প্রতিবেদন

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- জীবনপুরের পথিক

    জীবনপুরের পথিক
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    জীবনপুরের পথিক বিশেষণটি যদি কারো জন্য সুপ্রযুক্ত হয়ে থেকে থাকে তবে তা হল সাতাশি বছরের তরুণ মানুষটির জন্যে, এই বয়সেও জীবন সম্পর্কে যাঁর আগ্রহ, কৌতূহল, সৃষ্টিশীলতা অবাক বিস্ময়ে অনুভব করে সমগ্র জগৎ।
    জীবন তাঁকে দিয়েছে অনেক কিন্তু কেড়েও নিয়েছে প্রচুর।

    জীবনের শুরুটা ছিল আরও পাঁচটি শিশুর মতোই। উনিশশো চৌত্রিশ সালের পরাধীন ভারতে তাঁর জন্ম। বৃটিশ বংশোদ্ভূত পিতা, মাতার সন্তান, শিশুটির ছেলেবেলা অতিবাহিত হয়েছে জামনগর এবং সিমলায়। আর পাঁচটা শিশুর মতোই দিব্যি হেসে খেলে বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় আনন্দে কাটছিলো ছেলেবেলার দিন, কিন্তু ভাগ্য যে তার জন্য লিখে রেখেছিল এক অন্য গল্প। টের‌ও পায়নি কখন যেন বাবা মায়ের সম্পর্কে ধরেছে চিড়। ক্রমশ বাড়তে থাকলো ফাটল। অবশেষে ঘটে গেল বিচ্ছেদ, উপরন্তু মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিল শিশুটির শৈশব।
    অতঃপর বাবার হাত ধরে জীবনপথে যাত্রা শুরু। বাবা-ই তার একমাত্র বন্ধু পথপ্রদর্শক।
    বাবার সঙ্গেই কাটে দিন। পড়াশোনার ফাঁকে বাবার হাত ধরেই প্রকৃতির পাঠ নেওয়া শুরু। জঙ্গলের পশুপাখি বৃক্ষলতা সব‌ই হয়ে ওঠে পরমাত্মীয়। এর‌ই মাঝে ধীরে ধীরে, গড়ে উঠছে অবসর সময়ে গল্পের ব‌ই পড়ার এক অদম্য নেশা, এ-ও বাবার কাছে থেকেই পাওয়া উত্তরাধিকার।
    কিন্তু জীবন তো আর সবসময় এক‌ই খাতে বয় না ।
    বাবার বদলির চাকরি। এবারে তাদের প্রকৃতির কোল ছেড়ে চলে যেতে হলো দিল্লীতে।
    সপ্তাহের অন্যান্য দিন বাবার অফিস, তার স্কুল। ছুটির দিনে বেড়ানো, থিয়েটার দেখতে যাওয়া, গান শোনা। অজস্র রেকর্ড কিনে আনেন বাবা। তাই নিয়ে দিব্যি কাটে দিন। পরিকল্পনা হয়, ভবিষ্যতে বিলেতে পাড়ি দেবার।

    বাবার বদলির চাকরি। হঠাৎ কলকাতায় বদলি হতে হলো। আপাতত সিমলায় বিশপ কটন স্কুলে বোর্ডিং স্কুলেই ভর্তি করে দিলেন বাবা। প্রতি সপ্তাহে বাবার চিঠি আসে। পরম সম্পদের মতো সেগুলো আঁকড়ে ধরে রাখে বালক। এতেই মেলে বাবার সাহচর্য।
    কিন্তু আবার‌ও ঘটলো ভাগ্যবিপর্যয়। আচমকাই তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাবা। স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় হারিয়ে গেল তার জীবনের একমাত্র মহার্ঘ্য সম্পদ, বাবার লেখা চিঠির তাড়া। পরিপূর্ণ হয়ে গেল নিঃস্বতার মাত্রা।
    এবার তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গিয়ে পড়লো কখনও ঠাকুমা কখনও বা তার মা আর সৎ বাবার উপর। না, তাঁরা এড়িয়ে যান নি, তার খাওয়া পরা, পড়াশুনার সব দায়িত্ব নিয়েছেন কিন্তু, মনের দায় নেয় কে? নিঃসঙ্গ শিশুটির সঙ্গী হলো প্রকৃতি আর কিছু গল্পের বই। ঈশ্বর বুঝি পারিবারিক গন্ডীর আওতা ছাড়িয়ে, তাকে দিয়ে দিলেন বিশ্ব নিখিলের অধিকার।
    নিঃসঙ্গ বালক একা একা পথ পথ হাঁটে বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে। চেনা হয়, পশু পাখি, জানা হয় মানুষকে। অচিরেই বন্ধু জুটে যায়। ভবঘুরে কিশোর, ফল‌ওয়ালা, ভিক্ষুক, জীবনযুদ্ধের সৈনিক একা ফেরিওয়ালা। ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতে থাকে অভিজ্ঞতার ঝুলি। বই পড়ার নেশা তো ছিলই। এই দুইয়ে মিলে কিশোর মনে জন্ম নেয় লেখালেখির নেশা। পড়াশুনার ফাঁকে শুরু হলো লেখালেখি। মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখা হয়ে গেল, সাড়া জাগানো গল্প- untouchable কিছুদিন পর আত্মজীবনীমুলক উপন্যাস- The room on the roof জিতে নিল বৃটিশ সরকারের মর্যাদাপূর্ণ J.L.R. পুরস্কার।
    বিশপ কটন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনায় সে পাড়ি দিয়েছিল ইংল্যান্ডে। কিন্তু তার যে মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে ভারতবর্ষের সেই ছেলেবেলার শহর। মনে অনুক্ষণ ভাবনা কী করে ফেরা যায়!
    ইংল্যান্ডে বসবাস কালে চাকরির পাশাপাশি লেখালেখিও চলছিলো সমানতালে । সঙ্গে জুটলো ফটো স্টুডিওর কাজ। এতেও কিছু কিছু রোজগার হতে থাকলো। সব জমা হতে থাকে দেশে ফেরার প্যাসেজ মানি জোগাড় করতে। সেই টাকা জমতেই দেশে ফেরার জাহাজ ধরলো সে। মানুষের সংসর্গ যে বড্ডো প্রিয় তার। ততদিনে স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, লেখালেখিই তার ভবিতব্য, এ ছাড়া অন্য কিছুই তার পেশা হতে পারে না। মনের আনন্দে চলতে থাকে তার লেখনী। লেখা হতে থাকলো অজস্র গল্প, উপন্যাস। পাঠক মহলে সাড়া ফেললো সেই সব। Penguin Publishers বরাত দিলো, তাদের জন্য ছোট গল্প লিখতে, ক্রমশঃ জুটতে লাগলো পুরস্কার। বিখ্যাত গল্প THE BLUE UMBRELLA নিয়ে তৈরী হওয়া সিনেমা, রাতারাতি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেল তাঁকে। সাহিত্য একাডেমী, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ কী নেই তাঁর ঝুলিতে! সম্প্রতি সাহিত্য একাডেমী তাঁকে ফেলোশিপ দিতে পেরে নিজেরাই নিজেদের ধন্য মনে করেছেন।
    বৃটিশ বংশোদ্ভূত, সাতাশি বছরের এই ভারতীয় লেখকটি আজ‌ও সমান দাপটে বিচরণ করছেন সাহিত্যের সাম্রাজ্যে।
    অকৃতদার এই মানুষটির বর্তমান ঠিকানা মুসৌরির আইভি কটেজ। সেখানে তিনি বসবাস করছেন তাঁর ‘এক্সটেন্ডেড ‘ পরিবারের সঙ্গে।
    এককালের স্নেহকাঙাল নিঃসঙ্গ বালকটি আজ দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষের নয়নমণি, বিখ্যাত লেখক রাসকিন বন্ড। ভাবলে অবাক লাগে এভাবেও ফিরে আসা যায়! নাকি এভাবেই ফিরে আসতে হয়!

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- ভাস্কর্য শিল্পী অগস্ত্য রদ্যার অজানা জীবন কাহিনী

    ভাস্কর্য শিল্পী অগস্ত্য রদ্যার অজানা জীবন কাহিনী
    -সুনির্মল বসু

     

     

    গরীব কৃষকের ঘরের সন্তান তিনি। শিল্পকর্মে অপূর্ব হাত তাঁর। পাথর কেটে মূর্তি গড়েন তিনি। শিল্প প্রদর্শনী করবেন বলে রাজার কাছে সাহায্য চাইলেন। রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল অন্যান্য শিল্পীদের আনুকূল্য দিলেও, এই শিল্পীকে অনুদান থেকে বঞ্চিত করেন। শিল্পী তখন ধারদেনা করে তাঁবু খাটিয়ে শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।
    সব দর্শকের ভিড় সেখানেই।
    রাজা এই প্রদর্শনী দেখতে এলেন। তিনি তো বিস্ময়ে হতবাক। চোখ সরাবার অবকাশ পাচ্ছেন না। একের পর এক অসামান্য নির্মাণ এই শিল্পীর।

    ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক বালজাকের আঠারো খানা মূর্তি তৈরি করেছেন তিনি। নিজেই বলেছেন, আমার পরপর সতেরো খানা মূর্তির মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, কিন্তু আমার আঠারো সংখ্যক
    মূর্তির মধ্যে কোন ভুল ত্রুটি নেই। আমি বালজাককে দেখি নি, কিন্তু তাঁর দর্জির কাজ থেকে তাঁর শারীরিক অবয়বের মাপ নিয়েছি। আমার এই শিল্পকর্মটি একদিন পৃথিবীর মানুষকে ভাবাবে।

    নিজের শিল্প চেতনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এই শিল্পী।

    রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের একের পর এক মূর্তি দেখে চলেছেন। তিনি তখন মুগ্ধতার শেষ প্রান্তে। মুগ্ধ রাজা একের পর এক মূর্তি দেখে চললেন।

    প্রদর্শনীর শেষে এসে রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল দেখলেন, একটি ভাস্কর্য মূর্তি কাপড়ে ঢাকা। রাজা তখন পাগলের মতো মই বেয়ে উপরে উঠে শিল্পকর্মটি দেখতে যাচ্ছিলেন, ভাস্কর অগস্ত্য রদ্যা তাঁকে টেনে নামিয়ে দিলেন। বললেন, এই মূর্তিটি অসম্পূর্ণ রয়েছে, এটি দেখা যাবে না। এই মূর্তিটির উপরে একটা নাইটিংগেল পাখি ডিম পেড়েছে। আমার শিল্পকর্মের চেয়ে, একটা জীবনের দাম অনেক বেশি।

    শিল্পীর এই মহানুভবতা রাজাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি শিল্পীকে রাজসভায় সাদর আমন্ত্রণ জানালেন।

    বিশ্ববন্দিত এই অসামান্য ভাস্কর শিল্পী মানুষটি আজ জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছেন। বড় শিল্পী, তিনি বড় মনের মানুষ। বিশ্বজুড়ে অমরত্বের স্বর্ণ মুকুট আজ তাঁর মাথায়।

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- পর্দা

    পর্দা
    -সুনির্মল বসু

    পর্দা বলতে বুঝি, একটা আড়াল, একটা আবরণ। অনেকের চোখ এড়িয়ে পর্দার মাধ্যমে একটা আড়াল রচনা করবার সচেতন প্রয়াস। আর্থিক অবস্থান অনুযায়ী প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পর্দা ব্যবহারের রীতি প্রচলিত আছে। আমি যেখানে থাকি, সেখানে চর্ম শিল্প কারখানার উচ্চপদস্থদের বাড়ি দামি দামি দৃষ্টিনন্দন পর্দা দেখেছি। শোনা কথা, একজন ছিঁচকে চোর নাকি ওই পর্দার কাপড় চুরি করে জামা বানিয়েছিল। আমি অবশ্য নিজের চোখে সেই জামা কেমন দেখতে হয়েছিল, তা দেখিনি।
    পর্দা শব্দটি বৃহৎ অর্থে ব্যবহার করলে, দেখা যায় যে, অনেকেই ট্রামে বাসে ট্রেনে-অফিসে-আদালতে, অন্যের কাছে গোপন করার জন্য এমনি আড়াল রচনা করে থাকেন। এখানে পর্দা দৃশ্যমান না হলেও,
    অনুভবে উপলব্ধি করা যায়।
    সৎকাজ ও অসৎ কাজের মধ্যে পর্দা থাকে। হাল আমলে প্রেম-ভালোবাসা খুল্লামখুল্লা হয়ে গেছে। আমি প্রাচীন মানুষ, আমাদের সময়ে প্রেম ভালোবাসার মধ্যে খানিকটা পর্দা প্রথা চালু ছিল। চিঠি চালাচালি চলতো গোপনে। মনে হয়, দীর্ঘ বিরহ
    ভালোবাসাকে আরো গাঢ় করে তুলতো।
    পর্দা অনেক সময় ভয়ের কারণ বটে। ছাত্র অবস্থায় হেড স্যারের ঘরে ডাক পড়লে, ওই পর্দাটা তখন গায়ে জ্বর এনে দিত। অফিসে বড় সাহেবের ঘরে ঢোকার আগে মনে হতো, নিশ্চয়ই আমার কাজে কোথাও ভুল হয়েছে। এক্ষেত্রেও পর্দা ভয়ের প্রতীক।
    যৌবনে পছন্দের নারীকে কোনো মোহময় বিকেলে জানালার পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে, দিনটা ভালো হয়ে যেত। নিজেকে মনে হতো, আলেকজান্ডার, কিংবা নেপোলিয়ন।
    জীবনে পর্দার মাহাত্ম্য বলে শেষ করা যায় না। শুধু জীবনে কেন, মরণেও পর্দার গুরুত্ব থেকে যায়।
    ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি শুনুন, মৃত্যুর কিছু আগে বিখ্যাত লেখক জর্জ বার্নার্ড ‘শ ঘরের সকলকে অনুরোধ করেছিলেন, জানালার পর্দাটা সরিয়ে দাও, আলো আসুক।
    সকালবেলায় পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তরুণ আলো ঘরে ঢোকে, মানুষের জন্মের সময়টাও, পর্দা সরিয়ে প্রথম আলো দেখার মতো বিস্ময় মেশানো চরম আনন্দ। আবার মৃত্যু মানে, চলমান জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়া, যেন পর্দা টেনে দেবার মতো ব্যাপার।
    পর্দা শুধু আড়াল রচনা করে না, পর্দা ভালোবাসায় গভীরতা দেয়। পর্দার আড়াল টুকু কখনো কখনো অনেক দামি হয়ে ওঠে। জীবনের গভীর ব্যঞ্জনা তার মধ্যে ফুটে ওঠে।
    জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই পর্দা সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায়, স্মৃতিতে স্মরণে থেকে যায়।
    জীবনে পর্দার মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করা যায় না। পর্দা শব্দটি ছোট, কিন্তু তার গভীর ব্যঞ্জনা জীবনের প্রতি পদে পদে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- কবি ও কবিত্বশক্তি

    কবি ও কবিত্বশক্তি
    -সুনির্মল বসু

    নদীর ধারে বসে অস্ত গোধূলির আলোয় যে লোকটা ইজেল তুলি নিয়ে তেলরঙে দিনান্তে ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের ছবি আঁকছিল,
    মধ্যরাতে কয়েদখানায় বসে যে অপরাধীটি বাঁশিতে মিঠেল সুরের ঝড় তুলে জেলখানা সুরের রাগিনীতে ভরিয়ে দিয়েছিল,
    প্রত্যাখ্যাতা যে মেয়েটি খোলা জানালার ধারে বসে আনমনে বিরহের গান গাইছিল, তার দুচোখে তখন অঝোর বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল, ব্যথা পেয়ে মেয়েটির মন জেগে উঠেছিল,
    মধ‌্য দুপুরে ধানক্ষেতের পাশে যে কৃষকটি গাছের ছায়ায় বসে স্ত্রীর আনা খাবার খেতে খেতে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে, ভালোবাসা প্রকাশ করেছিল, উতরোল নদীতে দাঁড় বাইতে বাইতে যে মাঝিটি ভাটিয়ালি সুরে গান গাইছিল, উত্তাল নদীতে চলার ছন্দে সে তখন সুরের মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছিল, সে গাইছিল- মন মাঝি, তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না,
    এদের বাইরের পরিচয় যাই হোক, এরা নিজেদের অজান্তেই ওই মুহূর্তে কবি হয়ে উঠেছিল।
    কবিত্ব সবার মধ্যেই থাকে, আসলে প্রত্যেকেই কবি।
    কখনো কোনো বিরল অসতর্ক মুহূর্তে
    এই কবিত্ব শক্তি দিনের আলোয় প্রকাশিত হয়ে যায়।

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- লেখকেরা কে কিভাবে লেখেন

    লেখকেরা কে কিভাবে লেখেন
    -সুনির্মল বসু

     

     

    লেখকদের লেখবার ব্যাপারে সকলেরই নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। জার্মানির লেখক পল হেইস গন্ডগোল না হলে লিখতেই পারতেন না, এজন্য তাকে পার্টি দিতে হতো। ইটালির লেখক লুইজি পিরানদেল্লো উঁচু সাঁকোর উপর বসে লিখতেন, ইংরেজ লেখক ডি এইচ লরেন্স ট্রেনের কামরায় বসে লিখতেন। জর্জ বার্নার্ড শ দাঁড়িয়ে লিখতেন, তাড়াতাড়ি লেখায় তার দক্ষতা ছিল। স্যার ওয়াল্টার স্কট রাজার পোশাক পরে লিখতেন। রাশিয়ার লেখক মিখাইল শোলখভ পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তিনি ছয় মাসের মধ্যে ধীরে বহে ডন, উপন্যাসটি লেখেন। আলজেরিয়ার লেখক আলবেয়ার কামু তিন মাসে উপন্যাস লেখেন।
    বাংলা ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র পত্রিকার প্রয়োজনে একাধিক উপন্যাস লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির আলো ছায়ায় লিখতেন। শরৎচন্দ্র মনের প্রেরণা না পেলে, লিখতে চাইতেন না। মানুষের দুঃখ কষ্ট তাকে লিখিয়েছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশিরভাগ সময় বনে বসে লিখতে ভালোবাসতেন। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে লিখেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মাটিতে আসন পেতে জল চৌকিতে কাগজ রেখে লিখতেন। একালের লেখক সমরেশ বসু সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যে ছটা অবধি টানা লিখে যেতেন। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সারাক্ষণই লেখা নিয়ে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের পর সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন তিনি। প্রয়াত অতীন বন্দোপাধ্যায় সকালে লিখতে বেশি ভালোবাসতেন। বিখ্যাত লেখক বিমল মিত্র তেইশ বছর সারারাত জেগে সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাস লিখেছিলেন। খেলার মাঠের খবরাখবর নিয়ে সংবাদ করতে করতে লেখক মতি নন্দী স্ট্রাইকার, কোনি উপন্যাস লেখেন।
    আসলে, সৃষ্টি প্রক্রিয়া সকলের এক রকম নয়। বিভিন্ন লেখকের রচনা অভ্যাস ভিন্ন রকমের। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চোখের সামনে দেখা ঘটনাগুলির উপর অসামান্য কবিতা লিখেছেন। কলকাতার যীশু, উলঙ্গ রাজা তার অসামান্য সৃষ্টি। বিখ্যাত লেখক রমাপদ চৌধুরী বহু অসামান্য উপন্যাস লিখেছেন। বীজ, হৃদয়, যে যেখানে দাঁড়িয়ে, লাল বাঈ প্রভৃতি। শেষ দিকে বছরে একটা উপন্যাস লিখতেন। এইসব লেখার গভীরতা তুলনা হয় না। নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় একটি মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে প্রথম গল্প লেখেন, বর আসিতেছে। লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রথম গল্প লেখেন, রস। লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষ গল্প লেখেন, দুই কাননের পাখি।
    এভাবেই কবি ও লেখকদের মেজাজ মর্জিতে ভরে উঠেছে সাহিত্যের বিশাল অঙ্গন। প্রতিটি লেখকের চিন্তা ও রচনার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকরণ। কিন্তু তাতে সমৃদ্ধ হয়েছে, সাহিত্যের বিশাল অঙ্গন।

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- নবীন রূপে সাহিত্য

    নবীন রূপে সাহিত্য
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

    পরিবর্তন সৃষ্টির নিয়ম। প্রায় প্রতিদিনই আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে যেতে। সময়ের সাথে মানিয়ে চলতে গেলে আমাদের এই পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিতে হয়। চারিদিকে যেন পরিবর্তনের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই বন্যা থেকে ছাড় পায়নি সাহিত্য জগতও। বইয়ের পাতায় ছাপা অক্ষর থেকে এন্ড্রয়েড ফোনের স্ক্রিনের লম্বা যাত্রা দেখেছে সাহিত্য। যদি এটা বলা হয় যে সাহিত্য নিজের সীমা বিস্তার করেছে, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি সাহিত্য। আজ ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সাহিত্য এখন প্রায় ঘরে ঘরে অবস্থান করছে। নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছে নিজের প্রিয়জনেদের কাছে, সাহিত্য প্রেমীদের কাছে। এই সীমাহীন সাহিত্যই তো আমরা চাই, যেখানে থাকবে না কোনও বাধা। এখনকার দিনে হাতে মোবাইল থাকলেই নিজের ইচ্ছের মত ডুবে যেতে পারা যায় সাহিত্যের বিশাল সাগরে। অনলাইন সাহিত্য এখন নিজের আকার বৃদ্ধি করছে। মুদ্রণের পাশাপাশি সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনলাইনের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। সত্যি বলতে গেলে আজকের দিনে অনেক উঠতি কবি ও লেখকের স্বপ্নপূরণ করেছে অনলাইন সাহিত্য। কী করে? সেটারই বিস্তারিত চর্চা আমরা এবার করবো।
    সাহিত্যের বহু পুরনো রূপ হল মুদ্রণ আকার। কোনো পাঠকের দৃষ্টিকোণে হাতে বই নিয়ে পড়ার মজাই আলাদা। শোকেশে সাজানো থাকবে বড় বড় লেখকের বই। এই বই গুলো শুধু পড়ার কাজে আসে না, বরং বাড়ির সৌন্দর্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এগুলোর অবদান অনেক। অনেককেই বলতে শুনেছি – ‘বই সবসময় প্রিন্টেড হবে। মোবাইলে বই আবার কোনো বই নাকি।’ বইয়ের মূল্য এখনও কমেনি। তাই তো প্রতি বছর বইমেলায় লাখ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। যেকোনো লেখকের স্বপ্ন থাকে নিজের লেখাকে মুদ্রণ আকারে দেখার। সেই স্বপ্নপূরণের জন্য তারা অনেক কিছুই করতে রাজি। অনেক প্রকাশনী লেখকের মনের এই ইচ্ছেকে নিজের পকেট গরম করার সুগম পথ বানিয়ে নিয়েছে। এমন অনেক প্রকাশনীও আছে যারা লেখকের কথা চিন্তা করে, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম বলা যেতে পারে। ‘আমার লেখা গল্প কিম্বা কবিতা অমুক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।’ এই কথাটা নিজের প্রিয়জনেদের বলার জন্য বহু লেখককে নিজের পকেট থেকে হয়তো দুশো বা তিনশো টাকাও খরচ করতে হয়। এটা বলা যেতে পারে, এ সবের মাঝে লেখকদের অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছে অবলাইন সাহিত্য। অনলাইনই হলেও, তবুও কোনো পত্রিকাতে লেখকের লেখা তো প্রকাশিত হয়, যেটা লেখক গর্ব করে নিজের প্রিয়জনেদের দেখাতে পারে। দ্রুত গতিতে নিজের শাখা প্রশাখা বিস্তার করা অনলাইন সাহিত্য এখন লেখক ও পাঠকের মাঝে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু উঠতি লেখক বললে ভুল বলা হবে, অনেক নামকরা লেখকও আছেন যারা নিয়মিত ভাবে অনলাইন সাহিত্যে নিজের লেখা দিয়ে অনলাইন সাহিত্যকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
    আজ ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের সুবাদে আমরা অনেক অজানা লেখক ও কবিদের খুঁজে পাই। তাদের লেখা পড়তেও ভালো লাগে। তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনলাইন সাহিত্যের অবদানকে কোনো দিনই অস্বীকার করা যায় না। এটা ঠিকই যে, সাহিত্যের পুরাতন এবং আসল রূপ হল মুদ্রণ আকার। অনলাইন সাহিত্য যতই নিজের সীমা বৃদ্ধি করুক না কেন, এক লেখকের মন থেকে মুদ্রণ আকারে নিজের লেখা দেখার স্বপ্নকে কোনো দিনই মুছে দিতে পারবে না। কিন্তু এক নবীন লেখকের সাহিত্য জগতে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে অনলাইনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- বৃত্তি প্রবৃত্তি প্রভৃতি

    বৃত্তি প্রবৃত্তি প্রভৃতি
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    আবেদন:- না পড়ে অকারণ মতামত বা লাইক দেবার প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ।

    পৃথিবীর প্রাচীনতম কালে, যখন বর্ণাশ্রম সৃষ্টি হয়নি, সেই কালে মানুষের কিছু কাজকে বৃত্তি হিসাবে বিবেচিত করা হতো।
    যেমন- কিরাত বৃত্তি, দস্যুবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি এবং ভিক্ষাবৃত্তি। এগুলিই হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃত্তি।
    লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, এই পাঁচ বৃত্তির মধ্যে বেশ্যাবৃত্তি এবং ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে অসহায় অবস্থা অবস্থান করছে।
    চৌর্যবৃত্তির মধ্যে ধূর্ততা, দস্যুবৃত্তির মধ্যে নিষ্ঠুরতা এবং কিরাত বৃত্তির মধ্যে বীরত্ব বা সাহসীকতা ( কিরাত/ ব্যাধ বা শিকারী)।
    সেই অতি প্রাচীন কালে, এই পাঁচ প্রকার বৃত্তি ভিন্ন, অন্য কোনও রকম বৃত্তি বা জীবনধারণের উপায় তাদের জানা ছিল না।

    কালক্রমে চাষাবাদ, পশুপালন ইত্যাদি দ্বারা তারা সমাজবদ্ধ জীবনধারার প্রচলন করে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই প্রবর্তিত হয় সামাজিক নিয়মানুবর্তিতা। বর্ণাশ্রম এই নিয়মানুবর্তিতার একটি অঙ্গ।

    আজকের এই অতি আধুনিক যুগে, আবারও যদি ভালো করে লক্ষ্য করা যায়, দেখা যাবে, একমাত্র শিকারী বা কিরাত বৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ (যদিও চোরা শিকারী রমরমা)। বাকি চারপ্রকার বৃত্তি কিন্তু স্বমহিমায় উজ্জ্বল। যদিও তাদের রূপভেদ রঙভেদ ঘটেছে বিস্তর।
    কীরকম?
    ধরা পড়লে তবে চোর, নইলে সব ব্যাটাই সাধু। একসময় পুকুর চুরির কথা শোনা যেতো, এখন তো আকাশ পাতাল নদী পাহাড় সমুদ্র সবকিছুই চুরি যাচ্ছে (উচ্চস্তরীয় কান্ড)।
    ডাকাতি তো ডাংগুলি খেলার মতোই একটা বালক সুলভ চপলতা। থোড়াই কেয়ার।
    সাধারণ ভাবে অসামাজিক কাজ রোধ করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সেই কাজে কতখানি কর্তব্যপরায়ণ সে বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহের অবকাশ আছে।
    অবশ্যই এই প্রতিক্রিয়ার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।
    ইদানিং তো এমন অবস্থা যে, পুলিশকে রক্ষা করতে, পুলিশ রক্ষাবাহিনী গঠনের শীঘ্র প্রয়োজন। নইলে বেচারিরা লুপ্ত জাতিতে পরিণত হয়ে মিউজিয়াম আর ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে।

    বেশ্যাবৃত্তি। এটা যে কোন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, সে কথা কারও জানতে বাকি নেই।
    একসময় যে বৃত্তি শুধুমাত্র নিরুপায়, অসহায় অবস্থায় কেউ কেউ অনিচ্ছায় গ্রহণ করতে বাধ্য হতো,
    আজ তা অতি উচ্চ আকাঙ্খা আর লালসার কারণে বিকিকিনির মূল্যবান পসরা হয়ে উঠেছে। প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন। আগে এর একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। বাংলার বাবুকালচার এবং তার পরবর্তী সময়েও, কয়েকটি বিশেষ পল্লী পরিবেশে এদের পরিসর সীমিত ছিল। আধুনিকতার অনলাইন সিস্টেম, সমস্ত প্রাচীর চুরমার করে দিয়েছে।
    বহু বিউটি পার্লার, স্পা, মাসাজ পার্লারের আড়ালে রমরমা দেহ ব্যবসা। এছাড়াও হোটেল, রিসর্ট ইত্যাদি তো আছেই। আছে তথাকথিত নাইট পার্টি। মাখন শ্রেণীর ফুর্তি আলয়। আগেও ছিল, এখন শুধু আদল বদল।

    বাকি রইলো ভিক্ষাবৃত্তি।
    গুরুকুলের সময় কালে, আশ্রমিক শিক্ষার্থীদের ভিক্ষান্নে ক্ষুন্নি নিবারণ অনিবার্য ছিল। কৃচ্ছসাধন ছিল শিক্ষার অঙ্গ, তাই এই ব্যাবস্থার প্রচলন। রাজপুত্র কিংবা কোটালপুত্র এখানে বিবেচিত হতো না। শিক্ষার্থীই ছিল তাদের একমাত্র ভেদহীন পরিচয়।
    বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসীগণ, ভিক্ষু নামে পরিচিত ছিলেন। বৌদ্ধভিক্ষু। “ভিক্ষা অন্নে বাঁচাইবো বসুধা।”

    বৈষ্ণব সেবায় নিয়োজিত ভক্তগোষ্ঠী, ভিক্ষায় সংগৃহীত অন্ন গ্রহণ করতেন কিংবা আজও কেউ কেউ সেই প্রথার প্রতি অটল বিশ্বাস হেতু ভিক্ষান্ন সেবা করেন।
    হিন্দু সাধু কিংবা মুসলমান ফকির দরবেশ গন, গৃহস্থের বাড়িতে এসে ভিক্ষা গ্রহণ করতেন। গৃহস্থেরা এই সাধু, ফকিরদের সেবা করা, অতি পুণ্যকর্ম জ্ঞান করতেন।
    সন্ন্যাসী, ফকিরকে ভিক্ষা না দেওয়া, তারা গৃহস্থের অকল্যাণ বিবেচনা করতেন।
    এই প্রথা ছিল, একপ্রকার বিশুদ্ধ ধর্মাচারণ। কোনও তঞ্চকতা এবিষয়ে স্থান পেত না।

    আজকের অতি আধুনিকতায় মোড়া যুগে, ভিক্ষাবৃত্তি এক আশ্চর্য শিল্পকলায় পর্যবসিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। ভাড়া করা শিশু কোলে, কৃত্রিম অভাগী মায়ের অভিনয়ে বিগলিত হয়ে, কেউ কেউ পকেটে কয়েনের খোঁজ করেন।
    দাতা বিশ্বাস করেন তার এই অমূল্য এক বা দু’টাকার কয়েন, তাকে মহা পুণ্যবাণ হতে বিপুল সাহায্য করবে। কিন্তু তিনি একবারও ভেবে দেখলেন না, তার এই অকারণ নিষ্ফল দান, সেই মানুষটিকে কর্ম বিমুখতার দিকে একধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে,
    “অন্ধ কানাই গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে….. আজকের যুগে শুধু বেমানান নয়, সমাজের লজ্জাও বটে।
    স্বামীজি তাই বলেছিলেন, ভিক্ষা, মানুষের অলসতার প্রকাশ। তাকে উৎসাহ দান করে কর্মবিমুখ হতে সাহায্য করা মহা অন্যায়।

    অবশ্য, পাশাপাশি বলে রাখা ভালো- যারা সত্যিই নিতান্ত অপারগ, হীনবল ভগ্নদেহ, যারা অকৃত্রিম ভাবে অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে জীবন ধারণে অক্ষম। তাদের ভিক্ষা নয়। মননশীল সহযোগিতা এবং উপযুক্ত সাহায্য সহকারে সম্মান যুক্ত বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করা, অবশ্যই পুণ্যের কাজ।

  • প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- বিশল্যকরণী

    বিশল্যকরণী
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    রণাঙ্গনে লক্ষ্মণ ধরাশায়ী। প্রাণ সংশয়। বিশল্যকরণী চাই। এক্ষুনি চাই। ইমার্জেন্সি। রামের অনুজ বলে কথা। সাধারণ বানর সেনার মধ্যে কেউ হলে, ভবিতব্য বলে চালিয়ে দেওয়া যেতেই পারতো। যা ইতিমধ্যে গেছেও।
    সাধারণের কপাল, অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য দিয়েই গড়া। কিন্তু এই কেসটা তো তেমন হতে পারে না। উচ্চবর্গীয় রাজতনয় তথা স্বয়ং অবতারের অন্ধ ভক্ত ভ্রাতা, সাধারণ বানর সেনার ন্যায় বেঘোরে মরতে পারে না। আভিজাত্যের অবমাননা অসহ্য। ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
    সুতরাং বিশেষ জনের বিশেষ ব্যবস্থার নিদান। বিশল্যকরণী চাই। সূর্য অস্ত যাওয়ার পুর্বেই চাই।
    নতুবা,
    অবতার বিবশ অসহায়। হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলেন। হায় রে ভ্রাতা মোর, ভ্রাতা মোর, চোখ খোল একটি বার…
    ভার পড়ল অবতারের একনিষ্ঠ ভক্ত হনুমানের ওপরে। যেভাবে পারো, যেমন করে পারো নিয়ে এসো বিশল্যকরণী। এই একমাত্র ঔষধি। যদি ভক্ত ভ্রাতার পুনর্জীবন চাও। তাহলে এক্ষুনি ব্যবস্থা করো। যাও, কালক্ষয় করো না। যাও।
    ভক্ত হনুমান আদেশ পাওয়া মাত্র, মারলো একটা বিশাল লাফ। পৌঁছে গেল গন্ধমাদন পর্বতের চূড়ায়। চারিদিকে ঘন অরণ্যের মাঝে হনুমান দিশাহারা। হায় হায়, কী আপদ। এই এতো গাছগাছালির মধ্যে কোথায় সেই প্রাণদাত্রী গাছ। কোনটি? সেটা হোয়াটসঅ্যাপের যুগ নয়, যে ঝপ করে গোটাকতক ছবি তুলে ফটাফট পাঠিয়ে কনফার্ম করে নেবে। ওদিকে সময় পালায়। টেনশন বাড়ছে। দুরছাই নিকুচি করেছে। চল, গোটা পাহাড় শুদ্ধু উবড়ে নিয়ে চল। যাবে কোথায় বাছাধন। এরমধ্যেই তো আছে নিশ্চিত সেই অভিষ্ঠ বিশল্যকরণী। চল। যে চেনে সে খুঁজে নেবে।
    ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ। উড়ন্ত হনুমানের হাতে বিশাল গন্ধমাদন।
    কেল্লাফতে। লক্ষণের পুনর্জীবন লাভ। অবতারের মুখে বিজয় খুশির চওড়া হাসি। হনুমানের শক্ত কাঁধে সাবাশি চপেটাঘাত। জিও হনুমান জিও বেটা।
    এখন প্রশ্ন হতেই পারে, হঠাৎ এই গল্পের অবতারণা কেন? কারণ কী?
    আছে। কারণ আছে।
    গ্রামের যুবক ছেলে। হঠাৎ অসুস্থ। এখন মারণব্যাধির মহামারী। ডাকলেও সহজে কেউ রোগীর কাছে ঘেঁষতে চায় না।
    পৃথিবী বদলে গেছে। দুরত্বই এখন দস্তুর। তাই বলে তো রোগীর চিকিৎসা থেমে থাকতে পারেনা।
    ছেলেটির বাবা মা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যোগাড় করলো এম্বুলেন্স। প্রবল বিশ্বাসে ভর করে। হাসপাতালে গেলেই বাছা আমার সুস্থ হয়ে যাবে। ওখানেই আছে বিশল্যকরণী। যার পবিত্র ছোঁয়ায়, আবারও জেগে উঠবে, ভরসার প্রাণ।

    মানুষ তো বিশ্বাসেই বাঁচে। বিশ্বাস ভাঙলেই নিরাশা, আতঙ্ক। দিশাহারা অজানা অনিশ্চয়তার ছোটাছুটি। এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতাল। সেই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল।
    সকলেই দায়সারা স্তোকবাক্য শোনায় আর দূরে সরিয়ে দেয়।
    মৃত্যু ভয়, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।

    একমাত্র সন্তানের জনক জননী, ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে আসা সন্তানের মুখের পানে অসহায় নিরুপায় চাহনিতে চেয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ নিথর পাথরের মতো হয়ে উঠছিল।
    পৃথিবী ঢেকে যাচ্ছিলো নিকষকালো অন্ধকারে। চোখে ছিলো মরুভূমির শুষ্কতা। মন ছিল অনন্ত সমুদ্রের মাঝে দিকহারা নৌকোর মতো দোদুল্যমান। একটুকরো ভূখণ্ডের প্রত্যাশায় চঞ্চল।
    ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। ছোট এ তরী। হৃদয় আরও ছোটো।
    তবুও ঠাঁই পেলো সেই যৌবন। না না । মানবিক সেবা সহানুভূতির দরবারী কোলে নয়। অযাচিত অকাল মৃত্যুর শান্ত কোলে।
    বাহাত্তুরে স্বাধীনতার লাল কেল্লার লালচে পাথরের প্রাচীরে উড্ডীয়মান ত্রিরঙার প্রতি মুচকি হাসি হেসে, চিরবিদায় নিলো, ব্যর্থ মৃত্যুঞ্জয়।
    বিশল্যকরণীর গর্ভস্থান গন্ধমাদন রইলো দূরে, অনেক অনেক দূরে।
    হায় হতভাগ্য, তোমার জন্য অপেক্ষায় নেই কোনও ভক্ত হনুমান। তুমি সাধারণ। অতি সাধারণ দেশভক্ত ভোটার নাগরিক।

    সেদিন রাতে। শ্মশানের লেলিহান শিখার অনতিদূরে প্রজ্বলিত ছিল আরও একটি যাগযজ্ঞ অগ্নিশিখা।
    সেখানকার শুভশঙ্খ কাঁসর ধ্বনির সাথে পবিত্র মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে, মুখরিত হয়ে বিস্তারিত হচ্ছিল সমস্ত নির্মল আকাশ বাতাসে।
    আজ একজন লক্ষ্মণ, একটি বিলাসী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হয়েছেন নির্বিঘ্নে, অনায়াসে।
    লক্ষ কোটি ভক্তকুল , লক্ষণের রোগমুক্তির কাতর প্রার্থনায় রত।

    ওই চেয়ে দ্যাখো…একহাতে গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে উড়ন্ত হনুমানের আগমন। ওতেই আছে বিশল্যকরণী। শুধু খুঁজে নিয়ে প্রয়োগের অপেক্ষা।
    হায়রে…
    ঈশ্বর কী তবে, তোয়াজের গোলাম?

You cannot copy content of this page