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। কখনো বা দামাল বাতাসে, আবার কখনো রাতচরা পশু-পাখির ডাকে সে ধড়ফড় করে উঠে বসে। বসে বসে শুধু চিন্তাই করে যায়।আঁধার রাতেও তার চলা থামেনা। জ্যোৎস্না ঝলমলে রাতেও তার একটাই মন্ত্র…চরৈবেতি। অদ্ভূত, বুনো, উন্মাদের মতো একটা লোক…অথচ সে কারো ক্ষতি করে না। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সে করুণ বিলাপ করে…অন্ধকারে একদৃষ্টে দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর মনে মনে ভাবে এর মধ্যে কোন বাড়িতে তার ফীবি থাকতে পারে।
রাত দুটোর সময় তার ঘুম ভেঙে যাবেই। এই নশ্বর দেহের মধ্যে যে একটা ঘড়ি রয়েছে তার টিক টিক আওয়াজ শুনেই সে ঊঠে পড়ে। অত রাতে সে আর কোথাও যায়না। আনমনে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। তারা গোনে। কোন গভীর চিন্তায় যে ডুবে যায়! ঘুম ভেঙে গেলে আর শুয়ে থাকতে পারেনা সে। মনের বিকারে আরো কত কিছু দেখতে পায় সে। ওই যে কে যেন গাছের পাশ দিয়ে চলে গেল! হ্যাঁ ওই তো তার ফীবি! ব্যস এবার বাসন কোসন নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে হাতের লাঠিটা ঠুক ঠুক করে আবার তার শুরু হয় যাত্রা…নতুন করে খোঁজ। কিন্ত সেই ছায়ামূর্তি যেন লুকোচুরি খেলে তার সঙ্গে। চোখের নিমেষেই উধাও। তার সঙ্গে যে গিয়ে দুটো কথা বলবে…বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে তার কোনো সময়ই পায় না। সেই ছায়াশরীরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। মাঝপথেই রাস্তা হারায়। চোখে জল ভরে আসে…হাহুতাশ করে মানুষটা। তার এই খোঁজ কি আর শেষ হবে না! আর কত পরীক্ষা দিতে হবে তাকে!
দিন যায়্…মাস যায়…দেখতে দেখতে কেটে যে সাত বছর। তার চলা থামে না। এমনই এক বসন্তের দিনে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলতার স্ত্রী । আর এমনই এক ভরা বসন্তের দিনে বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে সে চলে রেড ক্লিফের পাশের মাঠে। তার হাতের লাঠিটাই দৈববলে এই রাস্তায় টেনে এনেছে তাকে। মাইলের পর মাইল হেঁটে এসেছে সে। রাত দশটা বেজে গেছে। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ে। এত দিন ধরে ভালো করে না খেয়ে এত দূর হেঁটে হেঁটে হাড্ডিসার চেহারা তার। হাড়ের ওপর যেন শুধু একটা চামড়ার পরত। দেহের শক্তি নয় তাদের অদ্ভুত মনের জোরই হয়ত তাকে একদিন টিকিয়ে রেখেছে। আজও ভালো করে খাবার জোটেনি। এই অন্ধকারে সে এবার একটু জিরোবে। পারলে একটু ঘুমিয়েও নেবে।
কিন্তু কেন জানি সে ঘুমোতেও পারেনা। তার চারপাশে কে যেন ঘুরে বেড়াছে। এ নিশ্চয়ইফীবি। কিছুদিন আগেই নিজের মনকে বুঝিয়েছে সে। এত বছর ধরে ফীবিকে পাওয়া যায়নি ঠিকই। কিন্তু এবার ফীবি তার কাছে ধরা দেবেই। আর সে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। এবার সে নিশ্চয়ই তার দেখা পাবে। তার সঙ্গে কথা বলবে। এই ভাবতে ভাবতেই হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে সে। মাঝরাতে আবার থালার মতো চাঁদ ওঠে। রাত দুটোতে সে যখন জেগে ওঠে তখন পুব দিকের গাছগুলো রুপোলি আলোয় মোড়া। চোখ খুলে রুপোলি আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় স্নান করা গাছগুলোকে মনে হয় এক একটা ছায়া শরীর। আবার সেই পুরোনো চিন্তাই মাথায় ফিরে আসে। তার ফীবি এই তো কাছাকাছিই রয়েছে। মনে অনেক আশা নিয়ে চোখ খুলে তাকায় সে। ওই দূরের ছায়ায় কী যেন একটা নড়ে উঠল মনে হয়। ধোঁয়ার মতো কিছু একটা এ গাছ ও গাছের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে যেন ঘুরে বেড়ায়। আর সে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর লুকোচুরির এই মায়াময় পরিবেশে সব কিছু যেন অদ্ভূত ঠেকে। দূরে বাদা জমিতে তির তির করে কেঁপে ওঠা আলেয়া…শত শত জোনাকির ওড়াউড়ি দেখে তার আবার বিভ্রম জাগে। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই আলো-শরীর আসলে ফীবির। সত্যিই কি ফীবি তাকে ডাকছে! গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আলেয়ার আলো তার পাশ দিয়ে চলে যায়। তার মনে হয় সে ফীবির চোখ দুটো দেখেছে। না না কালো কোট ছাই রঙা শাল পরা যে ফীবিকে শেষ যখন দেখেছে এই সেই ফীবি নয়। কিশোর বয়সে যে মেয়েটির ডাগর চোখ দেখে সে মজেছিল একেবারে এই চোখ। পেলব সে চোখে কিশোরীর উচ্ছ্বলতা। বুড়ো এবার উঠে দাঁড়ায়। আর দেরি করা যাবে না। এতগুলো বছর আশা-নিরাশার দোলায় তার জীবন কেটেছে…সে শুধু স্বপ্নই দেখেছে। এক্ষুনি সে একটা আলোময় শরীর দেখল। নিজের সাদা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে সে শুধু চেয়েই থাকে।
অনেক বছর পরে কিশোরী ফীবির ছবিটা তার সামনে ভেসে ওঠে। তার ওই মিষ্টি হাসি…এক ঢাল বাদামি চুল…পোশাকের ওপর একটা নীল শ্যাস। হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই তো সে পিকনিকের দিন পরেছিল। তার চলন বলন, হাঁটা চলায় কী আভিজাত্য ছিল!
আর দেরি করে না সে। গাছের তলা থেকে সোজা হাঁটা শুরু করে। চোখটা কুঁচকে কষ্ট করে আলোটা কোন দিকে যাচ্ছে দেখার চেষ্টা করে। নিজের বাসন কোসন…লাঠি কিছুই নেয় না সে। আলেয়ার পিছনে সে শুধু ছুটেই যায়। বসন্তের আলেয়া এদিক থেকে ওদিকে পালায় । ফীবির মাথায় যেন আলোর মুকুট। ছোট ছোট অ্যাশ আর বীচ আর হিকরির গাছের গুঁড়ির মধ্যে দিয়ে আলোটা যেন তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তরুনী ফিবি তার টকটক ফর্সা হাত দিয়ে তার হেনরিকে ডাকে। ‘ ও ফীবি! ও ফীবি! তুমি কি আজ সত্যিই এলে? তুমি কি আজ আমার ডাকে সাড়া দিলে!’ আলোর রেখা ধরে পাগলের মতো ছুটতে থাকে বুড়ো মানুষটা, একবার আছাড় খেয়ে পড়ে। কোনো রকমে ঊঠে বার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। আলোটা আবার দূরে সরে যায়। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার রুদ্ধশ্বাস দৌড়। গাছে তার হাত ঘসে যার। জালের মতো হয়ে থাকা গাছের ডালপালায় তার হাত, মুখ বাবার বার ঠোক্কর খায়। তার টুপি কখন যে মাথা থেকে পড়ে গেছে কে জানে। বুকের ভেতর যেন হাপর চলে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। মাথাটা আর কাজ করছে না। উদ্ভ্রান্তের মতো সে শুধু ছুটে চলে। খাড়াই পাহাড়টার ওপরে উঠে তার চোখ চলে যায় আবার নীচে। নীচে রুপোলি আলোয় ঢাকা বসন্তের ভরা আপেল বাগানে ওই যে সেই আলো… ‘ও ফীবি…ও ফীবি এবার আর আমায় ছেড়ে যেয়োনা’। ওই তো সেই জগত যেখানে শুধুই ভালোবাসা…সেখানে মানুষের বয়স বাড়েনা…সেই চির যৌবনের দুনিয়ায় সেও এবার যাবে। ফেলে আসা দাম্পত্যের দিনগুলোর কথা ভেবে চেঁচিয়ে ওঠে সে ‘ ফীবি আর একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি’। তারপর এক ঝাঁপ।
দিন কয়েক পরে এই এলাকারই এক চাষি গাছের গুঁড়িতে বাঁধা বাসন কোসনগুলো দেখতে পায়। তারপর পাহাড়ের নীচে পাওয়া যায় মানুষটার দেহ…হাত পা গুঁড়িয়ে যাওয়া সেই দেহ। কিন্তু মুখে কী প্রশান্তি ! তার ঠোঁটে হাসির আভাস। এতদিনে সেযেন পরম শান্তি পেয়েছে। পরে তার টুপিটাও পাওয়া যায়। কোনো একটা গাছের ডালে আটকে পড়েছিল। এখাকার সাদাসিদে লোকজনেরা বুঝতে পারে না আজ কতদিন পরে মানুষটা তার হারানো সাথীকে ফিরে পেয়েছে। আজ যে তার শুধুই আনন্দ। যে হারিয়ে গিয়েছিল তাকে বুঝি আজ আবার নতুন করে পেল সে।‘ যা হারিয়ে যায়’ গল্পটি থিয়োডোর ড্রেইসারের ‘ দ্য লস্ট ফীবি’ গল্পের অনুবাদ।
-
একটি নীরব মৃত্যু
একটি নীরব মৃত্যু
শেরউড অ্যান্ডারসন(অনুবাদে -বর্ণালী জানা সেন )
১
আমি যে ছোট্ট শহরটায় থাকতাম তার পাশের এক খামারে থাকতেন তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া অতি সাধারণ এক মহিলা। এদের মুখ সবারই খুব চেনা। গাঁয়ে গঞ্জে কি মফস্বলের রাস্তা ঘাটে প্রায়শই এদের দেখা মেলে। কিন্তু কেউ এদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। এমনই এক মহিলা বুড়ো হাড় জিরজিরে এক ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে শহরে এলেন । বোঁচকা বুঁচকি কাঁধে চাপিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতেও পায়ে হেঁটেও এসে থাকতে পারেন। সবই সম্ভব। সঙ্গে গোটাকয় মুরগি। এই মুরগির ডিম বিক্রি করেই তাঁকে পেট চালাতে হয়। একটা ঝুড়িতে ডিম নিয়ে প্রথমে তিনি যান মুদিখানায়। সেখানে ডিম বেচে একটু পর্ক আর বিনস যোগাড় করেন। এক কি দু পাউন্ড চিনি আর আর একটু ময়দাও পেয়ে যান। সেখান থেকে সোজা কসাইখানায়। কুকুরের জন্য একটু মাংসও নিয়ে নেন । এর মধ্যেই দশ কি পনেরো সেন্ট খরচ হয়ে গেছে। এবার একটু মেটে চান তিনি। আগে তো কসাইখানাগুলোতে মেটের কোনো কমতি ছিলনা। চাইলেই একেবারে মুফতে মিলে যেত। আমাদের বাড়িতে তো আগে সবসময় মেটে আসত। ওই পাশে মেলার মাঠে যে কসাইখানাটা আছে সেখান থেকে আমার দাদা তো একবার একটা আস্ত গরুর পুরো মেটেটাই নিয়ে চলে এসেছিল। মাগনার জিনিস কে আর ছাড়ে! খেতে খেতে আমাদের জিভে একেবারে চড়া পড়ে গিয়েছিল। এত মেটে খেয়েছি যে ওই জিনিসটা দেখলেই পরে আমার গা গুলিয়ে উঠত।
কসাইখানায় বলে কয়ে খামারের ওই বয়স্ক মহিলা একটু মেটে আর টেংরিও পেয়ে যান। শহরে কারো সঙ্গে কথা বলতেন না তিনি। নিজের জিনিসগুলো নিয়েই হন্ত দন্ত হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাতেন । এই বয়সে এত ভারি থলে বয়ে নিয়ে যেতে কষ্ট হয় তাঁর। কিন্তু কী আর করবেন তিনি। রাস্তায় এত গাড়ি যায়। কেউ তাঁকে একবারও বলেনা… ‘আসুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিই’। অমন সাদামাটা বয়স্ক একটা মানুষের দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ।
সেবার গ্রীষ্মে এমনই এক মহিলা আমাদের শহরে এসে ঘাঁটি গাড়লেন। আমি তখন খুব ছোট। আর বেতো জ্বরে খুব ভুগছিলাম। শহরে বিকি কিনি সেরে তিনি বাড়ির দিকে চললেন। তার পেছন পেছন দু তিনটে কুকুর। খ্যাংরাকাঠি চেহারা।
মহিলাকে নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। এমন শত শত নামহীন, গোত্রহীন না-চেনা মুখের সারি আমাদের সামনে রোজ ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কেন জানিনা ওই মহিলা কথা আমার মনে একেবারে গেঁথে গেল। আজ এতদিন পর তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। আর সেই বীভৎস ঘটনার কথা তো আমি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। সে এক নিদারুণ কাহিনি। চাইলেও ভোলা যায় না। পরে জেনেছিলাম ভদ্রমহিলার নাম গ্রাইমস। আমাদের শহর থেকে চার মাইল দূরে এক খাঁড়ির কাছে ভাঙা চোরা রংচটা ছোট্ট বাড়িতে স্বামী আর আর ছেলের সঙ্গে থাকতেন তিনি।
তাঁর স্বামী আর ছেলে দুজনেরই গুণের কোনোও ঘাটতি নেই! ছেলে এই একুশ বছর বয়সেই একবার শ্রীঘরের হাওয়া খেয়ে এসেছে! মহিলার মরদ নাকি ঘোড়া চুরিতে একেবারে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। শহরে এ নিয়ে খুব ফিসফাস । তা তিনি নাকি এর ওর বাড়ি থেকে ঘোড়া চুরি করে অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে বেচে দেন। যখনও কারও বাড়ি থেকে ঘোড়া চুরি যায় তখন তিনি স্রেফ বেপাত্তা হয়ে যান কিছুদিনের জন্য। কিন্তু হাতে নাতে কেউ তাঁকে ধরতে পারে না। একবার আমি কোনো একটা কাজে টম হোয়াইটহেডদের আস্তাবলে গিয়েছিলাম। দুলকি চালে লোকটা এল সেখানে। এসে বসল সামনের একটা বেঞ্চে। বেঞ্চে আগে থেকেই দু তিন জন বসে গল্প করছিল। কেউ অবশ্য তাঁর দিকে ফিরেও চাইল না। কোনো উচ্চবাচ্যও নয়। কারো কাছ থেকেই পাত্তা টাত্তা নে পেয়ে উঠে গেল লোকটা। যাওয়ার সময় এবার পিছন ঘুরে একটু বাঁকা হাসিও ছুঁড়ে দিয়ে গেল। তার চোখে অদ্ভূত একটা অবজ্ঞা…যেন সে বলতে চায় ‘ আমি যেচে তোমাদের সঙ্গে ভাবসাব করতে এসেছিলাম। তোমরা কেউ আমার সঙ্গে একটা কথাও কইলে না। শহরের সবাই আমায় এমনই অছেদ্দা করে। তারপর একদিন যখন তোমাদের কারো না কারো বাড়ি থেকে ঘোড়া উধাও হয়ে যাবে তখন আমায় দুষতে এসোনা কিন্তু’। তবে এ সবই আমার অনুমান। লোকটা কোনো কথাই বলেনি। ওর ওই আগুন-চোখের ভাষায় আমি একটা কথাই পড়তে পেরেছিলাম… ‘ এক ঘুষিতে তোমাদের গাল ফাটিয়ে দেব’। ওর ওই চাউনি দেখে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল। এখনো যেন আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি।
লোকটা কিন্তু পয়সাওলাবাড়ির ছেলে। ওহ এখন আমার মনে পড়ছে লোকটার নাম জ্যাক গ্রাইমস। তার বাবা জন গ্রাইমসের করাতকল ছিল একখানা। গ্রামের দিকে তখন প্রচুর গাছপালাও ছিল। ব্যবসা ভালোই জমে উঠেছিল। তারপর কাঁচা পয়সা হাতে এলে যা হয়! মদ আর মেয়ে মানুষের নেশাতে উড়ে পুড়ে গেল সব। এইভাবেই একদিন সে মরল। সম্পত্তির বাকি যেটুকু ছিল তা ঊড়িয়ে দিল ছেলে। কাটার জন্য আর বিশেষ গাছপালাও রইল না গ্রামে। দেনার দায়ে জমিজমা সব গেল।
বউটাকে সে পেয়েছিল এক জার্মান চাষির বাড়িতে। জুন মাসের কোনো একদিন সেই চাষির বাড়ি গম কাটতে গিয়েছিল সে। সেই চাষির বাড়িতেই দেখা হল কচি মেয়েটার সঙ্গে। সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকে মেয়েটা। মরতে তার দারুণ ভয়। আমার ধারণা ওই চাষির কেনা বাঁদী ছিল মেয়েটা। আর চাষির স্বভাব চরিত্তিরও সুবিধের নয়। মওকা পেলেই মেয়েটার সঙ্গে লটঘটের চেষ্টা চালিয়ে যায়। চাষি বউ সব টের পায়। মন থেকে সন্দেহ তার যায় না। বর বাড়িতে না থাকলে সে যত ঝাল ঝাড়ে নিরীহ মেয়েটার ওপর। সেদিন কেনাকাটা করতে চাষিবউ গিয়েছিল শহরে। মেয়েটার সঙ্গে একটু ফস্টিনস্টি করার এই তো সুযোগ! জ্যাকের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন মেয়েটা বলেছিল ওই চাষির সঙ্গে তার কোনো লেনাদেনাই নেই। কিন্তু জ্যাক একথা মন থেকে বিশ্বাস করতে পারেনি।
মেয়েটাকে খুব সহজেই হাতের মুঠোয় পেয়ে গিয়েছিল জ্যাক। তবে ওই চাষি যদি তাকে পালানোর পথটা দেখিয়ে না দিত তবে তার জীবনেও মেয়েটাকে বিয়ে করা হত না। সেদিনও রাতে সে চাষির বাড়িতে রাতে গম ঝাড়াই করছিল। মেয়েটাকে নিয়ে ছোট একটা ছ্যাকরা গাড়িতে করে একটু ঘুরেফিরেও এল। আবার পরের রোববার রাতে সে হাজির।
চাষির নজর বাঁচিয়ে মেয়েটি ঘরের বাইরে বেরোয়। তারপর যেই সে গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি মূর্তিমান বিভীষিকার মতো মালিক এসে হাজির। অন্ধকারে চারদিকে ভালো করে ঠাওর করা যায় না । কিছু বোঝার আগেই লোকটা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে লাগামটা হাতে টেনে নেয়। ওদিকে জ্যাক ঘোড়ার চাবুকটা টেনে বের করে। এবার শুরু হয় দুজনের লড়াই। চাষি সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। তার গায়ে বেশ তাকত। বউ জানতে পারল কি না পারল তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। ওদিকে জ্যাক লোকটার মুখে মারে চাবুকের এক বাড়ি। ভয় পেয়ে ঘোড়া ছুটতে শুরু করে। লোকদুটো তখন মারামারি করতে করতে কোথায় যে গেল মেয়েটি আর দেখতে পায়নি। ওদিকে ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। কোনোদিকে খেয়াল নেই। গাড়িতে মেয়েটা একা। পাগলা ঘোড়াটাকে কিছুতেই থামাতে পারে না সে। ভয়ে বুক কাঁপে। প্রায় এক মাইল ছোটার পর কোনো রকমে থামানো যায় ঘোড়াটাকে। মেয়েটি রাস্তার ধারে একটা গাছে ঘোড়াটাকে বেঁধে একটু হাঁফ ছাড়ে ( এত কথা আমি আমি কী করে জানলাম? মাঝে মাঝে আমারই অবাক লাগে। ছোট শহরে সবাই সব কথা জানতে পারে। সেই ছোট থেকে এর ওর কাছ থেকে টুকরো টাকরা কথা শুনে গল্পটাকে জোড়া লাগিয়েছি আমি।)
জার্মান চাষিটাকে আচ্ছা সবক শিখিয়ে মেয়েটাকে খুঁজতে শুরু করে জ্যাক। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝে মেয়েটিকে পেয়েও যায়। গাড়ির ভেতর গুটিসুটি মেরে বসে আছে মেয়েটি। ভয়ে মুখ সাদা। মনের সব কথা মেয়েটি উজাড় করে দেয় জ্যাকের কাছে। মালিক তাকে দিনরাত জ্বালিয়ে মারত। তার ওপর জোর জুলুম করার চেষ্টাও করেছে অনেক। মালিকের লোভের হাত থেকে বাঁচতে আস্তাবলে গিয়ে লুকোতে হয়েছে তাকে। আরো অনেক কীর্তি করতেছে সেই লোক। বাড়িতে তারা দুজনেই ছিল সেদিন। চাষিবউ গিয়েছিল শহরে। কেনাকাটা করতে। সেই মোক্ষম সু্যোগে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মালিক। জোর করতে গিতে তার জামাটাকে সামনে থেকে টান মেরে পুরো ছিঁড়ে দেয়। সেই সময় গেটের কাছে চাষিবউয়ের গাড়ির আওয়াজ না পেলে তার আর মান ইজ্জত থাকত না সেদিন। বউকে লুকিয়ে খিড়কির দরজা দিকে পালায় সেই শয়তান। যাওয়ার আগে মেয়েটিকে তার রীতিমতো শাসানি… ‘মুখ খুললে জানে মেরে দেব’। অগত্যা মিথ্যেই বলতে হয়। আস্তাবলে ঘোড়াগুলোকে খাওয়ানোর সময় ধ্বস্তাধ্বস্তিতে জামা ছিঁড়েছে। আর কী করতে পারত সে! কোথায়ই বা যেত। জন্ম থেকে থেকে সে যে কেনা গোলাম। বাপ মা নেই। খুব সম্ভবত তার বাপেরও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমার কথা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
এই দাসী বাঁদীদের ওপর কী যে অত্যাচার চলে সে আর বলার নয়। তারা জন্ম থেকে অনাথ। যেন দাসত্ব করার জন্যই তাদের জন্ম। তখনকার দিনে তো আর এত অনাথাশ্রম ছিল না। অন্যের বাড়িতে বাঁদীগিরি করেই জীবন কাটে এদের। মেয়েটি যে পালাতে পেরেছিল…সে নেহাতই বরাতজোরে।২
জ্যাককেই বিয়ে করে মেয়েটি। দুটো ছেলেমেয়েও হয় তাদের। তবে মেয়েটি বেশিদিন বাঁচেনি। বাড়িতে গাদা খানেক পোষা পশু পাখি। তাদের খাওয়ানোর কাজটা মেয়েটিকেও নিতে হয়। জার্মান মালিকের বাড়িতে মালিক…মালকিনের জন্য তাকেই রাঁধা বাড়া করতে হত। চাষিবউয়ের বেশ শক্ত পোক্ত পেটানো চেহারা। তিনি স্বামীর সঙ্গে খেতে কাজ করতেই ব্যস্ত। তাঁদের খাইয়ে গোয়াল ঘরে গরু, শুয়োর, ঘোড়া… মুরগি সব্বার মুখে খাবার তুলে দিতে হত তাকে। প্রতিদিন সেই একই রুটিন। প্রতি মুহূর্তে। অন্যের পেট ভরাতেই কেটে গেছে তার সারা কৈশোর…যৌবন।
বিয়ের পর স্বামীর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্বও চাপল। এমনিতে তার রোগা ক্ষয়াটে শরীর। বিয়ের তিন চার বছরের মধ্যে দুই সন্তানের জন্ম দিয়ে চেহারা তার একেবারে ভেঙে পড়ল। তার কাঁধ দুটো এখন নুয়ে আসে।
খাঁড়ির ধারে বাপের পরিত্যক্ত করাতকলের কাছেই জ্যাকের বাড়ি। জ্যাকের ইয়াবড় বড় কয়েকটা কুকুর বাড়ির পাশেই ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ। চুরি চামারি না করলে জ্যাকের একটাই কাজ। ঘোড়া কেনাবেচা। বেশ কয়েকটা হাড় জিরজিরে ঘোড়া আছে তার কাছে। চারটে শুয়োর আর এক একটা গরুও পুষেছে সে। বাড়ির আশে পাশে যেটুকই ঘাস-জমি আছে সেখানেই চরে খায় পশুগুলো। কোনো কাজ করতে চায় না জ্যাক। একেবারে অকম্মার ঢেঁকি।
একটা গম ঝাড়াই যন্ত্রের জন্য বেশকিছু টাকা ধার করেছিল সে। যন্ত্রটা চলেওছিল বেশ কয়েক বছর। কিন্তু লোকের দেনা শোধ করেনি সে। কেউ তাকে আর বিশ্বাস করে না। সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে পাছে সে রাতের অন্ধকারে গোলাঘর থেকে ফসল চুরি করে নিয়ে যায়! আশে পাশে সেকোনো কাজ পায়না। কাজের খোঁজে যেতে হয় অনেক দূরে। সেখানে আবার রাহা খরচে পোষায় না। শীতের সময় সে এটা ওটা শিকার করে বেড়ায়। আর জ্বালানির কাঠ কাটে। সেগুলো পাশের শহরে বিক্রি করে আসে।
ছেলে বড় হয়ে এক্কেবারে বাপেরই স্বাভাব পায়। বাপ ছেলে দুজনেই একসঙ্গে মদ গেলে। বাপ বেটা মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে বাড়িতে খাবার দাবার না পেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। বাপ তো আরো সরেস চিজ। মেরে বউয়ের মাথা ফাটিয়ে দেয়। লুকিয়ে চুরিয়েকয়েকটা মুরগি পুষেছিল বুড়ি। বাপ বেটার মুখে খাবার জোগাতে প্রতিবারই একটা না একটা মুরগি জবাই করতে হয়। সবকটা মুরগিকে মেরে ফেললে কী করে চলবে তার? এই মুরগির ডিম বেচেই তো তাকে শহর থেকে জিনিসপত্র আনতে হয়। এরাই যে তার শেষ ভরসা!
সবার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে সারা জীবন গেল তার। শুধু খাওয়ানো আর খাওয়ানো। জীবনে আর কিছু নেই তার। শুয়োরগুলোকে ভালো করে না খাওয়ালে তাদের গায়ে গত্তি লাগবে কী করে! ওগুলো একটু নাদুস নাদুস হলে তবেই না শীতের শুরুতে মাংস বেচে দুটো পয়সা ঘরে আসবে। শুয়োর কাটা হলেই তার মরদ বেশিরভাগ মাংস কেড়ে নেয়। তারপর বেচতে চলে যায় শহরে। কখনো কখনো বাপের আগে এসে মাংশে ভাগ বসায় ছেলে। মাংস নিয়ে শুরু হয় তাদের কাড়াকাড়ি…তারপর হাতাহাতি…ঘুসোঘুসি। বাপ ছেলের মারপিট দেখে থরথরিয়ে কাঁপে সে।
তবে এখন এসব তার সয়ে গেছে। গায়ে লাগে না আর। সে মুখও খোলেনা কোনোদিন। নীরবে শুধু নিজের কাজ করে যায়। জীবনটাকে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে এই চল্লিশ বছরেই কেমন বুড়িয়ে গেল সে। বাপ আর ছেলে প্রায়ই বাড়ি থাকে না। তাদের আর কী! হয় চুরি চামারি, নয়তো ঘোড়া বিক্রি…আর তা না হলে মদের ঠেক। এই ফাঁকা বাড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে নিজের মনেই বিড়বিড় করে সে। কী করে সে সবার খাবার জোগাবে…এই চিন্তাতেই পাগল পাগল লাগে। কুকুরগুলোকে খেতে দিতে হবে। গোলাঘরে অল্প কিছু খড় পড়ে আছে। তা দিয়ে গরু আর ঘোড়াগুলোর পেট কি আর কি ভরবে! মুরগীগুলোকে ভালো করে না খাওয়াকে ওরা ডিম দেবে কীভাবে? তবে একটাই যা বাঁচোয়া। স্বামীদেবতাটির শরীরের খিদে এখন আর তাকে মেটাতে হয় না। বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরে ওসব তাদের চুকে বুকে গেছে। মাঝে মাঝে বেশ কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যায় জ্যাক। কোথায় যায়…কী করে সে জানতেও পারে না। তারপর ছেলেটা বড় হতে সেও বাপের সঙ্গ ধরল।
বাড়িতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার কোনো খবর বাপ বেটা রাখেনা। তার একার কাঁধে স…ব। ওদিকে হাতে একটা পয়সা নেই। কী করে টানবে সে এই সংসারের জোয়াল। আশে পাশে কাউকে সে চেনে না। শহরে কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। শীতের সময় ঘর গরম রাখতে খড়কুটো কুড়িয়ে বেড়ায়। ঘরে যেটুকু খাবার আছে পশুপাখিগুলোকে দিয়ে দেয়। তাতে তাদের পেট ভরে না। গোয়াল ঘরে পশুপাখিগুলো খিদেয় কঁকিয়ে ওঠে। আর কুকুরগুলো খাবারের জন্য তার পিছু পিছু ঘোরে। শীতে এবার মুরগীগুলো এবার খুব অল্প ডিম দিল। শীতে মুরগীগুলো গোলাঘরের এক কোনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। আর তাকে আঁতি পাঁতি করে ডিম খুঁজতে হয়। এই শীতে ডিমগুলো একেবারে বরফের মতো জমে গিয়ে ভেঙে যায়।
এমনই এক শীতের দিনে কয়েকটা ডিম হাতে নিয়ে সে যায় শহরের দিকে। কুকুরগুলোয় তার পিছু নেয়। ঘরে সব গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে তিনটে বেজে গেল তার। বরফ পড়তে শুরু করেছে ততক্ষনে। কয়েকদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিজের মনে বিড়বিড় করে যায়। তার গায়ে কোনো গরম জামাকাপড় নেই। কাঁধ দুটো নুয়ে পড়েছে। গমের একটা বস্তায় ডিমগুলো নিয়ে বেরিয়েছে সে। এই কটা ডিম অতবড় থলের নীচে কোথায় যে হারিয়ে গেল! তবে এই শীতে ডিমের ভালো দাম পাওয়া যায়। ডিমগুলো বেচে আজ খানিকটা পর্ক, অল্প চিনি সে কিনে নিতে পারবে। একটু আধটু কফিও হয়ে যাবে হয়তো। কসাইখানায় গেলে দোকানদার হয়তো তাকে একটু মেটেও দিয়ে দিতে পারে।
শহরে সে যখন দোকানে দোকানে বিকিকিনি করতে ব্যস্ত তখনও তাকে বাইরে থেকে পাহারা দিয়ে যায় তার কুকুরগুলো। আজকের সওদা তার ভালোই হল। যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি জিনিসই পেয়েছে। এবার সে যায় কসাইখানায়। দোকানদার দয়া করে মেটে আর কুকুরের জন্য একটু মাংস দিয়ে দেয়। আজ এতদিন পরে এই দোকানদারই প্রথম তার সঙ্গে দুটো ভালো করে কথা বলল। সে যখন আসে তখন দোকানদার একা। এমন ঠান্ডার দিনে এই বয়স্ক মানুষটা কেন যে ঘর থেকে বেরোতে গেল ভেবেই একটু বিরক্ত হয় দোকানদার। তার ওপর মানুষটাকে কেমন যেন রুগ্ন আর ফ্যাকাশে লাগছে। মারাত্মক ঠান্ডা আজ। তারপর বরফ পড়ারও কোনো বিরাম নেই। দুপুরের দিকে একটু থেমেছিল বটে। এখন আবার লাগাতার শুরু হয়েছে। এমন একটা দিনে এই অসুস্থ মানুষটাকে কেউ বাইরে বেরোতে দেয়! মহিলার স্বামী আর ছেলেকে শাপ শাপান্ত করে দোকানদার। মহিলা একটু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে দোকানদারের দিকে। দোকানদার বলেই চলে মহিলাকে। ভাগ্যিস তিনি এসেছেন। তাঁর বদলে তাঁর ছেলে বা স্বামী যদি মেটে বা টেংরি কি মাংস নিতে আসত তাহলে সে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত তাদের। ওদের উপোস করে মরাই ভালো।
উপোস করে মরা? না না তা কী করে হয়! সবাইকে খেতে দিতে হবে যে। বাড়ির মানুষগুলোকে খেতে দিতে হবে। তারপর রয়েছে ঘোড়াগুলো। ওগুলো যদিও বিশেষ কোনো কম্মের নয়। তবুও দানাপানি তো দিতে তবে। খেতে না পেয়ে গরুটার হাড় পাঁজরা সব বেরিয়ে গেছে। তিন মাস দুধ দেয়নি।
সবার পেট ভরাতে হবে তাকে…ঘোড়া, গরু, শুয়োর, কুকুর, মানুষ…সব্বার।৩
অন্ধকার নামার আগে তাকে যে করেই হোক বাড়ি ফিরতে হবে। তাড়াতাড়ি পা চালায় বুড়ি। তার পিছু পিছু কুকুরের দল। বুড়ির পিঠে ঝোলানো ভারি থলেটার গন্ধ পেয়ে গেছে তারা। শহরের বাইরে বেরিয়ে একটা বেড়ায় ঠেসান দিয়ে একটা দড়ি দিয়ে পিঠের সঙ্গে ভালো করে বেঁধে নিয়েছে সে থলেটাকে। জামার পকেটে করে ভেবেচিন্তেই দড়িটা এনেছিল সে। পিঠে না বাঁধলে অত ভারি থলে নিয়ে পথ হাঁটা কি সম্ভব! হাতদুতো ব্যথায় টনটন করছে। কোনো মতে পা টেনে টেনেসে বেড়াটা টপকাতে যায়। শরীর দেয় না। পিঠে আবার অত ভারি বোঝা। উলটে গিয়ে পড়ে বরফের ওপর। মাংসের গন্ধে ছোঁক ছোঁক করে কুকুরগুলো। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় সে। বেড়াটা টপকাতে পারলে পাহাড় আর বনের ভেতর দিয়ে বাড়ি পৌঁছনোর একটা সহজ পথ আছে। ওটা ধরতে পারলে শহরের মধ্যে আর বেশি ঘুরপাক খেতে হবে না। সে কি সত্যিই আজ বাড়ি পৌঁছতে পারবে! ভয়ে গা শিউরে ওঠে তার। তাহলে যে পশু পাখিগুলো না খেয়ে মরবে। বাড়িতে একটু খড় বিচালি আর কয়েক মুঠো ভুট্টা বই তো আর কিছু নেই। বাপ বেটা কিছু আনলেও আনতে পারে। তারা তো সকালেই ছ্যাকরা গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছে। গাড়িটা যেমন লড়ঝরে তেমনি তার ঘোড়াটাও…উপোসী হাড় জিরজিরে চেহারা। গাড়ির পেছনে আরো দুটো দুবলা পাতলা ঘোড়া বাঁধা। এই একটা গাড়িই এখনও টিকে আছে গ্রাইমসদের। ঘোড়াগুলো বিক্রি করে হয়তো ওরা দুটো পয়সা আনতে পারে ঘরে। তবে ফিরবে তো আকন্ঠ গিলে। না না ওদের আগেই বাড়ি ফিরে খাবার দাবার বানিয়ে রাখতে হবে।
ছেলের তো আবার মতি গতি ভালো নয়। পাশের গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে খুব আশনাই হয়েছে তার। সে গ্রাম আবার পনেরো মাইল দূরে। সে মেয়েও অত সোজা নয়। কেমন যেন রুক্ষ…কাঠ কাঠ চেহারা। কোনো লাবণ্য নেই শরীরে। গেল গ্রীষ্মে মেয়েটাকে একবার ঘরে এনে তুলেছিল ছেলে। বাপ তখন বাড়িতে ছিল না। ছেলে আর তার ওই পীরিতের মেয়েছেলেটা মদ গিলতে গিলতে তার সঙ্গে যা তা ব্যবহার করেছিল। এই লাও…অই আনো। মা কি তোদের চাকর বাকর নাকি! তবে মুখে কিছুই বলেনি সে। মুখ বুজে সব হুকুম তামিল করে গেছে। এখন সে বোবা হয়ে গেছে একদম। সেই কিশোরী বেলায় যবে সে জার্মান চাষির বাড়িতে বাঁদি হয়েছিল তারপর বিয়ের এই এতগুলো বছরে কোনোদিন সাত চড়েও রা কাড়েনি সে। নীরবে করে গেছে নিজের সব কাজ। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার এটাই মন্ত্র তার। তারপর ছেলে তো মেয়েটাকে রাতে নিজের বিছানায় তুলল…যেন কতকালের বিয়ে করা বউ। তাতেও কিছু মনে হয়নি তার। কোনো কষ্টও নয়। কষ্টের বোধটা তার তার অনেককাল আগেই মরে গেছে।
খোলা মাঠের মধ্যে পুরু বরফের চাদর ঠেলে পা টেনে টেনে এগিয়ে চলে বুড়ি। পেছনে কুকুরের দল। পাহাড়ের ঠিক ওপারে যেখানে ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে সেখানে একটা ফাঁকা জমি দেখা যায়। কেউ হয়তো ঘরবাড়ি করার জন্য গাছপালা কেটে পরিষ্কার করেছিল। কে জানে! এই এতখানি জমিতে বাগানওলা বিশাল একখানা বাড়ি হয়ে যেত…ঐ শহরের বাড়িগুলোর মতো। ওই ফাঁকা জমিটার পাশ দিয়ে চলে গেছে পায়ে চলার গুঁড়ি পথ। এত দূরে এসে বুড়ির পা আর চলে না। ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে আসে। একটা গাছের নীচে খানিক বিশ্রাম নিতে বসে সে। কিন্তু এখানেই যে চরম বোকামিটা হয়ে যায়। গাছের গুঁড়িতে পিঠের বোঝাটা নিয়ে বসে আরামে চোখ বুজে আসে। আর ওঠার মতো পায়ে জোর পায় না সে। চিন্তায় পড়ে যায় সে। এত পরিশ্রম আর ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। খানিকক্ষণের জন্য ঘুমিয়েও পড়ে সে। প্রবল ঠাণ্ডায় হাত পায়ের সাড় চলে গেলে ঠান্ডার বোধও বুঝি আর থাকে না। দুপুরে একটু ঠান্ডাটা কম ছিল। তার আবার শুরু হয়েছে বরফ পড়া। এখন আবার আকাশটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। বরফ ঢাকা প্রান্তরে রুপো গলে গলে পড়ছে।
বাড়ির চারটে কুকুর বুড়ির পিছু পিছু শহরে গিয়েছিল। ইয়া লম্বা কঙ্কালসার চেহারা তাদের। জ্যাক গ্রাইমস আর ছেলের বাড়িতে এমন কুকুরই মানায় বটে। শত লাথি ঝাঁটা মারো…ঠিক এখানেই পড়ে থাকবে। কিন্তু তাদেরও তো খিদে আছে। তাই মাঝেই মাঝেই তাদের এখান ওখান থেকে খাবার দাবার চুরি করতে হয়। খোলা জায়গাটার পাসে গাছে ঠেসান দিয়ে বুড়ির চোখটা যখন একটু লেগে গিয়েছিল তখন তারা ছিল নিজেদের তালে। জঙ্গলে…পাশের জমিতে দু একটা খরগোশ শিকারের জন্য ছটাছুটি করছিল তারা। কোত্থেকে আরও তিনটে কুকুর এসে জুটেছে তাদের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর আবার খোলা জায়গাটায় ফিরে এল তারা। তাদের মধ্যে কীসের যেন ছটফটানি। এমন এমন ঠান্ডা কনকনে চাঁদ ধোয়া রাতে কুকুররা বোধহয় মাথার ঠিক রাখতে রাখতে পারে না। এমন রাতে তারা বুঝি মত্ত হয়ে ওঠে। এটা আজকের কথা নয়। সেই অনেক কাল আগে যখন তারা নেকড়ে ছিল তখন থেকেই তারা নিজেদের রক্তে বয়ে আনছে এই আদিম প্রবৃত্তি। এমন শীতের রাতে জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ানোর সেই পুরোনো অভ্যেস আজ যেন আবার ভর করল তাদের।
বুড়ির সামনেই দু তিনটে খরগোশ ধরে এখনকার মতো খিদে মিটিয়ে নিয়েছে তারা। পেটের জ্বালা আর নেই। মন এখন তাদের চনমনে। খোলা জায়গাটায় গোল করে ঘুরে ঘুরে তারা অদ্ভূত এক খেলা শুরু করে দেয়। গোল হয়ে ঘুরেই যায় তারা। সামনের কুকুরটার লেজের কাছের পরের কুকুরটার নাক…তাদের পথ একেবারে গোল। খোলা জায়গাটায় বরফে ঢাকা গাছের নীচে রুপোগলা রাতে তাদের এই অদ্ভূত খেলা মনে ধাঁদা লাগিয়ে দেয়। নীরবে গোল গোল হয়ে ঘুরেই যায় তারা। তাদের পায়ের ছাপ পড়ে বরফে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। সব নিঝুম।
দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে বুড়ি হয়তো এই দৃশ্য দেখেছিল। ঘুমোতে ঘুমোতে দু একবার হয়তো চোখ খুলেছিল তার। তখনই হয়তো ঘুম জড়ানো ঘোলা চোখে সে দেখে এই দৃশ্য। এখন আর অত ঠান্ডা লাগছে না তার। চোখ দুটো খালি বুজে আসছে। এই এতগুলো বছর জীবনটাকে বয়ে বয়ে সে ক্লান্ত। কী জানি… তার মাথাটাও বুঝি কাজ করছিল না সেসময়। স্বপ্নে হয়তো ফিরে এসেছিল তার ছেলেবেলা…ঐ জার্মান চাষির বাড়িতে তার বাঁদীগিরির দিনগুলো…হয়তো বা সেই কতকাল আগের শৈশবের কথা…মা-টা কেমন ছেড়ে চলে গেল তাকে! এই হাবিজাবি স্বপ্নই হয়তো সে দেখেছিল… ভালো কিছু নয়। তার জীবনে ভালো কিছু ঘটেছেই বা কবে! মাঝে সাঝে তার দু-একটা কুকুর দল ছেড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। কুকুরটা তার গন্ধ শুঁকে দেখেছিল আর লকলক করে উঠেছিল সেটার জিভ।
গোল হয়ে কুকুরগুলো ঘুরেই চলেছিল… যেন কোনো মৃত্যুর উৎসবে মেতেছে তারা। তারা যেন নিজের মধ্যে নেই। নিজেদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা নেকড়ের আদিম সত্ত্বা আজ এই মায়াবি রাতে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াছে। গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে একটু আশংকাও জাগে মনে। যেন কিছু বলতে চায় ওরা… ‘ আমরা কিন্তু এখন আর নেকড়ে নই। আমরা এখন কুকুর হয়ে গেছি। মানুষের ভৃত্য। মানুষ তুমি বেঁচে থাকো…তুমি মরে গেলে যে আমরা আবার নেকড়ে হয়ে যাব’।
এরই মধ্যে একটা কুকুর বুড়ির কাছে এসে তার মুখে নাক ঠেকিয়ে দেখে। তারপর খুশিমনে আবার চলে যায় নিজেদের দলে। আবার শুরু করে তাদের সেই বীভৎস নাচ। বুড়ি মরার আগে অবধি কুকুরগুলো এভাবেই নাচানাচি করেছিল। এসব কথা আমি পরে জেনেছি। বড় হওয়ার পরে এমনই এক শীতের রাতে ইলিয়নিসের এক জঙ্গলে আমিও কুকুরদের এই উন্মত্ত নাচ আমি দেখেছি। আমার মরার জন্য ওরা অপেক্ষা করছিল। আমার ছোটবেলায় এক বুড়ির মৃত্যুর জন্য ওরা ঠিক একই ভাবে ওঁত পেতে দাঁড়িয়েছিল। আমি যখন এই ঘটনার মধ্যে পড়ি তখন আমি রীতিমতো জোয়ান। শরীরে টগবগে রক্ত। মরার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমার।
সারা জীবনের মতো বুড়ির মৃত্যুটাও ছিল আশ্চর্য নীরব। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল বুড়ি। আবার একটা কুকুর এসে বুড়িকে শুঁকে দেখে। বুড়ি মরে কাঠ। নাচ থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গ্রাইমসদের কুকুরগুলো। তারা বুড়িকে ঘিরে দাঁড়ায়। বুড়ির দেহে যতদিন প্রাণ ছিল সব কুকুরকে সে খাইয়েছে। কিন্তু এবার কী হবে? বুড়ির পিঠে ভারি থলেটা বাঁধা। তার মধ্যে লোভনীয় সব জিনিস…নুন মাখানো পর্ক, মেটে, মাংস আর টেংরি। আজ জীবনের শেষ দিনে কসাইখানার লোকটা বুড়ির থলে একেবারে ভরে দিয়েছিল। বোধহয় একটু দয়া হয়েছিল তার। বুড়ি বেশ ভালো একটা দাঁও মেরেছিল আজ।
আবার এখন দাঁও মারার পালা… এবার কুকুরদের।৪
একটা কুকুর লাফিয়ে চলে যায় বুড়ির কাছে। আঁতি পাঁতি করে খোঁজে বুড়ির পিঠের থলে। আবার যে যেন তারা নেকড়ে হয়ে যায়। নেকড়দের দলে একজন নেতা থাকে সবসময়। তার সঙ্গে পোঁ ধরে বাকিরা। নেতাকে দেখে বাকিরাও বুড়ির পিঠে বাঁধা থলেতে আমূল দাঁত বসিয়ে দেয়। তারপর বুড়ির প্রাণহীন শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় খোলা জায়গাটায়। বুড়ির ময়লা তালি মা্রা জামাটা কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে একেবারে ফর্দাফাঁই হয়ে যায়। দু একদিন পরে বুড়ির দেহ যখন পাওয়া গেল তখন তার জামাটা ছিঁড়ে একসা। কোমরের কাছে শুধু একখণ্ড কাপড়। কুকুরগুলো তার শরীরে অবশ্য কোনো থাবা বসায়নি। থলেটা ছিঁড়ে খুড়ে তারা শুধু মাংসটা বের করে নিয়েছিল। বরফে কুঁকড়ে জমে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল দেহটা। তার সরু রোগাটে কাঁধটা দেখে মনে হয়েছিল সদ্য কিশোরী। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মধ্য পশ্চিমে খামার লাগোয়া শহরগুলোতে এমন ঘটনা মাঝেই মাঝেই ঘটত। বুড়ির দেহটা খুঁজে পায় এক শিকারি। বনে খরগোশ শিকারে বেরিয়ে বরফে ঢাকা খোলা জায়গাটায় দেহটা দেখতে পায় সে। তবে লাশটা সে স্পর্শও করেনি। কেমন যেন বেকুব বনে গিয়েছিল সে। বুড়ির থলেটা খাবলে খুবলে কুকুরগুলো তার দেহটা যেখানে এনে ফেলেছিল সে জায়টায় কেমন যেন এক অতিপ্রাকৃত নৈঃশব্দ। গা ছমছম করে ওঠে শিকারির। কোনো মতে ছুটে চলে আসে শহরে।
আমি তখন এক দাদার সঙ্গে বড় রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাদা এই শহরে খবরের কাগজ ফিরি করে। দাদা তখন বিকেলের কাগজ ফিরি করছিল দোকানে দোকানে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় সেই শিকারি ছুটতে ছুটতে মুদিখানায় এসে একনিঃশ্বাসে বলে যায় তার কাহিনী। তারপর সে যায় যন্ত্রপাতির দোকানে…সেখান থেকে ওষুধ দোকানে। কথটা চাউর হতেই রাস্তাঘাটে লোক জমে যায়। তারা সবাই মিলে ছোটে জঙ্গলের দিকে। দাদাও ছুটল তাদের সঙ্গে। কাগজ ফিরি করা মাথায় উঠল তার। যে পারে সে এসে জুটল এই দলে। আন্ডারটেকার* আর টাউন মার্শালও চলে এলেন। কেউ কেউ আবার ঘোড়ার গাড়িও জুটিয়ে ফেলল। কিন্তু বড় রাস্তাটা যেখানে বনের দিকে বেঁকে গেছে সেখানটা বড় পিছল। বার বার ঘোড়ার পা পিছলে যায়। শেষমেশ দেখা গেল যারা হাঁটাপথ ধরেছিল তারাই পৌছেছে আগে।
আমাদের টাউন মার্শালের বেশ লম্বা চওড়া মানুষ। গৃহযুদ্ধের সময় পায়ে তাঁর একটা আঘাত লেগেছে। একটা বেতের লাঠি নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই চললেন তিনি। আমি আর দাদা চললাম তাঁর পিছু পিছু। তারপর এত লোকজনের জটলায় মিশে গেলাম। শহর থেকে যে পথ ধরে বুড়ি বনে ঢুকেছিল সেই পথে এলাম আমরা। আজও আকাশে ভরা চাঁদ। রুপোলি আলোয় ভেসে যায় চারিদিক। মার্শালের মনে সন্দেহ। খুন টুন নয়তো? শিকারিকে তিনি তো রীতিমতো জেরা শুরু করে দিলেন। শিকারি কাঁধের ওপর বন্দুকটা চড়িয়ে বেশ হামবড়া ভাব দেখিয়ে যায়। তার পিছনে পিছনে একটা কুকুর। আজ সে একজন কেউকাটা। খরগোশ শিকার করে বেড়ানো একটা সামান্য জীবনে এত গুরুত্ব কি সে আগে পেয়েছে? আজ সবার দৃষ্টি তার দিকে। সে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে ব্যাপারখানা। টাউন মার্শালের পাশে পাশে সে সবাইকে রাস্তা দেখিয়ে চলে… ‘ আমি তো দেখে কোনো আঘাতের চিহ্ন টিহ্ন দেখিনি। কেমন ফুটফুটে একটা মেয়ে! মুখটা অবশ্য দেখিনি। মুখটা পুরো বরফে গোঁজা। না না আমি ওকে আগে কখনো দেখিনি’। শিকারি আসলে দেহটাকেও ভালো করে দেখেনি। সে ঘাবড়ে গিয়েছিল। কে জানে বাবা কে খুন খুন করে লাশটা এখানে ফেলে রেখে গেছে। সে লাশটা দেখতে গেলে খুনি যদি পিছন থেকে তার ওপরেও ঝাঁপিয়ে পড়ে! শীতের সময় এই ভর সন্ধেবেলা জঙ্গলের ভেতর এমনিতেই গা ছম ছম করে। চারদিকে ন্যাড়া ন্যাড়া সব গাছে…বরফে ঢাকা জমি…মনটা এমনিতেই যেন কু গায়। আশে পাশে যদি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে তাহলে এমনিতেই সেখান থেকে ছুটে পালাতে পারলে বাঁচা যায়।
মাঠ ঘাট পেরিয়ে বুড়ি যেপথ দিয়ে গিলেছিল সেই পথেই মার্শাল আর শিকারি পিছু পিছু দল বেঁধে চলল সব। জঙ্গলের পথে অনেক চড়াই রয়েছে।
আমি আর আমার দাদা একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিলাম। কোনো কথা যোগাচ্ছিল না আমাদের মুখে। দাদার কাধে কাগজের থলে। আবার শহরে ফিরেই তাকে ওগুলো ফিরি করতে বেরোতে হবে। তারপর সে বাড়ি যেতে পারবে। আমরা যদি এদের পিছু নিই তাহলে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। মা বা দিদিকে আমাদের খাবার গরম করার জন্য বসে থাকতে হবে। কিন্তু জঙ্গলে তো যাবই। শেষ না দেখে ছাড়ব না। শিকারি যখন আসে তখন ভাগ্যিস আমি মুদির দোকান ছিলাম! তাই তো খবরটা পেলাম। শিকারি এই আশে পাশের গাঁয়েই থাকে হয়তো। আগে তো কখনো ওকে দেখিনি।
আমাদের দলটা এখন জঙ্গলে ওই খোলা যায়গাটার কাছে চলে এসেছে। এই শীতের দিনে এই বন জঙ্গলে কেমন ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যায়। চাঁদের আলোয় আজ সবকিছু দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। যে গাছটার নীচে বুড়ি মরে পড়েছিল তার কাছেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা দুই ভাই। দেহটা একদম জমে গেছে বরফে। আকাশ চুঁইয়ে পড়া নরম আলোয় মানুষটাকে মোটেই বয়স্ক মনে হচ্ছিল না। আমাদেরই মধ্যে কেউ একজন গিয়ে উপুড় হয়ে থাকা দেহটাকে সোজা করে দিল গিয়ে। সব দেখে ফেললাম আমি। সব। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল আমার সারা গা। সে বিচিত্র এক অনুভূতি। বলে বোঝানো যায় না। আমার দাদাও কেঁপে উঠেছিল। কী জানি হয়তো ঠান্ডার জন্য।
নারী শরীর আর আগে আমরা কোনোদিন দেখিনি। বরফে মোড়া দুধ-সাদা ওই দেহটাকে কী অপূর্ব লাগছিল! যেন শ্বেতপাথর কুঁদে বানানো কোনো দেবী মূর্তি। আমাদের দলে কোনো মেয়েছিল না। একটা লোক এগিয়ে গিয়ে নিজের কোটটা খুলে দেহটাকে ঢেকে দিল। লোকটাকে আমি চিনি। ওই তো আমাদের ওখানকার কামার। ওই লোকটাই দেহটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আবার শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমরা সবাই ফেরার পথ ধরলাম। তখনও আমরা জানতাম না লাশটা কার। কী তার পরিচয়!৫
ওখানে সব দেখেছি আমি। বরফের ওপর একটা গোল মতো পায়ে চলা পথ আমার নজরে এসেছিল…ওই ওখানেই কুকুরগুলো বরফের ওপর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করেছিল। আমি দেখেছি বরফে জমা ধবধবে সাদা দেহটাকে দেখে সবাই কেমন বাক্যহারা বিবশ হয়ে পড়েছিল। আমি শুধু তাদের ফিসফিসানি শুনেছি। কেমন যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল তাদের। জোরে কথা বলার শক্তিটুকুও তারা হারিয়েছিল। আন্ডারটেকারের* ঘরে দেহটাকে নিয়ে যাওয়া হল। কামার, ওই শিকারি, মার্শাল আর আরো কয়েকজন ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। চার্চের ফাদার থাকলে তিনিও ঢুকতেন। কিন্তু আমাদের ছোটদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি মেলেনি।
আমিও দাদার সঙ্গে বাকি কাগজগুলো ফিরি করতে ছুটলাম। বাড়ি ফিরে দাদার মুখ থেকেই পুরো গল্পটা শুনি। আর কোনো কথা বলতে পারিনি সেদিন। চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। দাদা যেভাবে গল্পটা বলেছিল সেটা শুনে ঠিক আমার মন ভরেনি। আমার যে আরো অনেক কিছু জানার বাকি ছিল। পরে শহরের এদিক ওদিক আরো টুকরো টাকরা কথা শুনে আমি একটু একটু করে গল্পটাকে জোড়া দিয়েছি।
কোত্থেকে জানিনা মহিলার স্বামী আর ছেলেকে পুলিশ শহরে ধরে আনে। মহিলার মৃত্যুতে ওদের কোনো হাত ছিল কিনা জানার অন্য অনেক জেরাও হয়। কিন্তু ওরাও কম ঘোড়েল নয়। তারা যে ওইসময় ধারে কাছেও ছিল না তার হাতে গরম প্রমাণ ছিল তাদের কাছে। তবে গোটা শহরের লোকজন ওদের ওপর এত খাপ্পা হয়েছিল যে আস্তানা থেকে ওদের পাতটাড়ি গুটিয়ে পালাতে হয়।
আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে আসে ছবিটা। নিরাবরণ এক নারী শরীর…দুধের মতো সাদা…কিশোরীর মতো গড়ন…পুরু বরফের মধ্যে মুখখানা গোঁজা…বরফের ওপর কুকুরগূলোর পায়ে চলা পথের চিহ্ন…শীতের জ্যোস্নাভেজা রাত…আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়ানো থোকা থোকা সাদা মেঘ…আমার তখন বিহ্বল দশা। এ দৃশ্য কোনোদিন ভুলতে পারব না আমি।
ওইদিন জঙ্গলে যা দেখেছিলাম একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। সে কথা বার বার মনে করেই তো আজ এই সত্যি ঘটনাটা বলতে পারছি। এর তার কথার মধ্যে দিয়ে পুরো গল্পটা জোড়া দিতে পেরেছি অনেক পরে।
সময় গড়িয়ে যায়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বড় হয়ে আমিও এক জার্মান চাষির খামারে কাজে ঢুকেছিলাম। ওখানেও একজন কেনা বাঁদি ছিল। মালিকের ভয়ে সে তটস্থ হয়ে থাকত। মালিকের বউ দিনরাত দুচ্ছাই করতে তাকে। ওখানে কী কী ঘটত সব আমি নিজের চোখে দেখেছি।
তারপর বরফে মোড়া এক শীতের দিনে ইলিয়নিসের ঘন জঙ্গলে কুকুরদের এই বীভৎস উল্লাসও আমি দেখেছি। সেদিনও চাঁদের আলোর বান ডেকেছিল পৃথবীর বুকে।
আমি তখন স্কুলে পড়ি। গ্রীষ্মের একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে খাঁড়ির কাছে গ্রাইমসদের ওই বাড়িটা দেখে আমি। সে এখন ভূতের বাড়ি। কেউ থাকে না । দরজাগুলো সব ভেঙে পড়েছে। জানালার কাচও ভাঙা। বাড়ির পেছন থেকে দুটো কুকুর ছূটে এসেছিল আমাদের দিকে। মনে হয় এই খামারেরই কুকুর। লম্বা…হাড় পাঁজরা বের হওয়া কুকুর দুটো বেড়ার কাছে এসে আমাদের দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়েছিল।
ওই মহিলার মৃত্যর পুরো ঘটনাটা দূর থেকে ভেসে আসা কোনো সঙ্গীতের মতো মনে হয় আমার। সুরগুলোকে শুধু আলাদাভাবে চিনে নিতে হয়। মরমে মরমে উপলব্ধি করতে হয়।
বুড়ি শুধু পশুদের খিদেই মিটিয়ে গেল। জীবন ভর। সারাজীবন ধরে শুধু এই কাজই করেছে সে। হয়তো বা জন্মের আগে থেকেই। তারপর শৈশবে, কৈশোরে জার্মান চাষির খামারে…তারওপর বিয়ের পর স্বামীর ঘরে …এমনকি মৃত্যুতেও শুধু সে পশুদেরই খিদে মিটিয়েছে। মুরগি, শুয়োর, ঘোড়া, আর মানুষের মধ্যে লুকিয়ে জন্তুটার খিদের জ্বালা সেইশান্ত করেছে। মেয়েটা তার জন্মেই মরেছে। ছেলের কাছে থেকেও শুধু লাথি ঝাঁটাই খেয়েছে। মৃত্যুর দিনেও জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে কাঁধে ভারি থলে বইতে বইতে পশুদেহের খিদে মেটানোরই আয়োজন করেছিল সে। আর কিছু ছিল না তার জীবনে। পশুর মতো একটা জীবনই বয়ে বেড়াল সে।
জঙ্গলের ভেতরে একটা খোলা জায়গায় মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ার পরও সে পশুদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে।
এই কথাটাই বার বার মনে বেজেছিল আমার। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে আমার দাদা যখন গল্পটা বলেছিল আমার মা আর দিদি চুপ করে শুধু শুনেছিল। আমরা মনে হয়েছিল দাদা গল্পের আসল রহস্যটাই বোঝেনি। ও তো খালি ঘটনাই বলেছিল। অবশ্য কোনোকিছু তলিয়ে দেখার মতো বয়স ওর হয়নি। তখন আমিও খুব ছোট। কোনো কোনো ঘটনার মধ্যে এমন এক পূর্ণতা থাকে…এমন এক রহস্য থাকে যে তাকে অপার্থিব বলে মনে হয়।
যে রহস্য আমি পরে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছি তা আর ভাঙতে চাইনা। দাদার কাছ থেকে ঘটনটা শোনার পরেও কেন আমার মন ভরেনি সেটা আমি পরে বুঝতে পেরেছি। এই সাদামাটা একটা গল্প কেন আমি বার বার শোনাতে যাই আপনারা হয়তো বুঝতে পারবেন।• মৃতদেহর সমাধি হওয়ার আগে যিনি তার পরিচর্যা আর সংরক্ষণ করেন।
‘একটি নীরব মৃত্যু’ গল্পটি শেরুউড অ্যান্ডারসনের ‘ ডেথ ইন উডস’ গল্পটির অনুবাদ। -
মিষ্টি
মিষ্টি
-টনি মরিসনএতে আমার কী দোষ? আমার কিন্তু কোনো হাত ছিল না এতে। এমনটা যে হতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার নাড়ি কেটে ওকে আলাদা করার ঘণ্টা খানেক পরে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল আমার। কোথায় যেন একটা ভুল হয়ে গেছে…একটা সাংঘাতিক ভুল। ওর গায়ের রঙ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম আমি…একেবারে কুচকুচে কালো…সুদানের ওই লোকগুলোর মতো। কিন্তু আমি তো দিব্যি ফরসা। আমার চুলও বেশ লম্বা সোজা…হলদেটে। লুলা অ্যানের বাপেরও তাই। আমাদের গুষ্টিসুদ্ধ কারো রঙই অমন কালো নয় বাপু। কালো তো কালো…একেবারে আলকাতরাকেও হার মানিয়ে দেয়। গায়ের রঙের সঙ্গে ঢেউ খেলানো সোজা চুলটা আরো বেমানান। অস্ট্রেলিয়ার ওই ন্যাংটো আদিবাসীগুলোর মাথাতেই দেখেছি অমন চুল। আপনারা হয়তো বলবেন বংশের ধারা। নিকুচি করেছে বংশের। এমনধারা কালো আর কে আছে আমাদের বংশে? আপনারা আমার দিদাকে তো আর দেখেননি। দিদাকে তো মোটামুটি ফরসাই বলা যায়। পরের বিয়েটাও এক সাদা মানুষেরই সঙ্গে। মানুষটাকে বিয়ে করে আগের ছেলেমেয়েদের বেমালুম গেছেন ভুলে। আমার মা-মাসিরা তাঁকে চিঠি লিখলে খামটা না খুলেই তিনি ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। পুরোনো জীবনের সঙ্গে আর কোনো সংস্রব রাখতে চাননি তিনি। পরে মা-মাসিরাও হাল ছেড়ে দিয়েছে। দিদাকে আর বেশি ঘাঁটাতে যায়নি। তখনকার দিনে মুল্যাটো * আর কোয়াড্রুনদের* মাথায় লম্বা সাদা চুল থাকলেই নাকি কেল্লাফতে। তখন কেউ আর নিজেদের অর্ধেক কালো পরিচয়টা মনে রাখতে চায় না। নিজেদের সাদা ভেবেই ধন্য। কিন্তু কত সাদা চামড়ার নীচে যে কালো মানুষের রক্ত বইছে কে আর তার হিসেব রাখে! আমি শুনেছি এদের সংখ্যাটা নাকি শতকরা কুড়ি। আমার মা লুলা মে। তাঁকেও সাদা বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মিথ্যে পরিচয়ের আড়ালে তিনি নিজেকে কখনো লুকোননি। এর জন্য অনেক ভুগতে হয়েছে তাঁকে। মূল্যও দিতে হয়েছে অনেক। বাবার হাত ধরে মা যখন কোর্টে গিয়েছিল বিয়ে করতে তখন ওখানে ওরা দেখেন দুটো বাইবেল। একটা সাদাদের, একটা কালোদের। কালোদের বাইবেলে হাত রেখে বিয়ের শপথ নিতে হয়েছিল তাঁদের। বাইবেল নিয়েও এমন আমরা-ওরা! উফফফ ভাবা যায়!
এক বড়লোক শ্বেতাঙ্গ দম্পতির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন মা। আমার মায়ের হাতের রান্না তারিয়ে তারিয়ে খেতে তাঁদের আপত্তি ছিল না। বাথটাবে শুয়ে মাকে বলতেন পিঠে সাবান ঘষে দিতে। পিঠে সাবানঘষা থেকে আরো যে কত গা ঘষাঘষি হয়েছে ভগবান জানেন! কিন্তু কালো মানুষদের বাইবেলে হাত দিলেই নাকি ওদের জাত যায়!
এখানে রঙের আমি…রঙের তুমি… রঙ দিয়ে যায় চেনা। যে যত ফরসা সে নাকি তত ভালো। ক্লাবে, পাড়ায়, চার্চে এমনকী কালোদের স্কুলেও সেই একই নিয়ম। যার রঙ যত ফরসার দিকে সে নাকি তত ভালো। নিজেকে বাঁচাতে এই নিয়ম মানতেই হবে যে! নাহলে ওষু্ধের দোকানে তোমার মুখে লোকে থুথু দেবে…বাসস্টপে খামকা গুঁতো খাবে…সাদাদের রাস্তার পুরো ফুটপাথ ছেড়ে দিয়ে নর্দমার গা ঘেঁসে তোমায় হাঁটতে হবে…একটা ঠোঙার জন্য মুদি দোকানে তোমাকে বাড়তি পয়সা গুনতে হবে…অথচ সাদারা সেটা পেয়ে যাবে মুফতে। আরো কত যে খিস্তি খেউড় তোমাকে শুনে যেতে হবে সেগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। আমি নিজের কানে সব শুনেছি। আমার মাকে তো মোটামুটি ফরসাই বলা যায়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরের লেডিজ রুমে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে মা…কাউন্টারে দাঁড়িয়ে দু-একটা টুপিও পরখ করে দেখতে পারে। কেউ আটকায় না। আবার জুতোর দোকানে সামনের কাউন্টারে বসেই জুতো টুতো পায়ে গলিয়ে দেখতে পারতেন আমার বাবা। কালো মানুষদের মতো তাঁকে পেছনের ঘরে যেতে হত না। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে গেলেও ‘শুধুমাত্র কালোদের’ মদের দোকান থেকে কক্ষনো কোনো পানীয় ভুলেও কিনতেন না তাঁরা।
এ মেয়ের জন্ম থেকেই জ্বলে পুড়ে মরছি আমি। অন্য সব বাচ্চাদের মতো জন্মের সময় ওর গায়ের রঙ ছিল ফ্যাকাশে। জন্মের ঠিক পরে আফ্রিকান বাচ্চাদের গায়ের রঙও নাকি অমন ধারাই হয়।তারপর আমার চোখের সামনেই বদলে গেল সব…একেবারে নীলচে কালো। মাথাটা যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল আমার। এই বুঝি পাগল হয়ে যাব। মাথাটা আর কাজ করছিল না। বাচ্চার মাথা অবধি কম্বলটা টেনে হাত দিয়ে একেবারে চেপে ধরেছিলাম। না না শেষ পর্যন্ত করতে পারিনি। মেয়ের রঙ যতই বীভৎস কালো হোক না কেন মা হয়ে কি কেউ তা করতে পারে? মাঝে মাঝে মনে হত যাই ওকে কোনো অনাথাশ্রমে গিয়ে দিয়ে আসিগে, পারিনি। ওই যে মায়েরা তাদের বাচ্চাদের চার্চের সিঁড়িতে ফেলে আসে তাদের মতো হতে যে আমার দারুণ ঘেন্না। ওদের মতো কি আমি হতে পারি! এই তো কয়েকদিন আগে জার্মানির এক স্বামী-স্ত্রীর কথা শুনলাম। দুজনেই ধবধবে সাদা। আর তাদের বাচ্চার রং দেখে সবার চোখ কপালে। একেবারে ভূষো কালি। আবার কত যমজ বাচ্চার একজন সাদা, আরেকজন কালো। কিন্তু ব্যাপারটা কতটা সত্যি তা নিয়ে ধন্দ আছে আমার মনে। নিজের চোখে তো আর দেখিনি। কুচকুচে কালো বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে গা টা গুলিয়ে উঠছিল আমার। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই ধরিয়ে দিলাম ফিডিং বটল।
আমার বর লুইস রেলের পরিচারক। রেলের ডিউটি থেকে ফিরে এসে এমন করে চাইল আমার পানে যেন ভস্ম করে দেবে। বাচ্চাটা বুঝি অন্য কোন গ্রহ থেকে এসে পড়েছে ভাবটা ওর এমন। আমার বর এমনিতে মুখ খারাপ করে না…কিন্তু সেদিন যখন ও চেঁচিয়ে বলল… ‘ হে ভগবান! এ আবার কাকে তুলে এনেছ!’ তখনই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল আমার। সেই আমাদের সম্পর্কে ভাঙন শুরু। তারপর রাতদিন শুধু লড়াই আর ঝগড়া করতে করতে আমাদের বিয়েটাই গেল ভেঙে…একেবারের তাসের ঘরের মতো। আমাদের তিন বছরের বিবাহিত জীবন। কত আনন্দে…একে অপরের উষ্ণতায় কাটিয়েছি এই তিনটে বছর। বাচ্চাটাকে দেখে আমার দিকেই আঙুল তুলেছে লুইস। অভিযোগ করেছে বার বার। আর লুলা অ্যান তো ওর দু চক্ষের বিষ। কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি মেয়েকে।
আমিও নিজের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে যাইনি। কী হবে দিয়ে! আমি যে অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে আশনাই করে বেড়াইনি সে ব্যাখ্যান ওকে দিতে যাইনি। ও কি আমায় বিশ্বাস করবে? ও তো ভাববে আমি মিথ্যে বলছি। তবে সেদিন ঝগড়ার সময় আর চুপ থাকতে পারিনি…আমিও গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিয়েছি ‘ আমার গুষ্টিতে তো কেউ এমন কালো নেই…মেয়ে কালো কেন হয়েছে তা তুমি জানো…আর তোমার চোদ্দগুষ্টি জানে’। আমাদের তিক্ততা উঠল চরমে। একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল লুইস। মেয়েকে নিয়ে আমি একেবারে একা। আমার একার লড়াই শুরু। প্রথমে একটা সস্তার বাড়ি খোঁজা। বাড়ি খোঁজার সময় মেয়েকে সঙ্গে নিতাম না। বাড়িওলাদের চোখে পড়লেই মুশকিল। আমার এক তুতো বোনের কাছে বাচ্চাকে রেখে এখানে ওখানে বাড়ি খুঁজে বেড়াতাম। বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বেরনো যায় না। আমি পেরাম্বুলেটর ঠেলে নিয়ে যাই। আমাকে দেখে উৎসাহী হয়ে অনেকেই বাচ্চাটাকে একটু ‘সোনা মনা’ করার জন্য উঁকি মারে। তারপর বাচ্চাকে এক নজর দেখেই নাক মুখ সিঁটিয়ে তাঁরা এক হাত দূরে। খুব খারাপ লাগে আমার। আমাদের রঙটা বদলাবদলি হয়ে গেলে আমাকে হয়তো এই বাচ্চারই আয়া হয়ে পেট চালাতে হত। কে জানে! সাদা ছাড়া অন্য কোনো মহিলার পক্ষে শহরের ভদ্রস্থ জায়গায় ঘর ভাড়া পাওয়া যে কী মুশকিল! তা সে গায়ের রঙ যতই হলদেটে হোক না কেন! নব্বইয়ের দশকে লুলা অ্যান জন্মাল। তখন অবশ্য অনেক আইন কানুন হয়ে গেছে। রঙ দেখে নাকি ভাড়াটদের বিচার করা যাবে না। সবাইকে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে। তা বাড়িওয়ালারা সে কথা মানলে তো! সাদা ছাড়া অন্য কাউকে তারা ঘরই দেবে না। তবে মি. লেই অবশ্য ব্যতিক্রম। আমাকে ঘর দেওয়ার সময় ভাড়াটা বিজ্ঞপনের চেয়ে সাত ডলার বাড়িয়ে বললেন। ভাড়া দিতে একদিন দেরি হলেই চেঁচিয়ে মেচিয়ে একসা।
মেয়েকে মা ডাকতে শেখাইনি। ওকে বলেছি আমাকে ‘মিষ্টি’ বলে ডাকতে। এটাই সবদিক থেকে ভালো। একটা কালো কুচকুচে মোটা ঠোঁটওলা মেয়ে আমাকে ‘মা’ বলে ডাকলে সব লোকে বাঁকা চোখে তাকাবে। সে বড় বিচ্ছিরি। তারপর মেয়ের চোখ দুটোও ভারি অদ্ভুত। পিচকালো চোখে নীলের এক পোঁচে কেমন যেন পেত্নীর মতো লাগে ওকে দেখতে।
মা-মেয়ে দুজনের সংসার। একা একটা মেয়ে…তার ওপর স্বামী ছেড়ে চলে গেছে …কী কষ্ট করে যে তাকে সংসারের জোয়াল টানতে হয় তা আর কে বোঝে! আমার মনে হয় লুইসেরও পরে একটু অনুশোচনা হয়েছিল। কয়েক মাস পরে আমার নতুন বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার পর আমায় মাসে মাসে টাকা পাঠাতে শুরু করে। আমি ওর কাছ থেকে খোরপোষ চাইনি। এ নিয়ে আইন আদালতও করিনি। তবে প্রতি মাসে ওর পঞ্চাশ ডলারের মানি অর্ডারটা পেয়ে আমার যে কী উপকার হয়েছিল! রাতে হাসপাতালের চাকরি আর লুইসের পাঠানো পঞ্চাশ ডলার। আমাদের মা-মেয়ের পক্ষে যথেষ্ট। সরকারি সাহায্য আর নিতে হত না। জিনিসটা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের। আমার মা যখন ছোট ছিল তখন একে ‘সরকারি সাহায্য’ না বলে, বলা হত ‘ত্রাণ’। আমার মতে সেটাই শোনায় ভালো। যতদিন না তোমার করেকম্মে নিতে পারছ ততদিন সরকার দেখভাল করবে তোমার। সরকারি সাহায্যের এই টাকা বিলির করার জন্য যে কেরানিরা বসে থাকে তাদের মতো জঘন্য মানুষ আর জীবনে দেখিনি আমি। হাসপাতালের কাজটা পাওয়ার পরে ওদের চেয়ে ঢের বেশি কামাতাম আমি। ওরা আমাদের ভিখিরি ঠাওরেছিল। টাকা বের করতে যেন প্রাণ ফেটে যায় ওদের। তাও করুণা করে দু-দশ টাকার চেক ঠেকিয়ে আমাদের যেন কেনার গোলাম বানিয়ে নিত। তারওপর আমার বেলায় তো ওদের আরো বেশি কড়াকড়ি। লুলা অ্যানকে দেখে আমার দিকে যখন তাকাত ওদের চোখে মুখে ফুটে ওঠা সেই অবিশ্বাস আমি জীবনে ভুলবো না…যেন আমি ঠকিয়ে টাকা আদায় করে নিচ্ছি ওদের কাছ থেকে।
আমাদের অবস্থা ফিরেছে। কিন্তু আমি খুব চোখে চোখে রেখেছি মেয়েকে। এক চুলও এদিক থেকে ওদিক হতে দিইনি। ভীষণ কড়া শাসনে রাখতে হয়েছে মেয়েকে। বরাবর। আমি ওকে বলেছি রাস্তায় সবসময় মাথা নীচু করে হাঁটবে। বাইরে বেরিয়ে কোনো ঝুট-ঝামেলা করবে না। এরজন্য ওকে কতবার নাম বদলাতে হবে সে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল নেই। আমি শুধু জানি ওর এই মিশকালো রঙের বোঝাটা ওকে সারাটা জীবন ক্রুশের মতো বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। কোনো রেহাই নেই। কিন্তু এতে আমার কী দোষ! আমার কোনো দোষ ছিলনা এতে! কিচ্ছু না!
এখন ভাবলে খুব খারাপ লাগে। ছোটবেলায় ওকে কত না বকাঝকা করেছি। কিন্তু আমারও যে কিছু করার ছিল না। আমারও যে হাত পা বাঁধা। ওকে যে আমায় আগলে আগলে রাখতে হত। দুনিয়াদারির কী বোঝে ও? তার ওপর ওই তো গায়ের রঙ। এই রঙ নিয়ে কি ও সমাজে কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? পড়ে পড়ে মারই খাবে শুধু। কোনো দোষ না করেও মাথা নীচু করে ঘুরতে হবে তোমায়। শুধু এই গায়ের রঙের জন্য। স্কুলে একটু ঝগড়াঝাঁটি কি মারামারি করলেই ওরা তোমাকে পাঠিয়ে দেবে জুভেনাইল লকআপে। এই গায়ের রঙ নিয়ে তোমার চাকরি জুটবে সবার শেষে আর ছাঁটাই হবে সবার আগে। ও তো আর নিজে বুঝতে পারে না ওকে দেখলেই আশেপাশের লোকজন কেমন ঘেন্নায় কুঁকড়ে যায়। অনেকে আবার গলা ফাটিয়ে হাসে। তার ওপর কালো দেখলেই কত রকম মস্করা করে লোকে। ওই যে ওই মেয়েটাকে যেমন করেছিল। মেয়েটার গায়ের রঙ লুলা অ্যানের মতোই। কতই বা বয়স হবে মেয়েটার। বড়জোর দশ। একদল সাদা ছেলে ওকে ঘিরে ধরে এক পায়ে মারল এক ল্যাং। হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে যেই না মেয়েটা একটু সামলে নিল অমনি পেছন থেকে একটা ছেলে মারল এক লাথি। টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটা এবার চিৎ পটাং। ছেলেগুলোর মুখে সে যে কী বীভৎস হাসি! হাসতে ওদের হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড়। মেয়েটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাওয়ার পরেও হাসি আর তাদের থামেনা…যেন কী সাংঘাতিক বীরত্বের কাজ করে ফেলেছে একটা। আমি ছিলাম বাসে। জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলাম আমি। বাসে না থাকলে মেয়েটাকে হয়তো একটু সাহায্য করতে পারতাম। ওই সাদা ছোঁড়াগুলোর খপ্পর থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হয়তো পারতাম। ভাগ্যিস লুলা অ্যানকে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিলাম। তা নাহলে সাদা ছেলেদের নজর এড়িয়ে ও রাস্তা পার হতে পারত না। আমি ওকে যা শিখিয়েছিলাম জীবনে সেটা ওর সত্যিই কাজে লেগেছে। ওর জন্য আমার গর্ব হয়।
মা হিসেবে মোটেই খারাপ ছিলাম না আমি…মানতেই হবে। তাও একমাত্র মেয়েকে কত শাসন করেছি। আমি আর কীইবা করতে পারতাম! ওকে যে আমায় আগলে রাখতে হত। আমাকে যে এই শাসনটুকু করতেই হত। আর কোনো উপায় ছিল না আমার। যত নষ্টের গোড়া তো ওই গায়ের রঙ। প্রথম প্রথম ওই কালো চামড়ার ভেতরকার মানুষটাকে আমি আপন করে নিতে পারিনি। কিন্তু এখন পারি। এখন সত্যিই পারি। মেয়েও হয়তো এখন মাকে বুঝতে পারে। আমার তো তাই মনে হয়।
গত দুবার মেয়েকে দেখে চমকে উঠেছি আমি। সে তখন তেজি ঘোড়ার মতো…আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে মাঝে মাঝে। ওর গায়ের রংটা এখন আর তেমন করে চোখে লাগে না। বাহারি সাদা জামা কাপড়ে ওকে বেশ ঝলমলে আর খোলতাই লাগে।
মেয়ের কাছ থেকে খুব বড় একটা শিক্ষা পেয়ে গেছি আমি। এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বাচ্চাদের সঙ্গে তুমি যেমন আচরণ করবে সেটাই পরে ফেরত পাবে। বাচ্চারা কোনো কথা ভোলে না। সুযোগ পেয়েই আমাকে ছেড়ে চলে গেল মেয়ে। এই নির্জন ফ্ল্যাটে ভূতের মতো পড়ে রইলাম আমি একা। ক্যালিফোর্নিয়ায় মেয়ে এখন খুব বড় চাকরি করে। মায়ের কাছে আসার সুযোগ বিশেষ হয় না। ফোন টোনও করে না। হ্যাঁ মাকে অবশ্য টাকা পাঠায় নিয়ম করে। যখন যেমন সম্ভব। কতদিন যে মেয়ের মুখটা দেখিনা!
উইনস্টন হাউসের এই ছোট্ট ঘরোয়া ফ্ল্যাটেই ভালো আছি আমি। এখানেই আমার শান্তি। শহরের বাইরে ওই বড় ঝাঁ চকচকে ওল্ড এজ হোম টোমে যেতে চাই না। ওতে অনেক খরচ। সেই তুলনায় আমার ফ্ল্যাট অনেক সস্তা। এখানে নিজের মতো থাকতে পারি আমি। আর তাছাড়া এখানে চব্বিশ ঘণ্টার আয়া তো রয়েছেই। তারপর সপ্তাহে দুদিন ডাক্তার এসে দেখে যান। বয়স তো এমন কিছু হয়নি আমার। মাত্র তেষট্টি। এই বয়সেই হাড়ের ব্যামোয় প্রায় পঙ্গু। এই অবস্থায় যত্নের খুব প্রয়োজন। শরীরের ব্যথা বেদনা… তার ওপর নিঃসঙ্গতার এই অসহ্য যন্ত্রণা! আমার আয়ারা অবশ্য খুব ভালো। ওরা খুব যত্ন করে আমার। ওদের একজনের কাছেই খবরটা ফাঁস করেছিলাম আমি… ‘আমি দিদা হচ্ছি’। সেই শুনে আনন্দের চোটে সে বেটি তো আমাকে গালে একটা চুমুই দিয়ে ফেলল। তার আনন্দ আর ধরে না। ওর লাফালাফি দেখে মনে হচ্ছিল দিদা নয়, আমি যেন রানিই হয়ে যাব। নীল কাগজে লেখা মেয়ের চিঠিটা দেখালাম ওকে। মেয়ে চিঠির নীচে সই করেছে ‘ব্রাইড’। ওসবে আমি কোনোদিন পাত্তা দিইনা। কিন্তু ওর চিঠির কথাগুলো পড়ে কেমন যেন খাপছাড়া লাগল… ‘ আমি তোমাকে একটা দারুণ খুশির খবর দেব। তুমি কি আন্দাজ করতে পারছ? আমি মা হচ্ছি। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে…তোমারও নিশ্চয়ই হচ্ছে’। বাচ্চাটাকে নিয়েই আমার যত আনন্দ…বাচ্চার বাবাকে নিয়ে নয়। হবে কী করে? বাচ্চার বাবার কথাতো কিছু লেখেইনি মেয়ে। আচ্ছা সেও কি আমার মেয়ের মতো কালো? হলে তো একদিক থেকে ভালো। যে উদ্বেগ আর যন্ত্রণা আমাকে পোয়াতে হয়েছিল আমার মেয়েকে তা হবে না। অবস্থা এখন অনেক বদলে গেছে। আমাদের যুগ আর নেই। টিভি, ফ্যাশন ম্যাগাজিন, বিজ্ঞাপণ এমনকি সিনেমাতেও সব নীলচে কালোরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
খামে মেয়ের কোনো ঠিকানা দেওয়া নেই। খারাপ মা হওয়ার শাস্তি দিচ্ছে মেয়ে। চোখ না বোজা অবধি আমায় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে। আমি জানি মেয়ে আমাকে ঘেন্না করে। মা-মেয়ের সম্পর্ক আজ এসে দাঁড়িয়েছে শুধু টাকাপয়সায়। মেয়ের পাঠানো টাকাটা আমার কাজেই লাগে…সেটা অবশ্য অস্বীকার করতে পারিনা। অন্য রুগীদের মতো আয়াদের কাছে আমার হাত পাততে হয়না। যখন ইচ্ছে তখন নতুন তাসের প্যাকেট কিনে ফেলতে পারি। ওই ছেঁড়াখোড়া ময়লা তাস পেটাতে হয় না আমায়। দামি ফেস ক্রিমের যে বিলাসিতাটুকু আমি করি সে তো ওই টাকারই জোরে। তবে যার যাই হোক আমি তো আর বোকা নই। মেয়ে মায়ের কাছে আসতে পারে না…আসতে চায়না…তাই টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব সারে। বিবেকের দংশনও আর থাকে না।
আমাকে খুব খিটখিটে, অকৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে তাই না! আসলে অনুতাপের জ্বালায় দগ্ধে দগ্ধে মরছি আমি। জীবনে কত যে ছোট ছোট ভুল করে বসে আছি। যা করা আমার উচিত ছিল তা তো করিনি। মেয়ের যখন প্রথম মাসিক হল তখন কেমন রাগারাগি করেছিলাম আমি! তারপর মেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লে…হাত থেকে কোনো জিনিস ফেললে কত যে বকাবকি করেছি। ওর রংটা যে সহ্য হত না আমার…ওকে দেখলেই খিটখিটে হয়ে পড়তাম আমি। জন্মের পর ওকে যখন প্রথম দেখি তখন তো ভেবেই নিয়েছিলাম যে…না না ওসব কথা আর ভাবতে চাই না। কী হবে মন খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে। ওই অবস্থায় আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল সব করেছি। বর ছেড়ে চলে গেছে…একা একটা মেয়েমানুষ…এ অবস্থায় মেয়েকে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি আমার। যে যাই বলুক এই বোঝা আমি খুব ভালোভাবেই বয়েছি।
হ্যাঁ, ওর ওপর খুব কড়াকড়ি করেছি আমি। আমি তো মেনে নিচ্ছি। ও যখন বারো পুরে তেরোয় পড়ল তখন আমাকে আরো বেশি করে শাসন করতে হয়েছে বইকি! মেয়েটাও তখন কী অবাধ্যই না হয়ে উঠেছিল। আমি যা রান্না করব তা খাবে না, মুখে মুখে চোপা। তারপর চুলের ফ্যাশন। আমি যত্ন করে বেনী বেঁধে দিতাম। মেয়ে স্কুলে গিয়ে খুলে ফেলত। ও বিগড়ে যাবে সেটা আমি কী করে সহ্য করব। ওর ওপর আমি চেঁচাতাম খুব… ‘ যা ইচ্ছে তাই কর…তারপর লোকেরা যখন এই নামে ডাকবে ওই নামে ডাকবে তখন বুঝবি ঠেলা’। তবে আমার শিক্ষা কিছুটা হলেও তো কাজে দিয়েছে। আজ কত বড় চাকরি করে আমার মেয়ে। কত উজ্জ্বল কেরিয়ার ওর। হাতে ওর কত টাকাপয়সা। আপনারা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?
আজ মা হবে আমার মেয়ে। ভালো একটা চাল দিয়েছ লুলা অ্যান। তবে তুমি যদি ভাব মা হওয়া মানেই ঘুম পাড়ানি গান আর ন্যাপি বদলানো তাহলে কিন্তু খুব ভুল ভেবেছ। তুমি আর তোমার ওই নাম গোত্রহীন প্রেমিক… স্বামী…শয্যাসঙ্গী যাই বল না কেন… তোমরা শুধু ভাব… মা হওয়া মানেই বুঝি শুধু… ‘আমার সোনা…চাঁদের কণা’!
আমার কথা শোনো লুলা অ্যান। মা হওয়া মুখের কথা নয়। আর কদিন পরেই টের পাবে হাড়ে হাড়ে। বাবা-মা হলে দুনিয়াটা কীভাবে বদলে যায় তাও বুঝতে পারবে। বুঝবে কত ধানে কত চাল! আমার শুভেচ্ছা রইল। বাচ্চাটার মঙ্গল কর ভগবান!• সাদা আর কালো মানুষের বর্ণ সংকর।
অনুবাদ— বর্ণালী জানা সেন
লেখিকা সম্পর্কে—আমেরিকার কালো মানুষের জীবনের রূপকার তিনি। তাঁর কাব্যময় ভাষায় সমাজের প্রান্তিক কালো মানুষদের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখের কথা তিনি তুলে ধরেছেন। জন্ম আমেরিকার ওহিও প্রদেশের লোরেন-এ, ১৯৩১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।
মূলত উপন্যাসই লিখেছেন তিনি। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘সুলা’ ( ১৯৭৩), ‘ সং অফ সলোমন’ ( ১৯৭৭), ‘ টার বেবি’ ( ১৯৮১), ‘ বিলাভেড’ ( ১৯৮৭), ‘ জ্যাজ’ ( ১৯৯২), ‘ লাভ’ ( ২০০৩), ‘ আ মার্সি’ ( ২০০৮), ‘ হোম’ ( ২০১২)’ , ‘ গড হেল্প দ্য চাইল্ড’ (২০১৫)। ‘ বিলাভেড’ উপন্যাসটির জন্য পেয়েছেন পুলিৎজার প্রাইজ। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে।‘ মিষ্টি’ গল্পটি তাঁর ‘সুইটনেস’ গল্পের অনুবাদ। ‘নিউইয়র্কার’ পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।
-
স্বপ্নের দিন
স্বপ্নের দিন (কেট চপিন)
অনুবাদে – বর্ণালী জানা সেন
ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কী! নাহলে আচমকা তার হাতে কড়কড়ে এই পনেরো ডলার! বিশ্বাসই হয়না। টাকার ভারে পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া ব্যাগটা উপচে পড়ে। বুকের ভেতরটা উথলে ওঠে মিসেস সমার্সের। উফফ এত টাকা একসঙ্গে কখনো দেখেননি তিনি। নিজেকে এত কেউকেটা বহুদিন মনে হয়নি তাঁর।
কিন্তু এত টাকা খরচ করেন কীভাবে! না না, ভালোকরে ভেবেচিন্তে যা করার করতে হবেখন। স্বপ্নের ঘোরে দু-একদিন কেটে গেলেও মনে মনে হিসেব নিকেশ চলে পুরোদমে। খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। এখন তাড়াহুড়ো করে পরে কপাল চাপড়ালে চলবে না। মাঝরাতে সবাই গভীর ঘুমে…কিন্তু মনে মনে তাঁর হিসেব চলে যায়। নানান ভাবনা খেলে মাথায়। খুব গুণে গেঁথে খরচ করতে হবে টাকাগুলো।
জেনির জুতোর জন্য মোটামুটি যা খরচ হয় তার সঙ্গে আর দু-এক ডলার যোগ করলেই একটা ভালো জুতো হয়ে যাবে। সে জুতো টেঁকসইও হবে। ওটা আগে কেনা দরকার। ওর জুতোটা তো ছিঁড়ে একেবারে ফর্দাফাঁই। তারপর জেনি, ম্যাগ আর ছেলেদের নতুন শার্টওয়েস্ট-এর জন্য কয়েক গজ কাপড়ও কিনতে হবে। পুরনোগুলো অবশ্য রিফু করে চালিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু টাকাটা যখন হাতে এলই! আর ম্যাগের এবার একটা গাউন না হলেই নয়। দোকানে কাচের শোকেসের ভেতরে কত সুন্দর সুন্দর ডিজাইন দেখে রেখেছেন তিনি। সস্তার কাউন্টারে খুব একটা কিছু দামও হয়তো পড়বেনা। এই কেনাকাটা করেও নিজের জন্য দুজোড়া মোজা কি হার কেনা যাবে না! খুব যাবে। হ্যাঁ হ্যাঁ দুজোড়াতেই এখন অনেকদিন চলে যাবে। সূঁচ সুতো নিয়ে রিফু করার হাত থেকে অন্তত কিছুদিনের জন্য রেহাই। ও আর হ্যাঁ ছেলের জন্য মাথার ক্যাপ আর মেয়েদের জন্য কেতাদুরস্ত সেলার হ্যাট কিনে নিলেই ব্যাস। তাঁকে আর পায় কে! তাঁর বাচ্চারা নতুন জামাকাপড় পরে ঝলমলিয়ে বেড়াবে এই ভেবেই তাঁর আনন্দ…তাঁর শান্তি। এমন সুযোগ আর কবারই বা এসেছে তাদের জীবনে!
নতুন নতুন কল্পনায় নিজেকে বড় অস্থির লাগে। দু চোখের পাতা এক হয় না রাতে। মিসেস সমার্স হওয়ার আগে এমন রঙিন ফুরফুরে দিন তিনি অনেক দেখেছেন। পড়শিরা নিজেদের মধ্যে সেসব কথা বলাবলিও করে। তখনও তিনি মিসেস সমার্স হওয়ার কথা ভাবেননি। পুরনো দিনের কথা আর ভাবেন না তিনি। অতীত খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চান না তিনি। সংসারের নিত্য অভাব অভিযোগ মেটাতে মেটাতেই দিন গেল তাঁর। তাঁর জীবনে কোনো অতীত নেই…ভবিষ্যতের ছবিটাও খুব আবছা। শুধু মনে হয় বিরাট এক দৈত্য গিলে খেতে আসছে তাঁকে। তবে ভগবানের ইচ্ছায় সে দৈত্যটা কোনোদিন কাছে আসে না।
দরাদরি কাকে বলে মিসেস সমার্সের চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে! কোথায় কোন জিনিসটা সস্তায় বিকোচ্ছে সব তাঁর নখদর্পণে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে লক্ষ্যবস্তুটার দিকে এগিয়ে তাকে হাশিল করে নেওয়ার শিল্পটা একেবারে নিখুঁতভাবে রপ্ত করেছেন তিনি। দরকার হলে ভিড়ের মধ্যে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে নিজের জায়গায় পৌঁছে যেতে পারেন…তারপর যতক্ষণ না পালা আসে দোকানির সামনে ঠায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারেন। সকাল থেকে রাত। জীবন তাঁকে এইটুকু ধৈর্যের শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু জিনিসটা তাঁর চাই। সেটা না নিয়ে এক পাও নড়েন না তিনি।
দেখতে দেখতে চলে এল সেই দিন। আজ কেনাকাটা করবেন তিনি। শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে আজ। দুপুরে হালকা কিছু খেয়ে নেবেন কি? খাওয়ার কথা একবার মনে হয়েছিল বটে কিন্তু খাওয়া আর হয়নি। বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে…জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে নিজে তৈরি বেরোনোর ব্যস্ততায় দুপুরে খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন তিনি।
দোকানের কাউন্টারে ভিড় নেই তেমন। শোকেসে শার্টের কাপড়, নকশা তোলা লন ক্লথ দেখতে দেখতে ব্যস্ত শত শত ক্রেতার ভিড় ঠেলে কাউন্টারে যাওয়ার কথা ভেবেই দুবার ঢোঁক গেলেন মিসেস সমার্স। নিজের রিভলভিং চেয়ারটায় বসে যান আরো কিছুক্ষণ। পা দুটো যেন অবশ হয়ে আসে। শেষমেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে কাউন্টারের ওপর আপন মনে দুটো হাত মেলে দেন। হাত তাঁর অনাবৃত। কোনো গ্লাভ নেই। হঠাৎইহাতে যেন কোনো নরম স্পর্শ এসে লাগে…আহ কী তুলতুলে জিনিসটা…একেবারে পেঁজা তুলো! কী এটা! এ যে রাশি রাশি সিল্কের মোজা! পাশের বোর্ডেই দাম লেখা। এখন সেল চলছে। অনেক কম দামে মিলছে এই মোজা। দু ডলার পঞ্চাশ সেন্টের বদলে মাত্র এক ডলার আটানব্বই সেন্ট। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো কমবয়েসি সুবেশা মেয়েটি চটজলদি এগিয়ে আসে তাঁর সাহায্যে… ‘ম্যাডাম আমাদের এইসব সিল্কের হোসিয়ারি একদম নতুন। আপনি চাইলে পরখ করে দেখতে পারেন’। মিসেস সমার্সের মুখে চওড়া হাসি। নিজেকে খুব দামি মনে হয় তাঁর। মোজা তো কোন ছার যেন আস্ত এক হিরের মুকুট কিনতে এসেছেন তিনি। কত সাধাসাধি এদের… ‘ম্যাডাম একবার পরীক্ষা করে নিন… একবার পরে দেখুন’। উফফ পারেও বটে! তবে সেই নরম তুলতুলে জিনিসটাকে কিছুতেই হাত থেকে ছাড়তে পারেন না তিনি… বার বার ছুঁয়েও সাধ মেটে না। হাতে লেগে থাকে জিনিসটার নরম আদর। মোজাদুটো দুহাতে তারিয়ে তারিয়ে দেখেন…সাপের মতো হিলহিলিয়ে জিনিসটা তাঁর আঙুলের মাঝখান দিয়ে গলে পড়ে। শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় তাঁর। তাঁর শুকনো বিবর্ণ দুটো গালে বিন্দু বিন্দু রক্ত জমা হয়। দোকানি মেয়েটির দিকে মুখ তুলে তাকান তিনি… ‘এরমধ্যে সাড়ে আট সাইজের কিছু হবে’।
‘ হবে…প্রচুর হবে। এছাড়া অন্য সাইজের মোজা কমই রয়েছে দোকানে’।
রঙের যেন মেলা বসেছে…আসমানি, ল্যাভেন্ডার। তাছাড়া কালো, বাদামির নানা শেড আর ছাই রঙের মোজা তো রয়েছে ঝুড়ি ঝুড়ি। একজোড়া কালো মোজা বেছে নেন তিনি। অনেকক্ষণধরে খুঁটিয়ে দেখেন…যেন বুনোটটা একবার যাচাই করে নিচ্ছেন ভাবখানা এমন। দোকানি বলে ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। হাজার ঢুঁড়েও এ জিনিস মেলে না।
‘এক ডলার আটানব্বই সেন্ট…তাই তো? ঠিক আছে এই মোজাজোড়াই দিন তাহলে’…এই বলে তিনি পাঁচ ডলারের নোট বাড়িয়ে দেন দোকানির দিকে। বাকি টাকা আর মোজার প্যাকেটটার জন্য কাউন্টারে একটু অপেক্ষা করেন মিসেস সমার্স। ইসস্কতটুকু একখানা প্যাকেট দিয়েছে দেখো! তাঁর তেল চিটচিটে ঝোলা ব্যাগে প্যাকেটটা যেন হারিয়েই গেল।
সস্তার কাউন্টারের দিকে আর পা বাড়ালেন না মিসেস সমার্স। লিফ্টে করে সোজা ওপরের তলায়। এখানে মহিলাদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। ঘরের একটা ফাঁকা কোণে গিয়ে নিজের পুরোনো সুতির মোজাটা খুলে সদ্য কেনা রেশমি মোজাটা পায়ে গলিয়ে নেন তিনি। এসব তিনি কী করছেন…কেন করছেন …সে নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে চান না। এখন আর কোনো যুক্তি তক্কো ন্য…নিজের কাছে কোনো জবাবদিহিও নয়। মাথায় আর কিচ্ছু নেই তাঁর। রোজকার দিনযাপনের গ্লানি থেকে শুধু একটু মুক্তি চাই ব্যাস। এখন তিনই যা করছেন স…ব যন্ত্রের মতো। জীবনে এতসব দায়িত্বের বোঝা নিয়ে নিরন্তর লড়াই…হাঁফিয়ে গেছেন তিনি। একটু ছুটি চাই তাঁর।
নিজের রক্তমাংসের ওপর নরম রেশমের ছোঁয়া। প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যায়। গদিমোড়া এই চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়তে মন চাইছে তাঁর …এই মুহূর্তের বিলাসিতাটুকু শুষে নিতে চাইছে প্রাণ। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেন তিনি। তারপর একটানে খুলে ফেলেন নিজের জুতো। সুতির মোজাটা গোল্লা করে ছুঁড়ে দেন নিজের ঝোলা ব্যাগে। তারপর সোজা চলে যান স্টোরের জুতো সেকশনে। বসার চেয়ারটা নিজের মাপমতো ঠিক করে নেন। কোনো জুতোই আবার পছন্দ হয় না তাঁর। এটা নয় ওটা…এটা নয় সেটা..খালি খুঁত খুঁত করেই যান। নতুন মোজাজোড়ার সঙ্গে কোন জুতোখানা মানাবে ঠিক করতে হিমসিম খেয়ে যায় দোকানের কর্মচারী। তাঁরও মন ওঠেনা কিছুতে। শেষমেশ নিজের স্কার্ট খানা একটু উঁচুতে তুলে পা-টা সামনের দিকে বাড়িয়ে চকচকে, সরু মুখো বুট জোড়ার দিকে তেরছাভাবে চান। তাঁর পায়ের গড়ন…গোড়ালি এত সুন্দর! এগুলো কি তাঁর নিজের শরীরেরই অংশ! বিশ্বাস হয় না। এই সুন্দর পায়ের সঙ্গে মানানসই, ফ্যাশনদুরস্ত জুতো তাঁর চাই-ই চাই। দোকানের ছোঁড়াটাকে সাফ জানিয়ে দেন দাম দু-এক ডলার বেশি হোক…কিন্তু জিনিসটা তাঁর পছন্দের হওয়া চাই।
কতদিন হয়ে গেল এক জোড়া গ্লাভ কেনা হয়নি। কখনো সখনো দু একটা হয়তো কিনেছেন…তাও আবার সস্তার কাউন্টার থেকে। অত সস্তার জিনিস হাতের মাপমতো হবে…খাপে খাপে বসবে তা আশা করাটাও বোকামি। এবার তিনি আসেন গ্লাভ কাউন্টারে। কাউন্টারের নরম গদিতে কনুইটা ভর দিয়ে দাঁড়ান। এক সুন্দরী কমবয়সি মেয়ে মিষ্টি হেসে দামি চামড়ার গ্লাভে তাঁর হাত দুটো ঢেকে দেয়। কবজির ওপর গ্লাভটাকে একটু চেপে বোতামগুলো লাগিয়ে দেয় মেয়েটি। গ্লাভ পরা ছোট্ট সুন্দর হাত দুখানা দেখে দোকানি ও ক্রেতা…দুজনেই চুপ খানিক্ষণ। মিসেস সমার্সের এখন খুব তাড়া। আরো অনেক কেনাকাটা বাকি আছে তাঁর।
রাস্তায় কয়েক পা হাঁটলেই ম্যাগাজিন স্টল। দোকানের তাকে রাশি রাশি বই…ম্যাগাজিন। দুটো দামি ম্যাগাজিন কিনে নেন তিনি…সেই পুরোনো দিনের মতো যখন এমন শৌখিন বিলাসিতায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্যাকেট ছাড়াই ম্যাগাজিনদুটো নিয়ে রাস্তায় নামলেন তিনি। রাস্তার মোড়ে এসে স্কার্ট খানা একটু তুলে নিজেকে ভালো করে জরিপ করে নিলেন তিনি। তাঁর রেশমি মোজা, নতুন জুতো, হাতের খাপে খাপে বসা দামি গ্লাভ তাঁকে যেন আমূল বদলে দিয়েছে। নিজের ওপর এখন তাঁর অগাধ আস্থা। এই রাস্তার শত শত মানুষের ভিড়ে নিজেকে আর মোটেই ছোট মনে হচ্ছ না তাঁর। আজ তিনি এদেরই একজন।
হাঁটতে হাঁটতে খুব খিদে পেয়ে গেছে তাঁর। অন্য সময় হলে বাড়ি ফেরা অবধি পেটের খিদে পেটেই চেপে রাখতেন তিনি। বাড়ি ফিরে একটু চা বানিয়ে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় মুখে দিয়েই চলে যেত। কিন্তু আজ ভেতর থেকে কে যেন বলছে ‘ নিজেকে আর কষ্ট দিয়ো না’।
ওই রাস্তার কোণাতেই তো রেস্তরাঁ রয়েছে একটা। কিন্তু ওই কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সুযোগ তাঁর কোনোদিন হয়নি। বাইরে থেকে হাঁ করে রেস্তরাঁর জানালার দামি রেশমের পর্দা…দেওয়ালের ঝলমলে স্ফটিক…মান্যিগণ্যি বাবু বিবিদের কাছে আলতো পায়ে ওয়েটারদের ঘোরাফেরা…শাহি খানা পরিবেশনের দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আজ তিনি নিজেই কাচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন। তাঁকে দেখে কেউ অবাক হয় না। কেউ অবজ্ঞায় মুখ বাঁকায় না। এতক্ষণ মিথ্যেই ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। ছোট্ট একটা টেবিলে গিয়ে বসে পড়েন তিনি…একদম একা। তাঁকে দেখামাত্রই অর্ডার নিতে ছুটে আসে ওয়েটার। কাঁড়ি কাঁড়ি তো আর খাবেন না তিনি। ভালো কিছু খাবার অল্প করে চেখে দেখবেন…ওই যেমন গোটা ছয়েক ব্লু পয়েন্ট *, একটা প্লাম্প চপ আর তার সঙ্গে একটু স্যালাড…ডেজার্টের মধ্যে একটা ক্রেম ফ্রাপে** আর একটু রাইন ওয়াইন। সবশেষে এক কাপ কফি।
খাবার আসতে এখনো ঢের দেরি। একা একা বসে উশখুশ করেন মিসেস সমার্স। রয়ে সয়ে গ্লাভ জোড়া খুলে টেবিলে রাখেন তিনি। তারপর একটা ম্যাগাজিন বের করে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। ম্যাগাজিনের জোড়া পাতাগুলো ছুরির ভোঁতা দিকটা দিয়ে কাটতে থাকেন। আজ খুব ভালো লাগছে তাঁর। চারপাশের সবকিছুই খুব সুন্দর…বড় মায়াবি। বাইরে থেকে এতদিন যা মনে হত রেস্তরাঁর পরদাগুলো তারচেয়েও বেশি ধবধবে…আর দেওয়ালের স্ফটিকগুলোও যেন আরো ঝলমলে। তাঁর পাশে কত লোকজন…কেউ তাঁর দিকে নজর করছে না। তিনি ছোট্ট টেবিলটায় বসে নিজের মতো করে খেয়ে যান…এটা বুঝি তাঁর বাড়ির টেবিল…একদম তাঁর নিজস্ব। একটা হালকা বাজনা আসছে কানে। মৃদু বাতাস ভেসে আসছে জানালা দিয়ে। তৃপ্তি করে খাবারে কামড় দেন তিনি…প্রাণ ভরে স্বাদ নেন। আলতো করে চুমুক দেন সোনালি মদে। রেশমের মোজার ভেতর পায়ের আঙুলগুলো ঘষে নেন একবার। খাবারের দাম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাঁর। খাবারের দাম মিটিয়ে ওয়েটারের জন্য বাড়তি একটা কয়েন রেখে দেন ট্রে-তে। আহ্লাদে আটখানা ওয়েটার মাথা নীচু সেলাম ঠোকে তাঁকে…বুঝি কোনো দেশের রাজকন্যা তিনি।
ব্যাগে এখনো টাকা রয়েছে। এবার কী করা যায়! হঠাৎ ই তাঁর চোখে পড়ে দুপুরের সিনেমার পোস্টার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হলে ঢুকে তিনি দেখেন সিনেমা শুরু গেছে এর মধ্যে। হল একেবারে ভর্তি। এদিক ওদিক দু একটা খালি সিট পড়ে রয়েছে। তারই একটায় তাঁকে নিয়ে বসায় দ্বাররক্ষী। দামি দামি হাল ফ্যাশানের পোশাক আশাক পরে মহিলারা সব এসেছেন সময় কাটাতে। সিনেমা দেখার অছিলায় পপকর্ন আর ক্যান্ডি দিয়ে মুখ চালানো আর নিজেদের জামাকাপড়ের বিজ্ঞাপণ দেওয়া…হলে এসে এই তো তাদের কাজ। তবে মনোযোগী দর্শকও অবশ্য কিছু রয়েছে…সত্যিকারের সমঝদার। তাঁরা এসেছেন ছবির টানে। তবে মিসেস সমার্স যেভাবে সবকিছু হাঁ করে গিলে খাচ্ছিলেন তেমনটা আর কেউ করেনি…সামনের বড় পর্দায় হেঁটে চলে বেড়ানো অভিনেতা অভিনেত্রী থেকে শুরউ করে চারপাশের লোকজন…সবার মাঝে…সবকিছুর ভেতরে একেবারে ডুবে গেছেন মিসেস সমার্স। পর্দায় মজার দৃশ্য দেখে তিনি হাসেন…তারপরেই কেঁদে ভাসান। তাঁর পাশে বসা বাহারি পোশাক পরা মহিলাও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে একটু আধটু কথাও বলেন তাঁরা। ছোট চৌকো ফিনফিনে লেসের রুমাল দিয়ে মুখ চেপে হেঁচে ওঠেন সে মহিলা। মিসেস সমার্সের দিকে নিজের ক্যান্ডির বাক্সটা একবার বাড়িয়ে দেন।
সিনেমা শেষ। বাজনা থেমে যায়। শ্রোতের মতো লোকজন বেরিয়ে আসে রাস্তায়। স্বপ্নের ঘোর ভেঙে যায়। আবার সবাই বাস্তবের মাটিতে। যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করেন মিসেস সমার্স।
ট্রামে উল্টো দিকে বসা মানুষটা একদৃষ্টে নজর করে যায় তাঁকে। তাঁর রুক্ষ ফ্যাকাশে মুখের ভাষা কি মানুষটা পড়ে ফেলতে চায় তবে! কী লেখা আছে ওই মুখে…ওই দুটো আকুল চোখে…মানুষটা অবাক হয়। সে মুখে বিশেষ কিছুই দেখতে পান না তিনি। তবে ভগবান যদি দেখার মতো চোখ দিতেন তাঁকে তাহলে হয়তো তিনি এক নজরেই পড়ে ফেলতে পারতেন সামনে বসা ওই ছোট্ট খাট্ট ওই মহিলার মনের ক্তহা…জেনে ফেলতেন তাঁর সেই ভীষণ আকুতি…এই গাড়ি যেমন চলছে চলুক…চলতেই থাকুক…আজ কাল পরশু…সারাজীবন!
*এক ধরণের ঝিনুক যা লং আইল্যান্ডের ব্লু পয়েন্টে পাওয়া যায়।
** এক ধরণের ফলের রস।‘স্বপ্নের দিন’ গল্পটি কেট চপিনের ‘ আ পেয়ার অফ সিল্ক স্টকিংস’ এর অনুবাদ।
-
বড়দিন
বড়দিন (রিং ডব্লিউ লার্ডনার)
অনুবাদে -বর্ণালী জানা সেনরাত পোহালেই বড়দিন। বসার ঘরে বসে সময় আর কাটে না কার্টার দম্পতির…মানে টম আর গ্রেস কার্টার। সময় কাটাতে একটু গল্প করে…আর একটু পড়ার ভান। তাও ঘড়ির কাঁটা যেন আর নড়েই না। যে চিন্তাটা এখন তাঁরা মনে আনতে চান না সেটাই যেন আরো বেশি করে হানা দিয়ে যায় মনের কোণে। বড়দিনের ছুটিতে তাঁদের দুই ছেলে মেয়েই বোর্ডিং থেকে বাড়ি ফিরেছে। ছেলে জুনিয়র এই উনিশে পড়ল। মেয়ে গ্রেস দু বছরের ছোট। জুনিয়র এখন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে। আর মেয়ে এখনও স্কুলে। এইবার কলেজে ঢুকবে।
বাপ মা শখ করে নাম রাখলে কী হবে জুনিয়র তার নিজের তার নিজের নামটা বদলে করেছে টেড। আর নাম বদলের পর তার বোণ গ্রেস এখন ক্যারোলিন। নতুন নামেই তারা বেশি স্বচ্ছন্দ। বাবা-মাকে তারা বলে দিয়েছে এই নতুন নামেই ডাকতে। বড়দিনের আগের রাতে বসার ঘরে বসে শুধু ছেলে-মেয়ের কথাই ভাবেন কার্টার দম্পতি…ভাবেন তাদের মতিগতির কথা। কী যে ওরা চায় কে জানে!
এখানকার আরো কত ছেলেই তো ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। তারা তো দিব্যি একুশ তারিখে বাড়ি ফিরে এল। ওইদিনই তো ছুটি পড়ল। সবাই এল, এলনা শুধু টেড। এল তার টেলিগ্রাম। তার নকি কী সব জরুরি পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে সে সাংঘাতিক ব্যস্ত। তাই বাড়ি ফিরতে তার তার তিনদিন দেরি হবে। এই পরীক্ষায় উৎরোতে পারলে পরের টার্মে নাকি পড়ার চাপ অনেক কমবে। তারপর ফ্যাকেশে মুখ, চোখের তলায় এক পোঁচ কালি নিয়ে ছেলে যেদিন টলতে টলতে বাড়ি ফিরল তার মা তো রেগেই কাঁই। এই কচি ছেলেপুলেগুলোকে এত পড়ার চাপ দেওয়ার কোনো মানে হয়! পড়ে পড়ে বাছার শরীরের কী হাল হয়েছে! বাপের অভিজ্ঞ চোখ। তিনি যা বোঝার বুঝে যান। মনে শুধু একটাই চিন্তা। নেশা করার ঝোঁকে বিষাক্ত কিছু খেয়ে ফেলেনি তো ছেলে! হে ভগবান এই নেশার ঘোর যেন জলদি কেটে যায়। ছেলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
মেয়েও বাড়ি ফিরেছে দেরি করে। তার নাকি জামাকাপড় সব এদিক ওদিক হারিয়ে গিয়েছিল। সেসব খুঁজে…গুছিয়ে গাছিয়ে তবে সে আসতে পেরেছে।
ছেলে মেয়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় বাবা-মায়ের খুব মন খারাপ। তবে তাঁরা যথেষ্টই বিচক্ষণ। ছেলে মেয়ের কাছে কিচ্ছুটি প্রকাশ করেননি। এবার খুব জাঁকজমক করে বড়দিন পালন করবেন তাঁরা। নিজেদের কষ্ট ভুলে উৎসবের জন্য সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন। এবারের বড়দিনে ছেলে-মেয়েকে একেবারে চমকে দেবেন তাঁরা। ছেলে মেয়ের মুখে একটু হাসি…এর চেয়ে বড় পাওনা বাপ-মায়ের আর কীইবা আছে! ছেলেমেয়ের জন্য এবার প্রচুর উপহার কিনেছেন তাঁরা। টম যখন তাঁর নিজের ছেলের বয়সি ছিলেন তখন তাঁর বাপের সারা বছরে যা রোজগার ছিল তার দ্বিগুন কি তিন গুণ টাকা তিনি খরচ করছেন এই সব উপহারের পেছনে। বছর খানেক আগেও কি এত টাকা খরচের কথা ভাবতে পারতেন তিনি! তাঁর ভাগ্য তো ফিরল এই সেদিন। তার তৈরি নতুন ওয়াটার প্রুফ রংটা জেনারেল মোটর্স কিনে নেওয়ার পর। সেই দৌলতেই না শহরতলিতে আজ তাঁর এই বিশাল বাড়ি…এত বিলাসিতা…এত বৈভব। এই রাজকীয় বিলাসিতার কথা তাঁদের বাবা-মা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছেন! আজ তাঁদের অবস্থা ফিরেছে। তাঁদের ছেলেমেয়েরা যে আরাম…যে স্বাচ্ছন্দ্য আজ পাচ্ছে তা তাঁরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি।
ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে মিউজিক রুমের ভেতর। পিয়ানোর ওপরে, পিয়ানোর বেঞ্চে, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সব উপহারের প্যাকেট। সব ঝলমলে রঙিন ফিতে দিয়ে মোড়া। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়, কোনোটা ভারি, কোনোটা হাল্কা। একটা প্যাকেটের ওপর টম আরেকটা প্যাকেটের ওপর গ্রেসের নাম লেখা। চাকর-বাকরদের জন্যও রয়েছে গোটা কয়েক প্যাকেট। বাকি সব টেড আর ক্যারোলিনের। বিশাল এক বাক্সে ক্যারোলিনের জন্য রয়েছে সীলের চামড়ার কোট। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকার সময় বছরে যত ভাড়া গুনতে হত তত টাকা দাম কোটটার। এতো কিছুই নয়। আরো বেশি টাকা খরচ করে মেয়ের জন্য গয়না কিনেছেন বাবা-মা। ওপালের* ব্রোচ…সোনার ওপর ওপাল বসানো ব্রেসলেট…আরেকটা ওপালের আংটি…তার চারপাশে আবার হিরে বসানো।
হিরে মুক্তো নয়…ওপালই গ্রেসের বরাবর পছন্দ। ইচ্ছে করলেই আজ তিনি নিজের জন্য ওপালের একখানা গয়নার সেট কিনতেই পারেন। কিন্তু কীসে যেন একটা বাধে। থাকগে মেয়ের জন্য কিনেই তাঁর সুখ। মেয়েকে এই গয়নায় সেজে উঠতে দেখেই তাঁর শান্তি। তারপর মেয়ের জন্য বাক্সভর্তি রেশমের মোজা, অন্তর্বাস, গ্লাভ আর রুমাল তো রয়েইছে। আর টেডের জন্যও কম কিছু নেই…তিনশো ডলারের ঘড়ি, বালজাকের রচনাবলীর ডিল্যুক্স সংস্করণ, স্টিলের পাত বসানো গলফ স্টিক…পোর্টেবল ফোনোগ্রাফ। আর আসল চমকটাই তো এখনও বাকি…সেটা রয়েছে গ্যারাজে। ঝাঁ চকচকে নতুন গাড়ি…কালো রঙের গরহ্যাম সেড্যান…যাকে বলে আভিজাত্যের শেষ কথা। এরপাশে টমের এক বছর পুরোনো গাড়িটাকে নেহাতই ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে। আবহাওয়া ভালো থাকলে এই ছুটিতে গাড়িটা নিয়ে টেড এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে পারবে। সামনের বসন্তে কি গ্রীষ্মের ছুটিতেও বাড়ি এসে গাড়িটা চালাতে পারবে। কিন্তু গাড়িটা ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যেতে পারবে না। ওখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের প্রাইভেট কার চালানো মানা।
টেডের তখন তিন বছর বয়স। আর ক্যারোলিনের এক। সেই তখন থেকে বড়দিনের আগের রাতে বাচ্চাদের মোজায় নানা রকমের খেলনাপাতি ঝুলিয়ে রাখেন টম আর গ্রেস। বাজার থেকে সস্তায় কেনা সব খেলনা। ষোলো বছর হয়ে গেল আজ। এবারই বা এটা বাদ যাবে কেন? মোজা ভর্তি খেলনা দেখলে ছেলে মেয়েরা মজা পাবে খুব। এবারে তাই মোজার ভেতরে ঢুকল একটা খেলনা পুতুল…নিগ্রো ডান্সিং ডল…মিউজিক বক্স…খেলনা বেড়াল…পেট টিপলেই সেটা আবার ম্যাঁও করে ডেকে ওঠে। ছেলে মেয়েদের আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে মা…বড়দিনের আগের রাতে কিন্তু লক্ষ্মী ছেলের মতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। নাহলে কিন্তু সান্টা ক্লজ আর আসবে না।
মায়ের কথা শুনে সাত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার বান্দা ওরা নয়। ছেলে মেয়ে দুজনেরই আগে থেকে বন্ধুদের কথা দেওয়া আছে। শহরে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ওদের পার্টি খানা-পিনা রয়েছে। বিয়াত্রিস মার্ডকের সঙ্গে ক্যারোলিন বেরিয়ে গেল নাটক দেখতে। বিয়াত্রিসের সঙ্গে রয়েছে ওর উনিশ বছরের দাদা। নাটক দেখে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরেই ওরা ফিরবে। ক্যারোলিনকে নিতে সাড়ে ছটার সময় বাড়িতে গাড়ি নিয়ে হাজির বিয়াত্রিসের দাদা। আর ওদিকে ক্লাশের দুই বন্ধু হার্ব ক্যাসল আর বার্নার্ড কিং-এর সঙ্গে টেড গেল হকি ম্যাচ দেখতে। বাবার গাড়িটা নিয়ে যেতে চেয়েছিল টেড। বাবাকে তখন একটু মিথ্যেই বলতে হল…গাড়িটার ব্রেকটা তো খারাপ হয়ে পড়ে আছে। টেডকে এখন কোনো মতেই গ্যারাজের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না…অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়েই টেড আর ক্যারোলিন পল মার্ডকের কেতাদুরস্ত রোডস্টারে হু…শ করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় মাকে বলে গেল বারোটার মধ্যেই ফিরে আসবে…খুব বেশি হলে ঘণ্টা খানেক দেরি হলেও হতে পারে। আর আগামীকাল রাতে তারা বাড়িতেই থাকবে।
ছেলে মেয়েরা সেই কখন বেরিয়েছে। তাদের পথ চেয়ে বসে আছেন বাবা মা। ওরা না ঘুমোনো অবধি যে মোজাটায় খেলনা ভরে ঝোলানো যাচ্ছে না। ওরা যে টের পেয়ে যাবে! আর মনে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করার কোনো মানেই হয় না। মনে মনে অধৈর্য হয়ে ওথেন গ্রেস।
‘ কটা বাজে এখন’…রাতে খাওয়া দাওয়ার পর যে বইটা ‘পড়তে’ শুরু করেছিলেন তার তিন নম্বর পাতা থেকে মুখ তুলে স্বামীকে শুধোন গ্রেস।
‘ আড়াইটে’ ( বারোটার পর থেকে প্রতি পনেরো কুড়ি মিনিট অন্তর এই একই প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে তাঁকে)।
‘ ওদের কিছু হয়নি তো?’
‘ কিছু হলে আমরা জানতে পারতাম’…শান্ত গলায় জবাব দেন টম।
‘ এমনটা হওয়ার কথা নয়…কিন্তু ধরো এমন কোনো জায়গায় ওদের দুর্ঘটনা ঘটল যেখানে বাড়িতে খবর দেওয়ার মতো আশে পাশে কেউ নেই তখন কী হবে? মার্ডক ছেলেটা কেমন গাড়ি চালায় আমরা তো কেউ জানিনা’।
‘ না না ও তো টেডেরই বয়সি। এই বয়সের ছেলেপুলেরা একটু জোরে গাড়ি চালায় বটে…তবে ওরা ভালো চালায়। ওদের একটা দায়িত্ব আছে…চিন্তা কোরো না’।
‘ তুমি কী করে জানলে?’
‘ আমি ওদের কয়েক জনকে গাড়ি চালাতে দেখেছি’।
‘ সবাইকে তো আর দেখনি?’
‘ পৃথিবীর কজন দেখেছে শুনি?’
‘ আজকালকার ছেলেপুলেরা এত বেপরোয়া…কোনো কান্ডজ্ঞান নেই ওদের’।
‘ ওহ এত চিন্তা কোরো না তো। হয়তো ওদের আরো কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে…দেখো গে হয়তো কোথাও খাওয়া দাওয়া করছে একসঙ্গে’।
টম উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ান। ভালো করে চারিদিকটা জরিপ করে নেন… ‘আজকের রাতটা ভারি সুন্দর। আকাশের সব কটা তারা গোনা যাচ্ছে’। মখে বললে কী হবে। তারাভরা আকাশের দিকে তাঁর মন নেই। মনটা তাঁরও আজ বড় বিক্ষিপ্ত। থেকে থেকেই তাঁর চোখ চলে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। ওই দূরে কি কোনো গাড়ির আলো দেখা যায়! নাহ তাঁর মনের ভুল। আবার নিজের জায়গায় এসে বসেন তিনি।
‘ কী গো কটা বাজে’…ছটফট করে ওঠেন গ্রেস।
‘ কুড়ি মিনিট বাকি’।
‘ মানে? কীসের কুড়ি মিনিট?’
‘ তিনটে বাজতে’।
‘ তোমার ঘড়ি নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। তোমায় এক ঘণ্টা আগে জিগ্যেস করলাম। তুমি বললে আড়াইটে’।
‘ আমার ঘড়ি একদম ঠিক আছে। তুমিই ঘুমিয়ে পড়েছিলে’।
‘ মোটেই না। আমি দু চোখের পাতা এক করিনি’।
‘ না, তুমি করেছিলে। তুমি শুতে যাচ্ছনা কেন বল তো?’
‘ তুমিই বা যাচ্ছ না কেন?’
‘ আমার ঘুম পায়নি’।
‘ আমারও পায়নি। টম তোমার এভাবে জেগে থাকার কোনো মানেই হয় না। আমি তো জেগে আছি অন্য কারণে। আমাকে তো মোজাটার একটা সদ্গতি করতে হবে নাকি। আর তাছাড়া আমার ঘুমও আসছে না একদম…কিন্তু তোমার অমন হাঁ করে বসে থাকার কোনো মানে আছে কী?’
‘ ওরা বাড়ি ফেরা না অবধি আমার দু চোখের পাতা এক হবে না’।
‘কী বোকা বোকা সব কথা। এত চিন্তার কী আছে শুনি? বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করছে। তোমারও তো একদিন ওই বয়স ছিল নাকি?’
‘ যা বলেছ। যখন বয়স ছিল তখন ছিল’। খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে জাহাজের খবরগুলো পড়ার বৃথা চেষ্টা করে যান টম।
‘ হ্যাঁ গো কটা বাজে’…গিন্নি আবার সেই একই প্রশ্ন।
‘ তিনটে বাজতে পাঁচ’।
‘ ওরা কি রাতে মার্ডকদের ওখানে থেকে যাবে নাকি?’
‘তাহলে তো আমাদের একটা খবর দিত’।
‘ টেলিফোন করে আমাদের হয়তো ঘুম থেকে জাগাতে চায়নি’।
তখন তিনটে কুড়ি। সামনের গেটে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
‘ ওই তো ওরা এসে গেছে’।
‘ আমি বলেছিলাম না অত চিন্তার কিছু নেই’।
ছুটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান টম। রাস্তায় মার্ডকদের দামি গাড়িটার আবছা অবয়ব দেখা যায়। গাড়ির ভেতরে অন্ধকার। আলোগুলো কি সব খারাপ হয়ে গেল নাকি?
‘ গাড়িতে কোনো আলো নেই। বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। যাই গে একবার নীচে নেমে দেখি…আলোটা ঠিক করতে পারি কিনা’।
‘ না যেতে হবে না’। চেঁচিয়ে ওঠেন গ্রেস। ও ছেলে নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে খন। গাড়িটা তো এখন দাঁড়িয়েই রয়েছে। আলো জ্বালিয়ে শুধু মুধু ব্যাটারি পুড়িয়ে হবেটা কী?’
‘ ওরা ভেতরে আসছে না কেন?’
‘ হয়তো কোনো পার্টি টার্টির প্ল্যান করছে’।
‘ সে তো ঘরে বসেও করতে পারে’।
‘দাঁড়াও আমি এক্ষুণি নীচে গিয়ে ওদের বলছি যে আমরা এখনো জেগে আছি’।
এবারেও বাধা দেন গ্রেস… ‘ না না যেতে হবে না’।
গিন্নির কথা শুনে জানালার ধারেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন টম।
ঘড়ির কাঁটা তখন চারটে। হেড লাইট জ্বালিয়ে গাড়িটা চলে যায়। বাড়িতে ঢোকে ক্যারোলিন। বাবা-মাকে জেগে থাকতে দেখে সে অবাক।
‘ এ কী? তোমরা এত রাতে কী জেগে বসে রয়েছ কেন?’
টম একটা কিছু বলতে যান। কিন্তু গ্রেস থামিয়ে দেন তাঁকে… ‘এই আমরা বসে বসে একটু গল্প করছিলাম। ওই আগেকার ক্রিসমাসের কথা…অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই না?’
‘ কে জানে …ঠিক বলতে পারব না’।
‘ কিন্তু টেড কোথায়?’
‘ সে কী? এখনও বাড়ি ঢোকেনি? আমরা তো ওকে হকি ম্যাচের ওখানে নামিয়ে দিয়েও চলে গেলাম। তারপর তো ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি’।
‘ ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়’…মা অভয় দেন মেয়েকে… ‘ তুমি খুব ক্লান্ত এখন’।
‘ হ্যাঁ ভীষণ। নাটকের পর আমরা অনেক নাচানাচি করেছি। কাল ব্রেকফাস্ট কখন?’
‘ আটটায়’।
‘ ওহ মা নটায় হয়না?’
‘ কেন হবে না। কিন্তু তুমি তো বড়দিনে সবসময় তাড়াতাড়ি উঠে যাও’।
‘ হ্যাঁ সে যাই…কিন্তু আজ …’
‘ কার সঙ্গে বাড়ি এলে?’ বাবা শুধোন মেয়েকে।
‘ কেন পল মার্ডক আর…আর বিয়াত্রিস’।
‘ তোমাকে খুব উস্কো খুস্কো আর এলোমেলো লাগছে’।
‘ ওই একটা ‘এলোমেলো’ সিটে বসতে দিল যে!’…নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলে মেয়ে। তারপর বাব মাকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। বাবা-মায়ের বেশি কাছে ঘেঁসার সাহস হয় না তার।
মেয়ে চলে যাওয়ার পর মুখ খোলে টম… ‘ মার্ডকদের আদব-কায়দা তো দারুণ। অতিথিকে বাড়ি বয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা লড়ঝড়ে সিটে বসিয়ে দিল’!
চুপ করে শুনে গেলেন গ্রেস।
‘ তুমি শুতে চলে যাও। আমি টেডের জন্য অপেক্ষা করছি…গিন্নিকে জানিয়ে দেন টম। কর্তার কথা শুনে হাঁ হাঁ করে ওঠেন গ্রেস… ‘ তুমি তো মোজাটার ব্যবস্থা করতে পারবে না’।
‘ আমি তো ওটাতে এখন হাতই দেব না। ওটা সকালে মানে বেলার দিকে করলেও চলবে’।
‘ সে যাই হোক তুমি শুতে না গেলে আমিও যাব না’।
‘ ঠিক আছে আমরা একসঙ্গেই যাব। টেডও মনে হয় একটু পরেই চলে আসবে। ওর বন্ধুরাই ওকে দিয়ে যাবে। ওরা এলে আমরা ঠিক গাড়ির আওয়াজ পাব’।
ছটা বাজতে দশে অবশেষে টেড যখন বাড়ি ফেরে তখন কারো টের পেতে আর বাকি রইল না। ক্রিসমাসের জন্য রাতভর অনেক কেনাকাটা করেছে ছেলে। হাতে মস্ত একটা প্যাকেট নিয়ে সে ঢুকল ঘরে।
সাড়ে সাতটায় নীচে নেমে চাকর বাকরদের নির্দেশ দিয়ে দেন গ্রেস…ব্রেকফাস্ট হবে নটায়। ফায়ার প্লেসের ধারে পেরেক পুঁতে মোজাটা ঝুলিয়ে দেন তিনি। এবার মিউজিক রুমে ঢুকে দেখে নিতে হবে সব ঠিকঠাক রয়েছে কিনা। টেডের টুপি আর কোটটা সরিয়ে নেন তিনি। মিউজিক রুমেই ওগুলো ফেলে চলে এসেছে ছেলে। নটার একটু আগে ওপর থেকে নেমে আসেন টম। গিন্নিকে বলেন এবার ছেলে মেয়েদের ডেকে দিতে।
‘আমিই ওদের ডেকে দিচ্ছি’ এই বলে গ্রেস চলে যান ওপরে। টেডের ঘরের দরজাটা আলতো করে খোলেন। ছেলে এখনও ঘুমে কাদা। ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে দরজাটা বন্ধ করে এবার ঢোকেন মেয়ের ঘরে। মেয়ের ঘুম এখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। মাকে দেখে ঘুম জড়ানো গলায় আবদার করে ওঠে মেয়ে… ‘এখনই উঠতে হবে নাকি মা? মাইরি বলছি এখন দাঁতে কিছু কাটতে পারব না। মোল্লাকে বল না আমাকে একটু কফি দিয়ে যেতে। আজ আবার মার্ডকদের ওখানে ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন। সাড়ে বারোটার সময়…আরো দু-এক ঘণ্টা এখন ঘুমিয়ে নিতে পারব’।
‘ কিন্তু সোনা আজ যে একটার সময় আমাদের ক্রিসমাসের খাওয়া দাওয়া আছে’।
‘ ওহ মা খুব ভুল হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের খাওয়া দাওয়াটা রাতে’।
‘ তোমার উপহারগুলো দেখবে না?’
‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখব। তবে একটু পরে দেখলে হয় না মা?’
গ্রেস রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। রাঁধুনিকে বলতে খাওয়া দাওয়া একটার বলে সন্ধে সাতটায়। কিন্তু তিনি তো সিগনেকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছেন যে বিকেলটা আজ ছুটি দিয়ে দেবেন। দুপুরে অত ভারি খাওয়া দাওয়ার পর সন্ধেটায় তিনি ভেবেছিলেন হাল্কাফুল্কা কিছু খাবার বানিয়েই চালিয়ে নেবেন।
ছেলেমেয়েরা কেউ নীচে নামেনি। প্রাতরাশের টেবিলে শুধু কর্তা গিন্নি। একা একাই খেতে হল তাঁদের। বসার ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে আবার একটু গল্প গুজব করেন…ভাবনা চিন্তা করেন। কখনো বা একটু পড়ার ভান। ছেলেমেয়েদের এই রকম সকম দেখে আর চুপ থাকতে পারেন না টম… ‘তোমার কিন্তু ক্যারোলিনের সঙ্গে এবার একটু কথা বলা দরকার’।
‘ সে আমি বলব। তবে আজ নয়। আজ যে বড়দিন’।
‘ আমাকেও টেডের সঙ্গে কথা বলতে হবে দেখছি’।
‘ সে বোলো কিন্তু আজ নয়’।
‘ আমার মনে হয় আজ রাতেও ওরা বেরোবে’।
‘ না না আজ রাতে ওরা বাড়িতেই থাকবে। আমাকে যে কথা দিয়েছে। সবাই মিলে আজ আমরা সন্ধেটা একসঙ্গে কাটাব’।
‘ আমি এখনও বলছি অত আশা করো না’।
ছেলেমেয়েরা যখন নীচে নামে তখন সন্ধে গড়িয়ে গেছে। বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে হামি দিয়ে বড়দিনে শুভেচ্ছে আর আদর জানাতে কোনো ভুলচুক হয়না তাদের। মার্ডকদের বাড়িতে ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন নেওয়া হয়ে গেছে সে জন্য মা-বাবার কাছে বারবার ক্ষমাও চেয়ে নেয় তারা।
‘ আমি আর বোন দুজনেই ভেবেছিলাম যে আমাদের খাওয়া দাওয়া সন্ধে সাতটায়…তাই আরকি’…সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করে টেড।
‘ এ বাড়িতে ক্রিসমাসের খাওয়া দাওয়াটা বরাবরই একটায় হয়’…ছেলেমেয়েদের খামখেয়ালিপনা দেখে আর চুপ থাকতে পারেন না টম।
‘আসলে আজ যে ক্রিসমাস সেটাই মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গিয়েছিল’…টেডের একেবারে সোজাসাপটা জবাব।
‘ ওখানে ঝোলানো মোজাটা দেখেও কিছু মনে পড়ল না?’
এবার দু ভাইবোনেরই চোখ যায় খেলনাপাতি ঠাসা ওই মোজাটার দিকে।
‘কিন্তু মা আমাদের ক্রিসমাস ট্রি কোথায়?’
‘ রোসো রোসো সব আছে। আগে মোজাটা তো দেখ’।
‘ মা আমাদের হাতে আর একদম সময় নেই। এক্ষুনি বেরোতে হবে। আগে কি আমরা ক্রিসমাস ট্রি টা দেখতে পারিনা?’
‘ হ্যাঁ কেন পারবে না?’…ছেলেমেয়েকে নিয়ে মিঊজিক রুমের দিকে পা বাড়ান গ্রেস। চাকরবাকরদেরও তলব করা হয় ঘরে। সাজানো গোছানো ক্রিসমাস ট্রির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সবাই। মেয়েকে কাছে টেনে নেন গ্রেস… ‘তোমার উপহারগুলো দেখবে না?’
‘এখন সবকটা প্যাকেট খুলে দেখার সময় নেই মা। তুমি শুধু বল কোনটা স্পেশাল’।
বিরাট বাক্সটার মোড়ক খুলে মেয়ের ওভারকোট খানা বের করেন গ্রেস। আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে ক্যারোলিন… ‘ওহ মা করেছটা কী?’ এ যে সীলের চামড়ার কোট’।
‘ একবার পরে তো দেখো’ মেয়ের কাছে বাপের আবদার’
‘ এখন নর…পরে…এখন এখদম সময় নেই’।
‘ আরে এইটে তো দেখো’ এই বলে মেয়ের গয়নার বাক্স খোলেন মা।
‘ ও মা! এ যে ওপাল’।
‘ মণিমুক্তোর মধ্যে এইটেই আমার সবচেয়ে পছন্দের’।
‘ কেউ যদি কিছু মনে না করে আমি একটা কথা বলি…মাঝপথে নাটকীয় গলায় বলে ওঠে টেড … ‘আমি ফিরে আসার পর এই উপহারের প্যাকেট ট্যাকেট খুলব। তোমরা আমায় যা দিয়েছ সবই খুব পছন্দ হবে আমার। আর গাড়িটা যদি ঠিক না থাকে তাহলে তো আমাদের ট্যাক্সি ডাকতে হবে…তারপর ট্রেন ধরতে হবে…সে অনেক ঝক্কি’।
‘ মনে হয় গাড়িটা ঠিকই আছে। একবার এসো তো আমার সঙ্গে গ্যারাজে। দেখি গাড়িটার কী হাল। হ্যাট কোট চাপিয়ে টেড একেবারে বেরোনোর জন্য তৈরি। মাকে আলতো করে চুমু খেয়ে এবার সে বেরিয়ে পড়ে… ‘ওহ মা খুব ভুল হয়ে গেছে। তোমার আর বাবার জন্য তো কোনো উপহারই আনা হয়নি। কলেজে শেষ তিনদিন তো দম ফেলারই ফুরসৎ পাইনি। ভেবেছিলাম কাল রাতে একটু কেনাকাটা করব। কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়াতে মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে গেল। তারপর দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেল সব’।
ছেলেকে সান্ত্বনা দেন মা… ‘ওহ সোনা অত ভাবতে হবে না। ক্রিসমাস তো তোমাদের মতো ছেলেপুলের জন্য। আমাদের বয়স হয়েছে। আমাদের উপহার টুপহার না হলেও চলে’।
চাকর বাকরেরা এসে তাদের উপহারের প্যাকেট নিয়ে মালিক মালকিনকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে যে যার মতো সরে পড়ে।
মিউজিক রুমে এখন শুধু মা আর মেয়ে।
‘ আচ্ছা মা কোন দোকান থেকে কোটটা কিনেছ’।
‘ কেন? লয়েড অ্যান্ড হেনরিজ’।
‘ ওরা সব ধরণের পোশাক আশাক রাখে তাই না?’
‘ হ্যাঁ’।
‘ মা, আমি যদি এটা বদলে অন্য একটা নিই তুমি কি খুব রাগ করবে?’
‘ একদম নয় সোনা। তোমার যেটা খুশি নিতে পার। তবে এটা একটু বেশি দামি তো! তবে তাতে কিছু যায় আসে না। তোমার পছন্দ হলেই আমি খুশি। কাল বা পরশু আমরা একসঙ্গে তাহলে শহরে যাব। কিন্তন মার্ডকদের বাড়িতে ওপালের গয়নাগুলো পরে যাবে না?’
‘ না মা। কোথায় হারিয়ে ফেলব…তাছাড়া গয়নাগাঁটি পরতে আমার অত ভালো লাগে না’।
‘ তাহলে ওগুলোও বদলে নেওয়া যাবেখন। যাও তৈরি হয়ে নাও। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে’।
এই কথাটা শোনারি অপেক্ষায় ছিল ক্যারোলিন। একছুটে চলে যায় সে। একা ঘরে গ্রেসের মাথায় কত হাবিজাবি ভাবনা খেলে যায়।
ওদিকে ছেলেকে নিয়ে গ্যারাজের দরজা খোলেন টম। গ্যারাজে পাশাপাশি দুটো গাড়ি দেখে। একটু অবাকই হয় টেড… ‘ বাবা দুটো গাড়ি কবে থেকে হল’।
‘ নতুনটা আমার নয়’।
‘ তবে কার?’
‘ তোমার। এক্কেবারে নতুন মডেল’।
‘ বাবা, এ তো দারুণ চমক। কিন্তু এটাকে তো পুরোনোটার মতোই দেখতে’।
‘ পুরোনো গাড়িটা তো দারুন কাজের। তবে তোমারটা আরো ভালো। গাড়িটা চালিয়ে বুঝবে কী আরাম! মনে হবে পাখির মতো আকাশে উড়ছ। গাড়িতে গ্যাস ভরে দিয়েছি আমি’।
‘ বাবা আমি পুরোনোটাই নিয়ে যাই কেমন?’
‘ কেন? পুরোনোটা কেন নেবে?’
‘ বাবা, আসলে আমার বার্নেস স্পোর্টস রোডস্টারের খুব শখ…ওই পল মার্ডকের যেমন আছে। শুধু রংটা একটু আলাদা হলেই আমার চলবে। তাই এই গাড়িটায় হাত না দেওয়াই ভালো। তাহলে তুমি এটা ফেরত দিয়ে দিতে পারবে বা বার্নি কোম্পানিকে এই গাড়িটা দিয়ে সস্তায় একটা রোডস্টার পেয়ে যেতে পারো’।
অনেকক্ষণ কোনো কথা যোগায় না টমের মুখে। রীতিমতো বুরবক বনে গেছেন তিনি। অনেক পরে মুখ খুলতে পারেন… ‘ আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। আমার গাড়িটাই নিয়ে যাও। দেখি তোমার গাড়িটা নিয়ে কী করা যায়’।
দাদার জন্য অপেক্ষা করছিল ক্যারোলিন। হঠাৎ কিছু একটা মনে মাকে ডেকে ওঠে… ‘ ওহ মা আমার একদম মনে ছিল না। তোমার আর বাবার জন্য এই দুটো টিকিট… “জলি জেন” এর। কাল রাতে এই নাটকটাই তো আমরা দেখলাম। দারুণ। তাই তোমাদের জন্য টিকিটটা নিয়ে এলাম। তোমাদের খুব ভালো লাগবে দেখে নিও’।
‘ কিন্তু নাটকটা কখন?’
‘ কেন? আজ রাতে’।
‘ কিন্তু সোনা, আজ তো আমরা কোথাও বেরোব না। তোমরা কিন্তু কথা দিয়েছ আজ বাড়িতে থাকবে’।
‘ আমারা আমাদের কথা রাখব’…জবাব দেয় ক্যারোলিন। কিন্তু সন্ধেবেলা মার্ডকরা আসতে পারে। ওরা আরো কয়েকজন বন্ধু বান্ধবকেও আনবে। এখানে নাচা গানা হবে। জোরে গান চলবে। আই আমি আর টেড ভাবলাম এই এই হই হট্টগোলে তোমাদের হয়তো আসুবিধে হবে। তাই সন্ধেটা তোমরা যদি বাইরে কাটিয়ে আস…’
‘না না সোনা এ কী কথা! আমাদের কথা ভেবে নাটকের টিকিট এনেছ তাতেই মন ভরে গেছে। তোমরা একটু আমোদ আহ্লাদ করবে তাতে আমাদের আবার কী আসুবিধে হবে? তোমাদের আনন্দেই আমাদের আনন্দ।
‘ না না তা নয়। ভাবলাম তুমি আর বাবা একসঙ্গে একটু নিজেদের মতো করে একটু ভালো সময় কাটাতে পারবে…তাই আনলাম এই টিকিটটা’।
‘ আমাদের সবচেয়ে ভালো সময় কাটে তো তোমাদের নিয়ে…আমাদের দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমরা সারা সন্ধে গল্পগুজব করে কাটাব…এর চেয়ে ভালো কিছু তো আমি ভাবতেই পারিনা’।
‘ আসলে মা জানো তো মার্ডকরা নিজেরাই যেচে এই নেমন্তন্নটা নিল। ওরা নিজেরাই আসবে বলল। আমি তো আর মুখের ওপর না বলতে পারি না। ওরা এতবার আমাদের নেমন্তন্ন করেছে। সত্যি বলছি মা, নাটকটা কিন্তু তোমাদের দারুণ লাগবে’।
‘ রাতে বাড়িতেই খাবে তো?’
‘এখনও পর্যন্ত তো তাই ঠিক আছে। তবে আমাদের যদি একটু দেরিও হয় তুমি আর বাবা একটু অপেক্ষা করবে না? সাতটা কুড়ির ট্রেনটা ধরে নাও…সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে। একটাও সিন আর মিস করতে হব না। মা নাটকের প্রথম অ্যাক্টটা কিন্তু সত্যিই দারুণ। আমাদের মনে হয় খিদে পাবে না। তাও সিগনেকে হালকা কিছু একটা বানিয়ে দিতে বোলো…যদি খেতে ইচ্ছে করে’।
ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে যায়। চর্ব চোষ্য সাজিয়ে বড়দিনের ভোজে বসেন টম আর গ্রেস। মুখে কেউ বিশেষ কিছু তুলতে পারেন না। ষোলো পাউন্ডের টার্কির রোস্ট দেখের জিভে তাঁদের জল এল না। আসলে খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে তাঁদের। একটু কিছু মুখে তুলতে হয় তাই খেতে বসা। সিগনের হাতের রান্নাটা আজ বেড়ে হয়েছে…আকাশ আজ বেশ পরিষ্কার…এই নিয়ে টুকটাক কথা চলে তাঁদের। ছেলেমেয়ে আর বড়দিনের প্রসঙ্গ কেউই পারতপক্ষে তোলেন না।
আজ ছুটির দিন। বাড়িতে কিছু করারও নেই। তার ওপর হাতে দুখানা থিয়েটারের টিকিটও রয়েছে। দেখে আসাই যাক। ছটা দশের ট্রেনটা ধরলেই হবে। আর রাতের খাওয়ারটা না হয় মেট্রোপলেই হয়ে যাবে। টমের এই প্রস্তাবে গিন্নি কিছুতেই রাজি নন। ছেলে মেয়ে ফিরে যদি দেখে বাড়ি ফাঁকা তাহলে যে ওদের মন খারাপ হবে। কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নেন টম।
কর্তা গিন্নি বাড়িতেও বসে থাকেন। অনন্ত সময় যেন আর কাটেনে। সন্ধে সাতটা বেজে যায়। ছেলে মেয়ের টিকির দেখা নেই। অগত্যা তাঁরা ট্যাক্সি ধরে সোজা স্টেশনে চলে যান। তারপর ট্রেন ধরে শহরে। যাওয়ার পথে দুজনে গম্ভীর। কথাবার্তা হলনা বিশেষ। গ্রেস ভেবেছিলেন নাটকটা দেখে মনটা অন্তত ভালো হবে। কিন্তু এত রদ্দিমার্কা নাটক তিনি জীবনে দেখেননি। ওই যে দুটো নাটক আছে না ‘ক্র্যাডল স্ন্যাচার্স’ আর ‘সেক্স’…ওগুলো সবচেয়ে বাজে জিনিসগুলো নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকানো একটা নাটক। যাচ্ছেতাই!
কোনো মতে নাটক শেষ হতেই টম বলে… ‘এখন আমি আমি আমার গিন্নিকে কোভ ক্লাবে নেমন্তন্ন করছি। সকালে, দুপুরে, সন্ধেতে তুমি কিচ্ছু ভালো করে মুখে তোলোনি। এই উৎসবের দিবে তোমায় আমি অনাহারে রাখতে পারিনা। আমারও বাবা খুব খিদে পেয়েছে…তার ওপর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে’।
স্পেশাল থালি অর্ডার দিয়ে খাওয়ার শেষ করতে দুজনেরই নাকানি চোবানি অবস্থা। তেষ্টা মেটাতে পর পর ছয় পেগ হাই বল* নিয়ে নেন টম। তাও যেন মনটা ফুরফুরে হয়না। থেকে থেকেই কেমন যেন গুমরে ওঠে ভেতরটা। গ্রেসও হাই বল নেন এক পেগ। মনটা ক্ষণিকের জন্য একটু খুশি খুশি লাগে। ফেরার পথে ট্রেনটা যত বাড়ির দিকে আসে মনটা কেমন যেন তিতকুটে লাগে।
বাড়ি ফিরে দুজনেরই চোখ কপালে। বসার ঘরের একেবারে ছত্রখান অবস্থা…যেন খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে একটা। টেড আর ক্যারোলিন অবশ্য নিজেদের কথা কিছুটা হলেও রেখেছে। তারা বাড়ি থেকে বেরোয়নি। মার্ডকরা যেখান থেকে যত পারে বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে এনেছে। ঘরের অবস্থা দেখেও মালুম হয়। টেবিলে মেঝেতে ফাঁকা গেলাস গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘরময় ছাই আর সিগারেটের টুকরো। পেরেক থেকে খেলনা ভরা মোজাটা কে যেন আনাড়ি হাতে ছিঁড়ে নামিয়েছে। খেলনাগুলো সব মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রেসের প্রিয় কার্পেটে দুটো বড় বড় ফুটো…সিগারেটের ছাই টাই পড়েছে বোধহয়।
গিন্নিকে হাত ধরে মিউজিক রুমে নিয়ে যান টম… ‘তুমি কিন্তু তোমার উপহারের প্যাকেটটা এখনও খোলোনি’।
‘ সে তো তুমিও খোলোনি…ওরা এই ঘরে আসেনি। খুব একটা নাচা নাচা মনে হয় হয়নি’।
গিন্নির কাছ থেকে নিজের উপহারটা নেন টম। উৎসব অনুষ্ঠানে পরার জন্য হিরে বসানো কাফ বোতাম। আর কর্তার কাছ থেকে গ্রেস পেলেন ওপালের আংটি।
‘ওহ টম। কী দারুণ!’
আজ তাঁদের উৎসব। শুধু তাঁদের দুজনের।
‘ চল কাল রাতেই কোথাও বেরিয়ে পড়ি। তাহলে এই জিনিসগুলোও পরা হয়ে যাবে’।
‘ হ্যাঁ তার জন্য আজ রাতে ভালো করে বিশ্রাম নিতে হবে’।
‘ তুমি ওপরে যাও আমি এক্ষুনি আসছি’।‘ বড়দিন’ গল্পটি রিং ডব্লিউ লার্ডনারের ‘ওল্ড ফোকস ক্রিসমাস’ গল্পের অনুবাদ।
• এক ধরণের অ্যালকোহল মেশানো পানীয়। -
জানালা
জানালা
–এডিথ হোয়ার্টন
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
ওই জানালাটা তাঁর বড় প্রিয়। জানালা দিয়ে বাইরের এমন কিছু আহামরি দেখাও যায় না। তবে যা দেখা যায় মিসেস ম্যানস্টেরকাছে তাই ঢের। জানালার ওপারের জগতটা তাঁর কাছে ভারি সুন্দর। নিউ ইউর্কের এই বোর্ডিং এর চার তলায় জগদ্দল পাথরের মতো সেই কবে থেকে থিতু হয়ে বসেছেন তিনি। পাশের রাস্তার ধারে সবসময় জঞ্জালের গাড়ির আনাগোনা। ফুটপাথে যেটকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে কুইন্টাস কার্টিয়াসের মতো মানুষওবুরবক বনে যেতে পারে। মিসেস ম্যানস্টের স্বামী মারা গেছেন অনেক দিন। তিনি ছিলেন বিরাট এক পাইকারি দোকানের ক্লার্ক। স্বামী চলে যাওয়ার পরে বড় একা হয়ে পড়েছেন মিসেস ম্যানস্টে। থাকার মধ্যে মধ্যে ছিল এক মেয়ে। সেও বিয়ের পর ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে নিউ ইয়র্ক আসার ধকল তার পোষায় না। মিসেস ম্যানস্টে চাইলে অবশ্য মেয়ের কাছে যেতে পারেন। কিন্তু এতদিন দূরে দূরে থাকার পর মা-মেয়ের বাঁধনটা কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে। সেই টানটা আর নেই কারো। দুজনের মধ্যে যোগাযোগ বলতে কখনো সখনো মামুলি দু একটা চিঠি। মেয়ে লেখে দায়সারা ভাবে। আর মা লেখেন অতি কষ্টে। ডান হাতে এখন আর জোর পান না তিনি। বাতে হাতটা পুরো অকেজো হতে বসেছে। মেয়ের কাছে যাওয়ার জন্য যদি কখনো মনটা উচাটনও হয় এই চারতলা সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নামার কথা ভাবলেই গুটিয়ে যান তিনি। বয়স বাড়ছে। শরীরে সেই তাকতও নেই আর । তাই নিউ ইয়র্কের বোর্ডিং-এর এই নির্জন বাসকেই নিজের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন তিনি।
সত্যি কথা বলতে এমনিতে খুব একটা একা নন তিনি। এখনো জনা কয়েক বন্ধু কষ্ট করে হলেও দেখা করে যায় তাঁর সঙ্গে। কিন্তু দিনদিন তাঁদের আনাগোনাও কমছে। সবারই তো বয়স হচ্ছে। লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মিশতে পারেন না তিনি। যতদিন স্বামী ছিলেন তাঁকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন মিসেস ম্যানস্টে। অন্য কোনো সঙ্গী সাথীর দরকার হয়নি। গ্রামে গিয়ে থাকার বড় সাধ ছিল তাঁর। কত স্বপ্ন দেখতেন তিনি…তাঁর গ্রামের বাড়িরে একটা মুরগি খামার থাকবে…সামনে থাকবে একটা বাগান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চাওয়াটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। কিন্তু নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা নিঃসঙ্গ মানুষটার মধ্যে পশুপাখি…গাছপালার প্রতি নিবিড় ভালোবাসাটা সেই রয়েই গেছে। এই ভালোবাসার জন্যই তো ওই জানালাটার পাশে তাঁর সারাক্ষণ সেঁটে থাকা। জানালা কী যে অত দেখেন কে জানে। আর কারো চোখে তো তেমন কিছুই পড়ে না। অতি বড় রসিকজনও এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় হতাশ হবেন। কিন্তু ওই জানালাটাই সে মিসেস ম্যানস্টের জগত। তাঁর বাক্স মতো জানালায় যত্ন করে আইভি লতা আর লিলি লাগিয়েছেন তিনি। লিলির চারাগুলো তেমন পুষ্ট হয়নি অবশ্য। জানালা দিয়ে এই বোর্ডিং-বাড়ির উঠোন দেখার চেষ্টা করেন তিনি…কিন্তু ভালো করে দেখতে পাননা। জানালার নীচে এইলান্থাসের ডালপালাগুলো শুধু নজরে পড়ে। বছরের শুরুতেই ডিসেনট্রার ঝোপে গোলাপির উচ্ছাস। মানুষের হার্টের মতো দেখতে ফুলগুলোর গোলাপি আভায় মাতোয়ারা হয়ে যান তিনি।
তবে আশে পাশের বাড়িগুলোর উঠোনের দিকেই তাঁর নজর যায় বেশি…সেখানেই তাঁর যত আগ্রহ। বোর্ডিং বাড়ির লাগোয়া উঠোন কত আর ঝকঝকে তকতকে হবে! সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটা দিনে উঠোন বেয়ে সারি সারি জামা কাপড়, ছেঁড়াখোঁড়া টেবিল ক্লথ শুকোয়। এতে অবশ্য কিছু যায় আসেনা মিসেস ম্যানস্টের। যা দেখার এর মধ্যে থেকেও তা দেখে নেনতিনি । কোনো কোনো উঠোন জুড়ে আবার রাবিশের স্তূপ। পায়ের চলার মোরাম-পথে ইতিউতি ঘাস গজিয়েছে শুধু। বসন্তের কড়া রোদের দিনেও গাছের শীতল ছায়া মেলে না…ওই সারি সারি মেলা কাপড় চোপড়ের ছায়াই যা সম্বল। এই ম্যাড়ম্যাড়ে উঠোনগুলো একদম তাঁর পছন্দ হয় না। গাছ গাছালিতে ভরা উঠোনগুলোই তার বড় কাছের। তবে এখন অনেক কিছুই তাঁর চোখে সয়ে গেছে। ধুলোভরা রাস্তা…জঞ্জালের ঢিবি…এখানে ওখানে ছড়ানো বোতল, ভাঙাচোরা জিনিসপত্র দেখে আজকাল আর কিছু মনে হয় না। হাঁসের মতোই দুধ আর জল আলাদা করতে শিখে গেছেন তিনি। এই নোংরা…এলোমেলো জায়গার মাঝে যা কিছু সুন্দর…মনোরম শুধু সেটুকুই ছেঁনে নেন ।
এই তো আজ পাশের উঠোনে এমন এপ্রিলের দিনে ঘন নীল আকাশের পানে কেমন সাদা পাপড়ি মেলে দিয়েছে রাজকীয় ম্যাগনোলিয়া! তার পর মে মাসে শুরু হবে উইসতারিয়ার উৎসব। ওই ওদিকের উঠোনের বেড়াটা ছেয়ে যা্বে বেগুনি ফুলে। বড় বড় পাতার আড়াল ভেদ করে মাথা তুলবে গোছা গোছা হর্স-চেস্টনাট। হলদে আর গোলাপির সাজে সেজে উঠবে প্রকৃতি। আর জুন মাস এলেই ঠিক উলটো দিকের উঠোনে সকলের নজরের আড়ালে অবহেলায় আলগোছে বেড়ে উঠবে লাজুক সিরিঞ্জা। কোনো বাধার কাছেই হার মানবে না সে…যে করেই হোক নিজের মাথাটা বাড়িয়ে দেবে আলোর পানে।
গাছপালা, লতাপাতা নিজের মিসেস ম্যানস্টের আগ্রহ হয়তো একটু বেশিই কিন্তু তা বলে আশে পাশের বাড়ির মানুষগুলোকে নিয়েও কৌতূহল তাঁর কিছু কম নেই। উলটো দিকের ডাক্তারের বাড়ির জানালায় সরষে-রঙা পর্দাটা দেখে মুখটা বেজার হয়ে গেছে তাঁর। এই সেদিনই নতুন লাগানো হল পর্দাটা। বাড়ির রঙের সঙ্গে একদন মানাচ্ছে না ওটা। তবেওই নীচের পুরোনো ইঁটের বাড়িটায় নতুন রঙের পোঁচ পড়ায় বেজায় খুশি হয়েছেন তিনি। আশে পাশে বাড়িগুলোর লোকজন অবশ্য এই পেছনের জানালার দিকে বিশেষ আসেন না। তাই মোলাকাতও হয় না তাঁদের সঙ্গে। তবে চাকর বাকরদের দেখা মেলে হামেশাই। কাজের মেয়েগুলো বড্ড ক্যাঁচর ম্যাঁচর করে বটে। ওদের হাবভাব…রকম সকম একদম পছন্দ হয় না মিসেস ম্যানস্টের। তবে যে বাড়িটায় নতুন রঙ হল সে বাড়ির রাঁধুনি মেয়েটা কিন্তু বেশ। মালকিন হরদম ওর ওপর চেঁচাচ্ছে…গালাগালি দিচ্ছে তাও মেয়েটার মুখে কোনো রা নেই। রাত হলে সে আবার লুকিয়ে লুকিয়ে রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ায়। মেয়েটাকে বড় ভালো লাগে মিসেস ম্যানস্টের। বড় মায়া হয় ওর জন্য। আবার ওই যে ওপাশের বাড়ির কাজের ছুঁড়িটার কাণ্ড দেখে একবার মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সে বেটি দু দি…ন টিয়াপাখিটাকে খাবার দেয়নি। তিন দিনের দিন আর চুপ করে থাকতে পারেননি মিসেস ম্যানস্টে। বাতে প্রায় পঙ্গু হাত নিয়েই কোনো রকমে একটা চিরকুটে লিখে ফেললেন… ‘ ম্যাডাম আপনার টিয়া তিন দিন কিছু খায়নি’। তার একটু পরেই ছোলার বাটি নিয়ে হাজির হলেন সে মহারানি!
জানালার ধারে চুপ করে থাকতে থাকতে মনটা কোণ দিকশূন্যপুরে হারিয়ে যায় তাঁর। পড়শিদের উঠোন…চারপাশের ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি চলে যায় অনেক অনেক দূরে…ওই মিনারটা যেখানে আকাশে গিয়ে মিশেছে। বাদামি পাথরের চূড়াটা যখন গোধূলির রাঙা আলোয় ডুবে যায় তখন ইউরোপের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে তাঁর। সেই কবেকার কথা। ঝাপসা স্মৃতিগুলো ছায়াছবির দৃশ্যপটের মতো মনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে সেই গির্জার চূড়ো আর মায়াবি আকাশের কথা। তাঁর মধ্যে আসলে একটা শিল্পী মন লুকিয়ে রয়েছে। যে রূপ-রং-রসে তিনি মজে থাকেন সাধারণ চোখে আবার তা ধরা পড়ে না। প্রথম বসন্তের সবুজ বনানী তাঁর যত প্রিয়, ততটাই তাঁর মন কাড়ে বরফ-ভেজা দিনের শেষে ধোঁয়াটে বিবর্ণ আকাশের গায়ে জেগে থাকা ন্যাড়াডালপালাগুলোর অনুপম ভাস্কর্য।
রোদ ঝলমলে মার্চের দিনে মনটা খুশিয়াল হয়ে ওঠে তাঁর। বরফের ব্লটিং পেপারের ওপর চুঁইয়ে পড়া একফোঁটা কালির মতো জেগে ওঠে সবুজ মাটি। মন তাঁর মাতন লাগে। আরো যেন ভালো লাগে কুয়াশাচ্ছন্ন দূর আকাশের গায়ে নিষ্পত্র…অথচ প্রাণোচ্ছল ডালপালার জাফরি…শীত-আকাশের গায়ে যেন কোনো বিচিত্র শিল্পকলা। ওই দূরে কল-কারখানার চিমনির ধোঁয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কারখানা বন্ধ হলে ধোঁয়াও থাকে না আর। মনটা উশখুশ করে মিসেস ম্যানস্টের। খালি মনে হয় কী যেন একটা নেই।
জানালার ধারেই কেটে যায় তাঁর বেশিরভাগ সময়। এখানে বসেই তিনি একটু পড়াশোনা করেন…উল বোনেন। কতগুলো যে মোজা বুনে ফেলেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই জানালার ধার…জানালার বাইরে ওই চারপাশের দুনিয়াটা ছাড়া তাঁর চলে না। নিঃসঙ্গ ওই দ্বীপটার মতোই অবস্থা তাঁর…চারপাশে সমুদ্র ছাড়া যার কোনো অস্তিত্বই নেই। মাঝে মাঝে দু একজন দেখা করতে আসে বটে তখন আবার তাঁর মহা মুশকিল। জানালাটা থেকে কিছুতেই চোখই সরাতে পারেন না তিনি। পাশের বাড়ির জানালার ঝাড়পোঁছ…কিংবা ওদিকের বাড়ির ফুলের বাগানের মধ্যে একটা সবুজ পাতা দেখতেই হয়তো ব্যস্ত ছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন ওটা কি হায়াসিন্থ! এমন গভীর চিন্তার সময় কেউ যদি এসে ডাকে মনে মনে একটু বিরক্তই হন তিনি। কিন্তু কী আর করা! অতিথি এসে বকম বকম করে। নিজের নাতি নাতনির গল্প করে। তিনি মন দিয়ে শোনার ভান করে যান। এদের সঙ্গে ঠিক মন খুলে মিশতে পারেন না তিনি। তাঁর মন যে পড়ে থাকে ওই উঠোনের দিকে…সেখানকার লোকজনেদের দিকে…হায়াসিন্থ, ম্যাগনোলিয়া আর টিয়াপাখিটার দিকে। ওই যে কাজের মেয়েটা লুকিয়ে রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ায়…সরষে রঙা পর্দার ওপারে যে ডাক্তার ভারী ভারী জার্নাল পড়েন…এঁরাই যে তাঁর পরম বন্ধু। তার মন জুড়ে থাকে অস্তরাগের আলোয় রাঙানো আকাশ-ছোঁয়া ওই মিনার। আর কেউ না…আর কিচ্ছু না।
এপ্রিল পড়ে গেছে। সেদিন জানালার ধারে তাঁর প্রিয় জায়গাতে বসেছিলেন মিসেস ম্যানস্টে। উল কাঁটা সব পাশে ছড়ানো। চোখ তাঁর আকাশের দিকে। আকাশের গায়ে সাদা মেঘেদের ভেলা। চোখ আর তাঁর সরে না। হঠাৎই দরজায় ঠকঠক। বোর্ডিং-এর মালকিন এসেছেন দেখা করতে। মালকিনকে অত পাত্তা টাত্তা দেন না মিসেস ম্যানস্টে। তবে তিনি দেখা করতে এলে ওপরে ওপরে যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রাখেন। ওই নীল আকাশ আর পাশের বাড়ির ম্যাগনোলিয়ার গাছটার থেকে নজর সরিয়ে আর কিছুতেই যেন মিসেস স্যাম্পসনের সাদামাটা মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি!
‘ এবার কত তাড়াতাড়ি ম্যাগনোলিয়া ফুটেছে দেখুন তো! কী অবাক কাণ্ড তাই না মিসেস স্যাম্পসন?’ আজ আর নিজের উত্তেজনা কিছুতেই চেপে রাখতে পারলেন মিসেস ম্যানস্টে। নাহলে এমনিতে তাঁর এই দুনিয়ার ভাগ কাউকে দিতে চান না তিনি। কেনইবা দেবেন! তাঁর এই উদ্ভট শখের কথা তাঁর অতিথিদের মাথায় ঢুকবে না। আর তাছাড়া মনের কথা অত ভালো করে প্রকাশ করতেও পারেন না তিনি। কখন কোন শব্দটা বলা উচিত মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যায় তাঁর।
‘ কী যেন বললেন মিসেস ম্যানস্টে?’ অবাক হলেন মালকিন। ঘরটা ভালো করে দেখে নিলেন তিনি। কিন্তু কোথায় ম্যাগনোলিয়া?
‘ না মানে আমি পাশের বাড়ির…ওই মিসেস ব্ল্যাকের উঠোনের ম্যাগনোলিয়া গাছটার কথা বলছি’।
‘ ওহ তাই নাকি? ওখানে কোনো ম্যাগনোলিয়া আছে জানতাম না তো!’ আলগোছেই কথাখানা বলেন মিসেস স্যাম্পসন। এবার অবাক হওয়ার পালা মিসেস ম্যানস্টের। কী বলেছেন উনি! ঠিক পাশের বাড়িতেই একটা ম্যাগনোলিয়া গাছ রয়েছে…আর উনি এতদিন দেখেননি!
‘মিসেস ব্ল্যাকের কথা উঠতে মনে পড়ে গেল। পরের সপ্তাহেই তো ওঁর বাড়ির কাজ শুরু হচ্ছে। বাড়িটাকে এবার অনেকটা নাকি বাড়িয়ে নেবেন উনি’।
‘ উনি কী করবেন?’
‘ আরে বাড়ির এক্সটেনশন…বাড়িটাকে ওদিকে একটু বাড়িয়ে নেবেন’। ম্যাগনোলিয়ার গাছটার দিকে দেখিয়ে দেন মিসেস স্যাম্পসন… ‘ আপনি জানেন না? আমি তো তাই শুনলাম। মিসেস ব্ল্যাক ওই পুরো উঠোন জুড়ে বাড়িটাকে বাড়িয়ে নেবেন। এই মাগ্যি গণ্ডার বাজারে কোথা থেকে যে অত পয়সা পাচ্ছেন কে জানে! তবে উনি বরাবরই নতুন বাড়ি বানানোর জন্য পাগল। সেভেন্টিন্থ স্ট্রিটে ওঁর একটা বোর্ডিং হাউস ছিল…সেটায় আবার সখের ঝুল বারান্দা…এটা সেটা কারুকাজ করতে গিয়ে তো একেবারে দেউলিয়া হতে বসেছিলেন। ভেবেছিলাম যা হোক একটা শিক্ষা ওঁর হয়েছে। কিন্তু কোথায় কী! আমার মনের হয় এটা ওঁর একটা নেশা…ঠিক মদের মতো। যাইহোক যা শুনলাম সামনের সোমবার থেকেই তো বাড়ির কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে’।
মুখটা সাদা হয়ে যায় মিসেস ম্যানস্টের। তিনি বরাবরই ধীরে থেমে থেমে কথা বলেন। তাই কথা বলার মাঝে তিনি আজ তিনি কতবার যে থমকালেন তা লক্ষ্যই করলেন না মালকিন। অনেক কষ্টে শেষ মেষ একটাই কথা বলতে পারলেন মিসেস ম্যানস্টে… ‘নতুন বাড়ির দেওয়ালটা কত উঁচু হবে’?
‘ এ আবার কেমনতরো কথা! পুরোনো বাড়ির ছাদের সমানই উঁচু হবে…আর নয়তো কী!’
আবার একটু থামেন মিসেস ম্যানস্টে… ‘ না মানে ওখানে কাজ শুরু হলে তো আপনার খুব ঝামেলা হবে’।
‘ তা তো হবেই। কিন্তু কী আর করা যাবে। কেউ নতুন নতুন বাড়ি বানাতে চায় আমি কোন আইনে তাকে আটকাব?’
সে কী আর মিসেস ম্যানস্টে জানেন না। খুব জানেন তিনি। তাই চুপ করে থাকেন। এবার মুখ খোলেন মিসেস স্যাম্পসন… ‘আমার আর কিছু করার নেই। তবে আমি যদি চার্চের লোক হতাম তাহলেও মিসেস ব্ল্যাককে পথে বসতে দেখেও একটুও দুঃখ পেতাম না। ঠিক আছে ভালো থাকবেন মিসেস ম্যানস্টে। আপনাকে এত হাসি খুশি দেখে খুব ভালো লাগল’।
‘হাসি খুশি’! কথা ব্যঙ্গের মতো শোনায় মিসেস ম্যানস্টের কানে। মালকিন চলে যাওয়ার পরে আবার তিনি একা। জানালার দিয়ে একবার উঁকি মারেন তিনি। আজকের দিনটা কী সুন্দর। নীল আকাশের বুকে থোকা থোকা জলহারা সাদা মেঘ। নরম রোদের আলোয় এইলানথাস গাছটাকে লাগছে হলদেটে সবুজ। হায়াসিন্থগুলোতে কুঁড়ি ধরেছে…দুদিন পরেই ফুল ফুটবে। আর ম্যাগনোলিয়ার কী বাহার! দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়…যেন পাথর কুঁদে বানানো কোনো নিপুণ ভাস্কর্য। দিন কয়েকের মধ্যেই শুরু হবে উইস্তারিয়ার মেলা…তারপরে ডালি সাজিয়ে আসবে হর্স চেস্টনাট। কিন্তু এই আনন্দযজ্ঞে শুধু বঞ্চিত রয়ে যাবেন তিনি। তাঁর চোখের সামনে উঠে যাবে ইঁট, কাঠ, পাথরের দেওয়াল। ওই মিনারটাও হারিয়ে যাবে তাঁর কাছে থেকে। অন্ধকার হয়ে যাবে তাঁর দুনিয়া। রাতের খাবারটা আর দাঁতে কাটতে পারলেন না তিনি…ফিরিয়ে দিলেন যেমন কে তেমন। জানালার ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন । আকাশের মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে সুয্যি গেল পাটে। চরাচর জুড়ে নামে অন্ধকার। রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই কাটালেন তিনি। ঘুম এল না একফোঁটা।
ভোর না হতে হতেই আবার তিনি জানালার ধারে। আকাশে মুখ আজ ভার। সেইসঙ্গে বৃষ্টি। মেঘ-ছেঁড়া মরা আলোয় প্রকৃতি আজ অন্য সাজে। তাছাড়া গাছ-গাছালিগুলোর জন্যও তো একটু বৃষ্টি-বাদলা দরকার। নীচের এইলানথাসের পাতায় ধূলোর পরত পড়েছে। এই তো সেদিনই দেখলেন তিনি।
‘এখান থেকে তো চলেই যেতে পারি আমি’। জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি। জানালা থেকে মুখটা সরিয়ে নিজের ঘরটাকে একবার ভালো করে জরিপ করে নেন । হয় তাকে চলে যেতে হবে…নয়তো এখানে থেকেদগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে। দুটোর মধ্যে যাই হোক না মৃত্যু তার অনিবার্য। এটাই বুঝি তাঁর নিয়তি। জানালাটা ছাড়া যদিও এই ঘরের তেমন মূল্য নেই তাঁর কাছে তবুও এই ঘরটা কীভাবে যেন মিলে মিশে গেছে তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে। এই ঘরে সতেরো বছর হয়ে গেল তাঁর। এই ঘরের প্রতিটা আনাচ কানাচ, ওয়াল পেপারের দাগ, কার্পেটের একটা ছোট্ট ফুটো স…ব তাঁর ভীষণ চেনা। জানালা দিয়ে রোদটা তেরছা ভাবে এখন পড়েছে ঘরে। তাকের বইগুলোয় খুব ধূলো পড়েছে। তাঁর আইভি লতা আর লিলির চারাটা এই জানালা ছাড়া কেমন করে বাঁচবে! এই জানালাতেই থাকতে থাকতে তারা বুঝে নিয়েছে কোন দিক করে সূর্যের পানে তাকাবে তারা… ‘এখানেই যে শিকড় গজিয়ে গেছে আমাদের সবার। কোথায় যাব আর!’
বিকেলের দিকে বৃষ্টি থামে। মেঘের চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে বৃষ্টি ভেজা নীল আকাশ। বিকেলের সোনা রোদে ঝিকিয়ে ওঠে এইলাথাসের ঝাড়। মাটিতে সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে ফুলের বাগান।
রবিবারে বিকেলে বেসমেন্টে বোর্ডারদের খাবার দাওয়ার আয়োজন করছিলেন মিসেস ব্ল্যাক। এমন সময় পরিচারিকা এসে জানিয়ে গেল গেল এক বয়স্ক মহিলা দেখা করতে চান। কালো বর্ডার দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে আগন্তুকের নাম … ‘মিসেস ম্যানস্টে’। নামটা দেখেই চিনতে পারেন তিনি… ‘মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডার এখানে আবার কী মনে করে! উনি কি তবে মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডিং ছেড়ে আমার এখানে উঠতে চান। তবে এক্ষুনি তো আর হবে না। বাড়িটা বাড়ানো হলে সামনের বছর ওঁকে একটা ঘর দিতে পারব। দিনা…ওঁকে বল ওপরে আসতে…আমি এক্ষুনি আসছি’।
মিসেস ব্ল্যাকের হলঘরে দামি দামি সব শোপিস…চেয়ারের গায়ে ঝলমলে রেশমি চাদর। এ বাড়িতে এসে অতিথির মতো বসতে পারবেন না তিনি। কাজ সেরে মিসেস ব্ল্যাক যখন হলঘরে আসেন তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে মিসেস ম্যানস্টে। ধূলো ভর্তি রেজিস্টারটা খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নেন মিসেস ব্ল্যাক…দেখা যাক যদি এনাকে একটু জায়গা করে দেওয়া যায়। আগন্তুকের দিকে একটু এগিয়ে যান তিনি… ‘ আসুন আসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন। বসুন আপনি’। মিসেস ব্ল্যাকের গলায় উপচে পড়ে ভরপুর আত্মবিশ্বাস। এই বাজারে যিনি নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে পারেন এই আত্মবিশ্বাস তাঁকে সাজে বই কী। অগত্যা বসতেই হয় অতিথিকে।
‘ বলুন মিসেস ম্যানস্টে কী করতে পারি আপনার জন্য?…আমার বোর্ডিং তো এখন ভর্তি। তবে বাড়িটা বাড়িয়ে নেওয়ার পর…’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ওই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে এসেছি। আমার তেমন টাকাকড়ি নেই। সারা জীবনে সুখ পাইনি কখনো। আমার কথা একটু না শুনলে আপনি ব্যাপারটা ঠিক বুঝবেন না’।
এসব কী হাবিজাবি বকতে শুরু করেছেন এই মহিলা। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না মিসেস ব্ল্যাক।
‘ জানেন জীবনে যা চেয়েছে তা কোনোদিন পাইনি। একটার পর একটা স্বপ্ন ভেঙে গেছে আমার। কত সখ ছিল গ্রামে গিয়ে থাকার। মনে মনে কত রঙিন কল্পনা করেছি। কিন্তু সে সখ আমার পূরণ হয়নি। আমাদের ঘুপচি ঘরের জানালা দিয়ে রোদ আসত না। দিনের পর দিন আলো না পেয়ে আমার গাছগুলো সব মরে গেল। বিয়ের পর মেয়েও দূরে চলে গেল। তাছাড়া ওর হাবভাব… চিন্তা ভাবনা একদম আলাদা। আমার সঙ্গে মেলে না। সতেরো বছর আগে স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে গেলাম আমি। সেই থেকে মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডি-এই রয়েছি। এখন বয়স হয়েছে। শরীরও নড়বড়ে। হাতে পায়ে আর জোর পাই না। ঘর থেকে বেরোতেও পারি না বিশেষ। ওই আবহাওয়া ভালো থাকলে… শরীরে জুত পেলে তবে হয়তো এক আধদিন হয়তো বেরোই। বুঝতেই পারছেন ওই জানালাটা মানে চারতলার পেছনের জানালাটা আমার কাছে কত দামি। ওই জানালা দিয়েই জগতটাকে দেখিআমি’।
‘ ঠিক আছে মিসেস ম্যানস্টে আপনার কোনো চিন্তা নেই। আপনাকে পেছনের দিকের ঘরই দেবো…মানে বাড়ির কাজ শেষ হয়ে হয়ে গেলে একটা নতুন ঘর…’
‘ কিন্তু আমার ওই ঘর ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না…আমি পারবই না যেতে’…একেবারে আর্তনাদ করে ওঠেন মিসেস ম্যানস্টে… ‘ না মানে আমি আপানাকে বলছিলাম কি আপনার বাড়িটা এদিকে বেড়ে গেলে আমি জানালা দিয়ে কিচ্ছু দেখতে পাব না। কিচ্ছু না। আপনি কি বুঝতে পারছেন?’
মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি মহিলার। এ তো বদ্ধ পাগল। তবে মিসেস ব্ল্যাক সেই পুরোনো প্রবাদটা খুব ভালোমতোই জানেন পাগলদের সঙ্গে বেশ একটু তামাশা করতে হয়।
‘ ইসস তাই নাকি’…নিজের চেয়ারটাকে একটু পেছনে ঠেলে দেন মিসেস ব্ল্যাক… ‘ এটা তো খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা তো আমি একদম ভেবে দেখিনি। বাড়িটা হলে আপনার তো খু…ব অসুবিধা হবে। জানালা দিয়ে আর কিছুই দেখতে পাবেন না আপনি। আহারে’।
‘ আপনি বুঝেছেন তো?’ উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসে মিসেস ম্যানস্টের।
‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই বুঝেছি। আমার খুব খারাপ লাগছে জানেন তো। তবে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা নিজেদের মধ্যে একটা মিটমাট করে নেব’
চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন মিসেস ম্যানস্টে। ওদিরে দরজার দিকে আরো একটু সরে যান মিসেস ব্ল্যাক।
‘ মিটমাট করে নেবেন! মানে আপনি আপনি আমার কথায় বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেন! ওহ মিসেস ব্ল্যাক আপনি আমায় বাঁচালেন। ব্যাংকে আমার দু হাজার ডলার মতো রয়েছে। তার থেকে মোটামুটি ধরুন…মানে এই ধরুন হাজার ডলার আমি আপনাকে দিয়ে দিতে পারি…মানে আপনি যদি রাজি…’ আর কথা শেষ করতে পারেন না মিসেস ম্যানস্টে। চোখ থেকে অঝোর ধারা নামে।
‘ শুনুন… শুনুন মিসেস ম্যানস্টে…আপনি একদন চিন্তা করবেন না। আমরা নিশ্চয়ই একটা রফা করে নেবখন। কিন্তু আজ আর আপনাকে বেশি সময় দিতে পারছি না। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। বোর্ডারদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আসলে এই সময়টায় দম ফেলার ফুরসৎ পাই না’।
দরজার ছিটকিনিটা খুলে সবে যেই না তিনি পালাতে যাবেন অমনি মিসেস ম্যানস্টে উঠে এসে শক্ত করে চেপে ধরে তাঁর হাত… ‘ আপনি কিন্তু স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু বললেন না মিসেস ব্ল্যাক। আপনি কি আমার প্রস্তাবটা মেনে নিচ্ছেন’।
‘ ওটা নিয়ে আমায় একটু ভাবতে হবে মিসেস ম্যানস্টে। আমি নিশ্চয়ই ভাবব। পৃথিবীর কোনো কিছুর জন্য আপনাকে আমি কষ্ট দেব না’।
‘ কিন্তু আমি যা শুনলাম কাল থেকেই আপনার বাড়ির কাজ শুরু হচ্ছে’…মিসেস ব্ল্যাকের মুখের কথায় ঠিক ভরসা করে উঠতে পারেন না তিনি।
একটু ইতস্তত করেন করেন মিসেস ব্ল্যাক। এখন যা হোক কিছু একটা বলে এই বুড়ির হাত থেকে বাঁচতে হবে… ‘ না না কাল থেকে কাজ শুরু হবে না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আজ রাতেই ঠিকাদারকে আমি জানিয়ে দেব’। মিসেস ম্যানস্টে আরো শক্ত করেন তাঁর হাতের বাঁধন। কিছুতেই পালাতে পারে না মিসেস ব্ল্যাক।
‘ মিসেস ব্ল্যাক, আপনি আমায় ঠকাচ্ছেন না তো?’
এই কথার কী জবাব হয়! তোতলাতে শরু করেন মিসেস ব্ল্যাক… ‘ আরে না না। আপনি আমাকে এত খারাপ ভাবতে পারলেন!’
মিসেস ম্যানস্টের হাতের মুঠি আলগা হয়ে আসে। হলঘর দিয়ে বেরোনোর সময় নিজের মনেই বিড়বিড় করেন … ‘এক হাজার ডলার’। অশক্ত নড়বড়ে পায়ে মাঝে মাঝেই হোঁচট খেয়ে পড়েন। রাস্তার রেলিংটা ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নেন।
ওদিকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মিসেস ব্ল্যাক। তড়িঘড়ি দরজায় খিলটা তুলে দেন… ‘ আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল দেখছি। ওই মহিলার মাথায় যে এত ছিট রয়েছে আগে জানতাম না তো! সবসময় কেমন ভেজেবেড়াল সেজে থাকেন! আর হাবভাব তো পুরো উঁচু ঘরের মহিলাদের মতো!’
রাতে সেদিন বড় আরামে ঘুমোলেন মিসেস ম্যানস্টে। হাতুড়ি পেটার টং টং আওয়াজে পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। এক ছুটে জানালার কাছে গিয়ে তাঁর তো চোখ কপালে। মিসেস ব্ল্যাকের উঠোনভর্তি মিস্ত্রি, কুলি…কামিন। কেউ কেউ রান্নাঘর থেকে ভারি ইঁট বয়ে আনছে উঠোনে…কেউ না আবার পুরোনো বাড়ির কাঠের ব্যালকনিগুলো ভাঙতে ব্যস্ত। অনেক সখ করে বাড়ির প্রতিটা তলায় কাঠের ব্যালকনি বসিয়েছিলেন মিসেস ব্ল্যাক। এখন সেগুলো পুরোনো…সেকেলে। কথা রাখেননি মিসেস ব্ল্যাক। ভীষণ ঠকে গেছেন মিসেস ম্যানস্টে। এ বাড়ির মালকিন মিসেস স্যাম্পসনকে পুরো ব্যাপারটা জানালে কেমন হয়! না থাক। কী হবে আর জানিয়ে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে স্খলিত পায়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়েন তিনি। আর জানালার ধারে তিনি যাবেন না। ওদিকে উঠোনে কী হচ্ছে না হচ্ছে আর ফিরেও তাকাবেন না।
বিকেলের দিকে মনটা আবার আনচান করে। ওদিকে কী হল না হল বড় জানতে ইচ্ছে করে। সবচেয়ে খারাপ খবরটার জন্য মনকে তৈরি করে নেন। বিছানা থেকে উঠে জামা কাপড় পরে নেন। আজকাল জামা-কাপড় পরাটাও তাঁর কাছে বড় ঝক্কি। জামার বোতাম লাগাতে গিতে হাত কেঁপে যায় বারবার। বোতামের ঘরগুলো ভালো করে চোখেও দেখতে পান না।
আবার জানালার ধারে গিয়ে বসেন তিনি। ও বাড়ির উঠোনে কুলি কামিনরা ব্যালকনির ওপরের অংশ ভেঙে ফেলেছে। উঠোনে এখন সারি সারি ইঁট। কই এত ইঁট তো সকালে ছিল না। হুমদো মুখো এক চ্যাংড়া ছেলে একটা ম্যাগনোলিয়া ফুল ছিঁড়ে নেয়। একবার গন্ধ শুঁকেই সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরে মাথায় ইঁট নিয়ে আরেক কুলি ফুলটা মাড়িয়ে চলে যায়।
ওই দুই ছোঁড়ার মধ্যে আরাম করে পাইপ টানছেএকজন । তাই দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে অপরজন… ‘ দেখো জিম এখানে কিন্তু দেশলাই কাঠি টাঠি ফেলো না। একবার ওই কাগজের বস্তায় গিয়ে পড়লে আর আর দেখতে হবে না। পুরো বাড়ি জ্বলে যাবে’।
মিসেস ম্যানস্টে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন ও বাড়ির কাঠের ব্যালকনির নীচে বস্তা বস্তা কাগজ আর রাবিশ।
সন্ধে নেমে আসে। মিস্ত্রিদের কাজ বন্ধ হয়। কমলালেবুর মতো সূর্যটা আকাশে রঙ ছড়িয়ে দিগন্ত রেখার ওপারে হেলে পড়ে। ওই দূরের মিনারটার গায়েও লাগে গোধূলির রঙ। আঁধার ঘনিয়ে এলে জানালার পর্দাটা টেনে দেন মিসেস ম্যানস্টে। এবার লন্ঠনটা জ্বালতে হবে। যন্ত্রের মতো লন্ঠনটা বের করে তেল ভরে আগুনটা ধরান তিনি। এই কাজটা রোজ নিজের হাতেই করেন তিনি। লন্ঠনটা জ্বালিয়ে কেরোসিনের ডিবেটা রেখে দেন কুলুঙ্গিতে। এখনো খানিকটা কেরোসিন রয়েছে ওর মধ্যে। ঘরে ছড়িয়ে পড়ে লন্ঠনের নরম আলো। এই শান্ত সন্ধেয় এ ঘরের বাসিন্দার মতোই তাঁর যত বইপত্র, ছবি, তাঁর হাতে লাগানো সব গাছও যেন ঝিমিয়ে পড়ে। রোজকার মতো টেবিলের কাছে চেয়ারটা টেনে আবার উল কাঁটা নিয়ে বসেন মিসেস ম্যানস্টে।
সে রাতেই চোখের পাতা এক হয় না তাঁর। বাইরে হাওয়ার শোঁ শোঁ গর্জন। কালো মেঘের আড়ালে তারারা সব মুখ ঢেকেছে। হাতের কাজ ফেলে বার বার জানালার কাছে ছুটে যান মিসেস ম্যানস্টে। জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখেন। উলটো দিকের বাড়ির জানালায় শুধু লন্ঠণের টিমটিমে আলো। সে আলোও নিভে যায় খানিক পরে। পিচ কালো অন্ধকারে ঠাওর করা যায় নাকিছু । এক চিলতে আলোও নেই কোথাও। এরই মধ্যে রাত পোশাকের ওপর ঝটাপট পাতলা ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে নেন তিনি। একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নেনমাথায় । কুলুঙ্গি থেকে চুপিচুপি কেরোসিনের ডিবেটাও নিয়ে নেন। আর জামার পকেটে নেন কয়েকটা দেশলাই কাঠি। দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে বেরোন তিনি। সিঁড়ির ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকার হাতড়ে নামতে থাকেন তিনি। হলঘর থেকে গ্যাসের বাতির ক্ষীণ আলো ভেসে আসে। তিনি নেমে আসেন অন্ধকার বেসমেন্টে। যাক এবার একটু শান্তি। এখানে তাঁর পায়ের আওয়াজ আর কেউ শুনতে পাবে না। আর দেরি না করে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসেন উঠোনে। বাইরে বেরোতেই বরফ-ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা মেরে যায় তাঁর চোখে মুখে। হাড়েও যেন কাঁপন ধরে যায়। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি এগিয়ে চলেন তাঁর লক্ষ্যে।
দমকলের পাগলা ঘণ্টিতে ভোর তিনটে-তে ঘুম ভেঙে গেল গোটা পাড়ার। মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির উঠোনে দমকলের গাড়ি। মিসেস স্যাম্পসনের বোর্ডারদেরও চোখে মুখে আতংক। জানালা দিয়ে সবার নজর মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির দিকে। মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির পেছনদিকের কাঠের ব্যালকনিতে আগুন লেগেছে। জানালাটা হাট করে খুলে দিয়ে আগুনের ধ্বংসলীলা দেখেন মিসেস ম্যানস্টে। তাঁর পরনে এখনো সেই ফিনফিনে ড্রেসিং গাউন।
দমকলের চেষ্টায় আগুন তো নিভে গেল কিন্তু বাড়ির বাসিন্দাদের মন থেকে সেই ভয় আর গেল না। যে যেই পোশাকে ছিলেন সেই অবস্থাতেই কোনো রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে বেড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। আগুন নেভার পর হলঘরে জড়ো হয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায় তাঁদের। এ নির্ঘাৎ কোনো ফচকে ছোঁড়ার কাজ। শুধু জানালার কাচ ভেঙে আর শান্তি হচ্ছিল না ব্যাটাদের।
এই অগ্নিকাণ্ডে মিসেস ব্ল্যাকের কতটা ক্ষতি হল জানা নেই তবে মিসেস ম্যানস্টে একেবারে শয্যা নিলেন। এই বয়সে নিউমোনিয়া! রীতিমতো চিন্তার কথা। ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। গলা ঘড় ঘড় করে। শরীরের আর দোষ কী! এই ঠান্ডার দিনে একটা পাতলা গাউন চাপিয়ে জানালা দিয়ে অমন ঝুঁকে পড়লে এমনটা তো হবেই। বয়সটাও তো দেখতে হবে নাকি…রায় দিয়ে যায় বোর্ডিং-এর অন্য বাসিন্দারা। মিসেস ম্যানস্টের অবস্থা বেশ খারাপ…কিন্তু কতটা খারাপ সেটা ডাক্তার এসে জানিয়ে দেওয়া মাত্রই মুখ শুকিয়ে যায় সবার। এতটা বাড়াবাড়ি ভাবতে পারেননি তাঁরা। মিসেস স্যাম্পসনের টেবিলের চারধারে সবার জোর আলোচনা চলে। এমনিতে মিসেস ম্যানস্টের সঙ্গে কারোরই বিশেষ দহরম মহরম নেই। তিনি বরাবরই সবাইকে একটু এড়িয়েই চলেন। অন্যদের চেয়ে নিজেকে একটু উঁচুতলার ভাবতেন তিনি। বাকিরাও তাই তাঁর ধারপাশ মাড়াত না। কিন্তু তাও তাঁর এই বিপদের দিনে সবার মন আজ ভার। এতদিনকার সঙ্গী সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে। একজন মহিলা তো বলেই ফেলেন… ‘আজ ওঁর জায়গায় আমি থাকতে পারতাম…আপনিও থাকতে পারতেন’।
কিন্তু এই ঠান্ডায় কারো গায়ে আঁচ লাগল না শুধু মিসেস ম্যানস্টে এই ভয়ানক অসুখটা বাধিয়ে বসলেন। তাঁর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যায়। নিঃসঙ্গ না হয়েও সারাজীবন তিনি যেমন একা রয়ে গেছেন তেমনি মৃত্যুশয্যাতেও আজ তিনি একেবারে একা। রুগির দেখাশোনার জন্য একজন ভালো ট্রেইনড নার্সকে পাঠালেন ডাক্তার। মিসেস স্যাম্পসন পা টিপে টিপে সময়ে সময়ে রুগির ঘরে আসেন। দেখাশোনা করে আবার চলে যান। কিছুই বুঝতে পারেন না মিসেস ম্যানস্টে। তাঁর চোখে সব ঝাপসা। সব স্বপ্নের মতো। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়েছেন তিনি। মেয়ের ঠিকানা জিগ্যেস করা হলে শুধু ঘাড় নাড়েন। মাঝে মাঝে কান পেতে কোনো শব্দ শোনার চেষ্টা করেন যেন। সব লক্ষ্য করে নার্স। কোনো আওয়াজ না পেয়ে আবার নেতিয়ে পড়েন।
পরদিন সকালে অবস্থা আরো খারাপ হয়। রুগির শ্বাস বুঝি আর চলেনা। বিপদ বুঝে মিসেস স্যাম্পসনকে ডেকে আনে নার্স। বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলছে রুগি। শোনার জন্য নার্স আর মিসেস স্যাম্পসন দুজনেই কান পেতে দেয়… ‘ আমাকে একটু তুলে ধরো…একটু তুলে ধর আমাকে’…ফিসফিসিয়ে ওঠে রুগি।
দুজনে ধরাধরি করে টেনে তোলে তাঁকে। নিজের অসাড় নড়বড়ে হাতখানা রুগি বাড়িয়ে দেয় জানালার দিকে।
‘ ওহ ওই জানালার কথা বলছেন উনি। উনি বোধহয় জানালার পাশে একটু বসতে চান। ওইখানেই তো উনি বসে থাকতেন সারাক্ষণ। এখন ওখানে একটু বসলে আর বেশি কী ক্ষতি হবে বলুন’… গলা ধরে আসে মিসেস স্যাম্পসনের।
‘এখনআর কিছুতেই কিছু যায় আসে না’…জানিয়ে দেয় নার্স।
দুজনে মিলে ওরা জানালার ধারে রুগিকে নিয়ে গিয়ে তাঁর প্রিয় চেয়ারটায় বসিয়ে দেয়। এই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ। বাইরে বসন্তের ঝলমলে সকাল। দূরের ওই মিনারটায় আজ লেগেছে সোনা রোদের ছোঁয়া। ম্যাগনোলিয়া আর হর্স-চেস্টনাটের গাছটা এখনো যে ছায়ায় ঢাকা! মিসেস ব্ল্যাকের উঠোনে কেউ নেই আজ। খাঁ খাঁ করছে সব। পোড়া কাঠগুলো যেমন কে তেমনই পড়ে রয়েছে। তার মানে মিস্ত্রিরা আর কাজ শুরু করেনি। ম্যাগনোলিয়া গাছে নতুন ফুল ফুটেছে আরো কয়েকটা…যেন কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া ভাস্কর্য এক। জানালার বাইরে জগতটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতো। কোথাও কোনো বদল হয়নি।
এবার দমবন্ধ হয়ে আসে রুগীর। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। তিনি ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করেন… ‘জানালাটাকে খুলে দাও। বাইরের আলো দেখতে দাও আমায়’। কেউ বোঝে না তাঁর ইশারা। জানালাটা যদি খোলা যেত তাহলে হয়ত তিনি এইলানথাসের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগত তাঁর…সেই গন্ধে মাতাল হয়ে আবার হয়তো তিনি আগের মতো প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারতেন। তবে যাই হোক জানালা দিয়ে তিনি তাঁর দুনিয়াটাকে দেখে নিয়েছেন। সবকিছু রয়েছে আগের মতো। দূরে ওই বুঝি দেখা যায় সোনার মিনার। আকাশটা আজ বড্ড বেশি নীল। ম্যাগনোলিয়ারাও আজ উন্মুখ হয়ে রয়েছে আলোর পানে।
মিসেস ম্যানস্টের মুখে স্মিত হাসি। আজ আর কোনো খেদ নেই তাঁর। আস্তে আস্তে মাথাটা হেলে পড়ে তাঁর। সব শেষ।
সেদিনই আবার শুরু হয় মিসেস ব্ল্যাকের বাড়ির কাজ।
- ‘জানালা’ গল্পটি এডিথ হোয়ার্টনের ‘মিসেস ম্যানস্টে’জ ভিউ’ গল্পটির অনুবাদ।
-
ম্যাজিক রেডিও
ম্যাজিক রেডিও (জন চিভার)
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
জন আর আইরিন ওয়েস্টকোট। সুখী দম্পতি। রোজগারপাতি ভালোই। পরিশ্রমী। সমাজে একটা আলাদা সম্মানও আছে। মানে যতটা থাকলে কলেজের প্রাক্তনীদের সমাচারে মাণ্যিগণ্যি হিসাবে নাম তোলা যায় ততটা তো রয়েইছে। দুটি সন্তান তাঁদের। বিয়ে হয়েছে ন বছর। সাটন প্লেসের কাছে এক ফ্ল্যাট বাড়ির বারো তলায় বাস। এমনিতে বেশ শৌখিন মানুষ তারা। বছরে গড়ে ১০.৩ বার থিয়েটারে যাওয়া চাই। একদিন না একদিন ওয়েস্টচেস্টারে একটা বাড়ি বানানোর স্বপ্নও দেখে তারা।
খুব একটা সুন্দরী না হলে কী হবে আইরিন যেমন ভদ্র তেমন মিষ্টি। একমাথা নরম বাদামি চুল। তার ওই চওড়া কপালে অবশ্য তেমন সৌভাগ্যের কথা লেখা নেই। শীতের দিনে কায়দা করে একটা ফারের কোট জড়িয়ে রাখে গায়ে। সেটা আবার মিংকের ফারের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে রঙ করা। জিমকে দেখে তার বয়সের আন্দাজ পাওয়াই যায়…তবে বয়স কাবু করতে পারেনি তার মনকে। মন তার চিরসবুজ। মিলিটারি ছাঁটের চুলে অবশ্য পাক ধরতে শুরু করেছে। অ্যান্ডোভারের মতো অভিজাত শহরে তার গোত্রের লোকজন যে রকম পোশাক আশাক পরে জিমও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনিতে সাদাসিধে মানুষটার আচার ব্যবহারের মধ্যে দারুণ একটা আন্তরিকতা আছে…আবেগ আছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি, ক্লাশমেটদের সঙ্গে একটাই বিষয়ে অমিল তাদের…সেটা হচ্ছে গান বাজনা। তারা দুজনে গান-বাজনার ভক্ত…হালকা গানবাজনা নয়… উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। তারা নিয়মিত কনসার্টে যায়…যদিও সে নিয়ে বিশেষ কারো কাছেই উচ্চবাচ্চ্য করে না। আর সময় পেলেই রেডিওটা চালিয়ে বসে পড়ে। গান বাজনা শোনে।
তাদের রেডিওটা একেবারে আদ্যিকালের। ওটা যেমন অদ্ভূত তেমনি খামখেয়ালি…কখন যে বিগড়োবে আগে থেকে আঁচ পাওয়া মুশকিল। আর বোধহয় সারানো গেল না ওটাকে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আনাড়ি…রেডিওর কল কবজা কিছুই বোঝে না। চলতে চলতে রেডিওটা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন জিম উঠে রেডিওর মাথায় দুমদাম মারে কয়েক চাঁটি । তাতে কখনো কাজ হয়, কখনো হয় না। সেদিন রবিবার বিকেলে দিব্যি চলছিল শ্যুবার্টের কনসার্ট। বুঁদ হয়ে শুনছিল কত্তা-গিন্নি। হঠাৎই গান গেল থেমে। রেডিও-র মাথায় দুম দুম বাড়ি মেরেও কোনো লাভ হল না সেদিন। রেডিও আর চলল না। কনসার্ট উঠল মাথায়। নাহ এবার একটা নতুন রেডিও না কিনলেই নয়। নতুন রেডিও বাড়িতে আসবেই। বউকে কথা দিয়ে দিল জিম। সোমবার অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই খুশির খবরটা জানিয়ে দিল বউকে…নতুন রেডিও কেনা হয়ে গেছে। কেমন দেখতে, কত দাম, কী বেত্তান্ত কিছুই ভাঙল না সে…গিন্নিকে নাকি দারুণ একটা চমক দেবে।
পরের দিনে বিকেলে দোকানের লোক এসে জিনিস্টা দিয়ে গেল। ভাগ্যিস সঙ্গে মিস্ত্রি এসেছিল। মিস্ত্রি আর কাজের মেয়েটাকে নিয়ে বাক্স থেকে যন্ত্রটাকে বের করে বসার ঘরে কোনোরকমে নিয়ে গেল আইরিন। ভারি কাঠের ক্যাবিনেটওলা যন্ত্রটা ভারি কিম্ভূত। দেখেই মনটা তেতো হয়ে গেল তার। তার বসার ঘরে এই রেডিও একদম বেমানান। কত যত্ন করে নিজের হাতে বসার ঘরটাকে সে সাজিয়েছে… কত বেছে বেছে এ দোকান ও দোকান ঢুঁড়ে এ ঘরের সব আসবাব…পর্দার কাপড় কিনেছে। এত দেখে শুনে নিজের জামা কাপড়ও বোধহয় সে কেনে না। আর সেই ঘরে কি না জোর করে ঢুকে পড়ল এই ঢাউস বদখত একটা যন্ত্র! উফফ তার এত সাধের জিনিসপত্রের মাঝে ওই বেমক্কা একখানা জিনিস! এ যে চোখে দেখা যায় না! যন্ত্রটা যেমন কুচ্ছিত তেমনি অদ্ভূত তার কল কবজা। কিছুই বোঝা যায় না ছাই। একগাদা সুইচ…ডায়াল…প্যানেল। সব ভালো করে একবার দেখে প্লাগটা গুঁজে যন্ত্রটা চালিয়েই দিল সে। ঝপ ঝপ করে সবুজ আলো জ্বলে উঠল ডায়ালে। তারপর পিয়ানোর ক্ষ্ণীণ আওয়াজ…যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সেই আওয়াজ গাঁক গাঁক করে আছড়ে পড়ল ঘরময়…যেন বিশাল এক শব্দদানব হাঁ করে গিলে নেবে সব…বিকট সেই শব্দের তোড়ে টেবিল থেকে চিনা মাটির বাসন কোসন ঝন ঝন করে পড়ল মাটিতে। ছুটে গিয়ে ভল্যুমটা কমিয়ে দেয় সে । ওই কাঠের বাক্সটার মধ্যে কী যেন একটা অশুভ শক্তি লুকিয়ে রয়েছে। ওটাকে দেখলেই ভারি অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরতে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে । তারপর বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে যাওয়া…একটু ঘোরাঘুরি। যন্ত্রটার কথা আর মনেই ছিল না। রেডিওটা আবার চালনোর ফুরসত হল অনেক পর।
সন্ধে বেলা বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়েচান করাতে নিয়ে গেছে আয়া। আইরিনের এখন ছুটি। সে এবার রেডিওটা চালিয়ে বসতে পারে। এবার ভল্যুমটা সে অনেক কম করেই রাখল। কী ভাগ্য…এখন যে ভারি মোৎজার্টেরকনসার্ট দিয়েছে! আইরিন চোখ বন্ধ করে শোনে…সুরের আবেশে ভেসে যায়। খুব ভালো লাগে তার। এখন শব্দটা অনেক স্পষ্ট। কোনো গোলমাল নেই। দেখতে যেমনই হোক পুরোনোটার চেয়েবাবা এটা অনেক ভালো…এটার আওয়াজ অনেজ জোরালো…অনেক খাঁটি। কাঠের বাক্সটাকে নাহয় খুলে সোফার পেছনে রেখে দিলেই হবে। তখন ওটাকে দেখতেও আর অত খারাপ লাগবে না। রেডিও-টাকে এই সবে একটু ভালো লাগতে শুরু করেছিল…অমনি ঝামেলা শুরু। বাজনার মাঝে যেন কতগুলো বাইরের শব্দ। কখনো খট খট আওয়াজ কে যেন দেশলাই কাঠি জ্বালাচ্ছে…পরক্ষণেই শন শন শন শন…সমুদ্রের লোনা হাওয়ার কথা মনে পড়ে আইরিনের। বাজনা যত এগোয় শব্দ তত বাড়ে…হরেক কিসিমের শব্দ। ডায়াল আর সুইচগুলোকে সব টেপাটেপি করে দেখে নেয়। নাহ কোনো কাজ হয় না। যেই কে সেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সে। আর কিচ্ছু সে ভাবতে পারছে না। কিন্তু এত আওয়াজ আসছে কোথা থেকে। খুঁজে তাকে বের করতেই হবে। বসার ঘরের দেওয়ালের ওপারেই লিফটের সুড়ঙ্গ। হ্যাঁ তাইতো…রেডিওতে এতো লিফটেরই ঘর ঘর আওয়াজ। লিফটের কেবলের ক্যাঁচ কোঁচ, দরজা খোলা আর বন্ধ করার আওয়াজ…স…ব ধরা পড়ছে রেডিও-টার লাউড স্পিকারে। তার মানে এই যন্ত্রটার মধ্যে একটা আজব ব্যাপার আছে। আশে পাশের সব বিদ্যুৎ তরঙ্গ টেনে নিতে পারে এই যন্ত্র। এই ভাবতে না ভাবতেই ডোরবেলের টুং টাং, ওয়াশিং মেশিনের ঘটাং ঘটাং, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের একঘেঁয়ে শোঁ শোঁ শুনতে শুনতে তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে সে। কত রকমের যে শব্দ! কলিং বেলের আওয়াজ থেকে শুরু করে লিফটের বেল, ইলেকট্রিক রেজার দিয়ে দাঁড়ি কামানো, মিক্সি মেশিনে মশলা পেষাই…স…ব আওয়াজ এত স্পষ্ট যে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। তার আশে পাশের সব ফ্ল্যাটের এই বিচিত্র সব আওয়াজ এই জঘন্য রেডিওটার লাউডস্পকার ফুঁড়ে বেরোচ্ছে। ধন্যি একখানা যন্ত্র বটে! সেখানে যত গন্ডগোল…হই হল্লা…ক্যাঁচর ম্যাঁচর চুম্বকের মতো সব টেনে আনা চাই। এমন একখানা বিকট যন্ত্রকে বাগে আনা আইরিনের কম্ম নয়। হাল ছেড়ে দেয় সে। রেডিও টা বন্ধ করে বাচ্চাদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
রাতে বাড়ি ফিরে না ফিরেই রেডিওটা নিয়ে পড়ে জিম। যন্ত্রটা চালু করে তারও সেই একই অভিজ্ঞতা। একটা টক শো হচ্ছিল রেডিও স্টেশনে। দূর থেকে বক্তার মৃদু কন্ঠস্বর আচমকাই বিস্ফোরণের মতো কানে আছড়ে পড়ল তার। কানটা ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। কেঁপে ওঠে ঘরদোর। ছুটে গিয়ে রেডিও-র আওয়াজ কমিয়ে দেয় সে। তাতেও নিস্তার নেই। দু-এক মিনিট পর থেকেই আবার যত ঝামেলা। আবার সেই হরেক আওয়াজ…টেলফোন, কলিং বেল, লিফটের দরজার ঝাঁকুনি, রান্নার জিনিস পত্রের ঠুকঠাক… মাথার মধ্যে খিচুড়ি পাকিয়ে যায় সব। তবে আইরিনের চেয়ে তার বরের অভিজ্ঞতা অবশ্য একটু আলাদা। শব্দের দাপট বোধহয় আগের থেকে কমেছে। সারাদিনের ধকল বয়ে ক্লান্ত শহরটা ঝিমিয়ে পড়েছে এখন। এত রাতে রেডিও-র লাউড স্পিকারে আর কোনো ইলেকট্রিক রেজারের আওয়াজ নেই…নেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের বিরামহীন শন শন। রাতে সেগুলোর কাজ এখন শেষ। গৃহস্থের দেরাজে সব ঢুকে পড়েছে এখন। রেডিও-র নবগুলোকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে অনেক কসরত করে জিম। কিছুতেই কিছু হয় না। এই শব্দের হাত থেকে কোনো রেহাই নেই। তারা জোর করে ঢুকে পড়বেই। বিরক্ত হয়ে সেও রেডিওটা বন্ধ করেই দেয়। বউয়ের কাছে শুরু হয় তার যত গজ গজ…রেডিওটা গছিয়ে লোকগুলো একদম ঠকিয়ে দিয়েছে…কালই ওদের ডেকে বাপবাপান্ত করে ছাড়তে হবে।
পরের দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে আইরিনের বিকেল গড়িয়ে যায়। দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে একটু খাওয়া দাওয়া ছিল। বাড়ি ফিরতেই আয়া জানিয়ে দেয় দোকান থেকে লোক এসেছিল…রেডিওটা সারিয়ে দিয়ে গেছে। আর তর সয়না আইরিনের। টুপি, কোট না খুলেই সোজা বসার ঘরে গিয়ে আগে রেডিওটা চালিয়ে দেখে। লাউড স্পিকারে ভেসে আসে ভারি চমৎকার এক কনসার্ট…ওহ দারুণ … ‘মিসৌরি ওয়ালটজ’ । মনটা ভালো হয়ে যায় তার। এ তো ঠিক সেই তার ওই পুরোনো টেপ রেকর্ডারটার মতো রিনরিনে ঘসঘসে আওয়াজ। লেকের দিকে ছুটি কাটানোর সময় টেপ রেকর্ডারটা বাজিয়ে প্রায়ই শুনতো সে। কনসার্ট শেষ হয়। আইরিন অপেক্ষা করে যায়…দেখা যায় বাজনাটা নিয়ে ঘোষক কিছু বলে কিনা। কিন্তু ওপারে সব চুপচাপ। সেই ঘসঘসে আওয়াজটা এখনও শোনা যাচ্ছে। দূর ছাই এরা কিছু বলবে না। এবার অন্য স্টেশনে কী হচ্ছে না হচ্ছে একটু শোনা যাক। বাহ স্টেশন ঘোরাতেই এ যে ককেশিয়ান মিউসিক। ধুলোর মধ্যে দিয়ে ধপ ধপ করে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ আর সেইসঙ্গে ধাতব গয়নার ঝনঝনানি। কিন্তু গানের মাঝে আবার সেই ডোরবেল… একগাদা লোকের গলার আওয়াজ…জড়িয়ে যায় সব। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরে। সে রেডিওটা বন্ধ করে বাচ্চাদের ঘরে নিয়ে যায়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে জিম ফেরে রাতে। জামাকাপড়টা বদলে তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে রেডিও-টা খুলেছে কি খোলেনি অমনি আয়া এসে খাওয়ার তাড়া দিয়ে যায়।
সারা শরীরে ক্লান্তি। খেতে বসে জিম অত ভদ্রতা তদ্রটার ধার ধারে না। ডিনারের খাবার দাবার নিয়ে আইরিনের কোনো আগ্রহ নেই। খেতে হয় তাই খাওয়া। রুপোর মোমাদানির দিকে চেয়ে চেয়ে তার মন এবার চলে যায় আবার রেডি-ও টার দিকে। হালকা গান ভেসে আসছে যন্ত্রটা থেকে… শোঁপার প্রেলিউড। খুব মন দিয়ে সে শোনে। হঠাৎ রসভঙ্গ। গানের আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসে এক পুরুষ কণ্ঠ …’ ওহ দোহাই তোমাকে ক্যাথি, যখনই আমি বাড়িতে ঢুকব তখনই কি তোমায় পিয়ানোটা নিয়ে প্যান প্যান করতে হবে?। গান থেমে যায়। আইরিনের চোখ কপালে। এরপর মহিলার গলা… ‘সারাদিন তো অফিসেই থাকি। আর কখন সময় পাব বলো?’ তারপর আবার সেই পুরুষটির কথা…’সে তো আমিও থাকি’। লোকটা এবার পিয়ানোটাকে নিয়ে নোংরা একটা কথা বলে ধড়াস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার শুরু হয় গান। বিষণ্ণ মুর্চ্ছনা মীড় তুলে যায়।
আর নিজেকে সামলাতে পারে না আইরিন… ‘কী গো শুনতে পেলে?’
তখনো ডেসার্টটা খেতেইব্যস্ত জিম…’ কী বল তো?’
‘ আরে রেডিওটার কথা বলছি…ঐ গানটার মাঝে একটা লোক কেমন অসভ্য কথা বলল শুনলে না?’
‘ কোনো নাটক টাটক হবে হয়তো’।
‘না না। আমার তো মনে হয় না’।
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে কফিটা নিয়ে দুজনেই বসার ঘরে চলে আসে। রেডিও-তে অন্য আরেকটা স্টেশন চালানোর জন্য জিমকে বলে আইরিন। সেই মতো নবটা ঘোরায় জিম। কিন্তু আবার কার আওয়াজ? কোথা থেকে আবার এক পুরুষ কণ্ঠ… ‘ আমার রাবার ব্যান্ডদুটো দেখেছ?’ ‘ আমার রাবার ব্যান্ড? দেখেছ কী?’ পুরুষটির গলায় একরাশ বিরক্তি। এর পর আবার এক মহিলার গলা… ‘ আমার বোতাম কটা লাগিয়ে দাও… আমি খুঁজে দিচ্ছি তোমার রবার ব্যান্ড’। সঙ্গে সঙ্গে অন্য স্টেশনে নবটা ঘুরিয়ে দেয় জিম…সেখানেও আবার এক পুরুষের গলা… ‘আমার অ্যাশ ট্রে-তে আবার যেন আপেলের ছিবড়ে ফেলতে এসো না…ওই গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না’।
‘ এ তো ভুতূড়ে ব্যাপার স্যাপার’!
‘হ্যাঁ তাই তো বটে’।
নবটা আবার ঘোরায় জিম। এবার এক মহিলা ইংরেজদের কেতায় সুর করে ছড়াশুনিয়ে যায় … ‘On the coast of Coromondel where the pumpkins blow/ In the middle of the woods lived the Yonghy-Bonghy-Bo: Two old chairs, and half a candle, one old jug without a handle…’
চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে ওঠে আইরিন… ‘আরে! আ যে সুইনিদের বাড়ির আয়া’।
ওদিকে মহিলা তখনো সুর করে ছড়া আওড়ে যায়… ‘ These were all his wordly goods’.
‘বন্ধ করো, রেডিওটা এক্ষুণি বন্ধ করে দাও বলছি…ওরাও আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে’।
রেডিও-টা বন্ধ করে দেয় জিম।
আইরিনের ঘোর তখনো কাটেনি… ‘ উনি সুইনিদের আয়া। মিস আর্মস্ট্রং। ওদের বাড়ির বাচ্চাটাকে বোধহয় উনি ছড়া শোনাচ্ছিলেন। ওরা ১৭-বি ফ্ল্যাটে থাকে। পার্কে মিস আর্মস্ট্রং-এর সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি ওঁর গলা খুব ভালো করে চিনি। হে ভগবান! তারমানে অন্যদের বাড়ির হাঁড়ির খবর সব আমরা শুনতে পাচ্ছি।
‘ না না, তা কী করে সম্ভব’…জিমের গলায় এখনও অবিশ্বাস।
ধৈর্য হারায় আইরিন। সে আর বুঝিয়ে উঠতে পারছে না… ‘ আমি জানি উনিই সুইনিদের আয়া। আমি ওঁর গলা চিনি। আর ওঁকেও খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু ওরা আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না তো? শুধু এটাই ভাবছি আমি’।
সুইচটাকে একটু নাড়াচাড়া করে জিম। এবারও সেই একই কাণ্ড…দূর থেকে কাছে… আরো কাছে যেন বাতাসে ভেসে আসে সেই একই গলা। সুইনিদের আয়া আবার সুর করে পড়ে যায় তার ছড়া…পুরো ইংরেজদের কায়দায় ‘Lady, Jingly, Lady Jingly…Sitting where the pumpkins blow, Will you be my wife, said the Yonghy-Bonghy- Bo…’
জিম রেডিও-র লাউডস্পিকারে মুখ লাগিয়ে বলে ‘হ্যালো’। কোনো উত্তর নেই ওপাশ থেকে। সুইনিদের আয়া পড়েই চলে… ‘I am tired of living singly/ On this coast so wild and shingly/ I’m a-weary of my life/ if you’ll come and be my wife, quite serene be my life…’
‘নাহ ওরা বোধহয় কিছু শুনতে পাচ্ছে না। দাঁড়াও অন্য একটা স্টেশন দেখি’।
নবটা ঘুরিয়ে অন্য স্টেশনে দেয় জিম। এখানে যে খুব হইচই। বোধহয় ককটেল পার্টি চলছে কোথাও। কাচের গেলাসের টুং টাং…পিয়ানোর আওয়াজ…কে যেন একটা হেঁড়ে গলায় গানও গাইছে। কত লোকের উল্লাস…খুশিতে উপচে পড়া কথাবার্তা রেডিও-র লাউড স্পিকার বেয়ে জিন-আইরিনের বসার ঘরে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ে সব।… ‘আরেকটা স্যান্ডুইচ নিন না…’ বলেই হেসে গড়িয়ে পড়েন মহিলা। বুদিবুদিয়ে ওঠে হাসির ফোয়ারা। তার মাঝেই খাবারসুদ্ধ এক প্লেট ঝন ঝন করে পড়ে মাটিতে।
এবারও আইরিনের চোখ ছানাবড়া… ‘ এ তো ফুলারদের ফ্ল্যাট। ১১ ই। আমি তো জানি ওদের বাড়িয়ে আজ সন্ধ্যেতে পার্টি আছে। মিসেস ফুলারকে আজ সকালেই মদের দোকানে দেখেছি। এ কীসব ম্যাজিক হয়ে যাচ্ছে বলো তো দেখি! এবার অন্য কোনো স্টেশনে দাও তো দেখি…দেখি তো ১৮ সি ফ্ল্যাটের কিছু খবর পাওয়া যায় কি না!’
আরো কতকিছু শোনা যায় রেডিওতে। কানাডায় কে একজন স্যামন মাছ ধরে এসেছেন তার দীর্ঘ বিবরণ…তাসের আড্ডার খুচরো গল্প… সি আইল্যান্ডে পনেরো দিন কাটানোর গল্প শোনা যায় কোনো এক বাড়িতে… তারপর স্বামী-স্ত্রীর হুলুস্থুল ঝগড়া। ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তুলে ফেলেছে বউ। তাই নিয়ে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়। লোকের বাড়ির সব কিসসা শুনে মাঝেরাতে রেডিওটা বন্ধ করে শুতে যায় তারা। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল একদম। আরো রাতের দিকে জল খাওয়ার জন্য চেঁচায় ছেলে। আইরিন উঠে ছেলেকে জল দিতে যায়। আর ঘুম আসে না তার চোখে। রাত কত হল কে জানে? রাস্তার আলোগুলো নিভে গেছে সব। চারদিক নিঝুম…নিস্তব্ধ। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না তার। উশখুশ করতে করতে বসার ঘরে এসে আবার রেডিওটা চালিয়ে দেয় সে। ওপারে ঘড় ঘড় কাশির আওয়াজ… কারো যেন একটা আর্তনাদ। তারপর এক পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ… ‘ তুমি ঠিক আছ তো সোনা?’ উত্তরে মহিলা বলেন ‘হ্যাঁ’…তার গলাটা ভারি বিষণ্ণ…ক্লান্ত… ‘হ্যাঁ গো আমি ঠিকই আছি’। আবেগে উথলে ওঠেন মহিলা… ‘জানো চার্লি আমি মনে হয় আর নিজের মধ্যে নেই। হপ্তায় মিনিট পনেরো কুড়ি হবে যখন আমি নিজের মতো থাকি। কিন্তু আর কোনো ডাক্তারের কাছে আমি যাব না চার্লি। এত খরচ হয়ে গেছে এর মধ্যে। চার্লি সত্যি বলছি আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না…কেমন যেন হারিয়ে ফেলি নিজেকে’। এ নিশ্চয়ই মধ্যবয়সি কোনো দম্পতির সংলাপ। গলার স্বর শুনেই ঠিক বুঝতে পারে আইরিন। নিঃসঙ্গ এই মানুষদুটোর যন্ত্রণা…তার ওপর জানালা দিয়ে বাইরের শিরশিরে হাওয়া শরীরে কাঁপণ ধরিয়ে দেয় তার। আবার বিছানায় সেঁধোয় সে।
পরের দিন সকালের জলখাবারটা সে নিজের হাতেই বানায় । রান্নার মাসি এখনো এসে পৌঁছয়নি। এই তো একতলাতেই থাকে। তাও সময় মতো আসতে পারে না। নিজেই সে মেয়ের চুল বেঁধে দেয়। স্বামী, ছেলে-মেয়েরা লিফটে ওঠে। ওরা নীচে না নামা অবধি সে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই থাকে। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তার অখণ্ড অবসর। বসার ঘরে এসে এবার সে রেডিওটা চালায়। এবার এক বাচ্চার চিল চিৎকার ‘ আমি স্কুলে যাব না, যাব না। ভালো লাগে না আমার স্কুলে যেতে। আমি কিছুতেই যাব না’।
সঙ্গে সঙ্গে রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠেন ওপারের মহিলা… ‘যাব না বললেই হল। এমনি এমনি তোমাকে ওই স্কুলে দেওয়ার জন্য আটশো ডলার গচ্চা দিয়েছি? মরে গেলেও যেতে হবে তোমাকে’। রেডিও-তে আবার ভেসে ওঠে শতবার বাজানো সেই রেকর্ড…রিনরিনে মিসৌরি ওয়ালটজ। রেডিওটা চালিয়ে বেশ কয়েকটা বাড়ির সকালের খাওয়ার টেবিলের একান্ত আলাপচারিতা শুনে ফেলে সে…বদহজম নিয়ে খিটখিট…শরীর দেওয়া নেওয়ার রোমহর্ষক গল্প…কারো আকাশছোঁয়া অহংকার, কারো বা বিশ্বাস আর হতাশার কাহিনী… সব কানে আসে তার। শুনতে শুনতে ভারি মুষড়ে পড়ে সে। জীবনের এই অন্ধকার দিকটাকে তো সে আগে দেখেইনি। নিপাট সরল ছন্দেই কেটে গেছে তার জীবন…কোনো ঝড়ঝাপটাও আসেনি। রেডিওটার লাউডস্পিকারে এই কর্কশ…হিংস্র কথাবার্তা আর সহ্য হচ্ছে না তার। থেকে থেকেই গা-টা গুলিয়ে উঠছে। মাথাটা ভার। তাও তাকে সব শুনে যেতে হবে। কোন নিশিতে যে পেয়েছে তাকে! আয়া আসা অবধি একটানা সে শুনেই যায় নানা লোকের কেচ্ছা কাহিনি। তারপর আয়াকে দেখামাত্রই চট করে গিয়ে সুইচটা বন্ধ করে দেয়। সে যে এতক্ষণ চুরি করে অন্য লোকের কথা শুনছিল খেয়াল হয় তার। এক বন্ধুর সঙ্গে দুপুরের খাবারটা আজ বাইরেই খাবে সে। বারোটার একটু পরেই তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। তার ফ্ল্যাটের কাছে লিফট এসে থামে। লিফটের ভেতরে আগে থেকেই বেশ কয়েকজন মহিলা রয়েছেন। সে হাঁ করে চেয়ে থাকে তাঁদের দিকে। তাঁদের ফারের কোট, ফুলকাটা দামি পোশাক, মাথার টুপি আর ভাবলেশহীন মুখ দেখে আলাদা করে কিছু বোঝার উপায় তো নেই। কিন্তু এদের মধ্যে কে যে সি আইল্যান্ডে ছুটি কাটিয়ে এসেছে আর কে ই বা ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তুলে নিয়েছে মনে মনে বোঝার চেষ্টা করে আইরিন। এর মাঝেই এগারো তলায় এসে থামে লিফট। দুটো কুকুর নিয়ে এক মহিলা এসে ওঠেন। চুলটা তাঁর চুড়ো করে বাঁধা। গলায় কায়দা করে মিংকের ফারের শাল জড়ানো। মিসৌরি ওয়ালটজ-এর সুর গুণগুণ করে যান তিনি।
লাঞ্চে মাত্র দুটো মার্টিনি নেয় আইরিন। তার দুটো কৌতূহলী চোখ শুধু ঘুরে বেড়ায় বান্ধবীর চোখে মুখে…ওই চোখেও কি কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রয়েছে? খাওয়ার পরে একটু কেনাকাটা করার করার কথাও ছিল তাদের। কিন্তু এখন আর ওসবে মন নেই আইরিনের। তার মন পড়ে রয়েছে তার বসার ঘরে…রেডিওটার দিকে। কোনো রকমে একটা বাহানা করে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে আসে সে। আয়াকে বলে দেয় এখন যেন তাকে মোটেই বিরক্ত না করা হয়। একছুটে বসার ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে রেডিওটা চালিয়ে দেয়। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। অলস বিকেলের টুকরো টাকরা কিছু কথা ভেসে আসে রেডিও-তে। ভুলিয়ে ভালিয়ে পিসির মেজাজ ঠাণ্ডা করছে এক মহিলা…কারো বাড়িতে লাঞ্চ পার্টি এই শেষ হল…এখনও তার রেশ কাটেনি। ককটেলের অতিথিদের সামলানোর ব্যাপারে বাড়ির পরিচারিকাকে অতি মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছেন গৃহকর্ত্রী… ‘ শোন যাদের মাথার চুল সাদা একমাত্র তাদেরই দামি স্কচটা দেবে…আর কাউকে না। বুঝলে?’ … ‘ ও আর হ্যাঁ মেটের চচ্চড়িটা শেষ করার পর তবে ভালো খাবার দাবারগুলো বের করবে। ওহ আমাকে পাঁচ ডলার ধার দিতে পারবে…লিফটম্যানকে একটু টিপস দিতে হবে’।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। লাউডস্পিকারে মানুষের কলরব বাড়ে। বসার ঘরের চেয়ারটা থেকেই ইস্ট নদীর ওপরে আকাশটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আইরিন। আকাশের গায়ে থোকা থোকা সাদা মেঘ…যেন সমুদ্রের দখিনা বাতাস শীতের কুয়াশাকে ছিঁড়ে খুড়ে উত্তরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লাউডস্পিকারে ককটেল পার্টির অতিথিদের হই হল্লায় চটক ভাঙে তার। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই তো অতিথিরা সব এসে গেছে…ঐ কোন বাড়িতে বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরল…বাড়ির কর্তারা ফিরল অফিস থেকে। এর মাঝে আবার এক মহিলার গলা… ‘জানো তো আজ সকালে বাথরুমে একটা বড় হিরে কুড়িয়ে পেয়েছি, কাল নির্ঘাৎ ওটা মিসেস ডান্সটনের ব্রেসলেট থেকে খুলে পড়ে গেছে’।
‘ঠিক আছে রেখে দাও। আমরা ওটা বেচে দেব’। নিশ্চয়ই মহিলার স্বামীর গলা… ‘ ম্যাডিসন অ্যাভিনিউতে কোনো ভালো গয়নার দোকানে নিয়ে ওটাকে বেচে দাও। মিসেস ডান্সটন বুঝতেও পারবেন না। এমন হিরে ওঁর অনেক আছে। আমাদের বেশ ভালো একটা কামাই হয়ে যাবে কী বলো?’
সুইনিদের আয়ার গলাও পায় আইরিন। এখনো সে সুর করে ছড়াই বলে যাচ্ছে… ‘ Oranges and lemons, say the bells of Clements/ half pence and farthing, say the bells of St Martin’s/ When will you pay me? Say the bells at Old Bailey…’
‘আরে না না ওটা কোনো টুপির গল্প নয়…ওটা ওদের প্রেমের গল্প। হ্যাঁ হ্যাঁ…’ চিৎকার করে ওঠেন এক মহিলা… ‘আমাকে ওয়াল্টার ফ্লোরেল তাই বল্লেন…ওসব টুপি ফুপি আসলে ওদের দেখা করার বাহানা’। ভদ্রমহিলাই আবার গলাটা খাদে নামিয়ে কাউকে যেন একটা বলেন… ‘ তুমি কারো সঙ্গে কথা বলছ না কেন? কথা বল। ওই খিটকেল মহিলা যদি তোমায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে আমাদের পার্টি থেকে বের করে দেবে। তুমি তো জানো এইসব পার্টিতে আসতে আমি কত ভালোবাসি’।
ডিনারে সেদিন বাইরে যাওয়ার কথা। জিম বাড়ি ফিরে দেখে বউয়ের সাজগোজ শেষ হয়নি। আইরিনকে বড় শুকনো আর ছাড়া ছাড়া লাগে তার। একটু পানীয় নিলে হয়তো মনটা একটু ভালো হবে।এই ভেবে নিজেই ককটেলটা বানিয়ে আনে। বন্ধুরা সব অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। হেঁটেই রওনা দেয় তারা। তারাভরা আকাশটা আজ বড় মায়াবি। বসন্তের এই সুন্দর সন্ধেগুলোতেই তো মানুষের ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে উড়তে চায়। পুরোনো স্মৃতিরা মনের মধ্যে জেগে ওঠে। নরম বাতাস তাদের মুখ চোখ হাত ছুঁয়ে যায়। রাস্তার মোড়ে ‘সালভেশন আর্মি’র ব্যান্ড গান গাইছে ‘ জেসাস ইজ সুইটার’। স্বামীর হাতটা ধরে টেনে থামায় আইরিন। গানটা সে ভালো করে শুনতে চায়… ‘ এরা কী ভালো তাই না? আমরা চারপাশে যাদের দেখি তাদের চেয়ে এরা ঢের ভালো’। এই বলে নিজের পার্স থেকে একটা নোট বের করে ওদের কাছে গিয়ে দিয়ে দেয়। তার মুখে যেন কীসের যন্ত্রণা। জিম ঠিক ঠাহর করতে পারে না। ডিনার পার্টিতেই তার হাবভাব কেমন যেন খাপছাড়া ঠেকে। অন্যের কথার মাঝে সে বার বার কথা বলে ওঠে। সবার দিকে কেমন যেন কটমট করে চেয়ে থাকে। বাচ্চারা যদি এটা করত। এই আইরিনই তখন তাদের বকে ঝকে একসা করত।
পার্টি শেহ হওয়ার পর হেঁটেই বাড়ির পথ ধরে তারা। এখনো রাত তেমন হয়নি। বসন্তের রাতে একঝুড়ি তারার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকে আইরিন… ‘ কত দূর থেকে ওই তারাগুলো আলো ছড়াচ্ছে তাই না? এই পাঁকে ভরা দুনিয়ায় মানুষের ভালো কাজগুলোই শুধু ওই তারাদের মতো আলো হয়ে থাকে। বাকি তো সবই অন্ধকার’। বাড়ি ফিরে জিম ঘুমিয়ে পড়ে। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই যেন ছিল আইরিনএতক্ষণ। সে বসার ঘরে গিয়ে রেডিওটাকে নিয়ে পড়ে।
পরের দিন জিমের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে ছটা। এমা মানে আয়া তাকে দরজা খুলে দেয়। টুপিটা নামিয়ে রেখে সবে সে কোটটা খুলতে যাবে অমনি পাগলের হলঘরে ছুটে আসে আইরিন। চুল তার আলুথালু…মুখ চোখ টকটকে লাল… ‘এক্ষুনি ১৬ সি ফ্ল্যাটে যাও জিম। না না কোটটা আর খুলতে হবে না। তাড়াতাড়ি ১৬ সি-তে যাও। আর দেরি কোরো না। দোহাই তোমার। মি. অসবর্ন তার বউকে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে। সেই চারটে থেকে ওরা ঝগড়া করছে। এখন আবার এই মারপিট। যাও গিয়ে ওদের থামাও’।
বসার ঘরে রেডিও থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি, নোংরা গালাগালি, চড়-চাপ্পড়ের আওয়াজ স…ব শুনতে পায় জিম… ‘তোমার এসব শোনা মোটেই উচিত হয়নি আইরিন।…খুব বাজে অভ্যেস’। এক দৌড়ে বসার ঘরে গিয়ে রেডিওটা সে বন্ধ করে দেয়… ‘লোকের কথা আড়ি পেতে শোনা এ সব কী হচ্ছেটা কী আইরিন? তোমার কি এগুলো শোনা উচিত? তুমি রেডিওটা বন্ধ করে দিলেই পারতে’।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আইরিন… ‘উফফ কী সাঙ্ঘাতিক…কী ভয়ংকর! আর ভাবতে পারছি না আমি। আমি সারাদিন এসব শুনি। আমার মনটা ভেঙে চূরমার হয়ে যায়’।
‘ তোমার যদি এতই মন খারাপ হয় তাহলে এসব ছাইপাঁশ শোনো কেন? তুমি যাতে একটু আনন্দ পাও সেজন্যই এই রেডিওটা কেনা। অনেক টাকা ঢেলেছি এর পেছনে। ভেবেছিলাম তুমি অন্তত একটু আনন্দ পাবে। তোমার মুখে হাসি দেখতে চেয়েছি আমি’।
‘ আর না জিম। আমার সঙ্গে আর ঝগড়া কোরো না’। গলাটা কেমন যেন আর্তনাদের মতো শোনায় তার। মাথাটা সে এলিয়ে দেয় স্বামীর কাঁধের ওপর… ‘সবাই খালি সারাদিন ঝগড়াই করে যাচ্ছে। সব্বাই। সবাই শুধু টাকা টাকা করেই গেল। মিসেস হাচিনসনের মা ফ্লোরিডায় একা একা ক্যান্সারে ধুঁকছে। শুধু টাকার জন্য মায়ো ক্লিনিকে ওঁর চিকিৎসা হচ্ছে না। মি. হাচিনসন তো বলেই দিয়েছেন ওঁর হাতে টাকা নেই। আর এই ফ্ল্যাটবাড়ির কোন এক মহিলা ওই জঘন্য মিস্ত্রিটার সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। ভাবতে পারো? ছিঃ! ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে। মিসেস মেলভিলের আবার হার্টের ব্যামো। এই এপ্রিলেই মি.হেনড্রিক্সের চাকরিটা চলে যাবে। চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন মিসেস হেনড্রিক্স। আর ওই যে মেয়েটা মিসৌরি ওয়ালটজ গুনগুনিয়ে যায় সে একটা বেশ্যা…এক্কেবারে বাজারের মেয়ে। আমাদের লিফটম্যান টিউবারকুলোসিসে ভুগছে। আর মি.অসবর্ন তার বউকে ধরে পেটাচ্ছে। উফফ আর পারছি না আমি’…এই বলে কঁকিয়ে ওঠে সে। এক প্রবল যন্ত্রণায় সারা শরীর বেঁকেচূরে যায় তার। চোখের জল সামলাতে দু হাতে মুখটা চেপে ধরে সে।
‘ কেন এসব শোনো তুমি?…এতই যদি কষ্ট পাও তাহলে কেন শোনো এসব?’ চেঁচিয়ে ওঠে জিম। সে জবাবদিহি চায়’।
‘না না না। ওভাবে আর বোলো না। জীবনটা যে এত কষ্টের, এত যন্ত্রণার…এত নিষ্ঠুর আগে যে বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমাদের কক্ষনো এমনটা হয়নি তাই না? কী বল? আমরা তো সবসময় একে অপরকে সম্মান করেছি, ভালোবেসেছি…তাই না? আমাদের দুটো সন্তান রয়েছে…মিষ্টি…ফুটফুটে দুটো বাচ্চা। আমাদের জীবনে কোনো কষ্ট নেই তাই না সোনা? কী গো নেই তো? বলো না?’ স্বামীর গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে মুখটা আরো কাছে টেনে আনে সে… ‘আমরা তো সুখী কী গো বলো না? আমারা খুব সুখী তাই না?’
‘ হ্যাঁ তাই তো। আমরা খুব সুখী’। বউকে শান্ত করতে মুখ খুলতেই হয় জিমকে। কিন্তু মনের বিরক্তিটাকে আর চেপে রাখতে পারে না সে… ‘ হয় এই হতচ্ছাড়া রেডিওটাকে সারাবো নয় কালকেই ওটাকে বিদেয় করব’। বউয়ের চুলে বিলি কেটে দেয় সে… ‘ আমার লক্ষ্মী সোনা’।
‘তুমি তো আমাকে ভালবাসো তাই না? আমাদের মধ্যে কোনো ভণ্ডামি নেই। আমরা লোকের মতো অমন সারাক্ষণ টাকা টাকা করেও বেড়াই না। আমাদের মধ্যে কোনো লুকোছাপা নেই বাবা। কী তাই তো সোনা?’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ একদম তাই সোনা’।
পরের দিন সকালেই দোকান থেকে মিস্ত্রি এসে রেডিওটা সারিয়ে দেয়। খুব সাবধানে রেডিওটা খোলে আইরিন। নাহ জিনিসটা বোধহয় এবার ঠিক হয়েছে…ক্যালিফোর্নিয়া ওয়াইনের বিজ্ঞাপণের পর বিথোফেনের নাইন্থ সিমফনি শুনে মনটা নেচে ওঠে তার। তার ওপর উপরি পাওনা সিলারের ‘ওড টু জয়’। রেডিও চলে সারাদিন। আর কোনো গণ্ডগোল নেই। উফফ এবার তাহলে শান্তি।
জিম যখন বাড়ি ফেরে তখন একটা স্প্যানিশ মিউজিক বাজছিল। ‘ কী সব ঠিক আছে তো?’ বউয়ের কাছ থেকে সব খোঁজ খবর নেয় জিম। কিন্তু আজ জিমের মুখটা অত ফ্যাকাশে লাগছে কেন ? চিন্তায় পড়ে আইরিন। নিজেদের জন্য গেলাসে একটু ককটেল নিয়ে ডিনারের জন্য ‘অ্যানভিল কোরাসে’ ঢুঁ মারে তারা। সেখান থেকে দেবুসির ‘লা মের’। একের পর এক রেস্তোরাঁয় ঘুরে বেড়ায় তারা।
‘ রেডিওটার টাকা আজ দিয়ে দিয়েছি। চারশো ডলার। আশা করি এবার তোমার মনটা একটু ভালো থাকবে’।
‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই থাকবে’।
‘ দেখো চারশো ডলার কোনো মুখের কথা নয়। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে আমাকে। তোমার খুশির জন্য এটুকু আমি করেছি। এ বছর আর কোনো বিলাসিতা নয়। আচ্ছা তুমি ধোপার টাকা মেটাওনি কেন এখনো? তোমার ড্রেসিং টেবিলে বিলগুলো দেখলাম। তাহলে আমায় কেন বলেছিলে যে সব মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে? কেন মিথ্যে বলেছ আমায়?’
‘ দেখো এইসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাইনি’। গলা শুকিয়ে যায় আইরিনের। ঢোঁক ঢোঁক জল খায় সে… ‘না মানে আমি ভেবেছিলাম এমাসের হাতখরচের টাকা থেকে ওটা আমি মিটিয়ে দিতে পারব। কিন্তু গত মাসে ওই কুশন কভার কিনতে হল…তারপর পার্টির খরচ…
‘ শোনো…আমি যে টাকাটা তোমায় দিই সেটা আরো বুদ্ধি করে খরচ করতে হবে তোমায়।জানোই তো গত বছরের মতো এবার অত টাকা নেই এবার হাতে। টানাটানির মধ্যে রয়েছি। মাইকেলের সঙ্গে আজই আমার কথা হয়েছে। ঠিক মতো চলছে না কিছুই। কেউ কোনো জিনিস কিনছে না। তার ওপর কোম্পানির অবস্থাও ভালো নয়। নতুন নতুন জিনিস বানাতে আমারা কত সময় দিই। সেগুলোই যদি বাজারে না চলে! বয়সটাও আর বসে নেই। এই তো সাঁইত্রিশ হয়েই গেল। এরপর চুলে পাক ধরবে। কেরিয়ারে আমার যতটা উন্নতি করার কথা ছিল ততটা তো করে উঠতে পারি্নি। এখন আর নতুন করে কিছু হওয়ার নেই। আমাদের অবস্থা আর ফিরবে বলে তো মনে হয় না’।
‘হ্যাঁ তাই তো’।
‘খরচ কমাও…যেখানে পারো খরচ কমাও। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতে হবে। শোনো তোমাকে খোলাখুলি একটা কথা বলতে চাই…এই টাকা পয়সার চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না আমার। কাল কী হবে না হবে কেউ জানে না। আমার যদি কিছু ভালোমন্দ হয়ে যায়? বিমা একটা আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে আর কতদিন! তোমাকে…বাচ্চাদের একটু আরামে রাখার জন্য নিজের সবটা দিয়ে দিয়েছি আমি। কিন্তু জানো তো আমার রক্ত জল করা পরিশ্রম তোমার ওই ফার কোট, রেডিও আর কুশন কভার আর লোক দেখানো ঠাটবাটেরপেছনেই নষ্ট হবে এটা কিছুতেই মানতে পারি না’।
‘চুপ করো জিম…দোহাই তোমার…ওরা আমাদের শুনে ফেলবে’।
‘ কে? কে শুনবে? এখান থেকে এমা আমাদের কথা শুনতে পাবে না’।
‘ না না, ওই রেডিও’।
‘ উফফফ আমি আর পারছি না বিশ্বাস করো’…রাগে চেঁচিয়ে ওঠে জিম… ‘তোমার এই বাতিকের জ্বালায় পাগল হয়ে যাই আমি। রেডিও আমাদের কথা শুনতে পাবে না। কেউ শুনতে পাবে না। আর শুনলেই বা কী যায় আসে…আমি থোড়াই কেয়ার করি!’
আস্তে আস্তে উঠে বসার ঘরে চলে যায় আইরিন। জিমও যায় তার পিছু পিছু। মাথায় আজ ভূত চেপেছে তার। সব বিষ সে উগরেই ছাড়বে… ‘ এত সতী সাবিত্রী কবে থেকে হলে তুমি? এত কিছু কাণ্ডের পর রাতারাতি ধোয়া তুলসী পাতা সাজা হচ্ছে? ন্যাকামি! তোমার মায়ের উইল প্রবেট নেওয়ার আগেই তুমি তাঁর গয়না চুরি করনি? নিজের বোনকেও এক কানাকড়ি দাওনি তুমি। তাকে তুমি ঠকিয়েছ। তার প্রাপ্য টাকা থেকে তাকে বঞ্চিত করেছ। তার নিতান্ত দুর্দশার সময়েও এক পয়সা ঠেকাওনি তাকে। গ্রেস হাওল্যান্ডের জীবনটাকে বরবাদ করে দিয়েছ তুমি। আর যেদিন নাচতে নাচতে ওই হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে পেট খসাতে চলে গেলে সেদিন কোথায় ছিল তোমার এত নীতি…বড় বড় সব বুলি? সেদিন তোমার মধ্যে কোনো তাপ উত্তাপ ছিল না কি? দিব্যি সেজে গুজে ব্যাগপত্র নিয়ে চললে যেন পিকনিকে যাচ্ছ। গিয়ে বাচ্চাটাকে নিকেশ করে এলে। এর কোনো কারণ দেখাতে পারবে তুমি? কোনো একটা জুতসই কারণ?’
কিম্ভূত রেডিওটার পাশে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আইরিন। মুখে তার কোনো কথা যোগায় না। লজ্জায়, অপমানে মাটিতে মিশে যায় সে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে রেডিওটা চালিয়ে দেয়। এখন এই রেডিওটা শুনলেই হয়তো তার প্রাণটা একটু জুড়বে। সুইনিদের আয়ার ছড়া শুনতে খুব ইচ্ছে করছে তার। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিম চেঁচিয়ে চলেছে। আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত এত তাড়াতাড়ি বন্ধ হওয়ার নয়। রেডিওর লাউডস্পিকারেনিরুত্তাপ রুটিন ঘোষণা… ‘ আজ সকালে টোকিয়ো-তে রেল দুর্ঘটনায় ২৯ জন মৃত। বাফেলোর কাছে অন্ধ শিশুদের হাসপাতালে ভয়াবহ আগুন। নানদের চেষ্টায় আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে। আজকের তাপমাত্রা সাতচল্লিশ। আপেক্ষিক আর্দ্রতা উননব্বই’।
- ম্যাজিক রেডিও গল্পটি জন চিভারের ‘ইনরমাস রেডিও’ গল্পটির অনুবাদ।