গল্প
-
গল্প- জেন জি
জেন জি
–লোপামুদ্রা ব্যানার্জি
ও বাবা এতদিন বাদে বুঝি বুড়ি জেঠিমাকে মনে পড়ল! গত বছরের চরকের মেলায় এসেছিলি মেয়েকে নিয়ে। তারপর একটা বছর পর মনে পড়ল?
কৃষ্ণা কোলাপুরি চপ্পলগুলো দরজার বাইরে খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকেই ওর জেঠিমার পদ স্পর্শ করল। তারপর পায়ের ধুলোটা যত্ন ভরে মাথায় বুলিয়ে নিয়ে বলল, ও জেঠিমা তোমার কাছে আসতে তো মাঝে মধ্যেই বড্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু সংসারের কাজের চাপে হয়ে ওঠে না।
কৃষ্ণার জেঠিমা মালতি দেবী ইতিমধ্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন লেবুর শরবত করার জন্য। কাঁচের একটা সুদৃশ্য গ্লাসে আধ গ্লাস নরমাল জল আর আধ গ্লাস চিলড ওয়াটার দিয়ে নুন চিনিটা ভালো করে গুলে একটা মাঝারি মাপের পাতি লেবুর অর্ধেক কেটে বীজ গুলো ছুরির ডাগা দিয়ে ফেলে গ্লাসের জলে রসটা চিপতে চিপতে বলল, হ্যাঁ রে কৃষ্ণা তোদের তো মাত্র তিনটে লোকের সংসার। তাতেই দম ফেলার সময় পাস না তোরা। আর আমাদের ছিল ত্রিশটা লোকের সংসার। তার মধ্যেই সংসার সামলেও স্কুলের চাকরিটাও বজায় রাখতে হয়েছে হাসি মুখে।
কৃষ্ণা সোফায় বসে শরবতের গ্লাসে কিছুটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বলে,
হ্যাঁ গো জেঠিমা তোমরা কি করে পারতে?
মালতি দেবী কিচেনের দরজাটা বন্ধ করে এসে কৃষ্ণার পাশে বসল। তারপর কৃষ্ণার থুতনিতে হাত বাড়িয়ে চুমু খেয়ে বলল, দেখ কৃষ্ণা আমাদের কাল আর তোদের কালের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা ছেলে মানুষ করেছি অতি সাধারণ ভাবে। মোটা ভাত মোটা কাপড় আর বই খাতার জোগানটা দিতে পারলেই মোটামুটি কর্তব্য পালন করা হয়ে যেত। ছেলে মেয়েদেরও তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। তারই মধ্যে কেউ একটু বায়না করলেই বাবা জেঠু দাদুর ভয় দেখালেই সবাই চুপ হয়ে যেত।
তা যা বলেছো জেঠিমা। আর এখন তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলে মেয়েদের বায়না তে বাড়ির গার্জেন রা ভয়ে ভীত। এই তো আগের বছর জন্মদিনে আমার মেয়ের সে কি বায়না! তার সব বন্ধুদের কাছে দামী দামী মোবাইল আছে। তাকেও দিতে হবে। বোতাম টেপা মোবাইল নিয়ে আর টিউশন কলেজে যাওয়া যাচ্ছে না।
মালতি দেবী চোখ গুলো কপালে সামান্য তুলে বলে, বলিস কি রে? তারপর কি করলি তুই?
কি আর করব! অগত্যা বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্মার্ট ফোন দিতেই হলো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না!
তারপর শোনো এখন আবার কেবল কানেকশন থাকলেই হবে না। নেট ফ্লিক্স, অ্যামাজন আরো কত সব এ্যাপ বেরিয়েছে। সেইসব সাবসক্রিপশন না হলে চলবে না।
বলিস কি রে? এতসব নিয়ে মেতে থাকলে লেখাপড়া করে কখন?
আর লেখাপড়া। ও তো চোখে দেখতে পাওয়া যায় না।
সে কি রে! তাহলে রেজাল্ট কেমন করছে?
ওখানেই তো আশ্চর্য হয়ে যাই। রেজাল্ট তো যথেষ্ট ভালো করে। আসলে ওর যত লেখাপড়া শুরু হয় আমরা রাতে শুয়ে পড়লে। সারারাত পড়াশোনা। ভোর বেলায় শুতে যাওয়া।ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু বলতে গেলেই বলে, ডোন্ট ওরি ম্মামা। কিছু একটা তো করেই নেবো।
হ্যাঁ রে কৃষ্ণা এরা কোন প্রজন্ম? এরা তো স্বাভাবিকতা থেকে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
তবে শোন তোকে বলি এই গত সপ্তাহের ঘটনা। আমি পেনশন তুলে ফিরছি। বিরাটী স্টেশনে নেমে অটো ধরবো বলে রেল লাইনটা পার হচ্ছি। আমার পাশে পাশে দুটি অল্প বয়সী মেয়েও হাঁটছিল। ওদের মধ্যেই একটি মেয়ে কোল্ড-ড্রিঙ্কস খেয়ে বোতলটা রেল লাইনেই ছুঁড়ে ফেলল। আর একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, অ্যাই অসভ্য রেল লাইনের ওপর কেউ বোতল ছোঁড়ে? তোর কি কোনো বোধ বুদ্ধি নেই?
তখন যে মেয়েটি বোতল টা ফেলেছিল সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় হাসতে হাসতে, না আমার বোধ বুদ্ধি নেই।কারন আমি পশ্চিমবঙ্গ বাসী।
কৃষ্ণা ওই মেয়েটির প্রত্যুত্তর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই কিছু ক্ষনের জন্য।প্রথমেই ভাবি নিজের রাজ্য সম্বন্ধে কি ধারণা হয়েছে আমাদের ভাবি উত্তরাধিকারীদের। তারপর ভাবি এরা হচ্ছে জেন জি। কত সহজে বাস্তব কে মেনে নিতে শিখছে এরা।
একদম ঠিক বলেছো জেঠিমা। তাই এই প্রজন্মকে নিয়ে গেল গেল রব না তুলে বরং কবি গুরুর কথায় বলতে হয়, ‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।’
সমাপ্ত
-
গল্প- শাল মহুয়ার চিঠি
শাল মহুয়ার চিঠি
সুনির্মল বসুঅমল সকাল দশটায় ডালহৌসিতে অফিস গেছে। বুবন এখন স্কুলে। বাইরে চড়া রোদ্দুর। জানালার ওপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছে বসন্ত বাউরী এসে বসেছে। মহুয়া খাওয়া দাওয়ার পর টেবিলের উপর পড়ে থাকা পুরোনো অ্যালবামের পাতা উল্টাতে শুরু করল।
অমলের সঙ্গে ওর বিয়ের ছবি। সাত বছর হল, ওদের বিয়ে হয়েছে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ।
অমল খুব ভালোবাসে ওকে।অ্যালবামের পাতায় হঠাৎ একটা ছবির দিকে চেয়ে
মহুয়া আনমনা হয়ে পড়ে।মনে পড়ে, অনেক দিনের অনেক কথা। ছবিটা সজীবদার। ওদের পাশের বাড়ির ছেলে। ছেলেবেলার বন্ধু। সেই ছোট্টবেলায় কদবেল মাখা খেতে গিয়ে তুমুল ঝগড়া। কথা বন্ধ।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সজীবদা কলেজে গেল। তখন মহুয়া ক্লাস ইলেভেনে পড়ে।
নিউল্যান্ডে দুর্গাপুজোর মেলা বসেছিল। মায়ের বেনারসী শাড়ি পরে সেদিন ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিল মহুয়া।
সজীব ওর বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বটতলায় আড্ডা দিচ্ছিল। মহুয়াকে দেখে সামনে এগিয়ে এলো।বলল, কবে কোন ছোটবেলায় সামান্য কারণে ঝগড়া হয়েছিল, তাই বলে এতদিনের সম্পর্ক সব ভুলে গেলি?
মহুয়া বলল, আমি তো কতবার কথা বলতে চেয়েছি তোমার সঙ্গে। তুমিই তো মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছো।
তোকে আজ দুর্দান্ত লাগছে রে!
হলুদ পাঞ্জাবিতে তোমাকেও ভালো লাগছে।
আয় না ভাব করে নিই।
সত্যি কথা বলবো?
তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পারার জন্য আমার ভারী কষ্ট হয়,সজীবদা।
ব্যাস, মিটে গেল। আমরা বন্ধু ছিলাম, বন্ধু আছি, বন্ধু থাকবো।
প্রমিস।
হ্যাঁ, প্রমিস।ছুটির দিনে বিলের পাশ দিয়ে সরষে ক্ষেত ছাড়িয়ে কদম গাছের তলা দিয়ে ওরা ছাতিম বনের দিকে এগিয়ে যেত।
মহুয়া ভাবে, ছোটবেলায় ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়া, জোসনা রাতে লুকোচুরি খেলা, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে পড়ে আকাশে স্বাতী নক্ষত্রের পাশে অরুন্ধতীকে খোঁজা, কী সব মায়াময় দিন। কোন কোনদিন দীঘির পাড়ে সুপরি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জলের ঢেউ গোনা, কত কত স্মৃতি।মহুয়া একদিন সজীবের হাত ধরে বলেছিল, আমরা সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে পারিনা?
মৌ, আমি বেকার। পড়াশোনা শেষ হয়নি।
আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। ফাইনাল পরীক্ষাটা হয়ে গেলে, তুমি একটা কাজ খোঁজো।ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাবার পর, চাকরির জন্য দরোজায় দরোজায় গিয়েও, কিছুই কপালে জুটলো না সজীবের।
ততদিনে মহুয়া বিএ সেকেন্ড ইয়ার পড়ছে। হঠাৎ বাড়ি থেকে অমলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করা হলো।
লুকিয়ে দেখা করেছিল মহুয়া সজীবের সঙ্গে। বলেছিল, আমি কি করবো?
সজীব অসহায় ভাবে বলেছিল, আমার পায়ের তলায় কোন জমি নেই, মৌ।
মহুয়া কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল,আমি চলে যাচ্ছি।
আর কোনদিন তোমার কাছে আসবো না।সজীব কিন্তু বিয়ের দিন মহুয়াদের বাড়ি উপস্থিত ছিল। শুধু তাই নয়, ছোটাছুটি, পরিবেশন সবকিছুতেই হাত লাগিয়েছিল।
মহুয়া অ্যালবামে তাকিয়ে দেখলো, সজীবদা নিমন্ত্রিতদের খাবার পরিবেশন করছে।
মহুয়ার মনে পড়ল, অমলের সঙ্গে এম্বাসেডর গাড়ি করে শ্বশুর বাড়ি যাবার সময়, কোথাও সেদিন সজীবদাকে দেখা যায়নি। অথচ, মহুয়ার খুব ইচ্ছে করছিল, একবার মানুষটাকে চোখের দেখা দেখে যাই।বিয়ের পর বাপের বাড়ি প্রথম প্রথম যাওয়া-আসা ভালোই ছিল। বুবনের জন্মের পর থেকে আজকাল আর যাওয়া হয় না। মাস তিনেক আগে যখন বাড়ি গিয়েছিল, তখন ওর ছোড়দা বিকাশ বলেছিল, সজীব এখন একটা মার্কেন্টাইল ফার্মে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। কবিতা লেখে। বিয়ে করে নি। এ কথা জেনে সেদিন ভারী কষ্ট পেয়েছিল মহুয়া।
খুব ইচ্ছে করছিল সজীবদার সঙ্গে একবার কথা বলার। আবার মনের মধ্যে সংশয় জাগছিল, একজন বিবাহিতা নারী হিসেবে এই কাজটা কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে?
অ্যালবামটা মাথার বালিশের পাশে রেখে
ফোনটা তুলে মহুয়া সজীবদাকে রিং করলো,
হ্যালো!
কেমন আছো তুমি?
ভালো।
সত্যি বলছো?
নিজে বুঝতে পারিনা ঠিক।
বিয়ে করোনি কেন?
ইচ্ছে হয়নি।
তাই কি?
হ্যাঁ।
তুমি নাকি কবিতা লেখো?
কে বলেছে?
আমার ছোড়দা।
হু।
আমাকে তোমার কবিতা পড়াবে না?
পাঠিয়ে দেবো।
তুমি আসবে না?
না।
কেন?
আমি একটা ছায়া জীবন নিয়ে বেঁচে আছি। আমার মনের চারদিকে একটা দূর্গ বানানো আছে। সেখানে আমি একলা, অথচ, আমার মন জুড়ে কত বড় একটা আকাশ, কত বড় একটা সমুদ্র, কত আলো,
রাতের আকাশে কত তারা। চাঁদের কত স্নিগ্ধ আলো।
আমাকে ভুলে যেতে পারলে?
একটুও ভুলিনি। তোমার কথা প্রতিদিন আমার প্রতিটি লেখাতে বলি।
তোমার লেখা শেষ কবিতার বইটার নাম কি?
শাল মহুয়ার চিঠি।
মহুয়া বলল, ও। তারপর ফোন কেটে দিল।কিছু না পেয়ে একটা মানুষ এমন গভীরভাবে স্মৃতি আঁকড়ে ভালোবেসে যেতে পারে, একথা ভেবে মহুয়ার চোখে বর্ষা নামলো।
ততক্ষণে অমল বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বলল, চোখে জল কেন?
মহুয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল,মনে হয়, চোখে একটা পোকা পড়েছে। -
গল্প- মহানুভবতা
মহানুভবতা
-শচীদুলাল পালস্টেশন শ্রীরামপুর । প্রায় ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে পড়লো ফিজিক্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মনীষা। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই ট্রেনটি ধরতে না পারলে তার সঠিক সময়ে ফিজিক্স স্যারের কাছে লিলুয়ায় টিউটোরিয়ালে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিলো না। অন্যদিন লেডিসে ওঠে।লেডিস কম্পার্টমেন্ট দূরে ছিল তাই আজ সামনেই জেনারেল কম্পার্টমেন্টের ভীড়ে ঠাসা লোকালে উঠতে বাধ্য হলো সে।
উনিশ বছরের ফর্সা সুন্দরী ছিপছিপে গড়ন, আকর্ষণীয় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।সে ট্রেনের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এক রুক্ষ শুষ্ক চুল,মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধ ময়লা পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ।সে অনেকটা কাছে এসে তার হাত চেপে ধরল।মুখে যেন কি সব বলছে।মনীষা রেগে চীৎকার করে উঠলো।
— অসভ্য! জানোয়ার!
লোকটা আরও জোরে হাত চেপে ধরলো। মনীষা বললো
— ছাড়ুন। হাত ছাড়ুন।
সাথে সাথে ট্রেনের লোকজন বুড়োটাকে মারতে মারতে বললো
–বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে। কামুক বুড়ো! মার শালাকে।
বুড়োকে মেরে তারা বীরত্ব প্রকাশ করতে লাগলো। মেরে তার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিল।মুখে এমন ভাবে মারলো কপাল কেটে ঝরঝর রক্ত ঝরতে লাগলো। ঠোঁট ফেটে রক্তের ধারা বইতে লাগলো।
আরও যাদের হাত নিসপিস করছিল তারাও এসে মারতে মারতে পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।মনীষা ট্রেনের জানালায় এক ঝলক দেখলো রক্তাক্ত বৃদ্ধটি গোঁগাচ্ছে।
পুরো কম্পার্টমেন্ট বুড়োটার বিরুদ্ধে নানান কটুক্তি ও আদিম রসের রসদ পেয়ে কুৎসায় মসগুল হয়ে গেলো।
একজন বুদ্ধিজীবী বলছিল
–এক রকমের পুরুষ আছে এই পৃথিবীতে। কামনার আগুনে জ্বলছে। মেয়ে দেখলে তাদের স্পর্শ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এইসব বিকৃত মস্তিষ্ক পুরুষ জাতি দেশ ও সমাজের শত্রু।
সপ্তাহে একদিন সে টিউশন পড়তে আসে লিলুয়ায়। লিলুয়ায় নেমে আজ সে একটা রিক্সা নিল। অন্যদিন পায়ে হেঁটেই যায়। সারা শরীর কাঁপছে।
তার মনে হলো আজ তারই জন্য বৃদ্ধটির এই হাল হলো। সে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবতে লাগলো। বুড়োটা কি যেন তাকে বলছিল!
টিউটোরিয়াল কক্ষে সে আজ সব শেষ বেঞ্চে বসলো। আনমনা।কিছুই তার ভালো লাগছে না।৯৫% মার্কস পেয়ে সে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছে।টিউটোরিয়াল হোমে ও কলেজের ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট।
স্যার তাকে গতকালের পড়ানো থেকে প্রশ্ন করলেন। মনীষা থতমত হয়ে বলতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি ফিরে আসবার জন্য তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরলো। জানালা দিকে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার নজরে এলো উল্টো দিকের সেই প্লাটফর্মে সেই বৃদ্ধটি পড়ে আছে। সে তড়িঘড়ি করে নেমে বৃদ্ধটির কাছে গিয়ে দেখলো শীতে জুবিথুবি হয়ে প্লাটফর্মেই পড়ে আছে। বৃদ্ধটির কপাল ও ঠোঁট দিয়ে রক্তটা জমাট বেঁধে আছে। উস্কোখুস্কো চুল, শতছিন্ন পাঞ্জাবি ।কেউ ভিখারি ভেবে কিছু রুটি দিয়েছিল। সেগুলো কুকুরে টানাটানি করছে। মনীষা ব্যাগ থেকে চাদর বের করে বৃদ্ধটির গায়ে জড়িয়ে দিল।
রুমাল দিয়ে বৃদ্ধর রক্ত মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো আপনার নাম কি?
বৃদ্ধটি বললো — জানি না
বাড়ি কোথায়?
— জানিনা, ভুলে গেছি।
আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
— মনে নেই।
এবার সে মনীষাকে বললো
— আমি বাড়ি যাবো।
এবার মনীষার মনে হলো এই কথাটাই সে হাত ধরে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট স্বরে বারবার বলতে চাইছিল কিন্তু চলন্ত ট্রেনের শব্দে ও পাবলিকের চেঁচামেচিতে সে শুনতে বা বুঝতে পারেনি।
এবার মনীষা বৃদ্ধটিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।এবার সে নিজেই শক্ত করে তার হাত ধরলো। আপ ট্রেনের প্লাটফর্মে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠালো। তার নিজের স্টেশন শ্রীরামপুর আসলে বৃদ্ধটিকে নিয়ে হাত ধরে নামিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ঘরে এলো।
মা বাবাকে সব কথা বর্ণনা করে শুনালো।আদর্শবাদী পিতা তার বর্ণনা শুনে মেয়ের প্রশংসা করে বললো
— উপযুক্ত কাজ করেছিস মা।
— বাবা, আমিতো তোমার কাছ থেকে আদর্শ মানবিকতা ও শিষ্ঠতার জ্ঞান লাভ করেছি।
— কিন্তু ঘরে রাখলে কোনো সমস্যা হবেনা তো?
— না বাবা। আমি দেখবো বৃদ্ধকে।
মাকে বললো জল গরম করতে।
নিজে হাতে দুধ সুজির হালুয়া বানালো। জল গরম হয়ে গেলে বৃদ্ধটিকে স্নান করালো। ঘসে ঘসে শরীরের নোংরা উঠিয়ে দিল।বাবাকে বললো একটা তোমার পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে দাও।ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল।
লক্ষ করলো বৃদ্ধটির চোখমুখে এক আভিজাত্যের ছাপ।
ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়ে চামচে করে খাওয়াতে গেলো।
–খান।
বৃদ্ধটি ঘাড় নেড়ে বললো “খাবেনা। “
এবার মনীষা আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে আনলো। ধমক দিয়ে বললো
— খাও। তোমাকে খেতেই হবে।
এবার ধমক খেয়ে বাচ্চা ছেলের মতো এক চামচ খেলো।
দ্বিতীয় চামচের বেলায় আবার ধমক। এভাবে তাকে পেট পুরে সবটাই খাওয়ালো।
মুখ মুছিয়ে দিয়ে সিঙ্গল বেডের ঘরটিতে নিয়ে শুইয়ে দিল। মশারী খাটিয়ে চারিদিক গুঁজে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। এভাবে দিন তিনেক কেটে গেলো। মনীষার আদরে যত্নে বৃদ্ধটি বহাল তবিয়েতে থাকতে লাগলো।
একদিন মনীষা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বৃদ্ধটির ঘরে গিয়ে দেখলো, অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
সে তাকে বিরক্ত না করে পড়তে বসলো। ফিজিক্সের একটা অঙ্ক সে কিছুতেই পারছে না। অন্যদিন ঝটপট করে ফেলে। আজ তার মনে বিরক্তির ভাব। পিছনে একটা শব্দে হঠাৎ তাকিয়ে দেখলে গুটি গুটি পায়ে কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধটি। সে খাতাটি টেনে নিল। পেন নিয়ে অবশিষ্ট অঙ্কটি কাঁপা কাঁপা হাতে করে দিল।
মনীষা হতবম্ব হয়ে গেলো। এটা কি অলৌকিক! এ কিভাবে সম্ভব। ইনি কে? কি তার পরিচয়? ইনি তো সাধারণ মানুষ নন। ছুটে গেলো বাবা মার কাছে। সমস্ত ঘটনাটি খুলে বললো। তারা এসে জিজ্ঞেস করলো।
–কি নাম আপনার? কোথায় থাকেন? বাড়িতে কে কে আছে? বৃদ্ধ লোকটি বললো
— ভুলে গেছি। মনে করতে পারছিনা।
আপনার বাড়ির ফোন নম্বর বলুন।
এবার সে কষ্ট করে স্মৃতি হাতড়ে মনে করে একটা নম্বর বললেন।
মনীষা সামনে ফিজিক্স খাতাতেই লিখে নিলে।
অমিত মিত্র কল করলেন। রিং হচ্ছে।
একবার দুবার কিন্তু কেউ উঠাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর তৃতীয় বার চেষ্টা করতেই অপরপ্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো
— আমি প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়ের ছেলে ডাঃ হিমাদ্রি রায় বলছি। অমিত বাবু ভাবলো, যে ছেলে নিজের নামের আগে পিতার নাম আগে বলে সে নিশ্চয়ই কোনো আদর্শ পুত্র।
— কাল থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার ঘরে রয়েছেন। উনি নাম বাড়ির ঠিকানা কিছুই বলতে পারছেন না। মনে হয় স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করে এই নাম্বারটা উনি বলতে পেরেছেন।
— আপনি লোকটার বিবরণ বলুন।
অমিতবাবু সংক্ষেপে বর্ননা করলেন।
ডাঃ হিমাদ্রি অপরপ্রান্ত থেকে বললেন
— হ্যাঁ। আমার বাবা।প্রফেসার সমুব্ধ রায়।আমি তার পুত্র ডাঃ হিমাদ্রি রায়। বাবা আজ দিন কয়েক থেকে নিখোঁজ। খুঁজেছি নানাভাবে অনেক। কিন্তু পাইনি।আপনার ফোন পেয়ে অনেক আনন্দিত। আমি মাকে নিয়ে এখনই আসছি।
মনীষা ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে বললো
—এই যে স্যার। আপনার নাম কি প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
আপনার ছেলের নাম কি ডাঃ হিমাদ্রি রায়?
— কিছুই মনে পড়ছে না।
মনীষা স্নান করিয়ে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে, চুল আঁচড়ে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে বললো
—এখুনি আপনার ছেলে আসবে আপনাকে নিতে।
বাধ্য শিশু যেমন মায়ের দিকে নির্ভয়তায় চেয়ে থাকে তেমনি ভাবে অপলকে চেয়ে রইলো বৃদ্ধটি।
অনেকক্ষণ পর এক দামী গাড়ি এসে থামলো বাড়ির গেটের সামনে। নেমে এলেন ডাঃ হিমাদ্রি রায় ও তার মা।
ঘরে এসে অমিত বাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন।
অমিতবাবু বললেন
— এ সব সম্ভব হয়েছে আমার কন্যার জন্য।
এবার সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাবার হাত ধরে গাড়ীতে উঠাতে যাবেন তখন প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলেন মনীষাকে।তার চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো,বললেন
— আমি বাড়ি যাবো।এরপর একবছর কেটে গেছে।
প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায়, একদিন স্ত্রী মনোরমা, পুত্র ডাঃ হিমাদ্রিকে নিয়ে এক বিশাল গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে মনীষাদের বাড়িতে এলেন। সেদিন ছিলো ছুটির দিন।মনীষা ও তার বাবা মা বাড়িতেই ছিলো।
মনোরমা বললেন
— আজ আমার স্বামীকে ফিরে পেয়েছি আপনাদের মহানুভবতার জন্য।
অমিত বাবু বললেন
— সব কৃতিত্ব আমার কন্যার।
ডাঃ হিমাদ্রি বললেন
— বাবার সর্ট টার্ম মেমোরি লস হয়েছিলো। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
এবার প্রফেসর সম্বুদ্ধ রায় এগিয়ে এসে বললেন
— আমি একটা ভিক্ষা চাইছি।
আপনারা রাজি থাকলে দেবেন।
–বলুন। কি চাইছেন?
— আমি আপনার মেয়ে মনীষাকে আমার পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে চাই।আর আমার সাথী করে রাখতে চাই।কি মনীষা! তুমি আমার সাথী হবে?
মনীষার বাবামা বললেন
— এতো আমাদের সৌভাগ্য।
আনন্দে মনীষার দুচোখে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
প্রফেসর সম্বুদ্ধ স্যার ও মনোরমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো।সম্বুদ্ধ স্যারের হাত শক্ত করে ধরে বললো
” আমি বাড়ি যাবো “।নির্দিষ্ট দিনে মনীষা ও হিমাদ্রীর মহা ধূমধামে বিয়ে হয়ে গেল।
-
গল্প- সোপান
সোপান
– শিলাবৃষ্টিমাঝে মাঝেই দাদুর বলা সেই কথাগুলো মনে পড়ে যায় আমার। আজ দাদু নেই, সেই কবে পাড়ি দিয়েছে অন্যলোকে। তাকে ডাকতো দাদু রাজা বলে। ভীষণ ভালো বাসতো। বলতো অনেক কথা, কিন্তু কিছু কিছু কথা মনে এমন ভাবে গাঁথা হয়ে যায় যে….
” রাজা! তোর সামনে একটা কাল্পনিক আকাশ ছোয়ার সিঁড়ি রাখবি, সেই সিঁড়িটাতে খুব ধীরে ধীরে উঠবি দাদুভাই। তাড়াহুড়ো করলেই হাঁপিয়ে যাবি। আর হাঁপিয়ে গেলে উঠবি কি করে শেষ অব্দি? তোকে যে আকাশ ছুৃঁতেই হবে ভাই।”
পরে বুঝেছিলাম এই সিঁড়িটার নামই বোধহয় উন্নতির সোপান।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো দাদুর বয়েস হয়েছিল পঁচাত্তর বছর ঠিক ই কিন্ত দাদুর মৃত্যুর কারণ আবার এই সিঁড়িই হলো। দাদু সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার কারণেই মারা যান। সিঁড়ি দিয়েই দাদু স্বর্গে গেছে।
তখন আমার ক্লাস ইলেভেন। দাদুর মৃত্যুতে খুব ভেঙে পড়েছিলাম।তবু মন শক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম। দাদুর ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হই, তাই আর কোনোদিকে না তাকিয়ে আদা নুন জল খেয়ে লেগে পড়লাম। জয়েন্টে খুব ভালো র্যাংক হলো। আবার শুরু সিঁড়ি ভাঙা। আমাকে উঠতেই হবে একটা একটা করে অনেক সিঁড়ি। আকাশ ছোঁয়ার সেই সিঁড়িটাকে স্বপ্নেও আমি দেখতে পেলাম একদিন। খুব যত্ন করে অনেকগুলো ধাপ মুছলাম, যেন ধুলোতে না ঢেকে যায় আমার সোপান।
আমি ডাক্তার হয়েছি। দাদুর ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি। দাদুর গ্রামের বাড়ি মুকুন্দপুরে গরীব মানুষগুলোর কাছে সপ্তাহে একদিন পৌঁছে যাই আমি। তাদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করার মধ্যে আমি স্বর্গীয় সুখ লাভ করি।
সেই মাটিতে আমি অনুভবে দাদুকে পাই। ঝড় বৃষ্টিতে একদিন ফিরতে পারিনি। সেদিন সেই চারশ’ বছরের পুরাতন বাড়িতে রাতে যেন আমি স্পষ্ট দাদুকে দেখলাম। আমায় দাদু আশীর্বাদ করে, বলে গেল ” রাজা তোমার সামনে যে এখনো অনেকগুলো সিঁড়ি… ” সেটা স্বপ্ন ছিল না অন্যকিছু ডাক্তারি পরিভাষায় তার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। শুধু বুঝেছিলাম সেদিন দাদুর ইঙ্গিতটা। তাই…
শুরু করলাম লণ্ডণ যাওয়ার প্রস্তুতি।
…..
আজ আমি এফ আর সি এস চেষ্ট স্পেলালিস্ট। মানুষ বলে ” ডাক্তার নয়, এ যেন ভগবান।”
আজ যা কিছু আমি তা আমার দাদুর জন্য। খুব মিস করি তোমায় দাদু। আমি বাবা হয়েছি দাদু। আর তোমার সেই সোপান এখন আমার ছেলের জন্য অনেক যত্নে রোজ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখি আমি। তোমার দেখানো সোপান… আমি ভালোবাসা দিয়ে সাজাবো। -
গল্প- একজোড়া চায়ের কাপ
একজোড়া চায়ের কাপ
সুনির্মল বসুওয়েলিংটন স্টীটে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বহু বছর ধরে চাকরি করছি। সাজানো সুন্দর অফিস। চারদিক ঝকঝকে তকতকে। মাইনে কম। কিন্তু অফিসে ঠাট বাট আছে। নামে তাল-পুকুর, ঘটি ডোবে না।
পাঁচ বছর আগে বাটা কোম্পানি থেকে একজোড়া বুট জুতো কিনেছিলাম, বহু ব্যবহারের ফলে বর্তমানে তার শুকতলা খুলে পড়েছে। চিফ অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার এ নিয়ে কথা শুনিয়েছেন। সেদিন ছুটির পর চিনা পাড়ায় জুতো কিনতে গেলাম।
জুতোর দোকানের একটু আগে কাঁচের শোকেসের মধ্যে একজোড়া ভারী সুন্দর চায়ের কাপ ও প্লেট দেখতে পেলাম। কাপ এবং প্লেটের গায়ে নীল কারুকার্য করা ড্রাগনের ছবি। তিনশো কুড়ি টাকা দাম চাইলো। তিনশো টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম। জুতো কেনা হলো না, সামনের মাসে মাইনে পেলে দেখা যাবে।
বাড়িতে কাপ দুটি দেখে আমার গিন্নী মিলি তো আনন্দে আটখানা। বাড়িতে অনেক কাপ প্লেট থাকলেও, বিশেষ অতিথিদের জন্য এই কাপ দুটি ব্যবহার করা হোত।
অফিসের বস মিস্টার বিভাস চৌধুরী অনেক দিন আমার বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। এবার আমার ইচ্ছে হলো, ওনাকে একদিন বাড়িতে ডেকে চায়ের নেমন্তন্ন করে খাওয়াই। মিলিও এক কথায় রাজি।
পরের রোববার ওরা সস্ত্রীক এলেন। আমাদের ছোট্ট সাজানো ফ্ল্যাট। এই চায়ের কাপের জন্য আমার আজকে মান মর্যাদা বেড়ে গেল। চৌধুরী সাহেব এবং ওনার স্ত্রী বারবার কাপের প্রশংসা করলেন।মিলি আরো সতর্ক। বিশেষ অতিথি ছাড়া ঐ কাপ কখনো বাইরে বের করত না। কেউ বাড়িতে এসে চলে গেলে, অল্প বয়সী কাজের মেয়ে তিলোত্তমা
কাপ দুটিকে ভালো করে মেজে ঘষে, কাঁচের আলমারিতে তুলে রাখতো।তিলোত্তমা মাস ছয়েক ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মেয়েটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শুনেছি, রমেন বলে একটি যুবকের সে প্রেমে পড়েছে। রমেন বাপের পয়সায় মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় রেলা দিয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে হাত সাফাইয়ের কাজও করে। ওর বাবা ভবেশ বাবু বলেন, ছেলে আমার টেকনিকেলে কাজ করে। রাতে ডিউটি। যায় আর একটা ঘটি নিয়ে আসে, যায় আর একটা বাটি নিয়ে আসে। অবশ্য তাতে আমার কি। আমার অফিসের কলিগ শোভনাকে আমার খুব ভালো লাগে। ও আমাকে বিশেষ পছন্দ করে। মনে মনে ভালোবাসা তৈরি হচ্ছিল। একদিন ও বাড়ি এলো। মিলি চিনা কাপে ওকে চা করে এনে দিল।
শোভনা কাপের প্রশংসা করতে দ্বিধা করলো না।
আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিলি অবশ্য এই সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই জানতো না।যাবার সময় শোভনা টেবিলের পাশ গিয়ে বের হতে গিয়ে সামান্য ধাক্কায় একটি চায়ের কাপ ভেঙে গেল।
মিলির খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমারও। তবু যেহেতু ওর প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে, তাই আমি মেনে নিলেও, ও চলে যাবার পর মিলি বলল,
কিরকম চলাফেরা দেখেছো, এতদিনের ভালবাসার জিনিসটা টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল।একটি চায়ের কাপ ভেঙ্গে যাবার পর, শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগলো। অফিসের ইঞ্জিনিয়ার সুজিত মল্লিককে শোভনা ভালোবেসে ফেললো।
অফিস থেকে ফেরার পথে বাসের জানালায় বসে আমি ভাবছিলাম, একটা কাপের ভেঙ্গে যাওয়া এবং শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা। নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।
এখন থেকে অন্য কাপে সকাল সন্ধ্যায় আমি চা খাই। সেদিন অফিস থেকে ফিরছি, ফ্ল্যাটের সামনে কেউ একজন মুখে সিটি বাজালো। তিলোত্তমা তাড়াতাড়ি করে কাজ সেরে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে চা খেতে গিয়ে দ্বিতীয় কাপটার দেখা পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, তিলোত্তমা তার হাতসাফাই প্রেমিকের জন্য কাপটা চুরি করে নিয়ে গেছে।
পার্কে ওরা যখন কথা বলছিল, থানার ডিউটি অফিসার রমেনকে তাড়া করে। ওর নামে নানা এলিগেশন আছে। রমেন গলিপথে পালিয়ে যায়। এমনকি তিলোত্তমাও চটি খুলে দৌড়ায়।
বেজায় মন খারাপ হয়ে যায় আমার। কতদিনের শখের কাপ। শুনেছি, কাপটা ওখানে পড়েই ছিল।
বীথির মা দেখেছেন।দুই ভদ্রলোক পার্কে এসেছিলেন। ওরা দুজনেই কাপটা ওদের বলে দাবি করেছেন। একজন বললেন, আমি গড়িয়াহাট থেকে একজোড়া কাপ কিনেছিলাম, একটা বাড়িতে রয়েছে, অন্যটা এটি। অন্যজন বললেন, গুল মারবেন না তো, দু’বছর আগে পার্ক স্ট্রিট থেকে বড়দিনের দিন আমি এই কাপ কিনেছিলাম।
এরিয়ার টাফ রংবাজ হাত কাটা শ্যামল এসে বলল- কাপ তোদেরও না, তোদের বাপেদের না, এ কাপ হল আমার। তে’ মাথার মোড়ে বসে আমি এই কাপে চা খাবো, আর আমার ফিয়াসে বুলবুলির সঙ্গে প্রেম করবো।
শ্যামল কাপটা নিয়ে চলে গেল। ওর অপনেন্ট পার্টি তখন গলির মোড়ে পেটো চার্জ শুরু করেছে। শ্যামল পথ চলতি রামনিধি বাবুকে কাপটা দিয়ে দিল। দ্রুত রিভলবার বের করে বিপক্ষ দলের ল্যাংড়া হাবুকে তাড়া করলো।
পরদিন সকালে রামনিধি বাবু আমাদের বাড়িতে মিলির কাছে এলেন। বললেন, এই কাপটা শ্যামল আমাকে কালকে রাখতে দিয়েছিল। মারামারির জন্য আর ফেরত নিতে পারে নি। বৌমা, কাপটা তুমি রেখে দাও।
কাপের প্রতি খুব বিরক্ত এখন আমি।
বললাম, আপনি নিয়ে যান, ওই কাপ আমাদের চাই না।
রামনিধি বাবু বললেন, আমি তো শচীনের দোকানে গিয়ে চা খাই। বৌমা আমাকে চা দেয় না। এই কাপ নিয়ে আমি কি করবো।
কথাটা সত্যি, ভাবতে লাগলাম, তিলোত্তমা কাপটা চুরি করে ওর হাত সাফাই প্রেমিক রমেনকে দিয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে রমেন এবং তিলোত্তমা পালালে, দুই ভদ্রলোক এই কাপের দাবিদার হয়ে যান। যদিও তারা এই কাপের মালিক নন। মানুষের লোভ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
গায়ের জোরে শ্যামল কাপটা কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ও কাপটা ব্যবহার করতে পারেনি। রামনিধি বাবু কাপটা পেলেন। কিন্তু তাঁকে শচীনের দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়, বৌমা চা দেয় না।
আমি হেসে মিলিকে বললাম, ভাগ্যিস, অফিস ফেরত আমি সেদিন কাপ জোড়া এনেছিলাম, নইলে মানুষের এত বিচিত্র চরিত্র দেখতে পেতাম না।
অতিরিক্ত খুশিতে আমি মৌজ করে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, মিলি বলল, এখন সিগারেট ধরিও না। এই কাপে এখনই তোমাকে চা করে দিচ্ছি।
-
গল্প- খাদের অতি নিকটে
গল্প-
খাদের অতি নিকটে
-সুনির্মল বসুট্রান্সফার অর্ডারটা এসেছিল গত সপ্তাহে। কলকাতার অফিস থেকে যখন ওকে ব্যাঙ্গালোর পাঠাবার আদেশ এসেছিল, তখন মহুলের খুব মন খারাপ হয়েছিল। অথচ, হাতে অন্য কোনো অপশন ছিল না। বাবা-মাকে ছেড়ে প্রিয় শহর ছেড়ে যেতে মহুলের মোটেই ভালো লাগছিল না।
ও একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
পরে এমবিএ করেছে।বিকেলে গড়িয়াহাট মোড়ে দিতির সঙ্গে দেখা। ওদের মধ্যে বছর পাঁচেকের সম্পর্ক। শুনে দিতির খুব মন খারাপ।
-কিছু একটা করা যায় না?
-কি করব?
-তুমি তোমার প্রবলেমের কথা জানিয়েছো?
-হু। কিন্তু কোম্পানী শুনবে না।
-তুমি ওনাদের বুঝিয়ে বলো।
-কিছু করার নেই। চাকরিটা ট্রান্সফাররেবল
-এবার কি হবে?
-মন খারাপ কোরো না। প্রতিদিন ফোনে কথা হবে।
-আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।
-তুমি বুঝিয়ে বলো। আমি একটু গুছিয়ে নিই।
-বাবা পুরোনো আমলের মানুষ। কড়া ধাঁচের।
-এক্ষুনি আমি তো কোন উপায় দেখছি না।
-কবে যাবে?
-সোমবার সন্ধে ছটা চল্লিশে ফ্লাইট। ভালো থেকো।
-নিজের খেয়াল রেখো।সেদিন অনেক রাতে নতুন কর্মস্থলে পৌঁছল মহুল। মাকে পৌঁছানোর সংবাদ দেবার পর, দিতিকে ফোন করল- ভালো ভাবে পৌঁছে গেছি। তুমি ঠিক আছো তো?
-হ্যাঁ। আজ তোমার বন্ধু শুভমদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বললাম- তোমার অফিস তোমাকে বদলি করে পাঠিয়েছে।
-শুভমদা বলল, চলো, কফি হাউসের ঢুকি। গেলাম।
-ভালো।
শুভমদা একটা সিরিয়ালে চান্স পেয়েছে। আমায় বলল- টি স্টেটের চাকরিটা ও ছেড়ে দেবে।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ। তুমি এখন কি করছো?
-সবে তো এলাম। ঘর গোছাচ্ছি। সময় লাগবে।
-পেরে যাবে ঠিক।
-পারতেই হবে।
-তাহলে ছাড়ছি। পরে কথা হবে। টা টা।পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল মহুলের। জানালার সার্সির ভেতর থেকে দেখলো,:দূরে ঘুম ঘুম পাহাড়। হালকা মেঘ আকাশে ভেসে যাচ্ছে।
শহরটা সুন্দর করে সাজানো। বাড়ির বাইরে অজস্র ফুলের মেলা বসেছে যেন। তিন তলার উপরে ওর ঘর। সুন্দর বাথরুম। সামনে ঝুল বারান্দা। ঝুল বারান্দার পাশে, পাখিদের থাকবার ঘর। কত রকম পাখি সারাক্ষণ এখানে কিচিরমিচির করে চলেছে।মহুল একটা সিগারেট ধরানো। বাইরে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো, নিচের রাস্তায় অজস্র যানবাহন চলাফেরা করছে।
কাজের মেয়েটি এলো। ঘর পরিষ্কার করলো। তারপর জিজ্ঞেস করল- নাস্তা কিয়া?
-নেহী।
-মেয়েটি চা নাস্তা রেডি করে দিল। বলল, ওর নাম
জানকী।ও চলে যাবার পর, মহুল হোম ডেলিভারির জন্য ফোনে যোগাযোগ করলো। আপাতত কিছুদিন এভাবেই চালিয়ে নিতে হবে। পরে অন্য যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
পরে ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে বসেই অফিসের কাজ শুরু করলো। কোম্পানী আগামী সপ্তাহে ওর জন্য একটা গাড়ি স্যাংশন করেছে। দুদিন বাদে ও কাজে জয়েন করলো।
রাতের দিকে কলকাতা থেকে দিতির ফোন এলো।
-কি খবর?
-ঠিক আছি। তবে গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।
-আজ আমি তপন থিয়েটারে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।
-বাহ, খুব ভালো কথা।
-আরে, শুভমদার শো ছিল। আমাকে নিয়ে গেল। বলল, তুমি সঙ্গে থাকো। আমি ভরসা পাই।
-তোমার ভালো লেগেছে?
-হ্যাঁ। লোকটা কিন্তু খুব গুণী মানুষ।
-তাই।
-ওর সিরিয়ালটাও ভালো চলছে।
-ওকে আমাকে ফোন করতে বোলো।
বলবো। কাজের পরে কিভাবে তোমার সময় কাটছে?
-এখানে কলকাতার মতো পথে-ঘাটে ভিড় নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। খুব সাজানো এই শহরটা।
-তাই নাকি!
-আমি তো লিখতে পারি না। কিন্তু লিখতে পারলে, দূরের পাহাড়ের বর্ণনা দিতাম।
-কাল তুমি আমায় ফোন করবে।
-ঠিক আছে। ভালো থেকো।
-তুমিও।মহুল কোম্পানী থেকে হ্যারিয়ার গাড়ি পেয়েছে। কোম্পানী ওকে ড্রাইভার দিতে চেয়েছিল, নেয় নি। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে যায়।
কখনো আবার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনে যায়।
রাতের দিকে মহুল দিতিকে ফোন করে, -হ্যালো! আজ কোম্পানী থেকে গাড়ি দিয়েছে। তোমাকে ছবি পাঠাচ্ছি।
-দেখে কি করবো? এই শহরে না এলে, চড়া হবে না। কই দেখি?
-তোমার পছন্দ হয়েছে?
-খুব সুন্দর।
-তোমার কথা বলো।
-ঠিক আছি। শুভমদা মন্দারমনিতে যাবার জন্য বলছে।
-তুমি কি বললে?
-আমি কিছু বলিনি। বাড়ি থেকে পারমিশন নিতে হবে।
-তারপর?
-দমদম থেকে এক পাত্রপক্ষ আমাকে দেখে গেছে।
-তুমি আমাদের ভালোবাসার কথা বাবা মা’কে বলোনি?
-না। তুমি কবে কলকাতায় ফিরবে?
-সবে তো এলাম।
-আজ ছাড়ছি। ভালো থেকো।মহুল মাঝখানে অফিসের কাজ নিয়ে রায়পুরে গিয়েছিল। তিন দিনের জন্য ব্যাঙ্গালোরে থেকে ও আবার নাগপুরে চলে যায়।
ইতিমধ্যে দিতির ফোন আসেনি। কাজের ব্যস্ততায় মহুল ওকে ফোন করবার সুযোগ পায়নি।গত বুধবার রাতের দিকে শুভম ফোন করেছিল।
-হ্যাঁরে, কেমন আছিস?
-ভালো।
-তুই কি চাকরি ছেড়ে দিলি?
-হ্যাঁ। স্টেজে, সিরিয়ালে কাজ করছি। দুটো সিনেমায় কাজের অফার এসেছে।
-খুব ভালো কথা। দিতি তোর অভিনয়ের প্রশংসা করছিল।
-তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তুই ওকে তপন থিয়েটারে নিয়েগেছিলি, আমাকে বলেছে।
-আসলে কি জানিস, ও অভিনয়টা বোঝে।
-ভালো কথা।
-তাহলে ছাড়ছি।
-ভালো থাকিস।হ্যারিয়ার গাড়ি চালিয়ে মহুল অফিস থেকে ফিরছিল। রাতে শহরটা এত মায়াময় লাগে। মন ভালো হয়ে যায়। অফিসে খুব খাটাখাটনি গেছে।
মহুল একটা পাও ভাজির দোকানের কাছে গাড়িটা দাঁড় করালো। তারপর পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা আইসক্রিমের দোকান থেকে কুলফি মালাই কিনলো।
সবে খেতে যাবে, এমন সময় একটা মেয়েরই কন্ঠস্বর ভেসে এলো- অ্যাই মহুল, আমি সুপ্রিয়া বলছি, তাকিয়ে দ্যাখ্।
মহুল বলল- তুই এখানে?
-আমি তো এখানেই চাকরি করি।
মহুল ওর জন্য একটা কুলফি মালাই নিল। বলল- খেয়ে দ্যাখ্। ভালো লাগবে।
সুপ্রিয়া খুশিমনে কুলফি মালাইতে কামড় বসালো।মহুল জিজ্ঞেস করল- এখানে একাই আছিস?
-হ্যাঁ। এদিক-ওদিক বেড়াতে যাস না?
-মাঝে মাঝে। সিরডির সাঁই বাবার ওখানে দুবার গিয়েছি। ত্র্যয়ম্বকেশ্বর মন্দিরে একবার।
-তুই কোথায় উঠেছিস?
-কোম্পানীর দেওয়া ফ্ল্যাটে। আসিস একদিন।
-যাবো। যাক, একজন কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল।
মহুল হেসে ফেলল। বলল- আমারও।
-কি করে সময় কাটাস?
বই পড়ে। তুই?
-লেখালেখি করি।
-তাই নাকি?
-তোর এই গুনটার কথা আগে জানতাম না তো!
-কি করব, সময় কাটাবার জন্য।
-তোর লেখা পড়তে চাই।
-আগামী সপ্তাহে আসবো। তখন তোর জন্য কবিতার বই নিয়ে যাবো।
-ওয়েলকাম।
-থ্যাঙ্ক ইউ। চলি রে।অনেকদিন হয়ে গেল, দিতির কোন খবর নেই। মহুল ভেবে দ্যাখে, ওর স্বভাব ঠিক উল্টো। প্রতিদিন ও দিতিকে মনে করে যায়। দিতি এ কদিনে সব ভুলে গেল? আউট অফ সাইট,আউট অফ মাইন্ড।
সেদিন অফিসে হঠাৎ কলকাতা থেকে একটা ফোন এলো। আয়নাংশুর ফোন। ও হেয়ার স্কুলে একসঙ্গে ছোটবেলায় ওর সঙ্গে পড়তো।
-কেমন আছিস?
-ভালো।
-এখন অফিসে?
-হ্যাঁ।
-চাপে আছিস?
-সেভাবে নয়।
-একটা কথা বলি, দিতির সঙ্গে তোর রিলেশন ঠিক আছে?
-কেন?
-ইদানিং শুভমের সঙ্গে ওর মাখামাখি সম্পর্ক নিয়ে চারদিকে চর্চা চলছে। বন্ধু হিসেবে তোকে জানালাম।
-ঠিক আছে।দুই সপ্তাহ বাদে অফিসে বেয়ারা একটা বিয়ের কার্ড দিয়ে গেল। প্রজাপতি আঁকা ছবি। সাত পাঁকে বাঁধা।
মহুল ভাবলো- দিতি আমার সঙ্গে এমনটা করতে পারলো? বালিগঞ্জ লেক, মেনোকা হলে সিনেমা দেখা, আশুতোষ কলেজের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা বেলায় ফুচকা খাওয়া, গভীর রাতে নিয়ন আলোর নিচে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা। সব মিথ্যে, সবটাই অভিনয়। কিন্তু শুভম। ওর বন্ধু হিসেবে এটা কি করলো?
বিশ্বাস না থাকলে, মানুষ পৃথিবীতে কি নিয়ে বাঁচবে? দিতি একদিন বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। এর চেয়ে বড় মিথ্যে কথা আর কিছু হতে পারে না।
মহুল ভাবলো, জীবনটাকে আমি একটা আর্ট গ্যালারি বানাতে চেয়েছিলাম। ওরা তাতে কালি ছিটিয়ে দিল।
অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই, মহুল বিশ্রী ভাবে গাড়ি চালানো শুরু করলো।
তিনটে ক্রসিং পেরোতেই, সুপ্রিয়া ওকে গাড়ি থামাবার জন্য হাত দেখালো।
-কিভাবে গাড়ি চালাচ্ছিস তুই?
-কেন?
-এভাবে রাফ ড্রাইভিং কি ঠিক হচ্ছে?
ভালো লাগছে না।
-চল্, তোর সঙ্গে যাবো।
-কোথায়?
-কোথায় আবার! তোর বাড়ি।
সুপ্রিয়া গাড়িতে উঠে বসলো।
-আস্তে চালাবি। অফিসে ঝামেলা বাঁধিয়েছিস?
-না তো।
-তাহলে? কিরে চুপ করে আছিস কেন?
-মন ভালো নেই।
-হতেই পারে। তা বলে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাবি? কিছু বল, কথা বলছিস না কেন?
-বিশ্বাস শব্দের কোন দাম নেই।
-কে বলেছে?
-আজ আমি জানতে পারলাম।
-সহজ করে বল। আমি তোর মতিগতি বুঝতে পারছি না। আমার ভালো ঠেকছে না। কি হয়েছে তোর? আমাকে বলা যাবে না?মহুল ফ্ল্যাটের নিচে পৌঁছে গেছে। গাড়ি গ্যারেজ করে বলল- উপরে আয়।
ওরা উপরে এলো।সুপ্রিয়া বলল+ তোর কিচেন টা দেখা।
ডান হাত উঁচু করে মহল দেখিয়ে দিল।
সুপ্রিয়া চা করল। তারপর ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে মাইক্রোওভেনে গরম করল।
সামনে খাবার রেখে বলল, খেতে খেতে তোর কথা শুনবো।
মহুলের মাথাটা তখন টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়েছে।
বলল- কষ্ট হচ্ছে।
-আমাকে বল।
-সব কষ্টের কথা সবসময় বলা যায় না।
-তুই তাহলে আমাকে বন্ধু মনে করিস না?
মহুল চুপ করে রইল।
-কি বলবি না তো! ঠিক আছে। আমি যখন তোর বন্ধু নই, তাহলে এখানে আছি কেন? আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আমি চলে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকলো না।
-সুপ্রিয়া, শোন। চলে যাস না। আমি বলব, সব কথা তোকে বলবো।
সুপ্রিয়া ফিরে আসে। মুখোমুখি বসে।
মহুল বলে- দিতিকে আমি ভালবাসতাম। পাঁচ বছরের সম্পর্ক। আমি চলে আসার পর আমারই এক বন্ধুকে ও বিয়ে করছে। এই যে বিয়ের কার্ড।
সুপ্রিয়া চুপ করে শুনলো।
বলল- ও আসলে বেটার খুঁজছিল। তুই ওকে ভালবাসতিস। ও তোকে ঠকিয়েছে, তুই তো ঠকাসনি। তাহলে?
মহুল একটা সিগারেট ধরালো। বলল, যে ভালোবাসার আয়নায় মুখ দেখেছিলাম, ওরা সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।
সুপ্রিয়া বলল- এটা এখন ঘটেছে, ভালো। পরে ঘটলে কি হতো?
-জানিনা। কোনদিন ভেবে দেখিনি।
-আমি একটা কথা বলবো?
-বলতে পারিস।
-জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।
-মানে?
-আমি যদি বলি, মহুল, আমি তোকে ভালবাসি। তুই বিশ্বাস করবি?
-আমার জীবন থেকে বিশ্বাস শব্দটা চলে গেছে।
-আমি তোকে সব ফিরিয়ে দেবো।
-কি?
যা যা তুই জীবন থেকে হারিয়েছিস।
-আমার জন্য কেন তুই এসব করতে যাবি?
-ভালোবাসার কাদায় তোর পা ডুবে গেছে, আমি তোকে সত্যিকার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবো।
-কেন ?কেন? কেন?
কোন ভালো মানুষের কখনো দুঃখী মানুষ হওয়া চলে না।
সুপ্রিয়া মহুলের পিঠের উপর হাত রাখলো।
তারপর ধীরে ধীরে বলল-আয়, নতুন করে শুরু করি। ভালোবাসা পাওয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। সবার সেটা নেবার ক্ষমতা, দেবার ক্ষমতা থাকে না।মহুলের মনে হল, ঈশ্বর আছেন।
একদিন যে সত্যিকারের বন্ধু ছিল, সে এসে তার বিশ্বাসের হাতখানি, ভালোবাসার হাতখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
সহসা ওর মনে হলো, পাহাড়ের খাদের কাছে দাঁড়িয়ে আজ সুপ্রিয়া ওকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। তখন অনেক রাত। ফুল বাগানে কুয়াশা আর শিশির পড়ছে।
গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মহুল বললো- চল, তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিই।
সুপ্রিয়া তখন মহুলের কোলের উপর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল।
মহুলের বাঁ হাতের উপর হাত রেখে বলল- এই হাত আমি কোনদিন ছাড়বো না। কোনদিন না।
-
গল্প- অপেক্ষা
অপেক্ষা
-অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ“আমার একটা ভালো শাড়ি দিতে হবে। সেই সঙ্গে দুজোড়া বালা। সামনেই দূর্গা পুজো। মনে থাকে যেন আমার স– ব চাই। অনেক দিন থেকে বলে যাচ্ছো,দেবে দেবে।এবছর কিন্তু চাই “এমনি করে প্রতি বছর মল্লিকার আবদার মেটাতে মেটাতে রোহন হিমসিম।রোহন যখন প্রথম বউ নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়িসুদ্ধ সবাই বলেছিল,কি লক্ষ্মী বউ এনেছিস। ঘর আলো করে রাখবে।
দুটিতে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বাড়ির কারোর আপত্তি ছিল না। আপত্তি করেই বা লাভ কি! এখন নাকি ভালো মেয়ে পাওয়া যায় না। যা দিন কাল। আর ঘটকদের তো তেমন দেখায় যায় না। তাই রোহন যখন নতুনবউ নিয়ে এল। সবাই কত খুশি।কিন্তু তারপর শুধু চাই আর চাই। রোহনের যতই কষ্ট হোক, সে ভালোবাসার মানুষকে বিমুখ করবে না। তাই দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছে। তাতেও মল্লিকার কিছু এসে যায় না। বিয়ে যখন করেছে, সমস্ত দায়-দায়িত্ব স্বামীকেই নিতে হবে।
রোহনের একটা অটো রিকশা আছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা মেয়ে হলো। আরও খরচ।কোনো ক্রমে খেয়ে পরে চলে সংসার। তেমন ভাবে সঞ্চয় করতে পারে না কিছু। তাই বাড়িতে দিন রাত অশান্তি। মেয়ের খরচ, বউয়ের হাতখরচ মিটিয়ে মায়ের হাতে বেশী টাকা দিতে পারে না। মা সব বোঝে। ছেলের কষ্ট। তাই কিছুই বলে না।তবু বউকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। একদিন বলেই দিল, এভাবে থাকতে পারব না। শিল্পীর মা রোজ কত দামী দামী শাড়ি পরে আসে। নতুন নতুন গয়না পরে । আর আমি সেই একই শাড়ি গয়না। হাতে দামী ফোন। ভাল্লাগে না এভাবে থাকতে। আমার বুঝি ইচ্ছে হয় না, রোজ নতুন নতুন শাড়ি গয়না পরতে? মেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়াবে না। এতে নাকি মান থাকবে না। তাই কেজি স্কুলে ভর্তি করেছে। মেয়েকে নিয়ে রোজ স্কুলে গিয়ে বসে থাকে। সারাবেলা আড্ডা দিয়ে ছুটির পর বাড়ি ফেরে বউ। আজকাল এটাই বাড়ির বউয়ের ডিউটি। বাড়ির কাজের জন্য তো শাশুড়ি মা আছে। রোহনের মা ভাত বেড়ে, নাতনি বৌমাকে খাইয়ে তারপর নিজে খায়।
রোহনের খুব মন খারাপ লাগে, মায়ের কষ্ট দেখে। তবু কিচ্ছু বলতে পারে না বউকে সে খুব ভালোবাসে। নিজের যতই কষ্ট হোক, ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেবে না। তাই আরও রোজকার করতে হবে। নইলে বউয়ের চাহিদা মিটবে না। আরও একটা পার্টটাইম কাজ খুঁজতে লাগলো।একদিন রোহনের বউ বেশ সাজুগুজু করে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেল । কিন্তু আর ফিরল না।প্রতিদিনের মতো ছুটি হলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরত মল্লিকা । স্কুল থেকে ফোন এল, “আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যান। বাড়ি থেকে এখনো কেউ আনতে আসে নি”।
রোহন অটোরিকশা চালাতে চালাতে ফোনটা ধরে ছিল। হঠাৎ থেমে গেল গাড়ি। হাতটা কেঁপে উঠল। তবে কোথায় গেল মল্লিকা? মেয়েকে এখনো স্কুল থেকে আনে নি। নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বউকে একটা ফোন করল। ফোনের সুইচ অফ। আরও চিন্তায় প্যাসেঞ্জারদের মাঝরাস্তায় থামিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চলল স্কুলে। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর মল্লিকার খোঁজ পেল না। মল্লিকার বাপেরবড়ি, যেখানে যত আত্মীয় বন্ধু সবার কাছে খোঁজ নিল। কোথাও নেই মল্লিকা। পাড়ায় কানাঘুষো হতে লাগলো, এ বউ নিশ্চয় পালিয়েছে। রোহন বিশ্বাস করে নি। বিপদ বুঝে রোহন থানায় ডাইরি করল। ছোট্ট মেয়েটা মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। রোহনের দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না চোখে।
অবশেষে একটা ফোন এল।মল্লিকার ফোন।” আমি আর ফিরব না। নিজের মেয়ে নিজের কাছে রাখো। আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না। আমি, তোমার বন্ধু রোহিতের কাছে আছি। এর সাথেই থাকব। যে বউয়ের আবদার মেটাতে পারে না। মেয়ের পড়ার খরচ যোগাতে হিমসিম খায়। তার কাছে আর ফিরব না।বাই।”ফোনটা কেটে দিল।রোহন বিশ্বাস করতে পারছে না প্রাণের চেয়ে প্রিয়মানুষ, নিজের প্রাণের বন্ধুর সাথে চলে গেল!অস্থির হয়ে বারবার রিং করতে লাগলো। আবারও ফোনের সুইচ অফ। আর ফোন আসে না। দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কয়েকমাস। মেয়ে এখন পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে যায়। রোহন আরও পরিশ্রম করে। অনেক টাকা রোজকার করতে হবে। দুজোড়া বালা গড়তে হবে মল্লিকার জন্য। মেয়েকে জড়িয়ে আদর করে হাসতে হাসতে বলে, তোর মা ঠিক ফিরে আসবে। দুজোড়া সোনার বালা চেয়েছিল। আমি দিতে পারিনি। তাই অভিমানে চলে গেল। দূর্গাপুজোয় ঠিক ফিরে আসবে।
ওই শোনা যায় আগমনী সুর পাড়ার ক্লাব প্রাঙ্গণে।সামনেই মহালয়া। রোহন অপেক্ষায়।
-
গল্প- মহুলের মা
মহুলের মা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
সুবলা দেবী বেশ বিরক্তি সহকারে বলল, হ্যাঁ রে অভয় তুই যে এতো বড় স্ত্রৈণ হয়ে গিয়েছিস তা আজ টের পেলাম।
মলি, মলয় বলতো বটে, মা বড়দা আর আগের মতো নেই। সবসময় বৌদির কথাতেই সায় দেয়। সেদিন বরং আমিই বকে ছিলাম ওদের দুজনকে। এখন তো দেখছি ওরাই ঠিক চিনেছে বড় বৌকে।
অভয়ের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। তবুও সে শান্ত স্বরে বলল- মা মহুল যেমন তোমার নাতনি ঠিক তেমনি আমার আর হৈমন্তীর মেয়ে। তাই মহুলের জীবনের ব্যাপারে হৈমন্তীর মতামত খুব দামী অন্ততঃ আমার কাছে।
সুবলা দেবীর রাগের আগুনে খানিকটা ঘি-এর মতো যোগ হলো অভয়ের কথাগুলো। দাউ দাউ করে যজ্ঞের শিখার মতো জ্বলে উঠে বললেন, তুমি তো বাবা অফিস আর ঘর করো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমাকে থাকতে হয়।
এর মধ্যেই তোমার বউ-এর কীর্তি পাড়াতে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
হৈমন্তী কিচেনে খাবার রেডি করার জন্য দোতলা থেকে নেমে আসতেই সুবলা দেবীর মুখে এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
হাসি থামিয়ে বলল- মা আপনার তো তাহলে খুব নিন্দা মন্দ হচ্ছে পাড়াতে। তাহলে কিন্তু আজ থেকে আর পাড়া বেড়ানোটা বন্ধ করুন।
সুবলা দেবী মুখটা গম্ভীর করে বলল- তোমার মতো মুর্খ মেয়েমানুষ আমি তো এই প্রথম দেখলাম। নিজে সাধ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনো। তুমি আবার এম এ পাশ দিয়েছো!
সুবলা দেবীর এই একটা অস্ত্র আছে। যখন নিজে আর যুক্তি তর্কে পেরে ওঠে না তখন হৈমন্তীকে ধরাশায়ী করতে হৈমন্তীর শিক্ষা, বংশ এইসব নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করে।
হৈমন্তী ও তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রয়োগ করে খুব মিষ্টি ও সংযত ভাবে।
-মা ভাগ্যিস ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে ছিলাম। তাই তো উচ্চ শিক্ষার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন আপনারা। না হলে আমাকে কি আর মানুষ ভাবতেন? আপনাদের উচ্চ বনেদী বংশ। আপনারা ছিলেন গাঁয়ের বড়লোক। আর সেখানে আমার বাবা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মাত্র। আপনাদের উদার মানসিকতা। তাই তো আপনার স্বামী আমাকে আপনাদের ঘরের বউ করে এনেছিলেন। মনে আছে মা উনি আমাকে কি দিয়ে মুখ দেখেছিলেন? উনি ওনার বই আলমারির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বড় বৌমা এখন মরেও সুখ আমার। এতকাল শুধু ভাবতাম আমি মরে গেলে আমার বইগুলোর কি হবে? আমার সহধর্মিণী পুরানো খাতা-বই বিক্রির দোকানে গিয়ে হাফ দামে বিক্রি করে টাকাগুলো বগলদাবা করে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসে বই-এর খালি আলমারিটার মধ্যে ওনার মহামূল্য শাড়ি কাপড় রাখতে রাখতে বলবেন, কতবার বলেছিলাম একটা আলমারিতে আমার আর হচ্ছে না। আরেকটা আলমারি কিনে দাও। সে তো দিলে না। অগত্যা তোমার সাধের বই আলমারিটাই আমাকে বুদ্ধি করে কাজে লাগাতে হলো।
শ্বশুর মশাই এর এমন বুদ্ধি দীপ্ত রসিকতা শুনে সেদিন নতুন বউ এর ‘বউ বউ’ লজ্জা ভুলে বেশ হা হা আওয়াজ তুলে হেসেছিল হৈমন্তী।
হৈমন্তীর বিয়ের বছর দশেক পর মারা গিয়েছিলেন সুবলা দেবীর স্বামী। স্বামীর বিয়োগে সুবলা দেবী যত না ভেঙে পড়ে ছিলে তার থেকে অনেক বেশি ভিতর ভিতর ভেঙে গিয়েছিল হৈমন্তী।
নতুন এই ঠিকানায় তার তো একমাত্র মনের সঙ্গী ছিল তার শ্বশুর মশাই। বিকাল বেলা হলেই অভয়ের বাবা গল্পের বই বের করে হৈমন্তীকে ডাক দিতেন। বলতেন, বৌমা আমার চোখের জোড় তো আগের মতো নেই। তাই টানা অনেকক্ষণ ধরে বই পড়তে পারি না। তার চেয়ে ভালো এখন থেকে তুমি বই পড়বে আর আমি শুনবো।
এমন প্রস্তাবে হৈমন্তী যেন মনে মনে ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল সেদিন। তারপর দীর্ঘ দশটা বছরের ছয়টা মাস বাদ দিলে একশো চোদ্দো মাস বিকাল বেলার এই গল্পের আসর বসেছে হৈমন্তীর শ্বশুরবাড়িতে। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স্মরণজীৎ চক্রবর্তী, আশাপূর্না দেবী থেকে বানী বসু এমন নতুন পুরাতন লেখক লেখিকা কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ঝড় বয়ে যেতো সুবলা দেবীর তিনতলা বাড়িতে।
তবে সুবলা দেবী সাধারণত এড়িয়ে চলতো এই গল্পের আসরকে। মাঝে মাঝে স্বামীর অনুরোধে এসে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন নি। কারণ পাড়ার মহিলাদের মুখরোচক টাটকা গল্পের আসর থেকে ডাক আসতে থাকে বারংবার।
এইসব পুরানো কথা উঠলে কিছুতেই হৈমন্তী নিজের আবেগকে সংযত রাখতে পারে না। আসলে একটা চাপা যন্ত্রণা বড্ড টনটন করে ওঠে বুকের ভিতরটা। তার বড় ইচ্ছে ছিল নিজের লেখাপড়াটাকে কোনো সামাজিক কাজে লাগানোর। তাই সে ভেবেছিল গাঁয়ের নীচু পাড়াতে গিয়ে একটা অবৈতনিক নাইট স্কুল খোলার। স্বামী শ্বশুরকে পাশে পেলেও শাশুড়ি, ননদ, দেওর কাউকেই পাশে পায় নি। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা সম্ভব নয়। তাই সে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে ছিল।
তাই হয়তো এই কারণেই মহুলের পাকা কথার দিন ভরা সভাতে ছেলের বাড়ির পাকা মাথাদের সামনে হৈমন্তী বলে ওঠে- আমি মেয়ের মা হয়ে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই আপনাদের কাছে। আমার মেয়ে সরকারি অফিসের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন। এই চাকরিটা পাওয়ার জন্য দিন রাত এক করে মেহনত করেছে সে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম জানে কেবলমাত্র চালিয়ে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পরও এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে আশা করি না আমি। আর তখন যদি আপনারা ঘরের কাজকর্মের জন্য বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন তাহলে কিন্তু সমস্ত চাপটা এসে পড়বে আমার মেয়ের ওপর। তাই জানতে চাইছিলাম আপনাদের ছেলে কি দৈনন্দিন জীবনের জরুরী কাজ কর্মগুলো যেমন ধরুন রান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘর মোছা জানে তো?
হৈমন্তীর এই প্রশ্নে পাত্রের ঠাকুমা, মা, কাকীমা, দাদু, বাবা, কাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো মাত্র।
পাত্রের দাদু গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন- আমার পরিবারে মেয়েদের গৃহকাজে সাহায্য করার জন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছি। আমাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের কাজেই পারদর্শী বেশি। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি অভয় বাবু, আপনার সহধর্মিণী কিন্তু ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। আমাদের পরিবারের মেয়ে বউরা কিন্তু অনেক ভদ্র ও লাজুক। আজ আমরা আসি। বাড়িতে গিয়ে অর্ক দাদুভাই-এর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। তারপর জানাবো।
এরপর কেটে গেছে আরো দু তিনটে মাস। ভ্যাপসা গরমের জায়গা নিয়েছে ঠান্ডা আমেজ। আশ্বিন শেষ করে কার্তিক আগত। দু’ দুটো মল মাস পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে। সুবলা দেবীর খুব ইচ্ছা ছিল মহুলের বিয়েটা এই অগ্রহায়ণে হবে। কিন্তু হৈমন্তীর অদ্ভুত সব জিজ্ঞাসাবাদের দৌলতে মহুলের বিয়েটাই ঝুলে গেল। পাত্রপক্ষ চুপচাপ দেখেই চলে গেল। সুবলা দেবী এইসব কথা ভাবে আর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে হৈমন্তীর সেই দিনের বক্তব্যগুলো যত দিন যাচ্ছে চানাচুর তেলেভাজা সহযোগে পরিবেশন করতে থাকে।
অনেকেই অবশ্যই সুবলা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার নাতনির বিয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। এমন মোটা টাকার মাইনের চাকরি যার।
আবার অনেকই বলে তাই বলে পাত্রকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম জানতে হবে তবেই মা বিয়ে দেবে। এমন আবদার থাকলে পাত্র পেতে তো বেগ পেতেই হবে। যতই হোক আজও আমাদের সমাজ পুরুষ তন্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। একদিন ডিনার টেবিলে অভয় বলে- হৈমন্তী তোমার ঐ অসম্ভব জেদটা এবার ছাড়ো। আমি আমাদের মুখার্জী ঘটককে আসতে বলেছি আগামী কাল।
হৈমন্তীও গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- হ্যাঁ গো আমাদের সমাজের মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হলেও পুরুষরা কিন্তু এখনও মধ্য যুগেই পড়ে আছে। নারী তুমি যতই বিদূষী হও, যত বড় পদেই আসীন হও না কেন বাড়ি ফিরে ক্লান্তি ভুলে খুন্তি তুলে নিতেই হবে পরিশ্রান্ত হাতে।
রাতে শুয়ে শুয়েও এই বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্যে অভয়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, কেমন আছেন অভয় বাবু? আমি অর্কর দাদু বলছি।
অভয় তাড়াতাড়ি বালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসে। হৈমন্তী চোখের ইশারায় ফোনটা স্পিকারে দিতে বলে।
অর্কের দাদু বলেন, আমাদের বাড়ির মেয়ে, বৌমারা অর্ককে একটা বছর ধরে ঘষে মেজে প্রাত্যহিক ঘরোয়া কাজকর্ম শিখিয়ে ফেলেছে মোটামুটি। এখন আমার দাদুভাই ডাক্তারির পাশাপাশি ভাত, ডাল রান্না করতে শিখে গেছে। সত্যি বলছি অভয় বাবু, সেদিন আপনার মিসেস এর কথা আমার প্রথমে একদমই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌমারা বোঝালো যে পুরুষ মানুষ টুকটাক রান্না বান্না ঘরের কাজ না জানলে তাদের কি কি অসুবিধা হয়। সেদিন বুঝলাম আপনার মিসেস এর কথাগুলো ওর একার কথা নয়। আজকালকার বেশিরভাগ মেয়েদেরই কথা।
তাদের অসুবিধার লিস্ট শুনে তো আমরা পুরুষরা খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর এই বয়সে এসে রান্নাবান্না শেখা সম্ভব নয়। তাই অর্কর বাবা আর অর্ককে বললাম, তোদের তো এখনও শেখার বয়স আছে। তোরা ই না হয় রান্না শিখে দেখিয়ে দে পুরুষ মানুষও বাইরে ও ঘর দুটোই সামলে নিতে পারে। কথাগুলো শেষ করে হো হো করে হাসি দিয়ে মোবাইলটা ভরিয়ে তুললেন।
হাসি থামিয়ে বললেন- তাহলে আপনারা কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে মহুল ও অর্কর বিয়ের দিনটা ঠিক করতে?
অভয় কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ হয়ে যায়। হৈমন্তীর ঠেলা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। শান্ত ভাবে বলে, মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে দিনটা জানাচ্ছি।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পরই অভয় হৈমন্তীর হাত দুটো নিজের কোলের কাছে টেনে এনে বলে, প্রথাগত আচার আচরণের বাইরে যাওয়ার জন্য অনেক সাহস লাগে। আমার তো সে সাহস কোনোদিন হলো না। কিন্তু তুমি চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও সেই সাহসটুকু দেখিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত জীবনটা কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত ও শান্তি পূর্ণ করে তুলতে পেরেছো।
হৈমন্তী জিতে যাওয়ার আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেলে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চলি বলেই তো সমাজের চলার পথে এতো আবর্জনা জমে যাচ্ছে। নারীদের উন্নতি চাইছি কিন্তু উন্নতির জন্য যে পরিবেশ দরকার তা আমরা তৈরি করতে রাজি নই। যাক গে সমগ্র সমাজ পাল্টানোর ক্ষমতা তো আমার নেই। কিন্তু আমি আমার মেয়ের জীবনে তো পরিবর্তনের হাওয়া আনতে পেরেছি।
এখন শুয়ে পড়ো। কাল সকালে মা’কে জানিও অর্কের দাদুর কথাগুলো। অভয় এল.ই.ডি. টিউবটা বন্ধ করে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অভয় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও হৈমন্তী সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। মনের মধ্যে উঠে আসতে লাগল মহুলের মা হওয়ার পর থেকেই মেয়ের জন্য আজ অবধি কত লড়াই না সে করেছে। -
গল্প- চিরদিনের
চিরদিনের
-শিলাবৃষ্টিএকটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষটার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছেনা। দুই ছেলে, দুই বৌমা প্রথম প্রথম তৎপর হয়ে খোঁজার চেষ্টা করলেও আবার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে! প্রতিভা দেবী আর কত বলবেন! ছেলেরাও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে হয়তো! পেপারে দেওয়া হয়েছে,এখন সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কি!
চল্লিশ বছর এক ছাদের তলায় দুজনে কাটিয়েছেন, কিন্তু এই বয়সে এসে এরকম ভাবে একা ফেলে চলে গেলেন অনাদি বাবু!
আসলে কিছুদিন ধরেই একটু অন্যমনস্ক ছিলেন তিনি। প্রতিভা দেবী অনেকবার প্রশ্ন করেছেন। একটাই উত্তর দিয়েছেন মাঝে মাঝে- আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করেনা। তুমিও ছেলেদের দলে ভিড়ে গেছ!
আসলে পুরোনো ধ্যান ধারণা ছেলেরা বউরা মানতে চায় না। প্রতিভা দেবীও অশান্তি এড়াতে ছেলেদের কথায় সাপোর্ট করতেন বেশী। গুম হয়ে যেতেন অনাদি বাবু। হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় সেই যে হাঁটতে গেলেন। আর বাড়ি ফিরলেন না।
কত খোঁজাখোঁজি করেও কোনো ফল হয়নি।
কত স্মৃতি আজ ভিড় করে আসে প্রতিভা দেবীর মনে। রাতে ঘুম আসেনা। তাহলে কি! না না আর কিছু ভাবতে চান না তিনি।
সকালে অফিস বেরোনোর সময় ছেলেদের কাছে
বলতে যান প্রতিভা- কিরে তোরা কিছুই আর করবি না? তোদের বাবা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল?
-দেখো মা! আমরা কি চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু এই করবো! বড় ছেলের উত্তর।
ছোট ছেলে বলে- দেখো মা, কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে আমরা কি করতে পারি!
চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যান প্রতিভা।
সংসারে কত জিনিস ফুরিয়ে গেছে! একে তাকে দিয়ে কত আনাবেন? চলে যাওয়ার পরে প্রতি মুহূর্তে মানুষটার অভাব তিনি বুঝতে পারছেন!সেদিন অনেক রাত তখন… আজকাল ঘুম আসতে চায় না। একতলার বড় ঘরটাই তাঁদের।ছেলেরা উপরে থাকে।
হঠাৎ জানালায় কার যেন ছায়া!
-কে কে? কে ওখানে?
ফিসফিসিয়ে বলে- চুপ! দরজা খোলো।
এসেছে, এসেছে সে। ছুটে যান প্রতিভা দেবী।
দরজা খুলে ঘরে নিয়ে আসেন স্বামীকে।
-কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে এতদিন?”
-আবার চলে যাবো এখনি।
-না আর যাবে না তুমি. বড় খোকা….
অনাদি প্রতিভার মুখ চেপে ধরেন- ওদের ডেকো না। আমার অনুপস্থিতিতে ওদের কারো কিছু যায় আসে না গিন্নী! আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি! চলো। কটা শাড়ি নিয়ে নাও ব্যাগে!
-কি বলছো এ সব? না আমি যাবো না। আমি চলে গেলে এদের….
-কিসসু হবে না এদের। রান্নার অসুবিধে হবে? রান্নার লোক রাখবে। নাতি নাতনিদের জন্য আয়া রাখবে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রতিভা।
-হ্যাঁ গো গিন্নী। একটু ভেবে দেখো। ওদের মানুষ করার জন্য নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য কি না করেছি আমরা। আজ প্রচুর পয়সা রোজগার করছে ওরা। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সবই তো রেখে যাচ্ছি। চলো না প্রতিভা আমরা যে কটা দিন বাঁচবো, একটু নিজেদের মতো করে বাঁচি।
-কিন্তু
-কোনো কিন্তু নয়। তুমি তো দেখলে এ কদিন। আমার জন্য কোনো মাথা ব্যথা আছে ওদের?
-কোথায় যাবো?
-আমার এক ছাত্রের একটা বাড়ি খালি পড়ে ছিল
এই শহরেই। সেই নীলেন্দ্র! মনে আছে তোমার? আমাকে এখনো এত শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে যে বলার নয়! সে আমেরিকায় থাকে পরিবার নিয়ে।
আমার সিদ্ধান্ত তাকে বলেছিলাম একদিন। সে বলেছে যতদিন খুশী আমি যেন তার বাড়িটায় বাস করি। তাহলে সে নিশ্চিন্ত হবে। কেয়ার টেকার থাকে সারাদিন। চলো গিন্নি, আমরা যেমন খুশী তেমন ভাবে বাঁচি।
….
ভোরের আলো ফোটার আগেই অনাদি আর প্রতিভা বেরিয়ে আসে সদর দরজা খুলে। দুজনেই
একবার পেছন ফিরে তাকায় নিজের বাড়িটার দিকে। পূব আকাশে রক্তিম আভা দেখা দেয়। অনাদি প্রতিভার হাতটা নিজের ডান হাত দিয়ে ধরে নেয়। তারপর গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করে। -
গল্প- মানুষ মানুষের জন্য
মানুষ মানুষের জন্য
-সুনির্মল বসুসেদিন কলেজের ছুটি ছিল। তাই অন্য একটা কাজ নিয়ে সুধাময় সান্যাল সীমান্ত শহর বনগাঁয় গিয়েছিলেন। অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। খিদেও পেয়েছিল খুব। ব্যাগের মধ্যে কিছু শুকনো মুড়ি ছিল। খেয়ে জল খেয়ে কোথাও একটু বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছিলেন।
তাঁকে এই অঞ্চলের পথের কুকুরগুলোও চেনে। তারা এসে ঘিরে ধরেছিল। তিনি স্টল থেকে বিস্কুট কিনে ওদের খেতে দিলেন।
তারপর স্টেশনে এসে পেতে রাখা টানা বেঞ্চিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন।
মাথার কাছে ব্যাগ ছিল। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা পয়সা ছিল। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠতেই, স্টেশনের উলঙ্গ বাচ্চাগুলো এসে বলল- জেঠু, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো, আমরা তোমার ব্যাগ পাহারা দিয়েছি।
সুধাময় বাবু ওদের খুব পরিচিত। ওই বাচ্চাদেরও তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেন।
বর্ধমান জেলার কালনা অঞ্চলে ওদের বিশাল জমিদারি ছিল একসময়। সুধাময় সব গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন।
ওর স্ত্রী মালবিকা একজন স্কুল শিক্ষিকা। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় ওদের একটা পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু সে দীর্ঘায়ু হয়নি।
বাচ্চাটা মারা যাবার পর, মালবিকা স্বামীকে বলেছিলেন, এবার আমাদের একটা বাচ্চা এডাপ্ট নিতে হবে।
সুধাময় বলেছিলেন, একটা বাচ্চা ভাবছো কেন, আমি একশো বাচ্চা এডাপ্ট নিতে চাই।
মালবিকা একথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
সুধাময় বলেছিলেন, আমি আমাদের জমিতে ছোটদের জন্য একটা স্কুল বানাবো।
ওনাদের বাড়ির মূল ফটকের পাশে পুরুষানুক্রমে রয়েছে একটি শিব মন্দির। প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যে এখানে ভক্তদের সমাগম ঘটে।
স্কুল করবার কথা জানাজানি হতে, ভক্তদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশেষ গুঞ্জন শুরু হলো।
একজন এসে বললেন, স্কুল বসালে, মুসলমান বাড়ির বাচ্চারা এখানে পড়তে আসবে, পাশে শিব মন্দির, এটা করা মনে হয় উচিত হবে না।
একদল এসে বলল- এ হলো গণ্ডমূর্খ গ্রাম। শুধু শুধু এদের পড়াবার জন্য চেষ্টা করলে, কোন লাভ হবেনা। ওরা কি বড় হয়ে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে।
সুধাময় শুনলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে ছোটদের জন্য স্কুল গড়তে গেলে, চারিদিক থেকে তার উপর চাপ আসবে।
তিনি বললেন, আমি তো ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে। কিন্তু মুসলমান বাড়ির ছেলেরা এখানে পড়তে আসলে আমার কোন অসুবিধা নেই। ওরা এক সময় আমাদের প্রজা ছিল। সুখে দুঃখে বংশ পরম্পরায় আমরা এখানে রয়েছি। কেউ জাতপাতের প্রশ্ন তোলেনি। বিপদে-আপদে ওরা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে।
অন্য একজন রগচটা তরুণ এসে বলল, দাদা, কাজটা তুমি মোটেই ভালো করছ না। এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে।
বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর উপর নানারকম চাপ এসেছিল। তিনি গ্রাহ্য করেন নি।
মনে মনে বলেছিলেন, একটাই তো জীবন। খালি হাতে এসেছি, খালি হাতে চলে যাবো। কিছু নিয়ে আসিনি, সঙ্গে করে কিছু নিয়েও যাবো না।
সুধাময় ততদিনে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি হাতে পেয়ে গিয়েছেন। কর্তা গিন্নীর উপার্জনের সিংহভাগ এই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ব্যয় হয়।
স্কুলের জন্য কম্পিউটার কিনেছেন, নিজে ভাঙ্গা কম্পিউটার নিয়ে বাড়িতে নিজের কাজ করেন।
মালবিকা স্কুলের নাম দিয়েছেন, সহজ পাঠ। দূর দূর গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে প্রতিদিন পড়তে আসে। বই খাতা পত্র সবই পেয়ে যায়।
সুধাময় বাবু বরাবর একটু অন্যরকম।
নিজেদের জমিদারি একদিন যেমন সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন, এভাবেই শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে,
আজ সহজপাঠ শিশু নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ওই অঞ্চলের মানুষ বলে, উনি মানুষ নন। বিলকুল দেবতা আছেন।প্রতিপক্ষেরা বলে, লোকটাকে কিছুতেই দমানো গেলো না।
একটা কাজ শেষ হয়েছে। আবার একটা কাজ শুরু করছেন তিনি। শিক্ষার আলো জ্বেলে দিতে হবে তাঁকে। বয়স বাড়ছে। সময় কমে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান আজও তিনি।
মানুষকে ভালোবাসার কথা তিনি মুখে কখনো বলেননি, করে দেখিয়েছেন।
গতকাল রাতে সন্ধের টিভির খবরে জানা গিয়েছে আগামী ২৬শে জানুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়া হবে, তাঁর রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবার ডাক এসেছে।
সেদিন কলকাতায় সুধাময় বাবুর সঙ্গে একটি সাহিত্যের বাসরে আমার দেখা হয়েছিল। ওনার কাজের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। এত বড় মনের মানুষ সংসারে সচরাচর চোখে পড়ে না।
আমি ওনার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। বললাম- ও দাদা, কি করে পারলে, এত মনের জোর তুমি কোথায় পাও?
উনি হেসে বললেন- রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না, কিছু করতে হবে না, শুধু শিকড়টা ছুঁয়ে থাকবি। আমার একটা ছেলে যেদিন মারা গেল, সেদিন আমি আমার গিন্নীকে একশো ছেলের দায়িত্ব নেব বলেছিলাম। আজ সহজ পাঠ শিশু নিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে। ভালো আছি ভাই। এর চেয়ে বেশি কখনো তো কিছু চাইনি। লিও টলস্টয় এর গল্প মনে পড়ে, একটা মানুষের কতটুকু জমি দরকার।
‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাস এ ম্যান রিকোয়ার্ড?’ফিরে এলাম।
মনে মনে বললাম, ভালোবাসার মানুষ থাকলে, ভালোবাসার বাড়ি হয়। মনে ভালোবাসা থাকলে, ছোটদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেবার ইচ্ছে জাগে। সহজ পাঠ শিশু নিকেতন তৈরি হয়।
দাদা তুমি পেরেছো, দাদা, তোমার মতো করে ভাবতে পারলে, দেশে শত শত হাজার হাজার দীপাবলীর রাতের মতো কত আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত।
সংসারের ক্ষেত্রে এমন পবিত্র আলোর মতো মনের মানুষ দেখতে পেলে, গভীর আবেগে হৃদয়ে ভালোবাসার ঢেউ ওঠে।
আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। শুধু মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ভাবনার গভীর ডুবে যাই। দু’চোখ জলে ভরে যায়।
পৃথিবীতে অনেক কিছুই মনের মতো নয় হয়তো, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, এত আলো জ্বালিয়ে দেন, তখন ওদের মানুষ মনে হয় না।
আমি কখনো ঈশ্বরকে দেখিনি। এদেরকে দেখলে মনে হয়, আমি ঈশ্বরকে দেখতে চাই না।
ছোটখাটো চেহারার মানুষগুলোকে তখন আকাশের সমান লম্বা মনে হয়। মনে হয়, এই তো! আমি ঈশ্বর দেখতে পাচ্ছি।এদের জন্য বড় শ্রদ্ধা জাগে মনে। কত কত দিন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, চোখের সামনে বারবার একই দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে।
তখন মনে হয়, জীবন আমার ভালবাসায় ভরে গেছে। ঈশ্বর আমাকে ঈশ্বর প্রতিম মানুষ দেখিয়েছেন।
চোখে জল আসে। ঘুরেফিরে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আপনারা এত ভালো কেন বলুন তো?
মনে মনে আমি ওনাকে বললাম, তোমাকে আনত প্রণাম, দাদা।
সেই সঙ্গে মনে হল, আমার এই দীর্ঘ জীবনে চলার পথে অন্তত দু-একজন ঈশ্বর ঈশ্বরীর দেখা পেয়েছি।
যাওয়া আসার পথের ধারে কত মনিমানিক্য পড়ে থাকে, দেখার চোখ থাকলে, জীবনের কোনো বাঁকে ঠিক একদিন ঈশ্বর এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন।