ধারাবাহিক

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২৩)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [পঁয়তাল্লিশ]

    পঞ্চায়েত প্রধান সনাতনের বাড়ি আসার অধিকার এখন এই অঞ্চলের সকলের। যে কেউ প্রয়োজনে তার কাছে আসতে পারে। আসেও। তাতে কারোর মনে প্রশ্ন থাকার কথা না যে, সেই ব্যক্তি কেন, কি উদ্দেশ্যে সনাতনদের বাড়ি এসেছে। সেই কথা মাথায় রেখে সেদিন ভোর-ভোর বিপ্লবের মা সীতাদেবী এসে হাজির সনাতনদের বাড়ি। ভোরে আসার কারণ, যাতে সনাতনকে একা পাওয়া যায়। সনাতন তখন বাথরুম সেরে দাঁতে ব্রাশ করছে। এত ভোরে বিপ্লবদার মাকে দেখে চমক খায় সনাতন। তাড়াতাড়ি করে মুখ ধুয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,“কি খবর কাকিমা? হঠাৎ এত সকালে? বিপ্লবদার কোন খবর আছে?” ততক্ষণে সীতাদেবীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তার খবর নিতেই তো তোমার কাছে এলাম বাবা। কতদিন হয়ে গেল ছেলেটা বাড়ি ছাড়া। বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে। অভিমানে ছেলে সেই যে বাড়ির সদরের বাইরে পা রাখল আর এ’মুখো হল না। আমি মা হয়ে কেমন করে তা মেনে নিই বল বাবা? রাতে ঘুম আসে না। স্বপ্নে দেখি ছেলেটাকে আর চমকে উঠি। বাপের মন ভাঙে তো বচন নড়ে না। বেজাতের মেয়েকে সে ঘরে তুলবে না। আর তোমার বিপ্লবদাকে তো তুমি চেনো। সেও তার কথা থেকে সরবে না। বাপ বেটার এই জেদাজেদির মধ্যে পড়ে আমার তো প্রাণ উবে যায়-যায়। এমনিতে কারবারে মন্দা যাচ্ছে। আর ছেলেটা বাড়ি ছাড়ার পর কাজকর্ম সব লাটে উঠেছে। তোমার কাছে ওর কোন খবর নেই, না বাবা?”
    -না কাকিমা। আমরাও তো সেই কথাই ভাবছি। বিপ্লবদা ইকনমিক্স নিয়ে এম.এস.সি. পড়ার তোড়জোড় করছিল। আমরা আনন্দ করে বললাম, তুমি এগিয়ে যাও দাদা। তোমাকে দেখে যদি আমরা প্রেরণা পাই। সেসব বন্ধ করে কোথায় গেল কে জানে! তবে আমি হাল ছাড়িনি। খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। হদিশ পেলেই আপনাকে খবর পাঠাব। সনাতন অন্তর থেকে বলল।
    আশেপাশে কেউ আছে কিনা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সীতাদেবী আস্তে করে সনাতনকে বলল, “হ্যাঁরে বাবা, ওই অলোকা মেয়েটার বাড়ির লোক ওর বিয়ের জন্যে দেখাশোনা করছে না?”
    সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তভাবে সনাতন বলল,“কেন বলো তো কাকিমা? সেরকম কিছু তুমি শুনেছো নাকি? বা তোমার হাতে অলোকাদির উপযুক্ত ছেলে আছে নাকি? তাছাড়া অলোকাদির বিয়েথার ব্যাপারটা অলোকাদির হাতেই ছেড়ে দিয়েছে ওদের বাড়ির বড়োরা। অলোকাদির মত বিদ্বান, সুন্দরী, শিক্ষিকার পাত্র দেখার যোগ্যতা ওর বাবা-মায়ের নেই। সেই কথা বলেও দিয়েছে তার বাবা-মা। আর আমি যতটুকু জানি, মানে অলোকাদি এবং বিপ্লবদার মুখ থেকে যতটা জেনেছি, ওরা দু’জনে দু’জনকে প্রচন্ড ভালবাসে। বিয়ে করলে ওরাই হবে ওদের পছন্দের পাত্রপাত্রী। এই জুটি বিপ্লবদার বাবার মতো তোমারও পছন্দ নয়, তাই না কাকিমা? আমার তো মনে হয়, মা হয়ে তোমাকে এটা মেনে নেওয়া উচিত। জাতপাত ছাড়ো না। ওটাকে তো চোখে দেখা যায় না। বিশ্বাসের ব্যাপার। তা, জন্মসূত্রে পাওয়া সেই বিশ্বাস যে যার নিজের মধ্যে থাকুক না। কিন্তু যেটা দৃশ্যত সত্যি সেটা হল বিপ্লবদা তোমাদের একমাত্র সন্তান। জাতের নিজস্ব কোনো চেহারা নেই। কিন্তু এই জাতের দোহাই দিয়ে নিজেদের মুর্খামি অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে না তো কাকিমা! বিপ্লবদা উচ্চশিক্ষিত একটা ছেলে। তার শিক্ষাদীক্ষার ধারে কাছে তোমরা কেন তোমাদের পাড়ার কেউ আজ পর্যন্ত যেতে পারেনি। তার জ্ঞানগম্মির সঙ্গে তোমাদের ওদিকের কারোর তুলনা চলে না। তাহলে কোন যোগ্যতায় তোমরা তার উপর অধিকার ফলাতে যাও জানি না। শুধু পিতামাতার অধিকারে এতবড় ভুল সিদ্ধান্ত তোমরা নিয়ে নিলে কাকিমা? তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে? এটা কেমন কাজ হল তোমাদের কাকিমা! কাকিমা, আমি জানি আমার শক্ত শক্ত কথাগুলো তোমার ভালো লাগছে না। তাই উশখুশ করছো কতক্ষণে তুমি এখান থেকে চলে যাবে। যাবে তো বটেই। তবে একবার ভেবে দেখো কাকিমা, আমি কি বলতে চাইলাম।”
    সনাতনের মাস্টারির হাতযশে এবার মাধ্যমিকে অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুব ভাল ফল করে সুন্দরীও। ওদের বাড়ি তো দারুণ খুশি। আনন্দে আপ্লুত হয়ে সুন্দরীর মা মিষ্টিমুখ করাতে সনাতনদের বাড়ি এসেছে। সুন্দরীও মায়ের আঁচল ধরে এসে হাজির। ওকে দেখে সনাতনের মা বলল,“তোর মাকে একটু চা করে খাওয়া তো মা? আমাদের জন্যেও বেশি করে জল বসিয়ে দিস। তোর স্যার ঘাটে গেছে। এক্ষুণি এসে যাবে।” সুন্দরী চা করতে গেলে সনাতনের মা বলে, “তোমার মেয়েটা বড়ই মিষ্টি স্বভাবের দিদি। কোনো কথায় ‘রা’ কাটে না। যা কাজ বলবো মুখ বুজে সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেবে সেটা করার জন্যে। ওটাকে আমার ঘরে রেখে দেব। বলে রাখছি তোমায় দিদি।”
    সনাতনের মায়ের কথায় সুন্দরীর মা বলে,“ছেলের মন আবার কি বলে তা তো জানা দরকার। তোমার শিক্ষিত ছেলে। সেইসঙ্গে আমাদের পঞ্চায়েতের প্রধান। কত দামি ছেলে তোমার। তার কাছে আমার সুন্দরী তো কত সাধারণ। পরে যদি সে বেঁকে বসে তো আমরা বিপদে পড়ে যাব। তাই না দিদি।”
    -তুমি অত বোকা কেন দিদি? এটুকুও বোঝো না। আজকাল কত ভালমন্দ, নামী-অনামী লোক প্রধানের বাড়িতে আসে। লোকজন একটু বেশি হলেই ছেলে আমাকে বলবে, সুন্দরীকে ডেকে আনো মা। তুমি একা এত কাজ সামলাতে পারবে না। পছন্দ না করলে কথায় কথায় সুন্দরীকে ডাক দেয় কেন ছেলে সেটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। মা হয়ে আমি ছেলের মন খুব ভাল করে বুঝতে পারি।” বলতে বলতে সনাতন ঘাট থেকে এসে দেখে সুন্দরী রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে আসছে। ওকে দেখে সনাতন বলল,“সুন্দরী এসেছিস, ভাল হয়েছে। দাবায় মাদুরটা বিছিয়ে ঘরের টেবিল থেকে লাল ফাইলটা আর পেনটা এনে দে।” আগের কথার রেশ ধরে সনাতনের মা বলল, “দেখলে তো সুন্দরীর মা, ছেলে কতটা তোমার মেয়েকে ভরসা করে। আমাদের বাড়ির কোথায় কি আছে সব তোমার মেয়ের মুখস্থ। আমি মুখ্যু মানুষ। কাগজপত্রর কিছু বুঝি নাকি! তাই সুন্দরীকে পেলে ছেলে আমার খুব খুশি। দেখছো তো নিজের চোখে। এর পর কি বলবে, ছেলের অপছন্দ তোমার মেয়েকে? ওসব ভাবনা ছাড়ো। সুন্দরীকে আমার জন্যেই রেখে দাও। পারলে এখন থেকেই থাকুক আমার কাছে। আমার তাহলে আর মেয়েকে ডাকতে তোমার বাড়ি বারবার ছুটতে হয় না। সময় মত চার হাত এক করে দেবো’খন। খুশির দমকে হাসতে হাসতে বলল সনাতনের মা।
    সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে আটচালার ভেতরটা সাজগোছ করা। তিনজন বসার মত ছোট্ট একটা স্টেজও করা হয়েছে তার মধ্যে। সাজানো হচ্ছে কাগজের রংবেরঙের ফুল দিয়ে। সনাতন আর অখিল দু’জনে মিলে সবকিছুর তদারকি করছে। পাড়ার সব বাড়ি বাড়ি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আজ আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করা মেয়ে, অলোকাকে সম্মানিত করা হবে। বাইরের কিছু
    গুনী মানুষ আসবেন এই উপলক্ষ্যে। অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্যে সকলের উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আগে থেকে অলোকাদির সঙ্গে কথা বলে আজকের দিনটাই স্থির হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে গোটা রুইদাসপাড়ায় একটা খুশি খুশি ভাব। বিশেষ করে উঠতি ছেলেমেয়েরা, যারা লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত। তাদের মনে তো খুশির অন্ত নেই। পাশাপাশি আবার প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মত আর একটা দল সনাতন-অলোকাদের কাজের বিরোধিতার অস্ত্রে শান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাড়ি বাড়ি অনুষ্ঠানের কথা জানানোর সময় ওই দলের অন্যতম স্যাঙাৎ বরেণ অনুষ্ঠানে তাদের ভূমিকার কথা সনাতন-অখিলকে জানিয়ে দিতে বলে, “তোমরা যাকে নিয়ে মাতামাতি করছো, সেই অলোকা রুইদাসের বিরুদ্ধে আমাদের গুরুতর অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগ জানানোর সুযোগ না দিলে আমরা কিন্তু বাইরের অতিথিদের সামনে গণ্ডগোল শুরু করে দেব। তখন তোমরা আমাদের দোষ দিতে পারবে না। আগে থেকে সেকথা জানিয়ে দিচ্ছি আমরা।” সেইসময় জড়ো হয়ে গেল ওই দলের নোচে, বিন্দে, কেলে, অভয়রাও। তারাও বরেণের কথাতে সায় দিয়ে হম্বিতম্বি করতে শুরু করে। সনাতন দেখল এদের এই মুহূর্তে থামাতে না পারলে এরা আরও মাথায় চড়ে বসবে। কড়া গলায় সনাতন বলল, “অলোকাদির সম্মান অনুষ্ঠানে কাউকে কিচ্ছু বলার অনুমতি দেওয়া হবে না। বাইরের গণ্যমান্য মানুষের সামনে কেউ যদি হুল্লোড় পাকাবার কথা ভাবে, তাহলে তারা ভুল করবে। তাদের মনে রাখা উচিৎ আয়োজকদেরও লোকজন আছে। তাদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখলে পরিণতি ভাল হবে না বলে দিলাম। তখন হুল্লোড়বাজরা কত ধানে কত চাল বুঝতে পারবে। মূল অনুষ্ঠান শেষ হবার পর অতিথিজনেরা চলে গেলে আটচালার সভা বসানো যেতে পারে। তখন তোরা তোদের কথা বলার সুযোগ পাবি। পাড়ার সব্বাইকে তখন থাকতে বলা হবে।” সনাতন বলার পর রাগে গরগর করতে করতে অখিল বলল, “ভাই সনাতন, তুই শুধু আমাকে মুখ ফুটে বলবি, কি করতে হবে। তারপর আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝে নেব। এদের দৌড় কতটা তা আমার খুব ভাল করে জানা আছে। কেষ্টার চুল্লুর ঠেক পর্যন্ত তো এদের দৌড়। সে আমি দেখে নেবখন।
    বরেণ-অভয়রা বুঝতে পারেনি সনাতন-অখিলরা এইভাবে তাদের ধমক দিতে পারে। ওরা থতমত খেয়ে যায় অখিলদের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়। থমকে গিয়ে অভয় বলে, “ঠিক আছে, পরে যখন আটচালা বসবে তখন আমাদের কিছু বলার নেই। বাইরের লোকের সামনে আমরা কিছু করতে যাব না। তাতে আমাদের পাড়াকে লোকে ভুল বুঝবে। সেইসঙ্গে আমাদেরকেও ওরা খারাপ চোখে দেখবে। পাড়ার বদনাম আমরা করতে চাই না।”
    কয়েকটা গ্রামের বিশিষ্ট অতিথিদের উপস্থিতিতে অমর স্যার অলোকার হাতে ফুলের তোড়ার সাথে সাথে একটা সুন্দর সাদা পাথরের সরস্বতীর মূর্তি দিয়ে সম্মান জানালেন। অমর স্যার তাঁর বক্তৃতায় বললেন,“আমাদের সমাজের প্রান্তস্তর থেকে অলোকার মত মেয়ে তার নিজের যোগ্যতায় এই জায়গায় উঠে আসা সত্যিই নজিরবিহীন এক ঘটনা। অলোকার এই সাফল্য সমাজের পিছিয়েপড়া এবং পড়াশোনায় বীতস্পৃহ ছেলেমেয়েদের প্রেরণা দেবে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে। আমার ছাত্রী হিসেবে নিজে গর্ব বোধ করছি। আপনাদেরও গর্ব আপনাদের ঘরের মেয়ে দেখিয়ে দিল কোন বাধাই এগিয়ে যাবার পথে অন্তরায় হতে পারে না যদি নিজের মধ্যে জেদ, সাহস এবং লক্ষ্য স্থির রেখে চলতে পারা যায়। বিশেষ করে অলোকাদের মত মেয়েরা। সবশেষে আমি অলোকাকে আশীর্বাদ করছি জীবনপথে ও আরও এগিয়ে যাক। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আপনাদের- ঘরের কোণে এই মেয়েটাকে আটকে না রেখে পড়ার সুযোগ করিয়ে দেবার জন্যে।” অমর স্যারের সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ হতেই সভায় হাততালির ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। এত মানুষ তার সাফল্যকে স্বাগত জানাচ্ছে দেখে অলোকা আপ্লুত হয়ে গেল। এক ভালোলাগার অভিঘাতে তার পা যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। সেইসঙ্গে চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে সামলে নেবার জন্যে।
    এবার সঞ্চালক, সনাতন রুইদাস আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, তাদের ঘরের সন্তান অলোকা রুইদাসকে নিজের অনুভূতির কথা বলার জন্যে অনুরোধ করলো। কিন্তু অলোকা এত মানুষের সামনে কিছু বলতে চাইছিল না। আসলে বলার অভ্যেস না থাকার জন্যে, কি বলবে বুঝতে না পারার কারণে এমন অনিহা জন্মায়। মনে মনে বলার চেষ্টা করে কিন্তু কথা যেন সব হারিয়ে যায়। কি কথা বলবে, গলায় এসে দলা পাকিয়ে সব আটকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে তার। তবু সকলের অনুরোধে বিশেষ করে তার অমর স্যারের অনুরোধে অলোকা বলতে উঠে শুধু এইটুকু বলতে পারল,“আমার এই সাফল্য আমি আমাদের রুইদাস সমাজকে উৎসর্গ করলাম। সেইসঙ্গে একটাই আমার চাওয়া- আমাদের সমাজ যেন আধুনিক ধ্যানধারণার প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করার ভাবনাকে সমর্থন জানায়। মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। তাহলে পিছিয়ে পড়ে থাকা এই সমাজ আর-সকল সমাজের সঙ্গে সমকক্ষ হতে দেরি হবে না। প্রতিভা তাদের জাতের মেয়েদের অন্যদের থেকে কম নয়। সেই প্রতিভাকে উন্মোচন করতে গেলে চাই সমাজ-ধারকদের মুক্ত ভাবনাচিন্তা। তাদের সমাজে যার ঘাটতি লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রকট। সবশেষে বলি, ব্যক্তির ভাল হলে সমাজেরও ভাল হবে। ব্যক্তি-সমাজ একে অপরের পরিপুরক। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ সম্পূর্ণ নয়।” অলোকাদির বলার শেষে অমর স্যারের মত হাততালির ঝড় উঠল না। বোঝা গেল অলোকার বক্তব্যে রুইদাস সমাজের দিক থেকে স্বতস্ফুর্ত হাততালি এল না। আসার কথা তো অলোকাদি বলেনি। ও যে তাদের সমাজকে সবক শেখার পরামর্শ দিয়েছে। তাই গোঁড়া আর নিন্দুকদের পছন্দ হবার কথা নয় যে। এরা এখনো তাদের জাতিগত সংস্কারকে শিখন্ডী রেখে সেই মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন পদক্ষেপকে জিইয়ে রাখতে চায়। সমাজের উপর নিজেদের প্রতিপত্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সেটা সনাতন-অখিলরা খুব ভাল করে বোঝে। ওদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হল না যে এর পরবর্তী পর্যায়ে আটচালার যে মিটিংটার দাবি করেছে বরেণ-অভয়রা সেখানে এই বক্তৃতার বিরুদ্ধ প্রভাব আছড়ে পড়তে বাধ্য। মনে হল শুধু বরেণ-অভয়দের দল নয়, অন্যরাও, বিশেষ করে আটচালার কমিটির ওই স্বঘোষিত সমাজ ধারক-বাহকরাও এই বক্তৃতাকে ভাল মনে নিতে পারেনি।
    অলোকা রুইদাসের বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে এই সারস্বত সভার সমাপ্তি ঘোষণা করে সনাতন। সম্মানীয় অতিথি এবং বিভিন্ন গ্রাম ও বাইরের পাড়ার বিশিষ্ট অতিথিরা ধীরে ধীরে সভা ত্যাগ করা শুরু করে। সেই অবসরে সনাতন তার বাবা, আটচালা কমিটির অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য রতনকে বাড়ি চলে যেতে বলে, “বাবা, এবার তুমি বাড়ি চলে যাও। এখন আটচালার যে মিটিংটা হবে তা অত্যন্ত উত্তেজনা প্রবণ হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা। ডাক্তারবাবু তোমাকে কোনোরকম উত্তেজনা বা গণ্ডোগোলের মধ্যে থাকতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। হার্টের রোগির পক্ষে এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই তুমি বাড়ি যাও। পাড়ার একটা দল এই মিটিংয়ে গণ্ডোগোল পাকাবার জন্যে অনেক আগে থেকে সলতে পাকাচ্ছে। সে খবর আমাদের কানে এসেছে।” ছেলের কথায় রতন আর ‘রা’ না কেটে নিজের আসন ছেড়ে উঠতেই নন্দ, দিবাকর, সুবোধকাকা সহ অন্যান্য বয়স্ক সদস্যরা হইহই করে ওঠে ! সুবোধকাকা বলে,“তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছ নাকি, রতন? আটচালার এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটায় তুমি থাকবে না?” সঙ্গে সঙ্গে রতন কিছু বলতে যাবার আগেই সনাতন বলল, “বাবার ওষুধ খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে। হার্টের রোগির ঠিক ঠিক সময় ওষুধ খাওয়া জরুরী। সেইজন্যে আমি বাবাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছি। তাছাড়া বাবা যায় যাক-না। তোমরা, মুরুব্বি মানুষরা তো আছো। আমরাও আছি। বাবা না থাকলে কোন অসুবিধা হবে না। বাবা ছাড়া সভা খুব ভালভাবেই চলবে।”
    রতন চলে যেতে তার জুটি নন্দকাকা যেন মনমরা হয়ে চুপচাপ হয়ে গেল। সনাতন তা দেখে বলল,“নন্দকাকা, বাবা চলে গেছে তা কি হয়েছে। তোমরা তো আছো। কারোর জন্যে কারোর দিন থেমে থাকে না। সভা শুরু করে দাও।” বলতেই সুবোধকাকা বলল,“আজকের এই জরুরী সভা কে বা কারা তলব করেছো? তারা এখন বলুক, তাদের আর্জিটা কি ?”
    সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে থেকে অভয় রুইদাস উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “একটু আগে যাকে নিয়ে হইচই হল। যার নামে গুনগান গেয়ে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তোলা হল, সেই গুণময়ী মহিলা, অলোকা রুইদাসের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী আজ সকলের সামনে আমি আবেদনকারী দলের পক্ষ থেকে তুলে ধরতে চাই। রুইদাস পাড়ার যে মেয়ে লেখাপড়ার ছুঁতো করে, পড়া জানার নাম করে ভিন জাতের ভিন পাড়ার ছেলের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায়, রুইদাস হয়ে আমরা তা মেনে নিতে পারি না। এই আটচালা বহু আগে থেকে এই কাজ না করার কঠোর বিধান দিয়ে রেখেছে। তা সত্ত্বেও এই অসতী, চরিত্রহীন মেয়ে আটচালার বিধানকে তোয়াক্কা না করে সমানে লেখাপড়ার অজুহাত সামনে রেখে বেজাতের ফালতু একটা ছেলের সঙ্গে দিনদুপুরে নারীসম্মান মাটির মধ্যে লুটিয়ে দিয়ে চারদিকে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এর আগেও একবার আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করেছিলাম। কিন্তু পাল পাড়া আমাদের কথা তখন বিশ্বাস না করে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে সেদিনের সেই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে, সেই পালপাড়া আজ আমাদের অভিযোগ মানতে বাধ্য হয়েছে। তারাও এই অসবর্ণ মেলামেশাকে মেনে নেয়নি। তাই বিপ্লব পাল এখন পাড়া ছাড়া। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, তাকে আর পাড়ায় দেখা যাচ্ছে না। লোকে বলে তাকে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা, মেয়ের এই জঘন্য কাজে তার পরিবার পুরোপুরি মদত দিয়ে গেছে। মেয়ের সঙ্গে তার পরিবারও সমদোষে দোষী। আমরাও চাই, অলোকা রুইদাস ও তার পরিবার এই অন্যায় কাজ করার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমা চাক এবং দস্তখত দিক, কোন অবস্থাতেই সে পালপাড়ার ছেলেটার সঙ্গে মেলামেশা করবে না। তাকে বিয়ে করতে হবে পাড়ারই কোন যুবককে। তবেই তাদের সমাজ জাতভ্রষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আর যদি শর্ত না মানে তবে ইতিপূর্বে আটচালার বিধানে সমান অপরাধ করার জন্যে যেমন অপরাধী পরিবারকে পাড়াছাড়া করা হয়েছে, এই পরিবারকেও তাই করা হোক। আটচালার কাছে এটাই আমাদের আবেদন। আশাকরি আমরা সঠিক বিচার পাব।”
    যে স্থান কয়েক মিনিট আগে তাকে সম্মানের এতটা উচ্চ শিখরে তুলে দিল সেই আটচালাই তার চরিত্র নিয়ে এমন নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি করতে পারছে! সে কার সঙ্গে কথা বলবে, কার সাথে মেলামেশা করবে, তা ঠিক করে দেবে পাড়ার এই গুটিকয় অশিক্ষিত মাতাল লম্পট ছেলেরা! সেটা আবার তারিয়ে তারিয়ে শুনছে পাড়ার গণ্যমান্য মুরুব্বি মানুষরা! ওই মাতাল অভয় রুইদাসকে এতগুলো কথা বলতে দিল এইসব গণ্যমান্যরা! এ কেমন সমাজে সে বাস করছে! এদের সমাজে তাহলে শিক্ষাদীক্ষা, আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার কোন জায়গা নেই? শুধুমুধু জাতভ্রষ্ঠের দোহাই দিয়ে একটা সেকেলে চিন্তাকে এইভাবে চাপিয়ে দিতে তারা পারে? এমন অপমান গায়ে মেখে বেঁচে থাকার থেকে তো তার মরে যাওয়াই ভালো। মৃত্যুই তার মুক্তির একমাত্র পথ। নাহলে তার জন্যে তার পরিবারকে শাস্তি পেতে হবে। তাদের পাড়াছাড়া হতে হবে। এইসময় এই বয়সে তারা কোথায় যাবে। প্রজন্মান্তর যে জায়গায় তারা কাটিয়ে আসছে একটা ঠুনকো কারণে তার জন্যে তাদের ভিটেছাড়া হতে হবে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। অলোকা তা হতে দেবে না। এমনসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় অলোকা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাকে নিয়ে সভায় হুটোপুটি পড়ে যায়। আঁজলা করে জল মুখে ছিটিয়ে দিলে ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়। সনাতন তখন অখিলকে বলল,“অখিলদা তুই অসুস্থ অলোকাদিকে বাড়িতে রেখে আয়। এই অবস্থায় ওর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হলে আমরা দায়ী হয়ে যাব।”
    সনাতনের কথামত অখিল তার ছেলেদের নিয়ে অলোকাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার তোড়জোড় শুরু করতেই বিচারকদের অন্যতম মাথা দিবাকর-নিত্যানন্দরা বলল, “মেয়েটা এখন সুস্থ হয়ে গেছে। মূল অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সে না থাকলে বিচার কেমন করে হবে। ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মনে হচ্ছে পরিকল্পনা করে ওকে এখান থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে।”
    এবার অখিল আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “একজন নির্দোষ অসুস্থ মেয়ের প্রতি এমন ব্যবহার নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নয়। এই মেয়েটা কি অন্যায় করেছে? ও একজনকে ভালবেসেছে। তাকে বিয়ে করতে চায়। এতে তার দোষ কোথায়! অলোকা একজন শিক্ষিত স্বাধীনচেতা মেয়ে। তার উপর সে সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। তার জ্ঞানবুদ্ধি, ভাবনাচিন্তার কোন মূল্য নেই! আর ওই মুর্খ মাতালরা বলে কিনা তাদের পাড়ার কাউকে বিয়ে করতে হবে? একটা মেয়ের রোজগারের টাকায় খাবে, মাতলামো করবে আর বিলের মোষ তাড়াবে? সেই খোয়াব দেখা হবু স্বামীটা কে শুনি? জাত রক্ষার ধুয়ো তুলে একটা মেয়েকে অপদস্ত করার কোন অধিকার নেই এই নোংরা ছেলেদের। আর কে আছে সেই উপযুক্ত সুপুরুষ যাকে অলোকার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে? দেখি তো একবার তার বদন খানা। অভয়, তুই তো তিন সন্তানের বাপ। তুই অলোকার পয়সায় বসে বসে খাবি বলে আবার বিয়ে করার দুঃস্বপ্নে মশগুল হয়ে আছিস নাকি!”
    অখিলের যুক্তির কাছে কথা খুঁজে না পেয়ে অভয় আমতা আমতা করে বলল,“আমি কেন বরেণ তো আছে। ও তো এখনো বিয়ে করেনি। স্বজাতির মধ্যে বরেণই অলোকার উপযুক্ত স্বামী হতে পারে বলে আমরা মনে করি।” অভয়ের কথায় তাল দিয়ে দিবাকর বলে, “একদম ঠিক কথা বলেছে অভয়। আমারও তাই মত।” সঙ্গে সঙ্গে অখিল বলে, “দশবার জন্মালেও বরেণ অলোকার উপযুক্ত হতে পারবে না। কি যোগ্যতা আছে ওর। ও স্বজাত। এটাই ওর যোগ্যতা? অলোকা অন্য জাতের ছেলেকে বিয়ে করলে ওর জাত চলে যাবে? কেন যাবে? যেখানেই ওর বিয়ে হোক, অলোকা, অলোকা রুইদাসই থাকবে। রুইদাসদের রক্ত ওর শরীরে বইছে। জন্মসূত্রেই ও রুইদাস ছিল, আছে, থাকবে। সে রক্ত কে টেনে বার করে অন্য জাতের রক্ত ঢোকাবে? অলোকা কেন পাল কুমোর হতে যাবে? হ্যাঁ, বিপ্লবকে বিয়ে করলে বিপ্লবের সন্তান, যে অলোকার পেটে ধারণ করবে তারা পাল হতে পারে। অলোকা নয়। আমাদের রুইদাস জাতের কোন ক্ষতি হবে না তাতে। আর দিবাকর কাকা, তুমি নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছো। বাড়ির মেয়েরা উদয়-অস্ত খেটে পয়সা রোজগার করে তোমাকে খাওয়াচ্ছে। আর তুমি এইসব মাতালদের দলে ভিড়ে মাতাল হয়ে ওদের সাওটা গাইছো। ভেবেছ একবার, তোমার বাড়ির মেয়েদের থেকে আমি যদি কাজ তুলে নিই, তোমার কি হাল হবে? ওই পুকুরের পাঁক তুলে তাতে উপুড় হয়ে শুয়ে পেটের জ্বালা জুড়োতে হবে। তাও যতক্ষণ কে ততক্ষণ।”
    অখিল এমন কথা বলার পর দিবাকরদের পক্ষে যারা আছে তারা হইচই ফেলে দেয়। নিত্যানন্দ বলে, “অখিল একজন বয়স্ক সদস্যকে এভাবে শাসাতে পারে না। অখিলও বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে জাত-বেজাত গুলিয়ে দিতে চাইছে। ওকে আমরা ক্ষমা করে দিয়ে ভুল করেছি। ওর পুনরায় বিচার করে শাস্তি দেওয়া দরকার।”
    এবার অখিলের পক্ষ নিয়ে সনাতনের বাবা রতনের বিশ্বস্ত সুভাষ বলে,“অখিল তার জাত খোয়ালো কোথায়! সে তো অন্য জাতের মেয়েকে রুইদাস করে নিয়েছে। অখিলের বউ রুইদাস সমাজকে নিজের হিসেবে মেনে নিয়েছে। অতএব তোমাদের এই যুক্তি ধোপে টেকে না। এই চল, আমরা অলোকাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। এই অসভ্যরা সবাই মিলে ওকে অপমানে অপমানে বিধ্বস্ত করে ফেলছে।” তখনই দিবাকর, নিত্যানন্দরা আবার চাপ দিয়ে বলে,“ওই শিক্ষিতদের কোন যুক্তি আমরা মানব না। এই কেসের বিচারে আগে যেমন রায় দেওয়া হয়েছে, আজও তেমন শাস্তি এই মেয়েটাকে তার পরিবারকে পেতে হবে।”
    এই বাদানুবাদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পক্ষ-বিপক্ষর চিৎকার চেঁচামেচি ! বিষয়টা নিয়ে রুইদাস পাড়া আড়াআড়ি দুটো ভাগ হয়ে গেছে। এটা মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। বলা যায় না, এটাকে বাড়তে দিলে রুইদাস পাড়ায় গৃহযুদ্ধও বেধে যেতে পারে। এবার সনাতন দেখল তার হস্তক্ষেপ ছাড়া এই গণ্ডোগোল মেটার উপায় নেই। এই সমস্যার সমাধান এখানে করা যাবে না। একটা জোর চিৎকার করে উঠল সনাতন! সনাতনের মত শান্তশিষ্ট ছেলে যে এতো জোর কথা বলতে পারে, সভা কল্পনাই করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে সভা একদম স্তব্ধ! এই সময়টাকে কাজে লাগাতে সনাতন বলল,“আটচালার একটা অতীত ভুলকে তুলে ধরে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আর একটা ভুল করা কোন যুক্তিযুক্ত কাজ নয়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নাহলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমি বুঝতে পারছি, এই বিচারসভা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। কোনভাবে কোন পক্ষের আর বেশি বাড়াবাড়ি করা চলবে না। আমি পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে এই বিষয়টা পঞ্চায়েতের বিচারসভায় ফেলতে চাই। সেখানকার সিদ্ধান্ত যদি মেনে নেওয়া না হয় তো দরকারে আমরা পঞ্চায়েত থেকে কেসটাকে থানায় পাঠিয়ে দেব। সেখানে দেশের আইন যা বলে সেটাকে সবাই মেনে নিতে বাধ্য।” তারপর সুবোধ কাকার উদ্দেশে বলল,“কাকা, আমি যা দেখতে পাচ্ছি আজকের সভায় এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। অসমাপ্ত এই সভা, পঞ্চায়েতের শালিশি সভায় ফেলার জন্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ এই সভা মুলতুবি করে দেওয়া হোক। রুইদাসদের বাঁচাতে গেলে আর বিকল্প পথ আমাদের সামনে নেই।”
    পঞ্চায়েত প্রধান, সনাতন রুইদাসের কথা মত পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, সুবোধ কাকা এদিনের সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে। এরপর আর কোন চেঁচামেচি, হইহুল্লোড় নেই। ফিসফিসে গুনগুনে এক সমবেত শব্দ আটচালা থেকে জন্ম নিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অভয়-বরেণদের গুলতানি আর যেন থামতে চায় না। পাড়ার আরও জনা- দুই মোদো মাতালকে জুটিয়ে তারা তেমাথানি মোড়ের বটগাছের গোড়ায় বসে চুল্লু খেতে খেতে কত যে শলা-পরামর্শ করতে থাকে কে জানে! সনাতনের নজর তা এড়ল না বটে। তবে ওইসব মাতালদের আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইল না। গুরুত্ব দিলেই ওরা পেয়ে বসবে।
    বিপ্লব কোথায় আছে, তাদের পাল পাড়া বা রুইদাস পাড়ার কেউ জানে না। অলোকাও জানে না। অলোকাকে বলেনি বিপ্লব। মাঝে মাঝে বিপ্লব অলোকার স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে মজলিশপুরের মোড়ে অপেক্ষা করে অলোকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। অলোকা পায়রাচালী প্রাইমারী স্কুল থেকে এই পথেই এক কিলোমিটারের মত রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। পাড়া অলোকাকে সম্মান জানাবে তা অলোকার কাছ থেকে বিপ্লব জেনেছে। তবে জানেনি যে ওইদিনও ওদের দু’জনকে জড়িয়ে আবার আলাদা একটা বিচারসভা রুইদাসদের আটচালায় বসবে। খুশি মনে বিপ্লব পরদিন অলোকার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, কেমন তার সংবর্ধনা সভা হল জানার জন্যে। সেদিন ও আশা নিয়ে এসেছিল, অলোকার খুশি মন দেখবে বলে। ভেবেছিল হয়তো অবোধ রুইদাসরা বোধে ফিরে তার কাজের সমর্থন করতে এই অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু অলোকার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই খুশির লেশমাত্র দেখা গেল না। বিপ্লবও গম্ভীর হয়ে গেল কোন অশনিসংকেতের শঙ্কায়! সেদিন অলোকা মজলিশপুরের মোড় থেকে কথা বলে বাড়ি ফেরেনি। ওরা দু’জন মজলিশপুর থেকে পশ্চিমের ফাঁকা রাস্তা ধরে হরিণডাঙ্গামুখো হল। মাঝে জাগলার পোলের নিরিবিলিতে বহুক্ষণ বসে রইল। কথার মাঝে একবার বিপ্লব অলোকার কান্নাভেজা মুখ মুছিয়ে দেয় তো অলোকা বিপ্লবের। কতক্ষণ যে এমন আদানপ্রদান চললো ! পশ্চিমাকাশের সূর্য ডোবার যন্ত্রণাঋদ্ধ লালাভ আলো বিচ্ছুরিত হবার দৃশ্য নজরে আসতে বিপ্লব বলল, “এবার বাড়ি চলো অলোকা। শীতের সন্ধ্যা। ঠান্ডাও বাড়ছে। তোমাকে এগিয়ে দিই। আর এখানে থাকা আমাদের ঠিক হবে না। ‘দিননাথ’ পাটে যাবার পর জায়গাটা সাধারণের জন্যে নিরাপদ নয়। প্রকৃত মৃত্যুর আগে অপঘাত মরণে কোন কৃতিত্ব নেই।”
    -প্রকৃত মরার আর বাকি রইল কোথায় বিপ্লবদা! এখন তো কেবল বেঁচে আছে আমার এই নশ্বর দেহটা। মান-সম্মান, ব্যক্তিত্ব কোন কিছুর অবশেষ আছে নাকি আমার আর? সেটা যখন নেই তখন সমাজের দুষ্ট মানুষের আক্রমণে যদি আমার মরণ হয় তো হোক না। পরক্ষণেই আবার নিজেকে শক্ত করে অলোকা বলল,“তাছাড়া তুমি তো আমার পাশে আছো বিপ্লবদা। এই যুগল শক্তিকে একত্র করে আমরা শত্রুকে প্রতিরোধ করতে পারব না? যেমনটা আমাদের অবোধ সমাজের বিরুদ্ধে করে চলেছি। না পারলে সহ-মরণ হয় হোক। ক্ষতি কি! আর একটু বসো। তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না আজ আমার। আরও দু’দন্ড বসি। তারপর যাচ্ছি।” একপ্রকার মরিয়া হয়ে যেন কথাগুলো বলল অলোকা ।
    দেখতে দেখতে সাতটা বেজে গেল। এইসময় গ্রামের শীতের রাত মানে অনেকটাই রাত বলে মনে হয়। মনে মনে অলোকা ভাবল এতটা রাত না করলেই হত। বাড়িতেও চিন্তা করবে। এখান থেকে এতটা পথ হেঁটে যেতে হবে। রাত আটটার কাছাকাছি হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছতে। বিপ্লব বলল, “এখন আর তোমাকে মজলিশপুরের মোড়ে ছেড়ে দেব না। চলো বাড়ির কাছাকাছি উত্তমের লেদ কারখানার সামনে ছেড়ে দিয়ে আসি। ওখান থেকে তোমাদের আটচালার আলো দেখা যায়। ওটাকে লক্ষ্য করে চলে যেতে পারবে। যদি তোমাদের পাড়ার কেউ আমাকে দেখে ফেলে ফেলবে। কিচ্ছু করার নেই আমার। সেই ভয়ে আমি তো আমার ভালোবাসাকে হেলাফেলা করতে পারি না।”
    হেড়ো পাগলা, পাগলের খেয়ালে কখন কোথায় থাকে তার হদিস ভালো মানুষের পাওয়া মুশকিল। রাতে কবে যে বাড়িতে শুয়েছে, তার মা নিজে সঠিক বলতে পারবে না। চরাচরই যেন ওর ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন। ওর কাছে সবাই আপনজন। কতদিন হয়েছে আটচালার ফাঁকা মেঝেতে ঘুমিয়ে থেকে রাত কাবার করে দিয়েছে। বাধাহীন চেতনায় রাতের সঙ্গে সখ্যতা করার জন্যে আটচালাই তার প্রথম পছন্দের জায়গা। শীতের রাত। ঘড়ির কাঁটা আটটাকে ছুঁয়ে গেছে কিছুটা আগে। রুইদাস পাড়া ততক্ষণে প্রায় ঘুমিয়ে কাত। হেড়ো পাগলাও আটচলার মেঝেতে ঝ্যাঁতলা বিছিয়ে তেলচিটে পড়া কম্বল জড়িয়ে থরথর করে কেঁপে চলেছে। কখন ঘুম আসবে তবে সেই কাঁপুনি থামবে। হঠাৎ একজন মেয়েমানুষের মরণ চিৎকারে তার পৃথিবীটা যেন টলমল করে উঠল! গায়ে মোড়া কম্বলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে দেখে গামছা দিয়ে মাথা-মুখ ঢাকা দুটো লোক ছুটে পালাতে পালাতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল! আর রাস্তায় ঠিকরে পড়া আটচালার আলোতে দেখতে পেল অদূরেই রক্তাক্ত অবস্থায় একটা মেয়ে গোঁ গোঁ করে কাতরাচ্ছে। সভয়ে হেড়ো পাগলা নীচু হয়ে দেখতে গেল কে মেয়েটা! মনে হল এ আর কেউ না তাদের পাড়ার অলোকা দিদিমণি। পাগলের মাথা প্রথমে ভিমরি খাবার মত হয়ে যায় ! কিন্তু যারা পেছন থেকে মেয়েটার মাথায় বাড়ি মেরে পালালো তারা কারা! অন্ধকারে বুঝতে পারল না। ততক্ষণে ওর বুকের ধড়ফড়ানি আরও বাড়তে লাগল। কিন্তু পাগলেরও মন বলছে, তাকে ভালো করে জানতে হবে রক্তাক্ত মেয়েটা কে? সময় নষ্ট করলে চলবে না। বিড়ি খাবার ম্যাচিসটা পকেট থেকে নিয়ে খস করে আলো জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে মুখের কাছে ধরতে চিনতে পারে সেই মুখটা, ঠিকই তো! এ তো তাদের অলোকা দিদিমণি! নিশ্চিত হয়েই ম্যাচিস-ফ্যাচিস ছুড়ে ফেলে বিকট চিৎকার জুড়ে দিয়ে ছুটতে থাকে,“ও সনাতন দাদা, ও সনাতন দাদা। তোমরা সব ওঠো! জাগো! ওঠো গো সনাতন দাদা। ওঠো গো অখিল দাদা! আমাদের অলোকা দিদিমণিকে কারা খুন করে পালাল। পাড়াপড়শিরা সবাই ওঠো গো। সব সর্বনাশ হয়ে গেল। আমাদের অলোকা দিদিমণি খুন হয়ে গেল গো। ও সনাতন দাদা ওঠো !” বলে ছুটতে ছুটতে রাস্তায় উঁচু হয়ে থাকা একটা ইটে হোঁচট খায়! সঙ্গে সঙ্গে পায়ে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে হেড়ো পাগলা!

    -সমাপ্ত-

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২২)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [তেতাল্লিশ]

    বাবার শরীর খারাপের জন্যে এই বছর সনাতনরা আর কোলকাতায় হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের দূর্গাপূজায় ঢাক বাজাতে যাবে না। দিঘিরপাড় বাজারে পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে একটু আগে আগেই সন্তোষবাবুকে ফোনে জানিয়ে দেয়। সনাতন এবং সন্তোষবাবু দু’তরফেরই এই সংবাদে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যদি প্রতিকুল হয় তখন কারোর কিছু করার থাকে না। সেটা মেনে নিয়ে সন্তোষবাবু সনাতনকে বলল, যদি তার জানাশোনা ভাল কোন ঢোলের দল পাঠাতে পারে তো ভাল হয়। ঢাক যেহেতু সনাতন-রতনরা বাজায়, সেই বাজনা তাদের কানে লেগে আছে। এর পর অন্য কারোর বাজনা ভালো লাগবে না। মন খারাপ হয়ে যাবে। তাই সন্তোষবাবু ঢোলের দল পাঠাবার প্রস্তাব দেয়। একবাক্যে সনাতন রাজি হয়ে যায় এবং তাদের উভয় পক্ষের যাতে মানসম্মান বজায় থাকে তেমন একটা দলকে সে পাঠাবে কথা দেয় সন্তোষবাবুকে। সনাতনের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে সন্তোষবাবু বলে, “এই জন্যেই সনাতন তোমাকে আমরা এতটা ভরসা করি। জানি, একটা সুব্যবস্থা তুমি করবেই।”
    তাজপুরের পাইক-পাড়ার তিমির পাইক সুবোধ কাকার বাড়ি কয়েকদিন ধরে যাতায়াত করছে, সনাতন দেখেছে। মনে হয় ঢোলের অর্ডার দিয়েছে সুবোধ কাকার কাছে। ঢোল তৈরীর পাকা মিস্ত্রী এই সুবোধ কাকা। ঢাক বানাতেও ওস্তাদ। কিন্তু রুইদাস পাড়ার বেশিরভাগ ঢাকি নিজেরাই নিজেদের ঢাক বানিয়ে নেয়। টুকটাক অসুবিধা হলে পাড়ার পাকা কারিগর যারা আছে তাদের সাহায্য নেয়। তাই ঢাকের অর্ডার বেশি পায় না। পাড়ার কয়েকজনই আছে যারা ঢাক- ঢোলের অর্ডার বাইরে থেকে পায়। সুবোধ কাকা তাদের মধ্যে অন্যতম। আর সময় নষ্ট না করে সুবোধ কাকার বাড়ি গেল সনাতন। পিপার মত একটা কাঠের খোলের এক মুখে গরুর চামড়া লাগাচ্ছিল কাকা। আর এক মুখ ছাগলের চামড়া দিয়ে তার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গেছে। সনাতন গিয়েই কাকাকে ডিস্টার্ব করতে চাইল না। কাকা পেছন ফিরে কাজ করছিল বলে তাকে দেখতে পায়নি। এক মনে কাজ করে চলেছে বুড়ো। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা টুলে বসে কাকার হাতের যাদু পরখ করে চলেছে। সনাতন জানে এর পর ঢোলের খোলের দু’মুখ মাঞ্জা দেওয়া মোটা সূতোর দড়ি বা নাইলন দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার ভেতর ছোট্ট আকারের পিতলের বালা পরাতে হবে। হিসেব করে বাঁধা দড়ি এই বালার মাধ্যমে টান করে বা আল্গা করে ঢোলের সুর বাঁধা হয়। কাজের ঝোঁকে এবার এদিকে ঘুরতে সনাতনকে দেখতে পায় সুবোধ কাকা। অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে,“আরে, আমার সনাতন বেটা যে। খবর কি রে বাবা? হঠাৎ কি মনে করে আমার বাড়ি? তুই তো বাবা খুব কাজের ছেলে। এমনি এমনি আমার বাড়ি আসতে পারবি না। নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছিস। বল বাবা বল। কি দরকার। কখন এসে চুপচাপ বসে আছিস। সাড়াই করিসনি। আমি আমার মত কাজে ডুবে আছি।”
    -ঠিক আছে কাকা। তাতে কি। এক মনে কাজ করছো। হাতের কাজটা না সেরে বা তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে কেমন করে। কাজের তাল কেটে যাবে। তাই আর ডাকাডাকি করিনি। যে জন্যে এসেছি, কাকা। ওই তিমির পাইক তোমার কাছে আসে দেখেছি। নিশ্চয়ই কাজের অর্ডার দিয়েছে। না হলে আর সেই তাজপুর থেকে এতটা পথ উজিয়ে আসতে যাবে কেন। ও আবার কবে আসবে কাকা? ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে। কোলকাতায় আমাদের দূর্গা পূজার অর্ডারটা ওকে দেব ভাবছি। জানো তো বাবার শরীর খারাপ। বাবাকে নিয়ে কোলকাতায় কাজে যাওয়া যাবে না। তা ভাবলাম তিমির পাইক মানুষটা, ভাল-মানুষ বলে পরিচিতি আছে। কোলকাতার ওরা তেমনই একজনকে পাঠাতে বলেছে। যদি ওরা রাজি হয় তাহলে যাবার কথা বলবো। তোমার কি মত কাকা?” পরামর্শ চাওয়ার মত করে সনাতন বলল।
    -হ্যাঁ। এটা ঠিক। তুমি যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। তিমির পাইকের ঢোলের দলের সুনাম আছে। যেমন ভাল বাজায় তেমন আচার ব্যবহারও লোকের মন কেড়ে নেবার মত। তা তুমি বিকেলের দিকে একবার ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসো-না। ওর আসার কথা আছে। তিনটে ঢোলের অর্ডার দিয়েছে। একটা হয়ে গেছে। সেটা নিতে আসবে। ও আমার লক্ষ্মী খদ্দের। মাল ডেলিভারী নেবার সাথে সাথে ফুল পেমেন্ট করে দেয়। কিছু আগামও দিয়ে দেয়। আমি চেয়ে নিই। আমার তো আর এইসব ঢোলের খোলের কাঠ কেনার মত অত বেশি পয়সা নেই। তাই আগাম না নিলে চলে না। তা, ওরা সেটা ‘না’ করে না। দিয়ে দেয়। তুষ্ট মনে সুবোধ কাকা বলল।
    সনাতন দেখলো হ্যাঁ, কাকা ঠিক কথাই বলেছে। আরও দুটো ঢোলের খোল ঘরে পড়ে আছে। কাকারা সাধারণত নিম বা কাঁঠাল কাঠের গোড়ে থেকে এই খোল বানিয়ে থাকে। অন্য কাঠেও সম্ভব। তবে আমাদের এখানে এই কাঠ বেশি পাওয়া যায় বলে ব্যবহার করা হয়। তাতে কাঠ বাবদ খরচটা অনেক কম হয়। এই যেমন মৃদঙ্গ-খোল তৈরীর জন্যে এগুলো ছাড়াও রক্ত চন্দন বা খয়ের কাঠ হলে খুবই ভাল হয়। সেই কাঠ আমাদের এদিকে কোথায়! অনেক খরচা তা জোগাড় করতে। পোষাবে কেন! একটা মোটা কাঠের গোড়ে মাঝ বরাবর চিরে নিয়ে তার ভেতরের শাঁস-অংশ কেটে বা চেঁচে ফেলে দিলে ভেতরটা
    ফাঁপা হয়ে যায়। দুটো অংশ এইভাবে ফাঁপা করে আঠা দিয়ে জুড়ে দিলে পূর্ণ একটা খোল তৈরী হয়ে যায়। এবার খোলের দু’প্রান্ত খানিকটা করে কেটে সরু মত করে দিতে হয়। তাহলে খোলের দু’মুখের তুলনায় মাঝবরাবর পেটের অংশ মোটা হয়ে গেল। একটা পূর্ণ ঢোলের চেহারা পেয়ে গেল। এবার সেটাকে মেজে ঘষে মসৃণ করে তার উপর সৌন্দার্যয়ণ করা হয়। এ’দুটোয় ওইগুলো সব এখন বাকি আছে। তার মানে তিমির পাইককে আরও কয়েকবার সুবোধ কাকার কাছে আসতে হবে। কাকার কথামত বিকেলের দিকে আসবে বলে সনাতন তখনকার মত চলে যাবার সময় বলে গেল,“কাকা, এখন আমার পড়ানো আছে। ছাত্রীরা এসে পড়বে। বিকেলে সময় মত আমি এসে যাব। আমি বাড়ি থেকে খেয়াল রাখব তিমির পাইক কখন তোমার বাড়ি আসছে। দেখতে পেলেই অমনি ছুটে চলে আসব।”
    বিকেলের ব্যাচটা পুরোপুরি তাদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের জন্যে রেখেছে সনাতন। এরা সব গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। বেশি পয়সা দিতে পারবে না। তাই অন্য ব্যাচের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে টিউশনির ফীস নিয়ে পাড়ার ছাত্র আর বাইরের ছাত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। পয়সার অভাবে ইচ্ছুক পাড়ার ছাত্রদের লেখাপড়া হবে না তা সনাতন কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। এটা তার নীতি নয়। হয়তো সংসারে পয়সার প্রয়োজনেই সে টিউশনি বেশি করে করছে সেটা ঠিক। সেইসঙ্গে সমাজ সংস্কারের একটা বোধ তার মনে সবসময় কাজ করে। সেই সংস্কার-কাজ চালাতে গেলে এই সমস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ঢোকানো প্রয়োজন। ওদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের বেশিদূর লেখাপড়া না হওয়ার কারণ একাধিক। উপযুক্ত গাইড না পাবার কারণে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতায় তারা পেরে ওঠে না তা নয়। পরীক্ষায় মোটেই ভাল ফল করতে পারে না। বড় হবার সাথে সাথে তাদের মধ্যে মান-অপমান বোধ জন্মে যায়। পড়া না-পারার গ্লানি তাদের মনের মধ্যে কাজ করে। অচিরেই তারা পড়া ছেড়ে দিয়ে রাখাল হয়ে গরু চরানোকে নিজের কাজ বলে মেনে নেয়। এটা যেন তাদের সম্প্রদায়ের একটা চিরাচরিত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই শাপমোচন করার লক্ষ্যে তার এই ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টা। যার পরিবারের যেমন সামর্থ তারা তেমন পয়সা দিল, যাদের নেই তারা দিল না। তাতে তার বিন্দুমাত্র আপসোস নেই। কিন্তু একটাই তার কড়া অনুশাসন, মন দিয়ে লেখাপড়া তাদের করতে হবে। নাহলে নির্বিচারে দানসত্র খোলার অভিপ্রায় তার বিন্দুমাত্র নেই।
    ন’ক্লাস থেকে বারো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়ায় সনাতন। বিকেলের ব্যাচের ছেলেরা সকলেই নাইনে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানের একটা প্রজেক্ট করতে দিয়েছে স্কুল থেকে। সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় সানাতন ছাত্রদের বলল,“আমি আজ তোমাদের প্রোজেক্টের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেব। তারপর সেই বিষয়টার ডিটেলস্ নোটস্ লিখে দেব। সেটা দেখে নিজের মত করে তোমরা ভাবনাচিন্তা করে প্রোজেক্টটা করে আমাকে দেখিয়ে তারপর স্কুলে জমা দেবে। আমি প্রস্তাব দেব, আমাদের মুচি-রুইদাসদের নিয়ে তোমরা কাজ করো। যেহেতু আমাদের এই জাতটা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর এবং সবদিক থেকে পেছিয়ে পড়া জাত। সেটা একটা প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারলে ভালো নাম্বার পাওয়া যেতে পারে।”
    সনাতন স্যারের কথার প্রেক্ষিতে সন্তোষ বলে ছাত্রটা বলল, “স্যার ক্লাসে অমর স্যার প্রোজেক্টের যে ধারণা দিয়েছিল তাতে বলেছিল, সমাজের দুর্নীতি বা মানবিক অবক্ষয় এইসব বিষয় নিয়ে প্রোজেক্টের ভাবনাটা রাখতে। সেখানে এই বিষয়টা একদম আলাদা। অমর স্যার এটা মেনে নেবে তো স্যার? আমরাই আবার আমাদের নিয়ে লিখছি। নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাচ্ছি। তেমন ভাববে না তো কেউ?”
    সন্তোষের প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে সনাতন বলল,“কথায় আছে না, “আপনা হাত জগন্নাথ” সেইরকম। আমাদের কথা সমাজের কাছে আমাদেরই তুলে ধরতে হবে। অন্য কেউ ভালোবেসে আমাদের কথা বলতে আসবে না। আমাদের সম্প্রদায় তো শুধু এই বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তামাম ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই মুচি সম্প্রদায়। সে’কথা ক’জন জানে? কোন প্রোজেক্টের কাজ একটা থিসিস লেখার মত প্রায়। এর মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরা যায়। সেইজন্যেই তো এই ‘প্রোজেক্ট বিষয়টা’ সিলেবাসের মধ্যে নিয়ে আসা। অমর স্যার যেটা তোমাদের বলেছে, সেটাই তো আমি তোমাদের বলতে চাইছি। তোমরা কি জানো? আমাদের এই মুচি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি কোথা থেকে? জানো না। এখানকার বয়স্ক মানুষদেরও মনে হয় জানা নেই। শোনা যায় মুচি শব্দটা এসেছে মোজা থেকে। গুজরাটের ‘পাভগাধে’র মানুষ বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জন্তুর চামড়া থেকে মোজা তৈরী করত। সেই থেকে মুচি নামটা, মুচি জাতে পরিণত হয়। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের মুচিরা আবার দাবি করে তারা মূলত রাজস্থানী। তাদের পেশা ছিল সৈন্যদের জন্যে চামড়ার মোজা, পোষাক তৈরী করা। তারা রাজপুত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই দুই মতের মধ্যে ‘মোজা’ কথাটায় মিল পাওয়া যায়। অতএব এই মোজা শব্দ থেকে মুচি নামটার একটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবনা থাকতে পারে। সেটা আমরা ধরেও নিতে পারি।” সনাতন স্যারের কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিজয় বলল,“এ তো স্যার বেশ অবাক করা কথা ! আমাদের তো এটা জানাই ছিল না। অথচ তা আমাদের সকলের জানা দরকার।” বিজয়ের কথা শেষ হতেই অমল বলল, “স্যার, আপনি যে বললেন না, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আমরা অবস্থান করছি। মোটামুটি কোথায় কোথায় আমরা আছি একটু বলবেন?” উত্তরে সনাতন বলল, “নিশ্চয়ই বলব। ভারতবর্ষের মধ্যে বিশেষ করে উত্তর ভারতে আমাদের সম্প্রদায়ের বাস বেশি। যেমন ধরো, উত্তর প্রদেশের সীতাপুর, এলাহবাদ, সুলতানপুর, ফরিদাবাদ, গন্ডা, কানপুর আর লক্ষনৌ জেলায় সবচেয়ে বেশি মুচিদের বাস। তারপর পাঞ্জাব, মহারাষ্টু, গুজরাট, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশের, কৃষ্ণা, গুন্টুর, পূর্ব গোদাবরি, হায়দ্রাবাদ, কুর্নুল, আদিলাবাদ জেলায়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলা ছাড়াও আরও কিছু কিছু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর বিহার, মধ্যপ্রদেশে তো বহু চামার সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। এই চামারদের সাব-কাস্ট হিসেবে মুচিদের ধরা হয়। শোন, যতটা আমার স্মরণে আছে মুখে সেটুকুই বলছি তোমাদের। নোটস যেটা দেব সেটাতে আরও বিস্তারিত লেখা থাকবে। মুখে একটু বুঝিয়ে দেবার পর নোটসটা পড়ে নিলে প্রজেক্টটা তৈরী করতে সুবিধা হবে। তবে কেউ কিন্তু কারোর দেখে বা হুবহু নকল করবে না। তাহলে সব্বাইয়ের প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে। অমর স্যার ঠিক ধরে ফেলবে। আমাদের ব্যাপারটা অমর স্যার অনেকটাই জানে। আমাকে খুব ভাল করে চেনে। অমর স্যার, আমারও স্যার। এই তথ্যগুলো নিয়ে নিজেদের স্বাধীন ভাবনায় লিখবে। বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।” চঞ্চল ছেলেটা এতক্ষণ পরে বলল,“স্যার আমরা তো বাংলায় কথা বলি। মানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। তা মুচিদের নিজস্ব কোন ভাষা আছে নাকি ? এই যেমন সাঁওতালরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। উত্তরবঙ্গের কামতাদের ভাষা হোল কামতাপুরি। সেইরকম আরকি।” চঞ্চলের প্রশ্নটা যে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং সঠিক তা মেনে নিয়ে সনাতন বলল, “তুই একটা দারুণ প্রশ্ন করেছিস, চঞ্চল। সাঁওতাল, কামতাপুরী বা এমনতর আরও অন্যান্য সম্প্রদায়ের যদি নিজস্ব ভাষা থাকতে পারে তাহলে মুচি-চামারদেরও তো তা থাকা অস্বভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তাহলে তো আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রয়াস চালিয়ে যেতাম। যেমন অন্যরা করছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করি সেই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাকেই নিজেদের ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি সে ভাবনা করতো তাহলে হয়তো তা হতে পারতো। কিন্তু তা না হবার যে অপরিহার্য কারণ, সেটা হল আমাদের মানুষগুলো চিরকালই অত্যন্ত অভাব এবং অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়ে এসেছে। তারা নিজেদের পেটের চিন্তা করবে না ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করবে। এই আমাদের রুইদাস পাড়ার দিকে তোরা তাকা-না। ক’টা লোক লেখাপড়া জানে দেখ। এখন দু’চারজন, তোদের আমাদের মত আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় এগিয়ে এসেছে। তাই আমরা এইসব ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছি। সেইসময়কার মানুষের যদি উদয় অস্ত পেটের চিন্তা না করতে হত তাদের ভাবনা চিন্তা অন্য খাতে বওয়ার ফুরসত থাকতো। তারা লেখাপড়ার কথা, ভাষা-সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারতো। যাক। যেটা বলছিলাম। সেটা ভেবে এখন আর লাভ নেই। এখন ভাবলেও আমরা আমাদের আপন ভাষা তৈরী করতে পারব না। বাস্তবসম্মতও নয়। এখন উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে যারা বাস করে তারা কথা বলে হিন্দি এবং দেবনাগরী ভাষায় লেখে। আসামের ভাষা আসামী, গুজরাটে গুজরাটি, মহারাষ্ট্রে মারাঠি, অন্ধ্রে তেলেগু, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবী, বিহারে ভোজপুরী, কর্ণটকে কানাড়া, উড়িষ্যা ওড়িয়া। এখানে একটা ব্যাপার দেখ, আমরা একই জাত-সম্প্রদায়ের হয়েও পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তার একটাই কারণ, ভাষার বিভিন্নতা। আমরা বাংলাভাষীরা কি মারাঠী ভাষীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব? পারব না। বরং তাদের ভাষা না বুঝতে পেরে তাদের থেকে দূরে সরে আসব। যেটা সারা ভারতবর্ষের সাঁওতাল বা কামতাপুরী বা অন্য অন্তজ শ্রেণীর মানুষ যারা নিজস্ব ভাষার অধিকারী, তাদের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই।”
    তাদের সনাতন স্যার নিজেদের জাতের ব্যাপারে এতকিছু জানে জেনে এই চার ছাত্রই অবাক হয়ে যায়! অথচ বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না। কত জ্ঞান এনার। এর কাছে পড়তে না এলে তারা এই স্যারের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। স্যারের কাছে যত পড়ছে ততই এনার সম্বদ্ধে তাদের ধারণা বদলে যাচ্ছে। বিস্ময়ের সঙ্গেই চঞ্চল আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি এতকিছু জানলেন কেমন করে? এর আগে কেউ তো আমাদের নিজেদের জাতের ইতিহাস এমন করে বলেনি। এমনকি আমার বাবা-দাদুরাও না।” এবার ছাত্রদের আশ্বস্ত করার জন্যে সনাতন বলল, “দেখ, আমাদের বাবা- দাদুরা লেখাপড়া শিখেছে? শেখেনি। এগুলো জানতে গেলে তো পড়াশোনা করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে হবে। সবার উপর জানার উদগ্র চেষ্টা বা ইচ্ছা থাকতে হবে। তোরা এখন পড়াশোনা করছিস বলে এতকিছু জানতে পারছিস। এই আমাদের পাড়ায় তোদের বয়সী আরও কত ছেলেমেয়ে তো আছে। ছেলেরা তো বাউন্ডুলের মতো ঘুরছে, মদ খেয়ে মাতলামী করছে। তারা বড় হয়ে সন্তানদের কি শেখাবে! ভেবে দেখেছিস একবারও! সেইজন্যে বলছি লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই রে। এবার আরও দু-একটা পয়েন্টস বলে আজকের মত ছুটি দিয়ে দেব। আগেও বলেছি, তারপর ডিটেলসটা নোটসে পড়ে নিস। এই আমরা মুচিরা তো হিন্দুধর্ম পালন করি। মানে আমরা হিন্দু। এই মুচিরা আবার মুসলমান, শিখ ধর্মালম্বীও আছে কিন্তু। পাঞ্জাবে যেমন হিন্দু মুচি আছে তেমনি শিখ মুচিও আছে। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীরে মুসলমান মুচি প্রচুর আছে। এরা মূলত হিন্দু ছিল একসময়। কিন্তু বিভিন্ন সময় শাসকশ্রেণীরা নিজেদের স্বার্থে বলপূর্বক তাদের মুসলিম বানিয়ে দেয়। পাঞ্জাবের হিন্দুরা আবার শিখ হয়েছে স্বেচ্ছায় । আর একটা কথা জানাই। এটা জানা বিশেষ দরকার। অন্ধ্রপ্রদেশে মুচিদের মধ্যে পঁয়ষট্টি ভাগ মুচি হিন্দু। তবে তারা সন্ত রবিদাসকে অবতার হিসেবে মানে। ইনি একজন চর্মকার ছিলেন। অন্ধ্রে নিমিশাম্বা দেবীকে আরাধ্যা দেবী হিসেবে মানে। আজ এই পর্যন্ত। এবার তোরা বাড়ি যা। আবার একটু পরে, পরের ব্যাচ আসবে। তার আগে আমাকে একবার সুবোধ কাকার বাড়ি যেতে হবে। তোরা খেয়াল রাখিস তো একজন বাইরের গ্রামের লোক সুবোধ কাকার বাড়ি আসবে। তেমন কাউকে দেখতে পেলে কেউ আমাকে একটু খবর দিস। আমি খেয়াল রাখছি। তবু যদি আমার চোখ এড়িয়ে যায় তাই তোদের বলে রাখলাম। যে দেখবি বলবি।”
    ঢোল ডেলিভারী নিতে গেলে পুরো দাম দিয়ে তবে নিতে হবে। বাকি রাখে না সুবোধ রুইদাস। যা দামে রফা হয়ে যায় পুরো টাকাটাই দিতে হয়। একটা পয়সা ছাড়ে না বুড়ো-টা। কিছু টাকা কম হচ্ছে। সেটা জোগাড় না করে তো যাওয়া যাবে না। আজ সন্ধ্যে যাবার কথা ছিল যে ঢোলটা রেডি হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আসার জন্যে। যাওয়াটা এখন বাতিল করা ছাড়া তার উপায় নেই। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিমির পাইক বসে গেল উঠোনে ফেলে রাখা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে। তাকে অন্তত পাঁচটা চুবড়ি আর তিনটে খড়কুঁচে রাখার মত বড় ঝোড়া তৈরী করতে হবে। কঞ্চিগুলো নেড়েচেড়ে দেখল অতটা মাল এগুলোয় হবে কি না। তার সঙ্গে আবার দুটো চুবড়ি আর একটা মাটি বওয়া ঝোড়া আলাদা করে বানাতে হবে। ওগুলো মাগনা যাবে, বাঁশের ঝাড়ের মালিককে দেবার জন্যে। ওদের এদিকে এই একটা সুবিধা আছে, বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে নিয়ে আসার জন্যে ঝাড়ের মালিককে আলাদা করে তার দাম দিতে হয় না। ওই থাবগো মূল্য ধরে সেই দামের চুবড়ি-ঝোড়া দিলেই চলে। তাতে তিমিরদের মত কাওরা-পাইকদের একটু লাভ বেশি হয়। ঝাড়-মালিকরা তো অতো বোঝে না, ক’টা কঞ্চিতে ক’টা চুবড়ি-ঝোড়া হতে পারে। তাছাড়া ওরা এই নিয়ে তেমন ভাবেও না। ঝাড় থেকে বাঁশ বিক্রি করার সময় কঞ্চি এমনিতেই বাঁশ গোলার ব্যবসায়ীরা ফেলে দিয়ে চলে যায়। ঝাড়ের মালিকদেরও এটা জ্বালানি ছাড়া আর কোন কামে লাগে না। আগে লোকে এই কঞ্চি ছিটেবেড়ার ঘর করতো। তখন কঞ্চির চাহিদা ছিল। এখন তো ছিটেবেড়ার বা মাটির বাড়ি প্রায় দেখাই যায় না। তবে একদম নেই তা জোর দিয়ে বলার সাহসও কারোর নেই। প্রান্তিক এলাকায় তেমন বাড়ি আছে বইকি। সেসব তো তাদের এই এলাকার নজরের বাইরে। বাজারে তাই এখন কঞ্চির এমন চাহিদাও নেই যে ঝাড় মালিকরা দর হাঁকিয়ে গেঁট হয়ে বসে থাকবে।
    অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেও অর্ধেকের বেশি মাল তৈরী করতে পারেনি তিমির। আর শরীর টানছিল না। এবার শুতে যেতে হবে। না হলে আবার সকাল সকাল ওঠা যাবে না। সকাল থেকে আবার কাজে লাগতে হবে। শুতে যাবার সময় ঠিক করে, তার ঢোলের মেন সহকারী, শিশিরকে একবার ডেকে নেবে। দু’জনে হাতে হাতে কাজ করতে পারলে দুপুরের মধ্যে কাজগুলো সাল্টানো যাবে। সেই ভেবে পরদিন ভোরেই শিশিরের বাড়ি যায় তিমির। গিয়ে দেখে, শিশির তাদের ঘরের সামনে উঠোনে উঁচু দাবা মত করে রাখা জায়গায় মাটির ডোঙার ভেতরে থাকা মাছের মীন নিয়ে নাড়াঘাটা করছে। তিমির জিজ্ঞেস করে,“কি করছিস ওখানে শিশির?”
    -এই যে কাকা। একসপ্তা হল নৈহাটি থেকে কই, মাগুর আর তেলাপিয়ার ডিম নিয়ে ছেড়েছিলাম। এখন সেই ডিম থেকে প্রচুর মীন জন্মেছে। সেগুলোকে দেখভাল করতে হচ্ছে। ঠিক ঠিক নিয়ম মেনে এগুলোকে না দেখলে আবার এদের মড়ক শুরু হয়ে যাবে। আমার লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেয়ে নেবে। আষাঢ়, শ্রাবণ আর ভাদ্র। এই তিন মাস তো মীনেরা আমাদের সংসার চালায় দাদা। সে তো তুমি ভালোই জানো। কোন কাজ নেই এই বর্ষায়। কিছু তো করতে হবে। আর বর্ষায় কাদা জাবড়ে বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি যোগাড় করা আমার পোষায় না। তোমার অবশ্য তাতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমি পারি না। তাই এখন বড় বড় কুমোর-হাঁড়িতে বাঁকে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মীন বেচে সংসার চালাতে হয়। যাকগে। আমার কথা ছাড়ো কাকা। কি বলতে এসেছো সেটা বলো। এবার তোমার কথা শুনি। শিশির বলল।
    – তোর কাজ কারবার দেখে আমার তো বলার ইচ্ছেটা চলে গেল। এইসব মীন-টিন নিয়ে যা এখন ফেঁদে বসেছিস। পারবি তুই আমার কথা রাখতে? তাই বলতে কিন্তু কিন্তু করছি।
    -আরে কাকা, বলতে এসেছো যখন, তখন বলেই ফেলো। তোমার বলাটা আমি রাখতে পারি কি না দেখি। না শুনলে আমি বা হ্যাঁ-না বলি কেমন করে। এবার যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তিমির বলল, “রুইদাস পাড়ার সুবোধ রুইদাসের কাছে একটা ঢোল তৈরী হয়ে পড়ে আছে। কিছু টাকা কম পড়েছে বলে আনতে যেতে পারছি না। আরও দুটোর অর্ডার দেওয়া আছে। এইটার
    ডেলিভারী না নিলে অন্যগুলোতে হাত দেবে না। এটার দাম মেটালে সেই টাকা দিয়ে আবার অন্য দুটোর মাল-মেটিরিয়ালস কিনবে। তা আমি ইতিমধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে কয়টা চুবড়ি আর ঝোড়া বানিয়েছি। আরও কয়েকটা না বানালে পুরো দাম হবে না। বর্ষার পরেই তো পুজোর মরশুম। আমরা ঢোল বাজাতে বার হবো। সারা বছরের আয় তো বলা যায় এই সময়ই করে নিতে হয়। সেটা তো হাতছাড়া করা যায় না। তোরও না, আমারও না। তাই বলছিলাম কি যদি তুই আমার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ কটা তুলে দিতিস তো আজ মালটা ডেলিভারী নিতে পারতাম। শুধু আনলেই তো হল না। ওটাকে বাড়ি নিয়ে এসে সুর বেঁধে বাজিয়ে দেখতে হবে, সব ঠিকঠাক হয়েছে কি না। বেসুরো গাইলে আবার নিয়ে যেতে হবে। সেইজন্যে একটু তাড়া ছিল আরকি।”
    -কাকা, তুমি তো দেখছো আমি কিভবে এ’কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এক্ষুনি আমাকে এই ধানি-মীনগুলোকে হাঁড়িতে তুলে বাঁক নিয়ে দৌড়তে হবে পাড়ায় পাড়ায়। ফিরতে ফিরতে সেই বেলা বয়ে যাবে। তারপর খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে না হয় তোমার সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে পারি। তার আগে তো আমার সময় হচ্ছে না কাকা। তুমি কিছু মনে কোরো না।” বলে শিশির, গুড় শিউলীদের গুড় জাল দেওয়া ইঞ্চি ছয়েকের মত উঁচু করে চারধার ঘেরা টিনের চ্যাটকা ডোঙা বা পাত্রর মত হুবহু দেখতে মাটি দিয়ে তৈরী পাত্র থেকে ধানি মীন তুলে হাঁড়িতে ভরতে থাকে। তাড়াতাড়ি বার হতে হবে। রোদ মাথায় উঠে গেলে আবার সেই তাত মীনেরা সহ্য করতে পারে না। অক্কা পায়!
    শিশিরের কাজের পরিস্থিতি দেখে তিমির আর চাপ দিতে পারল না তাকে। “ঠিক আছে, তুই তোর কাজ কর” বলে সোজা চলে গেল তার আর এক সাগরেদ, পরাগের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখে পরাগ আর তার বউ, দুয়ে মিলে এক বান্ডিল মাথা কাটা তালডাগ নিয়ে সেই ডাগের উপরের চকচকে ছাল ছলতে ব্যস্ত। তিমির ভালই জানে এই তালডাগের ছাল দিয়ে ওরা কি করবে। আগে বহুদিন সে ধান-চাল পাছড়ানো কুলো বানিয়েছে। বড্ড খাটনি। তাই ছেড়ে দিয়েছে এই কাজ। কঞ্চির চেটা দিয়ে কুলোর ধড় বানাতে হয়। তারপর বাঁশের বাঁখারি চেঁছে তার সঙ্গে কুলোর ধড়টা কষে বাঁধন দিতে হয়। তাল ডাগের ওই শক্ত ছলা ছাল দিয়ে বাঁধনটা দিলে আর সহজে কুলোর ধড় থেকে চারধারের বাঁখারির বাঁধন খুলবে না। বড়ই মেহনতের কাজ। তবু পেটের টানে তাদের জাতেরা এই কাজটাও চালিয়ে যায়, যখন ঢোল-কাঁশির বাজনার কাজে মন্দা থাকে। এই মীন, চুবড়ি-ঝুড়ি বা কুলো- সবই তাদের অসময়ের অন্নদাতা। তিমির কাকাকে হঠাৎ দেখে কাজ থামিয়ে দেয় পরাগ, “কিগো কাকা, হঠাৎ! কি মনে করে?” হতাশ হয়ে তিমির বলে,“বলবো কি। শিশিরের কাছে গেলাম, সে মীন নিয়ে জেরবার। তোর কাছে এলাম তুই কুলো নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিস। ভাবছিলাম তোকে নিয়ে যাব আমার কাজে একটু যোগান দেবার জন্যে। তা তো হবার নয় দেখছি। আজও রুইদাসের কাছ থেকে ঢোলটা আনা যাবে না। আমি একা এতগুলো ঝোড়া-চুবড়ি একদিনে শেষ করতে পারব না। তৈরী হওয়া মাল পড়ে থেকে ড্যামেজ না হয়ে যায়। রুইদাস জানিয়ে দিয়েছে মাল রেডি। এরপর ড্যামেজের দায় সে আর নেবে না। এবার পুজোয় ঢোলের বায়না ধরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে মনে হয়। দলের সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। সব দায় যেন আমার।” বলে মনে মনে গজগজ করতে করতে পরাগের বাড়ি থেকে চলে আসে তিমির।

    [চুয়াল্লিশ]

    সপ্তাহ খানেক পর সেদিন সবেমাত্র সনাতন সকালের টিউশনির ব্যাচটা শেষ করে টিফিন করতে শুরু করেছে। তার সন্ধ্যের ব্যাচের ছাত্র, চঞ্চল ছুটতে ছুটতে এসে তাকে বলল, “স্যার, সুবোধ দাদুর বাড়ির সামনে আমরা খেলছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা বাইরের লোক দাদুর ঘরে ঢুকলো। তখন তোমার কথা মনে পড়লো। ওই যে তুমি বলেছিলে না, বাইরের কেউ সুবোধ দাদুর বাড়ি এলে খবর দিতে? তাই ছুটে এলুম তোমাকে জানাতে। চলি স্যার।” বলে চঞ্চল আবার দৌড় মারলো। ছেলেটা এতই ছটফটে, আরও দু’এক কথা জিজ্ঞেস করবে। সে সুযোগ দিল না। সনাতন অবশ্য বুঝে গেছে বাইরের ওই লোকটা, ওস্তাদ ঢোলক তিমির পাইক। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে মায়ের তৈরী জলে ভেজানো আধ খাওয়া চিনি-মুড়ির বাটি থালা দিয়ে ঢেকে রেখে ছুট মারলো সুবোধ কাকার বাড়ির পানে।
    তিমির পাইক তখন দেরিতে আসার জন্যে সুবোধ কাকাকে কৈফিয়ৎ দিয়ে চলেছে। সেই সময় সনাতন ঢুকতে সুবোধ কাকা বলল, “এই সনাতন এসে গেছে। ও আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে। খুব ভালো ছেলে। তোমার সাথে ওর কি বিশেষ দরকার আছে তিমির। আগে ওর কথাটা সেরে নাও। সনাতন কাজের মানুষ। সময় ওর কাছে অনেক দামি।” পরিচয় করে দিতে সনাতন প্রথমে তিমির কাকাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে সুবোধ কাকার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “কাকা, আমি নয়, আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করেছে, পাড়ার গর্ব, অলোকা দিদি। লেখাপড়া শিখে স্কুলে মাস্টারী করছে। এটাই তো আসল মুখ উজ্জ্বল করা ঘটনা!রুইদাসদের জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারি ঘটনা হয়ে গেল।” সনাতনের কাছ থেকে এই সংবাদে উৎফুল্ল হয়ে তিমির কাকা বলল,“তাই নাকি! সে তো বিশাল ব্যাপার। ভালো ভালো। খুব ভালো খবর। তা তুমি বলো তো বাবা, কি তোমার কথা?” মন থেকে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে সনাতন কোলকাতার সন্তোষবাবুদের দূর্গা পূজার মন্ডপের সমস্ত গল্প বিস্তারিতভাবে জানিয়ে ঢোল বাজাবার প্রস্তাব দিল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল তিমির পাইক। বলল,“সনাতন, তুমি বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট হলেও, প্রথম আলাপে তোমার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধা ভাব জেগে উঠেছে। বুঝেছি তুমি ঠুনকো মনের ছেলে নও। সেই তুমি যখন আমাকে নির্বাচিত করেছো তোমার তৈরী বাগানে ফুল ফোটানোর জন্যে আমরা প্রস্তুত। আশাকরি তোমার সেই মান আমরা রাখতে পারবো। তোমার সাজানো বাগানকে নেড়া বাগান করে আসব না। আবার যেদিন আসব, তোমাদের বাড়িতে যাব। সব ঠিকানা ফোন নম্বর নিয়ে কোলকাতার ওনাদের সঙ্গে আলাপ করে নেব।”
    কথা হয়ে যাবার পর আর সময় না খাইয়ে সুবোধ কাকার বাড়ি থেকে ফেরার পথে অলোকাদির সঙ্গে দেখা সনাতনের। বোঝাই যাচ্ছে দিদি স্কুলে যাচ্ছে। দু’জনের পরস্পরের হাসি বিনিময় করার পর অলোকাদি বলল, “আমাকে নিয়ে তোমাদের সভাটা এই মাসের শেষে, মানে আঠাশ তারিখে হবার কথা-না, ভাই ? ওই তারিখে আমি তো থাকতে পারব না।
    ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার প্রচুর খাতা আমার কাছে এসেছে। সেগুলো দেখে সঙ্গে সঙ্গে জমা দিতে হবে। রেজাল্ট বার করার জন্যে। ওই সময় একটা মুহূর্ত আমি নষ্ট করতে পারব না। তোমরা বরং অনুষ্ঠানটা বাতিল করে দাও। কি হবে এ’সব করে। আমার অস্বস্তি হয়।”
    -ঠিক আছে দিদি। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো না। কাজ আগে। তারপর অন্যকিছু। অনুষ্ঠান আমরা পিছিয়ে দিচ্ছি। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলে আবার দিন ঠিক করব। তবে অনুষ্ঠান বাতিল হবে না। এটা আমাদের রুইদাসদের জাত্যাভিমানের প্রশ্ন। আমাদের জাতের গরিমা করার সুযোগ যখন একবার এসেছে, সেই সুযোগকে হেলায় বইয়ে দেব কেন! তার সদ্বব্যহার আমাদের করতেই হবে। তুমিই হবে তার মধ্যমণি।” কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্ত থমকে যায় সনাতন। পরে মুখটা গম্ভীর মত করে বলল, “তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো দিদি? বেশি সময় নেব না। বিশেষ কথা। তাই বলতেই হবে তোমাকে।” তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ কাছাকাছি আছে কি না। কেউ নেই ! তবু সন্তর্পনে বলল, “বিপ্লবদা সেদিন কেমন প্রচন্ড এক ঝড় অতিক্রম করা বিধ্বস্ত মানুষের চেহারা নিয়ে আমাদের বাড়ি এল! এমন চেহারায় বিপ্লবদাকে আমি কোনদিন দেখিনি। সবসময় ফিটফাট প্রাণবন্ত বিপ্লবদাকে দেখে এসেছি। দেখে আমারও মনটা দমে গেল। আমি ছুটে গিয়ে হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতে গেলাম। এল না। শুধু বলল, “তোমার অলোকাদির সঙ্গে আমার খুব দরকার ছিল সনাতন। কি করে দেখা করি বলো তো?” উত্তরে আমি কিছু বলার আগেই বলল,“ঠিক আছে। এখন আমি আসছি। পরে কোনদিন অলোকার সঙ্গে দেখা করে নেব’খন।” বলেই হনহন করে বাজারের দিকে যাবার বড় রাস্তা ধরে চলে গেল। ঠিক তার একদিন পর হেড়ো পাগলা হঠাৎ আমার রাস্তা আগলে বলে, “খুব ঝামেলা হয়েছে বিপ্লব দাদাবাবুর বাড়ি। ওর বাবা ওকে যাচ্ছেতাই বলে পচাল দিয়েছে। আমি রাস্তা থেকে শুনেছি। তারপর জানিনি, কি হয়েছে না হয়েছে।” মনে হয় হেড়ো পাগলা ভুল কিছু বলেনি। ও তো সবসময় রাস্তায় পায়চারি করে বেড়ায়। শুনে থাকতে পারে চেঁচামেচিগুলো!”
    -হ্যাঁ। আমিও তো বিপ্লবদাকে দেখতে পাচ্ছি না। তা অনেকদিন হয়ে গেল। কথাও ছিল অনেক। তোমার সঙ্গে যদি কোনদিন আবার দেখা হয় তো বোলো তো? যদি কোথাও দেখা করতে পারি। ভাল হয় তাহলে। মনটাও যেন কেমন ‘কু’ ডাকছে। এখন চলি ভাই। স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করা যাবে না। বলে স্কুলের পথ ধরে অলোকা।
    অলোকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সনাতন, তাদের রুইদাস পাড়ার রাস্তা আর সরকারি বড় রাস্তার তেমাথানির মোড় পর্যন্ত চলে আসে। মোড়ের পুরোনো বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অলোকাদির চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতে কি যেন ভেবে উদাস হয়ে যায়। ভাবে, অলোকাদি বিপ্লবদাকে কত ভালোবাসে। বিপ্লবদাও তেমন অলোকাদি ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে না। ওর আন্তরিক ভালোবাসা আর প্রেরণাতেই তো অলোকাদির এই সাফল্য। সেটা অলোকাদি কেমন করে অস্বীকার করবে! করেও না অলোকাদি। তাই সে যখন বিপ্লবদার বিধ্বস্ত অবস্থার কথা বলল, তখন সনাতন লক্ষ্য করল, অলোকাদির চোখমুখ কেমন যেন পানসে হয়ে গেল। দুর্মর ভালবাসা ছাড়া এই প্রতিক্রিয়া কারোর হতে পারে না। কিন্তু ওদের দু’জনের সমাজ তাদের এই অসবর্ণ মেলামেশা এবং তার পরিণতিতে বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে চাইবে না। তার অশনি সংকেত যেন এখন থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে। সনাতনের মনটা সেই ভেবে একদম ভালো নেই। এমন সময় তাদের পোস্ট অফিসের ডাক পিওন, কোচি-দা সাইকেল নিয়ে এসে থামে তার সামনে। বলে,“আচ্ছা সনাতন ভাই, তুমি কি বলতে পারবে, এই সম্পদ সরকার নামটা কার? তোমাদের পাড়ার ঠিকানা দেওয়া আছে। এত বছর ধরে আমি এই কাজ করছি। কয়েকটা গ্রামের প্রায় সব লোকের বাড়ি আমার যাতায়াত এই চিঠি বিলির সূত্রে। ‘সরকার’ পদবির কেউ এই চত্বরে আছে বলে তো আমার জানা নেই। এখানে এই পদবি কবে থেকে আমদানি হল কে জানে!”
    কোচি পিওনের কথায় খানিক চিন্তায় পড়ে গেল সনাতন। ‘সরকার’ পদবি! তাও আবার তাদের রুইদাস পাড়ার ঠিকানা! সম্পদ নামে তো তাদের পাড়ায় একজনই আছে। সে তো সম্পদ ঋষি। কোলকাতায় ঠিকাদারি করে এখন। ভাল পয়সা করে ফেলেছে। নাইনে পড়তে পড়তে স্কুল পালিয়ে কোলকাতায় রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজে ভিড়ে যায়। বহুদিন তার পাড়ায় দেখা যায়নি। হঠাৎ একদিন সুটেড বুটেড হয়ে পাড়ায় তার আবির্ভাব! তাকে দেখে তো পাড়ায় সবাই হতবাক! চেহারা চালচলন দেখে মনে হল ভালই পয়সা করেছে। পুরোনো খড়ের বাড়ি ভেঙে একসাথে সেখানে দোতলা বাড়ি হাঁকিয়ে দিল। আটচালার উন্নতির জন্যে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা ডোনেশান দিল। বখে
    যাওয়া ছেলেরা তার পিছে পড়ে গেল মদ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। সে-ও দু’হাত উপুড় করে তাদের আর্জি মত সব ব্যবস্থা করে দিল। পাড়ার ওইসব ছেলেরা সম্পদ ঋষির প্রসংশায় পঞ্চমুখ। তাদের কাছে তখন সম্পদ ঋষি আর দিলখুস সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাস দুই পাড়ায় থেকে একতলাটা বসবাসের উপযুক্ত করে বানিয়ে আবার উধাও সম্পদ ঋষি। সুবোধ কাকার বাড়ির পাশেই তার অট্টালিকা। বাড়ি তৈরীর সময় সুবোধ কাকা সম্পদকে জিজ্ঞেস করেছিল,“হ্যাঁরে কাকা, তুই তো পড়া পারতিস না বলে ক্লাসে মাস্টারের কাছে বেতের বাড়ি খেতিস। সেই অপমানে পড়া ছেড়ে দিয়ে মিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজে কোলকাতায় চলে গেলি। মাথা তোর কোনোদিন পরিষ্কার ছিল না বলেই বেতের বাড়ি খেতিস। হঠাৎ তোর মাথা এমন সরেস হয়ে গেল যে গুচ্ছের টাকা আয় করতে শুরু করলি!”
    সুবোধ কাকার কথায় মুচকি হেসে সম্পদ বলল,“কাকা, মাথা পরিষ্কারের জন্যে না। ভাগ্য সহায় হবার ফলে আমার কপাল খুলে যায়। বাবুর ভীষণ নেওটা ছিলাম। একসময় বাবু আমাকে এত বিশ্বাস করে ফেলল যে আমি ছাড়া কন্ট্রাক্টর বাবু এক পা চলতে পারতো না। আমারও ভাগ্যের হাত ধরে বুদ্ধি খুলতে লাগল। বাবুর বউ বাঁজা ছিল। আমি তার সন্তানের মত হয়ে গেলাম। পরের দিকে যারা আমাদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় তারা জানতো আমি বাবুর ছেলে। তা একদিন বুকের ব্যথায় বাবু চলে গেল। ছেলে হিসেবে বাবুর সব কাজ করলাম। গিন্নিমা এখনো বেঁচে আছে। আমি বেইমানি করিনি গিন্নিমার সঙ্গে। এখনো গিন্নিমাকে আমি মায়ের চোখে দেখি। ব্যবসার সব টাকা পয়সা গিন্নিমার ব্যাঙ্কের খাতায় রাখি। ইদানিং গিন্নিমা আর ওসব দেখে না। সবটাই আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে একটা সাংঘাতিক কথা আমাকে বলেছে গিন্নিমা। বলেছে,“বাবু, আমাদের সব সম্পত্তি তোর করে দিয়ে গেলাম। এরপর যদি তুই ভাবিস আমি তোর পথের কাঁটা হয়ে রইলাম তাহলে তুই আমার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে দম আটকে মেরে দিস।” কথাটা সুবোধ কাকাকে বলতে বলতে সম্পদের গলার কাছে কে যেন দলা পাকিয়ে কথা আটকে দেয়। খানিক থেমে আবার বলে, “গিন্নিমার সেই কথায় আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। প্রতিজ্ঞা করে বলি, জীবন দিয়ে আমি তোমার পাশে থাকব গিন্নিমা। এমন কথা দ্বিতীয়বার বলে আমাকে কষ্ট দিও না।” সুবোধ কাকা এইসব কথা একদিন আটচালায় বলছিল। ভাল চিন্তার মানুষরা তাকে বাহবা দিয়েছে। আর যারা লোভী তারা তাকে ‘বোকা’ দেগে দিয়ে আফসোস করেছে। এরপর বছর গড়িয়ে গেছে সম্পদের পাত্তা নেই পাড়ায়। পাড়া তাকে ভুলতে বসেছে। সেইসময় দিনু ঋষি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতে দিনু বলে, “ও তো আমাদের সম্পদ ঋষি গো। তোমরা জানো না? ও কোর্ট থেকে এফিডেভিট করে বাপ পিতেমহের পদবি বদলে ফেলেছে। পয়সা হয়েছে। তাই জাতে উঠে গেছে। রুইদাস তো ছোট জাত। এই টাইটেল শুনলে লোকে নাকি তাকে বেঁকা চোখে দেখে। তাই জাতে ওঠার জন্যে পদবি পরিবর্তন করে ‘সরকার’ হয়েছে। ছিঃ ছিঃ। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত নিজের জাত খোয়ানোর ইচ্ছে হল! এখন ওর বিরুদ্ধে কে কথা বলতে যাবে? অঢেল পয়সা। পয়সায় পাড়ার সকলকে কিনে রেখেছে। আটচালাকেও তো শুনেছি কিনে নিয়েছে। তাই আটচালা ওকে কিছু বলছে না। তা আমরা ছাপোষা মানুষ। দিন আনি দিন খাই। আমাদের কথা কে শুনবে বলো?”
    দিনু ঋষির কাছ থেকে ঘটনাটা জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল সনাতনের। পয়সার গোমরে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করতে পারে? তার জন্মসূত্রকে এত সহজে অস্বীকার করে ফেলতে পারে? যে তা করে, সে কেমন মানুষ? এ তো নরকের কীটেরও অধম। জন্মসূত্রে আমরা অধিকারী হয়েছি আমাদের এই জাতটাকে লালন করার। আমরা এই জাতকে লুপ্তপ্রায় জাতে পরিণত করতে পারি না। একে টিকিয়ে রাখা আমাদের জন্মাধিকার। সুবোধ কাকার কাছে ওর বৃত্তান্ত শুনে সম্পদের প্রতি মনে মনে একটা স্বস্তিবোধ জেগেছিল। এখন তো তাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। ‘সরকার’ পদবি নিলে কি সে আর ‘মুচি’ রইল না! ‘সরকার’ এসে ‘মুচি’কে মুছে দিল! কি জাত হল তাহলে এখন সে? একাধারে সে সাধারণ মানুষের কাছে নিজের জন্মবৃত্তান্তকে লুকিয়ে রাখল। আর স্বজাতিকে বার্তা দিতে চাইল যে সে এই মুচি জাতটাকে ঘৃণা করে। তাই যে সূত্র ধরে তার জন্ম সেই জন্মসূত্রকে অস্বীকার করছে। অস্বীকার যখন সে করছে তখন তাদের এই জীবনযাত্রার মধ্যে তার ঠাঁই হওয়া তো উচিৎ নয়। আটচালাকেই এখন ঠিক করতে হবে জাতভ্রষ্টকে পাড়ায় ঠাঁই দেওয়া হবে কি না। এখনই আটচালাকে তাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। নচেত ভবিষ্যতে এই প্রবণতা বাড়তে থাকবে। তখন তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে সমাজের প্রান্তিক এই সম্প্রদায়টা।
    কোচি পিওনের কাছ থেকে চিঠিটা দিনু ঋষিকে নিয়ে নিতে বলল সনাতন। বলল,“ও তো তোদেরই জ্ঞাতি ভাই। তার অনুপস্থিতিতে তুই চিঠিটা নিয়ে রাখ। পরে ওটা দরকার হতে পারে। আটচালা যখন আনতে বলবে নিয়ে আসবি।”
    আটচালার এবারের মিটিংয়ে পাড়ার সমস্ত সিনিয়র মানুষদের উপস্থিত থাকা জরুরী বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসেছেও সব্বাই। আলোচনা শুরু হবার আগে সনাতন তার ভাবনাগুলো বক্তব্যের আকারে সভায় ব্যক্ত করে। সব শুনে সুবোধ কাকা বলল, “এতো তাদের রুইদাসদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে যদি এমন অপকর্ম করার জন্যে শাস্তি দেওয়া না হয় তো আর একজন পয়সার গরম দেখিয়ে বলতে পারে এই মুচি জাত নীচু জাত। এই জাতের পদবি আমি মানব না। এর ফলে পাড়ায় তো একদিন জাত-বেজাতের সমাহার হয়ে দাঁড়াবে। পুরোপুরি অস্তিত্বের সঙ্কটে এসে দাঁড়াবে রুইদাসরা। দেখা যাবে একটা সময় পর পরবর্তী ধাপের সন্তানসন্ততিরা জানতেই পারবে না চর্মকার-মুচি জাত বলে একটা স্বতন্ত্র জাত এই গ্রামে ছিল। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। সম্পদের অঢেল সম্পদ আছে, থাকুক। যেমন বিদেশে আছে নিজের গোমর নিয়ে থাকুক। আমাদের তাতে কোন আপত্তি নেই। আবার এফিডেভিট করে নিজের পদবিতে ফিরে না এলে ওকে এই পাড়ায় ঠাঁই হবে না। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে ওর তৈরী হতে থাকা পাকা বাড়ি। তার আগে ওকে একবার সুযোগ দেওয়া হবে ভুল শোধরানোর। তা না শুনে পয়সার জোরে পুলিশ দিয়ে এখানে কিছু করতে পারবে না। পুলিশ খুব ভাল করে জানে এই রুইদাস পাড়ার অনুশাসন। ওরা কোনদিন আটচালার কাজে মাথা গলায়নি। এখনো গলাবে না।” সম্পদের জ্ঞাতি, দিনু ঋষিকে ভার দেওয়া হল আটাচালার এই সিদ্ধান্ত তার কানে পৌঁছে দেবার জন্যে। সম্পদের পয়সার দম্ভের কথা ভেবে প্রথমদিকে খবরটা পৌঁছে দেবার ব্যাপারে ঘোঁত ঘোঁত করছিল দিনু। পরে চাপে পড়ে রাজি হয়। পাড়ার উপস্থিত সকল মানুষ এক বাক্যে সুবোধ কাকার সমস্ত মতামতকে স্বীকার করে নেয়। সনাতনের ভাবনার সঙ্গে সুবোধকাকার ব্যাখ্যা হুবহু মিলে যায়। স্বস্তিবোধ করে সে।
    পঞ্চায়েত নির্বাচন আগামী তিন মাসের মধ্যে হবে বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন সেই নিয়ে ব্যস্ততা তুঙ্গে। জনসংখ্যার নিরিখে সনাতনদের পাড়া থেকে এবার একজন সদস্যর কোটা নির্ধারিত হয়েছে। এলাকার মূল দুই রাজনৈতিক শিবিরের দৃষ্টি এখন ওদের পাড়ার দিকে। রুইদাস পাড়া থেকে কাকে তাদের দলের প্রতিনিধি করা যায় সেই নিয়ে চুলচেরা আলোচনা চলেছে দুই দলের মধ্যে। মূলত এ’পাড়ার কোন লোকটার প্রতি মানুষের ভালো প্রভাব তাই নিয়েই চর্চা। অপরেশ সর্দারদের দল এখন প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে দীর্ঘ বছর রাজ্যের ক্ষমতায়। সেই দলের মুখের উপর কথা বলার সাহস এখন সাধারণ মানুষের তো নেই-ই, বিরোধী দলেরও নেই! অপরেশ সর্দার একদিন দলবল নিয়ে হাজির সনাতনদের বাড়ির উঠোনে! সনাতন তখন টিউশনি পড়াচ্ছে। সকালের ব্যাচের পড়ানো তখন প্রায় শেষের দিকে। এলাকার ডাকসাইটে নেতা, অপরেশবাবুকে কে না চেনে। তাকে দেখেই সনাতন উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে সনাতন বলল,“আসুন আসুন দাদা। দাবায় উঠে আসুন।” তার ছাত্রী, সুন্দরীকে দাবায় দুটো বড় মাদুর বিছিয়ে দিতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাচটাকে ছুটি দিয়ে দিল। সনাতনের আহ্বান মত ওনারা এসে দাবায় বসতে বসতে বলল, “তোমার সঙ্গে একটা বিশেষ দরকারে আমরা এসেছি। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে আমরা এসেছি মানে বুঝতে পারছো দরকারটা ব্যক্তিগত নয়, রাজনৈতিক।” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “সে কথা তো হবে। তার আগে যদি অনুমতি দেন তো একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। আপনাদের মত বড় মানুষ আমাদের এই গরিব ঘরে এসেছেন। সামান্য একটু চা দিয়ে যদি আপ্যায়ন করতে পারি তো আমরা ধন্য হয়ে যাব।”
    সনাতনের কথা এবং ব্যবহারে তৃপ্ত বোধ করে অপরেশবাবু। পাশে বসে থাকা সহকর্মীকে ফিসফিসিয়ে বলল, “ছেলেটা বেশ সোবার তো? তোমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত মনে হচ্ছে তো একদম সঠিক। এই ছেলের জনভিত্তি না থেকে পারে না। এখন তার পছন্দের ছেলে যদি চায়ের অফার করে প্রত্যাখ্যান করে কি করে। কথা না বাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে দেয় অপরেশবাবু।
    অন্য ছাত্রীদের ছুটি দিলেও সুন্দরীকে থেকে যেতে বলে, সনাতন। এতগুলো লোক তার বাড়িতে এসেছে। চা-টার তো ব্যবস্থা করতেই হবে। সেটা আগাম বুঝে সুন্দরীকে আটকে দেয়। মা একা সবকিছু সামলাতে পারবে না। সম্মতি পেয়ে সুন্দরীকে তাড়াতাড়ি চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে অপরেশবাবুদের কাছে এসে বসল সনাতন। বলল, “বলুন দাদা আপনার মত বড় মানুষের আমার কি দরকার?” অপরেশবাবু বলল, “সনাতন তোমাকে আমাদের দলের প্রতিনিধি হয়ে তোমাদের পাড়ায় দাঁড়াতে হবে। তুমি জানো কি না জানিনা, এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তোমাদের রুইদাস পাড়া, পালপাড়া এবং পদ্মরাজ পাড়া নিয়ে একটা নতুন সীট বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী জনসংখ্যার নিরিখে এটা হয়েছে। এটা আমাদের লোক্যাল কমিটির প্রস্তাব এবং জেলা কমিটি থেকে তা মঞ্জুর হয়ে এসেছে। আমরা এসেছি তোমার সম্মতি নিতে।”
    সনাতন কোনদিন ভাবেনি যে রাজনৈতিক দল থেকে এমন প্রস্তাব তার কাছে কোনদিন আসতে পারে। কেননা সে কোনদিন রাজনীতির ধারেকাছে যায়নি। ভালও লাগে না তার। তার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা গেঁথে আছে যে রাজনীতি মানেই হইহুল্লোড়, মারপিট, মিথ্যাচার, হিংসার বাতাবরণের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আর ক্ষমতা ভোগের অহমিকা। আর এই ধারণা তার মন থেকে মুছে ফেলা মুশকিল। অপরেশবাবুর মত বড় নেতা এসেছে মানেই গদগদ হয়ে বা ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে তার কথায় মাথা হেলে দেবে, সে ধাতের ছেলে নয় সনাতন। সে বলল,“দাদা, আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। কোন দলের হয়ে কোনও কাজ করিনি। সেই আমাকে কেন আপনাদের দলে টানতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। সেইসঙ্গে আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই, আমি কিন্তু ভবিষ্যতেও কোনদিন রাজনীতিতে ঢুকব না। আমি পছন্দ করি না। দয়া করে আমাকে এই অনুরোধটা করবেন না। বলে সনাতন চায়ের দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।”
    অপরেশবাবু মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটা যেমন ভদ্র তেমন দৃঢ়চেতাও বটে। এমন ছেলেকেই আমাদের দরকার। সনাতন সেখান থেকে চলে যাবার পরে সহকর্মীদের সঙ্গে একটু আলোচনা সেরে নিল। তারপর সনাতন ফিরে এলে হাসি মুখে তাকে বলল, “তোমাকে আমরা আমাদের দলের সদস্য হতে বলছি না। তাহলে তো তোমার ভাবনামত তুমি দলগত রাজনীতি করছো না। দলহীন প্রার্থী হতে এরপর নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি থাকার কথা না। আমাদের দলের সমর্থনে তোমাকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে বলছি। পরিষ্কার কথা, তোমাকে, তোমার মত করে আমাদের মধ্যে পেতে চাই।” এরপর সনাতন কোন পাল্টা যুক্তি দিয়ে অপরেশবাবুদের উপেক্ষা করতে পারল না। আসলে এরা হচ্ছে দুঁদে রাজনীতিবিদ। কোন ঠাকুর কোন ফুলে তুষ্ট হয় এরা তা খুব ভাল করে জানে। যুক্তির জালে এমন জড়িয়ে দেবে যে তার থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
    নির্বাচনে সনাতন বিপুল ভোটে জিতে গেল। তার বিপক্ষ দলের প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়ে গেল। অপরেশবাবুর দলও পঞ্চায়েতের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে পঞ্চায়েতরাজ দখল করে নিল। তাদের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটে লীড দিয়েছে সনাতন রুইদাস। তাছাড়া ওর জীবনশৃঙ্খল, কাজের দক্ষতা এবং মানুষের মনহরণের ক্ষমতা অপরেশবাবুরা পরখ করেছে নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন। অপরেশবাবুর মনে হয়েছে এই সনাতন রুইদাসই প্রধান হবার উপযুক্ত। ওর মত যোগ্য প্রার্থী তাদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে কেউ নেই।
    প্রধান হয়ে সনাতনের ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে গেল। চার ব্যাচ টিউশনি পড়ানোর সময় সে একদম দিতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত সকালের মেয়েদের ব্যাচ এবং বিকেলে তাদের পাড়ার ছাত্রদের ব্যাচ রেখে দিয়ে অন্য দুটো ব্যাচ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। সুষ্ঠভাবে এবং সততার সঙ্গে পঞ্চায়েত পরিচালনার একটা নজির রাখতে শুরু করল সনাতনের দক্ষ হাত। তার নিজের পাড়া থেকে এবার দাবি উঠল, আটচালা পরিচালনায় সনাতনকে যুক্ত করতে হবে। একজন পঞ্চায়েত প্রধান, যে তাদেরই পাড়ার সন্তান সে যদি আটচালার কমিটিতে থাকে তাহলে গ্রামের আরও অনেক উন্নতি হবে। অন্যদিকে পাড়ার একটা ছোকরা, সেদিনের ছেলে, সে কিনা তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে? পাড়ার কোনো কোনো বয়স্ক মানুষ সেটা মেনে নিতে চাইছিল না। বিরোধিতাও করেছে। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠের প্রবল চাপে সেই ক্ষীণ প্রতিরোধ ধোপে টেকেনি।
    তখনও নিজের পেচ্ছাপ-পাইখানার কাজটা নিজে সেরে নিতে পারতো রেখা বউয়ের শাশুড়ি। মনে হয় ও বুঝতে পেরেছিল, তার শেষের দিন আর বেশি দূরে নেই। সেই ভেবে রেখার অগোচরে অতীতে বাড়িতে বহুল ব্যবহৃত ছোট্ট কৌটোটা বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখে ভীষ্মর মা। পরপর করেকবার ছোট আকারে বুকের হৃদপিন্ড ধাক্কা খেয়েছে। ডাক্তার বলেছে,খুব সাবধানে রাখতে। চলাফেরা একদম করা চলবে না। ডাক্তারের পরামর্শমত ওষুধপত্রর সব ব্যবস্থা করে রেখেছে অখিল। কিন্তু বিছানাই এখন হয়ে গেল ভীষ্মর মায়ের পৃথিবী। মনে হয় আর বেশিদিন এই পৃথিবী তাকে ঠাঁই দেবে না। বুঝে গেছে রেখার শাশুড়ি।
    রেখার কান্নাকাটিতে পাশের বাড়ির বউরা দেখেতে এসে খবরটা চাউর হয়ে যায় মন্ডল পাড়ায়। পাড়ার আরও পুরুষ মহিলারা এসে পড়েছে। রোজকারের মত সকালে অখিলও এসে পড়েছে রুগিকে দেখতে। তখনও বুড়ি হাত-পা নাড়ছে, টুকটাক কথা বলতে পারছে। হঠাৎ বুড়ি অখিলকে কাছে ডেকে নেয়। কোনোদিন এমন কাতরভাবে তাকে কাছে ডাকেনি সে। অবাক করে অখিলকে! আরও যেন অবাক করা দৃশ্যের সাক্ষী হবার অপেক্ষায় ছিল তাদের ঘরের এই ছোট্ট পৃথিবীটা। মেয়ে রেখাকেও কাছে টেনে নেয়। এবার মাথার বালিশের তলা থেকে সেই অমূল্য কৌটো বার করে অখিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,“আমার মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর দান করো বাবা। যতক্ষণ না তুমি কাজটা শেষ করছো ততক্ষণ যমরাজ অপেক্ষায় থাকবে। আমাকে তুলে নেবে না। তুমি আমাকে মুক্তি দাও বাবা। আমি নিশ্চিন্তে তাহলে ওপারে চলে যেতে পারি।” একঘর পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে অখিল রেখার সিঁথিতে হৃদয় উজাড় করে সিঁদুর পরিয়ে দিল। কিছু কালের জন্যে যেন সেই পৃথিবী মূক হয়ে রইল ! মুক্ত হল রেখার মা। নব জীবনের অধিকারিনী রেখার চোখের জলের ধারায় শোধন হতে থাকল তার বৈধব্য জীবন-সহ চরাচরের মলিন যা কিছু সব। সব।
    এক গ্রাম সাক্ষী থেকে অখিল রেখাকে বিয়ে করেছে। উল্কার বেগে খবরটা ছড়িয়ে গেল আশপাশের এলাকা সহ তাদের রুইদাস পাড়াতেও। তেতে উঠতে সময় নিল না, অখিলের প্রবল বিরুদ্ধপক্ষ নোচে-বিন্দেদের দল। ছোটাছুটি পড়ে গেল পাড়ায়। প্রবল দাবি উঠতে থাকলো এই অন্যায়ের একটা বিহিত করার জন্যে। আটচালার উপর চাপ আসতে লাগল। কালবিলম্ব না করে অখিলের এই জঘন্য কাজের বিচার করতে হবে।
    বিচারসভায় অভিযোগকারিদের পক্ষে অভয় বলল,“একজন বেজাতের বিধবা বউকে বিয়ে করে অখিল তাদের রুইদাসদের মানসম্মান মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছে। ওকে অনেক আগে থেকে সাবধান করা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে এই নোংরা কাজ করেছে। ব্যবসার ছুতোয় অখিল মেয়েদের সঙ্গে অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকে এটাই তার প্রমাণ। ওকে গ্রামছাড়া করা হোক। নাহলে অন্যেরা এই কাজে প্রভাবিত হতে পারে। তা তাদের সমাজের পক্ষে চরম ক্ষতিকর হবে। এই নোংরামো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।”
    এবার অখিলের বলার সুযোগ আসতে সে বলল,“জেনেশুনেই সে একজন অরক্ষণীয়া স্বামীহারা মেয়ের পুর্ণজীবন দান করেছে। রেখার শাশুড়ি মারা যাবার পর ওকে রক্ষা করার জন্যে পৃথিবীতে কেউ ছিল না। নাহলে একটা স্বল্পবয়সী অসহায় যুবতীর শরীর কুকুর-শেয়ালে ছিঁড়ে খেতে পারতো। জাতপাতের উর্দ্ধ্বে যদি কেউ কারোর কাছে জীবনভিক্ষা চায় আমাদের প্রথম কর্তব্য হয় সাধ্যমত তার পাশে দাঁড়ানো। আমি ঠিক সেই কাজটা করেছি। আমি তো আমার জাত খোয়াইনি! মানবতার পাঠ নিয়েছি। আমি নির্দোষ। এই অন্যায় অভিযোগ থেকে আমাকে আটচালা রেহাই দিক, এটাই আমার প্রার্থনা।” এরপর অভিযোগকারিদের কোনো কথা বলার আছে কি না প্রশ্ন করতে গিয়ে সনাতনরা দেখে তারা আশেপাশে কোথাও নেই! কখন যেন উধাও হয়ে গেছে!

    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২১)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

     

    [একচল্লিশ]

    একাশি শতাংশ নম্বর নিয়ে হায়ারসেকেন্ডারী পাশ করল সনাতন। ইচ্ছা ছিল বিপ্লবদার মত কলেজের পড়া শেষ করে এম.এ.করবে। ইংরেজী অনার্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করতো। বিরানব্বুই নম্বর পেয়েছে ইংরেজীতে। ডায়মন্ড হারবার কলেজে সহজেই চান্স পেতে পারে। কিন্তু এই এগিয়ে যাবার ভাবনাকে পিছু টেনে ধরল তার অভাবী সংসার। বাবার হার্টের ব্যামো ধরা পড়ল। বাবার যাবতীয় শারীরিক পরিশ্রম বন্ধ। কড়া দাওয়াই ডাক্তারের, “বাবাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তো গতরে খাটা কাজ বন্ধ করতে হবে। টুকটাক চলাফেরা বা বসে থাকা কাজ করা যেতে পারে।” সেইমত বাজারের জুতো-ব্যাগ সারাইয়ের ফুটের দোকানে দু’বেলা কোনোমতে গিয়ে বসে। বসলে কি হবে আগের মত চটপটিয়ে গোছানো কাজ করতে পারে না। সেইজন্যে খদ্দেরও আস্তে আস্তে অন্য দোকানে চলে যেতে থাকে। দোকান থেকে আয়ে বাবার হাত খরচাটা হয়তো কোন রকমে চলে যায়। কিন্তু সংসার? সংসার তাদের চলবে কেমন করে? প্রশ্নটা এসে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল সনাতনের ঘাড়ে! ঘাড় থেকে এই ভারি পাথর সরিয়ে তার আর কলেজে পড়ার স্বপ্ন বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে পারল না।
    সনাতন ঠিক করল প্রাইভেট টিউশনির ব্যাচ বাড়িয়ে দেবে। তাদের জাত কারবার চামড়া বা বেতের কাজে কোনদিন তেমনভাবে রপ্ত করা তার হয়ে ওঠেনি। আসলে ওগুলোতে ওর মন টানতো না। বাবাও সে জন্যে তার উপর কোনদিন জোর খাটায়নি। বাবা মায়ের কাছে বলতো, “ছেলে যে কাজ করলে খুশি হবে সেই কাজ সে করুক। তারা রুইদাস বলে রুইদাসদের জাত কারবারে ঢুকতে হবে তার কোন মানে নেই।” তাই চাপ না থাকায় এই কাজে সে মাথা গলায়নি। অবশ্য ঢাক বাজানোর কাজটা সে ভাল করে রপ্ত করতে পেরেছিল। এখনো ওটার প্রতি তার অনিহা জন্মায়নি। ভগবানের প্রতি নিবেদিত এই বাজনার সুর-তাল-লয়। একে অবজ্ঞা করা তার সধ্যের বাইরে। তবে বাবা সঙ্গে না থাকলে সে কেমন করে রোজগারের জন্যে ঢাক হাতে নেবে! ঢাকের সঙ্গী যদি তার বাবা, রতন রুইদাস হয় তো তার ইচ্ছাশক্তি তখন প্রবল হয়ে যায়। আর এই বাজনার কাজ তো সম্বচ্ছর হয় না। মরসুমী পেশা এটা। এখন সর্বক্ষণের রোজগারের পথ একমাত্র তার সামনে খোলা রইল এই টিউশনি।
    মেয়েদের ব্যাচটাকে কোনো ডিস্টার্ব করতে চায় না সে। তবে সকালে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে আর একটা ব্যাচ বাড়ায়। ঠিক করল যদি ছাত্রছাত্রী বাড়ে তো সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত আরও দুটো ব্যাচ খুলে দেবে। তবে সন্ধ্যের ব্যাচ দুটোতে কোন মেয়েকে সে পড়াবে না। মেয়েদের রাতের অন্ধকারে আসা যাওয়া করার ঝুঁকি সে নিতে পারবে না। ঠিকও হবে না। অমঙ্গল কখনো বলে আসে না। সুযোগ বুঝে শিকারের উপর হামলে পড়ে। পাড়া গাঁয়ে যেমন গাছপালা-প্রকৃতির দাপটে এবং বিজলি আলোর অভাবে কালো-অন্ধকারের আধিক্য বেশি। তেমনি কালো-মনের মানুষেরও অভাব নেই। সংসারের চাকা গড়াতে গেলে এ ছাড়া তার সামনে আর বিকল্প কিছু রইল না বলেই এই সিদ্ধান্ত।
    বাবার অসুস্থতার কথা জেনে মেয়েদের ব্যাচের এক ছাত্রী, সুলতা বলে, “স্যার ডায়মন্ড হারবারে একজন বড় ডাক্তার আছে, আমার বাবার বন্ধু। বাবাকে বলবো, ওই ডাক্তার জ্যেঠুকে দেখাবার ব্যবস্থা করার জন্যে? বাবা বলে দিলে পয়সা লাগবে না। মনে হয় ওনার চিকিৎসায় আপনার বাবা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার বাবার অসুখের জন্যে আপনার মন খারাপ। তার জন্যে আমাদেরও মন কেমন করে।” মেয়েরা এমনিতেই স্পর্শকাতর হয়। তাই বলে তার মাস্টামশাইয়ের বাবার জন্যে তাদের মন কেমন করছে জেনে মনের মধ্যে এক গভীর তৃপ্তি বোধ কাজ করে যায়। সুলতার এই প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে শান্তচিত্তে সনাতন বলল, “আমাদের কুঞ্জ ডাক্তারবাবু দেখছেন। রোগ ধরতে পেরেছেন। সেইভাবে চিকিৎসা চলছে। বাবা এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছে। তুমি তোমার বাবাকে বলে রেখো, যদি প্রয়োজন হয় নিশ্চয়ই আমরা তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।” সনাতন মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলতে খুশি হয়। বলে, “ঠিক আছে স্যার। আগে থেকে আমি বাবাকে বলে রাখবো’খন।”
    পরদিন পড়ানোর দিন ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখহাত ধুয়ে ঘরের দাবায় বসে সনাতন মায়ের সঙ্গে চা খাচ্ছে। সেই সময় হঠাৎ সুন্দরী দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির, কোনকিছুর ভূমিকা না করে একটা সাদা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে সনাতনের মায়ের হাতে দিয়ে বলল, “জ্যেঠিমা, এতে অশ্বগন্ধা গাছের শেকড় আছে। মা বলেছে, খলে বেটে রোজ সকালে খালি পেটে এক চামচ করে জ্যেঠাকে খাইয়ে দিতে। তাহলে জ্যেঠা তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে। রোজ খাওয়াবে কিন্তু জ্যেঠিমা। একদম ভুল যেন না হয়। তোমাদের খল-নোড়া নেই না? ঠিক আছে, আমাদের বাড়িতে একস্ট্রা একটা পড়ে আছে। মা’কে বলে নিয়ে আসি গে। চলি।” বলে পিঠটান দেবার সময় সনাতন ডাকে, “সুন্দরী শোন। দাঁড়া দু’দন্ড! অত ছটফট করছিস কেন? তুই জানলি কেমন করে যে এতে বাবা সেরে উঠবে?”
    স্যার একথা বলা মাত্র শক্ত ডাঙ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সুন্দরী। তারপর মাথা নীচু করে তার স্বভাববিরুদ্ধ ঢঙে, শান্তভাবে বলল, “মা’কে বললাম, স্যারের বাবার হার্টের প্রবলেম হয়েছে। কোন ওষুধ তোমার জানা আছে মা? দাও না, দিয়ে আসি। স্যারের মুখ দেখে মনে হ’ল, স্যারের মনটা খুব খারাপ। মা তখন এটা দিল। আমাদের শরীর খারাপ হলে মা এইসব গাছগাছড়া, শেকড়-বাকড়ের ওষুধ দেয়। অসুখ সেরেও যায়। মা এসব জানে। তাই মাকে বললাম, মা দিয়ে দিল।” বলে আবার সনাতনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “জ্যেঠিমা, আমি আসছি। যেমন বললাম সেইভাবে জ্যেঠাকে খাইয়ে দিও কিন্তু।” আবার সেই ছটফট করে ওঠে, চলে যাবার জন্যে। সনাতন ফিরে তাকে ডাকে, “চলে যাচ্ছিস যে সুন্দরী? আমার কথা তো শেষ হয়নি। তুই কি খুব ব্যস্ত আছিস? পড়াশোনা করছিস নিশ্চয়ই? তাই এত ব্যস্ততা তোর? নাকি এমনি এমনি এখান থেকে পালাতে চাইছিস? সে তো তুই যাবি। থাকার জন্যে তো আসিসনি জানি।” একটু থেমে আবার সুন্দরীকে ঠাট্টা করে রাগিয়ে দেবার জন্যে বলল, “তা তুই শুধুমুধু পড়া ক্ষতি করে ছুটে এখানে আসতে গেলি কেন? বললে তো আমি বা মা তোর মায়ের কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে আসতে পারতাম। ওঁ-হুঁ। আমার মনে হয় শুধু ওষুধ দিতে তুই আসিসনি। ওষুধ দিতে আসার ছুতোয় আমার মায়ের সঙ্গে দেখাও করতে এসেছিস। কি, তাই কি না বল, সুন্দরী? চুপ করে থাকিস না, বল আমি ভুল বললাম কি না?”
    “আমি জানি না যাও…” বলে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে দাবা থেকে নেমে উঠোন ফুঁড়ে দৌড়ে পালালো, সুন্দরী !
    সনাতনের কথায় মেয়েটা যে লজ্জা পেয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে মা বলল, “কেন মিছিমিছি মেয়েটার পেছনে লাগতে গেলি? সে কোথায় তোদের উপকার করতে এল। বাহবা দিবি তাকে। না, উল্টে ক্ষেপিয়ে দিলি। এবার দেখবি পড়ার সময় বাদে অন্য সময় তুই বাড়ি থাকলে ও আর এ’মুখো হবে না। বড়ই ছটফটে হাসিখুশি মেয়ে। ওর মনটা কত সরল একবার ভেবে দেখ। তোর আরও ছাত্রী আছে। সুন্দরীর মত তো মনের হয় কেউ না। দেখতেও কেমন মিষ্টি মিষ্টি। আর কোনদিন ওকে ক্ষেপাবি না বলে দিলাম।”
    সুন্দরীর কথা মত রোজ সকালে অশ্বগন্ধা শেকড় খলে বেটে এক চামচ করে খাওয়ায় সনাতনের মা। খল-নোড়াটা পরদিন সনাতনের মা নিজেই সুন্দরীর মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছে, বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে। মায়ের সাথে যখন স্যারের মা কথা বলছে, সেইসময় সুন্দরী এসে বলে, “জেঠিমা, আমি গেছিলাম খলটা নিয়ে। তোমাদের বাড়ি উঁকি মেরে দেখি তুমি নেই। স্যার বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। স্যার যদি দেখতে পায়, সেই ভয়ে পালিয়ে এসেছি। আবার যদি দাঁড় করিয়ে কিসব প্রশ্ন করে? তাই।”
    -তা স্যারের দেখে তোর ভয় কিসের। স্যার কি বাঘ-ভাল্লুক! কেন পড়ার সময় স্যার তোদের বকাঝকা করে বুঝি? সেইজন্যে ভয় পাস। কিন্তু তোদের স্যার তো শান্তশিষ্ট মানুষ। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সনাতনের মা বলল।
    সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী বলল, “না না জ্যেঠিমা। স্যার পড়ানোর সময় একদম বকাঝকা করে না। খুব সুন্দর করে বোঝায় আমাদের। এত ভাল করে বোঝায় যে বাড়িতে এসে আর সেই বিষয়টা পড়ার দরকার হয় না। স্যারের মত মানুষ হয় না।”
    -তাহলে স্যারের দেখে ভয় পাস কেন, সেটা বল?
    -জানি না যাও। বলে সেখান থেকে পোঁও দৌড় দিল সুন্দরী ! সনাতনের মা, পুষ্প সুন্দরীর চপলতায় মনে মনে তৃপ্তি বোধ করে। ভাবে, মেয়েটাকে তাদের ঘরের বউ করলে মন্দ হয় না। মেয়েটার বুক ফাটে। মেয়ে হয়ে পুষ্প খুব ভাল করে তা বুঝতে পারে। তবু মুখে কাউকে বলার সাহস পায় না বেচারাটা। শরীরী ভাষায় তার ইঙ্গিত দিয়ে যায়, তার স্যারকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তার ছেলে বুঝেছে কিনা কে জানে। বুঝলে তো ভাল। মনের মত একটা বউমা তার ঘরে তুলতে পারে।
    বিকেলে সনাতন বাবার সঙ্গে দোকানে আছে। সে দেখেছে, একটা লোক ভ্যান রিক্সায় করে ওই শাকপাতা, শেকড়-জরিবুটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। ও মনে মনে ঠিক করে, ওই লোকটাকে দেখতে পেলে ধরবে তাকে। কিন্তু ক’দিন হয়ে গেল শেকড়ওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাজারে সে আসছে না নিশ্চয়ই। তাহলে দেখা তো হতোই। হঠাৎ একদিন তাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে বাবাকে কিছু না বলে উঠে গিয়ে লোকটাকে ধরে, “আচ্ছা দাদা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, বলবেন আমাকে। ভীষণ প্রয়োজন আমার।” লোকটা বলল, বলুন না কি দরকার। আমার জানা থাকলে বলবো না কেন? আমাদের চারপাশে প্রকৃতির মধ্যেই কত ওষধী গুণ লুকিয়ে রয়েছে। আমরা যদি তাকে কাজে লাগাই তো ওই হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিলাসী চিকিৎসা ব্যবস্থার ফাঁদে পড়তে হয় না। শেকড়-বাকড়, গাছপালার উপকারিতা মানুষকে জানানোর জন্যেই তো আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আপনি দ্বিধা না করে বলতে পারেন।” লোকটার কথায় উদ্দীপিত হয়ে সনাতন বলল,“আপনি একটু বলবেন, অশ্বগন্ধা গাছের শিকড় মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কতটা কাজ করে? আমার বাবার হার্টের সমস্যা হয়েছে। এ্যালোপ্যাথি ডাক্তার দেখেছেন। এখন একটু নিয়ন্ত্রণে আছে। সে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের এক পরিচিত মানুষ বাবাকে এই অশ্বগন্ধার শেকড় খলে বেটে রোজ সকালে খালি পেটে এক চামচ করে খেতে বলেছে। ওটা কি খাওয়া যেতে পারে? এ’ব্যাপারে আমরা তো অনভিজ্ঞ। যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি। আপনি তো এই নিয়ে সবসময় কাজ করছেন। সেইজন্যে ক’দিন ভ’র আপনাকে খুঁজছিলাম। আজকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলাম।” সনাতনের কথায় উৎসাহিত হয়ে লোকটা বলল,“যিনি এটা খেতে দিয়েছেন তিনি একদম নবিশ মানুষ নন। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন শক্ত অসুখে সাহস করে এই অশ্বগন্ধার শেকড় খেতে দিতে পারতেন না। একদম ঠিক ঠিক ওষুধ চেলেছেন তিনি। একটা তথ্য আপনাকে দিচ্ছি, প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে এই অশ্বগন্ধা গাছের শিকড়, পাতা ও কমলা-লাল রঙের ফল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশেষত জীবনীশক্তি, ধৈর্য, দৃঢ়তা, আয়ুবৃদ্ধি, হৃদয়ঘটিত সমস্যার নিরাময়ের জন্যে এই অশ্বগন্ধা গাছকে ব্যবহার করার কথা বলা হয়ে আসছে। এমনকি বর্তমানে ভারত সহ বিশ্বের কিছু দেশে এই অশ্বগন্ধা গাছের শিকড়, পাতা, বীজ এমনকি ফল বিভিন্ন ওষুধের সক্রিয় উপাদান রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের কাজে লাগছে। তাই বলছি, এর গুণের অন্ত নেই। আপনি নিশ্চিন্তে এটা আপনার বাবাকে খাইয়ে যেতে পারেন।” লোকটার কথা শুনে সনাতন একাধারে যেমন অবাক হয়ে গেল, সুন্দরীর মায়ের যোগ্যতা দেখে তেমনি এটা খাওয়ানোর জন্যে মনে মনে যে উদ্বেগ ছিল তা নিরসন হল। ভাবলো এমন একজন গুণী মানুষ নীরবে তার চিকিৎসার কাজ করে চলেছে, অথচ কেউ তা জানে না। এতদিন যদি সেটা জানা যেত তো অসুখবিসুখে ওই মহিলার হাত ধরে তাদের মত গরিব সমাজ কত না উপকৃত হত।
    নিত্যদিনের মত ভোরে উঠে পুষ্প তাদের মাটির ঘরের দাবা, দাবার সঙ্গে কানাচে গোবর মাটি দিয়ে নেতা দিতে শুরু করে। হঠাৎ বিষ্ময়ের সঙ্গে সে লক্ষ্য করে দাবার কোনায় দেয়ালে রোজকারের মত আড় করে ঠেকনা দিয়ে রাখা তাদের বাটনা বাটা শীল-নোড়া দুটো দেয়াল থেকে সরে এসে সিধে হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন ওগুলো খুব সন্তর্পনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে! কিছুক্ষণ সেদিকে ঠায় তাকিয়ে আছে পুষ্প! মনে হল, আবার সামান্য একটু এগিয়ে এল! এবার আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। চেঁচিয়ে ছেলেকে ডাকতে লাগল, “ও সনাতন, ওঠ ওঠ বাবা। এখানে কি কান্ডটা হচ্ছে দেখবি আয় বাবা! ও সনাতন উঠলি? দেখবি আয় না রে বাবা, শীল-নোড়া কেমন দাবায় হাঁটাহাঁটি করছে!” এত ডাকাডাকিতেও ছেলেটা ঘুমে কাদা। ওর বাপও তাই! কি ব্যাপার বুঝতে পারছে না পুষ্প! সনাতনের বাবাকে জোর করে ডাকছে না, লোকটার বুকের ব্যামো বলে। হঠাৎ চমকে ওঠা এই ব্যামোর পক্ষে ক্ষতিকর তাই। ডাক্তার বলেছে- চমকানো, ধমকানো, চেঁচামেচি এই
    রোগের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। সেদিক থেকে সাবধান থাকতে বলেছে। অগত্যা পুষ্প পাশের বাড়ির লোকজনকে বলে। দৌড়ে যায় সুন্দরীর মায়ের কাছে, এই অবাক করা কান্ডর কথা জানাতে।
    এবার একে একে লোকমুখে পাড়াময় হয়ে যায়। সুন্দরী, তার মা-বাবাও ছুটে আসে সনাতনদের বাড়ি। দেখে, সত্যি সত্যি বারান্দায় শীল-নোড়া দেয়াল থেকে একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পেছনে কোন ঠেকনা দেওয়া নেই! পাড়ার মানুষরা এবার উজিয়ে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অবিশ্বাস্য এই সংবাদটা পাড়ার গন্ডি টপকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর হয়ে যায়। নামতে থাকে মানুষের ঢল ! উপচে পড়তে থাকে সনাতনদের বাড়ি, উঠোন, রাস্তাঘাট ! গিজগিজে হয়ে যায় লোকের ভিড়ে। সুন্দরীরা যখন আসে তখন সবে এক-দুই করে মানুষের জটলা শুরু হচ্ছে। অবস্থা দেখে সুন্দরী নিজেই তার সনাতন স্যারের শোবার ঘরে ঢুকে যায়। কোনকিছু না ভেবেই স্যারের পায়ের দিকে হাত ছুঁয়ে ঠেলা মারে। এক ঠেলাতেই ঘুম ছুটে যায় সনাতনের। এমন নরম মোলায়েম হাতের ছোঁয়া তো ও জীবনে অনুভব করেনি! হৃদয়ে কাঁপ ধরানো এই হাত কার! চোখ খুলতেই আর এক চমক তাকে গ্রাস করে। সুন্দরী! সে ডাকে কেন? মনে হল এই মায়াবী পরশ কেবল তার পা কেন তার সর্বাঙ্গ অনুভবে একাকার হওয়ার তো উপযুক্ত। সে সুখ ভাল করে আত্মস্থ করার ফুরসৎ কেড়ে নিল তার ঘরের বাইরের কোলাহল ! বিস্ময়মাখা দু’চোখ নিয়ে সুন্দরীকে বলে, “বাইরে কি হয়েছে, সুন্দরী? বাবার কি কোন কিছু?” সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী তার কথা থামিয়ে বলে, “না না স্যার। জ্যেঠু ঠিক আছে। তুমি ওঠ। বাইরে অন্য এক অঘটন ঘটে গেছে! দেখবে আসো। একদম দেরি করবে না।”
    সুন্দরীর কথায় মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরের কান্ড দেখে যারপরনাই হতভম্ব সনাতন! একটা শীল-নোড়া দেয়ালে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। সেটা সোজা হয়ে গেছে, কোন ঠেকা না দিয়েও একই ভাবে আছে। এই দৃশ্য দেখতে এতো মানুষ! অলৌকিক ঘটনা বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে! বলছে, ভগবান শিব আর মা দূর্গা জাগ্রত হয়ে তাদের বাড়ি অধিষ্ঠান করেছে। ওগুলো নাকি আবার খুব সুক্ষ্মভাবে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে, মানে হাঁটছে! একটা অবিশ্বাস্য অবাস্তব ঘটনা কেমনভাবে মানুষের মনে ভগবায়ন হয়ে যায় ভেবে বিস্ময়ে বিমুঢ় সনাতন! কিন্তু এত মানুষের ভাবনার বিরুদ্ধে সে একা কেমন করে বিপরীত মত প্রকাশ করতে পারে! পারবে না। ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে এই হাজার হাজার মানবকন্ঠ ! শুধু হাতে কলমে পরীক্ষার জন্যে একটা কাস্তে নিয়ে এসে ওই শীল-নোড়ার একদম গা ঘেঁষে স্পষ্ট আঁক কেটে দিল সে। প্রমাণ করাতে চায় যে এই পাথর যুগলের চলন ক্ষমতা কোনদিন ছিল না, এখন নেই এবং ভবিষ্যতে থাকবেও না। কিন্তু সে যা ভাবলো, বাস্তবে ঘটল তার বিপরীত ঘটনা। মানুষ হই হই করে চেঁচিয়ে উঠল, কাস্তে দিয়ে তার ওই দাগ কাটার বিরুদ্ধে। কেন ছেলেটা পাকামো করে লোহা দিয়ে আঁক কাটতে গেল? এবার তো বাবা শিব রুষ্ট হয়ে প্রলয় কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে তাদের পাড়া-গাঁ। বাবা বটুকনাথকে ঠান্ডা না করতে পারলে ঘোর অমানিশা নেমে আসবে তাদের জীবনে। সেই ভাবনায় মানুষ একের পর এক ঘটি দিয়ে ওই শীল-নোড়ার মাথায় জল ঢালতে শুরু করে। কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যে বরফের টুকরো নিয়ে এসে তার মাথায় চড়িয়ে দিয়ে যায়। আর সুন্দরী? তার কান্ড আবার চোখে পড়ার মত। সে সমানে সেই জল কাপড়ে ছুপে ছুপে বালতিতে ভরে বাইরে ফেলতে থাকে। না হলে যে বাড়িময় জলে চান হয়ে যাবে। ক্ষতি হয়ে যাবে তার স্যারেদের মাটির ঘরদোর। সনাতন দেখলো এই মেয়েটাকে না আটকালে তো সারাক্ষণ বরফজল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঠান্ডা লেগে অসুখে পড়ে যাবে! উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলে, “আপনাদের হাতে পায়ে ধরে আমি আমার কৃতকর্মের জন্যে বাবা বটুকনাথ এবং মা গৌরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে মাথা খুঁড়ছি। সেইসঙ্গে আপনাদের কাছে করোজোড়ে আবেদন করছি আর এভাবে ঠাকুরের মাথা ঠান্ডা করার দাওয়াই হিসেবে জল-বরফ ঢালবেন না। আমার কাস্তে দিয়ে কাটা আঁক আমি মুছে দিচ্ছি ফুল, চালকলা দিয়ে।” এতক্ষণে সনাতনের আবেদনে কাজ হয়। শান্ত হয় জনতা।
    প্রথম দিন তো জনতার ঢলে পাড়ার জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের আর দোষ কি। সনাতন পরখ করল মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে আর একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ কিভাবে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে। প্রবল ভিড়ের প্রাবল্যকে কাজে লাগিয়ে সেই সন্ধানী দল বাঁশ-দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলল তাদের উঠোন, বারান্দা। এবার থেকে শিব-পার্বতীকে দেখতে গেলে টিকিট কাটতে হবে। পাঁচ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেখার সুযোগ পাবে জাগ্রত শিব- দূর্গাকে। কৈলাশ থেকে স্বয়ং ভগবান শিব তাদের পৃথিবীতে এসেছে। এই পূণ্যতীর্থকে স্পর্শ করতে গেলে এই সামান্য দক্ষিণা তো মানুষকে দিতে হবে। না হলে ভগবানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে কেমন করে। অতিথি ভগবানকে যত্ন না করলে ভগবান রুষ্ট হয়ে এই স্থান ত্যাগ করবে। এটা নিশ্চয়ই কারোর কাম্য নয়। হুজুগে মানুষও এক বাক্যে এই যুক্তি মেনে নিয়ে টিকিট কেটে ভগবান দর্শন করে চলেছে। ভিড়ের লাগাম পরানো যাচ্ছে না।
    এই পরিস্থিতিতে সনাতনদের তো প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা লাটে উঠে গেল।
    বাড়িতে রান্নাবান্না সব বন্ধ। সুন্দরী তাদের বাড়ি থেকে রান্না খাবার বয়ে নিয়ে দু’বেলা খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছে। মেয়েটা কেন যে তাদের জন্যে এতটা করে চলেছে কে জানে! তার সঙ্গে মেয়েটার সম্পর্ক তো শিক্ষক-ছাত্রীর। হঠাৎ যেন কোথা থেকে উল্কার মত ছুটে এসে জড়িয়ে পড়ল তাদের দৈনন্দিন জীবনচক্রের মধ্যে। এই কর্মকান্ড কি তাদের শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক থেকে উত্তরণ ঘটবার পূর্বাভাষ! ভেবে কুল পায় না সনাতন। যদি কোনভাবে সেই উত্তরণ ভবিতব্য হয় তো সনাতন তার বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
    টানা তিনদিন এইভাবে মানুষের ঢল নামার পর আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে থাকে। সুবিধাবাদিদের আয়েও ভাটা পড়তে থাকে। এবার দূরদূরান্ত গ্রাম থেকে মানুষ আসছে। সেও অনেকটা হাল্কা হাল্কা। সনাতনরা সুযোগ খুঁজতে লাগল, কেমন করে মনুষ্য ভাবনার শিব-দূর্গা তাদের বাড়ি থেকে অন্য কোন জায়গায় নতুন ঠাকুরথান করে প্রতিষ্ঠা করা যায়। আটচালাকে বলেছিল, মা শীতলা মন্দিরের পশ্চিমের সরকারি জায়গায় শিব-দূর্গার মন্দিরটা যদি তৈরী করা যায়। খরচের অর্ধাংশটা যারা ঠাকুর দেখার টিকিট মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছে তাদের কাছ থেকে নেওয়া যায়। বাকিটা আটচালার তহবিল থেকে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে ওই আদায়কারিরা বেঁকে বসে। তারা সেই টাকা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। পাড়ার কোন উৎসবে আনন্দ করার জন্যে এটা খরচ করা হবে। নানান তর্কাতর্কির পর শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব ভেস্তে গেল। গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সনাতনরা। এগুলো এখান থেকে স্থানান্তর না করলে যে তারা স্বাধীনভাবে শান্তিতে নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারছে না।
    অবশেষে এই সমস্যার একটা সমাধান সূত্র প্রস্তাবাকারে তাদের কাছে এল। দিঘিরপাড় বাজারের এক শিব ভক্তর মোড়ের বটগাছ তলায় খানিকটা জায়গা নিজের দখলে আছে। যদি রতন রুইদাস রাজি থাকে তাহলে ওই শিব- দুর্গা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে তার বিনিময়ে কোন টাকাপয়সা তারা রতনদের দিতে পারবে না। সেই ক্ষমতা তাদের নেই। এমনিতেই এই মন্দির গড়তে তাদের কাছে যা টাকা আছে কুলোবে না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা সাহায্য নিয়ে করতে হবে। দিঘড়ার নোদো হালদারের কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেয়ে সনাতনরা যেন হালে পানি পায়। পত্রপাঠ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
    অবশেষে নানান ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ পর্ব সমাপন করার পর সনাতদের বাড়ি এতদিন পর দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়। দুপুরে বাড়ির সবাই মিলে ভাত খেতে খেতে সনাতন তার মা’কে বলল, “মা, তুমি যদি এইভাবে ভগবানকে না দেখতে পেতে তো জীবনে উপলব্ধি করতে পারতাম না মানুষকে কত সহজে একটা হুজুগের মধ্যে ফেলে বোকা বানানো যায়।” রতন এবং সনাতনের মা, পুষ্প ছেলের এই নাস্তিক ভাবনায় অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে! সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না সনাতনের। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে একটা খবরের কাগজ বার করে তার বাবা-মা’কে পড়ায়। সেই দিনের ভোরে তাদের এলাকায় একটা মৃদু ভূকম্প হয়। তারপর সনাতন বলে,“আমরা ঘুমের ঘোরে সেটা অনুভব করতে পারিনি। ওই ভূমি কম্পনেই আমাদের শীল- নোড়া দুটো সিধে হয়ে ওখানে নরম মাটির দাবায় থেবড়ে বসে যায়।” ভগবানের কৃপাকে অবজ্ঞা করায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয়ে মা, পুষ্প বলে, “এ তুই কি অলক্ষুণে কথা বলছিস খোকা! ছিঃ ছিঃ, অমন কথা দ্বিতীয়বার তোর কাছ থেকে যেন না শুনি! ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ এই কথাটা মানিস তো? যদি মেনে থাকিস তাহলে ভগবানকে অবিশ্বাস করিস না। আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর মঙ্গলময়। তিনি সকলের ভাল চান। অগতির গতি তিনি। তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া জীবের মুক্তি নেই রে খোকা। তাঁকে আরাধনা কর, তোর মঙ্গল হবে।”
    সনাতন এক বলল, আর মা অন্য বুঝল। এখানেই বিশ্বাসের কাছে যুক্তি, বাস্তবতা কত অসহায়! তাই বলে সে মায়ের বিশ্বাসকে অসম্মান করতে চাইল না। কারোর ধারণাকে জোর করে পাল্টানো যায় না। যুক্তি দিয়ে বোঝালেও না। ভেতরের বোধ জাগ্রত হলে তবেই তা সম্ভব। তবে মা তাকে এইভাবে দুচ্ছা করার জন্যে মনে মনে সে আহত হয়। মা কোনদিন তাকে এইভাবে তিরস্কার করেনি। এখান থেকেই বোঝা যায় একটা ভাবনা, তা সঠিক বা বেঠিক হোক, সনাতনের কাছে মায়ের এই ভাবনা বেঠিকই। সেই ভাবনা কতটা গভীরে প্রোথিত হলে তবে নিজের আত্মজ, যে তার কাছে প্রাণাধিক বলে মনে করে,তাকেও হেলায় অবহেলা করতে পারে। অত সোজা না, এক লহমায় সেটাকে মনের ভেতর থেকে মুছে ফেলা। মা তখনও তার ওপর রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে যাচ্ছে সেখান থেকে। সে এখান থেকে চলে না গেলে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কাটবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে “সনাতন, সনাতন বাড়ি আছিস” বলে একজনের গলা শুনতে পায় সে। উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখে, বিপ্লবদা! এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে সে অবাক হয়ে যায়। বিপ্লবদা হঠাৎ তাকে ডাকছে? মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বিপ্লবদার চোখ জবাফুলের মত লাল টকটকে। মুখটা ফোলা ফোলা। মনে হচ্ছে একটা বিশাল ঝড়ের থেকেও অধিক সাইক্লোন, তার জীবনের উপর আছড়ে পড়ে বেরিয়ে গেছে! সেই পরিস্থিতিতে একটা কথাই সনাতনের মুখ থেকে বার হতে পারলো,“বিপ্লবদা! তুমি! কি হয়েছে তোমার, বিপ্লবদা?”

    [বিয়াল্লিশ]

    অলোকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটা কেলো করে ছাড়ার জন্যে কোমর বাঁধছে অভয়-বরেণরা। ইদানিং অভয়-বরেণের সঙ্গে জোট বেঁধেছে নোচে, বিন্দে কেলেরা। নোচে-বিন্দে এই দলে ঢোকার মূল কারণ অখিল, সনাতনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনুষ্ঠানটা করছে বলে। সনাতনের উপর তাদের কোন রাগ নেই। কিন্তু ওদের প্রধান শত্রু অখিলকে ওরা এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অন্যতম সদস্য করার জন্যে বাধ্য হচ্ছে ঘুরিয়ে সনাতনদের বিরোধিতা করার। কেননা এর মধ্যে দিয়ে অখিল সুনাম কুড়িয়ে যাবে তা তারা হতে দেবে না। অভয়, বরেণের কাছে লোকমুখের খবর আছে, মাঝে মাঝে অলোকা, বেপাড়ার এবং বেজাতের ছেলে, বিপ্লবের সঙ্গে ডায়মন্ড হারবারে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। অলোকা তার সঙ্গে যেখানে সেখানে প্রেম করে বেড়ায়। এটা সময় থাকতে রুখে না দিলে মেয়েটা বেজাতের হাতে পড়ে যাবে। তাদের রুইদাসদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে বাইরের সমাজের কাছে। অথচ যেটা তাদের গর্ব, তারা স্বজাতের বাইরে কোন আত্মীয়তা করার প্রবল বিরোধী। দেখা যাচ্ছে হালে পাড়ার কয়েকটা তথাকথিত লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েরা তাদের গর্বের সমাজের মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে কসুর করছে না। এই অনাচার কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বরেণরা ওদের এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপনে রচনা করে চলেছে। এতসব কিছুই তাদের এই চার-পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে, অনুষ্ঠান চলাকালীন একমাত্র পরিকল্পনাটা প্রকাশ করা হবে। যদি আগে তা ফাঁস হয়ে যায় তো বিরোধীপক্ষ সচেতন হয়ে গিয়ে তাদের প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেমনভাবে যেন অভয়দের পরিকল্পনাটা পায়ে পায়ে বিপ্লবদের পাল পাড়ায় চাউর হয়ে যায়। বিপ্লবদের পাড়ার সাথে সাথে তার বাড়ির গার্জেনদেরও কানে চলে যায় অলোকার সঙ্গে বিপ্লবের মেলামেশার কথাটা!
    বিপ্লবের বাবা, সমর পাল তখন বালী-মাটি আর এঁটেল মাটি মিশিয়ে তাতে পরিমাণ মত জল মিশিয়ে পা দিয়ে ধাসছে। ধেসে ধেসে একদম মাখনের মত মোলায়েম করে দিতে হবে এই মেশানো মাটি। মাটির অনুপাত কম বেশি হলে আবার কাজ হবে না। সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর আছে সমরের। এখানে একভাগ যদি বেলে মাটি দেওয়া হয় তো দু’ভাগ এঁটেল মাটি মেশালে তবেই এই মাটিকে বাগে এনে নিজের ইচ্ছেমত মাটির তৈজসপত্রের রূপদান করা যাবে। তৈরী হওয়া জিনিসটা তবেই শক্তপোক্ত এবং টেকসই হবে। বিশেষ করে মাটির হাঁড়ি, কলসি, সরা, হাঁড়ি-কলসির ঢাকনা, খুরি, জল খাবার গ্লাস, তিজেল বানানোর জন্যে যত্ন করে মাটি তৈরী করতে হয়। এছাড়া নানারকমের মাটির খেলনা সহ আরও অনেককিছু মাটির জিনিস তৈরী করে এরা। এইভাবে মাটির ‘পাট’ করতে করতে ঘেমে একদম চান করে যাচ্ছে সমর পাল। তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আসলে এতেই ওরা অভ্যস্ত। এই নিয়েই এদের জীবন। এর বাইরে অন্য কোনকিছু ভাববার সময় ওদের কোথায়! এত কষ্টের মধ্যে এটাই সান্ত্বনা যে তার ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পারছে। ইকনমিক্সে অনার্সে বি.এস.সি. তে ভাল মার্কস পাবার সুবাদে এম.এস.সি. তে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তার এই কষ্টের তুষ্টি তো এখানেই। এত মেহনতের মধ্যে সন্তানের সাফল্য কখন যেন কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। খুশিতে মনটা ভরপুর হয়ে যায়। হাসি হাসি মুখ নিয়ে পাঁচিলে ঘেরা বাড়ির প্রধান দরজা খোলার শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখে হেড়ো পাগলা ঢুকছে। এই এক পাগলা। আশপাশের সব বাড়িতে ওর অবারিত দ্বার। দুপুরে খিদে পেলে যে কারোর বাড়ি ঢুকে যায়। লোকে খেতেও দেয়। কি আর করবে। বাড়িতে বুড়ি মা ছাড়া ওর কেউ নেই। মা এবাড়ি সেবাড়ি ফায়ফরমাস খেটে নিজের পেটের খিদে মিটিয়ে ছেলের জন্যে যা পারে জোগাড় করে রাখে ঘরে। যদি ভুল করে ঘরে চলে আসে তো সেটাই খাইয়ে দেয়। কখন বাড়িতে আসবে তার কোন ঠিক নেই। রুইদাস পাড়ার হেড়ো পাগলাকে আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মানুষ চেনে। তবে চুরিচামারির স্বভাব ওর নেই। তাই মানুষ বিশ্বাসও করে ওকে। কেউ কোন কাজ বললে সঙ্গে সঙ্গে কোন বাক্যব্যায় ছাড়াই সে সেটা করে দেয়। লোকও সন্তুষ্ট হয়ে তাকে খেতে দেয়। হেড়ো পাগলা ঢুকতেই সমর পাল বলল, “হেড়ো, এদিকে আয় তো? এই পাট-করা মাটি ‘চাকি’র কাছে নিয়ে যা তো। জামাটা খোল। আর লুঙ্গিটা ভাল করে এল্টে-পাক দিয়ে বেঁধে নে। নাহলে আবার কাদা জাবড়ে যাবে লুঙ্গিতে। এ’কটা বওয়া হয়ে গেলে ভাল করে কাদা হাতমুখ ধুয়ে চলে আসবি। এখানে খেয়ে যাবি। পালাবি না কিন্তু। তোর তো কোন বিশ্বাস নেই। হাত-পা ধুয়ে আবার অন্য কোথাও পালিয়ে গেলি! পাগলের খেয়াল।” ফ্যালফেলিয়ে হেসে হেড়ো বলে,“নাগো বাবু আজ খেয়েই যাব তোমাদের বাড়ি। শোনো না বাবু। একটা কথা কানে এসেছে তোমার ছেলে বিপ্লবদাদাকে নিয়ে। আমাদের পাড়ার ছেলেরা বলাবলি করছিল। আমি যেতেই তাড়িয়ে দেয় আমাকে। তবে যা শোনার তা শুনে নিয়েছি।” পাগলটার কথায় পাত্তা না দিয়ে সমর পাল বলল,“ওসব কথা এখন থাক। তুই বকর বকর করতে থাকলে থামবি না। আগে কাজটা সেরে খেয়েদেয়ে নে। তারপর তোর কথা শুনব।” বলে সমর আবার পা দিয়ে কাদামাটি দলতে থাকে। তৈরী মাটি হেড়ো পাগলা বয়ে চাকির পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে আর শেষের দিকে কিছু মাটি সমর পালের নির্দেশমত চাকির উপর পাটাতনে রাখে। সব বওয়া শেষ হলে হেড়ো বলে শেষের মাটিগুলো তোমার গাড়ির চাকার উপর রেখে দিয়েছি কাকা।” গাড়ির চাকা! সমর একটু অবাকমত হয়ে পরে বুঝতে পারে হেড়ো কোনটাকে গাড়ির চাকা বলছে। তারপর হেসে বলে, “ধুর পাগল, ওটা গাড়ির চাকা হতে যাবে কেন? ওটা গাড়ির চাকার মত দেখতে একটা চাকা। আগে ওটা কাঠের হত। এখন মেটালের হয়েছে। মাটিতে গর্ত করে বিশেষ কায়দায় ওটা বসাতে হবে। তার মাঝে একটা লোহার রড পোঁতা থাকে। তার মাথায় আবার চাকাটা বনবন করে ঘোরাবার জন্যে বিয়ারিং সেই রডে লাগানো থাকে। যে কাঠের পাটাতনে তুই কাদা রাখলি ওটা ওই চাকার উপর বসিয়ে ওই যে পাশে একটা বাঁশের লাঠি আছে ওটা দিয়ে ঘোরানো হয়। এরপর হাতের কায়দায় যে জিনিস বানাবার দরকার সেটা তৈরী হয়ে যাবে। সেটা হয়ে গেলে ওই যে পাশে বাঁশের পাতলা চেটো দেখতে পাচ্ছিস, ঘুরন্ত অবস্থায় কাদার ভেতর ওটা সেঁধিয়ে দিলে, তাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তৈরী হওয়া জিনিসটা। সে হাঁড়ি, কলসি, তিজেল, সরা যাই হোক না কেন। বুঝলি পাগল? এইভাবে মাটির জিনিস তৈরী করতে হয়। কম খাটনি এই কাজে? সেই তুলনায় পয়সা পাই না রে। এটাই আমাদের দুঃখ। তার উপর আজকাল স্টীল, এ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র বাজারে এসে আমাদের মালের চাহিদা তো একদম তলানিতে। বিক্রী নেই বললে চলে। ধুঁকছে কুমোরদের এই কারবার। সব পরিকাঠামো বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে আছে বলে এখনো টিম টিম করে চালিয়ে যাচ্ছি।”
    “এত বকর বকর কার সঙ্গে করছো, বিপ্লবের বাপ?” বলে রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে দেখে হেড়ো পাগলা! অবাক হয়ে উঠোনে বেরিয়ে আসে বিপ্লবের মা সীতাদেবী। স্বামীকে বলে, “হ্যাঁগো, তুমি এই হেড়ো পাগলের সঙ্গে সেই তখন থেকে ফটর ফটর করছো? তোমাদের হাঁড়ি কলসি তৈরীর হাঁড়ির খবর বলার আর লোক পেলে না! তখন থেকে ভষ্মে ঘী ঢেলে চলেছো! বাব্বা, কেমন লোক গো তুমি। অন্য কোন সুস্থ মানুষকে বললে, সে মানুষটা বুঝতো আমাদের সুখ-দুঃখের কথা। ও গাল দিয়ে খাবার খাবে আর কান দিয়ে তোমার গপ্প বার করে দেবে। ওই পাগলের পেটে খাবার ছাড়া আর কোন কথা থাকে না কি? থেকেও বা লাভ কি। হেড়ো একটা মানুষ, সে আবার তোমার দুর্দশার সাক্ষী। নাও, অনেক হয়েছে। চানটান করে খেয়ে নও। এর পর চুলা জ্বালাতে হবে। তিন দিন ধরে রোদে শুকোচ্ছে কাঁচা মালগুলো। চুলার উপরের তাওয়াটা কাল দেখতে বলেছিলাম। সেটা দেখেছো? ফাটাফুটি নেই তো? মাটির অত মস্ত একটা তাওয়া। আগুনের তাপে কেটে গিয়ে থাকলে তার উপর এই মালগুলো চাপালে ভেঙে পড়ে যেতে পারে বা আগুন ফাটা দিয়ে বেরিয়ে মাল নষ্ট করে দিতে পারে। ইটভাটার মত মস্ত বড় চুলা। বাপ ঠাকুরদার আমলের জিনিস। তখন রমরমা কারবার ছিল, দরকার মত বানিয়েছিল তারা। এখন মালের টান নেই তো এতবড় চুলা করে লাভ কি। বলেছিলাম, ওটা ভেঙে অর্ধেক ছোট করে দাও। খামোখা এককাঁড়ি আগুন জ্বালাতে হয়। তাতে খরচাও বাড়ে। বড় বাফারা উঠোনে মস্ত একটা চুলা! লোক দেখে বাহবা দেবে, কত না বড় ব্যবসায়ী তুমি। কিন্তু এদিকে যে ঢপঢপে কলসি, সে এই সীতা ছাড়া আর কে জানবে। নাও, হয়েছে। এবার কাজগুলো সারো তো। আমাকে আবার খাইদাই সালটে আগের লটের পোড়ানো মালগুলোকে রঙ করতে বসতে হবে। আমার কাজ তো আর তোমরা করবে না। আমাকেই করতে হবে।” বলে সীতাদেবী গজগজ করতে করতে আবার রান্নাঘরে ব্যাস্ত হয়ে গেল।
    এমনিতে কাজ-কারবারে চরম মন্দা। মনটা আজকাল ভাল থাকে না সমরের। তাই মনকে বোধ দেবার জন্যে যাকে সামনে পায় তার সামনে বকবক করে। শ্রোতা শুনলো বা বুঝলো কি না তাতে তার যায় আসে না। তার উপর বোয়ের এই ধমকানি মনকে আরও যেন দমিয়ে দেয়। হেড়োর সঙ্গে বকর বকর থামিয়ে হাতের কাজ সেরে গামছা নিয়ে পুকুরঘাটের দিকে ঝোঁক মারতে মারতে পেছন ফিরে হেড়োকে বলল,“কিরে, তুই চানে যাবি নাকি? যাবি তো আয়। পরিষ্কার হয়ে নে।” একথা বলতেই রান্না ঘর থেকে আবার সেই তীক্ষ্ণ নারী কন্ঠ, “ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি যাও তো, তোমার কাজ সেরে আসো। ও কি রোজ চান করার লোক! তাহলে গায়ে অত গন্ধ হয় না। বলারই বা কে আছে, এই কাজগুলো করার! কথায় বলে,‘পাগোলে কি না করে আর ছাগলে কি না খায়।” এবারও বোয়ের ঝাঁঝ একদম মেনে নিতে পারলো না, সমর। হেড়োকে চান করতে বলার কারণ, ও মাটি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। হাতে-পায়ে কাদা লেপটে আছে। শুধু হাত-পা, মুখ ধুলে ভাল পরিষ্কার হবে না। তাই চান করার কথা বলছিল। সমরের কথায় হেড়ো বলে, “নাগো কাকা, আমি চান করবুনি। চান করতে আমার ভাল্লাগেনে। তুমি যাও। আমি এই সামনের ঘাটে হাত-পা ধুয়ে আসি।”
    খাওয়া-দাওয়া সেরে সীতাদেবী, চুলার উল্টোদিকে রং-ঘরের দিকে গেল। কিছু কালো রঙের ভাতের হাড়ির অর্ডার আছে। তারপর অন্য মালের চাকচিক্য আনার জন্যে বিভিন্ন রং করতে হয়। শৌখিন না হলে আবার খদ্দেরের চোখে আটকানো যায় না। দিনদিন সব রুচিও পাল্টাচ্ছে মানুষের। আগে বেশি বেশি অর্ডার থাকতো, তখন শুধু কালো মালেরই একচুলা মাল হত। সেসময় আর এখনকার মত কালো রংটা আলাদা করে লাগাতে হত না। চুলাকে কিছু সময় ঢেকে রাখলে যে কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তাতেই মালের রং কালো হয়ে যেত বা দরকার হলে চুলার আগুনে খৈল পোড়ালে একদম মিশমিশে কালো রং হয়ে যেত। এতে তাদের তেমন কোন খরচই হত না। এখন সেই কালো রং হাতে বানাতে হচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে কালো রং তৈরী করতে হয়। তাতে অতিরিক্ত খরচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় মালের চাহিদা বা দাম তারা পাচ্ছে না। তাছাড়া আরও কিছু মাল আছে যেগুলো লাল, হলুদ আর সবুজ রঙের করতে হবে। সীতা, লাল রং বানাতে গিয়ে দেখে সিসা একদম তলানিতে পড়ে আছে। কয়েকটা মালে রং করলেই শেষ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বাবাকে হেঁকে বলল,“লাল রঙের জন্যে সিসা একদম ফুরিয়ে গেছে। পারলে আজ বিকেলে কিনে আনবে। তা না হলে কাল সকাল সকাল আনতে হবে। রঙের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে এটা না আনলে। মাল ডেলিভারীও দেওয়া যাবে না।” না, সবুজের জন্যে দস্তার কৌটোতে দস্তা আছে। আর আর্সেনিকের ডিবেতে কতটা আর্সেনিক আছে দেখে নিল। যা আর্সেনিক আছে তাতে হলুদ রং আরও কয়েকদিন করা যাবে।
    একঘটি জল একটা মাটির ‘টাটি’ মানে ঢাকনা চাপা দিয়ে স্বামীর পাশে রেখে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেছিল সীতা। ভাত খাওয়ার পর জল খেয়ে একটা বিড়ি ধরাবে। তারপর ঘন্টা খানেক গড়িয়ে আবার কাজে লেগে যাবে। বিড়ি খাওয়াবে বলে হেড়োকে যেতে দেয়নি সমর। ভাত খেয়ে চলে যাচ্ছিল হেড়ো। সমর বলল, “দাঁড়া হেড়ো। একটু পরে যাবি। জল খেয়ে বিড়ি খাব। তাহলে ধোঁয়াটা পেটে সেঁটে যাবে না। পেটের ভেতর জলে ধাক্কা খেয়ে ও নিস্কর্মা হয়ে যাবে।” হেড়োর মুখে বিড়ির আগুন দিতে গিয়ে হঠাৎ সমরের মনে পড়ল, ও যেন ছেলের সম্বন্ধে তখন কি একটা বলছিল? ওকে থামিয়ে দিয়ে কাজে মন দিতে বলেছিল? মনে পড়েছে। কি কথা বলছিল জানতে হবে,“হ্যাঁরে হেড়ো, তখন বিপ্লবদাদাকে নিয়ে কি যেন তুই বলতে যাচ্ছিলিস? কি কথা এবার বল। শুনি। তোদের পাড়ার ছেলেরা বিপ্লবদাদাকে নিয়ে কি আলোচনা করছিল? একবার তো ওকে নিয়ে তোদের চ্যাংড়াগুলো কি না ঝামেলা পাকালো। আমরা রুখে দিতে থেমে গেল। আবার নতুন করে কোন ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছে না কিরে?”
    -হ্যাঁ গো কাকা। ওরা আবার বিপ্লবদাদা আর অলোকাদিদিকে নিয়ে অনেক কথা বলছে। বলছে এরা দু’জনে নাকি এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। ওদের পেছনে লোক লাগিয়েছে। হাতে নাতে ধরবে বলে। ধরতে পারলে আটচালায় বিচার বসিয়ে বিপ্লবদাদাকে জরিমানা করবে আর অলোকাদিদিকে গ্রাম ছাড়া করে দেবে। এই কথাটাই তো তোমাকে বলতে এসেছিলুম গো কাকা। নিজের কানে শুনে আর চুপ করে থাকতে পারিনি, তাই।” বলে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে,“চলি কাকা। আমি তোমাকে খবরটা দিয়েছি, সেকথা তুমি যেন কাউকে বোলো না। তাহলে আমাদের পাড়ার ওই অভয়, বরেনরা মারবে আমাকে।” হেড়ো পাগলা এক এক সময় এমন কথা বলবে, মনে হবে ও একদম ভাল মানুষ। লোকে যে ওকে পাগল বলে, পুরোপুরি বাজে কথা বলে। আবার যখন মাথায় ছিট চাপবে তখন পাগলের থেকেও হদ্দ। তাই ওর কথায় সহজে কেউ আমল দেয় না। কিন্তু এখন ও যে কথাগুলো বলে গেল, মনে হচ্ছে তো ঠিক কথাই বলছে। তার ছেলে আর রুইদাস পাড়ার ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ইতিমধ্যে তো বাজার গরম হয়েছে। এমনিতে কাজ কারবারে গতি নেই। তাই মন মেজাজ ঠিক নেই। তার উপর এই ছেলেকে নিয়ে আবার যদি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয় তো মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমরের। ছেলের প্রতি রাগ চড়চড় করে চড়তে থাকে। কাজ নেই কম্ম নেই বসে বসে খাচ্ছে আর ফপরদালালি করে বেড়াচ্ছে। লেখাপড়ার নাম করে বেলেল্লাপনা করে চলেছে। মেয়ের পেছনে ঘোরাঘুরি করছে। বেজাতের মেয়েকে বে-মারাবে না কি? এবার আর রাগটা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারল না সমর। এ’দাবা থেকে রং-ঘরের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবের মা’কে হাঁক দিল, “এদিকে এসো তো একবার! ওসব কাজ-মাজ রাখো। গুলি মারো তোমার কাজে। সব ফেলে এক্ষুনি এদিকে এসো।” ছেলের বাপের গলার ঢঙ শুনে সীতা বুঝতে পারে লোকটা ভীষণ রেগে গেছে। হেড়ো ছিট-পাগল কি এমন কথা ওনার কানে ঢুকিয়ে গেল যে ওই ঠান্ডা মানুষটা এত রেগে গেল? ঠান্ডা মানুষরা এমনিতে সহজে রাগে না। কিন্তু একবার রেগে গেলে সামলানো দায় হয়ে যায়। এতদিন ধরে ঘর করে সীতা বুঝে গেছে মানুষটার ধাত-ধরণ। সময় নষ্ট না করে সব কাজ ফেলে রেখে ওদিক থেকে এদিকে চলে আসে। বলে,“কি হয়েছে কি? হেড়ো কি কথা বলে গেল? হঠাৎ রেগে গেলে কেন? মাথা ঠান্ডা রাখো। তারপর বলো। রাগ মাথায় ঠিক কথা বলা যায় না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা তো চোখে সর্ষেফুল দেখব!”
    -আর কি হবে মাথা ঠান্ডা করে। তোমার গুনধর বেটা সেই কাজ করলে তো তবে মাথা ঠান্ডা থাকবে? ওই লেখাপড়ার নাম করে মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার শিক্ষিত বেটা। লোকে এবার ফাঁদে ফেলার জন্যে পেছনে লেগে পড়েছে। তাও আবার ওই ছোট জাতের মেয়েটার সঙ্গে। কতোবার তো তুমি বলেছো, রুইদাসপাড়ার ওই মেয়েটার সঙ্গে তুই একদম যোগাযোগ রাখবি না। সে কথা শুনেছে?” বলে, মস্ত এক ধমক দেয় সমর। হঠাৎ ধমকানিতে চমকে ওঠে সীতা ! সীতার মাথায়ও রাগ চেপে বসে, “তা তোমার ছেলে, বাবা মায়ের কথা না শুনে যদি বাইরের কোনো মেয়ের পেছনে ঘোরে তা ঘরে বসে আমি কি সেটা দেখতে যাচ্ছি? লেখাপড়ার নাম করে কতো জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনা করছে। ভাল ফলও করছে। তা সেই ছেলেকে আমরা কিভাবে আটকাবো। পায়ে বেড়ি পরিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখবো? মুখে বলা ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে?”
    -আছে, আছে। অনেককিছু করার আছে। তুমি তাকে শেষ বারের মত সাবধান করে দাও। ওই ছোটজাতের মেয়েটার সঙ্গে মেলামেশা যেন ও আর না করে। আমাদের কুম্ভকারদের মুখ না পোড়ায়। তাহলে কিন্তু ছেলে বলে আমি ওকে ছেড়ে কথা বলবো না। বাড়ি থেকে দূর করে দেব। ত্যাজ্যপুত্র করে দেব আমি। শিক্ষিতর এই শিক্ষার দাম! নিজের জাতের সম্মান যে ছেলে রাখতে অক্ষম, তাকে আমিও ঘরে পুষতে অক্ষম। বলে দিচ্ছি তোমাকে, বউ। পরে আমাকে দোষের ভাগি করতে পারবে না কিন্তু। সে কোথায়? কোথায় তোমার গুণধর বেটা। কোথায় গেছে? চুপ করে আছো কেন, বলো, সে কোথায়?”
    -আমতলায় গেছে কি সব বই কিনতে।
    -তার নিজের জন্যে বই না ওই রুইদাস-মুচির মেয়েটার জন্যে? সে খোঁজ তুমি নিয়েছো? নাও নি তাই তো? অন্ধ ভালবাসায় ছেলেকে ছেড়ে রেখেছো। লাটাইটা পর্যন্ত নিজের হাতে রাখো নি। লাটাই যখন হাতে নেই সে ঘুঁড়ি তো খেয়ালখুশি মত নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াবেই। এ তো জানা কথা। তা লাটসাহেবের বাচ্চা ফিরবেন কখন ঘরে? সেটা কি বলে গেছেন! নাকি তাও তোমার জানা নেই? বলতে বলতে রক্তজবা রং নেয় সমরের দু’চোখ।
    -বললো তো ফিরতে একটু বেলা হবে। এসে খাবে। তারপর পঁচিলের দরজার দিকে তাকায়। দেখে বিপ্লব ঢুকছে। তখন সীতাদেবী বলল, “ওই তো আসছে।” বলে সঙ্গে সঙ্গে অজানা কোন আশঙ্কায় সাবধানী হয়ে সীতা আবার স্বামীকে বলল, “বাইরে থেকে আসছে। রোদে-তাপে ওরও মাথা গরম হয়ে আছে। এখন তুমি কিছু বোলো না। তারপর দু’জনেই নিজেদের ঠিক রাখতে না পেরে যুদ্ধ যেন লাগিয়ে দিও না ! ও চানটান করে খাওয়া দাওয়া সেরে মাথা ঠান্ডা করে বসলে, তখন বোলো।”
    এতটা তার মাথা গরম হয়ে আছে যে বোয়ের কথায় পাত্তা দিল না সমর। বিপ্লব সদর দরজা পার হয়ে উঠোনে ঢুকতেই চেল্লে উঠে ছেলেকে বলে, “কোথায় গেছিলিস? ওই রুইদাস মেয়েটার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলিস? তোর মা যে বলল, তুই বই কিনতে গেছিস, আমতলায়। তা কই, তোর হাতে তো কোন বই নেই? কার জন্যে বই কিনতে গেছিলিস? ওই মুচি মেয়েটার জন্যে? সে তো শুনলুম মাস্টারির চাকরি পেয়েছে। তার আবার বই কি হবে ? মেয়ে মানুষের সঙ্গে ফুর্তি মারাতে গেছিলিস,তাই তো? উত্তর দিচ্ছিস না যে আমার কথার। যা বলছি তাহলে সব সত্যি বলছি আমি, লোকে তাহলে ফালতু বলে যায়নি?” সে যে অলোকার সঙ্গে মেলামেশা করে তা বাবা-মা’র কাছে আর গোপন করতে চায় না বিপ্লব। যা সত্যি তা বলে দেওয়াই ভাল। তাতে যা হাবার হবে। সেই ভাবনায় সে বলল, “হ্যাঁ, অলোকার জন্যে টিচার্স ট্রেনিংয়ের একটা বই আনতে গেছিলাম। নতুন চাকরি। এই বইটা কাজে লাগবে তাই। এর জন্যে এত চেঁচামেচির কি আছে বাবা? আমি তো অন্যায় কোন কাজ করিনি।” সীতা ছেলের এই কাজকে একদম পছন্দ করে না। সন্তানের প্রতি স্নেহের বশে কিছুতেই ওই বেজাতের মেয়েকে সে মেনে নেবে না। তবু এই পরিস্থিতিতে তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরে বাপ-ছেলেকে সামলাতে হবে। অবস্থা যেদিকে গড়াচ্ছে এবার দু’পক্ষের সুর চড়তে শুরু করবে। তার আগে এদের থামিয়ে দেওয়া দরকার। না হলে অনিষ্ট কিছু ঘটে যেতে পারে। বাপের রক্ত তো ছেলের মধ্যে বইছে। শান্ত ছেলেটা বাপের মত ক্ষেপে যদি যায় তো তাকেও সামলানো দায় হয়ে যাবে। সীতা তাড়াতাড়ি গিয়ে বিপ্লবের ডান হাতটা তার বাঁ-বগলে চেপে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, “যা, এখন আর কথায় কথা বাড়াতে হবে না। তুই আগে চান খাওয়া করে নে। তারপর যা কথা বলার বলবি।” আর স্বামীর দিকে তাকিলে বলে, “তুমি কি এখন থামবে? না, শুধু চেল্লাতেই থাকবে? তুমি তো পেট মোটা করে নিয়েছো। যে খায়নি তাকে তো খেতে দিতে হবে না কি?”
    বোয়ের কথায় পাত্তাই দিল না সমর। আবার চেঁচিয়ে ছেলের কথার পিঠে কথা চড়ালো,“অন্যায় তুই করিসনি মানে? জন্ম তোর কুমোরের ঘরে। জন্মসূত্রে জাতে তুই ‘কুম্ভকার’। নিজের জাতকুল জলাঞ্জলী দিয়ে একটা ছোট জাতের মেয়ের সঙ্গে লটরফটর করছিস। আবার নিজের হয়ে ‘সাওটা’ গাইছিস? তুই কি ভেবে রেখেছিস ওই ছোটলোক মেয়েটার মাস্টারির পয়সার লোভে বিয়ে মারিয়ে সেই পয়সা আমার ঘরে তুলবি? সে গুড়ে বালি। ছিঃ ছিঃ আমার বেটা হয়ে এই কাজ করতে তোর এতটুকু লজ্জাবোধ হল না! লেখাপড়ার ভেতর যে এত বেলেল্লাপনা লুকিয়ে আছে তা যদি জানতুম তাহলে কোনদিন তোকে পড়াশোনা করাতে পাঠাতাম ভেবেছিস? ওই কুমোর-চাকি ঘোরানোর কাজেই লাগিয়ে দিতাম। কাল থেকে ব্যবসার কাজে লেগে পড়বি। বাড়িতে হুদমো একটা বেটা থাকতে আমি বুড়ো বাপ কেন এত খাটতে যাব। খেটে পয়সা রোজগার করব আর তুমি লাটসাহেব, সেই পয়সায় বেজাতীয় প্রেম মারিয়ে বেড়াবে! তা আর হবে না। তোকে আর এম.এ. পড়া করতে হবে না। আমি আর খরচা জোগাতে পারব না। ঢের হয়েছে। এবার বাপ পিতেমহের জাত
    কারবার তোকেই দেখতে হবে। একবারও তো খোঁজ খবর নিস না যে, কারবার কেমন চলছে না চলছে। চিন্তাও হয় না। বাড়ির অবস্থা দেখেও মনে প্রশ্ন জাগে না যে, আগে বাড়ির উঠোনে এতো এতো মাল ঢাঁই হয়ে থাকতো। এখন তার অর্ধেকও থাকে না। মনেও ভাবনা আসে না যে, বাবার কারবারটা কি তাহলে লোকসানে যাচ্ছে? শুধু চুপি চুপি মাকে পটিয়ে টাকা হাতিয়ে মেয়ে নিয়ে ফুসুর ফুসুর করে বেড়ানো! তোর এই অপকর্মের জন্যে আমি কেন পাড়ার গন্যিমান্যিদের কাছে মাথা হেট করতে যাব। কেন? সেই কৈফিয়ৎ দিয়ে তবে তুই ঘরে ঢুকবি। না’হলে যে পথ দিয়ে এসেছিস সেই পথে বেরিয়ে যাবি বাড়ি থেকে। এই আমার শেষ কথা বলে দিলাম।” বলে থরথর করে কাঁপতে থাকে সমর পাল।
    বাবার কথায় ছেলে একদম চুপ! কোন কথাই বলছে না। সীতা এতে আরও ভয় পেয়ে যায়। সেই থেকে নিজের বগলদাবায় যে ছেলের হাত চেপে ধরে আছে আর ছাড়ছে না। কিন্তু ছেলের শরীরের স্পর্শে বুঝতে পারছে ওর গা যেন জ্বরের মত গরম হচ্ছে আর সেটা একে একে বাড়ছে। সীতার আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে ভেতরে ভেতরে বিপ্লব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাপের খেতে দেওয়া কাঁসার ঘটির অবশিষ্ট পড়ে থাকা জল ছুটে নিয়ে এসে ছেলের পায়ে ঢালতে থাকে। চরম রেগে যাওয়া মানুষের পায়ে সমানে জল ঢালতে থাকলে মাথার রাগ নাকি পা টেনে নিয়ে ধরিত্রির বুকে চালান করে দেয়। এবার দেখল, ছেলের গা-গরম এখন আর আগের মত তীব্র নেই। সত্যি সত্যি ধরিত্রি টেনে নিচ্ছে সেই অশুভ তেজগুলো! তারপর বলে,“আয় বাবা, ঘরে আয়। বাবা, গুরুজন মানুষ। এখন ওনার মাথার ঠিক নেই। কি বলতে কি বলছে, কাকে বলছে তা উনি নিজেই বুঝতে পারছে না।”
    একটা নির্মল ভালবাসা যে এইভাবে বিধ্বস্ত, অপদস্ত হবে এবং তা নিজের বাবার দিক থেকে ধেয়ে আসবে কল্পনা করতে পারেনি বিপ্লব! তার এত বছরের জীবনে কোনদিন বাবাকে এমন রেগে যেতে দেখেনি সে। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে বাবা এইভাবে রেগে গেল! তাও কিছুতেই থামতে চাইছে না। মা যত থামতে বলে ততই বেগে রাগ তুলে যায়! এইসব মানুষের কাছে মনুষ্যত্বের থেকে ঠুনকো জাত-বেজাতের প্রশ্ন এতটাই বড়ো! একটা অন্তজ শ্রেণীর মেয়ে। চরম প্রতিকুলতার মধ্যে থেকে এতবড় সাফল্যের মুখ দেখলো। তারপরেও তার জাত-ভাবনা তাকে এইভাবে পেছনে টেনে ধরবে! কিছুতেই সামনে এগিয়ে যেতে দেবে না? আর যারা এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, তাদেরও সমূলে উৎপাটন করে ছাড়বে? মনুষ্য সমাজের মধ্যে মিশে থাকা এইসব অমানুষ তো নরকের কীটের থেকেও জঘন্য। এই কীটের অধম মানুষের কথায় মুখ লাগাতেও তার ঘেন্না হচ্ছে। আর কোন কথা না বলে, জোর করে মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাপের কথা মত যে পথ দিয়ে সে এসেছিল সেই পথেই দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিপ্লব। পেছন পেছন তার মা, সীতাদেবী ছুটতে ছুটতে বলে, “খোকা কোথায় যাচ্ছিস দাঁড়া। এই অভুক্ত পেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে নেই। বাড়ির অকল্যাণ হয়। খোকা দাঁড়া! উদ্ভ্রান্তর মত সেই দৌড়ে সীতাদেবী আর নিজেকে সামাল দিতে না পেরে সদর দরজায় হোঁচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

    ক্রমশ… 

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (20)

    জন্মসূত্র

    -সুব্রত হালদার 

    [ উনচল্লিশ ]

     

    বিন্দে কল্পনা করতে পারেনি, তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অখিল এইভাবে গালাগালি দিয়ে তাকে সপাটে চড় মারবে! আসলে অখিলকে এতটা রাগতে সে কোনদিন দেখেনি। তাই কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই তার কাছে অন্যায় আব্দার করতে এসেছিল। চুল্লুর নেশায় সেই থাপ্পড়ের ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না বিন্দের। ধপাস করে উল্টে পড়ে যায়। অখিল আর মুহূর্ত দেরি না করে তার ঘর থেকে সাইকেলটা বার করে দ্রুত চলে যায় দিঘিরপাড় বাজারে। কুঞ্জ ডাক্তারের চেম্বারে। রুইদাস পাড়ার কেউ ভাবতে পারেনি, অখিল তার সাইকেলে চাপিয়ে কুঞ্জ ডাক্তাবাবুকে নিয়ে আসবে। ততক্ষণে লোকে জটলা পাকাচ্ছে অখিল কেন বিন্দেকে মেরে পালাল? তার কাছে টাকা ধার চেয়েছে, সে ইচ্ছে করে দেবে, না হলে দেবে না। তাই বলে তাকে মারতে হবে? এটা অখিল অন্যায় কাজ করেছে। এর বিচার করে ওর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে আহত বিন্দের ডাক্তার দেখাবার জন্যে। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে সোজা অখিল বিন্দের বাড়ি চলে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে মুক্তি নেই। বাপের বাড়ি চলে গেছে। আবার ডাক্তারবাবুকে তার সাইকেলে চাপিয়ে মুক্তির বাপেরবাড়ি যায়।
    ডাক্তারবাবু বলেছে, তিনদিন নিয়মমত ওষুধপত্র যা লিখে দিয়েছে দোকান থেকে কিনে সব খাওয়াতে হবে। কোন ওষুধ বাদ দেওয়া যাবে না। খরচার ভয়ে যা ওষুধ দেওয়া হয় সবটা না কিনে ভুল করে মানুষ। এখানে তা করলে চলবে না। তাহলে ক্ষতে সেপটিক হয়ে যেতে পারে। আবার অখিল ডাক্তারবাবুকে তার সাইকেলে চাপিয়ে ডাক্তারখানায় পৌঁছে দেয়। মোহনের ওষুধ দোকান থেকে সবকটা ওষুধ কিনে মুক্তির মায়ের হাতে দিয়ে যেমন যেমন ডাক্তারবাবু
    বলেছে, তেমন ভাবে খাওয়াতে বলে বাড়ি চলে যায়। পাড়ার লোক অখিলের এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে তার উপর যত শাস্তির খাঁড়া চাপাতে সরব হয়েছিল, সব নীরব হয়ে যায়। কেউ বলে, ছেলেটা বাইরে শক্ত হলে কি হবে, ভেতরটা খুব নরম। কেউ বলে, আমরা অখিলকে দোষী বলছি, বিন্দেকে সে মেরেছিল বলে। আর বিন্দে যে তার বউকে খুন করতে গেছিল, সে কথা তো কেউ উচ্চবাচ্য করলো না? এ তো তোমাদের একচোখো বিচার হল। দেখবে, এমন কানা বিচার সমাজে চললে, একটা সময় এমন বিচার কেউ মানবে না। উল্টে অবিবেচক বিচারকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করবে আজকালকার বিচারবুদ্ধিধরা যুবকরা। পাড়ায় একে একে শিক্ষিত ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার চেতনায় তাদের ঠিক বেঠিক ভাবার ক্ষমতা বাড়ছে। সেই হিসেবে বিচারওয়ালাদের এবার ভাবতে হবে, কেমন বিচার তারা করবে-না-করবে। তাই বলে তোমরা ভেব না আমি অখিলের হয়ে ‘গাওনা’ গাইছি। বিন্দেকে মেরে অখিল ঠিক করেনি এটা মানছি। কিন্তু চিন্তাভাবনা তো সবায়ের সব সময় ঠিক থাকে না। বউ মেরে হাতে রক্ত মেখে কেউ যদি কারোর সামনে এসে তার কাজের সাওটা গেয়ে অর্থাৎ সমর্থন করে টাকা চাইতে আসে, তখন অখিল কেন, যেকোন সুস্থ মনের মানুষেরই মাথা গরম হয়ে যেতে পারে। অখিলের বেলায় সেটাই হয়েছে। সেই দিক দিয়ে ভাবলে অখিল ভুল কিছু করেনি। সে অপরাধীকে থাপ্পড় মেরেছে। খুন করার চেষ্টা তো করেনি? সেটা সকলকে ভাবতে হবে। হুট করে একটা বিচার করে দিলে চলে না।
    অখিল, বিন্দের বউকে চিকিৎসার সব খরচ দিয়ে এতটা উপকার করল। তবু শালা নেশাড়ু বিন্দে তার উপকারের দাম তো দিলই না উল্টে সে দিনরাত তাকে গালাগাল দিয়ে যায়। কেন সে তাকে মেরে উল্টে ফেলে দিল তার বিচার চায়। কেউ তার বিচার করে না। অখিল শালা পয়সার জোরে বিচার কিনে নিয়েছে। সেই থেকে বিন্দে অখিলের শত্রু হয়ে যায়। কিন্তু শুধু মার খাওয়ার জন্যে এই শত্রুতা তা কিন্তু নয়। সেটা বিন্দে কোনদিন বাইরে আওড়ায় না। ওর বউ মুক্তি তারপর থেকে প্রায় এক বছর হয়ে গেল বিন্দের সঙ্গে ঘর করতে আসে না। বিন্দের ধারণা, মুক্তিকে এই বুদ্ধি দিয়েছে ওই শালা অখিল-টা। শ্বশুরবাড়ির উঠোনে গিয়ে নেশার ঘোরে কথাগুলো চেল্লায় বিন্দে। তখন মুক্তির মা মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে গেলে পালায় সে।
    এই বিন্দের জিগরি দোস্ত এখন নোচে। সংসার করার যোগ্য না হয়েও মোহে পড়ে আরতিকে বিয়ে করলে যা হবার তাই হতে শুরু হল তার সংসারে। আরতির মন কিছুতেই সে আদায় করতে পারেনি। আরতি যে তাকে অপছন্দ করে তা আরতির মুখ থেকে শুনে সে বিগড়োতে শুরু করে। শুরু করে মদকে সঙ্গী করতে। সেখান থেকেই বিন্দে তার দোসর হয়ে যায়। সেদিন বেলা ন’টা ট’টা হবে। অখিল কারিগরদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিল। আর ঘটনাটা ঘটবে তো ঘটবে সেই অখিলের সামনেই। হঠাৎ অখিল দেখতে পায় আরতি চেল্লামেল্লি করতে করতে তার বাপের বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। তার উল্টো দিক দিয়ে আসছে অখিল। হঠাৎ আরতি এসে তার পিছনে লুকিয়ে অখিলের জামাটা মুঠো মেরে ধরে বলে,“অখিলদা আমাকে বাঁচাও। ওই মাতালটা আমাকে মারতে আসছে ! ওই দেখো, আসছে! অখিল সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে নোচে একটা কঞ্চিবাড়ির মত গাছের ডাল উঁচিয়ে এদিকে দৌড়ে আসছে। অখিল তাকে থামায়! সঙ্গে সঙ্গে নোচে বলে,“তুই সরে যা অখিল। আমার কাজে বাধা দিবি না। ওই মাগিকে আজ আমি উচিৎ শিক্ষা দেবো। আমাকে গালাগালি দেওয়া?” সঙ্গে সঙ্গে আরতি বলে, “মাতালটা সারা রাত কোথায় উল্টে পড়েছিল কে জানে। নেশা ছুটে গেলে বাড়ি এসে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। আমাকে বিছানায় যেতে হবে। আদর করবে! যত কথা বলে, মুখ দিয়ে ভকভক্ করে চুল্লুর বিকট গন্ধ ঠিকরে এসে আমার নাকে জ্বালা ধরিয়ে দিতে থাকে! রান্না করছি। বলতে একবালতি জল উনুনে ঢেলে দিল! আর ওই বাড়িটা আনতে গেল আমাকে পেটাবে বলে। ভয়ে আমি পালিয়ে আসি ও বাড়ি থেকে।” বলে অখিলের পা জড়িয়ে ধরে আরতি। তারপর বলে, “আমি ওর ঘর করবো না অখিলদা। তুমি আমাকে তোমার কারখানার কাজ দেবে? তোমার কাজ করে আমার একার পেট আমি চালিয়ে নেব। আমি কিছুতেই ওর ঘরে যাব না।” আরতির কথা শুনে অখিল তীক্ষ্ণ চোখে নোচে মাতালের দিকে তাকাতে সে বিষহীন সাপের মত ফনা নামিয়ে হাতের ছড়িটা রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আগোছালো পদচালনায় বাড়িমুখো হয়। যেতে যেতে বিড়বিড় করে অখিলকে দেখে নেবে, সেই প্রতিজ্ঞা করে আর তার বাপ-বাপান্ত করতে থাকে।
    সনাতন সেইসময় নিজের কাজে পাড়ার রাস্তায় বেরিয়ে শুনতে পায় কোন মেয়ের আকুতিমিনতির স্বর! পা পা করে এগিয়ে গিয়ে দেখে তাদের পাড়ার মেয়ে আরতি। নোচের বউ! অখিলের কাছে কাজ ভিক্ষে চাইছে। আরতির প্রতি দরদে উচাটন হয়ে ওঠে সনাতনের নরম হৃদয়। আহা রে, দু’পয়সা রোজগার করে পেটে খাবার জন্যে কেমন প্রার্থনা করছে একজন যুবতী মেয়ে। যে মেয়ের একটা কুলাঙ্গার স্বামী বর্তমান। অন্যকিছু না ভেবে সনাতন বলে, “তোমার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে তোমার অন্য কারিগরের মত ওকেও কাজে লাগাও না, অখিলদা?”
    পাড়ার বুঝদার এবং ভাল ছেলে হিসেবে সনাতনকে সবাই মানে। ওর থেকে বয়সে ছোট হলে কি হবে, অখিলও তার কথাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সেই ছেলে আরতির হয়ে সুপারিশ করছে বলে অখিল মেয়েটার প্রতি আগ্রহ দেখায়। ওই মদখোর স্বামী, নোচের মুখচেয়ে কিছুতেই নয়। আরতিকে বলে, “তুই তো এখন কাজ শিখিসনি। আমার কাজ করবি কেমন করে। ঠিক আছে, আপাতত সহজ কাজ কিছু তোকে দেবো’খন। মন দিয়ে যদি করতে পারিস তাহলে মন্ডলপাড়ার রেখা বউয়ের কাছে তোকে পাঠাব। ওর কাছ থেকে কাজ শিখে নিবি।” তার মতামতকে গুরুত্ব দেবার জন্যে অখিলদার দিকে সন্তুষ্টির হাসি হেসে সনাতন নিজের কাজে চলে যায়।
    মাস-দুই পরে নোচে, আরতির দাদুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বউ আরতিকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে আসে। নোচের কথায় আরতির দাদু গলে জল হয়ে গিয়ে জোর করে নাতনিকে শ্বশুর ঘরে পাঠায়। মা কিন্তু নিমরাজি ছিল। দাদু পাত্তা দেয়নি আরতির মায়ের মতামতে। বাধ্য হয়ে আরতি অখিলের শোলার কাজগুলো সঙ্গে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়। যেদিন যায় সেদিন বউকে কিছু বলেনি নোচে। দু’দিন পরেও নোচে যখন আরতির মন গলাতে পারল না, আবার ক্ষেপে যায় বোয়ের উপর! অখিলের সব অর্ডারি শোলার কাজ ভেঙে দুমড়ে বাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে বলে, “ঢেমনা মাগী, নতুন নাঙ ধরেছো? ওই শোলাওলা তোমার নতুন নাঙ হয়েছে না? এই ঘুচিয়ে দিলাম তোর নতুন পিরিত। কি করতে পারে তোর ওই অখিল নাঙ এবার আমি দেখব। পয়সাওলা নাঙ, তাই নিজের বিয়ে করা স্বামীকে তোর আর পছন্দ হচ্ছে না, তাই না?”
    এই শোলার কাজ তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অবলম্বন কি না এই মাতালটা নিমেষে শেষ করে দিল! আর কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, আরতি। সেও মাতালটার ব্যবহারের যাবতীয় জিনিস লন্ডভন্ড করে বাইরের কাদামাটিতে লেপটে দিয়ে চিৎকার করে গালাগালি দিতে দিতে সনাতনদের বাড়ির দিকে ছুট মারে! সনাতন তখন বাড়িতেই ছিল। সনাতনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তাদের উঠোনে এসে থাবড়ে বসে। ধড়ফড়ানি বুকে বলতে থাকে, “সনাতনদা, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ওই মাতালটা অখিলদার সব শোলার গয়নাগাটি নষ্ট করে দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এখন আমি কেমন করে অখিলদার সামনে মুখ দেখাব? এমনিতেই কাজ জানি না বলে আমাকে কাজে নিতে চাইছিল না। তুমি বলাতে কাজ দিল। এখন আমার কি হবে দাদা! জানোয়ারটা আমার সব শেষ করে দিল। তুমি দাদা অখিলদাকে একটু বুঝিয়ে বলবে? ওর অনেক ক্ষতি করে দিল জন্তুটা। ওই ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা তো আমার নেই। আর কাজও আমাকে দেবে না। ওর ঘর আমি আর করব না। তাহলে কি করে আমি বাঁচব, দাদা। এখন গলায় কলসি-দড়ি ছাড়া আর তো অন্য সমাধান আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। একমাত্র তুমিই পারো আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। অখিলদা যেন আমাকে ভুল না বোঝে। আমাকে না দোষি সাব্যস্ত করে!”
    অখিল ক্ষমা করে দিয়েছিল আরতিকে। ক্ষমা করেনি বিন্দে, নোচেকে। আর সেই থেকে নোচে-বিন্দে তার জাতশত্রু হয়ে দাঁড়াল। অথচ তাদের উপকারের জন্যে সে কাজ করতে গেছিল। এতসব অনাচার দেখেও চোখে ঠুলি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়ার মুরুব্বি-বিচারকরা! নোচে-বিন্দের মত কাজ কারবার কত অতীত থেকে যে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে চলে আসছে তা কে জানে। কারোর হুঁশ নেই, বৃহত্তর সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমাজেরও পরিবর্তনের ডাক দেওয়া দরকার। নিজেরা নিজেদের মধ্যে বেলেল্লাপনা, নোংরামো, নারী-পীড়ন- সবকিছু বিনা প্রশ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে আটচালা কোন দোষ দেখে না। আবার এই ছেলেমেয়েরা যদি অন্য জাতের কোন ছেলেমেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে তো তার মত জঘন্য অপরাধ নাকি আর হতে পারে না। রুইদাসদের মাথাদের বিচারে সেটাই বলে। কিন্তু এই বলা তো বন্ধ করার সময় এসেছে। সনাতনের সঙ্গে এমনকিছু সামাজিক একচোখোমিকে নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করে অখিল। অখিল বলে, “আচ্ছা সনাতন ভাই, তুই বল। একটা অকাল-স্বামীহারা যুবতী মেয়ে। অরক্ষণীয়া হয়ে দিন কাটাচ্ছে। চরম বিপদগ্রস্থ সে। তার পাশে যদি আমি গিয়ে দাঁড়াই তাতে আমাদের পাড়ার মানুষের মাথা খারাপ হবার কারণ কি? তাছাড়া, ভীষ্ম মন্ডলের বউ, রেখা-বউ তো আমার কাজের গুরুত্বপূর্ণ কারিগর। তার হাতের কাজের পটুতায় বড়বাজারে আমার এত সুনাম হয়েছে। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থাকবে না? তুই আমার চেয়ে ছোট। ভায়ের মতো। তবু তোকে আর একটু খুলে বলতে আমার দ্বিধা নেই। কাজের সুবাদে যাতায়াত। ভীষ্ম বেঁচে থাকতেও কাজ নিয়ে আমি ওদের বাড়ি যেতাম। তখন মেয়েটার প্রতি আমার কোন টান জন্মায়নি। পরস্ত্রীর প্রতি লোভ করা আমার নীতিতে বাধে। মেয়েদের নিয়েই তো আমার যাবতীয় কাজ। ব্যবসা আমার লক্ষ্মী। এই লক্ষ্মীর সহচারিনী ওরা। ওখানে বাঁকা দৃষ্টি ফেলা মানে তো নিজের পায়ে কাড়ুল মারা। সেটা আমি কোনদিন হতে দিতে পারি না। দিইও নি। কিন্তু ভীষ্ম মারা যাবার পর তার বউটার অসহায় জীবন আমাকে ধাক্কা মারে। কে ওর জীবন যৌবনের রক্ষকর্তা হবে। জীবনের সবটাইতো ওর বাকি পড়ে রইল। ধূমকেতুর মত ক’টা দিন ভীষ্ম ওর জীবনে এল, আবার বিলীন হয়ে গেল। তাই তার বিপদে পাশে দাঁড়াবার জন্যে কাজে-অকাজে ওদের বাড়ি একটু বেশি যাতায়াত করতে শুরু করি। তখনও কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসা বাসা বাঁধতে পারেনি। হঠাৎ একদিন রেখা বউয়ের শাশুড়ি আমাকে মেয়েটার দায়িত্ব নিতে বলে। অকল্পনীয় এক প্রস্তাবে আমার সত্ত্বার ভেতরে কে যেন এসে আন্দোলন শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণের জন্যে যেন মনে হল, আমি আমার মধ্যে নেই। তখনকার মত অবশ্য নিজেকে সামলে নিই। কিন্তু সেই দিন থেকেই রেখা বউকে নিয়ে আমার ভেতরের ভাবনা অন্য খাতে বইতে শুরু করে। কখন যেন ধীরে ধীরে ওকে ভালবেসে ফেলতে থাকি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এখনও পর্যন্ত কিন্তু রেখা বউয়ের মনের হদিশ আমার ধরাছোঁয়ার বইরে। মনে হয় যেন একটা পলকা কাঁটা তার আমার দু’জনের মাঝখানে অবস্থান করছে। তবে আমি বিশ্বাস করি সেই কাঁটা সরিয়ে দিতে বেশি বেগ পেতে হবে না।”
    সনাতন ছেলেটা কম কথা বলে। সেটা অখিল কেন, পাড়ার সবাই জানে।
    তাই তার কাছ থেকে এত কথার উত্তরে অনেক কথা অখিল আশা করে না। খানিক চুপ থেকে সনাতন শুধু বলল, “অখিলদা, জাত ধর্ম বর্ণর নিক্তি-কাঠিতে ভালোবাসা কোনদিন মাপা যায় না। এ তো অন্তরের সঙ্গে অন্তরের বোঝাপড়ার ব্যাপার। অন্তরের আবার জাত ধর্ম বর্ণ-ফর্ণ কিছু আছে নাকি ! আমার তো জানা নেই। যারা এই ভাবনার বাইরে অন্যকিছু ভাবে, সে তো মধ্যযুগীয় ভাবনা। এ ভাবনা বর্তমান ধ্যানধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। জানাই যখন যাচ্ছে যে এ খাপে ওই খাপ মিলবে না, তখন অমন চর্চায় কি লাভ। তুমিই বলো না অখিলদা?”
    নিত্যানন্দ-দিবাকর, নোচে-বিন্দেরা যদি পাড়ার আটচালাকে শিখন্ডী রেখে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করতো তাহলে আজই তাদের বুঝিয়ে দিত কত ধানে কত চাল। কি শারীরিক ক্ষমতায় বা আর্থিক ক্ষমতায়। তারপর তো লোকবলের ব্যাপারটা আছেই। এখনকার ছেলেপিলেরা আর সেকেলেদের একদমই পাত্তা দিতে চায় না। কান পাতলে সেই হৃদয়-কথা শুনতে পাওয়া যায়।
    একটু আগোছালো পোষাকেই রেখা শোলার কাজ করতে বসে যায়। তাদের ঘরে তো এখন আর কোন পুরুষ মানুষ রইল না। বাইরে থেকে কারোর আসারও কথা না। হঠাৎ ঠিকাদারবাবুকে দেখে চমকে ওঠে রেখা! ধরফড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে গোছগাছ করে ভদ্রসদ্র হতে। অত তাড়াতাড়ি সে আর হবার। শাড়ী জড়িয়ে মড়িয়ে যেন একাকার হয়ে আছে। রেখার মত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অখিলও। পাশের ঘরে দরজার সোজাসুজি বসে ভীষ্মর মা। দুই কপোত-কপোতির বেসামাল অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে বুড়ি। এমনিতেই বুড়িরা একটু ঠোঁটকাটা হয়। তারই সাজুজ্য মেনে বুড়ি বলে,“আর লুকোচাপা খেলা খেলে কি হবে বৌমা। যা ভবিতব্য তা তো মিলে গেল। ধীরে সুস্থে তোমার কাপড় সামলাও। অত হুড়োহুড়িতে মাকড়শার জালের মতো নিজে আরও জড়িয়ে পড়বে। অখিলবাবা যা দেখার না চাইতেই তা দেখে ফেলেছে।” বলে ঘরের বাইরে চলে যায় বুড়ি। শাশুড়ির কথায় লজ্জায় আরও রক্তিম হয়ে যায় রেখা বউয়ের চোখমুখ। ওখান থেকে দৌড়ে শাশুড়ির ঘরে চলে এসে চাপা গলায় বলে,“তুমি-না মা, একদম যাচ্ছেতাই। তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। যাও তো ঠিকাদারবাবু কি ভাবলো কে জানে!”
    বাড়িতে হঠাৎ ঢোকার মুহূর্ত কয়েকের জন্যে যেটুকু দেখার দেখতে পেয়েছে অখিল। তারপর লজ্জায় সেই যে পাশ ফিরে দাঁড়িয়েছে, রেখা বউ ওঘরে চলে যাবার পরও সেইভাবে ছিল। রেখা বউ ফিটফাট হয়ে এসে ডাকতে তবে সামনে ঘুরে দাঁড়ায়। দু’জনে সামনাসামনি হতেই রেখা বউ মুচকি একটা হাসি ছুড়ে দেয় অখিলের দিকে। সেই হাসি পরম আদরে নিজের হাসিতে মিলিয়ে দেয় অখিল। রেখা বলে,“কিছু মনে করবেন না ঠিকাদারবাবু। আপনি আসবেন বুঝতে পারিনি। কোলকাতায় যাবার কথা তো আজ? গেলেন না যে? এরকমভাবে কাজে অবহেলা করলে কি করে হবে। মহাজন যদি অর্ডার বাতিল করে দেয়?”
    -আমার অর্ডার বাতিল করলে মহাজনেরই লোকসান হবে। আমার নয়। কত মহাজন হাত বাড়িয়ে আছে, আমার মাল নেবার জন্যে। সেটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র আমার রেখা বউয়ের জন্যে। যদি চলে যেতাম তাহলে কি এমন মায়াবী প্রকৃতির সঙ্গে আমি একাকার হতে পারতাম! প্রেমময়ের অসীম কৃপা না থাকলে এই অমূল্য দর্শন সম্ভব নয় রেখা বউ। আমি যে আজীবন এই প্রকৃতিতে নিজেকে সমর্পণ করতে চাই, প্রিয়া.. তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব। তুচ্ছ হয়ে যাবে আমার যাবতীয় পার্থিব চলনবলন, ইচ্ছা অনিচ্ছা। সব। সবকিছু- এমন লোকসান আমি প্রাণ থাকতে হতে দিতে চাই না রেখা বউ। আর তা থেকে রক্ষা করার চাবিকাঠি যে একমাত্র তোমারই হাতে।”
    -এ কি কথা বলছেন, ঠিকাদারবাবু! আমার মত পাপীতাপী তুচ্ছ মেয়েমানুষকে এমন লোভ দেখাবেন না বাবু। অলক্ষুণে স্বামীখাকি আমি। এ আমার জন্মান্তরের পাপের সাজা। যদি আমার ‘বেয়নে’ এমন অঘটন না ঘটবে তাহলে আমার বিয়ের আগেও তো লতার ছোবলে মরতে পারতো সে? তা তো হল না! আমাদের বিয়ে হল আর মরণ তাকে কেড়ে নিল! আমার পাপের ফল ছাড়া এমনটা হবার কথা নয়। আমাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিন ঠিকাদারবাবু! ভুলে যান এই অপয়া মেয়েমানুষকে। বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে রেখা বউ!
    রেখা বউয়ের কথায় হঠাৎ যেন কেমন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে অখিল! তার ভালোবাসাকে না পাবার আতঙ্কে বেসামাল হয়ে পাশের ঘরে যেতে যেতে বলে,“তা হলে আর এ জীবন কার জন্যে বাঁচিয়ে রাখা, রেখা বউ! একে আহুতি দেওয়াই সঠিক বিচার হবে। তুমিও যখন তা চাইছো তবে তাই হোক।”
    কোন অঘটন ঘটে যাবার আগেই রেখা দৌড়ে ওঘরে গিয়ে যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষের শারীরিক ব্যবধানকে উপেক্ষা করে প্রাণপণে অখিলকে জড়িয়ে একাকার হয়ে বলে, “এ কাজ তুমি করতে যেও না অখিল! দ্বিতীয়বার আবার আমাকে আপনজনের মৃত্যুর দায়ভার চাপিও না। তোমার কাছে আমি তোমার জীবন ভিক্ষা চাইছি। বিনিময়ে তোমার যা মনের ইচ্ছে তাই হবে। তুমি যা বলবে তাই করব। যা বলবে না করব না। শুধু আমার এই ক্ষতিটুকু হতে দিও না।”

    [ চল্লিশ ]

    আশাতিরিক্ত ভাল ফল করে সরিষা সারদা মন্দির থেকে বেসিক ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরল অলোকা। তার এই সাফল্যের পেছনে প্রধান অবদান যে বিপ্লবদার। এ অবদান জীবনে সে ভুলতে পারবে না। অলোকা ভাবে, বিপ্লবদা যদি তার জীবনে না আসতো তো এই ট্রেনিংটা নেওয়া তো হোত না। ট্রেনিং পিরিয়ডে যে ভাবে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রোজেক্ট তৈরীর ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে তার ঋণ সে কোনদিন শোধ করতে পারবে না। এক কথায় এই মানুষটা অন্তরাল থেকে তাকে সাহায্য না করলে গর্ব করে বলার মত এই রেজাল্ট করা তার একার পক্ষে কোনদিন সম্ভব ছিল না। এই সত্যকে সে যদি স্বীকার না করে তো তা আপন ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছু হবে না। যত এই মানুষটার সঙ্গে সে মিশছে তত তার প্রতি একটা অমোঘ টান মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এ তার জন্মান্তরের আপনজন। এখন অলোকার মনে হয় এই বিপ্লবদা ছাড়া তার জীবনে কোনদিন পূর্ণতা আসতে পারে না। সে সবসময় প্রস্তুত তার সর্বস্ব এই মানুষটাকে উজাড় করে দিতে। কিন্তু বিপ্লবদা কি তাকে সেই চোখে দেখে? কি জানি! এমনি বোঝা যায় সে যা চায় সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবদা তার নিজের চাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। অথচ মুখ ফুটে পরিষ্কার করে কেন যে বলে না, অলোকা আমি তোমাকে ভালোবাসি! কথায় বলে, ‘মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’। এ তো দেখছি তার উল্টো। অলোকা তো লজ্জাহীনভাবে তা যে কোন সময় প্রকাশ করতে পারে। এই মানুষটার সামনে প্রকাশিত হওয়াটায় কোন সঙ্কোচ বোধ তার মধ্যে নেই। কিন্তু গ্রাহকের আধার কতটা প্রস্তুত সেটাই তো খোলসা হল না তার কাছে।
    সারদা মন্দির থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসার পর বিপ্লবদাকে বলেছিল অলোকা, “এবার তো তার হাতে অঢেল সময়। পুনরায় ডিগ্রীকোর্সে ভর্তি হওয়া যায় তো বিপ্লবদা? আমার পুরোনো ইচ্ছেটা তাহলে পূর্ণ করতে পারি। তোমার কি মত?”
    -বেসিক পড়ার উদ্দেশ্য ছিল, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতার সুযোগ নেওয়া। এবার তুমি যদি সেই সুযোগ না নিয়ে আবার লেখাপড়ায় জড়িয়ে পড়ো তাহলে এত কষ্ট করে এটা পড়ার কোন যে মূল্য থাকে না অলোকা। আমার তো আশা তুমি প্রথম সুযোগেই চাকরিটা পেয়ে যাবে। তোমার প্রতি এতটা আমার আস্থা! এখন আমাদের কাজ, সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। সুযোগ এলে, সফল হলে তো আবার তোমাকে কলেজে পড়া ছাড়তে হবে। এবার তুমি বলো, কোন কাজটা তাহলে সঠিক হবে। সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বেসিক ট্রেনিং করা না থাকলে কোন প্রার্থীকে প্রাইমারী স্কুলের জন্যে টিচারের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে না। এই নিয়ে বছর খানেক হয়ে গেল কেস চলছে। নন- বেসিকের যারা সরকারের আগের নোটিফিকেশন মত দরখাস্ত করেছিল তারা সরকারের এই সম্প্রতি নোটিফিকেশনের বিরুদ্ধে কেস করেছে। তাদের যুক্তি, সরকারের আগের বিজ্ঞাপনে কোন ট্রেনিংয়ের কথা বলা ছিল না। এই কেসের বিরুদ্ধে সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং নতুন বিজ্ঞাপনের পক্ষে সাওয়াল করেছে। খুব সম্ভবত সামনের হেয়ারিংয়ে কেসটার ফাইনাল ডিসিশান দেবে কোর্ট। যা শোনা যাচ্ছে তাতে সরকারের পক্ষেই রায় যাবে। তাই যদি হয় তো আমাদের আর ফিরে তাকাতে হবে না। কেন বলো তো? কারণটা এর গভীরে লুকিয়ে আছে। গভর্নমেন্টের রেকর্ড মত যা ভ্যাকান্সি আছে, তার থেকে কম ক্যান্ডিডেট আছে বেসিক ট্রেনিং পাশ করা। তারপর তোমার Rank তো অনেক উপরের দিকে। এ অবস্থায় তোমাকে আটকায় কে? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিপ্লব বলল।
    অনেকদিন হয়ে গেল। দেখা হয়নি বিপ্লবদার সঙ্গে। কি করে যে দেখা করা যায়! মনটা উচাটন। তাদের পাড়াগাঁয়ের যা হালচাল, তার মত মেয়েদের হুটহাট অন্য পাড়ায় গিয়ে দেখা করার উপায় নেই। তারপর মেয়েটা যখন অলোকা, তো চব্বিশঘন্টা ঘুরে বেড়ানো পাড়ার অকেজোদের লাল চোখ তার উপর নিবদ্ধ হবেই হবে। আর অন্য পাড়া বলতে বিপ্লবদাদের পাল পাড়া হলে তো পরদিনই আটচালায় অশ্লীলতার দায়ে বিচারসভা বসে যাবে তাদের বিরুদ্ধে। একটা চিরকুট লিখে ঘোরাঘুরি করছে অলোকা। লক্ষ্য তার সনাতন। কখন ছেলেটাকে ঘরের বাইরে দেখবে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তো সনাতনদের বাড়ি গিয়ে চিরকুটটা তার হাতে ধরিয়ে বলা যায় না যে এটা বিপ্লবদাকে দিয়ে দিস। তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে সে। দুই ভাবনার সন্ধিক্ষণে সনাতনই প্রথম তাকে দেখতে পেয়ে বলে, “কেমন আছো, অলোকাদি। হ্যাঁ, সবসময় ঘরের ভেতর ভাল লাগে। একটু ঘোরাঘুরি করাও দরকার।” অলোকা দেখে, সনাতন বাজারের ওইদিক থেকে আসতে আসতে কথা বলছে। অলোকা ডাকে, “এদিকে একটু আয়-না ভাই। তোর সঙ্গে আমার কাজ আছে। তোকেই খুঁজছিলাম। তাই এই ঘোরাঘুরি।” সনাতন বলল, “বলো কি বলছো। হ্যাঁ, বিপ্লবদাকে দেখলাম মোহনের সেলুনে চুল কাটছে। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। না। তোমাকে বলার মত তেমন কিছু বলেনি। আমিও ওখানে দাঁড়াই নি। একটা বিশেষ কাজে বাড়ি আসছিলাম তাই। আবার এক্ষুণি বাজারে যাব।” বলে মুচকি একটু হেসে নেয় সনাতন। ভাইটার কাছে একটু লজ্জা মত পায় অলোকা। বলে, “আবার যখন বাজারে যাবি, তখন আমার একটা কাজ করে দিবি ভাই?” বলে সনাতনের ‘হ্যাঁ-না’ উত্তরের অপেক্ষা না করে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা চিরকুটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা বিপ্লবদাকে দিয়ে দিস। চুল কাটছে মানে একটু পরে গেলেও মোহনের সেলুনেই পেয়ে যাবি ওকে।” বলে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে অলোকা। সনাতন চিরকুটটা হাতে ধরে কিঞ্চিৎ উদাস চিত্তে অলোকাদিকে পেছন থেকে দেখতে থাকে। ভাবে, অলোকাদি কত ভালোবাসে বিপ্লবদাকে। এই নিয়ে পাড়ায় কত-না ঝামেলা হয়েছে। তবু দিদির মন যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। থাকবে না বা কেন? বিপ্লবদাই তো ওর জীবনের একমাত্র ‘ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড।’ সেই কৃতজ্ঞতা বোধ যদি অলোকাদির মধ্যে না থাকতো তো এক নিতান্ত সত্যকে নির্মমতার সঙ্গে অবহেলা করা হত।
    আর দেরি না করে সনাতন তাড়াতাড়ি তাদের বাড়ির দিকে গেল নিজের কাজ সামলাতে। তাড়াতাড়ি করে না বাজারে ফিরতে পারলে আবার বিপ্লবদার সঙ্গে তার দেখা না-ও হতে পারে। চুল-দাড়ি কাটা হয়ে গেলে ও সেখানে আড্ডা দেবার মানুষ নয়। কাজ থাকলে এদিক ওদিক কাজ সেরে বাড়ি চলে আসে। বই আর পড়াশোনা এদের দু’জনের অন্যতম প্রধান বন্ধু। কে যে এদের প্রধান বন্ধু- এরা পরস্পর দু’জন নাকি বই-লেখাপড়া সেটা বোঝা মুশকিল। সব যেন একাকার হয়ে আছে এদের মধ্যে।
    “ছুতোটা মায়ের জন্যে ওষুধ কিনতে যাওয়া। দিঘিরপাড় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না তাই ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। কাল দুপুর দুটোর সময় আমি বাজারের বাসস্ট্যান্ডে থাকব।” বিপ্লবকে উদ্দেশ্য করে চিরকুটে তাই লিখেছে অলোকা। সেটা পড়ে একটা সন্তুষ্টি ভাব নিজের মনের মধ্যে জরিয়ে নিতে নিতে বাড়ির পথ ধরে বিপ্লব। এত কাছে থেকেও কতদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তার মনটাও অস্বস্তিতে থিতু হচ্ছিল না কিছুতেই। তারও কলেজ শেষ। বাবার কারবারের কাজ না থাকলেও কাছে-দূরে, বাইরে কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। ভালোই হল এই সুযোগে তার কলেজভূমে একটু ঘুরে আসা যাবে। তবে বাড়িতে অন্য কাজের কথা বলে যেতে হবে। বাড়ির লোকজন পছন্দ করে না, রুইদাস পাড়ার মেয়ে অলোকার সঙ্গে সে মেলামেশা করুক। এইসব জাত-ফাত নিয়ে এরা চর্চা করতে এত পছন্দ করে কেন কে জানে! ওর মত গুণবতী বুদ্ধিমতী নম্র স্বভাবের মেয়ে সারা পালপাড়া ঢুঁড়ে বেড়ালেও একটা খুঁজে দিতে পারবে কেউ? পারবে না। আপাতত মুখে কিছু বলছে না যে রুইদাসরা তাদের থেকে নীচু জাত। তার উপর পশুর চামড়া নিয়ে ওদের কাজ কারবার। তাই এই জাতের প্রতি ওদের এমন ঘেন্না। কিন্তু চলনে বলনে তা বুঝিয়ে দিতে কসুর করছে না পালেরা। অলোকার সঙ্গে মেলামেশার বহর বেশি মনে হলে নিশ্চয়ই একদিন ভেতর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে মনের মূল প্রবৃত্তি! অলোকার বেসিক ট্রেনিংয়ের পড়ার সঙ্গে সে যে এত বেশিভাবে জড়িয়ে ছিল, তার বিন্দু বিসর্গও জানে না তার বাড়ি। বা পাড়াও। সেই সুযোগ সে করে দেয়নি। যা কিছু করেছে সবটাই এদের অন্তরালে রেখে। তিরাশি নম্বর বাসে দিঘিরপাড় থেকে উঠে দোস্তপুর চৌরাস্তার মোড়ে নামতে হয়। সেখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে ডায়মন্ড হারবারমুখী বাস ধরতে হবে। দোস্তপুর মোড়ে নেমে এত গাড়ির বহর দেখে একটু ইতস্তত বোধ করে অলোকা। তাই নিজে থেকেই সে বিপ্লবের বাঁহাতটা তার ডান হাত দিয়ে খাপটি মেরে ধরে ! অলোকার হাতের পেলব স্পর্শে সমস্ত শরীরে শিহরণ তুলে দেয় বিপ্লবের! ওকে নিজের জন না ভাবলে সে এটা করতো না। একটা তৃপ্তিবোধ তাকে যেন খুশি করে তোলে। রাস্তা পার হয়ে বাসের জন্যে ওপারে দাঁড়িয়ে তখনও হাত ছাড়েনি অলোকা। বিপ্লব একবার অলোকার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হাতের দিকে চায়। ইঙ্গিত বুঝে অলোকা বলে,“সারা জীবন আমি এই হাত ধরে বেঁচে থাকতে চাই। এ হাত আমার। ছেড়ে দেবার হাত নয় এটা। চলো গাড়ি আসছে। এবার হাত ছাড়ছি। অনুসরণ করছি তোমার। সেই সুযোগ তুমি আমায় দাও। জন্মান্তর!”
    কলেজে পড়তে আসার সুবাদে ডায়মন্ড হারবার শহর বিপ্লবের হাতের তালুর মত চেনা। অলোকার মায়ের জন্যে ওষুধ কেনার পর ডায়মন্ড হারবার গার্লস স্কুল ডানদিকে রেখে নুনগোলা এলাকা পেরিয়ে ওরা চলে যায় নদীর কিনারায়। নদী এখানে একটা বড় বাঁক নিয়ে সাগর অভিমুখে রওনা দিয়েছে। বাঁধানো নদীবাঁধে বিভিন্ন গাছ লাগানো আছে। গাছের শেকড়গুলো বাঁধের পাড়কে শক্তপোক্ত ধরে রাখার জন্যে। বিশেষ করে বট, অশত্থ, পাকুড়, দেবদারু আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারিগুলো পরিবেশকে যেন মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। প্রত্যেক গাছের ঠিক নীচে সুন্দর সুন্দর সিমেন্টের বাঁধানো বসার চাতাল। চেয়ারের মত দেখতে তার কাঠামো। অলোকা এই প্রথম এমন মনপাগল করা জায়গার সঙ্গে পরিচিত হল। অগণিত হাত মেলে ধরে একটা বট তার শীতল ছায়া বিতরণ করে চলেছে অকৃপণভাবে। গাছের তলায় বসার জায়গায় অলোকা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে বসতে বলল বিপ্লবকে। বলল, “এই ব্যবস্থা কি তাদের মত ভালোবাসার জনেদের জন্যে করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ! মনে হচ্ছে তো তাই। মানে বৃহত্তর সমাজ আমাদের এই নির্মল পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়ে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে আমরা ভুল কাজ কিছু করছি না। সংকীর্ণ স্বল্প-জানা ঈর্ষাধারি একদল মানুষ যাই ভাবুক না কেন।” বলে এবার অলোকা বিপ্লবের একটা হাত নিজের কোলের আঁচলের উপর রেখে তার উপর দিকটা পরম ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে। নিজের অন্তরের সুখানুভূতির সঙ্গে বিপ্লব তাকে প্রশ্রয় দিতে থাকে। কখন যেন দখিনা ঠান্ডা মোলায়েম বাতাসে স্নান করতে করতে চোখ বুজে আসে বিপ্লবের। হঠাৎ একটা চমক তাকে যেন জাগিয়ে তোলে। দেখে, অলোকার মোহময় দুটো ঠোঁটের ওম তার হাতে বিলি কাটছে! বিগলিত চিত্তে বিপ্লব বলল, “এত ভালোবাসার দায় আমি বহন করতে পারব তো অলোকা? আমি এর যোগ্য কি না তা তো আমার জানা নেই। আমাকে এইভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসার রজ্জুতে বেঁধে নিজের কাছে রাখতে চাইছো। আমিও সেই বাঁধন মুক্ত হতে চাই না। কিন্তু আমাদের দু’জনের সমাজ যদি দু’জনের মধ্যে দুর্ভেদ্য পাঁচিল তুলতে আগ্রাসী হয়! তখন কিভাবে আমরা সেই বাধা টপকাতে পারব তা তো আমার জানা হয়ে ওঠেনি অলোকা।”
    বিপ্লবের কথায় অলোকা কোন অজানা বিচ্ছেদ ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এবার তার ঠোঁট দিয়ে ভালবাসার ওমের স্পর্শর পরিবর্তে চোখ দিয়ে সদ্যভুমিষ্ঠ প্রেমের বারি বিপ্লবের হাতের উপরিভাগকে স্নান করিয়ে দিতে লাগল। বিপ্লবও আর পুরুষালী চিত্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। টপটপ করে তার চোখ বেয়ে গাল টপকে ভূমির পারে নত হতে থাকল।
    “মুখ তোলো অলোকা। এই নাও রুমাল। চোখমুখ মুছে নাও।” ধরে যাওয়া গলায় বিপ্লব বললে, হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে রুমালটা নিয়ে প্রথমে বিপ্লবের ভেজা হাতটা মুছতে যায় অলোকা। আটকে দেয় বিপ্লব। বলে,“এ আমার পরম ভালোবাসার অমূল্য দান। একে হেলায় নিঃশেষ হতে দিতে আমি পারি না। এর স্থান আমার সত্ত্বায়। সত্ত্বার মধ্যে আমি একে লীন করে দিতে চাই।” বলে সেই ভেজা হাতটা বিপ্লব তার মুখময় আলতো করে বুলিয়ে বুলিয়ে হৃদয় মাঝে স্থান করে দিল। বলল, “এবার ফেরা যাক আলোকা। বিকেল গড়ানের দিকে। যেতে যেতে পশ্চিমের সূর্য রক্তিম হয়ে আসবে। অন্ধকার নামলে তোমার বাড়ির লোক চিন্তায় পড়ে যাবে। খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। সেই পরিস্থিতি আমাদের কাম্য নয়। তার আগেই আমাদের ফিরতে হবে।”
    কোর্টে সরকারের জিৎ হবার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক নেবার কথা বলে। শর্ত, প্রত্যেক প্রার্থীকে বেসিক ট্রেনিং কোর্স পাশ করতে হবে। যথারীতি অলোকা দরখাস্ত করে এবং প্রথম সুযোগেই মাস্টারির চাকরিটা পেয়ে যায়। রুইদাস পাড়ার ইতিহাস রচনা করে ফেলল অলোকা এই মাস্টারির কাজটা পেয়ে। গর্বে বুকের ছাতি বেড়ে গেল রুইদাস পাড়ার। সনাতন এই সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইল না। সচেতনভাবে সে আটচালায় একটা অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা করল। সেখানে পাড়ার সব বাসিন্দাকে আসার আমন্ত্রণ জানানো হল। উদ্দেশ্য অলোকা রুইদাসকে সম্মান জানানো। সে রুইদাস পাড়াকে সম্মানিত করেছে। অতএব রুইদাস পাড়াও তাকে সম্মানিত করতে চায়। সনাতনের ইচ্ছা হচ্ছিল এই আনন্দানুষ্ঠানে বিপ্লবদাকে আমন্ত্রণ জানানোর। কিন্তু বেপাড়ার একটা ছেলেকে কোন যুক্তিতে এখানে ডাকা হবে সেই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। অলোকার একদম পছন্দ ছিল না তাকে নিয়ে এইসব প্রচার-ট্রচার করা হোক। কিন্তু সনাতন, অখিলরা সেকথা শুনবে না। তাদের গর্বের ধনকে তারা মানুষের সামনে তুলে ধরবেই। বাধ্য হয়েই ওদের কথায় অলোকাদি নিমরাজি হয়। তবে অলোকাদির প্রবল আপত্তি আছে বিপ্লবদাকে ডাকার ব্যাপারে। পাড়ার ওইসব মন্দ ছেলেগুলো যদি তাকে দেখে হুল্লোড় শুরু করে তো অসম্মানের আর অবশিষ্ট থাকবে না। অলোকার এই অনুষ্ঠানের বিরোধী হবার আর একটা কারণ ছিল, বিপ্লবদা। যে মানুষটার বিশাল অবদানের বিনিময়ে তার এই সাফল্য সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় কেমন করে? এ তো শিবহীন যজ্ঞ হয়ে যাবে। তবু অলোকা বিপ্লবদার ব্যাপারে এতটা কঠোর। সনাতনকে বলে, “বিপ্লবদাকে যদি তোরা আসতে বলিস তাহলে ওখানে আমাকে পাবি না। এটা আমি বলে দিলাম।”
    বিপ্লবের জীবনের যদি প্রথম সাফল্য আসে তো সেটা হল অলোকার চাকরি পাওয়া। চাকরিটা অলোকার। কিন্তু গর্ব তার। নিজের অবশিষ্ট প্রেরণার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে সে অলোকার এই সাফল্য ছুঁতে পারার পেছনে। তাই গর্বের সঙ্গে খুশি এবং সন্তুষ্টির অংশীদার তো সে হবেই। তার আরও ভাল লাগছে, ওই পেছিয়ে পড়া একটা সমাজ আজ তার সাফল্যকে সম্মান দিতে অনুষ্ঠান করতে চলেছে। এই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির জন্যে কেউ ডাকলো কি না-ডাকলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। ডাকলে সে যাবেও না। ওপাড়ার সব লোক যে কতটা সংকীর্ণমনা, তা সে খুব ভাল করে জানে। বরং বলা যায় বেশিরভাগ মানুষের মানসিকতা এখনও সেই মধ্যযুগীয় স্তরে দাঁড়িয়ে আছে। অলোকা, সনাতন বা অখিলরা তো গোবরে পদ্মফুলের মত জ্বলজ্বল করছে। ওই জনা-কয়েকের মুখের আয়নার সামনে সিংহভাগকে আনতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে রুইদাসদের।
    রুইদাস পাড়া এখন যেন উৎসব মেজাজে মশগুল। পাড়ার মেয়ের এতবড় একটা সাফল্যকে বাহবা দেবার জন্যে আটচালায় অনুষ্ঠান হবে। সেই উপলক্ষ্যে আবার অন্যপাড়ার গন্যমান্য কয়েকজন মানুষকে ডাকা হয়েছে। চলছে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করার তোড়জোড়। তাই নিয়ে সনাতনরা এখন অত্যন্ত ব্যস্ত। পাড়ার বয়জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে চলছে গুরুত্বপূর্ণ সব আলাপ আলোচনা। কিঞ্চিত মিষ্টিমুখেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে, আটচালার তহবিল থেকে। মিষ্টিমুখের প্রস্তাবটা আসে পাড়ার মুরুব্বিসম মানুষদের কাছ থেকেই। সনাতন, অখিল অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিল, আটচালার ফান্ড মানে তো সরকারি টাকা। অন্যরা যদি এই টাকা খরচ নিয়ে কোন মন্তব্য করে তো অস্বস্তির আর শেষ থাকবে না। তাই অখিল বলছিল,“বড়রা যখন বড় মুখ করে বলেছে তখন মিষ্টিমুখ করা হবে। তবে সবাই যদি রাজি থাকে তো আমি ওই খরচের ভারটা নিতে পারি। তাহলে
    সনাতনের ওই আশঙ্কাটা আর থাকবে না।” অখিলের প্রস্তাব উপেক্ষা না করেও নন্দকাকা বলল,“অখিলের বুকের পাটা আছে বলে এতটা সাহস দেখাতে পারল। কিন্তু অখিলকে অবজ্ঞা না করেই বলছি, আমরা, পাড়ার বয়স্করা আনন্দ করে একটা প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাবকে তোমরা সম্মান দেবে না? আমার তো মনে হয় না, আমাদের কথা বললে পাড়ার কেউ সেই কাজে আপত্তি তুলবে। সারা জীবন তো জীবন-পাত করে পাড়ার ভালোর জন্যে কাজ করে এলাম। এবার বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানোর একটা সুযোগ এসেছে। সময়ও এসেছে বলতে পারো। সেটাকে এলেবেলে করে দিতে পারি না আমরা। তোমরা কি বলো, সনাতন-অখিল? দরকার হলে আটচালা কমিটি থেকে এই খরচের কথাটা পাশ করিয়ে দিচ্ছি ! আমি, রতন, দিবাকর, সুবোধ কাকারা কেউই অরাজি হবে না এমন সুন্দর একটা প্রস্তাবে।” নন্দকাকার প্রস্তাবে একশো শতাংশ সায় দিয়ে সনাতন বলল, “ওই দিক থেকে আমাদের কোন সংশয় নেই কাকা। কিন্ত আমরা জানি, পাড়ার একটা দল আছে যারা সবসময় অন্যের খুঁত ধরবার জন্যে মুখিয়ে থাকে। কোন ভালো কাজেও সাথে না থেকে তাকে ব্যাগড়া দিতে পিছপা হয় না। এটা তাদের স্বভাব। চলতি সংস্কারকে হাতিয়ার করে ভাল কাজে এগিয়ে যাবার পথকে বেড়াল লেলিয়ে কেটে দেবার স্বভাব তাদের জন্মগত! যতই তাদের বোঝানো হোক তারা স্বভাব পাল্টাবে না। তারা কারা তা আমরা জানি কাকা। চোখ খুলে রাখলে তোমরাও দেখতে পাবে তাদের চাঁদপানা মুখগুলো। সেইজন্যেই বলছিলাম আরকি।”
    সনাতনের কথায় আরও জেদ চেপে যায় নন্দকাকার ! চোখমুখ খিঁচিয়ে রেগেমেগে বলে, “কোন্ বেটার সাহস আছে, আসুক আমাদের সামনে। ওই পেছনে থেকে মানুষকে উসকে দিলে চলবে না। মুখোমুখি হতে হবে তাদের। তারপর দেখব, সাহসীদের বুকের পাটা কতটা।” তারপর কি একটু ভেবে নন্দকাকা সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল,“সনাতন, তুমি বা জানলে কিরে যে একদল বিরোধিতা করবে আমাদের কাজে? নিশ্চিত না হয়ে আবার কারোর নামে বদনাম করাটাও তো ঠিক হবে না। কি বলো ষ?”
    -হ্যাঁ কাকা, সেটা তো ঠিক। তবে সঠিক খবরটাই আমাদের কাছে আছে। ওরা গুলতানি পাকাচ্ছে, আমাদের অনুষ্ঠানটাকে গুলিয়ে দেবার জন্যে। দেখবে, ইদানিং ওরা চার-পাঁচজন সমসময় একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে। পাড়ার আর কারোর সাথে ওরা মেশে না। সনাতন বলল।
    ঠিক সেইসময় ওই দলটা আটচালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। নন্দকাকা দেখতে পায় ওই দলটাকে। বলে,“ওরা না?” সঙ্গে সঙ্গে গলা হাঁকিয়ে বলে, “এই শোন শোন, তোরা এদিকে আয় একবার, পালাবি না কিন্তু। আয় এদিকে।”

    ক্রমশ…. 

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৯)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [ আটত্রিশ ]
    দিদিমা তাকে এমন করে বাড়ি চলে যাবার কথা বলাতে বাবলা মনে বেশ কষ্ট পায়। কি ভেবে দিদিমা তাকে কথাগুলো বলল, ও বুঝে উঠতে পারছে না। বাবলা খুব ভাল করে জানে, মামা-মামী দিদিমাকে কোনদিন খেতে পরতে দেবে না। দাদু মারা যাবার পর বাড়ির সম্পত্তি তার নামে লিখে দিতে বলেছিল মামা। বাবলা জেনেছে, মামীর বুদ্ধিতেই মামা, দিদিমাকে বলেছিল। দিদিমা রাজি হয়নি। বলেছিল, “বাস্তুর কিছুটা অংশ আমি বাবলাকে দিতে চাই। সেই এতটুকু বয়স থেকে ওকে আমি মানুষ করেছি। এটাকেই ও নিজের বাড়ি বলে মানে। তুই যদি তাতে রাজি হোস তাহলে তোদের মামা-ভাগ্না দু’জনের নামে বাস্তুর সম্পত্তি ভাগাভাগি করে লিখে দিতে পারি।” রাজি হয়নি মামা। ভীষণ রেগে গিয়ে মামা তার মাকে বলেছিল, “মরার সময় কে তোর মুখে জল দেয় আমি দেখব। মেয়ের ঘরের নাতি। ওরা কোনদিন আপন হতে পারে না। সম্পত্তি নিয়ে সেটা বিক্রী করে কেটে পড়বে। এই ছেলের পায়ে এসে শেষ পর্যন্ত মাথা খুঁড়তে হবে। তখন তোর কি হাল করি আমি, দেখবি!”
    মামার এমন হুমকির সামনে দিদিমা কিন্তু একদম দমে যায়নি। বুড়ি শিরদাঁড়া শক্ত করে সেদিন বলেছিল, “তোকে ওই কাজটা করতে যাবার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। সেই কামনা ভগবানের কাছে আমি করছি।” বলে বুড়ি, দিদিমা, তার আদরের নাতিকে জড়িয়ে হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। আর তার কিছুদিন পরেই এই বাস্তুর অর্ধেক অংশ বাবলার নামে লিখে দেয়, দিদা। সেই দিদিমাকে সে কিনা ‘জলে’ ফেলে দিয়ে স্বার্থপরের মত চলে যাবে? তার আদরের দিদাকে নির্দয় মামার হিংসার আগুনে সঁপে দেবে ! এ কোনদিন সে জীবন থাকতে করতে পারবে না। মন-খারাপি হৃদয়ে সে পাশের ঘরে চলে গিয়ে গোমড়া মুখে বসে থাকে ! দিদিমার বুঝতে অসুবিধা হল না তার প্রিয় দাদাভাই রেগে গেছে তার উপর। আস্তে আস্তে নাতির কাছে গিয়ে তার মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “দাদা, আমার ভুল হয়ে গেছে রে। এখান থেকে চলে যাবার কথাটা তোকে বলা আমার একদম ভুল হয়েছে। বুড়ো মানুষ তো। কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ভাবলাম কচি ছেলে তুই। এত কষ্ট করবি। আমার মনটা যেন তখন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু তোর মন কি চায় সেটাও আমার ভাবা দরকার ছিল।” মাথায় হাতের আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “দাদা, গরুটা বিক্রি করে যা টাকা হয়েছিল সেটা দিয়ে এতদিন সংসার চালিয়ে এখন আমার কাছে হাজার দুই টাকা পড়ে আছে। ওটা তুই নিয়ে যা। দেখ, ওটা দিয়ে কি কারবার করা যায়।” দিদার কথায় অবাক হয়ে মুখ তুলে বাবলা বলল, “ওই ক’টা টাকা নিয়ে নিলে সংসার চলবে কেমন করে, দিদা?”
    -কেন, ব্যবসা করে লাভ করবি তো। সেই টাকায় আমাদের দু’জনের সংসার তালেগোলে ঠিক চলে যাবে, দাদাভাই।
    -কিন্তু যদি লাভ না করতে পারি? তখন তো শুকিয়ে থাকতে হবে। ও টাকা আমি নেব না, দিদা। বিনা পুঁজিতে কি কারবার করা যায় তুমি সেই বুদ্ধিটা দাও না দিদি? সুবোধ বলেছে, ট্রেন এমন একটা জায়গা, সেখানে যে জিনিস নিয়ে কারবার করবি, সেটা বিক্রী হবে। কত ধরনের, কত রুচির মানুষ এই ট্রেনে যাতায়াত করে, তা এই হকারি করতে না এলে আমি জানতে পারতাম না। তা দিদা, বিনা পুঁজিতে কি জিনিস নিয়ে আমি কাজ করতে পারি, কি জানি! কিছুতেই বুদ্ধিটা মাথায় আসছে না।”
    খানিক চুপ থেকে দিদা বলল, “একটা কাজ কর দাদা। কাশেম মিঞার বিল ভর্তি হয়ে লকলক করছে কাঁড়ি কাঁড়ি কলমি শাক। ওই শাক আমি কেটে নিয়ে এসে ধুয়ে ধায়ে সুন্দর করে গুছিয়ে আঁটি বেঁধে দেবো। আমাদের বেতের বড় খোড়ায় করে তুই ওই টাটকা শাক সকাল সকাল ফাঁকা ট্রেনে ফিরি করবি। সব গেরস্ত বাড়ি এই শাক ভাজা-তরকারি করে খায়। মনে হয় তোর এই টাটকা শাক দেখলে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। দেখনা একবার চেষ্টা করে। তোর কপালে শিকে ছিঁড়তেও পারে।”
    দিদিমার বুদ্ধি মন্ত্রের মত যে কাজ করে যাবে তা বাবলা কল্পনাও করতে পারেনি। সুবোধরা তো নয়ই। ওরা মনে মনে হেসেছিল বাবলার এই কান্ড দেখে। তবে বাবলা যাতে দমে না যায় তাই মুখ ফুটে কিছু বলেনি তাকে। যত দিন এগোয়, বাবলার কলমি শাক তত জনপ্রিয় হতে থাকে। বিনা পুঁজির কারবার। দিদিমা কাশেম মিঞার বিল থেকে শাক কেটে আনে আর নাতি ট্রেনে হকারি করে। ভালই আয় হতে থাকে। সংসার চালিয়ে বেশ কিছু টাকা জমতেও থাকে।
    সেদিন অন্য খরিদ্দারের সঙ্গে এক সাধুবাবাও হাত বাড়াল, বাবলার কলমি শাক কেনার জন্যে। সাধুবাবা দুটো শাকের আঁটি নিয়ে গেটের মুখে ডানদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবলা অন্য খরিদ্দার সামলে সাধুবাবার কাছে গেল শাকের দাম নিতে। সকালের ফাঁকা ফাঁকা রেলগাড়ী। সাধুবাবা দাম দিতে দিতে বাবলাকে বলল, “তুমি তো পল্লী-গাঁয়ের ছেলে। কয়েকটা গাছের মূল আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে? না, মাগনা নেব না তোমার কাছ থেকে। আমার কিছু আফলা বিল্ব মূল মানে যে বেলগাছের তখনও কোন ফল ধরেনি, সেই গাছের মূল আর অনন্ত মূল খুব দরকার। যে লোকটা আমাকে এগুলো দিয়ে যায়, কেন জানিনা, সে আর আসছে না। খুব অসুবিধায় পড়ে গেছি। গ্রামের ছেলে তুমি। চেষ্টা করলে জোগাড় করে দিতে পারবে। আর যদি তুমি বরাবর আমাকে এগুলো জোগাড় করে দিতে পারো তাহলে তোমাকেই পাকাপাকি অর্ডার দেব। শুধু এই দুটো নয়, আরও অনেক জিনিসের বরাত তোমাকে দিতে পারি। যদি তুমি ঠিক ঠিক কথা রেখে কাজ করতে পারো। সেটা পরের কথা। এখন দেখো এই দুটো মূল তুমি জোগাড় করতে পারো কি না। আবার তিন দিন পরে এই গাড়িতে এই কামরায় তুমি আমাকে দেখতে পাবে।”
    কথাটা শুনে বাবলার জানার কৌতূহল হল এগুলো ঠিক কি কাজে লাগে। যেটা নিয়ে সে কাজ করবে, তার গুনাগুন জানাটা জরুরী। ভবিষ্যতে তার কাজে লাগতে পারে। তাই সাধুবাবার সামনে হাত জড়ো করে বলল, “প্রভু, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, অপরাধ নেবেন না? আমার খুব জানার ইচ্ছে করছে, তাই।”
    -তুমি কিশোর। নিষ্পাপ। বলো তুমি কি জানতে চাও।
    -এগুলো মানুষের কি কাজে লাগে একটু আমাকে বলবেন? সাধুবাবা মুচকি হেসে বলল,“গরীব মানুষরা, যাদের বিভিন্ন দরকারে পাথর ধারণ করার জন্যে জ্যোতিষীরা সুপারিশ করে তাদের পক্ষে সবসময় দামি দামি পাথর কেনা সম্ভব হয় না। তাদের জন্যে পরিবর্ত হিসেবে এই বৃক্ষমূল দেওয়া হয়। অবশ্য পাথরের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় পরিবর্ত ধাতুও। সেটা যদিও পাথরের থেকে কম দাম কিন্তু বৃক্ষমূলের থেকে অনেকটাই বেশি। সবসময় ওই সম্পন্নহীন মানুষদের সেগুলোও কেনার ক্ষমতা থাকে না। এই মূলই তাদের ভরসা। যেমন ধরো এই যে তোমাকে আফলা বিল্ব মূলের কথা বললাম। ‘রবি’ গ্রহের জন্যে কাজ করে। ওর পরিবর্ত ধাতু হল, তামা। আর পাথর হোল চুনী এবং আরও কয়েকটা পাথর। তেমনি অনন্ত মূলের পরিবর্ত ধাতু হচ্ছে তামা। বিল্ব মূল এবং অনন্ত মূল- এই দুই মূলের বদলে তামা ব্যবহার করা যায়। অনন্ত মূলের রত্ন বা পাথর হল, প্রবাল। মঙ্গল গ্রহের জন্যে এই মূল-রত্ন লাগে।
    সাধুবাবার কথা শেষ হতে হতে পরবর্তী স্টেশন এসে যায়। এই কামরা থেকে তাকে অন্য কামরায় যেতে হবে। বাবলা হাত জড়ো করে সাধুবাবার থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনে নেমে পরের কামরায় চলে যায়।
    কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দিদিমাকে সাধুবাবার সব গল্প শোনায় বাবলা। বলে, “দিদা, এই মূলগুলো কোথায় পাওয়া যায় তুমি জানো? আমি যদি এগুলো জোগাড় করে দিতে পারি তাহলে আমাকে পয়সা দেবে বলেছে সাধুবাবা। আর কথা রাখলে বরাবরের জন্যে আমার কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে এগুলো কিনবে। আমার ব্যবসার আর একটা নতুন ডাল গজাবে তাহলে।”
    নাতির কথায় খুশি হয়ে দিদিমা বলল, “হ্যাঁ রে দাদা। তোর কত চাই বল না। সব আমি জোগাড় করে দেব। তোর কোন চিন্তা নেই। কবে লাগবে, ঠিক তার আগের দিন শুধু তুই আমাকে বলবি। আমি জোগাড় করে সাফ-সুতরো করে রেখে দেব।”
    বুদ্ধিটা দিদিমাই তার কানে ঢুকিয়েছিল। সাধুবাবা যেদিন যেদিন বলে সেদিন ওই দু’ধরণের মূল দেয় বাবলা। সঙ্গে সঙ্গে পয়সাও পেয়ে যায়। দিদিমা বলল, “দাদা, তুই এক কাজ কর, আমি যা মূল জোগাড় করে আনি সাধুবাবা তো সবটা নেয় না। বাকিটা ঘরে পড়ে থেকে থেকে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। যে জিনিসটা মানুষকে দিলে পয়সা পাওয়া যায়, সেটা যদি এ’ভাবে শুকিয়ে নষ্ট হয় তো বড্ড গায়ে লাগে। আর আমি কত কষ্ট করে এগুলো জোগাড় করি। যদি কাজে লাগে তো আনন্দ পাই। তা দাদা, তুই এই শাকের খোড়াতেই এই মূলগুলো নিয়ে যা। মানুষকে জানাবি, কলমি শাক ছাড়াও তার কাছে বিল্ব মূল, অনন্ত মূল পাওয়া যায়। আর এই মূলের গুনাগুন যা সাধুবাবার কাছ থেকে জেনেছিস, সেসবই মানুষকে বোঝাবি। দেখবি, কেউ না কেউ তা কিনে নেবে। সাধুবাবা যা দাম দেয় তার থেকে বেশি দামেই তুই বিক্রী করতে পারবি।” বাবলা, দিদিমার কথা শুনতেই হাতনাতে তার ফল পেয়ে যায়। প্রথম দিনেই যা মূল নিয়ে গেছিল সবটাই বিকিয়ে যায়। খুশিতে টগবগ করে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আমার কি ভাল দিদা! তোমার কথা শুনলে আমার কোন অভাব হবে না।” আদরের নাতির কথায় ভাবে গদগদ হয়ে দিদিমা বলে, “আরে দাদা, ছাড় আমাকে। এভাবে জাপটে থাকলে আমার যে দম বন্ধ হয়ে যাবে। বুড়ো মানুষ, তোর মত যৌবনের ওই দম আর আমার আছে নাকি!”
    একজন খরিদ্দার চার আঁটি কলমি শাক নিয়ে তারপর বাবলার খোড়াতে গাছের মূল দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে ক্ষিরিকা মূল আর বৃদ্ধদ্দারককের মূল আছে? নেই তো মনে হচ্ছে। দু’রকমের মূল আছে। কাল ওই দুটো মূল আমাকে এনে দিতে পারবে? খুব দরকার। পয়সার জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।” হকারি করতে করতে বাবলা এখন একটু চটপটে হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “এই দুটো মূল কেন চাইছেন? কেউ আপনাকে জোগাড় করতে বলেছে না কি?”
    -হ্যাঁ, আমার জন্যে জ্যোতিষী, মুক্তা, মুনস্টোন বা এগেট এই তিনটে পাথরের মধ্যে যেকোন একটা পরতে বলেছে। আমার হাতের রেখায় চন্দ্র দুর্বল। ওটা কাটাতে গেলে এগুলোর একটা পরতে হবে। তা স্টোন কেনার পয়সা নেই। তখন রূপা-ধাতু পরতে বলে। শুনেছি, পাথর ধাতুর বদলে গাছের শেকড় বা ডালেও কাজ হয়। সেকথা বলতে জ্যোতিষী আমার জন্যে এই ক্ষিরিকা মূল আর আমার বৌয়ের জন্যে বৃদ্ধদ্দারককের মূল মাদুলিতে করে পরতে বলেছে। বৌয়ের আবার বুধ গ্রহের দোষ পড়েছে।
    -ঠিক আছে। আপনি কাল নয় পরশু পেয়ে যাবেন। তবে আমার কাছে যা মূল আছে তার থেকে একটু বেশি পয়সা লাগবে। আপনি যে মূলগুলোর কথা বললেন ওগুলো হাতের কাছে পাওয়া যায় না। আমাকেও খরচা করে জোগাড় করতে হবে, তাই।
    বাবলার খোড়ার ঝাঁকায় এখন কলমি শাকের সাথে সাথে বিল্ব মূল, ক্ষিরিকা মূল, অনন্ত মূল আর বৃদ্ধদ্দারককের মূল থাকে।
    সাধুবাবার চোখে একদিন তা পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাবলাকে বলে, “তুমি তাহলে এখন এই শাকের সাথে সাথে গাছের মূল-টুলও বিক্রী করছো? বাঃ ভালোই হল। আমার দরকারে তোমার কাছ থেকে নিতে পারব।” তারপর খানিক চুপ থেকে আবার বলল,“খোকা, তুমি এক কাজ করতে পারো তো… সব গ্রহের মূল তো তুমি তোমার ঝাঁকায় রাখতে পারো। এগুলো যখন জোগাড় করতে পারছো, তাহলে অন্যগুলোও পারবে। যেমন বৃহস্পতির জন্যে বামনহাটির মূল বা ব্রহ্মজৈষ্ঠীর মূল। এর পরিবর্ত ধাতু হোল, সোনা আর রত্ন হোল পোখরাজ বা হলুদ টোপাজ। শুক্রর জন্যে রামবাসকের মূল। ধাতু, প্লাটিনাম, রত্ন, হীরা, জারকোন বা ওপাল। শনিদেবের জন্যে শ্বেতবেড়ালার মূল। ধাতু, লোহা। রত্ন, নীলা, এমিথিস্ট, নীল টোপাজ বা তানজানাইট। সব শেষে রাহুর জন্যে শ্বেত চন্দনের মূল। ধাতু, লোহা বা স্টীল। রত্ন, গোমেদ। আর কেতুর জন্যে অশ্বগন্ধার মূল। ধাতু, স্টীল আর রত্ন, ক্যাটস্ আই বা টাইগার আই। আসলে, আগেও বলেছি তোমাকে যে ধাতু বা রত্ন এত দামি যে স্বল্প সামর্থের আমজনতা তার খরচা কুলিয়ে উঠতে পারে না। তখন আমরা মানুষকে মূলের কথা বলে থাকি।”
    বাবলা সাধুবাবাকে বলল, “আপনার হাত দেখার চেম্বার কোথায় সাধুবাবা? এই মূলগুলো যোগাড় করে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে হবে তো। এত জিনিস জোগাড় করে আপনার সঙ্গে কবে দেখা হবে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকলে তো সব নষ্ট হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম। এ’কথা বললাম বলে আমাকে ভুল বুঝবেন না সাধুবাবা।”
    -আরে বাবা না না। তুমি তো ঠিক কথাই বলেছো। আমি বলার আগেই তুমি আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলে। আমি নিজেই বলতাম, আমার ওখানে এগুলো পৌঁছে দেবার জন্যে। না বাবা, আমার কোন চেম্বার নেই। বহরমপুরের মন্দির রোডের তারা-মা মন্দিরের আমি সেবাইত। ওখানেই আমি ভক্তদের কল্যাণে হাতের রেখা বিচার করে মূল-পাথর দিই। কোষ্ঠী বিচার করি। ওখানে ‘শাস্ত্রীবাবার তারা-মা মন্দির’ কোথায় খোঁজ করলে ভক্তরা আমার মন্দিরে তোমাকে পৌঁছে দেবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। পথে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে যাকে দেখতে পাবে তাকেই বলবে। সেই তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর যেদিন যাবে সেদিন ওখানেই প্রসাদ পেয়ে যাবে। খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না।” বেশ জাগ্রত ঢঙে সাধুবাবা বলল।
    সময় যত এগিয়েছে বাবলা তার ব্যবসা তত উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে নিয়ে চলেছে। তার বিপদের বন্ধু সুবোধের থেকেও এখন সে ভাল আয় করতে পারছে। কলমি শাকের চেয়ে এই শেকড়-জড়িবুটি বিক্রীতে তার আয় অনেকটা বেড়ে গেছে। কলমি শাকের কারবারে এখন তার যেন মন কম টানছে। কিন্তু এই শাকের কারবারই তো বন্ধু, সুবোধের মত পথপ্রদর্শক। তাই ছেড়ে দিতেও মন জবরদস্ত সায় দেয় না। ট্রেনের ডেইলী প্যাসেঞ্জারর্স মহলে সে ‘শাক হকার’ বলে পরিচিত হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে ইদানিং শাক কম করে আনে। দিদিমাকে সে কত খাটাবে। এদিকে শাক তুলবে আবার শেকড় জড়িবুটি জোগাড় করবে। বুড়ো মানুষটা যেন আর পারছে না। দিদার এই হাড়ভাঙা খাটনি দেখে মাঝে মাঝে তার মনটা কেমন দমে যায়। হঠাৎ যদি এই মানুষটার ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায় তো সে অথৈ জলে পড়ে যাবে। এই মানুষটাকে তাই সে ‘মুলো-বাড়ি করতে চায় না। বেগুন-বাড়ি’ করে রাখতে চায়। মুলো চাষের বাগানে যখন মুলো উপযুক্ত হয়ে যায় তখন সব মুলোকে চাটি সমেত উপড়ে নিতে হয়। নাহলে বুড়ো হয়ে খাবার অযোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু বেগুন বাগানের বেগুন বহুদিন ফল দিয়ে যায়। চাষী তাই বেগুন বাগানকে খুব যত্ন-পরিচর্যায় রাখে। এই বেগুন বাগানের মত যত্নে সে তার দিদাকে রাখতে চায়। সেইজন্যে ইদানিং যেসব মূল-জড়িবুটি অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়, সেগুলো দিদাকে আনতে বারণ করেছে বাবলা। মালদার টাউন মার্কেটে জড়িবুটির একটা দোকানের সে সন্ধান পেয়েছে। সেই দোকানদারকে সে অর্ডার দিয়ে আনায়। তাতে একটু বেশি তার খরচ হয়ে যায় ঠিক। লাভ ভাগাভাগি হয়ে যায়। দিদার বেলায় যেটা হত না। কিন্তু সব সময় লাভের লোভে জড়িয়ে পড়লে চলবে কেন।
    শেকড় জড়িবুটির যোগান দিতে দিতে বহরমপুরের তারা-মা মন্দিরের সাধুবাবার সঙ্গে বাবলার ভালই জানাশোনা হয়ে গেছে। একদিন সাধুবাবা বলল, “বাবলা, এতদিন তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় কিন্তু এখনও তোমার বাড়িটা কোথায় জানা হল না। সবসময় তো তোমার সঙ্গে আমার ট্রেনেই যোগাযোগ হয়। যেন এই ট্রেনই তোমার বাড়ি-ঘর। কিন্তু তা তো নয়। এতদিন আমার জিজ্ঞেসই করা হয়নি। এটা ঠিক হয়নি। আসলে কি জানো তো, ট্রেনে বাসে নিত্যদিন কত মানুষের সঙ্গে আলাপ, কথাবার্তা হয়। তাই বলে সঙ্গে সঙ্গে তার খোলের খবর জানতে চাওয়াটাও সবাই ঠিকভাবে নেয় না। পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে তবেই এসব সমীচিন বলে মনে হয়।” সাধুবাবার কথায় ইতস্তত না করেই বাবলা বলল, “আমার বাড়ি মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায়। আমি আমার দিদার সঙ্গে থাকি। দাদু মারা গেছে অনেক আগে। দাদু-দিদাই আমাকে মানুষ করেছে। এখন আমার দিদাই আমার জীবনের অবলম্বন। আমি যে এতটা কাজ করতে পারছি, তার পেছনে সবটাই আমার দিদার অবদান। নাহলে আমি পারতামই না। সবটাই দিদা সংগ্রহ করে। আমি শুধু গলাবাজি করে ট্রেনে বিক্রী করি।”
    -হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায়? ওখানে সবই তো চর্মকার-রুইদাসদের বাস! তুমি তাহলে রুইদাস সম্প্রদায়ের? অবাক দৃষ্টিতে সাধুবাবা জিজ্ঞেস করল!
    -হ্যাঁ, সাধুবাবা। আমরা জাতিতে চর্মকার-মুচি। আমাদের আসল বাড়ি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা থানার বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়ায়। আমার বাবা-মা ওখানে থাকে। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন না হওয়ায় একদম ছোট্ট বেলায় দাদু মানুষ করবে বলে আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে। সেই থেকে আমি এখানে। আগে তো ওখানে যেতাম না। দাদু মারা যাবার পর এখন হাতে কাজ কম থাকলে মাঝে মাঝে আমি ফলতায় যাই। আবার চলে আসি। একা দিদাকে ফেলে বাইরে কোথাও বেশিদিন থাকতে পারি না। মন কেমন করে।
    ওরা জাতিতে চর্মকার জানতে পেরে বাবলার প্রতি আরও আগ্রহ বেড়ে গেল সাধুবাবার। বহুদিন ধরে যে জিনিসটার জন্যে প্রতি পদে পদে বিশেষ কয়েকজন জ্যোতিষীর গাম্ভীর্যের কাছে অবনত হতে হচ্ছে এবার বোধ হয় সেই গ্লানি থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারবে। কেননা এই জিনিসটা এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে হাতেগোনা কয়েকজন জ্যোতিষী তাকে হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছে। আর নিজেদের আধিপত্য জারি রাখতে এই কয়েকজন কিছুতেই জিনিসটা কোথা থেকে জোগাড় করল তার ঠিক-ঠিকানা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সংগ্রহে রেখেছে। তবে সাধুবাবা জানতে পেরেছে যে এটা একমাত্র চর্মকাররাই সংগ্রহ করতে সক্ষম। রুইদাস-চর্মকাররাই একমাত্র ভাগাড়ে গরুর চামড়া সংগ্রহ করতে যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই জানে না যে গরুর পেটে এমন একটা দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্লভ দ্রব্য পাওয়া যায়। ওই দু-একজনই নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এতটাই গোপনে জিনিসটা সংগ্রহ করে যে তাদের জাতভাইরাও এব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছে। সেই সূত্রে সাধুবাবা বহুবার ওই মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজনপাড়ায় গিয়েছে। কিন্তু ওখানকার কোন চর্মকার তাকে শঙ্কামুক্ত করতে পারেনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া কোন চর্মকারই এই জিনিসটার বিষয়ে সম্যক অবগত নয়! বলে,“সে কি জিনিস আমাদের জানা নেই সাধুবাবা। আপনি মনে হয় ভুল করে আমাদের কাছে এসেছেন। কেউ ভুলভাল কিছু বলেছে আর সেই কথা শুনে আপনি কষ্ট করে আমাদের এখানে ছুটে এসেছেন।” ওদের কথায় কিন্তু সাধুবাবা বিন্দুমাত্র হতাশ হয় নি। খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই দুর্লভ ব্যক্তি যে এর হালহকিকত জানাতে পারে। এই যে মাঝে মাঝেই বহরমপুর থেকে মালদার এদিকে ছুটে আসে, তা একমাত্র এরই উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই দুর্লভ ব্যক্তি যে অজান্তেই তার কাছে ধরা দিয়ে ফেলেছে। বাবলা ছেলেটাকে সে আর কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। এই ছেলেটা কিচ্ছু না জেনেও যেভাবে শেকড় জড়িবুটির কারবারের গোটা ব্যাপারটই স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজের করায়ত্বের মধ্যে এনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তেমনি এই দুর্লভ জিনিসটাও সে চেষ্টা করলে সংগ্রহ করতে পারবে। সেই বিশ্বাস এই ছেলেটার উপর তার আছে। ছেলেটা তার যোগ্যতা দিয়ে বিশ্বাসটা দিয়ে অর্জন করাতে পেরেছে।
    যেহেতু এখানকার রুইদাসরা এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তাই তাদের কাছে ব্যাপারটা ভাঙতে চাইল না সাধুবাবা। কেননা এরা কেউই তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে হল না। তাছাড়া চেনাজানা না থাকলে এমন অতি গোপনীয় ব্যাপারগুলো জানানোও উচিত নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই বাবলা ছেলেটাকে এই গোপন তথ্য জানানো যেতে পারে। সেদিন বাবলা সাধুবাবার কাছে অর্ডারমত জড়িবুটি, শেকড় ডেলিভারী দিতে এলে বলল, “বাবলা, আজ তোমার এখন বাড়ি যাওয়া যাবে না। মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করে বিশ্রাম নাও। তোমার সাথে অনেক জরুরী কথা আছে আমার। আমি মন্দিরের কাজ সেরে হাল্কা হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি তোমার কাছে।”
    হঠাৎ সাধুবাবা এমন কথা বলায় বিস্মিত হয় বাবলা! সাধুবাবা এমন কথা তাকে কোনদিন বলে না তো ! তার সঙ্গে কি এমন দরকার থাকতে পারে সাধুবাবার? এদের সব কতরকম কাজ কারবার থাকে। কোন আজেবাজে কাজে তাকে জড়িয়ে দেবে না তো? এককাঁড়ি প্রশ্ন মনের মধ্যে প্রসব করে টানটান হয়ে বাবলা অপেক্ষা করছে সাধুবাবার জন্যে। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছে। তেমন কিছু বললে, যেটা তার পক্ষে ভাল হবে না বলে মনে হলে আর কোনদিন এই সাধুবাবার সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখবে না। দরকার নেই তার অত পয়সার লোভ করে। তাতে বরং তার কলমি শাক বেচে দিন কাটিয়ে দেওয়াটা অনেক শান্তির।
    মনের মধ্যে এমন সাতপাঁচ জাবর কাটতে কাটতে দেখে সাধুবাবার তার কাছে আসছে। একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে সাধুবাবা তার সামনে এসে বসলো। বসার আগে ঘরের দরজার ছিটকিনিটা আটকে দিতে চমকে উঠেছিল বাবলা ! সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে নিজেকে সামলে নিল।
    বাবলার সামনে নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে সাধুবাবা বলল, “বাবলা, তোমাকে কয়েকটা গোপন কথা জানাতে চাই। তার আগে তোমাকে তারা মায়ের পা ছুঁয়ে বলতে হবে, এই খবর তুমি আর দ্বিতীয় কাউকে জানাবে না। যদি জানাও তো মা তোমার বহুৎ অনিষ্ট করে দেবে।” বলে সাধুবাবা নামাবলীর ভেতর থেকে তারা মায়ের ছবিটা বার করে বাবলার সামনে ধরল।
    সাধুবাবার কথায় বাবলা বুঝল তার খারাপ কিছু হবে এমন কথা সাধুবাবা তাকে বলতে আসেনি। নিশ্চয় এমন কোন গোপন কথা আছে যেটা বিশ্বাস করে সাধুবাবা তাকেই কেবল বলতে চাইছে। তাই মায়ের পায়ে হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নিতে চাইছে।
    মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সাধুবাবা যা যা করতে বলল বাবলা তাই করে সাধুবাবার মুখের দিকে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুড়ে তাকিয়ে রইল। বাবলার উপর সন্তুষ্ট হয়ে সাধুবাবা বলল,“তুমিই উপযুক্ত ছেলে যে এই দুরুহ কাজটা নিরাপদে করতে পারবে। যদি তুমি তাতে সফল হও তাহলে তোমার মাধ্যমে আমার মন্দিরের যেমন শ্রীবৃদ্ধি হবে, সাথে সাথে তোমার জীবনের উন্নতির একটা নতুন দিক খুলে যাবে। আর্থিকভাবে তুমি অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে। তার জন্যে এই কাজটাকে তোমার ধ্যানজ্ঞান করে নিতে হবে। আর আমার আশীর্বাদ রইল। তুমি সফল হবে।”
    তার সম্বন্ধে এত উচ্চ প্রশংসা করায় সাধুবাবার প্রতি অন্য এক আন্তরিক আনুগত্য মনের মধ্যে খেলে বেড়াতে লাগল বাবলার। তার আর্থিক উন্নতির আশ্বাস দিচ্ছে সাধুবাবা ! তাহলে খারাপ কিছু কাজ সাধুবাবা তাকে দিয়ে করাতে পারে। এই চিন্তা যে প্রথমে করছিল সেটা ভুল ভাবনা ছিল তার। সেই বিশ্বাস মনে পোষণ করে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বাবলা বলল,“কি কাজটা আমাকে করতে হবে বলবেন সাধুবাবা? আপনার কোন কাজ তো আমি এতদিন পর্যন্ত এড়িয়ে যাইনি। এখনও যাব না। যেমন যেমনটি বলবেন ঠিক সেই কাজটাই আমি করব। আপনি যেমন আমাকে বিশ্বাস করেছেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আমি রাখার চেষ্টা করব। অন্যথা হবে না।”
    বাবলার প্রতিশ্রুতিতে তৃপ্ত হয় সাধুবাবা। মনে ভাবে, এবার কথাটা ছেলেটাকে বলা যেতে পারে। তারপর নিজের ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা কাঁচের বয়াম বার করল। বাবলা দেখতে পাচ্ছে, বয়ামটার ভেতর পীত বর্ণের থেবড়ানো গোলাকার একটা রঙিন পদার্থ। এই জিনিসটাকে নিয়ে সাধুবাবার এত আগ্রহ? কি এটা? কি কাজে লাগে! এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন তার মনের ভেতর তালগোল পাকাতে থাকে? বিষ্ময় এবং যুগপৎ মুচকি হেসে সাধুবাবা জিনিসটা বয়াম থেকে বার করে হাতের তালুতে নিয়ে বাবলার সামনে ধরল! বাবলাও বিস্ময়াবনত হয়ে সেটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,“এটা কি জিনিস সাধুবাবা? এই প্রথম আমি এমন জিনিসটা দেখছি। মনে হচ্ছে তো এটা দুস্প্রাপ্য কোন বস্তু! এটার সম্বন্ধে কি আমাকে এত কথা বললেন?
    -হ্যাঁ, এটাকে নিয়েই এত কথা! আর এটার জন্যে তুমিই আমার তুরুপের তাস! এই রঙিন দুর্লভ দ্রব্যটার নাম ‘গোরোচনা!’ বহুমুখী এর কার্যক্ষমতা। যারা এর গুণের পরিচয় জানে তাদের কাছে এই বিস্ময় বস্তুটা একাধারে যেমন বহুমূল্য তেমনই আকর্ষণীয়! আর যারা জানে না, তাদের কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। এই যেমন তোমার কাছে। এই দ্রব্যটার সম্বন্ধে তুমি কিছুই জানো না। এখন যদি তোমার হাতে এটা তুলে দিই তুমি অকামের বস্তু বিবেচনায় অবহেলায় কোথাও নির্বাসিত করবে একে। তোমার মতো সব মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। সবেমাত্র এর সঙ্গে তুমি পরিচিত হতে চলেছ। এখনো সম্পূর্ণ কিছু জানতে পারোনি। পারলে একে তুমি স্বর্ণমুদ্রার থেকেও আদরে গ্রহণ করবে।” যারপরনাই কৌতূহলোদ্দীপক চিত্তে সাধুবাবা বলল।
    ঠিক ততটাই উৎকন্ঠার সঙ্গে এবার বাবলা বলল, “আপনি একদম সঠিক কথা বলেছেন সাধুবাবা। মনে হচ্ছে তো এটা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় ঠিক ততটাই কাজের জিনিস হবে। আপনি সেটা না জানালে আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব নয়। সবটাই আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। যদি জানান তাহলে জানব এবং আপনার কথা মত আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি কাজ করতে পারব, এতটুকু ভরসা আপনাকে আমি দিতে পারি। গোরোচনার প্রতি ভেতরে ভেতরে তীব্র আগ্রহকে বাইরে প্রকাশ না করে হাল্কা ভাবনায় বাবলা বলল।”
    বাবলার জিনিসটার প্রতি আগ্রহ ঠিক কত, সেটা এতক্ষণ ধরে পরখ করার জন্যে এতটা কথা চালাচালি করল সাধুবাবা। বুঝলো, না, ছেলেটাকে নির্বাচন করে সে ভুল করেনি। এর দ্বারাই তার কার্যসিদ্ধি হবে। তবে ছেলেটাকেও সে ঠকাবে না। ওর উপযুক্ত পাওনা সে দিতে কুন্ঠা করবে না। ওকে বঞ্চিত করা মানে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়ে যাবে। দিন যত গড়াবে ছেলেটার জিনিসটার প্রতি দখল বাড়বে। একবার যদি বুঝতে পারে যে তাকে সাধুবাবা ঠকাচ্ছে তখন ও আর তার কাছে পড়ে থাকবে না। অন্য ঠিকানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে এবং সন্ধান পেয়েও যাবে। তার মত কত সাধুবাবা আছে, এইরকম ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যোগাযোগে যুক্ত হতে বেশি কসরত করতে হবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধুবাবা বলল, “পাথরসম শক্ত এই গোরোচনা বস্তুটা কতরকম যে কাজে লাগে তা এককথায় এবং একবারে তোমাকে বলে শেষ করতে পারব না। সময় সময় তুমি আমার কাছ থেকে সবই জানতে পারবে। আচ্ছা, তোমার জানা আছে কি যে যেকোন পাথর শোধন করে তবে মানুষকে পরতে বলে জ্যোতিষীরা? সংগ্রহ করে আনা পাথর আংটিতে লাগিয়ে সরাসরি মানুষের আঙুলে পরিয়ে দিলে কাজ হয় না। তাকে শোধন অর্থাৎ বিশুদ্ধ করতে হয়। এক এক পাথরের শোধন প্রক্রিয়া আবার ভিন্নভাবে করতে হয়। আমরা যে গোমেদ পাথরের কথা বলি। শেকড়, জড়িবুটি নিয়ে যখন নাড়াঘাটা করছো, গোমেদ বা অন্য সব পাথরের নাম তোমার জানা এটা বলা যায়। সেই গোমেদ পাথর শোধনের জন্যে এই গোরোচনা মিশ্রিত জল প্রয়োজন হয়। এটা ছাড়া এই পাথর শুদ্ধ হয় না। আর বলেছি তো তোমাকে, গোমেদ কোন গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া গোরোচনার বহুগুণের আর একটা গুন তোমাকে জানাচ্ছি। এখন আমার হাতে আর তেমন সময় নেই। তোমার সঙ্গে আরও কথা সারা আমার প্রয়োজন। শুধু গুনাগুণ বলতে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে। আমাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী নানারকমের টনিকের প্রয়োজন হয়। এই গোরোচনা অন্যতম এক টনিক এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধেরও কাজ করে। তাছাড়া আমরা যে তিলক কাটি না? এই জিনিসটা ‘খল-নোড়া’ দিয়ে চূর্ণ করে কপালে চন্দনের তিলক কাটার মত রঙিন তিলক কাটার কাজে লাগে।”
    খানিক চুপ থেকে সুধাবাবা আবার বলল, “এবার যে কথাটা তোমাকে আমার বলা। সেটা হল, তোমরা তো জাতিতে চর্মকার রুইদাস। ভাগাড়ে গরু পড়লে তোমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ সেই গরুর চামড়া আহরণ করে। ওই মানুষজনের, বলা যায় প্রায় সব্বাই ভাগাভাগি করে সেই চামড়া নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওই গরুর পেটে যে এই দুর্লভ গোরোচনা বস্তুটা থাকে তা তাদের অজানা। তোমাদের মধ্যে বিরল দু-একজন আছে যারা এর হালহকিকত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তুমি এখন সেই বিরল মানুষদের মধ্যে একজন হয়ে গেলে। এই মানুষরা কিন্তু ভাগাড়ে গিয়ে ওই চামড়ার জন্যে ঝুলপেটাপেটি করে না। চামড়া শিকারীরা চামড়া নিয়ে চলে গেলে চুপিসাড়ে তারপর সে নিজের কাজ সারার জন্যে লেগে পড়ে। তবে সবসময় যে সে সফল হয় তা কিন্তু নয়। সব গরুর মধ্যে জিনিসটা থাকে না। কপালে থাকলে তবে তার দেখা মেলে। মিললে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। এক একটা গুলির দাম হাজার হাজার টাকা! এবার একটা গরুর মধ্যে অনেকগুলো করে গোরোচনা থাকে। এখানে একটাই হতাশার দিক হল, তোমাকে অনবরত এ-গরু সে-গরুর মধ্যে খুঁজে বেড়াতে হবে। ওই অন্ধকারে হাঁচানোর মত আর কি।”
    সাধুবাবার কথায় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল বাবলা। কিন্তু তার পরে পরেই আবার মনটা দমে গেল! দমে গেল এইজন্যে যে তাদের এই মালদা এলাকায় গরুর কোন ভাগাড় প্রায় নেই বললেই চলে। মুসলিম আধিক্যের এলাকায় কোন গরু বৃদ্ধ হয়ে মরার আগেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুসলমানদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বা মুসলমানরা জানতে পারলে নিজেরাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিনে নিয়ে চলে যায়। ফলে এলাকা ভাগাড়শূন্য হয়ে গেছে বলা যায়। তবু তাকে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে পড়তে হবে। তার জন্যে শুধু মালদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে তাকে আরও দূরে বহু দূরে যেতে হলে সে যাবে। ওর চোখমুখে ফুটে উঠল একটা কিছু করার অভিব্যক্তি! সাধুবাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল,“বুঝতে পারছি এই কাজ নিতান্ত মামুলি কাজ নয়। প্রচুর মেহনত করতে হবে আমাকে। তার পরেও আমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব কি না জানি না। তাই আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আমি যাতে এই কাজে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারি।”
    দিদিমাকে হাজার-দুই টাকা দিয়ে বাবলা বলল,“তুমি সাবধানে থাকবে দিদা। আমি মাসখানেক বাড়ি থাকব না। বিশেষ জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি। দরকার হলে আরও দু-তিন মাস হয়ে যেতে পারে আমার ফিরতে ফিরতে। মামা-মামী কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবে, কিছু বলে যায়নি। বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে বলে বাবলা চলে গেছে। তা আমাকে নিয়ে তোদের চিন্তা করতে হবে না। খেতে পরতেও দিতে হবে না। বাবলা সব ব্যবস্থা করে গেছে। ভাল কাজেই যাচ্ছি দিদা। তুমি চিন্তা করবে না। কাজ সারা হয়ে গেলে সময়মত ঠিক ফিরে আসব।”
    মালদা থেকে ট্রেনে চড়ে একদম ভোরে ধূপগুড়ি স্টেশনে নামল বাবলা। এখানেই এই ট্রেনটার যাত্রার অন্তিম স্টেশন। এইসব এলাকা সম্বন্ধে ওর কিছুই জানা নেই। ট্রেন থেকে নামার আগে বাথরুমের কাজটা সেরে পরিষ্কার হয়ে নেয়। নতুন জায়গা, কোথায় কি আছে তার জানা নেই। স্টেশনে এদিক ওদিকে ঘুরেঘারে কিছুটা সময় কাটিয়ে দেয়। সূর্যের আলো একটু ভাল করে ফুটে উঠতে গোটা স্টেশন চত্বর জমজমিয়ে উঠতে লাগল। খিদে পেয়েছে। এবার সকালের টিফিনটা সেরে নেবার জন্যে একটা স্টলের সামনে বেঞ্চে এসে বসল। দোকানদারকে কচুরি-আলুদমের অর্ডার করল। চারটে কচুরি খেয়েও যেন খিদেকে বশে আনতে পারলো না। আরও চারটের অর্ডার করে এবার আলুরদমের বদলে চারটে ল্যাংচা দিতে বলল। তারপর পরপর দু’কাপ চা খেল। এবার যেন পেটের আন্দোলনকে থামানো গেল। বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পয়সা দেবার জন্যে পকেটে হাত ঢোকালো। আবার কি মনে করে হাত বার করে বলল, “ডাবল ডিমের ওমলেট দাও তো দাদা।”
    ওমলেটের প্লেটটা বাবলার হাতে ধরিয়ে প্রশ্নমুখো হয়ে বাবলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল দোকানদারটা। বাবলা বুঝতে পারে সেটা। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কিছু বলবে আমাকে দাদা?”
    -আসলে কি জানো তো ভাই, তোমার মত খরিদ্দার আমি এতদিন কারবার করছি, একটাও পাইনি। একসঙ্গে এত খাবার কেউ অর্ডার করে না। তোমার খুব খিদে পেয়েছিল বুঝি? হাসি হাসি মুখে দোকানদারটা জিজ্ঞেস করল বাবালাকে।
    সাধারণভাবে বাবলাও কোনদিন একসঙ্গে ‘আক্যুটের’ মত এত খাবার খায় না। নতুন এলাকা। কোথায় কি আছে কিছুই জানে না। সেটা জানতে গেলে এখানকার কারোর সঙ্গে তো তাকে আলাপ করতেই হবে। তা আচমকা কারোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ পাত্তা দেবে না। উল্টে তাকে সন্দেহ করে বসলে উল্টো বিপত্তি হতে পারে। তাই দোকানদারের তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এমন অস্বাভাবিক আচরণ সে পরিকল্পনা মতই করেছে। এবার সে অতি সহজেই স্থানীয় এই দোকানদার ছেলেটার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারবে। দোকানদারের হাসি মুখের রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই বাবলা বলল, “হ্যাঁ দাদা। সেই আগের দিন দুপুরে ভাত খেয়েছি। নানান কারণে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি। খুব খিদে পেয়েছিল। তাই।”
    -কোথা থেকে আসছো তুমি? দেখে মনে হচ্ছে তো তুমি এখানকার ছেলে নও। কোথায় যাবে? জায়গাটা যদি না জানা থাকে বলো, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। আমি এখানকারই ছেলে।
    এবার বাবলা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো আশেপাশে কেউ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে কি না ! কেউ নেই দেখে বলল,“তোমার নাম কি দাদা বলবে? আমার নাম বাবলা রুইদাস। মালদার হরিশচন্দ্রপুরে এক গ্রামে আমার বাড়ি।”
    অতশত দিক না চিন্তা করেই সরল মনে দোকানদার বলল,“আমি নিত্যানন্দ বৈরাগী।” ধূপগুড়ির বৈরাগী পাড়ায় আমার বাড়ি। আমাদের গোটা গ্রামেই বৈরগীদের বাস। আমরা সব কৃষ্ণ ভক্ত। এখানকার গৌরাঙ্গ মঠ খুব নামকরা। আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের হিন্দুরা এই মঠে আসে। নাম সংকীর্তনে অংশ নেয়। সকালে গ্রাম পরিক্রমা করে। তা তুমি কোথায় যাবে?”
    এবার বাবলা বুদ্ধি করে বলল,“শুনেছি ধূপগুড়িতে খুব জাগ্রত রাধাকৃষ্ণের গৌরাঙ্গ মঠ আছে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ওই মঠটায় যাবো। তা ধূপগুড়ির ঠিক কোথায় তা আমার জানা ছিল না। এই তোমার কাছে জানলাম দাদা। খুব খুশি হলাম। ওই মঠেই আমি যাবো। যদি আমাকে বলে দাও কেমন করে যাবো।”
    বাবলা বুঝে গেল এলাকাটা পুরোপুরি হিন্দুদের বাস। তার উপর বৈষ্ণবরা গরুর ভীষণ ভক্ত। ভগবতী জ্ঞানে গরুকে ওরা দেখে। কোন অবস্থাতেই ওরা নিতান্ত পয়সার লোভে বৃদ্ধ বা অশক্ত গরুকে মুসলিমদের হাতে সঁপে দেবে না। মারা গেলে এলাকার কোন ভাগাড়েই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবে। কেউ কেউ আবার মৃত গরুকে কবরস্থও করে। তাতে অবশ্য সরকার থেকে জনসাধারণের কাছে আবেদন রাখা হয়েছে যে কোন গরু ছাগল বা ওই জাতীয় কোন জীবজন্তুকে কবর না দেওয়ার জন্যে। এর ফলে সমাজে শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিগত বছরগুলোতে আমরা যে শকুন দেখতে পেতাম, আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না। তাদের প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবেই এই দশা বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত। তাতে অবশ্য অনেকটা কাজ হয়েছে। একদম গোঁড়া ভক্তরা ছাড়া অন্য উদার মানসিকতার মানুষরা গরুকে কবর দেয় না।
    স্টেশনের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়েছে বাবলা। বেশ কয়েকদিন স্টেশন চত্বরের এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আর নিত্যানন্দর চা-টিফিন দোকানে এসে সময় কাটায়। অবশ্যই শুকনো মুখে নয়। নিয়মিতভাবে টিফিন করে চা খায় ওর দোকানে। তাতে নিত্যানন্দও বেশ খুশি। অগের থেকে অনেক খোলামেলা ভাবেই সে এখন বাবলার সঙ্গে কথাবার্তা বলে। বলা যেতে পারে বন্ধুর মত হয়ে গেছে। একদিন নিত্যানন্দ বলল, “বাবলা ভাই, সামনের সোমবার আমার দোকান বন্ধ থাকবে। বাড়িতে পুজো আছে। তুমি চলো আমার বাড়ি। ওই দিনটা তুমি আমাদের বাড়ি প্রসাদ পাবে এবং রাত্রের ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান দেখে পরদিন ফিরে আসবে। অবশ্য ভাববে না যে পরদিন আমি তোমাকে খাওয়াতে পারব না বলে চলে আসতে বলছি। ইচ্ছা করলে তুমি থাকতে পারো আমাদের বাড়ি। আমার বাড়ি মনে করে ‘অতিথি দেব ভব।’ মা তোমাকে হয়তো আসতেই দেবে না। দেখবে!”
    নিত্যানন্দদার কথায় রাজি হয়ে যায় বাবলা। ও তো এটাই চাইছিল। এবং একদিন ওখানে থাকবেও। নিজের কাজ সারতে গেলে এলাকাটা তাকে দেখতেই হবে। বিশেষ করে কোথায় কোথায় ভাগাড় আছে তা তো তার জানা অত্যন্ত জরুরী।
    তিন মাস ধুপগুড়ি স্টেশন আর বৈরাগী পাড়া ছিল বাবলার কর্মক্ষেত্র। এলাকায় খান তিনেক ভাগাড়ের সন্ধান করতে পেরেছে। পাঁচ পাঁচটা গরু এই তিন ভাগাড়ে পেয়েছে সে। আর ভাগাড় আছে মানেই চর্মকার থাকবে। তবে তারা কিন্তু তাদের মত বাঙালী চর্মকার নয়। অবাঙালী এরা। কয়েকজন আবার মুসলিম চর্মকার। শকুনের নিশানে তার বুঝতে অসুবিধা হয় না ভাগাড়ে গরু পড়ার সংবাদ পেতে। গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়ে যায়। দূর থেকে দেখে লোকগুলো গরুর চামড়া কেটে নিয়ে চলে গেলে বাবলা তার বিশেষ কাজে নেমে পড়ে। পাঁচটা গরুর পেট কেটে দুটোতে সে সফল হয়। আর আনন্দে ছটফট করতে থাকে কতক্ষণে এগুলো নিয়ে সে সাধুবাবার কাছে হাজির হবে! বাড়ি ফেরার দিন বন্ধু নিত্যানন্দকে বলে যায় আবার সে আসবে। খুশি নিত্যানন্দ বন্ধুকে বিদায় জানায়। সেদিন আর ও বন্ধুর কাছ থেকে কোন টিফিনের দাম নেয় নি।
    গোরোচনার পাথরগুলো বাবলার কাছ থেকে পেয়ে খুশিতে টগবগ করতে থাকে সাধুবাবা। বলে,“কি জানিস তো বাবলা, মা আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিল, এই বাবলা ছেলেটাই পারবে তোর অভিষ্টকে সিদ্ধ করতে। তুই ওকে ভরসা করতে পারিস। ওকেই তুই সবকিছু খুলে বল। ছেলেটা তোর সঙ্গে বেইমানী করবে না। তা মায়ের আশীর্বাদ কি কখনো বিফলে যায়! বলে সাধুবাবা তার শোবার ঘরে দ্রুত চলে যায়।” অল্প সময় পরেই ফিরে এসে বাবলার হাতে একটা টাকার বান্ডিল দিয়ে বলে,“এতে দশ হাজার টাকা আছে। কাউকে এই টাকার কথা আর গোরোচনার কথা বলবি না। তুই এই জিনিসটা সংগ্রহের মধ্যেই নিজেকে নিবিষ্ট কর। আর দরকার নেই ওই জড়িবুটি বা কলমি শাকের কারবার করে। আমার সঙ্গে লেগেপড়ে থাক। দেখবি দিনে দিনে তোর ব্যাঙ্কের বই ভারি হয়ে উঠছে।
    একসঙ্গে এতগুলো টাকা বাবলা তার জীবনের এই সময় সীমার মধ্যে দেখেনি। টাকাটা পেয়ে প্রথমে ভেতরে ভেতরে আবেগে কাঁপতে থাকে সে! ভাবে, সে এটা দিবাস্বপ্ন দেখছে না তো! সত্যি সত্যি এই জিনিসটা এত মূল্যবান! সাধুবাবা যদি এককথায় তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দেয় তো এর প্রকৃত দাম তাহলে কত? সাধুবাবা তো আর টাকার দানসত্র খুলে বসেনি। যে এমনি এমনি খুশি হয়ে তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দিল। অবশ্যই সে এর থেকে অনেক অনেক বেশি টাকা আয় করবে। আবার মনকে বোধ দিয়ে ভাবে, যাকগে। যার ধর্ম যার কাছে। তার আর অতি লোভ করে কাজ নেই। না চাইতেই সে যা পেয়েছে তাতেই সে সন্তুষ্ট। তার চোদ্দপুরুষ তো ভাবতে পারে না গরুর শরীরে কতকগুলো নুড়ি পাথরের এত দাম হতে পারে। এই কথাটা একমাত্র সে তার দিদাকে বলবে। দিদাকে কথাটা গোপন রাখতে বললে, মরে গেলেও দিদার মুখ থেকে সে কথাটা বার হবে না। কথা ফেচকাবার মানুষ দিদা নয়। আর তার দিদার মুখ চেয়ে সে ট্রেনে ওই কলমি শাকের ফেরি করা বন্ধ করবে না। সাধুবাবা যতই বলুক। তাতে দিদার মন খারাপ হতে পারে। কত মনপ্রাণ দিয়ে দিদা এগুলো সংগ্রহ করে দেয় নাতির কারবার করার জন্যে।
    তাছাড়া এই কারবার থেকেই তো তার উত্থান। অসময়ের জীবন দিশারী। তাকে ত্যাগ করা মানে অকৃতজ্ঞর মত কাজ করা হয়ে যাবে। শেকড় জড়িবুটির কাজও সে করে যাবে। সবসময় তো আর গোরোচনার খোঁজে তাকে বার হতে হচ্ছে না। যখন বার হবে তখন এই কাজটা বন্ধ তো সে রাখছেই। তিনমাস তো সে কাজ করেনি। তারপর কি, হঠাৎ কারবারটা বন্ধ করে দিলে লোকে অন্যরকম কথা তাকে নিয়ে ভাবতে পারে। ভাল, মন্দ সবরকমের ভাবনা মানুষের বা হকার বন্ধুদের মধ্যে খেলে বেড়াবে। তখন সে একটা সমালোচনার পাত্র হয়ে দাঁড়াবে। সেই তুরুপের তাসটা সে কারোর হাতে তুলে দিতে চায় না।
    গোরোচনার কর্মক্ষমতা নিয়ে যে কথাটা প্রথম দিন বলতে বলতে সাধু বাবা কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে, পরে বলবে বলে অসম্পূর্ণ রেখে গেল সেটা তাকে জানতেই হবে। ওই যে, বলছিল তান্ত্রিক বশিকরণ করা। অবাধ্য স্ত্রী বা প্রেমিকাকে বশীভূত করা নাকি এটার মাধ্যমে সম্ভব! এ’ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হবে। সাধুবাবা কি সেই বিদ্যা তাকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করবে? মনে হয় তো না। ওরা কথা দিলে কথা রাখার চেষ্টা করে। আর ‘না’ করলে?

    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৮)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

     

    [ সাঁইত্রিশ ]

    চারজন ছাত্রীকে টিউশনি পড়াতো অলোকাদি। বেসিক ট্রেনিং পড়তে যখন চলে যাচ্ছে তখন স্কুল শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়। এবার এই মেয়েদের পড়াশোনার কি হবে? চিন্তায় পড়ে যায় সে। ছাত্রীরা এবং তাদের বাবা মায়েদেরও মাথায় হাত। অন্য যারা টিউশানি পড়ায় তারা কেউ বাড়িতে এসে এই অসময়ে তার বাসি হতে যাওয়া ছাত্রীদের পড়াতে রাজি হবে না। এদের অভিভাবকরা চেষ্টাও যে করেনি তা নয়। কিন্তু রাজি হয়নি কেউ। আর অলোকাদির মত এত কম পয়সায় বাইরের কেউ টিউশনি পড়াবে না। সেইসঙ্গে অলোকাদির মত ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর তো প্রশ্নই নেই। দু’একটা কোচিং সেন্টার অবশ্য নিমরাজি হয়েছিল, তাদের সেন্টারে এসে পড়ার জন্যে। কিন্তু বছরের মাঝপথে কোচিং সেন্টারে পড়ে কোন লাভ নেই। অলোকাদিও তাদের সেই পরামর্শ দিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন যে অলোকাদি কোনভাবে চেষ্টা করলেও বাড়িতে এসে পড়াতে পারবে না। কেননা সারদা মন্দিরে বেসিক ট্রেনিংয়ের গোটা ব্যাপারটাই রেসিডেন্সিয়াল। আর এই ক’টা মেয়ের পড়ানোর জন্যে তো সে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে অলোকাদি তার উৎকন্ঠার কথাটা সনাতনকে জানায়। তারপর বলে, “ভাই, তুই আমার একটা উপকার করবি? একমাত্র তুই পারিস আমার এই মরমে মরার হাত থেকে বাঁচাতে। আগে কথা দে, আমার কথা তুই রাখবি? তাহলে তোকে বলব। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি যে আরও কষ্ট পাবো। তোকে যে আমি আমার আপনজনের চোখে দেখি।”
    -আপনজন কখনো আপনজনকে কষ্ট দিতে পারে দিদি? বলোই না তোমার কথাটা। তারপর দেখো, আমি সেই কথাটা রাখতে পারি কি না।
    -ওই মেয়েগুলোকে তুই পড়াবি? ওদের মধ্যে দু’জন নাইনে পড়ে আর দু’জন টেনে। টেনের দু’জনের জন্যে আমার আরও বেশি চিন্তা। পরের বছর তো ওরা মাধ্যমিক দেবে। কি হল! হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছিস যে? ভাবছিস নাইন টেন ক্লাসের ছাত্রীদের তুই পড়াতে পারবি কি না, তাই তো? আলবাৎ পারবি তুই। পড়াশোনায় তুই অত ভাল। তুই ওদের পড়াতে পারবি না সেটা হতে পারে না। তুই পারবি। সে আস্থা তোর ওপর আমার আছে। হ্যাঁ, একটা চিন্তা তোর হতে পারে, তুই কোনদিন কাউকে টিউশানি পড়াস নি। তাই তার ধরণ-ধাঁচে তুই রপ্ত নোস। কিন্তু সেটা বা হবে কেন। একটু পাল্টা বুদ্ধি চালা না। তুই তো টিউশনি পড়েছিস। এবার তুই পড়াবি। মাস্টারমশাই তোকে যেমন নিয়মে পড়াতো সেটা মনে কর না। বুদ্ধি খাটিয়ে সেই বুদ্ধি এবার তুই মাস্টারমশাই হয়ে প্রয়োগ কর ! তাহলে ওই অনভিজ্ঞতাজনিত ভাবনা থেকে মুক্ত হতে পারবি। আবার বলছি সনাতন, তুই পারবি। সনাতনের উপর গভীর আস্থা রেখে অলোকা বলল।
    সে যাতে মাঝপথে ফেলে যাওয়া তার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে তাই অলোকাদি তাকে এতটা উৎসাহ দিচ্ছে তা সনাতন খুব সহজেই বুঝে নেয়। দিদির ধারণাটা যে একদম অমূলক তাও নয়। চেষ্টা করলে সে পেরে যাবে। সেই বিশ্বাস তার নিজের ওপর আছে। কিন্তু খটকা তো অন্য জায়গায় লেগে যাচ্ছে। সেদিকটা মনে হয় অলোকাদি অত তলিয়ে ভাবে নি। সনাতন প্রস্তাবটা শোনা মাত্রই সেই কথা ভেবে, তার মাথায় তালগোল পাকাতে শুরু করে!
    ভাবনায় ঢুকে গিয়ে সনাতন কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না। বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনছে যেন। সম্বিৎ ফেরে অলোকার কথায়,“কিরে ভাই, একদম চুপ মেরে গেলি যে? আমার কথার কিছু একটা উত্তর দিবি তো, না কি! আমি যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি তোর উত্তরের জন্যে?”
    -দিদি, আমি যে দিকটার কথা ভাবছি, সেটা কিন্তু ওই পড়াশোনার দিকটা নয়। টাকাপয়সার দিকও নয়। টাকাপয়সা তুমি যা নিতে সেটা দিলেও আছি, না দিলেও আছি। পয়সার দরকার আছে ঠিকই। কিন্তু বিদ্যে বেচা আমার চিন্তা ভাবনার একদম বাইরে। তাই এইসব নিয়ে আমার দিক থেকে তোমার উৎকন্ঠার কোন দরকার নেই। যেটা আমার প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন সেটা হল, আমি যাদের পড়াবো তারা তো সব্বাই ছাত্রী। আর আমি ছেলে। মেয়েরা ছেলে মাস্টারের কাছে পড়বে, সেটা তাদের গার্জেনরা মানবে? তুমি মেয়ে বলে, অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের তোমার কাছে পড়তে দিয়েছে। গার্জেনরা হয়তো চাপে পড়ে নিমরাজি হতে পারে। কিন্তু আমাদের পাড়ার মানসিকতা তো তুমি খুব ভাল করে জানো। আমার এই পড়ানোর বিষয়টা আবার শেষ পর্যন্ত আটচালায় উঠবে না তো? আমায় মেয়ে পড়ানোর অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না তো? আর একটা কথা আমার বলার আছে দিদি। আমার হাতে যা সময় আছে, তাতে চার ছাত্রীর বাড়ি চার টাইমে পড়াতে যাওয়া হয়ে উঠবে না। চারজনকে আমি একসঙ্গে পড়াতে পারি। তা সে যেকোন ছাত্রীর বাড়ি হতে পারে। অথবা তাদের কারোর বাড়ি সেই পরিস্থিতি না থাকলে আমাদের বাড়িতে তারা পড়তে আসতে পারে। আমাদের বড় দাবায়, যেখানে আমি এখনো পড়ি, সেখানে চারজন কেন, আটজনের একসাথে পড়তে বসার ব্যবস্থা করা যাবে। এই দিকগুলো একটু ভাববার ব্যাপার আছে দিদি। তুমি কিন্তু ভাববে না, এইসব কথা বলে আমি না-পড়ানোর অজুহাত দেখাচ্ছি। এগুলো তো একদম জ্বলন্ত বাস্তব কথা। একটা ছেলে, মেয়েদের পড়াতে গেলে মনের ভাবনা একটু
    উদার না হলে সবকিছু খাপ খাবে কেমন করে? তুমি আমার কথাগুলো একটু ভাবো দিদি। তারপর তার একটা সমাধান আমাকে বাতলাও। তেমনভাবে আমি এগোব। মনে হয় সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারব, যদি ঠিক ঠিক পদক্ষেপ আমরা নিই।
    এই সনাতন ছেলেটা কেমন বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করল। এত গভীরে গিয়ে ভাবার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। এইটুকু বয়সে সমাজ জীবনের ভাব-ভাবনায় কত যেন পরিণত হয়েছে ছেলেটা। এর যত কাছাকাছি সে আসছে তত যেন অবাক হচ্ছে। ছেলেটা যে কথাগুলো তার সামনে তুলে ধরল,তার কোনটাই উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। অলোকা খানিক চিন্তা করে তারপর বলল,“সনাতন মেয়েরা তোর কাছে পড়বে কি পড়বে না,ওই ব্যাপারটা আমি দেখছি। তিনজন গার্জেন তো আমাকে বলেছিল, অন্য ব্যবস্থা করে দিতে। আর একজন ওসব কিছু বলেনি। আমি প্রত্যেক ছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছি। আর ওই একসাথে চারজনকে পড়ানো যায় কি না সে বিষয়টা নিয়েও ওদের সঙ্গে কথা বলছি। ওরা এখন অসুবিধায় পড়ে গেছে। সম্মানজনক যে কোন প্রস্তাবে ওদের রাজি হয়ে যাওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। হয়তো হয়েও যাবে। মেয়েদের কারোর বাড়িতে যদি সেই সুযোগ না থাকে তো তোর বাড়িতেই পড়াবি। তবে ওই পাড়া, আটচালা- এই ব্যাপারটা তো আমার এক্তিয়ারের বাইরে। ওই ব্যাপারটা তোকেই সামলাতে হবে। তার জন্যে যদি তোর সাথে আমাকে যেতে হয়, আমি রাজি আছি। চলে যাব।”
    অলোকার কথায় সায় দিয়ে সনাতন বলল,“ঠিক আছে দিদি। পাড়া আটচালার দিকটা আমি দেখছি। আর তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আশাকরি চেষ্টা জারি রাখলে আমি সফল হব।”
    সনাতন প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে তার বাবা রতনের সঙ্গে আলোচনা করল। ওর বাবা বলল,“টিউশনি পড়াবি, সেটা তো ভাল কথা। এতে বুদ্ধি চকচকে হয়। পুরোনো পড়া চর্চায় না থাকলে পুরোনো লোহার মত তাতে জঙ লাগে। জঙধরা লোহা ক্রমাগত ঘষতে ঘষতে যেমন চকচকে হয়ে যায়, তেমনটা আরকি। একমাত্র টিউশানিই স্মৃতির সেই জঙ ঘষে মেজে ঝাঁ চকচকে করে তুলতে পারে। তাতে হবে কি, তুমি যখন উঁচু ক্লাসে উঠবে সেটা কাজে লাগবে। সে তো এক কথা। কিন্তু মেয়েদের পড়ানো নিয়েই তোমার বেলায় চিন্তা তো থেকেই যায়। তা একটা কথা বলি বাবা, পড়ানো শুরু করার আগে বিষয়টার একটা ফয়সালা করে নেওয়া সঠিক কাজ হবে। আমি নিজে সরাসরি বললে ওরা ভাববে নিজের ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছে। অন্য কেউ হলে বেঁকে বসতো। তাই তুমিই যাবে। তুমি যাবে নন্দ কাকার কাছে। সুবোধ কাকার কাছে। আর যাবে নিত্যানন্দ আর দিবাকরের কাছে। কাউকেই বিস্তারিত কিছু বলতে হবে না। শুধু বলবে, আপনারা অনুমতি দিলে আমি পাড়ার মেধাবী কয়েকটা মেয়ের পড়াতে পারি। তাদের বাবা-মা আমাকে খুব করে অনুরোধ করছে। এবার পাড়ার আপনাদের মত সম্মানীয় মানুষদের অনুমতি ছাড়া আমি ছেলে হয়ে কেমন করে মেয়েদের পড়াতে পারি। তারপর পাড়ার অন্য লোক এই নিয়ে যদি নিন্দেমন্দ কোন কথা বলে তাহলে মেয়েদের গায়ে বদনামের কালি লেগে যাবে। সেটা তো ঠিক কাজ হবে না তাই। দেখবে, এই কথা বললে ওরা নিজেরা মনে মনে গর্ব বোধ করবে। কোন দ্বিধা না রেখে তোমাকে আশীর্বাদ দিয়ে দেবে। ওদের নাড়ির গতি আমার খুব ভাল করে জানা। তারপরও অবশ্য পাড়ায় যারা সবসময় মানুষের খুঁত ধরে বেড়ায় তাদের চপচপানি এড়ানো যাবে না। সেটা বন্ধ করতে তখন আর আমাদের কাঠখড় পোড়াতে হবে না। এই মুরুব্বিরাই সব সামলে নেবে। নিন্দেমন্দের কালো পাঁক-জল বেশিদূর গড়াতে দেবে না।”
    বাড়ির বড়রা যে সত্যিই মাথার উপর ছাদ। সনাতন তার বাবাকে দিয়ে প্রমাণ পেল। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। পাড়ার সিনিয়র মানুষদের অনুমতি নিয়ে সে তাদের বাড়িতেই মেয়েদের পড়ানো শুরু করে দিল। এদিকে যখন সনাতন পাড়া সামলাচ্ছে, ওদিকে অলোকাদি মেয়েদের দিকটা একদম ঠিকঠাক ভাবে সামলে দিয়েছে। খুশি মনে অলোকাদি তাকে বলেছে,“কি জানিস, আসলে ছেলেটা যেহেতু সনাতন রুইদাস, তাই আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমার অতিরিক্ত কোন মেহনত করতে হল না। প্রত্যেক গার্জেন আমার প্রত্যেকটা কথা অত্যন্ত খুশি মনে মেনে নিয়েছে। মানুষ যে তোকে এতটা স্নেহের এবং ভালোবাসার চোখে দেখে তা জানা ছিল না আমার। তুইও জানিস না। তোর জানার দরকারও নেই। তুই তোর মত থাক। যাক! তবে গার্জেনরা একটা কথা বলেছে, সনাতন যেন ওই ব্যাচটায় অন্তত কোন ছেলেকে না পড়ায়। ওটা মেয়েদেরই ব্যাচ হিসেবে পড়ায়। তার উত্তরে আমি বলেছি,“এই একটাই ব্যাচ ও পড়াবে, তাও আমার অনুরোধে। টিউশনি ও পড়ায় না। ওর হাতে অত সময়ও নেই। সামনে ওর নিজেরই এইচ.এস. পরীক্ষা। সময় কোথায় অত ওর। তারপর বাবাকে সাহায্য করার জন্যে বাবার দোকানে ওকে নিত্য বসতে হয়।” এরপর কয়েকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে অলোকা আবার বলল, “এবার আমি নিশ্চিন্ত মনে সারদা মন্দিরে পড়তে যেতে পারব। আমার মনটা এত হাল্কা লাগছে যে কি বলব।”
    নাইনের দুটো মেয়ে আশাতীত ভাল রেজাল্ট করে ক্লাস টেনে উঠেছে। আর অন্য যে দু’জন টেনে পড়ে তারা টেস্ট পরীক্ষায় এক চান্সে উতরে গিয়েছে
    যথেষ্ট ভাল নম্বর নিয়ে। এদের সকলের গার্জেন দারুণ খুশি মেয়েরা এতটা উন্নতি করায়। গার্জেনরা বলে, সনাতনের হাতে পড়ে মেয়েরা এতটা ভাল ফল করতে পারল। সংবাদটা অলোকাদির কানেও যায়। সনাতনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে অলোকাদি। সেই কথাটা বিপ্লবদার মাধ্যমে জেনেছে সে। বিপ্লবদা বলে,“এখন তো তোরই জয়জয়কার রে সনাতন। ওই চারটে মেয়ের বাবারা তো পাড়া মাত করে বেড়াচ্ছে তোর পড়ানোর গুনের কথা বলে। আমারও কানে এসেছে।” খুশিতে সনাতন বলল,“আমি আমার সাধ্যমত যতটা পারি ওদের কোচিং দিয়েছি। ওরা সেগুলো ধরতে পেরেছে বলেই তো পরীক্ষায় ঠিকঠাক লিখেছে। আমার থেকে যোগ্যতা ওদেরই বেশি। তাই বাহবা যদি পেতেই হয় তাহলে সেটা প্রাপ্য মেয়েদেরই।”
    সুন্দরী নাইন থেকে টেনে উঠেছে। এবারও সে সনাতন স্যারের কাছে পড়বে। ওর বাবা চেয়েছিল, যেহেতু মেয়ে পরের বছর মাধ্যমিক দেবে, তাই স্কুলের অভিজ্ঞ মাস্টারের কাছে টিউশনি পড়ানোর জন্যে। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসে। সে তার বাবাকে বলে,“সনাতন স্যারের মত অত গুছিয়ে সুন্দর করে স্কুলের কোন মাস্টার পড়াতে পারে না। স্যার একবার বুঝিয়ে দিলে মাথার মধ্যে একদম গেঁথে থাকে সেই পড়া। আর স্কুলের যে স্যারের কথা তুমি বলছো, ও স্যার তো নিজের মত হুড়মুড়িয়ে বকর বকর করে চলে যায়। ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টা বুঝলো কি না বুঝলো সে দিকে নজর তার থাকে না। পড়াও তেমন ধরতে চায় না। আবার পরের দিন অন্য চ্যাপ্টারে চলে গেল। কেউ যদি নিজে থেকে না-বুঝতে পারা কোন বিষয় নিয়ে জানতে চায় তখনও একই ঢঙে বলবে, এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো? তারপর বকার ভয়ে কেউ সাহস করে বলে না যে ‘বুঝতে পারেনি।’ এমন স্যারের কাছে পড়লে আমার ভাল রেজাল্ট কিছুতেই হবে না। তুমি ওই স্যারের কাছে আমাকে টিউশনি পড়তে যেতে বোলো না বাবা। সনাতন স্যারের কাছে যেমন পড়ছি, তেমন পড়তে চাই। এই স্যারই আমার কাছে ঠিক আছে।” সুন্দরীর অন্য বন্ধুটা সনাতন স্যারের কাছ থেকে ছেড়ে গিয়ে ওই স্কুলের স্যারের কাছেই প্রাইভেট পড়তে গেল। আর যে দু’জন মাধ্যমিক ফাইনাল দেবে, টেস্ট পরীক্ষার পর তারা আর বিশেষ আসে না। মাঝে সাঝে কোথাও আটকালে দেখে নিয়ে যায়। সনাতন নিজে থেকেই বলেছে, তাদের প্রয়োজন হলে কোন দ্বিধা না করে যেকোন ডাউট ক্লিয়ার করে যেতে।
    একজন ছাত্রীর জন্যে তার এতটা সময় ব্যয় করা কতটা সঠিক হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সনাতন। এতে এমনিতেই নিজের পড়ার টাইম কাটতে হয় তাকে। তাও, চারজন ছিল বলে মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু একজনের জন্যে সেটা করা তো মুশকিল। সুন্দরীকে বলেছিল সে যে, তার একার জন্যে এতটা সময় ব্যয় করা সম্ভব নয়। সে যেন অন্য কোথাও খোঁজ খবর করে ভাল স্যার দেখে চলে যায়।
    মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে এমন কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না সুন্দরী। আকাশ থেকে পড়ার মত বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,“আপনি আমাকে পড়াবেন না স্যার? আমি তাহলে কোথায় যাব? বাবা তো আমাকে স্কুলের ইংরেজী স্যারের কাছে পড়তে বলেছিল। আমি যেতে রাজি হইনি, আপনার কাছে পড়বো বলে। বাবা বলে দিলে হয়তো এখনও গেলে সেখানে ভর্তি হতে পারব। কিন্তু আমি সেখানে যাব না। আপনি যদি আমাকে না পড়ান তো আমি পড়া ছেড়ে দেব।” বলে ফোঁসফোঁসিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সেই শুরু আর যেন শেষ হতে চায় না! ফোঁসফোঁসানি শব্দ অবশেষে বন্ধ হলে কি হবে সমানে আন্দোলিত হতে থাকা দু’বুক জানান দিচ্ছে, তার ভেতরের কান্না তখনও সমানে জারি রয়েছে। সেই অন্দোলনকে আপাতত দমন করার জন্যে সনাতন অবশেষে বলতে বাধ্য হল যে,“ঠিক আছে। এখন তুমি চুপ করো। আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়। তুমি যেমন মাধ্যমিক দেবে সামনের বছর। আমি তেমনি এই বছরই উচ্চমাধ্যমিক দেব। আমারও তো পড়ার টাইমটা বার করতে হবে। অলোকাদি তোমাদের পড়ার মাঝপথে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল বলে সেই গ্যাপটা আমি পূরণ করার জন্যে তোমাদের পড়াতে রাজি হয়েছিলাম। তার মানে তো এই নয় যে, আমি পেশাগতভাবে পড়াতেই থাকব। তারপর তোমার একার জন্যে আমার সময় কাটিয়ে দেব কেমন করে সেটাই তো ভেবে উঠতে পারছি না। আবার তুমি বলছো, আমি না পড়ালে পড়া ছেড়ে দেবে। এটাও তো বোকা বোকা সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কোন মানে হয় না। আমাকে দু’চারদিন সময় দাও। তারপর আমি তোমাকে না হয় ফাইনাল জানিয়ে দেব।”
    ইতিমধ্যে সনাতন মাস্টারের ছাত্রীরা আশাতীত রেজাল্ট যে করেছে সেটা ছাত্র সমাজে চাউর হয়ে গেছে। তারপর চাউর হয়েছে তার অমায়িক ভদ্র আচরণের প্রসঙ্গও। অভিভাবক মহলেও সেটা বেশ প্রচার পেয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে একের পর এক গার্জেন সনাতনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে। এমনকি বাজারে সনাতনের বাবার দোকানেও তার সঙ্গে অনেকে দেখা করতে আসে, তার মেয়েকে পড়াতে চেয়ে। সনাতনের বাবা, রতন এতে বেশ খুশি বোধ করে। তার ছেলের কাছে কত ভদ্রলোকেরা এসে অনুরোধ করছে, তাদের মেয়েদের পড়াবার জন্যে। এটা কি কম ভাললাগার ব্যাপার ! আবেগে ছেলেকে জিজ্ঞেস না করেই রতন কাউকে কাউকে বলে দেয়, তার ছেলে পড়াবে। আমি বলে দেবো’খন, তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। বাবার কাছ থেকে পরে শুনে সনাতন একটু দ্বিধা বোধ করে, কিন্তু গুরুজন, বাবাকে কিছু বলে না। ও বোঝে বাবা চাইছে সে পড়াক। সংসারে কিছু আয় বাড়ুক। অবশেষে একরকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় সে। রাজি হয়ে যায় পড়াতে। সুন্দরীকেও সেটা জানিয়ে দিতে তার সে কি আনন্দ! সুন্দরীর আনন্দের এতটা বহিঃপ্রকাশ দেখে থমকে যায় সনাতন! অন্য ভাবনা মনের মধ্যে না প্রশ্রয় দিয়ে এড়িয়ে যায় সুন্দরীর তার অতি-আগ্রহপনা ভাবনাকে। এক এক করে সুন্দরীকে নিয়ে ছয়জন ছাত্রী হয়ে যায়। তিনজন ছাত্রও আসে পড়ার প্রস্তাব নিয়ে। সনাতন এককথায় তাদের ফিরিয়ে দেয়,“মেয়েদের ব্যাচের সঙ্গে ছেলেদের আমি পড়াই না। আর ছেলেদের জন্যে আলাদা ব্যাচ খোলার আমার কোন অভিপ্রায় নেই। তাহলে আমার নিজের পড়ার দফারফা হয়ে যাবে। নিজের ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। উচিৎ ও নয়।” তাদের নিরাশ করতে বাধ্য হয়েছে সনাতন।
    সনাতন স্যারের কাছে পুরোনো ছাত্রী সুন্দরী। তাই এখানে সে অন্য সকলের থেকে বেশি সপ্রতিভ। ভাবটা এমন দেখায়, স্যারের প্রতি তার আধিপত্য অন্যদের থেকে বেশি। তাই আবদারের বহরও চোখে পড়ার মত। সনাতনের একটা সুবিধা হয়েছে, সব ছাত্রীই ক্লাস টেনের। ভিন্ন ক্লাসের হলে যে পড়া আলাদা আলাদা করে দেখাতে হত তার। তবে একা সুন্দরীর দাপটে তার যেন নাজেহাল হবার উপক্রম। সুন্দরী তাদের পাড়ার মেয়ে। সনাতনদের চারটে বাড়ির পরে তাদের বাড়ি। যে চ্যাপ্টারের পড়া আগের দিন শেষ করে দিয়েছে। পরের দিন নতুন পড়া ধরার কথা, হঠাৎ সুন্দরী বলে বসলো,“স্যার আগের পড়াটা আর একবার ঝালিয়ে দিন। আমার বুঝতে একটু খটমট লাগছে। ও বুঝে গেছে যে স্যারকে এটা বললে স্যার সেটা ক্লিয়ার না করে নতুন পড়ায় যাবে না। অন্য ছাত্রীদের ইচ্ছা নতুনে যাবার। সুন্দরী তা মানতে নারাজ। জোর খাটাতে থাকে স্যারের উপর। অগত্যা অন্যদের বুঝিয়ে স্যার বাধ্য হয় পুরোনোকে ঘষামাজা করতে।
    সেবার পরপর দু’দিন পড়ানো বন্ধ ছিল। সনাতন স্যারের পেটের গন্ডগোল। সুন্দরী, স্যারের মায়ের কাছ থেকে জেনেছে স্যারের ডিসেন্ট্রি হয়েছে। শোনামাত্রই দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে আধঘন্টার মধ্যে একপাঁজা ‘থানকুনি পাতা’ এনে সনাতনের মায়ের হাতে দিয়ে বলে,“এর রস স্যারকে খাওয়াবে কাকিমা। আর থানকুনি পাতার ঝোল করে দেবে। আমার মা বলেছিল, কয়েকবার খেলেই এতে আমাশয় ধরে যাবে। স্যারের কষ্ট কমে যাবে!” বলে সঙ্গে সঙ্গে টানা দৌড় দিয়ে চলে যায় তাদের বাড়ির দিকে। সুন্দরীর এই আচরণে সনাতনের মা হাঁ করে একগাদা প্রশ্ন-মুখে দৌড়তে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

    ক্রমশ…. 

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র(১৭)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [ছত্রিশ]
    সারাদিন চাষের কাজ সেরে দু’পক্ষই- মালিক আর হেলো-জনমজুর সকলে বাজারে উঠে পরদিন কোথায় কি কাজ হবে সেইসব দরকারি কথাবার্তা সারে। তারপর চা দোকানে চা খেতে খেতে একটু আড্ডা দিয়ে আবার সবর সবর যে যার বাড়ি ফিরে যায়। আড্ডা দিতে দিতে বেশি রাত করলে পরদিন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। এই কাজের সময় চাষী মজুররা সেটা করতে চায় না।

    আজকের দুপুরের ভাগাড়ের ঘটনাটা মাথাতেই ছিল না সুধার। হঠাৎ চা দোকানে যতন রুইদাসকে দেখে স্মৃতি চাগাড় দিয়ে উঠতে আগ্ৰহ নিয়ে কথাটা পাড়লো সুধা, “হ্যাঁ রে যতন, বাবলা তোর ছেলের নাম?” হঠাৎ সুধার মুখে তার ছেলে বাবলার নাম শুনে অবাক হয়েই গেল যতন। বাবলার নাম এই সুধা-হেলো জানল কেমন করে? ওকে তো এখানকার বেশিরভাগ লোকেরই চেনার কথা না। বাবলা এখানে খুব কমই থাকে। মনে প্রশ্ন নিয়ে যতন বলল, “হ্যাঁ,বাবলা আমার ছেলে ছেলে। তা তুমি কি করে আমার ছেলেকে চিনলে সুধা-দা? আবার ও আমার ছেলে তাও নিশ্চিত হয়ে বলছো। কেন, ওর সঙ্গে তোমার আবার কোন ঝামেলা টামেলা হয়েছে নাকি? বাবলা তো ঝামেলা পাকানোর ছেলে নয়! কেন, কি হয়েছে আমাকে বলবে?”
    -আরে বাবা, তুই অত উতলা হচ্ছিস কেন? আমার কথা শুনে তোর কি মনে হল, তোর ছেলের সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছে? তা হতে যাবে কেন। তুই একদম ঠিক কথাই বলেছিস, তোর ওই ছেলে, কারোর সঙ্গে কোন ঝামেলা পাকানোর ছেলে নয়। ঠান্ডা মাথায় চুপিসাড়ে নিজের কাজ হাসিল করে কেটে পড়ায় চোস্ত তোর ছেলে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে হাসিল করতে যেখানে যেমন করা দরকার তা করতে ওর জুড়ি মেলা ভার। একদম বেড়াল-তপস্বীর মত- যেখানে চুপচাপ থাকা দরকার তো সেখানে ওর মত শান্তশিষ্ট ছেলে আর হয় না। আর যেখানে শিকারির ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন সেখানে অত দ্রুত কাজ সারা, ওরে বাপরে বাপ! না দেখলে কারোর বিশ্বাস করানো মুশকিল। সেটা আজ আমার দুটো জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে দেখলাম। একটা গাঁয়ের ছেলে যে একাধারে এত ধীরস্থির আবার এতটা তরতরে হতে পারে, তা আমি এই তোর ছেলেকে প্রথম দেখলাম। তা তোর ছেলে গরুর পেট কেটে ওই কটকটে হলদেটে পাথরের মত একগুচ্ছ জিনিস নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমাদের ভাগাড় থেকে তোদের বাড়ির পানে ছুটলো! কি ওগুলো রে, যতন? চোখে মুখে কৌতূহল ঠিকরে বার করে সুধা বলল।
    -তা তো আমি জানি না, দাদা। ও ছেলে কখন কোথায় কি করে, কবে কোথায় থাকে না-থাকে তা আমি বলতে পারবো না। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ বাড়ি এলো। মায়ের সঙ্গে কি-সব ফুসফুস গুজগুজ করল। কিছু টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দিল। আবার কখন দেখলাম বাড়ি নেই! বাবলার কাজকারবারের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। আগে তো বাড়ি আসতই না। এই বছর খানেক হল বাড়ি আসা-যাওয়া করছে। চোখের সামনে নিজের ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি, এটাই আমার সান্ত্বনা।
    -ছেলেটা তো দেখে মনে হল আঠেরো-কুড়ির মত বয়স। তা ও এখানে থাকে না তো থাকে কোথায়?
    -মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায় ওর মামারবাড়িতে ও মানুষ। আমার রতন-দার শ্বশুর বাড়ির দু’একটা ঘর পরেই আমার শ্বশুরবাড়ি। বৌদিই আমার এই সম্বন্ধটা পাকা করে দিয়েছিল। মায়ের বুকের দুধ-ছাড়ার বয়স থেকেই ছেলে ওখানে থেকে যায়। ওকে ওর দাদুর কি চোখে লেগে যায়, মেয়েকে বলে, “তোর ছেলেটাকে আমি মানুষ করবো। তোর কোন খরচা-খারচি করতে হবে না। আমাদের যা আয়-পয় আছে, তাতে আমার নাতিকে মানুষ করতে অসুবিধা হবে না।
    -সে তো তাহলে বলতে হবে তোর পাতা-চাপা কপাল রে যতন। ছেলে পয়দা করলি অথচ তার খাওয়া-পরার দায় তোকে নিতে হল না। এমন ভাগ্য ক’জনের হয়। তা নাতিকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, দাদু? নাহলে কেবল খেতে পরতে দিতে আর ঝক্কি কিসের। ও অনেকেই করতে পারে।
    -না গো সুধা-দা। বুড়ো, ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছে। মাধ্যমিক পাশ, আমার বাবলা। বুড়োর ইচ্ছে ছিল নাতিকে আরও পড়াবে। কিন্তু বিধাতা নারাজ হলে নগণ্য মানুষের আর কি করার আছে। হঠাৎ করে বুকের ধুকপুকুনি থেমে গেল বুড়োটার। ডাক্তার দেখানোরও সময় দিল না। বড় দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। তখন আমরা বাবলাকে বললাম,“বাড়িতে চলে আয় খোকা। দাদু নেই। এবার তোর মামা-মামী তোকে পালতে চাইবে না। তোকে নিয়ে ওদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আয়। তাতে মামাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকবে। লোকের সংসারে আজকাল তো দেখছি, কি হচ্ছে সব।”
    -ঠিকই প্রস্তাব দিয়েছিলিস তুই। মামা কিছু না বললেও, মামী তো পরের বাড়ির মেয়ে। সে মেনে নিতে নাও পারে। সমাজে যেন সব রোগ ধরে গেছে। ভালোবেসে পরের দায় কেউ নিতে চায় না। তার উপর ভাগনার সম্পর্কের কেউ।
    -তা একদম তুমি ভুল কথা বলোনি গো সুধা-দা। সেই কথা উঠেছিল। তা আমার শাশুড়ি-মা কিছুতেই বাবলাকে ছাড়তে চাইল না। ছেলে-বউমাকে বলল, “আমার স্বামী বাবলাকে ভালবেসে এখানে রেখেছে। সেই গুড়বেলা মানে ছোটবেলা থেকে আমি ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি বেঁচে থাকতে ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবো না। তা ও বড় হয়েছে। ও যদি নিজে থেকে চলে যায় সেটা অন্য কথা। আমার বুক ফাটবে ঠিকই কিন্তু তখন আমার আর বাধা দেবার অধিকার থাকবে না। বাবলার খাওয়া পরার জন্যে তোদের চিন্তা করতে হবে না। এই গরু-বাছুর থেকে আমার যা আয় হয় তাতে আমাদের দুই দিদিমা-নাতির ভালভাবে চলে যাবে। তোদের সংসার নিয়ে তোরা থাক। আমরা আলাদা হাঁড়ি করে নিচ্ছি।” বুড়ি তাই করল। আর ছেলেও দিদিমাকে এত ভালবাসে, কিছুতেই ওখান থেকে আসতে চাইল না। কিন্তু লেখাপড়াটা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না ছেলেটা। দিদিমার অত ক্ষমতা ছিল না।
    -তা তোর শাশুড়ি বেশ তেজী মহিলা বলতে হবে?
    -হ্যাঁ, খুব চৌখোশ আর জেদি মহিলা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে, বুড়ির সেই তেজ মরে গেল একটা দুঃখজনক ঘটনায়। হঠাৎ একমাস পিঠোপিঠি বুড়ির দু-দুটো গাইগরু অজানা রোগে মরে গেল! বিডিওর ডাক্তার এসে কিচ্ছু করতে পারল না। তারা রোগই ধরতে পারল না! এইসব ডাক্তার পড়ে পাশ করেছে না টুকে কে জানে। রোগির রোগ ধরতে পারবে না তো সে কেমন ডাক্তার? ওই গরুর দুধ বিক্রির টাকাতেই তো বুড়ির যত নফর -চফর। এই পরিস্থিতিতে বুড়ির ঘাড়ের উপর বসে খাওয়া তো ঠিক না। তাই ছেলেকে আবার বললাম, “বাবলা, তুই এবার বাড়ি ফিরে আয়ে। তুই ওখানে থাকলে, তোকে নিয়ে দিদিমা বিপদে পড়বে। তার চাইতে তুই চলে এলে তোর দিদিমা তার আলাদা সংসারের হাঁড়ি তুলে দিয়ে ছেলে-বউয়ের সংসারে ঢুকে পড়তে পারবে।” কিন্তু ছেলে তো আমার কথার একদম উল্টো কথা বলল, “কি বলছো তুমি বাবা? দিদিমা আমাকে এত বড় করে তুলল। এখনো তার আঁচলের ওমে আমাকে রেখেছে। আর এখন দিদিমার খারাপ সময়ে আমি তাকে ছেড়ে স্বার্থপরের মত চলে যাব? তখন তো মামারাই বলবে, দেখলে তো মা, এইজন্যেই লোকে বলে- জন-মামাই-ভাগনা, তিন নয় আপনা। এই কথার জিন অর্থাৎ মর্মার্থ আমি ভেঙে তছনছ করে দেব। এ’কথাটা যে আমার কাছে কত ফালতু কথা, তা সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব। দিদিমাকে আমি কিছুতেই মামা-মামীর বোঝা করে রাখতে দেব না।”
    -তা তোর ছেলে তো তখন বেকার। কি করে সে দু’জনের সংসার সামলালো? মুখে বড় বড় কথা বলা আর কাজে তা দেখিয়ে দেওয়া তো এক কথা না।
    -হ্যাঁ। ঠিক তাই। কাজ করেই সে দেখিয়ে দিল। আমি ভাবতে পারিনি আমার ছেলেটা এতটা গোঁয়ার। জেদ করে বসল, তাকে যেভাবেই হোক সৎ পথে রোজগার করতে হবে। দিদিমার কষ্ট সে দেখতে পারবে না। আর যা ভাবা তাই কাজ। ওর খেলাবয়সের দু’জন বন্ধু ট্রেনে হকারি করতো। সেই বন্ধুদের সাহায্যে সেও ট্রেনে হকারির কাজে লেগে পড়ল। প্রথম প্রথম কষ্ট হত। অসুবিধাও হত। ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হত অন্য হকারদের সঙ্গে। এই বন্ধুরাই আবার তা সামলে দিত। আসলে এইসব লাইনে নতুন কেউ ঢুকলে, মাটি কামড়ে না থাকতে পারলে পুরোনোরা তাকে খেদিয়ে দেবে। পুরোনোদের জমিতে হুট করে নতুন একজন ঢুকে তাদের রোজগারে ভাগ বসাবে আর তারা চুপ থেকে মেনে নেবে তা হতে দেবে না। নতুনকে যথেষ্ট লড়াই করে নিজের পায়ের তলার মাটি জোগাড় করে নিতে হয়। নতুন জীবনটা ছেলে কিছুদিনের মধ্যে রপ্ত করে নিল। দিদিমা-নাতির সংসারে অসুবিধা তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু উপরওয়ালার ডাকে দিদিমাও তার দাদুর কাছে চলে গেল। দাদু-দিদিমার গোলকভূমে যাবার ফারাকটা বেশিদিন ছিল না। বছর দেড়েক হবে। মামার বাড়িতে বাবলা একা হয়ে গেল। এবার নিজে থেকেই আস্তে আস্তে বাড়ি আসা শুরু করে। তবে পাকাপাকিভাবে না। এত বছরের জীবন যেখানে কেটেছে, তার মায়া সে ত্যাগ করে কেমন করে। ওর রোজগারের জায়গা, বন্ধু-বান্ধব সবই তো ওখানে। ওখানে সে দেড়-কামরার একটা ঘরও বানিয়েছে। তার জন্যে আমরা তাকে কিছু বলি না। ও যেটা ভাল মনে করবে তাই করবে। ওখানে ঘরটা থাকলে ওর মায়েরও বাপেরবাড়ি গিয়ে থাকার একটা নিজস্ব ঠাঁইও মেলে। আমিও যাই শ্বশুরবাড়িতে নিজের ঘরে থেকে আসি দিন কতক করে। একটু থেমে যতন আবার বলল, “এবার উঠি গো সুধা-দা। কথায় কথায় আমার অনেক কথা তোমাকে বলে ফেললুম। হঠাৎ ছেলের কথা তুললে। ছেলে-কাহানি শুনিয়ে দিলাম তোমাকে। বলতে বলতে রাত বেড়ে গেল। কাল আবার ভোর ভোর বিছানা ছাড়তে না পারলে কাজে বেলা হয়ে যাবে।”
    -চায়ের দাম তোকে দিতে হবে না যতন। যাবার সময় প্রদ্যুৎকে বলে যা, তোর এই চায়ের দামটা আমি দিয়ে দেব। একটু পরে আমরাও চলে যাব। সুধা বলল।
    দিঘিরপাড় বাজার থেকে বাড়ির পথে যেতে যেতে যতনের মনে পড়ল, সকালে সুধা-দার ছেতো ওই ভূপাল পাড়ায় খবর দিতে এসেছিল ভাগাড়ে গরু পড়েছে বলে। যতন শুনেছে। কিন্তু ওসব কাজ ও আর করে না বলে গা-করেনি সে কথায়। তারপরই অবশ্য ও দেখেছে বাবলা বাড়ি থেকে বার হয়ে গুটি গুটি পায়ে ভূপালের পেছন পেছন চলেছে। বাবলা তো আর গরুর চামড়ার কাজ করে না। তাই সে ছেলের যাওয়ার ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। ভাবল, অন্য
    কোন কাজে ও বাইরে বেরোচ্ছে। ও যে সত্যি সত্যি ভাগাড়মুখো হচ্ছে তা যতন কল্পনাই করতে পারে নি। এখন সুধা-দার মুখে গল্প শুনে বুঝলো। বাড়িতে গিয়ে বাবলাকে জিজ্ঞেস করবে সে, ওই কালচে হলদে রঙের পাথরগুলো কি? গরুর পেট থেকে নাকি সে বার করেছে ওগুলো। প্রায় জীবনভর যতনরা গরু নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করল, কোনদিন তো শোনেনি যে গরুর পেটে ওইরকম রঙিন পাথর থাকে ! তাও আবার সেগুলো নেবার জন্যে মানুষ ছুটে যায়! নিশ্চয়ই এগুলো কোন কাজের জিনিস। এবং দামী। সেটা বাবলা কোনভাবে জেনেছে। এখনো পর্যন্ত পাড়ার কোন মুচি এই পাথরের ব্যাপারটা জানে না তা সে হলফ করে বলতে পারে। জানলে চামড়ার ভাগ নেবার মত ওই পাথর ভাগ পাওয়ার জন্যে ছেঁড়াছেঁড়ি করতো ওরা। পয়সার গন্ধ পেলে কে-না তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যতনও চুপ থাকতো না। তা এমন গোপনীয় জিনিসের কথা বাবলা বা ফেচকাতে যাবে কেন! কাউকে না জানিয়ে সে তো বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।
    বাড়িতে গিয়ে যতন ছেলের খোঁজ করলে ওর মা বলল, “সে খেয়েদেয়ে শুতে চলে গেছে।” একই বিছানায় ওরা বাপ-বেটা শোয়। খাওয়া সেরে যতন শুতে চলে গেল। বাবলা তখনও শুতে যায়নি। ছোট্ট পালিশহীন ফেরিওয়ালা- টেবিলের সামনে টুলের ওপর বসে কাগজ-টাগজ নিয়ে কিসব করছে। যতন বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করল, “কিরে বাপ। শুবি না? রাত হয়ে যাচ্ছে। আয় শুয়ে পড়। তুই শুলে তবে মশারি টাঙাতে পারব। যা মশার উৎপাত হয়েছে আজকাল!”
    -তুমি মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়ো বাবা। আমি একটু পরে শুচ্ছি। তোমার আবার সক্কালে উঠে কাজে বেরোতে হবে। এই হাতের কাজটা সেরে নিই। তারপর।
    -হ্যাঁরে খোকা,একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ইতস্তত করে যতন বলল। সঙ্গে সঙ্গে বাবলা বলল,“কি, বলো-না বাবা।”
    -দৌলতপুরের সুধা-হেলো বলছিল তুই নাকি আজ কাউকে না জানিয়ে একদম গোপনে ভাগাড়ে গরুর পেট থেকে কিসব পাথর-টাথর বার করে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিস? বাজারে দেখা হতে সে তো আমাকে চেপে ধরেছে। তুই কি জিনিস নিয়ে চলে এলি, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছে। তা আমি তো তার কথা শুনে অবাক ! ‘কিছুই জানি না’ বলতে সে আমার কথা বিশ্বাস করল না। মুখে কিছু বলল না। তবে হাবভাবে বুঝিয়ে দিল, আমি তাকে গোপন করছি। কিন্তু সত্যি তো আমি কিছুই জানিনা।”
    যতনের কথায় দেরি না করে ওর ফোমের সাইড ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া পাথরগুলো বাবাকে দেখাল, বাবলা। বলল, “দেখো বাবা, গরুর পেটে এগুলো থাকে। তবে সব গরুর পেটে আবার পাওয়া যায় না। কোন গরুর পেটে এগুলো থাকবে আর কার পেটে থাকবে না তা সাধারণভাবে কেউ বলতে পারবে না। ভাগ্য জোরে আজ আমি এই গরুর মধ্যে পেয়ে গেছি। না হলে কাটাছেঁড়া করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হত। তবে একটা লক্ষণ আছে, যে লক্ষণটা জানতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যায়, সেই গরুটার পেটে এগুলো পাওয়া যাবেই যাবে। কিন্তু বাইরের কোন লোকের পক্ষে সেই লক্ষণ জানা সম্ভব নয়। লক্ষণটা জানতে পারে একমাত্র সেই বাড়ির মালিক বা যে সেই গরু সবসময় দেখভাল করে সে।
    ছেলের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল! বলে কি এ! গরু সম্পর্কে সে এত জানে? অথচ তার বাপ, গরু ঘেঁটে ঘেঁটে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকলো, কিছুই জানলো না! প্রশ্নমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কি বলে তা শোনার জন্যে। বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলল,“কি সেই লক্ষণ সেটা জানতে চাইছো তো? রাত্রে ঘুমের সময় যে গরু জোরে জোরে নাক ডাকে, দেখা গেছে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই পেটের মধ্যে এমন পাথর আছে। অবশ্য দু-একটার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হয়েছে। পাওয়া যায়নি। সেটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে চলবে। যারা এইসব নিয়ে চর্চা করে তারা গবেষণা করে এটা জানতে পেরেছে। কিন্তু গরুর মালিক বা গরু দেখভাল করা লোকটা তো আর জানে না, নাক ডাকার মধ্যে এমন রহস্য লুকিয়ে আছে! আর বাইরের লোক বা জানবে কেমন করে কোন গরু ঘুমোবার সময় নাক ডাকছে কি ডাকছে না। তাই বাইরের লোক, যারা এইসব পাথর নিয়ে কাজ করে, তাদের আন্দাজেই ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। হয় ছক্কা, নয়তো ফক্কা!”
    যতন এবার ধৈর্য ধরতে না পেরে সরাসরি ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে বাবা, এই পাথরের কি নাম? এর তো একটা নাম কেউ কোন সময় দিয়েছে। আর নিশ্চয়ই পাথরটা বাজারে অনেক দামে বিকোয়? আর একটা কথা বলতো, এটা কি কামে লাগে যে তার এতো দাম? আমার তো জানতে ইচ্ছে করছে।”
    বাবার কথায় এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল বাবলা। বলল, “এগুলো সবই গোপন কথা বাবা। এর কোন উত্তর তোমাকে এখন আমি দিতে পারব না। সময় হলে তোমাকে বলব। এখন তোমাকে বললে তুমি যদি একবার বাইরে ফেচকে দাও তো আমি বিপদে পড়ে যাব। আমার ইনকাম চৌপাট হয়ে যাবে। এইসব কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে না বাবা। এখানকার কেউ যখন জানে না তখন তোমাকেও জানতে হবে না। আমার জানা আমার মধ্যেই থাক।” ছেলের কথার ওপর আর কথা বাড়ালো না যতন। চুপ করে গেল।
    নিত্যকারের মত মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “বেশি রাত করিস না বাবা। সকালে আবার শরীর ম্যাচ ম্যাচ করবে। কাল কি তুই হরিশচন্দ্রপুর যাবি, না থাকবি। যদি যাস তো, তোর মাকে বলতে হবে, সকাল সকাল রান্না বসিয়ে দিতে।” বাবার কথায় বাবলা বলল, “হ্যাঁ বাবা। কাল যাব। তুমি শুয়ে পড়েছো আর উঠতে হবে না। আমি মাকে বলে দিচ্ছি। ওখানকার কাজ সেরে তবে ফিরব। কবে ফিরব আগে থেকে বলতে পারব না।”
    বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে যদি সে ট্রেনের হকারি লাইনে না আসত তাহলে কোনোদিন এই মহা-মূল্যবান বস্তুটার সঙ্গে পরিচয় তার হত না। বাবলা সেইজন্যে তার দুই বন্ধু, সুবোধ আর বিমানের কাছে ঋণী। সেইজন্যে যখনই ওর এই বন্ধুরা কোন অসুবিধায় পড়ে, বাবলা সব কাজ ফেলে ছুটে যায়। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক বন্ধু আছে যারা কেবল সুযোগ সন্ধানে থাকে। কাজ হাসিল হয়ে গেলে কেটে পড়ে। এরা সেইসব বন্ধুর একদম উল্টো। এমন বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের দরকার। বাবলাও তাই তাদের ভোলে না। লেপটে রাখে বন্ধুদের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে।
    তার নিজের তো কোন পুঁজি নেই। অথচ কিছু একটা করতে হবে। হঠাৎ মালদা স্টেশনে সুবোধের সঙ্গে দেখা। সুবোধই প্রথম তাকে দেখতে পায়, “কিরে বাবলা, কোথায় যাচ্ছিস? কতদিন পর তোকে দেখলাম। সেই ক্লাস ফাইভে স্কুল ছাড়লাম। বাবা অভাবের তাড়নায় পড়া ছাড়িয়ে দিল। তোর সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আমরা কেমন ক’জন বন্ধু মিলে আলোচনা করে ক্লাসে পড়া দিতাম। আমি, তুই, বিমান একসঙ্গে খেলাধূলা করতাম। অন্য কেউ আমাদের মারতে এলে বা কিছু বললে আমরা তিনজনে মিলে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কি সুন্দর জীবন ছিল তখন বল? জানিস তো, ওই বিমানও এই ট্রেনে হকারি করে। আমি স্টেশনারী আইটেম আর বিমান আয়ুর্বেধিক ওষুধ। বিমান তো খুব ভালো ভালো কথা বলতে পারে। তাই ওই ওষুধ বিক্রিতে ও এক নম্বর। আমি আবার অত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। আসলে অত বকর বকর আমার পোষায় না। তাই এটা আমি বেছে নিয়েছি। আমি তো হড়হড় করে আমার কথা বলে যাচ্ছি। এবার তোর কথা বল? তুই কদ্দুর লেখাপড়া করলি?”
    -মাধ্যমিক পাশ করেছি। কিন্তু তা করেও তো কোন কাজে আসল না। তার থেকে তোরা অনেক ভাল আছিস। দাদু হঠাৎ করে মারা গেল। সংসারের আয় বন্ধ। দিদিমাকে নিয়ে এখন আমি অথৈ জলে। তাও দিদিমা দুটো গাই গরুর দুধ বেচে কিছু কাঁচা পয়সা আয় করত। তাতেও টুনমুন করে দু’জনের সংসারটা চলছিল। কিন্তু কি রোগে কে জানে, ডাক্তার রোগ ধরতে পারল না। পরপর ক’দিন ছাড়া ছাড়া দুটো গরুই মরে গেল। দিদিমার হাত এখন ফাঁকা ঢনঢন! সংসার আর চলে না। এখন আমাকে কিছু করতে হবে। কি করব বুঝতে পারছি না। হাতে পয়সা নেই যে ব্যবসা করব। ভবঘুরের মত তাই এই স্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খুঁজে বেড়াচ্ছি, যদি কোন ইনকামের সন্ধান পাই।
    -হকারি করবি? অবশ্য তোর মত শিক্ষিত ছেলেকে হকারি করতে বলাটা আমার ঠিক না। তবু বলে ফেললাম। এই ট্রেনে হকারি এমন একটা পেশা না, তুই যা ইচ্ছা নিয়ে ব্যবসা কর। ট্রেন তোকে ফিরিয়ে দেবে না। সারাদিনে কিছু না কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। লোকের করুণা ভিক্ষের থেকে স্বাধীন ব্যবসা তো অনেক সম্মানের রে বাবলা। আমরা সেটা বুঝে গেছি। আর একটা কি জানিস, এতে কোন লজ্জার কিছু নেই। কোন কাজ তো ছোট নয় রে। তারপর একটা কথা কি বলতো, আমরা লোকের পকেট মেরে, চুরি ছিনতাই করে পয়সা কামাচ্ছি না তো ? পেটের দায়ে সৎ উপায়ে পয়সা রোজগারের জন্যে এই পেশায় এসেছি। হ্যাঁ এটা ঠিক, আমরা ‘হকার’ এই তকমা মানুষের মনে সবসময়ই গেঁথে থাকে। ট্রেনের কাজের বাইরে সাধারণ জীবনে, যেমন হাটে বাজারে বা অন্য কোথাও আমাদের দেখলে অন্য কোন সম্বোধনের কথা না ভেবে আমরা পরিচিত ‘হই হকার’ বলে। মানুষ বলবেই, ‘এই ছেলেটা ট্রেনে হকারি করে।’ এই পেশায় এলে সারা জীবন আমাদের পিঠে এই ‘হকার’ নামটা সেঁটে দেওয়া হয়ে যায়। আমাদের যেন আর অন্য কোন সামাজিক পরিচয় থাকে না। আমাদের পেশাটাই আমাদের পরিচয়। সে আর কি করা যাবে। ভাল পরিচয়ের মাদুলি গলায় ঝুলিয়ে থাকলে তো পেট চলবে না।” খানিক থেমে আবার সুবোধ বলল, “তোকে আমাদের লাইনে আসতে বলছি ঠিকই, তবে এখানে ঢোকাও খুব সহজ কাজ না রে বাবলা। তুই ঢুকলেই, যাই নিয়ে তুই কাজ কর, পুরোনো হকারকুল রে-রে করে তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আদাজল খেয়ে তোর তাড়াবার চেষ্টা করবে। যতই তোর কাছে রেলের হকার পাশ থাকুক। অন্যের বেলায় আমরাও করি। আসলে আমরা সবাই ভাবি, নতুন একজন দলে ঢুকল মানে, পুরোনোর কামানোর উপর সে ভাগ বসাতে এল। তাদের পেটে টান পড়ার আশঙ্কায় সব এমন করে। তবে তুই যদি এই দলে ঢুকিস তো অতটা বেগ পেতে তোকে হবে না। যেটা আমরা পেয়েছি। আমাদের আট-দশ জনের একটা গ্রুপ আছে। আমরাই তোকে গার্ড দেব। তবে এমন অনেক আছে যারা তুই আমাদের গ্রুপের বলে নাও চিনতে পারে। তারা তোকে না চেনার জন্যে ঝামেলা পাকাতে পারে। সে আমরা সামলে দেব। বাধা পেলে তুই ঘাবড়ে যাবি না।” কথা বলতে বলতে একটা খদ্দের এসে সুবোধের কাছে ‘নেল কাটার’ চাইলো। ডেলি প্যাসেঞ্জাররা এলাকার সব হকারদের চিনে
    যায়। কার কাছে কি পাওয়া যায় এদের জানা হয়ে যায়। দোকানের মত সরাসরি এদের কাছ থেকে কিনে নেয়। খদ্দেরটাকে ছেড়ে সুবোধ আবার বলল, “আসলে কি জানিস বাবলা, তোর প্রতি আমার একটা ভালোবাসা আছে। তোর জন্যেই আমি ক্লাস ফাইভ পাশ করতে পেরেছিলাম। না তো সেটাও হোত না। মাথা মোটা ছিলাম তো। কিছুই পারতাম না। তোর পাশে আমার সিট পড়েছিল। তোর মনটা এত ভাল, আমি জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে তুই সব আমাকে বলে দিলি। সব বিষয়েই তাই হয়েছিল। তাই তোকে আমি ভুলতে পারিনি। কোনদিন পারবও না। এমন উপাকারি বন্ধু ক’জন হয়, বল না! সেই বন্ধু এখন বিপদে পড়েছে। তার পাশে আমি দাঁড়াবো না ?”
    বাবলা তো কল্পনাই করেনি, দেবদূতের মত সুবোধ এসে তার সামনে হাজির হবে! দিশাহীন জীবন-সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে খড়কুটোর মত সুবোধ এসে তার সামনে হাজির। আর সেটাকে সে আঁকড়ে ধরবে না? না ধরলে যে হারিয়ে যাবে। সে হেরে যাবে। অত সহজে যে হার মানার ছেলে সে নয়। মনকে শক্ত করে সুবোধকে বলল, “আমি হকারি করব। তুই আমাকে সাহায্য কর। তুই যা বলবি তাই করব। কিন্তু কি কারবার করব সেটা তো ভাবতে পারছি না। ব্যবসা করার মত আমার তো কোন পুঁজিই নেই। কারবারে নামতে গেলে অল্প হলেও নিজস্ব কিছু পুঁজি তো লাগবে। সেটাই বা কোথা থেকে জোগাড় করি। দেখি দিদিমার সঙ্গে কথা বলি। তবে এই কাজটাই আমি করব, সুবোধ। তুই আমাকে সাহায্য করিস।”
    -হকারিতে তেমন কোন পুঁজি লাগে না। বিনা পুঁজিতেও কাজ করা যায়। শুধু তোকে ভাবতে হবে কোন মালটা নিয়ে তুই হকারি করবি। সেটা ঠিক করতে পারলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওইটা ঠিক করাই বলতে পারিস বেশ ঝামেলার ব্যাপার। দেখবি যে জিনিস নিয়ে তুই কাজে নামবি হয়তো সেটা অন্য কেউ করছে। তখন তো সে ফুঁসে উঠবেই। আমাদের গ্রুপের লোকও বিরক্ত হতে পারে। তার পেটে লাথ পড়বে। সে ছেড়ে দেবে? দেবে না। ঝামেলাটা তখনই হয়। এমন জিনিস নিয়ে কাজে নামতে হবে, যেটা আমাদের এই এলাকায় কেউ করে না। তাহলে কেচাল কম হবে। তুই বাড়ি যা, বাবলা। আগে তুই তোর দিদিমার সঙ্গে আলোচনা কর। তারপর মন ঠিক করে স্টেশনে আয়। কাজে নামবি যখন ঠিকই করছিস তখন একটা কিছু তো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাবলাকে সাহস দিল সুবোধ।
    পেট যখন নাড়িভুঁড়িকে মোচড় মেরে খাবার চাইবে তখন লেখাপড়া জানার মান নিয়ে বাবুয়ানার কোন মানে হয় না। এভাবে ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। লড়াইয়ের ময়দানে তাকে নামতেই হবে। সুবোধ তাকে যে সাহস দিচ্ছে, প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করছে। বিপদের বন্ধু সুবোধ। চিরকাল তার কাছে সে প্রকৃতই বন্ধু হয়ে থাকবে। এখন কি জিনিস নিয়ে সে হকারি করবে সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। দিদিমার সঙ্গে আলোচনা করে তাকে এগোতে হবে। কথায় বলে ‘তিন মাথা যার, বুদ্ধি নেবে তার।’ বুড়ো মানুষদের পাকা বুদ্ধি। জীবনযুদ্ধের অগাধ অভিজ্ঞতা। দিদিমা একটা পথ তাকে বাতলে দেবে, সেই বিশ্বাস তার আছে। সুবোধের সঙ্গে তার যা যা কথা হয়েছে সবটা দিদিমাকে জানিয়ে বাবলা বলল, “এখন আমি কি করব তুমি বলো না, দিদা? আমার কাছে তো কোন পুঁজি নেই। আর কি কারবার করব তাও তো বুঝতে পারছি না। সেটা আগে ঠিক করলে তবে না পুঁজির ধারণা করা যেতে পারে?”
    সুবোধের কথায় খানিক চিন্তা করে দিদিমা বলল, “তুই দাদা এত খাটাখাটনি করতে যাবি কেন। আমি এই বুড়ো পেটটা যেভাবেই হোক চালিয়ে নেব। তুই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা। সেখানে তোর মা-বাবা আছে। নিজেদের সংসারে চলে গেলে এখন আর তোর রোজগারের চিন্তা সেইসঙ্গে পেটের চিন্তা করতে হবে না। কচি ছেলে তুই। তোর কি এখন পয়সা কামাবার বয়স হয়েছে? যা, চলে যা তুই তোর নিজের ঘরে।”
    দিদিমার কথায় রেগে ‘কাঁই’ হয়ে যায় বাবলা! চোখ বড়বড় করে বলে,“দিদা, তুমি আমাকে এতই অকৃতজ্ঞ ভাবো? সেই একটুকখানি বয়স থেকে তুমি-দাদু মিলে আমাকে মানুষ করলে। দাদু চলে গেল। তুমি আমাকে জড়িয়ে বেঁচে আছো। আর আমি, তোমার সেই শেষ অবলম্বন, তোমাকে ফেলে রেখে স্বার্থপরের মত পালিয়ে যাব? কে বলেছে তোমাকে যে আমি এখন খাটাখাটনি করতে পারব না? ওই সুবোধ ছেলেটা। ও তো আমার সহপাঠী ছিল। সমবয়সী আমরা। সুবোধ পারলে আমি পারব না কেন? এ তুমি কেমন কথা বললে, দিদা?”

    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৬)

     জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

     

    এতক্ষণে রুইদাসপাড়া ফুঁড়ে তিনটে ছোকরা হেলেদুলে এদিকে আসছে দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টির নাগালে আসতে সুধা বুঝতে পারল, কারোর পায়ের চলন স্বাভাবিক নেই। প্রত্যেকেই নেশায় চুর হয়ে আছে। তা তোরা যা পারিস ছাই পাঁশ গিলগে যা। তোরা এসে আমার গরুটার একটা হিল্লে কর আগে। মুখে কোন কথা নেই। এসেই তিনজনে লেগে পড়ল কাজে। ঝপাঝপ হাত চলছে ওদের। কাজের বেলায় এরা একদম পোক্ত কারিগরের দক্ষতায় ব্যস্ত। ভূপাল কা টিফিন নিয়ে আসতে আসতে ওদের অর্ধেক কাজ শেষ। খাবার আসতে আর ওদিকে মন নেই সুধার। গপ গপ করে পুঁউরুটি খায় আর এক কামড় শশা চিবিয়ে নেয়। শেষে অবশিষ্ট শশা কঁচ কঁচ করে কামড়ে খেয়ে নেয়। এতক্ষণে যেন খিদের ছটপটানি দমে শান্ত হয় শরীরটা। খাওয়া সেরে ওদিক তাকিয়ে দেখে মুচিদেরও কাজ প্রায় শেষ ! সত্যি এই কাজের দক্ষতাটা রুইদাসদের রক্তে সবসময় মজুত থাকে। কাউকে যেন শেখাতে হয় না। কিন্তু সুধা অবাক হয়ে গেল, প্রথম থেকে যে ছেলেটা তাদের পাশে এসে বসেছিল, সে এখনো ঠিক তেমনভাবেই বসে? কারণটা তাকে না জিজ্ঞেস করে পারল না সুধা, “হ্যাঁরে খোকা! তুই সেই প্রথম থেকে এসে বসে আছিস। হাতে তো চামড়া ছাড়ানো ছুরি মজুত। অথচ তুই ওদের সঙ্গে কাজে হাত দিলি না যে? সুধার কথায় ওর যেন কোন ভাবান্তর নেই! চুপ করে গরুটার দিকে তাকিয়ে অন্যদের কাজ করা দেখে যাচ্ছে। এবার সে আগ্রহ নিয়েই সেদিকে তাকিয়ে আছে। সুধা আবার বলল,“কিরে, আমার কথার কোন উত্তর দিলি না যে?” সুধার কথাটা ওই দলের একজনের কানে যায়। সে তখন বলল, “ও চামড়ার ভাগ নেয় না। আমরা চলে গেলে কি করে কে জানে। গরুর পেট কেটে কিসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ফিরে আসে। কি খোঁজে, আমরা ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। চুপ করে থাকে। বলে না কিছু। কিছু বলে না বলে আমারও ওকে আর তেল মাখাই না। যা পারে করুকগে। আর জিজ্ঞেস করি না। লাভও নেই ওকে নিয়ে বেশি কজলাকজলি করে। তাহলে আবার যদি চামড়ার ভাগ চেয়ে বসে তো আমাদের দিতেই হবে। আমাদের ভাগে তখন কম হয়ে যাবে।” এবার সুধা আবার তাকে জিজ্ঞেস করল, “খোকা, তোর নাম কি রে?” সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “বাবলা। বাবলা রুইদাস। যতন রুইদাসের ছেলে আমি। চেনো তো যতনকে? ওই যে, রতন রুইদাসের ভাই। রতন আমার জ্যোঠা। সনাতন জ্যেঠতুতো দাদা।
    ইতিমধ্যে ওই তিন ছেলে কাজ সেরে চামড়া নিয়ে পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। এবার বাবলা গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সুধার মনে জেদ চেপে যায়, বেটা এখন গরুটার পেট কেটে কি করে সেটা দেখে তবে এখান থেকে যাবে।
    ভূপাল-কা’কে বলল, “কাকা, খিদে তো মারা হল। এবার গামছা বিছিয়ে এই গাছের ছায়ায় একটুকখানি শরীরটা এলিয়ে দি আয় দু’জনে। বাড়ি যাচ্ছি, দাঁড়া। আড় চোখে দেখি আয়, ও বেটা এবার গরুটাকে নিয়ে কি করে! নিশ্চয়ই গোপন কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, ওর এই কাজের মধ্যে। ছেলেটা যে মহা-সেয়ানা সেটা তুই বুঝতে পারছিস, ভূপাল কাকা? ও কিন্তু একদম মদ খায়নি। মদ না-খাওয়া ছেলের কথাবার্তা, চালচলন, খাওয়াদের থেকে একদম আলাদা। আর দেখেছিস, ছেলেটা কথা একদম কম বলে! এই কথা কম বলা ছেলেরা মোটেই লেলাখেপা হয় না। সাহসী এবং মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে এরা। খুব সিরিয়াস হয়। সরাসরি ওদিকে তাকালে ও আমাদের লুকিয়ে কাজ করবে। ঘুমোবার ভান করে চোখ পিটপিটিয়ে দেখতে হবে, বেটা কি করছে।
    একদম দক্ষ কারিগরের মত কাজ! ফটাফট গরুটার পেট চিরে তার ভেতরে হাতটা সেঁধিয়ে দিল। খান তিনেক শকুন ইতিমধ্যে জুটে গেছে। ছেলেটা ‘ফুস্ ফুস্’ করে হাতের ছুরিটা উঁচিয়ে তাদের তাড়া করে আর নিজের কাজে মন দেয়। কিছুক্ষণ সেখানে হাতটা নাড়াচাড়া করে বার করে নিল হাতটা! রক্ত মাখা ডান হাতটা বাঁ হাত দিয়ে উপর দিক থেকে চেপে ধরে ঘষে নিচের দিকে টেনে সরিয়ে দিলো রক্তগুলো! আবার ডান হাতটা ঢোকালো! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাত বার করে মুঠো মেরে রইল। এবার আর হাতের মুঠো খুললো না। আগের মত বাঁ হাত দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে নিয়ে মুঠো খুলে চোখের দেখা দেখে নিল জিনিসটা ! সুধা, ভূপাল-কা ও সেই ফাঁকে দেখতে পেল, চকচকে হলদেটে পীতবর্ণের চার পাঁচটা শক্ত কিছু জিনিস! গরুর পেটের ভেতর এগুলো থাকে এ ছেলেটা জানে। জানতেই পারে। কিন্তু ওসব কি এমন জিনিস যে এত গোপনভাবে জোগাড় করতে হবে! নিশ্চয়ই ওগুলো রহস্যজনক দামি কিছু হবে! এইসব সাতপাঁচ ভাবনার ফাঁকেই ছেলেটা কখন গামছার খোঁটে সেগুলো বেঁধে পাঁই পাঁই করে দৌড় মারল! সুধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটা পগার পার! ওকে নাম ধরে ডাকারও ফুরসৎ দিল না! সুধা বুঝেছে, ওদের এ ব্যাপারে কিছু জানাবে না বলেই ছেলেটা চোখের পলকে তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল!
    সুধা-রা দু’জন তো ‘বাবলা’ ছেলেটার কান্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল! বলল, “কি ব্যাপার বলতো ভূপাল-কা? নিশ্চয়ই ওই চ্যাপটা নুড়ি পাথর মত দেখতে জিনিসগুলোর মধ্যেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে। কোন দামি পাথরের বস্তু হবে যেটা গরুর পেটের ভেতর থাকে।” তারপর চুপ করে গিয়ে ভাবতে লাগল, এতদিন তারা কেউ এসব রহস্যের কথা জানতো না। জানার অবকাশও কোনদিন তাদের হয়নি। ওদের কোন কল্পনাতেও ছিল না। পাকেচক্রে হঠাৎ ওরা এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাওয়াতে দেখতে পেল। বিস্ময়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল সুধা!
    -আচ্ছা ভাইপো, এখন ওই গরুর পেটের যেখান থেকে বেটা-টা ওই জিনিসগুলো বার করে নিয়ে গেল, একবার গিয়ে দেখলে হয় না? ঠিক কোন জায়গা থেকে বার করলো ওসব? বা যদি একটা আধটা ওই পাথর পড়ে থাকে তাহলে তো বোঝাই যাবে জিনিসটা কি এবং গরুর পেটের ঠিক কোন জায়গায় ওগুলো থাকে? কৌতূহলের সঙ্গে ভূপাল-কা বলল।
    -জানিস ভূপাল-কা, তোর মত বোকা-হাঁদা মানুষ বলেই এই কথাগুলো বলতে পারলি। প্রথমত ওই পীতবর্ণ পাথরের মত শক্ত পদার্থ একটাও অবশিষ্ট ওখানে পড়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। যে আগ্রহের সঙ্গে ছেলেটা ওগুলো নিল, নিশ্চয়ই ওর কাছে সেগুলোর গুরুত্ব সীমাহীন। সেই দ্রব্য ছিটকে ছাটকে গরুটার শরীরের ভেতর পড়ে থাকবে তা ছেলেটা হতে দেবে না। তারপর গরুর শরীরের ঠিক কোন জায়গা থেকে ওগুলো সে বার করল তা না জানলে আন্দাজে তুই কোথায় হাঁচাবি। সবই তো মাংসের ভেতর থাকে। মাংসের ঠিক কোন জায়গা থেকে কেটে নিল তা আমাদের মত গোলা লোকের খুঁজে বার করা সম্ভব না। ওসব ছাড়। এখন আমাদের জানলে ভাল হত, জিনিসটা ঠিক কি এবং কি কারণে ওর প্রতি ছেলেটার এত টান? কাজটা যে ছেলেটা প্রচন্ড গোপনীয়তার সঙ্গে করে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ফলে সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে কিছুতেই বলবে না। হয়তো এটাই ওর রুজিরুটির প্রধান অবলম্বন। যেমনটা আমাদের মজুর খাটা। সন্ধ্যেবেলা দিঘিরপাড় বাজারে তো যাচ্ছি। তুইও আমার সঙ্গে থাকবি। ওর বাবা যতনকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব। সে কি বলে দেখা যাক। অবশ্য যতন আমাদের না-ও বলতে পারে। ছেলের মত গোপন করে যেতে পারে। চল, বাড়ি যাই। আজ নতুন একটা রহস্য সামনে এসে হাজির হল। কিন্তু তা উদ্ধার করা হল না। কোনদিন আমাদের পক্ষে তা হবে কি না জানা যাচ্ছে না। সে না হয় তো কি করা যাবে। ওসব রুইদাসদের ব্যাপার। আমরা তো আর কোনদিন এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাব না। তাই আমাদের বেশি আগ্রহ দেখানোরও বা দরকার কি। কি বলিস তুই, ভূপালকা? বলে আবার ঘুরেফিরে সুধা বলে, “তবু নতুন একটা জিনিস দেখলাম। কি সেটা জানার জন্যে মনটা ভেতরে ভেতরে যেন গুলতানি পাকাচ্ছে?”

    [পঁয়ত্রিশ]

    হেড়ো পাগলার রকমসকম দেখে তাজ্জব বনে যায় অখিল! থমকে যায় তার চলার পথ। “এই হেড়ো, ওঠ বেটা” বলে গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে উঠতে ধড়ফড়িয়ে উঠে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। আবার একই ঢঙে অখিল বলে, “আমাকে দেখে উঁকিঝুঁকি মারছিলিস কেন, বল?” ভয় পেয়ে যায় হেড়ো। এবার হাত জড়ো করে বলে, “আমার কোন দোষ নেই অখিল দাদা ! ওই নোচে আর বিন্দে মদ খেতে দিয়ে আমাকে তোমার ওপর নজর রাখতে বলেছে। কখন তুমি বাড়ি ফেরো সেটা জানাতে বলেছে। বলতে পারলে এবার চুল্লুর সঙ্গে মাংসও খাওয়াবে বলেছে। সেই লোভে সারা রাত আমি এখানে জেগে বসে আছি, তুমি কখন আসো তাই চৌকি দিচ্ছি।”
    হেড়োর কথায় মাথা গরম হয়ে যায় অখিলের। বলে, “মদ-মাংসের লোভে তুই আমার পেছনে পড়েছিস। ধরা পড়ে গেলি। এবার আমি যদি তোকে ‘কেলিয়ে বৃন্দাবন’ দেখিয়ে দিই? এখন তোর নোচে-বিন্দে বাঁচাতে আসবে তো? শালা, আমি তোকে খেতে দিই না? যখন দেখা হয় বলিস, অখিল দাদা, আজ খাওয়া হয়নি। দশটা টাকা দাও যা হোক কিছু কিনে খাবো। এবার তুই ‘খেতে পাসনি বলে’ একবার আমার কাছে হাত পাতিস। দেখবি, তোর কি হাল করি। বেইমান কোথাকার!” ভয় পেয়ে যায় অখিলের কথায় হেড়ো পাগলা। সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে অখিলের পা জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমার নামে ওদের কাছে কিছু বলবো না অখিল দাদা। আমাকে কিচ্ছু বোলো না। ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দাও অখিল দাদা।” অখিলের রাগ তখনও যেন কমতে চায় না। আবার বলে,“শালা পাগলা। এই সময় তো ভাল মানুষের মত বেশ ভাল ভাল কথা বলছিস। ওই কথায় বলে না,‘নিজের ভাল পাগলেও বোঝে।’ তুই শালা তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তোকে বলে রাখছি হেড়ো, আমার কথা যদি তোর মুখ দিয়ে কখনো বার হয়, তোকে কিন্তু আমি ছেড়ে দেব না। ছাড়! পা-ছাড় শালা পাগলা-কেষ্ট।” বলে অখিল বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
    যেতে যেতে ভাবে, ও তো পাগলের মরণ। কখন কি খেয়ালে থাকে তার কোন ঠিক আছে না কি! ও আবার নোচে-বিন্দের খপ্পরে পড়লে তাদের লোক হয়ে যাবে। মারব ধরব বলে যদি ভয় দেখায় বা কাছের লোকের অভিনয় করে মদ গিলিয়ে দেয় তো কেল্লা ফতে। যা দেখেছে সব বলে দেবে। দেবে দেবে! কি আর করা যাবে। ঝামেলা হামলে পড়ে তার ঘাড়ে উঠতে চাইলে তখন চুপ করে থাকা যাবে না তো। কঠোর হাতে তাকে মোকাবিলা করতে হবে। তার জন্যে অখিল বিন্দুমাত্র ভীত নয়। কারোর ঘরের চালে তার পুঁইশাখ তোলা নেই যে তাদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে থাকতে হবে। এক নম্বর হল, রেখা বউ তার কারিগর। তারপর সে এখন বিপদে পড়ে আছে। মানুষ হিসেবে এবং তার কাজের ঠিকেদার হিসেবে বিপদগ্রস্থ এই মানুষের পাশে সে দাঁড়াবে না? তাতেও মানুষের আপত্তি! আসলে এইসব নিষ্কর্মাদের আপত্তির কারণ অন্য জায়গায়। তার মত আইবুড়ো রসালো ছেলেটা শেষে কি না একটা বিধবা বোয়ের সঙ্গে জুটে গেল! সত্যি গেল কি না গেল তার প্রমাণ দেওয়া পরের কথা। এখন তো তকমাটা তার গায়ে সেঁটে ফায়দা লোটা যেতে পারে। অখিলের কাছ থেকে ফায়দা লোটা অত যে সহজ নয় সেটা সময় বলে দেবে। তাছাড়া যদি সে ওই বিধবা বউটাকে ভালই বাসে। তাতে অন্যের কি যায় আসে? হ্যাঁ,ওদের যায় আসে। সেটা অখিল খুব ভাল করে জানে। নিজেদের বন্নের মেয়ে ছেড়ে অন্য জাতের মেয়ের আঁচলে মুখ ঢাকলে তো তাদের জাতের একটা মেয়ের হিল্লে হল না। তার উপর জাত খুইয়ে দিল! এ যে জঘন্য অপরাধ, তাদের মত স্বঘোষিত গোঁয়ার অন্ধ জাতভক্তদের কাছে। কিন্তু দিনকাল যে পাল্টে যাচ্ছে। জাতের নামে হুজ্জুতি যে এখনকার ছেলেপুলেরা মানছে না। তা ওই সাবেকী মুরুব্বিদের মগজে এখনো ঢোকেনি। এবার সময় এসেছে তা তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেবার। ফাঁকা মাঠে লাঠি ঘোরাবার সময় শেষ। এখন প্রতিপক্ষ ময়দানে এসে গেছে। মুখোমুখি দাঁড়াতে তারা প্রস্তুত।
    বাড়িতে এসে ঘন্টা দুই বিশ্রাম নিয়ে নেয় অখিল। মাকে বলে রেখেছিল, সকাল সকাল রান্না করে দিতে। কোলকাতায় যাবে। মায়ের ডাকে উঠে চানটান সেরে পরিষ্কার হয়ে নেয়। মা ভাত বেড়ে দিলে, খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির বাইরে পা বাড়ায় ও। ভোর ভোর যাবার কথা ছিল। কিন্তু শরীর টানতে পারল না। তাই দেরি হয়ে গেল বার হতে। দেরিই যখন হল, তখন ভাবল, তাহলে যাবার সময় রেখা বউয়ের বাড়ি একবার চক্কর দিয়ে পালপাড়ার কারিগরদের কাজ কতটা কি হল দেখে নিয়ে কোলকাতায় রওনা দেবে। উত্তম ভ্যানয়ালা সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে গেল কি না সেটাও একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন। এগুলো মেয়েদের কাজ না। এইজন্যে বাড়িতে একটা ছেলে থাকা দরকার।
    ভাবনা মত অখিল রেখা বউদের বাড়ি যাবার পথ ধরল। আটচালার কাছাকাছি আসতে দেখে দূরে তাদের পাড়ার ওই তেমাথানি মোড়, যেটা গ্রামের মেন রাস্তার সঙ্গে জুড়েছে, সেখানে বড় বটগাছ তলায় জনা চারেক বসে আছে। ওরা কার জন্যে ওখানে জড়ো হয়েছে তা অখিল বিলক্ষণ বুঝতে পারে। দলে নোচে-বিন্দেও আছে। আর আছে দুই জাতরক্ষার ধ্বজাধারী মুরুব্বি, দিবাকর রুইদাস আর নিত্যানন্দ ঋষিদাস! ওদের দেখে থমকে যায় সে। ওখান দিয়ে গেলেই ওরা তাকে ধরবে। কি বলবে তা তার জানা নেই। তবে
    ভালোবাসবে না তা সে নিশ্চিত। তাকে বিরক্ত করার জন্যেই ওৎ পেতে আছে ওখানে। সক্কাল বেলা। শান্ত খোলা মনে কাজে বেরোচ্ছে। এখনই যদি ও ওদের সঙ্গে কথাকাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে তো সারা দিনটা তার মাটি হয়ে যাবে। সব কাজ চৌপাট হয়ে যাবে। তাই ঠিক করল এদিক দিয়ে না গিয়ে উল্টো রাস্তা ধরে আগে পালপাড়ার কাজটা দেখে তারপর রেখা বউদের বাড়িতে একটু তদারকি করে কোলকাতায় রওনা দেবে। ভাবনা মত পেছন ফিরতেই বিন্দে জোর গলায় হাঁক পাড়লো, “এই অখিল, ওখলে। আমাদের দেখে পিছু হটছিস নাকি রে? ভয় পেয়েছিস বুঝি। এভাবে পালিয়ে ক’দিন বাঁচবি? ধরা তো তোকে একদিন আমাদের কাছে দিতেই হবে।” অখিল যেটা চাইছিল না, পরিস্থিতি মনে হয় সেই দিকেই এগোচ্ছে। শালা নেশাখোর বিন্দের কথায় হু হু করে মাথা তার গরম হয়ে উঠল। নাঃ এদের সমঝে না দিলে চলছে না দেখছি। সত্যি তো, পিছু না হঠে মুখোমুখি হওয়াই সঠিক পথ। রাগে সমস্ত শরীর টগবগ করে ফুটতে লাগল তার। এবার বড় বড় পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। যেতে যেতে হঠাৎ রেখা বউয়ের মুখটা তার মুখের সামনে ভেসে উঠল। রেখা বউ তাকে বলেছিল, “ঠিকাদার বাবু, আপনি আমাদের বাড়ি ঘন ঘন আসেন। ওরা নিশ্চয়ই ভাবছে আপনার সঙ্গে আমি জুটে আছি। তাই আপনার পাড়ার লোকেরা এটা ভাল চোখে দেখে না। প্রথমত আমি স্বল্প বয়সী বিধবা। তার উপর আমরা বেজাত তো। আপনাদের জাতের লোকেরা বড্ড জাত-বেজাত মান্য করে চলে। আপনি একা মানুষ। রাত বিরেতে একা একা যাতায়াত করেন। তাই যখন তখন ওরা আপনার বিপদ ঘটিয়ে দিতে পারে। ওরা কেউ কোন কথা বললে, তাদের কথায় আপনি কান লাগিয়ে মাথা গরম করবেন না।” সঙ্গে সঙ্গে অখিলের উথলে ওঠা রক্ত থিতিয়ে যেতে লাগল। ভেবে নিল, মেয়েরা অল্পেতেই ভয় পেয়ে আপনজনকে সাবধান হতে বলে। অখিল ওদের দেখে বিন্দুমাত্র ডরায় না। তবু এই সাত-সকালে ওদের কোন নরম গরম কথায় সে মাথা গরম করবে না। কথা বলার প্রয়োজন হলে ঠান্ডা মাথায় বিনয়ের সঙ্গে ওদের সঙ্গে কথা বলে নিজের কাজে চলে যাবে। কিন্তু ও জানে, ওরা তা চাইবে না। ওরা চাইবে আমি ওদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কথার পিঠে কথা চাপিয়ে পরিবেশ গরম করে তুলি। তেমাথানি রাস্তায় পাড়া-বেপাড়ার লোক জড়ো হয়ে যাক। তার নামে অপবাদ তুলে সেটা চাউর করে দিক সর্বত্র। সেই সুযোগ ওদের সে করে দেবে না নিশ্চিত হয়ে বিন্দের ডাকেই পিছু না হটে সামনে এগিয়ে গেল। পাড়ার অন্যতম দুই মুরুব্বি, দিবাকর আর নিত্যানন্দদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে কিছু বলবে, নিত্যানন্দ কাকা?” অখিল হঠাৎ নোচে-বিন্দেদের কিছু না বলে তার নাম ধরে সরাসরি প্রশ্ন করায় থতমত খেয়ে যায় নিত্যানন্দ! তাকে ডাকল বিন্দে। আর সেই বিন্দেকে এড়িয়ে কথা বলতে চাইলো তার সঙ্গে? অখিলের কথায় কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে বলল,“না বাবা। আমার কিছু বলার নেই তোমাকে। এখন কাজে বেরোচ্ছ বুঝি?” উত্তরে অখিল বলল, “হ্যাঁ কাকা। জরুরী কাজে কোলকাতায় যেতে হবে। তার আগে আমার কারিগরদের বাড়ি বাড়ি একবার যেতে হবে। তারা সব কাজ কতটা কি করল। দেখে নিতে হচ্ছে। মহাজনদের তাড়া আছে। সময়মত না কাজ দিতে পারলে ওরা, মাড়োয়াড়িরা ভীষণ ট্যাঁকখোর। উল্টোপাল্টা কথা বলে। টাকা কেটে রাখে। সেই সুযোগটা আমি ওদের দিতে চাই না। তাই প্রথমে কোনদিকে যাব ভাবতে ভাবতে তখন থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আবার ঠিক করলাম, আগে মন্ডল পাড়ার ভীষ্মর বোয়ের বাড়ি হয়ে পাল পড়ায় যাব। সেখান থেকে কোলকাতা।” সঙ্গে সঙ্গে নিত্যানন্দ বলল, “আমার বৌমাও তাই বলছিল। অখিলদাদার মালটা আজকেই রেডি করে দিতে হবে। নিয়ে যাবে। ঠিক আছে বাবা তুমি যাও তোমার কাজে।”
    অখিল ইচ্ছে করেই এই চালটা দিল। বিন্দেদের পাত্তা না দিয়ে নিত্যানন্দ কাকাকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল। তার কাছে যে ওদের টিকি বাঁধা আছে। অখিল কাজ দেয় বলে ওনার ছেলের বউ কাজ পায়। সংসারে আয় হয়। সেই আয়েই ঘরে বসে বসে বুড়োর যত নফরচফর। অখিল কাজ বন্ধ করে দিলে যাবতীয় তেলানী শুকিয়ে বাতাসের কাঁধে ভর করে হাওয়া হয়ে যাবে। আর দিবাকর কাকা? ওর দশাও একদম নিত্যানন্দ কাকার মত। বিন্দে, নোচেদের মত ছ্যাবলামো করলে ওদের চলবে নাকি!
    এই বিন্দে একসময় অখিলের এক নম্বর বন্ধু ছিল। একই বয়সী ওরা। নোচেও ওদের সমবয়সী। তখন অখিল মোহন গোড়ের শোলা কারখানায় কাজ করত। দিন মজুরী নিয়ে বাড়ি ফিরতো। বিন্দে সে সময় পাড়ায় টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াতো। অখিল বন্ধু বিন্দেকে বলেছিল, মোহনের কারখানায় যদি কাজ করতে সে ইচ্ছে করে তাহলে মালিককে বলে কয়ে কাজে লাগিয়ে দিতে পারে। হাতে দুটো পয়সা এলে মনও খুশ থাকে। সংসারে দু’চার পয়সা দিতে পারে। অনেকটা বড় হয়েও অখিল সেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর টান তখনও জোরদার ছিল। কিন্তু ছেলেটা এঁচোড়ে পেকে গেল। পাড়ার উঠতি মেয়েদের পেছনে সময় কাটিয়ে জীবন গড়ার সময়কে হেলাফেলা করল। একদিন হঠাৎ বিন্দে তার কাছে এসে বলে, “অখিল তুই আমার মান বাঁচা। আমাকে তিরিশটা টাকা ধার দে। পরশু তোকে শোধ দিয়ে দেব। না হলে মুক্তির কাছে আমি মুখ দেখাতে পারব না। আজ ওকে ফতেপুরে শীতলা টকিজে সিনেমা দেখাব বলেছিলাম। ভুলেই গেছি। সেজেগুজে ও রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার কাছে একটা কানাকড়ি নেই!”
    -মুক্তির সঙ্গে তুই প্রেম করছিস? ও তো সবে সিক্সে পড়ে!
    -কি করবো বল। ওকে আমার ভাল লেগে গেল। আমি সাহস নিয়ে সরাসরি ওকে ভালোবাসার কথা বললাম। সেদিন ও ‘ধ্যাৎ’ বলে দৌড়ে পালালো! দিন কয়েক পর বট গাছ তলায় আমি ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। স্কুল যাবার সময় হয়ে গেছে। মুক্তি এবার স্কুলে যাবে। অবশেষে অপেক্ষায় পাশ! স্কুলের পথে ওর পেছন পেছন কথা বলতে বলতে অনেকটা গেলাম। ও কিন্তু কোন কথা বলছে না। শেষে বললাম,“কই, তুমি উত্তর দিচ্ছ না যে আমার কথায়?” তখন ও বলল, “প্রেম করতে এসেছো, খাওয়াবার ক্ষমতা আছে? আগে সেটা বলো।”
    -তোমার জন্যে আমি প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারি।
    বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তারপর ট্যাঁক থেকে গরুর চামড়া কাটা ছুরি বার করে বিন্দে বলল, “তুমি চাইলে এইটা আমি আমার পেটে ঢুকিয়ে দিতে পারি। তোমাকে আমি এতটা ভালোবাসি। আর বউ হলে বউকে খেতে দেয়া তো কোন ছার। দরকার হলে নিজে না খেয়ে বউকে খাওয়াব।”
    বিন্দের এমন পণে সক্রিয় হয়ে মুক্তি বলল, “না না বাবা ! মানুষ খুনের দায় আমি নিতে পারব না। আমাকে ভালবাসতে গিয়ে তুমি যদি মরে যাও তা আমার ধর্মে সইবে না। ঠিক আছে, তুমি যা চাও তাই হবে।” এই বলে মুক্তি খিলখিলিয়ে হাসি দিয়ে স্কুলের পথে দৌড় মারল।
    তাদের প্রেম পর্বের খন্ড কথা শুনিয়ে বিন্দে কাতরভাবে অখিলকে বলল,“জানিস অখিল, সেই থেকে মুক্তি আমার। মুক্তি আমার ধ্যান জ্ঞান। আমার ইহকাল- পরকাল। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারব না। এখন ওই তিরিশটা টাকা দিয়ে তুই আমার মান বাঁচা অখিল।”
    শালা বিন্দে, হারামজাদা! দিনকতক মুক্তির সঙ্গে ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর করে একদিন সন্ধ্যের মুখে পাড়ার ছোকরাদের হাতে ধরা পড়ল। রতন কাকার গোয়াল ঘরের পাশে খড়কাটার পাশ কামরায় বিন্দে আর মুক্তি নাকি দু’জনে চুরি-চামারি করে শরীর দেয়ানেয়া করছিল। ব্যাস! পাড়ায় চেঁচামেচি হইচই, লোকজড়ো। ছোকরারা এক কাপড়ে দু’জনকে জড়িয়ে আটচালায় এনে হাজির! তাদের দাবি আজ রাতেই এদের ‘ধরে বিয়ে’ দেওয়া হবে। ডাক পড়ল উভয়ের বাবা মায়ের। ছেলের বাবা পন-পাওনা না পেলে এ বিয়েতে রাজি নয়। ছেলের বাপের কথা, “এটা ঠিক, আজ হঠাৎ করে তো এসব জোগাড় করা সম্ভব নয়। অন্তত আজ কথা দিতে হবে মেয়ের বাপকে যে তিন মাসের মধ্যে ছেলের তিনটে, মানে ঘড়ি-অংটি-বোতাম আর মেয়ের তিনটে, হাতে-কানে-গলায় সোনার গয়না যৌতুক হিসেবে এবং নগদ পাঁচ হাজার টাকা তারা দিতে রাজি। বর পক্ষের কথায় মেয়ে পক্ষের তো কপালে হাত। তারা নিজেরা ঠিক মত দু’বেলা খাবার জোটাতে পারে না। এত বর-পন-যৌতুক তারা তিন মাস কেন তিরিশ বছরেও জোগাড় করতে পারবে না। পাত্র-পাত্রী নিজেরা প্রেম করেছে মেলামেশা করেছে। ওরাই বুঝুক কি করবে। তবে আমার মেয়ের সর্বনাশ যদি ওই ছেলে করে থাকে তো আমরা ছেড়ে কথা বলব না। আটচালা যদি এর একটা বিহিত না করে তো থানা-পুলিশ আমরা করব!
    শেষ পর্যন্ত আটচালার নিদানে ওই রাত্রেই দিঘিরপাড়ের জামা কাপড় দোকানদার, বাসু ঘোষের বাড়ি গিয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে বিয়ের সাজসজ্জা বাকিতে নিয়ে যায়। ধারের টাকাটা দেবে পাত্রপক্ষ। জামিনদার হল, আটচালা। পাত্রপক্ষ কথা খেলাপ করলে আটচালার ফান্ড থেকে আপাতত সেই ধার শোধ করা হবে। তারপর আটচালা বিন্দেদের কাছ থেকে আদায় করে নেবে।
    এমন বিয়ে ওদের রুইদাস পাড়ায় আখচার আগে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিন্দে তো তবু ভালো। ভদ্রসদ্র ভাবে একটা বিয়ে হয়েছিল। আর ওই নোচে! ও তো আর এক ‘ঢেমনা’। ও নাকি পাড়ার সুবোধ কাকার নাতনি, আরতির প্রেমে পড়েছে।
    আরতির যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন ওর বাপ অকালে কলেরায় মরে যায়। দাদু, সুবোধ কাকা তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করছে। প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে, ছেড়ে দেয় পড়া। দাদুর ঢাক-ঢোল তৈরী বা সারাইয়ের কাজে যোগান দিয়ে দিন কাটায়। শরীর ‘রঙিন হবার’ সময়কাল পার করে আরও বছর দুয়েক পেরিয়েছে তার বয়স তখন। সেই সময় থেকেই নোচে তার পেছনে পড়ে যায়। আরতি তাকে নাকি পাত্তাই দেয় না। কিন্তু নোচের গোঁ, ওকে সে বউ করে ঘরে তুলবে। যখন তখন রাস্তাঘাটে মেয়েটাকে বিরক্ত করতো। আর পাড়ায় একদল নিষ্কর্মা ছেলে ছিল, যারা এইসব অকর্মাকে ধরার জন্যে ওৎ পেতে থাকতো। নোচে একদিন রাত্রে আরতির শোবার ঘরের বাইরে জানলা দিয়ে ফিসফিস করে ডাকছে, “আরতি, তুমি একটু উঠে বাইরে আসবে? তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার আছে। অনেক কথা আছে আমার। তোমাকে সেকথা না বললে আমার রাতের পর রাত ঘুম হচ্ছে না। না-ঘুমে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আরতি। তুমি চাও, এইভাবে তিলে তিলে শরীর খারাপ হতে হতে আমি মরে যাই? আমার এই অকাল মরণের জন্যে তুমিই কিন্তু দায়ী থাকবে আরতি।”
    নোচের এই উস্কানীমূলক কথাগুলো পেছন থেকে চৌকী দেওয়া পাড়ার ছেলেরা শুনছিল। ঘরের ভেতর থেকে অবশ্য আরতির কোন গলার শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। নিশ্চয়ই বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল তখন সে। গভীর রাত। সেটাই স্বাভাবিক। এবার পাড়ার ছেলেরা তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। এখানে ওই মেয়েটার ঘরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন তাকে বিরক্ত করছিল, তার কৈফিয়ৎ চায়। নোচে সাফ কথা জানিয়ে দেয়, সে আরতিকে বিয়ে করবে। খুব ভালোবাসে সে আরতিকে। ও রাজি না হলে সে আত্মহত্যা করবে বলে পণ করে। ভালবাসার কারণে জ্বলজ্যান্ত টগবগে একটা ছেলে আত্মহত্যা করেবে তা কেমন করে হয় ! ছেলেরা কেউ তা চায় না। ওই রাতেই ডাক পড়ল পাড়ার মুরুব্বিদের। ডাক পড়ল আরতির দাদু, সুবোধ কাকা এবং নোচের বাবা মায়ের। সাব্যস্ত হল, নোচের সঙ্গে আরতির বিয়ে দেওয়া হবে, এই রাত্রেই। তবে কোন বরপণ দিতে হবে না মেয়ের পক্ষ থেকে। গরিব সুবোধ কাকা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। বাপ মরা মেয়েটা যে তার গলগ্রহ হয়ে আছে। এই মওকায় যদি মেয়েটার একটা উপায় হয়ে যায় মন্দ কি! আরতির মা, শ্বশুরের কথায় সায় না দিয়ে বলে, “ওইরকম বাজে ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে আমার একদম মন নেই। মেয়েও এ ছেলেকে পছন্দ করে না। এ বিয়ে তুমি বন্ধ করো বাবা।” তখন রেগে গিয়ে আরতির দাদু তার মাকে বলে,“তাহলে মেয়ের বিয়ের দায় তোমাকে নিতে হবে। ওর বিয়ের বোঝা আমি এই বুড়ো কাঁধে বইতে পারব না।” তখন বাধ্য হয়ে আরতির মা বলে, “তা আমি মেয়েমানুষ, মেয়ের বিয়ের দায় কেমন করে নেব। তাই যদি তোমার ইচ্ছে তাহলে তাই হোক। সবাই মিলে মেয়েটাকে আমরা দরিয়ায় ভাসিয়ে দিই। ভাসতে ভাসতে উল্টো স্রোতে যদি মেয়েটা আবার তোমার ডেরায় ফিরে আসে তার দায় কিন্তু তোমাকে নিতে হবে বাবা? আমি ঘুম থেকে তুলে দিচ্ছি তোমার নাতনিকে।” বলে আটচালা থেকে তরতরিয়ে বাড়িতে চলে এসে মেয়েকে ডাকে, “এই আরতি, ওঠ! অনেক ঘুমিয়েছিস। আর ঘুমোতে হবে না। ওঠ! ওঠ! তোর বিয়ে! ওঠ! ওদিকে লোকজন সব বাজারে গেছে, বিয়ের সাজ আনতে। মুখ ধুয়ে টুয়ে রেডি হয়ে নে। বাজার থেকে বিয়ের সাজ নিয়ে আসলেই কনে সাজে আটচালায় যেতে হবে। নোচের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে তোর দাদু আর পাড়ার লোকজন। তোর, আমার ইচ্ছাকে ওরা ‘ধরতার’ মধ্যে আনতে চাইছে না।”
    কিভাবে রোজগার করে জীবনে বড় হওয়া যায় সেই ভাবনা নেই। কিন্তু অপরিণত বয়সে যখন তখন বিয়ে করার ভাবনায় রুইদাস পাড়া মশগুল। মেয়েদের চাওয়া পাওয়ার এরা কোন দাম দেয় না। কেউ এই অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গেলে সমবেতভাবে তার উপর চাপ দিয়ে দমিয়ে দেওয়া হয়। ওদের পাড়ার বেশিরভাগ মেয়েই পাড়ার মধ্যে থেকে যায়, পাড়ার কোন না কোন ছেলের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে। আটচালার তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
    বরং তাকে মদত দিয়ে যায়। আটচালা তথাকথিত মুরুব্বি বিচারকদের কথা, তারা কিছুতেই চায় না তাদের জাত, ‘বর্ণ-শঙ্কর জাতে’ পরিণত হোক। সংসারের ঘানি আর টানতে পারছিল না বিন্দে। পারবে কেমন করে। আগে তো নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। তার পরে তো বিয়ে! একদিন বউ পিটিয়ে, গরুর চামড়া কাটা ছুরি দিয়ে বোয়ের হাতে ‘চ্যাঁ’ দিয়ে সেই রক্ত হাতে নিয়ে ছুটে এসেছে অখিলের কাছে, বিন্দে শালাটা! বলে, চাল কিনে আনতে পারিনি বলে মুক্তি যাচ্ছেতাই বলে গালাগালি দিচ্ছিল। সহ্য হচ্ছিল না। চুল্লু খেয়েছিলাম, মাথায় খুন চেপে গিয়ে এই ভুল কান্ডটা করে ফেলিছি অখিল। তুই আমাকে কিছু টাকা ধার দে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই বউকে।” কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অখিল বিন্দের গালে সপাটে একটা চড় কসিয়ে বলে,“শালা শুয়োরের বাচ্চা!”
    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৫)

     জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার


    [তেত্রিশ]

    অলোকাদির মায়ের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে দাবায় এসে দাঁড়ায় সনাতন। জিজ্ঞেস করে, “কি জ্যেঠিমা? দিদি কেমন আছে? যেদিন কোলকাতা থেকে ফিরি সেদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারপর অনেকদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়নি। আসলে সেই পুজোর আগে কোলকাতায় গিয়েছি লক্ষ্মীপুজো সেরে বাড়ি ফিরি। অনেক কাজ জমে ছিল। সেইসব কাজ গোছগাছ করে নিতে আরও কতদিন সময় চলে গেল। যাব যাব করে দিদির কাছে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দিদির সঙ্গে আমারও দরকার আছে। তোমরা সবাই ভালো আছো তো জ্যেঠিমা? বলো, আমাকে কিছু বলবে?”
    অলোকা কী বিশেষ দরকারে তোকে ডেকেছে রে বাবা। দরকারটা নাকি জরুরী। সে’কথা আমাকে বারবার বলতে বলেছে তোকে। আর বলেছে, যদি ব্যস্ত থাকে তো কাজটা সেরেই যেন আমার কাছে চলে আসে। তা তুই বাবা সময় করে একবার আমাদের বাড়ির দিকে যাস। না হলে আবার আমাকে ‘মুখ’ করবে। বলবে, তুমি নিশ্চয়ই সনাতনকে ভালো করে বলে আসনি। আমি মুখ্যু মানুষ। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কথা যেন ধরতেই পারি না। মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।” অপারগতার ভাবনায় অলোকাদির মা বলল। অলোকাদির মায়ের কাছ থেকে দিদির তলবের কথা শুনে মনে মনে জিভ কাটে সনাতন। ইস্,কোলকাতা থেকে ফেরা ইস্তক দিদির সঙ্গে না দেখা করাটা ঠিক হয়নি। সেই দিনই দিদি বলেছিল দেখা করার জন্যে। বাজে কাজ হয়ে গেল। কিন্তু এখন তো সে যেতে পারবে না। বাবা দোকানে চলে গেছে। তাকেও যেতে হবে। বাবা অপেক্ষা করবে তার জন্যে। তাই অলোকাদির মা’কে বলল, “জ্যেঠিমা, দিদিকে বলে দিও আজ দোকান থেকে ফিরে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আমি যাব।” সনাতন বলার পর অলোকাদির মা ফিরে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় সনাতনের মা পেছন থেকে ডাকলো, “কিগো দিদি। চলে যাচ্ছো যে। এসো একটু চা খেয়ে যাও। চা খেতে খেতে দু’দন্ড কথা বলা যাবে। এমনিতে তো আর ঘর-সংসারের কাজের ঝামেলায় এতটুকুও বকবক করার সময় হয় না।”
    -নাগো দিদি। এখন একদম সময় নেই। এই এখন গিয়ে আমার গরুর খড় কুঁচতে হবে। জাবনা করে দিতে হবে। মেজলা একদম শুকনো হয়ে আছে। সন্ধ্যের আগে গরু নিয়ে এসে ওর বাবা গোল ঘরের এই অবস্থা দেখলে আমাকে আর তিষ্টতে দেবে না। চলি গো দিদি। পরে সময় করে আসবো’খন।” শাড়ীটা কোলকাতার হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজো কমিটির প্রধান, সন্তোষবাবুর স্ত্রী বউবাজার মার্কেট থেকে নিজে গিয়ে কিনে বাবাকে দিয়ে বলেছে,“বৌদিকে এটা দিলাম। পরতে বলবেন।” দামী শাড়ী সেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে। বাবা খুব খুশি হয়েছিল। পুরোনো জামা কাপড়ের সাথে একদম নতুন শাড়ী ওই পাড়ার কয়েকজন দিয়েছে। বড়মুখ করে বাবা, মা’কে শাড়ীটা পরতে বলে। মা কিছুতেই রাজি নয়, “এমন মোটা কাজ করা শাড়ী আমি জীবনে পরিনি। কোমরে গুঁজে রাখতে পারব না। অভ্যেস নেই তো কি করব।” তারপর বলে,“একটা দামী শাড়ী পরে বড়লোকি চাল চেলে তো লাভ নেই। নিজের ক্ষমতায় এমন শাড়ী কোনদিন কিনতে পারব না। কিনবও না। অযথা পয়সা নষ্ট করা আমি একদম পছন্দ করি না। তাই বলছি, অন্য কাউকে যদি পারো দিয়ে দাও। সে পরে আনন্দ পাবে।” মায়ের কথা শুনে বাবা বলল, “তোমার কথায় অবশ্য যুক্তি আছে। তুমি না পরতে চাইলে আমি জোর করব না।” তখনই মা সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এক কাজ কর সনাতন। তোর অলোকাদিকে এই শাড়ীটা দিয়ে আসিস। ও পড়াশোনা করা মেয়ে। বাইরে এদিক ওদিক রোজ বার হতে হয় ওকে। তাই শাড়ীও বেশি লাগে। লোক-সমাজে এমন শাড়ী পরলে ওর মানাবেও ভাল। প্রথমে অবশ্য মেয়েটা ‘না-না’ করবে। মুখচোরা মেয়ে। তবে মনে হয় তুই দিলে ও তোকে ফেরাবে না।” সনাতন দেখল মায়ের কথায় বাবাও মাথা নেড়ে সায় দিল। কোলকাতা থেকে ফেরার দিন ও অলোকাদিকে উপহার দেবে বলেছিল। তবে সেটা অবশ্য এই শাড়ীর মত দামী নয়। মা-বাবা এই শাড়ীর কথা বলতে ও বেশ খুশি হয়। একটা ভাল উপহার দিদিকে দিতে পারবে ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এখন দুটো উপহার একসাথে সে দিদিকে দিতে পারবে।
    মোটামুটি সাড়ে সাতটা হবে ওদের উঠোনে টর্চের আলো ফেলে একজন কাউকে গুটি গুটি পায়ে আসতে দেখে অলোকা। এই সময় সনাতনের আসার কথা। নিশ্চিয়ই সনাতন আসছে। তৃপ্ত মনে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে অলোকা জিজ্ঞেস করল, “কে, সনাতন?” ‘হ্যাঁ’ বলতে বলতেই সনাতন দাবার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। “আয়, উপরে উঠে আয় ভাই। চটিটা একদম নীচে রাখিস না। উপরের সিঁড়িতে রাখ। আসা যাওয়াতে কারোর পায়ে লেগে এদিক ওদিক ছিটকে চলে যেতে পারে।” সনাতনকে দোলায় বসতে বলে ঘরের ভেতর থেকে বেতের মোড়া আনতে যাবার সময়ই সনাতন বলল,“দিদি, শোনো না। এই শাড়ীটা মা তোমার জন্যে পাঠিয়েছে। আমরা কোলকাতায় কাজ করে ফেরার সময় পুজো কমিটির হেড-বাবু এটা উপহার দিয়েছে। মা এমন শাড়ী পরতে একদম চাইছে না। বলে,“এসব কম বয়সী মেয়েদের মানায়। আমরা এখন বুড়োর দলে। তুই বরং একটা কাজ কর । ওটা তুই তোর অলোকাদিকে দে। ওকে মানাবে ভাল। মা তোমার নাম বলাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। খুশি মনে আমি এটা তোমাকে দিতে এসেছি। তুমি কিন্তু ফিরিয়ে দেবে না দিদি। তাহলে আমি মনে কষ্ট পাব। বড় মুখ করে এনেছি, তোমার জন্যে।”
    সনাতন ভায়ের মত। আর এমন করে ছেলেটা বলছে। কেমন করে সে তাকে ফিরিয়ে দেয়। নেব না বললেই ছেলেটা একদম মনমরা হয়ে যাবে। তাছাড়া দাতা যদি অন্তরের ভালবাসা দিয়ে কিছু দান করে তো তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। অলোকার বুঝতে অসুবিধা হল না যে সনাতন সম্পূর্ণ নিষ্পাপ মনেই তাকে এটা দিতে চাইছে। আর অলোকা সেটা নিলে প্রকৃতই সে তৃপ্ত হবে। পুলকিত মনে অলোকা সেটা হাতে নিয়ে হাঁক পেড়ে তার মা’কে ডাকলো,“মা, এদিকে আসো, সনাতন আমার জন্যে কি এনেছে দেখো। পাগল ছেলে। আমি এটা না নিলে নাকি ও ভীষণ কষ্ট পাবে।” মা আসতেই প্যাকেট থেকে সেটা বার করে খেলিয়ে দেখতে দেখতে মা’কে বলে,“কি সুন্দর শাড়ীটা দেখো মা! সুন্দর সুন্দর চিকনের কাজ। রঙের কম্বিনেশন! এত দামী শাড়ী আমি কোনদিন পরিনি। পরবো কেমন করে! কেনার ক্ষমতাই নেই! এই শাড়ীটা মা, আমি তোলা শাড়ী হিসেবে রেখে দেব। কোন বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এটা পরব।”
    দিদির আনন্দে সনাতনও মনে মনে আপ্লুত হয়ে বলে,“দিদি। আর একটা জিনিস আমি নিজে পছন্দ করে তোমার জন্যে এনেছি। এটা আমি আমার পাওয়া বকশিশের পয়সায় কোলকাতার দোকান থেকে কিনে এনেছি। তুমি জিনিসটা পরতে ভালবাসো আমি দেখেছি। পকেটের ভেতর সেটা লুকিয়ে রেখে বলল, বলো তো দেখি এটা কি হতে পারে?”
    -কি আবার, মাথার ক্লিপ? ওটা আমার শখ।
    -তুমি একদম ঠিক ধরেছো। তবে এটা বেশ অন্য ধরণের। এদিকে পাওয়া যায় না। ওটা বাইরে থেকে আসে। বাংলাদেশ। তোমার পছন্দ না হয়ে যায় না, দেখবে?
    এইসব কথালাপের মধ্যে হঠাৎ অলোকার মনে পড়ে গেল, যে জন্যে সনাতনকে তার জরুরী তলব, সেটা বাদ দিয়ে অন্য কত সব কথা হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন একটু গম্ভীর হল অলোকা। সনাতনকে বলল, “তোকে যে জন্যে মাকে দিয়ে ডাকালাম সেটাই তো এখনো বলা হয়ে উঠল না।” মায়ের দিকে চেয়ে বলল, “মা, তুমি শাড়ীটা নিয়ে চলে যাও। এর সঙ্গে আমার অন্য কথা আছে।” বলে অলোকা ঘরের ভেতর থেকে সারদা মিশনের চিঠিটা নিয়ে এল। আস্তে আস্তে দুলতে থাকা দোলাটাকে বাঁ-হাত দিয়ে থামিয়ে বসার মোড়াটা সনাতনের আরও কাছে টেনে নিয়ে বসে গলার স্বর ছোট করে বলল,“ভাই, এই চিঠিটা তুই বিপ্লবদার হাতে দিয়ে আসতে পারবি? খুব দরকারি চিঠি। আমাদের পাড়ার কেউ যেন জানতে না পারে যে আমি তোকে বিপ্লদার কাছে পাঠিয়েছি। তাহলে পাড়ার মধ্যে আবার একটা অনর্থ শুরু হয়ে যাবে।” সনাতনের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে উদাস মনে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল অলোকা। কতক্ষণ, যেন তার খেয়াল নেই! সম্বিৎ ফেরে সনাতন যখন বলে, “কি ভাবছো দিদি? মনে হচ্ছে তুমি বেশ চিন্তিত? তোমার চিন্তা করতে হবে না দিদি। পাড়ার কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। আমাকে যে দায়িত্ব তুমি দিলে তা মসৃণভাবেই আমি পালন করে দেব।” সনাতন কি বলছে সেদিকে যেন মনই নেই অলোকার! অন্ধকার থেকে ঘাড় ফিরিয়ে সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে হয় আমার আর কলেজে পড়া হবে না রে ভাই। কত স্বপ্ন ছিল, রুইদাস পাড়ার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হব। মনে হয় স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেল আমার জীবনে।”
    অলোকাদির এমন অভাবনীয় কথায় চমকে ওঠে সনাতন! বিস্ময়ের সঙ্গে বলে,“এমন কথা বলছো কেন দিদি? বাধা কোথায় দিদি? আমি পারব না তোমার পাশে থাকতে? আমি থাকতে কোন বাধাই তোমার বাধা হতে দেব না। কোলকাতায় কাজে গিয়ে অনেক বড়বড় মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তারা আমাকে কথা দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা সবসময় আমার পাশে থাকবে বলেছে। বাবুদের বললে, তোমার পড়াশোনার সব ব্যবস্থা ওরা করে দেবে। কোন দুশ্চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।”
    -না রে ভাই। কেউ আমাকে পড়ায় বাধা দিচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে, ডিগ্রী পড়া এখন আর আমার হবে না। অন্য পড়া পড়তে হবে। চাকরির পড়া। প্রাইমারী স্কুলে পড়াবার জন্যে ট্রেনিংয়ের পড়া! মন থেকে এটা এখন আমি চাইছিলাম না। বিপ্লবদার কথা মতো সরিষা মা সারদা মন্দিরে দরখাস্ত করেছিলাম বেসিক ট্রেনিং পড়ার জন্যে। ভেবেছিলাম, আমাদের ধরাকরার কেউ নেই। ওটা পড়ার সুযোগ পাব না। কিন্তু মেধার জোরে আমার সুযোগটা এসে যায়। এটা তারই চিঠি। না-খুশি, না-দুখী মনে অলোকা কথাগুলো বলল।
    অলোকাদির হাত থেকে চিঠির খামটা প্রায় ছিনিয়ে নেবার মত করে নিয়ে সনাতন বলল,“বেসিক ট্রেনিংয়ের চান্স পাওয়া চিঠি! কি মজা। দিদি বেসিক ট্রেনিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, কি বলব। আমার অলোকাদি এটা পাশ করলেই যেকোন সময় মাস্টারির চাকরি পেয়ে যাবে। আজকাল এটা পাশ না করলে প্রাইমারী স্কুলে ঢোকার সুযোগই নেই। আর দিদি ! তুমি কি না মন খারাপ করছো ডিগ্রী পড়তে পারবে না বলে? আসলে দিদি, তুমি জানোই না তোমার কতটা যোগ্যতা। তাই তুমি তোমার যোগ্যতাকে খাটো করে দেখো। কত ছেলেমেয়ে এটা পড়ার জন্যে মাথা খোঁড়ে, জানো! চান্সই পায় না। সেখানে কোন মামা-দাদা না ধরেই তুমি তোমার আপন যোগ্যতায় সুযোগটা পেয়ে গেলে। গুলি মারো তোমার বি.এ. পাশ। ওটা পাশ করার অনেক সময় তুমি পাবে। আগে জীবনটা বাঁচুক। তারপর,জীবন যাত্রা। আমি কাল সক্কালে বিপ্লবদা কলেজে বেরিয়ে যাবার আগেই পৌঁছে যাব ওদের বাড়ি। দিদি, আবার বলছি, কোনো মন খারাপ নয়, আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে এখানে তুমি ভর্তি হয়ে যাও। আর বিপ্লবদা যা যা বলবে, অক্ষরে অক্ষরে তুমি তাই করবে। তোমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।”
    -তুই তো দেখছি একদম বিপ্লবদার মত কথা বললি। ঠিক একই কথা সে আমাকে বলেছিল, এটার জন্যে দরখাস্ত করার সময়। আমি চাইছিলাম না। আর সে নাছোড়। করতেই হবে। সেই চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসা পুজো করার মত অবহেলাতেই আবেদন পত্রে সই করে দিয়েছিলাম। পুরো ফর্ম ফিল আপটা বিপ্লবদাই করে দিয়েছিল। সে এবার চিঠিটা দেখলে খুবই আনন্দ পাবে। সেই আনন্দ তোর বিপ্লবদার মত আমার কিন্তু হচ্ছে না।”
    সপ্তাহে একদিন, শুক্রবার করে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ছাত্রীদের দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। দরকারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্যে সারদা মন্দিরের বাইরেও ছাত্রীকে নিয়ে যেতে পারবে বাড়ির লোক। অলোকা, বাড়ির লোক হিসেবে বিপ্লবের নামটা লিখিয়ে রেখেছে। কেননা তার বাবা-মা তো এখানে আসবে না। বাবা দিনমজুর। এখানে আসা মানেই একদিনের রোজগার বন্ধ। তার উপর আসা যাওয়ার খরচা। আর মা, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। মেয়ের ইস্কুল পাঠশাল লেখাপড়ার ব্যাপারে খোঁজ নেবার যোগ্যতাই তার নাকি নেই। অলোকা জোর করে বললেও তা কানে নিতে চায় না, তার মা। ঘর- গেরস্থালির কাজেই মা বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে দু’জন বাড়ির লোকের নাম রেজিস্ট্রি করাতে হয়। যারা সেই ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাবে। মেয়েদের স্কুল বলেই এতটা কড়াকড়ি। বাবা মাকে জানিয়েই অলোকা, বাড়ির লোক হিসেবে বিপ্লবের নামটা দিয়েছে। মেয়ে, অলোকার পড়াশোনার ব্যাপারে যেহেতু তার প্রয়োজন, তারা ‘না’ বা বলে কেমন করে। মনে মনে যে অলোকা বিপ্লবকে পছন্দ করে সেটাও ওর বাবা মায়ের অজানা নয়। তাছাড়া বিপ্লব ছেলেটা তো খুবই ভাল ছেলে। পরোপকারি। এই ছেলেটা অলোকার পাশে না থাকলে তাদের মেয়ে পড়াশোনায় এতটা উপরে যে উঠতে পারত না তা তারা খুব ভাল করেই জানে। সেইজন্যে ওরা তার প্রতি কৃতজ্ঞও।
    নানান হাতের কাজ, ড্রয়ইং, প্রোজেক্ট ওয়ার্ক হিসেবে জমা দিতে হয়
    অলোকাদের। এমন শক্ত শক্ত সব কাজ যেটা অলোকাদের মত মেয়েদের পক্ষে ওই ট্রেনিং সেন্টারে বসে করা সম্ভব নয়। প্রায় কোন মেয়েই তা করতে পারে না। সব্বাই বাড়ির লোকের উপর ভরসা করে। বাড়ির লোক আবার নিজেরা না পারলে অপরকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে ওই শুক্রবার করে দিয়ে আসে এবং অন্য দরকারি কথা সেরে নেয়। দু’দন্ড প্রিয়জনকে চোখের সামনে দেখে মানসিকভাবে তৃপ্ত হয়। অলোকার এখন মনে পড়ছে, সেই দরখাস্ত লেখার সময় বিপ্লবদা তাকে এরকমই প্রজেক্ট ওয়ার্ক এখানে করতে হয়, তেমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল। তখন অলোকা সেই কথাকে, বলতে গেলে আমলই দেয়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, কতটা সঠিক ছিল সেই কথাগুলো। সেদিনের দেওয়া কথামত বিপ্লবদা অলোকার এইসব কাজ তৈরী করে দেবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। তাই এই কাজের জন্যে এবং অলোকার প্রতি আকর্ষণের অদৃশ্য এক সূতোর টানে সপ্তাহের নির্দিষ্ট সেই দিনে বিপ্লব সারদা মন্দিরের ভিজিটিং রুমে গিয়ে হাজির হয়। বিপরীতে, বলা যায় সারা সপ্তাহ ধরে অলোকাও মুহূর্ত গুনতে থাকে কখন শুক্রবার আসবে। তার বিপ্লবদার সঙ্গে দেখা হবে। তাই আকর্ষণটা শুধু এক তরফের নয়, দু’তরফেরই।
    প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসের জন্যে দিদিমণি কাপড়ের ছিট তার রঙ এবং সাইজ দিয়ে দিয়েছে। সেটা বাড়ির লোকদের দিয়ে কিনিয়ে রাখতে হবে। রুটিনমত নির্দিষ্ট দিনে সেটা লাগবে। বিপ্লবদাকে বললে হয়তো সে ওগুলো কিনে এনে দেবে। কিন্তু মনের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব রয়ে যায় অলোকার। যদি বিপ্লবদা ঠিক ঠিক মত সবটা কিনে উঠতে না পারে? কেননা, দিদিমণি ক্লাসে তাদের দেখিয়ে দিয়েছে কাপড়গুলোর রঙ এবং সাইজ। বিপ্লবদা তো সেটা দেখেনি। অলোকার চোখে যেটা ভাসছে, বিপ্লবদার তা হবার নয়। তাই ও ঠিক করল, বিপ্লবদাকে সঙ্গে নিয়ে ডায়মন্ড হারবার থেকে ওগুলো কিনে নিয়ে আসবে। সেই শুক্রবার অলোকা একদম তৈরী হয়েই আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। বিপ্লবদা আসতেই বলল,“আজ এখানে বসে কথা বলার সময় নেই বিপ্লবদা। আমাদের ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। কিছু জিনিস কেনার আছে। তোমাকে বললে, তুমি হয়তো তা কিনে আনতে পারবে। কিন্তু যদি দিদিমণির চাহিদামত সব ঠিকঠাক না হয় তো অসুবিধায় পড়ে যাব। তাই আমরা দু’জনে আজ যাব। ওইসময় যা কথা বলার বলা যাবে’খন। চলো আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ি। অফিস থেকে আমি বাইরে যাবার অনুমতি আগেই নিয়ে রেখেছি। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, সেটাও লিখে দিয়েছি।”
    সাইজ মত সাদা এবং রঙিন ছিট কাপড় আর সেলাইয়ের অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা হয়ে যাবার পর বিপ্লব বলল,“চলো অলোকা, তোমাকে কিছু খাওয়াই। এই প্রথম তুমি আমার সঙ্গে বাইরে কোথাও বার হলে। তোমাকে কিছু না খাওয়াতে পারলে আমার খারাপ লাগবে। তাছাড়া আমি তো বড়। ছোটদের উপর বড়দের একটা দায়িত্ব থাকে। অনেকক্ষণ আগে হোস্টেলের খাবার খেয়েছো। খিদেও পেয়ে যাবার কথা। তারপর শরীর খারাপ হলে তার দায় আমাকে নিতে হবে।”
    বিপ্লবের কথায় তীর্যক ঢঙে অলোকা বলল,“হুঁ, বড় মানে, একদম তালগাছের মত বড় আমার থেকে। তুমি কোন ক্লাস আর আমি কোন ক্লাস একবার হিসেব করে দেখো তো দেখি? কতবড় তালগাছ তুমি? তাছাড়া আমার এখন খিদে পায়নি। এটাসেটা খেয়ে পয়সা নষ্ট করতে হবে না। এই তো এগুলো কিনতে কত টাকা খরচ হয়ে গেল। সবার আগেই পকেটে হাত গলাবার স্বভাব তোমার। আমাকে কিছুই দিতে দিলে না।”
    এখন নাই বা দিলে। যখন দেবার সময় হবে তখন হৃদয় উজাড় করে দিও। তাহলেই তো হবে। তখন কার্পণ্য করে আমাকে হতাশ করলে চলবে না কিন্তু! বলে মুচকি একটা হাসি অলোকার দিকে ছুঁড়ে দিল বিপ্লব! প্রতিহাসিতে অলোকা বলল, “খুব কথা শিখেছো তো দেখছি। কি বলতে চাইলে আমি বুঝতে পারলাম না ভাবছ, তাই না? অত বোকা আমি নই।”
    কে বলেছে তুমি বোকা? অনেকের থেকে অনেক বুদ্ধিমতি এবং চালাক বলেই না তুমি আজ এখানে আসতে পেরেছো। বলতে বলতে আবার একটা কপট হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বিপ্লব বলল, তবে হ্যাঁ, এই ব্যাপারটায় তুমি কিঞ্চিত বোকা তো বটেই।”
    -কি! আমি বোকা? কোন্ ব্যাপারটায় আমি বোকা তোমাকে আজ বলতেই হবে। বলে ডান হাতের মুঠো বাগিয়ে বিপ্লবের পিঠে কিল সাঁটাবার জন্যে তেড়ে যায়, অলোকা।
    সঙ্গে সঙ্গে কিল খাবার হাত থেকে নিজেকে বাঁচার জন্যে নিজের দু’হাত অলোকার সামনে মেলে ধরে বিপ্লব বলে,“বলছি বলছি মহারানি। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। ওরে বাব্বা। ওই সুন্দর টুকটুকে ফর্সা হাতের কিল আমার পিঠে পড়লে আমি তো একেবারে কুপোকাত হয়ে যাব! কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। বলছি, ঠিক এই ব্যাপারটাতেই তুমি এতটা বোকা ছিলে। যেই রনং দেহী হয়ে আমার দিকে ধেয়ে এলে, সেই মুহূর্ত থেকেই তুমি ‘বোকা’ তকমা মুক্ত হয়ে গেলে। বোকা থেকে তুমি বোদ্ধা হয়ে গেলে।” বলে হো হো করে হাসতে থাকে বিপ্লব!
    বিপ্লবের এই হাসিতে নিজের ভেতরটা এক অনাবিল আনন্দে টৈটুম্বুর হয়ে গেল অলোকার। প্রতিহাসি মুখে ফুটিয়ে ক্ষীণ স্বর তুলে অলোকা বলল,“কি হচ্ছেটা কি! লোকে তো দেখছে। ভাবছে, এই ছেলে-মেয়েটা একদম যাচ্ছেতাই। রাস্তাঘাটে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।”
    -ভাবুক-গে। ভালবাসায় অন্যের ভাবাভাবিতে কান দিতে নেই। সবসময় স্বচ্ছ হৃদয়ে নিষ্পাপ ভাবনায় আদরের সঙ্গে তাকে লালন করতে হয়। তবে সে আধারের বশে থাকে। কিঞ্চিত আবেগমথিত হয়ে বিপ্লব বলল। অলোকাও কতক্ষণের জন্যে যেন উদাস হয়ে গেল! কি নির্মল, সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারে বিপ্লবদা। মনে হচ্ছে এ’কথা যুগ যুগান্তরের ভালবাসার ডাক। এ ডাক ফিরিয়ে দেবার সাধ্য কার! অলোকার সাধ্যে তা কুলোবে না। জন্মান্তর এমন ভালবাসায় আবৃত থাকতে তার কোন বাধা নেই। এখন তো নেই-ই ! বিপ্লবদা তাকে লালন করবে তো?

    [চৌত্রিশ]

    অগ্রহায়ণ মাসের দিকে আমন চাষের সরু ধান পাকতে শুরু করে। তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু জমিতেই এই ধান চাষ হয়। সরু ধান বেশি জল সহ্য করতে পারে না। তার থেকে যে জমি একটু নাবাল, সেই জমিতে মোটা ধান হয়। এরা আবার বেশি জলেই নিজেদের স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এইসময় সুধা-কাসেমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই সরু ধান তোলা হয়ে গেলে সেই জমিতে চাষ দিতে। তখন থেকেই তাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। পৌষ মাষ পড়লেই বোরো ধান চাষের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে রবি শস্য চাষেরও তাড়া পড়ে যায়। শীতের সব্জি বাজারে তুলতে গেলে চাষীদের এখনই বীজ বুনতে শুরু করতে হয়। বোরো ধান চাষের জন্যে এই সরু ধানের জমিতেই বীজতোলা ফেলতে হয়। আজীবনের এই নিয়মে এবারে এত ভয়ঙ্করভাবে ছন্দপতন ঘটবে তা সুধা-কাসেমের মত হেলোরা ভাবতে পারেনি। পুরোনো ধারাকে পেছনে ফেলে নতুন ধারা এগিয়ে যেতে একটু সময় লাগে। এই ভাবনা যে এমনভাবে ধাক্কা খাবে, তা কে জানতো! ট্রাক্টরওলারা যেন এই সময়টার জন্যে মুখিয়ে ছিল। এলাকায় এলাকায় একটার পর একটা ট্রাক্টর মাঠে নামাতে শুরু করল। হ্যান্ড ট্রাক্টর বর্ষার প্রবল জলে তেমন কায়দা করতে পারে না বলে চুপচাপ ছিল এই শুখা সময়ের মুখ চেয়ে। সুধা-কাসেমরা এখন এদের দাপটে দিশাহারা। কথায় কথায় কাসেম বলল, “সুধা, আর হালের জোড়া পুষে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে গরুদুটোকে হাটে বেচে দিতে হবে। ওই দু’টো বেচে যে কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে যাহোক একটা ব্যবসা-ট্যাবসা শুরু করতে হবে। পেট তো চালাতে হবে না? বিডিও অফিসের পশু ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ে আমার বাঁয়াটা অনেক সুস্থ হয়েছে। এখন আর খোঁড়াচ্ছে না। সুস্থ থাকতে থাকতে ছেড়ে দিলে কিছুটা বেশি পয়সা পাওয়া যাবে। ভাবছি সামনের মাসে বিবিরহাটের গরুহাটে বেচে দিয়ে আসব এদের। তুই যদি বেচতে চাস, ভেবে দেখিস। আমার সঙ্গে যেতে পারিস। একসাথে দু’জনে চলে যাব।”
    কত শক্ত মন এই কাসেমটার। যে গরুজোড়া এতদিন তার ভাতভিতের জোগাড়ে জীবনপাত করে একসঙ্গে লড়ে গেল, সেই তাদেরই বাজারে বিক্রি করার ভাবনা কত সহজেই এ করতে পারে। তাছাড়া এত বছর তো এরা তোর সংসার জীবনের অন্যতম সদস্য হয়ে থেকেছিল। কেন, ওরা শুধু অবলা পশু বলে ওদের এক কথায় ত্যাগ করে দিতে হবে! টাকাপয়সাই ওর কাছে বড় হয়ে গেল! মায়া-মমতা, মানবিকতা- এইসব ওর কাছে কিচ্ছু না! হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে ও বলতে পারে, ওরা যেমন আমাদের কাজ দিয়েছে, আমাদের সংসার চালাতে সহযোগিতা করেছে, তেমনি ওদের ভরণপোষণের জন্যেও তো খরচ করতে হয়েছে। সংসার জীবনের একজন সদস্যের জন্যে এই হিসেব নিকেশ কি একজন বিবেচক মানুষের পক্ষে মানায়! মানায় না। সুধা তা কিছুতেই করতে পারবে না। তার জোড়া দুটোকে সে কিছুতেই গরু-হাটে বেচে পয়সা রোজগার করতে পারবে না। তাই যদি তার ভাবনা থাকতো তাহলে তো একটু শক্ত সমর্থ থাকতে থাকতে বুড়ো গরুটাকে সে হাটে বেচে দিয়ে পয়সা আয় করতে পারতো। তার সংসারে যা আয় হবে সে বউ-বাচ্চার সঙ্গে গরুদেরকে নিয়ে ভাগ করে খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে থাকবে। কাসেমের কথায় একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধা বলল, “নারে কাসেম। তুই যা ভাল মনে করবি করিস। আমি আমার গরুদের হাটে বিক্রি করে দিয়ে আসতে পারব না। আমার মন কাঁদবে।”
    কাসেম একটা মস্ত ভুল করে ফেলল। ও যদি আগে বিবির হাটের গরুহাটে এসে দেখে যেত, গরুর বাজার কেমন যাচ্ছে। তাহলে জোড়া দুটোকে সঙ্গে করে আনতো না। গরু হাটে নিয়ে গিয়ে দেখে শয়ে শয়ে মানুষ গরু নিয়ে হাটে জড়ো হয়েছে। এমনটা নাকি বর্ষার চাষ শেষ হবার পর থেকে প্রত্যেক হাটে বিক্রির জন্যে গরু জড়ো হচ্ছে। অথচ সে নিজে অন্য সময় চাষের বলদ কিনতে কয়েকবার এই হাটে এসেছে। কত? বড়ো জোর দশ-বারো, কি পনেরো জোড়া গরু সাধারণভাবে হাটে জড়ো হয়? সেখানে এত গরু ! ও ভেবে এসেছিল যে, বেশ কয়েক হাজার টাকা পেলে তা দিয়ে একটা কারবারপাতি ফেঁদে বসবে। তা তো হবার নয়। গরু নাকি এখন জলের দরে বিকোচ্ছে। হচ্ছেও তাই। ও তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। কবে এর দাম চড়বে তা ব্যাপারিরা কেউ বলতে পারছে না। এটা তো কারবারের নিয়ম- যোগান বেশি হলেই মালের দাম কমতে থাকবে। চাহিদায় ‘এলা’ এসে পড়বে। পড়ছেও। না, সে এই জলের দরে তার গরু বিক্রি করবে না। বাড়ি ফিরে এলো ওদের নিয়ে। ঘরে ওদের রেখে এসে প্রথম সুধার কাছে এসে হাটের পরিস্থিতি সব গপ্পো করল। বলল, “তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস সুধা। যে উদ্দেশ্যে আমি আমার পোষ্যের মায়া ত্যাগ করে বেচে দিতে চেয়েছিলাম, তা যদি সিদ্ধ না হয় তাহলে ওদের আমি কেন হাতছাড়া করবো।” সুধা, কাসেমের কথায় কোন উচ্চবাচ্য করল না। করে লাভ কি? কাসেমের ভাবনার সঙ্গে ওর ভাবনা তো মেলার নয়। যতই ওর চিন্তার সঙ্গে এক পংক্তিতে সুধার ভাবানা বসাবার চেষ্টা করুক না কেন। বাস্তবে তা তো নয়। হাটে গরুর দাম চড়লে ও আবার ছুটে চলে যাবে তাদের বেচে দিতে। আর সুধা তো তা কোনদিন ভাববেই না।
    সেদিন সকালে গোয়ালঘর থেকে গরু বাইরে বার করতে গিয়ে সুধা দেখে বুড়ো গরুটা মরে পড়ে আছে। অন্য গরুদুটোর চোখের গোড়া থেকে নাকের ফুটো পর্যন্ত জলের ভিজে দাগের রেখা পড়ে গেছে। কখন রাতে মরে গেছে কে জানে! সঙ্গীরা সেই শোকে সারারাত নীরবে চোখের জল ফেলে গেছে। পশুদের মনেও কত মায়া! ওরা মানুষের মত কথা বলে মনের দুঃখ বোঝাতে পারে না। কিন্তু ওদের মনও যে কাঁদে! সুধার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে এল! পরম মমতায় অন্য দুই গরুর গলাবন্ধের বাঁধন খুলে বাইরে বেঁধে দিয়ে এল। কিন্তু সুধা অবাক হয়ে দেখল, অন্য দিনের মত এরা বাইরে বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে যে ঘাসে মুখ দিয়ে খেতে শুরু করে, এখন ওরা তা করল না ! চুপচাপ সোজা মুখ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবছে কে জানে! খাবার কথা মুখেই আনছে না এরা। আর থাকতে না পেরে সুধা ওদের গলায় মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আর দুঃখ করে কি করবি বল। সবাইকে তো একদিন যেতে হবে। নে, একটু খাওয়া দাওয়া কর। এখানে বেশ বড় বড় ঘাস আছে।” গলায় হাত বোলাতে ওরা আরও লম্বা করে গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ দিয়ে হাল্কা নতুন জলের রেখা দেখা যাচ্ছে। তবু ঘাসে মুখ রাখছে না। যতক্ষণ না বুড়োটাকে ঘরছাড়া করে ওদের চোখের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মনে হয় ওদের মুখে কোন খাবারই রুচবে না।
    ভাগাড়ের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে বহুদিন এখানে কেউ গরু ফেলতে আসেনি। ঝোপ জঙ্গলে চেপে গেছে গরু ফেলার জায়গাটা। গরু পড়লে, শকুন-কুকুর- শেয়ালের আনাগোনায় এই চাপ চাপ জঙ্গল থাকে না। তারপর মরা গরুর প্রথম শিকারী, মানুষ আসলে তো তারা তাদের নিজেদের দরকারে জঙ্গল সাফ করে দিত। সুধা মনে মনে ভাবল, এই ঘন ‘মুতো-ঘাস’ বনে গরুটাকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে! হাজার হলেও গরুটাতো এতদিন তাদের পরিবারের একজন ভেবে ঘরে রেখে দিয়েছিল। মায়ার টানে তাকে হেলাফেলা করেনি। এখন মরে গেছে বলে হেলায় তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া ঠিক হবে না। সঙ্গে আসা লোকদের বলল, “তোরা গরুটাকে ফাঁকায় রাখ। আগে কাস্তে কাটারি দিয়ে ওই খেলকদম, ডাকরঞ্চের বন ছেঁটে ফেলে দে। তারপর কোদাল দিয়ে মুতো-ঘাস মোটামুটি চেঁচে ফেলে গরুটাকে রেখে যাই চল। এই বেহদ্দ জঙ্গলে অবহেলায় একে ফেলে গেলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না রে। ভূপাল-কা, ভাগ্যিস তুই বুদ্ধি করে এই যন্তরগুলো সঙ্গে এনেছিলিস! অবশ্য তুইও একবার বলেছিলিস, ভাগাড় বুনো ঝোপে ভর্তি হয়ে আছে। ওগুলো কেটে পরিস্কার না করলে গরু ফেলা মশকিল হয়ে যাবে।” কিন্তু এইসব করতে করতে তো ঘন্টা-দুই পার হয়ে গেল! কোন শকুনের দেখা নেই কেন রে ভূপাল-কাকা। আগেও তো গরু ফেলে গেছি এখানে। আধঘন্টা তর সয় নি, বড় গাছের মাথায় শকুনরা এসে ঘাপটি মেরে বসে গেছে। অপেক্ষা করে মুচিরা কতক্ষণে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে গরুটার চামড়া ছাড়িয়ে তাদের খাবারের সুব্যবস্থা করে দেয়। ভূপাল-কা দেখেছিস, এতক্ষণ সময় পার হয়ে গেল, একটা মুচিরও সেই উর্দ্ধশ্বাস দৌড় দেখতে পাচ্ছিস? পাচ্ছিস না।” স্বভাবজাত ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ভূপাল-কা বলল, “হুঁ, গাছের মাথায় শকুন বসলেই সেই নিশানায় তো মুচিরা দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরা গরুর উপর। সেই নিশান তো তারা পাচ্ছে না। পাবে কোত্থেকে, শকুনরা বুঝে গেছে গ্রামের ভাগাড়ে তো আর তাদের খিদে মেটাবার জন্যে গরু পড়েই না। তাই ওদিকে শুকুনী-দৃষ্টি ফেলে লাভ নেই। শুধু সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। তাই ওরা এখন শহুরে ভাগাড়ের মধ্যে নিজেদের মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। সেখানে কালে-ভদ্রে গরু পড়লেও অন্য জীবজন্তুর মরা দেহ পড়ার তো ইয়ত্তা নেই। হয়তো দেখা যাবে বেশ কিছুদিন পর আমাদের এই গরুর শরীর থেকে তীব্র পচা গন্ধ বার হবার পর তাদের টনক নড়বে। তাদের টনক নড়লে মুচিদেরও টনক নড়বে। তুমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো, সুধা ভাইপো? আমাদের বয়ারের রুইদাস পাড়ার মুচিরা কিন্তু আর আগের মত ভাগাড়ে গরু পড়ার ওপর ভরসা করে দিন কাটায় না? কাটাবে কেমন করে বলো? আগে যতই পাতলা হোক, দু’তিন মাসের ফারাকে কোন না কোন ভাগাড়ে একটা-দুটো গরু পড়তো। সেই গরুর চামড়া নিয়ে কাজ করে তারা সংসার খরচের অনেকটাই সামলে নিত। তারপর চাষবাস, এটা সেটা কাজ করে দিন চালিয়ে দিত। ওদের পাড়ার রতন রুইদাসের সঙ্গে আমি তো অনেক কাজ করেছি। তুমিও তো জানো। তোমারই কাদা করা জমিতে আমাদের সঙ্গে রতনরাও রোয়ার কাজ করে গেছে। ওই রতন বা অন্যরা কথায় কথায় এই সব গল্প করতো। এখন কিন্তু রতনদের বয়সী মুচিরা আর ভাগাড়ের এমুখো হয় না। ওদের পাড়ার কিছু বেকার ছেলেপুলে, যাদের অন্য কোন কাজে মন বসে না। দিনরাত দেশি, চুল্লু খেয়ে পাড়া মাত করে, তারাই খবর পেলে ভাগাড়ে আসে গরুর চামড়া ছাড়াতে। ভাগাড়ে একবার একটা গরু পড়লে আগে মুচিদের মধ্যে সেই চেনা হইহুল্লোড় এখন আর নেই। এই কারবার ছেড়ে দিয়ে তারা অন্য পথ দেখে নিয়েছে। কেননা বাঁচতে তো হবে। ওই ইঞ্জিন হাল এসে তো মানুষের বলদ গরু পোষার প্রয়োজনীয়তা শেষ করে দিয়েছে। যাদের, তোমাদের মত হালের কাঁড়া ছিল, তারা সক্কলেই সব হালের গরু-জোড়া বেচে দিয়েছে। শুধু তোমরা কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছো। অত গরু পরপর যদি মানুষ প্রাণের দায়ে বেচে দেয় তো দেশে গরু থাকবে কোত্থেকে। আর সমাজে গরু না থাকলে ভাগাড়ে তো খেলকদম আর মুতো-ঘাসে ভরে যাবেই। তাতে ভাগাড়ের আর কি দোষ। তেমনি দোষ বা কোথায়, ওই শকুন আর রুইদাসদের!”
    ভূপাল-কার কথা এতটাই দিনের আলোর মত সত্যি যে, সুধা তার বিন্দুমাত্র খন্ডন করতে পারলো না। ভাবনায় গলা যেন শুকিয়ে যাচ্ছিল সুধার। বার দুই গলা খাকরি মেরে বলল,“তাহলে এখন কি করা যায় বল তো ভূপাল-কা? প্রথম কাজ মুচিদের পাড়ায় এই গরু পড়ার কথাটা পৌঁছে দেওয়া। তাহলে ওদের পাড়ার কেউ না কেউ তো চামড়া ছাড়াতে আসবেই। তোর কথা মত ওই ছেলে ছোকরারা তো আসবে। কে এলো- ছোকরা কি ধেড়ে, তাতে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। গরুটার চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়াটাই আসল কথা। তাহলে সেই দূর নীলিমায় ভেসে বেড়ানো শকুনকুলের দৃষ্টি এখানে এসে পড়বেই পড়বে। এই বিশ্বাস আমার আছে। তুই যাই বলিস কাকা, শকুনের দৃষ্টি গ্রাম-শহর আলাদা করে পড়ে না। ওদের দৃষ্টি, ওদের সুষম খাদ্যের দিকে। সেই খাদ্য যেখানে থাকবে সেখানে ওরা ছুটে যাবে। হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক, এটা সকল জীবেরই ধর্ম। যেখানে খাবার সহজে পাওয়া যায় প্রথমেই মন সেদিকে দৃষ্টি ফেলে। শকুনরা তার থেকে আলাদা বা হবে কেমন করে। তুই যা-না খুড়ো, মুচিদের পাড়ায় একবার খবরটা দিয়ে আয় না। আমি ততক্ষণ এখানে বসে আছি। তুই না ফিরলে আমি এখান থেকে যাব না। সঙ্গে আসা অন্যদের বাড়ি চলে যেতে বলে সুধা কথামত ভাগাড়েই ভূপাল-কা না আসা পর্যন্ত বসে রইল।
    সেই প্রথম সকাল থেকে এই গরু নিয়ে সে দৌড়াদৌড়ি করছে। বেলা অনেকটা হয়ে গেল। মাঝ আকাশ থেকে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। এতটা বেলা হয়ে গেল, কিছুই খাওয়া হয়নি। খিদেতে পেট মোচড় দিচ্ছে। তবু কিচ্ছু করার নেই সুধার। ভূপাল-কা না ফেরা পর্যন্ত সে এখান থেকে যেতে পারবে না। কথা দিয়ে কথা খেলাপ করা ঠিক না। দৌলতপুরের চড়ার ধারের ভাগাড়ের কাছে পুরোনো বটগাছের ছায়ায় বসে সোজাসুজি রুইদাস পাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। দূরের আবছা দৃষ্টি খানিক পর আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়। ভুপাল-কা আর সঙ্গে একজন। ওটা মুচি পাড়ার ছেলে ছাড়া আর কে বা হবে। ছেলেটার পায়ের চলনে যেন কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ‘গা-গদগদ-খিদে মন্দ’র মত তার চলার ধরণ। তাড়া যত যেন ভূপাল-কার। তার থেকে একটু এগিয়ে এসে আবার থমকে তার চলনের তালে তাল মেলায়। আবার এগোয়। আবার পিছোয়। ওরা দু’জনে কোন কথা বলাবলি করে আসছে বলে মনে হচ্ছে না। ভাগাড়ে গরু পড়ার খবর পাবার পর ওদের মধ্যে যে উত্তেজনা সুধারা আগে দেখেছে, এই ছোকরার মধ্যে সেই চেনা উত্তেজনার রেশ বিন্দুমাত্র নেই!
    অবশেষে পা-পা করে এল বটে ওরা। কিন্তু ছেলেটা এসে সুধাদের একটু তফাতে বটগাছের গোড়ায় হাতে গরুর চামড়া ছাড়ানোর ছুরিটা নিয়ে বসে পড়ল। মুখে তার কোন কথা নেই। কাজে তার কোন তাড়া নেই ! মাঝে মাঝে গরুটার দিকে তাকায় আর তাদের পাড়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখে। ছেলেটার এমন ভাব দেখে আর চুপ করে থাকতে পারল না সুধা। মুখ খুলল, “এই ছোকরা, হাতে ছুরি নিয়ে চুপ করে বসে আছিস? কাজে হাত দিবি না? তোদের জন্যে তখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা। তুই একা? আর সব কোথায়, তোদের পাড়ার?
    “ওরা আসতেছে। মদ খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসতেছে বলল।” বলে, ছেলেটা আবার আগের মত চুপ করে বসে রইল। সুধা মনে মনে ভাবল, আর ছেলেগুলো না আসা অব্দি তারা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, এ ছেলেটা আবভাবে কেমন উল্টোপুরানে চলে। তারা যখন মদ খাচ্ছে তখন ওদেরও কিছু খাওয়া দরকার এই ফাঁকে। গ্যাঁট থেকে পয়সা বার করে ভূপাল-কা কে বলল, “কাকা, তুই দিঘিরপাড় থেকে কিছু খাবার নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে কিছু না খেয়ে চলে এসেছি। তোরও তো খাওয়া হয়নি। কি খাওয়া যায় বলতো? এত বেলায় তেমন টিফিন তো পাওয়া যাবে না। এক কাজ কর, কাকা। প্রদ্যুতের চা-দোকান থেকে দুটো কোয়ার্টার পাঁউরুটি নিবি। আর ভুতোর আনাজ দোকান থেকে দুটো বড় বড় শশা নিবি। ওটা জলের তেষ্টা মেটাবে। শুকনো পাঁউরুটি খাবার পর জল না খেলে বুকের ছাতি জল-জল করে ছটপটাবে। এই ধূ ধূ ভাগাড়, চড়া-ময়দানে কোথায় আর জল পাওয়া যাবে! শশাটা নিতে ভুলবি না কিন্তু কাকা। শহরের মত এখানে তো আর বোতলের জল কিনতে পাওয়া যায় না। ওটা না হলে পাঁউরুটি খাওয়াই যাবে না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যা কাকা। যাবি আর আসবি।” এই ভুপাল-কা তার বরাবরের ভীষণ নেওটা। সুধা যেখানে হালের কাজে যায়, জমির ঘাস ছেঁড়া, আল ছাঁদা, হালের তোলা মাটি এদিক ওদিক ফেলে জমির খালা উুঁচু জায়গা সমান করা- এইসব কাজ করে। ফাইফরমায়েসের কাজে ও বেশ পটু। তবে ভারি, তেজী কাজ ও তেমন পারে না। আসলে বয়েস হয়েছে তো। জোয়ানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে কেন। তাই ওই দলের কাজে ওকে বাবুরা নিতে চায় না। তবে সুধা যেখানে যায়, ভূপাল-কা কে নিয়ে যায়। ওর সঙ্গে থাকলে বাবুরা আর ‘না’ করতে পারে না। তাই যেখানে সুধা, সেখানে ভূপাল-কা। লোকে বলে ওরা নাকি মাণিকজোড়। তাতে সুধার কিছু যায় আসে না। একটা মানুষের ভালোর জন্যে যদি এই তকমা তার পেতে হয়, হোক না। তাতে তো তার কোন অসুবিধা নেই!

    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৪)

    জন্মসূত্র
    সুব্রত হালদার

     


    [ বত্রিশ ]


    গত কয়েক বছরের তুলনায় এই বছর কালবৈশাখীর দাপদাপানিটা যেন বড্ড বেশি দেখা যাচ্ছে। সেই চৈত্র মাস থেকে শুরু হয়েছে। সারা বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ দফে দফে কতবার যে ঝড় বৃষ্টি হ’ল তার ঠিক নেই। তারপর এই আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে মৌসুমী বায়ুর এমন হামলা দেখা যায় না। হাওয়া অফিস তো একটার পর একটা ফরমান দিয়ে চলেছে। মাঠে চাষে যেতে নিষেধ করছে বজ্রাঘাত থেকে চাষীদের প্রাণ বাঁচাতে তো নদী-সমুদ্রে ট্রলার-নৌকো ভাসাতে কড়া বার্তা দিয়ে চলেছে। ওদের কথা না মানলে তো আবার ঝড়ের গ্রাসে মাঝ সমুদ্রে ট্রলার মাঝি সমেত গায়েব হয়ে যাচ্ছে। খবরিয়ার দল টিভিতে, খবরের কাগজে, রেডিওতে মন্তব্য করছে, পৃথিবীতে গরমের হু হু করে বাড়বাড়ন্তর জন্যেই প্রকৃতি এই খামখেয়ালীপনা শুরু করেছে। এর জন্যে দায়ী মানুষই। এত কলকারখানা, এত যানবাহন, এত গাছপালা হুড়মুড়িয়ে কেটে সাফ করে দিলে মা ধরিত্রীকে ঠান্ডা করার সাধ্য কার! ফলে যা হবার তো হচ্ছে। দেখবি, আবার একটা সময় আসবে, এই অতিবৃষ্টি, খেয়ালীপনায় আবার অনাবৃষ্টির অবস্থার সৃষ্টি না হয়। তখন তো আবার আমাদের এই জলের জন্যে আসমান পানে দু’হাতের আঁজলা পেতে,‘জল জল’ করে হাপিত্যেশ করে যেতে হবে। পাই ধরে একই জমিতে ‘আগো চাষ’ দিতে দিতে কথায় কথায় বলছিল দুই হালের কাঁড়া’র দুই হেলো, সুধা আর কাসেম। হ্যাট্ হ্যাট্ করে নাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে সুধা একটু এগিয়ে যায়। কাসেম যায় সুধার থেকে খানিক পেছিয়ে। একসাথে নাঙ্গল ঠেলার সময় আগুপেছু বেশি ফারাক হলে আবার চলে না। পাই ঘেঁটে যায়। তাই কাসেম বলল,“সুধা, দাঁড়িয়ে যা। আমার বাঁয়াটা একটু কমজোরি আছে। সেই একহপ্তা হয়ে গেল ‘হাটগেছের’ মাঠে চাষের সময় নাঙ্গলের ফলাটা বাঁয়ার খুরের ভেতর গুঁজে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি। গরুটাও তখন কোন গুরুত্ব দেয়নি। দিলে তখনই সে খোঁড়াতো। কিন্তু হাল ছেড়ে যখন জোত খুলে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরছি, তখনই বেটা খোঁড়াতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ব্যথাটা বাড়ে আর কি। পা ধরে তুলে দেখি তখনও রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়া গাছের পাতা হাতে কচলে তার রস দিলাম। বাড়িতে গিয়ে শুকনো লঙ্কা-তেল গরম করে লাগালাম। তখন বেটা বেশ পা ছটকাচ্ছিল। তারপর জাবনা খেয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে দেখি আর খোঁড়াচ্ছে না গরুটা। ওখানেই আমার ভুল হয়েছিল, পরের দিন আবার হাল নিয়ে মাঠে নামা। ঘা-টা তো পুরো সারলো না। আবার সেই পা নিয়ে শক্ত আগো মাটি ভাঙতে গিয়ে তাতে বারবার আঘাত লাগে। পরদিন আবার খোঁড়াতে লাগল। বিডিওতে ডাক্তারের কাছে যেতে ডাক্তার ওষুধ-ইঞ্জেকশন দিল। বলল, “এখন এক সপ্তা গরুকে জিরেন দিতে হবে। নাহলে তোমার এই বর্ষার চাষে এ গরুকে আর কাজে লাগাতে পারবে না।” তাই করলাম। কিন্তু সেই থেকে গরুটা যেন অনেকটা কমজোরি হয়ে গেল। ডাঁয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারে না। আবার যদি সে জখম হয়ে যায়! সেই ভয়ে আমিও আর বাঁয়াকে চাপাচাপি করি না। সুধা, তুই একটু থাম। গরুজোড়াকে খানিক জিরেন দিই। সেইসঙ্গে আমরাও দু-চার ফুঁক বিড়ির টান দিয়ে নিই।” কাসেমের কথায় সুধা তার হালজোড়া থামিয়ে দেয়,“চল তা’লে কাসেম। জমির আলে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। ঘন্টাদুই হয়ে গেল আমরা জিরেন নিইনি। আমাদের সঙ্গে গরুরাও খেটে চলেছে। দু’তরফেরই একটু বিশ্রাম দরকার।”
    ক’দিনের বৃষ্টিতে জমিতে মইচাপ জল দাঁড়িয়ে গেছে। সেই জলে হাতটা ধুয়ে নেয় কাসেম। ভিজে হাতটা গামছার এক খোঁটে মুছে অন্য খোঁটে পলিথিনের ছোট্ট থলেতে জড়িয়ে রাখা বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই সতর্ক হয়ে বার করে। যাতে দেশলাই বাক্স আবার ভিজে না যায়। তাহলে তো আর তাতে কাঠি ঘসে আগুনের জন্ম দেওয়া হয়ে উঠবে না। বিড়ি ফোঁকারও দফারফা হয়ে যাবে। পেরেছে কাসেম। দেশলাই কাঠিতে আগুনকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে পেরে মনে মনে পরীক্ষায় পাশের গর্ববোধ করে। এরপর আর সময় খুইয়ে দেবার উপায় নেই। বিড়িটা কাঠির আগুনের সামনে আহুতি দিয়ে ফুঁক ফুঁক করে দু-চারটে লম্বা টান মেরে মুখের ভেতর একগাদা ধোঁয়া ভরে নিল। ওদিকে বাঁ হাতে নিজের বিড়িটা ধরে ডান হাতটা বাড়িয়ে আছে কাসেমের দিকে সুধা। ও জানে প্রথম দফায় ক’টা সুখটান দিয়েই কাসেম তার দিকে ধরানো বিড়িটা বাড়িয়ে দেবে। সুধা সেই বিড়ির আগুনে নিজের বিড়ি ফুঁকিয়ে কয়েকবার টেনে আগুন হস্তান্তর করে নিল। এইসময় এই পরিবেশে ওরা, চাষীরা অভ্যস্ত আগুন হস্তান্তরে। এখানে জাত বেজাত, উঁচু নীচুর কোন বালাই নেই। একটাই শ্রেণী, একটাই সম্প্রদায় তখন ওরা। ওরা কৃষিপ্রধান দেশের কৃষক সম্প্রদায়। অন্য সব কথিত ধর্ম সম্প্রদায় এখানে এসে একাকার হয়ে গেছে।
    নিজের বিড়ি ধরিয়ে সুধা বলল,“তবু তো নাবি-বর্ষার দৌলতে শুকনো খটখটে জমির এখন অনেকটাই রাগ কমে গেছে। তাই আমাদের নাঙ্গল কত সহজে জমির আগো ভাঙতে পারছে। গরুগুলোরও কষ্ট কম হচ্ছে। না’হলে খটখটে জমির আগো ভাঙতে গরুর যা কষ্ট।” সুধার কথার খেই ধরে কাসেম বলল,“শুধু গরুর কেন, হেলোদের বুঝি কম কষ্ট হয়? শালা, নাঙ্গলের মুঠো চেপে ধরে থাকতে থাকতে দাবনা গজে যাবার জোগাড় হয় না বুঝি?”
    -তা যা বলেছিস তুই। সন্ধ্যে বাড়ি ফিরে গায়ে যেন ‘তার’ থাকে না। খাওয়াদাওয়ার পর বউ উশম গরম তেল দিয়ে মালিশ করলে তবে যেন ব্যথা শরীর থেকে ছাড়ান দেয়। পরের দিন আবার নতুন দমে বলদ জোড়া নিয়ে হালে নামতে পারি।
    সুধা এই ‘নতুন দমের’ কথা বলতেই কেমন যেন উদাস হয়ে আসমানের দিকে চোখ রাখল কাসেম,“এই নতুন দমে কতদিন জমি চাষে তোদের দরকার হয় দেখ। এখন এই যে মানুষ হাল চাষের জন্যে তোর আমার, যাদের জোড়া বলদের কাঁড়া আছে তাদের এত কদর করে। মনে হয় এই কদর আর আমরা বেশিদিন উপভোগ করতে পারব নারে সুধা। এমন দিন সামনে এগিয়ে আসছে, সেইদিন মানুষ আর আমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। আমাদের এই হম্বিতম্বি একদিন ঘুচে যাবে। এই যে লোকে রোজ সন্ধ্যে বা ভোরে আমাদের বাড়ি উজিয়ে এসে তাদের জমি চষে দেবার জন্যে অনুরোধ উপরোধ করে। আর আমরা, ‘আজ হবে না বাবু, কাল, পরশু দেখব। কাল হালদারদের হবে তো পরশু মন্ডলদের। তারপর তোমাদের।’এইসব বলে দর হাঁকাইয়ের দিনগুলোর অস্ত যাবার সময় হয়ে এসেছে।” কাসেমের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুধা। বিড়ির শেষের দিকে ফুক ফুক করে ঘনঘন দুটো লম্বা টান দিয়ে তা জমির জলে ফেলে দিতে ‘চোঁক’ শব্দ ঠিকরে আসে সেদিক থেকে। মুহূর্তের জন্যে সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে আনে কাসেমের দিকে! এবার একগাদা প্রশ্নমুখো হয়ে কাসেমকে বলে,“এত গম্ভীর মুখে এই কথা হঠাৎ তুই বলছিস যে কাসেম? কি এমন হল, যে অমন উদাস হয়ে ভয়-ভয় মনে বললি কথাগুলো? আমাকে ভড়কে দিতে চাইছিস, তাই না? তোর ওই ভড়কানিতে আমি ভিজে যাবার লোক না বুঝলি? অত বোকা নই আমি। হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, একটা উদ্ভট কথা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছিস, বল? যা-তো, হচ্ছে চাষবাসের কথা। কোথা থেকে ভড়ংবাজি দিয়ে দিলি, কি না আমাদের সামনে সমূহ বিপদ। তা আমাদের মত গরিবদের বিপদ তো ডাঁয়ে বাঁয়ে সব সময়। ও আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওতে ভয় পেলে আমাদের চলবে নাকি। তাহলে তো বউ-ছেলে-সংসার নিয়ে বাঁচাই দায় হয়ে যাবে। ওসব আজেবাজে কথা ছাড়ান দে,কাসেম। চল। এবেলা এই বন্দেটা সারতে হবে। বিকেলে হাটগাছার মাঠে আমাদের যেতে হবে। ওটা সারা হয়ে গেলে হালদার বাবুর কাজটা আপাতত শেষ হবে। পরদিন সকালে ভূতবাড়ির কাছে দাসেদের দেড় বিঘেটা ধরতে হবে।”
    -এতটা জায়গা একবেলাতে কেমন করে সারবি? জায়গার মাপটা একবার আঁচ করে দেখেছিস? নাকি থাবগো একটা কিছু ভেবে বলে দিলি, এবেলা সারা হয়ে যাবে! যদি বিকেলে হাটগাছায় যেতেই হয়, হালদার বাবুদের কথা দিয়ে থাকিস তো তাহলে এক কাজ করি আয়। এখন একেবারে এক টাইমের ‘চৌপুরো’ কাজ করে এটা সেরে নিই। তাছাড়া উপায় দেখছি না। কাসেম বলল। কাসেমের কথায় সায় দিয়ে সুধা বলল,“কথাটা তুই একদম ভুল বলিসনি কাসেম। আমি তখন অতটা তলিয়ে ভাবিনি। এক বেলায় পারা যাবে না। চাপাচাপি করেও হবে না দেখছি। চৌপুরো মেরে না গেলে সবদিক সামলানো যাবে না দেখছি। অন্য দিনের জন্যে খিঁচ জায়গাটার ‘আগো-ভাঙা’ ফেলে রাখা ঠিক হবে না। কবে আবার এইটুকুর জন্যে এদিকে আসা হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। এই আমন চাষের সময় আমাদের ঝামেলার আর শেষ থাকে না। সবাই চায় তার জমি আগে হাল হয়ে যাক। কিন্তু রোগী ছটফট করলে কি ডাক্তার ছটফটাবে? ফটাবে না। যার কথা না রাখা হবে তার গোঁসা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দিকটাও তো বাবুদের ভাবা দরকার। এরা আবার আমাদের ছাড়া অন্য হেলোদের কাছে যাবে না। বাবুরা বলে কি না, তোদের মত দরদ দিয়ে অন্যরা এত সুন্দর জমি কাদা করতে পারে না। তা ভালো জিনিস পেতে গেলে একটু তো ধৈর্য ধরতে হবে, কি বল তুই কাসেম?
    -তোর কথাটা একদম ফেলনা নয় তা মানছি। কিন্তু মানুষের মন তো। থিতু হতে চায় না। একজনের জমিতে নাঙ্গল পড়লে অন্যজনও চায় তারটাতেও নাঙ্গল নামুক। আর বর্ষার প্রথম ঝটকায় রোয়া সারতে পারলে তাড়াতাড়ি গাছের মাটি ধরে নিতে সহজ হয়। সুস্থ সবল গাছ হলে পোকা মাকড়ের হামলা সামলে নিতে পারে। ওই তো, ওই জন্যেই না শিবুবাবুর ছেলে শুভবাবু, কথায় কথায় ছড়া কেটে বলে,‘লাগালাগি বাস, দেখাদেখি চাষ।’ একজনের চাষ শুরু হলে অন্যরাও হামলে পড়ে তাদের জমি কত তাড়াতাড়ি চাষ সেরে ফেলা যায়। আর আমরা হেলোরা বাবুদের ইচ্ছেকে থমকে দিতে থাকি। আসলে আমাদের ক্ষমতার তো একটা সীমা আছে। গরু তো আর মেশিন নয়। যত খুশি খাটানো যাবে। সেও তো মানুষের মত একটা জীব। মানুষের মত তার শরীরকেও তো জিরেন দিতে হয়। নাহলে সে লড়বে কেমন করে। তাই মানুষের চাওয়ার সীমার সঙ্গে আমাদের গতর দেবার সীমার তফাৎ তো থাকবেই। আসল গোলটা সেখানেই। গতর খাটাবার সীমাই এখানে যত ঝামেলার মূলে। অত তলিয়ে এসব কথা যেমন আমরা ভাবি না, তেমনি বাবুরাও ভাবে না। ভাবলে এই মন কষাকষি আর থাকে না। কিন্তু এখানে আমাদেরই বা কি করার আছে বল, কাসেম। এটা তো সকলকে বুঝতে হবে। না বুঝে উপায় বা কি। এর বিকল্প তো আর হবার উপায় নেই। আমাদের যেমন বাবুদের উপর ভরসা করতে হবে। বাবুরাও আমাদের ফেলে যাবে বা কোথায়। আমাদের হাল পছন্দ না হলে অন্য কারোর হাল, তার কাজ অপছন্দ হলে আর একজনের কাছে যেতে হবে। আমাদের মত যেকোন হেলোর কাছেই বাবুদের যেতে হবে। নাহলে চাষ বন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে। জমি বন্ধ্যা করে ফেলে রাখতে হবে। তা তো কেউ করতে পারবে না। খাবে কি তাহলে মানুষ!
    সুধার কথায় মনের ভেতর শ্লেষের হাসি খেলে গেল কাসেমের। তুই কোন খোঁজখবর যে রাখিস না সুধা, তা তোর এই কথায় বোঝাই যাচ্ছে। তাই আমি যখন বললাম, আমাদের এই সুদিন আর বেশিদিন নেই, তখন তুই আমাকে হেলায় উড়িয়ে দিতে পারলি। কিন্তু তুই কি জানিস, আমাদের এখান থেকে ছ’ সাত কিলোমিটার দূরে, ঈশ্বরীপুর গ্রামের মাঠে ইঞ্জিন-হাল নেমে গেছে! এই ইঞ্জিনওয়ালা হ্যান্ড ট্রাক্টর দিয়ে মানুষ একদিনে বিঘের পর বিঘে জমি চষে নিচ্ছে! হ্যাঁ, এটা ঠিক, এই হ্যান্ড ট্রাক্টর হাঁটুর উপর, কোমর জলে চলবে না। ইঞ্জিন ডুবে গেলে তার চলা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমাদের গরুর কাঁড়া দরকার পড়বে। কিন্তু যদিও এখনো আমাদের রাজ্যে, জমিতে বড় চাকার বিশাল বিশাল ফলার ট্রাক্টর নামেনি। ওগুলো কিন্তু আমাদের দেশের অন্য প্রদেশে চালু হয়ে গেছে বহুদিন আগে থেকে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার মত আরও অনেক উন্নত উচ্চ ফলনশীল চাষ এলাকায় এগুলো ছেয়ে গেছে। তা সেই বড় ট্রাক্টর আমাদের এদিকে আসতে যে আর বেশি দেরি হবে না, তার নমুনা ওই হ্যান্ড ট্রাক্টর। কম জলে বা শুকনো জমিতে এই ইঞ্জিন ট্রাক্টরের দাপটের সামনে গরুর হাল যে খাপ খুলতে পারবে না তা পাগলেরও বুঝতে অসুবিধে হবার কথা না। মনের আতঙ্ক মনের ভেতর পুষে রেখে কাসেম বলল,“চল সুধা। আর বসে থেকে বেলা চড়িয়ে লাভ নেই। কাজ যখন আমাদের করতে হবে তখন করেই ফেলা যাক।”
    মাঠে নেমে এবার সুধা বলল,“কাসেম, তোর গরুটা যেকালে কমজোরি, তো এক কাজ কর। তোর গরুর জোতটা নিয়ে তুই আমার আগে যা। আমি তোর পেছনে থাকি। তাহলে তোর জোতের বশে আমি যেতে পারব। তখন আর আগুপেছু হতে হবে না আমাদের। গরু দমে গেলে হেলোর যা কষ্ট তা আমি খুব ভাল করে জানি। আমার ডাইনেটা যখন বয়সের টানে কমজোরি হতে লাগল। কিছুতেই আমার মনের টানে সে টান দিতে পারছিল না। তখন অতটা বুঝিনি যে ওর বয়স হয়ে যাচ্ছে। সেই যৌবনের শক্তি আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছে ও। সেটা না বুঝে কম কঞ্চির ঘা খেয়েছে ও! বাড়িতে গিয়ে কম চেল্লাচেল্লি করেছি? বউ তখন সতর্ক করে আমাকে বলল, “ওর বয়সটা কত হয়েছে তুমি খেয়াল রেখেছ? প্রায় দশ বছর হয়ে গেল ও তোমার হাল টানছে। কত খাটাবে তুমি একটা অবলা জীবকে? তুমি এখন যেমন তাগদ নিয়ে খাটতে পারছো, বুড়ো বয়সে পারবে?” তখনই আমার টনক নড়ে। সেইজন্যেই তো এ বছর এই ডায়নেটা কিনলাম। সে তো তুই সবই জানিস, কাসেম।”
    -তা তোমার বুড়োটাকে তো তোমরা বুড়ো বাবা-মায়ের মত ঘরে লালন পালন করো। আমাদের জাতের মত কুরবানির জন্যে গরু-হাটে বেচে দাও না। তা সে তোমাদের নিয়মে যা হয় তাই করো। পরে মরে গেলে ভাগাড়ে ফেলে দাও। সেটা অবশ্য একটা ভাল কাজ। ভাগাড়ে ফেললে কত শকুনের খিদে মেটে। না হলে ওরাই বা যায় কোথায়। খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে তো জীব জগৎ চলে। এটা না থাকলে সৃষ্টি যে আবার লোপাট হয়ে যায়।
    -শুধু শকুনের কথা বলছিস কেন কাসেম? মানুষও তো ঘুরিয়ে পেটের খিদে মেটায় এই মরা গরুকে সম্বল করে। তুই মুচি- রুইদাসদের কথা ভুলে গেলি! ভাগাড়ে গরু পড়লে তবেই না ওরা তাদের ছাল-চামড়া জোগাড় করতে পারে? সেই চামড়ায় ঢাক ঢোল জুতো আরও কত কি চামড়ার জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালায়। সে কথাটা বাদ দিলে তো চলবে না। জ্যান্ত হাতির মত মরা হাতিও যেমন লক্ষাধিক টাকায় বিকোয়, তেমনি জ্যান্ত গরুর মত মরা গরুরও কদর আমাদের সমাজে কম না। আর একটা কথা শুধাই তোকে কাসেম, একটা পশুকে বছরের পর বছর ঘরে পালন করতে করতে তাকেও না, পরিবারের অন্য সদস্যের মত আমরা আপনজন মনে করে ফেলি। সেইজন্যে যতই সে পশু হোক, তাকে ত্যাগ করতে আমাদের জাতের মানুষদের মনে খোঁচা লাগে। মরণ পর্যন্ত তাকে কাছে রাখতে চাই আমরা। তা সে ছাগল, মুরগি যাই হোক। আর গরুর বেলায় তো কথাই নেই। আমাদের শাস্ত্রেই তো তাকে সম্মানের সঙ্গে জায়গা করে দেয়া হয়েছে। এই যে ছাগল, মুরগি, আজন্ম পুষে যখন অর্থের কারণে তাকে ফেরিওয়ালার কাছে বেচে দেয়া হয়, মনটা ডুকরে ওঠে। মেয়েরা তো কাঁদতে শুরু করে। তবু, ওই যে বললি, খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের কারণেই জীব জগৎ টিকে থাকে। সেই বেঁচে বর্তে থাকার জন্যে আবার মনকে দমিয়ে রাখতে হয়।” সুধার কথায় সায় দিয়ে কাসেম বলল,“ঠিক কথাই বলেছিস তুই। তোদের মনের কথা আর আমাদের মনের কথায় কোন ফারাক নেই রে সুধা।”
    মাঝ আকাশের সূর্য ক্রমশ পশ্চিম দিকে কাত খেতে শুরু করেছে। সুধা সেটা খেয়াল করল। ভেবে নিল এইভাবে ধীর গতিতে যদি তাদের হাল চলতে থাকে তো বাকি জমির যতটা চষতে বাকি আছে তা চৌপুরোতেও শেষ হবে না। কাসেমের বাঁয়াটা সত্যি সত্যি তাগৎ নিয়ে এগোতে পারছে না। ওর পায়ে যে একটা কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। আর কাসেমকে তাড়া দিয়েও তাই কাজের কাজ কিছু হবে না। তাড়া দিলে ও তখন গরুটাকে হাতের কঞ্চির বেত দিয়ে কাপসাতে শুরু করবে। ওইভাবে পশুপীড়ন করাটাও ঠিক না। ও বেটার সেই বোধ আছে বলে মনে হয় না। যখন তখন গরুকে কাপসায়। আরে বাবা ওরা তো মানুষ না হলেও ভগবানের দেওয়া জ্যান্ত জীব। প্রহার করলে আমাদের মত ওরাও তো যন্ত্রণা পায়। তাই সুধা ঠিক করল কাসেমের কাঁড়াকে জমি চষা থেকে তুলে দিতে বলবে সে। ওকে তুলে ও তার হাল নিয়ে তাড়াতাড়ি চালিয়ে সময়ের মধ্যে কাজ সেরে নেবে। না হলে, সুধার ইচ্ছে থাকলেও কাসেমের জন্যে সে এগোতে পারছে না। সেইমত সুধা কাসেমকে বলল, “তুই এক কাজ কর কাসেম, তুই তোর জোড়া নিয়ে উঠে পড়। তোর বাঁয়াটা থমকাচ্ছে। তাই তোর ইচ্ছে থাকলেও তুই এগোতে পারছিস না। এই বাকিটুকু আমি তাড়াতাড়ি হাল চালিয়ে শেষ করে নিচ্ছি। তুই ততক্ষণে ওদের কাঁধের জোল নামিয়ে মুখের জালতি খুলে দে। ওদের একটু ঘাস খাইয়ে দে।”
    সুধার কথা মত কাসেম মাঠ থেকে উঠে পড়ল। জালতি খুলে দিল ঠিকই তবে একেবারে ছেড়ে দিল না। নিয়ম মত সিংয়ে দড়ি বেঁধে দুটো গরুর খোঁটা নিজের হাতে রেখে দিল। নাহলে পাশে যারা ধান গাছ রুয়ে গেছে, তাদের রোয়া খেয়ে নিলে ঝামেলায় পড়তে হবে। গরু-গাধাদের তো আর ওইসব জ্ঞানগম্মী নেই যে কোনটা ঘাস আর কোনটা ধানের চারা বোনা। বাঁয়াটার কাছে গিয়ে পায়ের খুরের ভেতর ঘা-টার কি অবস্থা দেখল। এখনো ভাল করে শুকোয় নি। তার উপর এই জলকাদা ওর ভেতর ঢুকছে। শুকোবার ফুরসতই তো পাচ্ছে না ও। মাঠে জমে থাকা জল একমুখ ভরে পিচকিরির মত সরু করে কয়েকবার ছিটিয়ে দিল খুরের গলাসির ভেতর। সেখান থেকে আটকে থাকা কাদা সব বেরিয়ে গেল। গরুটা কি শান্তভাবে তাকে কাজটা করতে দিল। কোন ছটফট করল না। অন্য সময় হলে পা ছটকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করত। আসলে কাদা বেরিয়ে যাচ্ছে, ওর আরাম হচ্ছে। গলা উঁচিয়ে শান্তভাবে কেমন দাঁড়িয়ে আছে। ডাইনের থেকে বাঁয়াটার বয়সও অনেকটা বেশি। বুড়োর দিকে ঢলে যাচ্ছে তার বয়স। এমনিতেই বেশিদিন হাল টানতে পারবে না। এই মরসুমটা যদি বা টেনেটুনে চালিয়ে দিতে পারে তো সামনের মরসুমে এদের দিয়ে কাজ হবে কি না বলা যাচ্ছে না। তার উপর ওর এই পায়ে ঘা। অনেকদিন ধরেই সারছে না। কি হবে বলা যাচ্ছে না। আদৌ তা সারবে কি না কে জানে। এইসব চিন্তা করতে করতে কাসেম গলা বাড়িয়ে সুধাকে বলল,“জানিস সুধা, আমার এই বাঁয়াটা যদি আর কাজে না লাগে তো আমি নতুন করে আর গরু কিনবো না। ডাঁয়াটা বেচে দিয়ে হালের কাঁড়া তুলে দেব।”
    কাসেমের কথায় চমকে ওঠে সুধা! আস্তে আস্তে চলন্ত হালের কাঁড়া থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,“কি বললি তুই কাসেম! কাঁড়া তুলে দিবি! কেন, হঠাৎ কি এমন ঘটল যে তুই এমন অলক্ষুণে চিন্তা করছিস? হালের কাঁড়া তুলে দিলে তুই খাবি কি? বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখ-দুঃখে দিন চলে যাচ্ছে, তা বুঝি সহ্য হচ্ছে না?” বলতে বলতে আকাশের দিকে চোখ উঠতে, বেলা গড়ানের ইঙ্গিত দেখে আবার হাল চালু করতে করতে সুধা বলল, “তোকে দেখছি জমি থেকে তুলে দিয়ে ঠিক হল না। উঠেই আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে বকরবকর করে চলেছিস। এ’কথা আমি তো ভাবতেই পারছি না। তাই আমার বুড়োটাকে ঘরে রেখে এই জোয়ানটাকে ঘরে তুললাম।”
    -সে তুই ঘরে তুলেছিস, ভুল কাজ করিসনি। কিন্তু নতুন করে আমি যদি তুলি তো মস্ত ভুল হয়ে যাবে আমার। এই ভুল আমি জেনে বুঝে করতে পারব না। তোর হাল-জোড়া, বলতে গেলে একদম নাবী। সর্বনাশা পরিস্থিতি আমাদের উপর আছড়ে পড়তে পড়তে তোর জোড়া ততক্ষণে বুড়ো হবার সময় হয়ে যাবে। তখন তুইও আমার মত ভাবতে শুরু করবি।
    -কেন তুই এমন অলক্ষুণে কথা বলতে শুরু করেছিস বলতো, কাসেম? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তোর মাথা-টাথা খারাপ হল কি না বলতো?
    -ঈশ্বরীপুরের মত আর একটা হ্যান্ড ট্রাক্টর পশ্চিম দেবীপুরে নেমেছে। সে খবর তুই রেখেছিস? এবার আস্তে আস্তে পূর্ব দেবীপুর, বাসুদেবপুর তারপর দৌলতপুর, বয়ারিয়া, উলকুনী, কোদালিয়া- চারদিক ছেয়ে যাবে। তুই শুধু এই বর্ষাটা কাটতে দে না। তারপর দেখবি তাদের রমরমা আছে কোথায়! তখন আমার না, তোরই মাথা-টাথা খারাপ হবার জোগাড় হয়ে দাঁড়াবে, দেখে নিস। খানিক চুপ করে রইল ওরা দু’জনেই। তারপর কাসেম আবার বলল, “কিরে সুধা, একেবারে চুপ মেরে গেলি যে? এতক্ষণ তো আমার কথা হুড়িয়ে দিচ্ছিলিস। এবার বুঝি মগজে সেঁধিয়েছে, কথাগুলো?” এবার হ্যাট হ্যাট করে গরু তাড়িয়ে নাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে সুধা বলল, “তুই শালাই তো আমার মনে ভয় সেঁধিয়ে দিচ্ছিস। চুপ হয়ে যাব না তো কি করব। তোর কথা যদি সত্যি হয় তো তাহলে আমাদের জীবন তছনছ হয়ে যাবে রে কাসেম। চাষীর সমাজে ‘হেলো’ বলে অন্য মজুরদের থেকে যে বাড়তি কদর পেতাম তা তো ঘুচে যাবার দিন সামনে আগত। পেট বাঁচাতে আবার সেই জন-মজুরের দলে মাথা গুঁজতে হবে। কাম-হাঙর যখন একবার তাদের কামের বুকে থাবা বসাতে শুরু করেছে, সত্যিই তো একদিন আসবে, ও বেটা তাদের গিলে খাবেই খাবে।” বলতে বলতে মনমরা হয়ে গেল সুধা। এতটাই দমে গেল যে আর যেন সে হাল চালাতে পারছিল না। গায়ের জোর হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু আরও তো দুটো পাই চষতে বাকি আছে। এটা শেষ করে তবে কাঁড়া তুলতে হবে। অগত্যা সে কাসেমকেই বলল, “কাসেম, তুই এইটুকু হাল টেনে দে। আমি যেন আর টানতে পারছি না। তোর জোড়ার খোঁটা আমি ততক্ষণে ধরছি।” কাসেমের বেঁধে রাখা গরু দুটোর খোঁটা ধরে ঘাষ খাওয়াতে খাওয়াতে সুধা ভাবতে লাগল, ওই ইঞ্জিন-হাল সত্যি সত্যি একদিন তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে। কিন্তু তাদের মত হেলোরা যদি এক জোট হয়ে এই যন্ত্রকে মাঠে নামতে না দেয় তো রক্ষা পেতে পারে তাদের ভবিষ্যৎ দুর্ভাগ্য। যেখানে হালের ট্রাক্টর দেখা পাওয়া যাবে সেখানে সবাই মিলে গিয়ে তার ড্রাইভারকে পিটিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বাধ্য করবে। ‘প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে হয়।’ প্রচলিত এই কথার খেই ধরে সুধা ভাবল, সবে ট্রাক্টর-হাল মাঠে নামা শুরু করেছে। তাই প্রথম এই যন্ত্র মাঠে নামানো তাদের আটকাতে হবে। তবে যদি তারা বাঁচে।
    বাকি হালটুকু শেষ করে কাসেম, সুধার গরুর কাঁড়া তুলে নিল। জোয়াল, নাঙল খুলে ওরা দুজনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সুধা, কাসেমকে তার ভাবনার কথা বলতে কাসেম বলল, “তুই যা ভাবছিস সেটা করলে মন্দ হয় না। একটা প্রতিবাদ করা যেতেই পারে। না হলে ট্রাক্টরওলারা তাদের নাকের ডকা দিয়ে ‘ফাঁকা মাঠে লাঠি ঘুরিয়ে’ পার পেয়ে যাবে। তবে আর একটা কথা কি জানিস সুধা, আমাদের চাপে হয়তো ট্রাক্টরওলা হাল না করে ফিরে যাবে। কিন্তু কতদিন আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতে পারব তার কোন ঠিক ঠিকানা থাকবে না বলে আমার মনে হয়। যাদের জমি ওই মেশিন-হাল চাষ করবে তারা যদি জোর করে তাদের ডেকে নিয়ে আসে আর বলে, কে বাধা দিতে আসে দেখব। যারা বাধা দিতে আসবে তাদের আমরা দেখে নেব। তখন তো একটা বড় গন্ডগোলের মধ্যে আমাদের জড়িয়ে পড়তে হবে। মারপিট, থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে। আমরা ছা-পোষা মানুষ। দিন আনি দিন খাই। ওইসব থানা-পুলিশ সামলানোর ক্ষমতা আমাদের আছে? নেই। যদি লকআপে দশদিন পুরে রাখে, বউ-বাচ্চা তো না খেতে পেয়ে মরে যাবে। আমাদের গরিবদের হয়ে কেউ বলতে আসবে না। উল্টে বাবুরা বলবে, এতদিন তোদের মেজাজে তেল মাখিয়ে আমাদের চলতে হত। যখন ইচ্ছে কাজে আসতিস। যখন ইচ্ছে আসতিস না। এখন তোদের বিকল্প আমরা পেয়ে গেছি। তোদের ভাল হল কি মন্দ হল তা দেখে আমাদের আর কাজ নেই। এতদিন তোদের হালের খামখেয়ালির উপর আমাদের চাষের ভাগ্য ঠিক হত। এখন এই ট্রাক্টর একদিনে বিঘের পর বিঘে জমি হাল দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর গরুর হালের মুখ চেয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সেই অপেক্ষার দিন শেষ।”
    -তা আমাদের গরুর হালের ক্ষমতার তো একটা সীমা আছে। আমরা সকলের
    মনের সঙ্গে দৌড়ে হাল দৌড় করাবো কেমন করে কাসেম? তা তো সম্ভব নয়। তবু বাবুরা আমাদের জীবন জীবিকার কথা একবারও ভাববে না!
    -এখানে কেউ কারোর ভালোর কথা ভাবে না রে সুধা। সব দেনা-পাওনার হিসেব কষে চলে। ইঞ্চিন হালের খরচও নাকি আমাদের গরুর হালের থেকে কম। একটা জমি চষলে আমরা তিনজনের খরচ নিই। দুই গরু আর হেলো। সেখানে ইঞ্জিন ঘন্টার হিসেবে দাম নেয়। তাতে নাকি গড়ে অনেকটা খরচ কমে আমাদের থেকে। তাহলে বাবুরা আমাদের মুখ চেয়ে কেন গ্যাঁটের কড়ি বেশি খরচ করতে যাবে! যাবে না। কিছুতেই যাবে না। তা ইঞ্জিন জমি চষে যাবার পর সেই কাদা মাটি সমান করার জন্যে তো মই দিতে হবে। সেটার জন্যে এখনো ইঞ্জিন তৈরী হয়নি। এই হেলোদের তখন ডাক পড়বে। তখন একটু কদর পাব আমরা। না হলে জমি রোয়া যাবে না। তা ওই মই দেবার জন্যে আর কটা হালের কাঁড়া লাগবে। তাতেও দুর্ভাগ্য আমাদের থেকে ছাড়ান দেবার নয়।

    ক্রমশ…

You cannot copy content of this page