গল্প
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৮)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[আঠারো]
মিলন, মিলন-বউ মেয়ে অলোকাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ওদের সমাজে দেখতে শুনতে ভাল কোন সন্তান জন্মানোটা সত্যি সত্যি যেন মহাপাপ। মেয়েটা যত বড় হচ্ছে তত যেন মেয়েটার আর সেইসঙ্গে ওদের সামনে বিপদ হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্যে কাঁছা বাগাচ্ছে। বিপ্লবকে নিয়ে এই গন্ডগোলটা না পাকালে জানাই হ’ত না পাড়ার বখাটেরা তার মেয়ের পেছনে পড়ে গেছে। আচ্ছা, কি যোগ্যতা আছে নিষ্কর্মা ওই ছোঁড়াদের? এক পয়সা রোজগার করার যোগ্যতা নেই। বাপের হোটেলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। তাদের আবার সুন্দরী মেয়ে দেখে তার উপর হামলে পড়ার শখ। প্রেম করে ‘বে’ মারাবে। আরে বেটাচ্ছেলে, ‘বে’ মারিয়ে বউকে ঘরে তুলবি যে, তার আগে সেই বউয়ের ভরণ-পোষণের যোগ্যতা দেখা। দেখা মরদের জোর। তার পর তো। তা না, এদিকে ‘নোনুর’ জোর ফলাবার জন্যে উতলা হয়ে পড়েছে, হারামজাদারা ! অলোকা যদি খেঁদি-বুঁচি হত তো তাদের এই সকাল-সকাল এত বিপত্তির মধ্যে পড়তে হত না। পাড়ায় আরও তো ওর বয়সী মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বাবা-মা’দের তো এত ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না! অলোকা ওদের পাত্তা দিচ্ছে না বলেই মেয়েটার বদনাম দিতে হারামি বাচ্চারা বিপ্লবকে নিয়ে ক্যাচাল শুরু করে দিয়েছে। আরে মেনিমুখোরা, তোরা ওই বিপ্লবের নখের যগ্যি হতে পারবি? ওর মত নম্র, ভদ্র, সভ্য ছেলে পাওয়া এ’বাজারে মুশকিল। এ-অব্দি ও লেখাপড়া যা শিখেছে তার ধারেকাছে আসা তো তোদের এ-জম্মে আর হল না। সরকারের মিড-ডে-মিলের দৌলতে কেউ তিন কেলাস কেউ চার কেলাস পর্যন্ত দৌড় দেখিয়েছিস। তোদের আবার অত বীরত্ব কিসের ? বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াবার সাহস দেখাস! এবার রাগে গরগর করতে করতে মিলন মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে অলোকা, ওই বখাটে ছেলেরা যে স্কুলে যাবার সময় তোর পেছনে লাগে তা তো তুই কোনদিন বলিসনি? আমাকে না বলিস, না বললি, তোর মা’কেও তো বলিসনি? জানতে পারলে ওদের এই বাড়-বাড়ন্ত কবে ঘুচিয়ে দিতাম? আটচালায় শয়তানদের পেড়ে ফেলে মেয়েদের পেছনে লাগার সাধ মিটিয়ে দিতাম!”
মিলনের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে বুঝে অলোকার মা বলল, “মেয়ে আমাকে ওই অভয়দের কথা একদম যে বলেনি তা নয়। আমি বলেছি, ওদের কথায়, আচার আচরণে তুই কান দিবি না। ওদের পাত্তা দিলেই ওরা মাথায় উঠবে। দেখবি একদিন দমে এলিয়ে গিয়ে ওরা চুপ মেরে যাবে। তোর পেছনে লাগার জোশ হারিয়ে ফেলবে। আর এইসব খুচখাচ কথা পুরুষদের কানে শোনালে হিতে বিপরীত হয়। তাই আমি তোমাকে জানাই নি। এখন তো দেখছি সেই ভাবনা ভুল। যা ভেবেছিলাম তার থেকে ওরা আরও বেয়াড়া দেখছি। ওর লোভে পড়ে গেছে বেহায়ারা। এখনই এসব আটকাতে না পারলে বেড়ে যেতে পারে ওদের লালসা।”
অলোকার মায়ের কথায় মিলনের ভেতরে রোখ আরও যেন চেপে বসল। ঠিক করল ব্যাপারটা যখন প্রকাশ্যে ফুটে উঠেছে তখন এটাকে ধামাচাপা দিতে গেলে একটা সময় তা আরও শক্তি সঞ্চয় করে ধামা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়বে। তখন তাকে সামাল দেওয়া তার ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তাই একে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। আটচালা বসিয়ে এর একটা বিহিত করতেই হবে। সময় নষ্ট না করে মিলন পাড়ার অন্যতম মুরুব্বি-বিচারক- নন্দ, রতনের কাছে নালিশ জানাবে মনস্থ করল। রতন এমনিতেই ব্যাপারটা জানে। ওর সামনে আর নতুন করে বেশি কথা কাপচাতে হবে না। নন্দরও আর অজানা কিছু নেই।
মিলনের নালিশ পেয়ে রতন যেন মনে মনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। ওই ছোকরাগুলো সেদিনের পর থেকে বেশ কয়েকবার তাকে চাপ দিয়ে আসছে আচটালা বসাবার জন্যে। তাদের মতে সেদিন বিপ্লব আর অলোকা পাড়ার মধ্যে বেলল্লাপনা হয়েছে, তাতে তাদের পাড়ার সুনাম নষ্ট হয়েছে। বে-পাড়ার ছেলে এসে পাড়ার মধ্যেই পাড়ার মেয়েকে নিয়ে ফুসফুস গুজগুজ করে জঘন্য অন্যায় কাজ করেছে। দু’জনকেই আটচালায় ডেকে বিচার করতে হবে। ছোকরাদের অভিযোগ একদম ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারছিল না সে। ওরা যে নিয়মটার কথা বলছে, তা তো আটচালা থেকেই চালু করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, “তাদের রুইদাসদের জাতের অর্থাৎ মুচি সম্প্রদায়ের জাত-কৌলিন্য ঠিক রাখতে গেলে অন্য জাতের কারোর সঙ্গে সম্বন্ধ করে হোক বা ভালবাসা করে হোক বিয়ে করা তো কোন ছার, মেলামেশাও করা যাবে না।” সেই বিধানে ওরা এই ঘটনাটা জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু ওই বিধানে তো লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও মেলামেশা করতে পারবে না, সে কথা বলা নেই। তাহলে তো পাড়ার কোন মেয়ের আর স্কুল পাঠশালায় পাঠানো যাবে না। স্কুলে পাঠালে তো ছেলেমেয়েরা মিলমিশ করেই পড়াশোনা করবে। সেই যুক্তিতে রতন অলোকার সঙ্গে পাল পাড়ার ছেলেটার কথা বলাতে কোন দোষ দেখছে না। তাছাড়া ছেলেটা তো তাকে পড়ার বই-খাতা দিতে এসেছিল। সে যদি আটচালার বিধিনিষেধের গেরোয় এই পাড়ায় না আসে তো মিলনের মেয়েকেই পর-পাড়ায় যেতে হয়। আর পাল পাড়ায় এইসব মেলামেশার কড়াকড়ির কোন বালাই নেই। অবাধে ছেলেমেয়েরা কথাবার্তা চালায়। এত গভীরে গিয়ে ভাবার ক্ষমতা যদি এইসব ছোকরাদের থাকতো তো এদের অনেক দাম হয়ে যেত। মুর্খদের সেকথা বুঝিয়ে বললেও মুর্খরা বুঝবে না। বিচারশালায় বসিয়ে ঘাড় মটকে যদি বোঝানো যায় তো তবে যদি ওরা বোঝে।
রুইদাস পাড়ার ছেলেরা তাকে যেভাবে হেনস্থা করল তা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না পালপাড়ার ছেলে বিপ্লব। হয়তো মেয়েটার রূপের প্রতি তার একটা আলগা টান জন্মেছিল। মনে মনে অলোকাকে যে সে ভালবেসে ফেলেছে, তা কিন্তু ও স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। মেয়েটার থেকে ও দু’ক্লাস উঁচুতে পড়ে। টিউশানি পড়ার সময় অমর স্যার বলেছিল, “বিপ্লব, তোর তো এইচ. এসের পুরোনো টেস্ট পেপার বাড়িতে পড়ে আছে। সেটা অলোকাকে দিতে পারবি না? নাকি, অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছিস? ওর বাবা এখনো ওর জন্যে টেস্টপেপার কিনে উঠতে পারেনি। আর যে নোটসগুলো দিয়েছিলাম তার একটা জেরক্স কপি অলোকাকে দিয়ে দিস। জেরক্সের দাম আমি তোকে দিয়ে দেব। ইতিমধ্যে ওগুলো যদি কাউকে দিয়ে দিস তো তার কাছ থেকে নিয়ে জেরক্স করে ওকে দিয়ে দিস। যেহেতু তুই-অলোকা একই গ্রামে থাকিস এবং পাশের পাড়ায় থাকিস, তাই তোকে এই কাজটা আমি দিলাম।” স্যারের কথা ফেলবে, এ সাধ্য কার। এসব কোন কিছুই ও অন্য কাউকে দেয়নি। সবই তার কাছে আছে। তাই বিপ্লব এক কথায় রাজি হয়ে যায়। আর মেয়েটা যখন অলোকা, তখন মনে মনে ও খুশিই হয়। কেন খুশি তা সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না। তারপর তার মনে হল, শুধু পুরোনো টেস্ট পেপার দেওয়াটা খারাপ ব্যাপার হবে। তার কাছে যা টাকা আছে তাতে এবারের নতুন একটা টেস্টপেপার হয়ে যাবে। পুরোনোর সাথে নতুন একটা কিনে অলোকাকে দিয়ে আসবে। তাহলে আর ওর বাবাকে বইটা কেনার জন্যে টাকা জোগাড়ের চিন্তা করতে হবে না। এই অবস্থায় অলোকার সামনেই তাকে যেভাবে হেনস্থা করা হ’ল। অপমানে তার সমস্ত সত্ত্বা যে মাটিতে মিশে গড়াগড়ি খেলো। কিছুতেই সে তা মেনে নিতে পারছিল না। বাড়িতে বাবা-মাকে জানানোর সময় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, বিপ্লব। ছেলের কান্না দেখে মা’ও গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। বিপ্লবের মায়ের কান্নার আওয়াজ প্রকৃতিতে সওয়ার হয়ে পাশের বাড়ি টপকে এদিক ওদিকে পাড়ি দিতে লাগল। এক এক করে তাদের পাল পাড়ার অন্যরা এসে জড়ো হয় বিপ্লবদের বাড়ির উঠোনে। তাদের পাড়ার ছেলের এই অপমান অন্যরাও মেনে নিতে পারল না। এই আবহে আবার যখন সবাই শুনল, মুচিপাড়ার আটচালায় বিপ্লবকে নিয়ে বিচার বসাবার কথা বলেছে ওরা! আগুনে ঘি ফেলার মত দাউ দাউ করে রাগে জ্বলে উঠল গোটা পাল পাড়া,“শালা ছোটলোক রুইদাস, তাদের আবার এতবড় সাহস, তারা কিনা বিচার করবে আমাদের উঁচু বর্ণের ঘরের ছেলের? ও ছেলে তাদের মাস্টারের আদেশ পালন করার জন্যে ওদের পাড়ায় গিয়েছে। সে তো ওদের পাড়ার মেয়ের উপকারের জন্যে গিয়েছিল। কোথায় সেই কাজের জন্যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে। তা না করে উল্টে ছেলেটার নামে মেয়ে নিয়ে টানাটানির বদনাম দিচ্ছে? তার উপর বিপ্লবের মত লেখাপড়া করা শান্তশিষ্ট নম্র-ভদ্র ছেলেকে জড়িয়ে! এতবড় সাহস ওই ছোটলোক মুর্খ ছাগল-গরুর মাংস-চামড়া ঘাঁটা, নোংরা ঘাঁটা অচ্ছুুৎ জাতের! আমরা পালপাড়ার সবাই মিলে যাবো রুইদাস পাড়ায়। এই অপমানের জন্যে ওদের ক্ষমা চাইতে হবে। না হলে ওদের অনেক খারাপ ফলের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।”
পাল পাড়ার মান্যিগন্যি মানুষ, অনুকুল কুম্ভকার। মাটির হাঁড়ি, সরা, মালসা ছাড়াও কুমোরসজ্জার যাবতীয় জিনিস নিজের পাঁজার চুল্লিতে তৈরী করে পাইকারকে বেচে ভালই পয়সা করেছে অনুকুল পাল। ওর মত এত বড় আকারের কারবার পাড়ার কেউই করে না। আসলে অত পুঁজি সবাইয়ের নেই। অনেকে আবার তাদের উৎপাদিত মাল অনুকুল পালকে যোগান দেয়। তারপর পাড়ার মধ্যে দশের কাজে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে কোন সময় দ্বিধা করে না অনুকুল পাল। ব্যবসার লাভের পয়সা যে সবটাই নিজে খেয়ে নেয় তা নয়। তাই গ্রামের মোড়ল প্রথা উঠে গেলেও এখনও সবাই অনুকুল পালের কথা মোড়ল জ্ঞানে মানে। বিপ্লবের বিষয়টা নিয়ে পাড়ার লোকজন অনুকুল পালের কাছে গেল। পরামর্শ চাইল, তাদের এখন কি করা উচিৎ? সব কথা শুনে অনুকুল পাল বলল,“রুইদাসদের আটচালায় আমাদের যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ওখানে যাওয়া মানে আমাদের পাড়ার চরম মানহানি হওয়া। আমরা কেন ওদের বিচারের সামনে দাঁড়াবো। কি যোগ্যতা আছে ওদের, আমাদের বিচার করার? এতবড় সাহস ওরা পায় কোথা থেকে। বিপ্লব যা করেছে তাতে ওদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ আমাদের পাড়ার প্রতি। তা না করে দু’চারটে বখাটের মোদো মাতাল খামখেয়ালির শিকার আমরা হতে যাব কেন? দরকার হলে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। অতদূর যাবার আগে একটা কথা বলি, আমাদের দু’চারজন মুরুব্বিকে পাঠানো হোক ওদের ওই রতন, নন্দদের কাছে। ওরাই তো রুইদাস পাড়ার মাথা। কারণ জানতে চাওয়া হোক, আমাদের ছেলের কি অন্যায় সেটা খোলসা করে বলার জন্যে। তখন দেখবে, রতন-নন্দরা আমতা আমতা করতে থাকবে। পরিস্কার করে কিছু বলতে পারবে না। তখনই বোঝা যাবে ওই বখাটেদের চাপে ওরা বিচারের কথা বলেছে। আর সেই চাপ যদি ওরা সামলাতে না পারে তো আমাদের লোক বলে আসবে, রুইদাসদের আটচালায় নয়, বিচার বসবে পালপাড়ার ঠাকুর দালানে। এই কথা বললেই দেখবে, ওরা সিঁটিয়ে যাবে। বিচারশালা বসাবার জন্যে আর মাথাঝাড়া দেবার সাহস করবে না বাছাধনেরা।”
বিচারশালা বাতিল হয়েছে শুনে ক্ষেপে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয় অভয়-বরেণদের মত ছোকরারা। দিনমানেই চুল্লু গলায় ঢেলে প্রথমে হামলা করতে যায় রতন-নন্দদের মত পাড়ার মুরুব্বিদের বাড়ি। কোন বাছবিচার না করে পাড়ার মা-বোনেদের সামনেই অকথ্য গালাগালি দিতে থাকে তাদের। পাড়ার আর যারা বুঝদার মানুষ, তারা সেটা মেনে নিতে পারেনি। সমবেত হয়ে তাদের ঠেলেঠুলে আটচালার দালানে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়। মদের দুলুনিতে কে যে কোথায় পা ফেলে তার হিসেব কে রাখে। তবে সমান তালে মুখ দিয়ে চুল্লুর বিটকেল গন্ধের সঙ্গে বেরোতে থাকে অসহ্য সব পচাল গালাগালি। কখনো নিজেদের পাড়ার মুরুব্বিদের নিয়ে কখনো পালপাড়াকে জড়িয়ে। দুপুরে খাবার সময় হলে মানুষ যে যার মত বাড়িমুখো হতে থাকে। ভিড় পাতলা হয়ে যায়। মাতালরা কিন্তু স্বমহিমায়! অভয় আর তার অন্য স্যাঁঙাৎ মিলে মোট পাঁচজন টলমল শরীরে নির্জন আটচালা জাগিয়ে রেখেছে। হঠাৎ অভয়-মাতাল জড়ানো জিভে বলে,“চল্ সবাই, ওই শালা বিপ্লবের বিচার যখন রতন-নন্দরা করবে না তখন আমাদেরই করতে হবে। পাল পাড়ায় গিয়ে ওই শালা সতীনবেটাকে উচিৎ শিক্ষে দিয়ে আসি। এই তোদের ট্যাঁকে গরুকাটা ছুরিগুলো আছে তো? দেখে নে ভাল করে। এই দিয়ে মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোর বদলে ওই সতীন-বাবার জ্যান্ত ছাল ছাড়াবো আজ।” যেমন কথা তেমন কাজ। টলতে টলতে মুখ দিয়ে পচাল ছাড়তে ছাড়তে সতীনবেটা বিপ্লবের নামে জবাই ধ্বনি দিতে দিতে ঢুকে পড়ে পালপাড়ায়। অভয়মুচিদের হামলার কথা হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাল পাড়া। কেউ ভাতের থালা ফেলে, কেউ ভাত খেয়ে আঁচাতে আঁচাতে, কেউ বা চান করতে করতে বা চানে যেতে যেতে ছুটে আসতে থাকে তাদের রুখে দিতে। লাঠি শাবল, কোদাল গাঁইতি তো অনেকের হাতে ছিল। ওসব দিয়ে আঘাত করলে মানুষ খুনের দায়ে পড়তে হবে। তাই মুরুব্বিরা আদেশ দিলে, নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ হাঁড়ি, কলসি, সরা যাবতীয় সবকিছুর ভাঙা যার কাছে যা আছে সেই নিয়ে নিক্ষেপ করতে থাকো শত্রুর দিকে। তার আঘাতে কেটেকুটে বা মাথা ফেটে রক্ত ঝরলে বেটারা রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার কোঠরে ঢুকে যাবে।
হামলাকারি পাঁচজনই কমবেশি রক্তাক্ত হয়ে নেশা কাটিয়ে বাড়ি ফেরে ভর-দুপুরে। তাদের অবস্থা দেখে রুইদাস পাড়াও গরমাগরম হয়ে যায়! দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে কেউ আর ভাতঘুমে না গিয়ে আটচালায় এসে জড়ো হয়। দুই পাড়া যখন সম্মুখসমরে এসে দাঁড়িয়ে তখন কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা জিইয়ে রাখলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও ঘোরালো হয়ে যেতে পারে। এবার যে পক্ষ যেমন সুযোগ পাবে পরস্পরের উপর হামলে পড়া-প্রবণ হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। পালেদের পয়সার গরম আছে। মুখোমুখি টক্করে গেলে ওদের সঙ্গে রুইদাসরা পেরে উঠবে না। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি হলে কে সামলাবে? অত ট্যাঁকের জোর রুইদাস পাড়ার কার আছে? পয়সা কারোর কারোর থাকলেও তারা এতসবে নিজেদের জড়াতে চায় না। তাই ঠিক হল পঞ্চায়েতকে গোটা ব্যাপারটা জানাবে। আর্জি জানাবে দু’পক্ষকে ডেকে ওরা যাতে একটা মিটমাটের রাস্তা বাতলে দেয় সেই ব্যবস্থা করার জন্যে। সেইসঙ্গে পাড়ার কাউকে না জানিয়ে যে মাতাল ছোকরারা পালপাড়ায় ঝামেলা করতে গিয়েছিল তাদের আচ্ছা করে কড়িয়ে দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে দ্বিতীয়বার এই কাজ ওরা না করে সেটা কবুল করিয়ে নেওয়া হবে। প্রথমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। তাতে তারা বাগ না মানলে চোক রাঙানো ছাড়া উপায় থাকবে না। আপোশের কথা শুনলে প্রথম ধাক্কাতেই ওরা নিশ্চয়ই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠবে। পালেদের হাতে মার খাওয়া আর অপমানের প্রতিশোধ নেবার আস্ফালন দেখাবে। কিন্তু ভাল কথায় কাজ না হলে অগত্যা আঙুল বেঁকাতে হলে তাই করতে হবে![ঊনিশ]
ওকে নিয়ে ওইসব আজেবাজে কান্ডকারখানা ঘটার পর থেকে অলোকা পাড়ার ছেলে-বউ ঝি-ঝিউড়ি, কারোর সঙ্গে নিতান্ত দরকার ছাড়া মেলামেশা তো দূরের কথা, কথা পর্যন্ত বলে না। বাড়ির কাজকর্ম, নিজের পড়াশোনা আর দু’ভাইবোনেদের পড়িয়েই দিন কাটিয়ে দেয়। পাড়ার সার্বজনীন কোন পূজা বা উৎসবেও বাড়ি থেকে বার হয় না। ওর মত একটা শিক্ষিত মেয়ে যে পাড়ায় আছে তা বোঝার উপায় নেই। অথচ বলাই যেতে পারে, এই অলোকাই রুইদাস পাড়ার গর্বের কন্ঠমালা। এ পাড়ার ইতিহাসে প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং প্রথম একজন, যে স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজের চৌকাঠে পা দেবার যোগ্যতা দেখিয়েছে। বাইরের জগতে গোটা রুইদাস পাড়া ওকে নিয়ে গর্ব করে। পাড়ার বয়স্ক মুরুব্বি মানুষ, সুবোধ কাকা তো দিঘিরপাড় বাজারে মুখ ভর্তি বাতাস বুকে চালান করে ছাতি উঁচিয়ে বলে, “আমাদের মিলনের মেয়ে গো, ওই যে, মিলন, দক্ষিণমোড়ে যে জুতো সারাই করে, ধামা বেচে। ওরই মেয়ে। আমাদের রুইদাসদের ঘাড়ে যে গো-মুর্খ হয়ে থাকার ‘শাপ’ ভর করে ছিল, সেই শাপ ওই মেয়ে মোচন করল গো। এটা আমাদের কত গর্ব জানো তোমরা! এই শাপমোচনের পর এবার দেখবে পাড়ায় একে একে ছেলেপিলেরা লেখাপড়ায় মন দেবে। শিক্ষিত হবে।”
বড়দের এই ভাবনাগুলো সনাতনকে অনেকটাই উৎসাহিত করে। কিন্তু বাবার অভাবী করুণ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে আবার ‘নিরুৎসাহ’ এসে কেমন যেন মনটাকে গ্রাস করে। বাবা ওই যে নিজেকে ‘ক্রীতদাস’ বনে যাবার কথা বলল, সেটা ও কিছুতেই হজম করতে পারছে না। একজন বাবার মনে কত কষ্ট হলে নিজের মুখ দিয়ে এমন সাংঘাতিক কথা বার করতে পারে ! ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় করতে না পারার ব্যর্থতা তার বাবাকে কতটা কাঁদায়, এই কথার মধ্যে দিয়ে সে মর্মে মর্মে অনুভব করে। বুকের ভেতরটা কান্নায় যেন ডুকরে ডুকরে ওঠে। মনটা এমন থম মেরে যায় যে কোনকিছুই তার ভাল লাগে না। অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কেউ যাতে এই জল দেখে না ফেলে তাই তড়িঘড়ি হাতের কব্জির উল্টো দিকে দিয়ে মুছে নেবার চেষ্টা করে। এই জল যে তার একান্ত নিজস্ব। এ অন্য কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করার নয়। খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছেও চলে যায়। তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার তেমাথানি ওই ছায়াঘেরা বটের তলায় একা একা চুপচাপ বসে থাকে। হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটু দুটোর ওপর ঝুঁকে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন দখিনা বাতাসে সওয়ার হয়ে তার কানে প্রবেশ করে অমর স্যারের সেই অভয় মেশানো গলার স্বর, “যত কষ্ট হোক সনাতন, পড়াশোনা তোকে চালিয়ে যেতে হবে। তোকে বড় হতে হবে। শিক্ষিত হয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে, তোদের মত পেছিয়ে পড়া মানুষরাও সুযোগ পেলে, পারে অন্যদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে। সমাজে এগিয়ে থাকা মানুষের পায়ে পা মিলিয়ে চলার ক্ষমতা তোকে দেখিয়ে দিতে হবে। তুই পারবি সনাতন। তোর মধ্যে সেই জোশ আছে। আমি সেটা দেখতে চাই। যেমনটা দেখতে পাই তোদের পাড়ার মেয়ে অলোকার মধ্যে। যত বাধা আসুক, তুই বিচলিত হবি না। দশ পা এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে দু’পা পিছিয়ে আসার দরকার হলে তাই করবি। তবে কোন সময় পিঠটান দেবার ভাবনা স্বপ্নেও আনবি না। আবার বলছি, তুই পারবি সনাতন। আমি তোর পেছনে আছি। পিঠটান দিতে গেলেই আমার সঙ্গে তোর ধাক্কা লাগবে। আমার মুখোমুখি হলে আর তুই পিছু হটতে পারবিই না। আর, একটা মেয়ে যদি চরম প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে থেকে কঠোর লড়াই চালিয়ে যেতে পারে তাহলে তুই বা পারবি না কেন। তুই তো ছেলে-বাচ্চা। অলোকা তো মেয়ে। মেয়েদের কত অন্যায় নিয়মকানুনের শৃঙ্খল দিয়ে সমাজ বেঁধে রেখেছে। তার ওপর নিয়ত তাদের মান-সম্মান, সম্ভ্রমকে বাঁচিয়ে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে হয়। দেখলি না, অলোকাকে কত ঝড়ঝাপটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ঠান্ডা মাথায়, ভেতরের জেদকে দৃঢ়তর করে এক-পা দু’পা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে?”
বিকেল এসে দুপুরের জায়গা ততক্ষণে দখল করেছে। সনাতন তখনও মাটি থেকে ঠেলে ফুঁড়ে ওঠা সেই বটগাছের বড় শেকড়ের ওপর একভাবে হাঁটু মুড়ে বসে। আর সনাতনের মা, ছেলেকে বাবা-বাছাধন করে আকুতি মিনতি করে চলেছে খেতে আসার জন্যে। ছেলের তাতে কোন সাড়াশব্দ নেই। আর মা সমানে আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মোছে আর কপালের দোষের যুক্তি শোনায় চরাচরকে। ঠিক সেই সময় অলোকা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছে। মা-ছেলের এই রাগ-বিরাগের চিত্রপট অলোকার চোখে পড়ে। আলোকা এসে পড়তেই ঘটনাচক্রে সনাতন মুখ তুলে তাকায়। অলোকা দেখে ছেলেটার চোখদুটো জবাফুলের মত টকটকে লাল হয়ে আছে। খানিক থমকায় অলোকা। কি ভাবলো আবার এগিয়ে চলল নিজের বাড়ির দিকে। ওদের মা-ছেলের বিরাগ যাপনের মধ্যে তার প্রবেশ করাটা ঠিক হবে না ভেবেই অলোকা কোন কথা না বলে চলে যায়। তাছাড়া এমনিতেই ও, পাড়ার কারোর সাথে আর তেমনভাবে কথা বলে না। এখানে হঠাৎ এদের মধ্যে ঢুকে পড়লে ছেলেটার মা যদি মুখের ওপর কোন কথা শুনিয়ে দেয় তো, তা তার মোটেই ভাল লাগবে না। তবু ছেলেটা যেহেতু সনাতন, পাড়ার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছেলে। মাধ্যমিকে কুড়ির মধ্যে সতেরো রাঙ্ক পাওয়া ছেলে। তাই কেন যেন তার মনটা মুহূর্তের জন্যে তার চলাচলকে থমকে দিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল জানতে, কেন সে ওইভাবে বসে আছে। তার মা-ই বা কেন তার সামনে কান্নকাটি করছে। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা ভাল কিছু নয়। কি ভাল নয় সেটা জানার ইচ্ছেটা যেন প্রবল হয়ে পড়েছিল। পরে নিজেকে সামলে নেয়। অযাচিত উৎসাহ দেখানোর ফলটা যদি তার পক্ষে না যায়?
অলোকা চলে যাবার পরই সনাতন বটের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মা তার আদরমাখা হাতটা বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। সনাতন নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরে। মা তার পেছু পেছু এগিয়ে যায়। উঠোন থেকে দাবায় ওঠা সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে বসে পড়ে সনাতন। ঘুঁটের ছাই দিয়ে মাজা চকচকে কাঁসার ঘটিটা দাবায় রাখা বালতির জলে চুবিয়ে এক ঘটি জল নিয়ে ছেলের মুখ চোখে জল হাত বুলিয়ে ভাল করে ধুয়ে দেয় মা। বামুন ঠাকুরের কাছ থেকে কেনা কমদামী জালি পাতলা গামছা দিয়ে ছেলের মুখ চোখের ভেজা জল পরম মমতায় মুছিয়ে দিয়ে বলে, “বয়ে যাওয়া বেলায় আর ভাত খেতে হবে না। গরমে মুগের ডালটা টকসি টকসি লাগছে। আলুভাতেটা মাখা ছিল না বলে এখনো টকেনি। এখন মুড়ি খা। সন্ধ্যে গরম ভাতেভাত করে দেব’খন। মুড়ি খেয়ে একটু গড়িয়ে নে। শরীরটা ধকল খেয়েছে। একটু শুয়ে না নিলে কাহিল হয়ে যাবি।”
কলের জলে মুড়ি ভিজিয়ে কিছুক্ষণ রাখে সনাতনের মা, পুষ্প। ভেজানো মুড়ি হাতের আঙুলের ছাকনিতে তুলে পেতলের কাঁশি-বাটিতে রাখে। ভেজানো মুড়িতে উপর উপর চার চিমটে ধুলো চিনি ছড়িয়ে দিয়ে সনাতনের সামনে ধরে,“আমি খাইয়ে দেব বাবা? তুই বস। আমি খাইয়ে দিই। তুই নিজের হাতে খেতে গেলে আবার তোকে হাত ধুতে উঠতে হবে।” মায়ের কথায় চুপ থাকে ছেলে। চুপ থেকে সম্মতি জানায়।
এই ভেজানো হাতে-ছাঁকা মুড়ি এরা দুই বাপ-বেটা খুব পছন্দ করে। মুড়ির উপর একটু চিনির ধুলো ছড়িয়ে দিলে পরম তৃপ্তিতে তা খেয়ে নিতে পারে। বড় দানার চিনির তো দাম বেশি। অত বড়লোকী চাল দেখানোতে ওদের কাজ নেই। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে আর কি। পুষ্প এই খাওয়াটা শ্বশুরবাড়িতে এসে শিখেছে। খুব একটা যে আহামরি মুখোরোচক খাবার তা সে জোর দিয়ে বলতে পারবে না। আবার একদম খেতে পারবে না তাও কিন্তু নয়। প্রথম প্রথম পুষ্পর খেতে একটু অস্বস্তি হ’ত। এখন খারাপ লাগে না। সনাতনের বাবা তো বলে, “ভেজানো মুড়ি ছেঁকে তুলে চিনি অথবা নুন-লঙ্কা দিয়ে খেতে খারাপ লাগে না। আর এই খাবার একদম শুদ্ধ খাবার। মুড়ি জলে ভিজিয়ে রাখলে মুড়ির গায়ে যে বালির ধুলো লেগে থাকে তা ধুয়ে জলের তলায় নেমে যায়। শুকনো মুড়ি খেলে যেটা হবার নয়। পেট ঠান্ডাও করে এই খাবার। সেটা পুষ্প দেখেছে। মুড়ি ছেঁকে নেবার পর জলের তলায় অনেক কালো কালো ময়লা পড়ে থাকে। ওদের বাপেরবাড়ি এই খাবারের চল নেই। মালদার হরিশচন্দ্রপুরের বাপের বাড়ি থেকে বাবা প্রথম যখন মেয়ের বাড়ি আসে, পুষ্প খাইয়েছিল এই খাবার। একটা বাটিতে চিনি দিয়ে আর একটায় নুন-লঙ্কা দিয়ে। অল্প অল্প করেই দিয়েছিল। বাবা তো প্রথমে এই খাবার দেখে বিষ্ময়ে বড় বড় চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল, “এটা কি খাবার রে মা? প্রথম ভাবলাম এটা চিড়ে ভেজানো। কিন্তু না-তো! এ তো মুড়ি? মুড়ি আবার এমন করে খাওয়া যায়?” মৃদু হেসে পুষ্প বলেছিল,“দুটো বাটিতে দু’রকম ভাবে তৈরী। খেয়ে দেখো, কেমন লাগে?” তা বাবা দুটোই খেয়েছিল। চিনির থেকে নুন-লঙ্কা মাখানোটা বাবার বেশি পছন্দ হয়েছিল, “বাঃ ভালই খেলাম রে মা নতুন খাবারটা। তোর মা’কে গিয়ে গল্প করব। তবে চিনির থেকে নোনতা ঝালটা পছন্দ হ’ল।” সনাতনের বাবাও নোনতা-ঝালটাই বেশি সময় চায়। আর তার উল্টো, ছেলেটা। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদটাই ওর ভীষণ প্রিয়।
নিজ হাতে পরম মমতায় ছেলেকে খাইয়ে দেয় পুষ্প। পছন্দের খাবার পেয়ে আর ‘না’ করেনি সনাতন। মায়ের দেয়া অমৃত তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নেয়। কাঁসার ভারি গ্লাসে এক গ্লাস জল মায়ের হাত থেকে নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে নিয়ে বলে, “মা, এখন শুতে গেলে আমার চলবে না। অলোকাদিদের বাড়ি যাবো। খুব দরকার আছে। না গেলে আমার চলবে না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করা যাবে না।” ছেলের কথায় অবাক হয়ে যায় পুষ্প,“সে কি রে! হঠাৎ ওদের বাড়ি যাবি যে? কোনদিন তো তুই ওদের বাড়ি যাসনি? তাছাড়া ও তো পাড়ার কারোর সঙ্গে কথা বলে না। নিজের গোমরে থাকে। পাড়ার প্রথম শিক্ষিত মেয়ে। আর সবাই গো-মুখ্যু। তুই গেলে তোকে পাত্তা দেবে? তা হঠাৎ কি দরকার পড়ল ওর সঙ্গে? আমার তো মনে হয় ওদের বাড়িতে তোকে ঢুকতেই দেবে না! তা তখন তো ও তোর-আমার সামনে দিয়েই কলেজ থেকে ফিরল। দরকারটা তখনই তো সেরে নিতে পারতিস। সন্ধ্যে হয়ে এল। এই সময় লোকের বাড়ি যাওয়াটা ঠিক? ওদের বাড়ি পাল পাড়ার ওই ছেলেটা যাওয়া নিয়ে কত-না ঝামেলা অশান্তি হয়ে গেল। এখনো তার দাগ মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। কোনদিন যাবে বলে মনেও হয় না। তারপর তুইও বড় হচ্ছিস!”
মায়ের কথায় বিরক্ত হয় সনাতন, “না- জেনেশুনে কারোর নামে আজেবাজে কথা বলা ঠিক না, মা। লেখাপড়া তো তোমার ছেলেও শিখছে। তাহলে তোমার কথা মত তোমার ছেলেরও তো গোমরে মাটিতে পা না পড়াই উচিৎ। কেউ যদি তোমার ছেলের নামে এমন কথা বলে তাহলে তুমি সেকথা হজম করতে পারবে মা? আমার দরকারে আমি যাচ্ছি। তা সে যদি সেই দরকার মেটাতে না পারে, না পারবে। আমার তাতে কিছু মনে করার নেই তো? আর এটা তুমি নিশ্চয়ই জানো অলোকাদি আমার থেকে চার বছরের বড়। তোমাদের কাছেই এ’কথা আমার শোনা। সন্ধ্যে ছাড়া কখন যাবো ওদের বাড়ি? সক্কাল হলেই তো অলোকাদি কলেজ যাবার তোড়জোড় শুরু করে দেবে। আবার সেই কবে রবিবার আসবে তবে। অতদিন অপেক্ষা করা যাবে না। তোমার সনাতনের প্রতি এই বিশ্বাসটা তুমি রাখতে পারো মা।” ছেলের কথার পিঠে আর কথা চাপাতে চাইল না পুষ্প। শুধু বলল, “বেশি রাত করিসনি। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে আসিস।”
পাড়ার মূল রাস্তা থেকে বাঁয়ে ঘুরে অলোকাদিদের বাড়িমুখো হলেই ওদের বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোনটা পড়ে। ফাঁকা নিকোনো উঠোন পেরিয়ে তবে মাটির উঁচু দাবায় ওঠা যায়। কেউ উঠোনে পা দিলেই বাড়ির দাবা থেকে তা দেখা যায়। সনাতন ওদিকে নামতে উঠোনের দিকের বাল্বের আলো জ্বলে উঠল। সেই আলো ভেদ করে সনাতন বাড়ির দিকের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওর উল্টোদিকের সবাই ওকে দেখতে পাচ্ছে। সনাতনকে দেখে অলোকা দাবার উপরে পইটের সামনে এসে দাঁড়ায়,“কি রে সনাতন, তুই হঠাৎ আমাদের বাড়ি? কোনদিন তো আসিসনি?” অলোকাদির এমন কথার জন্যে তৈরী ছিল না সনাতন। অপ্রস্তুতে থমকে যায় সে। গলাটা যেন শুকনো হয়ে গেল হঠাৎ। কি বলবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। কিন্তু প্রশ্ন যেমনটাই হোক উত্তর তো তাকে দিতেই হবে। তাই গলা ফুঁড়ে বার না হতে চাওয়া কথা জোর করে ফোটাতে গিয়ে ফসফস করে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল! কি শব্দ তা সে নিজেই বুঝতে পারল না। বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা খাকরি দিয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে অলোকাদি।” সঙ্গে সঙ্গে অলোকা বলল, “তা উঠোনে দাঁড়িয়ে কি কথা বলবি, উপরে দাবায় উঠে আয়।”
দাবায় উঠতে পাট-দড়ির দোলা দেখিয়ে অলোকাদি বলল, “এই দোলাটায় তুই বস, সনাতন।”
-তুমি বসো দিদি। আমি দাঁড়িয়ে আছি।
-এই বোকা, তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস। তোকে বসতে না দিয়ে আমি বসে পড়বো? সে আবার হয় নাকি!
সঙ্গে সঙ্গে অলোকাদির মা রান্নাঘর থেকে বলল,“অলোকা তুই ঘরের ভেতর থেকে মোড়াটা নিয়ে ওর সামনে বস। ও দোলায় বসবে আর তুই দাঁড়িয়ে থাকবি, তাতে ও কিন্তু কিন্তু করছে। ঘরের দরজার ডানদিকে ওটা আছে। নিয়ে আয়।”
মোড়াটা নিয়ে সনাতনের সামনে বসতে বসতে অলোকা বলল,“কি দরকারে এসেছিস বল।”
সনাতন তারপরও চুপ করে থাকে। কিভাবে কথাটা অলোকাদির সামনে পাড়বে তা বুঝে উঠতৈ পারছে না যেন। উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পেপারের কথা বলার আগে বিপ্লবদার নামটা তুলবে না কি! বিপ্লবদার নাম করে বললে সহজেই অলোকাদি বুঝে যাবে ঠিক কোন বইটা সে চাইছে। কেননা ওটা বিপ্লবদা ওকে দিয়েছিল। আর এইটা দিতে এসেই তো দুই পাড়ার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল। এখনো সড়গড় হয়নি। তাহলে আবার অলোকাদির মনটা বিগড়ে যাবে না তো? এখন বিপ্লবদার প্রতি অলোকাদির ধারণা বা সম্পর্ক কেমন তা তো জানা নেই। ভাল সম্পর্ক থাকলে ভাল কথা। আর যদি তা না হয় তো তার কপাল মন্দ। আবার অলোকাদি কথা তোলে, “কিরে ছেলে, আমার সঙ্গে দরকার আছে বললি, আর কি দরকার তা বলতে পারছিস না? সে আবার কেমন কথা! মনে হচ্ছে কথাটা বলতে তোর ভয় ভয় করছে। আরে বাবা আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে দেখে ভয়ে চুপ করে আছিস?” সনাতন দেখল এরপর আর চুপ মেরে থাকাটা ঠিক কাজ হবে না। অন্যকিছু ভাবতে পারে অলোকাদি। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেতর থেকে একটা বল পেয়ে গেল। বলল, “দিদি, তোমার উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টপেপারটা আমাকে দেবে? নতুন টেস্টপেপার বাবা কিনে দিতে পারবে না। অমর স্যার ভাল করে টেস্টপেপার প্র্যাক্টিস করতে বলেছে। এখন টেস্টপেপার কোথায় পাই? বন্ধুদের অনেকের কাছে চেয়েছি। কিছুদিনের জন্যে চেয়েছিলাম। রাতদিন করে পড়ে ফেরত দেব বলেছিলাম। এক সপ্তাহের জন্যেও কেউ দিল না। তাই ভাবলাম তুমি উচ্চমাধ্যমিকের সময় যে টেস্টপেপারে প্র্যাকটিস করেছো সেটা যদি পাই তবু কিছুটা কাজে দিতে পারে। পুরোনো হলেও, সেখানে তো অনেক প্রশ্ন-উত্তর আছে। বইয়ের চ্যাপটার তো পাল্টায়নি। তোমাদের সময় যে চ্যাপটারগুলো ছিল এখনো তাই আছে। শুধু বাংলার টেক্সট বইয়ে খান দুই গল্প পাল্টেছে।”
তার কাছে টেস্টপেপার আছে তা সনাতন জানলো কেমন করে? যেহেতু সে উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গেছে এবং এ’সময় সবাই এই বই ব্যবহার করে, সেই ভাবনায় আন্দাজে তার কাছে এটা আছে ধরে নিয়ে এসেছে? না কি, তার জীবনের সেই কালো দিনটার কথা ছেলেটা ভাল করেই জানে? বিপ্লবের তাদের বাড়িতে আসার কথা, তাকে বিষয় করে পাড়ার বদমায়েশদের টানাহেঁচড়া করা। সব ঘটনা জেনেই কি সনাতন এসেছে? সনাতন বইটা চাওয়ার পর খানিক চুপ করে থেকে কথাগুলো ভাবল অলোকা। তারপর দু’হাতের আঙুলের ফাঁকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া চুলগুলো গুছিয়ে পেছনের দিকে ফেলে বলল, “আমার কাছে টেস্টপেপার আছে তুই জানলি কি করে, সনাতন? ওটা কিনে দেবার সামর্থ আমার বাবার তো ছিল না। তোর বাবার মত অবস্থা আমার বাবারও। তোকে কেউ কি বলেছে?”
অলোকাদির এমন পাল্টা প্রশ্নে সনাতন কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণের জন্যে মনটা ওকে থমকে দেয়। ঠিক কি বললে অলোকাদি কিছু মনে করবে না সেসব সাত সতেরো ভাবতে থাকে। কিন্তু জুতসই কোন তোষামোদি কথা সে খুঁজে পেল না। বড়ই বিড়ম্বনার ব্যাপার। আসলে একটা ঠিক কথাকে চাপা দিতে গিয়ে অনেকগুলো বেঠিক কথা সাজাতে হয়। আর শেষ পর্যন্ত অন্যপক্ষ নিশ্চিতও হয়ে যায় যে সে ঠিক কথা বলছে না। তাতে নিজেকে ছোট হতে হয়। তাই সত্যি কথাই বলতে চাইল সনাতন, “জানো তো অলোকাদি, সেই যে তোমাকে জড়িয়ে বিপ্লবদার সঙ্গে পাড়ায় ঝামেলা হয়েছিল না, তখন এই টেস্টপেপার-টেস্টপেপার কথা খুব চাউর হয়ে গেছিল। যারা চাউর করছিল তারা কিন্তু টেস্টপেপার কি, খায় না মাখে তার কিচ্ছু জানে না। সবই তো ‘ক’ অক্ষর গো মাংস’র দল। মাধ্যমিকে আমি টেস্টপেপার ঘেঁটেছি, তাই ওটা আমার মাথায় থেকে গেছিল। এখন আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম কেমন করে টেস্টপেপার জোগাড় করি। নিরুপায়ে তাই তোমার পুরোনোটা নিয়েই কাজ চালিয়ে দেব ভাবি। বিপ্লবদার কথা তুললাম বলে তুমি কিছু মনে করলে, দিদি? আমি কিন্তু ইতস্তত করছিলাম বিপ্লবদার নামটা তুলতে। তোমাকে তুষ্ট রাখতে ঘুরিয়ে অন্য কথা বলা যায় কি না ভাবছিলাম। কিন্তু মিথ্যা বলতে বাঁধছিল। তাই সত্যিটা বলে দিলাম।”
কিঞ্চিৎ উদাসী হয়ে গেল যেন অলোকাদি, তার কথায়। শূন্যে দৃষ্টি উঁচিয়ে অলোকাদি বলল,“কি আর মনে করবো বল ভাই। যা সত্যি তা সত্যিই। সেটা কখনো মিথ্যা হয়ে নবরূপ নিতে পারে না। এটা তুই তো মানবি যে বিপ্লবদার মত সমকক্ষ একটা ছেলে আমাদের এই রুইদাস পাড়ায় পাওয়া যাবে না। আমাদের পাড়া কেন, ওদের পাল পাড়াতেও পাওয়া যাবে না। আমাকে কত উপকার করেছে তা আমি জানি। ও যদি আমার পাশে না থাকতো তো আমি নিজেদের চেষ্টায় এতটা লেখাপড়া করতে পারতাম না। অসম্ভব ছিল আমাদের পক্ষে। কত বই-খাতা-নোটস্ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে জানিস? তার নখের যোগ্য হতে পারবে রুইদাস পাড়ার ওইসব অসভ্যগুলো? ওরাই আবার আমাকে পেতে চায়। কতবড় স্পর্ধা ! তোর কথায় আমার মনে করার কি আছে। বরং আমি খুশি হয়েছি, তুই সত্যি কথাটা বলতে পেরেছিস বলে। পাড়ার ছেলে হিসেবে তোরও সবটা জানা দরকার। তাই তুই ছোট হলেও বড় দিদির কথা তোকে বললাম। আর একটা কথা কি জানিস তো সনাতন, তোর জীবনখাত আর আমার, বলা যেতে পারে প্রায় একই খাতে বইছে। তোকে যেমন অভাবের সঙ্গে, বদ্ধ সমাজের সঙ্গে লড়ে এগোতে হচ্ছে, আমারও তাই। মেয়ে হিসেবে আমার সমস্যা আরও অনেকটা বেশি এই যা। দিনমানে হলেও, আমি যে এই একা একা বাড়ির বাইরে বার হতে পারছি, কলেজে যেতে পারছি। তা তো আমার কত-জন্মের সৌভাগ্য। এই সেদিন পর্যন্ত। আমাদের মায়েদের সময়। মেয়েদের, আমাদের মত একা বাইরে পা বাড়াবার আইন ছিল? সেই দুঃসাহস কেউ দেখালে সেই মেয়ের জীবন সমাজের কাছে বলি প্রদত্ত হয়ে যেত। তুলনামূলকভাবে আমাদের রুইদাসপাড়া এই ব্যাপারে বলা যেতে পারে এই হালে করে একটু সাবালক হয়েছে। পাড়ার লোকজন, মুরুব্বিরা রুজি রোগারের তাড়নায় বাইরে এদিক সেদিক বার হতে বাধ্য হচ্ছে। বৃহত্তর সমাজে মেলামেশা করছে বলে বদ্ধতা থেকে কিঞ্চিৎ খোলা মন হতে পেরেছে। এখন বাদ দে ওসব। যে কথা বলছিলাম, আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় বটগাছ তলায় অমন হতাশ এবং মনঃকষ্টে বসে আছিস দেখে আমি বুঝেছিলাম তোর লড়াইটা কত প্রকট। অসহায় তোর মা ছেলের এই কষ্টে মুহ্যমান। হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখে ক্ষণিকের জন্যে আমি থমকে গেছিলাম। নিজেকে ধরে রাখতে পারব না বলে আমি কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। আমারই বা কত ক্ষমতা বল। তোর চলাফেরা, লেখাপড়ার সব খবর রাখার চেষ্টা করি আমি। হয়তো সবটা সবসময় জেনে উঠতে পারিনি। তবু চেষ্টা জারি রাখি। মাধ্যমিকে তুই অত ভাল রেজাল্ট করেছিস। তা কি আমাদের কম গর্বের বিষয়। তবু পাড়ার কেউ তোর পাশে এসে দাঁড়ায় না। যার সামর্থ আছে সেও না। আর যার নেই সে তো নয়ই। কিন্তু এই নেই-ওয়ালারা তো মানসিক শক্তি, সাহস যোগাতে পারে। সেই বোধেরও কত অভাব। সবসময় কেমন করে চুল্লু, মদ পাওয়া যায় সেই চিন্তায় দিন কাবারে ব্যস্ত থাকলে আর সুস্থ চিন্তা তাদের মধ্যে আসবে কেমন করে! তুই আমাদের বাড়ি এসে ঠিক কাজটাই করেছিস। আমার পক্ষে তোর পড়াশোনায় যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব আমি করব। প্রয়োজন হলেই তুই আমার কাছে চলে আসবি। কোন দ্বিধা করবি না। আমার কাছে দুটো টেস্ট পেপার আছে। দুটোই বিপ্লবদা দিয়েছিল। একটা পুরোনো, আর একটা নতুন কিনে দিয়েছিল বিপ্লবদা। সঙ্গে অমর স্যারের দেওয়া ভাল ভাল কিছু নোটস্ও আমাকে দিয়েছিল। এখন টেস্টপেপার দুটো নিয়ে যা। নোটগুলো অন্য দিন নিয়ে যাস। এদিক ওদিক সব খাতা-বইয়ের ভেতর লুকিয়ে আছে। গুছিয়ে একসাথে করে নিই। সামনের রবিবার তুই আসিস।পেয়ে যাবি। ভাল করে পড়। মাধ্যমিকের থেকে উচ্চমাধ্যমিক আরও টাফ্। সেটা তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। দেখা গেছে অনেকে মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট করেও উচ্চমাধ্যমিকে সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। সেটা মাথায় রেখে এগোবি। তবে পাশাপাশি একটা কথা মনে রাখবি, আমরা কিন্তু ছাপোষা ঘরের ছেলেমেয়ে। তারপর তুই ছেলে। বড় হচ্ছিস। অভাবী সংসারে বাবার একটু হাতেধরা হতে হয়। আলালের ঘরের দুলাল হয়ে শুধু বইয়ে মুখগুঁজে থাকার কপাল আমাদের নয় রে সনাতন। সংসারকে বাঁচাতে তোকে বাবার সঙ্গও দিতে হবে। বাবার কষ্টের মুখটার দিকেও তোকে তাকাতে হবে। প্রচুর প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে। সবটার সঙ্গেই লড়াই করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মনে জোর রাখ। দেখবি সাফল্য তোর কাছে ধরা না দিয়ে পারবে না। সাফল্য কিন্তু উপযুক্ত পাত্রে ধরা দেবার জন্যে সবসময় মুখিয়ে থাকে। জাত-বেজাত গরিব-ধনীর কোন ছুৎমার্গ তার নেই।”
কথায় কথায় অনেকটা সময় চলে যায়। রাস্তা থেকে এক ব্যাটারির কমদামী চর্টলাইটের টিমটিমে আলো এসে পড়ে অলোকাদের উঠোনে। সনাতনের মায়ের গলা ঠিকরে আসে এদিকে, “সনাতন, সনাতন! সনাতন?”
সঙ্গে সঙ্গে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ায় অলোকা, “ওই তোর মা ডাকছে সনাতন। যা। অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছিস। চলে যা। রবিবার আসিস।” সনাতন দোলা থেকে উঠে টেস্টপেপার দুটো বাঁ-হাতে নিয়ে সাড়া দিল,“যাচ্ছি মা ! আলোটা এদিকে ধরো। অলোকাদি, আসছি। রবিবার সন্ধ্যে উপচে আসব। ওইদিন দুপুরে বাবার সঙ্গে হাটে যাবো ধামা-পালি বেচতে।”[কুড়ি]
বাবার ‘হাতে-ধরা’ হতে মাঝে মাঝে সময় পেলেই সনাতন দিঘিরপাড়ে জুতো সারাই দোকানে বসে। জুতোর কোন ধরণের সারাইয়ে কত দাম, তা সে দোকানে থেকে থেকে শিখে গেছে। ইনবাইসের শুঁড়ের ভেতর জুতোর ছেঁড়া অংশটা ঢুকিয়ে বাটালি দিয়ে ধুম ধুম করে কেঁটকী মেরে সারাইয়ে সবচেয়ে সস্তা পড়ে। তারপর ফোঁড়-সূতো দিয়ে সেলাইয়ে একটু বেশি দাম পড়ে। সবচেয়ে দামী সারাই হল, চামড়া জুড়ে জুতো সারাই। একটু বাবুবাবু দেখতে খদ্দের হলে, সনাতন দেখেছে, তার বাবা জিজ্ঞেস করে,“চামড়া দিয়ে সেলাই করে দেব বাবু? মজবুত হবে। অনেকদিন টিকে যাবে। তবে কেঁটকীর থেকে দাম বেশি পড়বে। আর কেঁটকী সেলাইয়ের কোন গ্যারান্টি নেই। আপনার জুতোর শরীরের যা হাল, এতে সূতো দিয়ে সেলাই করলে, সেলাই ধরে রাখা যাবে। ফেঁসে যাবে না জুতোর শরীর।” কেউ বাবার কথায় রাজি হয়, কেউ না হয়ে বলে, “ও তুমি কেঁটকী মেরেই দাও রতন। এ জুতোর আয়ু হয়ে এসেছে। অত যত্ন ওর কপালে সইবে না।” আর পথ চলতি মহিলা খদ্দের? যত জন, তত রকম ভাবনা। তারা এত ব্যস্ত যে চমড়া দিয়ে তাপ্পি মারার সময় তাদের হাতে নেই। জুতোর শোল থেকে খুলে বেরিয়ে গেছে উপরের অংশ। আঠা খুলে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে জুতোটা নতুন। বাবা বলল, “দিদিমণি, এ তো নতুন জুতো। কেঁটকী মারলে শোল-চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন চামড়া জুড়ে সেলাই করে দিই। দশ টাকা লাগবে।” ব্যস্ততায় খরিদ্দার বলল, “কেঁটকী তিন টাকা আর সেলাই দশ? একটাকা বেশি নাও, চারটাকা দেব। চামড়া দিয়ে সারিয়ে দাও।
-না দিদিমণি। হবে না। বলছেন যখন তখন আট টাকা দেবেন। আমার চামড়ার দাম আছে না?
-ঠিক আছে, তোমার দামী চামড়া তোমার কাছে রাখো। কেঁটকীই মারো। আমার তাড়া আছে। কোন রকমে বাড়িতে যেতে পারলেই হল। আবার এই ফালতু জুতো পায়ে গলাবো নাকি!
খদ্দের চলে গেলে রতন ছেলেকে বলল, “দেখবি, ওই মেয়েটা ফের ওই জুতো পরেই বাইরে বার হবে। কেঁটকী আর ক’দিন সামলে রাখবে। দু’চার দিনের মধ্যেই হার মানবে সে। মেয়েটাকে আমি চিনি। আলুপোতায় বাড়ি। হাঁটা পথে এখান থেকে আধ ঘন্টা সময় লাগে। তার উপর রাস্তা উবলো খাবলা।” কথাটা বলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় রতন,“আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি রে বাবা। মিলিয়ে নিস কথাটা। আর চামড়ার কথা উপযাচক হয়ে কেন খদ্দেরকে বলি জানিস, এতে দুটো পয়সা চোখে দেখা যায়। ব্যবসার এটা একটা কৌশল। মানুষকে না ঠকিয়ে যদি একটু বেশি আয় করা যায় সেটাতে তো কোন অন্যায় নেই!”
সেদিনটাও রবিবার ছিল। সনাতন বাবার সাথে দোকানে। ও দেখল, সেই মেয়েটাই ‘রতনদা রতনদা’ বলে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে,“রতনদা, জুতোটা ছিঁড়ে গেছে। সেরে দাও না। বড্ড তাড়া আছে। বাড়ি ফিরতে হবে।” সনাতন দেখল, সেই জুতোটাই, যেটা সেদিন তার বাবা কেঁটকী মেরে সারিয়ে দিয়েছিল। ওর বাবা আর কোন কথা না বাড়িয়ে কয়েকটা কেঁটকী ধপাং ধপাং করে মারতে শুরু করে দেয়। ব্যস্ত খরিদ্দার, তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে। তাই তারও ব্যস্ততার অন্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বলল,“কি করছো রতনদা। কেঁটকী মারছো কেন? আমি তোমাকে কেঁটকী মারতে বললাম? কেঁটকী মারলে তো আবার তা খুলে যাবে। মাঝ পাথে ছেঁড়া জুতো পায়ে ন্যংচাতে ন্যংচাতে আসা। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার। সব ছেলেরা তাকিয়ে থাকে। ইস্ যাচ্ছেতাই ব্যাপার। চামড়া দিয়ে সেলাই করে দাও ভাল করে। দেখবে, যেন কেঁটকীর মত রাস্তাঘাটে সেলাই খুলে না যায়।”
এবার একটু বিরক্ত হল রতন, “আপনি তো দিদিমণি বলেননি যে চামড়া দিয়ে সেলাই করতে হবে। তাড়া আছে বললেন। সেলাই করতে হলে তো আমাকে সময় দিতে হবে। সে সময় তো আপনার কাছে নেই! এখন তো দুটো কেঁটকী আমার মারা হয়ে গেছে। কি করবো এখন?”
-ও দুটো খুলে সেলাই করে দাও। বাব্বা, আবার ওই কেঁটকীর চক্করে আমি যাই। তুমি সেলাই করে দাও রতনদা। আমি অপেক্ষা করছি।
-আমার যে দুটো কেঁটকী নষ্ট হয়ে গেল। তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আপনি দেবেন তো? তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
এবার মেয়েটা নরম হয়ে বলল, “ছেড়ে দাও রতনদা। ওর দাম নিয়ে আর চাপাচাপি কোরো না। দেখো আমরা তো তোমার বাঁধা খদ্দের বলো? সুবিধে অসুবিধে হলে আমরা কি অন্য কোথাও যাই? যাই না। তোমার কাছেই আসি।” রতন আর কথা বাড়ালো না। কারবারে সবসময় চুলচেরা হিসেব করলে হয় না। কোনটায় লাভ কম কোনটায় পুষিয়ে যায়।
পাশে সনাতন তখন একটা খদ্দেরের বুট পালিশ করছিল। খদ্দের ছেড়ে রতন বলল,“দেখলি খোকা, আমার কথা মিলে গেল তো। এরকম কত ধরণের খদ্দের সামলাতে হয় দেখ। তুই তখন আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলিস। কেন, তা আমি বুঝিনি মনে করেছিস ? বুঝেছি। ভাবছিলিস বাবা মেয়েটার কাছ থেকে কেঁটকীর দাম নিল না কেন? আমাদের দোকানের তাহলে তো লস্ হয়ে গেল! তোর ভাবনায় ভুল নেই। কিন্তু অনেক সময় মানুষকে দরকারে একটু পিছিয়ে গেলে দোষের কিছু না রে। আখেরে সেটা ভালই হয়। এগিয়ে যাবার রাস্তা খুলে দেয় ওই পিছড়েবর্গ। দেখবি, ওই মেয়েটা দরকারে আমাদের কাছেই আসবে। এই যে ওর কাছ থেকে দাম কম নিলাম, আমার প্রতি ওর বিশ্বাসটা পাকা হয়ে গেল যে রতন জুতোওলা এক পয়সার মা বাপ না। একটা ভাল ভাবনা আমাদের প্রতি ওর মনে পাকা হয়ে রইল। ওই খদ্দেরটাই আমাদের হয়ে অন্য খদ্দেরকে সুপারিশ করবে। তাই বলে সবসময় ঢালাও ছাড় দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সেটা আমরা পারবো কেন। আমাদের ছোট্ট কলিজা। বেশি ধকল সইতে পারবো না।”
একটা অফিসবাবু বুট পালিশ করতে দিয়ে বাজার করতে গেছে। সনাতন সেটা পালিশ করে কাঠের বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ছেলের পালিশ দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হয় রতন। এই কাজটা ছেলে ভালই রপ্ত করেছে। চকচক করছে জুতোটা। ওর সামনে মুখ রাখলে মুখ দেখা যাচ্ছে। ওর মনে এই ধারণাটা হয়েছে যে কাজ ভাল করলে তাদের কারবারে সুনাম হবে আর খদ্দের বাড়বে। তাই এত যত্ন করে কাজটা করেছে। অবশ্য কালির সাথে ক্রিম পালিশ হয়েছে বলে এতটা ভাল হয়েছে। সব খদ্দের তো আবার ক্রিম পালিশের পয়সা দিতে চায় না। ক্রিম পালিশের একটু দাম বেশি। এমনি কালির পালিশ আট টাকা আর ক্রিমে বারো টাকা। এই চার টাকার জন্যে লোকে যেন মুর্ছা যায় আরকি। সেই জন্যে রতন আগে থেকে ঝগড়া করে নেয়, শুধু কালির পালিশ না ক্রিম পালিশ। ক্রিম হলে আরও চার টাকা বেশি দিতে হবে বাবু। এই বাবুর সঙ্গেও আগে থেকে কথা ভেঙে নিয়েছে। ক্রিম পালিশে রাজি হয়েছে। ছেলেটাও যত্ন করে কাজটা করে দিয়েছে। আসলে ক্রিমে ওদের একটু লাভ হয়। তাই খদ্দেরের সঙ্গে ওরা নিজে থেকেই কথা পেড়ে নেয়। জোর দেয় ক্রিমে, যদি রাজি হয় আর কি…
অফিসবাবু, তার জুতো পালিশ দেখে খুশি হয়ে নীরবে হাসে, “বারে রতন, বেশ চকচকে করে পালিশ করেছিস তো!”
-আমি করিনি বাবু, আমার ছেলে করেছে। তাছাড়া ক্রিম পালিশে একটু সুন্দর দেখতেও হয়। চামড়াও ভাল থাকে। তার উপর কারিগরের কব্জির টানটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
-তোর ছেলেটা তাহলে ভালই হাতেধরা হয়েছে বল, রতন?
-তা একটু হয়েছে। বাপের যুগ তো আস্তে আস্তে খতমের দিকে। এবার তো ছেলেদের যুগ। সবকিছু বুঝে না নিলে চলবে কেন? তারপর সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলে,“টাকাটা বাবুর কাছ থেকে নিয়ে নে খোকা।টাকাটা নিয়ে সনাতন বলে, “আর দু’টাকা দিন বাবু। বারো টাকা।” বলে ওই দশ টাকার নোট হাতে নিয়ে, তার হাতটা বাবুর দিকে বাড়িয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাবুটা বলে, “কি বলছিস, আরও দু’টাকা কিসের? উল্টে তুই আমাকে দু’টাকা ফেরত দিবি। জুতো পালিশ তো আট টাকা। বারো টাকা আবার কবে হল! দে, আমাকে দু’টাকা ফেরত?” সঙ্গে সঙ্গে রতন বলে, “না বাবু, ক্রিম পালিশ বারো টাকা। আর এমনি কালির পালিশ আট টাকা। আপনাকে তো ক্রিম পালিশ করে দেওয়া হয়েছে। আপনার সঙ্গে আগে থেকে কথা ভেঙে নেওয়া হয়েছে। আপনি রাজি হয়েছেন বলেই তো আমরা ক্রিম পালিশ করেছি।” এবার অবজ্ঞার ছলে লোকটা বলে,“তুই ছাড় তো ক্রিম পালিশের গপ্প। সব সমান। সামান্য দু’চার টাকার মায়া ছাড়তে পারছিস না বল্? দে, আমায় দু’টাকা ফেরত দে। এই ছেলেটা, হাত নামা। তোর বাপকে বল্ দু’টাকা ফেরত দিতে।” বাপের সঙ্গে এই কথাকাটাকাটি সনাতন একদম মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। আচ্ছা বেয়াড়া লোক তো! কথা বলে কাজ করা হয়েছে। এখন উল্টো গাইছে? এবার সনাতন বলল, “না বাবু, আপনাকে আরও দু’টাকা দিতেই হবে। আমাদের গতরে খাটা পয়সা। মাগনা আপনাকে ছেড়ে দেব না। দিন বাবু দিন, আর দু’টাকা দিন। দু’টাকা ছাড়া যাবে না। আপনারা বাবু লোক। অফিস কাছারি করেন। আপনি এই ক’টা টাকার মায়া ছাড়তে পারছেন না। উল্টে আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষকে ‘মায়া-ছাড়ার’ নিদান দিচ্ছেন! আচ্ছা ‘তরফের’ মানুষ তো আপনি!” এই “আচ্ছা তরফের মানুষ” কথাটা বলতেই আঁতে ঘা লেগে যায় বাবুর! ক্ষেপে লাল চোখ করে বলে,“শালা ছোটলোক রুইদাস বাচ্চা। গাল টিপলে দুধ বার হবে। তুই আমাকে ব্যঙ্গ করিস। দে শালা দে আমার দু’টাকা ফেরত দে। ভেবেছিলাম টাকাটা ছেড়ে দেব। এ তো দেখছি ‘তায়বাড়া’। খুব রোখ দেখছি এর। একে তো ছাড়া যাবে না!” এবার সনাতন আর মাথার ঠিক রাখতে পারে না। টগবগে উঠতি যুবক। বিনা অন্যায়ে তাকে জাত তুলে ছোটলোক বলায় ওর মনে আঘাত লাগে খুব। দোকান ছেড়ে উঠে লোকটার কাছ থেকে জুতো জোড়া ছিনিয়ে নিয়ে বলে, “টাকা দেবেন তারপর জুতো নিয়ে যাবেন। আমরা ছোটলোক রুইদাস বাচ্চা কে না জানে। এত যদি এদের ওপর ঘেন্না তো আসেন কেন এদের সেবা নিতে। নিজের কাজ নিজে করবেন। কোনদিন আর আসবেন না আমাদের দোকানে। আপনার মত খরিদ্দার না এলেও আমাদের চলে যাবে। আমরা ঠিক খেতে পাবো।” তার হাত থেকে জুতো কেড়ে নেওয়ায় আরও অপমানিত হয় লোকটা, “শালা ছোটলোকের বাচ্চা, তোর এত বড় সাহস, আমার হাত থেকে জুতো কেড়ে নিস? জীবনে এই জুতো পায়ে গলাবার যোগ্য হতে পারবি না। এর দাম কত জানিস। বাটার ‘মোকাসিনো’ জুতো কত দাম তোর বাপেরও জানা নেই। দে শালার বেটা আমার জুতো?” বলে সনাতনের হাত টানতে থাকে। সনাতনও নাছোড়। তার শান্ত ছেলেটা ক্ষেপে গেছে দেখে রতনও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাবুটাকে থামাতে চেষ্টা করে বলে,“সনাতন ত্যাগ দে ওই দু’চার টাকার মায়া। আমাদের মুখ্যুসুখ্যু পেয়ে কত বাবু ওরকম ঠকিয়ে যায়।” ইতিমধ্যে চেঁচামেচিতে বাজারের লোক জড়ো হতে থাকে। লোকের মুখে মুখে ঘটনাটা চাউর হতে সমবেত লোক জুতোবাবুকে নিয়ে নানান বিরূপ টিপ্পনী শুরু করে দেয়, “শালা চোরের মায়ের বড় গলা রে। গরিবের পয়সা মেরে আবার হম্বিতম্বি করতে কসুর করে না। মানুষের মদত পেয়ে সনাতন আরও নাছোড়বান্দা হয়ে যায়। রোখ চেপে যায় ওর মধ্যে। পুরো পয়সা না দিলে সে জুতো হাতছাড়া করবে না। শেষপর্যন্ত মানুষের চাপে পুরো টাকা দিতে বাধ্য হয় জুতোবাবু।
ঘটনাটার কথা লোকের মুখে সওয়ার হয়ে রুইদাসপাড়া ছেয়ে যায়। সনাতনের মত নির্বিবাদী ছেলে এখন পাড়ার সকলের মুখে মুখে। তাদের জাতের অপমানের প্রকাশ্য প্রতিবাদ সনাতনের মত মুখচোরা ছেলে যে করতে পারে তা যেন কারোরই ধারণায় ছিল না। ওকে নিয়ে গর্ববোধ করতে থাকে সবাই। সনাতন কিন্তু ব্যাপারটায় গর্ব করার মত কিছু দেখতে পায় না। উল্টে বরং ও চিন্তা করতে থাকে, এতটা প্রতিবাদী হওয়াটা মনে হয় তার ঠিক হল না। শান্ত পুকুরে যেন একটা বড় আধলা ইট ফেলে দিল সে। সেই ইটের অভিঘাতে সে এখন বাজারে, পাড়ায় ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। সবার চোখে তো সে আর হিরো বনে যেতে পারে না। ওই জুতোবাবুর পক্ষে যারা তারা তো তাকে বাঁকা চোখে দেখবেই। বাঁকা চোখে দেখা মানেই তার অমঙ্গলের ভাবনা ওরা করতে থাকবে। সুযোগ পেলে ক্ষতিসাধন করতে তাদের বাধবে না। কিন্তু তাদের মত গরিব ঘরের পক্ষে সেই ক্ষতির অভিঘাত সে কেমন করে সামলাবে। এমনিতেই দুবেলা পেটের অন্ন জোগাতে বাবা হিমসিম খায়। তো উটকো কোন ঝামেলা ঘাড়ে চাপলে কি হবে ! বাবা তো একদম গুম হয়ে রয়েছে। সে যে কোন অন্যায় করেনি তা বাবা ভাল করে বুঝেছে। তাই তার এই রুখে দাঁড়ানোতে বাধা দিয়ে কোন কথা বলেনি। ছেলেকে সামাল দিয়ে গেছে। কিন্তু বাবার চিন্তা যে অন্য জায়গায় তা সে খুব ভাল করে বুঝতে পারছে। বাবা ভাবছে এইসব নিয়ে যদি কোন উটকো বিপদ হামলে পড়ে তো সামলাবে কেমন করে। সেই চিন্তা সনাতনেরও। তাই তার মনে হচ্ছে অত জেদ না করলেই হয়তো হত। ছেড়ে দিলেই হত ওই চারটে টাকা। কিন্তু আবার ভাবে, প্রশ্নটা তো চার টাকার নয়। প্রশ্নটা তাদের আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানিতে। তারা মুচি, গরিব, তথাকথিত নিচু জাত। তা সমাজের কে না জানে। তাই বলে ওই জাত তুলে, গরিবীর সুযোগ নিয়ে তাদের ওইরকম কুৎসিৎভাবে ঘেন্না করার অধিকার তো কারোর নেই! সে তো পড়েছে, ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।’ তাহলে এই মহান কথাটা একদম ফালতু? মানুষ হিসেবে তাদের তো একটা ন্যুনতম সম্মান পাবার অধিকার আছে। সেই অধিকারে আঘাত পেলে সে রুখে দাঁড়াবে না? রুখে দাঁড়িয়ে কি সে ভুল করেছে? নিশ্চয়ই করেনি। বরং সেজন্যে সে গর্বিত। কিন্তু ওই যে। ওরা গরিব। ওদের অর্থ নেই। ওরা আর্থিকভাবে দুর্বল। তাই ওরা সমাজের একশ্রেণীর পচা পয়সাওলাদের দ্বারা পদদলিত। অবহেলিত। তবু যেন এই অবহেলা, বঞ্চনার কথা তাদের মুখ ফুটে বলার অধিকার নেই!
ওইদিন সন্ধ্যেবেলা কথামত অলোকাদিদের বাড়ি যায় সনাতন। অলোকাদি তখন রান্নাঘরে। সেখান থেকেই বলল, “সনাতন দোলায় বস। আমি যাচ্ছি। এই হাতের কাজটা সেরে নিই। তোর তাড়া নেই তো?” একটু ব্যস্ত হয়ে তখনই সনাতন বলল, “না না দিদি। তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি কাজ সেরে এসো। আমার তাড়া নেই। আমি ততক্ষণে এই দোলাতে নাড়া খাই। নাড়া খেলে গায়ে হাওয়া লাগে।” দোলনাড়া খেতে খেতে সনাতন দেখে অলোকাদি একটা বাটিতে কি যেন নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মোড়াটা বাঁহাতে নিয়ে ডান হাতে বাটিটা নিয়ে ওর সামনে বসল,“এই নে সনাতন, নাড়ু খা। চৈতে নাড়ু মা বানাচ্ছিল। আমি মাকে হেল্প করছিলাম। গরম গরম। খেতে ভাল লাগবে। আমি খেয়েছি। সবটাই তোর। আমার জন্যে তোর ব্যস্ত হতে হবে না।” বলে সনাতনের হাতে নাড়ুর বাটিটা তুলে দিল, অলোকা। সনাতন তৃপ্তি ভরে নাড়ু খেতে থাকে। অলোকা আত্মতৃপ্তিতে তা উপভোগ করে। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল, তোর এই তৃপ্তি আমার হৃদয়কে যেন আনন্দে ভরিয়ে তুলল।” সনাতন খেতে খেতে খুশি মুখে বলল, সত্যি দিদি, আমার মনটাও আনন্দে ভরে উঠল। কতদিন এই চৈতে নাড়ু খাইনি। এসব তো আমাদের কাছে বিলাসিতা। দু’মুঠো ভাত যোগাতে যারা হিমসিম তাদের সংসারে নাড়ু বানানো তো স্বপ্ন। ইচ্ছে থাকলেও মা’র সামর্থ নেই।” সনাতনের কথায় পরিবেশটা যেন একটু ভারি হয়ে গেল। সেটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যে অলোকা বলল,“তোর সব নোটস এখনো খোঁজা হয়ে ওঠেনি। আসলে কলেজে একটা প্রজেক্ট জমা দেবার তাড়া ছিল। সেটা জমা দিতেই হবে। নাহলে নাম্বার কাটা যাবে। তা তুই আসবি বলে সামনাসামনি হাতের কাছে যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো টেবিলে রাখা আছে। দিচ্ছি তোকে। ততক্ষণ তুই এগুলো দেখ। একসাথে তো সব পড়া যায় না। এগুলো দেখতে দেখতে ততক্ষণে আমি অন্যসব খুঁজে রেখে দেব। পরে নিয়ে যাস বা রাস্তায় দেখা হলে আমি তোকে বলে দেব’খন।
তখন নিয়ে আসবি। দাঁড়া, খা ততক্ষণ। নোটগুলো আমি ঘর থেকে নিয়ে আসি।” একটা পলিথিনের প্যাকেটে ওগুলো নিয়ে অলোকাদি এল। ভারি প্যাকেট দেখে সনাতন বলল,“দিদি, এতো প্রচুর নোটস্। এর পরেও আরও আছে ! দিদি, তোমার অত ব্যস্ত হতে হবে না। আগে আমি এগুলো পড়ে শেষ করি, তারপর অন্যগুলো তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাব। আজ তাহলে আসি দিদি।” বলে সনাতন দোলা থেকে উঠতে যাবে, সেই সময় কৌতূহলী দৃষ্টিতে অলোকা বলল,“হ্যাঁরে সনাতন, আজ তোকে নিয়ে বাজারে কি গন্ডগোল হয়েছে রে? পাড়ার লোক সব তোকে নিয়ে আলোচনা করছে? কলেজ থেকে আসতে আসতে আটচালায় জটলা হয়ে লোকে তোর কথা বলাবলি করছে। ঘরে আসতে আমার মা-ও একই কথা বলল?”
আবার দোলাতে কঁ-চ করে বসে পড়ল সনাতন। ঘটনার সবিস্তার বিবরণ দিয়ে সনাতন মন্তব্য করল, “আচ্ছা দিদি, তুমি বলো, আমরা গরিব, মুচি তথা নীচু জাত বলে কি আমাদের কোন মান সম্মান থাকতে পারে না? লোকটা ঘেন্নার দৃষ্টিতে আমার সঙ্গে আচরণ করছে ! তখনই আমার মধ্যে জেদ চেপে যায়। আমিও লোকটাকে সহজে ছাড়িনি। লোকটাকে ভুল স্বীকার করিয়েছি, পুরো পয়সাও আদায় করেছি। পরে ভাবলাম দিদি, এতটা করা মনে হয় আমার ঠিক হ’ল না। আমার পক্ষে এটা বাড়াবাড়ি হ’ল কি না কে জানে। ওই বাবু লোকটা তো আমাকে কোনদিন ভাল চোখে দেখবে না। এক বাজার লোকের সামনে অপমানিত হতে হয়েছে তাকে। ও কি সহজে আমাকে ছেড়ে দেবে ! কি জানি, কি হবে! আমরা গরিব ঘরের ছেলে। ওই পয়সাওলাদের সঙ্গে যুঝবো কেমন করে! যদি লোকটা থানায় কেসমেস করে দেয়! অলোকা দেখলো ছেলেটা বেশ ভয় খেয়ে গেছে। কিন্তু এত ভয় পাবার তো কোন কারণ নেই? ওকে সাহস দিয়ে ভয় কাটানো দরকার, “এই সনাতন, তুই অত দমে যাচ্ছিস কেন। তুই তো কোন অন্যায় করিসনি। সেটা তো বাজারের সব মানুষ জানে। মানুষই তো বাধ্য করিয়েছে লোকটাকে ভুল স্বীকার করাতে। লোকটা তোর বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে মানুষই তোর পাশে দাঁড়াবে। তোর বিরুদ্ধে কোনকিছুই তখন ধোপে টিকবে না। ভয় পাওয়া মানে তো হেরে বসে থাকা। চেতনাকে টলমল করে দেওয়া। তোর মধ্যে শিক্ষা ছিল বলেই তোর চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের রুইদাসরা এইভাবে পয়সাওলাদের কাছে মাথা নত করে এসেছে। সেই শিক্ষা রুইদাসরা এতদিন পায়নি বলেই এটা হয়ে এসেছে। তোর সঙ্গে তোর বাবাও তো ছিল। যেটা তুই করতে পারলি সেটা তোর বাবা করতে পারতো। পারতো না। সেই শিক্ষা তোর বাবা পেয়ে উঠতে পারেনি তাই সম্ভব হয়নি। যা বাড়ি যা। বুকের বলের উপর ভর করে এগিয়ে যা।”
অলোকাদিদির কথায় সনাতনের মনের ভেতর যেন একটা আশার আলো ফুটে ওঠে। ভাবে এইরকম করে তো এর আগে তাকে কেউ বলেনি ! অমর স্যার তার পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু তার জীবন চলনের যন্ত্রণা, বাধাবিপত্তি থেকে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার প্রেরণা এই প্রথম সে অলোকাদির কাছ থেকে পেল। মনের যাবতীয় দুর্বলতা, ভীতি যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। দিদির প্রতি কৃতজ্ঞতাভরা অভিব্যক্তিতে বলল,“দিদি, আজ আসি। রাত হয়ে যাচ্ছে। মা না হলে আবার ডাকতে আসবে। দিদি, আর একটা কথা বলি। তুমি অন্যভাবে নেবে না তো?”
-আরে ভাই বল না। দিদি বলে যখন ডেকেছিস তখন ভায়ের কথায় দিদি অন্যরকম কিছু ভাববে কেন! মন খুলে বল।
-না দিদি, সেরকম কিছু নয়। মাঝে মাঝে আমি কিন্তু দিদি, তোমার কাছে আসবো। তোমার মূল্যবান পরামর্শ আমার চাই। যখনই দরকার পড়বে আমি আসবো। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?
-এই পাগল ছেলে। অত বিনয়ের কি আছে। আমি বাড়ি থাকলে তোর যখন মনে হবে চলে আসবি। পরীক্ষার পড়ার ব্যাপারেও কোন জানার থাকলে চলে আসবি। আমার সাধ্যমত আমি তোকে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করব। একদম ইতস্তত করবি না। তোর জন্যে আমাদের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা।ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৭)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[পনেরো]
পরেশের বউ সনকার সঙ্গে সল্টলেকের বাবুর-বাড়ির মালিক চন্দনের সম্পর্ক এখন আর ওই গতানুগতিক কাজের মাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তিগত ভাবে বাড়ির মালিকের সঙ্গে সনকার সম্পর্ক যেমন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় এসে ঠেকেছে তেমনই ওদের পরিবারেরও একজনের মত হয়ে গেছে। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তরণ সনকার কাজের যোগ্যতার নিরিখে সম্ভব হয়েছে। আর পুরুষ মালিক আকৃষ্ট হয় তার যৌবনের তীব্র আর্তিতে। অবশ্যই এই সম্পর্ক বৈধতার বিচারের কষ্ঠিপাথরে সায় না নিয়েই। সেই নিয়ে চন্দনের পরিবারে ব্যাপক ঝড়ঝাপটা বয়ে যায়। রূপসা কেন চাইবে তার স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ুক? তাও আবার বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে! সুস্থ সামাজিক ভাবনায় ঋদ্ধ কোন নারী কি তা মেনে নিতে পারে? পারে না। রূপসাও তাই পারেনি। রূপসা তাই প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে দোষারোপ করে চলে। অবশ্য নিতান্তই সরল বিশ্বাসে স্বামীর কষ্ট লাঘবের কথা চিন্তা করে দিল্লীতে বিয়েবাড়ি যাবার সময় সনকাকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। শ্বাশুড়ি-স্বামীকে দেখভাল করার জন্যে। মুহূর্ত সময়ের জন্যেও এই ভাবনা ঝিলিক মারেনি যে যুবতী ওই কাজের মেয়ের সঙ্গে চন্দন কোন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। দিল্লী থেকে ফেরার পর চন্দনের ব্যবহারে কেমন যেন বিরুদ্ধ স্রোত বয়ে যাবার লক্ষণ সে প্রত্যক্ষ করে! দিল্লী যাবার আগে তার সঙ্গে চন্দনের ব্যবহার আর পরের ব্যবহারে এতটা খটকা লাগার মত হ’ল কেন তা বুঝতে রূপসার বেশ কিছুদিন সময় লাগে। রাতের বেডরুমে স্বামীর আচরণে সে প্রথম টের পায়। বেডরুমে তার প্রতি আকর্ষণ রাতারাতি যেন কেমন তলানিতে এসে ঠেকেছে। অথচ রূপসা যে স্বামীর সঙ্গে শয্যা বিনিময়ে অপারগ তা তো নয়! বরং পূর্ণমাত্রায় আগের মতো তা বর্তমান। স্বামীর আদর খাওয়া তো দূরের কথা উল্টে অনাদরে তাকে বিদ্ধ করতে থাকে, “গায়ের কাছে সেঁটে এসে বিরক্ত করবে না তো! সরে যাও। আমার ভাল্লাগছে না। শান্তিতে একটু ঘুমোতে দাও। তোমার চোখে ঘুম নেই না কি?” চন্দনের এমন আচরণে তাজ্জব বনে যায় রূপসা! এ কোন্ চন্দনের সঙ্গে সে শুয়ে আছে? এ তো সে চন্দন নয়? দাম্পত্য সম্পর্ক যে একটা নতুন বাঁকে এসে পড়েছে সেই সময়ই টের পায় রূপসা। তা আরও স্পষ্ট হল যখন ও নিশ্চিত হয়, সনকার সঙ্গে চন্দনের অবৈধ্য যৌন সম্পর্কের বাস্তবতা। মেনে নিতে পারেনি রূপসা। যেমন সুস্থ অবস্থায় কোন নারী তা পারে না। পত্রপাঠ সনকাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার ফরমান দেয় সে। কিন্তু তাতে বাধ সাধে চন্দন স্বয়ং এবং রূপসার উপর শারীরিক অত্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি সে। একজন ঝি-মেয়েমানুষের সামনে এইভাবে অত্যাচারিত হওয়া, অপমানিত হওয়াটা তাৎক্ষণিক ভাবে তার মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক ছুটে দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে কার্নিশ টপকে মরণঝাঁপ দেওয়াটাই সঠিক বলে মেনে নেয় সে। কিন্তু মরণ তাকে বরণ করেনি। হাসপাতাল থেকে অবশেষে প্রাণ নিয়ে ফিরে এল ঠিকই কিন্তু সুস্থ জীবন আর ফিরে পেল না রূপসা। চলাফেরার শক্তি স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলল সে। শরীরের নীচের অংশ অবশ হয়ে রূপসা এখন তাদের বেডরুমের বিছানার স্থায়ী বাসিন্দা। যে বিছানা একদিন ছিল তার আর চন্দনের দাম্পত্য ভালবাসার স্বর্গসম।
চন্দন এখন আর এই বিছানা ছোঁয়া তো দূরের কথা, দেখতেও আসে না। বিছানাটা কেমন আছে। কতটা খারাপ আছে। তাও না। সনকার চোখের আয়নায় নাকি মাঝে মাঝে রূপসা দেখে তার অতীত দাম্পত্যের অতিথিকে। সনকাই সে কথা তাকে বলে, “বাবুকে আমি আপনার খবর দিই গো বৌদি। তখন শোনে কথাগুলো। কখনো উত্তর দেয়, কখনো চুপচাপ শুনে চলে যায়। কস্মিন কালে কিছু মনে হলে হয়তো জিজ্ঞেস করে, বৌদি কি করছে, ঘুমিয়ে না জেগে। তখন বলি, ওনার তো ঘুম-জাগায় কোন ফারাক নেই। এ প্রশ্ন করা তো মুর্খামি। যান না, একবার বৌদির সঙ্গে কথা বলে আসুন না। কথা বলতে তো অসুবিধা নেই। এই কথা বললে বলে, কথার ভাঁড়ার যে শূন্য। ওই শূন্য ভান্ডার আর পূরণ হবে না সনকা। এখন তোমার যত্নের ভাঁড়ার যতদিন না ফাঁকা হয়, তুমি বৌদিকে সেবা করে যাও সনকা। তাহলেই বৌদি ভাল থাকবে। আমাকে নিয়ে আর টানাটনি কোরোনা। আমাকে আমার মত থাকতে দাও।” সনকার বুঝতে অসুবিধা হল না, দিনের পর দিন বাবু বৌদিমণির সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করেছে তা আর সহ্য করতে না পেরেই তো সে আত্মহত্যা করতে যায়। মরণ ওকে টেনে নিলেই বরং মুক্তি পেত বৌ-টা। কত কষ্ট পাচ্ছে। এখন বাবু সেই কষ্ট দেখে আফসোস করছে। নিজের বিবেকের সঙ্গে তাকে যে নিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। বাবুর এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই তার ভেতরের যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। সনকা নিজে কি ধোয়া তুলসীপাতা! সেও তো বাবুর সঙ্গে সম-দোষে দোষী। সে যদি বাবুকে প্রশ্রয় না দিত তাহলে তো বৌদিমণির হাতছাড়া হত না বাবু! তাই বৌদিমণির এই পরিণতির দায় থেকে সেও মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বাবুকে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। তার এবং তার লোচনের জীবনের প্রশ্নে সে বাবুর সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য ছিল। নাহলে বাবু তাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিত। তখন তো তাকে আবার জনারণ্যে ভেসে বেড়াতে হত। কুকুর-শেয়াল ছিঁড়ে খেত তার ভরা যৌবনকে।
সকলেই প্রথম ভালবাসে নিজেকে। তারপর দ্বিতীয় পছন্দ অন্য কেউ। দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল, চন্দন-বাড়ির অঘোষিত মালকিন সনকা। সনকা ছাড়া এই বাড়ির সূর্য উদয় হয় না, ডুব সাঁতারও দেয় না। চন্দনবাড়ির সংসার এখন তার সংসার। পাকাপাকিভাবে বিছানা নেওয়া চন্দন-বৌদির যাবতীয় বাসি কাজ নিজের হাতে সারে সনকা। যে সনকার জন্যে রূপসা বৌদির আজ এই বিলম্বিত যাত্রাপথ সেই সনকাই এখন তার জীবন বৈতরণী পার করার একমাত্র যষ্ঠী। প্রিয় সনকা এখন তার যেন চোখেহারা সাথী। কত জন্মান্তরের সঙ্গী যেন সে রূপসা বৌদির। এখন সনকা যদি রূপসার বকলম নিয়ে চন্দনকে স্বামী ভাবনায় সময়ের সঙ্গী হয় তো রূপসার কোন আপত্তি নেই। চন্দনের তো নয়ই। তবে বৈধ্য স্ত্রী বেঁচে থাকতে তো সনকাকে বৈধ্যতা দেওয়া যায় না। তাই এতটুকু যা দূরত্ব চন্দন-সনকার। বাদবাকি যাবতীয় দাম্পত্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেওয়া নেওয়ায় একাকার এখন ওরা। হয়তো জীবনচলনের বাধ্যতায় রূপসাকে ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু রূপসার মন কি তাতে দু’হাত তুলে সায় দিতে পারে? না তা হয় না। যদি সেটাই হবে তো তখনই সে ওদের এই অবৈধ্যতাকে মেনে নিতে পারতো। তাহলে তাকে আজ এই করুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হ’ত না! সত্যিই রূপসা আজ এই বিকলাঙ্গ দেহটাকে বিছানায় লটকে রেখেও ভেতর থেকে মানতে পারেনি। এটা তো যে কোন বিবাহিত নারী জীবনের শাশ্বত ভাবনা। ওই বা সেই ভাবনা থেকে কেমন করে বেরিয়ে আসতে পারে? পারে না। তাই নিয়ত ও সময়ের কাছে করজোড়ে তার হৃদয়চলনকে থামিয়ে দেবার জন্যে কামনা করে চলেছে। সনকার কাছে যেমন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত জীবনের প্রেরণার নব নব উৎস। তেমনই রূপসার কাছে সব অচল পয়সা ছাড়া আর কিছু নয়। যাবতীয় অনীহা এখন তার সবসময়ের সঙ্গী হয়ে শেষের সেদিনের পথ চেয়ে অপেক্ষায়। এ অপেক্ষার কবে সমাপ্তি ঘটবে তা কে জানে! কেউ জানে না। সে তো জানেই না। জানে না চন্দন-সনকা। জানে না আকাশ বাতাস, জানে না ধূলিকণাও।
চন্দন চেয়েছিল তার গর্ভ-হ্রদে একটা নতুন ভ্রুণ সাঁতার কেটে বেড়াক। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল সনকা, “এ তুমি কি আবদার করে বসলে বাবু? আমরা চাকর বাকর মানুষ। কপালগুনে তোমার দেহসঙ্গী হতে পেরেছি। সেটা আমার সৌভাগ্য। এই আব্দার মেনে নিয়ে আর আমার ভাগ্যকে আকাশপানে ছুড়ে দিতে চাই না। একবার ছুড়ে দিলে পড়ার সময় আলগোছে ধরে নেবার ক্ষমতা তোমার যেমন হবে না। আমারও না। তখন আমার ভাগ্য ভূপাতিত হওয়া ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। বাবু, এই জন্যেই কি তুমি আমার লোচনের চাকরির ব্যবস্থা করে সেই বিদেশ বিভুঁই, বোম্বেতে পাঠিয়ে দিলে? এই হাত জড়ো করে তোমার কাছে ভিখ্ মাঙছি বাবু। আমার কপাল আর বৌদিমণির কপাল একাকার করে দিও না। তার থেকে বরং আমি দেশের বাড়ি ফিরে যাই। বাকি সময়টা ওখানেই কাটিয়ে দেব। না না, তোমাকে ভাবতে হবে না। যতদিন বৌদিমণির প্রাণবায়ু ধুকপুক করছে, ততদিন না হয় আমি এখানে দিনপাত করলাম। আমার মনের কষ্ট এই বৌদিমণির জন্যে। আমি যদি যৌবনের ঝাপটায় তোমার সঙ্গে লটরপটর না করতাম তাহলে তো বৌদিমণির এই পরিণতি হত না। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তটা আমি করে যেতে চাই।”
তবে বাবুর কাছে সনকা চিরঋণী হয়েই থাকবে। এই বাবু তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় না দিলে তার জীবনটাও তো দরিয়ায় ভেসে ঠিকানাহীন হয়ে যেত। পোদ পাড়ার ওই বাদল শয়তানের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এই বাবুর জন্যেই। যেদিন থেকে বাবু বুঝে গেছে, ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যে বাদল আসে তা তার আত্মীয়তার কর্তব্যের দায় মেটাতে নয়, সনকার প্রতি তার যৌন লালসা চরিতার্থ করতে। তখন থেকেই বাবু এ’বাড়িতে তার আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সনকাও মন থেকে সেটা চাইছিল। তখন থেকে সনকা বাড়ির বাইরে কোন কাজে গেলে সঙ্গে বাবু থাকে। কয়েকবার আশপাশে বাদলকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেওছে সনকা। পাত্তা দেয়নি। যেন চেনেই না তাকে, এমন আচরণ করে তার গা ঘেঁষে চলে গেছে।
সনকার সঙ্গে চন্দন বাবুর সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠতা ছুঁয়েছে তার ছেলে লোচনের ওপর বাবুর নজরও পড়েছে ততটাই আগ্রহের সঙ্গে। বাবুর চেষ্টাতেই লোচন মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষিত হতে পেরেছিল। না হলে তার তো মুর্খ হয়ে বেঁচে থাকার লিখন দেগে দেওয়া ছিল। বাপ জেলে। নিরুপায় সনকার ক্ষমতা তখন কোথায়, ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার? ছেলের সেই ভবিতব্য খন্ডন করেছে এই চন্দন বাবুই। যে মানুষটা তার জন্যে এতটা করতে পারে তো সেই মানুষটাকে তার বয়ে যাওয়া যৌবন যদি উজাড় করে সে দেয় তাতে তার অন্যায়টা বা কোথায়! সনকা তো সেখানে অন্যায় কিছু দেখে না। না, রূপসা বৌদির কথা তুলেছিল সনকা। তাদের সঙ্গে দেহজ ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে বৌদির কথা তুলেছে সনকা, “আমার শরীরের ওপর তোমার এত লোভ কেন গো বাবু? অত সুন্দরী বৌদিমণি থাকতে। আমি এক পাড়া গাঁয়ের মেয়ে। অবহেলায় যার জীবন-যৌবন কাটে। তার প্রতি তোমার এত লোভ কেন? আমাকে পেয়ে তুমি এমন করছো যেন জীবনে এই প্রথম কোন মেয়েমানুষের সঙ্গ পেলে তুমি। কেন, বৌদিমণি তোমাকে সুখ দিতে পারেনে? তা তো হয় না। তাহলে তোমাদের ছেলেটা হল কেমন করে? পুরুলিয়ার মিশনে তোমাদের ছেলেটা যে পড়ে, সে কি তোমাদের দু’জনের বাচ্চা না? না কি আমার মত অন্য কোন সনকা তুমি জুটিয়ে রেখেছো। ও তার গর্ভে জন্মেছে?” এই কথা বলতেই আঁতে ঘা লেগে যায় চন্দন বাবুর! সনকার শরীর ছেড়ে উঠে পড়ে চোখ কটমট করে বলে, “এই কথা তুমি দু’বার আর বলবে না। ও আমার আদরের সন্তান। ওকে আমরা, আমি-রূপসা মন থেকে চেয়ে পৃথিবীতে এনেছি। তুমি না জেনে সাংঘাতিক একটা খারাপ কথা বলে ফেলেছো সনকা। এবারের মত তুমি ছাড় পেয়ে গেলে, তোমার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়েছি বলে। কোন আলগা কথা আমার নামে বলে ফেললে আমি মাফ করে দিতে পারি। আমার সন্তানের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোন কথা বলার সাহস তুমি দেখাবে না, সনকা।”
এমন সুন্দর ঘনিষ্ট মুহূর্তটা এই সন্তানের কথাটা তুলে যেন জোলো হয়ে গেল। দু’জনেই অতৃপ্ত মনে যেন ফুঁসতে থাকে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরিবেশকে স্বাভাবিক করতে প্রাণ ভরে জড়িয়ে ধরে বাবুকে, “বাবু, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ক্ষমা চাইছি বাবু। একবারের জন্যে আমাকে ক্ষমাঘেন্না করে দাও। দু’বার আর মুখ থেকে কু’কথা বার হবে না। কথা দিলাম বাবু।”
সনকার স্বীকারোক্তিতে গলে জল হয়ে গেল চন্দন। সনকার উত্তুঙ্গ দু’বুকের পেলব স্পর্শ তাকে যেন পুনরায় উত্তেজনায় শিহরিত করে তুলতে থাকে। চন্দনের সেই শিহরণ সনকা আহরণ করতে করতে কখন যেন পরস্পর পরস্পরের মধ্যে হারিয়ে যায়। সনকাতে নিঃস্ব হয়ে চন্দন তৃপ্ত হয়ে বলে “তুমি যে বৌদিমণির কথা প্রথমে তুলেছিলে, সেই কথায় টান দিয়ে বলি, আমি তো কোনদিন তোমার বৌদিমণিকে অসন্তুষ্ট করিনি। বরং বৌদিমণি সবসময় আমাকে পূর্ণ ভাবে নিঃস্ব করতে পারেনি। যেটা তুমি পারো। তোমাতে আমি তাই সন্তুষ্ট। তবে তোমার বৌদিমণিকে আমি পূর্ণ মাত্রায় তুষ্ট করে এসেছি। এখনও করতে আমার কোন বাধা নেই। বাধা আসছে তোমার বৌদির দিক থেকে। আসলেও এখানে আমার কিছু করার নেই। সমস্যাটা তোমার বৌদিরই।”
বোম্বেতে চাকরিটা ভালোভাবেই করতে পারছে লোচন। ওখানকার পরিবেশটা ও মানিয়ে নিতে পেরেছে। প্রথম প্রথম কোলকাতার কথা খুব বলত। এখন আর বলে না। আসতে বললে আসতেও চায় না। চন্দনবাবু এ কাজটা দেখে না দিলে ও কোথায় কি করতো কে জানে। ছেলে ওখানে ভালো আছে, তাতেই মা সনকার মন ভাল। আরও মন ভাল হয়ে যায় যখন ও ওখানকার একটা মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করতে চায় খবরটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় সনকা। এবার মা’কে নিজের কাছে রাখতে চায় লোচন। কিন্তু চাইলেই তো সবসময় সবকিছু পাওয়া যায় না। সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়টার জন্যে ছেলেকে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিল সনকা।[ষোল]
পরেশের ছেলে লোচন যা প্রস্তাব দিল, তারপর অনুকুল কুম্ভকারের ওই জমি কিনতে অস্বীকার করার আর অবকাশ থাকল না। ও যে দাম দেবে সেই দামেই সে বিক্রি করতে রাজি। তাই বলে তো আর সেই সুযোগ নিয়ে একটা যাচ্ছেতাই দাম দেবার কথা বলতে পারে না। হয়তো বাজার চলতি দাম থেকে কিছুটা কম দাম সে দিতে পারে। বাজার চলতি বলতে এই রুইদাস পাড়া এলাকার মধ্যে সম্প্রতি যে দামে জমি বা বাস্তু বেচা কেনা হয়েছে, হিসেবটা সেই নিয়মেই হতে চায়। কেননা, আশপাশের জায়গা থেকে এখানকার জায়গার দাম অনেকটাই কম হবার কথা। প্রথমত এখানকার জমির চাহিদা কম। গরিব পরিবারের বাস এখানে। অন্যান্য জায়গার মত অত দাম দিয়ে কেনার আর্থিক ক্ষমতা এইসব মুচিদের কারোর নেই। আর বাইরের লোক মরতে এই অজ পাড়ার ভেতরে কেন কিনতে যাবে? এখানে পয়সা ঢেলে তো কোন আয় তার থেকে পাওয়া যাবে না। অনুকুলও অমন জায়গা কিনে তার থেকে এক কানাকড়িও আয় করতে পারবে না। ওই বাঁজা জমিতে বসত ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না, যেমনটা পরেশরা ছিল। তবু এই বাচ্চা ছেলেটার আকুতি আর ওর অসহায় মায়ের মুখের কথা ভেবে তাদের উপকার করতে সে কেনার কথা ভাবছে। মানে টাকাটা জলে ফেলতে যাচ্ছে। এরপর আবার রুইদাসদের মধ্যে যে টাকাপয়সায় একটু সড়গড় তাকে তেলাতে হবে, কেনার জন্যে। তবে তার কারবারের আসল টাকা উদ্ধার হবে। লাভ তো দূর অস্ত। বরং বলা যায় পয়সা দিয়ে জেনেশুনে অযথা ঝামেলা কেনা আর কি। তবু সে নিমরাজি। তবে তার আগে ওদের আটচালার মাতব্বরদের সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চায়। না হলে কেনার পর ওরা যদি তাকে হুড়িয়ে দেয় তো, ‘কানাকেষ্টর ঘটি বাটি সব যাবে।’ অন্যের উপকার করতে যাওয়ার সুড়সুড়ি ঘুচে যাবে।
সময় করে একদিন অনুকুল কুম্ভকার তার চাকিঘরের বসার জায়গায় কিছু দরকারি কথা আলোচনার জন্যে নন্দ আর রতনকে আসতে বলল। যেহেতু আলোচনাটা ব্যক্তিগত পরিসরে। সরাসরি রতনদের আটচালার সঙ্গে যুক্ত নয়। তাই ওদের আটচালায় কথা বলাটা ঠিক হবে না বলেই তার বাড়িতে আসতে বলা। সেটা রাতনরা মেনেও নেয়। অনুকুলের সঙ্গে পরেশের ছেলে লোচনের জমি বিক্রির জন্যে এগিয়ে চলার এত কথা রতনরা জানতো না। লোচন ওদের পাড়ার রাস্তা দিয়ে কুমোর পাড়ায় না গিয়ে বড় পাকারাস্তা ধরে উল্টোদিক দিয়ে অনুকুলদের বাড়িতে কথা বলে সেই পথেই চলে যেত। অনুকুলের কাছেই প্রথম সেই কথা জানতে পারে রতনরা।
পরেশের ছেলে তোমাকে তাদের বাস্তুজমি বেচলে আমাদের কোন আপত্তি নেই অনুকুল দা। সে তো আমাদের কমিটির পাশ করা কথা যে রুইদাসদের কেউই সরাসরি পরেশের বাস্তু কিনতে পারবে না। বাইরের কেউ কিনলে, তার কাছ থেকে যদি কারোর সামর্থ থাকে তবে তাদের পাড়ার কেউ কিনতে পারে। তবে অবশ্যই যে কিনেছে সে যদি কোন চাপের কাছে মাথা নীচু না করে কাউকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় তবে। কিন্তু এর পরও একটা কথা আছে দাদা। কথা হল কি, পরেশের ছেলে লোচন ওই জমি বিক্রি করার অধিকারী কি না। আমরা যতটুকু জানি, জমিটা পরেশের বাবার। সেই সূত্রে পরেশই ওটার প্রথম হকদার। তা প্রথম হকদার, পরেশ তো মরে যায়নি। দিব্য বেঁচে আছে এবং খুনের দায়ে জেল খাটছে। পরেশ যদি মরে যেত, তখন না হয় পরবর্তী ওয়ারিশন হত এই লোচন। তুমি যে জমিটা কিনবে, দলিলে তো পরেশের সই থাকবে না। থাকবে তার ছেলের। বড় জোর ছেলের মায়ের। সেটা আইনত সাব্যস্ত হবে কি না ভাল করে জেনে তবে কেনা দরকার। আমাদের এই কথাটা বলার কারণ, ওই জমিটায় তো তুমি বাসের জন্যে বাড়ি বানাতে যাবে না। তোমার এখানে এতবড় মহল-বাড়ি। তাহলে খদ্দের পেলে তুমি সেটা বিক্রিই করবে। কিনবে আমাদের পাড়ারই কেউ। যে কিনবে সে যাতে ফাঁপরে পড়ে না যায় সেটাও দেখা দরকার। পরেশের তো আমরণ যাবজ্জীবন হয়নি। শুধু যাবজ্জীবন। তা আমাদের দেশের যা আইন তাতে যদি ইতিমধ্যে ও জেলে মরে না যায় তাহলে একদিন না একদিন ও ছাড়া পাবে। তখন এসে পরেশ যদি তার জায়গা দাবি করে বসে? বলে, আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলে কি করে জায়গা বেচে? এ বেআইনী। তখন তো যে কিনবে আবার আইনী ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতে হবে। তখন তার ছেলে-বউ ওকে কতটা সামলাতে পারবে সেটা তো ওরাই ভাল করে বলতে পারবে। সেসব কথা পরেশের ছেলের সঙ্গে ভাল করে বলে তবে কেনা উচিৎ বলে আমার মনে হয়। কথাগুলোর উপর বেশ চাপ দিয়ে রতন বলল।
রতন শেষ করতেই নন্দ বলল, “দেখতে দেখতে তো চোদ্দ বছর হয়ে গেল পরেশের জেল খাটা। মনে হয় আর বেশিদিন ওকে জেলে থাকতে হবে না। সেটা উকিলের সঙ্গে কথা বললে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার যতটুকু জানা, পরেশ এবার ছাড়া পেতে পারে। আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখলে মনে হয় ভাল হবে। এতদিন তো পড়ে আছে জায়গাটা। আরও ছ’মাস কি এক বছর না হয় অপেক্ষা করবে পরেশের ছেলে। এবার তুমি দেখো অনুকুলদা। কি করবে। তবে এই অসুবিধাগুলো না কাটিয়ে তুমি জায়গা কিনলে পরে বিক্রি করতে তুমি পারবে না। জেনেশুনে ওই ঝামেলার মধ্যে আমাদের পাড়ার কেউ ঢুকতে যাবে না। এরা সব গরিবগুর্বো মানুষ। পয়সা দিয়ে কেউ বিপদ কিনতে যাবে না।”
রতন আর নন্দের কথায় অনুকুল কুম্ভকার বেশ ধন্ধে পড়ে যায়। রতনরা যে একেবারে উড়িয়ে দেবার মত কথা বলল তা কিন্তু নয়। ওর টাকা আছে বলে তো জেনেশুনে তা বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পারে না। খেটে টাকা রোজগার করতে হয়। সত্যি তো। জেলখাটা পরেশের সঙ্গে তার ছেলে বউয়ের সম্পর্ক তো বহুদিন বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন তার গ্রামের সঙ্গে। এতদিন ওর ছেলে বউ একরকম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার আগে অন্যভাবে চলেছে। এখন আবার সেই পুরোনো জীবনে ফিরে আসা ওদের পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। পরেশের জীবনের ছন্দও তো ওলটপালট হয়ে গেছে। জেলখাটা আসামীর মন ফাঁকায় এসে কি রূপ নেবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে। পরেশের ছেলে লোচন আবার বোম্বেতে কাজের সূত্রে থাকে। সেখানকার আধুনিক চালচলন কোলকাতার থেকেও অন্যরকম। সেই মন, কোলকাতায় ওর মায়ের মন আর জেল ফেরত পরেশের মন কত যে ফারাক অভ্যাসে অবস্থান করছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তাই ভাল করে না বুঝে না শুনে তার পক্ষে এগোনো আর সম্ভব নয়। লোচন তাড়াহুড়ো করতেই পারে। তাই বলে সে তার তালে ভিড়ে গেলে চলবে না। ব্যবসায়িক চাল এখানে তাকে চালতেই হবে।
বোম্বে থেকে অনুকুল কুম্ভকারকে ফোন করলে লোচন অবগত হয় তাদের বাস্তুজমির প্রকৃত মালিকানা নিয়ে অনুকুলের আশঙ্কার কথা। অত অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে চাইছে না অনুকুল কুম্ভকার। ওনাদের পক্ষ থেকে হঠাৎ এমন প্রশ্ন আসতে পারে তা একদম ভাবতে পারেনি লোচন। তার বাবা সমেত তাদের পরিবারের কাছে ওই জমি এখন বদ্ধভূমি ছাড়া আর কিছু নয়। সেই জমি বেচে দিলে বাবা বাধা দেবে তা হতে পারে না। সে বা তার মা ছাড়া বাবার এই পৃথিবীতে আর কে আছে। আর বাবা জেল থেকে ছাড়া পেলে কোনদিন সে বাবাকে ওই গ্রামে নিয়ে যাবে না। মানুষ-খুনি বলে লোকে তার বাবাকে দুয়ো দেবে, তা প্রাণ থাকতে সে মেনে নিতে পারবে না। অত ছোট্ট বেলায় বাবা তাকে ছেড়ে মা’কে ছেড়ে জেল খাটতে বাধ্য হয়েছিল। বাবার মুখ অনেক বড় হয়ে সে চিনেছে। জেলে নিয়ে গিয়ে মা তাকে চিনিয়ে দিয়েছে বাবার মুখ। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, “তোর বাবার মত শান্ত কর্মঠ ভাল মানুষ ওই পাড়ায় কম ছিল রে বাপ। ওই গরু কাটা, ছুরি, ইনবাইস, কুরপি আরও কত কি এইসব নিয়েই মুচিদের দিন কাটে। ওটাই তাদের জীবন জীবিকার প্রধান পথ। তা সংসারের জন্যেই তো তোর বাবা কাজ করতে ভাগাড়ে গিয়েছিলো। পেটের জ্বালা মেটাতে ঘটনাক্রমে তোর বাবা একটা ভুল করে ফেলেছিল। সেটা মেনেও নিয়েছিল সে। কিন্তু দেশের আইন, সমাজ তাকে খুনি হিসেবেই দেগে দিল। কেন এমন কাজ ওই শান্ত মানুষটা করে ফেলল সেসব তখন কেউ বিচার করে দেখল না। অথচ এই মানুষটা রাগের বসে অকাজটা করে ফেলেছে স্বীকার করে সকলের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিল। কেউ ক্ষমাভিক্ষা দিল না। তোর বাবাকে জেলের ঘানি টানতে বাধ্য করালো এরা। পাড়ার একটা মানুষও কথার-কথায় আমাদের ওপর দরদ দেখালো না। দেখালে আমাকে তিন মাসের মধ্যে গ্রাম ছাড়ার নিদান দেয়? কারোর হৃদেতে একটু দয়াও হল না যে, এই মেয়েটা চার বছরের একটা শিশুকে নিয়ে কার কাছে যাবে, কোথায় দাঁড়াবে? তোর বাপের, আমার বাপেরবাড়ির তিনকুলের কোন আত্মীয় বেঁচে নেই যে তাদের দাবায় গিয়ে দাঁড়াবো। তোকে নিয়ে আমি ভেসে গেলাম অকুল দরিয়ায়। ওই দুলাল কাকার হাত ধরে এই চন্দনবাবু যদি আমাদের ঠাঁই না দিত, কুকুর-শেয়ালে আমাদের মায়ে-পোয়ের জীবন ছিঁড়েকুটে ছিবড়ে করে শেষ করে দিত। একদিন না একদিন তোর বাবা তো জেল থেকে ছাড়া পাবেই। জেলে পচে মরে গেলে আলাদা কথা। উপরঅলা এই পোড়া কপালে কি রেখেছে জানি না। তবে যদি ফিরে আসে তো বাবাকে তোর কাছে আশ্রয় দিস বাপ। আমিও আর তোকে ছেড়ে এখানে পড়ে থাকবো না। তিন জনে নতুন করে আবার সংসার পাতবো।” সেই নির্বিবাদী ভালমানুষটা, আমার বাপ কিনা আমাদের কাজের বিরোধিতা করবে! এটা কোনদিন হয়? তেমন প্রয়োজন হলে অনুকুল কাকাকে, বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জেলে নিয়ে যাবো। বাবার সামনে কথা বলিয়ে দেবো! তাহলে তো তখন আর আপত্তি থাকবে না। হয়তো কয়েদখানায় থাকার জন্যে জমির দলিলে বাবার সই দেয়াতে বিধিনিষেধ থাকতে পারে। অমন ঝুঁকি সে নিতেও চায় না। তখন হিতে বিপরীত হলে অন্য বিপত্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারে ওরা। দরকার কি। বাবার যে আপত্তি নেই, সেই কথাটা ওনার সামনে মুখ ফুটে বাবা বললেই তো হল। একবার মুখ ফুটে বলে পরে অস্বীকার করবে এমন মানুষ পরেশ রুইদাস নয়।
অনুকুল কুম্ভকারের সঙ্গে তো কয়েকবার দেখা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি পেশের পর শেষ পর্যন্ত রাজি করতে সক্ষম হয় লোচন। রাজি হয় অনুকুল কুম্ভকার তাদের জায়গাটা কিনতে। তা হঠাৎ আবার এই মালিকানার প্রশ্নটা তুলল কেন বুঝতে পারছে না। নিশ্চয়ই তাদের রুইদাস পাড়ার কেউ তার কান কামড়েছে। হয়তো বাবাকে যারা পছন্দ করে না তাদের কেউ এমন কাজটা করেছে। তারা চায় না পরেশের ছেলে তাদের বাস্তু বেচে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলে দেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যে সফল হবে না তা লোচন নিশ্চিত। বোম্বে থেকেই ফোন লাগালো অনুকুল কুম্ভকারকে, “কাকা, আমি মা এবং বাবার অনুমতি নিয়েই এই জমি বিক্রির কাজে হাত দিয়েছি। জেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে বাবার সঙ্গে কথা বলে বাবার মতামত নিয়েছি। এর পরও যদি আপনার কোন প্রশ্ন থাকে তো সরাসরি বাবার সঙ্গে আপনার কথা বলিয়ে দিতে পারি। তাহলে আপনাকে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের তারিখে জেলে আসতে হবে। আপনি সেটা করতে চাইলে আমাকে বলবেন। আর তা না করে যদি আমাকে বিশ্বাস করেন তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমিটা রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করুন। জেনেশুনে আপনাকে বিপাকে ফেলার কোন ভাবনা আমার নেই। তাছাড়া সেটা আমি বা করতে যাব কেন। আপনি কি আমার শত্রু? না, তা তো নয়। আপনি আমার বিপদে পাশে দাঁড়ানো উপকারি স্বজন। স্বজনের ক্ষতি কোন সভ্য মানুষ চাইতে পারে না। তাছাড়া আপনার কথা মা খুব বলে। মা বলে, পয়সা তো অনেক মানুষের থাকে। বেশির ভাগেরই দম্ভে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু মা বলে, আপনি ঠিক তার উল্টো মনের মানুষ। সব মানুষের সঙ্গে আপনি, আপন মানুষের মত ব্যবহার করেন। এমন যে মানুষ, সেই মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে পাপ তো হবেই সেইসঙ্গে তারও একদিন না একদিন ক্ষতি হবে। সেই শিক্ষাই আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, কাকা।”
লোচনের এমন গুছোনো কথায় সন্তুষ্ট হয় অনুকুল। এর পর আর কোন কথা না তুলে বলল, “ঠিক আছে। মুহুরির সঙ্গে কথা বলে কাগজপত্র তৈরী করে তোমাকে আমি খবর দিচ্ছি। সেইমত তুমি মা’কে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো।”[সতেরো]
ছেলেটার জন্যে রতনের যেন চিন্তার শেষ নেই। এবারে আবার মাধ্যমিকটা পাশ করতে সেই চিন্তা আরও বেড়ে গেল। সে নাকি পড়া ছাড়বে না। ইলেভেনে ভর্তি হবে। কথাটা শুনেই রতনের মাথায় হাত! বলে কি রে ‘গোহর ব্যাটা’! টেনেটুনে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে কত কষ্টে এতটা পড়াতে পেরেছে সে। এর পর আবার! ও ভাবছিল এবার ছেলেকে নিজের কাজে টেনে নেবে। আর পেরে উঠছে না। বয়সটাও আস্তে আস্তে চোখ বুজোনোর সময়কে ছুঁতে দৌড়চ্ছে। সনাতনের মায়ের সাথে সেই কথাটাই হচ্ছিল, “আর আমার একার পক্ষে সংসার টেনে নিয়ে চলা যাচ্ছে না গো। ছেলেটা এবার তো একটু হাতে ধরা হয়েছে। পাশও করল একটা। অনেকটাই হয়েছে। এই পাড়ায় ওই মিলনের মেয়ে অলোকার পর এখনো কেউ মাধ্যমিক টপকাতে পারেনি। তোমার সনাতন আবার প্রথম কুড়ির মধ্যে সতেরো। গর্বের কথা। গর্ব হচ্ছে আমার। কিন্তু এই গর্ব বুকে আগলে বসে থাকলে তো পেট শুনবে না। এই রাক্ষসটাকে তো সময় মেনে চাহিদা পূরণ করে যেতে হবে। ছেলেকে এবার ঢাক বাজানো, গরুর চামড়া ছাড়ানো, জুতো তৈরী, সেলাই সব আমাদের মুচিদের যা কাজ, সবটাই আস্তে আস্তে শিখিয়ে দিতে হবে। আর ওই কুনকে, সের, পালি বা ধামা বোনার কাজগুলো চলতে ফিরতে শিখিয়ে দিলে চলবে। ও যা মাথাওয়ালা ছেলে, কয়েকবার দেখিয়ে দিলেই ওগুলো পেরে যাবে। এখন অতটা জরুরী নয় ওগুলোর কাজ রপ্ত করার। তাছাড়া এইসব বেতের কাজের এখন তো আর বাজার তেমন নেই বললেই চলে। প্লাস্টিকের ড্রাম, বাটি ইত্যাদি উঠে গিয়ে বেতের জিনিস কেউ আর কিনতে চায় না। বেত তো অত সস্তার জিনিস নয় যে প্লাস্টিকের দামে বিকোবে! মানুষ সব আজকাল কম দামের জিনিস খোঁজে। কিন্তু প্লাস্টিক যে মানুষকে কত ক্ষতি করে তা সকলে জেনে বুঝেও সেই আগুনে হাত বাড়ায়। তা মানুষের ভালমন্দ মানুষ বুঝবে’খন। নিজের ভাল কিসে হয় সেটাই এখন আমাদের লাখটাকার প্রশ্ন। সংসারের হাতে ধরার মত করে দিতে যেটুকু এখন শেখানো দরকার সেইগুলোই ছেলেটাকে শেখাবো ঠিক করে আছি। এতদিন ধরে এই যখন তার ভাবনা-পরিকল্পনা, ওই একটা বাক্যে তার সবটায় জল ঢেলে দিল বেটা আমার! এখন আমি কোথায় যাই, কি করে বোঝাই যে তোদের ঘরের ছেলেপিলেদের বেশি লেখাপড়া করতে নেই। বেশি পড়া শিখলেও কেউ তোকে চাকরি দেবে না। নীচু জাতকে বাবু জাতেরা ঘেন্না করে। তার উপর আমরা চর্মকার-মুচি। হিন্দু হয়ে গরুর চামড়া-মাংস ঘাঁটাঘাঁটি করি। আমাদেরকে তো বাবুরা দেখতেই পারে না। চোখের বিষ। সেই আমাদের পোলা হয়ে তোরা লেখাপড়া শিখে ওই বাবুদের পাশের চেয়ারে বসে আফিসে চাকরি করবি? এ কোনদিন সম্ভব না রে বাপ। কেন শুনবে বেটা, এই প্রায় মুর্খ বাপের কথা। শিক্ষিত মাস্টারের কথা শুনবে! আর ওই মাস্টাগুলোও হয়েছে তেমন। ওরাই ওর মাথাটা খাচ্ছে। বিশেষ করে অমর স্যারটা। সনাতন মাধ্যমিকে সতেরো হয়েছে। লেখাপড়ায় এত ভাল। পরিবার এবং অন্যদের একটু সাহায্য পেলে অনেক উপরে উঠতে পারবে ও। তারপর সরকারি সংরক্ষণের সুযোগে তরতর করে এগিয়ে যাবে। এদের উৎসাহ দেবার জন্যেই তো সরকার সমাজের এই পিছিয়ে পড়া অংশের উচ্চ শিক্ষায় বা চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের ঘরের ছেলে, উজ্জ্বল সম্ভাবনা যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সে কেন পড়া চালিয়ে যাবে না। যতই অভাব-কষ্ট থাক, পড়াশোনা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে। এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে হবে সনাতনকে।”
অমর স্যার কিছু বললেই যেন ছেলেটা তা বেদবাক্য ধরে নেয়। একবার যদি কোন কথা এর মাথায় গুঁজে দেয় তো বেটাচ্ছেলেকে কার বাপের সাধ্যি সেখান থেকে বার করে আনতে পারে! আমাদের মত গরিব ঘরে এসব মানায় নাকি? এই মাধ্যমিকের সময় কি চাপটাই না খেতে হল। একবার বলল, “একটা ছাত্রবন্ধু আনতে হবে বাবা।” তো একসপ্তা পরেই বলে বসল, “আমাকে টেস্ট পেপার কিনতে হবে। অমর স্যার বলেছে। টেস্ট পেপার দেখে প্র্যাকটিস না করলে নাকি ভাল রেজাল্ট করা যাবে না।” বলল তো তাই মাধ্যমিকের সময়! তা উঠোউঠি এইরকম বই কেনার চাপ দিলে সেও বা তার দাম জোগায় কোথা থেকে! কাজের বাজার তো একদম যাচ্ছেতাই। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ধামা পালি সারাই, বিক্রী করে যা সামান্য কিছু রোজগার হয় তাতে একবেলা একসন্ধে পেটে দিয়ে দিন চলে। পাড়া ফিরি করার কাজে কি মোটা পয়সা পাওয়া যায়? যায় না। সেটা বোঝে না ছেলেটা। ওই মাস্টারটাও। রেগেমেগে একদিন সনাতনকে বলেছিল, বাপ কি হাড়ভাঙা খাটনি খেটে দু’পায়সা ঘরে আনে জানিস তো। তার পর এই বই-ফই কেনার চাপ দিলে আমি পারবো কেন? তাও যদি আমার কথা না শুনিস তাহলে এক কাজ কর, আমাকেই বিক্রি করে দে? তাতে যদি তোর চাহিদা মত টাকা পাস তো নিয়ে নে? ক্রীতদাস হয়ে যাই। ছেলে যখন আমার তখন তার মানুষ করার দায়ও বাবার থাকে। তোর অমর স্যার তো জানে আমাদের বাড়ির অবস্থা কেমন। তার পর কেমন করে চাপ দেয় রে? কেমন-তারা মাস্টার, ওই লোকটা?”
রতনের কথায় কেঁদে ফেলেছিল সনাতন। তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে আর বই কেনার কথা বলে বাবাকে চাপ দেয় নি। অমর স্যার নিজের চেষ্টায়, গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে তাকে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করে দেয়। সনাতন মনের ভেতর গুমরে গুমরে আওড়েছে, “আমি ভাল করে পড়তে চাইলেও পড়তে পারব না। আমরা গরিব বলে যেন আমাদের পড়ার অধিকার নেই ! বাবার বা কি দোষ। তাদের পেটে দুটো দানা জোটাতেই বাবা হিমসিম খাচ্ছে। মা এদিক ওদিক থেকে লোকের গরুর গোবর জোগাড় করে ঘুঁটে বানিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বেচে কিছু পয়সা বাবার সংসারে জোগান দেয়। সেই সংসার আবার তার পড়ার খরচ যোগাবে কেমন করে! কিন্তু অমর স্যার বলেছে, পড়া ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তাকে বড় হতে হবে। সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে, তাদের মত ছোট জাতের, গরিব ঘরের সন্তানরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তুই পারবি সনাতন। তোর হাত দিয়েই সেই কাজ হবে। যত বাধা আসুক। দমে গেলে চলবে না। তুই জানবি, বাধা তোর আসবেই এবং সেই বাধা তোকে পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অমর স্যারের কথা সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে চায়। কিন্তু সেটা কেমন করে, তা তো সে বুঝে উঠতে পারছে না। উচ্চ মাধ্যমিকের একটা টেস্ট পেপার এখনো সে জোগাড় করে উঠতে পারল না।
হঠাৎ সনাতনের চোখের সামনে ভেসে উঠল পূব-পাড়ার ওই অলোকাদির মুখটা! তাদের বাড়ি থেকে পূব দিকে আট-দশটা বাড়ি পরে অলোকাদিদের বাড়ি। পাশের পাল পাড়ার বিপ্লবদা পড়তো অলোকাদির দু’ক্লাস উঁচুতে। অলোকাদিকে বিপ্লবদার পছন্দ হয়েছিল কি না কে জানে! মনে মনে ভালবাসতোও হয়তো। অসম্ভব কিছু নয়। না হলে পড়া দেখিয়ে দেবার ছুতোয় ঘনঘন এ’পাড়ায় ও আসবে কেন। এমনিতে পালপাড়ার লোকেরা একটু নাক উঁচু। লেখাপড়া, টাকাপয়সা, সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা রুইদাসদের ওরা কেমন যেন বাঁকা চোখে দেখে। তাই নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওরা তাদের রুইদাসপাড়া মাড়ায় না। অথচ বিপ্লবদা, তার পুরোনো একটা টেস্টপেপার আর সেইসঙ্গে একটা নতুন টেস্টপেপার, কিছু নোটস অলোকাদিকে দিতে এসেছিল। তাছাড়া ওগুলো দরকারও অলোকাদির। বরং অলোকাদির তার প্রয়োজন মেটাতে বিপ্লবদার বাড়ি যাওয়া উচিৎ। সাধারণ ভাবনায় এটাই হবার কথা। কিন্তু এখানে তার উল্টো। অলোকাদির প্রতি বিপ্লবদার ভাললাগা বা ভালবাসার টান না থাকলে এই উল্টোপুরাণ হয় কেমন করে। আসলে অলোকাদিকে দেখতে খুব সুন্দর। দুপুরে পাড়ার মেয়েমহল বড়-পুকুরের সান বাঁধানো ঘাটে বাসন মাজা আর আড্ডার সময় প্রায়ই অলোকাদির কথা পাড়ে। দেরি হচ্ছে বলে পুকুরঘাটে তার মা’কে ডাকতে গিয়ে কথাগুলো শুনেছে সনাতন, “মিলন রুইদাসের মেয়ে, ওই অলোকাটা, যেমন ফর্সা তেমন মাজাঘসা মুখের বাহার। রুইদাসদের ‘বাজার ছাড়া’ মেয়ে। কি করে ওদের গর্ভে এই সুন্দরীটা এলো কে জানে। রুইদাসদের কোন মেয়ে-পোলা তো এত চকচকে না? সব তো কেলে-কুসুন্ড আর ফিঙে ফর্সা।” একজন আবার মাথার ঘোমটায় মুখ আড়াল করে শরীর দুলিয়ে ফুট কেটে বলল, “কি জানি বাবা, মেয়ের মা’র চালচলন ঠিক ছিল কি না কে জানে! ঠিক থাকলে ভাল। ভগবান ভ’র করেছে তাই অমন সুন্দরী মেয়ে বিইয়েছে।”
অলোকাদি এখন হরিণডাঙ্গার কাছে হেলেগাছিতে ‘সাধন চন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে’ বাংলা অনার্স নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে আর বিপ্লবদা ডায়মন্ড হারবার ‘ফরিক চাঁদ কলেজে’ ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ে। ওই বই-নোটস্গুলো তো এখন আর অলোকাদির কাজে লাগবে না। নিশ্চয়ই ওগুলো অলোকাদির কাছে পড়ে আছে। অলোকাদি ইতিমধ্যে অন্য কাউকে দিয়ে দিলে বা দেবে বলে কথা দিয়ে থাকলে তো তার ভাগ্যে আর জুটল না। ওই বই জোগাড় করা নিয়ে তাহলে তার কপালে অনেক কষ্ট আছে। আর দেরি না করে কলেজ থেকে অলোকাদি ফিরলে সন্ধ্যেবেলাই ওদের বাড়ি যাবে সে।
সেবার অলোকাদি আর বিপ্লবদার মধ্যে এই টেস্ট পেপার-বই আর নোটস্- টোটস্ দেয়া নেয়া নিয়ে জানাজানি হয়ে যেতে সে কি গন্ডগোল! পাল পাড়া আর রুইদাস পাড়ার মধ্যে বলা যায় আড়াআড়ি বিভাজন যেন হয়ে যেতে বসল। বিপ্লবদা উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে বাংলার নোটস্ আর টেস্ট পেপার নিয়ে অলোকাদিকে দিতে এসেছিল সেদিন। এইসব পড়াটড়া নিয়ে আলোচনা করতে করতে সন্ধ্যেটা একটু ভারি হয়ে গেছিল তা ওরা বুঝতে পারেনি। তক্কে তক্কে ছিল পাড়ার বখাটেরা। বিপ্লবদা, অলোকাদিদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। পেছনে অলোকাদি টেঁপি-লম্পোর আলো ধরেছে। মাটির ঘরের উঁচু বারান্দা থেকে সিঁড়ি ভাঙতে যাতে বিপ্লবদার অসুবিধা না হয়। তাছাড়া ক’দিন ভ’র বৃষ্টি হওয়ায় ঘরের সামনের উঠোনটা কাদা প্যাচ প্যাচে হয়ে গেছিল। পা-পা মাপ করে ইট বেছানো আছে উঠোনে। কাদা মাড়ানো থেকে পার পেতে। একটু আলো না ধরলে অন্ধকারে হোঁচট খেতে পারে বিপ্লবদা। নিজের শরীরটা একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে অলোকাদি বিপ্লবদার দিকে টেঁপির আলোটা বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বলছে, “সাবধানে দেখে ইটে পা রাখো বিপ্লবদা। না হলে পায়ে ঠোক্কর লেগে কাদায় পা পড়ে যেতে পারে। অলোকাদি সেই মুহূর্তে হয়তো বিপ্লবদার একটু কাছাকাছি এসে পড়েছিল। খানিক তফাতে রাস্তার উপর অন্ধকারে পাড়ার ওরা ওৎ পেতে ছিল ওদের দু’জনের ঠিক এইরকম কোন একটা প্রায় অন্তরঙ্গের মুহূর্তের জন্যে। অন্ধকারের ভেতরে চোখ ফুঁড়ে তারা ধরেই নিয়েছিল বিপ্লবদা, অলোকাদিকে জড়িয়ে ধরেছে! সঙ্গে সঙ্গে চৌকী-অলারা হই হই করে তাদের উঠোনে নেমে এসে তাদের ঘিরে ধরে। হঠাৎ এমন ঘটনায় চমকে ওঠে অলোকাদিরা। থরথর করে কাঁপতে থাকে বিপ্লবদা। তারা যা সন্দেহ করছে তা যে কিছুই না, বারবার অলোকাদিরা দু’জনেই বলার পরও পাড়ার ওরা কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়। বিপ্লবদা বেলেল্লাপনা করছিল অলোকাদির সঙ্গে। এই বদনাম থেকে তারা কিছুতেই পিছোতে রাজি নয়। এই জঘন্য কাজের জন্যে শাস্তি পেতে হবে বিপ্লবদাকে। আটচালায় বিচার হবে বিপ্লবদার। বেলেল্লাপনার জন্যে মোটা টাকার ফাইন করা হবে। এইসব হুল্লোড়ের খবর হাওয়ার বেগে উড়ে বেড়ালো গোটা পাড়ায়। একে একে লোক জড়ো হতে থাকে। কিন্তু পাড়ার মধ্যে মুরুব্বি বুঝদার লোকও তো আছে। তাদের মধ্যে সনাতনের বাবা রতনও আছে। ভীড় কাটিয়ে সনাতনের বাবা চলে যায় অলোকাদির বাড়িতে। যাবার সময় বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যায় অলোকাদিকে। অলোকাদির বাবা-মা’র সঙ্গে সব কথা আলোচনা করে বোঝা যায় ব্যপারটা পাড়ার ছোকরারা যেভাবে চাউর করেছে তা সঠিক নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে এত লোকজনকে তো সহজে বোধ মানানো যাবে না। চাউর হয়ে যাওয়া কথাগুলো ভুল তা সহজে মানুষকে বোঝানো যাবে না। আর কিছু মানুষ আছে যারা আবার ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করবে। এই সুযোগে অলোকার বাবা, মিলনের সঙ্গে যার পুরোনো ‘আকছা আকছি’ আছে তারা শোধ তোলার চেষ্টা করবে। আর ঝগড়াঝাটি একজনের সঙ্গে আর একজনের বা একাধিক কারোর সঙ্গে টুকটাক থাকতেই পারে, থাকেও। গ্রামের এমন মানুষ নেই বললেই চলে, যার সাথে অন্য কারোর কোনদিন বিবাদ বা কথাকাটাকাটি হয়নি। তাতে একে অপরের মনে আঘাত লাগতেই পারে। কেউ সেটা ভুলে যায় বা মেনে নেয়, কেউ নেয় না। মনের মধ্যে তা পুষে রেখে দেয়। সুযোগ পেলে সে তার মনের ঝাল মেটাবার চেষ্টা করে। তবু রতন আপাতত গ্যাঞ্জাম হটাবার জন্যে ভীড়কে বলল, “ঠিক আছে, তোমাদের আর্জি মত আটচালা বসানো হবে। এই গন্ডগোলের একটা বিহিত করা হবে। এখন সবাই শান্ত হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাও। বিপ্লবও বলেছে, সে তার বাড়ির সঙ্গে কথা বলে যেদিন আপনাদের আটচালা বসবে, সেদিন আমাদের পক্ষও হাজির হবে। মিলন, তার মেয়ে অলোকাকে বিচারে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে ভীড় থেকে দক্ষিণ পাড়ার সুদর্শন ঋষির ছেলে, অভয় বলল, “কেন, অলোকা আটচালায় পাবলিকের সামনে আসতে যাবে কেন? ওর তো কোন অন্যায় নেই। ওই বিপ্লব ব্যাটা বেপাড়া থেকে এখানে এসে আমাদের পাড়ার মেয়েকে ফুঁসলে নিতে এসেছে। অন্যায় ওর। অলোকা আটচালায় আসবে না। বিচার হবে বিপ্লবকে নিয়ে এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে। কড়া শাস্তি। তাহলে আর দ্বিতীয়বার বেপাড়ার কোন ছ্যাঁচড়া আমাদের রুইদাস পাড়ার মেয়েদের দেখে ছোঁক ছোঁক করার সাহস পাবে না।” অভয়ের কথায় একদম পেছন থেকে তাকে ভেঞ্চি কেটে রে রে করে ওঠে বরেণ, “এই ব্যাটা ওভে, তুই ওই মেয়েটাকে আড়াল করতে চাইছিস কেন? এক হাতে তালি বাজে, না-রে? দু’পক্ষের কথা শুনে তবে তো বিচারক সঠিক বিচার করবে। আটচালায় দু’জনের কথাই শুনতে হবে। না হলে ‘এ্যাকেনে’ বিচার হয়ে যাবে। ঝাড় খেয়ে যাবে অন্য পাড়ার ছেলেটা। আর তুই কেন মেয়েটাকে সমক্ষে আনতে চাইছিস না তা কি আমরা জানিনা বুঝি। ওর প্রতি তোর লোভ আছে তা পাড়ার কে না জানে? অলোকা স্কুলে বার হলেই তেমাথানি মোড়ের বটগাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকিস, তা কার না চোখে পড়েছে। গলায় গামছার মুড়ির ঝোলা ঝুলিয়ে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তা চিবোতে চিবোতে তার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে থাকিসনি? অলোকার সাথে কথা বলার জন্যে ওকে দেখলেই বিষধরের মত কেমন হিস হিস করিস তাও সবাই দেখেছে। যেন নাগালে পেলেই তাকে ছোবল মারে আর কি! সে কথা যদি আটচালায় কেউ পাড়ে তাই তোর এই মাতব্বরি। সেটা আমরা বুঝিনা বুঝি? শালা দুনিয়ার ধান্ধাবাজ কোথাকার! মানুষকে বোকা বানাতে চায়।”
এত লোকের সামনে হাটে হাঁড়ি ভাঙতেই অভয় রাগে গরগর করতে থাকে আর ফুঁসে উঠে তেড়ে যায় বরেণের দিকে, “শালা শুয়োরের বাচ্চা, তুই প্রমাণ করতে পারবি, আমি অলোকার পেছনে লাগি? কেউ কারোর দিকে তাকালেই তার উদ্দেশ্য খারাপ? তুই কি করে জানলি, আমি অলোকার দিকে তাকাই? তাহলে তুইও নিশ্চয়ই ওর দিকে তাকাস? তোর কথাতেই প্রমাণ হয়ে গেল তোরও উদ্দেশ্য খারাপ। নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়লি তো-ও? ওই কথা আছে না, “চালুনির পোঁদ ঝর ঝর করে, আবার চালুনি ছুঁচের বিচার করে?” তোকে সাবধান করে দিচ্ছি বরেণ, ফের যদি তুই ওই শান্তশিষ্ট গোবেচারা মেয়েটার দিকে তোর লালসার চোখ ফেলিস তো প্রচুর খেসারত দিতে হবে তোকে। শালা ঢ্যামনার বাচ্চা! ফালতু এত লোকের সামনে আমাকে তুই অপমান করলি? দাঁড়া শালা, তোকে দেখাচ্ছি মজা। একটা শক্ত ঘুষি বাগিয়ে বরেণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অভয়। বরেণও ছাড়ার পো নয়। পাঁজা মেরে অভয়কে ধরে পাছড়ে মাটিতে ফেলে সিনেমার ঢঙে তার বুকে লাথি তুলতে যাবার আগেই অন্যরা ধরে ফেলে তাকে। ওদের দু’জনের মারপিট সামলাতেই এবার ভিড় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চিৎকার চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই ফাঁকে যারা এসব পছন্দ করে না, তারা পাতলা হয়ে যায়। যুযুধান দু’জনকে অন্যরা যে যার বাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে আসে। তখনও অভয়ের ফোঁসফোঁসানি দমেনি, “এই আমার মায়ের দিব্যি রে শালা বরেণ, তোকে আমি ছাড়বো না। তুই বিষ-পতঙ্গ, ভীমরুলের চাকে ঢিল মেরেছিস। তার হাত থেকে তোর রেহাই নেই। এই আমি তোর পেছনে পড়ে গেলাম। অলোকার কেসের সাথে সাথে তোর এই চোরপুট্টিরও একটা বিহিত না করে আমি থামছি না।” ততক্ষণে ভিড় ফাঁকা। রতন এবার বিপ্লবকে তাদের পাড়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই ছোকরারা যেভাবে রুখেছে, মনে হচ্ছে তোমাদের নিয়ে আটচালায় বসার একটা ব্যবস্থা না করে ছাড়বে না। ভাবছিলাম এই নিয়ে আর ‘কলাগাছের থোঁড় কচলানিতে’ কাজ নেই। যত কচলাবে তত জল-রস বার হবে। কিন্তু কতটা কি পরিস্থিতি হবে তা দু-একদিন না গেলে বোঝা যাবে না। যদি তোমাকে ডাকতে বাধ্য হতে হয় তো তোমাকে বসতে হবে আমাদের আটচালার বিচারের সামনে। তবে মেয়ের বাড়ির লোকরা যখন তোমার বিরুদ্ধে নয়, তখন তোমার কোন অসুবিধা হবার কথা না। তাই তোমার ভয়েরও কিছু নেই। তবু দেখো আটচালা বিচারটা কোন দিকে ঠেলা মারে? জোয়ারে, না ভাটায়!”ক্রমশ…
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৬)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[বারো]
নানান টানাপোড়েনের দীর্ঘ সময়ের পর রুইদাস পাড়ায় স্থায়ীভাবে নিয়মটা চালু হয়। তাতে অন্তত এই ভাগাড়ের গরু বা মরা ছাগল পড়লে তার চামড়া সংগ্রহের পর ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে যে অশান্তি হয় তা বন্ধ করা সম্ভব হবে। যে আগে আসুক বা পরে, যতক্ষণ পশুর শরীর থেকে চামড়া পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা না যাচ্ছে ততক্ষণে তাদের সম্প্রদায়ের যে এসে পশুকে ছুঁতে পারবে, সেও সমান অংশে চামড়ার ভাগীদার হবে। মায় নিজের গামছার এক খুঁট নিজের কাছে ধরে অন্য দিকের খুঁটটা যদি পশুর শরীর থেকে চামড়া বিচ্ছিন্ন হবার আগে ঠেকিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও সে ভাগ পাবে। এখন রতনদের মত বয়স্করা যেমন খুশি, তেমন অল্পবয়সীরাও। সবাই মিলেমিশে ভাগবাঁটোয়ারা করে বেঁচেবর্তে থাকার একটা ব্যবস্থা আর কি। কিন্তু কালের গতির সঙ্গে তাল দিতে দিতে একটা ব্যাপার রতনরা টের পায়, কোন ব্যবস্থাই যেন চিরস্থায়ী এবং চিরসন্তুষ্টির ব্যবস্থা নয়। আটচালা কমিটির টাকাপয়সার দায়দায়িত্ব হাতে আসার পর রতন দেখছে দিনকে দিন কমিটির ভাঁড়ার কমতে শুরু করেছে। এক সময় যে ভাঁড়ার সবসময় টৈটুম্বুর হয়ে থাকত এখন সে তার কৌলীন্য হারাচ্ছে। কমিটির আয় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। একদিন কমিটির কর্তাদের নিয়ে এই পয়সাকড়ির ব্যাপারে আলোচনায় বসে ওরা। তাতে দেখা যাচ্ছে ভাগাড় থেকে যে হারে আয় আসতো তা ভীষণভাবে কমে আসছে। ভাগাড়ের পাওনা চামড়ার ভাগ ঠিকভাবে আটচালাকে লোকে দিচ্ছে না।
তাদের বয়ারিয়ার রুইদাস পাড়ার এলাকার মধ্যে পড়ে ফলতা থানার যাবতীয় ভাগাড়। শুধু ফলতা থানা কেন, কাছাকাছি যেসব থানায় তাদের মুচি সম্প্রদায় নেই, সেইসব থানার ভাগাড়ও অন্য এলাকার মুচিদের আলোচনা সাপেক্ষে তাদের আওতায় পড়বে। সব ভাগাড়ই আবার দুইভাগে ভাগ করা আছে। একভাগ নির্দিষ্ট করা আছে আটচালা কমিটির জন্যে, অন্যভাগ পাড়ার সকল বাসিন্দাদের জন্যে। কমিটির ভাগের ভাগাড়ে কোন পশু পড়লে সেই পশুর পঁচাত্তর শতাংশ চামড়া কমিটি পাবে। বাকি পঁচিশ শতাংশ পাবে যারা ওই চামড়া সংগ্রহ করতে আসবে। যে ক’জন চামড়া পাবার অধিকারী হবে তারা ওই পঁচিশ শতাংশ সমানভাগে ভাগ করে নেবে। পঁচাত্তর শতাংশর এক চিমটে চামড়ার তারা ভাগ পাবে না। সবটাই যাবে কমিটির তহবিলে।
ওদের পাড়ার কাছাকাছি বলতে দৌলতপুর মৌজা আর আলমবিবি মৌজার ভাগাড় সাধারণ রুইদাস বাসিন্দাদের জন্যে নির্দিষ্ট করা আছে। এই দুটো মৌজার ভাগাড়ে বিশাল এলাকার মানুষ আসে তাদের মৃত পোষ্য ফেলতে।
ফলে এখানে অন্য ভাগাড় অপেক্ষা অনেক বেশি মৃত পশু ফেলা হয়। বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে এর সুবিধা নিতে পারে তার জন্যে এই ব্যবস্থা অনেক আগে থেকে নির্দিষ্ট করা আছে। এছাড়া আর যে ছোট-মাঝারি তিন-চারটে ভাগাড় আছে, যেমন মনষার হাট বা ফতেপুর অথবা কোদালিয়া এইসবকটাই কমিটির জন্যে ঠিক করা আছে। তা সারা বছরে এইসব ছোট ভাগাড়ে যা অল্পবিস্তর পশু পড়ে তাতে কমিটির আয় পুষিয়ে যায়। এতদিন তাই হত। কিন্তু ইদানিং বছর দুই-তিন হবে সেই আয় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। রতনের আগে যারা দায়িত্বে ছিল, তারা কেউই আয়ের এই মন্থর গতি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। এটা তাদের দেখা উচিৎ ছিল। দেখা উচিৎ ছিল এর কারণটা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে।
কমিটির কর্তাদের সেই মিটিংয়ে এটাও ঠিক হয় যে তদন্ত করে দেখতে হবে এই আয় কমে যাবার সঠিক কারণ এবং কে বা কাদের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। রতন আর নন্দকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এটা তদন্ত করার জন্যে। কারণ ওরা নিজেরা এখন আর কোন ভাগাড়ে যায় না চামড়া সংগ্রহের জন্যে। বয়সের কারণে ওরা আগের মত দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। আয়ুক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শরীরের শক্তিক্ষয়ও হয়ে চলেছে। তাই এই পেশা থেকে ওরা সরে এসেছে। যেহেতু চামড়া সংগ্রহের প্রতি ওদের কোন আগ্রহ নেই তাই ওরাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারবে।
তদন্তে নেমে নন্দ-রতনের তো চক্ষু চড়কগাছ! এ যে সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে। গোপনে গোপনে ওরা মনষার হাট বা ফতেপুর-কোদালিয়ার মানুষদের সঙ্গে একান্তভাবে কথা বলেছে। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে নিয়মিত গরু-ছাগল পোষা হয়। গরুর দুধ এবং ছাগলের দুধ বা মাংস বিক্রি করেই যাদের সংসার চলে। এইসব মানুষের জীবন ওই গরু-ছাগলের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। এরা তাদের পোষ্যদের নিজের পরিবারের একজন করে নিয়ে বসবাস করে। ফলে এই মানুষগুলো কোনদিন ভাবে না যে তাদের পোষ্যরা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে আর তাদের সংসারের জন্যে আয় দিতে পারবে না তখন কোন ব্যাপারিকে শুধুমাত্র অন্যের মাংস খাবার ‘আয়ের’ হিসেবে বিক্রি করে দেবে। বিশেষ করে গরুর ক্ষেত্রে। এরা একবাক্যে গরুকে মা ভগবতী জ্ঞানে দেখে। তাই এদের বাড়ির পশু মারা গেলে ভাগাড়ে তো ফেলবেই। কোদালিয়ার এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে নন্দ-রতন। রতনের সঙ্গে তাদের আগে থেকেই চেনা-জানা। ওই পাড়ায় পাড়ায় ধামা-কুনকে সারাবার জন্যে ফেরি করতে দিনের পর দিন আসতে আসতে জানাশোনা হয়ে গেছে। কথায় কথায় রতনরা তাদের বাড়ির গরুর কথা তুলতে তুলসীদাস বাবু বলল, “এই তো এগারোদিন হল আমাদের বড় গাভীটা মারা গেল। ক’দিন ভ’র সে শয্যা নিয়েছিল। তা তোমাদের এক মুচি, নামটা ঠিক জানা নেই, তবে মুখচেনা, পাড়ায় বেত নিয়ে ফেরি করতে করতে দেখতে পেয়েছে আমাদের গরুটা অসুস্থ। সেই যে দেখতে পেল, তারপর প্রতিদিন এসে একবার করে ঢোঁ মেরে যেতো আমাদের গোয়ালঘরে। ও মনে হয় বুঝতে পেরেছিল যেকোন দিন গরুটা মরে যাবে। সরাসরি এসে আমাকে বলল, ‘বাবু, আপনার গরুটা মারা গেলে আপনাদের কোদালের ভাগাড়ে ফেলে দেবেন না। আমরা লোক পাঠিয়ে দেব। ওরা ওটা দৌলতপুরের ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবে। রোজই ভোরবেলা আমরা জনাচারেক লোক আসবো। দেখে যাব। মরে গেলে ওই ভোরেই আমাদের লোক এটাকে নিয়ে চলে যাবে।’ তা আমরা তো তোমাদের রুইদাসদের ভেতরে এই গরু, ভাগাড় নিয়ে কি সব আইনকানুন আছে জানি না। আমাদের পরিবারের প্রিয় এক পোষ্য মারা যাচ্ছে, তাতেই বাড়িময় শোকের আবহ। তার মধ্যে মারা গেলে তাকে কে কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে আমাদের অত মাথা ঘামাবার ফুরসৎ নেই। তুমি, রতন এখন এই কথা তুললে, তাই বললাম আরকি। তা এসব নিয়ে তোমাদের নিজেদের মধ্যে পাড়ায় কোন ঝামেলা টামেলা হচ্ছে নাকি? আমাদের কাছে তো কোদালের ভাগাড় আর দৌলতপুরের ভাগাড় সব সমান। সেইজন্যে ওসব নিয়ে আমাদের মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। প্রশ্ন করে আমাদের কোন কাজও নেই। ও তোমাদের রুইদাসদের ব্যাপার, তোমরা নিজেরা জেনেবুঝে নাওগে। আমাদের এর মধ্যে জড়িও না।”
রতনদের বুঝতে কষ্ট হল না যে এখনকার পড়শি ছেলেপুলেরা কতটা স্বার্থপর হয়ে পড়েছে। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ কতটা নিরাপদ থাকে সেদিকে তাদের আসল লক্ষ্য। তাতে সমষ্টির উন্নতির ভাবনা চুলোয় যাক। কমিটির ভাগাড়ে ফেললে তো ছিটেফোঁটা চামড়া ভাগ পাবে। তাই ওখানে যাতে না পড়ে তার জন্যে কত আগে থেকে এরা সতর্ক থাকে! ভেবে তাজ্জব রতনরা! আরে বাব্বা, আটচালা-কমিটি বেঁচে না থাকলে তোদের সমাজ এক লহমায় কোথায় ওলটপালট হয়ে ছন্নছাড়া হয়ে পড়বে সে খেয়াল তোরা রেখেছিস? থাকবে তোদের গর্ব করার মত এই সামাজিক কৌলীন্য? থাকবে না। এই সমাজ ব্যাভিচারে, অনাচারে ভরে যাবে। বর্ণশঙ্করে পরিণত হবে তোদের রুইদাসরা। তখন তোরা আর বুক বাজিয়ে বলতে পারবি না আমরা রুইদাস, ঋষিদাস, রুহিদাস বা ঋষি-মুচি সম্প্রদায়ের মানুষ। পোদে কৈবর্ত্যে মিলেমিশে তোদের জাতটা ঘেঁটে একেবারে ‘ঘ’ হয়ে যেতে তাহলে আর বেশি সময় নেবে না রে ব্যাটাচ্ছেলেরা!
এক ভাগাড়ের গরু চালাকি করে অন্য ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে আখের গোছানোর মত জঘন্য অপরাধ যে বা যারা করেছে বা করছে তাদের ছেড়ে কথা বলা হবে না। ক্ষিপ্ত রতন-নন্দদের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। অপরাধীদের খুঁজে বার করে এমন শাস্তি দেওয়া হবে যে জীবনে আর কেউ এই নোংরা কাজ করতে গেলে দু’বার ভাববে। যে ভাগাড় এলাকার গরু মরেছে তার গতি তো সেই ভাগাড়ে হবে। চিরকাল তারা এটা দেখে এসেছে এবং তার মান্যতা দিয়েছে। এমনিতেই কমিটির বরাদ্দে যে ভাগাড়গুলো আছে সেখানে গরু সাধারণের জন্যে নির্দিষ্ট ভাগাড়গুলো থেকে অনেক কমই পড়ে। তা সেখানেও শয়তানদের নজর গিয়ে পড়েছে! এর থেকে দুঃখজনক অবস্থা আর কি বা হতে পারে।
এইসব নিয়ে ফাঁকা আটচালার সিঁড়িতে বসে নন্দ, রতন আলোচনা করছে। এমন সময় সুবোধ কাকা তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হন্তদন্ত হয়ে রতন কোমর থেকে পিঠটা উঁচিয়ে ডাক দিল, “কাকা, এদিকে একটু আসো না। তোমার কাছ থেকে একটু পরামর্শ নিই। এখন আমাদের কি করার তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। বড়ই অনাচার হয়ে চলেছে আমাদের পাড়ায়। একটা কিছু কড়া সিদ্ধান্তে আমাদের আসতেই হবে। নাহলে সমাজটাকে আর ধরে রাখা যাবে না। তোমরাই তখন বলতে থাকবে, আমাদের সময় তো এমনটা হতো না। তোমরা, রতনরা পাড়ার মাতব্বরির ভার নেবার পর থেকে মানুষগুলো এমন বেলাগাম হয়ে পড়েছে। আমাদের ব্যর্থতাই তখন তোমরা আঙুল তুলে দেখাবার চেষ্টা করবে। তাতে অবশ্য তোমাদের দোষ দিচ্ছি না। যা হচ্ছে সেটাই তোমরা বলবে। কিন্তু কাকা, সময় থাকতে আমাদের লাটাই গোটাতেই হবে। তুমি এসো কাকা, আমাদের কাছে একটু বসো। একটু আলোচনা সেরে নিই। কোথায় যাচ্ছিলে কাকা, তুমি? কোন দরকারে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছিলে? না এমনি এমনি পা ছাড়াচ্ছিলে? তাই যদি হয় তাহলে একটুকুন বসো কাকা।”
রতনদের কাছে সব শুনে চোখ বড় বড় করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সুবোধ কাকা। তারপর কাকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁরে রতন এও সম্ভব? আমরা মুচিরা গরিব হতে পারি। খিদে ভুলতে চুল্লু, দেশি মদ গলায় ঢালতে পারি। এইসব ছাইপাঁস গিলে নিজেদের পিলে জ্বালিয়ে দিতে পারি। সেই নিয়ে যা বদনাম হয় সেগুলোও গোগ্রাসে গিলে নিতে পারি। কিন্তু গর্ব করে বলি আমরা চোর নই। ফেরেব্বাজ নই, মিথ্যুক নই। আমরা বেইমান নই। সেই আমাদের এই মুচি জাত কি না এমন ফেরেব্বাজি কাজে ঢুকে পড়েছে! কেবলমাত্র নিজের নিজের আখের গোছাবার জন্যে! সমষ্টির মুখের দিকে একবারও তাকাবার কথা ভাবলো না! এটা তো সত্যিই সর্বনাশা প্রবণতা। এটাকে আটকাতেই হবে। নন্দ, রতন, তোমাদের বলছি, আমি জীবিত থাকতে থাকতে যেন এই নোংরামো বন্ধ হয়েছে দেখে যেতে পারি। তবে তোমাদের একটা কথা বলব, ওই তুলসীবাবুর মুখের কথায় বা অন্য কারোর কাছে শোনা কথায় কাউকে শাস্তি দিও না বাবা। যদিও কাজটা বড়ই শক্ত। তবু তা করতে হবে। তোমাদের কিছু একান্ত বিশ্বস্ত লোককে এ কাজে নিযুক্ত করতে হবে। কমিটির আওতায় যে ভাগাড়গুলো আছে সেই এলাকাগুলোতে সেইসব ছেলেপিলেদের গোপনে চৌকী দিতে পাঠাতে হবে। দেখতে হবে কারোর বাড়িতে অসুস্থ কোন গরু-ছাগল আছে কি না। থাকলে আরও সুক্ষ্মভাবে সেই অসুস্থ পশুর পরিণতি কি হল লক্ষ্য রাখতে হবে। আর একদিকে নজর দিতে হবে, আমাদের পাড়ার কোন কোন বেটাছেলে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করতে যায়। ফেরি তারা করুক। এটা তো আমাদের জীবন জীবিকার একটা দিক। কিন্তু ওই ফেরির নাম করেই, আমার মন ঠাওর করছে, তারা অন্যায়গুলো করে চলেছে। তাদের পেছনে চৌকি দিতে হবে। তবে তারা যেন ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে না পারে। তাহলে রতন দেখবে একদম হাতেনাতে তোমরা অপরাধীকে ধরে ফেলতে পারবে। তখন আটচালা যদি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে তো কারোর কিছু বলার থাকবে না।” এরপর খানিক দম নিয়ে সুবোধ কাকা আবার বলল, “দেখো বাবা, আমি যে তোমাদের বুদ্ধিগুলো দিলাম তা যেন আমার নামে বাজারে চাউর করে দিও না। তাহলে যাদের স্বার্থে ঘা লাগছে তারা আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। দিনকাল বড়ই খারাপ গো বাপেরা। ভীমরুল চাকে ঢিল মারলে তুরন্ত ভীমরুল তার প্রতিশোধ নিতে ধেয়ে আসে আক্রমণকারীর দিকে। এ তো আর মৌচাক নয় যে তার কামড় সহ্য করা যাবে। দিনে দিনে কি কাল এল রে বাপেরা!”
[ তেরো ]
দুলাল লোকটাকে তাদের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেওয়াটা এখন মনে হচ্ছে সঠিক কাজ হয়নি। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে তার এই পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না চন্দনের। যেভাবে মেয়েটা ওই দুলালের হাত ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। মনে হল যেন একই মায়ের নাড়িকাটা দুই ভাইবোন। কোনদিন বাড়ি থেকে বাইরে বার হয়নি পাড়াগাঁয়ের এই বোন। স্বামী বেয়নে কোলের শিশুটাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে বাড়ির বাইরে বার হয়েছে। “বোন ভয় পেয়ে কান্নকাটি করছে। ছলছল চোখে বলেছিল দুলাল।” আবেগটা সক্রিয় হয়ে পড়ল। তাই মেয়েটার কান্না বন্ধ করার জন্যে সেদিন প্রস্তাবটা দিয়েছিল চন্দন। এখন তো মনে হচ্ছে ওগুলো সবই তাদের অভিনয়। বিশেষ করে তাদের দু’জনের ঘোষিত সম্পর্কটা। মর্নিং ওয়াকের সময় এ.-ই. ব্লকের বক্সিবাবুকে বলেছিল তাদের কাজের লোকের সমস্যার কথা। বক্সিবাবু বলেছিলেন, ঠিক আছে চন্দন, আমাদের কাজের মেয়ে নমিতাকে বলব’খন যদি তাদের দেশের বাড়ি থেকে কোন কাজের মেয়ে জোগাড় করে দিতে পারে। সেই নমিতাই দুলালের মারফত সনকাকে জোগাড় করে দেয়। এখন তো মনে হচ্ছে এই দুলাল দালালির মত কাজ করেছে। যদিও সে পেশাদার দালাল নয়। দুলালেরও খোঁজ সে নিয়েছে। বৈঠকখানায় একটা পেপারের দোকানে সে কাজ করে। গ্রামের বাড়ি-টাড়ি সব ঠিক আছে। সনকাদের এলাকাতেই তার বাড়ি।
শীতের দুপুরে টিফিনটাইম উপভোগ করতে দলবল নিয়ে চন্দন নিক্কোপার্কে গেল। অভ্যাসমত বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা দৃশ্যে চোখ আটকাতে চমকে ওঠে সে! চলতে চলতে থমকে দাঁড়ায়। অন্যরা সমস্বরে বলে ওঠে, “কি হল চন্দনদা, দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? চলুন!” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে পা পা করে এগিয়ে চলে। এক মহিলা, যে চন্দনের বেশি নেওটা, সে বলল,“চন্দনদা, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলেন যে? আচ্ছা, হঠাৎ আপনার কি হল বলুন তো? কি এমন হল! আমাদের মধ্যে কেউ কিছু বলেছে নাকি যে আপনি এমন চুপ হয়ে গেলেন? আমাদের কথার কোন উত্তরও দিচ্ছেন না। ধুর! ভাল্লাগে না।” বলে মেয়েটাও গোমড়া মুখ করে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে। চন্দন দেখল, এবার আর চুপ করে থাকা চলে না। পরিস্থিতি তাহলে অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। সামনের দিকে হাত উঁচিয়ে চন্দন বলল, “আরে ভাই আমাকে কেউই কোন কিছু বলেনি। যার জন্যে তোমরা সব চিন্তায় পড়ে যাচ্ছো। হঠাৎ একটা ঘটনার কথা মনে পড়তে থমকে গেছিলাম। কথাটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। ভুলে গেছিলাম কাজটা করতে। বাকি রয়ে গেছে। তাই সেটা মনে পড়তে থমকে যাই। ওসব ছাড়ো। পরে সামলে নেওয়া যাবে। এখন চলো। সবাই মিলে গরম কফি খাওয়া যাক। সেইসঙ্গে কড়া করে বেগুনিভাজা।”
অফিসে ফিরে আর আগের মত কাজে মন বসাতে পারছিল না চন্দন। নিক্কোপার্কের দেখা দৃশ্যটা বারবার তার চোখের সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে। রূপসা তাহলে ওদের সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছিল তা তো দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। সনকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে দুলাল! আর সনকা তার মাথার চুলে বিলি কেটে লাজুক মুখে কত কি বলে চলেছে। ওদের মধ্যে পরকীয়া প্রেম যে গাঢ় থেকে গাঢ়তর তা এই ছবিতে পরিস্কার। স্বামী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও সনকা পরপুরুষের সঙ্গে প্রেমালাপে মসগুল। স্বামী যে জীবিত তার প্রমাণ ওর মাথার সিঁদুর। অথচ সনকা স্বামীর ব্যাপারটা তাদের খোলসা করে বলেনি কোনদিন। চন্দন জিজ্ঞেসও করেছিল সনকাকে। কিন্তু তার উত্তর ওকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ও’ব্যাপারে একটা ধোঁয়াশা সে রেখেই দিয়েছে। হয় ও স্বামী বিচ্ছিন্না অথবা কোন কারণে স্বামীর সঙ্গে ও থাকে না। ছেলে কোলে করে স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে যখন এসেছে তখন আবার ঘটা করে সতী সাজতে সিঁদুর পরার মানে কি! ও যে সতী নয়, সেই ভাবনা চন্দনের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। হঠাৎ ওর মনে হ’ল লোভনীয় টোপ ফেললে মাছটা গিলতে পারে টোপটা। সত্যিই সনকার শরীরের এমন টান যে শুধু দুলাল কেন দুলালের থেকেও আচ্ছা আচ্ছা পুরুষ তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে সময় নেবে না। মুখের কাটিংও মনে ধরার মত। অবচেতনে চন্দনের মনও যেন ধরা দিতে উতলা হয়ে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল, দুলালের ব্যাপারটা সনকার কাছে জানতে চাইবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে সনকার মন থেকে সে হাজার যোজন দূরে চলে যাবে। ওকে পেতে গেলে আস্তে আস্তে ফন্দি করে দুলালকে তার কাছ থেকে দূরে সরাতে হবে। কাছে টানতে হবে সনকাকে। যুগপৎ সবটাই চলবে রূপসার অগোচরে।
দুলাল-সনকাকে সেই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার পর থেকে যখনই চন্দনরা নিক্কোপার্কে আসে তার সেই দৃশ্যটা অমনি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তখনই চন্দন অন্যমনস্ক। এই অন্যমনস্কতাকে সঙ্গী করে ওরা পার্ক থেকে ফিরছিল। সদলবলেই ফিরছিল। চন্দন তখন রাস্তা পার হবার জন্যে হাত নেড়ে সকলকে সিগন্যাল দিতেই সবাই মিলে এপার থেকে ওপারে যাবার কালেই একটা দ্রুতগামী বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে! কপাল ভালো বাইকটা সরাসরি কারোর ঘাড়ে চেপে বসেনি। দলের এক ফাঁকটায় সে ঢুকে পড়ে। তাতে ওদের কারোর প্রাণহানির সম্ভাবনা থেকে রেহাই পায়। তবে অল্প-বিস্তর রক্তারক্তি চোট পায় কমবেশি সকলেই। মন্দ কপাল, চন্দন পড়ে গেলে তার বাঁ পা ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। প্রথম ক’দিন হাসপাতাল তারপর বাড়িতে ছ’মাসের জন্যে বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। ওর এই বিপদে রুপসা-সনকা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেবাযত্ন করতে থাকে। সনকা যখনই তার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, চন্দন মনে মনে ভাবে এই মেয়েটাকে নিয়ে তার মধ্যে পাপ চিন্তা প্রবেশ করেছিল। উপরওয়ালা তাই সেই পাপের শাস্তি এইভাবে দিয়ে শিক্ষা দিল, স্বচ্ছ মন এবং সঠিক পথে চললে অমঙ্গল মানুষকে ছুঁতে পারে না।
ডাক্তারের দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই চন্দনের পায়ের প্লাস্টার কেটে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে লাঠির উপর ভর করে হাঁটাচলা অভ্যাস করার পর্ব এসে যায়। কিন্তু তার জন্যে কারোর সাহায্য দরকার। কখনো রূপসা কখনো সনকা, যার যেমন কাজের ফাঁকে ফুরসৎ হয় চন্দনকে হাঁটতে সাহায্য করে। সেই সুবাদে দুই রমনীর শরীরের পেলব ঘ্রাণ তাকে অতিরিক্ত সতেজ করতে সাহায্য করে বইকি। বিশেষ করে ইতিপূর্বের অধরা যুবতী সনকার শরীরের মরমী স্পর্শ! যেমনটি প্রথম প্রথম রূপসার স্পর্শ তাকে মাতাল করে দিত। রূপসার সেই স্পর্শর একঘেয়েমি এখন আর তাকে তেমন মাতিয়ে তুলতে পারে না। যেমন পারছে সনকা। সনকার ভেতরটা তার স্পর্শে কতটা দোলন দেয় তা তো চন্দনের বোঝার অতীত। তবে কিছুটা ইঙ্গিত যেন উঁকি দেয় তার প্রতি সনকার সেবার একাগ্রতার বহরে। তাহলে তো চন্দন এটাও ভাবতে পারে যে এই দুর্ঘটনা ওর কাছে শাপে বর হয়েছে! এই অঘটনের জন্যেই সে সনকাকে এত কাছে পেয়েছে এবং তা কোনরকম ফন্দিফিকির না করেই!
সনকার কাজে চন্দনের বাড়ির সকলেই সন্তুষ্ট। রূপসা তো তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ, “জানো তো, গ্রামের মেয়ে সনকাকে প্রথম প্রথম যতটা অকেজো হবে বলে মনে হয়েছিল এখন দেখছি আমার সেই ধারণা একদম ভুল। সনকা, ওর কাজের মধ্যে দিয়ে আমার সেই ভুল খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাঙিয়ে দিয়েছে। যেভাবে ও তোমাকে সেবাযত্ন করেছে এবং তা একান্ত আপনজনের মত ভেবে করেছে, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। শুধু করেছে না, এখনো করছে। ও যেন পণ করেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও তোমাকে অফিস পাঠিয়ে তবে ছাড়বে। ডাক্তারের অনুমানের আগেই তোমাকে অফিস পাঠিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় যে ও। অথচ দেখো মেয়েটা একবারও মুখ ফুটে সে কথা বলে না। মুখ ফুটে কোনদিন অসন্তোষ প্রকাশ তো করেই না। ওই অসন্তোষ, অনিচ্ছা, অনীহা- এসব যেন ওর ধাতে নেই। খুব ভাল একটা কাজের মেয়েকে আমরা পেয়েছি। এত ভাল মেয়ে, অথচ দেখো, ভাল করে তার স্বামীর ঘর করা হল না। ভাবছি তুমি অফিসে জয়েন করার পর সেই মাসেই ওর বেতনটা বাড়িয়ে দেবো। দশ থেকে এগারো হাজার করে দেবো। আমরা দু’জন কাজে বেরিয়ে গেলে বাড়ির সব দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দেবো ভাবছি। কি, এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না তো? তোমার কি মনে হয়? আমার তো মনে হয় এ মেয়ে তেমন মেয়ে নয়। এক হাঁড়ি ভাতের একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় হাঁড়ির ভেতর অন্যসব চালের অবস্থা কেমন।”
সনকার প্রতি রূপসার এই দরাজ সুপারিশে এবার মনে মনে প্রমাদ গোনে চন্দন। এবার তার কপালের পরত পেঁয়াজের খোসার মত একটা একটা করে খুলছে। খুলতে খুলতে একসময় তার সেই ইপ্সিত রসাল বিন্দুতে মনে হয় একদিন পৌঁছোতে সক্ষম হবে। যতটা সম্ভব ভেতরের সরস ঢেউকে সামাল দিয়ে চন্দন বলল, “হ্যাঁ রূপসা। তোমার থার্ড আইয়ের পর্যবেক্ষণকে তারিফ না করে পারা যায় না। এই জন্যেই তো তুমি আমার যোগ্য স্ত্রী। তোমার মতের সঙ্গে আমি পুরোপুরি এক মত।”
ছোট ভায়ের বিয়েতে রূপসাকে দিন পনেরোর জন্যে দিল্লী যেতে হচ্ছে। অফিস ছুটি মঞ্জুর করেছে। এই ছুটি পেয়ে যারপরনাই খুশি রূপসা। মঞ্জুর হবে কি না তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিল সে। ভায়ের বিয়েতে আনন্দ করতে পারবে না, সেই আতঙ্কে ক’দিন ভর মন ভার করে রেখেছিল। বাবুর দেখাশোনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব সনকার উপর দিয়ে গেল। চন্দনের দেখভালে যে কোন ত্রুটি হবে না, সে বিশ্বাস সনকার ওপর রাখে রূপসা। অবশ্য রূপসা দিল্লী যাবার আগে আগেই চন্দন অফিসে জয়েন করে ফেলেছে। কিন্তু এই সন্ধিক্ষণেই তো সদ্য সেরে ওঠা রোগীর প্রতি আরও বেশি করে নজর রাখা দরকার। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই আবার কোন শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রবল। সনকাকে বলে গেছে রূপসা, “দেখো, বাবু বাইরে বেরোবার সময় যেন স্টিলের চারপেয়ে লাঠিটা নিতে ভুলে না যায়। ডাক্তার এখন ওটাকে সবসময় সঙ্গে রাখতে বলেছে। যতই হাড় জুড়ে যাক, এখনই পুরোপুরি পায়ের উপর চাপ দেওয়া যাবে না।”
নীচের সিঁড়ি ঘরের পাশে ছোট্ট সার্ভেন্ট কোয়ার্টার সনকার জন্যে নির্দিষ্ট। কিন্তু চন্দনকে নিয়ত দেখাশোনার জন্যে দোতলা থেকে তাকে ডাকাডাকি করা বা সনকারও বারবার উপর-নীচ করা কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে। তাই রূপসাই ঠিক করে দেয় দোতলার পশ্চিম বারান্দার প্রান্তে ফাঁকা পড়ে থাকা বড় ঘরে সনকাকে থাকার জন্যে। সনকা তার ছেলেকে নিয়ে ওখানে থাকবে এবার থেকে। তাহলে বাবুকেও চোখে চোখে রাখতে পারবে। বুড়ো শাশুড়ির পক্ষে সেই লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময়টাই উনি ঠাকুরঘরে কাটান। এটা ওনার বহুদিনের অভ্যেস। অতএব সনকাই এখন ওদের ভরসা। প্রত্যেক দিনই অফিস বেরোবার সময় এই লাঠি নেওয়া-না নেওয়া নিয়ে সনকার সঙ্গে ঝুলপেটাপেটি হয় চন্দনের, “বাবু, আবার সেই লাঠি না নিয়ে অফিস যাচ্ছো? বৌদি পই পই করে আমাকে বলে গেছে, তুই দেখবি সনকা, বাবু যেন ওটা ফেলে না চলে যায়। তাছাড়া ও ইচ্ছে করেও না নিতে পারে। তোর ওপর ভার দিয়ে গেলাম। সেটা করতে দিবি না। ভীষণ তেড়েল লোক আছে তোর বাবু। সব কিছুতেই গাজোয়ারী করে। এই জন্যেই তো আমার সঙ্গে যখন তখন লাগে।” তারপরও কথা না শুনে এগোতে গেলে সনকা লাঠিটা নিয়ে ওর সামনে পথ আটকায়, “আগে এটা হাতে ধরো তারপর বার হবে। বৌদি আমার ভরসায় আপনাকে রেখে গেছে।”
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই চন্দন লক্ষ্য করছে প্রথম যখন সনকা তাদের বাড়ি আসে তখন যে শুকনো-শাকনা মত ছিল এই বাড়িতে আসার পর ভাল খাওয়াদাওয়া এবং খুশবন্দ মনে থাকার ফলে তার চেহারার ভোলই পাল্টে গেছে। বাড়িতে ছাওয়ায় থেকে থেকে যেমন শরীরের রঙ চকচকে হয়ে গেছে তেমনি গড়নও ভরভরন্ত এবং আকর্ষণীয়ভাবে টানটান হয়েছে। মনে মনে তার যৌবনের প্রতি লাগামহীন ঝোঁক পেয়ে বসছে। কিন্তু সম্ভ্রমের বাঁধন তাকে আটকে রেখেছিল। এখন সনকার এই ব্যবহার তার যাবতীয় বাঁধনকে যেন ছিঁড়েমিড়ে ছারখার হয়ে গেল! অধৈর্য চন্দন সনকার ফুটন্ত যৌবনকে সপাটে নিজের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়, “বৌদি যখন ভরসা করে আমাকে তোমার কাছে রেখে গেছে তখন বৌদির সমস্ত কাজটাই তো তোমাকে বকলম দিয়েছে। আঃ কি সুন্দর তুমি সনকা। ওঁ হুঁ! বাধা দিও না সনকা। আরও কিছুক্ষণ তোমার শরীরের এই মাতাল করা ওম আমাকে গ্রহণ করতে দাও। এরপর সনকার সমগ্র মুখমন্ডলে উপর্যুপরি চুমু এঁকে দিতে থাকে চন্দন। ক্ষান্ত হওয়ার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সনকা তখন যেন চন্দনকে বাধা দেবার যাবতীয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চন্দনের ভালবাসার অভিঘাতে সনকা আস্তে আস্তে যেন শিথীল হতে থাকে। অফিস যাওয়া বন্ধ করে চন্দন এখন তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কোন কিছুতেই সনকার আপত্তি নেই![চোদ্দ]
সুবোধ কাকার পরামর্শগুলো মনে ধরে রতন-নন্দদের। এর আগে পর্যন্ত ওরা দ্বিধায় ছিল কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। রতন বলল, “এই জন্যে কথায় আছে ‘তিন মাথা যার বুদ্ধি নেবে তার’। সুবোধ কাকার কথাগুলো আমাদের মাথায়ও আসেনি। নন্দ, আমার মনে হয় এই ধান্দাবাজদের পাকড়াও করতে গেলে এমন লোককে গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দিতে হবে যারা ইদানিং আর ভাগাড়ের ওদিক মাড়ায় না। তুই আমি বাদে পাড়ার আর কারা কারা ভাগাড়ের কাজ করে না সেটা তুই ভাল করে খোঁজ খবর নে নন্দ। শুধু ভাগাড়ে কাজ করে না, এই যুক্তিতে কাউকে কাজে লাগানো যাবে না। তাকে কমিটির বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজনও হতে হবে। না হলে সব পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। তাছাড়া আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। যারা এত ঘোরাঘুরি করবে তাদের তো একটু জলখাবারের খরচা দিতে হবে। কেবল মুখে জালতি বেঁধে গরু-পাক খাওয়ালে তো চলবে না। ওটা না দিলে কাজ করতে ওরা উৎসাহও দেখাতে চাইবে না। চক্ষুলজ্জায় কমিটির কথা শুনে হয়তো কাজ করতে যাবে। কিন্তু সে কাজ মন থেকে হবে না। কখনো হয়তো দেখা যাবে, তারা কাজে যাচ্ছি বলে পাড়া থেকে বার হ’ল কিন্তু গেল না। নিজের অন্য কোন কাজে চলে গেল। আমরা কিন্তু তখন তাকে জোর করতে পারবো না। এটা তোকে মাথায় রাখতে হবে নন্দ।” এরপর নন্দ কি একটা বলতে যাচ্ছিল, রতন তার কথার উপর কথা চাপিয়ে আবার বলল, “আমাদের দিনু ঋষি রে। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখেছি, ও ওই ভাগাড়ে গিয়ে গরুকাটা, চামড়ার ভাগ নিয়ে আকচা-আকচি একদম পছন্দ করে না। তাই জীবনে ওকে ভাগাড়মুখি হতে দেখিনি আমরা। সারা জীবন চাষবাস আর চাষের কাজ না থাকলে বাড়িতে ধামা-খোড়া, কুনকে, পালি সহ অন্য বেতের কাজ করে সংসার চালায়। আটচালা নতুন করে তৈরীর সময় প্রায় রোজই এক-দু ঘন্টা গায়ে-গতরে খেটে দিয়েছে। সে তো তুই জানিস, নন্দ। আর সেই ইট চুরির ঘটনার কথা তোর মনে আছে! আটচালার ভিত গাঁথার সময় প্রায়ই দু’চারটে করে ইট চুরি যাচ্ছে। প্রথম প্রথম তো বোঝাই যাচ্ছিল না। ওই দিনুই প্রথম ঠাওর করে ব্যাপারটা! তুই, আমি সবাই চিন্তিত। একে চেয়েচিন্তে ইট, বালি জোগাড় করে এটা তৈরী করা হচ্ছে। সেখানেও যদি কেউ এইসব চোরটামি করে কার না গায়ে রাগ ধরে। দিনের বেলা কারোর সাহস হবে না এ কাজ করার। এইসব চুরি চামারি হচ্ছে বলে রাতেও আমরা পাহারার ব্যবস্থা করলাম। তবুও চুরি আটকানো যাচ্ছে না। ঘটনাটা দিনুরও মনে আঘাত লেগেছে। ওর ওই আঘাত লাগাটা কিন্তু ও কাউকে ফেচকায়নি। ও চিন্তা করেছে, দিনমানে চুরি হবার নয়। রাতেও পাহারা। তাহলে চুরি হচ্ছেটা কখন? আর চুরি করছেটা কে? গবেষণা করে একটা দিন ভোরবেলা চৌকী দিতেই দিনু চোরবেটাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে! ধরা পড়তে জানা গেলো ওই ব্যাটা পাঁড় মাতাল সুফলে কান্ডটা করছিল। কিন্তু ওই সুফলে মাতাল ইট নিয়ে তো ঘর বাঁধবে না। ও নিশ্চয়ই চুল্লু সাঁটাবার জন্যে কাউকে সেই ইট বেচে। এবার ওই গছনদারকে ধরতে হবে। আটচালার উল্টোদিকে দেশমালা ঠাকুর থানের বারান্দায় নিয়ে এসে মাতালটাকে উত্তম-মধ্যম দিতেই মুখ ফসকে বমি করে দেয় গছনদারের নামটা। পোদপাড়ার রুইলের কাজ এটা। রুইলের ছিটেবেড়া ঘরের পেছনে সব চোরাই ইট পাওয়া যায়। তারপর তো নন্দ, তুই পঞ্চায়েতে নালিশ জানিয়ে সব ইট উদ্ধার করলি। রুইলেটা বেঁচে গেল, ও আমাদের আটচালার আওতায় পড়ে না বলে। চোরাই মাল গছনের জন্যে থানায় চালান করা যেত। পঞ্চায়েত বলল, লঘু পাপে গুরুদন্ড দিয়ে দরকার নেই। ওকে ফাইন করে আর দু-চার ঘা ধরিয়ে আমরা কবুল করিয়ে নিচ্ছি, যাতে দু’বার সে এই কাজটা না করে। তা নন্দ, যেটা তোকে বলার জন্যে এত পুরোনো ঘটনা জাবর কাটলাম সেটা হচ্ছে দিনুর মধ্যে কোন অপরাধের রহস্য খুঁজে বার করার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। ওর ওই ক্ষমতাকে এখানে আমরা যদি কাজে লাগাই তাহলে মনে হয় সফল হতে পারি। কারা কারা চুকলিবাজি করে কমিটির ভাগাড়ের গরু সাধারণের ভাগাড়ে চালান করছে ধরে ফেলতে পারবো। আটচালাকে ও মন থেকে পছন্দ করে। দেখা হলে দিনুকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস। আমার কথা ও শোনে। দিনুকে রাজি করানোর ভারটা আমি নিচ্ছি।”
রতনের কথায় আশ্বস্ত হয় নন্দ। কিন্তু দিনুর একার দিয়ে এতবড় এলাকা নজর রাখা অসুবিধা। আর একজন অন্তত কাউকে জোগাড় করতে হবে। আর কাকে পাওয়া যায়, কাকে পাওয়া যায় সেই চিন্তা করতে করতে রতনের হঠাৎ মনে পড়ল সুভাষের কথা। সুভাষ ওর শালীর ছেলে। উঠতি যুবক। এখনো সংসার-ধর্ম করেনি। বাজারে ওর জুতো সারাই, পালিশ, চামড়ার ব্যাগ বিক্রির দোকান। ভাগাড়ে গিয়ে ওইসব কাজকর্ম ওর একদম পছন্দ নয়। তাই সুযোগ এলেও কোনদিন ও ভাগাড়মুখো হয়নি। নন্দর নেওটা ও। মেসোর কথা সুভাষ ফেলে না। নিজের বাবা কি বলছে না বলছে তাতে তার কোন হেলদোল নেই। তবে নন্দ কোনকিছু বললে গুরুত্ব দিয়ে সেই কথা পালন করে। সুভাষকে ও এই কাজে লাগাবে ঠিক করে। দোকান বন্ধ করে বাড়িতে খেতে আসার সময় সারা দুপুরটা ও ফাঁকা থাকে। আবার সেই সন্ধ্যে ছ’টায় দোকান খোলে। এই তিনচার ঘন্টা দিব্বি ও কাজটা করতে পারবে। রতনকে বলে, “আর একজনকে পেয়ে গেছি রতন। আমার শালীর ছেলে, সুভাষ। ও একদম এই কাজে উপযুক্ত হবে। আমি বললে আমার কথা ও ফেলতে পারবে না। ওর ওপর আমরা নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারি।”
নন্দ আর একজন পাহারাদারকে পেয়ে গেছে। তাদের গোয়েন্দাগিরির লোকের আকাল আপাতত মিটল বটে। তবে রতনের আর একটা কথা মনে জিগির টেনে বসল। দিনু বা নন্দর শালীর ছেলে সুভাষ তো তাদের পাড়ার ছেলে। এদের তো অপরাধীরা আলবাৎ চেনে। তাহলে দিনু-সুভাষকে দেখলে ওরা তো সাবধান হয়ে যাবে। চোর ধরা পড়বে না। কিছুটা টান টান হয়ে রতন নন্দকে বলল, “হ্যাঁরে নন্দ, দিনু-সুভাষদের বিনা কারণে ঘোরাঘুরি করলে তো বদমায়েশগুলো বুঝে যাবে, অন্য কোন মতলবে ওরা ঘোরাঘুরি করছে। কথায় বলে না, ‘চোরের মন বোঁচকার তন’ মানে বোঁচকার দিকে। ওরা বুঝে নেবে কমিটি তাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। সাবধান হয়ে যাবে। এভাবে এগোলে তো আমরা কোনদিন অপরাধী পাকড়াও করতে পারবো না। আমার তো মনে হচ্ছে সুবোধকাকার বুদ্ধি, গলে জল হয়ে যাবে। কাজের কাজ হবে না। তুই অন্য কোন কৌশল বার কর নন্দ।”
রতনের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নন্দ। খানিক চিন্তায় পড়ে যায় সে। রতন যে কথাটা বলল, তা তো একদম ফেলে দেবার মত নয়। কিন্তু গোয়েন্দগিরি ছাড়া তাদের সামনে তো আর কোন রাস্তা খোলা নেই। ভুবন জুড়ে সব অপরাধের কিনারা তো হয় এই গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে। তাই এই কৌশল ঠিক আছে। তবে একটা ভাবনা তার মাথায় চলকে উঠছে যেন। তাদের দুই গোয়েন্দাকে সাদামাটাভাবে ছেড়ে দিলে হবে না। ভোল বদল করতে হবে দিনু সুভাষকে। নতুন বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে পকেট থেকে ম্যাচিসটা বার করে হাতে ধরা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে নন্দ বলল, “এই রতন, অত হুটহাট ঘাবড়ে গেলে চলবে না। শোন, এই বুদ্ধিটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। দিনু সুভাষকেও বেত, ইনবাইশ, কুরপি হাতে পাড়ায় ছেড়ে দিতে হবে। ওরাও চোরেদের মত পাড়ায় পাড়ায় ধামা, সের, কুনকে, জুতো ইত্যাদি সারার জন্যে ওই সরঞ্জামগুলো হাতে নিয়ে ঘুরবে। কাজ পেলে কাজ করবে। তবে ওদের মূল কাজ কিন্তু গোয়েন্দাগিরি। লোকের সামগ্রী সারাইয়ের কাজ নয়। তাহলে আমাদের কাজ হাসিল করা যাবে। আর আমাদের সুভাষ তো এসব কাজে ওস্তাদ। আশেপাশের গ্রামের মানুষ দেখে, বাজারে ও এই কাজই করে। অতএব সাধারণ মানুষ তো ধরতেই পারবে না যে সুভাষ মুচি ঢঙ করে হকারি করছে পাড়ায় পাড়ায়। আসল ধান্ধা অন্য।”
খুব গোপনে এবং সন্তর্পণে গোয়েন্দাগিরিটা চলতে লাগল। দিন পনেরো হয়ে গেল দিনু-সুভাষ গ্রামে গ্রামে ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে নজর রেখে চলেছে।
ওরা দেখতে পাচ্ছে, মধ্য পাড়ার সুফলে, আর দক্ষিণ পাড়ার গদাই আর ছেনোর চলাফেরা আচার আচরণ নিটোল ফেরিওয়ালার মত নয়। শুধুই যদি জুতো-ধামা-কুন্কে ইত্যাদি সারাইয়ের জন্যে এরা পাড়া ঘুরতো তো অন্যরকম তাদের চোখ-মুখের,শরীরের ভাষা হ’ত। যেমন তাদের পাড়ার অন্যরা করে। তাই ওরা ঠিক করল, এই তিনজনের উপর তাদের নজর-জালটা ফেলে যেতে হবে। ওদের পেছন-পেছন গোপনে পাহারা দিয়ে যেতে হবে। যে পাড়ায় এবং যে বাড়িতে ওরা অকারণে একটু বেশি ঠেক নেবে, সেখানেই ওরা ছুটে যাবে। সেটা অবশ্যই অত্যন্ত গোপনে। সুফলেরা টের পেলে গোটা পরিকল্পনাটা মাটি হয়ে যাবে। দিনুরা ঠিক করল, কোন পাড়ায় ওরা দু’জন একসাথে ঢুকবে না। সুফলেরা যেমন বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘোরে, ওরাও তেমন তাদের পেছু নেবে, পাড়া ফেরির ভান করে।
সুফলে, গদাই আর ছেনোর মধ্যে এই ছেনোটা খুব ধূর্ত। সুফলে, গদাইয়ের মাথায় এটা নেই বা ভাবতে পারে না ওদের এই অপকর্মের পেছনো কেউ চালাক দিতে পারে। কিন্তু ছেনোটা একদম পাক্কা ছেঁচ্চোড়। সরলসিধে মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করাটা ওর পেশা। লোক ঠকিয়ে কামাই করে ওর সংসার চলে। ধরা পড়ে কতবার যে গণধোলাই খেতে হয়েছে। বাজারে পাঁচ’শ আলু কিনে ব্যাগে ঢোকানোর অছিলায় দুটো আলু দোকানের আলুর ঢিবিতে ইচ্ছে করে ফেলে দিয়ে আর চার-পাঁচটা আলু তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। ব্যস্ত দোকানদারের সব সময় এই হাতসাফাইয়ের দিকে নজর থাকে না। কিন্তু পাঁচবার এমন করতে করতে একদিন তো নজরে এসে যাবে! তাই হল। সেই নিয়ে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, লোক জড়ো, মারপিট! দোকানদার বলল, “শালা, মুচির বাচ্চা! ক’দিন ভ’র আমি তক্কে তক্কে আছি। কিছুতেই হাতেনাতে ধরা যাচ্ছিল না। এবার শালা তুই যাবি কোথায়?” বলে উত্তম-মধ্যম কসিয়ে দিল ছেনো চোরকে। এবার বাজারে যেমন হয়। এক এক লোকের এক এক মত। কেউ আবার সেই মার দেখে ছেনোর পক্ষ নিয়ে নিল, “ছেনো যে তোর দোকানের আলু হাত সাফাই করেছে, তার প্রমাণ কি? কে সাক্ষী আছে?” এটা ঠিক আজকাল ছাপোষা খদ্দেররা ওইসব সাক্ষী-টাক্ষীর ঝুট ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে চায় না। এড়িয়ে যায় এসব। চোখে দেখেও সে লোক আলু দোকানদারের পক্ষে কথা না বলে গা সটকে যায়। দোকানদার সাক্ষী পায় না। তখন ছেনোর হয়ে কথা বলা অতি উৎসাহিরা দোকানদারের উপর চড়াও হয়। এই নিয়ে কত কেচাল হ’ল সেবার। একবার তো কাপড় দোকানে কাপড় বাছাবাছি করতে করতে কোন ফাঁকে একটা শাড়ী তার ব্যাগে সেঁধিয়ে নেয়। দূর থেকে ক্যাশে বসে থাকা দোকানের মালিকের চোখে পড়ে যায়। ছেনো চোরকে দোকান মালিক হাত বেঁধে বাজার কমিটির কাছে বামাল সমেত হাজির করে। ছেনোর এইসব কান্ডকারখানায় তাদের রুইদাসদের মাথা হেঁট হয়ে যায় বাজারের মানুষজনের কাছে। বাজার কমিটির বিচারের সময় রুইদাসরা কেউই অবশ্য ছেনোর পক্ষে যায় নি। পাঁচখুরো করে মাথায় আলকাতরা মাখিয়ে, নাকখত খাইয়ে, চরম সাবধান করে রেহাই দেয় তাকে। সেসব যদি মনে রাখতো তো ফিরেফিত্যে আর ও এই কাজ করতে আসতো না। শালার গায়ে গন্ডারের চামড়া। পাবলিকের পেটানি ওই যতক্ষণ কে ততক্ষণ। কিছুই মনে রাখে না। গায়ের ব্যথা মরে গেলে সব ধোলাইয়ের কথা ভুলে যায়। মনটাকে যে মানি’র জায়গায় উতরে দিতে হয়, তবেই মানুষের কাছে নিজের মর্যাদা টিকে থাকে সেসব ভাবনা ওই ছেনো শালার নেই।
বেশ কিছুদিন এইভাবে চলতে চলতে ছেনো ঠাওর করে, যেখানেই ও যায়, ওই শালা সুভাষ বেটাকে দেখা যায়! মনে কিন্তু কিন্তু ভাব চাগাড় দেয় তার! ওই শালা কমিটির মাতব্বর, রতনের শালীর বেটা সুভাষকে রোজ, এই ক’দিন ভ’র দেখতে পায় কেন? পাড়ার আর তো কাউকে দেখা যায় না? তাহলে কি সুভাষটা কমিটির টিকটিকি? ছেনো তো বলতে গেলে পেশাদার চোর-ছ্যাঁচোড়। অপকর্ম করার সাথে সাথে সাবধনী মনকেও সজাগ রাখে। বিভিন্ন সময় ধরা পড়ে, মার খেয়ে, অপমানিত হয়ে এই বোধে ও এখন সক্রিয়। তাই সুভাষের গতিবিধি ওর ভাল লাগল না। এবার সুভাষকে ও সন্দেহ করতে লাগল। নিশ্চয়ই ও শালা কমিটির টিকটিকি। শিবপুরে একটা বাড়িতে গাই গরুর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ব্লকের ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বয়স হয়েছে। বুড়ো দাঁতে আর ও জাবর কাটতে পারছে না। এইভাবে যতদিন বাঁচে, বাঁচুক। এখানে আর আনতে হবে না। ব্লক থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় ওই বাড়ির বুড়োটার সঙ্গে দেখা হতে ছেনো তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে। তখনই ছেনো বুড়োর হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা ধরো কাকা। গরুটা মরে গেলে তোমরা যেখানে সেখানের ভাগাড়ে ফেলবে না। আমি নিয়ে চলে যাবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তাছাড়া রোজই আমি তোমার গরুটা কেমন আছে দেখে যাবো।” এরপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার স্বর নামিয়ে বলে, “কাকা, আমাদের আর কেউ যদি আসে তাদের পাত্তা দেবে না। আর কেউ তোমাদের গরুর খোঁজ খবর নিতে আসলে আমাকে জানিও। একদম পাত্তা দেবে না কাকা, তাকে। পরে আর কিছু টাকা তোমাকে দেব’খন।” ছেনো আরও টাকা দেবার লোভ দেখালে ওই বুড়োটা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় তার কথায়। অভাবী মানুষটা এই গরু নেড়েচেড়ে দিন চালায়। তার আবার ব্যামো। গরুটা থেকে সে আর কোন আয় করতে পারবে না। এমন সময় ছেলেটার টাকার লোভ বুড়ো সামলাতে পারেনি। বোঝার চেষ্টাও করেনি যে এই টাকা কেন দিচ্ছে ছেলেটা। নিশ্চয়ই ছেলেটার কোন অভিসন্ধি আছে। অতশত ভেবে তার কাজ নেই। যাদের মাথা ফেটেছে তারা চুন খুঁজে নেবেখন।
ছেনোরা এই ধারণাটা করে ফেলেছে যে, তাদের পেছনে কমিটির লোক লেগে পড়েছে। নাহলে ওই শালা সুভাষ তো কষ্মিন কালে পাড়া করত না। বরাবরই বাজারে জুতো-টুতো সারাই করত। ওদিকে দিনুটা আবার সুফলে গদাইদের পেছনে পড়ে গেছে। যে দিনু সারা জীবন চাষবাস আর বাড়িতে ধামা-টামা বানিয়ে এলো, হঠাৎ সে পাড়ায় সারাইয়ের কাজে নেমে পড়ল! এটা বিশ্বাস করা যে মুশকিল হয়ে পড়ছে। ওই দুই শালাই আটচালা কমিটির টিকটিকি। আটচালা ওই দুটোকে তাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছেনোরাও ছেড়ে কথা বলার ছাবাল নয়। ওরা তিনজনে ষাট করে ওই দুই শালাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা দেবে, জীবনে আর এই টিকটিকিগিরি করার নাম করবে না। সাথে সাথে ওদের মাধ্যমে আটচালা কমিটিকেও আচ্ছারকম সমঝে দেওয়া যাবে।
কোদালিয়া সরকারি ভাগাড় এলাকার কয়েকটা গ্রাম ছেনো কাজ ফেরি করে। মনষার হাট আর ফতেপুর সুফলে-গদাইয়ের। ওরা তিনজনে আলোচনা করে এই ফেরি করার ব্যবস্থা করেছে। ছেনো ভাল করে লক্ষ্য করেছে, সুভাষ টিকটিকিও ওই ছেনোর কোদালিয়া এলাকার বাইরে যায় না। যদি সুভাষের আসল উদ্দেশ্য হকারি নয়, অন্যকিছু, বা খোলসা করে বললে ছেনোর পেছনে চালাক দেওয়া তাহলে তো ওর আরও অন্য এলাকায় ঘোরার কথা। কিন্ত ও শালা তা করে না। অন্য দিনের মত এদিনও ছেনো তার এলাকায় কাজ করে টুক করে গা আড়াল দেয়। দেখে যে জায়গায় ছেনো গেছে গোপনে তা লক্ষ্য করে ঠিক সেই সেই গ্রামে টিকটিকি সুভাষ যাচ্ছে। একটা বাড়িতে সুভাষ গিয়ে ছেনোর মত কিছুটা ঘোরাঘুরি করার সময় ওই পাড়ার কয়েকজন ছোকরা তাকে ঘিরে ফেলে ‘ছাগল চোর ছাগল চোর’ বলে চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। সুভাষকে আর এগোতে দেয় না। তখন ও ভয় পেয়ে যায়! ওর মনে হয়, গতিক ভাল না। ছেলেরা চেঁচিয়ে লোক জোগাড় করে তাকে ছাগলচোর বদনাম দিয়ে গণধোলাই দেবার ফন্দি করছে। হ্যাঁ, ঠিক কথা যে ওই বাড়িতে তিনচারটে ছাগল ঘোরাঘুরি করছিল। ও সেদিক তাকিয়ে ছিল। যেমনটা ছেনো করেছিল। পরখ করার চেষ্টা করছিল, ছেনো ওইভাবে কেন ছাগলগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। তার দিক থেকে ছাগল চুরির তো কোন প্রশ্নই ছিল না। সে কথা সে ছেলেগুলোকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টাও করছে। কিন্তু তারা তার কোন কথাই শুনতে চাইছে না। তাকে চোর সাব্যস্ত করে পেটানোই যে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য! ভয়ে সে তাদের বেড়া ফুঁড়ে ছুট মারার চেষ্টা করতেই ধরে গণধোলাই দিতে শুরু করে! মার খেতে খেতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সুভাষ! মরে গেছে ভেবে থানা পুলিশের ভয়ে এবার যারা ওখানে জড়ো হয়েছিল সব্বাই কেটে পড়ে! খবর যায় থানায় এবং সঙ্গে সঙ্গে আটচালা কমিটিতেও। সাধু সেজে ছেনোই প্রথম হান্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে কমিটিকে খবরটা দেয়। কমিটি প্রথমেই থানায় খবর পাঠায় আর ছেনোকে আটচালার সামনে পাকুড় গাছের সাথে পিচমোড়া করে বেঁধে সুভাষকে উদ্ধার করতে ছুটে যায়। রতন-নন্দরা কোদালিয়ায় গিয়ে দেখে ওখানকার কিছু সহানুভূতিশীল মানুষ সেবাশুশ্রুষা করে সুভাষের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছে। গরম দুধ খাইয়েছে। শরীরের যেসব জায়গায় মারের চোটে ছড়েছাড়ে গেছে সেখানে ডেটোল জলে ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। এমনটা দেখে রতনরা অবাক হয়ে ভাবল, প্রদীপের নীচ যতটা অন্ধকারে ঢাকে, তার থেকে প্রদীপের শিখা অনেক, অনেকগুণ বেশি আলো বিস্তার করে থাকে। পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যা কালোর থেকে বেশি বলেই এখনও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়নি। স্বমহিমায় সে তার অস্তিত্বকে জানান দিয়ে মনুষ্য বাসের উপযুক্ত করে রেখেছে।
রতনরা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারল ছেনো কোদালিয়ার কিছু মাতাল জাঁতালকে মদ খাইয়ে আর পয়সার লোভ দেখিয়ে ষড়যন্ত্র করে সুভাষকে মার খাইয়েছে। অসুস্থ সুভাষকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেনো চোরের উপর। সেই বাঁধন অবস্থায় জরুরী আটচালা বসিয়ে ছেনোকে জল-বিছুটির ছিটকি দিয়ে মারের বিধান আদায় করে নিয়ে চড়াও হয়ে তার উপর। যতক্ষণ না ছেনো তার দোষ কবুল করল ততক্ষণ চলল এই বিছুটি পেটা। একটা সময় নেতিয়ে পড়ে ছেনো। তবু মার থামে না। শেষে পুলিশ এসে ছেনোকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। ছেনোর পরিণতি দেখে সুফলে-গদাই সেই যে গ্রামছাড়া হল, বছর ঘুরে গেল, তারা এখনো গ্রামে পা রাখার সাহস দেখাল না। অথচ পাড়ায় খবর আছে, ওদের একজন পদ্মপুকুরে অন্যজন ঝিনকি গ্রামে আত্মীয়র বাড়ি রয়েছে। লোক মারফত কমিটি চেষ্টা করেছে তাদের গ্রামে ফিরিয়ে আনতে। দোষ কবুল করলে তাদের শাস্তি মুকুব করা হবে আটচালার এই বিধানটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সেই কথা কমিটিকে বলেছিল বলেই তাদের কথার মান রাখতে এই বিধান দেওয়া হয়। কিন্তু ছেনোর পরিণতির কথা ভেবে তারা এখনো কমিটির উপর ভরসা রাখতে পারছে না। তাদের জানা নেই কেমন করে কবে তারা বাড়ি ফিরবে?ক্রমশ…
-
গল্প- আদর্শ
আদর্শ
– সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)আজ ছোট্ট রাইমাকে নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবে তার বাবা মা। এই কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি হয়েছিল ওকে নিয়ে। ডাক্তার আদর্শ সেনের তত্বাবধানে একটা অপারেশান হয়েছে। বেশ বড় অপারেশান। ওইটুকু মেয়ের পক্ষে বেশ ভয়েরই ছিল। অপারেশন সফল। জয়ীর হাসি ডাক্তার আদর্শের মুখে। একজন চিকিৎসক যখন মানুষকে নতুন জীবন দেন, তাঁর মনে যে অপূর্ব অনুভূতি হয়, সেই অপূর্ব অনুভূতিতে আদর্শ র মন ভরে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে বাচ্চাটির ওষুধ, অন্যান্য দরকারী জিনিস অনেকটাই আদর্শ সেনকে কিনে দিতে হয়েছে। কারণ রাইমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই সাধারণ। অবশ্য ‘মানবিক’ নামক এই নার্সিংহোমের এইটাই রীতি । যতটা কম খরচে রোগীর চিকিৎসা করা যায়,ততটা কম খরচেই চিকিৎসা করা হয়।
আদর্শ সেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। সবাই তাঁকে ধন্বন্তরি বলে। তাঁর চেম্বারে সব সময় রোগীদের ভীড়। তাঁর সাম্মানিক বা পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম। করোনার সময় ও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি একজন সমাজসেবক। অভাবী মেধাবীদের জন্য তিনি একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। মেধাবীই বা বলি কেন সব রকম মেধার মানুষকেই তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। যার যা প্রতিভা আছে তিনি সেই প্রতিভা বিকশিত হতে সাহায্য করেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে এলে তিনি তাদের কথা শোনেন ঠিকই, কিন্তু তাদের থেকে কোনো রকম উপহার গ্রহণ করেন না। রোগীর প্রয়োজন অনুয়ায়ী একদম কম দামের ওষুধ তিনি ব্যবস্থা পত্রে লেখেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো রকম ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি দ্বারা প্রভাবিত হন না। তাঁদের কথা তিনি শোনেন শুধুমাত্র জ্ঞান বৃদ্ধি বা বাজারে রোগীর জন্য উপকারী কি ওষুধ আছে, কি কি নতুন ওষুধ এল শুধুমাত্র সেইটুকু জানার জন্য। একবার তিনি অতি সামান্য ভিসিট বাড়ানোর কথা ভেবেছিলেন, তাঁর মা তাঁকে বলেন,জীবিকার প্রয়োজনে, জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্য তোর যা দরকার সেইটুকুই ব্যাস,তার বেশী বাড়াবি না, তুই মানুষের ডাক্তার মানবিকতার প্রতিভূ। না,ভিসিট বাড়ানো হয়নি তার। – ডাক্তারবাবু আমাদের কাগজের জন্য একটা সক্ষাৎকার চাই যদি একটু সময় দেন।
– আমার রোগী দেখার পরে আসুন।-শুভ দুপুর ডাক্তারবাবু
-শুভ দুপুর
– অভিনন্দন ডাক্তার বাবু, আদর্শ চিকিৎসক হিসাবে সরকার আপনাকে পুরস্কৃত করতে চলেছে। – ধন্যবাদ
– এটা কি ঠিক, আপনি খুব অল্প দামী ওষুধ দেন আর তাতেই আপনার রোগীরা সুস্থ হয়ে যায়।
– চেষ্টা করি
– আপনার মনে হয় না এতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর লোকসান হতে পারে?
– একজন চিকিৎসক হিসাবে আমার তো মানুষের কথা ভাবার কথা, রোগীদের ভালো করার কথা ভাবার কথা, তাদের সামর্থের কথা ভাবার কথা, কোনো কোম্পানির সুবিদার্থের কাজ করার কথা তো নয়।
– তাহলে বাজারে একই কম্পোজিশনে একই রকম কর্যকরী কম দামী ও বেশীদামী দুইরকমই ওষুধ থাকে, এই কথা কি ঠিক?
– আমি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। রোগীকে সুস্থ করার জন্য আমার যা করণীয় আমি তাই করি এবং তাই করবো।
– আচ্ছা ডাক্তারবাবু আপনার মেয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ছে, আপনার মনে হয় না বিজ্ঞান শাখায় পড়লে জীবনে উন্নতি করতে পারতো, হয়তো বা ডাক্তার হতে পারতো।
– না আমি তা মনে করিনা, আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের সেই কাজই করা উচিৎ,যা সে ভালোবেসে করতে পারবে, ছোট থেকে ইতিহাসের প্রতি ওর অগাধ ভালোবাসা। আমি মনে করি, ইতিহাস নিয়ে কাজ করেই ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে।
– তাহলে আপনার একমাত্র সন্তান ডাক্তার হল না বলে আপনার কোনো আপসোস নেই, যেখানে আপনি ও আপনার স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার।
– একেবারেই না, আর ও যদি ডাক্তারিতে আগ্রহীও হত, তাহলেও ওর যোগ্যতা থাকলে তবেই আমি পড়াতাম । ডোনেশান দিয়ে কখনই পড়াতাম না। আমি যোগ্যতায় বিশ্বাসী। ওর যোগ্যতা অনুযায়ী ও কাজ ঠিক খুঁজে নেবে।
– আপনাকে সরকার একজন আদর্শ ডাক্তার হিসাবে পুরস্কৃত করতে চলেছে, আপনি খুশি? -পুরস্কারের জন্য তো কিছু করি না, মানুষ হিসাবে যা করণীয় তাই করি, তবে হ্যাঁ পুরস্কার মূল্যের ওই টাকাটা আমি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবো।-পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে আপনার মতামত?
– প্রয়োজন হলে করাব, কিন্তু অকারণে নয়। সবাই বলে আপনার ক্লিনিকাল আই ভীষণ ভালো, অপ্রয়োজনে পরীক্ষা করান না। মৃদু হাসি, কোনো মন্তব্য নেই।
-আপনি কি কোনো চিকিৎসক দ্বারা অনুপ্রাণিত?
– বলতে পারেন বোলপুরের একজন ডাক্তার, যাকে মানুষ ‘একটাকার ডাক্তার’ বলতেন তাঁর দ্বারা। তাছাড়া শ্যামনগরের একজন ডাক্তার, যিনি করোনায় চলে গেলেন, আপনারা নিশ্চয় সংবাদে মানুষের তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখেছেন। ওই করোনাকালেও তার শেষযাত্রায় মানুষের চোখের জল নিয়ে নীরবে তার সাথে সাথে চলেছিল। বাড়িগুলো থেকে ফুল বর্ষণ হচ্ছিল । এছাড়াও আরো অনেক ডাক্তার আজও আছেন, যারা মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করেন, ডাক্তারীর স্বীকৃতি র সময় নেওয়া পণের মান রাখতে পারেন, বয়স নির্বিশেষে তারাই আমার আদর্শ।
– আপনি কি মনে করেন এখনও এইরকম ভালো ডাক্তার অনেক আছেন?
– নিশ্চয়, এই তো আজকের খবরের কাগজেই দেখলাম ,ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাওয়া একজন ডাক্তার সঠিক সময়ে অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছাবার জন্য গাড়ি থেকে নেমে ছুটে নার্সিং হোমে পৌঁছেছেন। কদিন আগে দেখলাম একজন ডাক্তার নিজে রক্ত দিয়ে একজন প্রসূতিকে বাঁচিয়েছেন। আমার প্রিয় লেখক বনফুল, যিনি নিজেও ডাক্তর ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ‘অগ্নিশ্বর’-রা বাস্তবেও আছেন।
– যারা ডাক্তার হতে চলেছে তাদের প্রতি আপনার বার্তা!
– মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াক, সাম্মানিক বা পারিশ্রমিকটা মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখুক,অনেক মানুষ শুধু অর্থের কারণে আজও ওঝা, ঝাড়ফুঁক, হাতুরড়দের কাছে যেতে বাধ্য হয়, তাদের কথা ভাবুক। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করুক। সৎ ভাবে কাজ করুক।
“
– সম্প্রতি আপনার মেয়েকে বোধ হয় লোভনীয় কিছু উপহার দিতে চেয়েছিল কোনো কোম্পানি, আপনার মেয়ে প্রত্যাখান করেছে একথা কি সত্যি?
– হ্যাঁ আমি গর্বিত, ওকে আমি ছোট থেকেই শিখিয়েছিলাম স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেউ কিছু দিতে গেলে সেটা গ্রহণ না করতে, ও আমার মান রেখেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তা সে যেভাবেই হোক। রক্ত বা জিন সত্যিই বোধ হয় কথা বলে। উচ্চ মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় আছে আদর্শ সেন। ডাক্তারির জয়েন্টে এন্ট্রাস পরীক্ষাতেও প্রথম পাঁচজনের মধ্যে। কিন্তু চরম দারিদ্র্য তাদের পরিবারের। কিভাবে পড়াবে মুকুল সেন ছেলেকে ডাক্তারি! পুরো পরিবার চিন্তায়। এতদিন তো স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা খুব সাহায্য করেছেন তাকে। বাড়িতে এসে পর্যন্ত পড়া দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। না কোনো গৃহশিক্ষক বা গৃহশিক্ষিকা তার ছিল না। কোনো নামী কোচিং সেন্টারেও তার পক্ষে পড়া সম্ভব হয়নি। সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতায় সে আজ সফল। বাতাস কোচিং সেন্টার থেকে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাকে শুধু বলতে হবে, যে সে বাতাস কোচিং এ পড়ে সফল, অনেক অনেক টাকা ডাক্তারী র বই সব দেবে তারা। মানিনি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে,তাকে শুধু বলতে হবে তাদের বই পড়েই তার এই সাফল্য। বাড়ি সারিয়ে দেবে। ডাক্তারী পড়ায় আর্থিক ভাবে সাহায্য করবে। আত্মীয়দের অনেকে, পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকেই এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে বলছে। তা নাহলে পড়বে কি করে। ছাদ ফেটে গেছে। জল পড়ছে মাথায়। দেওয়ালের জীর্ণ দশা। সামনে বিরাট অনিশ্চয়তা। কি করবে আদর্শ? বাবা মা তোমরা কি বলো?
– তোর নাম আদর্শ রেখেছিলাম,অনেক আশা নিয়ে, জানি আমি তোকে হয়তো পড়াতে পারবো না, তবুও বলি অনেক আশায় তোর নাম আদর্শ রেখেছিলাম, বাবা বললেন। বাবার ইঙ্গিতবাহী কথা বুঝতে আদর্শর কোনো অসুবিধা হয় নি সেদিন। আর সত্যি তো সে নিজেও সততা ও সত্যের আদর্শে বিশ্বাসী । পরের দিন বাড়িতে আসা সাংবাদিকদের সে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিল,বাবা,মা আর স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাকে সাহায্য করেছে, আর যে বইগুলো সে সত্যি করে পড়েছে, সেই বই গুলোর নাম বললো। আরো বললো পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়া তাকে স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকারাই শিখিয়েছে। আর স্পষ্ট জানিয়ে দিল কোনো কোচিং সেন্টারের সাহায্য সে নেয়নি। হ্যাঁ, সেদিন তার শুরুটা খুব কঠিন হয়েছিল, অনেক প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়াই করে আজ তিনি সফল ডাক্তার। সেদিন যে আদর্শকে তিনি জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, আজও সেই আদর্শ তাঁর সাথে আছে। থাকবে চিরকাল। হ্যাঁ বাবার মায়ের দেওয়া আদর্শ নাম সার্থক ।
( সঞ্চিতার ছোট্ট বক্তব্য- এই গল্পে ব্যবহৃত চরিত্রের নাম বা সংস্থার নাম সম্পূর্ণ কাল্পনিক । বাস্তবের সংস্থা বা চরিত্রর নামের সাথে মিল থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত। তবে এই রকম আদর্শরা, এই রকম ভালো চিকিৎসকরা আছেন, ছিলেন ,থাকবেন আমাদের সমাজে। আর হ্যাঁ আদর্শের আদর্শ হিসাবে যে চিকিৎসকদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতই আছেন বা ছিলেন। আর সে জন্যই সমাজটা পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর।) -
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৫)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[ নয় ]
নিজের কত্তা যে খেঁজুর রসের ভাঁড় ফেলে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি পরেশ-গিন্নীর। নিশান যে সারা পাড়া এখন দেখছে। পরেশগিন্নীর উৎকন্ঠা, এত বেলা হয়ে গেল, এখনও লোচনের বাবা ফিরছে না বলে। যতক্ষণে ভাগাড়ে গিয়েছে তাতে শিকারের চামড়া ছাড়িয়ে অনেক আগেই ফিরে আসার কথা। সেইজন্যে সে একবার দাবা থেকে রাস্তায় ওঠে, আবার ঘরপানে চলে যায়। আটচালার দিকে এসে লোককে তার চিন্তার কথা বলতে পারছে না। পাড়ার বউ-বাচ্চা-মরদরা সব সামনের ফাঁকা ডাঙায় শীতের সকালের মিষ্টি রোদে চান সেরে নিচ্ছে যেন। কারোর নড়াচড়ার কোন তাড়া নেই। সেখানে গিয়ে কাউকে তার খোঁজ নেবার কথা বললেই পেছনে লেগে যাবে মরদরা, “এখন রসের নাগর আসতে দেরি করছে বলে তোমার চিন্তা হচ্ছে। ঢেড়ি পিটিয়ে মানুষকে জানাচ্ছো। কিন্তু যখন নিশান দেখে কত্তা রসের ভাঁড় ফেলে দৌড় মারলো তখন তো বলোনি, দেখো গো দেখো আমার মরদটা কোথায় হারিয়ে গেল! তা তো বলবে না। যদি অন্য কেউ বলে ফেলে আমি আগে নিশান দেখেছি। ছুট মেরে তার আগে শিকার দখল করে নেয়!” তাই নিজের চিন্তা নিজের মধ্যে রেখে ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে পরেশ গিন্নী সনকা!
খানিক পরেই আটচালার দিক থেকে লোকজনের জোরে জোরে কথা বলার শব্দ কানে আসে লোচনের মায়ের! তখন সে বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছিল। ছেলে খাওয়ানো ফেলে দৌড়ে রাস্তায় উঠে আসে। দেখে, লোচনের বাপের গায়ের গেঞ্জী আর এল্টেতোলা কাপড়-গামছা সব রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। মরা গরুর ছাল ছাড়াতে তো এত রক্ত গায়ে লাগার কথা নয়! মরা জীবের শরীরে অস্ত্র ফোটালে রক্ত ফিনকি খায় না। তাই এমনভাবে রক্ত মাখামাখি হবার কথা না। কি এমন ঘটল যে সে এমন অবস্থায় বাড়ি ফিরছে? কাঁধে আবার গরুর ছাল ঝুলছে। পাড়ার মেয়ে-মদ্দ তাকে ঘিয়ে কিসব জিজ্ঞেস করছে আর উত্তর দিতে দিতে সে বাড়ির পানে এগিয়ে আসছে! শেষমেষ কি কথা যে সে বলল, তা সে এতদূর থেকে বুঝতে পারছে না। জনা তিনেক লোক তাকে ঘিরে রেখে বাকি সব্বাই দল বেঁধে হইহই করে ছুটলো দৌলতপুরের ভাগাড় পানে! পেছন থেকে লোচনের বাপের গেঞ্জি একজন মুঠো মেরে ধরল আর দু’জন তার দুটো হাত খাপটি মেরে ধরে এদিকে আসতে লাগল। কাঁধে ঝোলানো গরুর চামড়াটা আর দেখা যাচ্ছে না। ওটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে। দলবলের কেউ ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়ই। আর চুপ করে থাকতে না পেরে ওদিকে পা-পা করে এগিয়ে যায় লোচনের মা। কাছাকাছি গিয়ে বলে, “ওকে ওইভাবে তোমরা পাকড়াও করে আনছো কেন? ও কি চোর, না ডাকাত? দূর থেকে ওর কাঁধে গরুর চামড়া দেখতে পেলুম, সেটা আবার কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? তোমরা ওটা ছিনতাই করার জন্যে দলবেঁধে আটচালার সামনে রোদ পোহাচ্ছিলে বুঝি? দাও, ছেড়ে দাও ওকে? একটা ভালমানুষকে এইভাবে পাছড়া-পাছড়ি করে ধরে আনতে তোমাদের বিবেকে বাঁধলো না বুঝি? এ কেমন ধারা বিচারবুদ্ধি তোমাদের!”
এবার মুখ খুলল রতনের ভাই যতন, “তোমার কত্তা চুরি ডাকাতি করলে তবু মাফ ছিল গো গিন্নী। তার চেয়ে আরও ভয়ানক কাজ করে ফিরছে তোমার মরদ। কষ্মিন কালে কখনো গরুর ছাল ছাড়াতে গিয়ে কারোর সারা গা এমন রক্তে মাখামাখি হতে দেখেছো? সেটা তো জিজ্ঞেস করছো না, এত রক্ত কেন? সোয়ামির অক্ষত দেহ, তার পরেও সারা শরীর এতো রক্তে ভেজা কেন? মানুষ খুন করেছে তোমার কত্তা। গরুর চামড়ার জন্যে একটা জলজ্যান্ত মানুষের পেটের চামড়া ফালা করে ভুঁড়ি ভসকে দিয়ে বীরদর্পে বাড়ি ফিরছেন বাবু। এর চেহারা দেখে আমরা তো চমকে উঠি! একি! পরেশের সারা শরীর রক্তমাখা কেন? নিশ্চয়ই কোন অঘটন কিছু একটা ঘটেছে। আমাদের কয়েকজনের প্রথমে খটকা লাগে। যারা অতটা তলিয়ে ভাবেনি তাদের কেউ বলে, ও কিছু না। টাটকা গরু পড়লে রক্ত ছিটকে গায়ে লাগতেই পারে। আরে বাবা, ও তো ভোরবেলা খেঁজুর রস কাটতে গিয়ে নিশান দেখে ছুটেছে। অত ভোরে মরা গরুকে মানুষ কোনদিন ভাগাড়ে ফেলতে আসে না। তাহলে নিশ্চয়ই গরুটাকে আগের দিন বেলাবেলি বা সন্ধ্যেরাতে ফেলা হয়েছে। ততক্ষণে তার আর টাটকা ভাব কোথায় পাওয়া যাবে? যুক্তিটা তারপর সকলে মেনে নিয়ে একে চাপাচাপি করতে রাধাকান্তকে খুন করার কথা বেটা কবুল করে! সত্যি মিথ্যা যে কারণেই হোক। কে আগে নিশান দেখেছে, কে পরে দেখেছে তাই নিয়ে অমত হতেই পারে। তাই বলে সেই বিতর্কের এতটা ঝাল যে জলজ্যান্ত মানুষটাকে খুন করে দিতে হবে? তোর যদি সন্দেহ হয় তার জন্যে তো পাড়ার আটচালা আছে। সেখানে কথাটা বিচারে ফেলতে পারতিস। দেখতিস তার কোন বিহিত হয় কি না। অত তিরিক্ষি মেজাজ কিসের? তোর মেজাজ তুই তোর বোয়ের কাছে দেখা না। কেউ তোকে বলতে আসবে না।”
রাধাকান্তর শরীরের রক্তে ধোয়া পরেশ, বোয়ের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। মাথা নীচু করে শুধু একটা কথা বলল, “কোথা থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। মাথায় খুন চেপে গেল। খুন চাপিয়ে দিল ওই ব্যাটা নিজেই। গালি দিচ্ছিল আর আমার রাগ চড়ছিল। হঠাৎ ওর ছুরির আঁচড়ে আমার হাতের চামড়া চিরে রক্ত পড়তেই আর মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি। পাল্টা আঘাতে শেষ করে দিলাম ওটাকে। ওকে শেষ করেছি, এবার আমার ইহলীলা শেষ। খুনের বিধান তো ফাঁসিতে লটকানো।”
পাড়ার যারা দৌলতপুরের ভাগাড়ের দিকে ছুটছিল, তারা হঠাৎ যাবার পথে রাস্তার উপর অমিত মুদিকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল! অমিত মুদি আবার এখানে পড়ে কেন? দেখে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। রতন তার নাকের কাছে নিজের কানের লতি ঠেকাতে টের পেল, গরম বাতাস। নিঃশ্বাস পড়ছে। হার্টফেল করে মরে যায়নি। সঙ্গে সঙ্গে সে জনা তিনেককে এখানে রেখে রতন মুদিকে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে বলে বাকি সবাইকে নিয়ে ভাগাড়ের দিকে ছুট মারল। বুকে হাপর টানতে টানতে ওরা ভাগাড়ে পৌঁছে দেখল, মরা গরুর পাশে নিথর রাধাকান্তর নিশ্চিন্ত সহাবস্থান! হাতের মুঠোয় তখনও নিত্যসঙ্গী ছুরিটা ধরা। যেন মরণের পরেও জীবনচলনের হাতিয়ারকে সে যথাযথ সম্মান দিয়ে গেল।
পরেশ যেমনটি বলেছিল সব ঠিকঠাক মিলে গেছে। ধারাকান্ত এইভাবে পশুর মত মরে পড়ে থাকার দৃশ্য সহ্য করতে পারছিল না ওরা কেউই। কারোর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তো কেউ বা মনে মনে গুম হয়ে ভেতরের কষ্টটাকে সামাল দেবার চেষ্টা করছে। হাজার হোক নিজের পড়শি তো। দুবেলা চোখাচোখি, কথাবার্তা। সুখ-দুঃখের আলোচনা। আবার কখনো কথাকাটাকাটি। মদের নেশায় গালাগালি। তবু তার মধ্যে জীবনকে খুঁজে পাওয়া। আবার ভাব ভালবাসায় জড়িয়ে যাওয়া। এই নিয়েই তো তাদের জীবনের রোজনামচা। সেই জীবন প্রবাহের মধ্যে এই অন্যায় খুন-খারাপি বড্ড বেমানান। এটা এদের কেউই মেনে নিতে পারছে না। এমন অসহ্য ঘটনা যাতে দ্বিতীয়বার না ঘটে তার জন্যে তারা আটচালায় শপথ নেবে। শপথ নেবে, জীবনের সুখ- দুঃখের যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মিলেমিশে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেবার।
তাৎক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে রতন বলল, “এই অবস্থায় লাশ তো আমরা ছুঁতে পারি না। পুলিশ ছাড়া এ লাশ এখন ছোঁয়ার অধিকার কারোর নেই। থানায় খবর দিতে হবে।” বলে রতন তিন-চার জনকে ওখানে রেখে চলে এল।
দাবানলের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মানুষ খুন দেখার জন্যে লোকের ভীড় হতে লাগল দেখার মত। রতনরা বুঝল, যতক্ষণ না পুলিশ এসে লাশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ এই ভীড় আটকানো যাবে না। পাড়ার দু’জনকে পাঠিয়েছে, তাড়াতাড়ি থানায় খবর দিয়ে পুলিশ নিয়ে আসার জন্যে। ততক্ষণে ওদিকে অমিত-মুদির জ্ঞান ফিরে এসেছে। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা অনুভব করে। রতনরা তাকে পাঁজা করে তুলে দেখে মাথার পেছন থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রাধাকান্তকে খুন করে ফেরার পথে অমিত মুদির কাছে বাধা পেয়ে পরেশ এর মাথায় আঘাত করেনি তো? না কি ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল অমিত। নাহ। দুটোর কোনটাই নয়। জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, দুর্বল রাশের মানুষ অমিত মুদি। রক্তে ভেজা পোশাকে সদ্য খুনি পরেশের মুখোমুখি হতেই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর কোথায় কি হ’ল তা সে আর বলতে পারবে না। রতন তাদের পাড়ার ছেলেদের ধরাধরি করে অমিতকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে রাধাকান্ত খুনি পরেশের সঙ্গে কথা বলার জন্যে পাড়ার দিকে রওনা দিল। কোন পরিস্থিতিতে পড়ে সে এই কান্ডটা ঘটালো তা জানা দরকার।
মন এবং শরীরের দিক থেকে এতটা কাহিল হয়ে পড়েছে অমিত মুদি যে, সে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। ছেলেরা ধরাধরি করে তুলে দাঁড় করাতে গেলেই সে পড়ে যাচ্ছে। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না। সেইসঙ্গে মাথা ফাটার তীব্র যন্ত্রণা। বাধ্য হয়ে সবাই মিলে আলগোছে তুলে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেল। দিঘিরপাড় বাজারের উপর দিয়েই যেতে হবে অমিত মুদির বাড়ি। বাজারে উঠতেই উজাড় হয়ে লোক অমিতকে দেখতে জড়ো হয়ে গেল। সেলুন মালিক মোহন বলল, “দাদাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কি তোমরা পুতুল নাচ দেখবে? বাড়িতে কি ডাক্তার বসানো আছে? আগে ডাক্তারখানায় নিয়ে চলো। কুঞ্জ ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আর ওনার বাড়ির লোককে কেউ একজন এক্ষুণি খবর দাও। এই বিমলে, তুই বাড়ি যাবি তো? বাজার হয়ে গেছে? অমিতদার বাড়ির পাশ দিয়ে তো তোকে বাড়ি যেতে হবে। তবে আর এখানে ভীড় জমাসনি। বাড়ি যা এক্ষুণি। যাবার পথে অমিতদার বাড়িতে খবর দে। আমরা এনাকে কুঞ্জ ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার দেখে রোগীর ভাল-মন্দ বুঝে বাড়ি পাঠাবে না হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, ডাক্তার নিজেই সেটা ঠিক করবে। আমরা রোগীর ভাল-মন্দ কি বুঝবো। যেভাবে অমিতদা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, মনে হয় আঘাতটা হাল্কা কিছু নয়।”
কুঞ্জ ডাক্তার নিজের হাতে রোগী রাখতে চাইল না। মাথার আঘাতের থেকে মানসিক আঘাতটা প্রচন্ড বলে মনে হ’ল। তাই একে হাসপাতালে পাঠানোই শ্রেয় মনে করল। সেইভাবে প্রেস্ক্রিপসান লিখে বাড়ির লোককে দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল। হাসপাতালে পাঠানোর খবর ছড়িয়ে পড়তে বাজারের লোকজন, বিশেষ করে যারা অমিতদাকে পছন্দ করে, তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। দু-একজনের উসকানিতে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল বাজারের ইয়ং দোকানদাররা। সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ল পরেশের উপর। ও বাড়ি আছে খবরটা জেনে ওই ছেলেরা দল বেঁধে চড়াও হতে ছুট দিল রুইদাসপাড়ার দিকে। পরেশকে উত্তম-মধ্যম ধোলাই দিয়ে তবে তারা ক্ষান্ত হবে। বাতাসের বেগে পরেশের বাড়িতে হামলা হবার খবরটা রুইদাস পাড়ায় পৌঁছে যায়। পাড়ার ছেলেরা প্রবীনদের মধ্যে রতন, নন্দকে জানায় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে তারা এখন কি করবে। কোন রাখঢাক না করে নন্দ আদেশ দিয়ে দিল, “বাজারকে রুখে দিতে হবে। প্রয়োজনে লড়াই হলে হবে। এটা আমাদের পাড়ার ইজ্জতের প্রশ্ন। বাইরের লোক এসে আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই পাড়ার মানুষকে মারধর করে যাবে তা হতে পারে না। হতেই পারে পরেশ একটা অন্যায় কাজ করেছে। সেজন্যে আমাদের কেউই তার এই কাজকে সমর্থন তো করি না। পরন্তু আইন মেতাবেক তার শাস্তির ব্যবস্থা করছে। তাই বলে আইন হাতে তুলে নেবার কোন অধিকার কারোর নেই। সেই জায়গায় বেপাড়া এসে এখানে মস্তানি করে যাবে তা হতে দেবো না আমরা।” নন্দর আদেশে পাড়ার যুবকরা ফুটতে থাকে। প্রয়োজনে লাঠিসোটা ব্যবহার করতে তারা কসুর করবে না। রুইদাসদের রোখের সামনে আর এগোতে পারলো না বাজারের ছেলেরা। পাড়ার সীমানায় ঢোকার অনেকটা আগেই তাদের থেমে যেতে হয়। এবার ওরা নন্দদের সঙ্গে যুক্তিতর্কের মধ্যে তর্জা সীমাবদ্ধ রাখে। নন্দরা সেটা জিইয়ে রাখে থানা থেকে পুলিশ না আসা পর্যন্ত। খুনের খবরটা পুলিশকে জানাতে থানা আর পা ঘষাঘষি না করে জিপ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে।[ দশ ]
কি করে যে এই হাস্যকর নিয়মটা তাদের সমাজে এতদিন চালু ছিল তা রতনরা নিজেরাও তলিয়ে কোনদিন ভাবেনি। বছরের পর বছর একটা নিয়ম চালু আছে। সবাই এখনও তা মেনে চলছে। পরেশ রুইদাসের হাতে রাধাকান্ত ঋষিদাস খুন হবার পর যেন মাতব্বরদের টনক নড়ে।
কার কোথায় বর্তমান অবস্থান কেউ জানে না। নিশান উড়ছে আকাশে। এবার বিচারটা করবে কে যে, দাবিদারদের মধ্যে কে আগে দেখেছে? তবু এতদিন নিশান দেখে যে আগে ভাগাড়ে যেতে পেরেছে, অন্যরা ধরে নিয়েছে সে আগে দেখেছে বলেই না আগে যেতে পেরেছে! কিন্তু যে আগে দেখেছে বলে দাবি করে তাদের মহার্ঘটা দখল নিল, অন্যরা তলিয়ে দেখল না দখলদারের অবস্থানটা তখন ঠিক কোথায় ছিল? রাধাকান্ত খুন না হলে হয়তো এই অনিয়মটা নিয়ে এখনো কোন প্রশ্ন উঠত না।
অন্য মতের কেউ কেউ বলে, আসলে এখনকার মত এত ঘর মানুষের বাস তো এ পাড়ায় সে সময় ছিল না। ওই রতনের ঠাকুরদা, নন্দদের পূর্বপুরুষ, রাধাকান্তরা আর দিবাকরের তিন পুরুষের বাস সেই সাবেক কাল থেকে। কেউ বলে চম্পা বুড়ি বলে আরও একজন থাকতো। চম্পা বুড়ির বর কালো রুহিদাস মরে যাবার পর তার দুই ছেলে বিহারের চম্পামারিতে পাশোয়ানদের চামড়ার কারখানায় কাজে গিয়ে আর দেশে ফেরেনি। প্রথম প্রথম নাকি ছেলেদুটো মায়ের জন্যে মানি অর্ডারে কুড়ি টাকা করে মাসে পাঠাতো। তাতে বুড়ির সারা মাস টেনেটুনে চলে যেত। হঠাৎ কি হল কে জানে, আর টাকা পাঠায় না। তারা আসেও না দেশে। চোখের দেখা একবার মাকে দেখতেও এল না কেউ। মা কেমন আছে। বেঁচে না মরে আছে। পাড়ার লোক কে বা আছে যে উদ্যোগী হয়ে খরচ করে সেই সুদূর বিহারে বুড়ির ছেলেদের খোঁজ করতে যাবে। বিদেশ বিভুঁইয়ে যাবার পয়সা বা কে দেবে। সবারই তো ‘ভাঁড়ে মা ভবানি।’ তা ওই কালো রুহিদাসের ছেলেদুটো আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে তা পাড়ার কেউ জানে না। শেষমেষ বুড়ি পেটের জ্বালা সামলাতে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষে ফিরতে শুরু করল। তাতে যা চলছিল, চলছিল। হঠাৎ একদিন বুড়ি ভিক্ষে ফিরে হাতে কাস্তেটা নিয়ে কুমোর পাড়ার সনৎ পালের পুকুর-ডোবায় গেল কলমি শাক কাটতে। আনাজপাতি সেদিন ভিক্ষেতে জোটেনি। ওই কলমি শাক সেদ্ধ আর ভাত নুন মাখিয়ে খাবে ঠিক করে। কয়েক আঁটি শাক কাটা তখন হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা খরিস কেউটো পেছন থেকে ফোঁস ফোঁস গর্জে মারল তার কোমরে ছোবল! কেউটে ছোবল মেরেছে বুঝতে পেরে বুড়ি পেছন দিকে কোঁচড়ের কাপড় দিয়ে চেপে চিৎকার করতে করতে পাড়ায় ছুটে আসে। পাড়ার মেয়ে-মদ্দ জড়ো হয়ে যায়! প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে সাইকেল ভ্যানে পাঠিয়ে দেয় ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের অভিমুখে। বুড়ির বেঁচে থাকার ‘দানা’ আর কপালে ছিল না। ভ্যানে যেতে যেতে ঝিঙের পোলের কাছে বুড়ির সারা শরীর নীল হয়ে নিঃশ্বাস থেমে যায়। রতনের ঠাকুরদা গল্প করতো, পায়ে-টায়ে সাপ কামড়ালে ঘরোয়া চিকিৎসায় কখনো সখনো কাজ হয়। বিষরক্ত মাথায় উঠতে দেরি হয়। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে শরীরে ওষুধ পড়লে বেঁচে যায় রোগী। কিন্তু কোমরে কামড়ে সেই সময় পাওয়া যায় না! কোমর থেকে মাথার দূরত্ব আর কত যোজন হবে। ওখানে ছোবল মারলে মানুষের মরণ রোখা দায়। সেই চম্পা বুড়ি মারা যাবার পর সবাই ধরে নেয় তাদের বংশ লোপাট হয়ে গেছে। তাই ওদের আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না কেউ। ওই বিন্দে ঋষিদের বাড়ির দক্ষিণ পানে যে মাটির ঢিবি মতন জায়গাটা পড়ে আছে, ওখানে নাকি চম্পাবুড়ির বাড়ি ছিল। অবশ্য ওই জায়গাটা এখনও দাবিদারহীন হয়ে পড়ে আছে। এখনকার কেউ বলতে পারবে না ওই পোড়ো ঝোপটা কাদের। তাই পাড়ার সবাই ধরে নেয় ওখানেই চম্পাবুড়ির বাড়ি ছিল। বুড়ির ছেলেপুলে বা নাতি-নাতনিরা কেউ যদি কোনদিন দেশে ফেরে তো তাদের জায়গা তারা ভোগ করবে। তখন ওই ক’ঘর। আর এখন তো বেড়ে বেড়ে সত্তর-ঘর নিয়ে পাড়া জমজমাট। সব যে বংশ বিস্তারে এত ভীড় তা কিন্তু নয়। কেউ শ্বশুর-সম্পত্তি পেয়ে ঘর জামাই হয়ে থেকে গেছে। কেউ বা মাতুল সম্পত্তির অধিকারি হয়েছে। ওই মিত্তুনে তো মামারবাড়ির বখরার সবটাই পেয়েছে। ওর মা, মিত্তুনের দাদুর একমাত্র মেয়ে। বুড়ো উপরে চলে যেতে ওরা মায়ে পোয়ে সেই ঝিঙ্কির হাট থেকে বাস তুলে দিয়ে এখানে চলে আসে। মিত্তুনের বাবা শিয়ালদহ-ডায়মন্ড হারবার রেল লাইনে মদের নেশায় টলমল পায়ে লাইন পার হতে গিয়ে পা ফসকে লাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারহীন দেহ নিয়ে লাইন থেকে উঠে পড়ার আগেই আপ-ডায়মন্ডহারবার লোকালে কাটা পড়ে। ওই তো, রোজ খাটলে রোজ খাবার জোটে। মদের নেশা আবার সেই রোজগারে ভাগ বসায়। দেড়-শতক খোড়ো ঘরে বাস। তা সেই একমাত্র রোজগেরে লোক চলে গেলে তাদের মায়ে-বেটায় চলে কেমন করে। তবু বাপের একটা পুকুর আর চাষের বিঘে খানেক জমি রয়েছে। সেই ভরসায় ওই বাস বিকিয়ে মিত্তুনের মা ছেলের হাত ধরে বাপের বাড়ি ওঠে। তাই ভাগাড়ের চামড়া সংগ্রহ করার চাহিদাও সে সময়ের মানুষের তেমন ছিল না। অনেকে আগ্রহও দেখাতো না। যারা আগ্রহ দেখাতো, তারাই বেশি খেয়াল রাখতো এ সবের। কিন্তু এখন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সাথে সাথে চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে রোজগারের সুযোগের অভাব। ফলে আয়ের যেখানে যেটুকু সুযোগ আছে, দলবেঁধে সবাই সেদিকে হামলে পড়ছে। একটা পদক্ষেপকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। সেখান থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসছে। যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর না এলেই ঝিমমেরে থাকা প্রতিবাদ তেড়েফুঁড়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে। বাড়ছে রেষারেষি। যার অনিবার্য পরিণতি, কলহ বিবাদ। আর এই বিবাদ মিমাংসার জন্যে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে পাড়ার আটচালাকে।
বিশ দিন আগে আটচালার খুঁটিতে নোটিশ লটকে দেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজের ওপর কঞ্চির পেন দিয়ে আলতার লাল কালিতে লেখা হয়েছে। শিরোনামে লেখা জরুরী সভা। শেষে পাড়ার মেয়ে-মদ্দ সকলকে উপস্থিত থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। যে অনুপস্থিত থাকবে, পরে তার কোন কথা শোনা হবে না। সভায় যা মানতে বলা হবে তাই সব্বাইকে মাথা পেতে নিতে হবে। আলোচনার বিষয় ‘ভাগাড়ের চামড়ার বখরা।’
গমগমে আটচালা। একে একে পাড়ার প্রায় সব মানুষই জড়ো হয়ে গেছে। এখনো পাতলা হয়ে দু-একজন করে আসছে। আনুষ্ঠানিক সভা শুরু হবার আগেই রতনের ভাই, যতন মদ্যপ অবস্থায় বেসামাল জিভে চেল্লাতে শুরু করে, “ভাগাড়ের চামড়ার বখরার নতুন কোন নিয়ম আমরা মানছি না মানবো না। বছর বছর ধরে যেমন চলে আসছে তেমন চলবে। কোন শালা ভালমানুষের পো’র ক্ষমতা নেই এই চলতি নিয়ম জলাঞ্জলি দেয়। যে শালা আগে নিশান দেখবে সে শালা ভাগাড়ের অধিকারী হবে। এই শালা রতন-নন্দরা যত নষ্টের গোড়া। শালারা বুড়ো হচ্ছে। চোখের মাথা খাচ্ছে আর নিজেদের আখের গোছাতে নতুন নতুন নিয়ম বাতলাচ্ছে। ওই সব শালাদের পোঁ..ও.. !” গালাগাল পুরোটা মুখ থেকে বার করার আগেই রতন ছুটে এসে তার ভায়ের মুখে সপাটে মারে এক চড়! দাদার হাতে চড় খেয়ে যতন ভিমরি খেয়ে পড়ে যায়। মুখের সামনে খাওয়া চড়ের অভিঘাতে যতনের ঠোঁটের সাথে দাঁতের ঠোক্করে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। অন্যরা গামছা ভিজিয়ে ঠান্ডা জল ক্ষত জায়গায় চেপে ধরে। ততক্ষণে ঠোঁটটা ফুলে ঢোল। যতনের টলমল শরীরটাকে ধরে দু’জন ছোকরা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে। এসেই ছোকরা দুটো হম্বিতম্বি করতে থাকে, “এইভাবে যতনকে মারা উচিৎ হয়নি রতনদার। নেশার ঘোরে ও কি বলছে না বলছে তা কি ওর খেয়াল আছে। চুল্লু পেটে নিয়ে সবাই কি নিজেকে সামলে নিতে পারে? পারে না।” এবার অনেকে মিলে ওই দুই ছোকরাকে চুপ করে যেতে বলে। ওরা যে যতনের এক গেলাশের দোস্ত তা সবাই জানে। তাই যতনের আঘাত ওদের গায়ে লাগে। কিন্তু ওরাও যদি গেলাশের দোস্তের পক্ষ নিয়ে সমানে কেচাল করে তো যতনের পরিণতি তাদেরও হবে বলে কড়কে দিতে দুটোতে চুপ মেরে যায়।
মিটিংয়ের আগে যেহেতু নিজেকে জড়িয়ে একটা আজেবাজে ঘটনা ঘটে গেল, তাই রতন আর বেশি উদ্যোগ নিয়ে সভা পরিচালনায় এগিয়ে আসলো না। মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে রইল। নন্দকে বলল, “তোমরা আজ মিটিংটা চলিয়ে নাও। আমার ভাল লাগছে না। মন ভাল নেই। মাথাও গরম। তাই আবার কোথায় কি বলে ফেলব বা করে ফেলব। তখন সবাই আমাকে দুষবে। হাজার হোক নিজের মায়ের পেটের ভাই তো। এমন মারলুম রক্তারক্তি হয়ে গেল। আমি তো এটা চাইনি। গাধাটা এমন কান্ড করতে শুরু করল, আমি নিজেকে সামলে নিতে পারলুম না। সমাজে আমারও তো একটা মান আছে।”
নন্দ আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইল না রতনকে। সে পাড়ার বয়স্ক মানুষ সুবোধ কাকাকে বলল, “কাকা, তুমি তো পাড়ার একজন মুরুব্বি মানুষ। তুমিই বলো, এই বিচ্ছিরি নিয়ম এখনো চলতে দেওয়া উচিৎ কি না। সবাই মানছে এই কালা নিয়ম চলা উচিৎ নয়। তবুও চলে আসছে। যা হবার হয়ে গেছে। যে কারণেই হোক এতদিন কেউ প্রতিবাদ করেনি। বা এখনকার মত জোট বেঁধে কিছু বলেনি। পুরোনো মানুষ হিসেবে তুমিই এর একটা উপায় বাতলে দাও। তুমি যা নিদান দেবে সেটাই আমরা মাথা পেতে নেবো।” এবার নন্দ সভায় উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, “কি গো বাপ-সকল মা-সকল, সুবোধ কাকা যা বিধান দেবে তোমরা সকলে মানবে তো? না কি মানবে না। যদি না মানো তো আগে থেকে বলো। যে বা যারা বলতে আসবে তাদেরই উপর দায় চাপবে সঠিক নিদান দেওয়ার।”
এই কথার পর কেউ আর ওইসব ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইল না। এমনিতেই সভার আগে একটা যাচ্ছেতাই ঘটনা ঘটে গেল। তারপর আবার কে ওই ঝামেলার মধ্যে মাথা গলাতে যাবে। কয়েক মুহূর্ত সভা একদম চুপ। আবার নন্দ বলল, “কি হল, সব চুপ কেন? কিছু তো একটা বলতে হবে। চুপচাপ থাকার জন্যে তো সবাই কাজ ফেলে এখানে আসেনি। বলতেই হবে, সুবোধ কাকার কথা আমরা মানবো কি মানবো না?” এবার আরও গলা চড়িয়ে বলল, “কি, মানবো কি মানবো না?” এবার সভা আর চুপ করে রইল না। সব্বাই একবাক্যে নন্দর কথায় সায় দিয়ে বলল, “মানবো মানবো। সুবোধ কাকা যেটা বলবে, সেটাই আমরা মানবো।”
সুবোধ কাকার বয়স হলে কি হবে। এখনও যথেষ্ঠ শক্ত ঠকঠকে বুড়ো। কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সে দ্বিধা করে না। তাই ওর ওপরে পাড়ার সবাই আস্থা রাখে। এবার শান্ত সভায় মসৃণ গলায় বলল, “আমি আর কি বলি। দিনকাল পাল্টেছে। আমার মতের সঙ্গে এ’কালের মতের মিল হবার তো কথা না। একটা কিছু বলে ফেললে তোমরাই আবার পরে আমাকে শাপ শাপান্ত করবে। বুড়ো বয়সে আর অন্যের অভিশাপ কুড়িয়ে কাজ নেই। তোমরা সব বাপ সকল, এত মানুষ আছো। তোমরাই ঠিক করে নাও গো। আমাকে ছাড়ান দাও।”
নন্দ তখন সুবোধ কাকাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, “না না কাকা, তোমাকে কেউ…!” হঠাৎ সেই কথার ফাঁকে পেছন থেকে একজন ফুট কেটে বলে উঠল, “বুড়ো ভাম এবার নিজের দর বাড়াচ্ছে রে!” সঙ্গে সঙ্গে গোটা আটচালা গুনগুনিয়ে উঠল! বুঝি সভা এবার পন্ড হতে না বসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নন্দ চেঁচিয়ে উঠল, “পেছন থেকে কে ফুট কাটলো রে? কে? কে? এই কেলে, তোদের ওদিক থেকে কথাটা ঠিকরে এলো। কে বলল কথাটা? মান্যি লোককে মান্য করতে জানিস না তো সমাজে আছিস কেন? পাড়া থেকে দূর করে দেবো বলে দিচ্ছি। কে কথাটা বলল বল?” পাড়া ছাড়ার হুঙ্কারে কেলে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আমি না। হেড়ো পাগলা।” সঙ্গে সঙ্গে সুবোধ কাকার লাঠিটা নিয়ে হেড়ো পাগলার দিকে তেড়ে গেল নন্দ, “শালা, হারামি, পাগলামির জায়গা পাওনি না? কে ওকে এখানে ডেকেছে, রে?” নন্দর তাড়া খেয়ে পাঁই পাঁই করে সভা ছেড়ে পালায় পাগলা। ও পাগলার কথা ছাড়ান দাও কাকা। বলো, কাকা, আমরা এখন কি করবো।” সেই থেকেই সুবোধ কাকার কথা মত এই চার-পাঁচ বছর ধরে, ‘যে আগে এসে গরু ছুঁতে পারবে সেই হবে সেই গরুর চামড়ার মালিক’ নিয়মটা চালু হয়। তখনকার মত একবাক্যে সবাই তা মেনেও নেয়। আসলে মানুষ এতবছরের একটা কালা নিয়ম, ‘নিশান যে আগে দেখবে, সেই চামড়ার অধিকারি হবে’ থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিল তখন। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে এটাও একটা কালা নিয়ম। ‘জোর যার মুলুক তার’ হয়ে যাচ্ছে। জোরের দাপটে অশক্তরা ভাগাড়ের অধিকার হারাচ্ছে। এ চলতে পারে না। এ আর এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে তারা।[ এগারো ]
কথাটা গ্রামীন জনপদের অনেক জায়গার চালু কথা যে ‘স্বামীগৃহই হল মেয়েদের জীবনের স্থায়ী পূন্যভূম।’ দশ বছর হয়ে গেল পরেশের বউ সনকাকে আটচালার বিধানে গ্রাম ছাড়া হতে হয়েছে। মাঝে মাঝেই মনটা ডুকরে ওঠে, তার সেই স্বামীর লীলাভুমে একবার ঘুরে আসতে। চোখের দেখা দেখে আসতে। ঘড়বাড়ি তো এতদিনে ঝোপজঙ্গলে টৈটুম্বুর। ভেতরে ঢোকার উপায় থাকবে না। তবু বাইরে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে থেকে অশান্ত মনকে একটু বোধ দেওয়া যায়। তার প্রিয় শ্বশুরালয়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঘ্রাণ নিলে মনটা যেন তৃপ্ত হয়। আবার কোথা থেকে যেন অভিমানি মন শক্ত হয়ে রুখে দেয় তার সেই দুর্বল চিত্তকে। না, যে পাড়া স্বামীছিন্ন এক অসহায় যুবতী নারীকে শিশু সন্তান সমেত গ্রামছাড়া করে, সে পাড়ায় সে আর ঢুকবে না। আবার ভাবে, লোচনের বাপের জন্মভিটে ওটা। ওর বাপ যদি কোনদিন জেল থেকে ছাড়া পায় তো সে প্রথমেই তার ভিটেতেই উঠবে। সে মেয়েমানুষ। ভিন গোত্রের মেয়ে। ওই ভিটের ওপর তার হয়তো নাড়িছেঁড়া টান নেই ঠিকই। কিন্তু আজন্ম যে মানুষটা একটা জায়গায় কাটালো, সে তো কিছুতেই তা ভুলতে পারবে না। আর স্বামী এলে বউকে তো আসতেই হবে। স্বামী-সংসারেই তো মেয়েদের জীবনের সার্থকতা। স্বামীর ঘর না পেলে মেয়েমানুষের জনমই বৃথা। সেদিক থেকে সনকার কপাল যে মন্দ নয় তা বলা যায়। স্বামী-সংসারেও তো তার কোন বিরাগ ছিল না। অভাব অনটনের মধ্যেও দিন চলছিল। স্বামী তার কোনদিন বারমুখো ছিল না। সনকার দিন তাই নিশ্চিন্তেই কাটছিল। কি একটা আচমকা ভুলচুক করে ফেলল লোচনের বাপ। সে ভুলের আর মাপ হল না। থানা-পুলিশের সাথে সাথে পাড়ার মাতব্বরাও মেতে উঠল ওই ভাল মানুষটাকে গারদে পুরতে। সেইসঙ্গে তাদের মায়ে-বেটারও শাস্তির বিধান দিয়ে বসল। এত বেয়াড়া মনের মানুষ এরা কেন তা কে জানে।
তাদের রুইদাস পাড়ার মানুষ এক রকম আর এই শহরের জীবনযাত্রা আর এক রকম। কোলকাতার সল্টলেকের সমাজ ব্যবস্থা আর তাদের গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থার যেন কোন দিক থেকে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে কেউ কারোর তেমনভাবে খোঁজ খবর রাখে না। একই বাড়িতে, পাশের দরজার ফ্ল্যাটের লোক একে অপরকে চেনে না জানে না। চেষ্টাই করে না কেউ। যে যার মত ব্যস্ততায় দিন কাটায়। হয়তো কোন সময় মুখোমুখি হয়ে পড়লে দেঁতো হাসি হেসে ঘাড় কাত করে মনুষ্যেতর জীব যে তারা নয় তার নজির রাখার চেষ্টা করে। সনকাদের গ্রামীণ রক্ষণশীল জীবন থেকে এই জীবন হয়তো মনে হবে এক খোলা হাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে দিন কাটার জীবন। সেই দিক থেকে সংস্কারমুক্ত এক স্বাধীন জীবন সে যেন খুঁজে পেয়েছে বলতে পারে। সেই স্বাধীনতার পাদানিতে পা দিয়েই তো সে এখন আর গ্রামের ঘোমটাটানা পরেশ রুইদাসের লাজুক বউ নেই। চটপটে বেপরোয়া যেমন খুশি সাজো, যেমন খুশি চলো’র সনকাদি বনে গিয়ে শহুরে আর্দ্রতায় সিক্ত হয়ে রসেবসে দিন কাটাচ্ছে।
আটচালা যখন তাকে গ্রামছাড়ার নিদান শত আকুতি মিনতিতেও ফিরিয়ে নিল না তখন সনকা বুঝেই গেছিল ওখানে তার আর বাস করাই যাবে না। গ্রাম তাকে ছাড়তেই হবে। তা এখন সে একা মেয়েমানুষ বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যাবে! দিশাহারা চোখ তখন হঠাৎ আটকে গেল পোদপাড়ার বাদলের চোখে। তার চোখে ঠেকনা রেখে চোখ ফেলল বাদলের বন্ধু দুলাল রুইদাসের চোখে। ওরা দু’জনেই লোচনের বাবার এক পেয়ালার বন্ধু ছিল। সেই সুবাদে তাদের বাড়ি আসতে আসতেই অজান্তে কখন যেন দুলাল রুইদাসকে তার মনের এক কোণে ঠাঁই দিয়ে ফেলে। আর দুলালও মনে হয় তার মনের ভেতরের রসায়ন ধরে ফেলেছিল। সনকা ধরা পড়ে গেছিল দুলালের কাছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে লোচনের বাপের চোখের আড়ালে তার বুকে হাতও দিয়েছে। প্রতিবাদ করতে পারেনি সনকা। সাবধানে তার হাতটা চেপে লাজুক চোখে সরিয়েও দিয়েছে। সেই হাতধরাধরি তখনও ভুলতে পারেনি দুলাল। ওর বাপ জেলে যাবার পরও তার খোঁজ নিয়ে গেছে সে। ফিরে যাবার সময় বলে গেছিল, “কোন দরকার হলে আমাকে খবর দিও। আমার সাধ্যমত আমি তোমার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করব। আমাকে জানাতে কোন কিন্তু কিন্তু করবে না। আমার মনের মণিকোঠায় সবসময় তুমি জ্বলজ্বল করছো।”
তাদের সংসারে এই প্রবল ঝড়ঝাপটার মধ্যে দুলালকে নিয়ে তার পরকীয়া প্রেমের ঢেউ কখন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সত্যিই তো, সংসারে যখন অভাব এসে বাসা বাঁধে। যুবতী নারীর সতীত্ব যখন প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায় তখন এইসব পরকীয়া-টরকীয়া কোথায় যেন বাষ্প হয়ে উবে যায়। জীবন থেকে সনকা সেটা মর্মে মর্মে ঠাওর করতে পারছে। নিজের জীবনের এই দুই প্রবল ধাক্কা থেকে উদ্ধার পাওয়াই এখন তার প্রধান কাজ। মন তাই হাতড়াতে হাতড়াতে বাদলের হাত ধরে দুলালের মুখটা ভেসে উঠল তার সামনে। সুতোর মত সেই হাল্কা টানের খুঁট ধরে বাদলের মারফত খবর দিয়েছিল দুলালদাকে, “আমাকে তুমি বাঁচাও দুলালদা। ধু ধু জলাশয়ে আমি এখন হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি আমার পাশে না দাঁড়ালে এই শিশুটাকে নিয়ে আমার সলিল সমাধির ভবিতব্য কেউ রুখতে পারবে না। এরা, মানে আমাদের এই রুইদাস পাড়ার আটচালা নিদান দিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। যে অন্যায় করেছে তার তো জেল জরিমানা হয়েছে। অন্যায়ের শাস্তি সে পেয়েছে। তা আমি কি অন্যায় করলাম। আমার এই দু’বছরের শিশুটা কাকে খুন করল, যে তাকে গ্রাম ছাড়তে হবে? কত আকুতি জানালাম। কোন কাজ হল না। পাড়া আমাকে ছাড়তেই হবে। এখন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো, কি খাবো? গ্রামের এই মানুষগুলো কেমন মানুষ? এদের হৃদয় বলে কি কিচ্ছু নেই! আমরা গ্রামে থাকলে নাকি আমাদের খুনে বাড়ির ছোঁয়ায় পাড়ার অন্য লোকের মানুষ খুন করার প্রবৃত্তি জেগে উঠবে। তাই আমরা পাড়ার শত্রু। প্রথম রাতেই বেড়াল মারার মত প্রথম চটকাতেই শত্রু-বীজ নিকেশ করা দরকার। তাই মাতব্বরদের এই বিধান। তুমি একবার বলেছিলে না দুলালদা, বিপদে পড়লে আমাকে খবর দিও? তাই তোমার কথা প্রথমেই আমার মনে পড়ল। আমার একটা হিল্লে তুমি করে দাও দাদা। কথা দিচ্ছি, তোমার উপকার আমি ভুলে যাবো না। আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। সময়মত সেই ঋণ আমি শোধ করব।”
পরেশের বোয়ের শেষ কথাটায় কয়েকবার যেন পায়ের রক্ত মাথায় আর মাথার রক্ত পায়ে চলকে চলকে ওঠা-নামা করে গেল দুলালের। স্বামী-ছাড়া পরেশের বউ, সনকার গায়ে জড়ানো পোষাক ভেদ করে সে যেন তার শরীরের উত্তুঙ্গ যৌবন পরখ করে নিল একবার। সঙ্গে সঙ্গে চনমনিয়ে উঠল তার মনের ভেতরটা! বাইরে পরেশের বোয়ের এই শাস্তির বিরুদ্ধে সে গলা তাড়লেও মনে মনে খুশিই হয়েছে সে। গ্রাম থেকে একবার মেয়েটাকে বার করে আনতে পারলে সে তো তারই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তখন ভালবাসা দিয়ে তাকে যেমন খুশি তেমনভাবে পেতে পারবে। পরকীয়া প্রেমের কারণে তাদের পাড়ার আটচালার কোপে আর তাকে পড়তে হবে না। বড্ড কট্টর এখানকার রুইদাসরা। সনকাকে আশ্বাস দিয়ে সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়ল দুলাল। যাবার সময় বলে গেল, “শুনছো লোচনের মা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে তোমার একটা হিল্লে করতে পারি তার ব্যবস্থা করছি। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তোমার হাতে তো তিনমাস সময় আছে। অতদিন সময় আমি নেব না। দেখো না, খুব শিগ্গিরই তুমি পাড়ার মুখে নুড়ো জ্বেলে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে আসতে পারবে। সে ক্ষমতা যে এই দুলাল মুচির আছে তা সে দেখিয়ে দিয়ে তবে থামবে। রুইদাস পাড়া ভাবছে পরেশকে যেমন শাস্তি পেতে হচ্ছে তেমনই তার বউকেও শাস্তি দিয়ে বগল বাজাবে। তুমি জেনে রাখো সনকা, সে গুড়ে বালি। তুমি দেখে নেবে, পাড়া ছাড়ার সময় তোমার পায়ের ধুলোবালি ওদের চোখে ঠিকরে পড়ে চোখ করকর করে অঝোর ধারায় জল পড়বে। তখন বুঝবে কি ভুল ওরা করেছে।”
মাসে একবার সনকার সঙ্গে দেখা করতে যায় দুলাল। সল্টলেকের যে বাড়িতে সনকাকে কাজে লাগিয়েছে, সেই বাবুর সঙ্গে দুলালের কথা হয়েছে। বাবু বলেছে, “দুলালবাবু আপনি মাসে মাসে এসে দেখে যাবেন আপনার বোন কেমন আছে। আমরা তাকে কষ্টে রেখেছি না ভালভাবে আছে। একবার তো আসবেনই, মনে হলে অন্য কোন দিনও ঘুরে যেতে পারেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই তাতে। বোনকে নিয়ে একটু শহরটা ঘুরিয়ে দেখালেন। মার্কেটে নিয়ে গেলেন। এতে সনকার মনটাও ভাল থাকবে। কাজের চাপে আমাদের বাড়ির কারোর তো সে সময় হয়ে ওঠে না। সনকার মন ভাল থাকলে কাজেও সহজে মন বসাতে পারে। তাতে আখেরে আমাদেরই লাভ।”
বাবুর কথায় দুলালেরও মনটা উতলা হয়ে ওঠে। বাবুর কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে সে। এবার সনকাকে মাসে এক বা দু’দিন নিজের মত কাছে পেতে আর কোন অসুবিধা হবে না। মনের ইচ্ছে মত সে তাকে তার ভালবাসা উজাড় করে দিতে পারবে। তাছাড়া শুধু তারই বা কেন, সনকারও তো যৌবন বলে কিছু আছে। তার ডগমগে ভরভরন্ত শরীরের চাহিদা দুলালকে উজাড় করার ইচ্ছে সে আকারে ইঙ্গিতে কতবার প্রকাশ করেছে। সুযোগের খোঁজে ছিল। এতদিনে খোঁজ মিলেছে।
নিক্কো পার্কের পাশেই চন্দনবাবুদের মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর অফিস। দীর্ঘ সময় কাজের পর একঘেয়েমী কাটাবার জন্যে চন্দনবাবুরা কিছুক্ষণের জন্যে নিক্কো পার্কের ভেতর কাছাকাছি এদিক ওদিক ঘুরে আসে। সেই ফাঁকে দুপুরের টিফিনটাও সেরে নেয়। ওদের দলে মেয়ে কলিগেরই আধিক্য। চন্দনবাবু সব্বাইয়ের পছন্দের মানুষ। যেমন রসিক তেমন সপ্রতিভ। চন্দনবাবুও মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে এবং স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ওরা, বিশেষ করে শীতকালটা এদিকে আসে বেশি। শীতে রোদের উষ্ণতার সঙ্গে নারীসঙ্গের ওমের যৌথ মিলনে এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি সে খুঁজে পায়। এ সুখ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই নিয়ে অন্য পুরুষ কলিগরা তাকে ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। কিন্তু তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। সে তো জোর করে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে যাচ্ছে না। মেয়েরা তার সঙ্গ পেয়ে খুশি হয়। তাই তারা তাকে সঙ্গে নেয়। সে এই সঙ্গ পেতে পছন্দও করে। নারীর পেলব সঙ্গ কোন্ পুরুষ আর অপছন্দ করে। কিন্তু পছন্দ করলেই তো হবে না। তাদের কাছে আকর্ষনীয় হবার যোগ্যতা থাকা দরকার। সেটা আবার সব পুরুষের মধ্যে থাকে না। তাই তারা চন্দনকে দেখে আফসোস করে।
প্রায় প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে দুলাল আসে তাদের বাড়ি। সনকার খোঁজ খবর নেয় আর সনকার সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে খানিকক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে ছোট্ট লোচনকে ঘুম পাড়িয়ে দুজনেই বেরিয়ে যায়। সময়টা ঠিক দুপুর বেলা। বাড়ির সব কাজটাজ সেরে বাড়ির মানুষরা যখন বিশ্রামে যায়, তখন। আর দুলাল কোনসময় ছুটির দিন, মানে শনিবার বা রবিবার আসে না। কাজের দিন এবং দেখা গেছে সোমবার বা মঙ্গলবার। রূপসা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। চন্দন তো আর ওই সময় বাড়ি থাকে না। তাই তার এসব চাক্ষুশ করার সুযোগও নেই। রূপসাই স্বামীর কানে সনকার ব্যাপারটা তুলেছে। রূপসা বলছিল, “ওই দুলাল বলে লোকটা, যে সনকার দাদা বলে পরিচয় দিয়েছে। ওই লোকটা বাড়িতে আসলেই সনকার চোখ মুখের ভাষা, চলনবলন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। যেটা সত্যিকারের নিজের ভাইবোন হলে হবার কথা না। বেশ কয়েকদিন ধরে আমি সেটা লক্ষ্য করছি। তোমাকে বলিনি। এখন প্রায় নিশ্চিত যে ওদের মধ্যে অন্যরকম কোন নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে। দুলাল আসলেই সনকা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কোনো কাজ যদি বাকি থেকে যায় তা সেরেসুরে নেবার। তারপর বেরোবার জন্যে সাজগোজের যা বাহার, আমরাও অতটা দেখাতে পারি না। যাকগে। ওটা ওর নিজের ব্যাপার। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের নাক গলিয়ে কাজ নেই। যে জন্যে আমাদের বাড়ি ওর আসা, সেই কাজগুলো সময়মত এবং ঠিকঠাক পেলেই হল। না হলে অত টাকা দিয়ে আমরা ওকে সর্বক্ষণের কাজের লোক হিসেবে রাখব কেন। থাকা খাওয়া নিয়ে দশ দশটি হাজার টাকা। কম কথা নয়। ওদের কাছে তো এই টাকা পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়া। আমি শুধু তোমাকে ব্যাপারটা শুনিয়ে রাখলাম। বাড়ির কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে তা বাড়ির মালিককে সময়মত জানিয়ে রাখা দরকার। যদি কখনো কোন ঘটন-অঘটন ঘটে যায়?” তখন কি হবে?”ক্রমশ….
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৪)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ সাত ]
রুইদাস পাড়ার পাশেই পৌন্ড্রক্ষত্রিয় পাড়া। পোদ পাড়া বললে এক ডাকে সবাই চেনে। আটচালার মিটিংয়ে সেই পোদ পাড়ার বাদল এসেছে। সঙ্গে দুলাল বলে একজন। দুলাল কিন্তু পোদ নয়। ও মুচি-রুইদাস। ওর বাড়ি সেই উস্তির পদ্মপুকুরের দিকে। বাদলের সঙ্গে দুলালের বন্ধুত্ব সবার জানা। ওদের দু’জনের আলাপ, হাইওয়েতে ট্রাক চালানোর সুবাদে। দু’জনেই ট্রাক ড্রাইভার। আর বিদেশ বিভুঁইয়ে বিপদ আপদ ঘটলে মানুষ এলাকার কাউকে কাছে পেলে আঁকড়ে ধরতে চায়। অচেনা হলেও। দু’জনে বাঙালী তো? আর খুব কাছাকাছি না হলেও মোটামুটি এলাকার লোক তখন কত আপন হয়ে যায়। জাতপাতের বজ্জাতি এই পাড়া এলাকাতেই জমাট বাঁধে। বাইরে সেসবের কোন গুরুত্ব নেই। সেখানে এক ভাষাভাষী এলাকার মানুষ এই পরিচয়ই যথেষ্ট। এমনকি ভিন্ন ধর্মের হলেও কোন ফারাক পড়ে না।
রুইদাস পাড়ার লতায়পাতায় কারোর সঙ্গে দুলালের আত্মীয়তাসূত্রে বাঁধন নেই। ওই বাদলের বাড়ি আসা যাওয়া করতে করতে পরেশের সঙ্গে দুলালের আলাপ। ঘনিষ্ঠতাও জমে ওঠে। বাদলের এখানে দুলাল আসলেই পরেশের বাড়ি আড্ডা দিতে সে আসবেই। জাতভাইয়ের একটা যে টান তা অস্বীকার করবে কে। সেইসঙ্গে দোসর যৌবনের উচ্ছ্বাসে টগবগ করা পরেশের বউ! এ টান কি আর প্রকাশ্যে গলা উঁচিয়ে বলা যায়? যায় না। এ টান অন্তর্সলীলে বয়ে যায়। পরেশের সঙ্গে আলাপের পর থেকে দুলালের এ’পাড়ায় আসার বহরও বেড়ে যায়। তাতে অবশ্য কারোর কিছু বলার নেই। বাড়ির বউ-মরদ দু’লোকে যখন কেউ কিছু বলে না, তা পাড়ার লোক আগ বাড়িয়ে ঝগড়া কিনতে যাবে কেন। তবে এ নিয়ে কানাঘুষো চর্চা যে চলে না তা নয়। সব জায়গায় পাড়া কালচার বলে একটা কথা আছে। সেই পাড়া কালচারে এসব নিয়ে জল-গুলুনি তো চলতেই থাকবে। বাদলও আসে দুলালের সঙ্গে। তিনজনের আড্ডাটা এখানেই বেশি জমে। এমন মধুর চিত্রপটে হঠাৎ কি করে যে কি হয়ে গেল। দুলাল কিছুতেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। পরেশের জেল হয়ে যাবার পর কোন মুখে আর সে ওবাড়িতে আড্ডা দিতে যাবে? চারিদিকে তাহলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। এমনকি পরকিয়া প্রেমের অপরাধ তার ঘাড়ে চাপিয়ে শাস্তির মধ্যেও পড়তে হতে পারে। পরেশের জেলযাত্রার পর কয়েকবার বাদলের বাড়ি এসেছে দুলাল। পরেশ-বৌদির খোঁজ খবরও নিয়েছে। কিন্তু এদিন এসে যখন শুনলো আটচালার বিচারে ওদের গ্রামছাড়া করা হয়েছে, দুলাল সঙ্গে সঙ্গে খেপে আগুন হয়ে যায়! বাদলকে বলে, “এ কেমন বিচার গো তোমাদের ওপাড়ার রুইদাসদের? যে অন্যায় করল, তার তো চরম শাস্তি আইন দিয়েছে। তা নিরাপরাধ ওই মেয়েটা আর শিশুটা কি অন্যায় করল? এ কাজটা ওদের আটচালার করা ঠিক হয়নি। একটা অন্যায়ের শাস্তি দিতে দিয়ে আর একটা বড় অন্যায় ওরা করে ফেললো? গ্রামের একটা লোকও ওই অসহায় মেয়েটার পক্ষ নিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করল না! আমাদের পাড়াতেও তোমাদের আটচালার মত সরকারি বড় দালানঘর আছে। পাড়ার যাবতীয় মিটিং-টিটিং ওখানে হয়। বিচার-শালিশিও বসে। তবে এমন অমানবিক আর একতরফা বিচার মাতব্বররা কেউ কোনদিন করতে পারে না। ভুল হলেই অন্যরা চেপে ধরবে। মাতব্বরদের তড়পানির ভয়ে কেউ সিঁটিয়ে থাকে না। শুনলাম আজ সেই পরেশকে জড়িয়েই তো তোমাদের আটচালায় মিটিং আছে। আমি যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর আগে ওদের মাতব্বরদের দিতে হবে, তার পর ছুরি ব্যবহারের বিষয়ে কি নীতি নেবে তা নেবে। ও ব্যাপারে আমার কোন কথা নেই। তবে এই নিত্যসঙ্গী ছুরি ব্যবহারে একটা সঠিক নিয়ম মেনে চলা উচিত।”
দুলালের কথায় সায় দিয়ে বাদল বলল, “দেখো দুলাল, তোমাদের ওই রুইদাসদের কালচারের সঙ্গে আমাদের কালচার একদম মেলে না। আমরা, নস্কররা এই রুইদাসদের কোন ব্যাপারে মাথা গলাই না। এমনিতে ওরা ভীষণ হুটকো। দিনরাত সময় পেলেই মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে আর মতের অমিল হলে মারপিট, গালিগালাজ এদের মধ্যে লেগেই আছে। কোন ভদ্রলোক এই পাড়া দিয়ে যেতে সায় দেয় না। যারা এদের কথা জানে না, তাদের তো কিছু করার নেই। ওদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হবার সুযোগ তখন তাদের হয়ে যায়। অবশ্য তাই বলে সবাই মাতলামো, গালাগালি, মারপিট-প্রিয় তা নয়। আজকাল কেউ কেউ বাইরে কাজে যেতে শিখেছে। সেই পরিবেশ আর এখানকার দমবন্ধ করা পরিবেশ তারা আলাদাভাবে বুঝতে শিখেছে। তারা চেষ্টা করে সমাজটাকে একটু ভদ্র জায়গায় নিয়ে যেতে। কিন্তু সময় লাগবে। যতক্ষণ না এদের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো মুশকিল। তাই একদম লাগোয়া পাড়া, আমাদের নস্কর পাড়া হলে কি হবে, এই মুচিদের ব্যাপারে আমাদের কিচ্ছু বলার বা করার নেই। হ্যাঁ আমাদের পোদ পাড়া যে শিক্ষা দীক্ষায় টৈটুম্বুর তা কিন্তু নয়। বরং গরিব এবং অশিক্ষিতই বেশি। তবে এদের মতো অবুঝ নয়। এদের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে আমরা কোনদিন পার পাইনি। পাড়া ঝেঁটিয়ে ওরা আমাদের দিকে তেড়ে আসতে কসুর করে না। তাই আমরা এদের কোন ব্যাপারে মুখ লাগাই না। তুমি ওদের জাতভাই আছো। তোমার কথা ওরা হয়তো শুনতে পারে। তবে এরা যা হেঁকাতে, মানবে বলে তো মনে হয় না।”নন্দ-রতনরা, দুলালকে ভাল করে চেনে। নন্দর পিসির মেয়ের দুলালদের পদ্মপুকুরেই বিয়ে হয়েছে। তাই ওদের পাড়ায় ওর যাতায়াত আছে। একটা সময় ঘনঘনই যেত। ইদানিং কাজের চাপে আর তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাছাড়া অনেকদিন থেকে পরেশের বাড়িতে আসা যাওয়ার সুবাদে পাড়ার সকলেই দুলালকে চেনে। আরও ভাল করে চেনে, পরেশের যুবতী বউকে নিয়ে ওর সম্বন্ধে নানান টক-ঝাল-মিষ্টি আলোচনা-মস্করার সুবাদে।
সব কাজ কর্ম সেরে সন্ধ্যে আটটার মধ্যে পাড়ার সকলকে আটচালায় আসতে বলা হয়েছে। দুলালকে মিটিংয়ে আসতে দেখে নন্দরা একটু থমকে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে বলল, “আরে দুলাল ভাই। তুমি কবে এলে বাদলের বাড়িতে। তাও হঠাৎ আবার আমাদের আটচালার মিটিংয়ে? তা এসে যখন পড়েছো, তখন দেখে যাও আমাদের আলোচনা সভা। আমরা কেমন বিচার আচার করি, বিধান দিই। আমাদের বিচারের নিয়মকানুন তুমি জানতে পারবে। সেই অভিজ্ঞতা তুমি তোমাদের দালান বাড়ির সভায় কাজে লাগাতে পারবে।”
ততক্ষণে পাড়ার সবাই একে একে হাজির হয়ে গেছে। রতন বলল, “আমরা আজ কি জন্যে আটচালা ডেকেছি তা তো সবার জানা। এ’ব্যাপারে কারোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারো। আমরা আগে কে কি বলতে চায় শুনে নিই। তারপর আরও আলোচনা না হয় করা যাবে।” রতনের কথা শেষ হতে না হতেই দুলাল বলল, “আজকের যে তোমাদের আটচালা বসছে, তা জেনেই আমি এসেছি। কি বিষয় নিয়ে আলোচনা তাও আমার জানা। এই ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে এই আটচালার উদ্দেশ্যে আমার কিছু জরুরী প্রশ্ন বলো, বক্তব্য বলো, আছে। মূল আলোচনার আগে আমার কথাগুলো শোনার অনুরোধ জানাচ্ছি। তার পরেই আমি চলে যাবো। তোমাদের নিজস্ব আলোচনায় আমি বাইরের লোক, থাকতে চাই না।”
দুলালের কথা শুনে আটচালা গুনগুন আওয়াজে ভরে উঠল। কেউ বুঝতে পারছে না, দুলাল এখানে ঠিক কি বলতে এসেছে। পাড়ার মাতব্বররাও ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা সেরে নিতে ব্যস্ত। হতেই পারে তাদের স্বজাতি কিন্তু অন্য গ্রামের লোক। তার বক্তব্য এখানে রাখতে দেওয়া হবে কি না সেই নিয়ে আলোচনা। শেষমেষ মাতব্বররা রাজি হয়ে গেল। নন্দ বলল, “বলো দুলাল, তুমি কি বলতে চাইছো। তোমার কথা শোনার পর আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরবো।”
কিছু সময়ের জন্যে সভা একদম স্থির। পিন পড়লেও শোনা যাবে এমন। এবার দুলাল কোন ভূমিকা না করে সরাসরি সভাকে আক্রমণ করে বলল, “একজন নিরাপরাধ যুবতী-মা আর একটা দুধের শিশু, তারা কি অন্যায় করল যে তাদের জোর করে গ্রামছাড়া করা হল? অপরাধ যে করেছে সে তো শাস্তি পেয়েছে। একই অপরাধে দু’বার শাস্তি! প্রশাসন পরেশকে জেল-জরিমানা করে শাস্তি দিল। আবার তার পাড়ার আটচালা সেই পরেশকে শাস্তি দিল তার বউ বাচ্চাকে গ্রামছাড়া করে! এটা তোমরা কি বিচার করলে? তোমরা একবার ভেবে দেখলে না, তাড়িয়ে দিলে একটা মেয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবে? সে তো তোমাদের পাড়ারই একজন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। পরেশ ভুলবশত একটা কাজ করে ফেলেছে। সে কাজটা ঠিক করেনি এটা মানছি। ও যদি এই ভুলটা না করত তাহলে তো পরেশ, ওর বউ-বাচ্চা সকলের চোখে তখন অন্য পড়শিদের মত আপনজন হত। এখন তো পাড়ার কেউ জানে না সেই মেয়েটা কোথায় আছে? কেমন আছে? নারীর মান-মর্যাদা নিয়ে সে টিকে আছে তো!”
দুলালের কথা শেষ হতেই সভায় হইচই শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ আবার দুলাল যে একেবারে বেঠিক কথা বলেনি সেটা বুঝে চুপচাপ থেকে গেল। তবে যারা সেদিন পরেশের বউকে গ্রামছাড়া করার জন্যে বেশি মাথাচাড়া দিয়েছিল, দুলালের কথায় তারা রে রে করে উঠল। মিত্তুনে চেঁচিয়ে উঠল, “পরেশের বউকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন রে? সে তোর সম্পর্কে কে হয় ? তোর তো দেখছি মা’র থেকে মাসির দরদ বেশি। তার সঙ্গে তোর কোন গোপন সম্পর্ক আছে না কি রে? খুব বুঝি রসিয়ে রসিয়ে ভোগ করা হচ্ছিল পরেশের বোয়ের যৌবন? ওই জন্যে পরেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসা হত। এখন তা আর হচ্ছে না বলে তোর গায়ে জ্বালা ধরছে, তাই না?” এবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দুলাল লম্পটকে এক্ষুণি এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। পরেশের ব্যাপারে আমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই ঠিক। ও বিদেশ বিভুঁইয়ের লোক, ও আমাদের গ্রামের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছে কেন? এক্ষুনি ওকে এখান থেকে তাড়াতে হবে।”
তাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলতে মিত্তুনের উপর ‘খার’ বেড়ে যায় দুলালের, “আচ্ছা, আমি তো কথাটা মিত্তুনের বাড়িতে গিয়ে বলিনি। আর কাউকে দোষ দিয়ে বলিনি। এই সভা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তর উপর আমার মনের কথা বলিছি। তাতে মিত্তুনের অত গায়ে জ্বালা ধরল কেন? ওর এই জ্বালা ধরার পেছনে কারণ আছে। সবার সামনে আমার তা ফাঁস করার ইচ্ছে ছিল না। সেই কথা এ’পাড়ার কেউ কেউ জানেও। তা ও যখন আমাকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলে এতবড় অপমান করল তখন আমি আর চুপ করে থাকবো না। চলে তো আমি যাবই। এখানে থাকতে আসিনি। তবে ওর কেচ্চা না শুনিয়ে যাব না। সবাই জানুক, পরেশের বোয়ের উপর ওর কেন এত রাগ। পরেশ আমাকে সব গল্প করেছে। পরেশের সামনে থাকলে ও কেঁচো হয়ে থাকত। এখন সে নেই তাই এই হম্বিতম্বি।” দুলালের কথায় সভার নজর এবার গিয়ে পড়ল মিত্তুনের দিকে। যেন অপেক্ষা করতে লাগল, দুলালের কথার কাটান দিতে পাল্টা কি কথা মিত্তুনে বলে, তার জন্যে। কেননা দুলাল যদি প্রমাণ করতে পারে তো পরকীয়ার অপরাধে মিত্তুনের শাস্তি অবধারিত। গোপনে কে কি করছে ওই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু ধরা পড়লে বা প্রমাণিত হলে পরকীয়ার জন্যে কড়া শাস্তি দেয় আটচালা। সেটা মিত্তুনেও খুব ভাল করে জানে। তাই নিজেকে রক্ষা করতে সে দ্বিগুন চেল্লে উঠে বলে, “তুই আমার নামে কি ফাঁস করবি রে ‘গোহর’ বেটা? সাহস থাকে বলতো দেখি? আর বলতে না পারলে এ’পাড়ায় চিরদিনের মত তোর আসা বন্ধ হয়ে যাবে বলে দিলুম।”
দুলাল এবার আরও গলার স্বর চড়িয়ে বলল, “কেন পরেশের বউকে তুই বিপত্তারিনীর ডোর দিয়ে বলিসনি, এটা তুমি হাতে বেঁধে নিও। তোমার কোন বিপদ হবে না। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমরা গোপনে শীতলা টকীজে সিনেমা দেখতে যাব। আবার পরেশের বউ যখন ঘাটে চান করতে যায় সেই সময় তোরও চান করা পায়। পিট পিট করে হেসে তুই গিয়ে ঘাটের সামনে এসে দাঁড়াস। মেয়েরা ঘাটে চানে গেলে পুরুষরা কেউ যায়? যায় না। পরেশের বউ অনেকদিন তোকে বারণ করেছে। শুনিসনি। একদিন পরেশ আছোলা বাঁশের লাঠি নিয়ে তাড়া করতে তুই পাঁইপাঁই করে ছুট মেরেছিলিস। মনে আছে সেই কথা? এখন তো বলবি, সব মিথ্যে কথা। যেহেতু পরেশ এখন জেলে। আরও বাকি আছে। এটা তো সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। তখনই পাড়ার কয়েকজন সেটা দেখে ফেলে। যারা দেখেছে তাদের অনেকে এখানে আছে। পাড়ার মায়েদের জনা দুই জানে। তাদের আমি নাম বলতে চাই না। পরেশ আমাকে ওর কীর্তির কথা গল্প করেছে তাই জানি। ভোরবেলা পরেশের বউ দক্ষিণমাঠে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়েছে। মেয়েরা তো লজ্জার মাথা খেয়ে আলো-অন্ধকারের ভোরে কাজ সারতে বাধ্য হয়। সেটা চৌকীতে থেকে ওই বেটা মিত্তুনে পরেশের বোয়ের পথ আটকায়। পরেশের বউ কোন উপায় না দেখে চেঁচাতে শুরু করে। সেসময় দূরে কাছে থাকা অন্য মেয়েরা চেল্লাচেল্লি করতে মাঠঘেঁষা বাড়ি থেকে লোক হাঁক পাড়তে ইজ্জৎ-চোরটা এক ছুটে পগার পার। পরেশ সেসময় ঘটনাটা আটচালায় তুলতে পারতো। কিন্তু এখানে নিজের বউকে নিয়ে ঘটনা। তাছাড়া ওই মিত্তুন বেটাকে তাহলে গ্রামছাড়া হতে হবে। তাই, তা না করে ওকে একদিন ডেকে পরেশ শেষবারের মত সাবধান করে দিয়েছিল। আর যেহেতু পাড়ার সামান্য দু’চারজন জেনেছে তাই ব্যাপারটা সবাই চেপে যেতে রাজি হয়। চোরের মা’র বড় গলা! আমাকে খেপিয়েছে। আমি ছেড়ে দেবো?”
দুলালের কথায় তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল মিত্তুনে, “তোকে শালা প্রমাণ দিতে হবে। নাহলে আমি তোকে ছাড়বো না। তুই আমাকে চিনিস না।” এবার মাতব্বররা মিত্তুনেকে থামতে বলল। রতন বলল, “দুলাল যে কেচ্চার কথা মিত্তুনের বিরুদ্ধে তুলল আর যাদের জড়িয়ে ব্যাপারটা, পাড়ায় তারা তো কেউ নেই। অতএব মিত্তুনের কেসটা আটচালার আড়কাঠে তোলা রইল। পরেশের বউ কোনদিন না কোনদিন তো গ্রামে ফিরবে। সেসময় কেসটা তোলা হবে। সে যদি অভিযোগ জানায়, তখন মিত্তুনেকে শাস্তি পেতে হবে। পরেশের বউকে শুধু ব্যাপারটা মুখ ফুটে বলতে হবে। কোন প্রমাণ দেবার দরকার নেই। তার মুখের কথাই সব। কেননা কোন মহিলা নিজের চরিত্রহনেন কথা পাঁচকান করে না যতক্ষণ না তা ঘটে। এতবড় অভিযোগ সবার সামনে তুলেছে দুলাল। এটা চাড্ডি কথা না।”
এবার দুলাল বলল, “আমার যে মূল বক্তব্য ছিল তার কি কোন উত্তর পাবো?” দুলালের কথায় রতন-নন্দদের পাশে বসা অন্য মাতব্বররা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা চালাচালি করল। তারপর রতন বলল, “একটা বিশেষ যুক্তিতে সভা পরেশের বউকে গ্রামছাড়ার নিদান দিয়েছিল। তখনকার সিদ্ধান্তটা একদম ভুল তা আমরা মানছি না। দেখতে দেখতে তা বছর গড়িয়ে গেল। এখন মন হচ্ছে সেই শাস্তি তুলে নেওয়া যেতে পারে। তা পরেশের বউ যদি তার বাচ্চাকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চায় ফিরতে পারে। আটচালা আর বাধা দেবে না।”
দুলাল-মদন মিটিংস্থল ছেড়ে চলে যেতে কিছুক্ষণ সব চুপচাপ হয়ে যায়। কিন্তু মিত্তুনকে, দুলালের ওপর রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে দেখা যায়। ওকে কেউ আমল না দিয়ে রতনরা তাদের আজকের মূল বিষয়টা আলোচনার কথা তোলে। রুইদাস তথা মুচিদের জীবিকার মূল উপায় হল ভাগাড়ে পড়া গরুর চামড়া ছাড়িয়ে নানান পদক্ষেপের মাধ্যমে চামড়ার জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরী করা। সেই চামড়া ওরা মরা গরুর শরীর থেকে বার করতে যে ছুরি ব্যবহার করে সেটা তাদের কাছে লক্ষ্মী-পয়মন্তর। সেই জন্যে ওরা বাবা বিশ্বকর্মার কাছে সেই ছুরি সমর্পণ করে পুজো দেয়। আশীর্বাদ চায় যাতে সেই ছুরি সম্বচ্ছর সচল থাকে। এটা ওরা, মুচি-চর্মকার নির্বিশেষে মেনে চলে। এককথায় ওই অস্ত্র তারা ভগবানের কাছে নিবেদন করে থাকে। সেই ভগবান নিবেদিত বস্তুটাকে নিয়ে যদি কোন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে তা হবে নিতান্তই গর্হিত কাজ। এ কাজের কোন ক্ষমা নেই। এই কাজ করা মানে বাবা বিশ্বকর্মার সঙ্গে প্রতারণা করা। ভগবানের সঙ্গে যে প্রতারণাটা করল আমাদের ওই পরেশ রুইদাস। পরে হয়তো তার অনুশোচনা হয়েছে। কিন্তু তির একবার ছোড়া হয়ে গেলে তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। ভুলের মাশুল তো তাকে গুনতেই হচ্ছে। মাতব্বরদের নির্দেশমত রতন কথাগুলো সভায় বলে গ্রামবাসীর এ বিষয়ে কারোর যদি আর কোন পরামর্শ বা বক্তব্য থাকে তা বলতে বলল। বিশু বলল, “বিপদের সময় নিজের জান বাঁচাতে হাতের কাছে যদি কিছু না পাই তো ঠাকুরের কাছে অচ্ছগ্য করা এই ছুরি তো আমরা ব্যবহার করতেই পারি। এতে তো কোন অন্যায় হওয়ার কথা না।” সঙ্গে সঙ্গে নন্দ বলল, “আলবাত অন্যায়। আমাদের কোমরে ছুরিটা সবসময় গোঁজা থাকে আমাদের রুজির কারণে। যাদের এই পেশা নেই তারাও কি আত্মরক্ষায় এমন অস্ত্র ট্যাঁকে গুঁজে রাখে? রাখে না। অন্য সব মানুষই তো অস্ত্র ছাড়াই চলে। আমরা কি এমন তালেবর হয়ে গেলাম যে সবসময় প্রাণ সংশয়ে কাটাতে হয় আমাদের? ওসব অজুহাত তুললে চলবে না। যে এই নির্দেশ মানবে না তাকে শাস্তি পেতে হবে। পরেশের থেকেও কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আর তা দেবে এই আটাচালা।” রতন তখন নন্দর কথার রেশ ধরে বলল, “এই বিধিনিষেধ না মানা হলে আমাদের সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। দেখতে পাচ্ছি ইদানিংকালের ছেলেপুলেদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব খুব। কাউকে সহ্য না হলে কথায় কথায় হাত তুলে বসে। এবার তাদের হাতে যদি এমন কোন অস্ত্র থাকে তো তারা সাতপাঁচ না ভেবেই সেই অস্ত্র ব্যবহার করে বসবে। ‘খুনি সমাজে’র তকমা মানুষ দেগে দেবে আমাদের সমাজটার উপর। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সময় থাকতে রাশ টেনে ধরা দরকার।”
এমন বিস্তর আলোচনার মধ্যেই পরেশের হাতে খুন হওয়া রাধাকান্ত ঋষিদাসের ছেলে নিত্যানন্দর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার খুনি, পরেশকাকুর স্বীকার করা কথাগুলো! কিভাবে তাদের দু’জনের ঝগড়া শুরু আর পরেশ তার পেটে ছুরি চালালো। নিত্যানন্দর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। গামছার খোঁট দিয়ে তা শুষে নিয়ে সে বলল, “পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার সময় পরেশ কাকু মায়ের হাত ধরে বাবাকে খুন করার ঘটনার সবটাই কবুল করে বলেছিল, “সেইসময় ওদের দু’জনের মধ্যে ভয়ানক কথা কাটাকাটি চলছে। কেউ কাউকে রেয়াত করছে না। কেন যে নিত্যানন্দ তার উপর অতটা রেগে গেল তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। আসলে ও এমন নোংরা নোংরা গালাগাল তাকে দিচ্ছিল, সে মেজাজ ধরে রাখতে পারেনি।” কথা শেষ করতে দিল না পুলিশ। হেঁচকা টান দিয়ে প্রিজনভ্যানে তুলে নিল পরেশকাকুকে।”
[আট]
সময়টা পৌষ মাস। ভরভরন্ত শীত। প্রথম কাটের খেজুর গাছের রসের তখন স্বাদই আলাদা। ভোর পাঁচটার মধ্যে পরেশ রুইদাসের দাবায় লাইন পড়ে যায় তীব্র মিষ্টি স্বাদের সুগন্ধী খেজুর রস খাবার জন্যে। প্রতি গ্লাস দাম তিন টাকা। তাতেই পরেশ খুশি। এ’বছর আট আনা বাড়িয়েছে। নাহলে গত বছর আড়াই টাকা গ্লাস বেচেছে। এই ভিড়কে সামাল দিতে পরেশ তাই সূর্য ভোরের আলোর ফোকাস ফেলার আগেই হেঁসো নিয়ে বেরিয়ে যায় খেঁজুর গাছের রস নামানোর জন্যে। দিন শুরুর আগে এটা তার বাড়তি আয়। যদিও মরসুমী আয়। তাতে কি। সম্বচ্ছরের মাস তিনেক এই বাড়তি আয় বা আসে কোত্থেকে। এপাড়ায় আরও অনেকে পরেশের মত খেঁজুর রস বেচে। কেউ আবার রস তাওয়ায় ঢেলে তাতারসি বিক্রি করে, কেউ নলেন গুড়। যে যেটায় স্বচ্ছন্দ। তবে রস বিক্রি করতে গেলে ওই ভোর ভোর। সুর্য উঁকি মারলেই সেই সুস্বাদু রস থেকে গাঁজা বেরিয়ে তাড়ির বিটকেল গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে। তখন আবার সেটা নেশার বস্তুতে পরিণত হয়। মাতাল যারা হতে চায় তাদের কাছে এই তাড়ির আকর্ষণ আলাদা। তবে পরেশদের মত এই খেঁজুর রসের শিউলিরা তাড়ি বানায় না। বউ ছেলে নিয়ে ঘর-সংসারে ওই মাতালদের আনাগোনা পরেশের একদম অপছন্দ। তাড়ির গন্ধ শুরু হবার লক্ষণ হলেই ও তাওয়ায় ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে নলেনগুড় বানিয়ে নেয়। রস থেকে গুড় তৈরী করে আবার তা বিক্রির জন্যে হাটে বাজারে নিয়ে যাওয়া বা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে হয়। বড্ড সময় নষ্ট হয়ে যায়। পরেশের তাই একঝটকায় কাঁচা রস বিক্রি করাটাই বেশি পছন্দের। এই পছন্দের কাজ করতে গিয়ে তাই সে রোজ ভোর জেগে ওঠার আগেই শীতের ঘন কুয়াশা ভেদ করে বিড়ির মুখে আগুন ধরিয়ে খক্ খক্ করতে করতে চলে রসের ভাঁড় নামাতে। বারোখানা গাছ সে কাটে। এক দফে ছ’খানা তিন দিন পর দ্বিতীয় দফে ছ’খানা। খেঁজুর রস জোগাড়ের এটা নিয়ম, পরপর তিন দিন গাছের শরীরের মাস হেঁসো দিয়ে পাতলা করে কেটে সংগ্রহ করার পর তাকে জিরেন দিতে হয়। সেইসময় আর তার শরীরের আঁশ কাটা হবে না। আবার তিন দিন পর। এই তিন দিন জিরেনের পর চারদিনের মাথায় যখন প্রথম গাছে আঁশ কাটা হয় তাকে জিরেন কাটের রস বলা হয়। এই রসের স্বাদ বাকী দু’দিনের রসের থেকে অন্যরকম সুস্বাদু এবং তার নলেন গুড়ও সমানভাবে সুস্বাদু ও সুগন্ধী। এইভাবে বসে না থেকে পাল্টাপাল্টি করে গোটা শীত মরশুমটা কাজ চালাতে পারে।
সেদিন রাত-ভোরের কুয়াশা ভেদ করে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পরেশ খেঁজুরের রস নিতে ব্যস্ত। চারটে গাছের রস ততক্ষণে একজায়গায় করা হয়ে গেছে। ভোর একটু একটু করে আড়মোড় ভেঙে জেগে উঠতে উদ্যত। হঠাৎ কুয়াশা ফুঁড়ে আসমানের আবছা আলোয় দেখতে পায় দৌলতপুরের চড়ার ধারের বটগাছের মাথায় তারা দল বেঁধে চক্কর মারছে। কেউ কেউ বটের মগডালে খানিক বিশ্রাম নিতে নিতে জমিনের দিকে ইতিউতি নজর ফেলে আবার উড়তে শুরু করেছে। ওরা যেন পরেশদের নিশান উড়িয়ে জানাচ্ছে, ভাগাড়ে খাবার এসে গেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসে তোমাদের খাবারটা নিয়ে যাও। তারপর আমরা আমাদের দায়িত্ব বুঝে নেব। তোমরা তোমাদের কাজ না সারলে আমরা দায়িত্ব বুঝে নিতে এগোতে পারছি না।
নিশানা দেখা মাত্র পরেশ খেঁজুর রস সংগ্রহের কাজে জলাঞ্জলী দিল। এতক্ষণের জোগাড় করা রসের বড় কলসিটা একটা খেঁজুর গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে দিল। গাছ কাটার হেঁসোটা গাছের গায়ে কোপ মেরে সেঁটে বসিয়ে রেখে চুপিসাড়ে দে-দৌড়! একবারও ভাবার চেষ্টা করল না যে যারা রোজ ভোরে ওর কাছে খেঁজুরের রস খেতে আসে তারা অপেক্ষা করে আছে। ওর মুখ দেখার আশায় হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশায় থেকে থেকে একটা সময় হতাশ হয়ে পড়বে। এদিকে খদ্দেরদেরও চিন্তা বাড়তে থাকে পরেশকে নিয়ে। কোনকিছু বিপদ হ’ল নাকি পরেশের! রস পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে-টড়ে যায়নি তো? অথবা অন্য কোন বিপদ! এক এক জন এক এক রকম ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ চলেও গেল। অন্য কারোর কাছে যদি খেজুর রস পাওয়া যায়। পাল পাড়ার পড়শী, নিতাই কিন্তু পরেশের দাওয়ায় বসে থেকে থেকে ভাবল পরেশ যে গাছগুলো থেকে রস পাড়ে সেখানে গিয়ে দেখলে কেমন হয়? যা ভাবনা তাই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালো সেদিকে। নিতাই গিয়ে দেখে একটা খেঁজুর গাছের গায়ে বড় রসের ভাঁড়টা ঝুলছে। আর একটা খালি ভাঁড় তার গোড়ায় পড়ে। হেঁসোটা সেই গাছের গায়ে কোপ মেরে আটকে রাখা। অন্যকিছু ভাবার আগে মাতাল নিতাই আশপাশটা একবার দেখে নিল কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না। কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে পাশেই একটা পেঁপে গাছ থেকে পেঁপের ডাগ কেটে তার ডগা থেকে পাতার দিকটা ছিঁড়ে সেই ডাগের নল রসভর্তি কলসিতে চুবিয়ে চোঁক চোঁক করে মনের সুখে পেট ভরে জিরেন কাটের রস খেয়ে নিল। রসে পেট মোটা করার পর মনে পড়ল পরেশের খোঁজের কথা। এই সব ফেলে কোথায় গেল বেটা মুচির বাচ্চা কে জানে! এ শালাদের কোন ভরসা নেই। কখন যে কোথায় পট করে হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চয়ই শালা ভাগাড়ে কোন গরু পড়ার গন্ধ পেয়েছে। এছাড়া আর কোথায় যাবে। অবশ্য জোর হাগা পেতেও পারে। তাড়ি খেয়ে খেয়ে পেট গরমে আমাশা বাঁধিয়েছে। তাই হাগার বেগ সামলাতে না পেরে মেরেছে ছুট। অনেকটা রস সে খেয়ে ফেলেছে। পরেশ ব্যাটা হেগে পেট খালি করে এসে যদি দেখে তার কলসির রস খোলে পড়ে আছে, তাহলে তাকে সন্দেহ করতে পারে। ও আসার আগে কেটে পড়াই ভাল। সেই চিন্তা করে নিতাই সেখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ যদি দেখে ফেলে তো তাকে সন্দেহ করতে পারে। পরেশ এসে রস চুরি গেছে বলে চেল্লাতে থাকলে সে তার নাম পরেশকে বলে দিতে পারে।
রাধাকান্ত ঋষিদাস দিঘিরপাড় বাজারে রাতে অমিত-মুদির দোকান মোনে। ও অমিত মুদির খুবই বিশ্বস্ত। তাই রাত্রে ওর হাতে অতবড় মুদি দোকানের সব ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়িতে বোয়ের পাশে ঘুমোতে পারে। বিনিময়ে রাধাকান্তর মাসের বেনে বাজারের প্রায় সব দায় নিয়ে নেয় অমিত-মুদি। এই তো প্রায় পঁচ বছর গড়াতে যায় রাধাকান্ত এইভাবে আছে। কেউ কোনদিন ওর বিরুদ্ধে কথা তোলেনি। অমিত-মুদিও তেমন খারাপ কিছু ওর মধ্যে দেখেনি।
ওই ভোরে রাধাকান্তর জোর পেচ্ছাপ পায়। পেচ্ছাপ করে ফিরতে গিয়ে নজর আটকায় সেই আকাশ-নিশানায়! সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘুমন্ত তেজহীন শরীর চনমনিয়ে ওঠে! ঝিমিয়ে থাকা সারা শরীরের রক্তগুলো যেন চিলিক খেয়ে ঠেলা মারতে থাকে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। বাজার তো তখন সুনসান। দোকান ছেড়ে যাওয়াটা কি তার ঠিক হবে? যদি চোরবেটা সুযোগ বুঝে কোপ মারার ধান্ধা করে! তখন তো তার সর্বনাশ, অমিত মুদির সাড়ে-সর্বনাশ। ওই চোরবেটাগুলো সব সময় তক্কে তক্কে থাকে। কারোর অসাবধানতার সুযোগ কাজে লাগাতে ওরা ওস্তাদ। সে এখন কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে দোকানে ঢুকে খিল-তাড়া মেরে চিৎ হয়ে শুয়ে কপালে দু’হাত ঠেকনা দিয়ে ভাবতে থাকে। খানিক পর বাঁ পাশ ফিরে হাতের কব্জিতে ঘাড় তুলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। কোনদিকে চেয়ে আছে তা সে নিজেও জানে না। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে। ঘাড় কনকন করছে। আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। তবু কিছুতেই যেন বুদ্ধিটা বার করতে পারছে না এখন সে কি করবে! হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসল। এবার আর সাতপাঁচ না ভেবে দোকানের বড়বড় দুটো তালা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বাজারের রাস্তার এদিক ওদিক ভাল করে চোখপেড়ে দেখে নিল। সন্দেহের তেমন কিছু দেখতে পেল না। তাড়া লাগিয়ে তালা দুটোর একটা দরজার মাথায় লাগানো শেকলে আর একটা দরজার বালায় লাগিয়ে দিয়ে মারল ছুট! ছুটতে ছুটতে কোমরে হাত দিয়ে দেখে নিল জীবনসঙ্গী ছুরিটা আছে কি না।
পরেশের জিরেনকাটের খেজুর-রস চুরি করে খেয়ে ফিরতি পথে নিতাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রুইদাস পাড়ার দু’জনের সঙ্গে। ওরাও পরেশের ওখানে গিয়েছিল রস খাওয়ার জন্যে। না পেয়ে অন্য ঠেকে তাড়ি খেয়ে ফিরছিল। নিতাইকে দেখে বলল, “কিরে নিতাই, পরেশ এসেছে রস নিয়ে? এত বেলায় ওটা তো আর রস নেই। গেঁজলা উঠে তাড়ি হয়ে গেছে। আমরাও তাই খেলাম। তাড়ির নেশায় বেশ ভাল ঘোর লেগেছে রে। চুল্লুকে মনে হচ্ছে হার মানাবে।” ওদের কথার উত্তরে নিতাই, পরেশের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “হুঁ, কোথায় চুল্লু আর কোথায় তাড়ি। আকাশ আর পাতাল। তোরা তাহলে সেই চুল্লু কোনদিন গলায় সেঁধাস নি। আমার সঙ্গে একদিন যাস ননী-শুঁড়ির ঠেকে। বুঝতে পারবি নবাবী-চুল্লু কাকে বলে। তুই কে আর সিরাজদৌল্লা কে ফারাক করতে পারবি না। চলি রে। আর তোদের সঙ্গে গজালি করলে চলবে না। ওদিকে কাজে হাজিরা দিতে দেরি হয়ে যাবে। দেরি হলেই বড্ড খ্যাচর খ্যাচর করে ওই শালা মালিকটা।”
নিতাই চলে যেতেই ওদের দু’জনের, নোচে আর বিন্দের খেয়াল হল। নোচে বলল, “আরে, নেতাই শালা বলে গেল না তো পরেশ এসেছে কি না? তাহলে ওর কাছ থেকে দু’পাঁট তাড়ি খেয়ে যাওয়া যেত।” উত্তরে বিন্দে বলল, “চল না, রাস্তা থেকে তো পরেশের উঠোন দেখা যায়। ও বাড়ি ফিরলে দেখতে পাবো।”
না। তখনও শালা পরেশের দেখা নেই। বাড়ি ফেরেনি শালা। গেল কোথায় তবে? সেই ভোরে রস কাটতে গিয়ে কোথায় উধাও হ’ল বেটা? বিন্দে আওড়াতে লাগল। নোচে এবার থমকে দাঁড়াল! হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে পরেশ উধাও হবার রহস্য। তোর চোখের দূরবীনটা ঘোরাতো বিন্দে সেই দৌলতপুরের চড়ার ধারে খেলার মাঠের বটগাছটার দিকে। কি নিশানা দিচ্ছে গাছ বেটা! চোখ তোর নেশায় ঘোলাটে হয়ে আছে। ভাল করে শক্ত হয়ে দূরবীনটা ফেল। তবে স্পষ্ট হবে।”
এবার বিন্দে তার ডান হাতটা নোচের ঘাড়ে চেপে ধরে কাছে টেনে এনে বলল, “ওই দেখ, দেখ? আমি একা বললে তুই বলবি আমার চোখ ঘোলা। এবার তোর সাদা চোখে দেখ। ব্যাপারটা হচ্ছে কি ওদিকে!”
সঙ্গে সঙ্গে নোচে আর বিন্দে লুঙ্গী হাফ করে গুটিয়ে বেঁধে নেয়। কোমরে গোঁজা ছুরিটাকে আর একবার পেঁচিয়ে শক্ত করে আটকে টলমল পায়ে দৌড়ানোর ঢঙে এগোতে লাগল। ইটের হোঁচট খেয়ে, বিন্দে ঠাকুরের মানত করা দন্ডী কাটার মতো সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টলমলে নোচে তার হাত ধরে উল্টোদিক দিয়ে টেনে তুলতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিন্দে গালাগাল দিয়ে বলে, “এই শালা গোহর বেটা। উল্টো দিক দিয়ে হাত ধরে টানছিস, আমার হাত তো খুলে যাবে দাবনা থেকে। লাগছে। ছাড় ছাড়। ভীষণ লাগছে! ততক্ষণে বিন্দের নেশা ছুটে গেছে। নেশামুক্ত বিন্দে বলে, “আমরা শালা এমন গাধির বাচ্চা সে আর কি বলব। শুধুমুধু ছুটতে গিয়ে আহত হলাম। পরেশ শালা কোন ভোরে ওই নিশান দেখে রস নামানো ফেলে ছুটেছে। এতক্ষণে তার গরুর ছাল ছাড়িয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির ফেরার সময় হয়ে গেল। একটু এগোলেই হয়তো আমাদের মুখোমুখি হবে সে। আর ওদিকে পা বাড়িয়ে লাভ নেই। বাড়ি ফের। আটচালায় গিয়ে গজালি করি। কাজের কাজ হবে।”
কোমর সমান পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়াল দিয়ে গাঁথা আটচালা। সেটা প্লাস্টার করে মেঝে সমেত সিমেন্ট দিয়ে মাজা। আগে এসব ছিল না। কিন্তু এদিক ওদিক ঝোপঝাড় থেকে যখন তখন সাপ-বিছে বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে বর্ষাকালে। সাপের কামড় থেকে অনেকে অনেকবার বেঁচে গেছে মা মনসার কৃপায়। তারপর সিদ্ধান্ত হয় ওটা ঘিরে দেবার। নোচে-বিন্দে সেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দু’পা সামনে খেলিয়ে গজালি করতে করতে বিন্দেই কথাটা তোলে, “জানিস নোচে এবারে মিটিংয়ে এই ব্যাপারটা তুলতে হবে। যে শালা আগে নিশানা দেখবে গরুর চামড়া তার দখলে! আশ্চর্য! এটা একটা নিয়ম? এ তো কালা আইন। কে আগে নিশান দেখল, তা সাব্যস্ত করবে কে? দু’টো লোক যদি দু’ জায়গা থেকে দেখে? বুঝবে কি করে কে আগে দেখেছে? অনেক দিন থেকে এই নিয়ে গজগজ করছি। কোন শালা মাথা ঘামাচ্ছে না। যেদিন একটা বিশাল কেচাল হবে, সেদিন মাতব্বর শালাদের টনক নড়বে। তুই দেখবি, কেচাল একটা হবেই হবে। কেউ না বাধালে, আমি শালা নিজে বাধাব। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে আজ আমার খুব লেগেছে। তাও লাগাটা ভুলে যাওয়া যেত যদি চামড়াটা আমাদের দখলে আসতো। কিছুই হল না। শুকনো শুকনো ঝাড় খেতে হল।”
বিন্দের কথায় নোচের যেন কোন ‘গা’ নেই। তাড়ির নেশা তখনও তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বিন্দে বকবক করছে আর নোচে কখন নেশার ঘুমে ঢলে পড়েছে। হঠাৎ বিন্দে লক্ষ্য করে নোচে বেটা নাক ডাকছে, “ধুর-শালা। কাকে রাম-নাম শোনাচ্ছি। এতক্ষণ তাহলে ভষ্মে ঘী ঢাললাম! হারামি-শালা নোচে কোথাকার! তুই শালা যখন ঘুমোচ্ছিস, আমিও বকর বকর করে শক্তি ক্ষয় করি কেন। আমিও গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাই রাজকুমার-রাজকুমারীর পরীর দেশে! সুন্দরী সুন্দরী পরীদের সঙ্গে জলকেলি করি।”
মঙ্গলবার বড়বাজারে দোকানের মাল গস্তের দিন। তিরাশি রুটের ফার্স্ট বা সেকেন্ড বাসে করে যেতে হয় বাজারে। অমিত মুদি তাই এ’দিন সকালে আলো ফোটার আগে আগেই বাজারে চলে আসে। রাধাকান্তকে ঘুম থেকে তুলে বাজারের ঢাউস চারখানা ব্যাগ নিয়ে টাকা পয়সা ঠিকঠাক ট্যাঁকে সাইজ করে তৈরী থাকতে হবে, বাসের জন্যে। একটু দূরে রাস্তার ওপার থেকে দোকানের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে অমিত মুদির! দোকানে বাইরে থেকে বড় বড় দুটো তালা ঝুলছে! দোকানের দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাধাকান্ত কোথাও গেছে, না কি! না আদৌ সে গত রাত্রে শুতে আসেনি? ওঁ-হুঁ! তা তো হবার নয়। অমিত নিজে রাধাকান্তকে দোকানের ভেতর থেকে দরজায় খিল দেবার শব্দ শুনে তবে ঘরে গেছে। এটা একদম ভুল কথা না। তাহলে ও তালা ঝুলিয়ে গেল কোথায়? ও তো জানে আমি আজ গস্তে যাবো। সকাল সকাল দোকানে আসব। জেনেও এভাবে বেআক্কেলের মত চলে যাওয়া তো ঠিক করেনি! যাবে যদি বলতে পারতো। আমিই না হয় একটা রাত দোকানে কাটাতাম। এখন সময় বয়ে যাচ্ছে। ফার্স্ট বাস আসার সময় হয়ে গেল। ওটা যে ধরা যাবে না তা সে নিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু সেকেন্ডটা না ধরতে পারলে তো আজ গস্তে যাওয়াই যাবে না। এটা সেটা অনেক মাল ফুরিয়ে গেছে। সারা সপ্তা তাহলে দোকান সে চালাবে কেমন করে? এ রকম ফ্যাসাদে তো সে কখনো পড়েনি। কি বিপদ দেখো দিকিনি! এখন সে কি করে? কোথায় গেল রাধাকান্ত বোকাচোদাটা! মুখ খারাপ কি এমনি এমনি আসে। ওদের আচরণে আসে। মুখ খারাপের কাজ করলে তো গালাগালি খেতেই হবে। রাগে গা গজগজ করছে তো কি করবে। কৃষ্ণনাম জপবে? তারা বৈষয়িক মানুষ। অত মহান এখনো হতে পারেনি। এসব সাতপাঁচ নিজের মধ্যে গজরাতে গজরাতে পাশে মোহনের সেলুন দোকানের দিকে এগোয়। মোহন ঘুম থেকে উঠে দোকান ঝাঁট দিয়ে ধূপধূনো দিচ্ছে। সেকেন্ড বাসটা আসতে এখনো আধঘন্টা দেরী। গোহরবেটা রাধাকান্তর জন্যে ততক্ষণে ওখানে বসে মোহনের সঙ্গে দু’চারটে কথা বলতে বলতে অপেক্ষা করবে আর কি।
ভাগাড় থেকে তখনো দশ-পনেরো ধ্বজি দূরে পরেশ। ঘন কুয়াশা ভেদ করে চোখে পড়ছে ছায়ার মত একটা মানুষের আকার নড়াচড়া করছে। একবার নীচু হয় আবার খাড়া হয়! আর একবার তাদের গ্রামের রাস্তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে আবার যে কাজটা করছে সেদিকে মুখ ঘোরায়! চলকে ওঠে পরেশের বুকের রক্ত। ধকপক করে উঠছে ভেতরটা। লোকে বলে ওখানে নাকি মানুষের হৃদপিন্ড থাকে। হৃদপিন্ড মানুষকে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালিয়ে বাঁচতে সাহায্য করে। ওখানে চাপ পড়লে ও এইরকম ছটপট করতে থাকে। তাই এই ধকপকানিটা হচ্ছে। এসব ব্যাখ্যা পাশে সরিয়ে টানটান করে পরেশ এগিয়ে চলে ভাগাড়ের দিকে! অতসব ডাক্তারি কেতা জেনে তার কি লাভ? কোন্ শালা ওটা আগে তাকে দেখতে হবে। সে যখন নিশান দেখেছে তখন পৃথিবী পড়ন্ত রাতের ঘুমে মশগুল। কোনো ‘খানকির বেটার’ পক্ষে সম্ভব নয়, এই পরেশ রুইদাসের আগে নিশানটা দেখার।
রাধাকান্ত খুব ভাল করে জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পাড়ার দিক থেকে কেউ না কেউ আসবেই। শীতের মরশুমে এই ভোরের আলো-আঁধারে অনেকেই খেজুর-রস পাড়তে আসে। আর একটু পরেই বাহ্যে ফিরতে মাঠে ঘাটে সব বার হয়। খেঁজুর গাছে যারা উঠবে তারা সবথেকে আগে নিশান লক্ষ্য করতে পারবে। সেই হিসেবে কেউ না কেউ আসবেই। তাই মাঝে মাঝে ইতিউতি তাকায় আর গরুর ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে!
হিসেব মত খেঁজুর গাছে চড়ে যে নিশান দেখতে পাবে সেই সবার আগে দেখবে। তাদের গ্রাম উজিয়ে এতটা পথ আসতে তো অনেকটা সময় কেটে যাবে। সেই তুলনায় বাজার থেকে ভাগাড়ের দূরত্ব গ্রামের রাস্তার তুলনায় সিকি ভাগ। পাড়ায় দাঁড়িয়ে যে দেখবে, বাজার থেকে তার অনেকটা পরে দেখেও পাড়ার থেকে আগে চলে যেতে পারবে। এই কম দূরত্বের সুযোগটা যে রাধাকান্ত নিয়েছে, তা সে খুব ভাল করে জানে। কিন্তু চামড়ার লোভ। যেন যুবতী বোয়ের যৌবনের প্রতি লালসার থেকে এই গরুর চামড়ার লালসা মুচিদের কাছে আরও অনেক বেশি। লাথি-ঝেঁটা মারলেও বউ সহজে হাতছাড়া হয় না। স্বামীর কাছেই মাথা গুঁজে টিকে থাকে। আর চামড়ার ক্ষেত্রে মুহূর্তের হিসেবের গরমিলে পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই রাধাকান্ত সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর। কেউ তাকে আটকাতে এলে সে মিথ্যা কথাই বলবে, “সবার আগে সেই নিশানা দেখেছে। পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে ভোরের কুয়াশার আলো আঁধারিতে তার আগে কেউ নিশান দেখতে পারে না। কেননা, বাজার থেকে এই ভাগাড়টা অনেক কাছে। তাদের পাড়া থেকে এতটা দূরে তো দৃষ্টি পাতা যাবেই না। কুয়াশা সব আকাশকে গিলে বসে আছে।”
পরেশ ভাগাড়ের কানাচে আসতেই এতক্ষণের যত্তসব কুয়াশা যেন পগার পার! পরিস্কার দেখতে পেল তাদের পাড়ার রাধাকান্তকে? এই শুয়োরের বাচ্চা রাধে, তুই আমার আগে কোত্থেকে এলি? নিশান আমার আগে কেউ দেখবে, তা পারে না। আর তোর এতবড় সাহস, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তুই গরুর চামড়া ছাড়াতে শুরু করেছিস?”
পরেশের কথায় আমল না দিয়ে রাধাকান্ত যেন নির্বিকারে চামড়া ছাড়ানোর কাজটা করে যাচ্ছে। পেছন থেকে রাধাকান্তর পোঁদে সজোরে একটা লাথি কসালো পরেশ! মরা গরুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাধাকান্ত। পড়ে গিয়ে রাধাকান্ত আহত তো হলই তার উপর ভয়ও পেল! কোনরকমে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ও ভাবতে লাগল, পরেশ এমন বদ মেজাজী তো কোনদিন ছিল না! আজ হঠাৎ এত মারমুখী হয়ে গেল কেমন করে? পাড়ায় কারোর সঙ্গে কোনদিন জোর গলায় কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করেনি। অবাক হল ওর এই স্বভাববিরুদ্ধ রূপ দেখে। তবু চামড়ার লোভ মুচিদের মন থেকে যাবার নয়। মার খেয়ে ভয় পেলে ও তাকে আরও চেপে ধরবে। রুখে তাকে দাঁড়াতেই হবে।
পরেশ আবার রাধাকান্তকে লাথি কসিয়ে নিশ্চিন্ত রইল না। কিছুটা থমকে গিয়ে সেও জোর খাটিয়ে গরুটার অধিকার নেবার উদ্যোগ দেখাল না। ও অপেক্ষায় ছিল লাথ খাবার পর রাধাকান্তর দিক থেকে কি প্রত্যুত্তর আসে সেটা দেখার। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। দু’জনেই তো তাদের একান্ত পরিচিত পড়শি। সম্পর্ক তো কোন কারণেই দু’জনের মধ্যে তিক্ত হয়নি কোনদিন। বরং অনেক বেশি স্বাভাবিক। সেই দুই পক্ষ এখন মুখোমুখী। কাঠি-ঘা খাওয়া ক্ষিপ্ত সাপের মত মেজাজী ঢঙে রাধাকান্ত বলল, “তুই আমার পোঁদে অত জোর লাথি মারলি কেন? আমি কেন তোর কথায় উত্তর দিতে যাবো। আমি সবার আগে বটের মাথায় শকুন ওড়ার নিশান দেখেছি। দেখা মাত্রই ছুটে এসে আমার পাওনা গরু চামড়া আমার অধিকারে নিয়েছি। তুই কিছুতেই আমাকে এভাবে মারতে পারিস না। আটচালায় আমি এই অন্যায়ের বিচার চাইবো। তোকে পাড়া ছাড়া করে তবে ছাড়বো। আমার এই অপমানের শোধ আমি তুলবোই। আর এ গরুর চামড়া আমি কিছুতেই তোকে নিতে দেবো না। এটা আমার পাওনা, আমিই নেবো। কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আর তুই তো পরেশ রুইদাস। বেজন্মা জাত। তুই কোন্ ছার।”
জাত তুলে কথা বলতেই পরেশ আরও খেপে লাল হয়ে যায়, “হ্যাঁরে শালা। আমি বেজন্মা জাত। আর তুই কি জাত? তুই বেজন্মা থেকে আবার কবে মুচি হলি-রে শালা।” একটু থেমে পরক্ষণেই আবার পরেশ বলল, “তুই যে বললি শকুন ওড়ার নিশান দেখেই দৌড়ে চলে এসেছিস। হ্যাঁরে বোকাচোদা, বাজার থেকে এই ভাগাড়ে আসতে তড়কো পায়ে বড়জোর মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। এদিকে বলছিস পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে নিশান দেখেই চলে এসেছিস। তাহলে তুই গরু ছোঁয়া থেকে বড়জোর পাঁচ মিনিট আগে নিশান দেখেছিস? আর আমাদের রুইদাস পাড়া থেকে এখানে আসতে বারো মিনিট লাগে। আমি এসে দেখলাম তুই সবে গরুর গায়ে খান দুই চ্যাঁ দিয়েছিস। তার জন্যে দু’মিনিট ধর। তাহলে ওদিকে পাঁচ আর এদিকে দুই। মোট সাত মিনিট তোর দিকে। আর আমার দিকে বারো মিনিট। এখন হিসেব কি বলে? তোর থেকে পাঁচ মিনিট আগে আমি নিশান দেখেছি। এবার তুই শালা অঙ্কে মেলা? কে আগে নিশান দেখেছে? কোন শালা অঙ্কবিদ এসে আমার হিসেবের ভুল ধরতে পারবে না রে শালা শুয়োরের বাচ্চা! মিথ্যে কথা অন্য মুচিকে দেখাবি। এই পরেশ রুইদাসকে দেখাতে আসবি না। এর পর তুই এখান থেকে না কাটলে তোকে আমি শেষ করে দেব বলে দিচ্ছি, রাধাকান্ত!”
-তুই ‘বাল্’কোন হরিদাস রে? তোর ভয়ে আমি কাটতে যাব? তোর ওসব অঙ্ক-ফঙ্ক আমি মানি না। আমি আগে নিশান দেখেছি, আগে এসেছি। এ গরুর অধিকার আমার। বলে রাধাকান্ত পাল্টা একটা ঠেলা পরেশের বুকে মারতে পরেশ উল্টে বসে পড়ে। তার সেই ঠেলায় রাধাকান্তর হাতে থাকা ছুরির আঁচড় পরেশের দাবনা থেকে কব্জি পর্যন্ত চিরে রক্ত বেরোতে থাকে! সঙ্গে সঙ্গে পরেশ তার কোমরে বাঁধা গামছাটা ক্ষতে বেড় দিয়ে চেপে বেঁধে দেয়। মাথায় খুন চেপে যায় পরেশের। দ্বিতীয়বার আর অন্য কোন কথা চিন্তা না করে পরেশ সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাধাকান্তর উপর! ট্যাঁকে গোঁজা গরু ছাড়ানো ছোরাটা চেপে বসিয়ে দেয় রাধাকান্তর পেটে। ছোরাটা বসিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি পরেশ। মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছোরাটা দু’বার পেটের এপাশ ওপাশ চালিয়ে দেয়। গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো পোক্ত হাত নিখুঁতভাবে রাধাকান্তর শরীরে প্রয়োগ করে সে।
ভাগাড়ে এখন দুটো লাশ। একটা গরুর, একটা মানুষের। শকুনদের তো পোয়া বারো। একজন গরুর লাশে বসে তো অন্যজন রাধাকান্তর ভসকানো ভুঁড়ির উপর। ভাগ্য এতটা পয়মন্তর, ‘বিরল’ শকুনদের কাছে। অন্যদিনের থেকে আরও যেন বেশি বেশি শকুন আজ এখানে এসে হাজির হয়েছে। হয়তো ইতিমধ্যে জোড়া খাদ্য ভাগাড়ে পড়ার খবর ওদের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে।
রাধাকান্ত বেয়নে অমিত মুদির বড়বাজারে গস্তে যাওয়া তো ডগে উঠল। কিন্তু এতটা বেলা হবার পরও তাকে আসতে না দেখে অমিতের মনে ‘কু’ ডাকতে শুরু করল। অত ভোরে কোথায় বার হল লোকটা! কতটা বেলা হয়ে গেল এখনো ফিরল না। ওর কোন ক্ষতি টতি হয়ে গেল না তো? সেলুন মালিক, মোহনকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করি বলতো মোহন। দৌলতপুরের ভাগাড়ের দিকে প্রচুর শকুন ওড়াউড়ি করছে। গরু তো নিশ্চয়ই পড়েছে। রাধাকান্ত সেখানে গিয়ে এতক্ষণে ওর ফিরে আসার কথা। ও তো গল্প করে, একটা গরুর চামড়া ছাড়াতে ওদের সামান্য সময় লাগে। তার উপর দোকানের চাবি তার কাছে। সেটা মাথায় রাখলে ওর তো এত দেরি করার কথা নয়!” মোহন পরামর্শ দিল, “তুমি একবার না হয় পা পা করে ভাগাড়ের দিকে যাও কাকা। ওইটুকু তো রাস্তা। এখানে বসে থেকে বেলা করে লাভ নেই। কোলকাতার গস্ত তো ডব্বায় গেল। এবার সারাদিন দোকান খোলাটাই না ডগে ওঠে। ওদিকে না গেলে বুঝতেও পারছো না, কি থেকে কি হচ্ছে। দরকার হলে এখন তোমার রুইদাস পাড়াতেও ছুটতে হতে পারে।”
মোহন নাপিতের পরামর্শ মত অমিত মুদি গুটি পায়ে ভাগাড়মুখো হয়।কিছুটা এগোবার পর পরেশ মুচির মুখোমুখি হয়। তার চেহারা দেখে তো অমিতের চোখ কপালে ওঠার জোগাড় ! এল্টে তোলা কাপড়ের ওপর পাতলা ‘বামুনে’ গামছা জড়ানো। বাঁ হাতের কব্জিতে মোটা করে কাপড় জড়ানো। বোঝাই যায় খোঁজুর রস কাটার হেঁসোর ধার বজায় রাখার জন্যে ঘষতে ঘষতে সাদা কাপড়ের সামনের দিকটা কেল্টে এন্দেকার হয়ে গেছে। এই শীতেও তার লোমঅলা বুকে জড়ানো স্যান্ডো সাদা গেঞ্জী রক্তে লাল হয়ে আছে। অবশ্য পরেশদের মত গাছে-চড়া লোকদের শরীরে এই হাল্কা শীত তেমন কামড় বসাতে পারে না। এল্টেতোলা কাপড়-গামছাও রক্তে ভিজে জবজবে! পরেশের এমন চেহারা দেখে একবার গা-টা গুলিয়ে ওঠে অমিতের! সঙ্গে সঙ্গে ওসব গরুর রক্ত হবে ভেবে নিয়ে নিজেকে সতেজ করে পরেশকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে পরেশ, ভাগাড়ের ওদিক থেকে তো আসছিস। রাধাকান্তকে দেখলি? শালার বেটা শালা সেই ভোরে কখন আমার দোকানের চাবি নিয়ে ভেগেছে, এতটা বেলা হয়ে গেল, এখনো তার পাত্তা নেই? এত ক্যালাস লোক তো জীবনে দেখিনি?” সঙ্গে সঙ্গে পরেশ বলল, “দেখিছি। তুমি দেখো গে যাও। ভুঁড়ি ভসকে ভাগাড়ে মরা গরুর পাশে কেমন পড়ে আছে তোমার গান্ডু দোকান মুননদার, রাধাকান্ত ঋষিদাস!” কথাটা বলেই পরেশ নির্বিকারে নিজের পথ ধরল। অমিত পেছন ফিরে পরেশকে দেখে আর ঠায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে!ক্রমশ…..
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৩)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ পাঁচ ]
দৌলতপুরের মিতালী সংঘ ক্লাব গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তাব মত একটা জরুরী সভা ডাকে। মিটিংটা তাদের ক্লাবের সদস্য এবং গ্রামবাসীদের নিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইমত সভার তোড়জোড়ও শুরু হয়। যেহেতু গাছ কাটার প্রতিবাদটা কেবল গ্রামের মধ্যে থেকে নয়, পাশের গ্রাম, বিশেষ করে বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়া থেকেও প্রবল আপত্তি এসেছিল। তাই কাদের কাদের মিটিং-এ ডাকা হবে সেই নিয়ে আলোচনার সময় ক্লাবেরই এক সদস্য, অসীম নস্কর কথাটা তুলেছিল- বলেছিল,“রুইদাস পাড়ার আটচালার মাথাদেরও উপস্থিত থাকার জন্যে বলা হোক, যেহেতু ওই বটগাছটার পশ্চিমপাশে ভাগাড় আছে। ওই ভাগাড়ে গরু-ছাগল পড়লে ওরা সবসময় মুখিয়ে থাকে তাদের চামড়া নেবার জন্যে। এটা ওদের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন বলে মনে হয় ওদের ডাকা উচিৎ।” অসীমের কথায় তেড়েফুঁড়ে ওঠে ক্লাবের সম্পাদক, সুপ্রভাত সরকার, “কেন, ওরা আমাদের গ্রামের কে? ওদের কিছুতেই ডাকা যাবে না। তাহলে ওরা পার পেয়ে যাবে। ‘সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বার হবার’ চেষ্টা করবে। তারপর অন্য কোন বিষয়ে, হয়তো সেখানে ওরা কোনভাবে যুক্ত আছে, সেখানেও বলবে, আমাদের না জানিয়ে তোমরা কাজটা করতে পারবে না। একদম ওদের পাত্তা দেওয়া চলবে না। নীচু জাত ওরা। পায়ের পাতায় থাকার যোগ্য ওরা। কোনদিন ওদের মাথায় তুলতে নেই। প্রচলিত একটা কথা আছে না, ‘কুকুরকে ‘লায় দিলে মাথায় ওঠে!’
সম্পাদকের যুক্তিটা একদম মেনে নিতে পারেনি অসীম। একটা মধ্যযুগীয় ধারণা নিজের মধ্যে ধরে রেখে কথাটা বলছে লোকটা। মানুষের জাতপাত নিয়ে এমন নগ্ন মন্তব্য মানতে পারল না ও। একটা সম্প্রদায়ের মানুষকে উনি কি না কুকুরের সঙ্গে তুলনা করল! এইসব তথাকথিত উচ্চবর্ণের গেঁয়োদের মানসিকতা কোন্ তলানিতে এসে ঠেকেছে! এখন আস্তে আস্তে রুইদাস সমাজেও শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে। ছেলেরা স্কুল-পাঠশাল যেতে শিখছে। সরকার নানাভাবে ওদের উৎসাহিত করছে বাচ্চাদের স্কুলমুখো করার জন্যে। ওদের পাড়ার কিছু ছেলে-মেয়ে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে। হয়তো ওদের আগের প্রজন্ম মুর্খই ছিল। কিন্তু সন্তানদের মাধ্যমে বড়রা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছে। এইজন্যেই ওরা দৌলতপুরের উচ্চবর্ণ বাবুদের মন থেকে ‘বাবু’ বলে আর ভাবতে চায় না। ক্ষমতাবান বলে ওরা বাবুদের সামনে সমীহ করার মত আচরণ করলেও আড়ালে মোটেই সম্মান করে না। সেটা জনান্তিকে ওদের কথায় কান পাতলে বোঝা যায়। অসীম সম্পাদকের উদ্দেশে বলল, “এই যুক্তিটা কিছুতেই মানা যায় না। সমাজের অন্তজ শ্রেণীর মানুষদেরও মানুষের সম্মান দেওয়া উচিৎ। রুইদাসদের মিটিংয়ে না ডাকার বিষয়ে সম্পাদকের এই যুক্তি সব সদস্য যদি মেনে নেয় তো তাই করবে। তবে একে আমি সমর্থন করতে পারছি না। প্রকাশ্যে আমি সম্পাদকের এই বক্তবের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
সম্পাদকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই প্রথম প্রকাশ্যে কেউ একজন প্রতিবাদ করল! সামান্য একটা উঠতি ছোকরা তার মুখের উপর কথা বলাটা কিছুতেই ঢোক গিলে ভেতরে গ্রহণ করতে পারছে না, সুপ্রভাত সরকার। বমির মত তাই তা উগরে দেবার প্রবণতায় অসীমের উদ্দেশ্যে বলল, “আজকাল কিছু উঠতি ছোকরারা দেখছি ভালই ডানা ঝাপটতে শিখেছে। বড়দের সিদ্ধান্তের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। ওদের ডানা এখনই ছাঁটা দরকার। প্রথম রাতেই বেড়াল না মারতে পারলে সকলকেই পস্তাতে হবে। গ্রামের রাশ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গ্রামে অরাজকতা-অনাচার ছড়িয়ে পড়বে। কোনদিন দেখা যাবে ওই রুইদাস পাড়া থেকে কোন মেয়েকে তুলে নিয়ে নিজের বউ বলে বসবে।”
অসীম দেখল সম্পাদকের এই অন্যায় বক্তব্যের উপর তার এক্ষুণি প্রবল প্রতিবাদ জানানো দরকার। রাগে তার পা-জোড়া থরথর করে কাঁপতে লাগল! বুঝতে পেরে গ্রামের তারই এক সহপাঠী প্রদীপ সঙ্গে সঙ্গে তার কাঁধে হাত রাখল।অসীমের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রদীপ বলল, “মাথা গরম করছিস কেন? দেখছিস না, ক্লাবের মাতব্বররা সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথা বলছে না! এখন তুই-আমি মুখ খুললেই ওইসব গোঁড়া বর্ণাশ্রমপ্রিয় লোকগুলো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাতে কেচ্চা আরও বেড়ে যাবে। আর দেখ, আমরা কিন্তু দলে সংখ্যালঘু। বাড়াবাড়ি হলে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব না। তার চেয়ে বরং চল, আমরা নিজে থেকেই ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যাই। আর কোনদিন ক্লাবমুখো হবো না। সেইসঙ্গে গ্রামের বাইরে এদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাব।”
অসীমদের কাছ থেকে হোক বা অন্য কোনভাবে, মিতালী সংঘের মিটিংয়ের খবরটা পেয়ে যায় রুইদাস পাড়া। সঙ্গে সঙ্গে আটচালায় জরুরী ভিত্তিতে সবাই মিলে আলোচোনায় বসে যায়, এ ব্যাপারে তাদের ঠিক কি করণীয়? হঠাৎ করে বসেছে বলে পাড়ার সব মাতব্বররা একসঙ্গে জড়ো হতে পারেনি। যে যার মত রুজি রোজগারে ব্যস্ত। মুখে মুখে খবর পৌঁছোতে সবাই একে একে এসে পড়ে। সবিস্তার আলোচনোর পর আটচালা নন্দকে ভার দেয়, এই মিটিংয়ে কি কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তা সবিস্তারে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া জন্যে।
ওরা ঠিক করে মিতালী সংঘ মিটিংয়ে তাদের ডাকুক বা নাই ডাকুক, উপযাচক হয়ে তারা সেখানে দলবল নিয়ে যাবে। রুইদাস পাড়া থেকে এতগুলো লোক ওখানে গেলেই প্রথমে মিতালী সংঘের কর্তারা ভিমরি খেয়ে যাবে ! তাদের উপস্থিতিকে ওরা মেনে নেবে না। কিন্তু তারা ওই মিটিংয়ে থাকবেই। তাদের বক্তব্য মিতালী সংঘকে শুনতেই হবে। তারা বোঝাবে, মিটিংয়ে অন্য কোন বিষয়ের আলোচনায় তাদের কোন দায় নেই। তারা উচ্চবাচ্য করবে না। কিন্তু ওই পুরোনো বটগাছটা কাটার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তার আগে তাদের বক্তব্য শুনতে হবে। যদি মিতালী সংঘ তা মানতে না চায় তো বড় কোন গন্ডোগোলও বেঁধে যেতে পারে। সংঘ কর্তারা রুখে দাঁড়িয়ে তাদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতেও পারে। কিন্তু তারা গাছ কাটার কোন সিদ্ধান্ত না জেনে যাবে না। তখনই সংঘাতটা বাঁধতে পারে। সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তার মোকাবিলা করার জন্যে আমাদের আগে থেকে তৈরী হয়ে যেতে হবে। দরকারে আত্মরক্ষার্থে সেই অস্ত্র আমাদের প্রয়োগ করতে হবে। তবে কোন পরিস্থিতিতে প্রথম আঘাত আমাদের দিক থেকে যেন না হয়। আমরা আক্রান্ত হলে তবেই আত্মরক্ষার জন্যে রুখে দাঁড়াবো। কেননা দৌলতপুরের গ্রামের লোকেদের অনেক পয়সা আছে। ওটা বড়লোকের গ্রাম। থানা-পুলিশ পয়সা দিয়ে ওরা কিনে রেখেছে। তাই ওরা অন্যায় করলেও ঘুরিয়ে অন্যায়টা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পুলিশের হাত কাঁপবে না। যদিও বাবার উপর বাবা আছে। দরকার হলে আমরা থানার উপরের প্রশাসনিক দপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারি। আর আমরা যে হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের ডেরায় যাচ্ছি, আমাদের পক্ষে উপযুক্ত অস্ত্র আছে বলেই না যাচ্ছি? সেই অস্ত্র আমরা এখানে দেখাচ্ছি না। সময়মত তা প্রয়োগ করবো। তখন মিতালী সংঘ সত্যি সত্যি ভিমরি খেয়ে পড়বে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। আমাদের রুজি রোজগারের জন্যে বিশেষ করে খোড়া, কুনকে, পালি, কুলো সারাবার জন্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়। দৌলতপুর গ্রামটা আমাদের রুজির ক্ষেত্রে একটা পয়া গ্রাম। ওই গ্রাম থেকে আমরা অনেক কাজ পাই। শুধু ওগুলো কেন, বাবুদের জুতো পালিশও আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে করে আসি। তাতে যেমন বাবুদের রাস্তায় বা বাজার-গঞ্জে গিয়ে জুতো পালিশ করতে হয় না। তেমনি আমরাও বাড়ি বয়ে কাজটা করি বলে দুটো বেশি পয়সা পাই। আমাদের এইসব কাজ দৌলতপুরে যতটা হয়, অন্য কোন গ্রামে এতটা হয় না। এতে আমরা যেমন উপকৃত হই, তেমনি ওদেরও সুবিধা হয়। সেই দিকটাও চিন্তা করে আমাদের সেইরকম ব্যবহার ওদের সাথে করতে হবে। প্রথম দিকে আমরা হাত জড়ো করে অনুনয় বিনয় করে আমাদের কথা পাড়বো। আশাকরি ওরা সেটা বুঝতে পারবে। কেননা ওরা বেশিরভাগই শিক্ষিত পরিবারের লোক। নন্দ কথাগুলো আটচালাকে বুঝিয়ে বলতে এককথায় সবাই তাতে সায় দেয়। সেইসঙ্গে আটচালা রতন আর নন্দকে ভার দেয় মিতালী সঙ্ঘের সঙ্গে যাবতীয় কথা বলার জন্যে। মানে রুইদাস পাড়ার প্রতিনিধি হয়ে রতন আর নন্দ সব কথা বলবে। কেননা, পাড়ার মধ্যে এদের দু’জনের পেটে একটু বিদ্যেবুদ্ধি আছে। দু’জনেই ফাইভ ক্লাস টপকাতে পেরেছিল। তারপর তো সবাই ‘ক-অক্ষর গো-মাংস’। পেটে ঘুসি মারলে স্বরবর্ণ বা ব্যাঞ্জনবর্ণের একটা অক্ষরও বার হবে না। তাছাড়া এরা একটু যুক্তি দিয়ে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে পারে। অন্যদের মত অতটা হ্যাঁকাতে নয়। কথায় কথায় মারব ধরব বলে চেল্লায় না। রতন-নন্দ বোঝালে বাবুরা নিশ্চয়ই তাদের আবেদন মঞ্জুর করবে। ওই সর্বনাশা প্রস্তাব মুলতুবি করবে। এই বিশ্বাস রেখে ওরা মিটিংয়ের নির্দিষ্ট দিনে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
গোটা রুইদাস পাড়া ঝেঁটিয়ে হঠাৎ গিয়ে হাজির মিতালী সংঘের বিশাল পাকা ক্লাব ঘরের সামনের প্রশস্ত ফাঁকা জায়গায়।
ক্লাব ঘরের মাঝখানটা নাট মন্দিরের মত বড় দালান। দালানের এক দিকে দূর্গা মায়ের কাঠামো। বিসর্জন দেবার পর জল থেকে কাঠামা তুলে এখানে রাখা হয়। প্রায় এক’শ বছর ছুঁই ছুঁই এদের এই পূজা। দালানের দু’দিকে বড় বড় দুটো ঘর। একটা ঘরে ক্যারাম তাস লুডো খেলা হয়। অন্য ঘরটা অফিস ঘরের জন্যে বা ছোট খাটো মিটিংয়ের কাজে লাগে। এই ঘরটায় দেয়াল ঘেঁষে বইয়ের সুন্দর তাক আছে। প্রচুর বই রাখা আছে। সদস্যরা বা গ্রামের যে কেউ এখানে এসে বই পড়তে পারে। কেউ আবার বাড়িতেও নিয়ে যায়। সেই ব্যবস্থা করা আছে। বড় দালানটায় ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা এবং অন্যন্য সদস্য হাজির। এমন সময় রুইদাস পাড়ার মেয়ে-মদ্দদের দেখে কিছুটা অবাকই হয় সবাই। ঝাঁক ঝাঁক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রুইদাসদের দিকে আছড়ে পড়ে। তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রতন নন্দদের। এই অস্বস্তিকর মুহূর্তকে বেশিক্ষণ টিকিয়ে না রেখে রতন বলল, “বাবু, আমরা এসেছি আজকের আপনাদের মিটিংয়ে ওই ভাগাড়ের বটগাছটা কাটা নিয়ে আলোচনা হবে, এই কথা জেনে। সত্যি যদি তা নিয়ে আলোচনা হয় তো আমরা থাকব, না হলে চলে যাব। আর এই আলোচনার আগে যদি আপনাদের অন্য কোন বিষয় নিয়ে মিটিং হয় তো ততক্ষণ আমরা ওই দূরে অপেক্ষা করছি। যখন বটগাছটার বিষয় আলোচনায় উঠবে তখন আমরা আসব। আমাদের এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। তাই অনাহুতের মত আমরা আপনাদের পাড়ায় এসেছি। সেজন্য মাপ করে দেবেন বাবুরা।”
রতনের কথায় যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে, মিতালী সংঘের সম্পাদক, সুপ্রভাত সরকার, “আমাদের গ্রামের ভাগাড়, আমাদের গ্রামের খেলার মাঠ আর আমাদের বটগাছ। সেই বটগাছ আমরা কাটব না রাখব সেটা আমাদের গ্রামের মানুষের নিজস্ব বিষয়। তা নিয়ে তোদের কথা শুনতে যাবো কেন রে? শালা, তোরা চামার জাত, ছোটলোক, তোদের কথা শুনে আমাদের চলতে হবে? তোরা কিনা মেয়ে-মদ্দে মিলে আমাদের ঘর বয়ে তেড়ে এসেছিস? কে তোদের এতবড় সাহস দিল রে, রতন? ওই ঘরশত্রু বিভিষণ অসীম-প্রদীপরা বুঝি? ওদের তো আমাদের ক্লাব থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। এবার দরকার পড়লে গ্রামছাড়া করব। রামায়ণে বিভিষণ চরিত্রটা এমনি এমনি এসেছে? এইজন্যেই এসেছে। সব শালা বেইমান, মীরজাফরের জাত। তোদের কোন কথা আমরা শুনব না রতন-নন্দ। মেয়ে-মদ্দে যে পথে এসেছিস সেই পথ দেখে ফিরে যা। দ্বিতীয়বার এ’মুখো হবি না। ফল ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।”
সুপ্রভাতের কথায় সঙ্গে সঙ্গে রুইদাসপাড়ার মেয়ে বউরা গুনগুনিয়ে ওঠে! ছেলেরাও কেউ কেউ গজরাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নন্দ ধমক দিয়ে বলে,“এই জন্যেই মেয়েদের বলেছিলুম তোমাদের আসতে হবে না। জানি তো তোমরা মুখ-ফটকা। কোথায় কখন কি বলতে হয় জানো না। আমরা তো আছি। তাহলে তোমরা আমার আর রতনের উপর কথা বলার ভার দিলে কেন। আমরা সরে যাচ্ছি, তোমরাই তাহলে কথা বলো।” নন্দর ধমকে রুইদাসরা চুপ মেরে যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলতে থাকে রতন-নন্দরাও। এমন হ্যাঁকাতে লোক এই সরকারটা! কেন যে একে এতবড় একটা ক্লাবের সম্পাদক করে রেখেছে কে জানে। এমন রগচটা লোককে এই দামী পদে রাখা ঠিক হয়নি দৌলতপুরের।
সম্পাদকের এই অপমানজনক কথা মানতে পারেনি তরুণ সংঘের সভাপতি বলাই হালদার। ধুতি-পাঞ্জাবী পরা দোহারা তামাটে চামড়ার প্রবীণ মানুষ। কথায় ধীরস্থির ভদ্রতা মেশানো। আলটপকা দেখলে সমীহ করতে ইচ্ছে করবে। নন্দরা তখন ব্যস্ত রুইদাসদের সামাল দিতে। তখনই বলাই বাবু উঠে বলল, “সুপ্রভাত, তোমার এমন কড়া কথা বলা উচিত হয়নি। ওরা ছোটলোক, নীচু জাত কি উঁচু জাত তা তো ওদের গায়ে লেখা নেই। আর জাত? কেউ মায়ের পেটের ভেতর থেকে জাত বেজাতের টিকিট হাতে ধরে পৃথিবীতে আসেনি। মানুষকে এইভাবে অপমান করা ঠিক হয়নি। ওরা কি বলতে চাইছে তা না শুনে প্রথমেই এইভাবে উগ্র ব্যবহার করা যায় না। আমি তো দেখছি তোমার সম্পাদক হবার যোগ্যতাই নেই। গ্রামের নেতা হতে গেলে অনেক সহনশীল হতে হয়।”
সভাপতি বলাই বাবুর কথায় একদম চুপমেরে যায় সম্পাদক। সভাপতি তখন দাঁড়িয়েই আছে। ক্লাবের প্রবীণ সদস্য, দুলাল-কা বলল, “ওদের বক্তব্য, ভাগাড়ের ওই পুরোনো বটগাছটা ক্লাব যেন না কাটে। ভাগাড়ে গরু পড়লে আসমান থেকে শকুনেরা উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে ওই গাছাটায় বিশ্রাম নেয়। শকুনেরা ওড়াউড়ি করলেই রুইদাসরা বুঝতে পারে, ভাগাড়ে গরু পড়েছে। ওরা প্রস্তুতি নিতে পারে সেই গরুর চামড়া নেবার জন্যে। আর গাছটা না থাকলে শকুনেরও বসার জায়গা থাকে না, রতনরাও সহজে বুঝতে পারবে না, ভাগাড়ে গরু পড়েছে কি না। এই হচ্ছে রতন-নন্দদের আসল বক্তব্য। এই প্রক্রিয়াটা একদম ওদের নিজস্ব বলে ওরা সাধারণভাবে মুখ ফুটে অন্যকে বলতে চায় না। গোপন রাখতে চায়। কেননা অন্যরা জেনে গেলে ওদের এই নিয়ে খোঁটা দিতে পারে তাই।” দুলাল-কার কথাগুলো নন্দদের মনের কথা। একদম ঠিক বলেছে দুলাল-কা। নন্দর সঙ্গে দুলাল-কার অনেক ঘরোয়া কথা হয়। তাই দুলাল-কা ভেতরের গপ্প এতটা জানে। ব্যক্তিগত ভাবে নন্দ, ‘কাকা’ না বলে লোকের কাছে ‘দুলাল-কা’ বলেই পরিচয় করায়। দুলাল-কা বলার পর রতন বলল, “বলাই বাবু, দুলাল-কা যে কথাগুলো বলল, ওটাই আমাদের কথা। আর অন্য কোন কথা আমরা বলতে আসিনি। তাছাড়া আমরা গরিব মানুষ। এই মরা গরুর চামড়া দিয়ে আমরা নানান জিনিস বানিয়ে পেটের ভাত জোগাড়ের অনেকটা ব্যবস্থা করতে পারি। ওই গাছ কেটে দিলে আমাদের পেটে লাথি মারা হবে যে বাবু। কোন শত্রুও এ’কাজ করতে চাইবে না। আমরা কি আপনাদের শত্রু, বাবু?”
রতনের আবেগ মেশানো কথাগুলো ক্লাবের অন্যদের মনে ধরে। সবাই যেন এবার গুন গুন করে রতনদের পক্ষে কিছু একটা বলছে বলে মনে হ’ল। তবু সভাপতি বলাইবাবু, সম্পাদক সুপ্রভাতকে বলল, “রতনদের বক্তব্যের উপর তোমার কি বলার আছে বলো।” সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদক বলল, “ওরা বলছে বলে ওদের কথা আমাদের মেনে নিতে হবে এটা ঠিক কথা নয়। আমরা তো একটা উদ্দেশ্য নিয়ে গাছটা কাটার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। গাছটা কাটলে মাঠটা অনেক বড় করা যায়। তখন আমরা ওখানে খেলার টুর্ণামেন্ট চালাতে পারব। বাইরের কত ক্লাব তখন আমাদের এখানে খেলতে আসবে। তাদের খেলা দেখে গ্রামের ছেলেপুলেরা খেলা শিখতে পারবে।”
সুপ্রভাতের কথার টানকে টেনে ধরে বলাইবাবু বলল, “বটগাছ সমেত মাঠটা যতটা বড় আছে তাতে তো খেলাধূলা ছেলেরা ভালই করতে পারে। আমরাও তো সেসময় ওখানে খেলাধূলা করে এসেছি। তারপর এখন যারা খেলা করতে বা হাওয়া খেতে একটু বিশ্রাম নিতে মাঠে যায় তারাও রাজি হচ্ছে না। গাছ কাটার পক্ষে মত দিচ্ছে না। এতকাল তো টুর্নামেন্ট ওখানে হয়নি। নাই বা হল। তাতে আমাদের গ্রামের তো কোন শ্রীবৃদ্ধি হবে না। বরং ওইসব করতে গিয়ে অনেক উটকো ঝামেলা ক্লাবকে পোহাতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার অধিকার আগে না নেচেকুঁদে ফুর্তি মেটানোটা আগে। সেইটা আমাদের ভাল করে বুঝতে হবে। যে গাছ এক-গ্রাম বা এক-পাড়া মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, সামান্য দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় করার বিলাসিতায় আমরা মানুষের জীবন মরণের প্রশ্নটাকে তুচ্ছ করে দেখব? এ তো দেখছি সেই কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটার ছায়া এখানে এসে পড়েছে! বাবুর জমি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান হতে হবে। তাই গরিব উপেনের বেঁচে থাকার সামান্য অবলম্বনটুকুও ক্ষমতার দম্ভে কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনি।”
এরপর যথাসম্ভব কড়া গলায় সভাপতি বলাইবাবু বলল, “সম্পাদকের প্রস্তাবে আমার সায় নেই। এবার সমবেত সদস্যবৃন্দ এবং গ্রামবাসী তাদের মতামত জানাক। বটগাছটা কাটা হবে, না যেমন আছে তেমন থাকবে। এখন প্রত্যেক মানুষ যে যার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে যে উত্তর পাবে সেই উত্তর এখানে পেশ করা হোক। অধিকাংশ মানুষ যা চাইবে তাই হবে।”
সভাপতির মতামতের পর সভায় বেশ খানিকক্ষণ ধরে গুঞ্জন চলতে থাকে। থামতে যেন আর চায় না। মাথা নেড়ে একে অপরের বক্তব্যে কেউ সাড়া দিচ্ছে, কেউ চুপচাপ থেকে অন্যকে সমর্থন দিচ্ছে, কেউ আবার বড়বড় রাগত দৃষ্টিতে সম্পাদকের দিকে তাকিয়ে, মনে হচ্ছে বিরূপ মন্তব্য ছিটিয়ে দিচ্ছে। মুখ ফুটে আর কেউ সম্পাদকের পক্ষে কোন কথা বলছে না। পরিস্থিতি বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হ’ল না সম্পাদক সুপ্রভাত সরর্কারের। নিরুপায়ে সেই মুখ খুলল, “আমার বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে আমার পক্ষে অধিকাংশ সদস্য নেই। আমি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে নিশ্চয়ই গাছ কাটার কথা তুলিনি। গ্রামের সুনাম যাতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই লক্ষ্যে আমি এগোতে চেয়েছিলাম। সুনাম হলে সেই সুনাম আমি একা উপভোগ করবো না। সকল গ্রামবাসীরও তা প্রাপ্য। আমার যুক্তিটা কেউ বোঝার চেষ্টা করল না। অন্য গ্রামের লোকেদের ভাল-মন্দ নিয়ে সবায়ের রাতের ঘুম যেন ছুটে গেল। এটাও ভেবে আমার খারাপ লাগছে যে, যারা সেসময় আমার মতামতে সায় দিয়েছিল, যাদের সমর্থনে আমি এ কাজে এগিয়েছিলাম তারাও আমার পক্ষে কোন কথা বলছে না। এই পরিস্থিতিতে আমার আর সম্পাদক পদ আঁকড়ে থাকার কোন মানে হয় না। আমি মিতালী সংঘের সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে এই সভা পরিত্যাগ করলাম।”
[ ছয় ]সেই যে দৌলতপুরের চড়ার ধারে ভাগাড়ে গরুটা ফেলে এসে বাড়ি গেল, দেখতে দেখতে দশ দিন পার, এসেরালি আর এদিকে আসছে না। ওর সঙ্গে আরও পাঁচজন ভাগাড়ে গেছিল ওকে সাহায্য করার জন্যে। তাদের যখন খবর দেওয়া হয়েছে তারা কাজে এসেছে। এসেরালির বাড়িটা একটু দূরে। সেই তেলিয়া গ্রামে। হাঁটা পথে তো চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়। ওদের পাড়ার হাসেম, নিয়েতকে দিঘিরপাড় বাজারে দেখা হলে বারবারই এসেরালিকে আসতে বলতে বলেছে শিবুবাবু। কিন্তু তার পাত্তা নেই। একদিন হাসেমকে চেপে ধরতে সে বলল, “তার মেয়েটাকে বলেছি, তোর বাপকে বলিস, বাবু দেখা করতে বলেছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই বলেছে। তা সে যদি না আসে আমি বা কি করি।” এবার শিবুবাবু চাপ দিয়ে বলল, “ও বাচ্চা মেয়ে। খেলে বেড়ায়। ওর কি ওসব মাথায় থাকে। তুইও হাসেম, আছিস তেমন। নিজে গিয়ে একবার বলে আসতে পারলি না। নিয়েতকে বললাম। সেও হয়তো তোর মত কাউকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে। এমন কথার বাহনকে পাঠিয়েছে, সেও ওই এসেরালির কচি মেয়েটার মত কেউ হবে। ঠিক আছে, তোরা যখন খবর দিবি না তখন আমাকেই ওর বাড়ি যেতে হবে। লোকটা কেন এতদিন হয়ে গেলে এদিকে আসছে না তা তো জানা দরকার। শরীর-টরির তো খারাপ হতে পারে? নাকি অন্য কিছু। কে জানে!”
হাসেম দেখলো বাবু ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে। প্রকাশ্যে না বললেও মনে মনে হয়তো তাদের এই কাজে হতাশ! শিবুবাবু চাষবাসে তাদের অনেক কাজ দেয়। বাগান চাষ তো বারোমাস করে। ওরাই সেইসব কাজ করে। এবার বাবুকে বিগড়ে দিলে আর কাজে নাও ডাকতে পারে। তাই আগ্রহ দেখিয়ে বলল, “বাবু, তোমাকে আর অতদূর হেঁটে এসেরালির বাড়ি যেতে হবে না। আমি আজই, এখনই বাজার থেকে ফিরে ওর বাড়ি যাচ্ছি। বিকেলে হাটে ফেরার সময় তোমার বাড়ি ঘুরে এসেরালির খবর দিয়ে তারপর নিজের কাজে যাবো। তুমি একদম চিন্তা করবে না। তুমি এত চিন্তা করছো, আর ও ব্যাটা নিশ্চিন্তে ঘরে শুয়ে আছে। এটা ও ঠিক কাজ করেনি।”
বিকেলে হাটে যাবার আগে হাসেম শিবুবাবুর বাড়িতে এসে খবর দিল, ক’দিন ভ’র এসেরালির ধুম জ্বর। দিন দুই হল জ্বরের দাপটে একটু লাগাম টেনেছে। কাজে বার হতে পারছে না। ফলে এদিকে রান্নাঘরের ভাঁড়াড়ে টান পড়েছে। এসেরালির বউ বলল, “বাবুর গরুটা ভাগাড়ে ফেলে আসার দুদিন পর থেকেই জ্বরটা কামড়ে ধরল ওকে। গরুটাকে নিয়ে দিনরাত চিন্তা করত। আসলে খুব ভালবেসে ফেলেছিল যে। ওটার মরণ ও মেনে নিতে পারছিল না।” হাসেমের কথা শুনে শিবুবাবুর মনটাও কেমন দমে গেল। জানে, এসেরালি গরু জোড়াদুটোকে ভালবাসতো। কিন্তু সে যে ওদের এতটা আপনজনের মত করে নিয়েছিল তা কোনদিন ভাবেনি। বাবুর পাশে গিন্নীমা দাঁড়িয়ে ছিল। হাসেমের কথা শুনে গিন্নীমা বলল, “গরুদের এত ভালবাসতো এসেরালি, নাঙল জোড়ার আগে ওদের একবার জাবনা খাইয়ে তবে চাষে নামাবে। বলবে, পেটে বল পেলে তবে না শরীরের তাকত দেখাতে পারবে । পেটে বল নেই আর তাদের যদি হ্যাট হ্যাট, চল্ চল্ বলো আর কঞ্চি দিয়ে কাপসাও, তারা পারবে কেন। এইজন্যেই তো ওরা এত খাটতে পারতো। আর লোকে হিংসে করতো, শিবুবাবুর গরু জোড়া রোজ যতটা জমি চষতে পারে, তার ধারেকাছে অন্য কোন বলদ জোড়া যেতে পারে না। হালের জোড়া, শিবুবাবুর হালের জোড়া। দেখার মতো জোড়া। আর সেইসঙ্গে তার হেলো, এসেরালি। দক্ষ পরিচালক না হলে আবার কর্মঠ কর্মী থেকেও কাজে আসবে না। লোকে যা বলে একদম সত্যি। হেলোকেও হতে হবে দক্ষ। শুধু চাষে নামার আগে কেন, গরু গোয়ালে ঢুকিয়ে আবার খোলভুষি দিয়ে জাবনার ব্যবস্থা করে তারপর সে হাত পা ধুয়ে ক্ষান্ত হয়। এমন পয়মন্তর হেলোও ক’টা পাওয়া যায়!” বলে একটু থেমে গিন্নীমা আবার বলল, “হাসেম, হাট থেকে তুমি বাড়ি ফেরার সময় আমাদের বাড়ি হয়ে একবার যেও? সত্যি তো, দশ দশটা দিন ও কাজে বার হতে পারেনি। রান্নার ভাঁড়ারে টান তো পড়বেই। বেচারা যেমন কষ্টে আছে, তার বাচ্চা বউরাও তো শুকিয়ে আছে গো! আমি এক পুঁটলি চাল আর কিছু সব্জি গুছিয়ে রাখছি। নিয়ে যেও। এসেরালিকে বোলো, গিন্নীমা পাঠিয়েছে। আর সুস্থ হলে আসতে বোলো।”
গিন্নীমা চাল ডাল সব্জি এসেরালির জন্যে গোছাতে ব্যস্ত। পাশেই শিবুবাবু বারান্দার চেয়ারে বসে। শিবুবাবু বলল, “জানো, ভাবছি কাল একবার সময় করে সাইকেলটা নিয়ে এসেরালির বাড়ি যাই। ওকে দেখে আসি। ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছে নাকি শুধু ওইসব টোটকা-মোটকা করে পড়ে আছে কে জানে। না হলে এতদিন তো জ্বরে ভোগার কারণ দেখছি না। জ্বর সাধারণত তিন দিন থেকে বিদেয় হয়। আর আমার জন্যে ও অসুখে পড়ল। ওর বিপদে পাশে আমাদেরই থাকা দরকার। তুমি কি বলো?” গিন্নীমা উত্তরে বলল, “সেটা ঠিক কথাই বলেছো। পাশে থাকা মানে শুধু ওর বাড়ি গিয়ে পাশে বসে ভালমন্দ কথা শুনিয়ে কর্তব্য শেষ কোরো না যেন। কিছু নগদ টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসো। পাশকরা ডাক্তার দেখাতে গেলে তো পয়সার দরকার। কাজ নেই তার পাবে কোথা থেকে। পেটের ভাত জোগাড় করতে পারছে না আবার পাশ করা ডাক্তার দেখাবে। দেখো গে, ওই টোটকাতেই হয়তো দিন পার করছে। হ্যাঁ, আর একটা কথা, যে টাকা দেবে, সেটা আবার যেন ওর দাদনের খাতার হিসেবে যোগ করে দিও না। গরিবরা তো এই করেই দেনার জালে জড়িয়ে জীবনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। জন্ম জন্ম বাবুদের পায়ের তলায় গড়াগড়ি খেতে হয়। সেই কাজটা তুমি করবে না। অবশ্য তুমি তেমন মানুষ নও। তবু বলে রাখলাম।” গিন্নীমাকে তারিফ করে শিবুবাবু বলল, “এই জন্যেই লোকে যোগ্য বাবুর যোগ্য গিন্নীমা বলে তোমাকে। তুমি তো আমার মনের কথাই কেড়ে নিয়ে বলে দিলে। ওইটাই আমি ভেবে রেখেছিলাম। তোমাকে শোনানোর আগেই তুমি আমায় শুনিয়ে দিলে। টাকা তো কত লোকের আছে। কিন্তু ক’জন সেই টাকা সঠিক কাজে লাগায় বলো তো ? সব অকাজে খরচ করে বসে। আমি যদি এসেরালির এই বিপদে ওর পাশে দাঁড়াই, ও আমাকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করবে। আমাদের কোন দরকারে-অদরকারে ও জান লড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। যে লড়াই পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। হৃদয় দিলে তবেই হৃদয়কে ছোঁয়া যায়।”
মজলিশপুরের মোড় থেকে ইট বেছানো রাস্তাটা বেশ খানিকটা এঁকে বেঁকে যাবার পর বাঁদিকে এসেরালিদের তেলিয়া গ্রামটা রেখে চলে গেছে মলং-কোদালিয়া হয়ে ইদমহল, বলাখালি ছুঁয়ে আমিড়ার দিকে চলে গেছে। আগের দিন রাত্রে কয়েক পশলা ভারি বৃষ্টিও হয়ে গেছে। মাটির উপর ইট পাতা। সাইকেল, ভ্যান, বাইক যাতায়াত করতে করতে রাস্তার ইট কোথাও ডেবে গেছে কোথাও আবার মুখ উঁচিয়ে আকাশ দেখছে। ইট আলগা হয়ে তার ফাঁকে জমে থাকা কাদা জল কখনো ফচাৎ করে ছিটকে সাইকেল তো বটে, নীচের দিকে কাপড়ে ছিটকে দেগে দিয়ে যাচ্ছে। সাইকেলের কলকব্জা কতটা আঁটোসাঁটো, তা এই রাস্তায় এলেই বোঝা যায়। কাদাজলের দোসর এখন এই সাইকেলের ঝনঝনে শব্দ। বিরক্তির আর শেষ নেই। মনে হচ্ছিল যেন, এমন জানলে এসেরালির বাড়ি আসার রায় সে দিত না। আর রাস্তার পাশে যেখানে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বট অশ্বত্থ বা বাবলাগাছ আছে, সেখানে বলার কথাই নেই! ফচাৎ ফচাৎ কাদা ছেটকানোর যেন প্রতিযোগিতা চলছে। দেখেশুনে সাবধানে না চালালে চাকা হড়কে সাইকেল আছাড়ও খেতে পারে। তবু কিচ্ছু করার নেই। যাবতীয় বিড়ম্বনাকে এড়িয়েই এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
নিয়েতই প্রথম দেখতে পায় শিবুবাবু সাইকেল টানতে টানতে তাদের পাড়ার দিকে আসছে। দৌড়ে ছুটে যায় সে, “আরে বাবু, তুমি আমাদের পাড়ায়? এসেরালির খবর নিতে? দিন সাইকেলটা আমাকে। কাদায় কাদায় তো ব্রেকের কাছে জমাট বেঁধে গেছে। গড়াবে কেমন করে। আপনি আস্তে আস্তে এগোন বাবু। আমি সাইকেলটা ধুয়ে পরিস্কার করে নিয়ে যাচ্ছি।” একটু চেঁচিয়ে বলল, “ও হাসেম, বাবু এসেছে রে আমাদের পাড়ায়। সঙ্গে করে নিয়ে যা এসেরালির বাড়ি।” শিবুবাবু এসেছে মানে তেলিয়া গ্রামে যেন ভগবানের মত কেউ এসেছে। একে একে ভীড় জমতে লাগল। জড়ো হওয়া মেয়েদের আবার উৎসাহ বেশি। একবারের জন্যে তারা বাবুকে দেখতে চায়। নিজেদের মদ্দদের কাছে বাবুর নাম শুনেছে। কিন্তু চোখে দেখেনি। এখন যখন হাতের কাছে পেয়েছে, অদেখার খামতিটা মেটাতে চায় ওরা। হাসেম, নিয়েত, খাজেবক্স সারাক্ষণ ছিল এসেরালির বাড়ি। বাবু বেরোলে সাথে সাথে তারাও চলে যায়। আসলে এই পাড়ার প্রায় সবাই জন-মজুরের কাজ করে। শিবুবাবুর মণিবীয়ানা সক্কলের মন ছুঁয়ে যায়। জন-মজুরকে শিবুবাবু কোনদিন নিছক জন-মজুর হিসেবে দেখে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার করে। তাই সকলের কাছে এত প্রিয়।
ফেরার সময় শিবুবাবুকে আবার ওই কাদামাটির রাস্তার উপর দিয়ে যেতে হবে। মেন রাস্তাটা ইট বেছানো হলে কি হবে, ওদের তেলে গ্রামের ভেতরের রাস্তায় এখনো তা হয়নি। ফলে একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা কাদাজলে একাকার। বাবুর কষ্ট হবে। তাই হাসেম বলল, “বাবু চলুন, আমি আপনার সাইকেলটা টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের গ্রামের রাস্তাটা আপনাকে সঙ্গ দিয়ে পার করে দিই। আপনি খালি হাতে চলুন। কাদায় সাইকেল টানতে টানতে আপনার হাত পা ব্যথা হয়ে যাবে।” এদের এই আতিথেয়তায় শিবুবাবু যারপরনাই অভিভূত! এরা টাকাপয়সায় গরিব হলে কি হবে, এদের মত ধনী অন্তর, পয়সায় বড়লোকদের মধ্যে মেলা ভার। গল্প করতে করতে শিবুবাবু বলছিল, “জানিস হাসেম, বলদ জোড়ার একটা তো চলে গেল। মনে হচ্ছে ওর ওই চলে যাওয়াটা আমার ভবিষ্যৎ জীবন চলনের গতি প্রকৃতিও এদিক ওদিক হতে চলছে। ইদানিং শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এসেরালিকে বলেছিলাম আগেরটার মত আর একটা বলদের খোঁজ কর। কিন্তু সেও তো খোঁজ দিতে পারছে না। আসলে কি জানিস, ঠিক ঠিক অমন জোড়া পাওয়া মুশকিল। তাই ভাবছি আর হালের জোড়া নতুন করে বাঁধবো না। চাষবাস আমি এবার ছেড়ে দেবো। ডাক্তার বারবার পরামর্শ দিচ্ছে চেঞ্জে যাবার জন্যে। আবহাওয়া পরিবর্তন করতে। অন্তত কয়েক মাস। তবে যদি নড়বড়ে হতে থাকা শরীরটা শক্তপোক্ত হয়। এদিকে তোর গিন্নীমা ডাক্তারের নিদেনের কথা ছেলের কানে শুনিয়ে দিতেই ব্যাস। শিলং থেকে ছেলে চাপ দিচ্ছে ওখানে চলে আসার জন্যে। বাপ-ছেলের এই ঝুল পেটাপেটি চলছে অনেক দিন থেকে। এখানে এইসব কর্মযজ্ঞ ছেড়ে যাই বা কেমন করে। তাই আমি ছেলের কথায় ঘাড় পাতছিলাম না। শৈল শহর শিলংয়ের ডি.এম. তোদের দাদাবাবু। বড় বাংলো। অনেক ঘরবাড়ি। থাকার কোন অসুবিধা নেই। মনোরম পরিবেশ। স্বাস্থ্যদ্ধারের একদম উপযুক্ত স্থান। তাই ভাবছি এবার হয়তো ছেলের কথায় সায় দিতে হবে। চিন্তা করছি কালো গরুটা এসেরালিকে দিয়ে দেবো। ওর হাতে গড়া গরু। ওই ভালভাবে পালতে পারবে। আর চাষবাস সব আমার মেজো আর ছোট ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দেবো। ওরাই ওগুলো দেখাশোনা করবে। সার ওষুধের যা আকাশছোঁয়া দাম হয়ে গেছে, চাষে আজকাল তেমন লাভের মুখ দেখা যায় না। লোকের মজুরী আর অন্য যাবতীয় খরচ সামলে সামান্য কিছু পড়ে থাকে। তা থেকে ভাইরা যা দেবে মেনে নিতে হবে। তবে হ্যাঁ, এসেরালির একটা ব্যবস্থা করে যাব ভেবেছি। আমার দক্ষিণ মাঠের ওই দশবিঘের বন্দের মধ্যে দু’বিঘে জমি এসেরালিকে চাষ করতে দেব। চাষবাস করে যা পারবে আমাকে দেবে’খন। চাপাচাপি করব না।”
এবার হাসেম কথাটা তুলল, “বাবু, তুমি ওকে দু’বিঘে জমি চাষ করতে দেবে, তা আগাম চাষ না ভাগ চাষ।” বাবু বলল, “আরে বোকা, আগাম বা ভাগচাষ, ওসব কিছুই না। ওর সংসারটা বাঁচানোর জন্যে যা হোক সম্বচ্ছর ধান, মুগ, খেসারি কড়াই বা এটাসেটা চাষ করবে। আর এদিক সেদিক জন-মজুর খেটে নগদ পয়সাটা পেলে ওর চলে যাবে। মেজোবাবু, ছোটবাবুকে অবশ্য বলব, এসেরালি এবং তোদেরও যাতে দরকার পড়লেই কাজে ডাকে। তুই তো এমনিতেই ছোটবাবুর কাছে কাজ করিস। আমার জমিজমা চাষের জন্যেও তোদের কথা বলব’খন।”
হাসেম কিন্তু টিপ রেখে দাঁড়িয়ে আছে ওর প্রশ্নের উপর, “বাবু তুমি যাই বলো, তুমি তো আশা করছো এসেরালি যা পারবে কিছু কিছু চাষের লাভের অংশ তোমাকে দেবে। তার মানে তো ও তোমার ভাগচাষী হয়ে গেল। এবার ও যদি তোমার ওই দু’বিঘের বর্গা রেকর্ড করে নেয়? তখন তো তোমার জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে। ও জমি তুমি আর ফেরত পাবে না। এসেরালির হয়ে যাবে। না, তাই বলে ভাববে না, তুমি এসেরালিকে জমি দেবে বলছো বলে আমি ভাঙচি দিচ্ছি। সমাজে যা ঘটছে, তাই দেখেশুনে বলছি আরকি। অন্যসব বাবুদের কত জমি এইভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল! সেইজন্যে এখন সম্বচ্ছর আগো জমি পড়ে থাকবে- তবু আচ্ছা। কিন্তু ভাগচাষ বাবুরা আর কেউ দিতে চাচ্ছে না। এতে হল কি জানো বাবু, আমাদের মত গরিব চাষি-মজুরদের পেটে লাথি মারা হল।”
শিবুবাবু একটু চিন্তা করে বলল, “তুই যে কথাটা বলছিস তা একদম বাজে কথা তা তো নয়। আকছার এই ঘটনাটা ঘটছে। তাতে কি হচ্ছে বলতো, তোরা তো চাষের জমি না পেয়ে মরছিস, সেইসঙ্গে যারা পেয়ে বর্গা রেকর্ড করেছে তারাও কি ভাল আছে? বরাবরের জন্যে সেই জমি তারা ধরে রাখতে পারছে? পারছে না। ওই দেখ না, দিঘিরপাড়ের দিকে যেতে ডানদিকের জমিগুলো। সরকার থেকে চাষের জন্যে গরিব লোকগুলোকে পাট্টা দিল। কিছুদিন তারা চাষ করল। কিন্তু এখন দেখ, একটা জমি সেই লোকগুলো ধরে রাখতে পেরেছে? অভাবের তাড়নায় এক এক করে সব্বাই অন্য লোককে বিক্রি করে দিল! আসল লোক এখন একটাও নেই! আমারও তো উলকুনীর দশবিঘে জমি বর্গা হয়ে গেল। আমি তার কিচ্ছু পাই না। কিন্তু যারা বর্গা রেকর্ড করল, সেই জমি তাদের কারোর হাতে নেই। দু’বার এমনকি তিনবারও হাত ফিরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে সেই জমি। তাই শুধু জমি বর্গা করে দখল-অধিকারে নিলে হবে না, সেই অধিকার ধরে রাখার ক্ষমতা রাখতে হবে। চাষবাসের যা খরচ এখন ওই দু’বেলা দু’মুঠো মজুর খেটে আনা মানুষগুলো সেই চাষের খরচ সামলাবে কেমন করে। তাই তারা অভাবে দখল হাত ফেরি করছে। কিন্তু সেই জমির আসল দলিল প্রকৃত মালিকের হাতে। সেই অধিকার বর্গারা কোনদিন পাবে না। সরকার পাল্টাবে, পরিস্থিতি পাল্টাবে এবং একটা সময় আসবে, সেই জমি আসল মালিকের হাতে চলে আসবে। এই বর্গা-টর্গা সরকারের রাজনৈতিক চমক ছাড়া আর কিছু নয়। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যে কিছুদিন এই চমক কাজ দেবে। তারপর সেই চমকের ফানুস ফটাস করে ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই দেখ না, সিঙ্গুরে কি হ’ল। টাটার কারখানার জন্যে সরকার জমি নিল। ক্ষতিপূরণ কারা পেল? জমির আসল দলিল যাদের হাতে, সেই মালিক পেল। আর ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত ভাগচাষিরা রেকর্ড করা বর্গা দলিল নিয়ে নাচানাচি করে গেল। লবডঙ্কা পেল তারা। বরং ওসব না করে বাবুদের সঙ্গে সৎ আচরণ করলে আখেরে চাষিদেরও লাভ। তাদের কোনদিন পেটের ভাতের অভাব হবে না।”
দু’একদিন ছাড়াই শিবুবাবু হাসেম বা নিয়েত অথবা ওদের গ্রামের যার সঙ্গে দেখা হয়, এসেরালির শরীরের খোঁজ নেয়। সবাই একই কথা বলে, জ্বর ছাড়ান দিচ্ছে না ওর। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা হাসেম হন্তদন্ত হয়ে শিবুবাবুকে ডাকাডাকি শুরু করে, “বাবু এসেরালির শরীর একদম ভাল না। ভোর রাত থেকে খিঁচ শুরু হয়ে গেছে। ওকে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার বলল, এক্ষুণি ওর পা অপারেশন করতে হবে। গোড়ালির উপর থেকে পা কেটে বাদ দিতে হবে। গ্যাংরিণ হয়ে গেছে। পচন শুরু হয়ে গেছে ওর পায়ে। কবে মাঠে কাজ করতে গিয়ে পেরেক মেরেক ফুটেছিল। সেটা নাকি বার হয়নি। সেই থেকে পচন শুরু। এখন কি হবে বাবু?” শিবুবাবু সঙ্গে সঙ্গে শিলংয়ে ছেলের কাছে ফোন করে পিজির সুপারকে বলতে বলল, যাতে ওকে পিজিতে ভর্তি করানো যায়। ছেলে সব ব্যবস্থা করে পাল্টা ফোন করে পিজিতে রোগীকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে বলল। শিবুবাবু নগদ হাজার পাঁচেক টাকা হাসেমের হাতে দিয়ে বলল, “যা, এক্ষুণি অ্যাম্বুলেন্সে পিজির এমার্জিন্সিতে নিয়ে যা। ওখানে ডাক্তার পল্লব পাল বলে একজন ডাক্তারবাবু থাকবে। তাকে আমার ছেলের নাম বললেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পল্লব ডাক্তার তোর দাদাবাবুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছে। ও ডাক্তার হয়েছে। আর তোর দাদাবাবু আই.এ.এস অফিসার। যা, একদম দেরি করিস না।”
শিবুবাবুর ভোরের আরাম-ঘুম ছুটে গেল। মুখটুখ ধুয়ে গিন্নিকে বলল চা বানিয়ে আনতে। দু’লোকে ডাইনিং টেবিলে চা খেতে খেতে এসেরালিকে নিয়ে আলোচনা করছিল। বাবু বলল, “হাসেম কি বলতে কি বলছে বুঝতে পারছি না, খিঁচুনি যদি ধরে যায় তো ও রোগীকে ফেরানো মুশকিল। ধনুষ্টঙ্কার রোগীর বেঁচে ফেরা মনে হয় সম্ভব নয়। পিজি বড় হাসপাতাল। যদি ওদের কেরামতিতে এসেরালি প্রাণ ফিরে পায়। তবে মনে হয় না। এই মনে একটু সান্ত্বনা যে ভাল জায়গায় চিকিৎসা করেও বাঁচানো গেল না। দেখো, ওদের পরিবারের কাছে আমরা ঋণী হয়ে গেলাম। আমার জমিতে চাষের কাজ করতে গিয়েই তো ওর পায়ে জংধরা পেরেক গেঁথে গেছিল। আর ওটা এমন হ্যাঁকাতে, পাত্তাই দিল না সেটাকে। হয়তো বাবলা কাঁটা-মাটা ফুটেছে ভেবে অবজ্ঞা করেছে। তখনই সাবধান হলে, প্রণব ডাক্তারের কাছে গিয়ে সেটা পা থেকে বার করে দিলে এই বিপদে পড়তে হত না। এখন তো ওর সংসারটা ভেসে যাবে। আমার আর কি করার আছে। বড়জোর ভাইদের বলে ওর বোয়ের জন্যে চাষের জমিতে বা ডাঙায় যতটা বেশি পারা যায় মজুরের কাজের ব্যবস্থা করতে পারি। আর যে দু’বিঘে জমি এসেরালিকে চাষ করার জন্যে দেবো বলেছি সেটা যদি ওর বউ করে, করবে। এমনিতে তো ওর বউ জমিতে ঘাষ নিড়ানের কাজ করে। চাষের কাজে অভ্যস্ত সে। এবার তার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল আর কি।” -
গল্প- কুয়াশা
কুয়াশা
-পাপিয়া ঘোষ সিংহসকালে উঠে বাইরের দিকে তাকায় রুমেলা। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এরপর বিছানা ছেড়ে আয়নার কাছে এসে দাঁড়ায় রুমি, চোখ গুলো খুব ফুলেছে তার। আসলে গতরাতে সে ঘুমোতে ই পারেনি। মাথার মধ্যে একটা কথায় ঘুরছে, কি এমন বলেছিল রুমি, যে দীপন ওরকম করে খেঁকিয়ে উঠলো??
রুমেলা মিত্র, ইউনিভার্সিটির বাংলা এম এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, ছোট থেকেই রুমেলা খুব শান্ত,ধীর স্বভাবের। সবার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করার জন্য তাকে ভালোবাসে সবাই। বাবা-মায়ের আদরের রুমি জীবনে কখনও কোনো আঘাত পায়নি। বেশ আদরে, আবদারে দিন কাটতো তার,খুব রিজার্ভ হ’লেও রুমেলার বন্ধুর অভাব ছিল না। তবে একটু অন্য ইঙ্গিত পেলেই রুমেলা সেই সব ছেলে বন্ধুদের থেকে দূরেই থাকতো।
হঠাৎ সেদিন কি হলো?? রুমি মনে মনে ফিরে গেল বছর পাঁচেক আগের সেই দিনে। খুব ঠান্ডা, রুমি তখন টিউশন থেকে ফিরছিল।একে শীতকাল,তাইতে আবার টিপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় পাশে চায়ের দোকানটায় দাঁড়ালো। সাইকেলে এই রাস্তায় রুমি রোজই যায়, এই দোকানে একদল ছেলেদের আড্ডা দেওয়া দেখতে পায়। তবে আজ সেই দল নেই। আছে একজন। এগিয়ে এসে রুমিকে প্রশ্ন- আমরা একে অপরকে চিনি?? রুমি বলে হ্যাঁ দেখেছি তো। তবে সেভাবে চেনা জানা হয়নি। অপরজন আবার বললো বন্ধু হ’তে পারি? এই বলে এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে সে বললো তুমি খুব ভালো কবিতা বলো। রুমি র মুখে লাজুক হাসি। তারপর সে বললো আমি দীপন, দীপঙ্কর চ্যাটার্জি, বি-টেক ফাইনাল ইয়ার। রুমি বললো আচ্ছা। দীপন কথা বলতেই থাকে। সুন্দর, সাবলীল, আন্তরিক কথা বলা রুমিকে কেমন মোহিত করে দেয়। বৃষ্টি থেমেছে, সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, রুমি ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে। রুমিকে উঠতে দেখেই দীপন বলে এখনই চলে যাচ্ছো? আবার কবে দেখা হবে?? রুমি হাসে, বলে অনেক দেরি হয়ে গেছে, দেখা প্রায়ই তো হয় আসতে-যেতে। এবার দীপন এগিয়ে এসে বলে রুমেলা আমরা আলাদা দেখা করতে পারি না?? রুমেলা চুপ করে যায়। কিছু না বলেই বেরিয়ে আসে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়িতে আসার পর থেকেই রুমেলার কানে একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে-“আমরা আলাদা দেখা করতে পারি না”? দীপঙ্কর চ্যাটার্জি হ্যান্ডসাম, কর্মদ্যোগী, ছটফটে, অদ্ভুতভাবে কথা বলে মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। রুমি অনেক মেয়ের কাছে দীপনের নাম শুনেছে। কেউ বলে আমাদের দীপনদা এরকম, তো কেউ বলে দীপন তো আমার খুব ভালো বন্ধু। অত্যন্ত মেধাবী, সু-বক্তা ছাত্রনেতা দীপঙ্কর চ্যাটার্জি যে এভাবে রুমেলার বন্ধুত্ব চায়বে সেটা রুমেলা কখনও ভাবেই নি। সেই ডাক তার কানে বাজছে,কেমন করে ফেরাবে সে?
না ফেরানোর ক্ষমতা রুমির নেই, শুরু হলো তাদের আলাদা দেখা করা, কথা বলা, প্রেম-ভালোবাসা। রুমি হায়ার সেকেন্ডারি, কলেজ পেরিয়ে আজ ইউনিভার্সিটিতে। দীপন বি-টেক,এম-টেক করে বড়ো কোম্পানির অফিসার, জীবন পাল্টেছে,শহর পাল্টেছে, তবুও তাদের সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয়নি। দু’জনে দু’জনকেই খুব ভালোবাসে। রুমির মাস্টার্স কমপ্লিট হলেই দু’জনের বিয়ে হবে।
সম্পর্কের গভীরতা অধিকারের জন্ম দেয়।রুমির প্রতি দীপনের অধিকার রুমি সবসময়ই সাদরে মেনে নেয়। কিন্তু রুমি যদি কোনসময় দীপনকে অধিকার নিয়ে কিছু বলে দীপন মেনে তো নেয় না উপরন্তু রেগে যায়। কথা বন্ধ করে দেয়। দীপনকে ছেড়ে থাকতে পারে না বলে রুমি নিজেই মানিয়ে নেয়।এভাবে চলছে আজ একবছর। রুমির মনে কিছু প্রশ্ন জমা হয়। প্রশ্নহীন আনুগত্য কি ভালোবাসা? কেন এমন হচ্ছে মাঝে মাঝে? কেন দীপন ভুল বুঝছে রুমিকে? আগের দীপন তার রুমির কাছে কবে ফিরবে কুয়াশা কাটিয়ে ? মনের জমাট বাঁধা প্রশ্ন আজ প্রাক বরষার মেঘে পরিণত। রুমির মন চায়ছে বৃষ্টি নামুক। ধুয়ে দিক দুজনের মনের সমস্ত জটিলতার কালো। রুমি কে বুঝতে পারবে দীপন,অবশ্যই পারবে। রুমির ভালোবাসা তার দীপনকে ঠিক কুয়াশার চাদর থেকে বের করে আনবে ঝলমলে রোদ্দুরে।
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২)
( সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার[ তিন ]
শিবুবাবুর বাড়ির লোকের ইচ্ছে ছিল না এতদিনের মায়ার বাঁধনে বাঁধাপড়া মৃত সাদা গরুটাকে ভাগাড়ের ফাঁকা ময়দানে ফেলে দেওয়ার। ওখানে ফেলা মানেই তো কুকুর-শেয়াল-শকুনে তাদের আদরের পোষ্যর নিথর শরীরটাকে ছিঁড়েকুটে বরবাদ করবে। আর ওপথে ওরা কেউ গেলে তা চোখ পেড়ে দেখতে হবে। অযথা মনের মধ্যে থিতু হতে থাকা কষ্ট চাগাড় দিয়ে উঠবে। এসেরালিও এই নিয়ে দ্বিধায় ছিল সবসময়। বাড়ির মানুষরা যেন তার মনের কথা খোলসা করে বলে ফেলল। তবু মুখ ফুটে সে কথা সে বলতে চাইল না। যেহেতু সে এসেরালি, তাই তার মতামত কে কেমনভাবে নেবে তা তো তার জানা নেই। এ সব মণিবদের পরিবারের আপন আপন মতামতের ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে ও তো এই বাড়ির কাজের মানুষ। আগ বাড়িয়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধন্তের ভেতর তার ঢোকা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শিবুবাবু মত দিল, “নারে এসেরালি, আমার বাড়ির লোকের সাথে আমার মত মিলছে না। তুই মুখফুটে এ ব্যাপারে তোর কোন মতামত জানাতে চাইচ্ছিস না ঠিকই তবে আমি জানি, আমার সিদ্ধান্ত তোরও মনঃপুত হবে না। আমি তো জানি, তুই তোর চাষের সঙ্গীদের কতটা ভালবাসিস। সেই ভালবাসার টানে তুইও মনমরা। তবু বলি, ওটাকে আমাদের ভাগাড়ের মাঠেই রেখে দিয়ে আয়। গ্রামের সবাই তো তাই করে। প্রত্যেকেরই তো আদরের পোষ্য একদিন না একদিন মারা যায়। কেউই এই প্রথার দ্বিমত করে না। এই তো দিনকুড়ি আগে দাস পাড়ার তপনদের গাভীটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। ওই হাতুড়ে পশু-ডাক্তারটার জন্যেই জলজ্যান্ত টগবগে গরুটাকে চলে যেতে হ’ল। আরে বাবা, মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চাটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই যখন তখন তুই কেসটা ধরে রাখলি কেন? কাছেই তো, ব্লক অফিসে পাশ করা সরকারি ডাক্তার ছিল। তাদের কাজই তো এইসব দেখাশোনা করা। দরকারে তারা গঞ্জের পশু হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে পারতো। সেখানে এই আপাতকালীন অবস্থা মোকাবিলা করার জন্যে যাবতীয় পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি সব আছে। তা পরিস্থিতি যে তোর বিদ্যের বাইরে সেটা কবুল করে দিলেই হত! আর তপনদের বলি, ওই আনকোরা স্বঘোষিত কোয়াক পশু-ডাক্তারের ভরসায় থাকা ওর একদম সঠিক কাজ হয়নি। মধ্যিখান থেকে বেচারা পোষ্যটার প্রাণ গেল। তপনদের বাড়ির মেয়েদের কি তীব্র আফসোস! বিশেষ করে তপনের ওই বারো বছরের মেয়েটা। গরুটাকে প্রায় কোলেপিঠে করে বড় করেছে সে। মেয়েটার ছটফটানি দেখে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছিল। তা তারাই যখন সেই আদরের পশুটাকে ভাগাড়ে দিয়ে আসতে পারে তো আমাদের প্রিয় বলদটাকে ওখানে দিয়ে আসতে অসুবিধা কোথায়।
এসেরালি, বাবুর কথার উপর আর কথা বলার চেষ্টা করেনি। ও জানে বাবু যে সিদ্ধান্তটা একবার নেয় তা সহজে ফেরায় না। তবে যুক্তি দিয়ে যদি বাবুকে বোঝানো যায় তখন সে অবুঝ হয় না। বাবুর সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে। না হলে বাড়ির লোক বলার পরেও তাদের উড়িয়ে দিত না। তবু গিন্নীমা স্বামীকে বলেছিল, “তোমার কি মায়া-দয়া, মন বলে কিছু নেই? যে পশুটা এতদিন তোমাদের সংসারের জন্যে জান কবুল করে লড়ে গেল, তাকে এইভাবে বেওয়ারিশের মত ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসবে? হতে পারে সে পশু। এতদিন তো সংসারের একজন হয়ে সে ছিল। যখন সে গতর দিচ্ছিল তখন তোমার কাছে তার মত ভাল আর কেউ ছিল না। যেই তার সব শেষ হয়ে গেল, তার কাছ থেকে পাবার আর কিছু নেই, তখন তাকে এক কথায় ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাবতে চাইলে না! তাহলে অন্যদের সঙ্গে তোমার আর তফাৎ কি রইল? এদিকে তো কথায় কথায় নিজেকে সমাজের একজন গণ্যমান্য বলে জাহির করো। লোক মান্য করে বলে তুমি তাই ভাবো। তাতে আমার কিছু বলার নেই। তবে তোমার এই সিদ্ধান্ত আমরা মন থেকে একদম মানতে পারছি না।”
নিজের বউয়ের কাছে একপ্রকার ধমকই খেল শিবুবাবু। বাবুর চোখমুখ সঙ্গে সঙ্গে থমথমে হয়ে গেল। চোখ লাল! রেগে গেলে বাবু এমনটা হয়ে যায়। সেটা এসেরালি অভিজ্ঞতা থেকে জানে। এবার বাবুর দিক থেকে আগুনের গোলা না ছোটে। সেই আশঙ্কায় এসেরালি সন্ত্রস্ত হয়ে একধারে অপেক্ষায় রইল, সময় ব্যয় না করে বাবুর কড়া আদেশ তালিমের জন্যে। রাগী বাবু এখন যা করতে বলবে, কারোর কথা না শুনে সে তাই করতে প্রস্তুত! কিন্তু না! সে পথে তার বাবু, শিবুবাবু এবার হাঁটল না। আসলে শিবুবাবু বুঝেছিল, গরুটা মারা যাওয়ায় সে যেমন দুঃখ পেয়েছে, বাড়ির আর সবাইও একই রকম মনঃকষ্টে আছে। মায় এসেরালিও। তাই এখন ইটের বদলে পাটকেল মারার সময় নয়। মানুষের মন পেতে গেলে মন দিয়ে তা জয় করতে হবে। বাবু তাই শান্তভাবে গিন্নীমা সহ বাড়ির সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “প্রবাদটা আমরা সবাই জানি, জ্যান্ত হাতির দাম যেমন লাখ টাকা, তেমনই মরা হাতির দামও তাই। জীবন্ত হাতি যেমন আমাদের কাছে বহুমূল্যবান, তেমন মৃত হাতিও। গরু হাতির থেকে চেহারায় ছোট বলে কিন্তু ওদের ছোট চোখে দেখার উপায় নেই। ওরা ওই হাতির মতই জীবন্ত এবং মৃত, মানুষের কাছে সমান মূল্যবান। এ ব্যাপারটা সাধারণ ভাবে আমরা তলিয়ে দেখিনা তাই তার প্রকৃত মূল্যায়ন আমাদের কাছে নেই। গরুকে মায়ার মোড়কে জড়িয়ে আমরা কবর বা মাটি চাপা দিয়ে তার অন্তিম কাজ সমাধা করে দিতেই পারি। এটা তো অতি সরল ঐকিক নিয়মের অঙ্কের হিসেব হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের স্মৃতি থেকে কখন যেন হারিয়ে যাবে। একটা সময় তার অস্তিত্বের কথা বেমালুম চাপা পড়ে যাবে। আমরা আমাদের নিকটাত্মীয়ের কথা মনে রাখি না তো একটা পোষ্য। আমি যে কথগুলো নিছক কথার-কথা বলছি না, তা একটু ভেবে দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে। আর যদি ওই গরুটাকে আমরা ভাগাড়ে ফেলে দিই, মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা বড় রূঢ়। কিন্তু ওই গরুটা ভাগাড়ে ফেললে প্রথমেই ছুটে আসবে আমাদের সমাজের আমাদেরই মত একদল মানুষ। ওই যে দেখোনা, পাশের গ্রাম, বয়ারিয়ার রুইদাসরা। ভাগাড়ে মরা গরু-ছাগল পড়ার সংবাদ যদি একবার ওদের কানে চলে যায় তো রক্ষে নেই। হামলে পড়বে ওই মরা গরুটার উপর! এর মানেটা কি? ওরা কিন্তু ওই মরা গরুর মাংস শকুনের মত ছেঁড়াছেঁড়ি বা ভাগাভাগি করে নেবার জন্যে আসে না। ওরা ওই গরুটার চামড়া নিতে আসে। আর এই চামড়া নিয়ে তারা তাদের জীবিকার কিছুটা উপায় খুঁজে পায়। চামড়া বিভিন্ন পদ্ধতিতে শোধন করে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে ওরা। ঘুরিয়ে সেই আমাদের গরুর চামড়া কিন্তু আমরা ব্যবহার করি। আমরা যে চামড়ার জুতো, বা চামড়ার ব্যাগ বা অন্য কোন ব্যবহারের উপযোগী জিনিস আমাদের দৈনন্দিন কাজে লাগাই তার কিছুটা তো আমাদের এই গরুর চামড়া থেকে হবে। এই রুইদাস বা মুচি-চর্মকারদের হাত ধরেই তো সেটা আমাদের কাছে আসে। তাহলে তোমরা একবার বোঝার চেষ্টা করো যে, আমাদের গরু মরার পরেও আমাদের কত কাজে লাগে। আমরা উপকৃত হচ্ছি এর দ্বারা। শুধু আমরা নই, ওই মুচিরাও এদের চামড়ার নানান দ্রব্য তৈরী করে পেটের ভাত জোগাড় করছে। বেঁচে বর্তে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে এসেরালির চোখের সামনে ভেসে উঠল, ভাগাড়ে গরু পড়লে তার আশেপাশের আকাশের মাথায় বড় বড় শকুনের চক্কর মারা দৃশ্য, “শুধু আমরা একাই ফায়দা নিচ্ছি না কিন্তু বাবু। আমাদের মত জান-প্রাণ নিয়ে টিকে থাকা আর এক প্রাণীজাতীও উপকৃত হচ্ছে। ওই যে গো বাবু, শকুনদের কথা বলছি।”
শকুনের কথা কানে আসতেই এসেরালিকে থামিয়ে দিয়ে শিবুবাবু বলল, “তোর কথা তো চাঁদ-সূর্যর মত সত্যি কথা রে এসেরালি। ওই শকুনরা কোথায় থাকে কে জানে। ভাগাড়ে একবার গরু পড়লে দূরদূরান্ত থেকে ঠিক তাদের নজরে পড়ে যায়। আসলে কি জানিস, পেটের জ্বালা তো সবার। তোর আমার মুচিদের যেমন, তেমন শকুনদেরও। ওরা প্রাণীকুলের মরা মাংস খেয়েই বেঁচে থাকে বলা যায়। মরা মাংস ওদের ভীষণ প্রিয়। তাই পেটের দায়ে ওরা এখানে ছুটে আসে। এমনিতে কথায় বলে না, “শকুনের লক্ষ্য ভাগাড়ের দিকে।”
কোন এলাকায় কোথায় ভাগাড় আছে তা ওদের নখদর্পনে। সেই দূর আকাশ থেকে ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেইসব ভাগাড় অঞ্চলের দিকে। তা আমাদের গরুকে যদি আমরা মাটিতে গোর দিয়ে দিই এরাও বা প্রাণ ধরে রাখে কেমন করে। পরিবেশে প্রাণ ধারণের অধিকার সবার আছে রে এসেরালি। সৃষ্টিকর্তা সবকিছুর ব্যবস্থা করেই জীব সৃষ্টি করেছে। তার জন্যে সৃষ্টিকর্তাই খাদ্যশৃঙ্খলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু কি জানিস এসেরালি, দিন যত এগোচ্ছে মানুষ যত আধুনিক সভ্যতার দিকে পা বাড়াচ্ছে। একটা অশনি সংকেত কিন্তু আমাদের সামনে এসে উঁকি মারছে। হয়তো আমাদের এই চলতি জীবন- ছন্দ আমরা আর ধরে রাখতে পারব না। চাষবাষের ক্ষেত্রে যেভাবে আধুনিক মেশিনপত্র বাজারে এসে পড়ছে, বেশি দূরে নয় সেই দিন, যে দিন ওই মেশিনই চাষ আবাদের সব কাজ করে দেবে। অবলুপ্তির আর সেই দিন বেশি বাকি নেই যেদিন মানুষের নিজ হাতে করা এখনকার এই নাঙল-জোল-গরু দিয়ে মাটি চষা, ধান বোনা, ধান কাটা, ঝাড়া। সব-সব সবকিছুই মেশিন করে দেবে। এতে হবে কি বল তো এসেরালি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই গৃহপালিত পশুরাও একটা দিন অবলুপ্তির তালিকায় স্থান করে নেবে। ওদের সাথে সাথে মানুষও অস্তিত্বর সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। যদি তাড়াতাড়ি চলে যাই তাহলে হয়তো আমি তা দেখে যেত পারবো না। আমার আর ক’দিন। দেখতে দেখতে ষাট তো টপকে দিলাম। কিন্তু তোদের কি হবে! বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো সেই হাহাকারের মুখোমুখি হতে বাধ্য। আমাদের দেশে চাষ-আবাদ করার জন্য বলদ গরু আর হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। একধামা চালে একটা কুরুই খুঁজে পাবার মত ধুঁড়ে, মানে সন্ধানে বেড়াতে হবে ওই বলদ জোড়ার জন্যে। যে দু’চার গাছা থাকবে তাদের ডাক অবশ্য আকাশছোঁয়া হবে, এটা ঠিক। তাছাড়া যত এ্যঁড়া বাছুর হবে, সব বড় হবে মাংস জোগান দেবার জন্যে। বগনা বাছুর বা গাভীরা অবশ্য আদরে বেঁচে বর্তে থাকবে, তারা দুধ দেয় বলে। এতে হবে কি বলতো এসেরালি, তোদের মত হেলো বা অন্য চাষীরা আর তেমন কাজ পাবে না। হেলোরা তো সত্যি সত্যি হারিয়েই যাবে। এসেরালি হেলো, জব্বর হেলো বলে এখন তোর যে কদর তা আর থাকবে না। আমার সামনের দৃষ্টি সেই কথারই আভাষ দেয়। তবে এসেরালি এখনই তোর ভেঙে পড়ার দরকার নেই। তুই আর একটা তাগড়াই বলদের খোঁজ কর। সে যেন আমাদের কালোটার সঙ্গে জোঝার ক্ষমতা রাখে। আমি যদ্দিন আছি তোর কাজ হারাবার ভয় নেই। আমি বেঁচে থাকতে আমার হালের কাঁড়া আমি নষ্ট করব না। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমার বংশধররা যদি তা ধরে রাখতে না পারে তো যা হবার তাই হবে।”যে কথা বলতে বলতে শিবুবাবু অন্য টানে ফিরে গেছিল, সেখান থেকে ফিরে এসে বলল, “হ্যাঁ কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। বলছিলাম কি শুধু শকুনরা যে ভাগাড়ের মাংস খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকে তা তো নয়, রাতের বেলা হুক্কা হু ডাকে সদলবলে শেয়ালেরা যেভাবে এখানে আনন্দের আসর বসায় তা তো হেলাফেলার ব্যাপার নয়। শেয়ালেরা এখানে নিজেদের খাবার অনেকটা পেয়ে যায় বলেই না আমাদের বাড়ির হাঁস মুরগি ছাগলরা ওদের লালসার হাত থেকে রেহাই পায়। রেহাই একদম পায় তা বলা যাবে না। ওই হেংলা জাতটা সুযোগ পেলেই তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না। তবু ভাগাড় না থাকলে ওদের অত্যাচারে পাড়ার চোখে ঘুম ছুটে যেত। জানিস এসেরালি, এবার সেই ঘুম ছুটে যাবার দিন আগুয়ান। সমাজে গরু না থাকলে ভাগাড়ও যে কান্নায় ভাসাবে। তার সাথে সাথে পরিবেশের যে খাদ্যশৃঙ্খল সেখানেও জবরদস্ত হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে যাবে। পরিবেশের জন্যে মহামূল্যবান এই শকুন বলে প্রাণীটাই পৃথিবীতে লুপ্তপ্রায় জাতি বনে না যায়।”
বাবুর কথায় এসেরালি বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। প্রাণীরা তো যাবে। সমাজ থেকে বলদ বিলীন হয়ে গেলে তাদেরই বা কি হবে। তাদের মত হেলো শ্রেণীটারও কি সমাধি ঘটবে? তাহলে সে খাবে কি! সংসার নিয়ে ছোট ছোট ছেলেপুলেদের পেটে চার-ছ’টা দানা বা জোগাবে কেমন করে! এই বয়সে চাষের কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজ তার জানা নেই। নতুন করে কাজ শেখার সেই সুযোগই বা কে দেবে?[ চার ]
পরেশ রুইদাস নিজের জীবিকার হাতিয়ার, কোমরে থাকা গরু-ছাগলের চামড়া কাটা ছুরি দিয়েই খুন করেছিল রাধাকান্ত ঋষিদাসকে। ওদের রুইদাস পাড়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোন খুনের ঘটনা ঘটল। সেটা মেয়ে-মদ্দ সমেত পাড়ার কেউই মেনে নিতে পারেনি। তার থেকেও বড় কথা তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার সেই ‘গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো’ ছুরি দিয়ে মানুষ কাটা! তাদের সমাজ এই ছুরি বাবা বিশ্বকর্মার কাছে সমর্পণ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। ভগবানের কাছে এই ছুরি পূজিত। তা দিয়ে কেউ কোনভাবে কোন অপরাধমূলক কাজ করতে পারে না।
মতামতটা এককভাবে প্রকাশ্যে কেউ তুলছে না। অথচ পাড়া প্রতিবেশীর মুখে মুখে চাউর হয়ে চলেছে। পাড়ার মাতব্বর, রতন-নন্দদের কানেও সেটা চলে যায়। রতনের বউয়ের কাছ থেকে রতন প্রথম শোনে। নন্দর কাছে কথাটা পাড়তে সে রতনকে বলে, “হ্যাঁ রে রতন, আটচালার কাছ দিয়ে আসার সময় আমি ব্যাপারটা শুনতে পাই। একদল বউ আটচালায় বসে এইসব কথা নিয়ে গুলতানি করছিল। তা ওরা যা বলছে, খুব একটা আজেবাজে কিছু বলছেনা রে। ঠিকই তো, যে হাতিয়ার ঠাকুরের কাছে সঁপে পুজো দিয়ে আমরা মানত করি। ঠাকুর যেন চিরকাল এই হাতিয়ার সচল রাখে। তাহলে আমরা বেঁচেবর্তে থাকতে পারি। সেটার অপব্যবহার করা একদম ঠিক কাজ না। পরেশ যে অন্যায় কাজ করেছে তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। এমনিতে দেশের আইনের দিক থেকে সে অপরাধী গণ্য হওয়ায় তার জেল-জরিমানা হয়েছে। সে তো একটা দিক। আর একটা অন্যায় করেছে, অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার না করে পরেশ অহরহ আমাদের ট্যাঁকে রাখা জীবিকা রক্ষার অস্ত্র অপব্যবহার করেছে। আটচালায় আমাদের বসতে হবে রতন। এই অপব্যবহার আটকাতে পাড়াকে একটা আদেশ শোনাতে হবে। না হলে অন্য কেউ আবার এই অন্যায় করে বসতে পারে।”
নন্দর কথা পুরোপুরি সমর্থন করল রতন। তারপর ও মনে মনে ভাবতে লাগল, পরেশ রুইদাস মানুষটা কিন্তু কোনদিন খুন-খারাপি করার মত হ্যাঁকাতে মানুষ ছিল না। মানুষের সঙ্গে কোনদিন মুখ তুলে চেঁচামেচি বা ঝগড়া করতে তাকে কেউ দেখেনি। বরং উল্টে হেসে-খেলে সকলের সাথে ভাব-ভালবাসা রেখে চলে। তাই খুনে-পরেশের পরিবারকে যখন গ্রাম ছাড়ার নিদেন আটচালা থেকে দেওয়া হ’ল, তার পরের দিনই পরেশের বউ বলেছিল, রতনকেই হাত ধরে বলেছিল, “ঠাকুরপো, তোমরা শুধু ওর খুন করাটা দেখলে। আমি তো বলছি না ও কাজটা ঠিক করেছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া ওর ঠিক কাজ হয়নি। কিন্তু ও কি কোনদিন এরকম বেয়াড়া চরিত্রের মানুষ ছিল। তোমরা তো ওর সঙ্গে মেলামেশা করতে। জ্বালাধরা বুক নিয়ে ভুলবশত একটা বাজে কাজ সে করে ফেলেছে। কিন্তু কেন করেছে সেটা কেউ একবার তলিয়ে দেখল না, শালিশিতে আমি কতবার সেই কথাটা বলতে চেয়েছি। কিন্তু সকলের তার ওপর এত রাগ যে তার হয়ে বলা কোন কথা কেউ কানে তুলতে চাইল না। তুমি বুঝদার মানুষ হিসেবে আলাদা করে তোমাকেও বোঝাতে চাইলাম। ওদের চাপে তুমিও আমার দিকে নজর দিয়েও মুখ ঘুরিয়ে নিলে। জানো ওইসময় সাতদিন আমাদের সংসারে কারোর পেটে চালের দানাও পড়েনি। এবারের বর্ষায় জমিজিরেত বৃষ্টির জমা জলে সব পচে হেজে গেছে। সে তো সকলের গেছে। চাষ না হলে আর খোরোয় ধান তোলা, ধান ঝাড়ার কাজ হবে কি করে। সেটা তোমরাও দেখতে পাচ্ছো। বলতে গেলে কারোরই মাঠের কাজ নেই। নগদ পয়সার টান। শীতের ‘তাইচুন’ চাষ শুরু হলে তবে কাজ পাওয়া যাবে। আর খেঁজুর গাছ কাটা সবে শুরু হয়েছে। যে দু’চারটে পয়সা হাতে আসছে তা দেনার গব্বে ঢুকে যাচ্ছে। চাষ বেয়নে লোকের হাতেও পয়সার টান। বেত কাঁধে চড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঢুঁ মারতে মারতে কাহিল। তবু কেউ আর কাজ করায় না। দু’বছরের ছেলে লোচন যখন ‘কি খাবো কি খাবো বলে’ আমার কাছে চেল্লায় তখন তার বাপের মাথা গরম হয়ে ওঠে। এমন এক ধমক দেয় ছেলেকে। সে তো চমকে উঠে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলে। গাল ফুলে ফোঁপাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে কোলের বাচ্চাটাকে সামলাতে আমি আমার শুকনো বুক দুটো পাল্টাপাল্টি ওর মুখে গুঁজে ধরে থাকি। কিছুক্ষণের জন্যে চুপ মেরে যায় বাচ্চাটা। অপদার্থ মা আমিও চোখের জল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেই দেখে আর বাড়িতে থির থাকতে পারে না বাপটা। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে। সন্ধ্যের আগে কাঁধে বেত আর হাতে বাটালি নিয়ে খালি হাতে ফিরে হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে মাখা নীচু করে দাওয়ায় বসে থাকে। আমি মেয়েমানুষ আর কি করি। লোকের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা ভাতের ফ্যান ওনার জন্যে একটু রেখে দিই। শরীরের ধকল থিতিয়ে গায়ের ঘামটা মিলিয়ে গেলে বলি, “এই ফ্যানটুকু চুঁচে খেয়ে নাও। আজও রান্নাবান্না কিছু হয়নি। কচু শাকের ঘ্যাঁট আর কাঠখোলা কলমি শাকের ভাজা আছে। চান সেরে এসে খেয়ে নেবে।”
খুনে-পরেশের বোয়ের কথা শুনতে শুনতে রতন একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ভাবছিল, পরেশটা তখন খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। সত্যি তো, এটা তো সে দেখেছে রান্না চড়াবার আগেই রান্নাঘরে তার বউয়ের হাতে পরেশের বউ একটা ডেকচি ধরিয়ে দিয়ে বলছে, “তোমাদের ভাতের ফ্যান ঝাড়া হয়ে গেলে তা এই ডেকচিতে ঢেলে রান্নাঘরের দরজার একপাশে রেখে দিও। সময়মত এসে আমি নিয়ে যাবো।” বউটা তখন তারপর কি বলে চলেছে তার আওয়াজ কানে ঢুকলেও, কি বলছে তা ভেতরে যেন সেঁধাচ্ছিল না। হঠাৎ মুখ ফুটে মেয়েমানুষের করুণ আওয়াজের কান্না তার ভেতরে ধাক্কা মারতে সম্বিৎ ফেরে রতনের। কাঁদতে কাঁদতে পরেশের বউ বলছে, “সারারাত তো দু’চোখ এক করল না মানুষটা। পেটের জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মরদের চোখ না বুজলে মেয়েমানুষ কেমন করে ঘুমকে বশ মানাবে। সেও রাতজাগা। শীতের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই খেঁজুররস কাটার হেঁসো আর কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিন আর একটু পরে বার হয়। সেও তখন বিছানা ছেড়ে উঠোন ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। তারপর ঘর-দাবা নিকোন দেবে। আস্তে আস্তে এ পাড়া, পালপাড়া থেকে এক এক করে রস খাবার জন্যে আমাদের দাবায় জড়ো হতে শুরু করেছে। আমি ঘর-দালান, উঠোন পরিস্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওরা নেশা চটকে এক একজন একেক রকম বকর বকর করতে করতে একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের উঠোন ছাড়তে শুরু করে। অন্য ঠেকে যাবার কথা বলে চলে যায়। পাল পাড়ার নিতাই আরও খানিক বসে যেদিকে ওর বাপ রস কাটতে গেছে সেই গাছের গোড়াতে খোঁজ করতে চলে যায়। আমি ‘কু’ কিছু না ভেবে আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তারপর তো শুনি ওই ভাগাড়েই রাধাকান্তর সঙ্গে মারপিট করতে করতে তার বুকে ছুরি চালিয়ে দেয় লোচনের বাপ। ঘরে ফিরতে দেখি ধস্তাধস্তিতে তারও ডান হাতের দাবনার কাছ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ম্যালেরিয়া গাছের পাতা কচলে তার রস সমেত দলানো পাতা চেপে নেকড়া দিয়ে বেঁধে রক্ত বন্ধ করি আমি। কে আগে নিশান দেখেছে চামড়াটা কার পাওনা হবে তার চুলচেরা বিচার পরে হতে পারতো। তাই বলে মানুষ খুনের কাজটা ঠিক করেনি লোচনের বাপ। ছালটা ছাড়িয়ে এসে আটচালায় বিচার-শালিশি বসাতে পারতো ওরা। আসলে ক’দিনের জীবনযন্ত্রণা ওকে দিশাহারা করে তুলেছে। কিছুতেই ও চামড়াটা হাতছাড়া করতে দিতে চায়নি। রাধাকান্তও গোঁও ধরে, বলে ও নাকি আগে নিশান দেখেছে। রাধাকান্ত ছিল দিঘিরপাড় বাজারে। তখন ও রাতে অমিত মুদির দোকান মুনতে যেতো। ভোরে পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে ও নাকি প্রথম শকুনের চক্করমারা নিশান দেখেছে। বিবাদ শুরু এই নিয়ে। কে আগে নিশান দেখেছে। কে দেবে তার প্রমাণ! কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। এবার রতন ঠাকুরপো তুমি বলো, লোচনের বাপ কি ভাগাড়ে গিয়েছিল রাধাকান্তর বুকে ছুরি বসাতে না গরুর চামড়া ছাড়াতে। এক কাজে গেল আর এক কাজ করে ফেলল লোকটা। আমি এখন কি করি, কোথায় যাই। তোমরা আমাদের পাড়া ছাড়ার নিদান দিলে! ওই দুধের বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি তো এখন জলে ভাসলুম গো ঠাকুরপো। এই শিশুটার মুখ চেয়ে আমার প্রতি একটু দয়া করতে পারলে না তোমরা! পাড়া আমাকে ছাড়তেই হবে, ঠাকুরপো?”
পরেশের বোয়ের পাড়া না-ছাড়ার সেই করুণ আকুতি তখন রতনের ভেতরকে দুমড়ে দিতে থাকে। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। গলার স্বরযন্ত্রর উপর শক্ত কিছু যেন টোপলা হয়ে আটকে আছে। পাড়ার সকলে এক মত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে একা বা সে আর নন্দ মিলে এটা করেনি। শুধু সে সিদ্ধান্তটা সকলের হয়ে আটচালার সামনে তুলে ধরেছে। তাই সব দোষ যেন তার ঘাড়ে এসে পড়ছে। একবার মনে হচ্ছে, সত্যি তো ওই অসহায় মেয়েমানুষটা দুধের শিশুটাকে নিয়ে যাবেই বা কোথায়। আবার ভাবছে, এদের পাড়াছাড়া না করলে জেল থেকে ওই খুনেটা ছাড়া পেলে তো আবার বউ-বাচ্চার কাছে এই পাড়াতেই ফিরবে। শুনেছে জেল ফেরত আসামীরা নাকি বেশিরভাগই ভীষণ বেপরোয়া হয়ে যায়। পুনরায় অপরাধ ঘটানোর সাহস জেল থেকে জুগিয়ে নিয়ে আসে। সংশোধনাগারে শুদ্ধ না হয়ে এসে আরও দাগী অপরাধী বনে যায়। কেউ কেউ আবার শুধরেও যায়। তবে তা নাকি খুবই নগণ্য। তা তাদের পরেশ যদি সেই নগণ্যর মধ্যে না থাকে তো পাড়ার পক্ষে আরও বিপদ! তার থেকে বরং বিপদের বীজ মূল থেকে উৎপাটন করাই ঠিক কাজ হবে। এই ভাবনা ভেতরে ভেতরে জারিয়ে রতন যেন নিজেকে মনে মনে শক্ত করে নিতে পারল। পরেশের বউকে বলল, “না গো লোচনের মা। তুমি আলাদা করে আমার কাছে আর্জি জানাচ্ছো বটে, তবে এখানে আমার কিচ্ছু করার নেই। হয়তো আমি আটচালায় তোমাদের রায়টা শুনিয়েছি। কিন্তু তুমি তো দেখেছো, এই রায় আমাদের দু’একজনের নয়। পাড়ার সকলে তাতে মত দিয়েছে। পাড়ার মত উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই।”
রতন দেখল তার রায় শোনার পর আর একটা শব্দও ব্যয় করল না পরেশের বউ। আটচালা থেকে হনহন করে পাশে তার ঘরে চলে গেল। বাচ্চাটার কান্নার শব্দ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিল। হয়তো তার খিদে পেয়েছে। হয়তো দু’বছরের প্রায়-শুকনো বুক দুটো তার মুখে গুঁজে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
পরেশের বউকে পাড়া ছাড়ার জন্যে তিনমাস সময় দিয়েছিল আটচালা। এই সময়ের মধ্যেই পাড়া ছাড়তে হবে তাকে। কোথায় যাবে কি করবে তার দায় আটচালার নয়। নিদানটায় রতন মন থেকে বেশ দ্বিধায় ছিল। সত্যি তো, ওই ভরা যৌবন নিয়ে মেয়েটা যাবে কোথায়। নিজের বোয়ের মুখটা ভেসে উঠল। ভেসে উঠল তার তিন বছরের সনাতনের হাসি খিলখিলে মুখটা। কষ্ট হচ্ছে রতনের ভেতরটা। কিন্তু সেই কষ্টটা বাইরে ওগরাতে পারছে না। এ তো আর এক অর্ন্তজ্বালা বাসা বাঁধল তার মধ্যে। পরেশের বোয়ের যৌবন যদি নাকাল হয় তো তার দায় সেও তো এড়াতে পারবে না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে চুপ মেরে রইল। একদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না রতন। সনাতনের মা’কে মনের কথা উগরে দিল। সনাতনের মা-ও স্বামীর মতে মত দিয়ে বলল, “ঠিকই তো, অপরাধ করল যে জন সে তো শাস্তি পেয়েছে। ফাঁসিতে লটকাতে লটকাতে তা রদ হয়ে যাবৎজীবন হয়েছে। তারপর তার ঘরের নিরাপরাধ প্রাণীগুলো শাস্তি পাবে কেন? তারা কি অন্যায় করল! এক অপরাধে দু’দফায় শাস্তি কেন? এটা পুলিশ-সরকারের দেখা উচিত। তোমাদের আটচালা এই নিদান দিয়ে একদম ঠিক কাজ করেনি। লোচনের মা থানায় যাচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। তার এতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে দেখে থানা কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারবে না। তারা এর একটা বিহিত করতই।” সনাতনের মায়ের কথায় সায় দিয়েও রতন বলল, “মরিয়া পরেশের বউ গিয়েছিল থানায়। নালিশ জানিয়েছিল আমাদের আটচালার বিরুদ্ধে। কিন্তু থানা কোন উচ্চবাচ্য করল না। যেহেতু সিদ্ধান্তটা আটচালার। ওরা জানে আটচালার সিদ্ধান্ত মানে সারা পাড়ার লোক একমত হয়ে নিদানটা দিয়েছে। তাই পাড়ার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করলে পাড়া যদি খেপে গিয়ে থানায় হামলা করে বসে? সেই ঝুঁকি থানা নিতে চাইল না। ঘাপটি মেরে বসে গেল। তারা খুব ভাল করে জানে ওই মুখ্যুসুখ্যু মেয়েমানুষটা থানা টপকে উপরে নালিশ জানাবার সাহস দেখাবে না। হয়তো সে জানেও না যে থানার বিরুদ্ধেও কোথাও নালিশ জানানো যায়।”
সত্যিই জানা নেই লোচনের মায়ের। রতনরাও তা জানিয়ে ঘোলা জল আরও ঘোলা করতে চাইল না। একজনের বিপদে পাশে না দাঁড়ানোটা ঠিক কাজ নয় জেনেও রতন চুপ মেরে গেল শুধু তার বউ-বাচ্চার মুখ চেয়ে। আটচালার বিরুদ্ধে কথা বলে যদি তার উপর আটচালার খাঁড়া এসে পড়ে? পরেশের ভরা যৌবনা বোয়ের সঙ্গে তার কোন গোপন সম্পর্কের কথা তুলে যদি তাকেও পাড়া ছাড়ার নিদান আটচালা দিয়ে বসে? এইসব পরকিয়ার ঘটনায় আগে তো দুই জোড়াকে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে আটচালা। আটচালা পাড়াটাকে একদম শুদ্ধ মঠ-মন্দির করে রাখতে চায়। এখানে কোন বেলেল্লাপনা চলবে না। কিন্তু এত শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও পাড়ায় কি পরকিয়া প্রেম ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে? যায়নি। গোপনে রাসখেলা সমানে জারি রয়েছে। কথায় বলে না, ‘চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে, যদি না পড়ে ধরা।’ এখানেও তাই, ধরা পড়লে তখন সে অসচ্চরিত্র, না পড়লে সাধু ! রতন একটা জিনিস ভেবে কুল পায় না, আটচালার এত কড়া শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও যৌবন কেমন করে এত বেপরোয়া, ছন্নছাড়া হয়! এটা কি প্রকৃতির সহজাত প্রবণতা! যুগে যুগে যা কোনদিন কোন নিয়মনীতি দিয়ে বশে রাখতে পারেনি!
সেদিনের পর থেকে পরেশের বউ রোজ ভোরবেলা বাচ্চাটাকে কাঁখে বেঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ফেরে সন্ধ্যে অনেকটা পার করে রাতের কাছাকাছি। পাড়ার মেয়েমানুষদের কানে কানে কানাকানি হয়ে কথাটা রতনের কানে এসেছে, পরেশের বউ নাকি কোলকাতার কোন বাবুর বাড়ি কাজে যায়। বাচ্চাটাকে সারাদিন রাখার জন্যে এবং সেও দিনমানে কাজের ফাঁকে ছেলের পাশে থেকে কিছুক্ষণ জিরেনের জন্যে বাবুরা তাদের সিঁড়ির নীচে ছোট্ট একটা কুঠরী দিয়েছে। কথাটা নিশ্চয়ই পরেশের বউ পাড়ার মেয়েদের কারোর কাছে গল্প করেছে। না হলে মেয়েরা বা জানবে কেমন করে। রতনের মনে হল পরেশের বোয়ের এই কাজটা মনে ধরেছে। তাই কোনদিন কাজে কামাই দিত না। মানবিকতার খাতিরে গ্রাম ছাড়ার জন্যে ওকে তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছিল। একা মেয়েছেলে, সাত দিনের নোটিশে বাড়ি ছাড়তে বলাটা অন্যায় কাজ হবে। তাকে গুছিয়ে নিতে সময় দেওয়া দরকার। আটচালা থেকে কেউ আবার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গ্রামছাড়ার কথা তুলেছিল। শেষমেষ ওই তিন মাস ওকে সময় দেওয়া সাব্যস্ত হয়। কিন্তু রতনের মনে হল এই নিদানের বিরুদ্ধে অপমানে ক্ষুব্ধ পরেশের বউ আটচালার মুখে বিষ্ঠা ঢেলে তিরিশ দিন গড়াতে না গড়াতেই পাড়ার আদেশ তামিল করল। একমাস গড়ানোর আগেই হঠাৎ দেখা গেল পরেশের বউকে ছেলে কাঁখে জড়িয়ে আর রাতে বাড়ি ফিরছে না ! সেই যে তালা দিয়ে গেল আর সে তালা খুলতে এল না।
আটচালার পাশেই তো পরেশ রুইদাসের বাড়ি। বাড়ির সামনে পেছনে বেশ খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা আছে। সাকুল্যে জায়গাটা হয়তো খুব বেশি নয়। কাঠা আড়াই-তিনেক হবে। কিন্তু অতটা জায়গার মধ্যে এক কামরা ঘর, একটা পাশকামরা আর সামনে দাওয়া নিয়ে ছোট্ট বাড়ি বলে মনে হয় অনেকটা জায়গা। সেই জায়গায় টুকটাক মরসুমী শব্জিও ফলাতো পরেশের বউ। বহুদিন ব্যবহার না করে করে জায়গাটা পোড়ো হয়ে গেছে। জঙ্গল গজাতে গজাতে এখন ওখানে মানুষ ঢুকতে ভয় করে। আর ঘরের ভেতর কত না সাপখোপের বিছের বা অন্য বিষাক্ত পোকামাকড়ের আস্তানা হয়েছে কে জানে। যেহেতু পাশেই আটচালা, দিনে রাতে পাড়ার সবাই এখানে বসে, আড্ডা দেয় তাই ভয় করে হঠাৎ ওই জঙ্গল ফুঁড়ে কোন বিষধর না আক্রমণ করে! তাই কেউ কেউ কথা তুলতে শুরু করেছে, পরেশের ওই পোড়ো জায়গাটা আটচালা দখল করে নিক। পরে যখন ওরা কেউ জায়গার দাবি নিয়ে আসবে তখন তাকে মূল্য ধরে দিলে চলবে। ওই গোটা জায়গা নিয়ে আটচালাটা বড় করে তৈরী করা হোক। তাহলে হাত-পা ছড়িয়ে সকলে বসতে পারে, গড়াগড়ি খেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ওই জঙ্গলের হাত থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া যায়। নাহলে আটচালায় এসে কারোর কোন ক্ষতি হলে পরেশের বউ দায় নেবে নাকি? ও আবার কি দায় নেবে, ক্ষতি তো যার হবার হয়ে যাবে। সে ক্ষতি আর পূরণ হবার না।
রতন-নন্দরা দেখল, এই জঙ্গল জঙ্গল করে অজুহাত দেখিয়ে সত্যি সত্যি না একদিন কেউ জায়গাটা দখল করে নেয়। এটা খুবই অনুচিত কাজ হবে। ওরা নিশ্চিত, এই জায়গার টানে ওদের কেউ না কেউ একদিন এদিকে আসবে। বেদখল হলেই জায়গার অধিকার দাবি করবে। থানা-পুলিশ, আইন-আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে আর এক নতুন বিপত্তি এসে জুটবে। তার থেকে আটচালা থেকে এই পোড়ো জায়গাটা নিয়ে একটা বিধান দেওয়া ভাল। সেই ভাবনা মত একদিন আটচালা বসে সিদ্ধান্ত নিল, খুনে পরেশের ওই জায়গা পাড়ার কেউ কোনদিন সরাসরি পরেশের বউ বা তার কোন বংশধরের কাছ থেকে কিনতে পারবে না। যে সেই অপচেষ্টা করবে তাকেও পাড়াছাড়া করা হবে। আটচালাও ওই জায়গা দখল বা কেনাকাটার মধ্যে যাবে না। ওটা পরেশের ভদ্রাসন। পরেশের রায়ত সম্পত্তি। পরেশ জেলখাটার মেয়াদ শেষে যদি বেঁচে থাকে তো সে ঠিক করবে বা তার বংশধর কেউ ভাববে, কি করা যায় ওটা নিয়ে। বসবাস তো ওদের কেউ করতে পারবে না। একমাত্র আটচালার জন্যে বা বেপাড়ার কাউকে যদি তারা ওই জায়গা লিখে দেয় তো তার একটা হিল্লে হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের কথা উঠতে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আটচালা থেকে খরচ করে বছরে একবার জঙ্গল পরিস্কার করা হবে। সেই খরচের হিসেব রেখে দেওয়া হবে। ওই জায়গা যখন ওরা সাফকোবলা করতে আসবে তখন কড়ায় গন্ডায় তা হিসেব করে নিয়ে নেওয়া হবে। জঙ্গল সাফাইয়ের পয়সা দিতে অস্বীকার করলে যে জায়গা কিনবে তাকে দখল নিতে দেওয়া হবে না। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে চুপিসাড়ে জায়গাটা হাতবদল হয়ে যাবে আমরা নাও বুঝতে পারি। কিন্তু দখল তো সেই ক্রেতাকে নিতে আসতে হবে। তখন আদর করে তাকে বলা হবে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর!’ জঙ্গল সাফাইয়ের খরচা মেটাও, জায়গার দখল নাও। এখানে কোন ওজর আপত্তি খাটবে না। আটচালার পাশের জায়গা জঙ্গল হয়ে থাকবে। আর সাপ বিছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে থাকবে, তারপর? সবসময় এখানে লোক বসে। সাপের কামড়ে কেউ যদি মরে যায় ক্ষতিটা কার হবে?ক্রমশ…..
-
ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১)
(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদারক’দিন ধরে শিবুবাবুর সাদা বলদটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বি.ডি.ও. অফিসের পশু-ডাক্তারের কাছে কয়েকবার নিয়ে গেছে এসেরালি। সঙ্গে মণিব, শিবুবাবুও ছিল। গরুর ব্যাপারে তাকে সবসময় জড়িয়ে রাখে শিবুবাবু। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, তবু গরুটার মুখে খাবার রুচি ফেরেনি। আরও যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মন খারাপ শিবুবাবুর। সাদা আর কালো বলদ-দুটো তার ভীষণ ‘পয়া’ ছিল। কোন হেলদোল ছাড়াই বছরের পর বছর তাদের জোতে হাল টেনে গেছে অবলীলায়। যেমন তাদের তাগড়াই চেহারা তেমন গতরের তাকত। কত লোকে এদের দেখে হিংসে করেছে। আসলে আশেপাশে দু’পাঁচটা গ্রাম ঢুঁড়লেও এমন জোড়া বলদের খোঁজ মেলা ভার। দাদাগিরিও এদের দু’জনের কম ছিল না। এখন সাদাটা দমে গিয়ে দু’জনেরই দাপাদাপি থমকেছে। কালোটাও যেন তার অসুস্থ জুড়িদারের জন্যে মন মরা। নইলে ওটাই তো নাটের গুরু। বেড়ালের গলায় ঘন্টা তো ওটাই প্রথম বাঁধতে উদ্যত হয়। আর তাতে দোয়ার্কি দেবার মত কালোর সঙ্গে তাল মেলায় সাদা। ওদের যাওয়া আসার পথে অন্য কোন গরুকুলের ঘুরঘুর করার আইন নেই। বিশেষ করে কোনো জোড়া-বলদের। সেই হেলোকে তৎপর হয়ে নিজের জোড়াকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে এদের যাবার রাস্তা করে দিতেই হবে। ব্যাপারটা অন্য কোন নতুন হেলোর জানা না থাকলে বিপদ। প্রবল বেগে গুঁতিয়ে তাদের কাহিল করে তবে ক্ষান্ত হবে এরা। তখনই শুরু হয় চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি। এসেরালিকে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে। মেজাজ ধরে রাখতে না পারলে কখনো কখনো নিজের ঘর সামলাতে মোটা কঞ্চির ঘায়ে এদের সারা গায়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছে সে। পরে আবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। অবলা পশু। এতটা মারধর করা তার ঠিক হয়নি। ওরা তো অমনই। ওরা কি মানুষ? শাসন করলে শুধরোবে? পুনরায় এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে ওরা এমনটাই করবে। শিবুবাবুকে সব জানিয়ে রাখে। বাবু তাকে কিছু বলে না। বাবু জানে এসেরালি গরু দুটোকে কতটা নিজের মত দেখে। শুধু বলে, “বড্ড বজ্জাত ও দুটো। নাটের গুরু তো ওই কালোটা। আর সাথীর তালে তাল না দিলে তো সাথী বিপদে পড়ে যেতে পারে, তাই সাদাটাও নেবে পড়ে রণক্ষেত্রে। দেখ এসেরালি, পশুরাও কেমন দরকারে বন্ধুর পাশে দাঁড়ায়! আমরা মানুষরা যদি এমন হতাম, সমাজজীবনটা এত জটিল হোত না।” আবার অনেকে তারিফও করেছে। বলেছে, এমন হৃষ্টপুষ্ট জোড়াবলদ পাওয়াও ভাগ্যের দরকার। জানো এসেরালি তোমার বাবুর কপাল ভাল, তাই এদের সঙ্গে সঙ্গে তোমার মত দায়িত্ববান হেলোও পেয়ে গেছে। এদের নিয়ে মনের মধ্যে তখন গর্ব উগরে উঠত শিবুবাবুর। কথার ছত্রছায়ায় তা জানানও দিয়েছে শিবুবাবু। এসেরালির নজর এড়ায়নি। গর্র তার মধ্যেও কম হয়নি। এমন জোড়া দুটোর চালনার দায়িত্ব পাওয়াটাও তো কম কথা না। তাকত বলদের তাকতওলা হেলো না হলে তাদের বশে রাখাটা অত সোজা কাজ না। তাই সুবিধে অসুবিধেয় এসেরালি কোনদিন কাজে কামাই দিলে শিবুবাবুর মাথায় হাত পড়ে যায়। এর কারণও আছে। অন্য কোন হেলো এই বলদ জোড়াকে নিয়ে হাল চষার কাজ সামাল দিতে পারে না। ওদের তালে তাল মিলিয়ে চলায় যে খাটনি তা তাদের সয় না। তাছাড়া জোড়া দুটোও অন্য হেলোর কথা শুনতে চায় না। লেজ মটকে বাঁদিকে যেতে বললে তারা ডানদিকে ছোটে। এসেরালি কিন্তু কোনদিন এদের কারোর লেজ মটকায়নি। হাল পরিচালনার এই মুদ্রাটা এরা একদম মেনে নিতে পারে না। বিদ্রোহ করবেই করবে। কাঁধে জোল, হাল সমেত তারা ছোটাছুটি লাগিয়ে দেবে। তখন কোন নিয়ম অনুশাসনকে তারা তোয়াক্কা করে না। প্রথম প্রথম এদের সামলাতে তাই এসেরালির বড্ড বেগ পেতে হয়েছিল। চিন্তায় পড়ে গেছিল সে। গরুদুটো এমন লাগামছাড়া হলে সে কাজ করবে কেমন করে ! একটা সময় মনে হয়েছিল এ’গরু নিয়ে সে হাল চষতে পারবে না। নিজের হতাশার কথা পেড়েও ছিল বাবুর কাছে। সব দেখেশুনে বাবু বলেছিল, “এসেরালি, তুমি এক কাজ করো, ওই গরুর লেজ মটকে নাঙলচষার দাওয়াইটা ত্যাগ করো। অন্য গরুর সঙ্গে আমার এই বলদজোড়াকে এক পংক্তিতে ফেলো না। তুমি ওদের সঙ্গে ভদ্রসভ্য ব্যবহার করো, ওরাও তোমায় মাথায় তুলে রাখবে। আমার গরুর রাশ আমি ভাল করে বুঝি। ‘জাবনা’ দেবার সময় হেইহুই করে যষ্টি উঁচানোর মত হাত উঁচিয়ে শাসন করতে গেলে ওরা আমাকেও রেয়াত করে না। সেটা বুঝে গিয়ে আর ওভাবে আমি ওদের উপর খবরদারি করি না। গলায়, গায়ে হাতবুলিয়ে জাবনা মাখালে ওরা একদম শান্ত ছেলের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। সরে যেতে বললে সঙ্গে সঙ্গে আদেশ তালিম করবে। তুমিও তাই করো, দেখবে তোমার কাছে ওরা কত আপনজনের মত হয়ে যাবে।” বলদ জোড়া সামলানোর এই বিদ্যেটা তো আর অন্য আনকোরা হেলোরা জানেনা। না জানার কারণে তাদের হেনস্থা হতে হয়। এই কারণেই তার উপর এত ভরসা শিবুবাবুর। চাষের কাজ শেষ হলে আর তো জমি চষার তেমন কোন কাজ থাকে না। হেলোরও দরকার হয় না। তাই বলে অন্য মালিকের মত শিবুবাবু তার বাঁধা হেলোকে ‘কাজ নেই’ বলে বেকার করে দেয় না। অসময়ে ডাঙা জমিতে সব্জির অল্পস্বল্প হালের কাজ ছাড়াও অন্য কাজে সারা বছর জড়িয়ে রাখে। তাতে দিনমজুর হেলো, এসেরালিরও আর কাজ পাওয়ার জন্যে গ্রামে গ্রামে ফিরি করতে হয় না। বাবু যেমন অসময়ে তাকে দেখে, সেও সময়ে বাবুর পাশে থেকে মন জুগিয়ে যায়। শিবুবাবুর ঘরের লোকেদের একজন হয়ে গেছে সে।
এবার সাদাটা জাবরকাটাও বন্ধ করে দিল। উঠে দাঁড়ায়ও না। এসেরালি কতবার চেষ্টা করল দাঁড় করাতে। কিন্তু গরুটার নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করেও আর নিজের ওই বিশাল শরীরটাকে তুলে ধরতে পারছে না। এসেরালির কথা এরা দু’জন খুব শোনে। ওরা ওকেই পালনকর্তা হিসেবে মানে। আর এসেরালি মানে শিবুবাবুকে। সাদা-জন তার মনিবের কথা শোনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। আসলে খাচ্ছে না তো কিছুই। গায়ে জোর পাবে কোথা থেকে। পেটে কিছু থাকলে তবে তো জাবর কাটবে, শরীরকে শক্তির রসদ যোগাবে।
বাড়ি সুদ্ধ সকলের মন খারাপ সাদা বলদের জন্যে। আর হয়তো ওকে বাঁচানো যাবে না। ডাক্তারের কোন ওষুধ কাজ করছে না। ডাক্তারও কোন আশ্বাস দিতে পারল না। শুধু বলল,“যাবার সময় হয়ে গেলে কার সাধ্য আটকানো যায়। আমরা তো শুধু মনের বোধ দেবার জন্যে চেষ্টা করতে পারি মাত্র। প্রবীণ এই পশুটার মাড়ির দাঁতের অবস্থান জানান দিচ্ছে পৃথিবীর আলো বাতাস আর বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। তাই একে বেশি করে মায়ার বাঁধনে বেঁধে লাভ নেই। মন থেকে পোষ্যের প্রতি মায়া ছিন্ন করা সত্যিই কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক। তবু যা অনিবার্য তাকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই।”
সেদিন বিকেল থেকে শুধু ডেকেই চলেছে গরুটা। কাকে ডাকছে কে জানে! এতদিন শরীর খারাপ করেছে, কোনদিন এইভাবে ও ডাকাডাকি করেনি। বলদ গরুরা এমনিতেই কম ডাকে। তারপর এদের মত তেজীরা তো তেমন নয়ই। ওর ডাক শুনে এবার কালোটাও ডাকতে শুরু করেছে। তবে এর মত তারস্বরে এবং সবসময় ডাকছে না কালো জন। ওরা হয়তো নিজেদের ডাকের মাধ্যমে মনের কথা আদান-প্রদান করছে! মানুষরা যার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসেরালির মনটা এবার কেমন যেন ‘কু’ ডাকতে শুরু করেছে। দিগন্তে সূর্য লাল-গোলাপী আলো ছড়িয়ে জানান দিয়ে যাচ্ছে ঘুমের দেশে চলে যাবার কথা। চরাচরে অন্ধকার নিজের স্থান দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় গৃহস্থের বাড়ির আলোর ছটা যেন ক্ষীণ চেষ্টা করছে অন্ধকারের সর্বগ্রাসী একাধিপত্তকে রুখে দেবার জন্যে। শিবুবাবু বলল, “এসেরালি, এবার তুমি বাড়ি যাও। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। তোমাকে আবার অন্ধকার ফুঁড়ে অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। আমরা বাড়ির সবাই মিলে রাতে পালা করে গোয়ালঘরে অবলাটাকে পাহারা দিই। ‘হাম্বা হাম্বা’ করে মনঃকষ্টর কথা কি বলছে তা তো বোঝা যায় না। হয়তো অন্তিম সময় আমাদের সবাইকে ওর পাশে এসে থাকতে বলছে। ঠিক শেষ সময় মানুষ যেমন করে। মনঃকষ্ট এবং আত্মার ইচ্ছে, মানুষ আর পশুর মধ্যে আলাদা কিছু হয় বলে তো মনে হয় না। শুধু আমাদের মুখে ভাষা আছে তাই আমারা বুঝতে পারি, আর ওদের তা নেই।”
ইতস্তত করে বাড়ি ফেরার কথা মাথায় আনতেই এবার এসেরালির বুকের ভেতরটায় কে যেন সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। কে আর দেবে। ভেতরে যে দাপাদাপি করে সে! সেই মনপবনটা! ইতস্ততর কারণটা এবার যেন ওর ভেতরে চাগাড় দিয়ে উঠল। তার আদরের পশুটার এই অন্তিম সময়ে সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে? তা হয় নাকি! গলার স্বর দৃঢ় করে এসেরালি বলল, “বাবু, আজ আর আমি বাড়ি যাবো না। বাজারে নাসির চাচার দোকানে বলে আসি, আজ রাতে বাড়ি যাবো না। বাবুর বাড়ি থাকবো। বাড়ির ওরা যেন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে।” দিঘিরপাড় বাজারে ওদের পড়শি নাসির চাচার বিড়ির দোকান। জরুরী কোন খবরাখবর বাড়িতে দেবার থাকলে নাসির চাচাকে দিয়ে পাঠায় এসেরালি। বাবুও যেন ভেতরে ভেতরে চাইছিল, এসেরালি আজ রাতটা তার হাতের তালুর মত চেনা পশুটার পাশে থাকুক। তা এসেরালি নিজে থেকে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ না করলে তো জোর করতে পারে না। সে’কথা ও প্রকাশ করতেই বাবু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “তবে যা, রাত বাড়নমুখো, নাসির যদি দোকান বন্ধ করে চলে যায় তো তোর বাড়িতে আর খবর দিতে পারবি না। বাড়ি তখন চিন্তায় খোঁজখুঁজি শুরু করে এখান পর্যন্ত ছুটে চলে আসতে পারে।” এবার এসেরালি বাবুকে আশ্বস্ত করে বলল, এখন সবে সন্ধেরাত। চাচার দোকান বন্ধ হতে হতে রাত ন’টা হয়ে যায়। গরুটার গাল থেকে ঝরে পড়া লালাগুলো একটু ধুইয়ে-মুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”
গোয়ালঘরে বাবু একটা হ্যাজাকের ব্যবস্থা করেছিল। লম্প বা হারিকেনের আলোয় সবকিছু নজরে আসতে অসুবিধা হচ্ছিল। মধ্যরাত হবে, বাবু তার সঙ্গে ছিল। এসেরালি বলল, “বাবু, এবার আপনি ঘরে চলে যান। শুয়ে পড়ুন। আমি আছি। সেরকম হলে বৈঠকখানার বিছানায় আমি গিয়ে শুয়ে পড়বখন।” কিন্তু এসেরালি ভাল করে জানে আজ সারারাত তার দু’চোখের পাতা এক হবেনা। হ্যাজাকের তীব্র আলোয় ও দেখতে পাচ্ছে গরুটার চোখদুটো কেমন ড্যামড্যামে হয়ে আছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, যেন সেই চোখদুটো তার দিকেই তাকিয়ে কি সব বলতে চাইছে। এতক্ষণ ধরে যে স্বরে সে ডেকে চলেছিল এবার তার বহর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাম্বা ডাকটা অনেক পরে পরে ভেতর থেকে যেন কত কষ্টে বেরিয়ে আসছে। ওই মায়াময় চোখদুটো এসেরালির দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে, ভেতরটা কেমন যেন ডুকরে উঠছে! কালোটার দিকে একবার চোখ পড়ল এসেরালির। বেচারা! তারও চোখে ঘুম নেই। জাবরকাটা বন্ধ করে ঠায় তার সহদরের দিকে চেয়ে রয়েছে। চোখের কোণে জলে ভেজা রেখা হ্যাজাকের তীব্র আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখে চোখ পড়তে সে একবার হাম্বা করে তার প্রভুকে ভেতরের দুঃখটা যেন ভাগ করে নিতে চাইল। এবার এসেরালি আর নিজের চোখের জলকে ধরে রাখতে পারল না। লুঙ্গির খোঁট দিয়ে চোখের কোণের পানিটাকে সামাল দিয়ে কালোটার পাশে গিয়ে তার গলায়, মাথায় মুখে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল। পশু হলেও এমন তাদের মনের ক্রিয়া, এসেরালির গায়ের আরো কাছাকাছি চলে এসে তার গা ঘুনতে থাকল। ঠিক যেমন মানুষের পরমাত্মীয় বিয়োগের মুহূর্তে মানুষ করে থাকে। আর নিজেকে সামাল দিতে পারল না ও। পুরুষমানুষের ডুকরে ওঠা কান্না বাতাসে সওয়ার হয়ে চরাচরে ভেসে যেতে লাগল। বাতাসের সেই বার্তা শিবুবাবুর কান ছুঁয়ে গেল কি না কে জানে। নির্ঘুম বাবুর ভেতরটাও হয়তো এসেরালির মত ডুকরে উঠেছিল! বাবু টর্চের তীব্র আলো ছড়িয়ে তড়কো পায়ে এসেরালির নাম করে হাঁক দিতে দিতে এদিকে চলে এল, “কি হয়েছে রে এসেরালি? অমন করে তুই চিৎকার করে কেঁদে উঠলি কেন? দাঁড়া দাঁড়া, আমি যাচ্ছি দাঁড়া!”
[ দুই ]
প্রাচীন ওই দীর্ঘ বটগাছটা আর তাকে কেন্দ্র করে তার চৌহদ্দির নীলাকাশ। এরা যেন ওদের জীবন চলনের অভিমুখ। দৈনন্দিন আশা-নিরাশার কেতন যেমন তারা ওড়াবে, তারই তালে তাল দিয়ে গড়ায় ওদের দিনরাতের আহ্নিক গতি। ওদের রুইদাস পাড়া থেকে সেই প্রায় সিকি কিলোমিটার দূরে দৌলতপুরের শেষ সীমানায় গলা উঁচিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে। সেই প্রবীন বটবৃক্ষ। সকাল-দুপুর-বিকেল, ওদের পাড়া ফুরসৎ পেলেই তীব্র দৃষ্টিতে নিশানা ফেলে সেই বটের শীর্ষপট সংলগ্ন নীলিমায়। তাদের শ্যেন দৃষ্টি খুঁজে ফেরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সেই শ্যেনেদের উপস্থিতি। ওদের উপস্থিতি টের পেলেই চনমনিয়ে ওঠে রুইদাস পাড়ার ভিতর-বাহির সব অঞ্চল।
বটবৃক্ষ লাগোয়া প্রশস্ত ফাঁকা জায়গাটা দৌলতপুরের ছেলেপুলেদের খেলার মাঠ। বিকেল হলেই গমগম করে এই মাঠ এলাকা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এখানে ছুটে আসে স্বস্তির শ্বাস নিতে। ছোটরা খেলার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় খেলাধুলা করছে। বউ-বোন-মায়েরা এদিকে ওদিকে হাঁটাচলা ছুটোছুটি করে। দিনের ক্লান্তি দূর করে আনন্দসুখ আত্মস্থ করে। কেউ কেউ আবার দখিনা বাতাস বুকভরে গ্রহণ করার জন্যে ওই সুশীতল বটের তলায় আশ্রয় নেয়। খেলায় খেলায় ক্লান্ত ছেলেপিলেদের তো কথাই নেই। মাঝে মাঝে এসে চিত হয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে, আবার খেলা-যুদ্ধে সামিল হবার জন্যে।
এক সময় এই সেই খেলার মাঠ আরও প্রশস্ত করার তাগিদ আসে গ্রামের ক্লাবের কর্মকর্তাদের। তার জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে থাকা প্রাচীন এবং বিশাল এই বটগাছটাকে হত্যা করে চিহ্নহীন করার। গাছটার কাছ থেকে খেলাধূলা করতে আসা বা একটু শ্বাস নিতে আসা মানুষ এত উপকৃত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে তার যে অপূরণীয় অবদান, এই কর্মকর্তারা যেন বেমালুম উড়িয়ে দিতে চাইল। তার থেকে তারা গুরুত্ব দিল মাঠ দৈর্ঘে প্রস্থে আরও চওড়া করার বাসনাকে! প্রস্তাবটা কানে কানে চাউর হয়ে গেল আশপাশের গ্রামগুলোতে। স্তম্ভিত সমস্ত গ্রামের মানুষ! পরিকল্পনা বাতিল করার আবেদন আসতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে। কান ছুঁয়ে গেল প্রশাসনের। কিন্তু সেখানেও অদৃশ্য কোন শক্তির প্রভাবে প্রশাসনের দ্রুত সক্রিয় হবার কোন আঁচ পাওয়া গেল না। উৎকন্ঠা নিয়ে ক্রমাগত অপেক্ষা এবং ধৈর্য পরীক্ষার সামনে এসে দাঁড়ালো রুইদাস পাড়ার মানুষজন। তাদের জীবন-চলনের কেতন যে গাছ উড়িয়ে যায়, তার পতন মানে তো তাদেরও জীবন পতনের পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়া। তা তারা কেমন করে মেনে নেবে! শত অনুরোধ উপরোধে যদি ক্লাব নিরস্ত না হয় তো তারাও সক্রিয় প্রতিরোধে সামিল হতে দ্বিধা করবে না। হতেই পারে জায়গাটা ওই দৌলতপুরের সীমানায় অবস্থিত। ওর মালিকানা কিন্তু ওই ক্লাবের নয়। তাদের দখলে আছে মাত্র। প্রকৃতপক্ষে জায়গাটা সরকারি ভেস্টেড। সেই অর্থে ওটা সরকারি জায়গা। সরকারের জায়গা মানে ওর উপর অধিকার তাহলে সকল নাগরিকের। রুইদাসদেরও। সরকারি জায়গা কারোর দখলে থাকা মানে সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। সেই হিসেবে একটা সমাজের দিনপাত এবং সংস্কার যে ক্রিয়াকর্মের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল তাকে সম্মান দিতে তারা তো বাধ্য। মানবিকতার এই পাঠ যদি তারা না নিয়ে থাকে তো জোর করে, বলপূর্বক সেই পাঠ তাদের কানে পশিয়ে দিতে তারা বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না।
রতনরা ক্লাবকে পই পই করে বুঝিয়েছে, “বাবুরা, এই গাছ তোমরা যদি কেটে দাও তো আমরা পথে বসবো। এই গাছের নিশানা নির্দিষ্ট করে দেয় আমাদের রুজিরোজগারের হালহকিকৎ। ব্যপারটা কি, কেমন করে এই গাছ আমাদের জীবনের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে, তোমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে চাই না বাবু। এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব এবং গোপনীয় সংকেত। কানাঘুষো তোমরা তার কিছুটা জানো। তার বিস্তারিত জেনে তোমাদের কোন কাজে আসবে না। শুধুমুধু আমাদের সমাজের নিজস্ব এক গোপনীয় প্রক্রিয়া তোমরা জেনে হাসাহাসি করবে আর আমরা অপমানিত বোধ করবো। কেবল আমরা যেটা অনুরোধ করছি তা তোমরা মেনে নাও। আর তোমাদের যদি সত্যি কোন ত্রিনয়ন থাকে তাহলে আমাদের দিকে একটু খেয়াল রেখো। দিনের আলোর মত তোমাদের সব প্রশ্ন বা কৌতূহল হাট হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। আসলে আমরা ‘রুইদাস’। তোমাদের তথাকথিত উচ্চজনের কাছে ছোট অন্তজ সম্প্রদায়ের মানুষ। বরাবর তাই তোমরা আমাদের উপেক্ষা করে এসেছো। আমাদের সম্পর্কে কোন আগ্রহ কোনদিন তোমরা দেখাও নি। তাই জানবে না আমরা কে, কেমন আমাদের চলন বলন। তোমরা শুধু জানো আমরা ভাগাড়ের গরু-ছাগলের ছাল ছাড়াই। তার ছাল চামড়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছেড়ি করি। বাজারে ছাগলের মাংস বিক্রি করি। আমরা পাড়ায় পাড়ায় বাবুদের ছেঁড়া জুতো সারাই। বেতের ধামা, সের, কুনকে, পালি বানাই। তোমরা আদেশ করলে সেগুলো সারিয়ে দিয়ে যাই। হাটে বাজারে বড়-মানুষদের পায়ের জুতো পালিশ করে চকচকে করে দিই বাইরেটা। ভেতরটা পড়ার যোগ্যতা বা সাহস আমাদের নেই! তবে এটা ঠিক বাবুরা, একটা সময় তোমরা আমাদের দিকে বেশ নজর দাও। সেটা স্বীকার না করলে আমাদের পাপ হবে। ওই পূজা-পার্বন, উৎসবের মরশুমে। আমাদের ঢাক কাঁসির উপস্থিতি সেসময় তোমাদের কাছে অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। হ্যাঁ তোমরা তখন আমাদের যারপরনাই খাতির যত্ন করো। খেতে দাও। নতুন নতুন জামা ধূতি পরিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রায় একরকম উচ্ছগ্য করো। পুজো শেষে বাড়ির ছেলেপুলেদের, বউদের জন্যে তোমাদের বাড়ির উচ্ছিষ্ট পুরোনো জামা কাপড় দাও। অবশ্য এটাও ঠিক, গরিব মানুষ আমরা, এই সময় ছাড়া এগুলো চাওয়া পাওয়ার সুযোগ আমাদের থাকে না। চাইলে তোমরা দেবেও না। মুখ করে ভাগিয়ে দেবে বা চাঁদ সদাগরের মনসাপুজো করার মতো বাঁ হাতে এক আধটা ছুড়ে দেবে। হ্যাঁ, অভাবি আমরা সেসময় চাই-ও। ঘরে আমাদের বাচ্চা-বউরা পথপানে চাতকের মত চেয়ে থাকে, পুজো শেষে কখন তাদের বাবা বা স্বামী বাড়ি ফিরবে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তারা মুখে এক-ঝিলিক হাসি ফোটাবে। বাবুর বাড়ি থেকে চেয়ে-চিনতে আনা জামা-প্যান্ট, শাড়ী-কাপড় তারা গায়ে চড়াবে। পুজোর ভাল পোষাক পুজো শেষে গায়ে চড়িয়ে উৎসবের রেশ কাটার আগেই তা উপভোগ করবে। পরিবারের এই তৃপ্তি আমাদের মনকেও ছুঁয়ে যায় গো বাবু। তাই তোমাদের কাছে হাত পাতি, তোমরাও দাও। এই পর্যন্ত। এর বাইরে এতটুকুও তোমরা আমাদের প্রতি আগ্রহ দেখাও না। তাই তোমরা জানো না আমরা কেন আমাদের জীবন-পূজারী এই গাছকে নিধন করতে তোমাদের নিষেধ করছি।”
রতনের এত কথাতেও ক্লাবের বাবুদের মুখের ভাবে আশার কোন ফুলকি দেখতে পেল না। ওর কথায় বাবুরা কি বলে তার জন্যে খানিক অপেক্ষায় থাকল রতন। কিন্তু ও-পক্ষ কোন উচ্চবাচ্য না করায় রতন এবার যেন ভেতর থেকে শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। গলার স্বর মজবুত করে বলল, “তবে বাবু এটা ঠিক, তোমরা যদি আমাদের কথা না নাও তো আমরাও ছেড়ে কথা কইব না। এটা আমাদের জীবন-জীবিকার এক অপরিহার্য প্রশ্ন। রুখে আমরা দাঁড়াবই। তোমাদের কোন প্রভাব প্রতিপত্তি এখানে খাপ খুলতে পারবে না। তার জন্যে যেখানে যেতে হয়, যতদূর যেতে হয় আমরা যাবো।” এবার রতনদের কথা ক্লাবের বাবুরা মন দিয়ে শোনে। “সামনের মিটিংয়ে তোমাদের কথা আমরা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবো। কিন্তু আমরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, এই গাছটা তোমাদের এতো কি কাজে আসে? তোমাদের পাড়া থেকে এ তো অনেক দূরে। তাছাড়া তোমাদের ওদিকের কেউ এখানে খেলাধূলা করতে আসে না। বুঝতে পারছি তোমরা কারণটা মুখ ফুটে আমাদের বলতে চাইছো না। তা চাইছো না যখন আর চাপাচাপি করবো না। তবে তার কারণটা আমরা যেভাবেই হোক জানার চেষ্টা করবো। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য আমাদের গ্রামেরও অনেকে এই গাছ কাটার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বিশেষ করে মাঠে খেলাধূলা করতে আসা মানুষজন এমনকি ছেলেছোকরারাও। ওদের বিশ্রামের সুন্দর জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে তা তারা মেনে নিতে পারছে না। তবে ক্লাবের মুখের উপর এদের কারোর কথা বলার প্রবণতা নেই বলেই নিজেদের গুঞ্জনের মধ্যে প্রতিবাদগুলো দেয়ানেয়া করছে। এই দেয়ানেয়া চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমাদের কানে আসছে। সেইজন্যে এই সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনা করার একটা বাতাবরণও তৈরী হয়েছে। দেখা যাক, অধিকাংশ সদস্য যদি তোমাদের মতে মত দেয় তো গাছকাটা বন্ধ থাকবে। নাহলে বিরুদ্ধ পরিস্থিতির সম্মুখে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।”
ভোরবেলা দক্ষিণের ফাঁকা মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারতে এসে প্রথম নজরে আসে রতন রুইদাসের! তাদের জীবন নিশান দৌলতপুরের খেলার মাঠের সেই দিগন্ত ছুঁতে উদ্যত বটগাছটার মাথায় দলবেঁধে ওরা বসে! ওদের আগমনে রতনরা ধরেই নেয় গাছের তলায় ভাগাড়ে গরু পড়েছে। কোন বারেই ওদের সেই ধারণা ভূল প্রমাণিত হয়নি। প্রাতঃকৃত্য মাথায় তুলে চুপিসাড়ে সে মারল ছুট সেই দিকে। রতনের মত ওখানকার সব মদ্দর কাছে সবসময় একটা ধারালো ছুরি কোমরে জড়ানো থাকে। ওরা কোন সময়ের জন্যে ঝুঁকি নিতে চায় না। কখন যে গাছটা তার আকাশ-নিশান ওড়াবে তার কোন ঠিক নেই। তাই ওরা এত সাবধানী। নিশান উড়লেই ওদের ছুট মারতে হয়। এটা নাকি ওদের কর্তব্য। না হলে অধর্ম হয়। ওদের কাজ শেষ না করলে আবার ওই শ্যেনের দল খেতে আসতে পারবে না। ওই গাছের উপর বসে অপেক্ষা করতে থাকবে।
কর্তব্য পালনের দায় রতন, নন্দ বা দিবাকর, কারোর একার নয়, রুইদাসদের সকলের। তাহলে রতন নিশানা দেখে চুপিসাড়ে একাই দৌড় দিল কেন? সেটা রতন-নন্দরা খুব ভাল করে জানে। এখন রতন সবার আগে নিশানা নজর করেছে তাই সে নীরব-দৌড় দিয়েছে। নিশান দেখে তার আগে যদি কেউ গিয়ে গরুটাকে একবার ছুঁয়ে দিতে পারে তাহলে গোটা গরুর চামড়াটা তার দখলে চলে যাবে! রতনের জায়গায় নন্দ বা দিবাকর বা রুইদাসদের অন্য যে কোন মরদ হলে সেও তার মালিক হয়ে যাবে।এটা একটা নিয়ম, ওদের মধ্যে কালে কালে চলে আসছে। মনে হবে যেন এই গোপনীয়তায় তাদের অধিকার আছে। কেউ এজন্যে কাউকে তার কাজে বাধা বা দোষারোপ করে না।
হাজার হোক বয়স তো দিনে দিনে কমে না, বাড়ে। বাড়তে বাড়তে শেষের সে দিনে এসে ঠেক খাবে, যেদিন পৃথিবীর আলো-বাতাসের সব মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের মত চলে যেতে হবে। রতনের বয়সের অভিমুখ এখন পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে। তাই সেদিনের সেই যৌবনের গতিতে এখন অনেকটা ভাটার টান। এই ভাটার সুযোগ নিয়ে কোন যুবক ছোঁড়া যদি তাকে টপকে চলে যায় তো তার কপালে ভোঁ-ভাঁ! একবার পেছন ফিরে তাকায়, অন্য কোন ছোঁড়া ছুট মেরে এদিকে ধেয়ে আসছে কি না। আবার সামনে এগোয়। বয়সের সঙ্গে দেহ-মনের এই লড়াই জারি রাখা তার পক্ষে আর যেন সম্ভব হচ্ছে না। তবু মনকে লাঠি বানিয়ে সেই লাঠিতে ভর করে এগিয়ে চলে সে। সবার আগে তাকে গরুটাকে ছুঁতেই হবে। হাতে কাজকম্ম বাড়ন্ত। আয়ে ভাটা। কাজের মরসুমের জমানো টাকা কটা নেড়ে চেড়ে এখন দিন চলে। এই গরুর চামড়াটা পেলে আবার কিছুদিন সংসার-গাড়ির চাকা গড়ানো যাবে। পা চালিয়ে এগোচ্ছে। চোখ কিন্তু চরকির মত চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন দিক থেকে ফুস করে কেউ যদি উদয় হয়ে তার বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দেয় তো হয়ে গেল। সব আশা ভরসা মাঠে মারা যাবার দাখিল হয়ে যাবে তাহলে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেও সে যুদ্ধ জারি রাখে। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র সম মেদিনী।’ আসলে এমনটা ভাবনার কারণ একদম অমূলক নয়। অতীতে এমন অনেক ঘটনার নজির তাদের পাড়ায় অনেকের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে। বিশেষ করে ওদের মত ভারি বয়সের মানুষরা শিকার হয়েছে তাদের থেকে অল্প বয়সী ছেলে ছোকরাদের দ্বারা। সেইজন্যে বেশিরভাগ বয়স গড়ানো মানুষ আর এই টানাপোড়েনের মধ্যে নিজেদের জড়াতে চায় না। আগে ভাগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে দেয়। নিশান দেখলেই আর বকের মত শক্ত হয়ে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে না। রতন এই ভাবনার শরিক হলেও এতদিনের অভ্যেসকে সহজে যেন বশে আনতে পারছে না। তাই এই নিশান-দৌড়।
যা ভাবনা ঠিক তাই, যেন বিধান হয়েছিল আগে থেকে। হঠাৎ রতনের চোখে পড়ল, দৌলতপুর ঘেঁষা তাদের গ্রামের কোরোঙ্গা পাড়ার রাস্তার গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একজন ছোকরা হন-হন করে এদিকে আসছে! এমন সময় অন্য কে বা আসবে। নিশ্চয়ই তার প্রতিপক্ষ কেউ হবে। রতন আরও জোরে পা চালাবার চেষ্টা করল। ব্যাস! ওই চেষ্টাই তার কপাল পোড়ালো। রাস্তায় পড়ে থাকা গোবরের তালে পা পড়ে হড়কে একদম চিৎপটাং! পড়ল তো পড়ল, পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়ল রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে। তবু সে হার মানার পাত্র নয় যেন। পড়ে গিয়ে কোথায় লেগেছে না লেগেছে সে বিচার পরে হবে। ঝপাঝপ সেখান থেকে উঠে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাঃ, পারল না সে। ভাগাড়ে-পড়া গরুর কাছে গিয়ে দেখে ওই মিত্তুনের জোয়ান ছেলে কেলে, গরুর ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই সময় ওরা কেউ কারোর সঙ্গে বাক্যালাপ করে না। নিজের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। গরুর শরীর থেকে চামড়া পুরোপুরি ছাড়িয়ে নেবার পর অন্য কথা। হতাশ রতন তাই কেলের সঙ্গে কোন কথা না পেড়ে মন খারাপ করে ফিরতি পথে বাড়িমুখো হয়। ফিরতে ফিরতে রতন ভাবে, এমন নিয়ম যদি সমাজে চলতে থাকে তাহলে তো কোন বয়স্ক মানুষ কোনদিন চামড়ার অধিকারী হতে পারবে না। অথচ রতনের, তার সংসারের তো পেট-পোঁদ আছে। তার উপরই সবটাই নির্ভর। ওদের সংসার তাহলে কেমন করে চলবে? এ নিয়ম আর চলতে দিলে হবে না। এই নিয়মের বাইরে একটা যুক্তিযুক্ত নিয়ম তৈরী করা অবশ্যই দরকার। সমাজে শুধু কম বয়সী আর ছেলে ছোকরারা বেঁচে থাকবে আর কর্মঠ বয়স্করা পেটে কিল মেরে পড়ে থাকবে তা তো হতে পারে না। নিয়ম পাল্টানোর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবনাগুলো মনেমনে বিড়বিড় করতে করতে রতন বাড়ির দিকে আসতে থাকে। এবার বাহ্যে ফেরার কথা মনে পড়ে। কিন্তু বেলা অনেকটা উপরে উঠে গেছে। মেয়েমদ্দরা সব এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছে। আর ফাঁকায় বাহ্যে ফেরা হবে না। পাড়ার বাঁশ বাগানের আড়ালে নালায় বাঁশ খাটানো পায়খানায় বসতে হবে।
এটা তো একটা ‘বাঁজা’ নিয়ম। এই নিয়মটা অবশ্য খুব বেশি দিনের নয়। তিন কি চার বছরের পুরোনো। এক বিবেচনাহীন নিয়মকে রুখে দিতে গিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি এর জন্ম দেওয়া হয়। এখনকার মত একটু তলিয়ে দেখলে হয়তো সে সময় এটা চালু হোত না। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, একেও সমাধি দিতে হবে। আর যাকে সমাধিস্থ করার জন্যে এই নিয়মের জন্ম তার কথা ভাবলে এখনো গুমরে থাকা রাগ মাথায় চড়ে বসে যেন। সে সময়ের নিয়মটা ছিলো পুরোপুরি একপেশে। যে আগে ‘নিশান’ দেখবে সেই পাবে গরুর পুরো চামড়ার ভাগ। কিন্তু কে আগে দেখেছে, এবং সেই দাবী সত্য, তা সাব্যস্ত করবে কে? নন্দ দক্ষিণ মাঠে তো রতন পুবে বা দিবাকর হাটে বাজারের যাবার রাস্তায়। প্রকৃত ভাবে দক্ষিণ মাঠ থেকে নন্দ আগে দেখলেও সেখান থেকে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পঁচিশ-তিরিশ মিনিট লাগবেই লাগবে। অথচ দিবাকর রতনের থেকে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরেও দেখতে পেলে সে বাজারের রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছে যাবে। যেহেতু দিবাকর আগে পৌঁছে গেছে অথএব পুরো চামড়ার অধিকার বর্তাচ্ছে দিবাকরের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের চলতি নিয়মে ‘সবার আগে নিশান-দেখা’ নন্দ হন্তদন্ত হয়ে নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে গেলে লাগবে নিজেদের মধ্যে লড়াই। নন্দ যতই বলুক সে যে কুড়ি মিনিট আগে দেখেছে, সেই সত্যি কথাটা সে প্রমাণ করবে কেমন করে দিবাকরের কাছে ? জীবন ধারনের তাগিদ তো সকলের। যে পুরো চামড়ার অধিকারী হবে তার সামনেই তো মোটা আয়ের হাতছানি ঘুরপাক খাচ্ছে। যে পাচ্ছে, তার থেকে যাতে বঞ্চিত না হয় তার জন্যে লড়াই তো সে করবেই। আর যে বা যারা না-পাওয়ার দলে রয়ে গেল তারাও পাওয়ার জন্যে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাতে দ্বিধা করবে না। এই দ্বন্দ্বে পড়েই তো বিশাল ঝগড়া-ঝাটি, মারপিট এবং শেষে খুন-খারাপি পর্যন্ত হয়ে গেল। এই চরম পরিস্থিতি এড়াতে আবার পাড়ায় সকলে বসে নতুন নিয়ম চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়।
নিত্যানন্দর বাবা, রাধাকান্ত ঋষিদাস খুন হয়েছিল লোচন রুইদাসের বাবা পরেশের হাতে। বিচারে, খুনের দায়ে পরেশ রুইদাসের ফাঁসির সাজা হয়ে গেল। পরে আপিল মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির সাজা রদ হয়ে যাবৎজীবন হয় পরেশ রুইদাসের। পাড়ার মানুষদের কাছে লোচন রুইদাসদের পরিবার খুনে পরিবার হিসেবে দেগে গেল।
পূর্বপুরুষ থেকে এদের পাড়ায় আট-চালের একটা বড় বাফারা, মানে ফাঁকা সরকারি দালান ঘর আছে। সেখানেই পাড়ার যাবতীয় বিরোধ মিমাংসা বা ভালমন্দ কোন সরকারি আলোচনা হয়ে থাকে। আড্ডা, ক্যারাম,তাস খেলা তো যখন তখন চলে। সব্বাই এই দালানঘরকে আটচালা বলে চেনে। আটচালায় কোন দেয়াল নেই। চারিদিক ফাঁকা। কেবল শক্তপোক্ত শালখুঁটি আর বাঁশখুঁটির ঠেকনা দিয়ে পাকা বাঁশের আড়া-কাঁচি দু’থাকে চার-চার করে আটটা চালে তৈরী। গ্রামে এমন কাঠামো শৈলীতে অনেক বাড়ি আছে। তবে তাতে দেয়াল থাকে। এখানকার আটচালায় যা নেই। বদলে চারফুট উচ্চতায় পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়ালের মত ঘেরা আছে। গোটা কাঠামো টেকসই করার জন্যে আলকাতরা দিয়ে লেপে দেওয়া আছে। সেই আটচালার বিধানে চার বছরের শিশু লোচনকে ট্যাঁকে বেঁধে তার মা’কে গ্রামছাড়া হতে হয়েছিল। আর তাদের পাড়ামুখো হতে দেখেনি কেউ। বড় হয়ে লোচন প্রায় জলের দরে তাদের সেই অভিশপ্ত জায়গা বেচতে বাধ্য হয়। জলের দরে বেচার কারণ, খুনে পরিবারের জায়গা, মানুষের কাছে অপয়া জায়গা। তাই সরাসরি সেই জায়গা পাড়ার কেউ কিনতে চাইল না। অগত্যা পাশের কুমোর পাড়ার অনুকুল কুম্ভকারের কাছে এসে লোচন অনুনয় বিনয় করল যদি তাদের বাস্তুটা ওরা যা দাম দেবার সামর্থ, তাই দিয়ে যেন কিনে নেয়। কিন্তু অনুকুল কুম্ভকার বলল, “আরে বাবু, তোদের রুইদাসদের পাড়ায় বাস্তু জায়গা কিনে আমরা কি বাস করতে যাবো? কি হবে আমার, ওই পতিত জায়গাটা। ওটা আমার কাছে বাঁজা জায়গা ছাড়া আর কিছু না। না পারবো ঘর বানাতে, না পারবো চাষবাস করতে। চাষের জমি হলে না হয় ভাবা যেত। আমরা ও জায়গা নিয়ে ব্যবসার টাকা আটক রাখতে পারবো না রে, তুই অন্য কারোর কাছে যা। দেখ তারা কি বলে।” কিন্তু লোচন তো নাছোড়বান্দা। কুমোরদের মধ্যে এই অনুকুল কুম্ভকারই মাটির হাঁড়ি-কলসির ব্যবসা করে কাঁড়ি পয়সা করেছে। ওর এই ব্যবসার কপাল এখন তুঙ্গে। কুমোরদের কেউই ওর মত ফুলে ফেঁপে উঠতে পারেনি। এই অঢেল টাকা থেকে কিছুটা তার জমি কেনার জন্যে সরিয়ে দিলে ওর ব্যবসায় কোন আঁচড় লাগবে না। তাছাড়া পয়সাওলাকে সবাই একটু সমীহ করে চলে। আরও কয়েকজন কুমোরবাড়ি লোচন যে ঢুঁ মারেনি তা নয়। তারা একদম ঘাড় পাততে চায়নি। বরং উল্টে পাশ কাটায় অনুকুলবাবুর দিকে ঢেসিয়ে, “আমাদের ‘বন্নে’র মানে জাতের মধ্যে তোমার ওই জমি কিনলে একমাত্র অনুকুল কুম্ভকারই কিনতে পারবে। সাগর থেকে একফোঁটা জল তুলে নিলে অনুকুলবাবুর সম্পদের আড়ে-বহরে কোন প্রভাব পড়বে না। তুমি ওকে গিয়ে ভাল করে পাকড়াও। তারপর মানুষটাও খারাপ নয়। দয়ালু মন। ওই মনটাকে ভেজাতে তোমার বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। এবার দেখাও তোমার কেরামতি।”
এবার নিরুপায়ে অনুকুলবাবুর হাত ধরে বলে, “বাবু, অনেকের দোর ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে এসেছি। পাড়ায় ভালমানুষ হিসেবে, পরোপকারি হিসেবে তোমার নাম যশ আছে। তুমি যদি আমায় ফিরিয়ে দাও তো আমি আর কোথায় যাই। আর কারোর দোরে যাবার রাস্তা আমার সামনে নেই। তুমি আমার দিকে একটু মুখ তুলে চাও কাকা। তুমি যদি ওই জায়গা নাই-ই ব্যবহার করতে পারো তো পরে আমাদের পাড়ার অন্য কাউকে বেচে দেবে। তুমি একবার কিনলে জায়গাটা শুদ্ধ হয়ে যাবে। ওটা যে ‘খুনেদের জায়গা’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন এ’পাড়ায় যে পয়সা করেছে, তোমার কাছ থেকে তারও জায়গা কিনতে কোন বাধা থাকবে না। তখন সে তো আর একজন ‘খুনে’ পরিবারের কাছ থেকে জায়গা কিনছে না। ভাল মানুষের কাছ থেকে কিনছে। আর যে দরে তুমি আমার কাছ থেকে কিনছো তার থেকে অনেক বেশি দর তুমি হাঁকলে তাতেও ওরা মুখ ফেরাবে না। কেননা আমাদের ভদ্রাসনটা তো একদম পাড়ার আটচালার পাশেই না? গমগমে জায়গা। পাড়ার আর কোথাও তো দু’দন্ড হাত-পা ছড়িয়ে সময় কাটাবার জায়গা নেই। এই আটচালাটাই একরকম বলা যায় এ’পাড়ার এজমালি সম্পত্তি। তাই দিনরাত লোক এখানে আড্ডা দেয়, রেডিও নিয়ে গান শোনে। সুখ-দুঃখের গল্প করে। ভাল-মন্দ কথা-চালাচালি করে।” এই ‘ভাল-মন্দ কথা চালাচালির’ কথা বলতেই অনুকুল মৃদু ধমক দিয়ে লোচনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর বলিস না। ওই আটচালাতেই তো বিন্দের মা আর যতনের মা গ্যাঁট হয়ে বসে আশু আর চোনোর বউয়ের কেচ্চা নিয়ে সমালোচনার ঢেউ বইয়ে দিয়েছিল। একটু দূরে কমলেরর মা আড়-কানে শুনে লাগিয়ে দিয়েছিল চোনোর কানে! সেই নিয়ে কি লঙ্কা কান্ডটা না ঘটে গেল তোদের পাড়ায়। শেষ পর্যন্ত আটচালায় বাঁখারির বেড়া বানিয়ে সেটা বন্ধ করে দিতে হল।” অনুকুলের কথার রেশ ধরে লোচন বলল, “তাতে কি আর পাড়ায় কেচ্চা বন্ধ হয়েছে কাকা, হয়নি। সে অনেক গপ্প আছে। আজ না, সময়-ফুরসৎ হলে পরে অনেক কাহিনী তোমাকে বলবখন। হ্যাঁ, যে কথা তোমাকে বলছিলাম, “আটচালার জন্যে ওই জায়গার সামনে অনেকটা প্রশস্ত হাওদাখানা। আলো-বাতাস সবসময় খেলে বেড়ায়। আমাদের এই জায়গাটার ওপর পাড়ার কয়েকজনের লোভ আছে। শুধু আমাদের জায়গাটা ‘খুনি পরিবারের জায়গা, গ্রামের কেউ কিনতে পারবে না’ বলে মাতব্বরদের হুলিয়ার জন্যে পাড়ার কেউ সাহস করে কিনতে পারছে না। তুমি নিলেই দেখবে তোমার কাছে কতজন এসে হামলে পড়বে জায়গাটা নেবার জন্যে। এ’জায়গা নিলে তোমার ঠকা হবে না গো কাকা।”
লোচনের এই যুক্তিটা এবার মাথায় ঢোকে অনুকুল কুম্ভকারের। অনুকুল এবারে লোচনের বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে কিছুটা সন্ধানী বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বলে, “তুমি যখন এত করে বলছো তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমাকে জমিটা কিনতে হবে। তোমাদের পাড়ার লোকের যা মতিগতি তা তো অন্য মানুষের মত স্বাভাবিক মনের নয়। এত উগ্র মনের মানুষদের মধ্যে আমাকে পড়তে হবে। তারপর পেটে দু’এক পাঁইট চোলাই পড়লে তো আর রক্ষে নেই। ওই মাতাল-জাঁতালদের মোকাবিলা করাই একটা বিশাল ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। সেই ঝুঁকির মূল্য তোমাকে দিতে হবে লোচন। তুমি যা দাম চাইছো তা তোমাকে বিবেচনা করতে হবে। অত দাম আমি দিতে পারবো না। আমি কুমোর পাড়ার লোক তোমাদের রুইদাস পাড়ায় জমি কিনে মনে হচ্ছে স্বস্তিতে থাকতে পারবো না। ঝামেলা আমাকে পোহাতেই হবে।”
অনুকুলের কথায় লোচন চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল, এমনিতেই কম দামে জায়গাটা ছাড়তে হচ্ছে। অনুকুলকাকা আমার বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে। ভাবছে আমি বুঝছি না। কিন্তু এখন তার কিই বা করার আছে। জমি তো তাকে ছাড়তেই হবে। আধাকড়িতে হলেও ছেড়ে দিতে হবে। না হলে ওই জমি লুঠপাঠ হয়ে যাবে। অনুকুলকাকা যখন নিতে রাজি হয়েছে তখন ওর শর্তকে মেনে নিতে হবে। কিছু তো করার নেই, “ঠিক আছে কাকা, আমার যা দাম তা তো আমি তোমাকে বলেছি। এবার যে টাকা দিলে তোমার ধর্মে সইবে তাই দাও। একটু মনে মনে আহত হয়েই আমি কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা আমি এখন খন্দে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই সবটাই তোমার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম। কবে দস্তখত করতে হবে বোলো। তবে যা করার তাড়াতাড়ি করবে কাকা। আমার আর দেরি করার উপায় নেই।”ক্রমশ……….