গল্প

  • গল্প

    গল্প- একা’দশী তিথি

    একা’দশী তিথি
    -সুবিনয় হালদার

     

     

    চতুর্থ প্রহর শেষে ঊষালগ্নে উদ্ভাসিত হতে থাকে পৃথিবী।
    নিশি সমাপন মুহূর্ত জানান দেয় পাখিদের সমবেত কিচিরমিচির ডাক আর আজানের আওয়াজ।
    মা’ ষষ্ঠীর শঙ্খধ্বনিতে সকাল-সকাল তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে নেয় একা’দশী, আজ তার আর্য্য-ভূমিতে সংস্কৃতি যজ্ঞের পৌরোহিত্য করতে হবে।
    সেখানে তার পরিচিত বহু মানুষজন আসবে, নমোনমো দুগ্গাদুগ্গা করে আত্মপ্রত্যয়ে বেড়িয়ে পরে একা’দশী।

    সেখানেই সেদিন প্রথম দেখা- তিথি ; পঞ্চমীদির সাথে ছোটবোন দ্বিতির হাত ধরে এসেছিল ওখানে।
    দিদি’ই তাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়-, বাক্য বিনিময় হয় সামান্য কিছু- ব্যাস এইটুকু।
    তারপর ধীরেধীরে দামোদরে জোয়ার আসে! কোটালে ভেসে যায় সবকিছু কিন্তু তিথি সেটা বোঝেনি কখনোই!
    তবুও আসে, জানান দেয় সে আছে !
    তিথির মেজ বোন অষ্টমী খুব সুন্দরী। মনে সংগোপনে লালিতপালিত কামিনীকাঞ্চন শোভিত যা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষীত !
    আসাযাওয়া গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে। দিন যায়- বছর ঘুরে বছর আসে আর যায়- ; উত্তর থেকে দক্ষিণায়ন অতিবাহিত হয় কত কিন্তু উত্তর মেলেনি আজো !

    বসন্তের পরন্ত বৈকালে ঝরাপাতায় ফাগুন হাওয়ায় মর্মরধ্বনির সাথে কোকিলের ডাক শুনে নেচেছিল মন !
    চেতনা পুরে প্রেরণা’ এসে জাগিয়েছিল সাদা খামে হলুদ ছোঁয়ার অনুভূতি !
    তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিলো- এক মায়াবী আলোর উৎস সন্ধানে ;
    তার’ই জন্যে সে অপেক্ষা করছিলো- অনেকটা সময় ধরে, রাস্তার পাশে গাছের তলায় এক যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে।
    পথচলতি কত মানুষ- কত ব্যস্ততা- বাস গাড়ির হর্ণ এর বিকট আওয়াজ- দুষিত আবহাওয়া- সব কিছু উপেক্ষা করে !
    সমস্ত বাধা অতিক্রম করে হন্তদন্ত হয়ে ঘামে-নেয়ে একসা শরীরে একা’দশী তিথির সামনে দাঁড়ালো- ;
    অন্যমনস্ক তিথি যেন রূপকথার দেশে মায়াবী পরী,
    কী বলবে- ও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলো-না !

    সুন্দর পরিপাট্য বেশভূষায় বেশ লাগছে ।
    একা’দশীকে এইভাবে বোকা স্ট্যাচুর মতো হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো- চলো- অনেক দেরি হয়ে গেছে ! বলে সটান রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে থাকলো !
    একা’দশী তখন ওর কাছে গিয়ে আলতো স্বরে বললো- তোমাকে-না আজ খুব সুন্দর লাগছে ।
    ধ্যাৎ,মোটেই না- ; কী-যে বলো-না- আজকাল ; বলে- শরৎ মেঘের ওড়না উড়িয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে চললো-,
    অগত্যা সে-ও ওর পিছু-পিছু হাঁটতে থাকলো !

    মোড়ের বাম দিক ঘুরে একটু এগিয়ে একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করলো । ও কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে বললো- ওঠো ;
    একা’দশী আগে উঠে বসার পর সে তার একেবারে পাশে- গায়ে গা-ঠেকিয়ে গেটের দিকে বসলো ।

    অটোরিকশা চলতে থাকলো একা’দশীর নাজানা গন্তব্যে !
    হাওয়ায় তিথির চুল গুলো ঠোঁট স্পর্শ করে উড়ে এসে পরছে একা’দশীর মুখে আর তিথির মেয়েলি গন্ধে তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে এক পারিজাতের নরম স্নিগ্ধতা ভরিয়ে দিচ্ছে !
    তার শাড়ির আঁচলটা বারবার উড়ে এসে ওর মুখমণ্ডলটা ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে কেউ যেন একটা কাশফুল দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে !

    তিথির ঘোরে আচ্ছন্ন একা’দশী শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকে ! হাল্কা লাজুক হাসি আর চোখেমুখে উজ্জ্বল আভার উপস্থিতি ভরে উঠেছে তিথি ।
    কোন কথা বলছেনা দেখে সে জিগ্যেস করতে যাবে- ঠিক সেই সময় তিথি বলে উঠলো- এই দাঁড়াও- দাঁড়াও এখানে ।

    নেমে পড়লো দুজনে । ভাড়াটা বের করার আগেই তিথি চালকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে একা’দশীর দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় বললো- চলো- সামনের ওইখানে আমরা যাবো !

    দেখলো দূরে একটা বড় বিল্ডিং আর তার গেটের বাইরে ইংরেজিতে লেখা- The Asylum .

  • গল্প

    গল্প- আনন্দ পার্বণ

    আনন্দ পার্বণ

    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারলাম, সদা পরিবর্তনশীল এই সময়ে , প্রবচনটিকে বোধহয় একটুখানি শুধরে নেওয়াই যায়।আজ বোধহয় বাঙালি নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, উঁহু ,আর তেরো নয় , গোটাগুটি চোদ্দোটি পার্বণের গৌরবময় উপস্থিতি বাঙালির পার্বণ লিষ্টিতে। সেই সানন্দ সংযোজনটি হলো বই -পার্বণ, পৌষ পার্বণের পিছু পিছুই যার সগৌরব উপস্থিতি। আপামর বঙ্গসন্তানদের সে বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন।
    পিকনিক, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ইত্যাদি শীতের সাতকাহনের মাঝেই হৈ হৈ করে বইমেলার রব উঠে পড়ে।
    লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী,প্রুফ রিডার, ছাপাখানা মায় বাঁধাই কর্মী, ভ্যান গাড়ি কারুরই আর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। ওদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হেথা হোথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাঁশ, কাঠের তক্তা, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে থাকে ছোট বড়ো নানা আকারের স্টলে। কথ্যভাষায় স্টল বটে, আদতে সেগুলি বুঝি সুন্দর লাল নীল কাপড়ে মোড়া, অজস্র মণিমুক্তো ঠাসা মণিমঞ্জুষা। দেশী বিদেশী বিদগ্ধ পন্ডিতজনের মণীষায় উজ্জ্বল, নানা আকারের পুঁথিপত্তরের পাশাপাশি নব নবীন সমস্ত লেখকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাস্বর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গৌরব এই বইমেলা। সমগ্র বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন মহাসমারোহে বই উৎসব পালিত হতে দেখা যায়।
    ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু ওলটালেই দেখা যায় বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্র্যাংকফার্টে।আজও সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা বলে পরিগণিত ।আন্তর্জাতিক স্তরেও আকারে এবং চরিত্রে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখে সেটি। সেই তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে, বাঙালি যা পেয়েছে তাতেও সে অখুশি নয় মোটেই। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাঠকের উপচে পড়া ভীড় তার সাক্ষ্য দেয়। ওই ক’টা দিনে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জীবনের যতো অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা ,বুঝি ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। সম্বৎসর মনের মাঝে জমানো যতো বইয়ের নাম ছিলো, সেগুলিকে ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, সে পকেটে রেস্তর জোর থাকুক চাই নাই বা থাকুক। পুস্তকপ্রেমী এই সুযোগ কি ছাড়তে পারে! এবারে হয়তো কেনা হলো না, সামনের বার নিশ্চয়ই হবে, এই আশাই, আগামী দিনে পথ চলার পাথেয়। আসলে আমরা যখন বই সংগ্রহ করি তখন তো শুধু বই নয়, আমরা আনন্দও সংগ্রহ করি।
    বিগত বেশ কয়েকটি বছর বইমেলা যাওয়া, হয়ে ওঠে নি, এই বছর আকস্মিকভাবে সেই সুযোগটি এসে গেল। ভিড়ের মাঝে নয়, কিঞ্চিৎ ফাঁকায় দুপুর দুপুর সেরে ফেলার সংকল্পে বেলাবেলি পৌঁছনো গেল। তখনই শুরু হয়ে গেছে নামকরা প্রকাশনার স্টলগুলোতে, আবালবৃদ্ধবনিতার লম্বা লাইন। কেনার পাশাপাশি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহও কিছু কম নয়। শিশুদের ঝলমলে মুখ, তরুণ প্রজন্মের সদ্য প্রকাশিত বইসমূহ উল্টেপাল্টে দেখার পাশাপাশি, প্রাজ্ঞ ও বয়স্কজনের তালিকায় থাকা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমন্বিত গুরুগম্ভীর পুস্তক সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে মনে হয়, বাঙালির যে দিন গেছে, তার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি, কিছু তো আছেই,যার খবর আমরা রাখি না।
    মনে রাখতে হবে এই মেলা কেবলমাত্র লেখকের নয়, বছরের পর বছর ধরে সে নবীন পাঠকও নির্মাণ করে এসেছে, আজও করে। বাবা, মা, অভিভাবকদের হাত ধরে আসা শিশু কিশোরের দল, উত্তেজনায় ভরপুর তাদের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি, সেই সাক্ষ্য দেয়।
    পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বভারতীর ফাঁকা স্টল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিলো। । এই বছরে সেখানে উপচে পড়া ভীড়, চিত্তে শান্তির প্রলেপ দিলো। স্টলের নিভৃত কোণটিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এরা শুধুই ঘর সাজানোর সামগ্রী সংগ্রাহকদের দলভুক্ত, না-কি হুজুগে মাতামাতি করা,”পাবলিক”!
    অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, অথবা যৌবনের প্রান্তসীমায় দন্ডায়মান, কিছু এলোমেলো পোশাকের যুবকের , হাতের লিস্টি মিলিয়ে বই সংগ্রহের ছবি ,আমায় আশ্বস্ত করলো, বুঝিয়ে দিলো আমার সে আশঙ্কা মিথ্যে করে এঁরা প্রকৃতই পাঠক শ্রেণীভুক্ত।
    হেরে যাওয়াও যে কখনো সখনো এতো আনন্দদায়ক হতে পারে, তা কে কবে ভেবেছে!
    এই যে নানা আলোচনায় শুনি বাঙালি আজকাল আর বই পড়ে না, সেকথা সর্বৈব সত্যি নয় তাহলে ! বাঙালির সব কিছুই হারিয়ে যায়নি একেবারে।
    আমার নিজস্ব সংগ্রহের তালিকায় থাকা , এবং ভালোবাসার জনদের উপহার দেবার জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়ি।
    সূর্য আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে। ভিড় বাড়ছে। ঠেলাঠেলি এই বয়সে আর পোষায় না।
    দুপাশে স্টলের সারি, মধ্যিখানে সোজা রাস্তা। খানিকটা এগোতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়তেই, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধুলোমাখামাখি রাস্তার ঠিক মাঝ মধ্যিখানে বসা বছর ছয়েকের একটি শিশু , অভিভাবকদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সদ্য সংগৃহীত ছড়ার বইখানি পথের মাঝে খুলে রেখে , তার উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। আশেপাশের ভীড়ের দিকে তার হুঁশ নেই।
    স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রই।
    অবধারিত রবীন্দ্রনাথের পংক্তিতে ছেয়ে যায় মন। —
    “শুধায়ো না কবে কোন গান,
    কাহারে করিয়াছিনু দান—
    পথের ধুলার পরে
    পড়ে আছে তারই তরে
    যে তাহারে দিতে পারে মান।
    তুমি কি শুনেছো মোর বাণী
    হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি ?
    জানি না তোমার নাম,
    তোমারেই সঁপিলাম
    আমার ধ্যানের ধনখানি। “

  • গল্প

    গল্প- কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা

    কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
    -সুনির্মল বসু

    ঝাউবন পেরিয়ে সামনে নীল সমুদ্র। রঞ্জনা বিয়ের পর এই প্রথম স্বামী অনিকেতের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।
    সামনে ধূ ধূ বালিয়াড়ীর ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছিল। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।
    অনিকেত রঞ্জনার হাত ধরেছিল। বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে রঞ্জনার শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছিল।
    অনিকেত কম কথা বলা মানুষ।
    রঞ্জনা বলল, কি মশাই, একেবারেই চুপচাপ যে,
    অনিকেত বলল, সমুদ্র দেখছি, বড়র সামনে এলে,
    মুখে ভাষা আসে না।
    রঞ্জনা বলল, সমুদ্র কত পুরাতন, কত নতুন,
    আমাদের আগে কত মানুষ এখানে এসেছে, কত মানুষ ফিরে গিয়েছে, সমুদ্র একই রকম আছে।
    অনিকেত বলল, আমরা একদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না, সমুদ্র থাকবে।
    রঞ্জনা তাকিয়ে দেখল, দূর সমুদ্রের ধারে কিছু
    নুলিয়ারা একটি দাঁড়িয়ে থাকা নৌকোর পাশে ব্যস্ততার সঙ্গে নিজেদের কাজ করে চলেছে।
    সমুদ্রের পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানে ওরা চা খেতে এলো।
    তখন পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠে একটা ডাক এলো, এই অনিকেত,
    পেছন ঘুরে অনেকেত দেখল, রিমঝিমকে। সঙ্গে একজন সুদর্শন যুবক।
    রিমঝিম পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাসবেন্ড
    পার্থ, আর এ হোল, অনিকেত। আমার কলেজ লাইফের বন্ধু।
    অনিকেত রঞ্জনার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল।
    অনিকেতের মনে পড়ছিল, এই সেই রিমঝিম, যে একদিন ওকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল। পরে অনিকেত জানতে পেরেছিল, বাবার মনোনীত বড়লোক পাত্র পেয়ে, তাকেই বিয়ে করেছে রিমঝিম।
    ভালোবাসা আজকাল বড় সস্তা হয়ে গেছে। আর অনিকেত অংক করে ভালবাসতে শেখে নি।
    সেদিন কত কথা ছিল ওদের।
    কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে, গোলদীঘির পাড়ে প্রতিদিন দেখা হতো ওদের।
    রিমঝিম বলেছিল, তোমাকে না পেলে, আমি মরে যাবো, অনিকেত।
    কী মিথ্যে, কী মিথ্যে,
    সেদিনের রিমঝিমের সঙ্গে আজকের এই সুখী রিমঝিমকে একটুও মেলানো যায় না।
    রিমঝিম সত্যিই কি সুখী হয়েছে। নাকি, সুখে থাকার অভিনয় করছে। একটা মানুষের কত অসংখ্য মুখ থাকে।
    আজকে ওই ভালোবাসাকে প্রবলভাবে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, অনিকেতের।
    রিমঝিম জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছো,
    রঞ্জনা বলল, হোটেল তরঙ্গমালায়। আপনারা একদিন আসুন না।
    পার্থ বলল, যাবো কাল সকালে,
    অনিকেত চুপ করে ছিল। ও কিছুতেই রিমঝিমকে আর সহ্য করতে পারছিল না।
    তখন আকাশে একটি দুটি তারা ফুটেছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। পার্থ রিমঝিমকে বিদায় দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এলো।
    পরদিন রিমঝিম স্বামী পার্থকে সঙ্গে করে, অনিকেতের সঙ্গে দেখা করতে এলো।
    রিমঝিম বলল, কবে বিয়ে করলে, জানাওনি তো,
    অনিকেত বলল, চাকরি পাবার বছর তিনেক বাদে
    বাবা মা বিয়েটা দিলেন।
    ও, ভালো, তোমার বউ তো খুব সুন্দরী হয়েছে।
    আমি একটা সুন্দর মন খুঁজেছিলাম,
    পার্থ তখন টিভি চালিয়ে খেলা দেখছিল।
    রঞ্জনা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল।
    রিমঝিম বলল, আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছো না কেন, অনিকেত। দেখছি, আমার উপর থেকে তোমার রাগ এখনো পড়েনি।
    অনিকেত জবাব দিল না।
    রিমঝিম বলল, কি, আমার কথার উত্তর দেবে না,
    অনিকেত বলল, আমি সত্যিকার ভালোবেসে ছিলাম, আমি কাউকে ঠকাইনি। যে ভালোবাসা নিয়ে একদিন খেলেছিল, সে ঠকেছে।
    রঞ্জনা ওদের মিষ্টি ও কফি পরিবেশন করলো।
    বলল, ওর কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি, রিমঝিম।
    এ কথার কোন উত্তর দিল না রিমঝিম। মনে মনে অনুভব করল, সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে,
    একদিন সেই ভালোবাসার জন্য কাঁদতে হয়। সেদিনের জয়, আজ এত পরাজয়ের বার্তা এনে দেবে, রিমঝিম কোনো দিন সে কথা ভাবেনি।
    মিষ্টি কফি খাবার পর, পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে
    শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করছিল।
    একসময় ওরা বিদায় নিল। যাবার আগে, পার্থ অনিকেত আর রঞ্জনাকে ওদের লেকটাউনের বাড়িতে যাবার নেমন্তন্ন করেছিল।
    গভীর রাতে, রঞ্জনা বলল, রিমঝিমের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে,
    অনিকেত বলল, একেবারে না। আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু গোপন করিনি।
    রঞ্জনা বলল, ভালোবাসা আর ঘৃণা পাশাপাশি থাকে, দেখলে, রিমঝিম তোমাকে দেখাবার জন্য কেমন পার্থকে নিয়ে ঢলাঢলি করছিল।
    অনিকেত বলল, যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে ভালোবাসা দেখাবার জন্য এমন আদিখ্যেতা দেখাতে হয়।
    রঞ্জনা বলল, ওদের বাড়ি লেক টাউনে একবার যাবে নাকি,
    অনিকেত বলল, কক্ষনো না। রিমঝিম শুধু আমার বিশ্বাস ভাঙ্গেনি, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে খেলা করেছে,
    বিকেল বেলায় ওরা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মোহনার কাছে অনিকেত আর রঞ্জনা চলে এসেছিল।
    বিশ্রামের জন্য ওরা একটা দেবদারু গাছের নিচে
    দাঁড়ালো। রঞ্জনা দেখলো, ওদের পায়ের কাছে অনেক লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল কাঁকড়া গুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, আবার গর্তে ফিরে যাচ্ছিল।
    তা দেখে অনিকেত বলল, সবাই ঘর খোঁজে, ভালো ঘর, ভালোবাসার ঘর খোঁজে কজন,
    রঞ্জনা বলল, যত বড়ই ঘর হোক, ভালোবাসা না থাকলে, সে আবার ঘর কিসের,
    সমুদ্রের উতরোল ঢেউ এসে, ওদের দুজনের পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল।

  • গল্প

    গল্প- অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে

    অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
    -সুনির্মল বসু

    তখন তাঁর ভয়ংকর ব্যস্ততার দিন।
    সারাদিন স্কুল করবার পর, অনেক সময় খাবার সময় জোটে না, তাঁকে এ বাড়ি ও বাড়ি টিউশনি করে বেড়াতে হয়। যাতায়াতের জন্য সাইকেল একমাত্র ভরসা।
    সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা ব্যাচ পড়িয়ে সুদিন বাবু সবে দ্বিতীয় ব্যাচ পড়াতে শুরু করেছেন, গিন্নী জয়ার ফোন।
    তুমি কোথায়?
    স্টেশন রোডের কাছে, পড়াচ্ছি তো!
    একবার একটু এখানে আসতে পারবে?
    কোথায়?
    জয়দেব দার দুর্গা বাড়িতে।
    কেন?
    এসোই না, তখন বলবো।
    ছাত্রদের টেস্ট পেপার থেকে কাজ দিয়ে সুদিন বাবু
    ওখানে উপস্থিত হলেন।
    সন্ধ্যেবেলায় আরতি পর্ব চলছিল। প্রচুর ভক্তদের ভিড়।
    জয়া বললো, এসো।
    জয়দেবদা, সুদিন বাবুর হাতটা দেখতে চাইলেন।
    অনেকক্ষণ দেখার পর বললেন, আজ কিছু বলবো না। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই,আপনি পরে একদিন আসুন।
    সুদিনবাবু ফিরে গিয়ে পুনরায় ছাত্র পড়াতে বসলেন।
    কদিন বাদে সময় বের করে দুর্গা বাড়ি গেলেন।
    জয়দেবদা বললেন, আপনার তো এখানে জন্মাবার কথা না!
    মানে?
    আপনি তো বিরাট বড় বাড়ির লোক মশাই।
    কি বলছেন?
    আপনার তো বিরাট বাড়ি। বিরাট প্রজামহল। সবাই আপনাকে খুব মান্যতা করে।
    দাদা, আমি খুব সামান্য মানুষ। দেখছেন না, সারাদিন দুটো পয়সার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।
    আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
    কি করে হবে?
    আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলবো। সেটা করতে পারবেন? তাহলে আপনি নিজেই বুঝে যাবেন।

    তিনি কানে কানে একটা প্রক্রিয়ার কথা বললেন। বললেন, কাউকে বলা যাবে না কিন্তু! আজ রাতেই করুন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন।

    সুদিন বাবু টিউশনি পড়াতে ঢুকলেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে ব্যাপারটা মাথার মধ্যে নেননি কখনো।
    অনেক রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি যখন শুতে গেলেন, তখন জয়দেব দার গোপন প্রক্রিয়াটার কথা তার মনে পড়ল।

    পরীক্ষার ছলে তিনি সেটি করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। একটু বাদেই ঘুম এসে গেল। সারাদিন খাটাখাটুনির পর এমন ঘটনাই স্বাভাবিক।

    ঘুমের মধ্যে খানিকটা সময় বাদে জিনিস দেখলেন, তিনি যেন ওপর থেকে নিচের দিকে চাইছেন। দেখলেন, প্রচুর সবুজ গাছপালা। একটা বড় রাজপ্রাসাদের মত সাদা বাড়ি। বড় বড় জানালার উপর লাল রঙের সেড দেওয়া। বাড়ির বিশাল বড় গেট। সুদিন বাবু দৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। দেখলেন, বড় একটি আম গাছের নিচে এক ভদ্রলোক হলুদ ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জমিদারী স্টাইলের পাঞ্জাবী ও ধূতি। পায়ে সাদা রঙের চটি।
    সুদিন বাবু ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে চাইলেন।
    ওনার পাঞ্জাবিটা ঘাড় থেকে সামান্য নেমে এসেছে।
    পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সুদিন বাবু বিভিন্ন সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাষণ দিতে যান।
    বক্তৃতা দেবার সময় বারবার জামার কলারে হাত দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হচ্ছিল, ওনার পাঞ্জাবিটা উনি একটু তুলে দিলেই পারতেন। ভদ্রলোক শ্যাম বর্ণ। সুদিন বাবুর সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারায় কিছু মাত্র মিল নেই। কিন্তু ওনার চোখের দিকে তাকাতেই, সুদিন বাবু একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। হুবহু ওনার নিজের চোখ। চিন্তান্বিত অবস্থায় তাঁর চোখটা এমনই দেখায়। প্রথম দিন এই পর্যন্ত।

    পরদিন সুদিন বাবু দুর্গাবাড়িতে গেলেন। জয়দেবদাকে বললেন, আমি আমাকে গতকাল রাতে দেখেছি।
    জয়দেব দা বড় মাপের সাধক। বললেন, মাঝে মাঝে আবারো করুন। নিজেই সব দেখতে পাবেন।
    সুদিন বাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল।

    দুদিন বাদে তিনি আবার ওই প্রক্রিয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন, আগের দিনের সেই ভদ্রলোক একটা বিরাট জলাশয়ের কাছে এসেছেন।
    তাঁর চারপাশে ফতুয়া আর ধূতি পরা কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক জলাশয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে ওনাদের কিছু একটা দেখিয়ে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছেন।

    পরদিন সুদিন বাবু জয়দেব দার কাছে দ্বিতীয় দিনের স্বপ্নের কথা জানালেন।
    তৃতীয় দিন রাতে ওই প্রক্রিয়াটি করবার পর, সুদিন বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নের ঘরের মধ্যে দেখলেন, টানা বারান্দা দিয়ে এক দীর্ঘকায় ভদ্রমহিলা হেঁটে চলেছেন।
    পরদিন তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
    দাদা, কাকে দেখলাম?
    আপনার আগের জন্মের স্ত্রী।

    কদিন বাদে সুদিন বাবু ওই প্রক্রিয়াটি করে শুতে গেলেন। খালি বাদে স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, মাটির চওড়া রাস্তা। পথের দুপাশে সবুজ গাছপালা। অনেক লোক বাসের মাচায় করে দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে।
    জয়দেবদা, এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি?
    আপনার বাড়িতে পূজোর জন্য দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি মায়ের মুখটা দেখতে পেয়েছেন?
    নাতো দাদা। দেখিনি। তবে অনেক মানুষ বাসের মাচাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখেছি।

    কদিন পর সুদিন বাবু আবার ওই প্রক্রিয়া করলেন। তারপর শুতে গেলেন।
    ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন। আগের দিনের সেই ভদ্রমহিলা গোল ঘোরানো সিঁড়ির দোতলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক প্রধান দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। তাঁকে ঘরের ফিরতে দেখে, ভদ্রমহিলার চোখে মুখে একটা স্বস্তির ছাপ পড়লো যেন।

    এর কিছুদিন পর সুদিন বাবুর বাবা বার্ধক্য জনিত কারণে পরিণত বয়সে মারা গেলেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেল।

    সুদিন বাবু এই অশৌচ কালের মধ্যে জয়দেব দার শেখানো প্রক্রিয়াটি করলেন। কিন্তু কোনই ফল পেলেন না। বারে বারে চেষ্টা করা সত্ত্বেও, কিছুতেই আর সেই ছবিগুলো আসছিল না।

    তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
    দাদা, বারবার চেষ্টা করছি। আর তো আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
    পাবেন না তো!
    কেন?
    আপনার এখন অশৌচ কাল।

    সুদিন বাবু নানান ব্যস্ততার কারণে পরবর্তীকালে আর কখনো ওই চেষ্টাটা করেননি।

    কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, এইসব অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। বর্তমান সংসারের প্রতি মায়াটান কমে যায়।

    জয়দেবদা বললেন, আগামী জন্মে আপনি ও বাড়িতেই জন্মাবেন। আগের জন্মে কালী মন্দিরটা অসম্পূর্ণ রেখে আপনি মারা গিয়েছিলেন। আগামী জন্মে ওখানে জন্মে আপনাকে সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।

  • গল্প

    গল্প- সিনেমার আড্ডাটা

    সিনেমার আড্ডাটা
    অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

    “ঠিক ১২ টাই আমতলায় চৌরাস্তার মোড়ে।
    মনে থাকবে যেন।মিস করিস না একদম।”
    কথা মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম আমতলার মোড়ে।
    নামটা শুনলেই মন ছুটে যায় সেই দিন গুলোর স্মৃতি পাতায়।

    ২-৫টা। ৫টা -৮ টা।এগুলো হয়তো কারোর মনে নেই।
    হাউসফুল, ব্লাকে টিকিট কাটা। ফাস্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস,ব্যাল্কনি শব্দ গুলোর সাথে একালের ছেলেমেয়েরা খুব একটা পরিচিত নয়।আমাদের সময়ে সিনেমা হলে গিয়ে, সিনেমা দেখার স্মৃতি কথা ।
    আমার এলাকার প্রতিটি সিনেমা হল আমার চেনা।
    দিনে তিন টাইম সিনেমা হতো।এখনো বেশ কিছু দামী সিনেমা হল খোলা আছে ঠিকই কিন্তু মানুষের তেমন ঢ্ল দেখা যায় না। সিনেমা পাগল দর্শক যারা আছেন,তারা হয় মোবাইলে ডাউনলোর্ড করে নিচ্ছে নয় তো টিভিতে, নেটে বা অন্য কোনো ভাবে দেখে নিচ্ছে।
    হলে বসে তিন ঘন্টা টানা সিনেমা দেখার সময় কারোর নেই।
    আর কেউ খবরই রাখি না।
    আশেপাশের অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গোনা যে কটি সিনেমা হল আছে তাও স্কুল কলেজ পালানো ছেলেমেয়েদের কাছে। অজানা অথবা গুরুত্বহীন। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে একটা স্মার্টফোন থাকলেই সব স্বপ্ন পূর্ণ। ফোনে সারা বিশ্ব দর্শন। সিনেমা দেখা হয়ে যায়। সিনেমা হলে যেতে লাগে না খুব একটা।

    আমাদের সময়ে নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পেলেই কোন হলে সিনেমাটা আসছে? কত সপ্তাহ থাকবে একেবারে মুখস্থ রাখত রোহিত, সুব্রত ঝুমা, কাকলি আমরা সবাই। উঃ কি রোমাঞ্চকর ছিল সেই দিন গুলি।
    যেদিন স্কুলে গিয়ে শুনি আজ ছাত্র ধর্মঘট । ব্যস ক্লাস বন্ধ। আন্দোলন করে ক্লাস বয়কট। কিন্তু কিসের জন্য কেন ধর্মঘট? ওসব জানার সময় ও নেই আর ইচ্ছে ও নেই। স্কুল বন্ধ মানেই সিনেমা দেখা। চারজনে মিলে দৌড় সিনেমা হলে। তখন পাঁচ দশ মিনিট বাকি। যার কাছে যা টাকা আছে টিফিন খাওয়ার কিংবা খাতা কলম কেনার। সব একত্রিত করে টিকিট কাটতে লাইন। রোহিত তো রীতিমতো ঝগড়া লাইনে দাঁড়িয়ে। কেন হাফ টিকিট দেওয়া হবে না? সব জায়গায় স্কুল ছাত্রের হাফ টিকিট বাসে অটোতে। আর সিনেমা দেখার বেলা ফুল। আসলে কিছু টাকা কম পড়ছিল। যদি একটু ম্যানেজ করা যায় আর কি।
    ঝুমা ও কম নয়। হলের কাউন্টারে গিয়ে কাউন্টারের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যদি বাকি টাকাটা না দিতে হয়। কাউন্টার কাকুও বুঝল স্কুল পালানো ছেলে মেয়ে এদের চটিয়ে লাভ নেই। বরং একটু কমিয়ে দিই। হলের সিটগুলো তো ভর্তি হবে।
    ঝুমা অবশ্য বলে আসত কাকুকে। আমার ভালো কাকু। সামনের দিন এলে সব মিটিয়ে দেব কেমন? তবে ব্যাল্কনিতে দিতে হবে সিট। হাজার হোক তোমার পাশের স্কুলের ছাত্র ছাত্রী আমরা। হলের বিপদ হলে আমরাই তো ছুটে আসব।
    দিব্যি বাড়ি না গিয়ে নতুন জুটির প্রসেনজিৎ জুহির “অমর প্রেম” সিনেমাটা দেখা হয়ে গেল। স্কুল জীবনে সিনেমা দেখা ছিল দারুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
    শারুখ খান কাজলের নতুন সিনেমা রিলিজ হলেই আর রক্ষে নেই। কতক্ষণ দেখব সিনেমাটা। আশেপাশের হলে ব্যাগের ভেতরে অন্যএকটা বাড়ির জামা লুকিয়ে আনতাম। তারপর সবাই একসাথে কোথাও দেখা করে স্কুলড্রেস গুলো বদলে নিতাম। চললাম মহানন্দে হলের দিকে। টিকিট কেটে একেবারে ব্যাল্কনির সিট। একটু আরামদায়ক নিরিবিলি। কিছুক্ষণ পরেই বাদাম ওয়ালা ঠোকায় ঠোকায় বাদাম বিক্রি করছে। ঝাল নজেন্স,ভুট্টা ভাজার প্যাকেট কিনে মুখে পুরে দিলাম। একটা করে বাদাম মুখে দিয়ে হইহই করতে করতে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে। রাহুল আর ঝুমার মধ্যে একটু খুনসুটি চলছিল,কারোর আর বুঝতে বাকি রইল না দুজনার অমরপ্রেমকাহিনীর কথা । সারা স্কুলের সেরা জুটি রাহুল ঝুমা।
    রোহিত সবার চেয়ে একটু বেশি ই দুষ্টু। ওদের একসাথে সিট দিত ইচ্ছে করে ই। দুজনার প্রেমের সুযোগ করে দিত।
    শেষ হওয়ার একটু আগেই বেরিয়ে আসতাম। দিনের আলোয় যাতে কেউ চিনতে না পারে। সবার চক্ষুর আড়ালে জনতার ভীড়ে নিজেরা লুকিয়ে ফেলতাম নিজেদের।
    সিনেমার আড্ডাটা আর নেই। হারিয়ে গেছে দিনগুলি। তবু বারে বারে মনে আসে সিনেমার আড্ডার স্মৃতি। মনে আসে ঝুমা রাহুলের প্রেম কাহিনি। বি এ পাশ করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দেখা সাক্ষাৎ বন্ধুত্ব সব অতীতের আড্ডা টুকু কেমন ধোঁয়াসে হয়ে যায় কর্মের ব্যস্ততায়। দীর্ঘ দশ বছর পর রাহুলের সাথে দেখা। সেই হাসি খুশি ছেলেটা কেমন বুড়িয়ে গেছে। পাথরের মতো স্থির কঠিন হয়ে গেছে। ঝুমার কথা উঠতেই এড়িয়ে গেল অন্য প্রসঙ্গে।
    শুনেছিলাম ওদের বিয়েটা হয় নি। রাহুল যে তখনো বেকার। এখনো বেকার বলা চলে। খবরের কাগজের দপ্তরের খবর সাপ্লাই দেয়। এমন ছেলের সাথে কে ই বা বিয়ে দেবে?
    ঝুমার গ্যাজুয়েশান শেষ করেই বিয়ে হয়ে গেল বিখ্যাত ব্যারিস্টারের সাথে। ঝুমা পারে নি রাজি করাতে বাবাকে।
    সিনেমা হলেই শেষ হয়ে গেল দুজনের অমর প্রেম।
    দিন গুলো বড্ড পিছু টানে।
    সেদিন হঠাৎ রোহিতের সাথে দেখা। আজও আগের মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সেই চাহনি সেই উজ্জ্বল দুটো চোখের ভাষায় কোথাও কোনো ভুল নেই। তবু স্বহাস্যে বুঝিয়ে দিল দিব্যি আছে খোশমেজাজে।
    যাবার সময় শুধু একবার প্রশ্ন করল, কিছুই কি মনে নেই?
    আমিও একগাল হেসে বুঝিয়ে দিলাম, রবি ঠাকুরের কথায়,রাতের সব তারারাই আছে দিনের আলোর অন্ধকারে।
    চলে গেল একমুখ তৃপ্তির হাসি হেসে।
    সিনেমার আড্ডাটা আজ আর নেই।
    আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়।

  • গল্প

    গল্প- নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য

    নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য
    -সুনির্মল বসু

    নীলাঞ্জনার সঙ্গে দেখা বিশ বছর বাদে। আসলে, দুর্গাপুর থার্মাল প্রজেক্টের একটা কাজ দেখতে এখানে আসা।
    চীফ ইঞ্জিনিয়ার অনুতোষ চৌধুরীর
    অনুরোধে তাঁর বাড়িতে আসতে হল নিরুপমকে। নীলাঞ্জনা যে অনুতোষ চৌধুরীর স্ত্রী, এটা জানা ছিল না ওর।

    স্মৃতিতে ধাক্কা।

    সেই নীলাঞ্জনা, নিরুপমের অতীত।
    পরিচয়পর্ব সারা হল। নীলাঞ্জনার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। নিরুপম স্বাভাবিক হতে পারছে না।

    স্মৃতি পিছু টানছে।

    ভার্সিটিতে এক সঙ্গে পড়তো ওরা। সাহিত্য সভায় গল্প পড়তো নিরুপম। নীলাঞ্জনার বাবা কোম্পানির ডিরেক্টর। প্রতিদিন এম্বাসেডর চেপে আসতো ও।
    নীলাঞ্জনা যথেষ্ট সুন্দরী। ছেলেদের পাত্তা দিত না। সেই মেয়ে একদিন যেচে আলাপ করতে এসেছিল নিরুপমের সঙ্গে।
    আমিতো বন্ধন রায়ের প্রেমে পড়ে গেছি।
    বন্ধন রায় নিরুপমের গল্পের নায়ক। সেই প্রথম আলাপ।
    তারপর রাখালদের ক্যান্টিনে, কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে কতবার কথা হয়েছে, কত অসংখ্য বার। রাতে গোল দীঘির পাড়ে বসে চাঁদের আলোয় জ্যোৎসনায় ভিজেছে দুজন, কতদিন।

    এক বিকেলে কফি হাউসে গিয়ে দু কাপ কফির অর্ডার দিতেই, নীলাঞ্জনা হঠাৎ বলেছিল, ওই দ্যাখো, অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি এসেছেন!
    ওনার পাশের ভদ্রলোককে চেনো?
    নাতো। ঠিক বলতে পারছি না!
    উনি হলেন এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য।
    তাই বুঝি! আমি রেগুলার ওই পত্রিকা পড়ি।
    আমি ইবসেনের নাটকের উপর ওনার পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়েছি।
    কফিটা ঠান্ডা হচ্ছে। খেতে হবে তো!
    হু।
    বাংলা ভাষায় তোমার প্রিয় কবি কে?
    শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
    দুজনই আমার প্রিয় কবি। সেই সঙ্গে আমি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাম যোগ করছি।
    ঠিক বলেছো। ওনার নাম বাদ দিলে, সেটা বিরাট অন্যায় হয়ে যেত।
    এবার উঠতে হবে। লাইব্রেরীতে যাবো। কাল ভার্সিটিতে আসছো তো?
    আসবো তো অবশ্যই। ইদানিং আমার বিয়ে নিয়ে বাবা-মা খুব উঠে পড়ে লেগেছেন।
    আমাদের ভালবাসার কি হবে?
    তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?
    আমি মোটেই সে কথা বলিনি।

    আরেকদিন সন্ধ্যায় বসুশ্রী হলে সিনেমা দেখে বেরিয়ে নীলাঞ্জনা বলেছিল, গত দুদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, আমার বুকের মধ্যে যে কি কষ্ট হচ্ছিল,
    তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
    ভালোবাসা মানে একটা ঝড়, বুকের মধ্যে সব সময় থমকে থামা ঝড়ের ইশারা।
    তোমার কষ্ট হয় না, আমাকে না দেখলে?
    হয় তো বটেই। কাছে না পেলে, মনে মনে তোমাকে কত অসংখ্যবার পেতে চেষ্টা করি।
    মানে?
    মানে, আমার চারদিকে তখন নীলাঞ্জনা ছায়াছবির মতো ঘুরে বেড়ায়। বলে, কষ্ট পেয়ো না, এইতো আমি তোমার কাছেই আছি। আমাকে ছুঁয়ে দ্যাখো!
    অ্যাই, সব সময় ঠাট্টা ইয়ার্কি না?
    নিরুপম হো হো করে হেসে ফেলে।

    কত কত দিন কেটে গেছে এভাবেই। সেইসব সোনালী বিকেলগুলো, মনোরম সন্ধ্যা গুলো চার জোড়া চোখে কত যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। স্বপ্নের মিনার, স্বপ্নের গম্বুজ, স্বপ্ন দিয়ে গড়া ভালবাসার রাজপ্রাসাদ।

    অথচ, তারপর একদিন এলো, সব স্বপ্নের ইমারত ভেঙেচুরে খানখান। আজ সে সব অতীত।

    কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?
    নিরুপম অতীত খুঁড়ে দেখতে চায় নি কখনো।

    নীলাঞ্জনাও স্বামীর সামনে অতীত পরিচয়ের কথা তোলেনি, নিরুপম উদাস থেকেছে।
    এক সময় কফি মিষ্টি খেয়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

    বিকেলে পার্টিতে আবার দেখা।
    অনুতোষ রিসেপশনে ব্যস্ত।

    নীলাঞ্জনা কাছে এলো নিরুপমের।
    আবার দেখা হলো,
    তাইতো,
    কুড়িটা বছর পার,
    জীবন তো রাজধানী এক্সপ্রেস,
    হুম,
    সেসব দিন মনে পড়ে?
    পড়ে, না পড়াই ভালো,
    কেন?
    শুধু শুধু পুরনো ক্ষতে হাত,
    দোষটা কার?
    কারো নয়,
    মানে?
    দোষটা ভাগ্যের,
    বিয়ে করেছো?
    প্রেমহীন বিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই, তাছাড়া সময় পাই নি,
    নিজেকে কষ্ট দাও কেন?
    জানিনা, বলতে পারব না,
    আমি কিন্তু অপেক্ষা করেছিলাম!
    জানি, আমার পায়ের তলায় তখন জমি ছিল না,
    আমার বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা চলছিল, হয়ে গেল,
    আর, সেই রাতে আমি কলকাতা থেকে পালিয়ে সোজা ধানবাদ,
    খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না?
    পুরুষের অক্ষমতা তুমি বুঝবে না,
    জানি, আন্দাজ করতে পারি,
    ভালো হয়েছে, কেউ নেই, তাই কারো জন্য ভাবনার ঢেউ নেই,
    তাই নাকি?
    তুমি সুখী হয়েছো তো?
    দেখে কি মনে হয়?
    দেখে বোঝা যায় নাকি?
    চলে যাচ্ছে বেশ,
    মিস্টার চৌধুরী তো যথেষ্ট সফিস্টিকেটেড মানুষ।
    তা ঠিক, তবে কি জানো, বিয়ে একটা অভ্যাস, একটা দায়বদ্ধতা, এই নিয়ে বেঁচে থাকা।

    আমার মনে হয়, তোমাকে পাইনি বলে, তুমি রোজ আমার কাছে আসো, যখন তোমাকে দেখি না, তখন তোমাকে আরো বেশি করে দেখি,
    কাজের সূত্রে আসো না এখানে,
    না, ভাগ্য যে দেয়নি, তাকে ঘুরপথে পেতে চাইনা,
    তুমি বদলে গেছো নিরুপম,
    হবে হয়তো,
    আমার তো সব মনে পড়ে,
    কি?
    সেই সব পুরনো দিনের স্মৃতি, সেইসব মায়াবী রাত, গড়িয়াহাটে সন্ধ্যেটা কাটানো, ঝিলের পাশে পাশাপাশি হাঁটা, আলেয়া সিনেমাতে উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখা, সব সব,
    আমি জানলে, এখানে আসতাম না,
    আমি তো ভুলে থাকতে চাই, তুমি এসে আবার সব কিছু মনে করিয়ে দিলে,
    নীলাঞ্জনা, এই ভালো। সেই সব দিনগুলো আমার জীবনের ওয়েসিস, স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় বেশ,
    তুমি পারো, আমি পারিনা,
    তুমিও পারবে,
    কিভাবে?
    ঝরা ফুলের গন্ধ কেমন জানো, দেখবে তার মধ্যেও ভালোবাসার সুগন্ধ লুকিয়ে থাকে। আমাকে ভুলে যেও, আমাকে মনে রেখো না, স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো!

    ততক্ষনে পার্টিতে ঘোষণা শোনা গেল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী, প্লীজ্ কাম অন স্টেজ।

    নিরুপম দেখলো, নীলাঞ্জনা আর ওর স্বামী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। ভালো লাগছে, ওদের দুজনকে।

    ভালো থাকো তোমরা। সুখের বৃষ্টি আসুক তোমাদের জীবনে। সেই সব দিন রাত্রি গুলো আমার কাছে স্মৃতির সংগ্রহশালা হয়ে থাক, নিরুপম মনে মনে বললো।

    ভালো থেকো নীলাঞ্জনা। সুখী হও।

    নীলাঞ্জনা, আমি আর আসবো না। যেটুকু পেলাম, সেটুকুই আমার স্বর্ণ কমল সঞ্চয়, যা পেলাম না, তা হয়তো আমার ছিল না।

    আমার নিঃসঙ্গ জীবনে সেদিনের স্মৃতি গুলো গভীর মমতায় আগলে রাখবো আমি, নিজেকে বোঝাবো,
    কিছু হারায় নি আমি। ভালোবাসা হারায় না কখনো।

    জীবনের বিভিন্ন মোড়ে বারবার শুধু তার অর্থ পরিবর্তন হয়। ঝরা ফুলের সুগন্ধ নিতে কজন জানে।

    যে জানে, সে জানে।

    তার কাছে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে সানাইয়ের সুরের মতো বেজে বেজে যায়।

    কজন সেই সুরের মাহাত্ম্য শুনতে পায়, যে শুনতে পায়, তার বেঁচে থাকাটা অন্য মাত্রা পায়।
    নিরুপম নিজেকে বোঝালো, নীলাঞ্জনাকে পেলে,
    প্রতিদিনের ধূলিমলিনতায় হয়তো এই ভালবাসার
    মর্যাদা নষ্ট হতো, অথচ, ওকে পায় নি বলে, আশ্চর্যজনকভাবে আজ ওদের সেদিনের ভালোবাসা চিরকালের ভালোবাসা হয়ে রইলো, এই পবিত্র ভালোবাসা স্মরণ করলে, এক জীবন পার করে দেওয়া মোটেই শক্ত নয়, নিরুপমের এরকমই মনে হল।

    ততক্ষনে স্যান্ট্রো গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ও দ্রুত গতিতে শহরের হাইওয়ের দিকে ছুটে চললো।

  • গল্প

    গল্প- রুম নাম্বার ২০৫

    রুম নাম্বার ২০৫
    – মুনমুন রাহা

    অন্ধকারের বুক চিড়ে ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে । কামরার বেশির ভাগ মানুষই নিদ্রা দেবীকে আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুম নেই কেবল মিতুলের চোখে। মনটা কেমন ভারি ভারি লাগছে ‌। বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে কথা বলার পর থেকে। মিতুলের সেই কবেকার ইচ্ছে হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবে । বিয়ের আগে হবু বর অরিত্রকে সে নিজের ইচ্ছা জানিয়েছিল , অরিত্র তখন সম্মতি ও দিয়েছিল। কিন্তু গোল বাধল বিয়ের পর । এক তো অরিত্র অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছে না। আর দুই নম্বর হল অরিত্রর মা। তিনি ছেলের বিয়ের জন্য জগন্নাথ দেবের কাছে মানত করে বলে এসেছেন একটা ভালো মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বৌ আগে জগন্নাথের শ্রী চরণে মাথা ঠেকিয়ে আসবে। আর কি করার মিতুলরা তাই সুইজারল্যান্ড বাদ দিয়ে পুরী চলছে হানিমুনে। বন্ধুদের এই নিয়ে খিল্লির শেষ নেই। এই তো কালকেই পৌষালি বলছিল ,
    “মিতুরে, তুই ও শেষে দীপুদার প্রেমে পড়লি? দীপুদা অর্থাত বাঙালির প্রিয় তিনটি জায়গা, দীঘা , পুরী , দার্জিলিং।”
    যদিও অরিত্র বলেছে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুইজারল্যান্ড যাবে। তবু যেন সুইজারল্যান্ডে হানিমুনে না যাওয়ার দুঃখটা কিছুতেই মিতুলের পিছু ছাড়ছে না।

    পুরী তে পা দিয়ে মিতুলের মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। পুরীতে মিতুল আগেও এসেছে তবে অরিত্রর সাথে জগন্নাথ দর্শন , সি বিচে হাতে হাত রেখে হাঁটা , বিশাল সমুদ্রতে অরিত্রর সাথে হারিয়ে যাওয়া , বড় কোন ঢেউ আসলে অরিত্রর মিতুল কে আগলে রাখা এসব কিছুই মিতুলের কাছে চেনা পুরীকে অচেনা স্বপ্ন নগর করে তুলেছে । কেবল হোটেল রুমে মিতুলের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। হোটেলটা এমনিতে বেশ সুন্দর। সমুদ্রের বেশ কাছে। পাঁচ তারা হোটেলটার সুইমিং পুল , বার , রেস্টুরেন্ট সব কিছুই বেশ বিলাস বহুল। মিতুলরা রুমটাও পেয়েছে সি ফেসিং। হোটেলটা পুরো ভর্তি তারপরও এত কম নোটিশে মিতুলরা যে এমন একটা ঘর পাবে তা আশা করে নি মিতুল। তাই প্রথম দিন রুম টা দেখে বেশ খুশি খুশি লাগছিল মনটা। কিন্তু কিছুক্ষন পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে মিতুলের। মনে হয় কেউ যেন আছে যাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। সবসময় কেউ যেন তার সাথে সাথে সর্বক্ষন ঘুরছে। বিশেষ করে অরিত্র আর মিতুলের একান্ত হওয়ার মূহুর্ত গুলোতে যেন বেশি বেশি করে অচেনা অস্তিত্ব টের পাচ্ছে মিতুল।

    প্রথম দিন রাতে অরিত্র নব বিবাহিতা স্ত্রী মিতুল কে কাছে টেনে নেয় । মিতুলও অরিত্রর স্পর্শে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। অরিত্র মিতুলের উন্মুক্ত পিঠে , কোমরে , গলায় নিজের ঠোঁট দিয়ে আদর করতে লাগে । মিতুলও অরিত্রর আদরের উষ্ণতায় ক্রমে বিগলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনই মিতুলের মনে হয় তার গায়ে একটা গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ থাকায় প্রথমে মনে হয় অরিত্রর নিঃশ্বাস হয়তো। কিন্তু একটু পরেই খেয়াল হয় অরিত্রর মুখ মিতুলের কোমোর বেয়ে নীচে নামছে তবে তো অরিত্রর নিঃশ্বাস মিতুলের ঘাড়ে পরা সম্ভব নয়! ভয় পেয়ে যায় মিতুল ছিটকে ওঠে অরিত্রর কাছ থেকে। অরিত্র অবাক হয় মিতুলের ব্যাবহারে। মিতুল অরিত্রকে তার অসস্তির কথা বললে অরিত্র বিশ্বাস করে না। বলে এ নিশ্চয়ই মিতুলের মনের ভুল। তেমন কিছু হলে অরিত্রও নিশ্চয়ই অনুভব করত। সে রাতে অরিত্র মিতুলর মিলন পর্ব অসমাপ্ত রয়ে যায়। ভীত মিতুল কে বুকে টেনে নিয়ে অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে। মিতুল কিন্তু অরিত্রর বুকের মাঝে চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারে কেউ যেন তাদের খাটের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতি কেন অরিত্রর হচ্ছে না কে জানে? কেটে গেল আরও দুটো দিন। এই অনুভূতি পিছু ছাড়ল না মিতুলের।

    খুব ভোরে মিতুলের ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আধ ফোটা আলোয় রাতের ভীবিষিকা ম্লান হয়ে আসে। মিতুল মনকে বোঝায় অরিত্র ঠিকই বলেছে , এসব অবাস্তব অনুভূতি মিতুলের মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয়।
    সান রাইস দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় । মিতুল দেখে অরিত্র অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মিতুল আর তাকে ডাকে না। ঠিক করে একই যাবে সান রাইস দেখতে। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেলে মিতুলের মনের অলৌকিক অনুভূতি গুলো আবার মাথা চাড়া দেয়। মনে হতে থাকে যেন দুটো অদৃশ্য চোখ তার উপর দৃষ্টিপাত করে চলেছে অনবরত। মিতুল কোন রকমে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসে। সে প্রথমে যায় হোটেলের রিসেপশনে। সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। একজন বয়স্ক লোক আর দুজন স্টাফ। মিতুল বয়স্ক লোকটির কাছে এগিয়ে যায়। তারপর তাকে জানায় মিতুল রুম চেঞ্জ করতে চায়। এবং সেটা আজই দরকার হলে এখনই । মিতুলের গলার স্বরে এতটাই উত্কন্ঠা ছিল যে বয়স্ক লোকটি মাথা তুলে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলে ,
    “কেন ম্যাডাম এত তাড়া কিসের? রুমে কিছু অসুবিধা হলে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সমাধান করার। ”
    মিতুল বলতে গিয়েও থেমে যায় যদি অরিত্রর মতো এই লোকটিও অবিশ্বাস করে ! মিতুল বলে,
    ” আমি বললাম তো আমি ঐ রুমে থাকব না । আমাকে রুম পাল্টে দিতেই হবে। ”
    মিতুলের আচরণে ভদ্রলোক খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর কি যেন ভেবে বলেন,
    ” কোন রুম ?”
    ” ২০৫ ”
    কথাটা শুনে ভদ্রলোক কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
    ” ঠিক আছে ম্যাডাম আমি দেখছি কি করা যায়। তবে যদি এখানে অন্য রুম না পান তবে অন্য কোন হোটেলের ব্যবস্থা করুন।”
    কথাটা শেষ হতে না হতেই হোটেলের মালিক এসে উপস্থিত হলো। মিতুল আর ভদ্রলোকের কথা কানে যেতেই রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে। ভদ্রলোককে চিৎকার করে বলল,
    ” কি যা তা বলেছেন অমল বাবু? আর ম্যাডাম আপনাকে পরিস্কার করে জানিয়ে দি আমাদের পক্ষে এখন অন্য ঘরের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। হোটেল ভর্তি। আপনারা চাইলে অন্য হোটেলে যেতেই পারেন তবে আপনাদের পাঁচ দিনের অ্যডভান্স কিন্তু ফেরত পাবেন না।”
    মিতুল আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চলে এলো সমুদ্রের ধারে। সূর্য দেব ততক্ষণে আকাশে উঁকি দিয়েছেন। মিতুলের আর সান রাইস দেখা হলো না । তবু সে হোটেলে ফিরল না। সকালের নরম আলোটা বেশ ভালো লাগছে। মনে অনেক গুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে পড়ছে বয়স্ক ভদ্রলোকের ২০৫ রুম নাম্বার শুনে আঁতকে ওঠার কথা। ম্যানেজারের কথা চাপা দেওয়ার প্রয়াস। মিতুল এখন নিশ্চিত এই অনুভূতি তার মনের ভুল নয় কিছু নিশ্চয়ই আছে ঐ রুমে। কিন্তু কি আছে রুম নাম্বার ২০৫ এ !

    ” কি রে , খুব চিন্তায় আছিস মনে হচ্ছে? ”
    হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজে কানে যেতে মিতুল মুখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় এক জটাজুটো ধারীকে যার পরনে কেবল কৌপিন, গলায় রকমারি পাথরের মালা চোখ গুলো টকটকে লাল, কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। তিনি আবার বললেন,
    ” ভেবে কিছু হবে না। জানতে হবে ! তোকেই জানতে হবে কি চায় সে ! আমি তোকে শুধু সাহায্য করতে পারি।”
    মিতুলের বুঝতে বাকি রইলো না সাধু কি সম্পর্কে কথা বলছেন। মিতুল হাত জোড় করে বলল,
    ” দয়া করুন বাবা । আমি আর এইসব সইতে পারছি না অজানা আতঙ্কের সাথে অজানা অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করে আমি ক্লান্ত । আমার এই অস্বস্তি এই অনুভূতি আমি কাউকে বোঝাতেও পারছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করছে না। এমন কি আমার স্বামী ও নয়। ”
    ” কেউ বিশ্বাস করবে না রে । যে জীবন দিয়ে অনুভব করে বিশ্বাস কেবল তার জন্মায়। এবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোকে আমি একটা তাবিজ দিচ্ছি এটা গলায় পরবি আর একটা পাথরের মালা দেব সেটা হাতে নিবি। তারপর সেই অশরীরীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি। তবে মনে রাখিস তখন যেন আর কেউ না থাকে তোর সাথে। তাকে রাত বারোটার পরেই ডাকা ভালো। ভয় পাবি না । আমার বিশ্বাস সে তোর সাথে কথা বলার জন্যেই তোর পিছু ধরেছে। ক্ষতি করার হলে এতদিন করে দিত। ”
    এই বলে সাধু মালা আর তাবিজ মিতুলের হাতে দিয়ে যেযন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই চলে গেল। ভোরের নরম আলো কেটে উজ্জ্বল রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। মিতুল ধীর পায়ে হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা হল । হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিল সাধুর দেওয়া সেই তাবিজ আর মালা।

    রাত বারোটা। মিতুল দেখল অরিত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কদিন মিতুল কিছুতেই অরিত্রর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে পারে নি। যতবার মিতুল অরিত্রর কাছে আসার চেষ্টা করেছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে মিতুলর কাছে আর মিতুলও ছিটকে সরে এসেছে অরিত্রর কাছ থেকে। মিতুল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ঘড়িতে ১২-৩০ । মিতুল উঠে বসল। অদৃশ্য অশরীরীর সাথে বোঝাপড়া করার সময় এসে গেছে। সে যে ঘরেই আছে তা মিতুল জানে তার অনুভূতি দিয়ে। মিতুল হাতে সাধুর দেওয়া মালাটা নিল আর গলায় পড়ল তাবিজটা তারপর চলে গেল বারান্দায়। চোখ বন্ধ করে ধীর গলায় বলতে লাগলো ,
    ” তুমি কে আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই। জানতে চাই কেন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে ঘুরছো তুমি? ”
    একবার , দুবার কোন উত্তর নেই। মিতুল আবার বলল তার কথা গুলো। তিনবারের বার সাড়া পেল মিতুল। সামনের চেয়ারে কেউ এসে বসলো। মিতুল চোখ খুলে দেখল একটা আবছা ছায়া। যেন কোন মানুষ কে সে অনেক গুলো কুয়াশার পর্দার ভিতর থেকে দেখছে। তারপর শোনা গেল তার রক্ত হিম করা ফ্যাঁসফ্যাঁসে এক গলার আওয়াজ। যেন অনেক দূর থেকে কথা গুলো আসছে।
    ” আমি এসেছি তোমার ডাকে। তুমি ঠিক বলেছ আমি তোমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আছি। তবে তার উদ্দেশ্য তোমার ক্ষতি নয়। আমার মুক্তি। ”
    মিতুলর ভয়ে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে তবু সে নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে। বলে,
    ” বেশ, বল আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?”
    ” আমি নীলা। ছয় মাস আগেও এই হোটেলের রিসেপশনিস্ট ছিলাম। নতুন কাজ ভালোই লাগছিলো আমার। মন দিয়ে নিজের কাজ করতাম। কত নতুন মানুষর সাথে পরিচয় হতো রোজ। বেশ কাটছিল দিন গুলো। তবে দিন গুলো আরও রঙিন হয়ে উঠল আকাশের সাথে সম্পর্ক তৈরী হওয়ার পর। আকাশ এই হোটেলের ম্যানেজার। আমাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস ক্রমে মজবুত হল । অন্তত আমার কাছে । আকাশ আমাকে আরও কাছে পেতে চাইল। আমি আপত্তি করিনি। কয়েকদিন পরেই যার সাথে বিয়ে তাকে আপন করে নিতে আমার দ্বিধা বোধ কাজ করে নি। আকাশ আর আমি মাঝেমাঝে মিলিত হতে লাগলাম। বিয়ে তে আকাশ আপত্তি করে নি কিন্তু দেরি করছিল। আমি তাড়া দিতে লাগলাম। আমার আর এই ভাবে মেলামেশা ভালো লাগছিল না। আমি সংসার বাঁধতে চাইছিলাম। একদিন আমি জানতাম পারলাম আমি মা হতে চলেছি। ছুটলাম আকাশের কাছে। বললাম আর দেরি নয় আমাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে যে আসছে তার জন্য আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে নেওয়া দরকার। আমাকে অবাক করে আকাশ বলল ,
    ” বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? এ বাচ্চা যে আমার তার প্রমাণ কি? আমি মানি না। আর তুমি ভাবলে কি ভাবে যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? তোমার মতো ক্যারেকটার লেস মেয়ে কে আমি কখনও বিয়ে করব না। যে মেয়ে আমার সাথে শুতে পারে সে তো অন্য পুরুষের সাথে ও শুতে পারে! ” তারপর বিচ্ছিরি ভাবে হেসে আকাশ বলল,
    ” তাই ভালো কথা বলছি এইসব বাচ্চার ঝামেলা হটাও। কালই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করো। তারপর আমাদের সম্পর্ক‌ যেমন চলছিল চলবে। আর ঢাক ঢাক গুর গুর নয় সোজাসুজি সওদা। তুমি আমাকে শরীর দেবে বদলে আমি তোমাকে কর্ম ক্ষেত্রে উপরে উঠতে সাহায্য করবো। ”
    আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। কিন্তু আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমার সন্তানকে কিছুতেই মারব না। ঠিক করলাম আকাশ কে এর উচিত শিক্ষা দেব। দুদিন পর আকাশকে ফোন করে বললাম তাকে আমি সাতদিন সময় দিলাম। সে যদি আমাকে অস্বীকার করে তবে আমি মালিক পক্ষের সাথে এই নিয়ে কথা বলব। বলব কিভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকাশ আমাকে ব্যবহার করেছে । আরও বললাম দরকার হলে পুলিশের কাছেও যাব। বাচ্চা হওয়ার পর ডি এন‌ এ টেষ্ট করলেই পুলিশ বুঝতে পারবে আমি ঠিক কথা বলছি কি না। কেটে গেল দুটো দিন। আমি কদিন হোটেল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। আকাশের সাথেও তাই আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। এদিকে আমার বাড়িতে সব কিছু জানতে পেরে যায়। সমাজের ভয়ে বাড়ির লোক আমাকে চাপ দিতে থাকে বাচ্চা নষ্ট করতে। আমিও আমার প্রতিজ্ঞায় অনড়। তাই অশান্তি তখন আমার নিত্য সঙ্গী। আমি সমাজ সহ পরিবারের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত ‌। চার দিনের দিন ফোনটা এল আকাশের কাছ‌‌ থেকে। বলল নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে। তবে তার বিয়ে নিয়ে কিছু শর্ত আছে আর সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমাকে একান্তে ডাকল সে। আকাশের কথা মতো রাত আটায় আমি গেলাম হোটেলে। আকাশ আমাকে প্রথমে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আমাকে চেয়ারে বসতে দিল তারপর আমাকে কিছু একটা ড্রিঙ্ক দিল। সেটাতে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল। আমার কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল।
    তারপর আকাশ বলল ,
    ” আমাকে ফাঁসাবি না ? এই বাচ্চা দিয়ে ফাঁসাবি তো ! দেখ এবার না থাকবি তুই আর না থাকবে তোর বাচ্চা। ”
    একটা লোহার রড সে আগেই জোগাড় করে রেখেছিল। সেটা দিয়ে মারতে লাগলো। আমার পেটে , মাথায়, মুখে। আমি ককিয়ে উঠছিলাম কিন্তু বাধা দিতে পারছিলাম না। এক সময় আমার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আকাশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার লাশকে সামনে রেখে সে একটা সিগারেট ধরাল । হোটেলে তখন কিছু রুমের কাজ চলছে। আকাশ বোধ হয় কিছু মিস্ত্রীকে আগে থেকেই টাকা খাইয়ে রেখেছিল। তাদের সাহায্যে আমর লাশটা নিয়ে আসা হলো এই ২০৫ রুমে। এই ঘরে মেরামতের কাজ চলার জন্য ওদের বেশি বেগ পেতে হলো না আমার লাশ লুকাতে। মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হলো আমার লাশ ও আমার ব্যাগ যা আমি সাথে এনেছিলাম। তারপর মিস্ত্রীরা সুন্দর করে ইট বালি সিমেন্টের প্রলেম ঢেলে দিলো তাতে। মুছে দিল আমার হত্যার সকল প্রমাণ। আমার পরিবারের কাছে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে রইলাম। কিন্তু আমার আত্মা মুক্তি পেল না । ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর বড় অমানবিক হয় মিতুল । তাই তো আমি তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে মিলিত হতে দিইনি। আমি মুক্তি চাই। আকাশের শাস্তি চাই। ”

    এতক্ষন কথা বলার পর এবার একটু থামলো নীলা। মিতুলের আর এই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভয় করছে না বরং কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। মিতুল বলল,
    ” না নীলা সব ছেলেরা এক রকম হয় না। আমার স্বামী অরিত্র খুব ভালো মানুষ। তবে তোমাকে আমি মুক্তি দিতে চাই। শাস্তিও দিতে চাই আকাশ কে। কিন্তু কি করে হবে ! আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কেন মানবে আমার কথা ? ”
    ” প্রমাণ আছে। প্রমাণ আমার ব্যাগে আছে। আমি এখানে আসার দিন ব্যাগে স্পাই ক্যামেরা ফিট করে এসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল আকাশ যদি বিয়ে নিয়ে কোন বাহানা করে অথবা আমাকে নোংরা প্রস্তাব দেয় তবে সেই ভিডিও আমি পুলিশ কে দেখাব। আমার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে আমার মার্ডার হওয়ার ভিডিওটা পেয়ে যাবে। ”
    এই বলে আবাছা ছায়াটা মিলিয়ে গেল বাতাসে।

    মিতুল কে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি আকাশ কে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নীলা ঠিকই বলেছিল তার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে সব কিছু রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। কেবল মিতুল কিভাবে এই হত্যার কথা জানল সেই উত্তরটা পুলিশ কে দিতে পারেনি মিতুল। অরিত্র প্রথমে মিতুলের পুলিশ ডাকা নিয়ে খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিতুলর কথা মতো সব প্রমাণ পাওয়া গেলে বেশ অবাক হয়ে যায় সে। তারপর মিতুলের মুখ থেকে নীলার সব কথা জেনে মিতুলের কাছে ক্ষমা চায় সে মিতুল কে অবিশ্বাস করার জন্য। নীলার সৎকারের ব্যবস্থা নীলার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে মিতুলরা আজ বেরিয়ে পড়ল কোলকাতার উদ্দেশ্যে।

    গাড়ি তে যেতে যেতে অরিত্র বলে
    “এই হানিমুনটাতো মাটি হলো এবার গিয়েই সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থা করব । ”
    মিতুল বলে ,
    ” একটাই শর্ত, হোটেল সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ করে নেবে। ”
    ” সে আর বলতে ! এবারে না হয় জগন্নাথের কৃপা ছিল। আর ভুল করি !”
    অরিত্রর বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে মিতুল। এতদিন পরে মিতুলর মুখে প্রাণ খোলা হাসি দেখে হাসি খেলে যায় অরিত্রর ঠোঁটেও।

  • গল্প

    গল্প- ওরা দুজনে

    ওরা দুজনে
    -সুবিনয় হালদার

     

     

    দেবা আর কান্তি বাল্য বন্ধু । একেবারে জোড়েরপায়রা । যেমন ডাকাবুকো তেমনি সাহস, পরিশ্রমীও বটে । দিন-খাটা দিন-আনা পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাই পড়াশোনার পাশাপাশি হাতখরচার পয়সা জোগাড় করতে দুজনেই বিভিন্ন সময়ে এর-ওর জনমজুরের কাজ করে দু-এক-পয়সা রোজগার করতো । তা থেকে মা-বাবার কাছে বেশীটা দিয়ে বাকিটা নিজেদের কাছে রাখতো । যে কাজটাতে তারা হাত দিতো একেবারে নিষ্ঠার সাথে শেষ করতো । এতটুকু ফাঁকি ছিলোনা তাতে । শিস বাজিয়ে গান করতে করতে ইয়ার্কির ছলে তারা কঠিন কাজকে খুব সহজই শেষ করে দম নিতো, মনে হতো যেন কঠোর পরিশ্রমের কাজ তাদের কাছে বাঁহাতের খেল্ । সে মাটি কাটা অথবা মাটি কোপানো হোক, মাঠে তোলা-ভাঙা, রোয়া, ধান কাটা, ঝাড়া, বওয়া কিংবা গাছে ওঠা- যেকোনো কাজই- এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- সবেতেই একেবারে সিদ্ধহস্ত । মাঝেমাঝে অবসর সময়ে খেলার মাঠে আসতো-, গামছার খুুঁটে মুড়ি বেঁধে নিয়ে কাঁচা পিঁয়াজ আর লঙ্কা চিবোতে চিবোতে । তাতে হাত গলিয়ে ভাগ বসাতে আমরাও কসুর করতামনা । টিভিতে খেলা সিনেমা দেখার খুব ঝোঁক ছিলো । সেই সময় গ্রামে হাতে গোণা দু-একটা বাড়িতে এ্যান্টেনা যুক্ত টিভি ছিলো, তাও আবার সাদাকালো-, ব্যাটারিচালিত । ফুটবল ক্রিকেট খেলা হলে তো কথাই নেই-, সব কাজ ফেলে আগেভাগে বাড়িতে এসে হাজির । গল্প আড্ডা ইয়ার্কি ফাজলামি হতো প্রচুর, আর যেদিন তেমন কাজকর্ম থাকতো-না সেদিন খেলার মাঠে খেলতে হাজির হয়ে যেতো তারা । খু্ব ভালো হা-ডু-ডু খেলতো-, ভালো ব্যাক খেলতো । অসম্ভব শক্তি হওয়ায় কাদামাঠে তাদের টপকে বল নিয়ে গোল করা প্রায় অসম্ভব ছিলো । খোরোকালে মাঠে ধান উঠে গেলে তাদেরকেই আমরা ক্রিকেট খেলার পিচ করে দিতে বলতাম এবং তারা করেও দিতো খুব সুন্দর ভাবে ।

    সেই সময় তখনো গ্রামে বৈদ্যুতিকের আলো আসেনি । বিনোদন বলতে শীতকালে মাঠে ষোল মি.মি.’র স্ক্রিন প্রোজেক্টরে ওঠা সিনেমা আর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে গ্রামে-গ্রামে ভি.ডি.ও. ! যার বেশীরভাগই চলতো জেনারেটরে ।

    এমনি একদিন সকালবেলা দেখি দুজনে ধানকাটার কাজ করছে রাস্তার ধারে চেয়ারম্যানদের জমিতে । আমাকে দেখে বললো- কই-রে-ভাই- কোথায় যাচ্ছিস্ ? শোন-না-এদিকে, একটা কথা বলি । আজ বৈকালের পর একজায়গায় যাবি ?
    কোথায়-?
    ভি.ডি.ও. দেখতে হাটখোলায়- !
    ওরে- বাব্বা- ; পাগল নাকি ?
    সে তো যমের দুয়ার- ; তাও আবার সন্ধ্যেবেলায়, ওখানে আমি মরে গেলেও যাবোনা ! তোরা যাচ্ছিস্ যা তবে আমি বলি কী- যাসনা ভাই !

    হাটখোলা জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশী পায়ে হাঁটা পথ । দুটো গ্রাম টপকে মেঠো রাস্তা ধরে যেতে হবে । রাস্তার দু-ধারে শুধু ধান-জলা আর আলের ধারে-ধারে বাবলাগাছ, খেজুর গাছ । কোথাও আবার দূরে তালগাছের সারি । সে গুলো পেরিয়ে মাঝে একটা খুব বড় ঘন বাঁশ বন পরবে, তার মধ্যে দিয়ে পথ । দিনের বেলায় আমি কয়েকবার সাইকেল নিয়ে সিনিয়র দাদাদের সাথে গিয়েছি ক্রিকেট খেলতে । প্রথমবারের অভিজ্ঞতা- উফ্ কী-আর বলবো- ; সে যেন এক ভয়ানক ব্যাপার ! বাঁশ বন শুরু হওয়ার বেশ কিছুটা আগে আলি আর কেষ্টদা বললো- ভাই, সাইকেল থামা । নেমে পর । একটু হেঁটে হেঁটে যাই চল্ । অনেকক্ষণ হলো সাইকেল চালিয়ে এসেছি-, কোমর’টা একেবারে ধরে গেছে ; একটু ছাড়িয়ে নেওয়া যাক্ ! সবাই কিন্তু পাশাপাশি একেবারে সারিবদ্ধভাবে যাবো- যাতে করে প্রত্যেকে একে অপরের সংস্পর্শে থাকি আর দেখতেও ভালো লাগবে । কী বলিস ভাই ? আমি বললাম- সে ঠিক আছে- কিন্তু কতক্ষণ- ? ওরা বললো- এই মিনিট দশ-কুড়ি-! ভাই- এই-ভাই- রাগ করিসনা, সবার- ভালোর জন্য বলছি ! সাইকেল থাকতে এ্যাতোক্ষন হাঁটবো-? আমি বললাম, কেন- ? কীসের জন্যে বলছো জানিনা কিন্তু– ; আর কিন্তু করিসনা ভাই- যেমনটা বললো- সে রকম সব এগোতে থাক্- গোঁসাই’খুড়ো, ইন্দ্রদা একটু যেন কেমন সুরে বললো ! মনে যেন একটা খটকা লাগলো ! সামান্য কিছুক্ষণ উদাস মনে মুখটা গোমড়া করে সবার সাথে হেঁটে চলেছি, চারপাশে ডাঙা জমি আর বিভিন্ন গাছপালায় ভরা ! একটু পরে একটা জোড়া বট-অশ্বত্থ গাছে মোড়া ভাঙা মন্দির তলা, বেশ বড় এলাকা জুড়ে, তার পাশ থেকে রাস্তা’টা চলে গেছে । কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব ! চলতে-চলতে ডানপাশে দেখি বেশ বড়-ধরনে একটা পুকুর, তার বেশীরভাগই কচুরিপানাতে ভরা । পুকুরের রাস্তার দিকের অংশে পুরানো শানবাঁধানো ঘাটের ভগ্নাবশেষ এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে ! মনে হলো যেন বহুপুরোনো কোনো জমিদারদের সময়কার । চারিদিকে আম জাম কাঁঠাল খিড়িসগাছে ভরা জঙ্গলের ফাঁক থেকে আবছা চোখে পরে একটা বড় বাড়ির ভাঙাচোরা অংশ, এর ঠিক পরেই বাঁদিকে রাস্তা ঘুরে গিয়ে দেখি একেবারে অন্ধকার- শুধু বাঁশগাছ আর বাঁশগাছ-! এতোটাই ঘন আর দীর্ঘ যে সূর্যের আলোও ঠিকঠাক প্রবেশ করেনা ! একটু আগে হেঁটে আসা নিয়ে কথাবার্তা এবার সব যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ! নন্দ বললো- কী-রে- কেমন লাগছে ? আমি’তো একেবারে ভয়ে কাঁটা ; আমার গায়ের লোমকূপ গুলো সব খাড়া হয়ে উঠেছে ! মুখে কে যেন কুলুপ এঁটে দিয়েছে ! সকাল নটা দশটায় যদি এই অবস্থা হয় তাহলে— আমি ভাবতেই পারছিনা ! এমন সময় সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া শরীর স্পর্শ করতে না করতেই দেখি চারিদিকে কড়মড় – মড়মড় শব্দ আর তার সাথে-সাথে ডাকপাখি, বাদুর, বক ও অন্যান্য পাখিদের সমবেত কলরব আর ডানা ঝাপটানো- যেন আভাস দেয় একটা মায়াবী ভয়ার্ত পরিবেশ ! কেষ্ট’দা বললো- বুঝলি এবার কেন হেঁটে যাচ্ছি ? ওই বাঁশ বনের রাস্তা পার হয়ে সাইকেলে চেপে যখন হাটখোলা গ্রামে প্রবেশ করি তখন আমাদের খেলা শুরু হওয়ার জন্য মাইকে ডাকাডাকি চলছে ।

    এমন এক জায়গায় ওরা দুজনে নাকি সন্ধ্যার পর ভি.ডি.ও. দেখতে যাবে- ; কল্পনা করা যায় ! কথামত যথারীতি সন্ধ্যার পর দেবা আর কান্তি হাটখোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো- বারবার নিষেধ করা স্বত্ত্বেও ! প্রথম গ্রামের মাঝামাঝি এসে একটা দোকানে হুড়ুমভাজা কিনে চিবোতে চিবোতে আবার হাঁটা লাগালো । দ্বিতীয় গ্রামের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে একটু বসে চা বিস্কুট খেতে-খেতে গল্পে-গল্পে ওরা যে হাটখোলায় ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছে যেইনা বলেছে- ; ওমনি ওখানে উপস্থিত দু-চারজন মানুষ আঁৎকে উঠলো ! সবাই অবাক হয়ে বলে- বলো-কী-তোমরা ? বয়স্ক দোকানদার বললো- দ্যাখো ছেলে বাড়ি ফিরে যাও ; তোমাদের ভালোর জন্যেই বলছি- । দেখুন কাকা, আমরা দুজনে যখন যেটা করবো ভাবি তখন সেটা করেই ছাড়ি, তোমার কত হলো বলো ? দাম মিটিয়ে ওরা দুজনে যখন উঠে দাঁড়ালো তখন চা দোকানের রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ শেষ হয়ে “চাষী ভাইদের বলছি” আসর শুরু হয়েছে অর্থাৎ আটটা শোয়া’আটা হবে । চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে ওরা দুজনে পুনরায় হাঁটা শুরু করলো । জনপ্রাণী-হীন মেঠো রাস্তায় ওরা শুধু দুজন হেঁটে চলেছে ! দূরের তালগাছ গুলো অন্ধকারে রণপা’র মতো দাঁড়িয়ে এক একটা যমরাজ-বর্গ এবং বাদায় কিছু কাটা কিছু শুয়ে পরা দাঁড়িয়ে থাকা ধানগাছ সব জনসাধারণ আর আলের ধারে-ধারে বাবলাগাছ খেজুর গাছ গুলো যেন সব যমদূতদের পর্যায়ক্রমিক শ্রেণী ! হাঁটতে হাঁটতে ভাঙা মন্দিরতলার কাছে আসতেই ওরা নাকি শুনতে পেল কারা যেন কথাবার্তা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে ! ওরা ভাবলো ওদের মতো অন্য কেউ হয়তো ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছে ! তারপর যখন ওই পুকুরটার কাছে এলো তখন ওদের মনে হলো শানের ঘাট হতে কেউ বা কারা যেন বাগানের ভিতর পড়ো বাড়িটার দিকে চলাফেরা করছে ! ওরা ভাবলো নেশাখোররা কেউ হবে হয়তো ! তারপর সেই বাঁশ বন- যেখানে পৌঁছে ওরা আর পথ দেখতে পাচ্ছেনা ! তবুও ওরা এক-পা দু-পা অনুমান করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকলো শিস বাজিয়ে গান করতে করতে ! কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর হঠাৎ ওদের মনে হলো এইরে সেই ভাঙা মন্দিরতলাতে আবার এসে গেছি- ; এটা কিরকম হলো ? এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করছে এমন সময় কান্তি দেখে ভাঙা মন্দির-তলা থেকে একজন বেড়িয়ে রাস্তায় উঠছে ! দেবার হাতটা ধরে বললো- চল্ বন্ধু, ওই লোকটার পিছুপিছু যাই তাহলে মনে হয় ঠিক রাস্তা পাবো ! সামনের মূর্তিটা যখন শানের ঘাটের কাছে তখন ভিতরের ওই পোড়ো বাড়ি হতে আরো একজন বেড়িয়ে এসে তার সাথে যোগ দিলো ; তারপর ওরা দুজনে এগিয়ে চললো বাঁশবনের রাস্তায় হাটখোলার দিকে । ওরাও দুজনে যথারীতি ওদেরকে অনুসরণ করতে থাকলো, দুজনের থেকে দুজনার দূরত্ব মেরেকেটে ন’দশ মিটার হবে কিন্তু এতোটাই অন্ধকারের ঘনত্ব যে কেউ কাউকে ঠিকমতো দেখতেই পাচ্ছেনা ! কান্তি গলাটা একটু খেঁকরে নিয়ে বললো- ও-দাদা, একটু দাঁড়ান-না, কোনো উত্তর নেই ! তখন দেবা শিস দিয়ে একটা টোন্ করলো তার সাথে-সাথেই সামনে হতে ঠিক একই টোনে প্রতুত্তোর ভেসে এলো ! কান্তি তখন শিস দিয়ে বলার চেষ্টা করলো- ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছেন ? শিসের মাধ্যমে উত্তর এলো- হ্যাঁ ! বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর হটাৎ সামনের ওই দুজনকে এরা আর ঠাহর করতে পারেনা ! আশ্চর্য- ; দেবা বললো- যা অন্ধকার ঘোড়ার ডিম দেখতে পাবি ? যেমন যাচ্ছি তেমন চলতে থাক্ ! ওইভাবে বেশ অনেকক্ষণ চলার পর দেখে ওরা দুজনে একটা বাদা বনের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ! অনেক দূরে লাইটের একটা আভা খুব ক্ষীণ দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওখানে যাবে কিভাবে ? অগত্যা আবার পিছনের দিকে হাঁটা লাগালো ! এরকম করে বাঁশবনটা প্রায় চড়কি-পাক খেলো ঘন্টার পর ঘণ্টা ! ওদেরই অজান্তে ওরা অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে কখন যে বাঁশবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে টেরও পায়নি । গ্রামের একজন লোক ফাঁকের দিকে লন্ঠন হাতে বের হয়েছিলো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হঠাৎ ওরা দুজন দেখতে পায় । তখন ওদের দুজনকে দেখে তো সেই লোকটার আত্মারাম খাঁচা ! ওরা জিগ্যেস করলো দাদা এখানে ভি.ডি.ও. টা কোথায় হচ্ছে ? লোকটা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো- তোমরা কারা- ; কোথা থেকে আসছো ? ভি.ডি.ও. তো মনে হয় প্রায় শেষের পথে ! এখন তো ভোর হতে চললো । ওরা দুজনে সব ঘটনা সবিস্তারে বললো ওই লোকটাকে । শুনে তো লোকটা অবাক ; তারপর বললো- তোমরা আজ খুব জোর বেঁচে গেছো, মনে হয় তোমাদের রাস খুব ভারী, সাহসও প্রচণ্ড ! তা-নাহলে কেউ এই রাস্তায় রাতে আসে ?

  • গল্প

    গল্প- নির্জন নদীতীর, নীল সন্ধ্যা, ভালোবাসা

    নির্জন নদীতীর, নীল সন্ধ্যা, ভালোবাসা
    -সুনির্মল বসু

     

     

    কথা হচ্ছিল, নদীর কিনারে জেটির পাশে দাঁড়িয়ে,দুপাড়ে তখন সাঁঝ বাতি জ্বলে উঠেছে। নদীর ওপর শান্ত চাঁদের আলো। দু একটা নৌকো ভেসে যাচ্ছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, মাঝিদের জলজ সংসার।
    কতক্ষণ এসেছো?
    আধঘন্টা হবে।
    সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল।
    কেন?
    আগের ট্রেনটা পাইনি।
    অফিসের কি খবর?
    কাজের প্রেসার আছে।
    দুজনেই চুপ।
    তোমার লেখালেখির কি খবর?
    লিখছি। কিছু একটা খুঁজছি। যেখানে পৌঁছবার কথা, সেই জায়গাটা আজও খুঁজে পাই নি।
    বুঝতে পারলাম না।
    অতৃপ্তি। ভালো লিখতে না পারলে, আমার কষ্ট হয়।
    লোকে তো তোমার লেখার খুব প্রশংসা করে।
    তাই নাকি!
    হ্যাঁ তো।
    আমি নিজের লেখা নিয়ে খুশি নই। অথচ, খুশি হতে পারলে, কি ভালো যে লাগতো।
    লেখায় এত নতুন নতুন ভাবনা তোমার আসে কি করে?
    আমার ব্যর্থ অতীত, সেদিনের অপমান, এত কান্না,
    যা কাউকে কখনো বলা হলো না, সেগুলোই লিখি।
    পরাজয়ের কথা লিখে কি লাভ?
    জানিনা, বলতে পারব না।
    সেদিন যারা জিতেছিল, তারা কি তোমার বর্তমান অবস্থার কথা জানে।
    তা কি করে বলবো! তবে এটা ঠিক যে,
    কি?
    তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
    কেন?
    সেদিন ওরা আমায় অপমান না করলে, আমি হয়তো কখনো কলম ধরতাম না।
    তুমি কি স্বাতীর কথা বলছো?
    সে আমার অন্ধ অতীত। মনে করতে চাই না সেসব।
    তবু কাউকে কাউকে তো বলতেই হয়। না বললে বাঁচা যায় না।
    জানি। ও তখন বেটার খুঁজে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারিনি। সাত বছর ধরে আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে, হঠাৎ একদিন আমার হাতে প্রজাপতি আঁকা বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিল।
    তারপর?
    অগ্নিসাক্ষী করে যখন অভিনব চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হচ্ছিল, আমি সেই আগুনে আমার ভালোবাসাকে পুড়ে যেতে দেখেছিলাম। সেই থেকে ভালোবাসা আমার কাছে জলাতঙ্ক। আমার জাহাজে দাউ দাউ আগুন।
    তোমার লেখায় তাই বারবার ভালোবাসার মধ্যে কান্না ফুটে ওঠে।
    হয়তো হবে।
    নিজেকে পুড়িয়ে তবু কেন তুমি ধূপের গন্ধ ছড়াও?
    বলতে ইচ্ছে করে। না বলে নিজে সুস্থ থাকতে পারি না। তাই ক্রমাগত নিজেকে খুঁড়ে চলি। আমি বাইরে গল্প খুঁজি না। আমার মধ্যে, আমার চারপাশের মধ্যে, আমার অভাবের দিনগুলোর অতীতে গল্প খুঁজি।
    একটা কথা বলবো?
    বলো।
    ওই আঘাতগুলো না পেলে, আজ তুমি লেখক হতে পারতে না।
    যারা ভালোবাসার কথা বলে মিথ্যা নাটক করে একদিন স্বপ্নের ভালোবাসার বাড়িটা ভেঙে দিয়ে যায়, তাদের আমি মানুষ মনে করি না।
    কি বলছো তুমি?
    ঠিকই বলছি। ভালোবাসা খুন করা আর মানুষ খুন করার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখি না।
    শুনেছি, আজকাল স্বাতী নাকি তোমার লেখার অনুরাগী পাঠিকা। আমায় বলছিল, একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
    কিন্তু আমি ভাঙা কাঁচের আয়নায় মুখ দেখি না। আমার কাছে এলেও, ওকে ফিরে যেতে হবে।
    মানুষকে ক্ষমা করতে শেখো।
    কেন ক্ষমা? কিসের জন্য ক্ষমা?
    ভুলে যাও।
    কেমন করে ভুলি? কত বছর হয়ে গেল, পথের মোড়ে কাঠফাটা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছি কতকাল।
    আমার জন্য কোন ছায়াময় বৃক্ষ নেই। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
    তুমি কি আমার কথা একবারও ভাববে না?
    কি বলতে চাইছো তুমি?
    আমার বাবা শান্তিনিকেতনে প্রফেসর ছিলেন। উনি ছেলেবেলায় আমাকে বলতেন, আমার নাকি খুব
    নাক উঁচু। সবাইকে পছন্দ হয় না, সব জায়গা পছন্দ হয় না।
    তাহলে?
    কিন্তু যেদিন থেকে তোমার লেখা পড়তে শুরু করলাম, সেদিন থেকে মানুষটাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছি। কবে কখন কিভাবে এসব হলো, নিজেও বুঝতে পারিনি।
    মোনালিসা, তুমি দেখি, সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার মতো করে কথা বলছো!
    কি?
    সুনীলদা লিখেছেন, ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
    যেন মায়াপাশ।
    শোনো অগ্নিভ, এত বড় বিরাট পৃথিবীতে ভালোবাসা ঠিক কোথাও আছেই আছে। শুধু খুঁজে নিতে হয়।
    তাই কি?
    ভালোবাসা নিয়ে স্বাতী যেটা করেছে, জেনে নাও, সে কি সত্যিই সুখে আছে?
    কি বলতে চাইছো তুমি?
    অন্যকে ঠকিয়ে বড়লোক বাড়ির বউ হওয়া যায়, সত্যিকারের ভালোবাসা তো অন্য পৃথিবীর গল্প বলে।
    কি সুন্দর করে বললে!
    অনেক রাত হল। নতুন শীত এসেছে।
    তোমার শীত করছে, মোনালিসা?
    নাহ। আমরা কি আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করতে পারিনা?
    আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। ভাঙ্গা এ মন যদি কোনদিন সাহারা মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে ওয়েসিসের সন্ধান করে, সেদিন আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো। তুমি কি অপেক্ষা করতে পারবে?
    পারবো পারবো।
    ওরা তখন বাড়িতে ফিরছে। স্মৃতিতে ফিরছে। হয়তো ভালোবাসাতেও ফিরছে।

    জীবন পথের কিনারায় ভালোবাসার একটা ঘর কবে থেকে এভাবেই খুঁজে যাচ্ছে মানুষ।

  • গল্প

    গল্প- পুরনো আবাস

    পুরনো আবাস
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    শান্তিনিকেতনে আমি বহুবার গেছি তবু কেন কে জানে শান্তিনিকেতন আমাকে অহরহ ডাক পাঠায়। সংসারের পাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো আমার, সবসময় সেই ডাকে সাড়া দেবার সুযোগ ঘটে না বটে, তবু অহরহ মনে মনে আমি ‘সেথায় মরি ঘুরে।’
    সদা ব্যস্ত সংসারী মানুষজনের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। পৌষ মেলা,বসন্ত উৎসব, সোনাঝুরির হাট, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা, উত্তরায়ণ,সব‌ই তো হয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার, তবে? তবে আবার কেন?
    কেন যে সেকথা বোঝাই কাকে, কী করেই বা বোঝাই ,তাছাড়া আমার সবাইকে সব কিছু বোঝানোর দায়টাই বা কী! আমি বরং একা একাই পথ হাঁটি না হয়।
    যারা কেবল উৎসবের শান্তিনিকেতন দেখেই সন্তুষ্ট ,তারা থাক না নিজ মনে, আমার যে আর‌ও কতো কিছু দেখবার, অনুভব করবার বাকি রয়ে গেছে!
    আমি দেখতে চাই দূরের মাঠ পেরিয়ে ধেয়ে আসা কালবোশেখীর রুদ্ররূপ, পেতে চাই ঘন বর্ষায় কেতকী ফুলের গন্ধ, লেবুফলের গন্ধমাখা‌ ভোর, উন্মুখ হয়ে থাকি, কবে কখন, শীতের হাওয়া, নাচন লাগাবে আমলকীর ঐ ডালে ডালে ! শুকনো‌ পাতা খসে পড়ার খসস্ শব্দ মনে ভরে নিয়ে নিঝুম দুপুরে, হলদে পাখির পালক খুঁজতে যদি চলেই যাই খোয়াই এর শীর্ণ নদীটির পাশে,
    ‘তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার !’
    একা একা পথ চলি। আশ্রম গেটের সামনে থমকে থেমে মনে‌ মনে দেখি, সাঁঝবেলাতে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটি পিছনে রেখে ঐ বুঝি তিনি হেঁটে আসছেন শালবীথির রাঙামাটির পথটি ধরে।
    আসেন না নিশ্চয়‌ই। তবুও ভাবলাম‌ই বা, অসুবিধে কোথায়!
    আসন্ন সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি, তারার আলোয় একলা দাঁড়িয়ে থাকা তালাবন্ধ বাড়িগুলোর সামনে।একসময়ে কতো না আনন্দে দিনযাপন ছিলো বাসিন্দাদের। আজ পরিত্যক্ত বাড়িগুলির গেটে পাথরের ফলকে লেখা, আদরের নামটিও অস্পষ্ট, কেবল আগাছা ভরা বাগানের এক কোণে বৃদ্ধ কাঁঠাল গাছের মোটা পাতায়, শিশির ঝরে টুপটাপ। কেন এতো অবহেলা! উত্তরাধিকারীরা কী সবাই ভয়ঙ্কর রকমের কর্মব্যস্ত! হবেও বা! এই যে সামনের ‘গেহ’ নামের পেল্লায় দোতলা বাড়িটা, কবে থেকে একলাটি বসে আছে ।শুনি নাকি সেই বাড়ির অন্দরে ব‌ই আর ছবির মেলা। কারুর‌ই বোধহয় আর সাধ জাগে না সেগুলি আর একবার উলটে পালটে দেখতে!
    এবার নিজেই নিজেকে জোর ধমক লাগাই।
    অন্যের ব্যপারে নাক গলানোর স্বভাবটা আর গেল না! তাঁদের সুবিধে অসুবিধের কথা কী জানো হে! ধমক খেয়ে মনের দুর্বল অংশটা গুটিয়ে যায়, তাও মিনমিন করতেই থাকে…
    এসব কথা কী কাউকে বলবার!

    মোটকথা কেবল‌ই দেখতে নয়, রূপ,রস, গন্ধ সমেত সমস্তটুকু নিজের মধ্যে ভরে নিতে আমার এই বারে বারে ফিরে আসা।
    সন্ধ্যা গাঢ় হয়, আমি একলাটি পথ চলি।
    চেনা টোটোওয়ালাটি কাছে এসে দাঁড়ায়। দিদিমণির ধাত তার বোঝা হয়ে গেছে।
    ” সাঁঝের বেলায় এখন আর কী দেখবেন! কাল সকাল সকাল তোয়ের হয়ে থাকবেন‌, যে-যে বাড়ি দেখতে চান সব দেখিয়ে দেব। সমস্ত বিখ্যাত লোকের বাড়ির হদিশ,আমার জানা। আজ রাতেই লিষ্টিটা করে রাখবেন।”

    অভিভাবকের ভূমিকায় নিজেকে স্বনিযুক্ত করে টোটোওয়ালা চলে যায়।

    লিষ্টি আর নতুন করে কী বানাবো,সে তো কবে থেকেই আমার মনের মধ্যে ‘তোয়ের’ হয়ে রয়েছে!
    প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবি’তে কতকাল আগে পড়ে ফেলেছি , শান্তিনিকেতনে তাঁদের বাড়ি তৈরির গল্প।
    অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে‌,পারুলডাঙায় জমি কেনা,পরে ধীরে ধীরে ছোট্ট একখানা বাড়িও হলো।বাড়ির নাম দেওয়া হ’লো ‘স্বাগত-বিদায়’…বুদ্ধদেবের শেষ বয়সে রচিত কাব্যগ্রন্থটির নামে, সেই বাড়ির নামকরণ।
    শেষজীবনে প্রতিভা বসু , মহানগরীর কোলাহল এড়িয়ে, ওই বাড়িতেই থাকতে‌‌ চাইতেন,নিস্তব্ধ রাতের চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা বাড়িটি কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকতো।
    পাশের সোনাঝুরি নামের বাড়িটি গায়িকা নীলিমা সেনের।
    “আচ্ছা প্রতিভাদি সারাক্ষণ বারান্দায় বসে তুমি কী দেখো?”
    “উপরে আকাশ দেখি ,আর নীচে দেখতে আসি কখন তুমি যাও।তোমার সুন্দর মুখখানা দেখে আমার আকাশ দেখার‌ই আনন্দ হয়।”—- এবারে ঠিক দেখে নেব সেইসব বাড়ি ঘর।

    আগের বারে এসে দেখে গেছি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের দোতলা বাড়ি, ‘আনন্দধারা’। এখন সেখানে তাঁর ছোটবোনের সপরিবারে বসবাস। তাই সে বাড়িটির সর্বত্র যত্নের ছোঁয়া, শুধুই কী তাই! বাড়ি দেখতে গিয়ে এমন আন্তরিক অভ্যর্থনা কল্পনার‌ও অতীত ছিল। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা শিল্পীর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ণ দেখে, ফিরে আসার আগে, সামনে এসে বসলেন শিল্পীর ছোটবোন। দুইবোনের মুখশ্রীর মিল অবাক করা। গরম চায়ের পেয়ালা দিয়ে আপ্যায়ন শেষে বিদায়‌ নিয়ে ফিরে আসার আগে পরমাত্মীয়ের মতোই বললেন ‘আবার এসো।’ অভিভূত আমার মুখে বিশেষ কথা জোগায় না।ওই আন্তরিকতার জবাবে,ধন্যবাদ‌ও কী দেওয়া যায়!

    পরদিন সকাল সকাল টোটোওয়ালা এসে হাজির। তার অভিভাবকত্বে নিজেকে সঁপে দেবার আগে, নিজের ইচ্ছেটাও জানান দিয়ে রাখি।
    প্রতিভা বসুর মতোই, লীলা মজুমদার‌ও চেয়েছিলেন শেষজীবনে এই শান্তিনিকেতনেই ঠাঁই নিতে। অনেক পরিশ্রমের পর তৈরী হলো তাঁর মনের মতো বাড়ি। তার বিস্তৃত বিবরণ নিজেই দিয়েছেন সম্ভবত পাকদন্ডী ব‌ইতে। বাড়ির নাম হলো
    সু-র-ক-লি, স্বামী,পুত্র,কন্যা এবং নিজের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে।
    গাছপালায় ঘেরা সেই বাড়ির জানলার পাশে লেখার টেবিল। খাতার পাতা রোদে মাখামাখি।সেইখানে বসে তিনি লিখে চলেছেন- হলদে পাখির পালক। সেই পূণ্যতীর্থ না দেখে কী ফেরা যায়!

    টোটোওয়ালা হতাশ। সেই বাড়ি তো আর নেই গো। হাতবদলের পর সেটি এখন নিশ্চিহ্ণ। তবুও আমার হতাশা কাটাতে শুধু জায়গাটি দেখাতেই আমায় নিয়ে চলে সে। গাইড হ‌ওয়া কী চাড্ডিখানি কথা!!

    আশাপূর্ণা দেবীর সাধের বাড়ি ‘উজ্জ্বয়িনী’র‌ও ওই এক‌ই হাল।আশাপূর্ণাদেবীর স্বামীর নাম ছিল কালিদাস গুপ্ত। শুনেছিলাম স্বয়ং নরেন্দ্র দেব নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাড়িটির, ওই নামটিই পছন্দ করে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িটির কথা টোটোওয়ালার জানা নেই। শোনেই নি সেটির কথা। তাও চেষ্টা চালায় বেচারি। ইজ্জত কী স‌ওয়াল! কিন্তু সেই বাড়িটি সম্পর্কে কেউই কোন খবর জানাতে পারে না। কেউ যে আমাকে ভারতবর্ষের মানচিত্র খুঁজে দেখার পরামর্শ দেয় নি এই ঢের!
    বাড়িটি না হয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, জমিটিও কি তাই ! আমার স্বনিযুক্ত গাইডটির অহমিকা চূর্ণ! সাধে কি আর শাস্ত্রে বলেছে ‘মা কুরু…’ ইত্যাদি ইত্যাদি, থাক সেকথা।
    সারথিটি এতক্ষণ আমার‌ই ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।‌ আহত সম্মান পুনরুদ্ধারে, এবারে লাগামটি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, নিজেই হাল ধরলেন। নিত্য‌ই কতো ঝামেলাবাজ ট্যুরিষ্ট সামলান তিনি! আর এ-তো…..,আমিও চুপটি করে বসে থাকি,উটকো বায়না ধরি নে।
    পিচের মসৃণ পথ বেয়ে চলতে চলতে আচমকাই, এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় নেমে যায় টোটো। দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে, কোথায় কে জানে! সহসাই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যান চালক ।
    বাঁ ধারে খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অর্ঘ্য সেনের বাড়ি… ‘খোঁয়াড়’। বাইরে থেকে দেখে মোটেও খোঁয়াড়ের মতো ঠেকে না, হাট করে খোলা গেটের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় একফালি সবুজ জমি, ওপাশের কিনারা ঘেঁষে কিছু আটপৌরে ফুল গাছ। বাইরে দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। নীচ তলায় কারা যেন ঘরের কাজে ব্যস্ত। একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিত্যই এমন পাতিমার্কা লোকজন দেখে তারা ক্লান্ত।দোতলাটি বন্ধ‌ই। বাড়ির এমন নামকরণের কারণ ব্যখ্যা করতে পারতেন যিনি, তিনি দর্শকদের কাছে জবাবদিহি করার জন্য এই ধরাধামে আর বসে নেই।

    একটু এগিয়েই ডান হাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দোতলা বাড়ি— ‘একা এবং কয়েকজন’, একলাটি দুয়ার এঁটে নিশ্চুপ। বাইরে থেকেও কিচ্ছুটি দেখবার জো নেই। লোহার পাতে মোড়া পেল্লায় কপাটটি যেন বাড়িটিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
    এবার এগিয়ে আসেন আমার অভিভাবক, টোটো স্যার।
    গেটের বাইরে থেকেই পেল্লায় একখানা বাঁজখাই হাঁক ছাড়তেই, চিচিং ফাঁক।কেয়ার টেকার তার চেনা মনিষ্যি কিনা।সেই সুবাদে গেটের ভিতরে লাল কাঁকুরে পথটিতে পা রাখার অনুমতি মেলে। পথটি সোজা এগিয়ে বাড়ির সদরের সিঁড়ি ছুঁয়ে দুপাশে চলে গেছে। ডানপাশে লন। লনের ওপাশে সুনীলের কালো পাথরের আবক্ষ মূর্তি। সামনে দোতলা বাড়িটি এখন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে, বাঁদিকে ছোট্ট পুকুরে হাঁস সাঁতার দেয়। দেখতে দেখতে মনে ধাঁধা লাগে ,ওই বুঝি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন, মহা সোরগোল তুলে সশব্দে দোতলায় উঠে যাচ্ছেন সিঁড়ি বেয়ে!
    টোটোওয়ালা সারাদিন আমায় ঘোরায়, হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারে সে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
    দূর থেকেই দেখি রাণী চন্দের বড়ো সাধের ‘জিৎভূম,’ বুদ্ধদেব গুহর ‘রবিবার’, —এই‌ তো মাত্তর সেইদিন‌ও যেখানে জমাটি আড্ডাটি বসেছিলো।

    শান্তিনিকেতনে বাংলা পড়াতে এসে জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন কবি অশোকবিজয় রাহা। শান্তির নীড় ছোট্ট বাড়িখানার নাম দিলেন ‘সুরাহা’…স্ত্রী সুপ্রীতি আর অশোকবিজয় রাহার মিলিত রূপে বাড়ির নাম। কতশত জ্ঞানীগুণীজনের আনাগোনা।সদাহাস্যময়ী সুপ্রীতি তৎপর থাকতেন অতিথি সেবায়।
    আজ বাড়িখানার হাতবদল হয়ে সেখানে উঠেছে আধুনিক কেতার দোতলা বাড়ি। গেটের বাইরে প্রস্তর ফলকে ‘সুরাহা’ নামটি অটুট রয়েছে এইটুকুই যা সান্ত্বনা।
    শেষ বেলায় এসে দাঁড়াই ‘স্বাগত বিদায়’ এর বন্ধ গেটের সামনে। ওই তো বিশাল জমির ওপ্রান্তে দু কামরার ছোট্ট বাড়িখানা।
    একসময়ের গুণীজনসম্মেলন ধন্য, সেই আবাস, আজ একাকী, নিশ্চুপ। বাগানভরা ফুলেরা কবেই বিদায় নিয়েছে, ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের দাপটে। কেবল গেটের ফলকের ‘স্বাগত বিদায়’ আর বারান্দার থামে উৎকীর্ণ, ‘চিঠি’ শব্দটি আজ‌ও অপেক্ষায়।
    ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামে, আকাশে একফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যায়… বুঝি চুপিসাড়ে দেখে যায় এই অবেলায় আবার কে এলো !
    পাশেই সোনাঝুরি। গায়িকা অনেকদিন আগেই বিদায় নিলেও বাড়িটি সযতনে রক্ষিত। কারা যেন আজ‌ও বসবাস করেন সেখানে।গেটের সামনে থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি লাল মোরামের‌ পথটিতে,গুটিকতক সাদা ফুল ঝরে পরে আছে। মনের মধ্যে সব কিছু ভরে নিয়ে ফিরে চলি।
    অদেখা রয়ে গেল আর‌ও কতো শতো পূণ্যস্মৃতির ঠিকানা। ভারি মনে পথ চলি। আগামীকাল,কলকাতা ফেরার টিকিট। কিন্তু একেবারেই ফিরে যাওয়া কী যাবে!
    নিজেকেই নিজে কথা দিই আবার আসিবো ফিরে, আসবোই।

You cannot copy content of this page