গল্প

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (20)

    জন্মসূত্র

    -সুব্রত হালদার 

    [ উনচল্লিশ ]

     

    বিন্দে কল্পনা করতে পারেনি, তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অখিল এইভাবে গালাগালি দিয়ে তাকে সপাটে চড় মারবে! আসলে অখিলকে এতটা রাগতে সে কোনদিন দেখেনি। তাই কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই তার কাছে অন্যায় আব্দার করতে এসেছিল। চুল্লুর নেশায় সেই থাপ্পড়ের ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না বিন্দের। ধপাস করে উল্টে পড়ে যায়। অখিল আর মুহূর্ত দেরি না করে তার ঘর থেকে সাইকেলটা বার করে দ্রুত চলে যায় দিঘিরপাড় বাজারে। কুঞ্জ ডাক্তারের চেম্বারে। রুইদাস পাড়ার কেউ ভাবতে পারেনি, অখিল তার সাইকেলে চাপিয়ে কুঞ্জ ডাক্তাবাবুকে নিয়ে আসবে। ততক্ষণে লোকে জটলা পাকাচ্ছে অখিল কেন বিন্দেকে মেরে পালাল? তার কাছে টাকা ধার চেয়েছে, সে ইচ্ছে করে দেবে, না হলে দেবে না। তাই বলে তাকে মারতে হবে? এটা অখিল অন্যায় কাজ করেছে। এর বিচার করে ওর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে আহত বিন্দের ডাক্তার দেখাবার জন্যে। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে সোজা অখিল বিন্দের বাড়ি চলে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে মুক্তি নেই। বাপের বাড়ি চলে গেছে। আবার ডাক্তারবাবুকে তার সাইকেলে চাপিয়ে মুক্তির বাপেরবাড়ি যায়।
    ডাক্তারবাবু বলেছে, তিনদিন নিয়মমত ওষুধপত্র যা লিখে দিয়েছে দোকান থেকে কিনে সব খাওয়াতে হবে। কোন ওষুধ বাদ দেওয়া যাবে না। খরচার ভয়ে যা ওষুধ দেওয়া হয় সবটা না কিনে ভুল করে মানুষ। এখানে তা করলে চলবে না। তাহলে ক্ষতে সেপটিক হয়ে যেতে পারে। আবার অখিল ডাক্তারবাবুকে তার সাইকেলে চাপিয়ে ডাক্তারখানায় পৌঁছে দেয়। মোহনের ওষুধ দোকান থেকে সবকটা ওষুধ কিনে মুক্তির মায়ের হাতে দিয়ে যেমন যেমন ডাক্তারবাবু
    বলেছে, তেমন ভাবে খাওয়াতে বলে বাড়ি চলে যায়। পাড়ার লোক অখিলের এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে তার উপর যত শাস্তির খাঁড়া চাপাতে সরব হয়েছিল, সব নীরব হয়ে যায়। কেউ বলে, ছেলেটা বাইরে শক্ত হলে কি হবে, ভেতরটা খুব নরম। কেউ বলে, আমরা অখিলকে দোষী বলছি, বিন্দেকে সে মেরেছিল বলে। আর বিন্দে যে তার বউকে খুন করতে গেছিল, সে কথা তো কেউ উচ্চবাচ্য করলো না? এ তো তোমাদের একচোখো বিচার হল। দেখবে, এমন কানা বিচার সমাজে চললে, একটা সময় এমন বিচার কেউ মানবে না। উল্টে অবিবেচক বিচারকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করবে আজকালকার বিচারবুদ্ধিধরা যুবকরা। পাড়ায় একে একে শিক্ষিত ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার চেতনায় তাদের ঠিক বেঠিক ভাবার ক্ষমতা বাড়ছে। সেই হিসেবে বিচারওয়ালাদের এবার ভাবতে হবে, কেমন বিচার তারা করবে-না-করবে। তাই বলে তোমরা ভেব না আমি অখিলের হয়ে ‘গাওনা’ গাইছি। বিন্দেকে মেরে অখিল ঠিক করেনি এটা মানছি। কিন্তু চিন্তাভাবনা তো সবায়ের সব সময় ঠিক থাকে না। বউ মেরে হাতে রক্ত মেখে কেউ যদি কারোর সামনে এসে তার কাজের সাওটা গেয়ে অর্থাৎ সমর্থন করে টাকা চাইতে আসে, তখন অখিল কেন, যেকোন সুস্থ মনের মানুষেরই মাথা গরম হয়ে যেতে পারে। অখিলের বেলায় সেটাই হয়েছে। সেই দিক দিয়ে ভাবলে অখিল ভুল কিছু করেনি। সে অপরাধীকে থাপ্পড় মেরেছে। খুন করার চেষ্টা তো করেনি? সেটা সকলকে ভাবতে হবে। হুট করে একটা বিচার করে দিলে চলে না।
    অখিল, বিন্দের বউকে চিকিৎসার সব খরচ দিয়ে এতটা উপকার করল। তবু শালা নেশাড়ু বিন্দে তার উপকারের দাম তো দিলই না উল্টে সে দিনরাত তাকে গালাগাল দিয়ে যায়। কেন সে তাকে মেরে উল্টে ফেলে দিল তার বিচার চায়। কেউ তার বিচার করে না। অখিল শালা পয়সার জোরে বিচার কিনে নিয়েছে। সেই থেকে বিন্দে অখিলের শত্রু হয়ে যায়। কিন্তু শুধু মার খাওয়ার জন্যে এই শত্রুতা তা কিন্তু নয়। সেটা বিন্দে কোনদিন বাইরে আওড়ায় না। ওর বউ মুক্তি তারপর থেকে প্রায় এক বছর হয়ে গেল বিন্দের সঙ্গে ঘর করতে আসে না। বিন্দের ধারণা, মুক্তিকে এই বুদ্ধি দিয়েছে ওই শালা অখিল-টা। শ্বশুরবাড়ির উঠোনে গিয়ে নেশার ঘোরে কথাগুলো চেল্লায় বিন্দে। তখন মুক্তির মা মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে গেলে পালায় সে।
    এই বিন্দের জিগরি দোস্ত এখন নোচে। সংসার করার যোগ্য না হয়েও মোহে পড়ে আরতিকে বিয়ে করলে যা হবার তাই হতে শুরু হল তার সংসারে। আরতির মন কিছুতেই সে আদায় করতে পারেনি। আরতি যে তাকে অপছন্দ করে তা আরতির মুখ থেকে শুনে সে বিগড়োতে শুরু করে। শুরু করে মদকে সঙ্গী করতে। সেখান থেকেই বিন্দে তার দোসর হয়ে যায়। সেদিন বেলা ন’টা ট’টা হবে। অখিল কারিগরদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিল। আর ঘটনাটা ঘটবে তো ঘটবে সেই অখিলের সামনেই। হঠাৎ অখিল দেখতে পায় আরতি চেল্লামেল্লি করতে করতে তার বাপের বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। তার উল্টো দিক দিয়ে আসছে অখিল। হঠাৎ আরতি এসে তার পিছনে লুকিয়ে অখিলের জামাটা মুঠো মেরে ধরে বলে,“অখিলদা আমাকে বাঁচাও। ওই মাতালটা আমাকে মারতে আসছে ! ওই দেখো, আসছে! অখিল সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে নোচে একটা কঞ্চিবাড়ির মত গাছের ডাল উঁচিয়ে এদিকে দৌড়ে আসছে। অখিল তাকে থামায়! সঙ্গে সঙ্গে নোচে বলে,“তুই সরে যা অখিল। আমার কাজে বাধা দিবি না। ওই মাগিকে আজ আমি উচিৎ শিক্ষা দেবো। আমাকে গালাগালি দেওয়া?” সঙ্গে সঙ্গে আরতি বলে, “মাতালটা সারা রাত কোথায় উল্টে পড়েছিল কে জানে। নেশা ছুটে গেলে বাড়ি এসে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। আমাকে বিছানায় যেতে হবে। আদর করবে! যত কথা বলে, মুখ দিয়ে ভকভক্ করে চুল্লুর বিকট গন্ধ ঠিকরে এসে আমার নাকে জ্বালা ধরিয়ে দিতে থাকে! রান্না করছি। বলতে একবালতি জল উনুনে ঢেলে দিল! আর ওই বাড়িটা আনতে গেল আমাকে পেটাবে বলে। ভয়ে আমি পালিয়ে আসি ও বাড়ি থেকে।” বলে অখিলের পা জড়িয়ে ধরে আরতি। তারপর বলে, “আমি ওর ঘর করবো না অখিলদা। তুমি আমাকে তোমার কারখানার কাজ দেবে? তোমার কাজ করে আমার একার পেট আমি চালিয়ে নেব। আমি কিছুতেই ওর ঘরে যাব না।” আরতির কথা শুনে অখিল তীক্ষ্ণ চোখে নোচে মাতালের দিকে তাকাতে সে বিষহীন সাপের মত ফনা নামিয়ে হাতের ছড়িটা রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আগোছালো পদচালনায় বাড়িমুখো হয়। যেতে যেতে বিড়বিড় করে অখিলকে দেখে নেবে, সেই প্রতিজ্ঞা করে আর তার বাপ-বাপান্ত করতে থাকে।
    সনাতন সেইসময় নিজের কাজে পাড়ার রাস্তায় বেরিয়ে শুনতে পায় কোন মেয়ের আকুতিমিনতির স্বর! পা পা করে এগিয়ে গিয়ে দেখে তাদের পাড়ার মেয়ে আরতি। নোচের বউ! অখিলের কাছে কাজ ভিক্ষে চাইছে। আরতির প্রতি দরদে উচাটন হয়ে ওঠে সনাতনের নরম হৃদয়। আহা রে, দু’পয়সা রোজগার করে পেটে খাবার জন্যে কেমন প্রার্থনা করছে একজন যুবতী মেয়ে। যে মেয়ের একটা কুলাঙ্গার স্বামী বর্তমান। অন্যকিছু না ভেবে সনাতন বলে, “তোমার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে তোমার অন্য কারিগরের মত ওকেও কাজে লাগাও না, অখিলদা?”
    পাড়ার বুঝদার এবং ভাল ছেলে হিসেবে সনাতনকে সবাই মানে। ওর থেকে বয়সে ছোট হলে কি হবে, অখিলও তার কথাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সেই ছেলে আরতির হয়ে সুপারিশ করছে বলে অখিল মেয়েটার প্রতি আগ্রহ দেখায়। ওই মদখোর স্বামী, নোচের মুখচেয়ে কিছুতেই নয়। আরতিকে বলে, “তুই তো এখন কাজ শিখিসনি। আমার কাজ করবি কেমন করে। ঠিক আছে, আপাতত সহজ কাজ কিছু তোকে দেবো’খন। মন দিয়ে যদি করতে পারিস তাহলে মন্ডলপাড়ার রেখা বউয়ের কাছে তোকে পাঠাব। ওর কাছ থেকে কাজ শিখে নিবি।” তার মতামতকে গুরুত্ব দেবার জন্যে অখিলদার দিকে সন্তুষ্টির হাসি হেসে সনাতন নিজের কাজে চলে যায়।
    মাস-দুই পরে নোচে, আরতির দাদুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বউ আরতিকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে আসে। নোচের কথায় আরতির দাদু গলে জল হয়ে গিয়ে জোর করে নাতনিকে শ্বশুর ঘরে পাঠায়। মা কিন্তু নিমরাজি ছিল। দাদু পাত্তা দেয়নি আরতির মায়ের মতামতে। বাধ্য হয়ে আরতি অখিলের শোলার কাজগুলো সঙ্গে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়। যেদিন যায় সেদিন বউকে কিছু বলেনি নোচে। দু’দিন পরেও নোচে যখন আরতির মন গলাতে পারল না, আবার ক্ষেপে যায় বোয়ের উপর! অখিলের সব অর্ডারি শোলার কাজ ভেঙে দুমড়ে বাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে বলে, “ঢেমনা মাগী, নতুন নাঙ ধরেছো? ওই শোলাওলা তোমার নতুন নাঙ হয়েছে না? এই ঘুচিয়ে দিলাম তোর নতুন পিরিত। কি করতে পারে তোর ওই অখিল নাঙ এবার আমি দেখব। পয়সাওলা নাঙ, তাই নিজের বিয়ে করা স্বামীকে তোর আর পছন্দ হচ্ছে না, তাই না?”
    এই শোলার কাজ তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অবলম্বন কি না এই মাতালটা নিমেষে শেষ করে দিল! আর কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, আরতি। সেও মাতালটার ব্যবহারের যাবতীয় জিনিস লন্ডভন্ড করে বাইরের কাদামাটিতে লেপটে দিয়ে চিৎকার করে গালাগালি দিতে দিতে সনাতনদের বাড়ির দিকে ছুট মারে! সনাতন তখন বাড়িতেই ছিল। সনাতনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তাদের উঠোনে এসে থাবড়ে বসে। ধড়ফড়ানি বুকে বলতে থাকে, “সনাতনদা, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ওই মাতালটা অখিলদার সব শোলার গয়নাগাটি নষ্ট করে দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এখন আমি কেমন করে অখিলদার সামনে মুখ দেখাব? এমনিতেই কাজ জানি না বলে আমাকে কাজে নিতে চাইছিল না। তুমি বলাতে কাজ দিল। এখন আমার কি হবে দাদা! জানোয়ারটা আমার সব শেষ করে দিল। তুমি দাদা অখিলদাকে একটু বুঝিয়ে বলবে? ওর অনেক ক্ষতি করে দিল জন্তুটা। ওই ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা তো আমার নেই। আর কাজও আমাকে দেবে না। ওর ঘর আমি আর করব না। তাহলে কি করে আমি বাঁচব, দাদা। এখন গলায় কলসি-দড়ি ছাড়া আর তো অন্য সমাধান আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। একমাত্র তুমিই পারো আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। অখিলদা যেন আমাকে ভুল না বোঝে। আমাকে না দোষি সাব্যস্ত করে!”
    অখিল ক্ষমা করে দিয়েছিল আরতিকে। ক্ষমা করেনি বিন্দে, নোচেকে। আর সেই থেকে নোচে-বিন্দে তার জাতশত্রু হয়ে দাঁড়াল। অথচ তাদের উপকারের জন্যে সে কাজ করতে গেছিল। এতসব অনাচার দেখেও চোখে ঠুলি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়ার মুরুব্বি-বিচারকরা! নোচে-বিন্দের মত কাজ কারবার কত অতীত থেকে যে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে চলে আসছে তা কে জানে। কারোর হুঁশ নেই, বৃহত্তর সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমাজেরও পরিবর্তনের ডাক দেওয়া দরকার। নিজেরা নিজেদের মধ্যে বেলেল্লাপনা, নোংরামো, নারী-পীড়ন- সবকিছু বিনা প্রশ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে আটচালা কোন দোষ দেখে না। আবার এই ছেলেমেয়েরা যদি অন্য জাতের কোন ছেলেমেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে তো তার মত জঘন্য অপরাধ নাকি আর হতে পারে না। রুইদাসদের মাথাদের বিচারে সেটাই বলে। কিন্তু এই বলা তো বন্ধ করার সময় এসেছে। সনাতনের সঙ্গে এমনকিছু সামাজিক একচোখোমিকে নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করে অখিল। অখিল বলে, “আচ্ছা সনাতন ভাই, তুই বল। একটা অকাল-স্বামীহারা যুবতী মেয়ে। অরক্ষণীয়া হয়ে দিন কাটাচ্ছে। চরম বিপদগ্রস্থ সে। তার পাশে যদি আমি গিয়ে দাঁড়াই তাতে আমাদের পাড়ার মানুষের মাথা খারাপ হবার কারণ কি? তাছাড়া, ভীষ্ম মন্ডলের বউ, রেখা-বউ তো আমার কাজের গুরুত্বপূর্ণ কারিগর। তার হাতের কাজের পটুতায় বড়বাজারে আমার এত সুনাম হয়েছে। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থাকবে না? তুই আমার চেয়ে ছোট। ভায়ের মতো। তবু তোকে আর একটু খুলে বলতে আমার দ্বিধা নেই। কাজের সুবাদে যাতায়াত। ভীষ্ম বেঁচে থাকতেও কাজ নিয়ে আমি ওদের বাড়ি যেতাম। তখন মেয়েটার প্রতি আমার কোন টান জন্মায়নি। পরস্ত্রীর প্রতি লোভ করা আমার নীতিতে বাধে। মেয়েদের নিয়েই তো আমার যাবতীয় কাজ। ব্যবসা আমার লক্ষ্মী। এই লক্ষ্মীর সহচারিনী ওরা। ওখানে বাঁকা দৃষ্টি ফেলা মানে তো নিজের পায়ে কাড়ুল মারা। সেটা আমি কোনদিন হতে দিতে পারি না। দিইও নি। কিন্তু ভীষ্ম মারা যাবার পর তার বউটার অসহায় জীবন আমাকে ধাক্কা মারে। কে ওর জীবন যৌবনের রক্ষকর্তা হবে। জীবনের সবটাইতো ওর বাকি পড়ে রইল। ধূমকেতুর মত ক’টা দিন ভীষ্ম ওর জীবনে এল, আবার বিলীন হয়ে গেল। তাই তার বিপদে পাশে দাঁড়াবার জন্যে কাজে-অকাজে ওদের বাড়ি একটু বেশি যাতায়াত করতে শুরু করি। তখনও কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসা বাসা বাঁধতে পারেনি। হঠাৎ একদিন রেখা বউয়ের শাশুড়ি আমাকে মেয়েটার দায়িত্ব নিতে বলে। অকল্পনীয় এক প্রস্তাবে আমার সত্ত্বার ভেতরে কে যেন এসে আন্দোলন শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণের জন্যে যেন মনে হল, আমি আমার মধ্যে নেই। তখনকার মত অবশ্য নিজেকে সামলে নিই। কিন্তু সেই দিন থেকেই রেখা বউকে নিয়ে আমার ভেতরের ভাবনা অন্য খাতে বইতে শুরু করে। কখন যেন ধীরে ধীরে ওকে ভালবেসে ফেলতে থাকি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এখনও পর্যন্ত কিন্তু রেখা বউয়ের মনের হদিশ আমার ধরাছোঁয়ার বইরে। মনে হয় যেন একটা পলকা কাঁটা তার আমার দু’জনের মাঝখানে অবস্থান করছে। তবে আমি বিশ্বাস করি সেই কাঁটা সরিয়ে দিতে বেশি বেগ পেতে হবে না।”
    সনাতন ছেলেটা কম কথা বলে। সেটা অখিল কেন, পাড়ার সবাই জানে।
    তাই তার কাছ থেকে এত কথার উত্তরে অনেক কথা অখিল আশা করে না। খানিক চুপ থেকে সনাতন শুধু বলল, “অখিলদা, জাত ধর্ম বর্ণর নিক্তি-কাঠিতে ভালোবাসা কোনদিন মাপা যায় না। এ তো অন্তরের সঙ্গে অন্তরের বোঝাপড়ার ব্যাপার। অন্তরের আবার জাত ধর্ম বর্ণ-ফর্ণ কিছু আছে নাকি ! আমার তো জানা নেই। যারা এই ভাবনার বাইরে অন্যকিছু ভাবে, সে তো মধ্যযুগীয় ভাবনা। এ ভাবনা বর্তমান ধ্যানধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। জানাই যখন যাচ্ছে যে এ খাপে ওই খাপ মিলবে না, তখন অমন চর্চায় কি লাভ। তুমিই বলো না অখিলদা?”
    নিত্যানন্দ-দিবাকর, নোচে-বিন্দেরা যদি পাড়ার আটচালাকে শিখন্ডী রেখে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করতো তাহলে আজই তাদের বুঝিয়ে দিত কত ধানে কত চাল। কি শারীরিক ক্ষমতায় বা আর্থিক ক্ষমতায়। তারপর তো লোকবলের ব্যাপারটা আছেই। এখনকার ছেলেপিলেরা আর সেকেলেদের একদমই পাত্তা দিতে চায় না। কান পাতলে সেই হৃদয়-কথা শুনতে পাওয়া যায়।
    একটু আগোছালো পোষাকেই রেখা শোলার কাজ করতে বসে যায়। তাদের ঘরে তো এখন আর কোন পুরুষ মানুষ রইল না। বাইরে থেকে কারোর আসারও কথা না। হঠাৎ ঠিকাদারবাবুকে দেখে চমকে ওঠে রেখা! ধরফড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে গোছগাছ করে ভদ্রসদ্র হতে। অত তাড়াতাড়ি সে আর হবার। শাড়ী জড়িয়ে মড়িয়ে যেন একাকার হয়ে আছে। রেখার মত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অখিলও। পাশের ঘরে দরজার সোজাসুজি বসে ভীষ্মর মা। দুই কপোত-কপোতির বেসামাল অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে বুড়ি। এমনিতেই বুড়িরা একটু ঠোঁটকাটা হয়। তারই সাজুজ্য মেনে বুড়ি বলে,“আর লুকোচাপা খেলা খেলে কি হবে বৌমা। যা ভবিতব্য তা তো মিলে গেল। ধীরে সুস্থে তোমার কাপড় সামলাও। অত হুড়োহুড়িতে মাকড়শার জালের মতো নিজে আরও জড়িয়ে পড়বে। অখিলবাবা যা দেখার না চাইতেই তা দেখে ফেলেছে।” বলে ঘরের বাইরে চলে যায় বুড়ি। শাশুড়ির কথায় লজ্জায় আরও রক্তিম হয়ে যায় রেখা বউয়ের চোখমুখ। ওখান থেকে দৌড়ে শাশুড়ির ঘরে চলে এসে চাপা গলায় বলে,“তুমি-না মা, একদম যাচ্ছেতাই। তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। যাও তো ঠিকাদারবাবু কি ভাবলো কে জানে!”
    বাড়িতে হঠাৎ ঢোকার মুহূর্ত কয়েকের জন্যে যেটুকু দেখার দেখতে পেয়েছে অখিল। তারপর লজ্জায় সেই যে পাশ ফিরে দাঁড়িয়েছে, রেখা বউ ওঘরে চলে যাবার পরও সেইভাবে ছিল। রেখা বউ ফিটফাট হয়ে এসে ডাকতে তবে সামনে ঘুরে দাঁড়ায়। দু’জনে সামনাসামনি হতেই রেখা বউ মুচকি একটা হাসি ছুড়ে দেয় অখিলের দিকে। সেই হাসি পরম আদরে নিজের হাসিতে মিলিয়ে দেয় অখিল। রেখা বলে,“কিছু মনে করবেন না ঠিকাদারবাবু। আপনি আসবেন বুঝতে পারিনি। কোলকাতায় যাবার কথা তো আজ? গেলেন না যে? এরকমভাবে কাজে অবহেলা করলে কি করে হবে। মহাজন যদি অর্ডার বাতিল করে দেয়?”
    -আমার অর্ডার বাতিল করলে মহাজনেরই লোকসান হবে। আমার নয়। কত মহাজন হাত বাড়িয়ে আছে, আমার মাল নেবার জন্যে। সেটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র আমার রেখা বউয়ের জন্যে। যদি চলে যেতাম তাহলে কি এমন মায়াবী প্রকৃতির সঙ্গে আমি একাকার হতে পারতাম! প্রেমময়ের অসীম কৃপা না থাকলে এই অমূল্য দর্শন সম্ভব নয় রেখা বউ। আমি যে আজীবন এই প্রকৃতিতে নিজেকে সমর্পণ করতে চাই, প্রিয়া.. তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব। তুচ্ছ হয়ে যাবে আমার যাবতীয় পার্থিব চলনবলন, ইচ্ছা অনিচ্ছা। সব। সবকিছু- এমন লোকসান আমি প্রাণ থাকতে হতে দিতে চাই না রেখা বউ। আর তা থেকে রক্ষা করার চাবিকাঠি যে একমাত্র তোমারই হাতে।”
    -এ কি কথা বলছেন, ঠিকাদারবাবু! আমার মত পাপীতাপী তুচ্ছ মেয়েমানুষকে এমন লোভ দেখাবেন না বাবু। অলক্ষুণে স্বামীখাকি আমি। এ আমার জন্মান্তরের পাপের সাজা। যদি আমার ‘বেয়নে’ এমন অঘটন না ঘটবে তাহলে আমার বিয়ের আগেও তো লতার ছোবলে মরতে পারতো সে? তা তো হল না! আমাদের বিয়ে হল আর মরণ তাকে কেড়ে নিল! আমার পাপের ফল ছাড়া এমনটা হবার কথা নয়। আমাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিন ঠিকাদারবাবু! ভুলে যান এই অপয়া মেয়েমানুষকে। বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে রেখা বউ!
    রেখা বউয়ের কথায় হঠাৎ যেন কেমন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে অখিল! তার ভালোবাসাকে না পাবার আতঙ্কে বেসামাল হয়ে পাশের ঘরে যেতে যেতে বলে,“তা হলে আর এ জীবন কার জন্যে বাঁচিয়ে রাখা, রেখা বউ! একে আহুতি দেওয়াই সঠিক বিচার হবে। তুমিও যখন তা চাইছো তবে তাই হোক।”
    কোন অঘটন ঘটে যাবার আগেই রেখা দৌড়ে ওঘরে গিয়ে যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষের শারীরিক ব্যবধানকে উপেক্ষা করে প্রাণপণে অখিলকে জড়িয়ে একাকার হয়ে বলে, “এ কাজ তুমি করতে যেও না অখিল! দ্বিতীয়বার আবার আমাকে আপনজনের মৃত্যুর দায়ভার চাপিও না। তোমার কাছে আমি তোমার জীবন ভিক্ষা চাইছি। বিনিময়ে তোমার যা মনের ইচ্ছে তাই হবে। তুমি যা বলবে তাই করব। যা বলবে না করব না। শুধু আমার এই ক্ষতিটুকু হতে দিও না।”

    [ চল্লিশ ]

    আশাতিরিক্ত ভাল ফল করে সরিষা সারদা মন্দির থেকে বেসিক ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরল অলোকা। তার এই সাফল্যের পেছনে প্রধান অবদান যে বিপ্লবদার। এ অবদান জীবনে সে ভুলতে পারবে না। অলোকা ভাবে, বিপ্লবদা যদি তার জীবনে না আসতো তো এই ট্রেনিংটা নেওয়া তো হোত না। ট্রেনিং পিরিয়ডে যে ভাবে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রোজেক্ট তৈরীর ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে তার ঋণ সে কোনদিন শোধ করতে পারবে না। এক কথায় এই মানুষটা অন্তরাল থেকে তাকে সাহায্য না করলে গর্ব করে বলার মত এই রেজাল্ট করা তার একার পক্ষে কোনদিন সম্ভব ছিল না। এই সত্যকে সে যদি স্বীকার না করে তো তা আপন ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছু হবে না। যত এই মানুষটার সঙ্গে সে মিশছে তত তার প্রতি একটা অমোঘ টান মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এ তার জন্মান্তরের আপনজন। এখন অলোকার মনে হয় এই বিপ্লবদা ছাড়া তার জীবনে কোনদিন পূর্ণতা আসতে পারে না। সে সবসময় প্রস্তুত তার সর্বস্ব এই মানুষটাকে উজাড় করে দিতে। কিন্তু বিপ্লবদা কি তাকে সেই চোখে দেখে? কি জানি! এমনি বোঝা যায় সে যা চায় সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবদা তার নিজের চাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। অথচ মুখ ফুটে পরিষ্কার করে কেন যে বলে না, অলোকা আমি তোমাকে ভালোবাসি! কথায় বলে, ‘মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’। এ তো দেখছি তার উল্টো। অলোকা তো লজ্জাহীনভাবে তা যে কোন সময় প্রকাশ করতে পারে। এই মানুষটার সামনে প্রকাশিত হওয়াটায় কোন সঙ্কোচ বোধ তার মধ্যে নেই। কিন্তু গ্রাহকের আধার কতটা প্রস্তুত সেটাই তো খোলসা হল না তার কাছে।
    সারদা মন্দির থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসার পর বিপ্লবদাকে বলেছিল অলোকা, “এবার তো তার হাতে অঢেল সময়। পুনরায় ডিগ্রীকোর্সে ভর্তি হওয়া যায় তো বিপ্লবদা? আমার পুরোনো ইচ্ছেটা তাহলে পূর্ণ করতে পারি। তোমার কি মত?”
    -বেসিক পড়ার উদ্দেশ্য ছিল, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতার সুযোগ নেওয়া। এবার তুমি যদি সেই সুযোগ না নিয়ে আবার লেখাপড়ায় জড়িয়ে পড়ো তাহলে এত কষ্ট করে এটা পড়ার কোন যে মূল্য থাকে না অলোকা। আমার তো আশা তুমি প্রথম সুযোগেই চাকরিটা পেয়ে যাবে। তোমার প্রতি এতটা আমার আস্থা! এখন আমাদের কাজ, সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। সুযোগ এলে, সফল হলে তো আবার তোমাকে কলেজে পড়া ছাড়তে হবে। এবার তুমি বলো, কোন কাজটা তাহলে সঠিক হবে। সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বেসিক ট্রেনিং করা না থাকলে কোন প্রার্থীকে প্রাইমারী স্কুলের জন্যে টিচারের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে না। এই নিয়ে বছর খানেক হয়ে গেল কেস চলছে। নন- বেসিকের যারা সরকারের আগের নোটিফিকেশন মত দরখাস্ত করেছিল তারা সরকারের এই সম্প্রতি নোটিফিকেশনের বিরুদ্ধে কেস করেছে। তাদের যুক্তি, সরকারের আগের বিজ্ঞাপনে কোন ট্রেনিংয়ের কথা বলা ছিল না। এই কেসের বিরুদ্ধে সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং নতুন বিজ্ঞাপনের পক্ষে সাওয়াল করেছে। খুব সম্ভবত সামনের হেয়ারিংয়ে কেসটার ফাইনাল ডিসিশান দেবে কোর্ট। যা শোনা যাচ্ছে তাতে সরকারের পক্ষেই রায় যাবে। তাই যদি হয় তো আমাদের আর ফিরে তাকাতে হবে না। কেন বলো তো? কারণটা এর গভীরে লুকিয়ে আছে। গভর্নমেন্টের রেকর্ড মত যা ভ্যাকান্সি আছে, তার থেকে কম ক্যান্ডিডেট আছে বেসিক ট্রেনিং পাশ করা। তারপর তোমার Rank তো অনেক উপরের দিকে। এ অবস্থায় তোমাকে আটকায় কে? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিপ্লব বলল।
    অনেকদিন হয়ে গেল। দেখা হয়নি বিপ্লবদার সঙ্গে। কি করে যে দেখা করা যায়! মনটা উচাটন। তাদের পাড়াগাঁয়ের যা হালচাল, তার মত মেয়েদের হুটহাট অন্য পাড়ায় গিয়ে দেখা করার উপায় নেই। তারপর মেয়েটা যখন অলোকা, তো চব্বিশঘন্টা ঘুরে বেড়ানো পাড়ার অকেজোদের লাল চোখ তার উপর নিবদ্ধ হবেই হবে। আর অন্য পাড়া বলতে বিপ্লবদাদের পাল পাড়া হলে তো পরদিনই আটচালায় অশ্লীলতার দায়ে বিচারসভা বসে যাবে তাদের বিরুদ্ধে। একটা চিরকুট লিখে ঘোরাঘুরি করছে অলোকা। লক্ষ্য তার সনাতন। কখন ছেলেটাকে ঘরের বাইরে দেখবে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তো সনাতনদের বাড়ি গিয়ে চিরকুটটা তার হাতে ধরিয়ে বলা যায় না যে এটা বিপ্লবদাকে দিয়ে দিস। তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে সে। দুই ভাবনার সন্ধিক্ষণে সনাতনই প্রথম তাকে দেখতে পেয়ে বলে, “কেমন আছো, অলোকাদি। হ্যাঁ, সবসময় ঘরের ভেতর ভাল লাগে। একটু ঘোরাঘুরি করাও দরকার।” অলোকা দেখে, সনাতন বাজারের ওইদিক থেকে আসতে আসতে কথা বলছে। অলোকা ডাকে, “এদিকে একটু আয়-না ভাই। তোর সঙ্গে আমার কাজ আছে। তোকেই খুঁজছিলাম। তাই এই ঘোরাঘুরি।” সনাতন বলল, “বলো কি বলছো। হ্যাঁ, বিপ্লবদাকে দেখলাম মোহনের সেলুনে চুল কাটছে। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। না। তোমাকে বলার মত তেমন কিছু বলেনি। আমিও ওখানে দাঁড়াই নি। একটা বিশেষ কাজে বাড়ি আসছিলাম তাই। আবার এক্ষুণি বাজারে যাব।” বলে মুচকি একটু হেসে নেয় সনাতন। ভাইটার কাছে একটু লজ্জা মত পায় অলোকা। বলে, “আবার যখন বাজারে যাবি, তখন আমার একটা কাজ করে দিবি ভাই?” বলে সনাতনের ‘হ্যাঁ-না’ উত্তরের অপেক্ষা না করে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা চিরকুটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা বিপ্লবদাকে দিয়ে দিস। চুল কাটছে মানে একটু পরে গেলেও মোহনের সেলুনেই পেয়ে যাবি ওকে।” বলে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে অলোকা। সনাতন চিরকুটটা হাতে ধরে কিঞ্চিৎ উদাস চিত্তে অলোকাদিকে পেছন থেকে দেখতে থাকে। ভাবে, অলোকাদি কত ভালোবাসে বিপ্লবদাকে। এই নিয়ে পাড়ায় কত-না ঝামেলা হয়েছে। তবু দিদির মন যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। থাকবে না বা কেন? বিপ্লবদাই তো ওর জীবনের একমাত্র ‘ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড।’ সেই কৃতজ্ঞতা বোধ যদি অলোকাদির মধ্যে না থাকতো তো এক নিতান্ত সত্যকে নির্মমতার সঙ্গে অবহেলা করা হত।
    আর দেরি না করে সনাতন তাড়াতাড়ি তাদের বাড়ির দিকে গেল নিজের কাজ সামলাতে। তাড়াতাড়ি করে না বাজারে ফিরতে পারলে আবার বিপ্লবদার সঙ্গে তার দেখা না-ও হতে পারে। চুল-দাড়ি কাটা হয়ে গেলে ও সেখানে আড্ডা দেবার মানুষ নয়। কাজ থাকলে এদিক ওদিক কাজ সেরে বাড়ি চলে আসে। বই আর পড়াশোনা এদের দু’জনের অন্যতম প্রধান বন্ধু। কে যে এদের প্রধান বন্ধু- এরা পরস্পর দু’জন নাকি বই-লেখাপড়া সেটা বোঝা মুশকিল। সব যেন একাকার হয়ে আছে এদের মধ্যে।
    “ছুতোটা মায়ের জন্যে ওষুধ কিনতে যাওয়া। দিঘিরপাড় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না তাই ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। কাল দুপুর দুটোর সময় আমি বাজারের বাসস্ট্যান্ডে থাকব।” বিপ্লবকে উদ্দেশ্য করে চিরকুটে তাই লিখেছে অলোকা। সেটা পড়ে একটা সন্তুষ্টি ভাব নিজের মনের মধ্যে জরিয়ে নিতে নিতে বাড়ির পথ ধরে বিপ্লব। এত কাছে থেকেও কতদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তার মনটাও অস্বস্তিতে থিতু হচ্ছিল না কিছুতেই। তারও কলেজ শেষ। বাবার কারবারের কাজ না থাকলেও কাছে-দূরে, বাইরে কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। ভালোই হল এই সুযোগে তার কলেজভূমে একটু ঘুরে আসা যাবে। তবে বাড়িতে অন্য কাজের কথা বলে যেতে হবে। বাড়ির লোকজন পছন্দ করে না, রুইদাস পাড়ার মেয়ে অলোকার সঙ্গে সে মেলামেশা করুক। এইসব জাত-ফাত নিয়ে এরা চর্চা করতে এত পছন্দ করে কেন কে জানে! ওর মত গুণবতী বুদ্ধিমতী নম্র স্বভাবের মেয়ে সারা পালপাড়া ঢুঁড়ে বেড়ালেও একটা খুঁজে দিতে পারবে কেউ? পারবে না। আপাতত মুখে কিছু বলছে না যে রুইদাসরা তাদের থেকে নীচু জাত। তার উপর পশুর চামড়া নিয়ে ওদের কাজ কারবার। তাই এই জাতের প্রতি ওদের এমন ঘেন্না। কিন্তু চলনে বলনে তা বুঝিয়ে দিতে কসুর করছে না পালেরা। অলোকার সঙ্গে মেলামেশার বহর বেশি মনে হলে নিশ্চয়ই একদিন ভেতর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে মনের মূল প্রবৃত্তি! অলোকার বেসিক ট্রেনিংয়ের পড়ার সঙ্গে সে যে এত বেশিভাবে জড়িয়ে ছিল, তার বিন্দু বিসর্গও জানে না তার বাড়ি। বা পাড়াও। সেই সুযোগ সে করে দেয়নি। যা কিছু করেছে সবটাই এদের অন্তরালে রেখে। তিরাশি নম্বর বাসে দিঘিরপাড় থেকে উঠে দোস্তপুর চৌরাস্তার মোড়ে নামতে হয়। সেখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে ডায়মন্ড হারবারমুখী বাস ধরতে হবে। দোস্তপুর মোড়ে নেমে এত গাড়ির বহর দেখে একটু ইতস্তত বোধ করে অলোকা। তাই নিজে থেকেই সে বিপ্লবের বাঁহাতটা তার ডান হাত দিয়ে খাপটি মেরে ধরে ! অলোকার হাতের পেলব স্পর্শে সমস্ত শরীরে শিহরণ তুলে দেয় বিপ্লবের! ওকে নিজের জন না ভাবলে সে এটা করতো না। একটা তৃপ্তিবোধ তাকে যেন খুশি করে তোলে। রাস্তা পার হয়ে বাসের জন্যে ওপারে দাঁড়িয়ে তখনও হাত ছাড়েনি অলোকা। বিপ্লব একবার অলোকার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হাতের দিকে চায়। ইঙ্গিত বুঝে অলোকা বলে,“সারা জীবন আমি এই হাত ধরে বেঁচে থাকতে চাই। এ হাত আমার। ছেড়ে দেবার হাত নয় এটা। চলো গাড়ি আসছে। এবার হাত ছাড়ছি। অনুসরণ করছি তোমার। সেই সুযোগ তুমি আমায় দাও। জন্মান্তর!”
    কলেজে পড়তে আসার সুবাদে ডায়মন্ড হারবার শহর বিপ্লবের হাতের তালুর মত চেনা। অলোকার মায়ের জন্যে ওষুধ কেনার পর ডায়মন্ড হারবার গার্লস স্কুল ডানদিকে রেখে নুনগোলা এলাকা পেরিয়ে ওরা চলে যায় নদীর কিনারায়। নদী এখানে একটা বড় বাঁক নিয়ে সাগর অভিমুখে রওনা দিয়েছে। বাঁধানো নদীবাঁধে বিভিন্ন গাছ লাগানো আছে। গাছের শেকড়গুলো বাঁধের পাড়কে শক্তপোক্ত ধরে রাখার জন্যে। বিশেষ করে বট, অশত্থ, পাকুড়, দেবদারু আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারিগুলো পরিবেশকে যেন মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। প্রত্যেক গাছের ঠিক নীচে সুন্দর সুন্দর সিমেন্টের বাঁধানো বসার চাতাল। চেয়ারের মত দেখতে তার কাঠামো। অলোকা এই প্রথম এমন মনপাগল করা জায়গার সঙ্গে পরিচিত হল। অগণিত হাত মেলে ধরে একটা বট তার শীতল ছায়া বিতরণ করে চলেছে অকৃপণভাবে। গাছের তলায় বসার জায়গায় অলোকা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে বসতে বলল বিপ্লবকে। বলল, “এই ব্যবস্থা কি তাদের মত ভালোবাসার জনেদের জন্যে করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ! মনে হচ্ছে তো তাই। মানে বৃহত্তর সমাজ আমাদের এই নির্মল পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়ে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে আমরা ভুল কাজ কিছু করছি না। সংকীর্ণ স্বল্প-জানা ঈর্ষাধারি একদল মানুষ যাই ভাবুক না কেন।” বলে এবার অলোকা বিপ্লবের একটা হাত নিজের কোলের আঁচলের উপর রেখে তার উপর দিকটা পরম ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে। নিজের অন্তরের সুখানুভূতির সঙ্গে বিপ্লব তাকে প্রশ্রয় দিতে থাকে। কখন যেন দখিনা ঠান্ডা মোলায়েম বাতাসে স্নান করতে করতে চোখ বুজে আসে বিপ্লবের। হঠাৎ একটা চমক তাকে যেন জাগিয়ে তোলে। দেখে, অলোকার মোহময় দুটো ঠোঁটের ওম তার হাতে বিলি কাটছে! বিগলিত চিত্তে বিপ্লব বলল, “এত ভালোবাসার দায় আমি বহন করতে পারব তো অলোকা? আমি এর যোগ্য কি না তা তো আমার জানা নেই। আমাকে এইভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসার রজ্জুতে বেঁধে নিজের কাছে রাখতে চাইছো। আমিও সেই বাঁধন মুক্ত হতে চাই না। কিন্তু আমাদের দু’জনের সমাজ যদি দু’জনের মধ্যে দুর্ভেদ্য পাঁচিল তুলতে আগ্রাসী হয়! তখন কিভাবে আমরা সেই বাধা টপকাতে পারব তা তো আমার জানা হয়ে ওঠেনি অলোকা।”
    বিপ্লবের কথায় অলোকা কোন অজানা বিচ্ছেদ ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এবার তার ঠোঁট দিয়ে ভালবাসার ওমের স্পর্শর পরিবর্তে চোখ দিয়ে সদ্যভুমিষ্ঠ প্রেমের বারি বিপ্লবের হাতের উপরিভাগকে স্নান করিয়ে দিতে লাগল। বিপ্লবও আর পুরুষালী চিত্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। টপটপ করে তার চোখ বেয়ে গাল টপকে ভূমির পারে নত হতে থাকল।
    “মুখ তোলো অলোকা। এই নাও রুমাল। চোখমুখ মুছে নাও।” ধরে যাওয়া গলায় বিপ্লব বললে, হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে রুমালটা নিয়ে প্রথমে বিপ্লবের ভেজা হাতটা মুছতে যায় অলোকা। আটকে দেয় বিপ্লব। বলে,“এ আমার পরম ভালোবাসার অমূল্য দান। একে হেলায় নিঃশেষ হতে দিতে আমি পারি না। এর স্থান আমার সত্ত্বায়। সত্ত্বার মধ্যে আমি একে লীন করে দিতে চাই।” বলে সেই ভেজা হাতটা বিপ্লব তার মুখময় আলতো করে বুলিয়ে বুলিয়ে হৃদয় মাঝে স্থান করে দিল। বলল, “এবার ফেরা যাক আলোকা। বিকেল গড়ানের দিকে। যেতে যেতে পশ্চিমের সূর্য রক্তিম হয়ে আসবে। অন্ধকার নামলে তোমার বাড়ির লোক চিন্তায় পড়ে যাবে। খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। সেই পরিস্থিতি আমাদের কাম্য নয়। তার আগেই আমাদের ফিরতে হবে।”
    কোর্টে সরকারের জিৎ হবার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক নেবার কথা বলে। শর্ত, প্রত্যেক প্রার্থীকে বেসিক ট্রেনিং কোর্স পাশ করতে হবে। যথারীতি অলোকা দরখাস্ত করে এবং প্রথম সুযোগেই মাস্টারির চাকরিটা পেয়ে যায়। রুইদাস পাড়ার ইতিহাস রচনা করে ফেলল অলোকা এই মাস্টারির কাজটা পেয়ে। গর্বে বুকের ছাতি বেড়ে গেল রুইদাস পাড়ার। সনাতন এই সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইল না। সচেতনভাবে সে আটচালায় একটা অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা করল। সেখানে পাড়ার সব বাসিন্দাকে আসার আমন্ত্রণ জানানো হল। উদ্দেশ্য অলোকা রুইদাসকে সম্মান জানানো। সে রুইদাস পাড়াকে সম্মানিত করেছে। অতএব রুইদাস পাড়াও তাকে সম্মানিত করতে চায়। সনাতনের ইচ্ছা হচ্ছিল এই আনন্দানুষ্ঠানে বিপ্লবদাকে আমন্ত্রণ জানানোর। কিন্তু বেপাড়ার একটা ছেলেকে কোন যুক্তিতে এখানে ডাকা হবে সেই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। অলোকার একদম পছন্দ ছিল না তাকে নিয়ে এইসব প্রচার-ট্রচার করা হোক। কিন্তু সনাতন, অখিলরা সেকথা শুনবে না। তাদের গর্বের ধনকে তারা মানুষের সামনে তুলে ধরবেই। বাধ্য হয়েই ওদের কথায় অলোকাদি নিমরাজি হয়। তবে অলোকাদির প্রবল আপত্তি আছে বিপ্লবদাকে ডাকার ব্যাপারে। পাড়ার ওইসব মন্দ ছেলেগুলো যদি তাকে দেখে হুল্লোড় শুরু করে তো অসম্মানের আর অবশিষ্ট থাকবে না। অলোকার এই অনুষ্ঠানের বিরোধী হবার আর একটা কারণ ছিল, বিপ্লবদা। যে মানুষটার বিশাল অবদানের বিনিময়ে তার এই সাফল্য সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় কেমন করে? এ তো শিবহীন যজ্ঞ হয়ে যাবে। তবু অলোকা বিপ্লবদার ব্যাপারে এতটা কঠোর। সনাতনকে বলে, “বিপ্লবদাকে যদি তোরা আসতে বলিস তাহলে ওখানে আমাকে পাবি না। এটা আমি বলে দিলাম।”
    বিপ্লবের জীবনের যদি প্রথম সাফল্য আসে তো সেটা হল অলোকার চাকরি পাওয়া। চাকরিটা অলোকার। কিন্তু গর্ব তার। নিজের অবশিষ্ট প্রেরণার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে সে অলোকার এই সাফল্য ছুঁতে পারার পেছনে। তাই গর্বের সঙ্গে খুশি এবং সন্তুষ্টির অংশীদার তো সে হবেই। তার আরও ভাল লাগছে, ওই পেছিয়ে পড়া একটা সমাজ আজ তার সাফল্যকে সম্মান দিতে অনুষ্ঠান করতে চলেছে। এই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির জন্যে কেউ ডাকলো কি না-ডাকলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। ডাকলে সে যাবেও না। ওপাড়ার সব লোক যে কতটা সংকীর্ণমনা, তা সে খুব ভাল করে জানে। বরং বলা যায় বেশিরভাগ মানুষের মানসিকতা এখনও সেই মধ্যযুগীয় স্তরে দাঁড়িয়ে আছে। অলোকা, সনাতন বা অখিলরা তো গোবরে পদ্মফুলের মত জ্বলজ্বল করছে। ওই জনা-কয়েকের মুখের আয়নার সামনে সিংহভাগকে আনতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে রুইদাসদের।
    রুইদাস পাড়া এখন যেন উৎসব মেজাজে মশগুল। পাড়ার মেয়ের এতবড় একটা সাফল্যকে বাহবা দেবার জন্যে আটচালায় অনুষ্ঠান হবে। সেই উপলক্ষ্যে আবার অন্যপাড়ার গন্যমান্য কয়েকজন মানুষকে ডাকা হয়েছে। চলছে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করার তোড়জোড়। তাই নিয়ে সনাতনরা এখন অত্যন্ত ব্যস্ত। পাড়ার বয়জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে চলছে গুরুত্বপূর্ণ সব আলাপ আলোচনা। কিঞ্চিত মিষ্টিমুখেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে, আটচালার তহবিল থেকে। মিষ্টিমুখের প্রস্তাবটা আসে পাড়ার মুরুব্বিসম মানুষদের কাছ থেকেই। সনাতন, অখিল অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিল, আটচালার ফান্ড মানে তো সরকারি টাকা। অন্যরা যদি এই টাকা খরচ নিয়ে কোন মন্তব্য করে তো অস্বস্তির আর শেষ থাকবে না। তাই অখিল বলছিল,“বড়রা যখন বড় মুখ করে বলেছে তখন মিষ্টিমুখ করা হবে। তবে সবাই যদি রাজি থাকে তো আমি ওই খরচের ভারটা নিতে পারি। তাহলে
    সনাতনের ওই আশঙ্কাটা আর থাকবে না।” অখিলের প্রস্তাব উপেক্ষা না করেও নন্দকাকা বলল,“অখিলের বুকের পাটা আছে বলে এতটা সাহস দেখাতে পারল। কিন্তু অখিলকে অবজ্ঞা না করেই বলছি, আমরা, পাড়ার বয়স্করা আনন্দ করে একটা প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাবকে তোমরা সম্মান দেবে না? আমার তো মনে হয় না, আমাদের কথা বললে পাড়ার কেউ সেই কাজে আপত্তি তুলবে। সারা জীবন তো জীবন-পাত করে পাড়ার ভালোর জন্যে কাজ করে এলাম। এবার বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানোর একটা সুযোগ এসেছে। সময়ও এসেছে বলতে পারো। সেটাকে এলেবেলে করে দিতে পারি না আমরা। তোমরা কি বলো, সনাতন-অখিল? দরকার হলে আটচালা কমিটি থেকে এই খরচের কথাটা পাশ করিয়ে দিচ্ছি ! আমি, রতন, দিবাকর, সুবোধ কাকারা কেউই অরাজি হবে না এমন সুন্দর একটা প্রস্তাবে।” নন্দকাকার প্রস্তাবে একশো শতাংশ সায় দিয়ে সনাতন বলল, “ওই দিক থেকে আমাদের কোন সংশয় নেই কাকা। কিন্ত আমরা জানি, পাড়ার একটা দল আছে যারা সবসময় অন্যের খুঁত ধরবার জন্যে মুখিয়ে থাকে। কোন ভালো কাজেও সাথে না থেকে তাকে ব্যাগড়া দিতে পিছপা হয় না। এটা তাদের স্বভাব। চলতি সংস্কারকে হাতিয়ার করে ভাল কাজে এগিয়ে যাবার পথকে বেড়াল লেলিয়ে কেটে দেবার স্বভাব তাদের জন্মগত! যতই তাদের বোঝানো হোক তারা স্বভাব পাল্টাবে না। তারা কারা তা আমরা জানি কাকা। চোখ খুলে রাখলে তোমরাও দেখতে পাবে তাদের চাঁদপানা মুখগুলো। সেইজন্যেই বলছিলাম আরকি।”
    সনাতনের কথায় আরও জেদ চেপে যায় নন্দকাকার ! চোখমুখ খিঁচিয়ে রেগেমেগে বলে, “কোন্ বেটার সাহস আছে, আসুক আমাদের সামনে। ওই পেছনে থেকে মানুষকে উসকে দিলে চলবে না। মুখোমুখি হতে হবে তাদের। তারপর দেখব, সাহসীদের বুকের পাটা কতটা।” তারপর কি একটু ভেবে নন্দকাকা সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল,“সনাতন, তুমি বা জানলে কিরে যে একদল বিরোধিতা করবে আমাদের কাজে? নিশ্চিত না হয়ে আবার কারোর নামে বদনাম করাটাও তো ঠিক হবে না। কি বলো ষ?”
    -হ্যাঁ কাকা, সেটা তো ঠিক। তবে সঠিক খবরটাই আমাদের কাছে আছে। ওরা গুলতানি পাকাচ্ছে, আমাদের অনুষ্ঠানটাকে গুলিয়ে দেবার জন্যে। দেখবে, ইদানিং ওরা চার-পাঁচজন সমসময় একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে। পাড়ার আর কারোর সাথে ওরা মেশে না। সনাতন বলল।
    ঠিক সেইসময় ওই দলটা আটচালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। নন্দকাকা দেখতে পায় ওই দলটাকে। বলে,“ওরা না?” সঙ্গে সঙ্গে গলা হাঁকিয়ে বলে, “এই শোন শোন, তোরা এদিকে আয় একবার, পালাবি না কিন্তু। আয় এদিকে।”

    ক্রমশ…. 

  • গল্প

    গল্প- রং- বেরং

    রং- বেরং
    -মুনমুন রাহা

     

    আকাশ জুড়ে রংয়ের মেলা। কোথাও ধূসর কোথাও বেগুনি আবার কোথাও এখনো লালচে আভা। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বিদায় নিচ্ছেন সূর্য দেব । এই ক্লান্ত জৌলুসহীন সূর্যকে আর দরকার নেই পৃথিবীর। যতক্ষন পর্যন্ত তার তেজ ছিল , পরিশ্রমের ক্ষমতা ছিল ততক্ষন সে ছিল ভারী অমূল্য , ভারী প্রয়োজনের। আজ সে নিজের শক্তির সাথে নিজের প্রয়োজনীয়তাও হারিয়েছে। ঠিক সুচিত্রা দেবীর মতো ।

    নিজের ঘরের বড় জানলাটার সামনে রাখা চেয়ারে বসে অস্তাচল সূর্যের দিকে তাকিয়ে এ কথাই ভাবছিলেন সুচিত্রা দেবী। আজকাল তার জীবনটাকে বোঝা মনে হয়। যত বার্ধক্য ঘিরে ধরছে ততই যেন পুরোন দিনের কথা গুলো বেশি বেশি মনে পড়ছে। আগে যে সংসারের ঊন কোটি চৌষট্টীটা কাজ তাকে ছাড়া হতো না সে সংসারের এখন সব কিছুই তাকে ছাড়াই হয় । নাঃ , অমর্যাদা নেই তার এই সংসারে । ছেলে , বৌ , নাতি বা সদ্য আসা নাত বৌ সবাই সম্মান করে । কিন্ত সব কিছুতেই যেন তিনি ব্রাত্য। কোন কিছু রান্না করতে গেলে বৌমা রে রে করে ওঠে , ঝাঁজ লেগে এখনই কাশি উঠবে বলে , বড়ি দেওয়া , সেলাই করাও বন্ধ হয়ে গেছে । চোখের অপারেশন আর কোমরের অপারেশনের পর ছেলের স্ট্রিকলি নির্দেশ তিনি যেন এসব কাজ না করেন। তবে সত্যি কথা আরও একটা আছে , কেবল সবাই বকাবকি করেন বলে যে তিনি এসব কাজ থেকে বিরতি নিয়েছেন তা নয় , তিনি নিজেও বুঝতে পারেন তিনি আর আগের মতো পারেন না , কষ্ট হয় বড়। তাই মেনেই নিয়েছেন সব কিছু।

    এই যে কদিন আগে নাতির বিয়ে হল , তাতে কোন কাজে লাগলেন তিনি ? কেবল নাত বৌ বাড়ি আসার পর আশীর্বাদ করা ছাড়া! অথচ বিয়ে বাড়িতে কত কাজ , তার কাছে এসব কাজ এককালে নস্যি ছিল। আজ ইচ্ছা থাকলেও ক্ষমতার অভাব! আজকাল আর কিছুই ভাল লাগে না । খেতেও ইচ্ছা করে না , নানা রোগে ঘুম তো কবেই ছেড়ে গেছে। রাতে খুব জোর ঘন্টা দুই তিন ঘুমান । আজকাল মনে হয় এই বিশ্ব সংসারে তিনিই কর্মহীন। অন্তহীন সময় তাকে গ্রাস করতে আসে। তিনি যেন একটা ভার হয়ে বসে আছেন এই পৃথিবী বক্ষে। তার একমাত্র কাজ মুক্তির অপেক্ষা। এসব ভাবতে ভাবতে দুচোখ দিয়ে কখন যেন বারিধারা নেমে এসেছে । তিনি ক্লান্ত মনটাকে একটু আরাম দিতেই চোখ বুঝলেন।

    সুচিত্রা দেবীর নাত বৌ পরমা এসে থেকেই দেখছে তার দিদি শাশুড়ি তেমন ভাবে কথা বলেন না , খান না । গল্প করা , হাসি আনন্দ এসবের যেন তার জীবনে কোন অস্তিত্বই নেই। আজ সুযোগ বুঝে তার বর মানে সুচিত্রা দেবীর নাতি রক্তিমকে জিজ্ঞেস করল,

    ” আচ্ছা আমি এসে থেকেই দেখছি তোমার ঠাম্মা ভারী রিজার্ভ। তাই না! আমি যে এত হাহা হিহি করে বেরাই সারাদিন তোমাদের বাড়িতে উনি কি তাতে রাগ করেন গো! মানে তেমন ভাবে তো কথাই বলেন না , তাই ঠিক বুঝতেও পারি না। “

    রক্তিম নতুন বৌকে একটু কাছে টেনে বলল,

    ” তুমি আমার ঠাম্মাকে চেনোই নি। ভারী ভাল মানুষ। ছোটবেলায় কত মজার মজার গল্প বলতো জানো ! মা তো চাকরিতে যেত , আমাকে খাইয়ে দেওয়া , ঘুম পাড়ানো সব ঠাম্মা করত । এতকিছু করেও সুন্দর সুন্দর সেলাই করত, বড়ি আচার আরও কত কিছু বানাত। আর সব থেকে ভাল ছিল ঠাম্মার রান্না। রান্নার লোক থাকলেও আমি ছোটবেলায় ঠাম্মার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই চাইতাম না! জানো ঠাম্মা একটা গলদা চিংড়ির মালাইকারি করত দা_রুণ । তারপর আস্তে আস্তে সব বদলে গেল। ঠাম্মার শরীর ভেঙে পড়ল। মা ঠাম্মার খেয়াল রাখতে চাকরি থেকে বিরতি নিল সংসারের হাল ধরল। আমিও পড়াশোনা , চাকরিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। ঠাম্মাও আস্তে আস্তে কেমন যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে লাগল। এখন তো আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। ভাল করে খাওয়া ঘুম কিছুই করে না । ডাক্তার তো বলছে ডিপ্রেসানের দিকে চলে যাচ্ছে । দেখা যাক কি হয়!
    তবে এত কিছুর পরেও, আজও সেই গলদা চিংড়ির মালাইকারির জন্য মন কেমন করে । “

    সুচিত্রা দেবী সবে স্নান সেরে উঠেছেন। পরমা গুটিগুটি পায়ে এল তার ঘরে ,

    ” আসব ?”
    ” কে ? “
    এক ঝলক পরমা দেখে খানিক বিরক্ত হয়েই বললেন,

    ” কি ব্যাপার! তোমার আবার কি চাই? হঠাৎ আমার কাছে ?”

    ” কেন আসতে পারি না ?”

    ” আমার এত কথা ভাল লাগছে না ! কোন দরকার থাকলে বল ?”

    ” তোমার নাতি কাল তোমার গল্প করছিল! তোমার রান্নার গল্পও করল । শোনালো তোমার হাতের গলদা চিংড়ির মালাইকারির স্বাদের গল্প। ঠাম্মা , আমি এসব রান্না তেমন জানিনা । কিন্ত শিখতে চাই। শেখাবে আমাকে ?”

    সুচিত্রা দেবী কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন পরমার দিকে। তারপর বলেন,

    ” রতির এখনও মনে আছে আমার রান্নার কথা !”

    ” হ্যাঁ গো। শুধু মনে নয়, প্রাণে জিভে সবেতেই আছে । শেখাবে গো আমাকে ?”

    ” বলছ রান্না জানো না ? কিন্ত তোমার শাশুড়ি মা যে বলেছিলেন, তুমি নাকি খুব ভাল রান্না কর ! “

    ” করি তো । তবে ইন্ডিয়ান পারি না। আমি খুব ভাল চাইনিজ আর থাই করি ।”

    সচিত্রা দেবী একটু থেমে বললেন,

    ” সেসব না হয় বুঝলাম, কিন্ত আমার তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে তোমাকে রান্না করে শেখাব ! শরীর জানান দিচ্ছে এসব আর আমার জন্য নয়!”

    ” রান্না করতে হবে কেন ! তুমি বলবে আমি লিখে নেব , তারপর যখন রান্না করব তখন তুমি একটু করে চেখে দেখবে আর কি ভুল হয়েছে বলবে ,তাহলেই হবে।”

    আজকাল সুচিত্রা দেবীর ভারী জ্বালা হয়েছে পরমাকে নিয়ে। সেই যে সেদিন মালাইকারি খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করল, সেই থেকেই মেয়েটা মাঝেমাঝেই চলে আসে সুচিত্রা দেবীর কাছে রান্নার রেসেপি জেনে নিতে । সত্যি বলতে কি সুচিত্রা দেবীরও বেশ ভালোই লেগেছিল যখন নাতি রক্তিম মালাইকারি খেয়ে সোজা হাজির হয়েছিল সুচিত্রা দেবীর ঘরে । সেই ছোট্ট বেলার মতো গলা জড়িয়ে বলেছিল,

    ” ঠাম্মা অনেকদিন পর আবার তোমার হাতের মতো রান্না খেলাম । তোমার তালিমে পরমা বেশ ভালোই রেঁধেছিল বল ! জানো কতবার ভেবেছি একবার বলি একদিন মালাইকারি করতে , কিন্ত ভয় হতো যদি আবদার সামলাতে গিয়ে তোমার শরীর খারাপ হয়!”

    সুচিত্রা দেবীর ছেলে আনন্দ আর বৌমা শীলাও বেশ খুশি , রক্তিমের তো কথাই নেই । এখন ছুটির দিন হলেই সুচিত্রা দেবীর তালিম নিয়ে পরমা মাঝেমাঝেই সাবেকি রান্না করে । অবশ্য মাঝেমাঝে থাই বা চাইনিজও হয়। শীলা রোজকার রান্নাতে থাকে । দিন গুলো এগোতে থাকে । সুচিত্রা দেবী এখন আর দুঃখ বিলাসের খুব একটা সময় পাননা। পরমার জন্য রান্নার রেসিপি ভেবে রাখতে হয় যে !

    শীত হাল্কা হাল্কা পরতে শুরু করেছে সবে । নিজের ঘরে দুপুর বেলা পানের ডিবেটা সবে বার করেছেন সুচিত্রা দেবী এমন সময় বাড়িতে হৈ হৈ শব্দ শুনে একটু থমকালেন। গলাটা যে পরমা আর রক্তিমের তাতে সন্দেহ নেই। কিন্ত কি এত চেঁচামেচি করছে কে জানে ! আজ ছুটির দিন হলেও দুজনের টিকির দেখা নেই সকাল থেকে। অবশ্য নতুন বিয়ে এটাই তো সময় একে অপরের হাতে হাত রেখে ঘোরার! এসব ভাবনার মাঝেই পরমা , রক্তিম, শীলা, আনন্দ সবাই হৈ হৈ করে ঢুকে পড়েছে সুচিত্রা দেবীর ঘরে । আনন্দ এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,

    ” দেখ তোমার নাত বৌ কি করেছে! “

    পরমা এগিয়ে এসে সুচিত্রা দেবীর হাতে তুলে দেয় একটা বই । কিছু না বুঝতে পেরে সুচিত্রা দেবী চোখে চশমা এঁটে দেখেন বইয়ের মলাটে বড় অক্ষরে লেখা ” সাবেকি রান্নার সম্ভার ” লেখিকা , সুচিত্রা স্যানাল। খান চারেক বার নিজের নামটা পড়লেন সুচিত্রা দেবী , তারপর ভেজা দুচোখে পরমাকে বললেন,

    ” এসব সত্যি! আমার রান্নার রেসিপির বই ! এসব করলি কখন! “

    ” কেন মনে নেই তোমার থেকে রেসেপি জেনে একটা খাতায় লিখতাম! কেমন লাগছে বল ! রাইটার সুচিত্রা স্যানাল!”

    রক্তিম বলে ,

    ” উঁ হুঁ , ওসব চোখের জলটলে কিচ্ছু হবে না । ট্রিট চাই ব্যাস! আজই অর্ডার করব মন যা চায়, পেমেন্ট কিন্ত তুমি করবে ঠাম্মা। “

    সুচিত্রা দেবী তখনও তাকিয়ে আছেন পরমার দিকে , বললেন,

    ” জানিস আমার মনে হত আমার বুঝি সব কাজ শেষ হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে । কিন্ত তোর জন্য আবার একটা কাজ খুঁজে পেয়েছিলাম! যাক শেষ জীবনে নিজের নামটা তো বইয়ের পাতায় দেখতে পেলাম তোর জন্য। আমার আর কিছু দরকার নেই রে ! “

    পরমা এবার সুচিত্রা দেবীর কাছে গিয়ে বলে ,

    ” ঠাম্মা এতবড় পৃথিবীর মাঝে আমাদের এইটুকু জীবনে সব কাজ ফুরানো এত সহজ নয়। কেবল কাজের দিক পরিবর্তনের দরকার হয় সময় মতো । বই লেখার কাজ শেষ তো কি ! আমি প্ল্যান করেছি আমরা , মানে আমি আর তুমি একটা রান্নার স্কুল খুলব। আমি থাই আর চাইনিজ শেখাব আর তুমি সাবেকি রান্না । অবশ্য আমি তোমার হেল্পারও হব। বয়স হলেই সব কিছু ফুরিয়ে যায় না ! পুরোন কে পিছনে ফেলে নতুনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন! আর তাছাড়াও ঠাম্মা ইউ আর আ স্টার। ঠিক সূর্যের মতো।”

    সুচিত্রা দেবী এতক্ষন অবাক হয়ে পরমার কথা শুনছিলেন এবার বললেন,

    ” আমিও নিজেকে সূর্যের সাথে তুলনা করি জানিস ! অস্তচলে যাওয়া সূর্যের মতো যার সব কাজ শেষ , যার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে , যার তেজ শেষ হয়ে গেছে , তেমন সূর্য আমি ! “

    পরমা হেসে বলে ,

    ” তোমার তো কনসেপ্টটাই ভুল। যার নিজস্ব আলো আছে তার তেজ কি ফুরায়? না তার প্রয়োজন কখনও কমে। আসলে সূর্য তো অস্ত যায় না , পৃথিবীর একদিকে আলো দেওয়া হয়ে গেলে সে চলে অন্যদিক আলোকিত করতে । দিক পরিবর্তন। তুমিও তেমন। সংসারের জন্য তুমি অনেক কাজ করেছ এককালে গায়ে গতরে। এখন অন্য ভাবে পরিশ্রম কর । যা তোমার শরীরে সহ্য হয়। অন্যভাবে আলোকিত কর আমাদের। আমাদের জীবনের রং আমরাই ঠিক করি । আমরা চইলে তা রঙিন আর না চাইলে তা বেরঙিন । শরীর বয়স তো আটকানো যাবে না তাই সে বাড়ুক নিজের মতো কেবল লক্ষ্য রাখবে মনের বয়স যেন না বাড়ে। ব্যাস , তাহলেই তুমি ইয়ং। বুঝলে ডারলিং!”

    সুচিত্রা দেবী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

    ” মেয়ের সাহস তো কম নয় দিদি শাশুড়ির সাথে মশকরা হচ্ছে!”

    রক্তিম আবার ফুট কাটে ,

    ” আমার প্রস্তাবের কি হল ?”

    সুচিত্রা দেবী এবার আদেশের সুরে বলেন,

    ” তোমার প্রস্তাব ক্যানসেল করা হল । পরমা , খাতা নিয়ে আয় আজ রাতের মেনুর রেসিপিটা লিখে নে , বাসমতি পোলাও আর নবাবী মটন। “

  • গল্প

    গল্প- কুটুম্ব

    কুটুম্ব
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

    তনিমা দেবী খুব যত্ন করে তার বেয়াই আর বেয়ানে -এর জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন। তনিমা দেবীর মেয়ে তৃপ্তির বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হয়ে গেল। কিন্তু এই প্রথম তৃপ্তির শ্বশুর, শাশুড়ি আসছে তৃপ্তির বাপের বাড়িতে।
    আসলে তৃপ্তির বিয়ের দেখাশোনা, পাকা কথা সবই হয়েছিল ওর পিসতুতো বোন রাজন্যার বাড়ি কলকাতা থেকেই। তৃপ্তির শ্বশুর শাশুড়ির মনে হয়েছিল গোপাল মাঠ বড্ড দূরে। যদিও রাজন্যা বারবার বলেছিল, আন্টি কলকাতা থেকে দূর্গাপুর মাত্র তিন ঘন্টার রাস্তা। সিটি সেন্টার থেকে আধ ঘন্টাও লাগবে না গোপাল মাঠ পৌঁছাতে।
    আপনি আর আঙ্কেল নিজে গিয়ে একবার দেখে আসুন তৃপ্তি কেমন ঘরের মেয়ে।
    রাজন্যার কথা শুনে তৃপ্তির শাশুড়ি লীনা দেবী বলেছিলেন, তোমার মুখে তো শুনেছি তোমার মামার তেমন অবস্থা নয়। আর সত্যি কথা বলতে কি তৃপ্তিকে আমাদের সবার ভীষণ পছন্দ। এটাই বড় কথা। তৃপ্তির বাবার কি আছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তাছাড়া অমিতের বাবাকে তো জানোই তুমি। উনি হচ্ছেন একজন জন দরদি কাউন্সিলর। গরিব মানুষের প্রতি ওনার একটা আলাদা অনুভুতি কাজ করে সবসময়।
    রাজন্যার মুখ থেকে লীনা দেবীর এই কথাগুলো শুনে তৃপ্তি ও তার মা বাবা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল যে তৃপ্তির শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যন্ত ভদ্র ও নিরহংকারী।
    তৃপ্তির বিয়েতে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা গায়ে হলুদের তত্ব দেখে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের একেবারে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। তৃপ্তির পিসি মানে রাজন্যার মা বলেছিল, ভাগ্যিস তৃপ্তি আমাদের রাজুর বাড়িতে থেকে রবীন্দ্র ভারতীতে ক্লাস করতে যেত। তাই তো এমন বড়লোক, শিক্ষিত, রুচিশীল শ্বশুরবাড়ি পেল।
    তৃপ্তির বর অমিত পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বেশ নম্র ভদ্র ও দায়িত্ববান ছেলে। তৃপ্তির সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এর দিকে সজাগ দৃষ্টি। এই পাঁচ বছরে নিজে হয়তো খুব বেশি শ্বশুর বাড়িতে রাত কাটায়নি। কিন্তু তৃপ্তি যখনই গোপাল মাঠ আসতে চেয়েছে তখনই গাড়ী করে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
    বিয়ের পর কনসিভ করতে তৃপ্তির বেশ সমস্যা হচ্ছিল। অনেক গাইনোকলজিস্ট দেখানোর পর সে বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় অন্তঃস্বত্তা হয়। তৃপ্তির বাবা মা-এর একান্ত অনুরোধে অমিত ও তার মা বাবা তৃপ্তিকে রাখতে এসেছে গোপাল মাঠে।
    শক্তিগড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা ভদ্রস্থ মাপের রেস্টুরেন্টে সকালের টিফিনটা সেরে নিয়েছে ওরা। তৃপ্তি যদিও একবার ওর শাশুড়িকে বলেছিল, মা এখন তো সবে আটটা। আর দু’ ঘন্টা র মধ্যে তো বাড়ি পৌঁছে যাব। বাড়িতে গিয়ে না হয় মায়ের হাতে লুচি তরকারি খাব।
    লীনা দেবী মিষ্টি হাসি দিয়ে মিষ্টি করে বলেছিল, জানো তো তোমার বাপি নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। গোপাল মাঠে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গেলে বেশি দেরি হয়ে যাবে। তাই এখানেই খেয়ে নেওয়া ভালো।
    প্রাতঃরাশ খেয়ে হালকা মিউজিক চালিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল অমিত। দশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করার পরই চোখে পড়ল একটা ডাবওয়ালা। অমিতের বাবা চন্দ্রশেখর বাবু গাড়ী থেকে নেমে চারজনের জন্য চারটা ডাব কিনে আনলেন।
    ডাবটা হাতে নিয়েই তৃপ্তির চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর বাবার মুখটা। ডাবের জল খেতে বড্ড ভালোবাসে। তবুও দাম দিয়ে ডাব কিনে খেতে চায় না। গরমে ক্লান্ত হয়ে সবজি বাজার থেকে ফিরে এসে নুন চিনির শরবত খাবে রোজ দিন। তবু টাকা খরচ করে ডাব কিনবে না।
    তৃপ্তি এক চুমুক ডাবের জল খেয়ে অমিতের উদ্দেশ্যে বলে, অ্যাই আরো দু’টো ডাব কিনে নাও না বাড়ির জন্য। এখানে তা’ও চল্লিশ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের গোপাল মাঠে আরো দাম।
    লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে, তাই বুঝি। তোমার বাপের বাড়ির ওদিকে ডাবের খুব দাম। এই অমিত দুটো বড় দেখে ডাব কিনে নে তোর শ্বশুর শাশুড়ির জন্য।
    জাতীয় সড়ক-এর বুকে ছুটে চলেছে অমিতের দামী চার চাকা। স্বামীর পাশে বসে হালকা মিউজিক শুনতে শুনতে তৃপ্তি ভাবে, সত্যি সে ভীষন লাকি। অমিতের মতো দায়িত্ববান স্বামী, মামনি আর বাপির মতো উদারমনষ্ক শ্বশুর, শাশুড়ি পেয়ে। কত সহজে ওনারা আমার অত্যন্ত ছাপোষা মা- বাবাকে আপন করে নিয়েছেন। আমার বাবা যে একটা সামান্য গুমটি দোকান আছে। তার জন্য কিন্তু ওনাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। পাঁচ বছরে কখনো শুনিনি কোনো অসম্মান জনক বাক্য। বরং প্রতি বছর পুজোতে মামনি নিজে গিয়ে আমার মা বাবার জন্য দামি জামা কাপড় কিনে উপহার হিসেবে পাঠায়। প্যাকেটের উপর সুন্দর করে লিখে দেন, ‘আমার দাদা দিদির জন্য ছোট্ট উপহার এই বোনের বাড়ির তরফ থেকে।’
    এইসব আন্তরিক কথাবার্তা ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি তৃপ্তি যেন টের পায় নি।
    অমিতের গলার স্বর শুনে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো তৃপ্তি।
    কি গো এসে গিয়েছি তো? এবার তো নামো।
    লাজুক হাসি দিয়ে তৃপ্তি নামল খুব সাবধানে। লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, দেখো বৌমা সাবধানে। বাপের বাড়ি এসে বেশি ছোটাছুটি করতে যেও না যেন।
    তনিমা দেবী তাড়াতাড়ি দুটো চেয়ার এনে উঠানে পেতে দিল। চেয়ারের উপর বিছিয়ে দিয়েছে পুরানো শাড়ির পাড় থেকে তোলা সুতো দিয়ে নিজের হাতে বোনা আসন।একটা নড়বড়ে টুলের ওপর এনে রাখল শরবতের গেলাসগুলো।
    লীনা দেবী হাত নেড়ে বলল, দিদি ব্যস্ত হবেন না। তিন চার ঘন্টা তো বসেই এলাম। এখন বরং একটু দাঁড়িয়ে থাকি। পা টা ছাড়ুক একটু।
    তৃপ্তির বাবা তার সারল্য মাখা হাসি দিয়ে বলল, সেই ভালো দিদি। চলুন আমরা বরং একটু হেঁটে স্কুল বাড়ির দিকটা দিয়ে। জানেন তো ওখানে গাছ গাছালি প্রচুর। গরমের দিনে ওই জায়গাটা ছেড়ে ঘরে আসতেই মন চায় না।
    চন্দ্রশেখর বাবু বললেন, সেই ভালো। এই তো প্রথমবার এলাম। তল্লাটটা বরং ঘুরে দেখি।
    তৃপ্তির বাবা বেয়ান, বেয়াই, জামাই সবাইকে নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করাতে গেলেন। নড়বড়ে টুলটার ওপর পরে রইলো শরবত-এর গেলাসগুলো।অতিথিদের কাছে শরবত-এর গেলাসগুলো কোনো সমাদরই পেল না।
    তৃপ্তি বরং ওর মায়ের হাতে ডাব দুটো দিয়ে বলল, মা তোমার আর বাবার জন্য নিয়ে এসেছে তোমার জামাই। খুব টেস্টি জলটা। আমরা সবাই তো খেলাম।
    ওওওও তাই বোধহয় আর কেউ শরবত এর গেলাসগুলো ছুঁয়ে দেখল না। এতক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।
    যাক গে। ও তৃপ্তি তুই আমার সঙ্গে একবার রান্নাঘরে আয় মা। দেখ তো সব জোগাড় ঠিকঠাক আছে কিনা।
    রান্না ঘরে ঢুকে তৃপ্তি তো অবাক হয়ে যায়। দেরাদুন রাইসের গন্ধে ভরে উঠেছে টালির ছোট্ট রান্নাঘরটা। একে একে তনিমা ঢাকা খুলে দেখাতে লাগল কি কি সে বানিয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য।
    তৃপ্তি বলে, ও মা এত কেন রান্না করতে গিয়েছ। মাটনটাই তো ঠিক ছিল। আবার গলদা চিংড়ি করার কি খুব দরকার ছিল।
    হ্যাঁ গো মা বাবার তো পকেটের খুব চাপ হয়ে গেছে। যে মানুষটা নিজেদের জন্য সচারাচর গলদা চিংড়ি কেনে না শুধু মাত্র দামের জন্য।সেই মানুষ একসঙ্গে খাসী আর গলদা কিনে এনেছে।
    দেখ তৃপ্তি যতই হোক তোর শ্বশুরবাড়ির লোকরা বড়লোক। বড়লোকদের পাতে কি কুচো চিংড়ি দেওয়া যায়? না ওনাদের পাতে রেশনের চালের মোটা ভাত দেওয়া যায়?যারা যেমন মানুষ তাদের কে তো তেমন আপ্যায়ন করতে হবে তাই না।
    তৃপ্তি ওর মোবাইলটা অন করে দেখলো বেলা একটা বাজতে চলেছে। তনিমার উদ্দেশ্যে বলে, মা বাপির দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ওরা এখনই এসে পড়বে। চল আমরা পাকা ঘরের বারান্দায় জল, জায়গা করে ফেলি।
    মিনিট দশেকের মধ্যেই তৃপ্তির বাবা অমিতের মা বাবাকে না ফিরে এল। এসেই বললেন- তনিমা বেয়াই বেয়ানরা একটু দূর্গাপুর ব্যারেজ দেখতে যাবে বলছেন। তাই বলছি এখন আর খাবার বেড়ে কাজ নেই।
    লীনা দেবী মিষ্টি হেসে বললেন, যেতে আসতে যেটুকু সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না। আমরা দূর্গাপুর থেকে ফিরে এসে কব্জি ডুবিয়ে খাব দিদির হাতের টেস্টি সব রান্না।আর হ্যাঁ, তৃপ্তির সঙ্গে আপনারও খেয়ে নিন কিন্তু। না হলে কিন্তু সবার খেতেই দেরি হয়ে যাবে। তখন আবার হজমের সমস্যা হবে।
    তৃপ্তি বলে, মামনি বাপি তো একটার মধ্যে খাবার খান বাড়িতে। দেরি হলে বাপির তো কষ্ট হবে।
    তৃপ্তির কথাটা জাস্ট হাওয়াতে উড়িয়ে দিয়ে লীনা দেবী বললেন, একদিন অনিয়ম করলে তোমার বাপির কিছু হবে না। তাছাড়া তো ঘন্টা খানেক-এর তো মামলা।
    অমিতরা চলে যাওয়ার পর তৃপ্তির মা বলল, তৃপ্তি চল আমরা সবাই এক মুঠো করে খেয়ে নিই। তোর তো এইসময় অনিয়ম করা উচিত হবে না।
    তৃপ্তির বাবা বলল, বুঝলে তৃপ্তির মা আগে জামাই বাবাজীবন, বেয়াই আর বেয়ানের পাতে মাংস, চিংড়ি পড়ুক। ওনারা খাওয়ার পর যদি কিছু বেঁচে থাকে তখন না হয় রাতে আমরা খাব। এই বেলা ডাল, আলু চচ্চড়ি দিয়ে খেয়ে নিই আমরা।
    খাওয়া দাওয়ার সেরে বিছানায় শুয়ে বারবার তৃপ্তি জানালার দিকে উঁকি মারতে লাগল।বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। ঘড়িতে যখন সাড়ে তিনটে তখন অমিতদের গাড়িটা এসে থামলো তৃপ্তিদের বাড়ির সামনের রাস্তায়।
    তনিমা, তৃপ্তির বাবা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। লীনা দেবী মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, সরি সরি খুব দেরি হয়ে গেল আমাদের ফিরতে।
    তনিমা বলে ,হ্যাঁ দিদি বড্ড অবেলা হয়ে গেল যে। চলুন একটু করে খেয়ে নেবেন কিছু।
    লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না দিদি আপনাদেরকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা সিটি সেন্টার থেকে লাঞ্চ করেই ফিরছি। আধ ঘন্টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। বুঝতেই তো পারছেন বেশি দেরি করা যাবে না। অমিত নিজেই তো ড্রাইভ করবে।
    লীনা দেবী কিছুক্ষণ তৃপ্তিকে এটা ওটা প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত জ্ঞান দিয়ে তারপর রওনা দিলেন। অমিত যাওয়ার সময় তৃপ্তিকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গেল। তৃপ্তির হাতের ওপর আলতো নিজের হাতটা ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে জানান দিল ওর আবেগকে।
    অমিতরা চলে যাওয়ার পর তৃপ্তির মা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হ্যাঁ রে তৃপ্তি তোর শ্বশুর, শাশুড়ি আমাদের ঘরের এক গ্লাস জল পযর্ন্ত মুখে তুলল না।
    তৃপ্তি একটা তিতো হাসি দিয়ে বলল, ছাড় না মা। ওনারা তো মাটন, চিংড়ি রোজ খাচ্ছে। বরং আজ আমরা তিনজনে জমিয়ে রাতে খাওয়া দাওয়া করব।
    তনিমা দেবী হালকা ধমকের সুরে বলল, একি অসভ্যের মতো কথা তৃপ্তি। ওনাদের জন্য খাবারের আয়োজন করলাম। আর ওনারাই কিছু না খেয়ে চলে গেলেন।
    তৃপ্তি বলে, মা গরিব ঘরের মেয়েকে বড়লোকরা নিজেদের পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পুত্রবধূর মা বাবাকে নিজেদের সম গোত্রীয় ভাবতে পারে না কিছুতেই। দোষ কি কখনও বড়লোকদের হয় না। দোষ তো আমাদের মতো গরীবদের।যারা বড়লোকদের সঙ্গে কুটুম্বিতা করতে ছুটি। এই জন্যই তো বলে আত্মীয়তা করতে সমানে সমানে।
    তনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তৃপ্তি কতবড় কঠিন কথাটা তুই কি অবলীলায় বললি রে মা। গরিবরা চিরকালই বড়লোকদের দয়ার পাত্র হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না।

  • গল্প

    গল্প- মাধু

    মাধু
    -সুজিত চ্যাটার্জি

     

     

    মাধু বিয়ের দশদিনের মাথায় বিধবা হল। বর রতন মাঠে চাষ করতে গিয়ে সাপের ছোবল খেল।
    ধন্বন্তরি ওঝার যাবতীয় ঝাড়ফুঁক কেরামতিকে নিষ্ফল প্রতিপন্ন করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সব্বাইকে আকুল পাথারে ভাসিয়ে রতন চলে গেল।
    কপাল লিখনে অবিশ্বাসী গুটিকয় অনামুখো যারা বলেছিল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ছেলেটা প্রাণে বেঁচে যেত, রতনের সর্বজ্ঞানী মুখরা মা শীতলা, তাদের সাতগুষ্টির মৌখিক শ্রাদ্ধ করে পিন্ডি চটকে নিদান দিয়েছিল, তাদের ছেলেমেয়েদের সাপে কাটলে যেন তারা তেমনই করে।
    কেননা কপালের লেখন খন্ডায় কারো বাপের সাধ্যি নেই।

    মাধু বিধবা হবার দশদিনের মাথায় তারই মেজ দেওরের সঙ্গে মাঝরাতে একই ঘরে একসঙ্গে পাকড়ে গেল।
    পাকড়াও করার অসাধ্য সাধন করল কে?
    সেই সর্বজ্ঞানী মুখরা মা শীতলা।
    মাধু চোখের জলে নাকানিচুবানি খেয়ে প্রাণান্তকর ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল, সে কোনও ভাবেই দায়ী না ।
    একলা ঘরে সুযোগ বুঝে মেজ দেওর এই কান্ড ঘটিয়েছে, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ।
    ভোবি ভোলবার নয়।
    শীতলার অকাট্য প্রমাণ, তার নির্ভুল অনুমান দক্ষতা এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
    সে নিশ্চিত জানতো, এ মেয়ে অপয়া, এক ছেলেকে খেয়েছে এবার নির্বংশ করে তবেই ছাড়বে এই রাক্ষসী ডাইনির বংশধর।
    সুতরাং এই কালনাগিনীকে কোনোমতেই আর এ ভিটেতে রাখা চলেনা।
    বিধবা মাধু শ্বশুর ঘর ছাড়া হল।

    উঠতি ধনী দাসু বাবুর দয়ার শরীর, তার ওপর তিনি সদ্য বিপত্নীক।
    মাধু দেখতে শুনতে বেশ। বয়স কম, এমন ডাগরডোগর বিধবাকে তো আকুলে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং মোসাহেবদের মান এবং মুখ রাখতে মাধু এখন দাসু বাবুর আশ্রিতা।

    মাধু এখন অনেক পরিণত।
    প্রতি রাতেই তার ঘরে পুরুষ ঢোকে। দয়ালু দাসু বাবু, রসালো বাবু হয়ে রাত বিতোয় নধর নারী শরীরের সঙ্গে।
    তবে একেবারে খালি হাতে নয়।
    মাধুর দেওয়া শর্ত পূরণের অঙ্গীকারে।
    প্রতি রাতেই পুরনো তবুও নতুন খেলা।
    প্রতি রাতেই নতুন নতুন শর্তের অঙ্গীকার।
    আজ অলংকার, কাল টাকা, পরশু জমির দলিল আরও আরও আরও…
    দূর্বল মুহূর্তে পুরুষেরা বড়ই দাতা হয়ে ওঠে।
    মাধু বুঝেছে বোবা আর বোকা থাকার অনেক জ্বালা। তাছাড়া যৌবনের জৌলুশ বড়ই ক্ষণস্থায়ী।
    মেজ দেওরের ধাষ্টামো আর সর্বজ্ঞানী মুখরা মা শীতলার নির্মম আচরণ তাকে চতুর হতে শিখিয়েছে।

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুলে পাক ধরা মাধুর এখন নিজস্ব ঘর।
    মেয়ে ঐশ্বর্য আর কিছুদিনের পরেই ডাক্তার হয়ে যাবে।
    ভাগ্যিস সেদিন প্রবল চাপের মধ্যেও অবিচল থেকেছিল মাধু।
    না, সে গর্ভত্যাগ করেনি।
    সবই দয়ালু দাসু বাবুর দান।
    শুধু একটাই আফসোস,
    দয়ালু দাসু বাবু মান আর মুখ বাঁচাতে স্বেচ্ছায় কড়িকাঠে ঝুলে প্রাণত্যাগ করেছিল।

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৯)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [ আটত্রিশ ]
    দিদিমা তাকে এমন করে বাড়ি চলে যাবার কথা বলাতে বাবলা মনে বেশ কষ্ট পায়। কি ভেবে দিদিমা তাকে কথাগুলো বলল, ও বুঝে উঠতে পারছে না। বাবলা খুব ভাল করে জানে, মামা-মামী দিদিমাকে কোনদিন খেতে পরতে দেবে না। দাদু মারা যাবার পর বাড়ির সম্পত্তি তার নামে লিখে দিতে বলেছিল মামা। বাবলা জেনেছে, মামীর বুদ্ধিতেই মামা, দিদিমাকে বলেছিল। দিদিমা রাজি হয়নি। বলেছিল, “বাস্তুর কিছুটা অংশ আমি বাবলাকে দিতে চাই। সেই এতটুকু বয়স থেকে ওকে আমি মানুষ করেছি। এটাকেই ও নিজের বাড়ি বলে মানে। তুই যদি তাতে রাজি হোস তাহলে তোদের মামা-ভাগ্না দু’জনের নামে বাস্তুর সম্পত্তি ভাগাভাগি করে লিখে দিতে পারি।” রাজি হয়নি মামা। ভীষণ রেগে গিয়ে মামা তার মাকে বলেছিল, “মরার সময় কে তোর মুখে জল দেয় আমি দেখব। মেয়ের ঘরের নাতি। ওরা কোনদিন আপন হতে পারে না। সম্পত্তি নিয়ে সেটা বিক্রী করে কেটে পড়বে। এই ছেলের পায়ে এসে শেষ পর্যন্ত মাথা খুঁড়তে হবে। তখন তোর কি হাল করি আমি, দেখবি!”
    মামার এমন হুমকির সামনে দিদিমা কিন্তু একদম দমে যায়নি। বুড়ি শিরদাঁড়া শক্ত করে সেদিন বলেছিল, “তোকে ওই কাজটা করতে যাবার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। সেই কামনা ভগবানের কাছে আমি করছি।” বলে বুড়ি, দিদিমা, তার আদরের নাতিকে জড়িয়ে হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। আর তার কিছুদিন পরেই এই বাস্তুর অর্ধেক অংশ বাবলার নামে লিখে দেয়, দিদা। সেই দিদিমাকে সে কিনা ‘জলে’ ফেলে দিয়ে স্বার্থপরের মত চলে যাবে? তার আদরের দিদাকে নির্দয় মামার হিংসার আগুনে সঁপে দেবে ! এ কোনদিন সে জীবন থাকতে করতে পারবে না। মন-খারাপি হৃদয়ে সে পাশের ঘরে চলে গিয়ে গোমড়া মুখে বসে থাকে ! দিদিমার বুঝতে অসুবিধা হল না তার প্রিয় দাদাভাই রেগে গেছে তার উপর। আস্তে আস্তে নাতির কাছে গিয়ে তার মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “দাদা, আমার ভুল হয়ে গেছে রে। এখান থেকে চলে যাবার কথাটা তোকে বলা আমার একদম ভুল হয়েছে। বুড়ো মানুষ তো। কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ভাবলাম কচি ছেলে তুই। এত কষ্ট করবি। আমার মনটা যেন তখন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু তোর মন কি চায় সেটাও আমার ভাবা দরকার ছিল।” মাথায় হাতের আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “দাদা, গরুটা বিক্রি করে যা টাকা হয়েছিল সেটা দিয়ে এতদিন সংসার চালিয়ে এখন আমার কাছে হাজার দুই টাকা পড়ে আছে। ওটা তুই নিয়ে যা। দেখ, ওটা দিয়ে কি কারবার করা যায়।” দিদার কথায় অবাক হয়ে মুখ তুলে বাবলা বলল, “ওই ক’টা টাকা নিয়ে নিলে সংসার চলবে কেমন করে, দিদা?”
    -কেন, ব্যবসা করে লাভ করবি তো। সেই টাকায় আমাদের দু’জনের সংসার তালেগোলে ঠিক চলে যাবে, দাদাভাই।
    -কিন্তু যদি লাভ না করতে পারি? তখন তো শুকিয়ে থাকতে হবে। ও টাকা আমি নেব না, দিদা। বিনা পুঁজিতে কি কারবার করা যায় তুমি সেই বুদ্ধিটা দাও না দিদি? সুবোধ বলেছে, ট্রেন এমন একটা জায়গা, সেখানে যে জিনিস নিয়ে কারবার করবি, সেটা বিক্রী হবে। কত ধরনের, কত রুচির মানুষ এই ট্রেনে যাতায়াত করে, তা এই হকারি করতে না এলে আমি জানতে পারতাম না। তা দিদা, বিনা পুঁজিতে কি জিনিস নিয়ে আমি কাজ করতে পারি, কি জানি! কিছুতেই বুদ্ধিটা মাথায় আসছে না।”
    খানিক চুপ থেকে দিদা বলল, “একটা কাজ কর দাদা। কাশেম মিঞার বিল ভর্তি হয়ে লকলক করছে কাঁড়ি কাঁড়ি কলমি শাক। ওই শাক আমি কেটে নিয়ে এসে ধুয়ে ধায়ে সুন্দর করে গুছিয়ে আঁটি বেঁধে দেবো। আমাদের বেতের বড় খোড়ায় করে তুই ওই টাটকা শাক সকাল সকাল ফাঁকা ট্রেনে ফিরি করবি। সব গেরস্ত বাড়ি এই শাক ভাজা-তরকারি করে খায়। মনে হয় তোর এই টাটকা শাক দেখলে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। দেখনা একবার চেষ্টা করে। তোর কপালে শিকে ছিঁড়তেও পারে।”
    দিদিমার বুদ্ধি মন্ত্রের মত যে কাজ করে যাবে তা বাবলা কল্পনাও করতে পারেনি। সুবোধরা তো নয়ই। ওরা মনে মনে হেসেছিল বাবলার এই কান্ড দেখে। তবে বাবলা যাতে দমে না যায় তাই মুখ ফুটে কিছু বলেনি তাকে। যত দিন এগোয়, বাবলার কলমি শাক তত জনপ্রিয় হতে থাকে। বিনা পুঁজির কারবার। দিদিমা কাশেম মিঞার বিল থেকে শাক কেটে আনে আর নাতি ট্রেনে হকারি করে। ভালই আয় হতে থাকে। সংসার চালিয়ে বেশ কিছু টাকা জমতেও থাকে।
    সেদিন অন্য খরিদ্দারের সঙ্গে এক সাধুবাবাও হাত বাড়াল, বাবলার কলমি শাক কেনার জন্যে। সাধুবাবা দুটো শাকের আঁটি নিয়ে গেটের মুখে ডানদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবলা অন্য খরিদ্দার সামলে সাধুবাবার কাছে গেল শাকের দাম নিতে। সকালের ফাঁকা ফাঁকা রেলগাড়ী। সাধুবাবা দাম দিতে দিতে বাবলাকে বলল, “তুমি তো পল্লী-গাঁয়ের ছেলে। কয়েকটা গাছের মূল আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে? না, মাগনা নেব না তোমার কাছ থেকে। আমার কিছু আফলা বিল্ব মূল মানে যে বেলগাছের তখনও কোন ফল ধরেনি, সেই গাছের মূল আর অনন্ত মূল খুব দরকার। যে লোকটা আমাকে এগুলো দিয়ে যায়, কেন জানিনা, সে আর আসছে না। খুব অসুবিধায় পড়ে গেছি। গ্রামের ছেলে তুমি। চেষ্টা করলে জোগাড় করে দিতে পারবে। আর যদি তুমি বরাবর আমাকে এগুলো জোগাড় করে দিতে পারো তাহলে তোমাকেই পাকাপাকি অর্ডার দেব। শুধু এই দুটো নয়, আরও অনেক জিনিসের বরাত তোমাকে দিতে পারি। যদি তুমি ঠিক ঠিক কথা রেখে কাজ করতে পারো। সেটা পরের কথা। এখন দেখো এই দুটো মূল তুমি জোগাড় করতে পারো কি না। আবার তিন দিন পরে এই গাড়িতে এই কামরায় তুমি আমাকে দেখতে পাবে।”
    কথাটা শুনে বাবলার জানার কৌতূহল হল এগুলো ঠিক কি কাজে লাগে। যেটা নিয়ে সে কাজ করবে, তার গুনাগুন জানাটা জরুরী। ভবিষ্যতে তার কাজে লাগতে পারে। তাই সাধুবাবার সামনে হাত জড়ো করে বলল, “প্রভু, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, অপরাধ নেবেন না? আমার খুব জানার ইচ্ছে করছে, তাই।”
    -তুমি কিশোর। নিষ্পাপ। বলো তুমি কি জানতে চাও।
    -এগুলো মানুষের কি কাজে লাগে একটু আমাকে বলবেন? সাধুবাবা মুচকি হেসে বলল,“গরীব মানুষরা, যাদের বিভিন্ন দরকারে পাথর ধারণ করার জন্যে জ্যোতিষীরা সুপারিশ করে তাদের পক্ষে সবসময় দামি দামি পাথর কেনা সম্ভব হয় না। তাদের জন্যে পরিবর্ত হিসেবে এই বৃক্ষমূল দেওয়া হয়। অবশ্য পাথরের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় পরিবর্ত ধাতুও। সেটা যদিও পাথরের থেকে কম দাম কিন্তু বৃক্ষমূলের থেকে অনেকটাই বেশি। সবসময় ওই সম্পন্নহীন মানুষদের সেগুলোও কেনার ক্ষমতা থাকে না। এই মূলই তাদের ভরসা। যেমন ধরো এই যে তোমাকে আফলা বিল্ব মূলের কথা বললাম। ‘রবি’ গ্রহের জন্যে কাজ করে। ওর পরিবর্ত ধাতু হল, তামা। আর পাথর হোল চুনী এবং আরও কয়েকটা পাথর। তেমনি অনন্ত মূলের পরিবর্ত ধাতু হচ্ছে তামা। বিল্ব মূল এবং অনন্ত মূল- এই দুই মূলের বদলে তামা ব্যবহার করা যায়। অনন্ত মূলের রত্ন বা পাথর হল, প্রবাল। মঙ্গল গ্রহের জন্যে এই মূল-রত্ন লাগে।
    সাধুবাবার কথা শেষ হতে হতে পরবর্তী স্টেশন এসে যায়। এই কামরা থেকে তাকে অন্য কামরায় যেতে হবে। বাবলা হাত জড়ো করে সাধুবাবার থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনে নেমে পরের কামরায় চলে যায়।
    কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দিদিমাকে সাধুবাবার সব গল্প শোনায় বাবলা। বলে, “দিদা, এই মূলগুলো কোথায় পাওয়া যায় তুমি জানো? আমি যদি এগুলো জোগাড় করে দিতে পারি তাহলে আমাকে পয়সা দেবে বলেছে সাধুবাবা। আর কথা রাখলে বরাবরের জন্যে আমার কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে এগুলো কিনবে। আমার ব্যবসার আর একটা নতুন ডাল গজাবে তাহলে।”
    নাতির কথায় খুশি হয়ে দিদিমা বলল, “হ্যাঁ রে দাদা। তোর কত চাই বল না। সব আমি জোগাড় করে দেব। তোর কোন চিন্তা নেই। কবে লাগবে, ঠিক তার আগের দিন শুধু তুই আমাকে বলবি। আমি জোগাড় করে সাফ-সুতরো করে রেখে দেব।”
    বুদ্ধিটা দিদিমাই তার কানে ঢুকিয়েছিল। সাধুবাবা যেদিন যেদিন বলে সেদিন ওই দু’ধরণের মূল দেয় বাবলা। সঙ্গে সঙ্গে পয়সাও পেয়ে যায়। দিদিমা বলল, “দাদা, তুই এক কাজ কর, আমি যা মূল জোগাড় করে আনি সাধুবাবা তো সবটা নেয় না। বাকিটা ঘরে পড়ে থেকে থেকে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। যে জিনিসটা মানুষকে দিলে পয়সা পাওয়া যায়, সেটা যদি এ’ভাবে শুকিয়ে নষ্ট হয় তো বড্ড গায়ে লাগে। আর আমি কত কষ্ট করে এগুলো জোগাড় করি। যদি কাজে লাগে তো আনন্দ পাই। তা দাদা, তুই এই শাকের খোড়াতেই এই মূলগুলো নিয়ে যা। মানুষকে জানাবি, কলমি শাক ছাড়াও তার কাছে বিল্ব মূল, অনন্ত মূল পাওয়া যায়। আর এই মূলের গুনাগুন যা সাধুবাবার কাছ থেকে জেনেছিস, সেসবই মানুষকে বোঝাবি। দেখবি, কেউ না কেউ তা কিনে নেবে। সাধুবাবা যা দাম দেয় তার থেকে বেশি দামেই তুই বিক্রী করতে পারবি।” বাবলা, দিদিমার কথা শুনতেই হাতনাতে তার ফল পেয়ে যায়। প্রথম দিনেই যা মূল নিয়ে গেছিল সবটাই বিকিয়ে যায়। খুশিতে টগবগ করে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আমার কি ভাল দিদা! তোমার কথা শুনলে আমার কোন অভাব হবে না।” আদরের নাতির কথায় ভাবে গদগদ হয়ে দিদিমা বলে, “আরে দাদা, ছাড় আমাকে। এভাবে জাপটে থাকলে আমার যে দম বন্ধ হয়ে যাবে। বুড়ো মানুষ, তোর মত যৌবনের ওই দম আর আমার আছে নাকি!”
    একজন খরিদ্দার চার আঁটি কলমি শাক নিয়ে তারপর বাবলার খোড়াতে গাছের মূল দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে ক্ষিরিকা মূল আর বৃদ্ধদ্দারককের মূল আছে? নেই তো মনে হচ্ছে। দু’রকমের মূল আছে। কাল ওই দুটো মূল আমাকে এনে দিতে পারবে? খুব দরকার। পয়সার জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।” হকারি করতে করতে বাবলা এখন একটু চটপটে হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “এই দুটো মূল কেন চাইছেন? কেউ আপনাকে জোগাড় করতে বলেছে না কি?”
    -হ্যাঁ, আমার জন্যে জ্যোতিষী, মুক্তা, মুনস্টোন বা এগেট এই তিনটে পাথরের মধ্যে যেকোন একটা পরতে বলেছে। আমার হাতের রেখায় চন্দ্র দুর্বল। ওটা কাটাতে গেলে এগুলোর একটা পরতে হবে। তা স্টোন কেনার পয়সা নেই। তখন রূপা-ধাতু পরতে বলে। শুনেছি, পাথর ধাতুর বদলে গাছের শেকড় বা ডালেও কাজ হয়। সেকথা বলতে জ্যোতিষী আমার জন্যে এই ক্ষিরিকা মূল আর আমার বৌয়ের জন্যে বৃদ্ধদ্দারককের মূল মাদুলিতে করে পরতে বলেছে। বৌয়ের আবার বুধ গ্রহের দোষ পড়েছে।
    -ঠিক আছে। আপনি কাল নয় পরশু পেয়ে যাবেন। তবে আমার কাছে যা মূল আছে তার থেকে একটু বেশি পয়সা লাগবে। আপনি যে মূলগুলোর কথা বললেন ওগুলো হাতের কাছে পাওয়া যায় না। আমাকেও খরচা করে জোগাড় করতে হবে, তাই।
    বাবলার খোড়ার ঝাঁকায় এখন কলমি শাকের সাথে সাথে বিল্ব মূল, ক্ষিরিকা মূল, অনন্ত মূল আর বৃদ্ধদ্দারককের মূল থাকে।
    সাধুবাবার চোখে একদিন তা পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাবলাকে বলে, “তুমি তাহলে এখন এই শাকের সাথে সাথে গাছের মূল-টুলও বিক্রী করছো? বাঃ ভালোই হল। আমার দরকারে তোমার কাছ থেকে নিতে পারব।” তারপর খানিক চুপ থেকে আবার বলল,“খোকা, তুমি এক কাজ করতে পারো তো… সব গ্রহের মূল তো তুমি তোমার ঝাঁকায় রাখতে পারো। এগুলো যখন জোগাড় করতে পারছো, তাহলে অন্যগুলোও পারবে। যেমন বৃহস্পতির জন্যে বামনহাটির মূল বা ব্রহ্মজৈষ্ঠীর মূল। এর পরিবর্ত ধাতু হোল, সোনা আর রত্ন হোল পোখরাজ বা হলুদ টোপাজ। শুক্রর জন্যে রামবাসকের মূল। ধাতু, প্লাটিনাম, রত্ন, হীরা, জারকোন বা ওপাল। শনিদেবের জন্যে শ্বেতবেড়ালার মূল। ধাতু, লোহা। রত্ন, নীলা, এমিথিস্ট, নীল টোপাজ বা তানজানাইট। সব শেষে রাহুর জন্যে শ্বেত চন্দনের মূল। ধাতু, লোহা বা স্টীল। রত্ন, গোমেদ। আর কেতুর জন্যে অশ্বগন্ধার মূল। ধাতু, স্টীল আর রত্ন, ক্যাটস্ আই বা টাইগার আই। আসলে, আগেও বলেছি তোমাকে যে ধাতু বা রত্ন এত দামি যে স্বল্প সামর্থের আমজনতা তার খরচা কুলিয়ে উঠতে পারে না। তখন আমরা মানুষকে মূলের কথা বলে থাকি।”
    বাবলা সাধুবাবাকে বলল, “আপনার হাত দেখার চেম্বার কোথায় সাধুবাবা? এই মূলগুলো যোগাড় করে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে হবে তো। এত জিনিস জোগাড় করে আপনার সঙ্গে কবে দেখা হবে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকলে তো সব নষ্ট হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম। এ’কথা বললাম বলে আমাকে ভুল বুঝবেন না সাধুবাবা।”
    -আরে বাবা না না। তুমি তো ঠিক কথাই বলেছো। আমি বলার আগেই তুমি আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলে। আমি নিজেই বলতাম, আমার ওখানে এগুলো পৌঁছে দেবার জন্যে। না বাবা, আমার কোন চেম্বার নেই। বহরমপুরের মন্দির রোডের তারা-মা মন্দিরের আমি সেবাইত। ওখানেই আমি ভক্তদের কল্যাণে হাতের রেখা বিচার করে মূল-পাথর দিই। কোষ্ঠী বিচার করি। ওখানে ‘শাস্ত্রীবাবার তারা-মা মন্দির’ কোথায় খোঁজ করলে ভক্তরা আমার মন্দিরে তোমাকে পৌঁছে দেবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। পথে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে যাকে দেখতে পাবে তাকেই বলবে। সেই তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর যেদিন যাবে সেদিন ওখানেই প্রসাদ পেয়ে যাবে। খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না।” বেশ জাগ্রত ঢঙে সাধুবাবা বলল।
    সময় যত এগিয়েছে বাবলা তার ব্যবসা তত উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে নিয়ে চলেছে। তার বিপদের বন্ধু সুবোধের থেকেও এখন সে ভাল আয় করতে পারছে। কলমি শাকের চেয়ে এই শেকড়-জড়িবুটি বিক্রীতে তার আয় অনেকটা বেড়ে গেছে। কলমি শাকের কারবারে এখন তার যেন মন কম টানছে। কিন্তু এই শাকের কারবারই তো বন্ধু, সুবোধের মত পথপ্রদর্শক। তাই ছেড়ে দিতেও মন জবরদস্ত সায় দেয় না। ট্রেনের ডেইলী প্যাসেঞ্জারর্স মহলে সে ‘শাক হকার’ বলে পরিচিত হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে ইদানিং শাক কম করে আনে। দিদিমাকে সে কত খাটাবে। এদিকে শাক তুলবে আবার শেকড় জড়িবুটি জোগাড় করবে। বুড়ো মানুষটা যেন আর পারছে না। দিদার এই হাড়ভাঙা খাটনি দেখে মাঝে মাঝে তার মনটা কেমন দমে যায়। হঠাৎ যদি এই মানুষটার ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায় তো সে অথৈ জলে পড়ে যাবে। এই মানুষটাকে তাই সে ‘মুলো-বাড়ি করতে চায় না। বেগুন-বাড়ি’ করে রাখতে চায়। মুলো চাষের বাগানে যখন মুলো উপযুক্ত হয়ে যায় তখন সব মুলোকে চাটি সমেত উপড়ে নিতে হয়। নাহলে বুড়ো হয়ে খাবার অযোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু বেগুন বাগানের বেগুন বহুদিন ফল দিয়ে যায়। চাষী তাই বেগুন বাগানকে খুব যত্ন-পরিচর্যায় রাখে। এই বেগুন বাগানের মত যত্নে সে তার দিদাকে রাখতে চায়। সেইজন্যে ইদানিং যেসব মূল-জড়িবুটি অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়, সেগুলো দিদাকে আনতে বারণ করেছে বাবলা। মালদার টাউন মার্কেটে জড়িবুটির একটা দোকানের সে সন্ধান পেয়েছে। সেই দোকানদারকে সে অর্ডার দিয়ে আনায়। তাতে একটু বেশি তার খরচ হয়ে যায় ঠিক। লাভ ভাগাভাগি হয়ে যায়। দিদার বেলায় যেটা হত না। কিন্তু সব সময় লাভের লোভে জড়িয়ে পড়লে চলবে কেন।
    শেকড় জড়িবুটির যোগান দিতে দিতে বহরমপুরের তারা-মা মন্দিরের সাধুবাবার সঙ্গে বাবলার ভালই জানাশোনা হয়ে গেছে। একদিন সাধুবাবা বলল, “বাবলা, এতদিন তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় কিন্তু এখনও তোমার বাড়িটা কোথায় জানা হল না। সবসময় তো তোমার সঙ্গে আমার ট্রেনেই যোগাযোগ হয়। যেন এই ট্রেনই তোমার বাড়ি-ঘর। কিন্তু তা তো নয়। এতদিন আমার জিজ্ঞেসই করা হয়নি। এটা ঠিক হয়নি। আসলে কি জানো তো, ট্রেনে বাসে নিত্যদিন কত মানুষের সঙ্গে আলাপ, কথাবার্তা হয়। তাই বলে সঙ্গে সঙ্গে তার খোলের খবর জানতে চাওয়াটাও সবাই ঠিকভাবে নেয় না। পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে তবেই এসব সমীচিন বলে মনে হয়।” সাধুবাবার কথায় ইতস্তত না করেই বাবলা বলল, “আমার বাড়ি মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায়। আমি আমার দিদার সঙ্গে থাকি। দাদু মারা গেছে অনেক আগে। দাদু-দিদাই আমাকে মানুষ করেছে। এখন আমার দিদাই আমার জীবনের অবলম্বন। আমি যে এতটা কাজ করতে পারছি, তার পেছনে সবটাই আমার দিদার অবদান। নাহলে আমি পারতামই না। সবটাই দিদা সংগ্রহ করে। আমি শুধু গলাবাজি করে ট্রেনে বিক্রী করি।”
    -হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায়? ওখানে সবই তো চর্মকার-রুইদাসদের বাস! তুমি তাহলে রুইদাস সম্প্রদায়ের? অবাক দৃষ্টিতে সাধুবাবা জিজ্ঞেস করল!
    -হ্যাঁ, সাধুবাবা। আমরা জাতিতে চর্মকার-মুচি। আমাদের আসল বাড়ি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা থানার বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়ায়। আমার বাবা-মা ওখানে থাকে। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন না হওয়ায় একদম ছোট্ট বেলায় দাদু মানুষ করবে বলে আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে। সেই থেকে আমি এখানে। আগে তো ওখানে যেতাম না। দাদু মারা যাবার পর এখন হাতে কাজ কম থাকলে মাঝে মাঝে আমি ফলতায় যাই। আবার চলে আসি। একা দিদাকে ফেলে বাইরে কোথাও বেশিদিন থাকতে পারি না। মন কেমন করে।
    ওরা জাতিতে চর্মকার জানতে পেরে বাবলার প্রতি আরও আগ্রহ বেড়ে গেল সাধুবাবার। বহুদিন ধরে যে জিনিসটার জন্যে প্রতি পদে পদে বিশেষ কয়েকজন জ্যোতিষীর গাম্ভীর্যের কাছে অবনত হতে হচ্ছে এবার বোধ হয় সেই গ্লানি থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারবে। কেননা এই জিনিসটা এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে হাতেগোনা কয়েকজন জ্যোতিষী তাকে হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছে। আর নিজেদের আধিপত্য জারি রাখতে এই কয়েকজন কিছুতেই জিনিসটা কোথা থেকে জোগাড় করল তার ঠিক-ঠিকানা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সংগ্রহে রেখেছে। তবে সাধুবাবা জানতে পেরেছে যে এটা একমাত্র চর্মকাররাই সংগ্রহ করতে সক্ষম। রুইদাস-চর্মকাররাই একমাত্র ভাগাড়ে গরুর চামড়া সংগ্রহ করতে যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই জানে না যে গরুর পেটে এমন একটা দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্লভ দ্রব্য পাওয়া যায়। ওই দু-একজনই নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এতটাই গোপনে জিনিসটা সংগ্রহ করে যে তাদের জাতভাইরাও এব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছে। সেই সূত্রে সাধুবাবা বহুবার ওই মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজনপাড়ায় গিয়েছে। কিন্তু ওখানকার কোন চর্মকার তাকে শঙ্কামুক্ত করতে পারেনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া কোন চর্মকারই এই জিনিসটার বিষয়ে সম্যক অবগত নয়! বলে,“সে কি জিনিস আমাদের জানা নেই সাধুবাবা। আপনি মনে হয় ভুল করে আমাদের কাছে এসেছেন। কেউ ভুলভাল কিছু বলেছে আর সেই কথা শুনে আপনি কষ্ট করে আমাদের এখানে ছুটে এসেছেন।” ওদের কথায় কিন্তু সাধুবাবা বিন্দুমাত্র হতাশ হয় নি। খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই দুর্লভ ব্যক্তি যে এর হালহকিকত জানাতে পারে। এই যে মাঝে মাঝেই বহরমপুর থেকে মালদার এদিকে ছুটে আসে, তা একমাত্র এরই উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই দুর্লভ ব্যক্তি যে অজান্তেই তার কাছে ধরা দিয়ে ফেলেছে। বাবলা ছেলেটাকে সে আর কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। এই ছেলেটা কিচ্ছু না জেনেও যেভাবে শেকড় জড়িবুটির কারবারের গোটা ব্যাপারটই স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজের করায়ত্বের মধ্যে এনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তেমনি এই দুর্লভ জিনিসটাও সে চেষ্টা করলে সংগ্রহ করতে পারবে। সেই বিশ্বাস এই ছেলেটার উপর তার আছে। ছেলেটা তার যোগ্যতা দিয়ে বিশ্বাসটা দিয়ে অর্জন করাতে পেরেছে।
    যেহেতু এখানকার রুইদাসরা এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তাই তাদের কাছে ব্যাপারটা ভাঙতে চাইল না সাধুবাবা। কেননা এরা কেউই তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে হল না। তাছাড়া চেনাজানা না থাকলে এমন অতি গোপনীয় ব্যাপারগুলো জানানোও উচিত নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই বাবলা ছেলেটাকে এই গোপন তথ্য জানানো যেতে পারে। সেদিন বাবলা সাধুবাবার কাছে অর্ডারমত জড়িবুটি, শেকড় ডেলিভারী দিতে এলে বলল, “বাবলা, আজ তোমার এখন বাড়ি যাওয়া যাবে না। মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করে বিশ্রাম নাও। তোমার সাথে অনেক জরুরী কথা আছে আমার। আমি মন্দিরের কাজ সেরে হাল্কা হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি তোমার কাছে।”
    হঠাৎ সাধুবাবা এমন কথা বলায় বিস্মিত হয় বাবলা! সাধুবাবা এমন কথা তাকে কোনদিন বলে না তো ! তার সঙ্গে কি এমন দরকার থাকতে পারে সাধুবাবার? এদের সব কতরকম কাজ কারবার থাকে। কোন আজেবাজে কাজে তাকে জড়িয়ে দেবে না তো? এককাঁড়ি প্রশ্ন মনের মধ্যে প্রসব করে টানটান হয়ে বাবলা অপেক্ষা করছে সাধুবাবার জন্যে। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছে। তেমন কিছু বললে, যেটা তার পক্ষে ভাল হবে না বলে মনে হলে আর কোনদিন এই সাধুবাবার সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখবে না। দরকার নেই তার অত পয়সার লোভ করে। তাতে বরং তার কলমি শাক বেচে দিন কাটিয়ে দেওয়াটা অনেক শান্তির।
    মনের মধ্যে এমন সাতপাঁচ জাবর কাটতে কাটতে দেখে সাধুবাবার তার কাছে আসছে। একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে সাধুবাবা তার সামনে এসে বসলো। বসার আগে ঘরের দরজার ছিটকিনিটা আটকে দিতে চমকে উঠেছিল বাবলা ! সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে নিজেকে সামলে নিল।
    বাবলার সামনে নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে সাধুবাবা বলল, “বাবলা, তোমাকে কয়েকটা গোপন কথা জানাতে চাই। তার আগে তোমাকে তারা মায়ের পা ছুঁয়ে বলতে হবে, এই খবর তুমি আর দ্বিতীয় কাউকে জানাবে না। যদি জানাও তো মা তোমার বহুৎ অনিষ্ট করে দেবে।” বলে সাধুবাবা নামাবলীর ভেতর থেকে তারা মায়ের ছবিটা বার করে বাবলার সামনে ধরল।
    সাধুবাবার কথায় বাবলা বুঝল তার খারাপ কিছু হবে এমন কথা সাধুবাবা তাকে বলতে আসেনি। নিশ্চয় এমন কোন গোপন কথা আছে যেটা বিশ্বাস করে সাধুবাবা তাকেই কেবল বলতে চাইছে। তাই মায়ের পায়ে হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নিতে চাইছে।
    মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সাধুবাবা যা যা করতে বলল বাবলা তাই করে সাধুবাবার মুখের দিকে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুড়ে তাকিয়ে রইল। বাবলার উপর সন্তুষ্ট হয়ে সাধুবাবা বলল,“তুমিই উপযুক্ত ছেলে যে এই দুরুহ কাজটা নিরাপদে করতে পারবে। যদি তুমি তাতে সফল হও তাহলে তোমার মাধ্যমে আমার মন্দিরের যেমন শ্রীবৃদ্ধি হবে, সাথে সাথে তোমার জীবনের উন্নতির একটা নতুন দিক খুলে যাবে। আর্থিকভাবে তুমি অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে। তার জন্যে এই কাজটাকে তোমার ধ্যানজ্ঞান করে নিতে হবে। আর আমার আশীর্বাদ রইল। তুমি সফল হবে।”
    তার সম্বন্ধে এত উচ্চ প্রশংসা করায় সাধুবাবার প্রতি অন্য এক আন্তরিক আনুগত্য মনের মধ্যে খেলে বেড়াতে লাগল বাবলার। তার আর্থিক উন্নতির আশ্বাস দিচ্ছে সাধুবাবা ! তাহলে খারাপ কিছু কাজ সাধুবাবা তাকে দিয়ে করাতে পারে। এই চিন্তা যে প্রথমে করছিল সেটা ভুল ভাবনা ছিল তার। সেই বিশ্বাস মনে পোষণ করে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বাবলা বলল,“কি কাজটা আমাকে করতে হবে বলবেন সাধুবাবা? আপনার কোন কাজ তো আমি এতদিন পর্যন্ত এড়িয়ে যাইনি। এখনও যাব না। যেমন যেমনটি বলবেন ঠিক সেই কাজটাই আমি করব। আপনি যেমন আমাকে বিশ্বাস করেছেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আমি রাখার চেষ্টা করব। অন্যথা হবে না।”
    বাবলার প্রতিশ্রুতিতে তৃপ্ত হয় সাধুবাবা। মনে ভাবে, এবার কথাটা ছেলেটাকে বলা যেতে পারে। তারপর নিজের ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা কাঁচের বয়াম বার করল। বাবলা দেখতে পাচ্ছে, বয়ামটার ভেতর পীত বর্ণের থেবড়ানো গোলাকার একটা রঙিন পদার্থ। এই জিনিসটাকে নিয়ে সাধুবাবার এত আগ্রহ? কি এটা? কি কাজে লাগে! এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন তার মনের ভেতর তালগোল পাকাতে থাকে? বিষ্ময় এবং যুগপৎ মুচকি হেসে সাধুবাবা জিনিসটা বয়াম থেকে বার করে হাতের তালুতে নিয়ে বাবলার সামনে ধরল! বাবলাও বিস্ময়াবনত হয়ে সেটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,“এটা কি জিনিস সাধুবাবা? এই প্রথম আমি এমন জিনিসটা দেখছি। মনে হচ্ছে তো এটা দুস্প্রাপ্য কোন বস্তু! এটার সম্বন্ধে কি আমাকে এত কথা বললেন?
    -হ্যাঁ, এটাকে নিয়েই এত কথা! আর এটার জন্যে তুমিই আমার তুরুপের তাস! এই রঙিন দুর্লভ দ্রব্যটার নাম ‘গোরোচনা!’ বহুমুখী এর কার্যক্ষমতা। যারা এর গুণের পরিচয় জানে তাদের কাছে এই বিস্ময় বস্তুটা একাধারে যেমন বহুমূল্য তেমনই আকর্ষণীয়! আর যারা জানে না, তাদের কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। এই যেমন তোমার কাছে। এই দ্রব্যটার সম্বন্ধে তুমি কিছুই জানো না। এখন যদি তোমার হাতে এটা তুলে দিই তুমি অকামের বস্তু বিবেচনায় অবহেলায় কোথাও নির্বাসিত করবে একে। তোমার মতো সব মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। সবেমাত্র এর সঙ্গে তুমি পরিচিত হতে চলেছ। এখনো সম্পূর্ণ কিছু জানতে পারোনি। পারলে একে তুমি স্বর্ণমুদ্রার থেকেও আদরে গ্রহণ করবে।” যারপরনাই কৌতূহলোদ্দীপক চিত্তে সাধুবাবা বলল।
    ঠিক ততটাই উৎকন্ঠার সঙ্গে এবার বাবলা বলল, “আপনি একদম সঠিক কথা বলেছেন সাধুবাবা। মনে হচ্ছে তো এটা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় ঠিক ততটাই কাজের জিনিস হবে। আপনি সেটা না জানালে আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব নয়। সবটাই আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। যদি জানান তাহলে জানব এবং আপনার কথা মত আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি কাজ করতে পারব, এতটুকু ভরসা আপনাকে আমি দিতে পারি। গোরোচনার প্রতি ভেতরে ভেতরে তীব্র আগ্রহকে বাইরে প্রকাশ না করে হাল্কা ভাবনায় বাবলা বলল।”
    বাবলার জিনিসটার প্রতি আগ্রহ ঠিক কত, সেটা এতক্ষণ ধরে পরখ করার জন্যে এতটা কথা চালাচালি করল সাধুবাবা। বুঝলো, না, ছেলেটাকে নির্বাচন করে সে ভুল করেনি। এর দ্বারাই তার কার্যসিদ্ধি হবে। তবে ছেলেটাকেও সে ঠকাবে না। ওর উপযুক্ত পাওনা সে দিতে কুন্ঠা করবে না। ওকে বঞ্চিত করা মানে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়ে যাবে। দিন যত গড়াবে ছেলেটার জিনিসটার প্রতি দখল বাড়বে। একবার যদি বুঝতে পারে যে তাকে সাধুবাবা ঠকাচ্ছে তখন ও আর তার কাছে পড়ে থাকবে না। অন্য ঠিকানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে এবং সন্ধান পেয়েও যাবে। তার মত কত সাধুবাবা আছে, এইরকম ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যোগাযোগে যুক্ত হতে বেশি কসরত করতে হবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধুবাবা বলল, “পাথরসম শক্ত এই গোরোচনা বস্তুটা কতরকম যে কাজে লাগে তা এককথায় এবং একবারে তোমাকে বলে শেষ করতে পারব না। সময় সময় তুমি আমার কাছ থেকে সবই জানতে পারবে। আচ্ছা, তোমার জানা আছে কি যে যেকোন পাথর শোধন করে তবে মানুষকে পরতে বলে জ্যোতিষীরা? সংগ্রহ করে আনা পাথর আংটিতে লাগিয়ে সরাসরি মানুষের আঙুলে পরিয়ে দিলে কাজ হয় না। তাকে শোধন অর্থাৎ বিশুদ্ধ করতে হয়। এক এক পাথরের শোধন প্রক্রিয়া আবার ভিন্নভাবে করতে হয়। আমরা যে গোমেদ পাথরের কথা বলি। শেকড়, জড়িবুটি নিয়ে যখন নাড়াঘাটা করছো, গোমেদ বা অন্য সব পাথরের নাম তোমার জানা এটা বলা যায়। সেই গোমেদ পাথর শোধনের জন্যে এই গোরোচনা মিশ্রিত জল প্রয়োজন হয়। এটা ছাড়া এই পাথর শুদ্ধ হয় না। আর বলেছি তো তোমাকে, গোমেদ কোন গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া গোরোচনার বহুগুণের আর একটা গুন তোমাকে জানাচ্ছি। এখন আমার হাতে আর তেমন সময় নেই। তোমার সঙ্গে আরও কথা সারা আমার প্রয়োজন। শুধু গুনাগুণ বলতে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে। আমাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী নানারকমের টনিকের প্রয়োজন হয়। এই গোরোচনা অন্যতম এক টনিক এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধেরও কাজ করে। তাছাড়া আমরা যে তিলক কাটি না? এই জিনিসটা ‘খল-নোড়া’ দিয়ে চূর্ণ করে কপালে চন্দনের তিলক কাটার মত রঙিন তিলক কাটার কাজে লাগে।”
    খানিক চুপ থেকে সুধাবাবা আবার বলল, “এবার যে কথাটা তোমাকে আমার বলা। সেটা হল, তোমরা তো জাতিতে চর্মকার রুইদাস। ভাগাড়ে গরু পড়লে তোমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ সেই গরুর চামড়া আহরণ করে। ওই মানুষজনের, বলা যায় প্রায় সব্বাই ভাগাভাগি করে সেই চামড়া নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওই গরুর পেটে যে এই দুর্লভ গোরোচনা বস্তুটা থাকে তা তাদের অজানা। তোমাদের মধ্যে বিরল দু-একজন আছে যারা এর হালহকিকত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তুমি এখন সেই বিরল মানুষদের মধ্যে একজন হয়ে গেলে। এই মানুষরা কিন্তু ভাগাড়ে গিয়ে ওই চামড়ার জন্যে ঝুলপেটাপেটি করে না। চামড়া শিকারীরা চামড়া নিয়ে চলে গেলে চুপিসাড়ে তারপর সে নিজের কাজ সারার জন্যে লেগে পড়ে। তবে সবসময় যে সে সফল হয় তা কিন্তু নয়। সব গরুর মধ্যে জিনিসটা থাকে না। কপালে থাকলে তবে তার দেখা মেলে। মিললে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। এক একটা গুলির দাম হাজার হাজার টাকা! এবার একটা গরুর মধ্যে অনেকগুলো করে গোরোচনা থাকে। এখানে একটাই হতাশার দিক হল, তোমাকে অনবরত এ-গরু সে-গরুর মধ্যে খুঁজে বেড়াতে হবে। ওই অন্ধকারে হাঁচানোর মত আর কি।”
    সাধুবাবার কথায় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল বাবলা। কিন্তু তার পরে পরেই আবার মনটা দমে গেল! দমে গেল এইজন্যে যে তাদের এই মালদা এলাকায় গরুর কোন ভাগাড় প্রায় নেই বললেই চলে। মুসলিম আধিক্যের এলাকায় কোন গরু বৃদ্ধ হয়ে মরার আগেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুসলমানদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বা মুসলমানরা জানতে পারলে নিজেরাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিনে নিয়ে চলে যায়। ফলে এলাকা ভাগাড়শূন্য হয়ে গেছে বলা যায়। তবু তাকে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে পড়তে হবে। তার জন্যে শুধু মালদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে তাকে আরও দূরে বহু দূরে যেতে হলে সে যাবে। ওর চোখমুখে ফুটে উঠল একটা কিছু করার অভিব্যক্তি! সাধুবাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল,“বুঝতে পারছি এই কাজ নিতান্ত মামুলি কাজ নয়। প্রচুর মেহনত করতে হবে আমাকে। তার পরেও আমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব কি না জানি না। তাই আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আমি যাতে এই কাজে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারি।”
    দিদিমাকে হাজার-দুই টাকা দিয়ে বাবলা বলল,“তুমি সাবধানে থাকবে দিদা। আমি মাসখানেক বাড়ি থাকব না। বিশেষ জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি। দরকার হলে আরও দু-তিন মাস হয়ে যেতে পারে আমার ফিরতে ফিরতে। মামা-মামী কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবে, কিছু বলে যায়নি। বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে বলে বাবলা চলে গেছে। তা আমাকে নিয়ে তোদের চিন্তা করতে হবে না। খেতে পরতেও দিতে হবে না। বাবলা সব ব্যবস্থা করে গেছে। ভাল কাজেই যাচ্ছি দিদা। তুমি চিন্তা করবে না। কাজ সারা হয়ে গেলে সময়মত ঠিক ফিরে আসব।”
    মালদা থেকে ট্রেনে চড়ে একদম ভোরে ধূপগুড়ি স্টেশনে নামল বাবলা। এখানেই এই ট্রেনটার যাত্রার অন্তিম স্টেশন। এইসব এলাকা সম্বন্ধে ওর কিছুই জানা নেই। ট্রেন থেকে নামার আগে বাথরুমের কাজটা সেরে পরিষ্কার হয়ে নেয়। নতুন জায়গা, কোথায় কি আছে তার জানা নেই। স্টেশনে এদিক ওদিকে ঘুরেঘারে কিছুটা সময় কাটিয়ে দেয়। সূর্যের আলো একটু ভাল করে ফুটে উঠতে গোটা স্টেশন চত্বর জমজমিয়ে উঠতে লাগল। খিদে পেয়েছে। এবার সকালের টিফিনটা সেরে নেবার জন্যে একটা স্টলের সামনে বেঞ্চে এসে বসল। দোকানদারকে কচুরি-আলুদমের অর্ডার করল। চারটে কচুরি খেয়েও যেন খিদেকে বশে আনতে পারলো না। আরও চারটের অর্ডার করে এবার আলুরদমের বদলে চারটে ল্যাংচা দিতে বলল। তারপর পরপর দু’কাপ চা খেল। এবার যেন পেটের আন্দোলনকে থামানো গেল। বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পয়সা দেবার জন্যে পকেটে হাত ঢোকালো। আবার কি মনে করে হাত বার করে বলল, “ডাবল ডিমের ওমলেট দাও তো দাদা।”
    ওমলেটের প্লেটটা বাবলার হাতে ধরিয়ে প্রশ্নমুখো হয়ে বাবলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল দোকানদারটা। বাবলা বুঝতে পারে সেটা। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কিছু বলবে আমাকে দাদা?”
    -আসলে কি জানো তো ভাই, তোমার মত খরিদ্দার আমি এতদিন কারবার করছি, একটাও পাইনি। একসঙ্গে এত খাবার কেউ অর্ডার করে না। তোমার খুব খিদে পেয়েছিল বুঝি? হাসি হাসি মুখে দোকানদারটা জিজ্ঞেস করল বাবালাকে।
    সাধারণভাবে বাবলাও কোনদিন একসঙ্গে ‘আক্যুটের’ মত এত খাবার খায় না। নতুন এলাকা। কোথায় কি আছে কিছুই জানে না। সেটা জানতে গেলে এখানকার কারোর সঙ্গে তো তাকে আলাপ করতেই হবে। তা আচমকা কারোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ পাত্তা দেবে না। উল্টে তাকে সন্দেহ করে বসলে উল্টো বিপত্তি হতে পারে। তাই দোকানদারের তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এমন অস্বাভাবিক আচরণ সে পরিকল্পনা মতই করেছে। এবার সে অতি সহজেই স্থানীয় এই দোকানদার ছেলেটার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারবে। দোকানদারের হাসি মুখের রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই বাবলা বলল, “হ্যাঁ দাদা। সেই আগের দিন দুপুরে ভাত খেয়েছি। নানান কারণে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি। খুব খিদে পেয়েছিল। তাই।”
    -কোথা থেকে আসছো তুমি? দেখে মনে হচ্ছে তো তুমি এখানকার ছেলে নও। কোথায় যাবে? জায়গাটা যদি না জানা থাকে বলো, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। আমি এখানকারই ছেলে।
    এবার বাবলা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো আশেপাশে কেউ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে কি না ! কেউ নেই দেখে বলল,“তোমার নাম কি দাদা বলবে? আমার নাম বাবলা রুইদাস। মালদার হরিশচন্দ্রপুরে এক গ্রামে আমার বাড়ি।”
    অতশত দিক না চিন্তা করেই সরল মনে দোকানদার বলল,“আমি নিত্যানন্দ বৈরাগী।” ধূপগুড়ির বৈরাগী পাড়ায় আমার বাড়ি। আমাদের গোটা গ্রামেই বৈরগীদের বাস। আমরা সব কৃষ্ণ ভক্ত। এখানকার গৌরাঙ্গ মঠ খুব নামকরা। আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের হিন্দুরা এই মঠে আসে। নাম সংকীর্তনে অংশ নেয়। সকালে গ্রাম পরিক্রমা করে। তা তুমি কোথায় যাবে?”
    এবার বাবলা বুদ্ধি করে বলল,“শুনেছি ধূপগুড়িতে খুব জাগ্রত রাধাকৃষ্ণের গৌরাঙ্গ মঠ আছে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ওই মঠটায় যাবো। তা ধূপগুড়ির ঠিক কোথায় তা আমার জানা ছিল না। এই তোমার কাছে জানলাম দাদা। খুব খুশি হলাম। ওই মঠেই আমি যাবো। যদি আমাকে বলে দাও কেমন করে যাবো।”
    বাবলা বুঝে গেল এলাকাটা পুরোপুরি হিন্দুদের বাস। তার উপর বৈষ্ণবরা গরুর ভীষণ ভক্ত। ভগবতী জ্ঞানে গরুকে ওরা দেখে। কোন অবস্থাতেই ওরা নিতান্ত পয়সার লোভে বৃদ্ধ বা অশক্ত গরুকে মুসলিমদের হাতে সঁপে দেবে না। মারা গেলে এলাকার কোন ভাগাড়েই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবে। কেউ কেউ আবার মৃত গরুকে কবরস্থও করে। তাতে অবশ্য সরকার থেকে জনসাধারণের কাছে আবেদন রাখা হয়েছে যে কোন গরু ছাগল বা ওই জাতীয় কোন জীবজন্তুকে কবর না দেওয়ার জন্যে। এর ফলে সমাজে শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিগত বছরগুলোতে আমরা যে শকুন দেখতে পেতাম, আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না। তাদের প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবেই এই দশা বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত। তাতে অবশ্য অনেকটা কাজ হয়েছে। একদম গোঁড়া ভক্তরা ছাড়া অন্য উদার মানসিকতার মানুষরা গরুকে কবর দেয় না।
    স্টেশনের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়েছে বাবলা। বেশ কয়েকদিন স্টেশন চত্বরের এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আর নিত্যানন্দর চা-টিফিন দোকানে এসে সময় কাটায়। অবশ্যই শুকনো মুখে নয়। নিয়মিতভাবে টিফিন করে চা খায় ওর দোকানে। তাতে নিত্যানন্দও বেশ খুশি। অগের থেকে অনেক খোলামেলা ভাবেই সে এখন বাবলার সঙ্গে কথাবার্তা বলে। বলা যেতে পারে বন্ধুর মত হয়ে গেছে। একদিন নিত্যানন্দ বলল, “বাবলা ভাই, সামনের সোমবার আমার দোকান বন্ধ থাকবে। বাড়িতে পুজো আছে। তুমি চলো আমার বাড়ি। ওই দিনটা তুমি আমাদের বাড়ি প্রসাদ পাবে এবং রাত্রের ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান দেখে পরদিন ফিরে আসবে। অবশ্য ভাববে না যে পরদিন আমি তোমাকে খাওয়াতে পারব না বলে চলে আসতে বলছি। ইচ্ছা করলে তুমি থাকতে পারো আমাদের বাড়ি। আমার বাড়ি মনে করে ‘অতিথি দেব ভব।’ মা তোমাকে হয়তো আসতেই দেবে না। দেখবে!”
    নিত্যানন্দদার কথায় রাজি হয়ে যায় বাবলা। ও তো এটাই চাইছিল। এবং একদিন ওখানে থাকবেও। নিজের কাজ সারতে গেলে এলাকাটা তাকে দেখতেই হবে। বিশেষ করে কোথায় কোথায় ভাগাড় আছে তা তো তার জানা অত্যন্ত জরুরী।
    তিন মাস ধুপগুড়ি স্টেশন আর বৈরাগী পাড়া ছিল বাবলার কর্মক্ষেত্র। এলাকায় খান তিনেক ভাগাড়ের সন্ধান করতে পেরেছে। পাঁচ পাঁচটা গরু এই তিন ভাগাড়ে পেয়েছে সে। আর ভাগাড় আছে মানেই চর্মকার থাকবে। তবে তারা কিন্তু তাদের মত বাঙালী চর্মকার নয়। অবাঙালী এরা। কয়েকজন আবার মুসলিম চর্মকার। শকুনের নিশানে তার বুঝতে অসুবিধা হয় না ভাগাড়ে গরু পড়ার সংবাদ পেতে। গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়ে যায়। দূর থেকে দেখে লোকগুলো গরুর চামড়া কেটে নিয়ে চলে গেলে বাবলা তার বিশেষ কাজে নেমে পড়ে। পাঁচটা গরুর পেট কেটে দুটোতে সে সফল হয়। আর আনন্দে ছটফট করতে থাকে কতক্ষণে এগুলো নিয়ে সে সাধুবাবার কাছে হাজির হবে! বাড়ি ফেরার দিন বন্ধু নিত্যানন্দকে বলে যায় আবার সে আসবে। খুশি নিত্যানন্দ বন্ধুকে বিদায় জানায়। সেদিন আর ও বন্ধুর কাছ থেকে কোন টিফিনের দাম নেয় নি।
    গোরোচনার পাথরগুলো বাবলার কাছ থেকে পেয়ে খুশিতে টগবগ করতে থাকে সাধুবাবা। বলে,“কি জানিস তো বাবলা, মা আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিল, এই বাবলা ছেলেটাই পারবে তোর অভিষ্টকে সিদ্ধ করতে। তুই ওকে ভরসা করতে পারিস। ওকেই তুই সবকিছু খুলে বল। ছেলেটা তোর সঙ্গে বেইমানী করবে না। তা মায়ের আশীর্বাদ কি কখনো বিফলে যায়! বলে সাধুবাবা তার শোবার ঘরে দ্রুত চলে যায়।” অল্প সময় পরেই ফিরে এসে বাবলার হাতে একটা টাকার বান্ডিল দিয়ে বলে,“এতে দশ হাজার টাকা আছে। কাউকে এই টাকার কথা আর গোরোচনার কথা বলবি না। তুই এই জিনিসটা সংগ্রহের মধ্যেই নিজেকে নিবিষ্ট কর। আর দরকার নেই ওই জড়িবুটি বা কলমি শাকের কারবার করে। আমার সঙ্গে লেগেপড়ে থাক। দেখবি দিনে দিনে তোর ব্যাঙ্কের বই ভারি হয়ে উঠছে।
    একসঙ্গে এতগুলো টাকা বাবলা তার জীবনের এই সময় সীমার মধ্যে দেখেনি। টাকাটা পেয়ে প্রথমে ভেতরে ভেতরে আবেগে কাঁপতে থাকে সে! ভাবে, সে এটা দিবাস্বপ্ন দেখছে না তো! সত্যি সত্যি এই জিনিসটা এত মূল্যবান! সাধুবাবা যদি এককথায় তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দেয় তো এর প্রকৃত দাম তাহলে কত? সাধুবাবা তো আর টাকার দানসত্র খুলে বসেনি। যে এমনি এমনি খুশি হয়ে তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দিল। অবশ্যই সে এর থেকে অনেক অনেক বেশি টাকা আয় করবে। আবার মনকে বোধ দিয়ে ভাবে, যাকগে। যার ধর্ম যার কাছে। তার আর অতি লোভ করে কাজ নেই। না চাইতেই সে যা পেয়েছে তাতেই সে সন্তুষ্ট। তার চোদ্দপুরুষ তো ভাবতে পারে না গরুর শরীরে কতকগুলো নুড়ি পাথরের এত দাম হতে পারে। এই কথাটা একমাত্র সে তার দিদাকে বলবে। দিদাকে কথাটা গোপন রাখতে বললে, মরে গেলেও দিদার মুখ থেকে সে কথাটা বার হবে না। কথা ফেচকাবার মানুষ দিদা নয়। আর তার দিদার মুখ চেয়ে সে ট্রেনে ওই কলমি শাকের ফেরি করা বন্ধ করবে না। সাধুবাবা যতই বলুক। তাতে দিদার মন খারাপ হতে পারে। কত মনপ্রাণ দিয়ে দিদা এগুলো সংগ্রহ করে দেয় নাতির কারবার করার জন্যে।
    তাছাড়া এই কারবার থেকেই তো তার উত্থান। অসময়ের জীবন দিশারী। তাকে ত্যাগ করা মানে অকৃতজ্ঞর মত কাজ করা হয়ে যাবে। শেকড় জড়িবুটির কাজও সে করে যাবে। সবসময় তো আর গোরোচনার খোঁজে তাকে বার হতে হচ্ছে না। যখন বার হবে তখন এই কাজটা বন্ধ তো সে রাখছেই। তিনমাস তো সে কাজ করেনি। তারপর কি, হঠাৎ কারবারটা বন্ধ করে দিলে লোকে অন্যরকম কথা তাকে নিয়ে ভাবতে পারে। ভাল, মন্দ সবরকমের ভাবনা মানুষের বা হকার বন্ধুদের মধ্যে খেলে বেড়াবে। তখন সে একটা সমালোচনার পাত্র হয়ে দাঁড়াবে। সেই তুরুপের তাসটা সে কারোর হাতে তুলে দিতে চায় না।
    গোরোচনার কর্মক্ষমতা নিয়ে যে কথাটা প্রথম দিন বলতে বলতে সাধু বাবা কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে, পরে বলবে বলে অসম্পূর্ণ রেখে গেল সেটা তাকে জানতেই হবে। ওই যে, বলছিল তান্ত্রিক বশিকরণ করা। অবাধ্য স্ত্রী বা প্রেমিকাকে বশীভূত করা নাকি এটার মাধ্যমে সম্ভব! এ’ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হবে। সাধুবাবা কি সেই বিদ্যা তাকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করবে? মনে হয় তো না। ওরা কথা দিলে কথা রাখার চেষ্টা করে। আর ‘না’ করলে?

    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৮)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

     

    [ সাঁইত্রিশ ]

    চারজন ছাত্রীকে টিউশনি পড়াতো অলোকাদি। বেসিক ট্রেনিং পড়তে যখন চলে যাচ্ছে তখন স্কুল শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়। এবার এই মেয়েদের পড়াশোনার কি হবে? চিন্তায় পড়ে যায় সে। ছাত্রীরা এবং তাদের বাবা মায়েদেরও মাথায় হাত। অন্য যারা টিউশানি পড়ায় তারা কেউ বাড়িতে এসে এই অসময়ে তার বাসি হতে যাওয়া ছাত্রীদের পড়াতে রাজি হবে না। এদের অভিভাবকরা চেষ্টাও যে করেনি তা নয়। কিন্তু রাজি হয়নি কেউ। আর অলোকাদির মত এত কম পয়সায় বাইরের কেউ টিউশনি পড়াবে না। সেইসঙ্গে অলোকাদির মত ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর তো প্রশ্নই নেই। দু’একটা কোচিং সেন্টার অবশ্য নিমরাজি হয়েছিল, তাদের সেন্টারে এসে পড়ার জন্যে। কিন্তু বছরের মাঝপথে কোচিং সেন্টারে পড়ে কোন লাভ নেই। অলোকাদিও তাদের সেই পরামর্শ দিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন যে অলোকাদি কোনভাবে চেষ্টা করলেও বাড়িতে এসে পড়াতে পারবে না। কেননা সারদা মন্দিরে বেসিক ট্রেনিংয়ের গোটা ব্যাপারটাই রেসিডেন্সিয়াল। আর এই ক’টা মেয়ের পড়ানোর জন্যে তো সে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে অলোকাদি তার উৎকন্ঠার কথাটা সনাতনকে জানায়। তারপর বলে, “ভাই, তুই আমার একটা উপকার করবি? একমাত্র তুই পারিস আমার এই মরমে মরার হাত থেকে বাঁচাতে। আগে কথা দে, আমার কথা তুই রাখবি? তাহলে তোকে বলব। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি যে আরও কষ্ট পাবো। তোকে যে আমি আমার আপনজনের চোখে দেখি।”
    -আপনজন কখনো আপনজনকে কষ্ট দিতে পারে দিদি? বলোই না তোমার কথাটা। তারপর দেখো, আমি সেই কথাটা রাখতে পারি কি না।
    -ওই মেয়েগুলোকে তুই পড়াবি? ওদের মধ্যে দু’জন নাইনে পড়ে আর দু’জন টেনে। টেনের দু’জনের জন্যে আমার আরও বেশি চিন্তা। পরের বছর তো ওরা মাধ্যমিক দেবে। কি হল! হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছিস যে? ভাবছিস নাইন টেন ক্লাসের ছাত্রীদের তুই পড়াতে পারবি কি না, তাই তো? আলবাৎ পারবি তুই। পড়াশোনায় তুই অত ভাল। তুই ওদের পড়াতে পারবি না সেটা হতে পারে না। তুই পারবি। সে আস্থা তোর ওপর আমার আছে। হ্যাঁ, একটা চিন্তা তোর হতে পারে, তুই কোনদিন কাউকে টিউশানি পড়াস নি। তাই তার ধরণ-ধাঁচে তুই রপ্ত নোস। কিন্তু সেটা বা হবে কেন। একটু পাল্টা বুদ্ধি চালা না। তুই তো টিউশনি পড়েছিস। এবার তুই পড়াবি। মাস্টারমশাই তোকে যেমন নিয়মে পড়াতো সেটা মনে কর না। বুদ্ধি খাটিয়ে সেই বুদ্ধি এবার তুই মাস্টারমশাই হয়ে প্রয়োগ কর ! তাহলে ওই অনভিজ্ঞতাজনিত ভাবনা থেকে মুক্ত হতে পারবি। আবার বলছি সনাতন, তুই পারবি। সনাতনের উপর গভীর আস্থা রেখে অলোকা বলল।
    সে যাতে মাঝপথে ফেলে যাওয়া তার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে তাই অলোকাদি তাকে এতটা উৎসাহ দিচ্ছে তা সনাতন খুব সহজেই বুঝে নেয়। দিদির ধারণাটা যে একদম অমূলক তাও নয়। চেষ্টা করলে সে পেরে যাবে। সেই বিশ্বাস তার নিজের ওপর আছে। কিন্তু খটকা তো অন্য জায়গায় লেগে যাচ্ছে। সেদিকটা মনে হয় অলোকাদি অত তলিয়ে ভাবে নি। সনাতন প্রস্তাবটা শোনা মাত্রই সেই কথা ভেবে, তার মাথায় তালগোল পাকাতে শুরু করে!
    ভাবনায় ঢুকে গিয়ে সনাতন কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না। বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনছে যেন। সম্বিৎ ফেরে অলোকার কথায়,“কিরে ভাই, একদম চুপ মেরে গেলি যে? আমার কথার কিছু একটা উত্তর দিবি তো, না কি! আমি যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি তোর উত্তরের জন্যে?”
    -দিদি, আমি যে দিকটার কথা ভাবছি, সেটা কিন্তু ওই পড়াশোনার দিকটা নয়। টাকাপয়সার দিকও নয়। টাকাপয়সা তুমি যা নিতে সেটা দিলেও আছি, না দিলেও আছি। পয়সার দরকার আছে ঠিকই। কিন্তু বিদ্যে বেচা আমার চিন্তা ভাবনার একদম বাইরে। তাই এইসব নিয়ে আমার দিক থেকে তোমার উৎকন্ঠার কোন দরকার নেই। যেটা আমার প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন সেটা হল, আমি যাদের পড়াবো তারা তো সব্বাই ছাত্রী। আর আমি ছেলে। মেয়েরা ছেলে মাস্টারের কাছে পড়বে, সেটা তাদের গার্জেনরা মানবে? তুমি মেয়ে বলে, অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের তোমার কাছে পড়তে দিয়েছে। গার্জেনরা হয়তো চাপে পড়ে নিমরাজি হতে পারে। কিন্তু আমাদের পাড়ার মানসিকতা তো তুমি খুব ভাল করে জানো। আমার এই পড়ানোর বিষয়টা আবার শেষ পর্যন্ত আটচালায় উঠবে না তো? আমায় মেয়ে পড়ানোর অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না তো? আর একটা কথা আমার বলার আছে দিদি। আমার হাতে যা সময় আছে, তাতে চার ছাত্রীর বাড়ি চার টাইমে পড়াতে যাওয়া হয়ে উঠবে না। চারজনকে আমি একসঙ্গে পড়াতে পারি। তা সে যেকোন ছাত্রীর বাড়ি হতে পারে। অথবা তাদের কারোর বাড়ি সেই পরিস্থিতি না থাকলে আমাদের বাড়িতে তারা পড়তে আসতে পারে। আমাদের বড় দাবায়, যেখানে আমি এখনো পড়ি, সেখানে চারজন কেন, আটজনের একসাথে পড়তে বসার ব্যবস্থা করা যাবে। এই দিকগুলো একটু ভাববার ব্যাপার আছে দিদি। তুমি কিন্তু ভাববে না, এইসব কথা বলে আমি না-পড়ানোর অজুহাত দেখাচ্ছি। এগুলো তো একদম জ্বলন্ত বাস্তব কথা। একটা ছেলে, মেয়েদের পড়াতে গেলে মনের ভাবনা একটু
    উদার না হলে সবকিছু খাপ খাবে কেমন করে? তুমি আমার কথাগুলো একটু ভাবো দিদি। তারপর তার একটা সমাধান আমাকে বাতলাও। তেমনভাবে আমি এগোব। মনে হয় সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারব, যদি ঠিক ঠিক পদক্ষেপ আমরা নিই।
    এই সনাতন ছেলেটা কেমন বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করল। এত গভীরে গিয়ে ভাবার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। এইটুকু বয়সে সমাজ জীবনের ভাব-ভাবনায় কত যেন পরিণত হয়েছে ছেলেটা। এর যত কাছাকাছি সে আসছে তত যেন অবাক হচ্ছে। ছেলেটা যে কথাগুলো তার সামনে তুলে ধরল,তার কোনটাই উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। অলোকা খানিক চিন্তা করে তারপর বলল,“সনাতন মেয়েরা তোর কাছে পড়বে কি পড়বে না,ওই ব্যাপারটা আমি দেখছি। তিনজন গার্জেন তো আমাকে বলেছিল, অন্য ব্যবস্থা করে দিতে। আর একজন ওসব কিছু বলেনি। আমি প্রত্যেক ছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছি। আর ওই একসাথে চারজনকে পড়ানো যায় কি না সে বিষয়টা নিয়েও ওদের সঙ্গে কথা বলছি। ওরা এখন অসুবিধায় পড়ে গেছে। সম্মানজনক যে কোন প্রস্তাবে ওদের রাজি হয়ে যাওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। হয়তো হয়েও যাবে। মেয়েদের কারোর বাড়িতে যদি সেই সুযোগ না থাকে তো তোর বাড়িতেই পড়াবি। তবে ওই পাড়া, আটচালা- এই ব্যাপারটা তো আমার এক্তিয়ারের বাইরে। ওই ব্যাপারটা তোকেই সামলাতে হবে। তার জন্যে যদি তোর সাথে আমাকে যেতে হয়, আমি রাজি আছি। চলে যাব।”
    অলোকার কথায় সায় দিয়ে সনাতন বলল,“ঠিক আছে দিদি। পাড়া আটচালার দিকটা আমি দেখছি। আর তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আশাকরি চেষ্টা জারি রাখলে আমি সফল হব।”
    সনাতন প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে তার বাবা রতনের সঙ্গে আলোচনা করল। ওর বাবা বলল,“টিউশনি পড়াবি, সেটা তো ভাল কথা। এতে বুদ্ধি চকচকে হয়। পুরোনো পড়া চর্চায় না থাকলে পুরোনো লোহার মত তাতে জঙ লাগে। জঙধরা লোহা ক্রমাগত ঘষতে ঘষতে যেমন চকচকে হয়ে যায়, তেমনটা আরকি। একমাত্র টিউশানিই স্মৃতির সেই জঙ ঘষে মেজে ঝাঁ চকচকে করে তুলতে পারে। তাতে হবে কি, তুমি যখন উঁচু ক্লাসে উঠবে সেটা কাজে লাগবে। সে তো এক কথা। কিন্তু মেয়েদের পড়ানো নিয়েই তোমার বেলায় চিন্তা তো থেকেই যায়। তা একটা কথা বলি বাবা, পড়ানো শুরু করার আগে বিষয়টার একটা ফয়সালা করে নেওয়া সঠিক কাজ হবে। আমি নিজে সরাসরি বললে ওরা ভাববে নিজের ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছে। অন্য কেউ হলে বেঁকে বসতো। তাই তুমিই যাবে। তুমি যাবে নন্দ কাকার কাছে। সুবোধ কাকার কাছে। আর যাবে নিত্যানন্দ আর দিবাকরের কাছে। কাউকেই বিস্তারিত কিছু বলতে হবে না। শুধু বলবে, আপনারা অনুমতি দিলে আমি পাড়ার মেধাবী কয়েকটা মেয়ের পড়াতে পারি। তাদের বাবা-মা আমাকে খুব করে অনুরোধ করছে। এবার পাড়ার আপনাদের মত সম্মানীয় মানুষদের অনুমতি ছাড়া আমি ছেলে হয়ে কেমন করে মেয়েদের পড়াতে পারি। তারপর পাড়ার অন্য লোক এই নিয়ে যদি নিন্দেমন্দ কোন কথা বলে তাহলে মেয়েদের গায়ে বদনামের কালি লেগে যাবে। সেটা তো ঠিক কাজ হবে না তাই। দেখবে, এই কথা বললে ওরা নিজেরা মনে মনে গর্ব বোধ করবে। কোন দ্বিধা না রেখে তোমাকে আশীর্বাদ দিয়ে দেবে। ওদের নাড়ির গতি আমার খুব ভাল করে জানা। তারপরও অবশ্য পাড়ায় যারা সবসময় মানুষের খুঁত ধরে বেড়ায় তাদের চপচপানি এড়ানো যাবে না। সেটা বন্ধ করতে তখন আর আমাদের কাঠখড় পোড়াতে হবে না। এই মুরুব্বিরাই সব সামলে নেবে। নিন্দেমন্দের কালো পাঁক-জল বেশিদূর গড়াতে দেবে না।”
    বাড়ির বড়রা যে সত্যিই মাথার উপর ছাদ। সনাতন তার বাবাকে দিয়ে প্রমাণ পেল। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। পাড়ার সিনিয়র মানুষদের অনুমতি নিয়ে সে তাদের বাড়িতেই মেয়েদের পড়ানো শুরু করে দিল। এদিকে যখন সনাতন পাড়া সামলাচ্ছে, ওদিকে অলোকাদি মেয়েদের দিকটা একদম ঠিকঠাক ভাবে সামলে দিয়েছে। খুশি মনে অলোকাদি তাকে বলেছে,“কি জানিস, আসলে ছেলেটা যেহেতু সনাতন রুইদাস, তাই আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমার অতিরিক্ত কোন মেহনত করতে হল না। প্রত্যেক গার্জেন আমার প্রত্যেকটা কথা অত্যন্ত খুশি মনে মেনে নিয়েছে। মানুষ যে তোকে এতটা স্নেহের এবং ভালোবাসার চোখে দেখে তা জানা ছিল না আমার। তুইও জানিস না। তোর জানার দরকারও নেই। তুই তোর মত থাক। যাক! তবে গার্জেনরা একটা কথা বলেছে, সনাতন যেন ওই ব্যাচটায় অন্তত কোন ছেলেকে না পড়ায়। ওটা মেয়েদেরই ব্যাচ হিসেবে পড়ায়। তার উত্তরে আমি বলেছি,“এই একটাই ব্যাচ ও পড়াবে, তাও আমার অনুরোধে। টিউশনি ও পড়ায় না। ওর হাতে অত সময়ও নেই। সামনে ওর নিজেরই এইচ.এস. পরীক্ষা। সময় কোথায় অত ওর। তারপর বাবাকে সাহায্য করার জন্যে বাবার দোকানে ওকে নিত্য বসতে হয়।” এরপর কয়েকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে অলোকা আবার বলল, “এবার আমি নিশ্চিন্ত মনে সারদা মন্দিরে পড়তে যেতে পারব। আমার মনটা এত হাল্কা লাগছে যে কি বলব।”
    নাইনের দুটো মেয়ে আশাতীত ভাল রেজাল্ট করে ক্লাস টেনে উঠেছে। আর অন্য যে দু’জন টেনে পড়ে তারা টেস্ট পরীক্ষায় এক চান্সে উতরে গিয়েছে
    যথেষ্ট ভাল নম্বর নিয়ে। এদের সকলের গার্জেন দারুণ খুশি মেয়েরা এতটা উন্নতি করায়। গার্জেনরা বলে, সনাতনের হাতে পড়ে মেয়েরা এতটা ভাল ফল করতে পারল। সংবাদটা অলোকাদির কানেও যায়। সনাতনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে অলোকাদি। সেই কথাটা বিপ্লবদার মাধ্যমে জেনেছে সে। বিপ্লবদা বলে,“এখন তো তোরই জয়জয়কার রে সনাতন। ওই চারটে মেয়ের বাবারা তো পাড়া মাত করে বেড়াচ্ছে তোর পড়ানোর গুনের কথা বলে। আমারও কানে এসেছে।” খুশিতে সনাতন বলল,“আমি আমার সাধ্যমত যতটা পারি ওদের কোচিং দিয়েছি। ওরা সেগুলো ধরতে পেরেছে বলেই তো পরীক্ষায় ঠিকঠাক লিখেছে। আমার থেকে যোগ্যতা ওদেরই বেশি। তাই বাহবা যদি পেতেই হয় তাহলে সেটা প্রাপ্য মেয়েদেরই।”
    সুন্দরী নাইন থেকে টেনে উঠেছে। এবারও সে সনাতন স্যারের কাছে পড়বে। ওর বাবা চেয়েছিল, যেহেতু মেয়ে পরের বছর মাধ্যমিক দেবে, তাই স্কুলের অভিজ্ঞ মাস্টারের কাছে টিউশনি পড়ানোর জন্যে। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসে। সে তার বাবাকে বলে,“সনাতন স্যারের মত অত গুছিয়ে সুন্দর করে স্কুলের কোন মাস্টার পড়াতে পারে না। স্যার একবার বুঝিয়ে দিলে মাথার মধ্যে একদম গেঁথে থাকে সেই পড়া। আর স্কুলের যে স্যারের কথা তুমি বলছো, ও স্যার তো নিজের মত হুড়মুড়িয়ে বকর বকর করে চলে যায়। ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টা বুঝলো কি না বুঝলো সে দিকে নজর তার থাকে না। পড়াও তেমন ধরতে চায় না। আবার পরের দিন অন্য চ্যাপ্টারে চলে গেল। কেউ যদি নিজে থেকে না-বুঝতে পারা কোন বিষয় নিয়ে জানতে চায় তখনও একই ঢঙে বলবে, এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো? তারপর বকার ভয়ে কেউ সাহস করে বলে না যে ‘বুঝতে পারেনি।’ এমন স্যারের কাছে পড়লে আমার ভাল রেজাল্ট কিছুতেই হবে না। তুমি ওই স্যারের কাছে আমাকে টিউশনি পড়তে যেতে বোলো না বাবা। সনাতন স্যারের কাছে যেমন পড়ছি, তেমন পড়তে চাই। এই স্যারই আমার কাছে ঠিক আছে।” সুন্দরীর অন্য বন্ধুটা সনাতন স্যারের কাছ থেকে ছেড়ে গিয়ে ওই স্কুলের স্যারের কাছেই প্রাইভেট পড়তে গেল। আর যে দু’জন মাধ্যমিক ফাইনাল দেবে, টেস্ট পরীক্ষার পর তারা আর বিশেষ আসে না। মাঝে সাঝে কোথাও আটকালে দেখে নিয়ে যায়। সনাতন নিজে থেকেই বলেছে, তাদের প্রয়োজন হলে কোন দ্বিধা না করে যেকোন ডাউট ক্লিয়ার করে যেতে।
    একজন ছাত্রীর জন্যে তার এতটা সময় ব্যয় করা কতটা সঠিক হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সনাতন। এতে এমনিতেই নিজের পড়ার টাইম কাটতে হয় তাকে। তাও, চারজন ছিল বলে মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু একজনের জন্যে সেটা করা তো মুশকিল। সুন্দরীকে বলেছিল সে যে, তার একার জন্যে এতটা সময় ব্যয় করা সম্ভব নয়। সে যেন অন্য কোথাও খোঁজ খবর করে ভাল স্যার দেখে চলে যায়।
    মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে এমন কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না সুন্দরী। আকাশ থেকে পড়ার মত বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,“আপনি আমাকে পড়াবেন না স্যার? আমি তাহলে কোথায় যাব? বাবা তো আমাকে স্কুলের ইংরেজী স্যারের কাছে পড়তে বলেছিল। আমি যেতে রাজি হইনি, আপনার কাছে পড়বো বলে। বাবা বলে দিলে হয়তো এখনও গেলে সেখানে ভর্তি হতে পারব। কিন্তু আমি সেখানে যাব না। আপনি যদি আমাকে না পড়ান তো আমি পড়া ছেড়ে দেব।” বলে ফোঁসফোঁসিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সেই শুরু আর যেন শেষ হতে চায় না! ফোঁসফোঁসানি শব্দ অবশেষে বন্ধ হলে কি হবে সমানে আন্দোলিত হতে থাকা দু’বুক জানান দিচ্ছে, তার ভেতরের কান্না তখনও সমানে জারি রয়েছে। সেই অন্দোলনকে আপাতত দমন করার জন্যে সনাতন অবশেষে বলতে বাধ্য হল যে,“ঠিক আছে। এখন তুমি চুপ করো। আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়। তুমি যেমন মাধ্যমিক দেবে সামনের বছর। আমি তেমনি এই বছরই উচ্চমাধ্যমিক দেব। আমারও তো পড়ার টাইমটা বার করতে হবে। অলোকাদি তোমাদের পড়ার মাঝপথে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল বলে সেই গ্যাপটা আমি পূরণ করার জন্যে তোমাদের পড়াতে রাজি হয়েছিলাম। তার মানে তো এই নয় যে, আমি পেশাগতভাবে পড়াতেই থাকব। তারপর তোমার একার জন্যে আমার সময় কাটিয়ে দেব কেমন করে সেটাই তো ভেবে উঠতে পারছি না। আবার তুমি বলছো, আমি না পড়ালে পড়া ছেড়ে দেবে। এটাও তো বোকা বোকা সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কোন মানে হয় না। আমাকে দু’চারদিন সময় দাও। তারপর আমি তোমাকে না হয় ফাইনাল জানিয়ে দেব।”
    ইতিমধ্যে সনাতন মাস্টারের ছাত্রীরা আশাতীত রেজাল্ট যে করেছে সেটা ছাত্র সমাজে চাউর হয়ে গেছে। তারপর চাউর হয়েছে তার অমায়িক ভদ্র আচরণের প্রসঙ্গও। অভিভাবক মহলেও সেটা বেশ প্রচার পেয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে একের পর এক গার্জেন সনাতনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে। এমনকি বাজারে সনাতনের বাবার দোকানেও তার সঙ্গে অনেকে দেখা করতে আসে, তার মেয়েকে পড়াতে চেয়ে। সনাতনের বাবা, রতন এতে বেশ খুশি বোধ করে। তার ছেলের কাছে কত ভদ্রলোকেরা এসে অনুরোধ করছে, তাদের মেয়েদের পড়াবার জন্যে। এটা কি কম ভাললাগার ব্যাপার ! আবেগে ছেলেকে জিজ্ঞেস না করেই রতন কাউকে কাউকে বলে দেয়, তার ছেলে পড়াবে। আমি বলে দেবো’খন, তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। বাবার কাছ থেকে পরে শুনে সনাতন একটু দ্বিধা বোধ করে, কিন্তু গুরুজন, বাবাকে কিছু বলে না। ও বোঝে বাবা চাইছে সে পড়াক। সংসারে কিছু আয় বাড়ুক। অবশেষে একরকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় সে। রাজি হয়ে যায় পড়াতে। সুন্দরীকেও সেটা জানিয়ে দিতে তার সে কি আনন্দ! সুন্দরীর আনন্দের এতটা বহিঃপ্রকাশ দেখে থমকে যায় সনাতন! অন্য ভাবনা মনের মধ্যে না প্রশ্রয় দিয়ে এড়িয়ে যায় সুন্দরীর তার অতি-আগ্রহপনা ভাবনাকে। এক এক করে সুন্দরীকে নিয়ে ছয়জন ছাত্রী হয়ে যায়। তিনজন ছাত্রও আসে পড়ার প্রস্তাব নিয়ে। সনাতন এককথায় তাদের ফিরিয়ে দেয়,“মেয়েদের ব্যাচের সঙ্গে ছেলেদের আমি পড়াই না। আর ছেলেদের জন্যে আলাদা ব্যাচ খোলার আমার কোন অভিপ্রায় নেই। তাহলে আমার নিজের পড়ার দফারফা হয়ে যাবে। নিজের ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। উচিৎ ও নয়।” তাদের নিরাশ করতে বাধ্য হয়েছে সনাতন।
    সনাতন স্যারের কাছে পুরোনো ছাত্রী সুন্দরী। তাই এখানে সে অন্য সকলের থেকে বেশি সপ্রতিভ। ভাবটা এমন দেখায়, স্যারের প্রতি তার আধিপত্য অন্যদের থেকে বেশি। তাই আবদারের বহরও চোখে পড়ার মত। সনাতনের একটা সুবিধা হয়েছে, সব ছাত্রীই ক্লাস টেনের। ভিন্ন ক্লাসের হলে যে পড়া আলাদা আলাদা করে দেখাতে হত তার। তবে একা সুন্দরীর দাপটে তার যেন নাজেহাল হবার উপক্রম। সুন্দরী তাদের পাড়ার মেয়ে। সনাতনদের চারটে বাড়ির পরে তাদের বাড়ি। যে চ্যাপ্টারের পড়া আগের দিন শেষ করে দিয়েছে। পরের দিন নতুন পড়া ধরার কথা, হঠাৎ সুন্দরী বলে বসলো,“স্যার আগের পড়াটা আর একবার ঝালিয়ে দিন। আমার বুঝতে একটু খটমট লাগছে। ও বুঝে গেছে যে স্যারকে এটা বললে স্যার সেটা ক্লিয়ার না করে নতুন পড়ায় যাবে না। অন্য ছাত্রীদের ইচ্ছা নতুনে যাবার। সুন্দরী তা মানতে নারাজ। জোর খাটাতে থাকে স্যারের উপর। অগত্যা অন্যদের বুঝিয়ে স্যার বাধ্য হয় পুরোনোকে ঘষামাজা করতে।
    সেবার পরপর দু’দিন পড়ানো বন্ধ ছিল। সনাতন স্যারের পেটের গন্ডগোল। সুন্দরী, স্যারের মায়ের কাছ থেকে জেনেছে স্যারের ডিসেন্ট্রি হয়েছে। শোনামাত্রই দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে আধঘন্টার মধ্যে একপাঁজা ‘থানকুনি পাতা’ এনে সনাতনের মায়ের হাতে দিয়ে বলে,“এর রস স্যারকে খাওয়াবে কাকিমা। আর থানকুনি পাতার ঝোল করে দেবে। আমার মা বলেছিল, কয়েকবার খেলেই এতে আমাশয় ধরে যাবে। স্যারের কষ্ট কমে যাবে!” বলে সঙ্গে সঙ্গে টানা দৌড় দিয়ে চলে যায় তাদের বাড়ির দিকে। সুন্দরীর এই আচরণে সনাতনের মা হাঁ করে একগাদা প্রশ্ন-মুখে দৌড়তে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

    ক্রমশ…. 

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র(১৭)

    জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

    [ছত্রিশ]
    সারাদিন চাষের কাজ সেরে দু’পক্ষই- মালিক আর হেলো-জনমজুর সকলে বাজারে উঠে পরদিন কোথায় কি কাজ হবে সেইসব দরকারি কথাবার্তা সারে। তারপর চা দোকানে চা খেতে খেতে একটু আড্ডা দিয়ে আবার সবর সবর যে যার বাড়ি ফিরে যায়। আড্ডা দিতে দিতে বেশি রাত করলে পরদিন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। এই কাজের সময় চাষী মজুররা সেটা করতে চায় না।

    আজকের দুপুরের ভাগাড়ের ঘটনাটা মাথাতেই ছিল না সুধার। হঠাৎ চা দোকানে যতন রুইদাসকে দেখে স্মৃতি চাগাড় দিয়ে উঠতে আগ্ৰহ নিয়ে কথাটা পাড়লো সুধা, “হ্যাঁ রে যতন, বাবলা তোর ছেলের নাম?” হঠাৎ সুধার মুখে তার ছেলে বাবলার নাম শুনে অবাক হয়েই গেল যতন। বাবলার নাম এই সুধা-হেলো জানল কেমন করে? ওকে তো এখানকার বেশিরভাগ লোকেরই চেনার কথা না। বাবলা এখানে খুব কমই থাকে। মনে প্রশ্ন নিয়ে যতন বলল, “হ্যাঁ,বাবলা আমার ছেলে ছেলে। তা তুমি কি করে আমার ছেলেকে চিনলে সুধা-দা? আবার ও আমার ছেলে তাও নিশ্চিত হয়ে বলছো। কেন, ওর সঙ্গে তোমার আবার কোন ঝামেলা টামেলা হয়েছে নাকি? বাবলা তো ঝামেলা পাকানোর ছেলে নয়! কেন, কি হয়েছে আমাকে বলবে?”
    -আরে বাবা, তুই অত উতলা হচ্ছিস কেন? আমার কথা শুনে তোর কি মনে হল, তোর ছেলের সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছে? তা হতে যাবে কেন। তুই একদম ঠিক কথাই বলেছিস, তোর ওই ছেলে, কারোর সঙ্গে কোন ঝামেলা পাকানোর ছেলে নয়। ঠান্ডা মাথায় চুপিসাড়ে নিজের কাজ হাসিল করে কেটে পড়ায় চোস্ত তোর ছেলে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে হাসিল করতে যেখানে যেমন করা দরকার তা করতে ওর জুড়ি মেলা ভার। একদম বেড়াল-তপস্বীর মত- যেখানে চুপচাপ থাকা দরকার তো সেখানে ওর মত শান্তশিষ্ট ছেলে আর হয় না। আর যেখানে শিকারির ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন সেখানে অত দ্রুত কাজ সারা, ওরে বাপরে বাপ! না দেখলে কারোর বিশ্বাস করানো মুশকিল। সেটা আজ আমার দুটো জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে দেখলাম। একটা গাঁয়ের ছেলে যে একাধারে এত ধীরস্থির আবার এতটা তরতরে হতে পারে, তা আমি এই তোর ছেলেকে প্রথম দেখলাম। তা তোর ছেলে গরুর পেট কেটে ওই কটকটে হলদেটে পাথরের মত একগুচ্ছ জিনিস নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমাদের ভাগাড় থেকে তোদের বাড়ির পানে ছুটলো! কি ওগুলো রে, যতন? চোখে মুখে কৌতূহল ঠিকরে বার করে সুধা বলল।
    -তা তো আমি জানি না, দাদা। ও ছেলে কখন কোথায় কি করে, কবে কোথায় থাকে না-থাকে তা আমি বলতে পারবো না। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ বাড়ি এলো। মায়ের সঙ্গে কি-সব ফুসফুস গুজগুজ করল। কিছু টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দিল। আবার কখন দেখলাম বাড়ি নেই! বাবলার কাজকারবারের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। আগে তো বাড়ি আসতই না। এই বছর খানেক হল বাড়ি আসা-যাওয়া করছে। চোখের সামনে নিজের ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি, এটাই আমার সান্ত্বনা।
    -ছেলেটা তো দেখে মনে হল আঠেরো-কুড়ির মত বয়স। তা ও এখানে থাকে না তো থাকে কোথায়?
    -মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায় ওর মামারবাড়িতে ও মানুষ। আমার রতন-দার শ্বশুর বাড়ির দু’একটা ঘর পরেই আমার শ্বশুরবাড়ি। বৌদিই আমার এই সম্বন্ধটা পাকা করে দিয়েছিল। মায়ের বুকের দুধ-ছাড়ার বয়স থেকেই ছেলে ওখানে থেকে যায়। ওকে ওর দাদুর কি চোখে লেগে যায়, মেয়েকে বলে, “তোর ছেলেটাকে আমি মানুষ করবো। তোর কোন খরচা-খারচি করতে হবে না। আমাদের যা আয়-পয় আছে, তাতে আমার নাতিকে মানুষ করতে অসুবিধা হবে না।
    -সে তো তাহলে বলতে হবে তোর পাতা-চাপা কপাল রে যতন। ছেলে পয়দা করলি অথচ তার খাওয়া-পরার দায় তোকে নিতে হল না। এমন ভাগ্য ক’জনের হয়। তা নাতিকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, দাদু? নাহলে কেবল খেতে পরতে দিতে আর ঝক্কি কিসের। ও অনেকেই করতে পারে।
    -না গো সুধা-দা। বুড়ো, ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছে। মাধ্যমিক পাশ, আমার বাবলা। বুড়োর ইচ্ছে ছিল নাতিকে আরও পড়াবে। কিন্তু বিধাতা নারাজ হলে নগণ্য মানুষের আর কি করার আছে। হঠাৎ করে বুকের ধুকপুকুনি থেমে গেল বুড়োটার। ডাক্তার দেখানোরও সময় দিল না। বড় দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। তখন আমরা বাবলাকে বললাম,“বাড়িতে চলে আয় খোকা। দাদু নেই। এবার তোর মামা-মামী তোকে পালতে চাইবে না। তোকে নিয়ে ওদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আয়। তাতে মামাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকবে। লোকের সংসারে আজকাল তো দেখছি, কি হচ্ছে সব।”
    -ঠিকই প্রস্তাব দিয়েছিলিস তুই। মামা কিছু না বললেও, মামী তো পরের বাড়ির মেয়ে। সে মেনে নিতে নাও পারে। সমাজে যেন সব রোগ ধরে গেছে। ভালোবেসে পরের দায় কেউ নিতে চায় না। তার উপর ভাগনার সম্পর্কের কেউ।
    -তা একদম তুমি ভুল কথা বলোনি গো সুধা-দা। সেই কথা উঠেছিল। তা আমার শাশুড়ি-মা কিছুতেই বাবলাকে ছাড়তে চাইল না। ছেলে-বউমাকে বলল, “আমার স্বামী বাবলাকে ভালবেসে এখানে রেখেছে। সেই গুড়বেলা মানে ছোটবেলা থেকে আমি ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি বেঁচে থাকতে ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবো না। তা ও বড় হয়েছে। ও যদি নিজে থেকে চলে যায় সেটা অন্য কথা। আমার বুক ফাটবে ঠিকই কিন্তু তখন আমার আর বাধা দেবার অধিকার থাকবে না। বাবলার খাওয়া পরার জন্যে তোদের চিন্তা করতে হবে না। এই গরু-বাছুর থেকে আমার যা আয় হয় তাতে আমাদের দুই দিদিমা-নাতির ভালভাবে চলে যাবে। তোদের সংসার নিয়ে তোরা থাক। আমরা আলাদা হাঁড়ি করে নিচ্ছি।” বুড়ি তাই করল। আর ছেলেও দিদিমাকে এত ভালবাসে, কিছুতেই ওখান থেকে আসতে চাইল না। কিন্তু লেখাপড়াটা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না ছেলেটা। দিদিমার অত ক্ষমতা ছিল না।
    -তা তোর শাশুড়ি বেশ তেজী মহিলা বলতে হবে?
    -হ্যাঁ, খুব চৌখোশ আর জেদি মহিলা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে, বুড়ির সেই তেজ মরে গেল একটা দুঃখজনক ঘটনায়। হঠাৎ একমাস পিঠোপিঠি বুড়ির দু-দুটো গাইগরু অজানা রোগে মরে গেল! বিডিওর ডাক্তার এসে কিচ্ছু করতে পারল না। তারা রোগই ধরতে পারল না! এইসব ডাক্তার পড়ে পাশ করেছে না টুকে কে জানে। রোগির রোগ ধরতে পারবে না তো সে কেমন ডাক্তার? ওই গরুর দুধ বিক্রির টাকাতেই তো বুড়ির যত নফর -চফর। এই পরিস্থিতিতে বুড়ির ঘাড়ের উপর বসে খাওয়া তো ঠিক না। তাই ছেলেকে আবার বললাম, “বাবলা, তুই এবার বাড়ি ফিরে আয়ে। তুই ওখানে থাকলে, তোকে নিয়ে দিদিমা বিপদে পড়বে। তার চাইতে তুই চলে এলে তোর দিদিমা তার আলাদা সংসারের হাঁড়ি তুলে দিয়ে ছেলে-বউয়ের সংসারে ঢুকে পড়তে পারবে।” কিন্তু ছেলে তো আমার কথার একদম উল্টো কথা বলল, “কি বলছো তুমি বাবা? দিদিমা আমাকে এত বড় করে তুলল। এখনো তার আঁচলের ওমে আমাকে রেখেছে। আর এখন দিদিমার খারাপ সময়ে আমি তাকে ছেড়ে স্বার্থপরের মত চলে যাব? তখন তো মামারাই বলবে, দেখলে তো মা, এইজন্যেই লোকে বলে- জন-মামাই-ভাগনা, তিন নয় আপনা। এই কথার জিন অর্থাৎ মর্মার্থ আমি ভেঙে তছনছ করে দেব। এ’কথাটা যে আমার কাছে কত ফালতু কথা, তা সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব। দিদিমাকে আমি কিছুতেই মামা-মামীর বোঝা করে রাখতে দেব না।”
    -তা তোর ছেলে তো তখন বেকার। কি করে সে দু’জনের সংসার সামলালো? মুখে বড় বড় কথা বলা আর কাজে তা দেখিয়ে দেওয়া তো এক কথা না।
    -হ্যাঁ। ঠিক তাই। কাজ করেই সে দেখিয়ে দিল। আমি ভাবতে পারিনি আমার ছেলেটা এতটা গোঁয়ার। জেদ করে বসল, তাকে যেভাবেই হোক সৎ পথে রোজগার করতে হবে। দিদিমার কষ্ট সে দেখতে পারবে না। আর যা ভাবা তাই কাজ। ওর খেলাবয়সের দু’জন বন্ধু ট্রেনে হকারি করতো। সেই বন্ধুদের সাহায্যে সেও ট্রেনে হকারির কাজে লেগে পড়ল। প্রথম প্রথম কষ্ট হত। অসুবিধাও হত। ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হত অন্য হকারদের সঙ্গে। এই বন্ধুরাই আবার তা সামলে দিত। আসলে এইসব লাইনে নতুন কেউ ঢুকলে, মাটি কামড়ে না থাকতে পারলে পুরোনোরা তাকে খেদিয়ে দেবে। পুরোনোদের জমিতে হুট করে নতুন একজন ঢুকে তাদের রোজগারে ভাগ বসাবে আর তারা চুপ থেকে মেনে নেবে তা হতে দেবে না। নতুনকে যথেষ্ট লড়াই করে নিজের পায়ের তলার মাটি জোগাড় করে নিতে হয়। নতুন জীবনটা ছেলে কিছুদিনের মধ্যে রপ্ত করে নিল। দিদিমা-নাতির সংসারে অসুবিধা তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু উপরওয়ালার ডাকে দিদিমাও তার দাদুর কাছে চলে গেল। দাদু-দিদিমার গোলকভূমে যাবার ফারাকটা বেশিদিন ছিল না। বছর দেড়েক হবে। মামার বাড়িতে বাবলা একা হয়ে গেল। এবার নিজে থেকেই আস্তে আস্তে বাড়ি আসা শুরু করে। তবে পাকাপাকিভাবে না। এত বছরের জীবন যেখানে কেটেছে, তার মায়া সে ত্যাগ করে কেমন করে। ওর রোজগারের জায়গা, বন্ধু-বান্ধব সবই তো ওখানে। ওখানে সে দেড়-কামরার একটা ঘরও বানিয়েছে। তার জন্যে আমরা তাকে কিছু বলি না। ও যেটা ভাল মনে করবে তাই করবে। ওখানে ঘরটা থাকলে ওর মায়েরও বাপেরবাড়ি গিয়ে থাকার একটা নিজস্ব ঠাঁইও মেলে। আমিও যাই শ্বশুরবাড়িতে নিজের ঘরে থেকে আসি দিন কতক করে। একটু থেমে যতন আবার বলল, “এবার উঠি গো সুধা-দা। কথায় কথায় আমার অনেক কথা তোমাকে বলে ফেললুম। হঠাৎ ছেলের কথা তুললে। ছেলে-কাহানি শুনিয়ে দিলাম তোমাকে। বলতে বলতে রাত বেড়ে গেল। কাল আবার ভোর ভোর বিছানা ছাড়তে না পারলে কাজে বেলা হয়ে যাবে।”
    -চায়ের দাম তোকে দিতে হবে না যতন। যাবার সময় প্রদ্যুৎকে বলে যা, তোর এই চায়ের দামটা আমি দিয়ে দেব। একটু পরে আমরাও চলে যাব। সুধা বলল।
    দিঘিরপাড় বাজার থেকে বাড়ির পথে যেতে যেতে যতনের মনে পড়ল, সকালে সুধা-দার ছেতো ওই ভূপাল পাড়ায় খবর দিতে এসেছিল ভাগাড়ে গরু পড়েছে বলে। যতন শুনেছে। কিন্তু ওসব কাজ ও আর করে না বলে গা-করেনি সে কথায়। তারপরই অবশ্য ও দেখেছে বাবলা বাড়ি থেকে বার হয়ে গুটি গুটি পায়ে ভূপালের পেছন পেছন চলেছে। বাবলা তো আর গরুর চামড়ার কাজ করে না। তাই সে ছেলের যাওয়ার ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। ভাবল, অন্য
    কোন কাজে ও বাইরে বেরোচ্ছে। ও যে সত্যি সত্যি ভাগাড়মুখো হচ্ছে তা যতন কল্পনাই করতে পারে নি। এখন সুধা-দার মুখে গল্প শুনে বুঝলো। বাড়িতে গিয়ে বাবলাকে জিজ্ঞেস করবে সে, ওই কালচে হলদে রঙের পাথরগুলো কি? গরুর পেট থেকে নাকি সে বার করেছে ওগুলো। প্রায় জীবনভর যতনরা গরু নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করল, কোনদিন তো শোনেনি যে গরুর পেটে ওইরকম রঙিন পাথর থাকে ! তাও আবার সেগুলো নেবার জন্যে মানুষ ছুটে যায়! নিশ্চয়ই এগুলো কোন কাজের জিনিস। এবং দামী। সেটা বাবলা কোনভাবে জেনেছে। এখনো পর্যন্ত পাড়ার কোন মুচি এই পাথরের ব্যাপারটা জানে না তা সে হলফ করে বলতে পারে। জানলে চামড়ার ভাগ নেবার মত ওই পাথর ভাগ পাওয়ার জন্যে ছেঁড়াছেঁড়ি করতো ওরা। পয়সার গন্ধ পেলে কে-না তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যতনও চুপ থাকতো না। তা এমন গোপনীয় জিনিসের কথা বাবলা বা ফেচকাতে যাবে কেন! কাউকে না জানিয়ে সে তো বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।
    বাড়িতে গিয়ে যতন ছেলের খোঁজ করলে ওর মা বলল, “সে খেয়েদেয়ে শুতে চলে গেছে।” একই বিছানায় ওরা বাপ-বেটা শোয়। খাওয়া সেরে যতন শুতে চলে গেল। বাবলা তখনও শুতে যায়নি। ছোট্ট পালিশহীন ফেরিওয়ালা- টেবিলের সামনে টুলের ওপর বসে কাগজ-টাগজ নিয়ে কিসব করছে। যতন বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করল, “কিরে বাপ। শুবি না? রাত হয়ে যাচ্ছে। আয় শুয়ে পড়। তুই শুলে তবে মশারি টাঙাতে পারব। যা মশার উৎপাত হয়েছে আজকাল!”
    -তুমি মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়ো বাবা। আমি একটু পরে শুচ্ছি। তোমার আবার সক্কালে উঠে কাজে বেরোতে হবে। এই হাতের কাজটা সেরে নিই। তারপর।
    -হ্যাঁরে খোকা,একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ইতস্তত করে যতন বলল। সঙ্গে সঙ্গে বাবলা বলল,“কি, বলো-না বাবা।”
    -দৌলতপুরের সুধা-হেলো বলছিল তুই নাকি আজ কাউকে না জানিয়ে একদম গোপনে ভাগাড়ে গরুর পেট থেকে কিসব পাথর-টাথর বার করে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিস? বাজারে দেখা হতে সে তো আমাকে চেপে ধরেছে। তুই কি জিনিস নিয়ে চলে এলি, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছে। তা আমি তো তার কথা শুনে অবাক ! ‘কিছুই জানি না’ বলতে সে আমার কথা বিশ্বাস করল না। মুখে কিছু বলল না। তবে হাবভাবে বুঝিয়ে দিল, আমি তাকে গোপন করছি। কিন্তু সত্যি তো আমি কিছুই জানিনা।”
    যতনের কথায় দেরি না করে ওর ফোমের সাইড ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া পাথরগুলো বাবাকে দেখাল, বাবলা। বলল, “দেখো বাবা, গরুর পেটে এগুলো থাকে। তবে সব গরুর পেটে আবার পাওয়া যায় না। কোন গরুর পেটে এগুলো থাকবে আর কার পেটে থাকবে না তা সাধারণভাবে কেউ বলতে পারবে না। ভাগ্য জোরে আজ আমি এই গরুর মধ্যে পেয়ে গেছি। না হলে কাটাছেঁড়া করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হত। তবে একটা লক্ষণ আছে, যে লক্ষণটা জানতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যায়, সেই গরুটার পেটে এগুলো পাওয়া যাবেই যাবে। কিন্তু বাইরের কোন লোকের পক্ষে সেই লক্ষণ জানা সম্ভব নয়। লক্ষণটা জানতে পারে একমাত্র সেই বাড়ির মালিক বা যে সেই গরু সবসময় দেখভাল করে সে।
    ছেলের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল! বলে কি এ! গরু সম্পর্কে সে এত জানে? অথচ তার বাপ, গরু ঘেঁটে ঘেঁটে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকলো, কিছুই জানলো না! প্রশ্নমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কি বলে তা শোনার জন্যে। বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলল,“কি সেই লক্ষণ সেটা জানতে চাইছো তো? রাত্রে ঘুমের সময় যে গরু জোরে জোরে নাক ডাকে, দেখা গেছে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই পেটের মধ্যে এমন পাথর আছে। অবশ্য দু-একটার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হয়েছে। পাওয়া যায়নি। সেটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে চলবে। যারা এইসব নিয়ে চর্চা করে তারা গবেষণা করে এটা জানতে পেরেছে। কিন্তু গরুর মালিক বা গরু দেখভাল করা লোকটা তো আর জানে না, নাক ডাকার মধ্যে এমন রহস্য লুকিয়ে আছে! আর বাইরের লোক বা জানবে কেমন করে কোন গরু ঘুমোবার সময় নাক ডাকছে কি ডাকছে না। তাই বাইরের লোক, যারা এইসব পাথর নিয়ে কাজ করে, তাদের আন্দাজেই ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। হয় ছক্কা, নয়তো ফক্কা!”
    যতন এবার ধৈর্য ধরতে না পেরে সরাসরি ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে বাবা, এই পাথরের কি নাম? এর তো একটা নাম কেউ কোন সময় দিয়েছে। আর নিশ্চয়ই পাথরটা বাজারে অনেক দামে বিকোয়? আর একটা কথা বলতো, এটা কি কামে লাগে যে তার এতো দাম? আমার তো জানতে ইচ্ছে করছে।”
    বাবার কথায় এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল বাবলা। বলল, “এগুলো সবই গোপন কথা বাবা। এর কোন উত্তর তোমাকে এখন আমি দিতে পারব না। সময় হলে তোমাকে বলব। এখন তোমাকে বললে তুমি যদি একবার বাইরে ফেচকে দাও তো আমি বিপদে পড়ে যাব। আমার ইনকাম চৌপাট হয়ে যাবে। এইসব কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে না বাবা। এখানকার কেউ যখন জানে না তখন তোমাকেও জানতে হবে না। আমার জানা আমার মধ্যেই থাক।” ছেলের কথার ওপর আর কথা বাড়ালো না যতন। চুপ করে গেল।
    নিত্যকারের মত মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “বেশি রাত করিস না বাবা। সকালে আবার শরীর ম্যাচ ম্যাচ করবে। কাল কি তুই হরিশচন্দ্রপুর যাবি, না থাকবি। যদি যাস তো, তোর মাকে বলতে হবে, সকাল সকাল রান্না বসিয়ে দিতে।” বাবার কথায় বাবলা বলল, “হ্যাঁ বাবা। কাল যাব। তুমি শুয়ে পড়েছো আর উঠতে হবে না। আমি মাকে বলে দিচ্ছি। ওখানকার কাজ সেরে তবে ফিরব। কবে ফিরব আগে থেকে বলতে পারব না।”
    বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে যদি সে ট্রেনের হকারি লাইনে না আসত তাহলে কোনোদিন এই মহা-মূল্যবান বস্তুটার সঙ্গে পরিচয় তার হত না। বাবলা সেইজন্যে তার দুই বন্ধু, সুবোধ আর বিমানের কাছে ঋণী। সেইজন্যে যখনই ওর এই বন্ধুরা কোন অসুবিধায় পড়ে, বাবলা সব কাজ ফেলে ছুটে যায়। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক বন্ধু আছে যারা কেবল সুযোগ সন্ধানে থাকে। কাজ হাসিল হয়ে গেলে কেটে পড়ে। এরা সেইসব বন্ধুর একদম উল্টো। এমন বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের দরকার। বাবলাও তাই তাদের ভোলে না। লেপটে রাখে বন্ধুদের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে।
    তার নিজের তো কোন পুঁজি নেই। অথচ কিছু একটা করতে হবে। হঠাৎ মালদা স্টেশনে সুবোধের সঙ্গে দেখা। সুবোধই প্রথম তাকে দেখতে পায়, “কিরে বাবলা, কোথায় যাচ্ছিস? কতদিন পর তোকে দেখলাম। সেই ক্লাস ফাইভে স্কুল ছাড়লাম। বাবা অভাবের তাড়নায় পড়া ছাড়িয়ে দিল। তোর সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আমরা কেমন ক’জন বন্ধু মিলে আলোচনা করে ক্লাসে পড়া দিতাম। আমি, তুই, বিমান একসঙ্গে খেলাধূলা করতাম। অন্য কেউ আমাদের মারতে এলে বা কিছু বললে আমরা তিনজনে মিলে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কি সুন্দর জীবন ছিল তখন বল? জানিস তো, ওই বিমানও এই ট্রেনে হকারি করে। আমি স্টেশনারী আইটেম আর বিমান আয়ুর্বেধিক ওষুধ। বিমান তো খুব ভালো ভালো কথা বলতে পারে। তাই ওই ওষুধ বিক্রিতে ও এক নম্বর। আমি আবার অত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। আসলে অত বকর বকর আমার পোষায় না। তাই এটা আমি বেছে নিয়েছি। আমি তো হড়হড় করে আমার কথা বলে যাচ্ছি। এবার তোর কথা বল? তুই কদ্দুর লেখাপড়া করলি?”
    -মাধ্যমিক পাশ করেছি। কিন্তু তা করেও তো কোন কাজে আসল না। তার থেকে তোরা অনেক ভাল আছিস। দাদু হঠাৎ করে মারা গেল। সংসারের আয় বন্ধ। দিদিমাকে নিয়ে এখন আমি অথৈ জলে। তাও দিদিমা দুটো গাই গরুর দুধ বেচে কিছু কাঁচা পয়সা আয় করত। তাতেও টুনমুন করে দু’জনের সংসারটা চলছিল। কিন্তু কি রোগে কে জানে, ডাক্তার রোগ ধরতে পারল না। পরপর ক’দিন ছাড়া ছাড়া দুটো গরুই মরে গেল। দিদিমার হাত এখন ফাঁকা ঢনঢন! সংসার আর চলে না। এখন আমাকে কিছু করতে হবে। কি করব বুঝতে পারছি না। হাতে পয়সা নেই যে ব্যবসা করব। ভবঘুরের মত তাই এই স্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খুঁজে বেড়াচ্ছি, যদি কোন ইনকামের সন্ধান পাই।
    -হকারি করবি? অবশ্য তোর মত শিক্ষিত ছেলেকে হকারি করতে বলাটা আমার ঠিক না। তবু বলে ফেললাম। এই ট্রেনে হকারি এমন একটা পেশা না, তুই যা ইচ্ছা নিয়ে ব্যবসা কর। ট্রেন তোকে ফিরিয়ে দেবে না। সারাদিনে কিছু না কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। লোকের করুণা ভিক্ষের থেকে স্বাধীন ব্যবসা তো অনেক সম্মানের রে বাবলা। আমরা সেটা বুঝে গেছি। আর একটা কি জানিস, এতে কোন লজ্জার কিছু নেই। কোন কাজ তো ছোট নয় রে। তারপর একটা কথা কি বলতো, আমরা লোকের পকেট মেরে, চুরি ছিনতাই করে পয়সা কামাচ্ছি না তো ? পেটের দায়ে সৎ উপায়ে পয়সা রোজগারের জন্যে এই পেশায় এসেছি। হ্যাঁ এটা ঠিক, আমরা ‘হকার’ এই তকমা মানুষের মনে সবসময়ই গেঁথে থাকে। ট্রেনের কাজের বাইরে সাধারণ জীবনে, যেমন হাটে বাজারে বা অন্য কোথাও আমাদের দেখলে অন্য কোন সম্বোধনের কথা না ভেবে আমরা পরিচিত ‘হই হকার’ বলে। মানুষ বলবেই, ‘এই ছেলেটা ট্রেনে হকারি করে।’ এই পেশায় এলে সারা জীবন আমাদের পিঠে এই ‘হকার’ নামটা সেঁটে দেওয়া হয়ে যায়। আমাদের যেন আর অন্য কোন সামাজিক পরিচয় থাকে না। আমাদের পেশাটাই আমাদের পরিচয়। সে আর কি করা যাবে। ভাল পরিচয়ের মাদুলি গলায় ঝুলিয়ে থাকলে তো পেট চলবে না।” খানিক থেমে আবার সুবোধ বলল, “তোকে আমাদের লাইনে আসতে বলছি ঠিকই, তবে এখানে ঢোকাও খুব সহজ কাজ না রে বাবলা। তুই ঢুকলেই, যাই নিয়ে তুই কাজ কর, পুরোনো হকারকুল রে-রে করে তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আদাজল খেয়ে তোর তাড়াবার চেষ্টা করবে। যতই তোর কাছে রেলের হকার পাশ থাকুক। অন্যের বেলায় আমরাও করি। আসলে আমরা সবাই ভাবি, নতুন একজন দলে ঢুকল মানে, পুরোনোর কামানোর উপর সে ভাগ বসাতে এল। তাদের পেটে টান পড়ার আশঙ্কায় সব এমন করে। তবে তুই যদি এই দলে ঢুকিস তো অতটা বেগ পেতে তোকে হবে না। যেটা আমরা পেয়েছি। আমাদের আট-দশ জনের একটা গ্রুপ আছে। আমরাই তোকে গার্ড দেব। তবে এমন অনেক আছে যারা তুই আমাদের গ্রুপের বলে নাও চিনতে পারে। তারা তোকে না চেনার জন্যে ঝামেলা পাকাতে পারে। সে আমরা সামলে দেব। বাধা পেলে তুই ঘাবড়ে যাবি না।” কথা বলতে বলতে একটা খদ্দের এসে সুবোধের কাছে ‘নেল কাটার’ চাইলো। ডেলি প্যাসেঞ্জাররা এলাকার সব হকারদের চিনে
    যায়। কার কাছে কি পাওয়া যায় এদের জানা হয়ে যায়। দোকানের মত সরাসরি এদের কাছ থেকে কিনে নেয়। খদ্দেরটাকে ছেড়ে সুবোধ আবার বলল, “আসলে কি জানিস বাবলা, তোর প্রতি আমার একটা ভালোবাসা আছে। তোর জন্যেই আমি ক্লাস ফাইভ পাশ করতে পেরেছিলাম। না তো সেটাও হোত না। মাথা মোটা ছিলাম তো। কিছুই পারতাম না। তোর পাশে আমার সিট পড়েছিল। তোর মনটা এত ভাল, আমি জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে তুই সব আমাকে বলে দিলি। সব বিষয়েই তাই হয়েছিল। তাই তোকে আমি ভুলতে পারিনি। কোনদিন পারবও না। এমন উপাকারি বন্ধু ক’জন হয়, বল না! সেই বন্ধু এখন বিপদে পড়েছে। তার পাশে আমি দাঁড়াবো না ?”
    বাবলা তো কল্পনাই করেনি, দেবদূতের মত সুবোধ এসে তার সামনে হাজির হবে! দিশাহীন জীবন-সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে খড়কুটোর মত সুবোধ এসে তার সামনে হাজির। আর সেটাকে সে আঁকড়ে ধরবে না? না ধরলে যে হারিয়ে যাবে। সে হেরে যাবে। অত সহজে যে হার মানার ছেলে সে নয়। মনকে শক্ত করে সুবোধকে বলল, “আমি হকারি করব। তুই আমাকে সাহায্য কর। তুই যা বলবি তাই করব। কিন্তু কি কারবার করব সেটা তো ভাবতে পারছি না। ব্যবসা করার মত আমার তো কোন পুঁজিই নেই। কারবারে নামতে গেলে অল্প হলেও নিজস্ব কিছু পুঁজি তো লাগবে। সেটাই বা কোথা থেকে জোগাড় করি। দেখি দিদিমার সঙ্গে কথা বলি। তবে এই কাজটাই আমি করব, সুবোধ। তুই আমাকে সাহায্য করিস।”
    -হকারিতে তেমন কোন পুঁজি লাগে না। বিনা পুঁজিতেও কাজ করা যায়। শুধু তোকে ভাবতে হবে কোন মালটা নিয়ে তুই হকারি করবি। সেটা ঠিক করতে পারলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওইটা ঠিক করাই বলতে পারিস বেশ ঝামেলার ব্যাপার। দেখবি যে জিনিস নিয়ে তুই কাজে নামবি হয়তো সেটা অন্য কেউ করছে। তখন তো সে ফুঁসে উঠবেই। আমাদের গ্রুপের লোকও বিরক্ত হতে পারে। তার পেটে লাথ পড়বে। সে ছেড়ে দেবে? দেবে না। ঝামেলাটা তখনই হয়। এমন জিনিস নিয়ে কাজে নামতে হবে, যেটা আমাদের এই এলাকায় কেউ করে না। তাহলে কেচাল কম হবে। তুই বাড়ি যা, বাবলা। আগে তুই তোর দিদিমার সঙ্গে আলোচনা কর। তারপর মন ঠিক করে স্টেশনে আয়। কাজে নামবি যখন ঠিকই করছিস তখন একটা কিছু তো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাবলাকে সাহস দিল সুবোধ।
    পেট যখন নাড়িভুঁড়িকে মোচড় মেরে খাবার চাইবে তখন লেখাপড়া জানার মান নিয়ে বাবুয়ানার কোন মানে হয় না। এভাবে ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। লড়াইয়ের ময়দানে তাকে নামতেই হবে। সুবোধ তাকে যে সাহস দিচ্ছে, প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করছে। বিপদের বন্ধু সুবোধ। চিরকাল তার কাছে সে প্রকৃতই বন্ধু হয়ে থাকবে। এখন কি জিনিস নিয়ে সে হকারি করবে সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। দিদিমার সঙ্গে আলোচনা করে তাকে এগোতে হবে। কথায় বলে ‘তিন মাথা যার, বুদ্ধি নেবে তার।’ বুড়ো মানুষদের পাকা বুদ্ধি। জীবনযুদ্ধের অগাধ অভিজ্ঞতা। দিদিমা একটা পথ তাকে বাতলে দেবে, সেই বিশ্বাস তার আছে। সুবোধের সঙ্গে তার যা যা কথা হয়েছে সবটা দিদিমাকে জানিয়ে বাবলা বলল, “এখন আমি কি করব তুমি বলো না, দিদা? আমার কাছে তো কোন পুঁজি নেই। আর কি কারবার করব তাও তো বুঝতে পারছি না। সেটা আগে ঠিক করলে তবে না পুঁজির ধারণা করা যেতে পারে?”
    সুবোধের কথায় খানিক চিন্তা করে দিদিমা বলল, “তুই দাদা এত খাটাখাটনি করতে যাবি কেন। আমি এই বুড়ো পেটটা যেভাবেই হোক চালিয়ে নেব। তুই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা। সেখানে তোর মা-বাবা আছে। নিজেদের সংসারে চলে গেলে এখন আর তোর রোজগারের চিন্তা সেইসঙ্গে পেটের চিন্তা করতে হবে না। কচি ছেলে তুই। তোর কি এখন পয়সা কামাবার বয়স হয়েছে? যা, চলে যা তুই তোর নিজের ঘরে।”
    দিদিমার কথায় রেগে ‘কাঁই’ হয়ে যায় বাবলা! চোখ বড়বড় করে বলে,“দিদা, তুমি আমাকে এতই অকৃতজ্ঞ ভাবো? সেই একটুকখানি বয়স থেকে তুমি-দাদু মিলে আমাকে মানুষ করলে। দাদু চলে গেল। তুমি আমাকে জড়িয়ে বেঁচে আছো। আর আমি, তোমার সেই শেষ অবলম্বন, তোমাকে ফেলে রেখে স্বার্থপরের মত পালিয়ে যাব? কে বলেছে তোমাকে যে আমি এখন খাটাখাটনি করতে পারব না? ওই সুবোধ ছেলেটা। ও তো আমার সহপাঠী ছিল। সমবয়সী আমরা। সুবোধ পারলে আমি পারব না কেন? এ তুমি কেমন কথা বললে, দিদা?”

    ক্রমশ…

  • গল্প

    গল্প- মরিচিকা

    মরিচিকা

    -মুনমুন রাহা

     

     

    অন্তু আজ বড় ব্যাস্ত। এবাড়ির কর্তা অর্থাত অন্তুর বিপিন মামা মেয়ে ঝুমুরের বিয়ে আজ।তিনি বড় ভরসা করেন অন্তুর উপর। অন্তুও যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে খুশি রাখার। করারই কথা বিপিন মামা বড় বিপদের সময় আশ্রয় দেন অন্তুকে। অন্তু সে ঋণ কোনদিন ভুলতে পারে নি। তাই তো আজ সানাইয়ের শব্দটা যতই তেতো লাগুক এই বিয়ে বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাই সে হাসি মুখে করছে।

    প্যাণ্ডেলের লোককে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল অন্তু এমন সময় ডাক পড়ল অন্দরমহল থেকে। বিপিন বাবুর স্ত্রী নয়না দেবী ডাকছেন। গায়ে হলুদ নিয়ে আসা বরের বাড়ির লোকজনের খাবারের ব্যবস্থা করতে । জলখাবারের ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। অন্ত পরিবেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল। তখনই চোখ পড়ল ঝুমুরের দিকে। আজ ইচ্ছা করেই অন্তু ঝুমুরের সামনে আসেনি। কি দরকার নিজের ব্যাথা কে নিজে খোঁচানোর ! কিন্ত এখন যখন ঝুমুরের গলার আওয়াজ পেল তখন অবাধ্য চোখটাকে আর আটকাতে পারল না অন্তু।

    গায়ে হলুদের জন্য তৈরী হয়েছে ঝুমুর । সেজেছে হলুদ রাঙা শাড়িতে। ভারি সুন্দর লাগছে তাকে। তার অঙ্গের সব অলঙ্কার যেন ফিকে লাগছে ঝুমুরের রূপের আলোর কাছে। হেসে হেসে হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলছে সে। অন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মন দিল নিজের কাজে। ঝুমুরকে তার এখন মরিচিকার মতো মনে হয়। বড় কাঙ্খিত , কিন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

    দুপুর বেলাটা অন্তু নিজের ঘরে এল । উদ্দেশ্য একটু বিশ্রাম। মানসিক, শারীরিক দুই ক্ষেত্রেই দরকার। এই ঘরে অনেকদিন পরে এল সে।
    ঘরটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে আজ ।
    ভেবেছিল ঘরে এসে বিশ্রাম দেবে শরীরের সাথে মনটাকেও। ঝুমুরের সামনে না থাকলে হয়তো অতীত স্মৃতির থেকে মুক্তি পাবে। কিন্ত তা আর হল কৈ! ঘরে আসতেই মাথার মধ্যে ভির করে এল একরাশ স্মৃতিকথা। এই ঘরটাই একসময় বরাদ্দ ছিল তার জন্য। প্রথম যখন অন্তু এবাড়িতে এসেছিল তখন তার বয়স খুব বেশি ছিল না । বাবা মা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়ি থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল অন্তু। কিন্ত মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট হওয়ার পরেও মামা বাড়ির হতদরিদ্রতার জন্য যখন অন্তুর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল তখন তার ছোট মামা নিজের বাল্য বন্ধু বিপিন বাবুকে অনুরোধ করেছিল অন্তুর পড়াশোনাতে সাহায্য করতে । বিপিন বাবু অন্তুর রেজাল্ট দেখে তাকে নিজের বাড়িতে নিজের খরচে পড়াশোনা করেছিলেন। প্রথম দিকে যে মামি নয়না দেবী খুব ভাল ব্যবহার করেছিল অন্তুর সাথে তা ঠিক নয়। তবে ক্রমেই অন্তুর আর নয়না দেবীর দুজনেরই অভ্যাস হয়ে যায় দুজনের ব্যবহার।

    ঝুমুর তখন ক্লাস সেভেন। অন্তুর সাথে ঠিক বন্ধুত্ব হয়েছিল বলাটা ঠিক নয়। বরং ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া স্মার্ট ঝুমুর মফস্বলের নিরীহ এবং আপাত আনস্মার্ট অন্তুকে নানা ভাবে অপদস্থ করে বেশ মজা করত। অবশ্য তাতে অন্তু কিছু মনে করে নি কোনোদিন। তবে আস্তে আস্তে অবস্থার বদল ঘটল। বিপিন বাবুর কল্যাণে সব রকম সুযোগ সুবিধা পেয়ে অন্তু উচ্চমাধ্যমিকে তৃতীয় হল। সেইদিন ঝুমুরের চোখে অন্তু প্রথমবার নিজের জন্য কেমন একটা সম্মান দেখেছিল। কলেজের পরিবেশ আর ঝুমুরের বদান্যতায় অন্তুও বেশ স্মার্ট হয়ে উঠল ।

    তারপর আস্তে আস্তে ঝুমুরের সাথে সমীকরণ গুলো কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল। বন্ধুত্ব থেকে ভাললাগা তারপর ভালবাসা ।
    অবশ্য এই ব্যপারে পদক্ষেপটা ঝুমুরই প্রথম নিয়েছিল। অন্তুর মধ্যে বিপিন বাবুর প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ছিল সেটাই বারবার রাশ টানত অন্তুর মনের। কিন্ত ঝুমুরের জেদ আর জোরের কাছে টিকতে পারে নি সে সব । ঝুমুর বলত,
    ” দেখ , কলেজে পড় ! আর গার্ল ফ্রেন্ড থাকবে না ! তাও কি হয়! লোকে কি বলবে ! আর আমারও একটা বয় ফ্রেন্ডের দরকার । না হলে বন্ধুদের সামনে মান সম্মান থাকছে না । তাই সস্তার সেন্টিমেন্ট সরিয়ে রেখে জীবনে এনজয় কর ।”

    সুন্দরী রূপসী স্মার্ট ঝুমুরের ভালবাসার ডাককে অগ্রাহ্য করতে পারেনি অন্তু । মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসেছিল ঝুমুরকে। আঁকড়ে ধরেছিল মনের সবটুকু দিয়ে । তবে অন্তুর বরাবরই মনে হত ঝুমুরের যেন ভালবাসার থেকে অধিকার বোধটাই বেশি। যখন বলবে যে ভাবে বলবে সেভাবেই সব কিছু করতে হবে । বিশেষ করে ঝুমুরের বন্ধুদের সামনে অন্তুকে যেতে হলে অন্তুর জামা থেকে জুতো সবটাই পড়তে হত ঝুমুরের পছন্দের। এমন কি অন্তু কাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তাও ঠিক করত ঝুমুর । ঝুমুরের এই অধিকার প্রধান ভালবাসায় মাঝেমাঝেই হাঁপিয়ে যেত অন্তু । তবুও পরিজনের ভালবাসা না পাওয়া অন্তু তার আর ঝুমুরের সম্পর্কটাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল।

    কিন্ত এই ভালবাসা যে কেবল অন্তুর কাছেই দামী ছিল তা জানা গেল কিছুদিন পরে । অন্তু তখন সবে একটা চাকরি পেয়েছে । মাইনেটা অন্তুর কাছে বেশ সন্তোষ জনক। সে আর দেরী না করে ঝুমুরকে প্রস্তাব দেয় বিয়ের। ঝুমুর তখন কলেজের লাস্ট ইয়ারে পড়ছে । বিয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে ঝুমুর । বলে ,

    ” তুমি ভাবলে কি করে যে তোমাকে বিয়ে করব ! তোমাকে বিয়ে করলে আমার বাবার মান সম্মান কিছু থাকবে ? “

    ” কিন্ত আমরা তো ভালবাসি একে অপরকে ! “

    ” ভালবাসা ! ” খুব অবাক হয়েছিল ঝুমুর । বলে ,
    “আরে বাবা সমাজে চলতে গেলে কিছু দেখনদারী লাগে । তেমন আমার ও দরকার ছিল কাউকে বয় ফ্রেন্ড বানানো , তো ব্যাস তোমাকে তাই বলেছিলাম। এর মধ্যে এই সব ভালবাসা টালোবাসা টাইপের সেন্টিমেন্ট এনো না প্লিজ। “

    নাঃ , কথা গুলো মেনে নিতে পারে নি অন্তু। জীবনের প্রথম ভালবাসার নারীকে বাঁধতে চেয়েছিল আপ্রান। অন্তুর নাছোড় জেদ দেখে ঝুমুর কটাক্ষ করে তাকে। বলে ,

    ” তোমার স্বপ্ন কোনদিনও পূর্ণ হবে না অন্তু। তুমি ঙ কি ভেবেছিলে আমাকে বিয়ে করে আমার বাবার সম্পত্তি হাতাবে! তা হচ্ছে না । তোমার মতো একজন ছেলেকে আমি বিয়ে করতে যাবই বা কেন? আমার বাবার আশ্রিতকে বিয়ে করার ভিমরতি আমার হয় নি। তাই তোমার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে । “

    কথা গুলোর মধ্যে যে লুকনো বিষের ফলা ছিল তা সেদিন ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল অন্তুর সব স্বপ্ন গুলোকে। অন্তু আর ঝুমুর কে বোঝাতে যায় নি সে সত্যিই কি স্বপ্ন দেখেছিল । কোন সম্পত্তির লোভে নয় বরং একটু ভালবাসার আকাঙ্খাতেই ঝুমুর কে তার জীবনে চেয়েছিল অন্তু । এরপর অন্তু চাকরির অজুহাতে চলে যায় ঝুমুরদের বাড়ি থেকে। তবে ঝুমুরের সাথে যাই হোক বিপিন মামার উপকারের কথা ভোলে নি অন্তু। তাই বিপিন মামা যখনই অন্তুকে ডেকেছেন কোন কাজে অন্তু এক কথায় চলে এসেছে। কিছুদিন আগে অন্তু এবাড়িতে এসে জেনেছিল ঝুমুরের বিয়ে পাকা হওয়ার কথা । বিপিন মামা দেখেছিলেন তার হবু জামাইয়ের ছবি। বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হচ্ছে ঝুমুরের। অবশ্য বিয়ের পর জামাই আর মেয়ে বিপিন মামার বাড়িতেই থাকবে । এমনই ইচ্ছা ঝুমুরের, আর জামাই তো ঝুমুরের কথাতেই ওঠে বসে তাই তারও কোন আপত্তি নেই। এসব কথা বিপিন বাবুই গর্ব করে জানিয়েছিলেন অন্তুকে। ঝুমুরের বিয়ের কথাতে বুকটা মুচড়ে উঠেছিল ঠিকই তবে মনে হয়েছিল এই ছেলেই ঝুমুরের জন্য আদর্শ। যে ঝুমুরের প্রতি কথার তামিল করতে পারবে । এরপর অন্তুর আবার ডাক পড়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠানটা সামলে দেওয়ার জন্য। আসলে বিপিন মামার অর্থ বল থাকলেও ভরসার লোক বলতে অন্তুই। অন্তুও না করে নি , যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করছে সে ।

    আজ একলা ঘরে অন্তুর মনে হচ্ছিল অন্যরকম কিছু কথা । আচ্ছা যদি ঝুমুর সেদিন তার প্রস্তাব মেনে নিত! যদি সত্যিই তাদের বিয়ে হত ! তবে অন্তু হয়তো তখন খুশি হত ঠিকই কিন্ত সুখী হত কি ? না কি ঝুমুর কে সুখী করতে পারত ! অন্তু বোধহয় নিজের সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সারা জীবন কেবলমাত্র ঝুমুরের দাস হতে পারত না ! আর তাতে অন্তু বা ঝুমুর কেউই সুখী হত না। তাই যে যদি গুলো হয় নি তা বোধহয় ভালোই হয়েছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় ঠকঠক শব্দ। মিষ্টি আনতে যেতে হবে যে ! তাই আবার ডাক পড়েছে অন্তুর। অন্তু মনের ভিতর থাকা সব যদি গুলোকে পুরোনো ঘরের অন্ধকারে ফেলে রেখে বেরিয়ে আসে । ঠিক করে আর ছুটবে না মরিচিকার পিছনে। এবার পালা সামনে তাকানোর।

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৬)

     জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার

     

    এতক্ষণে রুইদাসপাড়া ফুঁড়ে তিনটে ছোকরা হেলেদুলে এদিকে আসছে দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টির নাগালে আসতে সুধা বুঝতে পারল, কারোর পায়ের চলন স্বাভাবিক নেই। প্রত্যেকেই নেশায় চুর হয়ে আছে। তা তোরা যা পারিস ছাই পাঁশ গিলগে যা। তোরা এসে আমার গরুটার একটা হিল্লে কর আগে। মুখে কোন কথা নেই। এসেই তিনজনে লেগে পড়ল কাজে। ঝপাঝপ হাত চলছে ওদের। কাজের বেলায় এরা একদম পোক্ত কারিগরের দক্ষতায় ব্যস্ত। ভূপাল কা টিফিন নিয়ে আসতে আসতে ওদের অর্ধেক কাজ শেষ। খাবার আসতে আর ওদিকে মন নেই সুধার। গপ গপ করে পুঁউরুটি খায় আর এক কামড় শশা চিবিয়ে নেয়। শেষে অবশিষ্ট শশা কঁচ কঁচ করে কামড়ে খেয়ে নেয়। এতক্ষণে যেন খিদের ছটপটানি দমে শান্ত হয় শরীরটা। খাওয়া সেরে ওদিক তাকিয়ে দেখে মুচিদেরও কাজ প্রায় শেষ ! সত্যি এই কাজের দক্ষতাটা রুইদাসদের রক্তে সবসময় মজুত থাকে। কাউকে যেন শেখাতে হয় না। কিন্তু সুধা অবাক হয়ে গেল, প্রথম থেকে যে ছেলেটা তাদের পাশে এসে বসেছিল, সে এখনো ঠিক তেমনভাবেই বসে? কারণটা তাকে না জিজ্ঞেস করে পারল না সুধা, “হ্যাঁরে খোকা! তুই সেই প্রথম থেকে এসে বসে আছিস। হাতে তো চামড়া ছাড়ানো ছুরি মজুত। অথচ তুই ওদের সঙ্গে কাজে হাত দিলি না যে? সুধার কথায় ওর যেন কোন ভাবান্তর নেই! চুপ করে গরুটার দিকে তাকিয়ে অন্যদের কাজ করা দেখে যাচ্ছে। এবার সে আগ্রহ নিয়েই সেদিকে তাকিয়ে আছে। সুধা আবার বলল,“কিরে, আমার কথার কোন উত্তর দিলি না যে?” সুধার কথাটা ওই দলের একজনের কানে যায়। সে তখন বলল, “ও চামড়ার ভাগ নেয় না। আমরা চলে গেলে কি করে কে জানে। গরুর পেট কেটে কিসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ফিরে আসে। কি খোঁজে, আমরা ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। চুপ করে থাকে। বলে না কিছু। কিছু বলে না বলে আমারও ওকে আর তেল মাখাই না। যা পারে করুকগে। আর জিজ্ঞেস করি না। লাভও নেই ওকে নিয়ে বেশি কজলাকজলি করে। তাহলে আবার যদি চামড়ার ভাগ চেয়ে বসে তো আমাদের দিতেই হবে। আমাদের ভাগে তখন কম হয়ে যাবে।” এবার সুধা আবার তাকে জিজ্ঞেস করল, “খোকা, তোর নাম কি রে?” সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “বাবলা। বাবলা রুইদাস। যতন রুইদাসের ছেলে আমি। চেনো তো যতনকে? ওই যে, রতন রুইদাসের ভাই। রতন আমার জ্যোঠা। সনাতন জ্যেঠতুতো দাদা।
    ইতিমধ্যে ওই তিন ছেলে কাজ সেরে চামড়া নিয়ে পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। এবার বাবলা গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সুধার মনে জেদ চেপে যায়, বেটা এখন গরুটার পেট কেটে কি করে সেটা দেখে তবে এখান থেকে যাবে।
    ভূপাল-কা’কে বলল, “কাকা, খিদে তো মারা হল। এবার গামছা বিছিয়ে এই গাছের ছায়ায় একটুকখানি শরীরটা এলিয়ে দি আয় দু’জনে। বাড়ি যাচ্ছি, দাঁড়া। আড় চোখে দেখি আয়, ও বেটা এবার গরুটাকে নিয়ে কি করে! নিশ্চয়ই গোপন কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, ওর এই কাজের মধ্যে। ছেলেটা যে মহা-সেয়ানা সেটা তুই বুঝতে পারছিস, ভূপাল কাকা? ও কিন্তু একদম মদ খায়নি। মদ না-খাওয়া ছেলের কথাবার্তা, চালচলন, খাওয়াদের থেকে একদম আলাদা। আর দেখেছিস, ছেলেটা কথা একদম কম বলে! এই কথা কম বলা ছেলেরা মোটেই লেলাখেপা হয় না। সাহসী এবং মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে এরা। খুব সিরিয়াস হয়। সরাসরি ওদিকে তাকালে ও আমাদের লুকিয়ে কাজ করবে। ঘুমোবার ভান করে চোখ পিটপিটিয়ে দেখতে হবে, বেটা কি করছে।
    একদম দক্ষ কারিগরের মত কাজ! ফটাফট গরুটার পেট চিরে তার ভেতরে হাতটা সেঁধিয়ে দিল। খান তিনেক শকুন ইতিমধ্যে জুটে গেছে। ছেলেটা ‘ফুস্ ফুস্’ করে হাতের ছুরিটা উঁচিয়ে তাদের তাড়া করে আর নিজের কাজে মন দেয়। কিছুক্ষণ সেখানে হাতটা নাড়াচাড়া করে বার করে নিল হাতটা! রক্ত মাখা ডান হাতটা বাঁ হাত দিয়ে উপর দিক থেকে চেপে ধরে ঘষে নিচের দিকে টেনে সরিয়ে দিলো রক্তগুলো! আবার ডান হাতটা ঢোকালো! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাত বার করে মুঠো মেরে রইল। এবার আর হাতের মুঠো খুললো না। আগের মত বাঁ হাত দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে নিয়ে মুঠো খুলে চোখের দেখা দেখে নিল জিনিসটা ! সুধা, ভূপাল-কা ও সেই ফাঁকে দেখতে পেল, চকচকে হলদেটে পীতবর্ণের চার পাঁচটা শক্ত কিছু জিনিস! গরুর পেটের ভেতর এগুলো থাকে এ ছেলেটা জানে। জানতেই পারে। কিন্তু ওসব কি এমন জিনিস যে এত গোপনভাবে জোগাড় করতে হবে! নিশ্চয়ই ওগুলো রহস্যজনক দামি কিছু হবে! এইসব সাতপাঁচ ভাবনার ফাঁকেই ছেলেটা কখন গামছার খোঁটে সেগুলো বেঁধে পাঁই পাঁই করে দৌড় মারল! সুধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটা পগার পার! ওকে নাম ধরে ডাকারও ফুরসৎ দিল না! সুধা বুঝেছে, ওদের এ ব্যাপারে কিছু জানাবে না বলেই ছেলেটা চোখের পলকে তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল!
    সুধা-রা দু’জন তো ‘বাবলা’ ছেলেটার কান্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল! বলল, “কি ব্যাপার বলতো ভূপাল-কা? নিশ্চয়ই ওই চ্যাপটা নুড়ি পাথর মত দেখতে জিনিসগুলোর মধ্যেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে। কোন দামি পাথরের বস্তু হবে যেটা গরুর পেটের ভেতর থাকে।” তারপর চুপ করে গিয়ে ভাবতে লাগল, এতদিন তারা কেউ এসব রহস্যের কথা জানতো না। জানার অবকাশও কোনদিন তাদের হয়নি। ওদের কোন কল্পনাতেও ছিল না। পাকেচক্রে হঠাৎ ওরা এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাওয়াতে দেখতে পেল। বিস্ময়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল সুধা!
    -আচ্ছা ভাইপো, এখন ওই গরুর পেটের যেখান থেকে বেটা-টা ওই জিনিসগুলো বার করে নিয়ে গেল, একবার গিয়ে দেখলে হয় না? ঠিক কোন জায়গা থেকে বার করলো ওসব? বা যদি একটা আধটা ওই পাথর পড়ে থাকে তাহলে তো বোঝাই যাবে জিনিসটা কি এবং গরুর পেটের ঠিক কোন জায়গায় ওগুলো থাকে? কৌতূহলের সঙ্গে ভূপাল-কা বলল।
    -জানিস ভূপাল-কা, তোর মত বোকা-হাঁদা মানুষ বলেই এই কথাগুলো বলতে পারলি। প্রথমত ওই পীতবর্ণ পাথরের মত শক্ত পদার্থ একটাও অবশিষ্ট ওখানে পড়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। যে আগ্রহের সঙ্গে ছেলেটা ওগুলো নিল, নিশ্চয়ই ওর কাছে সেগুলোর গুরুত্ব সীমাহীন। সেই দ্রব্য ছিটকে ছাটকে গরুটার শরীরের ভেতর পড়ে থাকবে তা ছেলেটা হতে দেবে না। তারপর গরুর শরীরের ঠিক কোন জায়গা থেকে ওগুলো সে বার করল তা না জানলে আন্দাজে তুই কোথায় হাঁচাবি। সবই তো মাংসের ভেতর থাকে। মাংসের ঠিক কোন জায়গা থেকে কেটে নিল তা আমাদের মত গোলা লোকের খুঁজে বার করা সম্ভব না। ওসব ছাড়। এখন আমাদের জানলে ভাল হত, জিনিসটা ঠিক কি এবং কি কারণে ওর প্রতি ছেলেটার এত টান? কাজটা যে ছেলেটা প্রচন্ড গোপনীয়তার সঙ্গে করে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ফলে সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে কিছুতেই বলবে না। হয়তো এটাই ওর রুজিরুটির প্রধান অবলম্বন। যেমনটা আমাদের মজুর খাটা। সন্ধ্যেবেলা দিঘিরপাড় বাজারে তো যাচ্ছি। তুইও আমার সঙ্গে থাকবি। ওর বাবা যতনকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব। সে কি বলে দেখা যাক। অবশ্য যতন আমাদের না-ও বলতে পারে। ছেলের মত গোপন করে যেতে পারে। চল, বাড়ি যাই। আজ নতুন একটা রহস্য সামনে এসে হাজির হল। কিন্তু তা উদ্ধার করা হল না। কোনদিন আমাদের পক্ষে তা হবে কি না জানা যাচ্ছে না। সে না হয় তো কি করা যাবে। ওসব রুইদাসদের ব্যাপার। আমরা তো আর কোনদিন এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাব না। তাই আমাদের বেশি আগ্রহ দেখানোরও বা দরকার কি। কি বলিস তুই, ভূপালকা? বলে আবার ঘুরেফিরে সুধা বলে, “তবু নতুন একটা জিনিস দেখলাম। কি সেটা জানার জন্যে মনটা ভেতরে ভেতরে যেন গুলতানি পাকাচ্ছে?”

    [পঁয়ত্রিশ]

    হেড়ো পাগলার রকমসকম দেখে তাজ্জব বনে যায় অখিল! থমকে যায় তার চলার পথ। “এই হেড়ো, ওঠ বেটা” বলে গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে উঠতে ধড়ফড়িয়ে উঠে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। আবার একই ঢঙে অখিল বলে, “আমাকে দেখে উঁকিঝুঁকি মারছিলিস কেন, বল?” ভয় পেয়ে যায় হেড়ো। এবার হাত জড়ো করে বলে, “আমার কোন দোষ নেই অখিল দাদা ! ওই নোচে আর বিন্দে মদ খেতে দিয়ে আমাকে তোমার ওপর নজর রাখতে বলেছে। কখন তুমি বাড়ি ফেরো সেটা জানাতে বলেছে। বলতে পারলে এবার চুল্লুর সঙ্গে মাংসও খাওয়াবে বলেছে। সেই লোভে সারা রাত আমি এখানে জেগে বসে আছি, তুমি কখন আসো তাই চৌকি দিচ্ছি।”
    হেড়োর কথায় মাথা গরম হয়ে যায় অখিলের। বলে, “মদ-মাংসের লোভে তুই আমার পেছনে পড়েছিস। ধরা পড়ে গেলি। এবার আমি যদি তোকে ‘কেলিয়ে বৃন্দাবন’ দেখিয়ে দিই? এখন তোর নোচে-বিন্দে বাঁচাতে আসবে তো? শালা, আমি তোকে খেতে দিই না? যখন দেখা হয় বলিস, অখিল দাদা, আজ খাওয়া হয়নি। দশটা টাকা দাও যা হোক কিছু কিনে খাবো। এবার তুই ‘খেতে পাসনি বলে’ একবার আমার কাছে হাত পাতিস। দেখবি, তোর কি হাল করি। বেইমান কোথাকার!” ভয় পেয়ে যায় অখিলের কথায় হেড়ো পাগলা। সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে অখিলের পা জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমার নামে ওদের কাছে কিছু বলবো না অখিল দাদা। আমাকে কিচ্ছু বোলো না। ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দাও অখিল দাদা।” অখিলের রাগ তখনও যেন কমতে চায় না। আবার বলে,“শালা পাগলা। এই সময় তো ভাল মানুষের মত বেশ ভাল ভাল কথা বলছিস। ওই কথায় বলে না,‘নিজের ভাল পাগলেও বোঝে।’ তুই শালা তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তোকে বলে রাখছি হেড়ো, আমার কথা যদি তোর মুখ দিয়ে কখনো বার হয়, তোকে কিন্তু আমি ছেড়ে দেব না। ছাড়! পা-ছাড় শালা পাগলা-কেষ্ট।” বলে অখিল বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
    যেতে যেতে ভাবে, ও তো পাগলের মরণ। কখন কি খেয়ালে থাকে তার কোন ঠিক আছে না কি! ও আবার নোচে-বিন্দের খপ্পরে পড়লে তাদের লোক হয়ে যাবে। মারব ধরব বলে যদি ভয় দেখায় বা কাছের লোকের অভিনয় করে মদ গিলিয়ে দেয় তো কেল্লা ফতে। যা দেখেছে সব বলে দেবে। দেবে দেবে! কি আর করা যাবে। ঝামেলা হামলে পড়ে তার ঘাড়ে উঠতে চাইলে তখন চুপ করে থাকা যাবে না তো। কঠোর হাতে তাকে মোকাবিলা করতে হবে। তার জন্যে অখিল বিন্দুমাত্র ভীত নয়। কারোর ঘরের চালে তার পুঁইশাখ তোলা নেই যে তাদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে থাকতে হবে। এক নম্বর হল, রেখা বউ তার কারিগর। তারপর সে এখন বিপদে পড়ে আছে। মানুষ হিসেবে এবং তার কাজের ঠিকেদার হিসেবে বিপদগ্রস্থ এই মানুষের পাশে সে দাঁড়াবে না? তাতেও মানুষের আপত্তি! আসলে এইসব নিষ্কর্মাদের আপত্তির কারণ অন্য জায়গায়। তার মত আইবুড়ো রসালো ছেলেটা শেষে কি না একটা বিধবা বোয়ের সঙ্গে জুটে গেল! সত্যি গেল কি না গেল তার প্রমাণ দেওয়া পরের কথা। এখন তো তকমাটা তার গায়ে সেঁটে ফায়দা লোটা যেতে পারে। অখিলের কাছ থেকে ফায়দা লোটা অত যে সহজ নয় সেটা সময় বলে দেবে। তাছাড়া যদি সে ওই বিধবা বউটাকে ভালই বাসে। তাতে অন্যের কি যায় আসে? হ্যাঁ,ওদের যায় আসে। সেটা অখিল খুব ভাল করে জানে। নিজেদের বন্নের মেয়ে ছেড়ে অন্য জাতের মেয়ের আঁচলে মুখ ঢাকলে তো তাদের জাতের একটা মেয়ের হিল্লে হল না। তার উপর জাত খুইয়ে দিল! এ যে জঘন্য অপরাধ, তাদের মত স্বঘোষিত গোঁয়ার অন্ধ জাতভক্তদের কাছে। কিন্তু দিনকাল যে পাল্টে যাচ্ছে। জাতের নামে হুজ্জুতি যে এখনকার ছেলেপুলেরা মানছে না। তা ওই সাবেকী মুরুব্বিদের মগজে এখনো ঢোকেনি। এবার সময় এসেছে তা তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেবার। ফাঁকা মাঠে লাঠি ঘোরাবার সময় শেষ। এখন প্রতিপক্ষ ময়দানে এসে গেছে। মুখোমুখি দাঁড়াতে তারা প্রস্তুত।
    বাড়িতে এসে ঘন্টা দুই বিশ্রাম নিয়ে নেয় অখিল। মাকে বলে রেখেছিল, সকাল সকাল রান্না করে দিতে। কোলকাতায় যাবে। মায়ের ডাকে উঠে চানটান সেরে পরিষ্কার হয়ে নেয়। মা ভাত বেড়ে দিলে, খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির বাইরে পা বাড়ায় ও। ভোর ভোর যাবার কথা ছিল। কিন্তু শরীর টানতে পারল না। তাই দেরি হয়ে গেল বার হতে। দেরিই যখন হল, তখন ভাবল, তাহলে যাবার সময় রেখা বউয়ের বাড়ি একবার চক্কর দিয়ে পালপাড়ার কারিগরদের কাজ কতটা কি হল দেখে নিয়ে কোলকাতায় রওনা দেবে। উত্তম ভ্যানয়ালা সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে গেল কি না সেটাও একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন। এগুলো মেয়েদের কাজ না। এইজন্যে বাড়িতে একটা ছেলে থাকা দরকার।
    ভাবনা মত অখিল রেখা বউদের বাড়ি যাবার পথ ধরল। আটচালার কাছাকাছি আসতে দেখে দূরে তাদের পাড়ার ওই তেমাথানি মোড়, যেটা গ্রামের মেন রাস্তার সঙ্গে জুড়েছে, সেখানে বড় বটগাছ তলায় জনা চারেক বসে আছে। ওরা কার জন্যে ওখানে জড়ো হয়েছে তা অখিল বিলক্ষণ বুঝতে পারে। দলে নোচে-বিন্দেও আছে। আর আছে দুই জাতরক্ষার ধ্বজাধারী মুরুব্বি, দিবাকর রুইদাস আর নিত্যানন্দ ঋষিদাস! ওদের দেখে থমকে যায় সে। ওখান দিয়ে গেলেই ওরা তাকে ধরবে। কি বলবে তা তার জানা নেই। তবে
    ভালোবাসবে না তা সে নিশ্চিত। তাকে বিরক্ত করার জন্যেই ওৎ পেতে আছে ওখানে। সক্কাল বেলা। শান্ত খোলা মনে কাজে বেরোচ্ছে। এখনই যদি ও ওদের সঙ্গে কথাকাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে তো সারা দিনটা তার মাটি হয়ে যাবে। সব কাজ চৌপাট হয়ে যাবে। তাই ঠিক করল এদিক দিয়ে না গিয়ে উল্টো রাস্তা ধরে আগে পালপাড়ার কাজটা দেখে তারপর রেখা বউদের বাড়িতে একটু তদারকি করে কোলকাতায় রওনা দেবে। ভাবনা মত পেছন ফিরতেই বিন্দে জোর গলায় হাঁক পাড়লো, “এই অখিল, ওখলে। আমাদের দেখে পিছু হটছিস নাকি রে? ভয় পেয়েছিস বুঝি। এভাবে পালিয়ে ক’দিন বাঁচবি? ধরা তো তোকে একদিন আমাদের কাছে দিতেই হবে।” অখিল যেটা চাইছিল না, পরিস্থিতি মনে হয় সেই দিকেই এগোচ্ছে। শালা নেশাখোর বিন্দের কথায় হু হু করে মাথা তার গরম হয়ে উঠল। নাঃ এদের সমঝে না দিলে চলছে না দেখছি। সত্যি তো, পিছু না হঠে মুখোমুখি হওয়াই সঠিক পথ। রাগে সমস্ত শরীর টগবগ করে ফুটতে লাগল তার। এবার বড় বড় পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। যেতে যেতে হঠাৎ রেখা বউয়ের মুখটা তার মুখের সামনে ভেসে উঠল। রেখা বউ তাকে বলেছিল, “ঠিকাদার বাবু, আপনি আমাদের বাড়ি ঘন ঘন আসেন। ওরা নিশ্চয়ই ভাবছে আপনার সঙ্গে আমি জুটে আছি। তাই আপনার পাড়ার লোকেরা এটা ভাল চোখে দেখে না। প্রথমত আমি স্বল্প বয়সী বিধবা। তার উপর আমরা বেজাত তো। আপনাদের জাতের লোকেরা বড্ড জাত-বেজাত মান্য করে চলে। আপনি একা মানুষ। রাত বিরেতে একা একা যাতায়াত করেন। তাই যখন তখন ওরা আপনার বিপদ ঘটিয়ে দিতে পারে। ওরা কেউ কোন কথা বললে, তাদের কথায় আপনি কান লাগিয়ে মাথা গরম করবেন না।” সঙ্গে সঙ্গে অখিলের উথলে ওঠা রক্ত থিতিয়ে যেতে লাগল। ভেবে নিল, মেয়েরা অল্পেতেই ভয় পেয়ে আপনজনকে সাবধান হতে বলে। অখিল ওদের দেখে বিন্দুমাত্র ডরায় না। তবু এই সাত-সকালে ওদের কোন নরম গরম কথায় সে মাথা গরম করবে না। কথা বলার প্রয়োজন হলে ঠান্ডা মাথায় বিনয়ের সঙ্গে ওদের সঙ্গে কথা বলে নিজের কাজে চলে যাবে। কিন্তু ও জানে, ওরা তা চাইবে না। ওরা চাইবে আমি ওদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কথার পিঠে কথা চাপিয়ে পরিবেশ গরম করে তুলি। তেমাথানি রাস্তায় পাড়া-বেপাড়ার লোক জড়ো হয়ে যাক। তার নামে অপবাদ তুলে সেটা চাউর করে দিক সর্বত্র। সেই সুযোগ ওদের সে করে দেবে না নিশ্চিত হয়ে বিন্দের ডাকেই পিছু না হটে সামনে এগিয়ে গেল। পাড়ার অন্যতম দুই মুরুব্বি, দিবাকর আর নিত্যানন্দদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে কিছু বলবে, নিত্যানন্দ কাকা?” অখিল হঠাৎ নোচে-বিন্দেদের কিছু না বলে তার নাম ধরে সরাসরি প্রশ্ন করায় থতমত খেয়ে যায় নিত্যানন্দ! তাকে ডাকল বিন্দে। আর সেই বিন্দেকে এড়িয়ে কথা বলতে চাইলো তার সঙ্গে? অখিলের কথায় কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে বলল,“না বাবা। আমার কিছু বলার নেই তোমাকে। এখন কাজে বেরোচ্ছ বুঝি?” উত্তরে অখিল বলল, “হ্যাঁ কাকা। জরুরী কাজে কোলকাতায় যেতে হবে। তার আগে আমার কারিগরদের বাড়ি বাড়ি একবার যেতে হবে। তারা সব কাজ কতটা কি করল। দেখে নিতে হচ্ছে। মহাজনদের তাড়া আছে। সময়মত না কাজ দিতে পারলে ওরা, মাড়োয়াড়িরা ভীষণ ট্যাঁকখোর। উল্টোপাল্টা কথা বলে। টাকা কেটে রাখে। সেই সুযোগটা আমি ওদের দিতে চাই না। তাই প্রথমে কোনদিকে যাব ভাবতে ভাবতে তখন থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আবার ঠিক করলাম, আগে মন্ডল পাড়ার ভীষ্মর বোয়ের বাড়ি হয়ে পাল পড়ায় যাব। সেখান থেকে কোলকাতা।” সঙ্গে সঙ্গে নিত্যানন্দ বলল, “আমার বৌমাও তাই বলছিল। অখিলদাদার মালটা আজকেই রেডি করে দিতে হবে। নিয়ে যাবে। ঠিক আছে বাবা তুমি যাও তোমার কাজে।”
    অখিল ইচ্ছে করেই এই চালটা দিল। বিন্দেদের পাত্তা না দিয়ে নিত্যানন্দ কাকাকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল। তার কাছে যে ওদের টিকি বাঁধা আছে। অখিল কাজ দেয় বলে ওনার ছেলের বউ কাজ পায়। সংসারে আয় হয়। সেই আয়েই ঘরে বসে বসে বুড়োর যত নফরচফর। অখিল কাজ বন্ধ করে দিলে যাবতীয় তেলানী শুকিয়ে বাতাসের কাঁধে ভর করে হাওয়া হয়ে যাবে। আর দিবাকর কাকা? ওর দশাও একদম নিত্যানন্দ কাকার মত। বিন্দে, নোচেদের মত ছ্যাবলামো করলে ওদের চলবে নাকি!
    এই বিন্দে একসময় অখিলের এক নম্বর বন্ধু ছিল। একই বয়সী ওরা। নোচেও ওদের সমবয়সী। তখন অখিল মোহন গোড়ের শোলা কারখানায় কাজ করত। দিন মজুরী নিয়ে বাড়ি ফিরতো। বিন্দে সে সময় পাড়ায় টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াতো। অখিল বন্ধু বিন্দেকে বলেছিল, মোহনের কারখানায় যদি কাজ করতে সে ইচ্ছে করে তাহলে মালিককে বলে কয়ে কাজে লাগিয়ে দিতে পারে। হাতে দুটো পয়সা এলে মনও খুশ থাকে। সংসারে দু’চার পয়সা দিতে পারে। অনেকটা বড় হয়েও অখিল সেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর টান তখনও জোরদার ছিল। কিন্তু ছেলেটা এঁচোড়ে পেকে গেল। পাড়ার উঠতি মেয়েদের পেছনে সময় কাটিয়ে জীবন গড়ার সময়কে হেলাফেলা করল। একদিন হঠাৎ বিন্দে তার কাছে এসে বলে, “অখিল তুই আমার মান বাঁচা। আমাকে তিরিশটা টাকা ধার দে। পরশু তোকে শোধ দিয়ে দেব। না হলে মুক্তির কাছে আমি মুখ দেখাতে পারব না। আজ ওকে ফতেপুরে শীতলা টকিজে সিনেমা দেখাব বলেছিলাম। ভুলেই গেছি। সেজেগুজে ও রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার কাছে একটা কানাকড়ি নেই!”
    -মুক্তির সঙ্গে তুই প্রেম করছিস? ও তো সবে সিক্সে পড়ে!
    -কি করবো বল। ওকে আমার ভাল লেগে গেল। আমি সাহস নিয়ে সরাসরি ওকে ভালোবাসার কথা বললাম। সেদিন ও ‘ধ্যাৎ’ বলে দৌড়ে পালালো! দিন কয়েক পর বট গাছ তলায় আমি ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। স্কুল যাবার সময় হয়ে গেছে। মুক্তি এবার স্কুলে যাবে। অবশেষে অপেক্ষায় পাশ! স্কুলের পথে ওর পেছন পেছন কথা বলতে বলতে অনেকটা গেলাম। ও কিন্তু কোন কথা বলছে না। শেষে বললাম,“কই, তুমি উত্তর দিচ্ছ না যে আমার কথায়?” তখন ও বলল, “প্রেম করতে এসেছো, খাওয়াবার ক্ষমতা আছে? আগে সেটা বলো।”
    -তোমার জন্যে আমি প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারি।
    বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তারপর ট্যাঁক থেকে গরুর চামড়া কাটা ছুরি বার করে বিন্দে বলল, “তুমি চাইলে এইটা আমি আমার পেটে ঢুকিয়ে দিতে পারি। তোমাকে আমি এতটা ভালোবাসি। আর বউ হলে বউকে খেতে দেয়া তো কোন ছার। দরকার হলে নিজে না খেয়ে বউকে খাওয়াব।”
    বিন্দের এমন পণে সক্রিয় হয়ে মুক্তি বলল, “না না বাবা ! মানুষ খুনের দায় আমি নিতে পারব না। আমাকে ভালবাসতে গিয়ে তুমি যদি মরে যাও তা আমার ধর্মে সইবে না। ঠিক আছে, তুমি যা চাও তাই হবে।” এই বলে মুক্তি খিলখিলিয়ে হাসি দিয়ে স্কুলের পথে দৌড় মারল।
    তাদের প্রেম পর্বের খন্ড কথা শুনিয়ে বিন্দে কাতরভাবে অখিলকে বলল,“জানিস অখিল, সেই থেকে মুক্তি আমার। মুক্তি আমার ধ্যান জ্ঞান। আমার ইহকাল- পরকাল। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারব না। এখন ওই তিরিশটা টাকা দিয়ে তুই আমার মান বাঁচা অখিল।”
    শালা বিন্দে, হারামজাদা! দিনকতক মুক্তির সঙ্গে ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর করে একদিন সন্ধ্যের মুখে পাড়ার ছোকরাদের হাতে ধরা পড়ল। রতন কাকার গোয়াল ঘরের পাশে খড়কাটার পাশ কামরায় বিন্দে আর মুক্তি নাকি দু’জনে চুরি-চামারি করে শরীর দেয়ানেয়া করছিল। ব্যাস! পাড়ায় চেঁচামেচি হইচই, লোকজড়ো। ছোকরারা এক কাপড়ে দু’জনকে জড়িয়ে আটচালায় এনে হাজির! তাদের দাবি আজ রাতেই এদের ‘ধরে বিয়ে’ দেওয়া হবে। ডাক পড়ল উভয়ের বাবা মায়ের। ছেলের বাবা পন-পাওনা না পেলে এ বিয়েতে রাজি নয়। ছেলের বাপের কথা, “এটা ঠিক, আজ হঠাৎ করে তো এসব জোগাড় করা সম্ভব নয়। অন্তত আজ কথা দিতে হবে মেয়ের বাপকে যে তিন মাসের মধ্যে ছেলের তিনটে, মানে ঘড়ি-অংটি-বোতাম আর মেয়ের তিনটে, হাতে-কানে-গলায় সোনার গয়না যৌতুক হিসেবে এবং নগদ পাঁচ হাজার টাকা তারা দিতে রাজি। বর পক্ষের কথায় মেয়ে পক্ষের তো কপালে হাত। তারা নিজেরা ঠিক মত দু’বেলা খাবার জোটাতে পারে না। এত বর-পন-যৌতুক তারা তিন মাস কেন তিরিশ বছরেও জোগাড় করতে পারবে না। পাত্র-পাত্রী নিজেরা প্রেম করেছে মেলামেশা করেছে। ওরাই বুঝুক কি করবে। তবে আমার মেয়ের সর্বনাশ যদি ওই ছেলে করে থাকে তো আমরা ছেড়ে কথা বলব না। আটচালা যদি এর একটা বিহিত না করে তো থানা-পুলিশ আমরা করব!
    শেষ পর্যন্ত আটচালার নিদানে ওই রাত্রেই দিঘিরপাড়ের জামা কাপড় দোকানদার, বাসু ঘোষের বাড়ি গিয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে বিয়ের সাজসজ্জা বাকিতে নিয়ে যায়। ধারের টাকাটা দেবে পাত্রপক্ষ। জামিনদার হল, আটচালা। পাত্রপক্ষ কথা খেলাপ করলে আটচালার ফান্ড থেকে আপাতত সেই ধার শোধ করা হবে। তারপর আটচালা বিন্দেদের কাছ থেকে আদায় করে নেবে।
    এমন বিয়ে ওদের রুইদাস পাড়ায় আখচার আগে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিন্দে তো তবু ভালো। ভদ্রসদ্র ভাবে একটা বিয়ে হয়েছিল। আর ওই নোচে! ও তো আর এক ‘ঢেমনা’। ও নাকি পাড়ার সুবোধ কাকার নাতনি, আরতির প্রেমে পড়েছে।
    আরতির যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন ওর বাপ অকালে কলেরায় মরে যায়। দাদু, সুবোধ কাকা তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করছে। প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে, ছেড়ে দেয় পড়া। দাদুর ঢাক-ঢোল তৈরী বা সারাইয়ের কাজে যোগান দিয়ে দিন কাটায়। শরীর ‘রঙিন হবার’ সময়কাল পার করে আরও বছর দুয়েক পেরিয়েছে তার বয়স তখন। সেই সময় থেকেই নোচে তার পেছনে পড়ে যায়। আরতি তাকে নাকি পাত্তাই দেয় না। কিন্তু নোচের গোঁ, ওকে সে বউ করে ঘরে তুলবে। যখন তখন রাস্তাঘাটে মেয়েটাকে বিরক্ত করতো। আর পাড়ায় একদল নিষ্কর্মা ছেলে ছিল, যারা এইসব অকর্মাকে ধরার জন্যে ওৎ পেতে থাকতো। নোচে একদিন রাত্রে আরতির শোবার ঘরের বাইরে জানলা দিয়ে ফিসফিস করে ডাকছে, “আরতি, তুমি একটু উঠে বাইরে আসবে? তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার আছে। অনেক কথা আছে আমার। তোমাকে সেকথা না বললে আমার রাতের পর রাত ঘুম হচ্ছে না। না-ঘুমে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আরতি। তুমি চাও, এইভাবে তিলে তিলে শরীর খারাপ হতে হতে আমি মরে যাই? আমার এই অকাল মরণের জন্যে তুমিই কিন্তু দায়ী থাকবে আরতি।”
    নোচের এই উস্কানীমূলক কথাগুলো পেছন থেকে চৌকী দেওয়া পাড়ার ছেলেরা শুনছিল। ঘরের ভেতর থেকে অবশ্য আরতির কোন গলার শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। নিশ্চয়ই বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল তখন সে। গভীর রাত। সেটাই স্বাভাবিক। এবার পাড়ার ছেলেরা তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। এখানে ওই মেয়েটার ঘরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন তাকে বিরক্ত করছিল, তার কৈফিয়ৎ চায়। নোচে সাফ কথা জানিয়ে দেয়, সে আরতিকে বিয়ে করবে। খুব ভালোবাসে সে আরতিকে। ও রাজি না হলে সে আত্মহত্যা করবে বলে পণ করে। ভালবাসার কারণে জ্বলজ্যান্ত টগবগে একটা ছেলে আত্মহত্যা করেবে তা কেমন করে হয় ! ছেলেরা কেউ তা চায় না। ওই রাতেই ডাক পড়ল পাড়ার মুরুব্বিদের। ডাক পড়ল আরতির দাদু, সুবোধ কাকা এবং নোচের বাবা মায়ের। সাব্যস্ত হল, নোচের সঙ্গে আরতির বিয়ে দেওয়া হবে, এই রাত্রেই। তবে কোন বরপণ দিতে হবে না মেয়ের পক্ষ থেকে। গরিব সুবোধ কাকা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। বাপ মরা মেয়েটা যে তার গলগ্রহ হয়ে আছে। এই মওকায় যদি মেয়েটার একটা উপায় হয়ে যায় মন্দ কি! আরতির মা, শ্বশুরের কথায় সায় না দিয়ে বলে, “ওইরকম বাজে ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে আমার একদম মন নেই। মেয়েও এ ছেলেকে পছন্দ করে না। এ বিয়ে তুমি বন্ধ করো বাবা।” তখন রেগে গিয়ে আরতির দাদু তার মাকে বলে,“তাহলে মেয়ের বিয়ের দায় তোমাকে নিতে হবে। ওর বিয়ের বোঝা আমি এই বুড়ো কাঁধে বইতে পারব না।” তখন বাধ্য হয়ে আরতির মা বলে, “তা আমি মেয়েমানুষ, মেয়ের বিয়ের দায় কেমন করে নেব। তাই যদি তোমার ইচ্ছে তাহলে তাই হোক। সবাই মিলে মেয়েটাকে আমরা দরিয়ায় ভাসিয়ে দিই। ভাসতে ভাসতে উল্টো স্রোতে যদি মেয়েটা আবার তোমার ডেরায় ফিরে আসে তার দায় কিন্তু তোমাকে নিতে হবে বাবা? আমি ঘুম থেকে তুলে দিচ্ছি তোমার নাতনিকে।” বলে আটচালা থেকে তরতরিয়ে বাড়িতে চলে এসে মেয়েকে ডাকে, “এই আরতি, ওঠ! অনেক ঘুমিয়েছিস। আর ঘুমোতে হবে না। ওঠ! ওঠ! তোর বিয়ে! ওঠ! ওদিকে লোকজন সব বাজারে গেছে, বিয়ের সাজ আনতে। মুখ ধুয়ে টুয়ে রেডি হয়ে নে। বাজার থেকে বিয়ের সাজ নিয়ে আসলেই কনে সাজে আটচালায় যেতে হবে। নোচের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে তোর দাদু আর পাড়ার লোকজন। তোর, আমার ইচ্ছাকে ওরা ‘ধরতার’ মধ্যে আনতে চাইছে না।”
    কিভাবে রোজগার করে জীবনে বড় হওয়া যায় সেই ভাবনা নেই। কিন্তু অপরিণত বয়সে যখন তখন বিয়ে করার ভাবনায় রুইদাস পাড়া মশগুল। মেয়েদের চাওয়া পাওয়ার এরা কোন দাম দেয় না। কেউ এই অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গেলে সমবেতভাবে তার উপর চাপ দিয়ে দমিয়ে দেওয়া হয়। ওদের পাড়ার বেশিরভাগ মেয়েই পাড়ার মধ্যে থেকে যায়, পাড়ার কোন না কোন ছেলের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে। আটচালার তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
    বরং তাকে মদত দিয়ে যায়। আটচালা তথাকথিত মুরুব্বি বিচারকদের কথা, তারা কিছুতেই চায় না তাদের জাত, ‘বর্ণ-শঙ্কর জাতে’ পরিণত হোক। সংসারের ঘানি আর টানতে পারছিল না বিন্দে। পারবে কেমন করে। আগে তো নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। তার পরে তো বিয়ে! একদিন বউ পিটিয়ে, গরুর চামড়া কাটা ছুরি দিয়ে বোয়ের হাতে ‘চ্যাঁ’ দিয়ে সেই রক্ত হাতে নিয়ে ছুটে এসেছে অখিলের কাছে, বিন্দে শালাটা! বলে, চাল কিনে আনতে পারিনি বলে মুক্তি যাচ্ছেতাই বলে গালাগালি দিচ্ছিল। সহ্য হচ্ছিল না। চুল্লু খেয়েছিলাম, মাথায় খুন চেপে গিয়ে এই ভুল কান্ডটা করে ফেলিছি অখিল। তুই আমাকে কিছু টাকা ধার দে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই বউকে।” কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অখিল বিন্দের গালে সপাটে একটা চড় কসিয়ে বলে,“শালা শুয়োরের বাচ্চা!”
    ক্রমশ…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৫)

     জন্মসূত্র
    -সুব্রত হালদার


    [তেত্রিশ]

    অলোকাদির মায়ের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে দাবায় এসে দাঁড়ায় সনাতন। জিজ্ঞেস করে, “কি জ্যেঠিমা? দিদি কেমন আছে? যেদিন কোলকাতা থেকে ফিরি সেদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারপর অনেকদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়নি। আসলে সেই পুজোর আগে কোলকাতায় গিয়েছি লক্ষ্মীপুজো সেরে বাড়ি ফিরি। অনেক কাজ জমে ছিল। সেইসব কাজ গোছগাছ করে নিতে আরও কতদিন সময় চলে গেল। যাব যাব করে দিদির কাছে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দিদির সঙ্গে আমারও দরকার আছে। তোমরা সবাই ভালো আছো তো জ্যেঠিমা? বলো, আমাকে কিছু বলবে?”
    অলোকা কী বিশেষ দরকারে তোকে ডেকেছে রে বাবা। দরকারটা নাকি জরুরী। সে’কথা আমাকে বারবার বলতে বলেছে তোকে। আর বলেছে, যদি ব্যস্ত থাকে তো কাজটা সেরেই যেন আমার কাছে চলে আসে। তা তুই বাবা সময় করে একবার আমাদের বাড়ির দিকে যাস। না হলে আবার আমাকে ‘মুখ’ করবে। বলবে, তুমি নিশ্চয়ই সনাতনকে ভালো করে বলে আসনি। আমি মুখ্যু মানুষ। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কথা যেন ধরতেই পারি না। মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।” অপারগতার ভাবনায় অলোকাদির মা বলল। অলোকাদির মায়ের কাছ থেকে দিদির তলবের কথা শুনে মনে মনে জিভ কাটে সনাতন। ইস্,কোলকাতা থেকে ফেরা ইস্তক দিদির সঙ্গে না দেখা করাটা ঠিক হয়নি। সেই দিনই দিদি বলেছিল দেখা করার জন্যে। বাজে কাজ হয়ে গেল। কিন্তু এখন তো সে যেতে পারবে না। বাবা দোকানে চলে গেছে। তাকেও যেতে হবে। বাবা অপেক্ষা করবে তার জন্যে। তাই অলোকাদির মা’কে বলল, “জ্যেঠিমা, দিদিকে বলে দিও আজ দোকান থেকে ফিরে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আমি যাব।” সনাতন বলার পর অলোকাদির মা ফিরে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় সনাতনের মা পেছন থেকে ডাকলো, “কিগো দিদি। চলে যাচ্ছো যে। এসো একটু চা খেয়ে যাও। চা খেতে খেতে দু’দন্ড কথা বলা যাবে। এমনিতে তো আর ঘর-সংসারের কাজের ঝামেলায় এতটুকুও বকবক করার সময় হয় না।”
    -নাগো দিদি। এখন একদম সময় নেই। এই এখন গিয়ে আমার গরুর খড় কুঁচতে হবে। জাবনা করে দিতে হবে। মেজলা একদম শুকনো হয়ে আছে। সন্ধ্যের আগে গরু নিয়ে এসে ওর বাবা গোল ঘরের এই অবস্থা দেখলে আমাকে আর তিষ্টতে দেবে না। চলি গো দিদি। পরে সময় করে আসবো’খন।” শাড়ীটা কোলকাতার হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজো কমিটির প্রধান, সন্তোষবাবুর স্ত্রী বউবাজার মার্কেট থেকে নিজে গিয়ে কিনে বাবাকে দিয়ে বলেছে,“বৌদিকে এটা দিলাম। পরতে বলবেন।” দামী শাড়ী সেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে। বাবা খুব খুশি হয়েছিল। পুরোনো জামা কাপড়ের সাথে একদম নতুন শাড়ী ওই পাড়ার কয়েকজন দিয়েছে। বড়মুখ করে বাবা, মা’কে শাড়ীটা পরতে বলে। মা কিছুতেই রাজি নয়, “এমন মোটা কাজ করা শাড়ী আমি জীবনে পরিনি। কোমরে গুঁজে রাখতে পারব না। অভ্যেস নেই তো কি করব।” তারপর বলে,“একটা দামী শাড়ী পরে বড়লোকি চাল চেলে তো লাভ নেই। নিজের ক্ষমতায় এমন শাড়ী কোনদিন কিনতে পারব না। কিনবও না। অযথা পয়সা নষ্ট করা আমি একদম পছন্দ করি না। তাই বলছি, অন্য কাউকে যদি পারো দিয়ে দাও। সে পরে আনন্দ পাবে।” মায়ের কথা শুনে বাবা বলল, “তোমার কথায় অবশ্য যুক্তি আছে। তুমি না পরতে চাইলে আমি জোর করব না।” তখনই মা সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এক কাজ কর সনাতন। তোর অলোকাদিকে এই শাড়ীটা দিয়ে আসিস। ও পড়াশোনা করা মেয়ে। বাইরে এদিক ওদিক রোজ বার হতে হয় ওকে। তাই শাড়ীও বেশি লাগে। লোক-সমাজে এমন শাড়ী পরলে ওর মানাবেও ভাল। প্রথমে অবশ্য মেয়েটা ‘না-না’ করবে। মুখচোরা মেয়ে। তবে মনে হয় তুই দিলে ও তোকে ফেরাবে না।” সনাতন দেখল মায়ের কথায় বাবাও মাথা নেড়ে সায় দিল। কোলকাতা থেকে ফেরার দিন ও অলোকাদিকে উপহার দেবে বলেছিল। তবে সেটা অবশ্য এই শাড়ীর মত দামী নয়। মা-বাবা এই শাড়ীর কথা বলতে ও বেশ খুশি হয়। একটা ভাল উপহার দিদিকে দিতে পারবে ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এখন দুটো উপহার একসাথে সে দিদিকে দিতে পারবে।
    মোটামুটি সাড়ে সাতটা হবে ওদের উঠোনে টর্চের আলো ফেলে একজন কাউকে গুটি গুটি পায়ে আসতে দেখে অলোকা। এই সময় সনাতনের আসার কথা। নিশ্চিয়ই সনাতন আসছে। তৃপ্ত মনে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে অলোকা জিজ্ঞেস করল, “কে, সনাতন?” ‘হ্যাঁ’ বলতে বলতেই সনাতন দাবার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। “আয়, উপরে উঠে আয় ভাই। চটিটা একদম নীচে রাখিস না। উপরের সিঁড়িতে রাখ। আসা যাওয়াতে কারোর পায়ে লেগে এদিক ওদিক ছিটকে চলে যেতে পারে।” সনাতনকে দোলায় বসতে বলে ঘরের ভেতর থেকে বেতের মোড়া আনতে যাবার সময়ই সনাতন বলল,“দিদি, শোনো না। এই শাড়ীটা মা তোমার জন্যে পাঠিয়েছে। আমরা কোলকাতায় কাজ করে ফেরার সময় পুজো কমিটির হেড-বাবু এটা উপহার দিয়েছে। মা এমন শাড়ী পরতে একদম চাইছে না। বলে,“এসব কম বয়সী মেয়েদের মানায়। আমরা এখন বুড়োর দলে। তুই বরং একটা কাজ কর । ওটা তুই তোর অলোকাদিকে দে। ওকে মানাবে ভাল। মা তোমার নাম বলাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। খুশি মনে আমি এটা তোমাকে দিতে এসেছি। তুমি কিন্তু ফিরিয়ে দেবে না দিদি। তাহলে আমি মনে কষ্ট পাব। বড় মুখ করে এনেছি, তোমার জন্যে।”
    সনাতন ভায়ের মত। আর এমন করে ছেলেটা বলছে। কেমন করে সে তাকে ফিরিয়ে দেয়। নেব না বললেই ছেলেটা একদম মনমরা হয়ে যাবে। তাছাড়া দাতা যদি অন্তরের ভালবাসা দিয়ে কিছু দান করে তো তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। অলোকার বুঝতে অসুবিধা হল না যে সনাতন সম্পূর্ণ নিষ্পাপ মনেই তাকে এটা দিতে চাইছে। আর অলোকা সেটা নিলে প্রকৃতই সে তৃপ্ত হবে। পুলকিত মনে অলোকা সেটা হাতে নিয়ে হাঁক পেড়ে তার মা’কে ডাকলো,“মা, এদিকে আসো, সনাতন আমার জন্যে কি এনেছে দেখো। পাগল ছেলে। আমি এটা না নিলে নাকি ও ভীষণ কষ্ট পাবে।” মা আসতেই প্যাকেট থেকে সেটা বার করে খেলিয়ে দেখতে দেখতে মা’কে বলে,“কি সুন্দর শাড়ীটা দেখো মা! সুন্দর সুন্দর চিকনের কাজ। রঙের কম্বিনেশন! এত দামী শাড়ী আমি কোনদিন পরিনি। পরবো কেমন করে! কেনার ক্ষমতাই নেই! এই শাড়ীটা মা, আমি তোলা শাড়ী হিসেবে রেখে দেব। কোন বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এটা পরব।”
    দিদির আনন্দে সনাতনও মনে মনে আপ্লুত হয়ে বলে,“দিদি। আর একটা জিনিস আমি নিজে পছন্দ করে তোমার জন্যে এনেছি। এটা আমি আমার পাওয়া বকশিশের পয়সায় কোলকাতার দোকান থেকে কিনে এনেছি। তুমি জিনিসটা পরতে ভালবাসো আমি দেখেছি। পকেটের ভেতর সেটা লুকিয়ে রেখে বলল, বলো তো দেখি এটা কি হতে পারে?”
    -কি আবার, মাথার ক্লিপ? ওটা আমার শখ।
    -তুমি একদম ঠিক ধরেছো। তবে এটা বেশ অন্য ধরণের। এদিকে পাওয়া যায় না। ওটা বাইরে থেকে আসে। বাংলাদেশ। তোমার পছন্দ না হয়ে যায় না, দেখবে?
    এইসব কথালাপের মধ্যে হঠাৎ অলোকার মনে পড়ে গেল, যে জন্যে সনাতনকে তার জরুরী তলব, সেটা বাদ দিয়ে অন্য কত সব কথা হয়ে যাচ্ছে। এবার যেন একটু গম্ভীর হল অলোকা। সনাতনকে বলল, “তোকে যে জন্যে মাকে দিয়ে ডাকালাম সেটাই তো এখনো বলা হয়ে উঠল না।” মায়ের দিকে চেয়ে বলল, “মা, তুমি শাড়ীটা নিয়ে চলে যাও। এর সঙ্গে আমার অন্য কথা আছে।” বলে অলোকা ঘরের ভেতর থেকে সারদা মিশনের চিঠিটা নিয়ে এল। আস্তে আস্তে দুলতে থাকা দোলাটাকে বাঁ-হাত দিয়ে থামিয়ে বসার মোড়াটা সনাতনের আরও কাছে টেনে নিয়ে বসে গলার স্বর ছোট করে বলল,“ভাই, এই চিঠিটা তুই বিপ্লবদার হাতে দিয়ে আসতে পারবি? খুব দরকারি চিঠি। আমাদের পাড়ার কেউ যেন জানতে না পারে যে আমি তোকে বিপ্লদার কাছে পাঠিয়েছি। তাহলে পাড়ার মধ্যে আবার একটা অনর্থ শুরু হয়ে যাবে।” সনাতনের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে উদাস মনে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল অলোকা। কতক্ষণ, যেন তার খেয়াল নেই! সম্বিৎ ফেরে সনাতন যখন বলে, “কি ভাবছো দিদি? মনে হচ্ছে তুমি বেশ চিন্তিত? তোমার চিন্তা করতে হবে না দিদি। পাড়ার কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। আমাকে যে দায়িত্ব তুমি দিলে তা মসৃণভাবেই আমি পালন করে দেব।” সনাতন কি বলছে সেদিকে যেন মনই নেই অলোকার! অন্ধকার থেকে ঘাড় ফিরিয়ে সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে হয় আমার আর কলেজে পড়া হবে না রে ভাই। কত স্বপ্ন ছিল, রুইদাস পাড়ার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হব। মনে হয় স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেল আমার জীবনে।”
    অলোকাদির এমন অভাবনীয় কথায় চমকে ওঠে সনাতন! বিস্ময়ের সঙ্গে বলে,“এমন কথা বলছো কেন দিদি? বাধা কোথায় দিদি? আমি পারব না তোমার পাশে থাকতে? আমি থাকতে কোন বাধাই তোমার বাধা হতে দেব না। কোলকাতায় কাজে গিয়ে অনেক বড়বড় মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তারা আমাকে কথা দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা সবসময় আমার পাশে থাকবে বলেছে। বাবুদের বললে, তোমার পড়াশোনার সব ব্যবস্থা ওরা করে দেবে। কোন দুশ্চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।”
    -না রে ভাই। কেউ আমাকে পড়ায় বাধা দিচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে, ডিগ্রী পড়া এখন আর আমার হবে না। অন্য পড়া পড়তে হবে। চাকরির পড়া। প্রাইমারী স্কুলে পড়াবার জন্যে ট্রেনিংয়ের পড়া! মন থেকে এটা এখন আমি চাইছিলাম না। বিপ্লবদার কথা মতো সরিষা মা সারদা মন্দিরে দরখাস্ত করেছিলাম বেসিক ট্রেনিং পড়ার জন্যে। ভেবেছিলাম, আমাদের ধরাকরার কেউ নেই। ওটা পড়ার সুযোগ পাব না। কিন্তু মেধার জোরে আমার সুযোগটা এসে যায়। এটা তারই চিঠি। না-খুশি, না-দুখী মনে অলোকা কথাগুলো বলল।
    অলোকাদির হাত থেকে চিঠির খামটা প্রায় ছিনিয়ে নেবার মত করে নিয়ে সনাতন বলল,“বেসিক ট্রেনিংয়ের চান্স পাওয়া চিঠি! কি মজা। দিদি বেসিক ট্রেনিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, কি বলব। আমার অলোকাদি এটা পাশ করলেই যেকোন সময় মাস্টারির চাকরি পেয়ে যাবে। আজকাল এটা পাশ না করলে প্রাইমারী স্কুলে ঢোকার সুযোগই নেই। আর দিদি ! তুমি কি না মন খারাপ করছো ডিগ্রী পড়তে পারবে না বলে? আসলে দিদি, তুমি জানোই না তোমার কতটা যোগ্যতা। তাই তুমি তোমার যোগ্যতাকে খাটো করে দেখো। কত ছেলেমেয়ে এটা পড়ার জন্যে মাথা খোঁড়ে, জানো! চান্সই পায় না। সেখানে কোন মামা-দাদা না ধরেই তুমি তোমার আপন যোগ্যতায় সুযোগটা পেয়ে গেলে। গুলি মারো তোমার বি.এ. পাশ। ওটা পাশ করার অনেক সময় তুমি পাবে। আগে জীবনটা বাঁচুক। তারপর,জীবন যাত্রা। আমি কাল সক্কালে বিপ্লবদা কলেজে বেরিয়ে যাবার আগেই পৌঁছে যাব ওদের বাড়ি। দিদি, আবার বলছি, কোনো মন খারাপ নয়, আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে এখানে তুমি ভর্তি হয়ে যাও। আর বিপ্লবদা যা যা বলবে, অক্ষরে অক্ষরে তুমি তাই করবে। তোমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।”
    -তুই তো দেখছি একদম বিপ্লবদার মত কথা বললি। ঠিক একই কথা সে আমাকে বলেছিল, এটার জন্যে দরখাস্ত করার সময়। আমি চাইছিলাম না। আর সে নাছোড়। করতেই হবে। সেই চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসা পুজো করার মত অবহেলাতেই আবেদন পত্রে সই করে দিয়েছিলাম। পুরো ফর্ম ফিল আপটা বিপ্লবদাই করে দিয়েছিল। সে এবার চিঠিটা দেখলে খুবই আনন্দ পাবে। সেই আনন্দ তোর বিপ্লবদার মত আমার কিন্তু হচ্ছে না।”
    সপ্তাহে একদিন, শুক্রবার করে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ছাত্রীদের দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। দরকারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্যে সারদা মন্দিরের বাইরেও ছাত্রীকে নিয়ে যেতে পারবে বাড়ির লোক। অলোকা, বাড়ির লোক হিসেবে বিপ্লবের নামটা লিখিয়ে রেখেছে। কেননা তার বাবা-মা তো এখানে আসবে না। বাবা দিনমজুর। এখানে আসা মানেই একদিনের রোজগার বন্ধ। তার উপর আসা যাওয়ার খরচা। আর মা, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। মেয়ের ইস্কুল পাঠশাল লেখাপড়ার ব্যাপারে খোঁজ নেবার যোগ্যতাই তার নাকি নেই। অলোকা জোর করে বললেও তা কানে নিতে চায় না, তার মা। ঘর- গেরস্থালির কাজেই মা বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে দু’জন বাড়ির লোকের নাম রেজিস্ট্রি করাতে হয়। যারা সেই ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাবে। মেয়েদের স্কুল বলেই এতটা কড়াকড়ি। বাবা মাকে জানিয়েই অলোকা, বাড়ির লোক হিসেবে বিপ্লবের নামটা দিয়েছে। মেয়ে, অলোকার পড়াশোনার ব্যাপারে যেহেতু তার প্রয়োজন, তারা ‘না’ বা বলে কেমন করে। মনে মনে যে অলোকা বিপ্লবকে পছন্দ করে সেটাও ওর বাবা মায়ের অজানা নয়। তাছাড়া বিপ্লব ছেলেটা তো খুবই ভাল ছেলে। পরোপকারি। এই ছেলেটা অলোকার পাশে না থাকলে তাদের মেয়ে পড়াশোনায় এতটা উপরে যে উঠতে পারত না তা তারা খুব ভাল করেই জানে। সেইজন্যে ওরা তার প্রতি কৃতজ্ঞও।
    নানান হাতের কাজ, ড্রয়ইং, প্রোজেক্ট ওয়ার্ক হিসেবে জমা দিতে হয়
    অলোকাদের। এমন শক্ত শক্ত সব কাজ যেটা অলোকাদের মত মেয়েদের পক্ষে ওই ট্রেনিং সেন্টারে বসে করা সম্ভব নয়। প্রায় কোন মেয়েই তা করতে পারে না। সব্বাই বাড়ির লোকের উপর ভরসা করে। বাড়ির লোক আবার নিজেরা না পারলে অপরকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে ওই শুক্রবার করে দিয়ে আসে এবং অন্য দরকারি কথা সেরে নেয়। দু’দন্ড প্রিয়জনকে চোখের সামনে দেখে মানসিকভাবে তৃপ্ত হয়। অলোকার এখন মনে পড়ছে, সেই দরখাস্ত লেখার সময় বিপ্লবদা তাকে এরকমই প্রজেক্ট ওয়ার্ক এখানে করতে হয়, তেমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল। তখন অলোকা সেই কথাকে, বলতে গেলে আমলই দেয়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, কতটা সঠিক ছিল সেই কথাগুলো। সেদিনের দেওয়া কথামত বিপ্লবদা অলোকার এইসব কাজ তৈরী করে দেবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। তাই এই কাজের জন্যে এবং অলোকার প্রতি আকর্ষণের অদৃশ্য এক সূতোর টানে সপ্তাহের নির্দিষ্ট সেই দিনে বিপ্লব সারদা মন্দিরের ভিজিটিং রুমে গিয়ে হাজির হয়। বিপরীতে, বলা যায় সারা সপ্তাহ ধরে অলোকাও মুহূর্ত গুনতে থাকে কখন শুক্রবার আসবে। তার বিপ্লবদার সঙ্গে দেখা হবে। তাই আকর্ষণটা শুধু এক তরফের নয়, দু’তরফেরই।
    প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসের জন্যে দিদিমণি কাপড়ের ছিট তার রঙ এবং সাইজ দিয়ে দিয়েছে। সেটা বাড়ির লোকদের দিয়ে কিনিয়ে রাখতে হবে। রুটিনমত নির্দিষ্ট দিনে সেটা লাগবে। বিপ্লবদাকে বললে হয়তো সে ওগুলো কিনে এনে দেবে। কিন্তু মনের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব রয়ে যায় অলোকার। যদি বিপ্লবদা ঠিক ঠিক মত সবটা কিনে উঠতে না পারে? কেননা, দিদিমণি ক্লাসে তাদের দেখিয়ে দিয়েছে কাপড়গুলোর রঙ এবং সাইজ। বিপ্লবদা তো সেটা দেখেনি। অলোকার চোখে যেটা ভাসছে, বিপ্লবদার তা হবার নয়। তাই ও ঠিক করল, বিপ্লবদাকে সঙ্গে নিয়ে ডায়মন্ড হারবার থেকে ওগুলো কিনে নিয়ে আসবে। সেই শুক্রবার অলোকা একদম তৈরী হয়েই আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। বিপ্লবদা আসতেই বলল,“আজ এখানে বসে কথা বলার সময় নেই বিপ্লবদা। আমাদের ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। কিছু জিনিস কেনার আছে। তোমাকে বললে, তুমি হয়তো তা কিনে আনতে পারবে। কিন্তু যদি দিদিমণির চাহিদামত সব ঠিকঠাক না হয় তো অসুবিধায় পড়ে যাব। তাই আমরা দু’জনে আজ যাব। ওইসময় যা কথা বলার বলা যাবে’খন। চলো আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ি। অফিস থেকে আমি বাইরে যাবার অনুমতি আগেই নিয়ে রেখেছি। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, সেটাও লিখে দিয়েছি।”
    সাইজ মত সাদা এবং রঙিন ছিট কাপড় আর সেলাইয়ের অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা হয়ে যাবার পর বিপ্লব বলল,“চলো অলোকা, তোমাকে কিছু খাওয়াই। এই প্রথম তুমি আমার সঙ্গে বাইরে কোথাও বার হলে। তোমাকে কিছু না খাওয়াতে পারলে আমার খারাপ লাগবে। তাছাড়া আমি তো বড়। ছোটদের উপর বড়দের একটা দায়িত্ব থাকে। অনেকক্ষণ আগে হোস্টেলের খাবার খেয়েছো। খিদেও পেয়ে যাবার কথা। তারপর শরীর খারাপ হলে তার দায় আমাকে নিতে হবে।”
    বিপ্লবের কথায় তীর্যক ঢঙে অলোকা বলল,“হুঁ, বড় মানে, একদম তালগাছের মত বড় আমার থেকে। তুমি কোন ক্লাস আর আমি কোন ক্লাস একবার হিসেব করে দেখো তো দেখি? কতবড় তালগাছ তুমি? তাছাড়া আমার এখন খিদে পায়নি। এটাসেটা খেয়ে পয়সা নষ্ট করতে হবে না। এই তো এগুলো কিনতে কত টাকা খরচ হয়ে গেল। সবার আগেই পকেটে হাত গলাবার স্বভাব তোমার। আমাকে কিছুই দিতে দিলে না।”
    এখন নাই বা দিলে। যখন দেবার সময় হবে তখন হৃদয় উজাড় করে দিও। তাহলেই তো হবে। তখন কার্পণ্য করে আমাকে হতাশ করলে চলবে না কিন্তু! বলে মুচকি একটা হাসি অলোকার দিকে ছুঁড়ে দিল বিপ্লব! প্রতিহাসিতে অলোকা বলল, “খুব কথা শিখেছো তো দেখছি। কি বলতে চাইলে আমি বুঝতে পারলাম না ভাবছ, তাই না? অত বোকা আমি নই।”
    কে বলেছে তুমি বোকা? অনেকের থেকে অনেক বুদ্ধিমতি এবং চালাক বলেই না তুমি আজ এখানে আসতে পেরেছো। বলতে বলতে আবার একটা কপট হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বিপ্লব বলল, তবে হ্যাঁ, এই ব্যাপারটায় তুমি কিঞ্চিত বোকা তো বটেই।”
    -কি! আমি বোকা? কোন্ ব্যাপারটায় আমি বোকা তোমাকে আজ বলতেই হবে। বলে ডান হাতের মুঠো বাগিয়ে বিপ্লবের পিঠে কিল সাঁটাবার জন্যে তেড়ে যায়, অলোকা।
    সঙ্গে সঙ্গে কিল খাবার হাত থেকে নিজেকে বাঁচার জন্যে নিজের দু’হাত অলোকার সামনে মেলে ধরে বিপ্লব বলে,“বলছি বলছি মহারানি। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। ওরে বাব্বা। ওই সুন্দর টুকটুকে ফর্সা হাতের কিল আমার পিঠে পড়লে আমি তো একেবারে কুপোকাত হয়ে যাব! কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। বলছি, ঠিক এই ব্যাপারটাতেই তুমি এতটা বোকা ছিলে। যেই রনং দেহী হয়ে আমার দিকে ধেয়ে এলে, সেই মুহূর্ত থেকেই তুমি ‘বোকা’ তকমা মুক্ত হয়ে গেলে। বোকা থেকে তুমি বোদ্ধা হয়ে গেলে।” বলে হো হো করে হাসতে থাকে বিপ্লব!
    বিপ্লবের এই হাসিতে নিজের ভেতরটা এক অনাবিল আনন্দে টৈটুম্বুর হয়ে গেল অলোকার। প্রতিহাসি মুখে ফুটিয়ে ক্ষীণ স্বর তুলে অলোকা বলল,“কি হচ্ছেটা কি! লোকে তো দেখছে। ভাবছে, এই ছেলে-মেয়েটা একদম যাচ্ছেতাই। রাস্তাঘাটে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।”
    -ভাবুক-গে। ভালবাসায় অন্যের ভাবাভাবিতে কান দিতে নেই। সবসময় স্বচ্ছ হৃদয়ে নিষ্পাপ ভাবনায় আদরের সঙ্গে তাকে লালন করতে হয়। তবে সে আধারের বশে থাকে। কিঞ্চিত আবেগমথিত হয়ে বিপ্লব বলল। অলোকাও কতক্ষণের জন্যে যেন উদাস হয়ে গেল! কি নির্মল, সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারে বিপ্লবদা। মনে হচ্ছে এ’কথা যুগ যুগান্তরের ভালবাসার ডাক। এ ডাক ফিরিয়ে দেবার সাধ্য কার! অলোকার সাধ্যে তা কুলোবে না। জন্মান্তর এমন ভালবাসায় আবৃত থাকতে তার কোন বাধা নেই। এখন তো নেই-ই ! বিপ্লবদা তাকে লালন করবে তো?

    [চৌত্রিশ]

    অগ্রহায়ণ মাসের দিকে আমন চাষের সরু ধান পাকতে শুরু করে। তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু জমিতেই এই ধান চাষ হয়। সরু ধান বেশি জল সহ্য করতে পারে না। তার থেকে যে জমি একটু নাবাল, সেই জমিতে মোটা ধান হয়। এরা আবার বেশি জলেই নিজেদের স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এইসময় সুধা-কাসেমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই সরু ধান তোলা হয়ে গেলে সেই জমিতে চাষ দিতে। তখন থেকেই তাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। পৌষ মাষ পড়লেই বোরো ধান চাষের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে রবি শস্য চাষেরও তাড়া পড়ে যায়। শীতের সব্জি বাজারে তুলতে গেলে চাষীদের এখনই বীজ বুনতে শুরু করতে হয়। বোরো ধান চাষের জন্যে এই সরু ধানের জমিতেই বীজতোলা ফেলতে হয়। আজীবনের এই নিয়মে এবারে এত ভয়ঙ্করভাবে ছন্দপতন ঘটবে তা সুধা-কাসেমের মত হেলোরা ভাবতে পারেনি। পুরোনো ধারাকে পেছনে ফেলে নতুন ধারা এগিয়ে যেতে একটু সময় লাগে। এই ভাবনা যে এমনভাবে ধাক্কা খাবে, তা কে জানতো! ট্রাক্টরওলারা যেন এই সময়টার জন্যে মুখিয়ে ছিল। এলাকায় এলাকায় একটার পর একটা ট্রাক্টর মাঠে নামাতে শুরু করল। হ্যান্ড ট্রাক্টর বর্ষার প্রবল জলে তেমন কায়দা করতে পারে না বলে চুপচাপ ছিল এই শুখা সময়ের মুখ চেয়ে। সুধা-কাসেমরা এখন এদের দাপটে দিশাহারা। কথায় কথায় কাসেম বলল, “সুধা, আর হালের জোড়া পুষে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে গরুদুটোকে হাটে বেচে দিতে হবে। ওই দু’টো বেচে যে কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে যাহোক একটা ব্যবসা-ট্যাবসা শুরু করতে হবে। পেট তো চালাতে হবে না? বিডিও অফিসের পশু ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ে আমার বাঁয়াটা অনেক সুস্থ হয়েছে। এখন আর খোঁড়াচ্ছে না। সুস্থ থাকতে থাকতে ছেড়ে দিলে কিছুটা বেশি পয়সা পাওয়া যাবে। ভাবছি সামনের মাসে বিবিরহাটের গরুহাটে বেচে দিয়ে আসব এদের। তুই যদি বেচতে চাস, ভেবে দেখিস। আমার সঙ্গে যেতে পারিস। একসাথে দু’জনে চলে যাব।”
    কত শক্ত মন এই কাসেমটার। যে গরুজোড়া এতদিন তার ভাতভিতের জোগাড়ে জীবনপাত করে একসঙ্গে লড়ে গেল, সেই তাদেরই বাজারে বিক্রি করার ভাবনা কত সহজেই এ করতে পারে। তাছাড়া এত বছর তো এরা তোর সংসার জীবনের অন্যতম সদস্য হয়ে থেকেছিল। কেন, ওরা শুধু অবলা পশু বলে ওদের এক কথায় ত্যাগ করে দিতে হবে! টাকাপয়সাই ওর কাছে বড় হয়ে গেল! মায়া-মমতা, মানবিকতা- এইসব ওর কাছে কিচ্ছু না! হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে ও বলতে পারে, ওরা যেমন আমাদের কাজ দিয়েছে, আমাদের সংসার চালাতে সহযোগিতা করেছে, তেমনি ওদের ভরণপোষণের জন্যেও তো খরচ করতে হয়েছে। সংসার জীবনের একজন সদস্যের জন্যে এই হিসেব নিকেশ কি একজন বিবেচক মানুষের পক্ষে মানায়! মানায় না। সুধা তা কিছুতেই করতে পারবে না। তার জোড়া দুটোকে সে কিছুতেই গরু-হাটে বেচে পয়সা রোজগার করতে পারবে না। তাই যদি তার ভাবনা থাকতো তাহলে তো একটু শক্ত সমর্থ থাকতে থাকতে বুড়ো গরুটাকে সে হাটে বেচে দিয়ে পয়সা আয় করতে পারতো। তার সংসারে যা আয় হবে সে বউ-বাচ্চার সঙ্গে গরুদেরকে নিয়ে ভাগ করে খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে থাকবে। কাসেমের কথায় একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধা বলল, “নারে কাসেম। তুই যা ভাল মনে করবি করিস। আমি আমার গরুদের হাটে বিক্রি করে দিয়ে আসতে পারব না। আমার মন কাঁদবে।”
    কাসেম একটা মস্ত ভুল করে ফেলল। ও যদি আগে বিবির হাটের গরুহাটে এসে দেখে যেত, গরুর বাজার কেমন যাচ্ছে। তাহলে জোড়া দুটোকে সঙ্গে করে আনতো না। গরু হাটে নিয়ে গিয়ে দেখে শয়ে শয়ে মানুষ গরু নিয়ে হাটে জড়ো হয়েছে। এমনটা নাকি বর্ষার চাষ শেষ হবার পর থেকে প্রত্যেক হাটে বিক্রির জন্যে গরু জড়ো হচ্ছে। অথচ সে নিজে অন্য সময় চাষের বলদ কিনতে কয়েকবার এই হাটে এসেছে। কত? বড়ো জোর দশ-বারো, কি পনেরো জোড়া গরু সাধারণভাবে হাটে জড়ো হয়? সেখানে এত গরু ! ও ভেবে এসেছিল যে, বেশ কয়েক হাজার টাকা পেলে তা দিয়ে একটা কারবারপাতি ফেঁদে বসবে। তা তো হবার নয়। গরু নাকি এখন জলের দরে বিকোচ্ছে। হচ্ছেও তাই। ও তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। কবে এর দাম চড়বে তা ব্যাপারিরা কেউ বলতে পারছে না। এটা তো কারবারের নিয়ম- যোগান বেশি হলেই মালের দাম কমতে থাকবে। চাহিদায় ‘এলা’ এসে পড়বে। পড়ছেও। না, সে এই জলের দরে তার গরু বিক্রি করবে না। বাড়ি ফিরে এলো ওদের নিয়ে। ঘরে ওদের রেখে এসে প্রথম সুধার কাছে এসে হাটের পরিস্থিতি সব গপ্পো করল। বলল, “তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস সুধা। যে উদ্দেশ্যে আমি আমার পোষ্যের মায়া ত্যাগ করে বেচে দিতে চেয়েছিলাম, তা যদি সিদ্ধ না হয় তাহলে ওদের আমি কেন হাতছাড়া করবো।” সুধা, কাসেমের কথায় কোন উচ্চবাচ্য করল না। করে লাভ কি? কাসেমের ভাবনার সঙ্গে ওর ভাবনা তো মেলার নয়। যতই ওর চিন্তার সঙ্গে এক পংক্তিতে সুধার ভাবানা বসাবার চেষ্টা করুক না কেন। বাস্তবে তা তো নয়। হাটে গরুর দাম চড়লে ও আবার ছুটে চলে যাবে তাদের বেচে দিতে। আর সুধা তো তা কোনদিন ভাববেই না।
    সেদিন সকালে গোয়ালঘর থেকে গরু বাইরে বার করতে গিয়ে সুধা দেখে বুড়ো গরুটা মরে পড়ে আছে। অন্য গরুদুটোর চোখের গোড়া থেকে নাকের ফুটো পর্যন্ত জলের ভিজে দাগের রেখা পড়ে গেছে। কখন রাতে মরে গেছে কে জানে! সঙ্গীরা সেই শোকে সারারাত নীরবে চোখের জল ফেলে গেছে। পশুদের মনেও কত মায়া! ওরা মানুষের মত কথা বলে মনের দুঃখ বোঝাতে পারে না। কিন্তু ওদের মনও যে কাঁদে! সুধার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে এল! পরম মমতায় অন্য দুই গরুর গলাবন্ধের বাঁধন খুলে বাইরে বেঁধে দিয়ে এল। কিন্তু সুধা অবাক হয়ে দেখল, অন্য দিনের মত এরা বাইরে বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে যে ঘাসে মুখ দিয়ে খেতে শুরু করে, এখন ওরা তা করল না ! চুপচাপ সোজা মুখ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবছে কে জানে! খাবার কথা মুখেই আনছে না এরা। আর থাকতে না পেরে সুধা ওদের গলায় মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আর দুঃখ করে কি করবি বল। সবাইকে তো একদিন যেতে হবে। নে, একটু খাওয়া দাওয়া কর। এখানে বেশ বড় বড় ঘাস আছে।” গলায় হাত বোলাতে ওরা আরও লম্বা করে গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ দিয়ে হাল্কা নতুন জলের রেখা দেখা যাচ্ছে। তবু ঘাসে মুখ রাখছে না। যতক্ষণ না বুড়োটাকে ঘরছাড়া করে ওদের চোখের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মনে হয় ওদের মুখে কোন খাবারই রুচবে না।
    ভাগাড়ের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে বহুদিন এখানে কেউ গরু ফেলতে আসেনি। ঝোপ জঙ্গলে চেপে গেছে গরু ফেলার জায়গাটা। গরু পড়লে, শকুন-কুকুর- শেয়ালের আনাগোনায় এই চাপ চাপ জঙ্গল থাকে না। তারপর মরা গরুর প্রথম শিকারী, মানুষ আসলে তো তারা তাদের নিজেদের দরকারে জঙ্গল সাফ করে দিত। সুধা মনে মনে ভাবল, এই ঘন ‘মুতো-ঘাস’ বনে গরুটাকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে যাবে! হাজার হলেও গরুটাতো এতদিন তাদের পরিবারের একজন ভেবে ঘরে রেখে দিয়েছিল। মায়ার টানে তাকে হেলাফেলা করেনি। এখন মরে গেছে বলে হেলায় তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া ঠিক হবে না। সঙ্গে আসা লোকদের বলল, “তোরা গরুটাকে ফাঁকায় রাখ। আগে কাস্তে কাটারি দিয়ে ওই খেলকদম, ডাকরঞ্চের বন ছেঁটে ফেলে দে। তারপর কোদাল দিয়ে মুতো-ঘাস মোটামুটি চেঁচে ফেলে গরুটাকে রেখে যাই চল। এই বেহদ্দ জঙ্গলে অবহেলায় একে ফেলে গেলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না রে। ভূপাল-কা, ভাগ্যিস তুই বুদ্ধি করে এই যন্তরগুলো সঙ্গে এনেছিলিস! অবশ্য তুইও একবার বলেছিলিস, ভাগাড় বুনো ঝোপে ভর্তি হয়ে আছে। ওগুলো কেটে পরিস্কার না করলে গরু ফেলা মশকিল হয়ে যাবে।” কিন্তু এইসব করতে করতে তো ঘন্টা-দুই পার হয়ে গেল! কোন শকুনের দেখা নেই কেন রে ভূপাল-কাকা। আগেও তো গরু ফেলে গেছি এখানে। আধঘন্টা তর সয় নি, বড় গাছের মাথায় শকুনরা এসে ঘাপটি মেরে বসে গেছে। অপেক্ষা করে মুচিরা কতক্ষণে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে গরুটার চামড়া ছাড়িয়ে তাদের খাবারের সুব্যবস্থা করে দেয়। ভূপাল-কা দেখেছিস, এতক্ষণ সময় পার হয়ে গেল, একটা মুচিরও সেই উর্দ্ধশ্বাস দৌড় দেখতে পাচ্ছিস? পাচ্ছিস না।” স্বভাবজাত ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ভূপাল-কা বলল, “হুঁ, গাছের মাথায় শকুন বসলেই সেই নিশানায় তো মুচিরা দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরা গরুর উপর। সেই নিশান তো তারা পাচ্ছে না। পাবে কোত্থেকে, শকুনরা বুঝে গেছে গ্রামের ভাগাড়ে তো আর তাদের খিদে মেটাবার জন্যে গরু পড়েই না। তাই ওদিকে শুকুনী-দৃষ্টি ফেলে লাভ নেই। শুধু সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। তাই ওরা এখন শহুরে ভাগাড়ের মধ্যে নিজেদের মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। সেখানে কালে-ভদ্রে গরু পড়লেও অন্য জীবজন্তুর মরা দেহ পড়ার তো ইয়ত্তা নেই। হয়তো দেখা যাবে বেশ কিছুদিন পর আমাদের এই গরুর শরীর থেকে তীব্র পচা গন্ধ বার হবার পর তাদের টনক নড়বে। তাদের টনক নড়লে মুচিদেরও টনক নড়বে। তুমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো, সুধা ভাইপো? আমাদের বয়ারের রুইদাস পাড়ার মুচিরা কিন্তু আর আগের মত ভাগাড়ে গরু পড়ার ওপর ভরসা করে দিন কাটায় না? কাটাবে কেমন করে বলো? আগে যতই পাতলা হোক, দু’তিন মাসের ফারাকে কোন না কোন ভাগাড়ে একটা-দুটো গরু পড়তো। সেই গরুর চামড়া নিয়ে কাজ করে তারা সংসার খরচের অনেকটাই সামলে নিত। তারপর চাষবাস, এটা সেটা কাজ করে দিন চালিয়ে দিত। ওদের পাড়ার রতন রুইদাসের সঙ্গে আমি তো অনেক কাজ করেছি। তুমিও তো জানো। তোমারই কাদা করা জমিতে আমাদের সঙ্গে রতনরাও রোয়ার কাজ করে গেছে। ওই রতন বা অন্যরা কথায় কথায় এই সব গল্প করতো। এখন কিন্তু রতনদের বয়সী মুচিরা আর ভাগাড়ের এমুখো হয় না। ওদের পাড়ার কিছু বেকার ছেলেপুলে, যাদের অন্য কোন কাজে মন বসে না। দিনরাত দেশি, চুল্লু খেয়ে পাড়া মাত করে, তারাই খবর পেলে ভাগাড়ে আসে গরুর চামড়া ছাড়াতে। ভাগাড়ে একবার একটা গরু পড়লে আগে মুচিদের মধ্যে সেই চেনা হইহুল্লোড় এখন আর নেই। এই কারবার ছেড়ে দিয়ে তারা অন্য পথ দেখে নিয়েছে। কেননা বাঁচতে তো হবে। ওই ইঞ্জিন হাল এসে তো মানুষের বলদ গরু পোষার প্রয়োজনীয়তা শেষ করে দিয়েছে। যাদের, তোমাদের মত হালের কাঁড়া ছিল, তারা সক্কলেই সব হালের গরু-জোড়া বেচে দিয়েছে। শুধু তোমরা কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছো। অত গরু পরপর যদি মানুষ প্রাণের দায়ে বেচে দেয় তো দেশে গরু থাকবে কোত্থেকে। আর সমাজে গরু না থাকলে ভাগাড়ে তো খেলকদম আর মুতো-ঘাসে ভরে যাবেই। তাতে ভাগাড়ের আর কি দোষ। তেমনি দোষ বা কোথায়, ওই শকুন আর রুইদাসদের!”
    ভূপাল-কার কথা এতটাই দিনের আলোর মত সত্যি যে, সুধা তার বিন্দুমাত্র খন্ডন করতে পারলো না। ভাবনায় গলা যেন শুকিয়ে যাচ্ছিল সুধার। বার দুই গলা খাকরি মেরে বলল,“তাহলে এখন কি করা যায় বল তো ভূপাল-কা? প্রথম কাজ মুচিদের পাড়ায় এই গরু পড়ার কথাটা পৌঁছে দেওয়া। তাহলে ওদের পাড়ার কেউ না কেউ তো চামড়া ছাড়াতে আসবেই। তোর কথা মত ওই ছেলে ছোকরারা তো আসবে। কে এলো- ছোকরা কি ধেড়ে, তাতে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। গরুটার চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়াটাই আসল কথা। তাহলে সেই দূর নীলিমায় ভেসে বেড়ানো শকুনকুলের দৃষ্টি এখানে এসে পড়বেই পড়বে। এই বিশ্বাস আমার আছে। তুই যাই বলিস কাকা, শকুনের দৃষ্টি গ্রাম-শহর আলাদা করে পড়ে না। ওদের দৃষ্টি, ওদের সুষম খাদ্যের দিকে। সেই খাদ্য যেখানে থাকবে সেখানে ওরা ছুটে যাবে। হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক, এটা সকল জীবেরই ধর্ম। যেখানে খাবার সহজে পাওয়া যায় প্রথমেই মন সেদিকে দৃষ্টি ফেলে। শকুনরা তার থেকে আলাদা বা হবে কেমন করে। তুই যা-না খুড়ো, মুচিদের পাড়ায় একবার খবরটা দিয়ে আয় না। আমি ততক্ষণ এখানে বসে আছি। তুই না ফিরলে আমি এখান থেকে যাব না। সঙ্গে আসা অন্যদের বাড়ি চলে যেতে বলে সুধা কথামত ভাগাড়েই ভূপাল-কা না আসা পর্যন্ত বসে রইল।
    সেই প্রথম সকাল থেকে এই গরু নিয়ে সে দৌড়াদৌড়ি করছে। বেলা অনেকটা হয়ে গেল। মাঝ আকাশ থেকে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। এতটা বেলা হয়ে গেল, কিছুই খাওয়া হয়নি। খিদেতে পেট মোচড় দিচ্ছে। তবু কিচ্ছু করার নেই সুধার। ভূপাল-কা না ফেরা পর্যন্ত সে এখান থেকে যেতে পারবে না। কথা দিয়ে কথা খেলাপ করা ঠিক না। দৌলতপুরের চড়ার ধারের ভাগাড়ের কাছে পুরোনো বটগাছের ছায়ায় বসে সোজাসুজি রুইদাস পাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। দূরের আবছা দৃষ্টি খানিক পর আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়। ভুপাল-কা আর সঙ্গে একজন। ওটা মুচি পাড়ার ছেলে ছাড়া আর কে বা হবে। ছেলেটার পায়ের চলনে যেন কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ‘গা-গদগদ-খিদে মন্দ’র মত তার চলার ধরণ। তাড়া যত যেন ভূপাল-কার। তার থেকে একটু এগিয়ে এসে আবার থমকে তার চলনের তালে তাল মেলায়। আবার এগোয়। আবার পিছোয়। ওরা দু’জনে কোন কথা বলাবলি করে আসছে বলে মনে হচ্ছে না। ভাগাড়ে গরু পড়ার খবর পাবার পর ওদের মধ্যে যে উত্তেজনা সুধারা আগে দেখেছে, এই ছোকরার মধ্যে সেই চেনা উত্তেজনার রেশ বিন্দুমাত্র নেই!
    অবশেষে পা-পা করে এল বটে ওরা। কিন্তু ছেলেটা এসে সুধাদের একটু তফাতে বটগাছের গোড়ায় হাতে গরুর চামড়া ছাড়ানোর ছুরিটা নিয়ে বসে পড়ল। মুখে তার কোন কথা নেই। কাজে তার কোন তাড়া নেই ! মাঝে মাঝে গরুটার দিকে তাকায় আর তাদের পাড়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখে। ছেলেটার এমন ভাব দেখে আর চুপ করে থাকতে পারল না সুধা। মুখ খুলল, “এই ছোকরা, হাতে ছুরি নিয়ে চুপ করে বসে আছিস? কাজে হাত দিবি না? তোদের জন্যে তখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা। তুই একা? আর সব কোথায়, তোদের পাড়ার?
    “ওরা আসতেছে। মদ খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসতেছে বলল।” বলে, ছেলেটা আবার আগের মত চুপ করে বসে রইল। সুধা মনে মনে ভাবল, আর ছেলেগুলো না আসা অব্দি তারা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, এ ছেলেটা আবভাবে কেমন উল্টোপুরানে চলে। তারা যখন মদ খাচ্ছে তখন ওদেরও কিছু খাওয়া দরকার এই ফাঁকে। গ্যাঁট থেকে পয়সা বার করে ভূপাল-কা কে বলল, “কাকা, তুই দিঘিরপাড় থেকে কিছু খাবার নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে কিছু না খেয়ে চলে এসেছি। তোরও তো খাওয়া হয়নি। কি খাওয়া যায় বলতো? এত বেলায় তেমন টিফিন তো পাওয়া যাবে না। এক কাজ কর, কাকা। প্রদ্যুতের চা-দোকান থেকে দুটো কোয়ার্টার পাঁউরুটি নিবি। আর ভুতোর আনাজ দোকান থেকে দুটো বড় বড় শশা নিবি। ওটা জলের তেষ্টা মেটাবে। শুকনো পাঁউরুটি খাবার পর জল না খেলে বুকের ছাতি জল-জল করে ছটপটাবে। এই ধূ ধূ ভাগাড়, চড়া-ময়দানে কোথায় আর জল পাওয়া যাবে! শশাটা নিতে ভুলবি না কিন্তু কাকা। শহরের মত এখানে তো আর বোতলের জল কিনতে পাওয়া যায় না। ওটা না হলে পাঁউরুটি খাওয়াই যাবে না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যা কাকা। যাবি আর আসবি।” এই ভুপাল-কা তার বরাবরের ভীষণ নেওটা। সুধা যেখানে হালের কাজে যায়, জমির ঘাস ছেঁড়া, আল ছাঁদা, হালের তোলা মাটি এদিক ওদিক ফেলে জমির খালা উুঁচু জায়গা সমান করা- এইসব কাজ করে। ফাইফরমায়েসের কাজে ও বেশ পটু। তবে ভারি, তেজী কাজ ও তেমন পারে না। আসলে বয়েস হয়েছে তো। জোয়ানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে কেন। তাই ওই দলের কাজে ওকে বাবুরা নিতে চায় না। তবে সুধা যেখানে যায়, ভূপাল-কা কে নিয়ে যায়। ওর সঙ্গে থাকলে বাবুরা আর ‘না’ করতে পারে না। তাই যেখানে সুধা, সেখানে ভূপাল-কা। লোকে বলে ওরা নাকি মাণিকজোড়। তাতে সুধার কিছু যায় আসে না। একটা মানুষের ভালোর জন্যে যদি এই তকমা তার পেতে হয়, হোক না। তাতে তো তার কোন অসুবিধা নেই!

    ক্রমশ…

You cannot copy content of this page