গল্প

  • গল্প

    গল্প- পিতৃত্বের দাবি

    পিতৃত্বের দাবি

    -মুনমুন রাহা

     

     

    ”  দেখ  তোমার  ঐ মালিটার তাকানো আমার একদম ভাল লাগে না । কেমন করে যেন আমার তিন্নির দিকে তাকায়। তুমি ওকে বিদায় করার ব্যাবস্থা কর।”

            ” তোমার এই সবাই কে সন্দেহ করাটা বন্ধ কর তাহলেই দেখবে সব ঠিক আছে। “

            ” বিশ্বাস কর এবার আমার মনের ভুল নয় গো । প্রতিবার কি ভুল হয়? আর তুমি জান না তিন্নি আমাদের কত ধৈর্য্যর ফল ?”

              এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে  অনামিকা। তমাল আর অনামিকার বিয়ের প্রায় সাত বছর পর তিন্নি আসে ওদের জীবনে । এর আগে অনামিকার পাঁচ বার মিসক্যারেজ হয়।  শেষের দিকে তো অনামিকা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল।  প্রতিবারের এই সন্তান হারনো তার আর তমালের জীবনের গতিটা যেন থামিয়ে দিয়েছিল। তিন্নির ছোট দুটো হাত ধরেই তারা ফিরেছিল জীবনের ছন্দে ।

              তমালের বাগানের বড় সখ । অফিসের চাপে সেই ভাবে নজর দিতে পারছে না গাছ গুলোতে তাই একটা মালি খুঁজছিল । পেয়েও  গেল । নাম চরণ দাস । তার সাথে আবার কদিনের মধ্যেই বেশ ভাল আলাপ হয়ে যায় চার বছরের তিন্নির। প্রথম প্রথম অনামিকা কিছু বলে নি কিন্তু আজকাল তার নানা রকম সন্দেহ হচ্ছে মনে। 

             তমাল অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসে । এসে দেখে চরণ তিন্নির ঘরে বাইরের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে । তমাল গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে সে । জিজ্ঞেস করতে বলে সাদা গোলাপ গাছে  ফুল এসেছে তিন্নি দেখবে বলেছিল তাই সে খুঁজছিল তাকে । কথাটা কেমন বিশ্বাস হয় না তমালের।  তবু তখন কিছু বলে না সে । আরো একদিন  তমাল লক্ষ করল সকাল বেলা চরণ কি যেন কথা বলছে তিন্নির সাথে । পরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে মালি কাকু তাকে জিজ্ঞেস করছিল তিন্নি তার সাথে তার বাড়ি যাবে কিনা ?

             না আর রিস্ক নিতে পারে না তমাল। আজকাল কত কিছুই তো হচ্ছে ।
    তার বাগানের ফুলের থেকে তার ফুলের মত মেয়ে তিন্নি তার কাছে অনেক বেশি দামী । তাই সেদিনই চরণ দাসকে একমাসের মাইনে সহ বিদায় দেয় সে । যাওয়ার আগে চরণ দাস তার সাথে দেখা করতে চায়  । বলে —

      ” বাবু আমি তো মালি তাই একটা কথা বলি। পরের বাগানের ফুল দিয়ে কখনও নিজের বাগান সাজানো যায় না । আর সাজালেও সে  ফুল বেশিদিন থাকে না ।”

       ” কি  বলতে চাও তুমি ? “

                আর দাঁড়ায় নি চরণ দাস। চরণ দাসের কথা গুলো যেন হঠাৎই তমাল কে পিছিয়ে নিয়ে যায় চার বছর আগে তিন্নির জন্মের সময়।  বহুদিন ধরে ভুলে থাকা কথা গুলো মনে পড়ে যায় তমালের।

             যখন  অনামিকার শরীরে নয় মাস ধরে তাদের সন্তান বেড়ে ওঠে তখন তমাল আর অনামিকা দুজনেই অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সেই সন্তান কে নিয়ে । আগের পাঁচ বারের মতো ভগবান তাদের সন্তান কে কেড়ে নেয়নি। তারপর সঠিক দিনে ডাক্তারের পরামর্শ মতোই অনামিকা ভর্তি হয় নার্সিংহোমে । তমাল অধীর আগ্রহে তখন অপেক্ষারত তাদের সন্তানের জন্য। 

               ওটি থেকে ডাক্তার এসে খবর দেয় তাদের এক কন্যা সন্তান হয়েছিল বটে কিন্ত  বেশিক্ষণ সে থাকে নি এই পৃথিবীতে । এদিকে অনামিকার যা অবস্থা এই খবর হয়তো তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে ।

                 তমালের তখন নিজেরই পাগলের মতো অবস্থা । এক তো ভগবানের নিষ্ঠুর পরিহাস অপরদিকে অনামিকার জীবন । যখন কি করবে কোন দিকে দিশা পাচ্ছে না তখন হঠাৎই অসিত বলে একটি ছেলে আসে তার কাছে । বলে সে নাকি সব কিছুই জানে তার ব্যাপারে  এবং আরও বলে একটি বাচ্চা আছে যার বাবা নেই । মা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে । এখন অসিত তাকে তমালের হাতে তুলে দিতে পারে কিছু অর্থের বিনিময়। ডাক্তারবাবু অবশ্য সবটাই জানতেন । কারণ তিনিও কিছু  অর্থ দাবী করেন ।

               সব কিছু সামলে আজ সেই ছোট্ট বাচ্চা টা তাদের আদরের তিন্নি । তারপর সব কিছুই যেন চাপা পরে যায় তিন্নির ভালবাসার কাছে । ছোট্ট ছোট্ট হাত গুলো দিয়ে যখন তমালের হাতের আঙুল গুলো চেপে ধরত ছোট্ট তিন্নি,তখন তমালের মনে হত এ তার ছাড়া আর কারো সন্তান হতেই পারে না ।

                  তিন্নির যত আবদার তার বাবার কাছে । মেয়েরও সব আবদার মাথায় করে রাখে তমাল । ছোট্ট পায়ে হামা দিতে দিতে, টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন কেটে গেছে চারটে বছর। এই এত বছর পর চরণের কথায়  তমালের মনে পরে পুরোন কথা গুলো । কিন্ত চরণ কেন বলল এমন কথা কে জানে!

               চরণ বাড়ি ফিরতে তার বৌ তুলসী জিজ্ঞেস করে—-
    “কি গো আর কত দিন পর আনবে আমাদের কমলি কে ? “

       ” একটু অপেক্ষা কর , আনব ,আমাদের কমলি আমাদের কাছেই ফিরবে । কাউকে দেব না । আমার যত অভাবই হোক কমলি আর বিমলির বাবা তাদের মুখে ঠিক খাবার তুলে দিতে পারবে ।”

            আজ সকাল থেকে তিন্নির কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না । সকালে সে বাগানে খেলতে গিয়েছিল সেই থেকে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না । অনামিকার অবস্থা ভাল নয় বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । নার্সিংহোমে ভর্তি করে তমাল চলল চরণের কাছে । তার মন বলছিল চরণের তিন্নিকে লুকিয়ে দেখা , তার বাড়ি যাওয়ার কথা বলা এবং শেষ দিনের তাকে দেওয়া উপদেশ এমনি এমনি নয়। পুলিশকে খবর দেয় সে । পুলিশ ও যাচ্ছে তার সাথে ।

             ” আমি বাবার কাছে যাব “

       ” কেন মা তোমার এখনে ভাল লাগছে না? এই দেখ তোমার বোন বিমলি। ও আর তুমি যে যমজ। দেখ তোমাদের এক রকম দেখতে না ! “

         “এতক্ষন তো থাকলাম মালি কাকু এবার আমার বাবার জন্য মন কেমন করছে । অফিস থেকে এসে আমায় খুঁজবে তো ?”

        ” তোমার মা তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে খাও মা। “

            না কিছুই খায় নি মেয়ে টা । বাবার কাছে যাবে এই বায়না করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে ।  তুলসী যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন দাই চম্পা বলেছিল তার পেটে দুটি প্রান বাড়ছে।  তারপর নির্দিষ্ট দিনে ব্যাথা উঠলে চম্পা কে খবর দেয় চরণ । কিন্ত চম্পা  তুলসীর অবস্থা দেখে পরামর্শ দেয় ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার জন্য।  বস্তির ছেলে অসিতের সাহায্যে তুলসী যায় নার্সিংহোমে । যদিও খরচটা বেশি কিন্ত চিকিৎসা ভাল।  সেখানে তুলসী আর তার এক মেয়ে বাঁচলেও আর একটা মেয়ে কে বাঁচাতে পারে না ডাক্তারা ।

             কিন্ত সব ভুল ভেঙে যায় তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে। তিন্নি কে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না এ তারই মেয়ে।  অবিকল বিমলির মুখ বসানো । তখনই ঠিক করে তিন্নি মানে তাদের কমলি কে নিয়ে আসবে তার কাছে । ঘর তার ভাঙা হলেও রাজকন্যা যে তার।

            সেই মতোই আজ তিন্নিকে নিয়ে আসে সে । কিন্ত এখন বুঝতে পারছে তার মেয়ের কাছে বাবা যে অন্য কেউ। বাবা হয়ে চরণ মেয়ের এত কান্না সহ্য করতে পারছে না । আর এটাও ঠিক তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে সে বুঝেছে তমাল ঠিক কতটা ভালবাসে তিন্নিকে ।  বাবা হয়ে আর এক বাবার কাছ থেকে তার মেয়ে কে কেড়ে নিতে পারবে না সে । তুলসীকেও বোঝায় সে ।

            বাইরে পুলিশের ডাকে বেরিয়ে আসে চরণ । দেখে পুলিশের সাথে তমালকে । তমাল তিন্নি খোঁজে ততক্ষণ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরে গিয়ে দেখতে পায় তিন্নির যমজ বোন বিমলি কে । কিছু আর বুঝতে বাকি থাকে না তমালের।

            তমাল পুলিশের কাছ থেকে কমপ্লেন তুলে নেয়।  হাত জোড় করে ক্ষমা চায় চরণের কাছে । এও জানায় কোন পরিস্থিতিতে তাকে ঠিক কি বলে অসিত।  অনুরোধ করে তিন্নিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

            চরণ বলে —-
    “নিয়ে যাও বাবু তোমার মেয়ে কে । ওর নরম মনে এত কথা বলে কষ্ট দিতে হবে না । আর তাছাড়াও ও তোমাকে বড় ভালবাসে ।তুমি বাবা যে !”

        “না  চরণ ও আজ থেকে শুধু আমার মেয়ে নয় তোমারও মেয়ে। আমরা দুজনেই ওর বাবা হতে পারি না ? “

             অনামিকাও আজ জানে সবটা । তমাল বাবু আর অনামিকার কাছে ভালোই আছে তিন্নি ।মাঝে মাঝে অবশ্য তার মালি কাকুও আসে ওর সাথে দেখা করতে ।

  • গল্প

    গল্প- অপরাহ্নের আলো

    অপরাহ্নের আলো
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    বিকেল বেলায় দোতলার বারান্দায় বসে অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত আকাশ দেখতে বড্ড ভালো লাগে ইন্দিরার। রোজ তাই এই সময়টায় বারান্দায় এসে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। আজ‌ও হাতদুটো কোলের উপর রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন , আকাশে ভাসা টুকরো টুকরো মেঘগুলো, অস্তগামী সূর্যের আলোয় কেমন সুন্দর নিজেদের রাঙিয়ে নিচ্ছে নানা রঙে।মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলেন, মানুষের জীবনটাও বোধহয় অনেকটা এইরকমই। প্রথম জীবনের নানা রঙের দিনগুলো, যখন বার্ধক্যের ছোঁয়ায় ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠতে থাকে ,তখন নিজেকেই চেষ্টা করে বাইরের রঙে রাঙিয়ে, জীবনকে উজ্জ্বল করে নিতে হয়, ন‌ইলে মনকেমনের আঁধারে ডুবে যায় দিনযাপন। সেই আঁধার সাঁতরে পার হ‌ওয়া যে কী পীড়াদায়ক, ভুক্তভোগী মাত্রের‌ই জানা। আশেপাশে কম মানুষকে তো আর দেখছেন না। বিদেশের মানুষজন যে এতো হবি নিয়ে মাতামাতি করে সে কি আর এমনি!
    উদার আকাশে হারিয়ে যেতে যেতে এইসব নানা দার্শনিক চিন্তায় ডুবে ছিলেন ইন্দিরা।

    “এই নাও , তোমার চা।” পাশে রাখা বেতের টেবিলে ঠক্ করে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে বললে মিনতি।

    “দাদুকে চা দিয়েছিস?”

    “হুঁ, কী একটা ব‌ই পড়তেছে তাই ঘরে বসেই চা খাবে বললো।”

    “আর আমার সুতো?”

    “এনেছি রে বাবা এনেছি, ন‌ইলে আমার কপালে দুঃখু আছে সে কী আর আমি জানি নে, ও,ভালো কতা, লেস বোনার সুতোর দাম কিন্তু পাঁচ ট্যাকা করে বেড়ে গেচে , বলে রাকলুম।”

    ” আচ্ছা বেশ, কী আর করা যাবে।”

    “সে তুমি বোজো গে যাও। সারাদিন ধরে কষ্ট করে আঙ্গুল ব্যাতা করে বোনো আর একে তাকে বিলিয়ে দাও ,তাও যদি সবাই এর মম্মো বুজতো “

    আরে আমি তো লেশ বুনতে ভালোবাসি রে , আর ভালোবেসেই ওদের দিই। তোকেও তো দিয়েছি, তুইও তো খুশি হয়েই নিলি”

    “আমার কতা বাদ দাও, তোমার ঐ ছোট জা সেদিন কী বললে মনে নেই! কতো বড়ো একখানা টেবিল ঢাকা দিলে, আর মুকের ওপর বলে কিনা, কী লাভ হয় বলতো দিদি, এইসব কষ্ট করে বুনে ,সব‌ই তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। তাছাড়া মেশিনে বোনা ওইসব লেসগুলোর ফিনিশ আরও কতো সুন্দর!ছেলে নাকি বিদেশ থেকে পাইট্যেচে, সেই দেমাকেই মলো। ইচ্ছে করছিলো দিই বেশ করে দুকতা শুনিয়ে, তুমি আবার কী বলবে তাই চুপ মেরে গেলাম।”

    “আচ্ছা বেশ আর দেব না ওকে, আর শোন্ এই সুতোটা আনালাম বিন্দি দিদিভাই এর জন্যে। ওর মা ফোন করেছিলো, দিদিভাইদের স্কুলে কুরুশ দিয়ে কী সব যেন করতে শেখাবে, তাই আগেভাগেই কুরুশ বোনা শেখাতে ওকে নিয়ে আসবে, মালবিকা।”

    “ওমা ,তা-ই!সে তো শুনিচি মেমসাহেব দিদিমণিদের ইস্কুল! সেখানেও এইসব শেখাবে?”

    “তবেই বোঝ্, নে এবারে তোর দুঃখু ঘুচলো তো। যা গিয়ে কাজে মন দে ,আর শোন্ কাল বিকেলে রুটি করার দরকার নেই।ওরাও আসবে , সকলের জন্য লুচি মাংস, বেশী করে বানাবি,তুইও বাড়ির জন্য নিয়ে যাস্।”

    “সে হবেখন, আর শোনো এরপর আমার জন্য একখানা টি,ভির ঢাকনা বানিয়ে দিও তো।”

    “ওমনি বায়না শুরু হলো ,যা তো এখন কাজে মন দে।”

    তা এটুকু বায়না সে করতেই পারে। বহুদিন ধরেই রয়েছে এই বাড়িতে, ইন্দিরা আর অমলেশের সংসারে, তাঁদের স্বঘোষিত অভিভাবক আর সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে। এখন ও-ই বোধহয় এই নিঃসন্তান দম্পতিটির সবচাইতে কাছের মানুষ-রক্তের সম্পর্কের অন্যান্য পরিজনদের চাইতেও বেশি। তারা মাঝে মাঝে ফোনে খবর নেয় না তা নয় তবে তাদের আর সময় কোথায়! এই মিনতিই বলতে গেলে সর্বক্ষণের সাথী।

    সকাল বেলা নিজের সংসার‌ কিছুটা সামলে ,সে চলে আসে এই বাড়িতে, দুপুর বেলা কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি যায়, আবার বিকেল হতেই চলে আসে, ইন্দিরার সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ সেরে , ছাদের দরজা বন্ধ করা থেকে শুরু করে মশারি টাঙিয়ে, মায় টিপয়ে জলের গ্লাস, বোতল রেখে, রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফেরে। মোটকথা জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ, এমনকি টুকটাক কাজে মিস্ত্রি ধরে আনা থেকে, ঠিকে কাজের লোকের উপরে ছড়ি ঘোরানো , সব কিছুই তার আওতায় পড়ে।

    মিনতি, নীচে নেমে গেল। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে , ইন্দিরা আবার ডুবে যাচ্ছিলেন নিজের ভাবনায়।

    তাঁদের একতলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বেশ কয়েকবছর আগে মালবিকারা ভাড়ায় এসেছিলো,বিন্দি তখন এইটুকু ,বোধহয় বছরখানেকের। দেখতে দেখতে বছর পাঁচেক কেটে গেলো। বিন্দি,এই বাড়িতেই বড়ো হলো, খিলখিল হাসিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে, উপর নীচে ছুটোছুটি করে বেড়াতো, সংসারটা বেশ ভরভরতি লাগতো, তারপর তো নিজেরা ফ্ল্যাট বানিয়ে চলে গেছে,ঘরদুয়ার আবার ফাঁকা।তবে যোগাযোগ আছে। এই তো মাসছয়েক আগে মালবিকার এন্-আর- আই দিদি আলোলিকা দেশে এসে দেখা করতে এসেছিল তাঁদের সঙ্গে, পারফিউম, ক্রিম,ব্যাগ, হ্যানা ত্যানা, আরও কতো উপহার নিয়ে। হঠাৎ একটা কথা মনে করে হাসি পেয়ে গেল। ইন্দিরা ওকেও খান দুই -তিন,হাতে বোনা বড়ো বড়ো লেশের ঢাকনা উপহার দিয়েছিলেন ।কী যে খুশি হয়েছিলো! দেশে ফিরে নিজের ঘরে , নানা কর্ণার টেবিলে সেগুলি পেতে সাজিয়ে গুছিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে।
    ও, খুশি হয়েছে, ব্যাস্, ওইটুকুই ইন্দিরার আনন্দ, আর কী চাই!

    পরদিন বিকেলবেলায় বিন্দিকে নিয়ে চলে এলো মালবিকা।বিন্দিকে হাতে ধরে কুরুশকাঠি ধরার কায়দা থেকে, আরম্ভ করে বোনার প্রাথমিক ধাপটুকু শিখিয়ে দিলেন ইন্দিরা। এরপর ক্লাশে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। তাছাড়া তিনি তো র‌ইলেন‌ই।

    ইন্দিরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলেন, মালবিকা কেমন যেন একটু উশখুশ করছে।বেশ বুঝতে পারছিলেন ওর আরও কিছু বলার আছে। শেষটায় ইন্দিরাই আগ বাড়িয়ে বললেন
    “নাও এবারে কী বলবে বলে ফেলো তো।

    মালবিকা অবাক—

    “কী করে বুঝলেন আমি কিছু বলবো?”

    “ভুলে যাও কেন আমাদের বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।”

    মালবিকা এবারে অকপট হলো।
    সঙ্গে আনা বড়োসড়ো ব্যাগ থেকে একগাদা লেশবোনার রেশমী সুতো আর ক্রচেট ডিজাইনের ব‌ই ইন্দিরার হাতে দিয়ে বললো
    “দিদি পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
    এইসঙ্গে একখানা আবদার‌ও আছে।

    “শুনি কী আবদার!”

    “আপনি দিদিকে যে লেসের ছোট বড়ো নানারকমের ঢাকা বুনে দিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে দিদির এক বিদেশিনী বান্ধবীর খুব পছন্দ হয়েছে …”

    “বুঝেছি তার‌ও গোটাকতক চাই, তাই তো! বেশ তো…”

    ” হ্যাঁ চাই তো বটেই, তবে তার চাহিদা আরও একটু বেশি।
    এইসব জিনিসগুলো একসময়ে খুব পপুলার ছিলো,বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সেকথা তো জানেনই। তারপর মাঝে ফ্যাশন উঠে গিয়েছিলো। ইদানিংকালে আবার নতুন করে সে ফ্যাশান চালু হয়েছে, যাকে বলে “ইন-থিং”। পোশাক আশাকে লেসের কাজের খুব চাহিদা।
    ওদিকে দিদির বান্ধবীটির একটা ছোটখাটো ফ্যাশান-স্টোর্স,আছে,ও চাইছিলো,যদি লেসের কিছু স্টক দোকানে রাখা যায়। তুমি যদি রাজি থাকো…”

    “ও বাবা , সে তো অনেক বড়ো ব্যাপার , আমি শখের কারবারি, এইসব কি করে সামলাবো?”

    “শোনো না , দিদির আরও একটু পরিকল্পনা রয়েছে। দিদি বলছিলো, আমাদের দেশে সেলাই করে সংসার চালায় এমন অনেক দুস্থ মহিলা আছেন, তাদের যদি তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দাও, হয়তো তোমার মতো এতো ভালো কাজ হবেনা তবু তাদের দিয়েই যদি নানা ডিজাইনের লেসের টেবিল ক্লথ, বেডকাভার তৈরি করানো যায়!!! মাল মেটিরিয়াল জোগান দেওয়া, থেকে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট ওদেশে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা,সব ওদের।”

    “কী বলছো ! এই বয়সে কি এইসব সম্ভব, তাছাড়া এটা তো আমার মনের আনন্দের ব্যাপার , না না এটাকে ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যেতে মন চায় না।”

    ” শোনো না, তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে, শুধু ওদের শিখিয়ে, ভুলভ্রান্তি শুধরিয়ে, নতুন নতুন ডিজাইনের কাজ করিয়ে নেবে। ইচ্ছে হলে তুমিও বুনবে, আগে যেমন নিজের জন্য বুনতে, ইচ্ছে না করলে নয়। ভেবে দেখো না এতে তোমার‌ও শখ মিটবে , কিছু গরীব মেয়েরাও কাজ পাবে। খুব কিছু মন্দ হবে কি?”

    এইরকম আচমকা প্রস্তাব এলে চট্ করে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় বিশেষ করে এই বয়সে এসে?
    বেশ কিছুদিন দোনামনা করতে করতে অবশেষে রাজিই হয়ে গেলেন ইন্দিরা। ভাবছিলেন, সত্যিই যদি তাঁর শখটা আরও একটু বিস্তৃত করলে কয়েকজনের আর্থিক সাহায্য হয়, তাহলে মন্দ কী! কতো মানুষ তো কতো ভালো কাজ করেন,তাই তো এই দুঃসময়েও পৃথিবীটা চলে!

    মাস ছয়েকের মধ্যেই ব্যাপারটা বেশ চালু হয়ে গেল।
    মিনতির উৎসাহ‌ই সবচেয়ে বেশি। সে-ই, স্বনিযুক্ত ম্যানেজার। হম্বিতম্বি ছুটোছুটি করে ব্যাপারটা বেশ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইন্দিরাও আজকাল মনের সুখে নিত্যনতুন ডিজাইন তুলিয়ে দেন মেয়েদের।সঙ্গে নিজের শখের বোনাও তো আছেই। মিনতিসহ অনেকক’টি মেয়ে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছে। আজকাল দেশের মধ্যেও এই হাতে বোনা লেসের চাহিদা বাড়ছে।
    খবরের কাগজের প্রতিবেদনে অনেকেই ব্যাপারটা এখন জেনে গেছেন। আত্মীয় স্বজনদের অভিনন্দনে মনে মনে হাসেন তিনি।
    এবারে পুজোর সময়, বিদেশেই আলোলিকারা স্টল দিয়েছিলো, সেখানে তাঁদের হাতের কাজ বেশ সাড়া ফেলেছে। বাংলাদেশের কৃষ্টিমনস্ক বঙ্গসন্তানদের আগ্রহে হয়তো বা আগামী বছর বিদেশের প্লেনে চড়তে চলেছেন ইন্দিরা আর অমলেশ।
    সূর্যাস্তের শোভায় মগ্ন থাকা ইন্দিরা ভাবেন তাঁর জীবনেও বুঝি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে অপরাহ্ণের আলো।

    সুমিতা দাশগুপ্ত।

  • গল্প

    গল্প- অজান্তে…

    অজান্তে…
    -শিলাবৃষ্টি

    আজকাল কেকাকে কেমন অচেনা লাগে!
    সব সময় ব্যস্ততা দেখায়! সত্যিই কি ও এতটা ব্যস্ত! মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় রাজুর। কেকাকে ছাড়া এখন কিছুই সে ভাবতে পারেনা, অথচ “ভালোবাসি তোকে ভীষণ” এই কথাটা আজো বলা হয়ে ওঠেনি। ঠিক যখন বলি বলি করছে মন তখনই কেকার পরিবর্তন রাজুকে ভাবনায় ফেলে দেয়।
    “হ্যালো কেকা ”
    ‘বল, কিরে কথা বল। তাড়াতাড়ি বল।’
    ” সবসময় এত তাড়া কেন তোর কেকা? ‘
    ” আছে বন্ধু, তাড়া আছে। তোকে তো জোজোর কথা বলাই হয়নি! কখন বলি বলতো? ”
    রাজু অবাক হয়! প্রশ্ন করে
    ” জোজো? ”
    ” হ্যাঁ বন্ধু। বেস্ট ফ্রেণ্ড হিসেবে তোকেই আমার আগে বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু ফোনে এত কথা হয়? আর আমিও তোর সাথে বেশী কথা বলতে পারছিনা এখন! প্লিজ ডোন্ট মাইণ্ড রাজু।আসলে জোজো কি ভাববে.. তাই তোর সাথে গল্প করতে পারিনা।
    ও আমাকে এত ভালোবাসে… তুই বিশ্বাস করতেও পারবিনা। আর আমিও। ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। ঠিক আছে রাখ। রাতে ফোন করিস।” বলেই লাইনটা কেটে দেয় কেকা। রাজু স্তম্ভিত। ও ভাবতেই পারেনা কেকা ওকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারে!
    সেই ইলেভেন থেকে ওরা এক আত্মা এক প্রাণ যেন। এতগুলো বছরেও কেকাকে সে চিনতে পারলো না! রাজু ভালো জবের জন্য কম্পিটিটিভ এক্সাম দিচ্ছে, কলকাতায় পড়াশোনার জন্য থাকতে হয় ঠিকই তবে মন পড়ে থাকে নিজের ছোট্ট শহর গোপালপুরে, কেকার কাছে।
    আজ আর কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসানো যাবে না। বিকেল বেলা রাজু এলোমেলো চিন্তা নিয়ে ময়দানের দিকে
    হাঁটতে থাকলো এদিক ওদিক।
    ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! কেকার জন্যই নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে ভেবেছিল৷ কিন্তু আর কিছুই হবেনা তার দ্বারা।
    রাতে কেকাকে ফোন করলো রাজু। আজ তাকে জানতেই হবে সব।
    “হ্যালো হ্যালো”
    ” ওয়েট কর একটু। জোজোর ঘুম ভেঙে যাবে। আমি ব্যালকনিতে যাই! ” ফিসফিসিয়ে বলে কেকা।
    “হোয়াট!! ”
    মিনিট খানিক চুপচাপ।
    ” বল, আসলে জোজো আর আমি আজ এক বিছানাতেই…. ”
    “মানে? !”
    “কি আবার মানে! ”
    “কাকিমা কাকু কোথায়! ”
    ” মামাবাড়ি গেছে। খুব বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। ফিরতে পারেনি।”
    ” আর তুই! ”
    ” নারে একটুও একা লাগছেনা, জোজো আছে তো! ও এত সুইট না… তুই ভাবতেও পারবিনা। আমার শয়নে স্বপনে শুধু এখন জোজো আর জোজো! বাপি আর মা নেই বলে ওকে আমি আমার কাছেই ডেকে নিয়েছি! আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছি। আর জোজোও কিন্তু ..
    রাজু মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় খাটে।
    এই কেকাকে সে ভালোবেসেছিল! ভাবতেই কেমন লাগছে। কেকা এত নোংরা?
    সারারাত ঘুমাতে পারেনা রাজু। মাথায় খুব যন্ত্রণা! বার বার হোয়াটসঅ্যাপ খোলে। পুরোনো চ্যাটগুলো দেখে। কত রাত অব্দি তারা গল্প করতো। কেকা বলেছিল সেটে কিছু সমস্যা হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ খুলতে পারলেও মেসেজ করতে পারছেনা।
    নাহ, এ জীবন রাজু আর রাখবেনা। বেঁচে থেকে কী হবে। কেকা তো এখন অন্যের।ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। এলার্ম বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সেকেণ্ড এপ্রিল সকাল সাতটা।
    অভ্যেস বশত হোয়াটসঅ্যাপ খুলে তাকালো।
    কেকার মেসেজ এসেছে!..

    আজ দেখছি মেসেজ করতে পারলাম।
    গুড মর্নিং রাজু
    এই দেখ – আমার জোজোকে।…

    কিন্তু ডাউনলোড হচ্ছেনা ছবিটা। রাজু
    দেখতেও চায়না। নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশী সুপুরুষ এই জোজো!
    হ্যাঁ হয়েছে ডাউনলোড। কিন্তু….
    কোথায় জোজো? এতো একটা বিদেশী কুকুরবাচ্চার ছবি!!
    …..
    টাইপিং কেকা…

    দেখলি আমার জোজোকে? কেমন লাগলো? দারুণ না? তোকে আমি পরে ভিডিও কল করে জোজোকে ভালোভাবে দেখাতে চাই । বাই।
    তুই কবে আসবি রাজু? আমি ভীষণ ভীষণ মিস করছি তোকে…

    মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে রাজু। অজান্তে দুটো চোখ জলে ভরে গেছে।
    কেকা না জেনেই এপ্রিল ফুল বানিয়ে দিয়েছে তাকে কাল সারাদিন সারারাত।
    “আই লাভ ইউ কেকা, আমি আসছি খুব তাড়াতাড়ি…” মনে মনে বলে ওঠে রাজু।

  • গল্প

    গল্প- কাল রাতে কে এসেছিল

    কাল রাতে কে এসেছিল
    -সুনির্মল বসু

    রাত্রি গভীর। চোখে ঘুম নেই। জানালায় জোসনার আলো। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নিচে সদর দরোজা খোলার শব্দ।

    দোতলার সিঁড়িতে যেন কার নুপুরের ধ্বনি বাজে। কে এলো। কেউ কি এলো। আমার ঘুম ভাঙানিয়া এই মধ্যরাতে কে এলো। জানালার নিচে ফুলের বাগান।

    নীলাঞ্জনা এসেছে। আমার অতীত। আমার ভালোবাসা। বললাম, এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল,
    সব সময় মনে পড়ে। আসা হয়ে ওঠে না।
    আমি তো তোমাকে ভুলে যেতেই চাই।
    সে কি, সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে না,
    কি লাভ,
    ক্ষতিও তো নেই,
    আছে,
    কি,
    কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে,
    সুশোভন, তুমি কখনো বাসি রজনীগন্ধার গন্ধ শুকেছো,
    না,
    শুকনো ফুলের গন্ধ অতীতের সুগন্ধ বয়ে আনে,
    সেসব কথা মনে করতে চাই না,
    কেন,
    আমাকে আমার মত থাকতে দাও,
    গড়িয়াহাটের বিকেল, মিলেনিয়াম পার্ক, কফি হাউসের সন্ধ্যেগুলো মনে নেই বুঝি,
    আছে, তোমার পথের থেকে আমার পথ বহুদূর,
    আমরা কি আবার নতুন করে শুরু করতে পারি না,
    না, তা হয় না। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

    আমি মানছি সুশোভন, সেদিন আমি তোমার কাছ থেকে চলে গিয়ে ভুল করেছিলাম, মনীষ যে শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সে কথা আমি ভাবতে পারিনি,
    ওসব কথা জেনে আমার কি লাভ, তুমি ফিরে যাও নীলাঞ্জনা,
    আমাকে তুমি ভুলে যাবে বলছো,
    জানিনা, ভাবি নি কিছু, বলতে পারব না,
    তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো,
    না,
    কিভাবে বাকি জীবনটা কাটাবে,
    ভেবে দেখিনি, আমার অন্ধকার ঘর ভালো, আলোতে এলে, আমার চোখ জ্বালা করে।
    তথাকথিত সভ্য মানুষদের দেখলে আমি ভয় পাই।
    তুমি চলে যাও নীলাঞ্জনা।

    আমি তাহলে কি নিয়ে থাকবো,
    সেদিনের স্মৃতির মধ্যে, সেইসব কৃষ্ণচূড়ার দিন, সেইসব রাতের স্মৃতি,
    সুশোভন, তুমি বড় নিষ্ঠুর,
    হা হা, তাই বুঝি,
    হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘ। প্রবল ঝড়ের শব্দ। গাছপালার মাতামাতি।
    সুশোভন আমি চলে যাচ্ছি। আমি আর কখনো তোমার কাছে আসবো না।
    আমাকে ভুলে যেও নীলাঞ্জনা। যদি জীবনে এইসব ঝড় একদিন থেমে যায়, আমি নিজেই তোমার কাছে সেদিন ফিরে যাবো।

    হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুশোভনের।

    মনে পড়ল, গতকাল বিকেলে গড়িয়াহাট মোড়ে এক ঝলক নীলাঞ্জনাকে ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যেতে দেখেছিল। উড়ু উড়ু অবাধ্য চুলগুলোকে সামলে নিয়ে ও তখন টালিগঞ্জগামী বাস ধরবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল।

  • গল্প

    গল্প- প্রতিশোধ

     প্রতিশোধ
    শিলাবৃষ্টি

     

     

    অণু ছোটবেলার সেই অপমান এখনো ভুলতে পারেনি। প্রায় সাত আট বছর কেটে গেছে, তবু যেন সেই দিনটার ছবি চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় সে। বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে অনেক আমগাছ, আর প্রতিটা গাছে শয়ে শয়ে কাঁচাপাকা আম ঝুলে ছিল, মাঝখানে পুকুরে পড়ে কত নষ্টও হয়ে গেছে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পাড়ার ছেলেমেয়েরা আর অণু আম পাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আর ঠিক তার পরের দিন রবিবার দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিচ্ছে, তখন চুপিচুপি ওরা বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে পেছনের ছোট গেট টপকিয়ে ঢুকে পড়ে। কয়েকজন গাছে উঠে আম পেড়ে ফেলছিল মাটিতে, আর বাকিরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে পলিপ্যাকে ভরছিল। প্রত্যেকে পলি প্যাক নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু অণু ভুলে গিয়েছিল। তাই সে গাছে বসে বসেই আম খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেলছিল গাছের পাশের একটা ঝোপে। আর নীচু গলায় বলছিল ‘আমার তোলা আম কেউ নিবিনা কিন্ত’ বন্ধুরা মেনে নেয় তার কথা।
    হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কাশির আওয়াজ পেয়ে সবাই সচকিত হয়ে গাছ থেকে নেমে একে একে দ্রুত আম বাগান থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু অণু গাছ থেকে নেমে ঝোপের ভেতর তার ফেলা আমগুলো খুঁজতে থাকে। তার বেরনো আর হয়না, দুহাতে কোনরকমে আমগুলো আঁকড়ে ধরে উঠতে যাবে, পেছন থেকে বিনোদকাকার বাড়িতে কাজ করে যে লোকটা মানে গনেশ নামের ছেলেটা তাকে আচমকা ধরে ফেলে, আতঙ্কে অণুর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। গনেশের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেও পারেনা। সে টানতে টানতে বিনোদকাকার ঘরে নিয়ে যায় তাকে। বিনোদকাকার সবে তখন দিবানিদ্রা ভেঙেছে। হাই তুলে জিজ্ঞেস করে- এ আবার কে?
    গণেশ বলে- চোর বাবু, চোর। এই বাগানের আমটা কলাটা চুরি করে নিয়ে যায়, নারকেল পড়লেই হলো, সব নিয়ে পালায়। আজ তকে তকে ছিলাম, আম গাছ থেকে নামতেই পাকড়াও করে এনেছি… বিনোদকাকা শুনে রেগে বলে- বেশ করেছিস, একটা ঘরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে এখন রেখে দে।
    সেদিন কান্নাকাটি করেও ছাড়া পায়নি অণু। সন্ধ্যাবেলায় যা ঘটলো ওই দশ বছর বয়েসেও সেই অপমান হজম করতে পারেনি সে।
    গ্রামের মাঝখানে একটা পুরোনো রাধামাধবের মন্দির আছে। সন্ধেবেলায় গ্রামের অনেক মানুষ বিশেষত মুরুব্বিরা মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দিরে গিয়ে বসে, কথাবার্তা বলে, তাস খেলে, চা খায়..

    বিনোদকাকার সেই গণেশ দরজা খুলে অণুকে নিয়ে বিনোদকাকার পেছনে পেছনে সেই নাট মন্দিরে আসে। সবে আরতি শেষ হয়েছে, সবাই জড়ো হয়েছে। এমন সময় বিনোদকাকা মুখ খোলে- দেখো গো তোমরা সবাই চোর দেখো
    সবাই অবাক হয়ে অণুর দিকে তাকায়।
    -যারা চোর দেখনি কোনদিন দেখে নাও আজ। এই মেয়েটা আমার বাড়ির বাগানের ফলমুল রোজ চুরি করে, আজ গনেশ ধরেছে চোরকে।
    সবাই এটা ওটা বলতে থাকে। গুঞ্জন শোনা যায়। এই রকম সময়ে অণুর জ্যেঠু এসে পৌঁছায়। সব শুনে ঠাস করে অণুর দুগালে দুটো চড় মারে। তারপরের কথা আর ভাবতে চায়না অণু। শুধু কানে এখনো শুনতে পায় তার নিজের বলা শেষ কথাগুলোই- কাকা মনে রাখবে তুমি, একমাঘে শীত যায়না। এ কথা আমি মায়ের কাছে শিখেছি, এ মিথ্যে হবেনা দেখো।
    বাচ্চা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সবাই সেদিন হেসে ফেলেছিল।এই ঘটনার পরে শীত এসেছে আর গেছে প্রায় সাতবার।
    ……..
    কলেজে যাওয়ার সময় খেতে বসেছে অণু রান্নাঘরে, কানে এলো লক্ষ্মীমাসী মাকে বলছে- বিনোদ ঘোষ লোকটার স্বভাব আর পাল্টাবে না!
    মা বললো- কেন রে লক্ষ্মী কি হয়েছে?
    -কেন আবার! ঘরে বউ ছেলে মেয়ে থাকতে বুড়োটা আবার বিধবা ওই রাধার উপর কৃপা করেছে। রাধার ঘরে তো আর কেউই নেই। বিনোদের পরিবার পুরী গেছে পরশু আর সেও মওকা পেয়ে রাধার ঘরে মউজ করছে।
    -সে কি রে!
    -হ্যাঁ, গো হ্যাঁ…

    পুরোনো অপমানটার শোধ এবারে হয়তো নেওয়া যাবে! অণু সব প্ল্যান তৈরী করে সারাদিন ধরে। তারপর গ্রামের অনেক মানুষকে জড়ো করে সেদিন রাত্রি বারোটাতে রাধার বাড়ির মেন দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে অনবরত। রাধা দরজা খুলতে বাধ্য হয়। সবাই ঘরে ঢুকে অণুর কথা মেলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বিনোদকে দেখতে পায়না। অবশেষে খিড়কির বাথরুম থেকে বিনোদ ঘোষকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে অণু। সবার কাছে প্রমাণ হয়ে যায় বিনোদ ঘোষের চরিত্র।
    হা হা করে হাসতে হাসতে অণু বলে- সাত
    বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে কাকা। একটা বাচ্চা মেয়ে একদিন তোমার বাগানের কটা আম পেড়েছিল বলে তুমি কি করেছিলে? সেদিন আমি বলেছিলাম- এক মাঘে শীত যায়না! মনে পড়ছে? আমিই সেই অনুপমা! যাকে ঘরে আটকে রেখে তুমি মজা দেখেছ! যাকে নাটমন্দিরে এনে সকলের কাছে অপমান করেছ! যাকে মার খাইয়েছ! আজ তোমার কীর্তি সকলের সামনে এনে আমার অপমানের শোধ নিতে পারলাম।
    সকলে ছি ছি করতে করতে বাড়ি চলে গেল। অণু আজ শান্ত হতে পারলো। আর
    রাধা অপমানে লজ্জায় বিনোদকে বের করে দিয়ে দরজাটা সজোরে লাগিয়ে দিল। টাকার দম্ভে ফুলে ওঠা বিনোদ ঘোষ স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হবে সে কোনদিন!

  • গল্প

    গল্প- কেঁচোর বিয়ে

    কেঁচোর বিয়ে
    – মুনমুন রাহা

    ঘটক আমাদের পুরো ঠকিয়েছে। মুখে বল্লে মেয়ে নাকি রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী। আর এখন দেখ পাড়াতে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের স্বরূপ প্রকাশ পেল তো! পাড়ার লোকেরাই তো বলল, মেয়ে নাকি পাড়ার গুণ্ডা! মেয়ের নাম মুনিয়া হলে কি হবে পাড়ার লোকে তাকে নাকি মুন্না ভাই বলে ডাকে!
    মাগো মা শেষে কিনা ঘটকটা আমাদের এমন করে ঠকাল!

    মেয়ে দেখতে এসে এমনই হা-হুতাশ করছিলেন কাঞ্চনের মা সুরমা দেবী। কাঞ্চনের বাবা পরেশ বাবু বললেন, আঃ, বারবার ঠকিয়েছে ঠকিয়েছে বলছো কেন বল দেখি! মেয়ের গুনের কথা শুনেই তুমি ভিরমী খেয়ে চলে এলে। আর একটু অপেক্ষা করলে মেয়ের রূপটাও দেখতে পেতাম। তখন বোঝা যেত ঘটক কতটা সত্যি বলেছে!

    -একদম ফালতু কথা বলবে না। ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুরমা দেবী তোমার তো সখ কম নয়! আবার রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলছো? বলি যদি ডানা কাটা পরীও হয় তবু কি ছেলের সাথে এমন মেয়ের বিয়ে দেব? রাত আটটা বাজে তবু মেয়ে বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেছে? না পড়ার কোন মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা পণ না দেওয়ার জন্য ছেলে ফেরত নিয়ে যাবে বলছে সেখানে! আবার তো শুনে এলাম সেখানে গণ্ডগোল করে কার নাক এক ঘুঁষিতে ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা রে বাবা আর থাকি ঐ বাড়ি! কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছি ।

    কাঞ্চন এতক্ষন চুপচাপই ছিল। বেচারার মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। একে তো রোগা পাতলা ভীতু ভীতু চেহারার জন্য কোন মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয় না। যদিবা অনেক দিন পর একটা মেয়ের বাড়ি থেকে আগ্রহ দেখাল তাও মায়ের জন্য সেটাও মাটি হল! মেয়ে মারকুটে শুনেই চলে এল। তারপর আবার এসব কথা বলেই চলেছে। এখন আর সহ্য করতে না পেরে সে বলল, একদম ক্যানসেল না করে একটা বার কথা বল্লে দোষ কি হতো!

    সুরমা দেবী চোখ পাকিয়ে বললেন, বাবু একদম চুপ কর বলছি। আর যেন এসব কথা না শুনি।
    ব্যাস, মায়ের ভয়ে বাবু কাবু। এমন স্বভাবের জন্যই পাড়ার লোকে তাকে কাঞ্চন নয় কেঁচো বলে ডাকে।

    এসব তর্ক বিতর্ক করতে করতেই পাত্রী দেখতে আসা পাত্রপক্ষের তিনজন চলছিল শুনশান রাস্তা দিয়ে। কিন্ত কপাল তাদের মন্দ ছিল সেদিন, তাই তো এই পাড়ার উঠতি মাস্তান বাচ্চু আর তার দলবলের সামনে পড়তে হল। সরমা দেবীর গয়না, পরেশ বাবুর ঘড়ি, মানিব্যাগ হস্তগত করে বাচ্চু এগোলো কাঞ্চনের দিকে । হাতের ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে টান মারল ফোনটা। অফিসের দরকারি ইনফরমেশন থাকা ফোনটা কাঞ্চন ছাড়তে একটু ইতস্তত করতেই বাচ্চুর মেজাজ গেল চটে। কাঞ্চনকে সোজা চেপে ধরল সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টে। গলায় শান দেওয়া ছুরি তাক করে কিছু হুমকি দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।
    একটা বিরাশি সিক্কার ঘুঁষি এসে পড়ল বাচ্চুর গালে । ঠিক হিরো থুরি হিরোইন টাইপের এন্ট্রি দিল আমাদের মুনিয়া ওরফে মুন্না ভাই। কলার চেপে বলল, আবার আমার পাড়ায় মাস্তান গিরি করছিস! আর যদি দেখি না মেরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব। বাচ্চু তখন অবশ্য এসব শোনার অবস্থায় নেই। ঘুঁষির চোটে সদ্য উপড়ে আসা দাঁত দুটি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষনে পগারপার। কেঁচো তখনও ল্যাম্পপোষ্টে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুন্না বাচ্চুর কবল থেকে সব জিনিস উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিল। তারপর কেঁচোকে বলল, উঠুন উঠুন এরকম ভয় পেলে চলবে? ভয়কে তো জয় করতে হবে! তবে না জীবনের মজা পাবেন।
    মুন্নার কথায় কেঁচো চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। বুকটা কেমন যেন একটা চিনচিন করে উঠল। এই প্রথম কেউ তার ভয় পাওয়া নিয়ে উপহাস না করে সাহস দিল। বুকের ব্যাথাটা অন্তরে গেঁথে যেতে যেতে কাঞ্চনের কানে এল তার মায়ের মধুর গলা।

    দেখ দেখি বাবা থুরি মা ! আমি তো আমার ছেলেকে এটাই বোঝাতে পারি না ভয় পেলে কি সবসময় চলে! আজ তুমি ভাগ্যিস ছিলে তাই আমরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। দেখে ভাল লাগল মা তুমি মেয়ে হয়েও কত্ত সাহসী।

    -কেন মাসিমা, মেয়েরা সাহসী হলেই অবাক হতে হয়! আগে কখনও সাহসী মেয়ে দেখেননি? কালী দুর্গা এরাও তো মেয়ে। তারা যদি অসুর মারতে পারে আমি কটা পাড়ার মাস্তান পেটাতে পারব না?

    পরেশ বাবু বললেন, ঠিকই তো । তা মা তোমার বাড়ি বুঝি এপাড়াতেই?

    মুনিয়া তার বাড়ির যা ঠিকানা দিল তাতে কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তারা এই মেয়েকেই দেখতে গিয়েছিল। সুরমা দেবী তখন আবেগে গদগদ। বললেন, আমি ঠিক জানতাম আমার গোপাল আমায় কিছুতেই ভুল মেয়ের বাড়ি পাঠাতেই পারে না!
    মুন্নাও বুঝে গেছে এই হল সেই লোকগুলোই যাদের কথা তার বাবা মা বলছিল, যারা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার নামে খানিক অকথা কুকথা বলে এসেছে। রাগে তার মাথাটা গেল গরম হয়ে। দাঁত কিরমির করতে করতে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই কেলেঙ্কারি।
    সুরমা দেবী এমন মেয়ে বৌমা হবে ভেবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে ব্যাগে রাখা গোপালকে ব্যাগ সমেত মাথায় ঠেকিয়ে নীচে নামানোর সময় সোজা নামালেন মুন্নার মাথায়। এমন বড়সড় পিতলের গোপালের বারি খেয়ে মুন্না লুটিয়ে পড়ল কেঁচোর কোলে।

    মুন্না চোখ খুলে দেখল বাবা মা সবাই চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ভীতু ভীতু মুখ যার দুচোখ জুড়ে এখন চিন্তার ছায়া। কেঁচোর চিন্তিত চোখ দুটো দেখে মুন্নার বুকটা কেঁপে উঠল। তাকে সবাই সাহসী শক্তপোক্ত বলেই জানে কিন্ত তারও যে কারও চিন্তার কারণ হতে ইচ্ছা করে তা কেউ ভাবেইনি । কেঁচো আর মুন্নার উভয়েরই ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা বেড়ে চলেছে একে অপরের জন্য।
    মুন্নাকে চোখ খুলতে দেখেই সোফাতে বসা সরমা দেবী কালী ঠাকুর হয়ে গেছেন। এক হাত জিভ বার করে বললেন, দেখ দেখি মা বড় ভুল করে ফেললাম। তোমাকে আঘাত করার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার ছিল না। তবু কি করে জানি হয়ে গেল। আসলে বুঝতে পারিনি আমার গোপাল তোমায় আশীর্বাদ করতে উপর থেকে ঝাঁপ দেবেন।
    মুন্না একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
    ঠিক আছে মাসিমা কোন ব্যাপার নয় এরম একটু আধটু চোটে মুনিয়ার কিছু হয় না।

    সরমা দেবী বললেন, এখন আর মাসিমা শুনবো না এবার থেকে মা বলতে হবে।
    মায়ের কথায় তো কেঁচোর বুক উথালপাথাল।
    মুন্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনটাও যে ততক্ষনে বাঁধা পড়েছে ঐ ভীতু কেঁচোটার কাছে।
    মুন্নার বাবা মা একটু ইতস্তত করছে। যারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ কথা বলে গেল তারাই কিনা বিয়ে পাকা করতে চাইছে! তাদের মনের অবস্থা বুঝে পরেশ বাবু বললেন, আসলে আমাদের ধারনা ছিল ঘরের বৌ লক্ষ্মীই হয় কিন্ত আপনাদের মেয়ে সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে । ঘরের বৌ যেমন লক্ষ্মী হয় তেমন কালী, দূর্গাও হয়।

    ব্যাস আর কি মধুরেনো সমাপতে চার হাত চার চোখ এক হল। সরমা দেবীদের বৌমা সংজ্ঞার ট্যাবু ভাঙল। বাচ্চু দলবল নিয়ে মুন্নার বিয়েতে খেটে দেওয়ার সাথে সাথে ভাঙা দাঁতেই নেমতন্নও খেল। কেঁচোর মুন্না আর মুন্নার কেঁচো হল।

    ঘটক আমাদের পুরো ঠকিয়েছে। মুখে বল্লে মেয়ে নাকি রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী । আর এখন দেখ পাড়াতে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের স্বরূপ প্রকাশ পেল তো ! পাড়ার লোকেরাই তো বলল , মেয়ে নাকি পাড়ার গুণ্ডা! মেয়ের নাম মুনিয়া হলে কি হবে পাড়ার লোকে তাকে নাকি মুন্না ভাই বলে ডাকে !
    মাগো মা শেষে কিনা ঘটকটা আমাদের এমন করে ঠকাল !

    মেয়ে দেখতে এসে এমনই হাহুতাস করছিলেন কাঞ্চনের মা সুরমা দেবী । কাঞ্চনের বাবা পরেশ বাবু বললেন,
    আঃ , বারবার ঠকিয়েছে ঠকিয়েছে বলছো কেন বল দেখি ! মেয়ের গুনের কথা শুনেই তুমি ভিরমী খেয়ে চলে এলে । আর একটু অপেক্ষা করলে মেয়ের রূপটাও দেখতে পেতাম। তখন বোঝা যেত ঘটক কতটা সত্যি বলেছে !

    একদম ফালতু কথা বলবে না ।
    ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুরমা দেবী তোমার তো সখ কম নয়! আবার রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলছো ? বলি যদি ডানা কাটা পরীও হয় তবু কি ছেলের সাথে এমন মেয়ের বিয়ে দেবো ? রাত আটটা বাজে তবু মেয়ে বাড়ি ফেরে নি । কোথায় গেছে , না পড়ার কোন মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা পণ না দেওয়ার জন্য ছেলে ফেরত নিয়ে যাবে বলছে সেখানে ! আবার তো শুনে এলাম সেখানে গণ্ডগোল করে কার নাক এক ঘুঁষিতে ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা রে বাবা আর থাকি ঐ বাড়ি! কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছি ।

    কাঞ্চন এতক্ষন চুপচাপই ছিল। বেচারার মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। একে তো রোগা পাতলা ভীতু ভীতু চেহারার জন্য কোন মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয় না । যদিবা অনেক দিন পর একটা মেয়ের বাড়ি থেকে আগ্রহ দেখাল তাও মায়ের জন্য সেটাও মাটি হল ! মেয়ে মারকুটে শুনেই চলে এল । তারপর আবার এসব কথা বলেই চলেছে। এখন আর সহ্য করতে না পেরে সে বলল ,

    একদম ক্যানসেল না করে একটা বার কথা বল্লে দোষ কি হতো !

    সুরমা দেবী চোখ পাকিয়ে বল্লেন,

    বাবু একদম চুপ কর বলছি । আর যেন এসব কথা না শুনি ।

    ব্যাস , মায়ের ভয়ে বাবু কাবু । এমন স্বভাবের জন্যই পাড়ার লোকে তাকে কাঞ্চন নয় কেঁচো বলে ডাকে ।

    এসব তর্ক বিতর্ক করতে করতেই পাত্রী দেখতে আসা পাত্র পক্ষের তিনজন চলছিল শুনশান রাস্তা দিয়ে। কিন্ত কপাল তাদের মন্দ ছিল সেদিন , তাই তো এই পাড়ার উঠতি মাস্তান বাচ্চু আর তার দলবলের সামনে পড়তে হল । সরমা দেবীর গয়না পরেশ বাবুর ঘড়ি মানিব্যাগ হস্তগত করে বাচ্চু এগোলো কাঞ্চনের দিকে । হাতের ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে টান মারল ফোনটা। অফিসের দরকারি ইনফরমেশন থাকা ফোনটা কাঞ্চন ছাড়তে একটু ইতস্তত করতেই বাচ্চুর মেজাজ গেল চটে । কাঞ্চন কে সোজা চেপে ধরল সামনে থাকা ল্যাম্পপোস্টে গলায় শান দেওয়া ছুরি তাক করে কিছু হুমকি দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা ।

    একটা বিরাশি সিক্কার ঘুঁষি এসে পড়ল বাচ্চুর গালে । ঠিক হিরো থুরি হিরোইন টাইপের এন্ট্রি দিল আমাদের মুনিয়া ওরফে মুন্না ভাই। কলার চেপে বল্ল ,
    আবার আমার পাড়ায় মাস্তান গিরি করছিস! আর যদি দেখি না মেরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব । বাচ্চু তখন অবশ্য এসব শোনার অবস্থায় নেই। ঘুঁষির চোটে সদ্য উপড়ে আসা দাঁত দুটি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষনে পগারপার। কেঁচো তখনও ল্যাম্পপোষ্টে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুন্না বাচ্চুর কবল থেকে সব জিনিস উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিল । তারপর কেঁচোকে বলল ,
    উঠুন উঠুন এরকম ভয় পেলে চলবে ? ভয়কে তো জয় করতে হবে ! তবে না জীবনের মজা পাবেন।
    মুন্নার কথায় কেঁচো চোখ তুলে তাকাল তার দিকে । বুকটা কেমন যেন একটা চিনচিন করে উঠল । এই প্রথম কেউ তার ভয় পাওয়া নিয়ে উপহাস না করে সাহস দিল । বুকের ব্যাথাটা অন্তরে গেঁথে যেতে যেতে কাঞ্চনের কানে এল তার মায়ের মধুর গলা ।

    দেখ দেখি বাবা থুরি মা ! আমি তো আমার ছেলে কে এটাই বোঝাতে পারি না ভয় পেলে কি সবসময় চলে ! আজ তুমি ভাগ্যিস ছিলে তাই আমরা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম । দেখে ভাল লাগল মা তুমি মেয়ে হয়েও কত্ত সাহসী ।

    কেন মাসিমা , মেয়েরা সাহসী হলেই অবাক হতে হয়! আগে কখনও সাহসী মেয়ে দেখেন নি ? কালী দুর্গা এরাও তো মেয়ে। তারা যদি অসুর মারতে পারে আমি কটা পাড়ার মাস্তান পেটাতে পারব না ?

    পরেশ বাবু বললেন,
    ঠিকই তো । তা মা তোমার বাড়ি বুঝি এপাড়াতেই ?

    মুনিয়া তার বাড়ির যা ঠিকানা দিল তাতে কারও বুঝতে বাকি রইল না যে তারা এই মেয়েকেই দেখতে গিয়েছিল । সুরমা দেবী তখন আবেগে গদগদ। বল্লেন,
    আমি ঠিক জানতাম আমার গোপাল আমায় কিছুতেই ভুল মেয়ের বাড়ি পাঠাতেই পারে না !
    মুন্নাও বুঝে গেছে এই হল সেই লোক গুলোই যাদের কথা তার বাবা মা বলছিল, যারা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার নামে খানিক অকথা কুকথা বলে এসেছে। রাগে তার মাথাটা গেল গরম হয়ে। দাঁত কিরমির করতে করতে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই কেলেঙ্কারি ।
    সুরমা দেবী এমন মেয়ে বৌমা হবে ভেবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে ব্যাগে রাখা গোপাল কে ব্যাগ সমেত মাথায় ঠেকিয়ে নীচে নামানোর সময় সোজা নামালেন মুন্নার মাথায়। এমন বড়সড় পিতলের গোপালের বারি খেয়ে মুন্না লুটিয়ে পড়ল কেঁচোর কোলে ।

    মুন্না চোখ খুলে দেখল বাবা মা সবাই চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা ভীতু ভীতু মুখ যার দুচোখ জুরে এখন চিন্তার ছায়া । কেঁচোর চিন্তিত চোখ দুটো দেখে মুন্নার বুকটা কেঁপে উঠল। তাকে সবাই সাহসী শক্তপোক্ত বলেই জানে কিন্ত তারও যে কারও চিন্তার কারণ হতে ইচ্ছা করে তা কেউ ভাবেই নি । কেঁচো আর মুন্নার উভয়েরই ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা বেড়ে চলেছে একে অপরের জন্য।
    মুন্নাকে চোখ খুলতে দেখেই সোফাতে বসা সরমা দেবী কালী ঠাকুর হয়ে গেছেন। এক হাত জিভ বার করে বললেন ,
    দেখ দেখি মা বড় ভুল করে ফেললাম। তোমাকে আঘাত করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার ছিল না । তবু কি করে জানি হয়ে গেল। আসলে বুঝতে পারি নি আমার গোপাল তোমায় আশীর্বাদ করতে উপর থেকে ঝাঁপ দেবেন ।
    মুন্না একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
    ঠিক আছে মাসিমা কোন ব্যাপার নয় এরম একটু আধটু চোটে মুনিয়ার কিছু হয় না ।

    সরমা দেবী বললেন,
    এখন আর মাসিমা শুনবো না এবার থেকে মা বলতে হবে ।
    মায়ের কথায় তো কেঁচোর বুক উথালপাথাল।
    মুন্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনটাও যে ততক্ষনে বাঁধা পড়েছে ঐ ভীতু কেঁচোটার কাছে ।
    মুন্নার বাবা মা একটু ইতস্তত করছে । যারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের মেয়ের সম্পর্কে এত খারাপ কথা বলে গেল তারাই কিনা বিয়ে পাকা করতে চাইছে ! তাদের মনের অবস্থা বুঝে পরেশ বাবু বললেন,
    আসলে আমাদের ধারনা ছিল ঘরের বৌ লক্ষ্মীই হয় কিন্ত আপনাদের মেয়ে সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে । ঘরের বৌ যেমন লক্ষ্মী হয় তেমন কালী , দূর্গাও হয়।

    ব্যাস আর কি মধুরেনো সমাপতে । চার হাত চার চোখ এক হল । সরমা দেবীদের বৌমা সঙ্গার ট্যাবু ভাঙল। বাচ্চু দলবল নিয়ে মুন্নার বিয়েতে খেটে দেওয়ার সাথে সাথে ভাঙা দাঁতেই নেমতন্নও খেল। কেঁচোর মুন্না আর মুন্নার কেঁচো হল ।।

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২৩)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [পঁয়তাল্লিশ]
    পঞ্চায়েত প্রধান সনাতনের বাড়ি আসার অধিকার এখন এই অঞ্চলের সকলের। যে কেউ প্রয়োজনে তার কাছে আসতে পারে। আসেও। তাতে কারোর মনে প্রশ্ন থাকার কথা না যে, সেই ব্যক্তি কেন, কি উদ্দেশ্যে সনাতনদের বাড়ি এসেছে। সেই কথা মাথায় রেখে সেদিন ভোর-ভোর বিপ্লবের মা সীতাদেবী এসে হাজির সনাতনদের বাড়ি। ভোরে আসার কারণ, যাতে সনাতনকে একা পাওয়া যায়। সনাতন তখন বাথরুম সেরে দাঁতে ব্রাশ করছে। এত ভোরে বিপ্লবদার মাকে দেখে চমক খায় সনাতন। তাড়াতাড়ি করে মুখ ধুয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,“কি খবর কাকিমা? হঠাৎ এত সকালে? বিপ্লবদার কোন খবর আছে?” ততক্ষণে সীতাদেবীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তার খবর নিতেই তো তোমার কাছে এলাম বাবা। কতদিন হয়ে গেল ছেলেটা বাড়ি ছাড়া। বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে। অভিমানে ছেলে সেই যে বাড়ির সদরের বাইরে পা রাখল আর এ’মুখো হল না। আমি মা হয়ে কেমন করে তা মেনে নিই বল বাবা? রাতে ঘুম আসে না। স্বপ্নে দেখি ছেলেটাকে আর চমকে উঠি। বাপের মন ভাঙে তো বচন নড়ে না। বেজাতের মেয়েকে সে ঘরে তুলবে না। আর তোমার বিপ্লবদাকে তো তুমি চেনো। সেও তার কথা থেকে সরবে না। বাপ বেটার এই জেদাজেদির মধ্যে পড়ে আমার তো প্রাণ উবে যায়-যায়। এমনিতে কারবারে মন্দা যাচ্ছে। আর ছেলেটা বাড়ি ছাড়ার পর কাজকর্ম সব লাটে উঠেছে। তোমার কাছে ওর কোন খবর নেই, না বাবা?”
    -না কাকিমা। আমরাও তো সেই কথাই ভাবছি। বিপ্লবদা ইকনমিক্স নিয়ে এম.এস.সি. পড়ার তোড়জোড় করছিল। আমরা আনন্দ করে বললাম, তুমি এগিয়ে যাও দাদা। তোমাকে দেখে যদি আমরা প্রেরণা পাই। সেসব বন্ধ করে কোথায় গেল কে জানে! তবে আমি হাল ছাড়িনি। খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। হদিশ পেলেই আপনাকে খবর পাঠাব। সনাতন অন্তর থেকে বলল।
    আশেপাশে কেউ আছে কিনা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সীতাদেবী আস্তে করে সনাতনকে বলল, “হ্যাঁরে বাবা, ওই অলোকা মেয়েটার বাড়ির লোক ওর বিয়ের জন্যে দেখাশোনা করছে না?”
    সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তভাবে সনাতন বলল,“কেন বলো তো কাকিমা? সেরকম কিছু তুমি শুনেছো নাকি? বা তোমার হাতে অলোকাদির উপযুক্ত ছেলে আছে নাকি? তাছাড়া অলোকাদির বিয়েথার ব্যাপারটা অলোকাদির হাতেই ছেড়ে দিয়েছে ওদের বাড়ির বড়োরা। অলোকাদির মত বিদ্বান, সুন্দরী, শিক্ষিকার পাত্র দেখার যোগ্যতা ওর বাবা-মায়ের নেই। সেই কথা বলেও দিয়েছে তার বাবা-মা। আর আমি যতটুকু জানি, মানে অলোকাদি এবং বিপ্লবদার মুখ থেকে যতটা জেনেছি, ওরা দু’জনে দু’জনকে প্রচন্ড ভালবাসে। বিয়ে করলে ওরাই হবে ওদের পছন্দের পাত্রপাত্রী। এই জুটি বিপ্লবদার বাবার মতো তোমারও পছন্দ নয়, তাই না কাকিমা? আমার তো মনে হয়, মা হয়ে তোমাকে এটা মেনে নেওয়া উচিত। জাতপাত ছাড়ো না। ওটাকে তো চোখে দেখা যায় না। বিশ্বাসের ব্যাপার। তা, জন্মসূত্রে পাওয়া সেই বিশ্বাস যে যার নিজের মধ্যে থাকুক না। কিন্তু যেটা দৃশ্যত সত্যি সেটা হল বিপ্লবদা তোমাদের একমাত্র সন্তান। জাতের নিজস্ব কোনো চেহারা নেই। কিন্তু এই জাতের দোহাই দিয়ে নিজেদের মুর্খামি অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে না তো কাকিমা! বিপ্লবদা উচ্চশিক্ষিত একটা ছেলে। তার শিক্ষাদীক্ষার ধারে কাছে তোমরা কেন তোমাদের পাড়ার কেউ আজ পর্যন্ত যেতে পারেনি। তার জ্ঞানগম্মির সঙ্গে তোমাদের ওদিকের কারোর তুলনা চলে না। তাহলে কোন যোগ্যতায় তোমরা তার উপর অধিকার ফলাতে যাও জানি না। শুধু পিতামাতার অধিকারে এতবড় ভুল সিদ্ধান্ত তোমরা নিয়ে নিলে কাকিমা? তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে? এটা কেমন কাজ হল তোমাদের কাকিমা! কাকিমা, আমি জানি আমার শক্ত শক্ত কথাগুলো তোমার ভালো লাগছে না। তাই উশখুশ করছো কতক্ষণে তুমি এখান থেকে চলে যাবে। যাবে তো বটেই। তবে একবার ভেবে দেখো কাকিমা, আমি কি বলতে চাইলাম।”
    সনাতনের মাস্টারির হাতযশে এবার মাধ্যমিকে অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুব ভাল ফল করে সুন্দরীও। ওদের বাড়ি তো দারুণ খুশি। আনন্দে আপ্লুত হয়ে সুন্দরীর মা মিষ্টিমুখ করাতে সনাতনদের বাড়ি এসেছে। সুন্দরীও মায়ের আঁচল ধরে এসে হাজির। ওকে দেখে সনাতনের মা বলল,“তোর মাকে একটু চা করে খাওয়া তো মা? আমাদের জন্যেও বেশি করে জল বসিয়ে দিস। তোর স্যার ঘাটে গেছে। এক্ষুণি এসে যাবে।” সুন্দরী চা করতে গেলে সনাতনের মা বলে, “তোমার মেয়েটা বড়ই মিষ্টি স্বভাবের দিদি। কোনো কথায় ‘রা’ কাটে না। যা কাজ বলবো মুখ বুজে সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেবে সেটা করার জন্যে। ওটাকে আমার ঘরে রেখে দেব। বলে রাখছি তোমায় দিদি।”
    সনাতনের মায়ের কথায় সুন্দরীর মা বলে,“ছেলের মন আবার কি বলে তা তো জানা দরকার। তোমার শিক্ষিত ছেলে। সেইসঙ্গে আমাদের পঞ্চায়েতের প্রধান। কত দামি ছেলে তোমার। তার কাছে আমার সুন্দরী তো কত সাধারণ। পরে যদি সে বেঁকে বসে তো আমরা বিপদে পড়ে যাব। তাই না দিদি।”
    -তুমি অত বোকা কেন দিদি? এটুকুও বোঝো না। আজকাল কত ভালমন্দ, নামী-অনামী লোক প্রধানের বাড়িতে আসে। লোকজন একটু বেশি হলেই ছেলে আমাকে বলবে, সুন্দরীকে ডেকে আনো মা। তুমি একা এত কাজ সামলাতে পারবে না। পছন্দ না করলে কথায় কথায় সুন্দরীকে ডাক দেয় কেন ছেলে সেটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। মা হয়ে আমি ছেলের মন খুব ভাল করে বুঝতে পারি।” বলতে বলতে সনাতন ঘাট থেকে এসে দেখে সুন্দরী রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে আসছে। ওকে দেখে সনাতন বলল,“সুন্দরী এসেছিস, ভাল হয়েছে। দাবায় মাদুরটা বিছিয়ে ঘরের টেবিল থেকে লাল ফাইলটা আর পেনটা এনে দে।” আগের কথার রেশ ধরে সনাতনের মা বলল, “দেখলে তো সুন্দরীর মা, ছেলে কতটা তোমার মেয়েকে ভরসা করে। আমাদের বাড়ির কোথায় কি আছে সব তোমার মেয়ের মুখস্থ। আমি মুখ্যু মানুষ। কাগজপত্রর কিছু বুঝি নাকি! তাই সুন্দরীকে পেলে ছেলে আমার খুব খুশি। দেখছো তো নিজের চোখে। এর পর কি বলবে, ছেলের অপছন্দ তোমার মেয়েকে? ওসব ভাবনা ছাড়ো। সুন্দরীকে আমার জন্যেই রেখে দাও। পারলে এখন থেকেই থাকুক আমার কাছে। আমার তাহলে আর মেয়েকে ডাকতে তোমার বাড়ি বারবার ছুটতে হয় না। সময় মত চার হাত এক করে দেবো’খন। খুশির দমকে হাসতে হাসতে বলল সনাতনের মা।
    সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে আটচালার ভেতরটা সাজগোছ করা। তিনজন বসার মত ছোট্ট একটা স্টেজও করা হয়েছে তার মধ্যে। সাজানো হচ্ছে কাগজের রংবেরঙের ফুল দিয়ে। সনাতন আর অখিল দু’জনে মিলে সবকিছুর তদারকি করছে। পাড়ার সব বাড়ি বাড়ি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আজ আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করা মেয়ে, অলোকাকে সম্মানিত করা হবে। বাইরের কিছু
    গুনী মানুষ আসবেন এই উপলক্ষ্যে। অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্যে সকলের উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আগে থেকে অলোকাদির সঙ্গে কথা বলে আজকের দিনটাই স্থির হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে গোটা রুইদাসপাড়ায় একটা খুশি খুশি ভাব। বিশেষ করে উঠতি ছেলেমেয়েরা, যারা লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত। তাদের মনে তো খুশির অন্ত নেই। পাশাপাশি আবার প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মত আর একটা দল সনাতন-অলোকাদের কাজের বিরোধিতার অস্ত্রে শান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাড়ি বাড়ি অনুষ্ঠানের কথা জানানোর সময় ওই দলের অন্যতম স্যাঙাৎ বরেণ অনুষ্ঠানে তাদের ভূমিকার কথা সনাতন-অখিলকে জানিয়ে দিতে বলে, “তোমরা যাকে নিয়ে মাতামাতি করছো, সেই অলোকা রুইদাসের বিরুদ্ধে আমাদের গুরুতর অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগ জানানোর সুযোগ না দিলে আমরা কিন্তু বাইরের অতিথিদের সামনে গণ্ডগোল শুরু করে দেব। তখন তোমরা আমাদের দোষ দিতে পারবে না। আগে থেকে সেকথা জানিয়ে দিচ্ছি আমরা।” সেইসময় জড়ো হয়ে গেল ওই দলের নোচে, বিন্দে, কেলে, অভয়রাও। তারাও বরেণের কথাতে সায় দিয়ে হম্বিতম্বি করতে শুরু করে। সনাতন দেখল এদের এই মুহূর্তে থামাতে না পারলে এরা আরও মাথায় চড়ে বসবে। কড়া গলায় সনাতন বলল, “অলোকাদির সম্মান অনুষ্ঠানে কাউকে কিচ্ছু বলার অনুমতি দেওয়া হবে না। বাইরের গণ্যমান্য মানুষের সামনে কেউ যদি হুল্লোড় পাকাবার কথা ভাবে, তাহলে তারা ভুল করবে। তাদের মনে রাখা উচিৎ আয়োজকদেরও লোকজন আছে। তাদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখলে পরিণতি ভাল হবে না বলে দিলাম। তখন হুল্লোড়বাজরা কত ধানে কত চাল বুঝতে পারবে। মূল অনুষ্ঠান শেষ হবার পর অতিথিজনেরা চলে গেলে আটচালার সভা বসানো যেতে পারে। তখন তোরা তোদের কথা বলার সুযোগ পাবি। পাড়ার সব্বাইকে তখন থাকতে বলা হবে।” সনাতন বলার পর রাগে গরগর করতে করতে অখিল বলল, “ভাই সনাতন, তুই শুধু আমাকে মুখ ফুটে বলবি, কি করতে হবে। তারপর আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝে নেব। এদের দৌড় কতটা তা আমার খুব ভাল করে জানা আছে। কেষ্টার চুল্লুর ঠেক পর্যন্ত তো এদের দৌড়। সে আমি দেখে নেবখন।
    বরেণ-অভয়রা বুঝতে পারেনি সনাতন-অখিলরা এইভাবে তাদের ধমক দিতে পারে। ওরা থতমত খেয়ে যায় অখিলদের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়। থমকে গিয়ে অভয় বলে, “ঠিক আছে, পরে যখন আটচালা বসবে তখন আমাদের কিছু বলার নেই। বাইরের লোকের সামনে আমরা কিছু করতে যাব না। তাতে আমাদের পাড়াকে লোকে ভুল বুঝবে। সেইসঙ্গে আমাদেরকেও ওরা খারাপ চোখে দেখবে। পাড়ার বদনাম আমরা করতে চাই না।”
    কয়েকটা গ্রামের বিশিষ্ট অতিথিদের উপস্থিতিতে অমর স্যার অলোকার হাতে ফুলের তোড়ার সাথে সাথে একটা সুন্দর সাদা পাথরের সরস্বতীর মূর্তি দিয়ে সম্মান জানালেন। অমর স্যার তাঁর বক্তৃতায় বললেন,“আমাদের সমাজের প্রান্তস্তর থেকে অলোকার মত মেয়ে তার নিজের যোগ্যতায় এই জায়গায় উঠে আসা সত্যিই নজিরবিহীন এক ঘটনা। অলোকার এই সাফল্য সমাজের পিছিয়েপড়া এবং পড়াশোনায় বীতস্পৃহ ছেলেমেয়েদের প্রেরণা দেবে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে। আমার ছাত্রী হিসেবে নিজে গর্ব বোধ করছি। আপনাদেরও গর্ব আপনাদের ঘরের মেয়ে দেখিয়ে দিল কোন বাধাই এগিয়ে যাবার পথে অন্তরায় হতে পারে না যদি নিজের মধ্যে জেদ, সাহস এবং লক্ষ্য স্থির রেখে চলতে পারা যায়। বিশেষ করে অলোকাদের মত মেয়েরা। সবশেষে আমি অলোকাকে আশীর্বাদ করছি জীবনপথে ও আরও এগিয়ে যাক। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আপনাদের- ঘরের কোণে এই মেয়েটাকে আটকে না রেখে পড়ার সুযোগ করিয়ে দেবার জন্যে।” অমর স্যারের সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ হতেই সভায় হাততালির ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। এত মানুষ তার সাফল্যকে স্বাগত জানাচ্ছে দেখে অলোকা আপ্লুত হয়ে গেল। এক ভালোলাগার অভিঘাতে তার পা যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। সেইসঙ্গে চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে সামলে নেবার জন্যে।
    এবার সঞ্চালক, সনাতন রুইদাস আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, তাদের ঘরের সন্তান অলোকা রুইদাসকে নিজের অনুভূতির কথা বলার জন্যে অনুরোধ করলো। কিন্তু অলোকা এত মানুষের সামনে কিছু বলতে চাইছিল না। আসলে বলার অভ্যেস না থাকার জন্যে, কি বলবে বুঝতে না পারার কারণে এমন অনিহা জন্মায়। মনে মনে বলার চেষ্টা করে কিন্তু কথা যেন সব হারিয়ে যায়। কি কথা বলবে, গলায় এসে দলা পাকিয়ে সব আটকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে তার। তবু সকলের অনুরোধে বিশেষ করে তার অমর স্যারের অনুরোধে অলোকা বলতে উঠে শুধু এইটুকু বলতে পারল,“আমার এই সাফল্য আমি আমাদের রুইদাস সমাজকে উৎসর্গ করলাম। সেইসঙ্গে একটাই আমার চাওয়া- আমাদের সমাজ যেন আধুনিক ধ্যানধারণার প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করার ভাবনাকে সমর্থন জানায়। মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। তাহলে পিছিয়ে পড়ে থাকা এই সমাজ আর-সকল সমাজের সঙ্গে সমকক্ষ হতে দেরি হবে না। প্রতিভা তাদের জাতের মেয়েদের অন্যদের থেকে কম নয়। সেই প্রতিভাকে উন্মোচন করতে গেলে চাই সমাজ-ধারকদের মুক্ত ভাবনাচিন্তা। তাদের সমাজে যার ঘাটতি লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রকট। সবশেষে বলি, ব্যক্তির ভাল হলে সমাজেরও ভাল হবে। ব্যক্তি-সমাজ একে অপরের পরিপুরক। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ সম্পূর্ণ নয়।” অলোকাদির বলার শেষে অমর স্যারের মত হাততালির ঝড় উঠল না। বোঝা গেল অলোকার বক্তব্যে রুইদাস সমাজের দিক থেকে স্বতস্ফুর্ত হাততালি এল না। আসার কথা তো অলোকাদি বলেনি। ও যে তাদের সমাজকে সবক শেখার পরামর্শ দিয়েছে। তাই গোঁড়া আর নিন্দুকদের পছন্দ হবার কথা নয় যে। এরা এখনো তাদের জাতিগত সংস্কারকে শিখন্ডী রেখে সেই মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন পদক্ষেপকে জিইয়ে রাখতে চায়। সমাজের উপর নিজেদের প্রতিপত্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সেটা সনাতন-অখিলরা খুব ভাল করে বোঝে। ওদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হল না যে এর পরবর্তী পর্যায়ে আটচালার যে মিটিংটার দাবি করেছে বরেণ-অভয়রা সেখানে এই বক্তৃতার বিরুদ্ধ প্রভাব আছড়ে পড়তে বাধ্য। মনে হল শুধু বরেণ-অভয়দের দল নয়, অন্যরাও, বিশেষ করে আটচালার কমিটির ওই স্বঘোষিত সমাজ ধারক-বাহকরাও এই বক্তৃতাকে ভাল মনে নিতে পারেনি।
    অলোকা রুইদাসের বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে এই সারস্বত সভার সমাপ্তি ঘোষণা করে সনাতন। সম্মানীয় অতিথি এবং বিভিন্ন গ্রাম ও বাইরের পাড়ার বিশিষ্ট অতিথিরা ধীরে ধীরে সভা ত্যাগ করা শুরু করে। সেই অবসরে সনাতন তার বাবা, আটচালা কমিটির অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য রতনকে বাড়ি চলে যেতে বলে, “বাবা, এবার তুমি বাড়ি চলে যাও। এখন আটচালার যে মিটিংটা হবে তা অত্যন্ত উত্তেজনা প্রবণ হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা। ডাক্তারবাবু তোমাকে কোনোরকম উত্তেজনা বা গণ্ডোগোলের মধ্যে থাকতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। হার্টের রোগির পক্ষে এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই তুমি বাড়ি যাও। পাড়ার একটা দল এই মিটিংয়ে গণ্ডোগোল পাকাবার জন্যে অনেক আগে থেকে সলতে পাকাচ্ছে। সে খবর আমাদের কানে এসেছে।” ছেলের কথায় রতন আর ‘রা’ না কেটে নিজের আসন ছেড়ে উঠতেই নন্দ, দিবাকর, সুবোধকাকা সহ অন্যান্য বয়স্ক সদস্যরা হইহই করে ওঠে ! সুবোধকাকা বলে,“তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছ নাকি, রতন? আটচালার এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটায় তুমি থাকবে না?” সঙ্গে সঙ্গে রতন কিছু বলতে যাবার আগেই সনাতন বলল, “বাবার ওষুধ খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে। হার্টের রোগির ঠিক ঠিক সময় ওষুধ খাওয়া জরুরী। সেইজন্যে আমি বাবাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছি। তাছাড়া বাবা যায় যাক-না। তোমরা, মুরুব্বি মানুষরা তো আছো। আমরাও আছি। বাবা না থাকলে কোন অসুবিধা হবে না। বাবা ছাড়া সভা খুব ভালভাবেই চলবে।”
    রতন চলে যেতে তার জুটি নন্দকাকা যেন মনমরা হয়ে চুপচাপ হয়ে গেল। সনাতন তা দেখে বলল,“নন্দকাকা, বাবা চলে গেছে তা কি হয়েছে। তোমরা তো আছো। কারোর জন্যে কারোর দিন থেমে থাকে না। সভা শুরু করে দাও।” বলতেই সুবোধকাকা বলল,“আজকের এই জরুরী সভা কে বা কারা তলব করেছো? তারা এখন বলুক, তাদের আর্জিটা কি ?”
    সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে থেকে অভয় রুইদাস উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “একটু আগে যাকে নিয়ে হইচই হল। যার নামে গুনগান গেয়ে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তোলা হল, সেই গুণময়ী মহিলা, অলোকা রুইদাসের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী আজ সকলের সামনে আমি আবেদনকারী দলের পক্ষ থেকে তুলে ধরতে চাই। রুইদাস পাড়ার যে মেয়ে লেখাপড়ার ছুঁতো করে, পড়া জানার নাম করে ভিন জাতের ভিন পাড়ার ছেলের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায়, রুইদাস হয়ে আমরা তা মেনে নিতে পারি না। এই আটচালা বহু আগে থেকে এই কাজ না করার কঠোর বিধান দিয়ে রেখেছে। তা সত্ত্বেও এই অসতী, চরিত্রহীন মেয়ে আটচালার বিধানকে তোয়াক্কা না করে সমানে লেখাপড়ার অজুহাত সামনে রেখে বেজাতের ফালতু একটা ছেলের সঙ্গে দিনদুপুরে নারীসম্মান মাটির মধ্যে লুটিয়ে দিয়ে চারদিকে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এর আগেও একবার আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করেছিলাম। কিন্তু পাল পাড়া আমাদের কথা তখন বিশ্বাস না করে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে সেদিনের সেই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে, সেই পালপাড়া আজ আমাদের অভিযোগ মানতে বাধ্য হয়েছে। তারাও এই অসবর্ণ মেলামেশাকে মেনে নেয়নি। তাই বিপ্লব পাল এখন পাড়া ছাড়া। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, তাকে আর পাড়ায় দেখা যাচ্ছে না। লোকে বলে তাকে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা, মেয়ের এই জঘন্য কাজে তার পরিবার পুরোপুরি মদত দিয়ে গেছে। মেয়ের সঙ্গে তার পরিবারও সমদোষে দোষী। আমরাও চাই, অলোকা রুইদাস ও তার পরিবার এই অন্যায় কাজ করার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমা চাক এবং দস্তখত দিক, কোন অবস্থাতেই সে পালপাড়ার ছেলেটার সঙ্গে মেলামেশা করবে না। তাকে বিয়ে করতে হবে পাড়ারই কোন যুবককে। তবেই তাদের সমাজ জাতভ্রষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আর যদি শর্ত না মানে তবে ইতিপূর্বে আটচালার বিধানে সমান অপরাধ করার জন্যে যেমন অপরাধী পরিবারকে পাড়াছাড়া করা হয়েছে, এই পরিবারকেও তাই করা হোক। আটচালার কাছে এটাই আমাদের আবেদন। আশাকরি আমরা সঠিক বিচার পাব।”
    যে স্থান কয়েক মিনিট আগে তাকে সম্মানের এতটা উচ্চ শিখরে তুলে দিল সেই আটচালাই তার চরিত্র নিয়ে এমন নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি করতে পারছে! সে কার সঙ্গে কথা বলবে, কার সাথে মেলামেশা করবে, তা ঠিক করে দেবে পাড়ার এই গুটিকয় অশিক্ষিত মাতাল লম্পট ছেলেরা! সেটা আবার তারিয়ে তারিয়ে শুনছে পাড়ার গণ্যমান্য মুরুব্বি মানুষরা! ওই মাতাল অভয় রুইদাসকে এতগুলো কথা বলতে দিল এইসব গণ্যমান্যরা! এ কেমন সমাজে সে বাস করছে! এদের সমাজে তাহলে শিক্ষাদীক্ষা, আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার কোন জায়গা নেই? শুধুমুধু জাতভ্রষ্ঠের দোহাই দিয়ে একটা সেকেলে চিন্তাকে এইভাবে চাপিয়ে দিতে তারা পারে? এমন অপমান গায়ে মেখে বেঁচে থাকার থেকে তো তার মরে যাওয়াই ভালো। মৃত্যুই তার মুক্তির একমাত্র পথ। নাহলে তার জন্যে তার পরিবারকে শাস্তি পেতে হবে। তাদের পাড়াছাড়া হতে হবে। এইসময় এই বয়সে তারা কোথায় যাবে। প্রজন্মান্তর যে জায়গায় তারা কাটিয়ে আসছে একটা ঠুনকো কারণে তার জন্যে তাদের ভিটেছাড়া হতে হবে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। অলোকা তা হতে দেবে না। এমনসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় অলোকা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাকে নিয়ে সভায় হুটোপুটি পড়ে যায়। আঁজলা করে জল মুখে ছিটিয়ে দিলে ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়। সনাতন তখন অখিলকে বলল,“অখিলদা তুই অসুস্থ অলোকাদিকে বাড়িতে রেখে আয়। এই অবস্থায় ওর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হলে আমরা দায়ী হয়ে যাব।”
    সনাতনের কথামত অখিল তার ছেলেদের নিয়ে অলোকাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার তোড়জোড় শুরু করতেই বিচারকদের অন্যতম মাথা দিবাকর-নিত্যানন্দরা বলল, “মেয়েটা এখন সুস্থ হয়ে গেছে। মূল অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সে না থাকলে বিচার কেমন করে হবে। ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মনে হচ্ছে পরিকল্পনা করে ওকে এখান থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে।”
    এবার অখিল আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “একজন নির্দোষ অসুস্থ মেয়ের প্রতি এমন ব্যবহার নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নয়। এই মেয়েটা কি অন্যায় করেছে? ও একজনকে ভালবেসেছে। তাকে বিয়ে করতে চায়। এতে তার দোষ কোথায়! অলোকা একজন শিক্ষিত স্বাধীনচেতা মেয়ে। তার উপর সে সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। তার জ্ঞানবুদ্ধি, ভাবনাচিন্তার কোন মূল্য নেই! আর ওই মুর্খ মাতালরা বলে কিনা তাদের পাড়ার কাউকে বিয়ে করতে হবে? একটা মেয়ের রোজগারের টাকায় খাবে, মাতলামো করবে আর বিলের মোষ তাড়াবে? সেই খোয়াব দেখা হবু স্বামীটা কে শুনি? জাত রক্ষার ধুয়ো তুলে একটা মেয়েকে অপদস্ত করার কোন অধিকার নেই এই নোংরা ছেলেদের। আর কে আছে সেই উপযুক্ত সুপুরুষ যাকে অলোকার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে? দেখি তো একবার তার বদন খানা। অভয়, তুই তো তিন সন্তানের বাপ। তুই অলোকার পয়সায় বসে বসে খাবি বলে আবার বিয়ে করার দুঃস্বপ্নে মশগুল হয়ে আছিস নাকি!”
    অখিলের যুক্তির কাছে কথা খুঁজে না পেয়ে অভয় আমতা আমতা করে বলল,“আমি কেন বরেণ তো আছে। ও তো এখনো বিয়ে করেনি। স্বজাতির মধ্যে বরেণই অলোকার উপযুক্ত স্বামী হতে পারে বলে আমরা মনে করি।” অভয়ের কথায় তাল দিয়ে দিবাকর বলে, “একদম ঠিক কথা বলেছে অভয়। আমারও তাই মত।” সঙ্গে সঙ্গে অখিল বলে, “দশবার জন্মালেও বরেণ অলোকার উপযুক্ত হতে পারবে না। কি যোগ্যতা আছে ওর। ও স্বজাত। এটাই ওর যোগ্যতা? অলোকা অন্য জাতের ছেলেকে বিয়ে করলে ওর জাত চলে যাবে? কেন যাবে? যেখানেই ওর বিয়ে হোক, অলোকা, অলোকা রুইদাসই থাকবে। রুইদাসদের রক্ত ওর শরীরে বইছে। জন্মসূত্রেই ও রুইদাস ছিল, আছে, থাকবে। সে রক্ত কে টেনে বার করে অন্য জাতের রক্ত ঢোকাবে? অলোকা কেন পাল কুমোর হতে যাবে? হ্যাঁ, বিপ্লবকে বিয়ে করলে বিপ্লবের সন্তান, যে অলোকার পেটে ধারণ করবে তারা পাল হতে পারে। অলোকা নয়। আমাদের রুইদাস জাতের কোন ক্ষতি হবে না তাতে। আর দিবাকর কাকা, তুমি নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছো। বাড়ির মেয়েরা উদয়-অস্ত খেটে পয়সা রোজগার করে তোমাকে খাওয়াচ্ছে। আর তুমি এইসব মাতালদের দলে ভিড়ে মাতাল হয়ে ওদের সাওটা গাইছো। ভেবেছ একবার, তোমার বাড়ির মেয়েদের থেকে আমি যদি কাজ তুলে নিই, তোমার কি হাল হবে? ওই পুকুরের পাঁক তুলে তাতে উপুড় হয়ে শুয়ে পেটের জ্বালা জুড়োতে হবে। তাও যতক্ষণ কে ততক্ষণ।”
    অখিল এমন কথা বলার পর দিবাকরদের পক্ষে যারা আছে তারা হইচই ফেলে দেয়। নিত্যানন্দ বলে, “অখিল একজন বয়স্ক সদস্যকে এভাবে শাসাতে পারে না। অখিলও বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে জাত-বেজাত গুলিয়ে দিতে চাইছে। ওকে আমরা ক্ষমা করে দিয়ে ভুল করেছি। ওর পুনরায় বিচার করে শাস্তি দেওয়া দরকার।”
    এবার অখিলের পক্ষ নিয়ে সনাতনের বাবা রতনের বিশ্বস্ত সুভাষ বলে,“অখিল তার জাত খোয়ালো কোথায়! সে তো অন্য জাতের মেয়েকে রুইদাস করে নিয়েছে। অখিলের বউ রুইদাস সমাজকে নিজের হিসেবে মেনে নিয়েছে। অতএব তোমাদের এই যুক্তি ধোপে টেকে না। এই চল, আমরা অলোকাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। এই অসভ্যরা সবাই মিলে ওকে অপমানে অপমানে বিধ্বস্ত করে ফেলছে।” তখনই দিবাকর, নিত্যানন্দরা আবার চাপ দিয়ে বলে,“ওই শিক্ষিতদের কোন যুক্তি আমরা মানব না। এই কেসের বিচারে আগে যেমন রায় দেওয়া হয়েছে, আজও তেমন শাস্তি এই মেয়েটাকে তার পরিবারকে পেতে হবে।”
    এই বাদানুবাদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পক্ষ-বিপক্ষর চিৎকার চেঁচামেচি ! বিষয়টা নিয়ে রুইদাস পাড়া আড়াআড়ি দুটো ভাগ হয়ে গেছে। এটা মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। বলা যায় না, এটাকে বাড়তে দিলে রুইদাস পাড়ায় গৃহযুদ্ধও বেধে যেতে পারে। এবার সনাতন দেখল তার হস্তক্ষেপ ছাড়া এই গণ্ডোগোল মেটার উপায় নেই। এই সমস্যার সমাধান এখানে করা যাবে না। একটা জোর চিৎকার করে উঠল সনাতন! সনাতনের মত শান্তশিষ্ট ছেলে যে এতো জোর কথা বলতে পারে, সভা কল্পনাই করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে সভা একদম স্তব্ধ! এই সময়টাকে কাজে লাগাতে সনাতন বলল,“আটচালার একটা অতীত ভুলকে তুলে ধরে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আর একটা ভুল করা কোন যুক্তিযুক্ত কাজ নয়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নাহলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমি বুঝতে পারছি, এই বিচারসভা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। কোনভাবে কোন পক্ষের আর বেশি বাড়াবাড়ি করা চলবে না। আমি পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে এই বিষয়টা পঞ্চায়েতের বিচারসভায় ফেলতে চাই। সেখানকার সিদ্ধান্ত যদি মেনে নেওয়া না হয় তো দরকারে আমরা পঞ্চায়েত থেকে কেসটাকে থানায় পাঠিয়ে দেব। সেখানে দেশের আইন যা বলে সেটাকে সবাই মেনে নিতে বাধ্য।” তারপর সুবোধ কাকার উদ্দেশে বলল,“কাকা, আমি যা দেখতে পাচ্ছি আজকের সভায় এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। অসমাপ্ত এই সভা, পঞ্চায়েতের শালিশি সভায় ফেলার জন্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ এই সভা মুলতুবি করে দেওয়া হোক। রুইদাসদের বাঁচাতে গেলে আর বিকল্প পথ আমাদের সামনে নেই।”
    পঞ্চায়েত প্রধান, সনাতন রুইদাসের কথা মত পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, সুবোধ কাকা এদিনের সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে। এরপর আর কোন চেঁচামেচি, হইহুল্লোড় নেই। ফিসফিসে গুনগুনে এক সমবেত শব্দ আটচালা থেকে জন্ম নিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অভয়-বরেণদের গুলতানি আর যেন থামতে চায় না। পাড়ার আরও জনা- দুই মোদো মাতালকে জুটিয়ে তারা তেমাথানি মোড়ের বটগাছের গোড়ায় বসে চুল্লু খেতে খেতে কত যে শলা-পরামর্শ করতে থাকে কে জানে! সনাতনের নজর তা এড়ল না বটে। তবে ওইসব মাতালদের আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইল না। গুরুত্ব দিলেই ওরা পেয়ে বসবে।
    বিপ্লব কোথায় আছে, তাদের পাল পাড়া বা রুইদাস পাড়ার কেউ জানে না। অলোকাও জানে না। অলোকাকে বলেনি বিপ্লব। মাঝে মাঝে বিপ্লব অলোকার স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে মজলিশপুরের মোড়ে অপেক্ষা করে অলোকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। অলোকা পায়রাচালী প্রাইমারী স্কুল থেকে এই পথেই এক কিলোমিটারের মত রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। পাড়া অলোকাকে সম্মান জানাবে তা অলোকার কাছ থেকে বিপ্লব জেনেছে। তবে জানেনি যে ওইদিনও ওদের দু’জনকে জড়িয়ে আবার আলাদা একটা বিচারসভা রুইদাসদের আটচালায় বসবে। খুশি মনে বিপ্লব পরদিন অলোকার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, কেমন তার সংবর্ধনা সভা হল জানার জন্যে। সেদিন ও আশা নিয়ে এসেছিল, অলোকার খুশি মন দেখবে বলে। ভেবেছিল হয়তো অবোধ রুইদাসরা বোধে ফিরে তার কাজের সমর্থন করতে এই অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু অলোকার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই খুশির লেশমাত্র দেখা গেল না। বিপ্লবও গম্ভীর হয়ে গেল কোন অশনিসংকেতের শঙ্কায়! সেদিন অলোকা মজলিশপুরের মোড় থেকে কথা বলে বাড়ি ফেরেনি। ওরা দু’জন মজলিশপুর থেকে পশ্চিমের ফাঁকা রাস্তা ধরে হরিণডাঙ্গামুখো হল। মাঝে জাগলার পোলের নিরিবিলিতে বহুক্ষণ বসে রইল। কথার মাঝে একবার বিপ্লব অলোকার কান্নাভেজা মুখ মুছিয়ে দেয় তো অলোকা বিপ্লবের। কতক্ষণ যে এমন আদানপ্রদান চললো ! পশ্চিমাকাশের সূর্য ডোবার যন্ত্রণাঋদ্ধ লালাভ আলো বিচ্ছুরিত হবার দৃশ্য নজরে আসতে বিপ্লব বলল, “এবার বাড়ি চলো অলোকা। শীতের সন্ধ্যা। ঠান্ডাও বাড়ছে। তোমাকে এগিয়ে দিই। আর এখানে থাকা আমাদের ঠিক হবে না। ‘দিননাথ’ পাটে যাবার পর জায়গাটা সাধারণের জন্যে নিরাপদ নয়। প্রকৃত মৃত্যুর আগে অপঘাত মরণে কোন কৃতিত্ব নেই।”
    -প্রকৃত মরার আর বাকি রইল কোথায় বিপ্লবদা! এখন তো কেবল বেঁচে আছে আমার এই নশ্বর দেহটা। মান-সম্মান, ব্যক্তিত্ব কোন কিছুর অবশেষ আছে নাকি আমার আর? সেটা যখন নেই তখন সমাজের দুষ্ট মানুষের আক্রমণে যদি আমার মরণ হয় তো হোক না। পরক্ষণেই আবার নিজেকে শক্ত করে অলোকা বলল,“তাছাড়া তুমি তো আমার পাশে আছো বিপ্লবদা। এই যুগল শক্তিকে একত্র করে আমরা শত্রুকে প্রতিরোধ করতে পারব না? যেমনটা আমাদের অবোধ সমাজের বিরুদ্ধে করে চলেছি। না পারলে সহ-মরণ হয় হোক। ক্ষতি কি! আর একটু বসো। তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না আজ আমার। আরও দু’দন্ড বসি। তারপর যাচ্ছি।” একপ্রকার মরিয়া হয়ে যেন কথাগুলো বলল অলোকা ।
    দেখতে দেখতে সাতটা বেজে গেল। এইসময় গ্রামের শীতের রাত মানে অনেকটাই রাত বলে মনে হয়। মনে মনে অলোকা ভাবল এতটা রাত না করলেই হত। বাড়িতেও চিন্তা করবে। এখান থেকে এতটা পথ হেঁটে যেতে হবে। রাত আটটার কাছাকাছি হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছতে। বিপ্লব বলল, “এখন আর তোমাকে মজলিশপুরের মোড়ে ছেড়ে দেব না। চলো বাড়ির কাছাকাছি উত্তমের লেদ কারখানার সামনে ছেড়ে দিয়ে আসি। ওখান থেকে তোমাদের আটচালার আলো দেখা যায়। ওটাকে লক্ষ্য করে চলে যেতে পারবে। যদি তোমাদের পাড়ার কেউ আমাকে দেখে ফেলে ফেলবে। কিচ্ছু করার নেই আমার। সেই ভয়ে আমি তো আমার ভালোবাসাকে হেলাফেলা করতে পারি না।”
    হেড়ো পাগলা, পাগলের খেয়ালে কখন কোথায় থাকে তার হদিস ভালো মানুষের পাওয়া মুশকিল। রাতে কবে যে বাড়িতে শুয়েছে, তার মা নিজে সঠিক বলতে পারবে না। চরাচরই যেন ওর ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন। ওর কাছে সবাই আপনজন। কতদিন হয়েছে আটচালার ফাঁকা মেঝেতে ঘুমিয়ে থেকে রাত কাবার করে দিয়েছে। বাধাহীন চেতনায় রাতের সঙ্গে সখ্যতা করার জন্যে আটচালাই তার প্রথম পছন্দের জায়গা। শীতের রাত। ঘড়ির কাঁটা আটটাকে ছুঁয়ে গেছে কিছুটা আগে। রুইদাস পাড়া ততক্ষণে প্রায় ঘুমিয়ে কাত। হেড়ো পাগলাও আটচলার মেঝেতে ঝ্যাঁতলা বিছিয়ে তেলচিটে পড়া কম্বল জড়িয়ে থরথর করে কেঁপে চলেছে। কখন ঘুম আসবে তবে সেই কাঁপুনি থামবে। হঠাৎ একজন মেয়েমানুষের মরণ চিৎকারে তার পৃথিবীটা যেন টলমল করে উঠল! গায়ে মোড়া কম্বলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে দেখে গামছা দিয়ে মাথা-মুখ ঢাকা দুটো লোক ছুটে পালাতে পালাতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল! আর রাস্তায় ঠিকরে পড়া আটচালার আলোতে দেখতে পেল অদূরেই রক্তাক্ত অবস্থায় একটা মেয়ে গোঁ গোঁ করে কাতরাচ্ছে। সভয়ে হেড়ো পাগলা নীচু হয়ে দেখতে গেল কে মেয়েটা! মনে হল এ আর কেউ না তাদের পাড়ার অলোকা দিদিমণি। পাগলের মাথা প্রথমে ভিমরি খাবার মত হয়ে যায় ! কিন্তু যারা পেছন থেকে মেয়েটার মাথায় বাড়ি মেরে পালালো তারা কারা! অন্ধকারে বুঝতে পারল না। ততক্ষণে ওর বুকের ধড়ফড়ানি আরও বাড়তে লাগল। কিন্তু পাগলেরও মন বলছে, তাকে ভালো করে জানতে হবে রক্তাক্ত মেয়েটা কে? সময় নষ্ট করলে চলবে না। বিড়ি খাবার ম্যাচিসটা পকেট থেকে নিয়ে খস করে আলো জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে মুখের কাছে ধরতে চিনতে পারে সেই মুখটা, ঠিকই তো! এ তো তাদের অলোকা দিদিমণি! নিশ্চিত হয়েই ম্যাচিস-ফ্যাচিস ছুড়ে ফেলে বিকট চিৎকার জুড়ে দিয়ে ছুটতে থাকে,“ও সনাতন দাদা, ও সনাতন দাদা। তোমরা সব ওঠো! জাগো! ওঠো গো সনাতন দাদা। ওঠো গো অখিল দাদা! আমাদের অলোকা দিদিমণিকে কারা খুন করে পালাল। পাড়াপড়শিরা সবাই ওঠো গো। সব সর্বনাশ হয়ে গেল। আমাদের অলোকা দিদিমণি খুন হয়ে গেল গো। ও সনাতন দাদা ওঠো !” বলে ছুটতে ছুটতে রাস্তায় উঁচু হয়ে থাকা একটা ইটে হোঁচট খায়! সঙ্গে সঙ্গে পায়ে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে হেড়ো পাগলা!

    -সমাপ্ত-

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২২)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [তেতাল্লিশ]
    বাবার শরীর খারাপের জন্যে এই বছর সনাতনরা আর কোলকাতায় হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের দূর্গাপূজায় ঢাক বাজাতে যাবে না। দিঘিরপাড় বাজারে পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে একটু আগে আগেই সন্তোষবাবুকে ফোনে জানিয়ে দেয়। সনাতন এবং সন্তোষবাবু দু’তরফেরই এই সংবাদে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যদি প্রতিকুল হয় তখন কারোর কিছু করার থাকে না। সেটা মেনে নিয়ে সন্তোষবাবু সনাতনকে বলল, যদি তার জানাশোনা ভাল কোন ঢোলের দল পাঠাতে পারে তো ভাল হয়। ঢাক যেহেতু সনাতন-রতনরা বাজায়, সেই বাজনা তাদের কানে লেগে আছে। এর পর অন্য কারোর বাজনা ভালো লাগবে না। মন খারাপ হয়ে যাবে। তাই সন্তোষবাবু ঢোলের দল পাঠাবার প্রস্তাব দেয়। একবাক্যে সনাতন রাজি হয়ে যায় এবং তাদের উভয় পক্ষের যাতে মানসম্মান বজায় থাকে তেমন একটা দলকে সে পাঠাবে কথা দেয় সন্তোষবাবুকে। সনাতনের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে সন্তোষবাবু বলে, “এই জন্যেই সনাতন তোমাকে আমরা এতটা ভরসা করি। জানি, একটা সুব্যবস্থা তুমি করবেই।”
    তাজপুরের পাইক-পাড়ার তিমির পাইক সুবোধ কাকার বাড়ি কয়েকদিন ধরে যাতায়াত করছে, সনাতন দেখেছে। মনে হয় ঢোলের অর্ডার দিয়েছে সুবোধ কাকার কাছে। ঢোল তৈরীর পাকা মিস্ত্রী এই সুবোধ কাকা। ঢাক বানাতেও ওস্তাদ। কিন্তু রুইদাস পাড়ার বেশিরভাগ ঢাকি নিজেরাই নিজেদের ঢাক বানিয়ে নেয়। টুকটাক অসুবিধা হলে পাড়ার পাকা কারিগর যারা আছে তাদের সাহায্য নেয়। তাই ঢাকের অর্ডার বেশি পায় না। পাড়ার কয়েকজনই আছে যারা ঢাক- ঢোলের অর্ডার বাইরে থেকে পায়। সুবোধ কাকা তাদের মধ্যে অন্যতম। আর সময় নষ্ট না করে সুবোধ কাকার বাড়ি গেল সনাতন। পিপার মত একটা কাঠের খোলের এক মুখে গরুর চামড়া লাগাচ্ছিল কাকা। আর এক মুখ ছাগলের চামড়া দিয়ে তার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গেছে। সনাতন গিয়েই কাকাকে ডিস্টার্ব করতে চাইল না। কাকা পেছন ফিরে কাজ করছিল বলে তাকে দেখতে পায়নি। এক মনে কাজ করে চলেছে বুড়ো। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা টুলে বসে কাকার হাতের যাদু পরখ করে চলেছে। সনাতন জানে এর পর ঢোলের খোলের দু’মুখ মাঞ্জা দেওয়া মোটা সূতোর দড়ি বা নাইলন দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার ভেতর ছোট্ট আকারের পিতলের বালা পরাতে হবে। হিসেব করে বাঁধা দড়ি এই বালার মাধ্যমে টান করে বা আল্গা করে ঢোলের সুর বাঁধা হয়। কাজের ঝোঁকে এবার এদিকে ঘুরতে সনাতনকে দেখতে পায় সুবোধ কাকা। অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে,“আরে, আমার সনাতন বেটা যে। খবর কি রে বাবা? হঠাৎ কি মনে করে আমার বাড়ি? তুই তো বাবা খুব কাজের ছেলে। এমনি এমনি আমার বাড়ি আসতে পারবি না। নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছিস। বল বাবা বল। কি দরকার। কখন এসে চুপচাপ বসে আছিস। সাড়াই করিসনি। আমি আমার মত কাজে ডুবে আছি।”
    -ঠিক আছে কাকা। তাতে কি। এক মনে কাজ করছো। হাতের কাজটা না সেরে বা তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে কেমন করে। কাজের তাল কেটে যাবে। তাই আর ডাকাডাকি করিনি। যে জন্যে এসেছি, কাকা। ওই তিমির পাইক তোমার কাছে আসে দেখেছি। নিশ্চয়ই কাজের অর্ডার দিয়েছে। না হলে আর সেই তাজপুর থেকে এতটা পথ উজিয়ে আসতে যাবে কেন। ও আবার কবে আসবে কাকা? ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে। কোলকাতায় আমাদের দূর্গা পূজার অর্ডারটা ওকে দেব ভাবছি। জানো তো বাবার শরীর খারাপ। বাবাকে নিয়ে কোলকাতায় কাজে যাওয়া যাবে না। তা ভাবলাম তিমির পাইক মানুষটা, ভাল-মানুষ বলে পরিচিতি আছে। কোলকাতার ওরা তেমনই একজনকে পাঠাতে বলেছে। যদি ওরা রাজি হয় তাহলে যাবার কথা বলবো। তোমার কি মত কাকা?” পরামর্শ চাওয়ার মত করে সনাতন বলল।
    -হ্যাঁ। এটা ঠিক। তুমি যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। তিমির পাইকের ঢোলের দলের সুনাম আছে। যেমন ভাল বাজায় তেমন আচার ব্যবহারও লোকের মন কেড়ে নেবার মত। তা তুমি বিকেলের দিকে একবার ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসো-না। ওর আসার কথা আছে। তিনটে ঢোলের অর্ডার দিয়েছে। একটা হয়ে গেছে। সেটা নিতে আসবে। ও আমার লক্ষ্মী খদ্দের। মাল ডেলিভারী নেবার সাথে সাথে ফুল পেমেন্ট করে দেয়। কিছু আগামও দিয়ে দেয়। আমি চেয়ে নিই। আমার তো আর এইসব ঢোলের খোলের কাঠ কেনার মত অত বেশি পয়সা নেই। তাই আগাম না নিলে চলে না। তা, ওরা সেটা ‘না’ করে না। দিয়ে দেয়। তুষ্ট মনে সুবোধ কাকা বলল।
    সনাতন দেখলো হ্যাঁ, কাকা ঠিক কথাই বলেছে। আরও দুটো ঢোলের খোল ঘরে পড়ে আছে। কাকারা সাধারণত নিম বা কাঁঠাল কাঠের গোড়ে থেকে এই খোল বানিয়ে থাকে। অন্য কাঠেও সম্ভব। তবে আমাদের এখানে এই কাঠ বেশি পাওয়া যায় বলে ব্যবহার করা হয়। তাতে কাঠ বাবদ খরচটা অনেক কম হয়। এই যেমন মৃদঙ্গ-খোল তৈরীর জন্যে এগুলো ছাড়াও রক্ত চন্দন বা খয়ের কাঠ হলে খুবই ভাল হয়। সেই কাঠ আমাদের এদিকে কোথায়! অনেক খরচা তা জোগাড় করতে। পোষাবে কেন! একটা মোটা কাঠের গোড়ে মাঝ বরাবর চিরে নিয়ে তার ভেতরের শাঁস-অংশ কেটে বা চেঁচে ফেলে দিলে ভেতরটা
    ফাঁপা হয়ে যায়। দুটো অংশ এইভাবে ফাঁপা করে আঠা দিয়ে জুড়ে দিলে পূর্ণ একটা খোল তৈরী হয়ে যায়। এবার খোলের দু’প্রান্ত খানিকটা করে কেটে সরু মত করে দিতে হয়। তাহলে খোলের দু’মুখের তুলনায় মাঝবরাবর পেটের অংশ মোটা হয়ে গেল। একটা পূর্ণ ঢোলের চেহারা পেয়ে গেল। এবার সেটাকে মেজে ঘষে মসৃণ করে তার উপর সৌন্দার্যয়ণ করা হয়। এ’দুটোয় ওইগুলো সব এখন বাকি আছে। তার মানে তিমির পাইককে আরও কয়েকবার সুবোধ কাকার কাছে আসতে হবে। কাকার কথামত বিকেলের দিকে আসবে বলে সনাতন তখনকার মত চলে যাবার সময় বলে গেল,“কাকা, এখন আমার পড়ানো আছে। ছাত্রীরা এসে পড়বে। বিকেলে সময় মত আমি এসে যাব। আমি বাড়ি থেকে খেয়াল রাখব তিমির পাইক কখন তোমার বাড়ি আসছে। দেখতে পেলেই অমনি ছুটে চলে আসব।”
    বিকেলের ব্যাচটা পুরোপুরি তাদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের জন্যে রেখেছে সনাতন। এরা সব গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। বেশি পয়সা দিতে পারবে না। তাই অন্য ব্যাচের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে টিউশনির ফীস নিয়ে পাড়ার ছাত্র আর বাইরের ছাত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। পয়সার অভাবে ইচ্ছুক পাড়ার ছাত্রদের লেখাপড়া হবে না তা সনাতন কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। এটা তার নীতি নয়। হয়তো সংসারে পয়সার প্রয়োজনেই সে টিউশনি বেশি করে করছে সেটা ঠিক। সেইসঙ্গে সমাজ সংস্কারের একটা বোধ তার মনে সবসময় কাজ করে। সেই সংস্কার-কাজ চালাতে গেলে এই সমস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ঢোকানো প্রয়োজন। ওদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের বেশিদূর লেখাপড়া না হওয়ার কারণ একাধিক। উপযুক্ত গাইড না পাবার কারণে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতায় তারা পেরে ওঠে না তা নয়। পরীক্ষায় মোটেই ভাল ফল করতে পারে না। বড় হবার সাথে সাথে তাদের মধ্যে মান-অপমান বোধ জন্মে যায়। পড়া না-পারার গ্লানি তাদের মনের মধ্যে কাজ করে। অচিরেই তারা পড়া ছেড়ে দিয়ে রাখাল হয়ে গরু চরানোকে নিজের কাজ বলে মেনে নেয়। এটা যেন তাদের সম্প্রদায়ের একটা চিরাচরিত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই শাপমোচন করার লক্ষ্যে তার এই ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টা। যার পরিবারের যেমন সামর্থ তারা তেমন পয়সা দিল, যাদের নেই তারা দিল না। তাতে তার বিন্দুমাত্র আপসোস নেই। কিন্তু একটাই তার কড়া অনুশাসন, মন দিয়ে লেখাপড়া তাদের করতে হবে। নাহলে নির্বিচারে দানসত্র খোলার অভিপ্রায় তার বিন্দুমাত্র নেই।
    ন’ক্লাস থেকে বারো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়ায় সনাতন। বিকেলের ব্যাচের ছেলেরা সকলেই নাইনে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানের একটা প্রজেক্ট করতে দিয়েছে স্কুল থেকে। সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় সানাতন ছাত্রদের বলল,“আমি আজ তোমাদের প্রোজেক্টের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেব। তারপর সেই বিষয়টার ডিটেলস্ নোটস্ লিখে দেব। সেটা দেখে নিজের মত করে তোমরা ভাবনাচিন্তা করে প্রোজেক্টটা করে আমাকে দেখিয়ে তারপর স্কুলে জমা দেবে। আমি প্রস্তাব দেব, আমাদের মুচি-রুইদাসদের নিয়ে তোমরা কাজ করো। যেহেতু আমাদের এই জাতটা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর এবং সবদিক থেকে পেছিয়ে পড়া জাত। সেটা একটা প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারলে ভালো নাম্বার পাওয়া যেতে পারে।”
    সনাতন স্যারের কথার প্রেক্ষিতে সন্তোষ বলে ছাত্রটা বলল, “স্যার ক্লাসে অমর স্যার প্রোজেক্টের যে ধারণা দিয়েছিল তাতে বলেছিল, সমাজের দুর্নীতি বা মানবিক অবক্ষয় এইসব বিষয় নিয়ে প্রোজেক্টের ভাবনাটা রাখতে। সেখানে এই বিষয়টা একদম আলাদা। অমর স্যার এটা মেনে নেবে তো স্যার? আমরাই আবার আমাদের নিয়ে লিখছি। নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাচ্ছি। তেমন ভাববে না তো কেউ?”
    সন্তোষের প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে সনাতন বলল,“কথায় আছে না, “আপনা হাত জগন্নাথ” সেইরকম। আমাদের কথা সমাজের কাছে আমাদেরই তুলে ধরতে হবে। অন্য কেউ ভালোবেসে আমাদের কথা বলতে আসবে না। আমাদের সম্প্রদায় তো শুধু এই বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তামাম ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই মুচি সম্প্রদায়। সে’কথা ক’জন জানে? কোন প্রোজেক্টের কাজ একটা থিসিস লেখার মত প্রায়। এর মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরা যায়। সেইজন্যেই তো এই ‘প্রোজেক্ট বিষয়টা’ সিলেবাসের মধ্যে নিয়ে আসা। অমর স্যার যেটা তোমাদের বলেছে, সেটাই তো আমি তোমাদের বলতে চাইছি। তোমরা কি জানো? আমাদের এই মুচি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি কোথা থেকে? জানো না। এখানকার বয়স্ক মানুষদেরও মনে হয় জানা নেই। শোনা যায় মুচি শব্দটা এসেছে মোজা থেকে। গুজরাটের ‘পাভগাধে’র মানুষ বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জন্তুর চামড়া থেকে মোজা তৈরী করত। সেই থেকে মুচি নামটা, মুচি জাতে পরিণত হয়। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের মুচিরা আবার দাবি করে তারা মূলত রাজস্থানী। তাদের পেশা ছিল সৈন্যদের জন্যে চামড়ার মোজা, পোষাক তৈরী করা। তারা রাজপুত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই দুই মতের মধ্যে ‘মোজা’ কথাটায় মিল পাওয়া যায়। অতএব এই মোজা শব্দ থেকে মুচি নামটার একটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবনা থাকতে পারে। সেটা আমরা ধরেও নিতে পারি।” সনাতন স্যারের কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিজয় বলল,“এ তো স্যার বেশ অবাক করা কথা ! আমাদের তো এটা জানাই ছিল না। অথচ তা আমাদের সকলের জানা দরকার।” বিজয়ের কথা শেষ হতেই অমল বলল, “স্যার, আপনি যে বললেন না, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আমরা অবস্থান করছি। মোটামুটি কোথায় কোথায় আমরা আছি একটু বলবেন?” উত্তরে সনাতন বলল, “নিশ্চয়ই বলব। ভারতবর্ষের মধ্যে বিশেষ করে উত্তর ভারতে আমাদের সম্প্রদায়ের বাস বেশি। যেমন ধরো, উত্তর প্রদেশের সীতাপুর, এলাহবাদ, সুলতানপুর, ফরিদাবাদ, গন্ডা, কানপুর আর লক্ষনৌ জেলায় সবচেয়ে বেশি মুচিদের বাস। তারপর পাঞ্জাব, মহারাষ্টু, গুজরাট, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশের, কৃষ্ণা, গুন্টুর, পূর্ব গোদাবরি, হায়দ্রাবাদ, কুর্নুল, আদিলাবাদ জেলায়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলা ছাড়াও আরও কিছু কিছু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর বিহার, মধ্যপ্রদেশে তো বহু চামার সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। এই চামারদের সাব-কাস্ট হিসেবে মুচিদের ধরা হয়। শোন, যতটা আমার স্মরণে আছে মুখে সেটুকুই বলছি তোমাদের। নোটস যেটা দেব সেটাতে আরও বিস্তারিত লেখা থাকবে। মুখে একটু বুঝিয়ে দেবার পর নোটসটা পড়ে নিলে প্রজেক্টটা তৈরী করতে সুবিধা হবে। তবে কেউ কিন্তু কারোর দেখে বা হুবহু নকল করবে না। তাহলে সব্বাইয়ের প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে। অমর স্যার ঠিক ধরে ফেলবে। আমাদের ব্যাপারটা অমর স্যার অনেকটাই জানে। আমাকে খুব ভাল করে চেনে। অমর স্যার, আমারও স্যার। এই তথ্যগুলো নিয়ে নিজেদের স্বাধীন ভাবনায় লিখবে। বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।” চঞ্চল ছেলেটা এতক্ষণ পরে বলল,“স্যার আমরা তো বাংলায় কথা বলি। মানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। তা মুচিদের নিজস্ব কোন ভাষা আছে নাকি ? এই যেমন সাঁওতালরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। উত্তরবঙ্গের কামতাদের ভাষা হোল কামতাপুরি। সেইরকম আরকি।” চঞ্চলের প্রশ্নটা যে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং সঠিক তা মেনে নিয়ে সনাতন বলল, “তুই একটা দারুণ প্রশ্ন করেছিস, চঞ্চল। সাঁওতাল, কামতাপুরী বা এমনতর আরও অন্যান্য সম্প্রদায়ের যদি নিজস্ব ভাষা থাকতে পারে তাহলে মুচি-চামারদেরও তো তা থাকা অস্বভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তাহলে তো আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রয়াস চালিয়ে যেতাম। যেমন অন্যরা করছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করি সেই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাকেই নিজেদের ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি সে ভাবনা করতো তাহলে হয়তো তা হতে পারতো। কিন্তু তা না হবার যে অপরিহার্য কারণ, সেটা হল আমাদের মানুষগুলো চিরকালই অত্যন্ত অভাব এবং অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়ে এসেছে। তারা নিজেদের পেটের চিন্তা করবে না ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করবে। এই আমাদের রুইদাস পাড়ার দিকে তোরা তাকা-না। ক’টা লোক লেখাপড়া জানে দেখ। এখন দু’চারজন, তোদের আমাদের মত আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় এগিয়ে এসেছে। তাই আমরা এইসব ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছি। সেইসময়কার মানুষের যদি উদয় অস্ত পেটের চিন্তা না করতে হত তাদের ভাবনা চিন্তা অন্য খাতে বওয়ার ফুরসত থাকতো। তারা লেখাপড়ার কথা, ভাষা-সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারতো। যাক। যেটা বলছিলাম। সেটা ভেবে এখন আর লাভ নেই। এখন ভাবলেও আমরা আমাদের আপন ভাষা তৈরী করতে পারব না। বাস্তবসম্মতও নয়। এখন উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে যারা বাস করে তারা কথা বলে হিন্দি এবং দেবনাগরী ভাষায় লেখে। আসামের ভাষা আসামী, গুজরাটে গুজরাটি, মহারাষ্ট্রে মারাঠি, অন্ধ্রে তেলেগু, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবী, বিহারে ভোজপুরী, কর্ণটকে কানাড়া, উড়িষ্যা ওড়িয়া। এখানে একটা ব্যাপার দেখ, আমরা একই জাত-সম্প্রদায়ের হয়েও পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তার একটাই কারণ, ভাষার বিভিন্নতা। আমরা বাংলাভাষীরা কি মারাঠী ভাষীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব? পারব না। বরং তাদের ভাষা না বুঝতে পেরে তাদের থেকে দূরে সরে আসব। যেটা সারা ভারতবর্ষের সাঁওতাল বা কামতাপুরী বা অন্য অন্তজ শ্রেণীর মানুষ যারা নিজস্ব ভাষার অধিকারী, তাদের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই।”
    তাদের সনাতন স্যার নিজেদের জাতের ব্যাপারে এতকিছু জানে জেনে এই চার ছাত্রই অবাক হয়ে যায়! অথচ বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না। কত জ্ঞান এনার। এর কাছে পড়তে না এলে তারা এই স্যারের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। স্যারের কাছে যত পড়ছে ততই এনার সম্বদ্ধে তাদের ধারণা বদলে যাচ্ছে। বিস্ময়ের সঙ্গেই চঞ্চল আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি এতকিছু জানলেন কেমন করে? এর আগে কেউ তো আমাদের নিজেদের জাতের ইতিহাস এমন করে বলেনি। এমনকি আমার বাবা-দাদুরাও না।” এবার ছাত্রদের আশ্বস্ত করার জন্যে সনাতন বলল, “দেখ, আমাদের বাবা- দাদুরা লেখাপড়া শিখেছে? শেখেনি। এগুলো জানতে গেলে তো পড়াশোনা করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে হবে। সবার উপর জানার উদগ্র চেষ্টা বা ইচ্ছা থাকতে হবে। তোরা এখন পড়াশোনা করছিস বলে এতকিছু জানতে পারছিস। এই আমাদের পাড়ায় তোদের বয়সী আরও কত ছেলেমেয়ে তো আছে। ছেলেরা তো বাউন্ডুলের মতো ঘুরছে, মদ খেয়ে মাতলামী করছে। তারা বড় হয়ে সন্তানদের কি শেখাবে! ভেবে দেখেছিস একবারও! সেইজন্যে বলছি লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই রে। এবার আরও দু-একটা পয়েন্টস বলে আজকের মত ছুটি দিয়ে দেব। আগেও বলেছি, তারপর ডিটেলসটা নোটসে পড়ে নিস। এই আমরা মুচিরা তো হিন্দুধর্ম পালন করি। মানে আমরা হিন্দু। এই মুচিরা আবার মুসলমান, শিখ ধর্মালম্বীও আছে কিন্তু। পাঞ্জাবে যেমন হিন্দু মুচি আছে তেমনি শিখ মুচিও আছে। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীরে মুসলমান মুচি প্রচুর আছে। এরা মূলত হিন্দু ছিল একসময়। কিন্তু বিভিন্ন সময় শাসকশ্রেণীরা নিজেদের স্বার্থে বলপূর্বক তাদের মুসলিম বানিয়ে দেয়। পাঞ্জাবের হিন্দুরা আবার শিখ হয়েছে স্বেচ্ছায় । আর একটা কথা জানাই। এটা জানা বিশেষ দরকার। অন্ধ্রপ্রদেশে মুচিদের মধ্যে পঁয়ষট্টি ভাগ মুচি হিন্দু। তবে তারা সন্ত রবিদাসকে অবতার হিসেবে মানে। ইনি একজন চর্মকার ছিলেন। অন্ধ্রে নিমিশাম্বা দেবীকে আরাধ্যা দেবী হিসেবে মানে। আজ এই পর্যন্ত। এবার তোরা বাড়ি যা। আবার একটু পরে, পরের ব্যাচ আসবে। তার আগে আমাকে একবার সুবোধ কাকার বাড়ি যেতে হবে। তোরা খেয়াল রাখিস তো একজন বাইরের গ্রামের লোক সুবোধ কাকার বাড়ি আসবে। তেমন কাউকে দেখতে পেলে কেউ আমাকে একটু খবর দিস। আমি খেয়াল রাখছি। তবু যদি আমার চোখ এড়িয়ে যায় তাই তোদের বলে রাখলাম। যে দেখবি বলবি।”
    ঢোল ডেলিভারী নিতে গেলে পুরো দাম দিয়ে তবে নিতে হবে। বাকি রাখে না সুবোধ রুইদাস। যা দামে রফা হয়ে যায় পুরো টাকাটাই দিতে হয়। একটা পয়সা ছাড়ে না বুড়ো-টা। কিছু টাকা কম হচ্ছে। সেটা জোগাড় না করে তো যাওয়া যাবে না। আজ সন্ধ্যে যাবার কথা ছিল যে ঢোলটা রেডি হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আসার জন্যে। যাওয়াটা এখন বাতিল করা ছাড়া তার উপায় নেই। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিমির পাইক বসে গেল উঠোনে ফেলে রাখা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে। তাকে অন্তত পাঁচটা চুবড়ি আর তিনটে খড়কুঁচে রাখার মত বড় ঝোড়া তৈরী করতে হবে। কঞ্চিগুলো নেড়েচেড়ে দেখল অতটা মাল এগুলোয় হবে কি না। তার সঙ্গে আবার দুটো চুবড়ি আর একটা মাটি বওয়া ঝোড়া আলাদা করে বানাতে হবে। ওগুলো মাগনা যাবে, বাঁশের ঝাড়ের মালিককে দেবার জন্যে। ওদের এদিকে এই একটা সুবিধা আছে, বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে নিয়ে আসার জন্যে ঝাড়ের মালিককে আলাদা করে তার দাম দিতে হয় না। ওই থাবগো মূল্য ধরে সেই দামের চুবড়ি-ঝোড়া দিলেই চলে। তাতে তিমিরদের মত কাওরা-পাইকদের একটু লাভ বেশি হয়। ঝাড়-মালিকরা তো অতো বোঝে না, ক’টা কঞ্চিতে ক’টা চুবড়ি-ঝোড়া হতে পারে। তাছাড়া ওরা এই নিয়ে তেমন ভাবেও না। ঝাড় থেকে বাঁশ বিক্রি করার সময় কঞ্চি এমনিতেই বাঁশ গোলার ব্যবসায়ীরা ফেলে দিয়ে চলে যায়। ঝাড়ের মালিকদেরও এটা জ্বালানি ছাড়া আর কোন কামে লাগে না। আগে লোকে এই কঞ্চি ছিটেবেড়ার ঘর করতো। তখন কঞ্চির চাহিদা ছিল। এখন তো ছিটেবেড়ার বা মাটির বাড়ি প্রায় দেখাই যায় না। তবে একদম নেই তা জোর দিয়ে বলার সাহসও কারোর নেই। প্রান্তিক এলাকায় তেমন বাড়ি আছে বইকি। সেসব তো তাদের এই এলাকার নজরের বাইরে। বাজারে তাই এখন কঞ্চির এমন চাহিদাও নেই যে ঝাড় মালিকরা দর হাঁকিয়ে গেঁট হয়ে বসে থাকবে।
    অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেও অর্ধেকের বেশি মাল তৈরী করতে পারেনি তিমির। আর শরীর টানছিল না। এবার শুতে যেতে হবে। না হলে আবার সকাল সকাল ওঠা যাবে না। সকাল থেকে আবার কাজে লাগতে হবে। শুতে যাবার সময় ঠিক করে, তার ঢোলের মেন সহকারী, শিশিরকে একবার ডেকে নেবে। দু’জনে হাতে হাতে কাজ করতে পারলে দুপুরের মধ্যে কাজগুলো সাল্টানো যাবে। সেই ভেবে পরদিন ভোরেই শিশিরের বাড়ি যায় তিমির। গিয়ে দেখে, শিশির তাদের ঘরের সামনে উঠোনে উঁচু দাবা মত করে রাখা জায়গায় মাটির ডোঙার ভেতরে থাকা মাছের মীন নিয়ে নাড়াঘাটা করছে। তিমির জিজ্ঞেস করে,“কি করছিস ওখানে শিশির?”
    -এই যে কাকা। একসপ্তা হল নৈহাটি থেকে কই, মাগুর আর তেলাপিয়ার ডিম নিয়ে ছেড়েছিলাম। এখন সেই ডিম থেকে প্রচুর মীন জন্মেছে। সেগুলোকে দেখভাল করতে হচ্ছে। ঠিক ঠিক নিয়ম মেনে এগুলোকে না দেখলে আবার এদের মড়ক শুরু হয়ে যাবে। আমার লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেয়ে নেবে। আষাঢ়, শ্রাবণ আর ভাদ্র। এই তিন মাস তো মীনেরা আমাদের সংসার চালায় দাদা। সে তো তুমি ভালোই জানো। কোন কাজ নেই এই বর্ষায়। কিছু তো করতে হবে। আর বর্ষায় কাদা জাবড়ে বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি যোগাড় করা আমার পোষায় না। তোমার অবশ্য তাতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমি পারি না। তাই এখন বড় বড় কুমোর-হাঁড়িতে বাঁকে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মীন বেচে সংসার চালাতে হয়। যাকগে। আমার কথা ছাড়ো কাকা। কি বলতে এসেছো সেটা বলো। এবার তোমার কথা শুনি। শিশির বলল।
    – তোর কাজ কারবার দেখে আমার তো বলার ইচ্ছেটা চলে গেল। এইসব মীন-টিন নিয়ে যা এখন ফেঁদে বসেছিস। পারবি তুই আমার কথা রাখতে? তাই বলতে কিন্তু কিন্তু করছি।
    -আরে কাকা, বলতে এসেছো যখন, তখন বলেই ফেলো। তোমার বলাটা আমি রাখতে পারি কি না দেখি। না শুনলে আমি বা হ্যাঁ-না বলি কেমন করে। এবার যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তিমির বলল, “রুইদাস পাড়ার সুবোধ রুইদাসের কাছে একটা ঢোল তৈরী হয়ে পড়ে আছে। কিছু টাকা কম পড়েছে বলে আনতে যেতে পারছি না। আরও দুটোর অর্ডার দেওয়া আছে। এইটার
    ডেলিভারী না নিলে অন্যগুলোতে হাত দেবে না। এটার দাম মেটালে সেই টাকা দিয়ে আবার অন্য দুটোর মাল-মেটিরিয়ালস কিনবে। তা আমি ইতিমধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে কয়টা চুবড়ি আর ঝোড়া বানিয়েছি। আরও কয়েকটা না বানালে পুরো দাম হবে না। বর্ষার পরেই তো পুজোর মরশুম। আমরা ঢোল বাজাতে বার হবো। সারা বছরের আয় তো বলা যায় এই সময়ই করে নিতে হয়। সেটা তো হাতছাড়া করা যায় না। তোরও না, আমারও না। তাই বলছিলাম কি যদি তুই আমার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ কটা তুলে দিতিস তো আজ মালটা ডেলিভারী নিতে পারতাম। শুধু আনলেই তো হল না। ওটাকে বাড়ি নিয়ে এসে সুর বেঁধে বাজিয়ে দেখতে হবে, সব ঠিকঠাক হয়েছে কি না। বেসুরো গাইলে আবার নিয়ে যেতে হবে। সেইজন্যে একটু তাড়া ছিল আরকি।”
    -কাকা, তুমি তো দেখছো আমি কিভবে এ’কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এক্ষুনি আমাকে এই ধানি-মীনগুলোকে হাঁড়িতে তুলে বাঁক নিয়ে দৌড়তে হবে পাড়ায় পাড়ায়। ফিরতে ফিরতে সেই বেলা বয়ে যাবে। তারপর খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে না হয় তোমার সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে পারি। তার আগে তো আমার সময় হচ্ছে না কাকা। তুমি কিছু মনে কোরো না।” বলে শিশির, গুড় শিউলীদের গুড় জাল দেওয়া ইঞ্চি ছয়েকের মত উঁচু করে চারধার ঘেরা টিনের চ্যাটকা ডোঙা বা পাত্রর মত হুবহু দেখতে মাটি দিয়ে তৈরী পাত্র থেকে ধানি মীন তুলে হাঁড়িতে ভরতে থাকে। তাড়াতাড়ি বার হতে হবে। রোদ মাথায় উঠে গেলে আবার সেই তাত মীনেরা সহ্য করতে পারে না। অক্কা পায়!
    শিশিরের কাজের পরিস্থিতি দেখে তিমির আর চাপ দিতে পারল না তাকে। “ঠিক আছে, তুই তোর কাজ কর” বলে সোজা চলে গেল তার আর এক সাগরেদ, পরাগের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখে পরাগ আর তার বউ, দুয়ে মিলে এক বান্ডিল মাথা কাটা তালডাগ নিয়ে সেই ডাগের উপরের চকচকে ছাল ছলতে ব্যস্ত। তিমির ভালই জানে এই তালডাগের ছাল দিয়ে ওরা কি করবে। আগে বহুদিন সে ধান-চাল পাছড়ানো কুলো বানিয়েছে। বড্ড খাটনি। তাই ছেড়ে দিয়েছে এই কাজ। কঞ্চির চেটা দিয়ে কুলোর ধড় বানাতে হয়। তারপর বাঁশের বাঁখারি চেঁছে তার সঙ্গে কুলোর ধড়টা কষে বাঁধন দিতে হয়। তাল ডাগের ওই শক্ত ছলা ছাল দিয়ে বাঁধনটা দিলে আর সহজে কুলোর ধড় থেকে চারধারের বাঁখারির বাঁধন খুলবে না। বড়ই মেহনতের কাজ। তবু পেটের টানে তাদের জাতেরা এই কাজটাও চালিয়ে যায়, যখন ঢোল-কাঁশির বাজনার কাজে মন্দা থাকে। এই মীন, চুবড়ি-ঝুড়ি বা কুলো- সবই তাদের অসময়ের অন্নদাতা। তিমির কাকাকে হঠাৎ দেখে কাজ থামিয়ে দেয় পরাগ, “কিগো কাকা, হঠাৎ! কি মনে করে?” হতাশ হয়ে তিমির বলে,“বলবো কি। শিশিরের কাছে গেলাম, সে মীন নিয়ে জেরবার। তোর কাছে এলাম তুই কুলো নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিস। ভাবছিলাম তোকে নিয়ে যাব আমার কাজে একটু যোগান দেবার জন্যে। তা তো হবার নয় দেখছি। আজও রুইদাসের কাছ থেকে ঢোলটা আনা যাবে না। আমি একা এতগুলো ঝোড়া-চুবড়ি একদিনে শেষ করতে পারব না। তৈরী হওয়া মাল পড়ে থেকে ড্যামেজ না হয়ে যায়। রুইদাস জানিয়ে দিয়েছে মাল রেডি। এরপর ড্যামেজের দায় সে আর নেবে না। এবার পুজোয় ঢোলের বায়না ধরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে মনে হয়। দলের সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। সব দায় যেন আমার।” বলে মনে মনে গজগজ করতে করতে পরাগের বাড়ি থেকে চলে আসে তিমির।

    [চুয়াল্লিশ]
    সপ্তাহ খানেক পর সেদিন সবেমাত্র সনাতন সকালের টিউশনির ব্যাচটা শেষ করে টিফিন করতে শুরু করেছে। তার সন্ধ্যের ব্যাচের ছাত্র, চঞ্চল ছুটতে ছুটতে এসে তাকে বলল, “স্যার, সুবোধ দাদুর বাড়ির সামনে আমরা খেলছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা বাইরের লোক দাদুর ঘরে ঢুকলো। তখন তোমার কথা মনে পড়লো। ওই যে তুমি বলেছিলে না, বাইরের কেউ সুবোধ দাদুর বাড়ি এলে খবর দিতে? তাই ছুটে এলুম তোমাকে জানাতে। চলি স্যার।” বলে চঞ্চল আবার দৌড় মারলো। ছেলেটা এতই ছটফটে, আরও দু’এক কথা জিজ্ঞেস করবে। সে সুযোগ দিল না। সনাতন অবশ্য বুঝে গেছে বাইরের ওই লোকটা, ওস্তাদ ঢোলক তিমির পাইক। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে মায়ের তৈরী জলে ভেজানো আধ খাওয়া চিনি-মুড়ির বাটি থালা দিয়ে ঢেকে রেখে ছুট মারলো সুবোধ কাকার বাড়ির পানে।
    তিমির পাইক তখন দেরিতে আসার জন্যে সুবোধ কাকাকে কৈফিয়ৎ দিয়ে চলেছে। সেই সময় সনাতন ঢুকতে সুবোধ কাকা বলল, “এই সনাতন এসে গেছে। ও আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে। খুব ভালো ছেলে। তোমার সাথে ওর কি বিশেষ দরকার আছে তিমির। আগে ওর কথাটা সেরে নাও। সনাতন কাজের মানুষ। সময় ওর কাছে অনেক দামি।” পরিচয় করে দিতে সনাতন প্রথমে তিমির কাকাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে সুবোধ কাকার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “কাকা, আমি নয়, আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করেছে, পাড়ার গর্ব, অলোকা দিদি। লেখাপড়া শিখে স্কুলে মাস্টারী করছে। এটাই তো আসল মুখ উজ্জ্বল করা ঘটনা!রুইদাসদের জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারি ঘটনা হয়ে গেল।” সনাতনের কাছ থেকে এই সংবাদে উৎফুল্ল হয়ে তিমির কাকা বলল,“তাই নাকি! সে তো বিশাল ব্যাপার। ভালো ভালো। খুব ভালো খবর। তা তুমি বলো তো বাবা, কি তোমার কথা?” মন থেকে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে সনাতন কোলকাতার সন্তোষবাবুদের দূর্গা পূজার মন্ডপের সমস্ত গল্প বিস্তারিতভাবে জানিয়ে ঢোল বাজাবার প্রস্তাব দিল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল তিমির পাইক। বলল,“সনাতন, তুমি বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট হলেও, প্রথম আলাপে তোমার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধা ভাব জেগে উঠেছে। বুঝেছি তুমি ঠুনকো মনের ছেলে নও। সেই তুমি যখন আমাকে নির্বাচিত করেছো তোমার তৈরী বাগানে ফুল ফোটানোর জন্যে আমরা প্রস্তুত। আশাকরি তোমার সেই মান আমরা রাখতে পারবো। তোমার সাজানো বাগানকে নেড়া বাগান করে আসব না। আবার যেদিন আসব, তোমাদের বাড়িতে যাব। সব ঠিকানা ফোন নম্বর নিয়ে কোলকাতার ওনাদের সঙ্গে আলাপ করে নেব।”
    কথা হয়ে যাবার পর আর সময় না খাইয়ে সুবোধ কাকার বাড়ি থেকে ফেরার পথে অলোকাদির সঙ্গে দেখা সনাতনের। বোঝাই যাচ্ছে দিদি স্কুলে যাচ্ছে। দু’জনের পরস্পরের হাসি বিনিময় করার পর অলোকাদি বলল, “আমাকে নিয়ে তোমাদের সভাটা এই মাসের শেষে, মানে আঠাশ তারিখে হবার কথা-না, ভাই ? ওই তারিখে আমি তো থাকতে পারব না।
    ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার প্রচুর খাতা আমার কাছে এসেছে। সেগুলো দেখে সঙ্গে সঙ্গে জমা দিতে হবে। রেজাল্ট বার করার জন্যে। ওই সময় একটা মুহূর্ত আমি নষ্ট করতে পারব না। তোমরা বরং অনুষ্ঠানটা বাতিল করে দাও। কি হবে এ’সব করে। আমার অস্বস্তি হয়।”
    -ঠিক আছে দিদি। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো না। কাজ আগে। তারপর অন্যকিছু। অনুষ্ঠান আমরা পিছিয়ে দিচ্ছি। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলে আবার দিন ঠিক করব। তবে অনুষ্ঠান বাতিল হবে না। এটা আমাদের রুইদাসদের জাত্যাভিমানের প্রশ্ন। আমাদের জাতের গরিমা করার সুযোগ যখন একবার এসেছে, সেই সুযোগকে হেলায় বইয়ে দেব কেন! তার সদ্বব্যহার আমাদের করতেই হবে। তুমিই হবে তার মধ্যমণি।” কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্ত থমকে যায় সনাতন। পরে মুখটা গম্ভীর মত করে বলল, “তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো দিদি? বেশি সময় নেব না। বিশেষ কথা। তাই বলতেই হবে তোমাকে।” তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ কাছাকাছি আছে কি না। কেউ নেই ! তবু সন্তর্পনে বলল, “বিপ্লবদা সেদিন কেমন প্রচন্ড এক ঝড় অতিক্রম করা বিধ্বস্ত মানুষের চেহারা নিয়ে আমাদের বাড়ি এল! এমন চেহারায় বিপ্লবদাকে আমি কোনদিন দেখিনি। সবসময় ফিটফাট প্রাণবন্ত বিপ্লবদাকে দেখে এসেছি। দেখে আমারও মনটা দমে গেল। আমি ছুটে গিয়ে হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতে গেলাম। এল না। শুধু বলল, “তোমার অলোকাদির সঙ্গে আমার খুব দরকার ছিল সনাতন। কি করে দেখা করি বলো তো?” উত্তরে আমি কিছু বলার আগেই বলল,“ঠিক আছে। এখন আমি আসছি। পরে কোনদিন অলোকার সঙ্গে দেখা করে নেব’খন।” বলেই হনহন করে বাজারের দিকে যাবার বড় রাস্তা ধরে চলে গেল। ঠিক তার একদিন পর হেড়ো পাগলা হঠাৎ আমার রাস্তা আগলে বলে, “খুব ঝামেলা হয়েছে বিপ্লব দাদাবাবুর বাড়ি। ওর বাবা ওকে যাচ্ছেতাই বলে পচাল দিয়েছে। আমি রাস্তা থেকে শুনেছি। তারপর জানিনি, কি হয়েছে না হয়েছে।” মনে হয় হেড়ো পাগলা ভুল কিছু বলেনি। ও তো সবসময় রাস্তায় পায়চারি করে বেড়ায়। শুনে থাকতে পারে চেঁচামেচিগুলো!”
    -হ্যাঁ। আমিও তো বিপ্লবদাকে দেখতে পাচ্ছি না। তা অনেকদিন হয়ে গেল। কথাও ছিল অনেক। তোমার সঙ্গে যদি কোনদিন আবার দেখা হয় তো বোলো তো? যদি কোথাও দেখা করতে পারি। ভাল হয় তাহলে। মনটাও যেন কেমন ‘কু’ ডাকছে। এখন চলি ভাই। স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করা যাবে না। বলে স্কুলের পথ ধরে অলোকা।
    অলোকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সনাতন, তাদের রুইদাস পাড়ার রাস্তা আর সরকারি বড় রাস্তার তেমাথানির মোড় পর্যন্ত চলে আসে। মোড়ের পুরোনো বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অলোকাদির চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতে কি যেন ভেবে উদাস হয়ে যায়। ভাবে, অলোকাদি বিপ্লবদাকে কত ভালোবাসে। বিপ্লবদাও তেমন অলোকাদি ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে না। ওর আন্তরিক ভালোবাসা আর প্রেরণাতেই তো অলোকাদির এই সাফল্য। সেটা অলোকাদি কেমন করে অস্বীকার করবে! করেও না অলোকাদি। তাই সে যখন বিপ্লবদার বিধ্বস্ত অবস্থার কথা বলল, তখন সনাতন লক্ষ্য করল, অলোকাদির চোখমুখ কেমন যেন পানসে হয়ে গেল। দুর্মর ভালবাসা ছাড়া এই প্রতিক্রিয়া কারোর হতে পারে না। কিন্তু ওদের দু’জনের সমাজ তাদের এই অসবর্ণ মেলামেশা এবং তার পরিণতিতে বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে চাইবে না। তার অশনি সংকেত যেন এখন থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে। সনাতনের মনটা সেই ভেবে একদম ভালো নেই। এমন সময় তাদের পোস্ট অফিসের ডাক পিওন, কোচি-দা সাইকেল নিয়ে এসে থামে তার সামনে। বলে,“আচ্ছা সনাতন ভাই, তুমি কি বলতে পারবে, এই সম্পদ সরকার নামটা কার? তোমাদের পাড়ার ঠিকানা দেওয়া আছে। এত বছর ধরে আমি এই কাজ করছি। কয়েকটা গ্রামের প্রায় সব লোকের বাড়ি আমার যাতায়াত এই চিঠি বিলির সূত্রে। ‘সরকার’ পদবির কেউ এই চত্বরে আছে বলে তো আমার জানা নেই। এখানে এই পদবি কবে থেকে আমদানি হল কে জানে!”
    কোচি পিওনের কথায় খানিক চিন্তায় পড়ে গেল সনাতন। ‘সরকার’ পদবি! তাও আবার তাদের রুইদাস পাড়ার ঠিকানা! সম্পদ নামে তো তাদের পাড়ায় একজনই আছে। সে তো সম্পদ ঋষি। কোলকাতায় ঠিকাদারি করে এখন। ভাল পয়সা করে ফেলেছে। নাইনে পড়তে পড়তে স্কুল পালিয়ে কোলকাতায় রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজে ভিড়ে যায়। বহুদিন তার পাড়ায় দেখা যায়নি। হঠাৎ একদিন সুটেড বুটেড হয়ে পাড়ায় তার আবির্ভাব! তাকে দেখে তো পাড়ায় সবাই হতবাক! চেহারা চালচলন দেখে মনে হল ভালই পয়সা করেছে। পুরোনো খড়ের বাড়ি ভেঙে একসাথে সেখানে দোতলা বাড়ি হাঁকিয়ে দিল। আটচালার উন্নতির জন্যে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা ডোনেশান দিল। বখে
    যাওয়া ছেলেরা তার পিছে পড়ে গেল মদ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। সে-ও দু’হাত উপুড় করে তাদের আর্জি মত সব ব্যবস্থা করে দিল। পাড়ার ওইসব ছেলেরা সম্পদ ঋষির প্রসংশায় পঞ্চমুখ। তাদের কাছে তখন সম্পদ ঋষি আর দিলখুস সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাস দুই পাড়ায় থেকে একতলাটা বসবাসের উপযুক্ত করে বানিয়ে আবার উধাও সম্পদ ঋষি। সুবোধ কাকার বাড়ির পাশেই তার অট্টালিকা। বাড়ি তৈরীর সময় সুবোধ কাকা সম্পদকে জিজ্ঞেস করেছিল,“হ্যাঁরে কাকা, তুই তো পড়া পারতিস না বলে ক্লাসে মাস্টারের কাছে বেতের বাড়ি খেতিস। সেই অপমানে পড়া ছেড়ে দিয়ে মিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজে কোলকাতায় চলে গেলি। মাথা তোর কোনোদিন পরিষ্কার ছিল না বলেই বেতের বাড়ি খেতিস। হঠাৎ তোর মাথা এমন সরেস হয়ে গেল যে গুচ্ছের টাকা আয় করতে শুরু করলি!”
    সুবোধ কাকার কথায় মুচকি হেসে সম্পদ বলল,“কাকা, মাথা পরিষ্কারের জন্যে না। ভাগ্য সহায় হবার ফলে আমার কপাল খুলে যায়। বাবুর ভীষণ নেওটা ছিলাম। একসময় বাবু আমাকে এত বিশ্বাস করে ফেলল যে আমি ছাড়া কন্ট্রাক্টর বাবু এক পা চলতে পারতো না। আমারও ভাগ্যের হাত ধরে বুদ্ধি খুলতে লাগল। বাবুর বউ বাঁজা ছিল। আমি তার সন্তানের মত হয়ে গেলাম। পরের দিকে যারা আমাদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় তারা জানতো আমি বাবুর ছেলে। তা একদিন বুকের ব্যথায় বাবু চলে গেল। ছেলে হিসেবে বাবুর সব কাজ করলাম। গিন্নিমা এখনো বেঁচে আছে। আমি বেইমানি করিনি গিন্নিমার সঙ্গে। এখনো গিন্নিমাকে আমি মায়ের চোখে দেখি। ব্যবসার সব টাকা পয়সা গিন্নিমার ব্যাঙ্কের খাতায় রাখি। ইদানিং গিন্নিমা আর ওসব দেখে না। সবটাই আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে একটা সাংঘাতিক কথা আমাকে বলেছে গিন্নিমা। বলেছে,“বাবু, আমাদের সব সম্পত্তি তোর করে দিয়ে গেলাম। এরপর যদি তুই ভাবিস আমি তোর পথের কাঁটা হয়ে রইলাম তাহলে তুই আমার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে দম আটকে মেরে দিস।” কথাটা সুবোধ কাকাকে বলতে বলতে সম্পদের গলার কাছে কে যেন দলা পাকিয়ে কথা আটকে দেয়। খানিক থেমে আবার বলে, “গিন্নিমার সেই কথায় আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। প্রতিজ্ঞা করে বলি, জীবন দিয়ে আমি তোমার পাশে থাকব গিন্নিমা। এমন কথা দ্বিতীয়বার বলে আমাকে কষ্ট দিও না।” সুবোধ কাকা এইসব কথা একদিন আটচালায় বলছিল। ভাল চিন্তার মানুষরা তাকে বাহবা দিয়েছে। আর যারা লোভী তারা তাকে ‘বোকা’ দেগে দিয়ে আফসোস করেছে। এরপর বছর গড়িয়ে গেছে সম্পদের পাত্তা নেই পাড়ায়। পাড়া তাকে ভুলতে বসেছে। সেইসময় দিনু ঋষি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতে দিনু বলে, “ও তো আমাদের সম্পদ ঋষি গো। তোমরা জানো না? ও কোর্ট থেকে এফিডেভিট করে বাপ পিতেমহের পদবি বদলে ফেলেছে। পয়সা হয়েছে। তাই জাতে উঠে গেছে। রুইদাস তো ছোট জাত। এই টাইটেল শুনলে লোকে নাকি তাকে বেঁকা চোখে দেখে। তাই জাতে ওঠার জন্যে পদবি পরিবর্তন করে ‘সরকার’ হয়েছে। ছিঃ ছিঃ। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত নিজের জাত খোয়ানোর ইচ্ছে হল! এখন ওর বিরুদ্ধে কে কথা বলতে যাবে? অঢেল পয়সা। পয়সায় পাড়ার সকলকে কিনে রেখেছে। আটচালাকেও তো শুনেছি কিনে নিয়েছে। তাই আটচালা ওকে কিছু বলছে না। তা আমরা ছাপোষা মানুষ। দিন আনি দিন খাই। আমাদের কথা কে শুনবে বলো?”
    দিনু ঋষির কাছ থেকে ঘটনাটা জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল সনাতনের। পয়সার গোমরে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করতে পারে? তার জন্মসূত্রকে এত সহজে অস্বীকার করে ফেলতে পারে? যে তা করে, সে কেমন মানুষ? এ তো নরকের কীটেরও অধম। জন্মসূত্রে আমরা অধিকারী হয়েছি আমাদের এই জাতটাকে লালন করার। আমরা এই জাতকে লুপ্তপ্রায় জাতে পরিণত করতে পারি না। একে টিকিয়ে রাখা আমাদের জন্মাধিকার। সুবোধ কাকার কাছে ওর বৃত্তান্ত শুনে সম্পদের প্রতি মনে মনে একটা স্বস্তিবোধ জেগেছিল। এখন তো তাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। ‘সরকার’ পদবি নিলে কি সে আর ‘মুচি’ রইল না! ‘সরকার’ এসে ‘মুচি’কে মুছে দিল! কি জাত হল তাহলে এখন সে? একাধারে সে সাধারণ মানুষের কাছে নিজের জন্মবৃত্তান্তকে লুকিয়ে রাখল। আর স্বজাতিকে বার্তা দিতে চাইল যে সে এই মুচি জাতটাকে ঘৃণা করে। তাই যে সূত্র ধরে তার জন্ম সেই জন্মসূত্রকে অস্বীকার করছে। অস্বীকার যখন সে করছে তখন তাদের এই জীবনযাত্রার মধ্যে তার ঠাঁই হওয়া তো উচিৎ নয়। আটচালাকেই এখন ঠিক করতে হবে জাতভ্রষ্টকে পাড়ায় ঠাঁই দেওয়া হবে কি না। এখনই আটচালাকে তাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। নচেত ভবিষ্যতে এই প্রবণতা বাড়তে থাকবে। তখন তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে সমাজের প্রান্তিক এই সম্প্রদায়টা।
    কোচি পিওনের কাছ থেকে চিঠিটা দিনু ঋষিকে নিয়ে নিতে বলল সনাতন। বলল,“ও তো তোদেরই জ্ঞাতি ভাই। তার অনুপস্থিতিতে তুই চিঠিটা নিয়ে রাখ। পরে ওটা দরকার হতে পারে। আটচালা যখন আনতে বলবে নিয়ে আসবি।”
    আটচালার এবারের মিটিংয়ে পাড়ার সমস্ত সিনিয়র মানুষদের উপস্থিত থাকা জরুরী বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসেছেও সব্বাই। আলোচনা শুরু হবার আগে সনাতন তার ভাবনাগুলো বক্তব্যের আকারে সভায় ব্যক্ত করে। সব শুনে সুবোধ কাকা বলল, “এতো তাদের রুইদাসদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে যদি এমন অপকর্ম করার জন্যে শাস্তি দেওয়া না হয় তো আর একজন পয়সার গরম দেখিয়ে বলতে পারে এই মুচি জাত নীচু জাত। এই জাতের পদবি আমি মানব না। এর ফলে পাড়ায় তো একদিন জাত-বেজাতের সমাহার হয়ে দাঁড়াবে। পুরোপুরি অস্তিত্বের সঙ্কটে এসে দাঁড়াবে রুইদাসরা। দেখা যাবে একটা সময় পর পরবর্তী ধাপের সন্তানসন্ততিরা জানতেই পারবে না চর্মকার-মুচি জাত বলে একটা স্বতন্ত্র জাত এই গ্রামে ছিল। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। সম্পদের অঢেল সম্পদ আছে, থাকুক। যেমন বিদেশে আছে নিজের গোমর নিয়ে থাকুক। আমাদের তাতে কোন আপত্তি নেই। আবার এফিডেভিট করে নিজের পদবিতে ফিরে না এলে ওকে এই পাড়ায় ঠাঁই হবে না। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে ওর তৈরী হতে থাকা পাকা বাড়ি। তার আগে ওকে একবার সুযোগ দেওয়া হবে ভুল শোধরানোর। তা না শুনে পয়সার জোরে পুলিশ দিয়ে এখানে কিছু করতে পারবে না। পুলিশ খুব ভাল করে জানে এই রুইদাস পাড়ার অনুশাসন। ওরা কোনদিন আটচালার কাজে মাথা গলায়নি। এখনো গলাবে না।” সম্পদের জ্ঞাতি, দিনু ঋষিকে ভার দেওয়া হল আটাচালার এই সিদ্ধান্ত তার কানে পৌঁছে দেবার জন্যে। সম্পদের পয়সার দম্ভের কথা ভেবে প্রথমদিকে খবরটা পৌঁছে দেবার ব্যাপারে ঘোঁত ঘোঁত করছিল দিনু। পরে চাপে পড়ে রাজি হয়। পাড়ার উপস্থিত সকল মানুষ এক বাক্যে সুবোধ কাকার সমস্ত মতামতকে স্বীকার করে নেয়। সনাতনের ভাবনার সঙ্গে সুবোধকাকার ব্যাখ্যা হুবহু মিলে যায়। স্বস্তিবোধ করে সে।
    পঞ্চায়েত নির্বাচন আগামী তিন মাসের মধ্যে হবে বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন সেই নিয়ে ব্যস্ততা তুঙ্গে। জনসংখ্যার নিরিখে সনাতনদের পাড়া থেকে এবার একজন সদস্যর কোটা নির্ধারিত হয়েছে। এলাকার মূল দুই রাজনৈতিক শিবিরের দৃষ্টি এখন ওদের পাড়ার দিকে। রুইদাস পাড়া থেকে কাকে তাদের দলের প্রতিনিধি করা যায় সেই নিয়ে চুলচেরা আলোচনা চলেছে দুই দলের মধ্যে। মূলত এ’পাড়ার কোন লোকটার প্রতি মানুষের ভালো প্রভাব তাই নিয়েই চর্চা। অপরেশ সর্দারদের দল এখন প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে দীর্ঘ বছর রাজ্যের ক্ষমতায়। সেই দলের মুখের উপর কথা বলার সাহস এখন সাধারণ মানুষের তো নেই-ই, বিরোধী দলেরও নেই! অপরেশ সর্দার একদিন দলবল নিয়ে হাজির সনাতনদের বাড়ির উঠোনে! সনাতন তখন টিউশনি পড়াচ্ছে। সকালের ব্যাচের পড়ানো তখন প্রায় শেষের দিকে। এলাকার ডাকসাইটে নেতা, অপরেশবাবুকে কে না চেনে। তাকে দেখেই সনাতন উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে সনাতন বলল,“আসুন আসুন দাদা। দাবায় উঠে আসুন।” তার ছাত্রী, সুন্দরীকে দাবায় দুটো বড় মাদুর বিছিয়ে দিতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাচটাকে ছুটি দিয়ে দিল। সনাতনের আহ্বান মত ওনারা এসে দাবায় বসতে বসতে বলল, “তোমার সঙ্গে একটা বিশেষ দরকারে আমরা এসেছি। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে আমরা এসেছি মানে বুঝতে পারছো দরকারটা ব্যক্তিগত নয়, রাজনৈতিক।” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “সে কথা তো হবে। তার আগে যদি অনুমতি দেন তো একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। আপনাদের মত বড় মানুষ আমাদের এই গরিব ঘরে এসেছেন। সামান্য একটু চা দিয়ে যদি আপ্যায়ন করতে পারি তো আমরা ধন্য হয়ে যাব।”
    সনাতনের কথা এবং ব্যবহারে তৃপ্ত বোধ করে অপরেশবাবু। পাশে বসে থাকা সহকর্মীকে ফিসফিসিয়ে বলল, “ছেলেটা বেশ সোবার তো? তোমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত মনে হচ্ছে তো একদম সঠিক। এই ছেলের জনভিত্তি না থেকে পারে না। এখন তার পছন্দের ছেলে যদি চায়ের অফার করে প্রত্যাখ্যান করে কি করে। কথা না বাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে দেয় অপরেশবাবু।
    অন্য ছাত্রীদের ছুটি দিলেও সুন্দরীকে থেকে যেতে বলে, সনাতন। এতগুলো লোক তার বাড়িতে এসেছে। চা-টার তো ব্যবস্থা করতেই হবে। সেটা আগাম বুঝে সুন্দরীকে আটকে দেয়। মা একা সবকিছু সামলাতে পারবে না। সম্মতি পেয়ে সুন্দরীকে তাড়াতাড়ি চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে অপরেশবাবুদের কাছে এসে বসল সনাতন। বলল, “বলুন দাদা আপনার মত বড় মানুষের আমার কি দরকার?” অপরেশবাবু বলল, “সনাতন তোমাকে আমাদের দলের প্রতিনিধি হয়ে তোমাদের পাড়ায় দাঁড়াতে হবে। তুমি জানো কি না জানিনা, এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তোমাদের রুইদাস পাড়া, পালপাড়া এবং পদ্মরাজ পাড়া নিয়ে একটা নতুন সীট বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী জনসংখ্যার নিরিখে এটা হয়েছে। এটা আমাদের লোক্যাল কমিটির প্রস্তাব এবং জেলা কমিটি থেকে তা মঞ্জুর হয়ে এসেছে। আমরা এসেছি তোমার সম্মতি নিতে।”
    সনাতন কোনদিন ভাবেনি যে রাজনৈতিক দল থেকে এমন প্রস্তাব তার কাছে কোনদিন আসতে পারে। কেননা সে কোনদিন রাজনীতির ধারেকাছে যায়নি। ভালও লাগে না তার। তার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা গেঁথে আছে যে রাজনীতি মানেই হইহুল্লোড়, মারপিট, মিথ্যাচার, হিংসার বাতাবরণের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আর ক্ষমতা ভোগের অহমিকা। আর এই ধারণা তার মন থেকে মুছে ফেলা মুশকিল। অপরেশবাবুর মত বড় নেতা এসেছে মানেই গদগদ হয়ে বা ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে তার কথায় মাথা হেলে দেবে, সে ধাতের ছেলে নয় সনাতন। সে বলল,“দাদা, আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। কোন দলের হয়ে কোনও কাজ করিনি। সেই আমাকে কেন আপনাদের দলে টানতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। সেইসঙ্গে আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই, আমি কিন্তু ভবিষ্যতেও কোনদিন রাজনীতিতে ঢুকব না। আমি পছন্দ করি না। দয়া করে আমাকে এই অনুরোধটা করবেন না। বলে সনাতন চায়ের দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।”
    অপরেশবাবু মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটা যেমন ভদ্র তেমন দৃঢ়চেতাও বটে। এমন ছেলেকেই আমাদের দরকার। সনাতন সেখান থেকে চলে যাবার পরে সহকর্মীদের সঙ্গে একটু আলোচনা সেরে নিল। তারপর সনাতন ফিরে এলে হাসি মুখে তাকে বলল, “তোমাকে আমরা আমাদের দলের সদস্য হতে বলছি না। তাহলে তো তোমার ভাবনামত তুমি দলগত রাজনীতি করছো না। দলহীন প্রার্থী হতে এরপর নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি থাকার কথা না। আমাদের দলের সমর্থনে তোমাকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে বলছি। পরিষ্কার কথা, তোমাকে, তোমার মত করে আমাদের মধ্যে পেতে চাই।” এরপর সনাতন কোন পাল্টা যুক্তি দিয়ে অপরেশবাবুদের উপেক্ষা করতে পারল না। আসলে এরা হচ্ছে দুঁদে রাজনীতিবিদ। কোন ঠাকুর কোন ফুলে তুষ্ট হয় এরা তা খুব ভাল করে জানে। যুক্তির জালে এমন জড়িয়ে দেবে যে তার থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
    নির্বাচনে সনাতন বিপুল ভোটে জিতে গেল। তার বিপক্ষ দলের প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়ে গেল। অপরেশবাবুর দলও পঞ্চায়েতের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে পঞ্চায়েতরাজ দখল করে নিল। তাদের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটে লীড দিয়েছে সনাতন রুইদাস। তাছাড়া ওর জীবনশৃঙ্খল, কাজের দক্ষতা এবং মানুষের মনহরণের ক্ষমতা অপরেশবাবুরা পরখ করেছে নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন। অপরেশবাবুর মনে হয়েছে এই সনাতন রুইদাসই প্রধান হবার উপযুক্ত। ওর মত যোগ্য প্রার্থী তাদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে কেউ নেই।
    প্রধান হয়ে সনাতনের ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে গেল। চার ব্যাচ টিউশনি পড়ানোর সময় সে একদম দিতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত সকালের মেয়েদের ব্যাচ এবং বিকেলে তাদের পাড়ার ছাত্রদের ব্যাচ রেখে দিয়ে অন্য দুটো ব্যাচ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। সুষ্ঠভাবে এবং সততার সঙ্গে পঞ্চায়েত পরিচালনার একটা নজির রাখতে শুরু করল সনাতনের দক্ষ হাত। তার নিজের পাড়া থেকে এবার দাবি উঠল, আটচালা পরিচালনায় সনাতনকে যুক্ত করতে হবে। একজন পঞ্চায়েত প্রধান, যে তাদেরই পাড়ার সন্তান সে যদি আটচালার কমিটিতে থাকে তাহলে গ্রামের আরও অনেক উন্নতি হবে। অন্যদিকে পাড়ার একটা ছোকরা, সেদিনের ছেলে, সে কিনা তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে? পাড়ার কোনো কোনো বয়স্ক মানুষ সেটা মেনে নিতে চাইছিল না। বিরোধিতাও করেছে। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠের প্রবল চাপে সেই ক্ষীণ প্রতিরোধ ধোপে টেকেনি।
    তখনও নিজের পেচ্ছাপ-পাইখানার কাজটা নিজে সেরে নিতে পারতো রেখা বউয়ের শাশুড়ি। মনে হয় ও বুঝতে পেরেছিল, তার শেষের দিন আর বেশি দূরে নেই। সেই ভেবে রেখার অগোচরে অতীতে বাড়িতে বহুল ব্যবহৃত ছোট্ট কৌটোটা বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখে ভীষ্মর মা। পরপর করেকবার ছোট আকারে বুকের হৃদপিন্ড ধাক্কা খেয়েছে। ডাক্তার বলেছে,খুব সাবধানে রাখতে। চলাফেরা একদম করা চলবে না। ডাক্তারের পরামর্শমত ওষুধপত্রর সব ব্যবস্থা করে রেখেছে অখিল। কিন্তু বিছানাই এখন হয়ে গেল ভীষ্মর মায়ের পৃথিবী। মনে হয় আর বেশিদিন এই পৃথিবী তাকে ঠাঁই দেবে না। বুঝে গেছে রেখার শাশুড়ি।
    রেখার কান্নাকাটিতে পাশের বাড়ির বউরা দেখেতে এসে খবরটা চাউর হয়ে যায় মন্ডল পাড়ায়। পাড়ার আরও পুরুষ মহিলারা এসে পড়েছে। রোজকারের মত সকালে অখিলও এসে পড়েছে রুগিকে দেখতে। তখনও বুড়ি হাত-পা নাড়ছে, টুকটাক কথা বলতে পারছে। হঠাৎ বুড়ি অখিলকে কাছে ডেকে নেয়। কোনোদিন এমন কাতরভাবে তাকে কাছে ডাকেনি সে। অবাক করে অখিলকে! আরও যেন অবাক করা দৃশ্যের সাক্ষী হবার অপেক্ষায় ছিল তাদের ঘরের এই ছোট্ট পৃথিবীটা। মেয়ে রেখাকেও কাছে টেনে নেয়। এবার মাথার বালিশের তলা থেকে সেই অমূল্য কৌটো বার করে অখিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,“আমার মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর দান করো বাবা। যতক্ষণ না তুমি কাজটা শেষ করছো ততক্ষণ যমরাজ অপেক্ষায় থাকবে। আমাকে তুলে নেবে না। তুমি আমাকে মুক্তি দাও বাবা। আমি নিশ্চিন্তে তাহলে ওপারে চলে যেতে পারি।” একঘর পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে অখিল রেখার সিঁথিতে হৃদয় উজাড় করে সিঁদুর পরিয়ে দিল। কিছু কালের জন্যে যেন সেই পৃথিবী মূক হয়ে রইল ! মুক্ত হল রেখার মা। নব জীবনের অধিকারিনী রেখার চোখের জলের ধারায় শোধন হতে থাকল তার বৈধব্য জীবন-সহ চরাচরের মলিন যা কিছু সব। সব।
    এক গ্রাম সাক্ষী থেকে অখিল রেখাকে বিয়ে করেছে। উল্কার বেগে খবরটা ছড়িয়ে গেল আশপাশের এলাকা সহ তাদের রুইদাস পাড়াতেও। তেতে উঠতে সময় নিল না, অখিলের প্রবল বিরুদ্ধপক্ষ নোচে-বিন্দেদের দল। ছোটাছুটি পড়ে গেল পাড়ায়। প্রবল দাবি উঠতে থাকলো এই অন্যায়ের একটা বিহিত করার জন্যে। আটচালার উপর চাপ আসতে লাগল। কালবিলম্ব না করে অখিলের এই জঘন্য কাজের বিচার করতে হবে।
    বিচারসভায় অভিযোগকারিদের পক্ষে অভয় বলল,“একজন বেজাতের বিধবা বউকে বিয়ে করে অখিল তাদের রুইদাসদের মানসম্মান মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছে। ওকে অনেক আগে থেকে সাবধান করা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে এই নোংরা কাজ করেছে। ব্যবসার ছুতোয় অখিল মেয়েদের সঙ্গে অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকে এটাই তার প্রমাণ। ওকে গ্রামছাড়া করা হোক। নাহলে অন্যেরা এই কাজে প্রভাবিত হতে পারে। তা তাদের সমাজের পক্ষে চরম ক্ষতিকর হবে। এই নোংরামো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।”
    এবার অখিলের বলার সুযোগ আসতে সে বলল,“জেনেশুনেই সে একজন অরক্ষণীয়া স্বামীহারা মেয়ের পুর্ণজীবন দান করেছে। রেখার শাশুড়ি মারা যাবার পর ওকে রক্ষা করার জন্যে পৃথিবীতে কেউ ছিল না। নাহলে একটা স্বল্পবয়সী অসহায় যুবতীর শরীর কুকুর-শেয়ালে ছিঁড়ে খেতে পারতো। জাতপাতের উর্দ্ধ্বে যদি কেউ কারোর কাছে জীবনভিক্ষা চায় আমাদের প্রথম কর্তব্য হয় সাধ্যমত তার পাশে দাঁড়ানো। আমি ঠিক সেই কাজটা করেছি। আমি তো আমার জাত খোয়াইনি! মানবতার পাঠ নিয়েছি। আমি নির্দোষ। এই অন্যায় অভিযোগ থেকে আমাকে আটচালা রেহাই দিক, এটাই আমার প্রার্থনা।” এরপর অভিযোগকারিদের কোনো কথা বলার আছে কি না প্রশ্ন করতে গিয়ে সনাতনরা দেখে তারা আশেপাশে কোথাও নেই! কখন যেন উধাও হয়ে গেছে!

    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২১)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

     

    [একচল্লিশ]

    একাশি শতাংশ নম্বর নিয়ে হায়ারসেকেন্ডারী পাশ করল সনাতন। ইচ্ছা ছিল বিপ্লবদার মত কলেজের পড়া শেষ করে এম.এ.করবে। ইংরেজী অনার্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করতো। বিরানব্বুই নম্বর পেয়েছে ইংরেজীতে। ডায়মন্ড হারবার কলেজে সহজেই চান্স পেতে পারে। কিন্তু এই এগিয়ে যাবার ভাবনাকে পিছু টেনে ধরল তার অভাবী সংসার। বাবার হার্টের ব্যামো ধরা পড়ল। বাবার যাবতীয় শারীরিক পরিশ্রম বন্ধ। কড়া দাওয়াই ডাক্তারের, “বাবাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তো গতরে খাটা কাজ বন্ধ করতে হবে। টুকটাক চলাফেরা বা বসে থাকা কাজ করা যেতে পারে।” সেইমত বাজারের জুতো-ব্যাগ সারাইয়ের ফুটের দোকানে দু’বেলা কোনোমতে গিয়ে বসে। বসলে কি হবে আগের মত চটপটিয়ে গোছানো কাজ করতে পারে না। সেইজন্যে খদ্দেরও আস্তে আস্তে অন্য দোকানে চলে যেতে থাকে। দোকান থেকে আয়ে বাবার হাত খরচাটা হয়তো কোন রকমে চলে যায়। কিন্তু সংসার? সংসার তাদের চলবে কেমন করে? প্রশ্নটা এসে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল সনাতনের ঘাড়ে! ঘাড় থেকে এই ভারি পাথর সরিয়ে তার আর কলেজে পড়ার স্বপ্ন বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে পারল না।
    সনাতন ঠিক করল প্রাইভেট টিউশনির ব্যাচ বাড়িয়ে দেবে। তাদের জাত কারবার চামড়া বা বেতের কাজে কোনদিন তেমনভাবে রপ্ত করা তার হয়ে ওঠেনি। আসলে ওগুলোতে ওর মন টানতো না। বাবাও সে জন্যে তার উপর কোনদিন জোর খাটায়নি। বাবা মায়ের কাছে বলতো, “ছেলে যে কাজ করলে খুশি হবে সেই কাজ সে করুক। তারা রুইদাস বলে রুইদাসদের জাত কারবারে ঢুকতে হবে তার কোন মানে নেই।” তাই চাপ না থাকায় এই কাজে সে মাথা গলায়নি। অবশ্য ঢাক বাজানোর কাজটা সে ভাল করে রপ্ত করতে পেরেছিল। এখনো ওটার প্রতি তার অনিহা জন্মায়নি। ভগবানের প্রতি নিবেদিত এই বাজনার সুর-তাল-লয়। একে অবজ্ঞা করা তার সধ্যের বাইরে। তবে বাবা সঙ্গে না থাকলে সে কেমন করে রোজগারের জন্যে ঢাক হাতে নেবে! ঢাকের সঙ্গী যদি তার বাবা, রতন রুইদাস হয় তো তার ইচ্ছাশক্তি তখন প্রবল হয়ে যায়। আর এই বাজনার কাজ তো সম্বচ্ছর হয় না। মরসুমী পেশা এটা। এখন সর্বক্ষণের রোজগারের পথ একমাত্র তার সামনে খোলা রইল এই টিউশনি।
    মেয়েদের ব্যাচটাকে কোনো ডিস্টার্ব করতে চায় না সে। তবে সকালে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে আর একটা ব্যাচ বাড়ায়। ঠিক করল যদি ছাত্রছাত্রী বাড়ে তো সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত আরও দুটো ব্যাচ খুলে দেবে। তবে সন্ধ্যের ব্যাচ দুটোতে কোন মেয়েকে সে পড়াবে না। মেয়েদের রাতের অন্ধকারে আসা যাওয়া করার ঝুঁকি সে নিতে পারবে না। ঠিকও হবে না। অমঙ্গল কখনো বলে আসে না। সুযোগ বুঝে শিকারের উপর হামলে পড়ে। পাড়া গাঁয়ে যেমন গাছপালা-প্রকৃতির দাপটে এবং বিজলি আলোর অভাবে কালো-অন্ধকারের আধিক্য বেশি। তেমনি কালো-মনের মানুষেরও অভাব নেই। সংসারের চাকা গড়াতে গেলে এ ছাড়া তার সামনে আর বিকল্প কিছু রইল না বলেই এই সিদ্ধান্ত।
    বাবার অসুস্থতার কথা জেনে মেয়েদের ব্যাচের এক ছাত্রী, সুলতা বলে, “স্যার ডায়মন্ড হারবারে একজন বড় ডাক্তার আছে, আমার বাবার বন্ধু। বাবাকে বলবো, ওই ডাক্তার জ্যেঠুকে দেখাবার ব্যবস্থা করার জন্যে? বাবা বলে দিলে পয়সা লাগবে না। মনে হয় ওনার চিকিৎসায় আপনার বাবা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার বাবার অসুখের জন্যে আপনার মন খারাপ। তার জন্যে আমাদেরও মন কেমন করে।” মেয়েরা এমনিতেই স্পর্শকাতর হয়। তাই বলে তার মাস্টামশাইয়ের বাবার জন্যে তাদের মন কেমন করছে জেনে মনের মধ্যে এক গভীর তৃপ্তি বোধ কাজ করে যায়। সুলতার এই প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে শান্তচিত্তে সনাতন বলল, “আমাদের কুঞ্জ ডাক্তারবাবু দেখছেন। রোগ ধরতে পেরেছেন। সেইভাবে চিকিৎসা চলছে। বাবা এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছে। তুমি তোমার বাবাকে বলে রেখো, যদি প্রয়োজন হয় নিশ্চয়ই আমরা তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।” সনাতন মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলতে খুশি হয়। বলে, “ঠিক আছে স্যার। আগে থেকে আমি বাবাকে বলে রাখবো’খন।”
    পরদিন পড়ানোর দিন ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখহাত ধুয়ে ঘরের দাবায় বসে সনাতন মায়ের সঙ্গে চা খাচ্ছে। সেই সময় হঠাৎ সুন্দরী দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির, কোনকিছুর ভূমিকা না করে একটা সাদা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে সনাতনের মায়ের হাতে দিয়ে বলল, “জ্যেঠিমা, এতে অশ্বগন্ধা গাছের শেকড় আছে। মা বলেছে, খলে বেটে রোজ সকালে খালি পেটে এক চামচ করে জ্যেঠাকে খাইয়ে দিতে। তাহলে জ্যেঠা তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে। রোজ খাওয়াবে কিন্তু জ্যেঠিমা। একদম ভুল যেন না হয়। তোমাদের খল-নোড়া নেই না? ঠিক আছে, আমাদের বাড়িতে একস্ট্রা একটা পড়ে আছে। মা’কে বলে নিয়ে আসি গে। চলি।” বলে পিঠটান দেবার সময় সনাতন ডাকে, “সুন্দরী শোন। দাঁড়া দু’দন্ড! অত ছটফট করছিস কেন? তুই জানলি কেমন করে যে এতে বাবা সেরে উঠবে?”
    স্যার একথা বলা মাত্র শক্ত ডাঙ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সুন্দরী। তারপর মাথা নীচু করে তার স্বভাববিরুদ্ধ ঢঙে, শান্তভাবে বলল, “মা’কে বললাম, স্যারের বাবার হার্টের প্রবলেম হয়েছে। কোন ওষুধ তোমার জানা আছে মা? দাও না, দিয়ে আসি। স্যারের মুখ দেখে মনে হ’ল, স্যারের মনটা খুব খারাপ। মা তখন এটা দিল। আমাদের শরীর খারাপ হলে মা এইসব গাছগাছড়া, শেকড়-বাকড়ের ওষুধ দেয়। অসুখ সেরেও যায়। মা এসব জানে। তাই মাকে বললাম, মা দিয়ে দিল।” বলে আবার সনাতনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “জ্যেঠিমা, আমি আসছি। যেমন বললাম সেইভাবে জ্যেঠাকে খাইয়ে দিও কিন্তু।” আবার সেই ছটফট করে ওঠে, চলে যাবার জন্যে। সনাতন ফিরে তাকে ডাকে, “চলে যাচ্ছিস যে সুন্দরী? আমার কথা তো শেষ হয়নি। তুই কি খুব ব্যস্ত আছিস? পড়াশোনা করছিস নিশ্চয়ই? তাই এত ব্যস্ততা তোর? নাকি এমনি এমনি এখান থেকে পালাতে চাইছিস? সে তো তুই যাবি। থাকার জন্যে তো আসিসনি জানি।” একটু থেমে আবার সুন্দরীকে ঠাট্টা করে রাগিয়ে দেবার জন্যে বলল, “তা তুই শুধুমুধু পড়া ক্ষতি করে ছুটে এখানে আসতে গেলি কেন? বললে তো আমি বা মা তোর মায়ের কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে আসতে পারতাম। ওঁ-হুঁ। আমার মনে হয় শুধু ওষুধ দিতে তুই আসিসনি। ওষুধ দিতে আসার ছুতোয় আমার মায়ের সঙ্গে দেখাও করতে এসেছিস। কি, তাই কি না বল, সুন্দরী? চুপ করে থাকিস না, বল আমি ভুল বললাম কি না?”
    “আমি জানি না যাও…” বলে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে দাবা থেকে নেমে উঠোন ফুঁড়ে দৌড়ে পালালো, সুন্দরী !
    সনাতনের কথায় মেয়েটা যে লজ্জা পেয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে মা বলল, “কেন মিছিমিছি মেয়েটার পেছনে লাগতে গেলি? সে কোথায় তোদের উপকার করতে এল। বাহবা দিবি তাকে। না, উল্টে ক্ষেপিয়ে দিলি। এবার দেখবি পড়ার সময় বাদে অন্য সময় তুই বাড়ি থাকলে ও আর এ’মুখো হবে না। বড়ই ছটফটে হাসিখুশি মেয়ে। ওর মনটা কত সরল একবার ভেবে দেখ। তোর আরও ছাত্রী আছে। সুন্দরীর মত তো মনের হয় কেউ না। দেখতেও কেমন মিষ্টি মিষ্টি। আর কোনদিন ওকে ক্ষেপাবি না বলে দিলাম।”
    সুন্দরীর কথা মত রোজ সকালে অশ্বগন্ধা শেকড় খলে বেটে এক চামচ করে খাওয়ায় সনাতনের মা। খল-নোড়াটা পরদিন সনাতনের মা নিজেই সুন্দরীর মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছে, বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে। মায়ের সাথে যখন স্যারের মা কথা বলছে, সেইসময় সুন্দরী এসে বলে, “জেঠিমা, আমি গেছিলাম খলটা নিয়ে। তোমাদের বাড়ি উঁকি মেরে দেখি তুমি নেই। স্যার বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। স্যার যদি দেখতে পায়, সেই ভয়ে পালিয়ে এসেছি। আবার যদি দাঁড় করিয়ে কিসব প্রশ্ন করে? তাই।”
    -তা স্যারের দেখে তোর ভয় কিসের। স্যার কি বাঘ-ভাল্লুক! কেন পড়ার সময় স্যার তোদের বকাঝকা করে বুঝি? সেইজন্যে ভয় পাস। কিন্তু তোদের স্যার তো শান্তশিষ্ট মানুষ। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সনাতনের মা বলল।
    সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী বলল, “না না জ্যেঠিমা। স্যার পড়ানোর সময় একদম বকাঝকা করে না। খুব সুন্দর করে বোঝায় আমাদের। এত ভাল করে বোঝায় যে বাড়িতে এসে আর সেই বিষয়টা পড়ার দরকার হয় না। স্যারের মত মানুষ হয় না।”
    -তাহলে স্যারের দেখে ভয় পাস কেন, সেটা বল?
    -জানি না যাও। বলে সেখান থেকে পোঁও দৌড় দিল সুন্দরী ! সনাতনের মা, পুষ্প সুন্দরীর চপলতায় মনে মনে তৃপ্তি বোধ করে। ভাবে, মেয়েটাকে তাদের ঘরের বউ করলে মন্দ হয় না। মেয়েটার বুক ফাটে। মেয়ে হয়ে পুষ্প খুব ভাল করে তা বুঝতে পারে। তবু মুখে কাউকে বলার সাহস পায় না বেচারাটা। শরীরী ভাষায় তার ইঙ্গিত দিয়ে যায়, তার স্যারকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তার ছেলে বুঝেছে কিনা কে জানে। বুঝলে তো ভাল। মনের মত একটা বউমা তার ঘরে তুলতে পারে।
    বিকেলে সনাতন বাবার সঙ্গে দোকানে আছে। সে দেখেছে, একটা লোক ভ্যান রিক্সায় করে ওই শাকপাতা, শেকড়-জরিবুটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। ও মনে মনে ঠিক করে, ওই লোকটাকে দেখতে পেলে ধরবে তাকে। কিন্তু ক’দিন হয়ে গেল শেকড়ওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাজারে সে আসছে না নিশ্চয়ই। তাহলে দেখা তো হতোই। হঠাৎ একদিন তাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে বাবাকে কিছু না বলে উঠে গিয়ে লোকটাকে ধরে, “আচ্ছা দাদা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, বলবেন আমাকে। ভীষণ প্রয়োজন আমার।” লোকটা বলল, বলুন না কি দরকার। আমার জানা থাকলে বলবো না কেন? আমাদের চারপাশে প্রকৃতির মধ্যেই কত ওষধী গুণ লুকিয়ে রয়েছে। আমরা যদি তাকে কাজে লাগাই তো ওই হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিলাসী চিকিৎসা ব্যবস্থার ফাঁদে পড়তে হয় না। শেকড়-বাকড়, গাছপালার উপকারিতা মানুষকে জানানোর জন্যেই তো আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আপনি দ্বিধা না করে বলতে পারেন।” লোকটার কথায় উদ্দীপিত হয়ে সনাতন বলল,“আপনি একটু বলবেন, অশ্বগন্ধা গাছের শিকড় মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কতটা কাজ করে? আমার বাবার হার্টের সমস্যা হয়েছে। এ্যালোপ্যাথি ডাক্তার দেখেছেন। এখন একটু নিয়ন্ত্রণে আছে। সে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের এক পরিচিত মানুষ বাবাকে এই অশ্বগন্ধার শেকড় খলে বেটে রোজ সকালে খালি পেটে এক চামচ করে খেতে বলেছে। ওটা কি খাওয়া যেতে পারে? এ’ব্যাপারে আমরা তো অনভিজ্ঞ। যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি। আপনি তো এই নিয়ে সবসময় কাজ করছেন। সেইজন্যে ক’দিন ভ’র আপনাকে খুঁজছিলাম। আজকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলাম।” সনাতনের কথায় উৎসাহিত হয়ে লোকটা বলল,“যিনি এটা খেতে দিয়েছেন তিনি একদম নবিশ মানুষ নন। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন শক্ত অসুখে সাহস করে এই অশ্বগন্ধার শেকড় খেতে দিতে পারতেন না। একদম ঠিক ঠিক ওষুধ চেলেছেন তিনি। একটা তথ্য আপনাকে দিচ্ছি, প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে এই অশ্বগন্ধা গাছের শিকড়, পাতা ও কমলা-লাল রঙের ফল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশেষত জীবনীশক্তি, ধৈর্য, দৃঢ়তা, আয়ুবৃদ্ধি, হৃদয়ঘটিত সমস্যার নিরাময়ের জন্যে এই অশ্বগন্ধা গাছকে ব্যবহার করার কথা বলা হয়ে আসছে। এমনকি বর্তমানে ভারত সহ বিশ্বের কিছু দেশে এই অশ্বগন্ধা গাছের শিকড়, পাতা, বীজ এমনকি ফল বিভিন্ন ওষুধের সক্রিয় উপাদান রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের কাজে লাগছে। তাই বলছি, এর গুণের অন্ত নেই। আপনি নিশ্চিন্তে এটা আপনার বাবাকে খাইয়ে যেতে পারেন।” লোকটার কথা শুনে সনাতন একাধারে যেমন অবাক হয়ে গেল, সুন্দরীর মায়ের যোগ্যতা দেখে তেমনি এটা খাওয়ানোর জন্যে মনে মনে যে উদ্বেগ ছিল তা নিরসন হল। ভাবলো এমন একজন গুণী মানুষ নীরবে তার চিকিৎসার কাজ করে চলেছে, অথচ কেউ তা জানে না। এতদিন যদি সেটা জানা যেত তো অসুখবিসুখে ওই মহিলার হাত ধরে তাদের মত গরিব সমাজ কত না উপকৃত হত।
    নিত্যদিনের মত ভোরে উঠে পুষ্প তাদের মাটির ঘরের দাবা, দাবার সঙ্গে কানাচে গোবর মাটি দিয়ে নেতা দিতে শুরু করে। হঠাৎ বিষ্ময়ের সঙ্গে সে লক্ষ্য করে দাবার কোনায় দেয়ালে রোজকারের মত আড় করে ঠেকনা দিয়ে রাখা তাদের বাটনা বাটা শীল-নোড়া দুটো দেয়াল থেকে সরে এসে সিধে হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন ওগুলো খুব সন্তর্পনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে! কিছুক্ষণ সেদিকে ঠায় তাকিয়ে আছে পুষ্প! মনে হল, আবার সামান্য একটু এগিয়ে এল! এবার আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। চেঁচিয়ে ছেলেকে ডাকতে লাগল, “ও সনাতন, ওঠ ওঠ বাবা। এখানে কি কান্ডটা হচ্ছে দেখবি আয় বাবা! ও সনাতন উঠলি? দেখবি আয় না রে বাবা, শীল-নোড়া কেমন দাবায় হাঁটাহাঁটি করছে!” এত ডাকাডাকিতেও ছেলেটা ঘুমে কাদা। ওর বাপও তাই! কি ব্যাপার বুঝতে পারছে না পুষ্প! সনাতনের বাবাকে জোর করে ডাকছে না, লোকটার বুকের ব্যামো বলে। হঠাৎ চমকে ওঠা এই ব্যামোর পক্ষে ক্ষতিকর তাই। ডাক্তার বলেছে- চমকানো, ধমকানো, চেঁচামেচি এই
    রোগের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। সেদিক থেকে সাবধান থাকতে বলেছে। অগত্যা পুষ্প পাশের বাড়ির লোকজনকে বলে। দৌড়ে যায় সুন্দরীর মায়ের কাছে, এই অবাক করা কান্ডর কথা জানাতে।
    এবার একে একে লোকমুখে পাড়াময় হয়ে যায়। সুন্দরী, তার মা-বাবাও ছুটে আসে সনাতনদের বাড়ি। দেখে, সত্যি সত্যি বারান্দায় শীল-নোড়া দেয়াল থেকে একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পেছনে কোন ঠেকনা দেওয়া নেই! পাড়ার মানুষরা এবার উজিয়ে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অবিশ্বাস্য এই সংবাদটা পাড়ার গন্ডি টপকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর হয়ে যায়। নামতে থাকে মানুষের ঢল ! উপচে পড়তে থাকে সনাতনদের বাড়ি, উঠোন, রাস্তাঘাট ! গিজগিজে হয়ে যায় লোকের ভিড়ে। সুন্দরীরা যখন আসে তখন সবে এক-দুই করে মানুষের জটলা শুরু হচ্ছে। অবস্থা দেখে সুন্দরী নিজেই তার সনাতন স্যারের শোবার ঘরে ঢুকে যায়। কোনকিছু না ভেবেই স্যারের পায়ের দিকে হাত ছুঁয়ে ঠেলা মারে। এক ঠেলাতেই ঘুম ছুটে যায় সনাতনের। এমন নরম মোলায়েম হাতের ছোঁয়া তো ও জীবনে অনুভব করেনি! হৃদয়ে কাঁপ ধরানো এই হাত কার! চোখ খুলতেই আর এক চমক তাকে গ্রাস করে। সুন্দরী! সে ডাকে কেন? মনে হল এই মায়াবী পরশ কেবল তার পা কেন তার সর্বাঙ্গ অনুভবে একাকার হওয়ার তো উপযুক্ত। সে সুখ ভাল করে আত্মস্থ করার ফুরসৎ কেড়ে নিল তার ঘরের বাইরের কোলাহল ! বিস্ময়মাখা দু’চোখ নিয়ে সুন্দরীকে বলে, “বাইরে কি হয়েছে, সুন্দরী? বাবার কি কোন কিছু?” সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী তার কথা থামিয়ে বলে, “না না স্যার। জ্যেঠু ঠিক আছে। তুমি ওঠ। বাইরে অন্য এক অঘটন ঘটে গেছে! দেখবে আসো। একদম দেরি করবে না।”
    সুন্দরীর কথায় মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরের কান্ড দেখে যারপরনাই হতভম্ব সনাতন! একটা শীল-নোড়া দেয়ালে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। সেটা সোজা হয়ে গেছে, কোন ঠেকা না দিয়েও একই ভাবে আছে। এই দৃশ্য দেখতে এতো মানুষ! অলৌকিক ঘটনা বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে! বলছে, ভগবান শিব আর মা দূর্গা জাগ্রত হয়ে তাদের বাড়ি অধিষ্ঠান করেছে। ওগুলো নাকি আবার খুব সুক্ষ্মভাবে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে, মানে হাঁটছে! একটা অবিশ্বাস্য অবাস্তব ঘটনা কেমনভাবে মানুষের মনে ভগবায়ন হয়ে যায় ভেবে বিস্ময়ে বিমুঢ় সনাতন! কিন্তু এত মানুষের ভাবনার বিরুদ্ধে সে একা কেমন করে বিপরীত মত প্রকাশ করতে পারে! পারবে না। ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে এই হাজার হাজার মানবকন্ঠ ! শুধু হাতে কলমে পরীক্ষার জন্যে একটা কাস্তে নিয়ে এসে ওই শীল-নোড়ার একদম গা ঘেঁষে স্পষ্ট আঁক কেটে দিল সে। প্রমাণ করাতে চায় যে এই পাথর যুগলের চলন ক্ষমতা কোনদিন ছিল না, এখন নেই এবং ভবিষ্যতে থাকবেও না। কিন্তু সে যা ভাবলো, বাস্তবে ঘটল তার বিপরীত ঘটনা। মানুষ হই হই করে চেঁচিয়ে উঠল, কাস্তে দিয়ে তার ওই দাগ কাটার বিরুদ্ধে। কেন ছেলেটা পাকামো করে লোহা দিয়ে আঁক কাটতে গেল? এবার তো বাবা শিব রুষ্ট হয়ে প্রলয় কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে তাদের পাড়া-গাঁ। বাবা বটুকনাথকে ঠান্ডা না করতে পারলে ঘোর অমানিশা নেমে আসবে তাদের জীবনে। সেই ভাবনায় মানুষ একের পর এক ঘটি দিয়ে ওই শীল-নোড়ার মাথায় জল ঢালতে শুরু করে। কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যে বরফের টুকরো নিয়ে এসে তার মাথায় চড়িয়ে দিয়ে যায়। আর সুন্দরী? তার কান্ড আবার চোখে পড়ার মত। সে সমানে সেই জল কাপড়ে ছুপে ছুপে বালতিতে ভরে বাইরে ফেলতে থাকে। না হলে যে বাড়িময় জলে চান হয়ে যাবে। ক্ষতি হয়ে যাবে তার স্যারেদের মাটির ঘরদোর। সনাতন দেখলো এই মেয়েটাকে না আটকালে তো সারাক্ষণ বরফজল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঠান্ডা লেগে অসুখে পড়ে যাবে! উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলে, “আপনাদের হাতে পায়ে ধরে আমি আমার কৃতকর্মের জন্যে বাবা বটুকনাথ এবং মা গৌরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে মাথা খুঁড়ছি। সেইসঙ্গে আপনাদের কাছে করোজোড়ে আবেদন করছি আর এভাবে ঠাকুরের মাথা ঠান্ডা করার দাওয়াই হিসেবে জল-বরফ ঢালবেন না। আমার কাস্তে দিয়ে কাটা আঁক আমি মুছে দিচ্ছি ফুল, চালকলা দিয়ে।” এতক্ষণে সনাতনের আবেদনে কাজ হয়। শান্ত হয় জনতা।
    প্রথম দিন তো জনতার ঢলে পাড়ার জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের আর দোষ কি। সনাতন পরখ করল মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে আর একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ কিভাবে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে। প্রবল ভিড়ের প্রাবল্যকে কাজে লাগিয়ে সেই সন্ধানী দল বাঁশ-দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলল তাদের উঠোন, বারান্দা। এবার থেকে শিব-পার্বতীকে দেখতে গেলে টিকিট কাটতে হবে। পাঁচ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেখার সুযোগ পাবে জাগ্রত শিব- দূর্গাকে। কৈলাশ থেকে স্বয়ং ভগবান শিব তাদের পৃথিবীতে এসেছে। এই পূণ্যতীর্থকে স্পর্শ করতে গেলে এই সামান্য দক্ষিণা তো মানুষকে দিতে হবে। না হলে ভগবানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে কেমন করে। অতিথি ভগবানকে যত্ন না করলে ভগবান রুষ্ট হয়ে এই স্থান ত্যাগ করবে। এটা নিশ্চয়ই কারোর কাম্য নয়। হুজুগে মানুষও এক বাক্যে এই যুক্তি মেনে নিয়ে টিকিট কেটে ভগবান দর্শন করে চলেছে। ভিড়ের লাগাম পরানো যাচ্ছে না।
    এই পরিস্থিতিতে সনাতনদের তো প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা লাটে উঠে গেল।
    বাড়িতে রান্নাবান্না সব বন্ধ। সুন্দরী তাদের বাড়ি থেকে রান্না খাবার বয়ে নিয়ে দু’বেলা খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছে। মেয়েটা কেন যে তাদের জন্যে এতটা করে চলেছে কে জানে! তার সঙ্গে মেয়েটার সম্পর্ক তো শিক্ষক-ছাত্রীর। হঠাৎ যেন কোথা থেকে উল্কার মত ছুটে এসে জড়িয়ে পড়ল তাদের দৈনন্দিন জীবনচক্রের মধ্যে। এই কর্মকান্ড কি তাদের শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক থেকে উত্তরণ ঘটবার পূর্বাভাষ! ভেবে কুল পায় না সনাতন। যদি কোনভাবে সেই উত্তরণ ভবিতব্য হয় তো সনাতন তার বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
    টানা তিনদিন এইভাবে মানুষের ঢল নামার পর আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে থাকে। সুবিধাবাদিদের আয়েও ভাটা পড়তে থাকে। এবার দূরদূরান্ত গ্রাম থেকে মানুষ আসছে। সেও অনেকটা হাল্কা হাল্কা। সনাতনরা সুযোগ খুঁজতে লাগল, কেমন করে মনুষ্য ভাবনার শিব-দূর্গা তাদের বাড়ি থেকে অন্য কোন জায়গায় নতুন ঠাকুরথান করে প্রতিষ্ঠা করা যায়। আটচালাকে বলেছিল, মা শীতলা মন্দিরের পশ্চিমের সরকারি জায়গায় শিব-দূর্গার মন্দিরটা যদি তৈরী করা যায়। খরচের অর্ধাংশটা যারা ঠাকুর দেখার টিকিট মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছে তাদের কাছ থেকে নেওয়া যায়। বাকিটা আটচালার তহবিল থেকে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে ওই আদায়কারিরা বেঁকে বসে। তারা সেই টাকা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। পাড়ার কোন উৎসবে আনন্দ করার জন্যে এটা খরচ করা হবে। নানান তর্কাতর্কির পর শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব ভেস্তে গেল। গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সনাতনরা। এগুলো এখান থেকে স্থানান্তর না করলে যে তারা স্বাধীনভাবে শান্তিতে নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারছে না।
    অবশেষে এই সমস্যার একটা সমাধান সূত্র প্রস্তাবাকারে তাদের কাছে এল। দিঘিরপাড় বাজারের এক শিব ভক্তর মোড়ের বটগাছ তলায় খানিকটা জায়গা নিজের দখলে আছে। যদি রতন রুইদাস রাজি থাকে তাহলে ওই শিব- দুর্গা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে তার বিনিময়ে কোন টাকাপয়সা তারা রতনদের দিতে পারবে না। সেই ক্ষমতা তাদের নেই। এমনিতেই এই মন্দির গড়তে তাদের কাছে যা টাকা আছে কুলোবে না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা সাহায্য নিয়ে করতে হবে। দিঘড়ার নোদো হালদারের কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেয়ে সনাতনরা যেন হালে পানি পায়। পত্রপাঠ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
    অবশেষে নানান ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ পর্ব সমাপন করার পর সনাতদের বাড়ি এতদিন পর দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়। দুপুরে বাড়ির সবাই মিলে ভাত খেতে খেতে সনাতন তার মা’কে বলল, “মা, তুমি যদি এইভাবে ভগবানকে না দেখতে পেতে তো জীবনে উপলব্ধি করতে পারতাম না মানুষকে কত সহজে একটা হুজুগের মধ্যে ফেলে বোকা বানানো যায়।” রতন এবং সনাতনের মা, পুষ্প ছেলের এই নাস্তিক ভাবনায় অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে! সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না সনাতনের। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে একটা খবরের কাগজ বার করে তার বাবা-মা’কে পড়ায়। সেই দিনের ভোরে তাদের এলাকায় একটা মৃদু ভূকম্প হয়। তারপর সনাতন বলে,“আমরা ঘুমের ঘোরে সেটা অনুভব করতে পারিনি। ওই ভূমি কম্পনেই আমাদের শীল- নোড়া দুটো সিধে হয়ে ওখানে নরম মাটির দাবায় থেবড়ে বসে যায়।” ভগবানের কৃপাকে অবজ্ঞা করায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয়ে মা, পুষ্প বলে, “এ তুই কি অলক্ষুণে কথা বলছিস খোকা! ছিঃ ছিঃ, অমন কথা দ্বিতীয়বার তোর কাছ থেকে যেন না শুনি! ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ এই কথাটা মানিস তো? যদি মেনে থাকিস তাহলে ভগবানকে অবিশ্বাস করিস না। আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর মঙ্গলময়। তিনি সকলের ভাল চান। অগতির গতি তিনি। তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া জীবের মুক্তি নেই রে খোকা। তাঁকে আরাধনা কর, তোর মঙ্গল হবে।”
    সনাতন এক বলল, আর মা অন্য বুঝল। এখানেই বিশ্বাসের কাছে যুক্তি, বাস্তবতা কত অসহায়! তাই বলে সে মায়ের বিশ্বাসকে অসম্মান করতে চাইল না। কারোর ধারণাকে জোর করে পাল্টানো যায় না। যুক্তি দিয়ে বোঝালেও না। ভেতরের বোধ জাগ্রত হলে তবেই তা সম্ভব। তবে মা তাকে এইভাবে দুচ্ছা করার জন্যে মনে মনে সে আহত হয়। মা কোনদিন তাকে এইভাবে তিরস্কার করেনি। এখান থেকেই বোঝা যায় একটা ভাবনা, তা সঠিক বা বেঠিক হোক, সনাতনের কাছে মায়ের এই ভাবনা বেঠিকই। সেই ভাবনা কতটা গভীরে প্রোথিত হলে তবে নিজের আত্মজ, যে তার কাছে প্রাণাধিক বলে মনে করে,তাকেও হেলায় অবহেলা করতে পারে। অত সোজা না, এক লহমায় সেটাকে মনের ভেতর থেকে মুছে ফেলা। মা তখনও তার ওপর রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে যাচ্ছে সেখান থেকে। সে এখান থেকে চলে না গেলে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কাটবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে “সনাতন, সনাতন বাড়ি আছিস” বলে একজনের গলা শুনতে পায় সে। উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখে, বিপ্লবদা! এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে সে অবাক হয়ে যায়। বিপ্লবদা হঠাৎ তাকে ডাকছে? মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বিপ্লবদার চোখ জবাফুলের মত লাল টকটকে। মুখটা ফোলা ফোলা। মনে হচ্ছে একটা বিশাল ঝড়ের থেকেও অধিক সাইক্লোন, তার জীবনের উপর আছড়ে পড়ে বেরিয়ে গেছে! সেই পরিস্থিতিতে একটা কথাই সনাতনের মুখ থেকে বার হতে পারলো,“বিপ্লবদা! তুমি! কি হয়েছে তোমার, বিপ্লবদা?”

    [বিয়াল্লিশ]

    অলোকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটা কেলো করে ছাড়ার জন্যে কোমর বাঁধছে অভয়-বরেণরা। ইদানিং অভয়-বরেণের সঙ্গে জোট বেঁধেছে নোচে, বিন্দে কেলেরা। নোচে-বিন্দে এই দলে ঢোকার মূল কারণ অখিল, সনাতনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনুষ্ঠানটা করছে বলে। সনাতনের উপর তাদের কোন রাগ নেই। কিন্তু ওদের প্রধান শত্রু অখিলকে ওরা এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অন্যতম সদস্য করার জন্যে বাধ্য হচ্ছে ঘুরিয়ে সনাতনদের বিরোধিতা করার। কেননা এর মধ্যে দিয়ে অখিল সুনাম কুড়িয়ে যাবে তা তারা হতে দেবে না। অভয়, বরেণের কাছে লোকমুখের খবর আছে, মাঝে মাঝে অলোকা, বেপাড়ার এবং বেজাতের ছেলে, বিপ্লবের সঙ্গে ডায়মন্ড হারবারে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। অলোকা তার সঙ্গে যেখানে সেখানে প্রেম করে বেড়ায়। এটা সময় থাকতে রুখে না দিলে মেয়েটা বেজাতের হাতে পড়ে যাবে। তাদের রুইদাসদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে বাইরের সমাজের কাছে। অথচ যেটা তাদের গর্ব, তারা স্বজাতের বাইরে কোন আত্মীয়তা করার প্রবল বিরোধী। দেখা যাচ্ছে হালে পাড়ার কয়েকটা তথাকথিত লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েরা তাদের গর্বের সমাজের মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে কসুর করছে না। এই অনাচার কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বরেণরা ওদের এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপনে রচনা করে চলেছে। এতসব কিছুই তাদের এই চার-পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে, অনুষ্ঠান চলাকালীন একমাত্র পরিকল্পনাটা প্রকাশ করা হবে। যদি আগে তা ফাঁস হয়ে যায় তো বিরোধীপক্ষ সচেতন হয়ে গিয়ে তাদের প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেমনভাবে যেন অভয়দের পরিকল্পনাটা পায়ে পায়ে বিপ্লবদের পাল পাড়ায় চাউর হয়ে যায়। বিপ্লবদের পাড়ার সাথে সাথে তার বাড়ির গার্জেনদেরও কানে চলে যায় অলোকার সঙ্গে বিপ্লবের মেলামেশার কথাটা!
    বিপ্লবের বাবা, সমর পাল তখন বালী-মাটি আর এঁটেল মাটি মিশিয়ে তাতে পরিমাণ মত জল মিশিয়ে পা দিয়ে ধাসছে। ধেসে ধেসে একদম মাখনের মত মোলায়েম করে দিতে হবে এই মেশানো মাটি। মাটির অনুপাত কম বেশি হলে আবার কাজ হবে না। সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর আছে সমরের। এখানে একভাগ যদি বেলে মাটি দেওয়া হয় তো দু’ভাগ এঁটেল মাটি মেশালে তবেই এই মাটিকে বাগে এনে নিজের ইচ্ছেমত মাটির তৈজসপত্রের রূপদান করা যাবে। তৈরী হওয়া জিনিসটা তবেই শক্তপোক্ত এবং টেকসই হবে। বিশেষ করে মাটির হাঁড়ি, কলসি, সরা, হাঁড়ি-কলসির ঢাকনা, খুরি, জল খাবার গ্লাস, তিজেল বানানোর জন্যে যত্ন করে মাটি তৈরী করতে হয়। এছাড়া নানারকমের মাটির খেলনা সহ আরও অনেককিছু মাটির জিনিস তৈরী করে এরা। এইভাবে মাটির ‘পাট’ করতে করতে ঘেমে একদম চান করে যাচ্ছে সমর পাল। তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আসলে এতেই ওরা অভ্যস্ত। এই নিয়েই এদের জীবন। এর বাইরে অন্য কোনকিছু ভাববার সময় ওদের কোথায়! এত কষ্টের মধ্যে এটাই সান্ত্বনা যে তার ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পারছে। ইকনমিক্সে অনার্সে বি.এস.সি. তে ভাল মার্কস পাবার সুবাদে এম.এস.সি. তে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তার এই কষ্টের তুষ্টি তো এখানেই। এত মেহনতের মধ্যে সন্তানের সাফল্য কখন যেন কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। খুশিতে মনটা ভরপুর হয়ে যায়। হাসি হাসি মুখ নিয়ে পাঁচিলে ঘেরা বাড়ির প্রধান দরজা খোলার শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখে হেড়ো পাগলা ঢুকছে। এই এক পাগলা। আশপাশের সব বাড়িতে ওর অবারিত দ্বার। দুপুরে খিদে পেলে যে কারোর বাড়ি ঢুকে যায়। লোকে খেতেও দেয়। কি আর করবে। বাড়িতে বুড়ি মা ছাড়া ওর কেউ নেই। মা এবাড়ি সেবাড়ি ফায়ফরমাস খেটে নিজের পেটের খিদে মিটিয়ে ছেলের জন্যে যা পারে জোগাড় করে রাখে ঘরে। যদি ভুল করে ঘরে চলে আসে তো সেটাই খাইয়ে দেয়। কখন বাড়িতে আসবে তার কোন ঠিক নেই। রুইদাস পাড়ার হেড়ো পাগলাকে আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মানুষ চেনে। তবে চুরিচামারির স্বভাব ওর নেই। তাই মানুষ বিশ্বাসও করে ওকে। কেউ কোন কাজ বললে সঙ্গে সঙ্গে কোন বাক্যব্যায় ছাড়াই সে সেটা করে দেয়। লোকও সন্তুষ্ট হয়ে তাকে খেতে দেয়। হেড়ো পাগলা ঢুকতেই সমর পাল বলল, “হেড়ো, এদিকে আয় তো? এই পাট-করা মাটি ‘চাকি’র কাছে নিয়ে যা তো। জামাটা খোল। আর লুঙ্গিটা ভাল করে এল্টে-পাক দিয়ে বেঁধে নে। নাহলে আবার কাদা জাবড়ে যাবে লুঙ্গিতে। এ’কটা বওয়া হয়ে গেলে ভাল করে কাদা হাতমুখ ধুয়ে চলে আসবি। এখানে খেয়ে যাবি। পালাবি না কিন্তু। তোর তো কোন বিশ্বাস নেই। হাত-পা ধুয়ে আবার অন্য কোথাও পালিয়ে গেলি! পাগলের খেয়াল।” ফ্যালফেলিয়ে হেসে হেড়ো বলে,“নাগো বাবু আজ খেয়েই যাব তোমাদের বাড়ি। শোনো না বাবু। একটা কথা কানে এসেছে তোমার ছেলে বিপ্লবদাদাকে নিয়ে। আমাদের পাড়ার ছেলেরা বলাবলি করছিল। আমি যেতেই তাড়িয়ে দেয় আমাকে। তবে যা শোনার তা শুনে নিয়েছি।” পাগলটার কথায় পাত্তা না দিয়ে সমর পাল বলল,“ওসব কথা এখন থাক। তুই বকর বকর করতে থাকলে থামবি না। আগে কাজটা সেরে খেয়েদেয়ে নে। তারপর তোর কথা শুনব।” বলে সমর আবার পা দিয়ে কাদামাটি দলতে থাকে। তৈরী মাটি হেড়ো পাগলা বয়ে চাকির পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে আর শেষের দিকে কিছু মাটি সমর পালের নির্দেশমত চাকির উপর পাটাতনে রাখে। সব বওয়া শেষ হলে হেড়ো বলে শেষের মাটিগুলো তোমার গাড়ির চাকার উপর রেখে দিয়েছি কাকা।” গাড়ির চাকা! সমর একটু অবাকমত হয়ে পরে বুঝতে পারে হেড়ো কোনটাকে গাড়ির চাকা বলছে। তারপর হেসে বলে, “ধুর পাগল, ওটা গাড়ির চাকা হতে যাবে কেন? ওটা গাড়ির চাকার মত দেখতে একটা চাকা। আগে ওটা কাঠের হত। এখন মেটালের হয়েছে। মাটিতে গর্ত করে বিশেষ কায়দায় ওটা বসাতে হবে। তার মাঝে একটা লোহার রড পোঁতা থাকে। তার মাথায় আবার চাকাটা বনবন করে ঘোরাবার জন্যে বিয়ারিং সেই রডে লাগানো থাকে। যে কাঠের পাটাতনে তুই কাদা রাখলি ওটা ওই চাকার উপর বসিয়ে ওই যে পাশে একটা বাঁশের লাঠি আছে ওটা দিয়ে ঘোরানো হয়। এরপর হাতের কায়দায় যে জিনিস বানাবার দরকার সেটা তৈরী হয়ে যাবে। সেটা হয়ে গেলে ওই যে পাশে বাঁশের পাতলা চেটো দেখতে পাচ্ছিস, ঘুরন্ত অবস্থায় কাদার ভেতর ওটা সেঁধিয়ে দিলে, তাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তৈরী হওয়া জিনিসটা। সে হাঁড়ি, কলসি, তিজেল, সরা যাই হোক না কেন। বুঝলি পাগল? এইভাবে মাটির জিনিস তৈরী করতে হয়। কম খাটনি এই কাজে? সেই তুলনায় পয়সা পাই না রে। এটাই আমাদের দুঃখ। তার উপর আজকাল স্টীল, এ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র বাজারে এসে আমাদের মালের চাহিদা তো একদম তলানিতে। বিক্রী নেই বললে চলে। ধুঁকছে কুমোরদের এই কারবার। সব পরিকাঠামো বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে আছে বলে এখনো টিম টিম করে চালিয়ে যাচ্ছি।”
    “এত বকর বকর কার সঙ্গে করছো, বিপ্লবের বাপ?” বলে রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে দেখে হেড়ো পাগলা! অবাক হয়ে উঠোনে বেরিয়ে আসে বিপ্লবের মা সীতাদেবী। স্বামীকে বলে, “হ্যাঁগো, তুমি এই হেড়ো পাগলের সঙ্গে সেই তখন থেকে ফটর ফটর করছো? তোমাদের হাঁড়ি কলসি তৈরীর হাঁড়ির খবর বলার আর লোক পেলে না! তখন থেকে ভষ্মে ঘী ঢেলে চলেছো! বাব্বা, কেমন লোক গো তুমি। অন্য কোন সুস্থ মানুষকে বললে, সে মানুষটা বুঝতো আমাদের সুখ-দুঃখের কথা। ও গাল দিয়ে খাবার খাবে আর কান দিয়ে তোমার গপ্প বার করে দেবে। ওই পাগলের পেটে খাবার ছাড়া আর কোন কথা থাকে না কি? থেকেও বা লাভ কি। হেড়ো একটা মানুষ, সে আবার তোমার দুর্দশার সাক্ষী। নাও, অনেক হয়েছে। চানটান করে খেয়ে নও। এর পর চুলা জ্বালাতে হবে। তিন দিন ধরে রোদে শুকোচ্ছে কাঁচা মালগুলো। চুলার উপরের তাওয়াটা কাল দেখতে বলেছিলাম। সেটা দেখেছো? ফাটাফুটি নেই তো? মাটির অত মস্ত একটা তাওয়া। আগুনের তাপে কেটে গিয়ে থাকলে তার উপর এই মালগুলো চাপালে ভেঙে পড়ে যেতে পারে বা আগুন ফাটা দিয়ে বেরিয়ে মাল নষ্ট করে দিতে পারে। ইটভাটার মত মস্ত বড় চুলা। বাপ ঠাকুরদার আমলের জিনিস। তখন রমরমা কারবার ছিল, দরকার মত বানিয়েছিল তারা। এখন মালের টান নেই তো এতবড় চুলা করে লাভ কি। বলেছিলাম, ওটা ভেঙে অর্ধেক ছোট করে দাও। খামোখা এককাঁড়ি আগুন জ্বালাতে হয়। তাতে খরচাও বাড়ে। বড় বাফারা উঠোনে মস্ত একটা চুলা! লোক দেখে বাহবা দেবে, কত না বড় ব্যবসায়ী তুমি। কিন্তু এদিকে যে ঢপঢপে কলসি, সে এই সীতা ছাড়া আর কে জানবে। নাও, হয়েছে। এবার কাজগুলো সারো তো। আমাকে আবার খাইদাই সালটে আগের লটের পোড়ানো মালগুলোকে রঙ করতে বসতে হবে। আমার কাজ তো আর তোমরা করবে না। আমাকেই করতে হবে।” বলে সীতাদেবী গজগজ করতে করতে আবার রান্নাঘরে ব্যাস্ত হয়ে গেল।
    এমনিতে কাজ-কারবারে চরম মন্দা। মনটা আজকাল ভাল থাকে না সমরের। তাই মনকে বোধ দেবার জন্যে যাকে সামনে পায় তার সামনে বকবক করে। শ্রোতা শুনলো বা বুঝলো কি না তাতে তার যায় আসে না। তার উপর বোয়ের এই ধমকানি মনকে আরও যেন দমিয়ে দেয়। হেড়োর সঙ্গে বকর বকর থামিয়ে হাতের কাজ সেরে গামছা নিয়ে পুকুরঘাটের দিকে ঝোঁক মারতে মারতে পেছন ফিরে হেড়োকে বলল,“কিরে, তুই চানে যাবি নাকি? যাবি তো আয়। পরিষ্কার হয়ে নে।” একথা বলতেই রান্না ঘর থেকে আবার সেই তীক্ষ্ণ নারী কন্ঠ, “ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি যাও তো, তোমার কাজ সেরে আসো। ও কি রোজ চান করার লোক! তাহলে গায়ে অত গন্ধ হয় না। বলারই বা কে আছে, এই কাজগুলো করার! কথায় বলে,‘পাগোলে কি না করে আর ছাগলে কি না খায়।” এবারও বোয়ের ঝাঁঝ একদম মেনে নিতে পারলো না, সমর। হেড়োকে চান করতে বলার কারণ, ও মাটি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। হাতে-পায়ে কাদা লেপটে আছে। শুধু হাত-পা, মুখ ধুলে ভাল পরিষ্কার হবে না। তাই চান করার কথা বলছিল। সমরের কথায় হেড়ো বলে, “নাগো কাকা, আমি চান করবুনি। চান করতে আমার ভাল্লাগেনে। তুমি যাও। আমি এই সামনের ঘাটে হাত-পা ধুয়ে আসি।”
    খাওয়া-দাওয়া সেরে সীতাদেবী, চুলার উল্টোদিকে রং-ঘরের দিকে গেল। কিছু কালো রঙের ভাতের হাড়ির অর্ডার আছে। তারপর অন্য মালের চাকচিক্য আনার জন্যে বিভিন্ন রং করতে হয়। শৌখিন না হলে আবার খদ্দেরের চোখে আটকানো যায় না। দিনদিন সব রুচিও পাল্টাচ্ছে মানুষের। আগে বেশি বেশি অর্ডার থাকতো, তখন শুধু কালো মালেরই একচুলা মাল হত। সেসময় আর এখনকার মত কালো রংটা আলাদা করে লাগাতে হত না। চুলাকে কিছু সময় ঢেকে রাখলে যে কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তাতেই মালের রং কালো হয়ে যেত বা দরকার হলে চুলার আগুনে খৈল পোড়ালে একদম মিশমিশে কালো রং হয়ে যেত। এতে তাদের তেমন কোন খরচই হত না। এখন সেই কালো রং হাতে বানাতে হচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে কালো রং তৈরী করতে হয়। তাতে অতিরিক্ত খরচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় মালের চাহিদা বা দাম তারা পাচ্ছে না। তাছাড়া আরও কিছু মাল আছে যেগুলো লাল, হলুদ আর সবুজ রঙের করতে হবে। সীতা, লাল রং বানাতে গিয়ে দেখে সিসা একদম তলানিতে পড়ে আছে। কয়েকটা মালে রং করলেই শেষ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বাবাকে হেঁকে বলল,“লাল রঙের জন্যে সিসা একদম ফুরিয়ে গেছে। পারলে আজ বিকেলে কিনে আনবে। তা না হলে কাল সকাল সকাল আনতে হবে। রঙের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে এটা না আনলে। মাল ডেলিভারীও দেওয়া যাবে না।” না, সবুজের জন্যে দস্তার কৌটোতে দস্তা আছে। আর আর্সেনিকের ডিবেতে কতটা আর্সেনিক আছে দেখে নিল। যা আর্সেনিক আছে তাতে হলুদ রং আরও কয়েকদিন করা যাবে।
    একঘটি জল একটা মাটির ‘টাটি’ মানে ঢাকনা চাপা দিয়ে স্বামীর পাশে রেখে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেছিল সীতা। ভাত খাওয়ার পর জল খেয়ে একটা বিড়ি ধরাবে। তারপর ঘন্টা খানেক গড়িয়ে আবার কাজে লেগে যাবে। বিড়ি খাওয়াবে বলে হেড়োকে যেতে দেয়নি সমর। ভাত খেয়ে চলে যাচ্ছিল হেড়ো। সমর বলল, “দাঁড়া হেড়ো। একটু পরে যাবি। জল খেয়ে বিড়ি খাব। তাহলে ধোঁয়াটা পেটে সেঁটে যাবে না। পেটের ভেতর জলে ধাক্কা খেয়ে ও নিস্কর্মা হয়ে যাবে।” হেড়োর মুখে বিড়ির আগুন দিতে গিয়ে হঠাৎ সমরের মনে পড়ল, ও যেন ছেলের সম্বন্ধে তখন কি একটা বলছিল? ওকে থামিয়ে দিয়ে কাজে মন দিতে বলেছিল? মনে পড়েছে। কি কথা বলছিল জানতে হবে,“হ্যাঁরে হেড়ো, তখন বিপ্লবদাদাকে নিয়ে কি যেন তুই বলতে যাচ্ছিলিস? কি কথা এবার বল। শুনি। তোদের পাড়ার ছেলেরা বিপ্লবদাদাকে নিয়ে কি আলোচনা করছিল? একবার তো ওকে নিয়ে তোদের চ্যাংড়াগুলো কি না ঝামেলা পাকালো। আমরা রুখে দিতে থেমে গেল। আবার নতুন করে কোন ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছে না কিরে?”
    -হ্যাঁ গো কাকা। ওরা আবার বিপ্লবদাদা আর অলোকাদিদিকে নিয়ে অনেক কথা বলছে। বলছে এরা দু’জনে নাকি এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। ওদের পেছনে লোক লাগিয়েছে। হাতে নাতে ধরবে বলে। ধরতে পারলে আটচালায় বিচার বসিয়ে বিপ্লবদাদাকে জরিমানা করবে আর অলোকাদিদিকে গ্রাম ছাড়া করে দেবে। এই কথাটাই তো তোমাকে বলতে এসেছিলুম গো কাকা। নিজের কানে শুনে আর চুপ করে থাকতে পারিনি, তাই।” বলে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে,“চলি কাকা। আমি তোমাকে খবরটা দিয়েছি, সেকথা তুমি যেন কাউকে বোলো না। তাহলে আমাদের পাড়ার ওই অভয়, বরেনরা মারবে আমাকে।” হেড়ো পাগলা এক এক সময় এমন কথা বলবে, মনে হবে ও একদম ভাল মানুষ। লোকে যে ওকে পাগল বলে, পুরোপুরি বাজে কথা বলে। আবার যখন মাথায় ছিট চাপবে তখন পাগলের থেকেও হদ্দ। তাই ওর কথায় সহজে কেউ আমল দেয় না। কিন্তু এখন ও যে কথাগুলো বলে গেল, মনে হচ্ছে তো ঠিক কথাই বলছে। তার ছেলে আর রুইদাস পাড়ার ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ইতিমধ্যে তো বাজার গরম হয়েছে। এমনিতে কাজ কারবারে গতি নেই। তাই মন মেজাজ ঠিক নেই। তার উপর এই ছেলেকে নিয়ে আবার যদি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয় তো মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমরের। ছেলের প্রতি রাগ চড়চড় করে চড়তে থাকে। কাজ নেই কম্ম নেই বসে বসে খাচ্ছে আর ফপরদালালি করে বেড়াচ্ছে। লেখাপড়ার নাম করে বেলেল্লাপনা করে চলেছে। মেয়ের পেছনে ঘোরাঘুরি করছে। বেজাতের মেয়েকে বে-মারাবে না কি? এবার আর রাগটা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারল না সমর। এ’দাবা থেকে রং-ঘরের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবের মা’কে হাঁক দিল, “এদিকে এসো তো একবার! ওসব কাজ-মাজ রাখো। গুলি মারো তোমার কাজে। সব ফেলে এক্ষুনি এদিকে এসো।” ছেলের বাপের গলার ঢঙ শুনে সীতা বুঝতে পারে লোকটা ভীষণ রেগে গেছে। হেড়ো ছিট-পাগল কি এমন কথা ওনার কানে ঢুকিয়ে গেল যে ওই ঠান্ডা মানুষটা এত রেগে গেল? ঠান্ডা মানুষরা এমনিতে সহজে রাগে না। কিন্তু একবার রেগে গেলে সামলানো দায় হয়ে যায়। এতদিন ধরে ঘর করে সীতা বুঝে গেছে মানুষটার ধাত-ধরণ। সময় নষ্ট না করে সব কাজ ফেলে রেখে ওদিক থেকে এদিকে চলে আসে। বলে,“কি হয়েছে কি? হেড়ো কি কথা বলে গেল? হঠাৎ রেগে গেলে কেন? মাথা ঠান্ডা রাখো। তারপর বলো। রাগ মাথায় ঠিক কথা বলা যায় না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা তো চোখে সর্ষেফুল দেখব!”
    -আর কি হবে মাথা ঠান্ডা করে। তোমার গুনধর বেটা সেই কাজ করলে তো তবে মাথা ঠান্ডা থাকবে? ওই লেখাপড়ার নাম করে মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার শিক্ষিত বেটা। লোকে এবার ফাঁদে ফেলার জন্যে পেছনে লেগে পড়েছে। তাও আবার ওই ছোট জাতের মেয়েটার সঙ্গে। কতোবার তো তুমি বলেছো, রুইদাসপাড়ার ওই মেয়েটার সঙ্গে তুই একদম যোগাযোগ রাখবি না। সে কথা শুনেছে?” বলে, মস্ত এক ধমক দেয় সমর। হঠাৎ ধমকানিতে চমকে ওঠে সীতা ! সীতার মাথায়ও রাগ চেপে বসে, “তা তোমার ছেলে, বাবা মায়ের কথা না শুনে যদি বাইরের কোনো মেয়ের পেছনে ঘোরে তা ঘরে বসে আমি কি সেটা দেখতে যাচ্ছি? লেখাপড়ার নাম করে কতো জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনা করছে। ভাল ফলও করছে। তা সেই ছেলেকে আমরা কিভাবে আটকাবো। পায়ে বেড়ি পরিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখবো? মুখে বলা ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে?”
    -আছে, আছে। অনেককিছু করার আছে। তুমি তাকে শেষ বারের মত সাবধান করে দাও। ওই ছোটজাতের মেয়েটার সঙ্গে মেলামেশা যেন ও আর না করে। আমাদের কুম্ভকারদের মুখ না পোড়ায়। তাহলে কিন্তু ছেলে বলে আমি ওকে ছেড়ে কথা বলবো না। বাড়ি থেকে দূর করে দেব। ত্যাজ্যপুত্র করে দেব আমি। শিক্ষিতর এই শিক্ষার দাম! নিজের জাতের সম্মান যে ছেলে রাখতে অক্ষম, তাকে আমিও ঘরে পুষতে অক্ষম। বলে দিচ্ছি তোমাকে, বউ। পরে আমাকে দোষের ভাগি করতে পারবে না কিন্তু। সে কোথায়? কোথায় তোমার গুণধর বেটা। কোথায় গেছে? চুপ করে আছো কেন, বলো, সে কোথায়?”
    -আমতলায় গেছে কি সব বই কিনতে।
    -তার নিজের জন্যে বই না ওই রুইদাস-মুচির মেয়েটার জন্যে? সে খোঁজ তুমি নিয়েছো? নাও নি তাই তো? অন্ধ ভালবাসায় ছেলেকে ছেড়ে রেখেছো। লাটাইটা পর্যন্ত নিজের হাতে রাখো নি। লাটাই যখন হাতে নেই সে ঘুঁড়ি তো খেয়ালখুশি মত নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াবেই। এ তো জানা কথা। তা লাটসাহেবের বাচ্চা ফিরবেন কখন ঘরে? সেটা কি বলে গেছেন! নাকি তাও তোমার জানা নেই? বলতে বলতে রক্তজবা রং নেয় সমরের দু’চোখ।
    -বললো তো ফিরতে একটু বেলা হবে। এসে খাবে। তারপর পঁচিলের দরজার দিকে তাকায়। দেখে বিপ্লব ঢুকছে। তখন সীতাদেবী বলল, “ওই তো আসছে।” বলে সঙ্গে সঙ্গে অজানা কোন আশঙ্কায় সাবধানী হয়ে সীতা আবার স্বামীকে বলল, “বাইরে থেকে আসছে। রোদে-তাপে ওরও মাথা গরম হয়ে আছে। এখন তুমি কিছু বোলো না। তারপর দু’জনেই নিজেদের ঠিক রাখতে না পেরে যুদ্ধ যেন লাগিয়ে দিও না ! ও চানটান করে খাওয়া দাওয়া সেরে মাথা ঠান্ডা করে বসলে, তখন বোলো।”
    এতটা তার মাথা গরম হয়ে আছে যে বোয়ের কথায় পাত্তা দিল না সমর। বিপ্লব সদর দরজা পার হয়ে উঠোনে ঢুকতেই চেল্লে উঠে ছেলেকে বলে, “কোথায় গেছিলিস? ওই রুইদাস মেয়েটার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলিস? তোর মা যে বলল, তুই বই কিনতে গেছিস, আমতলায়। তা কই, তোর হাতে তো কোন বই নেই? কার জন্যে বই কিনতে গেছিলিস? ওই মুচি মেয়েটার জন্যে? সে তো শুনলুম মাস্টারির চাকরি পেয়েছে। তার আবার বই কি হবে ? মেয়ে মানুষের সঙ্গে ফুর্তি মারাতে গেছিলিস,তাই তো? উত্তর দিচ্ছিস না যে আমার কথার। যা বলছি তাহলে সব সত্যি বলছি আমি, লোকে তাহলে ফালতু বলে যায়নি?” সে যে অলোকার সঙ্গে মেলামেশা করে তা বাবা-মা’র কাছে আর গোপন করতে চায় না বিপ্লব। যা সত্যি তা বলে দেওয়াই ভাল। তাতে যা হাবার হবে। সেই ভাবনায় সে বলল, “হ্যাঁ, অলোকার জন্যে টিচার্স ট্রেনিংয়ের একটা বই আনতে গেছিলাম। নতুন চাকরি। এই বইটা কাজে লাগবে তাই। এর জন্যে এত চেঁচামেচির কি আছে বাবা? আমি তো অন্যায় কোন কাজ করিনি।” সীতা ছেলের এই কাজকে একদম পছন্দ করে না। সন্তানের প্রতি স্নেহের বশে কিছুতেই ওই বেজাতের মেয়েকে সে মেনে নেবে না। তবু এই পরিস্থিতিতে তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরে বাপ-ছেলেকে সামলাতে হবে। অবস্থা যেদিকে গড়াচ্ছে এবার দু’পক্ষের সুর চড়তে শুরু করবে। তার আগে এদের থামিয়ে দেওয়া দরকার। না হলে অনিষ্ট কিছু ঘটে যেতে পারে। বাপের রক্ত তো ছেলের মধ্যে বইছে। শান্ত ছেলেটা বাপের মত ক্ষেপে যদি যায় তো তাকেও সামলানো দায় হয়ে যাবে। সীতা তাড়াতাড়ি গিয়ে বিপ্লবের ডান হাতটা তার বাঁ-বগলে চেপে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, “যা, এখন আর কথায় কথা বাড়াতে হবে না। তুই আগে চান খাওয়া করে নে। তারপর যা কথা বলার বলবি।” আর স্বামীর দিকে তাকিলে বলে, “তুমি কি এখন থামবে? না, শুধু চেল্লাতেই থাকবে? তুমি তো পেট মোটা করে নিয়েছো। যে খায়নি তাকে তো খেতে দিতে হবে না কি?”
    বোয়ের কথায় পাত্তাই দিল না সমর। আবার চেঁচিয়ে ছেলের কথার পিঠে কথা চড়ালো,“অন্যায় তুই করিসনি মানে? জন্ম তোর কুমোরের ঘরে। জন্মসূত্রে জাতে তুই ‘কুম্ভকার’। নিজের জাতকুল জলাঞ্জলী দিয়ে একটা ছোট জাতের মেয়ের সঙ্গে লটরফটর করছিস। আবার নিজের হয়ে ‘সাওটা’ গাইছিস? তুই কি ভেবে রেখেছিস ওই ছোটলোক মেয়েটার মাস্টারির পয়সার লোভে বিয়ে মারিয়ে সেই পয়সা আমার ঘরে তুলবি? সে গুড়ে বালি। ছিঃ ছিঃ আমার বেটা হয়ে এই কাজ করতে তোর এতটুকু লজ্জাবোধ হল না! লেখাপড়ার ভেতর যে এত বেলেল্লাপনা লুকিয়ে আছে তা যদি জানতুম তাহলে কোনদিন তোকে পড়াশোনা করাতে পাঠাতাম ভেবেছিস? ওই কুমোর-চাকি ঘোরানোর কাজেই লাগিয়ে দিতাম। কাল থেকে ব্যবসার কাজে লেগে পড়বি। বাড়িতে হুদমো একটা বেটা থাকতে আমি বুড়ো বাপ কেন এত খাটতে যাব। খেটে পয়সা রোজগার করব আর তুমি লাটসাহেব, সেই পয়সায় বেজাতীয় প্রেম মারিয়ে বেড়াবে! তা আর হবে না। তোকে আর এম.এ. পড়া করতে হবে না। আমি আর খরচা জোগাতে পারব না। ঢের হয়েছে। এবার বাপ পিতেমহের জাত
    কারবার তোকেই দেখতে হবে। একবারও তো খোঁজ খবর নিস না যে, কারবার কেমন চলছে না চলছে। চিন্তাও হয় না। বাড়ির অবস্থা দেখেও মনে প্রশ্ন জাগে না যে, আগে বাড়ির উঠোনে এতো এতো মাল ঢাঁই হয়ে থাকতো। এখন তার অর্ধেকও থাকে না। মনেও ভাবনা আসে না যে, বাবার কারবারটা কি তাহলে লোকসানে যাচ্ছে? শুধু চুপি চুপি মাকে পটিয়ে টাকা হাতিয়ে মেয়ে নিয়ে ফুসুর ফুসুর করে বেড়ানো! তোর এই অপকর্মের জন্যে আমি কেন পাড়ার গন্যিমান্যিদের কাছে মাথা হেট করতে যাব। কেন? সেই কৈফিয়ৎ দিয়ে তবে তুই ঘরে ঢুকবি। না’হলে যে পথ দিয়ে এসেছিস সেই পথে বেরিয়ে যাবি বাড়ি থেকে। এই আমার শেষ কথা বলে দিলাম।” বলে থরথর করে কাঁপতে থাকে সমর পাল।
    বাবার কথায় ছেলে একদম চুপ! কোন কথাই বলছে না। সীতা এতে আরও ভয় পেয়ে যায়। সেই থেকে নিজের বগলদাবায় যে ছেলের হাত চেপে ধরে আছে আর ছাড়ছে না। কিন্তু ছেলের শরীরের স্পর্শে বুঝতে পারছে ওর গা যেন জ্বরের মত গরম হচ্ছে আর সেটা একে একে বাড়ছে। সীতার আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে ভেতরে ভেতরে বিপ্লব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাপের খেতে দেওয়া কাঁসার ঘটির অবশিষ্ট পড়ে থাকা জল ছুটে নিয়ে এসে ছেলের পায়ে ঢালতে থাকে। চরম রেগে যাওয়া মানুষের পায়ে সমানে জল ঢালতে থাকলে মাথার রাগ নাকি পা টেনে নিয়ে ধরিত্রির বুকে চালান করে দেয়। এবার দেখল, ছেলের গা-গরম এখন আর আগের মত তীব্র নেই। সত্যি সত্যি ধরিত্রি টেনে নিচ্ছে সেই অশুভ তেজগুলো! তারপর বলে,“আয় বাবা, ঘরে আয়। বাবা, গুরুজন মানুষ। এখন ওনার মাথার ঠিক নেই। কি বলতে কি বলছে, কাকে বলছে তা উনি নিজেই বুঝতে পারছে না।”
    একটা নির্মল ভালবাসা যে এইভাবে বিধ্বস্ত, অপদস্ত হবে এবং তা নিজের বাবার দিক থেকে ধেয়ে আসবে কল্পনা করতে পারেনি বিপ্লব! তার এত বছরের জীবনে কোনদিন বাবাকে এমন রেগে যেতে দেখেনি সে। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে বাবা এইভাবে রেগে গেল! তাও কিছুতেই থামতে চাইছে না। মা যত থামতে বলে ততই বেগে রাগ তুলে যায়! এইসব মানুষের কাছে মনুষ্যত্বের থেকে ঠুনকো জাত-বেজাতের প্রশ্ন এতটাই বড়ো! একটা অন্তজ শ্রেণীর মেয়ে। চরম প্রতিকুলতার মধ্যে থেকে এতবড় সাফল্যের মুখ দেখলো। তারপরেও তার জাত-ভাবনা তাকে এইভাবে পেছনে টেনে ধরবে! কিছুতেই সামনে এগিয়ে যেতে দেবে না? আর যারা এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, তাদেরও সমূলে উৎপাটন করে ছাড়বে? মনুষ্য সমাজের মধ্যে মিশে থাকা এইসব অমানুষ তো নরকের কীটের থেকেও জঘন্য। এই কীটের অধম মানুষের কথায় মুখ লাগাতেও তার ঘেন্না হচ্ছে। আর কোন কথা না বলে, জোর করে মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাপের কথা মত যে পথ দিয়ে সে এসেছিল সেই পথেই দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিপ্লব। পেছন পেছন তার মা, সীতাদেবী ছুটতে ছুটতে বলে, “খোকা কোথায় যাচ্ছিস দাঁড়া। এই অভুক্ত পেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে নেই। বাড়ির অকল্যাণ হয়। খোকা দাঁড়া! উদ্ভ্রান্তর মত সেই দৌড়ে সীতাদেবী আর নিজেকে সামাল দিতে না পেরে সদর দরজায় হোঁচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

    ক্রমশ… 

  • গল্প

    গল্প- জ্বালা

    জ্বালা
    মুনমুন রাহা

     

     

                                  কলেজের দেরি হয়ে গেছে দেখে ঝটপট পা চালায় সৃজনী। গ্রামের খালের পোলের উপর দাঁড়ানো প্রতীক ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখে একটু থমকে যায় সৃজনী। এই এক উৎপাত শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে । রাস্তাঘাটে যেখানেই দেখা হয় এই প্রতীক সৃজনীকে তার ভালোবাসা জানায়। কতবার সৃজনী বুঝিয়েছে এই ভালোবাসা এক তরফা। কিন্ত কে শোনে কার কথা! তার উপর আবার প্রতীক হল এখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে। তাই বেশি কিছু বলতেও পারে না সৃজনী। যতটা পারে এড়িয়ে চলে।  সৃজনী কিছুদিন হল ঐ শিবতলার পথটা ছেড়ে এই পথ দিয়ে কলেজে যায় কেবলমাত্র এই প্রতীকের পাল্লায় পড়বে না বলে। কিন্ত আজ এখানেও ধাওয়া করেছে প্রতীক।

                সৃজনী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগোলো পোলের দিকে। পোলের মাঝামাঝি আসতেই প্রতীক বাইক নিয়ে একদম সৃজনীর গায়ের কাছে চলে আসে তারপর  বলে – ” কি সুন্দরী , আমার কাছে ধরা দেবে না বলে এই রাস্তা নিয়েছ তো! কিন্ত সোনা আমার কাছ থেকে যে পালানো এত সহজ নয়! আমার যে চোখ চারদিকে আছে। দেখ আমি তোমাকে ভালোবাসি বিয়ে করব । এই সোজা কথাটা কেন ঢুকছে না তোমার মাথায়? ভালো কথা অনেক দিন বলছি, এবার মটকা গরম হলে কিন্ত বিয়ের আগেই সব কিছু করব শুধু বিয়েটা করব না। “

    কথা বলতে বলতে প্রতীক বাইক থেকে নেমে সৃজনীর হাতটা চেপে ধরছে। প্রতীকের চটুল কথায় তার বন্ধুরা হায়নার মতো হাসছে পিছন থেকে। যেন কোন মুখরোচোক ঘটনার সাক্ষী থাকবে বলে প্রাণ আনচান করছে তাদের। সৃজনী নিজের হাতটা ছড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে- “দেখো প্রতীকদা আমি তো তোমায় কতবার বলেছি, আমি কল্যাণকে ভালবাসি। কেন বারবার তুমি এক কথা বল বলতো ?”
    -শালী বড্ড তেল বেড়েছে তোর, ভালো কথায় কিছু হবে না।

        এই কথা বলে প্রতীক সৃজনীর ওড়নাটা ধরে টান দেয়। সৃজনী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শেষে না পেরে প্রতীককে এক ধাক্কা মারে আর গালে একটা সজোরে চড় কষায়। প্রতীক আর তার বন্ধুরা বোধহয় এতটা আশা করেনি। তাই মুহুর্তের জন্য একটু বিচলিত হয়ে পড়ে এই সুযোগে সৃজনী ছুটে পালায়। প্রতীকরা কি ভেবে আর পিছু নিল না সৃজনীর।

                    কলেজের ক্লাসগুলোর একটাতেও মন দিতে পারে না সৃজনী । ক্লাস শেষ হতে কল্যাণের সাথে দেখা করতে যায় গঙ্গার ঘাটে। কল্যাণকে সব কথা বলতে, কল্যাণ বলে- “তুমি ঠিক করো নি সৃজা। ওরা অনেক পাওয়ারফুল লোক। এইভাবে ওদের সাথে ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হল না সৃজা।”

       – ছিঃ কল্যাণ, তুমি একথা বলছ! তাহলে আমি কি করতাম নিজকে ওদের হাতে সমর্পণ করতাম?

       – না না আমি ঠিক তা বলতে চাইনি।

       -দেখ কল্যাণ তুমি তো বলেছিলে তোমার বাবা মাকে তুমি আমার কথা বলেছ। এবার তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাবস্থা কর। আমার মনে হয় এটাই এই সমস্যার সমাধান।

        -একদম চিন্তা করো না সৃজা।  আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি। কালই তোমার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলব বাবা-মাকে । বিয়ের কথা কালই পাকা করে আসুক ওরা।

                   মনের ভারী ভাবটা একটু হাল্কা লাগছে সৃজনীর। যাক বিয়ের কথা যদি কালই হয়ে যায় তবে আর প্রতীক নিশ্চয়ই জ্বালাবে না । সারা রাস্তা সৃজনী স্বপ্ন বুনতে থাকে ওর বিয়ের। ভাবনা চিন্তার মাঝেই সৃজনী পৌঁছে যায় গ্রামের সরু রাস্তার ধারে। আচমকাই কতগুলো বাইক এসে পড়েছে। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় আর হেলমেটের জন্য ঠিক করে মুখ দেখা যাচ্ছে না কারও। হঠাৎই একটা বাইক আরোহী দ্রুত বেগে চলে যাওয়ার আগে একটা বোতল ছুঁড়ে মারল সৃজনীর মুখ লক্ষ্য করে।

                     আজ তিন দিন বাদে নার্সিংহোমের বিছানায় চোখ মেলে তাকালো সৃজনী। সেদিনের প্রচন্ড জ্বালার স্মৃতি ছাড়া আর কিছু মনে পড়ছে না তার। সেদিন সৃজনীর মনে হয়েছিল কেউ একদলা আগুন ছুঁড়ে দিয়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল। চোখ খুলে দেখতে পেল সৃজনীর অসহায় বাবা মায়ের মুখ । আরও জানতে পারল কেউ বা কারা তার মুখের উপর অ্যাসিড ফেলে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন। ভগবানের অশেষ করুনা যে সৃজনীর চোখ দুটো কিছু হয় নি। ঠোঁটের উপর থেকে গলার কিছুটা অংশ ঝলসে গেছে।

                  আজ প্রায় একমাস পর বাড়ি ফিরছে সৃজনী। এখনও ওষুধ চলছে। বাড়ি এসে দেখল বাবা মা বাড়ির সব আয়নাগুলো সরিয়ে দিয়েছে। কারণটা সৃজনীর অজানা নয়। প্রথম বার নিজের ঝলসে যাওয়া চেহারাটা দেখে নিজেই চিৎকার করে ওঠে সৃজনী। এই একমাস সাক্ষী হয়ে আছে সৃজনীর এমন অনেক লড়াইয়ের। অবশ্য লড়াইয়ে সৃজনীর পাশে সব সময় তার বাবা মা ছিল। কিন্ত আরও একজনকে আশা করেছিল সৃজনী । কল্যাণকে,  না তাকে দয়া করে বিয়ে করার জন্য নয় কেবল পরিচিতির খাতিরেই একবার দেখা করবে আশা করেছিল সৃজনী। কিন্ত কল্যাণ বোধহয় ভয় পেয়েছে, ভেবেছে দেখা করতে গেলে যদি সৃজনীর মতো আধ পোড়া মেয়ের দায়িত্ব নিতে হয়! তাই বোধহয় আর সাহস হয় নি তার সৃজনীকে নার্সিংহোমে দেখতে যাওয়ার।

                   ক্রমে দিনগুলো পার হতে থাকে । লড়াইটাও কঠিন হতে হতে একপ্রকার গা-সওয়া হয়ে গেছে সৃজনীর। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই। লোকের চোখে নিজেকে কুৎসিত করে দেখার লড়াই। আইনের কাছে নিজের হার মেনে নেওয়ার লড়াই। পুলিশ এসে বেশ কয়েকবার জেরা করে গেছিল সৃজনীকে। নার্সিংহোমে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না সৃজনীর তাই বাড়িতেই জিজ্ঞেসবাদ করে পুলিশ। সৃজনী জানায় তার সন্দেহের কথা। বলে , প্রতীক আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের ওকে বিরক্ত করার কথা। পুলিশ ‘দেখছি দেখছি’ করে কাটিয়ে দিল বেশ কিছুদিন। তারপর বলে, প্রতীকদের বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব তাই তাকে কেবল জিজ্ঞেসবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেইদিন নাকি প্রতীক এই গ্রামেই ছিল না। সৃজনী এখন রাস্তায় বেরলে মুখ ঢেকে বেরোয়। যেন নিজেকে আড়াল করতে চায় সবার থেকে।

                এইসব ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় ছমাস। সবার সবটা কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। সৃজনীর ঐ পোড়া মুখ দেখে গ্রামের লোক আর তেমন আতঙ্কিত হয় না। লোকের ঠুনকো সহানুভূতিগুলোও কেমন যেন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রামে বেশ উৎসবের হাওয়া পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলের বিয়ে বলে কথা যে! প্রতীকের সাথে সৃজনীর বাল্য বন্ধু তমশার বিয়ে হচ্ছে। কথাটা শোনার পর সৃজনীর বাবা মা সৃজনীকে তার মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে চায় না তারা।

                  পরবর্তী ঘটনাটা যেন ঘটে গেল আকস্মাৎ। বিয়ের আগের দিন প্রতীক সন্ধ্যার পর বাইক নিয়ে বেরোয় নিজস্ব কিছু কাজে। কিন্ত সেই সরু গলির মুখটাতে আসতেই মুখের উপর বোতল বন্দি আগুন এসে পড়ল। অ্যাসিড। ঝলসে যাওয়ার যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারায় প্রতীক। সবাই তাকে নিয়ে ছুটল নার্সিংহোমে। চোখ দুটোই বোধহয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

               সৃজনীর মা বাইরে ছিলেন, খবরটা শুনে ঘর আসে সৃজনীর বাবাকে খবরটা দিতে। কিন্ত এসে তাকে পায় না। হয়তো বাজারে গেছে। কিন্ত ঘরে পেল সৃজনীকে। তার হাতের কিছু কিছু জায়গা পুড়েছে । তাতেই মলম লাগাচ্ছিল সে। সৃজনীর মায়ের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। এসে দরজাটা বন্ধ করে মেয়েকে চেপে ধরে।

    -কেন, কেন সৃজা এসব করতে গেলি? কি পেলি? এখন যদি পুলিশ এসে ঝামেলা করে? তখন আমারা কি বলব? তাছাড়াও তমশা তোর ছোট বেলার বন্ধু,  তার কথাটাও একবার ভাবলি না রে? আইন নিজের হাতে নেওয়াটা যে ঠিক নয় রে মা।

         সৃজনী তার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ঠোঁটটা শক্ত করে চেপে নিল একবার তারপর বলে- “হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই বুঝেছ, আমিই প্রতীকের মুখটা অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। ওদের মতো বাবার ক্ষমতায় বলীয়ান জানোয়ারগুলো আইনের ফাঁক গলে ঠিক বেরিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়েই এই কাজ করলাম। তবে কি জানতো মা এদিকে ভালোই হয়েছে পুলিশ ওকে সাজা দেয়নি। ওর কি আর শাস্তি হতো বল? জেল হেফাজত! কিন্ত তাতে ও বুঝতো না আমার জ্বালাটা, আমার সেদিনের পুড়ে যাওয়ার মর্মটা। কিন্ত আজ ও বুঝেছে। মা এই জ্বালা বড় বেদনা দেয়। শরীরের পুড়ে ঝলসে যাওয়া অংশগুলো হয়তো ডাক্তারের চিকিৎসায় ক্রমে সেরে ওঠে কিন্ত মনটা জ্বলতে থাকে জ্বলতেই থাকে। এই সমাজ মনের আগুনটাকে কিছুতেই নিভতে দেয় না। তবে আজ অনেকদিন পর আমার মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনে একটু হলেও জল পরেছে। আর হ্যাঁ মা, কি বলছিলে তমশার কথা ভাবতে? মা, আমি ওকে বাঁচিয়ে দিলাম গো । ঐ রকম একটা জানোয়ারের হাতে সারা জীবন বাঁধা পড়ার থেকে।”

        -সব বুঝলাম, কিন্ত পুলিশ! কি বলব পুলিশ কে?
    – কেন মা , তোমরা তো আমাকে গ্রামের কত লোকের মাঝখান দিয়ে বেশ কিছুদিন আগে মাসির বাড়ি রেখে এসেছ ! আমি তো ওখানেই ছিলাম। তাই না? যেমন সেদিন প্রতীক বাড়ি ছিল না। আর পুলিশ অবিশ্বাস করলে গ্রামের লোকেরা বলবে তারা আমাকে মাসির বাড়ি যেতে দেখেছে কিনা? এখন আমি আসি মা। তবে এবার ফিরে এসে আবার নতুন করে জীবনটা সাজানোর চেষ্টা করব। আর তার শুরু করব আমার পড়াশোনা দিয়ে। আবার আমি কলেজে যাব। জানি লোকের চোখ, লোকের মুখ অনেক কিছু দেখবে, বলবে। কিন্ত আজ আর তাতে আমার খুব একটা কিছু যায় আসে না। আমি বাঁচাব আমার মতো, আমার শর্তে।

You cannot copy content of this page