গল্প
-
গল্প- শারদোৎসব
শারদোৎসব
সুমিতা দাশগুপ্তআকাশ জোড়া পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের অঝোরধারার বর্ষণে পৃথিবী যখন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ,মনখারাপি আবহ আর কাটতেই চায় না,ঠিক সেইসময়েই সহসা একদিন মেঘ ছেঁড়া আলো এসে উদ্ভাসিত করে তুললো আমাদের সাধের পৃথিবীখানাকে। নাড়া খেয়ে জেগে উঠলো শরৎকাল,গ্রামে গঞ্জে,মাঠে ঘাটে,নদীর ধারে আগমনী গান গেয়ে উঠলো গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। নিঝুমরাতের নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে, আকাশ থেকে তারার বাণী বহন করে যেন শিশির ঝরলো টুপটাপ।ঘুম ভাঙলো শেফালির। শিউলি গন্ধ মাখানো ভোরে,জেগে উঠলো মানুষ, মনে পড়ে গেল মেলাই কাজ পড়ে আছে,গড়িমসির সময় নেই আর। শারদোৎসব আসন্ন !
পাড়ায় পাড়ায় , বড়ো মাঠে পড়ে থাকা স্তূপাকৃতি বাঁশের দল, গা ঝাড়া দিয়ে তেড়েফুঁড়ে উঠলো, জলদি করো,জলদি করো, প্যান্ডেল বাঁধতে হবে ! সময় তো আর বেশী নেই, মা দুগগা এলেন বলে!
আসলে পুজো মানেই তো ফিরে আসা, ফিরে আসা নিজেরই কাছে, নিজের মাঝে, পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো অনুষঙ্গের অপ্রতিরোধ্য টানে। এই পুজোর সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে কত হারিয়ে যাওয়া দিন, মানুষজন,ঘর বাড়ি, আর ছেলেবেলা।আমাদের ছেলেবেলার অনেক ক’টা দিন কেটেছে বিহারে, বাবার কর্মস্থলে।
বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে তাঁকে, আকছার ছোটবড়ো নানা জায়গায় বদলি হতে হতো। বসবাসের জন্য অবশ্য রেল কোম্পানির কোয়ার্টারের সুবিধে মিলতো, ছোট, বড়ো মাঝারি, বাগানওয়ালা, বাগানবিহীন ইত্যাদি নানা কিসিমের কত রকমের যে বাড়ি ঘর দোর! নতুন জায়গায়,নতুন বন্ধুবান্ধব, তাদের অন্য ধরনের আচার ব্যবহার, জনবসতি। তবে একটি জিনিসই কেবল অপরিবর্তিত থাকতো। যখন যেখানেই থাকি না কেন, যথাসময়ে পুজোর গন্ধটা ঠিক মনের দুয়ারে কড়া নাড়তোই। জায়গা ভেদে মাতৃমুখের আদলে হয়তো কিঞ্চিৎ হেরফের হতো, আঞ্চলিক কারিগরের হাতে, তবে তাতে বিশেষ কিছু এসে যেতো না। মা,তো মা-ই হন। আয়তনেত্রের ওই করুণাঘন মায়াদৃষ্টির তো আর বদল হয় না!
আমরা যখন একটু বড়ো হয়ে উঠছি, সেইসময় বাবা বদলি হলেন বিহারের একটি সদর শহরে। কোয়ার্টারখানাও একটু অন্য ধরনের । বড়ো বড়ো পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বানানো পেল্লায় উঁচু ছাদওয়ালা , আগাগোড়া কাচের দরজা জানলা, কাঠের সানশেড, সামনে লম্বাচওড়া বিস্তৃত একখানা বারান্দা। তিন চার ধাপ সিঁড়ি নামলেই,বাড়ির চারপাশে অনেকটা করে বাগান করার জায়গা।
ওগুলোতে নাকি এককালে সাহেবসুবোদের কোয়ার্টার ছিলো। স্বাধীনতার পরে এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে দেশীয় সাহেবদের সেইসব কোয়ারর্টারে থাকতে দেওয়া হতো। এটি ছিল সেই জাতেরই একখানা বাড়ি।
সাহেবরা চিরকালের শৌখিন জাত। তাঁদের সময়ে, তাঁরা নিশ্চয়ই কোয়ার্টার সংলগ্ন বিস্তৃত ওই জায়গাটিতে ফুল ফলের বাগান তৈরী করেছিলেন, তবে আমরা যখন ওই বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলাম, তখন আর সেই সবের চিহ্ণমাত্রও ছিল না।অনাদরে অবহেলায়,কবেই সেইসব বাগান বিলুপ্ত।এখন তার শুকনো মরুভূমিসদৃশ আকার । আগের বাসিন্দারা বোধহয় ঘোরতর বৃক্ষবিরোধী ছিলেন।ওদিকে আমাদের বাবা আবার চিরকালের বাগানবিলাসী, গাছপালার সঙ্গে তাঁর অগাধ মৈত্রী। লতাপাতারা তাঁকে দেখলেই ডেকে কথা কয়। অতএব রতনে রতন চিনে নিল। কোয়ার্টারের সামনে ,পাশে , পিছনের বিস্তীর্ণ পোড়োজমি সদৃশ এলাকা,অচিরেই ফুলে ফলে বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ হয়ে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠলো।
দেখতে দেখতে দূরের পাঁচিলের সীমানা বরাবর,সারি সারি আম, পেয়ারা, সজনে গাছেরা মাথা তুলতে আরম্ভ করলো, হাওয়ায় তাদের ডালপালারা খুশিতে মাথা দোলায়। রুক্ষ লালচে মাটিতে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, এতদিনে কোয়ার্টারটাকে বেশ বাড়ি বাড়ি মনে হতে থাকলো।মাঝে মাঝে মায়ের আফশোশ ,কবে আবার বদলির হুকুম আসবে কে জানে! সব ছেড়েছুড়ে পাততাড়ি গুটোতে হবে!বাবা তখন দার্শনিক , আনমনে গানের লাইন আওড়াতে আওড়াতে জলের ঝারি হাতে তুলে নেন…
“পরের জায়গা,পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই…”
বাবার গলার স্বর ক্রমশ মৃদু হয়ে মিলিয়ে যায়।আমাদের তখন অতোশতো গভীর তত্ত্ব বোঝবার, বয়সই নয়! ছুটির দিনে বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াই। গাছপালার সঙ্গে একধরনের সখ্যও জন্মায়।
উঁচু বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে, লাল ইট বাঁধানো রাস্তা এগিয়েছে মূল ফটকের দিকে।সেই পথের দুপাশে বেলিফুলের ঝাড়, বৈশাখের ভোরের হাওয়াকে গন্ধে বিভোর করে তোলে। রাতের ঘুমে হাসনুহানা, আর লেবুফুলের স্নিগ্ধ সুবাস শান্তির প্রলেপ দেয় ।ওদিকে বর্ষার জল পেয়ে,পাঁচিলের ধারে ধারে স্থলপদ্ম আর শিউলিগাছ তেজী হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। পুজো আসছে, মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে, তাদেরই তো চাই। তখনও বিহারপ্রদেশে,খুব কম বাড়ির বাগানেই তাদের দেখা মিলতো। বাবা, কলকাতার রথের মেলা থেকে চারা সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
ক্রমে পুজো এসে পড়ে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে চকচকে মসৃণ রাঁচি- হাজারিবাগ রোড। একটু দূরেই সেই রাস্তাটি বাঁক নিয়ে সোজা এগিয়ে গেছে। সেই মোড়ের খাঁজে একখন্ড এবড়োখেবড়ো জমি্ সমান করে নিয়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়। ষষ্ঠির দিন সকালে প্রতিমা আসে।
আমাদের কাছাকাছি এলাকায় ওইটিই একমাত্র পুজো, অতএব অলিখিতভাবে ,ওটি আমাদেরই নিজস্ব পুজো। তাই উৎসাহ উদ্দীপনার আর অন্ত নেই।
সপ্তমীর সকালে ভোর হবার অপেক্ষা শুধু। স্নান সেরে, বাগান থেকে নতুন কেনা ছোট ছোট বাঁশের চুপড়ি ভরে শিউলি, স্থলপদ্মের রাশি নিয়ে দে ছুট, পুজোমন্ডপে ঠাকুরমশায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে তো! হরিণ গতিতে ভাই, আমার চাইতে অনেকটা এগিয়ে যায়,আমি পিছু পিছু ছুটতে থাকি।
অন্যান্য কিছু বাড়ি থেকেও পুজোর ফুল আসে , কিন্তু স্থলপদ্ম! উঁহু, সেটি আর হয় না। ঠাকুরমশায়ের হাতে ফুলের ডালাখানা ধরিয়ে দিয়ে গর্বে বুক ফুলে ওঠে দুই ভাইবোনের।
যথাসময়ে পুজো আর অঞ্জলি শেষে,একটু করে প্রসাদ মেলে, আখের টুকরো- পেয়ারা কুচি। ভাঙা নাড়ু পেলে তো আর কথাই নেই আহ্লাদে আটখানা। আমাদের মধ্যে ততক্ষণে কার ক’খানা, জামা হলো, কে কবে কোনটা পড়বে, দূরের হিলকলোনির পাড়ার সিংহটার চোখটা কেমন যেন ট্যারা ,ওদের চাইতে আমাদের প্রতিমা হাজার গুণে ভালো ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলে,ওদিকে মায়েদের ঘর গেরস্থালির কাহিনী… কোন ফাঁকে বেলা গড়ায়। ঘরে ফেরার সময় এসে পড়ে।
না ,তখনও এই দুনিয়ায় কর্পোরেট জগতের অঢেল দাক্ষিণ্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি পুজো প্যান্ডেলে, আমাদের ওই ছোট্ট বিহারী শহরে তো নয়ই, ফলে প্যান্ডেলে বসে ঢালাও খিচুড়ি খাবার গল্প তখনও দূর অস্ত্ , তবে যথাসময়ে প্যান্ডেলে উপস্থিত থাকলে শালপাতার দোনায় করে অল্প বিস্তর ভোগপ্রসাদও পাওয়া যেত বৈকি!
সন্ধ্যে হতে না হতেই,প্যান্ডেলের আলো জ্বলে ওঠে, গেটের আলো ছড়িয়ে পড়ে বাইরের ফাঁকা মাঠে। একে একে সবাই জড়ো হয়।অন্য পাড়ার লোকজনও কেউ কেউ আসেন প্রতিমা দর্শনে। তাঁদের দেখলেই আমরা ঠিক চিনে ফেলি , এঁরা আমাদের নন, অন্য পাড়ার ,নিজেদের মধ্যে কানাকানি চলে, গুরুজনদের ধমক খেয়ে চুপ করি।
শাঁখের আওয়াজে শুরু হয় আরতি, বাজে ঢাক ঢোল,কাঁসর ঘন্টা।ধুনুচির ধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসে মায়ের মুখ। ক্রমে রাত বাড়ে।
বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরি। শুনশান নির্জন পথ, মাথার উপরে একফালি চাঁদ, আকাশ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে, আমরা কেউ কথা বলি না , চুপচাপ পথ হাঁটি।
জীবনে তো কত পথ হাঁটা হলো, পাল্টে গেল বাড়িঘর,স্থান কাল পাত্র। দেখা হলো কতো ধরনের,পুজো, পুজোর আড়ম্বর, আয়োজন,সাজসজ্জা,মনোমুগ্ধকর অসামান্য সব শিল্পকর্ম।
তবু আজও জীবনের এই গোধূলিবেলায় এসে পুজো বলতেই মনের মাঝে ভেসে ওঠে সেই কতকাল আগে দেখা একটি মুখচ্ছবি,আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অর্চনা।
মন ফিরে চায়, সেদিনের সেই ছোট বিহারী শহরে। সেবারে উদ্যোক্তারা ঘোষণা করেছেন বেলাবেলি প্রতিমা বিসর্জনে রওনা হওয়া হবে, সকাল সকাল যেন বরণের কাজ সেরে ফেলা হয়।
মায়ের সঙ্গে আমরা দুই ভাইবোনও উপস্থিত। মা স্টেজে,আমরা নীচে দাঁড়িয়ে লোকজন দেখছি, বিশেষ করে কাছাকাছি গাঁও থেকে,প্রতিমা দর্শনে আসা একদল মানুষকে। কমলারঙা সিঁদুরমাথায় ঘোমটা টানা মহিলারা, মলিন বেশে ছেলেপুলে, যুবক, বৃদ্ধের একটা ছোটখাটো সমাবেশ।হঠাৎ হৈ হৈ রব, পিছু ফিরে দেখি স্টেজে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, সবাই দ্রুত নেমে আসছে –কীভাবে যেন প্রতিমার পিছনের পাতলা কাপড়ে আগুন ধরে গেছে! আগুন ছড়িয়ে পড়লো বলে!
সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সহসা দুহাতে ভীড় ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে স্টেজে উঠে এলো এক দেহাতী তরুণ, ঝাঁপিয়ে উঠে পড়লো জ্বলন্ত আগুনের পাশে,প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে। আগুনের হল্কা উপেক্ষা করে, হাত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে থাকলো জ্বলন্ত কাপড়ের টুকরোগুলো যাতে, আগুন মায়ের অঙ্গস্পর্শ করতে না পারে! নিজের প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ নেই ।
অবশেষে সে সফল হলো। আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারলো না,এড়ানো সম্ভব হলো বড়সড়ো বিপর্যয়।
এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে ঘিরে ধরলো তাকে,কেউ চায় তার পরিচর্যা করতে,আবার কেউ বা সাবাশি দিতে। তাঁর কিন্তু কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই,সে তখন মায়ের সামনে নতজানু হয়ে দরবিগলিত নয়নে অনন্যমনা হয়ে প্রার্থনা করে চলেছে, মা যেন ক্ষুদ্র মানুষের অপরাধ না নেন।
আজ এতগুলো বছর পার করে এসে, জীবনের অপরাহ্ণবেলাতেও প্রার্থনার সেই মুখচ্ছবিটি আমার মনে একই ভাবে সমুজ্জ্বল। -
গল্প- পার্সেল রহস্য
পার্সেল রহস্য
লোপামুদ্রা ব্যানার্জীমহালয়ার সকাল টা এমন করে শুরু হবে আমাদের এপার্টমেন্টে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অঞ্চলের পৌরমাতার উদ্দ্যোগে ভোর সাড়ে চারটা থেকে ই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনছি।আহা কী অপূর্ব লাগে! নাকে যেন সোজা ধূপ ধুনোর আঘ্রাণ ঢুকে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার শিউলি ফুল কুড়ানোর দিন গুলো। আরো একটা জিনিষ বড্ড মনে শিউলি ফুল দিয়ে হাতে মেহেন্দি করার শখ টা। তাই সকল আলস্য ছেড়ে ফেলে বিছানা ত্যাগ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে যাই।গঙ্গা বাড়ির পাশে হলেও স্নান করতে যাই না আমি কোনোদিনই।আসলে গঙ্গা স্নান করার পরে ভিজে কাপড় ছাড়ার পদ্ধতি গুলো আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তি কর। কিন্তু আমাদের এপার্টমেন্টের তলাপাত্র জেঠিমা প্রতিবছর মহালয়ার দিন গঙ্গা স্নানে ছোটেন নিজের স্বামীকে নিয়ে।জেঠু গিয়ে পূর্বপুরুষ দের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে আর জেঠিমা গঙ্গা স্নান।
কিন্তু আজ সকালে মাইকের মহালয়া কানে আসার আগেই তলপাত্র জেঠিমা বাজখাঁই গলা আমার কানে এলো। আমার ফ্ল্যাট ফার্স্ট ফ্লোরে।তাই গ্ৰাউন্ড ফ্লোরের কথা বার্তা বেশ স্পষ্ট কানে আসে।
জেঠিমা বলছেন , দাঁড়াও দাঁড়াও একদম না। একদম হাত লাগাবে না।কিসের না কিসের প্যাকেট কে জানে?
জেঠু বিরক্ত হয়ে বলছেন,ধ্যাত একটা পবিত্র কাজে বের হচ্ছি। এখন এইসব ফালতু ঝামেলা।
_ সে কথা বললে তো হবে না কর্তা মশাই।বাড়ি যখন প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তখন ভাবা উচিত ছিল। হাজার লোকের বাস হবে।তার সঙ্গে ফ্রী তে আসবে হাজার উৎপাত।
_ধূর বাপু তুমি চুপ করো না। স্কুটার টা কি করে বের করবো সেই কথা টা পারলে একটু ভাবো।
_ ও আজ তোমার স্কুটার বের করা যাবে না এখন।এমন ভাবে প্যাকেট টা পড়ে আছে সামনের চাকার নিচে যে গাড়ির স্ট্যান্ড খুললেই চাকা টা প্যাকেটের উপর উঠে পড়বে।প্যাকেটের ওপর চাকা পড়লেই প্যাকেট টা ফাটবে।আর ফাটলেই ওর ভিতর থেকে কিসব বেরিয়ে আসবে কে জানে?
_ তলাপাত্র জেঠু একটু ঝুঁকে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট টা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন ,বুঝলে গিন্নী প্যাকেট টা কিন্তু বেশ পরিস্কার দেখছি। হাত দিয়ে ই সরিয়ে দিই ।
_রীতিমতো চিৎকার করে উঠে জেঠিমা বলে, খবরদার না। দিনকাল একদম ভালো না।তার থেকে বরং তুমি আমাদের সেক্রেটারি দিবাকর বাবু একটা ফোন করো।বলো নীচে নেমে আসতে একবার।
অগ্যতা তলাপাত্র জেঠু বাধ্য স্বামীর মতো সেক্রেটারি দিবাকর বাবু কে ফোন লাগালেন। ইতিমধ্যে মাইকে মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।প্রতিটা ফ্ল্যাটে ই আলো জ্বলে উঠেছে।বার দুয়েক চেষ্টা করার পর দিবাকর বাবুর সঙ্গে তলাপাত্র জেঠু যোগাযোগ করতে পারলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দিবাকর বাবু এপার্টমেন্টের ক্যাশিয়ার ও প্রেসিডেন্ট কে সঙ্গে নিয়ে গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে এলেন।ক্যাশিয়ার তমাল কুন্ডু এসেই বললেন,এই সব ফালতু ঝামেলার জন্য ই আমি মেনগেটে তালা চাবির বদলে সিকিউরিটি রাখার কথা বলে আসছি এতবছর ধরে। কিন্তু তলাপাত্র জেঠুর আপত্তি ই সবচেয়ে বেশি। এবার বুঝুন ঠেলা।
রজত বাবু বললেন,আহা তমাল এখন থাক ঐ সব বিষয়। তার চেয়ে ভালো নয় কি প্যাকেট টা কোথা থেকে এলো,কে এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি, সাইকেলের মাঝে ফেলে গেল তা নিয়ে ভাবা দরকার।
তলাপাত্র জেঠিমা হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,দেখো তমাল তুমি রাগ করো না। তোমরা ইয়ং ছেলেদের দেখনদারি টা বড্ড বেশি। তোমাদের এখন রোজগার পাতি ভালো। কিন্তু তোমার জেঠু তো রিটায়ার্ড লোক। আমাদের কলসীর জল গড়িয়ে খেতে হয়। তাই আমাদের কাছে সিকিউরিটি রাখাটা কিছুটা বিলাসিতা মনে হয়। তুমি যখন তখন তোমার জেঠু কে আক্রমণ করো সিকিউরিটি র ব্যাপার নিয়ে।এ আমার একদম ভালো লাগে না।
তমাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু প্রেসিডেন্ট রজত বাবু চোখ টিপে ব্যাপার টা ক্লোজ করার রিকোয়েস্ট করে।আসলে এমন পুন্য ভোর বেলায় ঝগড়া অশান্তি সমীচীন নয়।
রজত বাবু এগিয়ে গিয়ে প্যাকেট টা দেখলেন।প্যাকেট টা যশোদা বস্ত্রালয়ের । মুখ টা বেশ টিপে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আঁটা।বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ভয়ের কিছু বলে মনে হচ্ছে না।আর তাছাড়া আমাদের এপার্টমেন্টের লোকজন সবাই ছাপোষা ভদ্রলোক। এখানে বিষ্ফোরক টোরক আসার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আমি বলছিলাম, আপনারা তো সবাই উপস্থিত আছেন।তাই আমি সবার সামনেই প্যাকেট টা খুলতে চাই।কারোর কোনো অবজেকশন নেই তো?
তমাল বলে, দাঁড়ান দাঁড়ান রজত দা।আমি মোবাইল এ ভিডিও টা চালু করি।পরে বিল্ডিং এর সকলের সামনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে।
ধীরে ধীরে প্যাকেট টা তলাপাত্র জেঠুর সামনের চাকার মুখ থেকে হাতে তুললেন রজত বাবু। হালকা নাচিয়ে বললেন ওজন এক কিলোর নীচেই হবে মনে হচ্ছে।
দিবাকর বাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,রজত দা আর দেরি করো না।মা দুর্গার নাম নিয়ে খুলে ফেলুন।
রজত বাবু প্যাকেটের মুখের রাবার ব্যান্ড টা খুলে ফেললেন। তারপর দেখলেন ভিতরে একটা কাগজের প্যাকেট। তাতে লেখা আছে অন লাইন শপিং ব্যান্ডের নাম। কিন্তু নাম, ঠিকানার জায়গা টা নীল রঙের কালি দিয়ে কেটে দেওয়া আছে। কিছুতেই পড়ে উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
তলাপাত্র জেঠিমা চোখ গুলো বড় বড় করে বলেন,এ আবার কি কান্ড!কেউ নতুন জিনিস এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি ঘোড়ার মাঝে ফেলে রাখে?
তলাপাত্র জেঠু বিরক্ত সহকারে বললেন,পয়সা বেশি হলে নতুন জিনিস ও মাটিতে গড়াগড়ি খায় দেখছি।যাক গে, ক্ষতিকারক যখন কিছু নেই তখন ভয়ের কিছু নেই।
বুঝলে দিবাকর তাহলে আমরা আর দেরি করবো না। তোমরা প্যাকেট টা খুলে দেখো।আমি আর গিন্নী বরং রওনা দিলাম।
তলাপাত্র জেঠু ওনার আমলের বাজাজ চৈতক কে স্টার্ট দিয়ে জেঠিমা কে পিছনে বসিয়ে গঙ্গা স্নানে ছুটলেন।
আমি আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে থেকে পুরো ব্যাপার টা লক্ষ্য করছিলাম। এবার মনে হলো একেবারে স্পটে যাই।হাউস কোর্ট টা গলিয়ে সিঁড়ির নিচে যেতেই তমাল আমাকে দেখে বলল,এই যে মৌমিতা দি এসে গেছে।ও দিদি প্যাকেট টা তুমি খুলে দেখ। মহিলাদের জিনিস যদি হয়।তাই আমরা কিন্তু কিন্তু করছিলাম।
আমি প্যাকেট টা হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর হাত দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তাই কাঁচির জন্য ওদের কে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এলাম। কাঁচি দিয়ে প্যাকেট টা কাটতেই বেরিয়ে এলো একটা দারুন দেখতে একটা ড্রেস। ব্লাক আর গ্ৰীন এর কম্বিনেশনে র ফ্লোরাল প্রিন্ট।
দিবাকর বাবু হেসে বললেন, ওওওও এতো মেয়েদের পোশাক।
রজত বাবু বললেন, কেউ নিঃশ্চয় সিঁড়ি নীচে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল।বিড়াল কিংবা ছুঁচো তে টানাটানি করে এমন রহস্য সৃষ্টি করলো মহালয়ার সকালে।আরে বাবা অন লাইন শপিং তো কোনো অন্যায় কাজ নয়।এই নিয়ে তো লুকোচুরির কিছু নেই।
তমাল বিজ্ঞের মতো বলল,সাধে কি আর বলে মেয়েছেলের বুদ্ধি।কথা টা বলেই ও বুঝতে পারে মুখ ফস্কে একটা বাজে কথা বলে ফেলেছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও বলে ওঠে, মৌমিতা দি আমি আমাদের হুয়াটস গ্ৰুপে এই ড্রেস টার একটা ছবি দিয়ে দিচ্ছি।আর লিখে দিচ্ছি,এই জিনিসটা যার তিনি যেন তোমার কাছ থেকে নিয়ে যায়।প্লিজ দিদি না করো না।
অগ্যতা আমি মালিক হীন পোশাক টা বাইরের ঘরের বুক সেলফের ওপর রেখে দিয়ে কিচেনে গেলাম। গ্যাসে লিকার চা বসিয়ে রাতের বেলায় ধুয়ে রাখা বাসন পত্র গুলো মুছে বাসন রাখার সেলফে তুলে রাখতে লাগলাম।
তারপর একটা কাঁচের গ্লাসে লিকার চা টা ঢেলে দুটো বিস্কুট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম। আর পার্সেল টা কার হতে পারে এই ভাবনা টা দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলা দিতে লাগলো আমার মনে।
মিনিট পনেরো পর ডোর বেল টা বেজে উঠলো।আমি দরজা খুলে দেখি তলাপাত্র জেঠিমার বৌমা রুচি।
মিষ্টি হাসি দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর কোনো রকমের ভনিতা ছাড়াই বললো,দিদি ওই পার্সেল টা আমার। গতকাল দুপুরে ডেলিভারি বয় দিয়ে গিয়েছিল।এই বলেই ফোন টা খুলে ওর অর্ডার লিস্ট টা দেখলো।
আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে ড্রেস টা রুচির। কিন্তু ওর ড্রেস টা কিভাবে সিঁড়ি ঘরে এলো সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
রুচি এই প্রথম বার আমার ফ্ল্যাটে এলো।তাই আমি ওর ডান হাত টা ধরে বললাম, প্রথমবার তুমি আমাদের ফ্ল্যাটে আসলে।আগে তো সোফায় বসো। তারপর পার্সেল নিয়ে কথা বলছি।
রুচি হালকা হাসি দিয়ে সোফায় বসলো। তারপর বললো,কি আর করবো বলো দি। আমার শাশুড়ি কারোর ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া খুব একটা পছন্দ করে না।
তারপর একটু বিরতি নিয়ে বললো, ওনার ধারনা অন্যদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে আমি নাকি বিগড়ে যাবো।ভাবো একবার! আমি কি দুধ খাওয়ার বাচ্চা।
আসলে আমি তো গ্ৰামের মেয়ে। শাশুড়ি মা সবসময় বলে,যত কম শহরের হাওয়া গায়ে লাগাবে।ততই সব দিক থেকে ভালো থাকবে। শহরের আদব কায়দা শিখলেই বিপত্তি।খরচ বেড়ে যাবে আকাশ ছোঁয়া। ওনার শুধু সাশ্রয় এর চিন্তা।আমি আসার পর তো ঠিকে কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে জানো। আমাকে বলা হল,বৌমা আমি তো এখন ও শক্ত সামর্থ আছি।তাই দুজনে মিলে মিশে সংসারের সব কাজ করে নেবো কেমন। কিন্তু দিদি মাস খানেক ও মিলেমিশে কাজ করতে পারলাম না আমরা। আমার শাশুড়ি মা সপ্তাহের ওয়ার্কিং দিন গুলোতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।যেমন ধরো মাথা ধরা কিংবা পেটে ব্যথায় ভুগবেন।
আমি বেশ বুঝতে পারছি তলাপাত্র জেঠিমা পাকা মাথার বুদ্ধি ধরেন সবসময়। কিন্তু রুচি ও যে খুব একটা বোকা মেয়ে তা কিন্তু নয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পার্সেল টা তুমি সিঁড়ি ঘরে রেখেছিলে কেন রুচি?
রুচি বলে দিদি আমার কপাল টাই খারাপ যাচ্ছে আজকাল।না হলে কি এমন বিপত্তি ঘটত।
মানে?
আমার শাশুড়ি মাকে লুকিয়ে অনলাইনে এটা ওটা আমি কিনি মাঝে মধ্যে ই। ডেলিভারি বয়ের থেকে জিনিস নিয়ে সিঁড়ি ঘরের যে বড় লেটার বক্স টা আছে তার মাথায় তুলে রাখি।সময় সুযোগ বুঝে আমি অথবা বর যে কেউ এসে টুক করে পার্সেল টা নিয়ে চলে যাই।
আমি চোখ গুলো কপালে তুলে বললাম, ওওওওও,ব্যাপারটা নতুন নয় তাহলে। ঠিক আছে নিয়ে যাও পার্সেল টা তাড়াতাড়ি। তোমার শাশুড়ি যে কোনো মুহুর্তে চলে আসতে পারে।
পার্সেল টা হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় রুচি আমার হাত টা ধরে বলে, প্লিজ মৌমিতা দি এই পার্সেল রহস্য এর কথা খুব বেশি কাউকে বলো না।
আমি রুচির হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। কমিটির তিন চার জন ছাড়া এই পার্সেল কার ছিল কেউ জানবে না।তবে এরপর থেকে সিঁড়ি ঘরে পার্সেল না রেখে সোজা নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবি। শাশুড়ি কিছু বললে বুদ্ধি দিয়ে উত্তর দিবি। লুকোচুরির পথের চেয়ে লড়াই এর পথ ভালো।লড়াই এর একটা পরিনতি থাকে। লুকোচুরি তে থাকে কেবলমাত্র ধোঁকা। ধোঁকার হাত ধরে যেমন ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না ঠিক তেমনি জীবনটা ও বিষময় হয়ে যায়।। -
গল্প- খেলা যখন
খেলা যখন
-সুমিতা দাশগুপ্ত
আজ রবিবার। ভোরবেলাতেই জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।এখন আকাশটা পরিষ্কার। নীল আকাশ বেয়ে সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ছে গাছগাছালির মাথায় মাথায়। চমৎকার দেখাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির শোভা, শুধু ডাঃ দিব্যদ্যুতি রায়ের আজকের প্রাতর্ভ্রমণটাই মাটি হয়ে গেল, এই যা!দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গেটের বাইরে সোজা কালো পিচের রাস্তাটার দিকে চেয়েছিলেন দিব্য। বৃষ্টিতে ঝরে পড়া কদমকেশর আর ছাতিমফুলের ছেঁড়া পাঁপড়িতে কালো পিচের রাস্তাটা যেন সেজে উঠেছে। শরৎকাল প্রায় এসে গেল ,তাও এই বছরে বৃষ্টিটা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। মহালয়াটা যেন কবে? আরে আজকেই তো!! এবারে মহালয়াটা রবিবারে পড়ায়,আলাদা ছুটি মেলে নি বলেই বোধহয় তারিখটা ঠিক খেয়াল করতে পারছিলেন না তিনি।
অভিজাত এই শুনশান পাড়াটায়, শব্দদূষণের প্রকোপ যেমন নেই, তেমনই নেই, ভোরবেলায় পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে আসা মহালয়ার স্ত্রোত্রপাঠের মন ভালো করা সুর।প্রতিবেশীরা সবাই কেমন যেন দূরে দূরে, প্রত্যেকেই নিজের মনে একলা থাকার অভ্যেস রপ্ত করে নিয়েছে।
একদা মধ্যবিত্ত দিব্য রায়, এখানে এসে পাড়া কালচারটা বড্ডো মিস্ করেন, অবশ্য কতক্ষণই বা বাড়িতে থাকেন তিনি ! সেই সাত সকালে বাড়ি থেকে বের হন, আর ফেরেন যখন তখন তো সন্ধ্যের চৌকাঠ পেরিয়ে, দিন রওনা দিয়েছে রাত -গভীরে।শহরের ব্যস্ততম ডাক্তারদের অন্যতম দিব্যদ্যুতি রায়ের, সারা সপ্তাহ দম ফেলবার ফুরসত থাকে না, কেবল রবিবার আর ছুটিছাটার দিনগুলিতেই ঢিলেঢালা অবকাশে সময় কাটানোর সামান্য যা সুযোগ মেলে।
ছুটির দিনে ভরপেট জলখাবার খেয়ে,ফোনে
দুই একজন আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে টুকটাক গপ্পোগাছা,ল্যাপটপে জমে থাকা ব্যক্তিগত মেইলগুলো চেক করে প্রয়োজনীয় চিঠিচাপাটি চালাচালি, এইসব করেই সকালটা পার হয়ে যায়। এছাড়া কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে। না, কোনোও বাঁধাধরা রুটিনমাফিক ব্যাপার নয়। স্বেচ্ছায় একেক দিন গিয়ে ঘুরে আসেন কয়েকটি ওল্ড এজ হোম থেকে। সাধারণ হেলথ চেক আপ, কিছুক্ষণ বৃদ্ধমানুষগুলির সঙ্গে বসে, সুখ দুঃখের গল্প করা, কারো কারো ব্যক্তিগত সমস্যায় কিছু পরামর্শ দেওয়া, অথবা সম্ভব হলে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এইসবই আর কী! এইটুকতেই কতো যে খুশি হয়ে যান একাকী নিঃসঙ্গ মানুষগুলো, সেই হাসিখুশি মুখগুলো দেখে দিব্যর মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। না, কোনও স্বার্থ নয়, কিছুটা সামাজিক দায়িত্ববোধে এই কাজগুলো করে থাকেন তিনি, ঠিক তাঁর নিজের বাবার মতোই। ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন তাঁর বাবা, রবিবার সকালটায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন এলাকার গরীবগুরবো মানুষগুলোর। দিব্যও বোধহয়, উত্তরাধিকার সূত্রেই এই দায়িত্ববোধটুকু বাবার কাছ থেকে লাভ করেছেন।দুপুরে পছন্দের খাওয়া দাওয়া, কোনও দিন দিবানিদ্রা, কখনও বা গপ্পের বই— সন্ধ্যাবেলায় কোনোদিন গ্রুপ থিয়েটার, আবৃত্তির আসর, অথবা চিত্রপ্রদর্শনী। ব্যস্, এইভাবেই কেটে যায় অকৃতদার দিব্য রায়ের একলা জীবন। গতানুগতিকতায় আবদ্ধ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা রবিঠাকুরের ভাষায়—- “যেন ঘোলা জলের ডোবা,না সেখানে হাঙর কুমিরের নিমন্ত্রণ,না রাজহাঁসের।”
পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো,সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী দিব্যদ্যুতি রায়, আজও সুদর্শন।বয়স বিশেষ একটা ছাপ ফেলতে পারে নি, কেবল একমাথা চুলের সামনেটায়,একগুচ্ছ কাশফুল অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখে যায়।
দিব্যর সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার বিভামাসিমার উপরে। না, রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই তাঁর সঙ্গে, কিছুটা আকস্মিক ভাবেই বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের জেরে দুটি মানুষ আজ পরষ্পরের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিব্যর পরিচিত একটি বৃদ্ধাবাসে, দায় এড়িয়ে ফেলে রেখে যাওয়া, অসহায়,নিঃসন্তান, ভাগ্যতাড়িতা অভিজাত মহিলাটিকে,দিব্যই একদিন উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। দয়া নয়, মানবিকতা! আশ্রিতা হিসেবে নয়, সসম্মানে মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এই সংসারে।
ব্যাপারটা ঘটেছিল খুব আকস্মিকভাবে।সেদিন দিব্যর ওখানে যাবার কথা ছিল না তবু ঘটনাচক্রে আচমকাই গিয়ে পড়েছিলেন ওই হোমটিতে।
সেইদিনই আবার হোমের কর্তৃপক্ষ,বিভাদেবীর হাতে ঘরছাড়ার নোটিস ধরিয়ে দিয়েছিলো। গত দুমাস ধরে নাকি প্রতিশ্রুতিমাফিক টাকাপয়সা জমা পড়ছিলো না। তথাকথিত আত্মীয়রা, যারা নাকি, কী সব কাগজপত্তরে, সইসাবুদ করিয়ে তাঁর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করার এবং নিয়মিত তাঁর মাসের টাকা পয়সা,তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়ে যাবার কড়ারে, ব্যাঙ্কের সমস্ত কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে , এবং সুযোগ বুঝে তাঁকে ঘরছাড়া করে এই বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিল, সম্প্রতি তারা সবাই নাকি “আনরিচেবল!”
নিজের সন্তান ছিল না বলে, বিভাদেবী যাদের সন্তানতুল্য জ্ঞান করতেন, বুকে করে মানুষ করলেন, স্বামী মারা যাবার পর, তাদের এই রূপান্তর তাঁর দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।
লোক পাঠিয়ে খবরাখবর নিতে গিয়ে জানা গেছে, সাবেকী বসতভিটা ভেঙে, ফ্ল্যাট উঠছে। প্রোমোটারের কাছ থেকে পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে শরিকরা সবাই হাওয়া হয়ে গেছে।অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিলেন বিভাদেবী। দিব্য রায় সেদিন বুঝি বা ঈশ্বর প্রেরিত দূত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন,তাঁর সামনে। ডুবে যাবার আগে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতোই দিব্যর হাত দুখানি ধরে বিভাদেবী,অশ্রুসজল চোখে, তাঁকেই কোনও অনাথ আশ্রমে
যা হয় একটা বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। নইলে যে রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিলো না।
অন্য কেউ হলে হয়তো বা দায় এড়িয়ে চলে যেতো, কিন্তু দিব্য পারেন নি। কী দেখেছিলেন সেই বিপন্ন মুখে কে জানে! হয়তো বা কতোকাল আগে লোকান্তরিতা মায়ের ছায়া!
সেই মুহূর্তে কী করবেন ঠিক করতে না পেরে, হোমের বাকি বকেয়া মিটিয়ে আরও ক’টা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। বড়ো কোনও সিদ্ধান্ত নেবার আগে ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা, বিচার বিবেচনা করার প্রয়োজন। বিপাকে পড়েছেন বলেই একদা সম্পন্ন ঘরের মাতৃসমা মহিলাটিকে কী করে অনাথ আশ্রমে, প্রায় পরিচারিকা হতে, রেখে দিয়ে আসা যেতে পারতো!
শেষটায় অনেক ভেবে দিব্য তাঁকে এই বাড়িতেই নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না মহিলাটিকে অবশ্য সহজে রাজি করানো যায় নি। অনেক কষ্টে অবশেষে দিব্য তাঁকে বোঝাতে পেরেছিলেন, যে প্রয়োজনটা কেবল তাঁর একার নয়, পারষ্পরিক। বস্তুত কয়েকমাস আগে প্রবল ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত দিব্যকে, মধ্যরাতে একগ্লাস জল এগিয়ে দেবার মতো একজনও কেউ ছিলো না। সেই থেকে, সত্যিই ইদানীং দিব্যর মনে, মাঝে মাঝে একটা বিপন্নতাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো।
দিব্য, বিভাদেবীকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল, লোকে যদি সন্তান দত্তক নিতে পারে ,তাহলে মা’কেই বা কেন নয়!
অনন্যোপায় বিভাদেবী প্রথমটায় সাময়িকভাবে থাকতে রাজি হয়েছিলেন বিকল্প ব্যবস্থা হলেই চলে যাবেন-এই শর্তে, কিন্তু পরবর্তীকালে,এই স্বজনহীন ছন্নছাড়া বিশৃঙ্খল সংসারে, দিশাহারা দিব্যকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারেন নি। তিনি থাকলে, সময়ে ভাতের থালাটুকু তো অন্তত মিলবে দিব্যর। আবারও সেই মায়া!!
বলাই বাহুল্য , নিকট আত্মীয়ের দল, যাঁরা কিনা নিজেদের দরকার ছাড়া, কখনো উঁকি দিতেও আসতেন না, তাঁদের কপালে বড়ো বড়ো চিন্তার ভাঁজ পড়েছিলো বৈকি, কিন্তু তাতে বিভাদেবীর কিচ্ছু এসে যায় নি । অতঃপর,সন্তানসম মানুষটির এই সংসারেই তিনি থেকে গেলেন দিব্যর মাসিমা হয়ে।
এই বাড়িতে আসার পর তিনি হাফডজন চাকর-বাকর, মালি, ড্রাইভারের হাতে থাকা টালমাটাল সংসারটির হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী, মৃদুভাষী মহিলাটির নির্দেশ অমান্য করার সাহস কারোর হয় না, এমন কী খাওয়া দাওয়া, শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দিব্যকেও আজকাল তাঁর নির্দেশ মেনেই চলতে হয়।বিভাদেবীর সব চাইতে ভালো ব্যাপার হলো, দিব্যর ব্যক্তিগত পরিসরে, তিনি কোনও দিন মাথা গলান না, নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে অকারণ কৌতূহল প্রকাশ করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ।
মোটকথা বিভাদেবী আসার পর, দিব্যর ছন্নছাড়া সংসারটা আবার মনের খুশিতে ঘরোয়া কাজকর্মের খুটখাট আর বাসনকোসনের ঠুনঠান, সুরেলা আওয়াজে মেতে ওঠে। স্রেফ ইট-কাঠ কংক্রিট দিয়ে তৈরী দিব্যর বাড়িখানা, এখন বেশ গেরস্তর ঘর-দুয়ার হয়ে শোভা পায়!
ইতিমধ্যে দিব্য আরও একটা কাজ করে ফেলেছেন। তাঁর প্রাক্তন রুগী, শহরের এক নামজাদা দুঁদে উকিল এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে, বিভাদেবীর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটি চালু করে দিয়েছেন। না শুধুই অর্থের জন্য নয়, ন্যায়বিচার পাবার অধিকার তো সকলেরই আছে। আরও একটা কারণে দিব্য এই পদক্ষেপটি নেওয়া জরুরী মনে করেছিলেন, নিজেকে আশ্রিতা ভাবার কুন্ঠাবোধ থেকে বিভাদেবীকে মুক্তি দেওয়া।এখন বেলা প্রায় এগারোটা। সকালের বৃষ্টিটার পর চড়া রোদ উঠেছে। বাগানের কোণের শিউলি গাছটা থেকে ঝরা শিউলির মৃদু সুবাস এখনও হাওয়ায় ভাসছে।
শিউলি ফুল মায়ের খুব প্রিয় ছিলো। মাসিমা সেই কথা জানতে পেরে রোজ সকালে কাঁচের ডিশে করে একরাশ শিউলি ফুল মায়ের ছবির সামনে রেখে আসেন। দিব্যর মনটা ভরে যায়।জীবনটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত।
কে যে কোন অন্তরালে বসে তার অদৃশ্য
অঙ্গুলি হেলনে এই বৃহৎ সংসারের নাটমঞ্চ পরিচালনা করেন ,ভেবেও কূল তল পাওয়া যায় না।
জীবনে একটু থিতু হতে না হতেই, দিব্যকে এই বিশাল পৃথিবীতে একা করে দিয়ে বাবা,মা দুজনেই চলে গেল, তারপরেও যাকে আঁকড়ে ধরে, নতুন করে জীবন সাজাতে চেয়েছিলেন
সে-ও তো—ভাবনাটা মনের চৌকাঠে এসে দাঁড়াতেই, সজোরে এঁটে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।
‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’
চটপট ঘরে এসে বিছানায় বসে ল্যাপটপটা খুলে বসলেন।
ও বাবা! কতো মেইল এসে পড়ে আছে। সবই সেই অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসা। সপ্তাহ পার হয়ে গেল,এখনও লোকের এতো উচ্ছ্বাস!
সম্প্রতি বিনা চিকিৎসায় মরতে বসা হতদরিদ্র একটি শিশুর খুব জটিল হার্ট অপারেশন করেছিলেন তিনি এবং তাঁর সহযোগিরা। সাফল্যের আশা প্রায় ছিলোই না। কতোটা তাঁদের হাতযশ আর কতোটা ঈশ্বরের কৃপা সে বিষয়ে তিনি নিজেই আজও নিশ্চিত নন। সংবাদপত্রে খবরটা ফলাও করে বেরিয়েছিল। দুই একটা কাগজ আবার তাঁর এবং সহযোগীদের ছবিও ছেপে দিয়েছে। ব্যস্ সারা শহর জুড়ে হৈ চৈ। উফফ্ ,বড়োই এমব্যারাসিং। এতো হৈ চৈ করার মতো কিছু আছে বলে দিব্য মনে করেন না। দায়িত্ববোধ সম্পন্ন যে কোনও ডাক্তারকেই তো,কখনও না কখনও প্রাণ বাঁচানোর এই লড়াইটা লড়তেই হয়!
হ্যাঁ এক্ষেত্রে লড়াইটা খুব কঠিন ছিলো সন্দেহ নেই, তবু…।
মেইলগুলো পরপর চেক করছিলেন। দরকারি কিছু মিস্ হয়ে না যায়। নজর বোলাতে বোলাতে আচমকা এক জায়গায় এসে দিব্যর নজরটা আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, লন্ডন থেকে জনৈক মিসেস ব্রাউন,একখানা দীর্ঘ মেইল পাঠিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার! কে এই মিসেস ব্রাউন! এই নামে কাউকে চেনেন বলে তো মনে পড়ে না, তা-ও আবার ঝরঝরে বাংলায়,এবং নির্ভুল বানানে!
কৌতূহলী হয়ে চিঠিতে মন দিলেন দিব্য।“শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
আপনি আমাকে চিনবেন না,আমি হলেম ঝুমকোলতা,আমার মায়ের নাম কলমীলতা,ওরফে কমলিনী।”
— কী –ই-ই। প্রচন্ড জোরে একখানা ধাক্কা লাগলো বুকের মধ্যে।
ঠাস্ করে বন্ধ করে দিলেন ল্যাপটপটা। ছটফটিয়ে উঠে আবার বেরিয়ে এলেন বাইরে। কে এই মিসেস ব্রাউন! তাঁর মুখে এইসব নাম ! কী করে –কোথা থেকে? আশ্চর্য!! যে কথা কেউ জানে না,যা একান্তই তাঁর মনের মণিকোঠায় তুলে রাখা নিজস্ব সম্পদ, সাত রাজার ধন এক মানিক, সেকথা অন্য কেউ জানলো কি করে!
উদগ্র কৌতূহল,তাঁকে বাধ্য করলো আবার ঘরে ফিরে এসে ল্যাপটপখানা খুলে বসতে।” জানি এইটুকু পড়েই আপনি টানটান, হয়ে উঠে বসেছেন। আরে দাঁড়ান,
আগেই অতোটা উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আপনাকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়,বরং বলতে পারেন, অচেনা কারো লেখা চিঠিখানা আপনি যাতে এড়িয়ে না যান, একটু মন দিয়ে আমার সমস্যাটার কথা শোনেন, সেইজন্য শুরুতেই এই ধাক্কাটা দিতে চেয়েছিলাম।আমার যে আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন! সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
এবারে আসল কথায় আসি।
শুনুন বলেছি বটে আমার মা, আসলে তিনি আমার মাতৃসমা পিসিমণি, আর আমি, তাঁর জীবনে ‘কোনওদিন না আসা মেয়ে’, —যাকে বলে মানসকন্যা। আমার আসল নাম, স্পৃহা।
আপনার বর্তমান অবস্থান, অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই আমার জানা নেই, কিন্তু এই দুনিয়ায় আর কাউকেও খুঁজে পেলাম না যিনি এই বিপদ থেকে আমার পিসিমণিকে উদ্ধার করতে পারেন। আমার পিসিমণির খুব বিপদ।
এককালে এই পৃথিবীতে আপনিই তো ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন! তাঁর নিজের লোকেরা যে থেকেও নেই ,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানে!
ভাবছেন হয়তো আমি নিজেই কেন এগিয়ে যাচ্ছি না।আসলে এই মুহূর্তে আমি একেবারে নিরুপায়। একে আমি লন্ডনবাসী,তার উপরে গত সপ্তাহে একটি কন্যা সন্তানের জননী হয়েছি। আশাকরি পরিস্থিতিটা বোঝাতে পারলাম।
আপনি হয়তো জানেন না, আপনাকে হারিয়ে পিসিমণি, সারাটা জীবন, সংসারে থেকেও সংসারের বাইরে নিজের তৈরী করা জগতেই বসবাস করে গেলেন। সেই জগতে ‘ফুল নেই পাখি ডাকে না, ভরা গলায় নাম ধরে ডাকে না কেউ’…তিনি আজও মনে মনে আপনারই পথ চেয়ে বসে আছেন।
মাঝের এতোগুলো বছর তাঁর কাছে, অস্তিত্বহীন। না,তিনি পাগল নন, কেবল গভীর বিতৃষ্ণায়,পরিবারের মানুষগুলিকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তারা যেন থেকেও নেই, পরাবাস্তবের,ছায়া মানব-মানবী। পিসিমণি তাঁর জীবনে একা। তাঁর দৈনন্দিন একলা যাপনে আজও আপনি, হ্যাঁ একমাত্র আপনিই তার সঙ্গী। আমাকেও অবশ্য একটু ঠাঁই দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন আমিও তো দূরের মানুষ হয়ে গেছি।খুব ছোটবেলায়,অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে টলোমলো পায়ে একদিন তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। জানলার শিক ধরে, পথের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির আঁচল ধরে টানতেই চমকে পিছন ফিরে, অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর সেই যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সারাজীবনেও আর ছাড়লেন না। সেই থেকে আমিই তাঁর ঝুমকোলতা, এই পরিবারে একমাত্র আপনজন।
একটু বড়ো হতে না হতেই ,তাঁর জীবনের সব কাহিনী আমার জানা হয়ে গেল, কিছুটা তাঁর টুকরো টুকরো কথায়, বেশির ভাগটাই, এই বাড়ির বহু পুরনো চাকর গোবিন্দদাদার কাছে, আর বাকিটা বাড়ির বাতাবরণে টাঙানো, ঢাকঢাক গুড়গুড়ের দরপরদার আড়াল থেকে উঁকিমারা গল্পের রেশ ধরে।
আপনি তখন মেডিক্যাল কলেজে সিনিয়ার হাউজস্টাফ, আর পিসিমণি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষ। ফেষ্টে আলাপ।প্রথম দর্শনেই মফস্বলের সহজ সরল,নরম স্বভাবের মেয়েটি নজর কাড়লো। তার, পিঠের প’রে দোলানো লম্বা বেণী আর দীঘল চোখের মায়ায় প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন, তারপর ভেসে গেলেন তার আবৃত্তির টানে। আপনি নিজেও যে একজন দক্ষ আবৃত্তিকার! দিনের পরে দিন যায়। পরিচয় দানা বাঁধে, ঘন হয়। আপনারা জুটি বেঁধে আবৃত্তি করেন।জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসা যুগল আবৃত্তির টানে টাপুর টুপুর শব্দ ঝরে, আপনাদের নিত্যকার জীবনেও। অবশেষে ঠিক সেইটাই হলো যেটা হওয়া স্বাভাবিক ছিলো। আপনাদের প্রেম ধীরে ধীরে দানা বাঁধলো।
ওদিক পাশ করেই আপনার চাকরী জুটে গেছে, পিসিমণি ফাইন্যাল দেবে।
স্বপ্নের দিন গোনা শুরু। নিরন্তর আঁকা হতে থাকে ভবিষ্যত সংসারের মনোরম ছবি। আপাদমস্তক রোম্যান্টিক আপনি পিসিমণির নতুন নাম দিলেন কলমীলতা,আর ভবিষ্যতের কন্যার নাম হলো ঝুমকোলতা! সুখের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে দুজনকে।
এইসব খবর তো আর চাপা থাকে না।দাবানলের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো, পৌঁছে গেল ঠাকুরদার কানে। পিসিমণিকে শুধু যে গৃহবন্দী করে ফেলা হলো তাই-ই নয়, অবিলম্বে ঘটক লাগিয়ে ,পালটি ঘরের পাত্র খোঁজা শুরু হলো। অচিরেই বংশমর্যাদায় মানানসই, অথচ,বয়স, শিক্ষা, আচার-ব্যবহার, রুচি, পছন্দে সম্পূর্ণ বেমানান এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে পাকাও হয়ে গেল। এই বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করলে না। কে করবে?পিসিমণির মা ছিলো না যে, তাছাড়া তখন বাকিরা সবাই পিসিমণিকে তড়িঘড়ি পাত্রস্থ করতে পারলেই বাঁচে। কখন কে এসে বাগড়া দেয়! ওদিকে পাত্রপক্ষরা আবার বেজায় ‘উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর!’ সোজা কথা !মরিয়া পিসিমণি গোপনে গৃহত্যাগের পরিকল্পনা করে, আপনাকে নাকি একখানা চিঠিও পাঠিয়েছিল, বিয়ের আগের রাতে পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থাও পাকা , কিন্তু পৃথিবীতে গুপ্তচরের তো আর অভাব নেই! আপনার আর পৃথ্বীরাজ হওয়া হলো না,পরদিন ভোরে গ্রামবাসীরা নাকি অর্ধমৃত অবস্থায় আপনাকে হাইওয়ের পাশ থেকে উদ্ধার করেছিলো।
কয়েক মাস বাদে সুস্থ হবার পর,আপনি স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, ব্যস্ এইটুকু খবরই জানা গিয়েছিলো,বাকিটা আমাদের কারো জানা নেই।পিসিমণির বিয়েটা কিন্তু হয় নি। একমুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেবার চেষ্টায় ছিলো বেচারি, ঈশ্বর সেইটুকু কৃপাও করেন নি তাঁকে।
এবার আসি পরবর্তী অধ্যায়ে।
বড়ো হয়ে পড়াশুনা শিখে আমি অধ্যাপনার জগতে পা রাখলাম। বাধা এসেছিলো বৈকি।তবে নখদন্তহীন শার্দুলরা তখন হীনবল।অধ্যাপনা করি, নিজের কাছেই মাঝে মাঝে লাইব্রেরী যেতে হয়।
একদিন বৃটিশ কাউন্সিলে,ঘটনাচক্রে জনের সঙ্গে আমার আলাপ। বৃটিশ হাইকমিশনের, কী একটা কাজে, সে এদেশে এসেছিলো। ইতিহাসের ছাত্রী জেনে উৎসাহিত জন নিজের থেকে এসে আলাপ করলে। জব চার্নকের শহরের প্রেমে মুগ্ধ বৃটিশ যুবকটি সারা শহর চষে বেড়াতে চায়। কে জানে কেন আমাকেই তার মুরুব্বি ঠাওরালে। কয়েকটা মাস কেটে গেল, কলকাতা শহরের প্রেমে মুগ্ধ ইংরেজ যুবকটির শহরবাসিনীর প্রেমে পড়তেও দেরী হলো না। বাকিটা,বুঝতেই পারছেন, অলমিতি বিস্তরেন।
না, পিসিমণির মতো ভুল আমি করিনি,বাড়িতে সবকিছু জানাজানি হয়ে যাবার আগেই রেজিষ্ট্রি বিয়েটা সেরে ফেলেছিলাম। তা সত্ত্বেও কম ঝামেলা পোয়াতে হয় নি, তবে দূতাবাসের ক্ষমতা তো জানেনই, আটকে দেবার আগেই তারা আমায় উদ্ধার করে নিয়েছিল।
অসহায় পিসিমণিকে ছেড়ে চলে আসতে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিলো। সেইদিন কিন্তু পিসিমণি তাঁর নিজস্ব ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো। কে জানে, হয়তো বা বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া নাটকের পুনরাভিনয় তাঁকে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে, চোখের জল মুছিয়ে, বলেছিলো —“যা পালা”।
উপহার দিয়েছিলো তাঁর একমাত্র সম্বল আপনার দেওয়া সঞ্চয়িতাখানা।চলে আসার আগে খুব গোপনে গোবিন্দদাদাকে একখানা মোবাইল কিনে দিয়ে এসেছিলাম। কেবল মা-ই, ব্যাপারটা জানতো। খবরাখবর সব তার মাধ্যমেই দেয়া নেয়া চলে। এইভাবেই দিন যায়। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত।
দিন পনেরো আগে মা সঙ্গোপনে গোবিন্দদাকে একখানা গোপন ষড়যন্ত্রের খবর দেয়।
আমাদের পেল্লায় বাড়িটা নাকি হাত বদল হতে চলেছে, হোটেল হবে। বিশাল লোভনীয় অফার, কেবল গোল বেধেছে পিসিমণিকে নিয়ে। কে তার দায়িত্ব নেয়!
উকিল বন্ধু পরামর্শ দিয়েছে,পিসিমণিকে পাগলা গারদে পাঠাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। একখানা সার্টিফিকেট জোগাড়ের ওয়াস্তা , তাহলেই কেল্লা ফতে! পিসিমণির দায়ও নিতে হয় না,ওদিকে তার ভাগের সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়া যায়। পুজোর পরেই নাকি সব ফর্মালিটিস সেরে ফেলা হবে!
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো, সমস্ত চেনা জানা সোর্স কাজে লাগিয়েও যখন কোনও সুরাহা করে উঠতে পারছিলাম না ,তখন স্বয়ং ঈশ্বরই যেন পথ দেখালেন। গোবিন্দদা কাগজে আপনার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে!
আমার স্বামী জন আপনার মেইলিং এ্যাড্রেসটা জোগাড় করেছে। আপনার বর্তমান পারিবারিক পরিস্থিতি আমার জানা নেই,তবু আপনার কাছে আমি করজোড়ে মিনতি করছি ,আপনি আমার পিসিমণিকে পাগলা গারদে যাওয়া থেকে আটকান। অবসাদগ্রস্ত একজন মানুষকে পাগলা গারদে ঠেলে দিলে, তার যে কী পরিণতি হতে পারে,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানবে!এখন তো আপনার অনেক প্রতিপত্তি, পিসিমণিকে উদ্ধার করে যে কোনও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন। টাকা পয়সার চিন্তা নেই সব দায় দায়িত্ব আমার। গোবিন্দদা আর তার বৌ- ই
সমস্ত দেখাশোনার ভার নেবে। আপনার এ্যাকআউন্ট নম্বরটা পেলেই আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। তারপরেই না হয় আপনি কাজটা শুরু করবেন!
আমার আর গোবিন্দদাদার ফোন নং এই সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি…জানি এই অপরাহ্ণবেলায়, প্রভাতকালের কোনও কিছুই হয়তো আর অবশিষ্ট নেই, তবু এককালে তো ভালোবেসেছিলেন, সেই ভালোবাসার দোহাই……।
আবার আকাশ কালো করে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে ,সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বনষ্পতিগুলো,প্রবলবেগে বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। দিব্যর মনেও মহাসমুদ্রের কলরোল। অতীতের ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা উড়ে এসে আবার সব কিছু এলোমেলো করে দিলো।প্রবল বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছিলেন দিব্য।
“আসতে পারি?” —বারান্দায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিভাদেবী।
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ”—গলাটা স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টায়,সোজা হয়ে বসলেন দিব্য।
“শরীরটা কি খারাপ? দুপুরে তো কিছুই প্রায় খেলেন না!”
” না না , একদম ঠিক আছি, ঐ একটা …” থেমে গেলেন দিব্য।
“তাহলে বুঝি মন খারাপ! একটু বসতে পারি?”
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ , কী আশ্চর্য…”
“বলছিলাম যে , মাসিমা বলে তো ডাকেন, দুঃখটা কি একটু ভাগ করে নেওয়া যায়!”
আর পারলেন না দিব্য। দরদী ছোঁয়ায়,এতো কালের চেপে রাখা পর্বতপ্রমাণ পাষাণভার, নামিয়ে হালকা হতে, এই প্রথমবার অকপট হলেন তিনি।
“এখন আমি কী করি?”
বাচ্চা ছেলেটি যেন মায়ের কোলে মুখ গুঁজেছে।
” এতো ভাবনার কী আছে ? আপনার কতো লোকবল। চটপট কাজে লেগে পড়ুন।পুলিশের ওপরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, আইনজীবির পরামর্শ নিন, ফর্মালিটিস সেরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পরুন রাজকন্যা উদ্ধারে।”
ম্লান একটুকরো হাসি দেখা দিলো দিব্যর মুখে।
“কিন্তু ওকে এনে রাখবো কোথায়? যেখানে সেখানে তো আর তোলা যায় না। ভাড়া বাড়ি অথবা হোম জোগাড় করতেও তো সময় লাগে, তাছাড়া মানসিক অবস্থাও তো–“
” কেন হোমের কী দরকার! গৃহলক্ষ্মীকে তো ঘরেই প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখন দেবীপক্ষ, ঘট স্থাপনের এটাই তো উপযুক্ত সময়!”
“মাসিমা!! “
“হ্যাঁ বাবা,আর দেরি নয়,কাজে লেগে প’রো। ছেলে,বৌমা নিয়ে ঘর করা আমার অনেক দিনের সাধ!”
আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন বিভাদেবী।
এরপর ঘটনার চাকা দ্রুত গড়ালো। দিন দুয়েক বাদে
একটু বেশী রাতে দিব্যর গাড়ি ছাড়াও পুলিশের গাড়িসহ আরও খানদুই গাড়ি নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করাই রণনীতি। দূরে কোথাও ছাতিম ফুটেছে। বাতাসে ছাতিমের ভারী গন্ধ।
আবৃত্তিকার দিব্য আবার জেগে উঠছিলো বহুদিন পর … …
মনের ভিতরে হাজির হ’লো চেনা ক’টি লাইন—
“লক্ষ বছর পার করেছি আমি
তোমার হাতেও আদিম কালের শোক
অতীত জীবন মুহূর্তে আগামী
এবার কোথাও নতুন কিছু হোক।আজ তাহলে বাঁচারই গান জ্বালি…”
এইখানে এসে চিন্তাটা থমকে গেল দিব্যর।কমলিনীর মনে তো আজও সেই তরুণ দিব্যরই বসবাস, এই দিব্যকে সে যদি চিনতে না পারে ? যদি অন্য কেউ ভেবে..!!
রাত পাড়ি দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে নির্জন রাস্তা দিয়ে।
দিব্যর মনে তোলপাড় প্রশ্ন
— সময়ের উজান কেউ কী কখনও বাইতে পেরেছে!
অন্তরীক্ষে, অনন্তনক্ষত্রবীথি নিরুত্তর। -
গল্প- জনৈক শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যু
জনৈক শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যু
-সুনির্মল বসুঅনেকদিন আগেকার কথা।
তখন আমাদের আশ্চর্য এক শৈশব ছিল। মানুষের শৈশবে কত যে রহস্য থাকে, সামান্য জিনিসের মধ্যে অসামান্যতা খোঁজা, এই বয়সের একটা ধর্ম।
মফস্বলে একেবারে অজপাড়া গায়ে থাকি। পাড়ার পেছনের দিকে একজন বিখ্যাত সাঁতারু থাকেন। বরুণ বর্মন। পাশের নদীতে তিনি ক্রমান্বয়ে দশ বারো বার সাঁতরাতে পারেন। তাঁর ঘর ভর্তি অজস্র মেডেল। অনেক অনেক মানপত্র।
তাঁর ঘরে গেলে, তিনি খুব খুশি হন। স্মিত হাসেন।
আমরা তাঁকে নিয়ে গর্বিত হই। আমাদের পাড়ায় এমন একজন খ্যাতিমান মানুষ থাকেন, এটা আমাদের অহংকার করার মত ব্যাপার।
কিন্তু এই গল্প তাঁকে নিয়ে নয়। তাঁর বাড়ির অন্য এক অতিথিকে নিয়ে। ছুটির দিনে, কিংবা স্কুল থেকে ফিরে আমরা মাঝে মাঝে বরুণদার বাড়ি যাই।
একদিন শুনলাম, ওনার বাড়িতে ওনার এক আত্মীয় এসেছেন, যিনি একজন শিল্পী। শিল্পী সম্পর্কে মনে একটা শ্রদ্ধার ভাব বরাবরই ছিল। কিন্তু নিজের চোখে কখনো শিল্পী দেখা হয়নি।
একদিন শিল্পীকে দেখতে গেলাম।তিনি সর্বক্ষণ ছবি আঁকেন। আমরা তখন স্কুলে পড়ি, আমরা যে এক্সারসাইজ খাতা ব্যবহার করি,
সেই খাতার উপরে কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো নেতাজি, আবার কখনো কাজী নজরুল ইসলামের ছবি থাকে, তা তাঁর আঁকা।ভদ্রলোকের ছোটখাটো চেহারা। পরনে পায়জামা ও বাঙালি শার্ট। হাতটা গোটানো। উদাস চেহারা। আমরা যে তাঁকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি, তাঁকে যে মনের গভীর থেকে এত শ্রদ্ধা করি, সেসব ব্যাপারে তাকিয়ে দেখার মত তাঁর সময় নেই। তিনি সদাসর্বদাই আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন। শিল্পী হিসেবে সবাই তাঁকে সম্মান করে। কিন্তু তাঁর বাড়ির চারদিকে প্রবল দারিদ্র্যের ছবি। ঘর দুয়ার প্রচন্ড আগোছালো।
বড় হয়ে স্কুল জীবনের সেই পুরনো খাতা গুলোর দিকে যখন তাকাই, তখন মনে হয়, ভদ্রলোক খুব যে ভালো ছবি আঁকতেন, তা আজ আর মনে হয়না। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল, কিংবা নেতাজি, আরও অনেক সুন্দর করে আঁকা উচিত ছিল। এখন বুঝি, শুধুমাত্র প্রবল দারিদ্র্যের কারণে ভদ্রলোক যেকোনো উপায়ে ছবি এঁকে, জীবিকা নির্বাহ করবার চেষ্টা করে গিয়েছেন।
ভদ্রলোক বিয়ে করেননি। আমরা তাকে চিরকুমার বলেই জানতাম। পরে জেনেছি, একটি মেয়েকে তিনি ভালোবাসতেন। দারিদ্র্যের কারণে মেয়েটি তাঁকে ছেড়ে চলে যায়।
নিদারুণ অভাব এবং প্রেমে ব্যর্থতা নিয়ে তিনি পেটের দায়ে ছবি আঁকতেন।এক রোববার তাঁর বাড়িতে গেলাম। তিনি তখন উঠোনে বসে জলরঙে প্রকৃতির ক্যানভাসে ছবি এঁকে চলেছেন। বিশাল শিমূল গাছ। অজস্র ফুলে ফুলে ভরে গেছে। রংবেরঙের নানা রকম পাখি এসে গাছের ডালে বসেছে। সবুজ পাতার আড়ালে রঙের উঁকি ঝুঁকি।আমরা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
তখন বসন্ত দিন। নীল আকাশ জুড়ে সাদা হালকা মেঘের ভেলা। আমরা গভীর বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়েছিলাম।
খানিক বাদে, ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
কি আঁকছেন,
তিনি বললেন, ভালোবাসার গাছ।
বললাম, এমন ছবি আঁকছেন কেন,
বললেন, যে ভালোবাসা পেয়েছে, সে ভালোবাসার গাছ কোনোদিন আঁকবে না,
বললাম, তাহলে আপনি যে আঁকছেন,
তিনি উত্তর দিলেন না।অভাব এতটাই তাঁকে স্পর্শ করেছিল, তিনি প্রায়ই অনেককে বলতেন, বাটায় লোক নেওয়া হচ্ছে, আমাকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দিন না, এইভাবে এত অভাব নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে গিয়েছি, একদিন ভদ্রলোকের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। অভাবে দারিদ্র্যে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা গিয়েছেন।ও বাড়ি গেলাম। সামান্য কিছু মানুষজন এসেছিলেন।
দৈনিক পত্রিকায় সংক্ষেপে এই খবর বেরিয়েছিল।শিল্পীর মৃত্যু ঘিরে কোনো শোকসভা সেদিন হয়নি। অভাবে দারিদ্র্যে তিনি চলে গেলেন।
মনে পড়ছিল, একদিন আমাকে বলেছিলেন, এই পোড়া দেশে শিল্প সৃষ্টি করে, আমাদের মতো হতদরিদ্র মানুষদের পেট চলে না।
আমরা সেদিন তাঁকে সম্মান জানাতে পারিনি। বন্ধুরা মিলে তাঁর বাড়ির সামনে, শিমূল চারা এনে বসিয়েছি। নাম দিয়েছি, ভালোবাসার গাছ।
শিল্পী চলে গিয়েছেন অনেকদিন, তবুও আমাদের পাড়াটার বাইরের লোকের কাছে আজ পরিচিতি, শিল্পী পাড়া বলে।
-
গল্প- পসেসিভ
পসেসিভ
-মুনমুন রাহাঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল পৌলমী । ছোট্ট বারান্দা থেকে রাতের সীমাহীন বিশাল আকাশটাকে দেখতে বেশ লাগছে। মনটা এই অসীমতায় ছড়িয়ে দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস টানল সে। অন্য দিন পৌলমীর মনের সব ঝড় এতেই কমে যায়। কিন্ত আজ তা হল না। আসলে আজকের মনের ঝড়টা বেশ বড় আকার ধারন করেছে। এই ঝড় এত তাড়াতাড়িই বোধহয় বিলীন হওয়ার নয়।
‘পসেসিভ’ কথাটাতে আগে বেশ গর্ব অনুভব করত পৌলমী । বিয়ের পর পর যখন আত্মীয়রা বা বন্ধুরা এক মুখ দুষ্ট হাসি নিয়ে বলত, ” তোর বর তোকে নিয়ে ভারী পসেসিভ”, তখন বেশ ভালোই লাগত পৌলমীর। কিন্ত আস্তে আস্তে সলিলের পসেসিভনেসটা সন্দেহ বাতিকে পরিবর্তন হয়েছিল। বিয়ের নতুনত্ব কাটতে না কাটতেই এই বাতিকের জেরে হাঁপিয়ে উঠেছিল পৌলমী। অফিসের কোন পুরুষ কলিগ দরকারে ফোন করলে সন্দেহ , কোন অনুষ্ঠান বা পার্টিতে কোন পুরুষের সাথে হেসে কথা বললে সন্দেহ। পাড়া প্রতিবেশিরদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ছিল না। প্রথম প্রথম পৌলমী সলিল কে বোঝাত। চাকরি সলিলও করে তাই তার বোঝা উচিত অফিসের কলিগ কাজের জন্য ফোন করতেই পারে , সেখানে নারী পুরুষের পার্থক্য হয় না। আর তাছাড়াও সমাজে থাকলে সামাজিকতাও করতে হয়। বন্ধু , আত্মীয় এদের সাথে সম্পর্ক রাখাও এক প্রকারের সামাজিকতা । কিন্ত সলিলকে হাজার বুঝিয়েও কাজ হয় না।
একবার পৌলমী অফিস থেকে সবে ফিরেছে , সলিল তখনও ফেরে নি। পৌলমীর শাশুড়িমা গেছেন গুরুদেবের আশ্রমে । এমন সময় সলিলের জাঠতুত ভাই সমীর এসে হাজির। পৌলমী যথা সম্ভব অথিতি আপ্যায়ন করেছে । এদিকে কিছুক্ষণ পরেই সলিল এল অফিস থেকে , এসে পৌলমী আর সমীরকে বাড়িতে একা দেখেই মুখ ভার করে চলে গেল ঘরে। তারপর রাতে পৌলমী ঘরে আসতেই সমীর আর পৌলমীকে নিয়ে নানা বাজে কথা বলতে লাগল। আরও অদ্ভুত ব্যাপার , সব কিছু শুনেও পৌলমীর শাশুড়ির মত হল, এ নাকি তার ছেলের বৌয়ের প্রতি ভালবাসা । সেদিন রাতে পৌলমী ঠিক করেছিল সকালে উঠেই চলে যাবে বাপের বাড়ি। কিন্ত সকালে উঠে আর যেতে পারে নি সে , কোথায় যেন সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা তাকে পিছু টেনেছিল। তবে সেদিনের পর থেকে সলিলকে সে আর কিছু বোঝাতে যেত না। পৌলমীর মনে হয়েছিল সলিলের এই অসুখের চিকিৎসা তার দ্বারা সম্ভব নয়।
এসব কিছুর পরেও সমাজের শৃঙ্খলতায় আর সম্পর্কের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে পৌলমী সলিলের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে চার চারটে বছর। আজ ভারী খুশি ছিল পৌলমী । ডাক্তার যখন তার প্রেগনেন্সি কনফার্ম করে তখন হঠাৎই মনের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। বুকের ভিতর একরাশ খুশি আর হাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্টটা নিয়ে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছিল সে। অনেকদিন পর অপেক্ষা করেছিল সলিলের জন্য। প্রথম খবরটা তাকেই দিতে চেয়েছিল সে। কিন্ত জীবনের পথে সব সময়ই যে সাজিয়ে রাখা হিসাব গুলো মিলে যায় তা কিন্ত নয়!
পৌলমীর ক্ষেত্রেও তা হল না। সলিল অফিস থেকে ফিরেই , বিনা ভূমিকায় শুরু করল,
” কি , তোমার ফস্টিনস্টি মিটল? কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানতে পারব না ? অফিসে হাফ ডে নিয়ে বাইরে ফুর্তি করে বেরাবে? আজ হাতেনাতে ধরে ফেলেছি !
খুব দুজনে হেসে ফুচকা খাওয়া হচ্ছিল! তাই না ! সাথে সাথেই তোমার অফিসের শর্মিলাদিকে ফোন করে জেনেছি , ব্যাক্তিগত দরকার আছে বলে হাফ ডে করে বেরিয়ে পড়েছিলে অফিস থেকে! তা এমন কতদিন চলছে !!”
পৌলমী এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল। এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। পৌলমী আজ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরতেই দেখা হয় ঋষির সাথে । ঋষি পৌলমীর কলেজ ফ্রেন্ড। ঋষির বৌও প্রেগনেন্ট । ঋষি তার বৌয়ের রিপোর্ট দেখাতে এসেছিল ডাক্তারকে। একাই এসেছিল।
পৌলমীকে ওখানে দেখেই গুড নিউজ আন্দাজ করে সে। আর দুই বন্ধুর গুড নিউজ সেলিব্রেট করতেই এই ফুচকা ট্রিট। ঠিক কলেজের মতো । আর সেটাই কোনভাবে দেখেছে সলিল তাই এই আস্ফালন। সলিলের কথা বলা এখনও থামে নি। পৌলমীর চোয়ালটা ক্রমেই শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যে খবরটা দেওয়ার জন্য এতক্ষন অপেক্ষারত ছিল সে, সেটা আর দিতে ইচ্ছা করছে না। আজ আর কোন সাফাই দিতেও মন সরছে না তার। তার জায়গায় মনের ভিতর অন্য চিন্তা বাসা বাঁধছে। খুব ইচ্ছা করছে সীমাবদ্ধতার গণ্ডিটা এক লাফে পেরিয়ে যেতে। আজ পৌলমীর সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।সকালে উঠে পৌলমীকে না দেখতে পেয়ে সলিল খুব একটা বিচলিত বোধ করে নি। কাল রাতের অশান্তিটা এখনও চলছে তার মনের ভিতর। এত বড় অভিযোগের পর পৌলমীর চুপ করে থাকাটা সলিল নিজের ভাবনার সত্যতার প্রমাণ বলে মনে করে। কিন্ত সন্ধ্যার সময় যখন বাড়ি ফিরে মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে যে পৌলমী তার বাপের বাড়ি যায় নি , তখন একটু বিচলিত হয়ে পড়ে সে। সলিলের মা পৌলমীর মাকে ফোন করেছিলেন মেয়ের কার্য কারিতা সম্পর্কে জানিয়ে দুটো কথা শোনাবেন বলে আর তখনই জানতে পারেন সেখানে পৌলমী নেই। সলিল এরপর অন্তত দশবার ফোন করেছে পৌলমীকে কিন্ত কোন উত্তর নেই। তাতে আরও রেগে গেছে সলিল । আজ বাড়ি ফিরলে পৌলমীকে দেখে নেবে সে , এইভেবেই রাগে ফুঁসছে ।
বেশ কিছুক্ষণ পর পৌলমীর ফোন থেকে একটা ম্যাসেজ ঢোকে সলিলের ফোনে ,
“সলিল , তোমার সাথে চার বছর সংসার করে আমি উপলব্ধি করেছি যে , অতিরিক্ত পসেসিভনেস কখনও গর্বের হয় না বরং অপমানের হয়। তোমার আমার প্রতি বিশ্বাসের কমতি আছে বলেই না আমাকে নিয়ে পসেসিভ হওয়ার এত বাড়াবাড়ি ! যাক সেসব কথা , আমি আজ অন্য কিছু বলতে চাই। আমি অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিচ্ছি খুব তাড়াতাড়িই। আমি অনেক চেষ্টা করে সব সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসেছি তোমার খাঁচা থেকে । হ্যাঁ , খাঁচাই বটে , যেখানে নিজের মতো বাঁচা যায় না , কারও নজর বন্দি হয়ে থাকতে হয়, যেখানে পদে পদে অবিশ্বাস আর সন্দেহের কাঁটা সেটা কি খাঁচার থেকে কম কিছু !
আগেও যে মনে হয় নি তা নয়, তবে , লোকে কি বলবে ! সমাজ আমাকে কি ভাবে দেখবে! এমন নানা প্রশ্ন উঠেছিল মনে আর সেই ভয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্ত না , আজ আমার আর সেসব ভয় করছে না । আমি যে আর একা নই তাই মনের সাহসটাও বেড়ে গেছে। হ্যাঁ , আমি মা হতে চলেছি। জানি, পিতৃ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোমার! তবে এই সন্দেহটা থাক । তুমি সারা জীবন এই সন্দেহের আগুনে তিল তিল করে জ্বলতে থাক । এটাই তোমার শাস্তি। একে যদি তোমার সন্তান বলে মনে কর তবুও তাকে তুমি কাছে পাবে না , আর যদি অন্য কারও সন্তান ভাব তবুও পরাজয় তোমারাই হল । উভয়ক্ষেত্রেই হার তোমার। আমাকে আর অযথা ফোন করো না । আর জানার চেষ্টাও করো না আমি কোথায় আছি বা ভবিষ্যতে কোথায় থাকব । ডিভোর্স পেপার ঠিক সময় পৌঁছে যাবে তোমার কাছে ।”ম্যাসেজটা পরে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে সলিলের। একবার মনে হচ্ছে পৌলমীর গর্ভের সন্তান তারই , আজই তাকে খুঁজে নিয়ে আসবে সে কিছুতেই যেতে দেবে না নিজের সন্তান কে নিজের থেকে দূরে । আবার মনে হচ্ছে সেই লোকটার কথা যার সাথে হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছিল পৌলমী । মনে পড়ছে আগের রাতে হাজার অভিযোগেও পৌলমীর চুপ করে থাকা ! সলিলের ভিতরটা জ্বলতে থাকে । নিজের বোনা সন্দেহের চোরাবালিতে ক্রমেই ডুবতে থাকে সে । নিজের মনের সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণতা কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে।
-
গল্প- দুঃখী মানুষের ফুটো নৌকো
দুঃখী মানুষের ফুটো নৌকো
-সুনির্মল বসুওকে কেউ ডাকে, বসন্ত। আবার কেউ কেউ ডাকে, বিলাস। দুটি ডাকেই ও সাড়া দেয়। ওর আসল নাম, বসন্ত বিলাস সামন্ত।
গরীব বাড়ির ছেলে বসন্ত। টাকা-পয়সার টানাটানির কারণে পড়াশুনো বেশি দূর করতে পারে নি। বাবা নিবারণবাবু চাষবাস করে জীবন চালাতেন। বয়স বেড়েছে। দেশে করোনা এলো, লকডাউন হোল। ওর বউ এলোকেশী কর্তাকে এর পর আর বাইরে বেরোতে দিতেন না।
ইদানীং বসন্ত জমিজারাত দেখাশোনা করছে। সেবারে মাঠে ভালো ফসল হবার সম্ভাবনা ছিল। আমফান ঝড়ে জমিজমা ঘরবাড়ি সব ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
বসন্ত ভাবে, আগেকার মানুষদের এত সবকিছু দেখতে হয়নি। এই প্রজন্মের মানুষকে এক জীবনে কত কিছু দেখতে হলো।
কিন্তু ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। একদিন তাই ট্রেনে উঠে বসল বসন্ত। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে কলেজ স্ট্রিটের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গ্রেস সিনেমা ছাড়িয়ে রাস্তার দুদিকে ব্যান্ড পার্টির দোকান
দেখতে পেলো।একসময় আড় বাঁশী বাজাতো ও।
মিউজিকের প্রতি ওর একটা আলাদা টান আছে বরাবর।সামনে রাজ ব্যান্ড পার্টির দোকান। বিয়ে বাড়ি অন্নপ্রাশন, উৎসবে অনুষ্ঠানে অর্ডার পেলে, এখানকার ব্যান্ড পার্টি সে বাড়িতে বাজাতে যায়।
বসন্ত সকালে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। এখন দুপুর দেড়টা বাজে। ওর খুব খিদে পেয়েছে। অভিরুচিতে ঢুকে ও চারটে কচুরি খেয়ে নিল। তারপর রাজ ব্যান্ড পার্টির দোকানে ঢুকলো।
দোকানের মালিক সানাইয়া চায়না বিহারের ছাপরা জেলার মানুষ। কলকাতায় অনেকদিন আছেন।
ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেনা। বললেন,
কি চাই আপনার?
বসন্ত বলল, আমাকে একটা কাজ দিন।
বাজনায় ইন্টারেস্ট আছে?
অল্প সল্প আছে।
বাড়ি কোথায়?
ধপধপি, ডায়মন্ড হারবার।
দেখুন, আপনি কেমন বাজান, আমার কোন আইডিয়া নেই। আমার টিম যখন বাজাবে, আমাদের ব্যান্ড মাস্টার যখন ড্রাম বাজাবে, আপনি পিঠে করে ওই ড্রাম বয়ে নিয়ে যাবেন।
আমি বাজাতে পারব না?
নিশ্চয়ই পারবেন। তার আগে আপনাকে কাজটা তো শিখতে হবে। রাজি হলে বলুন?
বাড়িতে যখন হাঁড়ি চড়ছে না। এক কথায় বসন্ত সেদিন রাজি হয়ে যায়।বেতনপত্র ঠিক হয়ে যায়। পরদিন সে কাজে জয়েন করে। সেদিন রাতেই কলাবাগান বস্তিতে একটা বিয়ে বাড়িতে ওদের ডাক পড়ে। আগের দিনে
ওকে কারুকার্য করা পোশাক, মাথায় টুপি, এবং পায়ে পরবার জন্য একজোড়া জুতো দেওয়া হয়েছিল।নতুন ড্রেস পরে আয়নায় বসন্ত নিজেকে দেখলো। কী ভালো যে লাগছে নিজেকে দেখতে। ও মনে মনে বলল, শালা, অক্ষয় কুমার, না অজয় দেবগন!
ব্যান্ড মাস্টার ওস্তাদ ওকে বলল, পিছন ঘুরে দাঁড়া,
আমি তোর পিঠে ড্রাম বেঁধে দিই।বসন্তের চাকরির জীবন শুরু হয়ে যায়। এইতো সেদিন হাতিবাগানে একটা বিয়ে বাড়িতে ওরা বাজিয়েছিল, ক্যায়সে বনি,ক্যায়সে বনি, ফুলুরি বিনা চাটনি ক্যায়সে বনি। সবাই প্রশংসা করছিল,
ব্যান্ড মাস্টারের।বসন্ত তো কিছু বাজায়নি। ও শুধু ড্রামটা বয়ে নিয়ে গেছে। ওর মনে অনেক স্বপ্ন, একদিন ও এই কলকাতা শহরে বড় বড় বিয়ে বাড়িতে নিজেই ড্রাম বাজাবে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে কলকাতায় বাসা ভাড়া নিল ও। রাতবিরেতে ডিউটি পড়ে। বাড়ি ফেরা যায় না।
তাছাড়া, যখন সকালে কাজ থাকে না, তখন ও ওস্তাদের কাছ থেকে ড্রাম বাজানো শেখে, প্র্যাকটিস করে। এরই মধ্যে অনেকগুলি গান ও তুলে নিয়েছে।দেবানন্দের গাইড ছবির গান, দিন ঢল যায়ে, রাত না আয়ে, তু তো না আয়ে, তেরি ইয়াদ সতা।
আবার রাজেশ খান্নার গান ওর খুব প্রিয়। নতুন করে গানটা তুলেছে, জিন্দেগি এক সফর হায় সুহানা,ইহা কাল কেয়া হো, কিস্ নে জানা।
ওদের দলে ট্রাম্পেট বাজায় চমন লাল। ঝাড়খণ্ডের গোইলকেরায় বাড়ি। স্যাক্সোফোন বাজায় দুর্জয় সিং। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে বাড়ি। ফুলুট বাজায় রাজমোহন। ছত্রিশ গড়ের মানুষ।
বসন্ত স্বপ্ন দ্যাখে, একদিন ওদের মতো বাজিয়ে শহর মাত করে দেবে ও। বাসায় ফিরে নিজের হাতে
রান্না করে খায় বসন্ত। রাতে তিনটে রুটি করে। মোড়ের দোকান থেকে তরকা কিনে আনে। পেটটা ভরে যায় কোনরকম।একদিন পাশের গলির একটি মেয়ে ওকে দেখে হেসে ফেলে। বলে, সেদিন চিৎপুরে বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলুম, তুমি পিঠে করে ড্রাম নিয়ে যাচ্ছিলে,
আর একটা লোক গান বাজাচ্ছিল।
কোন্ গানটা?
মেরা জুতা হায় জাপানি, পাতলুন হিন্দুস্তানি। তারপর মেয়েটি প্রশ্ন করল, তুমি নিজে কেন বাজাও না গো!
বাজাবো, বাজাবো। সময় আসুক। এরপর বসন্ত প্রশ্ন করলো, তোমার নাম কি?
আমার নাম কুসুম।
সুন্দর নাম তো! আমি এই গলিতে থাকি, এসো একদিন।
সেদিন রাতে মানিক তলায় একটা প্রোগ্রাম করে ফিরছিল বসন্ত। পথে কুসুমের সঙ্গে দেখা। ও প্যারামাউন্ট হল থেকে সিনেমা দেখে ফিরছিল।
খুব সুন্দর সেজেছে কুসুম। ওকে দেখে খুব ভালো লাগলো বসন্তর।
কোথায় গেছিলে?
সিনেমায়।
একা!
হ্যাঁ,
একা সিনেমায় যেতে ভালো লাগে?
কেন তুমি যাবে?
বললে যেতে পারি।
সামনের রোববার চলো।
যাবো। তুমি আমায় ডেকে নিয়ে যেও।
ঠিক আছে। ওই কথা থাকলো।
রোববার ইভিনিং শোতে ওরা সিনেমায় গেল।
পান্না সিনেমার রাস্তায় ফুচকা খেলো।এরপর একদিন বসন্ত ওকে ভালোবাসার কথা জানালো। কুসুম বলল, আমার বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে কথা বলো।
বসন্ত একদিন ও বাড়িতে গিয়ে ওর মায়ের অনুমতি নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে কুসুমকে বিয়ে করল। বসন্ত বিয়ের কথা বাড়িতে জানিয়েছিল। শুনে বাড়ির লোক সবাই রেগে গিয়েছিল। কেউ আসে নি।
মা বলেছিল, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়াটা খুব প্রয়োজন ছিল!বসন্ত কুসুমের সংসার চলছিল কোনমতে। অভাব ছিল, দারিদ্র ছিল। প্রথম প্রথম ভালবাসাও ছিল।
কতদিন হয়ে গেল, বসন্ত অনেকগুলো বাজনা শিখেছে।মাঝে মাঝে সকালে বাজায়, সাজন রে ঝুট মত বোলো, খুদা কি পাশ জানা হায়। কিংবা,
কখনো বাজায়, মিঠুনদার গান, আই এম এ ডিসকো ড্যান্সার।অনেকবার ও ওস্তাদকে বলেছে, আমাকে একটু ড্রাম বাজাতে দাও না, গুরু!
ওস্তাদ বলেছে, সে কিরে! তুই কবে আবার বাজনা শিখলি রে, সবাই শাল্লা এক লাফে আর্টিস্ট হতে চায়!দুর্জয় সিং সেক্সোফোন বাজায়। একদিন বসন্তকে ডেকে বলল, তোকে বাজনা শেখাবো। কাল সকালে তোর বাসায় যাবো। একটু মাল খাবার অ্যারেঞ্জমেন্ট করিস্!
আমি ওসব খাই না।
দুর্জয় সিং হেসে ফেললো, মিউজিক লাইনের লোক, মাল খাস না! হে হে।
পরদিন এসে দুর্জয় কিন্তু দারুণ বাজালো। কুসুম ওর জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করেছিল।দুর্জয় সিংকে দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল কুসুমের।
কত বড় বড় জায়গায় বাজায়। কত নতুন নতুন সুর তোলে। আর আমার বরটা আজ অবধি কিছু করতে পারলো না, শুধু ড্রাম বয়ে বেড়ালো।অন্যদিকে, দুর্জয় সিংয়ের নজর পড়েছিল কুসুমের শরীরটার উপর। সকাল দুপুর নেই, যখন তখন ও বাড়ি ঢুকে পড়তো দুর্জয় সিং।
বসন্ত সব দেখছিল। ও বুঝতে পারছিল, ক্রমশ ও খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পায়ের তলায় জমি থাকছে না। বাড়তি উপার্জন নেই। নিত্যদিনের অভাবের সংসার।
শেষবারের মতো শেষ চেষ্টা হিসেবে ও কুসুমকে বোঝাতে গিয়েছিল,
এসব ঠিক হচ্ছে না কুসুম!
কোনটা?
লোকটাকে পাত্তা দিচ্ছ কেন?
সম্মান দিয়ে কথা বলো। উনি একজন শিল্পী।
আর আমি?
তুমি কিছু না, ফালতু, বুঝলে ফালতু!দিনসাতেক বাদে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বসন্ত দেখলো, কুসুম ঘরে নেই।
শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করেছিল, তাই হোল।একদিন শহর মাতাল করে ড্রাম বাজাবো, স্বপ্ন ছিল বসন্তর। ভালোবাসা দিয়ে একটা সংসার গড়ে তুলবো, কত গভীর করে ভেবেছিল ও। না, ওসব কিছু না। পয়সা না থাকলে, যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারলে, জীবনের পরিণতি হয়তো এমনটাই হয়!
এবার সে কিভাবে মা-বাবার সামনে দাঁড়াবে? কি বলবে, বাড়ির মানুষদের, প্রতিবেশীদের?
পরদিন সে ব্যান্ড পার্টি অফিসে গেল। বলল, আমি আর কাজ করব না।
কেন রে, কি হলো?
শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার পাওনা গন্ডা দিয়ে দিন। আমি বাড়ি যাবো।মাসের মাইনে নিয়ে বাসা বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে বসন্ত শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে বসলো।
জানালার কাছে বসে দূরের আকাশ গাছপালা দেখছিল ও তখন। মনে মনে বলছিল, আমি একটা বাড়ি ছেড়ে, আর একটা বাড়িতে উঠেছিলাম। সারা জীবন আমি একটা ঘর খুঁজছিলাম। সারা জীবন মানুষ বাড়ি বানায়, বাড়ি খোঁজে, সত্যি সত্যিই ঘর পায় কজন!
ততক্ষণে ট্রেন তিনটে স্টেশন পেরিয়ে গিয়েছে।
-
গল্প- কাছের মানুষ
কাছের মানুষ
– মুনমুন রাহা
সূর্য দেব আজ যেন তার সমস্ত তেজ নিয়ে উপস্থিত হয়ে গেছেন সকাল সকাল। মাথার উপরের ছাতাটা কোন কাজই করছে না। শরীরের চামরাটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য অন্তরার কেবলমাত্র শরীরটাই নয় জ্বলছে তার বুকের ভিতরটাও। রোজ রোজ আর অপমান সহ্য হচ্ছে না তার। মাত্র তিন মাসের বিবাহিত জীবনেই হাঁপিয়ে গেছে সে। যদিও সমস্যাটা তার স্বামীর সাথে নয়। তার শাশুড়িমা অলোকা দেবীর সাথে । বিয়ের পর থেকে হাজার চেষ্টা করেও ভদ্রমহিলার মন পায় না অন্তরা । অথচ উঠতে বসতে অন্তরার কাজের , রূপের, গুনের , চাকরির কেবল দোষ ত্রুটি ধরে যান ভদ্রমহিলা । মাঝে মাঝে মনে হয় কৃষ্ণা বৌদির দেখানো পথ অবলম্বন করতে। কৃষ্ণ বৌদি এই পাড়াতেই থাকে। স্বভাবটা ভারি মিষ্টি। মুখে হাসিটা লেগেই আছে। কৃষ্ণা বৌদি প্রায়ই যায় অন্তরাদের বাড়ি । একদিন বাড়িতে কেউ নেই দেখে অন্তরাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে , নতুন বৌ মুখ কালো করে ঘুরছে কেন? অন্তরাও সেদিন কৃষ্ণা বৌদিকে তার সমস্যার কথা বলে । সব শুনে সেদিনই কৃষ্ণা বৌদি বলে , অন্তরার স্বামী বিতানকে সব কিছু জানিয়ে মানে মানে অন্তরার আলাদা সংসার পাতাই ভাল।
কথাটা শুনে আলাদা সংসার পাতার যে লোভ হয় নি অন্তরার তা নয়। কিন্ত ঐ যে বাবা মায়ের শিক্ষাটা মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। মনে হল যাক বয়স্ক বিধবা মানুষটার জীবনে ছেলে বিতান ছাড়া আছে কে! দেখা যাক আর একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে । কিন্ত এখন মনে হচ্ছে অনেক হয়েছে , রোজ রোজ অশান্তির থেকে আলাদা থাকাই ভাল। অভিমান , আর কষ্ট গুলো বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকেছে। এমন সময় চেনা ডাকটা কানে এল,
” অন্তরা , এই অন্তরা । ”
হ্যাঁ ঠিক, কৃষ্ণা বৌদির গলা। গেট থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকছে। অন্তরা কাছে যেতে জিজ্ঞেস করল ,
” কি গো আজ এত সকাল সকাল চাকরিতে যাচ্ছ যে ! ”
ম্লান হেসে অন্তরা বলে ,
” এই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি , অফিসে গিয়ে তো একটু শান্তিতে থাকতে পারব। বাড়িতে তো তার উপায় নেই। ”
কৃষ্ণা বৌদি জোর করে হাত ধরে নিয়ে যায় ঘরে । তারপর বলে ,
” চুপ করে বোস । মুখ দেখেই বুঝেছি কিচ্ছু খাসনি। আমি খিচুড়ি করেছি চুপচাপ খেয়ে তারপর যাবি অফিসে। ”
অন্তরার আপত্তিতে কোন কর্ণপাত না করে কৃষ্ণা বৌদি একবাটি খিচুড়ি এনে দেয়। তারপর নরম সুরে বলে ,
” আজ আবার কি হল রে ?”অন্তরার চোখ বেয়ে জল হয়ে নেমে এল গলার কাছে জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অন্তরা বলে ,
” কৃষ্ণা বৌদি তুমি তো জান , বিয়ের পর থেকে আমি কম কিছু সহ্য করি নি। ভালবেসে বিয়ে করেছি বলে আমাকে উঠতে বসতে কম কথা শোনায় না আমার শাশুড়ি । আমাদের হানিমুনে যাওয়া নিয়েও কত কাণ্ড করল , আমারা যেই অফিসের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করলাম সেই তার শরীর খারাপ। আমি তো প্রথমে সত্যিই ভেবেছিলাম। কিন্ত ঐ যে সত্যি কথা চাপা থাকে না । তাই তোমার কাছেই গল্প করল, যে এটা তার আমাদের একসাথে না ঘুরতে যেতে দেওয়ার প্ল্যান। আর ভাগ্যিস তুমি আমাকে বললে সে কথা ! না হলে তো আমার শাশুড়ি মায়ের স্বরূপ জানতেই পারতাম না।
শুধু তাই আমাকে দিয়ে ইচ্ছা করে ঘরের যাবতীয় কাজ করান , যাতে আমার অফিসের দেরি হয়ে যায়। চাকরিটা না থাকে। তুমি তো সবই জানো। তোমাকেই তো বলে এসব ।
আজ কি বলছে জানো, বলে আমার নাকি চরিত্রের ঠিক নেই। আমি অফিসে যাই ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে। আজ আমিও মাথার ঠিক রাখতে পারে নি কৃষ্ণা বৌদি । শুনিয়ে দিয়েছি দুকথা। কতদিন আর মুখ বুজে থাকব বলো তো ! আমার এমনই কপাল বাপের বাড়িতেও বলতে পারি না সব কিছু। এক তো নিজে দেখে বিয়ে করেছি তার উপর বাবা মাকে আর নিজের সমস্যার মধ্যে জড়াতে চাই না। ওদেরও তো বয়স হচ্ছে। ”
কৃষ্ণা বৌদি অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,
” আমি তো আগেই বলেছিলাম আলাদা সংসার পাত। বিতান কে বল হয় তোকে অথবা মাকে রাখুক তার জীবনে। ”
” আসলে বিতান ওর মাকে বড্ড ভালবাসে গো তাই , মানে ওর কথা ভেবেই এতদিন কিছু বলি নি। কিন্ত আজ তোমার কথা মানতেই ইচ্ছা করছে। দেখি অফিস থেকে ফিরে আসি, বিতানকে বলব সব কিছু। সত্যিই এবার মুক্তি চাই। আজ তো রাগ করে শুধু ডাল ভাত রান্না করে চলে এসেছি ।”
” বেশ করেছিস। আমি তো তোকে অনেকদিন বলেছি বেরিয়ে আয় । শোন অন্তরা তুই আমার বড় কাছের মানুষ, তোকে বড় ভালবাসি বলেই বলছি , তোর শাশুড়ি আমার কাছে তোর নামে কম নিন্দা করে নি রে । তোকে তো আমি বলেছি সবই । তোদের নাকি বংশ খারাপ, তোর বাবা মা নমস্কারীতে কম দামী জিনিসপত্র দিয়েছে। বিতানের সাথে তোকে মানায় না এমন কতো কিছু। আমার তোর নামে এসব শুনতে ভাল লাগে না। তাই বলছি , তিনটে মাস তো সহ্য করলি এবার নিজের মতো করে সংসার কর। ”
অন্তরা নিজের কাজে বেরিয়ে যায়। কিন্ত অফিসে গিয়ে থেকে শরীরটা খুব একটা ভাল লাগছে না। সে ঠিক করল বাড়ি চলে যাবে। মনের ভিতরটাও কেমন যেন একটা খচখচ করছে। রাগের মাথায় শুধু ডাল ভাত রান্না করাটা কেমন যেন একটা অপরাধ বোধে ভোগাচ্ছে । হাজার হোক একটা বয়স্ক মানুষ দুপুর বেলা খাবে তো ! তার বাবা মায়ের শিক্ষা , নিজের কর্তব্য নিজের কাছে। সাতপাঁচ ভেবে অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলো অন্তরা।
বাড়িতে গিয়ে বেল দেওয়ার দরকার বা ইচ্ছা কোনটাই হল না। তার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি থাকে । অন্তরা ভিতরে ঢুকেই বুঝল কেউ এসেছে যার সাথে তার শাশুড়ি অন্তরার নামেই কিছু বলছেন বেশ জোর গলাতে।
” ভাগ্যিস তুমি আছো । তাই তো জানতে পারলাম আমার বৌয়ের কৃতি কলাপ। ছিঃ ছিঃ ভালোবাসার বিয়ে, এখনও বছর গড়াল না এর মধ্যেই অন্য পুরুষের সাথে লটঘট! আমার ছেলেটার কথা একবার ভাবল না !”
অলোকা দেবীর বোধহয় চোখের জল মুছতে সময় নিলেন। এরমধ্যেই শোনা গেল আর একটা খুব পরিচিত গলার আওয়াজ।
” আর কি বলব মাসিমা , সে দৃশ্যের কথা আমি মুখে আনতে পারব না আপনার সামনে । বলেছিলাম না বংশটাই খারাপ। আমার তো অনেক পরিচিত লোকজন আছে ওখানে তাই যখন শুনলাম বিতান বিয়ে করেছে ঐ উত্তর পাড়ার দিকে তখনই খোঁজ করে খবর এনেছি। ঐ মেয়ের চরিত্র বিয়ের আগেও ভাল ছিল না। আর ওর বাবা এক নম্বরের কৃপন। বললাম না আপনাকে নমস্কারীর শাড়ি গুলো কেমন যেন পুরোন পুরোন। পরে তো আপনার বৌমাই আমাকে বলেছে , শাড়ি গুলো সব চৈত্র সেল থেকে কেনা। দেখুন মাসিমা , আপনাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপনার সম্পর্কে কুকথা শুনতে মন চায় না। কিন্ত বাবাঃ , আপনার বৌমা তো আপনার সম্পর্কে নিন্দে করা ছাড়া কিছু জানে না। আমি তো বলি এমন বৌ থাকার থেকে না থাকা ভাল। দূর করে দিন তো ছেলের জীবন থেকে ।
যাকগে , একটু খিচুড়ি এনেছিলাম আপনার জন্য। আপনার বৌমা কি রান্না করেছে তার ঠিক নেই। তাই ভাবলাম একটু নিয়ে যাই। আপনি যে আমার বড় কাছের মানুষ। খাবেন কিন্ত। ”
” আর মা রান্না! আজ তাকে দুটো সত্যি কথা বলেছি না! ঐ যে তার চরিত্র তুলে কথা বলেছি বলে তেজ করে সে ডাল ভাত রান্না করে গেছে। সবই আমার পোড়া কপাল। ভাগ্যিস তুমি ছিলে মা। ”
অন্তরা এতক্ষন সবটাই খুব অবাক হয়ে শুনছিল । তার এত কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি এসব কি বলছে । নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না তার । আর সহ্য হল না ,এবার ঘরে ঢুকে পড়ে সে। বলে ,
” আরে বাবা , এইটুকুই! আরও কিছু কথা কৃষ্ণা বৌদিকে জিজ্ঞেস করো মা ! আজকে যে আমি কিছু রান্না করি নি তোমার খাওয়ার অসুবিধা হবে , কৃষ্ণা বৌদি কেমন করে জানল ? বল , বল কৃষ্ণা বৌদি কি করে জানলে ? বলবে না ? তাহলে আমিই বলি , কারণ সেটা আমার কাছ থেকে জেনেছে। আমাকে সকালে ডেকে ভালবেসে খিচুড়ি খাইয়ে জেনেছে সংসারে কি হল , তারপর তোমার নামে কত নিন্দে করল আমার সাথে মিলে । আবার এও পরামর্শ দিল যে আমার উচিত এবার বিতান কে নিয়ে আলাদা থাকা । হ্যাঁ , আমিও তোমার মতোই ভরসার মানুষ মনে করে সংসারের সব কথা বলি যে কৃষ্ণা বৌদিকে।
আমার চরিত্র তুলে কথা বলেছিলে বলে খুব রাগ হয়েছিল সকালে তোমার উপর। সেটা শুনে কৃষ্ণা বৌদিতো আকাশ থেকে পড়ল। কিন্ত এখন বুঝতে পারছি আমার নামে চরিত্রহীনের আপবাদটা কে দিয়েছে। আচ্ছা কৃষ্ণা বৌদি , তুমি কবে আমাকে কার সাথে দেখেছ গো । আমাকে একটু বলতো ! আর কি করতে দেখেছো সেটাও বল ।”
কৃষ্ণা বৌদির তখন পালাই পালাই অবস্থা একবার ঢোক গিলে বলে ,
” কে জানে হয়তো ভুল দেখেছিলাম। আমার চোখের কি ঠিক আছে !”
অন্তরার শাশুড়ি অলোকা দেবী বেশ হতবাক। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না । অন্তরা আবার বলে ,
” আমার তো এটাও সন্দেহ হচ্ছে তোমার চোখের দৃষ্টির সাথে কানটাও মাঝেমাঝে উল্টোপাল্টা শোনে । আচ্ছা মা , তুমি কি আমাদের হানিমুনে যাওয়ার নাম শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। মানে নাটক করেছিলে!”
অলোকা দেবী রেগে আগুন। বলেন,
” কি যা তা বলছো ? আমাকে কি ভাব তুমি ? আমি কি মানুষ নয়? তোমরা দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে সদ্য বিয়ে করেছ বেড়াতে যাবে বলে ঠিক করেছ আর আমি তাতে ব্যাগরা দেব ইচ্ছা করে! তোমার কথা যদি ছেড়েও দি , আমি আমার ছেলের ভাল লাগা খারাপ লাগার মূল্য দেব না? কত আশা করে ছেলেটা টিকিট কেটেছিল বেড়াতে যাবার আর আমি মিথ্যে অসুখের অভিনয় করে তাকে যেতে দেব না ? ”
অন্তরা হেসে বলে ,
” আমি বলছি না , এই যে আমার আর তোমার শুভাকাঙ্খী , কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি বলেছে । আরও বলেছে এসব কথা তুমিই বলেছ তাকে ! ”
” কৃষ্ণা , এসব বলেছি আমি ? কেন এরকম মিথ্যা বলেছো আমার নামে ? আমার তো এখন বৌমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বৌমার নামেও আমার কাছে মিথ্যে বলেছো। ”
কৃষ্ণা বৌদি নিজের পিঠ বাঁচাতে বলে ,
” দেখুন মাসিমা , আপনার আর অন্তরার ব্যাপারে আমাকে টানবেন না । আপনাদের সংসার আপনারাই বুঝুন। ”
বলে আর দাঁড়ায় না কৃষ্ণা হনহনিয়ে বেরিয়ে পরে সে। অলোকা দেবী এখনও বিস্মিত। বলে ,
” মানুষ এমনও হয় ! আমি তো অগাত বিশ্বাস করতাম কৃষ্ণাকে। তার মুখের হাসিতে আর ভাল ব্যবহারে তাকে আপন মনে করে সব কথাই বলতাম। আর তার এই ফল ! ”
অন্তরা বলে ,
” আমিও তো তাই করেছিলাম। কিন্ত আজ কৃষ্ণা বৌদির ভাল মুখোশের আড়ালে নোংরা চেহারাটা দেখলাম। অবশ্য ভুল আমরাও করেছি। নিজের ঘরের কথা বাইরের লোককে আপন মনে করে বলাটাও হয়তো ভুল হয়েছিল আমাদের। এবার থেকে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটাতে চেষ্টা করব । তাহলে আর কোন কৃষ্ণা বৌদি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না । ”“আচ্ছা কৃষ্ণার এমন করে লাভ কি হল ” বলেন অলোকা দেবী,
” আসলে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের লাভের থেকে অন্যদের ক্ষতিতে বেশি সন্তুষ্ট হয়। এদের লোকের ঘরে আগুন লাগিয়েই আনন্দ। ”
” যাক , আমাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি মিটেছে এটাই বড় কথা । তবে একটা শিক্ষা হল , সংসারে থাকতে গেলে হয়তো আবার মনোমালিন্য হবে । কিন্ত তা মেটানোর দায়িত্ব আমরা দুজনেই নেব , তাই না বৌমা ! ” বলেন অলোকা দেবী ।
অন্তরা হেসে বলে ,
” একদম ঠিক। আমাদের সমস্যা আজ থেকে শুধু আমাদেরই । দরকার নেই আর কোন কাছের মানুষের। ”
-
গল্প – খেলাঘর
খেলাঘর
-অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)এক কামরা ঘর তার ওপরে আর একটা ঘর।সরু বারান্দার একপাশে সিঁড়ি। দুকামরার দোতালা এই বাড়িতেই ছিল ছোটো একটা সংসার।সাজানো গোছানো একটা পরিকল্পিত পরিবার। সারা গ্রাম এত দিন তাই জানতো। সুখী দম্পতির সুখের সংসার। ভালোবাসার সংসার। আজ সেই দুকামরার শুন্য বাড়িটা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। ভয়ংকর সেইসব ঘটনাগুলির সাক্ষী হয়ে।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পথ চলতি মানুষের একটাই প্রশ্ন মুখে মুখে। কি আবার হলো যার জন্য ছেলে মেয়েকে আর মাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো পুতুলকে?
সুখের সংসারটা ভেঙে দিয়ে এক বুক হতাশা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল পুতুল।দীর্ঘ ২০ বছরের সংসার ভেঙে পাড়ি দিতে হলো অন্য কুলে অন্য কোনো সুখের সন্ধানে। পুতুলের খেলাঘর ভেঙে গেল তাসের ঘরের মতো।মানুষের গঞ্জনা অত্যাচার গুজবের নীরব সাক্ষী এখন এই বাড়িটা।
বাড়িটা যদি কথা বলতে পারতো, যদি প্রতিবাদ করতে পারতো তাহলে হয়তো সব অত্যাচারের প্রতিবাদ করতো। অনেক আগেই মিটে যেত সব সমস্যা।
আজ শুন্য বাড়িটা একা। বড়ো একা। ক্ষতবিক্ষত মনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
এই বাড়িতেই জন্মেছিল ফুটফুটে একটা মেয়ে। চোখ দুটো টানা টানা। ঘনকালো লম্বা চুল। ঠিক যেন পুতুল। তাই নামটা ও রাখা হলো পুতুল।
পাড়ার সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াতো। তখনই এপাড়ার নয়না কাকিমা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার ছোট ছেলের বউ করে আনব।এ মেয়েকে কোথাও যেতে দেব না।
সবই ছিল কথার কথা অবশ্য।
একদিন সেই কথায় যে সত্যি হবে,কে তা জানত? ছোট ছেলের প্রেমে পড়ল পুতুল। বিয়েটা ও লুকিয়ে হয়ে গেল।
বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। সেই ছোট্ট মেয়েটা এত কম বয়সেই বউ হয়ে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো , এই বয়সে লুকিয়ে বিয়ে করায় নয়না কাকিমার চোখের বিষ হয়ে গেল।
অত্যাচার এমন চরমে উঠলো যে শ্বশুর বাড়িতে থাকা দুস্কর।
পুতুল ফিরে এসেছে নিজের বাড়িতে। জন্মদার্তী মায়ের কাছে। স্বামী সুকান্ত ও নিজের মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে এলো শ্বশুরবাড়িতে।
কথা ছিল নতুন একটা বাড়ি ঠিক করে বউকে নিয়ে চলে যাবে।
আপত্তি করল মেয়ের মা। পুতুলই তাদের একমাত্র সন্তান। একরত্তি মেয়ে বিয়ে করেছে বলে কি হাত পুড়িয়ে খাবে নতুন বাড়িতে? আদরের মেয়ে সেই থেকে মায়ের কাছেই থেকে গেল।
শ্বশুর বাড়ি যাওয়া আর হলো না। এই বাড়িতে ই জন্মেছিল।এই বাড়িতে শুরু হলো নতুন সংসার জীবন। আবার এই বাড়িতেই জন্ম নিল পুতুলের মেয়ে। আরও চার বছর পর একটি ছেলে। কুড়ি বছরের সংসার জীবন পরিপূর্ণ হলো দুই সন্তান নিয়ে।
একসময় মায়ের হাতে হাতে কাজ শিখে পাকা সংসারী হয়ে উঠলো।
এখনই তো সুখের সংসার। সুকান্ত মাসে একবারই বাড়ি ফেরে কলকাতা থেকে। কয়েক দিন থেকে আবার ফিরে যায় কলকাতায়। খাওয়াপরার অভাব ছিল না। পুতুলের ও কোনো অভিযোগ ছিল না প্রেমিক স্বামীর বিরুদ্ধে। দিব্যি ছিল মিলেমিশে। অন্তত আমরা মানে পাড়াপ্রতিবেশি তাই জানত। সুখের সংসার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত যে অশান্তি কেউ তা জানতো না। পুতুল এখন আছে ভাড়া বাড়িতে মা আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে।
বাড়িটা তালাবন্ধ।
কিন্তু কেন এমন হলো? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভাব করেছিলাম পুতুলের সাথে। তারই বয়ানে লেখা আমার কাহিনি।
সুকান্ত যখনই বাড়ি আসে। ব্যাগ ভর্তি বাজার সঙ্গে বিদেশি মদ। পুতুল সব জানতো।
অল্প আদরু মদ সবাই খায় এখন। এটা তেমন দোষের নয়।সুকান্তও খেতো। পুতুল মেনেও নিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু যত আয় বাড়ে। তত বন্ধু -বান্ধব, ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। দাদারা এই সুযোগে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করতে ভাইকে তোয়াজ করে চলল। একসময় পুতুলের কোনো কথায় আর কানে ঢুকলো না। মদের গন্ধে বাড়িটা ম ম করতে থাকে। নীচের ঘরে মদের আসর বসালো। যতসব মাতাল বন্ধুবান্ধব এসে জুটলো এই বাড়িতে। ওপরের ঘরে ছেলে মেয়ে মাকে নিয়ে একপ্রকার জড়োসড়ো হয়ে পড়ে থাকতো। অপেক্ষা করতো কখন আসর ভাঙবে? তাতেও শান্তি নেই। ডাক আসে পুতুলের। সবার জন্য মদ পরিবেশন করতে।
শান্তশিষ্ট পুতুল রাগে অপমানে গর্জে উঠল।
মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে প্রত্যেকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল।
তারপর থেকে সুকান্তের অত্যাচার চরমে ওঠে। “এত বড় সাহস আমারই খেয়ে আমারই বন্ধুদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া”।
শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করল। ঠিক করল,এবাড়ি না ছাড়লে পুতুলকে জব্দ করা যাবে না।
পুতুল সরল মনে তাই মেনে নিল। নতুন বাড়িতে নতুনভাবে সাজাবে সংসার। এত খুশির খবর।
কিন্তু বাড়ির বড় দাদারা ততক্ষণে সব জায়গা জমি থেকে বঞ্চিত করে দিল সুকান্তকে। জায়গা কিনে ঘর বাধা আর হলো না।
পুতুল বাড়ি ছাড়ল।
মাকে সঙ্গে নিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল অন্য কোথাও।
অনেক খোঁজ করে ও পুতুলদের আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
কয়েক দিন পর পাড়ায় এল পুলিশ। সুকান্তকে ধরে নিয়ে যেতে।
শুনলাম,পুতুল কেস করেছে স্বামীর বিরুদ্ধে।
এখন সুকান্ত আদালতের কাঠগড়ায়।
কতখানি যন্ত্রণা অত্যাচার করলে তবেই স্বামীর বিরুদ্ধে কেস করতে পারে কোনো প্রেমিকা বউ।
প্রতিশোধের আগুনে পাষাণী হয়ে উঠলো পুতুল।
যে মেয়ের মুখে সাড়া ছিল না এত গুলো বছর। স্বামীর সংসারে শান্তিতে ছিল বলে মনে হয়েছিল পথ চলতি মানুষের। সেই পুতুলই চরম নির্লজ্জতার কথা স্বীকার করল।
স্বামীর হাতে ধর্ষিতা দুই নারীর যন্ত্রনার কথা বলতে বাধ্য হলো। এক স্ত্রী পুতুল আর এক নারী নবম শ্রেণিতে পড়া নিজের মেয়ের ওপর বাবার পাশবিক অত্যাচার।
নিজের মেয়ের সামনে নিলজ্জের মতো পুতুলকে জড়িয়ে ধরে অসভ্যতা করা।
পাড়ার একদল লোকের সামনে থেকে কোলে তুলে এনে ছেলে মেয়ের চোখের সামনে শুরু করত যৌন আদরের নামে নৃশংসতা। শেষ পর্যন্ত নিজের মেয়েকেও —
তীব্র ঘৃণা আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ল পুতুল।
মেয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করতে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে ছিল দেহ। চাই না এ খাবার। চাই না খেলনা৷ চাই না চকলেট।কাঠগড়ায় আসামি সুকান্ত। বধূ নির্যাতন, মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার আইনের চোখে অপরাধী এক স্বামী।।
পরকীয়া নামক উপসংহারের তাজা মন্তব্য গুলি মুখে মুখে ঘুরছে এখন সারা পাড়া।
ছি ছি ছি স্বামী যতই খারাপ হোক তাবলে বড় ছেলে মেয়েকে নিয়ে অন্যের হাত ধরে ঘর ভেঙে নতুন ঘর গড়া। একেমন কলংকিত মেয়ে।
এ মেয়ে নির্ঘাত মরবে। কোনো দিনই সুখ পাবে না।
কাঠগড়ার মুখোমুখি সুকান্ত আর পুতুল। কোনো কথা নেই। পুতুল হঠাৎ সোজা গিয়ে সুকান্তের গালে স্বজোরে চড় মারল। ঘর ভর্তি জনতা হাঁ করে দেখল। প্রতিবাদহীন সবাই। পুতুলকে ঠান্ডা করে বসিয়ে দেওয়া হলো আসনে।
শুরু হলো বিচার।শেষ বিচারের আশায়। অর্ডার ওর্ডার সবাই অপেক্ষায়। -
গল্প- যখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র ছিলাম
যখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র ছিলাম
-সুনির্মল বসুআজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগেকার কথা বলছি, অথচ আজ মনে হয়, এইতো সেদিন, আমি আজও যেন বন্ধুদের ভিড়ে পড়াশোনা নিয়ে হইহই করে মেতে আছি। মাননীয় অধ্যাপকদের বক্তব্য শুনছি, কলেজের সোশালের আয়োজন নিয়ে মেতে আছি, ক্যান্টিনে চল্লিশ পয়সার ঘুগনি আর চা খাচ্ছি।
কী সব স্বপ্নের দিন। মাঝে মাঝে দিনগুলোর গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে।আটষট্টি সালে নঙ্গী স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করবার পর, বঙ্গবাসী কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। মাইনে ন টাকা। মেজ মামা বিমলেন্দু ঘোষ এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। উনি আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেন। অধ্যাপক জানকী বল্লভ চৌধুরী আমাকে ভর্তি করে নেন। পরে ক্লাসে উনি আমাদের শাক্তপদাবলী পড়াতেন।
সত্তর খানা সিঁড়ি ভেঙে পাঁচ তলায় আমাদের বাংলা অনার্সের ক্লাস হত। আমার গর্ব হত এই ভেবে, এই ঘরে বসে ক্লাস করে গিয়েছেন প্রথিতযশা গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরী।
বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত কবি ও সমালোচক অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। স্যার আমাদের বৈষ্ণব পদাবলী পড়াতেন। প্রথম দিন ক্লাসে এসে বলেছিলেন, এবার তোদের উপর অষ্টবজ্র সম্মীলন হবে। কলকাতা কাঁপানো আট জন দিকপাল বাংলার অধ্যাপক আমাদের অনার্সের ক্লাস নিতেন। ততদিনে জগদীশবাবুর কবি মানসী প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজে কবি ও কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
আকাশে মেঘ করলে,স্যারের পড়ানো সেদিন অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেত। জানালা দিয়ে আমরা সেদিন উদাস কলকাতা শহরের আকাশ দেখতাম।
অধ্যাপক গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় আমাদের অন্নদামঙ্গল পড়াতেন। অসম্ভব সুদর্শন তিনি। পড়াতেন ছবির মতো। আজও যেন তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই।
অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী আমাদের মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতেন। অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠস্বর তাঁর। পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন। তাঁর জোরালো বক্তব্য একদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিশেষ মর্যাদা পেত।
আমাদের কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। তিনি পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের শিক্ষা মন্ত্রী হন। আমরা অবশ্য ওনার কাছে পড়ার সুযোগ পাই নি। অনেক পরে আমরা ছাত্র হিসেবে কলেজে এসেছিলাম।
রাজসিংহ উপন্যাস পড়াতেন অধ্যাপক
পৃথ্বীশ নিয়োগী। তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ কোনদিন ভুলতে পারবোনা। উপন্যাসের নায়ক বিচার করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসের নায়ক রাজসিংহ না ঔরঙ্গজেব, বিশ্লেষণ করে দেখা।প্রবন্ধ পড়াতে আসতেন অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র নাথ সাহা। স্যার খুব খেটে পড়াতেন। অনেকে তাঁর কথাগুলো ভারী বলে ,মনোযোগ দিয়ে শুনতো না।
পরে বুঝেছি, তাঁর কথা গুলিতে জীবনের গভীর অনুভব ব্যক্ত হোত। তাঁর কথা না শোনাটা মূর্খামি।ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন ডক্টর অরুণ বসু। চেহারা দেখলে রাগী রাগী মনে হলেও, নরম গলায় সহজ করে পড়িয়ে যেতেন তিনি। স্যার নামকরা গীতিকার। ভাস্কর বসু নামে অজস্র ভালো গান তিনি লিখেছেন।
নামী শিল্পীরা প্রায় অনেকেই তাঁর লেখা গান
গেয়েছেন।আমাকে একদিন ডেকে বললেন, তুই কোথায় থাকিস রে,
আমি বললাম, বাটানগর।
স্যার বললেন, ওখানে আমার এক বান্ধবী আছেন,
কুমকুম চৌধুরী। ওর হাজবেন্ড বাটা কোম্পানির ফ্যাক্টরি ম্যানেজার। নাম, ভবতোষ সেন চৌধুরী।
আমার বাবা বাটা কর্মী। বাড়ি এসে বাবাকে বললাম, ভবতোষ সেন চৌধুরীর কথা। বাবা বললেন, উনি বি এস চৌধুরী। ফ্যাক্টরি ম্যানেজার।আমাদের নাটক পড়াতেন অধ্যাপক নলিনী রঞ্জন চক্রবর্তী। আমি তাঁর পরম ভক্ত ছিলাম। তিনি আমাদের নীলদর্পণ নাটক পড়াতেন। বাংলা নিয়ে পড়া আমার সার্থক হয়েছে, আমি স্যারের অসম্ভব ভালো নাটকের ক্লাস দিনের পর দিন শুনেছি। স্যারের উঁচু লম্বা চেহারা, গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি,
অসম্ভব সুন্দর উচ্চারণ ভুলতে পারিনা। একটা সংলাপ শিশির ভাদুড়ী কিভাবে বলতেন, অহীন্দ্র চৌধুরী কিভাবে বলবেন, নির্মলেন্দু লাহিড়ী কিভাবে বলবেন, তিনি সেভাবে দেখাতেন। বাড়িতে এসে কোনদিন পড়বার দরকার হয়নি। ক্লাসেই পড়া তৈরি হয়ে যেত। একদিন এসে বললেন, আমার দাঁতের গোড়ায় ব্যথা। আজ তোরা বল্, আমি শুনি। আমরা বলতেই, তিনি নিজস্ব ঢঙে প্রতিদিনকার মত অসম্ভব সুন্দর পড়িয়ে গেলেন। স্যারের কাছে যে,
আমাদের আজন্ম ঋণ। ভুলতে পারিনা। যদি ভুলে যাই, তাহলে যে পাপ হয়ে যাবে। সাত হাত ভাগ্য আমার, এমন মানুষের পায়ের কাছে বসে বাংলা পড়েছি।অনার্সের পাশাপাশি ইংরেজির ক্লাসে পেয়েছিলাম অধ্যাপক এস ব্যানার্জি, অধ্যাপক ভবানী শংকর সেন চৌধুরী, অধ্যাপক অশোক ঘোষ, অধ্যাপক এস মজুমদারকে। অধ্যাপক এস ব্যানার্জি আমাদের চার্লস ল্যাম্ব পড়াতেন। জুলিয়াস সিজার পড়াতেন অধ্যাপক এস মজুমদার। অধ্যাপক অশোক ঘোষ পড়াতেন ইংরেজি কবিতা। অধ্যাপক ভবানী শংকর সেন চৌধুরী আব্রাহাম লিংকন পড়াতেন। উনি পড়া ধরতেন।
পড়া না পারলে, কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হত। সমস্যা হল, আশ পাশের বাড়ির ছাদ থেকে মহিলারা আমাদের করুণ অবস্থা দেখে হাসতেন।
কলেজে পেছনের বেঞ্চে বসলে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেত। আমাদের তখন কাঁচা বয়স। দুপুর সাড়ে বারোটায় আকাশবাণী থেকে রবীন্দ্র সংগীত বাজানো হতো। আমাদের বন্ধুরা অনেকেই পাশের বাড়ির দিদি স্থানীয়দের দেখলে বলতো, দিদি, কাইন্ডলি একটু রেডিওটা চালিয়ে দিন না। এইভাবে কতদিন আমরা চিত্রলেখা চৌধুরী, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন, রাজেশ্বরী দত্তর গান শুনেছি।
কী সব মুগ্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর দিন। সেদিন আমরা সত্তর দশকের তরুণ। আজকাল কোমরের ব্যথা, পেটের গন্ডগোল, অম্বল চোয়া ঢেকুর নিয়ে অবস্থা বড় করুণ।
আশ্চর্যভাবে একদিন জানা গেল, স্যার নেতাজির ভক্ত। আমাদের ক্লাশের দুলাল দা স্যার ক্লাসে ঢুকলেই বলত, আজ কাগজে লিখেছে,শৌলমারীর সাধুই নেতাজী।
স্যার তখন সারা পিরিয়ড জুড়ে নেতাজির আলোচনায় মেতে যেতেন। আমাদের আর কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হতো না।
প্রেসিডেন্সি কলেজ আর হেয়ার স্কুলের মাঝখানে একটা বিশাল মাঠ। সেখানে ফুটবল খেলা হোত। ক্রিকেট খেলা নিয়ে কোন দিনই আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।
কিন্তু ফুটবল খেলার ব্যাপারে আমি ছিলাম অতিরিক্ত উৎসাহী। বর্ষার দিনে দাপিয়ে ওই মাঠে ফুটবল খেলেছি। বাঁ পায়ের জোর ছিল। খেলার শেষে গা-হাত-পা ধুয়ে বন্ধুবান্ধব মিলে জোর দার খাওয়া দাওয়া হোত। পরদিন বসুমতী কাগজে খেলার পাতায় আমাদের নাম ছাপা হলে, নিজেদের মনে হতো, কী একজন তালেবর হয়ে উঠেছি।
কিংবদন্তী ইংরেজীর অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী ততদিনে অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে কলেজে আসতেন। আমাদের করিডোরে ঘুরতে দেখলেই বলতেন, লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করতে। আজ যখন স্যারের নামে রাজকুমার চক্রবর্তী সরণি দিয়ে হাঁটি, তখন সে দিনে খুব কাছে থেকে দেখা স্যারের কথা গুলো মনে বাজে। স্যারের কাছে পড়তে পারিনি, কিন্তু তাঁর পরামর্শ, খুব কাছাকাছি থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ তো পেয়েছি। এসবের মূল্য যে অনেক।
ইতিহাসের ক্লাস নিতেন অধ্যাপক প্রেম বল্লভ সেন।
অসম্ভব পড়াশুনা ভদ্রলোকের। দুরন্ত পরিশ্রম করে ক্লাস নিতেন। ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক আশিস মুখোপাধ্যায়। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, তুই ফুটবল খেলিস, তোর চেহারাটা ফুটবল প্লেয়ার দের মতো।পরবর্তীকালে আমাদের কলেজের ফুটবল কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি লিংক ম্যান পজিশনে খেলতাম। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। খেলার পর ডিম পাউরুটি খাওয়া হোত।
অধ্যাপক অক্ষয় জীবন বসু বহুদিন আগে কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক। আমাদের প্রিন্সিপাল তাঁর ছাত্র। এক টাকা সন্মান দক্ষিণা নিয়ে তিনি সপ্তাহে একদিন প্রিন্সিপালের অনুরোধে কলেজে ক্লাস নিতে আসতেন। আমি যখন তাঁকে দেখেছিলাম, তখন অতিশয় বৃদ্ধ তিনি। অথচ, তাঁর ক্লাস করবার জন্য থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তিনি করিডোরে ঘোরাঘুরি পছন্দ করতেন না। বলতেন, লাইব্রেরীতে গিয়ে বসো।
গরীব বাড়ির ছেলে আমি। একদিন ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক সুদেব ঘোষ কে বাড়ির অবস্থার কথা বললাম। উনি হাফ ফ্রী করে দিয়েছিলেন।
আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার বসু।একুশ নম্বর গ্যালারি রুমে তাঁর ছবির মত ওড টু দ্য নাইটেঙ্গেল কবিতার ক্লাসের কথা মনে পড়ে। ছবির মত পড়াতেন স্যার। মনে আছে, একদিন পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, এ ডাফট অব ভিন্টেজ। বলেছিলেন,
মাটির নিচে থাকা এক ধরনের মদ, তারপর বলেছিলেন, আমি অবশ্য কখনো খেয়ে দেখি নি।
স্যারের ক্লাস থাকলে, প্রেসিডেন্সি, সুরেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্ররা স্যারের ক্লাস শুনতে আসতো।আমাদের কলেজের চত্বরে রেক্টর গিরিশ চন্দ্র বসুর
মূর্তির পাশে আমাদের প্রিন্সিপাল প্রশান্ত কুমার বসুর মূর্তি রয়েছে। কলেজে আজও গেলে, এখানে দাঁড়িয়ে নতমস্তক হই। কত যে ঋণী করে গেছেন,
এইসব নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদেরা। ভুলতে পারিনা।বন্ধু-বান্ধবদের কথায় আসি।
আমি বাটানগরের ছেলে। ডানকুনির অশ্বিনী কুমার গুপ্ত আমার বঙ্গবাসী কলেজের প্রথম বন্ধু। বেলেঘাটার স্বপন সরকার, হাওড়ার তপন ঘোষ, বিরাটির অজয় কুমার বিশ্বাস, মহিষাদলের অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার সুভাষ দাস, আমরা খুব কাছাকাছি বন্ধু ছিলাম।
তপন পত্রিকা বের করত। সে সময় নিজেও ভালো কবিতা লিখতো। সজল কান্তি শ্যাম, আমার বন্ধু, আজো ভালো কবিতা লেখে।
একদিন অনার্স নিয়ে পাশ করলাম। কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম। বঙ্গবাসী কলেজের স্মৃতি আজও টুকরো-টুকরো মনে ভাসে।
গায়ক অর্ঘ্য সেন, বিধায়ক অশোক দেব, মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা জহর গাঙ্গুলী, বিচারপতি সুধীর রঞ্জন দাস, অভিনেতা অসিত বরণ, সাংবাদিক বরুন সেনগুপ্ত, সাংবাদিক সুদেব রায় চৌধুরী, আরো কত খ্যাত কীর্তি মানুষ এই কলেজের ছাত্র।
আমার কলেজ আমার যৌবনের স্মৃতি। আমার কলেজ আমার গর্ব। কলেজের সামনে আজও গেলে, বুকটা হাহাকার করে ওঠে। চোখে জল আসে।
সকালবেলায় রেডিওতে সুবীর সেন, শ্যামল মিত্র, কিংবা আরতি মুখার্জির গান শুনে, ছুটে নটা এক চল্লিশ এর ট্রেন ধরা, এবং অনার্সের ক্লাসে পৌঁছে যাওয়া।
আহা, সত্তরটা সিঁড়ি পেরিয়ে আবার যদি অনার্সের ওই ক্লাসের মুগ্ধ দিনগুলি ফিরে পেতাম।
নাট্যকার রতন কুমার ঘোষের আলোকিত যৌবন নাটকে খ্যাতিমান অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়লগ মনে পড়ে, যখন নায়িকা বলছেন, আমি তাহলে কি নিয়ে থাকবো?
বিষন্ন নায়ক বলছেন,আমার আলোকিত যৌবন। যা শুধু দেয়, কখনো হারায় না।সত্যি বলছি, বঙ্গবাসী কলেজের এতোটুকু স্মৃতি আমি আজও হারাইনি, মৃত্যু পর্যন্ত এই সুখময় স্মৃতিটুকু বহন করে নিয়ে যাবো।
প্রিয় শিক্ষা মন্দিরকে লক্ষ কোটি প্রণাম।
-
গল্প- পূর্বাশ্রম
পূর্বাশ্রম
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)
লেখা রান্না করতে করতে ছুটে গিয়ে ল্যান্ডফোনটা ধরল , ‘হ্যালো কেমন আছিস’? ওপারের গলাটা লেখা চিনতে পারল না। তুই তো অনেকেই বলতে পারে, সম্বোধন টা কি করবে ভাবছিল ‘ঠিক চিনতে পারছি না তো’! ‘হুম না চেনার। ই কথা’। কিন্তু বচনভঙ্গিটা যেন বড় চেনা চেনা লাগছিল লেখার ।কে হতে পারে ? ‘বর আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দারুণ সংসার করছিস তাই তো ?এখনো চিনতে পারলি না আমি কুশল রে কুশাল’ ’কুশল’?’ তুই এতদিন পর আমার নাম্বার কোথায় পেলি’? ‘কোথায় থাকিস তুই এখন? কাকিমা কাকু কেমন আছে’? ‘ওরে বাবারে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে’? দাঁড়া, এক এক করে উত্তর দিচ্ছি কিন্তু ফোনে সব শুনে নিবি? একবার বাড়িতে আসতে বলবি না? নাকি তোর পতিদেবের আপত্তি আছে ,ছেলে বন্ধুকে বাড়িতে আসতে দিতে’! ‘ নারে সে মানুষটা অমন নয় আমার সব বন্ধুদের সাথে ওর আলাপ আছে’ । ‘তবে একদিন আসি তোর বাড়িতে কেমন? কিরে তোর আপত্তি আছ নাকি? ‘ একেবারেই না ,সেই ছোট্টবেলার বন্ধু তুই তোকে সত্যিই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!’ ‘তাহলে আজ রাখি রে, দেখা হচ্ছে তাড়াতাড়ি ‘ ।’ আমার ঠিকানাটা লিখবি না?’ ‘ আরে এতদিন পর যখন ল্যান্ড ফোন নাম্বারটা জোগাড় করতে পেরেছি তখন ঠিকানাটাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাব রে, বা পেয়ে গেছি ধর” ” কবে আসতে চাস বল ?” ‘তুই যেদিন ডাকবি !’ ‘এই রবিবার নয় এর পরের রবিবার চলে আসিস’। ‘ বেশ তবে তাই কথা রইল আজ রাখি রে ভালো থাকিস ‘।
ছোটবেলার বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে এসে দেখে রান্নাটা তলা থেকে ধরে গেছে। কি করবে এখন ছেলেমেয়েরা যে সন্ধ্যেবেলা কাশ্মীরি আলুর দম দিয়ে লুচি খাবে বলে খুশি খুশি মনে আছে ।বর ও খুব খুশি। মা ঠাকুমার ছোটবেলা শেখানোর টিপসগুলো কাজে লাগালো লেখা। হ্যাঁ ঠিকই তো অনেকটা সামলে নেওয়া গেছে। একটু টেস্ট করে দেখলো ভালোই হয়েছে খেতে। নুন মিষ্টি ঝাল একদম ঠিকঠাক। নিজের রান্নার তারিফ নিজেই করল মনে মনে।হাতের ইঙ্গিতে খাবার দুর্দান্ত হয়েছে বোঝালো লেখার মেয়ে ঈশিতা। ছেলে বলল ‘মা আর দুটো লুচি দাও তো ‘বাহ! তাহলে তো রান্না করাটা স্বার্থক। ভালো হয়েছে। রান্নার লোক আছে কিন্তু ছেলে মেয়েদের জন্য এসব রান্না সে নিজে করতেই ভালোবাসে । আর নিজে হাতে লুচি ভেজে খাওয়াতে ভালবাসে ছেলেমেয়েদের । কোনো কোনো সন্ধ্যেবেলা তারা এরকম লুচি আলুর দম বা অন্য কোন পদ খায়। বর বলল ‘ গ্র্যান্ড হোটেলের কুক করে দিমু’। সবাই হেসে উঠলো। কাল রবিবার। কালকে চারজন কোথাও বেরাবে না ঠিক করেছে। ইচ্ছে করে কোনো কোনো রবিবার কোথাও বেরোয় না কেউই। একসাথে থাকাটা এনজয় করে। কাল তেমনি একটা রবিবার। তাইতো কালকে আসতে বলেনি সে কুশল কে। কিন্তু কুশালের আসার কথাটা কি এখনই বলবে? এক সপ্তাহ দেরি আছে তো পরে বললেই হবে। ‘মা ম্যাটটা লাগিয়ে দাও তো, বড্ড মশা হয়েছে’ ‘দেখিস তোর আবার শ্বাসকষ্ট না হয়! তোর তো আবার এগুলো সহ্য হয় না।’ ‘ না মা একটুখানি লাগাও আমি বন্ধ করে দেব ডিনারটা তেমন জমবে না, অনেকগুলো লুচি খেয়ে ফেলেছে কিনা সবাই মিলে। যাইহোক এত বড় রাত্রি কিছু তো খেতেই হবে। অল্প সল্প খেয়ে তারা ঘুমোতে গেল।
রবিবারের সকালটা একটু মেঘলা। মেঘলা দিন বড্ড ভালোবাসে লেখা খুব মিষ্টি মিষ্টি লাগে এই ওয়েদারটাকে তার। বৃষ্টি পড়ছে না তবে রোদের তেজ একেবারেই নেই । একসঙ্গে থাকা রবিবার গুলো তারা খুব আনন্দে কাটায় একসঙ্গে জল খাবার খায়। একেক রবিবার একেক জনের পছন্দের খাবার হয়। এই রবিবার মেয়ে ইশিকার পছন্দের খাবার হয়েছে। ঘরোয়া করে ধোসা তৈরি করেছে লেখা। আজকে রান্নার মেয়েকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে নিজেদের মতন করে কাটাবে বলে দুপুরবেলা মুড়িঘন্ট আছে মেয়ের পছন্দের। আর ফ্রাইড রাইস নয়, ভাতটাকে একটু বিশেষ কায়দায় ভেজে নিয়েছে। খাবারটা মেয়ে খেতে খুব ভালোবাসে । দুপুরে খেতে বসে লেখা বলল ‘তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই আমি সামনের রবিবার আমার এক বন্ধুকে আসতে বলে দিয়েছি ’।‘আমার সঙ্গে পরামর্শ করার কি আছে তোমার বন্ধুরা তো মাঝে মধ্যেই আসে। ‘এ বন্ধুটা পুরুষ কিন্তু !’ ‘কেন তোমার কোনো পুরুষ বন্ধু আগে বাড়িতে আসেনি বুঝি’ ? আমাদের তো বন্ধু বান্ধবীদের জন্য দরজা খোলা। আমরা তো এসব নিয়ে কখনো কোন আলাদা করে কথা বলি না। বাই দ্যা ওয়ে নাম কি তোমার বন্ধুর?’ ’কুশল’ ‘ও বাবা এর নামটা শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না! কি স্মৃতিরতলে তলিয়ে গেছিল নাকি?’ না গো, এ আমার স্কুল বেলার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি তারপর ওর বাবার বদলি হলো প্রথম কিছুদিন যোগাযোগ ছিল পরে কেমন করে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কেটে গেল। তারপরেই এত বছর পর কালকে হঠাৎ ফোন করলো। জানিনা কিভাবে নাম্বার পেয়েছে তবে ছোটবেলার বন্ধু তো আসবে শুনে ভালো লাগছে গো ‘। ‘কোন বিশেষ ব্যাপার আছে নাকি ? ‘ধুর্ তুমি না সবসময় ইয়ার্কি কর’ ‘ না তাই বলছিলাম আরকি। মুখটা যেন কেমন রা রাঙ্গা রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে’ ‘ মা, তোমার বয়ফ্রেন্ড না কি গো? ছেলে ফুট কাটলো। ‘মারবো ‘ ‘দেখো বাবা তাহলে তো বেশ হয় মায়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ হবে’ মেয়ে বলে উঠলো ।’এই তোরা কি আরম্ভ করেছিস রে? আমি কিন্তু না করে দেব আসতে’। ‘আমরা একটা নতুন আনন্দ করবো রবিবার দিন ,কবে যে দিনটা আসবে মা তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করব কি মজা কি মজা! ঈশিতা বলছে। ’মারবো কিন্তু একদম ইয়ার্কি মারবি না’। ‘তোমার বন্ধুকে খুব গম্ভীর প্রকৃতির নাকি’?‘ না রে ও ভীষণ আলাপি। খুব মজা করতে ভালোবাসে অবশ্য এতদিন পরে সে কেমন হয়েছে সেটা ঠিক বলতে পারবো না’।
একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। একি কুশলের সঙ্গে লেখার মেয়ে নামছে। কি করে হলো? ও আচ্ছা, আমি একটা ছোট্ট কাগজের মোবাইল নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম সেখান থেকে দুষ্টু মেয়েটা যোগাযোগ করেছে আর কোথাও থেকে ঠিক ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠে পরেছে। ‘কি রে? চিনতে পারছিস দেখ তো ভালো করে’ ’হ্যাঁ রে, তোর মুখটা তো একই রকম আছে। শুধু বয়সের ছাপটা পড়েছে !’ ’বলছিস আমাকে তো সবাই এখনো ইয়াং বলে, এই যে তোর মেয়ে বলল একটু আগে বাহ তুমি কি ইয়াং আছো গো?’ তুমি মায়ের বয়সী মনে হচ্ছে না আমার মা টা বুড়ি গেলো’ । ‘ব্যাস আমার মেয়ের পাকামো শুরু হয়ে গেছে’। ‘আরে নারে ওর সঙ্গ টা খুব এনজয় করতে করতে এলাম যেটুকু সময় একসঙ্গে এলাম। খুব ভালো মেয়ে তোর। আরে বাবা দরজা দাঁড়িয়ে সব কথা বলবি নাকি ভিতরে যাব’? ‘ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসি, হ্যাঁ আমার আবার কোথাও থেকে এসে স্নান না করলে হয় না আমি টুক করে স্নান করে আসি ’ কি সুন্দর একটা গন্ধ বের হচ্ছে ‘কুশল মামা তুমি কি সাবান মেখেছো গো ’?সেই ছোট্টবেলা থেকে এখনো ছেলেটা একই সাবান ব্যবহার করে, এই গন্ধটা খুব ভালবাসতো লেখা। মা-বাবাকে বলতো ওই সাবানটায় কিনে এনে দিতে। মাঝেমধ্যে চুপচাপ নিজের জমানো পয়সা থেকে কুশল সাবানটা কিনে দিত লেখাকে। হঠাৎ করে ছোট্টবেলাটা মনে উঁকি দিল লেখার । ‘পুরানো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়’? ‘হ্যাঁ এবার একটু চট করে খেয়ে নে, জল খাবারটা খেয়ে তাড়াতাড়ি চল আমরা আড্ডা মারবো’। ‘রান্নার লোক রান্না করছে? তুই আমাকে রান্না করে খাওয়াবি না’? ‘হ্যাঁ রে খাওয়াবো’। কয়েকটা পদ আমি রান্না করবো। তোর প্রিয় খাবার গুলো এখন ও আমার মনে আছে। ’। ‘তোর বর কোথায় ’?‘ওর কথা আর বলিস না! তোর পছন্দের জিনিসগুলো জেনে নিয়ে ছুটেছে বাজারে’। ‘বাবা তোর বড তো বিশাল উদার লোক রে’। ‘তা বলতে পারিস এই ব্যাপারে আমি খুব লাকি রে ওকে পেয়ে সত্যিই আমি খুশি’। হালকা একটা বিষাদ কি উঁকি দিল কুশালের মুখে? ঠিক বুঝতে পারল না লেখা। ‘এই বাজারটা ধরো, এসে গেছি আরে কুশল বাবু এসে গেছেন ’ ‘আবার বাবু টাবু কেন নাম ধরে বলো, আর আপনি নয় তুই তুমি যা খুশি বলো ’। বেশতো! তুমি বলেই না হয় বললাম তুই এ নামার মত জায়গাতে এখনো পৌঁছাযইনি ,কখনো যদি পৌঁছাই তখন তুই বলব। আমার বউটি দেখছি খুব খুশি খুশি, পুরনো বন্ধুকে পেয়ে’।
‘চল চল তোর বাগানটা দেখে আসি বাহ!খুব সুন্দর ফুল ফুটিয়েছিস তো! বেগুন গুলোর সাইজ তো হেবি নিয়ে যাব যাওয়ার সময় দুখানা। জানিস তো আমি বেগুন পোড়া খেতে খুব ভালবাসি । মনে পড়ে আমরা কেমন বাগানের ফসল নিয়ে প্রতিযোগিতা করতাম। কার বেগুন গাছে কত বেশি বেগুন আসে কারটা কত বড় হয়! জৈব সার, ইউরিয়া ,নানা রকম সার কম্পিটিশন করে দিতাম দুজনে বল!‘তুই এখনো বাগান করিস’? ‘নারে!কোথায় বাগান করবো? আমার তো দু কামরার এক চিলতে ফ্ল্যাট আর আমি তো ঘুরে ঘুরে বেড়াই’। ‘কাকিমা কাকু কোথায় আছেন ’?‘ মা বাবা ফ্ল্যাটে থাকতে চাননা। তারা আমাদের দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। ওখানে বাগান নিয়ে ফুল নিয়ে গাছ নিয়ে বেশ ভালো আছেন। কাকু কাকিমা মানে তোর মা বাবা কেমন আছেন? ‘ওরাও ভালোই আছেন। কখনো আমার কাছে এসে কিছুদিন থাকেন, কখনো ভাইয়ের কাছে থাকেন। আবার বেশিরভাগ সময় নিজেদের মতো নিজেদের বাড়িতেই কাটান।’ ওই বাড়িতে ওরা আছে রে যে বাড়িতে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি ’। ‘ও নাইস! ওই বাড়িটা এখনো আছে নারে? আমি তাহলে যাব আমাদের বাড়িটা তো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, এখন ওখানে একজন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী কিনেছেন বাড়িটা অনেক বড় করেছেন বাড়িটাকে বিশাল টাকা ওয়ালা লোক রে !মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমরা টাকা নয় টাকওয়ালা লোকেদের টাকা ওয়ালা লোক বলতাম’। ইশিকা বলল , ‘মা তোমরা তো বেশ মজা করতে তো! । ‘তোর ছেলেটা একটু কম কথা বলে তাই না?’। ‘ হ্যাঁরে ও একটু শান্ত’ । ‘তোর বরটা আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল কেন রে’? ‘ওইটাই তো মুশকিল রে !বাড়িতে থাকলেও অফিসের কাজ করতে থাকে ওই জন্যই তো কিছু কিছু রবিবার আমরা ঠিক করি , একদম নিজেদের মত করে কাটাবো। ওকে অফিসের কাজ করতে দিই না সেদিন। এই আগের রবিবারেই আমরা চারজন ওইভাবে কাটিয়েছি। এর পরেরটা আবার কাটাব’। ‘ও এটা আমি এসে নষ্ট করে দিলাম না তো? নারে এটা একটা নতুন সুন্দর অভিজ্ঞতা হল। খুব ভালো লাগছে রে আচ্ছা তোর বউয়ের কথা বল । তোর পরিবারের কথা বল । ফোনে তো কিছুই বললি না সেসব’। ‘থাকলে তো বলব! ‘আমি আর ঐসব বন্ধনের মধ্যে নেই ’ ‘আর মানে? কোন সময় বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলি নাকি’? ‘হয়তো বা পড়েছিলাম’। কি বলতে চাইছে কুশল ?লেখার মনের মধ্যে প্রশ্ন আসছে। ‘চল তোর বরের সাথে একটু গল্প করি, আরে বাবা তুই তো বিশাল রান্না বিশারদ হয়েছিস রে, রান্নার লোককে বাড়ি চলে যেতে বললি, আমি তোর রান্না খাবো বলে। আরে এত রান্না করলি কখন তুই তো গল্প করছিলি? ও আচ্ছা তোর মেয়ে বরকে নিয়ে যখন গল্প করছিলাম সেই ফাঁকে টুকটুক করে করে ফেলেছিস খুব ভালো হয়েছে রে খেতে, কাকিমার রান্নার কথা মনে মনে পড়ছে। তোদের বাড়ি গিয়ে যখন তখন ডিনার লাঞ্চ করে ফেলতাম। তোদের বাড়ির ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম’। ‘ মা তোমরা মারামারি করতে না’? ‘হ্যাঁরে মারামারি করতাম খেলতাম ,নাটক করতাম । বেশ ছিলাম। ’ ঈশিকা আরিশান একটু বেরালো, তারা তাদের কুশল মামার জন্য গিফট কিনতে যাচ্ছে ।
লেখা, কুশল কে টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছে। লেখার বর একটু বেরিয়েছে। কুশল লেখার আলমারির বইগুলো দেখছে। শরৎ রচনাবলীর র দিকে চোখ পড়লো। সেই কবেকার সেই ছোট্টবেলা খেলা করছিল দুজনে খেলতে খেলতে কোন খেয়ালে লেখা হঠাৎ একটা সাদা পুতির মালা পরিয়ে দিল কুশলকে। লেখা পালিয়ে যাচ্ছিল ,কুশল ওর হাতটা চেপে ধরলো, হঠাৎ বলে বসলো,ললিতা যাস না,তুই অর্ধেক করেছিস আমি পুরোটা করে দিলাম বলে মালাটা লেখাকে পরিয়ে দিল। ললিতা! কুশল কি নিজেকে শেখর ভাবছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো লেখা। । তখন তো দুজনেই বইয়ের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে শরৎ রচনাবলী পড়তো। পরিণীতা গল্পের শেখর ললিতাকে নিয়ে আলোচনা করতো। মালাটা ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল লেখা। উচ্চমাধ্যমিকের পর কুশলের বাবা বদলী হওয়ায় কুশলরা দূরে চলে গিয়েছিল । প্রথম কিছু দিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কুশলের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ঘটনাটা। লেখা ব্যাপারটাকে অত গভীর ভাবে নেয় নি। তবুও তার মনে একটু প্রভাব ছিল ঘটনাটার।নিতান্ত যখন তার জীবনে আসে তখন নিতান্ত কে তার খুব ভালো লেগে যায়। ছোট্টবেলার কবে কি ঘটনা ঘটেছিল আস্তে আস্তে মন থেকে বোধহয় একটু একটু করে দূরে সরে যায় । অনেকটা আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ডের মতো। কিন্তু কুশল লেখাকে ভুলতে পারেনি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও দীর্ঘ আদর্শন হলেও সে লেখাকে ভোলেনি।দীর্ঘ অদর্শন ও বিনা পত্রালাপেও কুশলের মনে লেখার প্রতি ভালোবাসা সদা জাগরুক ছিল। । মনের কোণে কোথায় যেন প্রেমিকার ছবি হিসেবে, স্ত্রীর ছবি হিসাবে লেখার ছবিই আঁকা ছিল। না সে প্রেমও করতে পারেনি ,বিয়েও করতে পারেনি।মনের কোণে কোথাও আশা ছিল হয়তো পরিণীতার ললিতার মত তার লেখাও তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। কিন্তু লেখার বিয়ের খবর তার কাছে গোপন থাকেনি। কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। এই মালাটা সর্বক্ষণের সাথী ছিল তার । যেন মালাটাই তার জীবনসাথী। অদ্ভুত এক বন্ধন । বন্ধনে ধরা না দিয়েও বন্ধনে থাকা। কিন্তু না সে আর কোন বন্ধনে আটকে থাকতে চায় না। কি সুন্দর একটা সংসার লেখার। তা দেখে তার মনে হল তার ভালোবাসার জন সুখে আছে এটাই তার জন্য পরম আনন্দের। শেষের কবিতার অমিত লাবণ্যকে মনে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, লেখার সঙ্গে তার যে ভালোবাসা সেতো দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, তার মন তাতে সাঁতার দেবে। না না আর তার মনও আর সেই দিঘিতে সাঁতার দেবে না। ভালবাসার ওইদিগিতে সাঁতার দিয়ে তার মন শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার তার মন যেন বলছে,‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলো ’। মুক্তি মুক্তি বড় আনন্দের মুক্তি। সে তো পাহাড়ে, পাহাড়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় । জীবনধারণের জন্য বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু রোজগার করার প্রয়োজন সেটুকু করে নেয় আর বাকি সময়টা বাইক রাইড। । কখন ও বা চার চাকায় পাহাড়ে চলে যায় । বাইকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক বাইকারদের সঙ্গে তার বিশাল বন্ধুত্ব এসব নিয়ে বেশ আছে। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যেতে ভালোই লাগে। কিন্তু মালাটা কেন সে যেন ছাড়তে পারে নি এতদিন? এ কোন অদৃশ্য বন্ধন । ‘এবার যে আমার যেতে হবে লেখা আজকের দিনটা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি’। একটা দিন থেকে গেলে হতো না ’ ‘নারে আজ আমার যেতেই হবে কালকে আবার শুরু হবে ছুট, পাহাড়ের টানে বাইক রাইডে। চল তোকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঈশিকা, তুই যাবি আমাদের সাথে’? ‘না মা এটুকু সময় তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটু আনন্দে কাটাও ’ । গাড়ি করে স্টেশনের পর্যন্ত যাও এর মধ্যে তোমাদের গোপন কথাটা সেরে নাও’ । লেখার বর হাহা করে হেসে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো যাও যাও’। ‘ধুর তুমি না !আমি যাবই না তাহলে’। ‘ না না যাও ওনার ভালো লাগবে গাড়ি থেকে স্টেশন খুব বেশি কথা হলো না। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নীরবতা বজায় রয়েছে । একটু দেরি আছে ট্রেন আসতে। দুজনে স্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছে। ‘ চারিদিকে দৃশ্যগুলো দেখ ,তোর জন্য একটা উপহার আছে একটা ভালো উপহার আছে আর একটা অন্যরকম জিনিসও আছে বাক্সে। এখন খুলবি না। গিয়ে খুলিস। ট্রেন ছুটছে জানলা দিয়ে হাত দেখাতে দেখাতে চলে যাচ্ছে কুশল ক্রমাগত দূরে দূরে দূরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে । কৌতূহল খুব কৌতূহল হচ্ছে লেখার। বাড়ি গিয়েই দেখব। বাড়ি এসে চুপচাপ রেখে দিলে বাক্সটা। লুকিয়ে গভীর রাতে বর ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে আর মেয়ে নিজেদের ঘরে। বাক্সটা নিয়ে ধীরে ধীরে ডাইনিং রুমে এলো একটা খুব সুন্দর শোপিস দুটো পায়রার। সাদা তলায় লেখা ‘ভালো থাকিস’। আর এটা কি? একটা মালা, সাদা পুতির মালা। সেই মালাটা স্মৃতিতে ডুব দিল লেখা। হ্যাঁ, সেই মালাটাই মালাটা সে একদিন পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর বেশ কিছুদিন খুব লজ্জা পেতো কুশালের কাছাকাছি যেতে। তারপর ওরা দূরে চলে গেল। সঙ্গে একটা চিঠি।
লেখা,
হয়তো তোর মনের কোথাও আমি নেই, ছিলামও না ,তবুও যদি বিন্দুমাত্র থেকে থাকি সেটুকু বন্ধন থেকেও তোকে মুক্ত করলাম। আর হ্যাঁ আমিও বন্ধন থেকে মুক্ত হলাম, এই মালা যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে সব সময় মনে হবে আমি যেন বাঁধা পড়ে আছি তোর কাছে। একটা দিনের জন্যেও মালাটাকে কাছছাড়া করিনি। কিন্তু এই বন্ধন থেকে আমি মুক্তি চাই রে!আমার ভালোবাসা ভালো আছে ,এইটাই আমার জন্য অনেক রে! মন একটা সুন্দর প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। আর কোন বন্ধন ,আর কোন পিছুটান আমি রাখতে চাই না। তোকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল, দেখা হয়ে গেছে । হারটা রেখে গেলাম, আর কোনদিন সেই দিনটারর কথা ভাববো না । আমি সন্ন্যাসী নই ,সন্নাস নেবো ও না,নিজের মত করে নিজের ছন্দে বাঁচবো। তবু এটা যেন অনেকটা পূর্বাশ্রমের মতোই । সন্যাসীরা একটা পর্যায়ে পৌঁছে পূর্বাশ্রমকে আর মনে রাখে না। পূর্বাশ্রমের কথা মনে করে না। আমি তেমন ই এই ঘটনাটাকে আমার জীবনের পূর্বাশ্রম মনে করব। আর পিছনে ফিরে তাকাবো না । তাই মালাটা আর কাছে রাখলাম না । এতদিন প্রাণের থেকে প্রিয় বলে যাকে আগলে রেখেছি ,আজ তা ফেরত দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস। আমি চললাম পাহাড়ে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরবো, সমুদ্র সমুদ্রে ঘুরবো আমি আমার মত করে খুব ভালো থাকবো রে, আর এই বন্ধন মুক্তি আমাকে আরো ভালো রাখবে।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে লেখার। একদিকে মনে হচ্ছে সেও বন্ধন মুক্ত হলো,অবশ্য সে কি এই বন্ধনে কখন ও বাঁধা ছিল?সে তার বরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। সাজানো গোছানো সংসার আছে তার। কিন্তু তবুও ভিতরে একটা কষ্টের অনুভূতিও হচ্ছে। তবে কি তার ও অবচেতনে কোনো হালকা বন্ধন ছিল?মালাটা ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে পারলো না। বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে দিল। কুশল বন্ধনমুক্ত ।লেখাও বরকে খুবই ভালোবাসে, তবুও লেখার মনে বোধহয় একটা হালকা অদৃশ্য বন্ধন থেকে গেলো,নাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?