প্রবন্ধ
-
প্রবন্ধ- বিষকন্যা
বিষকন্যা
-শচীদুলাল পালবিষকন্যা এমন এক নারী, অতিসুন্দরী হলেও জুটতো না ঘর।
বরও যদি ভাগ্যে জুটতো
তা ক্ষণিকের জন্য। গনকের গননায় যার কুষ্টিতে বৈধব্য যোগ থাকতো তাকেই বিষকন্যা করা হতো। কারন তিনি বিষকন্যা হবার উপযুক্ত। রাজা রাজড়ারা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিষকন্যা ধীরে ধীরে তৈরি করতো।প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সময়ের গল্প-উপকথা-ইতিহাসের ভাণ্ডার নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। আর সে কৌতূহলেই বিভিন্ন সময় আমরা খুঁজে পাই বিভিন্ন আকর্ষণীয় চরিত্র। তার মধ্যে অন্যতম ‘বিষকন্যা’।
এই ললনাদের দেহের শিরা-ধমনী বেয়ে রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হতো বিষ। তাদের সঙ্গে সম্ভোগ তো দূরের কথা, সামান্য স্পর্শেই মৃত্যু অনিবার্য। বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে আগুন ধরানো এই সুন্দরীদের ব্যবহার করতো রাজা-মহারাজা-সম্রাটরা। কল্কিপুরাণ, শুকসপ্ততী এবং চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রে একাধিকবার এসেছে বিষকন্যাদের কথা। গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবার স্ত্রী সুলোচনা ছিলেন এক বিষকন্যা।
শুধু ভারতীয় সভ্যতাই নয়। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাতেও উল্লেখ আছে বিষকন্যাদের কথা। সভ্যতার আদিপর্বের সেই সমাজে নির্দিষ্ট করে বেছে নেয়া হতো মেয়েদের। তখনকার রীতি অনুযায়ী গণকের ভাগ্য গণনায় যদি দেখা যেত, সাধারণের ঘরের পরমা সুন্দরী কোনো মেয়ের ভাগ্যে বৈধব্যযোগ আছে,তবে তাদের আর স্বাভাবিক জীবনে থাকতে দেয়া হতো না। রাজা বা শাসকদের লোকজন তাদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে আসতো।বিচ্ছিন্ন জীবনে বরাদ্দ হতো বিশেষ পথ্য। শিশু বয়স থেকে তাদের দেহে প্রবেশ করানো হতো তিল তিল করে বিষ।
প্রথম প্রথম বিষফল খেতে দেওয়া হতো।তারপর একটু একটু করে বিষের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হতো। সব রকম বিষ যখন রক্তে ধারন করতে সক্ষম হতো তখন কন্যাটিকে জীভে বিষধর সাপের ছোবল গ্রহন করতো।
বিষে বিষক্ষয় অনিবার্য। বিষয়টা তাদের জন্য সহনীয় হয়ে যেত। পরে তাদের কেউ বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করতে পারত না। কিন্তু তারা কারোর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলে সঙ্গী পুরুষটির মৃত্যু হতো। ইংরেজিতে একে বলা হয় মিথ্রিডাটিজমনন্দরাজার মন্ত্রী এক বিষকন্যাকে পাঠিয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যার লক্ষ্যে। কিন্তু চাণক্যের কূটবুদ্ধিতে চন্দ্রগুপ্তের বদলে সে হত্যা করে বসে পর্বতককে।
অনেক ক্ষেতে শুধু সঙ্গম বা স্পর্শ বা দৃষ্টি নয়,এই সুন্দরীরা মদিরায় বিষ মিশিয়ে বধ করত শিকারকে। সাহিত্য, চলচ্চিত্রে ঘুরে ফিরে এসেছে বিষকন্যা বা পয়জন গার্লের প্রসঙ্গ।
পুরুষের ইচ্ছেতে, অঙ্গুলি হেলনে কন্যারাই বহন করেছেন বিষ। পঙ্কিল ষড়যন্ত্রের বিষ ধারণ করার জন্য নারীরাই ভাল আধার! তবে অনেক আখ্যানে বিষকন্যার কথা বলা আছে যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সত্য হিসেবেই। অনেকের মতে, অতিরঞ্জিত হলেও বিষকন্যার বাস্তবতা ছিল।
কোনো এক রাজ্যে
রাজ্যের বাছাই করা সদ্যোজাত শিশুকন্যাদের নিয়মিত বিষ খাওয়ানোর আদেশ দিলেন এক রাজা। এক জন ছাড়া মারা গেল তাদের সকলেই। আর প্রতিদিন বিষপানে বেঁচে থাকা সেই একটি মেয়ে এক সময়ে হয়ে উঠল চোখ-ধাঁধানো সুন্দরী এক বিষকন্যা।
এক দিন দলবল-সহ যুদ্ধে বন্দি হয়ে, বিষকন্যাকে শত্রু শিবিরে বীণা বাজাতে পাঠালেন আক্রান্ত রাজা। সেই মেয়ের রূপ যেন এক আগল ভাঙা প্লাবন! মুগ্ধ শত্রু-রাজা তাকে ডাকলেন নিজস্ব আড়ালে। তার পরে যেই তাকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে রাখলেন অধৈর্য চুম্বন, মারা গেলেন নিজে।
ষোড়শ শতকের এক ফরাসি আখ্যানে পাওয়া যায় এই গল্প। গবেষকেরা মনে করেন, খ্রিস্টের জন্মের আগেই বিষকন্যা ধারণার উৎপত্তি ভারতে, পরে তা ছড়িয়ে যায় বিশ্বের অন্যত্র। সম্ভোগের প্রখরতায় বিষকন্যারা সরাসরি রক্তে ঢেলে দিত বিষ। কখনও তাদের ঘাম অথবা দৃষ্টি, কখনও শুধু নিশ্বাসেই মৃত্যু ছিল অনিবার্য।‘অৰ্থশাস্ত্র’ প্রণেতা চাণক্যও রাজাকে সাবধান করে বলেছিলেন, অচেনা রমণীদের ব্যবহারের আগে ধুয়ে নিতে হবে তাদের উরু। কারণ হতেই পারে, তারা বিষকন্যা!
চন্দ্রগুপ্তকে বিষ খাওয়াতেন চাণক্য
জঙ্গলে বন্ধুদের সঙ্গে এক বালককে রাজা-রাজা খেলতে দেখে নিজের লক্ষ্য স্থির করে ফেললেন চাণক্য। দাম্ভিক, প্রজা-বিদ্বেষী রাজা ধননন্দের মুখে নিজের অপমানের বদলা নিতে সেই বালককেই ভবিষ্যতের মগধ অধিপতি হিসেবে তৈরি করলেন তিনি। তার পরে এক দিন ধননন্দকে যুদ্ধে হারিয়ে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে চাণক্য এগিয়ে দিলেন প্রিয় শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে। চার পাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্তের আভাস পাচ্ছিলেন চাণক্য, যার মধ্যে বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। প্রজ্ঞা আর চতুর কৌশলে চন্দ্রগুপ্তকে আগলে রেখেছিলেন চাণক্য, আর তাঁর খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য বিষ মিশিয়ে দিতেন তিনি। তিনি জানতেন, বিষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ভাবেই এক দিন তৈরি হয়ে উঠবে চন্দ্রগুপ্তের শরীর।দৈববাণী অনুযায়ী যে বসুদেব – দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তান রাজা কংসকে হত্যা করবে,
সে গোকুলে লালিত পালিত হচ্ছে,এরূপ এক দৈববাণী শুনে রাজা কংস দশ বারো দিন বয়সী সব সন্তানকে মেরে ফেলতে পুতনা রাক্ষসীকে পাঠিয়েছিল। পুতনা ইচ্ছেমতো তার রূপ পরিবর্তন করতে পারত। সুন্দরী বধূ সেজে স্তনদান করে শিশুদের মারতে গিয়েছিল। সে যখন বসুদেব- দেবকীর পুত্র কৃষ্ণ কে মারতে স্তনদান করতে গেলো অন্তর্যামী কৃষ্ণ বুজতে পেরে পুতনার স্তনকে এমনভাবে চুষে নিষ্পেষিত করেছিল তাতে তীব্র বিষ জ্বালায় ছটফট করতে করতে পুতনার মৃত্যু হয়েছিল।এই পুতনা ছিল বিষকন্যা।এলোমেলো ভাবে প্রাচীন ভারতের কিছু আখ্যানে ছড়িয়ে আছে বিষকন্যাদের কথা। তার অন্যতম হল, সোমদেব ভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’। শৈশব থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প বিষপানে পালিতা বিষকন্যাদের ব্যবহার করা হতো মূলত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার প্রয়োজনে। লালসার বশে বিষকন্যাদের দুর্নিবার আবেদনে সাড়া দিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা। কখনও নাচের দলে, কখনও বা উপহার হিসেবে, এই সব বিষকন্যাদের শত্রু শিবিরে ঢুকিয়ে দিত চতুর প্রতিপক্ষ. তার পরেই শুরু হয়ে যেত তাদের বিষের ছোবলে কাঙ্ক্ষিত হত্যার খবর আসার অধীর প্রতীক্ষা।
বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, এমনকী, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায়,
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যখন অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী ইত্যাদিকে ছলনায় পরাভূত করে মগধের প্রবল উত্থান ঘটছিল। তখন বিষকন্যারা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষত, নন্দ বংশের আমলে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সেই সময়ে রাজা ও রাজপুরুষদের হত্যা করে গোলযোগ তৈরি ছিল এক নৈমিত্তিক ঘটনা।উপসংহার
—————————————-
‘বিষকন্যা’ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে না-দেখলে অন্য কিছু দ্যোতনা প্রতীয়মান হয়। এমনটাই বলে গিয়েছেন কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। ভারতের সর্বত্র প্রচলিত ‘চাণক্য নীতি’-তে জানানো হয়েছে, ‘বিষকন্যা’ শব্দটি অনেক সময়েই একটি অভিধা এবং যুগে যুগে বিষকন্যারা পুরুষের সর্বনাশ করতে সক্রিয় থাকেন। অথবা পুরুষের লালসাই অনেক সময়ে সাধারণ নারীকেও ‘বিষকন্যা’ করে তোলে। -
প্রবন্ধ- কৌতুহল
কৌতুহল
-শচীদুলাল পালজগতের সেরা জীব মানুষ। তাদের মস্তিষ্ক উন্নত। জানার ইচ্ছা থেকেই জ্ঞান আসে। ইচ্ছে শক্তির মধ্যেই রয়েছে কৌতুহল।
অজানাকে জানার অদেখাকে দেখার কৌতুহল মানুষের চিরন্তন । বিশাল এই পৃথিবীর চারিদিকে কত কি দেখার, জানার রয়েছে, কত রহস্য রয়েছে লুকিয়ে । সেই অপরিচয়ের দুস্তর মহাসমুদ্রের অদৃশ্য তরঙ্গ প্রতিনিয়ত আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে । সেই অজানাকে জানবার জন্যে আমাদের অসীম আগ্রহ, অনন্ত উৎকণ্ঠা । এই দুর্নিবার আকর্ষণে আমরা রুদ্ধ দুয়ার খুলে বের হয়ে পড়ি অজানার সন্ধানে ।
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী, মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরুভূমি, কতনা অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু রয়ে গেছে অগোচরে ।
শিশুর মনে নানান কৌতূহল। কৌতুহল থেকেই জ্ঞানার্জন। সেই শিশুই কৌতুহল থেকেই বিজ্ঞানী হয়, মঙ্গলে চাঁদে মানুষ পাঠায়।কৌতুহলের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সে মুক্ত।ভাগীরথীর উৎস সন্ধানের কৌতুহল থেকেই গোমুখ পৌঁছে যাওয়া যায়।এভারেস্ট, থর মরুভূমি সাগর গিরি পাহাড় ডিঙিয়ে নিত্যনতুন স্থানে ভ্রমণে আগ্রহ জন্মে।
এই ভূখণ্ডকে জানবার জন্য কৌতুহল থেকেই দেশ ভ্রমণ । ইতিহাস ও ভুগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান ।
হৃদয়ের প্রসারতা ও মনের গতি আনে কৌতুহল । কৌতুহল আমাদের দেয় গতি, এই গতির আনন্দে মানুষ উষর মরু, উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি দেয় । কৌতুহলে আবিষ্ট হয়ে দুর্লঙ্ঘ্য গিরিশৃঙ্গ অতিক্রম করে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে । সুদূর চীন থেকে ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন ভারতবর্ষে । অজানা দেশ জয়ের আনন্দে কলম্বাস জীবন বাজি রেখে পাড়ি দিয়েছিলেন । ভাস্কো-দা-গামা, কলম্বাস, মার্কোপোলো প্রমূখ বিখ্যাত বিখ্যাত পর্যটকগনের দুঃ সাহসিক কৌতুহলের ফলে আজ পৃথিবীর বহু দুর্গম দেশ-দেশান্তর মানুষের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে এসে গেছে । আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীর কত নামহীন গিরি-নদী, কত অজানা অরণ্য, মরুভূমি, কত তুষারাছন্ন মেরুপ্রদেশ। মানুষের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
মানুষের কৌতুহলের কোনো শেষ আছে?
“চাঁদটা কেন বাড়ে কমে জোয়ার কেন আসে? “গ্রহন কেন হয়?
মাটিতে আপেলটা কেন পড়লো?
ফুটন্ত জলে কেটলির ঢাকনাটা কেন ওঠানামা করছে?
বানর সেনা পাথর জলে ফেলে পাথর জলে ভেসেছিল! সেতুবন্ধন করেছিল?মঙ্গল গ্রহে জল, অক্সিজেন আছে। মানুষ আছে!
রোবোট কিভাবে কারখানায় কাজ করে। ব্যাঙ্কে টাকা গুনে দেয়?
মানুষ কেন পাগল হয়!
প্রতিবেশীর ঘরে ঝগড়া হচ্ছে। কিসের ঝগড়া।
মেয়েটির মৃত্যু স্বাভাবিক, হত্যা নাকি আত্মহত্যা?
অপারেশন এর পর লোকটা বাঁঁচবে কিনা!
চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরিটা পাবে কিনা!
ঘরের বউ স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোথায় যায়।ঘরে কে আসে?
স্বামী রাত জেগে কার সাথে হোটাস এপে চ্যাট করে।অশান্তির মূলে কে? রেশনের চাল কোথায় যায়? সন্তানটি কী কারো প্রেমে পড়েছে? ঈশ্বর আছেন তাকে জানার কৌতুহল থেকেই ঈশ্বর দর্শন হয়। সুতরাং কৌতুহলই সভ্যতার উন্নতির সোপান । কৌতুহলে মানব সভ্যতার একদিকে যেমন বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে অত্যধিক কৌতুলের জন্য সন্দেহবাতিকতাও সৃষ্টি হয়। মানসিক রোগের কারণ হয়। -
প্রবন্ধ- অলসতার সপক্ষে
অলসতার সপক্ষে
-সুনির্মল বসুচলতি প্রবাদ আছে, অলস মস্তিষ্ক নাকি শয়তানের বাসা। কিন্তু মডার্ন টাইমস ছবিতে চার্লি চ্যাপলিন ক্রমাগত একটানা কাজ করলে, মানুষ কেমন যন্ত্র মানুষ হয়ে যায়, তাকে তির্যক হাসির মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন। দই পাততে হতে হয় একটু আড়ালে গিয়ে। এই আড়াল টুকুকে মেনে নিতে পারলে, কখনো কখনো মহৎ সৃষ্টি সম্ভব। উন্নত মানের সৃষ্টির জন্য এই নির্ভৃত সাধনা জরুরী। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলি অলসতার স্বভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বাইরে থেকে যাকে অলসতা মনে করা হয়েছিল, ভেতরের সৃষ্টিশীল মন তাকে বুদ্ধির নব নব উন্মেষ শালিনী প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে নানা উপহারে পৃথিবীকে ভরিয়ে দিয়েছে।
হান্না নিউটনের ছেলে আইজ্যাক নিউটন নিরীহ ছাত্র হিসেবে প্রতিদিন সহপাঠীদের কাছে মার খেতেন। অলস ছাত্র হিসেবে তাঁর দুর্নাম ছিল। একদিন সহপাঠীদের পাল্টা মার দিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। অলস মানসিকতা তাঁকে উদ্ভট চিন্তা এনে দেয়। গাছ থেকে আপেলটা নিচে পড়ল কেন, উপরে উঠে যায় নি কেন, এই সূত্র ধরে তিনি আবিষ্কার করেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। ততদিনে তিনি কেপলারের সূত্র এবং গ্যালিলিওর গতিসূত্র ও চলমান বস্তুর বল বিদ্যা শিখে নিয়েছিলেন।
টেলিফোনের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল জাতিতে ছিলেন স্কট। ছোটবেলায় ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি কানাডায় চলে যান। ভগ্ন শরীরে তিনি বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। টেলিফোনে তাঁর প্রথম সংলাপ, মিস্টার ওয়াটসন, কাম হেয়ার প্লিজ, আই ওয়ান্ট ইউ।
টেলিফোন, গ্রামোফোন, চলচ্চিত্র, রেডিও, টেলিগ্রাফি, বৈদ্যুতিক আলো, সবখানেই অবদান রেখে গিয়েছেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। অথচ, স্কুলে সবাই তাকে মাথামোটা ছেলে বলতো।
অর্থ ও সুনামে পৃথিবী বিখ্যাত হলে, তিনি একদিন নিজের ড্রয়ার খুলে দ্যাখেন, ছোটবেলায় স্কুলের প্রিন্সিপালের লেখা তাঁর মায়ের কাছে পাঠানো চিঠি। যেখানে তাঁকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, মাথামোটা ছাত্র হিসেবে। চিঠির নিচে এডিসন লিখলেন, একটি ব্যর্থ ছেলে টমাস আলভা এডিসনকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছেন, প্রেরণা দাত্রী জননী। তারপর নিজের নাম স্বাক্ষর করলেন। অলস এবং মাথামোটা ছাত্র টমাস আলভা এডিসন পরবর্তীকালে আমেরিকার নৌবাহিনীর প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন।
বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন গ্যালভানোমিটার এবং ভোল্টমিটারের নাম। বিজ্ঞানী লুইজি
গ্যালভানি এবং বিজ্ঞানী ভোল্টা দুজনেই ইতালির মানুষ। রঙ ঝরাই করাকে আমরা বলি গ্যালভানাইজ করা। প্রথম জীবনে রাজনীতির জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন গ্যালভানি। অলস ভাবে জীবন কাটছিল তাঁর। বিজ্ঞানমনস্ক মাথা সতত সক্রিয় ছিল গ্যালভানির । তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার গুলি পরবর্তীকালে মাইকেল ফ্যারাডের আবিষ্কারের পথ সুগম করে দেয়।জার্মানির দানিয়ুব নদীর তীরে উলম শহরে
আইনস্টাইনের জন্ম। ছাত্র হিসেবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ক্রমাগত ব্যর্থতা ছিল তাঁর। মহাকর্ষ, সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে একে একে বহু গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন তিনি। আইনস্টাইনের গবেষণার উপর থিসিস লিখেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। একদা অলসতার কারনে প্রাণিবিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, সেই মহাবিজ্ঞানী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯২২ সালে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
এবার অলসতার সপক্ষে সাহিত্যকারদের কথায় আসি। রাশিয়ান লেখক মিখাইল শলোকভ পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। ধীরে বহে ডন, উপন্যাস লিখে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। অলস মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। না লিখে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ফ্রান্সের লেখিকা গ্রাৎসিয়া
দেলেদদা। ইনি অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন। দিদিমার বাড়ির পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তাঁর পা ভেঙে যায়।
লোকলজ্জার ভয়ে তিনি বাইরে বেরোতেন না ।বাড়িতে বসে দিদিমার ছাপাখানায় উপন্যাস ছাপিয়ে ফেলেন। সেই উপন্যাসটি তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
তিনি কোনোদিন লেখক হতে চাননি। একবার আলজেরিয়াতে প্লেগ রোগ দেখা দিলে, শরীর খারাপ নিয়ে আলবেয়ার কামু চিকিৎসকের কাছে যান, চিকিৎসক তাঁকে জানান,
তাঁর পরমায়ু অল্পদিনের। তিনি দ্য প্লেগ উপন্যাস লিখে নোবেল পুরস্কার পান,পরে গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যান।
প্রথম জীবনে মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। একসময় রিং এর মধ্যে প্রবল মার খাবার পর, তিনি মুষ্টিযুদ্ধ ছেড়ে দেন। অলস ভাবে সময় কাটাতে কাটাতে জীবনের প্রবল ব্যর্থতার কথা স্মরণ করে তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন এবং নোবেল পুরস্কার পান ও লেখক হিসেবে বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেন।গন্ডগোল না হলে, জার্মানির লেখক পল হেইস লিখতেই পারতেন না, প্রবল আনন্দপ্রিয় অলস এই লেখক এভাবেই পৃথিবী কাঁপানো উপন্যাস লিখেছিলেন। রীতিমতো পার্টি দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে তিনি লিখতেন।
ম্যান এন্ড সুপারম্যান এবং আর্মস এন্ড দ্য ম্যান, লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন ইংরেজি লেখক জর্জ বার্নার্ড শ। তিন মাসে তিনি উপন্যাস শেষ করতেন। পিচবোর্ডের কাগজে লিখে তিনি উপন্যাস শেষ করতেন। তাঁর সহকারী পাতা সাজাতেন। লেখা শেষ হলে, আড্ডাবাজ এবং অলসতা প্রিয় বার্নার্ড শ বাড়ির সামনের যেকোনো ট্রামে উঠে পড়তেন, এবং শেষ পর্যন্ত যেতেন। তারপর আবার বাড়ি ফিরে আসতেন।ফ্রান্সের গ্রামের ছেলে ছিলেন বালজাক। শহরে এসে ধনী সুন্দরী মহিলাদের সম্পর্কে আসেন। তাঁরা লেখকের দারিদ্র নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন। এই সময় উপন্যাস লিখে বালজাক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকে পরিণত হন।
অলস এবং আড্ডাবাজ ছিলেন রবার্ট ব্রাউনিং। বার বার প্রেমে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। জার্মানিতে এসে দেখা হল, প্রেমিকা এলিজাবেথ বারেট ব্রাউনিং এর সঙ্গে। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন কবি রবার্ট ব্রাউনিং।
যুদ্ধে গিয়ে পা খোড়া হয়ে গিয়েছিল কবি জর্জ গরডন লর্ড বায়রনের। ঘরে বসে তিনি চাইল্ড হ্যারল্ড কাব্য লেখেন। এবং বিশ্ব বিখ্যাত কবি হিসেবে স্বীকৃত হন।
সিক্স ক্যারেক্টারস ইন সার্চ অফ অন অথর, লিখে বিখ্যাত হন ইটালির লেখক লুইজি পিরানদেললো।
তিনি উঁচু মাচায় বসে লিখতেন, সেখানেই ঘুমাতেন।
এই অলসতার সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচিত হয়েছিল।
কোনোদিনই লেখক হবার কথা ছিল না স্যার ওয়াল্টার স্কট এর। তিনি অলস ভাবে সময় কাটাতেন। প্রতিবেশী একজন বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে অহংকার দেখান, তখন স্যার ওয়াল্টার স্কট দ্য রবিন হুড ,উপন্যাস লিখে লেখক এবং ধনী মানুষ হিসেবে বিখ্যাত হন।
আড্ডাবাজ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন লেখক এইচ জি ওয়েলস। ট্রেনে ভ্রমণ করতে করতে তিনি উপন্যাস লিখে যেতেন।রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি মা উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। একসময় জীবনে চরম ব্যর্থতা এসেছিল বলে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে নাম নেন, আলেক্সি ম্যাক্সিমোভিস পেসকভ। এই নামের অর্থ হলো, জীবন সম্পর্কে তিক্ত। পরে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত হন। পরবর্তীকালে স্ট্যালিনের প্রধান বন্ধু হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্র লিখেছিলেন, পদ্মা নদীতে বোটে চড়ে যাবার পথে অলস মুহূর্তে। এটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রসাহিত্য।
বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বহুবার চাকরি ছেড়েছেন, অথবা তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংবাদপত্র অফিসে কাজে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। সবরমতী, কাল তুমি আলেয়া, উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কবি সমর সেন ছাত্র হিসেবেও কৃতী ছিলেন। কিন্তু কোনো জায়গাতে বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি। চড়া ব্যক্তিত্ব, স্বতন্ত্র ভাবনা, সৃষ্টিশীল অলস মানসিক চলন থাকার ফলে তিনি লিখেছেন কম।শ দেড়েক কবিতা কিন্তু তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত করে রেখেছে। বোম্বে প্রবাসী কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন ছাত্র লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় অলস অবকাশে একদিকে যেমন ব্যোমকেশ সমগ্র লিখেছেন, তেমনি অত্যন্ত সফল ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন, তুঙ্গ ভদ্রার তীরে।
সাংবাদিকতার অবকাশে লেখক নিমাই ভট্টাচার্য লিখেছেন মেম সাহেব এর মতো সারা জাগানো উপন্যাস। কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনের ছাত্র
প্রেমেন্দ্র মিত্র এক দুপুরে বেনারসের বাড়িতে বসে জীবনের প্রথম ছোট গল্প লিখেছিলেন, তেলেনাপোতা আবিষ্কার। প্রখ্যাত লেখক নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় এমএ পরীক্ষার পর দিনাজপুরের বাড়িতে বসে এক অনার্স মুহুর্তে জীবনের প্রথম গল্প লিখেছিলেন, বর আসিতেছে।গরীব চাষির ছেলে ছিলেন শিল্পী অগাস্তা রোদা। তিনি রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের কাছে প্রদর্শনী করবার জন্য সাহায্য চেয়ে ছিলেন। পাননি। পরবর্তীকালে রাজা তাঁর তৈরি ভাস্কর্য মূর্তি দেখে
মোহিত হন। একটি মুহূর্তে ঢাকা ছিল। রাজা দেখতে গেলে, শিল্পী তাঁকে নামিয়ে দেন। বলেন, ওখানে একটা নাইটেঙ্গেল পাখি ডিম পেড়েছে। আমার শিল্পের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। রাজা শিল্পীর এই জীবন দর্শন শুনে আপ্লুত হন। সারা জীবন অলস ভাবনা থেকেই অগস্ত্য রোদা অসম্ভব সুন্দর ভাস্কর্য মূর্তি রচনা করে গেছেন।
চোখে দেখতেন না শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। নন্দলাল বসুর কাছে আঁকা শিখতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উদয়নের বাড়ির সিলিং এ
ছবি আঁকতে বলেন, সেই ছবির সূত্রে তিনি নন্দলাল বসুর কাছে অংকন শিক্ষার সুযোগ পান। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায় তাঁকে নিয়ে তথ্য চিত্র তৈরি করেছেন। ইনার আই। শিল্পী নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর বেইজ অলস মুহূর্তে বহু পৃথিবী কাঁপানো ছবি এঁকেছেন, মূর্তি গড়েছেন। বাইরে থেকে এইসব কাজের নেপথ্য লোক দেখা যায় না হয়তো, তবু সৃষ্টিশীল মন কোন্ এক বিশেষ মুহূর্তে সৃজনের পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে।সঙ্গীত জগতে অনেক দুর্দান্ত গান লেখা ও সুর রচনা আর মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল অলস মুহূর্তে। একবার শচীন দেব বর্মন কিশোর কুমারকে বাড়ি থেকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে ফাঁকা ধানক্ষেতে ছুটতে
বললেন। তিনি নিজেও তখন ছোটা শুরু করেছেন।
পরবর্তীকালে অমর প্রেম ছবি গানের সুর দিলেন,
কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কহেনা। ভি বালসারা ঘোড়ার খুরের শব্দ থেকে বহু নতুন নতুন গানের টিউন তৈরি করেছিলেন। গীতিকার গুলজার ওয়েল্ডিং মেশিনে কাজ করতেন এক সময়, পরবর্তীকালে তিনি অজস্র অসম্ভব সুন্দর গান লিখেছেন। আইপিটিএ তে যোগ দিয়েছিলেন এক সময়। পরবর্তীকালে
গীতিকার শৈলেন্দ্র অলস মুহূর্তে হিন্দি ছবি গাইডের গানগুলি লিখেছিলেন।
পূর্ববাংলার নদীতে সস্ত্রীক নৌপথে যাবার সময়, একটি গ্রাম্য মেয়েকে শচীন কর্তা দেখেছিলেন, মেয়েটি বিভিন্ন নৌকোর মাঝির কাছে তাঁর বাপের বাড়ির সংবাদ নিতে চাইছিল। শচীন কর্তা স্ত্রী মীরা দেব বর্মণকে এ বিষয়ে গান লিখতে অনুরোধ করেন। লেখা হয় সেই বিখ্যাত গানটি, সুজন মাঝিরে, ভাটি গাঙ বাইয়া।অলসতা সব সময় সমালোচনার লক্ষ্য হলেও, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি গুলি অলসতার মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান ই হোক, অথবা ভারতবর্ষের তাজমহল, বহু বছরের পরিশ্রম, বহু অলস সৌন্দর্য ভাবনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠশিল্প তৈরি হতে সাহায্য করেছিল।
অলসতাকে তাই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলে চলবে না, বাইরে থেকে অলসতা চোখে পড়লেও, ভিতরে ভিতরে মানুষের সৃষ্টি প্রেমী মন এই অবসরে নতুন আবিষ্কারের দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে রবীন্দ্রনাথ ভাগ্যিস জমিদারি দেখতে গিয়েছিলেন, তাই সৃষ্টির সোনার ধানে তাঁর তরী পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। অলস মনের অবসর না থাকলে, কবির সোনার কলমে
এমন মহৎ সৃষ্টির রচিত হত কি।এই অলসতা টুকু না থাকলে, আমরা রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের যন্ত্র সভ্যতা পেতাম। যেখানে মানুষের কোন নাম নেই। সাতচল্লিশের ক, ঊন চল্লিশের গ। এমন যান্ত্রিক কাজ কারবারে আর যাই হোক, মহৎ সৃষ্টি কখনোই সম্ভব নয়।
-
প্রবন্ধ- বন্ধুত্ব
বন্ধুত্ব
-শচীদুলাল পালআজকের এই স্বার্থপরতার যুগে বন্ধুত্ব প্রায় বিলুপ্ত। স্বার্থ ছাড়া কোনো সম্বন্ধ চোখে পড়ে না। কোনো ভালোবাসা স্বার্থ ছাড়া হয় না। গিভ এন্ড টেক এর যুগে প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পাওয়া বড়ো মুস্কিল।
বাল্যকালে যখন মনে শিশুর সারল্য থাকে ততদিনই সমবয়সী বা সহপাঠীদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। একসাথে খেলার মাঠে, স্কুলে, পড়াশোনায় নোট দেওয়া নেওয়া, দুষ্টুমি, খুনসুটির মাধ্যমে বন্ধুত্বের প্রকাশ ঘটে-
“বন্ধুত্ব মানে এক থালায় খাওয়া, একসাথে ঘোরাঘুরি,
বন্ধুত্ব মানে কান্ট্রি লিকার সাথে কাঁচা লঙ্কা মুড়ি।”দুই কিশোরীর মধ্যেও সখ্যতা গড়ে উঠে। সই, মিতালি, বকুল ফুল, গঙ্গাজল ইত্যাদি নামে অবহিত করা হয়।
এই সখ্যতা সবার সাথে হয় না। এটি এক বিরল ঘটনা। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায় তাদের দুজনার মধ্যে এক অদৃশ্য টান-রাশিগত মিল।
কখনও ওরা বকুলফুল, কখনও ভালবুলি। কখনও আবার ওদের নাম চোখের বালি।‘সই’ নামের মানববন্ধন রীতিমতো উদ্যাপনের বিষয়। বন্ধুত্ব উদ্যাপনের এমনই এক উৎসব হল ‘সহেলা’।
তাই দার্শনিকের কথায় An old friend is gold.
পরে বড়ো হলেও সেই স্মৃতিটুকু থেকে যায়।শোলেতে জয়-বীরুর বন্ধুত্ব চির অমর।বন্ধুকে বাঁচাতে নিজেকে বিপদে সঁপে দেওয়ার মতো মহৎ কর্মে আত্মনিয়োগ করবার জন্য বন্ধু জয়ের কয়েনে দুই পিঠেই ছিল হেড সাইন।
আবার বয়স বাড়ার সাথে অবক্ষয় সমাজে বিভিন্ন পরিবেশে শুরু হয় স্বার্থপরতা বন্ধুত্বের নামে অপকর্ম।
পাঁচজন এক হলে একডাকে জড়ো হয়ে মদ কিনে নৈশ্য আসর জমিয়ে দেওয়া, দলবেঁধে কাউকে পেটানো, কাউকে হেনস্থা করা, ঘেরাও, ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার মতো ঘটনায় সামিল করার ক্ষেত্রে মেকি বন্ধুত্ব দেখা যায়।কোনো দুঃস্থ মানুষের, কোনো অসুস্থ মানুষের সাহায্যে, শ্লীলতাহানি থেকে মেয়েকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসা, আর্থিক সাহায্য করা, বন্ধুর জন্য স্বার্থত্যাগ আত্মত্যাগ আজকাল প্রায়ই দেখা যায় না।
তবুও সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশ আলাদা আলাদা তারিখে “ফ্রেন্ডশিপ ডে” পালন করে থাকে।সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি এই চার যুগ। যেমনি যেমনি যুগান্তর ঘটলো তেমনি তেমনি সমাজে অবক্ষয় নেমে আসতে লাগলো।
পুরাকালে বন্ধুত্ব ছিল। যেসব কাহিনী আজও অমর হয়ে আছে।
পুরাকালে কয়েকটি বন্ধুত্বের কাহিনী লিখি।
সৃষ্টির আদিতে ছিল শিব।
শিব প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে। সেই জ্যোতির্লিঙ্গ দেখে ব্রহ্মা বিষ্ণুর কৌতুহল হলো। শিব বিষ্ণুর নম্র স্বভাব সত্যবাদিতা দেখে তার প্রতি আসক্ত হন। এক প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সুখে দুখে এই দুই বন্ধু একসাথে থেকেছেন।ভস্মাসুর শিবের কাছে বর পেয়েছিল, যার মাথায় সে হাত রাখবে, সে ভস্ম হয়ে যাবে। ভস্মাসুর তখন শিবের মাথাতেই হাত রেখে তা পরীক্ষা করতে গেলো।
সমুহ বিপদ বুঝে বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে নাচে গানে ভস্মাসুরকে মোহিত করেন ও বশে আনেন। ভস্মাসুর তখন বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় ভুলে নিজের মাথায় হাত রাখেন আর ভস্মীভূত হয়ে যায়। পড়ে থাকে ভস্ম।আবার, শিব যখন সতীর শোকে পাগলপারা, তাঁর মৃতদেহ নিয়ে তাণ্ডবে মত্ত, বিশ্ব ব্রহ্মান্ড কাঁধে সতীর শবদেহ নিয়ে বিচরণ করছেন। তখন বিষ্ণুই তাঁর সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ ছিন্নভিন্ন করে শিবকে শান্ত করেন।
বিষ্ণু যখন নৃসিংহ রূপে হিরণ্যকশিপুকে বধের বরে কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না, তখন শিব ধারণ করেন ঋষভের রূপ। এমন এক পাখি যার মাথা বাঘের মতো।
সেই রূপে শিব পায়ে করে আকাশপথে তুলে নিয়ে যান নৃসিংহকে। বেশ কয়েক পাক ঘুরিয়ে গায়ের জোরে তাঁকে পরাস্ত করে শান্ত করেন। একই ঘটনা ঘটে যখন বিষ্ণু হয়েছিলেন বরাহ অবতার। সেই সময় বরাহ স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন। দেবলোকে ফিরছিলেন না পূর্ব রূপে। শিব তখন আবার ঋষভের রূপে ভয় দেখিয়ে তাঁর স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন।
তাঁদের বন্ধুত্ব এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে দুজনে মিশে গিয়েছিলেন একই শরীরে।
এইজন্য প্রিয় বন্ধুকে হরিহর-আত্মা বলা হয়।পুরাণে আর এক বন্ধুত্বের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে তা হলো “কৃষ্ণ সুদামার” বন্ধুত্ব।
দেবকী -বসুদেব যখন কংসের কারাগারে, তখন জন্ম হয় কৃষ্ণের। কংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণকে গোকুলে রেখে আসেন বসুদেব। সেখানে ছেলেবেলায় বন্ধুত্ব গড়ে উঠে সুদামার সাথে। মাখন চুরি, গরু চরানো, খেলাধূলায় সখ্যতা গড়ে উঠে সুদামার সাথে। সুদামা ছিল কৃষ্ণের ডান হাত।
পরবর্তী কালে কৃষ্ণ চলে গেলেন দ্বারকায়। সেখানে তিনি রাজা হলেন। এদিকে সুদামা দারিদ্রে জর্জরিত। দুবেলা খাওয়া জোটে না।
স্ত্রী সন্তান সহ নিদারুণ অন্নকষ্ট। একদিন সুদামার স্ত্রী তাকে জোরপূর্বক পাঠালেন কৃষ্ণের কাছে। কিছু সাহায্যের আশায়। অনিচ্ছায় কৃষ্ণ সাক্ষাতে গেলো সুদামা সাথে ভাঙা চাল (যাকে ক্ষুদ বলা হয়) নিয়ে, বন্ধুকে ভেট দেবে বলে।
সেখানে পৌঁছে তার চক্ষু চড়কগাছ। তার বন্ধু কৃষ্ণর বিশাল সুবর্ণ নির্মিত অট্টালিকা।
রাজদ্বারীরা বিশ্বাসই করলো না, কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা! ভিখারি ভেবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। হাসাহাসি করতে লাগল এবং সেই কথা ছড়িয়ে পড়ল রাজপুরীতে। সুদামা তখন বাড়ির পথ ধরেছেন।লজ্জিত হয়ে ফিরে আসছেন, হঠাৎ শুনলেন কে যেন পিছন থেকে ডাকছে। ফিরে দেখলেন কৃষ্ণ। জীর্ণ শীর্ণ দীন দরিদ্র বন্ধু সুদামাকে সমাদরে সসম্মানে রাজধানীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। নিজ হাতে পা ধুইয়ে দিলেন। রানী রুক্মিণীও তাকে সোনার থালায় উত্তম উৎকৃষ্ট ভোজন পরিবেশন করলেন। আর আড়ষ্ট সুদামার কাছ থেকে ভাঙা চাল কেড়ে পরম তৃপ্তি ভরে খেয়ে বন্ধুর ভেট গ্রহণ করলেন। সুদামা আনন্দে নিজ ঘরে এসে দেখলেন বন্ধু কৃষ্ণের কৃপায় তার সুবিশাল বাড়ী হয়েছে। সপরিবারে গরীব থেকে ধনীতে পরিণত হয়েছে। বন্ধুত্বে ধনী দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ নেই।
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বা অহং- কোনও কিছুই বাধা হতে পারে না নিখাদ বন্ধুত্বে।
কৃষ্ণ ও সুদামার ভালবাসা হ’ল প্রকৃত বন্ধুর ভালোবাসা। সত্যিকারের প্রেমে উচ্চ বা নিম্ন দেখা যায় না, এবং সম্পদ ও দারিদ্র্যও দেখা যায় না। এ কারণেই আজও বিশ্বে কৃষ্ণ ও সুদামার বন্ধুত্বকে সত্য বন্ধুত্ব প্রেমের প্রতীক হিসাবে স্মরণ করা হয়।কৃষ্ণার্জুন বন্ধুত্ব:-
কৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের পিসতুতো দাদা। কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের নিজের বোন পৃথা। রাজা কুন্তীভোজ তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন বলেই আমরা চিনি কুন্তী নামে!
একটা সময়ে কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে কোনও যোগাযোগই ছিল না। অর্জুনকে কৃষ্ণ প্রথম দেখেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। দেখেই চিনতে পারেন। অর্জুনকে তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। তখন কুন্তীর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন তিনি। দু’জনের বন্ধুত্বের সেই শুরু।
কৃষ্ণ বুঝেছিলেন, অর্জুনের চিত্ত বেশ বিক্ষিপ্ত। তাঁর পথপ্রদর্শক দরকার। তাই সব সময় তিনি থেকেছেন অর্জুনের সঙ্গে। তাঁর সহায়তাতেই অর্জুন অগ্নির কাছ থেকে লাভ করেন গাণ্ডীব ধনুক আর অক্ষয় তূণীর। যা চিরতরে জুড়ে যায় যোদ্ধা অর্জুনের পরিচিতির সঙ্গে।
অর্জুনকে কৃষ্ণ এতোটাই ভালবাসতেন যে সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি মেনে নেন সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের প্রেম। সারা ভারত, বিশেষ করে যাদবরা যখন গর্জে উঠেছে এই দুই ভাই-বোনের বিয়ে নিয়ে, তখন তাঁদের শান্ত করেন কৃষ্ণই। স্বীকৃতি দেন তাঁদের প্রেমকে।
আবার, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যখন বিষাদযোগে আচ্ছন্ন, তখন কৃষ্ণই দূর করেন তাঁর সব দ্বিধা। তাঁকে উচিত পরামর্শ দেন। সারথি হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের জয়ের সহায়ক হন।কৃষ্ণ -দ্রৌপদীর বন্ধুত্ব:-
কৃষ্ণ দ্রৌপদী একে অপরকে পছন্দ করতেন। স্বভাবের মিল তাঁদের আকৃষ্ট করে পরস্পরের প্রতি। কৃষ্ণ নিজেই বলেছিলেন দ্রৌপদীকে, তোমার আর আমার গায়ের রং এক। মিল আছে নামেও! আমি কৃষ্ণ, তুমি কৃষ্ণা।
কৃষ্ণ ইচ্ছে করলেই যোগ দিতে পারতেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে। কিন্তু তিনি যোগ দিলে অন্য কারও সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হতো না। তিনি তা করেননি। স্বয়ম্বরে এসেছিলেন নিতান্ত দর্শক হয়ে। বস্ত্রহরণের সময় কৃষ্ণই দ্রৌপদীর লজ্জারক্ষা করেছিলেন।দুর্যোধন যখন দুর্বাসা ঋষিকে পাঠিয়ে বনবাসে অপমান করতে চেয়েছিলেন পাণ্ডবদের, তখনও দ্রৌপদীর সহায় হন কৃষ্ণই। অগ্নির কাছ থেকে দ্রৌপদী পেয়েছিলেন একটি পাত্র। সেই পাত্রের খাদ্য ততক্ষণ ফুরাত না, যতক্ষণ না দ্রৌপদীর খাওয়া হত। এটা জেনেই দুর্যোধন দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হলে পাঠিয়েছিলেন শিষ্যসমেত দুর্বাসাকে।
অন্তর্যামী কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন পাত্রে খাবার নেই! বিপদ বুঝে হাজির হন কৃষ্ণ। সেই পাত্র হাতে নিয়ে দেখেন, তাতে একটি মাত্র ভাতের দানা পড়ে আছে।
সেটাই মুখে দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বাত্মা তুষ্ট হোক! আর দেখতে দেখতে পেট ভরে যায় জগতের সব ক্ষুধার্ত প্রাণীর। বিপদ বুঝে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দুর্বাসা।
এছাড়া দ্রৌপদীর সম্মানরক্ষার্থে আরও একটা কাজ করেছিলেন কৃষ্ণ। প্রিয় বোন সুভদ্রাকে নিতান্ত গরিবের পোশাকে পাঠিয়েছিলেন দ্রৌপদীর কাছে। বুঝেছিলেন, অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়েতে দুঃখ পেয়েছেন দ্রৌপদী। তাই মূল্যবান পোশাকে-গয়নায় সুভদ্রাকে তিনি সাজিয়ে দেননি। কৃষ্ণের এই সিদ্ধান্তে দ্রৌপদীর অহং রক্ষা হয়। সুভদ্রাকে তিনি গ্রহণ করেন হাসিমুখে। সাজিয়ে দেন নিজের গয়নায়!সীতা- সরমা:-
দ্রৌপদীর বন্ধু যেমন কৃষ্ণ, সীতার তেমনই বন্ধু সরমা। রাবণ যখন হরণ করে সীতাকে নিয়ে আসেন লঙ্কায়, তখন তাঁর দুঃখ বুঝেছিলেন একমাত্র বিভীষণের পত্নী সরমা। সরমা না থাকলে সীতা লঙ্কাপুরীতে অপমান আর উপহাসের মাঝে শান্তি খুঁজে পেতেন না। আর একটা সময়ের পর দুই নারীই এসে দাঁড়ান একই জায়গায়। বিভীষণ রামের শিবিরে যোগ দেওয়ায় স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন সরমাও। তাঁকেও তখন লঙ্কাপুরীতে শুনতে হচ্ছে গঞ্জনা। একমাত্র তখন সান্ত্বনা ছিল সরমা-সীতার বন্ধুত্ব।
শকুন্তলার দুই সখী অনসূয়া আর প্রিয়ম্বদা।শকুন্তলার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু ছিলেন আশ্রমকন্যা অনসূয়া আর প্রিয়ম্বদা। জন্মের পর মা মেনকা ছেড়ে যান শকুন্তলাকে। বিয়ের পর চিনতে অস্বীকার করে স্বামী দুষ্মন্তও। কিন্তু, এই দুই বন্ধু কখনই শকুন্তলাকে ছেড়ে যাননি। শকুন্তলার নাম নিলেই তাই এই দুই নারীর নামও একসঙ্গেই উচ্চারিত হয়।
কর্ণ আর দুর্যোধন:-
বন্ধুকে যে কখনই ছাড়া যায় না, তা আমরা জেনেছি কর্ণ আর দুর্যোধনের বন্ধুত্ব থেকে। কর্ণকে সূতপুত্র বা সারথির ছেলে, অর্থাৎ নিচু জাত বলে বিদ্রুপ করেননি একমাত্র দুর্যোধনই। কর্ণকে প্রথম দেখায় তাঁর এতটাই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি অঙ্গরাজ্য দান করেন তাঁকে। সেই দুর্যোধন, যিনি কখনই সম্পত্তি বা অধিকার ছাড়তে নারাজ ছিলেন। তাঁর বন্ধুত্বেই অভিজাত সমাজে স্থান পান কর্ণ। তাই দুর্যোধনকে তিনি কখনই ছেড়ে যাননি। কুন্তী তাঁর মা, পাণ্ডবরা তাঁর ভাই- এই সত্য জানার পরেও, দুর্যোধনের সিদ্ধান্ত ভুল জেনেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর হয়ে লড়াই করেন কর্ণ। প্রাণও দেন। আর আমরা বুঝতে শিখি, নিঃশর্ত বন্ধুত্বের জন্য পরিবারকেও ত্যাগ করা যায়!
-
প্রবন্ধ- মন
মন
-শচীদুলাল পালজগতের সবচেয়ে দ্রুতগামী হলো মন।
এই মুহুর্তে এখানে, পরমুহূর্তে দিল্লি বা আমেরিকায় এমনকি মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে যায়।
আমাদের যখন কোনো বিষয়ে লিখতে বলা হয়, তখন সেই বিষয়ের অনেক গভীরে প্রবেশ করি। সেই বিষয়ের মন সাগরের অতল জল থেকে সেরা মণিমুক্তাদি সংগ্রহ করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি।বিকশিত মন:-
মনের তিনটি স্তর। প্রথম স্তরটি হলো মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা আর বুঝতে না পারা যে সে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সচেতন না হওয়া। এক ভ্রান্তিতে থাকে। বুঝতে পারে না তার ধারণাটা ভুল।
দ্বিতীয় স্তরে বুঝতে পারে মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। কষ্টের কারণ হলো এই মায়ার বাঁধন।
তৃতীয় স্তরে সে বুঝতে পারে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত। মায়া দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বুঝতে পারে মায়া তার কিছুই করতে পারবে না।
দ্বিতীয় স্তরে বুঝতে পারে কোনো বিশেষ ব্যক্তি সম্বন্ধে যা ভেবেছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যা ভেবেছিল তা সেরকম নয়। তার থেকে বের করে আনা যায় না।
মন আহারের দ্বারা, পরিবেশের দ্বারা, যে সময়ের মধ্যে যাচ্ছে সেই সময়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
কখনো কখনো জীবনে এমন পরিস্থিতি আসে তখন আবেগের ঝড়ের ভিতর পড়ে যায়। সময়, খাদ্য আর পরিবেশ এই তিনটির প্রভাব থাকে মনের উপর।
অন্যকে দোষ দেওয়া মনের এক অস্বাভাবিক রূপ। এই স্বভাব সবার মনেই থাকে। অনেকে আবার নিজেকে দোষ দেয়।
এই দুটি স্বভাব থেকে মুক্ত করে জেগে উঠতে হবে। সচেতন হতে হবে।
কাউকে দোষ দিলে যেমন তার সাথে থাকতে পারে না তেমনই নিজেকে দোষ দিয়ে নিজের সাথেই থাকতে পারে না। আত্ম বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজেকে দোষ না দেওয়া।
তা বলে অন্যকে দোষ দেওয়া চলবে না। নিজের সব ভুলকে সমর্থন করা স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করা এক্কেবারে উচিত নয়।
মনের গভীরে শান্তি পেতে হলে বিশ্রাম আর কর্মের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে।
বিশ্রাম মানে শরীর বিছানায় এলিয়ে দেওয়া নয়। ভাবতে হবে আমি সন্তুষ্ট, আমি তৃপ্ত। কেবল তৃপ্তিই শান্তি দিতে পারে। কোনো কাজে নিযুক্ত থেকে এই মানসিক সন্তুষ্টি দিতে পারে না।
কেবল প্রজ্ঞায় দিতে পারে মানসিক তৃপ্তি।জীবনের যথার্থ জ্ঞান হলো
১.সবকিছুই অস্থায়ী,
২.আমি পরিতৃপ্ত,
৩.আমার কিছুই চাইনা।
এই তিনটিই হলো প্রজ্ঞার নির্যাস।
ক্ষমা করতে শিখতে হবে। মন যখন বিদ্বেষকে আর ধরে রাখতে পারে না, ঘৃণা করবার যন্ত্রণাকে আর সহ্য করতে পারে না, ক্রোধকে আর বইতে পারে না তখন ক্ষমার ভাব মনে এসে যায়।নীরব মন:-
মনের ভাবনাগুলো তাদের নিজেদের উদেশ্যে নয়। তাদের লক্ষ্য হলো নীরবতা। শ্বাসের সঙ্গে যে প্রার্থনা হয়, সেই প্রার্থনা নীরব।অন্তরের মধ্যে যে ভালোবাসা সে ভালোবাসা সেও মৌন। নিঃশব্দ প্রজ্ঞাও মৌন। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া দয়ামায়া, সেও নীরব।কর্তাবিহীন কর্মের সাধন হয় নীরবতায়।সম্পূর্ণ সত্তাময় যে হাসি সেই হাসি নীরব।
চেতনার বিকাশ থেকে মনের শান্তি আসে।
মন ভালো রাখতে হলে নিজের মুখের হাসিকে সহজলভ্য করে তুলতে হবে।
সাধারণত আমরা অন্যের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করি। হাসিকে লুকিয়ে রাখি। এর উল্টোটা হওয়া উচিৎ। ক্রোধকে সম্বরণ করে হাসিকে উপহার দিতে হবে।হৃদয় সব সময় পুরানোকে চায় আর মন চায় নতুনকে। জীবন এই দুইয়ের সমন্বয়। প্রত্যেক বছর যেন জীবন পুরানো জ্ঞান আর নতুনত্বে ভরে দেয়। জীবনে এই দুটিরই প্রয়োজন।
সৎসঙ্গ:-
যখন মানুষ সৎসঙ্গে আসে তখন তাদের সবার মনে যত বোঝা থাকে সব দূর হয়ে যায়।তারা তাদের মনকে অতিক্রম করে এক আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয়। আর ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
মন সাকার নয়- অমূর্ত। অর্থাৎ মনের কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মন কোনো ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তুও নয়।
বাইরের জগতের বিভিন্ন অনুভূতি আমরা গ্রহণ করি পঞ্চেন্দ্রিয় মাধ্যমে। এই পঞ্চেন্দ্রিয় হলো চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। এই পঞ্চেন্দ্রিয়র মধ্যে কোনোটির সাহায্যেই মনকে আমরা জানতে পারি না। যদিও গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ইন্দিয় সমূহের মধ্যে আমি হলাম মন। অর্থাৎ সে অর্থে মন যদি ইন্দ্রিয় হয় তবে সে পঞ্চেন্দ্রিয়র বাইরে অন্য কোনো ইন্দ্রিয় বা বিশেষ ধরনের অনূভুতি বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।ধ্যান:-
ধ্যান প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব–
মানুষের সব দুঃখ কষ্ট যাতনার মূলে রয়েছে -মনের আলতু ফালতু ভাবনা। অকারণে অযথা চিন্তা করা। মনের স্বভাব হচ্ছে এটা সেটা চিন্তা করা। এর ফলেই মনের স্বাস্থ্য দূর্বল হয়,অবসন্ন হয়। তার ফলেই রোগ যাতনা অশান্তি জন্ম নেয়। মানুষ নিরানন্দ হয়ে পড়ে। তাহলে উপায় কি? মনকে কিন্তু শিক্ষা দেওয়া যায়। মনকে একমুখী করা যায়। মনের আসল রূপ কিন্তু খুবই মনোরম। খুবই উদার খুবই বিশাল। যে শিক্ষা দ্বারা মনকে বশ করা যায় সেটি হচ্ছে ধ্যানযোগ। ধ্যানযোগ করলে মন একমুখী হয়। শান্ত হয়।রাগহীন হয়। এক অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায়। এই আনন্দ থাকলে রোগ দুঃখ হয় না।হলেও তা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করা যায় এই ধ্যানযোগের দ্বারা।
মন তার নিজের সৃষ্ট কুট কাচালি, ভ্রম ও অবাস্তবকে প্রশয় দেয়। কিন্তু ধ্যান মানে হচ্ছে চিন্তা থেকে মুক্তি।
একজন মানুষ যখন যথেষ্ট পরিণত তখন সে বুঝতে পারে তোষামোদে তুষ্ট হওয়া বা অপমানিত হওয়া সবই হলো মনের অহং ও স্বার্থপরতারই প্রকাশ। সুতরাং এগুলোতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ারই কথা।
মনকে ভালো রাখার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় ধ্যান।
কিন্তু দেখা যায় ধ্যান করার সময় নানান বিকার এসে জ্বালাতন করে। কামনা, লোভ, কারুর প্রতি রাগ, ঈর্ষা, কারোর প্রতি অনুরক্তি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
এগুলো জয় করতে হলে প্রত্যাহার সাহায্য করে। প্রত্যাহার মানে-
ঠিক আছে এই মুহুর্তে আমি কোনো কিছুর গন্ধ নিতে চাই না। এই মুহূর্তে আমি কোনো সুস্বাদু জিনিষের স্বাদ গ্রহণ করতে চাই না। এই মুহুর্তে আমি জগতের কোনো কিছু দেখতে চাই না। এমনকি এখন আমি কোনো পরোয়া করি না কোনো সুন্দর শব্দের। আমি কোনো স্পর্শের অনুভুতিও পরোয়া করিনা।
এইভাবে আমরা মনকে পঞ্চন্দ্রিয় থেকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে আনি। তখনই জাগতিক মায়ার ভ্রম থেকে মুক্ত হওয়া যায়।সুতরাং ধ্যান সফল হয় তখনই এইসব কৌশল দ্বারা মনকে ফিরিয়ে আনে। ধ্যান সফল হয়।অনেক জটিল ব্যাধি সৃষ্টি হয় না ধ্যানযোগের ফলে। মন পবিত্র হয়। শান্ত হয় তাই নয় বহু রোগ ভালো হয়। সাময়িক রাগের ফলে বহু মানুষ হার্ট স্ট্রোকে মারা যায়। এমন ঘটনা অনেক। ধ্যানযোগের ফলে তাদের অন্তত হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হবে না।
জগতে সুখ, ভালোবাসা, আনন্দ আসবে। মানুষের মন মধুময় হবে।
সবরকম প্রতিকূলতা, ঋণাত্মক দিক নিয়েও মানুষের মন মধুময় থাকবে এমনই শক্তিধর এই ধ্যানযোগ।অনেক সময় দেখা যায় কিছু কথা অন্যায়ভাবে বললো বা অপমান করলো। এর জন্য রাগ হলো। এর ফলে স্নায়ু থেকে এক উত্তেজক রস বেশি পরিমানে বার হবে। এই রস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্ষতি ডেকে আনবে। এই অঙ্গগুলি দূর্বল হয়ে পড়বে। এই ক্ষতিকে ঠিক করতে শান্তরসের দরকার হয়।আর এই শান্তরস বের করতে হলে চাই মনের ব্যায়াম। আর এই মনের ব্যায়ামই হলো ধ্যানযোগ।
ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়
মন ও হৃদয়ের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও হৃদয় তাকে গ্রহণ করতে পারে না। আবার হৃদয় চাইলেও মন তা গ্রহণ করতে পারে না।সাহিত্যিকদের মনটাই আসল রাজা। গল্পের গরুকে গাছে চড়িয়ে দিতে পারে। তারা পাথরে ফুল ফুটিয়ে দিতে পারে।
মনের শক্তি বা ইচ্ছাশক্তি থাকলে ঝড় জল তুফানের মধ্যেও বেরিয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌছাতে পারে। আবার মন না চাইলে শুয়েই থাকে। সেই-
” বুঝলে নটবর, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না। “পূর্বে রাজকন্যারা স্বয়ংম্বর সভায় যাকে ইচ্ছে তার গলায় মালা পরিয়ে দিত। এখন স্বয়ংম্বর সভা না থাকলেও যাকে মনে ধরে প্রেম প্রস্তাব করে বিয়ে করা যায়। বিপরীতে ঘৃণা মনেই সৃষ্টি হয়। আবেগ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার জন্ম হয় মনে। মন থেকে হৃদয়ে।
মানব সত্তা বড় বিচিত্র। অনেক সময় বা কোন কোন সময় মন এমন কিছু পেতে চায় যা বিবেক সমর্থন করে না। অর্থাৎ মানব সত্তা একক নয়। মানুষের দুটো সত্তা রয়েছে। একটি দেহসত্তা, অপরটি নৈতিক সত্তা। দেহ হলো বস্তুসত্তা। দুনিয়াটাও বস্তুসত্তা। বস্তুজগতের কতক উপাদানেই মানব দেহ গঠিত। তাই বস্তুজগতের প্রতি মানবদেহের প্রবল আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। এ পৃথিবীতে ভোগ করার মতো যা কিছু আছে তাই দেহ পেতে চায়। দেহের মুখপাত্রই হলো মন। দেহ যা চায় তাই মনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সুতরাং, মন যা চায় তা দেহেরই দাবী।
মন কোনো সময় খালি থাকে না। চেতন বা অবচেতন মনে কিছু না কিছু সে চিন্তা করেই চলেছে।মানসিক বা মনের রোগ:-
মনের রোগ হচ্ছে রোগীর অস্বাভাবিক আচরণ, অস্বাভাবিক জীবন-যাপন যা মস্তিষ্কের রোগের কারণে হয়। যার জন্য স্বাভাবিক পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত জীবন ব্যাহত হয় অথবা রোগী তীব্র মানসিক যন্ত্রণা বা অস্বস্তিতে ভোগে।মন থাকে মস্তিষ্কে। মনের সাধারণত ৩টি অংশ। ক) সচেতন মন খ) অচেতন মন গ) অবচেতন মন। সচেতন মন, মনের মাত্র ১০ ভাগ। মনের ৯০ ভাগ জুড়ে রয়েছে অচেতন বা অবচেতন মন।
মানসিক রোগের প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায় নি। বিভিন্ন কারনে মনের রোগ হতে পারে।
তবে কারণগুলোর মধ্যে জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব, শারীরিক মানসিক যৌন নির্যাতন, অস্বাভাবিকভাবে শিশুর লালন-পালন, ইন্টারনেট সহ অন্যান্য নেশা দ্রব্যের ব্যবহার, মস্তিষ্কের গঠন জনিত সমস্যা, নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাব, দীর্ঘমেয়াদী অস্বাভাবিক চাপ, এছাড়া মৃগীরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস্, ব্রেন ইনজুরি, ব্রেইন টিউমার, কিডনি, যকৃত, হৃদপিণ্ডের ফেইলিয়রও মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।
পরিশেষে– সুস্থ মনই সুস্থ শরীর প্রদান করে দীর্ঘজীবন দান করে। -
প্রবন্ধ- দেউলিয়া মনের উদাসপনা
দেউলিয়া মনের উদাসপনা
-সুনির্মল বসুপূজোর কিছুদিন আগে ছাত্র পড়াতে অফিসার্স কলোনিতে গিয়েছি, কলিং বেল বাজলো। মিসেস চৌধুরী দরজা খুলে দিলেন। আমি এ বাড়ীতে পারচেজিং ম্যানেজারের ছেলে বিক্রমকে পড়াই। শাড়ী বিক্রেতা কাঁধে প্রচুর শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস চৌধুরী গোটা পনেরো শাড়ি পছন্দমতো বেছে নিলেন। শাড়ি বিক্রেতা ভদ্রলোক তখনও বসে রয়েছেন।
মিসেস চৌধুরী বললেন, কি হলো, শাড়ি নিলাম তো, আপনি এখনো বসে রয়েছেন, ব্যাপারটা কি,
শাড়ি বিক্রেতা বললেন, মাইজি, আমি এই শাড়িগুলোর দাম চাইছি না, গতবছরের শাড়িগুলোর দাম যদি দেন, মিসেস চৌধুরী খুব রেগে গেলেন। যখন তখন দাম চাইবে না, আমি কি তোমার টাকা দেবো না বলেছি।আজকাল সুখ একটা দেখাবার বস্তু হয়ে গেছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে এই জিনিসটা খুব চোখে পড়ে। গিন্নীকে পটের বিবি সাজিয়ে মোটরসাইকেলে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে ভেসে-যাওয়াতে কী প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়, আমরা দুজন কত সুখী।
বর্তমানের দুনিয়াদারিতে দেখনদারিটাই আসল। আমার ফ্ল্যাট দ্যাখো, আমার গাড়ি দ্যাখো, আমার অফিস দ্যাখো, আমার স্ট্যাটাস দ্যাখো। সবই ভালো, তবে বৃদ্ধাশ্রমগুলি ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে এত গজিয়ে উঠছে কেন! সুখটা ঠিক কোথায়, মনের শূন্যতাওয়ালা মানুষগুলো সেটা ধরতেই পারছে না।
অনেক দিন আগের কথা। কলেজে পড়ি। পাড়ার ভবতোষ কাকু একটি পোস্ট কার্ড এনে বললেন,
আমি বলি, তুই লেখ্। আমি কাকুর ডিকটেশন লিখে চললাম। আর জায়গা নেই। কাকু বললেন, পুনশ্চ,
এখানে ইলিশ মাছ সস্তা হইয়াছে।পোস্টকার্ডের দাম উসুল করাই আঙ্কেলের লক্ষ্য।
একদিন সন্ধ্যায় কাকুর বাড়িতে প্রবল ঝগড়া। কাকু আর কাকিমার মধ্যে খন্ড যুদ্ধ চলছে। পরদিন কাকুর হাতে প্লাস্টার। বললাম, কি করে হলো। কাকু বললেন, কুয়োতলায় সিলিপ কাইটা গেছিলাম। আমার বন্ধু হেবো ভালো ইনফর্মার। ও এসে বলল, কাকিমার সঙ্গে কাকুর মহা সংগ্রাম কালে কাকিমার হাতপাখার প্রবল আঘাতে এই দূর্ঘটনা।
মনের শূন্যতা, মনের দেউলিয়াপনা আজকাল যেমন যত্রতত্র দেখা যায়, এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি।
আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক মুখ পুস্তকে ছবি দেন। একদিন প্রশ্ন করায়, তিনি বললেন, আমার বাড়িতে আবার কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না, গিন্নির ইচ্ছায় সবকিছু হয়। ও খুব লাইক কমেন্ট পছন্দ করে। আশ্চর্য হই, বাহাত্তর বছর বয়সে ভীমরতি।
দু কলম লেখার জন্য আজকাল মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় ডাক পড়ে। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক জায়গায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য পাঠ ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এত চিল চিৎকার। মনে হয়, ভুল করে কোনো চিটে গুড়ের আড়তে বাইচান্স ঢুকে পড়েছি। চারদিকে নিজস্বী তোলা চলছে।
আমাদের এক দাদা স্থানীয় কবি আছেন, যিনি দীর্ঘ কবিতা পড়ে দর্শক মন্ডলীকে অনুষ্ঠান থেকে ফুটিয়ে দেন, আজকাল তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, আমি পিছনে গিয়ে লুকোই। ডজন দুয়েক ছবি তোলার পর, তাঁর দাবি, আমার একখান ভালো ফটো তুলে দাও, ভাইটি। জিজ্ঞাসা করি, এত ছবি তুলে কি করবেন। দাদার সাফ জবাব, আমার ইস্তিরি বলে দেছেন, হ্যাঁগো, এই বয়সে তোমাকে তো নদের নিমাইয়ের মতো দেখতে, তুমি ছবি তুলে এনো, আমি মৌটুসীর মাকে দেখাবো।
এটা হল দেখনদারির যুগ। যে ছেলে বাবা মাকে চেনে না, ভাই বোনের সঙ্গে কোনো কালে সম্পর্ক রাখে নি, সে শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে রজনীগন্ধা ফুলের গোছা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ভাবা যায়। কী ডিউটিফুল জামাই।
বিয়ের পর মায়ের আঁচল ধরা ছেলে সেই যে লব কুশ করা বউকে নিয়ে লাপাতা হয়ে গেল, তারপর তাঁর আর দেখা নেই।
মুখ পুস্তকে তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে সে
লিখলো, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
সম্রাট শাহজাহান আজ বেঁচে থাকলে লজ্জিত হতেন। মমতাজের প্রতি এতদূর ভালোবাসা তিনি কি দেখাতে পেরেছিলেন।একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটি বি,এ ক্লাসের ব্যাচ পড়াতাম। একটি মেয়ে পড়তে এলো। সবে মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে শুরু করেছি, মিনিট পনেরো হয়েছে, মেয়েটি বলল, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, জামাইবাবুর সঙ্গে একটু মার্কেটে যেতে হবে স্যার। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটল। মাসের শেষে ওর বাবা দেখা করতে এলেন।
মাষ্টারমশাই, ওকে কেমন বুঝলেন,
বললাম, ওকে তো পড়াবার অবকাশ পাই না। ও জামাইবাবুর সঙ্গে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়।
ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, আমার তো ওই এক মেয়ে। আমার আবার জামাই কোথায়।মনের দেউলিয়াপনার কত ছবি। কত গভীর শূন্যতা মনের মধ্যে থাকলে, চারদিকে মানুষ নয়, ফানুস ঘোরে।
ট্রামে বাসে ট্রেনে, সর্বত্র দেখবেন, এখন শ্রোতা কম। বক্তা বেশি। প্রত্যেকেই এখন এডমন্ড বার্কের ভায়রা ভাই। এখানের মানুষ ডায়লগবাজিটা ভালো রপ্ত করেছেন।
অফিসে স্যুটেড-বুটেড মানুষজন দেখে, তাঁর পদমর্যাদা আন্দাজ করা যায় না। সবাই নাকি অফিসারের চাকরি করেন। তাহলে, sub-ordinate কারা।আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওদেশ থেকে এদেশে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেন, গাছের ইলিশ মাছ আর পুকুরের আম এত খাইছি, এখনো মুখে সেই টেস লাইগ্যা আছে।
আসলে, নিজের শূন্যতা ঢাকবার জন্য মানুষকে কত মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
একে বলে, দেউলিয়া মনের উদাস পণা।
শূন্যতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আরকি।আমাদের পাড়ার ভ্যাবলা যেদিন বিয়ে করতে গেল, সেদিন ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েতে তোর কোনো ডিমান্ড আছে। ভ্যাবলা বলেছিল, সারকেল ছাড়া বিয়ে করবু নি।
সমাজের পাঁজরে কবে যে এমন ক্যান্সার জন্মালো, আমরা প্রথমটা টের পাই নি। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের এই হৃদয়ের দীনতার ছবি প্রকটিত হচ্ছে।
এর শেষ কোথায়, আগামী দিন, আগামী সময় বলবে। -
প্রবন্ধ- সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র, লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র,
লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
-সুনির্মল বসুএক বছর মহালয়ার দিনে পিতৃতর্পণ উপলক্ষে একটি অতি জনপ্রিয় দৈনিকে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, এই লেখাটির গভীরতা আমাকে এতটাই আবিষ্ট করেছিল যে, সেইদিন থেকে আমি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অনুগত ভক্ত হয়ে যাই। ভাবনাকে কত গভীর উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়, সেই প্রথম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রচনায় তা প্রথম প্রত্যক্ষ করি।
এরপর একে একে পড়ে ফেলি, বৃষ্টিতে নিশিকান্ত, টাংকী সাফ, বৃষ্টির ঘ্রাণ, ফুটপাতের দোকান, যতীন বাবুর চাকর, বাসস্টপে কেউ নেই, প্রভৃতি রচনা।
প্রথম ধাক্কা খাই, লেখকের স্বকন্ঠে পঠিত, দেখা হবে, গল্পটি শুনে। দেখা হবে, সাধারণ কথা। কিন্তু বলিষ্ঠতম লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন,তা সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মনে হয়, এ যেন ঈশ্বরীয় বাণী। কেউ যেন তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস একে একে পড়েছি, ঘূনপোকা, মানবজমিন, দূরবীন, বাঘু মান্নার বরাত, অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার, কাগজের বউ, পাতালঘর, জন্মান্তর, ঝিকরগাছায় ঝঞ্ঝাট, প্রভৃতি রচনা।
তিনি বহু লিখেছেন। যেমন, মজার কাহিনী, শ্যামলাল ভাবছে। আমি সুমন, দুখিরাম, দীপুর অংক, বীরেন বাবুর প্রত্যাবর্তন, প্রভৃতি। শবর সিরিজের গল্প লিখেছেন, ঈগলের চোখ।
ভূতের গল্প লেখাতেও ভারী দক্ষ তিনি। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক, শুধু কিশোর মনে নয়, বড়দের কাছেও এইসব গল্পের আলাদা টান আছে।
মনে আছে, গণেশের মূর্তি, লক্ষ্মী পেঁচা, আমাকে দেখুন, গোঁসাইবাগানের ভূত, এই সব কাহিনী আমাদের এক আশ্চর্য রহস্যময় জগতে নিয়ে যেত।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার মধ্যে যে গভীরতা লক্ষ্য করেছি, সেটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি তাঁর লেখা পড়বার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাঁর ভাষা স্টাইল স্বতন্ত্র। মনে আছে, বৃষ্টিতে নিশিকান্ত, গল্পের শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, “কেচ্ছা কেলেঙ্কারির মতো বৃষ্টি হয়ে চলেছে কয়েকদিন।”
দেখা হবে, গল্পে একসময় লিখেছেন, “ছেলেবেলায় যেমন পাশ ফিরে মায়ের পিঠের দিকে শুতাম, এখন পৃথিবীর উল্টো পিঠের দিকে যেন পাশ ফিরে শুচ্ছি।”
ছেলেবেলার বর্ণ গন্ধ এখন আর পাই না।
বর্তমান সময়ে যখন চারদিকে ভাঙ্গনের খেলা চলেছে, আমাদের পৃথিবীটা স্বার্থপরতার কারণে, বিবেকহীনতার কারণে, মূল্যবোধ হারাবার কারণে যখন ছোট হয়ে আসছে, তখন যে মূল্যবোধের কথা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন রচনায় পরিবেশন করেছেন, তা পাঠ করলে, মানুষের মধ্যে শুভ চেতনা ফিরে আসবে।
সামান্য বিষয় নিয়ে লেখার শুরু করলেও, বারে বারে এই যশস্বী লেখক মানুষের শুভ চেতনাকে সাহিত্যে পরিস্ফূট করেছেন, নব নব আঙ্গিকে। অনেকেই চলে গিয়েছেন। রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী প্রমুখ।
দীর্ঘায়ু হোন এই লেখক। লেখার মধ্যে এই যে গভীরতা, বাংলা সাহিত্যে ইদানীং তা একান্তই দুর্লভ। কাহিনী বিন্যাসে, চরিত্র চিত্রনে, প্রকাশভঙ্গিতে, সংলাপ ব্যবহারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অনন্য।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “কাহিনীর প্রথম লাইনটা হাতে পেয়ে গেলে, আপনা-আপনি অসংখ্য চরিত্র এসে তাঁকে দিয়ে যেন লিখিয়ে নিয়ে যায়।” তিনি গল্পে বা উপন্যাসে বরাবর একাধিক চরিত্র
এনে থাকেন। অনেক চরিত্র নিয়ে কাজ করার মধ্যে লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নান্দনিক আনন্দ খুঁজে পান।
আগামীতে তাঁর কাছে অনেক অনেক মহৎ সৃষ্টির উপহার পাবো, আশা করি।
অসম্ভব গুনী এই জীবনী শিল্পীর প্রতি হৃদয়ের বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। -
প্রবন্ধ-নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নজরুল ইসলামের রচনায় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
– শিলাবৃষ্টিভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল “
– কবি অন্নদাশংকর রায়ভূমিকা :~
বাংলা কাব্য জগতে – হাতে অগ্নিবীণা, ও রণতূর্য, মুখের বাঁশের বাঁশরী আর রোমান্টিক কবিমন নিয়ে ধূমকেতুর মতই কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। তাঁর কবিতা ও গানে একই সঙ্গে বিদ্রোহের, পৌরুষের ও যৌবনের বেদনার ভাষা বানীরূপ লাভ করেছে । রবীন্দ্রোত্তর – কাব্যজগতে নজরুল রবিতাপে কিন্তু হারিয়ে যাননি ; বরং রবীন্দ্র মায়াজাল ভেঙে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে ছিলেন।জন্ম :~
বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের চব্বিশে মে (বাংলা ১১ই জ্যেষ্ঠ) অতি দরিদ্র এক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতা – কাজী ফকির আহমেদ, মাতা – জাহেদা খাতুন। বাল্যনাম – দুখুমিঞা। দারিদ্র্যতার কারণে শৈশব থেকেই জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নজরুল।প্রতিভার প্রেরণা :~
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁরও সৈনিক জীবনের সমাপ্তি ঘটল। দেশে ফিরলেন অনেক রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে। বুকে ছিল পরাধীনতার দুঃসহ বেদনা। রচনা করলেন “রিক্তের বেদন”। আবির্ভূত হলেন – বাংলার কাব্যাকাশে। তিনি বিদ্রোহের কবি, বৈভবের কবি।গজল :~
সঙ্গীতের প্রতি নজরুলের অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই। কবিতা রচনার সাথে সাথে তিনি রচনা করেছেন সঙ্গীত, করেছেন সুর সংগ্রহ। অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর। যেহেতু প্রবন্ধের বিষয় গজল ও শ্যামাসঙ্গীত, সেহেতু গজলের প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।
বাংলা গজল গানে নজরুল সার্থক স্রষ্টা। পারস্যের প্রেম সঙ্গীত রূপায়নের জন্যই গজলের জন্ম। গজলের দুটি অংশ –
১) অস্থায়ী এবং ২) অন্তরা। অস্থায়ী অংশ সুর ও তাল সহযোগে গাওয়া হয়, অন্তরা তাল ছাড়া, এই অংশকে বলা হয় – শের বা শেয়র। গজল গানে নজরুল নানারকম রাগ রাগিনী এনেছেন। মূল কাঠামো ঠিক রেখে তিনি – ঠুংরী ও দাদরার আঙ্গিকে বেশ কিছু গজল রচনা করেছেন। এরকম কয়েকটি গান – “উচাটন মন ঘরে রয়না”, “আধো আধো বোল লাজে”।
আবার বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রনে নতুন ধারার গজল সৃষ্টিতে তিনি অতুলনীয়।
বাগেশ্রী এবং পিলু রাগের মিশ্রনে তিনি সৃষ্টি করলেন –
“চেয়োনা সুনয়না ” দুটি বিপরীতমূখী রাগ এই গানে একাত্ম হয়ে গেছে। “আমার যাবার সময় হল”,”পাষানের ভাঙলে ঘুম “- অসামান্য দুটি গজল। নজরুলের গজলের কয়েকটি বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয়। যেমন – তাঁর হাতে –
১) বিদেশী শব্দগুলো একেবারে “বাঙালি” হয়েগেছে।
২) আরবী, ফার্সী শব্দ ব্যাপক ভাবে প্রয়োগ করেছেন।
৩) বাংলা সঙ্গীতে নজরুলের গজল একটি বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আগে বিত্তশালী এবং মুটে মজুরের গানের যে সীমারেখা ছিল – নজরুলের গজল যেন একটি যাদুকাঠিতে সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। “বাগিচায় বুলবুলি তুই” বা “কে বিদেশী, মন উদাসী” গজল গুলি জাত বেজাতের সীমা লঙ্ঘন করল। তাঁরই একটি গানে বলব – “পাষানের ভাঙালে ঘুম, কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়? ” ।শ্যামাসঙ্গীত :~
ভক্তিগীতি রচনায় নজরুল
যে অসাধারনত্ব এনেছেন – তা তাঁর আগে কারোরই বোধহয় সম্ভব হয়নি। তাঁর ভক্তি গীতির সংখ্যা – কৃষ্ণ, শ্যামা ও ইসলামী মিলিয়ে প্রায় ৭-৫০। এই গানগুলি এক অপূর্ব আলোয় ঝলমল করছে।
যে তিনটি শ্যামাসঙ্গীত প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে – সেগুলি – শ্মশানে জাগিছে শ্যামা ,বলরে জবা বল, কালো মেয়ের পায়ের তলায়।শ্মশানে জাগিছে > কৌশিক / ত্রিতালে রচিত। আশাবরী ঠাট, মালকোশের প্রভাবে – অপূর্ব এটি একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ কালীস্তোত্র। শ্মশান কালীর এই রূপ আর কোথাও পাওয়া যার না।
বলরে জবা বল -> গানটি ভাষার সারল্যে কাব্য সৌন্দর্যে বাঙালীর হৃদয় হরণ করেছে।
কালো মেয়ের পায়ের তলায় -> গানটি মিশ্র আশাবরী রাগে দাদরায় নিবদ্ধ। অসাধারণ সুর সংযোজনায় গানটি অতুলনীয়।।
এছাড়াও বেহাগ খাম্বাজ / দাদরায় – বক্ষে ধরেন শীব যে চরণ ;
দেশ খাম্বাজ / দাদরায় – আমার মুক্তি নিয়ে কী হবে মা, তুই লুকাবি কোথায় কালী।
নজরুলের এই সুরের সাম্রাজের বিশালতা শুধু অনুভব করতে হয়।উপসংহার :~
বঙ্গ সংস্কৃতির এক গৌরবময় সম্পদ নজরুলের গজল ও শ্যামাসঙ্গীত সহ সমস্ত গান। নজরুল গীতি যেন – অমৃত সুরসুধায় সিক্ত এক অপূর্ব আস্বাদন সামগ্রী। তিনি বলেগেছেন – “গান আমার আত্মার উপলব্ধি”। -
প্রবন্ধ- লীলাময়ী লীলা মজুমদার
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
লীলাময়ী লীলা মজুমদার
-সুমিতা দাশগুপ্তবড়ো ইচ্ছে, তাঁর জন্মদিনে একখানা হলদে পাখির পালক উপহার দিই ।
তুমি বলবে — ওমা সে তারিখ তো কবেই পেরিয়ে গেছে !
আমি বলি তাতে কী? তারিখ পেরিয়ে গেলেই তো আর জন্মদিনটা মিথ্যে হয়ে যায় না , বিশেষ করে আপামর বাঙালির বুকের মধ্যে একখানি মায়ার পিদ্দিম জ্বালিয়ে দিয়েছেন যিনি তাঁর তো প্রতিটি দিনই জন্মদিন!
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, তিনি হলেন আপামর বাঙালি পাঠকের প্রিয় লীলাময়ী, লীলা মজুমদার ।
এখন মুশকিল হলো উপহারটা যে দেব ,তা সেই পালকখানা পাই কোথায়? তাকে তো ঝগড়ু আর ঝগড়ুর ভাই ছাড়া কেউ দেখেই নি !
গুণুপন্ডিত বললে -” তা ওকেই শুধোও না গিয়ে।”
আহা, তা কি আর আমি ভাবিনি ভাবছো , মুশকিল হলো ঝগড়ুকেই বা পাই কোথায়!।সে তো বোগি আর রুমুকে সঙ্গে নিয়ে সারা দুপুর ,খোয়াই এর মধ্যে সেই ফুল খুঁজে বেড়ায় ,যা নাকি কক্ষনো শুকোয় না। কবে থেকে যে খুঁজেই চলেছে,আজও পায় নি -তবে কিনা চায়ও না পেতে! বলে, পেয়ে গেলেই তো সব মজা মাটি!
গণশা পরামর্শ দিলে — “পদিপিসির বর্মীবাক্সটা একবার খুঁজে দেখলে হতো না? ধনরত্নের মধ্যে যদি একখানা পালকও লুকিয়ে থাকে! ” শুনে গুপির সে কী হাসি !বললে
“ওরে সে বাক্স তো এখন খালি।ওর ভিতরের সোনাদানা, মণিমুক্তো,মায় , বিয়ের আসর থেকে চুরি যাওয়া মন্তরের পুঁথিখানা পর্যন্ত কবেই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নিয়েছে সবাই।”
তাহলে উপায়?
আচমকা পেরিস্তানের চোরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কালোমাস্টার বললে—
“সবাই জানে আমি মানুষটা মোটেও সুবিধের নই, কাউকে যেচে পরামর্শ দিই নে, কিন্তু এই যে ছেলেটা এর মতো এতো ভালো মনের মানুষ
ভূ ভারতে আর কোথাও দেখলাম না। আমায় আশ্রয় দিয়ে, লুকিয়ে রেখেছে ওর গোপন আস্তানায়, বাড়ি থেকে খাবার চুরি করে এনে খাওয়ায়।
তাই হদিশখানা বলেই দিচ্ছি। ঐ সামনের পাহাড়ে পাকদন্ডী বেয়ে উপরে উঠে যাও দিকিনি, ওখানে পাহাড়ের ঢালে বড় লামা থাকে ।ওর পুষ্যি হলো ধিঙ্গিপদ , সারা দিনমান ,হেথা হোথা ঘুরে ফিরে কাজকর্ম করে , দুনিয়ার খবর তার নখদর্পণে। শোনো তাকে আবার আহ্লাদ করে ঘাস খাওয়াতে যেও না যেন , সে কেবল সুয্যির আলো খায়।”
বড়লামার বাড়ি পৌঁছে দেখি,ধিঙ্গিপদ রোদে কাঠকুটো শুকোতে দিচ্ছে , আমাদের তো পাত্তাই দেয় না,বড় গুমোর তার, অনেক সাধ্যসাধনার পর, বললে
” যতদূর জানি পাহাড়চূড়োয় মেঘের দেশে যে বাতাসবাড়ি, হলদে পাখি ইদানীং সেখানেই আশ্রয় নেছে ,আর কিছু জানি নে ,যাও ভাগো” ।
তাড়া খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। তারপর ধিঙ্গিপদর কথামতো
পাকদন্ডী বেয়ে উঠছি তো উঠছিই , চারপাশে সে কী ঘন বন, বনের মধ্যে হু- হু করে হাওয়া বয় , পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো , আড়াল থেকে কারা যেন উঁকি ঝুঁকি মারে , তাকালেই চট করে সরে যায় ,সে ভারি রোমহর্ষক ব্যাপার! ভয় কাটাতে গুপি পকেট থেকে টিনের ব্যাঙ্ কটকটিখানা বের করে যেই না, কটকট করতে লেগেছে ওমনি কোথা থেকে একদল নোংরা জামাকাপড় পরা ছেলে মেয়ে এসে আমাদের পাশে পাশে হেঁটে ভয়ের রাস্তাটুকু পার করে দিয়ে গেল। একটাও কথা কইলে না। বোবা নাকি রে বাবা!
বন ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠেই দেখি, মাথার উপরে উপুড় করা প্রকান্ড একখানা গামলার মতো কী চমৎকার নীল আকাশ,রাস্তার ধারে ধারে, বাগান ঘেরা চমৎকার সব বাড়িঘর। সাদা রেলিং দেওয়া কাঠের বারান্দায় সারি সারি টবে রঙবেরঙের ফুল ফুটেছে, বাগানে নাসপাতিগাছে , সোনালীরঙা রস টুপটুপে পাকা ফলের বাহার । আরে এইটিই তো তাঁর ছেলেবেলার বাড়ি।
এরপর যতো এগোই পাকদন্ডীর প্রতিটি বাঁকে ,থুড়ি পৃষ্ঠায় কতো যে বিখ্যাত মানুষের ঠিকানা! তাঁদের অতুলনীয় কীর্তি কলাপ , অসামান্য জীবনযাপনের মনকাড়া গপ্পো।
ও হরি !এতক্ষণ বলি নি বুঝি , হলদে পাখির পালক খোঁজার অছিলায় তাঁরই লেখা বই নিয়ে বুঁদ হয়ে আছি আবারও। আহা ,যদি সত্যি হতো এই পথ চলা ! হঠাৎ শুনি মনের ভিতর ঝগড়ুই কথা কয়ে উঠলো
“সত্যি যে কোথায় শেষ হয়,আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু বলা মুশকিল।কেন তোমাদের রবিঠাকুরই তো বলে দিয়েছেন ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি ,ঘটে যা ,তা সব সত্য নহে’ —পড়ো নি বুঝি!”
এতক্ষণে হয়তো বিজ্ঞজনের ভ্রূ কুঁচকে গেছে। —এটা আবার কী ধরনের প্রবন্ধ ! গুরুগম্ভীর একখানা বিষয়, থান ইটের মতো শক্ত শক্ত শব্দ আর, তথ্যের বুনটে ঠাসা থাকবে , তবেই না বুঝি! কিন্তু কী আর করা , যাঁর সম্পর্কে লিখতে বসেছি তিনি মানুষটাই যে এমনই। সহজ সরল ভাষায় ,কখন যে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যান ,কেউ টেরটিও পায় না। তাঁর চরিত্রদের কেউ বা “বারান্ডাওয়ালা” টুপি পরে, আবার কারোও বা উত্তেজনায় চোখ “জ্বলজ্বলিং”।
যাঁর বর্ণনার এমন সহজ সরল ভাষা, তাঁর জন্য এমন ভাষাই তো লাগসই ,কী বলো!
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাইঝি, সুকুমার রায়ের বোন ,এই পরিচয় পাশে সরিয়ে রেখে , অনায়াসেই নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন শিশুসাহিত্যের পোক্ত জমিতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রী, স্বর্ণপদকসহ , রবীন্দ্র পুরস্কার ,দেশিকোত্তম আরও কতশত সম্মাননায় ভূষিত, কর্মজীবনে কখনও বা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিশ্বভারতীর শিক্ষকতা আবার কখনও বা কেন্দ্রীয় সরকারে উচ্চপদের গুরুদায়িত্ব ,এইসব সামলেও, তিনি অনায়াসেই খেলতে নেমে পড়েন শিশুমনের আঙিনায়।
কথায় বলে , নিজের ছেলেবেলা ভুলে যাওয়া নাকি মহাপাপ। লীলা মজুমদারের কলমের মায়ায় ,ঘটে যায় সেই শাপমুক্তি। কতো কী-ই যে মনে পড়িয়ে দেন তিনি! বাথরুমে বন্দী কতশত দুষ্টু শিশুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন সাবানের ফেনার রঙিন বুদবুদে রামধনু তৈরী করার ফন্দি ফিকির , আঙুলের ডগায় স্কেল নাচানোর খেলা , তিনিই তো শিখিয়ে দিয়েছেন কতগুলো ফুটোকে ময়দা দিয়ে জুড়ে তৈরী হয় পাঁউরুটি।
সেইসব মনে পড়তেই প্রাপ্তবয়স্করাও নিজেদের অজান্তেই সামিল হয়ে যান শিশুদের সঙ্গে পথ হাঁটতে। চলে লম্বা শোভাযাত্রা ।সেই শোভাযাত্রায় থাকে , কানকাটা নেড়ি ,ডানা ভাঙা পাখি,পকেটমার , বাঁশ বাগানের ভূতের দল, মায় রাতের বেলায় পুল পার হওয়া মালগাড়ির চেনে লেগে থাকা গানের সুর , টং -লিং – টং লিং।
দৈনন্দিন জীবনের ব্যথা বেদনায় দরদী হাতে মলম লাগিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। বুঝিয়ে দেন এই পৃথিবীটা মোটেও স্বর্গরাজ্য নয় , ভালো লোকের পাশাপাশি চোর জোচ্চোর ফেরেববাজেরও অভাব নেই কিন্তু তাই বলে তোমার মনের ভিতরে মায়ার প্রদীপখানি কিছুতেই নিভতে দেওয়া চলবে না। কারণ তুমি যে মানুষ!
তাঁর মুখচ্ছবিতে তামাম বাঙালি খুঁজে পায় নিজের ঠাকুমার আদল , আদর করে সকলের মনেই গেঁথে দিয়ে গেছেন জিয়নকাঠির মন্ত্র।তাই তো মনখারাপের আঁধার পেরিয়ে আজও ভোরের আলোয় হেসে ওঠে বাঙালি ,পায় প্রতিদিনের পথ চলার নতুন উৎসাহ। -
প্রবন্ধ- রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম
– শিলাবৃষ্টিসূচনা~
রাক্ষসী পলাশী গ্রাস করে নিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা সূর্যকে। দীর্ঘ দু’শ বছর ধরে শত শত সংগ্রামী নিজের দেশকে ভালোবেসে নির্ভয়ে এগিয়ে গেছে রণক্ষেত্রে,হাসি মুখে বলি দিয়েছে নিজের প্রাণ।
তবে দেশপ্রেম মানেই যে কেবল জীবন বিসর্জন দেওয়া, তা নয়।দেশের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ নানা ভাবে ঘটতে পারে।কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথও পরাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উদাসীন ছিলেন না।সংগীতে, কবিতায়, প্রবন্ধে এবং অন্যান্য রচনায় তিনি সেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।বাল্যজীবন ও শিক্ষা
~~~~~~~~~~~
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে যে বিস্ময়কর প্রতিভা জন্মগ্রহণ করেন- তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদা দেবী। ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ভোগবিলাসের মধ্যে যে তার জীবন কাটেনি–তা “জীবন স্মৃতি ” তে প্রকাশিত। বিভিন্ন নামী স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে নিয়ম মাফিক শিক্ষা তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির উন্নত পরিবেশের মধ্যেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা গ্রহণ। শুধু লেখাপড়াই নয়, সেকালের ঠাকুর পরিবারে সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীত চর্চার যে অনুকূল আবহাওয়া ছিল, সেই আবহাওয়ার মধ্যেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।সারস্বত সাধনা~
~~~~~~~~~~
“জল পড়ে পাতা নড়ে” দিয়ে যাঁর ছন্দের অনুরণন শুরু হয়,তা থেকেই নির্মিত হতে থাকে পরবর্তী কাব্য জগৎ।
বনফুল, প্রভাত সঙ্গীত, সন্ধ্যা সঙ্গীত,ভানু সিংহের পদাবলী দিয়ে যাত্রা শুরু করে মানসী, সোনার তরী, নৈবেদ্য, গীতালি, গীতাঞ্জলি , পূরবী,বলাকা, মহুয়া ইত্যাদি হয়ে শেষ লেখায় তিনি থামেন মৃত্যুর দেড় ঘণ্টা পূর্বে। কবি ছাড়াও
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার,প্রবন্ধকার,চিত্রকার,সুরকার,গীতিকার রবীন্দ্রনাথকে আমরা সবাই চিনি কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় মানুষ রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন-“মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।”স্বদেশ চিন্তা
~~~~~~~
স্বদেশচিন্তা – সৃজনকর্মে সদা ব্যস্ত মানুষটি শুধু সাহিত্য শিল্পের নন্দনকাননে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, প্রথম জীবন থেকেই তিনি দেশমাতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে চেয়েছেন – দেশবাসীর মনে চেতনা জাগাতে তুলে নিয়েছেন কলম। লিখেছেন একের পর এক স্বদেশী গান – “আমরা সবাই রাজা”, “এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি প্রান”, “এখন আর দেরি নয় ধরগো তোরা হাতে হাতে ধরগো”, “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”, “ও আমার দেশের মাটি”, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”। ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেম জাগাতে “ভারততীর্থ”র মত লিখেছেন কতনা কবিতা!দেশপ্রেম ~
~~~~~~
সমকালীন বহু ঘটনা তাঁর মনে ঝড় তুলেছে – রুখে দাঁড়িয়েছেন – উদ্ধত, মত্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে। মানুষের সুখ দুঃখের স্মারক হয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থ তিনি দান করে দিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদী আন্দোলনে তিনি স্বয়ং যোগদান করেছেন। তাঁর রচিত “বাংলার মাটি বাংলার জল” এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল। ১৯১৯ খ্রী. জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। ভাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে সৃষ্টি করেছেন “রাখীবন্ধন”। তাঁর রচিত “জনগণ মন” গানটি আজ স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত।উপসংহার ~
~~~~~~~
ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭-শে কিন্তু – তিনি সেদিন সে আনন্দে যোগদান করতে পারেননি, কারন তার মাত্র ৬ বছর আগে ১৯৪১-শে বাইশে শ্রাবণ তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু এ শুধু তাঁর মরদেহেরই অবসান। এই ভাবসাধক কবিশ্রেষ্ঠ খণ্ডকালের হয়েও সর্বকালের। ভারত-আত্মার এই বিগ্ৰহকে তাঁর বঙ্গভূমি, তাঁর ভারতবর্ষ তো ভোলেইনি, সমগ্ৰ বিশ্বের দরবারে তিনি সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত।।