গল্প

  • গল্প

    গল্প- নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য

    নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য
    -সুনির্মল বসু

    নীলাঞ্জনার সঙ্গে দেখা বিশ বছর বাদে। আসলে, দুর্গাপুর থার্মাল প্রজেক্টের একটা কাজ দেখতে এখানে আসা।
    চীফ ইঞ্জিনিয়ার অনুতোষ চৌধুরীর
    অনুরোধে তাঁর বাড়িতে আসতে হল নিরুপমকে। নীলাঞ্জনা যে অনুতোষ চৌধুরীর স্ত্রী, এটা জানা ছিল না ওর।

    স্মৃতিতে ধাক্কা।

    সেই নীলাঞ্জনা, নিরুপমের অতীত।
    পরিচয়পর্ব সারা হল। নীলাঞ্জনার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। নিরুপম স্বাভাবিক হতে পারছে না।

    স্মৃতি পিছু টানছে।

    ভার্সিটিতে এক সঙ্গে পড়তো ওরা। সাহিত্য সভায় গল্প পড়তো নিরুপম। নীলাঞ্জনার বাবা কোম্পানির ডিরেক্টর। প্রতিদিন এম্বাসেডর চেপে আসতো ও।
    নীলাঞ্জনা যথেষ্ট সুন্দরী। ছেলেদের পাত্তা দিত না। সেই মেয়ে একদিন যেচে আলাপ করতে এসেছিল নিরুপমের সঙ্গে।
    আমিতো বন্ধন রায়ের প্রেমে পড়ে গেছি।
    বন্ধন রায় নিরুপমের গল্পের নায়ক। সেই প্রথম আলাপ।
    তারপর রাখালদের ক্যান্টিনে, কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে কতবার কথা হয়েছে, কত অসংখ্য বার। রাতে গোল দীঘির পাড়ে বসে চাঁদের আলোয় জ্যোৎসনায় ভিজেছে দুজন, কতদিন।

    এক বিকেলে কফি হাউসে গিয়ে দু কাপ কফির অর্ডার দিতেই, নীলাঞ্জনা হঠাৎ বলেছিল, ওই দ্যাখো, অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি এসেছেন!
    ওনার পাশের ভদ্রলোককে চেনো?
    নাতো। ঠিক বলতে পারছি না!
    উনি হলেন এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য।
    তাই বুঝি! আমি রেগুলার ওই পত্রিকা পড়ি।
    আমি ইবসেনের নাটকের উপর ওনার পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়েছি।
    কফিটা ঠান্ডা হচ্ছে। খেতে হবে তো!
    হু।
    বাংলা ভাষায় তোমার প্রিয় কবি কে?
    শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
    দুজনই আমার প্রিয় কবি। সেই সঙ্গে আমি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাম যোগ করছি।
    ঠিক বলেছো। ওনার নাম বাদ দিলে, সেটা বিরাট অন্যায় হয়ে যেত।
    এবার উঠতে হবে। লাইব্রেরীতে যাবো। কাল ভার্সিটিতে আসছো তো?
    আসবো তো অবশ্যই। ইদানিং আমার বিয়ে নিয়ে বাবা-মা খুব উঠে পড়ে লেগেছেন।
    আমাদের ভালবাসার কি হবে?
    তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?
    আমি মোটেই সে কথা বলিনি।

    আরেকদিন সন্ধ্যায় বসুশ্রী হলে সিনেমা দেখে বেরিয়ে নীলাঞ্জনা বলেছিল, গত দুদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, আমার বুকের মধ্যে যে কি কষ্ট হচ্ছিল,
    তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
    ভালোবাসা মানে একটা ঝড়, বুকের মধ্যে সব সময় থমকে থামা ঝড়ের ইশারা।
    তোমার কষ্ট হয় না, আমাকে না দেখলে?
    হয় তো বটেই। কাছে না পেলে, মনে মনে তোমাকে কত অসংখ্যবার পেতে চেষ্টা করি।
    মানে?
    মানে, আমার চারদিকে তখন নীলাঞ্জনা ছায়াছবির মতো ঘুরে বেড়ায়। বলে, কষ্ট পেয়ো না, এইতো আমি তোমার কাছেই আছি। আমাকে ছুঁয়ে দ্যাখো!
    অ্যাই, সব সময় ঠাট্টা ইয়ার্কি না?
    নিরুপম হো হো করে হেসে ফেলে।

    কত কত দিন কেটে গেছে এভাবেই। সেইসব সোনালী বিকেলগুলো, মনোরম সন্ধ্যা গুলো চার জোড়া চোখে কত যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। স্বপ্নের মিনার, স্বপ্নের গম্বুজ, স্বপ্ন দিয়ে গড়া ভালবাসার রাজপ্রাসাদ।

    অথচ, তারপর একদিন এলো, সব স্বপ্নের ইমারত ভেঙেচুরে খানখান। আজ সে সব অতীত।

    কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?
    নিরুপম অতীত খুঁড়ে দেখতে চায় নি কখনো।

    নীলাঞ্জনাও স্বামীর সামনে অতীত পরিচয়ের কথা তোলেনি, নিরুপম উদাস থেকেছে।
    এক সময় কফি মিষ্টি খেয়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

    বিকেলে পার্টিতে আবার দেখা।
    অনুতোষ রিসেপশনে ব্যস্ত।

    নীলাঞ্জনা কাছে এলো নিরুপমের।
    আবার দেখা হলো,
    তাইতো,
    কুড়িটা বছর পার,
    জীবন তো রাজধানী এক্সপ্রেস,
    হুম,
    সেসব দিন মনে পড়ে?
    পড়ে, না পড়াই ভালো,
    কেন?
    শুধু শুধু পুরনো ক্ষতে হাত,
    দোষটা কার?
    কারো নয়,
    মানে?
    দোষটা ভাগ্যের,
    বিয়ে করেছো?
    প্রেমহীন বিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই, তাছাড়া সময় পাই নি,
    নিজেকে কষ্ট দাও কেন?
    জানিনা, বলতে পারব না,
    আমি কিন্তু অপেক্ষা করেছিলাম!
    জানি, আমার পায়ের তলায় তখন জমি ছিল না,
    আমার বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা চলছিল, হয়ে গেল,
    আর, সেই রাতে আমি কলকাতা থেকে পালিয়ে সোজা ধানবাদ,
    খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না?
    পুরুষের অক্ষমতা তুমি বুঝবে না,
    জানি, আন্দাজ করতে পারি,
    ভালো হয়েছে, কেউ নেই, তাই কারো জন্য ভাবনার ঢেউ নেই,
    তাই নাকি?
    তুমি সুখী হয়েছো তো?
    দেখে কি মনে হয়?
    দেখে বোঝা যায় নাকি?
    চলে যাচ্ছে বেশ,
    মিস্টার চৌধুরী তো যথেষ্ট সফিস্টিকেটেড মানুষ।
    তা ঠিক, তবে কি জানো, বিয়ে একটা অভ্যাস, একটা দায়বদ্ধতা, এই নিয়ে বেঁচে থাকা।

    আমার মনে হয়, তোমাকে পাইনি বলে, তুমি রোজ আমার কাছে আসো, যখন তোমাকে দেখি না, তখন তোমাকে আরো বেশি করে দেখি,
    কাজের সূত্রে আসো না এখানে,
    না, ভাগ্য যে দেয়নি, তাকে ঘুরপথে পেতে চাইনা,
    তুমি বদলে গেছো নিরুপম,
    হবে হয়তো,
    আমার তো সব মনে পড়ে,
    কি?
    সেই সব পুরনো দিনের স্মৃতি, সেইসব মায়াবী রাত, গড়িয়াহাটে সন্ধ্যেটা কাটানো, ঝিলের পাশে পাশাপাশি হাঁটা, আলেয়া সিনেমাতে উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখা, সব সব,
    আমি জানলে, এখানে আসতাম না,
    আমি তো ভুলে থাকতে চাই, তুমি এসে আবার সব কিছু মনে করিয়ে দিলে,
    নীলাঞ্জনা, এই ভালো। সেই সব দিনগুলো আমার জীবনের ওয়েসিস, স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় বেশ,
    তুমি পারো, আমি পারিনা,
    তুমিও পারবে,
    কিভাবে?
    ঝরা ফুলের গন্ধ কেমন জানো, দেখবে তার মধ্যেও ভালোবাসার সুগন্ধ লুকিয়ে থাকে। আমাকে ভুলে যেও, আমাকে মনে রেখো না, স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো!

    ততক্ষনে পার্টিতে ঘোষণা শোনা গেল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী, প্লীজ্ কাম অন স্টেজ।

    নিরুপম দেখলো, নীলাঞ্জনা আর ওর স্বামী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। ভালো লাগছে, ওদের দুজনকে।

    ভালো থাকো তোমরা। সুখের বৃষ্টি আসুক তোমাদের জীবনে। সেই সব দিন রাত্রি গুলো আমার কাছে স্মৃতির সংগ্রহশালা হয়ে থাক, নিরুপম মনে মনে বললো।

    ভালো থেকো নীলাঞ্জনা। সুখী হও।

    নীলাঞ্জনা, আমি আর আসবো না। যেটুকু পেলাম, সেটুকুই আমার স্বর্ণ কমল সঞ্চয়, যা পেলাম না, তা হয়তো আমার ছিল না।

    আমার নিঃসঙ্গ জীবনে সেদিনের স্মৃতি গুলো গভীর মমতায় আগলে রাখবো আমি, নিজেকে বোঝাবো,
    কিছু হারায় নি আমি। ভালোবাসা হারায় না কখনো।

    জীবনের বিভিন্ন মোড়ে বারবার শুধু তার অর্থ পরিবর্তন হয়। ঝরা ফুলের সুগন্ধ নিতে কজন জানে।

    যে জানে, সে জানে।

    তার কাছে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে সানাইয়ের সুরের মতো বেজে বেজে যায়।

    কজন সেই সুরের মাহাত্ম্য শুনতে পায়, যে শুনতে পায়, তার বেঁচে থাকাটা অন্য মাত্রা পায়।
    নিরুপম নিজেকে বোঝালো, নীলাঞ্জনাকে পেলে,
    প্রতিদিনের ধূলিমলিনতায় হয়তো এই ভালবাসার
    মর্যাদা নষ্ট হতো, অথচ, ওকে পায় নি বলে, আশ্চর্যজনকভাবে আজ ওদের সেদিনের ভালোবাসা চিরকালের ভালোবাসা হয়ে রইলো, এই পবিত্র ভালোবাসা স্মরণ করলে, এক জীবন পার করে দেওয়া মোটেই শক্ত নয়, নিরুপমের এরকমই মনে হল।

    ততক্ষনে স্যান্ট্রো গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ও দ্রুত গতিতে শহরের হাইওয়ের দিকে ছুটে চললো।

  • গল্প

    গল্প- রুম নাম্বার ২০৫

    রুম নাম্বার ২০৫
    – মুনমুন রাহা

    অন্ধকারের বুক চিড়ে ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে । কামরার বেশির ভাগ মানুষই নিদ্রা দেবীকে আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুম নেই কেবল মিতুলের চোখে। মনটা কেমন ভারি ভারি লাগছে ‌। বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে কথা বলার পর থেকে। মিতুলের সেই কবেকার ইচ্ছে হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবে । বিয়ের আগে হবু বর অরিত্রকে সে নিজের ইচ্ছা জানিয়েছিল , অরিত্র তখন সম্মতি ও দিয়েছিল। কিন্তু গোল বাধল বিয়ের পর । এক তো অরিত্র অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছে না। আর দুই নম্বর হল অরিত্রর মা। তিনি ছেলের বিয়ের জন্য জগন্নাথ দেবের কাছে মানত করে বলে এসেছেন একটা ভালো মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বৌ আগে জগন্নাথের শ্রী চরণে মাথা ঠেকিয়ে আসবে। আর কি করার মিতুলরা তাই সুইজারল্যান্ড বাদ দিয়ে পুরী চলছে হানিমুনে। বন্ধুদের এই নিয়ে খিল্লির শেষ নেই। এই তো কালকেই পৌষালি বলছিল ,
    “মিতুরে, তুই ও শেষে দীপুদার প্রেমে পড়লি? দীপুদা অর্থাত বাঙালির প্রিয় তিনটি জায়গা, দীঘা , পুরী , দার্জিলিং।”
    যদিও অরিত্র বলেছে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুইজারল্যান্ড যাবে। তবু যেন সুইজারল্যান্ডে হানিমুনে না যাওয়ার দুঃখটা কিছুতেই মিতুলের পিছু ছাড়ছে না।

    পুরী তে পা দিয়ে মিতুলের মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। পুরীতে মিতুল আগেও এসেছে তবে অরিত্রর সাথে জগন্নাথ দর্শন , সি বিচে হাতে হাত রেখে হাঁটা , বিশাল সমুদ্রতে অরিত্রর সাথে হারিয়ে যাওয়া , বড় কোন ঢেউ আসলে অরিত্রর মিতুল কে আগলে রাখা এসব কিছুই মিতুলের কাছে চেনা পুরীকে অচেনা স্বপ্ন নগর করে তুলেছে । কেবল হোটেল রুমে মিতুলের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। হোটেলটা এমনিতে বেশ সুন্দর। সমুদ্রের বেশ কাছে। পাঁচ তারা হোটেলটার সুইমিং পুল , বার , রেস্টুরেন্ট সব কিছুই বেশ বিলাস বহুল। মিতুলরা রুমটাও পেয়েছে সি ফেসিং। হোটেলটা পুরো ভর্তি তারপরও এত কম নোটিশে মিতুলরা যে এমন একটা ঘর পাবে তা আশা করে নি মিতুল। তাই প্রথম দিন রুম টা দেখে বেশ খুশি খুশি লাগছিল মনটা। কিন্তু কিছুক্ষন পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে মিতুলের। মনে হয় কেউ যেন আছে যাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। সবসময় কেউ যেন তার সাথে সাথে সর্বক্ষন ঘুরছে। বিশেষ করে অরিত্র আর মিতুলের একান্ত হওয়ার মূহুর্ত গুলোতে যেন বেশি বেশি করে অচেনা অস্তিত্ব টের পাচ্ছে মিতুল।

    প্রথম দিন রাতে অরিত্র নব বিবাহিতা স্ত্রী মিতুল কে কাছে টেনে নেয় । মিতুলও অরিত্রর স্পর্শে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। অরিত্র মিতুলের উন্মুক্ত পিঠে , কোমরে , গলায় নিজের ঠোঁট দিয়ে আদর করতে লাগে । মিতুলও অরিত্রর আদরের উষ্ণতায় ক্রমে বিগলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনই মিতুলের মনে হয় তার গায়ে একটা গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ থাকায় প্রথমে মনে হয় অরিত্রর নিঃশ্বাস হয়তো। কিন্তু একটু পরেই খেয়াল হয় অরিত্রর মুখ মিতুলের কোমোর বেয়ে নীচে নামছে তবে তো অরিত্রর নিঃশ্বাস মিতুলের ঘাড়ে পরা সম্ভব নয়! ভয় পেয়ে যায় মিতুল ছিটকে ওঠে অরিত্রর কাছ থেকে। অরিত্র অবাক হয় মিতুলের ব্যাবহারে। মিতুল অরিত্রকে তার অসস্তির কথা বললে অরিত্র বিশ্বাস করে না। বলে এ নিশ্চয়ই মিতুলের মনের ভুল। তেমন কিছু হলে অরিত্রও নিশ্চয়ই অনুভব করত। সে রাতে অরিত্র মিতুলর মিলন পর্ব অসমাপ্ত রয়ে যায়। ভীত মিতুল কে বুকে টেনে নিয়ে অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে। মিতুল কিন্তু অরিত্রর বুকের মাঝে চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারে কেউ যেন তাদের খাটের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতি কেন অরিত্রর হচ্ছে না কে জানে? কেটে গেল আরও দুটো দিন। এই অনুভূতি পিছু ছাড়ল না মিতুলের।

    খুব ভোরে মিতুলের ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আধ ফোটা আলোয় রাতের ভীবিষিকা ম্লান হয়ে আসে। মিতুল মনকে বোঝায় অরিত্র ঠিকই বলেছে , এসব অবাস্তব অনুভূতি মিতুলের মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয়।
    সান রাইস দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় । মিতুল দেখে অরিত্র অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মিতুল আর তাকে ডাকে না। ঠিক করে একই যাবে সান রাইস দেখতে। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেলে মিতুলের মনের অলৌকিক অনুভূতি গুলো আবার মাথা চাড়া দেয়। মনে হতে থাকে যেন দুটো অদৃশ্য চোখ তার উপর দৃষ্টিপাত করে চলেছে অনবরত। মিতুল কোন রকমে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসে। সে প্রথমে যায় হোটেলের রিসেপশনে। সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। একজন বয়স্ক লোক আর দুজন স্টাফ। মিতুল বয়স্ক লোকটির কাছে এগিয়ে যায়। তারপর তাকে জানায় মিতুল রুম চেঞ্জ করতে চায়। এবং সেটা আজই দরকার হলে এখনই । মিতুলের গলার স্বরে এতটাই উত্কন্ঠা ছিল যে বয়স্ক লোকটি মাথা তুলে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলে ,
    “কেন ম্যাডাম এত তাড়া কিসের? রুমে কিছু অসুবিধা হলে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সমাধান করার। ”
    মিতুল বলতে গিয়েও থেমে যায় যদি অরিত্রর মতো এই লোকটিও অবিশ্বাস করে ! মিতুল বলে,
    ” আমি বললাম তো আমি ঐ রুমে থাকব না । আমাকে রুম পাল্টে দিতেই হবে। ”
    মিতুলের আচরণে ভদ্রলোক খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর কি যেন ভেবে বলেন,
    ” কোন রুম ?”
    ” ২০৫ ”
    কথাটা শুনে ভদ্রলোক কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
    ” ঠিক আছে ম্যাডাম আমি দেখছি কি করা যায়। তবে যদি এখানে অন্য রুম না পান তবে অন্য কোন হোটেলের ব্যবস্থা করুন।”
    কথাটা শেষ হতে না হতেই হোটেলের মালিক এসে উপস্থিত হলো। মিতুল আর ভদ্রলোকের কথা কানে যেতেই রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে। ভদ্রলোককে চিৎকার করে বলল,
    ” কি যা তা বলেছেন অমল বাবু? আর ম্যাডাম আপনাকে পরিস্কার করে জানিয়ে দি আমাদের পক্ষে এখন অন্য ঘরের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। হোটেল ভর্তি। আপনারা চাইলে অন্য হোটেলে যেতেই পারেন তবে আপনাদের পাঁচ দিনের অ্যডভান্স কিন্তু ফেরত পাবেন না।”
    মিতুল আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চলে এলো সমুদ্রের ধারে। সূর্য দেব ততক্ষণে আকাশে উঁকি দিয়েছেন। মিতুলের আর সান রাইস দেখা হলো না । তবু সে হোটেলে ফিরল না। সকালের নরম আলোটা বেশ ভালো লাগছে। মনে অনেক গুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে পড়ছে বয়স্ক ভদ্রলোকের ২০৫ রুম নাম্বার শুনে আঁতকে ওঠার কথা। ম্যানেজারের কথা চাপা দেওয়ার প্রয়াস। মিতুল এখন নিশ্চিত এই অনুভূতি তার মনের ভুল নয় কিছু নিশ্চয়ই আছে ঐ রুমে। কিন্তু কি আছে রুম নাম্বার ২০৫ এ !

    ” কি রে , খুব চিন্তায় আছিস মনে হচ্ছে? ”
    হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজে কানে যেতে মিতুল মুখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় এক জটাজুটো ধারীকে যার পরনে কেবল কৌপিন, গলায় রকমারি পাথরের মালা চোখ গুলো টকটকে লাল, কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। তিনি আবার বললেন,
    ” ভেবে কিছু হবে না। জানতে হবে ! তোকেই জানতে হবে কি চায় সে ! আমি তোকে শুধু সাহায্য করতে পারি।”
    মিতুলের বুঝতে বাকি রইলো না সাধু কি সম্পর্কে কথা বলছেন। মিতুল হাত জোড় করে বলল,
    ” দয়া করুন বাবা । আমি আর এইসব সইতে পারছি না অজানা আতঙ্কের সাথে অজানা অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করে আমি ক্লান্ত । আমার এই অস্বস্তি এই অনুভূতি আমি কাউকে বোঝাতেও পারছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করছে না। এমন কি আমার স্বামী ও নয়। ”
    ” কেউ বিশ্বাস করবে না রে । যে জীবন দিয়ে অনুভব করে বিশ্বাস কেবল তার জন্মায়। এবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোকে আমি একটা তাবিজ দিচ্ছি এটা গলায় পরবি আর একটা পাথরের মালা দেব সেটা হাতে নিবি। তারপর সেই অশরীরীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি। তবে মনে রাখিস তখন যেন আর কেউ না থাকে তোর সাথে। তাকে রাত বারোটার পরেই ডাকা ভালো। ভয় পাবি না । আমার বিশ্বাস সে তোর সাথে কথা বলার জন্যেই তোর পিছু ধরেছে। ক্ষতি করার হলে এতদিন করে দিত। ”
    এই বলে সাধু মালা আর তাবিজ মিতুলের হাতে দিয়ে যেযন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই চলে গেল। ভোরের নরম আলো কেটে উজ্জ্বল রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। মিতুল ধীর পায়ে হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা হল । হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিল সাধুর দেওয়া সেই তাবিজ আর মালা।

    রাত বারোটা। মিতুল দেখল অরিত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কদিন মিতুল কিছুতেই অরিত্রর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে পারে নি। যতবার মিতুল অরিত্রর কাছে আসার চেষ্টা করেছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে মিতুলর কাছে আর মিতুলও ছিটকে সরে এসেছে অরিত্রর কাছ থেকে। মিতুল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ঘড়িতে ১২-৩০ । মিতুল উঠে বসল। অদৃশ্য অশরীরীর সাথে বোঝাপড়া করার সময় এসে গেছে। সে যে ঘরেই আছে তা মিতুল জানে তার অনুভূতি দিয়ে। মিতুল হাতে সাধুর দেওয়া মালাটা নিল আর গলায় পড়ল তাবিজটা তারপর চলে গেল বারান্দায়। চোখ বন্ধ করে ধীর গলায় বলতে লাগলো ,
    ” তুমি কে আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই। জানতে চাই কেন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে ঘুরছো তুমি? ”
    একবার , দুবার কোন উত্তর নেই। মিতুল আবার বলল তার কথা গুলো। তিনবারের বার সাড়া পেল মিতুল। সামনের চেয়ারে কেউ এসে বসলো। মিতুল চোখ খুলে দেখল একটা আবছা ছায়া। যেন কোন মানুষ কে সে অনেক গুলো কুয়াশার পর্দার ভিতর থেকে দেখছে। তারপর শোনা গেল তার রক্ত হিম করা ফ্যাঁসফ্যাঁসে এক গলার আওয়াজ। যেন অনেক দূর থেকে কথা গুলো আসছে।
    ” আমি এসেছি তোমার ডাকে। তুমি ঠিক বলেছ আমি তোমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আছি। তবে তার উদ্দেশ্য তোমার ক্ষতি নয়। আমার মুক্তি। ”
    মিতুলর ভয়ে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে তবু সে নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে। বলে,
    ” বেশ, বল আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?”
    ” আমি নীলা। ছয় মাস আগেও এই হোটেলের রিসেপশনিস্ট ছিলাম। নতুন কাজ ভালোই লাগছিলো আমার। মন দিয়ে নিজের কাজ করতাম। কত নতুন মানুষর সাথে পরিচয় হতো রোজ। বেশ কাটছিল দিন গুলো। তবে দিন গুলো আরও রঙিন হয়ে উঠল আকাশের সাথে সম্পর্ক তৈরী হওয়ার পর। আকাশ এই হোটেলের ম্যানেজার। আমাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস ক্রমে মজবুত হল । অন্তত আমার কাছে । আকাশ আমাকে আরও কাছে পেতে চাইল। আমি আপত্তি করিনি। কয়েকদিন পরেই যার সাথে বিয়ে তাকে আপন করে নিতে আমার দ্বিধা বোধ কাজ করে নি। আকাশ আর আমি মাঝেমাঝে মিলিত হতে লাগলাম। বিয়ে তে আকাশ আপত্তি করে নি কিন্তু দেরি করছিল। আমি তাড়া দিতে লাগলাম। আমার আর এই ভাবে মেলামেশা ভালো লাগছিল না। আমি সংসার বাঁধতে চাইছিলাম। একদিন আমি জানতাম পারলাম আমি মা হতে চলেছি। ছুটলাম আকাশের কাছে। বললাম আর দেরি নয় আমাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে যে আসছে তার জন্য আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে নেওয়া দরকার। আমাকে অবাক করে আকাশ বলল ,
    ” বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? এ বাচ্চা যে আমার তার প্রমাণ কি? আমি মানি না। আর তুমি ভাবলে কি ভাবে যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? তোমার মতো ক্যারেকটার লেস মেয়ে কে আমি কখনও বিয়ে করব না। যে মেয়ে আমার সাথে শুতে পারে সে তো অন্য পুরুষের সাথে ও শুতে পারে! ” তারপর বিচ্ছিরি ভাবে হেসে আকাশ বলল,
    ” তাই ভালো কথা বলছি এইসব বাচ্চার ঝামেলা হটাও। কালই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করো। তারপর আমাদের সম্পর্ক‌ যেমন চলছিল চলবে। আর ঢাক ঢাক গুর গুর নয় সোজাসুজি সওদা। তুমি আমাকে শরীর দেবে বদলে আমি তোমাকে কর্ম ক্ষেত্রে উপরে উঠতে সাহায্য করবো। ”
    আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। কিন্তু আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমার সন্তানকে কিছুতেই মারব না। ঠিক করলাম আকাশ কে এর উচিত শিক্ষা দেব। দুদিন পর আকাশকে ফোন করে বললাম তাকে আমি সাতদিন সময় দিলাম। সে যদি আমাকে অস্বীকার করে তবে আমি মালিক পক্ষের সাথে এই নিয়ে কথা বলব। বলব কিভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকাশ আমাকে ব্যবহার করেছে । আরও বললাম দরকার হলে পুলিশের কাছেও যাব। বাচ্চা হওয়ার পর ডি এন‌ এ টেষ্ট করলেই পুলিশ বুঝতে পারবে আমি ঠিক কথা বলছি কি না। কেটে গেল দুটো দিন। আমি কদিন হোটেল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। আকাশের সাথেও তাই আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। এদিকে আমার বাড়িতে সব কিছু জানতে পেরে যায়। সমাজের ভয়ে বাড়ির লোক আমাকে চাপ দিতে থাকে বাচ্চা নষ্ট করতে। আমিও আমার প্রতিজ্ঞায় অনড়। তাই অশান্তি তখন আমার নিত্য সঙ্গী। আমি সমাজ সহ পরিবারের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত ‌। চার দিনের দিন ফোনটা এল আকাশের কাছ‌‌ থেকে। বলল নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে। তবে তার বিয়ে নিয়ে কিছু শর্ত আছে আর সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমাকে একান্তে ডাকল সে। আকাশের কথা মতো রাত আটায় আমি গেলাম হোটেলে। আকাশ আমাকে প্রথমে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আমাকে চেয়ারে বসতে দিল তারপর আমাকে কিছু একটা ড্রিঙ্ক দিল। সেটাতে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল। আমার কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল।
    তারপর আকাশ বলল ,
    ” আমাকে ফাঁসাবি না ? এই বাচ্চা দিয়ে ফাঁসাবি তো ! দেখ এবার না থাকবি তুই আর না থাকবে তোর বাচ্চা। ”
    একটা লোহার রড সে আগেই জোগাড় করে রেখেছিল। সেটা দিয়ে মারতে লাগলো। আমার পেটে , মাথায়, মুখে। আমি ককিয়ে উঠছিলাম কিন্তু বাধা দিতে পারছিলাম না। এক সময় আমার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আকাশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার লাশকে সামনে রেখে সে একটা সিগারেট ধরাল । হোটেলে তখন কিছু রুমের কাজ চলছে। আকাশ বোধ হয় কিছু মিস্ত্রীকে আগে থেকেই টাকা খাইয়ে রেখেছিল। তাদের সাহায্যে আমর লাশটা নিয়ে আসা হলো এই ২০৫ রুমে। এই ঘরে মেরামতের কাজ চলার জন্য ওদের বেশি বেগ পেতে হলো না আমার লাশ লুকাতে। মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হলো আমার লাশ ও আমার ব্যাগ যা আমি সাথে এনেছিলাম। তারপর মিস্ত্রীরা সুন্দর করে ইট বালি সিমেন্টের প্রলেম ঢেলে দিলো তাতে। মুছে দিল আমার হত্যার সকল প্রমাণ। আমার পরিবারের কাছে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে রইলাম। কিন্তু আমার আত্মা মুক্তি পেল না । ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর বড় অমানবিক হয় মিতুল । তাই তো আমি তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে মিলিত হতে দিইনি। আমি মুক্তি চাই। আকাশের শাস্তি চাই। ”

    এতক্ষন কথা বলার পর এবার একটু থামলো নীলা। মিতুলের আর এই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভয় করছে না বরং কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। মিতুল বলল,
    ” না নীলা সব ছেলেরা এক রকম হয় না। আমার স্বামী অরিত্র খুব ভালো মানুষ। তবে তোমাকে আমি মুক্তি দিতে চাই। শাস্তিও দিতে চাই আকাশ কে। কিন্তু কি করে হবে ! আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কেন মানবে আমার কথা ? ”
    ” প্রমাণ আছে। প্রমাণ আমার ব্যাগে আছে। আমি এখানে আসার দিন ব্যাগে স্পাই ক্যামেরা ফিট করে এসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল আকাশ যদি বিয়ে নিয়ে কোন বাহানা করে অথবা আমাকে নোংরা প্রস্তাব দেয় তবে সেই ভিডিও আমি পুলিশ কে দেখাব। আমার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে আমার মার্ডার হওয়ার ভিডিওটা পেয়ে যাবে। ”
    এই বলে আবাছা ছায়াটা মিলিয়ে গেল বাতাসে।

    মিতুল কে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি আকাশ কে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নীলা ঠিকই বলেছিল তার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে সব কিছু রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। কেবল মিতুল কিভাবে এই হত্যার কথা জানল সেই উত্তরটা পুলিশ কে দিতে পারেনি মিতুল। অরিত্র প্রথমে মিতুলের পুলিশ ডাকা নিয়ে খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিতুলর কথা মতো সব প্রমাণ পাওয়া গেলে বেশ অবাক হয়ে যায় সে। তারপর মিতুলের মুখ থেকে নীলার সব কথা জেনে মিতুলের কাছে ক্ষমা চায় সে মিতুল কে অবিশ্বাস করার জন্য। নীলার সৎকারের ব্যবস্থা নীলার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে মিতুলরা আজ বেরিয়ে পড়ল কোলকাতার উদ্দেশ্যে।

    গাড়ি তে যেতে যেতে অরিত্র বলে
    “এই হানিমুনটাতো মাটি হলো এবার গিয়েই সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থা করব । ”
    মিতুল বলে ,
    ” একটাই শর্ত, হোটেল সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ করে নেবে। ”
    ” সে আর বলতে ! এবারে না হয় জগন্নাথের কৃপা ছিল। আর ভুল করি !”
    অরিত্রর বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে মিতুল। এতদিন পরে মিতুলর মুখে প্রাণ খোলা হাসি দেখে হাসি খেলে যায় অরিত্রর ঠোঁটেও।

  • গল্প

    গল্প- ওরা দুজনে

    ওরা দুজনে
    -সুবিনয় হালদার

     

     

    দেবা আর কান্তি বাল্য বন্ধু । একেবারে জোড়েরপায়রা । যেমন ডাকাবুকো তেমনি সাহস, পরিশ্রমীও বটে । দিন-খাটা দিন-আনা পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাই পড়াশোনার পাশাপাশি হাতখরচার পয়সা জোগাড় করতে দুজনেই বিভিন্ন সময়ে এর-ওর জনমজুরের কাজ করে দু-এক-পয়সা রোজগার করতো । তা থেকে মা-বাবার কাছে বেশীটা দিয়ে বাকিটা নিজেদের কাছে রাখতো । যে কাজটাতে তারা হাত দিতো একেবারে নিষ্ঠার সাথে শেষ করতো । এতটুকু ফাঁকি ছিলোনা তাতে । শিস বাজিয়ে গান করতে করতে ইয়ার্কির ছলে তারা কঠিন কাজকে খুব সহজই শেষ করে দম নিতো, মনে হতো যেন কঠোর পরিশ্রমের কাজ তাদের কাছে বাঁহাতের খেল্ । সে মাটি কাটা অথবা মাটি কোপানো হোক, মাঠে তোলা-ভাঙা, রোয়া, ধান কাটা, ঝাড়া, বওয়া কিংবা গাছে ওঠা- যেকোনো কাজই- এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- সবেতেই একেবারে সিদ্ধহস্ত । মাঝেমাঝে অবসর সময়ে খেলার মাঠে আসতো-, গামছার খুুঁটে মুড়ি বেঁধে নিয়ে কাঁচা পিঁয়াজ আর লঙ্কা চিবোতে চিবোতে । তাতে হাত গলিয়ে ভাগ বসাতে আমরাও কসুর করতামনা । টিভিতে খেলা সিনেমা দেখার খুব ঝোঁক ছিলো । সেই সময় গ্রামে হাতে গোণা দু-একটা বাড়িতে এ্যান্টেনা যুক্ত টিভি ছিলো, তাও আবার সাদাকালো-, ব্যাটারিচালিত । ফুটবল ক্রিকেট খেলা হলে তো কথাই নেই-, সব কাজ ফেলে আগেভাগে বাড়িতে এসে হাজির । গল্প আড্ডা ইয়ার্কি ফাজলামি হতো প্রচুর, আর যেদিন তেমন কাজকর্ম থাকতো-না সেদিন খেলার মাঠে খেলতে হাজির হয়ে যেতো তারা । খু্ব ভালো হা-ডু-ডু খেলতো-, ভালো ব্যাক খেলতো । অসম্ভব শক্তি হওয়ায় কাদামাঠে তাদের টপকে বল নিয়ে গোল করা প্রায় অসম্ভব ছিলো । খোরোকালে মাঠে ধান উঠে গেলে তাদেরকেই আমরা ক্রিকেট খেলার পিচ করে দিতে বলতাম এবং তারা করেও দিতো খুব সুন্দর ভাবে ।

    সেই সময় তখনো গ্রামে বৈদ্যুতিকের আলো আসেনি । বিনোদন বলতে শীতকালে মাঠে ষোল মি.মি.’র স্ক্রিন প্রোজেক্টরে ওঠা সিনেমা আর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে গ্রামে-গ্রামে ভি.ডি.ও. ! যার বেশীরভাগই চলতো জেনারেটরে ।

    এমনি একদিন সকালবেলা দেখি দুজনে ধানকাটার কাজ করছে রাস্তার ধারে চেয়ারম্যানদের জমিতে । আমাকে দেখে বললো- কই-রে-ভাই- কোথায় যাচ্ছিস্ ? শোন-না-এদিকে, একটা কথা বলি । আজ বৈকালের পর একজায়গায় যাবি ?
    কোথায়-?
    ভি.ডি.ও. দেখতে হাটখোলায়- !
    ওরে- বাব্বা- ; পাগল নাকি ?
    সে তো যমের দুয়ার- ; তাও আবার সন্ধ্যেবেলায়, ওখানে আমি মরে গেলেও যাবোনা ! তোরা যাচ্ছিস্ যা তবে আমি বলি কী- যাসনা ভাই !

    হাটখোলা জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশী পায়ে হাঁটা পথ । দুটো গ্রাম টপকে মেঠো রাস্তা ধরে যেতে হবে । রাস্তার দু-ধারে শুধু ধান-জলা আর আলের ধারে-ধারে বাবলাগাছ, খেজুর গাছ । কোথাও আবার দূরে তালগাছের সারি । সে গুলো পেরিয়ে মাঝে একটা খুব বড় ঘন বাঁশ বন পরবে, তার মধ্যে দিয়ে পথ । দিনের বেলায় আমি কয়েকবার সাইকেল নিয়ে সিনিয়র দাদাদের সাথে গিয়েছি ক্রিকেট খেলতে । প্রথমবারের অভিজ্ঞতা- উফ্ কী-আর বলবো- ; সে যেন এক ভয়ানক ব্যাপার ! বাঁশ বন শুরু হওয়ার বেশ কিছুটা আগে আলি আর কেষ্টদা বললো- ভাই, সাইকেল থামা । নেমে পর । একটু হেঁটে হেঁটে যাই চল্ । অনেকক্ষণ হলো সাইকেল চালিয়ে এসেছি-, কোমর’টা একেবারে ধরে গেছে ; একটু ছাড়িয়ে নেওয়া যাক্ ! সবাই কিন্তু পাশাপাশি একেবারে সারিবদ্ধভাবে যাবো- যাতে করে প্রত্যেকে একে অপরের সংস্পর্শে থাকি আর দেখতেও ভালো লাগবে । কী বলিস ভাই ? আমি বললাম- সে ঠিক আছে- কিন্তু কতক্ষণ- ? ওরা বললো- এই মিনিট দশ-কুড়ি-! ভাই- এই-ভাই- রাগ করিসনা, সবার- ভালোর জন্য বলছি ! সাইকেল থাকতে এ্যাতোক্ষন হাঁটবো-? আমি বললাম, কেন- ? কীসের জন্যে বলছো জানিনা কিন্তু– ; আর কিন্তু করিসনা ভাই- যেমনটা বললো- সে রকম সব এগোতে থাক্- গোঁসাই’খুড়ো, ইন্দ্রদা একটু যেন কেমন সুরে বললো ! মনে যেন একটা খটকা লাগলো ! সামান্য কিছুক্ষণ উদাস মনে মুখটা গোমড়া করে সবার সাথে হেঁটে চলেছি, চারপাশে ডাঙা জমি আর বিভিন্ন গাছপালায় ভরা ! একটু পরে একটা জোড়া বট-অশ্বত্থ গাছে মোড়া ভাঙা মন্দির তলা, বেশ বড় এলাকা জুড়ে, তার পাশ থেকে রাস্তা’টা চলে গেছে । কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব ! চলতে-চলতে ডানপাশে দেখি বেশ বড়-ধরনে একটা পুকুর, তার বেশীরভাগই কচুরিপানাতে ভরা । পুকুরের রাস্তার দিকের অংশে পুরানো শানবাঁধানো ঘাটের ভগ্নাবশেষ এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে ! মনে হলো যেন বহুপুরোনো কোনো জমিদারদের সময়কার । চারিদিকে আম জাম কাঁঠাল খিড়িসগাছে ভরা জঙ্গলের ফাঁক থেকে আবছা চোখে পরে একটা বড় বাড়ির ভাঙাচোরা অংশ, এর ঠিক পরেই বাঁদিকে রাস্তা ঘুরে গিয়ে দেখি একেবারে অন্ধকার- শুধু বাঁশগাছ আর বাঁশগাছ-! এতোটাই ঘন আর দীর্ঘ যে সূর্যের আলোও ঠিকঠাক প্রবেশ করেনা ! একটু আগে হেঁটে আসা নিয়ে কথাবার্তা এবার সব যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ! নন্দ বললো- কী-রে- কেমন লাগছে ? আমি’তো একেবারে ভয়ে কাঁটা ; আমার গায়ের লোমকূপ গুলো সব খাড়া হয়ে উঠেছে ! মুখে কে যেন কুলুপ এঁটে দিয়েছে ! সকাল নটা দশটায় যদি এই অবস্থা হয় তাহলে— আমি ভাবতেই পারছিনা ! এমন সময় সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া শরীর স্পর্শ করতে না করতেই দেখি চারিদিকে কড়মড় – মড়মড় শব্দ আর তার সাথে-সাথে ডাকপাখি, বাদুর, বক ও অন্যান্য পাখিদের সমবেত কলরব আর ডানা ঝাপটানো- যেন আভাস দেয় একটা মায়াবী ভয়ার্ত পরিবেশ ! কেষ্ট’দা বললো- বুঝলি এবার কেন হেঁটে যাচ্ছি ? ওই বাঁশ বনের রাস্তা পার হয়ে সাইকেলে চেপে যখন হাটখোলা গ্রামে প্রবেশ করি তখন আমাদের খেলা শুরু হওয়ার জন্য মাইকে ডাকাডাকি চলছে ।

    এমন এক জায়গায় ওরা দুজনে নাকি সন্ধ্যার পর ভি.ডি.ও. দেখতে যাবে- ; কল্পনা করা যায় ! কথামত যথারীতি সন্ধ্যার পর দেবা আর কান্তি হাটখোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো- বারবার নিষেধ করা স্বত্ত্বেও ! প্রথম গ্রামের মাঝামাঝি এসে একটা দোকানে হুড়ুমভাজা কিনে চিবোতে চিবোতে আবার হাঁটা লাগালো । দ্বিতীয় গ্রামের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে একটু বসে চা বিস্কুট খেতে-খেতে গল্পে-গল্পে ওরা যে হাটখোলায় ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছে যেইনা বলেছে- ; ওমনি ওখানে উপস্থিত দু-চারজন মানুষ আঁৎকে উঠলো ! সবাই অবাক হয়ে বলে- বলো-কী-তোমরা ? বয়স্ক দোকানদার বললো- দ্যাখো ছেলে বাড়ি ফিরে যাও ; তোমাদের ভালোর জন্যেই বলছি- । দেখুন কাকা, আমরা দুজনে যখন যেটা করবো ভাবি তখন সেটা করেই ছাড়ি, তোমার কত হলো বলো ? দাম মিটিয়ে ওরা দুজনে যখন উঠে দাঁড়ালো তখন চা দোকানের রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ শেষ হয়ে “চাষী ভাইদের বলছি” আসর শুরু হয়েছে অর্থাৎ আটটা শোয়া’আটা হবে । চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে ওরা দুজনে পুনরায় হাঁটা শুরু করলো । জনপ্রাণী-হীন মেঠো রাস্তায় ওরা শুধু দুজন হেঁটে চলেছে ! দূরের তালগাছ গুলো অন্ধকারে রণপা’র মতো দাঁড়িয়ে এক একটা যমরাজ-বর্গ এবং বাদায় কিছু কাটা কিছু শুয়ে পরা দাঁড়িয়ে থাকা ধানগাছ সব জনসাধারণ আর আলের ধারে-ধারে বাবলাগাছ খেজুর গাছ গুলো যেন সব যমদূতদের পর্যায়ক্রমিক শ্রেণী ! হাঁটতে হাঁটতে ভাঙা মন্দিরতলার কাছে আসতেই ওরা নাকি শুনতে পেল কারা যেন কথাবার্তা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে ! ওরা ভাবলো ওদের মতো অন্য কেউ হয়তো ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছে ! তারপর যখন ওই পুকুরটার কাছে এলো তখন ওদের মনে হলো শানের ঘাট হতে কেউ বা কারা যেন বাগানের ভিতর পড়ো বাড়িটার দিকে চলাফেরা করছে ! ওরা ভাবলো নেশাখোররা কেউ হবে হয়তো ! তারপর সেই বাঁশ বন- যেখানে পৌঁছে ওরা আর পথ দেখতে পাচ্ছেনা ! তবুও ওরা এক-পা দু-পা অনুমান করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকলো শিস বাজিয়ে গান করতে করতে ! কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর হঠাৎ ওদের মনে হলো এইরে সেই ভাঙা মন্দিরতলাতে আবার এসে গেছি- ; এটা কিরকম হলো ? এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করছে এমন সময় কান্তি দেখে ভাঙা মন্দির-তলা থেকে একজন বেড়িয়ে রাস্তায় উঠছে ! দেবার হাতটা ধরে বললো- চল্ বন্ধু, ওই লোকটার পিছুপিছু যাই তাহলে মনে হয় ঠিক রাস্তা পাবো ! সামনের মূর্তিটা যখন শানের ঘাটের কাছে তখন ভিতরের ওই পোড়ো বাড়ি হতে আরো একজন বেড়িয়ে এসে তার সাথে যোগ দিলো ; তারপর ওরা দুজনে এগিয়ে চললো বাঁশবনের রাস্তায় হাটখোলার দিকে । ওরাও দুজনে যথারীতি ওদেরকে অনুসরণ করতে থাকলো, দুজনের থেকে দুজনার দূরত্ব মেরেকেটে ন’দশ মিটার হবে কিন্তু এতোটাই অন্ধকারের ঘনত্ব যে কেউ কাউকে ঠিকমতো দেখতেই পাচ্ছেনা ! কান্তি গলাটা একটু খেঁকরে নিয়ে বললো- ও-দাদা, একটু দাঁড়ান-না, কোনো উত্তর নেই ! তখন দেবা শিস দিয়ে একটা টোন্ করলো তার সাথে-সাথেই সামনে হতে ঠিক একই টোনে প্রতুত্তোর ভেসে এলো ! কান্তি তখন শিস দিয়ে বলার চেষ্টা করলো- ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছেন ? শিসের মাধ্যমে উত্তর এলো- হ্যাঁ ! বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর হটাৎ সামনের ওই দুজনকে এরা আর ঠাহর করতে পারেনা ! আশ্চর্য- ; দেবা বললো- যা অন্ধকার ঘোড়ার ডিম দেখতে পাবি ? যেমন যাচ্ছি তেমন চলতে থাক্ ! ওইভাবে বেশ অনেকক্ষণ চলার পর দেখে ওরা দুজনে একটা বাদা বনের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ! অনেক দূরে লাইটের একটা আভা খুব ক্ষীণ দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওখানে যাবে কিভাবে ? অগত্যা আবার পিছনের দিকে হাঁটা লাগালো ! এরকম করে বাঁশবনটা প্রায় চড়কি-পাক খেলো ঘন্টার পর ঘণ্টা ! ওদেরই অজান্তে ওরা অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে কখন যে বাঁশবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে টেরও পায়নি । গ্রামের একজন লোক ফাঁকের দিকে লন্ঠন হাতে বের হয়েছিলো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হঠাৎ ওরা দুজন দেখতে পায় । তখন ওদের দুজনকে দেখে তো সেই লোকটার আত্মারাম খাঁচা ! ওরা জিগ্যেস করলো দাদা এখানে ভি.ডি.ও. টা কোথায় হচ্ছে ? লোকটা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো- তোমরা কারা- ; কোথা থেকে আসছো ? ভি.ডি.ও. তো মনে হয় প্রায় শেষের পথে ! এখন তো ভোর হতে চললো । ওরা দুজনে সব ঘটনা সবিস্তারে বললো ওই লোকটাকে । শুনে তো লোকটা অবাক ; তারপর বললো- তোমরা আজ খুব জোর বেঁচে গেছো, মনে হয় তোমাদের রাস খুব ভারী, সাহসও প্রচণ্ড ! তা-নাহলে কেউ এই রাস্তায় রাতে আসে ?

  • গল্প

    গল্প- নির্জন নদীতীর, নীল সন্ধ্যা, ভালোবাসা

    নির্জন নদীতীর, নীল সন্ধ্যা, ভালোবাসা
    -সুনির্মল বসু

     

     

    কথা হচ্ছিল, নদীর কিনারে জেটির পাশে দাঁড়িয়ে,দুপাড়ে তখন সাঁঝ বাতি জ্বলে উঠেছে। নদীর ওপর শান্ত চাঁদের আলো। দু একটা নৌকো ভেসে যাচ্ছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, মাঝিদের জলজ সংসার।
    কতক্ষণ এসেছো?
    আধঘন্টা হবে।
    সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল।
    কেন?
    আগের ট্রেনটা পাইনি।
    অফিসের কি খবর?
    কাজের প্রেসার আছে।
    দুজনেই চুপ।
    তোমার লেখালেখির কি খবর?
    লিখছি। কিছু একটা খুঁজছি। যেখানে পৌঁছবার কথা, সেই জায়গাটা আজও খুঁজে পাই নি।
    বুঝতে পারলাম না।
    অতৃপ্তি। ভালো লিখতে না পারলে, আমার কষ্ট হয়।
    লোকে তো তোমার লেখার খুব প্রশংসা করে।
    তাই নাকি!
    হ্যাঁ তো।
    আমি নিজের লেখা নিয়ে খুশি নই। অথচ, খুশি হতে পারলে, কি ভালো যে লাগতো।
    লেখায় এত নতুন নতুন ভাবনা তোমার আসে কি করে?
    আমার ব্যর্থ অতীত, সেদিনের অপমান, এত কান্না,
    যা কাউকে কখনো বলা হলো না, সেগুলোই লিখি।
    পরাজয়ের কথা লিখে কি লাভ?
    জানিনা, বলতে পারব না।
    সেদিন যারা জিতেছিল, তারা কি তোমার বর্তমান অবস্থার কথা জানে।
    তা কি করে বলবো! তবে এটা ঠিক যে,
    কি?
    তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
    কেন?
    সেদিন ওরা আমায় অপমান না করলে, আমি হয়তো কখনো কলম ধরতাম না।
    তুমি কি স্বাতীর কথা বলছো?
    সে আমার অন্ধ অতীত। মনে করতে চাই না সেসব।
    তবু কাউকে কাউকে তো বলতেই হয়। না বললে বাঁচা যায় না।
    জানি। ও তখন বেটার খুঁজে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারিনি। সাত বছর ধরে আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে, হঠাৎ একদিন আমার হাতে প্রজাপতি আঁকা বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিল।
    তারপর?
    অগ্নিসাক্ষী করে যখন অভিনব চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হচ্ছিল, আমি সেই আগুনে আমার ভালোবাসাকে পুড়ে যেতে দেখেছিলাম। সেই থেকে ভালোবাসা আমার কাছে জলাতঙ্ক। আমার জাহাজে দাউ দাউ আগুন।
    তোমার লেখায় তাই বারবার ভালোবাসার মধ্যে কান্না ফুটে ওঠে।
    হয়তো হবে।
    নিজেকে পুড়িয়ে তবু কেন তুমি ধূপের গন্ধ ছড়াও?
    বলতে ইচ্ছে করে। না বলে নিজে সুস্থ থাকতে পারি না। তাই ক্রমাগত নিজেকে খুঁড়ে চলি। আমি বাইরে গল্প খুঁজি না। আমার মধ্যে, আমার চারপাশের মধ্যে, আমার অভাবের দিনগুলোর অতীতে গল্প খুঁজি।
    একটা কথা বলবো?
    বলো।
    ওই আঘাতগুলো না পেলে, আজ তুমি লেখক হতে পারতে না।
    যারা ভালোবাসার কথা বলে মিথ্যা নাটক করে একদিন স্বপ্নের ভালোবাসার বাড়িটা ভেঙে দিয়ে যায়, তাদের আমি মানুষ মনে করি না।
    কি বলছো তুমি?
    ঠিকই বলছি। ভালোবাসা খুন করা আর মানুষ খুন করার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখি না।
    শুনেছি, আজকাল স্বাতী নাকি তোমার লেখার অনুরাগী পাঠিকা। আমায় বলছিল, একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
    কিন্তু আমি ভাঙা কাঁচের আয়নায় মুখ দেখি না। আমার কাছে এলেও, ওকে ফিরে যেতে হবে।
    মানুষকে ক্ষমা করতে শেখো।
    কেন ক্ষমা? কিসের জন্য ক্ষমা?
    ভুলে যাও।
    কেমন করে ভুলি? কত বছর হয়ে গেল, পথের মোড়ে কাঠফাটা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আছি কতকাল।
    আমার জন্য কোন ছায়াময় বৃক্ষ নেই। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
    তুমি কি আমার কথা একবারও ভাববে না?
    কি বলতে চাইছো তুমি?
    আমার বাবা শান্তিনিকেতনে প্রফেসর ছিলেন। উনি ছেলেবেলায় আমাকে বলতেন, আমার নাকি খুব
    নাক উঁচু। সবাইকে পছন্দ হয় না, সব জায়গা পছন্দ হয় না।
    তাহলে?
    কিন্তু যেদিন থেকে তোমার লেখা পড়তে শুরু করলাম, সেদিন থেকে মানুষটাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছি। কবে কখন কিভাবে এসব হলো, নিজেও বুঝতে পারিনি।
    মোনালিসা, তুমি দেখি, সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার মতো করে কথা বলছো!
    কি?
    সুনীলদা লিখেছেন, ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
    যেন মায়াপাশ।
    শোনো অগ্নিভ, এত বড় বিরাট পৃথিবীতে ভালোবাসা ঠিক কোথাও আছেই আছে। শুধু খুঁজে নিতে হয়।
    তাই কি?
    ভালোবাসা নিয়ে স্বাতী যেটা করেছে, জেনে নাও, সে কি সত্যিই সুখে আছে?
    কি বলতে চাইছো তুমি?
    অন্যকে ঠকিয়ে বড়লোক বাড়ির বউ হওয়া যায়, সত্যিকারের ভালোবাসা তো অন্য পৃথিবীর গল্প বলে।
    কি সুন্দর করে বললে!
    অনেক রাত হল। নতুন শীত এসেছে।
    তোমার শীত করছে, মোনালিসা?
    নাহ। আমরা কি আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করতে পারিনা?
    আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। ভাঙ্গা এ মন যদি কোনদিন সাহারা মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে ওয়েসিসের সন্ধান করে, সেদিন আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো। তুমি কি অপেক্ষা করতে পারবে?
    পারবো পারবো।
    ওরা তখন বাড়িতে ফিরছে। স্মৃতিতে ফিরছে। হয়তো ভালোবাসাতেও ফিরছে।

    জীবন পথের কিনারায় ভালোবাসার একটা ঘর কবে থেকে এভাবেই খুঁজে যাচ্ছে মানুষ।

  • গল্প

    গল্প- পুরনো আবাস

    পুরনো আবাস
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    শান্তিনিকেতনে আমি বহুবার গেছি তবু কেন কে জানে শান্তিনিকেতন আমাকে অহরহ ডাক পাঠায়। সংসারের পাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো আমার, সবসময় সেই ডাকে সাড়া দেবার সুযোগ ঘটে না বটে, তবু অহরহ মনে মনে আমি ‘সেথায় মরি ঘুরে।’
    সদা ব্যস্ত সংসারী মানুষজনের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। পৌষ মেলা,বসন্ত উৎসব, সোনাঝুরির হাট, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা, উত্তরায়ণ,সব‌ই তো হয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার, তবে? তবে আবার কেন?
    কেন যে সেকথা বোঝাই কাকে, কী করেই বা বোঝাই ,তাছাড়া আমার সবাইকে সব কিছু বোঝানোর দায়টাই বা কী! আমি বরং একা একাই পথ হাঁটি না হয়।
    যারা কেবল উৎসবের শান্তিনিকেতন দেখেই সন্তুষ্ট ,তারা থাক না নিজ মনে, আমার যে আর‌ও কতো কিছু দেখবার, অনুভব করবার বাকি রয়ে গেছে!
    আমি দেখতে চাই দূরের মাঠ পেরিয়ে ধেয়ে আসা কালবোশেখীর রুদ্ররূপ, পেতে চাই ঘন বর্ষায় কেতকী ফুলের গন্ধ, লেবুফলের গন্ধমাখা‌ ভোর, উন্মুখ হয়ে থাকি, কবে কখন, শীতের হাওয়া, নাচন লাগাবে আমলকীর ঐ ডালে ডালে ! শুকনো‌ পাতা খসে পড়ার খসস্ শব্দ মনে ভরে নিয়ে নিঝুম দুপুরে, হলদে পাখির পালক খুঁজতে যদি চলেই যাই খোয়াই এর শীর্ণ নদীটির পাশে,
    ‘তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার !’
    একা একা পথ চলি। আশ্রম গেটের সামনে থমকে থেমে মনে‌ মনে দেখি, সাঁঝবেলাতে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটি পিছনে রেখে ঐ বুঝি তিনি হেঁটে আসছেন শালবীথির রাঙামাটির পথটি ধরে।
    আসেন না নিশ্চয়‌ই। তবুও ভাবলাম‌ই বা, অসুবিধে কোথায়!
    আসন্ন সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি, তারার আলোয় একলা দাঁড়িয়ে থাকা তালাবন্ধ বাড়িগুলোর সামনে।একসময়ে কতো না আনন্দে দিনযাপন ছিলো বাসিন্দাদের। আজ পরিত্যক্ত বাড়িগুলির গেটে পাথরের ফলকে লেখা, আদরের নামটিও অস্পষ্ট, কেবল আগাছা ভরা বাগানের এক কোণে বৃদ্ধ কাঁঠাল গাছের মোটা পাতায়, শিশির ঝরে টুপটাপ। কেন এতো অবহেলা! উত্তরাধিকারীরা কী সবাই ভয়ঙ্কর রকমের কর্মব্যস্ত! হবেও বা! এই যে সামনের ‘গেহ’ নামের পেল্লায় দোতলা বাড়িটা, কবে থেকে একলাটি বসে আছে ।শুনি নাকি সেই বাড়ির অন্দরে ব‌ই আর ছবির মেলা। কারুর‌ই বোধহয় আর সাধ জাগে না সেগুলি আর একবার উলটে পালটে দেখতে!
    এবার নিজেই নিজেকে জোর ধমক লাগাই।
    অন্যের ব্যপারে নাক গলানোর স্বভাবটা আর গেল না! তাঁদের সুবিধে অসুবিধের কথা কী জানো হে! ধমক খেয়ে মনের দুর্বল অংশটা গুটিয়ে যায়, তাও মিনমিন করতেই থাকে…
    এসব কথা কী কাউকে বলবার!

    মোটকথা কেবল‌ই দেখতে নয়, রূপ,রস, গন্ধ সমেত সমস্তটুকু নিজের মধ্যে ভরে নিতে আমার এই বারে বারে ফিরে আসা।
    সন্ধ্যা গাঢ় হয়, আমি একলাটি পথ চলি।
    চেনা টোটোওয়ালাটি কাছে এসে দাঁড়ায়। দিদিমণির ধাত তার বোঝা হয়ে গেছে।
    ” সাঁঝের বেলায় এখন আর কী দেখবেন! কাল সকাল সকাল তোয়ের হয়ে থাকবেন‌, যে-যে বাড়ি দেখতে চান সব দেখিয়ে দেব। সমস্ত বিখ্যাত লোকের বাড়ির হদিশ,আমার জানা। আজ রাতেই লিষ্টিটা করে রাখবেন।”

    অভিভাবকের ভূমিকায় নিজেকে স্বনিযুক্ত করে টোটোওয়ালা চলে যায়।

    লিষ্টি আর নতুন করে কী বানাবো,সে তো কবে থেকেই আমার মনের মধ্যে ‘তোয়ের’ হয়ে রয়েছে!
    প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবি’তে কতকাল আগে পড়ে ফেলেছি , শান্তিনিকেতনে তাঁদের বাড়ি তৈরির গল্প।
    অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে‌,পারুলডাঙায় জমি কেনা,পরে ধীরে ধীরে ছোট্ট একখানা বাড়িও হলো।বাড়ির নাম দেওয়া হ’লো ‘স্বাগত-বিদায়’…বুদ্ধদেবের শেষ বয়সে রচিত কাব্যগ্রন্থটির নামে, সেই বাড়ির নামকরণ।
    শেষজীবনে প্রতিভা বসু , মহানগরীর কোলাহল এড়িয়ে, ওই বাড়িতেই থাকতে‌‌ চাইতেন,নিস্তব্ধ রাতের চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা বাড়িটি কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকতো।
    পাশের সোনাঝুরি নামের বাড়িটি গায়িকা নীলিমা সেনের।
    “আচ্ছা প্রতিভাদি সারাক্ষণ বারান্দায় বসে তুমি কী দেখো?”
    “উপরে আকাশ দেখি ,আর নীচে দেখতে আসি কখন তুমি যাও।তোমার সুন্দর মুখখানা দেখে আমার আকাশ দেখার‌ই আনন্দ হয়।”—- এবারে ঠিক দেখে নেব সেইসব বাড়ি ঘর।

    আগের বারে এসে দেখে গেছি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের দোতলা বাড়ি, ‘আনন্দধারা’। এখন সেখানে তাঁর ছোটবোনের সপরিবারে বসবাস। তাই সে বাড়িটির সর্বত্র যত্নের ছোঁয়া, শুধুই কী তাই! বাড়ি দেখতে গিয়ে এমন আন্তরিক অভ্যর্থনা কল্পনার‌ও অতীত ছিল। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা শিল্পীর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ণ দেখে, ফিরে আসার আগে, সামনে এসে বসলেন শিল্পীর ছোটবোন। দুইবোনের মুখশ্রীর মিল অবাক করা। গরম চায়ের পেয়ালা দিয়ে আপ্যায়ন শেষে বিদায়‌ নিয়ে ফিরে আসার আগে পরমাত্মীয়ের মতোই বললেন ‘আবার এসো।’ অভিভূত আমার মুখে বিশেষ কথা জোগায় না।ওই আন্তরিকতার জবাবে,ধন্যবাদ‌ও কী দেওয়া যায়!

    পরদিন সকাল সকাল টোটোওয়ালা এসে হাজির। তার অভিভাবকত্বে নিজেকে সঁপে দেবার আগে, নিজের ইচ্ছেটাও জানান দিয়ে রাখি।
    প্রতিভা বসুর মতোই, লীলা মজুমদার‌ও চেয়েছিলেন শেষজীবনে এই শান্তিনিকেতনেই ঠাঁই নিতে। অনেক পরিশ্রমের পর তৈরী হলো তাঁর মনের মতো বাড়ি। তার বিস্তৃত বিবরণ নিজেই দিয়েছেন সম্ভবত পাকদন্ডী ব‌ইতে। বাড়ির নাম হলো
    সু-র-ক-লি, স্বামী,পুত্র,কন্যা এবং নিজের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে।
    গাছপালায় ঘেরা সেই বাড়ির জানলার পাশে লেখার টেবিল। খাতার পাতা রোদে মাখামাখি।সেইখানে বসে তিনি লিখে চলেছেন- হলদে পাখির পালক। সেই পূণ্যতীর্থ না দেখে কী ফেরা যায়!

    টোটোওয়ালা হতাশ। সেই বাড়ি তো আর নেই গো। হাতবদলের পর সেটি এখন নিশ্চিহ্ণ। তবুও আমার হতাশা কাটাতে শুধু জায়গাটি দেখাতেই আমায় নিয়ে চলে সে। গাইড হ‌ওয়া কী চাড্ডিখানি কথা!!

    আশাপূর্ণা দেবীর সাধের বাড়ি ‘উজ্জ্বয়িনী’র‌ও ওই এক‌ই হাল।আশাপূর্ণাদেবীর স্বামীর নাম ছিল কালিদাস গুপ্ত। শুনেছিলাম স্বয়ং নরেন্দ্র দেব নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাড়িটির, ওই নামটিই পছন্দ করে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িটির কথা টোটোওয়ালার জানা নেই। শোনেই নি সেটির কথা। তাও চেষ্টা চালায় বেচারি। ইজ্জত কী স‌ওয়াল! কিন্তু সেই বাড়িটি সম্পর্কে কেউই কোন খবর জানাতে পারে না। কেউ যে আমাকে ভারতবর্ষের মানচিত্র খুঁজে দেখার পরামর্শ দেয় নি এই ঢের!
    বাড়িটি না হয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, জমিটিও কি তাই ! আমার স্বনিযুক্ত গাইডটির অহমিকা চূর্ণ! সাধে কি আর শাস্ত্রে বলেছে ‘মা কুরু…’ ইত্যাদি ইত্যাদি, থাক সেকথা।
    সারথিটি এতক্ষণ আমার‌ই ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।‌ আহত সম্মান পুনরুদ্ধারে, এবারে লাগামটি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, নিজেই হাল ধরলেন। নিত্য‌ই কতো ঝামেলাবাজ ট্যুরিষ্ট সামলান তিনি! আর এ-তো…..,আমিও চুপটি করে বসে থাকি,উটকো বায়না ধরি নে।
    পিচের মসৃণ পথ বেয়ে চলতে চলতে আচমকাই, এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় নেমে যায় টোটো। দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে, কোথায় কে জানে! সহসাই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যান চালক ।
    বাঁ ধারে খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অর্ঘ্য সেনের বাড়ি… ‘খোঁয়াড়’। বাইরে থেকে দেখে মোটেও খোঁয়াড়ের মতো ঠেকে না, হাট করে খোলা গেটের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় একফালি সবুজ জমি, ওপাশের কিনারা ঘেঁষে কিছু আটপৌরে ফুল গাছ। বাইরে দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। নীচ তলায় কারা যেন ঘরের কাজে ব্যস্ত। একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিত্যই এমন পাতিমার্কা লোকজন দেখে তারা ক্লান্ত।দোতলাটি বন্ধ‌ই। বাড়ির এমন নামকরণের কারণ ব্যখ্যা করতে পারতেন যিনি, তিনি দর্শকদের কাছে জবাবদিহি করার জন্য এই ধরাধামে আর বসে নেই।

    একটু এগিয়েই ডান হাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দোতলা বাড়ি— ‘একা এবং কয়েকজন’, একলাটি দুয়ার এঁটে নিশ্চুপ। বাইরে থেকেও কিচ্ছুটি দেখবার জো নেই। লোহার পাতে মোড়া পেল্লায় কপাটটি যেন বাড়িটিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
    এবার এগিয়ে আসেন আমার অভিভাবক, টোটো স্যার।
    গেটের বাইরে থেকেই পেল্লায় একখানা বাঁজখাই হাঁক ছাড়তেই, চিচিং ফাঁক।কেয়ার টেকার তার চেনা মনিষ্যি কিনা।সেই সুবাদে গেটের ভিতরে লাল কাঁকুরে পথটিতে পা রাখার অনুমতি মেলে। পথটি সোজা এগিয়ে বাড়ির সদরের সিঁড়ি ছুঁয়ে দুপাশে চলে গেছে। ডানপাশে লন। লনের ওপাশে সুনীলের কালো পাথরের আবক্ষ মূর্তি। সামনে দোতলা বাড়িটি এখন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে, বাঁদিকে ছোট্ট পুকুরে হাঁস সাঁতার দেয়। দেখতে দেখতে মনে ধাঁধা লাগে ,ওই বুঝি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন, মহা সোরগোল তুলে সশব্দে দোতলায় উঠে যাচ্ছেন সিঁড়ি বেয়ে!
    টোটোওয়ালা সারাদিন আমায় ঘোরায়, হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারে সে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
    দূর থেকেই দেখি রাণী চন্দের বড়ো সাধের ‘জিৎভূম,’ বুদ্ধদেব গুহর ‘রবিবার’, —এই‌ তো মাত্তর সেইদিন‌ও যেখানে জমাটি আড্ডাটি বসেছিলো।

    শান্তিনিকেতনে বাংলা পড়াতে এসে জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন কবি অশোকবিজয় রাহা। শান্তির নীড় ছোট্ট বাড়িখানার নাম দিলেন ‘সুরাহা’…স্ত্রী সুপ্রীতি আর অশোকবিজয় রাহার মিলিত রূপে বাড়ির নাম। কতশত জ্ঞানীগুণীজনের আনাগোনা।সদাহাস্যময়ী সুপ্রীতি তৎপর থাকতেন অতিথি সেবায়।
    আজ বাড়িখানার হাতবদল হয়ে সেখানে উঠেছে আধুনিক কেতার দোতলা বাড়ি। গেটের বাইরে প্রস্তর ফলকে ‘সুরাহা’ নামটি অটুট রয়েছে এইটুকুই যা সান্ত্বনা।
    শেষ বেলায় এসে দাঁড়াই ‘স্বাগত বিদায়’ এর বন্ধ গেটের সামনে। ওই তো বিশাল জমির ওপ্রান্তে দু কামরার ছোট্ট বাড়িখানা।
    একসময়ের গুণীজনসম্মেলন ধন্য, সেই আবাস, আজ একাকী, নিশ্চুপ। বাগানভরা ফুলেরা কবেই বিদায় নিয়েছে, ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের দাপটে। কেবল গেটের ফলকের ‘স্বাগত বিদায়’ আর বারান্দার থামে উৎকীর্ণ, ‘চিঠি’ শব্দটি আজ‌ও অপেক্ষায়।
    ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামে, আকাশে একফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যায়… বুঝি চুপিসাড়ে দেখে যায় এই অবেলায় আবার কে এলো !
    পাশেই সোনাঝুরি। গায়িকা অনেকদিন আগেই বিদায় নিলেও বাড়িটি সযতনে রক্ষিত। কারা যেন আজ‌ও বসবাস করেন সেখানে।গেটের সামনে থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি লাল মোরামের‌ পথটিতে,গুটিকতক সাদা ফুল ঝরে পরে আছে। মনের মধ্যে সব কিছু ভরে নিয়ে ফিরে চলি।
    অদেখা রয়ে গেল আর‌ও কতো শতো পূণ্যস্মৃতির ঠিকানা। ভারি মনে পথ চলি। আগামীকাল,কলকাতা ফেরার টিকিট। কিন্তু একেবারেই ফিরে যাওয়া কী যাবে!
    নিজেকেই নিজে কথা দিই আবার আসিবো ফিরে, আসবোই।

  • গল্প

    গল্প- শারদোৎসব

    শারদোৎসব
    সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    আকাশ জোড়া পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের অঝোরধারার বর্ষণে পৃথিবী যখন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ,মনখারাপি আবহ আর কাটতেই চায় না,ঠিক সেইসময়েই সহসা একদিন মেঘ ছেঁড়া আলো এসে উদ্ভাসিত করে তুললো আমাদের সাধের পৃথিবীখানাকে। নাড়া খেয়ে জেগে উঠলো শরৎকাল,গ্রামে গঞ্জে,মাঠে ঘাটে,নদীর ধারে আগমনী গান গেয়ে উঠলো গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। নিঝুমরাতের নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে, আকাশ থেকে তারার বাণী বহন করে যেন শিশির ঝরলো টুপটাপ।ঘুম ভাঙলো শেফালির। শিউলি গন্ধ মাখানো ভোরে,জেগে উঠলো মানুষ, মনে পড়ে গেল মেলাই কাজ পড়ে আছে,গড়িমসির সময় নেই আর। শারদোৎসব আসন্ন !
    পাড়ায় পাড়ায় , বড়ো মাঠে পড়ে থাকা স্তূপাকৃতি বাঁশের দল, গা ঝাড়া দিয়ে তেড়েফুঁড়ে উঠলো, জলদি করো,জলদি করো, প্যান্ডেল বাঁধতে হবে ! সময় তো আর বেশী নেই, মা দুগগা এলেন বলে!
    আসলে পুজো মানেই তো ফিরে আসা, ফিরে আসা নিজের‌ই কাছে, নিজের মাঝে, পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো অনুষঙ্গের অপ্রতিরোধ্য টানে। এই পুজোর সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে কত হারিয়ে যাওয়া দিন, মানুষজন,ঘর বাড়ি, আর ছেলেবেলা।

    আমাদের ছেলেবেলার অনেক ক’টা দিন কেটেছে বিহারে, বাবার কর্মস্থলে।
    বাবা রেল‌ওয়েতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে তাঁকে, আকছার ছোটবড়ো‌ নানা জায়গায় বদলি হতে হতো। বসবাসের জন্য অবশ্য রেল কোম্পানির কোয়ার্টারের সুবিধে মিলতো, ছোট, বড়ো মাঝারি, বাগানওয়ালা, বাগানবিহীন ইত্যাদি নানা কিসিমের কত রকমের যে বাড়ি ঘর দোর! নতুন জায়গায়,নতুন বন্ধুবান্ধব, তাদের অন্য ধরনের আচার ব্যবহার, জনবসতি। তবে একটি জিনিস‌ই কেবল অপরিবর্তিত থাকতো। যখন যেখানেই থাকি না কেন, যথাসময়ে পুজোর গন্ধটা ঠিক মনের দুয়ারে কড়া নাড়তোই। জায়গা ভেদে মাতৃমুখের আদলে হয়তো কিঞ্চিৎ হেরফের হতো, আঞ্চলিক কারিগরের হাতে, তবে তাতে বিশেষ কিছু এসে যেতো না। মা,তো মা-ই হন। আয়তনেত্রের ওই করুণাঘন মায়াদৃষ্টির তো আর বদল হয় না!
    আমরা যখন একটু বড়ো হয়ে উঠছি, সেইসময় বাবা বদলি হলেন বিহারের একটি সদর শহরে। কোয়ার্টারখানাও একটু অন্য ধরনের । বড়ো বড়ো পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বানানো পেল্লায় উঁচু ছাদওয়ালা , আগাগোড়া কাচের দরজা জানলা, কাঠের সানশেড, সামনে লম্বাচ‌ওড়া বিস্তৃত একখানা বারান্দা। তিন চার ধাপ সিঁড়ি নামলেই,বাড়ির চারপাশে অনেকটা করে বাগান করার জায়গা।
    ওগুলোতে নাকি এককালে সাহেবসুবোদের কোয়ার্টার ছিলো। স্বাধীনতার পরে এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে দেশীয় সাহেবদের সেইসব কোয়ারর্টারে থাকতে দেওয়া হতো। এটি ছিল সেই জাতের‌ই একখানা বাড়ি।
    সাহেবরা চিরকালের শৌখিন জাত। তাঁদের সময়ে, তাঁরা নিশ্চয়‌ই কোয়ার্টার সংলগ্ন‌ বিস্তৃত ওই জায়গাটিতে ফুল ফলের বাগান তৈরী করেছিলেন, তবে আমরা যখন ওই বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলাম, তখন আর সেই সবের চিহ্ণমাত্র‌ও ছিল না।অনাদরে অবহেলায়,কবেই সেইসব বাগান বিলুপ্ত।এখন তার শুকনো মরুভূমিসদৃশ আকার । আগের বাসিন্দারা বোধহয় ঘোরতর বৃক্ষবিরোধী ছিলেন।ওদিকে আমাদের বাবা আবার চিরকালের বাগানবিলাসী, গাছপালার সঙ্গে তাঁর‌ অগাধ মৈত্রী। লতাপাতারা তাঁকে দেখলেই ডেকে কথা কয়। অত‌এব রতনে রতন চিনে নিল। কোয়ার্টারের সামনে ,পাশে , পিছনের বিস্তীর্ণ পোড়োজমি সদৃশ এলাকা,অচিরেই ফুলে ফলে বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ হয়ে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠলো।
    দেখতে দেখতে দূরের পাঁচিলের সীমানা বরাবর,সারি সারি আম, পেয়ারা, সজনে গাছেরা মাথা তুলতে আরম্ভ করলো, হাওয়ায় তাদের ডালপালারা খুশিতে মাথা দোলায়। রুক্ষ লালচে মাটিতে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, এতদিনে কোয়ার্টারটাকে বেশ বাড়ি বাড়ি মনে হতে থাকলো।মাঝে মাঝে মায়ের আফশোশ ,কবে আবার বদলির হুকুম আসবে কে জানে! সব ছেড়েছুড়ে পাততাড়ি গুটোতে হবে!

    বাবা তখন দার্শনিক , আনমনে গানের লাইন আওড়াতে আওড়াতে জলের ঝারি হাতে তুলে নেন…

    “পরের জায়গা,পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি র‌ই
    আমি তো সেই ঘরের মালিক ন‌ই…”
    বাবার গলার স্বর ক্রমশ মৃদু হয়ে মিলিয়ে যায়।

    আমাদের তখন অতোশতো গভীর তত্ত্ব বোঝবার, বয়স‌ই নয়! ছুটির দিনে বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াই। গাছপালার সঙ্গে একধরনের সখ্য‌ও জন্মায়।

    উঁচু বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে, লাল ইট বাঁধানো রাস্তা এগিয়েছে মূল ফটকের দিকে।সেই পথের দুপাশে বেলিফুলের ঝাড়, বৈশাখের ভোরের হাওয়াকে গন্ধে বিভোর করে তোলে। রাতের ঘুমে হাসনুহানা, আর লেবুফুলের স্নিগ্ধ সুবাস শান্তির প্রলেপ দেয় ।ওদিকে বর্ষার জল পেয়ে,পাঁচিলের ধারে ধারে স্থলপদ্ম আর শিউলিগাছ তেজী হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। পুজো আসছে, মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে, তাদের‌ই তো চাই। তখন‌ও বিহার‌প্রদেশে,খুব কম বাড়ির বাগানেই তাদের দেখা মিলতো। বাবা, কলকাতার রথের মেলা থেকে চারা সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

    ক্রমে পুজো এসে পড়ে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে চকচকে মসৃণ রাঁচি- হাজারিবাগ রোড। একটু দূরেই সেই রাস্তাটি বাঁক নিয়ে সোজা এগিয়ে গেছে। সেই মোড়ের খাঁজে একখন্ড এবড়োখেবড়ো জমি্ সমান করে নিয়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়। ষষ্ঠির দিন সকালে প্রতিমা আসে।
    আমাদের কাছাকাছি এলাকায় ওইটিই একমাত্র পুজো, অত‌এব‌ অলিখিতভাবে ,ওটি আমাদের‌ই নিজস্ব পুজো। তাই উৎসাহ উদ্দীপনার আর অন্ত নেই।
    সপ্তমীর সকালে ভোর হবার অপেক্ষা শুধু। স্নান সেরে, বাগান থেকে নতুন কেনা ছোট ছোট বাঁশের চুপড়ি ভরে শিউলি, স্থলপদ্মের রাশি নিয়ে দে ছুট, পুজোমন্ডপে ঠাকুরমশায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে তো! হরিণ গতিতে ভাই, আমার চাইতে অনেকটা এগিয়ে যায়,আমি পিছু পিছু ছুটতে থাকি।
    অন্যান্য কিছু বাড়ি থেকেও পুজোর ফুল আসে , কিন্তু স্থলপদ্ম! উঁহু, সেটি আর হয় না। ঠাকুরমশায়ের হাতে ফুলের ডালাখানা ধরিয়ে দিয়ে গর্বে বুক ফুলে ওঠে দুই ভাইবোনের।
    যথাসময়ে পুজো আর অঞ্জলি শেষে,একটু করে প্রসাদ মেলে, আখের টুকরো- পেয়ারা কুচি। ভাঙা নাড়ু পেলে তো আর কথাই নেই আহ্লাদে আটখানা। আমাদের মধ্যে ততক্ষণে কার ক’খানা, জামা হলো, কে কবে কোনটা পড়বে, দূরের হিলকলোনির পাড়ার সিংহটার চোখটা কেমন যেন ট্যারা‌ ,ওদের চাইতে আমাদের প্রতিমা হাজার গুণে ভালো ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলে,ওদিকে মায়েদের ঘর গেরস্থালির কাহিনী… কোন ফাঁকে বেলা গড়ায়। ঘরে ফেরার সময় এসে পড়ে।
    না ,তখন‌ও এই দুনিয়ায় কর্পোরেট জগতের অঢেল দাক্ষিণ্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি পুজো প্যান্ডেলে, আমাদের ওই ছোট্ট বিহারী শহরে তো নয়‌ই, ফলে প্যান্ডেলে বসে ঢালাও খিচুড়ি খাবার গল্প তখন‌ও দূর অস্ত্ , তবে যথাসময়ে প্যান্ডেলে উপস্থিত থাকলে শালপাতার দোনায় করে অল্প বিস্তর ভোগ‌প্রসাদ‌ও পাওয়া যেত বৈকি!
    সন্ধ্যে হতে না হতেই,প্যান্ডেলের আলো জ্বলে ওঠে, গেটের আলো ছড়িয়ে পড়ে বাইরের ফাঁকা মাঠে। একে একে সবাই জড়ো হয়।অন্য পাড়ার লোকজন‌ও কেউ কেউ আসেন প্রতিমা দর্শনে। তাঁদের দেখলেই আমরা ঠিক চিনে ফেলি , এঁরা আমাদের নন, অন্য পাড়ার ,নিজেদের মধ্যে কানাকানি চলে, গুরুজনদের ধমক খেয়ে চুপ করি।
    শাঁখের আওয়াজে শুরু হয় আরতি, বাজে ঢাক ঢোল,কাঁসর ঘন্টা।ধুনুচির ধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসে মায়ের মুখ। ক্রমে রাত বাড়ে।
    বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরি। শুনশান নির্জন পথ, মাথার উপরে একফালি চাঁদ, আকাশ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে, আমরা কেউ কথা বলি না , চুপচাপ পথ হাঁটি।
    জীবনে তো কত পথ হাঁটা হলো, পাল্টে গেল বাড়িঘর,স্থান কাল পাত্র। দেখা হলো কতো ধরনের,পুজো, পুজোর আড়ম্বর, আয়োজন,সাজসজ্জা,মনোমুগ্ধকর অসামান্য সব শিল্পকর্ম।
    তবু আজ‌ও জীবনের এই গোধূলিবেলায় এসে পুজো বলতেই মনের মাঝে ভেসে ওঠে সেই কতকাল আগে দেখা একটি মুখচ্ছবি,আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অর্চনা।
    মন ফিরে চায়, সেদিনের সেই ছোট বিহারী শহরে। সেবারে উদ্যোক্তারা ঘোষণা করেছেন বেলাবেলি প্রতিমা বিসর্জনে র‌ওনা হ‌ওয়া হবে, সকাল সকাল যেন বরণের কাজ সেরে ফেলা হয়।
    মায়ের সঙ্গে আমরা দুই ভাইবোন‌ও উপস্থিত। মা স্টেজে,আমরা নীচে দাঁড়িয়ে লোকজন দেখছি, বিশেষ করে কাছাকাছি গাঁও থেকে,প্রতিমা দর্শনে আসা একদল মানুষকে। কমলারঙা সিঁদুরমাথায় ঘোমটা টানা মহিলারা, মলিন বেশে ছেলেপুলে, যুবক, বৃদ্ধের একটা ছোটখাটো সমাবেশ।হঠাৎ হৈ হৈ রব, পিছু ফিরে দেখি স্টেজে হুড়োহুড়ি‌ পড়ে গেছে, সবাই দ্রুত নেমে আসছে –কীভাবে যেন প্রতিমার পিছনের পাতলা কাপড়ে আগুন ধরে গেছে! আগুন ছড়িয়ে পড়লো বলে!
    সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়‌।
    সহসা দুহাতে ভীড় ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে স্টেজে উঠে এলো এক দেহাতী তরুণ, ঝাঁপিয়ে উঠে পড়লো জ্বলন্ত আগুনের পাশে,প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে। আগুনের হল্কা উপেক্ষা করে, হাত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে থাকলো জ্বলন্ত কাপড়ের টুকরোগুলো যাতে, আগুন মায়ের অঙ্গস্পর্শ করতে না পারে! নিজের প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ নেই ।
    অবশেষে সে সফল হলো। আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারলো না,এড়ানো সম্ভব হলো বড়সড়ো বিপর্যয়।
    এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে ঘিরে ধরলো তাকে,কেউ চায় তার পরিচর্যা করতে,আবার কেউ বা সাবাশি দিতে। তাঁর কিন্তু কোন‌ও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই,সে তখন মায়ের সামনে নতজানু হয়ে দরবিগলিত নয়নে অনন্যমনা হয়ে প্রার্থনা করে চলেছে, মা যেন ক্ষুদ্র মানুষের অপরাধ না নেন।
    আজ এতগুলো বছর পার করে এসে, জীবনের অপরাহ্ণবেলাতেও‌ প্রার্থনার সেই মুখচ্ছবিটি আমার মনে এক‌ই ভাবে সমুজ্জ্বল।

  • গল্প

    গল্প- পার্সেল রহস্য

    পার্সেল রহস্য
    লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    মহালয়ার সকাল টা এমন করে শুরু হবে আমাদের এপার্টমেন্টে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অঞ্চলের পৌরমাতার উদ্দ্যোগে ভোর সাড়ে চারটা থেকে ই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনছি।আহা কী অপূর্ব লাগে! নাকে যেন সোজা ধূপ ধুনোর আঘ্রাণ ঢুকে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার শিউলি ফুল কুড়ানোর দিন গুলো। আরো একটা জিনিষ বড্ড মনে শিউলি ফুল দিয়ে হাতে মেহেন্দি করার শখ টা। তাই সকল আলস্য ছেড়ে ফেলে বিছানা ত্যাগ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে যাই।গঙ্গা বাড়ির পাশে হলেও স্নান করতে যাই না আমি কোনোদিনই।আসলে গঙ্গা স্নান করার পরে ভিজে কাপড় ছাড়ার পদ্ধতি গুলো আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তি কর। কিন্তু আমাদের এপার্টমেন্টের তলাপাত্র জেঠিমা প্রতিবছর মহালয়ার দিন গঙ্গা স্নানে ছোটেন নিজের স্বামীকে নিয়ে।জেঠু গিয়ে পূর্বপুরুষ দের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে আর জেঠিমা গঙ্গা স্নান।
    কিন্তু আজ সকালে মাইকের মহালয়া কানে আসার আগেই তলপাত্র জেঠিমা বাজখাঁই গলা আমার কানে এলো। আমার ফ্ল্যাট ফার্স্ট ফ্লোরে।তাই গ্ৰাউন্ড ফ্লোরের কথা বার্তা বেশ স্পষ্ট কানে আসে।
    জেঠিমা বলছেন , দাঁড়াও দাঁড়াও একদম না। একদম হাত লাগাবে না।কিসের না কিসের প্যাকেট কে জানে?
    জেঠু বিরক্ত হয়ে বলছেন,ধ্যাত একটা পবিত্র কাজে বের হচ্ছি। এখন এইসব ফালতু ঝামেলা।
    _ সে কথা বললে তো হবে না কর্তা মশাই।বাড়ি যখন প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তখন ভাবা উচিত ছিল। হাজার লোকের বাস হবে।তার সঙ্গে ফ্রী তে আসবে হাজার উৎপাত।
    _ধূর বাপু তুমি চুপ করো না। স্কুটার টা কি করে বের করবো সেই কথা টা পারলে একটু ভাবো।
    _ ও আজ তোমার স্কুটার বের করা যাবে না এখন।এমন ভাবে প্যাকেট টা পড়ে আছে সামনের চাকার নিচে যে গাড়ির স্ট্যান্ড খুললেই চাকা টা প্যাকেটের উপর উঠে পড়বে।প্যাকেটের ওপর চাকা পড়লেই প্যাকেট টা ফাটবে।আর ফাটলেই ওর ভিতর থেকে কিসব বেরিয়ে আসবে কে জানে?
    _ তলাপাত্র জেঠু একটু ঝুঁকে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট টা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন ,বুঝলে গিন্নী প্যাকেট টা কিন্তু বেশ পরিস্কার দেখছি। হাত দিয়ে ই সরিয়ে দিই ।
    _রীতিমতো চিৎকার করে উঠে জেঠিমা বলে, খবরদার না। দিনকাল একদম ভালো না।তার থেকে বরং তুমি আমাদের সেক্রেটারি দিবাকর বাবু একটা ফোন করো।বলো নীচে নেমে আসতে একবার।
    অগ্যতা তলাপাত্র জেঠু বাধ্য স্বামীর মতো সেক্রেটারি দিবাকর বাবু কে ফোন লাগালেন। ইতিমধ্যে মাইকে মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।প্রতিটা ফ্ল্যাটে ই আলো জ্বলে উঠেছে।বার দুয়েক চেষ্টা করার পর দিবাকর বাবুর সঙ্গে তলাপাত্র জেঠু যোগাযোগ করতে পারলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দিবাকর বাবু এপার্টমেন্টের ক্যাশিয়ার ও প্রেসিডেন্ট কে সঙ্গে নিয়ে গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে এলেন।

    ক্যাশিয়ার তমাল কুন্ডু এসেই বললেন,এই সব ফালতু ঝামেলার জন্য ই আমি মেনগেটে তালা চাবির বদলে সিকিউরিটি রাখার কথা বলে আসছি এতবছর ধরে। কিন্তু তলাপাত্র জেঠুর আপত্তি ই সবচেয়ে বেশি। এবার বুঝুন ঠেলা।
    রজত বাবু বললেন,আহা তমাল এখন থাক ঐ সব বিষয়। তার চেয়ে ভালো নয় কি প্যাকেট টা কোথা থেকে এলো,কে এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি, সাইকেলের মাঝে ফেলে গেল তা নিয়ে ভাবা দরকার।
    তলাপাত্র জেঠিমা হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,দেখো তমাল তুমি রাগ করো না। তোমরা ইয়ং ছেলেদের দেখনদারি টা বড্ড বেশি। তোমাদের এখন রোজগার পাতি ভালো। কিন্তু তোমার জেঠু তো রিটায়ার্ড লোক। আমাদের কলসীর জল গড়িয়ে খেতে হয়। তাই আমাদের কাছে সিকিউরিটি রাখাটা কিছুটা বিলাসিতা মনে হয়। তুমি যখন তখন তোমার জেঠু কে আক্রমণ করো সিকিউরিটি র ব্যাপার নিয়ে।এ আমার একদম ভালো লাগে না।
    তমাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু প্রেসিডেন্ট রজত বাবু চোখ টিপে ব্যাপার টা ক্লোজ করার রিকোয়েস্ট করে।আসলে এমন পুন্য ভোর বেলায় ঝগড়া অশান্তি সমীচীন নয়।
    রজত বাবু এগিয়ে গিয়ে প্যাকেট টা দেখলেন।প্যাকেট টা যশোদা বস্ত্রালয়ের ‌। মুখ টা বেশ টিপে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আঁটা।বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ভয়ের কিছু বলে মনে হচ্ছে না।আর তাছাড়া আমাদের এপার্টমেন্টের লোকজন সবাই ছাপোষা ভদ্রলোক। এখানে বিষ্ফোরক টোরক আসার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আমি বলছিলাম, আপনারা তো সবাই উপস্থিত আছেন।তাই আমি সবার সামনেই প্যাকেট টা খুলতে চাই।কারোর কোনো অবজেকশন নেই তো?
    তমাল বলে, দাঁড়ান দাঁড়ান রজত দা।আমি মোবাইল এ ভিডিও টা চালু করি।পরে বিল্ডিং এর সকলের সামনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে।
    ধীরে ধীরে প্যাকেট টা তলাপাত্র জেঠুর সামনের চাকার মুখ থেকে হাতে তুললেন রজত বাবু। হালকা নাচিয়ে বললেন ওজন এক কিলোর নীচেই হবে মনে হচ্ছে।
    দিবাকর বাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,রজত দা আর দেরি করো না।মা দুর্গার নাম নিয়ে খুলে ফেলুন।
    রজত বাবু প্যাকেটের মুখের রাবার ব্যান্ড টা খুলে ফেললেন। তারপর দেখলেন ভিতরে একটা কাগজের প্যাকেট। তাতে লেখা আছে অন লাইন শপিং ব্যান্ডের নাম। কিন্তু নাম, ঠিকানার জায়গা টা নীল রঙের কালি দিয়ে কেটে দেওয়া আছে। কিছুতেই পড়ে উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
    তলাপাত্র জেঠিমা চোখ গুলো বড় বড় করে বলেন,এ আবার কি কান্ড!কেউ নতুন জিনিস এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি ঘোড়ার মাঝে ফেলে রাখে?
    তলাপাত্র জেঠু বিরক্ত সহকারে বললেন,পয়সা বেশি হলে নতুন জিনিস ও মাটিতে গড়াগড়ি খায় দেখছি।যাক গে, ক্ষতিকারক যখন কিছু নেই তখন ভয়ের কিছু নেই।
    বুঝলে দিবাকর তাহলে আমরা আর দেরি করবো না। তোমরা প্যাকেট টা খুলে দেখো।আমি আর গিন্নী বরং রওনা দিলাম।
    তলাপাত্র জেঠু ওনার আমলের বাজাজ চৈতক কে স্টার্ট দিয়ে জেঠিমা কে পিছনে বসিয়ে গঙ্গা স্নানে ছুটলেন।
    আমি আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে থেকে পুরো ব্যাপার টা লক্ষ্য করছিলাম। এবার মনে হলো একেবারে স্পটে যাই।হাউস কোর্ট টা গলিয়ে সিঁড়ির নিচে যেতেই তমাল আমাকে দেখে বলল,এই যে মৌমিতা দি এসে গেছে।ও দিদি প্যাকেট টা তুমি খুলে দেখ। মহিলাদের জিনিস যদি হয়।তাই আমরা কিন্তু কিন্তু করছিলাম।
    আমি প্যাকেট টা হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর হাত দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তাই কাঁচির জন্য ওদের কে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এলাম। কাঁচি দিয়ে প্যাকেট টা কাটতেই বেরিয়ে এলো একটা দারুন দেখতে একটা ড্রেস। ব্লাক আর গ্ৰীন এর কম্বিনেশনে র ফ্লোরাল প্রিন্ট।
    দিবাকর বাবু হেসে বললেন, ওওওও এতো মেয়েদের পোশাক।
    রজত বাবু বললেন, কেউ নিঃশ্চয় সিঁড়ি নীচে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল।বিড়াল কিংবা ছুঁচো তে টানাটানি করে এমন রহস্য সৃষ্টি করলো মহালয়ার সকালে।আরে বাবা অন লাইন শপিং তো কোনো অন্যায় কাজ নয়।এই নিয়ে তো লুকোচুরির কিছু নেই।
    তমাল বিজ্ঞের মতো বলল,সাধে কি আর বলে মেয়েছেলের বুদ্ধি।কথা টা বলেই ও বুঝতে পারে মুখ ফস্কে একটা বাজে কথা বলে ফেলেছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও বলে ওঠে, মৌমিতা দি আমি আমাদের হুয়াটস গ্ৰুপে এই ড্রেস টার একটা ছবি দিয়ে দিচ্ছি।আর লিখে দিচ্ছি,এই জিনিসটা যার তিনি যেন তোমার কাছ থেকে নিয়ে যায়।প্লিজ দিদি না করো না।
    অগ্যতা আমি মালিক হীন পোশাক টা বাইরের ঘরের বুক সেলফের ওপর রেখে দিয়ে কিচেনে গেলাম। গ্যাসে লিকার চা বসিয়ে রাতের বেলায় ধুয়ে রাখা বাসন পত্র গুলো মুছে বাসন রাখার সেলফে তুলে রাখতে লাগলাম।
    তারপর একটা কাঁচের গ্লাসে লিকার চা টা ঢেলে দুটো বিস্কুট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম। আর পার্সেল টা কার হতে পারে এই ভাবনা টা দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলা দিতে লাগলো আমার মনে।
    মিনিট পনেরো পর ডোর বেল টা বেজে উঠলো।আমি দরজা খুলে দেখি তলাপাত্র জেঠিমার বৌমা রুচি।
    মিষ্টি হাসি দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর কোনো রকমের ভনিতা ছাড়াই বললো,দিদি ওই পার্সেল টা আমার। গতকাল দুপুরে ডেলিভারি বয় দিয়ে গিয়েছিল।এই বলেই ফোন টা খুলে ওর অর্ডার লিস্ট টা দেখলো।
    আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে ড্রেস টা রুচির। কিন্তু ওর ড্রেস টা কিভাবে সিঁড়ি ঘরে এলো সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
    রুচি এই প্রথম বার আমার ফ্ল্যাটে এলো।তাই আমি ওর ডান হাত টা ধরে বললাম, প্রথমবার তুমি আমাদের ফ্ল্যাটে আসলে।আগে তো সোফায় বসো। তারপর পার্সেল নিয়ে কথা বলছি।
    রুচি হালকা হাসি দিয়ে সোফায় বসলো। তারপর বললো,কি আর করবো বলো দি। আমার শাশুড়ি কারোর ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া খুব একটা পছন্দ করে না।
    তারপর একটু বিরতি নিয়ে বললো, ওনার ধারনা অন্যদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে আমি নাকি বিগড়ে যাবো।ভাবো একবার! আমি কি দুধ খাওয়ার বাচ্চা।
    আসলে আমি তো গ্ৰামের মেয়ে। শাশুড়ি মা সবসময় বলে,যত কম শহরের হাওয়া গায়ে লাগাবে।ততই সব দিক থেকে ভালো থাকবে। শহরের আদব কায়দা শিখলেই বিপত্তি।খরচ বেড়ে যাবে আকাশ ছোঁয়া। ওনার শুধু সাশ্রয় এর চিন্তা।আমি আসার পর তো ঠিকে কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে জানো। আমাকে বলা হল,বৌমা আমি তো এখন ও শক্ত সামর্থ আছি।তাই দুজনে মিলে মিশে সংসারের সব কাজ করে নেবো কেমন। কিন্তু দিদি মাস খানেক ও মিলেমিশে কাজ করতে পারলাম না আমরা। আমার শাশুড়ি মা সপ্তাহের ওয়ার্কিং দিন গুলোতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।যেমন ধরো মাথা ধরা কিংবা পেটে ব্যথায় ভুগবেন।
    আমি বেশ বুঝতে পারছি তলাপাত্র জেঠিমা পাকা মাথার বুদ্ধি ধরেন সবসময়। কিন্তু রুচি ও যে খুব একটা বোকা মেয়ে তা কিন্তু নয়।
    আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পার্সেল টা তুমি সিঁড়ি ঘরে রেখেছিলে কেন রুচি?
    রুচি বলে দিদি আমার কপাল টাই খারাপ যাচ্ছে আজকাল।না হলে কি এমন বিপত্তি ঘটত।
    মানে?
    আমার শাশুড়ি মাকে লুকিয়ে অনলাইনে এটা ওটা আমি কিনি মাঝে মধ্যে ই। ডেলিভারি বয়ের থেকে জিনিস নিয়ে সিঁড়ি ঘরের যে বড় লেটার বক্স টা আছে তার মাথায় তুলে রাখি।সময় সুযোগ বুঝে আমি অথবা বর যে কেউ এসে টুক করে পার্সেল টা নিয়ে চলে যাই।
    আমি চোখ গুলো কপালে তুলে বললাম, ওওওওও,ব্যাপারটা নতুন নয় তাহলে। ঠিক আছে নিয়ে যাও পার্সেল টা তাড়াতাড়ি। তোমার শাশুড়ি যে কোনো মুহুর্তে চলে আসতে পারে।
    পার্সেল টা হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় রুচি আমার হাত টা ধরে বলে, প্লিজ মৌমিতা দি এই পার্সেল রহস্য এর কথা খুব বেশি কাউকে বলো না।
    আমি রুচির হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। কমিটির তিন চার জন ছাড়া এই পার্সেল কার ছিল কেউ জানবে না।তবে এরপর থেকে সিঁড়ি ঘরে পার্সেল না রেখে সোজা নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবি। শাশুড়ি কিছু বললে বুদ্ধি দিয়ে উত্তর দিবি। লুকোচুরির পথের চেয়ে লড়াই এর পথ ভালো।লড়াই এর একটা পরিনতি থাকে। লুকোচুরি তে থাকে কেবলমাত্র ধোঁকা। ধোঁকার হাত ধরে যেমন ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না ঠিক তেমনি জীবনটা ও বিষময় হয়ে যায়।।

  • গল্প

    গল্প- খেলা যখন

    খেলা যখন
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     


    আজ রবিবার। ভোরবেলাতেই জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।এখন আকাশটা পরিষ্কার। নীল আকাশ বেয়ে সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ছে গাছগাছালির মাথায় মাথায়। চমৎকার দেখাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির শোভা, শুধু ডাঃ দিব্যদ্যুতি রায়ের আজকের প্রাতর্ভ্রমণটাই মাটি হয়ে গেল, এই যা!

    দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গেটের বাইরে সোজা কালো পিচের রাস্তাটার দিকে চেয়েছিলেন দিব্য। বৃষ্টিতে ঝরে পড়া কদমকেশর আর ছাতিমফুলের ছেঁড়া পাঁপড়িতে কালো পিচের রাস্তাটা যেন সেজে উঠেছে। শরৎকাল প্রায় এসে গেল ,তাও এই বছরে বৃষ্টিটা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। মহালয়াটা যেন কবে? আরে আজকেই তো!! এবারে মহালয়াটা রবিবারে পড়ায়,আলাদা ছুটি মেলে নি বলেই বোধহয় তারিখটা ঠিক খেয়াল করতে পারছিলেন না তিনি।
    অভিজাত এই শুনশান পাড়াটায়, শব্দদূষণের প্রকোপ যেমন নেই, তেমন‌ই নেই, ভোরবেলায় পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে আসা মহালয়ার স্ত্রোত্রপাঠের মন ভালো করা‌ সুর।প্রতিবেশীরা সবাই কেমন যেন দূরে দূরে, প্রত্যেকেই নিজের মনে একলা থাকার অভ্যেস রপ্ত করে নিয়েছে।
    একদা মধ্যবিত্ত দিব্য রায়, এখানে এসে পাড়া কালচারটা বড্ডো মিস্ করেন, অবশ্য কতক্ষণ‌ই বা বাড়িতে থাকেন তিনি ! সেই সাত সকালে বাড়ি থেকে বের হন, আর ফেরেন যখন তখন তো সন্ধ্যের চৌকাঠ পেরিয়ে, দিন র‌ওনা দিয়েছে রাত -গভীরে।

    শহরের ব্যস্ততম ডাক্তারদের অন্যতম দিব্যদ্যুতি রায়ের, সারা সপ্তাহ দম ফেলবার ফুরসত থাকে না, কেবল রবিবার‌ আর ছুটিছাটার দিনগুলিতেই ঢিলেঢালা অবকাশে সময় কাটানোর সামান্য যা সুযোগ মেলে।
    ছুটির দিনে ভরপেট জলখাবার খেয়ে,ফোনে
    দুই একজন আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে টুকটাক গপ্পোগাছা,ল্যাপটপে জমে থাকা ব্যক্তিগত মেইলগুলো চেক করে প্রয়োজনীয়‌ চিঠিচাপাটি চালাচালি, এইসব করেই সকালটা পার হয়ে যায়। এছাড়া কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে। না, কোনোও বাঁধাধরা রুটিনমাফিক ব্যাপার নয়। স্বেচ্ছায় একেক দিন গিয়ে ঘুরে আসেন কয়েকটি ওল্ড এজ হোম থেকে। সাধারণ হেলথ চেক আপ, কিছুক্ষণ বৃদ্ধমানুষগুলির সঙ্গে বসে, সুখ দুঃখের গল্প করা, কারো কারো ব্যক্তিগত সমস্যায় কিছু পরামর্শ দেওয়া, অথবা সম্ভব হলে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এইসব‌ই আর কী! এইটুকতেই কতো যে খুশি হয়ে যান একাকী নিঃসঙ্গ মানুষগুলো, সেই হাসিখুশি মুখগুলো দেখে দিব্যর মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। না, কোন‌ও স্বার্থ নয়, কিছুটা সামাজিক দায়িত্ববোধে এই কাজগুলো করে থাকেন তিনি, ঠিক তাঁর নিজের বাবার মতোই। ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন তাঁর‌ বাবা, রবিবার সকালটায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন এলাকার গরীবগুরবো মানুষগুলোর। দিব্য‌ও বোধহয়, উত্তরাধিকার সূত্রেই এই দায়িত্ববোধটুকু বাবার কাছ থেকে লাভ করেছেন।

    দুপুরে পছন্দের খাওয়া দাওয়া, কোন‌ও দিন দিবানিদ্রা, কখন‌ও বা গপ্পের ব‌ই— সন্ধ্যাবেলায় কোনোদিন গ্রুপ থিয়েটার, আবৃত্তির আসর, অথবা চিত্রপ্রদর্শনী। ব্যস্, এইভাবেই কেটে যায় অকৃতদার দিব্য রায়ের একলা জীবন। গতানুগতিকতায় আবদ্ধ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা রবিঠাকুরের ভাষায়—- “যেন ঘোলা জলের ডোবা,না সেখানে হাঙর কুমিরের নিমন্ত্রণ,না রাজহাঁসের।”

    পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো,সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী দিব্যদ্যুতি রায়, আজ‌ও সুদর্শন।বয়স বিশেষ একটা ছাপ ফেলতে পারে নি, কেবল একমাথা চুলের সামনেটায়,একগুচ্ছ কাশফুল অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখে যায়।

    দিব্যর সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার বিভামাসিমার উপরে। না, রক্তের কোন‌ও সম্পর্ক‌ নেই তাঁর সঙ্গে, কিছুটা আকস্মিক ভাবেই বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের জেরে দুটি মানুষ আজ পরষ্পরের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    দিব্যর পরিচিত একটি বৃদ্ধাবাসে, দায় এড়িয়ে ফেলে রেখে যাওয়া, অসহায়,নিঃসন্তান, ভাগ্যতাড়িতা অভিজাত মহিলাটিকে,দিব্য‌ই একদিন উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। দয়া নয়, মানবিকতা! আশ্রিতা হিসেবে নয়, সসম্মানে মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এই সংসারে।

    ব্যাপারটা ঘটেছিল খুব আকস্মিকভাবে।সেদিন দিব্যর ওখানে যাবার কথা ছিল না তবু ঘটনাচক্রে আচমকাই গিয়ে পড়েছিলেন ওই হোমটিতে।
    সেইদিন‌ই আবার হোমের কর্তৃপক্ষ,বিভাদেবীর হাতে ঘরছাড়ার নোটিস ধরিয়ে দিয়েছিলো। গত দুমাস ধরে নাকি প্রতিশ্রুতিমাফিক টাকাপয়সা জমা পড়ছিলো না। তথাকথিত আত্মীয়রা, যারা নাকি, কী সব কাগজপত্তরে, স‌ইসাবুদ করিয়ে তাঁর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করার এবং নিয়মিত তাঁর মাসের টাকা পয়সা,তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়ে যাবার কড়ারে, ব্যাঙ্কের সমস্ত কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে , এবং সুযোগ বুঝে তাঁকে ঘরছাড়া করে এই বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিল, সম্প্রতি তারা সবাই নাকি “আনরিচেবল!”
    নিজের সন্তান ছিল না বলে, বিভাদেবী যাদের সন্তানতুল্য জ্ঞান করতেন, বুকে করে মানুষ করলেন, স্বামী মারা যাবার পর, তাদের এই রূপান্তর তাঁর দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।
    লোক পাঠিয়ে খবরাখবর নিতে গিয়ে জানা গেছে, সাবেকী বসতভিটা ভেঙে, ফ্ল্যাট উঠছে। প্রোমোটারের কাছ থেকে পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে শরিকরা সবাই হাওয়া হয়ে গেছে।

    অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিলেন বিভাদেবী। দিব্য রায় সেদিন বুঝি বা ঈশ্বর প্রেরিত দূত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন,তাঁর সামনে। ডুবে যাবার আগে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতোই দিব্যর হাত দুখানি ধরে বিভাদেবী,অশ্রুসজল চোখে, তাঁকেই কোন‌ও অনাথ আশ্রমে
    যা‌ হয় একটা বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ন‌ইলে যে রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিলো না।
    অন্য কেউ হলে হয়তো বা দায় এড়িয়ে চলে যেতো, কিন্তু দিব্য পারেন নি। কী দেখেছিলেন সেই বিপন্ন মুখে কে জানে! হয়তো বা কতোকাল আগে লোকান্তরিতা মায়ের ছায়া!
    সেই মুহূর্তে কী করবেন ঠিক করতে না পেরে, হোমের বাকি বকেয়া মিটিয়ে আর‌ও ক’টা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। বড়ো কোন‌ও সিদ্ধান্ত নেবার আগে ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা, বিচার বিবেচনা করার প্রয়োজন। বিপাকে পড়েছেন বলেই একদা সম্পন্ন ঘরের মাতৃসমা মহিলাটিকে কী করে অনাথ আশ্রমে, প্রায় পরিচারিকা হতে, রেখে দিয়ে আসা যেতে পারতো!
    শেষটায় অনেক ভেবে দিব্য তাঁকে এই বাড়িতেই নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
    প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না মহিলাটিকে অবশ্য সহজে রাজি করানো যায় নি। অনেক কষ্টে অবশেষে দিব্য তাঁকে বোঝাতে পেরেছিলেন, যে প্রয়োজনটা কেবল তাঁর একার নয়, পারষ্পরিক। বস্তুত কয়েকমাস আগে প্রবল ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত দিব্যকে, মধ্যরাতে একগ্লাস জল এগিয়ে দেবার মতো একজন‌ও কেউ ছিলো না। সেই থেকে, সত্যিই ইদানীং দিব্যর মনে, মাঝে মাঝে একটা বিপন্নতাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো।
    দিব্য, বিভাদেবীকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল, লোকে যদি সন্তান দত্তক নিতে পারে ,তাহলে মা’কেই বা কেন নয়!
    অনন্যোপায় বিভাদেবী প্রথমটায় সাময়িকভাবে থাকতে রাজি হয়েছিলেন বিকল্প ব্যবস্থা হলেই চলে যাবেন-এই শর্তে, কিন্তু পরবর্তীকালে,এই স্বজনহীন ছন্নছাড়া বিশৃঙ্খল সংসারে, দিশাহারা দিব্যকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারেন নি। তিনি থাকলে, সময়ে ভাতের থালাটুকু তো অন্তত মিলবে দিব্যর। আবার‌ও সেই মায়া!!
    বলাই বাহুল্য , নিকট‌ আত্মীয়ের দল, যাঁরা কিনা নিজেদের দরকার ছাড়া, কখনো উঁকি দিতেও আসতেন না, তাঁদের কপালে বড়ো বড়ো চিন্তার ভাঁজ পড়েছিলো বৈকি, কিন্তু তাতে বিভাদেবীর কিচ্ছু এসে যায় নি । অতঃপর,সন্তানসম মানুষটির এই সংসারেই তিনি থেকে গেলেন দিব্যর মাসিমা হয়ে।
    ‌‌ এই বাড়িতে আসার পর তিনি হাফডজন চাকর-বাকর, মালি, ড্রাইভারের হাতে থাকা টালমাটাল সংসারটির হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী, মৃদুভাষী মহিলাটির নির্দেশ‌ অমান্য করার সাহস কারোর হয় না, এমন কী খাওয়া দাওয়া, শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দিব্যকেও আজকাল তাঁর নির্দেশ মেনেই চলতে হয়।

    বিভাদেবীর সব চাইতে ভালো ব্যাপার হলো, দিব্যর ব্যক্তিগত পরিসরে, তিনি কোন‌ও দিন মাথা গলান না, নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে অকারণ কৌতূহল প্রকাশ করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ।
    মোটকথা বিভাদেবী আসার পর, দিব্যর ছন্নছাড়া সংসারটা আবার মনের খুশিতে ঘরোয়া কাজকর্মের খুটখাট আর বাসনকোসনের ঠুনঠান, সুরেলা আওয়াজে মেতে ওঠে। স্রেফ ইট-কাঠ কংক্রিট দিয়ে তৈরী দিব্যর বাড়িখানা, এখন বেশ গেরস্তর ঘর-দুয়ার হয়ে শোভা পায়!
    ইতিমধ্যে দিব্য আর‌ও একটা কাজ‌ করে ফেলেছেন। তাঁর প্রাক্তন রুগী, শহরের এক নামজাদা দুঁদে উকিল এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে, বিভাদেবীর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটি চালু করে দিয়েছেন। না শুধুই অর্থের জন্য নয়, ন্যায়বিচার‌ পাবার অধিকার তো সকলের‌ই আছে। আর‌ও একটা কারণে দিব্য‌ এই পদক্ষেপটি নেওয়া জরুরী মনে করেছিলেন, নিজেকে আশ্রিতা ভাবার কুন্ঠাবোধ থেকে বিভাদেবীকে মুক্তি দেওয়া।

    এখন বেলা প্রায় এগারোটা। সকালের বৃষ্টিটার পর চড়া রোদ উঠেছে। বাগানের কোণের শিউলি গাছটা থেকে ঝরা শিউলির মৃদু সুবাস এখন‌ও হাওয়ায় ভাসছে।
    শিউলি ফুল মায়ের খুব প্রিয় ছিলো। মাসিমা সেই কথা জানতে পেরে রোজ সকালে কাঁচের ডিশে‌ করে একরাশ শিউলি ফুল মায়ের ছবির সামনে রেখে আসেন। দিব্যর মনটা ভরে যায়।

    জীবনটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত।
    কে যে কোন অন্তরালে বসে তার অদৃশ্য
    অঙ্গুলি হেলনে এই বৃহৎ সংসারের নাটমঞ্চ পরিচালনা করেন ,ভেবেও কূল তল পাওয়া যায় না।
    জীবনে একটু থিতু হতে না হতেই‌, দিব্যকে এই বিশাল পৃথিবীতে একা করে দিয়ে বাবা‌,মা দুজনেই চলে গেল, তারপরেও যাকে আঁকড়ে ধরে, নতুন করে জীবন সাজাতে চেয়েছিলেন
    সে-ও তো—ভাবনাটা মনের চৌকাঠে এসে দাঁড়াতেই, সজোরে এঁটে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।
    ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’
    চটপট ঘরে এসে বিছানায় বসে ল্যাপটপটা খুলে বসলেন।
    ও বাবা! কতো মেইল এসে পড়ে আছে। সব‌ই সেই অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসা। সপ্তাহ পার হয়ে গেল,এখন‌ও লোকের এতো উচ্ছ্বাস!
    সম্প্রতি বিনা চিকিৎসায় মরতে বসা হতদরিদ্র একটি শিশুর খুব জটিল হার্ট অপারেশন করেছিলেন তিনি এবং তাঁর সহযোগিরা। সাফল্যের আশা প্রায় ছিলোই না। কতোটা তাঁদের হাতযশ আর কতোটা ঈশ্বরের কৃপা সে বিষয়ে তিনি নিজেই আজ‌ও নিশ্চিত নন। সংবাদপত্রে খবরটা ফলাও করে বেরিয়েছিল। দুই একটা কাগজ আবার তাঁর এবং সহযোগীদের ছবিও ছেপে দিয়েছে। ব্যস্ সারা শহর জুড়ে হৈ চৈ। উফফ্ ,বড়োই এমব্যারাসিং। এতো হৈ চৈ করার মতো কিছু আছে বলে দিব্য মনে করেন না। দায়িত্ববোধ সম্পন্ন যে কোন‌ও ডাক্তারকেই তো,কখন‌ও‌ না কখন‌ও প্রাণ বাঁচানোর এই লড়াইটা লড়তেই হয়!
    হ্যাঁ এক্ষেত্রে লড়াইটা খুব কঠিন ছিলো সন্দেহ নেই, তবু…।
    মেইলগুলো পরপর চেক করছিলেন। দরকারি কিছু মিস্ হয়ে না যায়। নজর বোলাতে বোলাতে আচমকা এক জায়গায় এসে দিব্যর নজরটা আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, লন্ডন থেকে জনৈক মিসেস ব্রাউন,একখানা দীর্ঘ মেইল পাঠিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার! কে এই মিসেস ব্রাউন! এই নামে কাউকে চেনেন বলে তো মনে পড়ে না, তা-ও আবার ঝরঝরে বাংলায়,এবং নির্ভুল বানানে!
    কৌতূহলী হয়ে চিঠিতে মন দিলেন দিব্য।

    “শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
    আপনি আমাকে চিনবেন না,আমি হলেম ঝুমকোলতা,আমার মায়ের নাম কলমীলতা,ওরফে কমলিনী।”
    — কী –ই-ই। প্রচন্ড জোরে একখানা ধাক্কা লাগলো বুকের মধ্যে।
    ঠাস্ করে বন্ধ করে দিলেন ল্যাপটপটা। ছটফটিয়ে উঠে আবার বেরিয়ে এলেন বাইরে। কে এই মিসেস ব্রাউন! তাঁর মুখে এইসব‌ নাম ! কী করে –কোথা থেকে? আশ্চর্য!! যে কথা কেউ জানে না,যা‌ একান্ত‌ই তাঁর মনের মণিকোঠায় তুলে রাখা নিজস্ব সম্পদ, সাত রাজার ধন এক মানিক, সেকথা অন্য কেউ জানলো কি করে!
    উদগ্র কৌতূহল,তাঁকে বাধ্য‌ করলো আবার ঘরে ফিরে এসে ল‌্যা‌পটপখানা খুলে বসতে।

    ” জানি এইটুকু পড়েই আপনি টানটান, হয়ে উঠে বসেছেন। আরে দাঁড়ান,
    আগেই অতোটা উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আপনাকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়,বরং বলতে পারেন, অচেনা কারো লেখা চিঠিখানা আপনি যাতে এড়িয়ে না যান, একটু মন দিয়ে আমার সমস্যাটার কথা শোনেন, সেইজন্য শুরুতেই এই ধাক্কাটা দিতে চেয়েছিলাম।আমার যে আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন‌! সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
    এবারে আসল কথায় আসি।
    শুনুন বলেছি বটে আমার মা, আসলে তিনি আমার মাতৃসমা পিসিমণি, আর আমি, তাঁর জীবনে ‘কোন‌ওদিন না আসা মেয়ে’, —যাকে বলে মানসকন্যা। আমার আসল নাম, স্পৃহা।
    আপনার বর্তমান অবস্থান, অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই আমার জানা নেই, কিন্তু এই দুনিয়ায় আর কাউকেও খুঁজে পেলাম না যিনি এই বিপদ থেকে আমার পিসিমণিকে উদ্ধার করতে পারেন। আমার পিসিমণির খুব বিপদ।
    এককালে এই পৃথিবীতে আপনিই তো ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন! তাঁর নিজের লোকেরা যে থেকেও নেই ,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানে!
    ভাবছেন হয়তো আমি নিজেই কেন এগিয়ে যাচ্ছি না।আসলে এই মুহূর্তে আমি একেবারে নিরুপায়।‌ একে আমি লন্ডনবাসী,তার উপরে গত সপ্তাহে একটি কন্যা সন্তানের জননী হয়েছি। আশাকরি পরিস্থিতিটা বোঝাতে পারলাম।
    আপনি হয়তো জানেন না, আপনাকে হারিয়ে পিসিমণি, সারাটা জীবন, সংসারে থেকেও সংসারের বাইরে নিজের তৈরী করা জগতেই বসবাস করে গেলেন। সেই জগতে ‘ফুল নেই পাখি ডাকে না, ভরা গলায় নাম ধরে ডাকে না কেউ’…তিনি আজ‌ও মনে মনে আপনার‌ই পথ চেয়ে বসে আছেন।
    মাঝের এতোগুলো বছর তাঁর কাছে, অস্তিত্বহীন। না,তিনি পাগল নন, কেবল গভীর বিতৃষ্ণায়,পরিবারের মানুষগুলিকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তারা যেন থেকেও নেই, পরাবাস্তবের,ছায়া মানব-মানবী। পিসিমণি তাঁর জীবনে একা। তাঁর দৈনন্দিন একলা যাপনে আজ‌ও আপনি, হ্যাঁ একমাত্র আপনিই তার সঙ্গী। আমাকেও অবশ্য একটু ঠাঁই দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন আমিও তো দূরের মানুষ হয়ে গেছি।

    খুব ছোটবেলায়,অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে টলোমলো পায়ে একদিন তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। জানলার শিক ধরে, পথের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির আঁচল ধরে টানতেই চমকে পিছন ফিরে, অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে র‌ইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর সেই যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সারাজীবনেও আর ছাড়লেন না। সেই থেকে আমিই তাঁর ঝুমকোলতা, এই পরিবারে একমাত্র আপনজন।
    একটু বড়ো হতে না হতেই ,তাঁর জীবনের সব কাহিনী আমার জানা হয়ে গেল, কিছুটা তাঁর টুকরো টুকরো কথায়, বেশির ভাগটাই, এই বাড়ির বহু পুরনো চাকর গোবিন্দদাদার কাছে, আর বাকিটা বাড়ির বাতাবরণে টাঙানো, ঢাকঢাক গুড়গুড়ের দরপরদার আড়াল থেকে উঁকিমারা গল্পের রেশ ধরে।
    আপনি তখন মেডিক্যাল কলেজে সিনিয়ার হাউজস্টাফ, আর পিসিমণি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষ। ফেষ্টে আলাপ।প্রথম‌ দর্শনেই মফস্বলের সহজ সরল,নরম স্বভাবের মেয়েটি নজর কাড়লো। তার, পিঠের প’রে দোলানো লম্বা বেণী আর দীঘল চোখের মায়ায় প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন, তারপর ভেসে গেলেন তার আবৃত্তির টানে। আপনি নিজেও যে একজন দক্ষ আবৃত্তিকার! দিনের পরে দিন যায়। পরিচয় দানা বাঁধে, ঘন হয়। আপনারা জুটি বেঁধে আবৃত্তি করেন।জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসা যুগল আবৃত্তির টানে টাপুর টুপুর শব্দ ঝরে, আপনাদের নিত্যকার জীবনেও। অবশেষে ঠিক সেইটাই হলো যেটা হ‌ওয়া স্বাভাবিক ছিলো। আপনাদের প্রেম ধীরে ধীরে দানা বাঁধলো।
    ওদিক পাশ করেই আপনার চাকরী জুটে গেছে, পিসিমণি ফাইন্যাল দেবে।
    স্বপ্নের দিন গোনা শুরু। নিরন্তর ‌আঁকা হতে থাকে ভবিষ্যত সংসারের মনোরম ছবি। আপাদমস্তক রোম্যান্টিক আপনি পিসিমণির নতুন নাম দিলেন কলমীলতা,আর ভবিষ্যতের কন্যার নাম হলো ঝুমকোলতা! সুখের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে দুজনকে।
    এইসব খবর তো আর চাপা থাকে না।দাবানলের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো, পৌঁছে গেল ঠাকুরদার কানে। পিসিমণিকে শুধু যে গৃহবন্দী করে ফেলা হলো তাই-ই নয়, অবিলম্বে ঘটক লাগিয়ে ,পালটি ঘরের পাত্র খোঁজা শুরু হলো। অচিরেই বংশমর্যাদায় মানানস‌ই, অথচ,বয়স, শিক্ষা, আচার-ব্যবহার, রুচি, পছন্দে সম্পূর্ণ বেমানান এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে পাকাও হয়ে গেল। এই বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করলে না। কে করবে?পিসিমণির মা ছিলো না যে‌, তাছাড়া তখন বাকিরা সবাই পিসিমণিকে তড়িঘড়ি পাত্রস্থ করতে পারলেই বাঁচে। কখন কে এসে বাগড়া দেয়! ওদিকে পাত্রপক্ষরা আবার বেজায় ‘উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর!’ সোজা কথা !

    মরিয়া পিসিমণি গোপনে গৃহত্যাগের পরিকল্পনা করে, আপনাকে নাকি একখানা চিঠিও পাঠিয়েছিল, বিয়ের আগের রাতে পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থাও পাকা , কিন্তু পৃথিবীতে গুপ্তচরের তো আর অভাব নেই! আপনার আর পৃথ্বীরাজ হ‌ওয়া হলো না,পরদিন ভোরে গ্রামবাসীরা নাকি অর্ধমৃত অবস্থায় আপনাকে হাইওয়ের পাশ থেকে উদ্ধার করেছিলো।
    ‌ কয়েক মাস বাদে সুস্থ হবার পর,আপনি স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, ব্যস্ এইটুকু খবর‌ই জানা গিয়েছিলো,বাকিটা আমাদের কারো জানা নেই।

    পিসিমণির বিয়েটা কিন্তু হয় নি। একমুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেবার চেষ্টায় ছিলো বেচারি, ঈশ্বর সেইটুকু কৃপাও করেন নি তাঁকে।

    এবার আসি পরবর্তী অধ্যায়ে‌।
    বড়ো হয়ে পড়াশুনা শিখে আমি অধ্যাপনার জগতে পা রাখলাম। বাধা এসেছিলো বৈকি।তবে নখদন্তহীন শার্দুলরা তখন হীনবল।

    অধ্যাপনা করি, নিজের কাছেই মাঝে মাঝে লাইব্রেরী যেতে হয়।
    একদিন বৃটিশ কাউন্সিলে,ঘটনাচক্রে জনের সঙ্গে আমার আলাপ। বৃটিশ হাইকমিশনের, কী একটা কাজে, সে এদেশে এসেছিলো। ইতিহাসের ছাত্রী জেনে উৎসাহিত‌ জন নিজের থেকে এসে আলাপ করলে। জব চার্নকের শহরের প্রেমে মুগ্ধ বৃটিশ যুবকটি সারা শহর চষে বেড়াতে চায়। কে জানে কেন আমাকেই তার মুরুব্বি ঠাওরালে। কয়েকটা মাস কেটে গেল, কলকাতা শহরের প্রেমে মুগ্ধ ইংরেজ যুবকটির শহরবাসিনীর প্রেমে পড়তেও দেরী হলো না। বাকিটা,বুঝতেই পারছেন, অলমিতি বিস্তরেন।
    না, পিসিমণির মতো ভুল আমি করিনি,বাড়িতে সবকিছু জানাজানি হয়ে যাবার আগেই রেজিষ্ট্রি বিয়েটা সেরে ফেলেছিলাম। তা সত্ত্বেও কম ঝামেলা পোয়াতে হয় নি, তবে দূতাবাসের ক্ষমতা তো জানেন‌ই, আটকে দেবার আগেই তারা আমায় উদ্ধার করে নিয়েছিল।
    অসহায় পিসিমণিকে ছেড়ে চলে আসতে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিলো। সেইদিন কিন্তু পিসিমণি তাঁর নিজস্ব ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো। কে জানে, হয়তো বা বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া নাটকের পুনরাভিনয় তাঁকে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে, চোখের জল মুছিয়ে, বলেছিলো —“যা পালা”।
    উপহার দিয়েছিলো তাঁর একমাত্র সম্বল আপনার দেওয়া সঞ্চয়িতাখানা।

    চলে আসার আগে খুব গোপনে গোবিন্দদাদাকে একখানা মোবাইল‌ কিনে দিয়ে এসেছিলাম। কেবল মা‌-ই, ব্যাপারটা জানতো। খবরাখবর সব তার মাধ্যমেই দেয়া নেয়া চলে। এইভাবেই দিন যায়। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত।
    দিন পনেরো আগে মা সঙ্গোপনে গোবিন্দদাকে একখানা গোপন ষড়যন্ত্রের খবর দেয়।
    আমাদের পেল্লায় বাড়িটা নাকি হাত বদল হতে চলেছে, হোটেল হবে। বিশাল লোভনীয় অফার, কেবল গোল বেধেছে পিসিমণিকে নিয়ে। কে তার দায়িত্ব নেয়!
    উকিল বন্ধু পরামর্শ দিয়েছে,পিসিমণিকে পাগলা গারদে পাঠাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। একখানা সার্টিফিকেট জোগাড়ের ওয়াস্তা , তাহলেই কেল্লা ফতে! পিসিমণির দায়‌ও নিতে হয় না,ওদিকে তার ভাগের সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়া যায়। পুজোর পরেই নাকি সব ফর্মালিটিস সেরে ফেলা হবে!
    মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো, সমস্ত চেনা জানা সোর্স কাজে লাগিয়েও যখন কোন‌ও সুরাহা করে উঠতে পারছিলাম না ,তখন‌ স্বয়ং ঈশ্বর‌ই যেন পথ দেখালেন। গোবিন্দদা কাগজে আপনার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে!
    আমার স্বামী জন আপনার মেইলিং এ্যাড্রেসটা জোগাড় করেছে। আপনার বর্তমান পারিবারিক পরিস্থিতি আমার জানা নেই,তবু আপনার কাছে আমি করজোড়ে মিনতি করছি ,আপনি আমার পিসিমণিকে পাগলা গারদে যাওয়া থেকে আটকান। অবসাদগ্রস্ত একজন মানুষকে পাগলা গারদে ঠেলে দিলে, তার যে কী পরিণতি হতে পারে,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানবে!

    এখন তো আপনার অনেক প্রতিপত্তি, পিসিমণিকে উদ্ধার করে যে কোন‌ও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন। টাকা পয়সার চিন্তা নেই সব দায় দায়িত্ব আমার। গোবিন্দদা আর তার বৌ- ই
    সমস্ত দেখাশোনার ভার নেবে। আপনার এ্যাকআউন্ট নম্বরটা পেলেই আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। তারপরেই না হয় আপনি কাজটা শুরু করবেন!
    আমার আর গোবিন্দদাদার ফোন নং এই সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি…

    জানি এই অপরাহ্ণবেলায়, প্রভাতকালে‌র ‌‌কোন‌ও কিছুই হয়তো আর অবশিষ্ট‌ নেই, তবু এককালে‌ তো ভালোবেসেছিলেন, সেই ভালোবাসার দোহাই……।

    আবার আকাশ কালো করে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে ,সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বনষ্পতিগুলো,প্রবলবেগে বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। দিব্যর মনেও মহাসমুদ্রের কলরোল। অতীতের ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা উড়ে এসে আবার সব কিছু এলোমেলো করে দিলো।প্রবল বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছিলেন দিব্য।

    “আসতে পারি?” —বারান্দায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিভাদেবী।

    “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ”—গলাটা স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টায়,সোজা হয়ে বসলেন‌ দিব্য।

    “শরীরটা কি খারাপ? দুপুরে তো কিছুই প্রায় খেলেন না!”

    ” না না , একদম ঠিক আছি, ঐ একটা …” থেমে গেলেন দিব্য।

    “তাহলে বুঝি মন খারাপ! একটু বসতে পারি?”

    “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ , কী আশ্চর্য…”

    “বলছিলাম যে , মাসিমা বলে তো ডাকেন, দুঃখটা কি একটু ভাগ করে নেওয়া যায়!”

    আর পারলেন না দিব্য। দরদী ছোঁয়ায়,এতো কালের চেপে রাখা পর্বতপ্রমাণ পাষাণভার, নামিয়ে হালকা হতে, এই প্রথমবার অকপট হলেন তিনি।

    “এখন আমি কী করি?”

    বাচ্চা ছেলেটি যেন মায়ের কোলে মুখ গুঁজেছে।

    ” এতো ভাবনার কী আছে ? আপনার কতো লোকবল। চটপট কাজে লেগে পড়ুন।পুলিশের ওপরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, আইনজীবির পরামর্শ নিন, ফর্মালিটিস সেরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পরুন রাজকন্যা উদ্ধারে।”

    ম্লান একটুকরো হাসি দেখা দিলো দিব্যর মুখে।

    “কিন্তু ওকে এনে রাখবো কোথায়? যেখানে সেখানে তো আর তোলা যায় না। ভাড়া বাড়ি অথবা হোম জোগাড় করতেও তো সময় লাগে, তাছাড়া মানসিক অবস্থাও তো–“

    ” কেন হোমের কী দরকার! গৃহলক্ষ্মীকে তো ঘরেই প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখন দেবীপক্ষ, ঘট স্থাপনের এটাই তো উপযুক্ত সময়!”

    “মাসিমা!! “

    “হ্যাঁ বাবা,আর দেরি নয়,কাজে লেগে প’রো। ছেলে,বৌমা নিয়ে ঘর করা আমার অনেক দিনের সাধ!”

    আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন বিভাদেবী।

    এরপর ঘটনার চাকা দ্রুত গড়ালো। দিন দুয়েক বাদে
    একটু বেশী রাতে দিব্যর গাড়ি ছাড়াও পুলিশের গাড়িসহ আর‌ও খানদুই গাড়ি নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করাই রণনীতি। দূরে কোথাও ছাতিম ফুটেছে। বাতাসে ছাতিমের ভারী গন্ধ।
    আবৃত্তিকার দিব্য আবার জেগে উঠছিলো বহুদিন পর … …
    মনের ভিতরে হাজির হ’লো চেনা ক‌’টি লাইন—
    “লক্ষ বছর পার করেছি আমি
    তোমার হাতেও আদিম কালের শোক
    অতীত জীবন মুহূর্তে আগামী
    এবার কোথাও নতুন কিছু হোক।

    আজ তাহলে বাঁচার‌ই গান জ্বালি…”

    এইখানে এসে চিন্তাটা থমকে গেল দিব্যর।কমলিনীর মনে তো আজ‌ও সেই তরুণ দিব্যর‌ই বসবাস, এই দিব্যকে সে যদি চিনতে না পারে ? যদি অন্য কেউ ভেবে..!!
    রাত পাড়ি দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে নির্জন রাস্তা দিয়ে।
    দিব্যর মনে তোলপাড় প্রশ্ন
    — সময়ের উজান কেউ কী কখন‌ও বাইতে পেরেছে!
    অন্তরীক্ষে, অনন্তনক্ষত্রবীথি নিরুত্তর।

  • গল্প

    গল্প- জনৈক শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যু

    জনৈক শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যু
    -সুনির্মল বসু

     

     

    অনেকদিন আগেকার কথা।

    তখন আমাদের আশ্চর্য এক শৈশব ছিল। মানুষের শৈশবে কত যে রহস্য থাকে, সামান্য জিনিসের মধ্যে অসামান্যতা খোঁজা, এই বয়সের একটা ধর্ম।

    মফস্বলে একেবারে অজপাড়া গায়ে থাকি। পাড়ার পেছনের দিকে একজন বিখ্যাত সাঁতারু থাকেন। বরুণ বর্মন। পাশের নদীতে তিনি ক্রমান্বয়ে দশ বারো বার সাঁতরাতে পারেন। তাঁর ঘর ভর্তি অজস্র মেডেল। অনেক অনেক মানপত্র।

    তাঁর ঘরে গেলে, তিনি খুব খুশি হন। স্মিত হাসেন।

    আমরা তাঁকে নিয়ে গর্বিত হই। আমাদের পাড়ায় এমন একজন খ্যাতিমান মানুষ থাকেন, এটা আমাদের অহংকার করার মত ব্যাপার।

    কিন্তু এই গল্প তাঁকে নিয়ে নয়। তাঁর বাড়ির অন্য এক অতিথিকে নিয়ে। ছুটির দিনে, কিংবা স্কুল থেকে ফিরে আমরা মাঝে মাঝে বরুণদার বাড়ি যাই।

    একদিন শুনলাম, ওনার বাড়িতে ওনার এক আত্মীয় এসেছেন, যিনি একজন শিল্পী। শিল্পী সম্পর্কে মনে একটা শ্রদ্ধার ভাব বরাবরই ছিল। কিন্তু নিজের চোখে কখনো শিল্পী দেখা হয়নি।
    একদিন শিল্পীকে দেখতে গেলাম।

    তিনি সর্বক্ষণ ছবি আঁকেন। আমরা তখন স্কুলে পড়ি, আমরা যে এক্সারসাইজ খাতা ব্যবহার করি,
    সেই খাতার উপরে কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো নেতাজি, আবার কখনো কাজী নজরুল ইসলামের ছবি থাকে, তা তাঁর আঁকা।

    ভদ্রলোকের ছোটখাটো চেহারা। পরনে পায়জামা ও বাঙালি শার্ট। হাতটা গোটানো। উদাস চেহারা। আমরা যে তাঁকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি, তাঁকে যে মনের গভীর থেকে এত শ্রদ্ধা করি, সেসব ব্যাপারে তাকিয়ে দেখার মত তাঁর সময় নেই। তিনি সদাসর্বদাই আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন। শিল্পী হিসেবে সবাই তাঁকে সম্মান করে। কিন্তু তাঁর বাড়ির চারদিকে প্রবল দারিদ্র্যের ছবি। ঘর দুয়ার প্রচন্ড আগোছালো।

    বড় হয়ে স্কুল জীবনের সেই পুরনো খাতা গুলোর দিকে যখন তাকাই, তখন মনে হয়, ভদ্রলোক খুব যে ভালো ছবি আঁকতেন, তা আজ আর মনে হয়না। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল, কিংবা নেতাজি, আরও অনেক সুন্দর করে আঁকা উচিত ছিল। এখন বুঝি, শুধুমাত্র প্রবল দারিদ্র্যের কারণে ভদ্রলোক যেকোনো উপায়ে ছবি এঁকে, জীবিকা নির্বাহ করবার চেষ্টা করে গিয়েছেন।

    ভদ্রলোক বিয়ে করেননি। আমরা তাকে চিরকুমার বলেই জানতাম। পরে জেনেছি, একটি মেয়েকে তিনি ভালোবাসতেন। দারিদ্র্যের কারণে মেয়েটি তাঁকে ছেড়ে চলে যায়।
    নিদারুণ অভাব এবং প্রেমে ব্যর্থতা নিয়ে তিনি পেটের দায়ে ছবি আঁকতেন।

    এক রোববার তাঁর বাড়িতে গেলাম। তিনি তখন উঠোনে বসে জলরঙে প্রকৃতির ক্যানভাসে ছবি এঁকে চলেছেন। বিশাল শিমূল গাছ। অজস্র ফুলে ফুলে ভরে গেছে। রংবেরঙের নানা রকম পাখি এসে গাছের ডালে বসেছে। সবুজ পাতার আড়ালে রঙের উঁকি ঝুঁকি।আমরা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

    তখন বসন্ত দিন। নীল আকাশ জুড়ে সাদা হালকা মেঘের ভেলা। আমরা গভীর বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়েছিলাম।

    খানিক বাদে, ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
    কি আঁকছেন,
    তিনি বললেন, ভালোবাসার গাছ।
    বললাম, এমন ছবি আঁকছেন কেন,
    বললেন, যে ভালোবাসা পেয়েছে, সে ভালোবাসার গাছ কোনোদিন আঁকবে না,
    বললাম, তাহলে আপনি যে আঁকছেন,
    তিনি উত্তর দিলেন না।

    অভাব এতটাই তাঁকে স্পর্শ করেছিল, তিনি প্রায়ই অনেককে বলতেন, বাটায় লোক নেওয়া হচ্ছে, আমাকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দিন না, এইভাবে এত অভাব নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
    স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে গিয়েছি, একদিন ভদ্রলোকের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। অভাবে দারিদ্র্যে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা গিয়েছেন।

    ও বাড়ি গেলাম। সামান্য কিছু মানুষজন এসেছিলেন।
    দৈনিক পত্রিকায় সংক্ষেপে এই খবর বেরিয়েছিল।

    শিল্পীর মৃত্যু ঘিরে কোনো শোকসভা সেদিন হয়নি। অভাবে দারিদ্র্যে তিনি চলে গেলেন।

    মনে পড়ছিল, একদিন আমাকে বলেছিলেন, এই পোড়া দেশে শিল্প সৃষ্টি করে, আমাদের মতো হতদরিদ্র মানুষদের পেট চলে না।

    আমরা সেদিন তাঁকে সম্মান জানাতে পারিনি। বন্ধুরা মিলে তাঁর বাড়ির সামনে, শিমূল চারা এনে বসিয়েছি। নাম দিয়েছি, ভালোবাসার গাছ।

    শিল্পী চলে গিয়েছেন অনেকদিন, তবুও আমাদের পাড়াটার বাইরের লোকের কাছে আজ পরিচিতি, শিল্পী পাড়া বলে।

  • গল্প

    গল্প- পসেসিভ

    পসেসিভ
    -মুনমুন রাহা

     

     

       ঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল পৌলমী । ছোট্ট বারান্দা থেকে রাতের সীমাহীন বিশাল আকাশটাকে দেখতে বেশ লাগছে। মনটা এই অসীমতায় ছড়িয়ে দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস টানল সে। অন্য দিন পৌলমীর মনের সব ঝড় এতেই কমে  যায়। কিন্ত আজ তা হল না। আসলে আজকের মনের ঝড়টা বেশ বড় আকার ধারন করেছে। এই ঝড় এত তাড়াতাড়িই বোধহয় বিলীন হওয়ার নয়।

                   ‘পসেসিভ’ কথাটাতে আগে বেশ গর্ব অনুভব করত পৌলমী । বিয়ের পর পর যখন আত্মীয়রা বা বন্ধুরা এক মুখ দুষ্ট হাসি নিয়ে বলত, ” তোর বর তোকে নিয়ে ভারী পসেসিভ”,  তখন বেশ ভালোই লাগত পৌলমীর। কিন্ত আস্তে আস্তে সলিলের পসেসিভনেসটা সন্দেহ বাতিকে পরিবর্তন হয়েছিল। বিয়ের নতুনত্ব কাটতে না কাটতেই এই বাতিকের জেরে হাঁপিয়ে উঠেছিল পৌলমী। অফিসের কোন পুরুষ কলিগ দরকারে ফোন করলে সন্দেহ , কোন অনুষ্ঠান বা পার্টিতে কোন পুরুষের সাথে হেসে কথা বললে সন্দেহ। পাড়া প্রতিবেশিরদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ছিল না। প্রথম প্রথম পৌলমী সলিল কে বোঝাত। চাকরি সলিলও করে তাই তার বোঝা উচিত অফিসের কলিগ কাজের জন্য ফোন করতেই পারে , সেখানে নারী পুরুষের পার্থক্য হয় না। আর তাছাড়াও সমাজে থাকলে সামাজিকতাও করতে হয়। বন্ধু , আত্মীয় এদের সাথে সম্পর্ক রাখাও এক প্রকারের সামাজিকতা । কিন্ত সলিলকে হাজার বুঝিয়েও কাজ হয় না। 

                        একবার পৌলমী অফিস থেকে সবে ফিরেছে , সলিল তখনও ফেরে নি। পৌলমীর শাশুড়িমা গেছেন গুরুদেবের আশ্রমে । এমন সময় সলিলের জাঠতুত ভাই সমীর এসে হাজির। পৌলমী যথা সম্ভব অথিতি আপ্যায়ন করেছে । এদিকে কিছুক্ষণ পরেই সলিল এল অফিস থেকে , এসে পৌলমী আর সমীরকে বাড়িতে একা দেখেই মুখ ভার করে চলে গেল ঘরে। তারপর রাতে পৌলমী ঘরে আসতেই সমীর আর পৌলমীকে নিয়ে নানা বাজে কথা বলতে লাগল। আরও অদ্ভুত ব্যাপার , সব কিছু শুনেও পৌলমীর শাশুড়ির মত হল, এ নাকি তার ছেলের বৌয়ের প্রতি ভালবাসা । সেদিন রাতে পৌলমী ঠিক করেছিল সকালে উঠেই চলে যাবে বাপের বাড়ি। কিন্ত সকালে উঠে আর যেতে পারে নি সে , কোথায় যেন সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা তাকে পিছু টেনেছিল। তবে সেদিনের পর থেকে সলিলকে সে আর কিছু বোঝাতে যেত না। পৌলমীর  মনে হয়েছিল সলিলের এই অসুখের চিকিৎসা তার দ্বারা সম্ভব নয়।

                  এসব কিছুর পরেও সমাজের শৃঙ্খলতায় আর সম্পর্কের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে পৌলমী সলিলের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে চার চারটে বছর। আজ ভারী খুশি ছিল পৌলমী । ডাক্তার যখন তার  প্রেগনেন্সি  কনফার্ম করে তখন হঠাৎই  মনের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। বুকের ভিতর একরাশ খুশি আর হাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্টটা নিয়ে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছিল সে। অনেকদিন পর অপেক্ষা করেছিল সলিলের জন্য। প্রথম খবরটা তাকেই দিতে চেয়েছিল সে। কিন্ত জীবনের পথে সব সময়ই যে সাজিয়ে রাখা হিসাব গুলো মিলে যায় তা কিন্ত নয়!

                     পৌলমীর ক্ষেত্রেও তা হল না। সলিল অফিস থেকে ফিরেই , বিনা ভূমিকায় শুরু করল,

        ” কি , তোমার ফস্টিনস্টি মিটল? কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানতে পারব না ?  অফিসে হাফ ডে নিয়ে বাইরে ফুর্তি করে বেরাবে? আজ হাতেনাতে ধরে ফেলেছি !

    খুব দুজনে হেসে ফুচকা খাওয়া হচ্ছিল! তাই না ! সাথে সাথেই তোমার অফিসের শর্মিলাদিকে ফোন করে জেনেছি , ব্যাক্তিগত দরকার আছে বলে হাফ ডে করে বেরিয়ে পড়েছিলে অফিস থেকে! তা এমন কতদিন চলছে !!”

             পৌলমী এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল। এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। পৌলমী আজ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরতেই দেখা হয় ঋষির সাথে । ঋষি পৌলমীর কলেজ ফ্রেন্ড। ঋষির বৌও প্রেগনেন্ট । ঋষি তার বৌয়ের রিপোর্ট দেখাতে এসেছিল ডাক্তারকে। একাই এসেছিল।
    পৌলমীকে ওখানে দেখেই গুড নিউজ আন্দাজ করে সে। আর দুই বন্ধুর গুড নিউজ সেলিব্রেট করতেই এই ফুচকা ট্রিট। ঠিক কলেজের মতো । আর সেটাই কোনভাবে দেখেছে সলিল তাই এই আস্ফালন।  সলিলের কথা বলা এখনও থামে নি। পৌলমীর চোয়ালটা ক্রমেই শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যে খবরটা দেওয়ার জন্য এতক্ষন অপেক্ষারত ছিল সে, সেটা আর দিতে ইচ্ছা করছে না। আজ আর কোন সাফাই দিতেও মন সরছে না তার। তার জায়গায় মনের ভিতর অন্য চিন্তা বাসা বাঁধছে। খুব ইচ্ছা করছে সীমাবদ্ধতার গণ্ডিটা এক লাফে পেরিয়ে যেতে। আজ পৌলমীর সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।

                    সকালে উঠে পৌলমীকে না দেখতে পেয়ে সলিল খুব একটা বিচলিত বোধ করে নি। কাল রাতের অশান্তিটা এখনও চলছে তার মনের ভিতর। এত বড় অভিযোগের পর পৌলমীর চুপ করে থাকাটা  সলিল নিজের ভাবনার সত্যতার প্রমাণ বলে মনে করে। কিন্ত সন্ধ্যার সময় যখন বাড়ি ফিরে মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে যে পৌলমী তার বাপের বাড়ি যায় নি , তখন একটু বিচলিত হয়ে পড়ে সে। সলিলের মা পৌলমীর মাকে ফোন করেছিলেন মেয়ের কার্য কারিতা সম্পর্কে জানিয়ে দুটো কথা শোনাবেন বলে আর তখনই জানতে পারেন সেখানে পৌলমী নেই। সলিল এরপর অন্তত দশবার ফোন করেছে পৌলমীকে কিন্ত কোন উত্তর নেই। তাতে আরও রেগে গেছে সলিল । আজ বাড়ি ফিরলে পৌলমীকে দেখে নেবে সে , এইভেবেই রাগে ফুঁসছে ।

    বেশ কিছুক্ষণ পর পৌলমীর ফোন থেকে একটা ম্যাসেজ ঢোকে সলিলের ফোনে ,

         “সলিল , তোমার সাথে চার বছর সংসার করে আমি উপলব্ধি করেছি যে , অতিরিক্ত পসেসিভনেস কখনও গর্বের হয় না বরং অপমানের হয়। তোমার আমার প্রতি বিশ্বাসের কমতি আছে বলেই না আমাকে নিয়ে পসেসিভ হওয়ার এত বাড়াবাড়ি !  যাক সেসব কথা , আমি আজ অন্য কিছু বলতে চাই। আমি অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিচ্ছি খুব তাড়াতাড়িই। আমি অনেক চেষ্টা করে সব সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসেছি তোমার খাঁচা থেকে । হ্যাঁ , খাঁচাই বটে , যেখানে নিজের মতো বাঁচা যায় না , কারও নজর বন্দি হয়ে থাকতে হয়, যেখানে পদে পদে অবিশ্বাস আর সন্দেহের কাঁটা সেটা কি খাঁচার থেকে কম কিছু !
    আগেও যে মনে হয় নি তা নয়, তবে , লোকে কি বলবে ! সমাজ আমাকে কি ভাবে দেখবে! এমন নানা প্রশ্ন উঠেছিল মনে আর সেই ভয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্ত না , আজ আমার আর সেসব ভয় করছে না । আমি যে আর একা নই তাই মনের সাহসটাও বেড়ে গেছে। হ্যাঁ , আমি মা হতে চলেছি। জানি, পিতৃ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোমার! তবে এই সন্দেহটা থাক । তুমি সারা জীবন এই সন্দেহের আগুনে তিল তিল করে জ্বলতে থাক । এটাই তোমার শাস্তি। একে যদি তোমার সন্তান বলে মনে কর তবুও তাকে তুমি কাছে পাবে না , আর যদি অন্য কারও সন্তান ভাব তবুও পরাজয় তোমারাই হল । উভয়ক্ষেত্রেই হার তোমার। আমাকে আর অযথা ফোন করো না । আর জানার চেষ্টাও করো না আমি কোথায় আছি বা ভবিষ্যতে কোথায় থাকব । ডিভোর্স পেপার ঠিক সময় পৌঁছে যাবে তোমার কাছে ।”

                   ম্যাসেজটা পরে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে সলিলের। একবার মনে হচ্ছে পৌলমীর গর্ভের সন্তান তারই , আজই তাকে খুঁজে নিয়ে আসবে সে কিছুতেই যেতে দেবে না নিজের সন্তান কে নিজের থেকে দূরে । আবার মনে হচ্ছে সেই লোকটার কথা যার সাথে হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছিল পৌলমী । মনে পড়ছে আগের রাতে হাজার অভিযোগেও পৌলমীর চুপ করে থাকা ! সলিলের ভিতরটা জ্বলতে থাকে । নিজের বোনা সন্দেহের চোরাবালিতে ক্রমেই  ডুবতে থাকে সে । নিজের মনের সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণতা কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে।

You cannot copy content of this page