গল্প

  • গল্প

    গল্প- মহুলের মা

    মহুলের মা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী


    সুবলা দেবী বেশ বিরক্তি সহকারে বলল, হ্যাঁ রে অভয় তুই যে এতো বড় স্ত্রৈণ হয়ে গিয়েছিস তা আজ টের পেলাম।
    মলি, মলয় বলতো বটে, মা বড়দা আর আগের মতো নেই। সবসময় বৌদির কথাতেই সায় দেয়। সেদিন বরং আমিই বকে ছিলাম ওদের দুজনকে। এখন তো দেখছি ওরাই ঠিক চিনেছে বড় বৌকে।
    অভয়ের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। তবুও সে শান্ত স্বরে বলল- মা মহুল যেমন তোমার নাতনি ঠিক তেমনি আমার আর হৈমন্তীর মেয়ে। তাই মহুলের জীবনের ব্যাপারে হৈমন্তীর মতামত খুব দামী অন্ততঃ আমার কাছে।
    সুবলা দেবীর রাগের আগুনে খানিকটা ঘি-এর মতো যোগ হলো অভয়ের কথাগুলো। দাউ দাউ করে যজ্ঞের শিখার মতো জ্বলে উঠে বললেন, তুমি তো বাবা অফিস আর ঘর করো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমাকে থাকতে হয়।
    এর মধ্যেই তোমার বউ-এর কীর্তি পাড়াতে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
    হৈমন্তী কিচেনে খাবার রেডি করার জন্য দোতলা থেকে নেমে আসতেই সুবলা দেবীর মুখে এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
    হাসি থামিয়ে বলল- মা আপনার তো তাহলে খুব নিন্দা মন্দ হচ্ছে পাড়াতে। তাহলে কিন্তু আজ থেকে আর পাড়া বেড়ানোটা বন্ধ করুন।
    সুবলা দেবী মুখটা গম্ভীর করে বলল- তোমার মতো মুর্খ মেয়েমানুষ আমি তো এই প্রথম দেখলাম। নিজে সাধ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনো। তুমি আবার এম এ পাশ দিয়েছো!
    সুবলা দেবীর এই একটা অস্ত্র আছে। যখন নিজে আর যুক্তি তর্কে পেরে ওঠে না তখন হৈমন্তীকে ধরাশায়ী করতে হৈমন্তীর শিক্ষা, বংশ এইসব নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করে।
    হৈমন্তী ও তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রয়োগ করে খুব মিষ্টি ও সংযত ভাবে।
    -মা ভাগ্যিস ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে ছিলাম। তাই তো উচ্চ শিক্ষার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন আপনারা। না হলে আমাকে কি আর মানুষ ভাবতেন? আপনাদের উচ্চ বনেদী বংশ। আপনারা ছিলেন গাঁয়ের বড়লোক। আর সেখানে আমার বাবা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মাত্র। আপনাদের উদার মানসিকতা। তাই তো আপনার স্বামী আমাকে আপনাদের ঘরের বউ করে এনেছিলেন। মনে আছে মা উনি আমাকে কি দিয়ে মুখ দেখেছিলেন? উনি ওনার বই আলমারির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বড় বৌমা এখন মরেও সুখ আমার। এতকাল শুধু ভাবতাম আমি মরে গেলে আমার বইগুলোর কি হবে? আমার সহধর্মিণী পুরানো খাতা-বই বিক্রির দোকানে গিয়ে হাফ দামে বিক্রি করে টাকাগুলো বগলদাবা করে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসে বই-এর খালি আলমারিটার মধ্যে ওনার মহামূল্য শাড়ি কাপড় রাখতে রাখতে বলবেন, কতবার বলেছিলাম একটা আলমারিতে আমার আর হচ্ছে না। আরেকটা আলমারি কিনে দাও। সে তো দিলে না। অগত্যা তোমার সাধের বই আলমারিটাই আমাকে বুদ্ধি করে কাজে লাগাতে হলো।
    শ্বশুর মশাই এর এমন বুদ্ধি দীপ্ত রসিকতা শুনে সেদিন নতুন বউ এর ‘বউ বউ’ লজ্জা ভুলে বেশ হা হা আওয়াজ তুলে হেসেছিল হৈমন্তী।
    হৈমন্তীর বিয়ের বছর দশেক পর মারা গিয়েছিলেন সুবলা দেবীর স্বামী। স্বামীর বিয়োগে সুবলা দেবী যত না ভেঙে পড়ে ছিলে তার থেকে অনেক বেশি ভিতর ভিতর ভেঙে গিয়েছিল হৈমন্তী।
    নতুন এই ঠিকানায় তার তো একমাত্র মনের সঙ্গী ছিল তার শ্বশুর মশাই। বিকাল বেলা হলেই অভয়ের বাবা গল্পের বই বের করে হৈমন্তীকে ডাক দিতেন। বলতেন, বৌমা আমার চোখের জোড় তো আগের মতো নেই। তাই টানা অনেকক্ষণ ধরে বই পড়তে পারি না। তার চেয়ে ভালো এখন থেকে তুমি বই পড়বে আর আমি শুনবো।
    এমন প্রস্তাবে হৈমন্তী যেন মনে মনে ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল সেদিন। তারপর দীর্ঘ দশটা বছরের ছয়টা মাস বাদ দিলে একশো চোদ্দো মাস বিকাল বেলার এই গল্পের আসর বসেছে হৈমন্তীর শ্বশুরবাড়িতে। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স্মরণজীৎ চক্রবর্তী, আশাপূর্না দেবী থেকে বানী বসু এমন নতুন পুরাতন লেখক লেখিকা কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ঝড় বয়ে যেতো সুবলা দেবীর তিনতলা বাড়িতে।
    তবে সুবলা দেবী সাধারণত এড়িয়ে চলতো এই গল্পের আসরকে। মাঝে মাঝে স্বামীর অনুরোধে এসে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন নি। কারণ পাড়ার মহিলাদের মুখরোচক টাটকা গল্পের আসর থেকে ডাক আসতে থাকে বারংবার।
    এইসব পুরানো কথা উঠলে কিছুতেই হৈমন্তী নিজের আবেগকে সংযত রাখতে পারে না। আসলে একটা চাপা যন্ত্রণা বড্ড টনটন করে ওঠে বুকের ভিতরটা। তার বড় ইচ্ছে ছিল নিজের লেখাপড়াটাকে কোনো সামাজিক কাজে লাগানোর। তাই সে ভেবেছিল গাঁয়ের নীচু পাড়াতে গিয়ে একটা অবৈতনিক নাইট স্কুল খোলার। স্বামী শ্বশুরকে পাশে পেলেও শাশুড়ি, ননদ, দেওর কাউকেই পাশে পায় নি। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা সম্ভব নয়। তাই সে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে ছিল।
    তাই হয়তো এই কারণেই মহুলের পাকা কথার দিন ভরা সভাতে ছেলের বাড়ির পাকা মাথাদের সামনে হৈমন্তী বলে ওঠে- আমি মেয়ের মা হয়ে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই আপনাদের কাছে। আমার মেয়ে সরকারি অফিসের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন। এই চাকরিটা পাওয়ার জন্য দিন রাত এক করে মেহনত করেছে সে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম জানে কেবলমাত্র চালিয়ে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পরও এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে আশা করি না আমি। আর তখন যদি আপনারা ঘরের কাজকর্মের জন্য বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন তাহলে কিন্তু সমস্ত চাপটা এসে পড়বে আমার মেয়ের ওপর। তাই জানতে চাইছিলাম আপনাদের ছেলে কি দৈনন্দিন জীবনের জরুরী কাজ কর্মগুলো যেমন ধরুন রান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘর মোছা জানে তো?
    হৈমন্তীর এই প্রশ্নে পাত্রের ঠাকুমা, মা, কাকীমা, দাদু, বাবা, কাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো মাত্র।
    পাত্রের দাদু গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন- আমার পরিবারে মেয়েদের গৃহকাজে সাহায্য করার জন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছি। আমাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের কাজেই পারদর্শী বেশি। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি অভয় বাবু, আপনার সহধর্মিণী কিন্তু ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। আমাদের পরিবারের মেয়ে বউরা কিন্তু অনেক ভদ্র ও লাজুক। আজ আমরা আসি। বাড়িতে গিয়ে অর্ক দাদুভাই-এর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। তারপর জানাবো।
    এরপর কেটে গেছে আরো দু তিনটে মাস। ভ্যাপসা গরমের জায়গা নিয়েছে ঠান্ডা আমেজ। আশ্বিন শেষ করে কার্তিক আগত। দু’ দুটো মল মাস পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে। সুবলা দেবীর খুব ইচ্ছা ছিল মহুলের বিয়েটা এই অগ্রহায়ণে হবে। কিন্তু হৈমন্তীর অদ্ভুত সব জিজ্ঞাসাবাদের দৌলতে মহুলের বিয়েটাই ঝুলে গেল। পাত্রপক্ষ চুপচাপ দেখেই চলে গেল। সুবলা দেবী এইসব কথা ভাবে আর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে হৈমন্তীর সেই দিনের বক্তব্যগুলো যত দিন যাচ্ছে চানাচুর তেলেভাজা সহযোগে পরিবেশন করতে থাকে।
    অনেকেই অবশ্যই সুবলা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার নাতনির বিয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। এমন মোটা টাকার মাইনের চাকরি যার।
    আবার অনেকই বলে তাই বলে পাত্রকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম জানতে হবে তবেই মা বিয়ে দেবে। এমন আবদার থাকলে পাত্র পেতে তো বেগ পেতেই হবে। যতই হোক আজও আমাদের সমাজ পুরুষ তন্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে।
    দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। একদিন ডিনার টেবিলে অভয় বলে- হৈমন্তী তোমার ঐ অসম্ভব জেদটা এবার ছাড়ো। আমি আমাদের মুখার্জী ঘটককে আসতে বলেছি আগামী কাল।
    হৈমন্তীও গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- হ্যাঁ গো আমাদের সমাজের মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হলেও পুরুষরা কিন্তু এখনও মধ্য যুগেই পড়ে আছে। নারী তুমি যতই বিদূষী হও, যত বড় পদেই আসীন হও না কেন বাড়ি ফিরে ক্লান্তি ভুলে খুন্তি তুলে নিতেই হবে পরিশ্রান্ত হাতে।
    রাতে শুয়ে শুয়েও এই বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্যে অভয়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, কেমন আছেন অভয় বাবু? আমি অর্কর দাদু বলছি।
    অভয় তাড়াতাড়ি বালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসে। হৈমন্তী চোখের ইশারায় ফোনটা স্পিকারে দিতে বলে।
    অর্কের দাদু বলেন, আমাদের বাড়ির মেয়ে, বৌমারা অর্ককে একটা বছর ধরে ঘষে মেজে প্রাত্যহিক ঘরোয়া কাজকর্ম শিখিয়ে ফেলেছে মোটামুটি। এখন আমার দাদুভাই ডাক্তারির পাশাপাশি ভাত, ডাল রান্না করতে শিখে গেছে। সত্যি বলছি অভয় বাবু, সেদিন আপনার মিসেস এর কথা আমার প্রথমে একদমই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌমারা বোঝালো যে পুরুষ মানুষ টুকটাক রান্না বান্না ঘরের কাজ না জানলে তাদের কি কি অসুবিধা হয়। সেদিন বুঝলাম আপনার মিসেস এর কথাগুলো ওর একার কথা নয়। আজকালকার বেশিরভাগ মেয়েদেরই কথা।
    তাদের অসুবিধার লিস্ট শুনে তো আমরা পুরুষরা খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর এই বয়সে এসে রান্নাবান্না শেখা সম্ভব নয়। তাই অর্কর বাবা আর অর্ককে বললাম, তোদের তো এখনও শেখার বয়স আছে। তোরা ই না হয় রান্না শিখে দেখিয়ে দে পুরুষ মানুষও বাইরে ও ঘর দুটোই সামলে নিতে পারে। কথাগুলো শেষ করে হো হো করে হাসি দিয়ে মোবাইলটা ভরিয়ে তুললেন।
    হাসি থামিয়ে বললেন- তাহলে আপনারা কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে মহুল ও অর্কর বিয়ের দিনটা ঠিক করতে?
    অভয় কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ হয়ে যায়। হৈমন্তীর ঠেলা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। শান্ত ভাবে বলে, মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে দিনটা জানাচ্ছি।
    ফোনটা কেটে দেওয়ার পরই অভয় হৈমন্তীর হাত দুটো নিজের কোলের কাছে টেনে এনে বলে, প্রথাগত আচার আচরণের বাইরে যাওয়ার জন্য অনেক সাহস লাগে। আমার তো সে সাহস কোনোদিন হলো না। কিন্তু তুমি চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও সেই সাহসটুকু দেখিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত জীবনটা কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত ও শান্তি পূর্ণ করে তুলতে পেরেছো।
    হৈমন্তী জিতে যাওয়ার আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেলে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চলি বলেই তো সমাজের চলার পথে এতো আবর্জনা জমে যাচ্ছে। নারীদের উন্নতি চাইছি কিন্তু উন্নতির জন্য যে পরিবেশ দরকার তা আমরা তৈরি করতে রাজি নই। যাক গে সমগ্র সমাজ পাল্টানোর ক্ষমতা তো আমার নেই। কিন্তু আমি আমার মেয়ের জীবনে তো পরিবর্তনের হাওয়া আনতে পেরেছি।
    এখন শুয়ে পড়ো। কাল সকালে মা’কে জানিও অর্কের দাদুর কথাগুলো। অভয় এল.ই.ডি. টিউবটা বন্ধ করে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অভয় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও হৈমন্তী সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। মনের মধ্যে উঠে আসতে লাগল মহুলের মা হওয়ার পর থেকেই মেয়ের জন্য আজ অবধি কত লড়াই না সে করেছে।

  • গল্প

    গল্প- চিরদিনের


    চিরদিনের
    -শিলাবৃষ্টি

    একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষটার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছেনা। দুই ছেলে, দুই বৌমা প্রথম প্রথম তৎপর হয়ে খোঁজার চেষ্টা করলেও আবার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে! প্রতিভা দেবী আর কত বলবেন!  ছেলেরাও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে হয়তো! পেপারে দেওয়া হয়েছে,এখন সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কি!
    চল্লিশ বছর এক ছাদের তলায় দুজনে কাটিয়েছেন, কিন্তু এই বয়সে এসে এরকম ভাবে একা ফেলে চলে গেলেন অনাদি বাবু!
    আসলে কিছুদিন ধরেই একটু অন্যমনস্ক ছিলেন তিনি। প্রতিভা দেবী অনেকবার প্রশ্ন করেছেন। একটাই উত্তর দিয়েছেন মাঝে মাঝে- আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করেনা।  তুমিও ছেলেদের দলে ভিড়ে গেছ!
    আসলে পুরোনো ধ্যান ধারণা ছেলেরা বউরা মানতে চায় না।  প্রতিভা দেবীও অশান্তি এড়াতে ছেলেদের কথায় সাপোর্ট করতেন বেশী। গুম হয়ে যেতেন অনাদি বাবু। হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় সেই যে হাঁটতে গেলেন। আর বাড়ি ফিরলেন না।
    কত খোঁজাখোঁজি করেও কোনো ফল হয়নি।
    কত স্মৃতি আজ ভিড় করে আসে প্রতিভা দেবীর মনে। রাতে ঘুম আসেনা। তাহলে কি! না না আর কিছু ভাবতে চান না তিনি।
    সকালে অফিস বেরোনোর সময় ছেলেদের কাছে
    বলতে যান প্রতিভা- কিরে তোরা কিছুই আর করবি না? তোদের বাবা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল?
    -দেখো মা! আমরা কি চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু এই করবো! বড় ছেলের উত্তর।
    ছোট ছেলে বলে- দেখো মা, কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে আমরা কি করতে পারি!
    চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যান প্রতিভা।
    সংসারে কত জিনিস ফুরিয়ে গেছে! একে তাকে দিয়ে কত আনাবেন? চলে যাওয়ার পরে প্রতি মুহূর্তে মানুষটার অভাব তিনি বুঝতে পারছেন!

    সেদিন অনেক রাত তখন… আজকাল ঘুম আসতে চায় না। একতলার বড় ঘরটাই তাঁদের।ছেলেরা উপরে থাকে।
    হঠাৎ জানালায় কার যেন ছায়া!
    -কে কে? কে ওখানে?
    ফিসফিসিয়ে বলে- চুপ! দরজা খোলো।
    এসেছে, এসেছে সে। ছুটে যান প্রতিভা দেবী।
    দরজা খুলে ঘরে নিয়ে আসেন স্বামীকে।
    -কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে এতদিন?”
    -আবার চলে যাবো এখনি।
    -না আর যাবে না তুমি. বড় খোকা….
    অনাদি প্রতিভার মুখ চেপে ধরেন- ওদের ডেকো না। আমার অনুপস্থিতিতে ওদের কারো কিছু যায় আসে না গিন্নী! আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি! চলো। কটা শাড়ি নিয়ে নাও ব্যাগে!
    -কি বলছো এ সব? না আমি যাবো না। আমি চলে গেলে এদের….
    -কিসসু হবে না এদের। রান্নার অসুবিধে হবে? রান্নার লোক রাখবে। নাতি নাতনিদের জন্য আয়া রাখবে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রতিভা।
    -হ্যাঁ গো গিন্নী। একটু ভেবে দেখো। ওদের মানুষ করার জন্য নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য কি না করেছি আমরা। আজ প্রচুর পয়সা রোজগার করছে ওরা। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সবই তো রেখে যাচ্ছি। চলো না প্রতিভা আমরা যে কটা দিন বাঁচবো, একটু নিজেদের মতো করে বাঁচি।
    -কিন্তু
    -কোনো কিন্তু নয়। তুমি তো দেখলে এ কদিন। আমার জন্য কোনো মাথা ব্যথা আছে ওদের?
    -কোথায় যাবো?
    -আমার এক ছাত্রের একটা বাড়ি খালি পড়ে ছিল
    এই শহরেই। সেই নীলেন্দ্র! মনে আছে তোমার? আমাকে এখনো এত শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে যে বলার নয়! সে আমেরিকায় থাকে পরিবার নিয়ে।
    আমার সিদ্ধান্ত তাকে বলেছিলাম একদিন। সে বলেছে যতদিন খুশী আমি যেন তার বাড়িটায় বাস করি। তাহলে সে নিশ্চিন্ত হবে। কেয়ার টেকার থাকে সারাদিন। চলো গিন্নি, আমরা যেমন খুশী তেমন ভাবে বাঁচি।
    ….
    ভোরের আলো ফোটার আগেই অনাদি আর প্রতিভা বেরিয়ে আসে সদর দরজা খুলে। দুজনেই
    একবার পেছন ফিরে তাকায় নিজের বাড়িটার দিকে। পূব আকাশে রক্তিম আভা দেখা দেয়। অনাদি প্রতিভার হাতটা নিজের ডান হাত দিয়ে ধরে নেয়। তারপর গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করে।

  • গল্প

    গল্প- মানুষ মানুষের জন্য

    মানুষ মানুষের জন্য
    -সুনির্মল বসু

    সেদিন কলেজের ছুটি ছিল। তাই অন্য একটা কাজ নিয়ে সুধাময় সান্যাল সীমান্ত শহর বনগাঁয় গিয়েছিলেন। অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। খিদেও পেয়েছিল খুব। ব্যাগের মধ্যে কিছু শুকনো মুড়ি ছিল। খেয়ে জল খেয়ে কোথাও একটু বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছিলেন।

    তাঁকে এই অঞ্চলের পথের কুকুরগুলোও চেনে। তারা এসে ঘিরে ধরেছিল। তিনি স্টল থেকে বিস্কুট কিনে ওদের খেতে দিলেন।

    তারপর স্টেশনে এসে পেতে রাখা টানা বেঞ্চিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন।

    মাথার কাছে ব্যাগ ছিল। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা পয়সা ছিল। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠতেই, স্টেশনের উলঙ্গ বাচ্চাগুলো এসে বলল- জেঠু, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো, আমরা তোমার ব্যাগ পাহারা দিয়েছি।

    সুধাময় বাবু ওদের খুব পরিচিত। ওই বাচ্চাদেরও তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেন।

    বর্ধমান জেলার কালনা অঞ্চলে ওদের বিশাল জমিদারি ছিল একসময়। সুধাময় সব গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন।

    ওর স্ত্রী মালবিকা একজন স্কুল শিক্ষিকা। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় ওদের একটা পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু সে দীর্ঘায়ু হয়নি।

    বাচ্চাটা মারা যাবার পর, মালবিকা স্বামীকে বলেছিলেন, এবার আমাদের একটা বাচ্চা এডাপ্ট নিতে হবে।

    সুধাময় বলেছিলেন, একটা বাচ্চা ভাবছো কেন, আমি একশো বাচ্চা এডাপ্ট নিতে চাই।

    মালবিকা একথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।

    সুধাময় বলেছিলেন, আমি আমাদের জমিতে ছোটদের জন্য একটা স্কুল বানাবো।

    ওনাদের বাড়ির মূল ফটকের পাশে পুরুষানুক্রমে রয়েছে একটি শিব মন্দির। প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যে এখানে ভক্তদের সমাগম ঘটে।

    স্কুল করবার কথা জানাজানি হতে, ভক্তদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশেষ গুঞ্জন শুরু হলো।

    একজন এসে বললেন, স্কুল বসালে, মুসলমান বাড়ির বাচ্চারা এখানে পড়তে আসবে, পাশে শিব মন্দির, এটা করা মনে হয় উচিত হবে না।

    একদল এসে বলল- এ হলো গণ্ডমূর্খ গ্রাম। শুধু শুধু এদের পড়াবার জন্য চেষ্টা করলে, কোন লাভ হবেনা। ওরা কি বড় হয়ে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে।

    সুধাময় শুনলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে ছোটদের জন্য স্কুল গড়তে গেলে, চারিদিক থেকে তার উপর চাপ আসবে।

    তিনি বললেন, আমি তো ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে। কিন্তু মুসলমান বাড়ির ছেলেরা এখানে পড়তে আসলে আমার কোন অসুবিধা নেই। ওরা এক সময় আমাদের প্রজা ছিল। সুখে দুঃখে বংশ পরম্পরায় আমরা এখানে রয়েছি। কেউ জাতপাতের প্রশ্ন তোলেনি। বিপদে-আপদে ওরা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে।

    অন্য একজন রগচটা তরুণ এসে বলল, দাদা, কাজটা তুমি মোটেই ভালো করছ না। এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে।

    বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর উপর নানারকম চাপ এসেছিল। তিনি গ্রাহ্য করেন নি।

    মনে মনে বলেছিলেন, একটাই তো জীবন। খালি হাতে এসেছি, খালি হাতে চলে যাবো। কিছু নিয়ে আসিনি, সঙ্গে করে কিছু নিয়েও যাবো না।

    সুধাময় ততদিনে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি হাতে পেয়ে গিয়েছেন। কর্তা গিন্নীর উপার্জনের সিংহভাগ এই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ব্যয় হয়।

    স্কুলের জন্য কম্পিউটার কিনেছেন, নিজে ভাঙ্গা কম্পিউটার নিয়ে বাড়িতে নিজের ‌কাজ করেন।

    মালবিকা স্কুলের নাম দিয়েছেন, সহজ পাঠ। দূর দূর গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে প্রতিদিন পড়তে আসে। বই খাতা পত্র সবই পেয়ে যায়।

    সুধাময় বাবু বরাবর একটু অন্যরকম।

    নিজেদের জমিদারি একদিন যেমন সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন, এভাবেই শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে,
    আজ সহজপাঠ শিশু নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
    ওই অঞ্চলের মানুষ বলে, উনি মানুষ নন। বিলকুল দেবতা আছেন।

    প্রতিপক্ষেরা বলে, লোকটাকে কিছুতেই দমানো গেলো না।

    একটা কাজ শেষ হয়েছে। আবার একটা কাজ শুরু করছেন তিনি। শিক্ষার আলো জ্বেলে দিতে হবে তাঁকে। বয়স বাড়ছে। সময় কমে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান আজও তিনি।

    মানুষকে ভালোবাসার কথা তিনি মুখে কখনো বলেননি, করে দেখিয়েছেন।

    গতকাল রাতে সন্ধের টিভির খবরে জানা গিয়েছে আগামী ২৬শে জানুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়া হবে, তাঁর রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবার ডাক এসেছে।

    সেদিন কলকাতায় সুধাময় বাবুর সঙ্গে একটি সাহিত্যের বাসরে আমার দেখা হয়েছিল। ওনার কাজের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। এত বড় মনের মানুষ সংসারে সচরাচর চোখে পড়ে না।

    আমি ওনার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। বললাম- ও দাদা, কি করে পারলে, এত মনের জোর তুমি কোথায় পাও?

    উনি হেসে বললেন- রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না, কিছু করতে হবে না, শুধু শিকড়টা ছুঁয়ে থাকবি। আমার একটা ছেলে যেদিন মারা গেল, সেদিন আমি আমার গিন্নীকে একশো ছেলের দায়িত্ব নেব বলেছিলাম। আজ সহজ পাঠ শিশু নিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে। ভালো আছি ভাই। এর চেয়ে বেশি কখনো তো কিছু চাইনি। লিও টলস্টয় এর গল্প মনে পড়ে, একটা মানুষের কতটুকু জমি দরকার।
    ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাস এ ম্যান রিকোয়ার্ড?’

    ফিরে এলাম।

    মনে মনে বললাম, ভালোবাসার মানুষ থাকলে, ভালোবাসার বাড়ি হয়। মনে ভালোবাসা থাকলে, ছোটদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেবার ইচ্ছে জাগে। সহজ পাঠ শিশু নিকেতন তৈরি হয়।

    দাদা তুমি পেরেছো, দাদা, তোমার মতো করে ভাবতে পারলে, দেশে শত শত হাজার হাজার দীপাবলীর রাতের মতো কত আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত।

    সংসারের ক্ষেত্রে এমন পবিত্র আলোর মতো মনের মানুষ দেখতে পেলে, গভীর আবেগে হৃদয়ে ভালোবাসার ঢেউ ওঠে।

    আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। শুধু মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ভাবনার গভীর ডুবে যাই। দু’চোখ জলে ভরে যায়।

    পৃথিবীতে অনেক কিছুই মনের মতো নয় হয়তো, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, এত আলো জ্বালিয়ে দেন, তখন ওদের মানুষ মনে হয় না।

    আমি কখনো ঈশ্বরকে দেখিনি। এদেরকে দেখলে মনে হয়, আমি ঈশ্বরকে দেখতে চাই না।
    ছোটখাটো চেহারার মানুষগুলোকে তখন আকাশের সমান লম্বা মনে হয়। মনে হয়, এই তো! আমি ঈশ্বর দেখতে পাচ্ছি।

    এদের জন্য বড় শ্রদ্ধা জাগে মনে। কত কত দিন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, চোখের সামনে বারবার একই দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে।

    তখন মনে হয়, জীবন আমার ভালবাসায় ভরে গেছে। ঈশ্বর আমাকে ঈশ্বর প্রতিম মানুষ দেখিয়েছেন।

    চোখে জল আসে। ঘুরেফিরে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আপনারা এত ভালো কেন বলুন তো?

    মনে মনে আমি ওনাকে বললাম, তোমাকে আনত প্রণাম, দাদা।

    সেই সঙ্গে মনে হল, আমার এই দীর্ঘ জীবনে চলার পথে অন্তত দু-একজন ঈশ্বর ঈশ্বরীর দেখা পেয়েছি।

    যাওয়া আসার পথের ধারে কত মনিমানিক্য পড়ে থাকে, দেখার চোখ থাকলে, জীবনের কোনো বাঁকে ঠিক একদিন ঈশ্বর এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন।

  • গল্প

    গল্প- নিরঞ্জন

    নিরঞ্জন
    -শচী দুলাল পাল

    বিজয়া দশমীর রাত্রি,বিসর্জনের পথে মা দূর্গা। আবালবৃদ্ধবনিতার শোভাযাত্রা চলেছে শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে গঙ্গার ঘাটে। ব্যান্ড পার্টি, আলোক সজ্জায় ধুনুচি হাতে যুবক যুবতীরা নৃত্য করছে। কেউ ভাং, কেউবা কোল্ড ড্রিংকস এর সাথে মদ মিশ্রিত পানীয় খেয়েছে। রাস্তার দুপাশে জনতার সারি। ঘরদোর ছেড়ে সবাই আজ রাস্তায়। অর্ঘ্য নামে একটি মেধাবী ছেলে সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রার আনন্দ উপভোগ করছিলো। হঠাৎ নাচের দল থেকে কয়েকজন বন্ধু অর্ঘ্যকে হাত ধরে টেনে নাচের দলে ঢুকিয়ে নিলো। সে নাচ জানেনা, অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাদের সাথে পা মিলাতে লাগলো।
    সেই নাচের দলে ছিল ভীরা নামে একটি ছেলে- তার সহপাঠী। ভীরা হিংসুটে ও দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। অর্ঘের উন্নতিতে তার জ্বলন হতো। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে যথারীতি মা’কে বিসর্জনের জন্য প্রতিমার জলে ভাসানের উদ্যোগ চলছে । অর্ঘ্য তীরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দেখছে। হঠাৎ দেখলো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীরা। ভীরা তাকে এক ধাক্কা দিতেই জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো। ভীরা তাকে বাঁচাবার ছল করে কিছু একটা দিয়ে তাকে আঘাত করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। সবাই চোখের সামনে দেখলো একটা ছেলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর সে জ্ঞান হারালো। বিসর্জনের যাত্রীরা কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলো না। কে নিজের জীবন বিপন্ন করে ডুবন্তকে বাঁচাতে যাবে? তারা সবাই ধরে নিলো বিসর্জনের রাতে অর্ঘ্য ভেসে গিয়ে মরে গেছে।
    জলের স্রোতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভাসতে ভাসতে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো দূরে, বহূদুরে। শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুতগতিতে সংবাদ সম্প্রচারিত হলো। অর্ঘ্য নামে একটি যুবক প্রতিমা বিসর্জন করতে গিয়ে ভেসে গেছে। অর্ঘ্যের মা-বাবা ও পরিবারের বুক ফাটা আর্তনাদে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো।
    কোনো এক গঙ্গা তীরে বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছের সমারোহ। বেশ ছায়া সুশীতল গাছ গাছালীতে ভরা এই স্থানটি। গঙ্গাধারে পর্ণকুটিরে জোনাই নামে একটি বছর পনেরোর কিশোরী তার মা বাবার সাথে থাকে। অন্যদিন বেশ বেলায় ঘুম থেকে ওঠে। আজ অজানা কারণে সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পুব আকাশে সূর্য উদয় হচ্ছে। তার রক্তিম রশ্মিতে জল লালে লাল। গঙ্গা তীরে গিয়ে নির্মল বাতাসে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
    হঠাৎ দেখলো প্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর কি একটা ভেসে আসছে। রক্তাক্ত দেহ। ভাসতে ভাসতে দেহটি এক্কেবারে তার সামনে এসে থামলো। দূর থেকে মৃতদেহ মনে হলেও সামনে এলে সে অনুভব করলো দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ছটফট করছে। জোনাই দেখলো বিসর্জিত দূর্গাকাঠামোর টুকরোর উপর ভাসমান যুবকটির প্রাণ আছে। সে যুবকটিকে জল থেকে তুলে নিজের যথাশক্তি দিয়ে ডাঙ্গায় তুললো। পেটে চাপ দিয়ে জল বার করলো।ধীরে ধীরে ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। অবসন্ন শরীর। কথা বলার ক্ষমতা নেই। জলে সাঁতার, মাছ ধরা, নিজের এক টুকরো বাগানে কাজ করা শক্তিশালী জোনাই নিজের শরীরে ভর নিয়ে যুবকটিকে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে নিয়ে এলো। গরম দুধ খেতে দিলো। সেবা পথ্য দিয়ে শরীরে প্রাণসঞ্চার করলো। যুবকটি চোখ মেলে চেয়ে দেখলো সেবারতা এক কিশোরীর হাত তার কপালে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে অবসন্ন দূর্বল শরীরে অক্ষম হয়ে পড়ে গেলো। জোনাই যুবকটিকে বলল- তুমি দূর্বল। মাথায় চোট লেগে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তোমাকে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? তোমাকে এক দেবীপ্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর গঙ্গা জল থেকে উদ্ধার করেছি।
    ছেলেটি তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিছুই মনে করতে পারছে না। বলল- আমি কিছু মনে করতে পারছি না?
    হাসপাতালে দিন কয়েক থেকে যুবকটি সুস্থ হলে জোনাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। জোনাই-এর বাপ দিনমজুর। সবদিন কাজ থাকে না। চুল্লু খেয়ে ঘুমায়। মা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজে। ঝিয়ের কাজ করে।
    গরীবের সংসার। বাপটা একদিন চুল্লু খেয়ে মেয়ের উপর চড়াও হলো- আর কতদিন গলগ্রহটাকে পুষবি? ওর মাথার ঠিক নেই। নিজের নাম ঠিকানা বলতে পারছে না।

    -না পারুক। একদিন না একদিন সে নিজেকে চিনতে পারবে।

    -তাতে তোর কি লাভ?

    -লাভ ক্ষতি আমি কিছু বুঝিনা। একজন মুমূর্ষুকে প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করেছি তাই নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি ওকে আমাদের ঘরেই রাখবো। ওকে এখনি ছেড়ে দিলে ক্ষিদে তৃষ্ণায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে।
    -আমরাই বা কোথা থেকে যোগাবো তার ভরণপোষণ?

    -আমার খাবারের আর্ধেক আমি ছেলেটিকে খাওয়াবো।

    -তার মানে তুই ছেলেটিকে এখানেই রাখবি? সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। লোকে কি বলবে?

    -যে যাই বলুক আমার কিছু যায় আসে না। যতদিন না তার পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারছে ততদিন আমি তাকে দেখবো। সংসার চালাতে তোমাদের যদি কষ্ট হয় আমি কাজ করব। উপার্জন করব।
    মা রান্না করতে করতে এসে বললো- তোদের বাপ বেটির সব কথা শুনেছি। ঠিক আছে কাল থেকে তুই কাজে লাগ। সামনের উর্বর জমিটায় সবজি লাগা। গতর খেটে উপার্জন কর।
    সবজি বেচে দু’ টাকা আয়ও হবে। আমিও না হয় দু’বাড়ি বেশি ঠিকে ঝির কাজ করব।
    এভাবেই থাকতে লাগলো ছেলেটি। তারা নাম দিল দূর্গাপদ।
    কয়েক বছর এভাবে কাটলো। জোনাই এখন অষ্টাদশী। দূর্গাপদ শহরে এক প্রোমোটারের অধীনে নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কর্মীর কাজ করে। জোনাইএর মা’কে সে মা বলে। বেতনের সব টাকা মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। একদিন তাদের অবস্থা সচ্ছল হলো। কাজকর্মে নিষ্টা, সততা, সরলতা দেখে প্রমোটার তাকে সুপারভাইজার পদে প্রমোশন দিলেন। দূর্গাপদ এখন উচ্চ আয়ের প্রমোটারের শ্রেষ্ঠ সেবক হলো। বেতনের টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করে দিল।
    জোনাই, দূর্গাপদ একে অপরকে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারা দিনান্তে প্রায়ই গঙ্গাতীরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে গঙ্গার অপূর্ব শোভার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা দুজনে নিজেদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।
    একদিন খবরের কাগজের চপ ভাজা সহযোগে ঠোঙায় ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বহুবছর আগে এক ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেখে জোনাই চমকে উঠলো। “অর্ঘ্য নামে এক যুবক দূর্গা বিসর্জনের রাতে হুগলির ঘাট থেকে জলে ভেসে গেছে। তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কোনো সহৃদয় ব্যাক্তি সন্ধান পেলে নীচের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে বাধিত হবো।”
    ঝালমুড়ি খাওয়া হয়ে গেলে জোনাই ঠোঙাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখে দিল।
    সে ভাবতে লাগলো এ তো সাধারণ ছেলে নয়। যদি সে এখনই তার পরিবারের হাতে তুলে দেয় দূর্গাপদকে তাহলে সে হাতছাড়া হয়ে যাবে। আশংকায় তার দিন কাটতে লাগলো।
    সারারাত তার ঘুম আসে না। একদিন মধ্যরাতে জোনাই দূর্গাপদর রুমে গিয়ে
    ইতস্তত করতে করতে দূর্গাপদর কপালে এক গভীর চুম্বন করলো। দূর্গাপদ প্রথম নারী স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখলো জোনাই তার সামনে দাঁড়িয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
    -এ কি!জোনাই তুমি কাঁদছো কেন?
    কি হয়েছে?
    জোনাই দূর্গাপদকে জড়িয়ে ধরে বললো- আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
    -সে তো আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কথাটা এতদিন মুখফুটে বলতে পারিনি।

    -কথা দাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না!
    -তিন সত্যি করে বলছি আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমাকে আমি বিয়ে করবো। আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় তোমায় স্থান দিয়েছি। সে স্থান চিরস্থায়ী থাকবে।
    একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাত্রি অবসান হলো দূরে কোথাও ভোরের পূজার ঘন্টা ও শঙ্খ ধ্বনি হলো।
    আজ বিজয়া দশমী। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বিসর্জনের বাদ্যি বাজছে। গঙ্গাতীরে উপচে পড়া ভীড়।
    দূর্গাপদ – জোনাই সুন্দর পোশাকে বিসর্জন দেখতে গেছে। তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে একপাশে দাঁড়িয়ে দূর্গা মায়ের বিসর্জন দেখছে। হঠাৎ পা পিছলে দুজনেই মায়ের কাঠামোর উপর পড়ে গেলো। শক্ত কাঠামোয় দূর্গাপদর কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। কে বা কারা যেন তাদের ডাঙায় নিয়ে এলো। জোনাই বললো- তোমার নাম “অর্ঘ্য”।
    সাথে সাথে দুর্গাপদর পূর্বস্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
    হ্যাঁ। আমি অর্ঘ্য। আমিই দূর্গাপদ। তুমি আমার বাকদত্তা স্ত্রী।
    এসো বিসর্জনের এই পুণ্য লগ্নে তোমাকে বরণ করি। অর্ঘ্য তার রক্তাক্ত কপালের রক্ত দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলো।
    ঢাক ঢোল কাঁসরঘণ্টা শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হলো।
    জোনাই মোবাইলে সেভ করা ফোন নম্বরটিতে ফোন কল করে বললো- এই নাও তোমার নিজের মা বাবার সাথে কথা বলো।
    অপর প্রান্ত থেকে নারী কন্ঠ ভেসে আসলো।

    -মা! আমি তোমার ছেলে অর্ঘ্য বলছি। আমি বেঁচে আছি মা। আজ রাতেই আমি আমার সদ্য পরিণীতা নববধূকে সাথে নিয়ে বাড়ি আসছি। তোমরা বরণডালা সাজিয়ে রেখো।

  • গল্প

    গল্প- খোঁজ

    খোঁজ
    -অজয় বিশ্বাস

            রমেনবাবু। রমেন রায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি বিভিন্ন মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অস্থায়ী তাঁবুতে থাকেন, আর সন্ন্যাসীদের আখড়ায় ঘুরে বেড়ান।খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ছেলেকে।
          ছোট থেকেই মেধাবী ছিল তার ছেলে। কলকাতায় কলেজে পড়ার জন্য কলেজের হস্টেলে সে থাকত। মাসে একবার বাড়ি যেত। ভালভাবেই পড়াশোনা চলছিল। একবার মাস পার হয়ে দু'মাস হতে চলল।ছেলে বাড়ি যাচ্ছে না। রমেনবাবু নিজেই এলেন খোঁজ করতে। সবাই অবাক। হস্টেলের ছেলেরা বলল, ও তো একদিন গেরুয়া বসন পরে সবাইকে জানাল ও বাড়ি যাচ্ছে। এরপর রমেনবাবু কোনোভাবেই তার ছেলের আর খোঁজ পাননি।
          এবার রমেনবাবু এসেছেন কুম্ভমেলায়। বুকে আশা নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এক ভোরে বেদের মন্ত্র উচ্চারণ শুনে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, সন্ন্যাসীরা বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। সকলেরই অল্প বয়স। সবাইকেই তার মনে হল, এরা সবাই তো তারই ছেলে। 
  • গল্প

    গল্প-মর্নিং ওয়াক

    মর্নিং ওয়াক
    -সুনির্মল বসু

    ভোরের কুয়াশায় ঢাকা নদী। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওপারে সূর্যের প্রথম আলো। ওঁরা চারজন এপারে একসঙ্গে হাঁটছিলেন। ভোরের পাখি আকাশের প্রান্তরেখায় ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছিল। ঘাসের উপরে শিশির বিন্দু। পথের পাশে বনফুলের রং বাহার।

    মর্নিং ওয়াক। ভোরের শীতল বাতাস ওদের নাকে মুখে চোখে এসে লাগছিল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এভাবেই ওঁরা প্রতিদিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে থাকেন। নদীর পাড়ে পার্কের দিকে বহু মানুষ মর্নিং ওয়াকে আসেন।

    ওঁরা সবাই সারা জীবন সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করেছেন। ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন। অবসর নেওয়ার পর নিজেদের মতো একটা অন্য জীবন কাটাচ্ছেন।

    ভুবন মুখুজ্জে বলছিলেন, মানুষের মধ্যে যদি বড় হবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসে।
    ত্রিদিব সিনহা বললেন, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
    সন্তোষ দাশগুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ক্যান, কি হইছে?
    অনল চৌধুরী বললেন, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই, বুঝলেন ভায়া।
    ত্রিদিব সিনহা বললেন, ইচ্ছাশক্তি শুধু থাকলেই হবে না, সেই সঙ্গে ভাগ্যের একটা হাত থাকা চাই।

    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- খোসা ছাড়াইয়া কন।

    অনল চৌধুরী দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন- চলুন, অনেকটা হেঁটেছি। গাছের ছায়ায় বসি।

    ত্রিদিব সিনহা গল্প শুরু করলেন।

    -ভাই, ভোরের আকাশ দেখে সারাদিনটা কেমন যাবে, আগে থেকে ভাবা যায় না। আপনাদের বাটা মোড়ের শ্রীকান্ত সরকারের কথা মনে আছে? ওর ছেলে সবুজ সরকার নঙ্গী স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বরাবর খানিকটা অস্থির প্রকৃতির। দু’ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসতো। বরাবর ফার্স্ট হত।
    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হ। পলাডার অনেক প্রশংসা শুনছি।
    ভুবন মুখুজ্জে বললেন- সবুজ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সরকারি চাকরির পরীক্ষা হচ্ছিল। বয়স্ক চাকরিপ্রার্থীরা বাইরে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করছিলেন- ট্রাম কে আবিষ্কার করেন? বলুন না?

    সবুজ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর দিল, মিঃ ট্রেন।
    সবাই চমকে গিয়েছিল সেদিন।

    ত্রিদিব সিনহা বললেন, সেই ছেলেটি জীবনের কোন ক্ষেত্রে কোথাও আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়নি। হারতে হারতে ওর পায়ের তলায় জমি নেই। তাই বলছিলাম, শুধু ইচ্ছা শক্তি বড় হলেই চলবে না, ভাগ্যের সহযোগিতা না থাকলে, জীবনে সাফল্যের সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

    সন্তোষ দাশগুপ্ত অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন-হেইডা কেমন কইরা ঘটল, একটু ক্লিয়ার কইরা বলেন।

    ভুবন মুখুজ্জে নিজের হাতের স্টিকের উপর মাথা রেখে বললেন- ভেরি স্যাড।

    অনল চৌধুরী বললেন- ছেলেটার উপর সবার খারাপ নজর পড়ে গিয়েছিল মনে হয়।

    ত্রিদিব সিনহা বললেন- মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষায় সবুজ ফার্স্ট হয়েছিল। অথচ, ফাইনালে ও কোনো রকমে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে। গোটা স্কুল বাড়ি সেদিন ওর এই শোচনীয় পরিনাম দেখে হতাশ হয়েছিল, দুঃখ পেয়েছিল।

    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হেরপর কি হইল?

    ভুবন মুখুজ্জে বললেন- অনেক পেছনে পড়ে থাকা ছেলে এইসব পরীক্ষায় ভালো ফল করে চমকে দেয়,
    আবার যাদের উপর স্কুল বহু আশা করে বসে আছে, ফাইনালি তারা ওখানে গিয়ে ডোবায়।

    ত্রিদিব সিনহা বললেন- কলেজে গিয়ে সবুজ সরকার ইকোনমিক্সে অনার্স নেয়। ম্যাক্রো, বেনহাম নিয়ে পড়াশোনা করে। সাময়িক ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। এই সময় ওর জীবনে এষা চ্যাটার্জীর আগমন ঘটে। সেই থেকে ওর জীবনে পতন শুরু হয়।

    জীবন মুখুজ্জে বলেন- একটা মেয়ে একজন পুরুষকে শূন্য থেকে উপরে ওঠাতে পারে, আবার তাকে ওপর থেকে নিচে নামিয়ে আনতে পারে।

    সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- আইজ কালকার পোলাপানদের পেরেম ভালোবাসার কথা আর বলবেন না, দেখছেন না, গান বানাইছে,তু তু তু তু তুতু তরা। য্যান কুত্তারে বিস্কুট দিতাসে।

    অনল চৌধুরী বললেন- তাই নাকি!

    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- সেদিন আমার মাইয়া শ্রাবন্তী আইছিল, আমারে একখান ফিল্ম দেখাইলো, কি নাম যেন, আমি তোমার কেডা।

    জীবন মুখুজ্জে হেসে বললেন- বুঝেছি ‘হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন’।

    ত্রিদিব সিনহা কথা শুরু করলেন। বললেন- এষা মেয়েটি প্রেম-ভালোবাসার অভিনয় করে একটা সিএ ছেলেকে বিয়ে করে সল্ট লেকে ভেগে গেল।

    অনল চৌধুরী বললেন, তারপর?

    ত্রিদিব সিনহা বললেন- সবুজ সরকারের ক্যারিয়ার খতম। অনার্স পেল না। ভালো চাকরি পেল না। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে পয়সা উপার্জন করছে। তাই বলছিলাম, ইচ্ছা শক্তি থাকলে, ভালো ছাত্র ছাত্রী হলেই চলবে না, ভাগ্য বলেও একটা ব্যাপার আছে। অথচ, জীবনের শুরুতে কত সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিল ওই ছেলেটা!

    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- এইসব ডেস্ট্রাক্টিভ মাইয়াগুলোর কথা আর বলবেন না।

    অনল চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

    ত্রিদিব সিনহা বললেন- ভাগ্যিস, সব মেয়েরা এইরকম নন। ম্যান টু ম্যান, মানুষে মানুষে তফাৎ তো চিরকাল থাকেই।

    অনল চৌধুরী বললেন- মেয়েরা সংসারের লক্ষ্মী। ওরা সংসারের সৌন্দর্য। ওরা না থাকলে, পৃথিবী অচল। ওদের মধ্যে ধারণী শক্তি রয়েছে।

    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- আমাগো মা কাকিমা গো কথা একবার ভাইববা দ্যাখেন। আমাগো মানুষ করতে গিয়া ওঁনারা কি না করেছেন! আর এত বছর যে চাকরি বাকরি কইরা আসলাম, তাও তো অগো জন্যই।

    জীবন মুখুজ্জে বললেন- সিনহাদা, আপনার কথা মানছি ভাই। সবকিছুর উপরে ভাগ্য একটা ব্যাপার।

    ওরা উঠে পড়লেন।

    সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- রোদ্দুর উইঠা গেছে। গিন্নী চা রেডি কইরা বইসা আছে। দেরি করলে, ডালের হাতার বাড়ি মারবো আনে।

    অনল চৌধুরী বললেন- দাদা, আপনি বৌদিকে ভয় পান?

    সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- বৌরে ভয় পায় না, কোন্ হালা?

  • গল্প

    দ্বিধা সীমন্তিনী

    দ্বিধা সীমন্তিনী
    -রীণা চ্যাটার্জী

    সব দ্বিধা শেষ। শুধু গল্পটা…

    বিয়ের আগে অত তলিয়ে ভাবেনি- হয়তো প্রয়োজন বোধ করেনি। সবকিছু চোখের সামনে আশৈশব দেখে এলেও অভ্যস্ত চোখে নিজের জন্য আলাদা করে প্রশ্ন জাগেনি। হয়তো এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় একটা আদ্যপান্ত বাঙালি পরিবারে, পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা মেয়ের জন্য এই অনুভূতি, তবুও এটাই সত্যি বিয়ের পরে তপতী প্রথম অনুভব করলো, বিবাহিত আর অবিবাহিত মেয়েদের দুই আলাদা সাজ পরিচয়ে, পরিধানে। নতুন করে বদলে যাওয়া সাজ-পোশাকে তপতীর কিন্তু খুব অস্বস্তি হতো বিয়ের পর- কেমন যেন লজ্জা করতো। ছোটোবেলা থেকে বাবা-কাকা- দাদা-মামা যাদের কোলে পিঠে বড়ো হয়েছে, কতো আব্দার, স্নেহ-খুনসুঁটির মাঝে বেড়ে উঠেছে। শ্বশুর বাড়িতে তাঁরা এলে বা শ্বশুর বাড়ির লোক তপতীর বাপের বাড়িতে এলে মাথায় আঁচল দিতে হতো- ঘোমটা টানা চলতি ভাষায়, খুব অস্বস্তি লাগতো, লজ্জা করতো, কেমন যেন পর পর মনে হতো, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারতো না। যে পাড়ায় ছোটো থেকে ফ্রক পরে ঘুরেছে, বড়ো হয়েছে, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করেছে, সেখানেই ঘোমটা টেনে ঢুকতে হবে সাথে ভাশুর বা খুড়শ্বশুর কেউ থাকলে। সঙ্কোচ-লজ্জা ঘিরে থাকতো ঘোমটার আড়ালে। অথচ মায়ের কড়া শিক্ষা বড়োদের সামনে ঘোমটা দিতেই হবে- না হলে না কি অপমান করা হয়। তাই আবার হয়! ঘোমটা দিলেই সম্মান করা হয়! আর ওই যে আপন-পর দ্বিধাবোধ! মন খুলে কথা বলতে না পারা, ওটাই না কি নববধূর ভূষণ- ধ্যেৎ, মনের আনন্দ তো গুলে কাদামাটি বিয়ের। তারপর সিঁদুর- বিয়ের সময় ঠিক ছিল- ফটো উঠলো বেশ কয়েকটা, ভালোই লাগলো। তবে চুলটা সেই যে লাল আর চটচটে হলো, মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়- রোজ না কি নিয়ম করে দুই বার সিঁদুর পরতে হবে, মনে থাকে না। যদিও বা মনে পড়ে, মনে হয় যেন কি এক পরাধীনতা- মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
    কখনো মনে হতো, আছে তো লাল হয়ে সিঁথি, না হয় থাক, আসলে নিয়ম করে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর অভ্যাসটাই তো নেই ছোটোবেলা থেকে কোনোদিন। তারপর স্নান করে ভিজে চুলে সিঁদুর লাগালে জলের মতো গড়িয়ে আসতো নাক বরাবর। জোকার মনে হতো। গরমের দিন হলে তো কথাই নেই-সোনায় সোহাগা, গড়াচ্ছে ঘামের সাথে নাকে-মুখে-চোখে, জ্বালা করতো খুব। ঠিক ওখানেই হাজার কথা- এয়োস্ত্রী মানুষ… সংসারের কল্যাণ, লক্ষণ। মানিয়ে নিয়েছিল মন। আর হাতের এক গয়না, সব রঙের সাথেই সাদা- লাল! একটু তো অদ্ভুত লাগতোই। কেমন যেন “মা… মা” ধরণ। তেলে-হলুদে-শাখা-সিঁদুরে-ঘোমটায়-পরাধীনতায় অন্য এক জীবন। তার সাথে বার-ব্রত-উপোস লেগেই আছে, আর আছে এই করতে নেই, ওই করতে নেই, আমাদের বাড়ির এই নিয়ম। মাঝে মাঝে একপেট খিদের সাথে এক ঝুড়ি প্রশ্ন তোলপাড় করতো শরীর মন। প্রশ্ন থেকেই যত বিপত্তি, উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো বিপত্তি। সবকিছুই যেন চাপিয়ে দেওয়া এক প্রথা, পরাধীনতার প্রতীক, আর পুরুষতান্ত্রিকতার বৃথা আষ্ফালন। যদিও সারবত্তা বদলে গেছে কালের প্রবাহে, প্রতীকগুলো বেঁচে আছে লোকাচারে, যাদের ওপর চাপানো হয়েছিল তারাই তো পরম বিশ্বাসে, ভরসায় এগুলো নিয়ে বেঁচে আছে, পরাধীনতার রক্ষাকারী হয়ে যুগ যুগ ধরে। তবু বলা যাবে না এইসব কথা, অগত্যা ভরসা ডায়েরি। মনের অশান্ত প্রশ্নগুলো লিখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শান্ত হবার চেষ্টা করে তপতী। বলা বারণ, মনের আগলে খিল দিয়ে রাখতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল আলাদা করে- ওটাই ভদ্রতা।
    বিয়ের পর পর বাবার বাড়ি (হঠাৎ করে বাড়ির নাম, সংজ্ঞাও বদলে যায়) এসেও রেহাই ছিল না, স্নান করে সাথে সাথে সিঁদুর না লাগালে কাকি-মা-বৌদি কেউ না কেউ ধ্যাবড়া করে খানিকটা লাগিয়ে দিত। সাথে সাথে প্রবচন- “এতোদিনে তো অভ্যাস হয়ে যায়, তোর কবে হবে?” হয়ে গেল, এইভাবে অভ্যাস হয়েই গেল, তৈরী হয়ে গেল সাজানো বিবাহিত মন- আর লজ্জা করতো না শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে, আর ভুল হতো না দু’ বেলা সিঁদুর লাগাতে, আর বেমানান লাগতো না শাঁখা-পলার সাদা, লালের সাথে যে কোনো রঙের শাড়ি। সাজসজ্জার ধারা- ধারণায় আমূল পরিবর্তন, মনের খচখচানি শীতঘুমে অচৈতন্য।
    মেঘে মেঘে বেশ বেলা- তপতীও এখন এক কন্যা সন্তানের মা। মেয়ে তিয়াস বড়ো হয়েছে- স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি পড়ুয়া। ছোটো থেকেই শান্ত, ধীর মেয়ে কিন্তু স্বাধীনচেতা। নিজস্ব মতামত, আর মতামতের পক্ষে যুক্তি নিয়ে আলোচনা করে তপতীর সাথে। তপতীর নিজের না বলতে পারা কথাগুলো ভাষা পায়, ভাবনাগুলো আকার পায়, প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে নেয় চুপিচুপি। খুব ভালো লাগে তপতীর, বাধা দেয় না- নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা কিন্তু ভেতর ভেতর সমাজের অনেক রীতি নীতি নিয়ে বেশ প্রতিবাদী। ব্রাম্ভ্রণ্য প্রথা, সমাজের শ্রেণীভেদ, জাতিভেদ, ধর্মীয় ধ্বজা, দেশীয় লোকাচার সব কিছুতেই যুক্তি খোঁজে- পায় না। খুঁজতে থাকে শিকড়- শিকড়ে গিয়ে দেখে হাজার গড়মিল আর সুবিধাবাদ। প্রতিবাদের মেঘ ঘোর হয়ে আসে মনে, নবীন ভাবনায়। কিন্তু সবকিছু যে প্রতিবাদে মেটে না- তাই তো আরো অশান্ত হয় মন।
    শরতের মেঘের মতো রোদ-বৃষ্টিতে পুড়তে থাকে, ভিজতে থাকে। অসহায় তপতী- বুঝতে পারে না, কি করবে! তার সম্পূর্ণ সমর্থন থাকলেও সাহায্য করার ক্ষমতা তো নেই!
    একদিন তপতী স্নান সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্যাসবশত সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়াতে যাবে তিয়াস এসে ঢোকে ঘরে।
    মা’র দিকে তাকিয়ে আজ আর চুপ করে থাকতে পারে না- সিঁদুর কেন পড়ো মা রোজ? জানো না এর ইতিহাস, আর উদ্দেশ্য! তোমার ডায়েরিতে কত কিছু লিখেছো, কতো প্রশ্ন রেখেছো, উত্তর খুঁজতে চেয়েছো। তুমি তো নিজেও জানো মা, তা’ও কেন মেনে নাও এই পরাধীনতার নির্লজ্জতা, ঘৃণ্য প্রতীক। প্রয়োজন তো নেই কোনো। তুমি সিঁদুর, শাঁখা পরার সাথে সংসারের কল্যাণ- অকল্যাণ, বাবার ভালো থাকা নির্ভর করে না, তা’ও কেন রোজ এইসব নিজের ওপর চাপিয়ে নাও। নিজের সম্মান নিজে রক্ষা করতে না পারলে- তুমিও তো গতানুগতিক এক ধারায় চলবে, একই ভাবে চলতে থাকবে প্রত্যেকটা প্রজন্ম- কেন মা, কেন?
    তপতী হেসে বলে- অভ্যাস হয়ে গেছে রে সোনাই। “সোনাই” তপতী এই নামে ডাকে,তিয়াসকে।
    -কিসের অভ্যাস মা?
    -মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস, মেনে নেওয়ার অভ্যাস।
    -যে অভ্যাস তোমাকে রোজ প্রশ্নের মুখে নিয়ে আসতো, সেই অভ্যাস আরো কতদিন মা?
    -এতোদিনের অভ্যাস কি পিছু ছাড়ে সোনাই এতো সহজে?
    -কিছু বলার নেই… কি করে যে সব জেনেও এইভাবে নিজেকে ছোটো করতে পারো কে জানে!
    -এখন এই বোধ আর কাজ করে না রে, একটা অভ্যাস শুধু। ছাড় এইসব, অন্য কিছু বল… কি করবি আজ? কখন বেরোবি?
    -সবসময় কথা ঘোরানোর চেষ্টা… একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে তিয়াস ঘর ছাড়ে। তপতী আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে, হাসে… অতীত অন্য কিছু দাবি রাখলো, ভবিষ্যত অন্য কিছু দাবি করছে। বর্তমান! বুঝতে পারে না…সংসারের অন্য কাজে মন দেয়।
    তবে একটা শৃঙ্খল থেকে মনকে আংশিক মুক্ত করতে অজুহাত সাজিয়েছে। শাঁখার ভীষণ দাম, কাজের হাত, যখন তখন বেড়ে (ভেঙে গেছে বলা না কি বারণ- বলতে নেই) যায়। ওটা তোলা সাজ করে রেখেছে, ইচ্ছে মতো, দরকার মতো গলিয়ে নেয়।
    দামের কথায় সব মানিয়ে যায় সংসারে, সে যদি হয় ঘরের বৌয়ের প্রয়োজনের তালিকা তো দ্বিতীয় বার আর কেউ ভাবে না। সেই সুযোগটাই নিয়েছে তপতী। অবশ্য ওর স্বামীর এইসব ব্যাপারে কোনো মতামত নেই, বক্তব্য নেই- নির্লিপ্ত মানুষ। যদিও তাতেও অসুবিধা হাজার- যত ঝামেলা তপতীকেই সামলাতে হয়। তিনি শুনবেন না, বুঝবেন না কিন্তু “মানিয়ে নিতে” বলতে ছাড়বেন না- ওতেই না কি সব সমস্যার সমাধান। হায় রে কপাল!
    দিন যেমন চলে- চলছিল। কখনো এর মন রেখে, কখনো ওর মন রেখে। নিজের মন? সে তো ঘুমিয়েছে না হারিয়েছে- সময় কোথায় ভাবার? কালের চাকায় সময় ঘুরে যায়, ঘুরতে থাকে।
    কালের নিয়ম মেনে হঠাৎ করেই তপতীর বাবা একদিন চলে গেলেন এপারের মায়া কাটিয়ে। মা’কে দেখলো তপতী শেষবারের মতো- মায়ের প্রিয় সাজে। দু’বেলা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে কাচা কাপড়, সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে ছোট্ট সিঁদুর টিপ। নিত্যদিনের সাজ হোক বা পুজো থেকে বিয়ে বাড়ি, যে কোনো অনুষ্ঠানে মা-র ওই এক সাজ- অন্য কোনো সাজে কোনোদিন দেখেনি মা’কে। ওটাই যেন মা’র প্রতীক।
    বদলে গেল এতোদিনের সাজ এক নিমিষে। চিরদিনের চুপচাপ, কম কথা বলা মানুষটা শোকটাও কেমন নিঃশব্দে পালন করলো। কপালে টিপ নেই- মায়ের এমন মুখ খুব কষ্ট দিচ্ছিল তপতীর মনে।
    মুখাগ্নি, অশৌচ, শ্রাদ্ধ সব মিটলো একে একে। এ কয়দিন তপতীও সিঁদুর পরেনি- পরতে নেই না কি…এমন কথাই সবাই বলেছে- তাই পালন করেছে। নিয়মভঙ্গের দিন ব্রাম্ভ্রণের পায়ে তেল-হলুদ দিয়ে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে চিরুনি নিয়ে শুনলো কাকিমা বলছে মা’কে- এবার কদিন চলুন আমাদের কাছে থেকে আসবেন। কোনোদিন তো কোথাও গেলেন না দাদার কষ্ট হবে বলে। এবার একটু ঘুরে আসবেন চলুন। ভালো লাগবে, একটু পরিবর্তন হবে।
    মা বললো- আমাকে আর বেরোতে বলিস না রে, এইভাবে কারোর সামনে যেতে পারবো না। আসল সাজটাই লোকটা সাথে নিয়ে চলে গেল- খালি কপাল, খালি সিঁথি নিয়ে কোথায় যাব বল? আমি এখানেই থাকবো… বাকি কটা দিন, যে কদিন বাঁচি, বাইরে বেরোবো না।
    অশৌচের পারলৌকিক আচার-বিচারে বেশ কদিন সিঁদুর না পরায় তপতীর সিঁথিও ফাঁকা। হাতে চিরুনি নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাবতে লাগলো- সাজ না পরাধীনতা, তর্ক না বিশ্বাস, ভালোলাগা না মানিয়ে নেওয়া… কোনটা আসল পথ?
    মায়ের কাছে যে সাজটা পরম সম্পদ, তা নিয়ে কি তর্ক চলে! মানবিকতা তো এইসময় সেই সায় দেয় না। কিন্তু তিয়াস! ওর যুক্তি তো ফেলে দেবার নয়- ও তো আত্মসম্মানের কথা বলে…
    হাজার প্রশ্ন আর দ্বিধা নিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে সরে এলো আয়নার সামনে থেকে।
    পরাধীনতা না কি এয়োস্ত্রীর সাজ একরাশ দ্বিধা নিয়ে সংসারের কাজে, কর্তব্য সারতে সমাজের ভিড়ে মিশে গেল সাজানো হাসি মুখে নিয়ে দ্বিধা সীমন্তিনী।

    পেরিয়ে গেল বছর দুই, আড়াই- মা চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত মা সত্যিই বাড়ির বাইরে পা রাখেন নি। শান্ত মানুষের জেদ বোধ হয় এমন নীরব আর কঠিন হয়। তপতী আবার একবার প্রিয়জন হারালো, সংসার ছোট হয়ে আসছে যেন দিনে দিনে। মনের গভীরে ডুব দিয়ে দিন কাটে- শত কাজের মধ্যেও মনে হয় মা’র সাথে কথা হলো না আজ,এমনই হয় মনে হয় সবার মা,বাবা-র ছায়া জীবন থেকে সরে গেলে।

    চলছিল জীবন বাঁধা গতে- হঠাৎ করেই ছন্দপতন। অফিস থেকে ফেরার পথে কথা বলেও বাড়ি এলো না। দমকা ঝড়ে নিভে গেল প্রাণপ্রদীপ- তপতী সেদিন হারিয়ে গেছিল নিজের পূর্বজীবনে যেখান থেকে একসাথে পথচলা শুরু সেইদিনে। বিশ্বাস তো দূর কথা ভাবতেও পারছিল না মানুষটা নেই। শুধু পাথরের মতো দাহকার্য, অশৌচ বিধি পালন করে গেল। অশৌচবিধি শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি দিয়ে অভ্যাসমতো সিঁথির দিকে তাকিয়ে সিঁদুরে হাত দিতে গিয়ে থমকে গেল। আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে অচেনা লাগছিল। নিজের মুখ নিজেই সহ্য করতে পারছিল না। আয়নার সঙ্গে খুব একটা সদ্ভাব কোনোদিনই তপতীর নেই। তবে যেতে আসতে চোখ পড়ে গেলে মনে হতো নেই, আর কোনো সাজ নেই। জীবনটা বদলে গেল। ডায়েরি হাতে নিল এক বছর পর। পুরোনো লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে উজাড় করে প্রশ্নের ভিড়… না কোনো তর্ক নেই, শুধু একটাই প্রশ্ন এইভাবে কি সত্যিই হারিয়ে যায় অভ্যাস! বদলে যায় বিশ্বাস? সব দ্বিধা কি এমনভাবেই কাঁদতে বাধ্য করে? জানা নেই- তপতীর কাছে অনেক প্রশ্ন, উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।

  • গল্প

    গল্প- অ্যাই পালা, ভগবান আসছে

    অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
    সুনির্মল বসু

    লোকটাকে সব বাচ্চারাই ভারী ভয় পেত। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা একটা বাঙালি শার্ট। পরনে ধুতি। বাঁ হাতে একটা ছোট বাক্স। ডান হাতে সর্বক্ষণ একটা ধূমায়মান সিগারেট। অদ্ভুত তাঁর সিগারেট টানার ভঙ্গি। ছোটখাটো চেহারা। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। একটু মোটা গোঁফ। মাথার চুল কাঁচা পাকা হলেও, গোঁফটা একেবারে কুচকুচে কালো।

    পথের মোড়ে তাঁকে দেখা গেলেই, সবাই বলতো, অ্যাই পালা, ভগবান আসছে।

    সে আসলে পেশায় নাপিত নাম- নরসুন্দর ভগবান দাস। পাড়ার লক্করবাজ চ্যাংড়ারা বলতো, ভগবান দাসের ইটালিয়ান সেলুন। ইটের উপর বাচ্চাদের বসিয়ে ভগবান চুল ছেঁটে দিত। মাথার সামনের দিকে ফুলের মতো
    সামান্য বড় চুল রেখে, বাকি পেছনের অংশে সবটাই সে জল দিয়ে হাতের যন্ত্রপাতির সাহায্যে সবটাই চেঁছে দিত।

    ভগবানের বাড়ি বালিয়াতে। ওখানে ওর বউ দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকে। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ের নাম দুলারী। হবু জামাইয়ের খেতির কারবার আছে। বড় ছেলে জীবনলাল হাটে সবজি বিক্রি করে। ছোট ছেলে পবনলাল সিক্স ক্লাসে পড়ে। সপ্তাহে সপ্তাহে ভগবান পরিবারের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠায়। সে বছরে দুবার বাড়িতে যায়। তখন সবার জন্য কলকাতা থেকে নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে যায়। দিন পনেরো থেকে আবার এখানে কাজের জায়গায় ফিরে আসে।

    যখন ছোট ছিলাম, ভগবান নির্বিচারে আমার চুল কেটে দিত। খুব মন খারাপ হতো আমার। চুল বড় থাকলে, মা বলতেন, তুই বড় চুল রাখছিস, দাঁড়া,তোর বাবাকে বলবো? বড় হবার পর,আমার নিজের বড় চুল রাখবার পেছনে আসল প্রতিবাদ ছিল সেখানেই। কিন্তু সেই ছোট্টবেলায় লোকটাকে খুব সমীহ করতাম।

    দুষ্টুমি করলে, মায়েরা বলতেন, ভগবানকে ডাকবো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বেশি বেশি ভাত খেতে হতো।মা হেসে বলতেন, এইতো সবটা খেলি। কার পেট ভরলো, আমার না তোর?

    তখন একটু বড় হচ্ছি। ক্লাস এইটে পড়ি। ইটের উপর বসে আছি। পাশে বাবা দাঁড়িয়ে ভগবানকে বলছেন, কেটে ছোট করে দাও। কানের উপর চুল, সখি সখি ভাব, আমার মোটেই পছন্দ নয়। ভগবান মনে মনে খুশি হচ্ছে। চুল ছোট করায় তাঁর বড় আনন্দ। একটু বড় হতেই, চুল কাটতে কাটতে ভগবান আমাদের অনেক নীতি শিক্ষা দিত।একদিন আমাকে বলল, বাবু, জীবনে ঘোড়ার মতো হবে, কখনো গাধা হবে না।
    -কেন?
    -সোসাইটিতে গাধার কোন মান সম্মান নেই। হ্যাঁ, যদি ঘোড়া হতে পারো, তাহলে লোকের কাজ থেকে রেসপেক্ট পাবে।

    বাংলায় কথা বলবার সময়, ভগবানের ডায়লগে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ বেরিয়ে আসতো। তার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। বাটা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মিঃ বারতোস থেকে শুরু করে মিঃ ওয়াটসন, মিস্টার চিচেক ভ্যালেন্টা, মিঃ ভেরোল, মিঃ লেডেন, মিঃ জন বেক, মিঃ ভবতোষ সেন চৌধুরী, মিঃ ভি, লিপনার, সবাই চুল, দাড়ি কাটবার জন্য ভগবানের শরণাপন্ন হতেন। ভগবান তখন সাহেবদের বাড়ি উপস্থিত হয়ে তাঁদের চুল দাড়ি কামাতেন। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ ভগবানের মুখে উচ্চারিত হতো। মুড ভালো থাকলে, ভগবান তাঁর ছেলেদের গল্প শোনাতো। বড় ছেলে বেশি লিখাপড়া করেনি। ছোট ছেলেকে শেষ পর্যন্ত লিখাপড়া করাবার ইচ্ছে ভগবানের।

    দিন বদলে গেল। সত্তর দশক এলো। যাদের এক সময় চুল কেটেছে ভগবান, তারা বড় হয়ে গেল।
    কলেজে পড়তে গেল। কেউ কেউ মস্তান হিসেবে পরিচিত হলো।

    হেবো মাস্তানি করে পয়সা করলো। তাঁর কোমরে দেশি পিস্তল সব সময় গোঁজা থাকে। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে রিভলবার নাচায়। সে এখন এই অঞ্চলের ত্রাস। একলা পুলিশ তাঁর মুখোমুখি হতে চায় না। ওসি সুবর্ণ সরকার একদিন জীপ থেকে নেমে বলেছিলেন- বড্ড তেল বেড়েছে দেখছি তোর। খুব জলদি তোকে তুলে নেব।

    হেবো রিভলবার নাচিয়ে বলেছে- আগের ওসিও ওই এক ডায়লগ দিয়েছিল। আমার সামনে কোনদিন খাপ খুলতে পারে নি।

    একদিন হেবোর সঙ্গে মুখোমুখি ভগবানের দেখা।ভগবানের ঘাড়ে হাত রেখে হেবো বললো- কেমন আছো গুরু?
    ভগবান ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললও-তোর বাপ আমাকে দাদা বলে ডাকে, ছোটবেলায় আমাকে দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলতিস, এখন আমাকে গুরু বলছিস? আচ্ছা, কলিকাল!

    দেশে অস্থিরতা শুরু হল। কোম্পানি ছোট হয়ে আসছে। কর্মীদের ছাটাই করে দেওয়া হচ্ছে। চুল দাড়ি কেটে নিজে খেয়ে বাড়িতে আর টাকা পাঠানো যায় না। খুব বিপদে পড়ে গেল ভগবান।

    তারপর একদিন আমাদের মফস্বল শহর ছেড়ে নিজের দেশের বাড়িতে চলে গেল। আমরা কেউ ভগবানকে মনে রাখি নি। প্রথম প্রথম কয়েকদিন চায়ের ঠেকে ভগবানকে নিয়ে আলোচনা হতো। তারপর স্মৃতির পাতা থেকে ছোটবেলার সেই ভয় পাওয়া মানুষটাকে আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম।

    বেশ কয়েক বছর পর আমি তখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বালিয়াতে ব্রিজ বানাবার কাজে গিয়েছি। অনেকদিন ধরে কনস্ট্রাকশন এর কাজ চলছিল। একদিন হঠাৎ দেখি, ভগবান রাস্তা ধরে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। ওর পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। পায়ে ছেঁড়া চটি। পরনে ময়লা পোশাক। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

    ভগবান আমাকে চিনতে পারেনি। আমি চিনতে পেরেছিলাম। সামনে গিয়ে বললাম- ভগবানদা, কেমন আছো তুমি?
    -ভালো নেই। বউ মারা গেল। ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে হাওয়া।
    -আমাকে চিনতে পারছো?
    -হা হা। তুমি ফোরম্যান দত্ত বাবুর ছেলে।
    – তোমার সংসার কিভাবে চলে?
    -হাত কাজ নাই। কাজ করবার সামর্থ্য নাই। বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি। ভগবানের কন্ঠে অসহায়তার সুর। আমার মনে পড়লো, সেই ছোট্টবেলায় আমরা সবাই এই মানুষটাকে দেখলে, ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে যেতাম।

    -তোমাকে কেউ দেখে না?
    -মেয়ে দ্যাখে।
    ছেলেরা?
    -আরে না না। আমি ছেলেদের পড়ালিখার জন্য পয়সা খরচা করেছিলাম। মেয়ের জন্য কিছু করিনি। আমি চারটে পাঁচশো টাকার নোট ভগবানের হাতে গুঁজে দিলাম।

    ভগবান বললো- আমার কথা মনে আছে তাহলে! তুমি ঘোড়া হয়েছো, ভাগ্যিস গাধা হওনি! তারপর খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির দিকে গলির প্রান্তে মিলিয়ে গেল। সেই শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ আজ আমার সঙ্গে কেমন আশ্চর্যভাবে আমাকে দেখা দিয়ে গেলেন। সেদিনের ভগবানের আশ্চর্য দাপটের সঙ্গে আজকের মন ভেঙ্গে যাওয়া মানুষটার কিছু মাত্র মিল, আমি দেখতে পেলাম না।

    মহুয়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি জীবনের প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হলাম। সময়, কাকে যে কিভাবে জীবন যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না।

    ভগবান গলির মোড়ে মিলিয়ে যেতেই, আমি কেমন ঘোরের মধ্যে নিজের মনে বলে ফেললাম, ভালো থেকো, তুমি ভালো থেকো, ভগবানদা।তারপর মনে মনে আবার বললাম, তোমাকে ভালো থাকতেই হবে, তা না হলে, তোমরা চলে গেলে, আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সেই সঙ্গে চলে যাবে যে!

  • গল্প

    গল্প- একা’দশী তিথি

    একা’দশী তিথি
    -সুবিনয় হালদার

     

     

    চতুর্থ প্রহর শেষে ঊষালগ্নে উদ্ভাসিত হতে থাকে পৃথিবী।
    নিশি সমাপন মুহূর্ত জানান দেয় পাখিদের সমবেত কিচিরমিচির ডাক আর আজানের আওয়াজ।
    মা’ ষষ্ঠীর শঙ্খধ্বনিতে সকাল-সকাল তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে নেয় একা’দশী, আজ তার আর্য্য-ভূমিতে সংস্কৃতি যজ্ঞের পৌরোহিত্য করতে হবে।
    সেখানে তার পরিচিত বহু মানুষজন আসবে, নমোনমো দুগ্গাদুগ্গা করে আত্মপ্রত্যয়ে বেড়িয়ে পরে একা’দশী।

    সেখানেই সেদিন প্রথম দেখা- তিথি ; পঞ্চমীদির সাথে ছোটবোন দ্বিতির হাত ধরে এসেছিল ওখানে।
    দিদি’ই তাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়-, বাক্য বিনিময় হয় সামান্য কিছু- ব্যাস এইটুকু।
    তারপর ধীরেধীরে দামোদরে জোয়ার আসে! কোটালে ভেসে যায় সবকিছু কিন্তু তিথি সেটা বোঝেনি কখনোই!
    তবুও আসে, জানান দেয় সে আছে !
    তিথির মেজ বোন অষ্টমী খুব সুন্দরী। মনে সংগোপনে লালিতপালিত কামিনীকাঞ্চন শোভিত যা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষীত !
    আসাযাওয়া গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে। দিন যায়- বছর ঘুরে বছর আসে আর যায়- ; উত্তর থেকে দক্ষিণায়ন অতিবাহিত হয় কত কিন্তু উত্তর মেলেনি আজো !

    বসন্তের পরন্ত বৈকালে ঝরাপাতায় ফাগুন হাওয়ায় মর্মরধ্বনির সাথে কোকিলের ডাক শুনে নেচেছিল মন !
    চেতনা পুরে প্রেরণা’ এসে জাগিয়েছিল সাদা খামে হলুদ ছোঁয়ার অনুভূতি !
    তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিলো- এক মায়াবী আলোর উৎস সন্ধানে ;
    তার’ই জন্যে সে অপেক্ষা করছিলো- অনেকটা সময় ধরে, রাস্তার পাশে গাছের তলায় এক যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে।
    পথচলতি কত মানুষ- কত ব্যস্ততা- বাস গাড়ির হর্ণ এর বিকট আওয়াজ- দুষিত আবহাওয়া- সব কিছু উপেক্ষা করে !
    সমস্ত বাধা অতিক্রম করে হন্তদন্ত হয়ে ঘামে-নেয়ে একসা শরীরে একা’দশী তিথির সামনে দাঁড়ালো- ;
    অন্যমনস্ক তিথি যেন রূপকথার দেশে মায়াবী পরী,
    কী বলবে- ও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলো-না !

    সুন্দর পরিপাট্য বেশভূষায় বেশ লাগছে ।
    একা’দশীকে এইভাবে বোকা স্ট্যাচুর মতো হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো- চলো- অনেক দেরি হয়ে গেছে ! বলে সটান রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে থাকলো !
    একা’দশী তখন ওর কাছে গিয়ে আলতো স্বরে বললো- তোমাকে-না আজ খুব সুন্দর লাগছে ।
    ধ্যাৎ,মোটেই না- ; কী-যে বলো-না- আজকাল ; বলে- শরৎ মেঘের ওড়না উড়িয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে চললো-,
    অগত্যা সে-ও ওর পিছু-পিছু হাঁটতে থাকলো !

    মোড়ের বাম দিক ঘুরে একটু এগিয়ে একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করলো । ও কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে বললো- ওঠো ;
    একা’দশী আগে উঠে বসার পর সে তার একেবারে পাশে- গায়ে গা-ঠেকিয়ে গেটের দিকে বসলো ।

    অটোরিকশা চলতে থাকলো একা’দশীর নাজানা গন্তব্যে !
    হাওয়ায় তিথির চুল গুলো ঠোঁট স্পর্শ করে উড়ে এসে পরছে একা’দশীর মুখে আর তিথির মেয়েলি গন্ধে তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে এক পারিজাতের নরম স্নিগ্ধতা ভরিয়ে দিচ্ছে !
    তার শাড়ির আঁচলটা বারবার উড়ে এসে ওর মুখমণ্ডলটা ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে কেউ যেন একটা কাশফুল দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে !

    তিথির ঘোরে আচ্ছন্ন একা’দশী শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকে ! হাল্কা লাজুক হাসি আর চোখেমুখে উজ্জ্বল আভার উপস্থিতি ভরে উঠেছে তিথি ।
    কোন কথা বলছেনা দেখে সে জিগ্যেস করতে যাবে- ঠিক সেই সময় তিথি বলে উঠলো- এই দাঁড়াও- দাঁড়াও এখানে ।

    নেমে পড়লো দুজনে । ভাড়াটা বের করার আগেই তিথি চালকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে একা’দশীর দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় বললো- চলো- সামনের ওইখানে আমরা যাবো !

    দেখলো দূরে একটা বড় বিল্ডিং আর তার গেটের বাইরে ইংরেজিতে লেখা- The Asylum .

  • গল্প

    গল্প- আনন্দ পার্বণ

    আনন্দ পার্বণ

    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারলাম, সদা পরিবর্তনশীল এই সময়ে , প্রবচনটিকে বোধহয় একটুখানি শুধরে নেওয়াই যায়।আজ বোধহয় বাঙালি নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, উঁহু ,আর তেরো নয় , গোটাগুটি চোদ্দোটি পার্বণের গৌরবময় উপস্থিতি বাঙালির পার্বণ লিষ্টিতে। সেই সানন্দ সংযোজনটি হলো বই -পার্বণ, পৌষ পার্বণের পিছু পিছুই যার সগৌরব উপস্থিতি। আপামর বঙ্গসন্তানদের সে বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন।
    পিকনিক, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ইত্যাদি শীতের সাতকাহনের মাঝেই হৈ হৈ করে বইমেলার রব উঠে পড়ে।
    লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী,প্রুফ রিডার, ছাপাখানা মায় বাঁধাই কর্মী, ভ্যান গাড়ি কারুরই আর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। ওদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হেথা হোথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাঁশ, কাঠের তক্তা, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে থাকে ছোট বড়ো নানা আকারের স্টলে। কথ্যভাষায় স্টল বটে, আদতে সেগুলি বুঝি সুন্দর লাল নীল কাপড়ে মোড়া, অজস্র মণিমুক্তো ঠাসা মণিমঞ্জুষা। দেশী বিদেশী বিদগ্ধ পন্ডিতজনের মণীষায় উজ্জ্বল, নানা আকারের পুঁথিপত্তরের পাশাপাশি নব নবীন সমস্ত লেখকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাস্বর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গৌরব এই বইমেলা। সমগ্র বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন মহাসমারোহে বই উৎসব পালিত হতে দেখা যায়।
    ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু ওলটালেই দেখা যায় বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্র্যাংকফার্টে।আজও সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা বলে পরিগণিত ।আন্তর্জাতিক স্তরেও আকারে এবং চরিত্রে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখে সেটি। সেই তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে, বাঙালি যা পেয়েছে তাতেও সে অখুশি নয় মোটেই। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাঠকের উপচে পড়া ভীড় তার সাক্ষ্য দেয়। ওই ক’টা দিনে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জীবনের যতো অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা ,বুঝি ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। সম্বৎসর মনের মাঝে জমানো যতো বইয়ের নাম ছিলো, সেগুলিকে ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, সে পকেটে রেস্তর জোর থাকুক চাই নাই বা থাকুক। পুস্তকপ্রেমী এই সুযোগ কি ছাড়তে পারে! এবারে হয়তো কেনা হলো না, সামনের বার নিশ্চয়ই হবে, এই আশাই, আগামী দিনে পথ চলার পাথেয়। আসলে আমরা যখন বই সংগ্রহ করি তখন তো শুধু বই নয়, আমরা আনন্দও সংগ্রহ করি।
    বিগত বেশ কয়েকটি বছর বইমেলা যাওয়া, হয়ে ওঠে নি, এই বছর আকস্মিকভাবে সেই সুযোগটি এসে গেল। ভিড়ের মাঝে নয়, কিঞ্চিৎ ফাঁকায় দুপুর দুপুর সেরে ফেলার সংকল্পে বেলাবেলি পৌঁছনো গেল। তখনই শুরু হয়ে গেছে নামকরা প্রকাশনার স্টলগুলোতে, আবালবৃদ্ধবনিতার লম্বা লাইন। কেনার পাশাপাশি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহও কিছু কম নয়। শিশুদের ঝলমলে মুখ, তরুণ প্রজন্মের সদ্য প্রকাশিত বইসমূহ উল্টেপাল্টে দেখার পাশাপাশি, প্রাজ্ঞ ও বয়স্কজনের তালিকায় থাকা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমন্বিত গুরুগম্ভীর পুস্তক সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে মনে হয়, বাঙালির যে দিন গেছে, তার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি, কিছু তো আছেই,যার খবর আমরা রাখি না।
    মনে রাখতে হবে এই মেলা কেবলমাত্র লেখকের নয়, বছরের পর বছর ধরে সে নবীন পাঠকও নির্মাণ করে এসেছে, আজও করে। বাবা, মা, অভিভাবকদের হাত ধরে আসা শিশু কিশোরের দল, উত্তেজনায় ভরপুর তাদের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি, সেই সাক্ষ্য দেয়।
    পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বভারতীর ফাঁকা স্টল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিলো। । এই বছরে সেখানে উপচে পড়া ভীড়, চিত্তে শান্তির প্রলেপ দিলো। স্টলের নিভৃত কোণটিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এরা শুধুই ঘর সাজানোর সামগ্রী সংগ্রাহকদের দলভুক্ত, না-কি হুজুগে মাতামাতি করা,”পাবলিক”!
    অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, অথবা যৌবনের প্রান্তসীমায় দন্ডায়মান, কিছু এলোমেলো পোশাকের যুবকের , হাতের লিস্টি মিলিয়ে বই সংগ্রহের ছবি ,আমায় আশ্বস্ত করলো, বুঝিয়ে দিলো আমার সে আশঙ্কা মিথ্যে করে এঁরা প্রকৃতই পাঠক শ্রেণীভুক্ত।
    হেরে যাওয়াও যে কখনো সখনো এতো আনন্দদায়ক হতে পারে, তা কে কবে ভেবেছে!
    এই যে নানা আলোচনায় শুনি বাঙালি আজকাল আর বই পড়ে না, সেকথা সর্বৈব সত্যি নয় তাহলে ! বাঙালির সব কিছুই হারিয়ে যায়নি একেবারে।
    আমার নিজস্ব সংগ্রহের তালিকায় থাকা , এবং ভালোবাসার জনদের উপহার দেবার জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়ি।
    সূর্য আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে। ভিড় বাড়ছে। ঠেলাঠেলি এই বয়সে আর পোষায় না।
    দুপাশে স্টলের সারি, মধ্যিখানে সোজা রাস্তা। খানিকটা এগোতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়তেই, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধুলোমাখামাখি রাস্তার ঠিক মাঝ মধ্যিখানে বসা বছর ছয়েকের একটি শিশু , অভিভাবকদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সদ্য সংগৃহীত ছড়ার বইখানি পথের মাঝে খুলে রেখে , তার উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। আশেপাশের ভীড়ের দিকে তার হুঁশ নেই।
    স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রই।
    অবধারিত রবীন্দ্রনাথের পংক্তিতে ছেয়ে যায় মন। —
    “শুধায়ো না কবে কোন গান,
    কাহারে করিয়াছিনু দান—
    পথের ধুলার পরে
    পড়ে আছে তারই তরে
    যে তাহারে দিতে পারে মান।
    তুমি কি শুনেছো মোর বাণী
    হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি ?
    জানি না তোমার নাম,
    তোমারেই সঁপিলাম
    আমার ধ্যানের ধনখানি। “

You cannot copy content of this page