গল্প
-
গল্প- দুঃখী মানুষের ফুটো নৌকো
দুঃখী মানুষের ফুটো নৌকো
-সুনির্মল বসুওকে কেউ ডাকে, বসন্ত। আবার কেউ কেউ ডাকে, বিলাস। দুটি ডাকেই ও সাড়া দেয়। ওর আসল নাম, বসন্ত বিলাস সামন্ত।
গরীব বাড়ির ছেলে বসন্ত। টাকা-পয়সার টানাটানির কারণে পড়াশুনো বেশি দূর করতে পারে নি। বাবা নিবারণবাবু চাষবাস করে জীবন চালাতেন। বয়স বেড়েছে। দেশে করোনা এলো, লকডাউন হোল। ওর বউ এলোকেশী কর্তাকে এর পর আর বাইরে বেরোতে দিতেন না।
ইদানীং বসন্ত জমিজারাত দেখাশোনা করছে। সেবারে মাঠে ভালো ফসল হবার সম্ভাবনা ছিল। আমফান ঝড়ে জমিজমা ঘরবাড়ি সব ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
বসন্ত ভাবে, আগেকার মানুষদের এত সবকিছু দেখতে হয়নি। এই প্রজন্মের মানুষকে এক জীবনে কত কিছু দেখতে হলো।
কিন্তু ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। একদিন তাই ট্রেনে উঠে বসল বসন্ত। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে কলেজ স্ট্রিটের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গ্রেস সিনেমা ছাড়িয়ে রাস্তার দুদিকে ব্যান্ড পার্টির দোকান
দেখতে পেলো।একসময় আড় বাঁশী বাজাতো ও।
মিউজিকের প্রতি ওর একটা আলাদা টান আছে বরাবর।সামনে রাজ ব্যান্ড পার্টির দোকান। বিয়ে বাড়ি অন্নপ্রাশন, উৎসবে অনুষ্ঠানে অর্ডার পেলে, এখানকার ব্যান্ড পার্টি সে বাড়িতে বাজাতে যায়।
বসন্ত সকালে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। এখন দুপুর দেড়টা বাজে। ওর খুব খিদে পেয়েছে। অভিরুচিতে ঢুকে ও চারটে কচুরি খেয়ে নিল। তারপর রাজ ব্যান্ড পার্টির দোকানে ঢুকলো।
দোকানের মালিক সানাইয়া চায়না বিহারের ছাপরা জেলার মানুষ। কলকাতায় অনেকদিন আছেন।
ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেনা। বললেন,
কি চাই আপনার?
বসন্ত বলল, আমাকে একটা কাজ দিন।
বাজনায় ইন্টারেস্ট আছে?
অল্প সল্প আছে।
বাড়ি কোথায়?
ধপধপি, ডায়মন্ড হারবার।
দেখুন, আপনি কেমন বাজান, আমার কোন আইডিয়া নেই। আমার টিম যখন বাজাবে, আমাদের ব্যান্ড মাস্টার যখন ড্রাম বাজাবে, আপনি পিঠে করে ওই ড্রাম বয়ে নিয়ে যাবেন।
আমি বাজাতে পারব না?
নিশ্চয়ই পারবেন। তার আগে আপনাকে কাজটা তো শিখতে হবে। রাজি হলে বলুন?
বাড়িতে যখন হাঁড়ি চড়ছে না। এক কথায় বসন্ত সেদিন রাজি হয়ে যায়।বেতনপত্র ঠিক হয়ে যায়। পরদিন সে কাজে জয়েন করে। সেদিন রাতেই কলাবাগান বস্তিতে একটা বিয়ে বাড়িতে ওদের ডাক পড়ে। আগের দিনে
ওকে কারুকার্য করা পোশাক, মাথায় টুপি, এবং পায়ে পরবার জন্য একজোড়া জুতো দেওয়া হয়েছিল।নতুন ড্রেস পরে আয়নায় বসন্ত নিজেকে দেখলো। কী ভালো যে লাগছে নিজেকে দেখতে। ও মনে মনে বলল, শালা, অক্ষয় কুমার, না অজয় দেবগন!
ব্যান্ড মাস্টার ওস্তাদ ওকে বলল, পিছন ঘুরে দাঁড়া,
আমি তোর পিঠে ড্রাম বেঁধে দিই।বসন্তের চাকরির জীবন শুরু হয়ে যায়। এইতো সেদিন হাতিবাগানে একটা বিয়ে বাড়িতে ওরা বাজিয়েছিল, ক্যায়সে বনি,ক্যায়সে বনি, ফুলুরি বিনা চাটনি ক্যায়সে বনি। সবাই প্রশংসা করছিল,
ব্যান্ড মাস্টারের।বসন্ত তো কিছু বাজায়নি। ও শুধু ড্রামটা বয়ে নিয়ে গেছে। ওর মনে অনেক স্বপ্ন, একদিন ও এই কলকাতা শহরে বড় বড় বিয়ে বাড়িতে নিজেই ড্রাম বাজাবে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে কলকাতায় বাসা ভাড়া নিল ও। রাতবিরেতে ডিউটি পড়ে। বাড়ি ফেরা যায় না।
তাছাড়া, যখন সকালে কাজ থাকে না, তখন ও ওস্তাদের কাছ থেকে ড্রাম বাজানো শেখে, প্র্যাকটিস করে। এরই মধ্যে অনেকগুলি গান ও তুলে নিয়েছে।দেবানন্দের গাইড ছবির গান, দিন ঢল যায়ে, রাত না আয়ে, তু তো না আয়ে, তেরি ইয়াদ সতা।
আবার রাজেশ খান্নার গান ওর খুব প্রিয়। নতুন করে গানটা তুলেছে, জিন্দেগি এক সফর হায় সুহানা,ইহা কাল কেয়া হো, কিস্ নে জানা।
ওদের দলে ট্রাম্পেট বাজায় চমন লাল। ঝাড়খণ্ডের গোইলকেরায় বাড়ি। স্যাক্সোফোন বাজায় দুর্জয় সিং। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে বাড়ি। ফুলুট বাজায় রাজমোহন। ছত্রিশ গড়ের মানুষ।
বসন্ত স্বপ্ন দ্যাখে, একদিন ওদের মতো বাজিয়ে শহর মাত করে দেবে ও। বাসায় ফিরে নিজের হাতে
রান্না করে খায় বসন্ত। রাতে তিনটে রুটি করে। মোড়ের দোকান থেকে তরকা কিনে আনে। পেটটা ভরে যায় কোনরকম।একদিন পাশের গলির একটি মেয়ে ওকে দেখে হেসে ফেলে। বলে, সেদিন চিৎপুরে বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলুম, তুমি পিঠে করে ড্রাম নিয়ে যাচ্ছিলে,
আর একটা লোক গান বাজাচ্ছিল।
কোন্ গানটা?
মেরা জুতা হায় জাপানি, পাতলুন হিন্দুস্তানি। তারপর মেয়েটি প্রশ্ন করল, তুমি নিজে কেন বাজাও না গো!
বাজাবো, বাজাবো। সময় আসুক। এরপর বসন্ত প্রশ্ন করলো, তোমার নাম কি?
আমার নাম কুসুম।
সুন্দর নাম তো! আমি এই গলিতে থাকি, এসো একদিন।
সেদিন রাতে মানিক তলায় একটা প্রোগ্রাম করে ফিরছিল বসন্ত। পথে কুসুমের সঙ্গে দেখা। ও প্যারামাউন্ট হল থেকে সিনেমা দেখে ফিরছিল।
খুব সুন্দর সেজেছে কুসুম। ওকে দেখে খুব ভালো লাগলো বসন্তর।
কোথায় গেছিলে?
সিনেমায়।
একা!
হ্যাঁ,
একা সিনেমায় যেতে ভালো লাগে?
কেন তুমি যাবে?
বললে যেতে পারি।
সামনের রোববার চলো।
যাবো। তুমি আমায় ডেকে নিয়ে যেও।
ঠিক আছে। ওই কথা থাকলো।
রোববার ইভিনিং শোতে ওরা সিনেমায় গেল।
পান্না সিনেমার রাস্তায় ফুচকা খেলো।এরপর একদিন বসন্ত ওকে ভালোবাসার কথা জানালো। কুসুম বলল, আমার বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে কথা বলো।
বসন্ত একদিন ও বাড়িতে গিয়ে ওর মায়ের অনুমতি নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে কুসুমকে বিয়ে করল। বসন্ত বিয়ের কথা বাড়িতে জানিয়েছিল। শুনে বাড়ির লোক সবাই রেগে গিয়েছিল। কেউ আসে নি।
মা বলেছিল, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়াটা খুব প্রয়োজন ছিল!বসন্ত কুসুমের সংসার চলছিল কোনমতে। অভাব ছিল, দারিদ্র ছিল। প্রথম প্রথম ভালবাসাও ছিল।
কতদিন হয়ে গেল, বসন্ত অনেকগুলো বাজনা শিখেছে।মাঝে মাঝে সকালে বাজায়, সাজন রে ঝুট মত বোলো, খুদা কি পাশ জানা হায়। কিংবা,
কখনো বাজায়, মিঠুনদার গান, আই এম এ ডিসকো ড্যান্সার।অনেকবার ও ওস্তাদকে বলেছে, আমাকে একটু ড্রাম বাজাতে দাও না, গুরু!
ওস্তাদ বলেছে, সে কিরে! তুই কবে আবার বাজনা শিখলি রে, সবাই শাল্লা এক লাফে আর্টিস্ট হতে চায়!দুর্জয় সিং সেক্সোফোন বাজায়। একদিন বসন্তকে ডেকে বলল, তোকে বাজনা শেখাবো। কাল সকালে তোর বাসায় যাবো। একটু মাল খাবার অ্যারেঞ্জমেন্ট করিস্!
আমি ওসব খাই না।
দুর্জয় সিং হেসে ফেললো, মিউজিক লাইনের লোক, মাল খাস না! হে হে।
পরদিন এসে দুর্জয় কিন্তু দারুণ বাজালো। কুসুম ওর জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করেছিল।দুর্জয় সিংকে দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল কুসুমের।
কত বড় বড় জায়গায় বাজায়। কত নতুন নতুন সুর তোলে। আর আমার বরটা আজ অবধি কিছু করতে পারলো না, শুধু ড্রাম বয়ে বেড়ালো।অন্যদিকে, দুর্জয় সিংয়ের নজর পড়েছিল কুসুমের শরীরটার উপর। সকাল দুপুর নেই, যখন তখন ও বাড়ি ঢুকে পড়তো দুর্জয় সিং।
বসন্ত সব দেখছিল। ও বুঝতে পারছিল, ক্রমশ ও খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পায়ের তলায় জমি থাকছে না। বাড়তি উপার্জন নেই। নিত্যদিনের অভাবের সংসার।
শেষবারের মতো শেষ চেষ্টা হিসেবে ও কুসুমকে বোঝাতে গিয়েছিল,
এসব ঠিক হচ্ছে না কুসুম!
কোনটা?
লোকটাকে পাত্তা দিচ্ছ কেন?
সম্মান দিয়ে কথা বলো। উনি একজন শিল্পী।
আর আমি?
তুমি কিছু না, ফালতু, বুঝলে ফালতু!দিনসাতেক বাদে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বসন্ত দেখলো, কুসুম ঘরে নেই।
শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করেছিল, তাই হোল।একদিন শহর মাতাল করে ড্রাম বাজাবো, স্বপ্ন ছিল বসন্তর। ভালোবাসা দিয়ে একটা সংসার গড়ে তুলবো, কত গভীর করে ভেবেছিল ও। না, ওসব কিছু না। পয়সা না থাকলে, যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারলে, জীবনের পরিণতি হয়তো এমনটাই হয়!
এবার সে কিভাবে মা-বাবার সামনে দাঁড়াবে? কি বলবে, বাড়ির মানুষদের, প্রতিবেশীদের?
পরদিন সে ব্যান্ড পার্টি অফিসে গেল। বলল, আমি আর কাজ করব না।
কেন রে, কি হলো?
শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার পাওনা গন্ডা দিয়ে দিন। আমি বাড়ি যাবো।মাসের মাইনে নিয়ে বাসা বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে বসন্ত শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে বসলো।
জানালার কাছে বসে দূরের আকাশ গাছপালা দেখছিল ও তখন। মনে মনে বলছিল, আমি একটা বাড়ি ছেড়ে, আর একটা বাড়িতে উঠেছিলাম। সারা জীবন আমি একটা ঘর খুঁজছিলাম। সারা জীবন মানুষ বাড়ি বানায়, বাড়ি খোঁজে, সত্যি সত্যিই ঘর পায় কজন!
ততক্ষণে ট্রেন তিনটে স্টেশন পেরিয়ে গিয়েছে।
-
গল্প- কাছের মানুষ
কাছের মানুষ
– মুনমুন রাহা
সূর্য দেব আজ যেন তার সমস্ত তেজ নিয়ে উপস্থিত হয়ে গেছেন সকাল সকাল। মাথার উপরের ছাতাটা কোন কাজই করছে না। শরীরের চামরাটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য অন্তরার কেবলমাত্র শরীরটাই নয় জ্বলছে তার বুকের ভিতরটাও। রোজ রোজ আর অপমান সহ্য হচ্ছে না তার। মাত্র তিন মাসের বিবাহিত জীবনেই হাঁপিয়ে গেছে সে। যদিও সমস্যাটা তার স্বামীর সাথে নয়। তার শাশুড়িমা অলোকা দেবীর সাথে । বিয়ের পর থেকে হাজার চেষ্টা করেও ভদ্রমহিলার মন পায় না অন্তরা । অথচ উঠতে বসতে অন্তরার কাজের , রূপের, গুনের , চাকরির কেবল দোষ ত্রুটি ধরে যান ভদ্রমহিলা । মাঝে মাঝে মনে হয় কৃষ্ণা বৌদির দেখানো পথ অবলম্বন করতে। কৃষ্ণ বৌদি এই পাড়াতেই থাকে। স্বভাবটা ভারি মিষ্টি। মুখে হাসিটা লেগেই আছে। কৃষ্ণা বৌদি প্রায়ই যায় অন্তরাদের বাড়ি । একদিন বাড়িতে কেউ নেই দেখে অন্তরাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে , নতুন বৌ মুখ কালো করে ঘুরছে কেন? অন্তরাও সেদিন কৃষ্ণা বৌদিকে তার সমস্যার কথা বলে । সব শুনে সেদিনই কৃষ্ণা বৌদি বলে , অন্তরার স্বামী বিতানকে সব কিছু জানিয়ে মানে মানে অন্তরার আলাদা সংসার পাতাই ভাল।
কথাটা শুনে আলাদা সংসার পাতার যে লোভ হয় নি অন্তরার তা নয়। কিন্ত ঐ যে বাবা মায়ের শিক্ষাটা মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। মনে হল যাক বয়স্ক বিধবা মানুষটার জীবনে ছেলে বিতান ছাড়া আছে কে! দেখা যাক আর একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে । কিন্ত এখন মনে হচ্ছে অনেক হয়েছে , রোজ রোজ অশান্তির থেকে আলাদা থাকাই ভাল। অভিমান , আর কষ্ট গুলো বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকেছে। এমন সময় চেনা ডাকটা কানে এল,
” অন্তরা , এই অন্তরা । ”
হ্যাঁ ঠিক, কৃষ্ণা বৌদির গলা। গেট থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকছে। অন্তরা কাছে যেতে জিজ্ঞেস করল ,
” কি গো আজ এত সকাল সকাল চাকরিতে যাচ্ছ যে ! ”
ম্লান হেসে অন্তরা বলে ,
” এই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি , অফিসে গিয়ে তো একটু শান্তিতে থাকতে পারব। বাড়িতে তো তার উপায় নেই। ”
কৃষ্ণা বৌদি জোর করে হাত ধরে নিয়ে যায় ঘরে । তারপর বলে ,
” চুপ করে বোস । মুখ দেখেই বুঝেছি কিচ্ছু খাসনি। আমি খিচুড়ি করেছি চুপচাপ খেয়ে তারপর যাবি অফিসে। ”
অন্তরার আপত্তিতে কোন কর্ণপাত না করে কৃষ্ণা বৌদি একবাটি খিচুড়ি এনে দেয়। তারপর নরম সুরে বলে ,
” আজ আবার কি হল রে ?”অন্তরার চোখ বেয়ে জল হয়ে নেমে এল গলার কাছে জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অন্তরা বলে ,
” কৃষ্ণা বৌদি তুমি তো জান , বিয়ের পর থেকে আমি কম কিছু সহ্য করি নি। ভালবেসে বিয়ে করেছি বলে আমাকে উঠতে বসতে কম কথা শোনায় না আমার শাশুড়ি । আমাদের হানিমুনে যাওয়া নিয়েও কত কাণ্ড করল , আমারা যেই অফিসের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করলাম সেই তার শরীর খারাপ। আমি তো প্রথমে সত্যিই ভেবেছিলাম। কিন্ত ঐ যে সত্যি কথা চাপা থাকে না । তাই তোমার কাছেই গল্প করল, যে এটা তার আমাদের একসাথে না ঘুরতে যেতে দেওয়ার প্ল্যান। আর ভাগ্যিস তুমি আমাকে বললে সে কথা ! না হলে তো আমার শাশুড়ি মায়ের স্বরূপ জানতেই পারতাম না।
শুধু তাই আমাকে দিয়ে ইচ্ছা করে ঘরের যাবতীয় কাজ করান , যাতে আমার অফিসের দেরি হয়ে যায়। চাকরিটা না থাকে। তুমি তো সবই জানো। তোমাকেই তো বলে এসব ।
আজ কি বলছে জানো, বলে আমার নাকি চরিত্রের ঠিক নেই। আমি অফিসে যাই ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে। আজ আমিও মাথার ঠিক রাখতে পারে নি কৃষ্ণা বৌদি । শুনিয়ে দিয়েছি দুকথা। কতদিন আর মুখ বুজে থাকব বলো তো ! আমার এমনই কপাল বাপের বাড়িতেও বলতে পারি না সব কিছু। এক তো নিজে দেখে বিয়ে করেছি তার উপর বাবা মাকে আর নিজের সমস্যার মধ্যে জড়াতে চাই না। ওদেরও তো বয়স হচ্ছে। ”
কৃষ্ণা বৌদি অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,
” আমি তো আগেই বলেছিলাম আলাদা সংসার পাত। বিতান কে বল হয় তোকে অথবা মাকে রাখুক তার জীবনে। ”
” আসলে বিতান ওর মাকে বড্ড ভালবাসে গো তাই , মানে ওর কথা ভেবেই এতদিন কিছু বলি নি। কিন্ত আজ তোমার কথা মানতেই ইচ্ছা করছে। দেখি অফিস থেকে ফিরে আসি, বিতানকে বলব সব কিছু। সত্যিই এবার মুক্তি চাই। আজ তো রাগ করে শুধু ডাল ভাত রান্না করে চলে এসেছি ।”
” বেশ করেছিস। আমি তো তোকে অনেকদিন বলেছি বেরিয়ে আয় । শোন অন্তরা তুই আমার বড় কাছের মানুষ, তোকে বড় ভালবাসি বলেই বলছি , তোর শাশুড়ি আমার কাছে তোর নামে কম নিন্দা করে নি রে । তোকে তো আমি বলেছি সবই । তোদের নাকি বংশ খারাপ, তোর বাবা মা নমস্কারীতে কম দামী জিনিসপত্র দিয়েছে। বিতানের সাথে তোকে মানায় না এমন কতো কিছু। আমার তোর নামে এসব শুনতে ভাল লাগে না। তাই বলছি , তিনটে মাস তো সহ্য করলি এবার নিজের মতো করে সংসার কর। ”
অন্তরা নিজের কাজে বেরিয়ে যায়। কিন্ত অফিসে গিয়ে থেকে শরীরটা খুব একটা ভাল লাগছে না। সে ঠিক করল বাড়ি চলে যাবে। মনের ভিতরটাও কেমন যেন একটা খচখচ করছে। রাগের মাথায় শুধু ডাল ভাত রান্না করাটা কেমন যেন একটা অপরাধ বোধে ভোগাচ্ছে । হাজার হোক একটা বয়স্ক মানুষ দুপুর বেলা খাবে তো ! তার বাবা মায়ের শিক্ষা , নিজের কর্তব্য নিজের কাছে। সাতপাঁচ ভেবে অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলো অন্তরা।
বাড়িতে গিয়ে বেল দেওয়ার দরকার বা ইচ্ছা কোনটাই হল না। তার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি থাকে । অন্তরা ভিতরে ঢুকেই বুঝল কেউ এসেছে যার সাথে তার শাশুড়ি অন্তরার নামেই কিছু বলছেন বেশ জোর গলাতে।
” ভাগ্যিস তুমি আছো । তাই তো জানতে পারলাম আমার বৌয়ের কৃতি কলাপ। ছিঃ ছিঃ ভালোবাসার বিয়ে, এখনও বছর গড়াল না এর মধ্যেই অন্য পুরুষের সাথে লটঘট! আমার ছেলেটার কথা একবার ভাবল না !”
অলোকা দেবীর বোধহয় চোখের জল মুছতে সময় নিলেন। এরমধ্যেই শোনা গেল আর একটা খুব পরিচিত গলার আওয়াজ।
” আর কি বলব মাসিমা , সে দৃশ্যের কথা আমি মুখে আনতে পারব না আপনার সামনে । বলেছিলাম না বংশটাই খারাপ। আমার তো অনেক পরিচিত লোকজন আছে ওখানে তাই যখন শুনলাম বিতান বিয়ে করেছে ঐ উত্তর পাড়ার দিকে তখনই খোঁজ করে খবর এনেছি। ঐ মেয়ের চরিত্র বিয়ের আগেও ভাল ছিল না। আর ওর বাবা এক নম্বরের কৃপন। বললাম না আপনাকে নমস্কারীর শাড়ি গুলো কেমন যেন পুরোন পুরোন। পরে তো আপনার বৌমাই আমাকে বলেছে , শাড়ি গুলো সব চৈত্র সেল থেকে কেনা। দেখুন মাসিমা , আপনাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপনার সম্পর্কে কুকথা শুনতে মন চায় না। কিন্ত বাবাঃ , আপনার বৌমা তো আপনার সম্পর্কে নিন্দে করা ছাড়া কিছু জানে না। আমি তো বলি এমন বৌ থাকার থেকে না থাকা ভাল। দূর করে দিন তো ছেলের জীবন থেকে ।
যাকগে , একটু খিচুড়ি এনেছিলাম আপনার জন্য। আপনার বৌমা কি রান্না করেছে তার ঠিক নেই। তাই ভাবলাম একটু নিয়ে যাই। আপনি যে আমার বড় কাছের মানুষ। খাবেন কিন্ত। ”
” আর মা রান্না! আজ তাকে দুটো সত্যি কথা বলেছি না! ঐ যে তার চরিত্র তুলে কথা বলেছি বলে তেজ করে সে ডাল ভাত রান্না করে গেছে। সবই আমার পোড়া কপাল। ভাগ্যিস তুমি ছিলে মা। ”
অন্তরা এতক্ষন সবটাই খুব অবাক হয়ে শুনছিল । তার এত কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি এসব কি বলছে । নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না তার । আর সহ্য হল না ,এবার ঘরে ঢুকে পড়ে সে। বলে ,
” আরে বাবা , এইটুকুই! আরও কিছু কথা কৃষ্ণা বৌদিকে জিজ্ঞেস করো মা ! আজকে যে আমি কিছু রান্না করি নি তোমার খাওয়ার অসুবিধা হবে , কৃষ্ণা বৌদি কেমন করে জানল ? বল , বল কৃষ্ণা বৌদি কি করে জানলে ? বলবে না ? তাহলে আমিই বলি , কারণ সেটা আমার কাছ থেকে জেনেছে। আমাকে সকালে ডেকে ভালবেসে খিচুড়ি খাইয়ে জেনেছে সংসারে কি হল , তারপর তোমার নামে কত নিন্দে করল আমার সাথে মিলে । আবার এও পরামর্শ দিল যে আমার উচিত এবার বিতান কে নিয়ে আলাদা থাকা । হ্যাঁ , আমিও তোমার মতোই ভরসার মানুষ মনে করে সংসারের সব কথা বলি যে কৃষ্ণা বৌদিকে।
আমার চরিত্র তুলে কথা বলেছিলে বলে খুব রাগ হয়েছিল সকালে তোমার উপর। সেটা শুনে কৃষ্ণা বৌদিতো আকাশ থেকে পড়ল। কিন্ত এখন বুঝতে পারছি আমার নামে চরিত্রহীনের আপবাদটা কে দিয়েছে। আচ্ছা কৃষ্ণা বৌদি , তুমি কবে আমাকে কার সাথে দেখেছ গো । আমাকে একটু বলতো ! আর কি করতে দেখেছো সেটাও বল ।”
কৃষ্ণা বৌদির তখন পালাই পালাই অবস্থা একবার ঢোক গিলে বলে ,
” কে জানে হয়তো ভুল দেখেছিলাম। আমার চোখের কি ঠিক আছে !”
অন্তরার শাশুড়ি অলোকা দেবী বেশ হতবাক। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না । অন্তরা আবার বলে ,
” আমার তো এটাও সন্দেহ হচ্ছে তোমার চোখের দৃষ্টির সাথে কানটাও মাঝেমাঝে উল্টোপাল্টা শোনে । আচ্ছা মা , তুমি কি আমাদের হানিমুনে যাওয়ার নাম শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। মানে নাটক করেছিলে!”
অলোকা দেবী রেগে আগুন। বলেন,
” কি যা তা বলছো ? আমাকে কি ভাব তুমি ? আমি কি মানুষ নয়? তোমরা দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে সদ্য বিয়ে করেছ বেড়াতে যাবে বলে ঠিক করেছ আর আমি তাতে ব্যাগরা দেব ইচ্ছা করে! তোমার কথা যদি ছেড়েও দি , আমি আমার ছেলের ভাল লাগা খারাপ লাগার মূল্য দেব না? কত আশা করে ছেলেটা টিকিট কেটেছিল বেড়াতে যাবার আর আমি মিথ্যে অসুখের অভিনয় করে তাকে যেতে দেব না ? ”
অন্তরা হেসে বলে ,
” আমি বলছি না , এই যে আমার আর তোমার শুভাকাঙ্খী , কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি বলেছে । আরও বলেছে এসব কথা তুমিই বলেছ তাকে ! ”
” কৃষ্ণা , এসব বলেছি আমি ? কেন এরকম মিথ্যা বলেছো আমার নামে ? আমার তো এখন বৌমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বৌমার নামেও আমার কাছে মিথ্যে বলেছো। ”
কৃষ্ণা বৌদি নিজের পিঠ বাঁচাতে বলে ,
” দেখুন মাসিমা , আপনার আর অন্তরার ব্যাপারে আমাকে টানবেন না । আপনাদের সংসার আপনারাই বুঝুন। ”
বলে আর দাঁড়ায় না কৃষ্ণা হনহনিয়ে বেরিয়ে পরে সে। অলোকা দেবী এখনও বিস্মিত। বলে ,
” মানুষ এমনও হয় ! আমি তো অগাত বিশ্বাস করতাম কৃষ্ণাকে। তার মুখের হাসিতে আর ভাল ব্যবহারে তাকে আপন মনে করে সব কথাই বলতাম। আর তার এই ফল ! ”
অন্তরা বলে ,
” আমিও তো তাই করেছিলাম। কিন্ত আজ কৃষ্ণা বৌদির ভাল মুখোশের আড়ালে নোংরা চেহারাটা দেখলাম। অবশ্য ভুল আমরাও করেছি। নিজের ঘরের কথা বাইরের লোককে আপন মনে করে বলাটাও হয়তো ভুল হয়েছিল আমাদের। এবার থেকে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটাতে চেষ্টা করব । তাহলে আর কোন কৃষ্ণা বৌদি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না । ”“আচ্ছা কৃষ্ণার এমন করে লাভ কি হল ” বলেন অলোকা দেবী,
” আসলে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের লাভের থেকে অন্যদের ক্ষতিতে বেশি সন্তুষ্ট হয়। এদের লোকের ঘরে আগুন লাগিয়েই আনন্দ। ”
” যাক , আমাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি মিটেছে এটাই বড় কথা । তবে একটা শিক্ষা হল , সংসারে থাকতে গেলে হয়তো আবার মনোমালিন্য হবে । কিন্ত তা মেটানোর দায়িত্ব আমরা দুজনেই নেব , তাই না বৌমা ! ” বলেন অলোকা দেবী ।
অন্তরা হেসে বলে ,
” একদম ঠিক। আমাদের সমস্যা আজ থেকে শুধু আমাদেরই । দরকার নেই আর কোন কাছের মানুষের। ”
-
গল্প – খেলাঘর
খেলাঘর
-অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)এক কামরা ঘর তার ওপরে আর একটা ঘর।সরু বারান্দার একপাশে সিঁড়ি। দুকামরার দোতালা এই বাড়িতেই ছিল ছোটো একটা সংসার।সাজানো গোছানো একটা পরিকল্পিত পরিবার। সারা গ্রাম এত দিন তাই জানতো। সুখী দম্পতির সুখের সংসার। ভালোবাসার সংসার। আজ সেই দুকামরার শুন্য বাড়িটা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। ভয়ংকর সেইসব ঘটনাগুলির সাক্ষী হয়ে।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পথ চলতি মানুষের একটাই প্রশ্ন মুখে মুখে। কি আবার হলো যার জন্য ছেলে মেয়েকে আর মাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো পুতুলকে?
সুখের সংসারটা ভেঙে দিয়ে এক বুক হতাশা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল পুতুল।দীর্ঘ ২০ বছরের সংসার ভেঙে পাড়ি দিতে হলো অন্য কুলে অন্য কোনো সুখের সন্ধানে। পুতুলের খেলাঘর ভেঙে গেল তাসের ঘরের মতো।মানুষের গঞ্জনা অত্যাচার গুজবের নীরব সাক্ষী এখন এই বাড়িটা।
বাড়িটা যদি কথা বলতে পারতো, যদি প্রতিবাদ করতে পারতো তাহলে হয়তো সব অত্যাচারের প্রতিবাদ করতো। অনেক আগেই মিটে যেত সব সমস্যা।
আজ শুন্য বাড়িটা একা। বড়ো একা। ক্ষতবিক্ষত মনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
এই বাড়িতেই জন্মেছিল ফুটফুটে একটা মেয়ে। চোখ দুটো টানা টানা। ঘনকালো লম্বা চুল। ঠিক যেন পুতুল। তাই নামটা ও রাখা হলো পুতুল।
পাড়ার সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াতো। তখনই এপাড়ার নয়না কাকিমা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার ছোট ছেলের বউ করে আনব।এ মেয়েকে কোথাও যেতে দেব না।
সবই ছিল কথার কথা অবশ্য।
একদিন সেই কথায় যে সত্যি হবে,কে তা জানত? ছোট ছেলের প্রেমে পড়ল পুতুল। বিয়েটা ও লুকিয়ে হয়ে গেল।
বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। সেই ছোট্ট মেয়েটা এত কম বয়সেই বউ হয়ে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো , এই বয়সে লুকিয়ে বিয়ে করায় নয়না কাকিমার চোখের বিষ হয়ে গেল।
অত্যাচার এমন চরমে উঠলো যে শ্বশুর বাড়িতে থাকা দুস্কর।
পুতুল ফিরে এসেছে নিজের বাড়িতে। জন্মদার্তী মায়ের কাছে। স্বামী সুকান্ত ও নিজের মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে এলো শ্বশুরবাড়িতে।
কথা ছিল নতুন একটা বাড়ি ঠিক করে বউকে নিয়ে চলে যাবে।
আপত্তি করল মেয়ের মা। পুতুলই তাদের একমাত্র সন্তান। একরত্তি মেয়ে বিয়ে করেছে বলে কি হাত পুড়িয়ে খাবে নতুন বাড়িতে? আদরের মেয়ে সেই থেকে মায়ের কাছেই থেকে গেল।
শ্বশুর বাড়ি যাওয়া আর হলো না। এই বাড়িতে ই জন্মেছিল।এই বাড়িতে শুরু হলো নতুন সংসার জীবন। আবার এই বাড়িতেই জন্ম নিল পুতুলের মেয়ে। আরও চার বছর পর একটি ছেলে। কুড়ি বছরের সংসার জীবন পরিপূর্ণ হলো দুই সন্তান নিয়ে।
একসময় মায়ের হাতে হাতে কাজ শিখে পাকা সংসারী হয়ে উঠলো।
এখনই তো সুখের সংসার। সুকান্ত মাসে একবারই বাড়ি ফেরে কলকাতা থেকে। কয়েক দিন থেকে আবার ফিরে যায় কলকাতায়। খাওয়াপরার অভাব ছিল না। পুতুলের ও কোনো অভিযোগ ছিল না প্রেমিক স্বামীর বিরুদ্ধে। দিব্যি ছিল মিলেমিশে। অন্তত আমরা মানে পাড়াপ্রতিবেশি তাই জানত। সুখের সংসার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত যে অশান্তি কেউ তা জানতো না। পুতুল এখন আছে ভাড়া বাড়িতে মা আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে।
বাড়িটা তালাবন্ধ।
কিন্তু কেন এমন হলো? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভাব করেছিলাম পুতুলের সাথে। তারই বয়ানে লেখা আমার কাহিনি।
সুকান্ত যখনই বাড়ি আসে। ব্যাগ ভর্তি বাজার সঙ্গে বিদেশি মদ। পুতুল সব জানতো।
অল্প আদরু মদ সবাই খায় এখন। এটা তেমন দোষের নয়।সুকান্তও খেতো। পুতুল মেনেও নিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু যত আয় বাড়ে। তত বন্ধু -বান্ধব, ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। দাদারা এই সুযোগে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করতে ভাইকে তোয়াজ করে চলল। একসময় পুতুলের কোনো কথায় আর কানে ঢুকলো না। মদের গন্ধে বাড়িটা ম ম করতে থাকে। নীচের ঘরে মদের আসর বসালো। যতসব মাতাল বন্ধুবান্ধব এসে জুটলো এই বাড়িতে। ওপরের ঘরে ছেলে মেয়ে মাকে নিয়ে একপ্রকার জড়োসড়ো হয়ে পড়ে থাকতো। অপেক্ষা করতো কখন আসর ভাঙবে? তাতেও শান্তি নেই। ডাক আসে পুতুলের। সবার জন্য মদ পরিবেশন করতে।
শান্তশিষ্ট পুতুল রাগে অপমানে গর্জে উঠল।
মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে প্রত্যেকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল।
তারপর থেকে সুকান্তের অত্যাচার চরমে ওঠে। “এত বড় সাহস আমারই খেয়ে আমারই বন্ধুদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া”।
শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করল। ঠিক করল,এবাড়ি না ছাড়লে পুতুলকে জব্দ করা যাবে না।
পুতুল সরল মনে তাই মেনে নিল। নতুন বাড়িতে নতুনভাবে সাজাবে সংসার। এত খুশির খবর।
কিন্তু বাড়ির বড় দাদারা ততক্ষণে সব জায়গা জমি থেকে বঞ্চিত করে দিল সুকান্তকে। জায়গা কিনে ঘর বাধা আর হলো না।
পুতুল বাড়ি ছাড়ল।
মাকে সঙ্গে নিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল অন্য কোথাও।
অনেক খোঁজ করে ও পুতুলদের আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
কয়েক দিন পর পাড়ায় এল পুলিশ। সুকান্তকে ধরে নিয়ে যেতে।
শুনলাম,পুতুল কেস করেছে স্বামীর বিরুদ্ধে।
এখন সুকান্ত আদালতের কাঠগড়ায়।
কতখানি যন্ত্রণা অত্যাচার করলে তবেই স্বামীর বিরুদ্ধে কেস করতে পারে কোনো প্রেমিকা বউ।
প্রতিশোধের আগুনে পাষাণী হয়ে উঠলো পুতুল।
যে মেয়ের মুখে সাড়া ছিল না এত গুলো বছর। স্বামীর সংসারে শান্তিতে ছিল বলে মনে হয়েছিল পথ চলতি মানুষের। সেই পুতুলই চরম নির্লজ্জতার কথা স্বীকার করল।
স্বামীর হাতে ধর্ষিতা দুই নারীর যন্ত্রনার কথা বলতে বাধ্য হলো। এক স্ত্রী পুতুল আর এক নারী নবম শ্রেণিতে পড়া নিজের মেয়ের ওপর বাবার পাশবিক অত্যাচার।
নিজের মেয়ের সামনে নিলজ্জের মতো পুতুলকে জড়িয়ে ধরে অসভ্যতা করা।
পাড়ার একদল লোকের সামনে থেকে কোলে তুলে এনে ছেলে মেয়ের চোখের সামনে শুরু করত যৌন আদরের নামে নৃশংসতা। শেষ পর্যন্ত নিজের মেয়েকেও —
তীব্র ঘৃণা আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ল পুতুল।
মেয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করতে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে ছিল দেহ। চাই না এ খাবার। চাই না খেলনা৷ চাই না চকলেট।কাঠগড়ায় আসামি সুকান্ত। বধূ নির্যাতন, মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার আইনের চোখে অপরাধী এক স্বামী।।
পরকীয়া নামক উপসংহারের তাজা মন্তব্য গুলি মুখে মুখে ঘুরছে এখন সারা পাড়া।
ছি ছি ছি স্বামী যতই খারাপ হোক তাবলে বড় ছেলে মেয়েকে নিয়ে অন্যের হাত ধরে ঘর ভেঙে নতুন ঘর গড়া। একেমন কলংকিত মেয়ে।
এ মেয়ে নির্ঘাত মরবে। কোনো দিনই সুখ পাবে না।
কাঠগড়ার মুখোমুখি সুকান্ত আর পুতুল। কোনো কথা নেই। পুতুল হঠাৎ সোজা গিয়ে সুকান্তের গালে স্বজোরে চড় মারল। ঘর ভর্তি জনতা হাঁ করে দেখল। প্রতিবাদহীন সবাই। পুতুলকে ঠান্ডা করে বসিয়ে দেওয়া হলো আসনে।
শুরু হলো বিচার।শেষ বিচারের আশায়। অর্ডার ওর্ডার সবাই অপেক্ষায়। -
গল্প- যখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র ছিলাম
যখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র ছিলাম
-সুনির্মল বসুআজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগেকার কথা বলছি, অথচ আজ মনে হয়, এইতো সেদিন, আমি আজও যেন বন্ধুদের ভিড়ে পড়াশোনা নিয়ে হইহই করে মেতে আছি। মাননীয় অধ্যাপকদের বক্তব্য শুনছি, কলেজের সোশালের আয়োজন নিয়ে মেতে আছি, ক্যান্টিনে চল্লিশ পয়সার ঘুগনি আর চা খাচ্ছি।
কী সব স্বপ্নের দিন। মাঝে মাঝে দিনগুলোর গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে।আটষট্টি সালে নঙ্গী স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করবার পর, বঙ্গবাসী কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। মাইনে ন টাকা। মেজ মামা বিমলেন্দু ঘোষ এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। উনি আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেন। অধ্যাপক জানকী বল্লভ চৌধুরী আমাকে ভর্তি করে নেন। পরে ক্লাসে উনি আমাদের শাক্তপদাবলী পড়াতেন।
সত্তর খানা সিঁড়ি ভেঙে পাঁচ তলায় আমাদের বাংলা অনার্সের ক্লাস হত। আমার গর্ব হত এই ভেবে, এই ঘরে বসে ক্লাস করে গিয়েছেন প্রথিতযশা গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরী।
বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত কবি ও সমালোচক অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। স্যার আমাদের বৈষ্ণব পদাবলী পড়াতেন। প্রথম দিন ক্লাসে এসে বলেছিলেন, এবার তোদের উপর অষ্টবজ্র সম্মীলন হবে। কলকাতা কাঁপানো আট জন দিকপাল বাংলার অধ্যাপক আমাদের অনার্সের ক্লাস নিতেন। ততদিনে জগদীশবাবুর কবি মানসী প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজে কবি ও কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
আকাশে মেঘ করলে,স্যারের পড়ানো সেদিন অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেত। জানালা দিয়ে আমরা সেদিন উদাস কলকাতা শহরের আকাশ দেখতাম।
অধ্যাপক গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় আমাদের অন্নদামঙ্গল পড়াতেন। অসম্ভব সুদর্শন তিনি। পড়াতেন ছবির মতো। আজও যেন তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই।
অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী আমাদের মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতেন। অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠস্বর তাঁর। পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন। তাঁর জোরালো বক্তব্য একদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিশেষ মর্যাদা পেত।
আমাদের কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। তিনি পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের শিক্ষা মন্ত্রী হন। আমরা অবশ্য ওনার কাছে পড়ার সুযোগ পাই নি। অনেক পরে আমরা ছাত্র হিসেবে কলেজে এসেছিলাম।
রাজসিংহ উপন্যাস পড়াতেন অধ্যাপক
পৃথ্বীশ নিয়োগী। তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ কোনদিন ভুলতে পারবোনা। উপন্যাসের নায়ক বিচার করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসের নায়ক রাজসিংহ না ঔরঙ্গজেব, বিশ্লেষণ করে দেখা।প্রবন্ধ পড়াতে আসতেন অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র নাথ সাহা। স্যার খুব খেটে পড়াতেন। অনেকে তাঁর কথাগুলো ভারী বলে ,মনোযোগ দিয়ে শুনতো না।
পরে বুঝেছি, তাঁর কথা গুলিতে জীবনের গভীর অনুভব ব্যক্ত হোত। তাঁর কথা না শোনাটা মূর্খামি।ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন ডক্টর অরুণ বসু। চেহারা দেখলে রাগী রাগী মনে হলেও, নরম গলায় সহজ করে পড়িয়ে যেতেন তিনি। স্যার নামকরা গীতিকার। ভাস্কর বসু নামে অজস্র ভালো গান তিনি লিখেছেন।
নামী শিল্পীরা প্রায় অনেকেই তাঁর লেখা গান
গেয়েছেন।আমাকে একদিন ডেকে বললেন, তুই কোথায় থাকিস রে,
আমি বললাম, বাটানগর।
স্যার বললেন, ওখানে আমার এক বান্ধবী আছেন,
কুমকুম চৌধুরী। ওর হাজবেন্ড বাটা কোম্পানির ফ্যাক্টরি ম্যানেজার। নাম, ভবতোষ সেন চৌধুরী।
আমার বাবা বাটা কর্মী। বাড়ি এসে বাবাকে বললাম, ভবতোষ সেন চৌধুরীর কথা। বাবা বললেন, উনি বি এস চৌধুরী। ফ্যাক্টরি ম্যানেজার।আমাদের নাটক পড়াতেন অধ্যাপক নলিনী রঞ্জন চক্রবর্তী। আমি তাঁর পরম ভক্ত ছিলাম। তিনি আমাদের নীলদর্পণ নাটক পড়াতেন। বাংলা নিয়ে পড়া আমার সার্থক হয়েছে, আমি স্যারের অসম্ভব ভালো নাটকের ক্লাস দিনের পর দিন শুনেছি। স্যারের উঁচু লম্বা চেহারা, গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি,
অসম্ভব সুন্দর উচ্চারণ ভুলতে পারিনা। একটা সংলাপ শিশির ভাদুড়ী কিভাবে বলতেন, অহীন্দ্র চৌধুরী কিভাবে বলবেন, নির্মলেন্দু লাহিড়ী কিভাবে বলবেন, তিনি সেভাবে দেখাতেন। বাড়িতে এসে কোনদিন পড়বার দরকার হয়নি। ক্লাসেই পড়া তৈরি হয়ে যেত। একদিন এসে বললেন, আমার দাঁতের গোড়ায় ব্যথা। আজ তোরা বল্, আমি শুনি। আমরা বলতেই, তিনি নিজস্ব ঢঙে প্রতিদিনকার মত অসম্ভব সুন্দর পড়িয়ে গেলেন। স্যারের কাছে যে,
আমাদের আজন্ম ঋণ। ভুলতে পারিনা। যদি ভুলে যাই, তাহলে যে পাপ হয়ে যাবে। সাত হাত ভাগ্য আমার, এমন মানুষের পায়ের কাছে বসে বাংলা পড়েছি।অনার্সের পাশাপাশি ইংরেজির ক্লাসে পেয়েছিলাম অধ্যাপক এস ব্যানার্জি, অধ্যাপক ভবানী শংকর সেন চৌধুরী, অধ্যাপক অশোক ঘোষ, অধ্যাপক এস মজুমদারকে। অধ্যাপক এস ব্যানার্জি আমাদের চার্লস ল্যাম্ব পড়াতেন। জুলিয়াস সিজার পড়াতেন অধ্যাপক এস মজুমদার। অধ্যাপক অশোক ঘোষ পড়াতেন ইংরেজি কবিতা। অধ্যাপক ভবানী শংকর সেন চৌধুরী আব্রাহাম লিংকন পড়াতেন। উনি পড়া ধরতেন।
পড়া না পারলে, কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হত। সমস্যা হল, আশ পাশের বাড়ির ছাদ থেকে মহিলারা আমাদের করুণ অবস্থা দেখে হাসতেন।
কলেজে পেছনের বেঞ্চে বসলে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেত। আমাদের তখন কাঁচা বয়স। দুপুর সাড়ে বারোটায় আকাশবাণী থেকে রবীন্দ্র সংগীত বাজানো হতো। আমাদের বন্ধুরা অনেকেই পাশের বাড়ির দিদি স্থানীয়দের দেখলে বলতো, দিদি, কাইন্ডলি একটু রেডিওটা চালিয়ে দিন না। এইভাবে কতদিন আমরা চিত্রলেখা চৌধুরী, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন, রাজেশ্বরী দত্তর গান শুনেছি।
কী সব মুগ্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর দিন। সেদিন আমরা সত্তর দশকের তরুণ। আজকাল কোমরের ব্যথা, পেটের গন্ডগোল, অম্বল চোয়া ঢেকুর নিয়ে অবস্থা বড় করুণ।
আশ্চর্যভাবে একদিন জানা গেল, স্যার নেতাজির ভক্ত। আমাদের ক্লাশের দুলাল দা স্যার ক্লাসে ঢুকলেই বলত, আজ কাগজে লিখেছে,শৌলমারীর সাধুই নেতাজী।
স্যার তখন সারা পিরিয়ড জুড়ে নেতাজির আলোচনায় মেতে যেতেন। আমাদের আর কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হতো না।
প্রেসিডেন্সি কলেজ আর হেয়ার স্কুলের মাঝখানে একটা বিশাল মাঠ। সেখানে ফুটবল খেলা হোত। ক্রিকেট খেলা নিয়ে কোন দিনই আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।
কিন্তু ফুটবল খেলার ব্যাপারে আমি ছিলাম অতিরিক্ত উৎসাহী। বর্ষার দিনে দাপিয়ে ওই মাঠে ফুটবল খেলেছি। বাঁ পায়ের জোর ছিল। খেলার শেষে গা-হাত-পা ধুয়ে বন্ধুবান্ধব মিলে জোর দার খাওয়া দাওয়া হোত। পরদিন বসুমতী কাগজে খেলার পাতায় আমাদের নাম ছাপা হলে, নিজেদের মনে হতো, কী একজন তালেবর হয়ে উঠেছি।
কিংবদন্তী ইংরেজীর অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী ততদিনে অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে কলেজে আসতেন। আমাদের করিডোরে ঘুরতে দেখলেই বলতেন, লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করতে। আজ যখন স্যারের নামে রাজকুমার চক্রবর্তী সরণি দিয়ে হাঁটি, তখন সে দিনে খুব কাছে থেকে দেখা স্যারের কথা গুলো মনে বাজে। স্যারের কাছে পড়তে পারিনি, কিন্তু তাঁর পরামর্শ, খুব কাছাকাছি থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ তো পেয়েছি। এসবের মূল্য যে অনেক।
ইতিহাসের ক্লাস নিতেন অধ্যাপক প্রেম বল্লভ সেন।
অসম্ভব পড়াশুনা ভদ্রলোকের। দুরন্ত পরিশ্রম করে ক্লাস নিতেন। ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক আশিস মুখোপাধ্যায়। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, তুই ফুটবল খেলিস, তোর চেহারাটা ফুটবল প্লেয়ার দের মতো।পরবর্তীকালে আমাদের কলেজের ফুটবল কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি লিংক ম্যান পজিশনে খেলতাম। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। খেলার পর ডিম পাউরুটি খাওয়া হোত।
অধ্যাপক অক্ষয় জীবন বসু বহুদিন আগে কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক। আমাদের প্রিন্সিপাল তাঁর ছাত্র। এক টাকা সন্মান দক্ষিণা নিয়ে তিনি সপ্তাহে একদিন প্রিন্সিপালের অনুরোধে কলেজে ক্লাস নিতে আসতেন। আমি যখন তাঁকে দেখেছিলাম, তখন অতিশয় বৃদ্ধ তিনি। অথচ, তাঁর ক্লাস করবার জন্য থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তিনি করিডোরে ঘোরাঘুরি পছন্দ করতেন না। বলতেন, লাইব্রেরীতে গিয়ে বসো।
গরীব বাড়ির ছেলে আমি। একদিন ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক সুদেব ঘোষ কে বাড়ির অবস্থার কথা বললাম। উনি হাফ ফ্রী করে দিয়েছিলেন।
আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার বসু।একুশ নম্বর গ্যালারি রুমে তাঁর ছবির মত ওড টু দ্য নাইটেঙ্গেল কবিতার ক্লাসের কথা মনে পড়ে। ছবির মত পড়াতেন স্যার। মনে আছে, একদিন পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, এ ডাফট অব ভিন্টেজ। বলেছিলেন,
মাটির নিচে থাকা এক ধরনের মদ, তারপর বলেছিলেন, আমি অবশ্য কখনো খেয়ে দেখি নি।
স্যারের ক্লাস থাকলে, প্রেসিডেন্সি, সুরেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্ররা স্যারের ক্লাস শুনতে আসতো।আমাদের কলেজের চত্বরে রেক্টর গিরিশ চন্দ্র বসুর
মূর্তির পাশে আমাদের প্রিন্সিপাল প্রশান্ত কুমার বসুর মূর্তি রয়েছে। কলেজে আজও গেলে, এখানে দাঁড়িয়ে নতমস্তক হই। কত যে ঋণী করে গেছেন,
এইসব নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদেরা। ভুলতে পারিনা।বন্ধু-বান্ধবদের কথায় আসি।
আমি বাটানগরের ছেলে। ডানকুনির অশ্বিনী কুমার গুপ্ত আমার বঙ্গবাসী কলেজের প্রথম বন্ধু। বেলেঘাটার স্বপন সরকার, হাওড়ার তপন ঘোষ, বিরাটির অজয় কুমার বিশ্বাস, মহিষাদলের অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার সুভাষ দাস, আমরা খুব কাছাকাছি বন্ধু ছিলাম।
তপন পত্রিকা বের করত। সে সময় নিজেও ভালো কবিতা লিখতো। সজল কান্তি শ্যাম, আমার বন্ধু, আজো ভালো কবিতা লেখে।
একদিন অনার্স নিয়ে পাশ করলাম। কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম। বঙ্গবাসী কলেজের স্মৃতি আজও টুকরো-টুকরো মনে ভাসে।
গায়ক অর্ঘ্য সেন, বিধায়ক অশোক দেব, মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা জহর গাঙ্গুলী, বিচারপতি সুধীর রঞ্জন দাস, অভিনেতা অসিত বরণ, সাংবাদিক বরুন সেনগুপ্ত, সাংবাদিক সুদেব রায় চৌধুরী, আরো কত খ্যাত কীর্তি মানুষ এই কলেজের ছাত্র।
আমার কলেজ আমার যৌবনের স্মৃতি। আমার কলেজ আমার গর্ব। কলেজের সামনে আজও গেলে, বুকটা হাহাকার করে ওঠে। চোখে জল আসে।
সকালবেলায় রেডিওতে সুবীর সেন, শ্যামল মিত্র, কিংবা আরতি মুখার্জির গান শুনে, ছুটে নটা এক চল্লিশ এর ট্রেন ধরা, এবং অনার্সের ক্লাসে পৌঁছে যাওয়া।
আহা, সত্তরটা সিঁড়ি পেরিয়ে আবার যদি অনার্সের ওই ক্লাসের মুগ্ধ দিনগুলি ফিরে পেতাম।
নাট্যকার রতন কুমার ঘোষের আলোকিত যৌবন নাটকে খ্যাতিমান অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়লগ মনে পড়ে, যখন নায়িকা বলছেন, আমি তাহলে কি নিয়ে থাকবো?
বিষন্ন নায়ক বলছেন,আমার আলোকিত যৌবন। যা শুধু দেয়, কখনো হারায় না।সত্যি বলছি, বঙ্গবাসী কলেজের এতোটুকু স্মৃতি আমি আজও হারাইনি, মৃত্যু পর্যন্ত এই সুখময় স্মৃতিটুকু বহন করে নিয়ে যাবো।
প্রিয় শিক্ষা মন্দিরকে লক্ষ কোটি প্রণাম।
-
গল্প- পূর্বাশ্রম
পূর্বাশ্রম
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)
লেখা রান্না করতে করতে ছুটে গিয়ে ল্যান্ডফোনটা ধরল , ‘হ্যালো কেমন আছিস’? ওপারের গলাটা লেখা চিনতে পারল না। তুই তো অনেকেই বলতে পারে, সম্বোধন টা কি করবে ভাবছিল ‘ঠিক চিনতে পারছি না তো’! ‘হুম না চেনার। ই কথা’। কিন্তু বচনভঙ্গিটা যেন বড় চেনা চেনা লাগছিল লেখার ।কে হতে পারে ? ‘বর আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দারুণ সংসার করছিস তাই তো ?এখনো চিনতে পারলি না আমি কুশল রে কুশাল’ ’কুশল’?’ তুই এতদিন পর আমার নাম্বার কোথায় পেলি’? ‘কোথায় থাকিস তুই এখন? কাকিমা কাকু কেমন আছে’? ‘ওরে বাবারে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে’? দাঁড়া, এক এক করে উত্তর দিচ্ছি কিন্তু ফোনে সব শুনে নিবি? একবার বাড়িতে আসতে বলবি না? নাকি তোর পতিদেবের আপত্তি আছে ,ছেলে বন্ধুকে বাড়িতে আসতে দিতে’! ‘ নারে সে মানুষটা অমন নয় আমার সব বন্ধুদের সাথে ওর আলাপ আছে’ । ‘তবে একদিন আসি তোর বাড়িতে কেমন? কিরে তোর আপত্তি আছ নাকি? ‘ একেবারেই না ,সেই ছোট্টবেলার বন্ধু তুই তোকে সত্যিই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!’ ‘তাহলে আজ রাখি রে, দেখা হচ্ছে তাড়াতাড়ি ‘ ।’ আমার ঠিকানাটা লিখবি না?’ ‘ আরে এতদিন পর যখন ল্যান্ড ফোন নাম্বারটা জোগাড় করতে পেরেছি তখন ঠিকানাটাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাব রে, বা পেয়ে গেছি ধর” ” কবে আসতে চাস বল ?” ‘তুই যেদিন ডাকবি !’ ‘এই রবিবার নয় এর পরের রবিবার চলে আসিস’। ‘ বেশ তবে তাই কথা রইল আজ রাখি রে ভালো থাকিস ‘।
ছোটবেলার বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে এসে দেখে রান্নাটা তলা থেকে ধরে গেছে। কি করবে এখন ছেলেমেয়েরা যে সন্ধ্যেবেলা কাশ্মীরি আলুর দম দিয়ে লুচি খাবে বলে খুশি খুশি মনে আছে ।বর ও খুব খুশি। মা ঠাকুমার ছোটবেলা শেখানোর টিপসগুলো কাজে লাগালো লেখা। হ্যাঁ ঠিকই তো অনেকটা সামলে নেওয়া গেছে। একটু টেস্ট করে দেখলো ভালোই হয়েছে খেতে। নুন মিষ্টি ঝাল একদম ঠিকঠাক। নিজের রান্নার তারিফ নিজেই করল মনে মনে।হাতের ইঙ্গিতে খাবার দুর্দান্ত হয়েছে বোঝালো লেখার মেয়ে ঈশিতা। ছেলে বলল ‘মা আর দুটো লুচি দাও তো ‘বাহ! তাহলে তো রান্না করাটা স্বার্থক। ভালো হয়েছে। রান্নার লোক আছে কিন্তু ছেলে মেয়েদের জন্য এসব রান্না সে নিজে করতেই ভালোবাসে । আর নিজে হাতে লুচি ভেজে খাওয়াতে ভালবাসে ছেলেমেয়েদের । কোনো কোনো সন্ধ্যেবেলা তারা এরকম লুচি আলুর দম বা অন্য কোন পদ খায়। বর বলল ‘ গ্র্যান্ড হোটেলের কুক করে দিমু’। সবাই হেসে উঠলো। কাল রবিবার। কালকে চারজন কোথাও বেরাবে না ঠিক করেছে। ইচ্ছে করে কোনো কোনো রবিবার কোথাও বেরোয় না কেউই। একসাথে থাকাটা এনজয় করে। কাল তেমনি একটা রবিবার। তাইতো কালকে আসতে বলেনি সে কুশল কে। কিন্তু কুশালের আসার কথাটা কি এখনই বলবে? এক সপ্তাহ দেরি আছে তো পরে বললেই হবে। ‘মা ম্যাটটা লাগিয়ে দাও তো, বড্ড মশা হয়েছে’ ‘দেখিস তোর আবার শ্বাসকষ্ট না হয়! তোর তো আবার এগুলো সহ্য হয় না।’ ‘ না মা একটুখানি লাগাও আমি বন্ধ করে দেব ডিনারটা তেমন জমবে না, অনেকগুলো লুচি খেয়ে ফেলেছে কিনা সবাই মিলে। যাইহোক এত বড় রাত্রি কিছু তো খেতেই হবে। অল্প সল্প খেয়ে তারা ঘুমোতে গেল।
রবিবারের সকালটা একটু মেঘলা। মেঘলা দিন বড্ড ভালোবাসে লেখা খুব মিষ্টি মিষ্টি লাগে এই ওয়েদারটাকে তার। বৃষ্টি পড়ছে না তবে রোদের তেজ একেবারেই নেই । একসঙ্গে থাকা রবিবার গুলো তারা খুব আনন্দে কাটায় একসঙ্গে জল খাবার খায়। একেক রবিবার একেক জনের পছন্দের খাবার হয়। এই রবিবার মেয়ে ইশিকার পছন্দের খাবার হয়েছে। ঘরোয়া করে ধোসা তৈরি করেছে লেখা। আজকে রান্নার মেয়েকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে নিজেদের মতন করে কাটাবে বলে দুপুরবেলা মুড়িঘন্ট আছে মেয়ের পছন্দের। আর ফ্রাইড রাইস নয়, ভাতটাকে একটু বিশেষ কায়দায় ভেজে নিয়েছে। খাবারটা মেয়ে খেতে খুব ভালোবাসে । দুপুরে খেতে বসে লেখা বলল ‘তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই আমি সামনের রবিবার আমার এক বন্ধুকে আসতে বলে দিয়েছি ’।‘আমার সঙ্গে পরামর্শ করার কি আছে তোমার বন্ধুরা তো মাঝে মধ্যেই আসে। ‘এ বন্ধুটা পুরুষ কিন্তু !’ ‘কেন তোমার কোনো পুরুষ বন্ধু আগে বাড়িতে আসেনি বুঝি’ ? আমাদের তো বন্ধু বান্ধবীদের জন্য দরজা খোলা। আমরা তো এসব নিয়ে কখনো কোন আলাদা করে কথা বলি না। বাই দ্যা ওয়ে নাম কি তোমার বন্ধুর?’ ’কুশল’ ‘ও বাবা এর নামটা শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না! কি স্মৃতিরতলে তলিয়ে গেছিল নাকি?’ না গো, এ আমার স্কুল বেলার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি তারপর ওর বাবার বদলি হলো প্রথম কিছুদিন যোগাযোগ ছিল পরে কেমন করে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কেটে গেল। তারপরেই এত বছর পর কালকে হঠাৎ ফোন করলো। জানিনা কিভাবে নাম্বার পেয়েছে তবে ছোটবেলার বন্ধু তো আসবে শুনে ভালো লাগছে গো ‘। ‘কোন বিশেষ ব্যাপার আছে নাকি ? ‘ধুর্ তুমি না সবসময় ইয়ার্কি কর’ ‘ না তাই বলছিলাম আরকি। মুখটা যেন কেমন রা রাঙ্গা রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে’ ‘ মা, তোমার বয়ফ্রেন্ড না কি গো? ছেলে ফুট কাটলো। ‘মারবো ‘ ‘দেখো বাবা তাহলে তো বেশ হয় মায়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ হবে’ মেয়ে বলে উঠলো ।’এই তোরা কি আরম্ভ করেছিস রে? আমি কিন্তু না করে দেব আসতে’। ‘আমরা একটা নতুন আনন্দ করবো রবিবার দিন ,কবে যে দিনটা আসবে মা তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করব কি মজা কি মজা! ঈশিতা বলছে। ’মারবো কিন্তু একদম ইয়ার্কি মারবি না’। ‘তোমার বন্ধুকে খুব গম্ভীর প্রকৃতির নাকি’?‘ না রে ও ভীষণ আলাপি। খুব মজা করতে ভালোবাসে অবশ্য এতদিন পরে সে কেমন হয়েছে সেটা ঠিক বলতে পারবো না’।
একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। একি কুশলের সঙ্গে লেখার মেয়ে নামছে। কি করে হলো? ও আচ্ছা, আমি একটা ছোট্ট কাগজের মোবাইল নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম সেখান থেকে দুষ্টু মেয়েটা যোগাযোগ করেছে আর কোথাও থেকে ঠিক ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠে পরেছে। ‘কি রে? চিনতে পারছিস দেখ তো ভালো করে’ ’হ্যাঁ রে, তোর মুখটা তো একই রকম আছে। শুধু বয়সের ছাপটা পড়েছে !’ ’বলছিস আমাকে তো সবাই এখনো ইয়াং বলে, এই যে তোর মেয়ে বলল একটু আগে বাহ তুমি কি ইয়াং আছো গো?’ তুমি মায়ের বয়সী মনে হচ্ছে না আমার মা টা বুড়ি গেলো’ । ‘ব্যাস আমার মেয়ের পাকামো শুরু হয়ে গেছে’। ‘আরে নারে ওর সঙ্গ টা খুব এনজয় করতে করতে এলাম যেটুকু সময় একসঙ্গে এলাম। খুব ভালো মেয়ে তোর। আরে বাবা দরজা দাঁড়িয়ে সব কথা বলবি নাকি ভিতরে যাব’? ‘ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসি, হ্যাঁ আমার আবার কোথাও থেকে এসে স্নান না করলে হয় না আমি টুক করে স্নান করে আসি ’ কি সুন্দর একটা গন্ধ বের হচ্ছে ‘কুশল মামা তুমি কি সাবান মেখেছো গো ’?সেই ছোট্টবেলা থেকে এখনো ছেলেটা একই সাবান ব্যবহার করে, এই গন্ধটা খুব ভালবাসতো লেখা। মা-বাবাকে বলতো ওই সাবানটায় কিনে এনে দিতে। মাঝেমধ্যে চুপচাপ নিজের জমানো পয়সা থেকে কুশল সাবানটা কিনে দিত লেখাকে। হঠাৎ করে ছোট্টবেলাটা মনে উঁকি দিল লেখার । ‘পুরানো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়’? ‘হ্যাঁ এবার একটু চট করে খেয়ে নে, জল খাবারটা খেয়ে তাড়াতাড়ি চল আমরা আড্ডা মারবো’। ‘রান্নার লোক রান্না করছে? তুই আমাকে রান্না করে খাওয়াবি না’? ‘হ্যাঁ রে খাওয়াবো’। কয়েকটা পদ আমি রান্না করবো। তোর প্রিয় খাবার গুলো এখন ও আমার মনে আছে। ’। ‘তোর বর কোথায় ’?‘ওর কথা আর বলিস না! তোর পছন্দের জিনিসগুলো জেনে নিয়ে ছুটেছে বাজারে’। ‘বাবা তোর বড তো বিশাল উদার লোক রে’। ‘তা বলতে পারিস এই ব্যাপারে আমি খুব লাকি রে ওকে পেয়ে সত্যিই আমি খুশি’। হালকা একটা বিষাদ কি উঁকি দিল কুশালের মুখে? ঠিক বুঝতে পারল না লেখা। ‘এই বাজারটা ধরো, এসে গেছি আরে কুশল বাবু এসে গেছেন ’ ‘আবার বাবু টাবু কেন নাম ধরে বলো, আর আপনি নয় তুই তুমি যা খুশি বলো ’। বেশতো! তুমি বলেই না হয় বললাম তুই এ নামার মত জায়গাতে এখনো পৌঁছাযইনি ,কখনো যদি পৌঁছাই তখন তুই বলব। আমার বউটি দেখছি খুব খুশি খুশি, পুরনো বন্ধুকে পেয়ে’।
‘চল চল তোর বাগানটা দেখে আসি বাহ!খুব সুন্দর ফুল ফুটিয়েছিস তো! বেগুন গুলোর সাইজ তো হেবি নিয়ে যাব যাওয়ার সময় দুখানা। জানিস তো আমি বেগুন পোড়া খেতে খুব ভালবাসি । মনে পড়ে আমরা কেমন বাগানের ফসল নিয়ে প্রতিযোগিতা করতাম। কার বেগুন গাছে কত বেশি বেগুন আসে কারটা কত বড় হয়! জৈব সার, ইউরিয়া ,নানা রকম সার কম্পিটিশন করে দিতাম দুজনে বল!‘তুই এখনো বাগান করিস’? ‘নারে!কোথায় বাগান করবো? আমার তো দু কামরার এক চিলতে ফ্ল্যাট আর আমি তো ঘুরে ঘুরে বেড়াই’। ‘কাকিমা কাকু কোথায় আছেন ’?‘ মা বাবা ফ্ল্যাটে থাকতে চাননা। তারা আমাদের দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। ওখানে বাগান নিয়ে ফুল নিয়ে গাছ নিয়ে বেশ ভালো আছেন। কাকু কাকিমা মানে তোর মা বাবা কেমন আছেন? ‘ওরাও ভালোই আছেন। কখনো আমার কাছে এসে কিছুদিন থাকেন, কখনো ভাইয়ের কাছে থাকেন। আবার বেশিরভাগ সময় নিজেদের মতো নিজেদের বাড়িতেই কাটান।’ ওই বাড়িতে ওরা আছে রে যে বাড়িতে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি ’। ‘ও নাইস! ওই বাড়িটা এখনো আছে নারে? আমি তাহলে যাব আমাদের বাড়িটা তো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, এখন ওখানে একজন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী কিনেছেন বাড়িটা অনেক বড় করেছেন বাড়িটাকে বিশাল টাকা ওয়ালা লোক রে !মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমরা টাকা নয় টাকওয়ালা লোকেদের টাকা ওয়ালা লোক বলতাম’। ইশিকা বলল , ‘মা তোমরা তো বেশ মজা করতে তো! । ‘তোর ছেলেটা একটু কম কথা বলে তাই না?’। ‘ হ্যাঁরে ও একটু শান্ত’ । ‘তোর বরটা আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল কেন রে’? ‘ওইটাই তো মুশকিল রে !বাড়িতে থাকলেও অফিসের কাজ করতে থাকে ওই জন্যই তো কিছু কিছু রবিবার আমরা ঠিক করি , একদম নিজেদের মত করে কাটাবো। ওকে অফিসের কাজ করতে দিই না সেদিন। এই আগের রবিবারেই আমরা চারজন ওইভাবে কাটিয়েছি। এর পরেরটা আবার কাটাব’। ‘ও এটা আমি এসে নষ্ট করে দিলাম না তো? নারে এটা একটা নতুন সুন্দর অভিজ্ঞতা হল। খুব ভালো লাগছে রে আচ্ছা তোর বউয়ের কথা বল । তোর পরিবারের কথা বল । ফোনে তো কিছুই বললি না সেসব’। ‘থাকলে তো বলব! ‘আমি আর ঐসব বন্ধনের মধ্যে নেই ’ ‘আর মানে? কোন সময় বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলি নাকি’? ‘হয়তো বা পড়েছিলাম’। কি বলতে চাইছে কুশল ?লেখার মনের মধ্যে প্রশ্ন আসছে। ‘চল তোর বরের সাথে একটু গল্প করি, আরে বাবা তুই তো বিশাল রান্না বিশারদ হয়েছিস রে, রান্নার লোককে বাড়ি চলে যেতে বললি, আমি তোর রান্না খাবো বলে। আরে এত রান্না করলি কখন তুই তো গল্প করছিলি? ও আচ্ছা তোর মেয়ে বরকে নিয়ে যখন গল্প করছিলাম সেই ফাঁকে টুকটুক করে করে ফেলেছিস খুব ভালো হয়েছে রে খেতে, কাকিমার রান্নার কথা মনে মনে পড়ছে। তোদের বাড়ি গিয়ে যখন তখন ডিনার লাঞ্চ করে ফেলতাম। তোদের বাড়ির ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম’। ‘ মা তোমরা মারামারি করতে না’? ‘হ্যাঁরে মারামারি করতাম খেলতাম ,নাটক করতাম । বেশ ছিলাম। ’ ঈশিকা আরিশান একটু বেরালো, তারা তাদের কুশল মামার জন্য গিফট কিনতে যাচ্ছে ।
লেখা, কুশল কে টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছে। লেখার বর একটু বেরিয়েছে। কুশল লেখার আলমারির বইগুলো দেখছে। শরৎ রচনাবলীর র দিকে চোখ পড়লো। সেই কবেকার সেই ছোট্টবেলা খেলা করছিল দুজনে খেলতে খেলতে কোন খেয়ালে লেখা হঠাৎ একটা সাদা পুতির মালা পরিয়ে দিল কুশলকে। লেখা পালিয়ে যাচ্ছিল ,কুশল ওর হাতটা চেপে ধরলো, হঠাৎ বলে বসলো,ললিতা যাস না,তুই অর্ধেক করেছিস আমি পুরোটা করে দিলাম বলে মালাটা লেখাকে পরিয়ে দিল। ললিতা! কুশল কি নিজেকে শেখর ভাবছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো লেখা। । তখন তো দুজনেই বইয়ের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে শরৎ রচনাবলী পড়তো। পরিণীতা গল্পের শেখর ললিতাকে নিয়ে আলোচনা করতো। মালাটা ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল লেখা। উচ্চমাধ্যমিকের পর কুশলের বাবা বদলী হওয়ায় কুশলরা দূরে চলে গিয়েছিল । প্রথম কিছু দিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কুশলের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ঘটনাটা। লেখা ব্যাপারটাকে অত গভীর ভাবে নেয় নি। তবুও তার মনে একটু প্রভাব ছিল ঘটনাটার।নিতান্ত যখন তার জীবনে আসে তখন নিতান্ত কে তার খুব ভালো লেগে যায়। ছোট্টবেলার কবে কি ঘটনা ঘটেছিল আস্তে আস্তে মন থেকে বোধহয় একটু একটু করে দূরে সরে যায় । অনেকটা আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ডের মতো। কিন্তু কুশল লেখাকে ভুলতে পারেনি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও দীর্ঘ আদর্শন হলেও সে লেখাকে ভোলেনি।দীর্ঘ অদর্শন ও বিনা পত্রালাপেও কুশলের মনে লেখার প্রতি ভালোবাসা সদা জাগরুক ছিল। । মনের কোণে কোথায় যেন প্রেমিকার ছবি হিসেবে, স্ত্রীর ছবি হিসাবে লেখার ছবিই আঁকা ছিল। না সে প্রেমও করতে পারেনি ,বিয়েও করতে পারেনি।মনের কোণে কোথাও আশা ছিল হয়তো পরিণীতার ললিতার মত তার লেখাও তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। কিন্তু লেখার বিয়ের খবর তার কাছে গোপন থাকেনি। কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। এই মালাটা সর্বক্ষণের সাথী ছিল তার । যেন মালাটাই তার জীবনসাথী। অদ্ভুত এক বন্ধন । বন্ধনে ধরা না দিয়েও বন্ধনে থাকা। কিন্তু না সে আর কোন বন্ধনে আটকে থাকতে চায় না। কি সুন্দর একটা সংসার লেখার। তা দেখে তার মনে হল তার ভালোবাসার জন সুখে আছে এটাই তার জন্য পরম আনন্দের। শেষের কবিতার অমিত লাবণ্যকে মনে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, লেখার সঙ্গে তার যে ভালোবাসা সেতো দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, তার মন তাতে সাঁতার দেবে। না না আর তার মনও আর সেই দিঘিতে সাঁতার দেবে না। ভালবাসার ওইদিগিতে সাঁতার দিয়ে তার মন শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার তার মন যেন বলছে,‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলো ’। মুক্তি মুক্তি বড় আনন্দের মুক্তি। সে তো পাহাড়ে, পাহাড়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় । জীবনধারণের জন্য বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু রোজগার করার প্রয়োজন সেটুকু করে নেয় আর বাকি সময়টা বাইক রাইড। । কখন ও বা চার চাকায় পাহাড়ে চলে যায় । বাইকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক বাইকারদের সঙ্গে তার বিশাল বন্ধুত্ব এসব নিয়ে বেশ আছে। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যেতে ভালোই লাগে। কিন্তু মালাটা কেন সে যেন ছাড়তে পারে নি এতদিন? এ কোন অদৃশ্য বন্ধন । ‘এবার যে আমার যেতে হবে লেখা আজকের দিনটা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি’। একটা দিন থেকে গেলে হতো না ’ ‘নারে আজ আমার যেতেই হবে কালকে আবার শুরু হবে ছুট, পাহাড়ের টানে বাইক রাইডে। চল তোকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঈশিকা, তুই যাবি আমাদের সাথে’? ‘না মা এটুকু সময় তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটু আনন্দে কাটাও ’ । গাড়ি করে স্টেশনের পর্যন্ত যাও এর মধ্যে তোমাদের গোপন কথাটা সেরে নাও’ । লেখার বর হাহা করে হেসে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো যাও যাও’। ‘ধুর তুমি না !আমি যাবই না তাহলে’। ‘ না না যাও ওনার ভালো লাগবে গাড়ি থেকে স্টেশন খুব বেশি কথা হলো না। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নীরবতা বজায় রয়েছে । একটু দেরি আছে ট্রেন আসতে। দুজনে স্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছে। ‘ চারিদিকে দৃশ্যগুলো দেখ ,তোর জন্য একটা উপহার আছে একটা ভালো উপহার আছে আর একটা অন্যরকম জিনিসও আছে বাক্সে। এখন খুলবি না। গিয়ে খুলিস। ট্রেন ছুটছে জানলা দিয়ে হাত দেখাতে দেখাতে চলে যাচ্ছে কুশল ক্রমাগত দূরে দূরে দূরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে । কৌতূহল খুব কৌতূহল হচ্ছে লেখার। বাড়ি গিয়েই দেখব। বাড়ি এসে চুপচাপ রেখে দিলে বাক্সটা। লুকিয়ে গভীর রাতে বর ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে আর মেয়ে নিজেদের ঘরে। বাক্সটা নিয়ে ধীরে ধীরে ডাইনিং রুমে এলো একটা খুব সুন্দর শোপিস দুটো পায়রার। সাদা তলায় লেখা ‘ভালো থাকিস’। আর এটা কি? একটা মালা, সাদা পুতির মালা। সেই মালাটা স্মৃতিতে ডুব দিল লেখা। হ্যাঁ, সেই মালাটাই মালাটা সে একদিন পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর বেশ কিছুদিন খুব লজ্জা পেতো কুশালের কাছাকাছি যেতে। তারপর ওরা দূরে চলে গেল। সঙ্গে একটা চিঠি।
লেখা,
হয়তো তোর মনের কোথাও আমি নেই, ছিলামও না ,তবুও যদি বিন্দুমাত্র থেকে থাকি সেটুকু বন্ধন থেকেও তোকে মুক্ত করলাম। আর হ্যাঁ আমিও বন্ধন থেকে মুক্ত হলাম, এই মালা যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে সব সময় মনে হবে আমি যেন বাঁধা পড়ে আছি তোর কাছে। একটা দিনের জন্যেও মালাটাকে কাছছাড়া করিনি। কিন্তু এই বন্ধন থেকে আমি মুক্তি চাই রে!আমার ভালোবাসা ভালো আছে ,এইটাই আমার জন্য অনেক রে! মন একটা সুন্দর প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। আর কোন বন্ধন ,আর কোন পিছুটান আমি রাখতে চাই না। তোকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল, দেখা হয়ে গেছে । হারটা রেখে গেলাম, আর কোনদিন সেই দিনটারর কথা ভাববো না । আমি সন্ন্যাসী নই ,সন্নাস নেবো ও না,নিজের মত করে নিজের ছন্দে বাঁচবো। তবু এটা যেন অনেকটা পূর্বাশ্রমের মতোই । সন্যাসীরা একটা পর্যায়ে পৌঁছে পূর্বাশ্রমকে আর মনে রাখে না। পূর্বাশ্রমের কথা মনে করে না। আমি তেমন ই এই ঘটনাটাকে আমার জীবনের পূর্বাশ্রম মনে করব। আর পিছনে ফিরে তাকাবো না । তাই মালাটা আর কাছে রাখলাম না । এতদিন প্রাণের থেকে প্রিয় বলে যাকে আগলে রেখেছি ,আজ তা ফেরত দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস। আমি চললাম পাহাড়ে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরবো, সমুদ্র সমুদ্রে ঘুরবো আমি আমার মত করে খুব ভালো থাকবো রে, আর এই বন্ধন মুক্তি আমাকে আরো ভালো রাখবে।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে লেখার। একদিকে মনে হচ্ছে সেও বন্ধন মুক্ত হলো,অবশ্য সে কি এই বন্ধনে কখন ও বাঁধা ছিল?সে তার বরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। সাজানো গোছানো সংসার আছে তার। কিন্তু তবুও ভিতরে একটা কষ্টের অনুভূতিও হচ্ছে। তবে কি তার ও অবচেতনে কোনো হালকা বন্ধন ছিল?মালাটা ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে পারলো না। বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে দিল। কুশল বন্ধনমুক্ত ।লেখাও বরকে খুবই ভালোবাসে, তবুও লেখার মনে বোধহয় একটা হালকা অদৃশ্য বন্ধন থেকে গেলো,নাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? -
গল্প- কুয়াশা–২
কুয়াশা-২
পাপিয়া ঘোষ সিংহকয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পর আজ আকাশ পরিস্কার। সন্ধ্যা বেলা ছাদে পায়চারি করতে করতে হঠাৎই চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই কত ভালোলাগা সাথে হাজার প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো রুমেলার।
বছর দুই হলো রুমির বিয়ে হয়েছে। রোমান্টিক দীপনের সাথেই। অনেক মান-অভিমান টানাপোড়েন পেরিয়ে ভালোবাসা পরিণতি পেয়েছে। বিয়ের পর এক বছর ওদের কেমন স্বপ্নের মতো কেটেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকে রাতভোর পর্যন্ত সবসময়ই যেন এক দুরন্ত প্রেম একটা বছর কিভাবে দাপিয়ে নিয়ে গেল। তারপর কেমন যেন ফিকে হতে থাকলো জীবনের রঙ। দীপন–দীপঙ্কর চ্যাটার্জি তার অফিসে প্রোমোশন পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ,ভীষণ চাপ। এরপর যেটুকু সময় পায় তখন আত্মীয়-বন্ধু, কলিগ ও তাদের ফ্যামিলি ফোন আসা-যাওয়া এসব নিয়ে দীপনের রুমির জন্য সময় থাকে না। সারাদিনের সমস্ত সেরে রাতের বিছানায় ও দীপন ঘুমন্ত এক পাথর।
রুমি একটি কলেজে পড়ায়, সকাল থেকে তারও কাজ থাকে। দীপনকে অফিসের আগে ব্রেকফাস্ট দেওয়া, লাঞ্চ বানিয়ে প্যাক করে দেওয়া, দীপন বেরিয়ে গেলে নিজে স্নান-খাওয়া সেরে কলেজে যাওয়া। রুমি প্রতিদিনই দীপনের পরে বেরিয়ে আগে বাড়ি ফেরে। যদিও কাজ অনুসারে এটাই স্বাভাবিক। রুমিও সংসার, কলেজ,সোশ্যাল ওয়ার্ক, বাগান করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, তবুও দীপনের কাজের ব্যস্ততা য় দূরে সরে যাওয়া যেন ক্রমশ রুমিকে একা করে দিচ্ছে। এত কাজেও যেন রুমির দিন কাটতে চায়না।
চাঁদের দিকে তাকায় রুমি, মনে পড়ে কত পুরোনো কথা। এই চাঁদকেই তো দীপন রুমির রূপের প্রতিচ্ছবি বলতো। কত প্রতিশ্রুতি ছিল দীপনের! রুমি আমরা কখনও বুড়ো হবো না, রুমি আমরা সারাজীবন একসাথে চাঁদ দেখবো। আকাশে মেঘ চাঁদের লুকোচুরি খেলায় আমরা দুজন রূপকথার দেশে পারি দেবো।আমি তোমার আকাশ,আর আমার বুকে তুমি আমার চাঁদ রুমি।
আজ আকাশের বুকে চাঁদকে দেখে রুমির মনে হলো এদের তো চিরন্তন সম্পর্ক। মানুষের সম্পর্ক কেন এত আপেক্ষিক? দীপন এখনো ফেরেনি, আজ কি দীপন আমার সঙ্গে চাঁদ দেখবে?
কলিং বেলের শব্দে নীচে তাকায় রুমি। ঐ তো দীপন এসেছে। ছুটে নীচে নেমে আসে রুমি। দীপনের, হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরে রেখে আসে,তারপর চা নিয়ে দীপনের কাছে গিয়ে বলে দীপন একবার ছাদে যাবে? দীপন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন করতে করতে অন্য ঘরে চলে যায়। মনে কুয়াশা ঘন হয়ে আসে রুমেলার। দীপনের ব্যবহার পাল্টে যাওয়ার কারণ কি শুধু কর্মব্যস্ততা?না কি অন্য কিছু? কি করবে রুমি!কুয়াশার আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে। সামনের পথ বড়োই অস্পষ্ট।
-
গল্প- দত্তক
দত্তক
– শিলাবৃষ্টিআমি রিনিঝিনি রায়। ছেলেবেলা থেকে কানাঘুষো শুনতে হয়েছে আমি দত্তক নেওয়া মেয়ে। একটা একান্নবর্তী পরিবারে আমি বড় হয়েছি। মায়ের কোনো অযত্ন ছিলনা কোনদিন। কিন্তু বাবা! না সেই মানুষটা হয়তো আমাকে সেভাবে মেনে নিতেই পারেননি। আসলে বাড়িতে আর পাঁচজন মানুষ যখন সমালোচনার ঝড় তোলে, তখন বাবা হয়তো ভাবেন যে বিরাট ভুল করে ফেলেছিলেন অতীতে!
আসলে আমিও এ বাড়ির আদব কায়দা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারিনি। আমার ভিতরে সবসময় একটা বিদ্রোহ কাজ করে। ছোটবেলায় বলতে পারতামনা, এখন বলি, প্রতিবাদের ভাষা আমার ঠোঁটে। আর সে জন্য কথায় কথায় আমাকে শুনতে হয় ” আমি এ বাড়ির দত্তক “।
” বিনোদবিহারী কোয়েড কলেজে ” সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী আমি। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে আজও কলেজে এসেছি। লিজার পিরিয়ডে অমল যথারীতি হাজির।
– চল রিনি এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিয়ে আসি ক্যাণ্টিনে।
অমল যে আমাকে লাইক করে সেটা আমার বুঝতে অসুবিধে হয়না। আমিও ওকে পছন্দ করিনা তা নয়! তবে ওকে সব বলা উচিৎ। বললাম
-তুই বাইক এনেছিস আজ?
-হ্যা, কেন রে?
-আজ লাস্ট পিরিয়ডের ক্লাসটা ডুব দিবি?
-বাব্বা! আজ রিনিঝিনি রায়ের হলো কি?
-ইয়ার্কি মারিসনা তো..
বিকেলের পড়ন্ত রোদে অমল আর আমি বাইকে
দিল্লী রোড ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও হঠাৎ বিনা মেঘেই বৃষ্টি নামলো। শেষে একটা মধ্যবিত্ত ধাবায় আমরা ঢুকে চা আর ওমলেট অর্ডার দিয়ে কোণের দুটো চেয়ার দখল করে বসলাম। এটা সেটা কথার পরে অমল বললো
-এবার আসল কথাটা বলে ফেল রিনি
– কি আসল কথা?
– যার জন্য ক্লাস অফ করে আমাকে নিয়ে এতদূর ছুটে এলি?
– হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস অমল…
– কিরে প্রোপোজ করবি নাকি?
বলেই অমল হা হা করে খানিক হেসে নিল।
নারে, যাতে তুই আমাকে কোনোদিন না প্রোপোজ করিস সেই ব্যবস্থা করতে।
কথাটা বলার সাথে সাথে অমলের মুখটা যেন রক্ত শূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । বললো
-কাউকে ভালোবাসিস তুই?
-না তো –
– তবে? আমার ভালোবাসায় তোর কি আস্থা নেই?
– আজ আমার সব কথা তোকে শুনতে হবে।
– বল
জানিস অমল আমাদের বাড়িটা মানে আমি যেখানে থাকি সেটা একটা একান্নবর্তী পরিবার। এখনো এক রান্নাঘরে চোদ্দ জনের রান্না হয়।
বাবারা তিন ভাই। আমার বাবা মেজ।
জ্যেঠুর দুই সন্তান। কাকারও এক মেয়ে। কিন্তু আমার মায়ের বিয়ের ছ বছর কেটে যাওয়ার পরেও কোল ভরে কোনো সন্তান এলোনা। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, অনেক জড়ি বুটি খাইয়েছিল ঠাম্মি কিন্তু না, মা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিতই থেকে গেল! জ্যেঠু কাকুরা যখন তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ভীষণ সুখী, মা বাবা তখন আড়ালে চোখের জল ফেলতো। ঠাকুমা কথায় কথায় মাকে আঁটকুড়ি বলতো। সেই সময় একদিন হঠাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশের এক বান্ধবী এ বাড়িতে আসেন আর মাকে জানিয়ে যান তিনিও ভাগ্য দোষে গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি ঠিকই, কিন্তু তিনি একজন পরিপূর্ণ মা। তিনি একবছরের একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছেন। মা যেন কথাটা শুনে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। বাবার কাছে দিন দুবেলা করুণ আবেদন নিয়ে বসে থাকলো। বাবা রাজি হতে পারেন নি সহজে, ঠাকুমা একেবারেই বেঁকে বসলো। বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকলো। মাও জেদ ধরে খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করলো। অনেক লড়াই এর পরে পুরুলিয়ার এক অনাথ আশ্রম থেকে মা যে শিশু কন্যাকে দত্তক নিয়ে এসেছিল সেই মেয়েটা আজ তোর সামনে বসে আছে অমল..
বলতে বলতে চোখদুটো ভিজে যায় আমার। নিজের ভাবাবেগকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। অমল কিন্তু নির্লিপ্ত। সে শুধু বলে
তাতে কি? কি এসে যায় তাতে?
অমল!
-বল, উত্তর দে। এতদিন যে শব্দগুলো শুধু মনেই জমা রেখেছিলাম, আজ তা প্রকাশ করছি রিনি।আই লাভ ইউ। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি পাগলী।
-কিন্তু, এ হয় না অমল। তোর বাড়ির কেউ আমাকে মেনে নেবেনা।
-দূর! আগে তো আমি তোকে প্রাণ ভরে ভালোবাসি, তারপর বাড়ি।
-অমল, আমাকে যে মা অনাথ আশ্রমে ফেলে চলে গিয়েছিল হয়তো সে কোনো
কুমারী! হয়তো মুসলিম! হয়তো বা
পতিতা! একবার ভেবে দেখ, কেন আমায় মানুষ মেনে নেবে?
-তোর কি দোষ? নিজেকে অসম্মান করিস না। যে মা তোকে বুকে নিয়ে সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল, পরম স্নেহে তোকে আগলে বড় করে তুলেছে, তোকে সন্তান হিসেবে পেয়ে যার সব শূন্যতা ভরে গেছে সেই তোর আসল মা।
অন্য কিছু আর ভাববিনা কোনোদিন।
বৃষ্টি কমে গেলেও আকাশে কালো মেঘ ছিল।
ফেরার পথে একবার দাঁড়িয়ে ও শুধু আমায় বললো – তুই নিজেকে ঘৃণা করিস?
আমি কোনো কথা না বলে ওর পিঠে মাথা রাখলাম।দুদিন কলেজে যাইনি। জ্বর কমছিলনা বলে মাকে নার্সিহোমে এডমিট করতে হয়েছিল। আগামীকাল সকালে ছুটি দেবে। বিকেলে অমল এসে হাজির। আমি তো চমকে গেছি প্রথমে। ও আমার ক্লাসমেট বলে পরিচয় দিল। বাবা মাও অবাক হয়েছে বুঝলাম। বাবা বসার টুলটা এগিয়ে দিল।এরপর ও বসে নিজস্ব বাচনভঙ্গীতে আলাপ চালিয়ে গেল। হঠাৎ একসময়ে মাকে প্রশ্ন করে বসলো
– মাসীমা! আপনার সেই ছোটবেলার বান্ধবীর নাম কি? যার কথায় আপনি রিনিকে দত্তক নিয়েছিলেন?
আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল।
– বুড়ি। ভালো নাম অসীমা
– বাড়ী কোথায় ছিল মাসীমা?
– মগরার দিকে। পরে…
– পরে কোন্নগরে ফ্ল্যাট কিনেছিল। অসীমা সরকার। আমার মা। মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আর আমিই সেই দত্তক নেওয়া ছেলে অমল।
অপার বিস্ময়ে আমি চমকে তাকাই অমলের দিকে। এও কি সম্ভব?
ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট কিরে হাসছে।
দেখ কি মিল আমাদের। একেবারে রাজজোটক।
বলেই মা আর বাবাকে প্রণাম করে বললো
—- আমি নিজেকে উপযুক্ত করে আবার আসবো। সেদিন রিনিকে চেয়ে নেব আপনাদের কাছ থেকে। আজ আসি।
আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি। -
গল্প- পলাশ শিমূলের দিনগুলো
পলাশ শিমূলের দিনগুলো
-সুনির্মল বসুডি এম অফিস। নর্থ বেঙ্গল। ডুয়ার্স। সকাল সাড়ে নটায় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ার গাড়ি অফিস করিডোরে ঢুকলো। নন্দিনী সেন গাড়ি থেকে নেমে দূরে গাছ পালার দিকে চাইলেন।
চোখের কালো চশমা খুলে দেখলেন,অজস্র শিমূল পলাশে চারদিক ছেয়ে আছে।
মাথার ওপরে নীল আকাশ। গাছের পাতা সবুজ। দূরে কোথাও গান বাজছিল,
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার।ভদ্রমহিলা পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব। উনি এক সময় যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন, সেটা বোঝা যায়। কপালের সামনের দিকে কিছু চুলে পাক ধরেছে।
তিনি নিজের চেম্বারে গিয়ে বসলেন। টেবিলের ওপর পলাশ আর শিমূল ফুলের গুচ্ছ রাখা আছে। এ নিশ্চয়ই ওর খাস বেহারা সাবিত্রীর কাজ। সাবিত্রী জানে, ম্যাডাম ফুল ভালোবাসেন।
নন্দিনী মুহূর্তের জন্য অতীতে ফিরে গেলেন।
উইমেন ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাস্তা। কত কতদিন ওখানেই এসে দাঁড়িয়ে থাকতো কৃষ্ণেন্দু। কোনো কোনোদিন দূরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতো।
একেক দিন কলেজ ছুটির পর, ঝিলের ধারে গিয়ে
বসতো ওরা দুজন। কত কথা হতো। কত স্বপ্ন ছিল সেদিন ভবিষ্যতে জীবন ঘিরে।
দূরের পলাশ বন দেখছো,
হ্যাঁ তো,
শিমূল ফুলের ডালে শালিক পাখি বসে মধু খাচ্ছে,
কি অপূর্ব দৃশ্য,
ভারী মায়াময়,
তোমার অফিসের কি খবর,
আমাকে নর্থ বেঙ্গলে ট্রান্সফার করে দিচ্ছে,
তুমি কিছু বলো নি,
বলেছিলাম, অফিস বলছে কোন উপায় নেই। যেতেই হবে।
এদিকে আমার থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে, বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হবে।
দূরে কোথাও রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল, বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা।
মনে হয়, শান্তিদেব ঘোষের গলা,
অমন দরাজ গলা আর কজনার,সিকিউরিটির ওসমান খাঁন সেলাম করে অফিসে ঢুকলো। একটা স্লিপ দেখিয়ে বলল, ম্যাডাম, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
আসতে বলো।
ভদ্রলোক দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, আসতে পারি।
আসুন। বসুন। বলুন।ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবা নন্দিনী সেন একটু চমকে গেলেন। সামনে কৃষ্ণেন্দু। নর্থ বেঙ্গলে আসার পর, এখানেই বিয়ে করে নতুন করে ফ্ল্যাট কিনে সংসার পেতেছে।
হায় ভালোবাসা,
কৃষ্ণেন্দু বলল, পৌরসভা থেকে আসছি।বালুরঘাটের রাস্তা সেংশনের টাকাটা
যদি কাইন্ডলি গ্র্যান্ট করে দেন,
নেসেসারি ফাইলপত্র দেখান,
অ্যাটাচি কেস থেকে ফাইলপত্র কৃষ্ণেন্দু টেবিলের ওপর রাখলো। সব দেখে, নন্দিনী ফাইলে সই করে দিলেন।অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, নন্দিনী,
ধন্যবাদ কেন, এটা আমার অফিসিয়াল ডিউটি,
কেমন আছো তুমি,
খুব ভালো,
সেসব দিনের কথা মনে পড়ে,
জেনে কি লাভ,
উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাস্তা, ল্যাম্পপোস্ট, ঝিলের ধার, পলাশ বন, শিমূল ফুলের সুরভি, কিছুই কি মনে নেই,
মনে আছে বলেই তো, ভালোবাসাটাকে সস্তা হতে দিইনি,
সেদিন আমি তোমার প্রতি অবিচার করেছিলাম নন্দিনী,
তাই নাকি, কবে থেকে এই বোধদয় হোল,
নর্থ বেঙ্গলে পোস্টিং হবার পর, আমি হাই সোসাইটির মেয়ে অনিন্দিতাকে বিয়ে করলাম,
খুব ভালো,
না নন্দিনী, কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারেনা,
কেন,
বিয়ের কিছুদিন পর আমার সামান্য আয় নিয়ে সংসারে অশান্তি। ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে রিসেন্টলি রনদীপকে বিয়ে করেছে।
তোমার মনে পড়ে কৃষ্ণেন্দু, সেদিন ঝিলের ধারে পলাশ শিমূলের ছায়ায় বসে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসার শপথ নিয়েছিলাম।
আমি কথা রাখতে পারিনি। কিন্তু আজ চেয়ারে তোমাকে দেখে, চমকে গিয়েছি।
তুমি চলে গেলে, খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম এক সময়।
এরপর মন শক্ত করলাম। পলাশ শিমূলের দিনগুলির মধ্যে আমি ভালোবাসার শক্তি খুঁজে পেলাম। ভাবলাম, ভালোবাসা হারেনা, ভালোবাসা মরে না, আমাকে প্রমাণ করতে হবে।
গ্রাজুয়েশনের পর আমি এ গ্রেডে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিলাম। তারপর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আজ এখানে।
একলার জীবন,তোমার কষ্ট হয় না,
ভালোবাসাটাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি, মানুষের জন্য কাজ করছি। আজ আমি একা নই, কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দু বলল, আজ আসি।
অফিস থেকে বেরোতেই, ওসমান খাঁন প্রশ্ন করলো, কাজ হয়েছে সাহেব।
কৃষ্ণেন্দু বলল, হ্যাঁ।
ওসমান বলল, ম্যাডাম কোনো ফাইল আটকে রাখেন না, অনাথ শিশুদের জন্য অনেক অনেক কাজ করেন।বিমর্ষ কৃষ্ণেন্দু পথে নেমে এলো। একটা সিগারেট ধরালো। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে মনে মনে বলল, পলাশ শিমূলের সৌন্দর্য সেদিন আমি দেখেছিলাম। নন্দিনীও দেখেছিল। বসন্ত দিনের ভালোবাসার শক্তি আমি সেদিন দেখতে পাইনি।
নন্দিনী দেখেছিল।আমি যা পারিনি, নন্দিনী তা করে দেখিয়েছে। ভালো থেকো নন্দিনী।
পিচ ঢালা পথের উপর যখন পলাশ শিমূলের চূর্ণ এসে পড়েছে। আলগোছে কৃষ্ণেন্দু কয়েকটা পলাশ ফুল নাকের কাছে তুলে নিল। দূরে লাউড স্পিকারে কোথাও গান বাজছিল, রঙ শুধু দিয়েই গেলে, সে রঙ কখন লাগলো আমার মনে, আমার জীবন মরণ ধন্য করে।
কৃষ্ণেন্দু মনে মনে বলল, একদিন তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি চলে গিয়েছিলাম। সেদিন তোমাকে আমি কাঁদিয়েছিলাম নন্দিনী। আজ তোমার সাফল্যে আমি খুশি। আমার খুশির এই চোখের জল, তুমি কোনোদিন দেখতে পাবে না নন্দিনী।
-
গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা
সোনার সিঁড়িতে পা
-সুনির্মল বসুতখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন। গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।
মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।
অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।
মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।
অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।
ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।
একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।
গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।
এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।
জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।
একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।
অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।বিশ্বরূপ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।
সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।
জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাপসলিউটলি,নট।
দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।
সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।
-
গল্প- পিতৃত্বের দাবি
পিতৃত্বের দাবি
-মুনমুন রাহা
” দেখ তোমার ঐ মালিটার তাকানো আমার একদম ভাল লাগে না । কেমন করে যেন আমার তিন্নির দিকে তাকায়। তুমি ওকে বিদায় করার ব্যাবস্থা কর।”
” তোমার এই সবাই কে সন্দেহ করাটা বন্ধ কর তাহলেই দেখবে সব ঠিক আছে। “
” বিশ্বাস কর এবার আমার মনের ভুল নয় গো । প্রতিবার কি ভুল হয়? আর তুমি জান না তিন্নি আমাদের কত ধৈর্য্যর ফল ?”
এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে অনামিকা। তমাল আর অনামিকার বিয়ের প্রায় সাত বছর পর তিন্নি আসে ওদের জীবনে । এর আগে অনামিকার পাঁচ বার মিসক্যারেজ হয়। শেষের দিকে তো অনামিকা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবারের এই সন্তান হারনো তার আর তমালের জীবনের গতিটা যেন থামিয়ে দিয়েছিল। তিন্নির ছোট দুটো হাত ধরেই তারা ফিরেছিল জীবনের ছন্দে ।
তমালের বাগানের বড় সখ । অফিসের চাপে সেই ভাবে নজর দিতে পারছে না গাছ গুলোতে তাই একটা মালি খুঁজছিল । পেয়েও গেল । নাম চরণ দাস । তার সাথে আবার কদিনের মধ্যেই বেশ ভাল আলাপ হয়ে যায় চার বছরের তিন্নির। প্রথম প্রথম অনামিকা কিছু বলে নি কিন্তু আজকাল তার নানা রকম সন্দেহ হচ্ছে মনে।
তমাল অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসে । এসে দেখে চরণ তিন্নির ঘরে বাইরের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে । তমাল গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে সে । জিজ্ঞেস করতে বলে সাদা গোলাপ গাছে ফুল এসেছে তিন্নি দেখবে বলেছিল তাই সে খুঁজছিল তাকে । কথাটা কেমন বিশ্বাস হয় না তমালের। তবু তখন কিছু বলে না সে । আরো একদিন তমাল লক্ষ করল সকাল বেলা চরণ কি যেন কথা বলছে তিন্নির সাথে । পরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে মালি কাকু তাকে জিজ্ঞেস করছিল তিন্নি তার সাথে তার বাড়ি যাবে কিনা ?
না আর রিস্ক নিতে পারে না তমাল। আজকাল কত কিছুই তো হচ্ছে ।
তার বাগানের ফুলের থেকে তার ফুলের মত মেয়ে তিন্নি তার কাছে অনেক বেশি দামী । তাই সেদিনই চরণ দাসকে একমাসের মাইনে সহ বিদায় দেয় সে । যাওয়ার আগে চরণ দাস তার সাথে দেখা করতে চায় । বলে —” বাবু আমি তো মালি তাই একটা কথা বলি। পরের বাগানের ফুল দিয়ে কখনও নিজের বাগান সাজানো যায় না । আর সাজালেও সে ফুল বেশিদিন থাকে না ।”
” কি বলতে চাও তুমি ? “
আর দাঁড়ায় নি চরণ দাস। চরণ দাসের কথা গুলো যেন হঠাৎই তমাল কে পিছিয়ে নিয়ে যায় চার বছর আগে তিন্নির জন্মের সময়। বহুদিন ধরে ভুলে থাকা কথা গুলো মনে পড়ে যায় তমালের।
যখন অনামিকার শরীরে নয় মাস ধরে তাদের সন্তান বেড়ে ওঠে তখন তমাল আর অনামিকা দুজনেই অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সেই সন্তান কে নিয়ে । আগের পাঁচ বারের মতো ভগবান তাদের সন্তান কে কেড়ে নেয়নি। তারপর সঠিক দিনে ডাক্তারের পরামর্শ মতোই অনামিকা ভর্তি হয় নার্সিংহোমে । তমাল অধীর আগ্রহে তখন অপেক্ষারত তাদের সন্তানের জন্য।
ওটি থেকে ডাক্তার এসে খবর দেয় তাদের এক কন্যা সন্তান হয়েছিল বটে কিন্ত বেশিক্ষণ সে থাকে নি এই পৃথিবীতে । এদিকে অনামিকার যা অবস্থা এই খবর হয়তো তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে ।
তমালের তখন নিজেরই পাগলের মতো অবস্থা । এক তো ভগবানের নিষ্ঠুর পরিহাস অপরদিকে অনামিকার জীবন । যখন কি করবে কোন দিকে দিশা পাচ্ছে না তখন হঠাৎই অসিত বলে একটি ছেলে আসে তার কাছে । বলে সে নাকি সব কিছুই জানে তার ব্যাপারে এবং আরও বলে একটি বাচ্চা আছে যার বাবা নেই । মা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে । এখন অসিত তাকে তমালের হাতে তুলে দিতে পারে কিছু অর্থের বিনিময়। ডাক্তারবাবু অবশ্য সবটাই জানতেন । কারণ তিনিও কিছু অর্থ দাবী করেন ।
সব কিছু সামলে আজ সেই ছোট্ট বাচ্চা টা তাদের আদরের তিন্নি । তারপর সব কিছুই যেন চাপা পরে যায় তিন্নির ভালবাসার কাছে । ছোট্ট ছোট্ট হাত গুলো দিয়ে যখন তমালের হাতের আঙুল গুলো চেপে ধরত ছোট্ট তিন্নি,তখন তমালের মনে হত এ তার ছাড়া আর কারো সন্তান হতেই পারে না ।
তিন্নির যত আবদার তার বাবার কাছে । মেয়েরও সব আবদার মাথায় করে রাখে তমাল । ছোট্ট পায়ে হামা দিতে দিতে, টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন কেটে গেছে চারটে বছর। এই এত বছর পর চরণের কথায় তমালের মনে পরে পুরোন কথা গুলো । কিন্ত চরণ কেন বলল এমন কথা কে জানে!
চরণ বাড়ি ফিরতে তার বৌ তুলসী জিজ্ঞেস করে—-
“কি গো আর কত দিন পর আনবে আমাদের কমলি কে ? “” একটু অপেক্ষা কর , আনব ,আমাদের কমলি আমাদের কাছেই ফিরবে । কাউকে দেব না । আমার যত অভাবই হোক কমলি আর বিমলির বাবা তাদের মুখে ঠিক খাবার তুলে দিতে পারবে ।”
আজ সকাল থেকে তিন্নির কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না । সকালে সে বাগানে খেলতে গিয়েছিল সেই থেকে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না । অনামিকার অবস্থা ভাল নয় বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । নার্সিংহোমে ভর্তি করে তমাল চলল চরণের কাছে । তার মন বলছিল চরণের তিন্নিকে লুকিয়ে দেখা , তার বাড়ি যাওয়ার কথা বলা এবং শেষ দিনের তাকে দেওয়া উপদেশ এমনি এমনি নয়। পুলিশকে খবর দেয় সে । পুলিশ ও যাচ্ছে তার সাথে ।
” আমি বাবার কাছে যাব “
” কেন মা তোমার এখনে ভাল লাগছে না? এই দেখ তোমার বোন বিমলি। ও আর তুমি যে যমজ। দেখ তোমাদের এক রকম দেখতে না ! “
“এতক্ষন তো থাকলাম মালি কাকু এবার আমার বাবার জন্য মন কেমন করছে । অফিস থেকে এসে আমায় খুঁজবে তো ?”
” তোমার মা তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে খাও মা। “
না কিছুই খায় নি মেয়ে টা । বাবার কাছে যাবে এই বায়না করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে । তুলসী যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন দাই চম্পা বলেছিল তার পেটে দুটি প্রান বাড়ছে। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ব্যাথা উঠলে চম্পা কে খবর দেয় চরণ । কিন্ত চম্পা তুলসীর অবস্থা দেখে পরামর্শ দেয় ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার জন্য। বস্তির ছেলে অসিতের সাহায্যে তুলসী যায় নার্সিংহোমে । যদিও খরচটা বেশি কিন্ত চিকিৎসা ভাল। সেখানে তুলসী আর তার এক মেয়ে বাঁচলেও আর একটা মেয়ে কে বাঁচাতে পারে না ডাক্তারা ।
কিন্ত সব ভুল ভেঙে যায় তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে। তিন্নি কে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না এ তারই মেয়ে। অবিকল বিমলির মুখ বসানো । তখনই ঠিক করে তিন্নি মানে তাদের কমলি কে নিয়ে আসবে তার কাছে । ঘর তার ভাঙা হলেও রাজকন্যা যে তার।
সেই মতোই আজ তিন্নিকে নিয়ে আসে সে । কিন্ত এখন বুঝতে পারছে তার মেয়ের কাছে বাবা যে অন্য কেউ। বাবা হয়ে চরণ মেয়ের এত কান্না সহ্য করতে পারছে না । আর এটাও ঠিক তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে সে বুঝেছে তমাল ঠিক কতটা ভালবাসে তিন্নিকে । বাবা হয়ে আর এক বাবার কাছ থেকে তার মেয়ে কে কেড়ে নিতে পারবে না সে । তুলসীকেও বোঝায় সে ।
বাইরে পুলিশের ডাকে বেরিয়ে আসে চরণ । দেখে পুলিশের সাথে তমালকে । তমাল তিন্নি খোঁজে ততক্ষণ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরে গিয়ে দেখতে পায় তিন্নির যমজ বোন বিমলি কে । কিছু আর বুঝতে বাকি থাকে না তমালের।
তমাল পুলিশের কাছ থেকে কমপ্লেন তুলে নেয়। হাত জোড় করে ক্ষমা চায় চরণের কাছে । এও জানায় কোন পরিস্থিতিতে তাকে ঠিক কি বলে অসিত। অনুরোধ করে তিন্নিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
চরণ বলে —-
“নিয়ে যাও বাবু তোমার মেয়ে কে । ওর নরম মনে এত কথা বলে কষ্ট দিতে হবে না । আর তাছাড়াও ও তোমাকে বড় ভালবাসে ।তুমি বাবা যে !”“না চরণ ও আজ থেকে শুধু আমার মেয়ে নয় তোমারও মেয়ে। আমরা দুজনেই ওর বাবা হতে পারি না ? “
অনামিকাও আজ জানে সবটা । তমাল বাবু আর অনামিকার কাছে ভালোই আছে তিন্নি ।মাঝে মাঝে অবশ্য তার মালি কাকুও আসে ওর সাথে দেখা করতে ।