ধারাবাহিক
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৩)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ পাঁচ ]
দৌলতপুরের মিতালী সংঘ ক্লাব গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তাব মত একটা জরুরী সভা ডাকে। মিটিংটা তাদের ক্লাবের সদস্য এবং গ্রামবাসীদের নিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইমত সভার তোড়জোড়ও শুরু হয়। যেহেতু গাছ কাটার প্রতিবাদটা কেবল গ্রামের মধ্যে থেকে নয়, পাশের গ্রাম, বিশেষ করে বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়া থেকেও প্রবল আপত্তি এসেছিল। তাই কাদের কাদের মিটিং-এ ডাকা হবে সেই নিয়ে আলোচনার সময় ক্লাবেরই এক সদস্য, অসীম নস্কর কথাটা তুলেছিল- বলেছিল,“রুইদাস পাড়ার আটচালার মাথাদেরও উপস্থিত থাকার জন্যে বলা হোক, যেহেতু ওই বটগাছটার পশ্চিমপাশে ভাগাড় আছে। ওই ভাগাড়ে গরু-ছাগল পড়লে ওরা সবসময় মুখিয়ে থাকে তাদের চামড়া নেবার জন্যে। এটা ওদের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন বলে মনে হয় ওদের ডাকা উচিৎ।” অসীমের কথায় তেড়েফুঁড়ে ওঠে ক্লাবের সম্পাদক, সুপ্রভাত সরকার, “কেন, ওরা আমাদের গ্রামের কে? ওদের কিছুতেই ডাকা যাবে না। তাহলে ওরা পার পেয়ে যাবে। ‘সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বার হবার’ চেষ্টা করবে। তারপর অন্য কোন বিষয়ে, হয়তো সেখানে ওরা কোনভাবে যুক্ত আছে, সেখানেও বলবে, আমাদের না জানিয়ে তোমরা কাজটা করতে পারবে না। একদম ওদের পাত্তা দেওয়া চলবে না। নীচু জাত ওরা। পায়ের পাতায় থাকার যোগ্য ওরা। কোনদিন ওদের মাথায় তুলতে নেই। প্রচলিত একটা কথা আছে না, ‘কুকুরকে ‘লায় দিলে মাথায় ওঠে!’
সম্পাদকের যুক্তিটা একদম মেনে নিতে পারেনি অসীম। একটা মধ্যযুগীয় ধারণা নিজের মধ্যে ধরে রেখে কথাটা বলছে লোকটা। মানুষের জাতপাত নিয়ে এমন নগ্ন মন্তব্য মানতে পারল না ও। একটা সম্প্রদায়ের মানুষকে উনি কি না কুকুরের সঙ্গে তুলনা করল! এইসব তথাকথিত উচ্চবর্ণের গেঁয়োদের মানসিকতা কোন্ তলানিতে এসে ঠেকেছে! এখন আস্তে আস্তে রুইদাস সমাজেও শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে। ছেলেরা স্কুল-পাঠশাল যেতে শিখছে। সরকার নানাভাবে ওদের উৎসাহিত করছে বাচ্চাদের স্কুলমুখো করার জন্যে। ওদের পাড়ার কিছু ছেলে-মেয়ে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে। হয়তো ওদের আগের প্রজন্ম মুর্খই ছিল। কিন্তু সন্তানদের মাধ্যমে বড়রা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছে। এইজন্যেই ওরা দৌলতপুরের উচ্চবর্ণ বাবুদের মন থেকে ‘বাবু’ বলে আর ভাবতে চায় না। ক্ষমতাবান বলে ওরা বাবুদের সামনে সমীহ করার মত আচরণ করলেও আড়ালে মোটেই সম্মান করে না। সেটা জনান্তিকে ওদের কথায় কান পাতলে বোঝা যায়। অসীম সম্পাদকের উদ্দেশে বলল, “এই যুক্তিটা কিছুতেই মানা যায় না। সমাজের অন্তজ শ্রেণীর মানুষদেরও মানুষের সম্মান দেওয়া উচিৎ। রুইদাসদের মিটিংয়ে না ডাকার বিষয়ে সম্পাদকের এই যুক্তি সব সদস্য যদি মেনে নেয় তো তাই করবে। তবে একে আমি সমর্থন করতে পারছি না। প্রকাশ্যে আমি সম্পাদকের এই বক্তবের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
সম্পাদকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই প্রথম প্রকাশ্যে কেউ একজন প্রতিবাদ করল! সামান্য একটা উঠতি ছোকরা তার মুখের উপর কথা বলাটা কিছুতেই ঢোক গিলে ভেতরে গ্রহণ করতে পারছে না, সুপ্রভাত সরকার। বমির মত তাই তা উগরে দেবার প্রবণতায় অসীমের উদ্দেশ্যে বলল, “আজকাল কিছু উঠতি ছোকরারা দেখছি ভালই ডানা ঝাপটতে শিখেছে। বড়দের সিদ্ধান্তের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। ওদের ডানা এখনই ছাঁটা দরকার। প্রথম রাতেই বেড়াল না মারতে পারলে সকলকেই পস্তাতে হবে। গ্রামের রাশ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গ্রামে অরাজকতা-অনাচার ছড়িয়ে পড়বে। কোনদিন দেখা যাবে ওই রুইদাস পাড়া থেকে কোন মেয়েকে তুলে নিয়ে নিজের বউ বলে বসবে।”
অসীম দেখল সম্পাদকের এই অন্যায় বক্তব্যের উপর তার এক্ষুণি প্রবল প্রতিবাদ জানানো দরকার। রাগে তার পা-জোড়া থরথর করে কাঁপতে লাগল! বুঝতে পেরে গ্রামের তারই এক সহপাঠী প্রদীপ সঙ্গে সঙ্গে তার কাঁধে হাত রাখল।অসীমের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রদীপ বলল, “মাথা গরম করছিস কেন? দেখছিস না, ক্লাবের মাতব্বররা সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথা বলছে না! এখন তুই-আমি মুখ খুললেই ওইসব গোঁড়া বর্ণাশ্রমপ্রিয় লোকগুলো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাতে কেচ্চা আরও বেড়ে যাবে। আর দেখ, আমরা কিন্তু দলে সংখ্যালঘু। বাড়াবাড়ি হলে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব না। তার চেয়ে বরং চল, আমরা নিজে থেকেই ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যাই। আর কোনদিন ক্লাবমুখো হবো না। সেইসঙ্গে গ্রামের বাইরে এদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাব।”
অসীমদের কাছ থেকে হোক বা অন্য কোনভাবে, মিতালী সংঘের মিটিংয়ের খবরটা পেয়ে যায় রুইদাস পাড়া। সঙ্গে সঙ্গে আটচালায় জরুরী ভিত্তিতে সবাই মিলে আলোচোনায় বসে যায়, এ ব্যাপারে তাদের ঠিক কি করণীয়? হঠাৎ করে বসেছে বলে পাড়ার সব মাতব্বররা একসঙ্গে জড়ো হতে পারেনি। যে যার মত রুজি রোজগারে ব্যস্ত। মুখে মুখে খবর পৌঁছোতে সবাই একে একে এসে পড়ে। সবিস্তার আলোচনোর পর আটচালা নন্দকে ভার দেয়, এই মিটিংয়ে কি কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তা সবিস্তারে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া জন্যে।
ওরা ঠিক করে মিতালী সংঘ মিটিংয়ে তাদের ডাকুক বা নাই ডাকুক, উপযাচক হয়ে তারা সেখানে দলবল নিয়ে যাবে। রুইদাস পাড়া থেকে এতগুলো লোক ওখানে গেলেই প্রথমে মিতালী সংঘের কর্তারা ভিমরি খেয়ে যাবে ! তাদের উপস্থিতিকে ওরা মেনে নেবে না। কিন্তু তারা ওই মিটিংয়ে থাকবেই। তাদের বক্তব্য মিতালী সংঘকে শুনতেই হবে। তারা বোঝাবে, মিটিংয়ে অন্য কোন বিষয়ের আলোচনায় তাদের কোন দায় নেই। তারা উচ্চবাচ্য করবে না। কিন্তু ওই পুরোনো বটগাছটা কাটার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তার আগে তাদের বক্তব্য শুনতে হবে। যদি মিতালী সংঘ তা মানতে না চায় তো বড় কোন গন্ডোগোলও বেঁধে যেতে পারে। সংঘ কর্তারা রুখে দাঁড়িয়ে তাদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতেও পারে। কিন্তু তারা গাছ কাটার কোন সিদ্ধান্ত না জেনে যাবে না। তখনই সংঘাতটা বাঁধতে পারে। সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তার মোকাবিলা করার জন্যে আমাদের আগে থেকে তৈরী হয়ে যেতে হবে। দরকারে আত্মরক্ষার্থে সেই অস্ত্র আমাদের প্রয়োগ করতে হবে। তবে কোন পরিস্থিতিতে প্রথম আঘাত আমাদের দিক থেকে যেন না হয়। আমরা আক্রান্ত হলে তবেই আত্মরক্ষার জন্যে রুখে দাঁড়াবো। কেননা দৌলতপুরের গ্রামের লোকেদের অনেক পয়সা আছে। ওটা বড়লোকের গ্রাম। থানা-পুলিশ পয়সা দিয়ে ওরা কিনে রেখেছে। তাই ওরা অন্যায় করলেও ঘুরিয়ে অন্যায়টা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পুলিশের হাত কাঁপবে না। যদিও বাবার উপর বাবা আছে। দরকার হলে আমরা থানার উপরের প্রশাসনিক দপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারি। আর আমরা যে হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের ডেরায় যাচ্ছি, আমাদের পক্ষে উপযুক্ত অস্ত্র আছে বলেই না যাচ্ছি? সেই অস্ত্র আমরা এখানে দেখাচ্ছি না। সময়মত তা প্রয়োগ করবো। তখন মিতালী সংঘ সত্যি সত্যি ভিমরি খেয়ে পড়বে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। আমাদের রুজি রোজগারের জন্যে বিশেষ করে খোড়া, কুনকে, পালি, কুলো সারাবার জন্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়। দৌলতপুর গ্রামটা আমাদের রুজির ক্ষেত্রে একটা পয়া গ্রাম। ওই গ্রাম থেকে আমরা অনেক কাজ পাই। শুধু ওগুলো কেন, বাবুদের জুতো পালিশও আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে করে আসি। তাতে যেমন বাবুদের রাস্তায় বা বাজার-গঞ্জে গিয়ে জুতো পালিশ করতে হয় না। তেমনি আমরাও বাড়ি বয়ে কাজটা করি বলে দুটো বেশি পয়সা পাই। আমাদের এইসব কাজ দৌলতপুরে যতটা হয়, অন্য কোন গ্রামে এতটা হয় না। এতে আমরা যেমন উপকৃত হই, তেমনি ওদেরও সুবিধা হয়। সেই দিকটাও চিন্তা করে আমাদের সেইরকম ব্যবহার ওদের সাথে করতে হবে। প্রথম দিকে আমরা হাত জড়ো করে অনুনয় বিনয় করে আমাদের কথা পাড়বো। আশাকরি ওরা সেটা বুঝতে পারবে। কেননা ওরা বেশিরভাগই শিক্ষিত পরিবারের লোক। নন্দ কথাগুলো আটচালাকে বুঝিয়ে বলতে এককথায় সবাই তাতে সায় দেয়। সেইসঙ্গে আটচালা রতন আর নন্দকে ভার দেয় মিতালী সঙ্ঘের সঙ্গে যাবতীয় কথা বলার জন্যে। মানে রুইদাস পাড়ার প্রতিনিধি হয়ে রতন আর নন্দ সব কথা বলবে। কেননা, পাড়ার মধ্যে এদের দু’জনের পেটে একটু বিদ্যেবুদ্ধি আছে। দু’জনেই ফাইভ ক্লাস টপকাতে পেরেছিল। তারপর তো সবাই ‘ক-অক্ষর গো-মাংস’। পেটে ঘুসি মারলে স্বরবর্ণ বা ব্যাঞ্জনবর্ণের একটা অক্ষরও বার হবে না। তাছাড়া এরা একটু যুক্তি দিয়ে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে পারে। অন্যদের মত অতটা হ্যাঁকাতে নয়। কথায় কথায় মারব ধরব বলে চেল্লায় না। রতন-নন্দ বোঝালে বাবুরা নিশ্চয়ই তাদের আবেদন মঞ্জুর করবে। ওই সর্বনাশা প্রস্তাব মুলতুবি করবে। এই বিশ্বাস রেখে ওরা মিটিংয়ের নির্দিষ্ট দিনে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
গোটা রুইদাস পাড়া ঝেঁটিয়ে হঠাৎ গিয়ে হাজির মিতালী সংঘের বিশাল পাকা ক্লাব ঘরের সামনের প্রশস্ত ফাঁকা জায়গায়।
ক্লাব ঘরের মাঝখানটা নাট মন্দিরের মত বড় দালান। দালানের এক দিকে দূর্গা মায়ের কাঠামো। বিসর্জন দেবার পর জল থেকে কাঠামা তুলে এখানে রাখা হয়। প্রায় এক’শ বছর ছুঁই ছুঁই এদের এই পূজা। দালানের দু’দিকে বড় বড় দুটো ঘর। একটা ঘরে ক্যারাম তাস লুডো খেলা হয়। অন্য ঘরটা অফিস ঘরের জন্যে বা ছোট খাটো মিটিংয়ের কাজে লাগে। এই ঘরটায় দেয়াল ঘেঁষে বইয়ের সুন্দর তাক আছে। প্রচুর বই রাখা আছে। সদস্যরা বা গ্রামের যে কেউ এখানে এসে বই পড়তে পারে। কেউ আবার বাড়িতেও নিয়ে যায়। সেই ব্যবস্থা করা আছে। বড় দালানটায় ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা এবং অন্যন্য সদস্য হাজির। এমন সময় রুইদাস পাড়ার মেয়ে-মদ্দদের দেখে কিছুটা অবাকই হয় সবাই। ঝাঁক ঝাঁক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রুইদাসদের দিকে আছড়ে পড়ে। তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রতন নন্দদের। এই অস্বস্তিকর মুহূর্তকে বেশিক্ষণ টিকিয়ে না রেখে রতন বলল, “বাবু, আমরা এসেছি আজকের আপনাদের মিটিংয়ে ওই ভাগাড়ের বটগাছটা কাটা নিয়ে আলোচনা হবে, এই কথা জেনে। সত্যি যদি তা নিয়ে আলোচনা হয় তো আমরা থাকব, না হলে চলে যাব। আর এই আলোচনার আগে যদি আপনাদের অন্য কোন বিষয় নিয়ে মিটিং হয় তো ততক্ষণ আমরা ওই দূরে অপেক্ষা করছি। যখন বটগাছটার বিষয় আলোচনায় উঠবে তখন আমরা আসব। আমাদের এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। তাই অনাহুতের মত আমরা আপনাদের পাড়ায় এসেছি। সেজন্য মাপ করে দেবেন বাবুরা।”
রতনের কথায় যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে, মিতালী সংঘের সম্পাদক, সুপ্রভাত সরকার, “আমাদের গ্রামের ভাগাড়, আমাদের গ্রামের খেলার মাঠ আর আমাদের বটগাছ। সেই বটগাছ আমরা কাটব না রাখব সেটা আমাদের গ্রামের মানুষের নিজস্ব বিষয়। তা নিয়ে তোদের কথা শুনতে যাবো কেন রে? শালা, তোরা চামার জাত, ছোটলোক, তোদের কথা শুনে আমাদের চলতে হবে? তোরা কিনা মেয়ে-মদ্দে মিলে আমাদের ঘর বয়ে তেড়ে এসেছিস? কে তোদের এতবড় সাহস দিল রে, রতন? ওই ঘরশত্রু বিভিষণ অসীম-প্রদীপরা বুঝি? ওদের তো আমাদের ক্লাব থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। এবার দরকার পড়লে গ্রামছাড়া করব। রামায়ণে বিভিষণ চরিত্রটা এমনি এমনি এসেছে? এইজন্যেই এসেছে। সব শালা বেইমান, মীরজাফরের জাত। তোদের কোন কথা আমরা শুনব না রতন-নন্দ। মেয়ে-মদ্দে যে পথে এসেছিস সেই পথ দেখে ফিরে যা। দ্বিতীয়বার এ’মুখো হবি না। ফল ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।”
সুপ্রভাতের কথায় সঙ্গে সঙ্গে রুইদাসপাড়ার মেয়ে বউরা গুনগুনিয়ে ওঠে! ছেলেরাও কেউ কেউ গজরাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নন্দ ধমক দিয়ে বলে,“এই জন্যেই মেয়েদের বলেছিলুম তোমাদের আসতে হবে না। জানি তো তোমরা মুখ-ফটকা। কোথায় কখন কি বলতে হয় জানো না। আমরা তো আছি। তাহলে তোমরা আমার আর রতনের উপর কথা বলার ভার দিলে কেন। আমরা সরে যাচ্ছি, তোমরাই তাহলে কথা বলো।” নন্দর ধমকে রুইদাসরা চুপ মেরে যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলতে থাকে রতন-নন্দরাও। এমন হ্যাঁকাতে লোক এই সরকারটা! কেন যে একে এতবড় একটা ক্লাবের সম্পাদক করে রেখেছে কে জানে। এমন রগচটা লোককে এই দামী পদে রাখা ঠিক হয়নি দৌলতপুরের।
সম্পাদকের এই অপমানজনক কথা মানতে পারেনি তরুণ সংঘের সভাপতি বলাই হালদার। ধুতি-পাঞ্জাবী পরা দোহারা তামাটে চামড়ার প্রবীণ মানুষ। কথায় ধীরস্থির ভদ্রতা মেশানো। আলটপকা দেখলে সমীহ করতে ইচ্ছে করবে। নন্দরা তখন ব্যস্ত রুইদাসদের সামাল দিতে। তখনই বলাই বাবু উঠে বলল, “সুপ্রভাত, তোমার এমন কড়া কথা বলা উচিত হয়নি। ওরা ছোটলোক, নীচু জাত কি উঁচু জাত তা তো ওদের গায়ে লেখা নেই। আর জাত? কেউ মায়ের পেটের ভেতর থেকে জাত বেজাতের টিকিট হাতে ধরে পৃথিবীতে আসেনি। মানুষকে এইভাবে অপমান করা ঠিক হয়নি। ওরা কি বলতে চাইছে তা না শুনে প্রথমেই এইভাবে উগ্র ব্যবহার করা যায় না। আমি তো দেখছি তোমার সম্পাদক হবার যোগ্যতাই নেই। গ্রামের নেতা হতে গেলে অনেক সহনশীল হতে হয়।”
সভাপতি বলাই বাবুর কথায় একদম চুপমেরে যায় সম্পাদক। সভাপতি তখন দাঁড়িয়েই আছে। ক্লাবের প্রবীণ সদস্য, দুলাল-কা বলল, “ওদের বক্তব্য, ভাগাড়ের ওই পুরোনো বটগাছটা ক্লাব যেন না কাটে। ভাগাড়ে গরু পড়লে আসমান থেকে শকুনেরা উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে ওই গাছাটায় বিশ্রাম নেয়। শকুনেরা ওড়াউড়ি করলেই রুইদাসরা বুঝতে পারে, ভাগাড়ে গরু পড়েছে। ওরা প্রস্তুতি নিতে পারে সেই গরুর চামড়া নেবার জন্যে। আর গাছটা না থাকলে শকুনেরও বসার জায়গা থাকে না, রতনরাও সহজে বুঝতে পারবে না, ভাগাড়ে গরু পড়েছে কি না। এই হচ্ছে রতন-নন্দদের আসল বক্তব্য। এই প্রক্রিয়াটা একদম ওদের নিজস্ব বলে ওরা সাধারণভাবে মুখ ফুটে অন্যকে বলতে চায় না। গোপন রাখতে চায়। কেননা অন্যরা জেনে গেলে ওদের এই নিয়ে খোঁটা দিতে পারে তাই।” দুলাল-কার কথাগুলো নন্দদের মনের কথা। একদম ঠিক বলেছে দুলাল-কা। নন্দর সঙ্গে দুলাল-কার অনেক ঘরোয়া কথা হয়। তাই দুলাল-কা ভেতরের গপ্প এতটা জানে। ব্যক্তিগত ভাবে নন্দ, ‘কাকা’ না বলে লোকের কাছে ‘দুলাল-কা’ বলেই পরিচয় করায়। দুলাল-কা বলার পর রতন বলল, “বলাই বাবু, দুলাল-কা যে কথাগুলো বলল, ওটাই আমাদের কথা। আর অন্য কোন কথা আমরা বলতে আসিনি। তাছাড়া আমরা গরিব মানুষ। এই মরা গরুর চামড়া দিয়ে আমরা নানান জিনিস বানিয়ে পেটের ভাত জোগাড়ের অনেকটা ব্যবস্থা করতে পারি। ওই গাছ কেটে দিলে আমাদের পেটে লাথি মারা হবে যে বাবু। কোন শত্রুও এ’কাজ করতে চাইবে না। আমরা কি আপনাদের শত্রু, বাবু?”
রতনের আবেগ মেশানো কথাগুলো ক্লাবের অন্যদের মনে ধরে। সবাই যেন এবার গুন গুন করে রতনদের পক্ষে কিছু একটা বলছে বলে মনে হ’ল। তবু সভাপতি বলাইবাবু, সম্পাদক সুপ্রভাতকে বলল, “রতনদের বক্তব্যের উপর তোমার কি বলার আছে বলো।” সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদক বলল, “ওরা বলছে বলে ওদের কথা আমাদের মেনে নিতে হবে এটা ঠিক কথা নয়। আমরা তো একটা উদ্দেশ্য নিয়ে গাছটা কাটার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। গাছটা কাটলে মাঠটা অনেক বড় করা যায়। তখন আমরা ওখানে খেলার টুর্ণামেন্ট চালাতে পারব। বাইরের কত ক্লাব তখন আমাদের এখানে খেলতে আসবে। তাদের খেলা দেখে গ্রামের ছেলেপুলেরা খেলা শিখতে পারবে।”
সুপ্রভাতের কথার টানকে টেনে ধরে বলাইবাবু বলল, “বটগাছ সমেত মাঠটা যতটা বড় আছে তাতে তো খেলাধূলা ছেলেরা ভালই করতে পারে। আমরাও তো সেসময় ওখানে খেলাধূলা করে এসেছি। তারপর এখন যারা খেলা করতে বা হাওয়া খেতে একটু বিশ্রাম নিতে মাঠে যায় তারাও রাজি হচ্ছে না। গাছ কাটার পক্ষে মত দিচ্ছে না। এতকাল তো টুর্নামেন্ট ওখানে হয়নি। নাই বা হল। তাতে আমাদের গ্রামের তো কোন শ্রীবৃদ্ধি হবে না। বরং ওইসব করতে গিয়ে অনেক উটকো ঝামেলা ক্লাবকে পোহাতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার অধিকার আগে না নেচেকুঁদে ফুর্তি মেটানোটা আগে। সেইটা আমাদের ভাল করে বুঝতে হবে। যে গাছ এক-গ্রাম বা এক-পাড়া মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, সামান্য দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় করার বিলাসিতায় আমরা মানুষের জীবন মরণের প্রশ্নটাকে তুচ্ছ করে দেখব? এ তো দেখছি সেই কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটার ছায়া এখানে এসে পড়েছে! বাবুর জমি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান হতে হবে। তাই গরিব উপেনের বেঁচে থাকার সামান্য অবলম্বনটুকুও ক্ষমতার দম্ভে কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনি।”
এরপর যথাসম্ভব কড়া গলায় সভাপতি বলাইবাবু বলল, “সম্পাদকের প্রস্তাবে আমার সায় নেই। এবার সমবেত সদস্যবৃন্দ এবং গ্রামবাসী তাদের মতামত জানাক। বটগাছটা কাটা হবে, না যেমন আছে তেমন থাকবে। এখন প্রত্যেক মানুষ যে যার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে যে উত্তর পাবে সেই উত্তর এখানে পেশ করা হোক। অধিকাংশ মানুষ যা চাইবে তাই হবে।”
সভাপতির মতামতের পর সভায় বেশ খানিকক্ষণ ধরে গুঞ্জন চলতে থাকে। থামতে যেন আর চায় না। মাথা নেড়ে একে অপরের বক্তব্যে কেউ সাড়া দিচ্ছে, কেউ চুপচাপ থেকে অন্যকে সমর্থন দিচ্ছে, কেউ আবার বড়বড় রাগত দৃষ্টিতে সম্পাদকের দিকে তাকিয়ে, মনে হচ্ছে বিরূপ মন্তব্য ছিটিয়ে দিচ্ছে। মুখ ফুটে আর কেউ সম্পাদকের পক্ষে কোন কথা বলছে না। পরিস্থিতি বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হ’ল না সম্পাদক সুপ্রভাত সরর্কারের। নিরুপায়ে সেই মুখ খুলল, “আমার বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে আমার পক্ষে অধিকাংশ সদস্য নেই। আমি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে নিশ্চয়ই গাছ কাটার কথা তুলিনি। গ্রামের সুনাম যাতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই লক্ষ্যে আমি এগোতে চেয়েছিলাম। সুনাম হলে সেই সুনাম আমি একা উপভোগ করবো না। সকল গ্রামবাসীরও তা প্রাপ্য। আমার যুক্তিটা কেউ বোঝার চেষ্টা করল না। অন্য গ্রামের লোকেদের ভাল-মন্দ নিয়ে সবায়ের রাতের ঘুম যেন ছুটে গেল। এটাও ভেবে আমার খারাপ লাগছে যে, যারা সেসময় আমার মতামতে সায় দিয়েছিল, যাদের সমর্থনে আমি এ কাজে এগিয়েছিলাম তারাও আমার পক্ষে কোন কথা বলছে না। এই পরিস্থিতিতে আমার আর সম্পাদক পদ আঁকড়ে থাকার কোন মানে হয় না। আমি মিতালী সংঘের সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে এই সভা পরিত্যাগ করলাম।”
[ ছয় ]সেই যে দৌলতপুরের চড়ার ধারে ভাগাড়ে গরুটা ফেলে এসে বাড়ি গেল, দেখতে দেখতে দশ দিন পার, এসেরালি আর এদিকে আসছে না। ওর সঙ্গে আরও পাঁচজন ভাগাড়ে গেছিল ওকে সাহায্য করার জন্যে। তাদের যখন খবর দেওয়া হয়েছে তারা কাজে এসেছে। এসেরালির বাড়িটা একটু দূরে। সেই তেলিয়া গ্রামে। হাঁটা পথে তো চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়। ওদের পাড়ার হাসেম, নিয়েতকে দিঘিরপাড় বাজারে দেখা হলে বারবারই এসেরালিকে আসতে বলতে বলেছে শিবুবাবু। কিন্তু তার পাত্তা নেই। একদিন হাসেমকে চেপে ধরতে সে বলল, “তার মেয়েটাকে বলেছি, তোর বাপকে বলিস, বাবু দেখা করতে বলেছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই বলেছে। তা সে যদি না আসে আমি বা কি করি।” এবার শিবুবাবু চাপ দিয়ে বলল, “ও বাচ্চা মেয়ে। খেলে বেড়ায়। ওর কি ওসব মাথায় থাকে। তুইও হাসেম, আছিস তেমন। নিজে গিয়ে একবার বলে আসতে পারলি না। নিয়েতকে বললাম। সেও হয়তো তোর মত কাউকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে। এমন কথার বাহনকে পাঠিয়েছে, সেও ওই এসেরালির কচি মেয়েটার মত কেউ হবে। ঠিক আছে, তোরা যখন খবর দিবি না তখন আমাকেই ওর বাড়ি যেতে হবে। লোকটা কেন এতদিন হয়ে গেলে এদিকে আসছে না তা তো জানা দরকার। শরীর-টরির তো খারাপ হতে পারে? নাকি অন্য কিছু। কে জানে!”
হাসেম দেখলো বাবু ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে। প্রকাশ্যে না বললেও মনে মনে হয়তো তাদের এই কাজে হতাশ! শিবুবাবু চাষবাসে তাদের অনেক কাজ দেয়। বাগান চাষ তো বারোমাস করে। ওরাই সেইসব কাজ করে। এবার বাবুকে বিগড়ে দিলে আর কাজে নাও ডাকতে পারে। তাই আগ্রহ দেখিয়ে বলল, “বাবু, তোমাকে আর অতদূর হেঁটে এসেরালির বাড়ি যেতে হবে না। আমি আজই, এখনই বাজার থেকে ফিরে ওর বাড়ি যাচ্ছি। বিকেলে হাটে ফেরার সময় তোমার বাড়ি ঘুরে এসেরালির খবর দিয়ে তারপর নিজের কাজে যাবো। তুমি একদম চিন্তা করবে না। তুমি এত চিন্তা করছো, আর ও ব্যাটা নিশ্চিন্তে ঘরে শুয়ে আছে। এটা ও ঠিক কাজ করেনি।”
বিকেলে হাটে যাবার আগে হাসেম শিবুবাবুর বাড়িতে এসে খবর দিল, ক’দিন ভ’র এসেরালির ধুম জ্বর। দিন দুই হল জ্বরের দাপটে একটু লাগাম টেনেছে। কাজে বার হতে পারছে না। ফলে এদিকে রান্নাঘরের ভাঁড়াড়ে টান পড়েছে। এসেরালির বউ বলল, “বাবুর গরুটা ভাগাড়ে ফেলে আসার দুদিন পর থেকেই জ্বরটা কামড়ে ধরল ওকে। গরুটাকে নিয়ে দিনরাত চিন্তা করত। আসলে খুব ভালবেসে ফেলেছিল যে। ওটার মরণ ও মেনে নিতে পারছিল না।” হাসেমের কথা শুনে শিবুবাবুর মনটাও কেমন দমে গেল। জানে, এসেরালি গরু জোড়াদুটোকে ভালবাসতো। কিন্তু সে যে ওদের এতটা আপনজনের মত করে নিয়েছিল তা কোনদিন ভাবেনি। বাবুর পাশে গিন্নীমা দাঁড়িয়ে ছিল। হাসেমের কথা শুনে গিন্নীমা বলল, “গরুদের এত ভালবাসতো এসেরালি, নাঙল জোড়ার আগে ওদের একবার জাবনা খাইয়ে তবে চাষে নামাবে। বলবে, পেটে বল পেলে তবে না শরীরের তাকত দেখাতে পারবে । পেটে বল নেই আর তাদের যদি হ্যাট হ্যাট, চল্ চল্ বলো আর কঞ্চি দিয়ে কাপসাও, তারা পারবে কেন। এইজন্যেই তো ওরা এত খাটতে পারতো। আর লোকে হিংসে করতো, শিবুবাবুর গরু জোড়া রোজ যতটা জমি চষতে পারে, তার ধারেকাছে অন্য কোন বলদ জোড়া যেতে পারে না। হালের জোড়া, শিবুবাবুর হালের জোড়া। দেখার মতো জোড়া। আর সেইসঙ্গে তার হেলো, এসেরালি। দক্ষ পরিচালক না হলে আবার কর্মঠ কর্মী থেকেও কাজে আসবে না। লোকে যা বলে একদম সত্যি। হেলোকেও হতে হবে দক্ষ। শুধু চাষে নামার আগে কেন, গরু গোয়ালে ঢুকিয়ে আবার খোলভুষি দিয়ে জাবনার ব্যবস্থা করে তারপর সে হাত পা ধুয়ে ক্ষান্ত হয়। এমন পয়মন্তর হেলোও ক’টা পাওয়া যায়!” বলে একটু থেমে গিন্নীমা আবার বলল, “হাসেম, হাট থেকে তুমি বাড়ি ফেরার সময় আমাদের বাড়ি হয়ে একবার যেও? সত্যি তো, দশ দশটা দিন ও কাজে বার হতে পারেনি। রান্নার ভাঁড়ারে টান তো পড়বেই। বেচারা যেমন কষ্টে আছে, তার বাচ্চা বউরাও তো শুকিয়ে আছে গো! আমি এক পুঁটলি চাল আর কিছু সব্জি গুছিয়ে রাখছি। নিয়ে যেও। এসেরালিকে বোলো, গিন্নীমা পাঠিয়েছে। আর সুস্থ হলে আসতে বোলো।”
গিন্নীমা চাল ডাল সব্জি এসেরালির জন্যে গোছাতে ব্যস্ত। পাশেই শিবুবাবু বারান্দার চেয়ারে বসে। শিবুবাবু বলল, “জানো, ভাবছি কাল একবার সময় করে সাইকেলটা নিয়ে এসেরালির বাড়ি যাই। ওকে দেখে আসি। ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছে নাকি শুধু ওইসব টোটকা-মোটকা করে পড়ে আছে কে জানে। না হলে এতদিন তো জ্বরে ভোগার কারণ দেখছি না। জ্বর সাধারণত তিন দিন থেকে বিদেয় হয়। আর আমার জন্যে ও অসুখে পড়ল। ওর বিপদে পাশে আমাদেরই থাকা দরকার। তুমি কি বলো?” গিন্নীমা উত্তরে বলল, “সেটা ঠিক কথাই বলেছো। পাশে থাকা মানে শুধু ওর বাড়ি গিয়ে পাশে বসে ভালমন্দ কথা শুনিয়ে কর্তব্য শেষ কোরো না যেন। কিছু নগদ টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসো। পাশকরা ডাক্তার দেখাতে গেলে তো পয়সার দরকার। কাজ নেই তার পাবে কোথা থেকে। পেটের ভাত জোগাড় করতে পারছে না আবার পাশ করা ডাক্তার দেখাবে। দেখো গে, ওই টোটকাতেই হয়তো দিন পার করছে। হ্যাঁ, আর একটা কথা, যে টাকা দেবে, সেটা আবার যেন ওর দাদনের খাতার হিসেবে যোগ করে দিও না। গরিবরা তো এই করেই দেনার জালে জড়িয়ে জীবনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। জন্ম জন্ম বাবুদের পায়ের তলায় গড়াগড়ি খেতে হয়। সেই কাজটা তুমি করবে না। অবশ্য তুমি তেমন মানুষ নও। তবু বলে রাখলাম।” গিন্নীমাকে তারিফ করে শিবুবাবু বলল, “এই জন্যেই লোকে যোগ্য বাবুর যোগ্য গিন্নীমা বলে তোমাকে। তুমি তো আমার মনের কথাই কেড়ে নিয়ে বলে দিলে। ওইটাই আমি ভেবে রেখেছিলাম। তোমাকে শোনানোর আগেই তুমি আমায় শুনিয়ে দিলে। টাকা তো কত লোকের আছে। কিন্তু ক’জন সেই টাকা সঠিক কাজে লাগায় বলো তো ? সব অকাজে খরচ করে বসে। আমি যদি এসেরালির এই বিপদে ওর পাশে দাঁড়াই, ও আমাকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করবে। আমাদের কোন দরকারে-অদরকারে ও জান লড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। যে লড়াই পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। হৃদয় দিলে তবেই হৃদয়কে ছোঁয়া যায়।”
মজলিশপুরের মোড় থেকে ইট বেছানো রাস্তাটা বেশ খানিকটা এঁকে বেঁকে যাবার পর বাঁদিকে এসেরালিদের তেলিয়া গ্রামটা রেখে চলে গেছে মলং-কোদালিয়া হয়ে ইদমহল, বলাখালি ছুঁয়ে আমিড়ার দিকে চলে গেছে। আগের দিন রাত্রে কয়েক পশলা ভারি বৃষ্টিও হয়ে গেছে। মাটির উপর ইট পাতা। সাইকেল, ভ্যান, বাইক যাতায়াত করতে করতে রাস্তার ইট কোথাও ডেবে গেছে কোথাও আবার মুখ উঁচিয়ে আকাশ দেখছে। ইট আলগা হয়ে তার ফাঁকে জমে থাকা কাদা জল কখনো ফচাৎ করে ছিটকে সাইকেল তো বটে, নীচের দিকে কাপড়ে ছিটকে দেগে দিয়ে যাচ্ছে। সাইকেলের কলকব্জা কতটা আঁটোসাঁটো, তা এই রাস্তায় এলেই বোঝা যায়। কাদাজলের দোসর এখন এই সাইকেলের ঝনঝনে শব্দ। বিরক্তির আর শেষ নেই। মনে হচ্ছিল যেন, এমন জানলে এসেরালির বাড়ি আসার রায় সে দিত না। আর রাস্তার পাশে যেখানে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বট অশ্বত্থ বা বাবলাগাছ আছে, সেখানে বলার কথাই নেই! ফচাৎ ফচাৎ কাদা ছেটকানোর যেন প্রতিযোগিতা চলছে। দেখেশুনে সাবধানে না চালালে চাকা হড়কে সাইকেল আছাড়ও খেতে পারে। তবু কিচ্ছু করার নেই। যাবতীয় বিড়ম্বনাকে এড়িয়েই এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
নিয়েতই প্রথম দেখতে পায় শিবুবাবু সাইকেল টানতে টানতে তাদের পাড়ার দিকে আসছে। দৌড়ে ছুটে যায় সে, “আরে বাবু, তুমি আমাদের পাড়ায়? এসেরালির খবর নিতে? দিন সাইকেলটা আমাকে। কাদায় কাদায় তো ব্রেকের কাছে জমাট বেঁধে গেছে। গড়াবে কেমন করে। আপনি আস্তে আস্তে এগোন বাবু। আমি সাইকেলটা ধুয়ে পরিস্কার করে নিয়ে যাচ্ছি।” একটু চেঁচিয়ে বলল, “ও হাসেম, বাবু এসেছে রে আমাদের পাড়ায়। সঙ্গে করে নিয়ে যা এসেরালির বাড়ি।” শিবুবাবু এসেছে মানে তেলিয়া গ্রামে যেন ভগবানের মত কেউ এসেছে। একে একে ভীড় জমতে লাগল। জড়ো হওয়া মেয়েদের আবার উৎসাহ বেশি। একবারের জন্যে তারা বাবুকে দেখতে চায়। নিজেদের মদ্দদের কাছে বাবুর নাম শুনেছে। কিন্তু চোখে দেখেনি। এখন যখন হাতের কাছে পেয়েছে, অদেখার খামতিটা মেটাতে চায় ওরা। হাসেম, নিয়েত, খাজেবক্স সারাক্ষণ ছিল এসেরালির বাড়ি। বাবু বেরোলে সাথে সাথে তারাও চলে যায়। আসলে এই পাড়ার প্রায় সবাই জন-মজুরের কাজ করে। শিবুবাবুর মণিবীয়ানা সক্কলের মন ছুঁয়ে যায়। জন-মজুরকে শিবুবাবু কোনদিন নিছক জন-মজুর হিসেবে দেখে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার করে। তাই সকলের কাছে এত প্রিয়।
ফেরার সময় শিবুবাবুকে আবার ওই কাদামাটির রাস্তার উপর দিয়ে যেতে হবে। মেন রাস্তাটা ইট বেছানো হলে কি হবে, ওদের তেলে গ্রামের ভেতরের রাস্তায় এখনো তা হয়নি। ফলে একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা কাদাজলে একাকার। বাবুর কষ্ট হবে। তাই হাসেম বলল, “বাবু চলুন, আমি আপনার সাইকেলটা টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের গ্রামের রাস্তাটা আপনাকে সঙ্গ দিয়ে পার করে দিই। আপনি খালি হাতে চলুন। কাদায় সাইকেল টানতে টানতে আপনার হাত পা ব্যথা হয়ে যাবে।” এদের এই আতিথেয়তায় শিবুবাবু যারপরনাই অভিভূত! এরা টাকাপয়সায় গরিব হলে কি হবে, এদের মত ধনী অন্তর, পয়সায় বড়লোকদের মধ্যে মেলা ভার। গল্প করতে করতে শিবুবাবু বলছিল, “জানিস হাসেম, বলদ জোড়ার একটা তো চলে গেল। মনে হচ্ছে ওর ওই চলে যাওয়াটা আমার ভবিষ্যৎ জীবন চলনের গতি প্রকৃতিও এদিক ওদিক হতে চলছে। ইদানিং শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এসেরালিকে বলেছিলাম আগেরটার মত আর একটা বলদের খোঁজ কর। কিন্তু সেও তো খোঁজ দিতে পারছে না। আসলে কি জানিস, ঠিক ঠিক অমন জোড়া পাওয়া মুশকিল। তাই ভাবছি আর হালের জোড়া নতুন করে বাঁধবো না। চাষবাস আমি এবার ছেড়ে দেবো। ডাক্তার বারবার পরামর্শ দিচ্ছে চেঞ্জে যাবার জন্যে। আবহাওয়া পরিবর্তন করতে। অন্তত কয়েক মাস। তবে যদি নড়বড়ে হতে থাকা শরীরটা শক্তপোক্ত হয়। এদিকে তোর গিন্নীমা ডাক্তারের নিদেনের কথা ছেলের কানে শুনিয়ে দিতেই ব্যাস। শিলং থেকে ছেলে চাপ দিচ্ছে ওখানে চলে আসার জন্যে। বাপ-ছেলের এই ঝুল পেটাপেটি চলছে অনেক দিন থেকে। এখানে এইসব কর্মযজ্ঞ ছেড়ে যাই বা কেমন করে। তাই আমি ছেলের কথায় ঘাড় পাতছিলাম না। শৈল শহর শিলংয়ের ডি.এম. তোদের দাদাবাবু। বড় বাংলো। অনেক ঘরবাড়ি। থাকার কোন অসুবিধা নেই। মনোরম পরিবেশ। স্বাস্থ্যদ্ধারের একদম উপযুক্ত স্থান। তাই ভাবছি এবার হয়তো ছেলের কথায় সায় দিতে হবে। চিন্তা করছি কালো গরুটা এসেরালিকে দিয়ে দেবো। ওর হাতে গড়া গরু। ওই ভালভাবে পালতে পারবে। আর চাষবাস সব আমার মেজো আর ছোট ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দেবো। ওরাই ওগুলো দেখাশোনা করবে। সার ওষুধের যা আকাশছোঁয়া দাম হয়ে গেছে, চাষে আজকাল তেমন লাভের মুখ দেখা যায় না। লোকের মজুরী আর অন্য যাবতীয় খরচ সামলে সামান্য কিছু পড়ে থাকে। তা থেকে ভাইরা যা দেবে মেনে নিতে হবে। তবে হ্যাঁ, এসেরালির একটা ব্যবস্থা করে যাব ভেবেছি। আমার দক্ষিণ মাঠের ওই দশবিঘের বন্দের মধ্যে দু’বিঘে জমি এসেরালিকে চাষ করতে দেব। চাষবাস করে যা পারবে আমাকে দেবে’খন। চাপাচাপি করব না।”
এবার হাসেম কথাটা তুলল, “বাবু, তুমি ওকে দু’বিঘে জমি চাষ করতে দেবে, তা আগাম চাষ না ভাগ চাষ।” বাবু বলল, “আরে বোকা, আগাম বা ভাগচাষ, ওসব কিছুই না। ওর সংসারটা বাঁচানোর জন্যে যা হোক সম্বচ্ছর ধান, মুগ, খেসারি কড়াই বা এটাসেটা চাষ করবে। আর এদিক সেদিক জন-মজুর খেটে নগদ পয়সাটা পেলে ওর চলে যাবে। মেজোবাবু, ছোটবাবুকে অবশ্য বলব, এসেরালি এবং তোদেরও যাতে দরকার পড়লেই কাজে ডাকে। তুই তো এমনিতেই ছোটবাবুর কাছে কাজ করিস। আমার জমিজমা চাষের জন্যেও তোদের কথা বলব’খন।”
হাসেম কিন্তু টিপ রেখে দাঁড়িয়ে আছে ওর প্রশ্নের উপর, “বাবু তুমি যাই বলো, তুমি তো আশা করছো এসেরালি যা পারবে কিছু কিছু চাষের লাভের অংশ তোমাকে দেবে। তার মানে তো ও তোমার ভাগচাষী হয়ে গেল। এবার ও যদি তোমার ওই দু’বিঘের বর্গা রেকর্ড করে নেয়? তখন তো তোমার জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে। ও জমি তুমি আর ফেরত পাবে না। এসেরালির হয়ে যাবে। না, তাই বলে ভাববে না, তুমি এসেরালিকে জমি দেবে বলছো বলে আমি ভাঙচি দিচ্ছি। সমাজে যা ঘটছে, তাই দেখেশুনে বলছি আরকি। অন্যসব বাবুদের কত জমি এইভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল! সেইজন্যে এখন সম্বচ্ছর আগো জমি পড়ে থাকবে- তবু আচ্ছা। কিন্তু ভাগচাষ বাবুরা আর কেউ দিতে চাচ্ছে না। এতে হল কি জানো বাবু, আমাদের মত গরিব চাষি-মজুরদের পেটে লাথি মারা হল।”
শিবুবাবু একটু চিন্তা করে বলল, “তুই যে কথাটা বলছিস তা একদম বাজে কথা তা তো নয়। আকছার এই ঘটনাটা ঘটছে। তাতে কি হচ্ছে বলতো, তোরা তো চাষের জমি না পেয়ে মরছিস, সেইসঙ্গে যারা পেয়ে বর্গা রেকর্ড করেছে তারাও কি ভাল আছে? বরাবরের জন্যে সেই জমি তারা ধরে রাখতে পারছে? পারছে না। ওই দেখ না, দিঘিরপাড়ের দিকে যেতে ডানদিকের জমিগুলো। সরকার থেকে চাষের জন্যে গরিব লোকগুলোকে পাট্টা দিল। কিছুদিন তারা চাষ করল। কিন্তু এখন দেখ, একটা জমি সেই লোকগুলো ধরে রাখতে পেরেছে? অভাবের তাড়নায় এক এক করে সব্বাই অন্য লোককে বিক্রি করে দিল! আসল লোক এখন একটাও নেই! আমারও তো উলকুনীর দশবিঘে জমি বর্গা হয়ে গেল। আমি তার কিচ্ছু পাই না। কিন্তু যারা বর্গা রেকর্ড করল, সেই জমি তাদের কারোর হাতে নেই। দু’বার এমনকি তিনবারও হাত ফিরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে সেই জমি। তাই শুধু জমি বর্গা করে দখল-অধিকারে নিলে হবে না, সেই অধিকার ধরে রাখার ক্ষমতা রাখতে হবে। চাষবাসের যা খরচ এখন ওই দু’বেলা দু’মুঠো মজুর খেটে আনা মানুষগুলো সেই চাষের খরচ সামলাবে কেমন করে। তাই তারা অভাবে দখল হাত ফেরি করছে। কিন্তু সেই জমির আসল দলিল প্রকৃত মালিকের হাতে। সেই অধিকার বর্গারা কোনদিন পাবে না। সরকার পাল্টাবে, পরিস্থিতি পাল্টাবে এবং একটা সময় আসবে, সেই জমি আসল মালিকের হাতে চলে আসবে। এই বর্গা-টর্গা সরকারের রাজনৈতিক চমক ছাড়া আর কিছু নয়। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যে কিছুদিন এই চমক কাজ দেবে। তারপর সেই চমকের ফানুস ফটাস করে ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই দেখ না, সিঙ্গুরে কি হ’ল। টাটার কারখানার জন্যে সরকার জমি নিল। ক্ষতিপূরণ কারা পেল? জমির আসল দলিল যাদের হাতে, সেই মালিক পেল। আর ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত ভাগচাষিরা রেকর্ড করা বর্গা দলিল নিয়ে নাচানাচি করে গেল। লবডঙ্কা পেল তারা। বরং ওসব না করে বাবুদের সঙ্গে সৎ আচরণ করলে আখেরে চাষিদেরও লাভ। তাদের কোনদিন পেটের ভাতের অভাব হবে না।”
দু’একদিন ছাড়াই শিবুবাবু হাসেম বা নিয়েত অথবা ওদের গ্রামের যার সঙ্গে দেখা হয়, এসেরালির শরীরের খোঁজ নেয়। সবাই একই কথা বলে, জ্বর ছাড়ান দিচ্ছে না ওর। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা হাসেম হন্তদন্ত হয়ে শিবুবাবুকে ডাকাডাকি শুরু করে, “বাবু এসেরালির শরীর একদম ভাল না। ভোর রাত থেকে খিঁচ শুরু হয়ে গেছে। ওকে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার বলল, এক্ষুণি ওর পা অপারেশন করতে হবে। গোড়ালির উপর থেকে পা কেটে বাদ দিতে হবে। গ্যাংরিণ হয়ে গেছে। পচন শুরু হয়ে গেছে ওর পায়ে। কবে মাঠে কাজ করতে গিয়ে পেরেক মেরেক ফুটেছিল। সেটা নাকি বার হয়নি। সেই থেকে পচন শুরু। এখন কি হবে বাবু?” শিবুবাবু সঙ্গে সঙ্গে শিলংয়ে ছেলের কাছে ফোন করে পিজির সুপারকে বলতে বলল, যাতে ওকে পিজিতে ভর্তি করানো যায়। ছেলে সব ব্যবস্থা করে পাল্টা ফোন করে পিজিতে রোগীকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে বলল। শিবুবাবু নগদ হাজার পাঁচেক টাকা হাসেমের হাতে দিয়ে বলল, “যা, এক্ষুণি অ্যাম্বুলেন্সে পিজির এমার্জিন্সিতে নিয়ে যা। ওখানে ডাক্তার পল্লব পাল বলে একজন ডাক্তারবাবু থাকবে। তাকে আমার ছেলের নাম বললেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পল্লব ডাক্তার তোর দাদাবাবুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছে। ও ডাক্তার হয়েছে। আর তোর দাদাবাবু আই.এ.এস অফিসার। যা, একদম দেরি করিস না।”
শিবুবাবুর ভোরের আরাম-ঘুম ছুটে গেল। মুখটুখ ধুয়ে গিন্নিকে বলল চা বানিয়ে আনতে। দু’লোকে ডাইনিং টেবিলে চা খেতে খেতে এসেরালিকে নিয়ে আলোচনা করছিল। বাবু বলল, “হাসেম কি বলতে কি বলছে বুঝতে পারছি না, খিঁচুনি যদি ধরে যায় তো ও রোগীকে ফেরানো মুশকিল। ধনুষ্টঙ্কার রোগীর বেঁচে ফেরা মনে হয় সম্ভব নয়। পিজি বড় হাসপাতাল। যদি ওদের কেরামতিতে এসেরালি প্রাণ ফিরে পায়। তবে মনে হয় না। এই মনে একটু সান্ত্বনা যে ভাল জায়গায় চিকিৎসা করেও বাঁচানো গেল না। দেখো, ওদের পরিবারের কাছে আমরা ঋণী হয়ে গেলাম। আমার জমিতে চাষের কাজ করতে গিয়েই তো ওর পায়ে জংধরা পেরেক গেঁথে গেছিল। আর ওটা এমন হ্যাঁকাতে, পাত্তাই দিল না সেটাকে। হয়তো বাবলা কাঁটা-মাটা ফুটেছে ভেবে অবজ্ঞা করেছে। তখনই সাবধান হলে, প্রণব ডাক্তারের কাছে গিয়ে সেটা পা থেকে বার করে দিলে এই বিপদে পড়তে হত না। এখন তো ওর সংসারটা ভেসে যাবে। আমার আর কি করার আছে। বড়জোর ভাইদের বলে ওর বোয়ের জন্যে চাষের জমিতে বা ডাঙায় যতটা বেশি পারা যায় মজুরের কাজের ব্যবস্থা করতে পারি। আর যে দু’বিঘে জমি এসেরালিকে চাষ করার জন্যে দেবো বলেছি সেটা যদি ওর বউ করে, করবে। এমনিতে তো ওর বউ জমিতে ঘাষ নিড়ানের কাজ করে। চাষের কাজে অভ্যস্ত সে। এবার তার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল আর কি।” -
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২)
( সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ তিন ]
শিবুবাবুর বাড়ির লোকের ইচ্ছে ছিল না এতদিনের মায়ার বাঁধনে বাঁধাপড়া মৃত সাদা গরুটাকে ভাগাড়ের ফাঁকা ময়দানে ফেলে দেওয়ার। ওখানে ফেলা মানেই তো কুকুর-শেয়াল-শকুনে তাদের আদরের পোষ্যর নিথর শরীরটাকে ছিঁড়েকুটে বরবাদ করবে। আর ওপথে ওরা কেউ গেলে তা চোখ পেড়ে দেখতে হবে। অযথা মনের মধ্যে থিতু হতে থাকা কষ্ট চাগাড় দিয়ে উঠবে। এসেরালিও এই নিয়ে দ্বিধায় ছিল সবসময়। বাড়ির মানুষরা যেন তার মনের কথা খোলসা করে বলে ফেলল। তবু মুখ ফুটে সে কথা সে বলতে চাইল না। যেহেতু সে এসেরালি, তাই তার মতামত কে কেমনভাবে নেবে তা তো তার জানা নেই। এ সব মণিবদের পরিবারের আপন আপন মতামতের ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে ও তো এই বাড়ির কাজের মানুষ। আগ বাড়িয়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধন্তের ভেতর তার ঢোকা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শিবুবাবু মত দিল, “নারে এসেরালি, আমার বাড়ির লোকের সাথে আমার মত মিলছে না। তুই মুখফুটে এ ব্যাপারে তোর কোন মতামত জানাতে চাইচ্ছিস না ঠিকই তবে আমি জানি, আমার সিদ্ধান্ত তোরও মনঃপুত হবে না। আমি তো জানি, তুই তোর চাষের সঙ্গীদের কতটা ভালবাসিস। সেই ভালবাসার টানে তুইও মনমরা। তবু বলি, ওটাকে আমাদের ভাগাড়ের মাঠেই রেখে দিয়ে আয়। গ্রামের সবাই তো তাই করে। প্রত্যেকেরই তো আদরের পোষ্য একদিন না একদিন মারা যায়। কেউই এই প্রথার দ্বিমত করে না। এই তো দিনকুড়ি আগে দাস পাড়ার তপনদের গাভীটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। ওই হাতুড়ে পশু-ডাক্তারটার জন্যেই জলজ্যান্ত টগবগে গরুটাকে চলে যেতে হ’ল। আরে বাবা, মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চাটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই যখন তখন তুই কেসটা ধরে রাখলি কেন? কাছেই তো, ব্লক অফিসে পাশ করা সরকারি ডাক্তার ছিল। তাদের কাজই তো এইসব দেখাশোনা করা। দরকারে তারা গঞ্জের পশু হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে পারতো। সেখানে এই আপাতকালীন অবস্থা মোকাবিলা করার জন্যে যাবতীয় পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি সব আছে। তা পরিস্থিতি যে তোর বিদ্যের বাইরে সেটা কবুল করে দিলেই হত! আর তপনদের বলি, ওই আনকোরা স্বঘোষিত কোয়াক পশু-ডাক্তারের ভরসায় থাকা ওর একদম সঠিক কাজ হয়নি। মধ্যিখান থেকে বেচারা পোষ্যটার প্রাণ গেল। তপনদের বাড়ির মেয়েদের কি তীব্র আফসোস! বিশেষ করে তপনের ওই বারো বছরের মেয়েটা। গরুটাকে প্রায় কোলেপিঠে করে বড় করেছে সে। মেয়েটার ছটফটানি দেখে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছিল। তা তারাই যখন সেই আদরের পশুটাকে ভাগাড়ে দিয়ে আসতে পারে তো আমাদের প্রিয় বলদটাকে ওখানে দিয়ে আসতে অসুবিধা কোথায়।
এসেরালি, বাবুর কথার উপর আর কথা বলার চেষ্টা করেনি। ও জানে বাবু যে সিদ্ধান্তটা একবার নেয় তা সহজে ফেরায় না। তবে যুক্তি দিয়ে যদি বাবুকে বোঝানো যায় তখন সে অবুঝ হয় না। বাবুর সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে। না হলে বাড়ির লোক বলার পরেও তাদের উড়িয়ে দিত না। তবু গিন্নীমা স্বামীকে বলেছিল, “তোমার কি মায়া-দয়া, মন বলে কিছু নেই? যে পশুটা এতদিন তোমাদের সংসারের জন্যে জান কবুল করে লড়ে গেল, তাকে এইভাবে বেওয়ারিশের মত ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসবে? হতে পারে সে পশু। এতদিন তো সংসারের একজন হয়ে সে ছিল। যখন সে গতর দিচ্ছিল তখন তোমার কাছে তার মত ভাল আর কেউ ছিল না। যেই তার সব শেষ হয়ে গেল, তার কাছ থেকে পাবার আর কিছু নেই, তখন তাকে এক কথায় ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাবতে চাইলে না! তাহলে অন্যদের সঙ্গে তোমার আর তফাৎ কি রইল? এদিকে তো কথায় কথায় নিজেকে সমাজের একজন গণ্যমান্য বলে জাহির করো। লোক মান্য করে বলে তুমি তাই ভাবো। তাতে আমার কিছু বলার নেই। তবে তোমার এই সিদ্ধান্ত আমরা মন থেকে একদম মানতে পারছি না।”
নিজের বউয়ের কাছে একপ্রকার ধমকই খেল শিবুবাবু। বাবুর চোখমুখ সঙ্গে সঙ্গে থমথমে হয়ে গেল। চোখ লাল! রেগে গেলে বাবু এমনটা হয়ে যায়। সেটা এসেরালি অভিজ্ঞতা থেকে জানে। এবার বাবুর দিক থেকে আগুনের গোলা না ছোটে। সেই আশঙ্কায় এসেরালি সন্ত্রস্ত হয়ে একধারে অপেক্ষায় রইল, সময় ব্যয় না করে বাবুর কড়া আদেশ তালিমের জন্যে। রাগী বাবু এখন যা করতে বলবে, কারোর কথা না শুনে সে তাই করতে প্রস্তুত! কিন্তু না! সে পথে তার বাবু, শিবুবাবু এবার হাঁটল না। আসলে শিবুবাবু বুঝেছিল, গরুটা মারা যাওয়ায় সে যেমন দুঃখ পেয়েছে, বাড়ির আর সবাইও একই রকম মনঃকষ্টে আছে। মায় এসেরালিও। তাই এখন ইটের বদলে পাটকেল মারার সময় নয়। মানুষের মন পেতে গেলে মন দিয়ে তা জয় করতে হবে। বাবু তাই শান্তভাবে গিন্নীমা সহ বাড়ির সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “প্রবাদটা আমরা সবাই জানি, জ্যান্ত হাতির দাম যেমন লাখ টাকা, তেমনই মরা হাতির দামও তাই। জীবন্ত হাতি যেমন আমাদের কাছে বহুমূল্যবান, তেমন মৃত হাতিও। গরু হাতির থেকে চেহারায় ছোট বলে কিন্তু ওদের ছোট চোখে দেখার উপায় নেই। ওরা ওই হাতির মতই জীবন্ত এবং মৃত, মানুষের কাছে সমান মূল্যবান। এ ব্যাপারটা সাধারণ ভাবে আমরা তলিয়ে দেখিনা তাই তার প্রকৃত মূল্যায়ন আমাদের কাছে নেই। গরুকে মায়ার মোড়কে জড়িয়ে আমরা কবর বা মাটি চাপা দিয়ে তার অন্তিম কাজ সমাধা করে দিতেই পারি। এটা তো অতি সরল ঐকিক নিয়মের অঙ্কের হিসেব হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের স্মৃতি থেকে কখন যেন হারিয়ে যাবে। একটা সময় তার অস্তিত্বের কথা বেমালুম চাপা পড়ে যাবে। আমরা আমাদের নিকটাত্মীয়ের কথা মনে রাখি না তো একটা পোষ্য। আমি যে কথগুলো নিছক কথার-কথা বলছি না, তা একটু ভেবে দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে। আর যদি ওই গরুটাকে আমরা ভাগাড়ে ফেলে দিই, মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা বড় রূঢ়। কিন্তু ওই গরুটা ভাগাড়ে ফেললে প্রথমেই ছুটে আসবে আমাদের সমাজের আমাদেরই মত একদল মানুষ। ওই যে দেখোনা, পাশের গ্রাম, বয়ারিয়ার রুইদাসরা। ভাগাড়ে মরা গরু-ছাগল পড়ার সংবাদ যদি একবার ওদের কানে চলে যায় তো রক্ষে নেই। হামলে পড়বে ওই মরা গরুটার উপর! এর মানেটা কি? ওরা কিন্তু ওই মরা গরুর মাংস শকুনের মত ছেঁড়াছেঁড়ি বা ভাগাভাগি করে নেবার জন্যে আসে না। ওরা ওই গরুটার চামড়া নিতে আসে। আর এই চামড়া নিয়ে তারা তাদের জীবিকার কিছুটা উপায় খুঁজে পায়। চামড়া বিভিন্ন পদ্ধতিতে শোধন করে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে ওরা। ঘুরিয়ে সেই আমাদের গরুর চামড়া কিন্তু আমরা ব্যবহার করি। আমরা যে চামড়ার জুতো, বা চামড়ার ব্যাগ বা অন্য কোন ব্যবহারের উপযোগী জিনিস আমাদের দৈনন্দিন কাজে লাগাই তার কিছুটা তো আমাদের এই গরুর চামড়া থেকে হবে। এই রুইদাস বা মুচি-চর্মকারদের হাত ধরেই তো সেটা আমাদের কাছে আসে। তাহলে তোমরা একবার বোঝার চেষ্টা করো যে, আমাদের গরু মরার পরেও আমাদের কত কাজে লাগে। আমরা উপকৃত হচ্ছি এর দ্বারা। শুধু আমরা নই, ওই মুচিরাও এদের চামড়ার নানান দ্রব্য তৈরী করে পেটের ভাত জোগাড় করছে। বেঁচে বর্তে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে এসেরালির চোখের সামনে ভেসে উঠল, ভাগাড়ে গরু পড়লে তার আশেপাশের আকাশের মাথায় বড় বড় শকুনের চক্কর মারা দৃশ্য, “শুধু আমরা একাই ফায়দা নিচ্ছি না কিন্তু বাবু। আমাদের মত জান-প্রাণ নিয়ে টিকে থাকা আর এক প্রাণীজাতীও উপকৃত হচ্ছে। ওই যে গো বাবু, শকুনদের কথা বলছি।”
শকুনের কথা কানে আসতেই এসেরালিকে থামিয়ে দিয়ে শিবুবাবু বলল, “তোর কথা তো চাঁদ-সূর্যর মত সত্যি কথা রে এসেরালি। ওই শকুনরা কোথায় থাকে কে জানে। ভাগাড়ে একবার গরু পড়লে দূরদূরান্ত থেকে ঠিক তাদের নজরে পড়ে যায়। আসলে কি জানিস, পেটের জ্বালা তো সবার। তোর আমার মুচিদের যেমন, তেমন শকুনদেরও। ওরা প্রাণীকুলের মরা মাংস খেয়েই বেঁচে থাকে বলা যায়। মরা মাংস ওদের ভীষণ প্রিয়। তাই পেটের দায়ে ওরা এখানে ছুটে আসে। এমনিতে কথায় বলে না, “শকুনের লক্ষ্য ভাগাড়ের দিকে।”
কোন এলাকায় কোথায় ভাগাড় আছে তা ওদের নখদর্পনে। সেই দূর আকাশ থেকে ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেইসব ভাগাড় অঞ্চলের দিকে। তা আমাদের গরুকে যদি আমরা মাটিতে গোর দিয়ে দিই এরাও বা প্রাণ ধরে রাখে কেমন করে। পরিবেশে প্রাণ ধারণের অধিকার সবার আছে রে এসেরালি। সৃষ্টিকর্তা সবকিছুর ব্যবস্থা করেই জীব সৃষ্টি করেছে। তার জন্যে সৃষ্টিকর্তাই খাদ্যশৃঙ্খলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু কি জানিস এসেরালি, দিন যত এগোচ্ছে মানুষ যত আধুনিক সভ্যতার দিকে পা বাড়াচ্ছে। একটা অশনি সংকেত কিন্তু আমাদের সামনে এসে উঁকি মারছে। হয়তো আমাদের এই চলতি জীবন- ছন্দ আমরা আর ধরে রাখতে পারব না। চাষবাষের ক্ষেত্রে যেভাবে আধুনিক মেশিনপত্র বাজারে এসে পড়ছে, বেশি দূরে নয় সেই দিন, যে দিন ওই মেশিনই চাষ আবাদের সব কাজ করে দেবে। অবলুপ্তির আর সেই দিন বেশি বাকি নেই যেদিন মানুষের নিজ হাতে করা এখনকার এই নাঙল-জোল-গরু দিয়ে মাটি চষা, ধান বোনা, ধান কাটা, ঝাড়া। সব-সব সবকিছুই মেশিন করে দেবে। এতে হবে কি বল তো এসেরালি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই গৃহপালিত পশুরাও একটা দিন অবলুপ্তির তালিকায় স্থান করে নেবে। ওদের সাথে সাথে মানুষও অস্তিত্বর সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। যদি তাড়াতাড়ি চলে যাই তাহলে হয়তো আমি তা দেখে যেত পারবো না। আমার আর ক’দিন। দেখতে দেখতে ষাট তো টপকে দিলাম। কিন্তু তোদের কি হবে! বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো সেই হাহাকারের মুখোমুখি হতে বাধ্য। আমাদের দেশে চাষ-আবাদ করার জন্য বলদ গরু আর হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। একধামা চালে একটা কুরুই খুঁজে পাবার মত ধুঁড়ে, মানে সন্ধানে বেড়াতে হবে ওই বলদ জোড়ার জন্যে। যে দু’চার গাছা থাকবে তাদের ডাক অবশ্য আকাশছোঁয়া হবে, এটা ঠিক। তাছাড়া যত এ্যঁড়া বাছুর হবে, সব বড় হবে মাংস জোগান দেবার জন্যে। বগনা বাছুর বা গাভীরা অবশ্য আদরে বেঁচে বর্তে থাকবে, তারা দুধ দেয় বলে। এতে হবে কি বলতো এসেরালি, তোদের মত হেলো বা অন্য চাষীরা আর তেমন কাজ পাবে না। হেলোরা তো সত্যি সত্যি হারিয়েই যাবে। এসেরালি হেলো, জব্বর হেলো বলে এখন তোর যে কদর তা আর থাকবে না। আমার সামনের দৃষ্টি সেই কথারই আভাষ দেয়। তবে এসেরালি এখনই তোর ভেঙে পড়ার দরকার নেই। তুই আর একটা তাগড়াই বলদের খোঁজ কর। সে যেন আমাদের কালোটার সঙ্গে জোঝার ক্ষমতা রাখে। আমি যদ্দিন আছি তোর কাজ হারাবার ভয় নেই। আমি বেঁচে থাকতে আমার হালের কাঁড়া আমি নষ্ট করব না। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমার বংশধররা যদি তা ধরে রাখতে না পারে তো যা হবার তাই হবে।”যে কথা বলতে বলতে শিবুবাবু অন্য টানে ফিরে গেছিল, সেখান থেকে ফিরে এসে বলল, “হ্যাঁ কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। বলছিলাম কি শুধু শকুনরা যে ভাগাড়ের মাংস খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকে তা তো নয়, রাতের বেলা হুক্কা হু ডাকে সদলবলে শেয়ালেরা যেভাবে এখানে আনন্দের আসর বসায় তা তো হেলাফেলার ব্যাপার নয়। শেয়ালেরা এখানে নিজেদের খাবার অনেকটা পেয়ে যায় বলেই না আমাদের বাড়ির হাঁস মুরগি ছাগলরা ওদের লালসার হাত থেকে রেহাই পায়। রেহাই একদম পায় তা বলা যাবে না। ওই হেংলা জাতটা সুযোগ পেলেই তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না। তবু ভাগাড় না থাকলে ওদের অত্যাচারে পাড়ার চোখে ঘুম ছুটে যেত। জানিস এসেরালি, এবার সেই ঘুম ছুটে যাবার দিন আগুয়ান। সমাজে গরু না থাকলে ভাগাড়ও যে কান্নায় ভাসাবে। তার সাথে সাথে পরিবেশের যে খাদ্যশৃঙ্খল সেখানেও জবরদস্ত হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে যাবে। পরিবেশের জন্যে মহামূল্যবান এই শকুন বলে প্রাণীটাই পৃথিবীতে লুপ্তপ্রায় জাতি বনে না যায়।”
বাবুর কথায় এসেরালি বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। প্রাণীরা তো যাবে। সমাজ থেকে বলদ বিলীন হয়ে গেলে তাদেরই বা কি হবে। তাদের মত হেলো শ্রেণীটারও কি সমাধি ঘটবে? তাহলে সে খাবে কি! সংসার নিয়ে ছোট ছোট ছেলেপুলেদের পেটে চার-ছ’টা দানা বা জোগাবে কেমন করে! এই বয়সে চাষের কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজ তার জানা নেই। নতুন করে কাজ শেখার সেই সুযোগই বা কে দেবে?[ চার ]
পরেশ রুইদাস নিজের জীবিকার হাতিয়ার, কোমরে থাকা গরু-ছাগলের চামড়া কাটা ছুরি দিয়েই খুন করেছিল রাধাকান্ত ঋষিদাসকে। ওদের রুইদাস পাড়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোন খুনের ঘটনা ঘটল। সেটা মেয়ে-মদ্দ সমেত পাড়ার কেউই মেনে নিতে পারেনি। তার থেকেও বড় কথা তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার সেই ‘গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো’ ছুরি দিয়ে মানুষ কাটা! তাদের সমাজ এই ছুরি বাবা বিশ্বকর্মার কাছে সমর্পণ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। ভগবানের কাছে এই ছুরি পূজিত। তা দিয়ে কেউ কোনভাবে কোন অপরাধমূলক কাজ করতে পারে না।
মতামতটা এককভাবে প্রকাশ্যে কেউ তুলছে না। অথচ পাড়া প্রতিবেশীর মুখে মুখে চাউর হয়ে চলেছে। পাড়ার মাতব্বর, রতন-নন্দদের কানেও সেটা চলে যায়। রতনের বউয়ের কাছ থেকে রতন প্রথম শোনে। নন্দর কাছে কথাটা পাড়তে সে রতনকে বলে, “হ্যাঁ রে রতন, আটচালার কাছ দিয়ে আসার সময় আমি ব্যাপারটা শুনতে পাই। একদল বউ আটচালায় বসে এইসব কথা নিয়ে গুলতানি করছিল। তা ওরা যা বলছে, খুব একটা আজেবাজে কিছু বলছেনা রে। ঠিকই তো, যে হাতিয়ার ঠাকুরের কাছে সঁপে পুজো দিয়ে আমরা মানত করি। ঠাকুর যেন চিরকাল এই হাতিয়ার সচল রাখে। তাহলে আমরা বেঁচেবর্তে থাকতে পারি। সেটার অপব্যবহার করা একদম ঠিক কাজ না। পরেশ যে অন্যায় কাজ করেছে তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। এমনিতে দেশের আইনের দিক থেকে সে অপরাধী গণ্য হওয়ায় তার জেল-জরিমানা হয়েছে। সে তো একটা দিক। আর একটা অন্যায় করেছে, অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার না করে পরেশ অহরহ আমাদের ট্যাঁকে রাখা জীবিকা রক্ষার অস্ত্র অপব্যবহার করেছে। আটচালায় আমাদের বসতে হবে রতন। এই অপব্যবহার আটকাতে পাড়াকে একটা আদেশ শোনাতে হবে। না হলে অন্য কেউ আবার এই অন্যায় করে বসতে পারে।”
নন্দর কথা পুরোপুরি সমর্থন করল রতন। তারপর ও মনে মনে ভাবতে লাগল, পরেশ রুইদাস মানুষটা কিন্তু কোনদিন খুন-খারাপি করার মত হ্যাঁকাতে মানুষ ছিল না। মানুষের সঙ্গে কোনদিন মুখ তুলে চেঁচামেচি বা ঝগড়া করতে তাকে কেউ দেখেনি। বরং উল্টে হেসে-খেলে সকলের সাথে ভাব-ভালবাসা রেখে চলে। তাই খুনে-পরেশের পরিবারকে যখন গ্রাম ছাড়ার নিদেন আটচালা থেকে দেওয়া হ’ল, তার পরের দিনই পরেশের বউ বলেছিল, রতনকেই হাত ধরে বলেছিল, “ঠাকুরপো, তোমরা শুধু ওর খুন করাটা দেখলে। আমি তো বলছি না ও কাজটা ঠিক করেছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া ওর ঠিক কাজ হয়নি। কিন্তু ও কি কোনদিন এরকম বেয়াড়া চরিত্রের মানুষ ছিল। তোমরা তো ওর সঙ্গে মেলামেশা করতে। জ্বালাধরা বুক নিয়ে ভুলবশত একটা বাজে কাজ সে করে ফেলেছে। কিন্তু কেন করেছে সেটা কেউ একবার তলিয়ে দেখল না, শালিশিতে আমি কতবার সেই কথাটা বলতে চেয়েছি। কিন্তু সকলের তার ওপর এত রাগ যে তার হয়ে বলা কোন কথা কেউ কানে তুলতে চাইল না। তুমি বুঝদার মানুষ হিসেবে আলাদা করে তোমাকেও বোঝাতে চাইলাম। ওদের চাপে তুমিও আমার দিকে নজর দিয়েও মুখ ঘুরিয়ে নিলে। জানো ওইসময় সাতদিন আমাদের সংসারে কারোর পেটে চালের দানাও পড়েনি। এবারের বর্ষায় জমিজিরেত বৃষ্টির জমা জলে সব পচে হেজে গেছে। সে তো সকলের গেছে। চাষ না হলে আর খোরোয় ধান তোলা, ধান ঝাড়ার কাজ হবে কি করে। সেটা তোমরাও দেখতে পাচ্ছো। বলতে গেলে কারোরই মাঠের কাজ নেই। নগদ পয়সার টান। শীতের ‘তাইচুন’ চাষ শুরু হলে তবে কাজ পাওয়া যাবে। আর খেঁজুর গাছ কাটা সবে শুরু হয়েছে। যে দু’চারটে পয়সা হাতে আসছে তা দেনার গব্বে ঢুকে যাচ্ছে। চাষ বেয়নে লোকের হাতেও পয়সার টান। বেত কাঁধে চড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঢুঁ মারতে মারতে কাহিল। তবু কেউ আর কাজ করায় না। দু’বছরের ছেলে লোচন যখন ‘কি খাবো কি খাবো বলে’ আমার কাছে চেল্লায় তখন তার বাপের মাথা গরম হয়ে ওঠে। এমন এক ধমক দেয় ছেলেকে। সে তো চমকে উঠে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলে। গাল ফুলে ফোঁপাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে কোলের বাচ্চাটাকে সামলাতে আমি আমার শুকনো বুক দুটো পাল্টাপাল্টি ওর মুখে গুঁজে ধরে থাকি। কিছুক্ষণের জন্যে চুপ মেরে যায় বাচ্চাটা। অপদার্থ মা আমিও চোখের জল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেই দেখে আর বাড়িতে থির থাকতে পারে না বাপটা। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে। সন্ধ্যের আগে কাঁধে বেত আর হাতে বাটালি নিয়ে খালি হাতে ফিরে হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে মাখা নীচু করে দাওয়ায় বসে থাকে। আমি মেয়েমানুষ আর কি করি। লোকের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা ভাতের ফ্যান ওনার জন্যে একটু রেখে দিই। শরীরের ধকল থিতিয়ে গায়ের ঘামটা মিলিয়ে গেলে বলি, “এই ফ্যানটুকু চুঁচে খেয়ে নাও। আজও রান্নাবান্না কিছু হয়নি। কচু শাকের ঘ্যাঁট আর কাঠখোলা কলমি শাকের ভাজা আছে। চান সেরে এসে খেয়ে নেবে।”
খুনে-পরেশের বোয়ের কথা শুনতে শুনতে রতন একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ভাবছিল, পরেশটা তখন খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। সত্যি তো, এটা তো সে দেখেছে রান্না চড়াবার আগেই রান্নাঘরে তার বউয়ের হাতে পরেশের বউ একটা ডেকচি ধরিয়ে দিয়ে বলছে, “তোমাদের ভাতের ফ্যান ঝাড়া হয়ে গেলে তা এই ডেকচিতে ঢেলে রান্নাঘরের দরজার একপাশে রেখে দিও। সময়মত এসে আমি নিয়ে যাবো।” বউটা তখন তারপর কি বলে চলেছে তার আওয়াজ কানে ঢুকলেও, কি বলছে তা ভেতরে যেন সেঁধাচ্ছিল না। হঠাৎ মুখ ফুটে মেয়েমানুষের করুণ আওয়াজের কান্না তার ভেতরে ধাক্কা মারতে সম্বিৎ ফেরে রতনের। কাঁদতে কাঁদতে পরেশের বউ বলছে, “সারারাত তো দু’চোখ এক করল না মানুষটা। পেটের জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মরদের চোখ না বুজলে মেয়েমানুষ কেমন করে ঘুমকে বশ মানাবে। সেও রাতজাগা। শীতের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই খেঁজুররস কাটার হেঁসো আর কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিন আর একটু পরে বার হয়। সেও তখন বিছানা ছেড়ে উঠোন ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। তারপর ঘর-দাবা নিকোন দেবে। আস্তে আস্তে এ পাড়া, পালপাড়া থেকে এক এক করে রস খাবার জন্যে আমাদের দাবায় জড়ো হতে শুরু করেছে। আমি ঘর-দালান, উঠোন পরিস্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওরা নেশা চটকে এক একজন একেক রকম বকর বকর করতে করতে একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের উঠোন ছাড়তে শুরু করে। অন্য ঠেকে যাবার কথা বলে চলে যায়। পাল পাড়ার নিতাই আরও খানিক বসে যেদিকে ওর বাপ রস কাটতে গেছে সেই গাছের গোড়াতে খোঁজ করতে চলে যায়। আমি ‘কু’ কিছু না ভেবে আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তারপর তো শুনি ওই ভাগাড়েই রাধাকান্তর সঙ্গে মারপিট করতে করতে তার বুকে ছুরি চালিয়ে দেয় লোচনের বাপ। ঘরে ফিরতে দেখি ধস্তাধস্তিতে তারও ডান হাতের দাবনার কাছ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ম্যালেরিয়া গাছের পাতা কচলে তার রস সমেত দলানো পাতা চেপে নেকড়া দিয়ে বেঁধে রক্ত বন্ধ করি আমি। কে আগে নিশান দেখেছে চামড়াটা কার পাওনা হবে তার চুলচেরা বিচার পরে হতে পারতো। তাই বলে মানুষ খুনের কাজটা ঠিক করেনি লোচনের বাপ। ছালটা ছাড়িয়ে এসে আটচালায় বিচার-শালিশি বসাতে পারতো ওরা। আসলে ক’দিনের জীবনযন্ত্রণা ওকে দিশাহারা করে তুলেছে। কিছুতেই ও চামড়াটা হাতছাড়া করতে দিতে চায়নি। রাধাকান্তও গোঁও ধরে, বলে ও নাকি আগে নিশান দেখেছে। রাধাকান্ত ছিল দিঘিরপাড় বাজারে। তখন ও রাতে অমিত মুদির দোকান মুনতে যেতো। ভোরে পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে ও নাকি প্রথম শকুনের চক্করমারা নিশান দেখেছে। বিবাদ শুরু এই নিয়ে। কে আগে নিশান দেখেছে। কে দেবে তার প্রমাণ! কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। এবার রতন ঠাকুরপো তুমি বলো, লোচনের বাপ কি ভাগাড়ে গিয়েছিল রাধাকান্তর বুকে ছুরি বসাতে না গরুর চামড়া ছাড়াতে। এক কাজে গেল আর এক কাজ করে ফেলল লোকটা। আমি এখন কি করি, কোথায় যাই। তোমরা আমাদের পাড়া ছাড়ার নিদান দিলে! ওই দুধের বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি তো এখন জলে ভাসলুম গো ঠাকুরপো। এই শিশুটার মুখ চেয়ে আমার প্রতি একটু দয়া করতে পারলে না তোমরা! পাড়া আমাকে ছাড়তেই হবে, ঠাকুরপো?”
পরেশের বোয়ের পাড়া না-ছাড়ার সেই করুণ আকুতি তখন রতনের ভেতরকে দুমড়ে দিতে থাকে। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। গলার স্বরযন্ত্রর উপর শক্ত কিছু যেন টোপলা হয়ে আটকে আছে। পাড়ার সকলে এক মত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে একা বা সে আর নন্দ মিলে এটা করেনি। শুধু সে সিদ্ধান্তটা সকলের হয়ে আটচালার সামনে তুলে ধরেছে। তাই সব দোষ যেন তার ঘাড়ে এসে পড়ছে। একবার মনে হচ্ছে, সত্যি তো ওই অসহায় মেয়েমানুষটা দুধের শিশুটাকে নিয়ে যাবেই বা কোথায়। আবার ভাবছে, এদের পাড়াছাড়া না করলে জেল থেকে ওই খুনেটা ছাড়া পেলে তো আবার বউ-বাচ্চার কাছে এই পাড়াতেই ফিরবে। শুনেছে জেল ফেরত আসামীরা নাকি বেশিরভাগই ভীষণ বেপরোয়া হয়ে যায়। পুনরায় অপরাধ ঘটানোর সাহস জেল থেকে জুগিয়ে নিয়ে আসে। সংশোধনাগারে শুদ্ধ না হয়ে এসে আরও দাগী অপরাধী বনে যায়। কেউ কেউ আবার শুধরেও যায়। তবে তা নাকি খুবই নগণ্য। তা তাদের পরেশ যদি সেই নগণ্যর মধ্যে না থাকে তো পাড়ার পক্ষে আরও বিপদ! তার থেকে বরং বিপদের বীজ মূল থেকে উৎপাটন করাই ঠিক কাজ হবে। এই ভাবনা ভেতরে ভেতরে জারিয়ে রতন যেন নিজেকে মনে মনে শক্ত করে নিতে পারল। পরেশের বউকে বলল, “না গো লোচনের মা। তুমি আলাদা করে আমার কাছে আর্জি জানাচ্ছো বটে, তবে এখানে আমার কিচ্ছু করার নেই। হয়তো আমি আটচালায় তোমাদের রায়টা শুনিয়েছি। কিন্তু তুমি তো দেখেছো, এই রায় আমাদের দু’একজনের নয়। পাড়ার সকলে তাতে মত দিয়েছে। পাড়ার মত উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই।”
রতন দেখল তার রায় শোনার পর আর একটা শব্দও ব্যয় করল না পরেশের বউ। আটচালা থেকে হনহন করে পাশে তার ঘরে চলে গেল। বাচ্চাটার কান্নার শব্দ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিল। হয়তো তার খিদে পেয়েছে। হয়তো দু’বছরের প্রায়-শুকনো বুক দুটো তার মুখে গুঁজে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
পরেশের বউকে পাড়া ছাড়ার জন্যে তিনমাস সময় দিয়েছিল আটচালা। এই সময়ের মধ্যেই পাড়া ছাড়তে হবে তাকে। কোথায় যাবে কি করবে তার দায় আটচালার নয়। নিদানটায় রতন মন থেকে বেশ দ্বিধায় ছিল। সত্যি তো, ওই ভরা যৌবন নিয়ে মেয়েটা যাবে কোথায়। নিজের বোয়ের মুখটা ভেসে উঠল। ভেসে উঠল তার তিন বছরের সনাতনের হাসি খিলখিলে মুখটা। কষ্ট হচ্ছে রতনের ভেতরটা। কিন্তু সেই কষ্টটা বাইরে ওগরাতে পারছে না। এ তো আর এক অর্ন্তজ্বালা বাসা বাঁধল তার মধ্যে। পরেশের বোয়ের যৌবন যদি নাকাল হয় তো তার দায় সেও তো এড়াতে পারবে না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে চুপ মেরে রইল। একদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না রতন। সনাতনের মা’কে মনের কথা উগরে দিল। সনাতনের মা-ও স্বামীর মতে মত দিয়ে বলল, “ঠিকই তো, অপরাধ করল যে জন সে তো শাস্তি পেয়েছে। ফাঁসিতে লটকাতে লটকাতে তা রদ হয়ে যাবৎজীবন হয়েছে। তারপর তার ঘরের নিরাপরাধ প্রাণীগুলো শাস্তি পাবে কেন? তারা কি অন্যায় করল! এক অপরাধে দু’দফায় শাস্তি কেন? এটা পুলিশ-সরকারের দেখা উচিত। তোমাদের আটচালা এই নিদান দিয়ে একদম ঠিক কাজ করেনি। লোচনের মা থানায় যাচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। তার এতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে দেখে থানা কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারবে না। তারা এর একটা বিহিত করতই।” সনাতনের মায়ের কথায় সায় দিয়েও রতন বলল, “মরিয়া পরেশের বউ গিয়েছিল থানায়। নালিশ জানিয়েছিল আমাদের আটচালার বিরুদ্ধে। কিন্তু থানা কোন উচ্চবাচ্য করল না। যেহেতু সিদ্ধান্তটা আটচালার। ওরা জানে আটচালার সিদ্ধান্ত মানে সারা পাড়ার লোক একমত হয়ে নিদানটা দিয়েছে। তাই পাড়ার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করলে পাড়া যদি খেপে গিয়ে থানায় হামলা করে বসে? সেই ঝুঁকি থানা নিতে চাইল না। ঘাপটি মেরে বসে গেল। তারা খুব ভাল করে জানে ওই মুখ্যুসুখ্যু মেয়েমানুষটা থানা টপকে উপরে নালিশ জানাবার সাহস দেখাবে না। হয়তো সে জানেও না যে থানার বিরুদ্ধেও কোথাও নালিশ জানানো যায়।”
সত্যিই জানা নেই লোচনের মায়ের। রতনরাও তা জানিয়ে ঘোলা জল আরও ঘোলা করতে চাইল না। একজনের বিপদে পাশে না দাঁড়ানোটা ঠিক কাজ নয় জেনেও রতন চুপ মেরে গেল শুধু তার বউ-বাচ্চার মুখ চেয়ে। আটচালার বিরুদ্ধে কথা বলে যদি তার উপর আটচালার খাঁড়া এসে পড়ে? পরেশের ভরা যৌবনা বোয়ের সঙ্গে তার কোন গোপন সম্পর্কের কথা তুলে যদি তাকেও পাড়া ছাড়ার নিদান আটচালা দিয়ে বসে? এইসব পরকিয়ার ঘটনায় আগে তো দুই জোড়াকে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে আটচালা। আটচালা পাড়াটাকে একদম শুদ্ধ মঠ-মন্দির করে রাখতে চায়। এখানে কোন বেলেল্লাপনা চলবে না। কিন্তু এত শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও পাড়ায় কি পরকিয়া প্রেম ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে? যায়নি। গোপনে রাসখেলা সমানে জারি রয়েছে। কথায় বলে না, ‘চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে, যদি না পড়ে ধরা।’ এখানেও তাই, ধরা পড়লে তখন সে অসচ্চরিত্র, না পড়লে সাধু ! রতন একটা জিনিস ভেবে কুল পায় না, আটচালার এত কড়া শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও যৌবন কেমন করে এত বেপরোয়া, ছন্নছাড়া হয়! এটা কি প্রকৃতির সহজাত প্রবণতা! যুগে যুগে যা কোনদিন কোন নিয়মনীতি দিয়ে বশে রাখতে পারেনি!
সেদিনের পর থেকে পরেশের বউ রোজ ভোরবেলা বাচ্চাটাকে কাঁখে বেঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ফেরে সন্ধ্যে অনেকটা পার করে রাতের কাছাকাছি। পাড়ার মেয়েমানুষদের কানে কানে কানাকানি হয়ে কথাটা রতনের কানে এসেছে, পরেশের বউ নাকি কোলকাতার কোন বাবুর বাড়ি কাজে যায়। বাচ্চাটাকে সারাদিন রাখার জন্যে এবং সেও দিনমানে কাজের ফাঁকে ছেলের পাশে থেকে কিছুক্ষণ জিরেনের জন্যে বাবুরা তাদের সিঁড়ির নীচে ছোট্ট একটা কুঠরী দিয়েছে। কথাটা নিশ্চয়ই পরেশের বউ পাড়ার মেয়েদের কারোর কাছে গল্প করেছে। না হলে মেয়েরা বা জানবে কেমন করে। রতনের মনে হল পরেশের বোয়ের এই কাজটা মনে ধরেছে। তাই কোনদিন কাজে কামাই দিত না। মানবিকতার খাতিরে গ্রাম ছাড়ার জন্যে ওকে তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছিল। একা মেয়েছেলে, সাত দিনের নোটিশে বাড়ি ছাড়তে বলাটা অন্যায় কাজ হবে। তাকে গুছিয়ে নিতে সময় দেওয়া দরকার। আটচালা থেকে কেউ আবার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গ্রামছাড়ার কথা তুলেছিল। শেষমেষ ওই তিন মাস ওকে সময় দেওয়া সাব্যস্ত হয়। কিন্তু রতনের মনে হল এই নিদানের বিরুদ্ধে অপমানে ক্ষুব্ধ পরেশের বউ আটচালার মুখে বিষ্ঠা ঢেলে তিরিশ দিন গড়াতে না গড়াতেই পাড়ার আদেশ তামিল করল। একমাস গড়ানোর আগেই হঠাৎ দেখা গেল পরেশের বউকে ছেলে কাঁখে জড়িয়ে আর রাতে বাড়ি ফিরছে না ! সেই যে তালা দিয়ে গেল আর সে তালা খুলতে এল না।
আটচালার পাশেই তো পরেশ রুইদাসের বাড়ি। বাড়ির সামনে পেছনে বেশ খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা আছে। সাকুল্যে জায়গাটা হয়তো খুব বেশি নয়। কাঠা আড়াই-তিনেক হবে। কিন্তু অতটা জায়গার মধ্যে এক কামরা ঘর, একটা পাশকামরা আর সামনে দাওয়া নিয়ে ছোট্ট বাড়ি বলে মনে হয় অনেকটা জায়গা। সেই জায়গায় টুকটাক মরসুমী শব্জিও ফলাতো পরেশের বউ। বহুদিন ব্যবহার না করে করে জায়গাটা পোড়ো হয়ে গেছে। জঙ্গল গজাতে গজাতে এখন ওখানে মানুষ ঢুকতে ভয় করে। আর ঘরের ভেতর কত না সাপখোপের বিছের বা অন্য বিষাক্ত পোকামাকড়ের আস্তানা হয়েছে কে জানে। যেহেতু পাশেই আটচালা, দিনে রাতে পাড়ার সবাই এখানে বসে, আড্ডা দেয় তাই ভয় করে হঠাৎ ওই জঙ্গল ফুঁড়ে কোন বিষধর না আক্রমণ করে! তাই কেউ কেউ কথা তুলতে শুরু করেছে, পরেশের ওই পোড়ো জায়গাটা আটচালা দখল করে নিক। পরে যখন ওরা কেউ জায়গার দাবি নিয়ে আসবে তখন তাকে মূল্য ধরে দিলে চলবে। ওই গোটা জায়গা নিয়ে আটচালাটা বড় করে তৈরী করা হোক। তাহলে হাত-পা ছড়িয়ে সকলে বসতে পারে, গড়াগড়ি খেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ওই জঙ্গলের হাত থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া যায়। নাহলে আটচালায় এসে কারোর কোন ক্ষতি হলে পরেশের বউ দায় নেবে নাকি? ও আবার কি দায় নেবে, ক্ষতি তো যার হবার হয়ে যাবে। সে ক্ষতি আর পূরণ হবার না।
রতন-নন্দরা দেখল, এই জঙ্গল জঙ্গল করে অজুহাত দেখিয়ে সত্যি সত্যি না একদিন কেউ জায়গাটা দখল করে নেয়। এটা খুবই অনুচিত কাজ হবে। ওরা নিশ্চিত, এই জায়গার টানে ওদের কেউ না কেউ একদিন এদিকে আসবে। বেদখল হলেই জায়গার অধিকার দাবি করবে। থানা-পুলিশ, আইন-আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে আর এক নতুন বিপত্তি এসে জুটবে। তার থেকে আটচালা থেকে এই পোড়ো জায়গাটা নিয়ে একটা বিধান দেওয়া ভাল। সেই ভাবনা মত একদিন আটচালা বসে সিদ্ধান্ত নিল, খুনে পরেশের ওই জায়গা পাড়ার কেউ কোনদিন সরাসরি পরেশের বউ বা তার কোন বংশধরের কাছ থেকে কিনতে পারবে না। যে সেই অপচেষ্টা করবে তাকেও পাড়াছাড়া করা হবে। আটচালাও ওই জায়গা দখল বা কেনাকাটার মধ্যে যাবে না। ওটা পরেশের ভদ্রাসন। পরেশের রায়ত সম্পত্তি। পরেশ জেলখাটার মেয়াদ শেষে যদি বেঁচে থাকে তো সে ঠিক করবে বা তার বংশধর কেউ ভাববে, কি করা যায় ওটা নিয়ে। বসবাস তো ওদের কেউ করতে পারবে না। একমাত্র আটচালার জন্যে বা বেপাড়ার কাউকে যদি তারা ওই জায়গা লিখে দেয় তো তার একটা হিল্লে হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের কথা উঠতে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আটচালা থেকে খরচ করে বছরে একবার জঙ্গল পরিস্কার করা হবে। সেই খরচের হিসেব রেখে দেওয়া হবে। ওই জায়গা যখন ওরা সাফকোবলা করতে আসবে তখন কড়ায় গন্ডায় তা হিসেব করে নিয়ে নেওয়া হবে। জঙ্গল সাফাইয়ের পয়সা দিতে অস্বীকার করলে যে জায়গা কিনবে তাকে দখল নিতে দেওয়া হবে না। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে চুপিসাড়ে জায়গাটা হাতবদল হয়ে যাবে আমরা নাও বুঝতে পারি। কিন্তু দখল তো সেই ক্রেতাকে নিতে আসতে হবে। তখন আদর করে তাকে বলা হবে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর!’ জঙ্গল সাফাইয়ের খরচা মেটাও, জায়গার দখল নাও। এখানে কোন ওজর আপত্তি খাটবে না। আটচালার পাশের জায়গা জঙ্গল হয়ে থাকবে। আর সাপ বিছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে থাকবে, তারপর? সবসময় এখানে লোক বসে। সাপের কামড়ে কেউ যদি মরে যায় ক্ষতিটা কার হবে?ক্রমশ…..
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদারক’দিন ধরে শিবুবাবুর সাদা বলদটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বি.ডি.ও. অফিসের পশু-ডাক্তারের কাছে কয়েকবার নিয়ে গেছে এসেরালি। সঙ্গে মণিব, শিবুবাবুও ছিল। গরুর ব্যাপারে তাকে সবসময় জড়িয়ে রাখে শিবুবাবু। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, তবু গরুটার মুখে খাবার রুচি ফেরেনি। আরও যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মন খারাপ শিবুবাবুর। সাদা আর কালো বলদ-দুটো তার ভীষণ ‘পয়া’ ছিল। কোন হেলদোল ছাড়াই বছরের পর বছর তাদের জোতে হাল টেনে গেছে অবলীলায়। যেমন তাদের তাগড়াই চেহারা তেমন গতরের তাকত। কত লোকে এদের দেখে হিংসে করেছে। আসলে আশেপাশে দু’পাঁচটা গ্রাম ঢুঁড়লেও এমন জোড়া বলদের খোঁজ মেলা ভার। দাদাগিরিও এদের দু’জনের কম ছিল না। এখন সাদাটা দমে গিয়ে দু’জনেরই দাপাদাপি থমকেছে। কালোটাও যেন তার অসুস্থ জুড়িদারের জন্যে মন মরা। নইলে ওটাই তো নাটের গুরু। বেড়ালের গলায় ঘন্টা তো ওটাই প্রথম বাঁধতে উদ্যত হয়। আর তাতে দোয়ার্কি দেবার মত কালোর সঙ্গে তাল মেলায় সাদা। ওদের যাওয়া আসার পথে অন্য কোন গরুকুলের ঘুরঘুর করার আইন নেই। বিশেষ করে কোনো জোড়া-বলদের। সেই হেলোকে তৎপর হয়ে নিজের জোড়াকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে এদের যাবার রাস্তা করে দিতেই হবে। ব্যাপারটা অন্য কোন নতুন হেলোর জানা না থাকলে বিপদ। প্রবল বেগে গুঁতিয়ে তাদের কাহিল করে তবে ক্ষান্ত হবে এরা। তখনই শুরু হয় চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি। এসেরালিকে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে। মেজাজ ধরে রাখতে না পারলে কখনো কখনো নিজের ঘর সামলাতে মোটা কঞ্চির ঘায়ে এদের সারা গায়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছে সে। পরে আবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। অবলা পশু। এতটা মারধর করা তার ঠিক হয়নি। ওরা তো অমনই। ওরা কি মানুষ? শাসন করলে শুধরোবে? পুনরায় এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে ওরা এমনটাই করবে। শিবুবাবুকে সব জানিয়ে রাখে। বাবু তাকে কিছু বলে না। বাবু জানে এসেরালি গরু দুটোকে কতটা নিজের মত দেখে। শুধু বলে, “বড্ড বজ্জাত ও দুটো। নাটের গুরু তো ওই কালোটা। আর সাথীর তালে তাল না দিলে তো সাথী বিপদে পড়ে যেতে পারে, তাই সাদাটাও নেবে পড়ে রণক্ষেত্রে। দেখ এসেরালি, পশুরাও কেমন দরকারে বন্ধুর পাশে দাঁড়ায়! আমরা মানুষরা যদি এমন হতাম, সমাজজীবনটা এত জটিল হোত না।” আবার অনেকে তারিফও করেছে। বলেছে, এমন হৃষ্টপুষ্ট জোড়াবলদ পাওয়াও ভাগ্যের দরকার। জানো এসেরালি তোমার বাবুর কপাল ভাল, তাই এদের সঙ্গে সঙ্গে তোমার মত দায়িত্ববান হেলোও পেয়ে গেছে। এদের নিয়ে মনের মধ্যে তখন গর্ব উগরে উঠত শিবুবাবুর। কথার ছত্রছায়ায় তা জানানও দিয়েছে শিবুবাবু। এসেরালির নজর এড়ায়নি। গর্র তার মধ্যেও কম হয়নি। এমন জোড়া দুটোর চালনার দায়িত্ব পাওয়াটাও তো কম কথা না। তাকত বলদের তাকতওলা হেলো না হলে তাদের বশে রাখাটা অত সোজা কাজ না। তাই সুবিধে অসুবিধেয় এসেরালি কোনদিন কাজে কামাই দিলে শিবুবাবুর মাথায় হাত পড়ে যায়। এর কারণও আছে। অন্য কোন হেলো এই বলদ জোড়াকে নিয়ে হাল চষার কাজ সামাল দিতে পারে না। ওদের তালে তাল মিলিয়ে চলায় যে খাটনি তা তাদের সয় না। তাছাড়া জোড়া দুটোও অন্য হেলোর কথা শুনতে চায় না। লেজ মটকে বাঁদিকে যেতে বললে তারা ডানদিকে ছোটে। এসেরালি কিন্তু কোনদিন এদের কারোর লেজ মটকায়নি। হাল পরিচালনার এই মুদ্রাটা এরা একদম মেনে নিতে পারে না। বিদ্রোহ করবেই করবে। কাঁধে জোল, হাল সমেত তারা ছোটাছুটি লাগিয়ে দেবে। তখন কোন নিয়ম অনুশাসনকে তারা তোয়াক্কা করে না। প্রথম প্রথম এদের সামলাতে তাই এসেরালির বড্ড বেগ পেতে হয়েছিল। চিন্তায় পড়ে গেছিল সে। গরুদুটো এমন লাগামছাড়া হলে সে কাজ করবে কেমন করে ! একটা সময় মনে হয়েছিল এ’গরু নিয়ে সে হাল চষতে পারবে না। নিজের হতাশার কথা পেড়েও ছিল বাবুর কাছে। সব দেখেশুনে বাবু বলেছিল, “এসেরালি, তুমি এক কাজ করো, ওই গরুর লেজ মটকে নাঙলচষার দাওয়াইটা ত্যাগ করো। অন্য গরুর সঙ্গে আমার এই বলদজোড়াকে এক পংক্তিতে ফেলো না। তুমি ওদের সঙ্গে ভদ্রসভ্য ব্যবহার করো, ওরাও তোমায় মাথায় তুলে রাখবে। আমার গরুর রাশ আমি ভাল করে বুঝি। ‘জাবনা’ দেবার সময় হেইহুই করে যষ্টি উঁচানোর মত হাত উঁচিয়ে শাসন করতে গেলে ওরা আমাকেও রেয়াত করে না। সেটা বুঝে গিয়ে আর ওভাবে আমি ওদের উপর খবরদারি করি না। গলায়, গায়ে হাতবুলিয়ে জাবনা মাখালে ওরা একদম শান্ত ছেলের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। সরে যেতে বললে সঙ্গে সঙ্গে আদেশ তালিম করবে। তুমিও তাই করো, দেখবে তোমার কাছে ওরা কত আপনজনের মত হয়ে যাবে।” বলদ জোড়া সামলানোর এই বিদ্যেটা তো আর অন্য আনকোরা হেলোরা জানেনা। না জানার কারণে তাদের হেনস্থা হতে হয়। এই কারণেই তার উপর এত ভরসা শিবুবাবুর। চাষের কাজ শেষ হলে আর তো জমি চষার তেমন কোন কাজ থাকে না। হেলোরও দরকার হয় না। তাই বলে অন্য মালিকের মত শিবুবাবু তার বাঁধা হেলোকে ‘কাজ নেই’ বলে বেকার করে দেয় না। অসময়ে ডাঙা জমিতে সব্জির অল্পস্বল্প হালের কাজ ছাড়াও অন্য কাজে সারা বছর জড়িয়ে রাখে। তাতে দিনমজুর হেলো, এসেরালিরও আর কাজ পাওয়ার জন্যে গ্রামে গ্রামে ফিরি করতে হয় না। বাবু যেমন অসময়ে তাকে দেখে, সেও সময়ে বাবুর পাশে থেকে মন জুগিয়ে যায়। শিবুবাবুর ঘরের লোকেদের একজন হয়ে গেছে সে।
এবার সাদাটা জাবরকাটাও বন্ধ করে দিল। উঠে দাঁড়ায়ও না। এসেরালি কতবার চেষ্টা করল দাঁড় করাতে। কিন্তু গরুটার নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করেও আর নিজের ওই বিশাল শরীরটাকে তুলে ধরতে পারছে না। এসেরালির কথা এরা দু’জন খুব শোনে। ওরা ওকেই পালনকর্তা হিসেবে মানে। আর এসেরালি মানে শিবুবাবুকে। সাদা-জন তার মনিবের কথা শোনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। আসলে খাচ্ছে না তো কিছুই। গায়ে জোর পাবে কোথা থেকে। পেটে কিছু থাকলে তবে তো জাবর কাটবে, শরীরকে শক্তির রসদ যোগাবে।
বাড়ি সুদ্ধ সকলের মন খারাপ সাদা বলদের জন্যে। আর হয়তো ওকে বাঁচানো যাবে না। ডাক্তারের কোন ওষুধ কাজ করছে না। ডাক্তারও কোন আশ্বাস দিতে পারল না। শুধু বলল,“যাবার সময় হয়ে গেলে কার সাধ্য আটকানো যায়। আমরা তো শুধু মনের বোধ দেবার জন্যে চেষ্টা করতে পারি মাত্র। প্রবীণ এই পশুটার মাড়ির দাঁতের অবস্থান জানান দিচ্ছে পৃথিবীর আলো বাতাস আর বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। তাই একে বেশি করে মায়ার বাঁধনে বেঁধে লাভ নেই। মন থেকে পোষ্যের প্রতি মায়া ছিন্ন করা সত্যিই কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক। তবু যা অনিবার্য তাকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই।”
সেদিন বিকেল থেকে শুধু ডেকেই চলেছে গরুটা। কাকে ডাকছে কে জানে! এতদিন শরীর খারাপ করেছে, কোনদিন এইভাবে ও ডাকাডাকি করেনি। বলদ গরুরা এমনিতেই কম ডাকে। তারপর এদের মত তেজীরা তো তেমন নয়ই। ওর ডাক শুনে এবার কালোটাও ডাকতে শুরু করেছে। তবে এর মত তারস্বরে এবং সবসময় ডাকছে না কালো জন। ওরা হয়তো নিজেদের ডাকের মাধ্যমে মনের কথা আদান-প্রদান করছে! মানুষরা যার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসেরালির মনটা এবার কেমন যেন ‘কু’ ডাকতে শুরু করেছে। দিগন্তে সূর্য লাল-গোলাপী আলো ছড়িয়ে জানান দিয়ে যাচ্ছে ঘুমের দেশে চলে যাবার কথা। চরাচরে অন্ধকার নিজের স্থান দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় গৃহস্থের বাড়ির আলোর ছটা যেন ক্ষীণ চেষ্টা করছে অন্ধকারের সর্বগ্রাসী একাধিপত্তকে রুখে দেবার জন্যে। শিবুবাবু বলল, “এসেরালি, এবার তুমি বাড়ি যাও। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। তোমাকে আবার অন্ধকার ফুঁড়ে অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। আমরা বাড়ির সবাই মিলে রাতে পালা করে গোয়ালঘরে অবলাটাকে পাহারা দিই। ‘হাম্বা হাম্বা’ করে মনঃকষ্টর কথা কি বলছে তা তো বোঝা যায় না। হয়তো অন্তিম সময় আমাদের সবাইকে ওর পাশে এসে থাকতে বলছে। ঠিক শেষ সময় মানুষ যেমন করে। মনঃকষ্ট এবং আত্মার ইচ্ছে, মানুষ আর পশুর মধ্যে আলাদা কিছু হয় বলে তো মনে হয় না। শুধু আমাদের মুখে ভাষা আছে তাই আমারা বুঝতে পারি, আর ওদের তা নেই।”
ইতস্তত করে বাড়ি ফেরার কথা মাথায় আনতেই এবার এসেরালির বুকের ভেতরটায় কে যেন সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। কে আর দেবে। ভেতরে যে দাপাদাপি করে সে! সেই মনপবনটা! ইতস্ততর কারণটা এবার যেন ওর ভেতরে চাগাড় দিয়ে উঠল। তার আদরের পশুটার এই অন্তিম সময়ে সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে? তা হয় নাকি! গলার স্বর দৃঢ় করে এসেরালি বলল, “বাবু, আজ আর আমি বাড়ি যাবো না। বাজারে নাসির চাচার দোকানে বলে আসি, আজ রাতে বাড়ি যাবো না। বাবুর বাড়ি থাকবো। বাড়ির ওরা যেন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে।” দিঘিরপাড় বাজারে ওদের পড়শি নাসির চাচার বিড়ির দোকান। জরুরী কোন খবরাখবর বাড়িতে দেবার থাকলে নাসির চাচাকে দিয়ে পাঠায় এসেরালি। বাবুও যেন ভেতরে ভেতরে চাইছিল, এসেরালি আজ রাতটা তার হাতের তালুর মত চেনা পশুটার পাশে থাকুক। তা এসেরালি নিজে থেকে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ না করলে তো জোর করতে পারে না। সে’কথা ও প্রকাশ করতেই বাবু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “তবে যা, রাত বাড়নমুখো, নাসির যদি দোকান বন্ধ করে চলে যায় তো তোর বাড়িতে আর খবর দিতে পারবি না। বাড়ি তখন চিন্তায় খোঁজখুঁজি শুরু করে এখান পর্যন্ত ছুটে চলে আসতে পারে।” এবার এসেরালি বাবুকে আশ্বস্ত করে বলল, এখন সবে সন্ধেরাত। চাচার দোকান বন্ধ হতে হতে রাত ন’টা হয়ে যায়। গরুটার গাল থেকে ঝরে পড়া লালাগুলো একটু ধুইয়ে-মুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”
গোয়ালঘরে বাবু একটা হ্যাজাকের ব্যবস্থা করেছিল। লম্প বা হারিকেনের আলোয় সবকিছু নজরে আসতে অসুবিধা হচ্ছিল। মধ্যরাত হবে, বাবু তার সঙ্গে ছিল। এসেরালি বলল, “বাবু, এবার আপনি ঘরে চলে যান। শুয়ে পড়ুন। আমি আছি। সেরকম হলে বৈঠকখানার বিছানায় আমি গিয়ে শুয়ে পড়বখন।” কিন্তু এসেরালি ভাল করে জানে আজ সারারাত তার দু’চোখের পাতা এক হবেনা। হ্যাজাকের তীব্র আলোয় ও দেখতে পাচ্ছে গরুটার চোখদুটো কেমন ড্যামড্যামে হয়ে আছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, যেন সেই চোখদুটো তার দিকেই তাকিয়ে কি সব বলতে চাইছে। এতক্ষণ ধরে যে স্বরে সে ডেকে চলেছিল এবার তার বহর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাম্বা ডাকটা অনেক পরে পরে ভেতর থেকে যেন কত কষ্টে বেরিয়ে আসছে। ওই মায়াময় চোখদুটো এসেরালির দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে, ভেতরটা কেমন যেন ডুকরে উঠছে! কালোটার দিকে একবার চোখ পড়ল এসেরালির। বেচারা! তারও চোখে ঘুম নেই। জাবরকাটা বন্ধ করে ঠায় তার সহদরের দিকে চেয়ে রয়েছে। চোখের কোণে জলে ভেজা রেখা হ্যাজাকের তীব্র আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখে চোখ পড়তে সে একবার হাম্বা করে তার প্রভুকে ভেতরের দুঃখটা যেন ভাগ করে নিতে চাইল। এবার এসেরালি আর নিজের চোখের জলকে ধরে রাখতে পারল না। লুঙ্গির খোঁট দিয়ে চোখের কোণের পানিটাকে সামাল দিয়ে কালোটার পাশে গিয়ে তার গলায়, মাথায় মুখে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল। পশু হলেও এমন তাদের মনের ক্রিয়া, এসেরালির গায়ের আরো কাছাকাছি চলে এসে তার গা ঘুনতে থাকল। ঠিক যেমন মানুষের পরমাত্মীয় বিয়োগের মুহূর্তে মানুষ করে থাকে। আর নিজেকে সামাল দিতে পারল না ও। পুরুষমানুষের ডুকরে ওঠা কান্না বাতাসে সওয়ার হয়ে চরাচরে ভেসে যেতে লাগল। বাতাসের সেই বার্তা শিবুবাবুর কান ছুঁয়ে গেল কি না কে জানে। নির্ঘুম বাবুর ভেতরটাও হয়তো এসেরালির মত ডুকরে উঠেছিল! বাবু টর্চের তীব্র আলো ছড়িয়ে তড়কো পায়ে এসেরালির নাম করে হাঁক দিতে দিতে এদিকে চলে এল, “কি হয়েছে রে এসেরালি? অমন করে তুই চিৎকার করে কেঁদে উঠলি কেন? দাঁড়া দাঁড়া, আমি যাচ্ছি দাঁড়া!”
[ দুই ]
প্রাচীন ওই দীর্ঘ বটগাছটা আর তাকে কেন্দ্র করে তার চৌহদ্দির নীলাকাশ। এরা যেন ওদের জীবন চলনের অভিমুখ। দৈনন্দিন আশা-নিরাশার কেতন যেমন তারা ওড়াবে, তারই তালে তাল দিয়ে গড়ায় ওদের দিনরাতের আহ্নিক গতি। ওদের রুইদাস পাড়া থেকে সেই প্রায় সিকি কিলোমিটার দূরে দৌলতপুরের শেষ সীমানায় গলা উঁচিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে। সেই প্রবীন বটবৃক্ষ। সকাল-দুপুর-বিকেল, ওদের পাড়া ফুরসৎ পেলেই তীব্র দৃষ্টিতে নিশানা ফেলে সেই বটের শীর্ষপট সংলগ্ন নীলিমায়। তাদের শ্যেন দৃষ্টি খুঁজে ফেরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সেই শ্যেনেদের উপস্থিতি। ওদের উপস্থিতি টের পেলেই চনমনিয়ে ওঠে রুইদাস পাড়ার ভিতর-বাহির সব অঞ্চল।
বটবৃক্ষ লাগোয়া প্রশস্ত ফাঁকা জায়গাটা দৌলতপুরের ছেলেপুলেদের খেলার মাঠ। বিকেল হলেই গমগম করে এই মাঠ এলাকা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এখানে ছুটে আসে স্বস্তির শ্বাস নিতে। ছোটরা খেলার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় খেলাধুলা করছে। বউ-বোন-মায়েরা এদিকে ওদিকে হাঁটাচলা ছুটোছুটি করে। দিনের ক্লান্তি দূর করে আনন্দসুখ আত্মস্থ করে। কেউ কেউ আবার দখিনা বাতাস বুকভরে গ্রহণ করার জন্যে ওই সুশীতল বটের তলায় আশ্রয় নেয়। খেলায় খেলায় ক্লান্ত ছেলেপিলেদের তো কথাই নেই। মাঝে মাঝে এসে চিত হয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে, আবার খেলা-যুদ্ধে সামিল হবার জন্যে।
এক সময় এই সেই খেলার মাঠ আরও প্রশস্ত করার তাগিদ আসে গ্রামের ক্লাবের কর্মকর্তাদের। তার জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে থাকা প্রাচীন এবং বিশাল এই বটগাছটাকে হত্যা করে চিহ্নহীন করার। গাছটার কাছ থেকে খেলাধূলা করতে আসা বা একটু শ্বাস নিতে আসা মানুষ এত উপকৃত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে তার যে অপূরণীয় অবদান, এই কর্মকর্তারা যেন বেমালুম উড়িয়ে দিতে চাইল। তার থেকে তারা গুরুত্ব দিল মাঠ দৈর্ঘে প্রস্থে আরও চওড়া করার বাসনাকে! প্রস্তাবটা কানে কানে চাউর হয়ে গেল আশপাশের গ্রামগুলোতে। স্তম্ভিত সমস্ত গ্রামের মানুষ! পরিকল্পনা বাতিল করার আবেদন আসতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে। কান ছুঁয়ে গেল প্রশাসনের। কিন্তু সেখানেও অদৃশ্য কোন শক্তির প্রভাবে প্রশাসনের দ্রুত সক্রিয় হবার কোন আঁচ পাওয়া গেল না। উৎকন্ঠা নিয়ে ক্রমাগত অপেক্ষা এবং ধৈর্য পরীক্ষার সামনে এসে দাঁড়ালো রুইদাস পাড়ার মানুষজন। তাদের জীবন-চলনের কেতন যে গাছ উড়িয়ে যায়, তার পতন মানে তো তাদেরও জীবন পতনের পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়া। তা তারা কেমন করে মেনে নেবে! শত অনুরোধ উপরোধে যদি ক্লাব নিরস্ত না হয় তো তারাও সক্রিয় প্রতিরোধে সামিল হতে দ্বিধা করবে না। হতেই পারে জায়গাটা ওই দৌলতপুরের সীমানায় অবস্থিত। ওর মালিকানা কিন্তু ওই ক্লাবের নয়। তাদের দখলে আছে মাত্র। প্রকৃতপক্ষে জায়গাটা সরকারি ভেস্টেড। সেই অর্থে ওটা সরকারি জায়গা। সরকারের জায়গা মানে ওর উপর অধিকার তাহলে সকল নাগরিকের। রুইদাসদেরও। সরকারি জায়গা কারোর দখলে থাকা মানে সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। সেই হিসেবে একটা সমাজের দিনপাত এবং সংস্কার যে ক্রিয়াকর্মের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল তাকে সম্মান দিতে তারা তো বাধ্য। মানবিকতার এই পাঠ যদি তারা না নিয়ে থাকে তো জোর করে, বলপূর্বক সেই পাঠ তাদের কানে পশিয়ে দিতে তারা বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না।
রতনরা ক্লাবকে পই পই করে বুঝিয়েছে, “বাবুরা, এই গাছ তোমরা যদি কেটে দাও তো আমরা পথে বসবো। এই গাছের নিশানা নির্দিষ্ট করে দেয় আমাদের রুজিরোজগারের হালহকিকৎ। ব্যপারটা কি, কেমন করে এই গাছ আমাদের জীবনের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে, তোমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে চাই না বাবু। এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব এবং গোপনীয় সংকেত। কানাঘুষো তোমরা তার কিছুটা জানো। তার বিস্তারিত জেনে তোমাদের কোন কাজে আসবে না। শুধুমুধু আমাদের সমাজের নিজস্ব এক গোপনীয় প্রক্রিয়া তোমরা জেনে হাসাহাসি করবে আর আমরা অপমানিত বোধ করবো। কেবল আমরা যেটা অনুরোধ করছি তা তোমরা মেনে নাও। আর তোমাদের যদি সত্যি কোন ত্রিনয়ন থাকে তাহলে আমাদের দিকে একটু খেয়াল রেখো। দিনের আলোর মত তোমাদের সব প্রশ্ন বা কৌতূহল হাট হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। আসলে আমরা ‘রুইদাস’। তোমাদের তথাকথিত উচ্চজনের কাছে ছোট অন্তজ সম্প্রদায়ের মানুষ। বরাবর তাই তোমরা আমাদের উপেক্ষা করে এসেছো। আমাদের সম্পর্কে কোন আগ্রহ কোনদিন তোমরা দেখাও নি। তাই জানবে না আমরা কে, কেমন আমাদের চলন বলন। তোমরা শুধু জানো আমরা ভাগাড়ের গরু-ছাগলের ছাল ছাড়াই। তার ছাল চামড়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছেড়ি করি। বাজারে ছাগলের মাংস বিক্রি করি। আমরা পাড়ায় পাড়ায় বাবুদের ছেঁড়া জুতো সারাই। বেতের ধামা, সের, কুনকে, পালি বানাই। তোমরা আদেশ করলে সেগুলো সারিয়ে দিয়ে যাই। হাটে বাজারে বড়-মানুষদের পায়ের জুতো পালিশ করে চকচকে করে দিই বাইরেটা। ভেতরটা পড়ার যোগ্যতা বা সাহস আমাদের নেই! তবে এটা ঠিক বাবুরা, একটা সময় তোমরা আমাদের দিকে বেশ নজর দাও। সেটা স্বীকার না করলে আমাদের পাপ হবে। ওই পূজা-পার্বন, উৎসবের মরশুমে। আমাদের ঢাক কাঁসির উপস্থিতি সেসময় তোমাদের কাছে অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। হ্যাঁ তোমরা তখন আমাদের যারপরনাই খাতির যত্ন করো। খেতে দাও। নতুন নতুন জামা ধূতি পরিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রায় একরকম উচ্ছগ্য করো। পুজো শেষে বাড়ির ছেলেপুলেদের, বউদের জন্যে তোমাদের বাড়ির উচ্ছিষ্ট পুরোনো জামা কাপড় দাও। অবশ্য এটাও ঠিক, গরিব মানুষ আমরা, এই সময় ছাড়া এগুলো চাওয়া পাওয়ার সুযোগ আমাদের থাকে না। চাইলে তোমরা দেবেও না। মুখ করে ভাগিয়ে দেবে বা চাঁদ সদাগরের মনসাপুজো করার মতো বাঁ হাতে এক আধটা ছুড়ে দেবে। হ্যাঁ, অভাবি আমরা সেসময় চাই-ও। ঘরে আমাদের বাচ্চা-বউরা পথপানে চাতকের মত চেয়ে থাকে, পুজো শেষে কখন তাদের বাবা বা স্বামী বাড়ি ফিরবে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তারা মুখে এক-ঝিলিক হাসি ফোটাবে। বাবুর বাড়ি থেকে চেয়ে-চিনতে আনা জামা-প্যান্ট, শাড়ী-কাপড় তারা গায়ে চড়াবে। পুজোর ভাল পোষাক পুজো শেষে গায়ে চড়িয়ে উৎসবের রেশ কাটার আগেই তা উপভোগ করবে। পরিবারের এই তৃপ্তি আমাদের মনকেও ছুঁয়ে যায় গো বাবু। তাই তোমাদের কাছে হাত পাতি, তোমরাও দাও। এই পর্যন্ত। এর বাইরে এতটুকুও তোমরা আমাদের প্রতি আগ্রহ দেখাও না। তাই তোমরা জানো না আমরা কেন আমাদের জীবন-পূজারী এই গাছকে নিধন করতে তোমাদের নিষেধ করছি।”
রতনের এত কথাতেও ক্লাবের বাবুদের মুখের ভাবে আশার কোন ফুলকি দেখতে পেল না। ওর কথায় বাবুরা কি বলে তার জন্যে খানিক অপেক্ষায় থাকল রতন। কিন্তু ও-পক্ষ কোন উচ্চবাচ্য না করায় রতন এবার যেন ভেতর থেকে শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। গলার স্বর মজবুত করে বলল, “তবে বাবু এটা ঠিক, তোমরা যদি আমাদের কথা না নাও তো আমরাও ছেড়ে কথা কইব না। এটা আমাদের জীবন-জীবিকার এক অপরিহার্য প্রশ্ন। রুখে আমরা দাঁড়াবই। তোমাদের কোন প্রভাব প্রতিপত্তি এখানে খাপ খুলতে পারবে না। তার জন্যে যেখানে যেতে হয়, যতদূর যেতে হয় আমরা যাবো।” এবার রতনদের কথা ক্লাবের বাবুরা মন দিয়ে শোনে। “সামনের মিটিংয়ে তোমাদের কথা আমরা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবো। কিন্তু আমরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, এই গাছটা তোমাদের এতো কি কাজে আসে? তোমাদের পাড়া থেকে এ তো অনেক দূরে। তাছাড়া তোমাদের ওদিকের কেউ এখানে খেলাধূলা করতে আসে না। বুঝতে পারছি তোমরা কারণটা মুখ ফুটে আমাদের বলতে চাইছো না। তা চাইছো না যখন আর চাপাচাপি করবো না। তবে তার কারণটা আমরা যেভাবেই হোক জানার চেষ্টা করবো। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য আমাদের গ্রামেরও অনেকে এই গাছ কাটার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বিশেষ করে মাঠে খেলাধূলা করতে আসা মানুষজন এমনকি ছেলেছোকরারাও। ওদের বিশ্রামের সুন্দর জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে তা তারা মেনে নিতে পারছে না। তবে ক্লাবের মুখের উপর এদের কারোর কথা বলার প্রবণতা নেই বলেই নিজেদের গুঞ্জনের মধ্যে প্রতিবাদগুলো দেয়ানেয়া করছে। এই দেয়ানেয়া চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমাদের কানে আসছে। সেইজন্যে এই সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনা করার একটা বাতাবরণও তৈরী হয়েছে। দেখা যাক, অধিকাংশ সদস্য যদি তোমাদের মতে মত দেয় তো গাছকাটা বন্ধ থাকবে। নাহলে বিরুদ্ধ পরিস্থিতির সম্মুখে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।”
ভোরবেলা দক্ষিণের ফাঁকা মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারতে এসে প্রথম নজরে আসে রতন রুইদাসের! তাদের জীবন নিশান দৌলতপুরের খেলার মাঠের সেই দিগন্ত ছুঁতে উদ্যত বটগাছটার মাথায় দলবেঁধে ওরা বসে! ওদের আগমনে রতনরা ধরেই নেয় গাছের তলায় ভাগাড়ে গরু পড়েছে। কোন বারেই ওদের সেই ধারণা ভূল প্রমাণিত হয়নি। প্রাতঃকৃত্য মাথায় তুলে চুপিসাড়ে সে মারল ছুট সেই দিকে। রতনের মত ওখানকার সব মদ্দর কাছে সবসময় একটা ধারালো ছুরি কোমরে জড়ানো থাকে। ওরা কোন সময়ের জন্যে ঝুঁকি নিতে চায় না। কখন যে গাছটা তার আকাশ-নিশান ওড়াবে তার কোন ঠিক নেই। তাই ওরা এত সাবধানী। নিশান উড়লেই ওদের ছুট মারতে হয়। এটা নাকি ওদের কর্তব্য। না হলে অধর্ম হয়। ওদের কাজ শেষ না করলে আবার ওই শ্যেনের দল খেতে আসতে পারবে না। ওই গাছের উপর বসে অপেক্ষা করতে থাকবে।
কর্তব্য পালনের দায় রতন, নন্দ বা দিবাকর, কারোর একার নয়, রুইদাসদের সকলের। তাহলে রতন নিশানা দেখে চুপিসাড়ে একাই দৌড় দিল কেন? সেটা রতন-নন্দরা খুব ভাল করে জানে। এখন রতন সবার আগে নিশানা নজর করেছে তাই সে নীরব-দৌড় দিয়েছে। নিশান দেখে তার আগে যদি কেউ গিয়ে গরুটাকে একবার ছুঁয়ে দিতে পারে তাহলে গোটা গরুর চামড়াটা তার দখলে চলে যাবে! রতনের জায়গায় নন্দ বা দিবাকর বা রুইদাসদের অন্য যে কোন মরদ হলে সেও তার মালিক হয়ে যাবে।এটা একটা নিয়ম, ওদের মধ্যে কালে কালে চলে আসছে। মনে হবে যেন এই গোপনীয়তায় তাদের অধিকার আছে। কেউ এজন্যে কাউকে তার কাজে বাধা বা দোষারোপ করে না।
হাজার হোক বয়স তো দিনে দিনে কমে না, বাড়ে। বাড়তে বাড়তে শেষের সে দিনে এসে ঠেক খাবে, যেদিন পৃথিবীর আলো-বাতাসের সব মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের মত চলে যেতে হবে। রতনের বয়সের অভিমুখ এখন পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে। তাই সেদিনের সেই যৌবনের গতিতে এখন অনেকটা ভাটার টান। এই ভাটার সুযোগ নিয়ে কোন যুবক ছোঁড়া যদি তাকে টপকে চলে যায় তো তার কপালে ভোঁ-ভাঁ! একবার পেছন ফিরে তাকায়, অন্য কোন ছোঁড়া ছুট মেরে এদিকে ধেয়ে আসছে কি না। আবার সামনে এগোয়। বয়সের সঙ্গে দেহ-মনের এই লড়াই জারি রাখা তার পক্ষে আর যেন সম্ভব হচ্ছে না। তবু মনকে লাঠি বানিয়ে সেই লাঠিতে ভর করে এগিয়ে চলে সে। সবার আগে তাকে গরুটাকে ছুঁতেই হবে। হাতে কাজকম্ম বাড়ন্ত। আয়ে ভাটা। কাজের মরসুমের জমানো টাকা কটা নেড়ে চেড়ে এখন দিন চলে। এই গরুর চামড়াটা পেলে আবার কিছুদিন সংসার-গাড়ির চাকা গড়ানো যাবে। পা চালিয়ে এগোচ্ছে। চোখ কিন্তু চরকির মত চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন দিক থেকে ফুস করে কেউ যদি উদয় হয়ে তার বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দেয় তো হয়ে গেল। সব আশা ভরসা মাঠে মারা যাবার দাখিল হয়ে যাবে তাহলে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেও সে যুদ্ধ জারি রাখে। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র সম মেদিনী।’ আসলে এমনটা ভাবনার কারণ একদম অমূলক নয়। অতীতে এমন অনেক ঘটনার নজির তাদের পাড়ায় অনেকের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে। বিশেষ করে ওদের মত ভারি বয়সের মানুষরা শিকার হয়েছে তাদের থেকে অল্প বয়সী ছেলে ছোকরাদের দ্বারা। সেইজন্যে বেশিরভাগ বয়স গড়ানো মানুষ আর এই টানাপোড়েনের মধ্যে নিজেদের জড়াতে চায় না। আগে ভাগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে দেয়। নিশান দেখলেই আর বকের মত শক্ত হয়ে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে না। রতন এই ভাবনার শরিক হলেও এতদিনের অভ্যেসকে সহজে যেন বশে আনতে পারছে না। তাই এই নিশান-দৌড়।
যা ভাবনা ঠিক তাই, যেন বিধান হয়েছিল আগে থেকে। হঠাৎ রতনের চোখে পড়ল, দৌলতপুর ঘেঁষা তাদের গ্রামের কোরোঙ্গা পাড়ার রাস্তার গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একজন ছোকরা হন-হন করে এদিকে আসছে! এমন সময় অন্য কে বা আসবে। নিশ্চয়ই তার প্রতিপক্ষ কেউ হবে। রতন আরও জোরে পা চালাবার চেষ্টা করল। ব্যাস! ওই চেষ্টাই তার কপাল পোড়ালো। রাস্তায় পড়ে থাকা গোবরের তালে পা পড়ে হড়কে একদম চিৎপটাং! পড়ল তো পড়ল, পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়ল রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে। তবু সে হার মানার পাত্র নয় যেন। পড়ে গিয়ে কোথায় লেগেছে না লেগেছে সে বিচার পরে হবে। ঝপাঝপ সেখান থেকে উঠে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাঃ, পারল না সে। ভাগাড়ে-পড়া গরুর কাছে গিয়ে দেখে ওই মিত্তুনের জোয়ান ছেলে কেলে, গরুর ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই সময় ওরা কেউ কারোর সঙ্গে বাক্যালাপ করে না। নিজের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। গরুর শরীর থেকে চামড়া পুরোপুরি ছাড়িয়ে নেবার পর অন্য কথা। হতাশ রতন তাই কেলের সঙ্গে কোন কথা না পেড়ে মন খারাপ করে ফিরতি পথে বাড়িমুখো হয়। ফিরতে ফিরতে রতন ভাবে, এমন নিয়ম যদি সমাজে চলতে থাকে তাহলে তো কোন বয়স্ক মানুষ কোনদিন চামড়ার অধিকারী হতে পারবে না। অথচ রতনের, তার সংসারের তো পেট-পোঁদ আছে। তার উপরই সবটাই নির্ভর। ওদের সংসার তাহলে কেমন করে চলবে? এ নিয়ম আর চলতে দিলে হবে না। এই নিয়মের বাইরে একটা যুক্তিযুক্ত নিয়ম তৈরী করা অবশ্যই দরকার। সমাজে শুধু কম বয়সী আর ছেলে ছোকরারা বেঁচে থাকবে আর কর্মঠ বয়স্করা পেটে কিল মেরে পড়ে থাকবে তা তো হতে পারে না। নিয়ম পাল্টানোর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবনাগুলো মনেমনে বিড়বিড় করতে করতে রতন বাড়ির দিকে আসতে থাকে। এবার বাহ্যে ফেরার কথা মনে পড়ে। কিন্তু বেলা অনেকটা উপরে উঠে গেছে। মেয়েমদ্দরা সব এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছে। আর ফাঁকায় বাহ্যে ফেরা হবে না। পাড়ার বাঁশ বাগানের আড়ালে নালায় বাঁশ খাটানো পায়খানায় বসতে হবে।
এটা তো একটা ‘বাঁজা’ নিয়ম। এই নিয়মটা অবশ্য খুব বেশি দিনের নয়। তিন কি চার বছরের পুরোনো। এক বিবেচনাহীন নিয়মকে রুখে দিতে গিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি এর জন্ম দেওয়া হয়। এখনকার মত একটু তলিয়ে দেখলে হয়তো সে সময় এটা চালু হোত না। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, একেও সমাধি দিতে হবে। আর যাকে সমাধিস্থ করার জন্যে এই নিয়মের জন্ম তার কথা ভাবলে এখনো গুমরে থাকা রাগ মাথায় চড়ে বসে যেন। সে সময়ের নিয়মটা ছিলো পুরোপুরি একপেশে। যে আগে ‘নিশান’ দেখবে সেই পাবে গরুর পুরো চামড়ার ভাগ। কিন্তু কে আগে দেখেছে, এবং সেই দাবী সত্য, তা সাব্যস্ত করবে কে? নন্দ দক্ষিণ মাঠে তো রতন পুবে বা দিবাকর হাটে বাজারের যাবার রাস্তায়। প্রকৃত ভাবে দক্ষিণ মাঠ থেকে নন্দ আগে দেখলেও সেখান থেকে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পঁচিশ-তিরিশ মিনিট লাগবেই লাগবে। অথচ দিবাকর রতনের থেকে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরেও দেখতে পেলে সে বাজারের রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছে যাবে। যেহেতু দিবাকর আগে পৌঁছে গেছে অথএব পুরো চামড়ার অধিকার বর্তাচ্ছে দিবাকরের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের চলতি নিয়মে ‘সবার আগে নিশান-দেখা’ নন্দ হন্তদন্ত হয়ে নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে গেলে লাগবে নিজেদের মধ্যে লড়াই। নন্দ যতই বলুক সে যে কুড়ি মিনিট আগে দেখেছে, সেই সত্যি কথাটা সে প্রমাণ করবে কেমন করে দিবাকরের কাছে ? জীবন ধারনের তাগিদ তো সকলের। যে পুরো চামড়ার অধিকারী হবে তার সামনেই তো মোটা আয়ের হাতছানি ঘুরপাক খাচ্ছে। যে পাচ্ছে, তার থেকে যাতে বঞ্চিত না হয় তার জন্যে লড়াই তো সে করবেই। আর যে বা যারা না-পাওয়ার দলে রয়ে গেল তারাও পাওয়ার জন্যে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাতে দ্বিধা করবে না। এই দ্বন্দ্বে পড়েই তো বিশাল ঝগড়া-ঝাটি, মারপিট এবং শেষে খুন-খারাপি পর্যন্ত হয়ে গেল। এই চরম পরিস্থিতি এড়াতে আবার পাড়ায় সকলে বসে নতুন নিয়ম চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়।
নিত্যানন্দর বাবা, রাধাকান্ত ঋষিদাস খুন হয়েছিল লোচন রুইদাসের বাবা পরেশের হাতে। বিচারে, খুনের দায়ে পরেশ রুইদাসের ফাঁসির সাজা হয়ে গেল। পরে আপিল মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির সাজা রদ হয়ে যাবৎজীবন হয় পরেশ রুইদাসের। পাড়ার মানুষদের কাছে লোচন রুইদাসদের পরিবার খুনে পরিবার হিসেবে দেগে গেল।
পূর্বপুরুষ থেকে এদের পাড়ায় আট-চালের একটা বড় বাফারা, মানে ফাঁকা সরকারি দালান ঘর আছে। সেখানেই পাড়ার যাবতীয় বিরোধ মিমাংসা বা ভালমন্দ কোন সরকারি আলোচনা হয়ে থাকে। আড্ডা, ক্যারাম,তাস খেলা তো যখন তখন চলে। সব্বাই এই দালানঘরকে আটচালা বলে চেনে। আটচালায় কোন দেয়াল নেই। চারিদিক ফাঁকা। কেবল শক্তপোক্ত শালখুঁটি আর বাঁশখুঁটির ঠেকনা দিয়ে পাকা বাঁশের আড়া-কাঁচি দু’থাকে চার-চার করে আটটা চালে তৈরী। গ্রামে এমন কাঠামো শৈলীতে অনেক বাড়ি আছে। তবে তাতে দেয়াল থাকে। এখানকার আটচালায় যা নেই। বদলে চারফুট উচ্চতায় পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়ালের মত ঘেরা আছে। গোটা কাঠামো টেকসই করার জন্যে আলকাতরা দিয়ে লেপে দেওয়া আছে। সেই আটচালার বিধানে চার বছরের শিশু লোচনকে ট্যাঁকে বেঁধে তার মা’কে গ্রামছাড়া হতে হয়েছিল। আর তাদের পাড়ামুখো হতে দেখেনি কেউ। বড় হয়ে লোচন প্রায় জলের দরে তাদের সেই অভিশপ্ত জায়গা বেচতে বাধ্য হয়। জলের দরে বেচার কারণ, খুনে পরিবারের জায়গা, মানুষের কাছে অপয়া জায়গা। তাই সরাসরি সেই জায়গা পাড়ার কেউ কিনতে চাইল না। অগত্যা পাশের কুমোর পাড়ার অনুকুল কুম্ভকারের কাছে এসে লোচন অনুনয় বিনয় করল যদি তাদের বাস্তুটা ওরা যা দাম দেবার সামর্থ, তাই দিয়ে যেন কিনে নেয়। কিন্তু অনুকুল কুম্ভকার বলল, “আরে বাবু, তোদের রুইদাসদের পাড়ায় বাস্তু জায়গা কিনে আমরা কি বাস করতে যাবো? কি হবে আমার, ওই পতিত জায়গাটা। ওটা আমার কাছে বাঁজা জায়গা ছাড়া আর কিছু না। না পারবো ঘর বানাতে, না পারবো চাষবাস করতে। চাষের জমি হলে না হয় ভাবা যেত। আমরা ও জায়গা নিয়ে ব্যবসার টাকা আটক রাখতে পারবো না রে, তুই অন্য কারোর কাছে যা। দেখ তারা কি বলে।” কিন্তু লোচন তো নাছোড়বান্দা। কুমোরদের মধ্যে এই অনুকুল কুম্ভকারই মাটির হাঁড়ি-কলসির ব্যবসা করে কাঁড়ি পয়সা করেছে। ওর এই ব্যবসার কপাল এখন তুঙ্গে। কুমোরদের কেউই ওর মত ফুলে ফেঁপে উঠতে পারেনি। এই অঢেল টাকা থেকে কিছুটা তার জমি কেনার জন্যে সরিয়ে দিলে ওর ব্যবসায় কোন আঁচড় লাগবে না। তাছাড়া পয়সাওলাকে সবাই একটু সমীহ করে চলে। আরও কয়েকজন কুমোরবাড়ি লোচন যে ঢুঁ মারেনি তা নয়। তারা একদম ঘাড় পাততে চায়নি। বরং উল্টে পাশ কাটায় অনুকুলবাবুর দিকে ঢেসিয়ে, “আমাদের ‘বন্নে’র মানে জাতের মধ্যে তোমার ওই জমি কিনলে একমাত্র অনুকুল কুম্ভকারই কিনতে পারবে। সাগর থেকে একফোঁটা জল তুলে নিলে অনুকুলবাবুর সম্পদের আড়ে-বহরে কোন প্রভাব পড়বে না। তুমি ওকে গিয়ে ভাল করে পাকড়াও। তারপর মানুষটাও খারাপ নয়। দয়ালু মন। ওই মনটাকে ভেজাতে তোমার বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। এবার দেখাও তোমার কেরামতি।”
এবার নিরুপায়ে অনুকুলবাবুর হাত ধরে বলে, “বাবু, অনেকের দোর ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে এসেছি। পাড়ায় ভালমানুষ হিসেবে, পরোপকারি হিসেবে তোমার নাম যশ আছে। তুমি যদি আমায় ফিরিয়ে দাও তো আমি আর কোথায় যাই। আর কারোর দোরে যাবার রাস্তা আমার সামনে নেই। তুমি আমার দিকে একটু মুখ তুলে চাও কাকা। তুমি যদি ওই জায়গা নাই-ই ব্যবহার করতে পারো তো পরে আমাদের পাড়ার অন্য কাউকে বেচে দেবে। তুমি একবার কিনলে জায়গাটা শুদ্ধ হয়ে যাবে। ওটা যে ‘খুনেদের জায়গা’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন এ’পাড়ায় যে পয়সা করেছে, তোমার কাছ থেকে তারও জায়গা কিনতে কোন বাধা থাকবে না। তখন সে তো আর একজন ‘খুনে’ পরিবারের কাছ থেকে জায়গা কিনছে না। ভাল মানুষের কাছ থেকে কিনছে। আর যে দরে তুমি আমার কাছ থেকে কিনছো তার থেকে অনেক বেশি দর তুমি হাঁকলে তাতেও ওরা মুখ ফেরাবে না। কেননা আমাদের ভদ্রাসনটা তো একদম পাড়ার আটচালার পাশেই না? গমগমে জায়গা। পাড়ার আর কোথাও তো দু’দন্ড হাত-পা ছড়িয়ে সময় কাটাবার জায়গা নেই। এই আটচালাটাই একরকম বলা যায় এ’পাড়ার এজমালি সম্পত্তি। তাই দিনরাত লোক এখানে আড্ডা দেয়, রেডিও নিয়ে গান শোনে। সুখ-দুঃখের গল্প করে। ভাল-মন্দ কথা-চালাচালি করে।” এই ‘ভাল-মন্দ কথা চালাচালির’ কথা বলতেই অনুকুল মৃদু ধমক দিয়ে লোচনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর বলিস না। ওই আটচালাতেই তো বিন্দের মা আর যতনের মা গ্যাঁট হয়ে বসে আশু আর চোনোর বউয়ের কেচ্চা নিয়ে সমালোচনার ঢেউ বইয়ে দিয়েছিল। একটু দূরে কমলেরর মা আড়-কানে শুনে লাগিয়ে দিয়েছিল চোনোর কানে! সেই নিয়ে কি লঙ্কা কান্ডটা না ঘটে গেল তোদের পাড়ায়। শেষ পর্যন্ত আটচালায় বাঁখারির বেড়া বানিয়ে সেটা বন্ধ করে দিতে হল।” অনুকুলের কথার রেশ ধরে লোচন বলল, “তাতে কি আর পাড়ায় কেচ্চা বন্ধ হয়েছে কাকা, হয়নি। সে অনেক গপ্প আছে। আজ না, সময়-ফুরসৎ হলে পরে অনেক কাহিনী তোমাকে বলবখন। হ্যাঁ, যে কথা তোমাকে বলছিলাম, “আটচালার জন্যে ওই জায়গার সামনে অনেকটা প্রশস্ত হাওদাখানা। আলো-বাতাস সবসময় খেলে বেড়ায়। আমাদের এই জায়গাটার ওপর পাড়ার কয়েকজনের লোভ আছে। শুধু আমাদের জায়গাটা ‘খুনি পরিবারের জায়গা, গ্রামের কেউ কিনতে পারবে না’ বলে মাতব্বরদের হুলিয়ার জন্যে পাড়ার কেউ সাহস করে কিনতে পারছে না। তুমি নিলেই দেখবে তোমার কাছে কতজন এসে হামলে পড়বে জায়গাটা নেবার জন্যে। এ’জায়গা নিলে তোমার ঠকা হবে না গো কাকা।”
লোচনের এই যুক্তিটা এবার মাথায় ঢোকে অনুকুল কুম্ভকারের। অনুকুল এবারে লোচনের বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে কিছুটা সন্ধানী বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বলে, “তুমি যখন এত করে বলছো তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমাকে জমিটা কিনতে হবে। তোমাদের পাড়ার লোকের যা মতিগতি তা তো অন্য মানুষের মত স্বাভাবিক মনের নয়। এত উগ্র মনের মানুষদের মধ্যে আমাকে পড়তে হবে। তারপর পেটে দু’এক পাঁইট চোলাই পড়লে তো আর রক্ষে নেই। ওই মাতাল-জাঁতালদের মোকাবিলা করাই একটা বিশাল ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। সেই ঝুঁকির মূল্য তোমাকে দিতে হবে লোচন। তুমি যা দাম চাইছো তা তোমাকে বিবেচনা করতে হবে। অত দাম আমি দিতে পারবো না। আমি কুমোর পাড়ার লোক তোমাদের রুইদাস পাড়ায় জমি কিনে মনে হচ্ছে স্বস্তিতে থাকতে পারবো না। ঝামেলা আমাকে পোহাতেই হবে।”
অনুকুলের কথায় লোচন চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল, এমনিতেই কম দামে জায়গাটা ছাড়তে হচ্ছে। অনুকুলকাকা আমার বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে। ভাবছে আমি বুঝছি না। কিন্তু এখন তার কিই বা করার আছে। জমি তো তাকে ছাড়তেই হবে। আধাকড়িতে হলেও ছেড়ে দিতে হবে। না হলে ওই জমি লুঠপাঠ হয়ে যাবে। অনুকুলকাকা যখন নিতে রাজি হয়েছে তখন ওর শর্তকে মেনে নিতে হবে। কিছু তো করার নেই, “ঠিক আছে কাকা, আমার যা দাম তা তো আমি তোমাকে বলেছি। এবার যে টাকা দিলে তোমার ধর্মে সইবে তাই দাও। একটু মনে মনে আহত হয়েই আমি কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা আমি এখন খন্দে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই সবটাই তোমার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম। কবে দস্তখত করতে হবে বোলো। তবে যা করার তাড়াতাড়ি করবে কাকা। আমার আর দেরি করার উপায় নেই।”ক্রমশ……….
-
ধারাবাহিক- বাজীকর (পর্ব-৩)
বাজীকর (পর্ব-৩)
-অযান্ত্রিক“রাজা হলো, দিল্লীর ফিরোজ শাহ মাঠের কিউরেটর। মাঠ বানান, পিচ তৈরি করা এইসব ছিল ওর কাজ। সেবার শীতের পোশাকের ব্যবসা করবো বলে আমি দিল্লী গেছিলাম মাল আনতে। আর আমার ক্রিকেট খেলার প্রতি টান যে ছোটো বেলার থেকেই সে তো জানোই। কাকতলীয় ভাবে আমি এক মহাজনের কাছে মাল নিতে গেছি, আর ঠিক তার পরের দিনই ভারত বনাম পাকিস্তানের টেস্ট খেলা। আমি মহাজনের কাছে একটু খোঁজ খবর নিতেই, উনি বললেন আমি আমার পুরো মাল যদি ওনার কাছ থেকে নিই তাহলে উনি আমায় একটা টিকিট ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। যদিও ওনার কাছ থেকে সব মাল নিলে, আমার একটু বেশী লাগতো তবে ভেবে দেখলাম টিকিটের দাম তার থেকে অনেক বেশী লাগতো। আমি আর সাত পাঁচ না ভেবে বললাম ঠিক আছে তাই হোক, ওনাকে পুরো অর্ডার বুঝিয়ে দিতেই উনি আমায় একটা পাঁচদিনের টিকিট দিলেন ক্লাব হাউজের। আমি খেলা দেখার উত্তেজনায় সেদিন সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না প্রায়। সকালে যথারীতি একটু সকাল সকাল টিকিট হাতে পৌঁছে গেলাম মাঠে। লাইন দিয়ে ঠিক সময় ভিতরে ঢুকতেই দেখি, একদম সামনের সারিতেই আমার বসার জায়গা। জীবনে প্রথমবার সামনে থেকে অতোবড় বড় খেলোয়ারদের সামনে থেকে দেখে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম আমি। খেলা শুরু হতেই আমি উত্তেজনার চরমসীমায় পৌঁছে গিয়ে একটু লাফালাফি করে ফেলি, কিন্তু পরক্ষণেই আশেপাশে লোকের বিরক্তি ভরা চাউনি দেখে নিজেকে সামলে নিতে থাকি। তারপর থেকে চুপচাপ বসে খেলা দেখতে শুরু করি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করি প্রত্যেকটা বল হওয়ার আগে কেউ যেন যেন আমার কানের কাছে এসে বলে যাচ্ছে, কত রান হবে কিম্বা আউট হবে কিনা, আর আশ্চর্যও হয়ে যাচ্ছিলাম দেখে, যা বলছে ঠিক তাই হচ্ছে, চার বললে চার, এক রান বললে এক, আর নো রান বললে ডট বল। সব থেকে অবাক হলাম যখন দেখলাম কুম্বলের একটা বলের আগে সেই অচেনা স্বর বলল আউট আর ওমনি একজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে পিছনে ফিরে দেখি, আমারই বয়সই একটা ছেলে আমার ঠিক পিছনটায় বসে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। আমাকে তাকাতে দেখে হেসে হিন্দিতেই বললো “আমি রাজা“ আমি আর কিছু কথা বলার আগেই আমাদের খেলা দেখার জায়গায় কজন সম্মানীয় ব্যক্তি এসে পড়াতে সবাই হই হই করে উঠলো, মাঠের থেকে ক্যামেরাও আমাদের দেখাতে লাগলো মাঠে লাগানো বিশাল টিভিটাতে। আমিও নিজেকে টিভিতে দেখে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠলাম আমাকে দেখাচ্ছে কিন্তু আমার পিছনের ছেলেটাকে তো দেখাচ্ছে না। আমি পিছনে ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অথচ ক্যামেরা ওকে দেখতে পাচ্ছে না? আমি আমার পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করাতে তিনিও জানালেন আমার পিছনের সীটটা খালি। অথচ আমি স্পষ্ট দেখছি রাজা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি বুঝতে পারলাম আমি ছাড়া রাজাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না, নিজের বোঝার উপরে নিজেরই আশ্চর্যও লাগলো, তাহলে কি আমি ভুত দেখছি? কিন্তু আমার ভয় লাগছে না তো। আমার এই ভাবনা চিন্তার মধ্যে সেই দিনকার খেলা শেষ হয়ে গেলো। আমি ক্লাব হাউজ থেকে বেরবার সময়ও দেখলাম উপর থেকে রাজা আমার দিকে তাকিয়েই হাসছে। সেদিন বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর কিছুতেই ঘুম আসছে না, তাই বাসার সামনে একটা ছোট্ট বারান্দার মতো জায়গায় এসে বসেছিলাম। তেমন কুয়াশাও ছিল না, কিন্তু তার মধ্যে আমার মনে হলো, রাস্তার ওপার থেকে কেউ যেন হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। আমি যাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবতে ভাবতে সেই ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেলো। বরাবরই আমার ভুত প্রেতাত্মায় খুব একটা বিশ্বাস নেই, তাই ভয়ও তেমন পাই না। আমি আবার ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, মনে হল কেউ যেন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ খুলে তাকাতেই দেখি, রাজা আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে, আমি ধড়মড় করে উঠে বসতেই সে “মা” বলে একটা কাগজ আমার হাতে দিলো । আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম ওটা ফিরোজ শাহ কোটলা ময়দান কর্তৃপক্ষের দেওয়া একটা পরিচয় পত্র,তাতে রাজার ছবি দেওয়া, নাম লেখা রাজারাম চৌধুরি কিউরেটর আর তার নীচে একটা ঠিকানা লেখা। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখি ঘরে কেউ নেই। সেই রাতে আর ঘুম এলো না, সকালের আলো ফুটতেই আমি তৈরি হয়ে মাঠে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু মাঠের সিকিউরিটি বললো, সময়ের আগে মাঠে ঢুকতে দেবে না, তাই বাইরেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। গেটের ভিতর থেকে একজন উর্দি পরা লোক আমায় অপেক্ষা করতে দেখে খুব সন্দেহের চোখে দেখে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। তখন সবে একজন দু’ জন করে দর্শক এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। আমি ঐ উর্দি পরা ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জমালাম। একটু বাদে জানতে চাইলাম রাজার ব্যাপারে। ভদ্রলোক জানালেন উনি খুব ভালো চিনতেন রাজা রামকে। মাঠের কাজ করতো, খুব ভালো ছেলে ছিল, মা আর ছেলে কাছেই বস্তিতে থাকতো। কিন্তু কি যে হল, কি করে ও বেটিং-এর বদনেশায় পরলো কে জানে, এক্কেবারে শেষ হয়ে গেলো। আর দেখো ওর মা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে লোকের দরজায় দরজায় দু’টো খাবারের জন্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। রাজার সাথে কি হয়েছিলো আমি জানতে চাইব ঠিক তখনই একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা আমার কাছে এসে হাত পাতলো। আর ঐ উর্দি পরা ভদ্রলোক আমাকে বললেন “এই দেখো আমি যার কথা বললাম সেই রাজারামের মা ইনিই, দেখছ ছেলের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। আমি কিছু বললাম না শুধু পকেট হাতড়ে দেখলাম একটা একশ টাকার নোট পেলাম সেটাই দিয়ে দিলাম ঐ ভদ্রমহিলাকে। আমাকে চমকে দিয়ে পরিস্কার বাংলায় সেই ভদ্রমহিলা বললেন ”ভগবান তোমার ভালো করুক বেটা” এর মধ্যে মাঠে ঢোকার গেট খুলে যাওয়াতে আমায় ঢুকে যেতে হলো। ক্লাবহাউজের দিকে যেতে যেতে একটা ছেলে আমার পিছনে পিছনে এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো “আপ রাজারামের দোস্ত আছেন না?” আমি “হ্যাঁ” বলতেই সে আমার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বললো “তব তো হামাদের ভি দোস্ত আছেন, চোলেন একসাথে বসে খেলা ভি দেখবে আর নিজেরাও খেলবে“ আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে, না বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না কেউ যেন জোর করে আমাকে দিয়ে হ্যাঁ বলিয়ে দিলো। খেলা দেখার জায়গায় গিয়ে ছেলেটা কাল রাজা ঠিক যেই জায়গায় বসেছিল ঠিক তার পাশের সীটটাতে বসলো। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। খেলা শুরু হতেই আমি বুঝতে পারলাম রাজা এসে ঠিক পিছনের খালি সীটটাতে এসে বসলো। ছেলেটা আমার কাঁধে হাত রেখে বললো “হামার নাম নিরাজ শুক্লা আছে, দোস্ত তুমার নাম কি আছে?” আমি আমার নাম বলতে সে বলল, “নাম সে কি যায় আসে? রাজার দোস্ত তো হামার ভি দোস্ত, তবে এই বরিং খেলা দেখতে দেখতে আমরা নিজেরাই একটা খেলা খেলি?” আমি না বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ”ঠিক আছে” বলে ফেললাম, বুঝতে পারলাম আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। শুনে নিরাজ বলল “তো চলো বিনোদ ভাই, হামরাও খেলা শুরু করি। এটা খুব সহজ খেলা হচ্ছে, আন্দাজের খেলা, ধরেন সামনে যে ওভার বল হবে তাতে কোতো রান হবে বলতে হবে। ধরো হামি বললাম দশ রান হবে, তুমি বললে না কম হবে। ওভার শেষ হলে যদি দশ রান হয় তুমি আমায় দশ টাকা দিবে আর কম হলে আমি দশ টাকা তোমায় দেবো । চল শুরু করো “আমি আবার না বলতে যাচ্ছিলাম কারণ তখন পকেটে উড়ানোর মতো টাকা আমার ছিল না কিন্তু বলতে পারলাম না জানো! সেই আগের মতই সম্মতি জানিয়ে ফেললাম। আমাদেরও খেলা শুরু হলো, নিরাজ বললো, এই ওভারে দুই রান হবে, ওমনি রাজা আমার কানে কানে বলল না চার হবে। আর বিশ্বাস করবে কিনা জানি না হলোও চার রান। নিরাজ আমায় চার টাকা দিলো। তারপরের ওভারে বললো এই ওভারে যদি কেউ আউট হয় তাহলে পঞ্চাশ তুমি দিবে যদি না হয় তাহলে আমি একশ দিবো । আমি আগের মতই বললাম আউট আর বলতে বলতে পাকিস্তানের একজন আউট হয়ে গেলো। আর নিরাজ আমায় কথা মতো একশ টাকা দিলো। আমার পকেট থেকে একটা টাকাও খরচ হলো না বরং সারা দিনে নিরাজ প্রায় হাজার টাকা আমার কাছে হেরে গেলো, ভুল হলো বরং বলা উচিত আমাকে দিয়ে খেলানো রাজার কাছে। খেলা শেষ হয়ে বেরনোর সময় দেখলাম রাজা আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতার হাসি হাসছে। নিরাজকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলাম। এতগুলো টাকা হেরেও ওর কোন দুঃখ নেই, উল্টে আমাকে বললো, “সাচ মে বিনোদ ভাই, তুমি রাজারাম ভাইয়ের সাচ্চা দোস্ত আছো, রাজাভাই ভি কভি হারতা নেহি থা, জিন্দেগী মে একবার হারা আউর দুনিয়া সে বাহার চলা গ্যায়া। পার কাল ভাই কাল মেরা আউর এক দোস্ত কে ভি লিয়ে আসবো। ওহ একদম জ্যোতিষ আছে, যা বলে তাই হয়।“ আমিও অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম কালই দেখা যাবে। গেট থেকে বেরিয়ে এসে আমার মাথায় একটা চিন্তা এলো, এই টাকাগুলো জিতেছে রাজা আমি তো শুধু মাধ্যম, আর এই টাকাগুলোর আমার কোনো প্রয়োজনও নেই। তাহলে কোন ভাবে যদি এই টাকাগুলো রাজারামের মা এর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় খুব ভালো হয়। যেমন ভাবা তেমনই কাজ আমি সকালের সেই উর্দিপরা ভদ্রলোককে খুঁজে বার করলাম। তারপর তার কাছ থেকে রাজারামের মায়ের ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে গেলাম রাজারামের বাড়ি। বাড়ি বলার চেয়ে ঝুপড়ি বলাই ভালো। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আমি বাইরের থেকে রাজা রাজা বলে ডাকতেই সকালের সেই ভদ্রমহিলা “কউন হ্যাঁয়” বলে বাইরে বেড়িয়ে এলেন। তারপর আমায় দেখে আবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বললেন “কউন হয় বেটা, রাজা সাথে কি কাম আছে?” আমি বেশ বুঝতে পারলাম উনি আমায় চিনতে পারেননি। আমি বললাম, “আমি রাজার দোস্ত আছি। রাজা নেই?” উনি বাইরে বেড়িয়ে এসে আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। আমিও দেখলাম ওনাকে তুমি বললে বিশ্বাস করবে না সুনন্দদাদা ওনাকে দেখতে অবিকল আমার পিসির মত যিনি বেশ কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। উনি আমায় ঝুপড়ির ভিতরে নিয়ে বসালেন তারপর সকালের মত পরিস্কার বাংলায় বললেন “তুমি কে বাবা? তোমার কথা তো আমি রাজার কাছে কোন দিন শুনিনি। আমার কথা শুনে ঘাবড়ে যেও না আমি বাংলারই মেয়ে, ভাগ্যচক্রে এখানে এসে পড়েছি, কয়েকবছর আগে স্বামী গত হয়েছেন তারপর মাস ছয়েক আগে ছেলেটাও চলে গেলো। কিন্তু ও কোনোদিন বলেনি তো ওর কোন বাঙ্গালী বন্ধু আছে।“ আমি কোনো রকমে ওনার প্রশ্নের জাল এড়িয়ে ওনার হাতে টাকা কটা দিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম। কিছুটা এগিয়ে আসতেই দেখি রাস্তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে রাজা, আর ওর মুখটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পর দিন সকালে মাঠে যেতেই দেখি সেই উর্দিপরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক গেটের কাছে। আমাকে দেখতেই উনি বললেন “বেটা তুমি তো বললে তুমি রাজার দোস্ত আছো, কিন্তু তুমি যে রাজার দূর সম্পর্কের ভাই সেটা তো বলোনি।” আমি একটু হেসে বললাম আপনি জানলেন কি করে?” উনি বললেন “আজ সকালে রাজার মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো সেই বললো“ আমি কিছু বললাম না শুধু একটু হেসে মাঠের দিকে চলে গেলাম। ভিতরে দেখা হয়ে গেলো নিরাজের সাথে ও আজকে ওর বন্ধু অভিজিৎকে নিয়ে এসেছে। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সেদিনও আমি অনেক টাকাই জিতলাম রাজার সাহায্যে। আর সেই টাকাও দিয়ে এলাম রাজার মা’কে, সেদিন রাজার বাড়ি যেতেই রাজার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর কান্না জড়ানো গলায় বললেন জানো আমার ছেলেটা খুব ভালো ছিল, মাঠে কাজ করার সুবাদে প্রচুর বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয় ছিল ওর, তাদের কেউ ভালো ছিল কেউ খারাপ, আমার ছেলেটা সেই ভালো খারাপের ফারাক করতে পারল না। শেষ হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম বাড়িতে টাকা দিত খাওয়া পরার খবর রাখত। কিন্তু তারপর কি যে হলো, জুয়া খেলার নেশায় সব শেষ হয়ে গেল । একবারও আমার কথা ভাবলো না । আমি সেদিন ওনাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আবেগের বশে পিসি বলে ডেকে ফেললাম। সেদিন ফেরার পর রাতে আমাকে আবার দেখা দিলো রাজা আর একপ্রকার মিনতি করলো আমি যেন ওর মাকে আমার সাথে নিয়ে আসি তার জন্য যি আর্থিক সাহায্য লাগে ও সব করবে এই বাজি ধরার মাধ্যমে। শুধু আমায় একটাই কথা দিতে হবে আমি প্রয়োজন ছাড়া ওর সাহায্য পাব না আর সে প্রয়োজন যেন কোনো ভাবে প্রাচুর্য আর বিলাসিতার জন্য না হয়। তাহলে ও আমাকে কোনো সাহায্য করবে না। এতদূর বলে বিনোদ থামলো। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে চা এসে গেছিল। এবার বিনোদ চুপ করতে বউমা বললো শুধু বসে অপেক্ষা করলে চলবে একটু কিছু খেতেও তো হবে নাকি। একটু মুড়ি বাতাসা দিয়ে গেলাম খেয়ে নাও, আর সত্যি দাদা কাল তুমি না থাকলে কি যে হতো? কাল সারারাত আমরা দু’জনে চোখের পাতা এক করতে পারিনি, আমি তোমাকে যখন দেখা হোল তখনই বলতাম কিন্তু পাছে তুমি ভয় পাও তাই বলিনি, কাল তুমি যাকে দেখেছ সে রাজা” মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো বৌমা “বিনোদ কাল সারাক্ষণ আমার সাথেই ছিল তোমার বাড়ি যায় নি“
সুনন্দ একটু হেসে বললো, “সত্যি রে বিনোদ তুই আসল বাজীকর, যে নিজের লোভের সংযমের বাজি খেলে প্রতিবার আর জিতে যায়, তোর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে গেলো।“
বলতে বলতে দরজা খোলার শব্দ হলো, আর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল বিনোদ। ভিতরে ঢুকতেই সুনন্দকে দেখে বিনোদ বলে উঠলো “আরে সুনন্দদাদা তুমি কখন এলে, তোমাকে একটা ভালো খবর দিই। জানো পিসি ভালো আছে ডাক্তার বলেছে ভয়ের আর কোন কারণ নেই, তুমি কাল যা উপকার করলে, তুমি আমার ভগবান।”
সুনন্দ চমকে টুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, টুলটা খালি কেউ নেই। সুনন্দর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে ওর মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বেরলো “তাহলে এতক্ষন?” -
ধারাবাহিক- বাজীকর (পর্ব-২)
বাজীকর (পর্ব -২)
-অযান্ত্রিক“আজকে কি তুই বিপদে পরিস নি? তাহলে খেলতে অসুবিধা কোথায়“ জানতে চাইলো সুনন্দ।
“আমার কাছে টাকা নেই গো দাদা, আর যা আছে সেটা দিয়ে খেললে অমৃতদা জানতে পারবে, আমি মিথ্যেবাদী হয়ে যাবো, তার থেকেও বড় কথা কাল সকাল হতেই চুড়ান্ত অশান্তি করবে, তাই তুমি ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।”
বিনোদের কথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো সুনন্দর মাথায় “তাহলে একটা কাজ কর, তুই তোর নামে খেলিস না, আমার হয়ে খেল, যা জিতবি সেটা তোর, তোকে আর শোধ করার চিন্তায় থাকতে হবে না আর অমৃত জানতে পারবে না“ বললো সুনন্দ।
“আমি জানতাম তুমি আমায় জুপিটারের হয়ে খেলতে বলবে, ওটা যে তোমার আই.ডি, সেটাও জানি গত সপ্তায় দিল্লীর খেলায় তুমি এগারো হাজার টাকা জিতেছ সেটাও জানি“ খুব নিঃস্পৃহভাবে বললো বিনোদ।
“তাহলে কি বলছিস? খেলবি? আমার হয়ে জিতলে জেতার টাকা তোর, আর মিনিট দশেকের মধ্যে এন্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে, তারপর সুযোগ থাকবে না“ খুব উৎসাহ নিয়ে বললো সুনন্দ।
বিনোদ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে ফোনটা কানে দিলো “মালতি, পিসি কেমন আছে? হ্যাঁ, চাপ নেই, ব্যবস্থা হয়েছে আমি আসছি একটু পরেই, তুমি ইঞ্জেকশনটা নিয়ে নাও” বলে সুনন্দর দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি রাজী, কিন্তু টাকাটা নগদ দেবে তো এখন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ সে আর বলতে, আমার কথায় ভরসা হচ্ছে না, এবার বলতো কলকাতায় কত লাগাবো?” উত্তেজিত হয়ে বললো সুনন্দ।
বিনোদ একবার চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলো, সারা ঘরের আলোগুলো একবার আচমকা দপদপ করে উঠলো, আর সেই সঙ্গে পুরো ঘর একটা বিশ্রী গন্ধে ভরে উঠলো এই গন্ধ সুনন্দের চেনা। শ্মশানের গন্ধ, মরা পোড়ার গন্ধ এটা, আর সেটা বুঝতে পেরেই সুনন্দর বুকটা একটা অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলো। আর তখনই “নন্দদা কলকাতার আজ রেট যতই বেশী থাক আজ কলকাতা হারছে। ব্যাঙ্গালোরে দশে কুড়ি দিচ্ছে, ওখানে ছয় হাজার লাগাও আর স্বপ্নের দলে যাদের নাম বলছি তাদের নিয়ে দল বানাও, তাড়াতাড়ি করো আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে। সুনন্দ চমকে ওঠে, দেখলো কথাগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলছে বিনোদ কিন্তু গলার স্বরটা বিনোদের স্বাভাবিক বিনোদের মতো নয়, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আছে হালকা, ফ্যাশফ্যাশে, পরিচিত আর বিনোদের চোখ দু’টো ভাটার মতো জ্বলছে ।
সুনন্দ কোন প্রশ্ন করলো না, ঐ অপরিচিত স্বর যেমন বললো ঠিক তেমন করে গেলো। ওর সিলেকশন শেষ হতেই, এন্ট্রি বন্ধ হয়ে গেলো। আবার সে স্বর ভেসে এলো সুনন্দর কানে কিন্তু এবার স্বরে আদেশের ভাব খুব স্পষ্ট ”আমার টাকাটা দিয়ে দিতেই পারো, আমি যখন বলেছি তখন তুমি জিতবেই, বিনোদ কোনোদিন হারে না, চালাকির কোনো চেষ্টাও করতে যেও না, মাসিমা রান্নাঘরে রুটি করছেন আর উনি জানেনও না সিলিন্ডারের থেকে গ্যাস লিক করছে। আমি অপকার করা ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু শাস্তি এখনো দিতে পারি“
“না না আমি এক্ষুণি টাকাটা দিচ্ছি, আমায় ভুল ভাবছিস তুই, একটু দাঁড়া আমি টাকাটা নিয়ে আসছি?” বলে বিনোদের কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করতে গিয়ে সুনন্দ দেখলো বিনোদের শরীর থেকে প্রচণ্ড তাপ বেরোচ্ছে আর চোখ দু’টো সেই লালই হয়ে আছে। সুনন্দ প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে, রান্নাঘরের এসে দরজা ঠেলে ঢুকতে গিয়ে দেখলো দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, আর ভিতরে খুব জোরে রেডিও চলছে, সুনন্দ চিৎকার করে উঠলো, “মা..মা’ কিন্তু কোনো সাড়া এলো না। তার বদলে ওর ঘর থেকে বিনোদ বেড়িয়ে এসে দাঁড়ালো, “সুনন্দদা, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
“দ্যাখ না মা দরজা খুলছে না, ঠিক আছে এক মিনিট“ বলে বিনোদের পাশ দিয়ে সুনন্দ নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে টাকাটা বার করে এনে বিনোদের হাতে দিলো।“ দাদা ট্রেলার দেখেই তোমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, পুরো সিনেমা দেখালে কি করতে গো? আমি যদি এখান থেকে অতো দূরে হওয়া খেলায় কি ঘটবে বলতে পারি তাহলে আমার থেকে এক হাত দূরে থাকা তুমি কি কি করবে একটু পরে সেটা জানতে পারবো না? আমি জানতাম তুমি টাকাটা নিয়ে ঘোরাতে, খেলা শেষ না হলে তুমি টাকা দিতে না, তাই এই নমুনা দিলাম, টাকাটার খুব দরকার দাদা” টাকাটা হাতে নিয়েই বললো সেই ফ্যাশফ্যাশে স্বর। “এই নে ভাই তোর টাকা, শুধু একটাই অনুরোধ আমায় ভুল বুঝিস না ভাই“ কাতর হয়ে বললো সুনন্দ। বিনোদ একটা শ্লেষের হাসি দিয়ে বললো “চিন্তা করো না দাদা, রাজার ভুল হয় না, এতো বছরে হয়নি, আজও হবে না“ সুনন্দর সে সব কথা কানে গেলো না , বিনোদ কে সরিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরের কাছে যেতেই দেখলো, মা ওর ঘরের দিকেই আসছেন।“ বাবু দেখ না, রান্না ঘরে বড্ড গ্যাসের গন্ধ বেরচ্ছে, বুঝতেই পারছি না কোথা থেকে আসছে” কথাগুলো সুনন্দর কানে যেতেই ধরে প্রাণ এলো যেন সুনন্দর, তার সাথে দুশ্চিন্তাটা বদলে গেলো একটা অজানা ভয়ে।
“থাক, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, তুমি আমার ঘরে গিয়ে বসো তো, আমি বাইরে থেকে রুটি আর তরকারী কিনে আনছি” বলে সুনন্দ মা’কে ঘরে একরকম জোরে করে ঢুকিয়ে দিল, “নন্দদা আমি আসি, আজ তুমি আমার যা উপকার করলে আমি জীবনে ভুলবো না, প্লীজ কাউকে কিছু বোলো না, জানোই তো” বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো বিনোদ “হ্যাঁ হ্যাঁ তুই আয়, আর পিসি কেমন থাকে কাল জানাস একবার’ কিছুটা আপদ বিদায় করার ঢঙ্গেই বলে উঠলো সুনন্দ। তার পর নিজের ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবীটা পড়তে পড়তে মাকে বললো, “তুমি বসো, আমি কানাইদার দোকান থেকে রুটি আর আলুর দম নিয়ে আসছি, রান্নাঘরে যেতে হবে না, আমি রান্নঘরের জানলা দরজা খুলে রেখে যাচ্ছি“
কানাইদার দোকানে যেতে যেতে, ভাবতে লাগলো ওর সাথে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। বিনোদ তো ওর কাছেই দাড়িয়ে ছিল, তাহলে এসব ও করলো কখন? নাকি ও আগেই ঘটিয়ে রেখে ছিল ওর থেকে পয়সা বার করার জন্য। দোকানে বেশ ভিড় রয়েছে তাও কোনো রকমে অর্ডারটা দিয়ে, বাইরে এসে দাঁড়িয়ে মোবাইলে খেলার রেজাল্ট দেখবে বলে মোবাইলটা পকেট থেকে বার করলো। ‘কি ব্যাপার, সুনন্দদা মাসিমার কি শরীর খারাপ তুমি রুটি নিতে এসেছ?” শুনে মুখটা তুলতেই দেখলো অমৃত দাড়িয়ে।
“না না মার শরীর ঠিকই আছে, বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারের থেকে লিক করছে, এই রাতের বেলায় লোক পাব কোথায়, তাই মাকে বললাম আজ রুটি বাইরে থেকেই নিয়ে আসি। ছাড় ওসব কথা, তোর খেলার কি খবর“ জানতে চাইলো সুনন্দ।
“আর খেলা, শালা আমার ব্যাড লাকটাও খারাপ মাইরি, কলকাতায় লাগালাম, ভালো রানও করলো কিন্তু ব্যাঙ্গালোর যা কেলান কেলাচ্ছে হয়তো দেখবে এক্ষুণি খেলা শেষ হয় যাবে” একরাশ হতাশা নিয়ে বললো অমৃত, আর তখন টিং করে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো অমৃতের ফোনে, ফোনে ম্যাসেজটা দেখে চরম বিরক্তি নিয়ে বললো, “বললাম না, শালা ডুবে গেলো, ভাগ্যিস বিনোদের কথায় কলকাতায় বেশী টাকা লাগাইনি, তাহলে আরও ডুবতাম, এই জুপিটার ব্যাটা কে, কে জানে? মালটা ভালো জিতলো। এ নির্ঘাত ওদের নিজের লোক।“
“নন্দদা তোমার খাবার রেডি নিয়ে যাও“ দোকান থেকে একটা ছেলে এসে জানাল সুনন্দকে। “হ্যাঁ, চল নিচ্ছি, অমৃত এলাম রে ভাই beter luck next time“ বলে তড়িঘড়ি এগোতে লাগলো সুনন্দ, ওর ফোনেও একটা ম্যাসেজ এসেছে কিন্তু অমৃতের সামনে সেটা বার করে দেখার সাহস পাচ্ছে না সুনন্দ। রুটির প্যাকেট নিয়ে দোকান থেকে একটু এগিয়ে এসে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখল ম্যাসেজ এসেছে জিতবে কে থেকে, congratulation , you have won rs 13000 towards ZITBE KE with a bonus of rs 1000 is credited to your registered bank account“ দেখে সুনন্দ বুঝতেই পারছে না খুশী হবে কি হবে না,এতো অবিশ্বাস্য।
‘চলো নন্দদা আমারও হয়ে গেছে, একসাথেই যাই।“ পাশ থেকে এসে বললো অমৃত, “জুপিটার ব্যাটার ভাগ্য খুব ভালো, আজ যদি আমাদের বিনু খেলত তাহলে জিতত কিন্তু বিনুই। আমি রাগ করছিলাম ঠিকই কিন্তু জানো তো বিনোদকে আমি মনে মনে খুব শ্রদ্ধা করি। ওর মতন ক্ষমতা থাকলে আমরা কবেই ভেসে যেতাম, ও কিন্তু যায়নি। আর আমি অবাক হয়ে যাই ওর সংযম দেখে, তুমিও লক্ষ্য করে দেখবে ওর কোনো বদগুণ নেই, এমনকি কোনো বিলাসিতাও নেই। সব থেকে বড় কথা, হয়তো সেটা তুমিও জানো, এই বাজারেও টাকা পয়সার লোভ ওর নেই, ওর ঠিক যত টুকু দরকার ঠিক ততটুকুর জন্যই খেলে, যদিও কোন বোনাস বা বেনিফিট পায় সে টাকাটা ও মনিশদা বা এমন অনেককে দিয়ে দেয়। অন্তত টাকা পয়সার ব্যাপারে, ও যাকে যা কথা দেয় সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। আর শুনলে অবাক হয়ে যাবে, আমরা মস্তি করার জন্য টাকা লাগাই, আর বিনু ওর টাকার প্রয়োজনেই টাকা লাগায়। ঐ জন্যই হয়তো বিনু জেতে প্রতিবার, আর আমরা হেরে যাই। ছাড়ো ওসব, বাড়ি এসে গেছে, দেখো হয়তো মাসিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। বিনু যা বলে তাই হয়, এই সব ক্ষেত্রে, এবার বুঝলে তো, আজ যা এক্সট্রা টাকা পেলে সেটা বিনুকে সাহায্য করার পুরস্কার“ শেষের কথাগুলো কানে যেতেই সুনন্দ চমকে পাশে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই ওর বুকের ভিতরটা আবার ধড়াস করে উঠলো। তড়িঘড়ি বাড়িতে ঢুকেই দেখল বসার ঘরে সোফায় মা ঘুমিয়ে পরেছে, ভাগ্যিস ঘরের একটা চাবি সুনন্দর সাথেই থাকে। দরজা বন্ধ করার শব্দ হতেই, মা বললেন “কি রে বাবু এলি? এতো দেরী হোল? তোর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার একটু চোখ লেগে গেছিল। নাহ্ এবার তোর একটা বিয়ে দিতেই হবে।“
“নাও নাও অনেক হয়েছে আর অশান্তি বাড়াতে হবে না, চলো খিদে পেয়েছে, কাল অফিস বেরতে হবে তো নাকি আমায়?” কথাগুলো এড়িয়ে গিয়ে বললো সুনন্দ। খাওয়া সেরে, বিছানায় পিঠ দিয়েও সুনন্দর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, কি হচ্ছে এসব, এর ব্যাখ্যা জানা দরকারী। যদি কাল সকালে সম্ভব হয়, একবার বিনোদের বাড়ি যাবে, যদি লাগে তো ছুটি নিয়ে নেবে, বাড়ির গ্যাসের কাজটাও তো করাতে হবে। এই সব ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমে ডুবে গেলো সুনন্দ। সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরিই হল, ঘড়িতে দেখল প্রায় নটা বাজে, নাহ্ আজ আর অফিস যাওয়া হবে না, তখনই মনে পড়ল যাবেই বা কি করে বাড়ির গ্যাসের সমস্যাটা সমাধান না করে তো যাওয়াও যাবে না। সুনন্দ ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলো, গ্যাসের কাজ করার লোক মনিশদার কাছে আছে, যাই ওখানে গিয়ে বলে আসি যদি করে দিয়ে যায় এসে এখন, যাওয়ার পথে একবার বিনোদের পিসিকেও দেখে যাওয়া যাবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছাকাছি আসতেই বিনোদ আর বিনোদের বউয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। বিনোদই এগিয়ে এসে বললো “সুপ্রভাত, নন্দদা, কাল তুমি যা উপকার করলে তার জন্য আমি সারা জীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকলাম“ সুনন্দ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই বিনোদের বউ বললো “আমি কাল আপনার ভাইয়ের কাছে সব শুনেছি, আজকের দিন কটা মানুষ এমন ভাবে পাশে এসে দাঁড়ায়। আপনাকে একবার অন্তত পায়ের ধুলো দিতেই হবে আজ আমাদের বাড়িতে, পিসিও এখন অনেকটা সামলে উঠেছে, চলুন কোন আপত্তি শুনবো না, একটু চা জল খাবার খেয়ে তারপর আপনার ছুটি। আপনার বাড়ির রান্নার গ্যাসেও তো শুনলাম কিছু সমস্যা হয়েছে, তার মানে সকালে চা’ও খাওয়া হয়নি। চলুন.. চলুন” সুনন্দ ভেবে দেখলঝ প্রস্তাব খারাপ নয়, কালকের ব্যাপারটাও খোলসা করে নেওয়া যাবে বিনোদের কাছ থেকে, “আচ্ছা চলো, তোমাদের সাথেই যাই, যদি রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হয়, ফিরোজদার বাড়িও তো তোমাদের ওইদিকে, আরে যে মনিশদার দোকানের পাশে গ্যাসের কাজ করে ,ওকেও ধরে নিয়ে আসবো” বলে দু’পা এগোতেই কেউ যেন বলে উঠলো “হ্যাঁরে বিনু, তোর পিসি কেমন আছে এখন” সবাই পিছনে ফিরতেই দেখলো সাইকেলে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে পিছনেই আসছে ফিরোজদা। ফিরোজকে দেখেই সুনন্দ বললো, “ফিরোজদা যে! দেখা হয়ে ভালোই হলো, আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম গতকাল রাত থেকে খুব বিপদে পড়ে গেছি, বাড়ির গ্যাসের সিলিন্ডারের থেকে খুব গ্যাসের গন্ধ আসছে, ভয়ে মা’কে রান্না ঘরে ঢুকতে দিইনি, তুমি যদি একবার এখন গিয়ে দেখে দাও খুব ভালো হয়।“
“সে আর তোমাকে বলতে হবে না, সকালে তুমি বেরবার পরেই আমি গেছিলাম, দেখে এসেছি, কিছু হয়নি শুধু রেগুলেটর লুজ হয়ে গেছিল। আমি বাজার থেকে তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসছিলাম, মাসিমা বারান্দা থেকে দেখে ডাকলেন, গিয়ে করে দিয়ে এসেছি, আমাকে বলে দিলেন তোমার সাথে দেখা হলে বাড়ি চলে যেতে, তুমি নাকি চা জল খাবার খেয়ে বেরোওনি?” বললো ফিরোজ। ফিরজের কথা শেষ হতেই বিনোদ বললো “পিসি ভালো আছে গো ফিরোজ দাদা, জানো তো কাল সুনন্দ দাদা না থাকলে কি যে হতো কে জানে”
”থাক, আর ওভাবে বলতে হবে না; চলতো চায়ের জন্য প্রাণটা হাঁকপাঁক করছে একেবারে” বিনোদের পিঠে একটা আদরের চাপড় মেরে বললো সুনন্দ।
“হ্যাঁ চলো তো চলো, তখন থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খালি কথা বলে যাচ্ছ” বিনোদকে তাড়া দিয়ে বললো বিনোদের স্ত্রী। ওর বলার ধরনে সবাই একসাথে হেসে উঠে বিনোদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলো।
বাড়িতে ঢুকে বিনোদ সুনন্দকে নিয়ে বাইরের ঘরে বসাল। সুনন্দকে বসার চেয়ারটা এগিয়ে দিতে দিতে বিনোদ বললো “তুমি কেন এসেছ মনে হয় আমি আমি জানি, আমার পিসির খবর ছাড়াও কালকের ব্যপারটা, তোমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? তবে তুমি না এলেও আমি বিকালে যেতাম তোমার কাছে। আসলে এটা আমি তোমাকে বললেও কি ভাবে বলবো, অথবা তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না..“
“সব যখন বুঝতেই পারছিস তখন আর এতো কিন্তু কিন্তু করে কোন লাভ নেই, তবে এই টুকু ভরসা রাখতে পারিস, আমি বিশ্বাস করি দেবতা যদি থাকেন তাহলে অপদেবতাও আছে, কারণ অন্ধকার আছে বলেই আলো আছে। তাই জানতে চাইছিলাম রাজা কে!” বিনোদের কথা শেষ করতে না দিয়েই বললো সুনন্দ।চলবে….
-
ধারাবাহিক- বাজীকর (পর্ব-১)
বাজীকর (পর্ব-১)
-অযান্ত্রিক“আজকে কলকাতা আর ব্যাঙ্গালোরের খেলায়, কার উপর টাকা লাগালি রে বিনোদ?” চায়ের গেলাসটা হাতে নিয়ে পাশের বেঞ্চিতে বসতে বসতে বললো সুনন্দ।
“লাগাইনি কোনো টাকা, টাকাই নেই পকেটে, লাগাব কথা থেকে, তবে লাগালে কলকাতার উপর লাগাতাম, দেখলাম দশ টাকায় পনেরো টাকা দিচ্ছে, লেগে গেলে ভালো দাঁও হবে কিন্তু সুনন্দ দাদা” বেশ আগ্রহ নিয়েই বলল বিনোদ।
“না ভাই, আমার ওসব বাজি লাগিয়ে কাজ নেই, অমন সাধও নেই, এমনিতেই পাথর চাপা কপাল, বাজিমাত করার মত ভাগ্যের জোরও নেই” হাসতে হাসতে বলল সুনন্দ।
“এই যে, এই কথাটা একদম লাখ টাকার কথা বলেছ সুনন্দদা, বিনোদের মত ভাগ্য পাওয়া দুস্কর, শালা আমাদের একশোয় একটা লেগে যায় আর বিনোদের একটাই মিস হয়। তবে, তাতে দেখেছ ওর কিন্তু একটুও অহঙ্কার নেই। নাহলে এতো দিনে আমাদের এই উস্তিতে ও এতোদিনে কি না করে ফেলত, আমাদের সাথে এই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিত না,” সুনন্দর কথায় হাসতে হাসতে সায় দিয়ে বললো তীর্থঙ্কর।
“তোমরা ওকে জিততে দ্যাখো কিন্তু কোন দিন লক্ষ্য করে দেখবে, বিনোদ কিন্তু খুব বেশী টাকা জেতে না, তার মানে বিনোদ বিনোদের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে খেলে না, একটুও লোভ নেই কিন্তু ওর”।
তীর্থাঙ্করের কথার শ্লেষটুকু এড়িয়ে গিয়ে সুনন্দ বললো, “হ্যাঁ রে বিনু তুই তো আগে এসবের মধ্যে থাকতিস না, এর মধ্যে তুই এলি কি করে?”
“ধুর, কি যে বলো না নন্দদা, ওসব কিছু না গো, আমি তো আন্দাজেই ঢিল ছুঁড়ি তোমাদের লাগে না, আমার ধারে কাছে লেগে লুগে যায়, এইটুকুই তীর্থাঙ্কর শুধু শুধু আমার পিছনে লাগে গো” একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গিয়ে বললো বিনোদ।
উস্তির, শিবকালিতলা বাসস্ট্যান্ডের মনিশদার চায়ের দোকান হল এই ছেলেগুলোর আড্ডার জায়গা। বিনোদ কলকাতার একটা বেসরকারি সংস্থায় ডেলিভারির কাজ করে, তীর্থাঙ্করও বেসরকারিতেই কাজ করে, তবে ম্যানেজার, কলকাতাতেই। সুনন্দ একটা কোম্পানির এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট হেড। রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় এখানেই বাস থেকে নেমে কিছু কখন চায়ের আড্ডা চলে ওদের, মানে বিনোদ, তীর্থাঙ্কর, অমৃত, আর সুনন্দ। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তারপর যে যার বাড়ির দিকে চলে যায়। মনিশদার দোকানেই সাইকেল রাখা থাকে ওখান থেকে নিয়েই বেড়িয়ে পরে ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দিয়ে। আজ এখনো অমৃত আসে নি, আইপিএল চলছে আর উঠতি বয়েসের ছেলেদের আড্ডায় মেতে ওঠার জন্য এর চেয়ে ভালো বিষয় কিছু নেই। এরা সবাই ক্রিকেট খেলা অন্ত প্রাণ, আর এখন ইন্টারনেট আর টিভির দৌলতে যে আইনি জুয়া “জিতবে কে?” আর “স্বপ্নের এগারো” খেলা চলে এরা তাতেও প্রায় এক আত্মা বলা যেতে পারে। আজ এদের আড্ডা শুরুই হয়েছে , কলকাতা আর বেঙ্গালরের খেলা নিয়ে, আর তাতে কে কার উপর কত টাকা লাগিয়েছে আর সে কেন জিতবে সেটা নিয়ে চুলচেরা আলোচনাও চলছে চরমে। তীর্থাঙ্কর, বিনোদ, আর অমৃত তিনজনেই নিয়মিত খেলে থাকে, যদিও তাতে দোষের কিছু তো নেই এতো এখন সবাই খেলছে। তবে, আলোচনায় নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে বিনোদ নিয়মিত খেলে আর জিতেও যায়, তাই বলে তীর্থাঙ্করকে কম ভাবলে ভুল করবেন মাননীয় পাঠকবৃন্দ । তীর্থাঙ্করও খেলে, তবে জেতে কম, হারে বেশী। দুজনেই অল্প পয়সার বাজী ধরে, যাতে হেরে গেলেও বেশী কষ্ট না হয়, কিন্তু স্বপ্ন দেখে একদিন বিশাল একটা বাজী জিতে তারপর পায়ের উপর পা তুলে আরামে দিন কাটাবে, আর এই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে দিন কাটাতে হবে না । ওরা নিজেরা আলোচনা করলেও বিনোদ কোনোদিন বলে না কোন দলের উপর টাকা লাগিয়েছে, শুধু যখন ফলাফল বেরোয় তখন দেখা যায় বিনোদ জিতেছে কিছু টাকা। যদিও তাই নিয়ে কোনো মনোমালিন্য হয় না বন্ধুদের মধ্যে। শুধু কি ক্রিকেট? হকি, ফুটবল, ভলিবল মেয়েদের ক্রিকেট সব কিছুতেই ওরা বাজী ধরে যেতে থাকে, আর বিনোদ এই সব বাজিতে জিতেও যায়। ওদের আলোচনা চলাকালীন, বাস থেকে নেমে আসলো অমৃত, এসেই স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বললো, “কি ভাই লোগ সব আরাম আছে কিনা?” তীর্থাঙ্কর মাথা না ঘুরিয়েই বললো “আরে অমৃত যে আয় আয়, মনিশদা আরও একটা চা, শুধু চিনি বেশী, না হলে এক্ষুনি অমৃতবানিতে নাকানিচোবানি খেতে হবে“
“চুপ কর, শালা, আসতে পারলাম না, পিছনে লাগা শুরু করে দিলো, বেটিং কিং বিনোদ, আজ কার উপর বাজী ধরলি ভাই একটু বল, আমি তো কলকাতায় একশো লাগালাম, দেখি কত আসে? নাকি পুরোটাই ডুবে যায়” বেঞ্চিতে একটা কোনা দখল করে বসতে বসতে বললো অমৃত।
‘আজ আমি খেলছি না গো দাদা, পকেট একদম খালি, আর আমি ধার করে খেলি না সে তো তুমি ভালোই জানো” অমৃতের কথার উত্তরে বললো বিনোদ।
“তা বটে! জাঙ্গিয়ার আবার বুকপকেট, খেলছে জুয়া তার আবার প্রিন্সিপাল, পারিসও মাইরি, কত যে রঙ্গ দেখবো দুনিয়ায়, ওরে ভাই রে। এদিকে, আমি গত তিনটে খেলায় একটা টাকাও জিততে পারিনি এবার কালী পুজোয় মদের খরচা তুলবো কি করে, কে জানে?” বেশ চিন্তিত মুখেই বললো অমৃত।
সুনন্দ হেসে বললো, “তাহলে তো ভালই হলো বলো, জিততে না পারলে মদ খাওয়াটা অন্তত আটকাবে, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন, আমায় দ্যাখো, আমি মদ খাইও না টাকা লাগাবার দরকারও পরে না চিন্তাও নেই”
“হ্যাঁ, সবাই তো তোর মতো গোপাল ঠাকুর হয় না, ভাই এই লক ডাউনে আমার ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ছয় মাস ধরে সত্তর পার্সেন্ট স্যালারি দিচ্ছে, এবার পূজ্যয় বোনাসও হয় নি। বাকি সব খরচ এদিক থেকে ওদিক থেকে ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই খরচটা কিছুতেই হচ্ছে না। আগে অফিসে কাজের বাইরে এদিক ওদিকে খেপ মেরে বাড়তি শখ শৌখিনতাগুলো করা যেতো, কিন্তু এখন করোনার চক্করে সেগুলোও বন্ধ। তাও মাঝখানে বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার খরচ দিচ্ছিল অফিস থেকে, ট্রেন চলছিল না বলে। এখন ট্রেন চলছে, আমাদের ম্যানেজার’খানাও শালা শকুন, যেই শুনেছে ট্রেন চলছে ওমনি বসকে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আর যাতায়াত খরচও বন্ধ” বেশ রাগের স্বরেই বলল অমৃত।
“যা বলেছিস ভাই,” অমৃতের কথায় সায় দিয়ে বললো তীর্থাঙ্কর। “এই করোনা পুরো গুষ্টির কাঁথায় আগুন দিয়ে দিলো মাইরি, আগে ডাল ভাত জুটিয়েও শখ শৌখিনতা করা যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন এই লক ডাউনে নুন আনতেই পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে, বাড়তি খরচের কথা ছেড়েই দে, এখন ‘স্বপ্নের দল কিম্বা জিতবে কে’ ছাড়া এই গরীব গুর্বো মানুষগুলোর কিছু করা অসম্ভব। বেশী টাকা লাগে না, কাজেই হেরে গেলেও খুব কষ্ট হয় না, সবাই তো আর বিনু নয়? সেই কবে থেকে বারোর জায়গায় ছয় হাজার টাকা মাইনে পাচ্ছে, কিন্তু বউ মা বাবা ছেলে পুলে নিয়ে সংসার চালিয়ে তো যাচ্ছে, সে তো এদের দৌলতেই। যাই বল, সেই বেআইনি সাট্টা মটকা এসব তো খেলছি না, না বউয়ের গয়না বেচে খেলছি “
“সে তোর যুক্তি না হয় মানলাম, কিন্তু এটাও তো ঠিক এই খেলার ঠ্যালায় তোদের কষ্টের উপার্জনগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে” বললো সুনন্দ।
“ সে তো বিড়ি খেয়ে, মাল খেয়েও বেড়িয়ে যায়, তবে তোমার কথাও ভুল নয়, সবসময় যে টাকা চলে যায় তাতো নয় ফিরে আসেও তো অনেক বার। ছাড়ো এসব নিয়ে আর চব্য করতে হবে না দেরী হয়ে যাচ্ছে, আজকাল বাবা একটু দেরী হলেই বড্ড ব্যস্তও হয়ে পড়ে, তারপর খুঁজতে না বেরিয়ে পড়ে“ বলে উঠে দাঁড়ালো বিনোদ।
“কিন্তু, বিনু প্লীজ বল না কলকাতা জিতবে তো রে, নাহলে অনেকগুলো টাকা ডুবে যাবে” কাতর ভাবে বললো অমৃত, উঠে পড়া বিনোদের হাতটা টেনে ধরে।
“এ মাহ্, আমি কি করে বলবো, বলো দেখি? আমি তো আর হাত গুনতে পারি না, যেটা বলি তোমাদের মতই আন্দাজে, তার উপর হাতে টাকা নেই, বলে আমি কোন খেলাতেই টাকা লাগাইনি, বিশ্বাস না হলে তীর্থাঙ্করকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো” নিজেকে বাচাবার একটা আর্তি ফুটে উঠলো বিনোদের গলায়।
“ঠিক আছে, বলবি না তো? কাল যদি দেখি উইনার লিস্টে তোর নাম, তখনই বুঝতে পারবি কত ধানে কত চাল, মনে আছে তো এখনো হাজার দুয়েক টাকা আমি পাই তোর কাছে। আম্ফানে বাড়ি সারানোর জন্য দশ নিয়ে ছিলি, তারই দুই বাকি এখনো” বেশ প্রচ্ছন্ন হুমকির স্বরেই বললো অমৃত।
“এই দ্যাখো, ওসব এর মধ্যে আনার কোন দরকার আছে কি? বন্ধু হয়ে বন্ধুকে সাহায্য করেছিলি তাই বলে এই ভাবে সবার সামনে অপদস্থ করার কোনো মানে হয়?“ খুব বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বললো সুনন্দ।
“না না সত্যি, সেদিন অমৃতদা যদি সাহায্য না করতো, তাহলে আমাকে পুরো পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নীচে রাস্তায় বসে কাটাতে হতো। তার জন্য আমি আজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো, তবে অমৃতদা বাকি দু’হাজার আমি তোমাকে বলেইছিলাম সামনের মাসে মাইনে পেয়েই দিয়ে দেবো। ভুলে যাবো কেন? আর আজ পর্যন্ত একবারও কি আমি ডেট মিস করেছি? আর তুমি আমাকে কেন বিশ্বাস করছো না? সত্যি আমি আজ খেলছি না, জানিও না কে জিতবে? শুধু শুধু জোর করছো কেন?“ বলে বেশ ক্ষুণ্ণ হয়ে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বিনোদ।
বিনোদকে বেড়িয়ে যেতে দেখে পিছন থেকে চীৎকার করে বললো অমৃত “মনে থাকে যেন কথাটা, বন্ধুর থেকে দরকারে হেল্প নিবি আর হেল্প করতে বললে যত নখরা..”
“দ্যাখ অমৃত ও হয়তো সত্যি বলছে, আন্দাজেই ও বাজী ধরে, লেগেও যায় কাকতলীয় ভাবে। না লাগলেও ওর পয়সাই নষ্ট হয় কিন্তু একবার ভেবে দ্যাখ ওর আন্দাজে ভর করে তুই টাকা লাগালি আর টাকা জলে চলে গেলো, তাহলে বিনু নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাবে না? ওইজন্যই ও হয়তো বলতে চাইছে না” অমৃতের রাগের পরিপ্রেক্ষিতে কৈফিয়ত দিয়ে বললো সুনন্দ। “আমিও এগোই, ভেবেছিলাম বিনুর সাথেই চলে যাবো কিন্তু তোর চুলকানিতে ও আগেই চলে গেলো, এবার এতোটা রাস্তা একাই যেতে হবে“ বলে সুনন্দ সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। তীর্থাঙ্কর মোবাইলে একবার সময়টা দেখে বললো “না রে ভাই আমিও এগোই, নটা থেকে খেলা শুরু হবে তার আগে বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিতে হবে, তুইও বাড়ি যা আর বসে বসে বিড়ি চুষতে হবে না।”
“হ্যাঁ চল আমিও এগোই” বলে অমৃত আর তীর্থাঙ্কর একসাথে বেড়িয়ে পড়লো, সেদিনকার মতো আড্ডাও ভেঙ্গে গেলো মনিশদার দোকানে।
শিবতলা মোড় থেকে চণ্ডী মণ্ডপ হয়েই যেতে হয় বিনোদের আর সুনন্দর বাড়ি। চণ্ডীমণ্ডপ থেকে একটু এগিয়েই হল গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সাধারণত বিনোদ আর সুনন্দ ঐ রাস্তায় ফেরে, আজ চণ্ডীমণ্ডপ পার করতেই দেখল বিনোদ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনেই দাঁড়িয়ে, সাইকেল নিয়ে।
“কি রে? তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে এলি, বাড়ি গেলি না?”
“যাচ্ছিলাম তো, কিন্তু বউ ফোন করে বললো, পিসির খুব শরীর খারাপ পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে ওরা এখানেই পিসিকে নিয়ে আসছে, তাই আমি আর গেলাম না। আসলে পিসির কেউ নেই কোনো কুলে যা করতে হবে আমাকেই করতে হবে। ও তুমি ভেবো না, তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, তুমি এগোও, ওরা তো আসছে টোটোতে করে তাই দাঁড়িয়ে আছি।”
“ওঃ ঠিক আছে, আমি এগোচ্ছি তাহলে, তবে কোন দরকার পরলে ডাকিস, তেমন হলে রাতে বউমা আর তুই আমার ওখানে চলে আসতেও পারিস, আমি অনেক রাত অব্ধি জেগে থাকি, তার উপর আবার আজ খেলাও আছে” বললো সুনন্দ।
“ঠিক আছে নন্দদা, সে রকম হলে আমি তোমায় ফোন করে নেবো। ঐ যে পিসিকে নিয়ে এলো বোধ হয়, আমি ওদিকে এগোই তুমি বাড়ি যাও দাদা” বলেই স্বাস্থ্য কেন্দ্রর ভিতরের দিকে চলে গেলো বিনোদ।
সুনন্দ সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলো। সাইকেল নিয়ে যেতে সুনন্দ মাথায় ঘুরতে লাগলো আড্ডার সেই প্রশ্নটাই, সত্যিই কি বিনোদ জ্যোতিষ জানে? ও নিজে ওদের সামনে বললেও ও তো নিজেই ঐ জুয়ার নেশায় ডুবে আছে। নেহাত বেনামে খেলে বলে অমৃত, বিনোদ, তীর্থঙ্কররা জানতে পারে না। যাইহোক, বাড়ি ঢুকে হাত পা ধুয়ে চা খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বসলো। হাত ঘড়িতে দেখল প্রায় সাতটা বাজে এখনো খেলা শুরু হতে বেশ কিছুক্ষণ বাকি, ও ল্যাপটপ খুলে দেখতে লাগলো জিতবে কে, কি রেট যাচ্ছে, তখন তো বিনু বললোই কলকাতার দশ টাকায় পনেরো টাকা দিচ্ছে এখন কত হয়েছে। ওমা এতো ভালোই বেড়ে গেছে এখন দশ টাকায় পঁচিশ দিচ্ছে। বিনু তো বলছিলই কলকাতায় লাগাতে, তাহলে কি কলকাতায় ?
ঠক ঠক ঠক ঠক দরজায় টোকার আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়ল সুনন্দর, “মাসিমা, নন্দদা আছে?” বুঝতে পারলো মা দরজা খুলেছে, তাই প্রশ্নটা মাকেই করলো কেউ। সুনন্দ বেড়িয়ে দেখতে যেতে যেতে শুনলো মা বলছে, “বাবু, বিনু এসেছে দ্যাখ, তোকে খুঁজছে? হ্যাঁ আছে রে, ওর ঘরে যা।” আর তার সাথেই দরজা বন্ধ করার শব্দও পেল। সুনন্দ পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এসে “আরে বিনু, কি হয়েছে, বউমা কই?” জানতে চাইলো।
“নন্দদা খুব বিপদে পড়ে তোমার কাছেই ছুটে এসেছি। পিসির স্ট্রোক হয়েছে, একটা ইঞ্জেকশান এক্ষুণি দিতে হবে, কিন্তু সেটার দাম ছয় হাজার কিন্তু ওতো টাকা আমার কাছে নেই, তুমি যদি আমায় কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারো? তাহলে পিসির প্রাণটা বাঁচাতে পারি, অমৃতকে বলেছিলাম ও আমাকে দেবে না বলে দিলো মুখের উপর” খুব কাতর স্বরে বললো বিনোদ।
“আরে দেখছি, দেখছি, তুই একটু শান্ত হয়ে এসে বস তো আগে, আয় ঘরে আয় তারপর দেখছি কি করা যায়” বলে ঘরের ভিতর নিয়ে গেলো বিনোদকে।
“এইভাবে তোমার কাছে টাকা চাইতে খুবই লজ্জা লাগছে আমার কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কাছে ওতো টাকা নেই, মায়ের দিব্যি করে বলছি, যত তাড়াতাড়ি পারি তোমার টাকা আমি শোধ করে দেবো“ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল বিনোদ। সুনন্দ অদ্ভুত ভাবে একবার তাকাল বিনোদের দিকে তারপর একটা লুব্ধ স্বরে বলল “টাকা তো তুই ইচ্ছে করলেই যোগাড় করতে পারিস, তোর লাগান দাঁও তো কোনোদিন ফস্কায় না। একটা বাজি খেললেই তো মুশকিল আসান।”
কথাটা যেন তীরের মতো বিঁধে দিলো বিনোদকে। একটা আত্ম বিশ্বাসের হাসি দিয়ে বললো বিনোদ “তার মানে তুমিও বিশ্বাস করো, তাহলে ঠিকই বিশ্বাস করো, আমি খেলার আগে জেনে যাই কে জিতবে কিন্তু তার একটা শর্ত আছে, টাকাটা আমার নিজের হতে হবে, আর প্রয়োজনটাও তেমনই জরুরি হতে হবে, অন্যের টাকায় খেললে আমার পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। বলতে পারো গুরুর আদেশ।”চলবে………..
-
ধারাবাহিক গল্প- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৪)
পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৪)
-অযান্ত্রিকমুখে জলের ছিটে লাগতেই জ্ঞান ফিরলো অরিত্রর। জ্ঞান ফিরতেই, উঠে বসে দেখলেন, অরিত্র নিজের ঘরের বিছানাতেই আছেন। মোহনা, মোহনা, মোহনা কোথায়? ও ঠিক আছে তো?
“যাক ঘুম ভাঙলো আপনার মহারাজ” চেনা কণ্ঠের স্বরে ফিরে তাকাতেই অরিত্র দেখলেন চা-এর ট্রে হাতে ঘরে খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মোহনা। আর খাটের থেকে একটু দূরে মেঝেতে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। অরিত্রও তার দিকে তাকাতেই সে বললো “অপরাধ মার্জনা করবেন হুজুর, অনেকক্ষণ আপনার জ্ঞান আসছে না দেখে আমিই গঙ্গা জল ছিটালাম।”
“সে ঠিক আছে, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না, আর খামকা আপনি আমাকে হুজুরই বা বলছেন কেন?” অবাক হয়ে বললেন অরিত্র। “তুমি ওনাকে চিনবে না অরিত্র, উনি হচ্ছেন বংশী ও আমাদের সবার শীতলদাদা। উনি নিজেই আজ সকালে বংশীদের সাথে এসেছেন আমাদের সাথে দেখা করতে, উনি সব জানেন কাল রাতের ঘটনার ব্যপারে। উনি সব বলবেন, তুমি একটু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো, তারপর খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসে শুনবো” বললেন মোহনা। অরিত্র কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চা শেষ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বাথরুমে চলে গেলেন ফ্রেশ হতে।
একটু বাদেই খাবার টেবিলে ওরা দুজনে পৌঁছে দেখলেন, টেবিলের উপর বড় বড় পেতলের পাত্রে ফুলকো ফুলকো লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল বেগুন ভাজা, মিষ্টি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। দেখে অরিত্র চনমন করে উঠে বললেন, “বাবা এতো কিছু সকালে! যাক, দাও দাও পেটের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে কাল রাত থেকে পেটে কিছু পড়েনি, আর শীতলদাদা কোথায়, উনি খাবেন না?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ হুজুর, কেন খাবেন না তবে শীতল দাদা এসব খায় না , আপনি বসুন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি” বলল বংশী।
“ওমা দাদা বাবু থেকে হুজুর হয়ে গেলাম কি করে গো বংশী দাদা?” বললেন অরিত্র।
“আজ্ঞে এই কারণে, হুজুর” শীতলদাদা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে অরিত্রও খেয়ালই করেন নি শীতল দাদার হাতে একটা বাঁধানো অয়েল পেন্টিং, আর তাতে সম্পূর্ণ রাজ পোশাকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে, যাকে অবিকল অরিত্রর মতই দেখতে। অরিত্রর চোখের সামনে আবার ভেসে উঠলো গতরাতের পুরো ঘটনা, আর এই সেই ছেলে যাকে মহারাজ নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে ছিলেন। “এই বাড়ি এতদিন আপনাদেরই অপেক্ষায় ছিল হুজুর, আজ পর্যন্ত বহুলোক এই বাড়ি কিনেছে কিন্তু ভোগ করতে পারে নি, কেউ এক রাতেই পাগল হয়ে গেছে নয়তো মারা গেছে। এই বাড়ি আর মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহের আত্মা এতদিন অপেক্ষা করছিল তার বংশজকে তুলে দেওয়ার জন্য। কাল বংশী ফিরে গিয়ে আমায় আপনাদের বিবরণ দিতেই আমি এই ছবিটা দেখাই, দেখাতেই ও জানায় আপনাকে অবিকল শৈল বিক্রম সিংহের ছেলে আদিত্য বিক্রম সিংহের মতো দেখতে। শুনে ভোরের আলো ফুটতেই চলে এসেছি হুজুর আমার শেষ দায়িত্ব পালন করতে..” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই হাঁপাতে লাগলো শীতলদাদা।
“শেষ দায়িত্ব মানে, তুমি এসব কি বলছ শীতল দাদা” আঁতকে উঠলেন মোহনা।
“হ্যাঁ, শেষ দায়িত্বই গিন্নিমা, কাল রাতে আপনারা যে নব্বধুর সাজে এই বাড়িকে দেখেছেন, সেই মোটা মোটা কার্পেট, ঝাড়বাতি আসবাব সে সব তুলে দিতে হবে বৈকি মহারাজের হাতে। ওটাই তো আমার দায়িত্ব, এত বছর ধরে যক্ষের মতো আগলে রেখেছি এই প্রাসাদ, এই নিন গিন্নিমা চাবি। ঐ সিঁড়ির ঘরের চাবি সব অক্ষুন্ন আছে আজও। অরাও অপেক্ষায় আছে গত ষাট ষাটটা বছর।“ বলে একটা তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে অপূর্ব কারুকার্য করা একটা চাবি এগিয়ে দিলো মোহনার দিকে। মোহনা চাবিটা হাতে নিয়ে বললেন, “এখন দিচ্ছো দাও কিন্তু এর পরেও এসবের দায়িত্ব তোমাদেরই থাকবে শীতলদাদা”
এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠলেন অরিত্র, “এসব কি হচ্ছে আমায় একটু খোলসা করে কি কেউ বলবে? কি ব্যাপার বলো তো শীতল দাদা?”
“তেমন কিছুই না হুজুর, এই প্রাসাদ বানিয়ে ছিলেন মহারাজ রবীন্দ্র বিক্রম সিংহ, তাও আমার দুই পুরুষ আগে, তখনও ইংরেজরা এদেশে আসেনি। তার ছেলে হলেন মহারাজা শৈল বিক্রম সিংহ, তিনিই যদিও প্রকৃত অর্থে এই প্রাসাদের শোভা বৃদ্ধি করেন। তিনি ছিলেন খুবই শৌখিন, কিন্তু প্রচণ্ড পরাক্রমী আর উনি ইংরেজদের একদম সহ্য করতে পারতেন না যদিও ইংরেজ সরকার ছলেবলে কৌশলে ওনার কাছ থেকে এই রাজ্য হাতিয়ে নিতে চাইছিল। তার ছেলে ছিলেন আদিত্য বিক্রম সিংহ, আমাদের ছোটো রাজা। রাজা হলেও তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ আর নরম প্রকৃতির। আর ঘটনা চক্রে, আমাদের ছোট রাজা এখানকার ইংরেজ শাসকের মেয়ের প্রেমে পরে যান। যদিও ঐ ইংরেজ অফিসার চাইতো কোনোভাবে বড়রাজা আর ছোট রাজাকে মেরে এই অঞ্চলের দখল নিতে। কিন্তু কোনো ভাবে সুবিধা করতে না পেরে, একটা চাল খাটিয়ে বড় রাজাকে দিয়ে ছোট রাজাকে বন্দি করালেন। ওনাকে বোঝালেন, যে ছোট রাজা নাকি বড় রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বড় রাজা যদিও খুব ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। উনি ছোট রাজা আর ঐ ইংরেজকে সামনাসামনি এনে ফয়সালা করতে দুজনকেই এক জায়গায় আনলেন। কিন্তু ঐ ইংরেজ অফিসার আসার সময় কিছু সৈন্য নিয়ে আসে লুকিয়ে। রাজবাড়িতে এসে, সাধারণ পোশাকে ছোট রাজাকে দেখে ঐ ইংরেজ অফিসার আবেগ সামলাতে না পেরে সত্ত্যি কথা বলে ফেলেন আর উত্তেজনায় ছোট রাজার ওপর গুলি চালিয়ে বসেন। সেইখানে ছোট রাজা আদিত্য বিক্রম সিংহের মৃত্যু হয়। রাগে, দুঃখে মহারাজ সেই সৈন্য সমেত ইংরেজ অফিসার আর তার মেয়েকে কচুকাটা করে ফেলে দেন জঙ্গলে। তার কিছুদিন পরেই সন্তান হারানোর শোকে যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ। সেই থেকে এ বাড়িতে কেউ থাকে না। কিনেছে বহু লোকেই কিন্তু বাস করতে পারে না কেউই।”
মোহনা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন, শীতল দাদার কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন, “চলো বংশীদাদা, আমরা ঘরটা খুলে দেখি। তারপর না হয় আবার এই বাড়িটাকে আগের মতো করেই সাজানো যাবে, চলো..”
মোহনা, শিতলদাদা, অরিত্র আর বংশী টেবিল থেকে উঠে সিঁড়ির ঘরের দিকে গেলো। সেই ঘরটার সামনে, মোহনা চাবিটা বংশিকে দিয়ে বললেন, “তুমিই খোলো বংশী দাদা” বংশী চাবিটা ফেরত দিয়ে বললো “এই বংশের লোক ছাড়া কারো হাতে যে এ তালা খোলে না গিন্নিমা, আপনাকেই খুলতে হবে” অরিত্রও এগিয়ে এসে তালায় চাবিটা ঢোকাতেই তালাটা নিজে নিজেই খুলে গেলো আর সে সাথে দরজাটাও অদ্ভুত একটা শব্দ করে খুলে গেলো। অরিত্র আর মোহনা ঘরে ঢুকে দেখলেন কাল রাতে যা যা আসবাব আর জিনিষ দেখেছে সব এখানে আছে আর দেওয়ালে আছে একটা ছবি হাতে আঁকা নয় ক্যামেরায় তোলা। অরিত্র ছবিটা হাতে নিয়ে বাইরে এসে দেখলেন ছবির ব্যক্তিটি আর কেউ নয় শীতল দাদা, তলায় লেখাও আছে নায়েব শীতল মজুমদার, জন্ম ১৮২২ মৃত্যু ১৯০১ আর তার পাশে আরও এক ভদ্রলোক নাম বংশী মজুমদার জন্ম ১৮৪২ মৃত্যু ১৯০১। অরিত্র আর মোহনা দুজনে চিৎকার করে ডাকলেন, “শীতল দাদা আ আ আ আ, বংশী দাদা আ আ আ আ”
সারা বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেদ করে চলে গেলো ডাকগুলো কোন সাড়া এলো না তার বদলে, বাড়ির বাইরে কয়েকটা গাড়ি এসে থামার শব্দ এলো, আর কেউ যেন দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল “হ্যালো, মিস্টার অরিত্র সোম, আপনারা কি বাড়িতে আছেন?” অরিত্রও এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন।
একজন নীল রঙের ইউনিফ্রম পরা ভদ্রলোক নমস্কার করে জানালো, “স্যার, আমরা রিবিল্ট ইন্টারন্যাশানাল থেকে আসছি । আমাদের যদিও পরশু আসার কথা ছিল, কিন্তু রাস্তায় ধ্বস নামায় আটকে পরে ছিলাম। ফোনেও নেটওয়ার্ক ছিল না। আমদের সঙ্গে মোহনা সোমের এগ্রিমেন্ট হয়েছিলো হসপিটালিটি অ্যান্ড হাউজ কিপিং ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে। অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন। “
অরিত্র পিছনে ফিরে মোহনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানে?”
তখনও টেবিলে আলুরদম লুচির থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। -
ধারাবাহিক গল্প- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৩)
পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৩)
– অযান্ত্রিকঅরিত্র ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দরজা বন্ধ করে উপরে উঠে এসে দেখলেন, মোহনা ভয়ে কুঁকড়ে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অরিত্র ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মোহনাকে। ভয়ে আতঙ্কে মোহনার সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আর মুখ দিয়ে গোঙানোর শব্দ হচ্ছে। “মোহনা, এই মোহনা, কি হয়েছে?মোহনা” অরিত্রর ডাকে আর ঝাঁকানিতে মোহনার একটু সম্বিৎ ফিরলো। “কি হয়েছে? অমন করছো কেন?”
গলায় একরাশ ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে, মোহনা বললেন, “অরিত্র.. অরিত্র আমাদের আজই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে, এই বাড়ি ভালো নয়..”
“মানে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলে নাকি, কি হয়েছে একটু পরিস্কার করে বলবে?” মোহনাকে শান্ত করতে করতে বললেন অরিত্র।
“তুমি নীচে যেতেই আমি একটু ওয়াশ রুমে গেছিলাম, ফ্রেশ হয়ে সেখান থেকে ফিরতেই দেখি একটা বছর পনেরোর মেয়ে দরজা দিয়ে ছুটে এসেই ঘরে এই দেরাজের ভিতর গিয়ে লুকালো, আমি এসে দেরাজ খুলে দেখি কেউ তো নেই । আর এই মেয়েটাকেই আমি দুপুরে স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি আর এখানে থাকব না প্লীজ চলো এখান থেকে” খুব ভয়ার্ত গলায় বললেন মোহনা।
“ওসব কিছু না, তুমি অত্যাধিক ক্লান্ত তাই ওসব হেলুসিনেট করেছো” আশ্বাস দিয়ে বললেন অরিত্র, ”চলো রাতের খাবার খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”
ঠিক তখনই, নীচে সদর দরজায় খুব জোরে ধাক্কানোর একটানা শব্দ হতে লাগলো। অরিত্র নীচে যাবে বলে উঠতেই মোহনা জড়িয়ে ধরে বললেন, “নানা তুমি একা যাবে না আমিও যাবো,” “/অরিত্র আপত্তি করলেন না। দুজনে দরজা খুলে বাইরে আসতেই, দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ ছাপিয়ে ওদের কানে এসে পৌঁছাল আরও একটা শব্দ ঢং ঢং ঢং, কোন দেওয়াল ঘড়ির শব্দ। কোনো ঘড়িতে যেন বারোটা বাজলো, মোহনা মোবাইলে দেখল সত্যিই বারোটা বাজে। কিন্তু সারাদিনে এ বাড়িতে ঘোরাঘুরিতে কোনো পেন্ডুলাম ঘড়ি তো চোখে পড়েনি! দুজনে দুজনের মুখ চাওয়াচায়ি করে তাড়াতাড়ি বাইরে করিডোরে আসতেই দুজনের বিস্ময়য়ের সীমা পরিসিমা থাকল না।
দুজনেই দুজনের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দেখছে এ তো কিছুক্ষন আগে দেখা ঘরের সাথে কোন মিল নেই। কিছুক্ষণ আগেই যে ছবি মোহনার কল্পনায় ছিল সেটা বাস্তবে সামনে দেখবে মোহনা ভাবতেই পারছে না। দোতলার পুরো করিডোর জুড়ে যেখানে একটু আগেও ছিল ধবধবে সাদা মারবেলের মেঝে সেটা এখন মেরুন আর সোনালী কারুকার্য করা মন মুগ্ধকর বিদেশী কার্পেটে ঢাকা পরে গেছে। দেওয়ালে লাগানো হাল ফ্যশানের আলোগুলোকে সরিয়ে,জায়গা করে নিয়েছে চার মোমবাতির ছোটো ছোটো ঝাড়বাতি। করিডরের রেলিঙটাও সেজে উঠেছে বিদেশী ফুল আর অর্কিড রাখা পিতলের পটে। দু’টো সিঁড়িই ঢাকা আছে লাল রঙের গালচে দিয়ে, এক নজরে ওর দুজনেই হকচকিয়ে গেলো, এ কোথায় এসে পড়লো ওরা। মোহনা আরও ভয় পেয়ে খামচে ধরলো অরিত্র-র কাঁধ। অরিত্র নিজেও এমন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে যে কোনো কথা বলতে পারছে না। শুধু এক পা এক পা করে নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে নিজের অজান্তেই। সিঁড়ির সামনেটায়, যেখান থেকে নীচের পুরো হলঘরটা দেখা যায় সেখানে এসে দুজনেই একদম বাকরুদ্ধ হয়ে পরল। সেই খালি ড্রয়িংরুম এখন আর খালি নেই। ওদের পেতে রাখা ছোট ছোট কার্পেটের জায়গায় একটা বিশাল মোটা আর বড় কাশ্মীরি জাজিম জায়গাটাকে এক রাজদরবার করে তুলেছে। ছাদ থেকে মোটা পেতলের শেকলে ঝুলছে বিশাল এক ঝাড়বাতি যার আলো রাতটাকে একেবারে দিন করে ফেলেছে। আস্তে আস্তে দুলছে একটা দড়ি টানা পাখা। পাশে কোন একটা ঘরের থেকে নাচ গানের আওয়াজ আসছে। হলের ভিতরে উর্দি পরা বেয়ারা, সবাইকে পানীয় পরিবেশন করছে। অতিথিদের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুজনে যেন কোনো টাইম মেশিনে করে ইতিহাসের কোনো সময়ে পৌঁছে গেছে। অনেক সাহসে ভর করে, অরিত্র আর মোহনা নীচে নেমে এসে দেখলেন ঘরের দেওয়ালগুলো বড় বড় হাতে আঁকা তৈলচিত্রে ঢাকা পরে গেছে, ঠিক যেমনটা করার কথা মোহনা ভেবেছিলেন। দুজনেই দুজনের হাত আঁকড়ে ধরে দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে, অরিত্রর মনে হচ্ছে যেন একটা হিম শীতল রক্তের স্রোত নেমে আসছে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। অরিত্র আর মোহনা এমন তন্ময় হয়ে দেওয়ালে লাগানো ছবিগুলো দেখছিল যে ওরা লক্ষ্যই করে নি, যে এক জন বেয়ারা, ওদের দিকে এগিয়ে এসেছে। ওদের দিকে পানীয়র ট্রে-টা এগিয়ে দিয়ে “স্যার, আপনারা কি কিছু নেবেন?” বলতে চমকে উঠলেন দুজনেই। মোহনা বেয়ারার কথা শুনে ট্রে-র দিকে তাকাতেই দেখলেন, একটা সুক্ষ্ম কারুকার্য করা রুপোর গেলাসে লাল রঙের কোনো তরল আছে, ওয়াইন হতেও পারে। ওরা কিছু উত্তর দিচ্ছে না দেখে বেয়ারা জানালো, “খাবার ঘরে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়ে গেছে, আপনারা চাইলে গিয়ে খেয়ে নিতে পারেন।” অরিত্র-র ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, ওরা যা দেখছে সেটা বাস্তব কোনও মতেই না, তবে কি কোন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? ওদের সাক্ষী রেখে, নাকি এই বাড়িটা ওদের কিছু জানাতে চাইছে।
এমন ভৌতিক ঘটনার সামনাসামনি ওরা দুজনেই কোনোদিন হয়নি, তবে আধুনিক মননশীল চিন্তাধারায় কিছুতেই এই চোখের সামনে চলতে থাকা ঘটনার কোনো ব্যখ্যা করতে পারছেন না। অরিত্র ঠিক করলেন মোহনাকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়িটা ছেড়ে বেড়িয়ে যাবেন, কিন্তু পারলেন না। একজন সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে এলো, আর খুব বিনীত ভাবে জানতে চাইলো, “মাফ করবেন আমি একটু ওদিকে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করিনি, আপনাদের কোন আসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনারা খেয়েছেন? খাবার পরিবেশন করা হয়ে গেছে।” অরিত্র ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন, আরে এই মুখ তো তার খুব চেনা, একটু আগেই দেওয়ালে টাঙ্গানো বিশাল ছবিটায় ওরা দুজনেই দেখেছেন। নীচে পরিচয়ও লেখা ছিল মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ, এই বাড়ির মালিক, অরিত্র বেশ বুঝতে পারলেন কাঁধের উপর মোহনার খামচে ধরা হাতের জোর আরও বাড়লো। মোহনাও খুব ভয় পেয়ে গেছে, এবার মোহনার নখগুলো মনে হয় বসে যাচ্ছে চামড়ার উপর, অরিত্রর নিজের অবস্থাও ভালো নয় সারা শরীর একটা অদ্ভুত উত্তেজনায় ঝিমঝিম করছে। অরিত্র ওনাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই একজন লোক এসে জানাল মেজর টেশলা এসে পরেছেন, মহারাজ অরিত্রর দিকে চেয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে “মাফ করবেন” বলে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে। বেশী দূর যেতে হলো না তার আগেই পুরোদস্তুর সামরিক পোশাকে এক ইংরেজকে ঢুকতে দেখল অরিত্র, সাথে একটা মেয়ে, বছর পনেরোর হবে। কিন্তু মেয়েটার মুখটা যেন দুঃখে, কষ্টে একদম লাল হয়ে আছে আর গালে আঙ্গুলের দাগও আছে। একটু কাছে আসতেই অরিত্রর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো, ওমা মেয়েটাকে দেখতে অবিকল মোহনার মতো। এটাও বুঝতে পারলেন মোহনা নিজেও চমকে উঠলো। ঐ ইংরেজ ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখে মাহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ আন্তরিক অভ্যর্থনা করে বললেন, “ওয়েলকাম মেজর টেশলা ওয়েলকাম, আই এ্যম ভেরী হ্যপ্প্যি টু শী ইউ হিয়ার..”
“থ্যাঙ্ক ইউ রাজা, থাঙ্ক্যউ ফর দ্যা ইনভাইটেশন, লুক হামি, আমার লড়কিকে লিয়ে এসেছি, মিট মাই চাইল্ড ‘বেলা’, ইজাবেলা, হোপ ইয়উ ডোন্ট মাইন্ড। বাই দ্যা ওয়ে, হ্যভ ইউ ডান দ্যা জব?” জানতে চাইলো মেজর টেশলা
“নো নো , নো ইস্যু এট অল, আমি আমার কাজ করেই রেখেছি এজ ইউ সেড, উপরেই রাখা আছে ছেলেটিকে “গো অপ স্তেয়ার অ্যান্ড গেট হিম“ বেশ সহজ ভাবেই বললেন রাজা শৈল বিক্রম সিংহ।
“ওকে, ওকে, রাজা হামি উহাকে ব্যবস্থা করিয়ে এসে খানাপিনা করবে এনজয় করবে। উহাতে কোন আপত্তি নেই তো রাজা” জানতে চাইলেন মেজর টেশলা।
“এজ ইউ উইশ, গো এন্ড গেট হিম, এইই কে আছিস মেজরকে সিঁড়ির ঘরে নিয়ে যা” বললেন মহারাজ আর তার কথায় দুজন তলোয়ার হাতে বরকন্দাজ মেজরকে সিঁড়ির ঘরে দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। মহারাজ আর অরিত্ররাও পিছন পিছন গেলো। ঘরের দরজা খুলতেই অরিত্র দেখল ঘরের ভিতরে একটা সুপুরুষ চেহারা ছেলে বসে আছে, আর সেই ছেলেটাকে হুবহু অরিত্র মতই দেখতে, অরিত্রর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তাহলে কি! কিন্তু ওর কিছু করার আগেই মেজর টেশলা তার কোমরে খাপ থেকে রিভলবার বার করে তাক করল ছেলেটার দিকে। ট্রিগারটা টানতে যাবে, ঠিক এমন সময় পিছন থেকে সিংহের মতো গর্জে উঠলেন মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ,
“সাবধান মেজর, আমার রাজ্যে কাউকে শাস্তি দেওয়ার আগে, জানাতেই হবে অপরাধীর অপরাধটা ঠিক কি?”
মেজরের হাতটা একটু কেঁপে গেল, রাগে অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল, দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,”দিশ নেটিভ লড়কা একটা ব্রিটিশ লড়কির সাথে প্রেম করিয়াছে, আর সেই অপরাধে উহাকে মরতে হবে।”
“বাঃ, প্রেম করেছে তো, খারাপ কিছু তো করে নি, তার জন্য ওদের বিয়ে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু মেরে ফেলতে হবে এমন কথা কোথায় লেখা আছে? আর যদি মরতেই হয় তাহলে ছেলে মেয়ে দুজনকেই মরতে হবে, একা ছেলেটা মরবে সেটা তো হতে পারে না।” মুখে একটা ক্রূর হাসি নিয়ে বললেন মহারাজ। বলেই মেজর টেশলার মেয়ের দিকে ওনার রিভলবার তুলে ধরলেন। “অ্যান্ড মেজর ইউ নো ভেরী ওয়েল আই নেভার মিস এনি টার্গেট। ডু ইউ থিঙ্ক উই ইন্ডিয়ান্স আর ইয়োর স্লেভ, ইফ ইয়েশ দ্যন ইউ আর লিভিং ইন আ ফুলস ওয়াল্ড..’
কথাগুলো যেন রাতের জঙ্গলে পশুরাজের গর্জনের মতো শোনাল, মেজর চমকে উঠলেন, কিন্তু পর মুহুর্তে দ্বিগুণ রাগে লাল হয়ে উঠলো তার চোখ মুখ। এমন ভাবে ছটফট করতে লাগলেন যেমন খাঁচায় বন্দি ইঁদুর করে। বিপদ বুঝতে পেরেই “নোওও” বলে চিৎকার করে ইজাবেলা দৌড়ে উঠে গেলো দোতলায় ঠিক যে ঘরটায় একটু আগেই অরিত্র আর মোহনা ছিলেন। ঠিক যেভাবে মোহনা দেখেছিলেন কিছুক্ষণ আগে। মহারাজ শৈল বিক্রম বললেন “এই কে আছিস ধরে নিয়ে আয় মেয়েটাকে, দেখিস যেন পালাতে না পারে। আর মেজর, ছেলেটাকে কিছু করার মনে রেখো, ছেলেটা কিন্তু মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহের ছেলে, তোমাদের একজনকেও এখান থেকে বেঁচে ফিরতে দেবো না।” কিন্তু মহারাজের কথা সেই রাগে অন্ধ শ্বেতাঙ্গের কানে গেলো না, নিমেষের মধ্যে গর্জে উঠলো তার হাতের বন্দুক। একটা গগনবিদারী আর্ত চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটি, বলির পাঁঠার মত ছটফট করতে করতে শান্ত হয়ে গেল রক্তের বন্যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে অরিত্র বুঝতে পারলেন কাঁধের উপর খামচে ধরা মোহনার হাতটা আলগা হয়ে গেল। চোখের নিমেষে ঘটনার গতি প্রকৃতি বদলে গেল দেখে অরিত্র কি করবে বুঝে উঠতে পারলেন না। পিছনে ফিরে দেখলেন মোহনা অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। অরিত্র মোহনাকে জড়িয়ে ধরে তুলে যাবেন এমন সময় মহারাজের লোকেরা সেই মেয়েটাকে ধরে নিয়ে এলো ততক্ষণে মেজরকেও অন্য লোকেরা বেঁধে ফেলেছে। “এদের জন্য দু’টো কার্তুজ খরচ করার কোন মানে হয় না” বলে মহারাজ বন্দুক ছেড়ে একজনের হাতের থেকে একটা তলোয়ার নিয়ে এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিলেন মেজরের আর পরের কোপটা মেয়েটাকে দিতে যাচ্ছেন এমন সময় কেউ একজন এসে বলল “মহারাজ মেজর জনা কুড়ি সৈন্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন, গুলির শব্দে তারা ভিতরে আসছে” মহারাজ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন “আসতে দে, আর দেখিস একটাও যেন বেঁচে ফিরতে না পারে, বিরাজ, সবাইকে নিয়ে বাইরে গিয়ে দ্যাখো, আমি এটাকে সাবার করে আসছি” বলেই হাতে ধরা রক্তাক্ত তলোয়ারটা সোজা নামিয়ে দিলেন ইজাবেলার গলায়, সঙ্গে সঙ্গে ধড় থেকে মাথাটা ছিটকে এসে, পড়লো অরিত্রর পায়ের সামনে। বাইরে তখন অবিরাম গুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার, মহারাজ তলোয়ার হাতেই বেড়িয়ে গেলেন বাইরে, তাজা গরম রক্তের স্রোতে ডুবে যেতে লাগলো অরিত্রর দুই পা। এতো চিৎকার, রক্ত দেখে চূড়ান্ত ভয়, উত্তেজনায় অরিত্রও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। -
ধারাবাহিক- পুনারাবৃত্ত (পর্ব-২)
পুনারাবৃত্ত (পর্ব-২)
-অযান্ত্রিকবংশী ডাকলো, “বউদিমনি, দুপুরের রান্না হয়ে গেছে, আপনাদের কি খেতে দিয়ে দেবে, মানে ঘরে দিয়ে আসবে, জানতে চাইলো, রাধার মা।“
“ওমা সেকি! এর মধ্যে রান্না হয়ে গেলো? কি কি রান্না করল গো রাধার মা?“ নিজেকে স্বাভাবিক করতে করতে বললেন মোহনা।
“তাড়াতাড়ি কি বলছেন বৌদিমণি, ঘড়িতে দেখেছেন দেড়টা বাজতে গেলো, কাল সারা রাত ভালো করে বিশ্রাম হয়নি, একটু বিশ্রাম না নিলে চলবে কি করে আপনাদের সামনে এতো বড় কাজ? ঐ যেমনটা আপনি বললেন তেমনই ভাত, মুশুরডাল, আলুভাজা, পেঁয়াজ পোস্ত আর আমড়ার আঁচার”
“বাবা এইটুকু সময়ে এতো কিছু করে ফেললো রাধার মা, এলেম আছে বলতে হবে। ঠিক আছে দাঁড়াও, আমি স্নানটা সেরে আসছি তোমার দাদাবাবু বোধহয় ঘুমাচ্ছে দেখছি গিয়ে, আধ ঘণ্টা সময় দাও দুজনেই আসছি নীচে, ওখানেই খেয়ে নেবো“ জানালেন মোহনা। বংশী মাথা নেড়ে চলে গেলো, আর মোহনাও দোতলায় নিজেদের ঘরে চলে গেলো। দরজাটা ভেজানোই ছিল, ঠেলা দিয়ে ঘরে ঢুকেই দেখলো, অরিত্র ঘরের মধ্যে পায়চারী করছে।
“কি ব্যাপার ঘুম হলো? স্নান করে নিয়েছ নাকি? খেতে যাবে তো? কখন উঠলে?” বেশ মজার স্বরেই বললেন মোহনা ।“ হ্যাঁ হ্যাঁ ওসব আগেই মিটিয়ে রেখেছি, স্নান করেই শুয়ে ছিলাম, খুব ভাল ঘুম এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, দেখলাম খিদেও পেয়েছে, তাই উঠে পায়চারি করছিলাম, তুমি এলে একসাথে খেতে যাবো। দারুণ জায়গা কিন্তু মানতেই হবে, যেমন ঘুম হয় তেমন খিদেও পায়, নাও নাও তুমি একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর একসাথে খেয়ে একটু জঙ্গলের দিকটায় ঘুরে আসবো। এসে থেকে জঙ্গলটা ডাকছে কিন্তু একবারও যেতে পারলাম না..” বললেন অরিত্র।
“ও বাবা সেকি গো, তারপর বউ ছেড়ে সংসার ছেড়ে জঙ্গলের ডাকে চলে যেও না যেন। তবে একটা বিষয় নিশ্চিন্ত, রাতে যা নাক দাকার আওয়াজ, তাতে বাঘ সিংহ যা আছে জঙ্গলে ঘাড় ধরে আবার তোমায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে..” স্নান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হেসে বলে গেলো মোহনা, অরিত্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই দড়াম করে স্নান ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন মোহনা।
একটু পরেই দুজনে নীচে রান্না ঘরের রাখা খাওয়ার টেবিলে হাজির হলো। ওদের আসতে দেখেই বংশী আর রাধার মা দুজন খাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। খেতে বসে, গরম গরম ভাত, ডাল, ভাজা, পোস্ত পেয়ে মোহনাও ভুলে গেলেন সিঁড়ির দরজার কথা। অরিত্র জঙ্গলের কথা জানতে চাইলেন বংশী আর যোগেন বাবুর কাছে, জীবজন্তু বেরোয় কিনা রাতের বেলায়, কি কি বন্য জন্তু আছে এই জঙ্গলে এই সব আর কি। ওদের কথা চলাকালীন, এক ভদ্রমহিলা বংশীর পিছনে এসে দাঁড়ালো। খুব বেশী বয়স হবে না, বড়জোর বছর তিরিশের হবে, বংশীর কানে কানে কিছু বলল, বংশী মাথা নেড়ে সায় দিতেই ভদ্রমহিলা আবার রান্নাঘরের ভিতরের দিকে চলে গেলো। মোহনা বংশীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বংশী দাদা উনিই তোমার রাধার মা? তা উনি চলে গেলেন কেন? তোমরা খেয়ে নিয়েছো তো না কি?”
“ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনাদের মিটলে পরে আমরা খেয়ে নেবো ক্ষণ। ঐ রাধার মা জানতে চাইছিল, আপনারা রাতের বেলায় কি খাবেন? রাতের খাবার, বিকালের জল খাবার করে দিয়ে আমাদেরও বাড়ি যেতে হবে, বাড়িতে বুড়ো বাপ ছোট মেয়েটা একা আছে। আর পথটাও তো কম নয়, শেষ বাস সন্ধ্যে ছটায় ছেড়ে যাবে। তার আগেই চলে যেতে হবে।“ বললো বংশী ।
“সেকি আমরা এখানে একা থাকব? কোথায় কি আছে জানি না তো” প্রায় আঁতকে উঠে বললেন অরিত্র।
“না না স্যার, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, ওরা চলে যাবে আমি তো আছি। আমি এখানেই থাকি।” অরিত্রকে আশ্বস্ত করে বললো যোগেন বাবু ।
“আচ্ছা সরকার বাবু, আমাদের এখানে স্টাফ কোয়াটার এর ব্যবস্থা করা যায় না? যদি নাও হয় আমাদের গাড়িটাতো আছেই, অতে করেই না হয় ওনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব আবার সকালে নিয়েও আসব, কি বলেন?” বললেন মোহনা।
“সে হতেই পারে, তবে আমাদের এই বাড়ির পিছন দিকে বেশ কয়েকটা ঘর আছে সেগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহারে মেরামতের অযোগ্য হয়ে গেছে। ভেঙ্গে নতুন করে করতে হবে, ততদিন দেখি কিছু অন্য ব্যবস্থা করা যায় কিনা“ জানালো যোগেন সরকার।
“দেখুন যা করবেন একটু তাড়াতাড়ি করুন, কারণ অনলাইন বুকিং শুরু হয়ে গেছে, খুব শীগগির অতিথিরাও আসতে শুরু করবেন। তখন যদি এই সমস্যা থেকে যায় তাহলে মুশকিলে পরে যাবো। আচ্ছা তাহলে আমি এবার উঠি, আলো থাকতে থাকতে একবার জঙ্গলের দিকটা ঘুরে আসি, মোহনা কি করবে? যাবে না কি একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে?” বলে খাওয়া শেষ করে উঠে পরলেন অরিত্র সোম।
“ না না তুমিই যাও আমি একটু ঘুমিয়ে নি বরং..“ মোহনা দেবীও খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বললেন। বংশী মোহনাকে হাত ধোয়ার জল এগিয়ে দিয়ে বললো, আপনারা কি রাতে রুটি খাবেন। তাহলে রুটি আর একটা কি দুটো তরকারী করতে বলে দি রাধার মা কে?” মোহনা সম্মতি জানিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেলো। সত্যিই যেন ডাকছে, চোখের জানলা দু’টো যেন কেউ জোর করে বন্ধ করে দিতে চাইছে। সেপ্টেম্বরের দুপুর হলেও গরম একেবারেই নেই। ঘরে ঢুকতেই জঙ্গলের দিক থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া মোহনাকে এমন জড়িয়ে ধরলো যে মোহনা বিছানায় পিঠ দিতে দিতেই হারিয়ে গেলো ঘুমের সমুদ্রে।
কয়েক ঘণ্টা কিভাবে কেটে গেলো মোহনা বুঝতেই পারলো না। মোহনার ঘুম ভাঙলো মেয়েলী কণ্ঠের একটা ডাকে। মোহনা ধড়মড় করে উঠে বসে দেখলেন, রাধার মা চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “বউদিমনি আপনি এতো ঘামছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? কোনো ভয়ের স্বপ্ন দেখেছেন?”
“না, ঠিক বুঝতে পারছি না। কটা বাজে? তোমাদের বোধ হয় খুব দেরী হয়ে গেল তাই না? দাদাবাবু ফিরেছেন?” একটু অপ্রস্তুত হয়ে জানতে চাইলো মোহনা ।
“হ্যাঁ হ্যাঁ দাদাবাবু তো অনেক্কখন ফিরে এসেছেন, যোগেন দাদার সাথে পিছনে ভাঙ্গা ঘরগুলো দেখছেন। কিন্তু আমি একটা কথা বলছিলাম যদি রাগ না করেন“ বললো রাধার মা।
“হ্যাঁ হ্যাঁ নির্ভয়ে বলো, আমি সহজে রাগ করি না, আর বাড়ির লোকের কথায় কি কেউ রাগ করে?”
“ বলছিলাম কি বউদিমনি, আমরা সারা দিন এখানে কাজ করবো, কিন্তু থাকার ব্যবস্থা করতে হবে না। বাড়িতে ছোট মেয়েটাকে আর বুড়ো বাবাকে রেখে আমরা এখানে থাকতে পারব না “
“ ওমা এই কথা! তা ওদের ওখানে একা রাখতে বলেছে কে? ঘরগুলো তো নতুন করে করা হচ্ছে যাতে তোমরা এখানে সবাই একসাথে থাকতে পারো। ও নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না একটু সময় লাগবে ততদিন অন্য কিছু ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলবো আমরা“ আশ্বস্ত করলেন মোহনা।
“ না গো বউদিমনি, সেটাও আসল কারণ নয়। কারণটা আমি এক্ষুনি বলতে পারবো না, সে অনেক কথা ওদিকে আবার কাজ পরে আছে, বাড়িও যেতে হবে। এখন আমি আসি“ বলেই হুড়মুড় করে দৌড় লাগাল রাধার মা, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকলেন অরিত্র, চায়ের কাপ হাতে। ”কি গো ঘুম হলো? তোমার চোখ মুখ অমন শুকনো লাগছে কেন?“
“ ঘুম তো হলো কিন্তু ভুলভাল স্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এখন আবার সেগুলো মনেও করতে পারছি না, যাই হোক ছাড় ওসব কথা, তুমি পিছনের ঘরগুলো দেখলে? কি অবস্থা?” জানতে চাইলেন মোহনা।
“দেখলাম, ওগুলো সত্যি মেরামত করা যাবে না। ভেঙ্গে নতুন করে করতে হবে। ততদিন ভাবছি একটা পিকআপ ভ্যানের ব্যবস্থা করবো। এমনিতেও স্টেশন থেকে গেস্ট পিক আপের জন্য লাগতোই, সেটা নাহয় কদিন আগেই কিনে নেবো, ওদের নিয়ে আসা দিয়ে আসার কাজে লেগে যাবে যতদিন না ঘরগুলো কমপ্লিট হয়” অরিত্র কথা শেষ করার আগেই ঘরের বাইরে কেউ টোকা দিল। “দাদাবাবু আসবো?”
“আরে এস এসো, বংশী দাদা “ বললেন অরিত্র। বংশী দুটো প্লেটে করে ভরতি আলুর পকোরা আর পেঁয়াজি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
“বউদিমনি, খেয়ে দেখুন আলুর পকোরা আর পেঁয়াজি রাধার মা খুব ভালো বানায়, ফ্লাক্সে করে চা এনেছি আর আপনাদের রাতের খাবার নীচের ঘরে টেবিলে রেখেছি সেগুলো কি উপরে দিয়ে যাবো? আসলে এবার আমাদেরও রওনা দিতে হবে সন্ধ্যেও হয়ে আসছে।”
“না না ওসব করার দরকার নেই আমরা নীচে গিয়েই খেয়ে নেবো, তোমাদের তো দেরী হয়ে যাচ্ছে তোমরা এগোও, অরিত্র ড্রাইভার দাদাকে একটু বলে দাও না ওদের পৌঁছে দিয়ে আসুক“ বললেন মোহনা, অরিত্র কিছু বলার আগে বংশী বললো, “না না বউদিমনি আপনাদের কষ্ট করতে হবে না আমরা ঠিক চলে যাবো, তবে একটা কথা ছিল, যদি কিছু মনে না করেন..”
“কি কথা বলো না, সঙ্কোচের কি আছে?” বললেন মোহনা , “দাদাবাবু অচেনা জায়গা তো রাতের বেলায় বেরোবেন না, কোন শব্দ পেলেও না। আর যতটা পারবেন উপরেই থাকবেন নীচে যাওয়াটা এড়িয়ে চলবেন, শুনেছি এখানে অপদেবতা বেরোয়, একটু সাবধানে থাকবেন।“ বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো বংশী। বংশী বেরিয়ে যেতেই মোহনা বললেন “এই বাড়ির কিছু ইতিহাস আছে অরিত্র আমি নিশ্চিত, আর সেটা এরা খুব ভালো জানে কিন্তু বলছে না।”
পাহাড়ি জঙ্গল এলাকায় যেমন ঝপ করে সন্ধ্যে নামে ঠিক সেই ভাবে হঠাৎ করে চারিদিকে সন্ধ্যে নেমে এসেছে বাইরে। অদ্ভুত একটা গাম্ভীর্য যেন গ্রাস করে নিতে চাইছে পুরো বাড়িটাকে, শুধু পারছে না জঙ্গল থেকে ভেসে আসা বন্য জন্তুর ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার জন্য। অরিত্র একটা আড়মোরা ভেঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “সারাদিনে এখানে কাজের চক্করে মেলগুলো চেক করা হয়নি, দেখি একবার আর মাল পত্তর কিছু আসার কথা ছিল আজ কিছুই তো এলো না সে গুলোও জানতে হবে” বলে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বার করে বিছানার পাশে টেবিলটায় গিয়ে বসলেন। মোহনাও ডুবে গেলেন একটা পত্রিকায়। আসার সময় কিনে ছিলেন পড়ার সময় হয় নি। কিছুক্ষন দুজনেই নিজের কাজে ডুবেই রইলেন । চমক ভাঙল একটা শব্দে, কেউ বা কারা নীচে সদর দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। অরিত্র বিরক্ত হয়ে বললেন “কে এলো আবার এখন? ওহ হতে পারে লজিস্টিকস-এর লোক বোধ হয়; কিন্তু যোগেন বাবু তো নীচেই ছিলেন, আমিই গিয়ে দেখি..” বলে ল্যাপটপ বন্ধ করে নীচে নেমে এসে দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই। তাও চারিদিক একবার চোখ বুলিয়ে দরজা বন্ধ করে সিঁড়িতে উঠতে যাবেন আবার দরজা ধাক্কানোর শব্দ, অরিত্র আবার নেমে এসে দরজা খুলে দেখলেন নাহ্ কেউ কোথাও নেই, কে এমন মস্করা করছে কে জানে?চলবে …………..
-
ধারাবাহিক- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-১)
পুনরাবৃত্ত (পর্ব-১)
– অযান্ত্রিক“বারান্দা থেকে জঙ্গলের দিকটা দেখতে দারুণ লাগছে, তাইনা মোহনা? দক্ষিণ দিকটা বোধ হয় ঐটাই” বললেন অরিত্র বাবু, মানে অরিত্র সোম। সোম হলিডে রিসোর্টের মালিক। মাস ছয়েক আগেই কিনেছেন এই প্রাসাদপম অট্টালিকা। বরাবরের মতই অকশানে। এই সোম দম্পতির, পায়ের তলায় তো সর্ষে, আর ব্যবসাটাও যখন রিসোর্টের তখন সেটা বাড়ানোরও তো একটা তাগিদ দুজনেরই আছে। বছর কয়েক আগে, জলদা পাড়া ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে এসেই শুনে ছিলেন অরিত্র বাবু, জঙ্গলটাও কাছেই যদিও সেটা জলদা পাড়া নয়, চিলাপাতা জঙ্গল। অরিত্র বাবু, দেখেছিলেন জঙ্গলটা খুব পরিচিত নয় ভ্রমণ পিপাসু মহলে, আশে পাশে তেমন ভাল হোটেল নেই। কাজেই থাকতে গেলে সবাইকেই সেই হাসিমারা টাউনেই থাকতে হয়। অরিত্র বাবু ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বলেই এই অভাবটা সত্যিই অনুভব করেছেন। আর ওনার যে খুব তীব্র ব্যবসায়িক বুদ্ধি সেটা কে আর না জানে। এমন জঙ্গলের কাছে যদি একটা আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত থাকার জায়গা করা যায় তাহলে তো আর কথাই নেই। অরিত্র বাবুদের হোটেল ব্যবসা বেশ কয়েক পুরুষের, দেশের নানা প্রান্তে ওনাদের হোটেল রিসোর্ট আছে- বকখালী, মন্দারমণি, দীঘা, গাংটক, চাদিপুর, গোপালপুর। অরিত্রবাবু নিজেও বেশ কটা করেছেন মধুপুর, গিরিডি, নেতারহাট, বক্সার। যদিও নামগুলো শুনেই বুঝতে পারছেন অরিত্র বাবুর জঙ্গলের প্রতি একটা টান আছে। গত তিন বছর ধরে চেষ্টার পরে কয়েক মাস আগেই এই বাড়িটা কিনেছেন। বাড়ি বলা ভুল হবে হাভেলি বলাই ভালো, জঙ্গলের একদম গায়েই। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তারপর অরিত্র বাবু খুলতে পারছেন তাদের সোম হোটেল রিসোর্টের নবতম শাখা চিলাপাতা জঙ্গলে। কেনার পর অরিত্র বাবু কয়েকবার ঘুরে গেলেও মোহনা দেবী প্রথমবার এলেন এবারই। আর আসবেন নাইবা কেন? দু’ দিন বাদেই তো উদ্বোধন হবে “চিলাপাতা গ্রিন ভাল্যি রিসোর্ট’। সব শাখা সাজানো গোছানোর দায়িত্ব সাধারণত মোহনা দেবীরই থাকে। আগে থেকে লাইভ ভিডিওতে যা যা করানোর, করিয়েছেন এবার শেষ বা ফিনিশিং টাচগুলো দিতে সশরীরে আসতেই হয়েছে। অরিত্র বাবুর কথায় মোহনা দেবী কোন উত্তর দিলেন না, শুধু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন।
“তোমার কি মনে হয়? লোকেশন হিসেবে ব্যবসা কেমন হতে পারে?“ আবার বললেন অরিত্র বাবু।
“সবার তো জঙ্গল ভালো লাগে না, তবে যাদের লাগে সেই স্তরের লোকের কাছে পৌঁছাতে পারলে ব্যবসা না হওয়ার তো কারণ দেখি না। তবে আমার মনে হয় যদি বাড়িটাকে রাজবাড়ীর মত করে আরও ডেকরেট করতে পারলে অন্য শ্রেণীর লোকের কাছেও পৌঁছানো যেতো। আজকাল তো হামেশাই বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এমন বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। ঘর তোঁ অনেক গুলোই আছে“ বললেন মোহনা দেবী।
“সেটা আমার মাথায়ও আছে, বহুদিনের বাড়ি হলেও, আমাদের রং করানো, আর ইলেকট্রিকের কাজ ছাড়া তেমন কিছু কাজ করতে হয় নি। তুমি লক্ষ্য করেছো কিনা জানি না একটাও দরজা জানলা দীর্ঘদিনের অব্যবহারেও পালিশ নষ্ট হয় নি, মেঝের মারবেল পালিশও খারাপ হয়নি। তাহলে ভাবো যিনি এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন, কত ভাল ভাল জিনিষ ব্যবহার করেছিলেন।“
“সে আমিও লক্ষ্য করেছি। আচ্ছা অরিত্র বাড়িটার ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু জেনেছ? মানে কাগজ পত্রে যা বয়স লেখা আছে সেটাই ঠিক নাকি বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশী। আজ পর্যন্ত কতবার হাত বদল হয়েছে? কোন গঠনগত পরিবর্তন হয়েছে কিনা? অথবা প্রথম অবস্থায় কেমন ছিল দেখতে“ জানতে চাইলেন মোহনা দেবী।
“না না অতসব আমি খোঁজ নিই নি, যা জানি সেটা অকশান ডকুমেন্ট থেকেই জেনেছি। ওদের কাগজ আর দলিল দেখে জেনেছিলাম, এই বাড়িটা ১৮৯৭ সালে হাসিমারার কোনো মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ করে ছিলেন, উনি নিজে ভাল শিকারীও ছিলেন। যদিও ১৯২০ সালে কোনো দুর্ঘটনায় উনি মারা যান। তার প্রায় বছর দশেক পরে ওনার পরিবারের লোক এই বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন। তারপরেও বহু হাত বদল হয়ে শেষমেশ বিজয় সরকার নামে একজন প্রপার্টি ডিলারের হাতে ছিল বাড়িটা। উনিও এই বাড়ি বাঙ্কের কাছে জমা দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা লোন নিয়েছিলেন। পরে শোধ করতে না পারায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাড়িটা নিলাম করে দেয়। আমি সেখান থেকেই কিনেছি, মালিকানার ব্যাপারে এর থেকে বেশী কিছু জানি না।“
মোহনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চা জল খাবার নিয়ে বারান্দায় ঢুকলো বংশী, “স্যার চা নিয়ে এলাম, আর দুপুরে কি রান্না করবে জানতে চাইলো রাধার মা, যা বলবেন সেই মতো বাজার যাবো।“
“আসো, আসো বংশীদাদা আরে আমাদের স্যার ম্যাডাম, বলে বাইরের লোক করে দিও না। আমরা তোমাদের বাড়ির লোক, বাড়ির লোককে কি কেউ স্যার ম্যাডাম বলে নাকি?” হাসতে হাসতে খুব আন্তরিক ভাবে বললেন মোহনা। “দুপুরে যে কোনো কিছু রান্না করো, মাছ মাংস খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। রাধার মাকে বলে দ্যাখো না যদি বাড়ির মতো করে মুসুর ডাল আর কিছু ভাজা টাজা আর একটা তরকারী করে দেয়, সারা রাত ট্রাভেল করে এসেছি তো, রিচ কিছু খাব না।“
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সেটাই বলে দিচ্ছি, রাধার মাকে“ বলে চলে যাচ্ছিলো বংশী, কিন্তু অরিত্র বললেন, “আচ্ছা বংশীদাদা, তোমরা তো শুনেছি এখানকার আদি বাসিন্দা। তাহলে এই বাড়ির ব্যাপারে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানো, মানে এই বাড়ির ইতিহাস আর কি। যদি একবার সে সব সময় করে একবার জানাও তাহলে সেই অনুযায়ী বাড়িটাকে সাজানো যায়, আমরা তো তেমন কিছু জানি না।“
“হ্যাঁ, সে ঠিক কথাই বলেছেন দাদাবাবু, আমরা প্রায় চার পুরুষ ধরে এখানেই আছি, আমার ঠাকুরদা তার বাপ তো এই বাড়িতেই কাজ করতো। তবে কিনা আমি জন্ম থেকে বাড়িটা বন্ধই দেখেছি, এর থেকে বেশী কিছু জানি না। জানলে শিতলদাদা জানতে পারে। বছর কয়েক আগে অব্ধি ঐ তো দেখাশুনা করতো, আর আমাকেও তো ঐ এখানে কাজের খবর দিয়েছিলো। দেখছেনই তো আশেপাশে দশ কিলমিটারের মধ্যে কোনো বাড়ি ঘর নেই, কে আর খবর রখে এই সিংহ বাড়ির.. “
“ওঃ তাহলে তো হয়েই গেলো, তাহলে একদিন চলো না শিতল দাদার কাছে বা একবার সময় করে নিয়েই এসো, আমার গাড়িটা আছেই এখানে।“ বললেন অরিত্র।
“হে হে দাদাবাবু, শিতল দাদা আমার ঠাকুরদাদা গো, বড্ড বুড়ো, হাঁটতে চলতে পারে না, আসবে কি করে? আপনাদের ম্যানেজার যোগেনকেও তো শিতল দাদাই খবর দিয়েছিলো, সেই জন্যই আমি আর যোগেন এক সাথেই কাজ লেগেছি।“
“ঠিক আছে, আমরাই না হয় যাবো একদিন সময় করে তোমার বাড়ি তাতে কোন আসুবিধা নেই তো? বললেন অরিত্র। বংশী লজ্জায় কানে হাত দিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। বংশী চলে যেতে মোহনা বললেন, “একবার পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলে হতো না? কি কি কাজ বাকি আছে সেটা তো দেখাই হল না।“
“সে করা যেতেই পারে রানী সাহেবা, কিন্তু সারা রাত গাড়ি চালিয়ে আমার একটু ঘুম পাচ্ছে। বিকালে দেখলে হতো না? আচ্ছা ঠিক আছে চলো” মৃদু আপত্তি জানিয়ে বললেন অরিত্র। “না ছেড়ে দাও, তুমি বরং চা জলখাবার খেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও, আমি নিজে ঘুরে দেখে নিচ্ছি, আর যোগেনবাবু তো আছেনই।“ বললেন মোহনা।
চা জলখাবার শেষ করে, ফ্রেশ হয়ে মোহনা দোতলার থেকে নীচে নেমে এলেন, সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথম যে ঘর সেই ঘরে। এসে প্রতি কোনা দেওাল খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। অরিত্র যদিও আগেই মোহনার কথা মতো সব দেওয়ালে ওয়াল পেপার আর মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেওয়ালগুলো কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মোহনাকে নীচের তলায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে এগিয়ে এলেন ম্যানেজার যোগেন সরকার।
“বৌদি, কিছু লাগবে?”
“ না না, আমার কিছু লাগবে না দাদা। এই একটু ঘুরে দেখছিলাম বাড়িটা। বাড়িটার গড়নটা তো বেশ রাজ বাড়ির মতো, তাই ভাবছিলাম এই দেওয়ালগুলোতে কিছু পুরনো ছবি লাগালে, সাজানোটা আরও আকর্ষণীয় লাগতো। আপনি কি দেখেছেন? উপরে ছাদের সাথে বেশ কয়েকটা হুক লাগানো আছে। এমন হুক সাধারণত ঝাড়বাতি লাগানর জন্যই হয় অথবা দড়ি টানা পাখা। আসলে দাদা, মানুষ এখন এমন রাজকীয় পরিবেশ বেশী পছন্দ আর তার জন্য অতিরিক্ত খরচ করতেও পিছুপা হয় না। তাই ভাবছিলাম এই বাড়ির পুরনো কোন ছবি, বা মালিকদের কোন তৈলচিত্র যদি এই দেওয়ালে লাগানো যায়, তাহলে মন্দ হয় না, আপনি কি বলেন?” বললেন মোহনা।
“সে আপনি যেমন ঠিক বোঝেন, মুশকিল হল আমি যত দিন এই বাড়িটাকে চিনি তাতে এই বাড়ির ছবি বা যেমন ছবির কথা আপনি বলছেন কোনটাই আমি দেখিনি। তবে শিতলদাদা জানতে পারে, কারণ উনিই দীর্ঘ দিন এই বাড়ির দেখভাল করেছেন আমিও তো গত দশ বারো বছর হলো ওর সাথেই এসেছি, তাও আমি ঝাড়বাতি, ছবি, দড়িটানা পাখা কোনোটাই দেখিনি।“ জানালো যোগেন সরকার ।
“ওহ তাহলে ঠিক আছে, আচ্ছা? গদি,খাট,পর্দা এসব যে পাঠিয়েছিলাম সে সব যেভাবে লাগাতে বলে ছিলাম সে ভাবেই লাগিয়েছেন তো, ভিডিও কলে যদিও দেখে ছিলাম তবে ওভাবে দেখলে তো ঠিক বোঝা যায় না তাই..“
“সে সব আপনার কথা মতই সেট করে দিয়েছি, আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে এখনই একবার দেখে নেবেন চলুন না।” বলে মোহনাকে সঙ্গে করে নিয়ে সব ঘরগুলো ঘুরে দেখাতে শুরু করলো। নীচ উপর মিলিয়ে কুড়িটা ঘর, যাদের মধ্যে একটা ঘর খুব বড়, সেটাই ওরা ঠিক করে রেখেছে খাওয়ার ঘর করবে, এমনি ঘরটা সাজানো হয়ে গেছে, শুধু চেয়ার টেবিলগুলো কাল কলকাতা থেকে এসে পৌঁছালে বসিয়ে দিলে হবে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে এবার উঠতে উঠতে মোহনার মনে হল ঘরগুলো কেন জানি না বেশ চেনা চেনা লাগছে। তবে বাড়িটার ধরণটা কিন্তু বেশ। মূল দরজা দিয়ে ঢুকে বড় একটা ড্রয়িং রুম, সেই ড্রয়িং রুমের ঠিক শেষ যেখানে, সেখানে দুইদিক দিয়ে দু’টো সিঁড়ি উঠে এসেছে দোতলায়। ড্রয়িং রুমটার বাম দিকে সারি দিয়ে পাঁচখানা ঘর আর ডান দিকে তিনটে ঘর, কিচেন আর ডাইনিং রুম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলে একটা লম্বা করিডর, যার পাশে পাশেই সার দিয়ে দশ খানা ঘর। নীচ থেকে যে সিঁড়ি দোতলায় উঠেছে সেটা মাঝখানে একটা জায়গায় এসে মিশেছে, সেখান থেকে আবার দু’দিকে ভাগ হয়ে উপরে উঠে গেছে। ঐ জায়গাটায় এসে মোহনা দেখলেন সেখানে দেওয়ালের মাঝখানে একটা দরজা। দরজাটায় অপূর্ব কারুকার্য করা, খুব পুরনো অথচ তার আকর্ষণীয়তা একটুও কমেনি। মোহনার সব থেকে আশ্চর্য লাগলো দরজার গায়ে লাগান তালাটা। একটু অদ্ভুত দেখতে, তার উপর একটা রুপালী রঙের চেন লাগানো, দেখে রুপোই মনে হচ্ছে আর সেই চেন থেকে অনেকগুলো ওঁ, স্বস্তিক চিহ্ন ঝুলছে। মোহনা কৌতূহলী হয়ে তালাটাতে হাত দিতেই ওর হাতটা যেন কেউ চেপে ধরলো সেই সঙ্গে কেউ যেন পিছন থকে টেনেও ধরলো ওকে। মোহনা সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে দেখলেন কেউ নেই, ভাবলেন হয়তো মনের ভুল। আবার দরজার দিকে ফিরে তালাটায় হাত দিতে যাবে এমন সময়ই–চলবে……….