গল্প
-
গল্প- কুয়াশা–২
কুয়াশা-২
পাপিয়া ঘোষ সিংহকয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পর আজ আকাশ পরিস্কার। সন্ধ্যা বেলা ছাদে পায়চারি করতে করতে হঠাৎই চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই কত ভালোলাগা সাথে হাজার প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো রুমেলার।
বছর দুই হলো রুমির বিয়ে হয়েছে। রোমান্টিক দীপনের সাথেই। অনেক মান-অভিমান টানাপোড়েন পেরিয়ে ভালোবাসা পরিণতি পেয়েছে। বিয়ের পর এক বছর ওদের কেমন স্বপ্নের মতো কেটেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকে রাতভোর পর্যন্ত সবসময়ই যেন এক দুরন্ত প্রেম একটা বছর কিভাবে দাপিয়ে নিয়ে গেল। তারপর কেমন যেন ফিকে হতে থাকলো জীবনের রঙ। দীপন–দীপঙ্কর চ্যাটার্জি তার অফিসে প্রোমোশন পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ,ভীষণ চাপ। এরপর যেটুকু সময় পায় তখন আত্মীয়-বন্ধু, কলিগ ও তাদের ফ্যামিলি ফোন আসা-যাওয়া এসব নিয়ে দীপনের রুমির জন্য সময় থাকে না। সারাদিনের সমস্ত সেরে রাতের বিছানায় ও দীপন ঘুমন্ত এক পাথর।
রুমি একটি কলেজে পড়ায়, সকাল থেকে তারও কাজ থাকে। দীপনকে অফিসের আগে ব্রেকফাস্ট দেওয়া, লাঞ্চ বানিয়ে প্যাক করে দেওয়া, দীপন বেরিয়ে গেলে নিজে স্নান-খাওয়া সেরে কলেজে যাওয়া। রুমি প্রতিদিনই দীপনের পরে বেরিয়ে আগে বাড়ি ফেরে। যদিও কাজ অনুসারে এটাই স্বাভাবিক। রুমিও সংসার, কলেজ,সোশ্যাল ওয়ার্ক, বাগান করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, তবুও দীপনের কাজের ব্যস্ততা য় দূরে সরে যাওয়া যেন ক্রমশ রুমিকে একা করে দিচ্ছে। এত কাজেও যেন রুমির দিন কাটতে চায়না।
চাঁদের দিকে তাকায় রুমি, মনে পড়ে কত পুরোনো কথা। এই চাঁদকেই তো দীপন রুমির রূপের প্রতিচ্ছবি বলতো। কত প্রতিশ্রুতি ছিল দীপনের! রুমি আমরা কখনও বুড়ো হবো না, রুমি আমরা সারাজীবন একসাথে চাঁদ দেখবো। আকাশে মেঘ চাঁদের লুকোচুরি খেলায় আমরা দুজন রূপকথার দেশে পারি দেবো।আমি তোমার আকাশ,আর আমার বুকে তুমি আমার চাঁদ রুমি।
আজ আকাশের বুকে চাঁদকে দেখে রুমির মনে হলো এদের তো চিরন্তন সম্পর্ক। মানুষের সম্পর্ক কেন এত আপেক্ষিক? দীপন এখনো ফেরেনি, আজ কি দীপন আমার সঙ্গে চাঁদ দেখবে?
কলিং বেলের শব্দে নীচে তাকায় রুমি। ঐ তো দীপন এসেছে। ছুটে নীচে নেমে আসে রুমি। দীপনের, হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরে রেখে আসে,তারপর চা নিয়ে দীপনের কাছে গিয়ে বলে দীপন একবার ছাদে যাবে? দীপন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন করতে করতে অন্য ঘরে চলে যায়। মনে কুয়াশা ঘন হয়ে আসে রুমেলার। দীপনের ব্যবহার পাল্টে যাওয়ার কারণ কি শুধু কর্মব্যস্ততা?না কি অন্য কিছু? কি করবে রুমি!কুয়াশার আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে। সামনের পথ বড়োই অস্পষ্ট।
-
গল্প- দত্তক
দত্তক
– শিলাবৃষ্টিআমি রিনিঝিনি রায়। ছেলেবেলা থেকে কানাঘুষো শুনতে হয়েছে আমি দত্তক নেওয়া মেয়ে। একটা একান্নবর্তী পরিবারে আমি বড় হয়েছি। মায়ের কোনো অযত্ন ছিলনা কোনদিন। কিন্তু বাবা! না সেই মানুষটা হয়তো আমাকে সেভাবে মেনে নিতেই পারেননি। আসলে বাড়িতে আর পাঁচজন মানুষ যখন সমালোচনার ঝড় তোলে, তখন বাবা হয়তো ভাবেন যে বিরাট ভুল করে ফেলেছিলেন অতীতে!
আসলে আমিও এ বাড়ির আদব কায়দা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারিনি। আমার ভিতরে সবসময় একটা বিদ্রোহ কাজ করে। ছোটবেলায় বলতে পারতামনা, এখন বলি, প্রতিবাদের ভাষা আমার ঠোঁটে। আর সে জন্য কথায় কথায় আমাকে শুনতে হয় ” আমি এ বাড়ির দত্তক “।
” বিনোদবিহারী কোয়েড কলেজে ” সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী আমি। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে আজও কলেজে এসেছি। লিজার পিরিয়ডে অমল যথারীতি হাজির।
– চল রিনি এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিয়ে আসি ক্যাণ্টিনে।
অমল যে আমাকে লাইক করে সেটা আমার বুঝতে অসুবিধে হয়না। আমিও ওকে পছন্দ করিনা তা নয়! তবে ওকে সব বলা উচিৎ। বললাম
-তুই বাইক এনেছিস আজ?
-হ্যা, কেন রে?
-আজ লাস্ট পিরিয়ডের ক্লাসটা ডুব দিবি?
-বাব্বা! আজ রিনিঝিনি রায়ের হলো কি?
-ইয়ার্কি মারিসনা তো..
বিকেলের পড়ন্ত রোদে অমল আর আমি বাইকে
দিল্লী রোড ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও হঠাৎ বিনা মেঘেই বৃষ্টি নামলো। শেষে একটা মধ্যবিত্ত ধাবায় আমরা ঢুকে চা আর ওমলেট অর্ডার দিয়ে কোণের দুটো চেয়ার দখল করে বসলাম। এটা সেটা কথার পরে অমল বললো
-এবার আসল কথাটা বলে ফেল রিনি
– কি আসল কথা?
– যার জন্য ক্লাস অফ করে আমাকে নিয়ে এতদূর ছুটে এলি?
– হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস অমল…
– কিরে প্রোপোজ করবি নাকি?
বলেই অমল হা হা করে খানিক হেসে নিল।
নারে, যাতে তুই আমাকে কোনোদিন না প্রোপোজ করিস সেই ব্যবস্থা করতে।
কথাটা বলার সাথে সাথে অমলের মুখটা যেন রক্ত শূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । বললো
-কাউকে ভালোবাসিস তুই?
-না তো –
– তবে? আমার ভালোবাসায় তোর কি আস্থা নেই?
– আজ আমার সব কথা তোকে শুনতে হবে।
– বল
জানিস অমল আমাদের বাড়িটা মানে আমি যেখানে থাকি সেটা একটা একান্নবর্তী পরিবার। এখনো এক রান্নাঘরে চোদ্দ জনের রান্না হয়।
বাবারা তিন ভাই। আমার বাবা মেজ।
জ্যেঠুর দুই সন্তান। কাকারও এক মেয়ে। কিন্তু আমার মায়ের বিয়ের ছ বছর কেটে যাওয়ার পরেও কোল ভরে কোনো সন্তান এলোনা। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, অনেক জড়ি বুটি খাইয়েছিল ঠাম্মি কিন্তু না, মা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিতই থেকে গেল! জ্যেঠু কাকুরা যখন তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ভীষণ সুখী, মা বাবা তখন আড়ালে চোখের জল ফেলতো। ঠাকুমা কথায় কথায় মাকে আঁটকুড়ি বলতো। সেই সময় একদিন হঠাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশের এক বান্ধবী এ বাড়িতে আসেন আর মাকে জানিয়ে যান তিনিও ভাগ্য দোষে গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি ঠিকই, কিন্তু তিনি একজন পরিপূর্ণ মা। তিনি একবছরের একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছেন। মা যেন কথাটা শুনে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। বাবার কাছে দিন দুবেলা করুণ আবেদন নিয়ে বসে থাকলো। বাবা রাজি হতে পারেন নি সহজে, ঠাকুমা একেবারেই বেঁকে বসলো। বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকলো। মাও জেদ ধরে খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করলো। অনেক লড়াই এর পরে পুরুলিয়ার এক অনাথ আশ্রম থেকে মা যে শিশু কন্যাকে দত্তক নিয়ে এসেছিল সেই মেয়েটা আজ তোর সামনে বসে আছে অমল..
বলতে বলতে চোখদুটো ভিজে যায় আমার। নিজের ভাবাবেগকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। অমল কিন্তু নির্লিপ্ত। সে শুধু বলে
তাতে কি? কি এসে যায় তাতে?
অমল!
-বল, উত্তর দে। এতদিন যে শব্দগুলো শুধু মনেই জমা রেখেছিলাম, আজ তা প্রকাশ করছি রিনি।আই লাভ ইউ। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি পাগলী।
-কিন্তু, এ হয় না অমল। তোর বাড়ির কেউ আমাকে মেনে নেবেনা।
-দূর! আগে তো আমি তোকে প্রাণ ভরে ভালোবাসি, তারপর বাড়ি।
-অমল, আমাকে যে মা অনাথ আশ্রমে ফেলে চলে গিয়েছিল হয়তো সে কোনো
কুমারী! হয়তো মুসলিম! হয়তো বা
পতিতা! একবার ভেবে দেখ, কেন আমায় মানুষ মেনে নেবে?
-তোর কি দোষ? নিজেকে অসম্মান করিস না। যে মা তোকে বুকে নিয়ে সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল, পরম স্নেহে তোকে আগলে বড় করে তুলেছে, তোকে সন্তান হিসেবে পেয়ে যার সব শূন্যতা ভরে গেছে সেই তোর আসল মা।
অন্য কিছু আর ভাববিনা কোনোদিন।
বৃষ্টি কমে গেলেও আকাশে কালো মেঘ ছিল।
ফেরার পথে একবার দাঁড়িয়ে ও শুধু আমায় বললো – তুই নিজেকে ঘৃণা করিস?
আমি কোনো কথা না বলে ওর পিঠে মাথা রাখলাম।দুদিন কলেজে যাইনি। জ্বর কমছিলনা বলে মাকে নার্সিহোমে এডমিট করতে হয়েছিল। আগামীকাল সকালে ছুটি দেবে। বিকেলে অমল এসে হাজির। আমি তো চমকে গেছি প্রথমে। ও আমার ক্লাসমেট বলে পরিচয় দিল। বাবা মাও অবাক হয়েছে বুঝলাম। বাবা বসার টুলটা এগিয়ে দিল।এরপর ও বসে নিজস্ব বাচনভঙ্গীতে আলাপ চালিয়ে গেল। হঠাৎ একসময়ে মাকে প্রশ্ন করে বসলো
– মাসীমা! আপনার সেই ছোটবেলার বান্ধবীর নাম কি? যার কথায় আপনি রিনিকে দত্তক নিয়েছিলেন?
আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল।
– বুড়ি। ভালো নাম অসীমা
– বাড়ী কোথায় ছিল মাসীমা?
– মগরার দিকে। পরে…
– পরে কোন্নগরে ফ্ল্যাট কিনেছিল। অসীমা সরকার। আমার মা। মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আর আমিই সেই দত্তক নেওয়া ছেলে অমল।
অপার বিস্ময়ে আমি চমকে তাকাই অমলের দিকে। এও কি সম্ভব?
ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট কিরে হাসছে।
দেখ কি মিল আমাদের। একেবারে রাজজোটক।
বলেই মা আর বাবাকে প্রণাম করে বললো
—- আমি নিজেকে উপযুক্ত করে আবার আসবো। সেদিন রিনিকে চেয়ে নেব আপনাদের কাছ থেকে। আজ আসি।
আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি। -
গল্প- পলাশ শিমূলের দিনগুলো
পলাশ শিমূলের দিনগুলো
-সুনির্মল বসুডি এম অফিস। নর্থ বেঙ্গল। ডুয়ার্স। সকাল সাড়ে নটায় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ার গাড়ি অফিস করিডোরে ঢুকলো। নন্দিনী সেন গাড়ি থেকে নেমে দূরে গাছ পালার দিকে চাইলেন।
চোখের কালো চশমা খুলে দেখলেন,অজস্র শিমূল পলাশে চারদিক ছেয়ে আছে।
মাথার ওপরে নীল আকাশ। গাছের পাতা সবুজ। দূরে কোথাও গান বাজছিল,
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার।ভদ্রমহিলা পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব। উনি এক সময় যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন, সেটা বোঝা যায়। কপালের সামনের দিকে কিছু চুলে পাক ধরেছে।
তিনি নিজের চেম্বারে গিয়ে বসলেন। টেবিলের ওপর পলাশ আর শিমূল ফুলের গুচ্ছ রাখা আছে। এ নিশ্চয়ই ওর খাস বেহারা সাবিত্রীর কাজ। সাবিত্রী জানে, ম্যাডাম ফুল ভালোবাসেন।
নন্দিনী মুহূর্তের জন্য অতীতে ফিরে গেলেন।
উইমেন ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাস্তা। কত কতদিন ওখানেই এসে দাঁড়িয়ে থাকতো কৃষ্ণেন্দু। কোনো কোনোদিন দূরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতো।
একেক দিন কলেজ ছুটির পর, ঝিলের ধারে গিয়ে
বসতো ওরা দুজন। কত কথা হতো। কত স্বপ্ন ছিল সেদিন ভবিষ্যতে জীবন ঘিরে।
দূরের পলাশ বন দেখছো,
হ্যাঁ তো,
শিমূল ফুলের ডালে শালিক পাখি বসে মধু খাচ্ছে,
কি অপূর্ব দৃশ্য,
ভারী মায়াময়,
তোমার অফিসের কি খবর,
আমাকে নর্থ বেঙ্গলে ট্রান্সফার করে দিচ্ছে,
তুমি কিছু বলো নি,
বলেছিলাম, অফিস বলছে কোন উপায় নেই। যেতেই হবে।
এদিকে আমার থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে, বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হবে।
দূরে কোথাও রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল, বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা।
মনে হয়, শান্তিদেব ঘোষের গলা,
অমন দরাজ গলা আর কজনার,সিকিউরিটির ওসমান খাঁন সেলাম করে অফিসে ঢুকলো। একটা স্লিপ দেখিয়ে বলল, ম্যাডাম, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
আসতে বলো।
ভদ্রলোক দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, আসতে পারি।
আসুন। বসুন। বলুন।ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবা নন্দিনী সেন একটু চমকে গেলেন। সামনে কৃষ্ণেন্দু। নর্থ বেঙ্গলে আসার পর, এখানেই বিয়ে করে নতুন করে ফ্ল্যাট কিনে সংসার পেতেছে।
হায় ভালোবাসা,
কৃষ্ণেন্দু বলল, পৌরসভা থেকে আসছি।বালুরঘাটের রাস্তা সেংশনের টাকাটা
যদি কাইন্ডলি গ্র্যান্ট করে দেন,
নেসেসারি ফাইলপত্র দেখান,
অ্যাটাচি কেস থেকে ফাইলপত্র কৃষ্ণেন্দু টেবিলের ওপর রাখলো। সব দেখে, নন্দিনী ফাইলে সই করে দিলেন।অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, নন্দিনী,
ধন্যবাদ কেন, এটা আমার অফিসিয়াল ডিউটি,
কেমন আছো তুমি,
খুব ভালো,
সেসব দিনের কথা মনে পড়ে,
জেনে কি লাভ,
উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাস্তা, ল্যাম্পপোস্ট, ঝিলের ধার, পলাশ বন, শিমূল ফুলের সুরভি, কিছুই কি মনে নেই,
মনে আছে বলেই তো, ভালোবাসাটাকে সস্তা হতে দিইনি,
সেদিন আমি তোমার প্রতি অবিচার করেছিলাম নন্দিনী,
তাই নাকি, কবে থেকে এই বোধদয় হোল,
নর্থ বেঙ্গলে পোস্টিং হবার পর, আমি হাই সোসাইটির মেয়ে অনিন্দিতাকে বিয়ে করলাম,
খুব ভালো,
না নন্দিনী, কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারেনা,
কেন,
বিয়ের কিছুদিন পর আমার সামান্য আয় নিয়ে সংসারে অশান্তি। ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে রিসেন্টলি রনদীপকে বিয়ে করেছে।
তোমার মনে পড়ে কৃষ্ণেন্দু, সেদিন ঝিলের ধারে পলাশ শিমূলের ছায়ায় বসে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসার শপথ নিয়েছিলাম।
আমি কথা রাখতে পারিনি। কিন্তু আজ চেয়ারে তোমাকে দেখে, চমকে গিয়েছি।
তুমি চলে গেলে, খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম এক সময়।
এরপর মন শক্ত করলাম। পলাশ শিমূলের দিনগুলির মধ্যে আমি ভালোবাসার শক্তি খুঁজে পেলাম। ভাবলাম, ভালোবাসা হারেনা, ভালোবাসা মরে না, আমাকে প্রমাণ করতে হবে।
গ্রাজুয়েশনের পর আমি এ গ্রেডে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিলাম। তারপর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আজ এখানে।
একলার জীবন,তোমার কষ্ট হয় না,
ভালোবাসাটাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি, মানুষের জন্য কাজ করছি। আজ আমি একা নই, কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দু বলল, আজ আসি।
অফিস থেকে বেরোতেই, ওসমান খাঁন প্রশ্ন করলো, কাজ হয়েছে সাহেব।
কৃষ্ণেন্দু বলল, হ্যাঁ।
ওসমান বলল, ম্যাডাম কোনো ফাইল আটকে রাখেন না, অনাথ শিশুদের জন্য অনেক অনেক কাজ করেন।বিমর্ষ কৃষ্ণেন্দু পথে নেমে এলো। একটা সিগারেট ধরালো। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে মনে মনে বলল, পলাশ শিমূলের সৌন্দর্য সেদিন আমি দেখেছিলাম। নন্দিনীও দেখেছিল। বসন্ত দিনের ভালোবাসার শক্তি আমি সেদিন দেখতে পাইনি।
নন্দিনী দেখেছিল।আমি যা পারিনি, নন্দিনী তা করে দেখিয়েছে। ভালো থেকো নন্দিনী।
পিচ ঢালা পথের উপর যখন পলাশ শিমূলের চূর্ণ এসে পড়েছে। আলগোছে কৃষ্ণেন্দু কয়েকটা পলাশ ফুল নাকের কাছে তুলে নিল। দূরে লাউড স্পিকারে কোথাও গান বাজছিল, রঙ শুধু দিয়েই গেলে, সে রঙ কখন লাগলো আমার মনে, আমার জীবন মরণ ধন্য করে।
কৃষ্ণেন্দু মনে মনে বলল, একদিন তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি চলে গিয়েছিলাম। সেদিন তোমাকে আমি কাঁদিয়েছিলাম নন্দিনী। আজ তোমার সাফল্যে আমি খুশি। আমার খুশির এই চোখের জল, তুমি কোনোদিন দেখতে পাবে না নন্দিনী।
-
গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা
সোনার সিঁড়িতে পা
-সুনির্মল বসুতখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন। গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।
মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।
অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।
মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।
অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।
ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।
একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।
গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।
এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।
জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।
একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।
অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।বিশ্বরূপ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।
জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাপসলিউটলি,নট।
দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।
সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।
-
গল্প- পিতৃত্বের দাবি
পিতৃত্বের দাবি
-মুনমুন রাহা
” দেখ তোমার ঐ মালিটার তাকানো আমার একদম ভাল লাগে না । কেমন করে যেন আমার তিন্নির দিকে তাকায়। তুমি ওকে বিদায় করার ব্যাবস্থা কর।”
” তোমার এই সবাই কে সন্দেহ করাটা বন্ধ কর তাহলেই দেখবে সব ঠিক আছে। “
” বিশ্বাস কর এবার আমার মনের ভুল নয় গো । প্রতিবার কি ভুল হয়? আর তুমি জান না তিন্নি আমাদের কত ধৈর্য্যর ফল ?”
এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে অনামিকা। তমাল আর অনামিকার বিয়ের প্রায় সাত বছর পর তিন্নি আসে ওদের জীবনে । এর আগে অনামিকার পাঁচ বার মিসক্যারেজ হয়। শেষের দিকে তো অনামিকা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবারের এই সন্তান হারনো তার আর তমালের জীবনের গতিটা যেন থামিয়ে দিয়েছিল। তিন্নির ছোট দুটো হাত ধরেই তারা ফিরেছিল জীবনের ছন্দে ।
তমালের বাগানের বড় সখ । অফিসের চাপে সেই ভাবে নজর দিতে পারছে না গাছ গুলোতে তাই একটা মালি খুঁজছিল । পেয়েও গেল । নাম চরণ দাস । তার সাথে আবার কদিনের মধ্যেই বেশ ভাল আলাপ হয়ে যায় চার বছরের তিন্নির। প্রথম প্রথম অনামিকা কিছু বলে নি কিন্তু আজকাল তার নানা রকম সন্দেহ হচ্ছে মনে।
তমাল অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসে । এসে দেখে চরণ তিন্নির ঘরে বাইরের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে । তমাল গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে সে । জিজ্ঞেস করতে বলে সাদা গোলাপ গাছে ফুল এসেছে তিন্নি দেখবে বলেছিল তাই সে খুঁজছিল তাকে । কথাটা কেমন বিশ্বাস হয় না তমালের। তবু তখন কিছু বলে না সে । আরো একদিন তমাল লক্ষ করল সকাল বেলা চরণ কি যেন কথা বলছে তিন্নির সাথে । পরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে মালি কাকু তাকে জিজ্ঞেস করছিল তিন্নি তার সাথে তার বাড়ি যাবে কিনা ?
না আর রিস্ক নিতে পারে না তমাল। আজকাল কত কিছুই তো হচ্ছে ।
তার বাগানের ফুলের থেকে তার ফুলের মত মেয়ে তিন্নি তার কাছে অনেক বেশি দামী । তাই সেদিনই চরণ দাসকে একমাসের মাইনে সহ বিদায় দেয় সে । যাওয়ার আগে চরণ দাস তার সাথে দেখা করতে চায় । বলে —” বাবু আমি তো মালি তাই একটা কথা বলি। পরের বাগানের ফুল দিয়ে কখনও নিজের বাগান সাজানো যায় না । আর সাজালেও সে ফুল বেশিদিন থাকে না ।”
” কি বলতে চাও তুমি ? “
আর দাঁড়ায় নি চরণ দাস। চরণ দাসের কথা গুলো যেন হঠাৎই তমাল কে পিছিয়ে নিয়ে যায় চার বছর আগে তিন্নির জন্মের সময়। বহুদিন ধরে ভুলে থাকা কথা গুলো মনে পড়ে যায় তমালের।
যখন অনামিকার শরীরে নয় মাস ধরে তাদের সন্তান বেড়ে ওঠে তখন তমাল আর অনামিকা দুজনেই অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সেই সন্তান কে নিয়ে । আগের পাঁচ বারের মতো ভগবান তাদের সন্তান কে কেড়ে নেয়নি। তারপর সঠিক দিনে ডাক্তারের পরামর্শ মতোই অনামিকা ভর্তি হয় নার্সিংহোমে । তমাল অধীর আগ্রহে তখন অপেক্ষারত তাদের সন্তানের জন্য।
ওটি থেকে ডাক্তার এসে খবর দেয় তাদের এক কন্যা সন্তান হয়েছিল বটে কিন্ত বেশিক্ষণ সে থাকে নি এই পৃথিবীতে । এদিকে অনামিকার যা অবস্থা এই খবর হয়তো তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে ।
তমালের তখন নিজেরই পাগলের মতো অবস্থা । এক তো ভগবানের নিষ্ঠুর পরিহাস অপরদিকে অনামিকার জীবন । যখন কি করবে কোন দিকে দিশা পাচ্ছে না তখন হঠাৎই অসিত বলে একটি ছেলে আসে তার কাছে । বলে সে নাকি সব কিছুই জানে তার ব্যাপারে এবং আরও বলে একটি বাচ্চা আছে যার বাবা নেই । মা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে । এখন অসিত তাকে তমালের হাতে তুলে দিতে পারে কিছু অর্থের বিনিময়। ডাক্তারবাবু অবশ্য সবটাই জানতেন । কারণ তিনিও কিছু অর্থ দাবী করেন ।
সব কিছু সামলে আজ সেই ছোট্ট বাচ্চা টা তাদের আদরের তিন্নি । তারপর সব কিছুই যেন চাপা পরে যায় তিন্নির ভালবাসার কাছে । ছোট্ট ছোট্ট হাত গুলো দিয়ে যখন তমালের হাতের আঙুল গুলো চেপে ধরত ছোট্ট তিন্নি,তখন তমালের মনে হত এ তার ছাড়া আর কারো সন্তান হতেই পারে না ।
তিন্নির যত আবদার তার বাবার কাছে । মেয়েরও সব আবদার মাথায় করে রাখে তমাল । ছোট্ট পায়ে হামা দিতে দিতে, টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন কেটে গেছে চারটে বছর। এই এত বছর পর চরণের কথায় তমালের মনে পরে পুরোন কথা গুলো । কিন্ত চরণ কেন বলল এমন কথা কে জানে!
চরণ বাড়ি ফিরতে তার বৌ তুলসী জিজ্ঞেস করে—-
“কি গো আর কত দিন পর আনবে আমাদের কমলি কে ? “” একটু অপেক্ষা কর , আনব ,আমাদের কমলি আমাদের কাছেই ফিরবে । কাউকে দেব না । আমার যত অভাবই হোক কমলি আর বিমলির বাবা তাদের মুখে ঠিক খাবার তুলে দিতে পারবে ।”
আজ সকাল থেকে তিন্নির কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না । সকালে সে বাগানে খেলতে গিয়েছিল সেই থেকে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না । অনামিকার অবস্থা ভাল নয় বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । নার্সিংহোমে ভর্তি করে তমাল চলল চরণের কাছে । তার মন বলছিল চরণের তিন্নিকে লুকিয়ে দেখা , তার বাড়ি যাওয়ার কথা বলা এবং শেষ দিনের তাকে দেওয়া উপদেশ এমনি এমনি নয়। পুলিশকে খবর দেয় সে । পুলিশ ও যাচ্ছে তার সাথে ।
” আমি বাবার কাছে যাব “
” কেন মা তোমার এখনে ভাল লাগছে না? এই দেখ তোমার বোন বিমলি। ও আর তুমি যে যমজ। দেখ তোমাদের এক রকম দেখতে না ! “
“এতক্ষন তো থাকলাম মালি কাকু এবার আমার বাবার জন্য মন কেমন করছে । অফিস থেকে এসে আমায় খুঁজবে তো ?”
” তোমার মা তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে খাও মা। “
না কিছুই খায় নি মেয়ে টা । বাবার কাছে যাবে এই বায়না করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে । তুলসী যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন দাই চম্পা বলেছিল তার পেটে দুটি প্রান বাড়ছে। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ব্যাথা উঠলে চম্পা কে খবর দেয় চরণ । কিন্ত চম্পা তুলসীর অবস্থা দেখে পরামর্শ দেয় ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার জন্য। বস্তির ছেলে অসিতের সাহায্যে তুলসী যায় নার্সিংহোমে । যদিও খরচটা বেশি কিন্ত চিকিৎসা ভাল। সেখানে তুলসী আর তার এক মেয়ে বাঁচলেও আর একটা মেয়ে কে বাঁচাতে পারে না ডাক্তারা ।
কিন্ত সব ভুল ভেঙে যায় তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে। তিন্নি কে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না এ তারই মেয়ে। অবিকল বিমলির মুখ বসানো । তখনই ঠিক করে তিন্নি মানে তাদের কমলি কে নিয়ে আসবে তার কাছে । ঘর তার ভাঙা হলেও রাজকন্যা যে তার।
সেই মতোই আজ তিন্নিকে নিয়ে আসে সে । কিন্ত এখন বুঝতে পারছে তার মেয়ের কাছে বাবা যে অন্য কেউ। বাবা হয়ে চরণ মেয়ের এত কান্না সহ্য করতে পারছে না । আর এটাও ঠিক তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে সে বুঝেছে তমাল ঠিক কতটা ভালবাসে তিন্নিকে । বাবা হয়ে আর এক বাবার কাছ থেকে তার মেয়ে কে কেড়ে নিতে পারবে না সে । তুলসীকেও বোঝায় সে ।
বাইরে পুলিশের ডাকে বেরিয়ে আসে চরণ । দেখে পুলিশের সাথে তমালকে । তমাল তিন্নি খোঁজে ততক্ষণ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরে গিয়ে দেখতে পায় তিন্নির যমজ বোন বিমলি কে । কিছু আর বুঝতে বাকি থাকে না তমালের।
তমাল পুলিশের কাছ থেকে কমপ্লেন তুলে নেয়। হাত জোড় করে ক্ষমা চায় চরণের কাছে । এও জানায় কোন পরিস্থিতিতে তাকে ঠিক কি বলে অসিত। অনুরোধ করে তিন্নিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
চরণ বলে —-
“নিয়ে যাও বাবু তোমার মেয়ে কে । ওর নরম মনে এত কথা বলে কষ্ট দিতে হবে না । আর তাছাড়াও ও তোমাকে বড় ভালবাসে ।তুমি বাবা যে !”“না চরণ ও আজ থেকে শুধু আমার মেয়ে নয় তোমারও মেয়ে। আমরা দুজনেই ওর বাবা হতে পারি না ? “
অনামিকাও আজ জানে সবটা । তমাল বাবু আর অনামিকার কাছে ভালোই আছে তিন্নি ।মাঝে মাঝে অবশ্য তার মালি কাকুও আসে ওর সাথে দেখা করতে ।
-
গল্প- অপরাহ্নের আলো
অপরাহ্নের আলো
-সুমিতা দাশগুপ্তবিকেল বেলায় দোতলার বারান্দায় বসে অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত আকাশ দেখতে বড্ড ভালো লাগে ইন্দিরার। রোজ তাই এই সময়টায় বারান্দায় এসে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। আজও হাতদুটো কোলের উপর রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন , আকাশে ভাসা টুকরো টুকরো মেঘগুলো, অস্তগামী সূর্যের আলোয় কেমন সুন্দর নিজেদের রাঙিয়ে নিচ্ছে নানা রঙে।মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলেন, মানুষের জীবনটাও বোধহয় অনেকটা এইরকমই। প্রথম জীবনের নানা রঙের দিনগুলো, যখন বার্ধক্যের ছোঁয়ায় ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠতে থাকে ,তখন নিজেকেই চেষ্টা করে বাইরের রঙে রাঙিয়ে, জীবনকে উজ্জ্বল করে নিতে হয়, নইলে মনকেমনের আঁধারে ডুবে যায় দিনযাপন। সেই আঁধার সাঁতরে পার হওয়া যে কী পীড়াদায়ক, ভুক্তভোগী মাত্রেরই জানা। আশেপাশে কম মানুষকে তো আর দেখছেন না। বিদেশের মানুষজন যে এতো হবি নিয়ে মাতামাতি করে সে কি আর এমনি!
উদার আকাশে হারিয়ে যেতে যেতে এইসব নানা দার্শনিক চিন্তায় ডুবে ছিলেন ইন্দিরা।“এই নাও , তোমার চা।” পাশে রাখা বেতের টেবিলে ঠক্ করে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে বললে মিনতি।
“দাদুকে চা দিয়েছিস?”
“হুঁ, কী একটা বই পড়তেছে তাই ঘরে বসেই চা খাবে বললো।”
“আর আমার সুতো?”
“এনেছি রে বাবা এনেছি, নইলে আমার কপালে দুঃখু আছে সে কী আর আমি জানি নে, ও,ভালো কতা, লেস বোনার সুতোর দাম কিন্তু পাঁচ ট্যাকা করে বেড়ে গেচে , বলে রাকলুম।”
” আচ্ছা বেশ, কী আর করা যাবে।”
“সে তুমি বোজো গে যাও। সারাদিন ধরে কষ্ট করে আঙ্গুল ব্যাতা করে বোনো আর একে তাকে বিলিয়ে দাও ,তাও যদি সবাই এর মম্মো বুজতো “
আরে আমি তো লেশ বুনতে ভালোবাসি রে , আর ভালোবেসেই ওদের দিই। তোকেও তো দিয়েছি, তুইও তো খুশি হয়েই নিলি”
“আমার কতা বাদ দাও, তোমার ঐ ছোট জা সেদিন কী বললে মনে নেই! কতো বড়ো একখানা টেবিল ঢাকা দিলে, আর মুকের ওপর বলে কিনা, কী লাভ হয় বলতো দিদি, এইসব কষ্ট করে বুনে ,সবই তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। তাছাড়া মেশিনে বোনা ওইসব লেসগুলোর ফিনিশ আরও কতো সুন্দর!ছেলে নাকি বিদেশ থেকে পাইট্যেচে, সেই দেমাকেই মলো। ইচ্ছে করছিলো দিই বেশ করে দুকতা শুনিয়ে, তুমি আবার কী বলবে তাই চুপ মেরে গেলাম।”
“আচ্ছা বেশ আর দেব না ওকে, আর শোন্ এই সুতোটা আনালাম বিন্দি দিদিভাই এর জন্যে। ওর মা ফোন করেছিলো, দিদিভাইদের স্কুলে কুরুশ দিয়ে কী সব যেন করতে শেখাবে, তাই আগেভাগেই কুরুশ বোনা শেখাতে ওকে নিয়ে আসবে, মালবিকা।”
“ওমা ,তা-ই!সে তো শুনিচি মেমসাহেব দিদিমণিদের ইস্কুল! সেখানেও এইসব শেখাবে?”
“তবেই বোঝ্, নে এবারে তোর দুঃখু ঘুচলো তো। যা গিয়ে কাজে মন দে ,আর শোন্ কাল বিকেলে রুটি করার দরকার নেই।ওরাও আসবে , সকলের জন্য লুচি মাংস, বেশী করে বানাবি,তুইও বাড়ির জন্য নিয়ে যাস্।”
“সে হবেখন, আর শোনো এরপর আমার জন্য একখানা টি,ভির ঢাকনা বানিয়ে দিও তো।”
“ওমনি বায়না শুরু হলো ,যা তো এখন কাজে মন দে।”
তা এটুকু বায়না সে করতেই পারে। বহুদিন ধরেই রয়েছে এই বাড়িতে, ইন্দিরা আর অমলেশের সংসারে, তাঁদের স্বঘোষিত অভিভাবক আর সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে। এখন ও-ই বোধহয় এই নিঃসন্তান দম্পতিটির সবচাইতে কাছের মানুষ-রক্তের সম্পর্কের অন্যান্য পরিজনদের চাইতেও বেশি। তারা মাঝে মাঝে ফোনে খবর নেয় না তা নয় তবে তাদের আর সময় কোথায়! এই মিনতিই বলতে গেলে সর্বক্ষণের সাথী।
সকাল বেলা নিজের সংসার কিছুটা সামলে ,সে চলে আসে এই বাড়িতে, দুপুর বেলা কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি যায়, আবার বিকেল হতেই চলে আসে, ইন্দিরার সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ সেরে , ছাদের দরজা বন্ধ করা থেকে শুরু করে মশারি টাঙিয়ে, মায় টিপয়ে জলের গ্লাস, বোতল রেখে, রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফেরে। মোটকথা জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ, এমনকি টুকটাক কাজে মিস্ত্রি ধরে আনা থেকে, ঠিকে কাজের লোকের উপরে ছড়ি ঘোরানো , সব কিছুই তার আওতায় পড়ে।
মিনতি, নীচে নেমে গেল। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে , ইন্দিরা আবার ডুবে যাচ্ছিলেন নিজের ভাবনায়।
তাঁদের একতলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বেশ কয়েকবছর আগে মালবিকারা ভাড়ায় এসেছিলো,বিন্দি তখন এইটুকু ,বোধহয় বছরখানেকের। দেখতে দেখতে বছর পাঁচেক কেটে গেলো। বিন্দি,এই বাড়িতেই বড়ো হলো, খিলখিল হাসিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে, উপর নীচে ছুটোছুটি করে বেড়াতো, সংসারটা বেশ ভরভরতি লাগতো, তারপর তো নিজেরা ফ্ল্যাট বানিয়ে চলে গেছে,ঘরদুয়ার আবার ফাঁকা।তবে যোগাযোগ আছে। এই তো মাসছয়েক আগে মালবিকার এন্-আর- আই দিদি আলোলিকা দেশে এসে দেখা করতে এসেছিল তাঁদের সঙ্গে, পারফিউম, ক্রিম,ব্যাগ, হ্যানা ত্যানা, আরও কতো উপহার নিয়ে। হঠাৎ একটা কথা মনে করে হাসি পেয়ে গেল। ইন্দিরা ওকেও খান দুই -তিন,হাতে বোনা বড়ো বড়ো লেশের ঢাকনা উপহার দিয়েছিলেন ।কী যে খুশি হয়েছিলো! দেশে ফিরে নিজের ঘরে , নানা কর্ণার টেবিলে সেগুলি পেতে সাজিয়ে গুছিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে।
ও, খুশি হয়েছে, ব্যাস্, ওইটুকুই ইন্দিরার আনন্দ, আর কী চাই!পরদিন বিকেলবেলায় বিন্দিকে নিয়ে চলে এলো মালবিকা।বিন্দিকে হাতে ধরে কুরুশকাঠি ধরার কায়দা থেকে, আরম্ভ করে বোনার প্রাথমিক ধাপটুকু শিখিয়ে দিলেন ইন্দিরা। এরপর ক্লাশে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। তাছাড়া তিনি তো রইলেনই।
ইন্দিরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলেন, মালবিকা কেমন যেন একটু উশখুশ করছে।বেশ বুঝতে পারছিলেন ওর আরও কিছু বলার আছে। শেষটায় ইন্দিরাই আগ বাড়িয়ে বললেন
“নাও এবারে কী বলবে বলে ফেলো তো।মালবিকা অবাক—
“কী করে বুঝলেন আমি কিছু বলবো?”
“ভুলে যাও কেন আমাদের বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।”
মালবিকা এবারে অকপট হলো।
সঙ্গে আনা বড়োসড়ো ব্যাগ থেকে একগাদা লেশবোনার রেশমী সুতো আর ক্রচেট ডিজাইনের বই ইন্দিরার হাতে দিয়ে বললো
“দিদি পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
এইসঙ্গে একখানা আবদারও আছে।“শুনি কী আবদার!”
“আপনি দিদিকে যে লেসের ছোট বড়ো নানারকমের ঢাকা বুনে দিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে দিদির এক বিদেশিনী বান্ধবীর খুব পছন্দ হয়েছে …”
“বুঝেছি তারও গোটাকতক চাই, তাই তো! বেশ তো…”
” হ্যাঁ চাই তো বটেই, তবে তার চাহিদা আরও একটু বেশি।
এইসব জিনিসগুলো একসময়ে খুব পপুলার ছিলো,বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সেকথা তো জানেনই। তারপর মাঝে ফ্যাশন উঠে গিয়েছিলো। ইদানিংকালে আবার নতুন করে সে ফ্যাশান চালু হয়েছে, যাকে বলে “ইন-থিং”। পোশাক আশাকে লেসের কাজের খুব চাহিদা।
ওদিকে দিদির বান্ধবীটির একটা ছোটখাটো ফ্যাশান-স্টোর্স,আছে,ও চাইছিলো,যদি লেসের কিছু স্টক দোকানে রাখা যায়। তুমি যদি রাজি থাকো…”“ও বাবা , সে তো অনেক বড়ো ব্যাপার , আমি শখের কারবারি, এইসব কি করে সামলাবো?”
“শোনো না , দিদির আরও একটু পরিকল্পনা রয়েছে। দিদি বলছিলো, আমাদের দেশে সেলাই করে সংসার চালায় এমন অনেক দুস্থ মহিলা আছেন, তাদের যদি তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দাও, হয়তো তোমার মতো এতো ভালো কাজ হবেনা তবু তাদের দিয়েই যদি নানা ডিজাইনের লেসের টেবিল ক্লথ, বেডকাভার তৈরি করানো যায়!!! মাল মেটিরিয়াল জোগান দেওয়া, থেকে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট ওদেশে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা,সব ওদের।”
“কী বলছো ! এই বয়সে কি এইসব সম্ভব, তাছাড়া এটা তো আমার মনের আনন্দের ব্যাপার , না না এটাকে ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যেতে মন চায় না।”
” শোনো না, তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে, শুধু ওদের শিখিয়ে, ভুলভ্রান্তি শুধরিয়ে, নতুন নতুন ডিজাইনের কাজ করিয়ে নেবে। ইচ্ছে হলে তুমিও বুনবে, আগে যেমন নিজের জন্য বুনতে, ইচ্ছে না করলে নয়। ভেবে দেখো না এতে তোমারও শখ মিটবে , কিছু গরীব মেয়েরাও কাজ পাবে। খুব কিছু মন্দ হবে কি?”
এইরকম আচমকা প্রস্তাব এলে চট্ করে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় বিশেষ করে এই বয়সে এসে?
বেশ কিছুদিন দোনামনা করতে করতে অবশেষে রাজিই হয়ে গেলেন ইন্দিরা। ভাবছিলেন, সত্যিই যদি তাঁর শখটা আরও একটু বিস্তৃত করলে কয়েকজনের আর্থিক সাহায্য হয়, তাহলে মন্দ কী! কতো মানুষ তো কতো ভালো কাজ করেন,তাই তো এই দুঃসময়েও পৃথিবীটা চলে!মাস ছয়েকের মধ্যেই ব্যাপারটা বেশ চালু হয়ে গেল।
মিনতির উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। সে-ই, স্বনিযুক্ত ম্যানেজার। হম্বিতম্বি ছুটোছুটি করে ব্যাপারটা বেশ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইন্দিরাও আজকাল মনের সুখে নিত্যনতুন ডিজাইন তুলিয়ে দেন মেয়েদের।সঙ্গে নিজের শখের বোনাও তো আছেই। মিনতিসহ অনেকক’টি মেয়ে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছে। আজকাল দেশের মধ্যেও এই হাতে বোনা লেসের চাহিদা বাড়ছে।
খবরের কাগজের প্রতিবেদনে অনেকেই ব্যাপারটা এখন জেনে গেছেন। আত্মীয় স্বজনদের অভিনন্দনে মনে মনে হাসেন তিনি।
এবারে পুজোর সময়, বিদেশেই আলোলিকারা স্টল দিয়েছিলো, সেখানে তাঁদের হাতের কাজ বেশ সাড়া ফেলেছে। বাংলাদেশের কৃষ্টিমনস্ক বঙ্গসন্তানদের আগ্রহে হয়তো বা আগামী বছর বিদেশের প্লেনে চড়তে চলেছেন ইন্দিরা আর অমলেশ।
সূর্যাস্তের শোভায় মগ্ন থাকা ইন্দিরা ভাবেন তাঁর জীবনেও বুঝি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে অপরাহ্ণের আলো।সুমিতা দাশগুপ্ত।
-
গল্প- অজান্তে…
অজান্তে…
-শিলাবৃষ্টিআজকাল কেকাকে কেমন অচেনা লাগে!
সব সময় ব্যস্ততা দেখায়! সত্যিই কি ও এতটা ব্যস্ত! মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় রাজুর। কেকাকে ছাড়া এখন কিছুই সে ভাবতে পারেনা, অথচ “ভালোবাসি তোকে ভীষণ” এই কথাটা আজো বলা হয়ে ওঠেনি। ঠিক যখন বলি বলি করছে মন তখনই কেকার পরিবর্তন রাজুকে ভাবনায় ফেলে দেয়।
“হ্যালো কেকা ”
‘বল, কিরে কথা বল। তাড়াতাড়ি বল।’
” সবসময় এত তাড়া কেন তোর কেকা? ‘
” আছে বন্ধু, তাড়া আছে। তোকে তো জোজোর কথা বলাই হয়নি! কখন বলি বলতো? ”
রাজু অবাক হয়! প্রশ্ন করে
” জোজো? ”
” হ্যাঁ বন্ধু। বেস্ট ফ্রেণ্ড হিসেবে তোকেই আমার আগে বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু ফোনে এত কথা হয়? আর আমিও তোর সাথে বেশী কথা বলতে পারছিনা এখন! প্লিজ ডোন্ট মাইণ্ড রাজু।আসলে জোজো কি ভাববে.. তাই তোর সাথে গল্প করতে পারিনা।
ও আমাকে এত ভালোবাসে… তুই বিশ্বাস করতেও পারবিনা। আর আমিও। ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। ঠিক আছে রাখ। রাতে ফোন করিস।” বলেই লাইনটা কেটে দেয় কেকা। রাজু স্তম্ভিত। ও ভাবতেই পারেনা কেকা ওকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারে!
সেই ইলেভেন থেকে ওরা এক আত্মা এক প্রাণ যেন। এতগুলো বছরেও কেকাকে সে চিনতে পারলো না! রাজু ভালো জবের জন্য কম্পিটিটিভ এক্সাম দিচ্ছে, কলকাতায় পড়াশোনার জন্য থাকতে হয় ঠিকই তবে মন পড়ে থাকে নিজের ছোট্ট শহর গোপালপুরে, কেকার কাছে।
আজ আর কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসানো যাবে না। বিকেল বেলা রাজু এলোমেলো চিন্তা নিয়ে ময়দানের দিকে
হাঁটতে থাকলো এদিক ওদিক।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! কেকার জন্যই নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে ভেবেছিল৷ কিন্তু আর কিছুই হবেনা তার দ্বারা।
রাতে কেকাকে ফোন করলো রাজু। আজ তাকে জানতেই হবে সব।
“হ্যালো হ্যালো”
” ওয়েট কর একটু। জোজোর ঘুম ভেঙে যাবে। আমি ব্যালকনিতে যাই! ” ফিসফিসিয়ে বলে কেকা।
“হোয়াট!! ”
মিনিট খানিক চুপচাপ।
” বল, আসলে জোজো আর আমি আজ এক বিছানাতেই…. ”
“মানে? !”
“কি আবার মানে! ”
“কাকিমা কাকু কোথায়! ”
” মামাবাড়ি গেছে। খুব বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। ফিরতে পারেনি।”
” আর তুই! ”
” নারে একটুও একা লাগছেনা, জোজো আছে তো! ও এত সুইট না… তুই ভাবতেও পারবিনা। আমার শয়নে স্বপনে শুধু এখন জোজো আর জোজো! বাপি আর মা নেই বলে ওকে আমি আমার কাছেই ডেকে নিয়েছি! আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছি। আর জোজোও কিন্তু ..
রাজু মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় খাটে।
এই কেকাকে সে ভালোবেসেছিল! ভাবতেই কেমন লাগছে। কেকা এত নোংরা?
সারারাত ঘুমাতে পারেনা রাজু। মাথায় খুব যন্ত্রণা! বার বার হোয়াটসঅ্যাপ খোলে। পুরোনো চ্যাটগুলো দেখে। কত রাত অব্দি তারা গল্প করতো। কেকা বলেছিল সেটে কিছু সমস্যা হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ খুলতে পারলেও মেসেজ করতে পারছেনা।
নাহ, এ জীবন রাজু আর রাখবেনা। বেঁচে থেকে কী হবে। কেকা তো এখন অন্যের।ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। এলার্ম বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সেকেণ্ড এপ্রিল সকাল সাতটা।
অভ্যেস বশত হোয়াটসঅ্যাপ খুলে তাকালো।
কেকার মেসেজ এসেছে!..আজ দেখছি মেসেজ করতে পারলাম।
গুড মর্নিং রাজু
এই দেখ – আমার জোজোকে।…কিন্তু ডাউনলোড হচ্ছেনা ছবিটা। রাজু
দেখতেও চায়না। নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশী সুপুরুষ এই জোজো!
হ্যাঁ হয়েছে ডাউনলোড। কিন্তু….
কোথায় জোজো? এতো একটা বিদেশী কুকুরবাচ্চার ছবি!!
…..
টাইপিং কেকা…দেখলি আমার জোজোকে? কেমন লাগলো? দারুণ না? তোকে আমি পরে ভিডিও কল করে জোজোকে ভালোভাবে দেখাতে চাই । বাই।
তুই কবে আসবি রাজু? আমি ভীষণ ভীষণ মিস করছি তোকে…মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে রাজু। অজান্তে দুটো চোখ জলে ভরে গেছে।
কেকা না জেনেই এপ্রিল ফুল বানিয়ে দিয়েছে তাকে কাল সারাদিন সারারাত।
“আই লাভ ইউ কেকা, আমি আসছি খুব তাড়াতাড়ি…” মনে মনে বলে ওঠে রাজু। -
গল্প- কাল রাতে কে এসেছিল
কাল রাতে কে এসেছিল
-সুনির্মল বসুরাত্রি গভীর। চোখে ঘুম নেই। জানালায় জোসনার আলো। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নিচে সদর দরোজা খোলার শব্দ।
দোতলার সিঁড়িতে যেন কার নুপুরের ধ্বনি বাজে। কে এলো। কেউ কি এলো। আমার ঘুম ভাঙানিয়া এই মধ্যরাতে কে এলো। জানালার নিচে ফুলের বাগান।
নীলাঞ্জনা এসেছে। আমার অতীত। আমার ভালোবাসা। বললাম, এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল,
সব সময় মনে পড়ে। আসা হয়ে ওঠে না।
আমি তো তোমাকে ভুলে যেতেই চাই।
সে কি, সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে না,
কি লাভ,
ক্ষতিও তো নেই,
আছে,
কি,
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে,
সুশোভন, তুমি কখনো বাসি রজনীগন্ধার গন্ধ শুকেছো,
না,
শুকনো ফুলের গন্ধ অতীতের সুগন্ধ বয়ে আনে,
সেসব কথা মনে করতে চাই না,
কেন,
আমাকে আমার মত থাকতে দাও,
গড়িয়াহাটের বিকেল, মিলেনিয়াম পার্ক, কফি হাউসের সন্ধ্যেগুলো মনে নেই বুঝি,
আছে, তোমার পথের থেকে আমার পথ বহুদূর,
আমরা কি আবার নতুন করে শুরু করতে পারি না,
না, তা হয় না। অনেক দেরি হয়ে গেছে।আমি মানছি সুশোভন, সেদিন আমি তোমার কাছ থেকে চলে গিয়ে ভুল করেছিলাম, মনীষ যে শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সে কথা আমি ভাবতে পারিনি,
ওসব কথা জেনে আমার কি লাভ, তুমি ফিরে যাও নীলাঞ্জনা,
আমাকে তুমি ভুলে যাবে বলছো,
জানিনা, ভাবি নি কিছু, বলতে পারব না,
তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো,
না,
কিভাবে বাকি জীবনটা কাটাবে,
ভেবে দেখিনি, আমার অন্ধকার ঘর ভালো, আলোতে এলে, আমার চোখ জ্বালা করে।
তথাকথিত সভ্য মানুষদের দেখলে আমি ভয় পাই।
তুমি চলে যাও নীলাঞ্জনা।আমি তাহলে কি নিয়ে থাকবো,
সেদিনের স্মৃতির মধ্যে, সেইসব কৃষ্ণচূড়ার দিন, সেইসব রাতের স্মৃতি,
সুশোভন, তুমি বড় নিষ্ঠুর,
হা হা, তাই বুঝি,
হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘ। প্রবল ঝড়ের শব্দ। গাছপালার মাতামাতি।
সুশোভন আমি চলে যাচ্ছি। আমি আর কখনো তোমার কাছে আসবো না।
আমাকে ভুলে যেও নীলাঞ্জনা। যদি জীবনে এইসব ঝড় একদিন থেমে যায়, আমি নিজেই তোমার কাছে সেদিন ফিরে যাবো।হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুশোভনের।
মনে পড়ল, গতকাল বিকেলে গড়িয়াহাট মোড়ে এক ঝলক নীলাঞ্জনাকে ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যেতে দেখেছিল। উড়ু উড়ু অবাধ্য চুলগুলোকে সামলে নিয়ে ও তখন টালিগঞ্জগামী বাস ধরবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল।
-
গল্প- প্রতিশোধ
প্রতিশোধ
– শিলাবৃষ্টিঅণু ছোটবেলার সেই অপমান এখনো ভুলতে পারেনি। প্রায় সাত আট বছর কেটে গেছে, তবু যেন সেই দিনটার ছবি চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় সে। বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে অনেক আমগাছ, আর প্রতিটা গাছে শয়ে শয়ে কাঁচাপাকা আম ঝুলে ছিল, মাঝখানে পুকুরে পড়ে কত নষ্টও হয়ে গেছে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পাড়ার ছেলেমেয়েরা আর অণু আম পাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আর ঠিক তার পরের দিন রবিবার দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিচ্ছে, তখন চুপিচুপি ওরা বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে পেছনের ছোট গেট টপকিয়ে ঢুকে পড়ে। কয়েকজন গাছে উঠে আম পেড়ে ফেলছিল মাটিতে, আর বাকিরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে পলিপ্যাকে ভরছিল। প্রত্যেকে পলি প্যাক নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু অণু ভুলে গিয়েছিল। তাই সে গাছে বসে বসেই আম খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেলছিল গাছের পাশের একটা ঝোপে। আর নীচু গলায় বলছিল ‘আমার তোলা আম কেউ নিবিনা কিন্ত’ বন্ধুরা মেনে নেয় তার কথা।
হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কাশির আওয়াজ পেয়ে সবাই সচকিত হয়ে গাছ থেকে নেমে একে একে দ্রুত আম বাগান থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু অণু গাছ থেকে নেমে ঝোপের ভেতর তার ফেলা আমগুলো খুঁজতে থাকে। তার বেরনো আর হয়না, দুহাতে কোনরকমে আমগুলো আঁকড়ে ধরে উঠতে যাবে, পেছন থেকে বিনোদকাকার বাড়িতে কাজ করে যে লোকটা মানে গনেশ নামের ছেলেটা তাকে আচমকা ধরে ফেলে, আতঙ্কে অণুর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। গনেশের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেও পারেনা। সে টানতে টানতে বিনোদকাকার ঘরে নিয়ে যায় তাকে। বিনোদকাকার সবে তখন দিবানিদ্রা ভেঙেছে। হাই তুলে জিজ্ঞেস করে- এ আবার কে?
গণেশ বলে- চোর বাবু, চোর। এই বাগানের আমটা কলাটা চুরি করে নিয়ে যায়, নারকেল পড়লেই হলো, সব নিয়ে পালায়। আজ তকে তকে ছিলাম, আম গাছ থেকে নামতেই পাকড়াও করে এনেছি… বিনোদকাকা শুনে রেগে বলে- বেশ করেছিস, একটা ঘরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে এখন রেখে দে।
সেদিন কান্নাকাটি করেও ছাড়া পায়নি অণু। সন্ধ্যাবেলায় যা ঘটলো ওই দশ বছর বয়েসেও সেই অপমান হজম করতে পারেনি সে।
গ্রামের মাঝখানে একটা পুরোনো রাধামাধবের মন্দির আছে। সন্ধেবেলায় গ্রামের অনেক মানুষ বিশেষত মুরুব্বিরা মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দিরে গিয়ে বসে, কথাবার্তা বলে, তাস খেলে, চা খায়..বিনোদকাকার সেই গণেশ দরজা খুলে অণুকে নিয়ে বিনোদকাকার পেছনে পেছনে সেই নাট মন্দিরে আসে। সবে আরতি শেষ হয়েছে, সবাই জড়ো হয়েছে। এমন সময় বিনোদকাকা মুখ খোলে- দেখো গো তোমরা সবাই চোর দেখো
সবাই অবাক হয়ে অণুর দিকে তাকায়।
-যারা চোর দেখনি কোনদিন দেখে নাও আজ। এই মেয়েটা আমার বাড়ির বাগানের ফলমুল রোজ চুরি করে, আজ গনেশ ধরেছে চোরকে।
সবাই এটা ওটা বলতে থাকে। গুঞ্জন শোনা যায়। এই রকম সময়ে অণুর জ্যেঠু এসে পৌঁছায়। সব শুনে ঠাস করে অণুর দুগালে দুটো চড় মারে। তারপরের কথা আর ভাবতে চায়না অণু। শুধু কানে এখনো শুনতে পায় তার নিজের বলা শেষ কথাগুলোই- কাকা মনে রাখবে তুমি, একমাঘে শীত যায়না। এ কথা আমি মায়ের কাছে শিখেছি, এ মিথ্যে হবেনা দেখো।
বাচ্চা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সবাই সেদিন হেসে ফেলেছিল।এই ঘটনার পরে শীত এসেছে আর গেছে প্রায় সাতবার।
……..
কলেজে যাওয়ার সময় খেতে বসেছে অণু রান্নাঘরে, কানে এলো লক্ষ্মীমাসী মাকে বলছে- বিনোদ ঘোষ লোকটার স্বভাব আর পাল্টাবে না!
মা বললো- কেন রে লক্ষ্মী কি হয়েছে?
-কেন আবার! ঘরে বউ ছেলে মেয়ে থাকতে বুড়োটা আবার বিধবা ওই রাধার উপর কৃপা করেছে। রাধার ঘরে তো আর কেউই নেই। বিনোদের পরিবার পুরী গেছে পরশু আর সেও মওকা পেয়ে রাধার ঘরে মউজ করছে।
-সে কি রে!
-হ্যাঁ, গো হ্যাঁ…পুরোনো অপমানটার শোধ এবারে হয়তো নেওয়া যাবে! অণু সব প্ল্যান তৈরী করে সারাদিন ধরে। তারপর গ্রামের অনেক মানুষকে জড়ো করে সেদিন রাত্রি বারোটাতে রাধার বাড়ির মেন দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে অনবরত। রাধা দরজা খুলতে বাধ্য হয়। সবাই ঘরে ঢুকে অণুর কথা মেলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বিনোদকে দেখতে পায়না। অবশেষে খিড়কির বাথরুম থেকে বিনোদ ঘোষকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে অণু। সবার কাছে প্রমাণ হয়ে যায় বিনোদ ঘোষের চরিত্র।
হা হা করে হাসতে হাসতে অণু বলে- সাত
বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে কাকা। একটা বাচ্চা মেয়ে একদিন তোমার বাগানের কটা আম পেড়েছিল বলে তুমি কি করেছিলে? সেদিন আমি বলেছিলাম- এক মাঘে শীত যায়না! মনে পড়ছে? আমিই সেই অনুপমা! যাকে ঘরে আটকে রেখে তুমি মজা দেখেছ! যাকে নাটমন্দিরে এনে সকলের কাছে অপমান করেছ! যাকে মার খাইয়েছ! আজ তোমার কীর্তি সকলের সামনে এনে আমার অপমানের শোধ নিতে পারলাম।
সকলে ছি ছি করতে করতে বাড়ি চলে গেল। অণু আজ শান্ত হতে পারলো। আর
রাধা অপমানে লজ্জায় বিনোদকে বের করে দিয়ে দরজাটা সজোরে লাগিয়ে দিল। টাকার দম্ভে ফুলে ওঠা বিনোদ ঘোষ স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হবে সে কোনদিন! -
গল্প- কেঁচোর বিয়ে
কেঁচোর বিয়ে
– মুনমুন রাহাঘটক আমাদের পুরো ঠকিয়েছে। মুখে বল্লে মেয়ে নাকি রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী। আর এখন দেখ পাড়াতে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের স্বরূপ প্রকাশ পেল তো! পাড়ার লোকেরাই তো বলল, মেয়ে নাকি পাড়ার গুণ্ডা! মেয়ের নাম মুনিয়া হলে কি হবে পাড়ার লোকে তাকে নাকি মুন্না ভাই বলে ডাকে!
মাগো মা শেষে কিনা ঘটকটা আমাদের এমন করে ঠকাল!মেয়ে দেখতে এসে এমনই হা-হুতাশ করছিলেন কাঞ্চনের মা সুরমা দেবী। কাঞ্চনের বাবা পরেশ বাবু বললেন, আঃ, বারবার ঠকিয়েছে ঠকিয়েছে বলছো কেন বল দেখি! মেয়ের গুনের কথা শুনেই তুমি ভিরমী খেয়ে চলে এলে। আর একটু অপেক্ষা করলে মেয়ের রূপটাও দেখতে পেতাম। তখন বোঝা যেত ঘটক কতটা সত্যি বলেছে!
-একদম ফালতু কথা বলবে না। ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুরমা দেবী তোমার তো সখ কম নয়! আবার রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলছো? বলি যদি ডানা কাটা পরীও হয় তবু কি ছেলের সাথে এমন মেয়ের বিয়ে দেব? রাত আটটা বাজে তবু মেয়ে বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেছে? না পড়ার কোন মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা পণ না দেওয়ার জন্য ছেলে ফেরত নিয়ে যাবে বলছে সেখানে! আবার তো শুনে এলাম সেখানে গণ্ডগোল করে কার নাক এক ঘুঁষিতে ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা রে বাবা আর থাকি ঐ বাড়ি! কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছি ।
কাঞ্চন এতক্ষন চুপচাপই ছিল। বেচারার মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। একে তো রোগা পাতলা ভীতু ভীতু চেহারার জন্য কোন মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয় না। যদিবা অনেক দিন পর একটা মেয়ের বাড়ি থেকে আগ্রহ দেখাল তাও মায়ের জন্য সেটাও মাটি হল! মেয়ে মারকুটে শুনেই চলে এল। তারপর আবার এসব কথা বলেই চলেছে। এখন আর সহ্য করতে না পেরে সে বলল, একদম ক্যানসেল না করে একটা বার কথা বল্লে দোষ কি হতো!
সুরমা দেবী চোখ পাকিয়ে বললেন, বাবু একদম চুপ কর বলছি। আর যেন এসব কথা না শুনি।
ব্যাস, মায়ের ভয়ে বাবু কাবু। এমন স্বভাবের জন্যই পাড়ার লোকে তাকে কাঞ্চন নয় কেঁচো বলে ডাকে।এসব তর্ক বিতর্ক করতে করতেই পাত্রী দেখতে আসা পাত্রপক্ষের তিনজন চলছিল শুনশান রাস্তা দিয়ে। কিন্ত কপাল তাদের মন্দ ছিল সেদিন, তাই তো এই পাড়ার উঠতি মাস্তান বাচ্চু আর তার দলবলের সামনে পড়তে হল। সরমা দেবীর গয়না, পরেশ বাবুর ঘড়ি, মানিব্যাগ হস্তগত করে বাচ্চু এগোলো কাঞ্চনের দিকে । হাতের ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে টান মারল ফোনটা। অফিসের দরকারি ইনফরমেশন থাকা ফোনটা কাঞ্চন ছাড়তে একটু ইতস্তত করতেই বাচ্চুর মেজাজ গেল চটে। কাঞ্চনকে সোজা চেপে ধরল সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টে। গলায় শান দেওয়া ছুরি তাক করে কিছু হুমকি দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।
একটা বিরাশি সিক্কার ঘুঁষি এসে পড়ল বাচ্চুর গালে । ঠিক হিরো থুরি হিরোইন টাইপের এন্ট্রি দিল আমাদের মুনিয়া ওরফে মুন্না ভাই। কলার চেপে বলল, আবার আমার পাড়ায় মাস্তান গিরি করছিস! আর যদি দেখি না মেরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব। বাচ্চু তখন অবশ্য এসব শোনার অবস্থায় নেই। ঘুঁষির চোটে সদ্য উপড়ে আসা দাঁত দুটি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষনে পগারপার। কেঁচো তখনও ল্যাম্পপোষ্টে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুন্না বাচ্চুর কবল থেকে সব জিনিস উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিল। তারপর কেঁচোকে বলল, উঠুন উঠুন এরকম ভয় পেলে চলবে? ভয়কে তো জয় করতে হবে! তবে না জীবনের মজা পাবেন।
মুন্নার কথায় কেঁচো চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। বুকটা কেমন যেন একটা চিনচিন করে উঠল। এই প্রথম কেউ তার ভয় পাওয়া নিয়ে উপহাস না করে সাহস দিল। বুকের ব্যাথাটা অন্তরে গেঁথে যেতে যেতে কাঞ্চনের কানে এল তার মায়ের মধুর গলা।দেখ দেখি বাবা থুরি মা ! আমি তো আমার ছেলেকে এটাই বোঝাতে পারি না ভয় পেলে কি সবসময় চলে! আজ তুমি ভাগ্যিস ছিলে তাই আমরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। দেখে ভাল লাগল মা তুমি মেয়ে হয়েও কত্ত সাহসী।
-কেন মাসিমা, মেয়েরা সাহসী হলেই অবাক হতে হয়! আগে কখনও সাহসী মেয়ে দেখেননি? কালী দুর্গা এরাও তো মেয়ে। তারা যদি অসুর মারতে পারে আমি কটা পাড়ার মাস্তান পেটাতে পারব না?
পরেশ বাবু বললেন, ঠিকই তো । তা মা তোমার বাড়ি বুঝি এপাড়াতেই?
মুনিয়া তার বাড়ির যা ঠিকানা দিল তাতে কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তারা এই মেয়েকেই দেখতে গিয়েছিল। সুরমা দেবী তখন আবেগে গদগদ। বললেন, আমি ঠিক জানতাম আমার গোপাল আমায় কিছুতেই ভুল মেয়ের বাড়ি পাঠাতেই পারে না!
মুন্নাও বুঝে গেছে এই হল সেই লোকগুলোই যাদের কথা তার বাবা মা বলছিল, যারা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার নামে খানিক অকথা কুকথা বলে এসেছে। রাগে তার মাথাটা গেল গরম হয়ে। দাঁত কিরমির করতে করতে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই কেলেঙ্কারি।
সুরমা দেবী এমন মেয়ে বৌমা হবে ভেবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে ব্যাগে রাখা গোপালকে ব্যাগ সমেত মাথায় ঠেকিয়ে নীচে নামানোর সময় সোজা নামালেন মুন্নার মাথায়। এমন বড়সড় পিতলের গোপালের বারি খেয়ে মুন্না লুটিয়ে পড়ল কেঁচোর কোলে।মুন্না চোখ খুলে দেখল বাবা মা সবাই চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ভীতু ভীতু মুখ যার দুচোখ জুড়ে এখন চিন্তার ছায়া। কেঁচোর চিন্তিত চোখ দুটো দেখে মুন্নার বুকটা কেঁপে উঠল। তাকে সবাই সাহসী শক্তপোক্ত বলেই জানে কিন্ত তারও যে কারও চিন্তার কারণ হতে ইচ্ছা করে তা কেউ ভাবেইনি । কেঁচো আর মুন্নার উভয়েরই ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা বেড়ে চলেছে একে অপরের জন্য।
মুন্নাকে চোখ খুলতে দেখেই সোফাতে বসা সরমা দেবী কালী ঠাকুর হয়ে গেছেন। এক হাত জিভ বার করে বললেন, দেখ দেখি মা বড় ভুল করে ফেললাম। তোমাকে আঘাত করার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার ছিল না। তবু কি করে জানি হয়ে গেল। আসলে বুঝতে পারিনি আমার গোপাল তোমায় আশীর্বাদ করতে উপর থেকে ঝাঁপ দেবেন।
মুন্না একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
ঠিক আছে মাসিমা কোন ব্যাপার নয় এরম একটু আধটু চোটে মুনিয়ার কিছু হয় না।সরমা দেবী বললেন, এখন আর মাসিমা শুনবো না এবার থেকে মা বলতে হবে।
মায়ের কথায় তো কেঁচোর বুক উথালপাথাল।
মুন্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনটাও যে ততক্ষনে বাঁধা পড়েছে ঐ ভীতু কেঁচোটার কাছে।
মুন্নার বাবা মা একটু ইতস্তত করছে। যারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ কথা বলে গেল তারাই কিনা বিয়ে পাকা করতে চাইছে! তাদের মনের অবস্থা বুঝে পরেশ বাবু বললেন, আসলে আমাদের ধারনা ছিল ঘরের বৌ লক্ষ্মীই হয় কিন্ত আপনাদের মেয়ে সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে । ঘরের বৌ যেমন লক্ষ্মী হয় তেমন কালী, দূর্গাও হয়।ব্যাস আর কি মধুরেনো সমাপতে চার হাত চার চোখ এক হল। সরমা দেবীদের বৌমা সংজ্ঞার ট্যাবু ভাঙল। বাচ্চু দলবল নিয়ে মুন্নার বিয়েতে খেটে দেওয়ার সাথে সাথে ভাঙা দাঁতেই নেমতন্নও খেল। কেঁচোর মুন্না আর মুন্নার কেঁচো হল।
ঘটক আমাদের পুরো ঠকিয়েছে। মুখে বল্লে মেয়ে নাকি রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী । আর এখন দেখ পাড়াতে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের স্বরূপ প্রকাশ পেল তো ! পাড়ার লোকেরাই তো বলল , মেয়ে নাকি পাড়ার গুণ্ডা! মেয়ের নাম মুনিয়া হলে কি হবে পাড়ার লোকে তাকে নাকি মুন্না ভাই বলে ডাকে !
মাগো মা শেষে কিনা ঘটকটা আমাদের এমন করে ঠকাল !মেয়ে দেখতে এসে এমনই হাহুতাস করছিলেন কাঞ্চনের মা সুরমা দেবী । কাঞ্চনের বাবা পরেশ বাবু বললেন,
আঃ , বারবার ঠকিয়েছে ঠকিয়েছে বলছো কেন বল দেখি ! মেয়ের গুনের কথা শুনেই তুমি ভিরমী খেয়ে চলে এলে । আর একটু অপেক্ষা করলে মেয়ের রূপটাও দেখতে পেতাম। তখন বোঝা যেত ঘটক কতটা সত্যি বলেছে !একদম ফালতু কথা বলবে না ।
ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুরমা দেবী তোমার তো সখ কম নয়! আবার রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলছো ? বলি যদি ডানা কাটা পরীও হয় তবু কি ছেলের সাথে এমন মেয়ের বিয়ে দেবো ? রাত আটটা বাজে তবু মেয়ে বাড়ি ফেরে নি । কোথায় গেছে , না পড়ার কোন মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা পণ না দেওয়ার জন্য ছেলে ফেরত নিয়ে যাবে বলছে সেখানে ! আবার তো শুনে এলাম সেখানে গণ্ডগোল করে কার নাক এক ঘুঁষিতে ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা রে বাবা আর থাকি ঐ বাড়ি! কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছি ।কাঞ্চন এতক্ষন চুপচাপই ছিল। বেচারার মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। একে তো রোগা পাতলা ভীতু ভীতু চেহারার জন্য কোন মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয় না । যদিবা অনেক দিন পর একটা মেয়ের বাড়ি থেকে আগ্রহ দেখাল তাও মায়ের জন্য সেটাও মাটি হল ! মেয়ে মারকুটে শুনেই চলে এল । তারপর আবার এসব কথা বলেই চলেছে। এখন আর সহ্য করতে না পেরে সে বলল ,
একদম ক্যানসেল না করে একটা বার কথা বল্লে দোষ কি হতো !
সুরমা দেবী চোখ পাকিয়ে বল্লেন,
বাবু একদম চুপ কর বলছি । আর যেন এসব কথা না শুনি ।
ব্যাস , মায়ের ভয়ে বাবু কাবু । এমন স্বভাবের জন্যই পাড়ার লোকে তাকে কাঞ্চন নয় কেঁচো বলে ডাকে ।
এসব তর্ক বিতর্ক করতে করতেই পাত্রী দেখতে আসা পাত্র পক্ষের তিনজন চলছিল শুনশান রাস্তা দিয়ে। কিন্ত কপাল তাদের মন্দ ছিল সেদিন , তাই তো এই পাড়ার উঠতি মাস্তান বাচ্চু আর তার দলবলের সামনে পড়তে হল । সরমা দেবীর গয়না পরেশ বাবুর ঘড়ি মানিব্যাগ হস্তগত করে বাচ্চু এগোলো কাঞ্চনের দিকে । হাতের ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে টান মারল ফোনটা। অফিসের দরকারি ইনফরমেশন থাকা ফোনটা কাঞ্চন ছাড়তে একটু ইতস্তত করতেই বাচ্চুর মেজাজ গেল চটে । কাঞ্চন কে সোজা চেপে ধরল সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টে গলায় শান দেওয়া ছুরি তাক করে কিছু হুমকি দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা ।
একটা বিরাশি সিক্কার ঘুঁষি এসে পড়ল বাচ্চুর গালে । ঠিক হিরো থুরি হিরোইন টাইপের এন্ট্রি দিল আমাদের মুনিয়া ওরফে মুন্না ভাই। কলার চেপে বল্ল ,
আবার আমার পাড়ায় মাস্তান গিরি করছিস! আর যদি দেখি না মেরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব । বাচ্চু তখন অবশ্য এসব শোনার অবস্থায় নেই। ঘুঁষির চোটে সদ্য উপড়ে আসা দাঁত দুটি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষনে পগারপার। কেঁচো তখনও ল্যাম্পপোষ্টে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুন্না বাচ্চুর কবল থেকে সব জিনিস উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিল । তারপর কেঁচোকে বলল ,
উঠুন উঠুন এরকম ভয় পেলে চলবে ? ভয়কে তো জয় করতে হবে ! তবে না জীবনের মজা পাবেন।
মুন্নার কথায় কেঁচো চোখ তুলে তাকাল তার দিকে । বুকটা কেমন যেন একটা চিনচিন করে উঠল । এই প্রথম কেউ তার ভয় পাওয়া নিয়ে উপহাস না করে সাহস দিল । বুকের ব্যাথাটা অন্তরে গেঁথে যেতে যেতে কাঞ্চনের কানে এল তার মায়ের মধুর গলা ।দেখ দেখি বাবা থুরি মা ! আমি তো আমার ছেলে কে এটাই বোঝাতে পারি না ভয় পেলে কি সবসময় চলে ! আজ তুমি ভাগ্যিস ছিলে তাই আমরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম । দেখে ভাল লাগল মা তুমি মেয়ে হয়েও কত্ত সাহসী ।
কেন মাসিমা , মেয়েরা সাহসী হলেই অবাক হতে হয়! আগে কখনও সাহসী মেয়ে দেখেন নি ? কালী দুর্গা এরাও তো মেয়ে। তারা যদি অসুর মারতে পারে আমি কটা পাড়ার মাস্তান পেটাতে পারব না ?
পরেশ বাবু বললেন,
ঠিকই তো । তা মা তোমার বাড়ি বুঝি এপাড়াতেই ?মুনিয়া তার বাড়ির যা ঠিকানা দিল তাতে কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তারা এই মেয়েকেই দেখতে গিয়েছিল । সুরমা দেবী তখন আবেগে গদগদ। বল্লেন,
আমি ঠিক জানতাম আমার গোপাল আমায় কিছুতেই ভুল মেয়ের বাড়ি পাঠাতেই পারে না !
মুন্নাও বুঝে গেছে এই হল সেই লোক গুলোই যাদের কথা তার বাবা মা বলছিল, যারা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার নামে খানিক অকথা কুকথা বলে এসেছে। রাগে তার মাথাটা গেল গরম হয়ে। দাঁত কিরমির করতে করতে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই কেলেঙ্কারি ।
সুরমা দেবী এমন মেয়ে বৌমা হবে ভেবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে ব্যাগে রাখা গোপাল কে ব্যাগ সমেত মাথায় ঠেকিয়ে নীচে নামানোর সময় সোজা নামালেন মুন্নার মাথায়। এমন বড়সড় পিতলের গোপালের বারি খেয়ে মুন্না লুটিয়ে পড়ল কেঁচোর কোলে ।মুন্না চোখ খুলে দেখল বাবা মা সবাই চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ভীতু ভীতু মুখ যার দুচোখ জুরে এখন চিন্তার ছায়া । কেঁচোর চিন্তিত চোখ দুটো দেখে মুন্নার বুকটা কেঁপে উঠল। তাকে সবাই সাহসী শক্তপোক্ত বলেই জানে কিন্ত তারও যে কারও চিন্তার কারণ হতে ইচ্ছা করে তা কেউ ভাবেই নি । কেঁচো আর মুন্নার উভয়েরই ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা বেড়ে চলেছে একে অপরের জন্য।
মুন্নাকে চোখ খুলতে দেখেই সোফাতে বসা সরমা দেবী কালী ঠাকুর হয়ে গেছেন। এক হাত জিভ বার করে বললেন ,
দেখ দেখি মা বড় ভুল করে ফেললাম। তোমাকে আঘাত করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার ছিল না । তবু কি করে জানি হয়ে গেল। আসলে বুঝতে পারি নি আমার গোপাল তোমায় আশীর্বাদ করতে উপর থেকে ঝাঁপ দেবেন ।
মুন্না একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
ঠিক আছে মাসিমা কোন ব্যাপার নয় এরম একটু আধটু চোটে মুনিয়ার কিছু হয় না ।সরমা দেবী বললেন,
এখন আর মাসিমা শুনবো না এবার থেকে মা বলতে হবে ।
মায়ের কথায় তো কেঁচোর বুক উথালপাথাল।
মুন্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনটাও যে ততক্ষনে বাঁধা পড়েছে ঐ ভীতু কেঁচোটার কাছে ।
মুন্নার বাবা মা একটু ইতস্তত করছে । যারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ কথা বলে গেল তারাই কিনা বিয়ে পাকা করতে চাইছে ! তাদের মনের অবস্থা বুঝে পরেশ বাবু বললেন,
আসলে আমাদের ধারনা ছিল ঘরের বৌ লক্ষ্মীই হয় কিন্ত আপনাদের মেয়ে সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে । ঘরের বৌ যেমন লক্ষ্মী হয় তেমন কালী , দূর্গাও হয়।ব্যাস আর কি মধুরেনো সমাপতে । চার হাত চার চোখ এক হল । সরমা দেবীদের বৌমা সঙ্গার ট্যাবু ভাঙল। বাচ্চু দলবল নিয়ে মুন্নার বিয়েতে খেটে দেওয়ার সাথে সাথে ভাঙা দাঁতেই নেমতন্নও খেল। কেঁচোর মুন্না আর মুন্নার কেঁচো হল ।।