চিঠি

  • চিঠি

    চিঠি- এক সাহসী পদক্ষেপের পরিণাম

    এক সাহসী পদক্ষেপের পরিণাম
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    শান্তিপুর
    নদীয়া।
    12/08/2019

    আমার মিতু,

                      আজকাল চিঠি লেখার চলন উঠেই গেছে। এটা তো হোয়াটসঅ্যাপ আর ম্যাসেঞ্জারের জমানা। তাও তোকে চিঠি না লিখে থাকতে পারলাম না। হ্যাঁ, তোকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করবো। জানি, তোর কোনও আপত্তি হবে না। আমাদের ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে আসা, আর ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ তে আসা একটা ইতিহাস। জানিস, প্রায় মনে পড়ে সে দিনের কথা, যে দিন প্রথম বার তোর সাথে ফোনে কথা হয়েছিল। সেই থেকে শুরু। তার পর কী ভাবে যে কী হয়ে গেল, সেটা না তুই বুঝতে পারলি, না আমি। তুই লিখতে ভালোবাসতিস। নানা কারণে, সংসারের নানা ঝামেলার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল তোর লেখা। তোর লেখা কবিতা ডায়রীর পাতায় বন্দি হয়ে রয়ে গিয়েছিল। যে দিন প্রথম তুই নিজের কবিতা পড়াস আমাকে, সে দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম যে তোর কবিতা কে ডায়রীর পাতা থেকে বের করে জনসমূহের সামনে নিয়ে আসবো। আজ আমি তোর থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের এই দূরত্বটা তোর লেখার প্রতি আমার ভালোবাসা কে বিন্দু মাত্র কম করতে পারেনি। তোর সব লেখা, সব বই পড়ি আমি। তোকে তো বলেছিলাম, তোর লেখা কে আমি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি।

    জীবনের এক বড় অধ্যায় জুড়ে শুধু তোরই নাম লেখা আছে মিতু। জানতাম তুই কোনও দিনই আমার হবি না। তাও তোর প্রতি যে ভালোলাগাটা আমার হৃদয়ে নিজের বাসা বেঁধেছিল সেটা প্রতিনিয়ত পূর্ণতা পাচ্ছিল। তুই যখন নিজের ইতিহাস আমায় বলতিস, কষ্ট হত আমার। ইচ্ছে হত তোর চোখের জল নিজের হাত দিয়ে মুছে দিই। অবশেষে এক দিন আমার হাত নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকলো না। অজান্তেই এগিয়ে গেল তোর গালের দিকে। মুছে দিলো তোর চোখের জল। সে দিন তোর চোখের জল কোনও বাধা মানেনি। আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলি তুই। তুই কাউকে কোনও দিন নিজের কাছে পাসনি। কেউ ছিল না যাকে তুই মনের দুটো কথা বলে শান্তি পেতিস। কেউ ছিল না যে তোকে বুঝতো। একটা নির্বিকার মানুষের সাথে জীবনযাপন করা যে কতটা দুষ্কর, সেটা তোকে দেখে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। আমি কারোর বিষয় খারাপ মন্তব্য করতে চাই না মিতু। শুধু একটি প্রশ্ন মনে বারবার জাগে। তোর কষ্ট, তোর চোখের জল কি সে দেখতে পেল না, যার জন্য তুই নিজের সর্বস্ব খুইয়ে দিয়েছিলিস? নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত খুইয়ে দিয়েছিলিস তুই। আসলে কি জানিস মিতু…. নারী চরিত্র চিরকাল আমাদের সামনে অবলা। স্বাধীন হয়ে বাঁচার অধিকার যেন সে জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই খুইয়েছে। প্রত্যেক নারী কে জীবনের প্রতিটি হিসেব মেলাতেই হবে। সে হিসেব মেলার মত হোক বা না হোক। তুইও অনেক এমন হিসেব মিলিয়েছিস যে হিসেব কোনও ভাবেই মেলে না। কিন্তু জীবন এমন ভাবে চলে না মিতু। প্রত্যেক প্রাণীর নিজের জীবনে নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। এটা ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার। তোরও অধিকার আছে নিজের জীবন নিজের মত করে বাঁচার। জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছিস তুই। অনেক চোখের জল ফেলেছিস। কেউ ছিল না রে তোর পাশে। কেউ ছিল না যে তোর দুঃখ কে নিজের দুঃখ মনে করতো। জীবনের দীর্ঘদিন নিজের বুক ফাটা আর্ত চিৎকার কে নিজের বুকের মধ্যেই চেপে রাখার পর এক দিন তুই আমায় পেলি। তোর জীবনে এই পরিবর্তনটা দরকার ছিল। মিতু, বলতে দ্বিধা নেই, আমি যদি তোর জীবনে না আসতাম তাহলে তোর বুকের ভিতর চেপে থাকা আর্তনাদ এক দিন আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হতো। তখনও কি কেউ থাকতো তোর পাশে? জলে ডুবতে থাকা মানুষ হাতের কাছে যা পায় সেটা ধরেই বাঁচতে চায় সে। কেন না বেঁচে থাকা তার অধিকার।

    মিতু, জানি আমাদের সম্পর্ক কে দুনিয়া কোনও দিনই ভালো নজরে দেখবে না। মানুষের মনের গভীরে ঢুকে তার কষ্ট কে বোঝার ক্ষমতা এই সমাজের নেই। সমাজ কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বানিয়ে দিয়েছে। মানুষের হাজার কষ্ট হোক, তাকে সেই নিয়ম মেনেই চলতে হয়। সেই নিয়মই মাঝে মাঝে মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের মধ্যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে তারা জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারে। তুই সমাজের কিছু নিয়ম কে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলিস। তবেই আজ তুই জীবন যুদ্ধে অনেকটাই এগোতে পেরেছিস। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি মিতু। কারোর পরিচয়ে বেঁচে থাকা মানুষের দুর্ভাগ্য। মানুষের নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাকা উচিত। তবেই সে আসল সম্মান পায়। প্রায় অর্ধেক জীবন তুই অন্যের পরিচয়ে বেঁচে থাকলি। তাই যথেষ্ট সম্মান কোনও দিনই পাসনি তুই। আজ তোর নিজেস্ব পরিচয় আছে, তাই আছে যথেষ্ট সম্মানও। তোর একটা সাহসী পদক্ষেপের জন্য যে সমাজ এক দিন তোর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, আজ সেই সমাজই তোর পদধুলি নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এটাই তো আমি চাইতাম মিতু। তুই নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাক, এটাই ছিল আমার স্বপ্ন।

    সত্যি বলতে আজ নিজের উপর আমার গর্ব হয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক মানুষ কে নতুন জীবন দিতে সক্ষম হয়েছি আমি। এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। মনে আছে, তুই আমায় বলেছিলিস যে যদি সম্ভব হতো তাহলে তুই আমার সাথে ঘর করতিস। আমাদের সন্তান হতো, হতো এক ছোট্ট পরিবার। চিন্তা করিস না মিতু। আমাদেরও ছোট্ট পরিবার আছে, আমাদেরও সন্তান আছে। আমরা তিন জন.. আমি, তুই আর তোর লেখা সমস্ত কবিতা। তোর লেখা কবিতাই তো আমাদের সন্তান মিতু, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন তোর কবিতা। আরও বড় কর আমাদের সন্তান কে। উন্নতির শিখরে নিয়ে যা তাকে।

    আমি আজ দূরে চলে এসেছি মিতু, তার পিছনে কারণ ছিল। আমার হয়েও পুরোপুরি আমার না হতে পারাটা কোথাও না কোথাও তোর মনে কষ্ট দিচ্ছিল। যখনই আমাকে দেখতিস, তোর এই কষ্টটা তোর মুখে ফুটে উঠতো। প্রভাব পড়ছিল তোর লেখাতেও। নিজের কলমের মাধ্যমে চাবুক চালাতে তুই অভ্যস্ত। চারিদিকে ঘটে যাওয়া নোংরামির উপর তোর কলম মারাত্মক চাবুক চালাতে পারে। অদ্ভুত ধার তোর কলমে। সেই ধার আমি কমে যেতে দেখছিলাম। শুধু প্রেম আর বিরহের লেখা পাচ্ছিলাম আমি তোর থেকে। তোর মনের কষ্ট ফুটে উঠছিল তোর কলমে। না মিতু, না…. তুই এক প্রতিবাদী কবি। প্রেম, বিরহের কবিতা তো অনেক মহিলা কবিই লিখতে পারে। ক’জন মহিলা কবির মধ্যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে? ক’জন মহিলা কবি নিজের কলমের মাধ্যমে সমাজে ঘটে যাওয়া নোংরামির উপর মোক্ষম চাবুক চালাতে পারে? তুই পারিস সেটা। আমি চাইতাম তোর এই পরিচয় বজায় থাকুক। তাই তোর থেকে দূরে সরে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাকে। তুই নিজেকে মজবুত করে নিয়েছিস মিতু। তুই এই সত্যটা মেনে নিয়েছিস যে আমি এক দমকা হাওয়া হয়ে তোর জীবনে এসেছিলাম। এতেই আমি খুশি।

    অনেক লেখা হলো। আর নয়। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি মিতু। এই দমকা হাওয়া তোর থেকে দূরে গিয়েও তোর পাশেই আছে। তোর প্রতিটি নিঃশ্বাসে আছে এই দমকা হাওয়া, তোর লেখা প্রতিটি অক্ষরে আছে এই দমকা হাওয়া। যেখানেই থাকি না কেন, চিরকাল তোর হয়েই থাকবো আমি। ভালো থাকিস মিতু। ভালো রাখিস আমাদের সন্তান কে। আরও অনেক বড় করিস তাকে। এখানেই শেষ করলাম।

    ইতি,
    তোর দমকা হাওয়া।

    এম পি নগর
    ভোপাল।

  • চিঠি

    চিঠি

    চিঠি
    – সুজিত চ্যাটার্জি

     

     সম্বোধন নিষ্প্রয়োজন ,
                                 কেমন আছিস জিজ্ঞেস করা, লৌকিকতার পোশাকিভদ্রতা। সেটুকু ভব্যতায় না গিয়ে শুধু জানালাম, আমি আর তোর মা, বেঁচে আছি। নিছক সংবাদ হিসেবে গ্রহণ করলেও, সমাজ সংসারের কোনও ক্ষতি বা শ্রীবৃদ্ধি হবেনা।
    তোদের একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, লোক মুখে জানলাম। সত্য মিথ্যা জানিনা।
    যদি ঈশ্বর কৃপায় সত্য হয়, তবে দেবশিশু, শ্রীজিত এর প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণ আশীর্বাদ বর্ষন করুন, এই কামনা।
    মূল্যহীন অমূলক সৌজন্য ভরা আশীর্বাদ দেবার নাটকীয় চেষ্টাও করলাম না।
    আর কোনও সংবাদ, দেওয়ার বা নেওয়ার ইচ্ছে চোখের জলে প্লাবিত। তাই এখানেই থামা।
    ধন্যবাদ।

                                                                         

                                                                             একজন বেদনাহত বৃদ্ধ বাবা।

     

  • চিঠি

    চিঠি- রাজকন্যে,তোমার জিয়ন কাঠি

    রাজকন্যে,তোমার জিয়ন কাঠি
    -ঋজু

     

    রাজকন্যে,

    মনে পড়ে তুমি বলেছিলে, আমার সবকটা বই তুমি নিজের সংগ্রহে রাখবে,পড়বে…
    এবারের ২৫ শে বৈশাখ আমার শেষ বইটি আসতে চলেছে।
    এবারেরটাও তোমায় নিয়েই। এখন জীবনানন্দের বনলতা বা,সুনীলের নীরার মতোন তুমিও চাইলেই বলতে পারবে “আমিও একজনের সবকটা কবিতা জুড়ে আছি”।
    হ্যাঁ গো,আমার সব কবিতায় উল্লিখিত ঐ “রাজকন্যে” নামটাতে তোমার অধিকারটা কখনো যায় নি;যাবেও না; যাক চাই ও না…
    না হয় তারপরে তোমাতে আগুনের দু’কদম বেশী অধিকার আমার চেয়ে; তোমার নতুন সংসারের তারাভাই বোন দের ও…
    বড়ো নিরুপায় লাগে রাতটা সুন্দর মনে হলে;বয়সের ওজন ক্লান্তি আনে মনে।

    মাঝে মাঝে কোনো মৌখিকতাহীন এমনই মৃদু অথচ নিরাপরাধ;অকারন দুপুরে তোমার অবয়বটা ইন্দ্রিয়গোচর হয় না; হাঁফিয়ে উঠি.. তোমার প্রিয় গানদুটো তুলবো বলে বেহালা কাঁধে পিঠ ঠেকাই দেওয়ালে।
    আচমকা লিখে ফেলি কতো কিছু আবোল তাবোল…

    জানো, এখন আমি আমার ঘর-বিছানা-টেবিল সব গুছিয়ে রাখতেও শিখে গেছি; নিয়ম করে ওষুধগুলো ও খাই। এখন ক্লিনশেভ রাখি যেমনটা তুমি চাইতে। রোজ জল দিই ক্যাকটাস গাছগুলোতে, প্রত্যেক শুক্রবার থিয়েটার দেখতে গিয়ে আমি, আমার জন্য দু’টো সিট বুকিং করাই…
    হয় না শুধু তোমার মতোন চীজ স্যান্ডউইচ; আর, বলা না কওয়া না…আচমকা কর্পূরের মতোন মহাবিশ্বের সবকটা নাম না জানা ধূলীকনার সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়া টা;ইচ্ছেমতোন ছুটি স্যাংশান করানো টা ও।

    নাঃ আমার কোনো পিছুটান নেই,তবু,আজকাল আর অঙ্ক ভালো লাগে না।
    বিকেলটা গড়ালে তবু,ছেলেমেয়েরা পড়তে আসবে ব্যাগ কাঁধে। বেশ কাটবে সন্ধ্যেটা ওদের নিয়ে। অন্ততঃ সে আশাটুকু রাখি ওদের হাসির কাছে। এভাবেই রাত বাড়বে।
    আর বেশী জাগতে পারি না; বয়েস হয়েছে,বোঝোই তো।তবু খাওয়াদাওয়া সেরে হাঁটতে আসি বারান্দাটায়। কতো চিঠি ছুড়ে দিই রোজ বারান্দায় থেকে তারাদের লক্ষ্য করে…
    “ওই? খেয়েছিস? কি খেলি আজ রাতে? একা খেলি?…” ইত্যাদি।
    পরদিন সকালে দেখি পৌরসভার সাফাইকর্মীরা মুখ টিপে হাসাহাসি করে। কি জানি কেন?

    বড়ো একটা উত্তর জানতে ইচ্ছে করে।
    আজো; কোনো বৈশাখের লোডশেডিং রাতে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখলে বিছানাটা জ্যোৎস্নায় এক্কেবারে ভিজে চুপচুপে;অবাক হয়ে চুপ মেরে যাবে তো আজো?
    আমি তো হই… আগের মতোনই ফোনের অপেক্ষা করি।জানি; তুমি ও দেখছো, চাঁদের ঐ কালো দাগটা।

    মনে পড়ছে বড্ডো একসাথে কাটানো প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে টা র কথা; বিশেষ করে আমাদের ঐ একে অপরকে নিয়ে লেখা কবিতার ঐ দু’টো লাইন…আর উল্টো পিঠে তোমার হাতের লেখায়, “প্রাপকের উদ্দেশ্যে, আজ যে শতাব্দী,সন,মাস,তারিখ,সময় ই হোক না কেন,আমরা একে অপরকে সেভাবেই ভালোবাসি। এটি পেলে নিম্নের নম্বর দুটিতে যোগাযোগ করুন।”
    বোতলবন্দী করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার সময়ও জানতাম আমরা সত্যি কথাই বলছি।আজ জানা আর মানা রা নিজেদের ভিতরকার সবকটা তফাৎ ভুলে মিশে একাকার হয়ে আছে।

    আমি ভালো আছি।
    ভালোবাসায় আছি; তুমি ও থেকো পারলে।
    মহাবিশ্বের যে প্রান্তেই থেকো, তুমি ও ভালো থেকো।                                                     -তোমার জিয়ন কাঠি             

                                                                          

                               

  • চিঠি

    চিঠি- ‘না লেখা চিঠি’

    না লেখা চিঠি
    -সঞ্চিতা রায়

     

    স্নিগ্ধ , এত বছর ধরে মনের যে অনুভূতিগুলো ছিল,একান্তই আমার অধীন, সে কেন যে আজ শব্দে শব্দে ধরা দিতে চাইছ, কেন যে বাঁধনহারা হতে চাইছে জানি না রে! আমার না বলা কথাগুলো আজ বহুবছর পর চিঠির পাতায় শব্দের মালা হয়ে ধরা দিতে চাইছে,তাই তো তোকে লিখছি। জানিস সেই ছোট্ট থেকে তোর উপর কেন জানিনা আমার অদ্ভূত এক অধিকার বোধ ছিল। মনে হ‘ত তুই সবার আগে আমার বন্ধু পরে অন্যদের। এখন ভাবলে বড্ড হাসি পায়। একসঙ্গে খেলা করতে করতে, পড়তে পড়তে এই অধিকার বোধ যে কবে কখন ভালোলাগায় পরিণত হয়ে যায়, তাও ভালো করে মনে নেই। ভালোলাগার পথ ধরে ঠিক কতটা হাঁটলে ভালোবাসা হয় রে! ধূর সেসব বোঝার বয়স ছিল নাকি তখন। সবই তো কিশোর বয়সের অবেগ প্রবণতা। শুধু তুই খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে খুব মন খারাপ হ‘ত। আর তুই ভালো ছেলে ছিলি বলে সচরাচর বকা খেতিস না, কিন্তু কোনো কারণে তুই বকা খেলে সারাদিনের জন্য মনটা আমার খারাপ হয়ে যেতো। এই অনুভূতিটাকে কী ভালোবাসা বলে নাকি রে?কেন যে দূরে গিয়ে বন্ধুদের দুষ্টুমির মধ্যে শুধু তোকে খুঁজতাম কে জানে? কিন্তু নবম শ্রেণীতে তোর হৃদয় জুড়ে অন্য কারুর উপস্থিতি দেখেও মনকে অদ্ভূত ঔদাসীন্য দিয়ে ভরিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। মনে হ‘ত আমার বন্ধু যেন ভালো থাকে, হ্যাঁ ওর যাকে ভালো লাগে তাকে পেয়েই ভালো থাক। ভালোবাসা বোধহয় আশ্চর্য নরম আর সুন্দর হয় তাই না রে? ত্যাগের আরেক নামই তো ভালোবাসা। আর আমার ওই মিষ্টি অনুভূতির নাম যদি ভালোবাসাও হয়ে থাকে তো ভালোবাসাকে খাঁচাবন্দী করায় আমার বিশ্বাস নেই। আমার ভালোবাসা তাই ডানা মেলুক অনন্ত আকাশে। তুই খুউউউউব ভালো থাক তোর ভালোলাগা আর ভালোবাসাকে নিয়ে। তোর ছোট বেলার বন্ধু অঙ্কিতা।

  • চিঠি

    চিঠি- লহ প্রণাম

    লহ প্রণাম
    -রীণা চ্যাটার্জী

    শ্রদ্ধেয় গুরুদেব,
    শুভ জন্মদিবসের হৃদয়ের সশ্রদ্ধ প্রণাম নিও গুরুদেব।
    অনেকটা ব্যস্ততা, আর আলস্যের মাঝে আবার বাঙ্গালীর পূণ্য লগন। প্রভাত ফেরি, রবীন্দ্র সঙ্গীতের মূর্ছনায় সাজো সাজো রব। আজ পঁচিশে বৈশাখ- তোমার শুভ জন্মদিবস। অনেক স্মৃতিচারণা, অনেক শ্রদ্ধা, অনেক প্রণাম, মালা, শ্রদ্ধার্ঘ্যর ভিড়ে তুমি আজ। তুমি প্রণম্য, তুমি বাঙ্গালীর বুলি, তোমার মাঝে ‘সহজ পাঠে’র আসর। “ঘরে বাইরে” তোমার থেকেই শেখা “দেনা পাওনা”র হিসাব। তোমার কলম থেকেই “নষ্টনীড়”র গ্ৰন্থি ধরে “নৌকাডুবি”র মাতন তুলে “চতুরঙ্গ” পেরিয়ে এসে “চার অধ্যায়” এর হাতটা ধরা।

    আজকের উৎসবের ভীড়ে কিছু কথা তোমাকে একান্তে বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। গুরুদেব অসীম শ্রদ্ধা নিয়ে বলি- অপরাধ নিও না। তুমি আমাদের প্রাণের কবি। তবুও তোমার মাঝে দেখি যেন এক প্রবল প্রেমিক, দুরন্ত প্রেমিক, অসহায় ভালোবাসার আর্তির সুরে হারিয়ে যাওয়া এক প্রেমিক। তুমি যেমন তোমার কবিতায়, সুরে পূজা-প্রেম এক করেছো বারবার। পড়তে পড়তে প্রেম পূজা যে আমাদেরও কখন একাকার হয়ে গেছে। “চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি, গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি…” পূজা যে প্রেম হয়ে ধরা দিল গুরুদেব! “কোথায় পাবো এমন আকুতি? আবার প্রকৃতির মাঝেও প্রেমের অনুভূতি দিয়ে বলে গেছ, “মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন/ তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম” তুমি শুধু তুমিই দিয়ে গেছ আমাদের এই অনুভূতি? আমার চোখে তুমি প্রবল পুরুষ, প্রেমের জোয়ারে ভেসেছো, ভাসিয়েছো যুগ যুগ ধরে।


    যেখানে যেখানে তোমার পদরেণু পড়েছে, তাই তীর্থ। তোমার কথা, সুর সব বীজমন্ত্র। তোমার বাণী চলার পাথেয়। তোমাকে অনুভব করতে শুধু চোখ বন্ধ করে মনের আগল খুলে রাখি, চিরন্তন অপেক্ষায়- “আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে, আমার এ দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো..”
    ভাষা দিয়ে তুমি বেঁধে গেছো আমাদের, আমরা তোমাকে বেঁধেছি ভালোবাসায়। তুমি আমাদের জীবন- বোধের দিয়েছো বাণী, শতাব্দী পার করে এসেও অমলিন তোমার ছবি।
    লহ প্রণাম হে গুরুদেব।….

  • চিঠি

    চিঠি- ফিরে এসো জবালা

    ফিরে এসো জবালা

    -রীণা চ্যাটার্জী

    সাহসিনী,
    অচেনা, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া একটা নাম তুমি। পরিচয়! তুমি নারী, তুমি দেহপসারিনী, তূমি উচ্ছৃঙ্খল, তুমি বহুভোগ্যা, তুমি দাসী। তথাকথিত বর্ণপ্রথার ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী সমাজের ঘৃণিত, নীচু শ্রেণীর একজন তুমি– জবালা তোমার নাম। তোমার আর এক পরিচয়, তুমি মা- ‘সত্যকামের মা’। তোমার সন্তান উপাধিধারী, বংশ পরিচয়ের বৃথা অহঙ্কারের ‘ব্রাহ্মণ’ নয়, প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী, ইন্দ্রিয় জয়ী, তেজস্বী ‘সত্যকাম’।

    আমার চোখে তুমি এক অদম্য সাহসিনী ‘মা’- যে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে, লালন-পালন করেছে মাতৃস্নেহে। যৌবনের ধর্মে সন্তানসম্ভবা হলে তোমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ঔরসধারীর পরিচয়, অনুমতির অপেক্ষা করো নি। অবশ্য স্বীকৃতি কেই বা দিত! যদিও সেই ব্যক্তি বড়ো হতভাগ্য.. সে বঞ্চিত হলো সন্তানের কৃতিত্বের গর্ব থেকে। ভবিষ্যত দ্রষ্টা হলে এ সুযোগ বোধহয় হারাতো না, পিতৃত্বের দাবী নিয়ে সজাগ থাকতো।
    ভূমিষ্ঠ জাতকের নাম দিয়েছো তুমি ‘সত্যকাম’, কি পবিত্র নিগূঢ় অর্থ! ভাবলে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়।

    ‘সত্যকাম’-কে হতে হয়নি অনাহুত ভ্রুণ, ঠাঁই পায়নি আস্তাকুঁড়ে কিংবা কোনো দুর্গম জায়গায়, পাশে বসে থাকেনি কোনো চিল, শকুন, শিয়াল লোভাতুর ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিয়ে সদ্যোজাতের লোভনীয় স্বাদ নেবার জন্য। পালিত হতে হয় নি অজ্ঞাত পরিচয়ের বোঝা নিয়ে সে তো শুধুই তোমার জন্য জবালা।

    আজ এতো যুগ পরেও তোমার মতো সাহস দেখাতে পারেন খুব কম সাহসিনীরা, যাঁরা সরে যান না তাঁদের মাতৃ ধর্ম থেকে, লজ্জিত হন না তাঁদের মাতৃত্বে, পিতৃহীন পরিচয়ের ভয়ে বঞ্চিত করেন না সন্তানকে তার প্রাপ্য স্নেহটুকু দিতে- সমাজের কটাক্ষ, নিপীড়ন উপেক্ষা করে জন্ম দেন তাঁর সন্তানের, একটি প্রাণ ভূমিষ্ঠ হয়।

    তবুও সমাজ যখন পিতৃপরিচয় চায় সেই সন্তানের, তখন অনেকেই নেন ছলনার আশ্রয়। বিভিন্ন কারণে, ভয়ে- সমাজের কাছে সত্য গোপন করেন। কারণ সমাজ এখনো মনে প্রাণে পিতৃতান্ত্রিক। তাই হয়তো বা লজ্জায় সন্তানের কাছে তুলে ধরতে পারেন না নির্দ্বিধায় অতীত কাহিনী। ভয় তো থেকেই যায় ভবিষ্যতে অতীতের অবগুণ্ঠন খুলে যাওয়ার। তাই দেখা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সন্তান ভবিষ্যতে জন্মের প্রতি, জীবনের প্রতি এক দুরন্ত অভিমানে, অভিযোগে বিপথগামী হয়, বা স্নেহের পবিত্র সম্পর্কটুকু নির্দ্বিধায় ছিন্ন করে (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। সত্যকে সহ্য করতে পারে না নির্ভীক চিত্তে।

    ‘সত্যকামে’র সত্যকে নির্ভীক চিত্তে মেনে নেওয়ার মন্ত্রে দীক্ষা তুমি কি তাকে তোমার গর্ভে থাকাকালীন দিয়েছিলে? কোন ভরসায় বলেছিলে, নির্ভীক চিত্তে অবলীলায় তার জন্মের ইতিহাস? শুধুই সত্যের জোরে! তাই কি তোমার সন্তানের দীপ্ত, দর্পিত পদক্ষেপ- মাতৃ পরিচয়ের সম্বল নিয়ে অহঙ্কারী, দাম্ভিক পিতৃতান্ত্রিক সমাজে! যাঁর সত্যবাদীতায় মুগ্ধ, স্তম্ভিত হয়ে যান ঋষি গৌতম, শিষ্যত্বে বরণ করে নেন সমাদরে। ভবিষ্যতের ইতিহাস পেল প্রকৃত জ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী ইন্দ্রিয়জয়ী ‘সত্যকাম’।

    তোমার সন্তানও ঠিক তোমার মতোই সমাজকে আর এক নতুন বার্তা দিল। জন্মে-বংশে নয়, কর্মে-মেধায় খুঁজে নিতে পরিচয়ের আসল কৌলিন্য। স্বীকৃতি দিলো মাতৃ পরিচয়ের, স্বাক্ষর দিলো সাহসের, মেধার, বিচক্ষণতার। রত্নগর্ভা ধন্য তুমি, কালজয়ী জ্ঞানী তোমার সন্তান। অবশ্যই সব-সবটুকু প্রাপ্তি ঘিরে তোমার সাহসী পদক্ষেপ। মাতৃগর্ভের, মাতৃক্রোড়ের সার্বজনীন স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজন শত শত সত্যকাম।

    বর্তমানে শিক্ষার মিথ্যা দম্ভে সমাজের অবক্ষয় ভীষণ পীড়াদায়ক। শৈশব, পরিচয়, অস্তিত্ব সব অদৃশ্য জাঁতাকলে পিষে চলেছে অবিরাম। সমাজের উন্নাসিকতার তুলাদণ্ড আজো বিচার করে মেধা। মেধা- শিক্ষা-চেতনা সবকিছু আজ দামী পসরা, উচ্চমূল্যে বিনিময় হয়। আমাদের আবারও ভীষণ প্রয়োজন জানো ইন্দ্রিয়জয়ী প্রকৃত জ্ঞানীর। ভেকধারীর মুখোশ খুলে দিতে দরকার অগুনতি ‘সত্যকাম’। নব উন্মেষের, উন্মুক্ত চিন্তার কান্ডারীর হাতে সমাজকে সঁপে দিয়ে যেতে শতরূপে ফিরে এসো জবালা, কোলে নিয়ে ‘সত্যকাম’।
    প্রতীক্ষা

  • চিঠি,  প্রথম বর্ষ - ২০১৯,  বর্ষপূর্তি কলম

    একান্ত আপন, আলাপ

    একান্ত আপন, আলাপ
    – রীণা চ্যাটার্জী

     

     

    একান্ত আপন, আলাপ,
                                কতো কথাই বলা হয়ে যায়, জানা-অজানার মাঝে, ছন্দে-সুরে সুললিত, ভঙ্গিমায় প্রত্যয়ী। অর্থ- অনর্থক কতো কথা জুড়ে তোমার আনাগোনা। আমি না হয় হলাম, ‘কথামালা’- তোমাকে ‘আলাপ’ নামে ডাকি? সই করবে আমায়? দু’জনে মিলেমিশে চারপাশে ছড়িয়ে যাবো অনেক কথা, চেনা-অচেনা, জানা-অজানা নানান আলাপনে।
    কখনো শুধুই বলার জন্যই বলতে চাওয়া তোমাকে ঘিরে। কখনো বা নিভৃতে, নীরবে কিছুই না বলায়, দৃষ্টির বিনিময়ে মুর্ত হয়ে ওঠো তুমি। কখনো তুমি চার দেওয়ালে বন্দী ভীষণ সতর্ক ফিসফিসানি, কখনো আলগা কথামালার হুল্লোড়, কখনো বা অসতর্কতার বিতর্ক। কখনো তুমি ফল্গুধারা, জীবনকে নিয়ে বহমান সজীবতা। কখনো এক টুকরো বরফ, নৈঃশব্দের শীতলতা। কখনো তপ্ত অগ্নি পিন্ড, জ্বালাময়ী হুঙ্কার। কখনো খন্ডিত পাথর, হতাশায় স্তব্ধ করে দেওয়া– ‘আলাপ’।

    গুরুদেবের ‘অবাক জলপান’ এ ভীষণ অদ্ভুত তোমার উপস্থাপনা। একদিকে তৃষ্ণার্ত পথিকের তৃষ্ণা নিবারণের অনুসন্ধান তো অপরদিকে অচেনা মানুষের শুধু বোঝা না বোঝার মাঝে মিলে হলো কতো কথামালা! দুই পক্ষের কথা বিনিময় তো শুধু মাত্র ‘আলাপ’ তোমারই জন্য।


    শ্রদ্ধেয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীরা’র জন্য মনের সাথে কতো কথা জুড়ে তো তুমিই ছিলে আলাপ- একান্তে নিভৃতের আলাপ।


    ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’-এ বিদ্রোহী কবি আলাপ করলেন এক উচ্চকিত বিদ্রোহের সাবধান বাণী দিয়ে।
    ‘আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস,….. দীর্ঘ বরষ মাস’– ভালোবাসা জুড়ে তো শুধু তুমি আর তুমি। শেষই হতে চায় না যে ভালোবাসায় ‘আলাপ’।


    দুই প্রতিবেশীর খেয়াল খুশির কুশল বিনিময়ের মাধ্যম তুমি, ভিড়ে উৎসুক জনতার চোখের চাহনির নীরব জিজ্ঞাসা বিনিময়ে তুমি, ব্যস্ত গৃহবধূর ক্ষণিকের অবসরে সাথী তুমি, কৈশোরের হুল্লোড় তুমি, যৌবনের উন্মাদনা তুমি, থমকে যাওয়া অবসর জীবনের ‘বার্ধক্যের বারাণসী’ ও বোধহয় তুমি– সব বাঁধার প্রাচীর ভেঙ্গে অচেনাকে বন্ধনে বাঁধো শুধুই তুমি।


    কোনো ক্ষয়, লয় কোনোদিন আসতে পারবে না আমাদের মাঝে। তোমার আমার এই পথচলা অনন্ত, অসীম। ছড়িয়ে যাবো গলি থেকে রাজপথে, পাহাড়-নদী-সমুদ্রে, আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলে মনের আনাচে-কানাচে বাঁধবো বাসা সুখ, দুঃখে, ভালোবাসায়। ওই শোনো আবার কারা যেন ডাকে তোমায়… চলো শুরু করি মিলেমিশে আবার। “… এই পথচলাতে আনন্দ”

  • চিঠি

    প্রিয় ভালোবাসা, তোমার উপেক্ষা।

    প্রিয় ভালোবাসা, তোমার উপেক্ষা

    -রীণা চ্যাটার্জী

    প্রিয় ভালোবাসা,
    তোমায় আকাশ ভেবেছিলাম,মেঘ হয়ে ভাসতে চেয়েছিলাম তোমার বুকে। এ পাশ ওপাশ সবটুকু জুড়ে নিজের মতো করে উড়ে বেড়াতাম আলতো ছোঁয়ায়, কখনো তুমি তোমার আলিঙ্গনে মিশিয়ে নিতে নিজের সাথে… একাত্ম হয়ে ওঠার সেই মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতাম তোমার মাঝে, থাকতো না আর আলাদা কোনো অস্তিত্ব…

    তোমাকে ভেবেছিলাম চঞ্চল সমীরণ, আমি সবুজ বনানী, কিংবা ধানসিঁড়ি। দুলিয়ে দিয়ে যেতে আসা যাওয়ার প্রতি মুহূর্তে আমায় আলতো ছোঁয়ায়… আমি ব্যাকুল হয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরার আশায় মেলে ধরতাম সমস্ত অবয়বটুকু…. পারতাম না তোমাকে ছুঁতে, তুমি শুধুই চঞ্চলতা নিয়ে আসতে আমার কাছে! তোমার লুকোচুরির খেলায় অস্থির হয়ে যেতাম ধরা-অধরার মাঝে, শ্রান্ত আমি হয়তো বা তোমাকে না পাওয়ার অভিমানে, তোমার আলিঙ্গনের বৃথা মনোবাসনায় হতাম ক্ষণিক স্তব্ধ। তখন তুমি ফিরে আসতে, বেঁধে নিতে দৃঢ় আলিঙ্গনে…

    তুমি যদি হতে নীল সাগর, আমি বেলাভূমি… দুরন্ত গর্জনে ছুঁয়ে যেতে আমায়– আমার মন,সত্তা তোমার পিছনে ছুটে যেত জগৎ সংসার সব ভুলে,বাকী অবয়বটুকু নীরবে উন্মুখ হয়ে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায়। তুমি আসতে ফিরে–ক্ষণিকের জন্য, ভরিয়ে দিয়ে যেতে। রিক্ত, সিক্ত আমি আবার প্রতীক্ষায়.. আমার হৃদয় জুড়ে তখন শুধু তোমার স্পর্শের দুরন্ত ছন্দ। অনন্তকাল এক হয়ে মিশে যেত, থাকতো না কোনো সময়ের গণ্ডী আমাদের মাঝে…

    তুমি যদি বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে আমার মাঝে, আন্দোলিত হতাম প্রতি অনু-পরমাণু জলকণায়। আমার উন্মুখ হয়ে থাকার অবসান হতো তোমার অঝোর ধারায়। তোমার ধারায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গরবিনী আমি নদী হয়ে বয়ে যেতাম তোমার সাথে নীরবে নিভৃতে। ভেসে চলতাম অভিন্ন হৃদয়ে.. জনরোলে মিশে যাওয়া নিবিড় বন্ধনে বন্দী দু’টি মন।

    হঠাৎ শিশির ছোঁয়ায় কেটে গেল তন্দ্রা– সুখের আবেশ কেটে স্বপ্নরা হারিয়ে গেল, ফিরে এলাম কঠিন বাস্তবে। আকাশ-কুসুম চিন্তায় অলীক স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলাম। তোমাকে প্রেমিক ভেবে, মুগ্ধতার রেশ নিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম নিজের স্বরূপ…. তুমি যে চিরন্তন এক প্রেমিক, কখনো খেয়ালী বশে ক্ষণিকের আলাপে এসেছিলে আমার কাছে। আমি অবোধ ভেবে নিলাম সত্যি! ভুলে গেছিলাম, গোলাপ তো নয়, যে তার রূপে বিমোহিত হয়ে বক্ষলগ্ন করে রাখবে আজীবন, ব্যথা পাবে তার ঝরে যাওয়ার জন্য, হৃদয় মথিত কাব্যে স্থান পাবে তোমার, সে যে তোমার ‘চিরন্তনী’। আমি কচুরিপানা, অকারণে ফুটে ওঠা এক অনামী ফুল… যাকে ঘিরে আসতে পারে চোখের ক্ষণিক মুগ্ধতা, কিন্তু মনের চিরন্তনী হবার যোগ্যতা তো রাখিনা। খেয়ালী নয় খামখেয়ালীর সাথী আমি,ঝরে যাওয়ায় ব্যথা তো অনেক দূরের, মনেও তো পড়বে না আমাকে… বড়ো অবহেলায় অপ্রয়োজনীয়। স্বপ্ন দেখার ধৃষ্টতা আমার ছিল তাই অলীক স্বপ্ন ভঙ্গের দায় সম্পূর্ণ আমার রেখেই বাস্তবকে সাথী করে নিলাম। নাহ্.. কোনো ইচ্ছে ,আশারা হাত ধরে নেই আমার। শুধু জোনাকি জ্বলা আলোর মাঝেই খুঁজবো নিজেকে এবার, জ্যোৎস্না থাক তোমার ভালোবাসার মধুরাতের জন্য।

    -তোমার উপেক্ষা

  • চিঠি

    উত্তর সূরীদের উদ্দেশ্যে চিঠি

    উত্তর সূরীদের উদ্দেশ্যে চিঠি
    -সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

     


    আমার লক্ষ্য অনেকদূর- পৌঁছতে পারবে কি না জানি না। তোমরা যারা আসছ তারা শপথ নিয়েই তবে আসবে। গতানুগতিকতায় আমার ঘৃনা।মানবতার শ্রেষ্ঠধাপে ওঠার আগে দৃঢ় প্রত্যয় চাই।তার জন্য যেকোনো মুল্য দিতে আমি প্রস্তুত-তোমরাও প্রস্তুত থেকো।চারিদিকে নানান বাধা বিপত্তি আর প্রলোভনের হাতছানি। লাঞ্ছনা অপমান ঘৃণা এখন আমার রোজকার খাদ্যতালিকা।মাঝে মাঝে মনের বিভ্রান্তিও যে ঘটেনা তা নয়। তবু তোমরা যারা আমার আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছ তাদের কথা ভেবেই মনকে শক্ত করেছি।এসো, আমার দেখা স্বপ্নের নাদেখা সূর্যটাকে পূব আকাশে জ্বালিয়ে দাও। সামাজিক ব্যভিচার কুসংস্কার কে শিখণ্ডির মত সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিও না। তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে এগিয়ে চল। নাহলে ওরা আবার বাধা দেবে। ওদের থেকে সাবধান। আর্থ-সামাজিকতা, আতিথেয়তা জীর্ণ কাপড়ের টুকরোর মতো কার্ণিশে ঝুলছে।সযত্নে ওদেরকে শরীরের মধ্যে নাও।মানবতায় ভেজাল দিও না।সুনামের জন্য ভিক্ষা কোরোনা। কলঙ্ক আসবেই। চন্দ্রের কিরণের স্নিগ্ধতা থাকলেও কলঙ্ক চিরকালীন।ভয় পেয়ো না। বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াও।ভিক্ষার ঝুলি পরিত্যাগ কর।
    অহংকারী বলে বিদ্রুপ আসবে।আসুক। অনুসরণ থামিয়ে দিওনা। দেশ মাতৃকা আমার, অনেক দিন হল শয্যাশায়ী। রোগমুক্তির জন্য উপযুক্ত ওষুধ,পদ্য, পানীয় প্রয়োজন। সম্পত্তির লোভে অনেকেই উঁকি দিচ্ছে। ওদের ভীড় ঠেলে মায়ের শয্যা পাশে এসে দাঁড়াও। মাকে অভয় দাও।মা সুস্থ হলেই তোমরাও সুস্থ হবে। আমি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। নৌকোর পাটাতনে পা দিলেই আমি ছুটি নেব- ভেবো না।
    ধীরে ধীরে নয়; হাওয়ার উল্টোদিকে ঝড়ের বেগে আস্তে হবে।এমন দিন হয়তো বেশি ক্ষণ পাবে না। মাকে সেবা করার এই-ই প্রকৃত সময়।সততা, সদাচার আর একনিষ্ঠ আত্ম- বলিদান দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। আমি তোমাদের পাশে পাশেই থাকবো চিরদিন। জয় মানবতার জয়, জয় সত্যের জয়।।


                                                                                               ইতি
                                                                                            সত্যান্বেষী।

  • চিঠি

    বলো বেণীমাধব

    বলো বেণীমাধব
    – রীণা চ্যাটার্জী

     

     

    বেণীমাধব,
    তোমাকে সেদিন হঠাৎ দেখলাম। চিনতে পেরেছো আমাকে, অবাক হয়েছো, তোমার দৃষ্টি বলছিল সেই কথা। পরিচিতের মতো কথা বলতে আগ্ৰহী হয়েছিলে… লজ্জা আর পাওনি না আমাকে পরিচিতা ভাবতে? কেমন আছো জানতে চাইনা আজ আর। ভুলে গিয়েছি কবেই তোমার অস্তিত্ব, স্মৃতিরাও অস্পষ্ট ছায়াময়। কালো রঙেই আজ আমি করেছি আমার ভূবনজয়। জীবনের চলার পথে রূপে নয় বেণীমাধব, পরিচয় পেয়েছি আমার দক্ষতায়। সেলাই আমি আজো করি, তবে পাই না তাতে গ্লানি, আসে না হীনমন্যতা। আমার পাশেও আজ ভীড় করে চোখ ধাঁধানো আলো। আমার তৈরী পোশাক আজ দামী বিপণীতে, অনেকেই আসে কিনে দিতে তার প্রেমিকাকে। নামটা আমার ভীষণ দামী, নাগাল কেউ পায়, কেউ পায় না। তোমাকেও দেখেছিলাম ভিড়ে, ভেবেছিলাম পূর্ব পরিচিতির সূত্র ধরে কিছু সুলভে… নাহ্, হয়ে ওঠে নি। ব্যস্ততার অন্যমনস্কতায় ভুলে গেছিলাম। একটু বলি বেণীমাধব?

    – আজ আমি চোখ ধাঁধানো আলোর ভীড়ে
    কেন তুমি হারিয়ে গেলে জনসমুদ্রের তীরে?
    আবছা স্মৃতি “মোহন বাঁশি তমাল তরুমূলে”
    ইচ্ছে পাখী হাত ধরেছে আমার সাফল্যে।

    শৈশবের, কৈশোরের দৈনতা, অবহেলা আজ আমার থেকে অ..নে..ক দূরে। হারিয়ে যাইনি আমি, না হারবার অদম্য জেদ আমাকে নতুন অঙ্ক শিখিয়েছিল। তুমি, তোমরা সবাই ভেবেছিলে কালো মেয়ের কিসের শখ! কিসের মান! ভাগ্যিস ভেবেছিলে! নাহলে আজকের ‘আমি’ হয়ে কি করে উঠতাম? নিজেকে চিনতে শিখিয়েছিল তোমাদের অবহেলা। তাই তো সেদিনের সেলাই দিদিমণির সেলাই আজ ভীষণ চাহিদায়, অনেকের আকাঙ্খার। বিশেষ দিনে প্রিয়জনকে উপহার দিয়ে অনেকেই আত্মতুষ্টি পায়… আবার বলি বেণীমাধব?

    – দেখেছিলাম তোমাদের যুগল মুর্তির অপূর্ব সেই আলো
    আমিও এখন শ্যামলা দীপ্ত আলো, নই অসহায়, কালো

    খাতাতে বেমিল হলেও, অঙ্কটা মিলিয়ে নিয়েছি জীবনে
    জ্যোৎস্না ভাসে আনন্দে জানো, বিলাসিতার আবাসনে।
    যে বোন আমার হারিয়ে ছিলাম চোরাস্রোতের বাঁকে…
    পেয়েছি ফিরে তাকেও জানো, আমার সকল সুখের ঝাঁকে।

    তোমাদের বোধে, চিন্তায় মেয়েরা বড়ো অসহায়। তাই তো প্রেমিক হয়েও চরম উন্নাসিকতায় প্রেমের মূল্য দাও। ভাবো তোমাদের দেওয়া মূল্যে আমাদের জীবন মরণ বেঁধে দেবে। ফাঁদে পড়া জন্তূর মতোই ভাবো। ভেবে নাও নীরব নিভৃতে অসহায় যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাবো বাতিলের দলে। না, বেণীমাধব বড়ো ভুল করো তোমরা। ছন্দে ছন্দে আমাদের জন্য ছদ্ম সমবেদনার কথা বলে উদার হতে চাও? জানি আমরা তোমাদের কামনায়, বাসনায়। ভালোবাসতে পারোনি শুধুই আকাঙ্খায়। একটু অন্যরকম ভাবো এবার… শেষে বলি বেণীমাধব!

    –’নষ্ট মেয়ে’ ধারণাটা মুছবে জানি না কবে
    বলতে পারো মেয়েরাই শুধু নষ্ট কেন হবে?
    কালের ঘরে সন্ধি করে অহঙ্কারী, শুধু মনের বলে
    অহঙ্কারের আগুন জ্বালাই? দেখি কেমন জ্বলে!
    আগুন জ্বালো বেণীমাধব এপার-ওপার ধ্বনি
    কেন তুমি ভীড়ের দলে? তোমার কথাই শুনি।
    ‌ ……….
    ** কোনো দুঃসাহস প্রকাশ নয়, শুধু মাত্র মেয়েদের না হেরে যাওয়া, না হারিয়ে যাওয়ার কথা বলার জন্যই কিছু বলার প্রয়াস। অতি পরিচিত এই কবিতার কবির প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান জ্ঞাপন করি।

You cannot copy content of this page