ধারাবাহিক
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৩)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ ত্রিশ ]
এই প্রথম টানা এতদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটালো সনাতন। সমাজ জীবনের বৃহত্তর পরিসরের সঙ্গে তার এই পরিচয় তাকে কত যে সমৃদ্ধ করল তা সে বুঝিয়ে কাউকে বলতে পারবে না। মা শীতলার আশীর্বাদ ছাড়া এ যে কোনদিন সম্ভব ছিল না তা ভেতর থেকে সে উপলব্ধি করতে পারছে। বাবার কাছে আজীবন মাথা নত হয়ে রইল তার জীবনের এই পরম পাওনা পাবার সুযোগ করে দেবার জন্যে। ওরা এই রুইদাস পাড়ায় বসে কুয়োর ব্যাঙের মত পৃথিবীটাকে বিচার করে। কুয়োর ভেতরে থেকে ভাবে এর চেয়ে বড় জগৎ আর হতে পারে না! প্রথাগত এবং সেইসঙ্গে সামাজিক শিক্ষাদীক্ষায় আমল না দিয়ে দিনরাত জাত কুজাত অজাত বেজাত নিয়ে গুলতানি করে যায় ওরা। অথচ বাংলার বৃহত্তর সমাজ এসবের কোন মূল্যই দেয় না। কলকাতা তথা জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত এইসব মানুষজন ভাবতেই পারে না যে এখনো সমাজে কোথাও কোথাও জাতের নামে আধিপত্যবাদিরা নিজেদের দাপট রক্ষা করার প্রয়াস জারি রেখেছে। সেইজন্যে ওদের সমাজে ওরা শিক্ষাদীক্ষার আলো ঢোকানোতে এতটা নিরুৎসাহ দেখায়। অথচ ওখানকার আলোকিত সমাজে কে কি জাতের মানুষ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা বিন্দুমাত্র নেই কারোর। বাঙালী অবাঙালী মানুষরা মিলেমিশে একাকার হয়ে কেমন মা দুর্গার আরাধনায় মেতে উঠেছে। একে অপরের সঙ্গে ‘কোলাকুলি’ করছে। পরস্পরের কুশল কামনা করছে। সবাই সব্বাইয়ের বাড়িতে ঢুকে বিজয়ার উৎসব পালন করছে। কে কোন জাত, কে কাকে তার বাড়িতে প্রবেশ করতে দেবে না দেবে এইসব মধ্যযুগীয় চর্চায় যে তাদের কোন কাজ নেই।
কলকাতার হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের সন্তোষবাবুরা আলবাত জানে যে রতনরা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ। বর্ণাশ্রমের নিরিখে যে এরা চর্মকার মুচি সম্প্রদায় থেকে এসেছে তাও তাদের বিলক্ষণ জানা। তবু সমাজের সর্বোচ্চ বর্ণ, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ব্যানার্জী পরিবার একবারের জন্যে, তাদের মুচি সম্প্রদায়ের মতো বর্ণাশ্রমকে হাতিয়ার করে দূরে ঠেলে রাখেনি।
লক্ষ্মীপুজোর বিসর্জনের পরের দিন সনাতনরা বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দেয়। পাড়ার মানুষজন যেমন হৃদয় ভরে তাদের আশীর্বাদ করেছে তেমনি দু’হাত উজাড় করে দিয়েছে ঢাকির সিধের সামগ্রী। কি না আছে তাতে! বাচ্চা ছেলেপুলেদের পরার জামা-প্যান্ট থেকে শুরু করে মায়েদের শাড়ী, ছেলেদের ধুতি প্যান্ট। কিছু পুরোনো অথচ ধুয়ে ইস্ত্রী করা, একেবারে নতুনের মতো। কিছু আনকোরা নতুন। প্রত্যেক বাড়ি থেকে পুরোনো সামগ্রীর সঙ্গে নতুন কিছু না কিছু দিয়েছে। হয়তো এখানকার রীতি- শুধু পুরোনো ব্যবহৃত জিনিস দিতে নেই, সঙ্গে নতুনও দিতে হয়! সেইসঙ্গে চাল-ডাল আলু-তেল তো আছে। সব মিলিয়ে ‘মোট’ এত বেশি হয়ে গেছে যে ওদের দু’জনের পক্ষে হাতে-কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে আছে তাদের জিয়নকাঠি, ঢাকটা নিজেই তো একটা বড় মোটের অধিকারি। সতর্ক সন্তোষবাবুর নজর এড়ালো না এই ব্যাপারটায়। এত সবকিছু হেফাজত করে নিজের চারচাকায় তুলে বাবুঘাটে তাদের পৌঁছে দিল ভদ্রলোক! রতন সনাতনদের এমন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে ফেলল মানুষটা যে এ জীবনে এনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না তাদের।
সন্তোষবাবুকে বিদায় দিয়ে সনাতনরা একটা একটা করে জিনিসভর্তি পোঁটলা তিরাশি নম্বর গাড়িতে তুলতে লাগল। ড্রাইভার সিটের পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় রাখতে থাকে ওরা। সেইসময়ই হাঁই হাঁই করে ছুটে এলো কন্ডাক্টরটা, “মাল কোথায় যাবে? এত মাল এখানে তুলছেন, মানুষ কোথায় দাঁড়াবে? লোকে তো না দাঁড়াতে পারলে আমাদের গালাগাল দেবে। নামান, নামান। এখানে মাল রাখা যাবে না। অন্য গাড়িতে দেখুন। এখানে হবে না।
কন্ডাক্টরের কথায় সনাতন থমকে যায়, “বাবা, এ তো মাল নামিয়ে নিতে বলছে। কি করব এখন? এত মাল আবার নামাতে হবে?
-দাঁড়া না। ভয় পাচ্ছিস কেন। ওরা তো মাল নিয়ে যায়। নিয়ে যায়না তা তো নয়। আমাদের না হয় একটু বেশি মাল আছে। নিয়ে যাবে। দেখনা। আসলে ওরা দর বাড়াতে চাইছে। এটা ওদের স্বভাব। আমরা যাতে ওদের বাধ্য হই। তাহলে ওরা যা ভাড়া হাঁকবে তাই আমাদের দিতে হবে।
রতন শেষ পুঁটলিটা বাসে উঠাতে যাচ্ছে। সেইসময় কন্ডাক্টরটা আবার বলল,“কি হল দাদা, আমি কি বলছি কানে যাচ্ছে না বুঝি? দেখবেন, মালগুলো কেমন নামিয়ে দেবো? তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবেন না।
-আরে ভাই, কেন অমন করছো! তুমি তো এমনি নিয়ে যাবে না। তাছাড়া তোমরা যে কোনদিন বাসে মাল তোল না তা তো নয়। কি, তোল না? রোজই কিছু না কিছু মাল নিয়ে যাও, মালের ভাড়া নাও। আমরাও ভাড়া দেব। আমাদের দেখে কি মনে হচ্ছে তোমাদের বঞ্চিত করে মাগনা এগুলো নিয়ে যাব? চলো চলো। যা ভাড়া হয়, সেই ভাড়াই দেব। আমরা দিঘিরপাড় বাজারে নামব।
-মালের জন্যে এক’শ টাকা ভাড়া দিতে হবে। আপনাদের দু’জনের ভাড়া আলাদা। অনেক মাল আছে। এক পয়সা কম হবে না। রাজি না হলে মাল নামিয়ে নিন।কন্ডাক্টরটরের কথায় চমকে ওঠে সনাতন! বলে কি এই লোকটা! বাস ভাড়া যেখানে কুড়ি টাকা। সেখানে মালের ভাড়া এক’শ টাকা! লোকটার মুখে আটকালো না এই টাকার কথা বলতে! আর চুপ করে থাকতে না পেরে সনাতন বলল,“যে জায়গায় মালগুলো আছে সেখানে ক’টা মানুষ দাঁড়াতে পারে একবার বলবেন? বড়জোর দু’জন ? তা দু’জনের ভাড়া হয় কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ। সেখানে আপনি এক’শ টাকা চাইছেন?” এরপর আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল সনাতন। রতন তাকে থামিয়ে দিয়ে কন্ডাক্টরকে বলল, “দেখো ভাই, আমাদের দেখে তোমার মনে হচ্ছে আমরা বোকা-হাঁদা লোক। তাই তুমি এই অবান্তর কথা বলছো, তাই না? ওটা ভেব না। আমাদের তুমি জোর করে নামিয়ে দিলে আমরা হয়তো নেমে যাব। কিন্তু ওই জায়গায় হয় দুটো লোক দাঁড়াবে। অথবা অন্য কেউ ওখানে মাল রাখবে। তাদের কাছ থেকে তুমি ওই এক’শ টাকা আদায় করতে পারবে তো? যদি পারো, সাহস দাও আমাদের তাহলে আমরা নেমে যাচ্ছি। আমারা নিশ্চিত তুমি তা পারবে না। তাই খামোকা কেন ঝগড়াঝাটির দিকে যাচ্ছো। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কি ঝগড়াঝাটির সম্পর্ক? নাকি তোমার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা আছে? আপোশে মাঝমাঝি একটা কিছু করে নাও। আমাদের দু’জনের ভাড়া বাদে মালের জন্যে আমরা পঞ্চাশ টাকা দেব। তুমি ‘না’ কোরো না, ভাই।”
রতনের যুক্তিযুক্ত কথায় কন্ডাক্টর যেন একটু নরম হয়। পাল্টা কোন আক্রমণাত্মক কথা না বলে বলল,“পঞ্চাশ টাকায় হবে না। আপনি বলছেন, তাই কুড়ি টাকা কমিয়ে দিচ্ছি। আশি টাকা দেবেন। এর থেকে এক পয়সা কম হবে না।”
-আচ্ছা বাবা, তোমার কথা থাক, আমার কথাও থাক। তুমি ষাট টাকা নিও। আর যদি অন্য কেউ মাল নিয়ে ওঠে তো আমাদের মোটের ওপর রেখে দিয়ো। আমাদের কোন ঠুনকো মাল নেই যে তার উপর চাপালে ভেঙেটেঙে যেতে পারে। তাহলে তোমার পুষিয়ে যাবে। আর এতটা রাস্তা, একদম মাল নিয়ে কোন যাত্রী উঠবে না তা তো হবার নয়।
ওদের দু-বাপ-বেটা মালের ডাঁইয়ের সামনের দুটো সিটে বসে সেগুলো লক্ষ্য রাখতে রাখতে চলল। সনাতন জানালার দিকে বসে কলকাতা দেখে আসতে আসতে আবার হঠাৎ হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের এতদিনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে এলো। ভেসে এলো সন্তোষবাবুর মুখ। ওখানকার মানুষজনের কত কথা। কত আনন্দঘন চিত্র। হঠাৎ সনাতন তার বাবাকে বলে,“বাবা, এখানে এতদিন থেকে একটা ব্যাপার আমার মনে লোহার পেরেক দিয়ে গভীর আঁচড় কাটার মত দাগ দেগে বসল। দেখেছো, এখানে জাত বেজাত উঁচুনীচুর
বিচার কেমন একাকার হয়ে বসে আছে? সব জাতের মানুষ ওখানে আছে। আনন্দ স্ফুর্তি করছে। মেলামেশা করছে। এমনকি সামাজিক আত্মীয়তার সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। আর আমরা সেই জাত নিয়ে কি না কড়া অনুশাসন চালিয়ে যাচ্ছি। আজও। সেই বর্ণাশ্রমের ছুৎমার্গ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। এটা না পারলে আমাদের রুইদাস তো সেই মধ্যযুগের বর্বর রুহিদাস হয়েই রয়ে যাব। না, আমি বলছি না যে আমাদের জাতটা সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যাক। সেটা আমরা হতে দেব না। কিন্তু জাতকে ভাঙিয়ে একদল গোঁড়া লোক ফায়দা তুলে যাবে, তা হতে পারে না। ওইসব মনগড়া গোঁড়ামি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে বাবা। আমার এখন খুবই খারাপ লাগে বাবা, তুমি সেই রুহিদাসদের আটচালার অন্যতম একজন মাতব্বর। যেকথা বলছি, তুমি আমার বাবা। তুমি এই মাতব্বরির কাজটা ছেড়ে দাও। আটচালায় যাও। সেটা বারণ করছি না। কিন্তু কলকাতার এখানকার মত আধুনিক মন নিয়ে আটচালায় যাও। বর্ণাশ্রমের লালন থেকে বিরত থাকো। তোমার মত বুঝদার মানুষ যদি আস্তে আস্তে এর বিরোধিতা করতে শুরু করে, দেখবে একদিন আমরা আমাদের সত্ত্বাকে সগর্বে জীবিত রেখেও কত উন্নতি করতে পারছি।”
-তুই আমার মনের কথাই বললি রে সনাতন। সেই থেকে আমিও ঠিক এই কথাগুলোই মনের ভেতর আওড়াচ্ছিলাম। কাজটা ভীষণ শক্ত। অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এই অচলায়তনকে ভাঙতে গেলে। তবু একটা কিছু তো করতে হবে।
বাবা যে একই মত পোষণ করছে তাতে সনাতন মনে মনে আশ্বস্ত হয়। বাবার এই বোধে সে নিজেকে গর্বিত বোধ করে। সনাতন মনে মনে যেন শপথ নিয়ে ফেলে যে তাদের সমাজকে এই মধ্যযুগীয় ভাবনা থেকে বার করে আনতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হবে। মুছে সাফ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, সমাজ মনে জমে থাকা যাবতীয় ময়লা। এইসব ভাবতে ভাবতে আর একটা কথা তার মনে জেগে উঠল তার বাবাকে বলার জন্যে,“আর একটা কথা কি জানো তো বাবা? অভয় আমাদের বেকায়দায় ফেলার জন্যে ষঢ়যন্ত্র করে শিয়ালদায় পাঠিয়েছিল। প্রথম দিকে যারপরনাই অপমান আর অপদস্থ আমাদের হতে হয়েছিল ঠিকই। সেদিক থেকে হয়তো ও সফল হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভয়ের শাপ আমাদের কাছে ‘বরে’ পরিণত হল। ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’ সেই প্রবাদটাই আমাদের বেলায় খেটে গেল। কিন্তু মনে মনে যে ও এখনো বগল বাজাচ্ছে- আমাদের বিপত্তিতে ফেলার কথা ভেবে। তা আমি নিশ্চিত। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে ওকে আচ্ছা করে কড়িয়ে দেব, এইভাবে আমাদের বিপদে ফেলার জন্যে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওকে কিছু একটা দিয়ে পুরস্কৃত করব। ওর জন্যেই যে জীবনের একটা নতুন দিকের সন্ধান আমরা পেলাম। যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করলাম তা এমনিভাবে কোনদিন হয়তো আমাদের পাওয়া হয়ে উঠতো না। সেই দিক থেকে অভয় আমাদের প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করে ফেলল ওর অজ্ঞানে এবং অজান্তেই।
আমতলায় এসে গাড়ি থামল। এখানে সব বাসই প্রায় অর্ধেক খালি হয়ে যায়। সনাতনদেরটাও তাই। গাড়ি চলা শুরু করতে কন্ডাক্টর এলো তাদের কাছে ভাড়ার টাকা নিতে। বাবার কথামত সনাতন নিজের কাঁধ ব্যাগটা কোলে রেখে তার ভেতর থেকে চুক্তিমত ভাড়ার টাকা দিল। কন্ডাক্টর শুধু তাদের দু’জনের ভাড়ার টিকিট দিয়ে চলে যায়। মালের ভাড়ার জন্যে যে টাকা দিল তার টিকিট দিল না। টিকিট তো টাকা দেবার রসিদের মত। তাহলে সে যা টাকা দিল তার পুরো রসিদ তো কন্ডাক্টরের দেবার কথা। সেই ভেবে সে সিট থেকে উঠে কন্ডাক্টরকে ডাকতে যাবে, সেই সময় তার বাবা হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে দিল,“কন্ডাক্টরকে ডাকতে যাচ্ছিস, মালের ভাড়ার টিকিট চাইবি বলে তো? আমি ঠিকই ধরেছি। আরে বোকা, মালের ভাড়ার টিকিট ওরা কেউ দেয় না। ওই টাকা ওদের হিসেবের বাইরে। মালিককে মালের ভাড়ার টাকা ওরা দেয় না। ওই টাকা ড্রাইভার- কন্ডাক্টর ভাগ করে নেয়। এটাই এখানকার রীতি। এটা বাসের মালিকেরও জানা। এই ছাড়টা মালিকরা ওদের দিয়ে রেখেছে। নাহলে ওরা ভাড়া থেকে টাকা হাতসাফাই করবে। ওদের তো জলপানির একটা খরচ আছে। সেটা তো মালিকরা আলাদা করে ওদের দেয় না। কেউ কেউ আবার প্যাসেঞ্জারের ভাড়ার টিকিটও দেয় না। যেমন এই কন্ডাক্টর আমাদের দিয়েছে।”
বাবা, সনাতনকে হাত ধরে সিটে বসিয়ে দেবার পর তার হাতে থাকা টিকিট দুটো ব্যাগে রাখতে গিয়ে সেই খবরের কাগজটা তার চোখে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনটা আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে! হয়তো এমন দিন এবার থেকে তার আরও আসতে পারে। বা এর থেকে আরও ভালো দিনও আসতে পারে। কিন্তু জীবনের প্রথম পাওয়া এমন আনন্দর সঙ্গে আর কোন খুশির সময় মেলানো যাবে না। খবরের কাগজটা আবার একবার ভাঁজ খুলে দেখে নেয় তার সোনালী দিনটা ধরে রাখার চিহ্নটা। বিখ্যাত বেঙ্গল পেন্টস প্রত্যেক বছর দূর্গা পূজায় বিভিন্ন পর্যায়ে- প্যান্ডেল, প্রতিমা সজ্জা, আলোক সজ্জা, বাদ্য পরিবেশন ইত্যাদির শ্রেষ্ঠদের পুরস্কৃত করে থাকে। মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পাবার জন্যে পুজোর সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা সবসময় সেই প্রচেষ্টা করে যায়। রতন-সনাতনদের সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা ছিল না। বিচারকরা তো কাউকে না জানিয়েই তাদের মত বিচারের কাজ করে চলে যায়। রতনরা ভাবতেই পারেনি তাদের ঢাক বাজনার বিষয় কোনো বিচারে স্থান পেতে পারে। হঠাৎ নবমীর দিন
সন্তোষবাবুরা দলবল মিলে হইহই করে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে তাদের কাছে ছুটে এলো, “দেখো রতন, সনাতন- তোমাদের ঢাক-কাঁশি বাজনার ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে! আমাদের পুজো কমিটির মান-সম্মান তোমরা কত উঁচুতে তুলে দিয়েছো! তোমাদের বাজনার পটুতায় তোমরা এ’বছর বিচারকদের বিচারে কলকাতার মধ্যে সেরা হয়েছো। তোমাদের সাথে সাথে আমাদের পুজো প্যান্ডেলের নাম কাগজে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। সত্যিই রতন, তোমাদের বাজনার গুণের অন্ত নেই। যোগ্য শিল্পী যোগ্য মর্যাদা পেয়েছে। আজ আমাদের কি আনন্দের দিন! প্রত্যেক বছর আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই, কোন পর্যায়ে যদি একটা পুরস্কার পেতে পারি কি না। এখনো পর্যন্ত সেই সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এই তোমাদের হাত ধরে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছুঁতে পারলাম।” বলে হঠাৎ একটা বিশাল চিৎকার করে সন্তোষবাবু বলে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর রতন-সনাতন!” সঙ্গে সঙ্গে সমবেত মানুষজন বলে উঠল, “হিপ হিপ হুররে!” বার তিনেক এইভাবে তাদের নামে সুখ্যাতি যখন করল, সনাতনের বাবা আনন্দে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ডুকরে ডুকরে যেন পাগলের মত কাঁন্না শুরু করে দিল! পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যে সনাতন তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“বাবা, কাঁদছো কেন। আজ তো আনন্দের দিন আমাদের। এসো চোখ মুছে বাবুদের সঙ্গে আমরাও আনন্দ করি। তোমার মন ফুঁড়ে শ্রেষ্ঠ বোল তোমার ঢাকে তোলো। সেই তালে আমিও কাঁসর বাজাই আর বাবুদের নাচের পায়ে পা মিলিয়ে যাই।” আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রতন ঢাকের কাঠি হাতে নিয়ে নিল। কতক্ষণ যে সেই বাজনার বোল চরাচরে ডানা মেলে খেলে বেড়াতে লাগল তা দুই বাপ-বেটার যেন কোন হুঁশই নেই! শেষ পর্যন্ত সন্তোষবাবুদের জোরাজুরিতে রতনরা বিরত হতে বাধ্য হল, “রতন-সনাতন, এবার তো আমাদের একটু বিশ্রাম নিতে হবে না কি? খাওয়া দাওয়া আমরা সবাই করবো তো এবার! বেলা যে গড়াতে শুরু করেছে। কিছুটা পরেই তো নবমীর সন্ধ্যারতির আরাধনায় মগ্ন হতে হবে। চলো রতন, চান খাওয়া করে নিই আমরা। সামান্যর জন্য হলেও একটু বিশ্রাম না নিলে শরীর সায় দেবে কেন!”
সনাতন মনে মনে ভাবল, দিঘিরপাড়ে যারা এই পত্রিকা দেখেছে, তারা নিশ্চয়ই তাদের ছবি নজর করেছে। এলাকার রুইদাস পাড়ার লোকের ছবি বাংলার প্রথমসারির খবরের কাগজে বেরিয়েছে দেখে তাদেরও খুশি হবার কথা। হয়েছেও নিশ্চয়ই। কিন্তু এ সংবাদ যে তাদের রুইদাস পাড়ার ‘গন্ডি’ টপকাবে না সে বিষয় সনাতন নিশ্চিত। কি করেই বা টপকাবে? যে পাড়া শিক্ষাদীক্ষাকে জীবনের মূল মন্ত্র করে সন্তানদের মানুষ করে না তাদের কাছে এই ছবি দেখা আর অন্ধের হস্তি দর্শন সমার্থক। তাতে অবশ্য সনাতনের কিচ্ছু যায় আসে না। পাড়ায় তাদের নাম বেশি ফাটলে বরং মদওয়ালাদের ডানচোখ নাচবে। তাদের প্রতি ঈর্ষায় জ্বলতে থাকবে। আর সেই জ্বলন নিবৃত্ত করতে ঢকঢক করে চুল্লু গলায় চালান করে দিয়ে বিরামহীন খিস্তিখেউড় শুরু করে দেবে। নিজেদের ব্যর্থতাকে এইভাবেই ওরা তোল্লা দিয়ে যায়। তাকে দমন করে সাফল্যের সু-বাতাস গায়ে মাখতে এখনো তারা শিখে উঠতে পারলো না।
দিঘিরপাড়ে বাস স্টপে স্বাভাবিক সময় থেকে একটু বেশি সময়ই দাঁড়িয়ে রইল বাস। রতন-সনাতন ব্যস্ত তাদের জিনিসপত্র এক এক করে নামাতে। সেই দৃশ্যে বাজারের অনেকের কৌতূহলী চোখ আটকে যায়। কৌতূহল তো হবেই। রুইদাস পাড়ার লোক বাস থেকে কি এত জিনিসপত্র নামায়। কয়েকজন কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েও যায়। বাস চলে যেতে চরাচর আড়ালমুক্ত হলে সনাতন যেন একবুক স্বস্তির বাতাস টেনে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে মিলিয়ে নিতে চায় আগের দেখার সঙ্গে বর্তমানের। রতন বলল, “খোকা, ওই মহাদেব কাকার রোল দোকানের পাশে উত্তমের ভ্যনটা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডেকে আন বাবা।” এত মাল ভ্যান ছাড়া বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না তারা বিলক্ষণ জানে। সনাতন পা চালিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে যেতে যেতেই শুনতে পায় একজন বাবু তার বাবার নাম ধরে বলছে, “কি গো রতন। কাগজে যে তোমাদের বাপ-বেটার নাম দিয়ে-ছবি বার হল। তোমরা ঢাকের বাজনা বাজানোর বিভাগে কোলকাতার মধ্যে প্রথম হয়েছো দেখে খুব খুশি হয়েছি আমরা। বাঃ খুব ভালো। ভালো লাগছে, আমাদের এলাকার মানুষের গুণের কথা ফলাও করে কাগজে প্রকাশ পাবার জন্যে। খুব ভাল হয়েছে। তোমার ছেলেও প্রশংসিত হয়েছে দেখলাম।”
দৌলতপুরের হালদার বাড়ির সুবিরবাবু যখন বাজারের মাঝে গর্বের সঙ্গে গলা চড়িয়ে বলছে তখন সেখানে জড়ো হয়ে থাকা লোকজন শুনে একটু অবাকই হয়ে যায়! ভাবনাটা, কই, তারা তো এত বড় খবরটার কিছুই জানে না? ক’জন লোক আর অত খুঁটিয়ে পেপার পড়ে। সনাতনরাও কি নিয়ম করে খবরের কাগজে চোখ বোলায়? বোলায় না। এখন নেহাত তাদের ছবি কাগজে ছাড়া হয়েছে বলে তারা পেপার-চর্চা করছে। যারা নিয়ম করে পড়ে তারা জানতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মুখে মুখে বাজারে চাউর হয়ে যায় রতনদের গুণকীর্তন। প্রায় ভিড় জমে যায় রতন আর বাস থেকে নামিয়ে রাখা তাদের মালপাটকে ঘিরে। কৌতূহলী মানুষের মন কত দিকে যে ধেয়ে যায়, কে বলতে পারে। কেউ ভাবছে রুইদাস পাড়ার লোকটা এত মাল কোথা থেকে আমদানি করল? দু’নম্বরি কিছু নয় তো? যখন আবার তাদের সু-কীর্তির কথা বলাবলি হচ্ছে তখন কেউ বলছে, এতে অনেক জিনিস আছে। পুরস্কার পেয়েছে ওরা ঢাক বাজিয়ে। পেপারে ছাপা হয়েছে ওদের নাম-ছবি! সনাতন দেখল এই মালপাট এক্ষুণি ভ্যানে বোঝাই করে এখান থেকে না সরালে এই ভিড় আর লোক চর্চা চলতেই থাকবে। আর বিলম্ব না করে সে মালগুলো উত্তমের ভ্যানে তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
উত্তমের সাইকেল ভ্যান রুইদাস পাড়ার সীমানা মাড়িয়ে সনাতনদের বাড়ির সামনাসামনি রাস্তায় এসে থামল। রাস্তা থেকে ঢালু পথে গাড়িটা নামানোর জন্যে সনাতন ভ্যানের পেছনটা টেনে ধরে আস্তে আস্তে নামাচ্ছে। সেই সময় অলোকাদি কলেজ থেকে ফিরছিলো। ঢাল থেকে নামতেই অলোকাদি সনাতনকে বলল, “সনাতন একটু দাঁড়া? তোরা তো সাংঘাতিক এক কান্ড করে ফেলেছিস রে। কাগজে খবরটা দেখে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছিল! মনে হচ্ছিল তোকে একটু আদর করে দিই। সত্যি তুই-কাকা মিলে আমাদের রুইদাসদের গর্ব করার মত কাজ করে ফেলেছিস। রুইদাসদের ইতিহাসে কোনদিন কারোর নাম এভাবে কাগজে ছাপা হয়নি। কি ভালো যে লাগছে না আমার! গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।”
-তুমি খবরটা কোথা থেকে জানলে অলোকাদি? এ সংবাদটা তো শুধু খবরের কাগজে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই কলেজ লাইব্রেরীর খবরের কাগজ পড়ো? তাছাড়া আর জানবে কেমন করে।
অলোকাদি এবার রাস্তা থেকে নেমে সনাতনের কানের কাছে এসে বলল,“না রে, তোর বিপ্লবদা আমাকে কাগজটা এনে দিল। বলল, তোমাদের পাড়ার সনাতন আর তার বাবার ছবি কাগজে বেরিয়েছে। ঢাক বাজিয়ে পুরস্কার পেয়েছে ওরা। এই দেখো, দেখো, কেমন ফলাও করে এখানে ছাপিয়েছে! আমাদের বয়ারিয়া গ্রামের মানুষের এমন খবরে সকলের গর্ব বোধ হচ্ছে। তারপর এরা একদম তোমাদের পাড়ার লোক। তোমাকে না জানিয়ে আর থাকতে পারলাম না। তাই দিঘিরপাড় বাসস্টপে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্যে। সন্ধ্যেয় তুমি কোচিং করে বাড়ি ফিরলে তোমার হাতে এটা দেব বলে। এই নাও। এটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাল করে সংবাদটা পড়ো। পারলে তোমাদের পাড়ার লোকদের জানিও। এদের কীর্তিকথা!” তা আমি আর পাড়ার কাকে জানাব। মা বাবাকে বললাম। মা বাবা শুনে আর তোমাদের ছবি দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। বাবা বলে, রতন আমাদের গ্রামের নাম উজ্জ্বল করে দিল। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজধানী- সক্কলে আমাদের গ্রামের নাম জেনে গেল। এ কম খুশির কথা!” যাঃ আর তোকে আটকে রাখব না। অতদূর থেকে আসছিস। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করগে।” আর একটা কথা, বলে সনাতনের কানের কাছে গিয়ে অলোকাদি বলল,“মা আজ নাড়ু বানিয়েছে। আমাদের বাড়ি যাস। তোকে খাওয়াবো। তোর পুরস্কারের সম্মানে আমার তরফে পুরস্কার!”
-তুমি এখন কোথা থেকে আসছো দিদি? কলেজ থেকে? এখন তো পুজোর ছুটি। খুলবে ভাইফোঁটার পর। তোমাদের কলেজে আবার অন্য নিয়ম?
-হ্যাঁ রে ভাই। পুজোর ছুটি ঠিকই আছে। তবে ছুটিতে যাতে পড়া পেছিয়ে না যায় তাই অনার্স ক্লাসগুলোর জন্যে স্পেশাল ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে কলেজ। তাই যেতে হচ্ছে।
-কলকাতা থেকে তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি অলোকাদি। তোমাকে জিনিসটা আমি দেব। তুমি কিন্তু ওটা নিতে ‘না’ করবে না। ভালোবেসে আমি তোমাকে দেব। যখন তোমাদের বাড়ি যাব সেটা নিয়ে যাব। ভালোবাসার জিনিস ফিরিয়ে দিতে নেই। না হলে যে প্রাণভরে দিতে চায় তাকে কষ্ট দেওয়া হয়ে যায়। নেবে দিদি?
-বেশ দামি দামি কথা বলতে শিখেছিস তো তুই, সনাতন। আচ্ছা, ঠিক আছে। সেটা দেখা যাবে। হ্যাঁ, আসল কথাটা তো তোকে জিজ্ঞাসা করা হল না। আমি কিরকম যা-তা দেখ। ওটা আমাকে আগেই বলা দরকার ছিল। তা কলকাতায় তোদের কোন অসুবিধা হয়নি তো? কোনদিন তো তুই কলকাতায় যাসনি। এই প্রথম।” একটু থেমে আবার অলোকাদি বলল,“কষ্ট আর হবে না? কাকাও শুনেছি এই প্রথম কলকাতায় ঢাক বাজাতে গেল। কষ্ট তো হয়েইছে। আমার মন সেটাই বলছে। তবে তোরা বাপে-ছেলে যা সহনশীল। তোরা সেই অসুবিধাগুলো সামলাতে সক্ষম হয়েছিস বলেই এই সাফল্য পেয়েছিস। এ’ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।[ একত্রিশ ]
যতক্ষণ না রেখা বউয়ের শ্বশুরের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ সে কারবারের কোন কাজই করতে পারবে না। রেখাবউ চেয়েছিল বাড়ির কাজের ফাঁকে কারবারের কাজ যতটা পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু অখিলই তাতে বাধ সাজে। অশৌচ না কাটা পর্যন্ত ঠাকুরের গয়নার কাজে ছোঁয়াছুঁয়ি করা যায় না। শাস্ত্রের বিধানে বাধে। বেমানানও। শোকবিহ্বল এক মহিলার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এমন নির্দয় কাজ করানোয় অখিলের বিবেক সায় দেয় নি। তাতে তার কারবারের লাভালাভে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়বে। পড়বে-পড়বে! তাতে কি? পালপাড়ার স্কুলে পড়া মেয়ে ঊষা, রেখা বউয়ের কাছাকাছি বুদ্ধি ধরে। সেও এই জটিল কাজ অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছে। এখন তার পুজোর দীর্ঘ ছুটি। স্কুল যাবার জন্যে অন্য সময় তার বেশি কাজ করা হয়ে ওঠে না। এখন সে অনেকটা বেশি কাজ তুলতে পারে। রেখা বউয়ের বরাদ্দ কাজের কিছুটা ওই মেয়েটাকে দিয়ে সে করাচ্ছে। তবে সে রেখা বউয়ের মত অত পাকাপোক্তভাবে দ্রুততার সঙ্গে কাজ নামাতে পারে না। কাজের ফিনিশিংও রেখা বউয়ের মত নয়। এই নকশার কাজটা সেইজন্যে জমে যাচ্ছে। যাচ্ছে যাক। শ্বশুরের কাজ মিটে গেলে রেখা বউ সুদে-আসলে তা মিটিয়ে দেবে। সে আস্থা তার উপর অখিলের আছে।
ভীষ্মর বাপের কাজে টানা তিনদিন সারাক্ষণই রেখা বউদের বাড়িতে থেকে সবকিছু তদারকি করেছে অখিল। মাঝে কোন ফুরসতে কারিগরদের বাড়িতে গিয়েছে কাজের খোঁজ খবর নিতে বা অন্য প্রয়োজনে। যতই ছোট করে গরিবীয়ানায় কাজ করা হোক না কেন তা সম্পন্ন করতে তো একটা খরচ আছে। সেই খরচও যোগান দেবার সামর্থ রেখা বউদের ছিল না। অখিলই মুশকিল আসান হয়ে তাদের সামনে হাজির হল বলেই সবকিছু সামাল দেওয়া গেল। রেখা বউয়ের তাই অখিলের প্রতি কৃতজ্ঞতার যেন অন্ত নেই। ভাল মনের মানুষ না হলে এবং সেই মানুষটার হৃদয় থেকে সাড়া না দিলে আচমকা কেউ এইভাবে অর্থ দিয়ে এবং গতর দান করে তাদের সমস্যার সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। তার সঙ্গে এই মানুষটার কিসের সম্পর্ক? কারিগর আর ঠিকাদারের সম্পর্ক ছাড়া তো আর কিছু না। সে তো সাধারণ নিয়ম মেনে অসুবিধায় পড়া কারিগরকে এককালীন কিছু নগদ হাতে ধরিয়ে কর্তব্য সেরে ফেলতে পারতো। তার স্বামীর বেলায় যেমন হয়েছিল তেমনি এবারও, কাজের মজুরী থেকে তা আস্তে আস্তে কাটান করে সেই ধার শোধ করে দিতে পারতো। ও শুনেছে লোকে নিখিল ঠিকাদারের এই কাজের জন্যে গুনগুন ফুসফুস করে বেড়াচ্ছে। বিধবা বউয়ের ওপর লোভে পড়ে গেছে রুইদাস পাড়ার এই ছেলেটা। তাই ও, বিধবাটার বাড়ি ঘনঘন আসা যাওয়া করে। কিন্তু সে তো কোনদিন অখিলবাবুর চোখে মুখে লোভীর রেখা ফুটে উঠতে দেখেনি! কক্ষনো এমন ব্যবহার সে তার সঙ্গে করেনি, যেটা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তার প্রতি ওই লোকটার নজর পড়ে গেছে। বরং এমন সভ্য ব্যবহার সে ছাড়া অন্য কারোর কাছে পায় নি। আর নিন্দুকরা যত তাদের নিয়ে অপচর্চা করে, ওই ভাল-মানুষটার প্রতি তার ভাবনা যেন বেশি করে পেয়ে বসে। মানুষটাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় দিতে তাকে যেন উৎসাহিত করে। এমনিতে ওনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখানোর জন্যে তার এগিয়ে আসার কথা না। সে একজন স্বামীখেকো মেয়েমানুষ। তিনকুলে তার কেউ আর বেঁচে নেই। এই এক আধমরা সদ্যবিধবা বুড়িটা এখন তার জীবনের ছাতা হয়ে নড়াচড়া করছে। এ চলে গেলে তার ভবিষ্যৎ কোন খাতে বইবে তা তার অজানা। তার মত একজন দায়বতী, অচ্ছ্যুৎ যুবতী বিধবার উপর কোন জলজ্যান্ত টগবগে যুবকের দুর্বলতা থাকতে পারে তা সে ভাবতেই পায় না। মানুষ যতই তাদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চালিয়ে যাক না কেন। নিজের জীবনকে সুরক্ষিত রাখার জন্যে এই ভাবনা তার মনেও আনা উচিত নয়। একজনের সরলতার সুযোগকে কাজে লাগাতে এমন আত্মপর সে হতে পারবে না। মানুষটাকে তার সম্মানীয় আরাধ্য পুরুষ ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে চায় না। তার প্রতি সে যদি কোন দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলে তো তা হবে মানুষটার প্রতি তার চরম অবিচার। এমন এক বড় মনের মানুষকে কেন সে অন্য রঙে রঙিন করার প্রয়াসে সচেষ্ট হতে যাবে! যাবে না সে। এটা তার ধর্ম। এ ধর্ম থেকে সে বিচ্যুত হতে চায় না।
নিয়মভঙ্গের দিন বাড়ির যাবতীয় কাজ সারতে সারতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। পরের দিন অখিলকে কোলকাতায় যেতে হবে। মহাজনের তলব এসেছে। আর সে এই কাজগুলো শেষ করে না গেলে সব পড়ে থাকবে। ডেকরেটরকে একদিনের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। সাইকেল ভ্যানকে বলে রেখেছে। সক্কাল হলেই সে এগুলো নিয়ে ডেকরেটরের ঘরে পৌঁছে দেবে। রাত তখন প্রায় একটার কাঁটা পেরিয়ে দুটোর দিকে টিকটিক করে এগোচ্ছে। রেখা বউয়ের বুড়ি শাশুড়ি পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। রেখা বউকে সব বুঝিয়ে বলে, বাড়ির দিকে পা বাড়াবে ঠিক করে এগিয়ে গেল অখিল, “রেখা বউ, আমি তাহলে এখন বাড়ি যাচ্ছি। আমার যা কাজ করার সব করে গুছিয়ে রেখেছি। সকালে উত্তম ভ্যানওয়ালা এসে ডেকরেটরের মালগুলো সব নিয়ে যাবে। কাল আর দেখা হবে না। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তোমরা সব সাবধানে থাকবে।” কথাগুলো বলে অখিল পেছন ফিরতেই রেখা বউ তার হাতটা টেনে ধরে! রেখা বউয়ের পেলব হাতের স্পর্শ তার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন উতলা হয়ে ওঠানামা করতে লাগল। উথাল পাথাল হতে থাকে ভেতরটা! দ্রুত রক্ত চলাচলে তার শরীরের রোমকুপের গোড়াগুলো ভিজে ভিজে মনে হতে লাগল ! জীবনে এই প্রথম কোন সুন্দরী যুবতীর স্পর্শ সে অনুভব করল। এ অনুভবে যে এমন মাদকতা আছে তা আগে কখনো জানা হয়ে ওঠেনি তার। মনে হচ্ছিল যেন এমন স্পর্শসুখ সে যদি আজীবন পেত, তার জীবন হয়তো সার্থক হয়ে যেত। রেখা বউয়ের হাতটা জোর করে না ছাড়িয়েই তার ছোঁয়াকে হৃদয়ের সঙ্গে একাকার করে নিতে নিতে প্রশ্নমুখো হয়ে ঘুরে প্রকৃতির মুখোমুখি হল। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখ থেকে ভেসে এল কথাটা, “অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। যতই কাছাকাছি বাড়ি হোক না কেন। বর্ষার রাত। অনবরত ঝিমঝিম টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বর্ষায় পাড়াগাঁয়ের রাতের রাস্তা একদম ভাল থাকে না। পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করে শিকার ধরার জন্যে। ঠিকাদার বাবু আমি এখন তোমাকে এই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারবো না। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় আমি পাল্টে দিচ্ছি। তুমি এ’ঘরে একটু গড়িয়ে নাও। সময় এখন রাত দুটোর কাছাকাছি। এ’পাশ ও’পাশ ফিরতে ফিরতেই ভোর হয়ে আসবে। অন্ধকার ফুঁড়ে ভোর উঁকি দিলেই না হয় বাড়ি চলে যেও। তবে এখন না। আমি পাশের ঘরে শাশুড়ি মায়ের কাছে শুতে যাচ্ছি।”
-নতুন বিছানায় শুলে আমার ঘুম আসে না। উশখুশ করেই রাত কাবার হয়ে যাবে। বাড়ি গেলে তবু কিছুটা ঘুমোনো যাবে।
-ঘুমোনোর জন্যে তো আমি শুতে বলছি না, সময় কাটাবার জন্যে। জেনেশুনে আমি বিপদের রাস্তায় তোমাকে ঠেলে দিতে পারবো না ঠিকাদারবাবু। যে ‘লতায়’ কেটে আমার জীবনে এতবড় সর্বনাশ ঘনিয়ে এলো, সেই লতাকে আমি আবার দ্বিতীয়বার আমার আর এক আপনজনের ‘আয়ের’ হতে দিতে পারি না।
-আমার কাছে টর্চ লাইট আছে। রাস্তা দেখে সাবধানে চলে যেতে পারবো। তাছাড়া আমার মত ডাকাবুকো ছেলেকে ছোবল মারতে এলে সাপ বেটাকে দু’বার ভেবে দেখতে হবে।
-ওইরকম সাহসী ছিল তোমার দাদা। আমার কথা শুনতো না। বলতো,“আমাকে কাটবে এমন সাপ এখনো জন্মায়নি। ও ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সাবধানী।” সেই সাবধানী পুরুষই লতার ছোবলে জীবন দিল তো? ঠিকাদার বাবু, দেখছি তুমিও সেই তেনার মত কথা বলছো। এমন কথা আমার বুকে বড়ো বাজে। বলে, রেখা বউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অখিলের হাত থেকে নিজের হাতটা আলগা করে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল! এরপর অখিলের পক্ষে আর সম্ভব হল না রেখা বউদের বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরের বর্ষার রাতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে। বসে পড়ল রেখা বউয়ের বিছানার উপর। সঙ্গে সঙ্গে আর সময় নষ্ট না করে রেখা বউ ‘পোটমান’ থেকে কাচা চাদর আর বালিশের ওয়াড় বার করে বিছানায় পেতে দিয়ে বাইরের দরজায় খিল আটকে পাশে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। শাশুড়ির পাশে রেখা শুলো বটে, কিন্তু দু’চোখ কিছুতেই এক করতে পারল না। এই প্রথম তাদের বাড়িতে একজন অবিবাহিত বাইরের পুরুষ শুয়েছে। রেখা তাকে জোর করে শুইয়েছে বলা যেতে পারে। কিন্তু এই কাজটা কি সে ঠিক কাজ করেছে? হলই বা সে বিধবা। কিন্তু তার শরীর তো যৌবনে টৈটুম্বুর। উনিশ বছরের মেয়েরা যেমনটা হয়। এই সময় এখনো কত মেয়ের বিয়ে হয় না। বিশেষ করে যারা কলেজে-টলেজের মত উঁচু ক্লাসে পড়ে। সেও যদি লেখাপড়া চালিয়ে যেত তো এখন কলেজে পড়ত। ‘কোদালের’ স্কুলে সিক্স অব্দি পড়ার পর মা আর পড়াতে পারল না। ওখানে আর ক্লাস ছিল না। এখন হয়েছে। তখন পড়তে গেলে তাকে বাইরের স্কুল, ওই ফতেপুর-দোস্তপুর বা মনসারহাট স্কুলে পড়তে যেতে হত। অত খরচ মা যোগাতে পারবে না। ছাড়তে হল পড়াশোনা। তা এই উনিশ-কুড়ি বয়সটা যে মেয়েদের পরিপূর্ণভাবে রূপরস ফুটে ওঠার বয়স। ঠিকাদারবাবুর মত যুবক পুরুষ তাদের ঘরে রাত কাটাচ্ছে! খবরটা পাড়াগাঁয়ে একবার চাউর হয়ে গেলে তার চরিত্র নিয়ে যে জল ঘুলিয়ে স্বচ্ছতার লেশমাত্র রাখবে না তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এসবের জন্যে তার থেকেও ওই মানুষটার উপর চাপ ভয়ানকভাবে এসে পড়বে। অথচ মানুষটার কোন দোষ নেই। আমার কাজ শেষ করার জন্যে এতটা রাত পর্যন্ত তাকে থাকতে হয়েছে। হয়তো এমন কোন বদনামের আশঙ্কায় ঠিকাদারবাবু ওই গভীর রাতেই বাড়ি চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু তাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি! পাছে অন্যকিছু ভেবে বসে! আমার আর অন্য কি ভাবার আছে। আমার তো, বলতে গেলে জীবনের ইচ্ছা আশা আকাঙ্খা বলে আর অবশিষ্ট কিছু রইল না। বিগত-যৌবনাদের মত এলিয়ে পড়া জীবনই এখন আমার ভবিতব্য। ঠিকাদারবাবু যদি তার ভাললাগার কথা টাগরা থেকে বারই করে ফেলতো, তাতেও তার কোন ভাবান্তর হত না। এই অভাগীর কপাল যে পোড়া, সেটা তো অনেক আগে থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। তা এমন যে মানুষ। যে তাদের উপকার করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার শঙ্কার কথা সে ভাববে না? না ভাবাটাই তো নির্লজ্জতা, নির্মমতার পরিচয়। একদিন এমনই শঙ্কার কথা সে তার ভীষ্মকে শুনিয়েছিল। সে শোনেনি তার কথা। চরম বিপর্যয় ঘটল তাদের জীবনে। আবার সেই শঙ্কা যখন তার মনে জাগল এমন এক বিপদহরণ বন্ধুকে নিয়ে, তখন সে তো পদক্ষেপ করবেই। ভীষ্ম তার কথা মানেনি। ঠিকাদারবাবু মেনেছে। লোকের বদনাম আগে না অমূল্য জীবন আগে! রেখা যা করেছে সঠিক কাজই করেছে। তাতে কে কি ভাবলো-না-ভাবলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। কই, তার বিপদে তো ওই গুলতানিপ্রিয় মানুষদের কেউ পাশে এসে দাঁড়াল না? একজন সংবেদনশীল ভাল মানুষ ছুটে এল বলেই না তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পেল! এমন মানুষের গায়ে যদি কেউ বদনামের পাঁক লেপতে আসে তা সে কখনোই মুখ বুজে মেনে নেবে না। তার পাশে সে দাঁড়াবে। নিজের চরিত্রের বদনামও তাকে দমাতে পারবে না।
নিশ্চুপ চরাচরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের বাড়িঘরও নীরবতার পাঠ নিতে তেমনই মনোযোগী। কেবল দেয়ালঘড়ির কাঁটাটা টিকটিক করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে। রেখার চোখ পড়ল সেদিকে। কখন যেন রাত তিনটের ঘর গড়িয়ে গিয়েছে তার বড় কাঁটাটা! নির্ঘুমে, নিয়ানো আঁচের মত গরম হয়ে যাওয়া চোখদুটোকে আর প্রশ্রয় দিতে চাইল না। বড়বড় চোখ করে তাকে দমাবার জন্যে বিছানায় উঠে বসল। আর শুয়ে থাকা যাবে না। চারটের দিকে কাঁটা ছুটলে ‘ভোরের ঘুম ভাঙার’ সময় এসে পড়বে। তার আগেই ঠিকাদারবাবুকে ডেকে দিতে হবে। বিষাক্ত লতারা অর্থাৎ সাপেরা তখন আর ‘যম’ হয়ে রাস্তায় চৌকি দেবে না। যে যার গর্ত-ঘরে শুতে চলে যাবে রাত জাগার ক্লান্তি মেটাবার জন্যে। এতক্ষণে শাশুড়ি ঘুম কেটে চোখ চেয়ে দেখে রেখা তার বিছানায়, “তুই এ’ঘরে কখন এসে শুলি-রে বউ? ভয় পেয়েছিস? তা পেতে পারিস। কচি মেয়ে তুই। এই বয়সে কত মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে ঘুময়। তারপর এমন পোড়া কপালী হলে তো ভয় পাবেই। তা এখনো তো আলো ফোটেনি। ভোর হতে দেরি আছে। উঠে বসে রইলি কেন, শুয়ে পড় বউ। আমার আর ঘুম আসবে না। আমি তোকে ডেকে দেব’খন। ক’দিন কত না ধকল তোর ওপর দিয়ে গেল। আর রুইদাস পাড়ার ওই ছোকরাটা! রুইদাসদের ঘরে উপরওয়ালা ওকে পাঠালে কি হবে। বড় মাপের মন ছেলেটার। আকাশের মত বড় ওর অন্তর। উপর থেকে যে দেখার দেখছে রে মা। সেই ওকে তোর মত হতভাগিনীর কাছে পাঠিয়েছে। মঙ্গলময় ওর মঙ্গল করবে। কত রাতে বাড়ি গেল রে ছেলেটা? আমার তো আর সবকিছু দেখা হয়ে উঠল না। বুড়ো মানুষ। শরীরটা ধড়ফড় করছিল। তাই শুয়ে থেকে থেকে কখন চোখ লেগেগেছিল। সে খাওয়া দাওয়া করে গেছে তো রে বউ?” আর কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিকাদার বাবুর নামে। শাশুড়িকে থামিয়ে রেখা ফিসফিসিয়ে বলল,“তুমি চুপ করো মা। সে বাড়ি যায়নি। ও’ঘরে ঘুমোচ্ছে। শুনতে পাবে তোমার কথাগুলো। আমি অত রাতে ওকে বাড়ি যেতে দিইনি।”
-ঠিক করেছিস বউ। একদম ঠিক কাজ করেছিস। আহা রে! বেচারা আমার। পর-বাড়ির জন্যে কি খাটান না খাটল এই তিন দিন। ওর ভাল হবে, তুই দেখে নিস বউ।
শাশুড়ি-বউ কথা বলতে বলতে ভোর হওয়ার মুখে এসে দাঁড়ায়। চারটে বাজতে যাচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে রেখা বলল, “মা, এবার ঠিকাদারবাবুকে ডেকে দিই। আলো ফোটার আগে আগেই বাড়ি চলে যাবে বলেছে। পাড়া জেগে গেলে অনেক কু-কথা চাউর হবে। প্রথম সকালের কাজের কাজিরা এবার বাহ্যে ফিরতে বার হবে।” এই বলে ও’ঘরে গিয়ে দেখে ঠিকাদার বাবু দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ক’দিনের খাটাখাটনির শরীর এমন বিশ্রামই চাইছিল। কিন্তু তবু নির্দয় হতে হবে রেখাকে। অমন শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে হবে তাকে। তাছাড়া কি করার আছে তার? না হলে যে তাদের আবার অন্য পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। সেটাও তো ঠিক না। তখন আবার ঠিকাদার বাবু তাকে দুষবে। তার থেকে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়াই কাজের কাজ হবে। বার তিনেক ডাক দিল ঘুম থেকে ওঠার জন্যে। কোন সাড়া নেই। এবার কি করে সে? গা ঠেলে না ডাকলে তো এ ঘুম ভাঙবে না। ঘুমের গভীরে এখন এ। সরাসরি গায়ে হাত দেবে? সেটা কি তার মত মেয়ের পক্ষে ঠিক হবে? অন্য কিছু ভাববে না তো? বর-খাকি বউটা গায়ে-পড়া হয়ে তাকে ঠেলাঠেলি করছে, ভেবে নেবে না তো? তাহলে এক কাজ করা যাক। হাতে হাত দিয়ে চাপ দিলে অন্যরকম কিছু মানে করবে না নিশ্চয়ই ! হাতে হাত দিতেই পারে সে। যেমন হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছিল রাতে বাড়ি যেতে দেবে না বলে।
হঠাৎ এক আদরমাখা ছোঁয়ার অনুভূতি তাকে যেন পরম তৃপ্তি দান করে চলেছে! ঘুমের ঘোরে সেই অনুভবকে সে যেন কিছুতেই নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে না। তাই সে তার প্রতিক্রিয়া জাগতিকভাবে দিতে একদম পছন্দ করছে না। একবার এই পাওয়া থেকে তাল কেটে গেলে যদি আর তা ফিরে না আসে! ঘুমে-জাগরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এখন অখিল। কিন্তু অনুভবে সুখের অস্তিত্ব তো ক্ষণস্থায়ী। তাই হয়তো রেখা বউয়ের স্পর্শের সাথে গলার বাড়তি স্বরে চমক ভাঙে অখিলের ! উঠে বসে ধরফড়িয়ে! কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে রেখা বউ, “আমার ওপর রাগ করবে না ঠিকাদার বাবু। জানি ক’দিনের কঠিন পরিশ্রমে তোমার শরীর বড়ই ক্লান্ত। তাছাড়া এখনও তো সকাল হয়নি। ঘুম ভাঙার সময়ও নয়। অসময়ে ডেকে দিতে বাধ্য হলাম। আলো ফুটে গেলে লোকে দেখে ফেলবে তুমি আমাদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছ। তখন আর এক বিপত্তি। তাই অসময়ে জাগিয়ে তুলতে আসা।” অখিল তার প্রতি বিরক্ত হয়নি। অখিলের চোখ মুখের ভাষা পড়ে বুঝতে পারে রেখা। গোঁফের কাছে হাল্কা হাসির রেখা। কি অনুভবে এই হাসির ফুলকি কে জানে! এবার সে মজা করে বলল,“কখন থেকে হাতে ঠেলা দিয়ে ডাকাডাকি করছি। কোন সাড়া নেই। যেন মটকা মেরে পড়ে আছে। জোরে ডাক দিয়ে ডাকতে তারপর তাড়াতাড়ি করে উঠলে। ভাবলাম কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। রাগে কি না কি বলে বকাবকি করবে আমায়। তাই ভয় পেয়ে যাই। কিছুই তো বললে না। বাঁচলাম। অন্ধকার পাতলা হতে শুরু করেছে। পুবাকাশ থেকে এবার ভোরের আলোর ছটা উঁকি মারবে। একটু চা করে দেব? চা খেয়ে যেতে? আবার তো সকাল সকাল কলকাতায় ছুটতে হবে বলেছিলে।”
তুমি কেমন করে বুঝবে রেখা বউ! তোমার এই স্পর্শের মহিমায় কি সুখ আমাকে পাইয়ে দিলে। হতে পারে এই স্পর্শ তোমার কাছে নিতান্ত কর্ম প্রয়াস মাত্র। কিন্তু আমার কাছে যে এ যুগান্তরের পরম প্রাপ্তি। হয়তো কত কাল ধরে এই পাওনার খোঁজে ফিরি করে চলেছি। এতদিনে তা পাবার জন্যে সাফল্যের কয়েক ধাপ এগোতে পেরেছি। তুমি এসব এখনো বোঝোনি রেখা বউ। তাই আমার এই অনুভবে তোমার অনুভব এখনো একাকার হয়ে উঠতে পারেনি। এমন ভাবনার ঘোর থেকে যেন কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইছে না অখিল। তাই রেখা বউয়ের কোন কথার উত্তর না দিয়ে পুলকে মনকে জারিয়ে রাখতে চাইছে। হোক ভোর হোক সকাল। নাই বা হল তার কলকাতায় যাওয়া আজ। এমন পরমপ্রিয় পরশ-সুখের ওই ভোর, সকাল, কলকাতার কাছে চাইলে তারা তাকে দিতে পারবে? পারবে না। পারবে না যখন তখন ওসবে ধ্যান দিয়ে তার কি লাভ! ওদিকে ধ্যান দিলেই হারিয়ে যাবে এ অনুভূতি। এই হারিয়ে যাবার ভাবনা অখিলের ইন্দ্রিয়কে যেন হঠাৎ সজাগ করে তোলে! দু’হাত জড়ো করে চোখ মুখে বুলিয়ে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে বসে বিছানায়। এতক্ষণের নিরিক্ষণে রেখা বুঝতে পারে তার ঠিকাদার বাবুর ঘুমের ঘোর কাটতে চলেছে,“কি গো বাবু। তখন থেকে কথাগুলো যে বললাম, একটাও বুঝি কানে পশেনি ? একটু চা করে দেবো বাবু ? তাড়াতাড়ি তৈরী করে আনছি। ওই পেতল-ঘটিতে জল আছে। চট করে চোখ-মুখ ধুয়ে নাও তুমি। শুকনো মুখে বাড়ি থেকে বার হতে নেই। গৃহস্থের অকল্যাণ হয় তাতে।” এই কথাটা যেন কত যোজন দূর থেকে আকাশবাণীর মত তার কানে এসে বাজলো! হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়া এমন কথা একমাত্র তারই জন্যে কিনা কে বলতে পারে! যে বলে সে তার নিতান্ত আপনজন ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। এমন জনের কথা অখিল না মেনে পারবে কেন! আর অখিল সঙ্গে সঙ্গে সময় নষ্ট না করে ঘটির জল নিয়ে বারান্দার নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেল।
রেখা বউয়ের হাতে বানানো চা খাবার পর কাঁচা ঘুম থেকে উঠে পড়া ঝিমোনো শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল। ভেতর থেকে তাড়া এল বাড়ি যাবার জন্যে। “আর দেরি করা যাবে না।” রেখা বউকে সে কথা জানাতে রেখা কাল বিলম্ব না করে বাইরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “সাবধানে যেও ঠিকাদারবাবু।” বলে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অখিলের চলে যাওয়া দেখতে লাগল। কি মনে করে অখিল একবার পেছন ফিরে তাকাল। দেখে রেখা বউ এখনো তার চলে যাওয়া কত উদাস নয়নে নিরিক্ষণ করে চলেছে। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা কয়েকবার কেমন যেন ধকধক করে উঠল! তার ভেতরটা এমন করে উঠল কেন? রেখা বউ বা তার দিকে এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকে নিয়ে কি ভাবছে? তারও ভেতরটা তেমন উতলা না হলে এমনটা অখিলের বা হতে যাবে কেন। রেখা বউ কি তাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছে? অখিলের মনও কি সেই কথা বলতে চাইছে যে “আমিও তোমাকে ভালবাসি, রেখাবউ” কিন্তু সে তো মেয়েমানুষ। তার উপর আবার বিধবা। সরাসরি তাকে অখিল কেমন করে ভালবাসার কথা বলবে, সেটা তো বুঝে উঠতে পারছে না। জোর করে তো আর ভালবাসা আদায় করা যায় না। অপরপক্ষের অন্তরের ডাক আসা দরকার। এই ভোররাতে মমতাভরা ছোঁয়া আর যত্ন নিয়ে চা করে তাকে খেতে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কি সেই ডাকের ইঙ্গিত দিয়ে দিল সে! কি জানি! সবকিছু যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে অখিলের।
রেখা বউদের বাড়ি থেকে তার বার হতে দেখলে লোকে অনেক কথা বলতে পারে। তাই রেখা বউ তাকে ভোরের জন্ম হবার আগেই আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে অখিলকে বাড়ি যাওয়াতে সায় দেয়। অখিলও রেখা বউয়ের কথা মাথায় রেখে সেই সায়ে তার সায় মিলিয়ে দেয়। মেয়েদের চরিত্র নিয়ে রসালো চর্চা চিরদিনই পছন্দ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অকেজো মানুষ জনেরা। তার উপর রেখা বউয়ের মত বিধবা যুবতী যদি সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় তো কথাই নেই। অখিল তাই বাইরের চরাচরের অলক্ষ্যেই দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তার বিশ্বাস তাকে কেউ এখনো দেখতে পায় নি। এইসময় কোন মানুষের বাইরে বার হবার কথা নয়। এটা এমন একটা সময় যখন নিশাচরেরা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় আর প্রাতঃভ্রমণকারীরা প্রস্তুতি নেয় এবং অপেক্ষা করে ভোরের চোখ আর একটু বড় করে খোলার জন্যে। তবুও অখিল পুরোপুরি আশ্বস্ত যেন হতে পারছে না। ওর বিশ্বাস কোনভাবেই তার এই রাত্রিবাস এবং সকলের অগোচরে এমন সময় নিজের বাড়ি চলে যাবার ঘটনা মানুষকে এড়াতে পারবে না। ওর মনে হয়, তার এই চলনদৃশ্য আর কেউ দেখুক না দেখুক
চরাচরের চোখকে তো সে এড়াতে পারছে না। লোকে বলে না
-দেওয়ালেরও কান আছে। তেমন তার মনে হয় চরাচরেরও ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ আছে। ওর চোখের আয়না দিয়েই সংবাদটা মানুষের কান কোন না কোন সময় ছুঁয়ে যাবে। সে যায় তো তার বা কি করার আছে। অখিল রুইদাস তাতে ভীত নয়। ও ভীত নয় আটচালার কামচোর নিন্দুক একদল অকর্মণ্য মাথাদের আলোচনা সমাচোলনায়। দিন যত এগোচ্ছে, দিনযাপনের পদ্ধতিরও পরিবর্তন হচ্ছে। আগেকার যুগের সেই অচলায়তন সমাজব্যবস্থা আর চলতে পারে না। তাদের সমাজের মত যারা সেই সাবেক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে, তারাই অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। উন্নত আধুনিক সমাজ থেকে তারা দূর আরও দূরে সরে যাচ্ছে। আটচালা তাকে এই কাজের জন্যে কৈফিয়ৎ চাইলে সে কৈফিয়ৎ দেবে। গর্বের সঙ্গে দেবে। তার এই ভাবনার কথা জোর দিয়ে সকলের সামনে প্রচার করবে। তারপর দেখা যাবে কি শাস্তি তারা তাকে দেবার সাহস দেখায়। তাদের সমাজে তার মত প্রজন্মের যুবক যুবতীরা চায় সেই মধ্যযুগীয় সমাজ ভাবনা থেকে মুক্ত হতে। আসলে প্রথম এই ভাবনা সমাজের সামনে তুলে ধরার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। তাই নবযুগের ভাবনা এখনকার যুগের হৃদয় থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে সময় দিতে হচ্ছে। সেই উপযুক্ত সময়, যে সময় শুধু আধুনিক চিন্তা ভাবনার স্ফুলিঙ্গ দেশলাই কাঠির মত যদি কেউ ঠিকরে বার করতে পারে, সেই সময়ের। তেমন হলে অখিলই প্রথম সেই দেশলাইয়ের স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে দেবার সাহস দেখাবে। তারপর আর তার একা হয়ে থাকতে হবে না। এ বিশ্বাস তার পুরোপুরি আছে।
গ্রামের মেন রাস্তা থেকে তাদের রুইদাস পাড়ার দিকে ঢাল হয়ে নেমে যাওয়া গড়ান রাস্তা কয়েক পা দ্রুত চালান দেবার পর ধীর পদে এগোতে থাকে অখিল। একটু এগোলেই বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে পাড়ার আটচালা। ওটার ভেতরে টিমটিমে বাল্বের আলো চরাচরের সীমাবদ্ধ অংশে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। হঠাৎ অখিল দেখতে পেল, সেই আলোর ছটায় কে যেন আটচালার আড়াইফুটি ঘেরা দেয়ালে মাথা লুকলো! কে? কে ওখানে? বলে গলা চড়াল অখিল। কোন সাড়া নেই। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এসে দেখে তাদের পাড়ার হেড়ো পাগলা! দেয়াল ঘেঁষে কাত্ হয়ে শুয়ে। টুকটুক করে আবার তার একটা পা নড়ছে! মটকা মেরে শুয়ে আছে,“এই শালা হেড়ো! ওঠ? ভাবছিস আমি বুঝতে পারব না, তুই মটকা মেরে শুয়ে ঘুমের ভান করে আছিস, তাই না? দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি মেরে কি দেখছিলিস? শালা পাগলার মরণ! ওঠ শালা”ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১২)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ আটাশ ]
বাবুদের কথায় কিঞ্চিৎ নমনীয় হয়ে রতন বলল, “আপনারা বুদ্ধিমান মানুষ। একটু মন দিলে অবশ্যই ঢাক বাজানো শিখতে পারবেন। আমাদের মত মাথামোটারা যদি পারে, আপনারা পারবেন না তা হতে পারে না। শুধু মনটা দিলেই হবে। আমার সামনে আপনারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যান। ছেলেদের এমন কান্ডর কথা পাড়ায় মুখে মুখে চাউর হয়ে যেতে পাড়ার মেয়ে-বউরাও একে একে জড়ো হতে থাকে। রতন ছেলেদের কেমন করে ঢাক বাজানো শেখায় তা দেখার জন্যে মেয়েরাও উৎসুখ হয়ে পড়ে।
বাবু, এই ‘তাল’ কথাটা যে আমরা বলি, তার মানে তালি। হাততালির তালি। এই তালির জায়গাতেই তবলা ব্যবহার করা হয়। আমাদের ঢাক, বলা যায় তবলারই বড় রূপ। তবলা হাতে বাজায়। ঢাক আমরা কাঠিতে বাজাই। ঢাক তবলার থেকে এত বড় যে ওই মামুলি হাতের কারসাজি এখানে চলে না। এই তালের আবার ছানাপোনা আছে। তালি, খালি, বিভাগ, মাত্রা, বোল, ঠেকা লয়, সম আর আবর্তন।
আমরা যখন দু-হাতে তালি বাজাই, হাতদুটি প্রতি দু’বার চুমু খাবার মাঝে একবার করে বিচ্ছিন্ন হয়। এই বিচ্ছিন্নর অংশটাকে ‘খালি’ বলে। দুটি তালির মাঝের সময়ের সম্পর্ক ত্যাগ। প্রতিটি তালি বা খালিতে একটি করে সময়ের মাপ আছে। এই মাপই বলে দেয় কোন তালে ক’টি মাত্রা। মাত্রা মানে তালের বেলায় শব্দের আঘাত। এই ঢাকের কাঠি দিয়ে যে ঢাকে মারলাম তারপর টাং করে শব্দ হল, সেটাই মাত্রা। -একটা শব্দ লেখার সময় আমরা যে মাত্রা দিই তেমনটাই আর কি? এক বাবু, রতন বলার ফাঁকে কথাটা ছুড়ে দিল।
রতন তখন বলল, “আমি অতটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না বাবু। এটুকুই আমার জানা।” সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবু বলল,“আরে রতনকে অত ক্রশ করিস না। ও তাহলে সব গুলিয়ে ফেলবে। যেটুকু ও জানে তার মধ্যেই ওকে থাকতে দে। মাঝপথে আমাদের শেখাটাই মাটি হয়ে যাবে। রতন, তুমি এবার শুরু করো। আমরা মন দিয়ে তোমার কথা শুনছি।”
তারপর বলি বাবু, “যখনই কোনো বাজনা শুনি জেনেবুঝে বা না বুঝে অজান্তে আমরা তাল দিই। ঘাড় নাড়ি, হাঁটু ভেঙে নেচে তাল দিই, হাতের অঙ্গভঙ্গী করি। ঠিকভাবে দেখলে বুঝতে পারব আমরা, সব জায়গায় একইভাবে তাল দিই না। মানে একইভাবে হাঁটু ভেঙে নাচি না একইভাবে তালি দিই না। কখনো ধীরে কখনো তাড়াতাড়ি। মানে তালিও খালি সেইমত নিজের জায়গা
করে নেয়।
খুব চেনা কয়েকটি তাল হচ্ছে দাদরা (৬/৩-৩), কাহারবা (৮/৪-৪), তেওড়া/রূপক (৭/৩-২-২), ঝম্পক (৫/৩-২), নবতাল (৯/৩-২-২-২), ঝাঁপতাল (১০/২-৩-২-৩), একতাল/ চৌতাল (১২-৪-৪-২-২/২-২-২-২- ২-২) আর ত্রিতাল (১৬/৪-৪-৪-৪-)।
এবার সন্তোষবাবু মুখ না খুলে পারল না,“আচ্ছা রতন, তুমি যে বলো তেমন কিছু বোঝ না। তা যেসব তালের কথা তুমি বললে তা তো বড়বড় সঙ্গীত শিক্ষায়তনের পাঠ। সেই পাঠ তুমি আমাদের দিচ্ছো। আর বলছো তুমি মুর্খ ! তোমার মত শিক্ষিত তো মনে হয় আমাদের মধ্যে কেউ নেই! তোমার মধ্যে এত গুণ। অথচ তোমার কোন অহং বোধ নেই! কত বড় মন হলে তবে মানুষ এমনটা হতে পারে। এটা একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার জানো তো রতন। এইসব ব্যাপারগুলোতে অত নজর রাখো না বলেই তোমরা অতটা সাদাসিধে। যতদিন তোমরা এইভাবে চলতে পারবে ততদিন তোমরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারবে। আর যেই অহংবোধ তোমাদের মধ্যে জেগে উঠবে তখনই হবে মুশকিল। তাই বলি, যেমন আছো তেমন থাকো। ভাল থাকো। হ্যাঁ, বলো রতন। কি বলছিলে। তোমাকে আমরা বারবার থামিয়ে দিয়ে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি না? কিন্তু এসব না বলেও তো থাকতে পারছি না। বলো রতন, বলো।”
-বাবু, এছাড়া আরও কত রকম তাল আছে জানো? ধামার আছে, আড়া চৌতাল আছে, সিতারখানি, মত্ত তাল দীপচন্দি, সুরতাল, ঝুমরা, তিলওয়ারা, ঝম্পক বা রূপম, পঞ্চম সাওয়ারী, ষষ্ঠী, খেমটা, চৌতাল, আড়খেমটা এইসব। আবার দুটি তালকে ইচ্ছেমত মিলিয়ে যে তাল হয় তাকে কাওয়ালি, বিচিত্র ইত্যাদি বলে। আর একটা কথা, যেই ঢাকে আঘাত করা হচ্ছে সবকটা মারের সঙ্গে যোগ আছে একটা করে ভাগ। এইটাই হোল ‘বোল’। আর ‘ঠেকা’ হোল বোল আর ভাগের ঠিক করা তালি, খালি। এগুলো মিলিয়েই তালের জন্ম। এত সব তাল কিন্তু বাবু আমাদের ঢাকে ব্যবহার করা হয় না। নির্দিষ্ট কয়েকটাকে ধরে পুজোর ভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাক বাজানো হয়। এবার তাল ধরে ধরে আমি কেমনভাবে বাজাচ্ছি দেখুন। তারপর এক এক করে আপনারা বাজাবেন। প্রথম প্রথম কাঠি হয়তো ঠিকমত ঢাকে ঠিক ঠিক জায়গায় পড়বে না। ওই যেটাকে বলে হাতের আড় ভাঙা আর কি। কাঠি নিয়ে প্রথমে হাতের আড় ভাঙতে হয় বাজিয়ে বাজিয়ে। তারপর তালে পা দিতে হয়। আড় ভাঙার ব্যাপারটায় লজ্জার কিছু নেই। নতুন যারা ঢাকে কাঠি মারবে সকলেরই এটা হবে। এ তো সব ক্ষেত্রেই হয়। ছেলেপিলেরা কি প্রথমবার জলে নেমেই সাঁতার শিখে যায়! কত জল খেয়ে ফেলে। জল খেতে খেতে একটা সময় ছপাৎ ছপাৎ করে জল টেনে সাঁতরে পুকুর এপার ওপার করে ফেলে। এ-ও তো তাই। বাবু, আপনারা যারা হাতের আড় ভাঙতে চান এক এক করে আসুন। তারপর আমি তাল বোলের দিকে যাব।”
সন্তোষবাবুরা পরপর প্রথম ঢাক বাজানোর হাতেখড়ির বাজনা বাজাতে শুরু করে। এক এক করে এমনটা করতে করতে সময় এসে যায় বিসর্জন পুজোর। বামুন ঠাকুর ওদিক থেকে হাঁক দিয়ে দিয়েছে। ঠাকুরমশাইয়ের হাঁক কানে আসতেই রতন সতর্ক হয়ে যায়, “বাবু, বিসর্জনের পুজো শুরু হয়ে গেছে। ঘটের সুতো কাটার মন্ত্র শুরু হয়ে যাবে। আমাকে সেই বিসর্জনের বাজনা বাজাতে হবে। এটা তো আর আগমনীর আনন্দের বাজনা হবে না। আবার পুরোপুরি বিষাদেরও নয়। বিনয়ের তাল বোল নিয়ে কাজ করতে হবে। আপনারা আগমনীর বাজনা শুনেছেন এবার বিনয়ের শুনুন। মন দিয়ে শুনলে বুঝতে পারবেন দুটোর মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কোথায়! তারপর পার্থক্য বুঝতে পারবেন সন্ধ্যেয় ধুনুচি নাচের বাজনা আর মা’কে পরের বছর আসার জন্যে আবেদন করে মায়ের বিসর্জনের বাজনা।” বলে রতন-সনাতন চলে গেল মায়ের থানের সামনে। পরম শ্রদ্ধাভরে মা’কে প্রণাম করে ঢাকে বোল তুলতে শুরু করে দিল।
প্রত্যেক বছর সন্তোষবাবুরা শিয়ালদা থেকে ঢাকি বায়না করে নিয়ে আসে। নিয়মমাফিক তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। ঢাকিরা তাদের ঢাক বাজানোর কর্তব্য করে টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। চলমান নিয়মের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়েই চলে সবকিছু। কিন্তু এই ঢাক বা ঢাকির মধ্যে যে এমন মন মাতানো শিল্প আছে আর এই শিল্পের যে এমন দক্ষ শিল্পী থাকতে পারে, রতনদের সঙ্গে যোগাযোগ না হলে তাদের জানাই হতো না। হয়তো অজানা থেকে যেত সমাজ জীবনের এমন একটা সুন্দর অংশের জবরদস্ত উপস্থিতি।
ধুনুচি নাচ আজ আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল রতনদের ঢাক কাঁসরের যুগলবন্দিতে জন্ম নেওয়া বোল তালের হাত ধরে। ধুনুচি নৃত্যশিল্পীরা যেন মন-মাতাল হয়ে বিরতিহীন নাচ চালাতে লাগল। রতন-সনাতনও ওদের সঙ্গে একাকারে পাগলপারা হয়ে গেল বাজনার যোগ্য সঙ্গত দিতে দিতে। তৃপ্ত মানুষ খুশিতে প্রাণ খুলে তাদের বকশিশ দিয়ে গেছে। এদের জন্যে কেউ যেন কার্পণ্যের কথা ভাবতে চায়নি। সেই কম কথা বলা গম্ভীর ভাবের ছেলেটা, সনাতনের কাঁসর বাজনাও চোখে পড়ার মত। সেও যে এতটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে পারে তা না দেখলে অজানা থেকে যেত। একটা দূর্গাপুজো কমিটির মাথায় বসার দায়দায়িত্ব যে কতটা সেইসঙ্গে মানসিক শারীরিক চাপ। তা যারা এই দায়িত্ব নেয় তারা হাড়ে হাড়ে টের পায়। কিন্তু এতকিছু সবটাই প্রাণে ধরে মেনে নেওয়া যায় যদি সার্বিক প্রচেষ্টা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। সন্তোষবাবু সেই দিক থেকে পুরোপুরি সফল এবং তৃপ্ত। এ’বছর তার এই পূর্ণ তৃপ্তি অনুভবের মূল কান্ডারী এই রতন-সনাতন, ওরা দুই বাপ-বেটা। অন্যান্যবারে এই অনুভবের মাত্রা এতটা উচ্চপর্যায়ে ছুঁতে পারেনি। তাই রতনরা যেন তার ভেতরের দুর্বলতার জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু অনুভবের কথা তো প্রকাশ্যে গলা ফাটিয়ে হাট করে দেওয়ার জিনিস নয়। ভেতরে সযত্নে লালন করার জিনিস। সেই লালনের হাত ধরে পরবর্তী পর্যায়ে নতুন করে কাজ করার প্রেরণা জন্ম নেয়। প্রেরণাঋদ্ধ হয়ে সামনের যাবতীয় কাজে তখন সাফল্য ছাড়া আর অন্যকিছু ভাবনা প্রশ্রয় পেতে পারে না।
মায়ের প্রতিমা ভাসানের কাজ সেরে বাবুঘাট থেকে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে বেজে যায়। পাড়ার মায়েদের উদ্যোগে ততক্ষেণে এদিকে মন্ডপে দধিকর্মা আর সিদ্ধি সরবত প্রস্তুত। সকলকে বলা হল, স্নানটান সেরে পরিষ্কার হয়ে চলে আসতে। রতনরাও তৈরী হয়ে এসে হাজির। একটা কাগজের বড় প্লেটে দধিকর্মা এবং একটা কাগজের বড়মত গ্লাসে সিদ্ধি দেওয়া হল প্রত্যেককে। খিদে তো সক্কলের পেয়েছে। পরম তৃপ্তিতে তা খেয়ে সবাই যে যার মত নিজেদের বাড়ি চলে যায়। রতনদের তারপর লুচি আলুরদম খাবার কথা বললে তারা তো আর খেতেই পারলো না। জল খেয়ে ভোর চারটে-সাড়ে চারটের সময় একটু গড়াতে গেল।
হৃদারাম ব্যানার্জী লেন জাগতে জাগতে বেলা আটটা-নটা বেজে গেল। এবার রতনদের বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করার কথা। সঙ্গে সঙ্গে রতনের সামনে ভেসে উঠল সনাতনের চার বছরের বোনের মুখটা, তার মায়ের মুখ। বাড়ি থেকে বার হবার সময় মেয়ে আর মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছিল, “যদি কাজ পায় তো বাড়ি ফেরার সময় পুজোর পোষাক তোদের জন্যে নিয়ে আসব।” বাথরুমে গিয়ে একেবারে স্নানটান সেরে পোষাক পরে তৈরী ওরা। অপেক্ষায় সন্তোষবাবুদের জন্যে। ঘরের বারান্দায় বিলম্বিত পায়ে চলাফেরা করছে। একজন বাবুর সঙ্গে দেখা। কোথাও যাচ্ছিল। যুগপৎ তার মেয়ের মুখ আর বাবুর, রতনের সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়াময় মেয়ের মুখখে টপকে বাবুকে বলে,“বাবু বাড়ির মানুষরা আমাদের জন্যে রাস্তাপানে তাকিয়ে থাকে, পুজোর কি বাজার আমরা তাদের জন্যে কোলকাতা থেকে করে নিয়ে আসছি। আমাদের তো দোকান থেকে নতুন পোষাক কিনে তাদের দেবার ক্ষমতা নেই। তাই যে পাড়ায় আমরা কাজ করতে যাই সেই পাড়ার মানুষদের বাড়ি বাড়ি যাই যদি কিছু তেনারা আমাদের সাহায্য করেন। তা আমরা কি পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে কিছু তোলা যোগাড় করতে পারি? যদি অনুমতি দাও তো যাই।” সঙ্গে সঙ্গে বাবু বলল,“যাও, যাবে না কেন। প্রত্যেক বছর ঢাকিরা তো যায়। তা তোমরা বা যাবে না কেন? এ’জন্যে কারোর অনুমতি লাগে না গো রতন। তুমি কোনো কিন্তু না করে বেরিয়ে পড়ো। বেলা হয়ে গেলে আবার সবাইকে নাও পেতে পারো। বিজয়ার প্রণাম করতে আবার লোকে বেরিয়ে পড়বে। আমাদের পাড়ায় এই সময় প্রণাম সারার নিয়ম-রীতি। তোমাদের বরং আর একটু আগে বার হওয়া দরকার ছিল। যাইহোক এখনই বেরিয়ে পড়ো। কোন সমস্যা হবে না।”
বাবুরা তো তাদের দু’জনের জন্যে অনেক পোষাক আসাক দিয়েছে। সপ্তমী অষ্টমী নবমী- তিন দিনের জন্যে তিন সেট করে নতুন পোষাক। বাসি পোষাক পরে মায়ের থানে যাবার নিয়ম নেই এখানে। সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মানতে ঢাকিদের জন্যে এই ব্যবস্থা। তাদের বাপ-বেটার আর পুজোর পোষাকের দরকার নেই। এবার ঘরের মানুষদের নিয়ে চিন্তা রতনের। কেমন কি পাবে কে জানে। কপাল ঠুকে দু’জনে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ল ঢাকের বোল তুলতে তুলতে। হ্যামলিনের বাঁশির মত যেন সেই বোলে মোহিত হয়ে পাড়ার মায়েরা, মেয়েরা বেরিয়ে পড়ল নিজেদের সামর্থমত পোষাক পরিচ্ছদ নিয়ে। যাদের তা নেই তারা সাধ্যমত নগদ দিয়ে দায় মেটালো। পাড়ার বাসিন্দরা এতে যে অভ্যস্ত, এমন স্বতস্ফুর্ত আচরণে ওরা বুঝে গেল। কারোর কাছেই মুখফুটে কোন আবেদন করতে হল না। ঢাকই যা বলার বলেছে আর মানুষ তা সমর্থন করেছে।
এত মানুষের সাহায্য-ভালবাসা পাবে তা রতনরা কল্পনা করতে পারেনি। ওদের মনে হচ্ছে মানুষ এত যে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাবার দান করেছে তা তারা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে তো? সেইসঙ্গে নগদ দানের পরিমাণও ভাবনার অতীত ছিল। খুশিতে দু’বাপ-বেটার মন টগবগ করে ফুটতে থাকে। রতনের মনে হয় এই দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদেরও কিছু দেয়া দরকার। কিন্তু তারা তো ছাপোষা মানুষ। এই বাবুদের দেবার মত কিই বা সম্বল তাদের আছে। একমাত্র গতর দান করার সামর্থ ছাড়া আর তো কিছু নেই। রতন ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করা যায় বলতো খোকা? এরা প্রাণ উজাড় করে আমাদের এতকিছু দিল। আমরা কি ওদের কিছু দিতে পারি না?” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমাদের যা সম্বল সেটাই দিতে পারি আমরা। এক কাজ করলে হয় বাবা। আরও দু’দিন আমরা যদি এখানে থেকে মা লক্ষ্মীর পুজো সেরে যাই? হ্যাঁ, অবশ্যই এই পুজোয় ঢাক বাজানোর জন্যে আমরা কোন পয়সা নেব না। বাবুরা হয়তো পয়সা না নেবার প্রস্তাবে সায় দিতে চাইবে না। কিন্তু এই জায়গায়, গতর খাটানো জায়গায় আমরা বাবুদের থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে। অতএব এখানেই আমরা বাবুদের উপর জবরদস্তি করতে পারি। তুমি এই প্রস্তাবটা বাবুদের দাও। এইসব কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল বলে সন্তোষবাবু আজকের দিনটা কাটিয়ে যেতে বলেছে। মাঝে আর একটা দিন বাদ দিলে পরের দিন লক্ষ্মী পুজো। এজন্যেও তো বাবুদের ঢাক বায়না করতে হয়। আমরা থেকে গেলে বাবুদের আর ছুটোছুটি করতে হবে না। অবশ্য অনেক পুজো প্যান্ডেল লক্ষ্মী পুজোর জন্যে ঢাক বা ঢোল বায়না করে না। এমনি ঠাকুরপুজোর কাঁসর-ঘন্টাতেই কাজ সেরে নেয়। তা এই বাবুরা কি করে তা তো আমাদের জানা নেই। নাই জানা থাক। আমরা যদি উপযাচক হয়ে ঢাক বাজাই তাতে তো বাবুদের অসুবিধা হবার কথা না। তুমি বরং সন্তোষবাবুকে ডেকে সে কথাটা বলো। হয়তো এই ক’দিন আমাদের জন্যে খাবার ব্যবস্থা বাবুদের করতে হবে। একটা খরচ অবশ্য ওনাদের বাড়বে। তা তেমন হলে না হয় আমরা আমাদের পয়সাতেই হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করে আসব। কোন অসুবিধা হবে না। ওনারা আমাদের জন্যে এত করল, আর আমরা এটুকু কষ্ট করতে পারবো না?”
সনাতনের কথা মনে ধরে রতনের। সন্তোষবাবু তো ওদের প্রস্তাবে রতনদের বকবে না বুকে জড়িয়ে ধরবে, সেই দোদুল্যমানতায় কিছুক্ষণের জন্যে থমকে যায়, “এ তুমি কি কথা বলছো সনাতন! তোমাদের মনের এই উদারতা আমাদের ভুলবার নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক, লক্ষ্মী পুজোয় আমরা ঢাক বায়না করি না। তাই বলে তোমরা গতরে খাটবে অথচ কোন পারিশ্রমিক নেবে না তা যদি হয় তো মা লক্ষ্মীও তো আমাদের ক্ষমা করবে না। এ হয় না রতন। এ কিছুতেই হতে পারে না। এতটা অমানবিক আমরা হতে পারবো না। -তার মানে কালই আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলছেন? কিন্তু এই প্রস্তাবটা আমার যতটা নয় তার থেকে বেশি সনাতনের। ও বাচ্চা ছেলে, মনের ভেতর থেকে এমন কথাটা জোর দিয়ে বলে ফেলেছে। কেবল আপনাদের এত ভালবাসায় প্রণাম জানাবার জন্যেই। ঠিক আছে বাবু। তাহলে কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাব। আমাদের ইচ্ছেকে দাম দিতে গিয়ে আপনাকে আবার আপনাদের কমিটির কাছে হয়তো জবাবদিহি করতে হতে পারে। সেটাও তো আমরা হতে দিতে পারি না।
-আহাঃ তা নয় রতন। আমাদের কমিটির সব্বাই সমমনের। এখানে ভিন্ন চিন্তার কিছু নেই। আমি যেটা বলি সেটা আমার নিজস্ব কথা নয়। আমাদের সকলের। ওদিকটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের পাড়ার জন্যে আমি গর্বিত।
-তাহলে বাবু, আমার কথা যদি একটু মন দিয়ে শোনেন। আমার ছেলে যে কথাটা বলেছে সেটা আমারও মনের কথা। আপনারা ‘না’ করবেন না। ধরেই নিন না এটা আমাদের পক্ষ থেকে মায়ের চরণে বরণডালা অর্পণ! আমরা ছোট মানুষ বলে মায়ের আরাধনায় এটুকু অংশ নিতে পারি না! এতটাই আমরা অযোগ্য, বাবু?
রতনের এমন ধারালো যুক্তির সামনে সন্তোষবাবু আর প্রতিযুক্তির জাল বেছাতে চাইল না, “রতন, তোমার ভেতরে এত গুণ! তোমার উন্নতিতে কেউই বেশিদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এগিয়ে যাও রতন, তোমরা।” বলে সন্তোষবাবু পাড়ার ঘরে ঘরে গলা ছেড়ে বলে আসতে গেল, “রতনরা লক্ষ্মীপুজোয় ঢাক বাজাবে। এবারের লক্ষ্মীপুজো হবে অন্যরকম আঙ্গিকে। এবারের পুজোর নবপ্রেরণা রতন-সনাতন। ওরা নিজ উদ্যোগে এই পুজোয় নব-প্রয়াস দিতে চলেছে।”[ ঊনত্রিশ ]
কলেজ থেকে ফিরে বাড়ি আসতে মা বলল, “কচি পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেছে। ‘পেতেনের’ ওপর তোর একটা বইয়ের ভেতর অর্ধেকটা ঢুকিয়ে রাখা আছে। দেখে নিস, কে কি লিখে পাঠালো।” চিঠির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অলোকা! ওর নামে চিঠি? কে চিঠি পাঠাবে ওকে! ও তো কাউকে কোনদিন চিঠি পাঠায়নি বা কাউকে চিঠি লিখতে বলেনি! মা আবার ওইরকম করে কথাটা বলল কেন? মা কি বাঁকা চোখে কথাটা বলল? যদি কোন ছেলে বদ মন নিয়ে তাকে চিঠি লেখে! মানে প্রেমপত্র-টত্র আর কি। মা নিশ্চয়ই তেমনটা ভেবেই বলেছে। মনটা উচাটন হয়ে উঠল, চিঠিটা পড়ার জন্যে। পোষাক না খুলে যেমন তেমন করে উঠুনের ‘পজরা’র কাছে রাখা বালতির জলে হাত মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘরে চলে যায়। বিকেল হলে তো, দিনমান যতই চেষ্টা করুক তাদের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা তার নেই। মাটির মোটা দেয়ালের ঘরটায় সোজাসুজি দুটো বাঁশের বাঁখারির আড়াই হাত লম্বা আর দেড় হাত চওড়া জানালা। ওইদিকটায় কাঠের তক্তপোশের বিছানা। অতি কষ্টে রোদ্দুর না, তার ছটা, আলোর রূপ ধারণ করে বিছানায় উপস্থিতি জানান দেয়। ঘরের মাঝামাঝি থাকা বড় পেতেনটা কোনোদিন এইসময় তাকে কাছে পাবার আশা করে না। বাবার বিড়ি খাবার ম্যাচিসটা নিয়ে খস খস করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে আগুনের জন্ম দেয়। সদ্যভূমিষ্ঠ আগুনের সাহায্য নিয়ে মায়ের বলে দেয়া ঠিকানা মত বইটার ভেতর থেকে চিঠির খামের বেরিয়ে থাকা অংশটা টেনে বার করে বাইরে চলে আসে। দাবায় টাঙানো দোলায় বসে খস করে খামের মাথার দিকের একটা অংশ সন্তর্পনে ছিঁড়ে ফেলে। যাতে খামের ভেতরে থাকা কাগজের কোন অংশ ছিঁড়ে না যায়। তাড়াতাড়ি কাগজের মোড়াটা খুলতে দেখে, সরিষার মা সারদা মন্দির থেকে এসেছে চিঠিটা। এতক্ষণে যে অজানা আতঙ্কমাখা মন নিয়ে ব্যস্ত ছিল তা থিতু হল। না, মায়ের ভাবনায়- বদ মতলবে কেউ তাকে চিঠি দেয়নি। চিঠিটা পুরো পড়ে এবার মনটা যেন তৃপ্ত হ’ল। সে সিলেক্ট হয়েছে, সারদা মন্দিরে বেসিক ট্রেনিং পড়ার জন্যে। শুধুমাত্র মেয়েদের এখানে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হবার জন্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হায়ার সেকেন্ডারীতে অলোকার ভাল রেজাল্টের সুবাদে এই সুযোগ সে পেয়েছে। এবার দশ দিনের মধ্যে তাকে জানিয়ে দিতে হবে, সে ভর্তি হবে কি না। অলোকার তো মনেই ছিল না বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্যে সে আবেদন করেছিল। খবরের কাগজ তো সে কোনদিন দেখেনি। পাবে কোথায়। এমনি পেটে ভাত জোটে না যাদের, তাদের আবার খবরের কাগজ পয়সা দিয়ে কিনে পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কি! বিপ্লবদা সেদিন দিঘিরপাড় বাজারের বাস স্টপে তার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল। কলেজ ছুটির পর বাস থেকে নামতে বিপ্লবদা বলল, “তোমার সাথে কথা আছে অলোকা। প্রদ্যুতের চা দোকানের ওইদিকে মুচিষা রোডের ফাঁকা জায়গাটায় চলো। এখানে মোড়ে লোকজনের হট্টগোলে ভাল করে কথা বলা যাবে না।” বলে বিপ্লবদা হন হন করে সেই দিকে এগিয়ে চলল। বাস থেকে নামতেই এমন কথা শুনে অলোকা একটু যেন থতমত খেয়ে যায়। কেন, বিপ্লদা কি কথা বলবে যেটা এখানে বলা যাবে না? অমন করে দু’একটা কথা বলে ওদিকে চলতে লাগল? তাহলে কোন মন্দ খবর নয় তো? তাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে আবার কোন জটলা হচ্ছে না তো তাদের পাড়ায়? আসলে মানুষের মন তো। এমন আবহাওয়ায় প্রথমে মন ‘কু’ ডাকের দিকে ধায়। অবশ্য তা নাও হতে পারে। কোন ভাল কথা থাকতে পারে। একটু সময় নিয়ে হয়তো কথা বলতে হবে তাই এই ভিড় থেকে সরে গিয়ে নিরালায় কথা বলতে চাইছে। এদিকে তো আবার ওদের পাড়ার লোকেদের জুতো সারাই, পালিশ, ধামা-খোড়ার সারানোর দোকান আছে। এমন সব মানুষদের মন তো সবসময় প্যাঁচ কষে। কখন কি ভেবে নেয় বলা মুশকিল। একটু এদিকে ওদিক তাকিয়ে তাদের পাড়ার কেউ কাছাকাছি আছে কি না বা পাড়ার ওই দোকানদাররা তার দিকে তাকাচ্ছে কি না খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে খানিক পরেই অলোকা বিপ্লবদা যেদিকে গেল সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওর জন্যে মুচিষা রোডে অপেক্ষা করছে সে।
অলোকা যেতেই একটা খবরের কাগজ বের করল বিপ্লবদা। যত্ন নিয়ে আস্তে আস্তে কাগজটার ভাঁজ খুলে অলোকার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সরিষা মা সারদা মন্দিরের বিজ্ঞাপন এটা। বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্যে ছাত্রীদের আবেদন করতে বলা আছে এতে। তোমার তো এইচ.এসে ভাল রেজাল্ট আছে। ওরা যা নম্বর চেয়েছে তোমার তার থেকে অনেক বেশি আছে। তুমি দরখাস্ত করলেই মনে হয় চান্স পেয়ে যাবে।”
-বেসিক ট্রেনিং? ওটা কি ট্রেনিং সেটাই তো জানি না। ও করে আমার কি হবে। কলেজে পড়তে পড়তে এটা আবার কি করে পড়বো! কিছুই তো বুঝতে পারছি না, বিপ্লবদা।
-প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা করার জন্যে এই ট্রেনিংটা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। মেয়েদের জন্যে আমাদের এদিকে ওই সরিষায় ‘মা সারদা মন্দিরে’ পড়ানো হয়। ভাল রেজাল্ট করা ছাত্রী ছাড়া যে-সে ওখানে পড়ার সুযোগ পায় না। তা তোমার রেজাল্ট অনেকটাই ভাল বলে আমার মনে হল তুমি দরখাস্ত করতে পারো। তাই বিজ্ঞাপনের এই কাগজটা তোমাকে দিতে ডেকেছিলাম।
আর এটাতে পাশ করলেই সরকারি প্রাইমারী স্কুলে চাকরি, বলতে পারো প্রায় নিশ্চিত। এখন সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, বেসিক ট্রেনিং না থাকলে প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করার জন্যে অ্যাপ্লাই করা যাবে না।
-কিন্তু আমি যদি দরখাস্ত করি তো আমার বি.এ. পড়ার কি হবে? এক বছর তো পড়া হয়ে গেল। সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে চলেছি। আর এক বছর পার করলেই থার্ড ইয়ার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তখন গ্র্যাজুয়েট হয়ে যেতে পারবো।
-তারপর? তারপর কি করবে? চাকরি করবে? মাস্টারির চাকরি? সেখানে কাজ পেতে গেলে তো আবার বি.এড. ট্রেনিং পাশ করতে হবে। আর এই বি.এড. ট্রেনিং পাশ করলেই যে তুমি কোন হাইস্কুলে কাজ পাবে এই গ্যারান্টি তোমায় কেউ দিতে পারবে না। হাইস্কুলের থেকে প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে চাকরির সুযোগও বেশি। সে জায়গায় হাইস্কুল ক’টা আছে তুমি আমাকে কড় গুনে বলো তো? আর প্রাইমারী স্কুল বলতে পারো প্রায় সব গ্রামে আছে।
-তাহলে তুমি এখন আমাকে ঠিক কি করতে বলো? খোলাখুলি বুঝিয়ে বলো। আমি কি তাহলে এখানে চান্স পেলে কলেজে পড়া ছেড়ে দেব? সেটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না তো? ওই ট্রেনিংটা নিয়ে আমি পাশ করে বেরিয়ে আসতে পারব?
-সেটা তো পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভর করছে। সেই নিশ্চয়তা আমি কেমন করে দেব যে তুমি পাশ করবেই? মন দিয়ে পড়াশোনা করলে কেউ ফেল করে? বোকা বোকা প্রশ্নর কোন মানে হয় না। তবে হ্যাঁ, এই ট্রেনিং কোর্সটা আমি যতটুকু জানি বেশ শক্ত। আমার চেনাজানা যারা আগে ট্রেনিংটা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে শোনা। তবে আমার মনে হয় তুমি পেরে যাবে। এক বছরের কোর্স। আবাসিক। ওখানে থেকে পড়াশোনা করতে হবে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করা যাবে না। পেপারে সব ডিটেলস-এ লেখা আছে। বাড়িতে গিয়ে ভাল করে আগে পড়ো। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবার নেবে।
-আমার তো কেমন ভয় ভয় করছে। একটা বড় ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কি জানি! তারপর পাশ করতে পারব কি না। না পারলে এ-কুল ও-কুল দু-কুল চলে যাবে।
-ঝুঁকি না নিলে এগোনো যায় নাকি, অলোকা? এই যে তুমি তোমাদের ওই পরিবেশ থেকে যুদ্ধ করে পড়াশোনায় এতটা এগোতে পেরেছো। ঝুঁকি নিয়েছিলে বলেই তো পেরেছো। ঝুঁকি প্রত্যেক মানুষকে নিতে হয় এবং হবে। না হলে পেছনে পড়ে থাকতে হবে। আর একটা কথা, এখানে পড়তে এসে তুমি কি ক্লাস ফোর-ফাইভের কোর্স পড়বার আশা করো? নিশ্চয়ই না? যত উপরে উঠবে কড়া সাবজেক্টের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এই ট্রেনিংয়ে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক অত্যন্ত বেশি। ড্রয়ইং, হাতের কাজ ইত্যাদি অনেকটাই করতে হয়। আমি জানি এ’সবে তুমি একটু মাটো আছো। সেদিকটা তোমার ভাবতে হবে না। ওই প্রজেক্ট, ড্রয়ইং- ট্রয়ইংটা আমি তোমাকে হেল্প করে দেব’খন। সপ্তাহে একদিন বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয় ওরা। ডায়মন্ডহারবারের কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি সরিষায় নেমে তোমার সঙ্গে দেখা করে আসব। যা কাজ থাকবে আমাকে দিয়ে দেবে। আমি সেগুলো রেডি করে আবার তোমাকে দিয়ে আসব। না না, তুমি ভেব না এটা কোন চিটিং করা হচ্ছে। সবাই এইভাবেই পাশ করে আসছে। তুমি দেখবে’খন তোমাদের ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্রীই এমনটা করছে। তারপর অন্য বিষয়গুলো সব তোমার কেরামতি। তুমি যেমন তৈরী হবে তেমন ফল পাবে। ওখানে বাড়ির লোকের কোন হাত নেই।
বিপ্লবদার কথায় দোনা-মোনায় পড়ে গেল অলোকা। একদিকে গ্র্যাজুয়েট হবার মোহ। অন্যদিকে চাকরির ট্রেনিং। বিপ্লবদা তাকে জোর করছে এই ট্রেনিংটা নেবার জন্যে। এমন সুযোগ নাকি সবসময় আসে না। সব বছর এটা পড়ানো হয় না। কোন বছর হবে তা কেউ বলতে পারে না। পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে জানতে হয়। আর একটা সাংঘাতিক বাস্তব কথা বিপ্লবদা তাকে বলল, যেটা শুনে সে অবাক হয়ে গেল ! বিপ্লবদা এতটা ভেতর থেকে কথাগুলো তাকে বলছে? তাকে নিয়ে, তাদের সংসারকে নিয়ে ও এতটা গভীরে গিয়ে চিন্তা ভাবনা করে! কোন রাখঢাক না করে বলেই ফেলল বিপ্লবদা, “দেখো অলোকা, আমরা নিতান্তই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ বা গরিব ঘরের মানুষ। আমাদের মত ঘরের মানুষরা লেখপড়া শেখে কিসের জন্যে? শুধুই কি জ্ঞান অর্জনের জন্যে? বিদ্যের সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা কি ঘরে বসে সেগুলো ধুয়ে জল খেয়ে বেঁচে থাকব? থাকব না। লেখাপড়ার মাধ্যমে যেমন জ্ঞান অর্জিত হবে। এ তো সর্বকালের সত্য কথা। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা যাতে হয় বিশেষত সেই লক্ষ্য আমাদের সামনে সবসময় থাকবে। এই কোর্সটা করে যদি তুমি চাকরি পাও তো তোমাদের সংসারটাকে এই সর্বগ্রাসী অনটন থেকে মুক্ত করতে পারবে। তাতে তুমি যেমন বাঁচবে। তেমনি দিনরাত পয়সা পয়সা করে হাহুতাশ করা থেকে রেহাই পাবে তোমাদের সংসার। চাকরি করতে করতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে পড়া চালিয়ে যাওয়ার প্রমাণ ভুরি ভুরি আছে। প্রাইমারী স্কুলের কাজটা নিয়ে তারপর তো তোমার আর কোন পিছুটান থাকছে না। বুক চিতিয়ে তখন তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও।
কে তোমাকে মানা করেছে সেটা করতে? তখন তোমার ওই গ্র্যাজুয়েট না হওয়ার আক্ষেপ আর থাকবে না। তারপর মাস্টার ডিগ্রী করো। আরো করো। ময়দান তো তখন তোমার জন্যে ওপেন। প্রাইমারী স্কুলের চাকরি ছেড়ে হাইস্কুলে, সেখান থেকে কলেজ-মাস্টার। কোন বাধা নেই। মনে জেদ থাকলে, সেই জেদের সঙ্গে সংগত দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে সব হবে। তবে শুরুর পথ সঠিক বাছতে হবে। তবেই সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।”
এত ভালো ভালো কথা বলল বিপ্লবদা। একটা কথাও যুক্তি দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে না অলোকা। তবু যেন কলেজের আকর্ষণ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। কলেজের ম্যাম-স্যারেদের সঙ্গে ক্লাসের পড়াশোনার আদানপ্রদান। বাংলা ক্লাসের কল্যাণী ম্যাম্ তাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখে। প্রথমত সে সমাজের এক অন্তজ শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে। তারপর ক্লাসে ম্যামের সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর তার কাছ থেকে পেয়ে যায় বলেই তাকে এতটা পছন্দ করে। বলা যেতে পারে যেন মায়ের আদর সে এই ম্যামের কাছ থেকে পায়। এই ম্যামকে সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। আর ক্লাসের বান্ধবীদের সঙ্গে মিলমিশ। কত মত বিনিময়। এতসব আকর্ষণ আঠার মত তাকে চিপটে ধরে আছে যেন। এখন সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে সে কিছুতেই কলেজ ছেড়ে দিতে পারবে না। বিপ্লবদা ওই যে বলল না, তাদের মত গরিব ঘরে লেখাপড়ার মাধ্যমে শুধু জ্ঞান অর্জনের থেকে আর্থিক স্বয়ম্ভরতা আশু জরুরী। কিন্তু তার মন যেন আর্থিক বিষয়টাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না। একটা বদ বুদ্ধি মুহূর্তের জন্যে তাকে যেন উসকে দিতে উদ্যত হল! সারদা মন্দিরে এই ভর্তির চিঠিটা যদি সে নষ্ট করে দেয় তো কেউ জানতে পারবে না তার চান্স পাবার কথা। বিপ্লবদাও নয়। বিপ্লবদাকে এই চিঠিটা ও না দেখালে তো জানতে পারছে না সে। তাহলে আর কারোর কাছে তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। আর সরিষা মা সারদা মন্দিরে গিয়ে কেউ জানতে যাবে না তার চান্স পাবার বিষয় নিয়ে। দিলেই-হয় এটা নষ্ট করে! আর এর বোঝাটা সে যেন বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। ভাবনার ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে, যখন সে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তের দিকে যেতে চাইছে, তখনই রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক সমুদ্রের ঢেউয়ের মত তার উপর আছড়ে পড়ল যেন,“কিরে মা অলোকা? এতক্ষণ ধরে ওই চিঠির খামটা হাতে ধরে দোলায় বসে বসে ভাবছিস কি? কলেজ থেকে এলি। কোথায় পুকুরঘাটে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে একটু কিছু মুখে দিবি। তা না, চুপচাপ বসে কি যে আগডুম বাগডুম চিন্তা করছিস কি জানি! যা-না মা, কলেজের জামা-কাপড় ছেড়ে কিছু পেটে দে-না! এতক্ষণ পেট খালি দিলে, পিত্তি পড়ে যাবে যে পেটে। তখন আর এক বিপত্তি হবে।” বলতে বলতে অলোকার মা ওদিক থেকে তার কাছে আসতে থাকে। দোলাতে বসেই অলোকার চোখ আটকে গেল মায়ের সামনের দিকে আঁচলের শাড়িটার খানিক ছেঁড়া অংশের দিকে! শাড়ির এই ছিঁড়ে যাওয়া অংশের দিকে কিন্তু প্রায়ই ওর চোখ পড়ে। গরিবের বাড়ির বৌ-ঝিদের এমন ছেঁড়া জীর্ণ পোশাক পরাটা ওদের গা-সওয়া ব্যাপার। এতে মনে তেমন আঁক কাটে না। কিন্তু এই মুহূর্তে, সে যখন জ্ঞান আর ক্ষুধা-অভাবের দ্বন্দ্বে দ্বিতীয়টাকে পাশে সরিয়ে বিদ্যা-জ্ঞানকে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত হচ্ছিল। আগুনের ছেঁকা লাগার মত বুকের ভেতরটা ছ্যাঁক করে উঠল! তাদের অভাবী সংসার মায়ের জন্যে একটা আস্ত শাড়ি জোটাতে পারছে না। কতদিন ধরে মা এমন পোশাক পরে দিন কাটায়। ব্যাপারটা বাবার মাথায় সবসময় কাজ করে। বাবা চেষ্টায় থাকে অবিরত। কিন্তু অক্ষমতা বাবাকে বারবার থমকে দেয়।
এখন কি করবে অলোকা? বুকে ক্রমাগত অভাবের ছ্যাঁকা সহ্য করে শুধুমাত্র জ্ঞানের পেছনে দৌড়বে তো? চিঠিটা কি তাহলে- একটু আগে যেটা ছিঁড়ে ফেলতে সে উদ্যত হচ্ছিল, সেই উদ্যোগ জারি রাখবে তো? এমন অসম যুদ্ধ যেন সে আর জারি রাখতে পারছিল না। চিঠিটা খামের ভেতর ঢুকিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেল। কলেজে যাওয়া বাইরের পোশাকেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। মা ততক্ষণে এসে দেখে মেয়ে দোলায় বসে নেই, “এই তো এখানে বসে ছিল মেয়েটা? গেল কোথায় আবার! ঝুলন্ত দোলা বাঁ হাতের মুঠোয় ধরে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে মেয়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে। আলো আঁধারিতে বুঝতে পারছে না মেয়ে বিছানায় শুয়ে ঠিক কি করছে। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখে, মেয়ের শরীর কান্নায় ঝাঁকা দিয়ে উঠছে,“কি হল রে মা? তুই অমন করে কাঁদছিস কেন? ওই চিঠিটা পড়ার পর থেকে দেখছি তুই কেমন করছিস! কি আছে ওই চিঠিতে? ওটা যদি তোকে এতো কষ্ট দেয় তো ছিঁড়ে ফেলে দে-না। ঝামেলা চুকে যায়। কোথা থেকে চিঠিটা এসেছে, কে পাঠিয়েছে আমাকে বলবি? তাহলে তোর বাবাকে দিয়ে খোঁজ লাগাবো, চিঠি পাঠানদারটা কেমন তারা? আমার মেয়েকে কাঁদায় কেন? সামান্য এক চিলতে কাগজের গায়ে এত জোর!” মায়ের কথায় আর শুয়ে থাকতে পারলো না অলোকা। বিছানায় উঠে বসে বলল,“তুমি চুপ করো মা। না জেনেবুঝে কিসব বোকার মত কথা বলো? চিঠিটা ছিঁড়ে সব ঝামেলা ঝক্কি শেষ হয়ে যাবে? এসব তুমি বুঝবে না। এই নিয়ে একদম চেঁচামেচি করতে যেও না। এখন তুমি যাও মা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। এখন আমার খিদে নেই। একটু পরে আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার কাজ করো গে।” গম্ভীরভাবে অলোকা কথাগুলো বলার পর মা আর মেয়ের বিড়ম্বনা বাড়াতে
চাইল না। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মা জানে, তার লেখাপড়া জানা মেয়ের সঙ্গে যুক্তি তর্কে পেরে উঠবে না। সেকথা মা অনেকবার কবুল করেছে। সত্যি তো। চিঠির এ’সবের বিষয় মা বুঝবে কি করে। বুঝিয়ে বললেও বুঝবে না। এক কথার মানে উল্টো বুঝে ভুলভাল কান্ড করে বসবে। তাই অলোকা তার মা’কে এর মধ্যে মাথা গলাতে দিতে চাইল না। কিন্তু পরিস্থিতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তাতে তো দেখা যাচ্ছে তার জীবনে বিপ্লবদার পরামর্শ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বিপ্লবদা এটাও সেদিন বলেছিল, “দেখো অলোকা, সময় প্রতি মুহূর্ত সবাইকে ছুঁয়ে চলে যায়। ও কোন মুহূর্তের ভগ্নাংশেও কারোর জন্যে অপেক্ষা করে না। কিন্তু এই চলার পথে যে তার সঙ্গী হতে চায়, তাকে সে সাদরে সঙ্গ দেয়। এখন সময় তোমাকে বলছে এই বেসিক ট্রেনিংয়ের ফর্ম যত্নের সঙ্গে ভর্তি করতে। আগেও বলেছি, আবার বলছি, যদি তুমি এই সময়কে হেলায় বইয়ে দাও তো সময় কিন্তু আর ফিরে আসবে না। পরে মাথা খুঁড়লেও সে এখনকার এই রূপ নিয়ে তোমার সামনে হাজির হবে না। তাই বলছি, যা গ্রহণযোগ্য তাকে গ্রহণ করো। আর যা নয় তাকে বর্জন করো।”
বিপ্লবদার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন ভেতর থেকে একটা তাড়া তাকে ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে তুলে দিল। কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা মনের যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! তার থেকে কিছুটা বড় বিপ্লবদা। এখনো ‘লোক’ হয়ে যাবার বয়স হয়নি। অথচ এই বয়সে কত পরিণত চিন্তাভাবনা তার। বাস্তবকে এত ভাল করে চেনার শক্তি সে পেল কোথা থেকে কে জানে! ও যেন ‘সূর্য’ হয়ে তার জীবনে অবিরত আলো দান করে যায়। অথচ এই সূর্যকে কত হেলায় দলন-পিড়ন করেছে তাদের পাড়ার ওই মুর্খ- মাতালরা! কলেজের পোশাক ছেড়ে পুকুরঘাটে চলে গেল অলোকা। সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে রান্নাঘরে গেল মায়ের কাছে, “মা, ওই রতন কাকার ছেলে গো, সনাতন। ওকে একটু খবর দিতে পারবে? বলবে আমি ওকে ডেকেছি? আর বলবে, যদি এখন ব্যস্ত থাকে তো কাজ সেরে সময় করে যেন অবশ্যই আসে। খুব দরকার! ভুলে যেন না যায়।”ক্রমশ….
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১১)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ছাব্বিশ]
বাবুদের সঙ্গে আস্তে আস্তে রতনরা এগিয়ে চলল হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পূজামন্ডপের দিকে। যেতে যেতে রতন ভাবছে, পাঁচ হাজার কেন, দু’হাজার দিলেও তারা রাজি হয়ে যেত। যে দুর্বিসহ অপমান যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাদের আসতে হল। কোলকাতার যে কোন পূজামন্ডপে তাদের বায়না পাওয়া অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। তাই হয়তো এই বৌবাজারের মোড়ে টানা এত ঘন্টা বাজনা বাজাবার শক্তি মা শীতলা তাদের দিয়েছিল। ফলও হাতে নাতে পেল। না হলে ফাঁকা হাতে বাড়ি ফিরে গেলে পাড়াবাসীর কাছে মরমে মরে যেতে হত। কারোর কারোর কাছে মজার খোরাকও তাদের হতে হত। এতদিন যে রতন, তার ঢাক বাজাবার দক্ষতা নিয়ে গর্ব করতো। ঢাক বাজানোর শিক্ষা নিতে দূর দূর থেকে লোকজন আসতো, পাকা এবং যোগ্য বাজনাদারের কাছে বাজনা বাজানোর তালিম নিতে। এই নিয়ে পাড়ার অন্য বাজনাদারদের ঈর্ষার কারণও হতে হয়েছে তাকে। সেই রতনের আসল পরীক্ষা হতে চলেছে এবার। নিজেকে বলছে, “রতন তুই যদি সত্যি সত্যি দেখিয়ে দিতে পারিস তোর ঢাক বাজানোর কেরামতি তো তোর এ জীবন সার্থক হবে রে। ‘ঘরে মধসূদন আর বিদেশে মোদো’ হওয়ার থেকে উল্টোটা হলেই তবে সমাজে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবি! এই দেখ না, এতদিন তো তুই এলাকায় ভালো ঢাক বাজানদার হিসেবে এবং প্রশিক্ষক হিসেবে নাম করে এসেছিস। তাতে তোর কি লাভ হয়েছে? কিচ্ছু না। উল্টে পড়শির ব্যাঁকা চোখ তোর ওপর আছড়ে পড়েছে। শত্রু বেড়েছে। নিষ্কর্মারা তোর বদনাম ছড়িয়ে এসেছে। তুই শুধু শুনে এসেছিস। কিচ্ছু করতে পারিসনি তাদের। এবার কোলকাতায় নাম ফাটিয়ে পাড়ায় দেখিয়ে দে রতন রতনে আছে। আসল রতনরা এই রতনকে চিনে নিয়েছে। তাদের বিচারের কষ্ঠিপাথরে গ্রামের রতন পাশ করে গেছে।”
বউবাজারের মোড়ে প্রথম যে বাবু তাদের সঙ্গে কথা বলেছিল সেই বাবুই এই পুজো কমিটির সভাপতি। সভাপতি সন্তোষবাবু প্যান্ডেল লাগোয়া এক বাড়ির বৈঠকখানা সংলগ্ন একটা ঘরে তাদের ক’দিনের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ওই ঘরের সঙ্গেই বাথরুম চানের ঘর আছে। শহরের ব্যাপার। গ্রামের মত বাইরে কোথাও বাথরুম পায়খানা করতে হবে না। প্রথম প্রথম একটু
অস্বস্তি হচ্ছিল ওদের। কোনদিন তো এমন সুন্দর পরিস্কার ঘেরা ঘরে বাথরুম করেনি। সন্তোষবাবু তাদের বাপ বেটার নাম জেনে নিয়েছে। ছেলের সম্বন্ধে টুকটাক জেনেও নিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে, এবার ফাইনাল দেবে। শুনে তো শুধু সন্তোষবাবু কেন, পাড়ার যে শুনেছে সনাতনকে তারিফ করেছে। তারপর রতন থাকতে না পেরে যখন বলেছে, মাধ্যমিকে ও স্টার পেয়েছে! ওকে নিয়ে যে কি সুখ্যাতি করলো ওরা! সনাতন তো বাপের ওপর ক্ষেপে লাল, “তুমি ওসব কথা ওনাদের বলতে গেলে কেন? কথাটা কি লোককে বলার জন্যে পেটের ভেতর ভুটভাট করছিল? আমরা ঢাক বাজাতে এসেছি বাজিয়ে চলে যাবো। এমনি টুকটাক নাম ঠিকানা জানিয়ে দেওয়া দরকার, বলে দেওয়া হল, এই পর্যন্ত। বেশি খোলের খবর না বলাই ভাল। তারপর কে কিভাবে নেবে বলা যায় না তো। যা বলেছো, বলেছো। আর বলবে না বাবা। নিজেদের এতটা হাট করে দেওয়া মনে হয় ঠিক না।” ছেলে বকুনি দিয়েছে ঠিক আছে। তাতে সে কিছু মনে করেনি। ছেলের সুকর্মের কথা বাপ-মা তো আগে মানুষকে জানিয়ে ভেতরের আনন্দকে বাঁচিয়ে তোলে।
সন্তোষবাবু বলল, “রতন, তোমরা পরিষ্কার হয়ে টিফিন সেরে নাও। তোমাদের টিফিন এসে গেছে। তারপর আটটায় পাড়ার সকলকে আসতে বলেছি। তোমাদের আগমনীর বাজনা শোনার জন্যে। মায়ের পুজোর ব্যস্ততা তো কাল, ষষ্ঠী থেকে শুরু হবে। প্রস্তুতি সব শেষ। এখন সবাই বিশ্রামে। কোন কাজ নেই। তাই এই সময়টা তোমার বাজনা শুনে কাটাতে চাই। এই প্রথম আমরা তোমাদের হাত ধরে ঢাকের বাজনার মাধ্যমে আগমনীর সুর, তাল, লয় উপভোগ করবো। এবার তোমার হাতের কেরামতি।”
পঞ্চমীতে আগমনী, ষষ্ঠীর কলাবৌ চান, মা দূর্গার বোধন, সপ্তমী-অষ্টমী নবমীর পূজার্চনার বাজনা, আরতির বাজনা, সন্ধ্যারতির বাজনা। নবমীতে কুমড়ো বলির বাজনার তাল। একে একে বাজনার কেরামতিতে হৃদারাম ব্যানার্জী লেনকে মাতিয়ে তুলল রতন-সনাতন। কত দিন, কত বছর পর যেন এই পুজোমন্ডপে আনন্দের জোয়ারে নতুন পালক জুড়ে গেল এই দুই বাপ-বেটার হাত ধরে।
নবমীতে মা’কে বলি উৎসর্গ করা শাস্ত্রের বিধান। কিন্তু কোথাও মাথার দিব্যি দিয়ে লেখা নেই যে মা’কে পাঁঠাবলি দিয়ে সেই বলি দেওয়া পাঁঠার রক্ত দিয়ে মায়ের পা ধুইয়ে দিতে হবে। অনেক পুজো প্যান্ডেলে এই পাঁঠাবলি প্রথা এখনো চালু আছে। রতনের একটা ভয় ছিল এবং সে আতঙ্কিতও ছিল যে এই হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজো কমিটি আবার পাঁঠাবলির জবরদস্ত পক্ষপাতি নয়তো? রতন পাঁঠাবলি প্রথার ঘোর বিরোধী। প্রতিবাদে সে পাঁঠাবলি তালের বাজনা জানলেও বলে তার জানা নেই। সে শেখেনি। মায়ের সন্তান যেমন জীব হিসেবে রক্তমাংসের মানুষ, ঠিক তেমনই জীব, ছাগ-পাঁঠা ! ছাগ-পাঁঠার রক্তে পদযুগল স্নান করালে যদি মা তুষ্ট হয় তো তাহলে মানুষের রক্তেও তো পদযুগল স্নান করালে মা তুষ্ট হবে! ছাগের বদলে মানুষ ওই নিষ্ঠুর কাপালিক বা তন্ত্র সাধক-সাধিকার মত মানুষের রক্তে পদযুগল স্নান করবে না কেন? অনেক জায়গায় প্রতিবাদ করেছে রতন। তাদের পাড়াতেও এই নিয়ে প্রচন্ড বিবাদ হয়েছে। কোথাও কোথাও সে জিতেছে। কোথাও কোথাও আবার গোঁড়াদের আধিক্যে তাকে পিছু হঠতে হয়েছে। এতদিনে এই বাবুদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে একটা নিবিড় সু-সম্পর্ক গড়ে উঠছে তাদের। নবমীর বলি প্রসঙ্গ এলে সেই তাল কেটে যাবে না তো! তাল কাটার ভাবনায় অষ্টমীর গভীর রাতে শুতে যাবার সময় থেকে দুশ্চিন্তা তাকে যেন গ্রাস করতে শুরু করে! কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। ঘুম এলই না রাতে। ভোর থাকতে উঠে পড়ে চানটান করে ঘরের বারান্দায় দাঁড়ায় সে। কমিটির বাবুদের যাকে সে প্রথম দেখবে তাকে জিজ্ঞেস করবে, এখানকার প্রথা কি? কি বলি দেওয়া হয় নবমীর সকালে মায়ের কাছে? যদি পাঁঠার কথা তোলে তো তাহলে সে সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে যাবে। পাঁঠা বলির বাজনা তার জানা নেই। তাছাড়া পাঁঠাবলির সে কঠোর বিরোধী। সেইজন্যেই সে শেখেনি এই পাঁঠাবলি বাজনার তাল।
হাতের গলাসিতে ফোস্কা তো সনাতনের পড়েছিল বৌবাজারের ফুটপাথে একটানা বাজাবার সময়। সেই ফোস্কা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে ওইদিন সন্ধ্যায় আবার বাজাবার সময়। সনাতনের হাতের যন্ত্রণার অভিঘাত তার মুখে ফুটে উঠছিল। তা চোখ এড়াতে পারলো না সন্তোষবাবুর! বাজনা কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ রাখার কথা বলল বাবু। তারপর বাবু বলল, “আমরা এখন চা খাবার বিরতি নিচ্ছি। আমরা সব্বাই এখন চা খাব। রতনরাও খাবে।” বলে বাবু
সনাতনকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছিল, খোকা? তোমার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছিল।” কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে রতন বলল, “হ্যাঁ, ওর আঙুলের গলাসিতে ফোস্কা পড়েছে। আসলে টানা চারঘন্টা ও কোনদিন কাঁসর বাজায়নি। ভারি কাজকর্ম করারও তেমন অভ্যেস নেই। লেখাপড়ার হাত। নরম। তাই আরকি।” এবার বাবু বলল, “দেখি তোমার হাত! কোথায় ফোস্কা পড়েছে!” সনাতন হাতটা দেখাতে চমকে ওঠে বাবু,“আরে খোকা! এখান দিয়ে তো রক্ত চুঁইয়ে আসছে! এক্ষুণি এর ট্রিটমেন্ট করা দরকার। না হলে ঘা হয়ে যাবে। তারপর এতদিন তোকে কাজ করতে হবে। হেলাফেলা করলে হবে না।” বলে পাশের একজনকে বলল, “প্রতোষকে দেখছি না। কোথায় গেল দেখ তো? মনে হয় ঘরে গেছে। গিয়ে বল এই ছেলেটার আঙুলের গলাসিতে ফোসকা পড়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। আর তোমাকে দাদা ডাকছে। এক্ষুণি চলে এসো।” খবর পেয়ে প্রতোষ সঙ্গে সঙ্গে এসে সনাতনকে দেখে প্রেস্ক্রিপসান করে একজনকে ওষুধ নিয়ে আসতে বলে বলল,“তুই এগুলো কিনে নিয়ে আয়। তারপর আমি যা করার করছি।”
এদিকে ওষুধ এসে গেল এবং ডাক্তারবাবুও খবর পেয়ে ফিরে এলো। ডাক্তারবাবু আসতে সন্তোষবাবু রতনকে বলল,“প্রতোষ আমার ছোট ভাই। ডাক্তার। বিদেশে থাকে। প্রত্যেক দূর্গা পূজায় ওরা সপরিবারে কোলকাতায় চলে আসে। কোলকাতার আনন্দ তো বিদেশে বসে সম্ভব নয়। প্রতোষের মত বাইরে যে যেখানে থাকে এইসময় সবারই নিজের নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসার জন্যে মন আনচান করতে থাকে।” ডাক্তারবাবু সনাতনের ক্ষতটা দেখে মলম দিয়ে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিল। আর দু’ধরণের ওষুধ দিল। দু’বেলা একটা করে খাবার জন্যে। সেই সঙ্গে একটা অম্বলের বড়ি খেতে দিল। বলল,“তিনদিনে এটা শুকিয়ে যাবে। এখানে যাতে জল না লাগে দেখবে। তোমরা তো এখন এখানে থাকবে। তিনদিন পর ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেসিং করে আবার ব্যান্ডেজ করে দেবো। আর কোন অসুবিধা হবে না।” ডাক্তারের কাজ হয়ে গেলে সন্তোষবাবু বলল, “রতন, আজ আর বাজাতে হবে না থাক। ছেলেটা কষ্ট পাবে।” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “না, আমি পারব।” কাঁসর বাজানো কাঠিটা নিয়ে বলল, “এইতো আমি বাজাতে পারছি। কোন অসুবিধা হচ্ছে না। লাগছেও না। আস্তে আস্তে, সাবধানে না হয় বাজাবো। তবে বাজনা থামানো যাবে না। এত গুনিজন মানুষ মন দিয়ে আমাদের বাজনা শুনছে। এনাদের হতাশ আমি কিছুতেই করতে পারবো না। বরং আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের বাজনা শোনার জন্যে ওনারা মূল্যবান সমন নষ্ট করে এখানে এসেছেন। সন্তোষবাবু, আপনি ‘না’ করবেন না। আর যদি অসুবিধা সত্যিই হয়, আমি জোর করে বাজাবো না। এই কথাটা আমি আপনাকে দিচ্ছি বাবু।” এত সুন্দর কথাটা বলল সনাতন, সন্তোষবাবু আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু বলল,“তুই ছেলে তো দেখছি বাবার মত ভালো কথা বলতে পারিস। এতক্ষণ চুপচাপ ছিলিস, বুঝতে পারছিলাম না। ভেতরের জমি উর্বর বলেই না মাধ্যমিকে অত ভাল রেজাল্ট করতে পেরেছিস। তা সে ছেলে ভাল কথা বলতে পারবে না তা হয় না।”
কথাটা জেনে রতন প্রচন্ড আনন্দ পেয়েছিল। এত আনন্দ জীবনে কোনদিন সে পেয়েছিল কিনা তার মনে নেই। কমিটির লোক যখন বলল, “আমাদের এখানে নবমীতে পশুবলি কোনদিন হয়নি। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই কত যুগ আগে থেকেই এই রক্তস্নানে বিশ্বাস করেনি। সেই রেওয়াজ এখনো চলে আসছে। ওই কুমড়ো বলি দিয়ে শাস্ত্রের বিধান আমরা অনুসরণ করে আসছি।” খুশিতে টগবগ মনে সঙ্গে সঙ্গে রতন মুখ থেকে বের করে ফেলল, “বলির পর্বে আমি এমন বাজনার তাল তুলবো, তা সকল মানুষ আনন্দে আত্মহারা হবার মতো হয়ে যাবে। দেখে নিও বাবু!” রতন যা বলেছিল তাই যেন করে দেখালো! পশু বলির ‘না’ যেন অন্য মানুষে উত্তরণ ঘটিয়েছিল রতনকে। কুশলী রতনের ঢাকের বোল এমনভাবে হৃদয়কে উদ্বেল করে তুলতে পারে তা পাড়ার মানুষরা যেন ভাবতেই পারছিল না। নৃত্যের তাল। তাও আবার ঢাক-কাঁসরে! সে তো উদ্দাম নৃত্যের মত হয় জানত এরা। কিন্তু এই তালের এমন গুনমুগ্ধ বোল হৃদয়ের ভেতর থেকে নৃত্যের অনুরণন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। চলৎশক্তিহীন শ্রোতারাও যেন হৃদয় উচ্ছ্বাসে থেকে নেচে উঠছে। অথচ উদ্দামতার লক্ষণ ছিটেফোঁটা নেই ! পাড়ার মেয়ে বউরা- যাদের কোনদিন বিসর্জনেও নৃত্যের তালে তাল দিতে পারা যায়নি, সেইসব রমনীরাও বোলের তালে তাল মেলাতে শুরু করে। উৎসাহিত কিছু যুবতীরা সন্তুষ্ট হয়ে রতনকে দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে কিছু কিছু করে নগদ টাকা দিয়ে এই আনন্দযজ্ঞে নিজেদের সামিল করে নেয়।
নবমীর সকাল থেকে শুরু। সবকিছু সেরেসুরে রতনরা যখন শুতে যাচ্ছে তখন রাত দেড়টা। ক্লান্ত শরীর। রতনের মনে হচ্ছে শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাবে। ছেলেকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়ল। চোখ বুজিয়ে চুপচাপ রয়ে গেল। কতক্ষণ যেন হয়ে গেল ! তবু পোড়া চোখে ঘুম নেই। এবার দু’হাত উল্টে বালিশের উপর রেখে তার উপর ঠেকনা দেয় মাথা। ক্লান্তি যদি ঘুমকে কাছে ডেকে নেয়। নাহ! তবু ‘ড্যাব ড্যাবে’ চোখ দুটো। কড়িকাঠে নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। রাত পোহালেই দশমীর বিসর্জনের আবহ। চরাচরে আসন্ন বিষাদের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করবে। সেই ভাবনায় রতনের মনটা যেন কেমন মুষড়ে যায়! এ’কদিনের খুশির উচ্ছ্বাস আনন্দর প্রবাহ এই বিজয়ার হাত ধরে বিদায় নেবে। অপেক্ষা করতে হবে আবার আসছে বছরের জন্যে। কিন্তু এই বাবুরা পরের বছর তাদের বায়না দেবে কি না তা তো অজানা। নাও দিতে পারে। ফি বছর তাদের মত কত ঢাকি আসে, ঢাকে বোল তুলে বাবুদের সন্তুষ্ট করে চলে যায়। এই পুজো প্যান্ডেলে আগের বছর যারা ঢাক বাজিয়ে গেছে তাহলে তাদেরই তো বাবুরা আবার এই বছর আসতে বলতে পারতো। তা তো হয়নি। তাই তাদের বেলাই বা হবে এমন জোর দিয়ে সে বলতে পারে না। তবে এই প্যান্ডেলে তারা যেমন ঢাকে কাঠি মেরে বোল ফোটানোর পটুত্ব দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। তারাও যারপরনাই আনন্দ পেয়েছে, খুশি হয়েছে। ঢাক বাজিয়ে এমন আনন্দ এই গড়ান বয়সে এসেও আগে কোনদিন পায়নি, রতন। মনে হচ্ছে যেন এখানকার প্রতি তার একটা অধিকার জন্মে গেছে। এখানকার মানুষের আচার ব্যবহার, তাদের প্রতি এনাদের ভালবাসা আর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী এই ধারণাকে যেন দৃঢ় করেছে। না, তাই বলে সে তার অধিকার ফলাতে সচেষ্ট হবে না। যা স্বাভাবিক, যেটা হবার সেটাকেই সে মেনে নেবে। আরও একটা দিন তাদের হাতে আছে। সুযোগ আছে রতনের কাছে, তার সর্বস্ব উজাড় করে দেবার। তারপর সবকিছু সে সময়ের হাতে সমর্পন করে দিতে চায়। যেমনটি শিয়ালদার সমাজবিরোধী, হাতকাটা ছেনোর হাতে অপমানিত, বিধ্বস্ত হয়ে ভাগ্যকে ভাসিয়ে দিয়েছিল দিগন্তমুখী সময় প্রবাহে।
দশমীর সকাল। বিসর্জন পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বামুনঠাকুররা আর বাসহরিজনেরা ব্যস্ত। পাড়ার কচিকাঁচারা ইতিউতি ছুটোছুটি আর আনন্দে মশগুল। সনাতনের সঙ্গে এদের ভালই ভাব জমে গেছে। এক একজন কচি এসে আব্দার করে, “ও সনাতন দাদা, আমাকে একটু কাঁসর বাজানো শেখাবে? তুমি কি সুন্দর কাঁসর বাজাও। আমার শুনতে খুব ভাল লাগে। ঠিক ওইরকম বাজনা আমাকে শেখাতে হবে কিন্তু।” সনাতনও কচিদের সঙ্গে কচি হয়ে যায়। আর একটু বড়রা আব্দার করে, রতনকে, ঢাক বাজাতে দিতে হবে। রতন তাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। ওরা কি আর ঢাকে বোল তুলতে পারে? ওরা ওদের মত ঢাকে কাঠি মারে। ও বোলে কোন তাল ওঠে না। কাটা তাল ভেসে বেড়ায়। তাদের সঙ্গে এমন কান্ড ছেলেপিলেরা করছে অনেকক্ষণ থেকে। বড়দের চোখ পড়তেই বড়ড়া হাঁই হাঁই করে ওঠে, “এই তোরা এমন উল্টোপাল্টা ঢাকে কাঠি পেটাচ্ছিপ, ঢাক তো ছিঁড়ে ঢপ ঢপ করবে রে শেষ পর্যন্ত। তখন রতনকাকু আর বিসর্জনের, ভাসানের বাজনা বাজাতে পারবে না। সব কেঁচোগন্ডুস হয়ে যাবে। আচ্ছা রতন। তোমরাও তো তেমন। কাজের জিনিস এমন অকেজোদের হাতে দিতে আছে? অকাজ কিছু হয়ে গেলে আমরাও তো আতান্তরে পড়ে যাবো !” মুচকি হেসে রতন বলল,“কাঠি দিয়ে ঢাকে আঘাত করে ঢাক ফাঁসানো যায় না বাবু। এই কাঠি দিয়ে আপনি যত খুশি একে আঘাত করুন এ খিলখিল করে শুধু হাসতেই থাকবে। গোমড়ামুখো এ একদম হবে না।”
বাঃ, তুমি বেশ কথা বললে তো রতন। মনে ধরার মত কথা তোমার। তা আমাকে একটু তোমার ঢাক বাজানো শেখাও না? আমি পারবো না, না ? ঢাকে তোমার মত অত সুন্দর বোল তুলতে?” রতন মুচকি হাসছে দেখে বাবু বলল, “হাসছো যে রতন? আমি পারবো না বলছো।”
-না বাবু। সেকথা আমি বলতে পারি! আপনারা অত বড় মাপের মানুষ। অত শিক্ষিত। আমরা এই মূর্খরা পারলে আপনারা পারবেন না, এতবড় হেলাফেলা কথা আমি বলতে পারি! বলছি আপনারা এই সব ছোটমোটো কাজ করতে যাবেন কেন। এ কাজ আমাদের মত নীচু ঘরের লোকেদের কাজ। হাসির মাধ্যমে সেই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম বাবু।
-তুমি মোটেই নীচু ঘরের নও। দুটো কাঠি দিয়ে যারা এত মনমাতানো বোল তুলে মাতৃমন্দির জাগিয়ে তোলে তারা কক্ষনো ছোট-বড়ো বিচারের আওতায় আসে না। শিল্পের জন্য শিল্পী। শিল্প ভগবানের হৃদয় মথিত কলা। এরা উঁচুনীচু সবার ঊর্দ্ধে। ওসব কথার মারপ্যাঁচ ছাড়ো। আমাকে একটু দেখাও তো, কেমন করে ঢাকে বোল তোলো তোমরা?
নবমী শেষ মানে মায়ের আরাধনার যাবতীয় মূল পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই কর্মকর্তারা সবাই প্রায় অনেকটা হাল্কা মেজাজে। একজন বাবুর কথা শুনে এদিক ওদিক থাকা অন্য বাবুরাও রতনকে ঘিরে ধরে ঢাক বাজানোর তালিম দেবার জন্যে। এমনকি সন্তোষবাবুও। সন্তোষবাবুকে দেখে রতন যেন আরও ভড়কে যায়। যদি সে এমন বড়বড় বাবুদের শেখাতে না পারে তাহলে তো সে মরমে মরে যাবে। ইতস্তত করছে রতন। বাবার মনের অবস্থা বুঝতে দেরি হয়নি সনাতনের। বাবাকে স্বাভাবিক করার জন্যে বলল,“বাবা, বাবুরা যখন বলছে তখন একটু না হয় দেখিয়ে দাওনা। বাবুরা টুকটাক বাজাতে পারলেই খুশি হবেন।” সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সনাতন বলল,“বাবা কিন্তু ঢাক বাজানো শেখানোর মাস্টার। আমাদের ওদিককার বহু দূর দূর থেকে মানুষ আসে বাবার কাছে ঢাক বাজানো শিখতে। বাবা চাইলে আপনাদেরও শেখাতে পারবে।” সনাতনের কথা শুনে এবার বাবুরা আর কিছুতেই রতনকে ছাড়বে না। কিছুটা অন্তত শেখাতে হবে তাদের।
আর কোন উপায় না দেখে রতন বলল, “বাবুরা, ঢাক বাজানো শিখতে গেলে ওই গানবাজনার তাল, লয়, বোল ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রাথমিক কিছু নিয়ম জানা দরকার। না হলে একটু পরেই আবার ভুলে যাবে। যেমন ছেলেপুলেদের গান বা তবলা শেখার সময় এই নিয়মগুলো শিখতে হয়।” সঙ্গে সঙ্গে বাবুরা বলল,“ঠিক আছে আমরা রাজি। তুমি শুধু ঢাক বাজানো শেখার জন্যে যে তাল, লয়, বোল-টোলগুলো প্রয়োজন সেগুলো শেখাও। আমরা মন দিয়ে শিখবো।”[সাতাশ]
নতুন নক্সার কাজে পারদর্শিতা দেখিয়ে বড়বাজারে মহাজন মহলে অখিলের কদর এখন দেখার মত। সেই সুনামের হাত ধরে একাধিক মহাজনের ঘরে এখন তার মালের চাহিদা তুঙ্গে। একবার সে তার তৈরী জিনিস নিয়ে যে ঘরে ঢুকবে, সেখান থেকে তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে। অন্য ঘরে দেবার মত মাল আর তার কাছে অবশিষ্ট থাকবে না। এই নতুন নক্সার গয়না নেবার জন্যে অনেকে আবার আগাম টাকা নেবার জন্যে ওকে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অখিল তাতে রাজি হয় না। আগে থেকে কেউ তাকে কিনে রেখে দেবে সেটা তার নীতিবিরুদ্ধ। গুরু, মোহন গোড়ে এই বিদ্যে অনেক আগেই তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। আর বাকির কারবারও সে কোনদিন করে না। তাতে তার জিনিস যদি বিক্রি নাও হয় তবু। তবে এমন পরিস্থিতির মধ্যে তাকে বা তার গুরুকে কোনদিন পড়তে হয়নি। বাজারে এ জিনিসের চাহিদা সবসময়। মাঝে মাঝে কারবারে ভাটার টান যে আসে না তা নয়। যদিও তা খুব কম সময়ই হয়েছে। তখন দাম ধরে না থেকে লাভ কম করে ছেড়ে দিলে কাটান হয়ে যায়।
অখিলের এই নব-উত্থানের মূল নেপথ্যচারি কিন্তু সেই রেখা বউ। তার দক্ষতা এবং পারদর্শিতাতেই এমন উন্নতি। রেখা বউ যদি জটিল নক্সার কাজটা সঠিকভাবে ধরতে না পারতো তো তার পক্ষে এই সুনাম অধরাই থেকে যেতো। অখিল তো শুধু ড্রয়ইং দিয়েই খালাস। অবশ্য রেখা বউয়ের এই কাজের সঙ্গে ও মাঝে মাঝে তার এতদিনে এই লাইনের অর্জিত অভিজ্ঞতার কিছুটা অংশীদার হয়েছে মাত্র। কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্যে যে সূক্ষ্ম দক্ষতা অর্জন করা দরকার তা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয় রেখা বউ। নিজে নিজে সে কি করে যে এমনটা করতে পারল তা ভেবে মনে মনে গর্ব বোধ করে ও। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর একাগ্রতা ছাড়া যে এসব সম্ভব নয় তা জলের মত পরিষ্কার। অখিল বুঝে গেছে, সেটা রেখা বউয়ের মধ্যে পুরোপুরি বর্তমান। মেয়েরা সঠিক জায়গা পেলে কত জটিল কাজই না উতরে দিতে পারে এই সমাজের। অথচ আমাদের পুরুষ সমাজ, তা অত সহজে করতে দিতে রাজি নয়। তাদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে একটা বেড়া রচনা করতে তারা যেন সবসময় সযত্ন থাকে।
আশপাশের কয়েকটা গ্রাম জুড়ে আছে অখিলের মহিলা কারিগর। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ও চেষ্টা করছিল এই দামি কাজগুলো অন্যদের দিয়েও যদি করানো যায়। কিন্তু বলা যেতে পারে ষোল আনার মধ্যে পনেরো আনাই অকর্মার ঢেঁকি! অত জটিল কাজের মধ্যে তারা ঢুকতেই চায় না! চেষ্টা করলে হয়তো তারা পারতো। কিন্তু সেই চেষ্টাতেই তারা মাথা চালাতে রাজি নয়।
ঘরসংসার, ছানাপোনা সামলে ওই মোটা বুদ্ধি খাটিয়ে উপর উপর যেটুকু কাজ চালানোর মত কাজ করা যায় তাতেই ওরা পড়ে থাকতে পছন্দ করে। উপরে উঠতে চায় না। নিজেকে মেলে ধরার জায়গা পেলেও আবার সবাই সেই জায়গায় পা রাখতে আগ্রহ দেখায় না। এইভাবেই ওরা নিজেদের পাওনা সুযোগ নষ্ট করে চলে। আর আধিপত্যবাদিরা সেই অনিহার সুযোগ নিয়ে যায় দিনের পর দিন। প্রকারান্তরে হয় কি, যারা সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে জবরদখল করা জায়গা উদ্ধার করতে। এই নিষ্কর্মারাও তখন চায় না তাদের গোত্রের অন্য কেউ ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাক। তখন লিঙ্গ ভেদে যৌথভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সক্ষমদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে।
গুটিকয় সক্ষমদের মধ্যে রেখা বউয়ের উপর অক্ষমদের নিন্দামন্দের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে সব থেকে বেশি। কেননা এই বউটাই তো তাদের অক্ষমতার ছবি সকলের সামনে তুলে ধরেছে তার যোগ্যতার সঠিক পরিচয় দেবার মাধ্যমে। অখিল প্রতি পদে পদে সকল কারিগরদের রেখা বউয়ের উদাহরণ দিয়ে চলেছে, “ওই একটা অল্পবয়সী মেয়ে যদি এত বৈচিত্রময় কাজ এমন সুচারুভাবে করতে পারে, তাহলে তোমরা পারবে না কেন? সে মেয়ে, তোমরাও মেয়ে। আসলে কি জানো তো কাজে যোগ্যতা দেখাবার ইচ্ছে তোমাদের মধ্যে আদৌ নেই। এবার তোমরা এবং রেখা বউরা- একই জাতের কারিগর হয়েও যদি রেখা বউদের নামডাক ছড়িয়ে যায় তখন তোমরাই আবার তাদের সেই সুনামকে মেনে নিতে অবশ্যই কিন্তু কিন্তু করবে। এমনটাই যেন আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম হয়ে গেছে। আমরা যেন সব কাঁকড়া হয়ে যাচ্ছি। হাঁড়িতে কাঁকড়া রাখো। দেখবে কিছু কাঁকড়া হাঁড়ি বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আবার কিছু কাঁকড়া, নীচ থেকে সেই বাইরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করা কাঁকড়াদের ঠ্যাং কামড় দিয়ে নীচে টেনে ধরে নামিয়ে দিচ্ছে। যারা উঠবার চেষ্টা করছে তাদের উঠতে দিচ্ছে না। নিজেরাও ওঠার চেষ্টা করছে না।
বড়বাজারে মহাজনদের ঘরে নতুন নক্সার হাত ধরে অখিলের এই সুনাম তার পেশা-গুরু মোহন গোড়েকে গোপন করেনি। গুরুকে টপকে বা আঁধারে রেখে কোন কাজ করা তার ধাতে নেই। তাই সে গুরুকে জানিয়ে বলল, “কাকা, এই নক্সার কাজটা কি আমাদের এই কারখানার কারিগরদের দিয়ে করানোর চেষ্টা করবো? তুমি একবার এদের বলে দেখো না? যদি ওদের কেউ করতে চায় বা পারে তাহলে আমি সেটা দিতে পারি। দরকারে মন্ডল পাড়ার রেখা বউকে আনিয়ে এদের তালিম দেওয়াতে পারি। কাজটা একটু জটিল। তবে একবার ধরে নিতে পারলে আর অসুবিধা হবার কথা না। এতে ভাল পয়সা দিচ্ছে মহাজনরা।”
অখিলের এই নতুন উদ্যোগের কথা মোহন গোড়ের কানে আগেই এসেছিল। ও অপেক্ষায় ছিল, অখিল কখন তাকে ব্যাপারটার কথা জানায়। এমনি সময় তো লোকের কাছে সবসময় আওড়ায়, মোহন গোড়ে আমার গুরু। গুরু গুরু করে বাইরে গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখায়। লোকও তাকে সত্যিকারের শিষ্য বলে ভাবে। পুরাকালে যেমন শিষ্যরা গুরুকে মান্য করে সেই জায়গায় নিজেকে স্থান দিতে চায়। মোহন ভাবে, এই কাজের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে যাবে অখিলের গুরুভক্তির সার-অসারের মাপ কতটা। মোহন উপযাচক হয়ে তাই কোন কথাই এ ব্যাপারে অখিলের থেকে জানতে চায়নি। ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় ছিল। মোহন ভাবছিল, আজকাল তো সমাজে স্বার্থপরের বাড়বাড়ন্ত কহতব্য নয়। আপন স্বার্থের জন্যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে মানুষ। উপযুক্ত পাত্রের প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে তাদের কার্পণ্যের অন্ত নেই। উল্টে কেমন করে উপকারিকে বদনামের পাঁকে নিমজ্জিত করা যায়, নিয়ত সেই চেষ্টায় সময় ব্যায় করতে পছন্দ করে। ওই জন্যেই তো এক শিষ্য যখন বিদ্যাসাগরের বিপক্ষ কর্মে লিপ্ত, তখন বিদ্যাসাগর মশাই প্রায় এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন, ওরে, তোরা খোঁজ নিয়ে দেখ। নিশ্চয়ই কোন না কোন সময় ওই ব্যক্তি তার কাছ থেকে কোনভাবে উপকৃত হয়েছে। তা না হলে সে আমার বিরুদ্ধাচরণ করতেই পারে না। মনে মনে এমন ভাবনাই মোহনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু অখিল যখন সেই স্বার্থপরজনের পথে পা না বাড়িয়ে সত্যকাম করে বসল, তখন ছেলেটার প্রতি মোহনের শুধু ভালবাসা নয় ভক্তি-শ্রদ্ধাও করতে ইচ্ছে হল। পুরাণ কথায় বর্ণিত গুরু-শিষ্যের সুসম্পর্কের বাণী নতুন করে যেন এই যুগে সে স্পষ্ট করে দিল। মনে মনে অখিলের আরও উন্নতি কামনা করল। বলল, “অখিল আমার জীবনের সর্বোত্তম পুরষ্কার তুই আজ আমাকে দিলি। কর্মগুরুর প্রতি তোর এই কৃজ্ঞতায় আমি যে কতটা তৃপ্ত হয়েছি তা তোকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। শিষ্যর বিরূপ আচরণে স্বয়ং বিদ্যাসাগর পর্যন্ত আক্ষেপ করেছিলেন। ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটামুটি আমরা তেমনটাই জেনে এসেছি। আর তুইই সেই শিষ্য, যে সেই বদ্ধ ধারণা থেকে আমাকে মুক্ত করলি। এ কথা মুখ ফুটে স্বীকার না করে আমার উপায় ছিল না। তোর মহানুভবতাকে তাহলে ঠিক ঠিক মর্যাদা দেওয়া হয় না। আর একটা কথা, তোর নতুন নকশা কোলকাতার মহাজনের কাছ থেকে আমি পেয়েছি। কিন্তু তোর তো অজানা নয় যে আমাদের এখানে যেসব কারিগর আছে, অমন কম বুদ্ধির কারিগরদের পক্ষে এ নকশা তোলা সম্ভব নয়। ওটা তোর ব্যবস্থাপনায় যারা করছে তারাই করুক। এই শিল্পের কাজে তারা আরও শিক্ষিত হোক। তোর হাত দিয়েই তাদের উত্তরণ ঘটবে। এই দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে। তুই এগিয়ে যা অখিল।”গুরুর আশীর্বাদ এবং স্বীকারোক্তিতে অখিলের মন যেন আরও চনমনিয়ে উঠল। আরও ভাল কাজ করার প্রেরণা ভেতর থেকে সক্রিয় হতে লাগল। সেই জাগরণের হাত ধরে সে রেখা বউকে নিজের কাজের মধ্যে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে চাইল। ওর মনের জাগরণ বলছে, এই মেয়েটা যদি তার আরও অনেক কাছের লোক হতে পারতো তো কতই না ভাল হত। কিন্তু সেটা বা কেমন করে সম্ভব। সে তো অন্য ঘরের মানুষ। অন্য ঘরের মানুষকে কেমন করে সে আরও কাছে করে নিতে পারবে। পরস্ত্রীর বেশি কাছাকাছি আসা মানে পরনিন্দা পরচর্চার সঙ্গে নিত্য ঘর করা। তার উপর রেখা বউ আবার বিধবা! এমন যে জন, তার নামে নিন্দামন্দ কথা তো আগুনের ফুলকির মত এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবার কথা না। গ্রাম-পাড়াগাঁয়ে এমনটা প্রচার বাস্তব সত্য। কিন্তু এই নিন্দামন্দর ভয়ে রেখা বউয়ের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবধান আগের মত বজায় রাখলে তো তার আর চলবে না। তার নিজের স্বার্থে, তার কারবারের স্বার্থে সে এটা হতে দিতে পারে না। সে যতটা তাকে কাছে টানতে পারবে উভয়ের জন্যে ততটাই মঙ্গল।
এমন এক দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতির মধ্যে ‘না ফেরার দেশে’ চলে গেল রেখা বউয়ের বিছানা-শয্যা শ্বশুর! আবার এক বিপর্যয় রেখা বউয়ের জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল। হয়তো তা একদিন- ‘আজ না হয় কাল’ তাদের জীবনে আসতে চলেছে তা এদের সকলের জানা ছিল। মনকে সেই বোধ দিয়ে মানসিক ধাক্কাটা হয়তো তেমন প্রচন্ডভাবে আসতে দেয়নি। কিন্তু ওটাকে সহনের পরেও অন্যসব সামাজিক এবং আর্থিক ধাক্কা- অন্যতম বিপর্যয় থেকে কম কি! কেমন করে সে এই ধাক্কাকে সামাল দেবে! জাগতিক স্তরে এই ধাক্কা সামলানোও তো তার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। সেই উপলব্ধি রেখা বউ ছাড়া আর কে করতে পারে। একমাত্র পারে সেই মানুষটা যে তার মরমে প্রবেশ করতে পেরেছে। সংবাদটা পাওয়ামাত্র অখিল দৌড়ে আসে রেখা বউয়ের বাড়িতে। উদ্ভ্রান্ত রেখার শাশুড়িকে আশ্বস্ত করে অখিল বলল,“কাকিমা, তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না। তুমি কেন ধরে নিচ্ছো না যে তোমার ভীষ্ম নেই তো কি। তোমার অখিল আছে তো! অজানা দেশে চলে যাওয়া তোমার ভীষ্মর ফাঁকা হয়ে যাওয়া জায়গায় এই অখিলকে তুমি বসাতে পারো না কাকিমা?” পরক্ষণেই অখিলের ভেতরে তোলপাড় করতে থাকলো, “তোমার ভীষ্মর ছায়া যদি অখিলের কায়া দিয়ে আড়াল করে দিতে পারো কাকিমা, তাহলে অখিলও বেঁচে থাকার নতুন পথ পেয়ে যায়। ক্রমশ রক্ষণহীন হতে যাওয়া তোমার স্নেহের পুত্রবধূও আর এক নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করে নতুনভাবে বাঁচার পথ পায়। তোমরা চাইলে সেই পথ সুগম করার ভার তো আমার।”
জীবনের উপান্তে নতুন সূর্যর মত উদয় হওয়া অখিলের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতাবোধ জেগে উঠল ওই প্রাচীন মানুষটার- ভীষ্মর মায়ের। ন্যুয়ে যাওয়া কোমর অখিলের প্রেরণায় যেন তেড়ে উঠে সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বৃদ্ধার নোল হয়ে যাওয়া চামড়ার দু’হাত জড়ো হয়ে এল অবলীলায়, “বাবা অখিল, আমারও যাবার ডাক এলো বলে। দেখতে দেখতে কখন যে সে ডাক এসে যাবে তা তো কারোর জানা নেই। তবু সে ডাক যে কেবল সময়ের অপেক্ষা তা তুমি আমি, রেখা-মা সকলের জানা। তারপর কি হবে বাবা আমার এই ভরা যৌবনা লাবণ্যময়ী বৌমার? ওর ওই আগত রক্ষণহীন জীবনকে রক্ষা করবে কে বাবা? যৌবন-লুঠেরাদের লুঠের মাল হয়ে যাবে না কি রে বাবা, আমার মেয়েটা? ওঃ ভাবনায় দেখা ওই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না রে বাবা। বুকটা ধকর ধকর করে চলেছে। একটু জল। রেখা মা তাড়াতাড়ি একটু জল দে না?” রেখা তখন ঘরের বাইরে দাবায় উবু হয়ে বসে দু’হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে সমানে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। অখিল দৌড়ে গিয়ে মাটির কলসি থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিয়ে বৃদ্ধার থুতনি আলতো করে উঁচুর দিকে তুলে ঢক ঢক করে জল খাইয়ে দিতে রক্ষে হয়। না হলে হয়তো বুড়িটা এখনই দমবন্ধ হয়ে মরে যেত! অখিলের হাতে জল খেয়ে শুকনো ছাতি ভিজিয়ে শান্ত হয় বুড়ি। খানিক চুপ থেকে বলে, “বাঁচালি বাবা এ যাত্রা আমাকে। তুইই পারবি বাবা আমার ডুবতে থাকা সংসারের নৌকো চাগিয়ে তুলতে। হ্যাঁ, যে কথা বলতে বলতে কথার তাল কেটে গেল। তুই তো বাবা এখনো ঘরে বৌমা তুলিসনি। নাই বা হলি তুই আমাদের জাতের। আজকাল আর সেই জাতের জারিজুরি নেই রে বাবা। সে ছিল একসময়। আমাদের জন্মকালে। সে তো কত যুগ, কত কালের প্রলেপে বিলীন। যেটুকু আছে তা একদল দাম্ভিক লোকের ঢেম্নামী ছাড়া আর কিছু না। তার জন্যে হয়তো তোকেই অনেক বাধা বিপত্তি টপকাতে হবে। তবু তুই দেখিস বাবা আমার বৌমাটাকে। এখন রেখা আমার শুধু বৌমা না রে বাবা। ও আমার আবার মেয়েও। যার সম্বন্ধে ও বৌমা সে তো কালের গর্ভে উবে গেছে। এখন সে নেই ‘বৌমা’ও নেই। আছে কেবল আমার মেয়ে, রেখা-মা। আমার শ্বাস থাকতে থাকতে আমি নিজের হাতে আমার মেয়েকে তোর কাঁধে সমর্পন করে যাবো। তুই শুধু সায় দে বাবা। না, এক্ষুণি না। তুই সময় নে। থিতু হয়ে ভাব। জীবনকে কোন খাতে ভাসাবি। তারপর আমাকে এই সুযোগটা করে দিস বাবা। তোর মত আমাকে তাড়াতাড়ি জানাস।”
শ্বশুরের শ্মশান-কাজ সেরে গামুইদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে প্রথমে পড়ে অখিলদের রুইদাস পাড়া তারপর রেখাদের মন্ডল পাড়া। রুইদাস পাড়ার মোড়ে আসতে অখিলদের পাড়ার কয়েকজন তাকে এদিকে চলে আসতে ডাকে।অখিল সেদিকে যাবার ঝোঁক নিতে যাবার কালেই রেখা গলার স্বর একটু বাড়িয়ে বলে, “তুমি এখন ওদিকে যাবে না বাবু। গামুই-আচার শেষ করে তবে বাড়ি ফিরবে। নাহলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। চলো আগে আমাদের বাড়ি।” অখিল আবার গামুই দলে ভিড়ে যায়। বে-পাড়ার বউটা যে তাদের পাড়ার ছেলেকে যেতে নিষেধ করতে পারে এবং ছেলেটাও যে বউটার কথা শুনে কাজ করবে আর তাদের অবজ্ঞা করবে তা লোকগুলো ভাবতে পারেনি। বউটা ওদের অপমান করলো! হজম করতে পারলো না ব্যাপারটা। অখিল আর বউটার উপর রাগ-বিদ্বেষ উগড়ে উঠল ওদের মধ্যে। ওরা অবাক হল, একটা মেয়েমানুষ তার উপর স্বামীখেকো মহিলার কথা এক বাক্যে মেনে নিল অখিল! তাদের কথার কোন দাম দিল না! এটা অখিল একদম ঠিক কাজ করল না। অখিলও বুঝল, পাড়ার লোকেদের কথা না মানায় তার উপর চাপ আসবে। কেননা ও, ওদের পাড়াকে খুব ভাল করে চেনে। মন্ডল পাড়া বা গ্রামের অন্য পাড়া মনের দিক থেকে যতটা আধুনিক হতে পেরেছে তাদের পাড়া ওদের ধারেকাছে এখনো পৌঁছতে পারেনি। তাই নিত্য তাদের পাড়ায় আচার বিচার জাত বেজাত চর্চা, জাতের নামে নোংরামি- সব সময় লেগে আছে। সব ওই সেকেলে কিছু
মাতব্বরদের মাতব্বরির জন্যে এসব গোঁয়ার্তুমি চলছে। অখিল তাতে চিন্তিত বটে। তবে ভীত নয়। পাড়ার লালচোখের ভয়ে সে সঠিক কাজ থেকে কিছুতেই পিছিয়ে আসবে না। তার বাবা মারা যাবার পর তারা তো কত দিন একবেলা আধবেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। মায়ের পাশে তখন পাড়ার কেউ কি দাঁড়িয়েছে? নিজের জাত, রুইদাসদের আটচালা এক কুনকে চাল দিয়ে বলেছে যে, এ বেলা তোদের রান্না হয়নি শুনলাম। এই চালটা রাখ। মায়ে পোয়ে ফুটিয়ে ফ্যান-ভাত নুন মেখে খা! বলেনি। নিজের জীবন পাত করে মা সংসারটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাই ও যখন বে-জাতের মানুষ, মোহন গোড়ের সাহায্যে নতুন জীবনের স্বাদ পেল তখন নিজের জাতভাইরা সাহস করে বলতে আসেনি, বেজাতের বাড়িতে তোর কাজ করতে হবে না। তাতে যদি তোরা মায়ে পোয়ে না খেয়ে মরিস তো মর। দেখতাম কত বড় বুকের পাটা তাদের! কথাটা দাঁড়ায় তাহলে যে, বে-জাতের দলে ভিড়ে পয়সা রোজগার করো। তাতে ঠিক আছে। কিন্তু বে-জাতের সঙ্গে মেলামেশা তোমার যাবে না। আজব সব ভাবনা এই সেকেলে গোঁয়ারদের। এই কু-সংস্কার যে এ যুগে অচল, তা তারা মানতে চায় না। আসলে সেই মানের মন তৈরীর শিক্ষা তো তারা কোনদিন পায় নি। সুযোগ আসলেও তারা সেই শিক্ষা নিতে চায়নি। তাহলে যে নিজেদের খবরদারির কারবারে ভাটা পড়ে যাবে। এতদিনের প্রতিপত্তির জায়গা অত সহজে কি কেউ ছেড়ে দিতে চায়। চায় না। সেই জায়গা থেকে
ওদের উচ্ছেদ না করলে ওরা সরবে না। ভাবনাটা মাথায় নিয়ে অখিল রেখা বউয়ের কথা মত তাদের সঙ্গে এগিয়ে গেল। শুরু হ’ল আর এক দ্বন্দ্বময় দিন যাপনের খুঁটিপুজো।
সারা রুইদাস পাড়া চাউর হয়ে গেল মন্ডল পাড়ার ভীষ্ম মন্ডলের বিধবা বউয়ের সঙ্গে জুটে গেছে অবাধ্য অখিলটা। পাড়ার ওই গোঁয়ার লোকগুলোই মুখে মুখে কথাটা ছড়িয়ে দেয়। এমনভাবে বলতে লাগল যে পাড়ার সবাই যাতে অখিলের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করে। রুইদাস পাড়ায় অখিলের মেয়ে কারিগর তো কম নয়। ঘরে বসে তাদের আয় ভালই হয়। এক দুই করে দেখতে দেখতে প্রায় বেশিরভাগ বাড়িতে অখিলের কারিগর আছে। এতে মেয়ে মহল বেশ দোটানায় পড়েছে। তারা তাদের ঠিকাদার মালিকের পক্ষে যাবে না বিপক্ষে। বিপক্ষে গেলে তো রোজগারে টান পড়বে। তখন বাড়ির মদ্দদেরও নফর-চফর ঘুচে যাবে। তাই বেশিরভাগ মেয়েই অখিলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে নারাজ। তাছাড়া ও যদি একটা বিধবা অসহায় মেয়েকে সাহায্যই করে। তাতে ওই অকর্মণ্য মদ্দদেরই বা ফাঁকা ঢপঢপে বুক ফাটে কেন? আর ভীষ্ম মন্ডলের বউ তো তার একনম্বর কারিগর। তার হাত ধরে অখিল কারবারে অনেক উন্নতি করেছে। ওই বউটা যে কাজ করে তা তাদেরও দিয়েছিল। তাদের পাড়ার কোন মেয়েই সেই কাজ তুলতে পারেনি। অত সরেস ঘিলু তাদের মাথায় নেই। যেটা ওই ভীষ্ম মন্ডলের বউয়ের আছে। বউটা ওই নতুন কাজটায় ব্যস্ত বলে অন্য সাধারণ নকশার কাজ করার সময় তার হয়ে ওঠে না। সেই কাজগুলো তো তারাই পাচ্ছে। তাদের আয় বাড়ছে। মদ্দদের আয়ের সঙ্গে তাদের রোজগার যোগ হচ্ছে বলেই না সংসারের সকলের নফরানি চফরানির বহর এতটা বেড়েছে। অখিলের পক্ষে তাই শুধু রুইদাস পাড়ার কারিগররা কেন, আশপাশের পাড়া-গাঁয়ের সব কারিগররাও। একটা বুদ্ধিমতী দক্ষ কারিগর, রেখা বউ। পাথরচাপা কপালের গুনে সে আজ বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত। ঠিকাদারবাবু যদি এই বিপদে মেয়েটার পাশে দাঁড়ায় তাতে দোষের কি? তার বড় মন বলেই না সে বিপদে এক অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে!
পাড়ার আটচালার গোঁয়ার মুরুব্বিরা কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে। অখিলকে ডেকে সরাসরি কৈফিয়ৎ চেয়েছে, কেন সে পরস্ত্রী বিধবার সঙ্গে মেলামেশা করছে। এতে তাদের জাতকুল বিপন্ন হতে চলেছে। তাই এই নোংরা কাজ তাকে বন্ধ করতে হবে। নচেৎ আটচালার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।ক্রমশ….
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১০)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[তেইশ]
অখিলদের দু’কামরা ঘরের এক কামরার একেবারে মটকা পর্যন্ত সোলার বস্তা ঠাসা। এমনকি সামনের বারান্দার অর্ধেক অংশও সোলায় ভর্তি।এখান থেকেই ও কারিগরদের দরকার মত সোলা সাপ্লাই করে। বরাবরই ওর রুইদাসদের জাত ব্যবসা ওই গরু-ছাগলের চামড়া নিয়ে কারবার, বেতের সরঞ্জাম তৈরী করে বিক্রির কারবার একদম পছন্দ নয়। ও জ্ঞান হওয়া বয়স থেকে দেখেছে পাড়ায় একে অপরের সঙ্গে এইসব কাজ কারবার নিয়ে পরস্পরের রেষারেষি, হিংসা, খুন, মারপিট- আরও কত কি। দিঘিরপাড় স্কুলে সেভেনে পড়ার সময় চন্দ্রবড়া সাপে কেটে বাপটা মারা গেল। ফি বছর বর্ষায় এদিকে এই চন্দ্রবড়া সাপের উৎপাতে মানুষের জীবন অতীষ্ট। এই সময় মনে হয় এরা ডিম পাড়ে। রাস্তাঘাটে ঝোপঝাড়ে ছোটবড় কত যে সাপ তারা মারে তার হিসেব নেই। তবু বেটারা নিকেশ হয় না। বাপটা মরতো না যদি সময়মত পাড়ার লোক ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে নিয়ে যেত। বর্ষায় দৌলতপুর শ্মশান চড়ার ওদিক থেকে ধান রোয়ার কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় ঘাস লতাপাতা কেটে বোঝা মেরে নিয়ে আসে। ঘরে দুটো ছাগল আছে। বর্ষার ঘাস পাতা খাওয়ালে ছাগল ফলফলিয়ে বেড়ে ওঠে। মা-ছাগলের দুধ বেড়ে যায়। যাদের যাদের বাড়ি ছাগল আছে তারা সবাই তাই করে। একবার তো ঘাস পাতা ছাগলকে খাওয়াবার সময় দেখে একটা কালকেউটো সাপের কাটা লেজ তার মধ্যে! সেই শুনে তাদের বাড়ি, পাড়ার লোক উপচে পড়ে। তা দেখে এক একজন এক এক রকম মন্তব্য ছুড়ে দেয়, “অখিলের বাবার ভাগ্য ভালো কাল ব্যাটা ঘুরে ছোবল মারেনি। ওর ছোবল একবার খেলে আর মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে না। ওখানেই কাত খেয়ে পড়ে যেতে হবে।” যারা নিত্য ঘাস কাটে তাদের কেউ বলে, “না বাবা, ছাগল বাঁচাতে গিয়ে নিজে মরবো নাকি! ওই ভাতের ফেন-ভুষি যা যোগাড় করতে পারব তাই খাওয়াব। ঘাসের জঙ্গলে আর না।” আরও কত লোকের কত কি কথা।
শ্রাবণ মাস। তখন বর্ষা পূর্ণ যৌবনা। পুকুর ডোবা, নালা, খানাখন্দ জলে টৈুটুম্বুর। সেই তালে যুবতী ঘাস যেন তার রূপের ছটা ঘেসুড়ে-ঘেসুড়িদের মাতাল করে দেয়। এরা তখন নিজেদের সামলে রাখতে পারে না। শত্রু বিপদের ভয় মাথায় তুলে তারা কাস্তে হাতে নেমে পড়ে লকলকে ঘাসের বনে। তাদের যুক্তি, কপালে গেরো থাকলে তা কে খন্ডাবে। যা হবার তাই হবে। সত্যি সত্যি তাই হল! এক কোমর জলে নেমে দু’হাত পাকড়ে ঘষ ঘষ করে হাত চালিয়ে ঘাস কেটে চলেছে অখিলের বাবা, চরণ। ঘেসুড়েরা জানে, ভারি জলে কোন বিষাক্ত সাপ থাকেই না বললে চলে। তবে পুকুর বা নালা ডোবার পাড়ে সাবধানে কাজ করতে হয়। ওই আরকি! দানা যখন শেষ হয়ে আসে তখন ‘সতর্কতা’ মাথা থেকে ফসকে যায়। কাটতে কাটতে নালাটার পাড়ে চলে আসে চরণ! সঙ্গে সঙ্গে শত্রু, গোদা চন্দ্রবড়াটা কুট করে ছোবল মারে চরণের বাঁহাতের কব্জির উপর দিকটায়। বাঁ হাতে তখন মুঠো ভর্তি ফুলকো ফুলকো ঘাস। বুঝতে পারেনি চরণ। ভাবলো ভোলা পিঁপড়ের মোটা দাঁড়া কামড় দিয়েছে। ভোলা পিঁপড়ে কামড়ালেও চুঁইয়ে রক্ত পড়ে ক্ষত থেকে। সেটাই ভাবে চরণ। কাজ থামায় না। হঠাৎ দেখে শালা গোদা চন্দ্রবড়াটা সামনে দিয়ে গতর নেড়ে চলে যাচ্ছে! আর বুঝতে দেরি হয়নি চরণের, কি সর্বনাশা কান্ড ঘটিয়ে গেল ওই কাল-শত্রুটা! চন্দ্রবড়ায় কাটলে কেউটোর মত অত যন্ত্রণা হয় না বা গলগল করে রক্ত ঝরে না। তাই সে পিঁপড়ের তত্ত্ব খাড়া করে নিজেকে বোধ দিচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে তো অনেকটা সময় জীবন থেকে কেটে বেরিয়ে গেছে। তবু যা সময় আছে তার ওপর ভরসা করে ঘাসের বোঝাগুলো বেঁধে মাথায় নিয়ে ভর দুপুরে বাড়ি ফিরে ধপাস করে বোঝাটা ফেলে মা’কে বলল, “দেখতো অখিলের মা, আমার হাতে মনে হয় বিষধর কিছু কামড়েছে। কামড়ায় যখন টের পেয়েছি। ওটা ভোলা পিঁপড়ে কামড় ভেবে গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু সময় যত গড়ায় শরীর ভেতর থেকে কেমন যেন করছে মনে হল। এখন কি করি বলতো? পাড়ায় একটু খবর দে-দিকিনি। অখিলকে বল গোটাকতক মেলেরিয়া পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসতে। দু’হাতের তালুতে ঘষে তার রস ছোবল খাওয়া জায়গায় দিয়ে দিই।”
খবর পেয়ে হুড়মুড়িয়ে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায়। যে যার মত টোটকার নিদেন দিতে থাকে। কে আবার উলকুনির শঙ্কর ওঝাকে খবর দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেও এসে ঝাড়ফুঁক চালিয়ে তার বিদ্যে ফলাতে শুরু করেছে। ভাবটা এমন, বিষ এক্ষুণি নামিয়ে দিল বলে। এদিকে রোগি আস্তে অস্তে যেন ঝিমিয়ে পড়ছে! দিঘিরপাড় স্কুলের অরুণ মাস্টার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হইহট্টগোলের শব্দ পেয়ে থমকে যায়! কারোর মুখে শোনে একজনের সাপে কেটেছে। বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া সাপ! ও তো সাংঘাতিক বিষধর সাপ! সময়মত হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মানুষকে বাঁচানো যায় না। সেটা বুঝে অরুণ মাস্টার পায়ে তাড়া লাগিয়ে পাড়ায় ঢোকে। হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে এখানে এইসব বুজরুকি হচ্ছে দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, “এক্ষুণি তোমরা একে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।” ওঝার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই ওঝা বেটা, যতই তুই মন্ত্রপুতে মাটির সরা-মালসা ফাটিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিস। পারবি তুই, এই মানুষটার শরীর থেকে বিষধরের বিষ নামাতে? কোনদিন তোরা পেরেছিস? কোথায় হয়তো বিষহীন চিতি সাপ, মেটলে সাপ বা দাঁড়াসাপ কামড়েছে, মানুষ দেখতে পায়নি সেই সাপটাকে। ভাবে যদি কোন বিষধর কামড়ায়? তখন তোদের ডাকে। তোরা এসে মন্ত্র আউড়ে ভড়কি দিস, সাপের বিষ নামিয়ে দিয়েছিস। শুনলাম অনেকক্ষণ থেকে নাকি তুই কেরামতি করে যাচ্ছিস। রোগি তো ক্রমশ আরও নেতিয়ে পড়ছে। এই যে রুইদাসরা সব, তোমরা ওই ওঝা বেটার কি ঢ্যামনামি দেখছো। এক্ষুণি নিয়ে চলো ওকে হাসপাতালে? আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। এমনিতেই বহু দেরি হয়ে গেছে। দেখো ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের রাস্তায় যেতে যেতে না মানুষটার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যায়!”
অরুণ মাস্টারের তাড়ায় এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে চরণকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু এত ভিতরের গ্রাম থেকে একে পাকা সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাবে কি করে! তারপর তো কোন গাড়ির ব্যবস্থা! পাড়া থেকে সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্যে কোন ভ্যান-রিক্সারও ব্যবস্থা করতে না পেরে ওরা চরণকে ধরাধরি করে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার বলে, “এ কি করছো তোমরা? সাপে কাটা রোগিকে কেউ এ’ভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়? একে একদম নাড়াচাড়া করা চলবে না। যত নাড়াচাড়া করবে তত ওর শরীরের ভেতরের রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠানামা করতে থাকবে। আর বিষ তুরন্ত মাথার দিকে উঠতে থাকবে। ওকে বিন্দুমাত্র হাঁটানো চলবে না। যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করতে হবে। কোনকিছুর উপর শুইয়ে মড়া নিয়ে যাবার মত কাঁধে করে নিয়ে যেতে হবে।” সঙ্গে সঙ্গে একজন বলল,“তাহলে এক কাজ করা যাক, চরণকে ধান ঝাড়া আগোড়ে কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে শুইয়ে নিয়ে চলো।” ইতিমধ্যে জনা দুই ছেলে সড়ক রাস্তায় চলে গেছে কোন অটো-টেম্পো যদি যোগাড় করা যায়। কিন্তু গ্রাম এলাকায় এই ভর-দুপুরে এমনিতেই রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলে কম। তারপর অটো-টেম্পোর কথা তো বলাই বাহুল্য। এতক্ষণ হয়ে গেল, রাস্তা দিয়ে একটাও ওইসব গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না। ততক্ষণে চরণকে আনা হয়ে গেছে। অরুণ মাস্টারও সঙ্গে এসেছে। একটা সাইকেল ভ্যান ধানগাছের চারা-তোলা নিয়ে যাচ্ছিল। মাস্টার সেই ভ্যানওলাটাকে থামিয়ে অনুরোধ করে বলল, “তুমি ভাই এই সাপেকাটা রোগিকে হাসপাতালে নিয়ে চলো। না হলে এ মরে যাবে। তোমার তোলা আমরা গুছিয়ে এখানে রাস্তার পাশে নামিয়ে রাখছি। ফিরে আসলে আবার আমাদের লোক তোমার ভ্যানে গুছিয়ে তুলে দেবে।” মাস্টারকে চেনে ভ্যানওলাটা। ওর ছেলে ওদের স্কুলে পড়ে। তাই মাস্টার এমন অনুরোধ করায় ও আর ‘না’ করতে পারলো না। তড়িঘড়ি সবাই মিলে তোলার বোঝা নামিয়ে চরণকে ওই কাঁথা-কম্বল সমেত ভ্যানে তুলে দিল। ভ্যানওলা বলল, “তোমাদের মধ্যে দু’জন আমার পেছনে দু’দিকে বসো। বেশি আর কাউকে ভ্যানে তোলা যাবে না। বেশি ওজন হয়ে গেলে গাড়ি গড়াবে না। আর দু’জনে দু’দিক থেকে আমার সঙ্গে প্যাডেলে চাপ দিয়ে যাবে। তাহলে গড়গড় করে গাড়ি ছুটবে।”
শেষ অবধি অরুণ মাস্টারের কথাই মিলে গেল। ঝিঙের পোল আর সরিষার হাটের মাঝামাঝি চেওড়ার কাছে যখন এল, ওরা দেখল চরণ, বিষের যন্ত্রণায় ‘উ-আঃ, মরে গেলাম’ বলে এতক্ষণ ধরে যেমন কাৎরাচ্ছিল, সেই কাৎরানি থেমে গেছে! ভ্যানওলাকে ওরা গাড়ি থামাতে বলল। ভ্যান থেকে নেমে ওরা দেখে চরণের শরীর আর নড়াচড়া করছে না। একবারে অচঞ্চল! সমস্ত শরীরটা নীল হয়ে গেছে। ডাক্তার না হলেও ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে চরণ আর বেঁচে নেই! তখন ভ্যানওলাটা বলল,“আর একে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। ওখানে নিয়ে গেলেই পুলিশ কেস হয়ে যাবে। পোস্টমর্টেম হবে। তখন হাজার হেপা তোমাদের বইতে হবে। তার চেয়ে পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। দিঘিরপাড় বাজারের কুঞ্জ ডাক্তার তো পাশ করা ডাক্তার। ও ডেথ সার্টিফিকেটে কাজ হয়ে যাবে।”
হঠাৎ বাবার অপঘাতের মরণে অখিলদের সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। মা দিশাহারা। ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে কেমন করে সে সংসার চালাবে! তার লেখাপড়ার খরচও বা কোথা থেকে জোগাড় করবে। নিজেদের কোন চাষজমি নেই যে সেই জমি চাষ করে সারা বছরের ধান-চালের খোরাক মিটে যাবে। ও মেয়েমানুষ, ওদের জাত-কারবার, চামড়া বা বেতের কোনকিছুই জানা নেই। শেষমেষ মা পেটের টানে মেয়ে-মজুরদের দলে নাম লেখাল। সব বিষয়ে মেয়েদের কত জ্বালা। মেয়েদের কত দুচ্ছা করা স্বভাব সমাজের। দশগন্ডা তোলা ভাঙা আর দশগন্ডা পোতা সারাদিনে দু’তরফই করছে। পুরুষ-মজুর এবং মেয়ে-মজুররা। অথচ মেয়েদের বেলায় রোজগন্ডা ছেলেদের থেকে কম! কেন হবে এমন অবিচার? অথচ কোন মেয়ে-মজুরের এই বেনিয়মের কথা বলার অধিকার নেই। যে ‘বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে যাবে’ তার কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে পুরুষ জাতেরা। মেয়েরা পুরুষের সমান সমান হবে তা আবার জাত-পুরুষরা মেনে নিতে পারে নাকি! ওরা খুব ভাল করে এটা বুঝেছে যে নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কোন ঘরের মেয়ে বাইরে বার হয় না। সেই সুযোগকে ওরা কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আর পুরুষ-মজুররা কাজ বয়কট করলে যে গোটা চাষ ব্যবস্থাটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই এই পুরুষ প্রাধান্য। এই কষ্টের কথা তার মা, অখিলকে শুনিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ত। বালক অখিলের মন মায়ের আকুতিতে ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তাই বাধ্য হয়ে সে পড়া ছেড়ে দিল, “মা, আমি আর স্কুলে যাবো না। তুমি কষ্ট করে জন খেটে আমাকে পড়াবে খাওয়াবে। তোমার এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না মা। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আমিও কাজে যাব।”
-এ কি কথা বলিস বাবা? তুই কোথায় কাজে যাবি। বাচ্চা ছেলে তুই। কে তোকে কাজে নেবে! তুই স্কুল ছাড়বি না। যে করে হোক আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব, অখিল। তুই দেখিস, যত কষ্ট হোক, তোর লেখাপড়া আমি আটকাব না।
কিন্তু মা একা ওই ক’টা টাকা জন খেটে কোথা থেকে তাদের খাওয়া-পরা আর তার লেখাপড়া শেখাবে? অখিল কিছুতেই সেই অঙ্ক মেলাতে পারছিল না। হাজার হোক নয়-নয় করে সে তো সেভেন ক্লাস অব্দি পড়ছে। একটু গাঁটগুনতির হিসেব সে তো বোঝে। এতটা বিপদে মা’কে ফেলা তার উচিত হবে না। স্কুলের টিফিন টাইমে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে ঘোরাফেরার সময় মাঝে মাঝে মোহন গোড়ের শোলা কারখানার কাজ দেখতে যেত সে। তার মত বা তার থেকে ছোট-বড় অনেক গরিব ঘরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা শোলা দিয়ে কি সুন্দর সুন্দর ঠাকুরের গয়না, মুকুট, টোপর তৈরী করছে! ভাল লাগত তার। অবাক হয়ে তাদের কাজ সে দেখতো। হঠাৎ একদিন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মোহন গোড়ের শোলার কারখানার ছবিটা! দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। মা’কে কিছু না বলে একদিন মোহন গোড়ের কাছে গিয়ে ধীর স্থির বিনয়ের সঙ্গে বলল, “কাকু, আমাকে তুমি চিনবে না। আমার বাড়ি রুইদাস পাড়ায়। চরণ রুইদাসের ছেলে আমি। বাবা সাপে কেটে মরে গেল। মা জন- খেটে আমাকে খাওয়ায়। তার ওপর আমার পড়ার খরচ মা আর চালাতে পারছে না। তোমার কারখানায় আমাকে কাজে নেবে? তুমি যা পয়সা দেবে তাতেই আমি কাজ করবো। মন দিয়ে কাজ করব। কাজে কোন ফাঁকি দেব না।”
-তা এখানে কাজ করে তুই পড়ার খরচ চালাবি তাই তো? ও গুড়ে বালি। পড়া ছেড়ে দিয়ে যদি তুই আসিস তাহলে আমি তোকে কাজে নিতে পারি। দু’নৌকায় পা দিয়ে তো চলা যায় না। ঢেউয়ের খামখেয়ালীতে নৌকো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে দু’পা চিরে গিয়ে জলে ঝপাং খেতে হবে। একটা কাজে লেগে মন ছুঁক ছুঁক করবে আর একটা কাজ কখন কিভাবে করা যায়, সেজন্যে। তাতে কোন কাজটাই মন দিয়ে করা যায় না। দু’কাজেই ফাঁকি পড়ে যায়। আর তুই বলছিস, মন দিয়ে কাজ করবি। তা কখনো হয় না। তারপর আমার এমন বাহুল্যতা নেই যে পুরো সময় কাজ না করে তিড়িং বিড়িং কিছু কাজ করে সময় কাটিয়ে চলে যাবি। আর ‘ফুল-ফুল’ রোজের পয়সা তোকে গুনে যাব। যাদের পেট চলে না তাদের পড়াটড়া তো বিলাসিতা ছাড়া আর কি? তোর বাপ
চরণ আমার জমিতেও চাষের কাজ করত। ‘লতার’ ছোবলে অকালে চলে গেল। আসলে কি জানিস, তোদের জাতটাই মুর্খ গোঁয়ার জাত। একটু যদি শিক্ষে-দীক্ষে থাকতো তো এই যুগে ওই ওঝা ডেকে বাজে সময় নষ্ট করে লোকটাকে মেরে দিত না। আর বলি কি, এদিকে পেটে ছুঁচোর ডন মারা রুখবে না বিদ্যের কচকচানিতে মজবে। এই যেমন তুই। বাপের নাড়ার গোড়ায় রস থাকলে তুই বিদ্যের মেজলায় মুখ জাবড়ে থাকতে পারতিস। সব কপাল। তোদের জাতটারই পাথরচাপা কপাল। তুই আর কি করবি। যদি কোনদিন তোদের কেউ ওই পাথর সরাবার ক্ষমতা দেখাতে পারে তবেই এই অশিক্ষের পাপ ঘুচতে পারে। চরণের মরণের খবর সব আমরা জানি। সেই চরণের ছেলে, তুই। এখন লোক নেওয়া আমার জরুরী নেই। তাই দরকার না থাকলেও তোকে কাজে নেবার কথা ভাবতে পারি। যদি আমার শর্তে রাজি থাকিস। তোর মা’র সঙ্গে কথা বলে সামনের মাস থেকে আসতে পারিস। আর একটা কথা, সবাই যেমন কাজ করে তোকেও তাই করতে হবে। আলাদা করে কারোর বেলায় কোন ছাড় নেই। পয়সার জন্যে সবাই আসে। একজনকে ছাড় দিলে আর একজন সেই সুযোগ নেবার কথা তুলে বসবে। সে ফায়দা আমি কাউকে দিতে রাজি নই।
মোহন গোড়ে যা বলল একদম ঠিক। পেটের জ্বালা মেটাবে না লেখাপড়া শিখবে! মায়ের কষ্ট অখিলের আর একদম সহ্য হয় না। সে যদি শোলা কারখানায় কাজ করে দু’দশ টাকা মায়ের হাতে দিতে পারে তো সংসারটা একটু গড়ায়। মা’কে আবার এ’কথা বললে মা কিছুতেই রাজি হবে না। সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করুক তা মা চায় না, সে তো মা আগে বলেই দিয়েছে। আবার মোহন গোড়ে এখন তাকে কাজে নিতে রাজি হয়েছে। এবার সে যদি যাবে না বলে দেয় তো পরে গেলে আর না-ও নিতে পারে। একবার মতি ঘুরে গেলে পরে আর রাজি করানো যাবে না।
রোজ ভোরে উঠে ছেলের জন্যে একটু ভাতেভাত করে নিজে এক টিফিনকারি পান্তা আর একটা পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা নিয়ে কাজে চলে যায় চপলা। পাড়ার আশেপাশে কাজ কম পায় সে। যেতে হয় অনেকটা দূরে। সেই কোদালে বা আমড়ের মাঠে। অতদূর থেকে দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার সময় নেই। জিরোনোর সময় পাবে না। আসা-যাওয়াতেই সময় কেটে যাবে। তাই যেখানে কাজ করে সেখানেই ফাঁকা মাঠে বাবলা গাছের ছায়ায় বসে এই পান্তা খেয়ে নেয়। আঁচলের খোঁটটা পুঁটলি করে মাথায় ঠেকিয়ে একটু চোখ বুজিয়ে থাকে। বিকেলে কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যের কাছাকাছি হয়ে যায়। রাত্রে একটা তরকারি আর একটু বেশি করে ভাত চাপিয়ে শান্তি করে মায়ে-পোয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়। যতদিন চাষের কাজ থাকে এইভাবেই চলে চপলার দিন-চক্র। অসময়ে লোকের বাড়ি তোলা-ঝিয়ের কাজ বা অন্য যা কাজ পায় তাই করে। থেমে থাকার আইন তার জীবনের জন্যে বরাদ্দ নয়। এমনই তার পেট-সামাল দেবার তাড়া যে ছেলেটা কি করছে না করছে তা দেখার সময় নেই। শুধু কথার কথা, না বললে নয় তাই বলে, “কিরে অখিল, ঠিকমত পড়াশোনা করছিস তো? স্কুল কামাই করছিস না তো? ইদানিং তো তোকে সকাল-সন্ধ্যে বই নিয়ে বসতে দেখি না। কখন পড়িস কি জানি। আমি বাড়ি থাকি না, দেখতেও পারি না কি করছিস না-করছিস।” এ ছাড়া তার কচি ছেলেটার ভাল-মন্দ কোন কিছুই তার আঁচলের মধ্যে ধরে রাখার সুযোগ নেই।
অখিল মায়ের কথায় কোন উত্তর দেয় না। সারাদিন সোলা কারখানায় খাটনি করে সন্ধ্যে আর শরীর সায় দেয় না। শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়েও যায়। মা রান্না করে খেতে ডাকলে খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে। আসলে অভ্যেস নেই তো এইভাবে এতটা টানা কাজ করার। সন্তানের এই অপরিচিত আচরণ চোখ এড়ায় না চপলার। মনের মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল বারবার তাকে ধাক্কা দেয়! হঠাৎ ছেলের কি হল যে এমন নিয়মভাঙা আচরণ করে চলেছে? প্রশ্ন নিয়ে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের পরশে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ছেলের কাছ থেকে মনমত উত্তর আসে না, “ও কিছু না, মা। এমনি।” বলে একটা দায়সারা উত্তর দিয়ে চুপ করে যায়। মনটা তাই উচাটন চপলার! কি যে করে বুঝে উঠতে পারে না। বাবা থাকলে দু’জনে আলোচনা করে মনটাকে থিতু করতে পারতো। কিন্তু সে উপায় তো নেই। কাজের জায়গায় যে সব মেয়ে ওর সঙ্গে কাজ করে তাদের কাছে দুঃখের কথা বলে। তারা তাদের মত কত যুক্তি দেয়। কিন্তু চপলার মন থিতু হয় না। একবার পাশের গ্রাম, দৌলতপুরের মাঠে রোয়া ধানের ঘাস নিড়োনোর কাজে যায় ও। সেখানে তাদের পাড়ার বিন্দুর মা ও কাজে লাগে। পয়সার অভাবে মেয়েকে স্কুলের দোর দেখায়নি বিন্দুর মা। মেয়ের শরীরের হাড়গোড় শোলার মোট বইবার মত শক্ত হতেই শোলা কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেয়। মনে মনে ভেবে নেয়, মেয়ের মুখের আদল, গায়ের রং চাঁছাছোলা আছে। দামড়ি মত হলেই বিয়ের বাজারে ফেলে দেবে। অনায়াসে বিকিয়ে যাবে। এমন দেখতে মেয়ের জন্যে ছেলেরা সবসময় ছোঁক ছোঁক করে। যে মেয়ের পেছনে ছোঁকছোঁকানির বহর বেশি সেই মেয়ের বাপ-মায়ের কপাল খুলে যায়। মেয়ের বিয়ের জন্যে তেমন পয়সা খরচা করতে লাগে না। মেয়ের পক্ষ যৌতুক-নগদ দিল-দিল, না-দিল না-দিল। এমনিই হিল্লে হয়ে যায়। বিয়ের জন্যে ঘটক-ঘটকির চক্করে পড়তে হয় না।
চপলা ছেলের কথা তুলতে বিন্দুর মা বলে, “কিগো চপলা-বউ, তুমি জানো না? তোমার ছেলে তো ওই মোহন গোড়ের সোলার কারখানায় কাজে যায়! কেন, ছেলে তোমাকে বলেনি? কেমন তারা ছেলে তোমার গো? আমার মেয়ে বিন্দুও মোহনের ওখানে কাজ করে। মেয়ে তোমার ছেলের গল্প করে বলে জানলুম। তোমার ছেলের মাথায় নাকি ভাল বুদ্ধি। মোহন তোমার ছেলের কাজে খুব খুশি। এত অল্প কয়েকদিনে এত সুন্দর কাজ ধরে নিতে নাকি আজ পর্যন্ত কোন কারিগর পারেনি। যেটা তোমার ছেলে পেরেছে। আর এতো ভাল ছেলে নাকি, সবাই ছুটি হয়ে বাড়ি চলে গেলেও তোমার ছেলে যায় না। এমন কাজ শিখে নেবার তাগিদ তার। তাতে হয় কি, আমার মেয়ের মত অন্য যারা কাজ করে তাদের অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। মালিক তোমার ছেলেকে দেখিয়ে এদের উপর খচর খচর করে, “ওই তো অখিল সবে কাজে ঢুকেছে। এখনো একমাস হয়নি। আর ক’দিন হলে মাস পূর্ণ হবে। এই নতুন ছেলেটা যদি একটু বেশি কাজ করে তো তোরা করতে পারবি না কেন? হতেই পারে ছুটির সময় হয়ে গেছে। একটু বেশি কাজ করলে কি তোদের গতর ক্ষয়ে যাবে? মালিক বাঁচলে তবে তো তোরা কাজ পাবি। বাঁচবি।” তোমার ছেলে এটা কিন্তু ঠিক কাজ করছে না।” বলো তো এখন কি ঝামেলায় পড়ে গেল আমার মেয়েরা ? ভালই ছিল ওরা। এখন তোমার ছেলে ঢুকে ওদের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। তুমি বউ, তোমার ছেলেকে বলে দিও, যেমন কাজের টাইম তেমনটি সময় মেনে যেন ও কাজ করে। কেন, বেশি কাজ করলে কি মোহন গোড়ে বেশি পয়সা দেবে? দেবে না। তাহলে বেশি কাজ করতে যাবে কেন লোকে? মান সরম খুইয়ে মেয়েরা পরের দোরে কাজে যাচ্ছে পয়সার জন্যে তো, না কি? ওই যে মালিকরা যেমন বলে, পয়সার দান-সত্র খুলে তারা বসে নেই যে কাজে ফাঁকি দিয়ে ‘সই-সই’ মানে সমান সমান পয়সা নিয়ে চলে যাবে! আর মজুরদের গতর বুঝি মাগনা? বেগার বেগার গতরের রস শুষে নেবে! না গো অখিলের মা, কথাগুলো তোমাকে বিঁধে বলছি না। তুমি আমি তো একই গোত্রের মানুষ। তোমার আমার বুকের জ্বালা কথায় কথায় উগরে দিলাম। তুমি যেন আবার গায়ে মেখে নিউনি। শুধু তোমার ছেলেকে বলতে বলছি, কেন ও এত মাগনা খাটতে যাবে। বুদ্ধি করে, গতর বাঁচিয়ে চললে তবে না বেশিদিন লড়াই চালাতে পারবে। না হলে যে অকালে বুড়িয়ে যেতে হবে।”
বিন্দুর মায়ের কাছে ছেলের কান্ডকারখানা শুনে চপলার মন যেন থম মেরে যায়! নিজের জীবনের জন্যে এতবড় একটা পরিবর্তনের কথা ছেলেটা ঠিক করে নিল! পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে গেল! একবারও মা’কে সে কথা জানাল না? তোকে তো বলেছিলাম বাবা, যত কষ্ট হোক আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব। পড়াশোনা করে তুই বড় হবি। তখন আর সারা জীবন ওই বাপ-ঠাকুর্দার মত চামড়া, জুতো, বেত আর লোকের বাড়ি জন মজুর খাটা- এইসব নিয়ে জীবন কাটাতে হবে না। তুই মায়ের কথা শুনলি না বাবা! বুঝেছি তুই নিজের ভালোর কথা না ভেবে মায়ের কষ্টের কথা ভেবেছিস। মায়ের এত কষ্ট তোর সহ্য হচ্ছে না। বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত যে মা ঘর থেকে বার হয়নি, সেই মা এখন লোকের বাড়ি ঝি-জন খাটছে সেটা তুই মেনে নিতে পারছিস না। কিন্তু বাবা-মায়ের তো এটা কর্তব্য বাবা, সন্তানদের মানুষ করা? সেই দায়িত্ব-কর্তব্য বাবা যখন বেঁচে নেই তখন মা’কে তো করতেই হবে। এটাই তো ভবিতব্য। আমি তো সেটাই করতে চেয়েছি বাবা! তাছাড়া তোর জীবনের জন্যে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত, তুই নিয়ে ফেললি, মা’কে জানাবার বোধ মনে জাগল না! জানি, তুই নিশ্চয়ই ভেবেছিস, একথা মা’কে বললে মা বাধা দেবে। তাই বলে তুই মা’কে জানাবি না! ঠিক আছে। মা’কে যেমন জানাসনি তেমন মা-ও তোর কাছে জানতে চাইবে না। যতক্ষণ না তুই মুখ ফুটে মা’কে বলছিস ততক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে খাপটি মেরে মা থাকবে তোর মুখ ফোটার অপেক্ষায়। আগ বাড়িয়ে জেনেও বা কি লাভ। এখন বাধা দিয়েও তো কোন কাজ হবে না। যা সিদ্ধান্ত তো তুই নিয়েই ফেলেছিস। আর পিছিয়ে আসার কোন রাস্তা নেই।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়েছে অখিল। মোহন গোড়ে যা টাকা দেবে বলেছিল তার থেকে একটু বেশি টাকা দিয়েছে। ওর কাজে খুশি হয়েই দিয়েছে। মাইনেটা দেবার সময় একথা তাকে বলেছে। অখিলও মনে মনে আনন্দ পেয়েছে, তার কাজের জন্যে সে পুরস্কৃত হয়েছে। তার জীবনের প্রথম আয়ের টাকার একটা পয়সা সে খরচ করবে না। সবটাই মায়ের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু কি বলে সে মা’কে টাকাটা দেবে? সে তো মায়ের সঙ্গে শঠতা করেছে। মা’কে না জানিয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগেছে পয়সা রোজগারের জন্যে। সংসারের একটু সুসার হবার জন্যে। মায়ের হাড়ভাঙা কষ্ট লাঘব করার জন্যে। মা’কে বলবে, আর তোমাকে লোকের বাড়ি ঝি খাটতে যেতে হবে না, মা। আমার বড়ই শরমে লাগে। এখন আমি রোজগার করছি আর তুমি টুকটাক কিছু করলে দু’জনের চলে যাবে। পরে আরও বেশি আয় করতে পারলে তখন তোমাকে বাড়ির বাইরে রোজগারের জন্যে বেরোতে দেব না আমি। তুমি দেখে নিও মা, আমি একদিন তোমার সংসারে আলো ফুটিয়ে তুলবই। সেই জেদ এখন অখিলের মনে সবমসয় কাজ করে চলে।[চব্বিশ]
স্টেশনের সেই লোকটার কথামত মেপে মেপে এগিয়ে সনাতনরা দুটো চা দোকানের মাঝের ফাঁকটায় কালো পলিথিন পর্দার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা ইতস্তত করে পর্দা সরিয়ে সটান ভেতরে চলে যাবে, না এই চা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করবে? কি করবে ঠিক করতে পারছিল না। ওদের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে দোকানদার বলল, “কি ব্যাপার, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন, কোথায় যাবেন? ওদিকে কিছু নেই। এদিকে আসুন। এদিকে আসুন। চা খাবেন তো দোকানের সামনে দাঁড়ান।” সঙ্গে সঙ্গে রতন দোকানদারটার কথা লুফে নিল, “হ্যাঁ, দিন তো আমাদের দু’কাপ চা আর দুটো করে টোস্ট বিস্কুট। চা-টা একটু কড়া করে বানাবেন।” বলে সে মনে মনে ভাবল,চা খেতে খেতে দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করে না হয় ছেনো স্যারের ডেরার কথা জানতে চাইলে ভাল হবে। ভাল মুখে তখন দোকানদারটা তাদের সঙ্গে কথা বলবে। না হলে শুকনো মুখে কে আর ভালো কথা বলতে চায়। ওই শুকনো কথাই ঠিকরে বার হবে। এবার ছেলেকে বলে,“নে বাবা, অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সেই সাত সকালে যা কচুড়ি ঘুঘনি আর চা খেয়েছিলাম। একটু চা বিস্কুট খেয়ে গলা ভেজাই।” চা খেতে খেতে রতন দোকানদারের কানের কাছে মুখটা বাড়িয়ে বলল,“দাদা, ছেনো স্যারের অফিসটা এইদিকে পড়বে? পর্দা সরিয়ে এই গলির ভেতরে না?” দোকানদারটা আরও দুটো খদ্দের ছাড়তে ব্যস্ত তখন। কোন কথা বলল না। রতনদেরও তখন চা খাওয়া শেষ হয়নি। যেই রতনরা চায়ের খুরি রাখার ভাঙা বালতিতে টং করে ছুঁড়ে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে সে ইশারা করে পর্দাটা সরিয়ে হাতছানি দিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একেবারে ছেনোর ডেরার দাবায় তুলে দিয়ে তড়কো পায়ে চলে এল। রতন পেছন ফিরে তাকে দেখতে গিয়ে দেখে সে একেবারে সেই কালো পর্দার কাছে পৌঁছে গেছে। ভাবছিল, লোকটাকে বলবে, ছোনো স্যারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার কথা। তা আর হল না। ভ্যাবাচ্যাকা মেরে দাবায় দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে ভেতর থেকে ছেনোর এক স্যাঙাৎ হাঁক পাড়ল, “কে, কি দরকার? নতুন মুরগি মনে হচ্ছে? বাইরে না, স্যার ভেতরে। ভেতরে এসো। এই যে আমাদের ছেনো স্যার। সিংহাসনে আসীন। কি আর্জি তোমার জানাও। মঞ্জুর হলে, মাল ঠেকাও, নাম্বার নিয়ে কেটে পড়ো। কোন রাখ- রাখ ঢাক-ঢাক ছেনো স্যারের কাছে নেই। সাফ-সাফ কথা ফটাফট কাজ। কাজ শেষ, ফুটে যাও।”
রতনদের সব কথা শুনে ক্ষেপে লাল হাতকাটা ছেনো মস্তান! চোখ পাকিয়ে বলে, “তোমাদের এত বড় সাহস, কোন হাভাতে গাঁ থেকে শহরে এসে আবার আমার অনুমতি পাওয়া পাবলিকের সঙ্গে মারপিট করতে যাও? সত্যিই তোমাদের কপাল ভালো, তারা আমার এখানে এসে কমপ্লেন করেনি। ওরা তো ওর ঠোঁট ফাটিয়েছে। আমার লোক গেলে তো হাত পা গুঁড়ো করে হসপিটালের সামনে ফেলে রেখে দিয়ে আসতো। তা এখানে এই প্রথম বুঝি? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। নিয়মকানুন জানে না বলেই লড়াই করার সাহস দেখিয়েছে। প্রথম বছর খাতায় নাম তোলার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা। তারপর প্রত্যেক বছর নম্বর নেবার জন্যে দু’হাজার করে দিতে হবে। না হলে পুজোয় এই শিয়ালদা স্টেশনে কারোর বসার আইন নেই। এখানে ছেনোর কথাই আইন। আর ছেনোর কথাই শেষ কথা। কোন পুলিশের বাপের সাহস নেই এখানে নাক গলায়। পুলিশের বাবার সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থা করা আছে। এই টাকা আমরা একা খাই না। ধাপে ধাপে নীচ থেকে মাথা পর্যন্ত সকলকে হিস্সা ঠেকিয়ে আমাদের খেতে হয়। তাই খরচা একটু বেশি পড়ে যায়। কিন্তু এতে আমাদের কিছু করার নেই।”
হাতকাটা ছেনো মস্তানের কথায় বোবা মেরে যায় রতন। বড় বড় চোখে অবাক হয়ে ছেনোর দিকে তাকিয়ে থাকে সনাতন! মনে মনে ভাবে, এরা মানুষ, না মানুষের পোষাকে একদল অমানুষ বিচরণ করছে। রতনের চোখ টলটলে জলে ভরে যায়, “বাবু আমি কোথায় পাবো অত টাকা! ওই টাকা যদি আমার থাকবে তো এত কষ্ট করে এখানে আসবো কেন দু’পায়সা রোজগার করতে? আমাদের বাপ ছেলেকে কেটে ফেললেও দু’হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। তার থেকে আবার আজকের পথ খরচ আর চা জলখাবার খেতে কিছু খরচ হয়ে গেছে। জানা ছিল না। তাহলে হয়তো ঘটিবাটি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে এখানে আসতাম। এবারটা মাপ করে দিন, স্যার। কথা দিচ্ছি, সামনের সালে এসে বাকি টাকা সমেত সবটাই মিটিয়ে দেব। বায়না না পাওয়া পর্যন্ত খাইদাই ইত্যাদির খরচা আছে। সেটুকু বাদ দিয়ে যা আছে তা না হয় দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে একটা নম্বর দিন স্যার। সেই সকাল সাতটা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে। কাজের কাজ কিছুই করতে পারলাম না। আপনি যদি দয়া করেন তো!”
রতনের কথা থামিয়ে আরও কড়া সুরে ছেনো বলে,“সব শালা শুয়োরের বাচ্চা প্রথম এসে এমন কাঁদুনি গায়। আগে ওই কাঁদুনিতে গলে গিয়ে অনেক ঠকেছি। আর না। শালা মাগির পো’রা বড় পার্টি ধরে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে পরের বছর আর এ চত্বর মাড়ায় না। সরাসরি সেই প্যান্ডেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফায়দা খেয়ে যাচ্ছে। আর আমরা আঙুল চুষছি। কোন প্যান্ডেলে কে যাচ্ছে তা তো আমাদের চৌকি দেওয়া কাজ নয়। এটা আমার এলাকা আমার কথাই শেষ কথা। অন্য এলাকায় আমার খবরদারি চলবে কেন। ঝাড় খেয়ে যেতে হবে না? অতএব যা হবে পাকাপাকি হবে। নগদানগদি হবে। ধারবাকির খপ্পরে আর ছেনো পড়ে না। তুমি বুড়ো, এই শর্তে যদি রাজি থাকো মাল ফেল, নাম্বার নাও। না তো এক্ষুণি কেটে পড়ো। সামনের বছর মাল জোগাড় করে আসবে নম্বর পাবে। নিয়ম তো এখন জেনে গেলে। অপেক্ষা করো একটা বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। বেশিরভাগ ধূর পার্টি তাই করে। তোমরাও করবে। যাও, ফোটো। আমার অনেক কাজ আছে। তোমার সঙ্গে ভ্যাজর ভ্যাজর করলে আমার চলবে না।”
হাতকাটা ছেনোর ডেরায় দরকষাকষি করতে করতে কখন সন্ধ্যা নেবে গেছে বুঝতে পারেনি রতন। বাইরে বেরিয়ে দেখে দিনমান গ্রাস করে নিয়েছে কোলকাতার বিজলি আলোগুলো। এখন ওরা কোথায় যাবে? আর তো বাড়ি ফেরার উপায় নেই। রাতটা এখানে কোথাও পার করতে হবে। রতনের মনে হল, ওই নম্বারওলা ঢাকিরা তো বাড়ি যাবে না। এখানে কোথাও থাকবে। দূর থেকে তক্কে থাকবে কোথায় ওরা রাত কাটায়। হাতকাটা ছেনোর থেকে নম্বর নিয়েছে নিজেদের বিকানোর জন্যে। রাত কাটাকানোর জন্যে আবার কোন ছেনো মস্তানের দয়ার খপ্পরে পড়তে হবে কি না কে জানে! স্টেশনের ওদিকে গিয়ে দেখল, এলাকা আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। যত রাত বাড়ছে স্টেশনের ভেতর চত্বরে সাধারণ যাত্রীর ভিড় পাতলা হচ্ছে। সেই পাতলা হওয়া স্টেশনের মেঝে চলে যাচ্ছে এলাকার যত ঠাঁইহীনদের দখলে। ঢাকি ঢোলিদের মিছিলও সেদিকে ধেয়ে চলেছে। রতন বলল,“চল সনাতন আগে স্টেশনের মেঝেয় আমরা সকালের মত দখল করি। তারপর দেখা যাক কি হয় না হয়। মনে হয় এখানে ছেনোর কারসাজি নেই। কেননা এখানে তাদের জাতের লোক ছাড়াও অন্য জাতের লোকের ভিড় কম নয়। এই স্টেশনের ছাউনি কত নিরাশ্রয় মানুষের রাতের আশ্রয়স্থল। ভিখিরি ভবঘুরে পাগল-ছাগল চোর-ছিনতাইবাজ, ফেরেপবাজ- সব জাতের মানুষ এই আশ্রয়স্থলে এসে একাকার হয়ে যায় যেন।
টিকিট ক্ষেত্রের বাইরে, যেখানে টিকিট কাউন্টার, টী-স্টল ইত্যাদি আছে তার বিশাল দৈত্যাকার ছাদের তলায় একটা চওড়া পিলারকে ঠেকনা নিয়ে বসে রতনরা। ওদের আগে আরও অনেকে ইতিমধ্যে জায়গা দখল করে বসে গেছে। রাত তখন দশটা। খিদেতে পেটটা মোচড় দিচ্ছে। ওর খিদে লেগেছে মানে ছেলেটারও তো তাই হবার কথা। উঠতি কাঁচা বয়সের ছেলে। ওদের খিদে আরও বেশি হবার কথা। কিন্তু এমন ছেলে, কোন সময় মুখফুটে বলবে না যে তার খিদে পেয়েছে। অথচ খেতে দিলে না করবে না। গোগ্রাসে খেয়ে নেবে। আসলে ও চায় না ওর কারণে ওর বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ুক। চাহিদাকে ঘাড় মুড়ে দমিয়ে রাখতে ওস্তাদ ছেলেটা! রতন বলল, “খোকা, আমি এখানে এগুলো পাহারা দিচ্ছি। এই নে পয়সা। তুই এক ছুটে গিয়ে দু’জনের জন্যে ওই সামনের দোকান থেকে তড়কা-রুটি নিয়ে চলে আয়। দেরি করবি না। তাহলে আমি আবার চিন্তায় পড়ে যাব। বিদেশ বিভুঁইয়ে পদে পদে বিপদ মুখিয়ে আছে হামলে পড়ার জন্যে। যা, যাবি আর আসবি। আর একটা জলের বোতল নিস।” একটু থেমে আবার বলে,“না, থাক। ওই জলের ট্যাপ দেখা যাচ্ছে। জলের কাজটা ওখান থেকেই সেরে নেব। আলতু ফালতু পয়সা খরচ করলে হবে না। অসময়ের জন্যে টাকা সাশ্রয় করে রাখা দরকার।”
রাত সাড়ে বারোটা। চোখে ঘুম নেই। আতঙ্ক যদি প্রতি মুহূর্তকে গ্রাস করে রাখে তো ঘুম আসবে কেমন করে ! একটা মেল ট্রেন বিকট একটা ভোঁ-ও দিয়ে ন’নাম্বার স্টেশনে এসে থামলো। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে স্টেশন চত্বরের এই বিশাল অংশ দখল করে রাখা রাতের আশ্রিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ! কাঁইমাই, হই হই, বাবা গো মেরো না উঠে যাচ্ছি বলে সমবেত একটা শব্দঝড় গোটা এলাকাকে ত্রস্ত করে তুলল। কাঁচা ঘুমভাঙা মানুষরা যে যার মত তল্পিতল্পা নিয়ে স্টেশনের বাইরে ফাঁকা জায়গাটায় এসে জড়ো হতে থাকে। তখনও পুলিশ তাদের দিকে আসেনি। আতঙ্কতাড়িত রতনরাও তখন ত্রাহি ত্রাহি রবে ছুটে বেরিয়ে পড়ে। দূর থেকে দেখে তাদের ওদিকে পুলিশ গেল না। যারা নিত্যদিনের আশ্রিত তারা কিন্তু ওই এলাকা থেকে উঠল না। ওরা এসবে অভিজ্ঞ। পুলিশ কোন দিক থেকে কতটা রাস্তা ফাঁকা করবে তা তাদের জানা। ওই ফাঁকা করা জায়গা মেল ট্রেনের যাত্রীদের যাওয়া আসার রাস্তা করে দেওয়া হল। রেল কোম্পানীর কাছে এই আশ্রয় নেওয়া বিনি পয়সার লোকেদের থেকে পয়সা দিয়ে আসা যাত্রীদের স্বচ্ছন্দটার দেখভাল করা জরুরী। তাই এই ব্যবস্থা। আনকোরা রতনদের তা অজানা। তাই তারা পলিয়ে যায়। আধ ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এলে রতন ফিরে আসে। কিন্তু অচিরেই যে তাদের ছেড়ে আসা শূন্য জায়গা বেদখল হয়ে যাবে তা তারা ভাবেনি। এটাই যে পাবলিক প্লেসের আদত, তা তারা জানবে কেমন করে! জায়গাটা তাদের কাছে বেশ নিরাপদ আর স্বস্তিদায়ক ছিল। কিন্তু উপায় আর কই। বাধ্য হয়ে অন্যদের মত সেই পুলিশে খালি করে দেওয়া জায়গার আপাত নিরাপদ এক পিলারের কোণ তারা নির্দিষ্ট করে থিতু হয়। বেঁজির মত মুখ উঁচু করে মাঝে মাঝে দূরে প্লাটফর্মের দিকে তাকায় আর বসে থাকে। যদি আবার মেলগাড়ী ঢোকে তো পুলিশের তাড়া খাওয়ার আগেই পালাতে হবে। গড়িমসি করলেই পুলিশের রুলের ঘা, খাবারের মেনুর মত হজম করে নিতে হবে। জেনেবুঝে রতন তা করতে যাবে কেন? প্লাটফর্মের বড় ঘড়ির কাঁটা তখন দুটো পাঁচে এসে টিক করল। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটা মেয়ের চিৎকার, হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে এল ওদের এদিকে! এদিকে টপকে আরও ওইদিকে। ওইদিকের লোকেরাও বেঁজির মত মাথা উচিঁয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলল চিৎকারের উৎস খোঁজে! রতন বলল,“ওই দেখ খোকা, ওদিকে একটা মেয়ে কেমন অসহায়ের মত চিৎকার করে যাচ্ছে, বাঁচাও বাঁচাও বলে। নিশ্চয়ই ওর কোন বিপদ হয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে একদল লোকের সমবেত হইচই শুরু হয়ে গেল। সনাতন বাপকে কিছু না বলে দৌড় দিল ওইদিকে। রতনের ‘খোকা-খোকা’ চিৎকারে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! রতন পড়েছে মহা ফাঁপরে। এত মালপত্র ফেলে ও যেতেও পারছে না ছেলেকে সামলাবার জন্যে। এইসব আপাত শান্ত চরিত্রের ছেলেদের নিয়ে বাপ-মায়ের যেন বিড়ম্বনার শেষ নেই। হঠাৎ কি দেখল না দেখল, মাথায় এমন পোকা কিলবিল করে উঠল যে তার বাড় সামলানো দায় ! তার এই উৎকন্ঠা অবশ্য বেশিক্ষণ জিইয়ে রাখতে দেয়নি সনাতন। একটু পরেই ফিরে আসে, “জানো বাবা, কি বিচ্ছিরি অবস্থা! একটা কম বয়সী ভবঘুরে মেয়ের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর একটা ভবঘুরে। মেয়েটা তাকে চায় না আর সে বেপরোয়া। পুলিশ এসে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে যায়।” সনাতন বাপকে গপ্প শুনিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলে কি হবে, রতনের রাগ কিন্তু কমে না,“তুই হুট করে আমাকে কিছু না বলে ওদিকে ছুট মারলি? মনে হচ্ছে যেন এইসব পরিবেশ পরিস্থিতির সবটাই তোর জানা? আমার নিষেধকে পাত্তাই দিলি না? যদি অঘটন কিছু ঘটে যায় তখন আমি পারবো সামলাতে? এইভাবে আমার কথা না শুনে এদিক ওদিক চলে যাস না। তোকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয়। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মায়ের কাছে কি কৈফিয়ৎ দেব? আমিও যে জীবনযুদ্ধে হেরে ভূত হয়ে যাবো।”
-ভুল হয়ে গেছে বাবা। আর এমন হবে না। তুমি দুঃখ পেও না। যা করব, তোমার পরামর্শ নিয়েই করব।
তাদের কাছাকাছি, একটু তফাতে। হঠাৎ একটা লোক উঠে পড়ে চোর চোর বলে একজনকে তাড়া করে ছুটছে, “আমার ব্যাগ ফেরত দে, ফেরত দে বলছি। না হলে তোর কপালে বহুৎ কষ্ট আছে !” অবস্থা বেগতিক দেখে চোরটা লোকটার ব্যাগ ফেলে ছুট মারে। আশেপাশে যত লোক ঘুমিয়ে বা শুয়ে ছিল সবাই তঠস্থ হয়ে উঠে বসে পড়ল। সনাতন বলল,“বাবা এখন বুঝতে পারছি, কেন তুমি সবসময় আমাদের ব্যাগ-প্যাঁটরা সামলে রাখতে বলো। এখন তো তাই দেখলাম। একটু অসতর্ক হলেই আমাদের জিনিস আর আমাদের থাকবে না। চোর ছিনতাইবাজদের দখলে চলে যাবে। কি আজব এইসব জায়গা! এখানে ভাগ্য বিড়ম্বনায় না এসে পড়লে জানাই হতো না এমন পৃথিবীর কথা ! এরকম আরও কত অজানা পৃথিবী আমাদের দেখতে হবে কে জানে!”
সারা রাত তো রতন-সনাতন দু’বাপবেটা দু’চোখ বুজিয়ে শরীরকে থিতু করতে পারল না। বড় ঘড়িতে চোখ পড়তে সনাতন দেখে ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে তিনটে থেকে হেলিয়ে তিনটে পঁয়ত্রিশের দিকে এগোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবাকে বলল,“বাবা একটু পরেই আজকের সূর্য জন্ম নেবে। আমাদের তো তৈরী হতে হবে। কখন পুলিশ তাড়া করবে জানি না। এইবেলা আমি দেখে আসব, কোথায় বাথরুম পায়খানা আছে? ভোররাতে সবাই ঘুমে মশগুল। এখন কোথাও ঠোক্কর না খেয়ে সবটা ঘুরেঘারে দেখে নেওয়া যাবে।” ঠিক সেইসময় সেই পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের ওপ্রান্ত থেকে একটা সুরেলা মেয়েলী কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে,“আমার রাত পোহালো …!” ধীরে ধীরে সুরটা মনে হচ্ছে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। থমকে গেল সনাতন। আহা, কি অপূর্ব কন্ঠ! দু-পা এগিয়ে দেখতে গেল কে গানটা গাইছে! সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা পেছন থেকে তার জামা টেনে ধরে বলল, “এগিয়ে গিয়ে দেখার কি আছে। ও তো এদিকেই আসছে। বস এখানে চুপচাপ!” বলে রতন নিজেও বসল এবং ছেলেকেও টেনে বসিয়ে দিল। এখন গোটা এলাকা শান্ত নিশ্চল। মনে হচ্ছে যেন চরাচর মোহিত হয়ে রয়েছে এই সুরসাগরে অবগাহন করে। একটা শতচ্ছিন্ন মলিন বেশের মেয়ে। সবাই তো একে পাগল বলবে। কিন্তু এ কি সত্যিই পাগল? পাগল আবার এত নিখুঁতভাবে গান গাইতে পারে নাকি! হয়তো পারে। তাই হয়তো এত অনিয়ম অনাচারের মলিনতার উপর এই সুর, শুদ্ধতার প্রলেপ দিয়ে চরাচরে সমতার বার্তা দিয়ে যায়। সনাতন বলে, “এবার যাই বাবা। দেখে আসি কোথায় বাথরুম পায়খানা আছে। এগুলো সেরে একেবারে আমরা এখানে থেকে বেরিয়ে যাব।” সঙ্গে সঙ্গে ওর মন ভেতর থেকে তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “কোথায় যাব আমরা?” তা তো তার জানা নেই ! তবে সে এটা নিশ্চিত করেছে যে এখান থেকে বেরিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না। লড়াই তো তার শেষ হয়নি। লড়াইয়ের ময়দান এখনো তাদের জন্যে উন্মুক্ত আছে। হারা বা জেতা, দুটোর কোনটা না দেখে তো তার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সে ফিরবে না।
পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বাথরুমের কাজ সেরে চানঘরে চানটান করে রতন সনাতন বেরিয়ে পড়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে। বড় ঘড়িতে তখন সকাল পাঁচটা। প্লাটফর্মের বাইরে বিশাল বিশাল সিঁড়ি নেমে গেছে সামনের বিশাল চাতালে পা দেবার জন্যে। যেখানে গতকাল সারাদিন তারা নিজেদের জায়গা
করে নেবার জন্যে লড়াই করে ব্যর্থ হয়। সিঁড়ির দু’ধাপ নেমে খানিক ডানদিক সরে নিরাপদ ধাপে এসে ওদের ঢাক-ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে বসে সনাতনরা। সিঁড়ির এই জায়গা দিয়ে যাতে বাধাহীন ওঠানামা করা যায় সেদিকটা খেয়াল রেখে মালপত্র রাখে ওরা। টিকিট কাউন্টারের ঘর, অনুসন্ধান অফিসঘর এই ধাপের সোজাসুজি। ফলে মানুষের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এখান দিয়ে নামার উপায় নেই। এখানে বসলে কাউকে নামা ওঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে হয় না। ফলে অকেজো সব্বাই এখানে এসে বসে অক্লেশে সময়কে গিলে খেতে পারে। আরও প্রায় ঘন্টাখানেক এখানে কাটিয়ে রতন বলল,“চল খোকা, এবার একটু চা জলখাবার খেয়ে নেওয়া যাক। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওদিকের চা-কচুরির দোকান খুলে গেছে।” বাবার কথামত সনাতন প্রস্তুত হচ্ছিল গোছগাছ করে সব জিনিসপত্র নিয়ে নেবার জন্যে। ঠিক সেইসময় পেছন থেকে একজনের কর্কশ গলার স্বর ঠিকরে এল তাদের দিকে, “ভেবেছিলে তোমাদের আমরা চিনতে পারব না! ছেনো স্যারের দলবল একবার যাকে দেখে, তার থোবড়া দ্বিতীয়বার দেখার দরকার করে না। সেই থোবড়া তাদের খুপরিতে পাকাপাকিভাবে গেঁথে যায়। উবে যাবার উপায় থাকে না। তোরা এখনো এখানে ঘুরঘুর করছিস? কালই তো ছেনো স্যার তোদের এলাকা ছাড়তে বলেছিল। আবার বুঝি জায়গা দখলের ধান্দা করছিস?” রতন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কথা ফোটার আগেই লোকটা বলল, “চোপ শালা! গাওনা গাওয়ার জায়গা পাওনা। এসব বাহানা জেনে বুঝে আমরা পাকা খয়ের হয়ে গেছি। ছেনো স্যার ঠিক বলেছে। বলেছে, আয়-তো একবার এলাকাটা টহল মেরে। কোন শালা পুঁটির বাচ্চা ধান্দা করার ফিকির করছে কি না? স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল! শালা বক-তপস্যির মত ওত পেতে আছিস! কখন সুযোগ পাবো। জায়গা দখল করব, এ্যাঁ? দশ গুনবো। এর মধ্যে এলাকা ছাড়া না হলে বাপ-বেটাকে কেলিয়ে কোমর ভেঙে ডাস্টবিনে ফেলে দেবো। কোন বাপের বেটা তোদের রক্ষা করতে আসবে না। যা শালা!” বলেই আরও গলার স্বর চড়িয়ে এক দুই করে কড় গুনতে শুরু করে লোকটা! আর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারা ছিল তারা ঠায় তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উপভোগ করছে কেমন তৎপরতায় তারা তামতুড়কি নিয়ে সরে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ওরা কত জঘন্য অপরাধে অপরাধী! মরমে যেন মরে যাচ্ছে সনাতন! তারা তো কারোর ক্ষতি করার জন্যে এখানে আসেনি। এখন এখানে বসেও নেই। অথচ কেমনভাবে তীব্র অপমানে বিধ্বস্ত হতে হচ্ছে তাদের। কাদের কাছে? না যারা ঘোষিত সমাজবিরোধী, তাদের কাছে। তার জীবনে এর চেয়ে খারাপ দিন আর আসবে বলে মনে হয় না। তাদের গ্রাম জীবনে অনেক অভাব অনটন আছে। পাশের বাড়ি বা পাড়ার কারোর সঙ্গে খিটিমিটি আছে। পরস্পরের মধ্যে মারামারির ঘটনাও আছে। আবার সমাধানও আছে। দুই বিবাদী পক্ষের মধ্যে মিলমিশেরও বিধান আছে। কিন্তু নিজের চরিত্রের এমন অবদমন সেখানে কোথাও নেই। মনের মধ্যে এমন সব কষ্টের বোঝা বইতে বইতে ওরা শিয়ালদা স্টেশন এলাকা ছেড়ে বাসস্টপের কাছে এসে দাঁড়ায়। বাবা বলেছিল, চা-জলখাবার খাবার কথা। কিন্তু দুর্বিসহ এই পরিস্থিতিতে সেই খাবার ইচ্ছে একদম উধাও হয়ে গেল। বাবাও আর সেকথা মুখে আনছে না। বাবা যেন একদম গুম হয়ে গেছে। মুখে স্বর চলে না। তার চেয়েও মনে হয় আরও বেশি আঘাত পেয়েছে বাবা। পাবেই তো। যে মানুষটা গ্রামে এত সম্মান পায়। অন্যের অন্যায়ের ন্যায্য বিচার দেবার ব্রতে ব্রতী অহরহ। সেই মানুষটাকে সমাজের একজন নিকৃষ্টতম অপরাধী প্রকাশ্য জনসমক্ষে ন্যায়ের বিধান দিয়ে অপমানে ভূতলে মিশিয়ে দেয়! তার মন কেমন করে শক্ত থাকবে। ভেঙে চুরমার তো হবেই।
বাসস্টপে কতক্ষণ ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারল না। বাবা ঢাক কাঁধে আর ও ব্যাগ-প্যাঁটরা কাঁধে। কাঁধ যে টনটন করছে। এবার বাবা বলল, “চল বাপ, বাবুঘাটের বাস ধরি। বাড়ি যাই। আমাদের মত লোকের জন্যে কোলকাতা নয় রে বাপ।” বাবার এই কথাগুলোর মধ্যে যেন মনঃস্তাপের ঝরণা ঝরে পড়ছিল। সনাতন এই ঝরণার জল মাটিতে ফেলতে চায় না। তাতে যে ধরিত্রি মায়ের অকল্যাণ হবে। তাই বাবার মনঃস্তাপ নিজে গলাধ্যকরণ করে বলল, “আমরা বাড়ি যাবো না বাবা। পুজোর এখনো দু’দিন বাকি। বাড়ি যাবার সময় পেরিয়ে যায়নি। চলো, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের দিকে এগোই।”
শিয়ালদহ থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে ওরা কলেজস্ট্রীটের দিকে এগোতে থাকে। এই রাস্তার কোথায় কি আছে তা কিন্তু বাপ-বেটা কারোর জানা নেই। অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে সময়কে ছেড়ে দিয়ে হাঁটা চলতে থাকে। চলতে চলতে সনাতন অন্য কথা ভাবতে থাকে। তারা যদি হেরে গিয়ে বাড়ি ফিরে যায় তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ওই শয়তান, অভয়! সনাতন এখন নিশ্চিত, অভয় সবকিছু জেনেবুঝেই তাদের এই গোলকধাঁধার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ও চেয়েছে এরা বিপদে পড়ুক। আর একেবারে নাস্তানাবুদ বিপর্যস্ত হয়ে গ্রামে ফিরে আসুক। অভয়ের এই দুর্বুদ্ধির কারণও এখন সনাতনের কাছে পরিস্কার। বাবা অতটা তলিয়ে হয়তো দেখছে না। তাই এই ভাবনা বাবার মধ্যে হয়তো কাজ করছে না। পাড়ার আটচালার বিচারক দলে তার বাবা। বরং বলা যায় বিচার-কর্তা। বিচারকদের অনেকে অনেক মন্তব্য করে আলোচনার সময়। কিন্তু বাবার কথাই শেষপর্যন্ত সেখানে সাব্যস্ত হয়। বিচারের ফল তো যে পক্ষে যাবে সে বা তারা খুশি হবে। আর বিপক্ষের লোক অখুশি তো হবেই। এই অখুশির লোকগুলোর কাছে বিচারকরা নিশ্চয়ই আদর পাবে না। মনে মনে তাদের উপর রাগ পোষণ করে থাকবে। এমন কোন বিচারে অভয়রা নিশ্চয়ই হারের দলে কোনসময় পড়েছে। সুযোগ বুঝে ও বিচারক কর্তা, রতন রুইদাসকে ফাঁপরে ফেলতে এমন ফন্দি এঁটেছে। সনাতনের এই ভাবনা অন্যথা হবার নয়। কিন্তু ও কিছুতেই অভয়ের কাছে তার বাবার মাথা নীচু করতে দেবে না। এক অর্থে হয়তো অভয় সাফল্য পেয়েছে তাদের এই অপদস্ত হওয়ার ঘটনায়। কিন্তু তা তো সে জানতে পারেনি। অসময়ে বাড়ি ফিরলে তখন সে নিশ্চিত হয়ে যাবে, তার চাতুরি কাজ দিয়েছে। কিন্তু তারা তো কারোর কোনদিন ক্ষতি করেনি এবং বাবা কোনদিন অন্যায় কোন কাজ করেনি। মা শীতলা এই অসময়ে নিশ্চয়ই তাদের পক্ষে থাকবে। এ’ব্যাপারে সনাতনের বিশ্বাস অটুট। হার মানার জন্যে সে লড়াইয়ের ময়দানে নামেনি। সাফল্যের মুখ তাকে দেখতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা চারমাথার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করে বাঁদিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে চলল। সাইনবোর্ড দেখে ওর মন পুলকে ভরে উঠল। কলেজস্ট্রীট এটা! এখানে তাহলে যাবতীয় বই পাওয়া যায়! বাঃ কি মজা। এই নামটা কতবার তার স্বপ্নে ঘোরাফেরা করেছে। তার সব পড়ার বই, গল্পের বই, বড়বড় সাহিত্যিকের গল্প উপন্যাসের বই- সব, সব এখানে মেলে। যা বই চাইবে সব পাবে। যদি কোনদিন বড় হয় তো সে এখানে আসবেই। রোজগার করে প্রাণ খুলে মনের মত বই কিনবে। একটু এগোতেই ডানদিকে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি! তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ! তারপর হেয়ার স্কুল! এই সবকটাই সে ইতিহাসের বইয়ে পড়েছে। আর সেই সাধনার ধন তার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে! হেয়ার স্কুলের গা ধরেই আবার কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল। ইতিহাসখ্যাত এই হাসপাতালে কত মানুষ গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আসে চিকিৎসা করাতে। বাবাকে দেখিয়ে বলল, “দেখো বাবা। এটা মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল। মানুষের বড় কোন অসুখ হলে এখানে সামান্য খরচে বা বিনা পয়সায় ভর্তি হওয়া যায়। গরিব মানুষরা সব এখানে আসে অসুখ সারাতে।
একটা বড় মোড়ে এসে দাঁড়ালো ওরা। কোথাও লেখা বউবাজার মোড়, কোথাও বি.বি.গাঙ্গুলী স্ট্রীট ! জায়গাটা একটু প্রশস্ত মত। সামনের দিকে একটু দূরে একটা পুজোর প্যান্ডেল। রতন বলল, “বাবা, খিদে পেয়েছে। অনেকটা পথ হেঁটে শরীর আনচান করছে। চলো না, ওই দিকটায় যাই। ওখানে ফুটপাথে লুচি ভাজা হচ্ছে। লুচি-চা একটু খেয়ে নিই।” রতন এখন ছেলের ইচ্ছেকে সম্বল করে মন্ত্রপুতের মত পথ চলছে। তেমন কিছু কথা না বলে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। টিফিন সেরে আবার সেই চারমাথার মোড়ের প্রশস্ত জায়গার একটা নিরাপদ কোনমোচড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পোঁটলার ভেতর থেকে মলিন জলের বোতলটা বার করে দু’জনেই ঢকঢক করে জল খেয়ে তেষ্টা মিটিয়ে ছাতিকে শান্ত করল। সনাতন বলল,“বাবা, ঢাকের কাঠি বার করো। এখানে আমরা ঢাক বাজাবো। তোমার সেরা বাজনা এখানে তুমি বাজাবে। সেই তালে সঙ্গত দিয়ে আমি কাঁশিতে তাল মেলাবো। প্রথমে আগমনির তালে তাল ঠুকবে। মা দূর্গার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে হবে সেই তাল ঠোকা। আমাদের থামা চলবে না বাবা। কখন আমরা থামব তা আমরা নিজেরা আগে থেকে বলতে পারব না। আমরা যে জাত ঢাকি তা এলাকার মানুষকে বুজিয়ে দিতে হবে। হ্যাঁ এটাও ঠিক, শহর কোলকাতার কত মানুষ। কত ধরণের মনের চলাচল তাদের। অনেকে হয়তো বিরক্তও হবে। আবার যারা বোঝার তারা নিশ্চয়ই বুঝবে। বুঝলেই কদর করবে।
কতক্ষণ যে তারা এই ঢাক বাজিয়ে চলেছে তার হিসেব নেই। কেননা তাদের কাছে তো কোন ঘড়ি নেই। কাঁসর বাজাতে বাজাতে সনাতনের আঙুলে ফোসকা পড়ে তা আবার গেলে গিয়ে জ্বালা করতে শুরু করেছে। তবু সে থামার পাত্র নয়। একটা আঙুলের গলাসি দমে যায় তো আর একটা। তারপর আর একটা। একটার পর একটা তার অঙ্গ হার মানলেও মনকে কিছুতেই হারতে দিতে চায় না সে। বাবা তো পেশাদার মানুষ। সে জানে সারাদিন বাজাতে বললে বাবা না থেমেই বাজিয়ে যাবে। কিন্তু সে তো একদম আনকোরা। সবে বাবার কাছে কাঁসরের তালজ্ঞান শিখেছে। ঢাকের তালও শিখছে। পুরো শেখা শিখে উঠতে পারেনি। আরও সময় লাগবে।
একটা সময় হঠাৎ সাদা ধপধপে ট্রাউজার পাঞ্জাবী পরা তিনজন বাবুলোক পাশ থেকে এসে তাদের ঘিরে ধরে! সনাতনরা তো সাধনার নিষ্ঠায় নিজেদের তাল লয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। সামনে এসে কেউ দাঁড়ালে হয়তো তাদের দৃষ্টিগোচর হত। কিন্তু পাশ দিয়ে এসে অকস্মাৎ এমনভাবে দাঁড়াল, সনাতনরা দু’জনেই চমকে ওঠে! থেমে যায় তাদের বাজনা। একজন বাবু
বলল,“ঠিক আছে থামো থামো। অনেকক্ষণ ধরে তোমরা ঢাক বাজাচ্ছো। এবার একটু জিরোও। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সেই বেলা ন’টা থেকে তোমরা ঢাক বাজাচ্ছো। আমরা লক্ষ্য করছি। এতক্ষণ টানা কেউ ঢাক বাজাতে পারে তা তো আমাদের জানা ছিল না। তারপর ঢাকের তাল যে এত সুরেলা এবং স্যুদিং হতে পারে তাও তো আমাদের কল্পনার বাইরে। আমরা তো জানি ঢাক মানে শুধু ধ্যান তারাক্কা নাচের বাজনা আর আরতির বাজনা। এ
বাজনা কিসের বাজনা?” বাবুর প্রশ্নের উত্তরে রতন বিনয়ের সঙ্গে বলল,“বাবু এটা আগমনির বাজনা। মা দশভূজার আগমনকে স্বাগত জানাতে এই প্রার্থনার তাল। একমাত্র মা মর্ত্যে আসার মুহূর্তে এই বাজনা বাজানো যায়। অন্যসময় কেউ বাজায় না। যারা এই তাল বাজাতে জানে, এই ব্যাপারে তারা সতর্ক। যখন তখন বাজাবে না। এই সময়টা তো সবায়ের হয়ে ওঠে না। ঢাকিরাও সবসময় মুডে থাকে না। তাই হয়তো আপনাদের শোনা হয়ে ওঠেনি।” আর এক বাবু বলল,“তা তোমরা হঠাৎ এখানে ফুটে দাঁড়িয়ে বাজাতে এলে কেন? এখানে তো কেউ কোনদিন এভাবে ঢাক বাজাতে আসে না? আমাদের ওই হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের দূর্গা পূজা এই বছর পঁচাত্তরে পড়ল। আবাল্য আমরা কোনদিন তো দেখিনি, আমাদের আগের সিনিয়ররাও কেউ কোনদিন এখানে এভাবে বাজনা বাজাতে দেখেছে বলে মনে হয় না। আমরা তো তৈরী হচ্ছিলাম শিয়ালদা স্টেশনের ঢাকের ঠেকে যাবো বলে। ওখান থেকেই বরাবর আমরা ঢাকি বায়না করে আনি। তা তোমরা কোথা থেকে আসছো?”
-আমরা বাবু সেই ফলতা থানা এলাকা থেকে আসছি। এখানে এসে এই ফুটপাথে ঢাক বাজাবার জন্যে সেই সুদূর গাঁ থেকে আসিনি। এসেছিলাম আপনারা যেখান থেকে ঢাক বায়না করেন সেখানে। বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে রতনের। আর বলতে পারল না সেই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সনাতন শিয়ালদায় তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কান্ডগুলো সবিস্তারে বলতে, বাবুরা অবাক!
এক বাবু বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, “ওখানে এই গরিবগুর্বো মানুষদের নিয়ে সমাজবিরোধীরা এইভাবে নোংরামো করে? ঠিকই তো, এদের সঙ্গে পুলিশের এক শ্রেণীর অসাধু লোক যুক্ত না থাকলে এভাবে এরা ফুলেফেঁপে উঠতে পারে না। অথচ দেখো, আমরা প্রত্যেক বছর যাচ্ছি ঢাক-ঢোল বায়না করছি, পুজো করছি। মনে হচ্ছে যেন সবই কেমন স্বচ্ছ সরলরেখায় বয়ে চলেছে জীবনস্রোত! বাইরের এই স্বচ্ছতার অন্তরালে যে এমন নির্মম অস্বচ্ছ কালো আর এক বিবর্ণ স্রোত বয়ে চলেছে তা ক’জনেরই বা নজর কাড়ে। এরা এইভাবে এখানে এসে না পড়লে তো সমাজের এই মলিন দিকটা আমাদের জানা হয়ে উঠতো না।” এই বাবুর বলা শেষে প্রথম বাবু বলল,“তা তোমরা কি আমাদের হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজোর বাজনা বাজানোর বায়না নেবে? যদি নাও তো বলো। তোমাদেরকেই এ বছর আমরা নিয়ে যাব। শিয়ালদাতে যাব না।”
-আমরা তো বাবু বায়না পাবার জন্যেই মায়ের সাধনা করে চলেছিলাম। তা, মা আমাদের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে সাড়া দিয়েছে। আপনারা তো বাবু মায়ের
মাধ্যম হয়ে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। মায়ের আদেশ ফিরিয়ে দেবার স্পর্ধা আমাদের নেই বাবু।
-তুমি তো বেশ ভাল কথা বলতে পারো হে! পেটে কিছু না থাকলে এই জ্ঞান জন্মায় না। যাই হোক, তাহলে আসল কথাটা সেরে নেওয়া যাক। আমরা পাঁচদিনের জন্যে তোমাদের পাঁচ হাজার টাকা দেবো। ষষ্ঠী থেকে দশমী। আজকের পঞ্চমী। আজকের দিনের জন্যে তোমাদের কোন টাকা পয়সা দেবার অনুমতি আমাদের নেই। আর আমাদের দর্শক এবং পাড়ার অধিবাসীদের যদি তোমরা তোমাদের হাতযশে মাতিয়ে দিতে পারো তো যথেষ্ট পরিমান বকশিশ পড়েই রইল তোমাদের জন্যে। ওটা তোমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব পাওনা। ওখানে কেউ ভাগ বসাতে যাবে না। তবে আজকের থাকা খাওয়াটা তোমরা আমাদের থেকে পাবে। কোন অসুবিধা হবে না। আর পারলে সন্ধ্যের দিকে একটু আগমনির বাজনা শুনিয়ো আমাদের পাড়ার মানুষজনের। মনে হচ্ছে তোমাদের হাত ধরে আমাদের এবারের পুজো ভালই হবে। এবার কাজের জায়গায় তোমাদের দক্ষতা দেখতে চাই।[ পঁচিশ ]
সময়ের সঙ্গে সখ্যতা করতে করতে জীবনযুদ্ধে দাঁড় টেনে অখিলও এগিয়ে চলেছে। মায়ের পুরোপুরি হাতেধরা হয়ে গেছে ও। আর মা’কে লোকের বাড়ি কাজে যেতে দেয় না। ওর হাত ধরে মোহন গোড়ের ব্যবসা এখন রমরমা। মোহন গোড়ে, ওর কারবার পরিচালনায় অনেকটাই অখিলের ওপর নির্ভর করে। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে একদিন মোহন বলল,“অখিল তুই এক কাজ কর। কতদিন আর আমার কারবারের মুখের দিকে চেয়ে তুই দিন কাটাবি। আমারও তো বয়স হচ্ছে। আমার সঙ্গে তুইও নতুন একটা ব্যবসা খুলে বস। আমার, তোর- দুটো কারবার দেখভাল কর। তাহলে আমরা দু’জনেই দুই কারবারের মালিক হবো। অথচ দু’জনে একসাথে কাজ করবো। বুঝতে পারলি না তো আমার কথা? শোন তবে তোকে খুলে বলি। আমার কারখানার বাইরে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে বসে যে মেয়েরা শোলার কাজ করতে পারে তা তো আমার বুদ্ধিতে জন্মায়নি। আমরা শোলা তাদের ঘরে ঘরে বিনে পয়সায় সাপ্লাই দিয়ে আসি আর মেয়েরা বাড়িতে বসে ড্রয়ইং মত কাজ করে। যেমন কাজ তেমন মজুরী পায় তারা। সবটাই তোর মাথার ওই খুপরির কেরামতি। তোর জন্যেই আমার কারবারের এই বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু আমি আর এতবড় কারবার সামলাতে পারছি না। বুড়ো হয়েছি। কবে হঠাৎ যদি টপকে যাই ! তখন এত লোক সব জলে পড়ে হাবুডুবু খাবে। তাই বলি সময় থাকতে কারখানার বাইরের এই কারবারটা তুই স্বাধীনভাবে দেখাশোনা কর। কারবারের এই অংশের মালিক তুই হয়ে যা। আমি তোকে লিখে দিচ্ছি। বড়বাজার থেকে আমার সঙ্গে তোরও শোলা আসবে। তুই তোরটা নিয়ে বাড়িতে গুদাম করবি। সেখান থেকে কারিগর দিয়ে কাজ করে আবার আমার চালানের সঙ্গে না হয় তোর মালটাও যাবে। পরে আস্তে আস্তে তুই নিজে চালান করে মাল ডেলিভারী করবি।”
মোহন গোড়ের এই সিদ্ধান্ত অখিলের ভাগ্যের চলন নতুন অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্যের চাকা উত্তরোত্তর গড়গড়িয়ে এগোতে থাকে। নিজের পাড়া টপকে আশেপাশের গ্রামগুলোতেও বাড়িয়ে দেয় তার কারবারের বিস্তার। বছর দুয়েকের মধ্যে নিজের কারবারের নামে চালান কেটে মাল ডেলিভারীও করতে থাকে। তবে হ্যাঁ, তার কারবারের গুরু, মোহন গোড়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা পূর্ণ মাত্রায় বজায় থাকে। নিজের কারবারের সাথে সাথে গুরুর কারবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা সে কোনদিন ভাবেনি। ভাবলে তার দিক থেকে কোন বাধা ছিল না। বা মোহন গোড়ের কিছু করার ছিল না। কিন্তু সে তা করেনি। করলে গুরুর কারবারটাই বন্ধ হয়ে যেত। ও দুই জগতের একচ্ছত্রপতি মালিক বনে যেতে পারতো। কেননা মোহনের কোন ছেলে নেই। একটা মাত্র মেয়ে। বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেছে তার। বাইরের অজানা লোকেরা জানে অখিলই মোহনের ছেলে। কেননা গুরু লোকের কাছে কথায় কথায় অখিলকে তার ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাতে অবশ্য অখিলের কোন আপত্তি নেই। নিজের সন্তান জ্ঞানেই তো গুরু তাকে কারবার শিখিয়েছে, বড় করেছে। অখিলের মা চপলাও তাকে বলেছে,“যে মানুষটা তোর জীবনের আলো দেখিয়ে এগিয়ে দিয়েছে, তাকে কোনদিন পেছনে ফেলে যাসনি বাবা। তাহলে মহাকাল কোনদিন তোর কোন ক্ষতি করার জন্যে পিছু নেবে না। তুই মসৃণভাবে তোর পথে এগিয়ে যেতে পারবি।”
নিজের প্রচেষ্টায় নিজের রোজগারে দু’কামরা ঘর-বারান্দা নিয়ে অখিলের পাকা বাড়ি। স্বচ্ছলভাবেই মা-ছেলের দিন চলে যায়। পাড়ায়, বাইরের পাড়ায় মেয়েদের ঘরে বসে শোলার কাজ পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে অখিল। রোজগারের একটা পথ পেয়েছে মেয়েরা। অবসর সময় আর তাদের হেলায় কাটিয়ে দিতে হচ্ছে না। সেই পটভূমে পাড়ায় বে-পাড়ায় নারী মহলে এখন অখিলের নামডাক ভালই। একটা রেষারেষি ভাবও আছে এই মহলে, কে কেমনভাবে অখিলের কত কাছের লোক হতে পারে। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে যদি বাড়তি কাজ আদায় করে নিতে পারে। রোজগারটা তাহলে একটু বেশি হয়। অখিল এখন এদের আশা-ভরসার স্থল। তাই যে যার কোলে ঝোল টানার তাগিদেই এই পারস্পরিক প্রচেষ্টা।
মেয়ে মহলের এই আলোড়ন অখিল স্বজ্ঞানেই উপভোগ করে। পছন্দও করে। যত এরা তাকে বিষয় করে চর্চা করবে ততই তার নামডাক পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে। নিয়মের হাত ধরে তার আয়ের রাস্তাও বাড়তে থাকবে। অখিলের এখন আশেপাশের পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত। শোলার গাঁট পাঠানো আবার তা থেকে তৈরী টোপর, ঠাকুরের গয়না ডেলিভারি নিয়ে আসা। হিসেব করে কারিগরদের মজুরি দেওয়া। এতসব কাজ সুষ্ঠভাবে করতে গেলে ছুটোছুটি তো তাকে করতেই হবে। সাইকেল নিয়ে পোঁও পোঁও করে ঘুরে বেড়ানো তার নৈমিত্যিক কাজের মধ্যে পড়ে। অনেক কারিগর আবার কাজ করে দেবার শর্তে আগাম দাদনও নিয়ে নেয়। তবে অখিল তাদের কাছ থেকে সুদটুদ দাবি করে না। সেও তো একদিন এমন অভাবি ছিল। তাই সেই জ্বালার সঙ্গে সে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। কোন্ পরিস্থিতি মানুষকে কোন্ সর্বনাশা পাঁকে চুবিয়ে দেবে তা কেউ বলতে পারে না।
সবে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ির ঘর সংসার সামলাচ্ছে মন্ডল পাড়ায় তার কারিগর, ভীষ্ম মন্ডলের বউ, রেখা। কতদিন হবে বিয়ে, এগারো কি বারো মাস। তার মধ্যে অখিলের সঙ্গে কাজের সুবাদে আলাপ হয়তো মাস ছয়েক। ভীষ্ম, ওই সাইকেল ভ্যান টানে আর চাষের সময় জন খেটে খায়। ভরা শ্রাবণের ধারায় এলাকার পুকুর ঘাট ভরভরন্ত। উঁচু ডাঙা জায়গাগুলো যেটুকু জেগে আছে এই যা। সকাল সাতটায় চাষের কাজে হাজিরা দিতে হবে। ভোর ভোর উঠে তাই রোজই ঘুমচোখ কচলাতে কচলাতে বাঁশঝাড়ে বাহ্যে ফিরতে যায় ভীষ্ম। ভীষ্মর মত পাড়ার অনেক বেটাছেলে যায়। এটাই এইসব গ্রাম পাড়া এলাকার দস্তুর। বাহ্যে বসে হঠাৎ পেছনে ফোঁস ফোঁস শব্দে চমকে ওঠে ভীষ্ম! গ্রামের ছেলে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি কিসের শব্দ ওটা! ধড়ফড়িয়ে উঠে পালাতে গিয়ে কাল কেউটের লেজে পা পড়তেই একটা মোক্ষম ছোবল এসে পড়ে ওর উরুর কাছে! চিৎকার করতে করতে ভীষ্ম পাড়ায় ছুটে আসে। কিন্তু সময়টা তো চরাচর আড়গোড় ভাঙার সময়। এত ভোরে মানুষ ঘুম চটকায় উঠে নিজেকে সামলে নিতে নিতেই সেই ফাঁকে ভোরের সূর্য আরও অনেকটা পথ এগিয়ে যায়। লোক ডাকাডাকি করে ভীষ্মরই সাইকেল ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। আজকাল মানুষ ঠকে ঠকে আর ওঝার খপ্পরে পড়া থেকে সাবধান হয়ে গেছে। বর্ষা এলেই গ্রামেগঞ্জে নানা বিষধর সাপের উপদ্রবে মানুষ অতীষ্ঠ। তাই ধাক্কা খেয়ে মানুষ অভিজ্ঞও হয়ে গেছে কিভাবে তাকে মোকাবিলা করে নিজেদের বাঁচানো যায়। ফলে সাপে কেটে মৃত্যুর হার আগের থেকে কিছুটা হলেও কমেছে। তবে ডাক্তাররা ভীষ্মকে রেখার সংসারে ফেরত পাঠাতে পারল না। কাল কেউটের বিষ যে সাংঘাতিক শক্তিধর। ডাক্তারদের, ওর সঙ্গে লড়াই করার সময় বড্ড কম দেয়। ছোবল মারার সঙ্গে সঙ্গে তুরন্ত হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে পৌঁছতে পারলে তবে ডাক্তাররা লড়াই করে জিততে পারে। প্রায় টানা দু’সপ্তা হাসপাতালে কেউটের বিষের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অবশেষে ভীষ্ম নীল হয়ে যায়! অকাল বিধবা হয়ে পড়ে যুবতী-বধু, রেখা। স্বামীর সৎকার, তারপর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ। এত খরচ রেখা পাবে কোথা থেকে! বৃদ্ধ শ্বশুর বিছানায় পড়ে। আর উঠতে পারবে না। গামুইদের কাঁধে চেপে একেবারে চেলাকাঠে ওঠার ভবিতব্য তার। কোমর নুইয়ে যতটা পারে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য করে যায় শাশুড়ী। ভীষ্মই ছিল তাদের সংসার-রথের সারথি। কত রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল ও রেখাকে নিয়ে।
প্রথম দেখাতেই ও যেন রেখার প্রেমে পড়ে গেছিল! ও সাইকেল ভ্যানে করে আলাদাতপুর থেকে কাঠের গুঁড়ি নিয়ে উলকুনী গ্রাম হয়ে যাবে ফতেপুরে কাঠ চেরাই কাখানায়। মধ্য দুপুরের বৈশাখী সূর্য পুড়িয়ে যেন খাক করে দিচ্ছিল চরাচর! আলাদাতপুর পেরিয়ে উলকুনী গ্রামের রাস্তায় পড়ে তেমাথানী মোড়ে ওর কাঠ বোঝাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। তেষ্টাতে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। আর টানতে পারছিল না গাড়ি। একটু তফাতে একটা কঞ্চির ছিটেবেড়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। একটা মেয়ে মাটির কলসি কাঁখে জল নিয়ে আসছিল। মেয়েটা কাছে আসতেই চোখ যেন দাঁড়িয়ে যায় ভীষ্মর। আস্তে আস্তে সে কাঁখের কলসিটা নিয়ে ওই মলিন আস্তানার ভেতর চলে যায়। ভীষ্ম থমকে থাকে সেখানে! ছাতিফাটা তেষ্টা যেন মুহূর্তে উবে গিয়ে শীতল হয়ে যায় ভেতরটা। এই ঘরে এত অপরূপা একটা কন্যার বাস! ঘরটার বাইরে একটু তফাতে তিন ঝিঁকের মাটির উনুনে ধান সেদ্ধ করছে একটা বেওয়া মেয়েমানুষ। মনে হয় লোকের ধান সেদ্ধ-শুকনো করে ভাঙিয়ে চাল করে ফেরত দেয়, যার ধান তাদের। আর ভাঙানো ধান থেকে কুলোয় পাছড়ে তুঁষ আর খুঁদ আলাদা করে সেই খুঁদ আর ধান ভাঙানোর বানি, অর্থাৎ মজুরি চালের মালিকের কাছ থেকে যা পায় তাই দিয়ে এদের সংসার চলে। ভীষ্ম নিশ্চিত ইনি এই উর্বশী রমণীর মা। কাছে গিয়ে বলল,“একটু ঠান্ডা জল খাওয়াবেন মা? তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আর ভ্যান টানতে পারছি না।” উত্তরে ব্যস্ত হয়ে মহিলা বলল,“একটু বসো বাবা। মেয়েটা জল আনতে গেছে সেই হালদার পাড়ায়। অনেকটা দূর। অনেকক্ষণ গেছে। আসার সময় হয়েছে। ও এলেই তোমাকে টিউকলের ঠান্ডা জল দিচ্ছি।” সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্ম বলল, “একটা মেয়ে কাঁখে এক কলসি জল নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ও কি তোমার মেয়ে, মা?” ভীষ্মর কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে মা বলল,“রেখা তুই এসেছিস? তবে এক গেলাস জল আর দুটো নকুলদানা হাতে নিয়ে ওই খোকাটাকে দে তো মা! তেষ্টায় বেচারার ছাতি ফেটে যাচ্ছে! আহা রে, কাঠফাটা গরমে বড় কষ্ট। দে মা তাড়াতাড়ি। তেষ্টারে তুষ্ট করলে পুণ্য হয় রে মা। সেই পুণ্যি জলে যায় না। অনেক সময় উপরওয়ালা ভেক ধরে তোর কাছে আসতে পারে। তোর মন পরীক্ষা করতে। সে পরীক্ষায় পাশ করলে তোর আর পেছন ফিরে তাকাতে হবেনে রে মা। তোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। ভাল পাত্রে বিয়ে তোর হবেই হবে। এই কথাটা বলে রাখলুম।”
একটা মোটা কাঁসার গ্লাসে জল আর ছোট্ট ঠাকুরপুজোর মতো রেকাবে গড়াগড়ি খাওয়া কয়েকটা নকুলদানা নিয়ে মেয়েটা ভীষ্মর সামনে এসে দাঁড়ালো! এক আসমান বিস্ময় নিয়ে জলের গ্লাসটা নেবার জন্যে হাতটা বাড়ালো ভীষ্ম! কিন্তু সেই গ্লাস পর্যন্ত তার হাত যেন পৌঁছাচ্ছে না। অথচ তার কত যুগ আগে যেন তার চোখ ছুঁয়ে গেছে রেখার চোখের অন্তরে। দু’জনের চোখ অন্য কোন দিশায় যেন আর সরছে না। দুজনের দুটো হাতও সেই দূরত্বে অপেক্ষায়। দুটো হাতের দূরত্ব হয়তো এক আঙুলও হবে না, ইঞ্চিকাঠি দিয়ে মাপলে। তবু সেই ফারাক যেন মনে হচ্ছে কত যোজন! মায়ের কথায় থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে দু’প্রান্তের দুটো হাত,“কিরে মা দিলি বেচারাকে এক আঁজলা জল? খাও বাবা খাও। আত্মার জ্বলন দমন করো। মা শীতলা তৃপ্ত হোক।”
সেদিনের পর থেকে ভীষ্ম যখনই ওই রাস্তা মাড়ায় তখনই তেষ্টার তাড়া থাকুক বা না থাকুক একবার থমকে যায় রেখার মায়ের বাড়ি,“কই গো মা ঠাকরুণ, কি করছো। ভাল আছো তো? সব খবর কুশল তো? বাড়িতে কাউকে দেখছি না কেন মা? সব গেল কোথায়?” এ ছেলে যে রেখার খোঁজ করছে তা কে না বোঝে। রেখার মা তো আলবাৎ বুঝবে, “সে মেয়ে এখন ঘরে নেই গো বাপ। হিমে হালদারের জমিতে মুগ কড়াই তুলতে গেছে। সেই কোন ভোর থাকতে গেছে। এখন বেলা মাথায় ওঠার টাইম হয়ে এলো। এত বেলায় তো কড়াই তোলা যায় না। পাকা কড়াইয়ের খোসা এখন মড়মড়ে হয়ে গেছে। ছিঁড়তে গেলেই হাতের মধ্যেই খোসা ফেটে চৌচির হয়ে সব কড়াই ভুঁয়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। হয়তো হিমে হালদারের বাড়িতে আছে। কড়াই খোড়া মেপে, সব মাপ বুঝিয়ে দিয়ে তবে না আসতে হবে। এক খোড়া কড়াই তোলার মজুরী পাঁচ টাকা। তাও আবার বলে কি না, খোড়া চূড়া মাপ করে দিতে হবে। তাতে আমি সায় দিইনি। হ্যাঁ খোড়ার মুখ বরাবর থেকে একটু উঁচুর দিকে ঢাল করে দিতে পারি। তা না আবার পাহাড়-মাথা চায়। কত্তো সাধ। মেয়েকে বলেছিলুম, অত কষ্ট করে তাহলে তোকে কড়াই তুলতে হবে নে। গতর খুইয়ে পয়সা পাব না তো কি হবে অত খেটে? তবে রাজি হয় হিমে হালদার। তোমাদের ওদিকে ক’পয়সা দেয় গো বাবা, এক খোড়ায়? আমাদের এদিকের মালিকদের যেন বড্ড হাত টান। কাজের লোকেদের জন্যে হাত উপুড় করতে এদের কি যে কষ্ট হয় তা বুঝে উঠতে পারিনি।”
ওই টুকটুকে মেয়েটা রোদে পুড়ে মুগ কড়াই তুললে ওর নরম শরীরের চামড়া তো ট্যান হয়ে খয়ের হয়ে যাবে? কেউ তখন ওর রূপে আর মাতাল হবে না। ভাবনাটা নিজের ভেতর তোলপাড় করে উঠতেই ব্যস্ত হয়ে ভীষ্ম বলল, “ও মা, মেয়েটাকে তুমি এত খাটিও না। আজকাল বড্ড জ্বালাপোড়া রোদ। ও কি আমাদের মত পুরুষ মানুষ, যে রোদের সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখবে? ওর শরীরের জেল্লা পাংসে হয়ে গেলে তোমার যেমন কষ্ট হবে, তেমন আমারও ভীষণ মন খারাপ হয়ে যাবে।”
-কি করবো বলো বাপ। সংসারে আলগা পয়সাও তো দরকার। না খাটলে কোথায় পাব। কে দেবে। বাপটা তো, সেই মেয়েটার যখন চার বছর বয়স, বউ-মেয়েকে অথৈ জলে ভাসিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল। কত খোঁজাখুঁজি করলাম। জনসমুদ্রে জাল ফেলে, পোলো মেরে কত হাঁচালাম। পেলাম না। মানুষটা কত ভাল ছিল। আমাদের দুই মা-মেয়েকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতো। সেবার কাজে যাবার সময় বলল, “রেখার মা, খিদিরপুরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ পেয়েছি। গ্রামে কখন কাজ হয় কখন হয় না। শহরে সবসময় কত অট্টালিকা হচ্ছে। ওখানে জোগাড়ের কাজের অভাব নেই। করতে পারলেই হবে। এই যাচ্ছি, মাস খানেক পর বাড়ি ফিরব। এক মাসের সংসার খরচের টাকা রেখে গেছি। চিন্তা করবে না আমার জন্যে। মেয়েকে নিয়ে তুমি সাবধানে থেকো।” বারো বছর পর পাড়ার মেয়েরা ধরে বেঁধে মা কালীর থানে নিয়ে
গিয়ে আমার হাতের শাঁখা ভেঙে, মাথার সিঁদুর মুছে থান পরিয়ে দিল। সেই যে থান ধরলাম এখনো তাই পরণে জ্বলজ্বল করছে। তবু কেন জানিনা বাবা, আমার মন যেন সায় দেয় না। মনে হয় এই বুঝি রেখার বাপ এসে ডাকল, “রেখার মা, কোথায় গো। এক গেলাস ঠান্ডা জল দও তো! গগনভেদি তেজে বুকের ছাতি যেন হাহাকার করছে।” তুমি কিছু মনে কোরো না বাপ। আমার ছেলের মত তুমি। তুমি মা বলে আমার কাছে প্রথম দিন যখন জল চাইলে না? আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠল! কার গলা এটা? রেখার বাপ নাকি? তোমায় দেখে তবে হৃদপিন্ডের নাচন-কোঁদন বন্ধ হল।
ভীষ্ম কেন ঘন ঘন তাদের ঘরের দাবায় এসে বসে তা রেখার মায়ের ধরতে কষ্ট হয় না। রেখাকে দেখার পর থেকে ওর এই আনাগোনা। সেটা ভীষ্মরও অজানা নয়। ও যে রেখাকে ভালবেসে ফেলেছে। তাই রেখার কষ্ট ওর বুকে যেন দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি ঠোকে। রেখা কষ্ট করবে কেন? ওর কষ্ট সে বুক পেতে নেবে। তাই আর রাখঢাক না করে ভীষ্ম একদিন রেখার মা’কে বলল,“মা, তোমার মেয়ের ভাগ্য-মালা আমার গলায় ঝুলিয়ে দেবে? আমি সারা জীবন সোনার মালার মত তাকে আগলে রাখব। মেয়েকে নিয়ে তোমার আর কোন চিন্তা করতে হবে না। একটা কানাকড়িও এই বিয়ের জন্যে তোমার খরচা করতে হবে না। খরচা করে আমরাই কনে সাজিয়ে তোমার মেয়েকে ঘরে তুলব।” ভীষ্মর কথায় অবাক হয়নি রেখার মা। ওর মনের ভাষা অনেক আগেই তো সে পড়ে নিয়েছে। তাই সরাসরি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “জানো বাবা, কত ছোকরা এই মেয়েকে বিয়ে করার কথা আমার কাছে তুলেছে? আসলে আমার রেখা একটু মাজাঘষা দেখতে বলে সক্কলের নজরে পড়ে যায়। কেউ যৌতুক চায়, কেউ চায় না। কেউ আবার সুন্দরের লোভে মেতে উঠে ছটফট করে। কিন্তু কারোর মন আমার মনকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তাই ওগুলোকে আমল দিইনি। দাবায় বসতেও বলিনি। জোর করে বসলে জল-নকুলদানা খাইয়ে অতিথি বিদেয় করি। কিন্তু একটা কথা কি জানো বাবা ভীষ্ম, তোমার মত কেউ কোনদিন আমাকে ‘মা’ বলে ডাকেনি। ছেলের মুখ থেকে মা-ডাকের লোভ আমার কাছে বাঁধনছেঁড়া লোভ। রেখার বাপের কাছে সেই লোভের কথা সরমের গুলি মেরে বলেওছিলাম। রাজি হয়েছিল ওর বাপ। খোকার মুখ থেকে মা-ডাক ও আমাকে শোনার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেই লোভ এখনো আমার ভেতর তাড়া করে বেড়ায়। তা তুমি সেই প্রথম দিন যখন ‘মা’ ডাক দিয়ে আমার কাছে ছাতির জ্বলন থামাবার জন্যে জল চাইলে। সেই ডাক, আমার বুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সেই অতৃপ্ত বাসনা যেন নতুন রূপ নিয়ে জন্ম নিল। তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পেলাম এতদিন চেয়ে ফেরা আমার ‘মা’ ডাক। একটা ভাল দিনক্ষণ দেখে তোমার সোনার মালা তুমি গলায় ঝুলিয়ে ঘরে তোল। আমার রেখাও যে তোমার গলায় ঝুলে পড়ার জন্যে আলাপের সেই প্রথম দিন থেকে তপস্যা করে যাচ্ছে। সন্তানের মনের কথা সবার আগে মা ছাড়া আর কে বুঝবে। মেয়ের একটা হিল্লে করে আমি এই বাস তুলে দিয়ে আমার দাদার বাড়ি চলে যাব, শিলিগুড়িতে। দাদার বয়স হয়েছে। তার দেখার লোক নেই। দুটো ভাইপো-বউ তাকে ঠিকমত দেখে না। অনেক দিন থেকে আমাকে ওখানে যেতে বলছে। কিন্তু মেয়ের একটা ব্যবস্থা না করে আমি যাই কেমন করে। আর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ওরা তখন আমাদের বোঝা মনে করবে। খেতে পায়নে তাই ননদ সংসার নিয়ে এখানে উঠেছে। দাদা বলেছে, “তুই চলে আয় বোন। আর তোকে ফিরতে হবে না। মরে যাবার আগে তোর একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা আমি করে যাব। তা মেয়ে যদি মনে করে ওখানে গিয়ে আমাকে দেখে আসবে, যাবে। আমারও মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হলে ডেকে পাঠাব। আর মরে গেলে তো ল্যাঠা চুকে গেল।”
রেখার জীবনের এই খন্ডকথা শুনতে শুনতে একেবারে যেন বিবশ হয়ে যায় অখিল। তার জীবন অনেক অভাব অনটন, উত্থান পতনের সাক্ষী। ছেলে বলে লড়াই করতে করতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। মেয়েরা যে লড়াই করতে পারে না তা নয়। কিন্তু মেয়েদের লড়াইয়ের পথে বড্ড কাঁটা বিছানো। তাই বেশিরভাগ মেয়ে কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আর এগোতে পারে না। প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। ভীষ্মর সঙ্গে রেখাও তো জীবনযুদ্ধ জয় করার জন্যে লড়াই জারি রেখেছিল। কিন্তু মাঝপথে ভীষ্মর মরণ-কাঁটার মোক্ষম আঘাতে সে তো এখন দিগভ্রান্ত! কে ওর সামনে হাওয়া-মোরগ হয়ে সঠিক পথের নিশানা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে? অখিলেরও তা অজানা। তবে মনের সাহসের ওপর ভর করে অখিল বলল, “রেখা-বউ, তুমি অত ঝিমিয়ে পোড়ো না। এক্ষুণি দমে গেলে, জীবনধারণের জন্যে দম কোথায় পাবে? সেই দম তো তোমাকে ধরে রাখতে হবে এবং অর্জনও করতে হবে। বুকে সাহসের জন্ম দাও। তোমরা তো জন্মদাত্রী। অনেক সাহসের জন্ম দাও। দেখবে ঠিক খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারবে। আপাতত আমি তোমাকে ভীষ্মদাদার সৎকারের খরচ আর শ্রাদ্ধশান্তির জন্যে যা যা লাগে সামলে দিচ্ছি। না, রেখা বউ। তুমি ভেবো না দানসত্র খুলে বসেছি আমি। ওইটা করলেই লোকে ‘কু’ ভাবনা এদিক ওদিক সর্বত্র চালান করে দেবে। এই ভাবনা চালানে লোকে ক্লান্ত হয় না। বরং আরও উৎসাহ ভরে এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তোমার কাজের মজুরি থেকে কাটান দিয়ে দিও। সুদখোরদের মত সুদ আদায়ের ধান্দা করব না। আর টাকা শোধ দেবার জন্যে চাপাচাপিও করবো না। যেমনটি পারবে তেমন ভাবেই কাটান করে দিও। শুধু মন দিয়ে নিখুঁত করে তোমার কাজটা করে যেও। সেটা অবশ্য তোমাকে বলতে হবে না। সে পরীক্ষায় তুমি পাশ অনেক আগেই করে গেছো। হ্যাঁ, আর একটা কথা রেখা বউ। কোলকাতা থেকে আরও সুন্দর সুন্দর ড্রইং এসেছে। তবে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে সেগুলোকে ঠাকুরের গয়নায় রূপ দিতে হবে। সবাই এটা পারবে না। বেশিরভাগ কারিগর তো মাথামোটা। সরু মাথারাও কুঁড়েমি করে মাথা ঘামাতে চায় না। তুমি সে গোত্রের নও তা আমি জানি। তোমাকে দিয়ে পরখ করতে চাই এই অর্ডার আমি সাহসের সঙ্গে নেব কি না। এই আঁকা দেখে দেখে কয়েকটাকে গয়নার রূপ দেবার চেষ্টা করো দিকিনি রেখা বউ ? তুমি যদি পারো তো তোমার দাম আরও বেড়ে যাবে। আর সকল কারিগর থেকে তুমি উঁচু জাতে উঠে যাবে। দামি কারিগর তো তখন দামি মজুরি দাবি করতেই পারে। আর সেই দাবি মানতে আমি নারাজ হব না। ভীষ্ম দাদার কাজ সব মিটে যাক। ইতিমধ্যে আমি কোলকাতায় যাচ্ছি। গুরুর আর আমার- দু’জনেরই অনেক মাল জমে গেছে। ডেলিভারি দিতে কোলকাতায় যাবার তাড়া পড়ে গেছে। সেইসময় ওই নকশা আমি নিয়ে আসবো। কোলকাতার মহাজন আমার উপর মনে হচ্ছে ভরসা করতে পারছে না। ভাবছে, এত শক্ত নকশার কাজ হয়তো আমার দ্বারা হবে না। মহাজনের সেই ভুল আমি ভাঙাতে চাই। আর একবার আমার গয়না মঞ্জুর হয়ে গেলে আমিও দাম হাঁকিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব। ওরা মনে হয় আরও অনেক কারখানার মালিককে দেখিয়েছে। তেমন দক্ষ কারিগর তাদের হাতে নেই বলে হয়তো তারা নাকচ করে দিয়েছে। তাই আমাকেও ওই ‘নাকচের’ দলে ফেলে দিয়ে একবার শুধু ধর্মের ডাক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়বার আর আমার সামনে সে’কথা তোলেনি। আর আমি তো এঁটেলচিমড়ে। ওই ড্রইং আমি দেখাতে বলেছি। হেলাফেলা করে আমাকে দু’বার দেয়নি। শেষদিন জোর করে চাপ দিয়ে বলে এসেছি। তোমার উপর ভরসা করে আমি বড়মুখ করে সেই চাপ দিয়েছি রেখা বউ। এখন আমরা দু’জনেই পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে। এ পরীক্ষায় আমরা পাশ করবোই। তুমি দেখে নিও। আর তার জন্যে আমার যেটুকু হাত লাগাতে বলবে আমি লাগাব। পিছু হটবো না।”
স্বামীর মৃত্যুর খবর শিলিগুড়িতে মায়ের কাছে ‘তার’ পাঠিয়ে জানিয়েছিল রেখা। অখিলই সব ব্যবস্থা করেছিল। পত্রপাঠ মা’কে চলে আসার কথা বলেছিল রেখা। কিন্তু ভীষ্মর শ্রাদ্ধের কাজের সময় এসে গেল তবু মা এল না। কেন এল না মা, এই নিয়ে নানান প্রশ্ন এবং দুশ্চিন্তা রেখার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। মা কি একেবারে তার দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে ! স্বামী মারা যাবার পর আবার যদি মেয়ে তার ঘাড়ে চাপে তাই? না কি অন্য কোন কারণ? তাদের বিয়ের মাস চারেক পর মা বড় মামার কাছে চলে যায়। সেই থেকে একবারও মা মেয়ের খবর নেয়নি। ভীষ্ম অবশ্য বার দুই মা’কে তার পাঠিয়ে খোঁজ
নিয়েছিল। আবার ভাবছে, মা ভাল আছে তো? না কি, মা একা আসতে পারবে না বলে আর জামাইয়ের শ্রাদ্ধের কাজে আসতে পারছে না। তাই যদি হবে তো মা পাল্টা তারে তাকে জানাতে পারতো! সম্ভব হলে রেখা কাউকে বলে কয়ে শিলিগুড়িতে পাঠাতে পারতো! সে মনে বোধ পেতো। এইসব নিয়ে বড়ই মনঃকষ্টে আছে রেখা। ভীষ্মর কাজ মেটার পর একটা চিঠি এল তার ঠিকানায় বড় মামার বাড়ি থেকে। ওরা সময়মতই তাদের সব খবর পেয়েছে। কিন্তু তার মা’কে সেই সংবাদটা দিতে পারেনি। মানে দেবার মত পরিস্থিতি মায়ের ছিল না। সেই সময় ডেঙ্গী জ্বরে মায়ের এত বাড়াবাড়ি যে রোগির হুঁশ পর্যন্ত ছিল না। সেই বেহুঁশ অবস্থাতেই মা ভীষ্মদের দেশে পাড়ি দিয়ে দিল!
বড় মামার বাড়ি থেকে চিঠিটা পাবার পর রেখার বুকের ছাতি যেন যন্ত্রণার আগুনে ফেটে চৌচির হতে যাবার পরিস্থিতি হয়ে গেল। মনে হ’ল গলা ফাটিয়ে হাট করে চিৎকার করে সেই আগুন চরাচরে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু তার জন্যে কে অপেক্ষায় আছে এই চিৎকার শোনার! কেউ নেই। দিগন্ত পেরিয়ে আদিগন্ত অতিক্রম করলেও কেউ শোনার নেই। অখিলকে দিয়ে চিঠিটা পড়ানোর পর সেটা তার হাত থেকে ছোঁও মেরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি লাঠি হাতে কোমর নুইয়ে নুইয়ে এসে বৌমার এই অবস্থা দেখে বিহ্বলে বয়সী ফোঁটা ফোঁটা আগুন জল ফেলতে ফেলতে বলল, “তোর জীবন পারের সাঁকো আর কেউ রইলো না রে মা। আমরা এই বুড়ো বুড়ি তো ভীষ্মর কাছে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আছি। আজ না হয় কাল ! আমরা পৃথিবী থেকে উবে যাবার সাথে সাথে তুই যে তাহলে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবি রে মা! আমাদের মরণ তো নিশ্চিন্ত মরণ হবে না রে মা! এই অতৃপ্ত মরণ কত জন্মের পাপ তা কে জানে! বুক ধড়ফড়িয়ে আবার ঠক ঠক করে মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর বিছানার দিকে ফিরে গেল ভীষ্মর মা।
অখিল, তার বাবার অকালমুত্যুর যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে। সেই মৃত্যুর পরিণতির নির্মমতা জীবন দিয়ে পরখ করেছে। কিন্তু আজ ও এই যে পরিস্থিতির সাক্ষী হল তা শুধু দুর্বিসহই নয়, তার কল্পনারও অতীত। বিপর্যয়ের এমন পর্যায়গুলো কেন যে মানুষের জীবনে আসে কে জানে! রেখা বউয়ের জীবনযন্ত্রণা তাকে যেন আরও বিচলিত করে তুলল। এই মেয়েটার জীবন তো সবে শুরু হ’ল। তার থেকেও কম বয়স মেয়েটার। পাপ-পূণ্যের কতটুকু বা মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়েছে এ! তবে এ কেন এত কষ্ট পেতে যাবে। আর অখিলের মত একটা সমর্থ যুবক তার স্বচ্ছ চোখ দিয়ে দেখার পরও এটা মেনে নেবে? প্রশ্নগুলোর মিশেলে ভেতর থেকে উগরে ওঠা গভীর যন্ত্রণাগুলো তাকে বিহ্বল করে তোলে। নিজেকে প্রশ্ন করে, তার কি এখানে কিচ্ছু করার নেই?ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৯)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[একুশ]
ছেলেটা একটু হাতেধরা হতে রতনের যেন কিছুটা আর্থিক সুরাহা হচ্ছে। বাপের সাথে বসে বসে জুতো পালিশ, তাপ্পি, সেলাই সবটাতেই বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া ওর নজর আছে বলে সব কাজের ফিনিশিংটা বেশ মনে ধরার মত। এইদিকটা ও বেশি নজর রাখে তা দেখেছে রতন। এতদিন কাজ করছে, কোনদিন ভাবেনি যে এই ফিনিশিংটাও তাদের ব্যবসার আর একটা দিক। মোটামুটি সারাই-মাড়াই করলেই হল। এমনটাই ধারণা ওদের প্রজন্মের। কিন্তু একটা জুতোয়, চামড়ার তাপ্পি দিয়ে সারার পর তাপ্পির চামড়ার যে একটা খাঁজ তৈরী হোল তা বাটালির ডগা দিয়ে সুক্ষভাবে কেটে আসল জুতোর চামড়ার সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে দিয়ে সেই জুতোটা যদি একবার ভাল করে পালিশ করে দেওয়া যায়, সত্যিই মনে হয় যেন জুতোটা নতুন হয়ে গেল। এই পালিশের জন্যে পয়সা নিল, কিন্তু তা শুধু পালিশ করতে আসাদের থেকে একটু কম পয়সা। কেননা ওই খদ্দেরটা তো জুতো পালিশ করতে আসেনি, এসেছিল রিপেয়ার করতে। এতে তারা জুতো সারাইয়ের পয়সা পেল, অতিরিক্ত কিছু পেল পালিশের জন্যে। খদ্দেরও তুষ্ট মনে কোন কথা না তুলে পয়সা দিয়ে দিল। এই অতিরিক্ত সামান্য কিছু দেবার জন্যে খদ্দেরটার তো গায়ে লাগল না। অথচ তার পুরোনো জুতো নতুন নতুন লাগল। এই বুদ্ধিতে নামও করে ফেলে সনাতন। ছেলের দেখে রতনও এখন তাই করে। আয়ও ছেলের হাত ধরে বাড়ে।
দিঘিরপাড় বাজারের পলিথিন টাঙানো ফুটের দোকানেই এখন হপ্তা’ভর বসে রতন। আর পাড়া করতে যায় না। বয়স যেন আর সায় দিতে চায় না। আশেপাশে প্রায় খান দশ-বারো গ্রাম ফেরি করে ওদের রুইদাস পাড়া। কত মাইল যে সারা দিনে হাঁটতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। এই হাঁটা বয়স যেন সায় দেয় না। দোকানটা যখন আয়ের টানকে পুষিয়ে দিচ্ছে তাতে মনও আর ঠেলা মারে না পাড়া করতে। ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সব কাজকর্ম শিখিয়ে দিয়েছে। কেমন করে পাড়া করতে হয়। কোন পাড়ার কোন বাড়িটা তাকে বেশি পছন্দ করে। কোন গ্রামে তার বেশি বাঁধা খদ্দের আছে। দিন তিনেক সাথে করে নিয়ে গিয়ে সব চিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। বাবুদের গিন্নিমায়েদের সঙ্গেও আলাপ করে দিয়েছে। তাদের এইসব কাজের লেনদেন গিন্নিমায়েদের সঙ্গেই বেশি। বাবুরা তো যে যার কাজেকম্মে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাড়ি থাকে গিন্নিমারা,“গিন্নিমা, এ আমার ছেলে, সনাতন। আমার তো বয়স হচ্ছে। আর হয়তো বেশিদিন পাড়া করতে শরীর সায় দেবে না। তাই ছেলেকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি। আপনারা একটু দেখবেন।”-তা, তোমার ছেলে লেখাপড়া করেনা না? তোমাদের তো দেখি বাবার জুতো-বেতের কাজ হস্তান্তর হয় ছেলের মধ্যে। কেউ আর এর থেকে বার হতে পারল না। না হলে তোমাদের উন্নতি হবে কেমন করে। এই ছেলে, তোর নাম কি? পড়াশোনা করতে পারলি না। সেই বাপের পেশায় তুইও সওয়ার হলি ?
-ও সনাতন গো গিন্নিমা। আপনাদের আশীর্বাদে ও মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে। এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। কিন্তু আমাদের সংসারে তো বাবুদের ছেলেপিলেদের মত শুধু লেখাপড়া করলে পেট শুনবে না। এই পেট-রাহুর হম্বিতম্বি বশে রাখতে গেলে কাজ করতে হবে। কাজ সেরে যদি দম থাকে তো লেখাপড়া শিখতে পারে। তা আমার সনাতন সেই দম দেখিয়ে দিয়েছে।
এবার গিন্নিমার অবাক হবার পালা, “তুই ছেলে এই জুতো-চামড়া-বেতের কাজ করিস আবার লেখাপড়াও করিস! তাও স্টার পাওয়া ছেলে ! আর আমাদেরগুলো দেখো, খাচ্চে-দাচ্ছে আর নবাবি করে বেড়াচ্ছে। তোমার কত কপাল ভাল, রতন। তোমার ছেলে সনাতনকে দেখে অন্য ছেলেপিলেদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। ছেলেটাকে দেখেই প্রথমে আমার একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। ও যে তোমাদের জাতের অন্য ছেলেদের থেকে অন্যরকম, সেটা মনে রেখেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, লেখাপড়া করছে না কি? খুব ভাল। তুমি ভাল করে লেখাপড়া শেখো ছেলে। কখনো কোন দরকার পড়লে আমাদের বাড়ি আসবে। ওর বাবাকে বলবো, যদি তোমার হয়ে কিছু করতে পারে। তবে আমার মনে হয় রতন, এ ছেলেকে তুমি, তোমার মত পাড়ায় ঘুরিও না। ও কাজ করুক। তবে পাড়ায় ঘুরে এই হাড়-খাটুনি যদি তুমি না খাটাও মনে হয় ওর পক্ষে ভাল হবে। আমার কথা তুমি ভেবে দেখতে পারো।” এই গিন্নিমা যেমন বলল তেমন অনেক পাড়া তাকে একই রকম কথা বলেছে। ছেলেকে এই রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে পাড়া না করার মত দিয়েছে। রতন ওই পরামর্শগুলো মাথায় রেখেছে। তবে সরাসরি সনাতনকে বলেনি যে তোমাকে পাড়া করতে যেতে হবে না। মানুষের জীবন। কখন কি মোড়ে মোচড় দেয় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ও যদি নিজে থেকে যায় যাবে। না গেলে না যাবে। রতন তাকে যেমন যেতে নিষেধ করবে না, তেমন যেতেও বলবে না।
কোন কোন বাবু বাজারে তার দোকানে এসে বলে,“কি রে রতন, তুই যে আর পাড়ায় যাচ্ছিস না। তোর গিন্নিমা তো আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। কয়েকটা খোড়া আর একটা পালির বেত খুলে গেছে। রোজ আমাকে বলে, বাজারে গেলে রতনকে বলে আসবে তো, বাড়িতে আসার জন্যে? তা সময় করে একদিন যাস, আমাদের বাড়িতে। ওই বড় বড় জিনিস তো আর আমার পক্ষে বাজারে বয়ে আনা সম্ভব নয়। যেমন বাড়িতে গিয়ে সারিয়ে আসতিস, তেমন যাস।
এই ধান কাটার মরসুম এসে যাচ্ছে। খোড়া, ধান কাটানো ‘কাটা’ আগে থেকে সারিয়ে না রাখলে তখন অসুবিধায় পড়তে হবে।” রতন তখন বাবুকে বলেছিল,“বাবু আমরা বাপ-বেটার কেউ যদি যেতে না পারি তো আমার পাড়া সম্পর্কের ভাইপো, কেলে, মানে কেলোকে পাঠাবো’খন। আপনি চিনবেন ওই যে মিত্তুন রুইদাস আছে না? আমাদের বাজারের মোড়ে বটগাছ তলায় যে ছাগল কাটে। হ্যাঁ, ওই মিত্তুনের ছেলে কেলে। ওরা দু’বাপ-ব্যাটা ছাগলের মাংসের কারবার করে। ছেলে পাড়া ঘুরে ছাগল কেনে আর বাবা বাজারে সেই ছাগল কেটে মাংস বেচে। ছাগল কেনার সাথে সাথে সারাইয়ের কাজটাও কেলে করে। করতে করতে এইসব সারাইয়ে কেলের হাত এখন ভাল হয়েছে। চটপটেও আছে। ও কখনো সখনো আপনাদের পাড়াতেও যায়। বলে দেব’খন ওকে আপনাদের বাড়ি যেতে। ও গিয়ে আমার নাম বললে বুঝবেন আমি পাঠিয়েছি।
আশেপাশে দশ-বারোটা গ্রামে রতন জ্যাঠার যা পরিচিতি তা দেখে অবাক হয়ে যায় কেলো। তার বাবা মিত্তুনেরও এত লোকে চেনে না। তাদের পাড়ার আরও অনেকে রতন জ্যাঠার মত গ্রামে গ্রামে ঘুরে জুতো সারাই, বেতের জিনিসের সারাই বা বিক্রির কাজ করে ঠিকই। কিন্তু এনাকে লোকে যত চেনে অন্যদের সব গ্রামের সবাই চেনে না। এ দিক থেকে রতন জ্যাঠা তাকে অনেক উপকারই করেছে। কেলো বা তার বাবা, মিত্তুনে তো কেবল ছাগলের কারবার করে বেড়াতো। যে-যে গ্রামের মানুষ ছাগল পোষে সেই-সেই গ্রাম তারা ঘুরে বেড়াতো। ঘর-ঘর ঢোঁ মারা তাদের হতো না। তার ফলে অত পরিচিতিও ছিল না। ওই চেনাজানার মধ্যে যারা সারাইয়ের কথা বলত, কেবল তাদের ঘরে তাদের যাতায়াত ছিল। একটা সময় তার বাবা এই কাজের পুরোটাই তার দায়িত্বে ফেলে দেয়। আর পাড়া করে না। পায়ের কলকব্জা নড়বড়ে হয়ে আসছে তাই। এবার রতন জ্যাঠা তার খদ্দেরের কাজ কেলোকে করার সুপারিশ করাতে এখন সে মন দিয়ে দুটো কাজই করে। ছাগলের কারবার আর জুতো-বেত সারাই। ঘরে উপরি দু-চারটে পয়সাও আসতে শুরু করেছে।
নতুন এই কাজটা করতে গিয়ে কেলো, তার পুরোনো কাজে যেন কিছুটা ঢিলে দিতে শুরু করেছে। কুঁড়েমী আর কি। অত দূর দূর পাড়ার পর পাড়া তার ঘুরতে যেন আর তেমন সায় দেয় না মন। ‘ছাগল আছে গো-ও, ছাগল আছে গো-ও বলে চেল্লাতে চেল্লাতে গলা একটা সময় এমন বসে যায়। মনে হয় গলাটা শরীর থেকে খুলে পড়ে যায় আরকি! ওই সারাইয়ের কাজ করতে করতে নজর-পড়া পাড়াগুলো ঘোরার মাঝে যেসব বাড়ি ছাগল পোষে সেগুলোতে ঢোঁ মারে। এই নিয়ে বাপ ছেলের কথাকাটাকাটি যে হয় না তা নয়। মাংসর
দোকানে ছাগলের যোগানে টান পড়ে। মিত্তুনকে দোকান চালাতে তাই রাজারহাটের ছাগলহাটের থেকে ছাগল কিনে আনতে হয়। পাড়ার ছাগল একটু কম দামে পাওয়া যায় আরকি। পাড়ার বউ-ঝিদের ভুজুং-ভাজুং দিয়ে হাটের ছাগলের থেকে অনেকটা কমে সে সওদা করতে পারে, “দিদি, আপনার ছাগলের নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে। এই দেখুন, চোখের জল গালের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে। আপনার ছাগলের ব্যায়রাম হয়েছে। বিডিওর পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। না হলে সে বাঁচবে না কিন্তু। ছাগলটাকে এতটা বড় করে শেষে মরে গেলে আপনার অনেক পয়সা মাঠে মারা যাবে।” বিডিওর পশু ডাক্তার পাওয়া অত সহজ কথা না। তারপর কবে তাকে পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে পারবে না। ছাগলটাকে টানতে টানতে দশ কিলোমিটার হেঁটে নিয়ে গিয়ে যদি না পাওয়া যায় তো বিপত্তির অন্ত নেই। তাই সহজে পাড়ার মেয়ে বউরা ডাক্তারের কথা মুখে আনতে চায় না। সেই সুযোগ কেলো-মিত্তুনেরা নেয়। তখন ছাগল মালিক বলে, “তুমি ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করে দাওনা। তোমার যাতায়াতের খরচা দিয়ে দেবো’খন।”
-আমার অত সময় নেইগো মা-সকল। একটা কথা বলি শোনো, তোমার ছাগলের দাম আমি পাঁচ হাজার টাকা দেবো। আমাকে দিয়ে দাও। তারপর ডাক্তারবদ্যির খরচ আমি করে নেবো।
-আমার আট হাজার টাকার মাল পাঁচে ছেড়ে দেবো? তুমি পাগল আছো? ডাক্তার খরচ তোমার কত হবে গো লোকটা!
-দেখুন মা-ঠাকরুন, ডাক্তার দেখা, ওষুধ পথ্যের খরচ তো একটা আছেই। আর একটা আসল কথা তো তুমি ভাবলে না। এই রোগী ছাগলকে সারিয়ে তুলতে তো বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে? না কি বলো? তা মানুষের রোগ হলে মানুষ রোগা হয়ে যায় না ? এ পশুও তো রোগা হয়ে যাবে। ওজন কমে যাবে। পশুর ওজনের ওপর তো তার দাম। ওজন কমে গেলে দামও তো কমবে, না কি? তা তোমার রোগা ছাগল পয়সা দিয়ে কিনে যদি আমার কারবারে লস্ হয় তো সে কারবার করে আমার লাভ কি? দেখো এবার তুমি কি করবে। তোমার জিনিস আমি তো জোর করতে পারি না। এখন যা দাম পাচ্ছো, পরে তা নাও পেতে পারো। তখন আর আমাকে দুষবে না কিন্তু।
কোন ছাগলের হয়তো পেটটা ডাবরা হয়ে আছে। পেটে হয়তো জল জমেছে। এমনটা হলে ছাগল একটু হাগে। পাতলা হাগে। ছাগল যে কোন সময় পাতলা হাগতে পারে তা যারা ছাগল পোষে তারা জানে। কিন্তু কি কারণে হাগে তা তারা অতটা জানে না। অনেক সময় হেগে হেগে ছাগলটা মরেও যায়। তখন মালিক কপাল চাপড়ায়, “ছাগলটার হাগা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে যদি বিক্রি করে দেওয়া যেতো তো এত টাকা তাদের ক্ষতি হত না।” সেই ধারণার সুযোগটা মিত্তুনে-কেলোরা নেয়, “মা-ঠাকরুন, তোমার ছাগলের পেট ডাবরা হয়ে গেছে। পেটের নীচে হাত দিয়ে উপরের দিকে ঠেলা মারলে ছলছল শব্দ হচ্ছে। জল জমেছে। এবার পাতলা হাগা শুরু হবে। তখন একে বাঁচানো শক্ত হয়ে যাবে। এক্ষুনি ডাক্তারের ব্যবস্থা করো।” এইসব ছাগল মোটামুটি দামাদামি করে কিছুটা কমে তারা গস্ত করতে পারে। তাতে মাংস বিক্রি করে কিছু বেশি পয়সা ঘরে তুলতে পারে। তবে যেসব ছাগল একদম টানটান সরেস মার্কা, তাদের নায্য দাম দিতেই হয়। ওখানে হুড়িয়ে-হাড়িয়ে কিছু করার জায়গা থাকে না। তবে তাতেও হাট থেকে গস্ত করা মালের থেকেও নরম দামে কেনা যায়।
বাপের গোঁত্তা খেয়ে কেলো একটু যেন টালমাটাল। সারাইয়ের কাজের সাথে সাথে পুরোনো ব্যবসাটায় জোর দিতে হচ্ছে। কিন্তু তাতে যেন মন জোর পায় না। হঠাৎ তার মনে একটা অন্য মতলব বাসা বাঁধে। সেটা সে তার বাপকেও জানায় না।
হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেয় পাড়া করে ফেরার কালে কেলো মাঝবয়সী একটা খাসি কাঁধে করে নিয়ে এসে ঘরের দাবায় ধপাং করে ফেলে। মিত্তুনে, কেলোর মা দেখে তো অবাক, “হ্যাঁরে কেলো, এ তো মরা খাসি। এ মালটা আবার কোথায় পেলি !” ছাগলটার গায়ে হাত দিতে একটু চমকে ওঠে মিত্তুনে, “কিরে কেলো, মনে হচ্ছে ছাগলটা সবে মরেছে। এর শরীর এখনো পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যায়নি! গরম গরম। সদ্য মরা ছাগলটা তুই পেলি কোথা থেকে? যাদের ছাগল, তারা খোঁজাখুঁজি করেনি?”
-তা করবে না? পাড়াময় হৈ হৈ পড়ে গেছে। লোক জড়ো হয়ে গেছে, যেখানে এটা পড়ে ছিল। বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম লোকজনের জটলা। মরা ছাগলটা ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে একজন বলল, “দেখতো কেলো। এর ধড়ে প্রাণ এখনো জিইয়ে আছে কি না। মনে হয় তো নেই। দেখেই বললাম এ শেষ। এবার মানুষের জল্পনা, কি করে মরল জলজ্যান্ত ছাগলটা, ইত্যাদি কথা চালাচালি করতে করতে জটলা পাতলা হতে থাকে। যাদের ছাগল তারা শুধু আছে। আমি বললাম, মরা ছাগল তো তোমরা এমনিতেই মাটিতে পুতে দেবে। আমি নিয়ে যাবো ? চামড়াটা তাহলে নিতে পারি। তারা তখন আর কিছু না বলায় আমি সময় নষ্ট না করে কাঁধে ফেলে নিলাম। কাল রবিবারের বাজার। মাংসের টান থাকবে। তুমি অন্য মাংসের সঙ্গে এটাও ভোর ভোর কেটে চালিয়ে দিতে পারবে। অসুবিধা হবে না।”
– অসুবিধা হবে না কি রে! সারারাত এভাবে ছাগলটা পড়ে থাকলে এ তো শক্ত ডাঙ হয়ে যাবে। মাংসের টেস্টও পাল্টে যাবে। রেগুলার মাংসের খদ্দেররা বুঝতে পারবে এতে কোন গলদ আছে। ওই ঝুঁকি নেওয়া যায় নাকি! তুই এক কাজ কর কেলো। বাজারে চলে যা। ইদ্রিসের আইসক্রিম কারখানা থেকে দুটো ইটের সাইজের আইসক্রিম বানানোর জন্যে রাখা বরফের প্লেট নিয়ে আয়। আমার নাম বলবি, ও দিয়ে দেবে। মাংস বিক্রি না হলে ওর দোকান থেকে বরফ নিয়ে সেগুলো চাপা দিয়ে রাখি সে ইদ্রিস জানে। কোন প্রশ্ন করবে না। দাম পরে আমি দেব’খন। আমি ততক্ষণে ছাগলটার চামড়া ছাড়িয়ে পরিস্কার করি। তুই বরফটা নিয়ে আসলে কাঠের বাক্সটার নীচে পলিথিন বিছিয়ে মাংসগুলো বরফ ঢাকা দিয়ে রাখবো। সকালেও একদম টাটকা থাকবে এটা তাহলে।
প্রথম পরীক্ষায় সফল হয়েছে কেলো। এবার লোভে পড়ে যায় এইভাবে অসৎ পথে ‘হবগা’ টাকা আয় করার জন্যে। রোজ করে না। হপ্তাহে দু’দিন এই কম্ম করে ও। তবে বহু দূর দূর গ্রাম হয় তার লক্ষ্য। কাছাকাছি হলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। অপারেশন করার আগে নির্দিষ্ট গ্রামটা বার কয়েক ঘুরে দেখে নেয় কোন বাড়িতে কটা ছাগল আছে। কোথায় চরাতে যায় ইত্যাদির খবর। তারপর সুযোগ বুঝে কলাপাতা বা কলমি শাকের সঙ্গে বিচি সমেত ধুঁতরো ফল জড়িয়ে ছাগলকে খাইয়ে দেয়। সবটাই চলে পরিস্থিতি বুঝে, নিরিবিলি সময়ে। না হলে কেউ দেখে ফেললে পাড়ার লোকের একটা মার বাইরে পড়বে না। সাফল্য বেশ কয়েকবার পেয়ে যায় কেলো। বাপ মিত্তুনেও খুশি মনে লোভের পাঁকে হাবুডুবু খেতে থাকে। একবারের জন্যেও ছেলেকে সতর্ক করে না যে এ অন্যায় কাজ। এ কাজ না করাই ভাল। বিরোধিতা না করে নীরব থেকে ছেলের কাজের সুবিধা নেওয়া মানেই তো পরোক্ষে সমর্থন করা। সেটাই করে চলল মিত্তুনে।
দূর দূরান্তের গ্রাম হলে কি হবে। লোক মুখে তো চাউর হচ্ছে ধীরে ধীরে যে কোন অজানা কারণে একটার পর একটা ছাগল মরে পড়ে থাকছে মাঠে ময়দানে। কারণ কেউ তেমন করে বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে কেলের দিনে দিনে সাফল্যের বহরে সাহসও বেড়ে যায়। এবার আশেপাশের চেনা জানা গ্রামেও নিজের হাতসাফাইয়ের বিদ্যে কাজে লাগাতে শুরু করে। তবে তা বেশি করে উঠতে পারেনি। আগের খবরগুলো এইসব গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক সময় চর্চা করতে করতে একটা হিসেব মানুষের মনে দেগে যায় যে এই মরা ছাগল একজনই শেষ পর্যন্ত নিয়ে চলে যায়। সেটা ওই রুইদাস পাড়ার মিত্তুনে রুইদাসের ছেলে কেলে ! কাছাকাছি গ্রামের লোক কেলেকে খুব ভাল করে চেনে। এবার তক্কে তক্কে থেকে একটা ছাগলকে শাক পাতার সঙ্গে ধুতরা ফল খাইয়ে দিতে গিয়ে বামাল সমেত হাতনাতে ধরে ফেলে কেলেকে! তারপর আচান্দা গ্রামের বল খেলার মাঠে গোল পোস্টে বেঁধে শুরু গণধোলাই।
হাওয়া এই চুরির খবর মুখে করে ছড়িয়ে দেয় দূরে কাছের গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের ঢল নামে এতদিন ধরে চলে আসা ছাগল মারার কারিগরকে দেখতে। সেইসঙ্গে উত্তম মধ্যম আছড়ে পড়ে কেলের শরীরে। এত লোক একবার করে যদি থাপ্পড় কসায় তো মরে যাবে যে চোরটা! পাড়ার কিছু সতর্ক মানুষ খবর পাঠায় পুলিশে।
রতন মরমে মরে যায়। এই চোরকে সে তার বিশ্বস্ত বাড়িতে কাজ করার জন্যে সুপারিশ করেছিল। বাবুরা এতদিন তার প্রতি যে বিশ্বাস পোষণ করেছিল তা এই কেলে চোরের হাত ধরে মাটিতে সমাধিস্থ হয়ে গেল। আফসোসের শেষ রইল না তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে। কিন্তু জানবে বা কেমন করে, মিত্তুনের ছেলে কেলে এমন অপরাধ প্রবণ ! আর জঘন্য মানুষ তো এই মিত্তুনে। সমানে সে ছেলের এই সমাজবিরোধী কাজে সায় দিয়ে এসেছে। ছেলের সঙ্গে সঙ্গে বাপকেও জেলে পোরা দরকার। চোর আর চোরাই মাল গছনদার- দু’জনেই সমান দোষে দোষী। হয়তো পুলিশ তাই করবে! করুক![বাইশ]
পুজোর মাস-দুই তিন আগে থেকে রুইদাস পাড়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঢাকের পরিচর্যা করতে। বছরভর এরা গরুর চামড়া ‘ট্যান’ করা পালিশ করা ইত্যাদির কাজ করে চামড়া ব্যবহারের উপযুক্ত করে রাখে। তারপর নানা রকম পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন ঢাক বানানো আর পুরোনো ঢাকের মেরামতি শুরু হয় এই সময় থেকে। দুটো কাজেই চূড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। মোটামুটি সারা বছরের এই সময়টার জন্যে ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। দূর্গা পুজো থেকে শুরু হয় ওদের পুজোর মরশুম। তারপর লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো ইত্যাদি চলতে থাকে। বাঙালীর বারো মাসের তেরো পার্বনের মধ্যে এই সময়গুলোই ওদের জীবনধারণের প্রধান উপায় ও অবলম্বন। এতসবের সাফল্যের টিকি কিন্তু বাঁধা হয়ে যায় এই দূর্গাপুজোর মধ্যে দিয়ে। কে কতটা ঢাক বাজানোর ডাক পাবে তা অনেকটা ঠিক হয়ে যায় দূর্গা পুজার ডাক কোথায় কে কেমনভাবে পেল-না-পেল সেটার উপর। সেইজন্যে এরা সবসময় টানটান হয়ে থাকে, কিভাবে কেমন করে কোন্ পুজোমন্ডপে সে কাজ করার সুযোগ পাবে, সেদিকে। শহর- কোলকাতার বড় ক্লাবের পুজো বা বনেদি বাড়ির পুজোর দিকে এদের টান বেশি। লক্ষ্য তো একটাই। বেশি রোজগার। তা সেই রোজগারের বহরটা ওরা কপালের উপরই ছেড়ে দেয়। সব্বাই তো আর বড় ক্লাব বা বনেদি বাড়ি ডাক পাবে না। এইসময় ওদের মত ঢাকিদের যোগান অনেক। কিন্তু পছন্দমত খরিদ্দার বা তাদের চাহিদা সীমিত। গ্রামের পুজো শহরের তুলানায় কমই হয়। বাহুল্যেও শহরের ধারেকাছে যেতে পারে না গ্রাম। তাই তারা জোয়ারের ঢেউয়ের মত শহরের দিকে ধেয়ে যায়। রতন অন্যদের মত শহরে গিয়ে ঠেলাঠেলি তেমন পছন্দ করে না। কিন্তু এই বছর সনাতন হাতেধরা হতে মনটা যেন উশখুশ করে শহরে ডাকে যাবার জন্যে। দু’পয়সা যদি বেশি আয় করতে পারে। সনাতন এ বছর প্রথম তার সঙ্গে সঙ্গ দিতে রাজি হয়েছে। এ বছরই ও ঢাকের বোলের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছে। দূর্গাপুজো আর লক্ষ্মীপুজোর ঢাকের বাজনার সব বোল-তাল একদম নিখুঁতভাবে বাজাতে পারে। কাঁশির বাজনা তো ও অনেকদিন থেকে বাজাতে পারে। সেই ফাইভে যখন পড়ে তখন থেকেই আশেপাশের পাড়া বা গ্রামে বায়না পেলে ছেলেকে নিয়ে যেতো কাঁসির সঙ্গত দিতে। বড় পুজোয় অনেক খাটনি। একা সবটা বাজানো চাপের হয়ে যায়। শহরে না যাবার এটাও একটা কারণ। এবার যখন সনাতন তৈরী তখন বাপ-বেটা পাল্টাপাল্টি করে ঢাক-কাঁসরে বোল তুলতে অসুবিধা হবে না। সেই সাহসে ভর করে রতন ছেলেকে বলল, “কিরে সনাতন, এ’বছর কোলকাতায় বাজাতে যাবি? কোলকাতায় ছোট-বড় বা যেমন তেমন প্যান্ডেলেও বায়না পেলে রোজগার মন্দ হয়না রে! ওই তো দেখিস না, পাড়ার অন্যরা পুজো শেষে পোঁটলা ভর্তি করে জিনিসপত্র আর ট্যাঁক ভরে টাকা পয়সা নিয়ে ফেরে! গ্রামে থেকে আমরা তার ছিটেফোঁটাও পাই না। চল্ একবার দেখে আসি শহরের রহস্যটা কেমন। অভিজ্ঞতা মনের সঙ্গে না মিললে আর যাব না পরের বছর।”
শহরে ডাকে যেতে সনাতনের তেমন সায় ছিল না। আসলে শহরের ওই গ্যাঞ্জাম, জটিল পরিবেশ- ওর একদম মন টানে না। গাছগাছালিতে ভরা গ্রামের শান্ত শীতল আবহাওয়া। মেঠো রাস্তার দূষণমুক্ত ধুলিধূসরিত পরিবেশ। বৃষ্টিসিক্ত ধরিত্রির সোঁদা গন্ধ তাকে যেন বেঁচে থাকার অন্যরকম এক স্বাদ খুঁজে দেয়। শহুরে তপ্ত পরিবেশ, ব্যস্ততায় মোড়া যন্ত্র-জীবন যেন তাকে হাঁফ ধরিয়ে দেয়। শুধু সনাতন কেন তাদের মত গাঁয়ের মানুষের ক’জনেরই বা শহর টানে। তেমন টানে না। তবু গাঁয়ের মানুষ উদ্ভ্রান্তের মত ছোটে সেই শহরের পথে। জীবনকে জিইয়ে রাখার তাগিদ যে বড় তাগিদ। দায়ও। দায়মুক্ত হতে তাই সবাই ওদিকে ছোটে বেঁচে থাকার রসদ আহরণে। শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে ‘দুয়ো’ দিয়ে রতনের চাপাচাপিতে সায় দিতে মাথা নাড়ে সনাতন। ছেলের সম্মতি পেয়ে রতন এবার খোঁজখবর চালায় পাড়ার আর যারা ফি বছর কোলকাতায় যায় তাদের কাছে, “হ্যাঁগো দিবাকর, ফি বছর তো পাড়াগাঁয়ে পুজোর বাজনা বাজাই। এবারটা ইচ্ছে হচ্ছে শহরে যাবার। কোলকাতায় গেলে, এটা তো ঠিক যে গাঁয়ে ঢাকের যা বায়না হয় তার থেকে ঢের বেশি টাকার কাজ পাব! সেই টানেই তো তোমরা পুজোর মরসুমে কোলকাতায় ছোটো। তা আমার তো এ বছর এই প্রথম। শহরের বায়না-টায়না নেবার নিয়মকানুন বা পদ্ধতি কিছুই তো আমার জানা নেই। তুমি যদি আমাকে একটু জানাও তো অজানা জায়গায় গিয়ে আমাদের আর বিপাকে পড়তে হয় না।”
সঙ্গে সঙ্গে দিবাকরের তৈরী হওয়া মুখের খাঁজগুলো দেখে রতনের বুঝতে অসুবিধা হ’ল না যে ওর কাছে সাহায্যের আশা, হতাশায় পরিণত হতে চলেছে। মুখের বিকৃত ভাঁজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দিবাকর বলল, “ওসব অনেক হ্যাপা গো দাদা। কোলকাতার লোক বলে কথা। ওদের সঙ্গে কাজকারবার করা অত সহজ কথা না। আচার ব্যবহার এত বাজে যে ওইসব শিক্ষিত বাবুদের চেহারা বেশভূষা দেখে বোঝাই যাবে না এরা কতটা সুযোগ সন্ধানী। আমাদের মত সাদাসিধে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ওদের একদম মিল নেই। কথার খেলাপের মস্তবড় খেলোয়াড় ওরা। তোমাকে এক বলে বায়না করে নিয়ে গেল। তারপর পুজো শেষে টাকা দেবার সময় অন্য কথা বলবে। বলবে, তোদের সঙ্গে এত
টাকা দেবার কথা হয়নি। প্রায় অর্ধেক কমিয়ে বলবে, এত টাকা কথা হয়েছে। তাছাড়া তোদের এতদিন কমিটি থেকে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করা হ’ল। নতুন ধুতি, গেঞ্জি-গামছা দেওয়া হল। ওগুলো পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি বুঝি? তারপর তোরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যে বকশিশ পেলি? সে তো আমাদের পাড়ার মানুষ দিয়েছে। পাড়ার মানুষের দেওয়া মানে কমিটিরই দেওয়া হল। সবটা জুড়লে তোরা কত টাকা এ’কদিনে আয় করলি একবার ভেবে দেখেছিস? এমন সব উটকো বাহানা চাগিয়ে তুলে আমাদের টাকা মারার ধান্ধা করে ওইসব শহুরে ধূর্ত লোকগুলো। তোমাদের মত লোক ওখানে গিয়ে খাপ খুলতে পারবে গো না দাদা। তুমি যেও না। রাম-ঠকা ঠকে যাবে।”
দিবাকরের কথায় শহরে যাবার ইচ্ছেটা যেন থমকে গেল রতনের। এত বড়মুখ করে সে সনাতনকে রাজি করালো পুজোয় শহরে ঢাক বাজাবার জন্যে। নিমরাজি ছেলেটা শেষপর্যন্ত সায় দিল। তার মনেও নিশ্চয়ই একটা আশার আলো ফুলকি মেরেছে। সেখানে দিবাকর যদি এমন মনমরা কথা শোনায় তো ছেলেটারও শহরের মানুষজনের প্রতি একটা খারাপ ধারণা হবে। গোমড়ামুখে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে ফিরছিল রতন। উল্টোদিক থেকে পাড়ার যুবক ছেলে অভয় আসছে, সে দেখতে পায়। রতনের মনমরা মুখের ভাষা কেমন করে যেন ছেলেটা পড়তে পারে, “কি গো কাকা, মুখ ভার করে আছো কেন? তোমাকে তো কোনদিন এমন করে থাকতে দেখিনি? তাই বলছিলাম আরকি।” উত্তরে রতন বলল, “না, তেমন কিছু নয়।” তারপর হঠাৎ মনে পড়ল এই অভয়ও তো কোলকাতায় ডাকে যায় পুজোর ঢাক বাজাতে। দিবাকরের কথাটা ওর কাছে একবার ঝালাই করে নিলে হয়, “এই শোন, অভয়, তুই তো ফি বছর কোলকাতায় ডাকে যাস পুজোর ঢাক বাজাতে। আমি তো কোনদিন ওদিক মাড়ায়নি। ভাবছি এ’বছর পুজোয় কোলকাতায় ঢাক বাজাতে যাব। তা, কি রে যাব ওইসব জায়গায়? দিবাকর তো আমাকে একরাশ ভয় দেখিয়ে না যাবার পরামর্শ দিল। আমি নাকি রাম-ঠকা ঠকে যাব। সেইজন্যে ইচ্ছেটা যেন দম পাচ্ছিল না। তাই মনমরা হয়ে গেলাম।”
পাড়ার মুরুব্বিদের ওপর মনে মনে অভয়, বরেণদের রাগ এখনো ধিক ধিক জ্বলে। ওদের দাবি মত অলোকা-বিপ্লবদের কেসটা আটচালায় তুলতে দিল না ওরা। মুরুব্বিদের মধ্যে রতন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বরং বলা যেতে পারে রতনের উপরই ওদের বেশি খার। এবার অভয় বাগে পেয়েছে রতনকে। উল্টোপাল্টা বলে এমন ঘোল খাইয়ে দেবে যে বাছাধন হাড়ে হাড়ে টের পাবে। অভয়দের অবজ্ঞা করার মাশুল এবার ব্যাটাকে দিতে হবে। তাদের দুচ্ছা করার প্রতিশোধ নেবার জন্যে একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ও। এবার সেই
সুযোগ এসে গেছে। কাজে লাগাতে হবে। দিবাকর শুধু তাকে কোলকাতায় ডাকে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে। তাতে তো ব্যাটার বেঁচে যাবার পথ সুগম হয়ে গেল। একে তা করলে চলবে না। এমন বোয়াল মাছের ঝাঁকে ফেলতে হবে, যার খপ্পরে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়, “আরে কাকা, দিবাকর কাকা যা তোমাকে বলেছে একদম ফালতু কথা বলেছে। তুমি যাতে ওদের দলে ভিড়ে ওদের বায়নায় ভাগ বসাতে না পারো তাই অমন কথা বলে তোমাকে ভাগাতে চেয়েছে। ওইসব চুকলিবাজির কোন মানে হয় না। ভাল বায়না, খারাপ বায়না, যে যার ভাগ্যে জোটে। সেটাকে মেনে নিতে হবে। তাইবলে পাড়ারই একজন মুরুব্বি মানুষ কোলকাতায় ডাকে যেতে চাইছে, তাকে যেতে দিতে চায় না! একদম অনুচিত কাজ এটা। এর মাধ্যমে তুমি লোক চিনে নাও কাকা। কে আসলে মানুষের ভাল চায় আর কে চায় না।” দিবাকরের বিরুদ্ধে রতনকে খেপিয়ে অভয় এটাও করতে চাইল যে আটচালার ওই দুই মুরুব্বির মধ্যে যাতে একটা ভাঙন ধরানো যায়। এই দিবাকরও তাদের বিরুদ্ধে রতনদের উসকে দিয়েছিল। অভয় বলল, “কাকা, তুমি কোন জায়গার ঢাকের হাটে বসতে চাও? হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদা স্টেশন, বাবুঘাট, ধর্মতলা, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে বা দক্ষিণ কোলকাতার টালিগঞ্জ। মোটামুটি কোলকাতার এইসব ঢাকি হাটে সবাই গিয়ে বসে পাঁচ’ছ দিনের জন্যে ঢাক-ঢোল সমেত নিজেদের বিক্রি হতে। পূজামন্ডপের বাবুরা ওইসব জায়গায় এসে ঢাক-ঢোলের বায়না করে যায়। এছাড়া আরও অনেক জায়গায় ঢাকির দল, ঢোলের দল এসে জড়ো হয়। এবার তোমার কোথায় যাবার মন চায় সেটা বলতে হবে। আমি তো প্রায় সব জায়গায় বসেছি। মোটামুটি সবকটার অভিজ্ঞতা আমার আছে।”
-তাহলে তুই নিজেই বল না অভয়। কোনটা গেলে আমার সুবিধা হবে। পয়সাও একটু বেশি পাওয়া যায়।
-আমার ওপর যদি ছেড়ে দাও তাহলে বলব তুমি শিয়ালদাতে যাও। যেমন প্রচুর খরিদ্দার তেমন ঢাক-ঢোল এসে সরগরম করে দেয় গোটা স্টেশনের সামনের চত্বর। তুমি প্রথম যাচ্ছ তো। দেখবে কেমন অভিজ্ঞতা হয়। যা তোমার জীবনে হয়নি। হ্যাঁ, আর একটা কথা, একদম ভোর ভোর শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। আগে না গেলে ওই ঢাক নিয়ে দাঁড়াবার জায়গা পাবে না। সেইসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখি কাকা, কোন সময় ঢাক-কাঁসিকে একলা ছেড়ে পাশের অন্য কারোর জিন্মায় রেখে এদিক ওদিক যাবে না। পেচ্ছাপ করতেও না। তুমি যাবে তো সনাতন থাকবে আর সনাতন যাবে তো তুমি থাকবে। কোলকাতা খতরনাক জায়গা। বিশেষ করে ওইসব ভিড়ভাট্টা এলাকায়। চোর ছে্যঁচোড় হাত সাফাইঅলাদের স্বর্গরাজ্য ওগুলো। মুহূর্তের মধ্যে কোথা দিয়ে কখন যে অতবড় আস্ত ঢাকটাই হাওয়া করে দেবে ভাবতে পারবে না। গাল হাঁ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তখন।
অভয়ের কথায় ‘ভয়’ ‘অভয়’ দুটোই পায় রতন। আর কথা না বাড়িয়ে বুকে সাহস জুগিয়ে মনে মনে বলে,“ঠিক আছে অভয়, তুই যখন বলছিস তখন শিয়ালদাতেই আমরা যাবো। আর তো বেশিদিন নেই। ততদিনে এদিকে ঢাকটাকে সুন্দর করে টানটোন দিয়ে গুছিয়ে গাছিয়ে একদম নতুন করে রাখি। তুই ভরসা দিলি বলে আমিও মনে বল পেলাম। না তো দিবাকর যেভাবে আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল। তোর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো এ বছর আমাদের কোলকাতায় যাওয়াই হত না।”
চলে গেল রতনবুড়ো বগল বাজাতে বাজাতে। অভয় পেছন ফিরে সেই যাওয়া দেখে আর মনে মনে মজা উপভোগ করে, “অভয় তোমায় উপকার করেছে কি অন্য কিছু করেছে তা তুমি শিয়ালদাতে গেলে বুঝতে পারবে, কাকা। এক-বছর সে গিয়েছিল ওখানে। কেঁদে কুল পায় নে। আর কোনদিন মুখেও আনে না শিয়ালদার ওদিক মাড়াবার কথা। জীবনেও আনবে না তা। তাই বলে কি ঢাকিরা ঢোলিরা ওদিকে যাচ্ছে না? যাচ্ছে। প্রচুর যাচ্ছে। ওইসব উৎপাত সামলাবার ক্ষমতা, সাহস যাদের আছে, তারা জেনেশুনে যাচ্ছে। কেউ না জেনে যাচ্ছে। কেউ লাভ করছে, কারোর লোকসান হয়ে যাচ্ছে, আবার কারোর সর্বনাশও হচ্ছে। এবার রতনকাকা, তুমি দেখো কোন্ ডাব্বায় তুমি হাবুডুবু খাবে। বুড়ো হাড়ে আর একবার পরীক্ষায় বসো।”
চতুর্থী থেকে শুরু হয় ঢাকিদের শহরে আসার প্রক্রিয়া। প্রথম বছর বলে রতনরা, বাপ-বেটা চতুর্থীতেই অভয়ের কথা মত ভোর-ভোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ভোর চারটেয় ৮৩ নং রুটের ফার্স্ট ট্রিপের বাসে সনাতনকে নিয়ে চড়ে বসে। একদম শেষে নামবে। বাবুঘাটে। সেখান থেকে শিয়ালদামুখী বাসে শিয়ালদা স্টেশন। অচেনা অজানা সময়-দরিয়ায় ভাসিয়ে দিল বাপ-বেটা নিজেদের ভাগ্যকে! সম্বল শুধু দু’জনের দুই-দুই চার হাতে চারমুঠো সাহস আর কৌতূহল!
বাসের ড্রাইভারের কেবিনের বাইরের প্রথম কাটা সিটের সামনে তাদের ঢাক আর লাগেজ ব্যাগটা রাখল, রতন-সনাতন। সিটদুটো আমতলায় খালি হবে। কন্ডাক্টরের কাছ থেকে জেনে ওই সিটের সামনে রতনরা বাপ-বেটা দাঁড়ালো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কতক্ষণ আমতলায় আসবে সেই প্রত্যাশায়। আমতলায় আসার আগে কৃপারামপুরে সিট খালি হয়ে গেল। যেমন নির্দিষ্ট জায়গায় আসার একটু আগে লোকে সিট ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আরকি। রতন ছেলেকে বলল জানলার ধারে বসতে। বাচ্চা ছেলে, প্রকৃতি দেখতে দেখতে কোলকাতার দিকে এগোবে। ঠাকুরপুকুর পেরলেই কোলকাতা দেখবে। ধারে না বসলে তো কোলকাতা দেখার স্বাদ মিটবে না। রতন বলল, “জানিস খোকা, বাস থেকে নামার সময় তুই কাঁসরের ঝোলাটা আর আমাদের জামাকাপড়-খাবারের ব্যাগ নিবি। আমি ঢাক নেবো। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রাখবি। দেখবি, কেউ যেন আবার ছিনিয়ে নিয়ে না পালায়।”
-তুমি ঠিক করে নেমো বাবা। ঢাকের যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমি ঠিক নেমে যাব। আমার জন্যে চিন্তা করতে হবে না। আর বাস একদম খালি হয়ে গেলে সবার শেষে আমরা নামব। তাহলে অত টেনশান করতে হবে না।
বাবুঘাটে নেমে রতনরা দেখে নদীর দিকে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় অনেকে ঢাক-ঢোল নিয়ে জড়ো হয়েছে আর যে যার মত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। তা দেখে সনাতন বলল,“বাবা, ওই তো ওরা ওদিকটা ঢাক নিয়ে বসেছে। চলো, আমরাও যাই। ওদের সঙ্গে মিশে যাই। ওদের কাছে খদ্দের আসলে আমাদের কাছেও আসবে।”
-না রে খোকা। অভয় বলেছে, শিয়ালদায় প্রচুর খদ্দের আসে। ওখানে জমজমাট খুব। এখানে এই ক’জন জমেছে। নিশ্চয়ই খরিদ্দার এখানে কম আসে। কোলকাতার আদত কি জানিস, এক জায়গায় একই জিনিসের বহু দোকান। জামাকাপড়ের দোকান তো এক জায়গায় বহু জামাকাপড়ের দোকান। মশলা দোকান তো পরপর সারি দিয়ে একই দোকান। একে ‘পট্টি’ বলে। কাপড় পট্টি, মশলা পট্টি। এই ধরণের সব। এর ফলে হয়কি মানুষ স্রোতের মত ওই পট্টি বাজারে ধেয়ে আসে। এ-দোকান, সে- দোকান ঘুরে মানুষ পছন্দমত জিনিস কিনতে পারে। ঠিক আমাদের এই ঢাক-ঢোলের বেলায়ও তাই। শিয়ালদা, হাওড়া ইত্যাদি নামকরা জায়গায় প্রচুর ঢাক-ঢোল যেমন বসে তেমন মানুষও ছুটে যায় নিজেদের পছন্দের বাজনা বায়না করতে। সেইজন্যে বলছি, যেখানে অনেক লোক সমাগম সেখানে গেলে ভাল দামে আমরা বায়না পেতে পারব। চল না, আগে শিয়ালদায় যাই। ওখানে যাবার জন্যে বাড়ি থেকে মনঃস্থির করে এসেছি। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে’খন।
সকাল সাতটার মধ্যে রতনরা শিয়ালদা স্টেশনের সামনে বাস থেকে নামে। ওখানেই একটু সরে এসে ফুটপাতের ওপর খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। ছেলেকে বলে, “তোর পেচ্ছাপ পেয়েছে, সনাতন? তাহলে যা। ব্যাগট্যাগ আমার কাছে দে। ওই যে, সব লোকে পেচ্ছাপ করে বার হচ্ছে। যা ওখান থেকে কাজ সেরে আয়। তুই এলে আবার আমি যাব। এইসব কাজ সেরে নিয়ে আসল কাজে গিয়ে ভাল করে মন দেওয়া যাবে। নাহলে মন ছোঁক ছোঁক করবে কখন পেচ্ছাপে যাব। ঝপাঝপ ওরা কাজ সেরে নিজেদের জিনিস নিয়ে স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে। যাবার পথে পরপর সার দেওয়া চা, লুচি-কচুরির দোকান। মাথায় কালো পলিথিনের ছাউনি। বোঝাই যায় ফুটপাথে গাজোয়ারী করে বসা। ছেলেটা এমন মুখচোরা, কিছুতেই খাবার কথা বলবে না। খুব খিদে পেলেও না। রতন বলল, “কিরে খোকা এইবেলা একটু জলখাবার খেয়ে গেলে হয় না? কখন সময় পাব না পাব।” সনাতন চুপ করে থাকে। একটা দোকানের সামনে রতন ঢাকটা নামায়, “চল এই দোকানে। চা-কচুরি খেয়ে নিই।” খেতে খেতে রতন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে ঢাক, ঢোলের বাজার কেমন দাদা?”
“ভাল। যান, ওই ডানদিক বেঁকে স্টেশনের চত্বরে ঢুকে যান। দেখবেন আপনার মত কত লোক এতক্ষণে এসে জুটে গেছে। খেয়ে দেয়ে আর কোথাও দেরি করবেন না। দাঁড়াবার জায়গা পাবেন না।”
আর কথা না বাড়িয়ে রতনরা দ্রুত টিফিন সেরে রওনা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে খান দশেক ঢাকি-ঢোলির দল এসে গেছে। জনা তিনেক তাদের মত ঢাকি আর বাদবাকী সব ঢোল পার্টি। ওরাই তো ভিড় বাড়িয়ে দিয়েছে। এক একটা ঢোল পার্টি তো তিনজনের কম হয়না। বাঁশি নিয়ে চারজন। আর ঢাকিরা দু’জন। ঢাক আর কাঁশি। কোন কোন ঢাকির দলে অবশ্য দু’জন বা তিন’জন ঢাক থাকে। তাবে কাঁশি একজন। দু’জন থাকে, তা খুব কম। লাইনের সবশেষে যে দল দাঁড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় রতনরা। সঙ্গে সঙ্গে পাশের লোকটা বলে, “এখানে না, এখানে না। এখানে লোক আছে। তফাতে যান। উড়ে এসে জুড়ে বসতে এসেছে। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে জানেন তো? যান, দূরে সরে যান?” লোকটার কথায় থমকে যায় রতন! পাল্টা বলে, “কেন,আমি তো আগে এসেছি। আমার পরে যে আসবে সে পরে দাঁড়াবে? আপনার লোক কোথায়? দেখছি না তো!” এবার লোকটা আরও বিরক্ত হয়ে বলল, “যা বলছি শুনুন। না হলে ঝামেলা হয়ে যাবে। বলছি তো আমার লোক আছে। যখন আসবে দেখতে পাবেন।”
রতন আর কথা বাড়ালো না। নতুন এসেছে। কোথায় কি ব্যাপার আছে বুঝতে পারছে না। আসা মাত্রই লোকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রথমেই মেজাজ খিঁচে গেলে, সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। সব গোলমাল হয়ে যাবে। পাশের লোকটার কথামত যতটা তফাত করে দাঁড়াতে বলল ততটাই দূরে ওরা দাঁড়াল। বেলা তখন এগারোটার মত হবে। হঠাৎ খানতিনেক ঢোলের দল হুড়মুড়িয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল, “ও দাদা, এ’বছর ‘বউনি বছর’ বুঝি? কেটে পড়ুন এখান থেকে। নাম্বার আছে, নাম্বার? কত নাম্বার আপনার, দেখান দেখি?” রতনকে জিজ্ঞেস করে সেই আগের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের লাস্ট নাম্বার কত, পনেরো? আমার
ষোল। সরুন, সরুন। সরে যান। সেই দূরে গিয়ে দাঁড়ান। নাম্বার নেই মানে হটে যান।” এবার বিস্ময়ে রতন জিজ্ঞেস করল,“হটে যাব কোথায়? সেইখানটায় প্রথমে দাঁড়িয়েছিলাম। ওনারা বলল এখানে দাঁড়াতে। আবার আপনি হটতে বলছেন। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছি না।”
-আপনাকে অত বোঝাবার জন্যে আমরা এখানে আসিনি। পয়সা কামাতে এসেছি। যা বলছি তাই করুন। নাম্বার নেই তো আপনার কোন ঠাঁই নেই। কেটে পড়ুন। তফাতে যান, তফাতে।
কোথায় কি হচ্ছে, রতন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। দল দল আসে আর রোয়াব দেখিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়। পাল্টা রোয়াব রতন দেখাতে পারে। কিন্তু এদের এই রোয়াবের রহস্য তো তার জানা নেই। তার বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে বড় কোন বিপদে পড়ে যাবে না তো? এবার মনের মধ্যে আতঙ্ক বাসা বাঁধতে থাকে। এ কোথায় এসে ওরা পড়ল রে বাবা! কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছে না। আবার কি সব নম্বর টম্বরের কথা বলছে লোকগুলো! কোথা থেকে এরা নম্বর পাচ্ছে, কারা নম্বর দিচ্ছে। কেউ তো খোলসা করে কিছুই বলতে চাইছে না। সরকার থেকে এমন কোন ব্যবস্থা থাকলে তো অভয় তাকে শিখিয়ে দিত। সে তো এসবের কিছু বলেনি ! আতঙ্কিত হয়েই এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,“হ্যাঁরে সনাতন, ব্যাপারটা কি হচ্ছে বলতো বাবা? আমার তো মোটেই ভাল ঠেকছে না। তুই কিছু বুঝতে পারছিস? মানে, কেউ ঢাক ঢোল কাঁশি বাঁশি নিয়ে এখানে এলো আর বায়নার জন্যে মুক্ত আকাশে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাপারটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে অত সোজা সরল হিসেবের নয়। সবকিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে।” বাবার মনে এমন সন্ত্রস্ত ভাব দেখে সনাতনও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে। ভাবল, বাবাকে সাহস যোগাতে হবে। লোকের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে তাকেও মুখ খুলতে হবে। কিন্তু অন্যায় কিছু দেখলে তো তার মাথা গরম হয়ে যায়। সরাসরি প্রতিবাদ করা ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প কিছু থাকে না। তখন আবার বাবা তাকে সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়। সে তো পরের কথা, এখন এই ব্যাপারটার পেছনে অন্য কোন শক্তি কাজ করছে নিশ্চয়ই। নাহলে লোকগুলো নাম্বার বা কোথা থেকে পাচ্ছে আর এত মেজাজ দেখানোর সাহস বা এরা পায় কেমন করে ! তারপর এরা তাদের খুলে কিছু বলছে না। বললে ওরা সেইভাবে না হয় এগোতে পারে। সনাতন বুঝতে পারে ঘটনাগুলো চুপকে চুপকে হচ্ছে। তাই কেউ প্রকাশ্যে খোলসা করে কিছু বলতে চাইছে না। সেইভাবেই সবাইকে বলা আছে নিশ্চয়ই, “জানো বাবা, এই ঘটনার পেছনে অন্য কোন বড় শক্তি কাজ করছে। এই যে নাম্বারের কথা ওরা বলছে, এটা কোন সরকারি ব্যবস্থা নয়। তাহলে সরকার আগে থেকে মানুষকে জানাতো। আর এই লোকগুলো খোলসা করে সব বলে দিত। কিন্তু এই জায়গা তো সরকারি জায়গা। এখানে যে কোন মানুষ আসতে পারে। আমাদের বারবার হটিয়ে দিয়ে এই লোকগুলো যে জায়গা দখল করে নিচ্ছে তা তো পুরোপুরি বেআইনী কাজ করছে। অন্যায় করছে। অন্যায় করছে আবার চোখ রাঙাচ্ছে। আর আমরা সেই চোখ রাঙানিতে বারবার পিছু হঠছি। ওই ‘চোরের মা’র বড় গলা’র’ মত আরকি। ওই তো পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। ওদের গিয়ে বললে হয় না বাবা, আমাদের এই লোকগুলো এখানে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। শুধু ওরাই ঢাক ঢোল বাজাবে। আমরা বাজাবো না? পেট শুধু ওদের আছে, আমাদের নেই? আমরা বানের জলে ভেসে এসেছি বুঝি? সরকারি জায়গায় ওরা হটিয়ে দেবার কে? তুমি এখানে দাঁড়াও বাবা। আমি ওই পুলিশদের কাছে নালিশ জানাই। দেখি ওরা কি করে। ওরা প্রশাসনের লোক। নিশ্চয়ই আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেবে।”
সনাতন পুলিশদের গিয়ে বলতে একজন তো ক্ষেপে তার দিকে হাতের রুলবাড়ি উঁচিয়ে ধেয়ে এলো, “একটুখানি ফোচকে, আবার বড় বড় কথা! সরকারি জায়গা, সবার বসার হক আছে। যা, হটে যা। তোদের ওইসব ফালতু কথা শোনার জন্যে আমরা এখানে ডিউটি করছি না। জানিস, সরকারি জায়গায় বসতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগে? তা তোদের আছে? এমন লাঠিপেটা করব না, একদম এলাকা ছাড়া করে দেবো।” পুলিশটা হঠাৎ তার ওপর অমন করে ক্ষেপে যেতে থতমত খেয়ে যায় সনাতন। তার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। মনে হচ্ছে পা বাড়াতে গেলে সে উল্টে পড়ে যাবে। মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বাবার কাছে ফিরে আসে। মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে। সেই সময় হঠাৎ অনেকগুলো লোক হুড়মুড়িয়ে তাদের ঘিরে ফেলে। লাইনের পেছনে তাদের বাপ বেটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হাতে নাম্বারের কাগজটা নিয়ে পরপর নাম্বার মিলিয়ে দাঁড়াতে থাকে। তাদের ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিতে রাগ তার মাথায় চড়ে বসে! সে তখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার সামনের দু’জনকে ঠেলে ফেলে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়,“শালা, সেই সকাল সাতটা থেকে আমরা এখানে এসে লাইন দিচ্ছি আর এক একটা দল এসে আমাদের জোর করে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা জায়গা দখল করে নিচ্ছে? গায়ের জোর আমাদেরও আছে। কিচ্ছু বলিনি বলে ভেবেছে ধুর পার্টি না?”
তার ছেলে এমনি শান্তশিষ্ট। কিন্তু অন্যায় দেখলে ভেতরে ভেতরে ও কেমন গোমরাতে থাকে। তার উপর সেই অন্যায়কারি যদি সরাসরি তাকে জড়িয়ে অপকর্ম করে তো ও মাথা ঠিক রাখতে পারে না। কিন্তু সব জায়গায় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায় না। নিজের জীবন বিপন্ন হবার জোগাড় হতে পারে, সেই বুদ্ধি তখন তার কাজ করে না। রতন এবার প্রমাদ গুনতে থাকে। কি না কি ক্ষতি তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। যে লোকটা সনাতনের ঠেলাতে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ঠোঁট কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এই রক্ত দেখে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সন্ডা সন্ডা চেহারা। সেখানে সনাতন ছিপছিপে রোগা। মল্লযুদ্ধে সন্ডাটার কাছে সে পেরে উঠবে কেন! ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ডাটা সপাটে সনাতনের থুতনিতে মারলো এক ঘুসি! ছেলের নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। তাই দেখে রতন বিকট জোরে চিৎকার করতে শুরু করল! আশপাশ থেকে লোক জড়ো হয়ে গেল। যে তিনজন পুলিশ কাছাকাছি এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল তারা এখন হাওয়া! কোন পুলিশের দেখা নেই। ভিড়ের মধ্যে একজন রুমাল ভিজিয়ে সনাতনের মুখে চেপে ধরল। একজন আবার দৌড়ে ফেরিওলার কাছ থেকে একটা আইসক্রিম এনে ওই ভিজে রুমালে জড়িয়ে সনাতনের গোটা মুখ বুলিয়ে দিয়ে রতনকে বলল, “আপনি এইভাবে ওর সারা মুখে খানিকক্ষণ বুলিয়ে দিন। একটু পরেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। জড়ো হওয়া লোকজন এই মারপিটের কারণ শুনতে শুনতে একজন রতনকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাছে নম্বর নেই তবু আপনি এখানে এসে গুঁতোগুঁতি করছেন কেন? আপনি জানেন না, নম্বর ছাড়া এখানে দাঁড়ানো যায় না? শুধু আজ কেন ষষ্ঠি-সপ্তমী এসে গেলেও কেউ আপনাকে দাঁড়াতে দেবে না। আপনি লাথ খেতেই থাকবেন। শেষ পর্যন্ত মোক্ষম লাথ খাবেন ‘হাতকাটা ছেনোর’লোকের কাছে।”
-সেইটাই তো আমি সেই সকাল থেকে জানতে চাইছিলাম, ওই নম্বর ব্যাপারটা কি? কিন্তু কেউ আমাকে খোলসা করে বলতে চায়নি। আমি তো এ’বছর এই প্রথম এখানে এসেছি। আগে কোনদিন আসিনি। তাই এখানকার আদবকায়দা আমার জানা নেই। লোক শুধু খেদিয়েই চলেছে আমাদের।
সনাতনের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে মনে হয় লোকটার মনে একটু দয়া জেগেছিল। তাই রতনদের ভিড় থেকে আলাদা করে ডেকে ফাঁকায় নিয়ে এলো, “এই ছেলেটা আপনার কে হয়? নিশ্চয়ই ছেলে? না কি?” রতন হ্যাঁ বলতে লোকটা বলল, “এই ব্যাপারটা একদমই বেআইনী এবং গোপন ব্যাপার। সেইজন্যে কেউ আপনাকে খুলে কিছু বলবে না। নিষেধ আছে। যে বলতে যাবে, তার বিপদ। আমিও যদি প্রকাশ্যে বলি আমারও বিপদ। আমাদের ঢোল পার্টির নম্বর বাইশ। বাচ্চাটার নাকেমুখে রক্ত দেখে মনটা খারাপ লাগল। এর বয়সী আমারও ছেলে আছে। আমাদের দলেই আছে। এখন দেখালে আপনি এই জায়গা থেকে বুঝতে পারবেন না। ছেলেটাকে দেখে আমার ছেলের মুখটা ভেসে উঠল। তাই উপযাচক হয়ে আপনাদের ফাঁকায় ডেকে আনলাম। আপনারা কিছুই জানেন না। না জানলে এইভাবে আপনাদের উপর আঘাত আসতেই থাকবে। শুনুন, ‘হাতকাটা ছেনো’কে মস্তানি ফি না দিয়ে কোন ঢাক বা ঢোলের দলের এখানে দাঁড়াবার আইন নেই। এটা শিয়ালদা স্টেশনের মস্তান, হাতকাটা ছেনো-মস্তানের আইন। পুলিশী আইন এ’চত্বরে চলে না। পুলিশ এখানে ‘গোপাল ঠাকুর’। এই যে মারপিট হল, আপনাদের প্রতিপক্ষ ছেনোর কাছে নালিশ জানাতে যায়নি বলে রক্ষে। না হলে ওর স্যাঙাতরা এসে উত্তম মধ্যম কেলিয়ে এই এলাকা ছাড়া করে দিত আপনাদের। এর পরেও যদি আপনারা এখানে দাঁড়াতে চান তাহলে বলি, ওই যে বড় গেট দেখতে পাচ্ছেন। ওখান দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেবেন। পা গুনে দশ পা এগোবেন। তারপর ডানদিকে দেখবেন কালো পলিথিন টাঙানো পরপর দুটো চা দোকান আছে। ওই চা দোকান দুটোর মাঝে ফুট চারেকের ফাঁক আছে। ওই ফাঁকটা কালো পলিথিনের পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দাটা সরিয়ে আধ মিনিট এগোলে এন. আর. এস. হাসপাতালের পাঁচিলের গা ঘেঁসে একটা ক্লাবঘর মত আছে। সামনে দু’ফুটের বারান্দা, তারপর ঘর। ঘরটা আলোতে ঝলমল করছে। টিভি চলছে। আট-দশটা জিনস্ পরা ছেলে হইহুল্লোড় করছে। আর একজন একটা কাঠের চেয়ারে বাদশার মত বসে আছে। চোখদুটো তার টকটকে লাল। সবসময় চুল্লুতে চুর হয়ে আছে। ওখানে গিয়ে শুধু বলবেন, আমি নম্বর নিতে এসেছি। তারপর যা বলার ওরা সব আপনাকে জামাই আদর করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে। কোন অসুবিধা হবে না। আর একটা কথা, যদি চারফুটের গলিটা চিনতে না পারেন তো যে কোন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করবেন ছেনো স্যারের অফিসটা কোথায় ? সঙ্গে সঙ্গে সেই দোকানদার, দোকানের খদ্দের ফেলে ‘ঠাট’ মানে দোকানের ভেতরে তার বসার জায়গা থেকে নেমে এসে আপনাকে দেখিয়ে দেবে, ছেনো স্যারের অফিস! যান, আপনার তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় সটকে পড়ুন এখান থেকে। অধিকার আদায় করে আবার বুক উঁচিয়ে ফিরে আসুন। দাঁড়িয়ে পড়ুন আপনার জন্যে নির্দিষ্ট নম্বরে। তখন আর কোন ‘মা-কা-লালের’ মানে মায়ের ব্যাটার সাহস হবে না আপনাকে বাধা দেবে।”
মার খেয়ে ছেলেটার দুটো ঠোঁটই ফুলে টোবলা হয়ে গেছে। দু’পয়সা রোজগার করতে এসে এ’ভাবে ওরা অপদস্ত হবে তা কল্পনাই করতে পারেনি, রতন। কষ্টে ভেতরটা যেন কঁকিয়ে উঠছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে আরও যেন দুমড়ে পড়ে মনটা। একবার মনে হচ্ছে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। দরকার নেই টাকা রোজগার করে। পাড়াগাঁয়ে থেকে যা রোজগার হয় তাই ভাল। বেশি লোভে কাজ নেই। আবার মনে হয়, মার যখন খেয়েছি তখন এর শেষ দেখে তবে যাবো। লড়াই না করে ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়া ভীরুতা ছাড়া আর কিছু নয়। তবু ছেলেটা কি বলে একবার জিজ্ঞেস করে দেখা যাক, “হ্যাঁরে খোকা, এখন কি করা যায় বলতো? বাড়ি ফিরে যাবো, না হাতকাটা ছেনোর ডেরায় যাব? তুই কি বলিস?”
-বাবা, এসেছি, অপদস্ত হয়েছি, মার খেয়েছি। দু’পয়সা রোজগার করার জন্যে। পেটের দায়ে। অত সহজে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে তো জীবন ভর পালিয়ে বেড়াতে হবে। লড়াই না করে কে বেঁচে আছে বাবা? পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আমরা মানুষ। গরিব মানুষ থেকে বড়লোক পয়সাওলা মানুষ। কে না লড়াই করছে। তা আমরা কেন লড়াই না করে ফিরে যাব? তাহলে তো অভয়রা আমাদের দেখে হাসবে। ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি বলে টিটকারি করবে। হারার আগে হেরে বসে থাকাটা ঠিক হবে না বাবা। চলো আমরা হাতকাটা ছেনোর কাছে যাই। দেখি, ওর কি কেরামতি। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। তবে অত সহজে আমরা বাড়ি ফিরছি না বাবা। সাহস বুকে নিয়ে এগোলে দেখবে, মা শীতলা আমাদের ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবে। আসার সময় আমার মা তো বলে দিয়েছে, বিপদে মা শীতলাকে ডাকবি। মা ঠিক তোদের পাশে এসে দাঁড়াবে। যাবতীয় বাধাকে জয় করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।ক্রমশ…..
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৮)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[আঠারো]
মিলন, মিলন-বউ মেয়ে অলোকাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ওদের সমাজে দেখতে শুনতে ভাল কোন সন্তান জন্মানোটা সত্যি সত্যি যেন মহাপাপ। মেয়েটা যত বড় হচ্ছে তত যেন মেয়েটার আর সেইসঙ্গে ওদের সামনে বিপদ হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্যে কাঁছা বাগাচ্ছে। বিপ্লবকে নিয়ে এই গন্ডগোলটা না পাকালে জানাই হ’ত না পাড়ার বখাটেরা তার মেয়ের পেছনে পড়ে গেছে। আচ্ছা, কি যোগ্যতা আছে নিষ্কর্মা ওই ছোঁড়াদের? এক পয়সা রোজগার করার যোগ্যতা নেই। বাপের হোটেলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। তাদের আবার সুন্দরী মেয়ে দেখে তার উপর হামলে পড়ার শখ। প্রেম করে ‘বে’ মারাবে। আরে বেটাচ্ছেলে, ‘বে’ মারিয়ে বউকে ঘরে তুলবি যে, তার আগে সেই বউয়ের ভরণ-পোষণের যোগ্যতা দেখা। দেখা মরদের জোর। তার পর তো। তা না, এদিকে ‘নোনুর’ জোর ফলাবার জন্যে উতলা হয়ে পড়েছে, হারামজাদারা ! অলোকা যদি খেঁদি-বুঁচি হত তো তাদের এই সকাল-সকাল এত বিপত্তির মধ্যে পড়তে হত না। পাড়ায় আরও তো ওর বয়সী মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বাবা-মা’দের তো এত ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না! অলোকা ওদের পাত্তা দিচ্ছে না বলেই মেয়েটার বদনাম দিতে হারামি বাচ্চারা বিপ্লবকে নিয়ে ক্যাচাল শুরু করে দিয়েছে। আরে মেনিমুখোরা, তোরা ওই বিপ্লবের নখের যগ্যি হতে পারবি? ওর মত নম্র, ভদ্র, সভ্য ছেলে পাওয়া এ’বাজারে মুশকিল। এ-অব্দি ও লেখাপড়া যা শিখেছে তার ধারেকাছে আসা তো তোদের এ-জম্মে আর হল না। সরকারের মিড-ডে-মিলের দৌলতে কেউ তিন কেলাস কেউ চার কেলাস পর্যন্ত দৌড় দেখিয়েছিস। তোদের আবার অত বীরত্ব কিসের ? বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াবার সাহস দেখাস! এবার রাগে গরগর করতে করতে মিলন মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে অলোকা, ওই বখাটে ছেলেরা যে স্কুলে যাবার সময় তোর পেছনে লাগে তা তো তুই কোনদিন বলিসনি? আমাকে না বলিস, না বললি, তোর মা’কেও তো বলিসনি? জানতে পারলে ওদের এই বাড়-বাড়ন্ত কবে ঘুচিয়ে দিতাম? আটচালায় শয়তানদের পেড়ে ফেলে মেয়েদের পেছনে লাগার সাধ মিটিয়ে দিতাম!”
মিলনের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে বুঝে অলোকার মা বলল, “মেয়ে আমাকে ওই অভয়দের কথা একদম যে বলেনি তা নয়। আমি বলেছি, ওদের কথায়, আচার আচরণে তুই কান দিবি না। ওদের পাত্তা দিলেই ওরা মাথায় উঠবে। দেখবি একদিন দমে এলিয়ে গিয়ে ওরা চুপ মেরে যাবে। তোর পেছনে লাগার জোশ হারিয়ে ফেলবে। আর এইসব খুচখাচ কথা পুরুষদের কানে শোনালে হিতে বিপরীত হয়। তাই আমি তোমাকে জানাই নি। এখন তো দেখছি সেই ভাবনা ভুল। যা ভেবেছিলাম তার থেকে ওরা আরও বেয়াড়া দেখছি। ওর লোভে পড়ে গেছে বেহায়ারা। এখনই এসব আটকাতে না পারলে বেড়ে যেতে পারে ওদের লালসা।”
অলোকার মায়ের কথায় মিলনের ভেতরে রোখ আরও যেন চেপে বসল। ঠিক করল ব্যাপারটা যখন প্রকাশ্যে ফুটে উঠেছে তখন এটাকে ধামাচাপা দিতে গেলে একটা সময় তা আরও শক্তি সঞ্চয় করে ধামা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়বে। তখন তাকে সামাল দেওয়া তার ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তাই একে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। আটচালা বসিয়ে এর একটা বিহিত করতেই হবে। সময় নষ্ট না করে মিলন পাড়ার অন্যতম মুরুব্বি-বিচারক- নন্দ, রতনের কাছে নালিশ জানাবে মনস্থ করল। রতন এমনিতেই ব্যাপারটা জানে। ওর সামনে আর নতুন করে বেশি কথা কাপচাতে হবে না। নন্দরও আর অজানা কিছু নেই।
মিলনের নালিশ পেয়ে রতন যেন মনে মনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। ওই ছোকরাগুলো সেদিনের পর থেকে বেশ কয়েকবার তাকে চাপ দিয়ে আসছে আচটালা বসাবার জন্যে। তাদের মতে সেদিন বিপ্লব আর অলোকা পাড়ার মধ্যে বেলল্লাপনা হয়েছে, তাতে তাদের পাড়ার সুনাম নষ্ট হয়েছে। বে-পাড়ার ছেলে এসে পাড়ার মধ্যেই পাড়ার মেয়েকে নিয়ে ফুসফুস গুজগুজ করে জঘন্য অন্যায় কাজ করেছে। দু’জনকেই আটচালায় ডেকে বিচার করতে হবে। ছোকরাদের অভিযোগ একদম ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারছিল না সে। ওরা যে নিয়মটার কথা বলছে, তা তো আটচালা থেকেই চালু করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, “তাদের রুইদাসদের জাতের অর্থাৎ মুচি সম্প্রদায়ের জাত-কৌলিন্য ঠিক রাখতে গেলে অন্য জাতের কারোর সঙ্গে সম্বন্ধ করে হোক বা ভালবাসা করে হোক বিয়ে করা তো কোন ছার, মেলামেশাও করা যাবে না।” সেই বিধানে ওরা এই ঘটনাটা জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু ওই বিধানে তো লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও মেলামেশা করতে পারবে না, সে কথা বলা নেই। তাহলে তো পাড়ার কোন মেয়ের আর স্কুল পাঠশালায় পাঠানো যাবে না। স্কুলে পাঠালে তো ছেলেমেয়েরা মিলমিশ করেই পড়াশোনা করবে। সেই যুক্তিতে রতন অলোকার সঙ্গে পাল পাড়ার ছেলেটার কথা বলাতে কোন দোষ দেখছে না। তাছাড়া ছেলেটা তো তাকে পড়ার বই-খাতা দিতে এসেছিল। সে যদি আটচালার বিধিনিষেধের গেরোয় এই পাড়ায় না আসে তো মিলনের মেয়েকেই পর-পাড়ায় যেতে হয়। আর পাল পাড়ায় এইসব মেলামেশার কড়াকড়ির কোন বালাই নেই। অবাধে ছেলেমেয়েরা কথাবার্তা চালায়। এত গভীরে গিয়ে ভাবার ক্ষমতা যদি এইসব ছোকরাদের থাকতো তো এদের অনেক দাম হয়ে যেত। মুর্খদের সেকথা বুঝিয়ে বললেও মুর্খরা বুঝবে না। বিচারশালায় বসিয়ে ঘাড় মটকে যদি বোঝানো যায় তো তবে যদি ওরা বোঝে।
রুইদাস পাড়ার ছেলেরা তাকে যেভাবে হেনস্থা করল তা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না পালপাড়ার ছেলে বিপ্লব। হয়তো মেয়েটার রূপের প্রতি তার একটা আলগা টান জন্মেছিল। মনে মনে অলোকাকে যে সে ভালবেসে ফেলেছে, তা কিন্তু ও স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। মেয়েটার থেকে ও দু’ক্লাস উঁচুতে পড়ে। টিউশানি পড়ার সময় অমর স্যার বলেছিল, “বিপ্লব, তোর তো এইচ. এসের পুরোনো টেস্ট পেপার বাড়িতে পড়ে আছে। সেটা অলোকাকে দিতে পারবি না? নাকি, অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছিস? ওর বাবা এখনো ওর জন্যে টেস্টপেপার কিনে উঠতে পারেনি। আর যে নোটসগুলো দিয়েছিলাম তার একটা জেরক্স কপি অলোকাকে দিয়ে দিস। জেরক্সের দাম আমি তোকে দিয়ে দেব। ইতিমধ্যে ওগুলো যদি কাউকে দিয়ে দিস তো তার কাছ থেকে নিয়ে জেরক্স করে ওকে দিয়ে দিস। যেহেতু তুই-অলোকা একই গ্রামে থাকিস এবং পাশের পাড়ায় থাকিস, তাই তোকে এই কাজটা আমি দিলাম।” স্যারের কথা ফেলবে, এ সাধ্য কার। এসব কোন কিছুই ও অন্য কাউকে দেয়নি। সবই তার কাছে আছে। তাই বিপ্লব এক কথায় রাজি হয়ে যায়। আর মেয়েটা যখন অলোকা, তখন মনে মনে ও খুশিই হয়। কেন খুশি তা সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না। তারপর তার মনে হল, শুধু পুরোনো টেস্ট পেপার দেওয়াটা খারাপ ব্যাপার হবে। তার কাছে যা টাকা আছে তাতে এবারের নতুন একটা টেস্টপেপার হয়ে যাবে। পুরোনোর সাথে নতুন একটা কিনে অলোকাকে দিয়ে আসবে। তাহলে আর ওর বাবাকে বইটা কেনার জন্যে টাকা জোগাড়ের চিন্তা করতে হবে না। এই অবস্থায় অলোকার সামনেই তাকে যেভাবে হেনস্থা করা হ’ল। অপমানে তার সমস্ত সত্ত্বা যে মাটিতে মিশে গড়াগড়ি খেলো। কিছুতেই সে তা মেনে নিতে পারছিল না। বাড়িতে বাবা-মাকে জানানোর সময় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, বিপ্লব। ছেলের কান্না দেখে মা’ও গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। বিপ্লবের মায়ের কান্নার আওয়াজ প্রকৃতিতে সওয়ার হয়ে পাশের বাড়ি টপকে এদিক ওদিকে পাড়ি দিতে লাগল। এক এক করে তাদের পাল পাড়ার অন্যরা এসে জড়ো হয় বিপ্লবদের বাড়ির উঠোনে। তাদের পাড়ার ছেলের এই অপমান অন্যরাও মেনে নিতে পারল না। এই আবহে আবার যখন সবাই শুনল, মুচিপাড়ার আটচালায় বিপ্লবকে নিয়ে বিচার বসাবার কথা বলেছে ওরা! আগুনে ঘি ফেলার মত দাউ দাউ করে রাগে জ্বলে উঠল গোটা পাল পাড়া,“শালা ছোটলোক রুইদাস, তাদের আবার এতবড় সাহস, তারা কিনা বিচার করবে আমাদের উঁচু বর্ণের ঘরের ছেলের? ও ছেলে তাদের মাস্টারের আদেশ পালন করার জন্যে ওদের পাড়ায় গিয়েছে। সে তো ওদের পাড়ার মেয়ের উপকারের জন্যে গিয়েছিল। কোথায় সেই কাজের জন্যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে। তা না করে উল্টে ছেলেটার নামে মেয়ে নিয়ে টানাটানির বদনাম দিচ্ছে? তার উপর বিপ্লবের মত লেখাপড়া করা শান্তশিষ্ট নম্র-ভদ্র ছেলেকে জড়িয়ে! এতবড় সাহস ওই ছোটলোক মুর্খ ছাগল-গরুর মাংস-চামড়া ঘাঁটা, নোংরা ঘাঁটা অচ্ছুুৎ জাতের! আমরা পালপাড়ার সবাই মিলে যাবো রুইদাস পাড়ায়। এই অপমানের জন্যে ওদের ক্ষমা চাইতে হবে। না হলে ওদের অনেক খারাপ ফলের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।”
পাল পাড়ার মান্যিগন্যি মানুষ, অনুকুল কুম্ভকার। মাটির হাঁড়ি, সরা, মালসা ছাড়াও কুমোরসজ্জার যাবতীয় জিনিস নিজের পাঁজার চুল্লিতে তৈরী করে পাইকারকে বেচে ভালই পয়সা করেছে অনুকুল পাল। ওর মত এত বড় আকারের কারবার পাড়ার কেউই করে না। আসলে অত পুঁজি সবাইয়ের নেই। অনেকে আবার তাদের উৎপাদিত মাল অনুকুল পালকে যোগান দেয়। তারপর পাড়ার মধ্যে দশের কাজে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে কোন সময় দ্বিধা করে না অনুকুল পাল। ব্যবসার লাভের পয়সা যে সবটাই নিজে খেয়ে নেয় তা নয়। তাই গ্রামের মোড়ল প্রথা উঠে গেলেও এখনও সবাই অনুকুল পালের কথা মোড়ল জ্ঞানে মানে। বিপ্লবের বিষয়টা নিয়ে পাড়ার লোকজন অনুকুল পালের কাছে গেল। পরামর্শ চাইল, তাদের এখন কি করা উচিৎ? সব কথা শুনে অনুকুল পাল বলল,“রুইদাসদের আটচালায় আমাদের যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ওখানে যাওয়া মানে আমাদের পাড়ার চরম মানহানি হওয়া। আমরা কেন ওদের বিচারের সামনে দাঁড়াবো। কি যোগ্যতা আছে ওদের, আমাদের বিচার করার? এতবড় সাহস ওরা পায় কোথা থেকে। বিপ্লব যা করেছে তাতে ওদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ আমাদের পাড়ার প্রতি। তা না করে দু’চারটে বখাটের মোদো মাতাল খামখেয়ালির শিকার আমরা হতে যাব কেন? দরকার হলে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। অতদূর যাবার আগে একটা কথা বলি, আমাদের দু’চারজন মুরুব্বিকে পাঠানো হোক ওদের ওই রতন, নন্দদের কাছে। ওরাই তো রুইদাস পাড়ার মাথা। কারণ জানতে চাওয়া হোক, আমাদের ছেলের কি অন্যায় সেটা খোলসা করে বলার জন্যে। তখন দেখবে, রতন-নন্দরা আমতা আমতা করতে থাকবে। পরিস্কার করে কিছু বলতে পারবে না। তখনই বোঝা যাবে ওই বখাটেদের চাপে ওরা বিচারের কথা বলেছে। আর সেই চাপ যদি ওরা সামলাতে না পারে তো আমাদের লোক বলে আসবে, রুইদাসদের আটচালায় নয়, বিচার বসবে পালপাড়ার ঠাকুর দালানে। এই কথা বললেই দেখবে, ওরা সিঁটিয়ে যাবে। বিচারশালা বসাবার জন্যে আর মাথাঝাড়া দেবার সাহস করবে না বাছাধনেরা।”
বিচারশালা বাতিল হয়েছে শুনে ক্ষেপে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয় অভয়-বরেণদের মত ছোকরারা। দিনমানেই চুল্লু গলায় ঢেলে প্রথমে হামলা করতে যায় রতন-নন্দদের মত পাড়ার মুরুব্বিদের বাড়ি। কোন বাছবিচার না করে পাড়ার মা-বোনেদের সামনেই অকথ্য গালাগালি দিতে থাকে তাদের। পাড়ার আর যারা বুঝদার মানুষ, তারা সেটা মেনে নিতে পারেনি। সমবেত হয়ে তাদের ঠেলেঠুলে আটচালার দালানে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়। মদের দুলুনিতে কে যে কোথায় পা ফেলে তার হিসেব কে রাখে। তবে সমান তালে মুখ দিয়ে চুল্লুর বিটকেল গন্ধের সঙ্গে বেরোতে থাকে অসহ্য সব পচাল গালাগালি। কখনো নিজেদের পাড়ার মুরুব্বিদের নিয়ে কখনো পালপাড়াকে জড়িয়ে। দুপুরে খাবার সময় হলে মানুষ যে যার মত বাড়িমুখো হতে থাকে। ভিড় পাতলা হয়ে যায়। মাতালরা কিন্তু স্বমহিমায়! অভয় আর তার অন্য স্যাঁঙাৎ মিলে মোট পাঁচজন টলমল শরীরে নির্জন আটচালা জাগিয়ে রেখেছে। হঠাৎ অভয়-মাতাল জড়ানো জিভে বলে,“চল্ সবাই, ওই শালা বিপ্লবের বিচার যখন রতন-নন্দরা করবে না তখন আমাদেরই করতে হবে। পাল পাড়ায় গিয়ে ওই শালা সতীনবেটাকে উচিৎ শিক্ষে দিয়ে আসি। এই তোদের ট্যাঁকে গরুকাটা ছুরিগুলো আছে তো? দেখে নে ভাল করে। এই দিয়ে মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোর বদলে ওই সতীন-বাবার জ্যান্ত ছাল ছাড়াবো আজ।” যেমন কথা তেমন কাজ। টলতে টলতে মুখ দিয়ে পচাল ছাড়তে ছাড়তে সতীনবেটা বিপ্লবের নামে জবাই ধ্বনি দিতে দিতে ঢুকে পড়ে পালপাড়ায়। অভয়মুচিদের হামলার কথা হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাল পাড়া। কেউ ভাতের থালা ফেলে, কেউ ভাত খেয়ে আঁচাতে আঁচাতে, কেউ বা চান করতে করতে বা চানে যেতে যেতে ছুটে আসতে থাকে তাদের রুখে দিতে। লাঠি শাবল, কোদাল গাঁইতি তো অনেকের হাতে ছিল। ওসব দিয়ে আঘাত করলে মানুষ খুনের দায়ে পড়তে হবে। তাই মুরুব্বিরা আদেশ দিলে, নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ হাঁড়ি, কলসি, সরা যাবতীয় সবকিছুর ভাঙা যার কাছে যা আছে সেই নিয়ে নিক্ষেপ করতে থাকো শত্রুর দিকে। তার আঘাতে কেটেকুটে বা মাথা ফেটে রক্ত ঝরলে বেটারা রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার কোঠরে ঢুকে যাবে।
হামলাকারি পাঁচজনই কমবেশি রক্তাক্ত হয়ে নেশা কাটিয়ে বাড়ি ফেরে ভর-দুপুরে। তাদের অবস্থা দেখে রুইদাস পাড়াও গরমাগরম হয়ে যায়! দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে কেউ আর ভাতঘুমে না গিয়ে আটচালায় এসে জড়ো হয়। দুই পাড়া যখন সম্মুখসমরে এসে দাঁড়িয়ে তখন কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা জিইয়ে রাখলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও ঘোরালো হয়ে যেতে পারে। এবার যে পক্ষ যেমন সুযোগ পাবে পরস্পরের উপর হামলে পড়া-প্রবণ হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। পালেদের পয়সার গরম আছে। মুখোমুখি টক্করে গেলে ওদের সঙ্গে রুইদাসরা পেরে উঠবে না। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি হলে কে সামলাবে? অত ট্যাঁকের জোর রুইদাস পাড়ার কার আছে? পয়সা কারোর কারোর থাকলেও তারা এতসবে নিজেদের জড়াতে চায় না। তাই ঠিক হল পঞ্চায়েতকে গোটা ব্যাপারটা জানাবে। আর্জি জানাবে দু’পক্ষকে ডেকে ওরা যাতে একটা মিটমাটের রাস্তা বাতলে দেয় সেই ব্যবস্থা করার জন্যে। সেইসঙ্গে পাড়ার কাউকে না জানিয়ে যে মাতাল ছোকরারা পালপাড়ায় ঝামেলা করতে গিয়েছিল তাদের আচ্ছা করে কড়িয়ে দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে দ্বিতীয়বার এই কাজ ওরা না করে সেটা কবুল করিয়ে নেওয়া হবে। প্রথমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। তাতে তারা বাগ না মানলে চোক রাঙানো ছাড়া উপায় থাকবে না। আপোশের কথা শুনলে প্রথম ধাক্কাতেই ওরা নিশ্চয়ই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠবে। পালেদের হাতে মার খাওয়া আর অপমানের প্রতিশোধ নেবার আস্ফালন দেখাবে। কিন্তু ভাল কথায় কাজ না হলে অগত্যা আঙুল বেঁকাতে হলে তাই করতে হবে![ঊনিশ]
ওকে নিয়ে ওইসব আজেবাজে কান্ডকারখানা ঘটার পর থেকে অলোকা পাড়ার ছেলে-বউ ঝি-ঝিউড়ি, কারোর সঙ্গে নিতান্ত দরকার ছাড়া মেলামেশা তো দূরের কথা, কথা পর্যন্ত বলে না। বাড়ির কাজকর্ম, নিজের পড়াশোনা আর দু’ভাইবোনেদের পড়িয়েই দিন কাটিয়ে দেয়। পাড়ার সার্বজনীন কোন পূজা বা উৎসবেও বাড়ি থেকে বার হয় না। ওর মত একটা শিক্ষিত মেয়ে যে পাড়ায় আছে তা বোঝার উপায় নেই। অথচ বলাই যেতে পারে, এই অলোকাই রুইদাস পাড়ার গর্বের কন্ঠমালা। এ পাড়ার ইতিহাসে প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং প্রথম একজন, যে স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজের চৌকাঠে পা দেবার যোগ্যতা দেখিয়েছে। বাইরের জগতে গোটা রুইদাস পাড়া ওকে নিয়ে গর্ব করে। পাড়ার বয়স্ক মুরুব্বি মানুষ, সুবোধ কাকা তো দিঘিরপাড় বাজারে মুখ ভর্তি বাতাস বুকে চালান করে ছাতি উঁচিয়ে বলে, “আমাদের মিলনের মেয়ে গো, ওই যে, মিলন, দক্ষিণমোড়ে যে জুতো সারাই করে, ধামা বেচে। ওরই মেয়ে। আমাদের রুইদাসদের ঘাড়ে যে গো-মুর্খ হয়ে থাকার ‘শাপ’ ভর করে ছিল, সেই শাপ ওই মেয়ে মোচন করল গো। এটা আমাদের কত গর্ব জানো তোমরা! এই শাপমোচনের পর এবার দেখবে পাড়ায় একে একে ছেলেপিলেরা লেখাপড়ায় মন দেবে। শিক্ষিত হবে।”
বড়দের এই ভাবনাগুলো সনাতনকে অনেকটাই উৎসাহিত করে। কিন্তু বাবার অভাবী করুণ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে আবার ‘নিরুৎসাহ’ এসে কেমন যেন মনটাকে গ্রাস করে। বাবা ওই যে নিজেকে ‘ক্রীতদাস’ বনে যাবার কথা বলল, সেটা ও কিছুতেই হজম করতে পারছে না। একজন বাবার মনে কত কষ্ট হলে নিজের মুখ দিয়ে এমন সাংঘাতিক কথা বার করতে পারে ! ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় করতে না পারার ব্যর্থতা তার বাবাকে কতটা কাঁদায়, এই কথার মধ্যে দিয়ে সে মর্মে মর্মে অনুভব করে। বুকের ভেতরটা কান্নায় যেন ডুকরে ডুকরে ওঠে। মনটা এমন থম মেরে যায় যে কোনকিছুই তার ভাল লাগে না। অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কেউ যাতে এই জল দেখে না ফেলে তাই তড়িঘড়ি হাতের কব্জির উল্টো দিকে দিয়ে মুছে নেবার চেষ্টা করে। এই জল যে তার একান্ত নিজস্ব। এ অন্য কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করার নয়। খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছেও চলে যায়। তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার তেমাথানি ওই ছায়াঘেরা বটের তলায় একা একা চুপচাপ বসে থাকে। হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটু দুটোর ওপর ঝুঁকে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন দখিনা বাতাসে সওয়ার হয়ে তার কানে প্রবেশ করে অমর স্যারের সেই অভয় মেশানো গলার স্বর, “যত কষ্ট হোক সনাতন, পড়াশোনা তোকে চালিয়ে যেতে হবে। তোকে বড় হতে হবে। শিক্ষিত হয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে, তোদের মত পেছিয়ে পড়া মানুষরাও সুযোগ পেলে, পারে অন্যদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে। সমাজে এগিয়ে থাকা মানুষের পায়ে পা মিলিয়ে চলার ক্ষমতা তোকে দেখিয়ে দিতে হবে। তুই পারবি সনাতন। তোর মধ্যে সেই জোশ আছে। আমি সেটা দেখতে চাই। যেমনটা দেখতে পাই তোদের পাড়ার মেয়ে অলোকার মধ্যে। যত বাধা আসুক, তুই বিচলিত হবি না। দশ পা এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে দু’পা পিছিয়ে আসার দরকার হলে তাই করবি। তবে কোন সময় পিঠটান দেবার ভাবনা স্বপ্নেও আনবি না। আবার বলছি, তুই পারবি সনাতন। আমি তোর পেছনে আছি। পিঠটান দিতে গেলেই আমার সঙ্গে তোর ধাক্কা লাগবে। আমার মুখোমুখি হলে আর তুই পিছু হটতে পারবিই না। আর, একটা মেয়ে যদি চরম প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে থেকে কঠোর লড়াই চালিয়ে যেতে পারে তাহলে তুই বা পারবি না কেন। তুই তো ছেলে-বাচ্চা। অলোকা তো মেয়ে। মেয়েদের কত অন্যায় নিয়মকানুনের শৃঙ্খল দিয়ে সমাজ বেঁধে রেখেছে। তার ওপর নিয়ত তাদের মান-সম্মান, সম্ভ্রমকে বাঁচিয়ে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে হয়। দেখলি না, অলোকাকে কত ঝড়ঝাপটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ঠান্ডা মাথায়, ভেতরের জেদকে দৃঢ়তর করে এক-পা দু’পা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে?”
বিকেল এসে দুপুরের জায়গা ততক্ষণে দখল করেছে। সনাতন তখনও মাটি থেকে ঠেলে ফুঁড়ে ওঠা সেই বটগাছের বড় শেকড়ের ওপর একভাবে হাঁটু মুড়ে বসে। আর সনাতনের মা, ছেলেকে বাবা-বাছাধন করে আকুতি মিনতি করে চলেছে খেতে আসার জন্যে। ছেলের তাতে কোন সাড়াশব্দ নেই। আর মা সমানে আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মোছে আর কপালের দোষের যুক্তি শোনায় চরাচরকে। ঠিক সেই সময় অলোকা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছে। মা-ছেলের এই রাগ-বিরাগের চিত্রপট অলোকার চোখে পড়ে। আলোকা এসে পড়তেই ঘটনাচক্রে সনাতন মুখ তুলে তাকায়। অলোকা দেখে ছেলেটার চোখদুটো জবাফুলের মত টকটকে লাল হয়ে আছে। খানিক থমকায় অলোকা। কি ভাবলো আবার এগিয়ে চলল নিজের বাড়ির দিকে। ওদের মা-ছেলের বিরাগ যাপনের মধ্যে তার প্রবেশ করাটা ঠিক হবে না ভেবেই অলোকা কোন কথা না বলে চলে যায়। তাছাড়া এমনিতেই ও, পাড়ার কারোর সাথে আর তেমনভাবে কথা বলে না। এখানে হঠাৎ এদের মধ্যে ঢুকে পড়লে ছেলেটার মা যদি মুখের ওপর কোন কথা শুনিয়ে দেয় তো, তা তার মোটেই ভাল লাগবে না। তবু ছেলেটা যেহেতু সনাতন, পাড়ার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছেলে। মাধ্যমিকে কুড়ির মধ্যে সতেরো রাঙ্ক পাওয়া ছেলে। তাই কেন যেন তার মনটা মুহূর্তের জন্যে তার চলাচলকে থমকে দিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল জানতে, কেন সে ওইভাবে বসে আছে। তার মা-ই বা কেন তার সামনে কান্নকাটি করছে। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা ভাল কিছু নয়। কি ভাল নয় সেটা জানার ইচ্ছেটা যেন প্রবল হয়ে পড়েছিল। পরে নিজেকে সামলে নেয়। অযাচিত উৎসাহ দেখানোর ফলটা যদি তার পক্ষে না যায়?
অলোকা চলে যাবার পরই সনাতন বটের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মা তার আদরমাখা হাতটা বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। সনাতন নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরে। মা তার পেছু পেছু এগিয়ে যায়। উঠোন থেকে দাবায় ওঠা সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে বসে পড়ে সনাতন। ঘুঁটের ছাই দিয়ে মাজা চকচকে কাঁসার ঘটিটা দাবায় রাখা বালতির জলে চুবিয়ে এক ঘটি জল নিয়ে ছেলের মুখ চোখে জল হাত বুলিয়ে ভাল করে ধুয়ে দেয় মা। বামুন ঠাকুরের কাছ থেকে কেনা কমদামী জালি পাতলা গামছা দিয়ে ছেলের মুখ চোখের ভেজা জল পরম মমতায় মুছিয়ে দিয়ে বলে, “বয়ে যাওয়া বেলায় আর ভাত খেতে হবে না। গরমে মুগের ডালটা টকসি টকসি লাগছে। আলুভাতেটা মাখা ছিল না বলে এখনো টকেনি। এখন মুড়ি খা। সন্ধ্যে গরম ভাতেভাত করে দেব’খন। মুড়ি খেয়ে একটু গড়িয়ে নে। শরীরটা ধকল খেয়েছে। একটু শুয়ে না নিলে কাহিল হয়ে যাবি।”
কলের জলে মুড়ি ভিজিয়ে কিছুক্ষণ রাখে সনাতনের মা, পুষ্প। ভেজানো মুড়ি হাতের আঙুলের ছাকনিতে তুলে পেতলের কাঁশি-বাটিতে রাখে। ভেজানো মুড়িতে উপর উপর চার চিমটে ধুলো চিনি ছড়িয়ে দিয়ে সনাতনের সামনে ধরে,“আমি খাইয়ে দেব বাবা? তুই বস। আমি খাইয়ে দিই। তুই নিজের হাতে খেতে গেলে আবার তোকে হাত ধুতে উঠতে হবে।” মায়ের কথায় চুপ থাকে ছেলে। চুপ থেকে সম্মতি জানায়।
এই ভেজানো হাতে-ছাঁকা মুড়ি এরা দুই বাপ-বেটা খুব পছন্দ করে। মুড়ির উপর একটু চিনির ধুলো ছড়িয়ে দিলে পরম তৃপ্তিতে তা খেয়ে নিতে পারে। বড় দানার চিনির তো দাম বেশি। অত বড়লোকী চাল দেখানোতে ওদের কাজ নেই। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে আর কি। পুষ্প এই খাওয়াটা শ্বশুরবাড়িতে এসে শিখেছে। খুব একটা যে আহামরি মুখোরোচক খাবার তা সে জোর দিয়ে বলতে পারবে না। আবার একদম খেতে পারবে না তাও কিন্তু নয়। প্রথম প্রথম পুষ্পর খেতে একটু অস্বস্তি হ’ত। এখন খারাপ লাগে না। সনাতনের বাবা তো বলে, “ভেজানো মুড়ি ছেঁকে তুলে চিনি অথবা নুন-লঙ্কা দিয়ে খেতে খারাপ লাগে না। আর এই খাবার একদম শুদ্ধ খাবার। মুড়ি জলে ভিজিয়ে রাখলে মুড়ির গায়ে যে বালির ধুলো লেগে থাকে তা ধুয়ে জলের তলায় নেমে যায়। শুকনো মুড়ি খেলে যেটা হবার নয়। পেট ঠান্ডাও করে এই খাবার। সেটা পুষ্প দেখেছে। মুড়ি ছেঁকে নেবার পর জলের তলায় অনেক কালো কালো ময়লা পড়ে থাকে। ওদের বাপেরবাড়ি এই খাবারের চল নেই। মালদার হরিশচন্দ্রপুরের বাপের বাড়ি থেকে বাবা প্রথম যখন মেয়ের বাড়ি আসে, পুষ্প খাইয়েছিল এই খাবার। একটা বাটিতে চিনি দিয়ে আর একটায় নুন-লঙ্কা দিয়ে। অল্প অল্প করেই দিয়েছিল। বাবা তো প্রথমে এই খাবার দেখে বিষ্ময়ে বড় বড় চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল, “এটা কি খাবার রে মা? প্রথম ভাবলাম এটা চিড়ে ভেজানো। কিন্তু না-তো! এ তো মুড়ি? মুড়ি আবার এমন করে খাওয়া যায়?” মৃদু হেসে পুষ্প বলেছিল,“দুটো বাটিতে দু’রকম ভাবে তৈরী। খেয়ে দেখো, কেমন লাগে?” তা বাবা দুটোই খেয়েছিল। চিনির থেকে নুন-লঙ্কা মাখানোটা বাবার বেশি পছন্দ হয়েছিল, “বাঃ ভালই খেলাম রে মা নতুন খাবারটা। তোর মা’কে গিয়ে গল্প করব। তবে চিনির থেকে নোনতা ঝালটা পছন্দ হ’ল।” সনাতনের বাবাও নোনতা-ঝালটাই বেশি সময় চায়। আর তার উল্টো, ছেলেটা। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদটাই ওর ভীষণ প্রিয়।
নিজ হাতে পরম মমতায় ছেলেকে খাইয়ে দেয় পুষ্প। পছন্দের খাবার পেয়ে আর ‘না’ করেনি সনাতন। মায়ের দেয়া অমৃত তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নেয়। কাঁসার ভারি গ্লাসে এক গ্লাস জল মায়ের হাত থেকে নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে নিয়ে বলে, “মা, এখন শুতে গেলে আমার চলবে না। অলোকাদিদের বাড়ি যাবো। খুব দরকার আছে। না গেলে আমার চলবে না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করা যাবে না।” ছেলের কথায় অবাক হয়ে যায় পুষ্প,“সে কি রে! হঠাৎ ওদের বাড়ি যাবি যে? কোনদিন তো তুই ওদের বাড়ি যাসনি? তাছাড়া ও তো পাড়ার কারোর সঙ্গে কথা বলে না। নিজের গোমরে থাকে। পাড়ার প্রথম শিক্ষিত মেয়ে। আর সবাই গো-মুখ্যু। তুই গেলে তোকে পাত্তা দেবে? তা হঠাৎ কি দরকার পড়ল ওর সঙ্গে? আমার তো মনে হয় ওদের বাড়িতে তোকে ঢুকতেই দেবে না! তা তখন তো ও তোর-আমার সামনে দিয়েই কলেজ থেকে ফিরল। দরকারটা তখনই তো সেরে নিতে পারতিস। সন্ধ্যে হয়ে এল। এই সময় লোকের বাড়ি যাওয়াটা ঠিক? ওদের বাড়ি পাল পাড়ার ওই ছেলেটা যাওয়া নিয়ে কত-না ঝামেলা অশান্তি হয়ে গেল। এখনো তার দাগ মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। কোনদিন যাবে বলে মনেও হয় না। তারপর তুইও বড় হচ্ছিস!”
মায়ের কথায় বিরক্ত হয় সনাতন, “না- জেনেশুনে কারোর নামে আজেবাজে কথা বলা ঠিক না, মা। লেখাপড়া তো তোমার ছেলেও শিখছে। তাহলে তোমার কথা মত তোমার ছেলেরও তো গোমরে মাটিতে পা না পড়াই উচিৎ। কেউ যদি তোমার ছেলের নামে এমন কথা বলে তাহলে তুমি সেকথা হজম করতে পারবে মা? আমার দরকারে আমি যাচ্ছি। তা সে যদি সেই দরকার মেটাতে না পারে, না পারবে। আমার তাতে কিছু মনে করার নেই তো? আর এটা তুমি নিশ্চয়ই জানো অলোকাদি আমার থেকে চার বছরের বড়। তোমাদের কাছেই এ’কথা আমার শোনা। সন্ধ্যে ছাড়া কখন যাবো ওদের বাড়ি? সক্কাল হলেই তো অলোকাদি কলেজ যাবার তোড়জোড় শুরু করে দেবে। আবার সেই কবে রবিবার আসবে তবে। অতদিন অপেক্ষা করা যাবে না। তোমার সনাতনের প্রতি এই বিশ্বাসটা তুমি রাখতে পারো মা।” ছেলের কথার পিঠে আর কথা চাপাতে চাইল না পুষ্প। শুধু বলল, “বেশি রাত করিসনি। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে আসিস।”
পাড়ার মূল রাস্তা থেকে বাঁয়ে ঘুরে অলোকাদিদের বাড়িমুখো হলেই ওদের বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোনটা পড়ে। ফাঁকা নিকোনো উঠোন পেরিয়ে তবে মাটির উঁচু দাবায় ওঠা যায়। কেউ উঠোনে পা দিলেই বাড়ির দাবা থেকে তা দেখা যায়। সনাতন ওদিকে নামতে উঠোনের দিকের বাল্বের আলো জ্বলে উঠল। সেই আলো ভেদ করে সনাতন বাড়ির দিকের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওর উল্টোদিকের সবাই ওকে দেখতে পাচ্ছে। সনাতনকে দেখে অলোকা দাবার উপরে পইটের সামনে এসে দাঁড়ায়,“কি রে সনাতন, তুই হঠাৎ আমাদের বাড়ি? কোনদিন তো আসিসনি?” অলোকাদির এমন কথার জন্যে তৈরী ছিল না সনাতন। অপ্রস্তুতে থমকে যায় সে। গলাটা যেন শুকনো হয়ে গেল হঠাৎ। কি বলবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। কিন্তু প্রশ্ন যেমনটাই হোক উত্তর তো তাকে দিতেই হবে। তাই গলা ফুঁড়ে বার না হতে চাওয়া কথা জোর করে ফোটাতে গিয়ে ফসফস করে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল! কি শব্দ তা সে নিজেই বুঝতে পারল না। বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা খাকরি দিয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে অলোকাদি।” সঙ্গে সঙ্গে অলোকা বলল, “তা উঠোনে দাঁড়িয়ে কি কথা বলবি, উপরে দাবায় উঠে আয়।”
দাবায় উঠতে পাট-দড়ির দোলা দেখিয়ে অলোকাদি বলল, “এই দোলাটায় তুই বস, সনাতন।”
-তুমি বসো দিদি। আমি দাঁড়িয়ে আছি।
-এই বোকা, তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস। তোকে বসতে না দিয়ে আমি বসে পড়বো? সে আবার হয় নাকি!
সঙ্গে সঙ্গে অলোকাদির মা রান্নাঘর থেকে বলল,“অলোকা তুই ঘরের ভেতর থেকে মোড়াটা নিয়ে ওর সামনে বস। ও দোলায় বসবে আর তুই দাঁড়িয়ে থাকবি, তাতে ও কিন্তু কিন্তু করছে। ঘরের দরজার ডানদিকে ওটা আছে। নিয়ে আয়।”
মোড়াটা নিয়ে সনাতনের সামনে বসতে বসতে অলোকা বলল,“কি দরকারে এসেছিস বল।”
সনাতন তারপরও চুপ করে থাকে। কিভাবে কথাটা অলোকাদির সামনে পাড়বে তা বুঝে উঠতৈ পারছে না যেন। উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পেপারের কথা বলার আগে বিপ্লবদার নামটা তুলবে না কি! বিপ্লবদার নাম করে বললে সহজেই অলোকাদি বুঝে যাবে ঠিক কোন বইটা সে চাইছে। কেননা ওটা বিপ্লবদা ওকে দিয়েছিল। আর এইটা দিতে এসেই তো দুই পাড়ার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল। এখনো সড়গড় হয়নি। তাহলে আবার অলোকাদির মনটা বিগড়ে যাবে না তো? এখন বিপ্লবদার প্রতি অলোকাদির ধারণা বা সম্পর্ক কেমন তা তো জানা নেই। ভাল সম্পর্ক থাকলে ভাল কথা। আর যদি তা না হয় তো তার কপাল মন্দ। আবার অলোকাদি কথা তোলে, “কিরে ছেলে, আমার সঙ্গে দরকার আছে বললি, আর কি দরকার তা বলতে পারছিস না? সে আবার কেমন কথা! মনে হচ্ছে কথাটা বলতে তোর ভয় ভয় করছে। আরে বাবা আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে দেখে ভয়ে চুপ করে আছিস?” সনাতন দেখল এরপর আর চুপ মেরে থাকাটা ঠিক কাজ হবে না। অন্যকিছু ভাবতে পারে অলোকাদি। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেতর থেকে একটা বল পেয়ে গেল। বলল, “দিদি, তোমার উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টপেপারটা আমাকে দেবে? নতুন টেস্টপেপার বাবা কিনে দিতে পারবে না। অমর স্যার ভাল করে টেস্টপেপার প্র্যাক্টিস করতে বলেছে। এখন টেস্টপেপার কোথায় পাই? বন্ধুদের অনেকের কাছে চেয়েছি। কিছুদিনের জন্যে চেয়েছিলাম। রাতদিন করে পড়ে ফেরত দেব বলেছিলাম। এক সপ্তাহের জন্যেও কেউ দিল না। তাই ভাবলাম তুমি উচ্চমাধ্যমিকের সময় যে টেস্টপেপারে প্র্যাকটিস করেছো সেটা যদি পাই তবু কিছুটা কাজে দিতে পারে। পুরোনো হলেও, সেখানে তো অনেক প্রশ্ন-উত্তর আছে। বইয়ের চ্যাপটার তো পাল্টায়নি। তোমাদের সময় যে চ্যাপটারগুলো ছিল এখনো তাই আছে। শুধু বাংলার টেক্সট বইয়ে খান দুই গল্প পাল্টেছে।”
তার কাছে টেস্টপেপার আছে তা সনাতন জানলো কেমন করে? যেহেতু সে উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গেছে এবং এ’সময় সবাই এই বই ব্যবহার করে, সেই ভাবনায় আন্দাজে তার কাছে এটা আছে ধরে নিয়ে এসেছে? না কি, তার জীবনের সেই কালো দিনটার কথা ছেলেটা ভাল করেই জানে? বিপ্লবের তাদের বাড়িতে আসার কথা, তাকে বিষয় করে পাড়ার বদমায়েশদের টানাহেঁচড়া করা। সব ঘটনা জেনেই কি সনাতন এসেছে? সনাতন বইটা চাওয়ার পর খানিক চুপ করে থেকে কথাগুলো ভাবল অলোকা। তারপর দু’হাতের আঙুলের ফাঁকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া চুলগুলো গুছিয়ে পেছনের দিকে ফেলে বলল, “আমার কাছে টেস্টপেপার আছে তুই জানলি কি করে, সনাতন? ওটা কিনে দেবার সামর্থ আমার বাবার তো ছিল না। তোর বাবার মত অবস্থা আমার বাবারও। তোকে কেউ কি বলেছে?”
অলোকাদির এমন পাল্টা প্রশ্নে সনাতন কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণের জন্যে মনটা ওকে থমকে দেয়। ঠিক কি বললে অলোকাদি কিছু মনে করবে না সেসব সাত সতেরো ভাবতে থাকে। কিন্তু জুতসই কোন তোষামোদি কথা সে খুঁজে পেল না। বড়ই বিড়ম্বনার ব্যাপার। আসলে একটা ঠিক কথাকে চাপা দিতে গিয়ে অনেকগুলো বেঠিক কথা সাজাতে হয়। আর শেষ পর্যন্ত অন্যপক্ষ নিশ্চিতও হয়ে যায় যে সে ঠিক কথা বলছে না। তাতে নিজেকে ছোট হতে হয়। তাই সত্যি কথাই বলতে চাইল সনাতন, “জানো তো অলোকাদি, সেই যে তোমাকে জড়িয়ে বিপ্লবদার সঙ্গে পাড়ায় ঝামেলা হয়েছিল না, তখন এই টেস্টপেপার-টেস্টপেপার কথা খুব চাউর হয়ে গেছিল। যারা চাউর করছিল তারা কিন্তু টেস্টপেপার কি, খায় না মাখে তার কিচ্ছু জানে না। সবই তো ‘ক’ অক্ষর গো মাংস’র দল। মাধ্যমিকে আমি টেস্টপেপার ঘেঁটেছি, তাই ওটা আমার মাথায় থেকে গেছিল। এখন আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম কেমন করে টেস্টপেপার জোগাড় করি। নিরুপায়ে তাই তোমার পুরোনোটা নিয়েই কাজ চালিয়ে দেব ভাবি। বিপ্লবদার কথা তুললাম বলে তুমি কিছু মনে করলে, দিদি? আমি কিন্তু ইতস্তত করছিলাম বিপ্লবদার নামটা তুলতে। তোমাকে তুষ্ট রাখতে ঘুরিয়ে অন্য কথা বলা যায় কি না ভাবছিলাম। কিন্তু মিথ্যা বলতে বাঁধছিল। তাই সত্যিটা বলে দিলাম।”
কিঞ্চিৎ উদাসী হয়ে গেল যেন অলোকাদি, তার কথায়। শূন্যে দৃষ্টি উঁচিয়ে অলোকাদি বলল,“কি আর মনে করবো বল ভাই। যা সত্যি তা সত্যিই। সেটা কখনো মিথ্যা হয়ে নবরূপ নিতে পারে না। এটা তুই তো মানবি যে বিপ্লবদার মত সমকক্ষ একটা ছেলে আমাদের এই রুইদাস পাড়ায় পাওয়া যাবে না। আমাদের পাড়া কেন, ওদের পাল পাড়াতেও পাওয়া যাবে না। আমাকে কত উপকার করেছে তা আমি জানি। ও যদি আমার পাশে না থাকতো তো আমি নিজেদের চেষ্টায় এতটা লেখাপড়া করতে পারতাম না। অসম্ভব ছিল আমাদের পক্ষে। কত বই-খাতা-নোটস্ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে জানিস? তার নখের যোগ্য হতে পারবে রুইদাস পাড়ার ওইসব অসভ্যগুলো? ওরাই আবার আমাকে পেতে চায়। কতবড় স্পর্ধা ! তোর কথায় আমার মনে করার কি আছে। বরং আমি খুশি হয়েছি, তুই সত্যি কথাটা বলতে পেরেছিস বলে। পাড়ার ছেলে হিসেবে তোরও সবটা জানা দরকার। তাই তুই ছোট হলেও বড় দিদির কথা তোকে বললাম। আর একটা কথা কি জানিস তো সনাতন, তোর জীবনখাত আর আমার, বলা যেতে পারে প্রায় একই খাতে বইছে। তোকে যেমন অভাবের সঙ্গে, বদ্ধ সমাজের সঙ্গে লড়ে এগোতে হচ্ছে, আমারও তাই। মেয়ে হিসেবে আমার সমস্যা আরও অনেকটা বেশি এই যা। দিনমানে হলেও, আমি যে এই একা একা বাড়ির বাইরে বার হতে পারছি, কলেজে যেতে পারছি। তা তো আমার কত-জন্মের সৌভাগ্য। এই সেদিন পর্যন্ত। আমাদের মায়েদের সময়। মেয়েদের, আমাদের মত একা বাইরে পা বাড়াবার আইন ছিল? সেই দুঃসাহস কেউ দেখালে সেই মেয়ের জীবন সমাজের কাছে বলি প্রদত্ত হয়ে যেত। তুলনামূলকভাবে আমাদের রুইদাসপাড়া এই ব্যাপারে বলা যেতে পারে এই হালে করে একটু সাবালক হয়েছে। পাড়ার লোকজন, মুরুব্বিরা রুজি রোগারের তাড়নায় বাইরে এদিক সেদিক বার হতে বাধ্য হচ্ছে। বৃহত্তর সমাজে মেলামেশা করছে বলে বদ্ধতা থেকে কিঞ্চিৎ খোলা মন হতে পেরেছে। এখন বাদ দে ওসব। যে কথা বলছিলাম, আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় বটগাছ তলায় অমন হতাশ এবং মনঃকষ্টে বসে আছিস দেখে আমি বুঝেছিলাম তোর লড়াইটা কত প্রকট। অসহায় তোর মা ছেলের এই কষ্টে মুহ্যমান। হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখে ক্ষণিকের জন্যে আমি থমকে গেছিলাম। নিজেকে ধরে রাখতে পারব না বলে আমি কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। আমারই বা কত ক্ষমতা বল। তোর চলাফেরা, লেখাপড়ার সব খবর রাখার চেষ্টা করি আমি। হয়তো সবটা সবসময় জেনে উঠতে পারিনি। তবু চেষ্টা জারি রাখি। মাধ্যমিকে তুই অত ভাল রেজাল্ট করেছিস। তা কি আমাদের কম গর্বের বিষয়। তবু পাড়ার কেউ তোর পাশে এসে দাঁড়ায় না। যার সামর্থ আছে সেও না। আর যার নেই সে তো নয়ই। কিন্তু এই নেই-ওয়ালারা তো মানসিক শক্তি, সাহস যোগাতে পারে। সেই বোধেরও কত অভাব। সবসময় কেমন করে চুল্লু, মদ পাওয়া যায় সেই চিন্তায় দিন কাবারে ব্যস্ত থাকলে আর সুস্থ চিন্তা তাদের মধ্যে আসবে কেমন করে! তুই আমাদের বাড়ি এসে ঠিক কাজটাই করেছিস। আমার পক্ষে তোর পড়াশোনায় যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব আমি করব। প্রয়োজন হলেই তুই আমার কাছে চলে আসবি। কোন দ্বিধা করবি না। আমার কাছে দুটো টেস্ট পেপার আছে। দুটোই বিপ্লবদা দিয়েছিল। একটা পুরোনো, আর একটা নতুন কিনে দিয়েছিল বিপ্লবদা। সঙ্গে অমর স্যারের দেওয়া ভাল ভাল কিছু নোটস্ও আমাকে দিয়েছিল। এখন টেস্টপেপার দুটো নিয়ে যা। নোটগুলো অন্য দিন নিয়ে যাস। এদিক ওদিক সব খাতা-বইয়ের ভেতর লুকিয়ে আছে। গুছিয়ে একসাথে করে নিই। সামনের রবিবার তুই আসিস।পেয়ে যাবি। ভাল করে পড়। মাধ্যমিকের থেকে উচ্চমাধ্যমিক আরও টাফ্। সেটা তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। দেখা গেছে অনেকে মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট করেও উচ্চমাধ্যমিকে সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। সেটা মাথায় রেখে এগোবি। তবে পাশাপাশি একটা কথা মনে রাখবি, আমরা কিন্তু ছাপোষা ঘরের ছেলেমেয়ে। তারপর তুই ছেলে। বড় হচ্ছিস। অভাবী সংসারে বাবার একটু হাতেধরা হতে হয়। আলালের ঘরের দুলাল হয়ে শুধু বইয়ে মুখগুঁজে থাকার কপাল আমাদের নয় রে সনাতন। সংসারকে বাঁচাতে তোকে বাবার সঙ্গও দিতে হবে। বাবার কষ্টের মুখটার দিকেও তোকে তাকাতে হবে। প্রচুর প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে। সবটার সঙ্গেই লড়াই করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মনে জোর রাখ। দেখবি সাফল্য তোর কাছে ধরা না দিয়ে পারবে না। সাফল্য কিন্তু উপযুক্ত পাত্রে ধরা দেবার জন্যে সবসময় মুখিয়ে থাকে। জাত-বেজাত গরিব-ধনীর কোন ছুৎমার্গ তার নেই।”
কথায় কথায় অনেকটা সময় চলে যায়। রাস্তা থেকে এক ব্যাটারির কমদামী চর্টলাইটের টিমটিমে আলো এসে পড়ে অলোকাদের উঠোনে। সনাতনের মায়ের গলা ঠিকরে আসে এদিকে, “সনাতন, সনাতন! সনাতন?”
সঙ্গে সঙ্গে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ায় অলোকা, “ওই তোর মা ডাকছে সনাতন। যা। অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছিস। চলে যা। রবিবার আসিস।” সনাতন দোলা থেকে উঠে টেস্টপেপার দুটো বাঁ-হাতে নিয়ে সাড়া দিল,“যাচ্ছি মা ! আলোটা এদিকে ধরো। অলোকাদি, আসছি। রবিবার সন্ধ্যে উপচে আসব। ওইদিন দুপুরে বাবার সঙ্গে হাটে যাবো ধামা-পালি বেচতে।”[কুড়ি]
বাবার ‘হাতে-ধরা’ হতে মাঝে মাঝে সময় পেলেই সনাতন দিঘিরপাড়ে জুতো সারাই দোকানে বসে। জুতোর কোন ধরণের সারাইয়ে কত দাম, তা সে দোকানে থেকে থেকে শিখে গেছে। ইনবাইসের শুঁড়ের ভেতর জুতোর ছেঁড়া অংশটা ঢুকিয়ে বাটালি দিয়ে ধুম ধুম করে কেঁটকী মেরে সারাইয়ে সবচেয়ে সস্তা পড়ে। তারপর ফোঁড়-সূতো দিয়ে সেলাইয়ে একটু বেশি দাম পড়ে। সবচেয়ে দামী সারাই হল, চামড়া জুড়ে জুতো সারাই। একটু বাবুবাবু দেখতে খদ্দের হলে, সনাতন দেখেছে, তার বাবা জিজ্ঞেস করে,“চামড়া দিয়ে সেলাই করে দেব বাবু? মজবুত হবে। অনেকদিন টিকে যাবে। তবে কেঁটকীর থেকে দাম বেশি পড়বে। আর কেঁটকী সেলাইয়ের কোন গ্যারান্টি নেই। আপনার জুতোর শরীরের যা হাল, এতে সূতো দিয়ে সেলাই করলে, সেলাই ধরে রাখা যাবে। ফেঁসে যাবে না জুতোর শরীর।” কেউ বাবার কথায় রাজি হয়, কেউ না হয়ে বলে, “ও তুমি কেঁটকী মেরেই দাও রতন। এ জুতোর আয়ু হয়ে এসেছে। অত যত্ন ওর কপালে সইবে না।” আর পথ চলতি মহিলা খদ্দের? যত জন, তত রকম ভাবনা। তারা এত ব্যস্ত যে চমড়া দিয়ে তাপ্পি মারার সময় তাদের হাতে নেই। জুতোর শোল থেকে খুলে বেরিয়ে গেছে উপরের অংশ। আঠা খুলে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে জুতোটা নতুন। বাবা বলল, “দিদিমণি, এ তো নতুন জুতো। কেঁটকী মারলে শোল-চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন চামড়া জুড়ে সেলাই করে দিই। দশ টাকা লাগবে।” ব্যস্ততায় খরিদ্দার বলল, “কেঁটকী তিন টাকা আর সেলাই দশ? একটাকা বেশি নাও, চারটাকা দেব। চামড়া দিয়ে সারিয়ে দাও।
-না দিদিমণি। হবে না। বলছেন যখন তখন আট টাকা দেবেন। আমার চামড়ার দাম আছে না?
-ঠিক আছে, তোমার দামী চামড়া তোমার কাছে রাখো। কেঁটকীই মারো। আমার তাড়া আছে। কোন রকমে বাড়িতে যেতে পারলেই হল। আবার এই ফালতু জুতো পায়ে গলাবো নাকি!
খদ্দের চলে গেলে রতন ছেলেকে বলল, “দেখবি, ওই মেয়েটা ফের ওই জুতো পরেই বাইরে বার হবে। কেঁটকী আর ক’দিন সামলে রাখবে। দু’চার দিনের মধ্যেই হার মানবে সে। মেয়েটাকে আমি চিনি। আলুপোতায় বাড়ি। হাঁটা পথে এখান থেকে আধ ঘন্টা সময় লাগে। তার উপর রাস্তা উবলো খাবলা।” কথাটা বলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় রতন,“আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি রে বাবা। মিলিয়ে নিস কথাটা। আর চামড়ার কথা উপযাচক হয়ে কেন খদ্দেরকে বলি জানিস, এতে দুটো পয়সা চোখে দেখা যায়। ব্যবসার এটা একটা কৌশল। মানুষকে না ঠকিয়ে যদি একটু বেশি আয় করা যায় সেটাতে তো কোন অন্যায় নেই!”
সেদিনটাও রবিবার ছিল। সনাতন বাবার সাথে দোকানে। ও দেখল, সেই মেয়েটাই ‘রতনদা রতনদা’ বলে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে,“রতনদা, জুতোটা ছিঁড়ে গেছে। সেরে দাও না। বড্ড তাড়া আছে। বাড়ি ফিরতে হবে।” সনাতন দেখল, সেই জুতোটাই, যেটা সেদিন তার বাবা কেঁটকী মেরে সারিয়ে দিয়েছিল। ওর বাবা আর কোন কথা না বাড়িয়ে কয়েকটা কেঁটকী ধপাং ধপাং করে মারতে শুরু করে দেয়। ব্যস্ত খরিদ্দার, তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে। তাই তারও ব্যস্ততার অন্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বলল,“কি করছো রতনদা। কেঁটকী মারছো কেন? আমি তোমাকে কেঁটকী মারতে বললাম? কেঁটকী মারলে তো আবার তা খুলে যাবে। মাঝ পাথে ছেঁড়া জুতো পায়ে ন্যংচাতে ন্যংচাতে আসা। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার। সব ছেলেরা তাকিয়ে থাকে। ইস্ যাচ্ছেতাই ব্যাপার। চামড়া দিয়ে সেলাই করে দাও ভাল করে। দেখবে, যেন কেঁটকীর মত রাস্তাঘাটে সেলাই খুলে না যায়।”
এবার একটু বিরক্ত হল রতন, “আপনি তো দিদিমণি বলেননি যে চামড়া দিয়ে সেলাই করতে হবে। তাড়া আছে বললেন। সেলাই করতে হলে তো আমাকে সময় দিতে হবে। সে সময় তো আপনার কাছে নেই! এখন তো দুটো কেঁটকী আমার মারা হয়ে গেছে। কি করবো এখন?”
-ও দুটো খুলে সেলাই করে দাও। বাব্বা, আবার ওই কেঁটকীর চক্করে আমি যাই। তুমি সেলাই করে দাও রতনদা। আমি অপেক্ষা করছি।
-আমার যে দুটো কেঁটকী নষ্ট হয়ে গেল। তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আপনি দেবেন তো? তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
এবার মেয়েটা নরম হয়ে বলল, “ছেড়ে দাও রতনদা। ওর দাম নিয়ে আর চাপাচাপি কোরো না। দেখো আমরা তো তোমার বাঁধা খদ্দের বলো? সুবিধে অসুবিধে হলে আমরা কি অন্য কোথাও যাই? যাই না। তোমার কাছেই আসি।” রতন আর কথা বাড়ালো না। কারবারে সবসময় চুলচেরা হিসেব করলে হয় না। কোনটায় লাভ কম কোনটায় পুষিয়ে যায়।
পাশে সনাতন তখন একটা খদ্দেরের বুট পালিশ করছিল। খদ্দের ছেড়ে রতন বলল,“দেখলি খোকা, আমার কথা মিলে গেল তো। এরকম কত ধরণের খদ্দের সামলাতে হয় দেখ। তুই তখন আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলিস। কেন, তা আমি বুঝিনি মনে করেছিস ? বুঝেছি। ভাবছিলিস বাবা মেয়েটার কাছ থেকে কেঁটকীর দাম নিল না কেন? আমাদের দোকানের তাহলে তো লস্ হয়ে গেল! তোর ভাবনায় ভুল নেই। কিন্তু অনেক সময় মানুষকে দরকারে একটু পিছিয়ে গেলে দোষের কিছু না রে। আখেরে সেটা ভালই হয়। এগিয়ে যাবার রাস্তা খুলে দেয় ওই পিছড়েবর্গ। দেখবি, ওই মেয়েটা দরকারে আমাদের কাছেই আসবে। এই যে ওর কাছ থেকে দাম কম নিলাম, আমার প্রতি ওর বিশ্বাসটা পাকা হয়ে গেল যে রতন জুতোওলা এক পয়সার মা বাপ না। একটা ভাল ভাবনা আমাদের প্রতি ওর মনে পাকা হয়ে রইল। ওই খদ্দেরটাই আমাদের হয়ে অন্য খদ্দেরকে সুপারিশ করবে। তাই বলে সবসময় ঢালাও ছাড় দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সেটা আমরা পারবো কেন। আমাদের ছোট্ট কলিজা। বেশি ধকল সইতে পারবো না।”
একটা অফিসবাবু বুট পালিশ করতে দিয়ে বাজার করতে গেছে। সনাতন সেটা পালিশ করে কাঠের বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ছেলের পালিশ দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হয় রতন। এই কাজটা ছেলে ভালই রপ্ত করেছে। চকচক করছে জুতোটা। ওর সামনে মুখ রাখলে মুখ দেখা যাচ্ছে। ওর মনে এই ধারণাটা হয়েছে যে কাজ ভাল করলে তাদের কারবারে সুনাম হবে আর খদ্দের বাড়বে। তাই এত যত্ন করে কাজটা করেছে। অবশ্য কালির সাথে ক্রিম পালিশ হয়েছে বলে এতটা ভাল হয়েছে। সব খদ্দের তো আবার ক্রিম পালিশের পয়সা দিতে চায় না। ক্রিম পালিশের একটু দাম বেশি। এমনি কালির পালিশ আট টাকা আর ক্রিমে বারো টাকা। এই চার টাকার জন্যে লোকে যেন মুর্ছা যায় আরকি। সেই জন্যে রতন আগে থেকে ঝগড়া করে নেয়, শুধু কালির পালিশ না ক্রিম পালিশ। ক্রিম হলে আরও চার টাকা বেশি দিতে হবে বাবু। এই বাবুর সঙ্গেও আগে থেকে কথা ভেঙে নিয়েছে। ক্রিম পালিশে রাজি হয়েছে। ছেলেটাও যত্ন করে কাজটা করে দিয়েছে। আসলে ক্রিমে ওদের একটু লাভ হয়। তাই খদ্দেরের সঙ্গে ওরা নিজে থেকেই কথা পেড়ে নেয়। জোর দেয় ক্রিমে, যদি রাজি হয় আর কি…
অফিসবাবু, তার জুতো পালিশ দেখে খুশি হয়ে নীরবে হাসে, “বারে রতন, বেশ চকচকে করে পালিশ করেছিস তো!”
-আমি করিনি বাবু, আমার ছেলে করেছে। তাছাড়া ক্রিম পালিশে একটু সুন্দর দেখতেও হয়। চামড়াও ভাল থাকে। তার উপর কারিগরের কব্জির টানটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
-তোর ছেলেটা তাহলে ভালই হাতেধরা হয়েছে বল, রতন?
-তা একটু হয়েছে। বাপের যুগ তো আস্তে আস্তে খতমের দিকে। এবার তো ছেলেদের যুগ। সবকিছু বুঝে না নিলে চলবে কেন? তারপর সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলে,“টাকাটা বাবুর কাছ থেকে নিয়ে নে খোকা।টাকাটা নিয়ে সনাতন বলে, “আর দু’টাকা দিন বাবু। বারো টাকা।” বলে ওই দশ টাকার নোট হাতে নিয়ে, তার হাতটা বাবুর দিকে বাড়িয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাবুটা বলে, “কি বলছিস, আরও দু’টাকা কিসের? উল্টে তুই আমাকে দু’টাকা ফেরত দিবি। জুতো পালিশ তো আট টাকা। বারো টাকা আবার কবে হল! দে, আমাকে দু’টাকা ফেরত?” সঙ্গে সঙ্গে রতন বলে, “না বাবু, ক্রিম পালিশ বারো টাকা। আর এমনি কালির পালিশ আট টাকা। আপনাকে তো ক্রিম পালিশ করে দেওয়া হয়েছে। আপনার সঙ্গে আগে থেকে কথা ভেঙে নেওয়া হয়েছে। আপনি রাজি হয়েছেন বলেই তো আমরা ক্রিম পালিশ করেছি।” এবার অবজ্ঞার ছলে লোকটা বলে,“তুই ছাড় তো ক্রিম পালিশের গপ্প। সব সমান। সামান্য দু’চার টাকার মায়া ছাড়তে পারছিস না বল্? দে, আমায় দু’টাকা ফেরত দে। এই ছেলেটা, হাত নামা। তোর বাপকে বল্ দু’টাকা ফেরত দিতে।” বাপের সঙ্গে এই কথাকাটাকাটি সনাতন একদম মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। আচ্ছা বেয়াড়া লোক তো! কথা বলে কাজ করা হয়েছে। এখন উল্টো গাইছে? এবার সনাতন বলল, “না বাবু, আপনাকে আরও দু’টাকা দিতেই হবে। আমাদের গতরে খাটা পয়সা। মাগনা আপনাকে ছেড়ে দেব না। দিন বাবু দিন, আর দু’টাকা দিন। দু’টাকা ছাড়া যাবে না। আপনারা বাবু লোক। অফিস কাছারি করেন। আপনি এই ক’টা টাকার মায়া ছাড়তে পারছেন না। উল্টে আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষকে ‘মায়া-ছাড়ার’ নিদান দিচ্ছেন! আচ্ছা ‘তরফের’ মানুষ তো আপনি!” এই “আচ্ছা তরফের মানুষ” কথাটা বলতেই আঁতে ঘা লেগে যায় বাবুর! ক্ষেপে লাল চোখ করে বলে,“শালা ছোটলোক রুইদাস বাচ্চা। গাল টিপলে দুধ বার হবে। তুই আমাকে ব্যঙ্গ করিস। দে শালা দে আমার দু’টাকা ফেরত দে। ভেবেছিলাম টাকাটা ছেড়ে দেব। এ তো দেখছি ‘তায়বাড়া’। খুব রোখ দেখছি এর। একে তো ছাড়া যাবে না!” এবার সনাতন আর মাথার ঠিক রাখতে পারে না। টগবগে উঠতি যুবক। বিনা অন্যায়ে তাকে জাত তুলে ছোটলোক বলায় ওর মনে আঘাত লাগে খুব। দোকান ছেড়ে উঠে লোকটার কাছ থেকে জুতো জোড়া ছিনিয়ে নিয়ে বলে, “টাকা দেবেন তারপর জুতো নিয়ে যাবেন। আমরা ছোটলোক রুইদাস বাচ্চা কে না জানে। এত যদি এদের ওপর ঘেন্না তো আসেন কেন এদের সেবা নিতে। নিজের কাজ নিজে করবেন। কোনদিন আর আসবেন না আমাদের দোকানে। আপনার মত খরিদ্দার না এলেও আমাদের চলে যাবে। আমরা ঠিক খেতে পাবো।” তার হাত থেকে জুতো কেড়ে নেওয়ায় আরও অপমানিত হয় লোকটা, “শালা ছোটলোকের বাচ্চা, তোর এত বড় সাহস, আমার হাত থেকে জুতো কেড়ে নিস? জীবনে এই জুতো পায়ে গলাবার যোগ্য হতে পারবি না। এর দাম কত জানিস। বাটার ‘মোকাসিনো’ জুতো কত দাম তোর বাপেরও জানা নেই। দে শালার বেটা আমার জুতো?” বলে সনাতনের হাত টানতে থাকে। সনাতনও নাছোড়। তার শান্ত ছেলেটা ক্ষেপে গেছে দেখে রতনও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাবুটাকে থামাতে চেষ্টা করে বলে,“সনাতন ত্যাগ দে ওই দু’চার টাকার মায়া। আমাদের মুখ্যুসুখ্যু পেয়ে কত বাবু ওরকম ঠকিয়ে যায়।” ইতিমধ্যে চেঁচামেচিতে বাজারের লোক জড়ো হতে থাকে। লোকের মুখে মুখে ঘটনাটা চাউর হতে সমবেত লোক জুতোবাবুকে নিয়ে নানান বিরূপ টিপ্পনী শুরু করে দেয়, “শালা চোরের মায়ের বড় গলা রে। গরিবের পয়সা মেরে আবার হম্বিতম্বি করতে কসুর করে না। মানুষের মদত পেয়ে সনাতন আরও নাছোড়বান্দা হয়ে যায়। রোখ চেপে যায় ওর মধ্যে। পুরো পয়সা না দিলে সে জুতো হাতছাড়া করবে না। শেষপর্যন্ত মানুষের চাপে পুরো টাকা দিতে বাধ্য হয় জুতোবাবু।
ঘটনাটার কথা লোকের মুখে সওয়ার হয়ে রুইদাসপাড়া ছেয়ে যায়। সনাতনের মত নির্বিবাদী ছেলে এখন পাড়ার সকলের মুখে মুখে। তাদের জাতের অপমানের প্রকাশ্য প্রতিবাদ সনাতনের মত মুখচোরা ছেলে যে করতে পারে তা যেন কারোরই ধারণায় ছিল না। ওকে নিয়ে গর্ববোধ করতে থাকে সবাই। সনাতন কিন্তু ব্যাপারটায় গর্ব করার মত কিছু দেখতে পায় না। উল্টে বরং ও চিন্তা করতে থাকে, এতটা প্রতিবাদী হওয়াটা মনে হয় তার ঠিক হল না। শান্ত পুকুরে যেন একটা বড় আধলা ইট ফেলে দিল সে। সেই ইটের অভিঘাতে সে এখন বাজারে, পাড়ায় ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। সবার চোখে তো সে আর হিরো বনে যেতে পারে না। ওই জুতোবাবুর পক্ষে যারা তারা তো তাকে বাঁকা চোখে দেখবেই। বাঁকা চোখে দেখা মানেই তার অমঙ্গলের ভাবনা ওরা করতে থাকবে। সুযোগ পেলে ক্ষতিসাধন করতে তাদের বাধবে না। কিন্তু তাদের মত গরিব ঘরের পক্ষে সেই ক্ষতির অভিঘাত সে কেমন করে সামলাবে। এমনিতেই দুবেলা পেটের অন্ন জোগাতে বাবা হিমসিম খায়। তো উটকো কোন ঝামেলা ঘাড়ে চাপলে কি হবে ! বাবা তো একদম গুম হয়ে রয়েছে। সে যে কোন অন্যায় করেনি তা বাবা ভাল করে বুঝেছে। তাই তার এই রুখে দাঁড়ানোতে বাধা দিয়ে কোন কথা বলেনি। ছেলেকে সামাল দিয়ে গেছে। কিন্তু বাবার চিন্তা যে অন্য জায়গায় তা সে খুব ভাল করে বুঝতে পারছে। বাবা ভাবছে এইসব নিয়ে যদি কোন উটকো বিপদ হামলে পড়ে তো সামলাবে কেমন করে। সেই চিন্তা সনাতনেরও। তাই তার মনে হচ্ছে অত জেদ না করলেই হয়তো হত। ছেড়ে দিলেই হত ওই চারটে টাকা। কিন্তু আবার ভাবে, প্রশ্নটা তো চার টাকার নয়। প্রশ্নটা তাদের আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানিতে। তারা মুচি, গরিব, তথাকথিত নিচু জাত। তা সমাজের কে না জানে। তাই বলে ওই জাত তুলে, গরিবীর সুযোগ নিয়ে তাদের ওইরকম কুৎসিৎভাবে ঘেন্না করার অধিকার তো কারোর নেই! সে তো পড়েছে, ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।’ তাহলে এই মহান কথাটা একদম ফালতু? মানুষ হিসেবে তাদের তো একটা ন্যুনতম সম্মান পাবার অধিকার আছে। সেই অধিকারে আঘাত পেলে সে রুখে দাঁড়াবে না? রুখে দাঁড়িয়ে কি সে ভুল করেছে? নিশ্চয়ই করেনি। বরং সেজন্যে সে গর্বিত। কিন্তু ওই যে। ওরা গরিব। ওদের অর্থ নেই। ওরা আর্থিকভাবে দুর্বল। তাই ওরা সমাজের একশ্রেণীর পচা পয়সাওলাদের দ্বারা পদদলিত। অবহেলিত। তবু যেন এই অবহেলা, বঞ্চনার কথা তাদের মুখ ফুটে বলার অধিকার নেই!
ওইদিন সন্ধ্যেবেলা কথামত অলোকাদিদের বাড়ি যায় সনাতন। অলোকাদি তখন রান্নাঘরে। সেখান থেকেই বলল, “সনাতন দোলায় বস। আমি যাচ্ছি। এই হাতের কাজটা সেরে নিই। তোর তাড়া নেই তো?” একটু ব্যস্ত হয়ে তখনই সনাতন বলল, “না না দিদি। তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি কাজ সেরে এসো। আমার তাড়া নেই। আমি ততক্ষণে এই দোলাতে নাড়া খাই। নাড়া খেলে গায়ে হাওয়া লাগে।” দোলনাড়া খেতে খেতে সনাতন দেখে অলোকাদি একটা বাটিতে কি যেন নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মোড়াটা বাঁহাতে নিয়ে ডান হাতে বাটিটা নিয়ে ওর সামনে বসল,“এই নে সনাতন, নাড়ু খা। চৈতে নাড়ু মা বানাচ্ছিল। আমি মাকে হেল্প করছিলাম। গরম গরম। খেতে ভাল লাগবে। আমি খেয়েছি। সবটাই তোর। আমার জন্যে তোর ব্যস্ত হতে হবে না।” বলে সনাতনের হাতে নাড়ুর বাটিটা তুলে দিল, অলোকা। সনাতন তৃপ্তি ভরে নাড়ু খেতে থাকে। অলোকা আত্মতৃপ্তিতে তা উপভোগ করে। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল, তোর এই তৃপ্তি আমার হৃদয়কে যেন আনন্দে ভরিয়ে তুলল।” সনাতন খেতে খেতে খুশি মুখে বলল, সত্যি দিদি, আমার মনটাও আনন্দে ভরে উঠল। কতদিন এই চৈতে নাড়ু খাইনি। এসব তো আমাদের কাছে বিলাসিতা। দু’মুঠো ভাত যোগাতে যারা হিমসিম তাদের সংসারে নাড়ু বানানো তো স্বপ্ন। ইচ্ছে থাকলেও মা’র সামর্থ নেই।” সনাতনের কথায় পরিবেশটা যেন একটু ভারি হয়ে গেল। সেটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যে অলোকা বলল,“তোর সব নোটস এখনো খোঁজা হয়ে ওঠেনি। আসলে কলেজে একটা প্রজেক্ট জমা দেবার তাড়া ছিল। সেটা জমা দিতেই হবে। নাহলে নাম্বার কাটা যাবে। তা তুই আসবি বলে সামনাসামনি হাতের কাছে যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো টেবিলে রাখা আছে। দিচ্ছি তোকে। ততক্ষণ তুই এগুলো দেখ। একসাথে তো সব পড়া যায় না। এগুলো দেখতে দেখতে ততক্ষণে আমি অন্যসব খুঁজে রেখে দেব। পরে নিয়ে যাস বা রাস্তায় দেখা হলে আমি তোকে বলে দেব’খন।
তখন নিয়ে আসবি। দাঁড়া, খা ততক্ষণ। নোটগুলো আমি ঘর থেকে নিয়ে আসি।” একটা পলিথিনের প্যাকেটে ওগুলো নিয়ে অলোকাদি এল। ভারি প্যাকেট দেখে সনাতন বলল,“দিদি, এতো প্রচুর নোটস্। এর পরেও আরও আছে ! দিদি, তোমার অত ব্যস্ত হতে হবে না। আগে আমি এগুলো পড়ে শেষ করি, তারপর অন্যগুলো তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাব। আজ তাহলে আসি দিদি।” বলে সনাতন দোলা থেকে উঠতে যাবে, সেই সময় কৌতূহলী দৃষ্টিতে অলোকা বলল,“হ্যাঁরে সনাতন, আজ তোকে নিয়ে বাজারে কি গন্ডগোল হয়েছে রে? পাড়ার লোক সব তোকে নিয়ে আলোচনা করছে? কলেজ থেকে আসতে আসতে আটচালায় জটলা হয়ে লোকে তোর কথা বলাবলি করছে। ঘরে আসতে আমার মা-ও একই কথা বলল?”
আবার দোলাতে কঁ-চ করে বসে পড়ল সনাতন। ঘটনার সবিস্তার বিবরণ দিয়ে সনাতন মন্তব্য করল, “আচ্ছা দিদি, তুমি বলো, আমরা গরিব, মুচি তথা নীচু জাত বলে কি আমাদের কোন মান সম্মান থাকতে পারে না? লোকটা ঘেন্নার দৃষ্টিতে আমার সঙ্গে আচরণ করছে ! তখনই আমার মধ্যে জেদ চেপে যায়। আমিও লোকটাকে সহজে ছাড়িনি। লোকটাকে ভুল স্বীকার করিয়েছি, পুরো পয়সাও আদায় করেছি। পরে ভাবলাম দিদি, এতটা করা মনে হয় আমার ঠিক হ’ল না। আমার পক্ষে এটা বাড়াবাড়ি হ’ল কি না কে জানে। ওই বাবু লোকটা তো আমাকে কোনদিন ভাল চোখে দেখবে না। এক বাজার লোকের সামনে অপমানিত হতে হয়েছে তাকে। ও কি সহজে আমাকে ছেড়ে দেবে ! কি জানি, কি হবে! আমরা গরিব ঘরের ছেলে। ওই পয়সাওলাদের সঙ্গে যুঝবো কেমন করে! যদি লোকটা থানায় কেসমেস করে দেয়! অলোকা দেখলো ছেলেটা বেশ ভয় খেয়ে গেছে। কিন্তু এত ভয় পাবার তো কোন কারণ নেই? ওকে সাহস দিয়ে ভয় কাটানো দরকার, “এই সনাতন, তুই অত দমে যাচ্ছিস কেন। তুই তো কোন অন্যায় করিসনি। সেটা তো বাজারের সব মানুষ জানে। মানুষই তো বাধ্য করিয়েছে লোকটাকে ভুল স্বীকার করাতে। লোকটা তোর বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে মানুষই তোর পাশে দাঁড়াবে। তোর বিরুদ্ধে কোনকিছুই তখন ধোপে টিকবে না। ভয় পাওয়া মানে তো হেরে বসে থাকা। চেতনাকে টলমল করে দেওয়া। তোর মধ্যে শিক্ষা ছিল বলেই তোর চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের রুইদাসরা এইভাবে পয়সাওলাদের কাছে মাথা নত করে এসেছে। সেই শিক্ষা রুইদাসরা এতদিন পায়নি বলেই এটা হয়ে এসেছে। তোর সঙ্গে তোর বাবাও তো ছিল। যেটা তুই করতে পারলি সেটা তোর বাবা করতে পারতো। পারতো না। সেই শিক্ষা তোর বাবা পেয়ে উঠতে পারেনি তাই সম্ভব হয়নি। যা বাড়ি যা। বুকের বলের উপর ভর করে এগিয়ে যা।”
অলোকাদিদির কথায় সনাতনের মনের ভেতর যেন একটা আশার আলো ফুটে ওঠে। ভাবে এইরকম করে তো এর আগে তাকে কেউ বলেনি ! অমর স্যার তার পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু তার জীবন চলনের যন্ত্রণা, বাধাবিপত্তি থেকে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার প্রেরণা এই প্রথম সে অলোকাদির কাছ থেকে পেল। মনের যাবতীয় দুর্বলতা, ভীতি যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। দিদির প্রতি কৃতজ্ঞতাভরা অভিব্যক্তিতে বলল,“দিদি, আজ আসি। রাত হয়ে যাচ্ছে। মা না হলে আবার ডাকতে আসবে। দিদি, আর একটা কথা বলি। তুমি অন্যভাবে নেবে না তো?”
-আরে ভাই বল না। দিদি বলে যখন ডেকেছিস তখন ভায়ের কথায় দিদি অন্যরকম কিছু ভাববে কেন! মন খুলে বল।
-না দিদি, সেরকম কিছু নয়। মাঝে মাঝে আমি কিন্তু দিদি, তোমার কাছে আসবো। তোমার মূল্যবান পরামর্শ আমার চাই। যখনই দরকার পড়বে আমি আসবো। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?
-এই পাগল ছেলে। অত বিনয়ের কি আছে। আমি বাড়ি থাকলে তোর যখন মনে হবে চলে আসবি। পরীক্ষার পড়ার ব্যাপারেও কোন জানার থাকলে চলে আসবি। আমার সাধ্যমত আমি তোকে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করব। একদম ইতস্তত করবি না। তোর জন্যে আমাদের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা।ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৭)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[পনেরো]
পরেশের বউ সনকার সঙ্গে সল্টলেকের বাবুর-বাড়ির মালিক চন্দনের সম্পর্ক এখন আর ওই গতানুগতিক কাজের মাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তিগত ভাবে বাড়ির মালিকের সঙ্গে সনকার সম্পর্ক যেমন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় এসে ঠেকেছে তেমনই ওদের পরিবারেরও একজনের মত হয়ে গেছে। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তরণ সনকার কাজের যোগ্যতার নিরিখে সম্ভব হয়েছে। আর পুরুষ মালিক আকৃষ্ট হয় তার যৌবনের তীব্র আর্তিতে। অবশ্যই এই সম্পর্ক বৈধতার বিচারের কষ্ঠিপাথরে সায় না নিয়েই। সেই নিয়ে চন্দনের পরিবারে ব্যাপক ঝড়ঝাপটা বয়ে যায়। রূপসা কেন চাইবে তার স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ুক? তাও আবার বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে! সুস্থ সামাজিক ভাবনায় ঋদ্ধ কোন নারী কি তা মেনে নিতে পারে? পারে না। রূপসাও তাই পারেনি। রূপসা তাই প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে দোষারোপ করে চলে। অবশ্য নিতান্তই সরল বিশ্বাসে স্বামীর কষ্ট লাঘবের কথা চিন্তা করে দিল্লীতে বিয়েবাড়ি যাবার সময় সনকাকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। শ্বাশুড়ি-স্বামীকে দেখভাল করার জন্যে। মুহূর্ত সময়ের জন্যেও এই ভাবনা ঝিলিক মারেনি যে যুবতী ওই কাজের মেয়ের সঙ্গে চন্দন কোন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। দিল্লী থেকে ফেরার পর চন্দনের ব্যবহারে কেমন যেন বিরুদ্ধ স্রোত বয়ে যাবার লক্ষণ সে প্রত্যক্ষ করে! দিল্লী যাবার আগে তার সঙ্গে চন্দনের ব্যবহার আর পরের ব্যবহারে এতটা খটকা লাগার মত হ’ল কেন তা বুঝতে রূপসার বেশ কিছুদিন সময় লাগে। রাতের বেডরুমে স্বামীর আচরণে সে প্রথম টের পায়। বেডরুমে তার প্রতি আকর্ষণ রাতারাতি যেন কেমন তলানিতে এসে ঠেকেছে। অথচ রূপসা যে স্বামীর সঙ্গে শয্যা বিনিময়ে অপারগ তা তো নয়! বরং পূর্ণমাত্রায় আগের মতো তা বর্তমান। স্বামীর আদর খাওয়া তো দূরের কথা উল্টে অনাদরে তাকে বিদ্ধ করতে থাকে, “গায়ের কাছে সেঁটে এসে বিরক্ত করবে না তো! সরে যাও। আমার ভাল্লাগছে না। শান্তিতে একটু ঘুমোতে দাও। তোমার চোখে ঘুম নেই না কি?” চন্দনের এমন আচরণে তাজ্জব বনে যায় রূপসা! এ কোন্ চন্দনের সঙ্গে সে শুয়ে আছে? এ তো সে চন্দন নয়? দাম্পত্য সম্পর্ক যে একটা নতুন বাঁকে এসে পড়েছে সেই সময়ই টের পায় রূপসা। তা আরও স্পষ্ট হল যখন ও নিশ্চিত হয়, সনকার সঙ্গে চন্দনের অবৈধ্য যৌন সম্পর্কের বাস্তবতা। মেনে নিতে পারেনি রূপসা। যেমন সুস্থ অবস্থায় কোন নারী তা পারে না। পত্রপাঠ সনকাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার ফরমান দেয় সে। কিন্তু তাতে বাধ সাধে চন্দন স্বয়ং এবং রূপসার উপর শারীরিক অত্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি সে। একজন ঝি-মেয়েমানুষের সামনে এইভাবে অত্যাচারিত হওয়া, অপমানিত হওয়াটা তাৎক্ষণিক ভাবে তার মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক ছুটে দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে কার্নিশ টপকে মরণঝাঁপ দেওয়াটাই সঠিক বলে মেনে নেয় সে। কিন্তু মরণ তাকে বরণ করেনি। হাসপাতাল থেকে অবশেষে প্রাণ নিয়ে ফিরে এল ঠিকই কিন্তু সুস্থ জীবন আর ফিরে পেল না রূপসা। চলাফেরার শক্তি স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলল সে। শরীরের নীচের অংশ অবশ হয়ে রূপসা এখন তাদের বেডরুমের বিছানার স্থায়ী বাসিন্দা। যে বিছানা একদিন ছিল তার আর চন্দনের দাম্পত্য ভালবাসার স্বর্গসম।
চন্দন এখন আর এই বিছানা ছোঁয়া তো দূরের কথা, দেখতেও আসে না। বিছানাটা কেমন আছে। কতটা খারাপ আছে। তাও না। সনকার চোখের আয়নায় নাকি মাঝে মাঝে রূপসা দেখে তার অতীত দাম্পত্যের অতিথিকে। সনকাই সে কথা তাকে বলে, “বাবুকে আমি আপনার খবর দিই গো বৌদি। তখন শোনে কথাগুলো। কখনো উত্তর দেয়, কখনো চুপচাপ শুনে চলে যায়। কস্মিন কালে কিছু মনে হলে হয়তো জিজ্ঞেস করে, বৌদি কি করছে, ঘুমিয়ে না জেগে। তখন বলি, ওনার তো ঘুম-জাগায় কোন ফারাক নেই। এ প্রশ্ন করা তো মুর্খামি। যান না, একবার বৌদির সঙ্গে কথা বলে আসুন না। কথা বলতে তো অসুবিধা নেই। এই কথা বললে বলে, কথার ভাঁড়ার যে শূন্য। ওই শূন্য ভান্ডার আর পূরণ হবে না সনকা। এখন তোমার যত্নের ভাঁড়ার যতদিন না ফাঁকা হয়, তুমি বৌদিকে সেবা করে যাও সনকা। তাহলেই বৌদি ভাল থাকবে। আমাকে নিয়ে আর টানাটনি কোরোনা। আমাকে আমার মত থাকতে দাও।” সনকার বুঝতে অসুবিধা হল না, দিনের পর দিন বাবু বৌদিমণির সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করেছে তা আর সহ্য করতে না পেরেই তো সে আত্মহত্যা করতে যায়। মরণ ওকে টেনে নিলেই বরং মুক্তি পেত বৌ-টা। কত কষ্ট পাচ্ছে। এখন বাবু সেই কষ্ট দেখে আফসোস করছে। নিজের বিবেকের সঙ্গে তাকে যে নিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। বাবুর এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই তার ভেতরের যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। সনকা নিজে কি ধোয়া তুলসীপাতা! সেও তো বাবুর সঙ্গে সম-দোষে দোষী। সে যদি বাবুকে প্রশ্রয় না দিত তাহলে তো বৌদিমণির হাতছাড়া হত না বাবু! তাই বৌদিমণির এই পরিণতির দায় থেকে সেও মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বাবুকে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। তার এবং তার লোচনের জীবনের প্রশ্নে সে বাবুর সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য ছিল। নাহলে বাবু তাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিত। তখন তো তাকে আবার জনারণ্যে ভেসে বেড়াতে হত। কুকুর-শেয়াল ছিঁড়ে খেত তার ভরা যৌবনকে।
সকলেই প্রথম ভালবাসে নিজেকে। তারপর দ্বিতীয় পছন্দ অন্য কেউ। দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল, চন্দন-বাড়ির অঘোষিত মালকিন সনকা। সনকা ছাড়া এই বাড়ির সূর্য উদয় হয় না, ডুব সাঁতারও দেয় না। চন্দনবাড়ির সংসার এখন তার সংসার। পাকাপাকিভাবে বিছানা নেওয়া চন্দন-বৌদির যাবতীয় বাসি কাজ নিজের হাতে সারে সনকা। যে সনকার জন্যে রূপসা বৌদির আজ এই বিলম্বিত যাত্রাপথ সেই সনকাই এখন তার জীবন বৈতরণী পার করার একমাত্র যষ্ঠী। প্রিয় সনকা এখন তার যেন চোখেহারা সাথী। কত জন্মান্তরের সঙ্গী যেন সে রূপসা বৌদির। এখন সনকা যদি রূপসার বকলম নিয়ে চন্দনকে স্বামী ভাবনায় সময়ের সঙ্গী হয় তো রূপসার কোন আপত্তি নেই। চন্দনের তো নয়ই। তবে বৈধ্য স্ত্রী বেঁচে থাকতে তো সনকাকে বৈধ্যতা দেওয়া যায় না। তাই এতটুকু যা দূরত্ব চন্দন-সনকার। বাদবাকি যাবতীয় দাম্পত্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেওয়া নেওয়ায় একাকার এখন ওরা। হয়তো জীবনচলনের বাধ্যতায় রূপসাকে ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু রূপসার মন কি তাতে দু’হাত তুলে সায় দিতে পারে? না তা হয় না। যদি সেটাই হবে তো তখনই সে ওদের এই অবৈধ্যতাকে মেনে নিতে পারতো। তাহলে তাকে আজ এই করুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হ’ত না! সত্যিই রূপসা আজ এই বিকলাঙ্গ দেহটাকে বিছানায় লটকে রেখেও ভেতর থেকে মানতে পারেনি। এটা তো যে কোন বিবাহিত নারী জীবনের শাশ্বত ভাবনা। ওই বা সেই ভাবনা থেকে কেমন করে বেরিয়ে আসতে পারে? পারে না। তাই নিয়ত ও সময়ের কাছে করজোড়ে তার হৃদয়চলনকে থামিয়ে দেবার জন্যে কামনা করে চলেছে। সনকার কাছে যেমন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত জীবনের প্রেরণার নব নব উৎস। তেমনই রূপসার কাছে সব অচল পয়সা ছাড়া আর কিছু নয়। যাবতীয় অনীহা এখন তার সবসময়ের সঙ্গী হয়ে শেষের সেদিনের পথ চেয়ে অপেক্ষায়। এ অপেক্ষার কবে সমাপ্তি ঘটবে তা কে জানে! কেউ জানে না। সে তো জানেই না। জানে না চন্দন-সনকা। জানে না আকাশ বাতাস, জানে না ধূলিকণাও।
চন্দন চেয়েছিল তার গর্ভ-হ্রদে একটা নতুন ভ্রুণ সাঁতার কেটে বেড়াক। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল সনকা, “এ তুমি কি আবদার করে বসলে বাবু? আমরা চাকর বাকর মানুষ। কপালগুনে তোমার দেহসঙ্গী হতে পেরেছি। সেটা আমার সৌভাগ্য। এই আব্দার মেনে নিয়ে আর আমার ভাগ্যকে আকাশপানে ছুড়ে দিতে চাই না। একবার ছুড়ে দিলে পড়ার সময় আলগোছে ধরে নেবার ক্ষমতা তোমার যেমন হবে না। আমারও না। তখন আমার ভাগ্য ভূপাতিত হওয়া ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। বাবু, এই জন্যেই কি তুমি আমার লোচনের চাকরির ব্যবস্থা করে সেই বিদেশ বিভুঁই, বোম্বেতে পাঠিয়ে দিলে? এই হাত জড়ো করে তোমার কাছে ভিখ্ মাঙছি বাবু। আমার কপাল আর বৌদিমণির কপাল একাকার করে দিও না। তার থেকে বরং আমি দেশের বাড়ি ফিরে যাই। বাকি সময়টা ওখানেই কাটিয়ে দেব। না না, তোমাকে ভাবতে হবে না। যতদিন বৌদিমণির প্রাণবায়ু ধুকপুক করছে, ততদিন না হয় আমি এখানে দিনপাত করলাম। আমার মনের কষ্ট এই বৌদিমণির জন্যে। আমি যদি যৌবনের ঝাপটায় তোমার সঙ্গে লটরপটর না করতাম তাহলে তো বৌদিমণির এই পরিণতি হত না। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তটা আমি করে যেতে চাই।”
তবে বাবুর কাছে সনকা চিরঋণী হয়েই থাকবে। এই বাবু তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় না দিলে তার জীবনটাও তো দরিয়ায় ভেসে ঠিকানাহীন হয়ে যেত। পোদ পাড়ার ওই বাদল শয়তানের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এই বাবুর জন্যেই। যেদিন থেকে বাবু বুঝে গেছে, ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যে বাদল আসে তা তার আত্মীয়তার কর্তব্যের দায় মেটাতে নয়, সনকার প্রতি তার যৌন লালসা চরিতার্থ করতে। তখন থেকেই বাবু এ’বাড়িতে তার আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সনকাও মন থেকে সেটা চাইছিল। তখন থেকে সনকা বাড়ির বাইরে কোন কাজে গেলে সঙ্গে বাবু থাকে। কয়েকবার আশপাশে বাদলকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেওছে সনকা। পাত্তা দেয়নি। যেন চেনেই না তাকে, এমন আচরণ করে তার গা ঘেঁষে চলে গেছে।
সনকার সঙ্গে চন্দন বাবুর সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠতা ছুঁয়েছে তার ছেলে লোচনের ওপর বাবুর নজরও পড়েছে ততটাই আগ্রহের সঙ্গে। বাবুর চেষ্টাতেই লোচন মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষিত হতে পেরেছিল। না হলে তার তো মুর্খ হয়ে বেঁচে থাকার লিখন দেগে দেওয়া ছিল। বাপ জেলে। নিরুপায় সনকার ক্ষমতা তখন কোথায়, ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার? ছেলের সেই ভবিতব্য খন্ডন করেছে এই চন্দন বাবুই। যে মানুষটা তার জন্যে এতটা করতে পারে তো সেই মানুষটাকে তার বয়ে যাওয়া যৌবন যদি উজাড় করে সে দেয় তাতে তার অন্যায়টা বা কোথায়! সনকা তো সেখানে অন্যায় কিছু দেখে না। না, রূপসা বৌদির কথা তুলেছিল সনকা। তাদের সঙ্গে দেহজ ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে বৌদির কথা তুলেছে সনকা, “আমার শরীরের ওপর তোমার এত লোভ কেন গো বাবু? অত সুন্দরী বৌদিমণি থাকতে। আমি এক পাড়া গাঁয়ের মেয়ে। অবহেলায় যার জীবন-যৌবন কাটে। তার প্রতি তোমার এত লোভ কেন? আমাকে পেয়ে তুমি এমন করছো যেন জীবনে এই প্রথম কোন মেয়েমানুষের সঙ্গ পেলে তুমি। কেন, বৌদিমণি তোমাকে সুখ দিতে পারেনে? তা তো হয় না। তাহলে তোমাদের ছেলেটা হল কেমন করে? পুরুলিয়ার মিশনে তোমাদের ছেলেটা যে পড়ে, সে কি তোমাদের দু’জনের বাচ্চা না? না কি আমার মত অন্য কোন সনকা তুমি জুটিয়ে রেখেছো। ও তার গর্ভে জন্মেছে?” এই কথা বলতেই আঁতে ঘা লেগে যায় চন্দন বাবুর! সনকার শরীর ছেড়ে উঠে পড়ে চোখ কটমট করে বলে, “এই কথা তুমি দু’বার আর বলবে না। ও আমার আদরের সন্তান। ওকে আমরা, আমি-রূপসা মন থেকে চেয়ে পৃথিবীতে এনেছি। তুমি না জেনে সাংঘাতিক একটা খারাপ কথা বলে ফেলেছো সনকা। এবারের মত তুমি ছাড় পেয়ে গেলে, তোমার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়েছি বলে। কোন আলগা কথা আমার নামে বলে ফেললে আমি মাফ করে দিতে পারি। আমার সন্তানের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোন কথা বলার সাহস তুমি দেখাবে না, সনকা।”
এমন সুন্দর ঘনিষ্ট মুহূর্তটা এই সন্তানের কথাটা তুলে যেন জোলো হয়ে গেল। দু’জনেই অতৃপ্ত মনে যেন ফুঁসতে থাকে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরিবেশকে স্বাভাবিক করতে প্রাণ ভরে জড়িয়ে ধরে বাবুকে, “বাবু, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ক্ষমা চাইছি বাবু। একবারের জন্যে আমাকে ক্ষমাঘেন্না করে দাও। দু’বার আর মুখ থেকে কু’কথা বার হবে না। কথা দিলাম বাবু।”
সনকার স্বীকারোক্তিতে গলে জল হয়ে গেল চন্দন। সনকার উত্তুঙ্গ দু’বুকের পেলব স্পর্শ তাকে যেন পুনরায় উত্তেজনায় শিহরিত করে তুলতে থাকে। চন্দনের সেই শিহরণ সনকা আহরণ করতে করতে কখন যেন পরস্পর পরস্পরের মধ্যে হারিয়ে যায়। সনকাতে নিঃস্ব হয়ে চন্দন তৃপ্ত হয়ে বলে “তুমি যে বৌদিমণির কথা প্রথমে তুলেছিলে, সেই কথায় টান দিয়ে বলি, আমি তো কোনদিন তোমার বৌদিমণিকে অসন্তুষ্ট করিনি। বরং বৌদিমণি সবসময় আমাকে পূর্ণ ভাবে নিঃস্ব করতে পারেনি। যেটা তুমি পারো। তোমাতে আমি তাই সন্তুষ্ট। তবে তোমার বৌদিমণিকে আমি পূর্ণ মাত্রায় তুষ্ট করে এসেছি। এখনও করতে আমার কোন বাধা নেই। বাধা আসছে তোমার বৌদির দিক থেকে। আসলেও এখানে আমার কিছু করার নেই। সমস্যাটা তোমার বৌদিরই।”
বোম্বেতে চাকরিটা ভালোভাবেই করতে পারছে লোচন। ওখানকার পরিবেশটা ও মানিয়ে নিতে পেরেছে। প্রথম প্রথম কোলকাতার কথা খুব বলত। এখন আর বলে না। আসতে বললে আসতেও চায় না। চন্দনবাবু এ কাজটা দেখে না দিলে ও কোথায় কি করতো কে জানে। ছেলে ওখানে ভালো আছে, তাতেই মা সনকার মন ভাল। আরও মন ভাল হয়ে যায় যখন ও ওখানকার একটা মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করতে চায় খবরটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় সনকা। এবার মা’কে নিজের কাছে রাখতে চায় লোচন। কিন্তু চাইলেই তো সবসময় সবকিছু পাওয়া যায় না। সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়টার জন্যে ছেলেকে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিল সনকা।[ষোল]
পরেশের ছেলে লোচন যা প্রস্তাব দিল, তারপর অনুকুল কুম্ভকারের ওই জমি কিনতে অস্বীকার করার আর অবকাশ থাকল না। ও যে দাম দেবে সেই দামেই সে বিক্রি করতে রাজি। তাই বলে তো আর সেই সুযোগ নিয়ে একটা যাচ্ছেতাই দাম দেবার কথা বলতে পারে না। হয়তো বাজার চলতি দাম থেকে কিছুটা কম দাম সে দিতে পারে। বাজার চলতি বলতে এই রুইদাস পাড়া এলাকার মধ্যে সম্প্রতি যে দামে জমি বা বাস্তু বেচা কেনা হয়েছে, হিসেবটা সেই নিয়মেই হতে চায়। কেননা, আশপাশের জায়গা থেকে এখানকার জায়গার দাম অনেকটাই কম হবার কথা। প্রথমত এখানকার জমির চাহিদা কম। গরিব পরিবারের বাস এখানে। অন্যান্য জায়গার মত অত দাম দিয়ে কেনার আর্থিক ক্ষমতা এইসব মুচিদের কারোর নেই। আর বাইরের লোক মরতে এই অজ পাড়ার ভেতরে কেন কিনতে যাবে? এখানে পয়সা ঢেলে তো কোন আয় তার থেকে পাওয়া যাবে না। অনুকুলও অমন জায়গা কিনে তার থেকে এক কানাকড়িও আয় করতে পারবে না। ওই বাঁজা জমিতে বসত ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না, যেমনটা পরেশরা ছিল। তবু এই বাচ্চা ছেলেটার আকুতি আর ওর অসহায় মায়ের মুখের কথা ভেবে তাদের উপকার করতে সে কেনার কথা ভাবছে। মানে টাকাটা জলে ফেলতে যাচ্ছে। এরপর আবার রুইদাসদের মধ্যে যে টাকাপয়সায় একটু সড়গড় তাকে তেলাতে হবে, কেনার জন্যে। তবে তার কারবারের আসল টাকা উদ্ধার হবে। লাভ তো দূর অস্ত। বরং বলা যায় পয়সা দিয়ে জেনেশুনে অযথা ঝামেলা কেনা আর কি। তবু সে নিমরাজি। তবে তার আগে ওদের আটচালার মাতব্বরদের সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চায়। না হলে কেনার পর ওরা যদি তাকে হুড়িয়ে দেয় তো, ‘কানাকেষ্টর ঘটি বাটি সব যাবে।’ অন্যের উপকার করতে যাওয়ার সুড়সুড়ি ঘুচে যাবে।
সময় করে একদিন অনুকুল কুম্ভকার তার চাকিঘরের বসার জায়গায় কিছু দরকারি কথা আলোচনার জন্যে নন্দ আর রতনকে আসতে বলল। যেহেতু আলোচনাটা ব্যক্তিগত পরিসরে। সরাসরি রতনদের আটচালার সঙ্গে যুক্ত নয়। তাই ওদের আটচালায় কথা বলাটা ঠিক হবে না বলেই তার বাড়িতে আসতে বলা। সেটা রাতনরা মেনেও নেয়। অনুকুলের সঙ্গে পরেশের ছেলে লোচনের জমি বিক্রির জন্যে এগিয়ে চলার এত কথা রতনরা জানতো না। লোচন ওদের পাড়ার রাস্তা দিয়ে কুমোর পাড়ায় না গিয়ে বড় পাকারাস্তা ধরে উল্টোদিক দিয়ে অনুকুলদের বাড়িতে কথা বলে সেই পথেই চলে যেত। অনুকুলের কাছেই প্রথম সেই কথা জানতে পারে রতনরা।
পরেশের ছেলে তোমাকে তাদের বাস্তুজমি বেচলে আমাদের কোন আপত্তি নেই অনুকুল দা। সে তো আমাদের কমিটির পাশ করা কথা যে রুইদাসদের কেউই সরাসরি পরেশের বাস্তু কিনতে পারবে না। বাইরের কেউ কিনলে, তার কাছ থেকে যদি কারোর সামর্থ থাকে তবে তাদের পাড়ার কেউ কিনতে পারে। তবে অবশ্যই যে কিনেছে সে যদি কোন চাপের কাছে মাথা নীচু না করে কাউকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় তবে। কিন্তু এর পরও একটা কথা আছে দাদা। কথা হল কি, পরেশের ছেলে লোচন ওই জমি বিক্রি করার অধিকারী কি না। আমরা যতটুকু জানি, জমিটা পরেশের বাবার। সেই সূত্রে পরেশই ওটার প্রথম হকদার। তা প্রথম হকদার, পরেশ তো মরে যায়নি। দিব্য বেঁচে আছে এবং খুনের দায়ে জেল খাটছে। পরেশ যদি মরে যেত, তখন না হয় পরবর্তী ওয়ারিশন হত এই লোচন। তুমি যে জমিটা কিনবে, দলিলে তো পরেশের সই থাকবে না। থাকবে তার ছেলের। বড় জোর ছেলের মায়ের। সেটা আইনত সাব্যস্ত হবে কি না ভাল করে জেনে তবে কেনা দরকার। আমাদের এই কথাটা বলার কারণ, ওই জমিটায় তো তুমি বাসের জন্যে বাড়ি বানাতে যাবে না। তোমার এখানে এতবড় মহল-বাড়ি। তাহলে খদ্দের পেলে তুমি সেটা বিক্রিই করবে। কিনবে আমাদের পাড়ারই কেউ। যে কিনবে সে যাতে ফাঁপরে পড়ে না যায় সেটাও দেখা দরকার। পরেশের তো আমরণ যাবজ্জীবন হয়নি। শুধু যাবজ্জীবন। তা আমাদের দেশের যা আইন তাতে যদি ইতিমধ্যে ও জেলে মরে না যায় তাহলে একদিন না একদিন ও ছাড়া পাবে। তখন এসে পরেশ যদি তার জায়গা দাবি করে বসে? বলে, আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলে কি করে জায়গা বেচে? এ বেআইনী। তখন তো যে কিনবে আবার আইনী ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতে হবে। তখন তার ছেলে-বউ ওকে কতটা সামলাতে পারবে সেটা তো ওরাই ভাল করে বলতে পারবে। সেসব কথা পরেশের ছেলের সঙ্গে ভাল করে বলে তবে কেনা উচিৎ বলে আমার মনে হয়। কথাগুলোর উপর বেশ চাপ দিয়ে রতন বলল।
রতন শেষ করতেই নন্দ বলল, “দেখতে দেখতে তো চোদ্দ বছর হয়ে গেল পরেশের জেল খাটা। মনে হয় আর বেশিদিন ওকে জেলে থাকতে হবে না। সেটা উকিলের সঙ্গে কথা বললে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার যতটুকু জানা, পরেশ এবার ছাড়া পেতে পারে। আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখলে মনে হয় ভাল হবে। এতদিন তো পড়ে আছে জায়গাটা। আরও ছ’মাস কি এক বছর না হয় অপেক্ষা করবে পরেশের ছেলে। এবার তুমি দেখো অনুকুলদা। কি করবে। তবে এই অসুবিধাগুলো না কাটিয়ে তুমি জায়গা কিনলে পরে বিক্রি করতে তুমি পারবে না। জেনেশুনে ওই ঝামেলার মধ্যে আমাদের পাড়ার কেউ ঢুকতে যাবে না। এরা সব গরিবগুর্বো মানুষ। পয়সা দিয়ে কেউ বিপদ কিনতে যাবে না।”
রতন আর নন্দের কথায় অনুকুল কুম্ভকার বেশ ধন্ধে পড়ে যায়। রতনরা যে একেবারে উড়িয়ে দেবার মত কথা বলল তা কিন্তু নয়। ওর টাকা আছে বলে তো জেনেশুনে তা বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পারে না। খেটে টাকা রোজগার করতে হয়। সত্যি তো। জেলখাটা পরেশের সঙ্গে তার ছেলে বউয়ের সম্পর্ক তো বহুদিন বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন তার গ্রামের সঙ্গে। এতদিন ওর ছেলে বউ একরকম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার আগে অন্যভাবে চলেছে। এখন আবার সেই পুরোনো জীবনে ফিরে আসা ওদের পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। পরেশের জীবনের ছন্দও তো ওলটপালট হয়ে গেছে। জেলখাটা আসামীর মন ফাঁকায় এসে কি রূপ নেবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে। পরেশের ছেলে লোচন আবার বোম্বেতে কাজের সূত্রে থাকে। সেখানকার আধুনিক চালচলন কোলকাতার থেকেও অন্যরকম। সেই মন, কোলকাতায় ওর মায়ের মন আর জেল ফেরত পরেশের মন কত যে ফারাক অভ্যাসে অবস্থান করছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তাই ভাল করে না বুঝে না শুনে তার পক্ষে এগোনো আর সম্ভব নয়। লোচন তাড়াহুড়ো করতেই পারে। তাই বলে সে তার তালে ভিড়ে গেলে চলবে না। ব্যবসায়িক চাল এখানে তাকে চালতেই হবে।
বোম্বে থেকে অনুকুল কুম্ভকারকে ফোন করলে লোচন অবগত হয় তাদের বাস্তুজমির প্রকৃত মালিকানা নিয়ে অনুকুলের আশঙ্কার কথা। অত অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে চাইছে না অনুকুল কুম্ভকার। ওনাদের পক্ষ থেকে হঠাৎ এমন প্রশ্ন আসতে পারে তা একদম ভাবতে পারেনি লোচন। তার বাবা সমেত তাদের পরিবারের কাছে ওই জমি এখন বদ্ধভূমি ছাড়া আর কিছু নয়। সেই জমি বেচে দিলে বাবা বাধা দেবে তা হতে পারে না। সে বা তার মা ছাড়া বাবার এই পৃথিবীতে আর কে আছে। আর বাবা জেল থেকে ছাড়া পেলে কোনদিন সে বাবাকে ওই গ্রামে নিয়ে যাবে না। মানুষ-খুনি বলে লোকে তার বাবাকে দুয়ো দেবে, তা প্রাণ থাকতে সে মেনে নিতে পারবে না। অত ছোট্ট বেলায় বাবা তাকে ছেড়ে মা’কে ছেড়ে জেল খাটতে বাধ্য হয়েছিল। বাবার মুখ অনেক বড় হয়ে সে চিনেছে। জেলে নিয়ে গিয়ে মা তাকে চিনিয়ে দিয়েছে বাবার মুখ। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, “তোর বাবার মত শান্ত কর্মঠ ভাল মানুষ ওই পাড়ায় কম ছিল রে বাপ। ওই গরু কাটা, ছুরি, ইনবাইস, কুরপি আরও কত কি এইসব নিয়েই মুচিদের দিন কাটে। ওটাই তাদের জীবন জীবিকার প্রধান পথ। তা সংসারের জন্যেই তো তোর বাবা কাজ করতে ভাগাড়ে গিয়েছিলো। পেটের জ্বালা মেটাতে ঘটনাক্রমে তোর বাবা একটা ভুল করে ফেলেছিল। সেটা মেনেও নিয়েছিল সে। কিন্তু দেশের আইন, সমাজ তাকে খুনি হিসেবেই দেগে দিল। কেন এমন কাজ ওই শান্ত মানুষটা করে ফেলল সেসব তখন কেউ বিচার করে দেখল না। অথচ এই মানুষটা রাগের বসে অকাজটা করে ফেলেছে স্বীকার করে সকলের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিল। কেউ ক্ষমাভিক্ষা দিল না। তোর বাবাকে জেলের ঘানি টানতে বাধ্য করালো এরা। পাড়ার একটা মানুষও কথার-কথায় আমাদের ওপর দরদ দেখালো না। দেখালে আমাকে তিন মাসের মধ্যে গ্রাম ছাড়ার নিদান দেয়? কারোর হৃদেতে একটু দয়াও হল না যে, এই মেয়েটা চার বছরের একটা শিশুকে নিয়ে কার কাছে যাবে, কোথায় দাঁড়াবে? তোর বাপের, আমার বাপেরবাড়ির তিনকুলের কোন আত্মীয় বেঁচে নেই যে তাদের দাবায় গিয়ে দাঁড়াবো। তোকে নিয়ে আমি ভেসে গেলাম অকুল দরিয়ায়। ওই দুলাল কাকার হাত ধরে এই চন্দনবাবু যদি আমাদের ঠাঁই না দিত, কুকুর-শেয়ালে আমাদের মায়ে-পোয়ের জীবন ছিঁড়েকুটে ছিবড়ে করে শেষ করে দিত। একদিন না একদিন তোর বাবা তো জেল থেকে ছাড়া পাবেই। জেলে পচে মরে গেলে আলাদা কথা। উপরঅলা এই পোড়া কপালে কি রেখেছে জানি না। তবে যদি ফিরে আসে তো বাবাকে তোর কাছে আশ্রয় দিস বাপ। আমিও আর তোকে ছেড়ে এখানে পড়ে থাকবো না। তিন জনে নতুন করে আবার সংসার পাতবো।” সেই নির্বিবাদী ভালমানুষটা, আমার বাপ কিনা আমাদের কাজের বিরোধিতা করবে! এটা কোনদিন হয়? তেমন প্রয়োজন হলে অনুকুল কাকাকে, বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জেলে নিয়ে যাবো। বাবার সামনে কথা বলিয়ে দেবো! তাহলে তো তখন আর আপত্তি থাকবে না। হয়তো কয়েদখানায় থাকার জন্যে জমির দলিলে বাবার সই দেয়াতে বিধিনিষেধ থাকতে পারে। অমন ঝুঁকি সে নিতেও চায় না। তখন হিতে বিপরীত হলে অন্য বিপত্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারে ওরা। দরকার কি। বাবার যে আপত্তি নেই, সেই কথাটা ওনার সামনে মুখ ফুটে বাবা বললেই তো হল। একবার মুখ ফুটে বলে পরে অস্বীকার করবে এমন মানুষ পরেশ রুইদাস নয়।
অনুকুল কুম্ভকারের সঙ্গে তো কয়েকবার দেখা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি পেশের পর শেষ পর্যন্ত রাজি করতে সক্ষম হয় লোচন। রাজি হয় অনুকুল কুম্ভকার তাদের জায়গাটা কিনতে। তা হঠাৎ আবার এই মালিকানার প্রশ্নটা তুলল কেন বুঝতে পারছে না। নিশ্চয়ই তাদের রুইদাস পাড়ার কেউ তার কান কামড়েছে। হয়তো বাবাকে যারা পছন্দ করে না তাদের কেউ এমন কাজটা করেছে। তারা চায় না পরেশের ছেলে তাদের বাস্তু বেচে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলে দেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যে সফল হবে না তা লোচন নিশ্চিত। বোম্বে থেকেই ফোন লাগালো অনুকুল কুম্ভকারকে, “কাকা, আমি মা এবং বাবার অনুমতি নিয়েই এই জমি বিক্রির কাজে হাত দিয়েছি। জেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে বাবার সঙ্গে কথা বলে বাবার মতামত নিয়েছি। এর পরও যদি আপনার কোন প্রশ্ন থাকে তো সরাসরি বাবার সঙ্গে আপনার কথা বলিয়ে দিতে পারি। তাহলে আপনাকে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের তারিখে জেলে আসতে হবে। আপনি সেটা করতে চাইলে আমাকে বলবেন। আর তা না করে যদি আমাকে বিশ্বাস করেন তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমিটা রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করুন। জেনেশুনে আপনাকে বিপাকে ফেলার কোন ভাবনা আমার নেই। তাছাড়া সেটা আমি বা করতে যাব কেন। আপনি কি আমার শত্রু? না, তা তো নয়। আপনি আমার বিপদে পাশে দাঁড়ানো উপকারি স্বজন। স্বজনের ক্ষতি কোন সভ্য মানুষ চাইতে পারে না। তাছাড়া আপনার কথা মা খুব বলে। মা বলে, পয়সা তো অনেক মানুষের থাকে। বেশির ভাগেরই দম্ভে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু মা বলে, আপনি ঠিক তার উল্টো মনের মানুষ। সব মানুষের সঙ্গে আপনি, আপন মানুষের মত ব্যবহার করেন। এমন যে মানুষ, সেই মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে পাপ তো হবেই সেইসঙ্গে তারও একদিন না একদিন ক্ষতি হবে। সেই শিক্ষাই আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, কাকা।”
লোচনের এমন গুছোনো কথায় সন্তুষ্ট হয় অনুকুল। এর পর আর কোন কথা না তুলে বলল, “ঠিক আছে। মুহুরির সঙ্গে কথা বলে কাগজপত্র তৈরী করে তোমাকে আমি খবর দিচ্ছি। সেইমত তুমি মা’কে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো।”[সতেরো]
ছেলেটার জন্যে রতনের যেন চিন্তার শেষ নেই। এবারে আবার মাধ্যমিকটা পাশ করতে সেই চিন্তা আরও বেড়ে গেল। সে নাকি পড়া ছাড়বে না। ইলেভেনে ভর্তি হবে। কথাটা শুনেই রতনের মাথায় হাত! বলে কি রে ‘গোহর ব্যাটা’! টেনেটুনে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে কত কষ্টে এতটা পড়াতে পেরেছে সে। এর পর আবার! ও ভাবছিল এবার ছেলেকে নিজের কাজে টেনে নেবে। আর পেরে উঠছে না। বয়সটাও আস্তে আস্তে চোখ বুজোনোর সময়কে ছুঁতে দৌড়চ্ছে। সনাতনের মায়ের সাথে সেই কথাটাই হচ্ছিল, “আর আমার একার পক্ষে সংসার টেনে নিয়ে চলা যাচ্ছে না গো। ছেলেটা এবার তো একটু হাতে ধরা হয়েছে। পাশও করল একটা। অনেকটাই হয়েছে। এই পাড়ায় ওই মিলনের মেয়ে অলোকার পর এখনো কেউ মাধ্যমিক টপকাতে পারেনি। তোমার সনাতন আবার প্রথম কুড়ির মধ্যে সতেরো। গর্বের কথা। গর্ব হচ্ছে আমার। কিন্তু এই গর্ব বুকে আগলে বসে থাকলে তো পেট শুনবে না। এই রাক্ষসটাকে তো সময় মেনে চাহিদা পূরণ করে যেতে হবে। ছেলেকে এবার ঢাক বাজানো, গরুর চামড়া ছাড়ানো, জুতো তৈরী, সেলাই সব আমাদের মুচিদের যা কাজ, সবটাই আস্তে আস্তে শিখিয়ে দিতে হবে। আর ওই কুনকে, সের, পালি বা ধামা বোনার কাজগুলো চলতে ফিরতে শিখিয়ে দিলে চলবে। ও যা মাথাওয়ালা ছেলে, কয়েকবার দেখিয়ে দিলেই ওগুলো পেরে যাবে। এখন অতটা জরুরী নয় ওগুলোর কাজ রপ্ত করার। তাছাড়া এইসব বেতের কাজের এখন তো আর বাজার তেমন নেই বললেই চলে। প্লাস্টিকের ড্রাম, বাটি ইত্যাদি উঠে গিয়ে বেতের জিনিস কেউ আর কিনতে চায় না। বেত তো অত সস্তার জিনিস নয় যে প্লাস্টিকের দামে বিকোবে! মানুষ সব আজকাল কম দামের জিনিস খোঁজে। কিন্তু প্লাস্টিক যে মানুষকে কত ক্ষতি করে তা সকলে জেনে বুঝেও সেই আগুনে হাত বাড়ায়। তা মানুষের ভালমন্দ মানুষ বুঝবে’খন। নিজের ভাল কিসে হয় সেটাই এখন আমাদের লাখটাকার প্রশ্ন। সংসারের হাতে ধরার মত করে দিতে যেটুকু এখন শেখানো দরকার সেইগুলোই ছেলেটাকে শেখাবো ঠিক করে আছি। এতদিন ধরে এই যখন তার ভাবনা-পরিকল্পনা, ওই একটা বাক্যে তার সবটায় জল ঢেলে দিল বেটা আমার! এখন আমি কোথায় যাই, কি করে বোঝাই যে তোদের ঘরের ছেলেপিলেদের বেশি লেখাপড়া করতে নেই। বেশি পড়া শিখলেও কেউ তোকে চাকরি দেবে না। নীচু জাতকে বাবু জাতেরা ঘেন্না করে। তার উপর আমরা চর্মকার-মুচি। হিন্দু হয়ে গরুর চামড়া-মাংস ঘাঁটাঘাঁটি করি। আমাদেরকে তো বাবুরা দেখতেই পারে না। চোখের বিষ। সেই আমাদের পোলা হয়ে তোরা লেখাপড়া শিখে ওই বাবুদের পাশের চেয়ারে বসে আফিসে চাকরি করবি? এ কোনদিন সম্ভব না রে বাপ। কেন শুনবে বেটা, এই প্রায় মুর্খ বাপের কথা। শিক্ষিত মাস্টারের কথা শুনবে! আর ওই মাস্টাগুলোও হয়েছে তেমন। ওরাই ওর মাথাটা খাচ্ছে। বিশেষ করে অমর স্যারটা। সনাতন মাধ্যমিকে সতেরো হয়েছে। লেখাপড়ায় এত ভাল। পরিবার এবং অন্যদের একটু সাহায্য পেলে অনেক উপরে উঠতে পারবে ও। তারপর সরকারি সংরক্ষণের সুযোগে তরতর করে এগিয়ে যাবে। এদের উৎসাহ দেবার জন্যেই তো সরকার সমাজের এই পিছিয়ে পড়া অংশের উচ্চ শিক্ষায় বা চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের ঘরের ছেলে, উজ্জ্বল সম্ভাবনা যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সে কেন পড়া চালিয়ে যাবে না। যতই অভাব-কষ্ট থাক, পড়াশোনা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে। এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে হবে সনাতনকে।”
অমর স্যার কিছু বললেই যেন ছেলেটা তা বেদবাক্য ধরে নেয়। একবার যদি কোন কথা এর মাথায় গুঁজে দেয় তো বেটাচ্ছেলেকে কার বাপের সাধ্যি সেখান থেকে বার করে আনতে পারে! আমাদের মত গরিব ঘরে এসব মানায় নাকি? এই মাধ্যমিকের সময় কি চাপটাই না খেতে হল। একবার বলল, “একটা ছাত্রবন্ধু আনতে হবে বাবা।” তো একসপ্তা পরেই বলে বসল, “আমাকে টেস্ট পেপার কিনতে হবে। অমর স্যার বলেছে। টেস্ট পেপার দেখে প্র্যাকটিস না করলে নাকি ভাল রেজাল্ট করা যাবে না।” বলল তো তাই মাধ্যমিকের সময়! তা উঠোউঠি এইরকম বই কেনার চাপ দিলে সেও বা তার দাম জোগায় কোথা থেকে! কাজের বাজার তো একদম যাচ্ছেতাই। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ধামা পালি সারাই, বিক্রী করে যা সামান্য কিছু রোজগার হয় তাতে একবেলা একসন্ধে পেটে দিয়ে দিন চলে। পাড়া ফিরি করার কাজে কি মোটা পয়সা পাওয়া যায়? যায় না। সেটা বোঝে না ছেলেটা। ওই মাস্টারটাও। রেগেমেগে একদিন সনাতনকে বলেছিল, বাপ কি হাড়ভাঙা খাটনি খেটে দু’পায়সা ঘরে আনে জানিস তো। তার পর এই বই-ফই কেনার চাপ দিলে আমি পারবো কেন? তাও যদি আমার কথা না শুনিস তাহলে এক কাজ কর, আমাকেই বিক্রি করে দে? তাতে যদি তোর চাহিদা মত টাকা পাস তো নিয়ে নে? ক্রীতদাস হয়ে যাই। ছেলে যখন আমার তখন তার মানুষ করার দায়ও বাবার থাকে। তোর অমর স্যার তো জানে আমাদের বাড়ির অবস্থা কেমন। তার পর কেমন করে চাপ দেয় রে? কেমন-তারা মাস্টার, ওই লোকটা?”
রতনের কথায় কেঁদে ফেলেছিল সনাতন। তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে আর বই কেনার কথা বলে বাবাকে চাপ দেয় নি। অমর স্যার নিজের চেষ্টায়, গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে তাকে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করে দেয়। সনাতন মনের ভেতর গুমরে গুমরে আওড়েছে, “আমি ভাল করে পড়তে চাইলেও পড়তে পারব না। আমরা গরিব বলে যেন আমাদের পড়ার অধিকার নেই ! বাবার বা কি দোষ। তাদের পেটে দুটো দানা জোটাতেই বাবা হিমসিম খাচ্ছে। মা এদিক ওদিক থেকে লোকের গরুর গোবর জোগাড় করে ঘুঁটে বানিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বেচে কিছু পয়সা বাবার সংসারে জোগান দেয়। সেই সংসার আবার তার পড়ার খরচ যোগাবে কেমন করে! কিন্তু অমর স্যার বলেছে, পড়া ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তাকে বড় হতে হবে। সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে, তাদের মত ছোট জাতের, গরিব ঘরের সন্তানরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তুই পারবি সনাতন। তোর হাত দিয়েই সেই কাজ হবে। যত বাধা আসুক। দমে গেলে চলবে না। তুই জানবি, বাধা তোর আসবেই এবং সেই বাধা তোকে পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অমর স্যারের কথা সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে চায়। কিন্তু সেটা কেমন করে, তা তো সে বুঝে উঠতে পারছে না। উচ্চ মাধ্যমিকের একটা টেস্ট পেপার এখনো সে জোগাড় করে উঠতে পারল না।
হঠাৎ সনাতনের চোখের সামনে ভেসে উঠল পূব-পাড়ার ওই অলোকাদির মুখটা! তাদের বাড়ি থেকে পূব দিকে আট-দশটা বাড়ি পরে অলোকাদিদের বাড়ি। পাশের পাল পাড়ার বিপ্লবদা পড়তো অলোকাদির দু’ক্লাস উঁচুতে। অলোকাদিকে বিপ্লবদার পছন্দ হয়েছিল কি না কে জানে! মনে মনে ভালবাসতোও হয়তো। অসম্ভব কিছু নয়। না হলে পড়া দেখিয়ে দেবার ছুতোয় ঘনঘন এ’পাড়ায় ও আসবে কেন। এমনিতে পালপাড়ার লোকেরা একটু নাক উঁচু। লেখাপড়া, টাকাপয়সা, সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা রুইদাসদের ওরা কেমন যেন বাঁকা চোখে দেখে। তাই নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওরা তাদের রুইদাসপাড়া মাড়ায় না। অথচ বিপ্লবদা, তার পুরোনো একটা টেস্টপেপার আর সেইসঙ্গে একটা নতুন টেস্টপেপার, কিছু নোটস অলোকাদিকে দিতে এসেছিল। তাছাড়া ওগুলো দরকারও অলোকাদির। বরং অলোকাদির তার প্রয়োজন মেটাতে বিপ্লবদার বাড়ি যাওয়া উচিৎ। সাধারণ ভাবনায় এটাই হবার কথা। কিন্তু এখানে তার উল্টো। অলোকাদির প্রতি বিপ্লবদার ভাললাগা বা ভালবাসার টান না থাকলে এই উল্টোপুরাণ হয় কেমন করে। আসলে অলোকাদিকে দেখতে খুব সুন্দর। দুপুরে পাড়ার মেয়েমহল বড়-পুকুরের সান বাঁধানো ঘাটে বাসন মাজা আর আড্ডার সময় প্রায়ই অলোকাদির কথা পাড়ে। দেরি হচ্ছে বলে পুকুরঘাটে তার মা’কে ডাকতে গিয়ে কথাগুলো শুনেছে সনাতন, “মিলন রুইদাসের মেয়ে, ওই অলোকাটা, যেমন ফর্সা তেমন মাজাঘসা মুখের বাহার। রুইদাসদের ‘বাজার ছাড়া’ মেয়ে। কি করে ওদের গর্ভে এই সুন্দরীটা এলো কে জানে। রুইদাসদের কোন মেয়ে-পোলা তো এত চকচকে না? সব তো কেলে-কুসুন্ড আর ফিঙে ফর্সা।” একজন আবার মাথার ঘোমটায় মুখ আড়াল করে শরীর দুলিয়ে ফুট কেটে বলল, “কি জানি বাবা, মেয়ের মা’র চালচলন ঠিক ছিল কি না কে জানে! ঠিক থাকলে ভাল। ভগবান ভ’র করেছে তাই অমন সুন্দরী মেয়ে বিইয়েছে।”
অলোকাদি এখন হরিণডাঙ্গার কাছে হেলেগাছিতে ‘সাধন চন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে’ বাংলা অনার্স নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে আর বিপ্লবদা ডায়মন্ড হারবার ‘ফরিক চাঁদ কলেজে’ ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ে। ওই বই-নোটস্গুলো তো এখন আর অলোকাদির কাজে লাগবে না। নিশ্চয়ই ওগুলো অলোকাদির কাছে পড়ে আছে। অলোকাদি ইতিমধ্যে অন্য কাউকে দিয়ে দিলে বা দেবে বলে কথা দিয়ে থাকলে তো তার ভাগ্যে আর জুটল না। ওই বই জোগাড় করা নিয়ে তাহলে তার কপালে অনেক কষ্ট আছে। আর দেরি না করে কলেজ থেকে অলোকাদি ফিরলে সন্ধ্যেবেলাই ওদের বাড়ি যাবে সে।
সেবার অলোকাদি আর বিপ্লবদার মধ্যে এই টেস্ট পেপার-বই আর নোটস্- টোটস্ দেয়া নেয়া নিয়ে জানাজানি হয়ে যেতে সে কি গন্ডগোল! পাল পাড়া আর রুইদাস পাড়ার মধ্যে বলা যায় আড়াআড়ি বিভাজন যেন হয়ে যেতে বসল। বিপ্লবদা উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে বাংলার নোটস্ আর টেস্ট পেপার নিয়ে অলোকাদিকে দিতে এসেছিল সেদিন। এইসব পড়াটড়া নিয়ে আলোচনা করতে করতে সন্ধ্যেটা একটু ভারি হয়ে গেছিল তা ওরা বুঝতে পারেনি। তক্কে তক্কে ছিল পাড়ার বখাটেরা। বিপ্লবদা, অলোকাদিদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। পেছনে অলোকাদি টেঁপি-লম্পোর আলো ধরেছে। মাটির ঘরের উঁচু বারান্দা থেকে সিঁড়ি ভাঙতে যাতে বিপ্লবদার অসুবিধা না হয়। তাছাড়া ক’দিন ভ’র বৃষ্টি হওয়ায় ঘরের সামনের উঠোনটা কাদা প্যাচ প্যাচে হয়ে গেছিল। পা-পা মাপ করে ইট বেছানো আছে উঠোনে। কাদা মাড়ানো থেকে পার পেতে। একটু আলো না ধরলে অন্ধকারে হোঁচট খেতে পারে বিপ্লবদা। নিজের শরীরটা একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে অলোকাদি বিপ্লবদার দিকে টেঁপির আলোটা বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বলছে, “সাবধানে দেখে ইটে পা রাখো বিপ্লবদা। না হলে পায়ে ঠোক্কর লেগে কাদায় পা পড়ে যেতে পারে। অলোকাদি সেই মুহূর্তে হয়তো বিপ্লবদার একটু কাছাকাছি এসে পড়েছিল। খানিক তফাতে রাস্তার উপর অন্ধকারে পাড়ার ওরা ওৎ পেতে ছিল ওদের দু’জনের ঠিক এইরকম কোন একটা প্রায় অন্তরঙ্গের মুহূর্তের জন্যে। অন্ধকারের ভেতরে চোখ ফুঁড়ে তারা ধরেই নিয়েছিল বিপ্লবদা, অলোকাদিকে জড়িয়ে ধরেছে! সঙ্গে সঙ্গে চৌকী-অলারা হই হই করে তাদের উঠোনে নেমে এসে তাদের ঘিরে ধরে। হঠাৎ এমন ঘটনায় চমকে ওঠে অলোকাদিরা। থরথর করে কাঁপতে থাকে বিপ্লবদা। তারা যা সন্দেহ করছে তা যে কিছুই না, বারবার অলোকাদিরা দু’জনেই বলার পরও পাড়ার ওরা কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়। বিপ্লবদা বেলেল্লাপনা করছিল অলোকাদির সঙ্গে। এই বদনাম থেকে তারা কিছুতেই পিছোতে রাজি নয়। এই জঘন্য কাজের জন্যে শাস্তি পেতে হবে বিপ্লবদাকে। আটচালায় বিচার হবে বিপ্লবদার। বেলেল্লাপনার জন্যে মোটা টাকার ফাইন করা হবে। এইসব হুল্লোড়ের খবর হাওয়ার বেগে উড়ে বেড়ালো গোটা পাড়ায়। একে একে লোক জড়ো হতে থাকে। কিন্তু পাড়ার মধ্যে মুরুব্বি বুঝদার লোকও তো আছে। তাদের মধ্যে সনাতনের বাবা রতনও আছে। ভীড় কাটিয়ে সনাতনের বাবা চলে যায় অলোকাদির বাড়িতে। যাবার সময় বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যায় অলোকাদিকে। অলোকাদির বাবা-মা’র সঙ্গে সব কথা আলোচনা করে বোঝা যায় ব্যপারটা পাড়ার ছোকরারা যেভাবে চাউর করেছে তা সঠিক নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে এত লোকজনকে তো সহজে বোধ মানানো যাবে না। চাউর হয়ে যাওয়া কথাগুলো ভুল তা সহজে মানুষকে বোঝানো যাবে না। আর কিছু মানুষ আছে যারা আবার ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করবে। এই সুযোগে অলোকার বাবা, মিলনের সঙ্গে যার পুরোনো ‘আকছা আকছি’ আছে তারা শোধ তোলার চেষ্টা করবে। আর ঝগড়াঝাটি একজনের সঙ্গে আর একজনের বা একাধিক কারোর সঙ্গে টুকটাক থাকতেই পারে, থাকেও। গ্রামের এমন মানুষ নেই বললেই চলে, যার সাথে অন্য কারোর কোনদিন বিবাদ বা কথাকাটাকাটি হয়নি। তাতে একে অপরের মনে আঘাত লাগতেই পারে। কেউ সেটা ভুলে যায় বা মেনে নেয়, কেউ নেয় না। মনের মধ্যে তা পুষে রেখে দেয়। সুযোগ পেলে সে তার মনের ঝাল মেটাবার চেষ্টা করে। তবু রতন আপাতত গ্যাঞ্জাম হটাবার জন্যে ভীড়কে বলল, “ঠিক আছে, তোমাদের আর্জি মত আটচালা বসানো হবে। এই গন্ডগোলের একটা বিহিত করা হবে। এখন সবাই শান্ত হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাও। বিপ্লবও বলেছে, সে তার বাড়ির সঙ্গে কথা বলে যেদিন আপনাদের আটচালা বসবে, সেদিন আমাদের পক্ষও হাজির হবে। মিলন, তার মেয়ে অলোকাকে বিচারে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে ভীড় থেকে দক্ষিণ পাড়ার সুদর্শন ঋষির ছেলে, অভয় বলল, “কেন, অলোকা আটচালায় পাবলিকের সামনে আসতে যাবে কেন? ওর তো কোন অন্যায় নেই। ওই বিপ্লব ব্যাটা বেপাড়া থেকে এখানে এসে আমাদের পাড়ার মেয়েকে ফুঁসলে নিতে এসেছে। অন্যায় ওর। অলোকা আটচালায় আসবে না। বিচার হবে বিপ্লবকে নিয়ে এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে। কড়া শাস্তি। তাহলে আর দ্বিতীয়বার বেপাড়ার কোন ছ্যাঁচড়া আমাদের রুইদাস পাড়ার মেয়েদের দেখে ছোঁক ছোঁক করার সাহস পাবে না।” অভয়ের কথায় একদম পেছন থেকে তাকে ভেঞ্চি কেটে রে রে করে ওঠে বরেণ, “এই ব্যাটা ওভে, তুই ওই মেয়েটাকে আড়াল করতে চাইছিস কেন? এক হাতে তালি বাজে, না-রে? দু’পক্ষের কথা শুনে তবে তো বিচারক সঠিক বিচার করবে। আটচালায় দু’জনের কথাই শুনতে হবে। না হলে ‘এ্যাকেনে’ বিচার হয়ে যাবে। ঝাড় খেয়ে যাবে অন্য পাড়ার ছেলেটা। আর তুই কেন মেয়েটাকে সমক্ষে আনতে চাইছিস না তা কি আমরা জানিনা বুঝি। ওর প্রতি তোর লোভ আছে তা পাড়ার কে না জানে? অলোকা স্কুলে বার হলেই তেমাথানি মোড়ের বটগাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকিস, তা কার না চোখে পড়েছে। গলায় গামছার মুড়ির ঝোলা ঝুলিয়ে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তা চিবোতে চিবোতে তার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে থাকিসনি? অলোকার সাথে কথা বলার জন্যে ওকে দেখলেই বিষধরের মত কেমন হিস হিস করিস তাও সবাই দেখেছে। যেন নাগালে পেলেই তাকে ছোবল মারে আর কি! সে কথা যদি আটচালায় কেউ পাড়ে তাই তোর এই মাতব্বরি। সেটা আমরা বুঝিনা বুঝি? শালা দুনিয়ার ধান্ধাবাজ কোথাকার! মানুষকে বোকা বানাতে চায়।”
এত লোকের সামনে হাটে হাঁড়ি ভাঙতেই অভয় রাগে গরগর করতে থাকে আর ফুঁসে উঠে তেড়ে যায় বরেণের দিকে, “শালা শুয়োরের বাচ্চা, তুই প্রমাণ করতে পারবি, আমি অলোকার পেছনে লাগি? কেউ কারোর দিকে তাকালেই তার উদ্দেশ্য খারাপ? তুই কি করে জানলি, আমি অলোকার দিকে তাকাই? তাহলে তুইও নিশ্চয়ই ওর দিকে তাকাস? তোর কথাতেই প্রমাণ হয়ে গেল তোরও উদ্দেশ্য খারাপ। নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়লি তো-ও? ওই কথা আছে না, “চালুনির পোঁদ ঝর ঝর করে, আবার চালুনি ছুঁচের বিচার করে?” তোকে সাবধান করে দিচ্ছি বরেণ, ফের যদি তুই ওই শান্তশিষ্ট গোবেচারা মেয়েটার দিকে তোর লালসার চোখ ফেলিস তো প্রচুর খেসারত দিতে হবে তোকে। শালা ঢ্যামনার বাচ্চা! ফালতু এত লোকের সামনে আমাকে তুই অপমান করলি? দাঁড়া শালা, তোকে দেখাচ্ছি মজা। একটা শক্ত ঘুষি বাগিয়ে বরেণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অভয়। বরেণও ছাড়ার পো নয়। পাঁজা মেরে অভয়কে ধরে পাছড়ে মাটিতে ফেলে সিনেমার ঢঙে তার বুকে লাথি তুলতে যাবার আগেই অন্যরা ধরে ফেলে তাকে। ওদের দু’জনের মারপিট সামলাতেই এবার ভিড় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চিৎকার চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই ফাঁকে যারা এসব পছন্দ করে না, তারা পাতলা হয়ে যায়। যুযুধান দু’জনকে অন্যরা যে যার বাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে আসে। তখনও অভয়ের ফোঁসফোঁসানি দমেনি, “এই আমার মায়ের দিব্যি রে শালা বরেণ, তোকে আমি ছাড়বো না। তুই বিষ-পতঙ্গ, ভীমরুলের চাকে ঢিল মেরেছিস। তার হাত থেকে তোর রেহাই নেই। এই আমি তোর পেছনে পড়ে গেলাম। অলোকার কেসের সাথে সাথে তোর এই চোরপুট্টিরও একটা বিহিত না করে আমি থামছি না।” ততক্ষণে ভিড় ফাঁকা। রতন এবার বিপ্লবকে তাদের পাড়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই ছোকরারা যেভাবে রুখেছে, মনে হচ্ছে তোমাদের নিয়ে আটচালায় বসার একটা ব্যবস্থা না করে ছাড়বে না। ভাবছিলাম এই নিয়ে আর ‘কলাগাছের থোঁড় কচলানিতে’ কাজ নেই। যত কচলাবে তত জল-রস বার হবে। কিন্তু কতটা কি পরিস্থিতি হবে তা দু-একদিন না গেলে বোঝা যাবে না। যদি তোমাকে ডাকতে বাধ্য হতে হয় তো তোমাকে বসতে হবে আমাদের আটচালার বিচারের সামনে। তবে মেয়ের বাড়ির লোকরা যখন তোমার বিরুদ্ধে নয়, তখন তোমার কোন অসুবিধা হবার কথা না। তাই তোমার ভয়েরও কিছু নেই। তবু দেখো আটচালা বিচারটা কোন দিকে ঠেলা মারে? জোয়ারে, না ভাটায়!”ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৬)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[বারো]
নানান টানাপোড়েনের দীর্ঘ সময়ের পর রুইদাস পাড়ায় স্থায়ীভাবে নিয়মটা চালু হয়। তাতে অন্তত এই ভাগাড়ের গরু বা মরা ছাগল পড়লে তার চামড়া সংগ্রহের পর ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে যে অশান্তি হয় তা বন্ধ করা সম্ভব হবে। যে আগে আসুক বা পরে, যতক্ষণ পশুর শরীর থেকে চামড়া পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা না যাচ্ছে ততক্ষণে তাদের সম্প্রদায়ের যে এসে পশুকে ছুঁতে পারবে, সেও সমান অংশে চামড়ার ভাগীদার হবে। মায় নিজের গামছার এক খুঁট নিজের কাছে ধরে অন্য দিকের খুঁটটা যদি পশুর শরীর থেকে চামড়া বিচ্ছিন্ন হবার আগে ঠেকিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও সে ভাগ পাবে। এখন রতনদের মত বয়স্করা যেমন খুশি, তেমন অল্পবয়সীরাও। সবাই মিলেমিশে ভাগবাঁটোয়ারা করে বেঁচেবর্তে থাকার একটা ব্যবস্থা আর কি। কিন্তু কালের গতির সঙ্গে তাল দিতে দিতে একটা ব্যাপার রতনরা টের পায়, কোন ব্যবস্থাই যেন চিরস্থায়ী এবং চিরসন্তুষ্টির ব্যবস্থা নয়। আটচালা কমিটির টাকাপয়সার দায়দায়িত্ব হাতে আসার পর রতন দেখছে দিনকে দিন কমিটির ভাঁড়ার কমতে শুরু করেছে। এক সময় যে ভাঁড়ার সবসময় টৈটুম্বুর হয়ে থাকত এখন সে তার কৌলীন্য হারাচ্ছে। কমিটির আয় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। একদিন কমিটির কর্তাদের নিয়ে এই পয়সাকড়ির ব্যাপারে আলোচনায় বসে ওরা। তাতে দেখা যাচ্ছে ভাগাড় থেকে যে হারে আয় আসতো তা ভীষণভাবে কমে আসছে। ভাগাড়ের পাওনা চামড়ার ভাগ ঠিকভাবে আটচালাকে লোকে দিচ্ছে না।
তাদের বয়ারিয়ার রুইদাস পাড়ার এলাকার মধ্যে পড়ে ফলতা থানার যাবতীয় ভাগাড়। শুধু ফলতা থানা কেন, কাছাকাছি যেসব থানায় তাদের মুচি সম্প্রদায় নেই, সেইসব থানার ভাগাড়ও অন্য এলাকার মুচিদের আলোচনা সাপেক্ষে তাদের আওতায় পড়বে। সব ভাগাড়ই আবার দুইভাগে ভাগ করা আছে। একভাগ নির্দিষ্ট করা আছে আটচালা কমিটির জন্যে, অন্যভাগ পাড়ার সকল বাসিন্দাদের জন্যে। কমিটির ভাগের ভাগাড়ে কোন পশু পড়লে সেই পশুর পঁচাত্তর শতাংশ চামড়া কমিটি পাবে। বাকি পঁচিশ শতাংশ পাবে যারা ওই চামড়া সংগ্রহ করতে আসবে। যে ক’জন চামড়া পাবার অধিকারী হবে তারা ওই পঁচিশ শতাংশ সমানভাগে ভাগ করে নেবে। পঁচাত্তর শতাংশর এক চিমটে চামড়ার তারা ভাগ পাবে না। সবটাই যাবে কমিটির তহবিলে।
ওদের পাড়ার কাছাকাছি বলতে দৌলতপুর মৌজা আর আলমবিবি মৌজার ভাগাড় সাধারণ রুইদাস বাসিন্দাদের জন্যে নির্দিষ্ট করা আছে। এই দুটো মৌজার ভাগাড়ে বিশাল এলাকার মানুষ আসে তাদের মৃত পোষ্য ফেলতে।
ফলে এখানে অন্য ভাগাড় অপেক্ষা অনেক বেশি মৃত পশু ফেলা হয়। বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে এর সুবিধা নিতে পারে তার জন্যে এই ব্যবস্থা অনেক আগে থেকে নির্দিষ্ট করা আছে। এছাড়া আর যে ছোট-মাঝারি তিন-চারটে ভাগাড় আছে, যেমন মনষার হাট বা ফতেপুর অথবা কোদালিয়া এইসবকটাই কমিটির জন্যে ঠিক করা আছে। তা সারা বছরে এইসব ছোট ভাগাড়ে যা অল্পবিস্তর পশু পড়ে তাতে কমিটির আয় পুষিয়ে যায়। এতদিন তাই হত। কিন্তু ইদানিং বছর দুই-তিন হবে সেই আয় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। রতনের আগে যারা দায়িত্বে ছিল, তারা কেউই আয়ের এই মন্থর গতি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। এটা তাদের দেখা উচিৎ ছিল। দেখা উচিৎ ছিল এর কারণটা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে।
কমিটির কর্তাদের সেই মিটিংয়ে এটাও ঠিক হয় যে তদন্ত করে দেখতে হবে এই আয় কমে যাবার সঠিক কারণ এবং কে বা কাদের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। রতন আর নন্দকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এটা তদন্ত করার জন্যে। কারণ ওরা নিজেরা এখন আর কোন ভাগাড়ে যায় না চামড়া সংগ্রহের জন্যে। বয়সের কারণে ওরা আগের মত দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। আয়ুক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শরীরের শক্তিক্ষয়ও হয়ে চলেছে। তাই এই পেশা থেকে ওরা সরে এসেছে। যেহেতু চামড়া সংগ্রহের প্রতি ওদের কোন আগ্রহ নেই তাই ওরাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারবে।
তদন্তে নেমে নন্দ-রতনের তো চক্ষু চড়কগাছ! এ যে সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে। গোপনে গোপনে ওরা মনষার হাট বা ফতেপুর-কোদালিয়ার মানুষদের সঙ্গে একান্তভাবে কথা বলেছে। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে নিয়মিত গরু-ছাগল পোষা হয়। গরুর দুধ এবং ছাগলের দুধ বা মাংস বিক্রি করেই যাদের সংসার চলে। এইসব মানুষের জীবন ওই গরু-ছাগলের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। এরা তাদের পোষ্যদের নিজের পরিবারের একজন করে নিয়ে বসবাস করে। ফলে এই মানুষগুলো কোনদিন ভাবে না যে তাদের পোষ্যরা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে আর তাদের সংসারের জন্যে আয় দিতে পারবে না তখন কোন ব্যাপারিকে শুধুমাত্র অন্যের মাংস খাবার ‘আয়ের’ হিসেবে বিক্রি করে দেবে। বিশেষ করে গরুর ক্ষেত্রে। এরা একবাক্যে গরুকে মা ভগবতী জ্ঞানে দেখে। তাই এদের বাড়ির পশু মারা গেলে ভাগাড়ে তো ফেলবেই। কোদালিয়ার এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে নন্দ-রতন। রতনের সঙ্গে তাদের আগে থেকেই চেনা-জানা। ওই পাড়ায় পাড়ায় ধামা-কুনকে সারাবার জন্যে ফেরি করতে দিনের পর দিন আসতে আসতে জানাশোনা হয়ে গেছে। কথায় কথায় রতনরা তাদের বাড়ির গরুর কথা তুলতে তুলসীদাস বাবু বলল, “এই তো এগারোদিন হল আমাদের বড় গাভীটা মারা গেল। ক’দিন ভ’র সে শয্যা নিয়েছিল। তা তোমাদের এক মুচি, নামটা ঠিক জানা নেই, তবে মুখচেনা, পাড়ায় বেত নিয়ে ফেরি করতে করতে দেখতে পেয়েছে আমাদের গরুটা অসুস্থ। সেই যে দেখতে পেল, তারপর প্রতিদিন এসে একবার করে ঢোঁ মেরে যেতো আমাদের গোয়ালঘরে। ও মনে হয় বুঝতে পেরেছিল যেকোন দিন গরুটা মরে যাবে। সরাসরি এসে আমাকে বলল, ‘বাবু, আপনার গরুটা মারা গেলে আপনাদের কোদালের ভাগাড়ে ফেলে দেবেন না। আমরা লোক পাঠিয়ে দেব। ওরা ওটা দৌলতপুরের ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবে। রোজই ভোরবেলা আমরা জনাচারেক লোক আসবো। দেখে যাব। মরে গেলে ওই ভোরেই আমাদের লোক এটাকে নিয়ে চলে যাবে।’ তা আমরা তো তোমাদের রুইদাসদের ভেতরে এই গরু, ভাগাড় নিয়ে কি সব আইনকানুন আছে জানি না। আমাদের পরিবারের প্রিয় এক পোষ্য মারা যাচ্ছে, তাতেই বাড়িময় শোকের আবহ। তার মধ্যে মারা গেলে তাকে কে কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে আমাদের অত মাথা ঘামাবার ফুরসৎ নেই। তুমি, রতন এখন এই কথা তুললে, তাই বললাম আরকি। তা এসব নিয়ে তোমাদের নিজেদের মধ্যে পাড়ায় কোন ঝামেলা টামেলা হচ্ছে নাকি? আমাদের কাছে তো কোদালের ভাগাড় আর দৌলতপুরের ভাগাড় সব সমান। সেইজন্যে ওসব নিয়ে আমাদের মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। প্রশ্ন করে আমাদের কোন কাজও নেই। ও তোমাদের রুইদাসদের ব্যাপার, তোমরা নিজেরা জেনেবুঝে নাওগে। আমাদের এর মধ্যে জড়িও না।”
রতনদের বুঝতে কষ্ট হল না যে এখনকার পড়শি ছেলেপুলেরা কতটা স্বার্থপর হয়ে পড়েছে। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ কতটা নিরাপদ থাকে সেদিকে তাদের আসল লক্ষ্য। তাতে সমষ্টির উন্নতির ভাবনা চুলোয় যাক। কমিটির ভাগাড়ে ফেললে তো ছিটেফোঁটা চামড়া ভাগ পাবে। তাই ওখানে যাতে না পড়ে তার জন্যে কত আগে থেকে এরা সতর্ক থাকে! ভেবে তাজ্জব রতনরা! আরে বাব্বা, আটচালা-কমিটি বেঁচে না থাকলে তোদের সমাজ এক লহমায় কোথায় ওলটপালট হয়ে ছন্নছাড়া হয়ে পড়বে সে খেয়াল তোরা রেখেছিস? থাকবে তোদের গর্ব করার মত এই সামাজিক কৌলীন্য? থাকবে না। এই সমাজ ব্যাভিচারে, অনাচারে ভরে যাবে। বর্ণশঙ্করে পরিণত হবে তোদের রুইদাসরা। তখন তোরা আর বুক বাজিয়ে বলতে পারবি না আমরা রুইদাস, ঋষিদাস, রুহিদাস বা ঋষি-মুচি সম্প্রদায়ের মানুষ। পোদে কৈবর্ত্যে মিলেমিশে তোদের জাতটা ঘেঁটে একেবারে ‘ঘ’ হয়ে যেতে তাহলে আর বেশি সময় নেবে না রে ব্যাটাচ্ছেলেরা!
এক ভাগাড়ের গরু চালাকি করে অন্য ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে আখের গোছানোর মত জঘন্য অপরাধ যে বা যারা করেছে বা করছে তাদের ছেড়ে কথা বলা হবে না। ক্ষিপ্ত রতন-নন্দদের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। অপরাধীদের খুঁজে বার করে এমন শাস্তি দেওয়া হবে যে জীবনে আর কেউ এই নোংরা কাজ করতে গেলে দু’বার ভাববে। যে ভাগাড় এলাকার গরু মরেছে তার গতি তো সেই ভাগাড়ে হবে। চিরকাল তারা এটা দেখে এসেছে এবং তার মান্যতা দিয়েছে। এমনিতেই কমিটির বরাদ্দে যে ভাগাড়গুলো আছে সেখানে গরু সাধারণের জন্যে নির্দিষ্ট ভাগাড়গুলো থেকে অনেক কমই পড়ে। তা সেখানেও শয়তানদের নজর গিয়ে পড়েছে! এর থেকে দুঃখজনক অবস্থা আর কি বা হতে পারে।
এইসব নিয়ে ফাঁকা আটচালার সিঁড়িতে বসে নন্দ, রতন আলোচনা করছে। এমন সময় সুবোধ কাকা তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হন্তদন্ত হয়ে রতন কোমর থেকে পিঠটা উঁচিয়ে ডাক দিল, “কাকা, এদিকে একটু আসো না। তোমার কাছ থেকে একটু পরামর্শ নিই। এখন আমাদের কি করার তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। বড়ই অনাচার হয়ে চলেছে আমাদের পাড়ায়। একটা কিছু কড়া সিদ্ধান্তে আমাদের আসতেই হবে। নাহলে সমাজটাকে আর ধরে রাখা যাবে না। তোমরাই তখন বলতে থাকবে, আমাদের সময় তো এমনটা হতো না। তোমরা, রতনরা পাড়ার মাতব্বরির ভার নেবার পর থেকে মানুষগুলো এমন বেলাগাম হয়ে পড়েছে। আমাদের ব্যর্থতাই তখন তোমরা আঙুল তুলে দেখাবার চেষ্টা করবে। তাতে অবশ্য তোমাদের দোষ দিচ্ছি না। যা হচ্ছে সেটাই তোমরা বলবে। কিন্তু কাকা, সময় থাকতে আমাদের লাটাই গোটাতেই হবে। তুমি এসো কাকা, আমাদের কাছে একটু বসো। একটু আলোচনা সেরে নিই। কোথায় যাচ্ছিলে কাকা, তুমি? কোন দরকারে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছিলে? না এমনি এমনি পা ছাড়াচ্ছিলে? তাই যদি হয় তাহলে একটুকুন বসো কাকা।”
রতনদের কাছে সব শুনে চোখ বড় বড় করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সুবোধ কাকা। তারপর কাকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁরে রতন এও সম্ভব? আমরা মুচিরা গরিব হতে পারি। খিদে ভুলতে চুল্লু, দেশি মদ গলায় ঢালতে পারি। এইসব ছাইপাঁস গিলে নিজেদের পিলে জ্বালিয়ে দিতে পারি। সেই নিয়ে যা বদনাম হয় সেগুলোও গোগ্রাসে গিলে নিতে পারি। কিন্তু গর্ব করে বলি আমরা চোর নই। ফেরেব্বাজ নই, মিথ্যুক নই। আমরা বেইমান নই। সেই আমাদের এই মুচি জাত কি না এমন ফেরেব্বাজি কাজে ঢুকে পড়েছে! কেবলমাত্র নিজের নিজের আখের গোছাবার জন্যে! সমষ্টির মুখের দিকে একবারও তাকাবার কথা ভাবলো না! এটা তো সত্যিই সর্বনাশা প্রবণতা। এটাকে আটকাতেই হবে। নন্দ, রতন, তোমাদের বলছি, আমি জীবিত থাকতে থাকতে যেন এই নোংরামো বন্ধ হয়েছে দেখে যেতে পারি। তবে তোমাদের একটা কথা বলব, ওই তুলসীবাবুর মুখের কথায় বা অন্য কারোর কাছে শোনা কথায় কাউকে শাস্তি দিও না বাবা। যদিও কাজটা বড়ই শক্ত। তবু তা করতে হবে। তোমাদের কিছু একান্ত বিশ্বস্ত লোককে এ কাজে নিযুক্ত করতে হবে। কমিটির আওতায় যে ভাগাড়গুলো আছে সেই এলাকাগুলোতে সেইসব ছেলেপিলেদের গোপনে চৌকী দিতে পাঠাতে হবে। দেখতে হবে কারোর বাড়িতে অসুস্থ কোন গরু-ছাগল আছে কি না। থাকলে আরও সুক্ষ্মভাবে সেই অসুস্থ পশুর পরিণতি কি হল লক্ষ্য রাখতে হবে। আর একদিকে নজর দিতে হবে, আমাদের পাড়ার কোন কোন বেটাছেলে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করতে যায়। ফেরি তারা করুক। এটা তো আমাদের জীবন জীবিকার একটা দিক। কিন্তু ওই ফেরির নাম করেই, আমার মন ঠাওর করছে, তারা অন্যায়গুলো করে চলেছে। তাদের পেছনে চৌকি দিতে হবে। তবে তারা যেন ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে না পারে। তাহলে রতন দেখবে একদম হাতেনাতে তোমরা অপরাধীকে ধরে ফেলতে পারবে। তখন আটচালা যদি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে তো কারোর কিছু বলার থাকবে না।” এরপর খানিক দম নিয়ে সুবোধ কাকা আবার বলল, “দেখো বাবা, আমি যে তোমাদের বুদ্ধিগুলো দিলাম তা যেন আমার নামে বাজারে চাউর করে দিও না। তাহলে যাদের স্বার্থে ঘা লাগছে তারা আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। দিনকাল বড়ই খারাপ গো বাপেরা। ভীমরুল চাকে ঢিল মারলে তুরন্ত ভীমরুল তার প্রতিশোধ নিতে ধেয়ে আসে আক্রমণকারীর দিকে। এ তো আর মৌচাক নয় যে তার কামড় সহ্য করা যাবে। দিনে দিনে কি কাল এল রে বাপেরা!”
[ তেরো ]
দুলাল লোকটাকে তাদের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেওয়াটা এখন মনে হচ্ছে সঠিক কাজ হয়নি। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে তার এই পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না চন্দনের। যেভাবে মেয়েটা ওই দুলালের হাত ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। মনে হল যেন একই মায়ের নাড়িকাটা দুই ভাইবোন। কোনদিন বাড়ি থেকে বাইরে বার হয়নি পাড়াগাঁয়ের এই বোন। স্বামী বেয়নে কোলের শিশুটাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে বাড়ির বাইরে বার হয়েছে। “বোন ভয় পেয়ে কান্নকাটি করছে। ছলছল চোখে বলেছিল দুলাল।” আবেগটা সক্রিয় হয়ে পড়ল। তাই মেয়েটার কান্না বন্ধ করার জন্যে সেদিন প্রস্তাবটা দিয়েছিল চন্দন। এখন তো মনে হচ্ছে ওগুলো সবই তাদের অভিনয়। বিশেষ করে তাদের দু’জনের ঘোষিত সম্পর্কটা। মর্নিং ওয়াকের সময় এ.-ই. ব্লকের বক্সিবাবুকে বলেছিল তাদের কাজের লোকের সমস্যার কথা। বক্সিবাবু বলেছিলেন, ঠিক আছে চন্দন, আমাদের কাজের মেয়ে নমিতাকে বলব’খন যদি তাদের দেশের বাড়ি থেকে কোন কাজের মেয়ে জোগাড় করে দিতে পারে। সেই নমিতাই দুলালের মারফত সনকাকে জোগাড় করে দেয়। এখন তো মনে হচ্ছে এই দুলাল দালালির মত কাজ করেছে। যদিও সে পেশাদার দালাল নয়। দুলালেরও খোঁজ সে নিয়েছে। বৈঠকখানায় একটা পেপারের দোকানে সে কাজ করে। গ্রামের বাড়ি-টাড়ি সব ঠিক আছে। সনকাদের এলাকাতেই তার বাড়ি।
শীতের দুপুরে টিফিনটাইম উপভোগ করতে দলবল নিয়ে চন্দন নিক্কোপার্কে গেল। অভ্যাসমত বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা দৃশ্যে চোখ আটকাতে চমকে ওঠে সে! চলতে চলতে থমকে দাঁড়ায়। অন্যরা সমস্বরে বলে ওঠে, “কি হল চন্দনদা, দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? চলুন!” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে পা পা করে এগিয়ে চলে। এক মহিলা, যে চন্দনের বেশি নেওটা, সে বলল,“চন্দনদা, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলেন যে? আচ্ছা, হঠাৎ আপনার কি হল বলুন তো? কি এমন হল! আমাদের মধ্যে কেউ কিছু বলেছে নাকি যে আপনি এমন চুপ হয়ে গেলেন? আমাদের কথার কোন উত্তরও দিচ্ছেন না। ধুর! ভাল্লাগে না।” বলে মেয়েটাও গোমড়া মুখ করে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে। চন্দন দেখল, এবার আর চুপ করে থাকা চলে না। পরিস্থিতি তাহলে অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। সামনের দিকে হাত উঁচিয়ে চন্দন বলল, “আরে ভাই আমাকে কেউই কোন কিছু বলেনি। যার জন্যে তোমরা সব চিন্তায় পড়ে যাচ্ছো। হঠাৎ একটা ঘটনার কথা মনে পড়তে থমকে গেছিলাম। কথাটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। ভুলে গেছিলাম কাজটা করতে। বাকি রয়ে গেছে। তাই সেটা মনে পড়তে থমকে যাই। ওসব ছাড়ো। পরে সামলে নেওয়া যাবে। এখন চলো। সবাই মিলে গরম কফি খাওয়া যাক। সেইসঙ্গে কড়া করে বেগুনিভাজা।”
অফিসে ফিরে আর আগের মত কাজে মন বসাতে পারছিল না চন্দন। নিক্কোপার্কের দেখা দৃশ্যটা বারবার তার চোখের সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে। রূপসা তাহলে ওদের সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছিল তা তো দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। সনকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে দুলাল! আর সনকা তার মাথার চুলে বিলি কেটে লাজুক মুখে কত কি বলে চলেছে। ওদের মধ্যে পরকীয়া প্রেম যে গাঢ় থেকে গাঢ়তর তা এই ছবিতে পরিস্কার। স্বামী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও সনকা পরপুরুষের সঙ্গে প্রেমালাপে মসগুল। স্বামী যে জীবিত তার প্রমাণ ওর মাথার সিঁদুর। অথচ সনকা স্বামীর ব্যাপারটা তাদের খোলসা করে বলেনি কোনদিন। চন্দন জিজ্ঞেসও করেছিল সনকাকে। কিন্তু তার উত্তর ওকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ও’ব্যাপারে একটা ধোঁয়াশা সে রেখেই দিয়েছে। হয় ও স্বামী বিচ্ছিন্না অথবা কোন কারণে স্বামীর সঙ্গে ও থাকে না। ছেলে কোলে করে স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে যখন এসেছে তখন আবার ঘটা করে সতী সাজতে সিঁদুর পরার মানে কি! ও যে সতী নয়, সেই ভাবনা চন্দনের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। হঠাৎ ওর মনে হ’ল লোভনীয় টোপ ফেললে মাছটা গিলতে পারে টোপটা। সত্যিই সনকার শরীরের এমন টান যে শুধু দুলাল কেন দুলালের থেকেও আচ্ছা আচ্ছা পুরুষ তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে সময় নেবে না। মুখের কাটিংও মনে ধরার মত। অবচেতনে চন্দনের মনও যেন ধরা দিতে উতলা হয়ে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল, দুলালের ব্যাপারটা সনকার কাছে জানতে চাইবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে সনকার মন থেকে সে হাজার যোজন দূরে চলে যাবে। ওকে পেতে গেলে আস্তে আস্তে ফন্দি করে দুলালকে তার কাছ থেকে দূরে সরাতে হবে। কাছে টানতে হবে সনকাকে। যুগপৎ সবটাই চলবে রূপসার অগোচরে।
দুলাল-সনকাকে সেই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার পর থেকে যখনই চন্দনরা নিক্কোপার্কে আসে তার সেই দৃশ্যটা অমনি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তখনই চন্দন অন্যমনস্ক। এই অন্যমনস্কতাকে সঙ্গী করে ওরা পার্ক থেকে ফিরছিল। সদলবলেই ফিরছিল। চন্দন তখন রাস্তা পার হবার জন্যে হাত নেড়ে সকলকে সিগন্যাল দিতেই সবাই মিলে এপার থেকে ওপারে যাবার কালেই একটা দ্রুতগামী বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে! কপাল ভালো বাইকটা সরাসরি কারোর ঘাড়ে চেপে বসেনি। দলের এক ফাঁকটায় সে ঢুকে পড়ে। তাতে ওদের কারোর প্রাণহানির সম্ভাবনা থেকে রেহাই পায়। তবে অল্প-বিস্তর রক্তারক্তি চোট পায় কমবেশি সকলেই। মন্দ কপাল, চন্দন পড়ে গেলে তার বাঁ পা ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। প্রথম ক’দিন হাসপাতাল তারপর বাড়িতে ছ’মাসের জন্যে বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। ওর এই বিপদে রুপসা-সনকা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেবাযত্ন করতে থাকে। সনকা যখনই তার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, চন্দন মনে মনে ভাবে এই মেয়েটাকে নিয়ে তার মধ্যে পাপ চিন্তা প্রবেশ করেছিল। উপরওয়ালা তাই সেই পাপের শাস্তি এইভাবে দিয়ে শিক্ষা দিল, স্বচ্ছ মন এবং সঠিক পথে চললে অমঙ্গল মানুষকে ছুঁতে পারে না।
ডাক্তারের দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই চন্দনের পায়ের প্লাস্টার কেটে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে লাঠির উপর ভর করে হাঁটাচলা অভ্যাস করার পর্ব এসে যায়। কিন্তু তার জন্যে কারোর সাহায্য দরকার। কখনো রূপসা কখনো সনকা, যার যেমন কাজের ফাঁকে ফুরসৎ হয় চন্দনকে হাঁটতে সাহায্য করে। সেই সুবাদে দুই রমনীর শরীরের পেলব ঘ্রাণ তাকে অতিরিক্ত সতেজ করতে সাহায্য করে বইকি। বিশেষ করে ইতিপূর্বের অধরা যুবতী সনকার শরীরের মরমী স্পর্শ! যেমনটি প্রথম প্রথম রূপসার স্পর্শ তাকে মাতাল করে দিত। রূপসার সেই স্পর্শর একঘেয়েমি এখন আর তাকে তেমন মাতিয়ে তুলতে পারে না। যেমন পারছে সনকা। সনকার ভেতরটা তার স্পর্শে কতটা দোলন দেয় তা তো চন্দনের বোঝার অতীত। তবে কিছুটা ইঙ্গিত যেন উঁকি দেয় তার প্রতি সনকার সেবার একাগ্রতার বহরে। তাহলে তো চন্দন এটাও ভাবতে পারে যে এই দুর্ঘটনা ওর কাছে শাপে বর হয়েছে! এই অঘটনের জন্যেই সে সনকাকে এত কাছে পেয়েছে এবং তা কোনরকম ফন্দিফিকির না করেই!
সনকার কাজে চন্দনের বাড়ির সকলেই সন্তুষ্ট। রূপসা তো তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ, “জানো তো, গ্রামের মেয়ে সনকাকে প্রথম প্রথম যতটা অকেজো হবে বলে মনে হয়েছিল এখন দেখছি আমার সেই ধারণা একদম ভুল। সনকা, ওর কাজের মধ্যে দিয়ে আমার সেই ভুল খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাঙিয়ে দিয়েছে। যেভাবে ও তোমাকে সেবাযত্ন করেছে এবং তা একান্ত আপনজনের মত ভেবে করেছে, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। শুধু করেছে না, এখনো করছে। ও যেন পণ করেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও তোমাকে অফিস পাঠিয়ে তবে ছাড়বে। ডাক্তারের অনুমানের আগেই তোমাকে অফিস পাঠিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় যে ও। অথচ দেখো মেয়েটা একবারও মুখ ফুটে সে কথা বলে না। মুখ ফুটে কোনদিন অসন্তোষ প্রকাশ তো করেই না। ওই অসন্তোষ, অনিচ্ছা, অনীহা- এসব যেন ওর ধাতে নেই। খুব ভাল একটা কাজের মেয়েকে আমরা পেয়েছি। এত ভাল মেয়ে, অথচ দেখো, ভাল করে তার স্বামীর ঘর করা হল না। ভাবছি তুমি অফিসে জয়েন করার পর সেই মাসেই ওর বেতনটা বাড়িয়ে দেবো। দশ থেকে এগারো হাজার করে দেবো। আমরা দু’জন কাজে বেরিয়ে গেলে বাড়ির সব দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দেবো ভাবছি। কি, এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না তো? তোমার কি মনে হয়? আমার তো মনে হয় এ মেয়ে তেমন মেয়ে নয়। এক হাঁড়ি ভাতের একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় হাঁড়ির ভেতর অন্যসব চালের অবস্থা কেমন।”
সনকার প্রতি রূপসার এই দরাজ সুপারিশে এবার মনে মনে প্রমাদ গোনে চন্দন। এবার তার কপালের পরত পেঁয়াজের খোসার মত একটা একটা করে খুলছে। খুলতে খুলতে একসময় তার সেই ইপ্সিত রসাল বিন্দুতে মনে হয় একদিন পৌঁছোতে সক্ষম হবে। যতটা সম্ভব ভেতরের সরস ঢেউকে সামাল দিয়ে চন্দন বলল, “হ্যাঁ রূপসা। তোমার থার্ড আইয়ের পর্যবেক্ষণকে তারিফ না করে পারা যায় না। এই জন্যেই তো তুমি আমার যোগ্য স্ত্রী। তোমার মতের সঙ্গে আমি পুরোপুরি এক মত।”
ছোট ভায়ের বিয়েতে রূপসাকে দিন পনেরোর জন্যে দিল্লী যেতে হচ্ছে। অফিস ছুটি মঞ্জুর করেছে। এই ছুটি পেয়ে যারপরনাই খুশি রূপসা। মঞ্জুর হবে কি না তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিল সে। ভায়ের বিয়েতে আনন্দ করতে পারবে না, সেই আতঙ্কে ক’দিন ভর মন ভার করে রেখেছিল। বাবুর দেখাশোনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব সনকার উপর দিয়ে গেল। চন্দনের দেখভালে যে কোন ত্রুটি হবে না, সে বিশ্বাস সনকার ওপর রাখে রূপসা। অবশ্য রূপসা দিল্লী যাবার আগে আগেই চন্দন অফিসে জয়েন করে ফেলেছে। কিন্তু এই সন্ধিক্ষণেই তো সদ্য সেরে ওঠা রোগীর প্রতি আরও বেশি করে নজর রাখা দরকার। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই আবার কোন শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রবল। সনকাকে বলে গেছে রূপসা, “দেখো, বাবু বাইরে বেরোবার সময় যেন স্টিলের চারপেয়ে লাঠিটা নিতে ভুলে না যায়। ডাক্তার এখন ওটাকে সবসময় সঙ্গে রাখতে বলেছে। যতই হাড় জুড়ে যাক, এখনই পুরোপুরি পায়ের উপর চাপ দেওয়া যাবে না।”
নীচের সিঁড়ি ঘরের পাশে ছোট্ট সার্ভেন্ট কোয়ার্টার সনকার জন্যে নির্দিষ্ট। কিন্তু চন্দনকে নিয়ত দেখাশোনার জন্যে দোতলা থেকে তাকে ডাকাডাকি করা বা সনকারও বারবার উপর-নীচ করা কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে। তাই রূপসাই ঠিক করে দেয় দোতলার পশ্চিম বারান্দার প্রান্তে ফাঁকা পড়ে থাকা বড় ঘরে সনকাকে থাকার জন্যে। সনকা তার ছেলেকে নিয়ে ওখানে থাকবে এবার থেকে। তাহলে বাবুকেও চোখে চোখে রাখতে পারবে। বুড়ো শাশুড়ির পক্ষে সেই লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময়টাই উনি ঠাকুরঘরে কাটান। এটা ওনার বহুদিনের অভ্যেস। অতএব সনকাই এখন ওদের ভরসা। প্রত্যেক দিনই অফিস বেরোবার সময় এই লাঠি নেওয়া-না নেওয়া নিয়ে সনকার সঙ্গে ঝুলপেটাপেটি হয় চন্দনের, “বাবু, আবার সেই লাঠি না নিয়ে অফিস যাচ্ছো? বৌদি পই পই করে আমাকে বলে গেছে, তুই দেখবি সনকা, বাবু যেন ওটা ফেলে না চলে যায়। তাছাড়া ও ইচ্ছে করেও না নিতে পারে। তোর ওপর ভার দিয়ে গেলাম। সেটা করতে দিবি না। ভীষণ তেড়েল লোক আছে তোর বাবু। সব কিছুতেই গাজোয়ারী করে। এই জন্যেই তো আমার সঙ্গে যখন তখন লাগে।” তারপরও কথা না শুনে এগোতে গেলে সনকা লাঠিটা নিয়ে ওর সামনে পথ আটকায়, “আগে এটা হাতে ধরো তারপর বার হবে। বৌদি আমার ভরসায় আপনাকে রেখে গেছে।”
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই চন্দন লক্ষ্য করছে প্রথম যখন সনকা তাদের বাড়ি আসে তখন যে শুকনো-শাকনা মত ছিল এই বাড়িতে আসার পর ভাল খাওয়াদাওয়া এবং খুশবন্দ মনে থাকার ফলে তার চেহারার ভোলই পাল্টে গেছে। বাড়িতে ছাওয়ায় থেকে থেকে যেমন শরীরের রঙ চকচকে হয়ে গেছে তেমনি গড়নও ভরভরন্ত এবং আকর্ষণীয়ভাবে টানটান হয়েছে। মনে মনে তার যৌবনের প্রতি লাগামহীন ঝোঁক পেয়ে বসছে। কিন্তু সম্ভ্রমের বাঁধন তাকে আটকে রেখেছিল। এখন সনকার এই ব্যবহার তার যাবতীয় বাঁধনকে যেন ছিঁড়েমিড়ে ছারখার হয়ে গেল! অধৈর্য চন্দন সনকার ফুটন্ত যৌবনকে সপাটে নিজের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়, “বৌদি যখন ভরসা করে আমাকে তোমার কাছে রেখে গেছে তখন বৌদির সমস্ত কাজটাই তো তোমাকে বকলম দিয়েছে। আঃ কি সুন্দর তুমি সনকা। ওঁ হুঁ! বাধা দিও না সনকা। আরও কিছুক্ষণ তোমার শরীরের এই মাতাল করা ওম আমাকে গ্রহণ করতে দাও। এরপর সনকার সমগ্র মুখমন্ডলে উপর্যুপরি চুমু এঁকে দিতে থাকে চন্দন। ক্ষান্ত হওয়ার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সনকা তখন যেন চন্দনকে বাধা দেবার যাবতীয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চন্দনের ভালবাসার অভিঘাতে সনকা আস্তে আস্তে যেন শিথীল হতে থাকে। অফিস যাওয়া বন্ধ করে চন্দন এখন তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কোন কিছুতেই সনকার আপত্তি নেই![চোদ্দ]
সুবোধ কাকার পরামর্শগুলো মনে ধরে রতন-নন্দদের। এর আগে পর্যন্ত ওরা দ্বিধায় ছিল কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। রতন বলল, “এই জন্যে কথায় আছে ‘তিন মাথা যার বুদ্ধি নেবে তার’। সুবোধ কাকার কথাগুলো আমাদের মাথায়ও আসেনি। নন্দ, আমার মনে হয় এই ধান্দাবাজদের পাকড়াও করতে গেলে এমন লোককে গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দিতে হবে যারা ইদানিং আর ভাগাড়ের ওদিক মাড়ায় না। তুই আমি বাদে পাড়ার আর কারা কারা ভাগাড়ের কাজ করে না সেটা তুই ভাল করে খোঁজ খবর নে নন্দ। শুধু ভাগাড়ে কাজ করে না, এই যুক্তিতে কাউকে কাজে লাগানো যাবে না। তাকে কমিটির বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজনও হতে হবে। না হলে সব পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। তাছাড়া আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। যারা এত ঘোরাঘুরি করবে তাদের তো একটু জলখাবারের খরচা দিতে হবে। কেবল মুখে জালতি বেঁধে গরু-পাক খাওয়ালে তো চলবে না। ওটা না দিলে কাজ করতে ওরা উৎসাহও দেখাতে চাইবে না। চক্ষুলজ্জায় কমিটির কথা শুনে হয়তো কাজ করতে যাবে। কিন্তু সে কাজ মন থেকে হবে না। কখনো হয়তো দেখা যাবে, তারা কাজে যাচ্ছি বলে পাড়া থেকে বার হ’ল কিন্তু গেল না। নিজের অন্য কোন কাজে চলে গেল। আমরা কিন্তু তখন তাকে জোর করতে পারবো না। এটা তোকে মাথায় রাখতে হবে নন্দ।” এরপর নন্দ কি একটা বলতে যাচ্ছিল, রতন তার কথার উপর কথা চাপিয়ে আবার বলল, “আমাদের দিনু ঋষি রে। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখেছি, ও ওই ভাগাড়ে গিয়ে গরুকাটা, চামড়ার ভাগ নিয়ে আকচা-আকচি একদম পছন্দ করে না। তাই জীবনে ওকে ভাগাড়মুখি হতে দেখিনি আমরা। সারা জীবন চাষবাস আর চাষের কাজ না থাকলে বাড়িতে ধামা-খোড়া, কুনকে, পালি সহ অন্য বেতের কাজ করে সংসার চালায়। আটচালা নতুন করে তৈরীর সময় প্রায় রোজই এক-দু ঘন্টা গায়ে-গতরে খেটে দিয়েছে। সে তো তুই জানিস, নন্দ। আর সেই ইট চুরির ঘটনার কথা তোর মনে আছে! আটচালার ভিত গাঁথার সময় প্রায়ই দু’চারটে করে ইট চুরি যাচ্ছে। প্রথম প্রথম তো বোঝাই যাচ্ছিল না। ওই দিনুই প্রথম ঠাওর করে ব্যাপারটা! তুই, আমি সবাই চিন্তিত। একে চেয়েচিন্তে ইট, বালি জোগাড় করে এটা তৈরী করা হচ্ছে। সেখানেও যদি কেউ এইসব চোরটামি করে কার না গায়ে রাগ ধরে। দিনের বেলা কারোর সাহস হবে না এ কাজ করার। এইসব চুরি চামারি হচ্ছে বলে রাতেও আমরা পাহারার ব্যবস্থা করলাম। তবুও চুরি আটকানো যাচ্ছে না। ঘটনাটা দিনুরও মনে আঘাত লেগেছে। ওর ওই আঘাত লাগাটা কিন্তু ও কাউকে ফেচকায়নি। ও চিন্তা করেছে, দিনমানে চুরি হবার নয়। রাতেও পাহারা। তাহলে চুরি হচ্ছেটা কখন? আর চুরি করছেটা কে? গবেষণা করে একটা দিন ভোরবেলা চৌকী দিতেই দিনু চোরবেটাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে! ধরা পড়তে জানা গেলো ওই ব্যাটা পাঁড় মাতাল সুফলে কান্ডটা করছিল। কিন্তু ওই সুফলে মাতাল ইট নিয়ে তো ঘর বাঁধবে না। ও নিশ্চয়ই চুল্লু সাঁটাবার জন্যে কাউকে সেই ইট বেচে। এবার ওই গছনদারকে ধরতে হবে। আটচালার উল্টোদিকে দেশমালা ঠাকুর থানের বারান্দায় নিয়ে এসে মাতালটাকে উত্তম-মধ্যম দিতেই মুখ ফসকে বমি করে দেয় গছনদারের নামটা। পোদপাড়ার রুইলের কাজ এটা। রুইলের ছিটেবেড়া ঘরের পেছনে সব চোরাই ইট পাওয়া যায়। তারপর তো নন্দ, তুই পঞ্চায়েতে নালিশ জানিয়ে সব ইট উদ্ধার করলি। রুইলেটা বেঁচে গেল, ও আমাদের আটচালার আওতায় পড়ে না বলে। চোরাই মাল গছনের জন্যে থানায় চালান করা যেত। পঞ্চায়েত বলল, লঘু পাপে গুরুদন্ড দিয়ে দরকার নেই। ওকে ফাইন করে আর দু-চার ঘা ধরিয়ে আমরা কবুল করিয়ে নিচ্ছি, যাতে দু’বার সে এই কাজটা না করে। তা নন্দ, যেটা তোকে বলার জন্যে এত পুরোনো ঘটনা জাবর কাটলাম সেটা হচ্ছে দিনুর মধ্যে কোন অপরাধের রহস্য খুঁজে বার করার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। ওর ওই ক্ষমতাকে এখানে আমরা যদি কাজে লাগাই তাহলে মনে হয় সফল হতে পারি। কারা কারা চুকলিবাজি করে কমিটির ভাগাড়ের গরু সাধারণের ভাগাড়ে চালান করছে ধরে ফেলতে পারবো। আটচালাকে ও মন থেকে পছন্দ করে। দেখা হলে দিনুকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস। আমার কথা ও শোনে। দিনুকে রাজি করানোর ভারটা আমি নিচ্ছি।”
রতনের কথায় আশ্বস্ত হয় নন্দ। কিন্তু দিনুর একার দিয়ে এতবড় এলাকা নজর রাখা অসুবিধা। আর একজন অন্তত কাউকে জোগাড় করতে হবে। আর কাকে পাওয়া যায়, কাকে পাওয়া যায় সেই চিন্তা করতে করতে রতনের হঠাৎ মনে পড়ল সুভাষের কথা। সুভাষ ওর শালীর ছেলে। উঠতি যুবক। এখনো সংসার-ধর্ম করেনি। বাজারে ওর জুতো সারাই, পালিশ, চামড়ার ব্যাগ বিক্রির দোকান। ভাগাড়ে গিয়ে ওইসব কাজকর্ম ওর একদম পছন্দ নয়। তাই সুযোগ এলেও কোনদিন ও ভাগাড়মুখো হয়নি। নন্দর নেওটা ও। মেসোর কথা সুভাষ ফেলে না। নিজের বাবা কি বলছে না বলছে তাতে তার কোন হেলদোল নেই। তবে নন্দ কোনকিছু বললে গুরুত্ব দিয়ে সেই কথা পালন করে। সুভাষকে ও এই কাজে লাগাবে ঠিক করে। দোকান বন্ধ করে বাড়িতে খেতে আসার সময় সারা দুপুরটা ও ফাঁকা থাকে। আবার সেই সন্ধ্যে ছ’টায় দোকান খোলে। এই তিনচার ঘন্টা দিব্বি ও কাজটা করতে পারবে। রতনকে বলে, “আর একজনকে পেয়ে গেছি রতন। আমার শালীর ছেলে, সুভাষ। ও একদম এই কাজে উপযুক্ত হবে। আমি বললে আমার কথা ও ফেলতে পারবে না। ওর ওপর আমরা নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারি।”
নন্দ আর একজন পাহারাদারকে পেয়ে গেছে। তাদের গোয়েন্দাগিরির লোকের আকাল আপাতত মিটল বটে। তবে রতনের আর একটা কথা মনে জিগির টেনে বসল। দিনু বা নন্দর শালীর ছেলে সুভাষ তো তাদের পাড়ার ছেলে। এদের তো অপরাধীরা আলবাৎ চেনে। তাহলে দিনু-সুভাষকে দেখলে ওরা তো সাবধান হয়ে যাবে। চোর ধরা পড়বে না। কিছুটা টান টান হয়ে রতন নন্দকে বলল, “হ্যাঁরে নন্দ, দিনু-সুভাষদের বিনা কারণে ঘোরাঘুরি করলে তো বদমায়েশগুলো বুঝে যাবে, অন্য কোন মতলবে ওরা ঘোরাঘুরি করছে। কথায় বলে না, ‘চোরের মন বোঁচকার তন’ মানে বোঁচকার দিকে। ওরা বুঝে নেবে কমিটি তাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। সাবধান হয়ে যাবে। এভাবে এগোলে তো আমরা কোনদিন অপরাধী পাকড়াও করতে পারবো না। আমার তো মনে হচ্ছে সুবোধকাকার বুদ্ধি, গলে জল হয়ে যাবে। কাজের কাজ হবে না। তুই অন্য কোন কৌশল বার কর নন্দ।”
রতনের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নন্দ। খানিক চিন্তায় পড়ে যায় সে। রতন যে কথাটা বলল, তা তো একদম ফেলে দেবার মত নয়। কিন্তু গোয়েন্দগিরি ছাড়া তাদের সামনে তো আর কোন রাস্তা খোলা নেই। ভুবন জুড়ে সব অপরাধের কিনারা তো হয় এই গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে। তাই এই কৌশল ঠিক আছে। তবে একটা ভাবনা তার মাথায় চলকে উঠছে যেন। তাদের দুই গোয়েন্দাকে সাদামাটাভাবে ছেড়ে দিলে হবে না। ভোল বদল করতে হবে দিনু সুভাষকে। নতুন বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে পকেট থেকে ম্যাচিসটা বার করে হাতে ধরা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে নন্দ বলল, “এই রতন, অত হুটহাট ঘাবড়ে গেলে চলবে না। শোন, এই বুদ্ধিটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। দিনু সুভাষকেও বেত, ইনবাইশ, কুরপি হাতে পাড়ায় ছেড়ে দিতে হবে। ওরাও চোরেদের মত পাড়ায় পাড়ায় ধামা, সের, কুনকে, জুতো ইত্যাদি সারার জন্যে ওই সরঞ্জামগুলো হাতে নিয়ে ঘুরবে। কাজ পেলে কাজ করবে। তবে ওদের মূল কাজ কিন্তু গোয়েন্দাগিরি। লোকের সামগ্রী সারাইয়ের কাজ নয়। তাহলে আমাদের কাজ হাসিল করা যাবে। আর আমাদের সুভাষ তো এসব কাজে ওস্তাদ। আশেপাশের গ্রামের মানুষ দেখে, বাজারে ও এই কাজই করে। অতএব সাধারণ মানুষ তো ধরতেই পারবে না যে সুভাষ মুচি ঢঙ করে হকারি করছে পাড়ায় পাড়ায়। আসল ধান্ধা অন্য।”
খুব গোপনে এবং সন্তর্পণে গোয়েন্দাগিরিটা চলতে লাগল। দিন পনেরো হয়ে গেল দিনু-সুভাষ গ্রামে গ্রামে ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে নজর রেখে চলেছে।
ওরা দেখতে পাচ্ছে, মধ্য পাড়ার সুফলে, আর দক্ষিণ পাড়ার গদাই আর ছেনোর চলাফেরা আচার আচরণ নিটোল ফেরিওয়ালার মত নয়। শুধুই যদি জুতো-ধামা-কুন্কে ইত্যাদি সারাইয়ের জন্যে এরা পাড়া ঘুরতো তো অন্যরকম তাদের চোখ-মুখের,শরীরের ভাষা হ’ত। যেমন তাদের পাড়ার অন্যরা করে। তাই ওরা ঠিক করল, এই তিনজনের উপর তাদের নজর-জালটা ফেলে যেতে হবে। ওদের পেছন-পেছন গোপনে পাহারা দিয়ে যেতে হবে। যে পাড়ায় এবং যে বাড়িতে ওরা অকারণে একটু বেশি ঠেক নেবে, সেখানেই ওরা ছুটে যাবে। সেটা অবশ্যই অত্যন্ত গোপনে। সুফলেরা টের পেলে গোটা পরিকল্পনাটা মাটি হয়ে যাবে। দিনুরা ঠিক করল, কোন পাড়ায় ওরা দু’জন একসাথে ঢুকবে না। সুফলেরা যেমন বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘোরে, ওরাও তেমন তাদের পেছু নেবে, পাড়া ফেরির ভান করে।
সুফলে, গদাই আর ছেনোর মধ্যে এই ছেনোটা খুব ধূর্ত। সুফলে, গদাইয়ের মাথায় এটা নেই বা ভাবতে পারে না ওদের এই অপকর্মের পেছনো কেউ চালাক দিতে পারে। কিন্তু ছেনোটা একদম পাক্কা ছেঁচ্চোড়। সরলসিধে মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করাটা ওর পেশা। লোক ঠকিয়ে কামাই করে ওর সংসার চলে। ধরা পড়ে কতবার যে গণধোলাই খেতে হয়েছে। বাজারে পাঁচ’শ আলু কিনে ব্যাগে ঢোকানোর অছিলায় দুটো আলু দোকানের আলুর ঢিবিতে ইচ্ছে করে ফেলে দিয়ে আর চার-পাঁচটা আলু তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। ব্যস্ত দোকানদারের সব সময় এই হাতসাফাইয়ের দিকে নজর থাকে না। কিন্তু পাঁচবার এমন করতে করতে একদিন তো নজরে এসে যাবে! তাই হল। সেই নিয়ে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, লোক জড়ো, মারপিট! দোকানদার বলল, “শালা, মুচির বাচ্চা! ক’দিন ভ’র আমি তক্কে তক্কে আছি। কিছুতেই হাতেনাতে ধরা যাচ্ছিল না। এবার শালা তুই যাবি কোথায়?” বলে উত্তম-মধ্যম কসিয়ে দিল ছেনো চোরকে। এবার বাজারে যেমন হয়। এক এক লোকের এক এক মত। কেউ আবার সেই মার দেখে ছেনোর পক্ষ নিয়ে নিল, “ছেনো যে তোর দোকানের আলু হাত সাফাই করেছে, তার প্রমাণ কি? কে সাক্ষী আছে?” এটা ঠিক আজকাল ছাপোষা খদ্দেররা ওইসব সাক্ষী-টাক্ষীর ঝুট ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে চায় না। এড়িয়ে যায় এসব। চোখে দেখেও সে লোক আলু দোকানদারের পক্ষে কথা না বলে গা সটকে যায়। দোকানদার সাক্ষী পায় না। তখন ছেনোর হয়ে কথা বলা অতি উৎসাহিরা দোকানদারের উপর চড়াও হয়। এই নিয়ে কত কেচাল হ’ল সেবার। একবার তো কাপড় দোকানে কাপড় বাছাবাছি করতে করতে কোন ফাঁকে একটা শাড়ী তার ব্যাগে সেঁধিয়ে নেয়। দূর থেকে ক্যাশে বসে থাকা দোকানের মালিকের চোখে পড়ে যায়। ছেনো চোরকে দোকান মালিক হাত বেঁধে বাজার কমিটির কাছে বামাল সমেত হাজির করে। ছেনোর এইসব কান্ডকারখানায় তাদের রুইদাসদের মাথা হেঁট হয়ে যায় বাজারের মানুষজনের কাছে। বাজার কমিটির বিচারের সময় রুইদাসরা কেউই অবশ্য ছেনোর পক্ষে যায় নি। পাঁচখুরো করে মাথায় আলকাতরা মাখিয়ে, নাকখত খাইয়ে, চরম সাবধান করে রেহাই দেয় তাকে। সেসব যদি মনে রাখতো তো ফিরেফিত্যে আর ও এই কাজ করতে আসতো না। শালার গায়ে গন্ডারের চামড়া। পাবলিকের পেটানি ওই যতক্ষণ কে ততক্ষণ। কিছুই মনে রাখে না। গায়ের ব্যথা মরে গেলে সব ধোলাইয়ের কথা ভুলে যায়। মনটাকে যে মানি’র জায়গায় উতরে দিতে হয়, তবেই মানুষের কাছে নিজের মর্যাদা টিকে থাকে সেসব ভাবনা ওই ছেনো শালার নেই।
বেশ কিছুদিন এইভাবে চলতে চলতে ছেনো ঠাওর করে, যেখানেই ও যায়, ওই শালা সুভাষ বেটাকে দেখা যায়! মনে কিন্তু কিন্তু ভাব চাগাড় দেয় তার! ওই শালা কমিটির মাতব্বর, রতনের শালীর বেটা সুভাষকে রোজ, এই ক’দিন ভ’র দেখতে পায় কেন? পাড়ার আর তো কাউকে দেখা যায় না? তাহলে কি সুভাষটা কমিটির টিকটিকি? ছেনো তো বলতে গেলে পেশাদার চোর-ছ্যাঁচোড়। অপকর্ম করার সাথে সাথে সাবধনী মনকেও সজাগ রাখে। বিভিন্ন সময় ধরা পড়ে, মার খেয়ে, অপমানিত হয়ে এই বোধে ও এখন সক্রিয়। তাই সুভাষের গতিবিধি ওর ভাল লাগল না। এবার সুভাষকে ও সন্দেহ করতে লাগল। নিশ্চয়ই ও শালা কমিটির টিকটিকি। শিবপুরে একটা বাড়িতে গাই গরুর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ব্লকের ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বয়স হয়েছে। বুড়ো দাঁতে আর ও জাবর কাটতে পারছে না। এইভাবে যতদিন বাঁচে, বাঁচুক। এখানে আর আনতে হবে না। ব্লক থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় ওই বাড়ির বুড়োটার সঙ্গে দেখা হতে ছেনো তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে। তখনই ছেনো বুড়োর হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা ধরো কাকা। গরুটা মরে গেলে তোমরা যেখানে সেখানের ভাগাড়ে ফেলবে না। আমি নিয়ে চলে যাবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তাছাড়া রোজই আমি তোমার গরুটা কেমন আছে দেখে যাবো।” এরপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার স্বর নামিয়ে বলে, “কাকা, আমাদের আর কেউ যদি আসে তাদের পাত্তা দেবে না। আর কেউ তোমাদের গরুর খোঁজ খবর নিতে আসলে আমাকে জানিও। একদম পাত্তা দেবে না কাকা, তাকে। পরে আর কিছু টাকা তোমাকে দেব’খন।” ছেনো আরও টাকা দেবার লোভ দেখালে ওই বুড়োটা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় তার কথায়। অভাবী মানুষটা এই গরু নেড়েচেড়ে দিন চালায়। তার আবার ব্যামো। গরুটা থেকে সে আর কোন আয় করতে পারবে না। এমন সময় ছেলেটার টাকার লোভ বুড়ো সামলাতে পারেনি। বোঝার চেষ্টাও করেনি যে এই টাকা কেন দিচ্ছে ছেলেটা। নিশ্চয়ই ছেলেটার কোন অভিসন্ধি আছে। অতশত ভেবে তার কাজ নেই। যাদের মাথা ফেটেছে তারা চুন খুঁজে নেবেখন।
ছেনোরা এই ধারণাটা করে ফেলেছে যে, তাদের পেছনে কমিটির লোক লেগে পড়েছে। নাহলে ওই শালা সুভাষ তো কষ্মিন কালে পাড়া করত না। বরাবরই বাজারে জুতো-টুতো সারাই করত। ওদিকে দিনুটা আবার সুফলে গদাইদের পেছনে পড়ে গেছে। যে দিনু সারা জীবন চাষবাস আর বাড়িতে ধামা-টামা বানিয়ে এলো, হঠাৎ সে পাড়ায় সারাইয়ের কাজে নেমে পড়ল! এটা বিশ্বাস করা যে মুশকিল হয়ে পড়ছে। ওই দুই শালাই আটচালা কমিটির টিকটিকি। আটচালা ওই দুটোকে তাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছেনোরাও ছেড়ে কথা বলার ছাবাল নয়। ওরা তিনজনে ষাট করে ওই দুই শালাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা দেবে, জীবনে আর এই টিকটিকিগিরি করার নাম করবে না। সাথে সাথে ওদের মাধ্যমে আটচালা কমিটিকেও আচ্ছারকম সমঝে দেওয়া যাবে।
কোদালিয়া সরকারি ভাগাড় এলাকার কয়েকটা গ্রাম ছেনো কাজ ফেরি করে। মনষার হাট আর ফতেপুর সুফলে-গদাইয়ের। ওরা তিনজনে আলোচনা করে এই ফেরি করার ব্যবস্থা করেছে। ছেনো ভাল করে লক্ষ্য করেছে, সুভাষ টিকটিকিও ওই ছেনোর কোদালিয়া এলাকার বাইরে যায় না। যদি সুভাষের আসল উদ্দেশ্য হকারি নয়, অন্যকিছু, বা খোলসা করে বললে ছেনোর পেছনে চালাক দেওয়া তাহলে তো ওর আরও অন্য এলাকায় ঘোরার কথা। কিন্ত ও শালা তা করে না। অন্য দিনের মত এদিনও ছেনো তার এলাকায় কাজ করে টুক করে গা আড়াল দেয়। দেখে যে জায়গায় ছেনো গেছে গোপনে তা লক্ষ্য করে ঠিক সেই সেই গ্রামে টিকটিকি সুভাষ যাচ্ছে। একটা বাড়িতে সুভাষ গিয়ে ছেনোর মত কিছুটা ঘোরাঘুরি করার সময় ওই পাড়ার কয়েকজন ছোকরা তাকে ঘিরে ফেলে ‘ছাগল চোর ছাগল চোর’ বলে চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। সুভাষকে আর এগোতে দেয় না। তখন ও ভয় পেয়ে যায়! ওর মনে হয়, গতিক ভাল না। ছেলেরা চেঁচিয়ে লোক জোগাড় করে তাকে ছাগলচোর বদনাম দিয়ে গণধোলাই দেবার ফন্দি করছে। হ্যাঁ, ঠিক কথা যে ওই বাড়িতে তিনচারটে ছাগল ঘোরাঘুরি করছিল। ও সেদিক তাকিয়ে ছিল। যেমনটা ছেনো করেছিল। পরখ করার চেষ্টা করছিল, ছেনো ওইভাবে কেন ছাগলগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। তার দিক থেকে ছাগল চুরির তো কোন প্রশ্নই ছিল না। সে কথা সে ছেলেগুলোকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টাও করছে। কিন্তু তারা তার কোন কথাই শুনতে চাইছে না। তাকে চোর সাব্যস্ত করে পেটানোই যে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য! ভয়ে সে তাদের বেড়া ফুঁড়ে ছুট মারার চেষ্টা করতেই ধরে গণধোলাই দিতে শুরু করে! মার খেতে খেতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সুভাষ! মরে গেছে ভেবে থানা পুলিশের ভয়ে এবার যারা ওখানে জড়ো হয়েছিল সব্বাই কেটে পড়ে! খবর যায় থানায় এবং সঙ্গে সঙ্গে আটচালা কমিটিতেও। সাধু সেজে ছেনোই প্রথম হান্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে কমিটিকে খবরটা দেয়। কমিটি প্রথমেই থানায় খবর পাঠায় আর ছেনোকে আটচালার সামনে পাকুড় গাছের সাথে পিচমোড়া করে বেঁধে সুভাষকে উদ্ধার করতে ছুটে যায়। রতন-নন্দরা কোদালিয়ায় গিয়ে দেখে ওখানকার কিছু সহানুভূতিশীল মানুষ সেবাশুশ্রুষা করে সুভাষের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছে। গরম দুধ খাইয়েছে। শরীরের যেসব জায়গায় মারের চোটে ছড়েছাড়ে গেছে সেখানে ডেটোল জলে ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। এমনটা দেখে রতনরা অবাক হয়ে ভাবল, প্রদীপের নীচ যতটা অন্ধকারে ঢাকে, তার থেকে প্রদীপের শিখা অনেক, অনেকগুণ বেশি আলো বিস্তার করে থাকে। পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যা কালোর থেকে বেশি বলেই এখনও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়নি। স্বমহিমায় সে তার অস্তিত্বকে জানান দিয়ে মনুষ্য বাসের উপযুক্ত করে রেখেছে।
রতনরা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারল ছেনো কোদালিয়ার কিছু মাতাল জাঁতালকে মদ খাইয়ে আর পয়সার লোভ দেখিয়ে ষড়যন্ত্র করে সুভাষকে মার খাইয়েছে। অসুস্থ সুভাষকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেনো চোরের উপর। সেই বাঁধন অবস্থায় জরুরী আটচালা বসিয়ে ছেনোকে জল-বিছুটির ছিটকি দিয়ে মারের বিধান আদায় করে নিয়ে চড়াও হয়ে তার উপর। যতক্ষণ না ছেনো তার দোষ কবুল করল ততক্ষণ চলল এই বিছুটি পেটা। একটা সময় নেতিয়ে পড়ে ছেনো। তবু মার থামে না। শেষে পুলিশ এসে ছেনোকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। ছেনোর পরিণতি দেখে সুফলে-গদাই সেই যে গ্রামছাড়া হল, বছর ঘুরে গেল, তারা এখনো গ্রামে পা রাখার সাহস দেখাল না। অথচ পাড়ায় খবর আছে, ওদের একজন পদ্মপুকুরে অন্যজন ঝিনকি গ্রামে আত্মীয়র বাড়ি রয়েছে। লোক মারফত কমিটি চেষ্টা করেছে তাদের গ্রামে ফিরিয়ে আনতে। দোষ কবুল করলে তাদের শাস্তি মুকুব করা হবে আটচালার এই বিধানটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সেই কথা কমিটিকে বলেছিল বলেই তাদের কথার মান রাখতে এই বিধান দেওয়া হয়। কিন্তু ছেনোর পরিণতির কথা ভেবে তারা এখনো কমিটির উপর ভরসা রাখতে পারছে না। তাদের জানা নেই কেমন করে কবে তারা বাড়ি ফিরবে?ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৫)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[ নয় ]
নিজের কত্তা যে খেঁজুর রসের ভাঁড় ফেলে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি পরেশ-গিন্নীর। নিশান যে সারা পাড়া এখন দেখছে। পরেশগিন্নীর উৎকন্ঠা, এত বেলা হয়ে গেল, এখনও লোচনের বাবা ফিরছে না বলে। যতক্ষণে ভাগাড়ে গিয়েছে তাতে শিকারের চামড়া ছাড়িয়ে অনেক আগেই ফিরে আসার কথা। সেইজন্যে সে একবার দাবা থেকে রাস্তায় ওঠে, আবার ঘরপানে চলে যায়। আটচালার দিকে এসে লোককে তার চিন্তার কথা বলতে পারছে না। পাড়ার বউ-বাচ্চা-মরদরা সব সামনের ফাঁকা ডাঙায় শীতের সকালের মিষ্টি রোদে চান সেরে নিচ্ছে যেন। কারোর নড়াচড়ার কোন তাড়া নেই। সেখানে গিয়ে কাউকে তার খোঁজ নেবার কথা বললেই পেছনে লেগে যাবে মরদরা, “এখন রসের নাগর আসতে দেরি করছে বলে তোমার চিন্তা হচ্ছে। ঢেড়ি পিটিয়ে মানুষকে জানাচ্ছো। কিন্তু যখন নিশান দেখে কত্তা রসের ভাঁড় ফেলে দৌড় মারলো তখন তো বলোনি, দেখো গো দেখো আমার মরদটা কোথায় হারিয়ে গেল! তা তো বলবে না। যদি অন্য কেউ বলে ফেলে আমি আগে নিশান দেখেছি। ছুট মেরে তার আগে শিকার দখল করে নেয়!” তাই নিজের চিন্তা নিজের মধ্যে রেখে ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে পরেশ গিন্নী সনকা!
খানিক পরেই আটচালার দিক থেকে লোকজনের জোরে জোরে কথা বলার শব্দ কানে আসে লোচনের মায়ের! তখন সে বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছিল। ছেলে খাওয়ানো ফেলে দৌড়ে রাস্তায় উঠে আসে। দেখে, লোচনের বাপের গায়ের গেঞ্জী আর এল্টেতোলা কাপড়-গামছা সব রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। মরা গরুর ছাল ছাড়াতে তো এত রক্ত গায়ে লাগার কথা নয়! মরা জীবের শরীরে অস্ত্র ফোটালে রক্ত ফিনকি খায় না। তাই এমনভাবে রক্ত মাখামাখি হবার কথা না। কি এমন ঘটল যে সে এমন অবস্থায় বাড়ি ফিরছে? কাঁধে আবার গরুর ছাল ঝুলছে। পাড়ার মেয়ে-মদ্দ তাকে ঘিয়ে কিসব জিজ্ঞেস করছে আর উত্তর দিতে দিতে সে বাড়ির পানে এগিয়ে আসছে! শেষমেষ কি কথা যে সে বলল, তা সে এতদূর থেকে বুঝতে পারছে না। জনা তিনেক লোক তাকে ঘিরে রেখে বাকি সব্বাই দল বেঁধে হইহই করে ছুটলো দৌলতপুরের ভাগাড় পানে! পেছন থেকে লোচনের বাপের গেঞ্জি একজন মুঠো মেরে ধরল আর দু’জন তার দুটো হাত খাপটি মেরে ধরে এদিকে আসতে লাগল। কাঁধে ঝোলানো গরুর চামড়াটা আর দেখা যাচ্ছে না। ওটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে। দলবলের কেউ ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়ই। আর চুপ করে থাকতে না পেরে ওদিকে পা-পা করে এগিয়ে যায় লোচনের মা। কাছাকাছি গিয়ে বলে, “ওকে ওইভাবে তোমরা পাকড়াও করে আনছো কেন? ও কি চোর, না ডাকাত? দূর থেকে ওর কাঁধে গরুর চামড়া দেখতে পেলুম, সেটা আবার কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? তোমরা ওটা ছিনতাই করার জন্যে দলবেঁধে আটচালার সামনে রোদ পোহাচ্ছিলে বুঝি? দাও, ছেড়ে দাও ওকে? একটা ভালমানুষকে এইভাবে পাছড়া-পাছড়ি করে ধরে আনতে তোমাদের বিবেকে বাঁধলো না বুঝি? এ কেমন ধারা বিচারবুদ্ধি তোমাদের!”
এবার মুখ খুলল রতনের ভাই যতন, “তোমার কত্তা চুরি ডাকাতি করলে তবু মাফ ছিল গো গিন্নী। তার চেয়ে আরও ভয়ানক কাজ করে ফিরছে তোমার মরদ। কষ্মিন কালে কখনো গরুর ছাল ছাড়াতে গিয়ে কারোর সারা গা এমন রক্তে মাখামাখি হতে দেখেছো? সেটা তো জিজ্ঞেস করছো না, এত রক্ত কেন? সোয়ামির অক্ষত দেহ, তার পরেও সারা শরীর এতো রক্তে ভেজা কেন? মানুষ খুন করেছে তোমার কত্তা। গরুর চামড়ার জন্যে একটা জলজ্যান্ত মানুষের পেটের চামড়া ফালা করে ভুঁড়ি ভসকে দিয়ে বীরদর্পে বাড়ি ফিরছেন বাবু। এর চেহারা দেখে আমরা তো চমকে উঠি! একি! পরেশের সারা শরীর রক্তমাখা কেন? নিশ্চয়ই কোন অঘটন কিছু একটা ঘটেছে। আমাদের কয়েকজনের প্রথমে খটকা লাগে। যারা অতটা তলিয়ে ভাবেনি তাদের কেউ বলে, ও কিছু না। টাটকা গরু পড়লে রক্ত ছিটকে গায়ে লাগতেই পারে। আরে বাবা, ও তো ভোরবেলা খেঁজুর রস কাটতে গিয়ে নিশান দেখে ছুটেছে। অত ভোরে মরা গরুকে মানুষ কোনদিন ভাগাড়ে ফেলতে আসে না। তাহলে নিশ্চয়ই গরুটাকে আগের দিন বেলাবেলি বা সন্ধ্যেরাতে ফেলা হয়েছে। ততক্ষণে তার আর টাটকা ভাব কোথায় পাওয়া যাবে? যুক্তিটা তারপর সকলে মেনে নিয়ে একে চাপাচাপি করতে রাধাকান্তকে খুন করার কথা বেটা কবুল করে! সত্যি মিথ্যা যে কারণেই হোক। কে আগে নিশান দেখেছে, কে পরে দেখেছে তাই নিয়ে অমত হতেই পারে। তাই বলে সেই বিতর্কের এতটা ঝাল যে জলজ্যান্ত মানুষটাকে খুন করে দিতে হবে? তোর যদি সন্দেহ হয় তার জন্যে তো পাড়ার আটচালা আছে। সেখানে কথাটা বিচারে ফেলতে পারতিস। দেখতিস তার কোন বিহিত হয় কি না। অত তিরিক্ষি মেজাজ কিসের? তোর মেজাজ তুই তোর বোয়ের কাছে দেখা না। কেউ তোকে বলতে আসবে না।”
রাধাকান্তর শরীরের রক্তে ধোয়া পরেশ, বোয়ের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। মাথা নীচু করে শুধু একটা কথা বলল, “কোথা থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। মাথায় খুন চেপে গেল। খুন চাপিয়ে দিল ওই ব্যাটা নিজেই। গালি দিচ্ছিল আর আমার রাগ চড়ছিল। হঠাৎ ওর ছুরির আঁচড়ে আমার হাতের চামড়া চিরে রক্ত পড়তেই আর মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি। পাল্টা আঘাতে শেষ করে দিলাম ওটাকে। ওকে শেষ করেছি, এবার আমার ইহলীলা শেষ। খুনের বিধান তো ফাঁসিতে লটকানো।”
পাড়ার যারা দৌলতপুরের ভাগাড়ের দিকে ছুটছিল, তারা হঠাৎ যাবার পথে রাস্তার উপর অমিত মুদিকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল! অমিত মুদি আবার এখানে পড়ে কেন? দেখে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। রতন তার নাকের কাছে নিজের কানের লতি ঠেকাতে টের পেল, গরম বাতাস। নিঃশ্বাস পড়ছে। হার্টফেল করে মরে যায়নি। সঙ্গে সঙ্গে সে জনা তিনেককে এখানে রেখে রতন মুদিকে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে বলে বাকি সবাইকে নিয়ে ভাগাড়ের দিকে ছুট মারল। বুকে হাপর টানতে টানতে ওরা ভাগাড়ে পৌঁছে দেখল, মরা গরুর পাশে নিথর রাধাকান্তর নিশ্চিন্ত সহাবস্থান! হাতের মুঠোয় তখনও নিত্যসঙ্গী ছুরিটা ধরা। যেন মরণের পরেও জীবনচলনের হাতিয়ারকে সে যথাযথ সম্মান দিয়ে গেল।
পরেশ যেমনটি বলেছিল সব ঠিকঠাক মিলে গেছে। ধারাকান্ত এইভাবে পশুর মত মরে পড়ে থাকার দৃশ্য সহ্য করতে পারছিল না ওরা কেউই। কারোর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তো কেউ বা মনে মনে গুম হয়ে ভেতরের কষ্টটাকে সামাল দেবার চেষ্টা করছে। হাজার হোক নিজের পড়শি তো। দুবেলা চোখাচোখি, কথাবার্তা। সুখ-দুঃখের আলোচনা। আবার কখনো কথাকাটাকাটি। মদের নেশায় গালাগালি। তবু তার মধ্যে জীবনকে খুঁজে পাওয়া। আবার ভাব ভালবাসায় জড়িয়ে যাওয়া। এই নিয়েই তো তাদের জীবনের রোজনামচা। সেই জীবন প্রবাহের মধ্যে এই অন্যায় খুন-খারাপি বড্ড বেমানান। এটা এদের কেউই মেনে নিতে পারছে না। এমন অসহ্য ঘটনা যাতে দ্বিতীয়বার না ঘটে তার জন্যে তারা আটচালায় শপথ নেবে। শপথ নেবে, জীবনের সুখ- দুঃখের যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মিলেমিশে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেবার।
তাৎক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে রতন বলল, “এই অবস্থায় লাশ তো আমরা ছুঁতে পারি না। পুলিশ ছাড়া এ লাশ এখন ছোঁয়ার অধিকার কারোর নেই। থানায় খবর দিতে হবে।” বলে রতন তিন-চার জনকে ওখানে রেখে চলে এল।
দাবানলের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মানুষ খুন দেখার জন্যে লোকের ভীড় হতে লাগল দেখার মত। রতনরা বুঝল, যতক্ষণ না পুলিশ এসে লাশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ এই ভীড় আটকানো যাবে না। পাড়ার দু’জনকে পাঠিয়েছে, তাড়াতাড়ি থানায় খবর দিয়ে পুলিশ নিয়ে আসার জন্যে। ততক্ষণে ওদিকে অমিত-মুদির জ্ঞান ফিরে এসেছে। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা অনুভব করে। রতনরা তাকে পাঁজা করে তুলে দেখে মাথার পেছন থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রাধাকান্তকে খুন করে ফেরার পথে অমিত মুদির কাছে বাধা পেয়ে পরেশ এর মাথায় আঘাত করেনি তো? না কি ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল অমিত। নাহ। দুটোর কোনটাই নয়। জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, দুর্বল রাশের মানুষ অমিত মুদি। রক্তে ভেজা পোশাকে সদ্য খুনি পরেশের মুখোমুখি হতেই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর কোথায় কি হ’ল তা সে আর বলতে পারবে না। রতন তাদের পাড়ার ছেলেদের ধরাধরি করে অমিতকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে রাধাকান্ত খুনি পরেশের সঙ্গে কথা বলার জন্যে পাড়ার দিকে রওনা দিল। কোন পরিস্থিতিতে পড়ে সে এই কান্ডটা ঘটালো তা জানা দরকার।
মন এবং শরীরের দিক থেকে এতটা কাহিল হয়ে পড়েছে অমিত মুদি যে, সে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। ছেলেরা ধরাধরি করে তুলে দাঁড় করাতে গেলেই সে পড়ে যাচ্ছে। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না। সেইসঙ্গে মাথা ফাটার তীব্র যন্ত্রণা। বাধ্য হয়ে সবাই মিলে আলগোছে তুলে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেল। দিঘিরপাড় বাজারের উপর দিয়েই যেতে হবে অমিত মুদির বাড়ি। বাজারে উঠতেই উজাড় হয়ে লোক অমিতকে দেখতে জড়ো হয়ে গেল। সেলুন মালিক মোহন বলল, “দাদাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কি তোমরা পুতুল নাচ দেখবে? বাড়িতে কি ডাক্তার বসানো আছে? আগে ডাক্তারখানায় নিয়ে চলো। কুঞ্জ ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আর ওনার বাড়ির লোককে কেউ একজন এক্ষুণি খবর দাও। এই বিমলে, তুই বাড়ি যাবি তো? বাজার হয়ে গেছে? অমিতদার বাড়ির পাশ দিয়ে তো তোকে বাড়ি যেতে হবে। তবে আর এখানে ভীড় জমাসনি। বাড়ি যা এক্ষুণি। যাবার পথে অমিতদার বাড়িতে খবর দে। আমরা এনাকে কুঞ্জ ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার দেখে রোগীর ভাল-মন্দ বুঝে বাড়ি পাঠাবে না হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, ডাক্তার নিজেই সেটা ঠিক করবে। আমরা রোগীর ভাল-মন্দ কি বুঝবো। যেভাবে অমিতদা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, মনে হয় আঘাতটা হাল্কা কিছু নয়।”
কুঞ্জ ডাক্তার নিজের হাতে রোগী রাখতে চাইল না। মাথার আঘাতের থেকে মানসিক আঘাতটা প্রচন্ড বলে মনে হ’ল। তাই একে হাসপাতালে পাঠানোই শ্রেয় মনে করল। সেইভাবে প্রেস্ক্রিপসান লিখে বাড়ির লোককে দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল। হাসপাতালে পাঠানোর খবর ছড়িয়ে পড়তে বাজারের লোকজন, বিশেষ করে যারা অমিতদাকে পছন্দ করে, তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। দু-একজনের উসকানিতে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল বাজারের ইয়ং দোকানদাররা। সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ল পরেশের উপর। ও বাড়ি আছে খবরটা জেনে ওই ছেলেরা দল বেঁধে চড়াও হতে ছুট দিল রুইদাসপাড়ার দিকে। পরেশকে উত্তম-মধ্যম ধোলাই দিয়ে তবে তারা ক্ষান্ত হবে। বাতাসের বেগে পরেশের বাড়িতে হামলা হবার খবরটা রুইদাস পাড়ায় পৌঁছে যায়। পাড়ার ছেলেরা প্রবীনদের মধ্যে রতন, নন্দকে জানায় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে তারা এখন কি করবে। কোন রাখঢাক না করে নন্দ আদেশ দিয়ে দিল, “বাজারকে রুখে দিতে হবে। প্রয়োজনে লড়াই হলে হবে। এটা আমাদের পাড়ার ইজ্জতের প্রশ্ন। বাইরের লোক এসে আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই পাড়ার মানুষকে মারধর করে যাবে তা হতে পারে না। হতেই পারে পরেশ একটা অন্যায় কাজ করেছে। সেজন্যে আমাদের কেউই তার এই কাজকে সমর্থন তো করি না। পরন্তু আইন মেতাবেক তার শাস্তির ব্যবস্থা করছে। তাই বলে আইন হাতে তুলে নেবার কোন অধিকার কারোর নেই। সেই জায়গায় বেপাড়া এসে এখানে মস্তানি করে যাবে তা হতে দেবো না আমরা।” নন্দর আদেশে পাড়ার যুবকরা ফুটতে থাকে। প্রয়োজনে লাঠিসোটা ব্যবহার করতে তারা কসুর করবে না। রুইদাসদের রোখের সামনে আর এগোতে পারলো না বাজারের ছেলেরা। পাড়ার সীমানায় ঢোকার অনেকটা আগেই তাদের থেমে যেতে হয়। এবার ওরা নন্দদের সঙ্গে যুক্তিতর্কের মধ্যে তর্জা সীমাবদ্ধ রাখে। নন্দরা সেটা জিইয়ে রাখে থানা থেকে পুলিশ না আসা পর্যন্ত। খুনের খবরটা পুলিশকে জানাতে থানা আর পা ঘষাঘষি না করে জিপ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে।[ দশ ]
কি করে যে এই হাস্যকর নিয়মটা তাদের সমাজে এতদিন চালু ছিল তা রতনরা নিজেরাও তলিয়ে কোনদিন ভাবেনি। বছরের পর বছর একটা নিয়ম চালু আছে। সবাই এখনও তা মেনে চলছে। পরেশ রুইদাসের হাতে রাধাকান্ত ঋষিদাস খুন হবার পর যেন মাতব্বরদের টনক নড়ে।
কার কোথায় বর্তমান অবস্থান কেউ জানে না। নিশান উড়ছে আকাশে। এবার বিচারটা করবে কে যে, দাবিদারদের মধ্যে কে আগে দেখেছে? তবু এতদিন নিশান দেখে যে আগে ভাগাড়ে যেতে পেরেছে, অন্যরা ধরে নিয়েছে সে আগে দেখেছে বলেই না আগে যেতে পেরেছে! কিন্তু যে আগে দেখেছে বলে দাবি করে তাদের মহার্ঘটা দখল নিল, অন্যরা তলিয়ে দেখল না দখলদারের অবস্থানটা তখন ঠিক কোথায় ছিল? রাধাকান্ত খুন না হলে হয়তো এই অনিয়মটা নিয়ে এখনো কোন প্রশ্ন উঠত না।
অন্য মতের কেউ কেউ বলে, আসলে এখনকার মত এত ঘর মানুষের বাস তো এ পাড়ায় সে সময় ছিল না। ওই রতনের ঠাকুরদা, নন্দদের পূর্বপুরুষ, রাধাকান্তরা আর দিবাকরের তিন পুরুষের বাস সেই সাবেক কাল থেকে। কেউ বলে চম্পা বুড়ি বলে আরও একজন থাকতো। চম্পা বুড়ির বর কালো রুহিদাস মরে যাবার পর তার দুই ছেলে বিহারের চম্পামারিতে পাশোয়ানদের চামড়ার কারখানায় কাজে গিয়ে আর দেশে ফেরেনি। প্রথম প্রথম নাকি ছেলেদুটো মায়ের জন্যে মানি অর্ডারে কুড়ি টাকা করে মাসে পাঠাতো। তাতে বুড়ির সারা মাস টেনেটুনে চলে যেত। হঠাৎ কি হল কে জানে, আর টাকা পাঠায় না। তারা আসেও না দেশে। চোখের দেখা একবার মাকে দেখতেও এল না কেউ। মা কেমন আছে। বেঁচে না মরে আছে। পাড়ার লোক কে বা আছে যে উদ্যোগী হয়ে খরচ করে সেই সুদূর বিহারে বুড়ির ছেলেদের খোঁজ করতে যাবে। বিদেশ বিভুঁইয়ে যাবার পয়সা বা কে দেবে। সবারই তো ‘ভাঁড়ে মা ভবানি।’ তা ওই কালো রুহিদাসের ছেলেদুটো আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে তা পাড়ার কেউ জানে না। শেষমেষ বুড়ি পেটের জ্বালা সামলাতে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষে ফিরতে শুরু করল। তাতে যা চলছিল, চলছিল। হঠাৎ একদিন বুড়ি ভিক্ষে ফিরে হাতে কাস্তেটা নিয়ে কুমোর পাড়ার সনৎ পালের পুকুর-ডোবায় গেল কলমি শাক কাটতে। আনাজপাতি সেদিন ভিক্ষেতে জোটেনি। ওই কলমি শাক সেদ্ধ আর ভাত নুন মাখিয়ে খাবে ঠিক করে। কয়েক আঁটি শাক কাটা তখন হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা খরিস কেউটো পেছন থেকে ফোঁস ফোঁস গর্জে মারল তার কোমরে ছোবল! কেউটে ছোবল মেরেছে বুঝতে পেরে বুড়ি পেছন দিকে কোঁচড়ের কাপড় দিয়ে চেপে চিৎকার করতে করতে পাড়ায় ছুটে আসে। পাড়ার মেয়ে-মদ্দ জড়ো হয়ে যায়! প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে সাইকেল ভ্যানে পাঠিয়ে দেয় ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের অভিমুখে। বুড়ির বেঁচে থাকার ‘দানা’ আর কপালে ছিল না। ভ্যানে যেতে যেতে ঝিঙের পোলের কাছে বুড়ির সারা শরীর নীল হয়ে নিঃশ্বাস থেমে যায়। রতনের ঠাকুরদা গল্প করতো, পায়ে-টায়ে সাপ কামড়ালে ঘরোয়া চিকিৎসায় কখনো সখনো কাজ হয়। বিষরক্ত মাথায় উঠতে দেরি হয়। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে শরীরে ওষুধ পড়লে বেঁচে যায় রোগী। কিন্তু কোমরে কামড়ে সেই সময় পাওয়া যায় না! কোমর থেকে মাথার দূরত্ব আর কত যোজন হবে। ওখানে ছোবল মারলে মানুষের মরণ রোখা দায়। সেই চম্পা বুড়ি মারা যাবার পর সবাই ধরে নেয় তাদের বংশ লোপাট হয়ে গেছে। তাই ওদের আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না কেউ। ওই বিন্দে ঋষিদের বাড়ির দক্ষিণ পানে যে মাটির ঢিবি মতন জায়গাটা পড়ে আছে, ওখানে নাকি চম্পাবুড়ির বাড়ি ছিল। অবশ্য ওই জায়গাটা এখনও দাবিদারহীন হয়ে পড়ে আছে। এখনকার কেউ বলতে পারবে না ওই পোড়ো ঝোপটা কাদের। তাই পাড়ার সবাই ধরে নেয় ওখানেই চম্পাবুড়ির বাড়ি ছিল। বুড়ির ছেলেপুলে বা নাতি-নাতনিরা কেউ যদি কোনদিন দেশে ফেরে তো তাদের জায়গা তারা ভোগ করবে। তখন ওই ক’ঘর। আর এখন তো বেড়ে বেড়ে সত্তর-ঘর নিয়ে পাড়া জমজমাট। সব যে বংশ বিস্তারে এত ভীড় তা কিন্তু নয়। কেউ শ্বশুর-সম্পত্তি পেয়ে ঘর জামাই হয়ে থেকে গেছে। কেউ বা মাতুল সম্পত্তির অধিকারি হয়েছে। ওই মিত্তুনে তো মামারবাড়ির বখরার সবটাই পেয়েছে। ওর মা, মিত্তুনের দাদুর একমাত্র মেয়ে। বুড়ো উপরে চলে যেতে ওরা মায়ে পোয়ে সেই ঝিঙ্কির হাট থেকে বাস তুলে দিয়ে এখানে চলে আসে। মিত্তুনের বাবা শিয়ালদহ-ডায়মন্ড হারবার রেল লাইনে মদের নেশায় টলমল পায়ে লাইন পার হতে গিয়ে পা ফসকে লাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারহীন দেহ নিয়ে লাইন থেকে উঠে পড়ার আগেই আপ-ডায়মন্ডহারবার লোকালে কাটা পড়ে। ওই তো, রোজ খাটলে রোজ খাবার জোটে। মদের নেশা আবার সেই রোজগারে ভাগ বসায়। দেড়-শতক খোড়ো ঘরে বাস। তা সেই একমাত্র রোজগেরে লোক চলে গেলে তাদের মায়ে-বেটায় চলে কেমন করে। তবু বাপের একটা পুকুর আর চাষের বিঘে খানেক জমি রয়েছে। সেই ভরসায় ওই বাস বিকিয়ে মিত্তুনের মা ছেলের হাত ধরে বাপের বাড়ি ওঠে। তাই ভাগাড়ের চামড়া সংগ্রহ করার চাহিদাও সে সময়ের মানুষের তেমন ছিল না। অনেকে আগ্রহও দেখাতো না। যারা আগ্রহ দেখাতো, তারাই বেশি খেয়াল রাখতো এ সবের। কিন্তু এখন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সাথে সাথে চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে রোজগারের সুযোগের অভাব। ফলে আয়ের যেখানে যেটুকু সুযোগ আছে, দলবেঁধে সবাই সেদিকে হামলে পড়ছে। একটা পদক্ষেপকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। সেখান থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসছে। যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর না এলেই ঝিমমেরে থাকা প্রতিবাদ তেড়েফুঁড়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে। বাড়ছে রেষারেষি। যার অনিবার্য পরিণতি, কলহ বিবাদ। আর এই বিবাদ মিমাংসার জন্যে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে পাড়ার আটচালাকে।
বিশ দিন আগে আটচালার খুঁটিতে নোটিশ লটকে দেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজের ওপর কঞ্চির পেন দিয়ে আলতার লাল কালিতে লেখা হয়েছে। শিরোনামে লেখা জরুরী সভা। শেষে পাড়ার মেয়ে-মদ্দ সকলকে উপস্থিত থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। যে অনুপস্থিত থাকবে, পরে তার কোন কথা শোনা হবে না। সভায় যা মানতে বলা হবে তাই সব্বাইকে মাথা পেতে নিতে হবে। আলোচনার বিষয় ‘ভাগাড়ের চামড়ার বখরা।’
গমগমে আটচালা। একে একে পাড়ার প্রায় সব মানুষই জড়ো হয়ে গেছে। এখনো পাতলা হয়ে দু-একজন করে আসছে। আনুষ্ঠানিক সভা শুরু হবার আগেই রতনের ভাই, যতন মদ্যপ অবস্থায় বেসামাল জিভে চেল্লাতে শুরু করে, “ভাগাড়ের চামড়ার বখরার নতুন কোন নিয়ম আমরা মানছি না মানবো না। বছর বছর ধরে যেমন চলে আসছে তেমন চলবে। কোন শালা ভালমানুষের পো’র ক্ষমতা নেই এই চলতি নিয়ম জলাঞ্জলি দেয়। যে শালা আগে নিশান দেখবে সে শালা ভাগাড়ের অধিকারী হবে। এই শালা রতন-নন্দরা যত নষ্টের গোড়া। শালারা বুড়ো হচ্ছে। চোখের মাথা খাচ্ছে আর নিজেদের আখের গোছাতে নতুন নতুন নিয়ম বাতলাচ্ছে। ওই সব শালাদের পোঁ..ও.. !” গালাগাল পুরোটা মুখ থেকে বার করার আগেই রতন ছুটে এসে তার ভায়ের মুখে সপাটে মারে এক চড়! দাদার হাতে চড় খেয়ে যতন ভিমরি খেয়ে পড়ে যায়। মুখের সামনে খাওয়া চড়ের অভিঘাতে যতনের ঠোঁটের সাথে দাঁতের ঠোক্করে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। অন্যরা গামছা ভিজিয়ে ঠান্ডা জল ক্ষত জায়গায় চেপে ধরে। ততক্ষণে ঠোঁটটা ফুলে ঢোল। যতনের টলমল শরীরটাকে ধরে দু’জন ছোকরা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে। এসেই ছোকরা দুটো হম্বিতম্বি করতে থাকে, “এইভাবে যতনকে মারা উচিৎ হয়নি রতনদার। নেশার ঘোরে ও কি বলছে না বলছে তা কি ওর খেয়াল আছে। চুল্লু পেটে নিয়ে সবাই কি নিজেকে সামলে নিতে পারে? পারে না।” এবার অনেকে মিলে ওই দুই ছোকরাকে চুপ করে যেতে বলে। ওরা যে যতনের এক গেলাশের দোস্ত তা সবাই জানে। তাই যতনের আঘাত ওদের গায়ে লাগে। কিন্তু ওরাও যদি গেলাশের দোস্তের পক্ষ নিয়ে সমানে কেচাল করে তো যতনের পরিণতি তাদেরও হবে বলে কড়কে দিতে দুটোতে চুপ মেরে যায়।
মিটিংয়ের আগে যেহেতু নিজেকে জড়িয়ে একটা আজেবাজে ঘটনা ঘটে গেল, তাই রতন আর বেশি উদ্যোগ নিয়ে সভা পরিচালনায় এগিয়ে আসলো না। মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে রইল। নন্দকে বলল, “তোমরা আজ মিটিংটা চলিয়ে নাও। আমার ভাল লাগছে না। মন ভাল নেই। মাথাও গরম। তাই আবার কোথায় কি বলে ফেলব বা করে ফেলব। তখন সবাই আমাকে দুষবে। হাজার হোক নিজের মায়ের পেটের ভাই তো। এমন মারলুম রক্তারক্তি হয়ে গেল। আমি তো এটা চাইনি। গাধাটা এমন কান্ড করতে শুরু করল, আমি নিজেকে সামলে নিতে পারলুম না। সমাজে আমারও তো একটা মান আছে।”
নন্দ আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইল না রতনকে। সে পাড়ার বয়স্ক মানুষ সুবোধ কাকাকে বলল, “কাকা, তুমি তো পাড়ার একজন মুরুব্বি মানুষ। তুমিই বলো, এই বিচ্ছিরি নিয়ম এখনো চলতে দেওয়া উচিৎ কি না। সবাই মানছে এই কালা নিয়ম চলা উচিৎ নয়। তবুও চলে আসছে। যা হবার হয়ে গেছে। যে কারণেই হোক এতদিন কেউ প্রতিবাদ করেনি। বা এখনকার মত জোট বেঁধে কিছু বলেনি। পুরোনো মানুষ হিসেবে তুমিই এর একটা উপায় বাতলে দাও। তুমি যা নিদান দেবে সেটাই আমরা মাথা পেতে নেবো।” এবার নন্দ সভায় উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, “কি গো বাপ-সকল মা-সকল, সুবোধ কাকা যা বিধান দেবে তোমরা সকলে মানবে তো? না কি মানবে না। যদি না মানো তো আগে থেকে বলো। যে বা যারা বলতে আসবে তাদেরই উপর দায় চাপবে সঠিক নিদান দেওয়ার।”
এই কথার পর কেউ আর ওইসব ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইল না। এমনিতেই সভার আগে একটা যাচ্ছেতাই ঘটনা ঘটে গেল। তারপর আবার কে ওই ঝামেলার মধ্যে মাথা গলাতে যাবে। কয়েক মুহূর্ত সভা একদম চুপ। আবার নন্দ বলল, “কি হল, সব চুপ কেন? কিছু তো একটা বলতে হবে। চুপচাপ থাকার জন্যে তো সবাই কাজ ফেলে এখানে আসেনি। বলতেই হবে, সুবোধ কাকার কথা আমরা মানবো কি মানবো না?” এবার আরও গলা চড়িয়ে বলল, “কি, মানবো কি মানবো না?” এবার সভা আর চুপ করে রইল না। সব্বাই একবাক্যে নন্দর কথায় সায় দিয়ে বলল, “মানবো মানবো। সুবোধ কাকা যেটা বলবে, সেটাই আমরা মানবো।”
সুবোধ কাকার বয়স হলে কি হবে। এখনও যথেষ্ঠ শক্ত ঠকঠকে বুড়ো। কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সে দ্বিধা করে না। তাই ওর ওপরে পাড়ার সবাই আস্থা রাখে। এবার শান্ত সভায় মসৃণ গলায় বলল, “আমি আর কি বলি। দিনকাল পাল্টেছে। আমার মতের সঙ্গে এ’কালের মতের মিল হবার তো কথা না। একটা কিছু বলে ফেললে তোমরাই আবার পরে আমাকে শাপ শাপান্ত করবে। বুড়ো বয়সে আর অন্যের অভিশাপ কুড়িয়ে কাজ নেই। তোমরা সব বাপ সকল, এত মানুষ আছো। তোমরাই ঠিক করে নাও গো। আমাকে ছাড়ান দাও।”
নন্দ তখন সুবোধ কাকাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, “না না কাকা, তোমাকে কেউ…!” হঠাৎ সেই কথার ফাঁকে পেছন থেকে একজন ফুট কেটে বলে উঠল, “বুড়ো ভাম এবার নিজের দর বাড়াচ্ছে রে!” সঙ্গে সঙ্গে গোটা আটচালা গুনগুনিয়ে উঠল! বুঝি সভা এবার পন্ড হতে না বসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নন্দ চেঁচিয়ে উঠল, “পেছন থেকে কে ফুট কাটলো রে? কে? কে? এই কেলে, তোদের ওদিক থেকে কথাটা ঠিকরে এলো। কে বলল কথাটা? মান্যি লোককে মান্য করতে জানিস না তো সমাজে আছিস কেন? পাড়া থেকে দূর করে দেবো বলে দিচ্ছি। কে কথাটা বলল বল?” পাড়া ছাড়ার হুঙ্কারে কেলে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আমি না। হেড়ো পাগলা।” সঙ্গে সঙ্গে সুবোধ কাকার লাঠিটা নিয়ে হেড়ো পাগলার দিকে তেড়ে গেল নন্দ, “শালা, হারামি, পাগলামির জায়গা পাওনি না? কে ওকে এখানে ডেকেছে, রে?” নন্দর তাড়া খেয়ে পাঁই পাঁই করে সভা ছেড়ে পালায় পাগলা। ও পাগলার কথা ছাড়ান দাও কাকা। বলো, কাকা, আমরা এখন কি করবো।” সেই থেকেই সুবোধ কাকার কথা মত এই চার-পাঁচ বছর ধরে, ‘যে আগে এসে গরু ছুঁতে পারবে সেই হবে সেই গরুর চামড়ার মালিক’ নিয়মটা চালু হয়। তখনকার মত একবাক্যে সবাই তা মেনেও নেয়। আসলে মানুষ এতবছরের একটা কালা নিয়ম, ‘নিশান যে আগে দেখবে, সেই চামড়ার অধিকারি হবে’ থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিল তখন। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে এটাও একটা কালা নিয়ম। ‘জোর যার মুলুক তার’ হয়ে যাচ্ছে। জোরের দাপটে অশক্তরা ভাগাড়ের অধিকার হারাচ্ছে। এ চলতে পারে না। এ আর এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে তারা।[ এগারো ]
কথাটা গ্রামীন জনপদের অনেক জায়গার চালু কথা যে ‘স্বামীগৃহই হল মেয়েদের জীবনের স্থায়ী পূন্যভূম।’ দশ বছর হয়ে গেল পরেশের বউ সনকাকে আটচালার বিধানে গ্রাম ছাড়া হতে হয়েছে। মাঝে মাঝেই মনটা ডুকরে ওঠে, তার সেই স্বামীর লীলাভুমে একবার ঘুরে আসতে। চোখের দেখা দেখে আসতে। ঘড়বাড়ি তো এতদিনে ঝোপজঙ্গলে টৈটুম্বুর। ভেতরে ঢোকার উপায় থাকবে না। তবু বাইরে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে থেকে অশান্ত মনকে একটু বোধ দেওয়া যায়। তার প্রিয় শ্বশুরালয়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঘ্রাণ নিলে মনটা যেন তৃপ্ত হয়। আবার কোথা থেকে যেন অভিমানি মন শক্ত হয়ে রুখে দেয় তার সেই দুর্বল চিত্তকে। না, যে পাড়া স্বামীছিন্ন এক অসহায় যুবতী নারীকে শিশু সন্তান সমেত গ্রামছাড়া করে, সে পাড়ায় সে আর ঢুকবে না। আবার ভাবে, লোচনের বাপের জন্মভিটে ওটা। ওর বাপ যদি কোনদিন জেল থেকে ছাড়া পায় তো সে প্রথমেই তার ভিটেতেই উঠবে। সে মেয়েমানুষ। ভিন গোত্রের মেয়ে। ওই ভিটের ওপর তার হয়তো নাড়িছেঁড়া টান নেই ঠিকই। কিন্তু আজন্ম যে মানুষটা একটা জায়গায় কাটালো, সে তো কিছুতেই তা ভুলতে পারবে না। আর স্বামী এলে বউকে তো আসতেই হবে। স্বামী-সংসারেই তো মেয়েদের জীবনের সার্থকতা। স্বামীর ঘর না পেলে মেয়েমানুষের জনমই বৃথা। সেদিক থেকে সনকার কপাল যে মন্দ নয় তা বলা যায়। স্বামী-সংসারেও তো তার কোন বিরাগ ছিল না। অভাব অনটনের মধ্যেও দিন চলছিল। স্বামী তার কোনদিন বারমুখো ছিল না। সনকার দিন তাই নিশ্চিন্তেই কাটছিল। কি একটা আচমকা ভুলচুক করে ফেলল লোচনের বাপ। সে ভুলের আর মাপ হল না। থানা-পুলিশের সাথে সাথে পাড়ার মাতব্বরাও মেতে উঠল ওই ভাল মানুষটাকে গারদে পুরতে। সেইসঙ্গে তাদের মায়ে-বেটারও শাস্তির বিধান দিয়ে বসল। এত বেয়াড়া মনের মানুষ এরা কেন তা কে জানে।
তাদের রুইদাস পাড়ার মানুষ এক রকম আর এই শহরের জীবনযাত্রা আর এক রকম। কোলকাতার সল্টলেকের সমাজ ব্যবস্থা আর তাদের গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থার যেন কোন দিক থেকে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে কেউ কারোর তেমনভাবে খোঁজ খবর রাখে না। একই বাড়িতে, পাশের দরজার ফ্ল্যাটের লোক একে অপরকে চেনে না জানে না। চেষ্টাই করে না কেউ। যে যার মত ব্যস্ততায় দিন কাটায়। হয়তো কোন সময় মুখোমুখি হয়ে পড়লে দেঁতো হাসি হেসে ঘাড় কাত করে মনুষ্যেতর জীব যে তারা নয় তার নজির রাখার চেষ্টা করে। সনকাদের গ্রামীণ রক্ষণশীল জীবন থেকে এই জীবন হয়তো মনে হবে এক খোলা হাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে দিন কাটার জীবন। সেই দিক থেকে সংস্কারমুক্ত এক স্বাধীন জীবন সে যেন খুঁজে পেয়েছে বলতে পারে। সেই স্বাধীনতার পাদানিতে পা দিয়েই তো সে এখন আর গ্রামের ঘোমটাটানা পরেশ রুইদাসের লাজুক বউ নেই। চটপটে বেপরোয়া যেমন খুশি সাজো, যেমন খুশি চলো’র সনকাদি বনে গিয়ে শহুরে আর্দ্রতায় সিক্ত হয়ে রসেবসে দিন কাটাচ্ছে।
আটচালা যখন তাকে গ্রামছাড়ার নিদান শত আকুতি মিনতিতেও ফিরিয়ে নিল না তখন সনকা বুঝেই গেছিল ওখানে তার আর বাস করাই যাবে না। গ্রাম তাকে ছাড়তেই হবে। তা এখন সে একা মেয়েমানুষ বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যাবে! দিশাহারা চোখ তখন হঠাৎ আটকে গেল পোদপাড়ার বাদলের চোখে। তার চোখে ঠেকনা রেখে চোখ ফেলল বাদলের বন্ধু দুলাল রুইদাসের চোখে। ওরা দু’জনেই লোচনের বাবার এক পেয়ালার বন্ধু ছিল। সেই সুবাদে তাদের বাড়ি আসতে আসতেই অজান্তে কখন যেন দুলাল রুইদাসকে তার মনের এক কোণে ঠাঁই দিয়ে ফেলে। আর দুলালও মনে হয় তার মনের ভেতরের রসায়ন ধরে ফেলেছিল। সনকা ধরা পড়ে গেছিল দুলালের কাছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে লোচনের বাপের চোখের আড়ালে তার বুকে হাতও দিয়েছে। প্রতিবাদ করতে পারেনি সনকা। সাবধানে তার হাতটা চেপে লাজুক চোখে সরিয়েও দিয়েছে। সেই হাতধরাধরি তখনও ভুলতে পারেনি দুলাল। ওর বাপ জেলে যাবার পরও তার খোঁজ নিয়ে গেছে সে। ফিরে যাবার সময় বলে গেছিল, “কোন দরকার হলে আমাকে খবর দিও। আমার সাধ্যমত আমি তোমার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করব। আমাকে জানাতে কোন কিন্তু কিন্তু করবে না। আমার মনের মণিকোঠায় সবসময় তুমি জ্বলজ্বল করছো।”
তাদের সংসারে এই প্রবল ঝড়ঝাপটার মধ্যে দুলালকে নিয়ে তার পরকীয়া প্রেমের ঢেউ কখন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সত্যিই তো, সংসারে যখন অভাব এসে বাসা বাঁধে। যুবতী নারীর সতীত্ব যখন প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায় তখন এইসব পরকীয়া-টরকীয়া কোথায় যেন বাষ্প হয়ে উবে যায়। জীবন থেকে সনকা সেটা মর্মে মর্মে ঠাওর করতে পারছে। নিজের জীবনের এই দুই প্রবল ধাক্কা থেকে উদ্ধার পাওয়াই এখন তার প্রধান কাজ। মন তাই হাতড়াতে হাতড়াতে বাদলের হাত ধরে দুলালের মুখটা ভেসে উঠল তার সামনে। সুতোর মত সেই হাল্কা টানের খুঁট ধরে বাদলের মারফত খবর দিয়েছিল দুলালদাকে, “আমাকে তুমি বাঁচাও দুলালদা। ধু ধু জলাশয়ে আমি এখন হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি আমার পাশে না দাঁড়ালে এই শিশুটাকে নিয়ে আমার সলিল সমাধির ভবিতব্য কেউ রুখতে পারবে না। এরা, মানে আমাদের এই রুইদাস পাড়ার আটচালা নিদান দিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। যে অন্যায় করেছে তার তো জেল জরিমানা হয়েছে। অন্যায়ের শাস্তি সে পেয়েছে। তা আমি কি অন্যায় করলাম। আমার এই দু’বছরের শিশুটা কাকে খুন করল, যে তাকে গ্রাম ছাড়তে হবে? কত আকুতি জানালাম। কোন কাজ হল না। পাড়া আমাকে ছাড়তেই হবে। এখন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো, কি খাবো? গ্রামের এই মানুষগুলো কেমন মানুষ? এদের হৃদয় বলে কি কিচ্ছু নেই! আমরা গ্রামে থাকলে নাকি আমাদের খুনে বাড়ির ছোঁয়ায় পাড়ার অন্য লোকের মানুষ খুন করার প্রবৃত্তি জেগে উঠবে। তাই আমরা পাড়ার শত্রু। প্রথম রাতেই বেড়াল মারার মত প্রথম চটকাতেই শত্রু-বীজ নিকেশ করা দরকার। তাই মাতব্বরদের এই বিধান। তুমি একবার বলেছিলে না দুলালদা, বিপদে পড়লে আমাকে খবর দিও? তাই তোমার কথা প্রথমেই আমার মনে পড়ল। আমার একটা হিল্লে তুমি করে দাও দাদা। কথা দিচ্ছি, তোমার উপকার আমি ভুলে যাবো না। আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। সময়মত সেই ঋণ আমি শোধ করব।”
পরেশের বোয়ের শেষ কথাটায় কয়েকবার যেন পায়ের রক্ত মাথায় আর মাথার রক্ত পায়ে চলকে চলকে ওঠা-নামা করে গেল দুলালের। স্বামী-ছাড়া পরেশের বউ, সনকার গায়ে জড়ানো পোষাক ভেদ করে সে যেন তার শরীরের উত্তুঙ্গ যৌবন পরখ করে নিল একবার। সঙ্গে সঙ্গে চনমনিয়ে উঠল তার মনের ভেতরটা! বাইরে পরেশের বোয়ের এই শাস্তির বিরুদ্ধে সে গলা তাড়লেও মনে মনে খুশিই হয়েছে সে। গ্রাম থেকে একবার মেয়েটাকে বার করে আনতে পারলে সে তো তারই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তখন ভালবাসা দিয়ে তাকে যেমন খুশি তেমনভাবে পেতে পারবে। পরকীয়া প্রেমের কারণে তাদের পাড়ার আটচালার কোপে আর তাকে পড়তে হবে না। বড্ড কট্টর এখানকার রুইদাসরা। সনকাকে আশ্বাস দিয়ে সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়ল দুলাল। যাবার সময় বলে গেল, “শুনছো লোচনের মা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে তোমার একটা হিল্লে করতে পারি তার ব্যবস্থা করছি। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তোমার হাতে তো তিনমাস সময় আছে। অতদিন সময় আমি নেব না। দেখো না, খুব শিগ্গিরই তুমি পাড়ার মুখে নুড়ো জ্বেলে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে আসতে পারবে। সে ক্ষমতা যে এই দুলাল মুচির আছে তা সে দেখিয়ে দিয়ে তবে থামবে। রুইদাস পাড়া ভাবছে পরেশকে যেমন শাস্তি পেতে হচ্ছে তেমনই তার বউকেও শাস্তি দিয়ে বগল বাজাবে। তুমি জেনে রাখো সনকা, সে গুড়ে বালি। তুমি দেখে নেবে, পাড়া ছাড়ার সময় তোমার পায়ের ধুলোবালি ওদের চোখে ঠিকরে পড়ে চোখ করকর করে অঝোর ধারায় জল পড়বে। তখন বুঝবে কি ভুল ওরা করেছে।”
মাসে একবার সনকার সঙ্গে দেখা করতে যায় দুলাল। সল্টলেকের যে বাড়িতে সনকাকে কাজে লাগিয়েছে, সেই বাবুর সঙ্গে দুলালের কথা হয়েছে। বাবু বলেছে, “দুলালবাবু আপনি মাসে মাসে এসে দেখে যাবেন আপনার বোন কেমন আছে। আমরা তাকে কষ্টে রেখেছি না ভালভাবে আছে। একবার তো আসবেনই, মনে হলে অন্য কোন দিনও ঘুরে যেতে পারেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই তাতে। বোনকে নিয়ে একটু শহরটা ঘুরিয়ে দেখালেন। মার্কেটে নিয়ে গেলেন। এতে সনকার মনটাও ভাল থাকবে। কাজের চাপে আমাদের বাড়ির কারোর তো সে সময় হয়ে ওঠে না। সনকার মন ভাল থাকলে কাজেও সহজে মন বসাতে পারে। তাতে আখেরে আমাদেরই লাভ।”
বাবুর কথায় দুলালেরও মনটা উতলা হয়ে ওঠে। বাবুর কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে সে। এবার সনকাকে মাসে এক বা দু’দিন নিজের মত কাছে পেতে আর কোন অসুবিধা হবে না। মনের ইচ্ছে মত সে তাকে তার ভালবাসা উজাড় করে দিতে পারবে। তাছাড়া শুধু তারই বা কেন, সনকারও তো যৌবন বলে কিছু আছে। তার ডগমগে ভরভরন্ত শরীরের চাহিদা দুলালকে উজাড় করার ইচ্ছে সে আকারে ইঙ্গিতে কতবার প্রকাশ করেছে। সুযোগের খোঁজে ছিল। এতদিনে খোঁজ মিলেছে।
নিক্কো পার্কের পাশেই চন্দনবাবুদের মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর অফিস। দীর্ঘ সময় কাজের পর একঘেয়েমী কাটাবার জন্যে চন্দনবাবুরা কিছুক্ষণের জন্যে নিক্কো পার্কের ভেতর কাছাকাছি এদিক ওদিক ঘুরে আসে। সেই ফাঁকে দুপুরের টিফিনটাও সেরে নেয়। ওদের দলে মেয়ে কলিগেরই আধিক্য। চন্দনবাবু সব্বাইয়ের পছন্দের মানুষ। যেমন রসিক তেমন সপ্রতিভ। চন্দনবাবুও মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে এবং স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ওরা, বিশেষ করে শীতকালটা এদিকে আসে বেশি। শীতে রোদের উষ্ণতার সঙ্গে নারীসঙ্গের ওমের যৌথ মিলনে এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি সে খুঁজে পায়। এ সুখ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই নিয়ে অন্য পুরুষ কলিগরা তাকে ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। কিন্তু তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। সে তো জোর করে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে যাচ্ছে না। মেয়েরা তার সঙ্গ পেয়ে খুশি হয়। তাই তারা তাকে সঙ্গে নেয়। সে এই সঙ্গ পেতে পছন্দও করে। নারীর পেলব সঙ্গ কোন্ পুরুষ আর অপছন্দ করে। কিন্তু পছন্দ করলেই তো হবে না। তাদের কাছে আকর্ষনীয় হবার যোগ্যতা থাকা দরকার। সেটা আবার সব পুরুষের মধ্যে থাকে না। তাই তারা চন্দনকে দেখে আফসোস করে।
প্রায় প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে দুলাল আসে তাদের বাড়ি। সনকার খোঁজ খবর নেয় আর সনকার সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে খানিকক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে ছোট্ট লোচনকে ঘুম পাড়িয়ে দুজনেই বেরিয়ে যায়। সময়টা ঠিক দুপুর বেলা। বাড়ির সব কাজটাজ সেরে বাড়ির মানুষরা যখন বিশ্রামে যায়, তখন। আর দুলাল কোনসময় ছুটির দিন, মানে শনিবার বা রবিবার আসে না। কাজের দিন এবং দেখা গেছে সোমবার বা মঙ্গলবার। রূপসা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। চন্দন তো আর ওই সময় বাড়ি থাকে না। তাই তার এসব চাক্ষুশ করার সুযোগও নেই। রূপসাই স্বামীর কানে সনকার ব্যাপারটা তুলেছে। রূপসা বলছিল, “ওই দুলাল বলে লোকটা, যে সনকার দাদা বলে পরিচয় দিয়েছে। ওই লোকটা বাড়িতে আসলেই সনকার চোখ মুখের ভাষা, চলনবলন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। যেটা সত্যিকারের নিজের ভাইবোন হলে হবার কথা না। বেশ কয়েকদিন ধরে আমি সেটা লক্ষ্য করছি। তোমাকে বলিনি। এখন প্রায় নিশ্চিত যে ওদের মধ্যে অন্যরকম কোন নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে। দুলাল আসলেই সনকা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কোনো কাজ যদি বাকি থেকে যায় তা সেরেসুরে নেবার। তারপর বেরোবার জন্যে সাজগোজের যা বাহার, আমরাও অতটা দেখাতে পারি না। যাকগে। ওটা ওর নিজের ব্যাপার। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের নাক গলিয়ে কাজ নেই। যে জন্যে আমাদের বাড়ি ওর আসা, সেই কাজগুলো সময়মত এবং ঠিকঠাক পেলেই হল। না হলে অত টাকা দিয়ে আমরা ওকে সর্বক্ষণের কাজের লোক হিসেবে রাখব কেন। থাকা খাওয়া নিয়ে দশ দশটি হাজার টাকা। কম কথা নয়। ওদের কাছে তো এই টাকা পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়া। আমি শুধু তোমাকে ব্যাপারটা শুনিয়ে রাখলাম। বাড়ির কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে তা বাড়ির মালিককে সময়মত জানিয়ে রাখা দরকার। যদি কখনো কোন ঘটন-অঘটন ঘটে যায়?” তখন কি হবে?”ক্রমশ….
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৪)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ সাত ]
রুইদাস পাড়ার পাশেই পৌন্ড্রক্ষত্রিয় পাড়া। পোদ পাড়া বললে এক ডাকে সবাই চেনে। আটচালার মিটিংয়ে সেই পোদ পাড়ার বাদল এসেছে। সঙ্গে দুলাল বলে একজন। দুলাল কিন্তু পোদ নয়। ও মুচি-রুইদাস। ওর বাড়ি সেই উস্তির পদ্মপুকুরের দিকে। বাদলের সঙ্গে দুলালের বন্ধুত্ব সবার জানা। ওদের দু’জনের আলাপ, হাইওয়েতে ট্রাক চালানোর সুবাদে। দু’জনেই ট্রাক ড্রাইভার। আর বিদেশ বিভুঁইয়ে বিপদ আপদ ঘটলে মানুষ এলাকার কাউকে কাছে পেলে আঁকড়ে ধরতে চায়। অচেনা হলেও। দু’জনে বাঙালী তো? আর খুব কাছাকাছি না হলেও মোটামুটি এলাকার লোক তখন কত আপন হয়ে যায়। জাতপাতের বজ্জাতি এই পাড়া এলাকাতেই জমাট বাঁধে। বাইরে সেসবের কোন গুরুত্ব নেই। সেখানে এক ভাষাভাষী এলাকার মানুষ এই পরিচয়ই যথেষ্ট। এমনকি ভিন্ন ধর্মের হলেও কোন ফারাক পড়ে না।
রুইদাস পাড়ার লতায়পাতায় কারোর সঙ্গে দুলালের আত্মীয়তাসূত্রে বাঁধন নেই। ওই বাদলের বাড়ি আসা যাওয়া করতে করতে পরেশের সঙ্গে দুলালের আলাপ। ঘনিষ্ঠতাও জমে ওঠে। বাদলের এখানে দুলাল আসলেই পরেশের বাড়ি আড্ডা দিতে সে আসবেই। জাতভাইয়ের একটা যে টান তা অস্বীকার করবে কে। সেইসঙ্গে দোসর যৌবনের উচ্ছ্বাসে টগবগ করা পরেশের বউ! এ টান কি আর প্রকাশ্যে গলা উঁচিয়ে বলা যায়? যায় না। এ টান অন্তর্সলীলে বয়ে যায়। পরেশের সঙ্গে আলাপের পর থেকে দুলালের এ’পাড়ায় আসার বহরও বেড়ে যায়। তাতে অবশ্য কারোর কিছু বলার নেই। বাড়ির বউ-মরদ দু’লোকে যখন কেউ কিছু বলে না, তা পাড়ার লোক আগ বাড়িয়ে ঝগড়া কিনতে যাবে কেন। তবে এ নিয়ে কানাঘুষো চর্চা যে চলে না তা নয়। সব জায়গায় পাড়া কালচার বলে একটা কথা আছে। সেই পাড়া কালচারে এসব নিয়ে জল-গুলুনি তো চলতেই থাকবে। বাদলও আসে দুলালের সঙ্গে। তিনজনের আড্ডাটা এখানেই বেশি জমে। এমন মধুর চিত্রপটে হঠাৎ কি করে যে কি হয়ে গেল। দুলাল কিছুতেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। পরেশের জেল হয়ে যাবার পর কোন মুখে আর সে ওবাড়িতে আড্ডা দিতে যাবে? চারিদিকে তাহলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। এমনকি পরকিয়া প্রেমের অপরাধ তার ঘাড়ে চাপিয়ে শাস্তির মধ্যেও পড়তে হতে পারে। পরেশের জেলযাত্রার পর কয়েকবার বাদলের বাড়ি এসেছে দুলাল। পরেশ-বৌদির খোঁজ খবরও নিয়েছে। কিন্তু এদিন এসে যখন শুনলো আটচালার বিচারে ওদের গ্রামছাড়া করা হয়েছে, দুলাল সঙ্গে সঙ্গে খেপে আগুন হয়ে যায়! বাদলকে বলে, “এ কেমন বিচার গো তোমাদের ওপাড়ার রুইদাসদের? যে অন্যায় করল, তার তো চরম শাস্তি আইন দিয়েছে। তা নিরাপরাধ ওই মেয়েটা আর শিশুটা কি অন্যায় করল? এ কাজটা ওদের আটচালার করা ঠিক হয়নি। একটা অন্যায়ের শাস্তি দিতে দিয়ে আর একটা বড় অন্যায় ওরা করে ফেললো? গ্রামের একটা লোকও ওই অসহায় মেয়েটার পক্ষ নিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করল না! আমাদের পাড়াতেও তোমাদের আটচালার মত সরকারি বড় দালানঘর আছে। পাড়ার যাবতীয় মিটিং-টিটিং ওখানে হয়। বিচার-শালিশিও বসে। তবে এমন অমানবিক আর একতরফা বিচার মাতব্বররা কেউ কোনদিন করতে পারে না। ভুল হলেই অন্যরা চেপে ধরবে। মাতব্বরদের তড়পানির ভয়ে কেউ সিঁটিয়ে থাকে না। শুনলাম আজ সেই পরেশকে জড়িয়েই তো তোমাদের আটচালায় মিটিং আছে। আমি যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর আগে ওদের মাতব্বরদের দিতে হবে, তার পর ছুরি ব্যবহারের বিষয়ে কি নীতি নেবে তা নেবে। ও ব্যাপারে আমার কোন কথা নেই। তবে এই নিত্যসঙ্গী ছুরি ব্যবহারে একটা সঠিক নিয়ম মেনে চলা উচিত।”
দুলালের কথায় সায় দিয়ে বাদল বলল, “দেখো দুলাল, তোমাদের ওই রুইদাসদের কালচারের সঙ্গে আমাদের কালচার একদম মেলে না। আমরা, নস্কররা এই রুইদাসদের কোন ব্যাপারে মাথা গলাই না। এমনিতে ওরা ভীষণ হুটকো। দিনরাত সময় পেলেই মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে আর মতের অমিল হলে মারপিট, গালিগালাজ এদের মধ্যে লেগেই আছে। কোন ভদ্রলোক এই পাড়া দিয়ে যেতে সায় দেয় না। যারা এদের কথা জানে না, তাদের তো কিছু করার নেই। ওদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হবার সুযোগ তখন তাদের হয়ে যায়। অবশ্য তাই বলে সবাই মাতলামো, গালাগালি, মারপিট-প্রিয় তা নয়। আজকাল কেউ কেউ বাইরে কাজে যেতে শিখেছে। সেই পরিবেশ আর এখানকার দমবন্ধ করা পরিবেশ তারা আলাদাভাবে বুঝতে শিখেছে। তারা চেষ্টা করে সমাজটাকে একটু ভদ্র জায়গায় নিয়ে যেতে। কিন্তু সময় লাগবে। যতক্ষণ না এদের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো মুশকিল। তাই একদম লাগোয়া পাড়া, আমাদের নস্কর পাড়া হলে কি হবে, এই মুচিদের ব্যাপারে আমাদের কিচ্ছু বলার বা করার নেই। হ্যাঁ আমাদের পোদ পাড়া যে শিক্ষা দীক্ষায় টৈটুম্বুর তা কিন্তু নয়। বরং গরিব এবং অশিক্ষিতই বেশি। তবে এদের মতো অবুঝ নয়। এদের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে আমরা কোনদিন পার পাইনি। পাড়া ঝেঁটিয়ে ওরা আমাদের দিকে তেড়ে আসতে কসুর করে না। তাই আমরা এদের কোন ব্যাপারে মুখ লাগাই না। তুমি ওদের জাতভাই আছো। তোমার কথা ওরা হয়তো শুনতে পারে। তবে এরা যা হেঁকাতে, মানবে বলে তো মনে হয় না।”নন্দ-রতনরা, দুলালকে ভাল করে চেনে। নন্দর পিসির মেয়ের দুলালদের পদ্মপুকুরেই বিয়ে হয়েছে। তাই ওদের পাড়ায় ওর যাতায়াত আছে। একটা সময় ঘনঘনই যেত। ইদানিং কাজের চাপে আর তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাছাড়া অনেকদিন থেকে পরেশের বাড়িতে আসা যাওয়ার সুবাদে পাড়ার সকলেই দুলালকে চেনে। আরও ভাল করে চেনে, পরেশের যুবতী বউকে নিয়ে ওর সম্বন্ধে নানান টক-ঝাল-মিষ্টি আলোচনা-মস্করার সুবাদে।
সব কাজ কর্ম সেরে সন্ধ্যে আটটার মধ্যে পাড়ার সকলকে আটচালায় আসতে বলা হয়েছে। দুলালকে মিটিংয়ে আসতে দেখে নন্দরা একটু থমকে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে বলল, “আরে দুলাল ভাই। তুমি কবে এলে বাদলের বাড়িতে। তাও হঠাৎ আবার আমাদের আটচালার মিটিংয়ে? তা এসে যখন পড়েছো, তখন দেখে যাও আমাদের আলোচনা সভা। আমরা কেমন বিচার আচার করি, বিধান দিই। আমাদের বিচারের নিয়মকানুন তুমি জানতে পারবে। সেই অভিজ্ঞতা তুমি তোমাদের দালান বাড়ির সভায় কাজে লাগাতে পারবে।”
ততক্ষণে পাড়ার সবাই একে একে হাজির হয়ে গেছে। রতন বলল, “আমরা আজ কি জন্যে আটচালা ডেকেছি তা তো সবার জানা। এ’ব্যাপারে কারোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারো। আমরা আগে কে কি বলতে চায় শুনে নিই। তারপর আরও আলোচনা না হয় করা যাবে।” রতনের কথা শেষ হতে না হতেই দুলাল বলল, “আজকের যে তোমাদের আটচালা বসছে, তা জেনেই আমি এসেছি। কি বিষয় নিয়ে আলোচনা তাও আমার জানা। এই ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে এই আটচালার উদ্দেশ্যে আমার কিছু জরুরী প্রশ্ন বলো, বক্তব্য বলো, আছে। মূল আলোচনার আগে আমার কথাগুলো শোনার অনুরোধ জানাচ্ছি। তার পরেই আমি চলে যাবো। তোমাদের নিজস্ব আলোচনায় আমি বাইরের লোক, থাকতে চাই না।”
দুলালের কথা শুনে আটচালা গুনগুন আওয়াজে ভরে উঠল। কেউ বুঝতে পারছে না, দুলাল এখানে ঠিক কি বলতে এসেছে। পাড়ার মাতব্বররাও ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা সেরে নিতে ব্যস্ত। হতেই পারে তাদের স্বজাতি কিন্তু অন্য গ্রামের লোক। তার বক্তব্য এখানে রাখতে দেওয়া হবে কি না সেই নিয়ে আলোচনা। শেষমেষ মাতব্বররা রাজি হয়ে গেল। নন্দ বলল, “বলো দুলাল, তুমি কি বলতে চাইছো। তোমার কথা শোনার পর আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরবো।”
কিছু সময়ের জন্যে সভা একদম স্থির। পিন পড়লেও শোনা যাবে এমন। এবার দুলাল কোন ভূমিকা না করে সরাসরি সভাকে আক্রমণ করে বলল, “একজন নিরাপরাধ যুবতী-মা আর একটা দুধের শিশু, তারা কি অন্যায় করল যে তাদের জোর করে গ্রামছাড়া করা হল? অপরাধ যে করেছে সে তো শাস্তি পেয়েছে। একই অপরাধে দু’বার শাস্তি! প্রশাসন পরেশকে জেল-জরিমানা করে শাস্তি দিল। আবার তার পাড়ার আটচালা সেই পরেশকে শাস্তি দিল তার বউ বাচ্চাকে গ্রামছাড়া করে! এটা তোমরা কি বিচার করলে? তোমরা একবার ভেবে দেখলে না, তাড়িয়ে দিলে একটা মেয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবে? সে তো তোমাদের পাড়ারই একজন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। পরেশ ভুলবশত একটা কাজ করে ফেলেছে। সে কাজটা ঠিক করেনি এটা মানছি। ও যদি এই ভুলটা না করত তাহলে তো পরেশ, ওর বউ-বাচ্চা সকলের চোখে তখন অন্য পড়শিদের মত আপনজন হত। এখন তো পাড়ার কেউ জানে না সেই মেয়েটা কোথায় আছে? কেমন আছে? নারীর মান-মর্যাদা নিয়ে সে টিকে আছে তো!”
দুলালের কথা শেষ হতেই সভায় হইচই শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ আবার দুলাল যে একেবারে বেঠিক কথা বলেনি সেটা বুঝে চুপচাপ থেকে গেল। তবে যারা সেদিন পরেশের বউকে গ্রামছাড়া করার জন্যে বেশি মাথাচাড়া দিয়েছিল, দুলালের কথায় তারা রে রে করে উঠল। মিত্তুনে চেঁচিয়ে উঠল, “পরেশের বউকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন রে? সে তোর সম্পর্কে কে হয় ? তোর তো দেখছি মা’র থেকে মাসির দরদ বেশি। তার সঙ্গে তোর কোন গোপন সম্পর্ক আছে না কি রে? খুব বুঝি রসিয়ে রসিয়ে ভোগ করা হচ্ছিল পরেশের বোয়ের যৌবন? ওই জন্যে পরেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসা হত। এখন তা আর হচ্ছে না বলে তোর গায়ে জ্বালা ধরছে, তাই না?” এবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দুলাল লম্পটকে এক্ষুণি এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। পরেশের ব্যাপারে আমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই ঠিক। ও বিদেশ বিভুঁইয়ের লোক, ও আমাদের গ্রামের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছে কেন? এক্ষুনি ওকে এখান থেকে তাড়াতে হবে।”
তাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলতে মিত্তুনের উপর ‘খার’ বেড়ে যায় দুলালের, “আচ্ছা, আমি তো কথাটা মিত্তুনের বাড়িতে গিয়ে বলিনি। আর কাউকে দোষ দিয়ে বলিনি। এই সভা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তর উপর আমার মনের কথা বলিছি। তাতে মিত্তুনের অত গায়ে জ্বালা ধরল কেন? ওর এই জ্বালা ধরার পেছনে কারণ আছে। সবার সামনে আমার তা ফাঁস করার ইচ্ছে ছিল না। সেই কথা এ’পাড়ার কেউ কেউ জানেও। তা ও যখন আমাকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলে এতবড় অপমান করল তখন আমি আর চুপ করে থাকবো না। চলে তো আমি যাবই। এখানে থাকতে আসিনি। তবে ওর কেচ্চা না শুনিয়ে যাব না। সবাই জানুক, পরেশের বোয়ের উপর ওর কেন এত রাগ। পরেশ আমাকে সব গল্প করেছে। পরেশের সামনে থাকলে ও কেঁচো হয়ে থাকত। এখন সে নেই তাই এই হম্বিতম্বি।” দুলালের কথায় সভার নজর এবার গিয়ে পড়ল মিত্তুনের দিকে। যেন অপেক্ষা করতে লাগল, দুলালের কথার কাটান দিতে পাল্টা কি কথা মিত্তুনে বলে, তার জন্যে। কেননা দুলাল যদি প্রমাণ করতে পারে তো পরকীয়ার অপরাধে মিত্তুনের শাস্তি অবধারিত। গোপনে কে কি করছে ওই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু ধরা পড়লে বা প্রমাণিত হলে পরকীয়ার জন্যে কড়া শাস্তি দেয় আটচালা। সেটা মিত্তুনেও খুব ভাল করে জানে। তাই নিজেকে রক্ষা করতে সে দ্বিগুন চেল্লে উঠে বলে, “তুই আমার নামে কি ফাঁস করবি রে ‘গোহর’ বেটা? সাহস থাকে বলতো দেখি? আর বলতে না পারলে এ’পাড়ায় চিরদিনের মত তোর আসা বন্ধ হয়ে যাবে বলে দিলুম।”
দুলাল এবার আরও গলার স্বর চড়িয়ে বলল, “কেন পরেশের বউকে তুই বিপত্তারিনীর ডোর দিয়ে বলিসনি, এটা তুমি হাতে বেঁধে নিও। তোমার কোন বিপদ হবে না। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমরা গোপনে শীতলা টকীজে সিনেমা দেখতে যাব। আবার পরেশের বউ যখন ঘাটে চান করতে যায় সেই সময় তোরও চান করা পায়। পিট পিট করে হেসে তুই গিয়ে ঘাটের সামনে এসে দাঁড়াস। মেয়েরা ঘাটে চানে গেলে পুরুষরা কেউ যায়? যায় না। পরেশের বউ অনেকদিন তোকে বারণ করেছে। শুনিসনি। একদিন পরেশ আছোলা বাঁশের লাঠি নিয়ে তাড়া করতে তুই পাঁইপাঁই করে ছুট মেরেছিলিস। মনে আছে সেই কথা? এখন তো বলবি, সব মিথ্যে কথা। যেহেতু পরেশ এখন জেলে। আরও বাকি আছে। এটা তো সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। তখনই পাড়ার কয়েকজন সেটা দেখে ফেলে। যারা দেখেছে তাদের অনেকে এখানে আছে। পাড়ার মায়েদের জনা দুই জানে। তাদের আমি নাম বলতে চাই না। পরেশ আমাকে ওর কীর্তির কথা গল্প করেছে তাই জানি। ভোরবেলা পরেশের বউ দক্ষিণমাঠে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়েছে। মেয়েরা তো লজ্জার মাথা খেয়ে আলো-অন্ধকারের ভোরে কাজ সারতে বাধ্য হয়। সেটা চৌকীতে থেকে ওই বেটা মিত্তুনে পরেশের বোয়ের পথ আটকায়। পরেশের বউ কোন উপায় না দেখে চেঁচাতে শুরু করে। সেসময় দূরে কাছে থাকা অন্য মেয়েরা চেল্লাচেল্লি করতে মাঠঘেঁষা বাড়ি থেকে লোক হাঁক পাড়তে ইজ্জৎ-চোরটা এক ছুটে পগার পার। পরেশ সেসময় ঘটনাটা আটচালায় তুলতে পারতো। কিন্তু এখানে নিজের বউকে নিয়ে ঘটনা। তাছাড়া ওই মিত্তুন বেটাকে তাহলে গ্রামছাড়া হতে হবে। তাই, তা না করে ওকে একদিন ডেকে পরেশ শেষবারের মত সাবধান করে দিয়েছিল। আর যেহেতু পাড়ার সামান্য দু’চারজন জেনেছে তাই ব্যাপারটা সবাই চেপে যেতে রাজি হয়। চোরের মা’র বড় গলা! আমাকে খেপিয়েছে। আমি ছেড়ে দেবো?”
দুলালের কথায় তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল মিত্তুনে, “তোকে শালা প্রমাণ দিতে হবে। নাহলে আমি তোকে ছাড়বো না। তুই আমাকে চিনিস না।” এবার মাতব্বররা মিত্তুনেকে থামতে বলল। রতন বলল, “দুলাল যে কেচ্চার কথা মিত্তুনের বিরুদ্ধে তুলল আর যাদের জড়িয়ে ব্যাপারটা, পাড়ায় তারা তো কেউ নেই। অতএব মিত্তুনের কেসটা আটচালার আড়কাঠে তোলা রইল। পরেশের বউ কোনদিন না কোনদিন তো গ্রামে ফিরবে। সেসময় কেসটা তোলা হবে। সে যদি অভিযোগ জানায়, তখন মিত্তুনেকে শাস্তি পেতে হবে। পরেশের বউকে শুধু ব্যাপারটা মুখ ফুটে বলতে হবে। কোন প্রমাণ দেবার দরকার নেই। তার মুখের কথাই সব। কেননা কোন মহিলা নিজের চরিত্রহনেন কথা পাঁচকান করে না যতক্ষণ না তা ঘটে। এতবড় অভিযোগ সবার সামনে তুলেছে দুলাল। এটা চাড্ডি কথা না।”
এবার দুলাল বলল, “আমার যে মূল বক্তব্য ছিল তার কি কোন উত্তর পাবো?” দুলালের কথায় রতন-নন্দদের পাশে বসা অন্য মাতব্বররা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা চালাচালি করল। তারপর রতন বলল, “একটা বিশেষ যুক্তিতে সভা পরেশের বউকে গ্রামছাড়ার নিদান দিয়েছিল। তখনকার সিদ্ধান্তটা একদম ভুল তা আমরা মানছি না। দেখতে দেখতে তা বছর গড়িয়ে গেল। এখন মন হচ্ছে সেই শাস্তি তুলে নেওয়া যেতে পারে। তা পরেশের বউ যদি তার বাচ্চাকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চায় ফিরতে পারে। আটচালা আর বাধা দেবে না।”
দুলাল-মদন মিটিংস্থল ছেড়ে চলে যেতে কিছুক্ষণ সব চুপচাপ হয়ে যায়। কিন্তু মিত্তুনকে, দুলালের ওপর রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে দেখা যায়। ওকে কেউ আমল না দিয়ে রতনরা তাদের আজকের মূল বিষয়টা আলোচনার কথা তোলে। রুইদাস তথা মুচিদের জীবিকার মূল উপায় হল ভাগাড়ে পড়া গরুর চামড়া ছাড়িয়ে নানান পদক্ষেপের মাধ্যমে চামড়ার জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরী করা। সেই চামড়া ওরা মরা গরুর শরীর থেকে বার করতে যে ছুরি ব্যবহার করে সেটা তাদের কাছে লক্ষ্মী-পয়মন্তর। সেই জন্যে ওরা বাবা বিশ্বকর্মার কাছে সেই ছুরি সমর্পণ করে পুজো দেয়। আশীর্বাদ চায় যাতে সেই ছুরি সম্বচ্ছর সচল থাকে। এটা ওরা, মুচি-চর্মকার নির্বিশেষে মেনে চলে। এককথায় ওই অস্ত্র তারা ভগবানের কাছে নিবেদন করে থাকে। সেই ভগবান নিবেদিত বস্তুটাকে নিয়ে যদি কোন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে তা হবে নিতান্তই গর্হিত কাজ। এ কাজের কোন ক্ষমা নেই। এই কাজ করা মানে বাবা বিশ্বকর্মার সঙ্গে প্রতারণা করা। ভগবানের সঙ্গে যে প্রতারণাটা করল আমাদের ওই পরেশ রুইদাস। পরে হয়তো তার অনুশোচনা হয়েছে। কিন্তু তির একবার ছোড়া হয়ে গেলে তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। ভুলের মাশুল তো তাকে গুনতেই হচ্ছে। মাতব্বরদের নির্দেশমত রতন কথাগুলো সভায় বলে গ্রামবাসীর এ বিষয়ে কারোর যদি আর কোন পরামর্শ বা বক্তব্য থাকে তা বলতে বলল। বিশু বলল, “বিপদের সময় নিজের জান বাঁচাতে হাতের কাছে যদি কিছু না পাই তো ঠাকুরের কাছে অচ্ছগ্য করা এই ছুরি তো আমরা ব্যবহার করতেই পারি। এতে তো কোন অন্যায় হওয়ার কথা না।” সঙ্গে সঙ্গে নন্দ বলল, “আলবাত অন্যায়। আমাদের কোমরে ছুরিটা সবসময় গোঁজা থাকে আমাদের রুজির কারণে। যাদের এই পেশা নেই তারাও কি আত্মরক্ষায় এমন অস্ত্র ট্যাঁকে গুঁজে রাখে? রাখে না। অন্য সব মানুষই তো অস্ত্র ছাড়াই চলে। আমরা কি এমন তালেবর হয়ে গেলাম যে সবসময় প্রাণ সংশয়ে কাটাতে হয় আমাদের? ওসব অজুহাত তুললে চলবে না। যে এই নির্দেশ মানবে না তাকে শাস্তি পেতে হবে। পরেশের থেকেও কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আর তা দেবে এই আটাচালা।” রতন তখন নন্দর কথার রেশ ধরে বলল, “এই বিধিনিষেধ না মানা হলে আমাদের সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। দেখতে পাচ্ছি ইদানিংকালের ছেলেপুলেদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব খুব। কাউকে সহ্য না হলে কথায় কথায় হাত তুলে বসে। এবার তাদের হাতে যদি এমন কোন অস্ত্র থাকে তো তারা সাতপাঁচ না ভেবেই সেই অস্ত্র ব্যবহার করে বসবে। ‘খুনি সমাজে’র তকমা মানুষ দেগে দেবে আমাদের সমাজটার উপর। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সময় থাকতে রাশ টেনে ধরা দরকার।”
এমন বিস্তর আলোচনার মধ্যেই পরেশের হাতে খুন হওয়া রাধাকান্ত ঋষিদাসের ছেলে নিত্যানন্দর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার খুনি, পরেশকাকুর স্বীকার করা কথাগুলো! কিভাবে তাদের দু’জনের ঝগড়া শুরু আর পরেশ তার পেটে ছুরি চালালো। নিত্যানন্দর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। গামছার খোঁট দিয়ে তা শুষে নিয়ে সে বলল, “পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার সময় পরেশ কাকু মায়ের হাত ধরে বাবাকে খুন করার ঘটনার সবটাই কবুল করে বলেছিল, “সেইসময় ওদের দু’জনের মধ্যে ভয়ানক কথা কাটাকাটি চলছে। কেউ কাউকে রেয়াত করছে না। কেন যে নিত্যানন্দ তার উপর অতটা রেগে গেল তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। আসলে ও এমন নোংরা নোংরা গালাগাল তাকে দিচ্ছিল, সে মেজাজ ধরে রাখতে পারেনি।” কথা শেষ করতে দিল না পুলিশ। হেঁচকা টান দিয়ে প্রিজনভ্যানে তুলে নিল পরেশকাকুকে।”
[আট]
সময়টা পৌষ মাস। ভরভরন্ত শীত। প্রথম কাটের খেজুর গাছের রসের তখন স্বাদই আলাদা। ভোর পাঁচটার মধ্যে পরেশ রুইদাসের দাবায় লাইন পড়ে যায় তীব্র মিষ্টি স্বাদের সুগন্ধী খেজুর রস খাবার জন্যে। প্রতি গ্লাস দাম তিন টাকা। তাতেই পরেশ খুশি। এ’বছর আট আনা বাড়িয়েছে। নাহলে গত বছর আড়াই টাকা গ্লাস বেচেছে। এই ভিড়কে সামাল দিতে পরেশ তাই সূর্য ভোরের আলোর ফোকাস ফেলার আগেই হেঁসো নিয়ে বেরিয়ে যায় খেঁজুর গাছের রস নামানোর জন্যে। দিন শুরুর আগে এটা তার বাড়তি আয়। যদিও মরসুমী আয়। তাতে কি। সম্বচ্ছরের মাস তিনেক এই বাড়তি আয় বা আসে কোত্থেকে। এপাড়ায় আরও অনেকে পরেশের মত খেঁজুর রস বেচে। কেউ আবার রস তাওয়ায় ঢেলে তাতারসি বিক্রি করে, কেউ নলেন গুড়। যে যেটায় স্বচ্ছন্দ। তবে রস বিক্রি করতে গেলে ওই ভোর ভোর। সুর্য উঁকি মারলেই সেই সুস্বাদু রস থেকে গাঁজা বেরিয়ে তাড়ির বিটকেল গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে। তখন আবার সেটা নেশার বস্তুতে পরিণত হয়। মাতাল যারা হতে চায় তাদের কাছে এই তাড়ির আকর্ষণ আলাদা। তবে পরেশদের মত এই খেঁজুর রসের শিউলিরা তাড়ি বানায় না। বউ ছেলে নিয়ে ঘর-সংসারে ওই মাতালদের আনাগোনা পরেশের একদম অপছন্দ। তাড়ির গন্ধ শুরু হবার লক্ষণ হলেই ও তাওয়ায় ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে নলেনগুড় বানিয়ে নেয়। রস থেকে গুড় তৈরী করে আবার তা বিক্রির জন্যে হাটে বাজারে নিয়ে যাওয়া বা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে হয়। বড্ড সময় নষ্ট হয়ে যায়। পরেশের তাই একঝটকায় কাঁচা রস বিক্রি করাটাই বেশি পছন্দের। এই পছন্দের কাজ করতে গিয়ে তাই সে রোজ ভোর জেগে ওঠার আগেই শীতের ঘন কুয়াশা ভেদ করে বিড়ির মুখে আগুন ধরিয়ে খক্ খক্ করতে করতে চলে রসের ভাঁড় নামাতে। বারোখানা গাছ সে কাটে। এক দফে ছ’খানা তিন দিন পর দ্বিতীয় দফে ছ’খানা। খেঁজুর রস জোগাড়ের এটা নিয়ম, পরপর তিন দিন গাছের শরীরের মাস হেঁসো দিয়ে পাতলা করে কেটে সংগ্রহ করার পর তাকে জিরেন দিতে হয়। সেইসময় আর তার শরীরের আঁশ কাটা হবে না। আবার তিন দিন পর। এই তিন দিন জিরেনের পর চারদিনের মাথায় যখন প্রথম গাছে আঁশ কাটা হয় তাকে জিরেন কাটের রস বলা হয়। এই রসের স্বাদ বাকী দু’দিনের রসের থেকে অন্যরকম সুস্বাদু এবং তার নলেন গুড়ও সমানভাবে সুস্বাদু ও সুগন্ধী। এইভাবে বসে না থেকে পাল্টাপাল্টি করে গোটা শীত মরশুমটা কাজ চালাতে পারে।
সেদিন রাত-ভোরের কুয়াশা ভেদ করে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পরেশ খেঁজুরের রস নিতে ব্যস্ত। চারটে গাছের রস ততক্ষণে একজায়গায় করা হয়ে গেছে। ভোর একটু একটু করে আড়মোড় ভেঙে জেগে উঠতে উদ্যত। হঠাৎ কুয়াশা ফুঁড়ে আসমানের আবছা আলোয় দেখতে পায় দৌলতপুরের চড়ার ধারের বটগাছের মাথায় তারা দল বেঁধে চক্কর মারছে। কেউ কেউ বটের মগডালে খানিক বিশ্রাম নিতে নিতে জমিনের দিকে ইতিউতি নজর ফেলে আবার উড়তে শুরু করেছে। ওরা যেন পরেশদের নিশান উড়িয়ে জানাচ্ছে, ভাগাড়ে খাবার এসে গেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসে তোমাদের খাবারটা নিয়ে যাও। তারপর আমরা আমাদের দায়িত্ব বুঝে নেব। তোমরা তোমাদের কাজ না সারলে আমরা দায়িত্ব বুঝে নিতে এগোতে পারছি না।
নিশানা দেখা মাত্র পরেশ খেঁজুর রস সংগ্রহের কাজে জলাঞ্জলী দিল। এতক্ষণের জোগাড় করা রসের বড় কলসিটা একটা খেঁজুর গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে দিল। গাছ কাটার হেঁসোটা গাছের গায়ে কোপ মেরে সেঁটে বসিয়ে রেখে চুপিসাড়ে দে-দৌড়! একবারও ভাবার চেষ্টা করল না যে যারা রোজ ভোরে ওর কাছে খেঁজুরের রস খেতে আসে তারা অপেক্ষা করে আছে। ওর মুখ দেখার আশায় হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশায় থেকে থেকে একটা সময় হতাশ হয়ে পড়বে। এদিকে খদ্দেরদেরও চিন্তা বাড়তে থাকে পরেশকে নিয়ে। কোনকিছু বিপদ হ’ল নাকি পরেশের! রস পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে-টড়ে যায়নি তো? অথবা অন্য কোন বিপদ! এক এক জন এক এক রকম ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ চলেও গেল। অন্য কারোর কাছে যদি খেজুর রস পাওয়া যায়। পাল পাড়ার পড়শী, নিতাই কিন্তু পরেশের দাওয়ায় বসে থেকে থেকে ভাবল পরেশ যে গাছগুলো থেকে রস পাড়ে সেখানে গিয়ে দেখলে কেমন হয়? যা ভাবনা তাই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালো সেদিকে। নিতাই গিয়ে দেখে একটা খেঁজুর গাছের গায়ে বড় রসের ভাঁড়টা ঝুলছে। আর একটা খালি ভাঁড় তার গোড়ায় পড়ে। হেঁসোটা সেই গাছের গায়ে কোপ মেরে আটকে রাখা। অন্যকিছু ভাবার আগে মাতাল নিতাই আশপাশটা একবার দেখে নিল কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না। কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে পাশেই একটা পেঁপে গাছ থেকে পেঁপের ডাগ কেটে তার ডগা থেকে পাতার দিকটা ছিঁড়ে সেই ডাগের নল রসভর্তি কলসিতে চুবিয়ে চোঁক চোঁক করে মনের সুখে পেট ভরে জিরেন কাটের রস খেয়ে নিল। রসে পেট মোটা করার পর মনে পড়ল পরেশের খোঁজের কথা। এই সব ফেলে কোথায় গেল বেটা মুচির বাচ্চা কে জানে! এ শালাদের কোন ভরসা নেই। কখন যে কোথায় পট করে হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চয়ই শালা ভাগাড়ে কোন গরু পড়ার গন্ধ পেয়েছে। এছাড়া আর কোথায় যাবে। অবশ্য জোর হাগা পেতেও পারে। তাড়ি খেয়ে খেয়ে পেট গরমে আমাশা বাঁধিয়েছে। তাই হাগার বেগ সামলাতে না পেরে মেরেছে ছুট। অনেকটা রস সে খেয়ে ফেলেছে। পরেশ ব্যাটা হেগে পেট খালি করে এসে যদি দেখে তার কলসির রস খোলে পড়ে আছে, তাহলে তাকে সন্দেহ করতে পারে। ও আসার আগে কেটে পড়াই ভাল। সেই চিন্তা করে নিতাই সেখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ যদি দেখে ফেলে তো তাকে সন্দেহ করতে পারে। পরেশ এসে রস চুরি গেছে বলে চেল্লাতে থাকলে সে তার নাম পরেশকে বলে দিতে পারে।
রাধাকান্ত ঋষিদাস দিঘিরপাড় বাজারে রাতে অমিত-মুদির দোকান মোনে। ও অমিত মুদির খুবই বিশ্বস্ত। তাই রাত্রে ওর হাতে অতবড় মুদি দোকানের সব ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়িতে বোয়ের পাশে ঘুমোতে পারে। বিনিময়ে রাধাকান্তর মাসের বেনে বাজারের প্রায় সব দায় নিয়ে নেয় অমিত-মুদি। এই তো প্রায় পঁচ বছর গড়াতে যায় রাধাকান্ত এইভাবে আছে। কেউ কোনদিন ওর বিরুদ্ধে কথা তোলেনি। অমিত-মুদিও তেমন খারাপ কিছু ওর মধ্যে দেখেনি।
ওই ভোরে রাধাকান্তর জোর পেচ্ছাপ পায়। পেচ্ছাপ করে ফিরতে গিয়ে নজর আটকায় সেই আকাশ-নিশানায়! সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘুমন্ত তেজহীন শরীর চনমনিয়ে ওঠে! ঝিমিয়ে থাকা সারা শরীরের রক্তগুলো যেন চিলিক খেয়ে ঠেলা মারতে থাকে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। বাজার তো তখন সুনসান। দোকান ছেড়ে যাওয়াটা কি তার ঠিক হবে? যদি চোরবেটা সুযোগ বুঝে কোপ মারার ধান্ধা করে! তখন তো তার সর্বনাশ, অমিত মুদির সাড়ে-সর্বনাশ। ওই চোরবেটাগুলো সব সময় তক্কে তক্কে থাকে। কারোর অসাবধানতার সুযোগ কাজে লাগাতে ওরা ওস্তাদ। সে এখন কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে দোকানে ঢুকে খিল-তাড়া মেরে চিৎ হয়ে শুয়ে কপালে দু’হাত ঠেকনা দিয়ে ভাবতে থাকে। খানিক পর বাঁ পাশ ফিরে হাতের কব্জিতে ঘাড় তুলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। কোনদিকে চেয়ে আছে তা সে নিজেও জানে না। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে। ঘাড় কনকন করছে। আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। তবু কিছুতেই যেন বুদ্ধিটা বার করতে পারছে না এখন সে কি করবে! হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসল। এবার আর সাতপাঁচ না ভেবে দোকানের বড়বড় দুটো তালা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বাজারের রাস্তার এদিক ওদিক ভাল করে চোখপেড়ে দেখে নিল। সন্দেহের তেমন কিছু দেখতে পেল না। তাড়া লাগিয়ে তালা দুটোর একটা দরজার মাথায় লাগানো শেকলে আর একটা দরজার বালায় লাগিয়ে দিয়ে মারল ছুট! ছুটতে ছুটতে কোমরে হাত দিয়ে দেখে নিল জীবনসঙ্গী ছুরিটা আছে কি না।
পরেশের জিরেনকাটের খেজুর-রস চুরি করে খেয়ে ফিরতি পথে নিতাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রুইদাস পাড়ার দু’জনের সঙ্গে। ওরাও পরেশের ওখানে গিয়েছিল রস খাওয়ার জন্যে। না পেয়ে অন্য ঠেকে তাড়ি খেয়ে ফিরছিল। নিতাইকে দেখে বলল, “কিরে নিতাই, পরেশ এসেছে রস নিয়ে? এত বেলায় ওটা তো আর রস নেই। গেঁজলা উঠে তাড়ি হয়ে গেছে। আমরাও তাই খেলাম। তাড়ির নেশায় বেশ ভাল ঘোর লেগেছে রে। চুল্লুকে মনে হচ্ছে হার মানাবে।” ওদের কথার উত্তরে নিতাই, পরেশের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “হুঁ, কোথায় চুল্লু আর কোথায় তাড়ি। আকাশ আর পাতাল। তোরা তাহলে সেই চুল্লু কোনদিন গলায় সেঁধাস নি। আমার সঙ্গে একদিন যাস ননী-শুঁড়ির ঠেকে। বুঝতে পারবি নবাবী-চুল্লু কাকে বলে। তুই কে আর সিরাজদৌল্লা কে ফারাক করতে পারবি না। চলি রে। আর তোদের সঙ্গে গজালি করলে চলবে না। ওদিকে কাজে হাজিরা দিতে দেরি হয়ে যাবে। দেরি হলেই বড্ড খ্যাচর খ্যাচর করে ওই শালা মালিকটা।”
নিতাই চলে যেতেই ওদের দু’জনের, নোচে আর বিন্দের খেয়াল হল। নোচে বলল, “আরে, নেতাই শালা বলে গেল না তো পরেশ এসেছে কি না? তাহলে ওর কাছ থেকে দু’পাঁট তাড়ি খেয়ে যাওয়া যেত।” উত্তরে বিন্দে বলল, “চল না, রাস্তা থেকে তো পরেশের উঠোন দেখা যায়। ও বাড়ি ফিরলে দেখতে পাবো।”
না। তখনও শালা পরেশের দেখা নেই। বাড়ি ফেরেনি শালা। গেল কোথায় তবে? সেই ভোরে রস কাটতে গিয়ে কোথায় উধাও হ’ল বেটা? বিন্দে আওড়াতে লাগল। নোচে এবার থমকে দাঁড়াল! হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে পরেশ উধাও হবার রহস্য। তোর চোখের দূরবীনটা ঘোরাতো বিন্দে সেই দৌলতপুরের চড়ার ধারে খেলার মাঠের বটগাছটার দিকে। কি নিশানা দিচ্ছে গাছ বেটা! চোখ তোর নেশায় ঘোলাটে হয়ে আছে। ভাল করে শক্ত হয়ে দূরবীনটা ফেল। তবে স্পষ্ট হবে।”
এবার বিন্দে তার ডান হাতটা নোচের ঘাড়ে চেপে ধরে কাছে টেনে এনে বলল, “ওই দেখ, দেখ? আমি একা বললে তুই বলবি আমার চোখ ঘোলা। এবার তোর সাদা চোখে দেখ। ব্যাপারটা হচ্ছে কি ওদিকে!”
সঙ্গে সঙ্গে নোচে আর বিন্দে লুঙ্গী হাফ করে গুটিয়ে বেঁধে নেয়। কোমরে গোঁজা ছুরিটাকে আর একবার পেঁচিয়ে শক্ত করে আটকে টলমল পায়ে দৌড়ানোর ঢঙে এগোতে লাগল। ইটের হোঁচট খেয়ে, বিন্দে ঠাকুরের মানত করা দন্ডী কাটার মতো সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টলমলে নোচে তার হাত ধরে উল্টোদিক দিয়ে টেনে তুলতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিন্দে গালাগাল দিয়ে বলে, “এই শালা গোহর বেটা। উল্টো দিক দিয়ে হাত ধরে টানছিস, আমার হাত তো খুলে যাবে দাবনা থেকে। লাগছে। ছাড় ছাড়। ভীষণ লাগছে! ততক্ষণে বিন্দের নেশা ছুটে গেছে। নেশামুক্ত বিন্দে বলে, “আমরা শালা এমন গাধির বাচ্চা সে আর কি বলব। শুধুমুধু ছুটতে গিয়ে আহত হলাম। পরেশ শালা কোন ভোরে ওই নিশান দেখে রস নামানো ফেলে ছুটেছে। এতক্ষণে তার গরুর ছাল ছাড়িয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির ফেরার সময় হয়ে গেল। একটু এগোলেই হয়তো আমাদের মুখোমুখি হবে সে। আর ওদিকে পা বাড়িয়ে লাভ নেই। বাড়ি ফের। আটচালায় গিয়ে গজালি করি। কাজের কাজ হবে।”
কোমর সমান পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়াল দিয়ে গাঁথা আটচালা। সেটা প্লাস্টার করে মেঝে সমেত সিমেন্ট দিয়ে মাজা। আগে এসব ছিল না। কিন্তু এদিক ওদিক ঝোপঝাড় থেকে যখন তখন সাপ-বিছে বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে বর্ষাকালে। সাপের কামড় থেকে অনেকে অনেকবার বেঁচে গেছে মা মনসার কৃপায়। তারপর সিদ্ধান্ত হয় ওটা ঘিরে দেবার। নোচে-বিন্দে সেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দু’পা সামনে খেলিয়ে গজালি করতে করতে বিন্দেই কথাটা তোলে, “জানিস নোচে এবারে মিটিংয়ে এই ব্যাপারটা তুলতে হবে। যে শালা আগে নিশানা দেখবে গরুর চামড়া তার দখলে! আশ্চর্য! এটা একটা নিয়ম? এ তো কালা আইন। কে আগে নিশান দেখল, তা সাব্যস্ত করবে কে? দু’টো লোক যদি দু’ জায়গা থেকে দেখে? বুঝবে কি করে কে আগে দেখেছে? অনেক দিন থেকে এই নিয়ে গজগজ করছি। কোন শালা মাথা ঘামাচ্ছে না। যেদিন একটা বিশাল কেচাল হবে, সেদিন মাতব্বর শালাদের টনক নড়বে। তুই দেখবি, কেচাল একটা হবেই হবে। কেউ না বাধালে, আমি শালা নিজে বাধাব। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে আজ আমার খুব লেগেছে। তাও লাগাটা ভুলে যাওয়া যেত যদি চামড়াটা আমাদের দখলে আসতো। কিছুই হল না। শুকনো শুকনো ঝাড় খেতে হল।”
বিন্দের কথায় নোচের যেন কোন ‘গা’ নেই। তাড়ির নেশা তখনও তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বিন্দে বকবক করছে আর নোচে কখন নেশার ঘুমে ঢলে পড়েছে। হঠাৎ বিন্দে লক্ষ্য করে নোচে বেটা নাক ডাকছে, “ধুর-শালা। কাকে রাম-নাম শোনাচ্ছি। এতক্ষণ তাহলে ভষ্মে ঘী ঢাললাম! হারামি-শালা নোচে কোথাকার! তুই শালা যখন ঘুমোচ্ছিস, আমিও বকর বকর করে শক্তি ক্ষয় করি কেন। আমিও গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাই রাজকুমার-রাজকুমারীর পরীর দেশে! সুন্দরী সুন্দরী পরীদের সঙ্গে জলকেলি করি।”
মঙ্গলবার বড়বাজারে দোকানের মাল গস্তের দিন। তিরাশি রুটের ফার্স্ট বা সেকেন্ড বাসে করে যেতে হয় বাজারে। অমিত মুদি তাই এ’দিন সকালে আলো ফোটার আগে আগেই বাজারে চলে আসে। রাধাকান্তকে ঘুম থেকে তুলে বাজারের ঢাউস চারখানা ব্যাগ নিয়ে টাকা পয়সা ঠিকঠাক ট্যাঁকে সাইজ করে তৈরী থাকতে হবে, বাসের জন্যে। একটু দূরে রাস্তার ওপার থেকে দোকানের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে অমিত মুদির! দোকানে বাইরে থেকে বড় বড় দুটো তালা ঝুলছে! দোকানের দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাধাকান্ত কোথাও গেছে, না কি! না আদৌ সে গত রাত্রে শুতে আসেনি? ওঁ-হুঁ! তা তো হবার নয়। অমিত নিজে রাধাকান্তকে দোকানের ভেতর থেকে দরজায় খিল দেবার শব্দ শুনে তবে ঘরে গেছে। এটা একদম ভুল কথা না। তাহলে ও তালা ঝুলিয়ে গেল কোথায়? ও তো জানে আমি আজ গস্তে যাবো। সকাল সকাল দোকানে আসব। জেনেও এভাবে বেআক্কেলের মত চলে যাওয়া তো ঠিক করেনি! যাবে যদি বলতে পারতো। আমিই না হয় একটা রাত দোকানে কাটাতাম। এখন সময় বয়ে যাচ্ছে। ফার্স্ট বাস আসার সময় হয়ে গেল। ওটা যে ধরা যাবে না তা সে নিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু সেকেন্ডটা না ধরতে পারলে তো আজ গস্তে যাওয়াই যাবে না। এটা সেটা অনেক মাল ফুরিয়ে গেছে। সারা সপ্তা তাহলে দোকান সে চালাবে কেমন করে? এ রকম ফ্যাসাদে তো সে কখনো পড়েনি। কি বিপদ দেখো দিকিনি! এখন সে কি করে? কোথায় গেল রাধাকান্ত বোকাচোদাটা! মুখ খারাপ কি এমনি এমনি আসে। ওদের আচরণে আসে। মুখ খারাপের কাজ করলে তো গালাগালি খেতেই হবে। রাগে গা গজগজ করছে তো কি করবে। কৃষ্ণনাম জপবে? তারা বৈষয়িক মানুষ। অত মহান এখনো হতে পারেনি। এসব সাতপাঁচ নিজের মধ্যে গজরাতে গজরাতে পাশে মোহনের সেলুন দোকানের দিকে এগোয়। মোহন ঘুম থেকে উঠে দোকান ঝাঁট দিয়ে ধূপধূনো দিচ্ছে। সেকেন্ড বাসটা আসতে এখনো আধঘন্টা দেরী। গোহরবেটা রাধাকান্তর জন্যে ততক্ষণে ওখানে বসে মোহনের সঙ্গে দু’চারটে কথা বলতে বলতে অপেক্ষা করবে আর কি।
ভাগাড় থেকে তখনো দশ-পনেরো ধ্বজি দূরে পরেশ। ঘন কুয়াশা ভেদ করে চোখে পড়ছে ছায়ার মত একটা মানুষের আকার নড়াচড়া করছে। একবার নীচু হয় আবার খাড়া হয়! আর একবার তাদের গ্রামের রাস্তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে আবার যে কাজটা করছে সেদিকে মুখ ঘোরায়! চলকে ওঠে পরেশের বুকের রক্ত। ধকপক করে উঠছে ভেতরটা। লোকে বলে ওখানে নাকি মানুষের হৃদপিন্ড থাকে। হৃদপিন্ড মানুষকে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালিয়ে বাঁচতে সাহায্য করে। ওখানে চাপ পড়লে ও এইরকম ছটপট করতে থাকে। তাই এই ধকপকানিটা হচ্ছে। এসব ব্যাখ্যা পাশে সরিয়ে টানটান করে পরেশ এগিয়ে চলে ভাগাড়ের দিকে! অতসব ডাক্তারি কেতা জেনে তার কি লাভ? কোন্ শালা ওটা আগে তাকে দেখতে হবে। সে যখন নিশান দেখেছে তখন পৃথিবী পড়ন্ত রাতের ঘুমে মশগুল। কোনো ‘খানকির বেটার’ পক্ষে সম্ভব নয়, এই পরেশ রুইদাসের আগে নিশানটা দেখার।
রাধাকান্ত খুব ভাল করে জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পাড়ার দিক থেকে কেউ না কেউ আসবেই। শীতের মরশুমে এই ভোরের আলো-আঁধারে অনেকেই খেজুর-রস পাড়তে আসে। আর একটু পরেই বাহ্যে ফিরতে মাঠে ঘাটে সব বার হয়। খেঁজুর গাছে যারা উঠবে তারা সবথেকে আগে নিশান লক্ষ্য করতে পারবে। সেই হিসেবে কেউ না কেউ আসবেই। তাই মাঝে মাঝে ইতিউতি তাকায় আর গরুর ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে!
হিসেব মত খেঁজুর গাছে চড়ে যে নিশান দেখতে পাবে সেই সবার আগে দেখবে। তাদের গ্রাম উজিয়ে এতটা পথ আসতে তো অনেকটা সময় কেটে যাবে। সেই তুলনায় বাজার থেকে ভাগাড়ের দূরত্ব গ্রামের রাস্তার তুলনায় সিকি ভাগ। পাড়ায় দাঁড়িয়ে যে দেখবে, বাজার থেকে তার অনেকটা পরে দেখেও পাড়ার থেকে আগে চলে যেতে পারবে। এই কম দূরত্বের সুযোগটা যে রাধাকান্ত নিয়েছে, তা সে খুব ভাল করে জানে। কিন্তু চামড়ার লোভ। যেন যুবতী বোয়ের যৌবনের প্রতি লালসার থেকে এই গরুর চামড়ার লালসা মুচিদের কাছে আরও অনেক বেশি। লাথি-ঝেঁটা মারলেও বউ সহজে হাতছাড়া হয় না। স্বামীর কাছেই মাথা গুঁজে টিকে থাকে। আর চামড়ার ক্ষেত্রে মুহূর্তের হিসেবের গরমিলে পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই রাধাকান্ত সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর। কেউ তাকে আটকাতে এলে সে মিথ্যা কথাই বলবে, “সবার আগে সেই নিশানা দেখেছে। পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে ভোরের কুয়াশার আলো আঁধারিতে তার আগে কেউ নিশান দেখতে পারে না। কেননা, বাজার থেকে এই ভাগাড়টা অনেক কাছে। তাদের পাড়া থেকে এতটা দূরে তো দৃষ্টি পাতা যাবেই না। কুয়াশা সব আকাশকে গিলে বসে আছে।”
পরেশ ভাগাড়ের কানাচে আসতেই এতক্ষণের যত্তসব কুয়াশা যেন পগার পার! পরিস্কার দেখতে পেল তাদের পাড়ার রাধাকান্তকে? এই শুয়োরের বাচ্চা রাধে, তুই আমার আগে কোত্থেকে এলি? নিশান আমার আগে কেউ দেখবে, তা পারে না। আর তোর এতবড় সাহস, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তুই গরুর চামড়া ছাড়াতে শুরু করেছিস?”
পরেশের কথায় আমল না দিয়ে রাধাকান্ত যেন নির্বিকারে চামড়া ছাড়ানোর কাজটা করে যাচ্ছে। পেছন থেকে রাধাকান্তর পোঁদে সজোরে একটা লাথি কসালো পরেশ! মরা গরুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাধাকান্ত। পড়ে গিয়ে রাধাকান্ত আহত তো হলই তার উপর ভয়ও পেল! কোনরকমে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ও ভাবতে লাগল, পরেশ এমন বদ মেজাজী তো কোনদিন ছিল না! আজ হঠাৎ এত মারমুখী হয়ে গেল কেমন করে? পাড়ায় কারোর সঙ্গে কোনদিন জোর গলায় কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করেনি। অবাক হল ওর এই স্বভাববিরুদ্ধ রূপ দেখে। তবু চামড়ার লোভ মুচিদের মন থেকে যাবার নয়। মার খেয়ে ভয় পেলে ও তাকে আরও চেপে ধরবে। রুখে তাকে দাঁড়াতেই হবে।
পরেশ আবার রাধাকান্তকে লাথি কসিয়ে নিশ্চিন্ত রইল না। কিছুটা থমকে গিয়ে সেও জোর খাটিয়ে গরুটার অধিকার নেবার উদ্যোগ দেখাল না। ও অপেক্ষায় ছিল লাথ খাবার পর রাধাকান্তর দিক থেকে কি প্রত্যুত্তর আসে সেটা দেখার। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। দু’জনেই তো তাদের একান্ত পরিচিত পড়শি। সম্পর্ক তো কোন কারণেই দু’জনের মধ্যে তিক্ত হয়নি কোনদিন। বরং অনেক বেশি স্বাভাবিক। সেই দুই পক্ষ এখন মুখোমুখী। কাঠি-ঘা খাওয়া ক্ষিপ্ত সাপের মত মেজাজী ঢঙে রাধাকান্ত বলল, “তুই আমার পোঁদে অত জোর লাথি মারলি কেন? আমি কেন তোর কথায় উত্তর দিতে যাবো। আমি সবার আগে বটের মাথায় শকুন ওড়ার নিশান দেখেছি। দেখা মাত্রই ছুটে এসে আমার পাওনা গরু চামড়া আমার অধিকারে নিয়েছি। তুই কিছুতেই আমাকে এভাবে মারতে পারিস না। আটচালায় আমি এই অন্যায়ের বিচার চাইবো। তোকে পাড়া ছাড়া করে তবে ছাড়বো। আমার এই অপমানের শোধ আমি তুলবোই। আর এ গরুর চামড়া আমি কিছুতেই তোকে নিতে দেবো না। এটা আমার পাওনা, আমিই নেবো। কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আর তুই তো পরেশ রুইদাস। বেজন্মা জাত। তুই কোন্ ছার।”
জাত তুলে কথা বলতেই পরেশ আরও খেপে লাল হয়ে যায়, “হ্যাঁরে শালা। আমি বেজন্মা জাত। আর তুই কি জাত? তুই বেজন্মা থেকে আবার কবে মুচি হলি-রে শালা।” একটু থেমে পরক্ষণেই আবার পরেশ বলল, “তুই যে বললি শকুন ওড়ার নিশান দেখেই দৌড়ে চলে এসেছিস। হ্যাঁরে বোকাচোদা, বাজার থেকে এই ভাগাড়ে আসতে তড়কো পায়ে বড়জোর মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। এদিকে বলছিস পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে নিশান দেখেই চলে এসেছিস। তাহলে তুই গরু ছোঁয়া থেকে বড়জোর পাঁচ মিনিট আগে নিশান দেখেছিস? আর আমাদের রুইদাস পাড়া থেকে এখানে আসতে বারো মিনিট লাগে। আমি এসে দেখলাম তুই সবে গরুর গায়ে খান দুই চ্যাঁ দিয়েছিস। তার জন্যে দু’মিনিট ধর। তাহলে ওদিকে পাঁচ আর এদিকে দুই। মোট সাত মিনিট তোর দিকে। আর আমার দিকে বারো মিনিট। এখন হিসেব কি বলে? তোর থেকে পাঁচ মিনিট আগে আমি নিশান দেখেছি। এবার তুই শালা অঙ্কে মেলা? কে আগে নিশান দেখেছে? কোন শালা অঙ্কবিদ এসে আমার হিসেবের ভুল ধরতে পারবে না রে শালা শুয়োরের বাচ্চা! মিথ্যে কথা অন্য মুচিকে দেখাবি। এই পরেশ রুইদাসকে দেখাতে আসবি না। এর পর তুই এখান থেকে না কাটলে তোকে আমি শেষ করে দেব বলে দিচ্ছি, রাধাকান্ত!”
-তুই ‘বাল্’কোন হরিদাস রে? তোর ভয়ে আমি কাটতে যাব? তোর ওসব অঙ্ক-ফঙ্ক আমি মানি না। আমি আগে নিশান দেখেছি, আগে এসেছি। এ গরুর অধিকার আমার। বলে রাধাকান্ত পাল্টা একটা ঠেলা পরেশের বুকে মারতে পরেশ উল্টে বসে পড়ে। তার সেই ঠেলায় রাধাকান্তর হাতে থাকা ছুরির আঁচড় পরেশের দাবনা থেকে কব্জি পর্যন্ত চিরে রক্ত বেরোতে থাকে! সঙ্গে সঙ্গে পরেশ তার কোমরে বাঁধা গামছাটা ক্ষতে বেড় দিয়ে চেপে বেঁধে দেয়। মাথায় খুন চেপে যায় পরেশের। দ্বিতীয়বার আর অন্য কোন কথা চিন্তা না করে পরেশ সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাধাকান্তর উপর! ট্যাঁকে গোঁজা গরু ছাড়ানো ছোরাটা চেপে বসিয়ে দেয় রাধাকান্তর পেটে। ছোরাটা বসিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি পরেশ। মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছোরাটা দু’বার পেটের এপাশ ওপাশ চালিয়ে দেয়। গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো পোক্ত হাত নিখুঁতভাবে রাধাকান্তর শরীরে প্রয়োগ করে সে।
ভাগাড়ে এখন দুটো লাশ। একটা গরুর, একটা মানুষের। শকুনদের তো পোয়া বারো। একজন গরুর লাশে বসে তো অন্যজন রাধাকান্তর ভসকানো ভুঁড়ির উপর। ভাগ্য এতটা পয়মন্তর, ‘বিরল’ শকুনদের কাছে। অন্যদিনের থেকে আরও যেন বেশি বেশি শকুন আজ এখানে এসে হাজির হয়েছে। হয়তো ইতিমধ্যে জোড়া খাদ্য ভাগাড়ে পড়ার খবর ওদের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে।
রাধাকান্ত বেয়নে অমিত মুদির বড়বাজারে গস্তে যাওয়া তো ডগে উঠল। কিন্তু এতটা বেলা হবার পরও তাকে আসতে না দেখে অমিতের মনে ‘কু’ ডাকতে শুরু করল। অত ভোরে কোথায় বার হল লোকটা! কতটা বেলা হয়ে গেল এখনো ফিরল না। ওর কোন ক্ষতি টতি হয়ে গেল না তো? সেলুন মালিক, মোহনকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করি বলতো মোহন। দৌলতপুরের ভাগাড়ের দিকে প্রচুর শকুন ওড়াউড়ি করছে। গরু তো নিশ্চয়ই পড়েছে। রাধাকান্ত সেখানে গিয়ে এতক্ষণে ওর ফিরে আসার কথা। ও তো গল্প করে, একটা গরুর চামড়া ছাড়াতে ওদের সামান্য সময় লাগে। তার উপর দোকানের চাবি তার কাছে। সেটা মাথায় রাখলে ওর তো এত দেরি করার কথা নয়!” মোহন পরামর্শ দিল, “তুমি একবার না হয় পা পা করে ভাগাড়ের দিকে যাও কাকা। ওইটুকু তো রাস্তা। এখানে বসে থেকে বেলা করে লাভ নেই। কোলকাতার গস্ত তো ডব্বায় গেল। এবার সারাদিন দোকান খোলাটাই না ডগে ওঠে। ওদিকে না গেলে বুঝতেও পারছো না, কি থেকে কি হচ্ছে। দরকার হলে এখন তোমার রুইদাস পাড়াতেও ছুটতে হতে পারে।”
মোহন নাপিতের পরামর্শ মত অমিত মুদি গুটি পায়ে ভাগাড়মুখো হয়।কিছুটা এগোবার পর পরেশ মুচির মুখোমুখি হয়। তার চেহারা দেখে তো অমিতের চোখ কপালে ওঠার জোগাড় ! এল্টে তোলা কাপড়ের ওপর পাতলা ‘বামুনে’ গামছা জড়ানো। বাঁ হাতের কব্জিতে মোটা করে কাপড় জড়ানো। বোঝাই যায় খোঁজুর রস কাটার হেঁসোর ধার বজায় রাখার জন্যে ঘষতে ঘষতে সাদা কাপড়ের সামনের দিকটা কেল্টে এন্দেকার হয়ে গেছে। এই শীতেও তার লোমঅলা বুকে জড়ানো স্যান্ডো সাদা গেঞ্জী রক্তে লাল হয়ে আছে। অবশ্য পরেশদের মত গাছে-চড়া লোকদের শরীরে এই হাল্কা শীত তেমন কামড় বসাতে পারে না। এল্টেতোলা কাপড়-গামছাও রক্তে ভিজে জবজবে! পরেশের এমন চেহারা দেখে একবার গা-টা গুলিয়ে ওঠে অমিতের! সঙ্গে সঙ্গে ওসব গরুর রক্ত হবে ভেবে নিয়ে নিজেকে সতেজ করে পরেশকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে পরেশ, ভাগাড়ের ওদিক থেকে তো আসছিস। রাধাকান্তকে দেখলি? শালার বেটা শালা সেই ভোরে কখন আমার দোকানের চাবি নিয়ে ভেগেছে, এতটা বেলা হয়ে গেল, এখনো তার পাত্তা নেই? এত ক্যালাস লোক তো জীবনে দেখিনি?” সঙ্গে সঙ্গে পরেশ বলল, “দেখিছি। তুমি দেখো গে যাও। ভুঁড়ি ভসকে ভাগাড়ে মরা গরুর পাশে কেমন পড়ে আছে তোমার গান্ডু দোকান মুননদার, রাধাকান্ত ঋষিদাস!” কথাটা বলেই পরেশ নির্বিকারে নিজের পথ ধরল। অমিত পেছন ফিরে পরেশকে দেখে আর ঠায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে!ক্রমশ…..