গল্প
-
গল্প- নিরঞ্জন
নিরঞ্জন
-শচী দুলাল পালবিজয়া দশমীর রাত্রি,বিসর্জনের পথে মা দূর্গা। আবালবৃদ্ধবনিতার শোভাযাত্রা চলেছে শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে গঙ্গার ঘাটে। ব্যান্ড পার্টি, আলোক সজ্জায় ধুনুচি হাতে যুবক যুবতীরা নৃত্য করছে। কেউ ভাং, কেউবা কোল্ড ড্রিংকস এর সাথে মদ মিশ্রিত পানীয় খেয়েছে। রাস্তার দুপাশে জনতার সারি। ঘরদোর ছেড়ে সবাই আজ রাস্তায়। অর্ঘ্য নামে একটি মেধাবী ছেলে সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রার আনন্দ উপভোগ করছিলো। হঠাৎ নাচের দল থেকে কয়েকজন বন্ধু অর্ঘ্যকে হাত ধরে টেনে নাচের দলে ঢুকিয়ে নিলো। সে নাচ জানেনা, অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাদের সাথে পা মিলাতে লাগলো।
সেই নাচের দলে ছিল ভীরা নামে একটি ছেলে- তার সহপাঠী। ভীরা হিংসুটে ও দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। অর্ঘের উন্নতিতে তার জ্বলন হতো। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে যথারীতি মা’কে বিসর্জনের জন্য প্রতিমার জলে ভাসানের উদ্যোগ চলছে । অর্ঘ্য তীরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দেখছে। হঠাৎ দেখলো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীরা। ভীরা তাকে এক ধাক্কা দিতেই জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো। ভীরা তাকে বাঁচাবার ছল করে কিছু একটা দিয়ে তাকে আঘাত করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। সবাই চোখের সামনে দেখলো একটা ছেলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর সে জ্ঞান হারালো। বিসর্জনের যাত্রীরা কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলো না। কে নিজের জীবন বিপন্ন করে ডুবন্তকে বাঁচাতে যাবে? তারা সবাই ধরে নিলো বিসর্জনের রাতে অর্ঘ্য ভেসে গিয়ে মরে গেছে।
জলের স্রোতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভাসতে ভাসতে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো দূরে, বহূদুরে। শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুতগতিতে সংবাদ সম্প্রচারিত হলো। অর্ঘ্য নামে একটি যুবক প্রতিমা বিসর্জন করতে গিয়ে ভেসে গেছে। অর্ঘ্যের মা-বাবা ও পরিবারের বুক ফাটা আর্তনাদে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো।
কোনো এক গঙ্গা তীরে বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছের সমারোহ। বেশ ছায়া সুশীতল গাছ গাছালীতে ভরা এই স্থানটি। গঙ্গাধারে পর্ণকুটিরে জোনাই নামে একটি বছর পনেরোর কিশোরী তার মা বাবার সাথে থাকে। অন্যদিন বেশ বেলায় ঘুম থেকে ওঠে। আজ অজানা কারণে সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পুব আকাশে সূর্য উদয় হচ্ছে। তার রক্তিম রশ্মিতে জল লালে লাল। গঙ্গা তীরে গিয়ে নির্মল বাতাসে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ দেখলো প্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর কি একটা ভেসে আসছে। রক্তাক্ত দেহ। ভাসতে ভাসতে দেহটি এক্কেবারে তার সামনে এসে থামলো। দূর থেকে মৃতদেহ মনে হলেও সামনে এলে সে অনুভব করলো দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ছটফট করছে। জোনাই দেখলো বিসর্জিত দূর্গাকাঠামোর টুকরোর উপর ভাসমান যুবকটির প্রাণ আছে। সে যুবকটিকে জল থেকে তুলে নিজের যথাশক্তি দিয়ে ডাঙ্গায় তুললো। পেটে চাপ দিয়ে জল বার করলো।ধীরে ধীরে ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। অবসন্ন শরীর। কথা বলার ক্ষমতা নেই। জলে সাঁতার, মাছ ধরা, নিজের এক টুকরো বাগানে কাজ করা শক্তিশালী জোনাই নিজের শরীরে ভর নিয়ে যুবকটিকে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে নিয়ে এলো। গরম দুধ খেতে দিলো। সেবা পথ্য দিয়ে শরীরে প্রাণসঞ্চার করলো। যুবকটি চোখ মেলে চেয়ে দেখলো সেবারতা এক কিশোরীর হাত তার কপালে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে অবসন্ন দূর্বল শরীরে অক্ষম হয়ে পড়ে গেলো। জোনাই যুবকটিকে বলল- তুমি দূর্বল। মাথায় চোট লেগে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তোমাকে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? তোমাকে এক দেবীপ্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর গঙ্গা জল থেকে উদ্ধার করেছি।
ছেলেটি তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিছুই মনে করতে পারছে না। বলল- আমি কিছু মনে করতে পারছি না?
হাসপাতালে দিন কয়েক থেকে যুবকটি সুস্থ হলে জোনাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। জোনাই-এর বাপ দিনমজুর। সবদিন কাজ থাকে না। চুল্লু খেয়ে ঘুমায়। মা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজে। ঝিয়ের কাজ করে।
গরীবের সংসার। বাপটা একদিন চুল্লু খেয়ে মেয়ের উপর চড়াও হলো- আর কতদিন গলগ্রহটাকে পুষবি? ওর মাথার ঠিক নেই। নিজের নাম ঠিকানা বলতে পারছে না।-না পারুক। একদিন না একদিন সে নিজেকে চিনতে পারবে।
-তাতে তোর কি লাভ?
-লাভ ক্ষতি আমি কিছু বুঝিনা। একজন মুমূর্ষুকে প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করেছি তাই নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি ওকে আমাদের ঘরেই রাখবো। ওকে এখনি ছেড়ে দিলে ক্ষিদে তৃষ্ণায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে।
-আমরাই বা কোথা থেকে যোগাবো তার ভরণপোষণ?-আমার খাবারের আর্ধেক আমি ছেলেটিকে খাওয়াবো।
-তার মানে তুই ছেলেটিকে এখানেই রাখবি? সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। লোকে কি বলবে?
-যে যাই বলুক আমার কিছু যায় আসে না। যতদিন না তার পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারছে ততদিন আমি তাকে দেখবো। সংসার চালাতে তোমাদের যদি কষ্ট হয় আমি কাজ করব। উপার্জন করব।
মা রান্না করতে করতে এসে বললো- তোদের বাপ বেটির সব কথা শুনেছি। ঠিক আছে কাল থেকে তুই কাজে লাগ। সামনের উর্বর জমিটায় সবজি লাগা। গতর খেটে উপার্জন কর।
সবজি বেচে দু’ টাকা আয়ও হবে। আমিও না হয় দু’বাড়ি বেশি ঠিকে ঝির কাজ করব।
এভাবেই থাকতে লাগলো ছেলেটি। তারা নাম দিল দূর্গাপদ।
কয়েক বছর এভাবে কাটলো। জোনাই এখন অষ্টাদশী। দূর্গাপদ শহরে এক প্রোমোটারের অধীনে নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কর্মীর কাজ করে। জোনাইএর মা’কে সে মা বলে। বেতনের সব টাকা মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। একদিন তাদের অবস্থা সচ্ছল হলো। কাজকর্মে নিষ্টা, সততা, সরলতা দেখে প্রমোটার তাকে সুপারভাইজার পদে প্রমোশন দিলেন। দূর্গাপদ এখন উচ্চ আয়ের প্রমোটারের শ্রেষ্ঠ সেবক হলো। বেতনের টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করে দিল।
জোনাই, দূর্গাপদ একে অপরকে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারা দিনান্তে প্রায়ই গঙ্গাতীরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে গঙ্গার অপূর্ব শোভার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা দুজনে নিজেদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।
একদিন খবরের কাগজের চপ ভাজা সহযোগে ঠোঙায় ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বহুবছর আগে এক ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেখে জোনাই চমকে উঠলো। “অর্ঘ্য নামে এক যুবক দূর্গা বিসর্জনের রাতে হুগলির ঘাট থেকে জলে ভেসে গেছে। তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কোনো সহৃদয় ব্যাক্তি সন্ধান পেলে নীচের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে বাধিত হবো।”
ঝালমুড়ি খাওয়া হয়ে গেলে জোনাই ঠোঙাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখে দিল।
সে ভাবতে লাগলো এ তো সাধারণ ছেলে নয়। যদি সে এখনই তার পরিবারের হাতে তুলে দেয় দূর্গাপদকে তাহলে সে হাতছাড়া হয়ে যাবে। আশংকায় তার দিন কাটতে লাগলো।
সারারাত তার ঘুম আসে না। একদিন মধ্যরাতে জোনাই দূর্গাপদর রুমে গিয়ে
ইতস্তত করতে করতে দূর্গাপদর কপালে এক গভীর চুম্বন করলো। দূর্গাপদ প্রথম নারী স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখলো জোনাই তার সামনে দাঁড়িয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-এ কি!জোনাই তুমি কাঁদছো কেন?
কি হয়েছে?
জোনাই দূর্গাপদকে জড়িয়ে ধরে বললো- আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
-সে তো আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কথাটা এতদিন মুখফুটে বলতে পারিনি।-কথা দাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না!
-তিন সত্যি করে বলছি আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমাকে আমি বিয়ে করবো। আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় তোমায় স্থান দিয়েছি। সে স্থান চিরস্থায়ী থাকবে।
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাত্রি অবসান হলো দূরে কোথাও ভোরের পূজার ঘন্টা ও শঙ্খ ধ্বনি হলো।
আজ বিজয়া দশমী। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বিসর্জনের বাদ্যি বাজছে। গঙ্গাতীরে উপচে পড়া ভীড়।
দূর্গাপদ – জোনাই সুন্দর পোশাকে বিসর্জন দেখতে গেছে। তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে একপাশে দাঁড়িয়ে দূর্গা মায়ের বিসর্জন দেখছে। হঠাৎ পা পিছলে দুজনেই মায়ের কাঠামোর উপর পড়ে গেলো। শক্ত কাঠামোয় দূর্গাপদর কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। কে বা কারা যেন তাদের ডাঙায় নিয়ে এলো। জোনাই বললো- তোমার নাম “অর্ঘ্য”।
সাথে সাথে দুর্গাপদর পূর্বস্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
হ্যাঁ। আমি অর্ঘ্য। আমিই দূর্গাপদ। তুমি আমার বাকদত্তা স্ত্রী।
এসো বিসর্জনের এই পুণ্য লগ্নে তোমাকে বরণ করি। অর্ঘ্য তার রক্তাক্ত কপালের রক্ত দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলো।
ঢাক ঢোল কাঁসরঘণ্টা শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হলো।
জোনাই মোবাইলে সেভ করা ফোন নম্বরটিতে ফোন কল করে বললো- এই নাও তোমার নিজের মা বাবার সাথে কথা বলো।
অপর প্রান্ত থেকে নারী কন্ঠ ভেসে আসলো।-মা! আমি তোমার ছেলে অর্ঘ্য বলছি। আমি বেঁচে আছি মা। আজ রাতেই আমি আমার সদ্য পরিণীতা নববধূকে সাথে নিয়ে বাড়ি আসছি। তোমরা বরণডালা সাজিয়ে রেখো।
-
গল্প- খোঁজ
খোঁজ
-অজয় বিশ্বাসরমেনবাবু। রমেন রায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি বিভিন্ন মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অস্থায়ী তাঁবুতে থাকেন, আর সন্ন্যাসীদের আখড়ায় ঘুরে বেড়ান।খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ছেলেকে। ছোট থেকেই মেধাবী ছিল তার ছেলে। কলকাতায় কলেজে পড়ার জন্য কলেজের হস্টেলে সে থাকত। মাসে একবার বাড়ি যেত। ভালভাবেই পড়াশোনা চলছিল। একবার মাস পার হয়ে দু'মাস হতে চলল।ছেলে বাড়ি যাচ্ছে না। রমেনবাবু নিজেই এলেন খোঁজ করতে। সবাই অবাক। হস্টেলের ছেলেরা বলল, ও তো একদিন গেরুয়া বসন পরে সবাইকে জানাল ও বাড়ি যাচ্ছে। এরপর রমেনবাবু কোনোভাবেই তার ছেলের আর খোঁজ পাননি। এবার রমেনবাবু এসেছেন কুম্ভমেলায়। বুকে আশা নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এক ভোরে বেদের মন্ত্র উচ্চারণ শুনে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, সন্ন্যাসীরা বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। সকলেরই অল্প বয়স। সবাইকেই তার মনে হল, এরা সবাই তো তারই ছেলে।
-
গল্প-মর্নিং ওয়াক
মর্নিং ওয়াক
-সুনির্মল বসুভোরের কুয়াশায় ঢাকা নদী। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওপারে সূর্যের প্রথম আলো। ওঁরা চারজন এপারে একসঙ্গে হাঁটছিলেন। ভোরের পাখি আকাশের প্রান্তরেখায় ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছিল। ঘাসের উপরে শিশির বিন্দু। পথের পাশে বনফুলের রং বাহার।
মর্নিং ওয়াক। ভোরের শীতল বাতাস ওদের নাকে মুখে চোখে এসে লাগছিল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এভাবেই ওঁরা প্রতিদিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে থাকেন। নদীর পাড়ে পার্কের দিকে বহু মানুষ মর্নিং ওয়াকে আসেন।
ওঁরা সবাই সারা জীবন সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করেছেন। ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন। অবসর নেওয়ার পর নিজেদের মতো একটা অন্য জীবন কাটাচ্ছেন।
ভুবন মুখুজ্জে বলছিলেন, মানুষের মধ্যে যদি বড় হবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসে।
ত্রিদিব সিনহা বললেন, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
সন্তোষ দাশগুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ক্যান, কি হইছে?
অনল চৌধুরী বললেন, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই, বুঝলেন ভায়া।
ত্রিদিব সিনহা বললেন, ইচ্ছাশক্তি শুধু থাকলেই হবে না, সেই সঙ্গে ভাগ্যের একটা হাত থাকা চাই।সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- খোসা ছাড়াইয়া কন।
অনল চৌধুরী দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন- চলুন, অনেকটা হেঁটেছি। গাছের ছায়ায় বসি।
ত্রিদিব সিনহা গল্প শুরু করলেন।
-ভাই, ভোরের আকাশ দেখে সারাদিনটা কেমন যাবে, আগে থেকে ভাবা যায় না। আপনাদের বাটা মোড়ের শ্রীকান্ত সরকারের কথা মনে আছে? ওর ছেলে সবুজ সরকার নঙ্গী স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বরাবর খানিকটা অস্থির প্রকৃতির। দু’ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসতো। বরাবর ফার্স্ট হত।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হ। পলাডার অনেক প্রশংসা শুনছি।
ভুবন মুখুজ্জে বললেন- সবুজ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সরকারি চাকরির পরীক্ষা হচ্ছিল। বয়স্ক চাকরিপ্রার্থীরা বাইরে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করছিলেন- ট্রাম কে আবিষ্কার করেন? বলুন না?সবুজ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর দিল, মিঃ ট্রেন।
সবাই চমকে গিয়েছিল সেদিন।ত্রিদিব সিনহা বললেন, সেই ছেলেটি জীবনের কোন ক্ষেত্রে কোথাও আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়নি। হারতে হারতে ওর পায়ের তলায় জমি নেই। তাই বলছিলাম, শুধু ইচ্ছা শক্তি বড় হলেই চলবে না, ভাগ্যের সহযোগিতা না থাকলে, জীবনে সাফল্যের সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
সন্তোষ দাশগুপ্ত অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন-হেইডা কেমন কইরা ঘটল, একটু ক্লিয়ার কইরা বলেন।
ভুবন মুখুজ্জে নিজের হাতের স্টিকের উপর মাথা রেখে বললেন- ভেরি স্যাড।
অনল চৌধুরী বললেন- ছেলেটার উপর সবার খারাপ নজর পড়ে গিয়েছিল মনে হয়।
ত্রিদিব সিনহা বললেন- মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষায় সবুজ ফার্স্ট হয়েছিল। অথচ, ফাইনালে ও কোনো রকমে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে। গোটা স্কুল বাড়ি সেদিন ওর এই শোচনীয় পরিনাম দেখে হতাশ হয়েছিল, দুঃখ পেয়েছিল।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হেরপর কি হইল?
ভুবন মুখুজ্জে বললেন- অনেক পেছনে পড়ে থাকা ছেলে এইসব পরীক্ষায় ভালো ফল করে চমকে দেয়,
আবার যাদের উপর স্কুল বহু আশা করে বসে আছে, ফাইনালি তারা ওখানে গিয়ে ডোবায়।ত্রিদিব সিনহা বললেন- কলেজে গিয়ে সবুজ সরকার ইকোনমিক্সে অনার্স নেয়। ম্যাক্রো, বেনহাম নিয়ে পড়াশোনা করে। সাময়িক ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। এই সময় ওর জীবনে এষা চ্যাটার্জীর আগমন ঘটে। সেই থেকে ওর জীবনে পতন শুরু হয়।
জীবন মুখুজ্জে বলেন- একটা মেয়ে একজন পুরুষকে শূন্য থেকে উপরে ওঠাতে পারে, আবার তাকে ওপর থেকে নিচে নামিয়ে আনতে পারে।
সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- আইজ কালকার পোলাপানদের পেরেম ভালোবাসার কথা আর বলবেন না, দেখছেন না, গান বানাইছে,তু তু তু তু তুতু তরা। য্যান কুত্তারে বিস্কুট দিতাসে।
অনল চৌধুরী বললেন- তাই নাকি!
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- সেদিন আমার মাইয়া শ্রাবন্তী আইছিল, আমারে একখান ফিল্ম দেখাইলো, কি নাম যেন, আমি তোমার কেডা।
জীবন মুখুজ্জে হেসে বললেন- বুঝেছি ‘হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন’।
ত্রিদিব সিনহা কথা শুরু করলেন। বললেন- এষা মেয়েটি প্রেম-ভালোবাসার অভিনয় করে একটা সিএ ছেলেকে বিয়ে করে সল্ট লেকে ভেগে গেল।
অনল চৌধুরী বললেন, তারপর?
ত্রিদিব সিনহা বললেন- সবুজ সরকারের ক্যারিয়ার খতম। অনার্স পেল না। ভালো চাকরি পেল না। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে পয়সা উপার্জন করছে। তাই বলছিলাম, ইচ্ছা শক্তি থাকলে, ভালো ছাত্র ছাত্রী হলেই চলবে না, ভাগ্য বলেও একটা ব্যাপার আছে। অথচ, জীবনের শুরুতে কত সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিল ওই ছেলেটা!
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- এইসব ডেস্ট্রাক্টিভ মাইয়াগুলোর কথা আর বলবেন না।
অনল চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ত্রিদিব সিনহা বললেন- ভাগ্যিস, সব মেয়েরা এইরকম নন। ম্যান টু ম্যান, মানুষে মানুষে তফাৎ তো চিরকাল থাকেই।
অনল চৌধুরী বললেন- মেয়েরা সংসারের লক্ষ্মী। ওরা সংসারের সৌন্দর্য। ওরা না থাকলে, পৃথিবী অচল। ওদের মধ্যে ধারণী শক্তি রয়েছে।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- আমাগো মা কাকিমা গো কথা একবার ভাইববা দ্যাখেন। আমাগো মানুষ করতে গিয়া ওঁনারা কি না করেছেন! আর এত বছর যে চাকরি বাকরি কইরা আসলাম, তাও তো অগো জন্যই।
জীবন মুখুজ্জে বললেন- সিনহাদা, আপনার কথা মানছি ভাই। সবকিছুর উপরে ভাগ্য একটা ব্যাপার।
ওরা উঠে পড়লেন।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- রোদ্দুর উইঠা গেছে। গিন্নী চা রেডি কইরা বইসা আছে। দেরি করলে, ডালের হাতার বাড়ি মারবো আনে।
অনল চৌধুরী বললেন- দাদা, আপনি বৌদিকে ভয় পান?
সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- বৌরে ভয় পায় না, কোন্ হালা?
-
দ্বিধা সীমন্তিনী
দ্বিধা সীমন্তিনী
-রীণা চ্যাটার্জীসব দ্বিধা শেষ। শুধু গল্পটা…
বিয়ের আগে অত তলিয়ে ভাবেনি- হয়তো প্রয়োজন বোধ করেনি। সবকিছু চোখের সামনে আশৈশব দেখে এলেও অভ্যস্ত চোখে নিজের জন্য আলাদা করে প্রশ্ন জাগেনি। হয়তো এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় একটা আদ্যপান্ত বাঙালি পরিবারে, পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা মেয়ের জন্য এই অনুভূতি, তবুও এটাই সত্যি বিয়ের পরে তপতী প্রথম অনুভব করলো, বিবাহিত আর অবিবাহিত মেয়েদের দুই আলাদা সাজ পরিচয়ে, পরিধানে। নতুন করে বদলে যাওয়া সাজ-পোশাকে তপতীর কিন্তু খুব অস্বস্তি হতো বিয়ের পর- কেমন যেন লজ্জা করতো। ছোটোবেলা থেকে বাবা-কাকা- দাদা-মামা যাদের কোলে পিঠে বড়ো হয়েছে, কতো আব্দার, স্নেহ-খুনসুঁটির মাঝে বেড়ে উঠেছে। শ্বশুর বাড়িতে তাঁরা এলে বা শ্বশুর বাড়ির লোক তপতীর বাপের বাড়িতে এলে মাথায় আঁচল দিতে হতো- ঘোমটা টানা চলতি ভাষায়, খুব অস্বস্তি লাগতো, লজ্জা করতো, কেমন যেন পর পর মনে হতো, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারতো না। যে পাড়ায় ছোটো থেকে ফ্রক পরে ঘুরেছে, বড়ো হয়েছে, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করেছে, সেখানেই ঘোমটা টেনে ঢুকতে হবে সাথে ভাশুর বা খুড়শ্বশুর কেউ থাকলে। সঙ্কোচ-লজ্জা ঘিরে থাকতো ঘোমটার আড়ালে। অথচ মায়ের কড়া শিক্ষা বড়োদের সামনে ঘোমটা দিতেই হবে- না হলে না কি অপমান করা হয়। তাই আবার হয়! ঘোমটা দিলেই সম্মান করা হয়! আর ওই যে আপন-পর দ্বিধাবোধ! মন খুলে কথা বলতে না পারা, ওটাই না কি নববধূর ভূষণ- ধ্যেৎ, মনের আনন্দ তো গুলে কাদামাটি বিয়ের। তারপর সিঁদুর- বিয়ের সময় ঠিক ছিল- ফটো উঠলো বেশ কয়েকটা, ভালোই লাগলো। তবে চুলটা সেই যে লাল আর চটচটে হলো, মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়- রোজ না কি নিয়ম করে দুই বার সিঁদুর পরতে হবে, মনে থাকে না। যদিও বা মনে পড়ে, মনে হয় যেন কি এক পরাধীনতা- মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কখনো মনে হতো, আছে তো লাল হয়ে সিঁথি, না হয় থাক, আসলে নিয়ম করে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর অভ্যাসটাই তো নেই ছোটোবেলা থেকে কোনোদিন। তারপর স্নান করে ভিজে চুলে সিঁদুর লাগালে জলের মতো গড়িয়ে আসতো নাক বরাবর। জোকার মনে হতো। গরমের দিন হলে তো কথাই নেই-সোনায় সোহাগা, গড়াচ্ছে ঘামের সাথে নাকে-মুখে-চোখে, জ্বালা করতো খুব। ঠিক ওখানেই হাজার কথা- এয়োস্ত্রী মানুষ… সংসারের কল্যাণ, লক্ষণ। মানিয়ে নিয়েছিল মন। আর হাতের এক গয়না, সব রঙের সাথেই সাদা- লাল! একটু তো অদ্ভুত লাগতোই। কেমন যেন “মা… মা” ধরণ। তেলে-হলুদে-শাখা-সিঁদুরে-ঘোমটায়-পরাধীনতায় অন্য এক জীবন। তার সাথে বার-ব্রত-উপোস লেগেই আছে, আর আছে এই করতে নেই, ওই করতে নেই, আমাদের বাড়ির এই নিয়ম। মাঝে মাঝে একপেট খিদের সাথে এক ঝুড়ি প্রশ্ন তোলপাড় করতো শরীর মন। প্রশ্ন থেকেই যত বিপত্তি, উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো বিপত্তি। সবকিছুই যেন চাপিয়ে দেওয়া এক প্রথা, পরাধীনতার প্রতীক, আর পুরুষতান্ত্রিকতার বৃথা আষ্ফালন। যদিও সারবত্তা বদলে গেছে কালের প্রবাহে, প্রতীকগুলো বেঁচে আছে লোকাচারে, যাদের ওপর চাপানো হয়েছিল তারাই তো পরম বিশ্বাসে, ভরসায় এগুলো নিয়ে বেঁচে আছে, পরাধীনতার রক্ষাকারী হয়ে যুগ যুগ ধরে। তবু বলা যাবে না এইসব কথা, অগত্যা ভরসা ডায়েরি। মনের অশান্ত প্রশ্নগুলো লিখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শান্ত হবার চেষ্টা করে তপতী। বলা বারণ, মনের আগলে খিল দিয়ে রাখতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল আলাদা করে- ওটাই ভদ্রতা।
বিয়ের পর পর বাবার বাড়ি (হঠাৎ করে বাড়ির নাম, সংজ্ঞাও বদলে যায়) এসেও রেহাই ছিল না, স্নান করে সাথে সাথে সিঁদুর না লাগালে কাকি-মা-বৌদি কেউ না কেউ ধ্যাবড়া করে খানিকটা লাগিয়ে দিত। সাথে সাথে প্রবচন- “এতোদিনে তো অভ্যাস হয়ে যায়, তোর কবে হবে?” হয়ে গেল, এইভাবে অভ্যাস হয়েই গেল, তৈরী হয়ে গেল সাজানো বিবাহিত মন- আর লজ্জা করতো না শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে, আর ভুল হতো না দু’ বেলা সিঁদুর লাগাতে, আর বেমানান লাগতো না শাঁখা-পলার সাদা, লালের সাথে যে কোনো রঙের শাড়ি। সাজসজ্জার ধারা- ধারণায় আমূল পরিবর্তন, মনের খচখচানি শীতঘুমে অচৈতন্য।
মেঘে মেঘে বেশ বেলা- তপতীও এখন এক কন্যা সন্তানের মা। মেয়ে তিয়াস বড়ো হয়েছে- স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি পড়ুয়া। ছোটো থেকেই শান্ত, ধীর মেয়ে কিন্তু স্বাধীনচেতা। নিজস্ব মতামত, আর মতামতের পক্ষে যুক্তি নিয়ে আলোচনা করে তপতীর সাথে। তপতীর নিজের না বলতে পারা কথাগুলো ভাষা পায়, ভাবনাগুলো আকার পায়, প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে নেয় চুপিচুপি। খুব ভালো লাগে তপতীর, বাধা দেয় না- নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা কিন্তু ভেতর ভেতর সমাজের অনেক রীতি নীতি নিয়ে বেশ প্রতিবাদী। ব্রাম্ভ্রণ্য প্রথা, সমাজের শ্রেণীভেদ, জাতিভেদ, ধর্মীয় ধ্বজা, দেশীয় লোকাচার সব কিছুতেই যুক্তি খোঁজে- পায় না। খুঁজতে থাকে শিকড়- শিকড়ে গিয়ে দেখে হাজার গড়মিল আর সুবিধাবাদ। প্রতিবাদের মেঘ ঘোর হয়ে আসে মনে, নবীন ভাবনায়। কিন্তু সবকিছু যে প্রতিবাদে মেটে না- তাই তো আরো অশান্ত হয় মন।
শরতের মেঘের মতো রোদ-বৃষ্টিতে পুড়তে থাকে, ভিজতে থাকে। অসহায় তপতী- বুঝতে পারে না, কি করবে! তার সম্পূর্ণ সমর্থন থাকলেও সাহায্য করার ক্ষমতা তো নেই!
একদিন তপতী স্নান সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্যাসবশত সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়াতে যাবে তিয়াস এসে ঢোকে ঘরে।
মা’র দিকে তাকিয়ে আজ আর চুপ করে থাকতে পারে না- সিঁদুর কেন পড়ো মা রোজ? জানো না এর ইতিহাস, আর উদ্দেশ্য! তোমার ডায়েরিতে কত কিছু লিখেছো, কতো প্রশ্ন রেখেছো, উত্তর খুঁজতে চেয়েছো। তুমি তো নিজেও জানো মা, তা’ও কেন মেনে নাও এই পরাধীনতার নির্লজ্জতা, ঘৃণ্য প্রতীক। প্রয়োজন তো নেই কোনো। তুমি সিঁদুর, শাঁখা পরার সাথে সংসারের কল্যাণ- অকল্যাণ, বাবার ভালো থাকা নির্ভর করে না, তা’ও কেন রোজ এইসব নিজের ওপর চাপিয়ে নাও। নিজের সম্মান নিজে রক্ষা করতে না পারলে- তুমিও তো গতানুগতিক এক ধারায় চলবে, একই ভাবে চলতে থাকবে প্রত্যেকটা প্রজন্ম- কেন মা, কেন?
তপতী হেসে বলে- অভ্যাস হয়ে গেছে রে সোনাই। “সোনাই” তপতী এই নামে ডাকে,তিয়াসকে।
-কিসের অভ্যাস মা?
-মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস, মেনে নেওয়ার অভ্যাস।
-যে অভ্যাস তোমাকে রোজ প্রশ্নের মুখে নিয়ে আসতো, সেই অভ্যাস আরো কতদিন মা?
-এতোদিনের অভ্যাস কি পিছু ছাড়ে সোনাই এতো সহজে?
-কিছু বলার নেই… কি করে যে সব জেনেও এইভাবে নিজেকে ছোটো করতে পারো কে জানে!
-এখন এই বোধ আর কাজ করে না রে, একটা অভ্যাস শুধু। ছাড় এইসব, অন্য কিছু বল… কি করবি আজ? কখন বেরোবি?
-সবসময় কথা ঘোরানোর চেষ্টা… একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে তিয়াস ঘর ছাড়ে। তপতী আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে, হাসে… অতীত অন্য কিছু দাবি রাখলো, ভবিষ্যত অন্য কিছু দাবি করছে। বর্তমান! বুঝতে পারে না…সংসারের অন্য কাজে মন দেয়।
তবে একটা শৃঙ্খল থেকে মনকে আংশিক মুক্ত করতে অজুহাত সাজিয়েছে। শাঁখার ভীষণ দাম, কাজের হাত, যখন তখন বেড়ে (ভেঙে গেছে বলা না কি বারণ- বলতে নেই) যায়। ওটা তোলা সাজ করে রেখেছে, ইচ্ছে মতো, দরকার মতো গলিয়ে নেয়।
দামের কথায় সব মানিয়ে যায় সংসারে, সে যদি হয় ঘরের বৌয়ের প্রয়োজনের তালিকা তো দ্বিতীয় বার আর কেউ ভাবে না। সেই সুযোগটাই নিয়েছে তপতী। অবশ্য ওর স্বামীর এইসব ব্যাপারে কোনো মতামত নেই, বক্তব্য নেই- নির্লিপ্ত মানুষ। যদিও তাতেও অসুবিধা হাজার- যত ঝামেলা তপতীকেই সামলাতে হয়। তিনি শুনবেন না, বুঝবেন না কিন্তু “মানিয়ে নিতে” বলতে ছাড়বেন না- ওতেই না কি সব সমস্যার সমাধান। হায় রে কপাল!
দিন যেমন চলে- চলছিল। কখনো এর মন রেখে, কখনো ওর মন রেখে। নিজের মন? সে তো ঘুমিয়েছে না হারিয়েছে- সময় কোথায় ভাবার? কালের চাকায় সময় ঘুরে যায়, ঘুরতে থাকে।
কালের নিয়ম মেনে হঠাৎ করেই তপতীর বাবা একদিন চলে গেলেন এপারের মায়া কাটিয়ে। মা’কে দেখলো তপতী শেষবারের মতো- মায়ের প্রিয় সাজে। দু’বেলা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে কাচা কাপড়, সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে ছোট্ট সিঁদুর টিপ। নিত্যদিনের সাজ হোক বা পুজো থেকে বিয়ে বাড়ি, যে কোনো অনুষ্ঠানে মা-র ওই এক সাজ- অন্য কোনো সাজে কোনোদিন দেখেনি মা’কে। ওটাই যেন মা’র প্রতীক।
বদলে গেল এতোদিনের সাজ এক নিমিষে। চিরদিনের চুপচাপ, কম কথা বলা মানুষটা শোকটাও কেমন নিঃশব্দে পালন করলো। কপালে টিপ নেই- মায়ের এমন মুখ খুব কষ্ট দিচ্ছিল তপতীর মনে।
মুখাগ্নি, অশৌচ, শ্রাদ্ধ সব মিটলো একে একে। এ কয়দিন তপতীও সিঁদুর পরেনি- পরতে নেই না কি…এমন কথাই সবাই বলেছে- তাই পালন করেছে। নিয়মভঙ্গের দিন ব্রাম্ভ্রণের পায়ে তেল-হলুদ দিয়ে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে চিরুনি নিয়ে শুনলো কাকিমা বলছে মা’কে- এবার কদিন চলুন আমাদের কাছে থেকে আসবেন। কোনোদিন তো কোথাও গেলেন না দাদার কষ্ট হবে বলে। এবার একটু ঘুরে আসবেন চলুন। ভালো লাগবে, একটু পরিবর্তন হবে।
মা বললো- আমাকে আর বেরোতে বলিস না রে, এইভাবে কারোর সামনে যেতে পারবো না। আসল সাজটাই লোকটা সাথে নিয়ে চলে গেল- খালি কপাল, খালি সিঁথি নিয়ে কোথায় যাব বল? আমি এখানেই থাকবো… বাকি কটা দিন, যে কদিন বাঁচি, বাইরে বেরোবো না।
অশৌচের পারলৌকিক আচার-বিচারে বেশ কদিন সিঁদুর না পরায় তপতীর সিঁথিও ফাঁকা। হাতে চিরুনি নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাবতে লাগলো- সাজ না পরাধীনতা, তর্ক না বিশ্বাস, ভালোলাগা না মানিয়ে নেওয়া… কোনটা আসল পথ?
মায়ের কাছে যে সাজটা পরম সম্পদ, তা নিয়ে কি তর্ক চলে! মানবিকতা তো এইসময় সেই সায় দেয় না। কিন্তু তিয়াস! ওর যুক্তি তো ফেলে দেবার নয়- ও তো আত্মসম্মানের কথা বলে…
হাজার প্রশ্ন আর দ্বিধা নিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে সরে এলো আয়নার সামনে থেকে।
পরাধীনতা না কি এয়োস্ত্রীর সাজ একরাশ দ্বিধা নিয়ে সংসারের কাজে, কর্তব্য সারতে সমাজের ভিড়ে মিশে গেল সাজানো হাসি মুখে নিয়ে দ্বিধা সীমন্তিনী।পেরিয়ে গেল বছর দুই, আড়াই- মা চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত মা সত্যিই বাড়ির বাইরে পা রাখেন নি। শান্ত মানুষের জেদ বোধ হয় এমন নীরব আর কঠিন হয়। তপতী আবার একবার প্রিয়জন হারালো, সংসার ছোট হয়ে আসছে যেন দিনে দিনে। মনের গভীরে ডুব দিয়ে দিন কাটে- শত কাজের মধ্যেও মনে হয় মা’র সাথে কথা হলো না আজ,এমনই হয় মনে হয় সবার মা,বাবা-র ছায়া জীবন থেকে সরে গেলে।
চলছিল জীবন বাঁধা গতে- হঠাৎ করেই ছন্দপতন। অফিস থেকে ফেরার পথে কথা বলেও বাড়ি এলো না। দমকা ঝড়ে নিভে গেল প্রাণপ্রদীপ- তপতী সেদিন হারিয়ে গেছিল নিজের পূর্বজীবনে যেখান থেকে একসাথে পথচলা শুরু সেইদিনে। বিশ্বাস তো দূর কথা ভাবতেও পারছিল না মানুষটা নেই। শুধু পাথরের মতো দাহকার্য, অশৌচ বিধি পালন করে গেল। অশৌচবিধি শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি দিয়ে অভ্যাসমতো সিঁথির দিকে তাকিয়ে সিঁদুরে হাত দিতে গিয়ে থমকে গেল। আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে অচেনা লাগছিল। নিজের মুখ নিজেই সহ্য করতে পারছিল না। আয়নার সঙ্গে খুব একটা সদ্ভাব কোনোদিনই তপতীর নেই। তবে যেতে আসতে চোখ পড়ে গেলে মনে হতো নেই, আর কোনো সাজ নেই। জীবনটা বদলে গেল। ডায়েরি হাতে নিল এক বছর পর। পুরোনো লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে উজাড় করে প্রশ্নের ভিড়… না কোনো তর্ক নেই, শুধু একটাই প্রশ্ন এইভাবে কি সত্যিই হারিয়ে যায় অভ্যাস! বদলে যায় বিশ্বাস? সব দ্বিধা কি এমনভাবেই কাঁদতে বাধ্য করে? জানা নেই- তপতীর কাছে অনেক প্রশ্ন, উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
-
গল্প- অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
সুনির্মল বসুলোকটাকে সব বাচ্চারাই ভারী ভয় পেত। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা একটা বাঙালি শার্ট। পরনে ধুতি। বাঁ হাতে একটা ছোট বাক্স। ডান হাতে সর্বক্ষণ একটা ধূমায়মান সিগারেট। অদ্ভুত তাঁর সিগারেট টানার ভঙ্গি। ছোটখাটো চেহারা। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। একটু মোটা গোঁফ। মাথার চুল কাঁচা পাকা হলেও, গোঁফটা একেবারে কুচকুচে কালো।
পথের মোড়ে তাঁকে দেখা গেলেই, সবাই বলতো, অ্যাই পালা, ভগবান আসছে।
সে আসলে পেশায় নাপিত নাম- নরসুন্দর ভগবান দাস। পাড়ার লক্করবাজ চ্যাংড়ারা বলতো, ভগবান দাসের ইটালিয়ান সেলুন। ইটের উপর বাচ্চাদের বসিয়ে ভগবান চুল ছেঁটে দিত। মাথার সামনের দিকে ফুলের মতো
সামান্য বড় চুল রেখে, বাকি পেছনের অংশে সবটাই সে জল দিয়ে হাতের যন্ত্রপাতির সাহায্যে সবটাই চেঁছে দিত।ভগবানের বাড়ি বালিয়াতে। ওখানে ওর বউ দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকে। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ের নাম দুলারী। হবু জামাইয়ের খেতির কারবার আছে। বড় ছেলে জীবনলাল হাটে সবজি বিক্রি করে। ছোট ছেলে পবনলাল সিক্স ক্লাসে পড়ে। সপ্তাহে সপ্তাহে ভগবান পরিবারের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠায়। সে বছরে দুবার বাড়িতে যায়। তখন সবার জন্য কলকাতা থেকে নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে যায়। দিন পনেরো থেকে আবার এখানে কাজের জায়গায় ফিরে আসে।
যখন ছোট ছিলাম, ভগবান নির্বিচারে আমার চুল কেটে দিত। খুব মন খারাপ হতো আমার। চুল বড় থাকলে, মা বলতেন, তুই বড় চুল রাখছিস, দাঁড়া,তোর বাবাকে বলবো? বড় হবার পর,আমার নিজের বড় চুল রাখবার পেছনে আসল প্রতিবাদ ছিল সেখানেই। কিন্তু সেই ছোট্টবেলায় লোকটাকে খুব সমীহ করতাম।
দুষ্টুমি করলে, মায়েরা বলতেন, ভগবানকে ডাকবো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বেশি বেশি ভাত খেতে হতো।মা হেসে বলতেন, এইতো সবটা খেলি। কার পেট ভরলো, আমার না তোর?
তখন একটু বড় হচ্ছি। ক্লাস এইটে পড়ি। ইটের উপর বসে আছি। পাশে বাবা দাঁড়িয়ে ভগবানকে বলছেন, কেটে ছোট করে দাও। কানের উপর চুল, সখি সখি ভাব, আমার মোটেই পছন্দ নয়। ভগবান মনে মনে খুশি হচ্ছে। চুল ছোট করায় তাঁর বড় আনন্দ। একটু বড় হতেই, চুল কাটতে কাটতে ভগবান আমাদের অনেক নীতি শিক্ষা দিত।একদিন আমাকে বলল, বাবু, জীবনে ঘোড়ার মতো হবে, কখনো গাধা হবে না।
-কেন?
-সোসাইটিতে গাধার কোন মান সম্মান নেই। হ্যাঁ, যদি ঘোড়া হতে পারো, তাহলে লোকের কাজ থেকে রেসপেক্ট পাবে।বাংলায় কথা বলবার সময়, ভগবানের ডায়লগে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ বেরিয়ে আসতো। তার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। বাটা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মিঃ বারতোস থেকে শুরু করে মিঃ ওয়াটসন, মিস্টার চিচেক ভ্যালেন্টা, মিঃ ভেরোল, মিঃ লেডেন, মিঃ জন বেক, মিঃ ভবতোষ সেন চৌধুরী, মিঃ ভি, লিপনার, সবাই চুল, দাড়ি কাটবার জন্য ভগবানের শরণাপন্ন হতেন। ভগবান তখন সাহেবদের বাড়ি উপস্থিত হয়ে তাঁদের চুল দাড়ি কামাতেন। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ ভগবানের মুখে উচ্চারিত হতো। মুড ভালো থাকলে, ভগবান তাঁর ছেলেদের গল্প শোনাতো। বড় ছেলে বেশি লিখাপড়া করেনি। ছোট ছেলেকে শেষ পর্যন্ত লিখাপড়া করাবার ইচ্ছে ভগবানের।
দিন বদলে গেল। সত্তর দশক এলো। যাদের এক সময় চুল কেটেছে ভগবান, তারা বড় হয়ে গেল।
কলেজে পড়তে গেল। কেউ কেউ মস্তান হিসেবে পরিচিত হলো।হেবো মাস্তানি করে পয়সা করলো। তাঁর কোমরে দেশি পিস্তল সব সময় গোঁজা থাকে। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে রিভলবার নাচায়। সে এখন এই অঞ্চলের ত্রাস। একলা পুলিশ তাঁর মুখোমুখি হতে চায় না। ওসি সুবর্ণ সরকার একদিন জীপ থেকে নেমে বলেছিলেন- বড্ড তেল বেড়েছে দেখছি তোর। খুব জলদি তোকে তুলে নেব।
হেবো রিভলবার নাচিয়ে বলেছে- আগের ওসিও ওই এক ডায়লগ দিয়েছিল। আমার সামনে কোনদিন খাপ খুলতে পারে নি।
একদিন হেবোর সঙ্গে মুখোমুখি ভগবানের দেখা।ভগবানের ঘাড়ে হাত রেখে হেবো বললো- কেমন আছো গুরু?
ভগবান ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললও-তোর বাপ আমাকে দাদা বলে ডাকে, ছোটবেলায় আমাকে দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলতিস, এখন আমাকে গুরু বলছিস? আচ্ছা, কলিকাল!দেশে অস্থিরতা শুরু হল। কোম্পানি ছোট হয়ে আসছে। কর্মীদের ছাটাই করে দেওয়া হচ্ছে। চুল দাড়ি কেটে নিজে খেয়ে বাড়িতে আর টাকা পাঠানো যায় না। খুব বিপদে পড়ে গেল ভগবান।
তারপর একদিন আমাদের মফস্বল শহর ছেড়ে নিজের দেশের বাড়িতে চলে গেল। আমরা কেউ ভগবানকে মনে রাখি নি। প্রথম প্রথম কয়েকদিন চায়ের ঠেকে ভগবানকে নিয়ে আলোচনা হতো। তারপর স্মৃতির পাতা থেকে ছোটবেলার সেই ভয় পাওয়া মানুষটাকে আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম।
বেশ কয়েক বছর পর আমি তখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বালিয়াতে ব্রিজ বানাবার কাজে গিয়েছি। অনেকদিন ধরে কনস্ট্রাকশন এর কাজ চলছিল। একদিন হঠাৎ দেখি, ভগবান রাস্তা ধরে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। ওর পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। পায়ে ছেঁড়া চটি। পরনে ময়লা পোশাক। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
ভগবান আমাকে চিনতে পারেনি। আমি চিনতে পেরেছিলাম। সামনে গিয়ে বললাম- ভগবানদা, কেমন আছো তুমি?
-ভালো নেই। বউ মারা গেল। ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে হাওয়া।
-আমাকে চিনতে পারছো?
-হা হা। তুমি ফোরম্যান দত্ত বাবুর ছেলে।
– তোমার সংসার কিভাবে চলে?
-হাত কাজ নাই। কাজ করবার সামর্থ্য নাই। বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি। ভগবানের কন্ঠে অসহায়তার সুর। আমার মনে পড়লো, সেই ছোট্টবেলায় আমরা সবাই এই মানুষটাকে দেখলে, ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে যেতাম।-তোমাকে কেউ দেখে না?
-মেয়ে দ্যাখে।
ছেলেরা?
-আরে না না। আমি ছেলেদের পড়ালিখার জন্য পয়সা খরচা করেছিলাম। মেয়ের জন্য কিছু করিনি। আমি চারটে পাঁচশো টাকার নোট ভগবানের হাতে গুঁজে দিলাম।ভগবান বললো- আমার কথা মনে আছে তাহলে! তুমি ঘোড়া হয়েছো, ভাগ্যিস গাধা হওনি! তারপর খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির দিকে গলির প্রান্তে মিলিয়ে গেল। সেই শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ আজ আমার সঙ্গে কেমন আশ্চর্যভাবে আমাকে দেখা দিয়ে গেলেন। সেদিনের ভগবানের আশ্চর্য দাপটের সঙ্গে আজকের মন ভেঙ্গে যাওয়া মানুষটার কিছু মাত্র মিল, আমি দেখতে পেলাম না।
মহুয়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি জীবনের প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হলাম। সময়, কাকে যে কিভাবে জীবন যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না।
ভগবান গলির মোড়ে মিলিয়ে যেতেই, আমি কেমন ঘোরের মধ্যে নিজের মনে বলে ফেললাম, ভালো থেকো, তুমি ভালো থেকো, ভগবানদা।তারপর মনে মনে আবার বললাম, তোমাকে ভালো থাকতেই হবে, তা না হলে, তোমরা চলে গেলে, আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সেই সঙ্গে চলে যাবে যে!
-
গল্প- একা’দশী তিথি
একা’দশী তিথি
-সুবিনয় হালদারচতুর্থ প্রহর শেষে ঊষালগ্নে উদ্ভাসিত হতে থাকে পৃথিবী।
নিশি সমাপন মুহূর্ত জানান দেয় পাখিদের সমবেত কিচিরমিচির ডাক আর আজানের আওয়াজ।
মা’ ষষ্ঠীর শঙ্খধ্বনিতে সকাল-সকাল তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে নেয় একা’দশী, আজ তার আর্য্য-ভূমিতে সংস্কৃতি যজ্ঞের পৌরোহিত্য করতে হবে।
সেখানে তার পরিচিত বহু মানুষজন আসবে, নমোনমো দুগ্গাদুগ্গা করে আত্মপ্রত্যয়ে বেড়িয়ে পরে একা’দশী।সেখানেই সেদিন প্রথম দেখা- তিথি ; পঞ্চমীদির সাথে ছোটবোন দ্বিতির হাত ধরে এসেছিল ওখানে।
দিদি’ই তাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়-, বাক্য বিনিময় হয় সামান্য কিছু- ব্যাস এইটুকু।
তারপর ধীরেধীরে দামোদরে জোয়ার আসে! কোটালে ভেসে যায় সবকিছু কিন্তু তিথি সেটা বোঝেনি কখনোই!
তবুও আসে, জানান দেয় সে আছে !
তিথির মেজ বোন অষ্টমী খুব সুন্দরী। মনে সংগোপনে লালিতপালিত কামিনীকাঞ্চন শোভিত যা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষীত !
আসাযাওয়া গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে। দিন যায়- বছর ঘুরে বছর আসে আর যায়- ; উত্তর থেকে দক্ষিণায়ন অতিবাহিত হয় কত কিন্তু উত্তর মেলেনি আজো !বসন্তের পরন্ত বৈকালে ঝরাপাতায় ফাগুন হাওয়ায় মর্মরধ্বনির সাথে কোকিলের ডাক শুনে নেচেছিল মন !
চেতনা পুরে প্রেরণা’ এসে জাগিয়েছিল সাদা খামে হলুদ ছোঁয়ার অনুভূতি !
তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিলো- এক মায়াবী আলোর উৎস সন্ধানে ;
তার’ই জন্যে সে অপেক্ষা করছিলো- অনেকটা সময় ধরে, রাস্তার পাশে গাছের তলায় এক যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে।
পথচলতি কত মানুষ- কত ব্যস্ততা- বাস গাড়ির হর্ণ এর বিকট আওয়াজ- দুষিত আবহাওয়া- সব কিছু উপেক্ষা করে !
সমস্ত বাধা অতিক্রম করে হন্তদন্ত হয়ে ঘামে-নেয়ে একসা শরীরে একা’দশী তিথির সামনে দাঁড়ালো- ;
অন্যমনস্ক তিথি যেন রূপকথার দেশে মায়াবী পরী,
কী বলবে- ও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলো-না !সুন্দর পরিপাট্য বেশভূষায় বেশ লাগছে ।
একা’দশীকে এইভাবে বোকা স্ট্যাচুর মতো হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো- চলো- অনেক দেরি হয়ে গেছে ! বলে সটান রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে থাকলো !
একা’দশী তখন ওর কাছে গিয়ে আলতো স্বরে বললো- তোমাকে-না আজ খুব সুন্দর লাগছে ।
ধ্যাৎ,মোটেই না- ; কী-যে বলো-না- আজকাল ; বলে- শরৎ মেঘের ওড়না উড়িয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে চললো-,
অগত্যা সে-ও ওর পিছু-পিছু হাঁটতে থাকলো !মোড়ের বাম দিক ঘুরে একটু এগিয়ে একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করলো । ও কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে বললো- ওঠো ;
একা’দশী আগে উঠে বসার পর সে তার একেবারে পাশে- গায়ে গা-ঠেকিয়ে গেটের দিকে বসলো ।অটোরিকশা চলতে থাকলো একা’দশীর নাজানা গন্তব্যে !
হাওয়ায় তিথির চুল গুলো ঠোঁট স্পর্শ করে উড়ে এসে পরছে একা’দশীর মুখে আর তিথির মেয়েলি গন্ধে তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে এক পারিজাতের নরম স্নিগ্ধতা ভরিয়ে দিচ্ছে !
তার শাড়ির আঁচলটা বারবার উড়ে এসে ওর মুখমণ্ডলটা ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে কেউ যেন একটা কাশফুল দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে !তিথির ঘোরে আচ্ছন্ন একা’দশী শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকে ! হাল্কা লাজুক হাসি আর চোখেমুখে উজ্জ্বল আভার উপস্থিতি ভরে উঠেছে তিথি ।
কোন কথা বলছেনা দেখে সে জিগ্যেস করতে যাবে- ঠিক সেই সময় তিথি বলে উঠলো- এই দাঁড়াও- দাঁড়াও এখানে ।নেমে পড়লো দুজনে । ভাড়াটা বের করার আগেই তিথি চালকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে একা’দশীর দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় বললো- চলো- সামনের ওইখানে আমরা যাবো !
দেখলো দূরে একটা বড় বিল্ডিং আর তার গেটের বাইরে ইংরেজিতে লেখা- The Asylum .
-
গল্প- আনন্দ পার্বণ
আনন্দ পার্বণ
-সুমিতা দাশগুপ্ত
ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারলাম, সদা পরিবর্তনশীল এই সময়ে , প্রবচনটিকে বোধহয় একটুখানি শুধরে নেওয়াই যায়।আজ বোধহয় বাঙালি নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, উঁহু ,আর তেরো নয় , গোটাগুটি চোদ্দোটি পার্বণের গৌরবময় উপস্থিতি বাঙালির পার্বণ লিষ্টিতে। সেই সানন্দ সংযোজনটি হলো বই -পার্বণ, পৌষ পার্বণের পিছু পিছুই যার সগৌরব উপস্থিতি। আপামর বঙ্গসন্তানদের সে বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন।
পিকনিক, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ইত্যাদি শীতের সাতকাহনের মাঝেই হৈ হৈ করে বইমেলার রব উঠে পড়ে।
লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী,প্রুফ রিডার, ছাপাখানা মায় বাঁধাই কর্মী, ভ্যান গাড়ি কারুরই আর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। ওদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হেথা হোথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাঁশ, কাঠের তক্তা, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে থাকে ছোট বড়ো নানা আকারের স্টলে। কথ্যভাষায় স্টল বটে, আদতে সেগুলি বুঝি সুন্দর লাল নীল কাপড়ে মোড়া, অজস্র মণিমুক্তো ঠাসা মণিমঞ্জুষা। দেশী বিদেশী বিদগ্ধ পন্ডিতজনের মণীষায় উজ্জ্বল, নানা আকারের পুঁথিপত্তরের পাশাপাশি নব নবীন সমস্ত লেখকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাস্বর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গৌরব এই বইমেলা। সমগ্র বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন মহাসমারোহে বই উৎসব পালিত হতে দেখা যায়।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু ওলটালেই দেখা যায় বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্র্যাংকফার্টে।আজও সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা বলে পরিগণিত ।আন্তর্জাতিক স্তরেও আকারে এবং চরিত্রে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখে সেটি। সেই তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে, বাঙালি যা পেয়েছে তাতেও সে অখুশি নয় মোটেই। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাঠকের উপচে পড়া ভীড় তার সাক্ষ্য দেয়। ওই ক’টা দিনে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জীবনের যতো অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা ,বুঝি ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। সম্বৎসর মনের মাঝে জমানো যতো বইয়ের নাম ছিলো, সেগুলিকে ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, সে পকেটে রেস্তর জোর থাকুক চাই নাই বা থাকুক। পুস্তকপ্রেমী এই সুযোগ কি ছাড়তে পারে! এবারে হয়তো কেনা হলো না, সামনের বার নিশ্চয়ই হবে, এই আশাই, আগামী দিনে পথ চলার পাথেয়। আসলে আমরা যখন বই সংগ্রহ করি তখন তো শুধু বই নয়, আমরা আনন্দও সংগ্রহ করি।
বিগত বেশ কয়েকটি বছর বইমেলা যাওয়া, হয়ে ওঠে নি, এই বছর আকস্মিকভাবে সেই সুযোগটি এসে গেল। ভিড়ের মাঝে নয়, কিঞ্চিৎ ফাঁকায় দুপুর দুপুর সেরে ফেলার সংকল্পে বেলাবেলি পৌঁছনো গেল। তখনই শুরু হয়ে গেছে নামকরা প্রকাশনার স্টলগুলোতে, আবালবৃদ্ধবনিতার লম্বা লাইন। কেনার পাশাপাশি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহও কিছু কম নয়। শিশুদের ঝলমলে মুখ, তরুণ প্রজন্মের সদ্য প্রকাশিত বইসমূহ উল্টেপাল্টে দেখার পাশাপাশি, প্রাজ্ঞ ও বয়স্কজনের তালিকায় থাকা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমন্বিত গুরুগম্ভীর পুস্তক সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে মনে হয়, বাঙালির যে দিন গেছে, তার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি, কিছু তো আছেই,যার খবর আমরা রাখি না।
মনে রাখতে হবে এই মেলা কেবলমাত্র লেখকের নয়, বছরের পর বছর ধরে সে নবীন পাঠকও নির্মাণ করে এসেছে, আজও করে। বাবা, মা, অভিভাবকদের হাত ধরে আসা শিশু কিশোরের দল, উত্তেজনায় ভরপুর তাদের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি, সেই সাক্ষ্য দেয়।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বভারতীর ফাঁকা স্টল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিলো। । এই বছরে সেখানে উপচে পড়া ভীড়, চিত্তে শান্তির প্রলেপ দিলো। স্টলের নিভৃত কোণটিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এরা শুধুই ঘর সাজানোর সামগ্রী সংগ্রাহকদের দলভুক্ত, না-কি হুজুগে মাতামাতি করা,”পাবলিক”!
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, অথবা যৌবনের প্রান্তসীমায় দন্ডায়মান, কিছু এলোমেলো পোশাকের যুবকের , হাতের লিস্টি মিলিয়ে বই সংগ্রহের ছবি ,আমায় আশ্বস্ত করলো, বুঝিয়ে দিলো আমার সে আশঙ্কা মিথ্যে করে এঁরা প্রকৃতই পাঠক শ্রেণীভুক্ত।
হেরে যাওয়াও যে কখনো সখনো এতো আনন্দদায়ক হতে পারে, তা কে কবে ভেবেছে!
এই যে নানা আলোচনায় শুনি বাঙালি আজকাল আর বই পড়ে না, সেকথা সর্বৈব সত্যি নয় তাহলে ! বাঙালির সব কিছুই হারিয়ে যায়নি একেবারে।
আমার নিজস্ব সংগ্রহের তালিকায় থাকা , এবং ভালোবাসার জনদের উপহার দেবার জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়ি।
সূর্য আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে। ভিড় বাড়ছে। ঠেলাঠেলি এই বয়সে আর পোষায় না।
দুপাশে স্টলের সারি, মধ্যিখানে সোজা রাস্তা। খানিকটা এগোতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়তেই, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধুলোমাখামাখি রাস্তার ঠিক মাঝ মধ্যিখানে বসা বছর ছয়েকের একটি শিশু , অভিভাবকদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সদ্য সংগৃহীত ছড়ার বইখানি পথের মাঝে খুলে রেখে , তার উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। আশেপাশের ভীড়ের দিকে তার হুঁশ নেই।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রই।
অবধারিত রবীন্দ্রনাথের পংক্তিতে ছেয়ে যায় মন। —
“শুধায়ো না কবে কোন গান,
কাহারে করিয়াছিনু দান—
পথের ধুলার পরে
পড়ে আছে তারই তরে
যে তাহারে দিতে পারে মান।
তুমি কি শুনেছো মোর বাণী
হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি ?
জানি না তোমার নাম,
তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি। “ -
গল্প- কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
-সুনির্মল বসুঝাউবন পেরিয়ে সামনে নীল সমুদ্র। রঞ্জনা বিয়ের পর এই প্রথম স্বামী অনিকেতের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।
সামনে ধূ ধূ বালিয়াড়ীর ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছিল। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।
অনিকেত রঞ্জনার হাত ধরেছিল। বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে রঞ্জনার শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছিল।
অনিকেত কম কথা বলা মানুষ।
রঞ্জনা বলল, কি মশাই, একেবারেই চুপচাপ যে,
অনিকেত বলল, সমুদ্র দেখছি, বড়র সামনে এলে,
মুখে ভাষা আসে না।
রঞ্জনা বলল, সমুদ্র কত পুরাতন, কত নতুন,
আমাদের আগে কত মানুষ এখানে এসেছে, কত মানুষ ফিরে গিয়েছে, সমুদ্র একই রকম আছে।
অনিকেত বলল, আমরা একদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না, সমুদ্র থাকবে।
রঞ্জনা তাকিয়ে দেখল, দূর সমুদ্রের ধারে কিছু
নুলিয়ারা একটি দাঁড়িয়ে থাকা নৌকোর পাশে ব্যস্ততার সঙ্গে নিজেদের কাজ করে চলেছে।
সমুদ্রের পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানে ওরা চা খেতে এলো।
তখন পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠে একটা ডাক এলো, এই অনিকেত,
পেছন ঘুরে অনেকেত দেখল, রিমঝিমকে। সঙ্গে একজন সুদর্শন যুবক।
রিমঝিম পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাসবেন্ড
পার্থ, আর এ হোল, অনিকেত। আমার কলেজ লাইফের বন্ধু।
অনিকেত রঞ্জনার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল।
অনিকেতের মনে পড়ছিল, এই সেই রিমঝিম, যে একদিন ওকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল। পরে অনিকেত জানতে পেরেছিল, বাবার মনোনীত বড়লোক পাত্র পেয়ে, তাকেই বিয়ে করেছে রিমঝিম।
ভালোবাসা আজকাল বড় সস্তা হয়ে গেছে। আর অনিকেত অংক করে ভালবাসতে শেখে নি।
সেদিন কত কথা ছিল ওদের।
কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে, গোলদীঘির পাড়ে প্রতিদিন দেখা হতো ওদের।
রিমঝিম বলেছিল, তোমাকে না পেলে, আমি মরে যাবো, অনিকেত।
কী মিথ্যে, কী মিথ্যে,
সেদিনের রিমঝিমের সঙ্গে আজকের এই সুখী রিমঝিমকে একটুও মেলানো যায় না।
রিমঝিম সত্যিই কি সুখী হয়েছে। নাকি, সুখে থাকার অভিনয় করছে। একটা মানুষের কত অসংখ্য মুখ থাকে।
আজকে ওই ভালোবাসাকে প্রবলভাবে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, অনিকেতের।
রিমঝিম জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছো,
রঞ্জনা বলল, হোটেল তরঙ্গমালায়। আপনারা একদিন আসুন না।
পার্থ বলল, যাবো কাল সকালে,
অনিকেত চুপ করে ছিল। ও কিছুতেই রিমঝিমকে আর সহ্য করতে পারছিল না।
তখন আকাশে একটি দুটি তারা ফুটেছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। পার্থ রিমঝিমকে বিদায় দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এলো।
পরদিন রিমঝিম স্বামী পার্থকে সঙ্গে করে, অনিকেতের সঙ্গে দেখা করতে এলো।
রিমঝিম বলল, কবে বিয়ে করলে, জানাওনি তো,
অনিকেত বলল, চাকরি পাবার বছর তিনেক বাদে
বাবা মা বিয়েটা দিলেন।
ও, ভালো, তোমার বউ তো খুব সুন্দরী হয়েছে।
আমি একটা সুন্দর মন খুঁজেছিলাম,
পার্থ তখন টিভি চালিয়ে খেলা দেখছিল।
রঞ্জনা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল।
রিমঝিম বলল, আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছো না কেন, অনিকেত। দেখছি, আমার উপর থেকে তোমার রাগ এখনো পড়েনি।
অনিকেত জবাব দিল না।
রিমঝিম বলল, কি, আমার কথার উত্তর দেবে না,
অনিকেত বলল, আমি সত্যিকার ভালোবেসে ছিলাম, আমি কাউকে ঠকাইনি। যে ভালোবাসা নিয়ে একদিন খেলেছিল, সে ঠকেছে।
রঞ্জনা ওদের মিষ্টি ও কফি পরিবেশন করলো।
বলল, ওর কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি, রিমঝিম।
এ কথার কোন উত্তর দিল না রিমঝিম। মনে মনে অনুভব করল, সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে,
একদিন সেই ভালোবাসার জন্য কাঁদতে হয়। সেদিনের জয়, আজ এত পরাজয়ের বার্তা এনে দেবে, রিমঝিম কোনো দিন সে কথা ভাবেনি।
মিষ্টি কফি খাবার পর, পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে
শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করছিল।
একসময় ওরা বিদায় নিল। যাবার আগে, পার্থ অনিকেত আর রঞ্জনাকে ওদের লেকটাউনের বাড়িতে যাবার নেমন্তন্ন করেছিল।
গভীর রাতে, রঞ্জনা বলল, রিমঝিমের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে,
অনিকেত বলল, একেবারে না। আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু গোপন করিনি।
রঞ্জনা বলল, ভালোবাসা আর ঘৃণা পাশাপাশি থাকে, দেখলে, রিমঝিম তোমাকে দেখাবার জন্য কেমন পার্থকে নিয়ে ঢলাঢলি করছিল।
অনিকেত বলল, যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে ভালোবাসা দেখাবার জন্য এমন আদিখ্যেতা দেখাতে হয়।
রঞ্জনা বলল, ওদের বাড়ি লেক টাউনে একবার যাবে নাকি,
অনিকেত বলল, কক্ষনো না। রিমঝিম শুধু আমার বিশ্বাস ভাঙ্গেনি, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে খেলা করেছে,
বিকেল বেলায় ওরা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মোহনার কাছে অনিকেত আর রঞ্জনা চলে এসেছিল।
বিশ্রামের জন্য ওরা একটা দেবদারু গাছের নিচে
দাঁড়ালো। রঞ্জনা দেখলো, ওদের পায়ের কাছে অনেক লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল কাঁকড়া গুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, আবার গর্তে ফিরে যাচ্ছিল।
তা দেখে অনিকেত বলল, সবাই ঘর খোঁজে, ভালো ঘর, ভালোবাসার ঘর খোঁজে কজন,
রঞ্জনা বলল, যত বড়ই ঘর হোক, ভালোবাসা না থাকলে, সে আবার ঘর কিসের,
সমুদ্রের উতরোল ঢেউ এসে, ওদের দুজনের পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল। -
গল্প- অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
-সুনির্মল বসুতখন তাঁর ভয়ংকর ব্যস্ততার দিন।
সারাদিন স্কুল করবার পর, অনেক সময় খাবার সময় জোটে না, তাঁকে এ বাড়ি ও বাড়ি টিউশনি করে বেড়াতে হয়। যাতায়াতের জন্য সাইকেল একমাত্র ভরসা।
সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা ব্যাচ পড়িয়ে সুদিন বাবু সবে দ্বিতীয় ব্যাচ পড়াতে শুরু করেছেন, গিন্নী জয়ার ফোন।
তুমি কোথায়?
স্টেশন রোডের কাছে, পড়াচ্ছি তো!
একবার একটু এখানে আসতে পারবে?
কোথায়?
জয়দেব দার দুর্গা বাড়িতে।
কেন?
এসোই না, তখন বলবো।
ছাত্রদের টেস্ট পেপার থেকে কাজ দিয়ে সুদিন বাবু
ওখানে উপস্থিত হলেন।
সন্ধ্যেবেলায় আরতি পর্ব চলছিল। প্রচুর ভক্তদের ভিড়।
জয়া বললো, এসো।
জয়দেবদা, সুদিন বাবুর হাতটা দেখতে চাইলেন।
অনেকক্ষণ দেখার পর বললেন, আজ কিছু বলবো না। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই,আপনি পরে একদিন আসুন।
সুদিনবাবু ফিরে গিয়ে পুনরায় ছাত্র পড়াতে বসলেন।
কদিন বাদে সময় বের করে দুর্গা বাড়ি গেলেন।
জয়দেবদা বললেন, আপনার তো এখানে জন্মাবার কথা না!
মানে?
আপনি তো বিরাট বড় বাড়ির লোক মশাই।
কি বলছেন?
আপনার তো বিরাট বাড়ি। বিরাট প্রজামহল। সবাই আপনাকে খুব মান্যতা করে।
দাদা, আমি খুব সামান্য মানুষ। দেখছেন না, সারাদিন দুটো পয়সার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।
আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
কি করে হবে?
আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলবো। সেটা করতে পারবেন? তাহলে আপনি নিজেই বুঝে যাবেন।তিনি কানে কানে একটা প্রক্রিয়ার কথা বললেন। বললেন, কাউকে বলা যাবে না কিন্তু! আজ রাতেই করুন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
সুদিন বাবু টিউশনি পড়াতে ঢুকলেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে ব্যাপারটা মাথার মধ্যে নেননি কখনো।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি যখন শুতে গেলেন, তখন জয়দেব দার গোপন প্রক্রিয়াটার কথা তার মনে পড়ল।পরীক্ষার ছলে তিনি সেটি করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। একটু বাদেই ঘুম এসে গেল। সারাদিন খাটাখাটুনির পর এমন ঘটনাই স্বাভাবিক।
ঘুমের মধ্যে খানিকটা সময় বাদে জিনিস দেখলেন, তিনি যেন ওপর থেকে নিচের দিকে চাইছেন। দেখলেন, প্রচুর সবুজ গাছপালা। একটা বড় রাজপ্রাসাদের মত সাদা বাড়ি। বড় বড় জানালার উপর লাল রঙের সেড দেওয়া। বাড়ির বিশাল বড় গেট। সুদিন বাবু দৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। দেখলেন, বড় একটি আম গাছের নিচে এক ভদ্রলোক হলুদ ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জমিদারী স্টাইলের পাঞ্জাবী ও ধূতি। পায়ে সাদা রঙের চটি।
সুদিন বাবু ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে চাইলেন।
ওনার পাঞ্জাবিটা ঘাড় থেকে সামান্য নেমে এসেছে।
পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সুদিন বাবু বিভিন্ন সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাষণ দিতে যান।
বক্তৃতা দেবার সময় বারবার জামার কলারে হাত দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হচ্ছিল, ওনার পাঞ্জাবিটা উনি একটু তুলে দিলেই পারতেন। ভদ্রলোক শ্যাম বর্ণ। সুদিন বাবুর সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারায় কিছু মাত্র মিল নেই। কিন্তু ওনার চোখের দিকে তাকাতেই, সুদিন বাবু একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। হুবহু ওনার নিজের চোখ। চিন্তান্বিত অবস্থায় তাঁর চোখটা এমনই দেখায়। প্রথম দিন এই পর্যন্ত।পরদিন সুদিন বাবু দুর্গাবাড়িতে গেলেন। জয়দেবদাকে বললেন, আমি আমাকে গতকাল রাতে দেখেছি।
জয়দেব দা বড় মাপের সাধক। বললেন, মাঝে মাঝে আবারো করুন। নিজেই সব দেখতে পাবেন।
সুদিন বাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল।দুদিন বাদে তিনি আবার ওই প্রক্রিয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন, আগের দিনের সেই ভদ্রলোক একটা বিরাট জলাশয়ের কাছে এসেছেন।
তাঁর চারপাশে ফতুয়া আর ধূতি পরা কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক জলাশয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে ওনাদের কিছু একটা দেখিয়ে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছেন।পরদিন সুদিন বাবু জয়দেব দার কাছে দ্বিতীয় দিনের স্বপ্নের কথা জানালেন।
তৃতীয় দিন রাতে ওই প্রক্রিয়াটি করবার পর, সুদিন বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নের ঘরের মধ্যে দেখলেন, টানা বারান্দা দিয়ে এক দীর্ঘকায় ভদ্রমহিলা হেঁটে চলেছেন।
পরদিন তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
দাদা, কাকে দেখলাম?
আপনার আগের জন্মের স্ত্রী।কদিন বাদে সুদিন বাবু ওই প্রক্রিয়াটি করে শুতে গেলেন। খালি বাদে স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, মাটির চওড়া রাস্তা। পথের দুপাশে সবুজ গাছপালা। অনেক লোক বাসের মাচায় করে দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে।
জয়দেবদা, এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি?
আপনার বাড়িতে পূজোর জন্য দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি মায়ের মুখটা দেখতে পেয়েছেন?
নাতো দাদা। দেখিনি। তবে অনেক মানুষ বাসের মাচাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখেছি।কদিন পর সুদিন বাবু আবার ওই প্রক্রিয়া করলেন। তারপর শুতে গেলেন।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন। আগের দিনের সেই ভদ্রমহিলা গোল ঘোরানো সিঁড়ির দোতলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক প্রধান দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। তাঁকে ঘরের ফিরতে দেখে, ভদ্রমহিলার চোখে মুখে একটা স্বস্তির ছাপ পড়লো যেন।এর কিছুদিন পর সুদিন বাবুর বাবা বার্ধক্য জনিত কারণে পরিণত বয়সে মারা গেলেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেল।
সুদিন বাবু এই অশৌচ কালের মধ্যে জয়দেব দার শেখানো প্রক্রিয়াটি করলেন। কিন্তু কোনই ফল পেলেন না। বারে বারে চেষ্টা করা সত্ত্বেও, কিছুতেই আর সেই ছবিগুলো আসছিল না।
তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
দাদা, বারবার চেষ্টা করছি। আর তো আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
পাবেন না তো!
কেন?
আপনার এখন অশৌচ কাল।সুদিন বাবু নানান ব্যস্ততার কারণে পরবর্তীকালে আর কখনো ওই চেষ্টাটা করেননি।
কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, এইসব অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। বর্তমান সংসারের প্রতি মায়াটান কমে যায়।
জয়দেবদা বললেন, আগামী জন্মে আপনি ও বাড়িতেই জন্মাবেন। আগের জন্মে কালী মন্দিরটা অসম্পূর্ণ রেখে আপনি মারা গিয়েছিলেন। আগামী জন্মে ওখানে জন্মে আপনাকে সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।
-
গল্প- সিনেমার আড্ডাটা
সিনেমার আড্ডাটা
–অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)“ঠিক ১২ টাই আমতলায় চৌরাস্তার মোড়ে।
মনে থাকবে যেন।মিস করিস না একদম।”
কথা মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম আমতলার মোড়ে।
নামটা শুনলেই মন ছুটে যায় সেই দিন গুলোর স্মৃতি পাতায়।২-৫টা। ৫টা -৮ টা।এগুলো হয়তো কারোর মনে নেই।
হাউসফুল, ব্লাকে টিকিট কাটা। ফাস্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস,ব্যাল্কনি শব্দ গুলোর সাথে একালের ছেলেমেয়েরা খুব একটা পরিচিত নয়।আমাদের সময়ে সিনেমা হলে গিয়ে, সিনেমা দেখার স্মৃতি কথা ।
আমার এলাকার প্রতিটি সিনেমা হল আমার চেনা।
দিনে তিন টাইম সিনেমা হতো।এখনো বেশ কিছু দামী সিনেমা হল খোলা আছে ঠিকই কিন্তু মানুষের তেমন ঢ্ল দেখা যায় না। সিনেমা পাগল দর্শক যারা আছেন,তারা হয় মোবাইলে ডাউনলোর্ড করে নিচ্ছে নয় তো টিভিতে, নেটে বা অন্য কোনো ভাবে দেখে নিচ্ছে।
হলে বসে তিন ঘন্টা টানা সিনেমা দেখার সময় কারোর নেই।
আর কেউ খবরই রাখি না।
আশেপাশের অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গোনা যে কটি সিনেমা হল আছে তাও স্কুল কলেজ পালানো ছেলেমেয়েদের কাছে। অজানা অথবা গুরুত্বহীন। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে একটা স্মার্টফোন থাকলেই সব স্বপ্ন পূর্ণ। ফোনে সারা বিশ্ব দর্শন। সিনেমা দেখা হয়ে যায়। সিনেমা হলে যেতে লাগে না খুব একটা।আমাদের সময়ে নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পেলেই কোন হলে সিনেমাটা আসছে? কত সপ্তাহ থাকবে একেবারে মুখস্থ রাখত রোহিত, সুব্রত ঝুমা, কাকলি আমরা সবাই। উঃ কি রোমাঞ্চকর ছিল সেই দিন গুলি।
যেদিন স্কুলে গিয়ে শুনি আজ ছাত্র ধর্মঘট । ব্যস ক্লাস বন্ধ। আন্দোলন করে ক্লাস বয়কট। কিন্তু কিসের জন্য কেন ধর্মঘট? ওসব জানার সময় ও নেই আর ইচ্ছে ও নেই। স্কুল বন্ধ মানেই সিনেমা দেখা। চারজনে মিলে দৌড় সিনেমা হলে। তখন পাঁচ দশ মিনিট বাকি। যার কাছে যা টাকা আছে টিফিন খাওয়ার কিংবা খাতা কলম কেনার। সব একত্রিত করে টিকিট কাটতে লাইন। রোহিত তো রীতিমতো ঝগড়া লাইনে দাঁড়িয়ে। কেন হাফ টিকিট দেওয়া হবে না? সব জায়গায় স্কুল ছাত্রের হাফ টিকিট বাসে অটোতে। আর সিনেমা দেখার বেলা ফুল। আসলে কিছু টাকা কম পড়ছিল। যদি একটু ম্যানেজ করা যায় আর কি।
ঝুমা ও কম নয়। হলের কাউন্টারে গিয়ে কাউন্টারের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যদি বাকি টাকাটা না দিতে হয়। কাউন্টার কাকুও বুঝল স্কুল পালানো ছেলে মেয়ে এদের চটিয়ে লাভ নেই। বরং একটু কমিয়ে দিই। হলের সিটগুলো তো ভর্তি হবে।
ঝুমা অবশ্য বলে আসত কাকুকে। আমার ভালো কাকু। সামনের দিন এলে সব মিটিয়ে দেব কেমন? তবে ব্যাল্কনিতে দিতে হবে সিট। হাজার হোক তোমার পাশের স্কুলের ছাত্র ছাত্রী আমরা। হলের বিপদ হলে আমরাই তো ছুটে আসব।
দিব্যি বাড়ি না গিয়ে নতুন জুটির প্রসেনজিৎ জুহির “অমর প্রেম” সিনেমাটা দেখা হয়ে গেল। স্কুল জীবনে সিনেমা দেখা ছিল দারুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
শারুখ খান কাজলের নতুন সিনেমা রিলিজ হলেই আর রক্ষে নেই। কতক্ষণ দেখব সিনেমাটা। আশেপাশের হলে ব্যাগের ভেতরে অন্যএকটা বাড়ির জামা লুকিয়ে আনতাম। তারপর সবাই একসাথে কোথাও দেখা করে স্কুলড্রেস গুলো বদলে নিতাম। চললাম মহানন্দে হলের দিকে। টিকিট কেটে একেবারে ব্যাল্কনির সিট। একটু আরামদায়ক নিরিবিলি। কিছুক্ষণ পরেই বাদাম ওয়ালা ঠোকায় ঠোকায় বাদাম বিক্রি করছে। ঝাল নজেন্স,ভুট্টা ভাজার প্যাকেট কিনে মুখে পুরে দিলাম। একটা করে বাদাম মুখে দিয়ে হইহই করতে করতে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে। রাহুল আর ঝুমার মধ্যে একটু খুনসুটি চলছিল,কারোর আর বুঝতে বাকি রইল না দুজনার অমরপ্রেমকাহিনীর কথা । সারা স্কুলের সেরা জুটি রাহুল ঝুমা।
রোহিত সবার চেয়ে একটু বেশি ই দুষ্টু। ওদের একসাথে সিট দিত ইচ্ছে করে ই। দুজনার প্রেমের সুযোগ করে দিত।
শেষ হওয়ার একটু আগেই বেরিয়ে আসতাম। দিনের আলোয় যাতে কেউ চিনতে না পারে। সবার চক্ষুর আড়ালে জনতার ভীড়ে নিজেরা লুকিয়ে ফেলতাম নিজেদের।
সিনেমার আড্ডাটা আর নেই। হারিয়ে গেছে দিনগুলি। তবু বারে বারে মনে আসে সিনেমার আড্ডার স্মৃতি। মনে আসে ঝুমা রাহুলের প্রেম কাহিনি। বি এ পাশ করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দেখা সাক্ষাৎ বন্ধুত্ব সব অতীতের আড্ডা টুকু কেমন ধোঁয়াসে হয়ে যায় কর্মের ব্যস্ততায়। দীর্ঘ দশ বছর পর রাহুলের সাথে দেখা। সেই হাসি খুশি ছেলেটা কেমন বুড়িয়ে গেছে। পাথরের মতো স্থির কঠিন হয়ে গেছে। ঝুমার কথা উঠতেই এড়িয়ে গেল অন্য প্রসঙ্গে।
শুনেছিলাম ওদের বিয়েটা হয় নি। রাহুল যে তখনো বেকার। এখনো বেকার বলা চলে। খবরের কাগজের দপ্তরের খবর সাপ্লাই দেয়। এমন ছেলের সাথে কে ই বা বিয়ে দেবে?
ঝুমার গ্যাজুয়েশান শেষ করেই বিয়ে হয়ে গেল বিখ্যাত ব্যারিস্টারের সাথে। ঝুমা পারে নি রাজি করাতে বাবাকে।
সিনেমা হলেই শেষ হয়ে গেল দুজনের অমর প্রেম।
দিন গুলো বড্ড পিছু টানে।
সেদিন হঠাৎ রোহিতের সাথে দেখা। আজও আগের মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সেই চাহনি সেই উজ্জ্বল দুটো চোখের ভাষায় কোথাও কোনো ভুল নেই। তবু স্বহাস্যে বুঝিয়ে দিল দিব্যি আছে খোশমেজাজে।
যাবার সময় শুধু একবার প্রশ্ন করল, কিছুই কি মনে নেই?
আমিও একগাল হেসে বুঝিয়ে দিলাম, রবি ঠাকুরের কথায়,রাতের সব তারারাই আছে দিনের আলোর অন্ধকারে।
চলে গেল একমুখ তৃপ্তির হাসি হেসে।
সিনেমার আড্ডাটা আজ আর নেই।
আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়।