গল্প
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৪)
জন্মসূত্র
–সুব্রত হালদার
[ বত্রিশ ]
গত কয়েক বছরের তুলনায় এই বছর কালবৈশাখীর দাপদাপানিটা যেন বড্ড বেশি দেখা যাচ্ছে। সেই চৈত্র মাস থেকে শুরু হয়েছে। সারা বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ দফে দফে কতবার যে ঝড় বৃষ্টি হ’ল তার ঠিক নেই। তারপর এই আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে মৌসুমী বায়ুর এমন হামলা দেখা যায় না। হাওয়া অফিস তো একটার পর একটা ফরমান দিয়ে চলেছে। মাঠে চাষে যেতে নিষেধ করছে বজ্রাঘাত থেকে চাষীদের প্রাণ বাঁচাতে তো নদী-সমুদ্রে ট্রলার-নৌকো ভাসাতে কড়া বার্তা দিয়ে চলেছে। ওদের কথা না মানলে তো আবার ঝড়ের গ্রাসে মাঝ সমুদ্রে ট্রলার মাঝি সমেত গায়েব হয়ে যাচ্ছে। খবরিয়ার দল টিভিতে, খবরের কাগজে, রেডিওতে মন্তব্য করছে, পৃথিবীতে গরমের হু হু করে বাড়বাড়ন্তর জন্যেই প্রকৃতি এই খামখেয়ালীপনা শুরু করেছে। এর জন্যে দায়ী মানুষই। এত কলকারখানা, এত যানবাহন, এত গাছপালা হুড়মুড়িয়ে কেটে সাফ করে দিলে মা ধরিত্রীকে ঠান্ডা করার সাধ্য কার! ফলে যা হবার তো হচ্ছে। দেখবি, আবার একটা সময় আসবে, এই অতিবৃষ্টি, খেয়ালীপনায় আবার অনাবৃষ্টির অবস্থার সৃষ্টি না হয়। তখন তো আবার আমাদের এই জলের জন্যে আসমান পানে দু’হাতের আঁজলা পেতে,‘জল জল’ করে হাপিত্যেশ করে যেতে হবে। পাই ধরে একই জমিতে ‘আগো চাষ’ দিতে দিতে কথায় কথায় বলছিল দুই হালের কাঁড়া’র দুই হেলো, সুধা আর কাসেম। হ্যাট্ হ্যাট্ করে নাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে সুধা একটু এগিয়ে যায়। কাসেম যায় সুধার থেকে খানিক পেছিয়ে। একসাথে নাঙ্গল ঠেলার সময় আগুপেছু বেশি ফারাক হলে আবার চলে না। পাই ঘেঁটে যায়। তাই কাসেম বলল,“সুধা, দাঁড়িয়ে যা। আমার বাঁয়াটা একটু কমজোরি আছে। সেই একহপ্তা হয়ে গেল ‘হাটগেছের’ মাঠে চাষের সময় নাঙ্গলের ফলাটা বাঁয়ার খুরের ভেতর গুঁজে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি। গরুটাও তখন কোন গুরুত্ব দেয়নি। দিলে তখনই সে খোঁড়াতো। কিন্তু হাল ছেড়ে যখন জোত খুলে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরছি, তখনই বেটা খোঁড়াতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ব্যথাটা বাড়ে আর কি। পা ধরে তুলে দেখি তখনও রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়া গাছের পাতা হাতে কচলে তার রস দিলাম। বাড়িতে গিয়ে শুকনো লঙ্কা-তেল গরম করে লাগালাম। তখন বেটা বেশ পা ছটকাচ্ছিল। তারপর জাবনা খেয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে দেখি আর খোঁড়াচ্ছে না গরুটা। ওখানেই আমার ভুল হয়েছিল, পরের দিন আবার হাল নিয়ে মাঠে নামা। ঘা-টা তো পুরো সারলো না। আবার সেই পা নিয়ে শক্ত আগো মাটি ভাঙতে গিয়ে তাতে বারবার আঘাত লাগে। পরদিন আবার খোঁড়াতে লাগল। বিডিওতে ডাক্তারের কাছে যেতে ডাক্তার ওষুধ-ইঞ্জেকশন দিল। বলল, “এখন এক সপ্তা গরুকে জিরেন দিতে হবে। নাহলে তোমার এই বর্ষার চাষে এ গরুকে আর কাজে লাগাতে পারবে না।” তাই করলাম। কিন্তু সেই থেকে গরুটা যেন অনেকটা কমজোরি হয়ে গেল। ডাঁয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারে না। আবার যদি সে জখম হয়ে যায়! সেই ভয়ে আমিও আর বাঁয়াকে চাপাচাপি করি না। সুধা, তুই একটু থাম। গরুজোড়াকে খানিক জিরেন দিই। সেইসঙ্গে আমরাও দু-চার ফুঁক বিড়ির টান দিয়ে নিই।” কাসেমের কথায় সুধা তার হালজোড়া থামিয়ে দেয়,“চল তা’লে কাসেম। জমির আলে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। ঘন্টাদুই হয়ে গেল আমরা জিরেন নিইনি। আমাদের সঙ্গে গরুরাও খেটে চলেছে। দু’তরফেরই একটু বিশ্রাম দরকার।”
ক’দিনের বৃষ্টিতে জমিতে মইচাপ জল দাঁড়িয়ে গেছে। সেই জলে হাতটা ধুয়ে নেয় কাসেম। ভিজে হাতটা গামছার এক খোঁটে মুছে অন্য খোঁটে পলিথিনের ছোট্ট থলেতে জড়িয়ে রাখা বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই সতর্ক হয়ে বার করে। যাতে দেশলাই বাক্স আবার ভিজে না যায়। তাহলে তো আর তাতে কাঠি ঘসে আগুনের জন্ম দেওয়া হয়ে উঠবে না। বিড়ি ফোঁকারও দফারফা হয়ে যাবে। পেরেছে কাসেম। দেশলাই কাঠিতে আগুনকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে পেরে মনে মনে পরীক্ষায় পাশের গর্ববোধ করে। এরপর আর সময় খুইয়ে দেবার উপায় নেই। বিড়িটা কাঠির আগুনের সামনে আহুতি দিয়ে ফুঁক ফুঁক করে দু-চারটে লম্বা টান মেরে মুখের ভেতর একগাদা ধোঁয়া ভরে নিল। ওদিকে বাঁ হাতে নিজের বিড়িটা ধরে ডান হাতটা বাড়িয়ে আছে কাসেমের দিকে সুধা। ও জানে প্রথম দফায় ক’টা সুখটান দিয়েই কাসেম তার দিকে ধরানো বিড়িটা বাড়িয়ে দেবে। সুধা সেই বিড়ির আগুনে নিজের বিড়ি ফুঁকিয়ে কয়েকবার টেনে আগুন হস্তান্তর করে নিল। এইসময় এই পরিবেশে ওরা, চাষীরা অভ্যস্ত আগুন হস্তান্তরে। এখানে জাত বেজাত, উঁচু নীচুর কোন বালাই নেই। একটাই শ্রেণী, একটাই সম্প্রদায় তখন ওরা। ওরা কৃষিপ্রধান দেশের কৃষক সম্প্রদায়। অন্য সব কথিত ধর্ম সম্প্রদায় এখানে এসে একাকার হয়ে গেছে।
নিজের বিড়ি ধরিয়ে সুধা বলল,“তবু তো নাবি-বর্ষার দৌলতে শুকনো খটখটে জমির এখন অনেকটাই রাগ কমে গেছে। তাই আমাদের নাঙ্গল কত সহজে জমির আগো ভাঙতে পারছে। গরুগুলোরও কষ্ট কম হচ্ছে। না’হলে খটখটে জমির আগো ভাঙতে গরুর যা কষ্ট।” সুধার কথার খেই ধরে কাসেম বলল,“শুধু গরুর কেন, হেলোদের বুঝি কম কষ্ট হয়? শালা, নাঙ্গলের মুঠো চেপে ধরে থাকতে থাকতে দাবনা গজে যাবার জোগাড় হয় না বুঝি?”
-তা যা বলেছিস তুই। সন্ধ্যে বাড়ি ফিরে গায়ে যেন ‘তার’ থাকে না। খাওয়াদাওয়ার পর বউ উশম গরম তেল দিয়ে মালিশ করলে তবে যেন ব্যথা শরীর থেকে ছাড়ান দেয়। পরের দিন আবার নতুন দমে বলদ জোড়া নিয়ে হালে নামতে পারি।
সুধা এই ‘নতুন দমের’ কথা বলতেই কেমন যেন উদাস হয়ে আসমানের দিকে চোখ রাখল কাসেম,“এই নতুন দমে কতদিন জমি চাষে তোদের দরকার হয় দেখ। এখন এই যে মানুষ হাল চাষের জন্যে তোর আমার, যাদের জোড়া বলদের কাঁড়া আছে তাদের এত কদর করে। মনে হয় এই কদর আর আমরা বেশিদিন উপভোগ করতে পারব নারে সুধা। এমন দিন সামনে এগিয়ে আসছে, সেইদিন মানুষ আর আমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। আমাদের এই হম্বিতম্বি একদিন ঘুচে যাবে। এই যে লোকে রোজ সন্ধ্যে বা ভোরে আমাদের বাড়ি উজিয়ে এসে তাদের জমি চষে দেবার জন্যে অনুরোধ উপরোধ করে। আর আমরা, ‘আজ হবে না বাবু, কাল, পরশু দেখব। কাল হালদারদের হবে তো পরশু মন্ডলদের। তারপর তোমাদের।’এইসব বলে দর হাঁকাইয়ের দিনগুলোর অস্ত যাবার সময় হয়ে এসেছে।” কাসেমের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুধা। বিড়ির শেষের দিকে ফুক ফুক করে ঘনঘন দুটো লম্বা টান দিয়ে তা জমির জলে ফেলে দিতে ‘চোঁক’ শব্দ ঠিকরে আসে সেদিক থেকে। মুহূর্তের জন্যে সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে আনে কাসেমের দিকে! এবার একগাদা প্রশ্নমুখো হয়ে কাসেমকে বলে,“এত গম্ভীর মুখে এই কথা হঠাৎ তুই বলছিস যে কাসেম? কি এমন হল, যে অমন উদাস হয়ে ভয়-ভয় মনে বললি কথাগুলো? আমাকে ভড়কে দিতে চাইছিস, তাই না? তোর ওই ভড়কানিতে আমি ভিজে যাবার লোক না বুঝলি? অত বোকা নই আমি। হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, একটা উদ্ভট কথা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছিস, বল? যা-তো, হচ্ছে চাষবাসের কথা। কোথা থেকে ভড়ংবাজি দিয়ে দিলি, কি না আমাদের সামনে সমূহ বিপদ। তা আমাদের মত গরিবদের বিপদ তো ডাঁয়ে বাঁয়ে সব সময়। ও আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওতে ভয় পেলে আমাদের চলবে নাকি। তাহলে তো বউ-ছেলে-সংসার নিয়ে বাঁচাই দায় হয়ে যাবে। ওসব আজেবাজে কথা ছাড়ান দে,কাসেম। চল। এবেলা এই বন্দেটা সারতে হবে। বিকেলে হাটগাছার মাঠে আমাদের যেতে হবে। ওটা সারা হয়ে গেলে হালদার বাবুর কাজটা আপাতত শেষ হবে। পরদিন সকালে ভূতবাড়ির কাছে দাসেদের দেড় বিঘেটা ধরতে হবে।”
-এতটা জায়গা একবেলাতে কেমন করে সারবি? জায়গার মাপটা একবার আঁচ করে দেখেছিস? নাকি থাবগো একটা কিছু ভেবে বলে দিলি, এবেলা সারা হয়ে যাবে! যদি বিকেলে হাটগাছায় যেতেই হয়, হালদার বাবুদের কথা দিয়ে থাকিস তো তাহলে এক কাজ করি আয়। এখন একেবারে এক টাইমের ‘চৌপুরো’ কাজ করে এটা সেরে নিই। তাছাড়া উপায় দেখছি না। কাসেম বলল। কাসেমের কথায় সায় দিয়ে সুধা বলল,“কথাটা তুই একদম ভুল বলিসনি কাসেম। আমি তখন অতটা তলিয়ে ভাবিনি। এক বেলায় পারা যাবে না। চাপাচাপি করেও হবে না দেখছি। চৌপুরো মেরে না গেলে সবদিক সামলানো যাবে না দেখছি। অন্য দিনের জন্যে খিঁচ জায়গাটার ‘আগো-ভাঙা’ ফেলে রাখা ঠিক হবে না। কবে আবার এইটুকুর জন্যে এদিকে আসা হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। এই আমন চাষের সময় আমাদের ঝামেলার আর শেষ থাকে না। সবাই চায় তার জমি আগে হাল হয়ে যাক। কিন্তু রোগী ছটফট করলে কি ডাক্তার ছটফটাবে? ফটাবে না। যার কথা না রাখা হবে তার গোঁসা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দিকটাও তো বাবুদের ভাবা দরকার। এরা আবার আমাদের ছাড়া অন্য হেলোদের কাছে যাবে না। বাবুরা বলে কি না, তোদের মত দরদ দিয়ে অন্যরা এত সুন্দর জমি কাদা করতে পারে না। তা ভালো জিনিস পেতে গেলে একটু তো ধৈর্য ধরতে হবে, কি বল তুই কাসেম?
-তোর কথাটা একদম ফেলনা নয় তা মানছি। কিন্তু মানুষের মন তো। থিতু হতে চায় না। একজনের জমিতে নাঙ্গল পড়লে অন্যজনও চায় তারটাতেও নাঙ্গল নামুক। আর বর্ষার প্রথম ঝটকায় রোয়া সারতে পারলে তাড়াতাড়ি গাছের মাটি ধরে নিতে সহজ হয়। সুস্থ সবল গাছ হলে পোকা মাকড়ের হামলা সামলে নিতে পারে। ওই তো, ওই জন্যেই না শিবুবাবুর ছেলে শুভবাবু, কথায় কথায় ছড়া কেটে বলে,‘লাগালাগি বাস, দেখাদেখি চাষ।’ একজনের চাষ শুরু হলে অন্যরাও হামলে পড়ে তাদের জমি কত তাড়াতাড়ি চাষ সেরে ফেলা যায়। আর আমরা হেলোরা বাবুদের ইচ্ছেকে থমকে দিতে থাকি। আসলে আমাদের ক্ষমতার তো একটা সীমা আছে। গরু তো আর মেশিন নয়। যত খুশি খাটানো যাবে। সেও তো মানুষের মত একটা জীব। মানুষের মত তার শরীরকেও তো জিরেন দিতে হয়। নাহলে সে লড়বে কেমন করে। তাই মানুষের চাওয়ার সীমার সঙ্গে আমাদের গতর দেবার সীমার তফাৎ তো থাকবেই। আসল গোলটা সেখানেই। গতর খাটাবার সীমাই এখানে যত ঝামেলার মূলে। অত তলিয়ে এসব কথা যেমন আমরা ভাবি না, তেমনি বাবুরাও ভাবে না। ভাবলে এই মন কষাকষি আর থাকে না। কিন্তু এখানে আমাদেরই বা কি করার আছে বল, কাসেম। এটা তো সকলকে বুঝতে হবে। না বুঝে উপায় বা কি। এর বিকল্প তো আর হবার উপায় নেই। আমাদের যেমন বাবুদের উপর ভরসা করতে হবে। বাবুরাও আমাদের ফেলে যাবে বা কোথায়। আমাদের হাল পছন্দ না হলে অন্য কারোর হাল, তার কাজ অপছন্দ হলে আর একজনের কাছে যেতে হবে। আমাদের মত যেকোন হেলোর কাছেই বাবুদের যেতে হবে। নাহলে চাষ বন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে। জমি বন্ধ্যা করে ফেলে রাখতে হবে। তা তো কেউ করতে পারবে না। খাবে কি তাহলে মানুষ!
সুধার কথায় মনের ভেতর শ্লেষের হাসি খেলে গেল কাসেমের। তুই কোন খোঁজখবর যে রাখিস না সুধা, তা তোর এই কথায় বোঝাই যাচ্ছে। তাই আমি যখন বললাম, আমাদের এই সুদিন আর বেশিদিন নেই, তখন তুই আমাকে হেলায় উড়িয়ে দিতে পারলি। কিন্তু তুই কি জানিস, আমাদের এখান থেকে ছ’ সাত কিলোমিটার দূরে, ঈশ্বরীপুর গ্রামের মাঠে ইঞ্জিন-হাল নেমে গেছে! এই ইঞ্জিনওয়ালা হ্যান্ড ট্রাক্টর দিয়ে মানুষ একদিনে বিঘের পর বিঘে জমি চষে নিচ্ছে! হ্যাঁ, এটা ঠিক, এই হ্যান্ড ট্রাক্টর হাঁটুর উপর, কোমর জলে চলবে না। ইঞ্জিন ডুবে গেলে তার চলা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমাদের গরুর কাঁড়া দরকার পড়বে। কিন্তু যদিও এখনো আমাদের রাজ্যে, জমিতে বড় চাকার বিশাল বিশাল ফলার ট্রাক্টর নামেনি। ওগুলো কিন্তু আমাদের দেশের অন্য প্রদেশে চালু হয়ে গেছে বহুদিন আগে থেকে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার মত আরও অনেক উন্নত উচ্চ ফলনশীল চাষ এলাকায় এগুলো ছেয়ে গেছে। তা সেই বড় ট্রাক্টর আমাদের এদিকে আসতে যে আর বেশি দেরি হবে না, তার নমুনা ওই হ্যান্ড ট্রাক্টর। কম জলে বা শুকনো জমিতে এই ইঞ্জিন ট্রাক্টরের দাপটের সামনে গরুর হাল যে খাপ খুলতে পারবে না তা পাগলেরও বুঝতে অসুবিধে হবার কথা না। মনের আতঙ্ক মনের ভেতর পুষে রেখে কাসেম বলল,“চল সুধা। আর বসে থেকে বেলা চড়িয়ে লাভ নেই। কাজ যখন আমাদের করতে হবে তখন করেই ফেলা যাক।”
মাঠে নেমে এবার সুধা বলল,“কাসেম, তোর গরুটা যেকালে কমজোরি, তো এক কাজ কর। তোর গরুর জোতটা নিয়ে তুই আমার আগে যা। আমি তোর পেছনে থাকি। তাহলে তোর জোতের বশে আমি যেতে পারব। তখন আর আগুপেছু হতে হবে না আমাদের। গরু দমে গেলে হেলোর যা কষ্ট তা আমি খুব ভাল করে জানি। আমার ডাইনেটা যখন বয়সের টানে কমজোরি হতে লাগল। কিছুতেই আমার মনের টানে সে টান দিতে পারছিল না। তখন অতটা বুঝিনি যে ওর বয়স হয়ে যাচ্ছে। সেই যৌবনের শক্তি আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছে ও। সেটা না বুঝে কম কঞ্চির ঘা খেয়েছে ও! বাড়িতে গিয়ে কম চেল্লাচেল্লি করেছি? বউ তখন সতর্ক করে আমাকে বলল, “ওর বয়সটা কত হয়েছে তুমি খেয়াল রেখেছ? প্রায় দশ বছর হয়ে গেল ও তোমার হাল টানছে। কত খাটাবে তুমি একটা অবলা জীবকে? তুমি এখন যেমন তাগদ নিয়ে খাটতে পারছো, বুড়ো বয়সে পারবে?” তখনই আমার টনক নড়ে। সেইজন্যেই তো এ বছর এই ডায়নেটা কিনলাম। সে তো তুই সবই জানিস, কাসেম।”
-তা তোমার বুড়োটাকে তো তোমরা বুড়ো বাবা-মায়ের মত ঘরে লালন পালন করো। আমাদের জাতের মত কুরবানির জন্যে গরু-হাটে বেচে দাও না। তা সে তোমাদের নিয়মে যা হয় তাই করো। পরে মরে গেলে ভাগাড়ে ফেলে দাও। সেটা অবশ্য একটা ভাল কাজ। ভাগাড়ে ফেললে কত শকুনের খিদে মেটে। না হলে ওরাই বা যায় কোথায়। খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে তো জীব জগৎ চলে। এটা না থাকলে সৃষ্টি যে আবার লোপাট হয়ে যায়।
-শুধু শকুনের কথা বলছিস কেন কাসেম? মানুষও তো ঘুরিয়ে পেটের খিদে মেটায় এই মরা গরুকে সম্বল করে। তুই মুচি- রুইদাসদের কথা ভুলে গেলি! ভাগাড়ে গরু পড়লে তবেই না ওরা তাদের ছাল-চামড়া জোগাড় করতে পারে? সেই চামড়ায় ঢাক ঢোল জুতো আরও কত কি চামড়ার জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালায়। সে কথাটা বাদ দিলে তো চলবে না। জ্যান্ত হাতির মত মরা হাতিও যেমন লক্ষাধিক টাকায় বিকোয়, তেমনি জ্যান্ত গরুর মত মরা গরুরও কদর আমাদের সমাজে কম না। আর একটা কথা শুধাই তোকে কাসেম, একটা পশুকে বছরের পর বছর ঘরে পালন করতে করতে তাকেও না, পরিবারের অন্য সদস্যের মত আমরা আপনজন মনে করে ফেলি। সেইজন্যে যতই সে পশু হোক, তাকে ত্যাগ করতে আমাদের জাতের মানুষদের মনে খোঁচা লাগে। মরণ পর্যন্ত তাকে কাছে রাখতে চাই আমরা। তা সে ছাগল, মুরগি যাই হোক। আর গরুর বেলায় তো কথাই নেই। আমাদের শাস্ত্রেই তো তাকে সম্মানের সঙ্গে জায়গা করে দেয়া হয়েছে। এই যে ছাগল, মুরগি, আজন্ম পুষে যখন অর্থের কারণে তাকে ফেরিওয়ালার কাছে বেচে দেয়া হয়, মনটা ডুকরে ওঠে। মেয়েরা তো কাঁদতে শুরু করে। তবু, ওই যে বললি, খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের কারণেই জীব জগৎ টিকে থাকে। সেই বেঁচে বর্তে থাকার জন্যে আবার মনকে দমিয়ে রাখতে হয়।” সুধার কথায় সায় দিয়ে কাসেম বলল,“ঠিক কথাই বলেছিস তুই। তোদের মনের কথা আর আমাদের মনের কথায় কোন ফারাক নেই রে সুধা।”
মাঝ আকাশের সূর্য ক্রমশ পশ্চিম দিকে কাত খেতে শুরু করেছে। সুধা সেটা খেয়াল করল। ভেবে নিল এইভাবে ধীর গতিতে যদি তাদের হাল চলতে থাকে তো বাকি জমির যতটা চষতে বাকি আছে তা চৌপুরোতেও শেষ হবে না। কাসেমের বাঁয়াটা সত্যি সত্যি তাগৎ নিয়ে এগোতে পারছে না। ওর পায়ে যে একটা কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। আর কাসেমকে তাড়া দিয়েও তাই কাজের কাজ কিছু হবে না। তাড়া দিলে ও তখন গরুটাকে হাতের কঞ্চির বেত দিয়ে কাপসাতে শুরু করবে। ওইভাবে পশুপীড়ন করাটাও ঠিক না। ও বেটার সেই বোধ আছে বলে মনে হয় না। যখন তখন গরুকে কাপসায়। আরে বাবা ওরা তো মানুষ না হলেও ভগবানের দেওয়া জ্যান্ত জীব। প্রহার করলে আমাদের মত ওরাও তো যন্ত্রণা পায়। তাই সুধা ঠিক করল কাসেমের কাঁড়াকে জমি চষা থেকে তুলে দিতে বলবে সে। ওকে তুলে ও তার হাল নিয়ে তাড়াতাড়ি চালিয়ে সময়ের মধ্যে কাজ সেরে নেবে। না হলে, সুধার ইচ্ছে থাকলেও কাসেমের জন্যে সে এগোতে পারছে না। সেইমত সুধা কাসেমকে বলল, “তুই এক কাজ কর কাসেম, তুই তোর জোড়া নিয়ে উঠে পড়। তোর বাঁয়াটা থমকাচ্ছে। তাই তোর ইচ্ছে থাকলেও তুই এগোতে পারছিস না। এই বাকিটুকু আমি তাড়াতাড়ি হাল চালিয়ে শেষ করে নিচ্ছি। তুই ততক্ষণে ওদের কাঁধের জোল নামিয়ে মুখের জালতি খুলে দে। ওদের একটু ঘাস খাইয়ে দে।”
সুধার কথা মত কাসেম মাঠ থেকে উঠে পড়ল। জালতি খুলে দিল ঠিকই তবে একেবারে ছেড়ে দিল না। নিয়ম মত সিংয়ে দড়ি বেঁধে দুটো গরুর খোঁটা নিজের হাতে রেখে দিল। নাহলে পাশে যারা ধান গাছ রুয়ে গেছে, তাদের রোয়া খেয়ে নিলে ঝামেলায় পড়তে হবে। গরু-গাধাদের তো আর ওইসব জ্ঞানগম্মী নেই যে কোনটা ঘাস আর কোনটা ধানের চারা বোনা। বাঁয়াটার কাছে গিয়ে পায়ের খুরের ভেতর ঘা-টার কি অবস্থা দেখল। এখনো ভাল করে শুকোয় নি। তার উপর এই জলকাদা ওর ভেতর ঢুকছে। শুকোবার ফুরসতই তো পাচ্ছে না ও। মাঠে জমে থাকা জল একমুখ ভরে পিচকিরির মত সরু করে কয়েকবার ছিটিয়ে দিল খুরের গলাসির ভেতর। সেখান থেকে আটকে থাকা কাদা সব বেরিয়ে গেল। গরুটা কি শান্তভাবে তাকে কাজটা করতে দিল। কোন ছটফট করল না। অন্য সময় হলে পা ছটকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করত। আসলে কাদা বেরিয়ে যাচ্ছে, ওর আরাম হচ্ছে। গলা উঁচিয়ে শান্তভাবে কেমন দাঁড়িয়ে আছে। ডাইনের থেকে বাঁয়াটার বয়সও অনেকটা বেশি। বুড়োর দিকে ঢলে যাচ্ছে তার বয়স। এমনিতেই বেশিদিন হাল টানতে পারবে না। এই মরসুমটা যদি বা টেনেটুনে চালিয়ে দিতে পারে তো সামনের মরসুমে এদের দিয়ে কাজ হবে কি না বলা যাচ্ছে না। তার উপর ওর এই পায়ে ঘা। অনেকদিন ধরেই সারছে না। কি হবে বলা যাচ্ছে না। আদৌ তা সারবে কি না কে জানে। এইসব চিন্তা করতে করতে কাসেম গলা বাড়িয়ে সুধাকে বলল,“জানিস সুধা, আমার এই বাঁয়াটা যদি আর কাজে না লাগে তো আমি নতুন করে আর গরু কিনবো না। ডাঁয়াটা বেচে দিয়ে হালের কাঁড়া তুলে দেব।”
কাসেমের কথায় চমকে ওঠে সুধা! আস্তে আস্তে চলন্ত হালের কাঁড়া থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,“কি বললি তুই কাসেম! কাঁড়া তুলে দিবি! কেন, হঠাৎ কি এমন ঘটল যে তুই এমন অলক্ষুণে চিন্তা করছিস? হালের কাঁড়া তুলে দিলে তুই খাবি কি? বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখ-দুঃখে দিন চলে যাচ্ছে, তা বুঝি সহ্য হচ্ছে না?” বলতে বলতে আকাশের দিকে চোখ উঠতে, বেলা গড়ানের ইঙ্গিত দেখে আবার হাল চালু করতে করতে সুধা বলল, “তোকে দেখছি জমি থেকে তুলে দিয়ে ঠিক হল না। উঠেই আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে বকরবকর করে চলেছিস। এ’কথা আমি তো ভাবতেই পারছি না। তাই আমার বুড়োটাকে ঘরে রেখে এই জোয়ানটাকে ঘরে তুললাম।”
-সে তুই ঘরে তুলেছিস, ভুল কাজ করিসনি। কিন্তু নতুন করে আমি যদি তুলি তো মস্ত ভুল হয়ে যাবে আমার। এই ভুল আমি জেনে বুঝে করতে পারব না। তোর হাল-জোড়া, বলতে গেলে একদম নাবী। সর্বনাশা পরিস্থিতি আমাদের উপর আছড়ে পড়তে পড়তে তোর জোড়া ততক্ষণে বুড়ো হবার সময় হয়ে যাবে। তখন তুইও আমার মত ভাবতে শুরু করবি।
-কেন তুই এমন অলক্ষুণে কথা বলতে শুরু করেছিস বলতো, কাসেম? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তোর মাথা-টাথা খারাপ হল কি না বলতো?
-ঈশ্বরীপুরের মত আর একটা হ্যান্ড ট্রাক্টর পশ্চিম দেবীপুরে নেমেছে। সে খবর তুই রেখেছিস? এবার আস্তে আস্তে পূর্ব দেবীপুর, বাসুদেবপুর তারপর দৌলতপুর, বয়ারিয়া, উলকুনী, কোদালিয়া- চারদিক ছেয়ে যাবে। তুই শুধু এই বর্ষাটা কাটতে দে না। তারপর দেখবি তাদের রমরমা আছে কোথায়! তখন আমার না, তোরই মাথা-টাথা খারাপ হবার জোগাড় হয়ে দাঁড়াবে, দেখে নিস। খানিক চুপ করে রইল ওরা দু’জনেই। তারপর কাসেম আবার বলল, “কিরে সুধা, একেবারে চুপ মেরে গেলি যে? এতক্ষণ তো আমার কথা হুড়িয়ে দিচ্ছিলিস। এবার বুঝি মগজে সেঁধিয়েছে, কথাগুলো?” এবার হ্যাট হ্যাট করে গরু তাড়িয়ে নাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে সুধা বলল, “তুই শালাই তো আমার মনে ভয় সেঁধিয়ে দিচ্ছিস। চুপ হয়ে যাব না তো কি করব। তোর কথা যদি সত্যি হয় তো তাহলে আমাদের জীবন তছনছ হয়ে যাবে রে কাসেম। চাষীর সমাজে ‘হেলো’ বলে অন্য মজুরদের থেকে যে বাড়তি কদর পেতাম তা তো ঘুচে যাবার দিন সামনে আগত। পেট বাঁচাতে আবার সেই জন-মজুরের দলে মাথা গুঁজতে হবে। কাম-হাঙর যখন একবার তাদের কামের বুকে থাবা বসাতে শুরু করেছে, সত্যিই তো একদিন আসবে, ও বেটা তাদের গিলে খাবেই খাবে।” বলতে বলতে মনমরা হয়ে গেল সুধা। এতটাই দমে গেল যে আর যেন সে হাল চালাতে পারছিল না। গায়ের জোর হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু আরও তো দুটো পাই চষতে বাকি আছে। এটা শেষ করে তবে কাঁড়া তুলতে হবে। অগত্যা সে কাসেমকেই বলল, “কাসেম, তুই এইটুকু হাল টেনে দে। আমি যেন আর টানতে পারছি না। তোর জোড়ার খোঁটা আমি ততক্ষণে ধরছি।” কাসেমের বেঁধে রাখা গরু দুটোর খোঁটা ধরে ঘাষ খাওয়াতে খাওয়াতে সুধা ভাবতে লাগল, ওই ইঞ্জিন-হাল সত্যি সত্যি একদিন তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে। কিন্তু তাদের মত হেলোরা যদি এক জোট হয়ে এই যন্ত্রকে মাঠে নামতে না দেয় তো রক্ষা পেতে পারে তাদের ভবিষ্যৎ দুর্ভাগ্য। যেখানে হালের ট্রাক্টর দেখা পাওয়া যাবে সেখানে সবাই মিলে গিয়ে তার ড্রাইভারকে পিটিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বাধ্য করবে। ‘প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে হয়।’ প্রচলিত এই কথার খেই ধরে সুধা ভাবল, সবে ট্রাক্টর-হাল মাঠে নামা শুরু করেছে। তাই প্রথম এই যন্ত্র মাঠে নামানো তাদের আটকাতে হবে। তবে যদি তারা বাঁচে।
বাকি হালটুকু শেষ করে কাসেম, সুধার গরুর কাঁড়া তুলে নিল। জোয়াল, নাঙল খুলে ওরা দুজনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সুধা, কাসেমকে তার ভাবনার কথা বলতে কাসেম বলল, “তুই যা ভাবছিস সেটা করলে মন্দ হয় না। একটা প্রতিবাদ করা যেতেই পারে। না হলে ট্রাক্টরওলারা তাদের নাকের ডকা দিয়ে ‘ফাঁকা মাঠে লাঠি ঘুরিয়ে’ পার পেয়ে যাবে। তবে আর একটা কথা কি জানিস সুধা, আমাদের চাপে হয়তো ট্রাক্টরওলা হাল না করে ফিরে যাবে। কিন্তু কতদিন আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতে পারব তার কোন ঠিক ঠিকানা থাকবে না বলে আমার মনে হয়। যাদের জমি ওই মেশিন-হাল চাষ করবে তারা যদি জোর করে তাদের ডেকে নিয়ে আসে আর বলে, কে বাধা দিতে আসে দেখব। যারা বাধা দিতে আসবে তাদের আমরা দেখে নেব। তখন তো একটা বড় গন্ডগোলের মধ্যে আমাদের জড়িয়ে পড়তে হবে। মারপিট, থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে। আমরা ছা-পোষা মানুষ। দিন আনি দিন খাই। ওইসব থানা-পুলিশ সামলানোর ক্ষমতা আমাদের আছে? নেই। যদি লকআপে দশদিন পুরে রাখে, বউ-বাচ্চা তো না খেতে পেয়ে মরে যাবে। আমাদের গরিবদের হয়ে কেউ বলতে আসবে না। উল্টে বাবুরা বলবে, এতদিন তোদের মেজাজে তেল মাখিয়ে আমাদের চলতে হত। যখন ইচ্ছে কাজে আসতিস। যখন ইচ্ছে আসতিস না। এখন তোদের বিকল্প আমরা পেয়ে গেছি। তোদের ভাল হল কি মন্দ হল তা দেখে আমাদের আর কাজ নেই। এতদিন তোদের হালের খামখেয়ালির উপর আমাদের চাষের ভাগ্য ঠিক হত। এখন এই ট্রাক্টর একদিনে বিঘের পর বিঘে জমি হাল দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর গরুর হালের মুখ চেয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সেই অপেক্ষার দিন শেষ।”
-তা আমাদের গরুর হালের ক্ষমতার তো একটা সীমা আছে। আমরা সকলের
মনের সঙ্গে দৌড়ে হাল দৌড় করাবো কেমন করে কাসেম? তা তো সম্ভব নয়। তবু বাবুরা আমাদের জীবন জীবিকার কথা একবারও ভাববে না!
-এখানে কেউ কারোর ভালোর কথা ভাবে না রে সুধা। সব দেনা-পাওনার হিসেব কষে চলে। ইঞ্চিন হালের খরচও নাকি আমাদের গরুর হালের থেকে কম। একটা জমি চষলে আমরা তিনজনের খরচ নিই। দুই গরু আর হেলো। সেখানে ইঞ্জিন ঘন্টার হিসেবে দাম নেয়। তাতে নাকি গড়ে অনেকটা খরচ কমে আমাদের থেকে। তাহলে বাবুরা আমাদের মুখ চেয়ে কেন গ্যাঁটের কড়ি বেশি খরচ করতে যাবে! যাবে না। কিছুতেই যাবে না। তা ইঞ্জিন জমি চষে যাবার পর সেই কাদা মাটি সমান করার জন্যে তো মই দিতে হবে। সেটার জন্যে এখনো ইঞ্জিন তৈরী হয়নি। এই হেলোদের তখন ডাক পড়বে। তখন একটু কদর পাব আমরা। না হলে জমি রোয়া যাবে না। তা ওই মই দেবার জন্যে আর কটা হালের কাঁড়া লাগবে। তাতেও দুর্ভাগ্য আমাদের থেকে ছাড়ান দেবার নয়।ক্রমশ…
-
গল্প- বিষ
বিষ
-মুনমুন রাহাআজকের রবিবারটা অন্য রবিবারগুলোর মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্ত সকালে বাজার থেকে এসে নিশিত যা খবর দিল তাতে মান্তুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মান্তুদের পাড়ায় অম্বিক আর তার বৌ নীতা নাকি একসাথে বিষ খেয়েছে। সকালের রান্নার লোক এসে অনেক ডাকাডাকি করেও যখন তুলতে পারেনি তখন পাড়ার ছেলেদের খবর দেয় আর তারপর তারাই দরজা ভেঙে দুটো মৃতদেহ উদ্ধার করে।
খবরটা শুনে থেকে মান্তুর মনটা কেমন যেন খচখচ করছে। খুব যে আলাপ ছিল ওদের সাথে তেমন নয়। কিন্ত নীতা মেয়েটাকে অফিস যাওয়ার পথে মাঝেমাঝেই দেখত মান্তু । কেমন যেন উদাস চোখে জানলার বাইরে দেখত। মুখ চেনা ছিল তাই চোখাচোখি হলে হাসি বিনিময় হত। কিন্ত ঐটুকুই। এর বেশি সেভাবে আলাপ ছিল না মান্তুর সাথে । আরও ভালো করে বলতে গেলে নীতার সাথে পাড়ার কারোরই সেভাবে আলাপ ছিল না । কেমন যেন ঘরকুনো প্রকৃতির মেয়েটা। অম্বিক বরাবরই নিজেকে নিয়েই থাকত । পাড়াতে খুব একটা মিশত না। কিন্ত সবাই ভেবেছিল ওর বৌ এসে এই দূরত্ব ঘোচাবে। কিন্ত বৌ নীতাও স্বামী অম্বিকের পথই অবলম্বন করল।
তবে মান্তু অম্বিকদের খবর মাঝেমাঝেই পেত পম্পার কাছ থেকে। পম্পা হল মান্তুদের বাসন মাজার লোক । সে আবার নীতাদের বাড়িতেও কাজ করত। সে মাঝেমাঝেই বলত অম্বিকের পয়সা থাকলেও নাকি তার মন খুব ছোট। নীতার আর অম্বিকের নাকি মিলমিশ নেই। আরও নানান কথা বলত কিন্ত মান্তু কোনোদিনই উৎসাহ দেখাত না এসব কথায়। অন্য লোকের হাঁড়ির খবর শুনতে কেমন যেন রুচিতে বাধত মান্তুর।
পরদিন সোমবার হলেও অফিস যায় নি মান্তু । ইচ্ছা একবার মায়ের কাছে যাওয়ার। পম্পা রবিবার দিন কাজে আসেনি । আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছে। পম্পা একটু চুপচাপ। চোখগুলোও কেমন ফোলাফোলা। মান্তু আজ আর নিজেকে সামলাতে পারে না । সব দ্বিধা দূর করে মান্তুকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে, নীতার এমন কথা শুনে কাল খুব কেঁদেছিস বুঝি ! কি করবি বল সবই নিয়তি। আচ্ছা, এই তো তুই বলতিস স্বামী স্ত্রীর বনিবনা হতো না ! তাহলে একসাথে বিষ খেল কেন? জানিস তুই কিছু? আমি অফিস যাওয়ার পথে দেখতাম নীতা জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত। হ্যাঁ রে প্রেমটেম কিছু ছিল না তো? না মানে, হয়তো নীতার সেই প্রেমিকই কোন অশান্তির জেরে দুজনকে বিষ দিয়েছে! এমন তো কত কথাই শুনি আজকাল!”
পম্পা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “বৌদি, বিষ দিতে কি শুধু বাইরের লোকই লাগে? অথবা বিষ কি শুধু দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়? না গো , অনেক সময় কাছের মানুষটাই বিষ দিতে পারে । আর জান তো সব থেকে শক্তিশালী বিষ মানুষের ভিতরেই থাকে। ইচ্ছা করলেই সেই বিষ ঢেলে সামনের মানুষটার জীবন বিষাক্ত করে দিতে পারে কিছু বিষাক্ত মানুষ।”
– মানে! কি বলতে চাইছিস ?
-বৌদি আমার তো আর নীতা বৌদির বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাই। নীতা বৌদির জীবনের গল্প। খানিকটা তার কাছ থেকে শোনা কিছুটা নিজের চোখে দেখা । পম্পা শুরু করল- পম্পা মান্তুর কাছে বসে কথা বললেও তার দৃষ্টি যেন বহু দূরের। সেই দৃষ্টির দূরত্ব মাপার বৃথা চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে মান্তু মন দিল পম্পার কথায়।নীতাকে ভগবান রূপ গুনে সুন্দর করে পাঠালেও, কপালটা তার সুন্দর ছিল না । খুব কম বয়সেই বাবা মাকে হারায় নীতা । বয়স তখন মাত্র বারো বছর। আশ্রয় হয় মামার বাড়িতে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ থাকলেও বাবা মা পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সাথে পড়াশোনাও বিদায় নেয় নীতার জীবন থেকে। কারণ নীতার মামি মনে করতেন নীতার পিছনে পড়াশোনার জন্য টাকা নষ্ট না করে মামা যদি ঐ টাকা জমায় তবে নীতার বিয়ের একটা হিল্লে হয়। তাই বারো বছরের নীতা পড়াশোনার পাঠ ছেড়ে মামির সংসারে ঝি বৃত্তি করতে লাগল।
এসব দেখে ভিতর ভিতর বড় কষ্ট পেত নীতার দিদিমা। কিন্ত তার কিছু করার ছিল না ছেলে বৌয়ের সংসারে। তাই তিনি যা করতে পারতেন তাই করলেন। চেনা পরিচিতদের পাত্র দেখার কথা বলেন। তখনই এক পরিচিত নীতার জন্য অম্বিকের সম্বন্ধটা আনলেন। অম্বিক বেশ অবস্থা সম্পন্ন। দাদুর কাছে মানুষ ছোট বেলা থেকে । বাবা মা নেই। দাদুও বেশ কিছু বছর হল স্বর্গবাসী। তাই এ হেন ভাল সম্বন্ধ হাত ছাড়া করতে চাইলেন না নীতার দিদিমা। তাই এগারো বছরের বড় অম্বিকের সাথেই পনেরো বছরের নীতার বিয়ে হয়ে গেল।
একরাশ স্বপ্ন বুকে বেঁধে দিন বদলের আশা নিয়ে নীতা অম্বিকের সাথে তার ঘরে এল। কিন্ত নীতার সেই স্বপ্ন আশা ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। কিছুদিনের মধ্যেই অম্বিকের আসল রূপ সামনে এল। অম্বিক নীতাকে বিয়ে করেছিল কেবল তার রূপ দেখে। রূপে মজে গিয়ে নয়! বরং নীতার রূপকে কাজে লাগিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার মতলবে। নিজের প্রমোশনের জন্য নীতাকে বসের কাছে ঠেলে দিত। নীতা রাজি হয়নি। কিন্ত অম্বিকের মার আর অত্যাচার তাকে বাধ্য করল অম্বিকের কথা মানতে।
নীতার রূপের মোহতে অম্বিকের বসও মাঝেমাঝেই বাড়িতে আসতে লাগল। প্রথম প্রথম একটু চটুল কথা। হাতে হাত রাখা। পার্টিতে বসকে নিজের কোমরে হাত দিয়ে নাচতে অনুমতি দেওয়া বা তার প্রিয় ড্রিংকটা হাতের সামনে এগিয়ে দেওয়াতেই খুশি ছিল অম্বিকের বস। তাই অম্বিকও তার কাজ হাসিল হচ্ছে দেখে এতেই সন্তুষ্ট ছিল।
কিন্ত ঐ যে কথায় আছে না, নেশা আর পাপ এদের গতি সর্বদাই ঊর্ধ্বমুখী হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। বছর খানেক পরেই বসের চাহিদা বাড়তে লাগল। কেবল এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় তার মন ভরল না। সে এবার বিছানায় একান্তে পেতে চাইল নীতাকে। অম্বিকের কোন কিছুতেই আপত্তি নেই। কিন্ত নীতা এই প্রস্তাব শুনেই ককিয়ে উঠল। তখন সে অম্বিকের সন্তানের মা হতে চলেছে। তার এক বুক নতুন স্বপ্ন সাজিয়েছে। মা ডাক শোনার অধির অপেক্ষারত সে। অম্বিকের হাতেপায়ে পড়ল। কিছুতেই কাজ হল না দেখ নীতা এবার আত্মহত্যার ভয় দেখায় অম্বিককে। এই কথায় অম্বিক থেমে যায়। কথা বাড়ায় না। নীতা নিশ্চিন্ত হয়।
তারপর হঠাৎই নীতার প্রতি অম্বিকের ভালবাসা আদর যত্ন বেড়ে যায়। মা হতে চলেছে বলে নীতার যত্নের ত্রুটি রাখে না সে। নীতা খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করে । ভাবে যাক, সে তার স্বামীর ভালবাসা না পেলেও তার সন্তান নিশ্চয়ই তার বাবার ভালবাসা পাবে । যে আগত সন্তানের জন্য অম্বিকের এত যত্ন , সেই সন্তান ভুমিষ্ট হলে না জানি কি করবে অম্বিক ! সুখের দিনের ভাবনায় আবার বুক বাঁধল নীতা। কিন্ত বোকা মেয়েটা এটা জানত না যে ছল কপট এইভাবেই আসে আশা ভরসার রূপ নিয়ে।নির্বিঘ্নে কাটল দুটো সপ্তাহ। একদিন সন্ধ্যার সময় অম্বিক নীতাকে বলে তার বন্ধুর বাড়িতে পার্টি আছে। আর অম্বিক চায় নীতা যেন তার সাথে যায়। নীতা খুব খুশি হয়েছিল। এতদিন পার্টি মানেই অফিস পার্টি । বসের নোংরা হাতের ছোঁয়া আর লালসার দৃষ্টি দেখে এসেছে নীতা। তাই এমন ঘরোয়া পার্টিতে যাওয়ার কথা শুনে দ্বিমত করে না নীতা।
নির্দ্বিধায় সে অম্বিকের সাথে যায় পার্টিতে। বাড়িটা ছিল অম্বিকের বসের বাগান বাড়ি । অম্বিকের ষড়যন্ত্রে সেদিন নীতার উপর সারা রাত অত্যাচার চালানোর সুযোগ পেল অম্বিকের বস ও তার কিছু বন্ধুরা। সকালে নীতা যখন ঘরে ফিরল তখন সে জীবন্ত একটা লাশ ছাড়া কিছু নয়। আমি কাজ করতে গিয়ে দেখলাম নীতার দু’পা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তধারা। সব কথা শুনে শিউরে উঠলাম আমি । বুঝলাম নীতার গর্ভপাত হয়েছে। আমি আকুল হয়ে কাঁদলাম। কারণ আমি তো জানি নীতার কত আশা ছিল এই সন্তানকে নিয়ে। কিন্ত অদ্ভুত, নীতার চোখে এক ফোঁটা জল নেই। যেন একটা মৃতদেহ।
অনেকক্ষণ পর আমাকে নীতা বলে, “পম্পাদি একটু বিষ এনে দিতে পার ? ভাল বিষ, যেন আমার সম্পর্কের মতো ভেজাল না হয়। অনেক পুণ্য করার বৃথা চেষ্টা করলাম। এবার পাপ করতে চাই। ঐ জানোয়ারটাকে যদি আমি নিজে হাতে শাস্তি না দি তবে আমার সন্তান যেখানেই থাকুক শান্তি পাবে না।”
আমারও মনে জেদ চেপে গেল। বললাম নিশ্চয়ই দেব। আর দেরি না করে এনে দিলাম কিছু সেঁকো বিষ। আমি অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে আমার বিষ চিনতে ভুল হয় না। তাই বারবার সাবধান করে এলাম বড় সাংঘাতিক বিষ। কিন্ত আমি বুঝিনি নীতা অম্বিকের খাবারে বিষ দিয়ে সেই খাবার নিজেও খাবে। ও তো অম্বিকের জন্যই আনতে বলেছিল এই বিষ কিন্ত নিজে কেন খেল কে জানে?”চুপ করল পম্পা। মান্তুর দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। সে জেন কিছুটা আপন মনেই বলে, “নীতা কি আজ মরেছে রে? নীতা তো সেদিনই মরে গেছিল যেদিন অম্বিকের কুচক্রে তার বস আর বসের বন্ধুরা মিলে ওর শরীরটাকে বিষিয়ে দিযেছিল। সেই বিষের এত জ্বালা যে ভিতরের ছোট্ট প্রাণটাও সেই বিষ সইতে পারেনি। নীতা তবুও নিজের মতদেহটাকে টেনে বাড়িতে এনেছিল বোধহয় অম্বিককে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। ওর কাজ শেষ করে ও নিজের শরীর থেকে মুক্তি নিয়েছে। হয়তো এই বিষাক্ত দুনিয়ার বাইরে ওর সন্তানের সাথে ওর আবার দেখা হবে!
যদিও আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্ত পরিস্থিতির চাপে। আর মানসিক যন্ত্রণায় নীতা কতটা মানসিক ভাবে সুস্থ ছিল আমার তাই নিয়ে খানিকটা সংশয় আছে । তবে একটাই শান্তি যে অম্বিকের মতো একটু জানোয়ার শাস্তি পেল। ইংরেজীতে একটা কথা আছে , চোখের বদলে চোখ। আর এখানে বিষের বদলে বিষ। অম্বিক যেমন নিজের বিষ দিয়ে নীতার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিল ঠিক তেমনই নীতা অম্বিকের খাবারে বিষ মিশিয়ে শাস্তি দিল তাকে।
-
গল্প – কলিকালে
কলিকালে
-শচীদুলাল পালস্নিগ্ধ বাতাসে ও ভোরের আলো এসে চোখে লাগতে ঘুমটা ভেঙে গেলে অনিরুদ্ধ দেখলো ঘরের দরজা খোলা।
বিছানা থেকে নেমে ঘর, উঠান, বেড়ার ধার, রাস্তা খুঁজে স্ত্রীকে না দেখতে পেয়ে চিন্তিত মনে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো। গতকাল রাতে স্ত্রী উশ্রীর সাথে কথাকাটি হয়েছিল।
— আমি এ বাড়িতে থাকবো না। তোমার সাথে ঘর করবো না।
— আমি তোকে ভালোবাসি।
— ভাত কাপড় দেবার মুরোদ নেই শুধু ভালোবাসি বললেই চলবে।
— আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু কি করবো বল। আয় কিছুতেই বাড়ছে না। বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে, ঘরে ঘরে পেপার দিয়ে কতটুকু আয় হয়!
কিন্তু উশ্রী যে কোথায় গেল!
এভাবে দিন দুয়েক কেটে গেল। অনিরুদ্ধ ভেবেছিলো হয়তো কোথাও আত্মীয়স্বজনের কাছে গিয়েছে, ফিরে আসবে। কিন্তু উশ্রি আর ফিরে আসেনি।আজ থেকে বছর দুয়েক আগে একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে টিউশন সেরে ফেরার পথে এক গাছ তলে দেখা হয়েছিল উশ্রীর সাথে। বছর ষোলোর কুমারী সদ্য যৌবনা সুন্দরী উশ্রী কোলে বাচ্চা নিয়ে কাঁদছে।
কৌতুহল বশত কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলেছিিল,
— আমি এক পুরুষের লালসার শিকার। আমি গরীব বিধবা মায়ের সন্তান। পেটের দায়ে এক বাড়িতে কাজ করতাম। আমার তখন চৌদ্দ বছর বয়স।সে বাড়ির মালিক আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে সম্ভোগ করতো দিনের পর দিন। সে অনেক টাকা দিতো। হাভাতে অবস্থা থেকে আমাদের অবস্থা সচ্ছল হয়েছিল। কিন্তু যখন পেটে বাচ্চা এলো তখন ওই শয়তানটা বলেছিল,
— বাচ্চাটাকে অন্য কোথাও অন্য শহরে জন্ম দে। অনেক টাকা দেব। তোকে বিয়ে করব। মালিকের কথামতো অন্য শহরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মা ও আমি থাকতাম। সেখানেই জন্ম হলো আমার বাচ্চার।
তারপর আমি ও মা একদিন বাচ্চা নিয়ে তার কাছে গেলে ‘বেশ্যা মাগী” বলে লাথি মেরে দূর করে দিলো। এখন আমার মাথার উপর এক বিরাট বোঝা। আমি অন্ধকার দেখছি। আমি বাচ্চটার মোহে আত্মহত্যা করতেও পারছিনা।আমি তখন দয়া পরবশ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
— আমি তোকে আত্মহত্যা করতে দেব না। আমি তোকে আশ্রয় দেব।
— কিন্তু কুমারীর এই সন্তান কি তোমার পরিবার মেনে নেবে?
— আমি তোকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেব।
আমি উশ্রী আর তার সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম। মা-বাবা দাদা-বৌদি ভাইপো-ভাইজিকে নিয়ে আমাদের পরিবার। পরিবারের সবার সামনে ঘটনাটা খুলে বললাম। সব শুনে তারা কেউ ঠাঁই দিতে রাজি হলো না। বাবা বললো,
— এই বেশ্যা মেয়েকে আমার ঘরে আশ্রয় দেব! তুই ভাবলি কি করে! মেয়েটাকে ত্যাগ কর। ছেড়ে দে।— তা হয়না বাবা। আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছি আমি বিয়ে করবো।
— বেরিয়ে যা। কুলাঙ্গার। তোর মুখ আমি দেখতে চাই না।
-এই বাড়ির কিছু অংশ আমার প্রাপ্য। সেখানে একটা ঘর নিয়ে থাকতে দাও। আমি আলাদাই থাকবো।
–এই বাড়ির ত্রিসীমার মধ্যে তুই ঢুকবি না। তোকে আমি ত্যজ্যপুত্র করলাম।
এই বলে লাথি মেরে দূর করে দিল।এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বস্তিতে এক দরমার ঘরে আশ্রয় নিলাম দুজনে।
অষ্টাদশী উশ্রী ছিলো উগ্র যৌবনা। যতো না সুন্দরী ছিল তার চেয়ে বেশি রূপসী মনে করতো নিজেকে। সাজগোজ করতে ভালোবাসতো। বাচ্চাটাকে খাটের সাথে বেঁধে সে কোথায় যেন যেত। অনেকদিন অধিক রাতে ঘরে ফিরতো। নিত্যনতুন নিজের জন্য অত্যাধুনিক সাজপোশাক বিলাস সামগ্রী কিনতো। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতো। আমি কিছু বলতাম না।
বাচ্চাটাকে যত্ন করা, দুধ খাওয়ানো, পরিস্কার করা ইত্যাদি কাজ আমিই করতাম।
আমার কেমন যেন একটা মায়া জন্মেগেছিল বাচ্চাটার উপর।
একদিন রাত্রি আটটা নাগাদ ঘরে এসে দেখি উশ্রি ফেরেনি। কিন্তু বাচ্চাটা গেল কোথাায়! দুশ্চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হলাম। এদিক ওদিক অনেক খুঁজলাম। দেখতে পেলাম না। অনেক রাতে উশ্রী এল। মুখে মদের গন্ধ। জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই মদ খেয়েছিস?
— হ্যাঁ। বেশ করেছি।
— বাচ্চাটা কোথায়?
— বেচে দিয়েছি।
— মানে!
— মানে বিক্রি করে দিয়েছি।
এই দ্যাখো কত টাকা।
বাঁচতে গেলে টাকা চাই। বুঝলে। আমি আমার যৌবন এমন ভাবে হেলায় তোমার কাছে গচ্ছিত রাখতে পারব না।
— আমি তোকে আশ্রয় দিতে গিয়ে আমার মা-বাবা, সংসার, বংশ, স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি সব ত্যাগ করলাম। আর তুই কিনা টাকার জন্য নিজেকে আর বাচ্চাটাকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিলি!
সেই থেকে বুঝতে পেরেছিলাম উশ্রী উগ্র যৌবনা দেহ স্বর্বস্ব এক মেয়ে।তার মন বলে কিচ্ছু নেই। সে আমার সাথে ছলনা করেছে।
তবুও তাকে আমি ভালোবাসতাম।তার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়েছিলাম।
কোনো দিন প্রতিবাদ করিনি।
ওর পাপের টাকা কোনো দিন ছুঁইনি। আমার স্বল্প আয়ে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিন আমার সংসার ছেড়ে আমার বুকে তীর মেরে কোথায় যে চলে গেলো।
কিন্তু তার এই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারিনি।
বস্তির লোকেদের সাথে রঙ মিস্তিরির কাজ করি। প্রায় প্রতিদিন কাজ থাকে। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে অতীত ভুলবার চেষ্টা করি।এক ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত হলাম। সেখানে বছরভর নানান অনুষ্ঠান হতো। খুব স্বল্প সংখ্যক লোকজন আসতো। মানুষের সনাতন ধর্মের প্রতি টান একেবারে তলানিতে। একদিন এক ধর্মীয় উৎসবের অনুষ্ঠানে এক প্রবচন প্রবক্তা বলছিলেন কলিযুগ প্রসঙ্গে —
কলিযুগ হল হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের শেষ যুগ। অন্য যুগগুলো হল সত্যযুগ, ক্রেতাযুগ ও দ্বাপরযুগ। বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরানে বলা হয়েছে, যেদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন সেদিন থেকেই পৃথিবীতে কলিযুগের সুচনা হয়েছে। পুরানে আছে—
ছলনা, মিথ্যা, আলস্য, নিদ্রা, হিংসা, দুঃখ, সুখ, ভীতি, দীনতা
লোভ, শঠতা, ঠকবাজি, অমানবিকতা কলি যুগের বৈশিষ্ট।বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী ব্রহ্মা সত্যযুগে সব কিছু সৃষ্টি করেন এবং কলিযুগে সমস্ত কিছু ধ্বংস করেন। বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী কম ধনের অধিকারী হয়ে মানুষ এই যুগে বেশি অহংকার করবে। ধর্মের জন্য অর্থ খরচ করবে না। ধর্ম গ্রন্থের ওপর মানুষের আকর্ষণ থাকবে না।মাতা পিতাকে মানবে না।
পুত্র পিতাকে হত্যা বা পিতা পুত্র হত্যা করতে কুণ্ঠিত হবে না। ধর্ম অনুসারে কেউ বিবাহিত থাকবে না। স্ত্রীলোকেরা নিজেকে সুন্দরী মনে করবে। ধনহীন পতিকে মহিলারা ত্যাগ করবে। আর ধনবান পুরুষরা সেই নারী গনের স্বামী হবেন।
কলিযুগে মানুষ ধর্মের জন্য অর্থ ব্যয় না করে কেবল গৃহ নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করবে। মানুষ পরকালের চিন্তা না করে কেবল অর্থ উপার্জনের চিন্তায় মগ্ন থাকবে। কলিযুগের নারীরা সাধারণত স্বেচ্ছাচারিণী ও বিলাস উপকরণে অতিশয় অনুরাগিণী হবে এবং পুরুষেরা অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করতে অভিলাষী হবে।
অসমর্থ মানুষেরা ধনহীন হয়ে পেটের জ্বালা ও ক্লেশ ভোগ করবে। কলিযুগে মানুষ যা কিছু ভোজন করবে। কলিকালে স্ত্রীলোকেরা নিতান্তই লোভী হবে, বহু ভোজনশীলা হবে। মহিলারা অনায়াসে পতি আজ্ঞা অবহেলা করবে।
নারীরা নিজের দেহ পোশাকে ব্যস্ত থাকবে, কঠোর ও মিথ্যা কথা বলবে। কলিকালে চোদ্দ থেকে ষোল বছরের বালকরা সহবাসে, বারো থেকে চোদ্দ বছরের বালিকারা সন্তান প্রসব করবে। কলিকালে মানুষের বুদ্ধি অতি অল্প হবে, তাদের ইন্দ্রিয় প্রভৃতি অতিশয় অপবিত্র হবে।
যখন পাষণ্ড লোকের প্রভাব অত্যন্ত বাড়বে তখন সমাজের ভালো লোকেরা কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকবে না। সুন্দরী স্ত্রী যার তার সাথে বন্ধুত্ব করবে।
একদিন কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি।দেখলাম পাড়ারই এক বাড়ির সামনে জটলা। বাড়ির মালিক মারা গেছে। তার শব পড়ে আছে।
মৃতদেহ স্টিফ হয়ে গেছে। সকাল থেকে বেশ কয়েকজন ডাক্তার এসে ফিরে গেছে। কেউ ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছে না।
লোকটা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ছিল। ঘরে স্ত্রী, যোয়ান মেয়ে ও ছেলে।
লোকে বলাবলি করছে, লোকটার ছেলেটা বোনের সাথে এক বিছানায় শুতো। ঘনিষ্ঠ হয়ে মিলিত হতো। লোকটা প্রতিবাদ করতো। তীব্র প্রতিবাদ করায় গতকাল রাতে তুলকালাম ঝগড়াঝাটি হয়েছে। পাড়ার লোকেরা শুনেছে। অবশেষে গতকাল রাতে স্ত্রী পুত্র কন্যা মিলে গলা টিপে লোকটাকে মেরে দিয়েছে। সকালবেলা শুনলো লোকজন রাতে চলে গেলে এক হাতুড়ে ডাক্তার এসে অনেক টাকা নিয়ে নরম্যাল ডেথ সার্টিফিকেট দিলে পাড়ার লোকজনের সহায়তায় রাতারাতি শ্মশানে নির্বিঘ্নে দাহ সম্পন্ন করেছে।আমি রঙ মিস্ত্রির কাজ করি এক বড়ো প্রমোটারের অধীনে। একদিন এক নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কাজ করছি। হঠাৎ অত্যাধুনিক সাজে স্বল্পবাস পরিহিতা এক মেয়ের উপর নজর পড়লো। গাড়ি থেকে নামছে। সাথে এক মধ্য বয়সী ধোপদুরস্ত লোক। দূর থেকে দেখলেও চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওইতো উশ্রী। ফর্সা সুন্দরী উশ্রী আরও সুন্দর হয়েছে। পরিপুষ্ট নির্মেদ শরীর। শরীরে এক চমক, এক মাদকতা। এই দুবছরে অনেক পরিবর্তন।
পাশের এক বিল্ডিংএ যাচ্ছে।
উশ্রী অশালীন পোশাকে লোকটার ঘনিষ্ঠ হয়ে এক ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। আমি দূর থেকে নিয়মিত অনুসরণ করে ও আবাসনের এক সিকিউরিটি গার্ডের সাথে ভাব করে জানতে পারলাম —
উশ্রী এক নষ্ট মেয়ে শুধু নয় এক চিটিংবাজ। এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে তার শিশু পুত্রটিকে অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছিলো। পরে বেইমানি করে জোর জবরদস্তি করে শিশুটিকে ছিনিয়ে এনে অন্য একজনকে মোটা টাকায় বিক্রি করে। ফ্ল্যাট কিনেছে, গাড়ি কিনেছে। বহু টাকার মালকিন। এখন সে এক কুখ্যাত মাফিয়ার রক্ষিতা। অশিক্ষিত মাফিয়াটি এ অঞ্চলের বেতাজ বাদশা। তার এই প্রকাশ্য ব্যভিচার এই আবাসনের সবাই সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে।উশ্রীকে সবাই ভয় করে।
-আচ্ছা। ওই যে লোকটা উশ্রীকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো সেই কি মাফিয়া?
–না। উনি মাফিয়া নন। উনি এক বিখ্যাত শিল্পপতি। উশ্রীর নতুন শিকার।
-কেউ কিছু বলে না?
-বলবে কি? এখন উশ্রী ধন ও মদমত্তে গর্বিত এই হাজার ফ্ল্যাট সমৃদ্ধ আবাসন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তার অঙ্গুলিহেলনে সবাই উঠবোস করে। -
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৩)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ ত্রিশ ]
এই প্রথম টানা এতদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটালো সনাতন। সমাজ জীবনের বৃহত্তর পরিসরের সঙ্গে তার এই পরিচয় তাকে কত যে সমৃদ্ধ করল তা সে বুঝিয়ে কাউকে বলতে পারবে না। মা শীতলার আশীর্বাদ ছাড়া এ যে কোনদিন সম্ভব ছিল না তা ভেতর থেকে সে উপলব্ধি করতে পারছে। বাবার কাছে আজীবন মাথা নত হয়ে রইল তার জীবনের এই পরম পাওনা পাবার সুযোগ করে দেবার জন্যে। ওরা এই রুইদাস পাড়ায় বসে কুয়োর ব্যাঙের মত পৃথিবীটাকে বিচার করে। কুয়োর ভেতরে থেকে ভাবে এর চেয়ে বড় জগৎ আর হতে পারে না! প্রথাগত এবং সেইসঙ্গে সামাজিক শিক্ষাদীক্ষায় আমল না দিয়ে দিনরাত জাত কুজাত অজাত বেজাত নিয়ে গুলতানি করে যায় ওরা। অথচ বাংলার বৃহত্তর সমাজ এসবের কোন মূল্যই দেয় না। কলকাতা তথা জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত এইসব মানুষজন ভাবতেই পারে না যে এখনো সমাজে কোথাও কোথাও জাতের নামে আধিপত্যবাদিরা নিজেদের দাপট রক্ষা করার প্রয়াস জারি রেখেছে। সেইজন্যে ওদের সমাজে ওরা শিক্ষাদীক্ষার আলো ঢোকানোতে এতটা নিরুৎসাহ দেখায়। অথচ ওখানকার আলোকিত সমাজে কে কি জাতের মানুষ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা বিন্দুমাত্র নেই কারোর। বাঙালী অবাঙালী মানুষরা মিলেমিশে একাকার হয়ে কেমন মা দুর্গার আরাধনায় মেতে উঠেছে। একে অপরের সঙ্গে ‘কোলাকুলি’ করছে। পরস্পরের কুশল কামনা করছে। সবাই সব্বাইয়ের বাড়িতে ঢুকে বিজয়ার উৎসব পালন করছে। কে কোন জাত, কে কাকে তার বাড়িতে প্রবেশ করতে দেবে না দেবে এইসব মধ্যযুগীয় চর্চায় যে তাদের কোন কাজ নেই।
কলকাতার হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের সন্তোষবাবুরা আলবাত জানে যে রতনরা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ। বর্ণাশ্রমের নিরিখে যে এরা চর্মকার মুচি সম্প্রদায় থেকে এসেছে তাও তাদের বিলক্ষণ জানা। তবু সমাজের সর্বোচ্চ বর্ণ, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ব্যানার্জী পরিবার একবারের জন্যে, তাদের মুচি সম্প্রদায়ের মতো বর্ণাশ্রমকে হাতিয়ার করে দূরে ঠেলে রাখেনি।
লক্ষ্মীপুজোর বিসর্জনের পরের দিন সনাতনরা বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দেয়। পাড়ার মানুষজন যেমন হৃদয় ভরে তাদের আশীর্বাদ করেছে তেমনি দু’হাত উজাড় করে দিয়েছে ঢাকির সিধের সামগ্রী। কি না আছে তাতে! বাচ্চা ছেলেপুলেদের পরার জামা-প্যান্ট থেকে শুরু করে মায়েদের শাড়ী, ছেলেদের ধুতি প্যান্ট। কিছু পুরোনো অথচ ধুয়ে ইস্ত্রী করা, একেবারে নতুনের মতো। কিছু আনকোরা নতুন। প্রত্যেক বাড়ি থেকে পুরোনো সামগ্রীর সঙ্গে নতুন কিছু না কিছু দিয়েছে। হয়তো এখানকার রীতি- শুধু পুরোনো ব্যবহৃত জিনিস দিতে নেই, সঙ্গে নতুনও দিতে হয়! সেইসঙ্গে চাল-ডাল আলু-তেল তো আছে। সব মিলিয়ে ‘মোট’ এত বেশি হয়ে গেছে যে ওদের দু’জনের পক্ষে হাতে-কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে আছে তাদের জিয়নকাঠি, ঢাকটা নিজেই তো একটা বড় মোটের অধিকারি। সতর্ক সন্তোষবাবুর নজর এড়ালো না এই ব্যাপারটায়। এত সবকিছু হেফাজত করে নিজের চারচাকায় তুলে বাবুঘাটে তাদের পৌঁছে দিল ভদ্রলোক! রতন সনাতনদের এমন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে ফেলল মানুষটা যে এ জীবনে এনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না তাদের।
সন্তোষবাবুকে বিদায় দিয়ে সনাতনরা একটা একটা করে জিনিসভর্তি পোঁটলা তিরাশি নম্বর গাড়িতে তুলতে লাগল। ড্রাইভার সিটের পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় রাখতে থাকে ওরা। সেইসময়ই হাঁই হাঁই করে ছুটে এলো কন্ডাক্টরটা, “মাল কোথায় যাবে? এত মাল এখানে তুলছেন, মানুষ কোথায় দাঁড়াবে? লোকে তো না দাঁড়াতে পারলে আমাদের গালাগাল দেবে। নামান, নামান। এখানে মাল রাখা যাবে না। অন্য গাড়িতে দেখুন। এখানে হবে না।
কন্ডাক্টরের কথায় সনাতন থমকে যায়, “বাবা, এ তো মাল নামিয়ে নিতে বলছে। কি করব এখন? এত মাল আবার নামাতে হবে?
-দাঁড়া না। ভয় পাচ্ছিস কেন। ওরা তো মাল নিয়ে যায়। নিয়ে যায়না তা তো নয়। আমাদের না হয় একটু বেশি মাল আছে। নিয়ে যাবে। দেখনা। আসলে ওরা দর বাড়াতে চাইছে। এটা ওদের স্বভাব। আমরা যাতে ওদের বাধ্য হই। তাহলে ওরা যা ভাড়া হাঁকবে তাই আমাদের দিতে হবে।
রতন শেষ পুঁটলিটা বাসে উঠাতে যাচ্ছে। সেইসময় কন্ডাক্টরটা আবার বলল,“কি হল দাদা, আমি কি বলছি কানে যাচ্ছে না বুঝি? দেখবেন, মালগুলো কেমন নামিয়ে দেবো? তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবেন না।
-আরে ভাই, কেন অমন করছো! তুমি তো এমনি নিয়ে যাবে না। তাছাড়া তোমরা যে কোনদিন বাসে মাল তোল না তা তো নয়। কি, তোল না? রোজই কিছু না কিছু মাল নিয়ে যাও, মালের ভাড়া নাও। আমরাও ভাড়া দেব। আমাদের দেখে কি মনে হচ্ছে তোমাদের বঞ্চিত করে মাগনা এগুলো নিয়ে যাব? চলো চলো। যা ভাড়া হয়, সেই ভাড়াই দেব। আমরা দিঘিরপাড় বাজারে নামব।
-মালের জন্যে এক’শ টাকা ভাড়া দিতে হবে। আপনাদের দু’জনের ভাড়া আলাদা। অনেক মাল আছে। এক পয়সা কম হবে না। রাজি না হলে মাল নামিয়ে নিন।কন্ডাক্টরটরের কথায় চমকে ওঠে সনাতন! বলে কি এই লোকটা! বাস ভাড়া যেখানে কুড়ি টাকা। সেখানে মালের ভাড়া এক’শ টাকা! লোকটার মুখে আটকালো না এই টাকার কথা বলতে! আর চুপ করে থাকতে না পেরে সনাতন বলল,“যে জায়গায় মালগুলো আছে সেখানে ক’টা মানুষ দাঁড়াতে পারে একবার বলবেন? বড়জোর দু’জন ? তা দু’জনের ভাড়া হয় কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ। সেখানে আপনি এক’শ টাকা চাইছেন?” এরপর আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল সনাতন। রতন তাকে থামিয়ে দিয়ে কন্ডাক্টরকে বলল, “দেখো ভাই, আমাদের দেখে তোমার মনে হচ্ছে আমরা বোকা-হাঁদা লোক। তাই তুমি এই অবান্তর কথা বলছো, তাই না? ওটা ভেব না। আমাদের তুমি জোর করে নামিয়ে দিলে আমরা হয়তো নেমে যাব। কিন্তু ওই জায়গায় হয় দুটো লোক দাঁড়াবে। অথবা অন্য কেউ ওখানে মাল রাখবে। তাদের কাছ থেকে তুমি ওই এক’শ টাকা আদায় করতে পারবে তো? যদি পারো, সাহস দাও আমাদের তাহলে আমরা নেমে যাচ্ছি। আমারা নিশ্চিত তুমি তা পারবে না। তাই খামোকা কেন ঝগড়াঝাটির দিকে যাচ্ছো। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কি ঝগড়াঝাটির সম্পর্ক? নাকি তোমার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা আছে? আপোশে মাঝমাঝি একটা কিছু করে নাও। আমাদের দু’জনের ভাড়া বাদে মালের জন্যে আমরা পঞ্চাশ টাকা দেব। তুমি ‘না’ কোরো না, ভাই।”
রতনের যুক্তিযুক্ত কথায় কন্ডাক্টর যেন একটু নরম হয়। পাল্টা কোন আক্রমণাত্মক কথা না বলে বলল,“পঞ্চাশ টাকায় হবে না। আপনি বলছেন, তাই কুড়ি টাকা কমিয়ে দিচ্ছি। আশি টাকা দেবেন। এর থেকে এক পয়সা কম হবে না।”
-আচ্ছা বাবা, তোমার কথা থাক, আমার কথাও থাক। তুমি ষাট টাকা নিও। আর যদি অন্য কেউ মাল নিয়ে ওঠে তো আমাদের মোটের ওপর রেখে দিয়ো। আমাদের কোন ঠুনকো মাল নেই যে তার উপর চাপালে ভেঙেটেঙে যেতে পারে। তাহলে তোমার পুষিয়ে যাবে। আর এতটা রাস্তা, একদম মাল নিয়ে কোন যাত্রী উঠবে না তা তো হবার নয়।
ওদের দু-বাপ-বেটা মালের ডাঁইয়ের সামনের দুটো সিটে বসে সেগুলো লক্ষ্য রাখতে রাখতে চলল। সনাতন জানালার দিকে বসে কলকাতা দেখে আসতে আসতে আবার হঠাৎ হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের এতদিনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে এলো। ভেসে এলো সন্তোষবাবুর মুখ। ওখানকার মানুষজনের কত কথা। কত আনন্দঘন চিত্র। হঠাৎ সনাতন তার বাবাকে বলে,“বাবা, এখানে এতদিন থেকে একটা ব্যাপার আমার মনে লোহার পেরেক দিয়ে গভীর আঁচড় কাটার মত দাগ দেগে বসল। দেখেছো, এখানে জাত বেজাত উঁচুনীচুর
বিচার কেমন একাকার হয়ে বসে আছে? সব জাতের মানুষ ওখানে আছে। আনন্দ স্ফুর্তি করছে। মেলামেশা করছে। এমনকি সামাজিক আত্মীয়তার সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। আর আমরা সেই জাত নিয়ে কি না কড়া অনুশাসন চালিয়ে যাচ্ছি। আজও। সেই বর্ণাশ্রমের ছুৎমার্গ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। এটা না পারলে আমাদের রুইদাস তো সেই মধ্যযুগের বর্বর রুহিদাস হয়েই রয়ে যাব। না, আমি বলছি না যে আমাদের জাতটা সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যাক। সেটা আমরা হতে দেব না। কিন্তু জাতকে ভাঙিয়ে একদল গোঁড়া লোক ফায়দা তুলে যাবে, তা হতে পারে না। ওইসব মনগড়া গোঁড়ামি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে বাবা। আমার এখন খুবই খারাপ লাগে বাবা, তুমি সেই রুহিদাসদের আটচালার অন্যতম একজন মাতব্বর। যেকথা বলছি, তুমি আমার বাবা। তুমি এই মাতব্বরির কাজটা ছেড়ে দাও। আটচালায় যাও। সেটা বারণ করছি না। কিন্তু কলকাতার এখানকার মত আধুনিক মন নিয়ে আটচালায় যাও। বর্ণাশ্রমের লালন থেকে বিরত থাকো। তোমার মত বুঝদার মানুষ যদি আস্তে আস্তে এর বিরোধিতা করতে শুরু করে, দেখবে একদিন আমরা আমাদের সত্ত্বাকে সগর্বে জীবিত রেখেও কত উন্নতি করতে পারছি।”
-তুই আমার মনের কথাই বললি রে সনাতন। সেই থেকে আমিও ঠিক এই কথাগুলোই মনের ভেতর আওড়াচ্ছিলাম। কাজটা ভীষণ শক্ত। অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এই অচলায়তনকে ভাঙতে গেলে। তবু একটা কিছু তো করতে হবে।
বাবা যে একই মত পোষণ করছে তাতে সনাতন মনে মনে আশ্বস্ত হয়। বাবার এই বোধে সে নিজেকে গর্বিত বোধ করে। সনাতন মনে মনে যেন শপথ নিয়ে ফেলে যে তাদের সমাজকে এই মধ্যযুগীয় ভাবনা থেকে বার করে আনতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হবে। মুছে সাফ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, সমাজ মনে জমে থাকা যাবতীয় ময়লা। এইসব ভাবতে ভাবতে আর একটা কথা তার মনে জেগে উঠল তার বাবাকে বলার জন্যে,“আর একটা কথা কি জানো তো বাবা? অভয় আমাদের বেকায়দায় ফেলার জন্যে ষঢ়যন্ত্র করে শিয়ালদায় পাঠিয়েছিল। প্রথম দিকে যারপরনাই অপমান আর অপদস্থ আমাদের হতে হয়েছিল ঠিকই। সেদিক থেকে হয়তো ও সফল হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভয়ের শাপ আমাদের কাছে ‘বরে’ পরিণত হল। ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’ সেই প্রবাদটাই আমাদের বেলায় খেটে গেল। কিন্তু মনে মনে যে ও এখনো বগল বাজাচ্ছে- আমাদের বিপত্তিতে ফেলার কথা ভেবে। তা আমি নিশ্চিত। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে ওকে আচ্ছা করে কড়িয়ে দেব, এইভাবে আমাদের বিপদে ফেলার জন্যে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওকে কিছু একটা দিয়ে পুরস্কৃত করব। ওর জন্যেই যে জীবনের একটা নতুন দিকের সন্ধান আমরা পেলাম। যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করলাম তা এমনিভাবে কোনদিন হয়তো আমাদের পাওয়া হয়ে উঠতো না। সেই দিক থেকে অভয় আমাদের প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করে ফেলল ওর অজ্ঞানে এবং অজান্তেই।
আমতলায় এসে গাড়ি থামল। এখানে সব বাসই প্রায় অর্ধেক খালি হয়ে যায়। সনাতনদেরটাও তাই। গাড়ি চলা শুরু করতে কন্ডাক্টর এলো তাদের কাছে ভাড়ার টাকা নিতে। বাবার কথামত সনাতন নিজের কাঁধ ব্যাগটা কোলে রেখে তার ভেতর থেকে চুক্তিমত ভাড়ার টাকা দিল। কন্ডাক্টর শুধু তাদের দু’জনের ভাড়ার টিকিট দিয়ে চলে যায়। মালের ভাড়ার জন্যে যে টাকা দিল তার টিকিট দিল না। টিকিট তো টাকা দেবার রসিদের মত। তাহলে সে যা টাকা দিল তার পুরো রসিদ তো কন্ডাক্টরের দেবার কথা। সেই ভেবে সে সিট থেকে উঠে কন্ডাক্টরকে ডাকতে যাবে, সেই সময় তার বাবা হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে দিল,“কন্ডাক্টরকে ডাকতে যাচ্ছিস, মালের ভাড়ার টিকিট চাইবি বলে তো? আমি ঠিকই ধরেছি। আরে বোকা, মালের ভাড়ার টিকিট ওরা কেউ দেয় না। ওই টাকা ওদের হিসেবের বাইরে। মালিককে মালের ভাড়ার টাকা ওরা দেয় না। ওই টাকা ড্রাইভার- কন্ডাক্টর ভাগ করে নেয়। এটাই এখানকার রীতি। এটা বাসের মালিকেরও জানা। এই ছাড়টা মালিকরা ওদের দিয়ে রেখেছে। নাহলে ওরা ভাড়া থেকে টাকা হাতসাফাই করবে। ওদের তো জলপানির একটা খরচ আছে। সেটা তো মালিকরা আলাদা করে ওদের দেয় না। কেউ কেউ আবার প্যাসেঞ্জারের ভাড়ার টিকিটও দেয় না। যেমন এই কন্ডাক্টর আমাদের দিয়েছে।”
বাবা, সনাতনকে হাত ধরে সিটে বসিয়ে দেবার পর তার হাতে থাকা টিকিট দুটো ব্যাগে রাখতে গিয়ে সেই খবরের কাগজটা তার চোখে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনটা আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে! হয়তো এমন দিন এবার থেকে তার আরও আসতে পারে। বা এর থেকে আরও ভালো দিনও আসতে পারে। কিন্তু জীবনের প্রথম পাওয়া এমন আনন্দর সঙ্গে আর কোন খুশির সময় মেলানো যাবে না। খবরের কাগজটা আবার একবার ভাঁজ খুলে দেখে নেয় তার সোনালী দিনটা ধরে রাখার চিহ্নটা। বিখ্যাত বেঙ্গল পেন্টস প্রত্যেক বছর দূর্গা পূজায় বিভিন্ন পর্যায়ে- প্যান্ডেল, প্রতিমা সজ্জা, আলোক সজ্জা, বাদ্য পরিবেশন ইত্যাদির শ্রেষ্ঠদের পুরস্কৃত করে থাকে। মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পাবার জন্যে পুজোর সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা সবসময় সেই প্রচেষ্টা করে যায়। রতন-সনাতনদের সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা ছিল না। বিচারকরা তো কাউকে না জানিয়েই তাদের মত বিচারের কাজ করে চলে যায়। রতনরা ভাবতেই পারেনি তাদের ঢাক বাজনার বিষয় কোনো বিচারে স্থান পেতে পারে। হঠাৎ নবমীর দিন
সন্তোষবাবুরা দলবল মিলে হইহই করে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে তাদের কাছে ছুটে এলো, “দেখো রতন, সনাতন- তোমাদের ঢাক-কাঁশি বাজনার ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে! আমাদের পুজো কমিটির মান-সম্মান তোমরা কত উঁচুতে তুলে দিয়েছো! তোমাদের বাজনার পটুতায় তোমরা এ’বছর বিচারকদের বিচারে কলকাতার মধ্যে সেরা হয়েছো। তোমাদের সাথে সাথে আমাদের পুজো প্যান্ডেলের নাম কাগজে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। সত্যিই রতন, তোমাদের বাজনার গুণের অন্ত নেই। যোগ্য শিল্পী যোগ্য মর্যাদা পেয়েছে। আজ আমাদের কি আনন্দের দিন! প্রত্যেক বছর আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই, কোন পর্যায়ে যদি একটা পুরস্কার পেতে পারি কি না। এখনো পর্যন্ত সেই সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এই তোমাদের হাত ধরে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছুঁতে পারলাম।” বলে হঠাৎ একটা বিশাল চিৎকার করে সন্তোষবাবু বলে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর রতন-সনাতন!” সঙ্গে সঙ্গে সমবেত মানুষজন বলে উঠল, “হিপ হিপ হুররে!” বার তিনেক এইভাবে তাদের নামে সুখ্যাতি যখন করল, সনাতনের বাবা আনন্দে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ডুকরে ডুকরে যেন পাগলের মত কাঁন্না শুরু করে দিল! পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যে সনাতন তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“বাবা, কাঁদছো কেন। আজ তো আনন্দের দিন আমাদের। এসো চোখ মুছে বাবুদের সঙ্গে আমরাও আনন্দ করি। তোমার মন ফুঁড়ে শ্রেষ্ঠ বোল তোমার ঢাকে তোলো। সেই তালে আমিও কাঁসর বাজাই আর বাবুদের নাচের পায়ে পা মিলিয়ে যাই।” আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রতন ঢাকের কাঠি হাতে নিয়ে নিল। কতক্ষণ যে সেই বাজনার বোল চরাচরে ডানা মেলে খেলে বেড়াতে লাগল তা দুই বাপ-বেটার যেন কোন হুঁশই নেই! শেষ পর্যন্ত সন্তোষবাবুদের জোরাজুরিতে রতনরা বিরত হতে বাধ্য হল, “রতন-সনাতন, এবার তো আমাদের একটু বিশ্রাম নিতে হবে না কি? খাওয়া দাওয়া আমরা সবাই করবো তো এবার! বেলা যে গড়াতে শুরু করেছে। কিছুটা পরেই তো নবমীর সন্ধ্যারতির আরাধনায় মগ্ন হতে হবে। চলো রতন, চান খাওয়া করে নিই আমরা। সামান্যর জন্য হলেও একটু বিশ্রাম না নিলে শরীর সায় দেবে কেন!”
সনাতন মনে মনে ভাবল, দিঘিরপাড়ে যারা এই পত্রিকা দেখেছে, তারা নিশ্চয়ই তাদের ছবি নজর করেছে। এলাকার রুইদাস পাড়ার লোকের ছবি বাংলার প্রথমসারির খবরের কাগজে বেরিয়েছে দেখে তাদেরও খুশি হবার কথা। হয়েছেও নিশ্চয়ই। কিন্তু এ সংবাদ যে তাদের রুইদাস পাড়ার ‘গন্ডি’ টপকাবে না সে বিষয় সনাতন নিশ্চিত। কি করেই বা টপকাবে? যে পাড়া শিক্ষাদীক্ষাকে জীবনের মূল মন্ত্র করে সন্তানদের মানুষ করে না তাদের কাছে এই ছবি দেখা আর অন্ধের হস্তি দর্শন সমার্থক। তাতে অবশ্য সনাতনের কিচ্ছু যায় আসে না। পাড়ায় তাদের নাম বেশি ফাটলে বরং মদওয়ালাদের ডানচোখ নাচবে। তাদের প্রতি ঈর্ষায় জ্বলতে থাকবে। আর সেই জ্বলন নিবৃত্ত করতে ঢকঢক করে চুল্লু গলায় চালান করে দিয়ে বিরামহীন খিস্তিখেউড় শুরু করে দেবে। নিজেদের ব্যর্থতাকে এইভাবেই ওরা তোল্লা দিয়ে যায়। তাকে দমন করে সাফল্যের সু-বাতাস গায়ে মাখতে এখনো তারা শিখে উঠতে পারলো না।
দিঘিরপাড়ে বাস স্টপে স্বাভাবিক সময় থেকে একটু বেশি সময়ই দাঁড়িয়ে রইল বাস। রতন-সনাতন ব্যস্ত তাদের জিনিসপত্র এক এক করে নামাতে। সেই দৃশ্যে বাজারের অনেকের কৌতূহলী চোখ আটকে যায়। কৌতূহল তো হবেই। রুইদাস পাড়ার লোক বাস থেকে কি এত জিনিসপত্র নামায়। কয়েকজন কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েও যায়। বাস চলে যেতে চরাচর আড়ালমুক্ত হলে সনাতন যেন একবুক স্বস্তির বাতাস টেনে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে মিলিয়ে নিতে চায় আগের দেখার সঙ্গে বর্তমানের। রতন বলল, “খোকা, ওই মহাদেব কাকার রোল দোকানের পাশে উত্তমের ভ্যনটা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডেকে আন বাবা।” এত মাল ভ্যান ছাড়া বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না তারা বিলক্ষণ জানে। সনাতন পা চালিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে যেতে যেতেই শুনতে পায় একজন বাবু তার বাবার নাম ধরে বলছে, “কি গো রতন। কাগজে যে তোমাদের বাপ-বেটার নাম দিয়ে-ছবি বার হল। তোমরা ঢাকের বাজনা বাজানোর বিভাগে কোলকাতার মধ্যে প্রথম হয়েছো দেখে খুব খুশি হয়েছি আমরা। বাঃ খুব ভালো। ভালো লাগছে, আমাদের এলাকার মানুষের গুণের কথা ফলাও করে কাগজে প্রকাশ পাবার জন্যে। খুব ভাল হয়েছে। তোমার ছেলেও প্রশংসিত হয়েছে দেখলাম।”
দৌলতপুরের হালদার বাড়ির সুবিরবাবু যখন বাজারের মাঝে গর্বের সঙ্গে গলা চড়িয়ে বলছে তখন সেখানে জড়ো হয়ে থাকা লোকজন শুনে একটু অবাকই হয়ে যায়! ভাবনাটা, কই, তারা তো এত বড় খবরটার কিছুই জানে না? ক’জন লোক আর অত খুঁটিয়ে পেপার পড়ে। সনাতনরাও কি নিয়ম করে খবরের কাগজে চোখ বোলায়? বোলায় না। এখন নেহাত তাদের ছবি কাগজে ছাড়া হয়েছে বলে তারা পেপার-চর্চা করছে। যারা নিয়ম করে পড়ে তারা জানতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মুখে মুখে বাজারে চাউর হয়ে যায় রতনদের গুণকীর্তন। প্রায় ভিড় জমে যায় রতন আর বাস থেকে নামিয়ে রাখা তাদের মালপাটকে ঘিরে। কৌতূহলী মানুষের মন কত দিকে যে ধেয়ে যায়, কে বলতে পারে। কেউ ভাবছে রুইদাস পাড়ার লোকটা এত মাল কোথা থেকে আমদানি করল? দু’নম্বরি কিছু নয় তো? যখন আবার তাদের সু-কীর্তির কথা বলাবলি হচ্ছে তখন কেউ বলছে, এতে অনেক জিনিস আছে। পুরস্কার পেয়েছে ওরা ঢাক বাজিয়ে। পেপারে ছাপা হয়েছে ওদের নাম-ছবি! সনাতন দেখল এই মালপাট এক্ষুণি ভ্যানে বোঝাই করে এখান থেকে না সরালে এই ভিড় আর লোক চর্চা চলতেই থাকবে। আর বিলম্ব না করে সে মালগুলো উত্তমের ভ্যানে তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
উত্তমের সাইকেল ভ্যান রুইদাস পাড়ার সীমানা মাড়িয়ে সনাতনদের বাড়ির সামনাসামনি রাস্তায় এসে থামল। রাস্তা থেকে ঢালু পথে গাড়িটা নামানোর জন্যে সনাতন ভ্যানের পেছনটা টেনে ধরে আস্তে আস্তে নামাচ্ছে। সেই সময় অলোকাদি কলেজ থেকে ফিরছিলো। ঢাল থেকে নামতেই অলোকাদি সনাতনকে বলল, “সনাতন একটু দাঁড়া? তোরা তো সাংঘাতিক এক কান্ড করে ফেলেছিস রে। কাগজে খবরটা দেখে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছিল! মনে হচ্ছিল তোকে একটু আদর করে দিই। সত্যি তুই-কাকা মিলে আমাদের রুইদাসদের গর্ব করার মত কাজ করে ফেলেছিস। রুইদাসদের ইতিহাসে কোনদিন কারোর নাম এভাবে কাগজে ছাপা হয়নি। কি ভালো যে লাগছে না আমার! গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।”
-তুমি খবরটা কোথা থেকে জানলে অলোকাদি? এ সংবাদটা তো শুধু খবরের কাগজে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই কলেজ লাইব্রেরীর খবরের কাগজ পড়ো? তাছাড়া আর জানবে কেমন করে।
অলোকাদি এবার রাস্তা থেকে নেমে সনাতনের কানের কাছে এসে বলল,“না রে, তোর বিপ্লবদা আমাকে কাগজটা এনে দিল। বলল, তোমাদের পাড়ার সনাতন আর তার বাবার ছবি কাগজে বেরিয়েছে। ঢাক বাজিয়ে পুরস্কার পেয়েছে ওরা। এই দেখো, দেখো, কেমন ফলাও করে এখানে ছাপিয়েছে! আমাদের বয়ারিয়া গ্রামের মানুষের এমন খবরে সকলের গর্ব বোধ হচ্ছে। তারপর এরা একদম তোমাদের পাড়ার লোক। তোমাকে না জানিয়ে আর থাকতে পারলাম না। তাই দিঘিরপাড় বাসস্টপে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্যে। সন্ধ্যেয় তুমি কোচিং করে বাড়ি ফিরলে তোমার হাতে এটা দেব বলে। এই নাও। এটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাল করে সংবাদটা পড়ো। পারলে তোমাদের পাড়ার লোকদের জানিও। এদের কীর্তিকথা!” তা আমি আর পাড়ার কাকে জানাব। মা বাবাকে বললাম। মা বাবা শুনে আর তোমাদের ছবি দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। বাবা বলে, রতন আমাদের গ্রামের নাম উজ্জ্বল করে দিল। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজধানী- সক্কলে আমাদের গ্রামের নাম জেনে গেল। এ কম খুশির কথা!” যাঃ আর তোকে আটকে রাখব না। অতদূর থেকে আসছিস। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করগে।” আর একটা কথা, বলে সনাতনের কানের কাছে গিয়ে অলোকাদি বলল,“মা আজ নাড়ু বানিয়েছে। আমাদের বাড়ি যাস। তোকে খাওয়াবো। তোর পুরস্কারের সম্মানে আমার তরফে পুরস্কার!”
-তুমি এখন কোথা থেকে আসছো দিদি? কলেজ থেকে? এখন তো পুজোর ছুটি। খুলবে ভাইফোঁটার পর। তোমাদের কলেজে আবার অন্য নিয়ম?
-হ্যাঁ রে ভাই। পুজোর ছুটি ঠিকই আছে। তবে ছুটিতে যাতে পড়া পেছিয়ে না যায় তাই অনার্স ক্লাসগুলোর জন্যে স্পেশাল ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে কলেজ। তাই যেতে হচ্ছে।
-কলকাতা থেকে তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি অলোকাদি। তোমাকে জিনিসটা আমি দেব। তুমি কিন্তু ওটা নিতে ‘না’ করবে না। ভালোবেসে আমি তোমাকে দেব। যখন তোমাদের বাড়ি যাব সেটা নিয়ে যাব। ভালোবাসার জিনিস ফিরিয়ে দিতে নেই। না হলে যে প্রাণভরে দিতে চায় তাকে কষ্ট দেওয়া হয়ে যায়। নেবে দিদি?
-বেশ দামি দামি কথা বলতে শিখেছিস তো তুই, সনাতন। আচ্ছা, ঠিক আছে। সেটা দেখা যাবে। হ্যাঁ, আসল কথাটা তো তোকে জিজ্ঞাসা করা হল না। আমি কিরকম যা-তা দেখ। ওটা আমাকে আগেই বলা দরকার ছিল। তা কলকাতায় তোদের কোন অসুবিধা হয়নি তো? কোনদিন তো তুই কলকাতায় যাসনি। এই প্রথম।” একটু থেমে আবার অলোকাদি বলল,“কষ্ট আর হবে না? কাকাও শুনেছি এই প্রথম কলকাতায় ঢাক বাজাতে গেল। কষ্ট তো হয়েইছে। আমার মন সেটাই বলছে। তবে তোরা বাপে-ছেলে যা সহনশীল। তোরা সেই অসুবিধাগুলো সামলাতে সক্ষম হয়েছিস বলেই এই সাফল্য পেয়েছিস। এ’ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।[ একত্রিশ ]
যতক্ষণ না রেখা বউয়ের শ্বশুরের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ সে কারবারের কোন কাজই করতে পারবে না। রেখাবউ চেয়েছিল বাড়ির কাজের ফাঁকে কারবারের কাজ যতটা পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু অখিলই তাতে বাধ সাজে। অশৌচ না কাটা পর্যন্ত ঠাকুরের গয়নার কাজে ছোঁয়াছুঁয়ি করা যায় না। শাস্ত্রের বিধানে বাধে। বেমানানও। শোকবিহ্বল এক মহিলার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এমন নির্দয় কাজ করানোয় অখিলের বিবেক সায় দেয় নি। তাতে তার কারবারের লাভালাভে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়বে। পড়বে-পড়বে! তাতে কি? পালপাড়ার স্কুলে পড়া মেয়ে ঊষা, রেখা বউয়ের কাছাকাছি বুদ্ধি ধরে। সেও এই জটিল কাজ অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছে। এখন তার পুজোর দীর্ঘ ছুটি। স্কুল যাবার জন্যে অন্য সময় তার বেশি কাজ করা হয়ে ওঠে না। এখন সে অনেকটা বেশি কাজ তুলতে পারে। রেখা বউয়ের বরাদ্দ কাজের কিছুটা ওই মেয়েটাকে দিয়ে সে করাচ্ছে। তবে সে রেখা বউয়ের মত অত পাকাপোক্তভাবে দ্রুততার সঙ্গে কাজ নামাতে পারে না। কাজের ফিনিশিংও রেখা বউয়ের মত নয়। এই নকশার কাজটা সেইজন্যে জমে যাচ্ছে। যাচ্ছে যাক। শ্বশুরের কাজ মিটে গেলে রেখা বউ সুদে-আসলে তা মিটিয়ে দেবে। সে আস্থা তার উপর অখিলের আছে।
ভীষ্মর বাপের কাজে টানা তিনদিন সারাক্ষণই রেখা বউদের বাড়িতে থেকে সবকিছু তদারকি করেছে অখিল। মাঝে কোন ফুরসতে কারিগরদের বাড়িতে গিয়েছে কাজের খোঁজ খবর নিতে বা অন্য প্রয়োজনে। যতই ছোট করে গরিবীয়ানায় কাজ করা হোক না কেন তা সম্পন্ন করতে তো একটা খরচ আছে। সেই খরচও যোগান দেবার সামর্থ রেখা বউদের ছিল না। অখিলই মুশকিল আসান হয়ে তাদের সামনে হাজির হল বলেই সবকিছু সামাল দেওয়া গেল। রেখা বউয়ের তাই অখিলের প্রতি কৃতজ্ঞতার যেন অন্ত নেই। ভাল মনের মানুষ না হলে এবং সেই মানুষটার হৃদয় থেকে সাড়া না দিলে আচমকা কেউ এইভাবে অর্থ দিয়ে এবং গতর দান করে তাদের সমস্যার সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। তার সঙ্গে এই মানুষটার কিসের সম্পর্ক? কারিগর আর ঠিকাদারের সম্পর্ক ছাড়া তো আর কিছু না। সে তো সাধারণ নিয়ম মেনে অসুবিধায় পড়া কারিগরকে এককালীন কিছু নগদ হাতে ধরিয়ে কর্তব্য সেরে ফেলতে পারতো। তার স্বামীর বেলায় যেমন হয়েছিল তেমনি এবারও, কাজের মজুরী থেকে তা আস্তে আস্তে কাটান করে সেই ধার শোধ করে দিতে পারতো। ও শুনেছে লোকে নিখিল ঠিকাদারের এই কাজের জন্যে গুনগুন ফুসফুস করে বেড়াচ্ছে। বিধবা বউয়ের ওপর লোভে পড়ে গেছে রুইদাস পাড়ার এই ছেলেটা। তাই ও, বিধবাটার বাড়ি ঘনঘন আসা যাওয়া করে। কিন্তু সে তো কোনদিন অখিলবাবুর চোখে মুখে লোভীর রেখা ফুটে উঠতে দেখেনি! কক্ষনো এমন ব্যবহার সে তার সঙ্গে করেনি, যেটা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তার প্রতি ওই লোকটার নজর পড়ে গেছে। বরং এমন সভ্য ব্যবহার সে ছাড়া অন্য কারোর কাছে পায় নি। আর নিন্দুকরা যত তাদের নিয়ে অপচর্চা করে, ওই ভাল-মানুষটার প্রতি তার ভাবনা যেন বেশি করে পেয়ে বসে। মানুষটাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় দিতে তাকে যেন উৎসাহিত করে। এমনিতে ওনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখানোর জন্যে তার এগিয়ে আসার কথা না। সে একজন স্বামীখেকো মেয়েমানুষ। তিনকুলে তার কেউ আর বেঁচে নেই। এই এক আধমরা সদ্যবিধবা বুড়িটা এখন তার জীবনের ছাতা হয়ে নড়াচড়া করছে। এ চলে গেলে তার ভবিষ্যৎ কোন খাতে বইবে তা তার অজানা। তার মত একজন দায়বতী, অচ্ছ্যুৎ যুবতী বিধবার উপর কোন জলজ্যান্ত টগবগে যুবকের দুর্বলতা থাকতে পারে তা সে ভাবতেই পায় না। মানুষ যতই তাদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চালিয়ে যাক না কেন। নিজের জীবনকে সুরক্ষিত রাখার জন্যে এই ভাবনা তার মনেও আনা উচিত নয়। একজনের সরলতার সুযোগকে কাজে লাগাতে এমন আত্মপর সে হতে পারবে না। মানুষটাকে তার সম্মানীয় আরাধ্য পুরুষ ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে চায় না। তার প্রতি সে যদি কোন দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলে তো তা হবে মানুষটার প্রতি তার চরম অবিচার। এমন এক বড় মনের মানুষকে কেন সে অন্য রঙে রঙিন করার প্রয়াসে সচেষ্ট হতে যাবে! যাবে না সে। এটা তার ধর্ম। এ ধর্ম থেকে সে বিচ্যুত হতে চায় না।
নিয়মভঙ্গের দিন বাড়ির যাবতীয় কাজ সারতে সারতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। পরের দিন অখিলকে কোলকাতায় যেতে হবে। মহাজনের তলব এসেছে। আর সে এই কাজগুলো শেষ করে না গেলে সব পড়ে থাকবে। ডেকরেটরকে একদিনের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। সাইকেল ভ্যানকে বলে রেখেছে। সক্কাল হলেই সে এগুলো নিয়ে ডেকরেটরের ঘরে পৌঁছে দেবে। রাত তখন প্রায় একটার কাঁটা পেরিয়ে দুটোর দিকে টিকটিক করে এগোচ্ছে। রেখা বউয়ের বুড়ি শাশুড়ি পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। রেখা বউকে সব বুঝিয়ে বলে, বাড়ির দিকে পা বাড়াবে ঠিক করে এগিয়ে গেল অখিল, “রেখা বউ, আমি তাহলে এখন বাড়ি যাচ্ছি। আমার যা কাজ করার সব করে গুছিয়ে রেখেছি। সকালে উত্তম ভ্যানওয়ালা এসে ডেকরেটরের মালগুলো সব নিয়ে যাবে। কাল আর দেখা হবে না। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তোমরা সব সাবধানে থাকবে।” কথাগুলো বলে অখিল পেছন ফিরতেই রেখা বউ তার হাতটা টেনে ধরে! রেখা বউয়ের পেলব হাতের স্পর্শ তার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন উতলা হয়ে ওঠানামা করতে লাগল। উথাল পাথাল হতে থাকে ভেতরটা! দ্রুত রক্ত চলাচলে তার শরীরের রোমকুপের গোড়াগুলো ভিজে ভিজে মনে হতে লাগল ! জীবনে এই প্রথম কোন সুন্দরী যুবতীর স্পর্শ সে অনুভব করল। এ অনুভবে যে এমন মাদকতা আছে তা আগে কখনো জানা হয়ে ওঠেনি তার। মনে হচ্ছিল যেন এমন স্পর্শসুখ সে যদি আজীবন পেত, তার জীবন হয়তো সার্থক হয়ে যেত। রেখা বউয়ের হাতটা জোর করে না ছাড়িয়েই তার ছোঁয়াকে হৃদয়ের সঙ্গে একাকার করে নিতে নিতে প্রশ্নমুখো হয়ে ঘুরে প্রকৃতির মুখোমুখি হল। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখ থেকে ভেসে এল কথাটা, “অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। যতই কাছাকাছি বাড়ি হোক না কেন। বর্ষার রাত। অনবরত ঝিমঝিম টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বর্ষায় পাড়াগাঁয়ের রাতের রাস্তা একদম ভাল থাকে না। পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করে শিকার ধরার জন্যে। ঠিকাদার বাবু আমি এখন তোমাকে এই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারবো না। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় আমি পাল্টে দিচ্ছি। তুমি এ’ঘরে একটু গড়িয়ে নাও। সময় এখন রাত দুটোর কাছাকাছি। এ’পাশ ও’পাশ ফিরতে ফিরতেই ভোর হয়ে আসবে। অন্ধকার ফুঁড়ে ভোর উঁকি দিলেই না হয় বাড়ি চলে যেও। তবে এখন না। আমি পাশের ঘরে শাশুড়ি মায়ের কাছে শুতে যাচ্ছি।”
-নতুন বিছানায় শুলে আমার ঘুম আসে না। উশখুশ করেই রাত কাবার হয়ে যাবে। বাড়ি গেলে তবু কিছুটা ঘুমোনো যাবে।
-ঘুমোনোর জন্যে তো আমি শুতে বলছি না, সময় কাটাবার জন্যে। জেনেশুনে আমি বিপদের রাস্তায় তোমাকে ঠেলে দিতে পারবো না ঠিকাদারবাবু। যে ‘লতায়’ কেটে আমার জীবনে এতবড় সর্বনাশ ঘনিয়ে এলো, সেই লতাকে আমি আবার দ্বিতীয়বার আমার আর এক আপনজনের ‘আয়ের’ হতে দিতে পারি না।
-আমার কাছে টর্চ লাইট আছে। রাস্তা দেখে সাবধানে চলে যেতে পারবো। তাছাড়া আমার মত ডাকাবুকো ছেলেকে ছোবল মারতে এলে সাপ বেটাকে দু’বার ভেবে দেখতে হবে।
-ওইরকম সাহসী ছিল তোমার দাদা। আমার কথা শুনতো না। বলতো,“আমাকে কাটবে এমন সাপ এখনো জন্মায়নি। ও ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সাবধানী।” সেই সাবধানী পুরুষই লতার ছোবলে জীবন দিল তো? ঠিকাদার বাবু, দেখছি তুমিও সেই তেনার মত কথা বলছো। এমন কথা আমার বুকে বড়ো বাজে। বলে, রেখা বউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অখিলের হাত থেকে নিজের হাতটা আলগা করে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল! এরপর অখিলের পক্ষে আর সম্ভব হল না রেখা বউদের বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরের বর্ষার রাতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে। বসে পড়ল রেখা বউয়ের বিছানার উপর। সঙ্গে সঙ্গে আর সময় নষ্ট না করে রেখা বউ ‘পোটমান’ থেকে কাচা চাদর আর বালিশের ওয়াড় বার করে বিছানায় পেতে দিয়ে বাইরের দরজায় খিল আটকে পাশে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। শাশুড়ির পাশে রেখা শুলো বটে, কিন্তু দু’চোখ কিছুতেই এক করতে পারল না। এই প্রথম তাদের বাড়িতে একজন অবিবাহিত বাইরের পুরুষ শুয়েছে। রেখা তাকে জোর করে শুইয়েছে বলা যেতে পারে। কিন্তু এই কাজটা কি সে ঠিক কাজ করেছে? হলই বা সে বিধবা। কিন্তু তার শরীর তো যৌবনে টৈটুম্বুর। উনিশ বছরের মেয়েরা যেমনটা হয়। এই সময় এখনো কত মেয়ের বিয়ে হয় না। বিশেষ করে যারা কলেজে-টলেজের মত উঁচু ক্লাসে পড়ে। সেও যদি লেখাপড়া চালিয়ে যেত তো এখন কলেজে পড়ত। ‘কোদালের’ স্কুলে সিক্স অব্দি পড়ার পর মা আর পড়াতে পারল না। ওখানে আর ক্লাস ছিল না। এখন হয়েছে। তখন পড়তে গেলে তাকে বাইরের স্কুল, ওই ফতেপুর-দোস্তপুর বা মনসারহাট স্কুলে পড়তে যেতে হত। অত খরচ মা যোগাতে পারবে না। ছাড়তে হল পড়াশোনা। তা এই উনিশ-কুড়ি বয়সটা যে মেয়েদের পরিপূর্ণভাবে রূপরস ফুটে ওঠার বয়স। ঠিকাদারবাবুর মত যুবক পুরুষ তাদের ঘরে রাত কাটাচ্ছে! খবরটা পাড়াগাঁয়ে একবার চাউর হয়ে গেলে তার চরিত্র নিয়ে যে জল ঘুলিয়ে স্বচ্ছতার লেশমাত্র রাখবে না তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এসবের জন্যে তার থেকেও ওই মানুষটার উপর চাপ ভয়ানকভাবে এসে পড়বে। অথচ মানুষটার কোন দোষ নেই। আমার কাজ শেষ করার জন্যে এতটা রাত পর্যন্ত তাকে থাকতে হয়েছে। হয়তো এমন কোন বদনামের আশঙ্কায় ঠিকাদারবাবু ওই গভীর রাতেই বাড়ি চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু তাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি! পাছে অন্যকিছু ভেবে বসে! আমার আর অন্য কি ভাবার আছে। আমার তো, বলতে গেলে জীবনের ইচ্ছা আশা আকাঙ্খা বলে আর অবশিষ্ট কিছু রইল না। বিগত-যৌবনাদের মত এলিয়ে পড়া জীবনই এখন আমার ভবিতব্য। ঠিকাদারবাবু যদি তার ভাললাগার কথা টাগরা থেকে বারই করে ফেলতো, তাতেও তার কোন ভাবান্তর হত না। এই অভাগীর কপাল যে পোড়া, সেটা তো অনেক আগে থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। তা এমন যে মানুষ। যে তাদের উপকার করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার শঙ্কার কথা সে ভাববে না? না ভাবাটাই তো নির্লজ্জতা, নির্মমতার পরিচয়। একদিন এমনই শঙ্কার কথা সে তার ভীষ্মকে শুনিয়েছিল। সে শোনেনি তার কথা। চরম বিপর্যয় ঘটল তাদের জীবনে। আবার সেই শঙ্কা যখন তার মনে জাগল এমন এক বিপদহরণ বন্ধুকে নিয়ে, তখন সে তো পদক্ষেপ করবেই। ভীষ্ম তার কথা মানেনি। ঠিকাদারবাবু মেনেছে। লোকের বদনাম আগে না অমূল্য জীবন আগে! রেখা যা করেছে সঠিক কাজই করেছে। তাতে কে কি ভাবলো-না-ভাবলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। কই, তার বিপদে তো ওই গুলতানিপ্রিয় মানুষদের কেউ পাশে এসে দাঁড়াল না? একজন সংবেদনশীল ভাল মানুষ ছুটে এল বলেই না তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পেল! এমন মানুষের গায়ে যদি কেউ বদনামের পাঁক লেপতে আসে তা সে কখনোই মুখ বুজে মেনে নেবে না। তার পাশে সে দাঁড়াবে। নিজের চরিত্রের বদনামও তাকে দমাতে পারবে না।
নিশ্চুপ চরাচরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের বাড়িঘরও নীরবতার পাঠ নিতে তেমনই মনোযোগী। কেবল দেয়ালঘড়ির কাঁটাটা টিকটিক করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে। রেখার চোখ পড়ল সেদিকে। কখন যেন রাত তিনটের ঘর গড়িয়ে গিয়েছে তার বড় কাঁটাটা! নির্ঘুমে, নিয়ানো আঁচের মত গরম হয়ে যাওয়া চোখদুটোকে আর প্রশ্রয় দিতে চাইল না। বড়বড় চোখ করে তাকে দমাবার জন্যে বিছানায় উঠে বসল। আর শুয়ে থাকা যাবে না। চারটের দিকে কাঁটা ছুটলে ‘ভোরের ঘুম ভাঙার’ সময় এসে পড়বে। তার আগেই ঠিকাদারবাবুকে ডেকে দিতে হবে। বিষাক্ত লতারা অর্থাৎ সাপেরা তখন আর ‘যম’ হয়ে রাস্তায় চৌকি দেবে না। যে যার গর্ত-ঘরে শুতে চলে যাবে রাত জাগার ক্লান্তি মেটাবার জন্যে। এতক্ষণে শাশুড়ি ঘুম কেটে চোখ চেয়ে দেখে রেখা তার বিছানায়, “তুই এ’ঘরে কখন এসে শুলি-রে বউ? ভয় পেয়েছিস? তা পেতে পারিস। কচি মেয়ে তুই। এই বয়সে কত মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে ঘুময়। তারপর এমন পোড়া কপালী হলে তো ভয় পাবেই। তা এখনো তো আলো ফোটেনি। ভোর হতে দেরি আছে। উঠে বসে রইলি কেন, শুয়ে পড় বউ। আমার আর ঘুম আসবে না। আমি তোকে ডেকে দেব’খন। ক’দিন কত না ধকল তোর ওপর দিয়ে গেল। আর রুইদাস পাড়ার ওই ছোকরাটা! রুইদাসদের ঘরে উপরওয়ালা ওকে পাঠালে কি হবে। বড় মাপের মন ছেলেটার। আকাশের মত বড় ওর অন্তর। উপর থেকে যে দেখার দেখছে রে মা। সেই ওকে তোর মত হতভাগিনীর কাছে পাঠিয়েছে। মঙ্গলময় ওর মঙ্গল করবে। কত রাতে বাড়ি গেল রে ছেলেটা? আমার তো আর সবকিছু দেখা হয়ে উঠল না। বুড়ো মানুষ। শরীরটা ধড়ফড় করছিল। তাই শুয়ে থেকে থেকে কখন চোখ লেগেগেছিল। সে খাওয়া দাওয়া করে গেছে তো রে বউ?” আর কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিকাদার বাবুর নামে। শাশুড়িকে থামিয়ে রেখা ফিসফিসিয়ে বলল,“তুমি চুপ করো মা। সে বাড়ি যায়নি। ও’ঘরে ঘুমোচ্ছে। শুনতে পাবে তোমার কথাগুলো। আমি অত রাতে ওকে বাড়ি যেতে দিইনি।”
-ঠিক করেছিস বউ। একদম ঠিক কাজ করেছিস। আহা রে! বেচারা আমার। পর-বাড়ির জন্যে কি খাটান না খাটল এই তিন দিন। ওর ভাল হবে, তুই দেখে নিস বউ।
শাশুড়ি-বউ কথা বলতে বলতে ভোর হওয়ার মুখে এসে দাঁড়ায়। চারটে বাজতে যাচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে রেখা বলল, “মা, এবার ঠিকাদারবাবুকে ডেকে দিই। আলো ফোটার আগে আগেই বাড়ি চলে যাবে বলেছে। পাড়া জেগে গেলে অনেক কু-কথা চাউর হবে। প্রথম সকালের কাজের কাজিরা এবার বাহ্যে ফিরতে বার হবে।” এই বলে ও’ঘরে গিয়ে দেখে ঠিকাদার বাবু দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ক’দিনের খাটাখাটনির শরীর এমন বিশ্রামই চাইছিল। কিন্তু তবু নির্দয় হতে হবে রেখাকে। অমন শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে হবে তাকে। তাছাড়া কি করার আছে তার? না হলে যে তাদের আবার অন্য পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। সেটাও তো ঠিক না। তখন আবার ঠিকাদার বাবু তাকে দুষবে। তার থেকে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়াই কাজের কাজ হবে। বার তিনেক ডাক দিল ঘুম থেকে ওঠার জন্যে। কোন সাড়া নেই। এবার কি করে সে? গা ঠেলে না ডাকলে তো এ ঘুম ভাঙবে না। ঘুমের গভীরে এখন এ। সরাসরি গায়ে হাত দেবে? সেটা কি তার মত মেয়ের পক্ষে ঠিক হবে? অন্য কিছু ভাববে না তো? বর-খাকি বউটা গায়ে-পড়া হয়ে তাকে ঠেলাঠেলি করছে, ভেবে নেবে না তো? তাহলে এক কাজ করা যাক। হাতে হাত দিয়ে চাপ দিলে অন্যরকম কিছু মানে করবে না নিশ্চয়ই ! হাতে হাত দিতেই পারে সে। যেমন হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছিল রাতে বাড়ি যেতে দেবে না বলে।
হঠাৎ এক আদরমাখা ছোঁয়ার অনুভূতি তাকে যেন পরম তৃপ্তি দান করে চলেছে! ঘুমের ঘোরে সেই অনুভবকে সে যেন কিছুতেই নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে না। তাই সে তার প্রতিক্রিয়া জাগতিকভাবে দিতে একদম পছন্দ করছে না। একবার এই পাওয়া থেকে তাল কেটে গেলে যদি আর তা ফিরে না আসে! ঘুমে-জাগরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এখন অখিল। কিন্তু অনুভবে সুখের অস্তিত্ব তো ক্ষণস্থায়ী। তাই হয়তো রেখা বউয়ের স্পর্শের সাথে গলার বাড়তি স্বরে চমক ভাঙে অখিলের ! উঠে বসে ধরফড়িয়ে! কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে রেখা বউ, “আমার ওপর রাগ করবে না ঠিকাদার বাবু। জানি ক’দিনের কঠিন পরিশ্রমে তোমার শরীর বড়ই ক্লান্ত। তাছাড়া এখনও তো সকাল হয়নি। ঘুম ভাঙার সময়ও নয়। অসময়ে ডেকে দিতে বাধ্য হলাম। আলো ফুটে গেলে লোকে দেখে ফেলবে তুমি আমাদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছ। তখন আর এক বিপত্তি। তাই অসময়ে জাগিয়ে তুলতে আসা।” অখিল তার প্রতি বিরক্ত হয়নি। অখিলের চোখ মুখের ভাষা পড়ে বুঝতে পারে রেখা। গোঁফের কাছে হাল্কা হাসির রেখা। কি অনুভবে এই হাসির ফুলকি কে জানে! এবার সে মজা করে বলল,“কখন থেকে হাতে ঠেলা দিয়ে ডাকাডাকি করছি। কোন সাড়া নেই। যেন মটকা মেরে পড়ে আছে। জোরে ডাক দিয়ে ডাকতে তারপর তাড়াতাড়ি করে উঠলে। ভাবলাম কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। রাগে কি না কি বলে বকাবকি করবে আমায়। তাই ভয় পেয়ে যাই। কিছুই তো বললে না। বাঁচলাম। অন্ধকার পাতলা হতে শুরু করেছে। পুবাকাশ থেকে এবার ভোরের আলোর ছটা উঁকি মারবে। একটু চা করে দেব? চা খেয়ে যেতে? আবার তো সকাল সকাল কলকাতায় ছুটতে হবে বলেছিলে।”
তুমি কেমন করে বুঝবে রেখা বউ! তোমার এই স্পর্শের মহিমায় কি সুখ আমাকে পাইয়ে দিলে। হতে পারে এই স্পর্শ তোমার কাছে নিতান্ত কর্ম প্রয়াস মাত্র। কিন্তু আমার কাছে যে এ যুগান্তরের পরম প্রাপ্তি। হয়তো কত কাল ধরে এই পাওনার খোঁজে ফিরি করে চলেছি। এতদিনে তা পাবার জন্যে সাফল্যের কয়েক ধাপ এগোতে পেরেছি। তুমি এসব এখনো বোঝোনি রেখা বউ। তাই আমার এই অনুভবে তোমার অনুভব এখনো একাকার হয়ে উঠতে পারেনি। এমন ভাবনার ঘোর থেকে যেন কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইছে না অখিল। তাই রেখা বউয়ের কোন কথার উত্তর না দিয়ে পুলকে মনকে জারিয়ে রাখতে চাইছে। হোক ভোর হোক সকাল। নাই বা হল তার কলকাতায় যাওয়া আজ। এমন পরমপ্রিয় পরশ-সুখের ওই ভোর, সকাল, কলকাতার কাছে চাইলে তারা তাকে দিতে পারবে? পারবে না। পারবে না যখন তখন ওসবে ধ্যান দিয়ে তার কি লাভ! ওদিকে ধ্যান দিলেই হারিয়ে যাবে এ অনুভূতি। এই হারিয়ে যাবার ভাবনা অখিলের ইন্দ্রিয়কে যেন হঠাৎ সজাগ করে তোলে! দু’হাত জড়ো করে চোখ মুখে বুলিয়ে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে বসে বিছানায়। এতক্ষণের নিরিক্ষণে রেখা বুঝতে পারে তার ঠিকাদার বাবুর ঘুমের ঘোর কাটতে চলেছে,“কি গো বাবু। তখন থেকে কথাগুলো যে বললাম, একটাও বুঝি কানে পশেনি ? একটু চা করে দেবো বাবু ? তাড়াতাড়ি তৈরী করে আনছি। ওই পেতল-ঘটিতে জল আছে। চট করে চোখ-মুখ ধুয়ে নাও তুমি। শুকনো মুখে বাড়ি থেকে বার হতে নেই। গৃহস্থের অকল্যাণ হয় তাতে।” এই কথাটা যেন কত যোজন দূর থেকে আকাশবাণীর মত তার কানে এসে বাজলো! হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়া এমন কথা একমাত্র তারই জন্যে কিনা কে বলতে পারে! যে বলে সে তার নিতান্ত আপনজন ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। এমন জনের কথা অখিল না মেনে পারবে কেন! আর অখিল সঙ্গে সঙ্গে সময় নষ্ট না করে ঘটির জল নিয়ে বারান্দার নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেল।
রেখা বউয়ের হাতে বানানো চা খাবার পর কাঁচা ঘুম থেকে উঠে পড়া ঝিমোনো শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল। ভেতর থেকে তাড়া এল বাড়ি যাবার জন্যে। “আর দেরি করা যাবে না।” রেখা বউকে সে কথা জানাতে রেখা কাল বিলম্ব না করে বাইরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “সাবধানে যেও ঠিকাদারবাবু।” বলে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অখিলের চলে যাওয়া দেখতে লাগল। কি মনে করে অখিল একবার পেছন ফিরে তাকাল। দেখে রেখা বউ এখনো তার চলে যাওয়া কত উদাস নয়নে নিরিক্ষণ করে চলেছে। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা কয়েকবার কেমন যেন ধকধক করে উঠল! তার ভেতরটা এমন করে উঠল কেন? রেখা বউ বা তার দিকে এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকে নিয়ে কি ভাবছে? তারও ভেতরটা তেমন উতলা না হলে এমনটা অখিলের বা হতে যাবে কেন। রেখা বউ কি তাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছে? অখিলের মনও কি সেই কথা বলতে চাইছে যে “আমিও তোমাকে ভালবাসি, রেখাবউ” কিন্তু সে তো মেয়েমানুষ। তার উপর আবার বিধবা। সরাসরি তাকে অখিল কেমন করে ভালবাসার কথা বলবে, সেটা তো বুঝে উঠতে পারছে না। জোর করে তো আর ভালবাসা আদায় করা যায় না। অপরপক্ষের অন্তরের ডাক আসা দরকার। এই ভোররাতে মমতাভরা ছোঁয়া আর যত্ন নিয়ে চা করে তাকে খেতে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কি সেই ডাকের ইঙ্গিত দিয়ে দিল সে! কি জানি! সবকিছু যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে অখিলের।
রেখা বউদের বাড়ি থেকে তার বার হতে দেখলে লোকে অনেক কথা বলতে পারে। তাই রেখা বউ তাকে ভোরের জন্ম হবার আগেই আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে অখিলকে বাড়ি যাওয়াতে সায় দেয়। অখিলও রেখা বউয়ের কথা মাথায় রেখে সেই সায়ে তার সায় মিলিয়ে দেয়। মেয়েদের চরিত্র নিয়ে রসালো চর্চা চিরদিনই পছন্দ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অকেজো মানুষ জনেরা। তার উপর রেখা বউয়ের মত বিধবা যুবতী যদি সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় তো কথাই নেই। অখিল তাই বাইরের চরাচরের অলক্ষ্যেই দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তার বিশ্বাস তাকে কেউ এখনো দেখতে পায় নি। এইসময় কোন মানুষের বাইরে বার হবার কথা নয়। এটা এমন একটা সময় যখন নিশাচরেরা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় আর প্রাতঃভ্রমণকারীরা প্রস্তুতি নেয় এবং অপেক্ষা করে ভোরের চোখ আর একটু বড় করে খোলার জন্যে। তবুও অখিল পুরোপুরি আশ্বস্ত যেন হতে পারছে না। ওর বিশ্বাস কোনভাবেই তার এই রাত্রিবাস এবং সকলের অগোচরে এমন সময় নিজের বাড়ি চলে যাবার ঘটনা মানুষকে এড়াতে পারবে না। ওর মনে হয়, তার এই চলনদৃশ্য আর কেউ দেখুক না দেখুক
চরাচরের চোখকে তো সে এড়াতে পারছে না। লোকে বলে না
-দেওয়ালেরও কান আছে। তেমন তার মনে হয় চরাচরেরও ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ আছে। ওর চোখের আয়না দিয়েই সংবাদটা মানুষের কান কোন না কোন সময় ছুঁয়ে যাবে। সে যায় তো তার বা কি করার আছে। অখিল রুইদাস তাতে ভীত নয়। ও ভীত নয় আটচালার কামচোর নিন্দুক একদল অকর্মণ্য মাথাদের আলোচনা সমাচোলনায়। দিন যত এগোচ্ছে, দিনযাপনের পদ্ধতিরও পরিবর্তন হচ্ছে। আগেকার যুগের সেই অচলায়তন সমাজব্যবস্থা আর চলতে পারে না। তাদের সমাজের মত যারা সেই সাবেক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে, তারাই অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। উন্নত আধুনিক সমাজ থেকে তারা দূর আরও দূরে সরে যাচ্ছে। আটচালা তাকে এই কাজের জন্যে কৈফিয়ৎ চাইলে সে কৈফিয়ৎ দেবে। গর্বের সঙ্গে দেবে। তার এই ভাবনার কথা জোর দিয়ে সকলের সামনে প্রচার করবে। তারপর দেখা যাবে কি শাস্তি তারা তাকে দেবার সাহস দেখায়। তাদের সমাজে তার মত প্রজন্মের যুবক যুবতীরা চায় সেই মধ্যযুগীয় সমাজ ভাবনা থেকে মুক্ত হতে। আসলে প্রথম এই ভাবনা সমাজের সামনে তুলে ধরার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। তাই নবযুগের ভাবনা এখনকার যুগের হৃদয় থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে সময় দিতে হচ্ছে। সেই উপযুক্ত সময়, যে সময় শুধু আধুনিক চিন্তা ভাবনার স্ফুলিঙ্গ দেশলাই কাঠির মত যদি কেউ ঠিকরে বার করতে পারে, সেই সময়ের। তেমন হলে অখিলই প্রথম সেই দেশলাইয়ের স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে দেবার সাহস দেখাবে। তারপর আর তার একা হয়ে থাকতে হবে না। এ বিশ্বাস তার পুরোপুরি আছে।
গ্রামের মেন রাস্তা থেকে তাদের রুইদাস পাড়ার দিকে ঢাল হয়ে নেমে যাওয়া গড়ান রাস্তা কয়েক পা দ্রুত চালান দেবার পর ধীর পদে এগোতে থাকে অখিল। একটু এগোলেই বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে পাড়ার আটচালা। ওটার ভেতরে টিমটিমে বাল্বের আলো চরাচরের সীমাবদ্ধ অংশে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। হঠাৎ অখিল দেখতে পেল, সেই আলোর ছটায় কে যেন আটচালার আড়াইফুটি ঘেরা দেয়ালে মাথা লুকলো! কে? কে ওখানে? বলে গলা চড়াল অখিল। কোন সাড়া নেই। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এসে দেখে তাদের পাড়ার হেড়ো পাগলা! দেয়াল ঘেঁষে কাত্ হয়ে শুয়ে। টুকটুক করে আবার তার একটা পা নড়ছে! মটকা মেরে শুয়ে আছে,“এই শালা হেড়ো! ওঠ? ভাবছিস আমি বুঝতে পারব না, তুই মটকা মেরে শুয়ে ঘুমের ভান করে আছিস, তাই না? দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি মেরে কি দেখছিলিস? শালা পাগলার মরণ! ওঠ শালা”ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১২)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ আটাশ ]
বাবুদের কথায় কিঞ্চিৎ নমনীয় হয়ে রতন বলল, “আপনারা বুদ্ধিমান মানুষ। একটু মন দিলে অবশ্যই ঢাক বাজানো শিখতে পারবেন। আমাদের মত মাথামোটারা যদি পারে, আপনারা পারবেন না তা হতে পারে না। শুধু মনটা দিলেই হবে। আমার সামনে আপনারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যান। ছেলেদের এমন কান্ডর কথা পাড়ায় মুখে মুখে চাউর হয়ে যেতে পাড়ার মেয়ে-বউরাও একে একে জড়ো হতে থাকে। রতন ছেলেদের কেমন করে ঢাক বাজানো শেখায় তা দেখার জন্যে মেয়েরাও উৎসুখ হয়ে পড়ে।
বাবু, এই ‘তাল’ কথাটা যে আমরা বলি, তার মানে তালি। হাততালির তালি। এই তালির জায়গাতেই তবলা ব্যবহার করা হয়। আমাদের ঢাক, বলা যায় তবলারই বড় রূপ। তবলা হাতে বাজায়। ঢাক আমরা কাঠিতে বাজাই। ঢাক তবলার থেকে এত বড় যে ওই মামুলি হাতের কারসাজি এখানে চলে না। এই তালের আবার ছানাপোনা আছে। তালি, খালি, বিভাগ, মাত্রা, বোল, ঠেকা লয়, সম আর আবর্তন।
আমরা যখন দু-হাতে তালি বাজাই, হাতদুটি প্রতি দু’বার চুমু খাবার মাঝে একবার করে বিচ্ছিন্ন হয়। এই বিচ্ছিন্নর অংশটাকে ‘খালি’ বলে। দুটি তালির মাঝের সময়ের সম্পর্ক ত্যাগ। প্রতিটি তালি বা খালিতে একটি করে সময়ের মাপ আছে। এই মাপই বলে দেয় কোন তালে ক’টি মাত্রা। মাত্রা মানে তালের বেলায় শব্দের আঘাত। এই ঢাকের কাঠি দিয়ে যে ঢাকে মারলাম তারপর টাং করে শব্দ হল, সেটাই মাত্রা। -একটা শব্দ লেখার সময় আমরা যে মাত্রা দিই তেমনটাই আর কি? এক বাবু, রতন বলার ফাঁকে কথাটা ছুড়ে দিল।
রতন তখন বলল, “আমি অতটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না বাবু। এটুকুই আমার জানা।” সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবু বলল,“আরে রতনকে অত ক্রশ করিস না। ও তাহলে সব গুলিয়ে ফেলবে। যেটুকু ও জানে তার মধ্যেই ওকে থাকতে দে। মাঝপথে আমাদের শেখাটাই মাটি হয়ে যাবে। রতন, তুমি এবার শুরু করো। আমরা মন দিয়ে তোমার কথা শুনছি।”
তারপর বলি বাবু, “যখনই কোনো বাজনা শুনি জেনেবুঝে বা না বুঝে অজান্তে আমরা তাল দিই। ঘাড় নাড়ি, হাঁটু ভেঙে নেচে তাল দিই, হাতের অঙ্গভঙ্গী করি। ঠিকভাবে দেখলে বুঝতে পারব আমরা, সব জায়গায় একইভাবে তাল দিই না। মানে একইভাবে হাঁটু ভেঙে নাচি না একইভাবে তালি দিই না। কখনো ধীরে কখনো তাড়াতাড়ি। মানে তালিও খালি সেইমত নিজের জায়গা
করে নেয়।
খুব চেনা কয়েকটি তাল হচ্ছে দাদরা (৬/৩-৩), কাহারবা (৮/৪-৪), তেওড়া/রূপক (৭/৩-২-২), ঝম্পক (৫/৩-২), নবতাল (৯/৩-২-২-২), ঝাঁপতাল (১০/২-৩-২-৩), একতাল/ চৌতাল (১২-৪-৪-২-২/২-২-২-২- ২-২) আর ত্রিতাল (১৬/৪-৪-৪-৪-)।
এবার সন্তোষবাবু মুখ না খুলে পারল না,“আচ্ছা রতন, তুমি যে বলো তেমন কিছু বোঝ না। তা যেসব তালের কথা তুমি বললে তা তো বড়বড় সঙ্গীত শিক্ষায়তনের পাঠ। সেই পাঠ তুমি আমাদের দিচ্ছো। আর বলছো তুমি মুর্খ ! তোমার মত শিক্ষিত তো মনে হয় আমাদের মধ্যে কেউ নেই! তোমার মধ্যে এত গুণ। অথচ তোমার কোন অহং বোধ নেই! কত বড় মন হলে তবে মানুষ এমনটা হতে পারে। এটা একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার জানো তো রতন। এইসব ব্যাপারগুলোতে অত নজর রাখো না বলেই তোমরা অতটা সাদাসিধে। যতদিন তোমরা এইভাবে চলতে পারবে ততদিন তোমরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারবে। আর যেই অহংবোধ তোমাদের মধ্যে জেগে উঠবে তখনই হবে মুশকিল। তাই বলি, যেমন আছো তেমন থাকো। ভাল থাকো। হ্যাঁ, বলো রতন। কি বলছিলে। তোমাকে আমরা বারবার থামিয়ে দিয়ে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি না? কিন্তু এসব না বলেও তো থাকতে পারছি না। বলো রতন, বলো।”
-বাবু, এছাড়া আরও কত রকম তাল আছে জানো? ধামার আছে, আড়া চৌতাল আছে, সিতারখানি, মত্ত তাল দীপচন্দি, সুরতাল, ঝুমরা, তিলওয়ারা, ঝম্পক বা রূপম, পঞ্চম সাওয়ারী, ষষ্ঠী, খেমটা, চৌতাল, আড়খেমটা এইসব। আবার দুটি তালকে ইচ্ছেমত মিলিয়ে যে তাল হয় তাকে কাওয়ালি, বিচিত্র ইত্যাদি বলে। আর একটা কথা, যেই ঢাকে আঘাত করা হচ্ছে সবকটা মারের সঙ্গে যোগ আছে একটা করে ভাগ। এইটাই হোল ‘বোল’। আর ‘ঠেকা’ হোল বোল আর ভাগের ঠিক করা তালি, খালি। এগুলো মিলিয়েই তালের জন্ম। এত সব তাল কিন্তু বাবু আমাদের ঢাকে ব্যবহার করা হয় না। নির্দিষ্ট কয়েকটাকে ধরে পুজোর ভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাক বাজানো হয়। এবার তাল ধরে ধরে আমি কেমনভাবে বাজাচ্ছি দেখুন। তারপর এক এক করে আপনারা বাজাবেন। প্রথম প্রথম কাঠি হয়তো ঠিকমত ঢাকে ঠিক ঠিক জায়গায় পড়বে না। ওই যেটাকে বলে হাতের আড় ভাঙা আর কি। কাঠি নিয়ে প্রথমে হাতের আড় ভাঙতে হয় বাজিয়ে বাজিয়ে। তারপর তালে পা দিতে হয়। আড় ভাঙার ব্যাপারটায় লজ্জার কিছু নেই। নতুন যারা ঢাকে কাঠি মারবে সকলেরই এটা হবে। এ তো সব ক্ষেত্রেই হয়। ছেলেপিলেরা কি প্রথমবার জলে নেমেই সাঁতার শিখে যায়! কত জল খেয়ে ফেলে। জল খেতে খেতে একটা সময় ছপাৎ ছপাৎ করে জল টেনে সাঁতরে পুকুর এপার ওপার করে ফেলে। এ-ও তো তাই। বাবু, আপনারা যারা হাতের আড় ভাঙতে চান এক এক করে আসুন। তারপর আমি তাল বোলের দিকে যাব।”
সন্তোষবাবুরা পরপর প্রথম ঢাক বাজানোর হাতেখড়ির বাজনা বাজাতে শুরু করে। এক এক করে এমনটা করতে করতে সময় এসে যায় বিসর্জন পুজোর। বামুন ঠাকুর ওদিক থেকে হাঁক দিয়ে দিয়েছে। ঠাকুরমশাইয়ের হাঁক কানে আসতেই রতন সতর্ক হয়ে যায়, “বাবু, বিসর্জনের পুজো শুরু হয়ে গেছে। ঘটের সুতো কাটার মন্ত্র শুরু হয়ে যাবে। আমাকে সেই বিসর্জনের বাজনা বাজাতে হবে। এটা তো আর আগমনীর আনন্দের বাজনা হবে না। আবার পুরোপুরি বিষাদেরও নয়। বিনয়ের তাল বোল নিয়ে কাজ করতে হবে। আপনারা আগমনীর বাজনা শুনেছেন এবার বিনয়ের শুনুন। মন দিয়ে শুনলে বুঝতে পারবেন দুটোর মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কোথায়! তারপর পার্থক্য বুঝতে পারবেন সন্ধ্যেয় ধুনুচি নাচের বাজনা আর মা’কে পরের বছর আসার জন্যে আবেদন করে মায়ের বিসর্জনের বাজনা।” বলে রতন-সনাতন চলে গেল মায়ের থানের সামনে। পরম শ্রদ্ধাভরে মা’কে প্রণাম করে ঢাকে বোল তুলতে শুরু করে দিল।
প্রত্যেক বছর সন্তোষবাবুরা শিয়ালদা থেকে ঢাকি বায়না করে নিয়ে আসে। নিয়মমাফিক তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। ঢাকিরা তাদের ঢাক বাজানোর কর্তব্য করে টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। চলমান নিয়মের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়েই চলে সবকিছু। কিন্তু এই ঢাক বা ঢাকির মধ্যে যে এমন মন মাতানো শিল্প আছে আর এই শিল্পের যে এমন দক্ষ শিল্পী থাকতে পারে, রতনদের সঙ্গে যোগাযোগ না হলে তাদের জানাই হতো না। হয়তো অজানা থেকে যেত সমাজ জীবনের এমন একটা সুন্দর অংশের জবরদস্ত উপস্থিতি।
ধুনুচি নাচ আজ আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল রতনদের ঢাক কাঁসরের যুগলবন্দিতে জন্ম নেওয়া বোল তালের হাত ধরে। ধুনুচি নৃত্যশিল্পীরা যেন মন-মাতাল হয়ে বিরতিহীন নাচ চালাতে লাগল। রতন-সনাতনও ওদের সঙ্গে একাকারে পাগলপারা হয়ে গেল বাজনার যোগ্য সঙ্গত দিতে দিতে। তৃপ্ত মানুষ খুশিতে প্রাণ খুলে তাদের বকশিশ দিয়ে গেছে। এদের জন্যে কেউ যেন কার্পণ্যের কথা ভাবতে চায়নি। সেই কম কথা বলা গম্ভীর ভাবের ছেলেটা, সনাতনের কাঁসর বাজনাও চোখে পড়ার মত। সেও যে এতটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে পারে তা না দেখলে অজানা থেকে যেত। একটা দূর্গাপুজো কমিটির মাথায় বসার দায়দায়িত্ব যে কতটা সেইসঙ্গে মানসিক শারীরিক চাপ। তা যারা এই দায়িত্ব নেয় তারা হাড়ে হাড়ে টের পায়। কিন্তু এতকিছু সবটাই প্রাণে ধরে মেনে নেওয়া যায় যদি সার্বিক প্রচেষ্টা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। সন্তোষবাবু সেই দিক থেকে পুরোপুরি সফল এবং তৃপ্ত। এ’বছর তার এই পূর্ণ তৃপ্তি অনুভবের মূল কান্ডারী এই রতন-সনাতন, ওরা দুই বাপ-বেটা। অন্যান্যবারে এই অনুভবের মাত্রা এতটা উচ্চপর্যায়ে ছুঁতে পারেনি। তাই রতনরা যেন তার ভেতরের দুর্বলতার জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু অনুভবের কথা তো প্রকাশ্যে গলা ফাটিয়ে হাট করে দেওয়ার জিনিস নয়। ভেতরে সযত্নে লালন করার জিনিস। সেই লালনের হাত ধরে পরবর্তী পর্যায়ে নতুন করে কাজ করার প্রেরণা জন্ম নেয়। প্রেরণাঋদ্ধ হয়ে সামনের যাবতীয় কাজে তখন সাফল্য ছাড়া আর অন্যকিছু ভাবনা প্রশ্রয় পেতে পারে না।
মায়ের প্রতিমা ভাসানের কাজ সেরে বাবুঘাট থেকে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে বেজে যায়। পাড়ার মায়েদের উদ্যোগে ততক্ষেণে এদিকে মন্ডপে দধিকর্মা আর সিদ্ধি সরবত প্রস্তুত। সকলকে বলা হল, স্নানটান সেরে পরিষ্কার হয়ে চলে আসতে। রতনরাও তৈরী হয়ে এসে হাজির। একটা কাগজের বড় প্লেটে দধিকর্মা এবং একটা কাগজের বড়মত গ্লাসে সিদ্ধি দেওয়া হল প্রত্যেককে। খিদে তো সক্কলের পেয়েছে। পরম তৃপ্তিতে তা খেয়ে সবাই যে যার মত নিজেদের বাড়ি চলে যায়। রতনদের তারপর লুচি আলুরদম খাবার কথা বললে তারা তো আর খেতেই পারলো না। জল খেয়ে ভোর চারটে-সাড়ে চারটের সময় একটু গড়াতে গেল।
হৃদারাম ব্যানার্জী লেন জাগতে জাগতে বেলা আটটা-নটা বেজে গেল। এবার রতনদের বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করার কথা। সঙ্গে সঙ্গে রতনের সামনে ভেসে উঠল সনাতনের চার বছরের বোনের মুখটা, তার মায়ের মুখ। বাড়ি থেকে বার হবার সময় মেয়ে আর মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছিল, “যদি কাজ পায় তো বাড়ি ফেরার সময় পুজোর পোষাক তোদের জন্যে নিয়ে আসব।” বাথরুমে গিয়ে একেবারে স্নানটান সেরে পোষাক পরে তৈরী ওরা। অপেক্ষায় সন্তোষবাবুদের জন্যে। ঘরের বারান্দায় বিলম্বিত পায়ে চলাফেরা করছে। একজন বাবুর সঙ্গে দেখা। কোথাও যাচ্ছিল। যুগপৎ তার মেয়ের মুখ আর বাবুর, রতনের সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়াময় মেয়ের মুখখে টপকে বাবুকে বলে,“বাবু বাড়ির মানুষরা আমাদের জন্যে রাস্তাপানে তাকিয়ে থাকে, পুজোর কি বাজার আমরা তাদের জন্যে কোলকাতা থেকে করে নিয়ে আসছি। আমাদের তো দোকান থেকে নতুন পোষাক কিনে তাদের দেবার ক্ষমতা নেই। তাই যে পাড়ায় আমরা কাজ করতে যাই সেই পাড়ার মানুষদের বাড়ি বাড়ি যাই যদি কিছু তেনারা আমাদের সাহায্য করেন। তা আমরা কি পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে কিছু তোলা যোগাড় করতে পারি? যদি অনুমতি দাও তো যাই।” সঙ্গে সঙ্গে বাবু বলল,“যাও, যাবে না কেন। প্রত্যেক বছর ঢাকিরা তো যায়। তা তোমরা বা যাবে না কেন? এ’জন্যে কারোর অনুমতি লাগে না গো রতন। তুমি কোনো কিন্তু না করে বেরিয়ে পড়ো। বেলা হয়ে গেলে আবার সবাইকে নাও পেতে পারো। বিজয়ার প্রণাম করতে আবার লোকে বেরিয়ে পড়বে। আমাদের পাড়ায় এই সময় প্রণাম সারার নিয়ম-রীতি। তোমাদের বরং আর একটু আগে বার হওয়া দরকার ছিল। যাইহোক এখনই বেরিয়ে পড়ো। কোন সমস্যা হবে না।”
বাবুরা তো তাদের দু’জনের জন্যে অনেক পোষাক আসাক দিয়েছে। সপ্তমী অষ্টমী নবমী- তিন দিনের জন্যে তিন সেট করে নতুন পোষাক। বাসি পোষাক পরে মায়ের থানে যাবার নিয়ম নেই এখানে। সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মানতে ঢাকিদের জন্যে এই ব্যবস্থা। তাদের বাপ-বেটার আর পুজোর পোষাকের দরকার নেই। এবার ঘরের মানুষদের নিয়ে চিন্তা রতনের। কেমন কি পাবে কে জানে। কপাল ঠুকে দু’জনে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ল ঢাকের বোল তুলতে তুলতে। হ্যামলিনের বাঁশির মত যেন সেই বোলে মোহিত হয়ে পাড়ার মায়েরা, মেয়েরা বেরিয়ে পড়ল নিজেদের সামর্থমত পোষাক পরিচ্ছদ নিয়ে। যাদের তা নেই তারা সাধ্যমত নগদ দিয়ে দায় মেটালো। পাড়ার বাসিন্দরা এতে যে অভ্যস্ত, এমন স্বতস্ফুর্ত আচরণে ওরা বুঝে গেল। কারোর কাছেই মুখফুটে কোন আবেদন করতে হল না। ঢাকই যা বলার বলেছে আর মানুষ তা সমর্থন করেছে।
এত মানুষের সাহায্য-ভালবাসা পাবে তা রতনরা কল্পনা করতে পারেনি। ওদের মনে হচ্ছে মানুষ এত যে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাবার দান করেছে তা তারা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে তো? সেইসঙ্গে নগদ দানের পরিমাণও ভাবনার অতীত ছিল। খুশিতে দু’বাপ-বেটার মন টগবগ করে ফুটতে থাকে। রতনের মনে হয় এই দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদেরও কিছু দেয়া দরকার। কিন্তু তারা তো ছাপোষা মানুষ। এই বাবুদের দেবার মত কিই বা সম্বল তাদের আছে। একমাত্র গতর দান করার সামর্থ ছাড়া আর তো কিছু নেই। রতন ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করা যায় বলতো খোকা? এরা প্রাণ উজাড় করে আমাদের এতকিছু দিল। আমরা কি ওদের কিছু দিতে পারি না?” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমাদের যা সম্বল সেটাই দিতে পারি আমরা। এক কাজ করলে হয় বাবা। আরও দু’দিন আমরা যদি এখানে থেকে মা লক্ষ্মীর পুজো সেরে যাই? হ্যাঁ, অবশ্যই এই পুজোয় ঢাক বাজানোর জন্যে আমরা কোন পয়সা নেব না। বাবুরা হয়তো পয়সা না নেবার প্রস্তাবে সায় দিতে চাইবে না। কিন্তু এই জায়গায়, গতর খাটানো জায়গায় আমরা বাবুদের থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে। অতএব এখানেই আমরা বাবুদের উপর জবরদস্তি করতে পারি। তুমি এই প্রস্তাবটা বাবুদের দাও। এইসব কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল বলে সন্তোষবাবু আজকের দিনটা কাটিয়ে যেতে বলেছে। মাঝে আর একটা দিন বাদ দিলে পরের দিন লক্ষ্মী পুজো। এজন্যেও তো বাবুদের ঢাক বায়না করতে হয়। আমরা থেকে গেলে বাবুদের আর ছুটোছুটি করতে হবে না। অবশ্য অনেক পুজো প্যান্ডেল লক্ষ্মী পুজোর জন্যে ঢাক বা ঢোল বায়না করে না। এমনি ঠাকুরপুজোর কাঁসর-ঘন্টাতেই কাজ সেরে নেয়। তা এই বাবুরা কি করে তা তো আমাদের জানা নেই। নাই জানা থাক। আমরা যদি উপযাচক হয়ে ঢাক বাজাই তাতে তো বাবুদের অসুবিধা হবার কথা না। তুমি বরং সন্তোষবাবুকে ডেকে সে কথাটা বলো। হয়তো এই ক’দিন আমাদের জন্যে খাবার ব্যবস্থা বাবুদের করতে হবে। একটা খরচ অবশ্য ওনাদের বাড়বে। তা তেমন হলে না হয় আমরা আমাদের পয়সাতেই হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করে আসব। কোন অসুবিধা হবে না। ওনারা আমাদের জন্যে এত করল, আর আমরা এটুকু কষ্ট করতে পারবো না?”
সনাতনের কথা মনে ধরে রতনের। সন্তোষবাবু তো ওদের প্রস্তাবে রতনদের বকবে না বুকে জড়িয়ে ধরবে, সেই দোদুল্যমানতায় কিছুক্ষণের জন্যে থমকে যায়, “এ তুমি কি কথা বলছো সনাতন! তোমাদের মনের এই উদারতা আমাদের ভুলবার নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক, লক্ষ্মী পুজোয় আমরা ঢাক বায়না করি না। তাই বলে তোমরা গতরে খাটবে অথচ কোন পারিশ্রমিক নেবে না তা যদি হয় তো মা লক্ষ্মীও তো আমাদের ক্ষমা করবে না। এ হয় না রতন। এ কিছুতেই হতে পারে না। এতটা অমানবিক আমরা হতে পারবো না। -তার মানে কালই আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলছেন? কিন্তু এই প্রস্তাবটা আমার যতটা নয় তার থেকে বেশি সনাতনের। ও বাচ্চা ছেলে, মনের ভেতর থেকে এমন কথাটা জোর দিয়ে বলে ফেলেছে। কেবল আপনাদের এত ভালবাসায় প্রণাম জানাবার জন্যেই। ঠিক আছে বাবু। তাহলে কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাব। আমাদের ইচ্ছেকে দাম দিতে গিয়ে আপনাকে আবার আপনাদের কমিটির কাছে হয়তো জবাবদিহি করতে হতে পারে। সেটাও তো আমরা হতে দিতে পারি না।
-আহাঃ তা নয় রতন। আমাদের কমিটির সব্বাই সমমনের। এখানে ভিন্ন চিন্তার কিছু নেই। আমি যেটা বলি সেটা আমার নিজস্ব কথা নয়। আমাদের সকলের। ওদিকটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের পাড়ার জন্যে আমি গর্বিত।
-তাহলে বাবু, আমার কথা যদি একটু মন দিয়ে শোনেন। আমার ছেলে যে কথাটা বলেছে সেটা আমারও মনের কথা। আপনারা ‘না’ করবেন না। ধরেই নিন না এটা আমাদের পক্ষ থেকে মায়ের চরণে বরণডালা অর্পণ! আমরা ছোট মানুষ বলে মায়ের আরাধনায় এটুকু অংশ নিতে পারি না! এতটাই আমরা অযোগ্য, বাবু?
রতনের এমন ধারালো যুক্তির সামনে সন্তোষবাবু আর প্রতিযুক্তির জাল বেছাতে চাইল না, “রতন, তোমার ভেতরে এত গুণ! তোমার উন্নতিতে কেউই বেশিদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এগিয়ে যাও রতন, তোমরা।” বলে সন্তোষবাবু পাড়ার ঘরে ঘরে গলা ছেড়ে বলে আসতে গেল, “রতনরা লক্ষ্মীপুজোয় ঢাক বাজাবে। এবারের লক্ষ্মীপুজো হবে অন্যরকম আঙ্গিকে। এবারের পুজোর নবপ্রেরণা রতন-সনাতন। ওরা নিজ উদ্যোগে এই পুজোয় নব-প্রয়াস দিতে চলেছে।”[ ঊনত্রিশ ]
কলেজ থেকে ফিরে বাড়ি আসতে মা বলল, “কচি পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেছে। ‘পেতেনের’ ওপর তোর একটা বইয়ের ভেতর অর্ধেকটা ঢুকিয়ে রাখা আছে। দেখে নিস, কে কি লিখে পাঠালো।” চিঠির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অলোকা! ওর নামে চিঠি? কে চিঠি পাঠাবে ওকে! ও তো কাউকে কোনদিন চিঠি পাঠায়নি বা কাউকে চিঠি লিখতে বলেনি! মা আবার ওইরকম করে কথাটা বলল কেন? মা কি বাঁকা চোখে কথাটা বলল? যদি কোন ছেলে বদ মন নিয়ে তাকে চিঠি লেখে! মানে প্রেমপত্র-টত্র আর কি। মা নিশ্চয়ই তেমনটা ভেবেই বলেছে। মনটা উচাটন হয়ে উঠল, চিঠিটা পড়ার জন্যে। পোষাক না খুলে যেমন তেমন করে উঠুনের ‘পজরা’র কাছে রাখা বালতির জলে হাত মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘরে চলে যায়। বিকেল হলে তো, দিনমান যতই চেষ্টা করুক তাদের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা তার নেই। মাটির মোটা দেয়ালের ঘরটায় সোজাসুজি দুটো বাঁশের বাঁখারির আড়াই হাত লম্বা আর দেড় হাত চওড়া জানালা। ওইদিকটায় কাঠের তক্তপোশের বিছানা। অতি কষ্টে রোদ্দুর না, তার ছটা, আলোর রূপ ধারণ করে বিছানায় উপস্থিতি জানান দেয়। ঘরের মাঝামাঝি থাকা বড় পেতেনটা কোনোদিন এইসময় তাকে কাছে পাবার আশা করে না। বাবার বিড়ি খাবার ম্যাচিসটা নিয়ে খস খস করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে আগুনের জন্ম দেয়। সদ্যভূমিষ্ঠ আগুনের সাহায্য নিয়ে মায়ের বলে দেয়া ঠিকানা মত বইটার ভেতর থেকে চিঠির খামের বেরিয়ে থাকা অংশটা টেনে বার করে বাইরে চলে আসে। দাবায় টাঙানো দোলায় বসে খস করে খামের মাথার দিকের একটা অংশ সন্তর্পনে ছিঁড়ে ফেলে। যাতে খামের ভেতরে থাকা কাগজের কোন অংশ ছিঁড়ে না যায়। তাড়াতাড়ি কাগজের মোড়াটা খুলতে দেখে, সরিষার মা সারদা মন্দির থেকে এসেছে চিঠিটা। এতক্ষণে যে অজানা আতঙ্কমাখা মন নিয়ে ব্যস্ত ছিল তা থিতু হল। না, মায়ের ভাবনায়- বদ মতলবে কেউ তাকে চিঠি দেয়নি। চিঠিটা পুরো পড়ে এবার মনটা যেন তৃপ্ত হ’ল। সে সিলেক্ট হয়েছে, সারদা মন্দিরে বেসিক ট্রেনিং পড়ার জন্যে। শুধুমাত্র মেয়েদের এখানে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হবার জন্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হায়ার সেকেন্ডারীতে অলোকার ভাল রেজাল্টের সুবাদে এই সুযোগ সে পেয়েছে। এবার দশ দিনের মধ্যে তাকে জানিয়ে দিতে হবে, সে ভর্তি হবে কি না। অলোকার তো মনেই ছিল না বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্যে সে আবেদন করেছিল। খবরের কাগজ তো সে কোনদিন দেখেনি। পাবে কোথায়। এমনি পেটে ভাত জোটে না যাদের, তাদের আবার খবরের কাগজ পয়সা দিয়ে কিনে পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কি! বিপ্লবদা সেদিন দিঘিরপাড় বাজারের বাস স্টপে তার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল। কলেজ ছুটির পর বাস থেকে নামতে বিপ্লবদা বলল, “তোমার সাথে কথা আছে অলোকা। প্রদ্যুতের চা দোকানের ওইদিকে মুচিষা রোডের ফাঁকা জায়গাটায় চলো। এখানে মোড়ে লোকজনের হট্টগোলে ভাল করে কথা বলা যাবে না।” বলে বিপ্লবদা হন হন করে সেই দিকে এগিয়ে চলল। বাস থেকে নামতেই এমন কথা শুনে অলোকা একটু যেন থতমত খেয়ে যায়। কেন, বিপ্লদা কি কথা বলবে যেটা এখানে বলা যাবে না? অমন করে দু’একটা কথা বলে ওদিকে চলতে লাগল? তাহলে কোন মন্দ খবর নয় তো? তাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে আবার কোন জটলা হচ্ছে না তো তাদের পাড়ায়? আসলে মানুষের মন তো। এমন আবহাওয়ায় প্রথমে মন ‘কু’ ডাকের দিকে ধায়। অবশ্য তা নাও হতে পারে। কোন ভাল কথা থাকতে পারে। একটু সময় নিয়ে হয়তো কথা বলতে হবে তাই এই ভিড় থেকে সরে গিয়ে নিরালায় কথা বলতে চাইছে। এদিকে তো আবার ওদের পাড়ার লোকেদের জুতো সারাই, পালিশ, ধামা-খোড়ার সারানোর দোকান আছে। এমন সব মানুষদের মন তো সবসময় প্যাঁচ কষে। কখন কি ভেবে নেয় বলা মুশকিল। একটু এদিকে ওদিক তাকিয়ে তাদের পাড়ার কেউ কাছাকাছি আছে কি না বা পাড়ার ওই দোকানদাররা তার দিকে তাকাচ্ছে কি না খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে খানিক পরেই অলোকা বিপ্লবদা যেদিকে গেল সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওর জন্যে মুচিষা রোডে অপেক্ষা করছে সে।
অলোকা যেতেই একটা খবরের কাগজ বের করল বিপ্লবদা। যত্ন নিয়ে আস্তে আস্তে কাগজটার ভাঁজ খুলে অলোকার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সরিষা মা সারদা মন্দিরের বিজ্ঞাপন এটা। বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্যে ছাত্রীদের আবেদন করতে বলা আছে এতে। তোমার তো এইচ.এসে ভাল রেজাল্ট আছে। ওরা যা নম্বর চেয়েছে তোমার তার থেকে অনেক বেশি আছে। তুমি দরখাস্ত করলেই মনে হয় চান্স পেয়ে যাবে।”
-বেসিক ট্রেনিং? ওটা কি ট্রেনিং সেটাই তো জানি না। ও করে আমার কি হবে। কলেজে পড়তে পড়তে এটা আবার কি করে পড়বো! কিছুই তো বুঝতে পারছি না, বিপ্লবদা।
-প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা করার জন্যে এই ট্রেনিংটা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। মেয়েদের জন্যে আমাদের এদিকে ওই সরিষায় ‘মা সারদা মন্দিরে’ পড়ানো হয়। ভাল রেজাল্ট করা ছাত্রী ছাড়া যে-সে ওখানে পড়ার সুযোগ পায় না। তা তোমার রেজাল্ট অনেকটাই ভাল বলে আমার মনে হল তুমি দরখাস্ত করতে পারো। তাই বিজ্ঞাপনের এই কাগজটা তোমাকে দিতে ডেকেছিলাম।
আর এটাতে পাশ করলেই সরকারি প্রাইমারী স্কুলে চাকরি, বলতে পারো প্রায় নিশ্চিত। এখন সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, বেসিক ট্রেনিং না থাকলে প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করার জন্যে অ্যাপ্লাই করা যাবে না।
-কিন্তু আমি যদি দরখাস্ত করি তো আমার বি.এ. পড়ার কি হবে? এক বছর তো পড়া হয়ে গেল। সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে চলেছি। আর এক বছর পার করলেই থার্ড ইয়ার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তখন গ্র্যাজুয়েট হয়ে যেতে পারবো।
-তারপর? তারপর কি করবে? চাকরি করবে? মাস্টারির চাকরি? সেখানে কাজ পেতে গেলে তো আবার বি.এড. ট্রেনিং পাশ করতে হবে। আর এই বি.এড. ট্রেনিং পাশ করলেই যে তুমি কোন হাইস্কুলে কাজ পাবে এই গ্যারান্টি তোমায় কেউ দিতে পারবে না। হাইস্কুলের থেকে প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে চাকরির সুযোগও বেশি। সে জায়গায় হাইস্কুল ক’টা আছে তুমি আমাকে কড় গুনে বলো তো? আর প্রাইমারী স্কুল বলতে পারো প্রায় সব গ্রামে আছে।
-তাহলে তুমি এখন আমাকে ঠিক কি করতে বলো? খোলাখুলি বুঝিয়ে বলো। আমি কি তাহলে এখানে চান্স পেলে কলেজে পড়া ছেড়ে দেব? সেটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না তো? ওই ট্রেনিংটা নিয়ে আমি পাশ করে বেরিয়ে আসতে পারব?
-সেটা তো পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভর করছে। সেই নিশ্চয়তা আমি কেমন করে দেব যে তুমি পাশ করবেই? মন দিয়ে পড়াশোনা করলে কেউ ফেল করে? বোকা বোকা প্রশ্নর কোন মানে হয় না। তবে হ্যাঁ, এই ট্রেনিং কোর্সটা আমি যতটুকু জানি বেশ শক্ত। আমার চেনাজানা যারা আগে ট্রেনিংটা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে শোনা। তবে আমার মনে হয় তুমি পেরে যাবে। এক বছরের কোর্স। আবাসিক। ওখানে থেকে পড়াশোনা করতে হবে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করা যাবে না। পেপারে সব ডিটেলস-এ লেখা আছে। বাড়িতে গিয়ে ভাল করে আগে পড়ো। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবার নেবে।
-আমার তো কেমন ভয় ভয় করছে। একটা বড় ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কি জানি! তারপর পাশ করতে পারব কি না। না পারলে এ-কুল ও-কুল দু-কুল চলে যাবে।
-ঝুঁকি না নিলে এগোনো যায় নাকি, অলোকা? এই যে তুমি তোমাদের ওই পরিবেশ থেকে যুদ্ধ করে পড়াশোনায় এতটা এগোতে পেরেছো। ঝুঁকি নিয়েছিলে বলেই তো পেরেছো। ঝুঁকি প্রত্যেক মানুষকে নিতে হয় এবং হবে। না হলে পেছনে পড়ে থাকতে হবে। আর একটা কথা, এখানে পড়তে এসে তুমি কি ক্লাস ফোর-ফাইভের কোর্স পড়বার আশা করো? নিশ্চয়ই না? যত উপরে উঠবে কড়া সাবজেক্টের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এই ট্রেনিংয়ে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক অত্যন্ত বেশি। ড্রয়ইং, হাতের কাজ ইত্যাদি অনেকটাই করতে হয়। আমি জানি এ’সবে তুমি একটু মাটো আছো। সেদিকটা তোমার ভাবতে হবে না। ওই প্রজেক্ট, ড্রয়ইং- ট্রয়ইংটা আমি তোমাকে হেল্প করে দেব’খন। সপ্তাহে একদিন বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয় ওরা। ডায়মন্ডহারবারের কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি সরিষায় নেমে তোমার সঙ্গে দেখা করে আসব। যা কাজ থাকবে আমাকে দিয়ে দেবে। আমি সেগুলো রেডি করে আবার তোমাকে দিয়ে আসব। না না, তুমি ভেব না এটা কোন চিটিং করা হচ্ছে। সবাই এইভাবেই পাশ করে আসছে। তুমি দেখবে’খন তোমাদের ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্রীই এমনটা করছে। তারপর অন্য বিষয়গুলো সব তোমার কেরামতি। তুমি যেমন তৈরী হবে তেমন ফল পাবে। ওখানে বাড়ির লোকের কোন হাত নেই।
বিপ্লবদার কথায় দোনা-মোনায় পড়ে গেল অলোকা। একদিকে গ্র্যাজুয়েট হবার মোহ। অন্যদিকে চাকরির ট্রেনিং। বিপ্লবদা তাকে জোর করছে এই ট্রেনিংটা নেবার জন্যে। এমন সুযোগ নাকি সবসময় আসে না। সব বছর এটা পড়ানো হয় না। কোন বছর হবে তা কেউ বলতে পারে না। পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে জানতে হয়। আর একটা সাংঘাতিক বাস্তব কথা বিপ্লবদা তাকে বলল, যেটা শুনে সে অবাক হয়ে গেল ! বিপ্লবদা এতটা ভেতর থেকে কথাগুলো তাকে বলছে? তাকে নিয়ে, তাদের সংসারকে নিয়ে ও এতটা গভীরে গিয়ে চিন্তা ভাবনা করে! কোন রাখঢাক না করে বলেই ফেলল বিপ্লবদা, “দেখো অলোকা, আমরা নিতান্তই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ বা গরিব ঘরের মানুষ। আমাদের মত ঘরের মানুষরা লেখপড়া শেখে কিসের জন্যে? শুধুই কি জ্ঞান অর্জনের জন্যে? বিদ্যের সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা কি ঘরে বসে সেগুলো ধুয়ে জল খেয়ে বেঁচে থাকব? থাকব না। লেখাপড়ার মাধ্যমে যেমন জ্ঞান অর্জিত হবে। এ তো সর্বকালের সত্য কথা। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা যাতে হয় বিশেষত সেই লক্ষ্য আমাদের সামনে সবসময় থাকবে। এই কোর্সটা করে যদি তুমি চাকরি পাও তো তোমাদের সংসারটাকে এই সর্বগ্রাসী অনটন থেকে মুক্ত করতে পারবে। তাতে তুমি যেমন বাঁচবে। তেমনি দিনরাত পয়সা পয়সা করে হাহুতাশ করা থেকে রেহাই পাবে তোমাদের সংসার। চাকরি করতে করতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে পড়া চালিয়ে যাওয়ার প্রমাণ ভুরি ভুরি আছে। প্রাইমারী স্কুলের কাজটা নিয়ে তারপর তো তোমার আর কোন পিছুটান থাকছে না। বুক চিতিয়ে তখন তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও।
কে তোমাকে মানা করেছে সেটা করতে? তখন তোমার ওই গ্র্যাজুয়েট না হওয়ার আক্ষেপ আর থাকবে না। তারপর মাস্টার ডিগ্রী করো। আরো করো। ময়দান তো তখন তোমার জন্যে ওপেন। প্রাইমারী স্কুলের চাকরি ছেড়ে হাইস্কুলে, সেখান থেকে কলেজ-মাস্টার। কোন বাধা নেই। মনে জেদ থাকলে, সেই জেদের সঙ্গে সংগত দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে সব হবে। তবে শুরুর পথ সঠিক বাছতে হবে। তবেই সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।”
এত ভালো ভালো কথা বলল বিপ্লবদা। একটা কথাও যুক্তি দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে না অলোকা। তবু যেন কলেজের আকর্ষণ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। কলেজের ম্যাম-স্যারেদের সঙ্গে ক্লাসের পড়াশোনার আদানপ্রদান। বাংলা ক্লাসের কল্যাণী ম্যাম্ তাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখে। প্রথমত সে সমাজের এক অন্তজ শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে। তারপর ক্লাসে ম্যামের সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর তার কাছ থেকে পেয়ে যায় বলেই তাকে এতটা পছন্দ করে। বলা যেতে পারে যেন মায়ের আদর সে এই ম্যামের কাছ থেকে পায়। এই ম্যামকে সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। আর ক্লাসের বান্ধবীদের সঙ্গে মিলমিশ। কত মত বিনিময়। এতসব আকর্ষণ আঠার মত তাকে চিপটে ধরে আছে যেন। এখন সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে সে কিছুতেই কলেজ ছেড়ে দিতে পারবে না। বিপ্লবদা ওই যে বলল না, তাদের মত গরিব ঘরে লেখাপড়ার মাধ্যমে শুধু জ্ঞান অর্জনের থেকে আর্থিক স্বয়ম্ভরতা আশু জরুরী। কিন্তু তার মন যেন আর্থিক বিষয়টাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না। একটা বদ বুদ্ধি মুহূর্তের জন্যে তাকে যেন উসকে দিতে উদ্যত হল! সারদা মন্দিরে এই ভর্তির চিঠিটা যদি সে নষ্ট করে দেয় তো কেউ জানতে পারবে না তার চান্স পাবার কথা। বিপ্লবদাও নয়। বিপ্লবদাকে এই চিঠিটা ও না দেখালে তো জানতে পারছে না সে। তাহলে আর কারোর কাছে তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। আর সরিষা মা সারদা মন্দিরে গিয়ে কেউ জানতে যাবে না তার চান্স পাবার বিষয় নিয়ে। দিলেই-হয় এটা নষ্ট করে! আর এর বোঝাটা সে যেন বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। ভাবনার ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে, যখন সে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তের দিকে যেতে চাইছে, তখনই রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক সমুদ্রের ঢেউয়ের মত তার উপর আছড়ে পড়ল যেন,“কিরে মা অলোকা? এতক্ষণ ধরে ওই চিঠির খামটা হাতে ধরে দোলায় বসে বসে ভাবছিস কি? কলেজ থেকে এলি। কোথায় পুকুরঘাটে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে একটু কিছু মুখে দিবি। তা না, চুপচাপ বসে কি যে আগডুম বাগডুম চিন্তা করছিস কি জানি! যা-না মা, কলেজের জামা-কাপড় ছেড়ে কিছু পেটে দে-না! এতক্ষণ পেট খালি দিলে, পিত্তি পড়ে যাবে যে পেটে। তখন আর এক বিপত্তি হবে।” বলতে বলতে অলোকার মা ওদিক থেকে তার কাছে আসতে থাকে। দোলাতে বসেই অলোকার চোখ আটকে গেল মায়ের সামনের দিকে আঁচলের শাড়িটার খানিক ছেঁড়া অংশের দিকে! শাড়ির এই ছিঁড়ে যাওয়া অংশের দিকে কিন্তু প্রায়ই ওর চোখ পড়ে। গরিবের বাড়ির বৌ-ঝিদের এমন ছেঁড়া জীর্ণ পোশাক পরাটা ওদের গা-সওয়া ব্যাপার। এতে মনে তেমন আঁক কাটে না। কিন্তু এই মুহূর্তে, সে যখন জ্ঞান আর ক্ষুধা-অভাবের দ্বন্দ্বে দ্বিতীয়টাকে পাশে সরিয়ে বিদ্যা-জ্ঞানকে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত হচ্ছিল। আগুনের ছেঁকা লাগার মত বুকের ভেতরটা ছ্যাঁক করে উঠল! তাদের অভাবী সংসার মায়ের জন্যে একটা আস্ত শাড়ি জোটাতে পারছে না। কতদিন ধরে মা এমন পোশাক পরে দিন কাটায়। ব্যাপারটা বাবার মাথায় সবসময় কাজ করে। বাবা চেষ্টায় থাকে অবিরত। কিন্তু অক্ষমতা বাবাকে বারবার থমকে দেয়।
এখন কি করবে অলোকা? বুকে ক্রমাগত অভাবের ছ্যাঁকা সহ্য করে শুধুমাত্র জ্ঞানের পেছনে দৌড়বে তো? চিঠিটা কি তাহলে- একটু আগে যেটা ছিঁড়ে ফেলতে সে উদ্যত হচ্ছিল, সেই উদ্যোগ জারি রাখবে তো? এমন অসম যুদ্ধ যেন সে আর জারি রাখতে পারছিল না। চিঠিটা খামের ভেতর ঢুকিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেল। কলেজে যাওয়া বাইরের পোশাকেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। মা ততক্ষণে এসে দেখে মেয়ে দোলায় বসে নেই, “এই তো এখানে বসে ছিল মেয়েটা? গেল কোথায় আবার! ঝুলন্ত দোলা বাঁ হাতের মুঠোয় ধরে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে মেয়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে। আলো আঁধারিতে বুঝতে পারছে না মেয়ে বিছানায় শুয়ে ঠিক কি করছে। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখে, মেয়ের শরীর কান্নায় ঝাঁকা দিয়ে উঠছে,“কি হল রে মা? তুই অমন করে কাঁদছিস কেন? ওই চিঠিটা পড়ার পর থেকে দেখছি তুই কেমন করছিস! কি আছে ওই চিঠিতে? ওটা যদি তোকে এতো কষ্ট দেয় তো ছিঁড়ে ফেলে দে-না। ঝামেলা চুকে যায়। কোথা থেকে চিঠিটা এসেছে, কে পাঠিয়েছে আমাকে বলবি? তাহলে তোর বাবাকে দিয়ে খোঁজ লাগাবো, চিঠি পাঠানদারটা কেমন তারা? আমার মেয়েকে কাঁদায় কেন? সামান্য এক চিলতে কাগজের গায়ে এত জোর!” মায়ের কথায় আর শুয়ে থাকতে পারলো না অলোকা। বিছানায় উঠে বসে বলল,“তুমি চুপ করো মা। না জেনেবুঝে কিসব বোকার মত কথা বলো? চিঠিটা ছিঁড়ে সব ঝামেলা ঝক্কি শেষ হয়ে যাবে? এসব তুমি বুঝবে না। এই নিয়ে একদম চেঁচামেচি করতে যেও না। এখন তুমি যাও মা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। এখন আমার খিদে নেই। একটু পরে আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার কাজ করো গে।” গম্ভীরভাবে অলোকা কথাগুলো বলার পর মা আর মেয়ের বিড়ম্বনা বাড়াতে
চাইল না। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মা জানে, তার লেখাপড়া জানা মেয়ের সঙ্গে যুক্তি তর্কে পেরে উঠবে না। সেকথা মা অনেকবার কবুল করেছে। সত্যি তো। চিঠির এ’সবের বিষয় মা বুঝবে কি করে। বুঝিয়ে বললেও বুঝবে না। এক কথার মানে উল্টো বুঝে ভুলভাল কান্ড করে বসবে। তাই অলোকা তার মা’কে এর মধ্যে মাথা গলাতে দিতে চাইল না। কিন্তু পরিস্থিতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তাতে তো দেখা যাচ্ছে তার জীবনে বিপ্লবদার পরামর্শ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বিপ্লবদা এটাও সেদিন বলেছিল, “দেখো অলোকা, সময় প্রতি মুহূর্ত সবাইকে ছুঁয়ে চলে যায়। ও কোন মুহূর্তের ভগ্নাংশেও কারোর জন্যে অপেক্ষা করে না। কিন্তু এই চলার পথে যে তার সঙ্গী হতে চায়, তাকে সে সাদরে সঙ্গ দেয়। এখন সময় তোমাকে বলছে এই বেসিক ট্রেনিংয়ের ফর্ম যত্নের সঙ্গে ভর্তি করতে। আগেও বলেছি, আবার বলছি, যদি তুমি এই সময়কে হেলায় বইয়ে দাও তো সময় কিন্তু আর ফিরে আসবে না। পরে মাথা খুঁড়লেও সে এখনকার এই রূপ নিয়ে তোমার সামনে হাজির হবে না। তাই বলছি, যা গ্রহণযোগ্য তাকে গ্রহণ করো। আর যা নয় তাকে বর্জন করো।”
বিপ্লবদার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন ভেতর থেকে একটা তাড়া তাকে ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে তুলে দিল। কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা মনের যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! তার থেকে কিছুটা বড় বিপ্লবদা। এখনো ‘লোক’ হয়ে যাবার বয়স হয়নি। অথচ এই বয়সে কত পরিণত চিন্তাভাবনা তার। বাস্তবকে এত ভাল করে চেনার শক্তি সে পেল কোথা থেকে কে জানে! ও যেন ‘সূর্য’ হয়ে তার জীবনে অবিরত আলো দান করে যায়। অথচ এই সূর্যকে কত হেলায় দলন-পিড়ন করেছে তাদের পাড়ার ওই মুর্খ- মাতালরা! কলেজের পোশাক ছেড়ে পুকুরঘাটে চলে গেল অলোকা। সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে রান্নাঘরে গেল মায়ের কাছে, “মা, ওই রতন কাকার ছেলে গো, সনাতন। ওকে একটু খবর দিতে পারবে? বলবে আমি ওকে ডেকেছি? আর বলবে, যদি এখন ব্যস্ত থাকে তো কাজ সেরে সময় করে যেন অবশ্যই আসে। খুব দরকার! ভুলে যেন না যায়।”ক্রমশ….
-
গল্প- শীতল পরশ
শীতল পরশ
– মুনমুন রাহাআজ রায় বাবুদের বাড়িটা সেজে উঠেছে আলোয় আলোয়। আনন্দমুখরিত পরিবেশ। সবাই এমন এলাহি আয়োজনে ধন্য ধন্য করছে। পাড়া প্রতিবেশি থেকে আত্মীয়, সবার মুখেই ভেনু থেকে মেনুর প্রশংসা। হবে নাই বা কেন রায়বাবুর একমাত্র ছেলে নীলাদ্রির বৌভাত আজ । রায়বাবু যে বিস্তর সম্পত্তির মালিক তা সবাই জানে তাই তার ছেলের বিয়েতে এমন আয়োজনই প্রত্যাশিত।
কেবল আয়োজন দেখেই নয়, লোকে প্রশংসা করছে নীলাদ্রির বৌ তাপসীরও। রঙে , রূপে, শিক্ষায় সব কিছুতেই অসামান্য সে। নীলাদ্রি আর তাপসী, যেন মেড ফর ইচ আদার। কেবল নীলাদ্রি আর তাপসীই নয় মিল আছে ওদের পরিবারেও। নীলাদ্রির মতো তাপসীরাও খুব বড়লোক। কানাঘুষো এটাও শোনা যাচ্ছে বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়েকে নীলাদ্রির বিয়ে করার কারণ হচ্ছে তাপসীর বাবার সম্পত্তি। যার মালিক হয়তো ভবিষ্যতে বকলমে নীলাদ্রিই হবে।
অতিথিরা ফিরে গেছে যে যার বাড়ি। তাপসী ফুলের সাজে অপেক্ষা করছে নীলাদ্রির জন্য। প্রথম রাতের উত্তেজনা আর ভয় দুটোই গ্রাস করছে তাকে। ঘরে এসে ঢুকল নীলাদ্রি । তার অবশ্য তেমন ভয় বা উত্তেজনা কোনটাই নেই। কারণ সে বিছানায় এর আগেও বহুবার খেলেছে। সে এবিষয়ে পাকা খেলোয়াড়। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে যায় তাপসীর দিকে। মুখটা তুলে ধরে তারপর তার কোমোল ঠোঁটে একটা গভীর চুম্বন এঁকে দেয়। তাপসী তার জীবনের প্রথম পুরুষের ছোঁয়াতে কেঁপে ওঠে। লজ্জায় রাঙা হয়ে নীলাদ্রির বুকে মুখ লুকায়।নীলাদ্রি আরও শক্ত করে তার বাহুডোর। নীলাদ্রির হাত খেলা করে তাপসীর পিঠের উপর আস্তে আস্তে নামতে থাকে হাত শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর পর্যন্ত আসতেই তাপসী হাত সরিয়ে দেয় নীলাদ্রির। লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলে, চেঞ্জ করে আসি। নীলাদ্রি আরও একবার বুকে টেনে নেয় তারপর পকেটে রাখা হীরের আংটিটা পরিয়ে দেয় তাপসীর অনামিকাতে আর হাতে একটা প্যাকেট দেয়। বলে, আজকের রাতের জন্য স্পেশাল নাইট ড্রেস। তাপসী হেসে চলে যায় বাথরুমে চেঞ্জ করতে।
নীলাদ্রি ব্যালকনিতে এসে একটা সিগারেট ধরাল। মনটা তার ভারী ফুরফুরে লাগছে আজ। সুন্দরী বৌ আর সাথে তার অগাধ সম্পত্তি, আর কি চাই জীবনে। হঠাৎই ঘরের লাইটটা অফ হয়ে যায়। নীলাদ্রি দেখে রাস্তার আলোগুলো সবই জ্বলছে কেবল অন্ধকারে ঢেকে গেছে তার ঘরখানা। নিশ্চয়ই শর্ট সার্কিট। দেখতে যাবে বলে ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। ঘরের বাইরে বেরোনোর আগেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে একটা মেয়েলি হাত, হাতটা হীম শীতল। বোধহয় সবে স্নান সেরেছে বলে । নীলাদ্রি ঘুরে দাঁড়ায়। অন্ধকারে ভাল করে না দেখা গেলেও রাস্তার আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে নীলাদ্রির দেওয়া লাল ফিনফিনে নাইট ড্রেসটা। নীলাদ্রি আর দেরি করে না । তাকে কোলে নিয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।
নীলাদ্রি বিছানায় নিয়ে গেলেও নীলাদ্রি কিছু করার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলাদ্রির উপর। ঠান্ডা হাতটা দ্রুত নিরাভরণ করে নীলাদ্রিকে। তারপর দখল নেয় তার শরীরের উপর। এক মিনিট, দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট… ছিটকে উঠে নীলাদ্রি একি! এ ছোঁয়া যে তার বড় চেনা। এই স্পর্শ সে তো ভুল করবে না! এ যে নয়নার স্পর্শ। এই উন্মাদনা তো নয়নার স্পর্শে সে পেত! কিন্ত নয়না! কিভাবে, কিভাবে সম্ভব! এবার দিল্লী থেকে পাকাপাকি কোলকাতায় আসার সময়েই তো নিজের হাতে গলা টিপে মেরে এসেছে নয়নাকে। বডিটারও ঠিকানা লাগিয়ে এসেছে। তাহলে , তাহলে! এসব কি হচ্ছে!ভাবনার মধ্যেই ঠান্ডা শরীরটা আবার দখল করেছে নীলাদ্রিকে। নীলাদ্রি চাইলেও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। অতিমানবিক শক্তির কাছে পরাস্ত সে। তার সর্বাঙ্গ লেহন করছে সাপের মতো ঠান্ডা শরীরটা। নীলাদ্রির মনে পড়ে ঠিক এইভাবেই নয়নাকে আদর করতে বাধ্য করত নীলাদ্রি। প্রথমে সে আদর করত নয়নাকে তারপর নয়নাকে বলত তাকে এইভাবে আদর করতে। নয়না লজ্জা পেত, সংকোচ করত। কিন্ত নীলাদ্রি বলত এই খেলাতে কেবল ছুঁতে ভাল লাগে না অন্যজনের ছোঁয়াতেও ভালো লাগে।
নীলাদ্রিদের দিল্লীর অফিসে মাঝারি পোস্টে চাকরি করত নয়না। প্রথম দিকে তেমন ভাবে নীলাদ্রির নজরেও পড়েনি সে। একদিন বৃষ্টির রাতে অফিসের বাইরে নয়নাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিফট্ দেয় নীলাদ্রি। অফিসের বসের যাচা লিফট্ অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা ছিল না নয়নার। তারপর নীলাদ্রি শুরু করে তার প্রেমের অভিনয়। যা এর আগেও সে বহুবার করেছে মেয়েদের বিছানায় তুলতে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে নয়নার সংস্কার একটু বেশিই ছিল। তাই খানিক সময় লাগে তাকে পার্ক, রেস্টুরেন্ট থেকে বিছানায় তুলতে । নয়না বিয়ের আগে নিজেকে সঁপে দিতে চায় নি নীলাদ্রির হাতে। কিন্ত নয়না আপত্তি জানালেই নীলাদ্রি সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখাত, তাতেই নয়না কাবু হয়ে যায়। কারণ নীলাদ্রি অভিনয় করলেও নয়না কিন্ত প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল নীলাদ্রিকে। দিল্লীতে ভালোই টাইম পাশ কাটছিল নীলাদ্রির। কিন্ত শেষের দিকে নয়না খালি ঘ্যানঘ্যান করত বিয়ের জন্য। তারপর যেদিন নয়না জানাল সে নীলাদ্রির বাচ্চার মা হতে চলেছে এবং এই বাচ্চা সে কিছুতেই নষ্ট করবে না। দরকার হলে নীলাদ্রির বাবা মাকে সব জানাবে, সেদিন আর নীলাদ্রি কোন রিস্ক নেয়নি। ততদিনে নীলাদ্রির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাপসীর সঙ্গে। নীলাদ্রি বোঝে নয়নার এই পদক্ষেপে বাধা পড়তে পারে তাপসীর সাথে বিয়েটা। তাই নয়নাকে সেই রাতেই গলা টিপে মারে সে।
নীলাদ্রির ঘুম ভাঙাল তাপসীর ডাকে। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে তাপসী বলে, ওঠো এবার, নীচে সবাই আমাকে কত খ্যাপাচ্ছে জানো, তুমি বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ বলে! মুখে একটা দুষ্টু হাসি খেলে যায় তাপসীর। নীলাদ্রি তাপসীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, আচ্ছা কাল রাতে তুমি কিছু টের পেয়েছিলে? মানে, কাল রাতে কি হয়েছিল মনে আছে তোমার? তাপসী হেসে বলে, না গো কিচ্ছু মনে নেই। কাল এত ক্লান্ত ছিলাম কখন যে বাথরুম থেকে ঘরে এসেছি আর ঘুমিয়ে পড়েছি মনেই নেই। সকালে দেখলাম তুমি পাশে ঘুমাচ্ছ ! নীলাদ্রির মাথায় কিছু ঢুকছে না। তাহলে কি হল কাল রাতে! তার যে অনুভূতি সেগুলো কি তবে সব কল্পনা! কিন্ত কল্পনা এত স্পষ্ট হয় কি?
মনের সব দ্বন্দ্ব কাটিয়ে রাতের ঘটনাটা কল্পনা বলেই মেনে নেয় নীলাদ্রি। সকালটা ভালোই কাটে। কোন অস্বাভাবিকতার লেশ মাত্র নেই। তাই নীলাদ্রি আরও নিশ্চিত হয় রাতের ঘটনা কল্পনা ছাড়া কিছু নয় বলে। কিন্ত রাতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই অন্ধকার, সেই লাল ফিনফিনে রাত পোষাক, সেই ঠাণ্ডা শরীরের ছোঁয়া, সেই সাপের মতো সর্বাঙ্গ লেহন, নীলাদ্রির শরীরের উপর ঠান্ডা শরীরটার আধিপত্য বিস্তার। তাপসীর রাতের কোন স্মৃতি না থাকা। একরাত নয় দু’ রাত নয়, প্রতিরাতে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্ত সমস্যা হল নীলাদ্রির এই কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাইভাবে নীলাদ্রি ভুল বকছে। আর তাপসী নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত থাকে তাই কখন ঘুমিয়ে পড়ে খেয়াল থাকে না তার। অবশ্য তাপসীর নিজেরও তাই ধারণা। শুধু ওর একটাই অস্বাভাবিকতা লাগে প্রথম রাতে নীলাদ্রির দেওয়া নাইট ড্রেসটা এত করে খোঁজার পরও খুঁজে পায় না সে।কেটে গেছে একটা বছর। এই একটা বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। নীলাদ্রি এখন বদ্ধ উন্মাদ। তাপসীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার । নীলাদ্রি যতবার রাতের অভিজ্ঞতার কথা তাপসীকে বলেছে ততবারই তাপসীর মনে হয়েছে নীলাদ্রির মাথায় নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে। নীলাদ্রি প্রতিরাতের অত্যাচারে আর সবার অবিশ্বাসে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আস্তে নীলাদ্রির আচরণে পাগলামোর লক্ষণ দেখা যায়। নীলাদ্রিকে নিয়ে ওর বাবা সাইকোলজিস্টের কাছেও গিয়েছিল কিন্ত লাভ হয় নি কিছু। ডাক্তারের দেওয়া কড়া ঘুমের ওষুধেও ঘুম হয় না তার। এখনও প্রতিরাতে তাকে সহ্য করতে হয় ঐ ঠান্ডা শরীরের ছোঁয়া। সেই ছোঁয়া যেন প্রতিরাতে নীলাদ্রিকে বুঝিয়ে দেয় অযাচিত ভাবে ছুঁলে ঠিক কেমন লাগে। প্রতিরাতে নীলাদ্রিকে শাস্তি পেতে হয় তার কৃতকর্মের। কতদিন পেতে হবে তা জানা নেই, হয়তো আজীবন নীলাদ্রিকে ভোগ করতে হবে ঠান্ডা শরীরের স্পর্শ।
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১১)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ছাব্বিশ]
বাবুদের সঙ্গে আস্তে আস্তে রতনরা এগিয়ে চলল হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পূজামন্ডপের দিকে। যেতে যেতে রতন ভাবছে, পাঁচ হাজার কেন, দু’হাজার দিলেও তারা রাজি হয়ে যেত। যে দুর্বিসহ অপমান যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাদের আসতে হল। কোলকাতার যে কোন পূজামন্ডপে তাদের বায়না পাওয়া অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। তাই হয়তো এই বৌবাজারের মোড়ে টানা এত ঘন্টা বাজনা বাজাবার শক্তি মা শীতলা তাদের দিয়েছিল। ফলও হাতে নাতে পেল। না হলে ফাঁকা হাতে বাড়ি ফিরে গেলে পাড়াবাসীর কাছে মরমে মরে যেতে হত। কারোর কারোর কাছে মজার খোরাকও তাদের হতে হত। এতদিন যে রতন, তার ঢাক বাজাবার দক্ষতা নিয়ে গর্ব করতো। ঢাক বাজানোর শিক্ষা নিতে দূর দূর থেকে লোকজন আসতো, পাকা এবং যোগ্য বাজনাদারের কাছে বাজনা বাজানোর তালিম নিতে। এই নিয়ে পাড়ার অন্য বাজনাদারদের ঈর্ষার কারণও হতে হয়েছে তাকে। সেই রতনের আসল পরীক্ষা হতে চলেছে এবার। নিজেকে বলছে, “রতন তুই যদি সত্যি সত্যি দেখিয়ে দিতে পারিস তোর ঢাক বাজানোর কেরামতি তো তোর এ জীবন সার্থক হবে রে। ‘ঘরে মধসূদন আর বিদেশে মোদো’ হওয়ার থেকে উল্টোটা হলেই তবে সমাজে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবি! এই দেখ না, এতদিন তো তুই এলাকায় ভালো ঢাক বাজানদার হিসেবে এবং প্রশিক্ষক হিসেবে নাম করে এসেছিস। তাতে তোর কি লাভ হয়েছে? কিচ্ছু না। উল্টে পড়শির ব্যাঁকা চোখ তোর ওপর আছড়ে পড়েছে। শত্রু বেড়েছে। নিষ্কর্মারা তোর বদনাম ছড়িয়ে এসেছে। তুই শুধু শুনে এসেছিস। কিচ্ছু করতে পারিসনি তাদের। এবার কোলকাতায় নাম ফাটিয়ে পাড়ায় দেখিয়ে দে রতন রতনে আছে। আসল রতনরা এই রতনকে চিনে নিয়েছে। তাদের বিচারের কষ্ঠিপাথরে গ্রামের রতন পাশ করে গেছে।”
বউবাজারের মোড়ে প্রথম যে বাবু তাদের সঙ্গে কথা বলেছিল সেই বাবুই এই পুজো কমিটির সভাপতি। সভাপতি সন্তোষবাবু প্যান্ডেল লাগোয়া এক বাড়ির বৈঠকখানা সংলগ্ন একটা ঘরে তাদের ক’দিনের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ওই ঘরের সঙ্গেই বাথরুম চানের ঘর আছে। শহরের ব্যাপার। গ্রামের মত বাইরে কোথাও বাথরুম পায়খানা করতে হবে না। প্রথম প্রথম একটু
অস্বস্তি হচ্ছিল ওদের। কোনদিন তো এমন সুন্দর পরিস্কার ঘেরা ঘরে বাথরুম করেনি। সন্তোষবাবু তাদের বাপ বেটার নাম জেনে নিয়েছে। ছেলের সম্বন্ধে টুকটাক জেনেও নিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে, এবার ফাইনাল দেবে। শুনে তো শুধু সন্তোষবাবু কেন, পাড়ার যে শুনেছে সনাতনকে তারিফ করেছে। তারপর রতন থাকতে না পেরে যখন বলেছে, মাধ্যমিকে ও স্টার পেয়েছে! ওকে নিয়ে যে কি সুখ্যাতি করলো ওরা! সনাতন তো বাপের ওপর ক্ষেপে লাল, “তুমি ওসব কথা ওনাদের বলতে গেলে কেন? কথাটা কি লোককে বলার জন্যে পেটের ভেতর ভুটভাট করছিল? আমরা ঢাক বাজাতে এসেছি বাজিয়ে চলে যাবো। এমনি টুকটাক নাম ঠিকানা জানিয়ে দেওয়া দরকার, বলে দেওয়া হল, এই পর্যন্ত। বেশি খোলের খবর না বলাই ভাল। তারপর কে কিভাবে নেবে বলা যায় না তো। যা বলেছো, বলেছো। আর বলবে না বাবা। নিজেদের এতটা হাট করে দেওয়া মনে হয় ঠিক না।” ছেলে বকুনি দিয়েছে ঠিক আছে। তাতে সে কিছু মনে করেনি। ছেলের সুকর্মের কথা বাপ-মা তো আগে মানুষকে জানিয়ে ভেতরের আনন্দকে বাঁচিয়ে তোলে।
সন্তোষবাবু বলল, “রতন, তোমরা পরিষ্কার হয়ে টিফিন সেরে নাও। তোমাদের টিফিন এসে গেছে। তারপর আটটায় পাড়ার সকলকে আসতে বলেছি। তোমাদের আগমনীর বাজনা শোনার জন্যে। মায়ের পুজোর ব্যস্ততা তো কাল, ষষ্ঠী থেকে শুরু হবে। প্রস্তুতি সব শেষ। এখন সবাই বিশ্রামে। কোন কাজ নেই। তাই এই সময়টা তোমার বাজনা শুনে কাটাতে চাই। এই প্রথম আমরা তোমাদের হাত ধরে ঢাকের বাজনার মাধ্যমে আগমনীর সুর, তাল, লয় উপভোগ করবো। এবার তোমার হাতের কেরামতি।”
পঞ্চমীতে আগমনী, ষষ্ঠীর কলাবৌ চান, মা দূর্গার বোধন, সপ্তমী-অষ্টমী নবমীর পূজার্চনার বাজনা, আরতির বাজনা, সন্ধ্যারতির বাজনা। নবমীতে কুমড়ো বলির বাজনার তাল। একে একে বাজনার কেরামতিতে হৃদারাম ব্যানার্জী লেনকে মাতিয়ে তুলল রতন-সনাতন। কত দিন, কত বছর পর যেন এই পুজোমন্ডপে আনন্দের জোয়ারে নতুন পালক জুড়ে গেল এই দুই বাপ-বেটার হাত ধরে।
নবমীতে মা’কে বলি উৎসর্গ করা শাস্ত্রের বিধান। কিন্তু কোথাও মাথার দিব্যি দিয়ে লেখা নেই যে মা’কে পাঁঠাবলি দিয়ে সেই বলি দেওয়া পাঁঠার রক্ত দিয়ে মায়ের পা ধুইয়ে দিতে হবে। অনেক পুজো প্যান্ডেলে এই পাঁঠাবলি প্রথা এখনো চালু আছে। রতনের একটা ভয় ছিল এবং সে আতঙ্কিতও ছিল যে এই হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজো কমিটি আবার পাঁঠাবলির জবরদস্ত পক্ষপাতি নয়তো? রতন পাঁঠাবলি প্রথার ঘোর বিরোধী। প্রতিবাদে সে পাঁঠাবলি তালের বাজনা জানলেও বলে তার জানা নেই। সে শেখেনি। মায়ের সন্তান যেমন জীব হিসেবে রক্তমাংসের মানুষ, ঠিক তেমনই জীব, ছাগ-পাঁঠা ! ছাগ-পাঁঠার রক্তে পদযুগল স্নান করালে যদি মা তুষ্ট হয় তো তাহলে মানুষের রক্তেও তো পদযুগল স্নান করালে মা তুষ্ট হবে! ছাগের বদলে মানুষ ওই নিষ্ঠুর কাপালিক বা তন্ত্র সাধক-সাধিকার মত মানুষের রক্তে পদযুগল স্নান করবে না কেন? অনেক জায়গায় প্রতিবাদ করেছে রতন। তাদের পাড়াতেও এই নিয়ে প্রচন্ড বিবাদ হয়েছে। কোথাও কোথাও সে জিতেছে। কোথাও কোথাও আবার গোঁড়াদের আধিক্যে তাকে পিছু হঠতে হয়েছে। এতদিনে এই বাবুদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে একটা নিবিড় সু-সম্পর্ক গড়ে উঠছে তাদের। নবমীর বলি প্রসঙ্গ এলে সেই তাল কেটে যাবে না তো! তাল কাটার ভাবনায় অষ্টমীর গভীর রাতে শুতে যাবার সময় থেকে দুশ্চিন্তা তাকে যেন গ্রাস করতে শুরু করে! কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। ঘুম এলই না রাতে। ভোর থাকতে উঠে পড়ে চানটান করে ঘরের বারান্দায় দাঁড়ায় সে। কমিটির বাবুদের যাকে সে প্রথম দেখবে তাকে জিজ্ঞেস করবে, এখানকার প্রথা কি? কি বলি দেওয়া হয় নবমীর সকালে মায়ের কাছে? যদি পাঁঠার কথা তোলে তো তাহলে সে সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে যাবে। পাঁঠা বলির বাজনা তার জানা নেই। তাছাড়া পাঁঠাবলির সে কঠোর বিরোধী। সেইজন্যেই সে শেখেনি এই পাঁঠাবলি বাজনার তাল।
হাতের গলাসিতে ফোস্কা তো সনাতনের পড়েছিল বৌবাজারের ফুটপাথে একটানা বাজাবার সময়। সেই ফোস্কা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে ওইদিন সন্ধ্যায় আবার বাজাবার সময়। সনাতনের হাতের যন্ত্রণার অভিঘাত তার মুখে ফুটে উঠছিল। তা চোখ এড়াতে পারলো না সন্তোষবাবুর! বাজনা কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ রাখার কথা বলল বাবু। তারপর বাবু বলল, “আমরা এখন চা খাবার বিরতি নিচ্ছি। আমরা সব্বাই এখন চা খাব। রতনরাও খাবে।” বলে বাবু
সনাতনকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছিল, খোকা? তোমার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছিল।” কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে রতন বলল, “হ্যাঁ, ওর আঙুলের গলাসিতে ফোস্কা পড়েছে। আসলে টানা চারঘন্টা ও কোনদিন কাঁসর বাজায়নি। ভারি কাজকর্ম করারও তেমন অভ্যেস নেই। লেখাপড়ার হাত। নরম। তাই আরকি।” এবার বাবু বলল, “দেখি তোমার হাত! কোথায় ফোস্কা পড়েছে!” সনাতন হাতটা দেখাতে চমকে ওঠে বাবু,“আরে খোকা! এখান দিয়ে তো রক্ত চুঁইয়ে আসছে! এক্ষুণি এর ট্রিটমেন্ট করা দরকার। না হলে ঘা হয়ে যাবে। তারপর এতদিন তোকে কাজ করতে হবে। হেলাফেলা করলে হবে না।” বলে পাশের একজনকে বলল, “প্রতোষকে দেখছি না। কোথায় গেল দেখ তো? মনে হয় ঘরে গেছে। গিয়ে বল এই ছেলেটার আঙুলের গলাসিতে ফোসকা পড়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। আর তোমাকে দাদা ডাকছে। এক্ষুণি চলে এসো।” খবর পেয়ে প্রতোষ সঙ্গে সঙ্গে এসে সনাতনকে দেখে প্রেস্ক্রিপসান করে একজনকে ওষুধ নিয়ে আসতে বলে বলল,“তুই এগুলো কিনে নিয়ে আয়। তারপর আমি যা করার করছি।”
এদিকে ওষুধ এসে গেল এবং ডাক্তারবাবুও খবর পেয়ে ফিরে এলো। ডাক্তারবাবু আসতে সন্তোষবাবু রতনকে বলল,“প্রতোষ আমার ছোট ভাই। ডাক্তার। বিদেশে থাকে। প্রত্যেক দূর্গা পূজায় ওরা সপরিবারে কোলকাতায় চলে আসে। কোলকাতার আনন্দ তো বিদেশে বসে সম্ভব নয়। প্রতোষের মত বাইরে যে যেখানে থাকে এইসময় সবারই নিজের নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসার জন্যে মন আনচান করতে থাকে।” ডাক্তারবাবু সনাতনের ক্ষতটা দেখে মলম দিয়ে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিল। আর দু’ধরণের ওষুধ দিল। দু’বেলা একটা করে খাবার জন্যে। সেই সঙ্গে একটা অম্বলের বড়ি খেতে দিল। বলল,“তিনদিনে এটা শুকিয়ে যাবে। এখানে যাতে জল না লাগে দেখবে। তোমরা তো এখন এখানে থাকবে। তিনদিন পর ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেসিং করে আবার ব্যান্ডেজ করে দেবো। আর কোন অসুবিধা হবে না।” ডাক্তারের কাজ হয়ে গেলে সন্তোষবাবু বলল, “রতন, আজ আর বাজাতে হবে না থাক। ছেলেটা কষ্ট পাবে।” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “না, আমি পারব।” কাঁসর বাজানো কাঠিটা নিয়ে বলল, “এইতো আমি বাজাতে পারছি। কোন অসুবিধা হচ্ছে না। লাগছেও না। আস্তে আস্তে, সাবধানে না হয় বাজাবো। তবে বাজনা থামানো যাবে না। এত গুনিজন মানুষ মন দিয়ে আমাদের বাজনা শুনছে। এনাদের হতাশ আমি কিছুতেই করতে পারবো না। বরং আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের বাজনা শোনার জন্যে ওনারা মূল্যবান সমন নষ্ট করে এখানে এসেছেন। সন্তোষবাবু, আপনি ‘না’ করবেন না। আর যদি অসুবিধা সত্যিই হয়, আমি জোর করে বাজাবো না। এই কথাটা আমি আপনাকে দিচ্ছি বাবু।” এত সুন্দর কথাটা বলল সনাতন, সন্তোষবাবু আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু বলল,“তুই ছেলে তো দেখছি বাবার মত ভালো কথা বলতে পারিস। এতক্ষণ চুপচাপ ছিলিস, বুঝতে পারছিলাম না। ভেতরের জমি উর্বর বলেই না মাধ্যমিকে অত ভাল রেজাল্ট করতে পেরেছিস। তা সে ছেলে ভাল কথা বলতে পারবে না তা হয় না।”
কথাটা জেনে রতন প্রচন্ড আনন্দ পেয়েছিল। এত আনন্দ জীবনে কোনদিন সে পেয়েছিল কিনা তার মনে নেই। কমিটির লোক যখন বলল, “আমাদের এখানে নবমীতে পশুবলি কোনদিন হয়নি। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই কত যুগ আগে থেকেই এই রক্তস্নানে বিশ্বাস করেনি। সেই রেওয়াজ এখনো চলে আসছে। ওই কুমড়ো বলি দিয়ে শাস্ত্রের বিধান আমরা অনুসরণ করে আসছি।” খুশিতে টগবগ মনে সঙ্গে সঙ্গে রতন মুখ থেকে বের করে ফেলল, “বলির পর্বে আমি এমন বাজনার তাল তুলবো, তা সকল মানুষ আনন্দে আত্মহারা হবার মতো হয়ে যাবে। দেখে নিও বাবু!” রতন যা বলেছিল তাই যেন করে দেখালো! পশু বলির ‘না’ যেন অন্য মানুষে উত্তরণ ঘটিয়েছিল রতনকে। কুশলী রতনের ঢাকের বোল এমনভাবে হৃদয়কে উদ্বেল করে তুলতে পারে তা পাড়ার মানুষরা যেন ভাবতেই পারছিল না। নৃত্যের তাল। তাও আবার ঢাক-কাঁসরে! সে তো উদ্দাম নৃত্যের মত হয় জানত এরা। কিন্তু এই তালের এমন গুনমুগ্ধ বোল হৃদয়ের ভেতর থেকে নৃত্যের অনুরণন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। চলৎশক্তিহীন শ্রোতারাও যেন হৃদয় উচ্ছ্বাসে থেকে নেচে উঠছে। অথচ উদ্দামতার লক্ষণ ছিটেফোঁটা নেই ! পাড়ার মেয়ে বউরা- যাদের কোনদিন বিসর্জনেও নৃত্যের তালে তাল দিতে পারা যায়নি, সেইসব রমনীরাও বোলের তালে তাল মেলাতে শুরু করে। উৎসাহিত কিছু যুবতীরা সন্তুষ্ট হয়ে রতনকে দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে কিছু কিছু করে নগদ টাকা দিয়ে এই আনন্দযজ্ঞে নিজেদের সামিল করে নেয়।
নবমীর সকাল থেকে শুরু। সবকিছু সেরেসুরে রতনরা যখন শুতে যাচ্ছে তখন রাত দেড়টা। ক্লান্ত শরীর। রতনের মনে হচ্ছে শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাবে। ছেলেকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়ল। চোখ বুজিয়ে চুপচাপ রয়ে গেল। কতক্ষণ যেন হয়ে গেল ! তবু পোড়া চোখে ঘুম নেই। এবার দু’হাত উল্টে বালিশের উপর রেখে তার উপর ঠেকনা দেয় মাথা। ক্লান্তি যদি ঘুমকে কাছে ডেকে নেয়। নাহ! তবু ‘ড্যাব ড্যাবে’ চোখ দুটো। কড়িকাঠে নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। রাত পোহালেই দশমীর বিসর্জনের আবহ। চরাচরে আসন্ন বিষাদের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করবে। সেই ভাবনায় রতনের মনটা যেন কেমন মুষড়ে যায়! এ’কদিনের খুশির উচ্ছ্বাস আনন্দর প্রবাহ এই বিজয়ার হাত ধরে বিদায় নেবে। অপেক্ষা করতে হবে আবার আসছে বছরের জন্যে। কিন্তু এই বাবুরা পরের বছর তাদের বায়না দেবে কি না তা তো অজানা। নাও দিতে পারে। ফি বছর তাদের মত কত ঢাকি আসে, ঢাকে বোল তুলে বাবুদের সন্তুষ্ট করে চলে যায়। এই পুজো প্যান্ডেলে আগের বছর যারা ঢাক বাজিয়ে গেছে তাহলে তাদেরই তো বাবুরা আবার এই বছর আসতে বলতে পারতো। তা তো হয়নি। তাই তাদের বেলাই বা হবে এমন জোর দিয়ে সে বলতে পারে না। তবে এই প্যান্ডেলে তারা যেমন ঢাকে কাঠি মেরে বোল ফোটানোর পটুত্ব দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। তারাও যারপরনাই আনন্দ পেয়েছে, খুশি হয়েছে। ঢাক বাজিয়ে এমন আনন্দ এই গড়ান বয়সে এসেও আগে কোনদিন পায়নি, রতন। মনে হচ্ছে যেন এখানকার প্রতি তার একটা অধিকার জন্মে গেছে। এখানকার মানুষের আচার ব্যবহার, তাদের প্রতি এনাদের ভালবাসা আর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী এই ধারণাকে যেন দৃঢ় করেছে। না, তাই বলে সে তার অধিকার ফলাতে সচেষ্ট হবে না। যা স্বাভাবিক, যেটা হবার সেটাকেই সে মেনে নেবে। আরও একটা দিন তাদের হাতে আছে। সুযোগ আছে রতনের কাছে, তার সর্বস্ব উজাড় করে দেবার। তারপর সবকিছু সে সময়ের হাতে সমর্পন করে দিতে চায়। যেমনটি শিয়ালদার সমাজবিরোধী, হাতকাটা ছেনোর হাতে অপমানিত, বিধ্বস্ত হয়ে ভাগ্যকে ভাসিয়ে দিয়েছিল দিগন্তমুখী সময় প্রবাহে।
দশমীর সকাল। বিসর্জন পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বামুনঠাকুররা আর বাসহরিজনেরা ব্যস্ত। পাড়ার কচিকাঁচারা ইতিউতি ছুটোছুটি আর আনন্দে মশগুল। সনাতনের সঙ্গে এদের ভালই ভাব জমে গেছে। এক একজন কচি এসে আব্দার করে, “ও সনাতন দাদা, আমাকে একটু কাঁসর বাজানো শেখাবে? তুমি কি সুন্দর কাঁসর বাজাও। আমার শুনতে খুব ভাল লাগে। ঠিক ওইরকম বাজনা আমাকে শেখাতে হবে কিন্তু।” সনাতনও কচিদের সঙ্গে কচি হয়ে যায়। আর একটু বড়রা আব্দার করে, রতনকে, ঢাক বাজাতে দিতে হবে। রতন তাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। ওরা কি আর ঢাকে বোল তুলতে পারে? ওরা ওদের মত ঢাকে কাঠি মারে। ও বোলে কোন তাল ওঠে না। কাটা তাল ভেসে বেড়ায়। তাদের সঙ্গে এমন কান্ড ছেলেপিলেরা করছে অনেকক্ষণ থেকে। বড়দের চোখ পড়তেই বড়ড়া হাঁই হাঁই করে ওঠে, “এই তোরা এমন উল্টোপাল্টা ঢাকে কাঠি পেটাচ্ছিপ, ঢাক তো ছিঁড়ে ঢপ ঢপ করবে রে শেষ পর্যন্ত। তখন রতনকাকু আর বিসর্জনের, ভাসানের বাজনা বাজাতে পারবে না। সব কেঁচোগন্ডুস হয়ে যাবে। আচ্ছা রতন। তোমরাও তো তেমন। কাজের জিনিস এমন অকেজোদের হাতে দিতে আছে? অকাজ কিছু হয়ে গেলে আমরাও তো আতান্তরে পড়ে যাবো !” মুচকি হেসে রতন বলল,“কাঠি দিয়ে ঢাকে আঘাত করে ঢাক ফাঁসানো যায় না বাবু। এই কাঠি দিয়ে আপনি যত খুশি একে আঘাত করুন এ খিলখিল করে শুধু হাসতেই থাকবে। গোমড়ামুখো এ একদম হবে না।”
বাঃ, তুমি বেশ কথা বললে তো রতন। মনে ধরার মত কথা তোমার। তা আমাকে একটু তোমার ঢাক বাজানো শেখাও না? আমি পারবো না, না ? ঢাকে তোমার মত অত সুন্দর বোল তুলতে?” রতন মুচকি হাসছে দেখে বাবু বলল, “হাসছো যে রতন? আমি পারবো না বলছো।”
-না বাবু। সেকথা আমি বলতে পারি! আপনারা অত বড় মাপের মানুষ। অত শিক্ষিত। আমরা এই মূর্খরা পারলে আপনারা পারবেন না, এতবড় হেলাফেলা কথা আমি বলতে পারি! বলছি আপনারা এই সব ছোটমোটো কাজ করতে যাবেন কেন। এ কাজ আমাদের মত নীচু ঘরের লোকেদের কাজ। হাসির মাধ্যমে সেই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম বাবু।
-তুমি মোটেই নীচু ঘরের নও। দুটো কাঠি দিয়ে যারা এত মনমাতানো বোল তুলে মাতৃমন্দির জাগিয়ে তোলে তারা কক্ষনো ছোট-বড়ো বিচারের আওতায় আসে না। শিল্পের জন্য শিল্পী। শিল্প ভগবানের হৃদয় মথিত কলা। এরা উঁচুনীচু সবার ঊর্দ্ধে। ওসব কথার মারপ্যাঁচ ছাড়ো। আমাকে একটু দেখাও তো, কেমন করে ঢাকে বোল তোলো তোমরা?
নবমী শেষ মানে মায়ের আরাধনার যাবতীয় মূল পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই কর্মকর্তারা সবাই প্রায় অনেকটা হাল্কা মেজাজে। একজন বাবুর কথা শুনে এদিক ওদিক থাকা অন্য বাবুরাও রতনকে ঘিরে ধরে ঢাক বাজানোর তালিম দেবার জন্যে। এমনকি সন্তোষবাবুও। সন্তোষবাবুকে দেখে রতন যেন আরও ভড়কে যায়। যদি সে এমন বড়বড় বাবুদের শেখাতে না পারে তাহলে তো সে মরমে মরে যাবে। ইতস্তত করছে রতন। বাবার মনের অবস্থা বুঝতে দেরি হয়নি সনাতনের। বাবাকে স্বাভাবিক করার জন্যে বলল,“বাবা, বাবুরা যখন বলছে তখন একটু না হয় দেখিয়ে দাওনা। বাবুরা টুকটাক বাজাতে পারলেই খুশি হবেন।” সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সনাতন বলল,“বাবা কিন্তু ঢাক বাজানো শেখানোর মাস্টার। আমাদের ওদিককার বহু দূর দূর থেকে মানুষ আসে বাবার কাছে ঢাক বাজানো শিখতে। বাবা চাইলে আপনাদেরও শেখাতে পারবে।” সনাতনের কথা শুনে এবার বাবুরা আর কিছুতেই রতনকে ছাড়বে না। কিছুটা অন্তত শেখাতে হবে তাদের।
আর কোন উপায় না দেখে রতন বলল, “বাবুরা, ঢাক বাজানো শিখতে গেলে ওই গানবাজনার তাল, লয়, বোল ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রাথমিক কিছু নিয়ম জানা দরকার। না হলে একটু পরেই আবার ভুলে যাবে। যেমন ছেলেপুলেদের গান বা তবলা শেখার সময় এই নিয়মগুলো শিখতে হয়।” সঙ্গে সঙ্গে বাবুরা বলল,“ঠিক আছে আমরা রাজি। তুমি শুধু ঢাক বাজানো শেখার জন্যে যে তাল, লয়, বোল-টোলগুলো প্রয়োজন সেগুলো শেখাও। আমরা মন দিয়ে শিখবো।”[সাতাশ]
নতুন নক্সার কাজে পারদর্শিতা দেখিয়ে বড়বাজারে মহাজন মহলে অখিলের কদর এখন দেখার মত। সেই সুনামের হাত ধরে একাধিক মহাজনের ঘরে এখন তার মালের চাহিদা তুঙ্গে। একবার সে তার তৈরী জিনিস নিয়ে যে ঘরে ঢুকবে, সেখান থেকে তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে। অন্য ঘরে দেবার মত মাল আর তার কাছে অবশিষ্ট থাকবে না। এই নতুন নক্সার গয়না নেবার জন্যে অনেকে আবার আগাম টাকা নেবার জন্যে ওকে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অখিল তাতে রাজি হয় না। আগে থেকে কেউ তাকে কিনে রেখে দেবে সেটা তার নীতিবিরুদ্ধ। গুরু, মোহন গোড়ে এই বিদ্যে অনেক আগেই তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। আর বাকির কারবারও সে কোনদিন করে না। তাতে তার জিনিস যদি বিক্রি নাও হয় তবু। তবে এমন পরিস্থিতির মধ্যে তাকে বা তার গুরুকে কোনদিন পড়তে হয়নি। বাজারে এ জিনিসের চাহিদা সবসময়। মাঝে মাঝে কারবারে ভাটার টান যে আসে না তা নয়। যদিও তা খুব কম সময়ই হয়েছে। তখন দাম ধরে না থেকে লাভ কম করে ছেড়ে দিলে কাটান হয়ে যায়।
অখিলের এই নব-উত্থানের মূল নেপথ্যচারি কিন্তু সেই রেখা বউ। তার দক্ষতা এবং পারদর্শিতাতেই এমন উন্নতি। রেখা বউ যদি জটিল নক্সার কাজটা সঠিকভাবে ধরতে না পারতো তো তার পক্ষে এই সুনাম অধরাই থেকে যেতো। অখিল তো শুধু ড্রয়ইং দিয়েই খালাস। অবশ্য রেখা বউয়ের এই কাজের সঙ্গে ও মাঝে মাঝে তার এতদিনে এই লাইনের অর্জিত অভিজ্ঞতার কিছুটা অংশীদার হয়েছে মাত্র। কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্যে যে সূক্ষ্ম দক্ষতা অর্জন করা দরকার তা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয় রেখা বউ। নিজে নিজে সে কি করে যে এমনটা করতে পারল তা ভেবে মনে মনে গর্ব বোধ করে ও। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর একাগ্রতা ছাড়া যে এসব সম্ভব নয় তা জলের মত পরিষ্কার। অখিল বুঝে গেছে, সেটা রেখা বউয়ের মধ্যে পুরোপুরি বর্তমান। মেয়েরা সঠিক জায়গা পেলে কত জটিল কাজই না উতরে দিতে পারে এই সমাজের। অথচ আমাদের পুরুষ সমাজ, তা অত সহজে করতে দিতে রাজি নয়। তাদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে একটা বেড়া রচনা করতে তারা যেন সবসময় সযত্ন থাকে।
আশপাশের কয়েকটা গ্রাম জুড়ে আছে অখিলের মহিলা কারিগর। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ও চেষ্টা করছিল এই দামি কাজগুলো অন্যদের দিয়েও যদি করানো যায়। কিন্তু বলা যেতে পারে ষোল আনার মধ্যে পনেরো আনাই অকর্মার ঢেঁকি! অত জটিল কাজের মধ্যে তারা ঢুকতেই চায় না! চেষ্টা করলে হয়তো তারা পারতো। কিন্তু সেই চেষ্টাতেই তারা মাথা চালাতে রাজি নয়।
ঘরসংসার, ছানাপোনা সামলে ওই মোটা বুদ্ধি খাটিয়ে উপর উপর যেটুকু কাজ চালানোর মত কাজ করা যায় তাতেই ওরা পড়ে থাকতে পছন্দ করে। উপরে উঠতে চায় না। নিজেকে মেলে ধরার জায়গা পেলেও আবার সবাই সেই জায়গায় পা রাখতে আগ্রহ দেখায় না। এইভাবেই ওরা নিজেদের পাওনা সুযোগ নষ্ট করে চলে। আর আধিপত্যবাদিরা সেই অনিহার সুযোগ নিয়ে যায় দিনের পর দিন। প্রকারান্তরে হয় কি, যারা সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে জবরদখল করা জায়গা উদ্ধার করতে। এই নিষ্কর্মারাও তখন চায় না তাদের গোত্রের অন্য কেউ ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাক। তখন লিঙ্গ ভেদে যৌথভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সক্ষমদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে।
গুটিকয় সক্ষমদের মধ্যে রেখা বউয়ের উপর অক্ষমদের নিন্দামন্দের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে সব থেকে বেশি। কেননা এই বউটাই তো তাদের অক্ষমতার ছবি সকলের সামনে তুলে ধরেছে তার যোগ্যতার সঠিক পরিচয় দেবার মাধ্যমে। অখিল প্রতি পদে পদে সকল কারিগরদের রেখা বউয়ের উদাহরণ দিয়ে চলেছে, “ওই একটা অল্পবয়সী মেয়ে যদি এত বৈচিত্রময় কাজ এমন সুচারুভাবে করতে পারে, তাহলে তোমরা পারবে না কেন? সে মেয়ে, তোমরাও মেয়ে। আসলে কি জানো তো কাজে যোগ্যতা দেখাবার ইচ্ছে তোমাদের মধ্যে আদৌ নেই। এবার তোমরা এবং রেখা বউরা- একই জাতের কারিগর হয়েও যদি রেখা বউদের নামডাক ছড়িয়ে যায় তখন তোমরাই আবার তাদের সেই সুনামকে মেনে নিতে অবশ্যই কিন্তু কিন্তু করবে। এমনটাই যেন আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম হয়ে গেছে। আমরা যেন সব কাঁকড়া হয়ে যাচ্ছি। হাঁড়িতে কাঁকড়া রাখো। দেখবে কিছু কাঁকড়া হাঁড়ি বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আবার কিছু কাঁকড়া, নীচ থেকে সেই বাইরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করা কাঁকড়াদের ঠ্যাং কামড় দিয়ে নীচে টেনে ধরে নামিয়ে দিচ্ছে। যারা উঠবার চেষ্টা করছে তাদের উঠতে দিচ্ছে না। নিজেরাও ওঠার চেষ্টা করছে না।
বড়বাজারে মহাজনদের ঘরে নতুন নক্সার হাত ধরে অখিলের এই সুনাম তার পেশা-গুরু মোহন গোড়েকে গোপন করেনি। গুরুকে টপকে বা আঁধারে রেখে কোন কাজ করা তার ধাতে নেই। তাই সে গুরুকে জানিয়ে বলল, “কাকা, এই নক্সার কাজটা কি আমাদের এই কারখানার কারিগরদের দিয়ে করানোর চেষ্টা করবো? তুমি একবার এদের বলে দেখো না? যদি ওদের কেউ করতে চায় বা পারে তাহলে আমি সেটা দিতে পারি। দরকারে মন্ডল পাড়ার রেখা বউকে আনিয়ে এদের তালিম দেওয়াতে পারি। কাজটা একটু জটিল। তবে একবার ধরে নিতে পারলে আর অসুবিধা হবার কথা না। এতে ভাল পয়সা দিচ্ছে মহাজনরা।”
অখিলের এই নতুন উদ্যোগের কথা মোহন গোড়ের কানে আগেই এসেছিল। ও অপেক্ষায় ছিল, অখিল কখন তাকে ব্যাপারটার কথা জানায়। এমনি সময় তো লোকের কাছে সবসময় আওড়ায়, মোহন গোড়ে আমার গুরু। গুরু গুরু করে বাইরে গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখায়। লোকও তাকে সত্যিকারের শিষ্য বলে ভাবে। পুরাকালে যেমন শিষ্যরা গুরুকে মান্য করে সেই জায়গায় নিজেকে স্থান দিতে চায়। মোহন ভাবে, এই কাজের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে যাবে অখিলের গুরুভক্তির সার-অসারের মাপ কতটা। মোহন উপযাচক হয়ে তাই কোন কথাই এ ব্যাপারে অখিলের থেকে জানতে চায়নি। ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় ছিল। মোহন ভাবছিল, আজকাল তো সমাজে স্বার্থপরের বাড়বাড়ন্ত কহতব্য নয়। আপন স্বার্থের জন্যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে মানুষ। উপযুক্ত পাত্রের প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে তাদের কার্পণ্যের অন্ত নেই। উল্টে কেমন করে উপকারিকে বদনামের পাঁকে নিমজ্জিত করা যায়, নিয়ত সেই চেষ্টায় সময় ব্যায় করতে পছন্দ করে। ওই জন্যেই তো এক শিষ্য যখন বিদ্যাসাগরের বিপক্ষ কর্মে লিপ্ত, তখন বিদ্যাসাগর মশাই প্রায় এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন, ওরে, তোরা খোঁজ নিয়ে দেখ। নিশ্চয়ই কোন না কোন সময় ওই ব্যক্তি তার কাছ থেকে কোনভাবে উপকৃত হয়েছে। তা না হলে সে আমার বিরুদ্ধাচরণ করতেই পারে না। মনে মনে এমন ভাবনাই মোহনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু অখিল যখন সেই স্বার্থপরজনের পথে পা না বাড়িয়ে সত্যকাম করে বসল, তখন ছেলেটার প্রতি মোহনের শুধু ভালবাসা নয় ভক্তি-শ্রদ্ধাও করতে ইচ্ছে হল। পুরাণ কথায় বর্ণিত গুরু-শিষ্যের সুসম্পর্কের বাণী নতুন করে যেন এই যুগে সে স্পষ্ট করে দিল। মনে মনে অখিলের আরও উন্নতি কামনা করল। বলল, “অখিল আমার জীবনের সর্বোত্তম পুরষ্কার তুই আজ আমাকে দিলি। কর্মগুরুর প্রতি তোর এই কৃজ্ঞতায় আমি যে কতটা তৃপ্ত হয়েছি তা তোকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। শিষ্যর বিরূপ আচরণে স্বয়ং বিদ্যাসাগর পর্যন্ত আক্ষেপ করেছিলেন। ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটামুটি আমরা তেমনটাই জেনে এসেছি। আর তুইই সেই শিষ্য, যে সেই বদ্ধ ধারণা থেকে আমাকে মুক্ত করলি। এ কথা মুখ ফুটে স্বীকার না করে আমার উপায় ছিল না। তোর মহানুভবতাকে তাহলে ঠিক ঠিক মর্যাদা দেওয়া হয় না। আর একটা কথা, তোর নতুন নকশা কোলকাতার মহাজনের কাছ থেকে আমি পেয়েছি। কিন্তু তোর তো অজানা নয় যে আমাদের এখানে যেসব কারিগর আছে, অমন কম বুদ্ধির কারিগরদের পক্ষে এ নকশা তোলা সম্ভব নয়। ওটা তোর ব্যবস্থাপনায় যারা করছে তারাই করুক। এই শিল্পের কাজে তারা আরও শিক্ষিত হোক। তোর হাত দিয়েই তাদের উত্তরণ ঘটবে। এই দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে। তুই এগিয়ে যা অখিল।”গুরুর আশীর্বাদ এবং স্বীকারোক্তিতে অখিলের মন যেন আরও চনমনিয়ে উঠল। আরও ভাল কাজ করার প্রেরণা ভেতর থেকে সক্রিয় হতে লাগল। সেই জাগরণের হাত ধরে সে রেখা বউকে নিজের কাজের মধ্যে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে চাইল। ওর মনের জাগরণ বলছে, এই মেয়েটা যদি তার আরও অনেক কাছের লোক হতে পারতো তো কতই না ভাল হত। কিন্তু সেটা বা কেমন করে সম্ভব। সে তো অন্য ঘরের মানুষ। অন্য ঘরের মানুষকে কেমন করে সে আরও কাছে করে নিতে পারবে। পরস্ত্রীর বেশি কাছাকাছি আসা মানে পরনিন্দা পরচর্চার সঙ্গে নিত্য ঘর করা। তার উপর রেখা বউ আবার বিধবা! এমন যে জন, তার নামে নিন্দামন্দ কথা তো আগুনের ফুলকির মত এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবার কথা না। গ্রাম-পাড়াগাঁয়ে এমনটা প্রচার বাস্তব সত্য। কিন্তু এই নিন্দামন্দর ভয়ে রেখা বউয়ের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবধান আগের মত বজায় রাখলে তো তার আর চলবে না। তার নিজের স্বার্থে, তার কারবারের স্বার্থে সে এটা হতে দিতে পারে না। সে যতটা তাকে কাছে টানতে পারবে উভয়ের জন্যে ততটাই মঙ্গল।
এমন এক দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতির মধ্যে ‘না ফেরার দেশে’ চলে গেল রেখা বউয়ের বিছানা-শয্যা শ্বশুর! আবার এক বিপর্যয় রেখা বউয়ের জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল। হয়তো তা একদিন- ‘আজ না হয় কাল’ তাদের জীবনে আসতে চলেছে তা এদের সকলের জানা ছিল। মনকে সেই বোধ দিয়ে মানসিক ধাক্কাটা হয়তো তেমন প্রচন্ডভাবে আসতে দেয়নি। কিন্তু ওটাকে সহনের পরেও অন্যসব সামাজিক এবং আর্থিক ধাক্কা- অন্যতম বিপর্যয় থেকে কম কি! কেমন করে সে এই ধাক্কাকে সামাল দেবে! জাগতিক স্তরে এই ধাক্কা সামলানোও তো তার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। সেই উপলব্ধি রেখা বউ ছাড়া আর কে করতে পারে। একমাত্র পারে সেই মানুষটা যে তার মরমে প্রবেশ করতে পেরেছে। সংবাদটা পাওয়ামাত্র অখিল দৌড়ে আসে রেখা বউয়ের বাড়িতে। উদ্ভ্রান্ত রেখার শাশুড়িকে আশ্বস্ত করে অখিল বলল,“কাকিমা, তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না। তুমি কেন ধরে নিচ্ছো না যে তোমার ভীষ্ম নেই তো কি। তোমার অখিল আছে তো! অজানা দেশে চলে যাওয়া তোমার ভীষ্মর ফাঁকা হয়ে যাওয়া জায়গায় এই অখিলকে তুমি বসাতে পারো না কাকিমা?” পরক্ষণেই অখিলের ভেতরে তোলপাড় করতে থাকলো, “তোমার ভীষ্মর ছায়া যদি অখিলের কায়া দিয়ে আড়াল করে দিতে পারো কাকিমা, তাহলে অখিলও বেঁচে থাকার নতুন পথ পেয়ে যায়। ক্রমশ রক্ষণহীন হতে যাওয়া তোমার স্নেহের পুত্রবধূও আর এক নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করে নতুনভাবে বাঁচার পথ পায়। তোমরা চাইলে সেই পথ সুগম করার ভার তো আমার।”
জীবনের উপান্তে নতুন সূর্যর মত উদয় হওয়া অখিলের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতাবোধ জেগে উঠল ওই প্রাচীন মানুষটার- ভীষ্মর মায়ের। ন্যুয়ে যাওয়া কোমর অখিলের প্রেরণায় যেন তেড়ে উঠে সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বৃদ্ধার নোল হয়ে যাওয়া চামড়ার দু’হাত জড়ো হয়ে এল অবলীলায়, “বাবা অখিল, আমারও যাবার ডাক এলো বলে। দেখতে দেখতে কখন যে সে ডাক এসে যাবে তা তো কারোর জানা নেই। তবু সে ডাক যে কেবল সময়ের অপেক্ষা তা তুমি আমি, রেখা-মা সকলের জানা। তারপর কি হবে বাবা আমার এই ভরা যৌবনা লাবণ্যময়ী বৌমার? ওর ওই আগত রক্ষণহীন জীবনকে রক্ষা করবে কে বাবা? যৌবন-লুঠেরাদের লুঠের মাল হয়ে যাবে না কি রে বাবা, আমার মেয়েটা? ওঃ ভাবনায় দেখা ওই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না রে বাবা। বুকটা ধকর ধকর করে চলেছে। একটু জল। রেখা মা তাড়াতাড়ি একটু জল দে না?” রেখা তখন ঘরের বাইরে দাবায় উবু হয়ে বসে দু’হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে সমানে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। অখিল দৌড়ে গিয়ে মাটির কলসি থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিয়ে বৃদ্ধার থুতনি আলতো করে উঁচুর দিকে তুলে ঢক ঢক করে জল খাইয়ে দিতে রক্ষে হয়। না হলে হয়তো বুড়িটা এখনই দমবন্ধ হয়ে মরে যেত! অখিলের হাতে জল খেয়ে শুকনো ছাতি ভিজিয়ে শান্ত হয় বুড়ি। খানিক চুপ থেকে বলে, “বাঁচালি বাবা এ যাত্রা আমাকে। তুইই পারবি বাবা আমার ডুবতে থাকা সংসারের নৌকো চাগিয়ে তুলতে। হ্যাঁ, যে কথা বলতে বলতে কথার তাল কেটে গেল। তুই তো বাবা এখনো ঘরে বৌমা তুলিসনি। নাই বা হলি তুই আমাদের জাতের। আজকাল আর সেই জাতের জারিজুরি নেই রে বাবা। সে ছিল একসময়। আমাদের জন্মকালে। সে তো কত যুগ, কত কালের প্রলেপে বিলীন। যেটুকু আছে তা একদল দাম্ভিক লোকের ঢেম্নামী ছাড়া আর কিছু না। তার জন্যে হয়তো তোকেই অনেক বাধা বিপত্তি টপকাতে হবে। তবু তুই দেখিস বাবা আমার বৌমাটাকে। এখন রেখা আমার শুধু বৌমা না রে বাবা। ও আমার আবার মেয়েও। যার সম্বন্ধে ও বৌমা সে তো কালের গর্ভে উবে গেছে। এখন সে নেই ‘বৌমা’ও নেই। আছে কেবল আমার মেয়ে, রেখা-মা। আমার শ্বাস থাকতে থাকতে আমি নিজের হাতে আমার মেয়েকে তোর কাঁধে সমর্পন করে যাবো। তুই শুধু সায় দে বাবা। না, এক্ষুণি না। তুই সময় নে। থিতু হয়ে ভাব। জীবনকে কোন খাতে ভাসাবি। তারপর আমাকে এই সুযোগটা করে দিস বাবা। তোর মত আমাকে তাড়াতাড়ি জানাস।”
শ্বশুরের শ্মশান-কাজ সেরে গামুইদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে প্রথমে পড়ে অখিলদের রুইদাস পাড়া তারপর রেখাদের মন্ডল পাড়া। রুইদাস পাড়ার মোড়ে আসতে অখিলদের পাড়ার কয়েকজন তাকে এদিকে চলে আসতে ডাকে।অখিল সেদিকে যাবার ঝোঁক নিতে যাবার কালেই রেখা গলার স্বর একটু বাড়িয়ে বলে, “তুমি এখন ওদিকে যাবে না বাবু। গামুই-আচার শেষ করে তবে বাড়ি ফিরবে। নাহলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। চলো আগে আমাদের বাড়ি।” অখিল আবার গামুই দলে ভিড়ে যায়। বে-পাড়ার বউটা যে তাদের পাড়ার ছেলেকে যেতে নিষেধ করতে পারে এবং ছেলেটাও যে বউটার কথা শুনে কাজ করবে আর তাদের অবজ্ঞা করবে তা লোকগুলো ভাবতে পারেনি। বউটা ওদের অপমান করলো! হজম করতে পারলো না ব্যাপারটা। অখিল আর বউটার উপর রাগ-বিদ্বেষ উগড়ে উঠল ওদের মধ্যে। ওরা অবাক হল, একটা মেয়েমানুষ তার উপর স্বামীখেকো মহিলার কথা এক বাক্যে মেনে নিল অখিল! তাদের কথার কোন দাম দিল না! এটা অখিল একদম ঠিক কাজ করল না। অখিলও বুঝল, পাড়ার লোকেদের কথা না মানায় তার উপর চাপ আসবে। কেননা ও, ওদের পাড়াকে খুব ভাল করে চেনে। মন্ডল পাড়া বা গ্রামের অন্য পাড়া মনের দিক থেকে যতটা আধুনিক হতে পেরেছে তাদের পাড়া ওদের ধারেকাছে এখনো পৌঁছতে পারেনি। তাই নিত্য তাদের পাড়ায় আচার বিচার জাত বেজাত চর্চা, জাতের নামে নোংরামি- সব সময় লেগে আছে। সব ওই সেকেলে কিছু
মাতব্বরদের মাতব্বরির জন্যে এসব গোঁয়ার্তুমি চলছে। অখিল তাতে চিন্তিত বটে। তবে ভীত নয়। পাড়ার লালচোখের ভয়ে সে সঠিক কাজ থেকে কিছুতেই পিছিয়ে আসবে না। তার বাবা মারা যাবার পর তারা তো কত দিন একবেলা আধবেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। মায়ের পাশে তখন পাড়ার কেউ কি দাঁড়িয়েছে? নিজের জাত, রুইদাসদের আটচালা এক কুনকে চাল দিয়ে বলেছে যে, এ বেলা তোদের রান্না হয়নি শুনলাম। এই চালটা রাখ। মায়ে পোয়ে ফুটিয়ে ফ্যান-ভাত নুন মেখে খা! বলেনি। নিজের জীবন পাত করে মা সংসারটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাই ও যখন বে-জাতের মানুষ, মোহন গোড়ের সাহায্যে নতুন জীবনের স্বাদ পেল তখন নিজের জাতভাইরা সাহস করে বলতে আসেনি, বেজাতের বাড়িতে তোর কাজ করতে হবে না। তাতে যদি তোরা মায়ে পোয়ে না খেয়ে মরিস তো মর। দেখতাম কত বড় বুকের পাটা তাদের! কথাটা দাঁড়ায় তাহলে যে, বে-জাতের দলে ভিড়ে পয়সা রোজগার করো। তাতে ঠিক আছে। কিন্তু বে-জাতের সঙ্গে মেলামেশা তোমার যাবে না। আজব সব ভাবনা এই সেকেলে গোঁয়ারদের। এই কু-সংস্কার যে এ যুগে অচল, তা তারা মানতে চায় না। আসলে সেই মানের মন তৈরীর শিক্ষা তো তারা কোনদিন পায় নি। সুযোগ আসলেও তারা সেই শিক্ষা নিতে চায়নি। তাহলে যে নিজেদের খবরদারির কারবারে ভাটা পড়ে যাবে। এতদিনের প্রতিপত্তির জায়গা অত সহজে কি কেউ ছেড়ে দিতে চায়। চায় না। সেই জায়গা থেকে
ওদের উচ্ছেদ না করলে ওরা সরবে না। ভাবনাটা মাথায় নিয়ে অখিল রেখা বউয়ের কথা মত তাদের সঙ্গে এগিয়ে গেল। শুরু হ’ল আর এক দ্বন্দ্বময় দিন যাপনের খুঁটিপুজো।
সারা রুইদাস পাড়া চাউর হয়ে গেল মন্ডল পাড়ার ভীষ্ম মন্ডলের বিধবা বউয়ের সঙ্গে জুটে গেছে অবাধ্য অখিলটা। পাড়ার ওই গোঁয়ার লোকগুলোই মুখে মুখে কথাটা ছড়িয়ে দেয়। এমনভাবে বলতে লাগল যে পাড়ার সবাই যাতে অখিলের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করে। রুইদাস পাড়ায় অখিলের মেয়ে কারিগর তো কম নয়। ঘরে বসে তাদের আয় ভালই হয়। এক দুই করে দেখতে দেখতে প্রায় বেশিরভাগ বাড়িতে অখিলের কারিগর আছে। এতে মেয়ে মহল বেশ দোটানায় পড়েছে। তারা তাদের ঠিকাদার মালিকের পক্ষে যাবে না বিপক্ষে। বিপক্ষে গেলে তো রোজগারে টান পড়বে। তখন বাড়ির মদ্দদেরও নফর-চফর ঘুচে যাবে। তাই বেশিরভাগ মেয়েই অখিলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে নারাজ। তাছাড়া ও যদি একটা বিধবা অসহায় মেয়েকে সাহায্যই করে। তাতে ওই অকর্মণ্য মদ্দদেরই বা ফাঁকা ঢপঢপে বুক ফাটে কেন? আর ভীষ্ম মন্ডলের বউ তো তার একনম্বর কারিগর। তার হাত ধরে অখিল কারবারে অনেক উন্নতি করেছে। ওই বউটা যে কাজ করে তা তাদেরও দিয়েছিল। তাদের পাড়ার কোন মেয়েই সেই কাজ তুলতে পারেনি। অত সরেস ঘিলু তাদের মাথায় নেই। যেটা ওই ভীষ্ম মন্ডলের বউয়ের আছে। বউটা ওই নতুন কাজটায় ব্যস্ত বলে অন্য সাধারণ নকশার কাজ করার সময় তার হয়ে ওঠে না। সেই কাজগুলো তো তারাই পাচ্ছে। তাদের আয় বাড়ছে। মদ্দদের আয়ের সঙ্গে তাদের রোজগার যোগ হচ্ছে বলেই না সংসারের সকলের নফরানি চফরানির বহর এতটা বেড়েছে। অখিলের পক্ষে তাই শুধু রুইদাস পাড়ার কারিগররা কেন, আশপাশের পাড়া-গাঁয়ের সব কারিগররাও। একটা বুদ্ধিমতী দক্ষ কারিগর, রেখা বউ। পাথরচাপা কপালের গুনে সে আজ বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত। ঠিকাদারবাবু যদি এই বিপদে মেয়েটার পাশে দাঁড়ায় তাতে দোষের কি? তার বড় মন বলেই না সে বিপদে এক অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে!
পাড়ার আটচালার গোঁয়ার মুরুব্বিরা কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে। অখিলকে ডেকে সরাসরি কৈফিয়ৎ চেয়েছে, কেন সে পরস্ত্রী বিধবার সঙ্গে মেলামেশা করছে। এতে তাদের জাতকুল বিপন্ন হতে চলেছে। তাই এই নোংরা কাজ তাকে বন্ধ করতে হবে। নচেৎ আটচালার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।ক্রমশ….
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১০)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[তেইশ]
অখিলদের দু’কামরা ঘরের এক কামরার একেবারে মটকা পর্যন্ত সোলার বস্তা ঠাসা। এমনকি সামনের বারান্দার অর্ধেক অংশও সোলায় ভর্তি।এখান থেকেই ও কারিগরদের দরকার মত সোলা সাপ্লাই করে। বরাবরই ওর রুইদাসদের জাত ব্যবসা ওই গরু-ছাগলের চামড়া নিয়ে কারবার, বেতের সরঞ্জাম তৈরী করে বিক্রির কারবার একদম পছন্দ নয়। ও জ্ঞান হওয়া বয়স থেকে দেখেছে পাড়ায় একে অপরের সঙ্গে এইসব কাজ কারবার নিয়ে পরস্পরের রেষারেষি, হিংসা, খুন, মারপিট- আরও কত কি। দিঘিরপাড় স্কুলে সেভেনে পড়ার সময় চন্দ্রবড়া সাপে কেটে বাপটা মারা গেল। ফি বছর বর্ষায় এদিকে এই চন্দ্রবড়া সাপের উৎপাতে মানুষের জীবন অতীষ্ট। এই সময় মনে হয় এরা ডিম পাড়ে। রাস্তাঘাটে ঝোপঝাড়ে ছোটবড় কত যে সাপ তারা মারে তার হিসেব নেই। তবু বেটারা নিকেশ হয় না। বাপটা মরতো না যদি সময়মত পাড়ার লোক ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে নিয়ে যেত। বর্ষায় দৌলতপুর শ্মশান চড়ার ওদিক থেকে ধান রোয়ার কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় ঘাস লতাপাতা কেটে বোঝা মেরে নিয়ে আসে। ঘরে দুটো ছাগল আছে। বর্ষার ঘাস পাতা খাওয়ালে ছাগল ফলফলিয়ে বেড়ে ওঠে। মা-ছাগলের দুধ বেড়ে যায়। যাদের যাদের বাড়ি ছাগল আছে তারা সবাই তাই করে। একবার তো ঘাস পাতা ছাগলকে খাওয়াবার সময় দেখে একটা কালকেউটো সাপের কাটা লেজ তার মধ্যে! সেই শুনে তাদের বাড়ি, পাড়ার লোক উপচে পড়ে। তা দেখে এক একজন এক এক রকম মন্তব্য ছুড়ে দেয়, “অখিলের বাবার ভাগ্য ভালো কাল ব্যাটা ঘুরে ছোবল মারেনি। ওর ছোবল একবার খেলে আর মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে না। ওখানেই কাত খেয়ে পড়ে যেতে হবে।” যারা নিত্য ঘাস কাটে তাদের কেউ বলে, “না বাবা, ছাগল বাঁচাতে গিয়ে নিজে মরবো নাকি! ওই ভাতের ফেন-ভুষি যা যোগাড় করতে পারব তাই খাওয়াব। ঘাসের জঙ্গলে আর না।” আরও কত লোকের কত কি কথা।
শ্রাবণ মাস। তখন বর্ষা পূর্ণ যৌবনা। পুকুর ডোবা, নালা, খানাখন্দ জলে টৈুটুম্বুর। সেই তালে যুবতী ঘাস যেন তার রূপের ছটা ঘেসুড়ে-ঘেসুড়িদের মাতাল করে দেয়। এরা তখন নিজেদের সামলে রাখতে পারে না। শত্রু বিপদের ভয় মাথায় তুলে তারা কাস্তে হাতে নেমে পড়ে লকলকে ঘাসের বনে। তাদের যুক্তি, কপালে গেরো থাকলে তা কে খন্ডাবে। যা হবার তাই হবে। সত্যি সত্যি তাই হল! এক কোমর জলে নেমে দু’হাত পাকড়ে ঘষ ঘষ করে হাত চালিয়ে ঘাস কেটে চলেছে অখিলের বাবা, চরণ। ঘেসুড়েরা জানে, ভারি জলে কোন বিষাক্ত সাপ থাকেই না বললে চলে। তবে পুকুর বা নালা ডোবার পাড়ে সাবধানে কাজ করতে হয়। ওই আরকি! দানা যখন শেষ হয়ে আসে তখন ‘সতর্কতা’ মাথা থেকে ফসকে যায়। কাটতে কাটতে নালাটার পাড়ে চলে আসে চরণ! সঙ্গে সঙ্গে শত্রু, গোদা চন্দ্রবড়াটা কুট করে ছোবল মারে চরণের বাঁহাতের কব্জির উপর দিকটায়। বাঁ হাতে তখন মুঠো ভর্তি ফুলকো ফুলকো ঘাস। বুঝতে পারেনি চরণ। ভাবলো ভোলা পিঁপড়ের মোটা দাঁড়া কামড় দিয়েছে। ভোলা পিঁপড়ে কামড়ালেও চুঁইয়ে রক্ত পড়ে ক্ষত থেকে। সেটাই ভাবে চরণ। কাজ থামায় না। হঠাৎ দেখে শালা গোদা চন্দ্রবড়াটা সামনে দিয়ে গতর নেড়ে চলে যাচ্ছে! আর বুঝতে দেরি হয়নি চরণের, কি সর্বনাশা কান্ড ঘটিয়ে গেল ওই কাল-শত্রুটা! চন্দ্রবড়ায় কাটলে কেউটোর মত অত যন্ত্রণা হয় না বা গলগল করে রক্ত ঝরে না। তাই সে পিঁপড়ের তত্ত্ব খাড়া করে নিজেকে বোধ দিচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে তো অনেকটা সময় জীবন থেকে কেটে বেরিয়ে গেছে। তবু যা সময় আছে তার ওপর ভরসা করে ঘাসের বোঝাগুলো বেঁধে মাথায় নিয়ে ভর দুপুরে বাড়ি ফিরে ধপাস করে বোঝাটা ফেলে মা’কে বলল, “দেখতো অখিলের মা, আমার হাতে মনে হয় বিষধর কিছু কামড়েছে। কামড়ায় যখন টের পেয়েছি। ওটা ভোলা পিঁপড়ে কামড় ভেবে গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু সময় যত গড়ায় শরীর ভেতর থেকে কেমন যেন করছে মনে হল। এখন কি করি বলতো? পাড়ায় একটু খবর দে-দিকিনি। অখিলকে বল গোটাকতক মেলেরিয়া পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসতে। দু’হাতের তালুতে ঘষে তার রস ছোবল খাওয়া জায়গায় দিয়ে দিই।”
খবর পেয়ে হুড়মুড়িয়ে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায়। যে যার মত টোটকার নিদেন দিতে থাকে। কে আবার উলকুনির শঙ্কর ওঝাকে খবর দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেও এসে ঝাড়ফুঁক চালিয়ে তার বিদ্যে ফলাতে শুরু করেছে। ভাবটা এমন, বিষ এক্ষুণি নামিয়ে দিল বলে। এদিকে রোগি আস্তে অস্তে যেন ঝিমিয়ে পড়ছে! দিঘিরপাড় স্কুলের অরুণ মাস্টার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হইহট্টগোলের শব্দ পেয়ে থমকে যায়! কারোর মুখে শোনে একজনের সাপে কেটেছে। বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া সাপ! ও তো সাংঘাতিক বিষধর সাপ! সময়মত হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মানুষকে বাঁচানো যায় না। সেটা বুঝে অরুণ মাস্টার পায়ে তাড়া লাগিয়ে পাড়ায় ঢোকে। হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে এখানে এইসব বুজরুকি হচ্ছে দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, “এক্ষুণি তোমরা একে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।” ওঝার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই ওঝা বেটা, যতই তুই মন্ত্রপুতে মাটির সরা-মালসা ফাটিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিস। পারবি তুই, এই মানুষটার শরীর থেকে বিষধরের বিষ নামাতে? কোনদিন তোরা পেরেছিস? কোথায় হয়তো বিষহীন চিতি সাপ, মেটলে সাপ বা দাঁড়াসাপ কামড়েছে, মানুষ দেখতে পায়নি সেই সাপটাকে। ভাবে যদি কোন বিষধর কামড়ায়? তখন তোদের ডাকে। তোরা এসে মন্ত্র আউড়ে ভড়কি দিস, সাপের বিষ নামিয়ে দিয়েছিস। শুনলাম অনেকক্ষণ থেকে নাকি তুই কেরামতি করে যাচ্ছিস। রোগি তো ক্রমশ আরও নেতিয়ে পড়ছে। এই যে রুইদাসরা সব, তোমরা ওই ওঝা বেটার কি ঢ্যামনামি দেখছো। এক্ষুণি নিয়ে চলো ওকে হাসপাতালে? আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। এমনিতেই বহু দেরি হয়ে গেছে। দেখো ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের রাস্তায় যেতে যেতে না মানুষটার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যায়!”
অরুণ মাস্টারের তাড়ায় এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে চরণকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু এত ভিতরের গ্রাম থেকে একে পাকা সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাবে কি করে! তারপর তো কোন গাড়ির ব্যবস্থা! পাড়া থেকে সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্যে কোন ভ্যান-রিক্সারও ব্যবস্থা করতে না পেরে ওরা চরণকে ধরাধরি করে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার বলে, “এ কি করছো তোমরা? সাপে কাটা রোগিকে কেউ এ’ভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়? একে একদম নাড়াচাড়া করা চলবে না। যত নাড়াচাড়া করবে তত ওর শরীরের ভেতরের রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠানামা করতে থাকবে। আর বিষ তুরন্ত মাথার দিকে উঠতে থাকবে। ওকে বিন্দুমাত্র হাঁটানো চলবে না। যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করতে হবে। কোনকিছুর উপর শুইয়ে মড়া নিয়ে যাবার মত কাঁধে করে নিয়ে যেতে হবে।” সঙ্গে সঙ্গে একজন বলল,“তাহলে এক কাজ করা যাক, চরণকে ধান ঝাড়া আগোড়ে কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে শুইয়ে নিয়ে চলো।” ইতিমধ্যে জনা দুই ছেলে সড়ক রাস্তায় চলে গেছে কোন অটো-টেম্পো যদি যোগাড় করা যায়। কিন্তু গ্রাম এলাকায় এই ভর-দুপুরে এমনিতেই রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলে কম। তারপর অটো-টেম্পোর কথা তো বলাই বাহুল্য। এতক্ষণ হয়ে গেল, রাস্তা দিয়ে একটাও ওইসব গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না। ততক্ষণে চরণকে আনা হয়ে গেছে। অরুণ মাস্টারও সঙ্গে এসেছে। একটা সাইকেল ভ্যান ধানগাছের চারা-তোলা নিয়ে যাচ্ছিল। মাস্টার সেই ভ্যানওলাটাকে থামিয়ে অনুরোধ করে বলল, “তুমি ভাই এই সাপেকাটা রোগিকে হাসপাতালে নিয়ে চলো। না হলে এ মরে যাবে। তোমার তোলা আমরা গুছিয়ে এখানে রাস্তার পাশে নামিয়ে রাখছি। ফিরে আসলে আবার আমাদের লোক তোমার ভ্যানে গুছিয়ে তুলে দেবে।” মাস্টারকে চেনে ভ্যানওলাটা। ওর ছেলে ওদের স্কুলে পড়ে। তাই মাস্টার এমন অনুরোধ করায় ও আর ‘না’ করতে পারলো না। তড়িঘড়ি সবাই মিলে তোলার বোঝা নামিয়ে চরণকে ওই কাঁথা-কম্বল সমেত ভ্যানে তুলে দিল। ভ্যানওলা বলল, “তোমাদের মধ্যে দু’জন আমার পেছনে দু’দিকে বসো। বেশি আর কাউকে ভ্যানে তোলা যাবে না। বেশি ওজন হয়ে গেলে গাড়ি গড়াবে না। আর দু’জনে দু’দিক থেকে আমার সঙ্গে প্যাডেলে চাপ দিয়ে যাবে। তাহলে গড়গড় করে গাড়ি ছুটবে।”
শেষ অবধি অরুণ মাস্টারের কথাই মিলে গেল। ঝিঙের পোল আর সরিষার হাটের মাঝামাঝি চেওড়ার কাছে যখন এল, ওরা দেখল চরণ, বিষের যন্ত্রণায় ‘উ-আঃ, মরে গেলাম’ বলে এতক্ষণ ধরে যেমন কাৎরাচ্ছিল, সেই কাৎরানি থেমে গেছে! ভ্যানওলাকে ওরা গাড়ি থামাতে বলল। ভ্যান থেকে নেমে ওরা দেখে চরণের শরীর আর নড়াচড়া করছে না। একবারে অচঞ্চল! সমস্ত শরীরটা নীল হয়ে গেছে। ডাক্তার না হলেও ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে চরণ আর বেঁচে নেই! তখন ভ্যানওলাটা বলল,“আর একে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। ওখানে নিয়ে গেলেই পুলিশ কেস হয়ে যাবে। পোস্টমর্টেম হবে। তখন হাজার হেপা তোমাদের বইতে হবে। তার চেয়ে পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। দিঘিরপাড় বাজারের কুঞ্জ ডাক্তার তো পাশ করা ডাক্তার। ও ডেথ সার্টিফিকেটে কাজ হয়ে যাবে।”
হঠাৎ বাবার অপঘাতের মরণে অখিলদের সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। মা দিশাহারা। ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে কেমন করে সে সংসার চালাবে! তার লেখাপড়ার খরচও বা কোথা থেকে জোগাড় করবে। নিজেদের কোন চাষজমি নেই যে সেই জমি চাষ করে সারা বছরের ধান-চালের খোরাক মিটে যাবে। ও মেয়েমানুষ, ওদের জাত-কারবার, চামড়া বা বেতের কোনকিছুই জানা নেই। শেষমেষ মা পেটের টানে মেয়ে-মজুরদের দলে নাম লেখাল। সব বিষয়ে মেয়েদের কত জ্বালা। মেয়েদের কত দুচ্ছা করা স্বভাব সমাজের। দশগন্ডা তোলা ভাঙা আর দশগন্ডা পোতা সারাদিনে দু’তরফই করছে। পুরুষ-মজুর এবং মেয়ে-মজুররা। অথচ মেয়েদের বেলায় রোজগন্ডা ছেলেদের থেকে কম! কেন হবে এমন অবিচার? অথচ কোন মেয়ে-মজুরের এই বেনিয়মের কথা বলার অধিকার নেই। যে ‘বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে যাবে’ তার কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে পুরুষ জাতেরা। মেয়েরা পুরুষের সমান সমান হবে তা আবার জাত-পুরুষরা মেনে নিতে পারে নাকি! ওরা খুব ভাল করে এটা বুঝেছে যে নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কোন ঘরের মেয়ে বাইরে বার হয় না। সেই সুযোগকে ওরা কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আর পুরুষ-মজুররা কাজ বয়কট করলে যে গোটা চাষ ব্যবস্থাটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই এই পুরুষ প্রাধান্য। এই কষ্টের কথা তার মা, অখিলকে শুনিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ত। বালক অখিলের মন মায়ের আকুতিতে ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তাই বাধ্য হয়ে সে পড়া ছেড়ে দিল, “মা, আমি আর স্কুলে যাবো না। তুমি কষ্ট করে জন খেটে আমাকে পড়াবে খাওয়াবে। তোমার এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না মা। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আমিও কাজে যাব।”
-এ কি কথা বলিস বাবা? তুই কোথায় কাজে যাবি। বাচ্চা ছেলে তুই। কে তোকে কাজে নেবে! তুই স্কুল ছাড়বি না। যে করে হোক আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব, অখিল। তুই দেখিস, যত কষ্ট হোক, তোর লেখাপড়া আমি আটকাব না।
কিন্তু মা একা ওই ক’টা টাকা জন খেটে কোথা থেকে তাদের খাওয়া-পরা আর তার লেখাপড়া শেখাবে? অখিল কিছুতেই সেই অঙ্ক মেলাতে পারছিল না। হাজার হোক নয়-নয় করে সে তো সেভেন ক্লাস অব্দি পড়ছে। একটু গাঁটগুনতির হিসেব সে তো বোঝে। এতটা বিপদে মা’কে ফেলা তার উচিত হবে না। স্কুলের টিফিন টাইমে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে ঘোরাফেরার সময় মাঝে মাঝে মোহন গোড়ের শোলা কারখানার কাজ দেখতে যেত সে। তার মত বা তার থেকে ছোট-বড় অনেক গরিব ঘরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা শোলা দিয়ে কি সুন্দর সুন্দর ঠাকুরের গয়না, মুকুট, টোপর তৈরী করছে! ভাল লাগত তার। অবাক হয়ে তাদের কাজ সে দেখতো। হঠাৎ একদিন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মোহন গোড়ের শোলার কারখানার ছবিটা! দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। মা’কে কিছু না বলে একদিন মোহন গোড়ের কাছে গিয়ে ধীর স্থির বিনয়ের সঙ্গে বলল, “কাকু, আমাকে তুমি চিনবে না। আমার বাড়ি রুইদাস পাড়ায়। চরণ রুইদাসের ছেলে আমি। বাবা সাপে কেটে মরে গেল। মা জন- খেটে আমাকে খাওয়ায়। তার ওপর আমার পড়ার খরচ মা আর চালাতে পারছে না। তোমার কারখানায় আমাকে কাজে নেবে? তুমি যা পয়সা দেবে তাতেই আমি কাজ করবো। মন দিয়ে কাজ করব। কাজে কোন ফাঁকি দেব না।”
-তা এখানে কাজ করে তুই পড়ার খরচ চালাবি তাই তো? ও গুড়ে বালি। পড়া ছেড়ে দিয়ে যদি তুই আসিস তাহলে আমি তোকে কাজে নিতে পারি। দু’নৌকায় পা দিয়ে তো চলা যায় না। ঢেউয়ের খামখেয়ালীতে নৌকো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে দু’পা চিরে গিয়ে জলে ঝপাং খেতে হবে। একটা কাজে লেগে মন ছুঁক ছুঁক করবে আর একটা কাজ কখন কিভাবে করা যায়, সেজন্যে। তাতে কোন কাজটাই মন দিয়ে করা যায় না। দু’কাজেই ফাঁকি পড়ে যায়। আর তুই বলছিস, মন দিয়ে কাজ করবি। তা কখনো হয় না। তারপর আমার এমন বাহুল্যতা নেই যে পুরো সময় কাজ না করে তিড়িং বিড়িং কিছু কাজ করে সময় কাটিয়ে চলে যাবি। আর ‘ফুল-ফুল’ রোজের পয়সা তোকে গুনে যাব। যাদের পেট চলে না তাদের পড়াটড়া তো বিলাসিতা ছাড়া আর কি? তোর বাপ
চরণ আমার জমিতেও চাষের কাজ করত। ‘লতার’ ছোবলে অকালে চলে গেল। আসলে কি জানিস, তোদের জাতটাই মুর্খ গোঁয়ার জাত। একটু যদি শিক্ষে-দীক্ষে থাকতো তো এই যুগে ওই ওঝা ডেকে বাজে সময় নষ্ট করে লোকটাকে মেরে দিত না। আর বলি কি, এদিকে পেটে ছুঁচোর ডন মারা রুখবে না বিদ্যের কচকচানিতে মজবে। এই যেমন তুই। বাপের নাড়ার গোড়ায় রস থাকলে তুই বিদ্যের মেজলায় মুখ জাবড়ে থাকতে পারতিস। সব কপাল। তোদের জাতটারই পাথরচাপা কপাল। তুই আর কি করবি। যদি কোনদিন তোদের কেউ ওই পাথর সরাবার ক্ষমতা দেখাতে পারে তবেই এই অশিক্ষের পাপ ঘুচতে পারে। চরণের মরণের খবর সব আমরা জানি। সেই চরণের ছেলে, তুই। এখন লোক নেওয়া আমার জরুরী নেই। তাই দরকার না থাকলেও তোকে কাজে নেবার কথা ভাবতে পারি। যদি আমার শর্তে রাজি থাকিস। তোর মা’র সঙ্গে কথা বলে সামনের মাস থেকে আসতে পারিস। আর একটা কথা, সবাই যেমন কাজ করে তোকেও তাই করতে হবে। আলাদা করে কারোর বেলায় কোন ছাড় নেই। পয়সার জন্যে সবাই আসে। একজনকে ছাড় দিলে আর একজন সেই সুযোগ নেবার কথা তুলে বসবে। সে ফায়দা আমি কাউকে দিতে রাজি নই।
মোহন গোড়ে যা বলল একদম ঠিক। পেটের জ্বালা মেটাবে না লেখাপড়া শিখবে! মায়ের কষ্ট অখিলের আর একদম সহ্য হয় না। সে যদি শোলা কারখানায় কাজ করে দু’দশ টাকা মায়ের হাতে দিতে পারে তো সংসারটা একটু গড়ায়। মা’কে আবার এ’কথা বললে মা কিছুতেই রাজি হবে না। সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করুক তা মা চায় না, সে তো মা আগে বলেই দিয়েছে। আবার মোহন গোড়ে এখন তাকে কাজে নিতে রাজি হয়েছে। এবার সে যদি যাবে না বলে দেয় তো পরে গেলে আর না-ও নিতে পারে। একবার মতি ঘুরে গেলে পরে আর রাজি করানো যাবে না।
রোজ ভোরে উঠে ছেলের জন্যে একটু ভাতেভাত করে নিজে এক টিফিনকারি পান্তা আর একটা পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা নিয়ে কাজে চলে যায় চপলা। পাড়ার আশেপাশে কাজ কম পায় সে। যেতে হয় অনেকটা দূরে। সেই কোদালে বা আমড়ের মাঠে। অতদূর থেকে দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার সময় নেই। জিরোনোর সময় পাবে না। আসা-যাওয়াতেই সময় কেটে যাবে। তাই যেখানে কাজ করে সেখানেই ফাঁকা মাঠে বাবলা গাছের ছায়ায় বসে এই পান্তা খেয়ে নেয়। আঁচলের খোঁটটা পুঁটলি করে মাথায় ঠেকিয়ে একটু চোখ বুজিয়ে থাকে। বিকেলে কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যের কাছাকাছি হয়ে যায়। রাত্রে একটা তরকারি আর একটু বেশি করে ভাত চাপিয়ে শান্তি করে মায়ে-পোয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়। যতদিন চাষের কাজ থাকে এইভাবেই চলে চপলার দিন-চক্র। অসময়ে লোকের বাড়ি তোলা-ঝিয়ের কাজ বা অন্য যা কাজ পায় তাই করে। থেমে থাকার আইন তার জীবনের জন্যে বরাদ্দ নয়। এমনই তার পেট-সামাল দেবার তাড়া যে ছেলেটা কি করছে না করছে তা দেখার সময় নেই। শুধু কথার কথা, না বললে নয় তাই বলে, “কিরে অখিল, ঠিকমত পড়াশোনা করছিস তো? স্কুল কামাই করছিস না তো? ইদানিং তো তোকে সকাল-সন্ধ্যে বই নিয়ে বসতে দেখি না। কখন পড়িস কি জানি। আমি বাড়ি থাকি না, দেখতেও পারি না কি করছিস না-করছিস।” এ ছাড়া তার কচি ছেলেটার ভাল-মন্দ কোন কিছুই তার আঁচলের মধ্যে ধরে রাখার সুযোগ নেই।
অখিল মায়ের কথায় কোন উত্তর দেয় না। সারাদিন সোলা কারখানায় খাটনি করে সন্ধ্যে আর শরীর সায় দেয় না। শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়েও যায়। মা রান্না করে খেতে ডাকলে খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে। আসলে অভ্যেস নেই তো এইভাবে এতটা টানা কাজ করার। সন্তানের এই অপরিচিত আচরণ চোখ এড়ায় না চপলার। মনের মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল বারবার তাকে ধাক্কা দেয়! হঠাৎ ছেলের কি হল যে এমন নিয়মভাঙা আচরণ করে চলেছে? প্রশ্ন নিয়ে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের পরশে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ছেলের কাছ থেকে মনমত উত্তর আসে না, “ও কিছু না, মা। এমনি।” বলে একটা দায়সারা উত্তর দিয়ে চুপ করে যায়। মনটা তাই উচাটন চপলার! কি যে করে বুঝে উঠতে পারে না। বাবা থাকলে দু’জনে আলোচনা করে মনটাকে থিতু করতে পারতো। কিন্তু সে উপায় তো নেই। কাজের জায়গায় যে সব মেয়ে ওর সঙ্গে কাজ করে তাদের কাছে দুঃখের কথা বলে। তারা তাদের মত কত যুক্তি দেয়। কিন্তু চপলার মন থিতু হয় না। একবার পাশের গ্রাম, দৌলতপুরের মাঠে রোয়া ধানের ঘাস নিড়োনোর কাজে যায় ও। সেখানে তাদের পাড়ার বিন্দুর মা ও কাজে লাগে। পয়সার অভাবে মেয়েকে স্কুলের দোর দেখায়নি বিন্দুর মা। মেয়ের শরীরের হাড়গোড় শোলার মোট বইবার মত শক্ত হতেই শোলা কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেয়। মনে মনে ভেবে নেয়, মেয়ের মুখের আদল, গায়ের রং চাঁছাছোলা আছে। দামড়ি মত হলেই বিয়ের বাজারে ফেলে দেবে। অনায়াসে বিকিয়ে যাবে। এমন দেখতে মেয়ের জন্যে ছেলেরা সবসময় ছোঁক ছোঁক করে। যে মেয়ের পেছনে ছোঁকছোঁকানির বহর বেশি সেই মেয়ের বাপ-মায়ের কপাল খুলে যায়। মেয়ের বিয়ের জন্যে তেমন পয়সা খরচা করতে লাগে না। মেয়ের পক্ষ যৌতুক-নগদ দিল-দিল, না-দিল না-দিল। এমনিই হিল্লে হয়ে যায়। বিয়ের জন্যে ঘটক-ঘটকির চক্করে পড়তে হয় না।
চপলা ছেলের কথা তুলতে বিন্দুর মা বলে, “কিগো চপলা-বউ, তুমি জানো না? তোমার ছেলে তো ওই মোহন গোড়ের সোলার কারখানায় কাজে যায়! কেন, ছেলে তোমাকে বলেনি? কেমন তারা ছেলে তোমার গো? আমার মেয়ে বিন্দুও মোহনের ওখানে কাজ করে। মেয়ে তোমার ছেলের গল্প করে বলে জানলুম। তোমার ছেলের মাথায় নাকি ভাল বুদ্ধি। মোহন তোমার ছেলের কাজে খুব খুশি। এত অল্প কয়েকদিনে এত সুন্দর কাজ ধরে নিতে নাকি আজ পর্যন্ত কোন কারিগর পারেনি। যেটা তোমার ছেলে পেরেছে। আর এতো ভাল ছেলে নাকি, সবাই ছুটি হয়ে বাড়ি চলে গেলেও তোমার ছেলে যায় না। এমন কাজ শিখে নেবার তাগিদ তার। তাতে হয় কি, আমার মেয়ের মত অন্য যারা কাজ করে তাদের অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। মালিক তোমার ছেলেকে দেখিয়ে এদের উপর খচর খচর করে, “ওই তো অখিল সবে কাজে ঢুকেছে। এখনো একমাস হয়নি। আর ক’দিন হলে মাস পূর্ণ হবে। এই নতুন ছেলেটা যদি একটু বেশি কাজ করে তো তোরা করতে পারবি না কেন? হতেই পারে ছুটির সময় হয়ে গেছে। একটু বেশি কাজ করলে কি তোদের গতর ক্ষয়ে যাবে? মালিক বাঁচলে তবে তো তোরা কাজ পাবি। বাঁচবি।” তোমার ছেলে এটা কিন্তু ঠিক কাজ করছে না।” বলো তো এখন কি ঝামেলায় পড়ে গেল আমার মেয়েরা ? ভালই ছিল ওরা। এখন তোমার ছেলে ঢুকে ওদের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। তুমি বউ, তোমার ছেলেকে বলে দিও, যেমন কাজের টাইম তেমনটি সময় মেনে যেন ও কাজ করে। কেন, বেশি কাজ করলে কি মোহন গোড়ে বেশি পয়সা দেবে? দেবে না। তাহলে বেশি কাজ করতে যাবে কেন লোকে? মান সরম খুইয়ে মেয়েরা পরের দোরে কাজে যাচ্ছে পয়সার জন্যে তো, না কি? ওই যে মালিকরা যেমন বলে, পয়সার দান-সত্র খুলে তারা বসে নেই যে কাজে ফাঁকি দিয়ে ‘সই-সই’ মানে সমান সমান পয়সা নিয়ে চলে যাবে! আর মজুরদের গতর বুঝি মাগনা? বেগার বেগার গতরের রস শুষে নেবে! না গো অখিলের মা, কথাগুলো তোমাকে বিঁধে বলছি না। তুমি আমি তো একই গোত্রের মানুষ। তোমার আমার বুকের জ্বালা কথায় কথায় উগরে দিলাম। তুমি যেন আবার গায়ে মেখে নিউনি। শুধু তোমার ছেলেকে বলতে বলছি, কেন ও এত মাগনা খাটতে যাবে। বুদ্ধি করে, গতর বাঁচিয়ে চললে তবে না বেশিদিন লড়াই চালাতে পারবে। না হলে যে অকালে বুড়িয়ে যেতে হবে।”
বিন্দুর মায়ের কাছে ছেলের কান্ডকারখানা শুনে চপলার মন যেন থম মেরে যায়! নিজের জীবনের জন্যে এতবড় একটা পরিবর্তনের কথা ছেলেটা ঠিক করে নিল! পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে গেল! একবারও মা’কে সে কথা জানাল না? তোকে তো বলেছিলাম বাবা, যত কষ্ট হোক আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব। পড়াশোনা করে তুই বড় হবি। তখন আর সারা জীবন ওই বাপ-ঠাকুর্দার মত চামড়া, জুতো, বেত আর লোকের বাড়ি জন মজুর খাটা- এইসব নিয়ে জীবন কাটাতে হবে না। তুই মায়ের কথা শুনলি না বাবা! বুঝেছি তুই নিজের ভালোর কথা না ভেবে মায়ের কষ্টের কথা ভেবেছিস। মায়ের এত কষ্ট তোর সহ্য হচ্ছে না। বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত যে মা ঘর থেকে বার হয়নি, সেই মা এখন লোকের বাড়ি ঝি-জন খাটছে সেটা তুই মেনে নিতে পারছিস না। কিন্তু বাবা-মায়ের তো এটা কর্তব্য বাবা, সন্তানদের মানুষ করা? সেই দায়িত্ব-কর্তব্য বাবা যখন বেঁচে নেই তখন মা’কে তো করতেই হবে। এটাই তো ভবিতব্য। আমি তো সেটাই করতে চেয়েছি বাবা! তাছাড়া তোর জীবনের জন্যে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত, তুই নিয়ে ফেললি, মা’কে জানাবার বোধ মনে জাগল না! জানি, তুই নিশ্চয়ই ভেবেছিস, একথা মা’কে বললে মা বাধা দেবে। তাই বলে তুই মা’কে জানাবি না! ঠিক আছে। মা’কে যেমন জানাসনি তেমন মা-ও তোর কাছে জানতে চাইবে না। যতক্ষণ না তুই মুখ ফুটে মা’কে বলছিস ততক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে খাপটি মেরে মা থাকবে তোর মুখ ফোটার অপেক্ষায়। আগ বাড়িয়ে জেনেও বা কি লাভ। এখন বাধা দিয়েও তো কোন কাজ হবে না। যা সিদ্ধান্ত তো তুই নিয়েই ফেলেছিস। আর পিছিয়ে আসার কোন রাস্তা নেই।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়েছে অখিল। মোহন গোড়ে যা টাকা দেবে বলেছিল তার থেকে একটু বেশি টাকা দিয়েছে। ওর কাজে খুশি হয়েই দিয়েছে। মাইনেটা দেবার সময় একথা তাকে বলেছে। অখিলও মনে মনে আনন্দ পেয়েছে, তার কাজের জন্যে সে পুরস্কৃত হয়েছে। তার জীবনের প্রথম আয়ের টাকার একটা পয়সা সে খরচ করবে না। সবটাই মায়ের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু কি বলে সে মা’কে টাকাটা দেবে? সে তো মায়ের সঙ্গে শঠতা করেছে। মা’কে না জানিয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগেছে পয়সা রোজগারের জন্যে। সংসারের একটু সুসার হবার জন্যে। মায়ের হাড়ভাঙা কষ্ট লাঘব করার জন্যে। মা’কে বলবে, আর তোমাকে লোকের বাড়ি ঝি খাটতে যেতে হবে না, মা। আমার বড়ই শরমে লাগে। এখন আমি রোজগার করছি আর তুমি টুকটাক কিছু করলে দু’জনের চলে যাবে। পরে আরও বেশি আয় করতে পারলে তখন তোমাকে বাড়ির বাইরে রোজগারের জন্যে বেরোতে দেব না আমি। তুমি দেখে নিও মা, আমি একদিন তোমার সংসারে আলো ফুটিয়ে তুলবই। সেই জেদ এখন অখিলের মনে সবমসয় কাজ করে চলে।[চব্বিশ]
স্টেশনের সেই লোকটার কথামত মেপে মেপে এগিয়ে সনাতনরা দুটো চা দোকানের মাঝের ফাঁকটায় কালো পলিথিন পর্দার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা ইতস্তত করে পর্দা সরিয়ে সটান ভেতরে চলে যাবে, না এই চা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করবে? কি করবে ঠিক করতে পারছিল না। ওদের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে দোকানদার বলল, “কি ব্যাপার, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন, কোথায় যাবেন? ওদিকে কিছু নেই। এদিকে আসুন। এদিকে আসুন। চা খাবেন তো দোকানের সামনে দাঁড়ান।” সঙ্গে সঙ্গে রতন দোকানদারটার কথা লুফে নিল, “হ্যাঁ, দিন তো আমাদের দু’কাপ চা আর দুটো করে টোস্ট বিস্কুট। চা-টা একটু কড়া করে বানাবেন।” বলে সে মনে মনে ভাবল,চা খেতে খেতে দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করে না হয় ছেনো স্যারের ডেরার কথা জানতে চাইলে ভাল হবে। ভাল মুখে তখন দোকানদারটা তাদের সঙ্গে কথা বলবে। না হলে শুকনো মুখে কে আর ভালো কথা বলতে চায়। ওই শুকনো কথাই ঠিকরে বার হবে। এবার ছেলেকে বলে,“নে বাবা, অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সেই সাত সকালে যা কচুড়ি ঘুঘনি আর চা খেয়েছিলাম। একটু চা বিস্কুট খেয়ে গলা ভেজাই।” চা খেতে খেতে রতন দোকানদারের কানের কাছে মুখটা বাড়িয়ে বলল,“দাদা, ছেনো স্যারের অফিসটা এইদিকে পড়বে? পর্দা সরিয়ে এই গলির ভেতরে না?” দোকানদারটা আরও দুটো খদ্দের ছাড়তে ব্যস্ত তখন। কোন কথা বলল না। রতনদেরও তখন চা খাওয়া শেষ হয়নি। যেই রতনরা চায়ের খুরি রাখার ভাঙা বালতিতে টং করে ছুঁড়ে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে সে ইশারা করে পর্দাটা সরিয়ে হাতছানি দিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একেবারে ছেনোর ডেরার দাবায় তুলে দিয়ে তড়কো পায়ে চলে এল। রতন পেছন ফিরে তাকে দেখতে গিয়ে দেখে সে একেবারে সেই কালো পর্দার কাছে পৌঁছে গেছে। ভাবছিল, লোকটাকে বলবে, ছোনো স্যারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার কথা। তা আর হল না। ভ্যাবাচ্যাকা মেরে দাবায় দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে ভেতর থেকে ছেনোর এক স্যাঙাৎ হাঁক পাড়ল, “কে, কি দরকার? নতুন মুরগি মনে হচ্ছে? বাইরে না, স্যার ভেতরে। ভেতরে এসো। এই যে আমাদের ছেনো স্যার। সিংহাসনে আসীন। কি আর্জি তোমার জানাও। মঞ্জুর হলে, মাল ঠেকাও, নাম্বার নিয়ে কেটে পড়ো। কোন রাখ- রাখ ঢাক-ঢাক ছেনো স্যারের কাছে নেই। সাফ-সাফ কথা ফটাফট কাজ। কাজ শেষ, ফুটে যাও।”
রতনদের সব কথা শুনে ক্ষেপে লাল হাতকাটা ছেনো মস্তান! চোখ পাকিয়ে বলে, “তোমাদের এত বড় সাহস, কোন হাভাতে গাঁ থেকে শহরে এসে আবার আমার অনুমতি পাওয়া পাবলিকের সঙ্গে মারপিট করতে যাও? সত্যিই তোমাদের কপাল ভালো, তারা আমার এখানে এসে কমপ্লেন করেনি। ওরা তো ওর ঠোঁট ফাটিয়েছে। আমার লোক গেলে তো হাত পা গুঁড়ো করে হসপিটালের সামনে ফেলে রেখে দিয়ে আসতো। তা এখানে এই প্রথম বুঝি? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। নিয়মকানুন জানে না বলেই লড়াই করার সাহস দেখিয়েছে। প্রথম বছর খাতায় নাম তোলার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা। তারপর প্রত্যেক বছর নম্বর নেবার জন্যে দু’হাজার করে দিতে হবে। না হলে পুজোয় এই শিয়ালদা স্টেশনে কারোর বসার আইন নেই। এখানে ছেনোর কথাই আইন। আর ছেনোর কথাই শেষ কথা। কোন পুলিশের বাপের সাহস নেই এখানে নাক গলায়। পুলিশের বাবার সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থা করা আছে। এই টাকা আমরা একা খাই না। ধাপে ধাপে নীচ থেকে মাথা পর্যন্ত সকলকে হিস্সা ঠেকিয়ে আমাদের খেতে হয়। তাই খরচা একটু বেশি পড়ে যায়। কিন্তু এতে আমাদের কিছু করার নেই।”
হাতকাটা ছেনো মস্তানের কথায় বোবা মেরে যায় রতন। বড় বড় চোখে অবাক হয়ে ছেনোর দিকে তাকিয়ে থাকে সনাতন! মনে মনে ভাবে, এরা মানুষ, না মানুষের পোষাকে একদল অমানুষ বিচরণ করছে। রতনের চোখ টলটলে জলে ভরে যায়, “বাবু আমি কোথায় পাবো অত টাকা! ওই টাকা যদি আমার থাকবে তো এত কষ্ট করে এখানে আসবো কেন দু’পায়সা রোজগার করতে? আমাদের বাপ ছেলেকে কেটে ফেললেও দু’হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। তার থেকে আবার আজকের পথ খরচ আর চা জলখাবার খেতে কিছু খরচ হয়ে গেছে। জানা ছিল না। তাহলে হয়তো ঘটিবাটি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে এখানে আসতাম। এবারটা মাপ করে দিন, স্যার। কথা দিচ্ছি, সামনের সালে এসে বাকি টাকা সমেত সবটাই মিটিয়ে দেব। বায়না না পাওয়া পর্যন্ত খাইদাই ইত্যাদির খরচা আছে। সেটুকু বাদ দিয়ে যা আছে তা না হয় দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে একটা নম্বর দিন স্যার। সেই সকাল সাতটা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে। কাজের কাজ কিছুই করতে পারলাম না। আপনি যদি দয়া করেন তো!”
রতনের কথা থামিয়ে আরও কড়া সুরে ছেনো বলে,“সব শালা শুয়োরের বাচ্চা প্রথম এসে এমন কাঁদুনি গায়। আগে ওই কাঁদুনিতে গলে গিয়ে অনেক ঠকেছি। আর না। শালা মাগির পো’রা বড় পার্টি ধরে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে পরের বছর আর এ চত্বর মাড়ায় না। সরাসরি সেই প্যান্ডেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফায়দা খেয়ে যাচ্ছে। আর আমরা আঙুল চুষছি। কোন প্যান্ডেলে কে যাচ্ছে তা তো আমাদের চৌকি দেওয়া কাজ নয়। এটা আমার এলাকা আমার কথাই শেষ কথা। অন্য এলাকায় আমার খবরদারি চলবে কেন। ঝাড় খেয়ে যেতে হবে না? অতএব যা হবে পাকাপাকি হবে। নগদানগদি হবে। ধারবাকির খপ্পরে আর ছেনো পড়ে না। তুমি বুড়ো, এই শর্তে যদি রাজি থাকো মাল ফেল, নাম্বার নাও। না তো এক্ষুণি কেটে পড়ো। সামনের বছর মাল জোগাড় করে আসবে নম্বর পাবে। নিয়ম তো এখন জেনে গেলে। অপেক্ষা করো একটা বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। বেশিরভাগ ধূর পার্টি তাই করে। তোমরাও করবে। যাও, ফোটো। আমার অনেক কাজ আছে। তোমার সঙ্গে ভ্যাজর ভ্যাজর করলে আমার চলবে না।”
হাতকাটা ছেনোর ডেরায় দরকষাকষি করতে করতে কখন সন্ধ্যা নেবে গেছে বুঝতে পারেনি রতন। বাইরে বেরিয়ে দেখে দিনমান গ্রাস করে নিয়েছে কোলকাতার বিজলি আলোগুলো। এখন ওরা কোথায় যাবে? আর তো বাড়ি ফেরার উপায় নেই। রাতটা এখানে কোথাও পার করতে হবে। রতনের মনে হল, ওই নম্বারওলা ঢাকিরা তো বাড়ি যাবে না। এখানে কোথাও থাকবে। দূর থেকে তক্কে থাকবে কোথায় ওরা রাত কাটায়। হাতকাটা ছেনোর থেকে নম্বর নিয়েছে নিজেদের বিকানোর জন্যে। রাত কাটাকানোর জন্যে আবার কোন ছেনো মস্তানের দয়ার খপ্পরে পড়তে হবে কি না কে জানে! স্টেশনের ওদিকে গিয়ে দেখল, এলাকা আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। যত রাত বাড়ছে স্টেশনের ভেতর চত্বরে সাধারণ যাত্রীর ভিড় পাতলা হচ্ছে। সেই পাতলা হওয়া স্টেশনের মেঝে চলে যাচ্ছে এলাকার যত ঠাঁইহীনদের দখলে। ঢাকি ঢোলিদের মিছিলও সেদিকে ধেয়ে চলেছে। রতন বলল,“চল সনাতন আগে স্টেশনের মেঝেয় আমরা সকালের মত দখল করি। তারপর দেখা যাক কি হয় না হয়। মনে হয় এখানে ছেনোর কারসাজি নেই। কেননা এখানে তাদের জাতের লোক ছাড়াও অন্য জাতের লোকের ভিড় কম নয়। এই স্টেশনের ছাউনি কত নিরাশ্রয় মানুষের রাতের আশ্রয়স্থল। ভিখিরি ভবঘুরে পাগল-ছাগল চোর-ছিনতাইবাজ, ফেরেপবাজ- সব জাতের মানুষ এই আশ্রয়স্থলে এসে একাকার হয়ে যায় যেন।
টিকিট ক্ষেত্রের বাইরে, যেখানে টিকিট কাউন্টার, টী-স্টল ইত্যাদি আছে তার বিশাল দৈত্যাকার ছাদের তলায় একটা চওড়া পিলারকে ঠেকনা নিয়ে বসে রতনরা। ওদের আগে আরও অনেকে ইতিমধ্যে জায়গা দখল করে বসে গেছে। রাত তখন দশটা। খিদেতে পেটটা মোচড় দিচ্ছে। ওর খিদে লেগেছে মানে ছেলেটারও তো তাই হবার কথা। উঠতি কাঁচা বয়সের ছেলে। ওদের খিদে আরও বেশি হবার কথা। কিন্তু এমন ছেলে, কোন সময় মুখফুটে বলবে না যে তার খিদে পেয়েছে। অথচ খেতে দিলে না করবে না। গোগ্রাসে খেয়ে নেবে। আসলে ও চায় না ওর কারণে ওর বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ুক। চাহিদাকে ঘাড় মুড়ে দমিয়ে রাখতে ওস্তাদ ছেলেটা! রতন বলল, “খোকা, আমি এখানে এগুলো পাহারা দিচ্ছি। এই নে পয়সা। তুই এক ছুটে গিয়ে দু’জনের জন্যে ওই সামনের দোকান থেকে তড়কা-রুটি নিয়ে চলে আয়। দেরি করবি না। তাহলে আমি আবার চিন্তায় পড়ে যাব। বিদেশ বিভুঁইয়ে পদে পদে বিপদ মুখিয়ে আছে হামলে পড়ার জন্যে। যা, যাবি আর আসবি। আর একটা জলের বোতল নিস।” একটু থেমে আবার বলে,“না, থাক। ওই জলের ট্যাপ দেখা যাচ্ছে। জলের কাজটা ওখান থেকেই সেরে নেব। আলতু ফালতু পয়সা খরচ করলে হবে না। অসময়ের জন্যে টাকা সাশ্রয় করে রাখা দরকার।”
রাত সাড়ে বারোটা। চোখে ঘুম নেই। আতঙ্ক যদি প্রতি মুহূর্তকে গ্রাস করে রাখে তো ঘুম আসবে কেমন করে ! একটা মেল ট্রেন বিকট একটা ভোঁ-ও দিয়ে ন’নাম্বার স্টেশনে এসে থামলো। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে স্টেশন চত্বরের এই বিশাল অংশ দখল করে রাখা রাতের আশ্রিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ! কাঁইমাই, হই হই, বাবা গো মেরো না উঠে যাচ্ছি বলে সমবেত একটা শব্দঝড় গোটা এলাকাকে ত্রস্ত করে তুলল। কাঁচা ঘুমভাঙা মানুষরা যে যার মত তল্পিতল্পা নিয়ে স্টেশনের বাইরে ফাঁকা জায়গাটায় এসে জড়ো হতে থাকে। তখনও পুলিশ তাদের দিকে আসেনি। আতঙ্কতাড়িত রতনরাও তখন ত্রাহি ত্রাহি রবে ছুটে বেরিয়ে পড়ে। দূর থেকে দেখে তাদের ওদিকে পুলিশ গেল না। যারা নিত্যদিনের আশ্রিত তারা কিন্তু ওই এলাকা থেকে উঠল না। ওরা এসবে অভিজ্ঞ। পুলিশ কোন দিক থেকে কতটা রাস্তা ফাঁকা করবে তা তাদের জানা। ওই ফাঁকা করা জায়গা মেল ট্রেনের যাত্রীদের যাওয়া আসার রাস্তা করে দেওয়া হল। রেল কোম্পানীর কাছে এই আশ্রয় নেওয়া বিনি পয়সার লোকেদের থেকে পয়সা দিয়ে আসা যাত্রীদের স্বচ্ছন্দটার দেখভাল করা জরুরী। তাই এই ব্যবস্থা। আনকোরা রতনদের তা অজানা। তাই তারা পলিয়ে যায়। আধ ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এলে রতন ফিরে আসে। কিন্তু অচিরেই যে তাদের ছেড়ে আসা শূন্য জায়গা বেদখল হয়ে যাবে তা তারা ভাবেনি। এটাই যে পাবলিক প্লেসের আদত, তা তারা জানবে কেমন করে! জায়গাটা তাদের কাছে বেশ নিরাপদ আর স্বস্তিদায়ক ছিল। কিন্তু উপায় আর কই। বাধ্য হয়ে অন্যদের মত সেই পুলিশে খালি করে দেওয়া জায়গার আপাত নিরাপদ এক পিলারের কোণ তারা নির্দিষ্ট করে থিতু হয়। বেঁজির মত মুখ উঁচু করে মাঝে মাঝে দূরে প্লাটফর্মের দিকে তাকায় আর বসে থাকে। যদি আবার মেলগাড়ী ঢোকে তো পুলিশের তাড়া খাওয়ার আগেই পালাতে হবে। গড়িমসি করলেই পুলিশের রুলের ঘা, খাবারের মেনুর মত হজম করে নিতে হবে। জেনেবুঝে রতন তা করতে যাবে কেন? প্লাটফর্মের বড় ঘড়ির কাঁটা তখন দুটো পাঁচে এসে টিক করল। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটা মেয়ের চিৎকার, হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে এল ওদের এদিকে! এদিকে টপকে আরও ওইদিকে। ওইদিকের লোকেরাও বেঁজির মত মাথা উচিঁয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলল চিৎকারের উৎস খোঁজে! রতন বলল,“ওই দেখ খোকা, ওদিকে একটা মেয়ে কেমন অসহায়ের মত চিৎকার করে যাচ্ছে, বাঁচাও বাঁচাও বলে। নিশ্চয়ই ওর কোন বিপদ হয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে একদল লোকের সমবেত হইচই শুরু হয়ে গেল। সনাতন বাপকে কিছু না বলে দৌড় দিল ওইদিকে। রতনের ‘খোকা-খোকা’ চিৎকারে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! রতন পড়েছে মহা ফাঁপরে। এত মালপত্র ফেলে ও যেতেও পারছে না ছেলেকে সামলাবার জন্যে। এইসব আপাত শান্ত চরিত্রের ছেলেদের নিয়ে বাপ-মায়ের যেন বিড়ম্বনার শেষ নেই। হঠাৎ কি দেখল না দেখল, মাথায় এমন পোকা কিলবিল করে উঠল যে তার বাড় সামলানো দায় ! তার এই উৎকন্ঠা অবশ্য বেশিক্ষণ জিইয়ে রাখতে দেয়নি সনাতন। একটু পরেই ফিরে আসে, “জানো বাবা, কি বিচ্ছিরি অবস্থা! একটা কম বয়সী ভবঘুরে মেয়ের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর একটা ভবঘুরে। মেয়েটা তাকে চায় না আর সে বেপরোয়া। পুলিশ এসে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে যায়।” সনাতন বাপকে গপ্প শুনিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলে কি হবে, রতনের রাগ কিন্তু কমে না,“তুই হুট করে আমাকে কিছু না বলে ওদিকে ছুট মারলি? মনে হচ্ছে যেন এইসব পরিবেশ পরিস্থিতির সবটাই তোর জানা? আমার নিষেধকে পাত্তাই দিলি না? যদি অঘটন কিছু ঘটে যায় তখন আমি পারবো সামলাতে? এইভাবে আমার কথা না শুনে এদিক ওদিক চলে যাস না। তোকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয়। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মায়ের কাছে কি কৈফিয়ৎ দেব? আমিও যে জীবনযুদ্ধে হেরে ভূত হয়ে যাবো।”
-ভুল হয়ে গেছে বাবা। আর এমন হবে না। তুমি দুঃখ পেও না। যা করব, তোমার পরামর্শ নিয়েই করব।
তাদের কাছাকাছি, একটু তফাতে। হঠাৎ একটা লোক উঠে পড়ে চোর চোর বলে একজনকে তাড়া করে ছুটছে, “আমার ব্যাগ ফেরত দে, ফেরত দে বলছি। না হলে তোর কপালে বহুৎ কষ্ট আছে !” অবস্থা বেগতিক দেখে চোরটা লোকটার ব্যাগ ফেলে ছুট মারে। আশেপাশে যত লোক ঘুমিয়ে বা শুয়ে ছিল সবাই তঠস্থ হয়ে উঠে বসে পড়ল। সনাতন বলল,“বাবা এখন বুঝতে পারছি, কেন তুমি সবসময় আমাদের ব্যাগ-প্যাঁটরা সামলে রাখতে বলো। এখন তো তাই দেখলাম। একটু অসতর্ক হলেই আমাদের জিনিস আর আমাদের থাকবে না। চোর ছিনতাইবাজদের দখলে চলে যাবে। কি আজব এইসব জায়গা! এখানে ভাগ্য বিড়ম্বনায় না এসে পড়লে জানাই হতো না এমন পৃথিবীর কথা ! এরকম আরও কত অজানা পৃথিবী আমাদের দেখতে হবে কে জানে!”
সারা রাত তো রতন-সনাতন দু’বাপবেটা দু’চোখ বুজিয়ে শরীরকে থিতু করতে পারল না। বড় ঘড়িতে চোখ পড়তে সনাতন দেখে ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে তিনটে থেকে হেলিয়ে তিনটে পঁয়ত্রিশের দিকে এগোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবাকে বলল,“বাবা একটু পরেই আজকের সূর্য জন্ম নেবে। আমাদের তো তৈরী হতে হবে। কখন পুলিশ তাড়া করবে জানি না। এইবেলা আমি দেখে আসব, কোথায় বাথরুম পায়খানা আছে? ভোররাতে সবাই ঘুমে মশগুল। এখন কোথাও ঠোক্কর না খেয়ে সবটা ঘুরেঘারে দেখে নেওয়া যাবে।” ঠিক সেইসময় সেই পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের ওপ্রান্ত থেকে একটা সুরেলা মেয়েলী কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে,“আমার রাত পোহালো …!” ধীরে ধীরে সুরটা মনে হচ্ছে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। থমকে গেল সনাতন। আহা, কি অপূর্ব কন্ঠ! দু-পা এগিয়ে দেখতে গেল কে গানটা গাইছে! সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা পেছন থেকে তার জামা টেনে ধরে বলল, “এগিয়ে গিয়ে দেখার কি আছে। ও তো এদিকেই আসছে। বস এখানে চুপচাপ!” বলে রতন নিজেও বসল এবং ছেলেকেও টেনে বসিয়ে দিল। এখন গোটা এলাকা শান্ত নিশ্চল। মনে হচ্ছে যেন চরাচর মোহিত হয়ে রয়েছে এই সুরসাগরে অবগাহন করে। একটা শতচ্ছিন্ন মলিন বেশের মেয়ে। সবাই তো একে পাগল বলবে। কিন্তু এ কি সত্যিই পাগল? পাগল আবার এত নিখুঁতভাবে গান গাইতে পারে নাকি! হয়তো পারে। তাই হয়তো এত অনিয়ম অনাচারের মলিনতার উপর এই সুর, শুদ্ধতার প্রলেপ দিয়ে চরাচরে সমতার বার্তা দিয়ে যায়। সনাতন বলে, “এবার যাই বাবা। দেখে আসি কোথায় বাথরুম পায়খানা আছে। এগুলো সেরে একেবারে আমরা এখানে থেকে বেরিয়ে যাব।” সঙ্গে সঙ্গে ওর মন ভেতর থেকে তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “কোথায় যাব আমরা?” তা তো তার জানা নেই ! তবে সে এটা নিশ্চিত করেছে যে এখান থেকে বেরিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না। লড়াই তো তার শেষ হয়নি। লড়াইয়ের ময়দান এখনো তাদের জন্যে উন্মুক্ত আছে। হারা বা জেতা, দুটোর কোনটা না দেখে তো তার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সে ফিরবে না।
পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বাথরুমের কাজ সেরে চানঘরে চানটান করে রতন সনাতন বেরিয়ে পড়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে। বড় ঘড়িতে তখন সকাল পাঁচটা। প্লাটফর্মের বাইরে বিশাল বিশাল সিঁড়ি নেমে গেছে সামনের বিশাল চাতালে পা দেবার জন্যে। যেখানে গতকাল সারাদিন তারা নিজেদের জায়গা
করে নেবার জন্যে লড়াই করে ব্যর্থ হয়। সিঁড়ির দু’ধাপ নেমে খানিক ডানদিক সরে নিরাপদ ধাপে এসে ওদের ঢাক-ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে বসে সনাতনরা। সিঁড়ির এই জায়গা দিয়ে যাতে বাধাহীন ওঠানামা করা যায় সেদিকটা খেয়াল রেখে মালপত্র রাখে ওরা। টিকিট কাউন্টারের ঘর, অনুসন্ধান অফিসঘর এই ধাপের সোজাসুজি। ফলে মানুষের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এখান দিয়ে নামার উপায় নেই। এখানে বসলে কাউকে নামা ওঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে হয় না। ফলে অকেজো সব্বাই এখানে এসে বসে অক্লেশে সময়কে গিলে খেতে পারে। আরও প্রায় ঘন্টাখানেক এখানে কাটিয়ে রতন বলল,“চল খোকা, এবার একটু চা জলখাবার খেয়ে নেওয়া যাক। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওদিকের চা-কচুরির দোকান খুলে গেছে।” বাবার কথামত সনাতন প্রস্তুত হচ্ছিল গোছগাছ করে সব জিনিসপত্র নিয়ে নেবার জন্যে। ঠিক সেইসময় পেছন থেকে একজনের কর্কশ গলার স্বর ঠিকরে এল তাদের দিকে, “ভেবেছিলে তোমাদের আমরা চিনতে পারব না! ছেনো স্যারের দলবল একবার যাকে দেখে, তার থোবড়া দ্বিতীয়বার দেখার দরকার করে না। সেই থোবড়া তাদের খুপরিতে পাকাপাকিভাবে গেঁথে যায়। উবে যাবার উপায় থাকে না। তোরা এখনো এখানে ঘুরঘুর করছিস? কালই তো ছেনো স্যার তোদের এলাকা ছাড়তে বলেছিল। আবার বুঝি জায়গা দখলের ধান্দা করছিস?” রতন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কথা ফোটার আগেই লোকটা বলল, “চোপ শালা! গাওনা গাওয়ার জায়গা পাওনা। এসব বাহানা জেনে বুঝে আমরা পাকা খয়ের হয়ে গেছি। ছেনো স্যার ঠিক বলেছে। বলেছে, আয়-তো একবার এলাকাটা টহল মেরে। কোন শালা পুঁটির বাচ্চা ধান্দা করার ফিকির করছে কি না? স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল! শালা বক-তপস্যির মত ওত পেতে আছিস! কখন সুযোগ পাবো। জায়গা দখল করব, এ্যাঁ? দশ গুনবো। এর মধ্যে এলাকা ছাড়া না হলে বাপ-বেটাকে কেলিয়ে কোমর ভেঙে ডাস্টবিনে ফেলে দেবো। কোন বাপের বেটা তোদের রক্ষা করতে আসবে না। যা শালা!” বলেই আরও গলার স্বর চড়িয়ে এক দুই করে কড় গুনতে শুরু করে লোকটা! আর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারা ছিল তারা ঠায় তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উপভোগ করছে কেমন তৎপরতায় তারা তামতুড়কি নিয়ে সরে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ওরা কত জঘন্য অপরাধে অপরাধী! মরমে যেন মরে যাচ্ছে সনাতন! তারা তো কারোর ক্ষতি করার জন্যে এখানে আসেনি। এখন এখানে বসেও নেই। অথচ কেমনভাবে তীব্র অপমানে বিধ্বস্ত হতে হচ্ছে তাদের। কাদের কাছে? না যারা ঘোষিত সমাজবিরোধী, তাদের কাছে। তার জীবনে এর চেয়ে খারাপ দিন আর আসবে বলে মনে হয় না। তাদের গ্রাম জীবনে অনেক অভাব অনটন আছে। পাশের বাড়ি বা পাড়ার কারোর সঙ্গে খিটিমিটি আছে। পরস্পরের মধ্যে মারামারির ঘটনাও আছে। আবার সমাধানও আছে। দুই বিবাদী পক্ষের মধ্যে মিলমিশেরও বিধান আছে। কিন্তু নিজের চরিত্রের এমন অবদমন সেখানে কোথাও নেই। মনের মধ্যে এমন সব কষ্টের বোঝা বইতে বইতে ওরা শিয়ালদা স্টেশন এলাকা ছেড়ে বাসস্টপের কাছে এসে দাঁড়ায়। বাবা বলেছিল, চা-জলখাবার খাবার কথা। কিন্তু দুর্বিসহ এই পরিস্থিতিতে সেই খাবার ইচ্ছে একদম উধাও হয়ে গেল। বাবাও আর সেকথা মুখে আনছে না। বাবা যেন একদম গুম হয়ে গেছে। মুখে স্বর চলে না। তার চেয়েও মনে হয় আরও বেশি আঘাত পেয়েছে বাবা। পাবেই তো। যে মানুষটা গ্রামে এত সম্মান পায়। অন্যের অন্যায়ের ন্যায্য বিচার দেবার ব্রতে ব্রতী অহরহ। সেই মানুষটাকে সমাজের একজন নিকৃষ্টতম অপরাধী প্রকাশ্য জনসমক্ষে ন্যায়ের বিধান দিয়ে অপমানে ভূতলে মিশিয়ে দেয়! তার মন কেমন করে শক্ত থাকবে। ভেঙে চুরমার তো হবেই।
বাসস্টপে কতক্ষণ ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারল না। বাবা ঢাক কাঁধে আর ও ব্যাগ-প্যাঁটরা কাঁধে। কাঁধ যে টনটন করছে। এবার বাবা বলল, “চল বাপ, বাবুঘাটের বাস ধরি। বাড়ি যাই। আমাদের মত লোকের জন্যে কোলকাতা নয় রে বাপ।” বাবার এই কথাগুলোর মধ্যে যেন মনঃস্তাপের ঝরণা ঝরে পড়ছিল। সনাতন এই ঝরণার জল মাটিতে ফেলতে চায় না। তাতে যে ধরিত্রি মায়ের অকল্যাণ হবে। তাই বাবার মনঃস্তাপ নিজে গলাধ্যকরণ করে বলল, “আমরা বাড়ি যাবো না বাবা। পুজোর এখনো দু’দিন বাকি। বাড়ি যাবার সময় পেরিয়ে যায়নি। চলো, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের দিকে এগোই।”
শিয়ালদহ থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে ওরা কলেজস্ট্রীটের দিকে এগোতে থাকে। এই রাস্তার কোথায় কি আছে তা কিন্তু বাপ-বেটা কারোর জানা নেই। অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে সময়কে ছেড়ে দিয়ে হাঁটা চলতে থাকে। চলতে চলতে সনাতন অন্য কথা ভাবতে থাকে। তারা যদি হেরে গিয়ে বাড়ি ফিরে যায় তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ওই শয়তান, অভয়! সনাতন এখন নিশ্চিত, অভয় সবকিছু জেনেবুঝেই তাদের এই গোলকধাঁধার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ও চেয়েছে এরা বিপদে পড়ুক। আর একেবারে নাস্তানাবুদ বিপর্যস্ত হয়ে গ্রামে ফিরে আসুক। অভয়ের এই দুর্বুদ্ধির কারণও এখন সনাতনের কাছে পরিস্কার। বাবা অতটা তলিয়ে হয়তো দেখছে না। তাই এই ভাবনা বাবার মধ্যে হয়তো কাজ করছে না। পাড়ার আটচালার বিচারক দলে তার বাবা। বরং বলা যায় বিচার-কর্তা। বিচারকদের অনেকে অনেক মন্তব্য করে আলোচনার সময়। কিন্তু বাবার কথাই শেষপর্যন্ত সেখানে সাব্যস্ত হয়। বিচারের ফল তো যে পক্ষে যাবে সে বা তারা খুশি হবে। আর বিপক্ষের লোক অখুশি তো হবেই। এই অখুশির লোকগুলোর কাছে বিচারকরা নিশ্চয়ই আদর পাবে না। মনে মনে তাদের উপর রাগ পোষণ করে থাকবে। এমন কোন বিচারে অভয়রা নিশ্চয়ই হারের দলে কোনসময় পড়েছে। সুযোগ বুঝে ও বিচারক কর্তা, রতন রুইদাসকে ফাঁপরে ফেলতে এমন ফন্দি এঁটেছে। সনাতনের এই ভাবনা অন্যথা হবার নয়। কিন্তু ও কিছুতেই অভয়ের কাছে তার বাবার মাথা নীচু করতে দেবে না। এক অর্থে হয়তো অভয় সাফল্য পেয়েছে তাদের এই অপদস্ত হওয়ার ঘটনায়। কিন্তু তা তো সে জানতে পারেনি। অসময়ে বাড়ি ফিরলে তখন সে নিশ্চিত হয়ে যাবে, তার চাতুরি কাজ দিয়েছে। কিন্তু তারা তো কারোর কোনদিন ক্ষতি করেনি এবং বাবা কোনদিন অন্যায় কোন কাজ করেনি। মা শীতলা এই অসময়ে নিশ্চয়ই তাদের পক্ষে থাকবে। এ’ব্যাপারে সনাতনের বিশ্বাস অটুট। হার মানার জন্যে সে লড়াইয়ের ময়দানে নামেনি। সাফল্যের মুখ তাকে দেখতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা চারমাথার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করে বাঁদিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে চলল। সাইনবোর্ড দেখে ওর মন পুলকে ভরে উঠল। কলেজস্ট্রীট এটা! এখানে তাহলে যাবতীয় বই পাওয়া যায়! বাঃ কি মজা। এই নামটা কতবার তার স্বপ্নে ঘোরাফেরা করেছে। তার সব পড়ার বই, গল্পের বই, বড়বড় সাহিত্যিকের গল্প উপন্যাসের বই- সব, সব এখানে মেলে। যা বই চাইবে সব পাবে। যদি কোনদিন বড় হয় তো সে এখানে আসবেই। রোজগার করে প্রাণ খুলে মনের মত বই কিনবে। একটু এগোতেই ডানদিকে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি! তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ! তারপর হেয়ার স্কুল! এই সবকটাই সে ইতিহাসের বইয়ে পড়েছে। আর সেই সাধনার ধন তার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে! হেয়ার স্কুলের গা ধরেই আবার কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল। ইতিহাসখ্যাত এই হাসপাতালে কত মানুষ গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আসে চিকিৎসা করাতে। বাবাকে দেখিয়ে বলল, “দেখো বাবা। এটা মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল। মানুষের বড় কোন অসুখ হলে এখানে সামান্য খরচে বা বিনা পয়সায় ভর্তি হওয়া যায়। গরিব মানুষরা সব এখানে আসে অসুখ সারাতে।
একটা বড় মোড়ে এসে দাঁড়ালো ওরা। কোথাও লেখা বউবাজার মোড়, কোথাও বি.বি.গাঙ্গুলী স্ট্রীট ! জায়গাটা একটু প্রশস্ত মত। সামনের দিকে একটু দূরে একটা পুজোর প্যান্ডেল। রতন বলল, “বাবা, খিদে পেয়েছে। অনেকটা পথ হেঁটে শরীর আনচান করছে। চলো না, ওই দিকটায় যাই। ওখানে ফুটপাথে লুচি ভাজা হচ্ছে। লুচি-চা একটু খেয়ে নিই।” রতন এখন ছেলের ইচ্ছেকে সম্বল করে মন্ত্রপুতের মত পথ চলছে। তেমন কিছু কথা না বলে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। টিফিন সেরে আবার সেই চারমাথার মোড়ের প্রশস্ত জায়গার একটা নিরাপদ কোনমোচড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পোঁটলার ভেতর থেকে মলিন জলের বোতলটা বার করে দু’জনেই ঢকঢক করে জল খেয়ে তেষ্টা মিটিয়ে ছাতিকে শান্ত করল। সনাতন বলল,“বাবা, ঢাকের কাঠি বার করো। এখানে আমরা ঢাক বাজাবো। তোমার সেরা বাজনা এখানে তুমি বাজাবে। সেই তালে সঙ্গত দিয়ে আমি কাঁশিতে তাল মেলাবো। প্রথমে আগমনির তালে তাল ঠুকবে। মা দূর্গার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে হবে সেই তাল ঠোকা। আমাদের থামা চলবে না বাবা। কখন আমরা থামব তা আমরা নিজেরা আগে থেকে বলতে পারব না। আমরা যে জাত ঢাকি তা এলাকার মানুষকে বুজিয়ে দিতে হবে। হ্যাঁ এটাও ঠিক, শহর কোলকাতার কত মানুষ। কত ধরণের মনের চলাচল তাদের। অনেকে হয়তো বিরক্তও হবে। আবার যারা বোঝার তারা নিশ্চয়ই বুঝবে। বুঝলেই কদর করবে।
কতক্ষণ যে তারা এই ঢাক বাজিয়ে চলেছে তার হিসেব নেই। কেননা তাদের কাছে তো কোন ঘড়ি নেই। কাঁসর বাজাতে বাজাতে সনাতনের আঙুলে ফোসকা পড়ে তা আবার গেলে গিয়ে জ্বালা করতে শুরু করেছে। তবু সে থামার পাত্র নয়। একটা আঙুলের গলাসি দমে যায় তো আর একটা। তারপর আর একটা। একটার পর একটা তার অঙ্গ হার মানলেও মনকে কিছুতেই হারতে দিতে চায় না সে। বাবা তো পেশাদার মানুষ। সে জানে সারাদিন বাজাতে বললে বাবা না থেমেই বাজিয়ে যাবে। কিন্তু সে তো একদম আনকোরা। সবে বাবার কাছে কাঁসরের তালজ্ঞান শিখেছে। ঢাকের তালও শিখছে। পুরো শেখা শিখে উঠতে পারেনি। আরও সময় লাগবে।
একটা সময় হঠাৎ সাদা ধপধপে ট্রাউজার পাঞ্জাবী পরা তিনজন বাবুলোক পাশ থেকে এসে তাদের ঘিরে ধরে! সনাতনরা তো সাধনার নিষ্ঠায় নিজেদের তাল লয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। সামনে এসে কেউ দাঁড়ালে হয়তো তাদের দৃষ্টিগোচর হত। কিন্তু পাশ দিয়ে এসে অকস্মাৎ এমনভাবে দাঁড়াল, সনাতনরা দু’জনেই চমকে ওঠে! থেমে যায় তাদের বাজনা। একজন বাবু
বলল,“ঠিক আছে থামো থামো। অনেকক্ষণ ধরে তোমরা ঢাক বাজাচ্ছো। এবার একটু জিরোও। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সেই বেলা ন’টা থেকে তোমরা ঢাক বাজাচ্ছো। আমরা লক্ষ্য করছি। এতক্ষণ টানা কেউ ঢাক বাজাতে পারে তা তো আমাদের জানা ছিল না। তারপর ঢাকের তাল যে এত সুরেলা এবং স্যুদিং হতে পারে তাও তো আমাদের কল্পনার বাইরে। আমরা তো জানি ঢাক মানে শুধু ধ্যান তারাক্কা নাচের বাজনা আর আরতির বাজনা। এ
বাজনা কিসের বাজনা?” বাবুর প্রশ্নের উত্তরে রতন বিনয়ের সঙ্গে বলল,“বাবু এটা আগমনির বাজনা। মা দশভূজার আগমনকে স্বাগত জানাতে এই প্রার্থনার তাল। একমাত্র মা মর্ত্যে আসার মুহূর্তে এই বাজনা বাজানো যায়। অন্যসময় কেউ বাজায় না। যারা এই তাল বাজাতে জানে, এই ব্যাপারে তারা সতর্ক। যখন তখন বাজাবে না। এই সময়টা তো সবায়ের হয়ে ওঠে না। ঢাকিরাও সবসময় মুডে থাকে না। তাই হয়তো আপনাদের শোনা হয়ে ওঠেনি।” আর এক বাবু বলল,“তা তোমরা হঠাৎ এখানে ফুটে দাঁড়িয়ে বাজাতে এলে কেন? এখানে তো কেউ কোনদিন এভাবে ঢাক বাজাতে আসে না? আমাদের ওই হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের দূর্গা পূজা এই বছর পঁচাত্তরে পড়ল। আবাল্য আমরা কোনদিন তো দেখিনি, আমাদের আগের সিনিয়ররাও কেউ কোনদিন এখানে এভাবে বাজনা বাজাতে দেখেছে বলে মনে হয় না। আমরা তো তৈরী হচ্ছিলাম শিয়ালদা স্টেশনের ঢাকের ঠেকে যাবো বলে। ওখান থেকেই বরাবর আমরা ঢাকি বায়না করে আনি। তা তোমরা কোথা থেকে আসছো?”
-আমরা বাবু সেই ফলতা থানা এলাকা থেকে আসছি। এখানে এসে এই ফুটপাথে ঢাক বাজাবার জন্যে সেই সুদূর গাঁ থেকে আসিনি। এসেছিলাম আপনারা যেখান থেকে ঢাক বায়না করেন সেখানে। বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে রতনের। আর বলতে পারল না সেই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সনাতন শিয়ালদায় তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কান্ডগুলো সবিস্তারে বলতে, বাবুরা অবাক!
এক বাবু বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, “ওখানে এই গরিবগুর্বো মানুষদের নিয়ে সমাজবিরোধীরা এইভাবে নোংরামো করে? ঠিকই তো, এদের সঙ্গে পুলিশের এক শ্রেণীর অসাধু লোক যুক্ত না থাকলে এভাবে এরা ফুলেফেঁপে উঠতে পারে না। অথচ দেখো, আমরা প্রত্যেক বছর যাচ্ছি ঢাক-ঢোল বায়না করছি, পুজো করছি। মনে হচ্ছে যেন সবই কেমন স্বচ্ছ সরলরেখায় বয়ে চলেছে জীবনস্রোত! বাইরের এই স্বচ্ছতার অন্তরালে যে এমন নির্মম অস্বচ্ছ কালো আর এক বিবর্ণ স্রোত বয়ে চলেছে তা ক’জনেরই বা নজর কাড়ে। এরা এইভাবে এখানে এসে না পড়লে তো সমাজের এই মলিন দিকটা আমাদের জানা হয়ে উঠতো না।” এই বাবুর বলা শেষে প্রথম বাবু বলল,“তা তোমরা কি আমাদের হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজোর বাজনা বাজানোর বায়না নেবে? যদি নাও তো বলো। তোমাদেরকেই এ বছর আমরা নিয়ে যাব। শিয়ালদাতে যাব না।”
-আমরা তো বাবু বায়না পাবার জন্যেই মায়ের সাধনা করে চলেছিলাম। তা, মা আমাদের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে সাড়া দিয়েছে। আপনারা তো বাবু মায়ের
মাধ্যম হয়ে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। মায়ের আদেশ ফিরিয়ে দেবার স্পর্ধা আমাদের নেই বাবু।
-তুমি তো বেশ ভাল কথা বলতে পারো হে! পেটে কিছু না থাকলে এই জ্ঞান জন্মায় না। যাই হোক, তাহলে আসল কথাটা সেরে নেওয়া যাক। আমরা পাঁচদিনের জন্যে তোমাদের পাঁচ হাজার টাকা দেবো। ষষ্ঠী থেকে দশমী। আজকের পঞ্চমী। আজকের দিনের জন্যে তোমাদের কোন টাকা পয়সা দেবার অনুমতি আমাদের নেই। আর আমাদের দর্শক এবং পাড়ার অধিবাসীদের যদি তোমরা তোমাদের হাতযশে মাতিয়ে দিতে পারো তো যথেষ্ট পরিমান বকশিশ পড়েই রইল তোমাদের জন্যে। ওটা তোমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব পাওনা। ওখানে কেউ ভাগ বসাতে যাবে না। তবে আজকের থাকা খাওয়াটা তোমরা আমাদের থেকে পাবে। কোন অসুবিধা হবে না। আর পারলে সন্ধ্যের দিকে একটু আগমনির বাজনা শুনিয়ো আমাদের পাড়ার মানুষজনের। মনে হচ্ছে তোমাদের হাত ধরে আমাদের এবারের পুজো ভালই হবে। এবার কাজের জায়গায় তোমাদের দক্ষতা দেখতে চাই।[ পঁচিশ ]
সময়ের সঙ্গে সখ্যতা করতে করতে জীবনযুদ্ধে দাঁড় টেনে অখিলও এগিয়ে চলেছে। মায়ের পুরোপুরি হাতেধরা হয়ে গেছে ও। আর মা’কে লোকের বাড়ি কাজে যেতে দেয় না। ওর হাত ধরে মোহন গোড়ের ব্যবসা এখন রমরমা। মোহন গোড়ে, ওর কারবার পরিচালনায় অনেকটাই অখিলের ওপর নির্ভর করে। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে একদিন মোহন বলল,“অখিল তুই এক কাজ কর। কতদিন আর আমার কারবারের মুখের দিকে চেয়ে তুই দিন কাটাবি। আমারও তো বয়স হচ্ছে। আমার সঙ্গে তুইও নতুন একটা ব্যবসা খুলে বস। আমার, তোর- দুটো কারবার দেখভাল কর। তাহলে আমরা দু’জনেই দুই কারবারের মালিক হবো। অথচ দু’জনে একসাথে কাজ করবো। বুঝতে পারলি না তো আমার কথা? শোন তবে তোকে খুলে বলি। আমার কারখানার বাইরে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে বসে যে মেয়েরা শোলার কাজ করতে পারে তা তো আমার বুদ্ধিতে জন্মায়নি। আমরা শোলা তাদের ঘরে ঘরে বিনে পয়সায় সাপ্লাই দিয়ে আসি আর মেয়েরা বাড়িতে বসে ড্রয়ইং মত কাজ করে। যেমন কাজ তেমন মজুরী পায় তারা। সবটাই তোর মাথার ওই খুপরির কেরামতি। তোর জন্যেই আমার কারবারের এই বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু আমি আর এতবড় কারবার সামলাতে পারছি না। বুড়ো হয়েছি। কবে হঠাৎ যদি টপকে যাই ! তখন এত লোক সব জলে পড়ে হাবুডুবু খাবে। তাই বলি সময় থাকতে কারখানার বাইরের এই কারবারটা তুই স্বাধীনভাবে দেখাশোনা কর। কারবারের এই অংশের মালিক তুই হয়ে যা। আমি তোকে লিখে দিচ্ছি। বড়বাজার থেকে আমার সঙ্গে তোরও শোলা আসবে। তুই তোরটা নিয়ে বাড়িতে গুদাম করবি। সেখান থেকে কারিগর দিয়ে কাজ করে আবার আমার চালানের সঙ্গে না হয় তোর মালটাও যাবে। পরে আস্তে আস্তে তুই নিজে চালান করে মাল ডেলিভারী করবি।”
মোহন গোড়ের এই সিদ্ধান্ত অখিলের ভাগ্যের চলন নতুন অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্যের চাকা উত্তরোত্তর গড়গড়িয়ে এগোতে থাকে। নিজের পাড়া টপকে আশেপাশের গ্রামগুলোতেও বাড়িয়ে দেয় তার কারবারের বিস্তার। বছর দুয়েকের মধ্যে নিজের কারবারের নামে চালান কেটে মাল ডেলিভারীও করতে থাকে। তবে হ্যাঁ, তার কারবারের গুরু, মোহন গোড়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা পূর্ণ মাত্রায় বজায় থাকে। নিজের কারবারের সাথে সাথে গুরুর কারবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা সে কোনদিন ভাবেনি। ভাবলে তার দিক থেকে কোন বাধা ছিল না। বা মোহন গোড়ের কিছু করার ছিল না। কিন্তু সে তা করেনি। করলে গুরুর কারবারটাই বন্ধ হয়ে যেত। ও দুই জগতের একচ্ছত্রপতি মালিক বনে যেতে পারতো। কেননা মোহনের কোন ছেলে নেই। একটা মাত্র মেয়ে। বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেছে তার। বাইরের অজানা লোকেরা জানে অখিলই মোহনের ছেলে। কেননা গুরু লোকের কাছে কথায় কথায় অখিলকে তার ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাতে অবশ্য অখিলের কোন আপত্তি নেই। নিজের সন্তান জ্ঞানেই তো গুরু তাকে কারবার শিখিয়েছে, বড় করেছে। অখিলের মা চপলাও তাকে বলেছে,“যে মানুষটা তোর জীবনের আলো দেখিয়ে এগিয়ে দিয়েছে, তাকে কোনদিন পেছনে ফেলে যাসনি বাবা। তাহলে মহাকাল কোনদিন তোর কোন ক্ষতি করার জন্যে পিছু নেবে না। তুই মসৃণভাবে তোর পথে এগিয়ে যেতে পারবি।”
নিজের প্রচেষ্টায় নিজের রোজগারে দু’কামরা ঘর-বারান্দা নিয়ে অখিলের পাকা বাড়ি। স্বচ্ছলভাবেই মা-ছেলের দিন চলে যায়। পাড়ায়, বাইরের পাড়ায় মেয়েদের ঘরে বসে শোলার কাজ পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে অখিল। রোজগারের একটা পথ পেয়েছে মেয়েরা। অবসর সময় আর তাদের হেলায় কাটিয়ে দিতে হচ্ছে না। সেই পটভূমে পাড়ায় বে-পাড়ায় নারী মহলে এখন অখিলের নামডাক ভালই। একটা রেষারেষি ভাবও আছে এই মহলে, কে কেমনভাবে অখিলের কত কাছের লোক হতে পারে। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে যদি বাড়তি কাজ আদায় করে নিতে পারে। রোজগারটা তাহলে একটু বেশি হয়। অখিল এখন এদের আশা-ভরসার স্থল। তাই যে যার কোলে ঝোল টানার তাগিদেই এই পারস্পরিক প্রচেষ্টা।
মেয়ে মহলের এই আলোড়ন অখিল স্বজ্ঞানেই উপভোগ করে। পছন্দও করে। যত এরা তাকে বিষয় করে চর্চা করবে ততই তার নামডাক পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে। নিয়মের হাত ধরে তার আয়ের রাস্তাও বাড়তে থাকবে। অখিলের এখন আশেপাশের পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত। শোলার গাঁট পাঠানো আবার তা থেকে তৈরী টোপর, ঠাকুরের গয়না ডেলিভারি নিয়ে আসা। হিসেব করে কারিগরদের মজুরি দেওয়া। এতসব কাজ সুষ্ঠভাবে করতে গেলে ছুটোছুটি তো তাকে করতেই হবে। সাইকেল নিয়ে পোঁও পোঁও করে ঘুরে বেড়ানো তার নৈমিত্যিক কাজের মধ্যে পড়ে। অনেক কারিগর আবার কাজ করে দেবার শর্তে আগাম দাদনও নিয়ে নেয়। তবে অখিল তাদের কাছ থেকে সুদটুদ দাবি করে না। সেও তো একদিন এমন অভাবি ছিল। তাই সেই জ্বালার সঙ্গে সে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। কোন্ পরিস্থিতি মানুষকে কোন্ সর্বনাশা পাঁকে চুবিয়ে দেবে তা কেউ বলতে পারে না।
সবে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ির ঘর সংসার সামলাচ্ছে মন্ডল পাড়ায় তার কারিগর, ভীষ্ম মন্ডলের বউ, রেখা। কতদিন হবে বিয়ে, এগারো কি বারো মাস। তার মধ্যে অখিলের সঙ্গে কাজের সুবাদে আলাপ হয়তো মাস ছয়েক। ভীষ্ম, ওই সাইকেল ভ্যান টানে আর চাষের সময় জন খেটে খায়। ভরা শ্রাবণের ধারায় এলাকার পুকুর ঘাট ভরভরন্ত। উঁচু ডাঙা জায়গাগুলো যেটুকু জেগে আছে এই যা। সকাল সাতটায় চাষের কাজে হাজিরা দিতে হবে। ভোর ভোর উঠে তাই রোজই ঘুমচোখ কচলাতে কচলাতে বাঁশঝাড়ে বাহ্যে ফিরতে যায় ভীষ্ম। ভীষ্মর মত পাড়ার অনেক বেটাছেলে যায়। এটাই এইসব গ্রাম পাড়া এলাকার দস্তুর। বাহ্যে বসে হঠাৎ পেছনে ফোঁস ফোঁস শব্দে চমকে ওঠে ভীষ্ম! গ্রামের ছেলে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি কিসের শব্দ ওটা! ধড়ফড়িয়ে উঠে পালাতে গিয়ে কাল কেউটের লেজে পা পড়তেই একটা মোক্ষম ছোবল এসে পড়ে ওর উরুর কাছে! চিৎকার করতে করতে ভীষ্ম পাড়ায় ছুটে আসে। কিন্তু সময়টা তো চরাচর আড়গোড় ভাঙার সময়। এত ভোরে মানুষ ঘুম চটকায় উঠে নিজেকে সামলে নিতে নিতেই সেই ফাঁকে ভোরের সূর্য আরও অনেকটা পথ এগিয়ে যায়। লোক ডাকাডাকি করে ভীষ্মরই সাইকেল ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। আজকাল মানুষ ঠকে ঠকে আর ওঝার খপ্পরে পড়া থেকে সাবধান হয়ে গেছে। বর্ষা এলেই গ্রামেগঞ্জে নানা বিষধর সাপের উপদ্রবে মানুষ অতীষ্ঠ। তাই ধাক্কা খেয়ে মানুষ অভিজ্ঞও হয়ে গেছে কিভাবে তাকে মোকাবিলা করে নিজেদের বাঁচানো যায়। ফলে সাপে কেটে মৃত্যুর হার আগের থেকে কিছুটা হলেও কমেছে। তবে ডাক্তাররা ভীষ্মকে রেখার সংসারে ফেরত পাঠাতে পারল না। কাল কেউটের বিষ যে সাংঘাতিক শক্তিধর। ডাক্তারদের, ওর সঙ্গে লড়াই করার সময় বড্ড কম দেয়। ছোবল মারার সঙ্গে সঙ্গে তুরন্ত হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে পৌঁছতে পারলে তবে ডাক্তাররা লড়াই করে জিততে পারে। প্রায় টানা দু’সপ্তা হাসপাতালে কেউটের বিষের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অবশেষে ভীষ্ম নীল হয়ে যায়! অকাল বিধবা হয়ে পড়ে যুবতী-বধু, রেখা। স্বামীর সৎকার, তারপর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ। এত খরচ রেখা পাবে কোথা থেকে! বৃদ্ধ শ্বশুর বিছানায় পড়ে। আর উঠতে পারবে না। গামুইদের কাঁধে চেপে একেবারে চেলাকাঠে ওঠার ভবিতব্য তার। কোমর নুইয়ে যতটা পারে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য করে যায় শাশুড়ী। ভীষ্মই ছিল তাদের সংসার-রথের সারথি। কত রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল ও রেখাকে নিয়ে।
প্রথম দেখাতেই ও যেন রেখার প্রেমে পড়ে গেছিল! ও সাইকেল ভ্যানে করে আলাদাতপুর থেকে কাঠের গুঁড়ি নিয়ে উলকুনী গ্রাম হয়ে যাবে ফতেপুরে কাঠ চেরাই কাখানায়। মধ্য দুপুরের বৈশাখী সূর্য পুড়িয়ে যেন খাক করে দিচ্ছিল চরাচর! আলাদাতপুর পেরিয়ে উলকুনী গ্রামের রাস্তায় পড়ে তেমাথানী মোড়ে ওর কাঠ বোঝাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। তেষ্টাতে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। আর টানতে পারছিল না গাড়ি। একটু তফাতে একটা কঞ্চির ছিটেবেড়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। একটা মেয়ে মাটির কলসি কাঁখে জল নিয়ে আসছিল। মেয়েটা কাছে আসতেই চোখ যেন দাঁড়িয়ে যায় ভীষ্মর। আস্তে আস্তে সে কাঁখের কলসিটা নিয়ে ওই মলিন আস্তানার ভেতর চলে যায়। ভীষ্ম থমকে থাকে সেখানে! ছাতিফাটা তেষ্টা যেন মুহূর্তে উবে গিয়ে শীতল হয়ে যায় ভেতরটা। এই ঘরে এত অপরূপা একটা কন্যার বাস! ঘরটার বাইরে একটু তফাতে তিন ঝিঁকের মাটির উনুনে ধান সেদ্ধ করছে একটা বেওয়া মেয়েমানুষ। মনে হয় লোকের ধান সেদ্ধ-শুকনো করে ভাঙিয়ে চাল করে ফেরত দেয়, যার ধান তাদের। আর ভাঙানো ধান থেকে কুলোয় পাছড়ে তুঁষ আর খুঁদ আলাদা করে সেই খুঁদ আর ধান ভাঙানোর বানি, অর্থাৎ মজুরি চালের মালিকের কাছ থেকে যা পায় তাই দিয়ে এদের সংসার চলে। ভীষ্ম নিশ্চিত ইনি এই উর্বশী রমণীর মা। কাছে গিয়ে বলল,“একটু ঠান্ডা জল খাওয়াবেন মা? তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আর ভ্যান টানতে পারছি না।” উত্তরে ব্যস্ত হয়ে মহিলা বলল,“একটু বসো বাবা। মেয়েটা জল আনতে গেছে সেই হালদার পাড়ায়। অনেকটা দূর। অনেকক্ষণ গেছে। আসার সময় হয়েছে। ও এলেই তোমাকে টিউকলের ঠান্ডা জল দিচ্ছি।” সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্ম বলল, “একটা মেয়ে কাঁখে এক কলসি জল নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ও কি তোমার মেয়ে, মা?” ভীষ্মর কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে মা বলল,“রেখা তুই এসেছিস? তবে এক গেলাস জল আর দুটো নকুলদানা হাতে নিয়ে ওই খোকাটাকে দে তো মা! তেষ্টায় বেচারার ছাতি ফেটে যাচ্ছে! আহা রে, কাঠফাটা গরমে বড় কষ্ট। দে মা তাড়াতাড়ি। তেষ্টারে তুষ্ট করলে পুণ্য হয় রে মা। সেই পুণ্যি জলে যায় না। অনেক সময় উপরওয়ালা ভেক ধরে তোর কাছে আসতে পারে। তোর মন পরীক্ষা করতে। সে পরীক্ষায় পাশ করলে তোর আর পেছন ফিরে তাকাতে হবেনে রে মা। তোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। ভাল পাত্রে বিয়ে তোর হবেই হবে। এই কথাটা বলে রাখলুম।”
একটা মোটা কাঁসার গ্লাসে জল আর ছোট্ট ঠাকুরপুজোর মতো রেকাবে গড়াগড়ি খাওয়া কয়েকটা নকুলদানা নিয়ে মেয়েটা ভীষ্মর সামনে এসে দাঁড়ালো! এক আসমান বিস্ময় নিয়ে জলের গ্লাসটা নেবার জন্যে হাতটা বাড়ালো ভীষ্ম! কিন্তু সেই গ্লাস পর্যন্ত তার হাত যেন পৌঁছাচ্ছে না। অথচ তার কত যুগ আগে যেন তার চোখ ছুঁয়ে গেছে রেখার চোখের অন্তরে। দু’জনের চোখ অন্য কোন দিশায় যেন আর সরছে না। দুজনের দুটো হাতও সেই দূরত্বে অপেক্ষায়। দুটো হাতের দূরত্ব হয়তো এক আঙুলও হবে না, ইঞ্চিকাঠি দিয়ে মাপলে। তবু সেই ফারাক যেন মনে হচ্ছে কত যোজন! মায়ের কথায় থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে দু’প্রান্তের দুটো হাত,“কিরে মা দিলি বেচারাকে এক আঁজলা জল? খাও বাবা খাও। আত্মার জ্বলন দমন করো। মা শীতলা তৃপ্ত হোক।”
সেদিনের পর থেকে ভীষ্ম যখনই ওই রাস্তা মাড়ায় তখনই তেষ্টার তাড়া থাকুক বা না থাকুক একবার থমকে যায় রেখার মায়ের বাড়ি,“কই গো মা ঠাকরুণ, কি করছো। ভাল আছো তো? সব খবর কুশল তো? বাড়িতে কাউকে দেখছি না কেন মা? সব গেল কোথায়?” এ ছেলে যে রেখার খোঁজ করছে তা কে না বোঝে। রেখার মা তো আলবাৎ বুঝবে, “সে মেয়ে এখন ঘরে নেই গো বাপ। হিমে হালদারের জমিতে মুগ কড়াই তুলতে গেছে। সেই কোন ভোর থাকতে গেছে। এখন বেলা মাথায় ওঠার টাইম হয়ে এলো। এত বেলায় তো কড়াই তোলা যায় না। পাকা কড়াইয়ের খোসা এখন মড়মড়ে হয়ে গেছে। ছিঁড়তে গেলেই হাতের মধ্যেই খোসা ফেটে চৌচির হয়ে সব কড়াই ভুঁয়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। হয়তো হিমে হালদারের বাড়িতে আছে। কড়াই খোড়া মেপে, সব মাপ বুঝিয়ে দিয়ে তবে না আসতে হবে। এক খোড়া কড়াই তোলার মজুরী পাঁচ টাকা। তাও আবার বলে কি না, খোড়া চূড়া মাপ করে দিতে হবে। তাতে আমি সায় দিইনি। হ্যাঁ খোড়ার মুখ বরাবর থেকে একটু উঁচুর দিকে ঢাল করে দিতে পারি। তা না আবার পাহাড়-মাথা চায়। কত্তো সাধ। মেয়েকে বলেছিলুম, অত কষ্ট করে তাহলে তোকে কড়াই তুলতে হবে নে। গতর খুইয়ে পয়সা পাব না তো কি হবে অত খেটে? তবে রাজি হয় হিমে হালদার। তোমাদের ওদিকে ক’পয়সা দেয় গো বাবা, এক খোড়ায়? আমাদের এদিকের মালিকদের যেন বড্ড হাত টান। কাজের লোকেদের জন্যে হাত উপুড় করতে এদের কি যে কষ্ট হয় তা বুঝে উঠতে পারিনি।”
ওই টুকটুকে মেয়েটা রোদে পুড়ে মুগ কড়াই তুললে ওর নরম শরীরের চামড়া তো ট্যান হয়ে খয়ের হয়ে যাবে? কেউ তখন ওর রূপে আর মাতাল হবে না। ভাবনাটা নিজের ভেতর তোলপাড় করে উঠতেই ব্যস্ত হয়ে ভীষ্ম বলল, “ও মা, মেয়েটাকে তুমি এত খাটিও না। আজকাল বড্ড জ্বালাপোড়া রোদ। ও কি আমাদের মত পুরুষ মানুষ, যে রোদের সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখবে? ওর শরীরের জেল্লা পাংসে হয়ে গেলে তোমার যেমন কষ্ট হবে, তেমন আমারও ভীষণ মন খারাপ হয়ে যাবে।”
-কি করবো বলো বাপ। সংসারে আলগা পয়সাও তো দরকার। না খাটলে কোথায় পাব। কে দেবে। বাপটা তো, সেই মেয়েটার যখন চার বছর বয়স, বউ-মেয়েকে অথৈ জলে ভাসিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল। কত খোঁজাখুঁজি করলাম। জনসমুদ্রে জাল ফেলে, পোলো মেরে কত হাঁচালাম। পেলাম না। মানুষটা কত ভাল ছিল। আমাদের দুই মা-মেয়েকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতো। সেবার কাজে যাবার সময় বলল, “রেখার মা, খিদিরপুরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ পেয়েছি। গ্রামে কখন কাজ হয় কখন হয় না। শহরে সবসময় কত অট্টালিকা হচ্ছে। ওখানে জোগাড়ের কাজের অভাব নেই। করতে পারলেই হবে। এই যাচ্ছি, মাস খানেক পর বাড়ি ফিরব। এক মাসের সংসার খরচের টাকা রেখে গেছি। চিন্তা করবে না আমার জন্যে। মেয়েকে নিয়ে তুমি সাবধানে থেকো।” বারো বছর পর পাড়ার মেয়েরা ধরে বেঁধে মা কালীর থানে নিয়ে
গিয়ে আমার হাতের শাঁখা ভেঙে, মাথার সিঁদুর মুছে থান পরিয়ে দিল। সেই যে থান ধরলাম এখনো তাই পরণে জ্বলজ্বল করছে। তবু কেন জানিনা বাবা, আমার মন যেন সায় দেয় না। মনে হয় এই বুঝি রেখার বাপ এসে ডাকল, “রেখার মা, কোথায় গো। এক গেলাস ঠান্ডা জল দও তো! গগনভেদি তেজে বুকের ছাতি যেন হাহাকার করছে।” তুমি কিছু মনে কোরো না বাপ। আমার ছেলের মত তুমি। তুমি মা বলে আমার কাছে প্রথম দিন যখন জল চাইলে না? আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠল! কার গলা এটা? রেখার বাপ নাকি? তোমায় দেখে তবে হৃদপিন্ডের নাচন-কোঁদন বন্ধ হল।
ভীষ্ম কেন ঘন ঘন তাদের ঘরের দাবায় এসে বসে তা রেখার মায়ের ধরতে কষ্ট হয় না। রেখাকে দেখার পর থেকে ওর এই আনাগোনা। সেটা ভীষ্মরও অজানা নয়। ও যে রেখাকে ভালবেসে ফেলেছে। তাই রেখার কষ্ট ওর বুকে যেন দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি ঠোকে। রেখা কষ্ট করবে কেন? ওর কষ্ট সে বুক পেতে নেবে। তাই আর রাখঢাক না করে ভীষ্ম একদিন রেখার মা’কে বলল,“মা, তোমার মেয়ের ভাগ্য-মালা আমার গলায় ঝুলিয়ে দেবে? আমি সারা জীবন সোনার মালার মত তাকে আগলে রাখব। মেয়েকে নিয়ে তোমার আর কোন চিন্তা করতে হবে না। একটা কানাকড়িও এই বিয়ের জন্যে তোমার খরচা করতে হবে না। খরচা করে আমরাই কনে সাজিয়ে তোমার মেয়েকে ঘরে তুলব।” ভীষ্মর কথায় অবাক হয়নি রেখার মা। ওর মনের ভাষা অনেক আগেই তো সে পড়ে নিয়েছে। তাই সরাসরি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “জানো বাবা, কত ছোকরা এই মেয়েকে বিয়ে করার কথা আমার কাছে তুলেছে? আসলে আমার রেখা একটু মাজাঘষা দেখতে বলে সক্কলের নজরে পড়ে যায়। কেউ যৌতুক চায়, কেউ চায় না। কেউ আবার সুন্দরের লোভে মেতে উঠে ছটফট করে। কিন্তু কারোর মন আমার মনকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তাই ওগুলোকে আমল দিইনি। দাবায় বসতেও বলিনি। জোর করে বসলে জল-নকুলদানা খাইয়ে অতিথি বিদেয় করি। কিন্তু একটা কথা কি জানো বাবা ভীষ্ম, তোমার মত কেউ কোনদিন আমাকে ‘মা’ বলে ডাকেনি। ছেলের মুখ থেকে মা-ডাকের লোভ আমার কাছে বাঁধনছেঁড়া লোভ। রেখার বাপের কাছে সেই লোভের কথা সরমের গুলি মেরে বলেওছিলাম। রাজি হয়েছিল ওর বাপ। খোকার মুখ থেকে মা-ডাক ও আমাকে শোনার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেই লোভ এখনো আমার ভেতর তাড়া করে বেড়ায়। তা তুমি সেই প্রথম দিন যখন ‘মা’ ডাক দিয়ে আমার কাছে ছাতির জ্বলন থামাবার জন্যে জল চাইলে। সেই ডাক, আমার বুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সেই অতৃপ্ত বাসনা যেন নতুন রূপ নিয়ে জন্ম নিল। তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পেলাম এতদিন চেয়ে ফেরা আমার ‘মা’ ডাক। একটা ভাল দিনক্ষণ দেখে তোমার সোনার মালা তুমি গলায় ঝুলিয়ে ঘরে তোল। আমার রেখাও যে তোমার গলায় ঝুলে পড়ার জন্যে আলাপের সেই প্রথম দিন থেকে তপস্যা করে যাচ্ছে। সন্তানের মনের কথা সবার আগে মা ছাড়া আর কে বুঝবে। মেয়ের একটা হিল্লে করে আমি এই বাস তুলে দিয়ে আমার দাদার বাড়ি চলে যাব, শিলিগুড়িতে। দাদার বয়স হয়েছে। তার দেখার লোক নেই। দুটো ভাইপো-বউ তাকে ঠিকমত দেখে না। অনেক দিন থেকে আমাকে ওখানে যেতে বলছে। কিন্তু মেয়ের একটা ব্যবস্থা না করে আমি যাই কেমন করে। আর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ওরা তখন আমাদের বোঝা মনে করবে। খেতে পায়নে তাই ননদ সংসার নিয়ে এখানে উঠেছে। দাদা বলেছে, “তুই চলে আয় বোন। আর তোকে ফিরতে হবে না। মরে যাবার আগে তোর একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা আমি করে যাব। তা মেয়ে যদি মনে করে ওখানে গিয়ে আমাকে দেখে আসবে, যাবে। আমারও মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হলে ডেকে পাঠাব। আর মরে গেলে তো ল্যাঠা চুকে গেল।”
রেখার জীবনের এই খন্ডকথা শুনতে শুনতে একেবারে যেন বিবশ হয়ে যায় অখিল। তার জীবন অনেক অভাব অনটন, উত্থান পতনের সাক্ষী। ছেলে বলে লড়াই করতে করতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। মেয়েরা যে লড়াই করতে পারে না তা নয়। কিন্তু মেয়েদের লড়াইয়ের পথে বড্ড কাঁটা বিছানো। তাই বেশিরভাগ মেয়ে কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আর এগোতে পারে না। প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। ভীষ্মর সঙ্গে রেখাও তো জীবনযুদ্ধ জয় করার জন্যে লড়াই জারি রেখেছিল। কিন্তু মাঝপথে ভীষ্মর মরণ-কাঁটার মোক্ষম আঘাতে সে তো এখন দিগভ্রান্ত! কে ওর সামনে হাওয়া-মোরগ হয়ে সঠিক পথের নিশানা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে? অখিলেরও তা অজানা। তবে মনের সাহসের ওপর ভর করে অখিল বলল, “রেখা-বউ, তুমি অত ঝিমিয়ে পোড়ো না। এক্ষুণি দমে গেলে, জীবনধারণের জন্যে দম কোথায় পাবে? সেই দম তো তোমাকে ধরে রাখতে হবে এবং অর্জনও করতে হবে। বুকে সাহসের জন্ম দাও। তোমরা তো জন্মদাত্রী। অনেক সাহসের জন্ম দাও। দেখবে ঠিক খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারবে। আপাতত আমি তোমাকে ভীষ্মদাদার সৎকারের খরচ আর শ্রাদ্ধশান্তির জন্যে যা যা লাগে সামলে দিচ্ছি। না, রেখা বউ। তুমি ভেবো না দানসত্র খুলে বসেছি আমি। ওইটা করলেই লোকে ‘কু’ ভাবনা এদিক ওদিক সর্বত্র চালান করে দেবে। এই ভাবনা চালানে লোকে ক্লান্ত হয় না। বরং আরও উৎসাহ ভরে এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তোমার কাজের মজুরি থেকে কাটান দিয়ে দিও। সুদখোরদের মত সুদ আদায়ের ধান্দা করব না। আর টাকা শোধ দেবার জন্যে চাপাচাপিও করবো না। যেমনটি পারবে তেমন ভাবেই কাটান করে দিও। শুধু মন দিয়ে নিখুঁত করে তোমার কাজটা করে যেও। সেটা অবশ্য তোমাকে বলতে হবে না। সে পরীক্ষায় তুমি পাশ অনেক আগেই করে গেছো। হ্যাঁ, আর একটা কথা রেখা বউ। কোলকাতা থেকে আরও সুন্দর সুন্দর ড্রইং এসেছে। তবে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে সেগুলোকে ঠাকুরের গয়নায় রূপ দিতে হবে। সবাই এটা পারবে না। বেশিরভাগ কারিগর তো মাথামোটা। সরু মাথারাও কুঁড়েমি করে মাথা ঘামাতে চায় না। তুমি সে গোত্রের নও তা আমি জানি। তোমাকে দিয়ে পরখ করতে চাই এই অর্ডার আমি সাহসের সঙ্গে নেব কি না। এই আঁকা দেখে দেখে কয়েকটাকে গয়নার রূপ দেবার চেষ্টা করো দিকিনি রেখা বউ ? তুমি যদি পারো তো তোমার দাম আরও বেড়ে যাবে। আর সকল কারিগর থেকে তুমি উঁচু জাতে উঠে যাবে। দামি কারিগর তো তখন দামি মজুরি দাবি করতেই পারে। আর সেই দাবি মানতে আমি নারাজ হব না। ভীষ্ম দাদার কাজ সব মিটে যাক। ইতিমধ্যে আমি কোলকাতায় যাচ্ছি। গুরুর আর আমার- দু’জনেরই অনেক মাল জমে গেছে। ডেলিভারি দিতে কোলকাতায় যাবার তাড়া পড়ে গেছে। সেইসময় ওই নকশা আমি নিয়ে আসবো। কোলকাতার মহাজন আমার উপর মনে হচ্ছে ভরসা করতে পারছে না। ভাবছে, এত শক্ত নকশার কাজ হয়তো আমার দ্বারা হবে না। মহাজনের সেই ভুল আমি ভাঙাতে চাই। আর একবার আমার গয়না মঞ্জুর হয়ে গেলে আমিও দাম হাঁকিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব। ওরা মনে হয় আরও অনেক কারখানার মালিককে দেখিয়েছে। তেমন দক্ষ কারিগর তাদের হাতে নেই বলে হয়তো তারা নাকচ করে দিয়েছে। তাই আমাকেও ওই ‘নাকচের’ দলে ফেলে দিয়ে একবার শুধু ধর্মের ডাক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়বার আর আমার সামনে সে’কথা তোলেনি। আর আমি তো এঁটেলচিমড়ে। ওই ড্রইং আমি দেখাতে বলেছি। হেলাফেলা করে আমাকে দু’বার দেয়নি। শেষদিন জোর করে চাপ দিয়ে বলে এসেছি। তোমার উপর ভরসা করে আমি বড়মুখ করে সেই চাপ দিয়েছি রেখা বউ। এখন আমরা দু’জনেই পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে। এ পরীক্ষায় আমরা পাশ করবোই। তুমি দেখে নিও। আর তার জন্যে আমার যেটুকু হাত লাগাতে বলবে আমি লাগাব। পিছু হটবো না।”
স্বামীর মৃত্যুর খবর শিলিগুড়িতে মায়ের কাছে ‘তার’ পাঠিয়ে জানিয়েছিল রেখা। অখিলই সব ব্যবস্থা করেছিল। পত্রপাঠ মা’কে চলে আসার কথা বলেছিল রেখা। কিন্তু ভীষ্মর শ্রাদ্ধের কাজের সময় এসে গেল তবু মা এল না। কেন এল না মা, এই নিয়ে নানান প্রশ্ন এবং দুশ্চিন্তা রেখার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। মা কি একেবারে তার দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে ! স্বামী মারা যাবার পর আবার যদি মেয়ে তার ঘাড়ে চাপে তাই? না কি অন্য কোন কারণ? তাদের বিয়ের মাস চারেক পর মা বড় মামার কাছে চলে যায়। সেই থেকে একবারও মা মেয়ের খবর নেয়নি। ভীষ্ম অবশ্য বার দুই মা’কে তার পাঠিয়ে খোঁজ
নিয়েছিল। আবার ভাবছে, মা ভাল আছে তো? না কি, মা একা আসতে পারবে না বলে আর জামাইয়ের শ্রাদ্ধের কাজে আসতে পারছে না। তাই যদি হবে তো মা পাল্টা তারে তাকে জানাতে পারতো! সম্ভব হলে রেখা কাউকে বলে কয়ে শিলিগুড়িতে পাঠাতে পারতো! সে মনে বোধ পেতো। এইসব নিয়ে বড়ই মনঃকষ্টে আছে রেখা। ভীষ্মর কাজ মেটার পর একটা চিঠি এল তার ঠিকানায় বড় মামার বাড়ি থেকে। ওরা সময়মতই তাদের সব খবর পেয়েছে। কিন্তু তার মা’কে সেই সংবাদটা দিতে পারেনি। মানে দেবার মত পরিস্থিতি মায়ের ছিল না। সেই সময় ডেঙ্গী জ্বরে মায়ের এত বাড়াবাড়ি যে রোগির হুঁশ পর্যন্ত ছিল না। সেই বেহুঁশ অবস্থাতেই মা ভীষ্মদের দেশে পাড়ি দিয়ে দিল!
বড় মামার বাড়ি থেকে চিঠিটা পাবার পর রেখার বুকের ছাতি যেন যন্ত্রণার আগুনে ফেটে চৌচির হতে যাবার পরিস্থিতি হয়ে গেল। মনে হ’ল গলা ফাটিয়ে হাট করে চিৎকার করে সেই আগুন চরাচরে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু তার জন্যে কে অপেক্ষায় আছে এই চিৎকার শোনার! কেউ নেই। দিগন্ত পেরিয়ে আদিগন্ত অতিক্রম করলেও কেউ শোনার নেই। অখিলকে দিয়ে চিঠিটা পড়ানোর পর সেটা তার হাত থেকে ছোঁও মেরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি লাঠি হাতে কোমর নুইয়ে নুইয়ে এসে বৌমার এই অবস্থা দেখে বিহ্বলে বয়সী ফোঁটা ফোঁটা আগুন জল ফেলতে ফেলতে বলল, “তোর জীবন পারের সাঁকো আর কেউ রইলো না রে মা। আমরা এই বুড়ো বুড়ি তো ভীষ্মর কাছে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আছি। আজ না হয় কাল ! আমরা পৃথিবী থেকে উবে যাবার সাথে সাথে তুই যে তাহলে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবি রে মা! আমাদের মরণ তো নিশ্চিন্ত মরণ হবে না রে মা! এই অতৃপ্ত মরণ কত জন্মের পাপ তা কে জানে! বুক ধড়ফড়িয়ে আবার ঠক ঠক করে মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর বিছানার দিকে ফিরে গেল ভীষ্মর মা।
অখিল, তার বাবার অকালমুত্যুর যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে। সেই মৃত্যুর পরিণতির নির্মমতা জীবন দিয়ে পরখ করেছে। কিন্তু আজ ও এই যে পরিস্থিতির সাক্ষী হল তা শুধু দুর্বিসহই নয়, তার কল্পনারও অতীত। বিপর্যয়ের এমন পর্যায়গুলো কেন যে মানুষের জীবনে আসে কে জানে! রেখা বউয়ের জীবনযন্ত্রণা তাকে যেন আরও বিচলিত করে তুলল। এই মেয়েটার জীবন তো সবে শুরু হ’ল। তার থেকেও কম বয়স মেয়েটার। পাপ-পূণ্যের কতটুকু বা মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়েছে এ! তবে এ কেন এত কষ্ট পেতে যাবে। আর অখিলের মত একটা সমর্থ যুবক তার স্বচ্ছ চোখ দিয়ে দেখার পরও এটা মেনে নেবে? প্রশ্নগুলোর মিশেলে ভেতর থেকে উগরে ওঠা গভীর যন্ত্রণাগুলো তাকে বিহ্বল করে তোলে। নিজেকে প্রশ্ন করে, তার কি এখানে কিচ্ছু করার নেই?ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৯)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[একুশ]
ছেলেটা একটু হাতেধরা হতে রতনের যেন কিছুটা আর্থিক সুরাহা হচ্ছে। বাপের সাথে বসে বসে জুতো পালিশ, তাপ্পি, সেলাই সবটাতেই বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া ওর নজর আছে বলে সব কাজের ফিনিশিংটা বেশ মনে ধরার মত। এইদিকটা ও বেশি নজর রাখে তা দেখেছে রতন। এতদিন কাজ করছে, কোনদিন ভাবেনি যে এই ফিনিশিংটাও তাদের ব্যবসার আর একটা দিক। মোটামুটি সারাই-মাড়াই করলেই হল। এমনটাই ধারণা ওদের প্রজন্মের। কিন্তু একটা জুতোয়, চামড়ার তাপ্পি দিয়ে সারার পর তাপ্পির চামড়ার যে একটা খাঁজ তৈরী হোল তা বাটালির ডগা দিয়ে সুক্ষভাবে কেটে আসল জুতোর চামড়ার সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে দিয়ে সেই জুতোটা যদি একবার ভাল করে পালিশ করে দেওয়া যায়, সত্যিই মনে হয় যেন জুতোটা নতুন হয়ে গেল। এই পালিশের জন্যে পয়সা নিল, কিন্তু তা শুধু পালিশ করতে আসাদের থেকে একটু কম পয়সা। কেননা ওই খদ্দেরটা তো জুতো পালিশ করতে আসেনি, এসেছিল রিপেয়ার করতে। এতে তারা জুতো সারাইয়ের পয়সা পেল, অতিরিক্ত কিছু পেল পালিশের জন্যে। খদ্দেরও তুষ্ট মনে কোন কথা না তুলে পয়সা দিয়ে দিল। এই অতিরিক্ত সামান্য কিছু দেবার জন্যে খদ্দেরটার তো গায়ে লাগল না। অথচ তার পুরোনো জুতো নতুন নতুন লাগল। এই বুদ্ধিতে নামও করে ফেলে সনাতন। ছেলের দেখে রতনও এখন তাই করে। আয়ও ছেলের হাত ধরে বাড়ে।
দিঘিরপাড় বাজারের পলিথিন টাঙানো ফুটের দোকানেই এখন হপ্তা’ভর বসে রতন। আর পাড়া করতে যায় না। বয়স যেন আর সায় দিতে চায় না। আশেপাশে প্রায় খান দশ-বারো গ্রাম ফেরি করে ওদের রুইদাস পাড়া। কত মাইল যে সারা দিনে হাঁটতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। এই হাঁটা বয়স যেন সায় দেয় না। দোকানটা যখন আয়ের টানকে পুষিয়ে দিচ্ছে তাতে মনও আর ঠেলা মারে না পাড়া করতে। ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সব কাজকর্ম শিখিয়ে দিয়েছে। কেমন করে পাড়া করতে হয়। কোন পাড়ার কোন বাড়িটা তাকে বেশি পছন্দ করে। কোন গ্রামে তার বেশি বাঁধা খদ্দের আছে। দিন তিনেক সাথে করে নিয়ে গিয়ে সব চিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। বাবুদের গিন্নিমায়েদের সঙ্গেও আলাপ করে দিয়েছে। তাদের এইসব কাজের লেনদেন গিন্নিমায়েদের সঙ্গেই বেশি। বাবুরা তো যে যার কাজেকম্মে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাড়ি থাকে গিন্নিমারা,“গিন্নিমা, এ আমার ছেলে, সনাতন। আমার তো বয়স হচ্ছে। আর হয়তো বেশিদিন পাড়া করতে শরীর সায় দেবে না। তাই ছেলেকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি। আপনারা একটু দেখবেন।”-তা, তোমার ছেলে লেখাপড়া করেনা না? তোমাদের তো দেখি বাবার জুতো-বেতের কাজ হস্তান্তর হয় ছেলের মধ্যে। কেউ আর এর থেকে বার হতে পারল না। না হলে তোমাদের উন্নতি হবে কেমন করে। এই ছেলে, তোর নাম কি? পড়াশোনা করতে পারলি না। সেই বাপের পেশায় তুইও সওয়ার হলি ?
-ও সনাতন গো গিন্নিমা। আপনাদের আশীর্বাদে ও মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে। এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। কিন্তু আমাদের সংসারে তো বাবুদের ছেলেপিলেদের মত শুধু লেখাপড়া করলে পেট শুনবে না। এই পেট-রাহুর হম্বিতম্বি বশে রাখতে গেলে কাজ করতে হবে। কাজ সেরে যদি দম থাকে তো লেখাপড়া শিখতে পারে। তা আমার সনাতন সেই দম দেখিয়ে দিয়েছে।
এবার গিন্নিমার অবাক হবার পালা, “তুই ছেলে এই জুতো-চামড়া-বেতের কাজ করিস আবার লেখাপড়াও করিস! তাও স্টার পাওয়া ছেলে ! আর আমাদেরগুলো দেখো, খাচ্চে-দাচ্ছে আর নবাবি করে বেড়াচ্ছে। তোমার কত কপাল ভাল, রতন। তোমার ছেলে সনাতনকে দেখে অন্য ছেলেপিলেদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। ছেলেটাকে দেখেই প্রথমে আমার একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। ও যে তোমাদের জাতের অন্য ছেলেদের থেকে অন্যরকম, সেটা মনে রেখেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, লেখাপড়া করছে না কি? খুব ভাল। তুমি ভাল করে লেখাপড়া শেখো ছেলে। কখনো কোন দরকার পড়লে আমাদের বাড়ি আসবে। ওর বাবাকে বলবো, যদি তোমার হয়ে কিছু করতে পারে। তবে আমার মনে হয় রতন, এ ছেলেকে তুমি, তোমার মত পাড়ায় ঘুরিও না। ও কাজ করুক। তবে পাড়ায় ঘুরে এই হাড়-খাটুনি যদি তুমি না খাটাও মনে হয় ওর পক্ষে ভাল হবে। আমার কথা তুমি ভেবে দেখতে পারো।” এই গিন্নিমা যেমন বলল তেমন অনেক পাড়া তাকে একই রকম কথা বলেছে। ছেলেকে এই রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে পাড়া না করার মত দিয়েছে। রতন ওই পরামর্শগুলো মাথায় রেখেছে। তবে সরাসরি সনাতনকে বলেনি যে তোমাকে পাড়া করতে যেতে হবে না। মানুষের জীবন। কখন কি মোড়ে মোচড় দেয় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ও যদি নিজে থেকে যায় যাবে। না গেলে না যাবে। রতন তাকে যেমন যেতে নিষেধ করবে না, তেমন যেতেও বলবে না।
কোন কোন বাবু বাজারে তার দোকানে এসে বলে,“কি রে রতন, তুই যে আর পাড়ায় যাচ্ছিস না। তোর গিন্নিমা তো আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। কয়েকটা খোড়া আর একটা পালির বেত খুলে গেছে। রোজ আমাকে বলে, বাজারে গেলে রতনকে বলে আসবে তো, বাড়িতে আসার জন্যে? তা সময় করে একদিন যাস, আমাদের বাড়িতে। ওই বড় বড় জিনিস তো আর আমার পক্ষে বাজারে বয়ে আনা সম্ভব নয়। যেমন বাড়িতে গিয়ে সারিয়ে আসতিস, তেমন যাস।
এই ধান কাটার মরসুম এসে যাচ্ছে। খোড়া, ধান কাটানো ‘কাটা’ আগে থেকে সারিয়ে না রাখলে তখন অসুবিধায় পড়তে হবে।” রতন তখন বাবুকে বলেছিল,“বাবু আমরা বাপ-বেটার কেউ যদি যেতে না পারি তো আমার পাড়া সম্পর্কের ভাইপো, কেলে, মানে কেলোকে পাঠাবো’খন। আপনি চিনবেন ওই যে মিত্তুন রুইদাস আছে না? আমাদের বাজারের মোড়ে বটগাছ তলায় যে ছাগল কাটে। হ্যাঁ, ওই মিত্তুনের ছেলে কেলে। ওরা দু’বাপ-ব্যাটা ছাগলের মাংসের কারবার করে। ছেলে পাড়া ঘুরে ছাগল কেনে আর বাবা বাজারে সেই ছাগল কেটে মাংস বেচে। ছাগল কেনার সাথে সাথে সারাইয়ের কাজটাও কেলে করে। করতে করতে এইসব সারাইয়ে কেলের হাত এখন ভাল হয়েছে। চটপটেও আছে। ও কখনো সখনো আপনাদের পাড়াতেও যায়। বলে দেব’খন ওকে আপনাদের বাড়ি যেতে। ও গিয়ে আমার নাম বললে বুঝবেন আমি পাঠিয়েছি।
আশেপাশে দশ-বারোটা গ্রামে রতন জ্যাঠার যা পরিচিতি তা দেখে অবাক হয়ে যায় কেলো। তার বাবা মিত্তুনেরও এত লোকে চেনে না। তাদের পাড়ার আরও অনেকে রতন জ্যাঠার মত গ্রামে গ্রামে ঘুরে জুতো সারাই, বেতের জিনিসের সারাই বা বিক্রির কাজ করে ঠিকই। কিন্তু এনাকে লোকে যত চেনে অন্যদের সব গ্রামের সবাই চেনে না। এ দিক থেকে রতন জ্যাঠা তাকে অনেক উপকারই করেছে। কেলো বা তার বাবা, মিত্তুনে তো কেবল ছাগলের কারবার করে বেড়াতো। যে-যে গ্রামের মানুষ ছাগল পোষে সেই-সেই গ্রাম তারা ঘুরে বেড়াতো। ঘর-ঘর ঢোঁ মারা তাদের হতো না। তার ফলে অত পরিচিতিও ছিল না। ওই চেনাজানার মধ্যে যারা সারাইয়ের কথা বলত, কেবল তাদের ঘরে তাদের যাতায়াত ছিল। একটা সময় তার বাবা এই কাজের পুরোটাই তার দায়িত্বে ফেলে দেয়। আর পাড়া করে না। পায়ের কলকব্জা নড়বড়ে হয়ে আসছে তাই। এবার রতন জ্যাঠা তার খদ্দেরের কাজ কেলোকে করার সুপারিশ করাতে এখন সে মন দিয়ে দুটো কাজই করে। ছাগলের কারবার আর জুতো-বেত সারাই। ঘরে উপরি দু-চারটে পয়সাও আসতে শুরু করেছে।
নতুন এই কাজটা করতে গিয়ে কেলো, তার পুরোনো কাজে যেন কিছুটা ঢিলে দিতে শুরু করেছে। কুঁড়েমী আর কি। অত দূর দূর পাড়ার পর পাড়া তার ঘুরতে যেন আর তেমন সায় দেয় না মন। ‘ছাগল আছে গো-ও, ছাগল আছে গো-ও বলে চেল্লাতে চেল্লাতে গলা একটা সময় এমন বসে যায়। মনে হয় গলাটা শরীর থেকে খুলে পড়ে যায় আরকি! ওই সারাইয়ের কাজ করতে করতে নজর-পড়া পাড়াগুলো ঘোরার মাঝে যেসব বাড়ি ছাগল পোষে সেগুলোতে ঢোঁ মারে। এই নিয়ে বাপ ছেলের কথাকাটাকাটি যে হয় না তা নয়। মাংসর
দোকানে ছাগলের যোগানে টান পড়ে। মিত্তুনকে দোকান চালাতে তাই রাজারহাটের ছাগলহাটের থেকে ছাগল কিনে আনতে হয়। পাড়ার ছাগল একটু কম দামে পাওয়া যায় আরকি। পাড়ার বউ-ঝিদের ভুজুং-ভাজুং দিয়ে হাটের ছাগলের থেকে অনেকটা কমে সে সওদা করতে পারে, “দিদি, আপনার ছাগলের নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে। এই দেখুন, চোখের জল গালের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে। আপনার ছাগলের ব্যায়রাম হয়েছে। বিডিওর পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। না হলে সে বাঁচবে না কিন্তু। ছাগলটাকে এতটা বড় করে শেষে মরে গেলে আপনার অনেক পয়সা মাঠে মারা যাবে।” বিডিওর পশু ডাক্তার পাওয়া অত সহজ কথা না। তারপর কবে তাকে পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে পারবে না। ছাগলটাকে টানতে টানতে দশ কিলোমিটার হেঁটে নিয়ে গিয়ে যদি না পাওয়া যায় তো বিপত্তির অন্ত নেই। তাই সহজে পাড়ার মেয়ে বউরা ডাক্তারের কথা মুখে আনতে চায় না। সেই সুযোগ কেলো-মিত্তুনেরা নেয়। তখন ছাগল মালিক বলে, “তুমি ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করে দাওনা। তোমার যাতায়াতের খরচা দিয়ে দেবো’খন।”
-আমার অত সময় নেইগো মা-সকল। একটা কথা বলি শোনো, তোমার ছাগলের দাম আমি পাঁচ হাজার টাকা দেবো। আমাকে দিয়ে দাও। তারপর ডাক্তারবদ্যির খরচ আমি করে নেবো।
-আমার আট হাজার টাকার মাল পাঁচে ছেড়ে দেবো? তুমি পাগল আছো? ডাক্তার খরচ তোমার কত হবে গো লোকটা!
-দেখুন মা-ঠাকরুন, ডাক্তার দেখা, ওষুধ পথ্যের খরচ তো একটা আছেই। আর একটা আসল কথা তো তুমি ভাবলে না। এই রোগী ছাগলকে সারিয়ে তুলতে তো বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে? না কি বলো? তা মানুষের রোগ হলে মানুষ রোগা হয়ে যায় না ? এ পশুও তো রোগা হয়ে যাবে। ওজন কমে যাবে। পশুর ওজনের ওপর তো তার দাম। ওজন কমে গেলে দামও তো কমবে, না কি? তা তোমার রোগা ছাগল পয়সা দিয়ে কিনে যদি আমার কারবারে লস্ হয় তো সে কারবার করে আমার লাভ কি? দেখো এবার তুমি কি করবে। তোমার জিনিস আমি তো জোর করতে পারি না। এখন যা দাম পাচ্ছো, পরে তা নাও পেতে পারো। তখন আর আমাকে দুষবে না কিন্তু।
কোন ছাগলের হয়তো পেটটা ডাবরা হয়ে আছে। পেটে হয়তো জল জমেছে। এমনটা হলে ছাগল একটু হাগে। পাতলা হাগে। ছাগল যে কোন সময় পাতলা হাগতে পারে তা যারা ছাগল পোষে তারা জানে। কিন্তু কি কারণে হাগে তা তারা অতটা জানে না। অনেক সময় হেগে হেগে ছাগলটা মরেও যায়। তখন মালিক কপাল চাপড়ায়, “ছাগলটার হাগা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে যদি বিক্রি করে দেওয়া যেতো তো এত টাকা তাদের ক্ষতি হত না।” সেই ধারণার সুযোগটা মিত্তুনে-কেলোরা নেয়, “মা-ঠাকরুন, তোমার ছাগলের পেট ডাবরা হয়ে গেছে। পেটের নীচে হাত দিয়ে উপরের দিকে ঠেলা মারলে ছলছল শব্দ হচ্ছে। জল জমেছে। এবার পাতলা হাগা শুরু হবে। তখন একে বাঁচানো শক্ত হয়ে যাবে। এক্ষুনি ডাক্তারের ব্যবস্থা করো।” এইসব ছাগল মোটামুটি দামাদামি করে কিছুটা কমে তারা গস্ত করতে পারে। তাতে মাংস বিক্রি করে কিছু বেশি পয়সা ঘরে তুলতে পারে। তবে যেসব ছাগল একদম টানটান সরেস মার্কা, তাদের নায্য দাম দিতেই হয়। ওখানে হুড়িয়ে-হাড়িয়ে কিছু করার জায়গা থাকে না। তবে তাতেও হাট থেকে গস্ত করা মালের থেকেও নরম দামে কেনা যায়।
বাপের গোঁত্তা খেয়ে কেলো একটু যেন টালমাটাল। সারাইয়ের কাজের সাথে সাথে পুরোনো ব্যবসাটায় জোর দিতে হচ্ছে। কিন্তু তাতে যেন মন জোর পায় না। হঠাৎ তার মনে একটা অন্য মতলব বাসা বাঁধে। সেটা সে তার বাপকেও জানায় না।
হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেয় পাড়া করে ফেরার কালে কেলো মাঝবয়সী একটা খাসি কাঁধে করে নিয়ে এসে ঘরের দাবায় ধপাং করে ফেলে। মিত্তুনে, কেলোর মা দেখে তো অবাক, “হ্যাঁরে কেলো, এ তো মরা খাসি। এ মালটা আবার কোথায় পেলি !” ছাগলটার গায়ে হাত দিতে একটু চমকে ওঠে মিত্তুনে, “কিরে কেলো, মনে হচ্ছে ছাগলটা সবে মরেছে। এর শরীর এখনো পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যায়নি! গরম গরম। সদ্য মরা ছাগলটা তুই পেলি কোথা থেকে? যাদের ছাগল, তারা খোঁজাখুঁজি করেনি?”
-তা করবে না? পাড়াময় হৈ হৈ পড়ে গেছে। লোক জড়ো হয়ে গেছে, যেখানে এটা পড়ে ছিল। বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম লোকজনের জটলা। মরা ছাগলটা ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে একজন বলল, “দেখতো কেলো। এর ধড়ে প্রাণ এখনো জিইয়ে আছে কি না। মনে হয় তো নেই। দেখেই বললাম এ শেষ। এবার মানুষের জল্পনা, কি করে মরল জলজ্যান্ত ছাগলটা, ইত্যাদি কথা চালাচালি করতে করতে জটলা পাতলা হতে থাকে। যাদের ছাগল তারা শুধু আছে। আমি বললাম, মরা ছাগল তো তোমরা এমনিতেই মাটিতে পুতে দেবে। আমি নিয়ে যাবো ? চামড়াটা তাহলে নিতে পারি। তারা তখন আর কিছু না বলায় আমি সময় নষ্ট না করে কাঁধে ফেলে নিলাম। কাল রবিবারের বাজার। মাংসের টান থাকবে। তুমি অন্য মাংসের সঙ্গে এটাও ভোর ভোর কেটে চালিয়ে দিতে পারবে। অসুবিধা হবে না।”
– অসুবিধা হবে না কি রে! সারারাত এভাবে ছাগলটা পড়ে থাকলে এ তো শক্ত ডাঙ হয়ে যাবে। মাংসের টেস্টও পাল্টে যাবে। রেগুলার মাংসের খদ্দেররা বুঝতে পারবে এতে কোন গলদ আছে। ওই ঝুঁকি নেওয়া যায় নাকি! তুই এক কাজ কর কেলো। বাজারে চলে যা। ইদ্রিসের আইসক্রিম কারখানা থেকে দুটো ইটের সাইজের আইসক্রিম বানানোর জন্যে রাখা বরফের প্লেট নিয়ে আয়। আমার নাম বলবি, ও দিয়ে দেবে। মাংস বিক্রি না হলে ওর দোকান থেকে বরফ নিয়ে সেগুলো চাপা দিয়ে রাখি সে ইদ্রিস জানে। কোন প্রশ্ন করবে না। দাম পরে আমি দেব’খন। আমি ততক্ষণে ছাগলটার চামড়া ছাড়িয়ে পরিস্কার করি। তুই বরফটা নিয়ে আসলে কাঠের বাক্সটার নীচে পলিথিন বিছিয়ে মাংসগুলো বরফ ঢাকা দিয়ে রাখবো। সকালেও একদম টাটকা থাকবে এটা তাহলে।
প্রথম পরীক্ষায় সফল হয়েছে কেলো। এবার লোভে পড়ে যায় এইভাবে অসৎ পথে ‘হবগা’ টাকা আয় করার জন্যে। রোজ করে না। হপ্তাহে দু’দিন এই কম্ম করে ও। তবে বহু দূর দূর গ্রাম হয় তার লক্ষ্য। কাছাকাছি হলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। অপারেশন করার আগে নির্দিষ্ট গ্রামটা বার কয়েক ঘুরে দেখে নেয় কোন বাড়িতে কটা ছাগল আছে। কোথায় চরাতে যায় ইত্যাদির খবর। তারপর সুযোগ বুঝে কলাপাতা বা কলমি শাকের সঙ্গে বিচি সমেত ধুঁতরো ফল জড়িয়ে ছাগলকে খাইয়ে দেয়। সবটাই চলে পরিস্থিতি বুঝে, নিরিবিলি সময়ে। না হলে কেউ দেখে ফেললে পাড়ার লোকের একটা মার বাইরে পড়বে না। সাফল্য বেশ কয়েকবার পেয়ে যায় কেলো। বাপ মিত্তুনেও খুশি মনে লোভের পাঁকে হাবুডুবু খেতে থাকে। একবারের জন্যেও ছেলেকে সতর্ক করে না যে এ অন্যায় কাজ। এ কাজ না করাই ভাল। বিরোধিতা না করে নীরব থেকে ছেলের কাজের সুবিধা নেওয়া মানেই তো পরোক্ষে সমর্থন করা। সেটাই করে চলল মিত্তুনে।
দূর দূরান্তের গ্রাম হলে কি হবে। লোক মুখে তো চাউর হচ্ছে ধীরে ধীরে যে কোন অজানা কারণে একটার পর একটা ছাগল মরে পড়ে থাকছে মাঠে ময়দানে। কারণ কেউ তেমন করে বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে কেলের দিনে দিনে সাফল্যের বহরে সাহসও বেড়ে যায়। এবার আশেপাশের চেনা জানা গ্রামেও নিজের হাতসাফাইয়ের বিদ্যে কাজে লাগাতে শুরু করে। তবে তা বেশি করে উঠতে পারেনি। আগের খবরগুলো এইসব গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক সময় চর্চা করতে করতে একটা হিসেব মানুষের মনে দেগে যায় যে এই মরা ছাগল একজনই শেষ পর্যন্ত নিয়ে চলে যায়। সেটা ওই রুইদাস পাড়ার মিত্তুনে রুইদাসের ছেলে কেলে ! কাছাকাছি গ্রামের লোক কেলেকে খুব ভাল করে চেনে। এবার তক্কে তক্কে থেকে একটা ছাগলকে শাক পাতার সঙ্গে ধুতরা ফল খাইয়ে দিতে গিয়ে বামাল সমেত হাতনাতে ধরে ফেলে কেলেকে! তারপর আচান্দা গ্রামের বল খেলার মাঠে গোল পোস্টে বেঁধে শুরু গণধোলাই।
হাওয়া এই চুরির খবর মুখে করে ছড়িয়ে দেয় দূরে কাছের গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের ঢল নামে এতদিন ধরে চলে আসা ছাগল মারার কারিগরকে দেখতে। সেইসঙ্গে উত্তম মধ্যম আছড়ে পড়ে কেলের শরীরে। এত লোক একবার করে যদি থাপ্পড় কসায় তো মরে যাবে যে চোরটা! পাড়ার কিছু সতর্ক মানুষ খবর পাঠায় পুলিশে।
রতন মরমে মরে যায়। এই চোরকে সে তার বিশ্বস্ত বাড়িতে কাজ করার জন্যে সুপারিশ করেছিল। বাবুরা এতদিন তার প্রতি যে বিশ্বাস পোষণ করেছিল তা এই কেলে চোরের হাত ধরে মাটিতে সমাধিস্থ হয়ে গেল। আফসোসের শেষ রইল না তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে। কিন্তু জানবে বা কেমন করে, মিত্তুনের ছেলে কেলে এমন অপরাধ প্রবণ ! আর জঘন্য মানুষ তো এই মিত্তুনে। সমানে সে ছেলের এই সমাজবিরোধী কাজে সায় দিয়ে এসেছে। ছেলের সঙ্গে সঙ্গে বাপকেও জেলে পোরা দরকার। চোর আর চোরাই মাল গছনদার- দু’জনেই সমান দোষে দোষী। হয়তো পুলিশ তাই করবে! করুক![বাইশ]
পুজোর মাস-দুই তিন আগে থেকে রুইদাস পাড়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঢাকের পরিচর্যা করতে। বছরভর এরা গরুর চামড়া ‘ট্যান’ করা পালিশ করা ইত্যাদির কাজ করে চামড়া ব্যবহারের উপযুক্ত করে রাখে। তারপর নানা রকম পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন ঢাক বানানো আর পুরোনো ঢাকের মেরামতি শুরু হয় এই সময় থেকে। দুটো কাজেই চূড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। মোটামুটি সারা বছরের এই সময়টার জন্যে ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। দূর্গা পুজো থেকে শুরু হয় ওদের পুজোর মরশুম। তারপর লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো ইত্যাদি চলতে থাকে। বাঙালীর বারো মাসের তেরো পার্বনের মধ্যে এই সময়গুলোই ওদের জীবনধারণের প্রধান উপায় ও অবলম্বন। এতসবের সাফল্যের টিকি কিন্তু বাঁধা হয়ে যায় এই দূর্গাপুজোর মধ্যে দিয়ে। কে কতটা ঢাক বাজানোর ডাক পাবে তা অনেকটা ঠিক হয়ে যায় দূর্গা পুজার ডাক কোথায় কে কেমনভাবে পেল-না-পেল সেটার উপর। সেইজন্যে এরা সবসময় টানটান হয়ে থাকে, কিভাবে কেমন করে কোন্ পুজোমন্ডপে সে কাজ করার সুযোগ পাবে, সেদিকে। শহর- কোলকাতার বড় ক্লাবের পুজো বা বনেদি বাড়ির পুজোর দিকে এদের টান বেশি। লক্ষ্য তো একটাই। বেশি রোজগার। তা সেই রোজগারের বহরটা ওরা কপালের উপরই ছেড়ে দেয়। সব্বাই তো আর বড় ক্লাব বা বনেদি বাড়ি ডাক পাবে না। এইসময় ওদের মত ঢাকিদের যোগান অনেক। কিন্তু পছন্দমত খরিদ্দার বা তাদের চাহিদা সীমিত। গ্রামের পুজো শহরের তুলানায় কমই হয়। বাহুল্যেও শহরের ধারেকাছে যেতে পারে না গ্রাম। তাই তারা জোয়ারের ঢেউয়ের মত শহরের দিকে ধেয়ে যায়। রতন অন্যদের মত শহরে গিয়ে ঠেলাঠেলি তেমন পছন্দ করে না। কিন্তু এই বছর সনাতন হাতেধরা হতে মনটা যেন উশখুশ করে শহরে ডাকে যাবার জন্যে। দু’পয়সা যদি বেশি আয় করতে পারে। সনাতন এ বছর প্রথম তার সঙ্গে সঙ্গ দিতে রাজি হয়েছে। এ বছরই ও ঢাকের বোলের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছে। দূর্গাপুজো আর লক্ষ্মীপুজোর ঢাকের বাজনার সব বোল-তাল একদম নিখুঁতভাবে বাজাতে পারে। কাঁশির বাজনা তো ও অনেকদিন থেকে বাজাতে পারে। সেই ফাইভে যখন পড়ে তখন থেকেই আশেপাশের পাড়া বা গ্রামে বায়না পেলে ছেলেকে নিয়ে যেতো কাঁসির সঙ্গত দিতে। বড় পুজোয় অনেক খাটনি। একা সবটা বাজানো চাপের হয়ে যায়। শহরে না যাবার এটাও একটা কারণ। এবার যখন সনাতন তৈরী তখন বাপ-বেটা পাল্টাপাল্টি করে ঢাক-কাঁসরে বোল তুলতে অসুবিধা হবে না। সেই সাহসে ভর করে রতন ছেলেকে বলল, “কিরে সনাতন, এ’বছর কোলকাতায় বাজাতে যাবি? কোলকাতায় ছোট-বড় বা যেমন তেমন প্যান্ডেলেও বায়না পেলে রোজগার মন্দ হয়না রে! ওই তো দেখিস না, পাড়ার অন্যরা পুজো শেষে পোঁটলা ভর্তি করে জিনিসপত্র আর ট্যাঁক ভরে টাকা পয়সা নিয়ে ফেরে! গ্রামে থেকে আমরা তার ছিটেফোঁটাও পাই না। চল্ একবার দেখে আসি শহরের রহস্যটা কেমন। অভিজ্ঞতা মনের সঙ্গে না মিললে আর যাব না পরের বছর।”
শহরে ডাকে যেতে সনাতনের তেমন সায় ছিল না। আসলে শহরের ওই গ্যাঞ্জাম, জটিল পরিবেশ- ওর একদম মন টানে না। গাছগাছালিতে ভরা গ্রামের শান্ত শীতল আবহাওয়া। মেঠো রাস্তার দূষণমুক্ত ধুলিধূসরিত পরিবেশ। বৃষ্টিসিক্ত ধরিত্রির সোঁদা গন্ধ তাকে যেন বেঁচে থাকার অন্যরকম এক স্বাদ খুঁজে দেয়। শহুরে তপ্ত পরিবেশ, ব্যস্ততায় মোড়া যন্ত্র-জীবন যেন তাকে হাঁফ ধরিয়ে দেয়। শুধু সনাতন কেন তাদের মত গাঁয়ের মানুষের ক’জনেরই বা শহর টানে। তেমন টানে না। তবু গাঁয়ের মানুষ উদ্ভ্রান্তের মত ছোটে সেই শহরের পথে। জীবনকে জিইয়ে রাখার তাগিদ যে বড় তাগিদ। দায়ও। দায়মুক্ত হতে তাই সবাই ওদিকে ছোটে বেঁচে থাকার রসদ আহরণে। শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে ‘দুয়ো’ দিয়ে রতনের চাপাচাপিতে সায় দিতে মাথা নাড়ে সনাতন। ছেলের সম্মতি পেয়ে রতন এবার খোঁজখবর চালায় পাড়ার আর যারা ফি বছর কোলকাতায় যায় তাদের কাছে, “হ্যাঁগো দিবাকর, ফি বছর তো পাড়াগাঁয়ে পুজোর বাজনা বাজাই। এবারটা ইচ্ছে হচ্ছে শহরে যাবার। কোলকাতায় গেলে, এটা তো ঠিক যে গাঁয়ে ঢাকের যা বায়না হয় তার থেকে ঢের বেশি টাকার কাজ পাব! সেই টানেই তো তোমরা পুজোর মরসুমে কোলকাতায় ছোটো। তা আমার তো এ বছর এই প্রথম। শহরের বায়না-টায়না নেবার নিয়মকানুন বা পদ্ধতি কিছুই তো আমার জানা নেই। তুমি যদি আমাকে একটু জানাও তো অজানা জায়গায় গিয়ে আমাদের আর বিপাকে পড়তে হয় না।”
সঙ্গে সঙ্গে দিবাকরের তৈরী হওয়া মুখের খাঁজগুলো দেখে রতনের বুঝতে অসুবিধা হ’ল না যে ওর কাছে সাহায্যের আশা, হতাশায় পরিণত হতে চলেছে। মুখের বিকৃত ভাঁজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দিবাকর বলল, “ওসব অনেক হ্যাপা গো দাদা। কোলকাতার লোক বলে কথা। ওদের সঙ্গে কাজকারবার করা অত সহজ কথা না। আচার ব্যবহার এত বাজে যে ওইসব শিক্ষিত বাবুদের চেহারা বেশভূষা দেখে বোঝাই যাবে না এরা কতটা সুযোগ সন্ধানী। আমাদের মত সাদাসিধে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ওদের একদম মিল নেই। কথার খেলাপের মস্তবড় খেলোয়াড় ওরা। তোমাকে এক বলে বায়না করে নিয়ে গেল। তারপর পুজো শেষে টাকা দেবার সময় অন্য কথা বলবে। বলবে, তোদের সঙ্গে এত
টাকা দেবার কথা হয়নি। প্রায় অর্ধেক কমিয়ে বলবে, এত টাকা কথা হয়েছে। তাছাড়া তোদের এতদিন কমিটি থেকে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করা হ’ল। নতুন ধুতি, গেঞ্জি-গামছা দেওয়া হল। ওগুলো পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি বুঝি? তারপর তোরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যে বকশিশ পেলি? সে তো আমাদের পাড়ার মানুষ দিয়েছে। পাড়ার মানুষের দেওয়া মানে কমিটিরই দেওয়া হল। সবটা জুড়লে তোরা কত টাকা এ’কদিনে আয় করলি একবার ভেবে দেখেছিস? এমন সব উটকো বাহানা চাগিয়ে তুলে আমাদের টাকা মারার ধান্ধা করে ওইসব শহুরে ধূর্ত লোকগুলো। তোমাদের মত লোক ওখানে গিয়ে খাপ খুলতে পারবে গো না দাদা। তুমি যেও না। রাম-ঠকা ঠকে যাবে।”
দিবাকরের কথায় শহরে যাবার ইচ্ছেটা যেন থমকে গেল রতনের। এত বড়মুখ করে সে সনাতনকে রাজি করালো পুজোয় শহরে ঢাক বাজাবার জন্যে। নিমরাজি ছেলেটা শেষপর্যন্ত সায় দিল। তার মনেও নিশ্চয়ই একটা আশার আলো ফুলকি মেরেছে। সেখানে দিবাকর যদি এমন মনমরা কথা শোনায় তো ছেলেটারও শহরের মানুষজনের প্রতি একটা খারাপ ধারণা হবে। গোমড়ামুখে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে ফিরছিল রতন। উল্টোদিক থেকে পাড়ার যুবক ছেলে অভয় আসছে, সে দেখতে পায়। রতনের মনমরা মুখের ভাষা কেমন করে যেন ছেলেটা পড়তে পারে, “কি গো কাকা, মুখ ভার করে আছো কেন? তোমাকে তো কোনদিন এমন করে থাকতে দেখিনি? তাই বলছিলাম আরকি।” উত্তরে রতন বলল, “না, তেমন কিছু নয়।” তারপর হঠাৎ মনে পড়ল এই অভয়ও তো কোলকাতায় ডাকে যায় পুজোর ঢাক বাজাতে। দিবাকরের কথাটা ওর কাছে একবার ঝালাই করে নিলে হয়, “এই শোন, অভয়, তুই তো ফি বছর কোলকাতায় ডাকে যাস পুজোর ঢাক বাজাতে। আমি তো কোনদিন ওদিক মাড়ায়নি। ভাবছি এ’বছর পুজোয় কোলকাতায় ঢাক বাজাতে যাব। তা, কি রে যাব ওইসব জায়গায়? দিবাকর তো আমাকে একরাশ ভয় দেখিয়ে না যাবার পরামর্শ দিল। আমি নাকি রাম-ঠকা ঠকে যাব। সেইজন্যে ইচ্ছেটা যেন দম পাচ্ছিল না। তাই মনমরা হয়ে গেলাম।”
পাড়ার মুরুব্বিদের ওপর মনে মনে অভয়, বরেণদের রাগ এখনো ধিক ধিক জ্বলে। ওদের দাবি মত অলোকা-বিপ্লবদের কেসটা আটচালায় তুলতে দিল না ওরা। মুরুব্বিদের মধ্যে রতন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বরং বলা যেতে পারে রতনের উপরই ওদের বেশি খার। এবার অভয় বাগে পেয়েছে রতনকে। উল্টোপাল্টা বলে এমন ঘোল খাইয়ে দেবে যে বাছাধন হাড়ে হাড়ে টের পাবে। অভয়দের অবজ্ঞা করার মাশুল এবার ব্যাটাকে দিতে হবে। তাদের দুচ্ছা করার প্রতিশোধ নেবার জন্যে একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ও। এবার সেই
সুযোগ এসে গেছে। কাজে লাগাতে হবে। দিবাকর শুধু তাকে কোলকাতায় ডাকে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে। তাতে তো ব্যাটার বেঁচে যাবার পথ সুগম হয়ে গেল। একে তা করলে চলবে না। এমন বোয়াল মাছের ঝাঁকে ফেলতে হবে, যার খপ্পরে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়, “আরে কাকা, দিবাকর কাকা যা তোমাকে বলেছে একদম ফালতু কথা বলেছে। তুমি যাতে ওদের দলে ভিড়ে ওদের বায়নায় ভাগ বসাতে না পারো তাই অমন কথা বলে তোমাকে ভাগাতে চেয়েছে। ওইসব চুকলিবাজির কোন মানে হয় না। ভাল বায়না, খারাপ বায়না, যে যার ভাগ্যে জোটে। সেটাকে মেনে নিতে হবে। তাইবলে পাড়ারই একজন মুরুব্বি মানুষ কোলকাতায় ডাকে যেতে চাইছে, তাকে যেতে দিতে চায় না! একদম অনুচিত কাজ এটা। এর মাধ্যমে তুমি লোক চিনে নাও কাকা। কে আসলে মানুষের ভাল চায় আর কে চায় না।” দিবাকরের বিরুদ্ধে রতনকে খেপিয়ে অভয় এটাও করতে চাইল যে আটচালার ওই দুই মুরুব্বির মধ্যে যাতে একটা ভাঙন ধরানো যায়। এই দিবাকরও তাদের বিরুদ্ধে রতনদের উসকে দিয়েছিল। অভয় বলল, “কাকা, তুমি কোন জায়গার ঢাকের হাটে বসতে চাও? হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদা স্টেশন, বাবুঘাট, ধর্মতলা, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে বা দক্ষিণ কোলকাতার টালিগঞ্জ। মোটামুটি কোলকাতার এইসব ঢাকি হাটে সবাই গিয়ে বসে পাঁচ’ছ দিনের জন্যে ঢাক-ঢোল সমেত নিজেদের বিক্রি হতে। পূজামন্ডপের বাবুরা ওইসব জায়গায় এসে ঢাক-ঢোলের বায়না করে যায়। এছাড়া আরও অনেক জায়গায় ঢাকির দল, ঢোলের দল এসে জড়ো হয়। এবার তোমার কোথায় যাবার মন চায় সেটা বলতে হবে। আমি তো প্রায় সব জায়গায় বসেছি। মোটামুটি সবকটার অভিজ্ঞতা আমার আছে।”
-তাহলে তুই নিজেই বল না অভয়। কোনটা গেলে আমার সুবিধা হবে। পয়সাও একটু বেশি পাওয়া যায়।
-আমার ওপর যদি ছেড়ে দাও তাহলে বলব তুমি শিয়ালদাতে যাও। যেমন প্রচুর খরিদ্দার তেমন ঢাক-ঢোল এসে সরগরম করে দেয় গোটা স্টেশনের সামনের চত্বর। তুমি প্রথম যাচ্ছ তো। দেখবে কেমন অভিজ্ঞতা হয়। যা তোমার জীবনে হয়নি। হ্যাঁ, আর একটা কথা, একদম ভোর ভোর শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। আগে না গেলে ওই ঢাক নিয়ে দাঁড়াবার জায়গা পাবে না। সেইসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখি কাকা, কোন সময় ঢাক-কাঁসিকে একলা ছেড়ে পাশের অন্য কারোর জিন্মায় রেখে এদিক ওদিক যাবে না। পেচ্ছাপ করতেও না। তুমি যাবে তো সনাতন থাকবে আর সনাতন যাবে তো তুমি থাকবে। কোলকাতা খতরনাক জায়গা। বিশেষ করে ওইসব ভিড়ভাট্টা এলাকায়। চোর ছে্যঁচোড় হাত সাফাইঅলাদের স্বর্গরাজ্য ওগুলো। মুহূর্তের মধ্যে কোথা দিয়ে কখন যে অতবড় আস্ত ঢাকটাই হাওয়া করে দেবে ভাবতে পারবে না। গাল হাঁ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তখন।
অভয়ের কথায় ‘ভয়’ ‘অভয়’ দুটোই পায় রতন। আর কথা না বাড়িয়ে বুকে সাহস জুগিয়ে মনে মনে বলে,“ঠিক আছে অভয়, তুই যখন বলছিস তখন শিয়ালদাতেই আমরা যাবো। আর তো বেশিদিন নেই। ততদিনে এদিকে ঢাকটাকে সুন্দর করে টানটোন দিয়ে গুছিয়ে গাছিয়ে একদম নতুন করে রাখি। তুই ভরসা দিলি বলে আমিও মনে বল পেলাম। না তো দিবাকর যেভাবে আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল। তোর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো এ বছর আমাদের কোলকাতায় যাওয়াই হত না।”
চলে গেল রতনবুড়ো বগল বাজাতে বাজাতে। অভয় পেছন ফিরে সেই যাওয়া দেখে আর মনে মনে মজা উপভোগ করে, “অভয় তোমায় উপকার করেছে কি অন্য কিছু করেছে তা তুমি শিয়ালদাতে গেলে বুঝতে পারবে, কাকা। এক-বছর সে গিয়েছিল ওখানে। কেঁদে কুল পায় নে। আর কোনদিন মুখেও আনে না শিয়ালদার ওদিক মাড়াবার কথা। জীবনেও আনবে না তা। তাই বলে কি ঢাকিরা ঢোলিরা ওদিকে যাচ্ছে না? যাচ্ছে। প্রচুর যাচ্ছে। ওইসব উৎপাত সামলাবার ক্ষমতা, সাহস যাদের আছে, তারা জেনেশুনে যাচ্ছে। কেউ না জেনে যাচ্ছে। কেউ লাভ করছে, কারোর লোকসান হয়ে যাচ্ছে, আবার কারোর সর্বনাশও হচ্ছে। এবার রতনকাকা, তুমি দেখো কোন্ ডাব্বায় তুমি হাবুডুবু খাবে। বুড়ো হাড়ে আর একবার পরীক্ষায় বসো।”
চতুর্থী থেকে শুরু হয় ঢাকিদের শহরে আসার প্রক্রিয়া। প্রথম বছর বলে রতনরা, বাপ-বেটা চতুর্থীতেই অভয়ের কথা মত ভোর-ভোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ভোর চারটেয় ৮৩ নং রুটের ফার্স্ট ট্রিপের বাসে সনাতনকে নিয়ে চড়ে বসে। একদম শেষে নামবে। বাবুঘাটে। সেখান থেকে শিয়ালদামুখী বাসে শিয়ালদা স্টেশন। অচেনা অজানা সময়-দরিয়ায় ভাসিয়ে দিল বাপ-বেটা নিজেদের ভাগ্যকে! সম্বল শুধু দু’জনের দুই-দুই চার হাতে চারমুঠো সাহস আর কৌতূহল!
বাসের ড্রাইভারের কেবিনের বাইরের প্রথম কাটা সিটের সামনে তাদের ঢাক আর লাগেজ ব্যাগটা রাখল, রতন-সনাতন। সিটদুটো আমতলায় খালি হবে। কন্ডাক্টরের কাছ থেকে জেনে ওই সিটের সামনে রতনরা বাপ-বেটা দাঁড়ালো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কতক্ষণ আমতলায় আসবে সেই প্রত্যাশায়। আমতলায় আসার আগে কৃপারামপুরে সিট খালি হয়ে গেল। যেমন নির্দিষ্ট জায়গায় আসার একটু আগে লোকে সিট ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আরকি। রতন ছেলেকে বলল জানলার ধারে বসতে। বাচ্চা ছেলে, প্রকৃতি দেখতে দেখতে কোলকাতার দিকে এগোবে। ঠাকুরপুকুর পেরলেই কোলকাতা দেখবে। ধারে না বসলে তো কোলকাতা দেখার স্বাদ মিটবে না। রতন বলল, “জানিস খোকা, বাস থেকে নামার সময় তুই কাঁসরের ঝোলাটা আর আমাদের জামাকাপড়-খাবারের ব্যাগ নিবি। আমি ঢাক নেবো। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রাখবি। দেখবি, কেউ যেন আবার ছিনিয়ে নিয়ে না পালায়।”
-তুমি ঠিক করে নেমো বাবা। ঢাকের যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমি ঠিক নেমে যাব। আমার জন্যে চিন্তা করতে হবে না। আর বাস একদম খালি হয়ে গেলে সবার শেষে আমরা নামব। তাহলে অত টেনশান করতে হবে না।
বাবুঘাটে নেমে রতনরা দেখে নদীর দিকে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় অনেকে ঢাক-ঢোল নিয়ে জড়ো হয়েছে আর যে যার মত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। তা দেখে সনাতন বলল,“বাবা, ওই তো ওরা ওদিকটা ঢাক নিয়ে বসেছে। চলো, আমরাও যাই। ওদের সঙ্গে মিশে যাই। ওদের কাছে খদ্দের আসলে আমাদের কাছেও আসবে।”
-না রে খোকা। অভয় বলেছে, শিয়ালদায় প্রচুর খদ্দের আসে। ওখানে জমজমাট খুব। এখানে এই ক’জন জমেছে। নিশ্চয়ই খরিদ্দার এখানে কম আসে। কোলকাতার আদত কি জানিস, এক জায়গায় একই জিনিসের বহু দোকান। জামাকাপড়ের দোকান তো এক জায়গায় বহু জামাকাপড়ের দোকান। মশলা দোকান তো পরপর সারি দিয়ে একই দোকান। একে ‘পট্টি’ বলে। কাপড় পট্টি, মশলা পট্টি। এই ধরণের সব। এর ফলে হয়কি মানুষ স্রোতের মত ওই পট্টি বাজারে ধেয়ে আসে। এ-দোকান, সে- দোকান ঘুরে মানুষ পছন্দমত জিনিস কিনতে পারে। ঠিক আমাদের এই ঢাক-ঢোলের বেলায়ও তাই। শিয়ালদা, হাওড়া ইত্যাদি নামকরা জায়গায় প্রচুর ঢাক-ঢোল যেমন বসে তেমন মানুষও ছুটে যায় নিজেদের পছন্দের বাজনা বায়না করতে। সেইজন্যে বলছি, যেখানে অনেক লোক সমাগম সেখানে গেলে ভাল দামে আমরা বায়না পেতে পারব। চল না, আগে শিয়ালদায় যাই। ওখানে যাবার জন্যে বাড়ি থেকে মনঃস্থির করে এসেছি। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে’খন।
সকাল সাতটার মধ্যে রতনরা শিয়ালদা স্টেশনের সামনে বাস থেকে নামে। ওখানেই একটু সরে এসে ফুটপাতের ওপর খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। ছেলেকে বলে, “তোর পেচ্ছাপ পেয়েছে, সনাতন? তাহলে যা। ব্যাগট্যাগ আমার কাছে দে। ওই যে, সব লোকে পেচ্ছাপ করে বার হচ্ছে। যা ওখান থেকে কাজ সেরে আয়। তুই এলে আবার আমি যাব। এইসব কাজ সেরে নিয়ে আসল কাজে গিয়ে ভাল করে মন দেওয়া যাবে। নাহলে মন ছোঁক ছোঁক করবে কখন পেচ্ছাপে যাব। ঝপাঝপ ওরা কাজ সেরে নিজেদের জিনিস নিয়ে স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে। যাবার পথে পরপর সার দেওয়া চা, লুচি-কচুরির দোকান। মাথায় কালো পলিথিনের ছাউনি। বোঝাই যায় ফুটপাথে গাজোয়ারী করে বসা। ছেলেটা এমন মুখচোরা, কিছুতেই খাবার কথা বলবে না। খুব খিদে পেলেও না। রতন বলল, “কিরে খোকা এইবেলা একটু জলখাবার খেয়ে গেলে হয় না? কখন সময় পাব না পাব।” সনাতন চুপ করে থাকে। একটা দোকানের সামনে রতন ঢাকটা নামায়, “চল এই দোকানে। চা-কচুরি খেয়ে নিই।” খেতে খেতে রতন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে ঢাক, ঢোলের বাজার কেমন দাদা?”
“ভাল। যান, ওই ডানদিক বেঁকে স্টেশনের চত্বরে ঢুকে যান। দেখবেন আপনার মত কত লোক এতক্ষণে এসে জুটে গেছে। খেয়ে দেয়ে আর কোথাও দেরি করবেন না। দাঁড়াবার জায়গা পাবেন না।”
আর কথা না বাড়িয়ে রতনরা দ্রুত টিফিন সেরে রওনা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে খান দশেক ঢাকি-ঢোলির দল এসে গেছে। জনা তিনেক তাদের মত ঢাকি আর বাদবাকী সব ঢোল পার্টি। ওরাই তো ভিড় বাড়িয়ে দিয়েছে। এক একটা ঢোল পার্টি তো তিনজনের কম হয়না। বাঁশি নিয়ে চারজন। আর ঢাকিরা দু’জন। ঢাক আর কাঁশি। কোন কোন ঢাকির দলে অবশ্য দু’জন বা তিন’জন ঢাক থাকে। তাবে কাঁশি একজন। দু’জন থাকে, তা খুব কম। লাইনের সবশেষে যে দল দাঁড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় রতনরা। সঙ্গে সঙ্গে পাশের লোকটা বলে, “এখানে না, এখানে না। এখানে লোক আছে। তফাতে যান। উড়ে এসে জুড়ে বসতে এসেছে। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে জানেন তো? যান, দূরে সরে যান?” লোকটার কথায় থমকে যায় রতন! পাল্টা বলে, “কেন,আমি তো আগে এসেছি। আমার পরে যে আসবে সে পরে দাঁড়াবে? আপনার লোক কোথায়? দেখছি না তো!” এবার লোকটা আরও বিরক্ত হয়ে বলল, “যা বলছি শুনুন। না হলে ঝামেলা হয়ে যাবে। বলছি তো আমার লোক আছে। যখন আসবে দেখতে পাবেন।”
রতন আর কথা বাড়ালো না। নতুন এসেছে। কোথায় কি ব্যাপার আছে বুঝতে পারছে না। আসা মাত্রই লোকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রথমেই মেজাজ খিঁচে গেলে, সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। সব গোলমাল হয়ে যাবে। পাশের লোকটার কথামত যতটা তফাত করে দাঁড়াতে বলল ততটাই দূরে ওরা দাঁড়াল। বেলা তখন এগারোটার মত হবে। হঠাৎ খানতিনেক ঢোলের দল হুড়মুড়িয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল, “ও দাদা, এ’বছর ‘বউনি বছর’ বুঝি? কেটে পড়ুন এখান থেকে। নাম্বার আছে, নাম্বার? কত নাম্বার আপনার, দেখান দেখি?” রতনকে জিজ্ঞেস করে সেই আগের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের লাস্ট নাম্বার কত, পনেরো? আমার
ষোল। সরুন, সরুন। সরে যান। সেই দূরে গিয়ে দাঁড়ান। নাম্বার নেই মানে হটে যান।” এবার বিস্ময়ে রতন জিজ্ঞেস করল,“হটে যাব কোথায়? সেইখানটায় প্রথমে দাঁড়িয়েছিলাম। ওনারা বলল এখানে দাঁড়াতে। আবার আপনি হটতে বলছেন। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছি না।”
-আপনাকে অত বোঝাবার জন্যে আমরা এখানে আসিনি। পয়সা কামাতে এসেছি। যা বলছি তাই করুন। নাম্বার নেই তো আপনার কোন ঠাঁই নেই। কেটে পড়ুন। তফাতে যান, তফাতে।
কোথায় কি হচ্ছে, রতন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। দল দল আসে আর রোয়াব দেখিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়। পাল্টা রোয়াব রতন দেখাতে পারে। কিন্তু এদের এই রোয়াবের রহস্য তো তার জানা নেই। তার বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে বড় কোন বিপদে পড়ে যাবে না তো? এবার মনের মধ্যে আতঙ্ক বাসা বাঁধতে থাকে। এ কোথায় এসে ওরা পড়ল রে বাবা! কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছে না। আবার কি সব নম্বর টম্বরের কথা বলছে লোকগুলো! কোথা থেকে এরা নম্বর পাচ্ছে, কারা নম্বর দিচ্ছে। কেউ তো খোলসা করে কিছুই বলতে চাইছে না। সরকার থেকে এমন কোন ব্যবস্থা থাকলে তো অভয় তাকে শিখিয়ে দিত। সে তো এসবের কিছু বলেনি ! আতঙ্কিত হয়েই এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,“হ্যাঁরে সনাতন, ব্যাপারটা কি হচ্ছে বলতো বাবা? আমার তো মোটেই ভাল ঠেকছে না। তুই কিছু বুঝতে পারছিস? মানে, কেউ ঢাক ঢোল কাঁশি বাঁশি নিয়ে এখানে এলো আর বায়নার জন্যে মুক্ত আকাশে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাপারটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে অত সোজা সরল হিসেবের নয়। সবকিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে।” বাবার মনে এমন সন্ত্রস্ত ভাব দেখে সনাতনও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে। ভাবল, বাবাকে সাহস যোগাতে হবে। লোকের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে তাকেও মুখ খুলতে হবে। কিন্তু অন্যায় কিছু দেখলে তো তার মাথা গরম হয়ে যায়। সরাসরি প্রতিবাদ করা ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প কিছু থাকে না। তখন আবার বাবা তাকে সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়। সে তো পরের কথা, এখন এই ব্যাপারটার পেছনে অন্য কোন শক্তি কাজ করছে নিশ্চয়ই। নাহলে লোকগুলো নাম্বার বা কোথা থেকে পাচ্ছে আর এত মেজাজ দেখানোর সাহস বা এরা পায় কেমন করে ! তারপর এরা তাদের খুলে কিছু বলছে না। বললে ওরা সেইভাবে না হয় এগোতে পারে। সনাতন বুঝতে পারে ঘটনাগুলো চুপকে চুপকে হচ্ছে। তাই কেউ প্রকাশ্যে খোলসা করে কিছু বলতে চাইছে না। সেইভাবেই সবাইকে বলা আছে নিশ্চয়ই, “জানো বাবা, এই ঘটনার পেছনে অন্য কোন বড় শক্তি কাজ করছে। এই যে নাম্বারের কথা ওরা বলছে, এটা কোন সরকারি ব্যবস্থা নয়। তাহলে সরকার আগে থেকে মানুষকে জানাতো। আর এই লোকগুলো খোলসা করে সব বলে দিত। কিন্তু এই জায়গা তো সরকারি জায়গা। এখানে যে কোন মানুষ আসতে পারে। আমাদের বারবার হটিয়ে দিয়ে এই লোকগুলো যে জায়গা দখল করে নিচ্ছে তা তো পুরোপুরি বেআইনী কাজ করছে। অন্যায় করছে। অন্যায় করছে আবার চোখ রাঙাচ্ছে। আর আমরা সেই চোখ রাঙানিতে বারবার পিছু হঠছি। ওই ‘চোরের মা’র বড় গলা’র’ মত আরকি। ওই তো পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। ওদের গিয়ে বললে হয় না বাবা, আমাদের এই লোকগুলো এখানে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। শুধু ওরাই ঢাক ঢোল বাজাবে। আমরা বাজাবো না? পেট শুধু ওদের আছে, আমাদের নেই? আমরা বানের জলে ভেসে এসেছি বুঝি? সরকারি জায়গায় ওরা হটিয়ে দেবার কে? তুমি এখানে দাঁড়াও বাবা। আমি ওই পুলিশদের কাছে নালিশ জানাই। দেখি ওরা কি করে। ওরা প্রশাসনের লোক। নিশ্চয়ই আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেবে।”
সনাতন পুলিশদের গিয়ে বলতে একজন তো ক্ষেপে তার দিকে হাতের রুলবাড়ি উঁচিয়ে ধেয়ে এলো, “একটুখানি ফোচকে, আবার বড় বড় কথা! সরকারি জায়গা, সবার বসার হক আছে। যা, হটে যা। তোদের ওইসব ফালতু কথা শোনার জন্যে আমরা এখানে ডিউটি করছি না। জানিস, সরকারি জায়গায় বসতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগে? তা তোদের আছে? এমন লাঠিপেটা করব না, একদম এলাকা ছাড়া করে দেবো।” পুলিশটা হঠাৎ তার ওপর অমন করে ক্ষেপে যেতে থতমত খেয়ে যায় সনাতন। তার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। মনে হচ্ছে পা বাড়াতে গেলে সে উল্টে পড়ে যাবে। মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বাবার কাছে ফিরে আসে। মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে। সেই সময় হঠাৎ অনেকগুলো লোক হুড়মুড়িয়ে তাদের ঘিরে ফেলে। লাইনের পেছনে তাদের বাপ বেটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হাতে নাম্বারের কাগজটা নিয়ে পরপর নাম্বার মিলিয়ে দাঁড়াতে থাকে। তাদের ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিতে রাগ তার মাথায় চড়ে বসে! সে তখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার সামনের দু’জনকে ঠেলে ফেলে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়,“শালা, সেই সকাল সাতটা থেকে আমরা এখানে এসে লাইন দিচ্ছি আর এক একটা দল এসে আমাদের জোর করে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা জায়গা দখল করে নিচ্ছে? গায়ের জোর আমাদেরও আছে। কিচ্ছু বলিনি বলে ভেবেছে ধুর পার্টি না?”
তার ছেলে এমনি শান্তশিষ্ট। কিন্তু অন্যায় দেখলে ভেতরে ভেতরে ও কেমন গোমরাতে থাকে। তার উপর সেই অন্যায়কারি যদি সরাসরি তাকে জড়িয়ে অপকর্ম করে তো ও মাথা ঠিক রাখতে পারে না। কিন্তু সব জায়গায় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায় না। নিজের জীবন বিপন্ন হবার জোগাড় হতে পারে, সেই বুদ্ধি তখন তার কাজ করে না। রতন এবার প্রমাদ গুনতে থাকে। কি না কি ক্ষতি তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। যে লোকটা সনাতনের ঠেলাতে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ঠোঁট কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এই রক্ত দেখে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সন্ডা সন্ডা চেহারা। সেখানে সনাতন ছিপছিপে রোগা। মল্লযুদ্ধে সন্ডাটার কাছে সে পেরে উঠবে কেন! ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ডাটা সপাটে সনাতনের থুতনিতে মারলো এক ঘুসি! ছেলের নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। তাই দেখে রতন বিকট জোরে চিৎকার করতে শুরু করল! আশপাশ থেকে লোক জড়ো হয়ে গেল। যে তিনজন পুলিশ কাছাকাছি এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল তারা এখন হাওয়া! কোন পুলিশের দেখা নেই। ভিড়ের মধ্যে একজন রুমাল ভিজিয়ে সনাতনের মুখে চেপে ধরল। একজন আবার দৌড়ে ফেরিওলার কাছ থেকে একটা আইসক্রিম এনে ওই ভিজে রুমালে জড়িয়ে সনাতনের গোটা মুখ বুলিয়ে দিয়ে রতনকে বলল, “আপনি এইভাবে ওর সারা মুখে খানিকক্ষণ বুলিয়ে দিন। একটু পরেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। জড়ো হওয়া লোকজন এই মারপিটের কারণ শুনতে শুনতে একজন রতনকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাছে নম্বর নেই তবু আপনি এখানে এসে গুঁতোগুঁতি করছেন কেন? আপনি জানেন না, নম্বর ছাড়া এখানে দাঁড়ানো যায় না? শুধু আজ কেন ষষ্ঠি-সপ্তমী এসে গেলেও কেউ আপনাকে দাঁড়াতে দেবে না। আপনি লাথ খেতেই থাকবেন। শেষ পর্যন্ত মোক্ষম লাথ খাবেন ‘হাতকাটা ছেনোর’লোকের কাছে।”
-সেইটাই তো আমি সেই সকাল থেকে জানতে চাইছিলাম, ওই নম্বর ব্যাপারটা কি? কিন্তু কেউ আমাকে খোলসা করে বলতে চায়নি। আমি তো এ’বছর এই প্রথম এখানে এসেছি। আগে কোনদিন আসিনি। তাই এখানকার আদবকায়দা আমার জানা নেই। লোক শুধু খেদিয়েই চলেছে আমাদের।
সনাতনের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে মনে হয় লোকটার মনে একটু দয়া জেগেছিল। তাই রতনদের ভিড় থেকে আলাদা করে ডেকে ফাঁকায় নিয়ে এলো, “এই ছেলেটা আপনার কে হয়? নিশ্চয়ই ছেলে? না কি?” রতন হ্যাঁ বলতে লোকটা বলল, “এই ব্যাপারটা একদমই বেআইনী এবং গোপন ব্যাপার। সেইজন্যে কেউ আপনাকে খুলে কিছু বলবে না। নিষেধ আছে। যে বলতে যাবে, তার বিপদ। আমিও যদি প্রকাশ্যে বলি আমারও বিপদ। আমাদের ঢোল পার্টির নম্বর বাইশ। বাচ্চাটার নাকেমুখে রক্ত দেখে মনটা খারাপ লাগল। এর বয়সী আমারও ছেলে আছে। আমাদের দলেই আছে। এখন দেখালে আপনি এই জায়গা থেকে বুঝতে পারবেন না। ছেলেটাকে দেখে আমার ছেলের মুখটা ভেসে উঠল। তাই উপযাচক হয়ে আপনাদের ফাঁকায় ডেকে আনলাম। আপনারা কিছুই জানেন না। না জানলে এইভাবে আপনাদের উপর আঘাত আসতেই থাকবে। শুনুন, ‘হাতকাটা ছেনো’কে মস্তানি ফি না দিয়ে কোন ঢাক বা ঢোলের দলের এখানে দাঁড়াবার আইন নেই। এটা শিয়ালদা স্টেশনের মস্তান, হাতকাটা ছেনো-মস্তানের আইন। পুলিশী আইন এ’চত্বরে চলে না। পুলিশ এখানে ‘গোপাল ঠাকুর’। এই যে মারপিট হল, আপনাদের প্রতিপক্ষ ছেনোর কাছে নালিশ জানাতে যায়নি বলে রক্ষে। না হলে ওর স্যাঙাতরা এসে উত্তম মধ্যম কেলিয়ে এই এলাকা ছাড়া করে দিত আপনাদের। এর পরেও যদি আপনারা এখানে দাঁড়াতে চান তাহলে বলি, ওই যে বড় গেট দেখতে পাচ্ছেন। ওখান দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেবেন। পা গুনে দশ পা এগোবেন। তারপর ডানদিকে দেখবেন কালো পলিথিন টাঙানো পরপর দুটো চা দোকান আছে। ওই চা দোকান দুটোর মাঝে ফুট চারেকের ফাঁক আছে। ওই ফাঁকটা কালো পলিথিনের পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দাটা সরিয়ে আধ মিনিট এগোলে এন. আর. এস. হাসপাতালের পাঁচিলের গা ঘেঁসে একটা ক্লাবঘর মত আছে। সামনে দু’ফুটের বারান্দা, তারপর ঘর। ঘরটা আলোতে ঝলমল করছে। টিভি চলছে। আট-দশটা জিনস্ পরা ছেলে হইহুল্লোড় করছে। আর একজন একটা কাঠের চেয়ারে বাদশার মত বসে আছে। চোখদুটো তার টকটকে লাল। সবসময় চুল্লুতে চুর হয়ে আছে। ওখানে গিয়ে শুধু বলবেন, আমি নম্বর নিতে এসেছি। তারপর যা বলার ওরা সব আপনাকে জামাই আদর করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে। কোন অসুবিধা হবে না। আর একটা কথা, যদি চারফুটের গলিটা চিনতে না পারেন তো যে কোন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করবেন ছেনো স্যারের অফিসটা কোথায় ? সঙ্গে সঙ্গে সেই দোকানদার, দোকানের খদ্দের ফেলে ‘ঠাট’ মানে দোকানের ভেতরে তার বসার জায়গা থেকে নেমে এসে আপনাকে দেখিয়ে দেবে, ছেনো স্যারের অফিস! যান, আপনার তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় সটকে পড়ুন এখান থেকে। অধিকার আদায় করে আবার বুক উঁচিয়ে ফিরে আসুন। দাঁড়িয়ে পড়ুন আপনার জন্যে নির্দিষ্ট নম্বরে। তখন আর কোন ‘মা-কা-লালের’ মানে মায়ের ব্যাটার সাহস হবে না আপনাকে বাধা দেবে।”
মার খেয়ে ছেলেটার দুটো ঠোঁটই ফুলে টোবলা হয়ে গেছে। দু’পয়সা রোজগার করতে এসে এ’ভাবে ওরা অপদস্ত হবে তা কল্পনাই করতে পারেনি, রতন। কষ্টে ভেতরটা যেন কঁকিয়ে উঠছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে আরও যেন দুমড়ে পড়ে মনটা। একবার মনে হচ্ছে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। দরকার নেই টাকা রোজগার করে। পাড়াগাঁয়ে থেকে যা রোজগার হয় তাই ভাল। বেশি লোভে কাজ নেই। আবার মনে হয়, মার যখন খেয়েছি তখন এর শেষ দেখে তবে যাবো। লড়াই না করে ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়া ভীরুতা ছাড়া আর কিছু নয়। তবু ছেলেটা কি বলে একবার জিজ্ঞেস করে দেখা যাক, “হ্যাঁরে খোকা, এখন কি করা যায় বলতো? বাড়ি ফিরে যাবো, না হাতকাটা ছেনোর ডেরায় যাব? তুই কি বলিস?”
-বাবা, এসেছি, অপদস্ত হয়েছি, মার খেয়েছি। দু’পয়সা রোজগার করার জন্যে। পেটের দায়ে। অত সহজে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে তো জীবন ভর পালিয়ে বেড়াতে হবে। লড়াই না করে কে বেঁচে আছে বাবা? পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আমরা মানুষ। গরিব মানুষ থেকে বড়লোক পয়সাওলা মানুষ। কে না লড়াই করছে। তা আমরা কেন লড়াই না করে ফিরে যাব? তাহলে তো অভয়রা আমাদের দেখে হাসবে। ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি বলে টিটকারি করবে। হারার আগে হেরে বসে থাকাটা ঠিক হবে না বাবা। চলো আমরা হাতকাটা ছেনোর কাছে যাই। দেখি, ওর কি কেরামতি। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। তবে অত সহজে আমরা বাড়ি ফিরছি না বাবা। সাহস বুকে নিয়ে এগোলে দেখবে, মা শীতলা আমাদের ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবে। আসার সময় আমার মা তো বলে দিয়েছে, বিপদে মা শীতলাকে ডাকবি। মা ঠিক তোদের পাশে এসে দাঁড়াবে। যাবতীয় বাধাকে জয় করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।ক্রমশ…..
-
গল্প- জিজীবিষা
জিজীবিষা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীতিন টে দিন কেটে গেল তবু রুমকির একটা খবর পেলাম না।যখনই ফোন করছি তখন ই ফোন সুইচ অফ বলছে। অগত্যা দুশ্চিন্তা ছাড়া আমার হাতে আর কিছু রইল না।
আমার পতিদেব বরুন কে বললাম,হ্যাঁ গো তুমি আমাকে একবার রুমকির জেঠুর বাড়িতে নিয়ে যাবে।
বরুন বলল, রুমকির জেঠুর বাড়িতে কেন যাবে তুমি?
_ ও মা তোমাকে তো বলাই হয় নি যে রুমকি ওর বাবা মায়ের কাছে থাকে না। থাকে না বললে ভুল বলা হবে। বরং বলতে পারো ওর মা মানে ওর সৎ মা থাকতে দেয় না।
জানো রুমকি বলছিল ওর সৎ মা প্রতি মাসে ওর থেকে পাঁচ ঘরে কাজ করে যা পায় ।সেই টাকা টুকু ও কেড়ে নিয়ে নেয়। তার ওপর ঠিকঠাক করে খেতে পর্যন্ত দেয় না।
তবে রুমকির জেঠিমা টা ভালো। সকালের টিফিন,ভাত তো এর ওর ঘর থেকে খেয়ে নেয়। শুধু রাতের খাবার টুকু আর শোওয়ার জায়গা টুকুর জন্য জেঠিমার কাছে কাছে রুমকি।
বরুন বলে,কত আর মেয়েটার বয়স হবে।এই বয়স থেকে কত সংগ্ৰাম করে বাঁচছে। তবে ওদের এই ধরনের জীবন সংগ্ৰাম গুলো ওদের কে বড্ড তাড়াতাড়ি স্বাবলম্বী হতে শেখায়।
তা যা বলেছো।রুমকি গত মাসে আঠারো তে পা দিয়েছে। সেদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল,বীথি দিদি পোস্ট অফিসে বই খুলতে গেলে কি করতে হয় গো?
তাই নাকি? বাঃ রুমকি তো চালাক চতুর ও আছে।
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,চালাক বলে চালাক।ওর জেঠু তুতো দিদির দেওরের সঙ্গে প্রেম ও করছে।যদিও বাড়িতে কেউ কিচ্ছুটি জানে না।
বল কি গো! তবে আর রুমকি কে নিয়ে চিন্তা করো না। রসিকতা করে বলল বরুন।মানে ভ্রু জোড়া বেঁকিয়ে বললাম,মানে?
মানে অতি সোজা।রুমকি বিয়ে টিয়ে করে বসে নি তো?
আমি রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বললাম,এই রে বাবা। তাহলে আমি এখন কি করব? তিন দিন তো হয়েই গেল।আর কদিন রুমকির পথ চেয়ে বসে থাকবো।প্লিজ লক্ষ্মী টি। আমাকে আজ সন্ধ্যা বেলায় একবার নিয়ে চলো ওর জেঠিমার বাড়ি। ইচ্ছে তো করছে তুমি অফিস বের হলেই আমি বেরিয়ে পড়ি ওর জেঠুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি তো কোনদিন ও নীচু পাড়ায় যাই নি।ওর জেঠুর বাড়ি টাও চিনি না।
ঠিক আছে ঠিক আছে।এত উতলা হয়ে লাভ নেই।আমি অফিস থেকে ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো ক্ষণ।
বরুন অফিসে বের হয়ে গেলে আমি আবার রুমকির নাম্বার টা ডায়েল করলাম। অপর প্রান্ত থেকে রিং আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমার হৃদ যন্ত্রটা যেন লাফাতে শুরু করলো।
কিন্তু আমার আনন্দ নিমেষে নিরানন্দে পরিনত হল। রিং হয়ে হয়ে ফোন টা থেমে গেল।যেমন অন্ধকারে ছিলাম ঠিক তেমনি অন্ধকারে রইলাম।
ঘর দোর পরিষ্কার করে স্নান সেরে পূজায় বসলাম।ফুল দিয়ে ঠাকুর কে সাজাতে সাজাতে আবার মনে পড়ল রুমকির কথা।এর ওর বাড়ি থেকে আমার জন্য পলিথিন ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতো।আর বলত,দিদি আমার তো নিজের ঘর নেই যে ঠাকুরের আসন পারবো। আমার হয়ে তুমি ই ফুল গুলো ঠাকুর কে দিয়ে দিও।
আমি বেশ বুঝতে পারতাম রুমকির একটা নিজস্ব ঘরের লোভ আছে। ছোট থেকেই আশ্রিতা হয়ে কাটছে যে ওর জীবন। আশ্রিতা দের জীবনে ভালোবাসা কম অনুকম্পা থাকে বেশি।
পূজো সেরে সোফায় বসে একটা মাসিক ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার মোবাইল টা বেজে উঠলো।স্ক্রীনে ফুটে উঠল রুমকির ছবি ও নাম।
তাড়াতাড়ি পত্রিকা টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মোবাইল টা হাতে তুলে নিয়ে বললাম,হ্যালো
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, দিদি আমি রুমকি বলছি।
হ্যাঁ রে রুমকি তোর ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ দিদি শরীর ঠিক আছে।
তাহলে তিন দিন ধরে কাজে এলে নি না কেন?
একটু একটু আমতা আমতা করে রুমকি বলল,দিদি আমি বিয়ে করে ফেলেছি।
বলিস কি রে!তা কাকে বিয়ে করলি?
তোমাকে বলেছিলাম না আগে। আমার জেঠ তুতো দিদির দেওরের কথা।ওকেই বিয়ে করলাম।
এ তো খুব আনন্দের খবর রে।
না দিদি আনন্দ করে তো আর বিয়ে টা করতে পারলাম না।
মানে?
আসলে আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে চুপিচুপি বিয়ে টা করলাম।
কেন রে? তোর জেঠুর মেয়ে তো সব জানতো তোদের ব্যাপারে।
দিদি আর কি করবে? দিদি ওর শাশুড়ি কে বলেছিল আমাদের সম্পর্কের কথা। তাই শুনে বুড়ি বলল, আমার ছোট ছেলের বিয়ে তে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা বর পণ চাই। তবেই তোমার খুড়তুতো বোন কে আমি ঘরে তুলব।
তারপর?
তারপর আর কি। আমার বাবা তো থেকে ও নেই।জেঠু ও বললো , আমার পক্ষে এতগুলো টাকা বর পণ দেওয়া সম্ভব নয়। তখন আমার বর অজিত একটা উপায় বের করল।
কি উপায়? অবাক হয়ে বললাম আমি?
অজিত বলল,রুমকি চল আমরা ঘর ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। তাহলে তো আর বর পণ দিতে হবে না।তারপর কোথায় ঘর ভাড়া করে থাকবো।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমার মতো অভাগী কে বিয়ে করার জন্য কোনো ছেলে নিজের ঘর ও ছাড়তে রাজি ! সেদিন রাতে জেঠিমার ঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আমার করনীয় কি? আকাশ পাতাল ভাববার পর ঠিক করলাম, আমার আবার জেঠুর ঘর ছাড়তে ভয় কিসের? নিজের সব খরচ নিজেই করি। শুধু রাত টুকু জেঠুর বাড়িতে ঠাঁই নিই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,রুমকি এখন কোথায় আছিস তাহলে?
দিদি দূর্গাপুর ইসটেশনের কাছে যে বস্তি আছে সেখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি।
তা বেশ।তাহলে আগামীকাল একবার আয় বর কে নিয়ে।দেখা করে যাস একবার।
পরেরদিন অজিতের সাইকেলের সামনে বসে রুমকি এলো আমাদের বাড়িতে। সিঁথি তে মোটা সিঁদুর,হাতে শাঁখা পলা পরে কি সুন্দর দেখাচ্ছে যেন রুমকি কে।
রুমকি একগাল হেসে আমাকে বলল,দিদি আমাকে বউ এর সাজে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি ও রসিকতা করে বললাম,তোর বর এখন ও বলে নি মনে হচ্ছে।
রুমকি মুচকি হেসে বললো,ওর তো দুচোখে এক প্রেম ঝরছে।না হলে আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতো।
অজিত লাজুক হাসি দিয়ে বললো,দিদি তোমার বোন টার মন টা পরিষ্কার নয়। কেবল ফালতু কথা বলে।
আমি অজিত কে বললাম, রুমকি কিন্তু তোমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।ও এখন আর কারোর আশ্রিতা নয়।ও এখন তোমার ঘরের ঘরনী। মেয়েটাকে তোমার প্রেম দিয়ে সারাজীবন আগলে রেখ ভাই।