ভৌতিক গল্প
-
ভৌতিক গল্প- ভাড়াবাড়ির অশরীরী
ভাড়াবাড়ির অশরীরী
-ইন্দ্রনীল মজুমদার
রাতে কি একটা শব্দে বেশ যেন সৌমিতের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। বেশ জাঁকিয়ে ঘুমটা এসেছিল বটে, কিন্তু এই আওয়াজটাই ঘুমের রেশটা কাটিয়ে দিল। ঘুমন্ত চোখে লাইটের স্যুইচটা জ্বেলে টলতে টলতে কোনোরকমে বাথরুমে গেল সে। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ঘুমের ভাবটা কাটাতে হবে। তারপর খুঁজতে হবে আওয়াজের উৎস। তাই হল। ভালোভাবে সব কিছু লক্ষ্য করতে আরম্ভ করল সৌমিত। খুব ভালোভাবেই মনে আছে কে যেন বেশ জোরে জানালাটা ধাক্কাচ্ছিল। হ্যাঁ, পাঁচিলের দিকের কাঠের জানালাটা বন্ধই থাকে। কেননা মশার ভয়। ওই জানলাটাই মনে হয় ধাক্কাচ্ছিল কেউ। সৌমিত কৌতূহলভরে জানলাটা খুলল। খুলে দেখল কেউ নেই। আবার জানালাটা বন্ধ করে বিছানায় আসতে যাবে এমন সময় সে জানলায় ধাক্কা মারার আওয়াজ শুরু হল। কে যেন হয়তো বোঝাচ্ছে যে, জানলা খোলো, অনেক দরকারি কথা আছে। সৌমিত ভয়ে অস্ফুট গলায় বলল, “কে? কে ওখানে?” কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পেল না। কিন্তু, জানলা ধাক্কানোর আওয়াজ ক্রমশ বেড়ে চলল। এক সময় মনে হল জানলাটা বোধহয় ভেঙেই যাবে। ঠিক তখনি বেশ সাহস সঞ্চয় করে জানলাটা খুলল সৌমিত। কিন্তু এবারও অবাক কাণ্ড! কোথাও কেউ নেই। সৌমিত জোড়ে চিৎকার করে উঠল,– “কে?জানলা ধাক্কাচ্ছিলেন কেন? কে আপনি? কই গেলেন?”কিন্তু, কোনও সাড়াশব্দ পেল না সৌমিত। ব্যাপারটা তো বেশ রহস্যজনক।
সৌমিত আজই কলকাতার এই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে এল। সদ্য কলকাতার একটি নামী অফিসে জয়েন করেছে সে। তাই কোচবিহার থেকে কলকাতার এই বাড়িতে আসা বৈকি। বাড়িটা বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল সৌমিতের। আর ভাড়াও বেশ কম। ও ওর একার পক্ষে এই বাড়ি ঠিকই আছে। কিন্তু প্রথম দিন রাতেই যে এমন অদ্ভূতুড়ে উপলব্ধি হবে, কিন্তু সেটা ও কোনোকালেই ভাবতেই পারেনি। সদ্য বি.টেক. পাশ করা বছর বাইশের সৌমিত কুণ্ডুর জীবনে এই প্রথম যেন অলৌকিকতার প্রবেশ ঘটল। যাই হোক, সৌমিত শুনেছিল যে বাড়িটা বহুদিন খালি পড়েছিল তাই হয়তো জানলা দরজাগুলো অব্যবহৃত ছিল। সেই জন্যে বোধহয় হালকা হাওয়ায় জানলাটা ওরকম করছিল। কিংবা পেঁচা কি বাঁদুড়ের সাথে ধাক্কা লাগছিল হয়তো জানলাটার সাথে তাই ওই আওয়াজটা হচ্ছিল। কিন্তু তা বলে এত…..। এরপর, সৌমিত আর কিছু ভাবলো না। ওইটুকু নিজেকে বুঝিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কেননা পরের দিন ওর অফিস আছে তাই ঘুমটা খুব দরকার।
সেই রাতে পরের দিকে ঘুমটা বেশ ভালই হল সৌমিতের। সকালে উঠে বেশ ঝরঝরে লাগলো। বেশ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিসের দিকে রওনা হল। অফিসের ব্যস্ততায় ভুলেই গেল গতকালের ঘটনা। সেদিন অফিসের একটু বেশি কাজ ছিল তাই ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। ফিরে যখন সদর দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আলোটা যেই না জ্বেলেছে ওমনি তার মনে হল খাটে কে যেন ছায়ামূর্তি বসে ছিল তাকে দেখে খাট থেকে নেমে পালিয়ে কোথায় যেন একটা মিলিয়ে গেল তা ঠিক ঠাহর করা গেল না। সৌমিতের শরীর দিয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে তারপর মনের ভুল ভেবে স্বাভাবিক কাজকর্মগুলো সম্পন্ন করল সে। সেদিন রাতে এমনকি বেশ কয়েকদিন কোনও ঘটনা ঘটল না। এমনিভাবেই চলছিল একদিন ঘটে গেল এক অদ্ভূতুড়ে ঘটনা। রাতে বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়ল সৌমিতের। বাথরুমের দরজাটা যেই না খুলতে যাবে ওমনি সে শুনতে পেল বাথরুমের কলের জলের আওয়াজ। কে যেন কল খুলে তার জল ব্যবহার করছে। এত রীতিমতো তাজ্জব ব্যাপার! তাহলে কি কোনও চোর ঢুকল ঘরে? শিগগিরি সৌমিত সদর দরজা চেক করল কিন্তু সদর দরজা তো বন্ধ। আর জানলাগুলো প্রায় সবই বন্ধ। একটা যাও খোলা কিন্তু সেখানে তো গ্রিল লাগানো আছে। তাহলে বাথরুমে কে? সৌমিত ছুটে গেল বাথরুমের দিকে। কিন্তু, আবার বিস্ময়কর ব্যাপার হল এই যে, বাথরুমের দরজা তো বাইরে থেকে আটকানো। তবে লোকে সেখানে ঢুকলো কিভাবে? সৌমিত বড় চমকে গিয়েই বাথরুমের আলোর স্যুইচ জ্বেলে দরজা খুলে দেখে কোত্থাও কেউ নেই। কলটাও বন্ধ। অথচ বাথরুম জলে ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে সদ্য কেউ যেন ব্যবহার করেছে। ভারী অবাক করার মতোই ব্যাপার। যাইহোক, সৌমিত বাথরুম করে ফিরে এল বেশ নির্বিঘ্নেই কোনও অসুবিধা ছাড়াই। আর মনে মনে ভাবল যে, এর একটা বিহিত করা দরকার। আগামীকাল শনিবার– অফিস ছুটি। তাই, একবার বাড়িওয়ালার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলা দরকার। এখানে অন্য কেউ আছে না কি? অশরীরী কেউ?
পরদিন বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে বেশ নিরাশাই হতে হল সৌমিতকে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি বেশ বয়স্ক। একাই থাকেন। বেশ হেসে হেসে বললেন, “কি হে সৌমিত? বাড়িটিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
– না। তবে কিছু কিছু ঘটনা ঘটছে যেগুলোর ঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না।
এই বলে সৌমিত ঘটনাগুলো সংক্ষিপ্তভাবে বলে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি শুনে প্রথমের দিকে বেশ গম্ভীর ছিলেন। কিছু একটা চিন্তায় বেশ বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন বেশ যেন। এক দৃষ্টিতে, এট মনে যেন কোনও এক চিন্তায় ডুবে ছিলেন। সৌমিত জ্যেঠু বলে ডাকাতে তাঁর যেন হুঁশ এল। তিনি যেন ঘোর কাটিয়ে বেশ স্বাভাবিক অবস্থায় হেসে বলেন, “না না, ও তোমার মনের ভুল। ও বাড়ি খুব ভালো বাড়ি। কোনোদিন কোনো অভিযোগ তো পাইনি। ঐসব তোমার মনের ভুল মাত্র। এত খাটা খাটনি কর তো। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করে করো।”
– আচ্ছা, বেশ। আসি তাহলে।
– কোন টেনশন নেই। কিছু সমস্যা হলে জানিও। ভালো থেকো।
কিন্তু এত কিছু আশ্বস্তবাণীর পরেও সৌমিতের মনের দ্বন্দ্ব কাটে না। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি কি যেন কোনও কথা না বলে চেপে গেলেন। খোলসা করে বললেন না ব্যাপারটা। সৌমিত অগত্যা নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। তা ঘরে ফিরে সৌমিত দেখে যে তার ঘর পুরো লণ্ডভণ্ড। ফাইল সব ছড়ানো আছে, বই সব মাটিতে পড়ে আছে, জলের বোতল খোলা আছে আর তার থেকে জল গড়িয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি যা তা অবস্থা হয়ে রয়েছে। সৌমিতের বেশ ভয় খেলে গেল। ঘরের কারুর ঢোকার তো জো নেই কেননা সদর দরজা তো বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করা ছিল। গ্রিল দেওয়া জানালাগুলোও তো বন্ধ ছিল। তাহলে? সৌমিত বেশ ভয়ে আবার রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো,– “কে তুমি? কি চাও কি? কে আছ এখানে?” বেশ কয়েকবার এই প্রশ্নগুলো উচ্চারণ করার পরও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এবার সৌমিত কিছুটা থেমে বেশ রেগে গিয়েই বলল, “তুমি যেই হও না কেন, চলে যাও এখান থেকে। চলে যাও।” ঠিক সেই সময় কে যেন সৌমিতকে পেছন থেকে জোড়ে ধাক্কা মারলো। সৌমিত উল্টে পড়ে গেল ঠিকই কিন্তু গুরুতর কোনো আঘাত বা চোট পেতে হয়নি তাকে।
এরপর, সোমবার অফিসে গিয়ে মানসীদিকে ব্যাপারটা জানায় সৌমিত। আসলে হয়েছে কি, সৌমিত ঐসব ভূতুড়ে ঘটনার জেড়ে বেশ মনমরা হয়ে পড়েছিল। তা দেখে মানসীদি সৌমিতকে জিজ্ঞাসা করেন, “কি রে, সৌমিত? কি হয়েছে তোর? খুব তো জলি থাকিস, তা আজ এত মনমরা লাগছে। ভাই, কি ব্যাপার বলতো?
সৌমিত কাতর কন্ঠে বলল, “আর বলো না দিদি। এই ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার পর যা সব ঘটছে।”
– তা ছেড়ে দে।
– আর কোথাও পাব বলো তো এত কম দামে?
– তা কি কি হচ্ছে বল তো।
– তোমাকে না হয় টিফিন টিফিন ব্রেকের সময় বলব। এখন প্রেজেন্টেশনটা একটু বানিয়ে নিই।
টিফিন ব্রেকের সময় সৌমিত মানসীদিকে সবকিছু খুলে বলে। মানসীদি সৌমিতকে নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করেন ও ভালোবাসেন। আবার সৌমিতের কাছে মানসীদি শুধুমাত্র একজন বন্ধু বা ফিলোসফার বা গাইডই নন– একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী ও বড়দির মতো। তা, মানসীদি তো সব শুনে বললেন, “ঐ বাড়িতে বেশিদিন থাকিস না। আমাদের এদিকে একটা ফ্ল্যাট আছে বটে এখানে চলে আয়। ঐ বাড়ির মধ্যে অশুভ কিছু প্রেত বা ভূত ঐ জাতীয় কিছু একটা আছে হয়তো।”
সৌমিত ভয়ে চমকে ওঠে, “কি বললে প্রেত বা ভূত?”
– হ্যাঁ। হতে পারে ঐ বাড়িতে কেউ আত্মহত্যা করেছিল বা খুন হয়েছিল, তোকে যা জানাইনি। জানালে বাড়ির জন্য ভাড়াটে পাওয়া যেত না।
– এই রে! (সৌমিত আরও ভয় পেয়ে যায়।)
– তাই বলছি আর কি। ঐ বাড়ি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দে।
সৌমিত তৎক্ষণাৎ ভেবেই নেয় যে ঐ হানাবাড়িতে এরপর আর থাকবে না। তাই এ মাসটা কোনওরকম কাটিয়ে চলে যাবে অন্য জায়গায়।
মানসীদি আবার বলে ওঠেন, “একটু খোঁজখবর নিস তো ঐ বাড়িতে কেউ কখনো আত্মঘাতী বা খুন হয়েছিল কি না।”
– আচ্ছা, বেশ। তোমার চেনা জানা কোনও ভাড়াবাড়ি পাওয়া যাবে? আছে তোমাদের ঐদিকে কোথাও?
– আছে। আমাদের বাড়ির কাছে। একটু খোঁজখবর নেব। বাড়িওয়ালা আমার হাসবেন্ডের চেনা আছে। আশা করি হয়ে যাবে। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি গেলে তোর অফিসটাও বেশ কাছে হয়ে যাবে। ঐ ভূতুড়ে বাড়ি ছেড়ে দে, চলে আয় এদিকে।
– তাই হোক দিদি।
সেদিন রাতে আর কিছু হল না। তার বেশ কয়েকদিন পর যা সব ঘটল তা সৌমিতের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এই ক’দিন অফিসের কাজের চাপে খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। সৌমিত মানসীদির কথা মতো তাঁদের ওখানেই যাচ্ছে। সেই মতো সবকিছুর তোড়জোড়ও চলছে। একদিন রাতে ফেরার সময় সৌমিত ভাবল যে, মানসীদি ঠিকই বলেছেন। ও যে বাড়িতে আছে সেই বাড়ি সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। কোথায় নেবে? সৌমিত ভাবল যে হোটেলে ও রাতে নিয়মিত খায় সেখানেই জিজ্ঞেস করবে। আগে করবে ভেবেছিল কিন্তু অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কিংবা নানান কারণে করা হয়ে ওঠেনি। আবার সময় পেয়ে যখন করবে ভেবেছিল তখন অচেনা মানুষজনকে প্রশ্ন করতে গিয়ে কোথাও একটা লজ্জাবশত ‘কিন্তু কিন্তু’ করেও জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। যাইহোক, খাবার খেয়ে বিল মেটানোর সময় দোকানে আর কেউ ছিল না সৌমিত তখন দোকানের মালিককেই জিজ্ঞেস করল, “কাকু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
– হ্যাঁ, বলো।
– আচ্ছা, আমি আপনাদের দোকানের উল্টোদিকের গলিতে দ্বিতীয় নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকি।
– ও আচ্ছা। তা বাড়িওয়ালার নামটা কি যেন।
– রঞ্জনবাবু, রঞ্জন বাগচী।
– ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। তা কি জানতে চাও বলো?
– ঐ বাড়ির ব্যাপারে কিছু বলবেন। কিরকম যেন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। একা খুব ভয়ে আছি। ওখানে কি কেউ আত্মহত্যা বা খুন হয়েছিল?
মালিক ভদ্রলোক কেযন যেন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, “একটা বাড়ির সম্বন্ধে এরকম শুনেছিলাম বটে। সেটাই কি এই বাড়ি? আচ্ছা, দাঁড়াও তো…” তারপর ওঁর পাশে বসা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ গো, বছর তিনেক আগে সুইসাইড করেছিল যে ছেলেটি, সেটা কি রঞ্জনবাবুর?
মালিকের স্ত্রী জানালেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। রঞ্জনবাবুর ছেলেই তো আত্মহত্যা করেছিল। ঐ বাড়ি নিয়েই তো যত অপবাদ। কেউ টিকতে পারে না।”
সৌমিত জিজ্ঞাসা করে, “কাকিমা, কাইন্ডলি একটু ডিটেলসে বলবেন?”
মালিকের স্ত্রী বলতে আরম্ভ করলেন,– “ছেলেটি যতদূর জানতাম একটু পাগলাটে গোছের ছিল। তাই ওর কিছু হয়নি। হাজার বলা সত্ত্বেও না করেছিল বিয়ে না করত কোনও কাজ। রাতদিন খালি নেশা করে একে ওকে তাকে জ্বালিয়ে কাটাত। বাপের থেকে খালি টাকা চাইতো। সেই নিয়ে বাপ ও ছেলের খুব ঝগড়া হত। ছেলে মারা যাবার বছর দশেক আগে রঞ্জনবাবুর স্ত্রীও মারা যান। শেষের দিকে ছেলেটা আরও বিগড়ে যাওয়াতে বাপে ও ছেলের মধ্যে এতটাই ঝগড়া হত যে পাড়া মাথায় উঠত। তা, একদিন হঠাৎ করে শুনলাম ছেলে ফ্যানে দড়ি লাগিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। ছেলের আত্মহত্যার পর রঞ্জনদাও ঐ বাড়ি ছেড়ে পাশের একটা ফ্ল্যাটে চলে যান। এরপর, একজন দম্পতি ভাড়াটে ছিলেন বটে তবে তাঁরা বেশিদিন থাকতে পারেননি। তাঁরাও নানান অভিযোগ করেছিল। তারপর বহুদিন ভাড়াটে ছিল না ওই বাড়িতে। মাঝে কোভিডের সময় তো বন্ধই ছিল। এই কয়েক মাস পর তুমি এলে।”
দোকানের মালিক এবার বললেন, “হ্যাঁ, মনে পড়লে এবার। আগের ভাড়াটে ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রীও বলতেন ঐ বাড়িতে থাকা যায় না। কার যেন ছায়া ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। বাথরুমের জল খোলা থাকে, জানলা ও দরজায় নানা ধরণের আওয়াজ হয় ইত্যাদি।”
দোকানের মালিকের স্ত্রী বললেন, “তুমিও বাবা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও। নয়তো তোমার শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। ঐ প্রেতাত্মা খুব জ্বালায়।”
সৌমিতের বেশ ভয়ে ধরে যায়। বাড়িতে এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ মাঝ রাতে এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে যে সিলিং ফ্যান থেকে দড়িতে কে যেন ঝুলছে। হঠাৎ, ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সৌমিত। না, কোথাও কেউ নেই। জল খেয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না কিছুতেই। এভাবেই ভোর হলে সৌমিত উঠে মর্নিং ওয়াকে বেড়োয় তাতে মনটা হয়তো ভালো থাকবে। আজ অফিস করে কাল ছুটি নিয়ে ঐ ভাড়া বাড়িতে চলে যেতে হবে। সব কথা বলাই আছে। মাসও শেষ হতে চলল। এর মধ্যে যা করার তাই করতে হবে। পরদিনের ছুটি মঞ্জুর হল। সামান্য জিনিস আছে বেশিক্ষণ লাগলো না শিফ্ট করতে। তারপরের দিন শনিবার– মাসের শেষ তারিখ। সৌমিত বাড়িওয়ালাকে মাসের টাকাটা দিয়ে আসল।
এবার এই ভূতের বাড়ি ছাড়তে হবে। ছাড়ার সময় যখন সদর দরজায় তালা আটকে সৌমিত চলে আসছিল তখন জোড়ে জোড়ে ভেতর থেকে দরজা ধাক্কার আওয়াজ শোনা গেল। সৌমিত এবারও কৌতূহলভরে আবার তালা খুলে দেখে ভেতরে কেউ নেই। এমনকি ভেতরে উঁকি-ঝুঁকি মেরেও কাউকে কোথাও দেখল না। আবার, দরজায় তালা দিয়ে বেড়োচ্ছে এমন সময় আবারও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শোনা গেল। এবার যেন আরও জোড়ে। সৌমিত এবার অবশ্য ভয় পেল না, বরং বেশ সাহস সঞ্চার করে বলল, “এই চোপ্!” ওমনি আওয়াজও থেমে গেল। তারপর সৌমিত দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর নরম গলায় বলল, “বিদায়, ভালো থাকিস। আর কাউকে জ্বালাস না। তুই শান্তি লাভ কর।” তারপর, আর কোনও আওয়াজ শোনা যায়নি। ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসে সৌমিত। তারপর, নতুন ভাড়া বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বলা ভালো, সে বিদায় দেয় ভাড়াবাড়ির অশরীরীকে।
-
ভৌতিক গল্প- জন্মেনজয়ের শ্মশান জাগানো
জন্মেনজয়ের শ্মশান জাগানো
-সুবিনয় হালদারছোটবেলা থেকে বিনয় মেধাবী ছেলে হিসাবে পরিচিত। সাহসী বুদ্ধিমানও বটে। সবকিছু সে যুক্তি দিয়ে বিচার করে তারপর যেটা ঠিক বলে মনে হতো সেটাই করত। এরজন্য তাকে অবশ্য পরবর্তী জীবনে অনেক মূল্য চোকাতে হয়। বিধিবাম, তার হাতে তো সবকিছু ছিলোনা! তাই সে আজো অপাংক্তেয় থেকে গেছে তথাকথিত সমাজ থেকে-, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়পরিজন থেকে কারন অন্যেরা যেখানে রকেট গতিতে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে সেখানে সে তার মূল্যবোধ আঁকড়ে যেই তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গেছে।
নদী লাগোয়া চন্দনপুর গ্রাম ও তার একেবারেই গাঘেঁষা কুন্দনপুর গ্রাম। দুই গ্রামকে প্রধান খাল হতে ভাগ হয়ে যাওয়া পতিত-খাল বিভক্ত করেছে। নোনাজল বয়ে যাওয়ায় খালে মাছ চিংড়ি কাঙড়া ভালোই হতো। ফলে এলাকার প্রচুর মানুষ পাটা মেরে অর্থাৎ বাঁধ দিয়ে, জাল ফেলে, ছিপ ফেলে মাছ চিংড়ি কাঙড়া ধরত সকাল বিকাল। চন্দনপুর আর কুন্দনপুর গ্রামের একেবারে পূর্বপ্রান্তের শেষে যেখানে পতিত-খাল বাঁক নিয়ে বাজারের দিকে চলে গেছে সেখানে একটা শ্মশান আছে। পতিত-খালের পাড় ধরে একটা মেঠো রাস্তা কুন্দনপুর বাজারের ১-নং. গেট হতে চন্দনপুর গ্রামে ঢুকেছে- শ্মশানের ওপর দিয়ে, মুসলিম পাড়া হয়ে আলিদের বাড়ির সামনে কবরস্থানের পাশদিয়ে ঠাকুর-তলায়। রাস্তার একধারে বাঁশবন, বড়বড় খিড়িসগাছ, শেওড়াগাছ, কৎবেল গাছ ও অন্যান্য গাছের ঘন জঙ্গল ঝুঁকে পরেছে খালের দিকে আর তার মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা শুনশান মেঠো রাস্তা। খোরোকালে অর্থাৎ শুকনো মরশুমে গ্রামের অনেক লোকজন দিনের বেলা ওই রাস্তা ব্যবহার করতো। মেঠো রাস্তার ধারে অর্থাৎ শ্মশান যেখানে শুরু হচ্ছে সেখানে একটা ঘর, না ঠিক ঘর-না মন্দির বলাই শ্রেয়! তার ভিতরে মুখ বন্ধকরা তিন চারটে হাঁড়ি! বিনয় একবার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে সেটা দেখেছে এবং গল্পে-গল্পে শুনেছে যে ওই হাঁড়ির কোনো একটার মধ্যে নাকি সুপারি আছে, আর যে ওটাকে ঘোর অমাবস্যাতিথির রাতে হাঁড়ির মুখের ঢাকা সরিয়ে নিয়ে আসবে সে নাকি বিশাল ধনীব্যক্তি হয়ে যাবে! তার অধীনে ভূতের রাজা থাকবে! মন্দিরের পিছনে বৃহৎ এলাকা জুড়ে একটা সুবিশাল বটগাছ। বটগাছের ঝুড়ি নেমে অনেক গুলো মোটা কাণ্ড চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, দেখলে মনে হবে- যেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটা অংশ। খালের এপারে আর-একটা রাস্তা চন্দনপুর গ্রামের ভিতর হতে ঠাকুর-তলা হয়ে কুন্দনপুর বাজারের ঠিক মাঝে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। এই রাস্তার অনতিদূরে মাঠের মাঝখানে অর্থাৎ পতিত-খালের এপারে শ্মশান হতে খুবই অল্প দূরত্বে একটা পোতা ছিলো। উঁচু একটা মাটির ঢিবি। ঢিবিটা বেশ কয়েক মিটার জায়গা জুড়ে। এখানে কোনো নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে মারা গেলে পুঁতে দেওয়া হতো। বড়বড় শিমূল গাছ, নিমগাছ, কদমগাছ, অশ্বত্থ গাছে ভরে ছিলো এই পোতা। গ্রামের গরু ছাগলও মারা গেলে এই পোতার একধারে পুঁতে দিতো গ্রামবাসীরা। লোকে বলাবলি করতো যে গভীর রাতে নাকি এই পোতা হতে একটা আলো ওই শ্মশানে যাতায়াত করে! ভরসন্ধ্যাতেও অর্থাৎ আটটা নটার সময় কয়েকজন গ্রামবাসী নাকি ওই আলো দেখেছে! অনেকে আবার বলে সন্ধ্যার পর প্রায়শই মানুষের মতো কে যেন আওয়াজ করে ডাকে! ঠাকুরতলা থেকে তাস, ক্যারাম খেলে রাতে যখন একা-একা বাড়ি ফিরত বিনয় তখন কয়েকবার সে ওই ডাক শুনেছে! সন্ধ্যার পর তাই ওই রাস্তায় গ্রামবাসীরা খুব একটা হাঁটে-না! বলতে গেলে একদমই কেউ যাতায়াত করতো না । কুন্দনপুর গ্রামে আর বাজারে বৈদ্যুতিকের আলো থাকলেও চন্দনপুর গ্রামে ঢোকার দুটো রাস্তাতে এবং চন্দনপুর গ্রামে কিন্তু তখনও কোনো বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা ছিলোনা! কেরোসিন তেলের হ্যারিকেন লন্ঠন’ই ভরসা, সঙ্গে দু-ব্যাটারি, তিন-ব্যাটারির EVEREADY টর্চ লাইট।
বিনয় যখন জুনিয়র হাই স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে সবে হাই স্কুলে পা রেখেছে, একদিন সন্ধ্যার পর ঠাকুর-তলার খেলার মাঠে বল খেলার পরিসমাপ্তির পর বন্ধুবান্ধবদের সাথে বসে গল্প আড্ডা মারছে এমন সময় কথায় কথায় ডাকু বলল- কুন্দনপুরে শ্মশানের রাস্তা দিয়ে রাতে তেমন কেউ আসা-যাওয়া করেনা ! তোদের মধ্যে কেউ ওই রাস্তা দিয়ে গিয়ে শ্মশানের হাঁড়ি থেকে সুপারি আনতে পারবি ? খুব তো বড় বড় বিঞ্জান- যুক্তিবাদী- সাহসের কথা বলিস! দেখি তোদের কেমন দম! বিনয় বলল- তুই বলে দে কোন্ হাঁড়িটার মধ্যে আছে-, আমি নিয়ে আসছি ! ব্যাস-, সবাই চুপ! কারোর মুখে আর সাড়া নেই! ঠিক তখনই বিবেক স্বরূপ তরুণ বলল- এই না- না- একদম না, ওসব করার দরকার নেই! কোথায় হিতে বিপরীত হয়ে যাবে- এসব আলোচনা ছাড়। ডাকু একটু গ্যাঁ গুঁ করে বলল- আচ্ছা ওটা থাক্ তবে তুই আমার এই গামছাটা শ্মশানে ফেলে আসতে পারবি ? তাহলে জানবো তোর কলজের জোর আছে ! বিনয় বলল- যদি পারি তবে তুই সবাইকে রসগোল্লা খাওয়াবি ? ডাকু বলল- হ্যাঁ খাওয়াবো। থমথমে গুমোট আবহাওয়ায় হঠাৎ মাঠে একটা ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া ধুলোবালি উড়িয়ে বয়ে গেলো! গুনো বলল- দ্যাখ, তোদের কথা ওখানে পৌঁছে গেছে! আমি ভাই এসবের মধ্যে নেই! ভাণ্ডু তোতলাতে তোতলাতে বলল- বি-বি- বিনয়, বা-বা-বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কি-কি-কিন্তু! বিনয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল- তু-তু-তুই থাম্ ? ঠিক আছে, আমি একটু ঘর থেকে ঘুরে আসছি, তোরা কেউ যাবিনা এখানেই থাক্। বলে সটান ঘরে গিয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেস হয়ে নিলো। তারপর এক কাপ চা খেয়ে একটা দু-ব্যাটারির টর্চ পকেটে পুরে তৈরী হয়ে সোজা ঠাকুরতলাতে হাজির। তখন সবাই সেখানে উল্টোপাল্টা কথা বলাবলি করছে। বিনয় এসে তাদের সাথে যোগ দিয়ে ডাকুকে বলল- দে গামছাটা দে। মিনমিনে সঙ্গে-সঙ্গে বত্রিশপাটি বের করে বলে উঠল- কীরে বিনয়, ঘরে থেকে তাবিজ-ফাবিজ নিয়ে এলি না-কি ? তা বেশ! তাহলে কী ভাবলি মানে আদৌ চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছিস তো বন্ধু ? না-কি- শুধুই লম্বা-চওড়া কথা বলে বাজিমাত করে দিতে চাইছিস! সবাই তখন এ-ওর মুখ দেখাদেখি করে বিনয়ের দিকে তাকাচ্ছে।
ডাকুর কাছ থেকে টাকলু মামা গামছাটা নিয়ে একটু তিরস্কার একটু অবহেলার হাসি হেসে বিনয়ের হাতে গামছাটা দিলো আর বলল- দেখিস ভাগ্না সাবধান- Best of Luck। ততক্ষণে এই ব্যাপারটা অনেকেই জেনে গেছে। বিনয় গামছা নিয়ে ঠাকুরের দিকে মুখ করে একটা প্রণাম ঠুকে রওনা দিলো। ঠাকুর ঘরের দালানের ঘড়িতে তখন রাত আটটার ঘণ্টা বাজছে।
ঘন-অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেছে। শুধু দূরে গাছপালা ঝোপঝাড়ের ফাঁক থেকে দু-একটা বাড়ির লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো চোখে পড়ছে! ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর মাঝে-মাঝে জোনাকির আলো এলাকার চারপাশ মায়াবী করে তুলেছে। বিনয় আলিদের কবরস্থানের কাছাকাছি যখন দূরে থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে এলো আর সঙ্গে সঙ্গে আলিদের পাড়ার কুকুরদের সদলবলে চিৎকার। কবরস্থান অতিক্রম করে বিনয় হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। আজিজদের ঘর টপকে বিনয় পতিত খালের মেঠো রাস্তায় উঠতেই গামছাটা বাম হাতে তাল করে মুঠো করে নিলো আর ডান হাতটা পকেটের টর্চ লাইটে রেখে এগোতে থাকলো। বাঁশ বনের কাছাকাছি আসতে বিনয়ের গা-টা যেন ছ্যাঁক করে উঠল! শীতল হাওয়ার স্পর্শে সমস্ত শরীরের লোমকূপ কাঁটা মেরে শিহরণ দেওয়ার সাথে-সাথেই হঠাৎ সামনে থেকে একটা কালো ছায়া রাস্তা পার হয়ে দ্রুতবেগে বিচ্ছিরী শব্দ করে চলে গেলো! বিনয় থমকে দাঁড়ালো। তখনি সে যেন টের পেলো তার আশেপাশে অন্য কিছুর উপস্থিতি! বাঁশ গাছের হেল-দোল, শেওড়াগাছ খিড়িসগাছ কৎবেল গাছে দৌড়ঝাঁপ ! ভয় একটু পেল ঠিকই কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। নিজেকে নিজে বোঝাতে লাগলো মনেমনে। এইসব সাতপাঁচ ভাবছে আর খুব ধীরগতিতে একটু একটু এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় বিনয়ের মনে হলো কেউ যেন উল্টো দিক হতে হেঁটে আসছে তার দিকে! বিনয় ভাবল যাইহোক একজনকে অন্ততপক্ষে দেখতে পাওয়া গেলো। শোনা কথা বেশীরভাগই যে ভুল হয়, আজ সে তার চাক্ষুষ প্রমান। বিনয়ের মনের জোর একটু বেড়ে গেলো। আবছা অন্ধকারে এগিয়ে চলা বিনয় কিছুতেই বুঝতে পারছেনা মূর্তিটা আদৌ আসছে না দাঁড়িয়ে আছে! মনে খটকা লাগলো! একবার ভাবল টর্চ লাইটটা বের করে মারবে! পরক্ষণে মনে হলো না- থাক্। এরই মধ্যে মূর্তিটা কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছেনা আসলে এটা কে ? এমনকি মূর্তিটার সাথে যখন তার পাশ কাটাকাটি হচ্ছে তখনো না! প্রবল ইচ্ছেতে জিগ্যেস করতে গেল- কে সৌগৎ চাচা ? কিন্তু বিনয়ের গলা থেকে কোনো আওয়াজই বের হলোনা, আশ্চর্য! পিছনে তাকানো বারণ এটা সে ঠাকুরমশাই এর কাছে শুনেছে। তাই সে সম্মুখ পানে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে কী ছিলো ওটা! প্রকৃত মানুষ নাকি শুধুই ছায়া! খানিকক্ষণ পর আবার ধীর-স্থির মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগিয়ে চলল বিনয়। শ্মশানের কাছাকাছি সবে সে এসেছে এমন সময় বিনয় দেখল- যেন কেউ খালে জাল ফেলছে! অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা ঠিকই কিন্তু জাল ফেলার শব্দটা সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে! আরো কাছে আসতে সে খালের নীচে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেল! না দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসতেই ডানহাতি শ্মশান আর সেই মন্দির। বিনয় চকিতে একটিবার তাকিয়ে বাম হাতে তাল করা সেই গামছাটা খালের দিকে হাল্কা করে ছুঁড়ে দিলো। সে দেখল খালের ধারে বড়বড় উলু-ঘাসে সেটা আটকে গেছে, জলে পরেনি। ঠিক তখনি শুনতে পেল সেই আওয়াজ- আয়- আয়-! বিনয়ের সাড়া শরীর ঝাঙ্কার মেরে উঠলো। প্রচণ্ড ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে সে। কান মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি এক দৌড়ে কুন্দনপুর বাজারে পালাবে! পরক্ষণে মনে হলো- কী সব ভুলভাল ভাবছে- শুনছে- সে! একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে পুনরায় ওই আওয়াজটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সে আওয়াজটা পরিষ্কার আবার শুনতে পেলো! এবার তার মনে হলো কেউ যেন মন্দিরের ভিতর হতে আওয়াজ করছে! একবার সে ভাবল- গিয়ে দেখবে আসলে ব্যাপারটা কী! কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো না থাক্! দোটানায় সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো। কিন্তু তার মতো একজন যুক্তিবাদী ছেলে এতো কাছে এসে এভাবে হেরে যাবে ? তাই ভয়ে ভয়ে অদম্য সাহসের ওপর ভর করে সে মন্দিরের দিকে গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে থাকলো আর পকেটের টর্চ লাইটটা বের করে ডান হাতে শক্ত করে বাগিয়ে ধরল। মন্দিরের যতো কাছে সে যাচ্ছে ততোই স্পষ্ট হতে লাগলো আওয়াজ! গুটি-গুটি পায়ে সে মন্দিরের সিঁড়িতে উঠে খুব আস্তে দরজার একটা পাল্লা ঠেলে যেই টর্চ লাইটটা জ্বেলেছে অমনি একজন জমকালো ভুঁড়িওয়ালা উলঙ্গ মূর্তি তার দিকে বড়বড় নাটানাটা চোখ করে কটমট করে তাকিয়ে আছে! আলোর ছটা তার চোখেমুখে পরতে বিনয়ের তো আত্মারাম খাঁচা! একি ? এতো আমাদের কুন্দনপুরের জন্মেনজয় মামা! বড়বড় চুল দাড়ি আর সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেড়ায়। বিয়েথা করেনি। লোকে অনেকে অনেক কথা বলাবলি করতো তাকে নিয়ে! কিন্তু এখানে এভাবে তাকে দেখবে, বিনয় কল্পনাও করতে পারেনি! হয়তো তিনি-ও তাই! সেই মুহূর্তে কিছু বুঝে ওঠার আগে বিনয় আমতাআমতা করে বলে উঠলো- জন্মেনজয় মামা-, তুমি-? উল্টো দিক হতে গম্ভীর কন্ঠে উত্তর এলো-, হ্যাঁ- আমি-। তুই এখানে কী করছিস ? বলতে বলতে এক কোনে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে ফেলে রাখা ধুতি পাঞ্জাবী পরছে-, বিনয় দেখল এটাই সুযোগে। ভাবা যা কাজ তা- সবে হাঁড়ির ঢাকা সরাতে যাবে হঠাৎ তার হাতটা কে যেন চেপে ধরল! বুকটা ধক্ করে উঠল- ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জন্মেনজয় মামা। বিনয়কে টেনে এনে মন্দিরের সিঁড়িতে বসলো তারপর বলতে লাগলো- বিনয়, ওই যে চারটে হাঁড়ি দেখলি, এর কোনো একটার মধ্যে সুপারি আছে কিন্তু সেটা আমিও জানিনা। আজ আমি দশটা বছর ধরে সাধনা করছি, শুধু কোন্ হাঁড়িটার মধ্যে সেই সুপারিটা আছে সেটা জানবার জন্য! কারন যদি আমি সুপারি বিহীন হাঁড়ির ঢাকা খুলে ফেলি আমার মৃত্যু অবধারিত! তাই আমি প্রতি রাতে শ্মশান জাগাই! ভূত প্রেতদের সর্দারকে তুষ্ট করতে! আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে তোর মতো দেখেনি ভাগ্না। সত্যি তোর বুকেরপাটা আছে। তুই আমাকে কথাদে ভাগ্না-, এই তোর হাত ধরে আমি বলছি- তুই যে আজ আমাকে এভাবে দেখলি কাউকে বলবিনা-। বিনয় বলল- ঠিক আছে বোলব-না। দেখ্ ভাগ্না, তু্ই কিন্তু এই অমাবস্যার রাতে শ্মশান মন্দিরে দাঁড়িয়ে কথা দিলি। বিনয় বলল- আচ্ছা জন্মেনজয় মামা, এই যে সবাই বলে ভূত প্রেত ; আদৌ কী এগুলো বাস্তবে আছে ? জন্মেনজয় মামা শান্ত নম্র স্বরে বলল- আছে আবার নেই-ও! পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে যে জয় করতে পারবে তার কাছে সবই তুচ্ছ। আজ আর সাধনা হবেনা। তুই এগিয়ে চল্ আমি সব গোছগাছ করে পরে আসছি।
বিনয় যুুদ্ধ জয়ের মেজাজে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে কুন্দনপুর ১-নং. গেট হয়ে বাজারে এসে পৌঁছল যখন তখন রাত বেশ অনেকটা হয়ে গেছে। বিনয়ের ফিরতে অনেক দেরি হচ্ছে দেখে ডাকু বিবেক ভাণ্ডু স্বরূপ কুন্দনপুর বাজারের কাছাকাছি দলবেঁধে লাইট হাতে এগিয়ে এসেছে। সামনাসামনি হতেই সবাই একটা স্বস্তির হাসি হেসে ডাকু বলল- তুই একদম বিচ্চু ঢ্যামনা ছেলে। এখানে বসে সময় কাটিয়ে আমাদেরকে বোঝাচ্ছিস তুই শ্মশান ঘুরে গামছা ফেলে তর্কে জিতে যাবি! ওসব রসগোল্লা ফসুগোল্লা হবেনা এই বলে দিলুম। তখন ভাণ্ডু তোতলাতে তোতলাতে জিগ্যেস করলো- কী-কী-কী-রে বিনয়, ভূ-ভূ-ভূ- ভূত দে-খেছিস ?
-
ভৌতিক গল্প- ভূত
ভূত
-মানিক দাক্ষিত১৯৭৩ সালের কথা। বেশ মনে পড়ে সেদিনটা ছিল শীতকালের অমাবস্যার রাত। সময় প্রায় রাত দশটা। হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। হাতে অগাধ সময়। আমরা ছয় বন্ধু মিলে ক্লাবঘরে খোসমেজাজে লণ্ঠনের আলোয় আড্ডা দিচ্ছি। প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁ। তখন ইলেকট্রিসিটির কথা ভাবাই যায় না। উচ্চ মধ্যবিত্তদের হ্যরিকেন, গরীব মধ্যবিত্তদের লণ্ঠন আর খেটে খাওয়া গরীব মানুষদের ঘরে
লম্ফ বা কুপীই ছিল রাতের আলো। বিভিন্ন পূজো-পার্বন, উত্সব, অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোর উত্স ছিল হ্যাজাক বা ডে-লাইট।পাড়া গাঁয়ের দশটার রাত মানেই গভীর রাত।শুনশান। বাইরেটা যেন নিকষ কালো অন্ধকার চাদরে ঢাকা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে রাতটাকে কেমন যেন এক অদ্ভূত রহস্যময়ী মায়াবী নি:স্তব্ধ আর একাকী করে তুলেছে। আড্ডা দিতে দিতে হঠাত্ তর্ক বেধে যায় কালুর সাথে বিশুর। তর্কটা বাধে ভূত নিয়ে। কালু বলে, ভূত বলে কোনো জিনিস আছে–আমি বিশ্বাসই করি না।
বিশু গলা ফাটিয়ে চীত্কার করে–আলবত্ ভূত আছে। আমি নিজের চোখে ভূত দেখেছি। আমাদের
দিকে তাকায়–কিরে তোরা ভূত বিশ্বাস করিস?
আমার আবার ভূতের ভীষণ ভয়। আমরা সবাই মিলে বিশুর মতকেই সমর্থন করি। কালুর
মুখে অবজ্ঞার হাসি—একমাত্র গাঁজাখোর আর যারা ভীতুর ডিম, তারাই বিশ্বাস করে ভূতকে।
বিশু তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে—জানিস, অমাবস্যার রাতে ব্রহ্মদত্যি,ভূত, পেত্নি, শাঁকচুন্নী- দের দেখা মেলে!কালুর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের সুর—“বেশ তো, আজ তো অমাবস্যা! দেখা না তোদের ভূত প্রেত
ব্রহ্মদত্যিকে। আমি তৈরী। বল কোথায় যেতে হবে। আমি যেতে রাজী।”
বিশু চীত্কারে গলা ফাটায়—“সোনাডাঙার মাঠে ঘোলগোড়ে কুকুরবাঁদি পুকুরের পাড়ে যে বুড়ো
বটগাছটা আছে, তার তলায় যেতে পারবি?”কালু দৃঢতার সাথে উত্তর দেয়—পারবো।
আমরা প্রমাদ গুনি। বুকটা কেঁপে ওঠে। বলে কি কালু! এ-তল্লাটের সবাই জানে ঘোলগোড়ে
কুকুরবাঁদি কি ভয়ংকর জায়গা! নাম শুনলেই ভয়ে প্রাণ আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। সন্ধ্যের পর
ঐ পথ মাড়াতে কেউ সাহস পায় না। কত যে মানুষ ঐ বুড়ো বটগাছটায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, তার ইয়ত্ত্বা নাই। কয়েকমাস আগেও মেটে পাড়ার নিধিরাম দিনদুপুরে গলায় দড়ি দিয়ে মরলো। জনশ্রুতি আছে–একবার যদি কেউ মরার কথা উচ্চারণ করে, তার আর রক্ষে নাই! ঐ বুড়ো বটগাছ তাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। শেষ পরিণতি–গলায় দড়ি দিয়ে তার মৃত্যু। বুকটা আমার কেঁপে ওঠে। বারণ করি কালুকে।
—অত সাহস ভাল নয় কালু। কোথা দিয়ে কি অঘটন ঘটে যাবে, বলা যায় না। সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার কি দরকার!কালু ঝেঁঝিয়ে ওঠে— থামতো! ভীতুর ডিম কোথাকার!
বিশু চোখ টিপে বিষয়টা চেপে যেতে বলে। আমি চুপ করে যাই।
কালু হাত বাড়ায়—বাজী রাখ, যদি যেতে পারি, কি দিবি?
বিশু সপাটে কালুর হাতে হাত লাগিয়ে বলে– একটা গোটা খাসি। আর যদি না পারিস? মরে
যাস?—মরে গেলে তো কথাই নাই। গেলাম। যদি না পারি, হেরে যাই, তাহলে আমিও দেবো গোটা
খাসি।
তর্কটা জমে উঠল। বিশু বলে–তুই যে সত্যিই রাতের অন্ধকারে ওখানে যাবি, আমরা বুঝবো
কি করে?
—বিশ্বাস!
“বিশ্বাসে কাজ নাই ভাই” বলে বিশু ঘর থেকে বেরিয়ে একছুটে বাড়ী থেকে মস্ত বড় একটা
লোহার গজাল আর হাতুড়ী এনে কালুর হাতে ধরায়, -এই গজালটা তুই বটগাছের গোড়ায় পুঁতে
আসতে পারলেই জানবো তুই গেছিস।–কুছ পরোয়া নেহি–বলে শীতের চাদরটাকে ভাল করে গায়ে জড়িয়ে কালু অন্ধকারে বেরিয়ে
যায়।ভয়ে আমাদের হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে যাবার যোগাড়। মুখে কথা নাই। বিশুর দিকে
তাকাতেই দেখি বিশুর চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি। বলে–“বেচারী একা। সতর্ক থাকা দরকার।
জায়গাটা ভাল নয়। তোরা টর্চ নিয়ে পিছন পিছন আয়। আমি চললাম” —বলে এক নিমেষে
এই কনকনে শীতের রাতে শরীর থেকে জামা- প্যাণ্ট খুলে বগলে ভরে একেবারে উদোম গায়ে
দে ছুট।দেরী না করে আমরা চারজন পাঁচ ব্যাটারির দুটো টর্চ নিয়ে রওনা দিলাম সোনাডাঙার দিকে।
আমরা চারজন, সাথে দুটো পাঁচ ব্যাটারির টর্চ– তবুও ভয়! কি হয় কি হয়! গা ছম ছম করছে।বটগাছটার কাছাকাছি আসতেই কানে ভেসে এল একটা বিশ্রী গোঙানির শব্দ। টর্চ জ্বালতেই
আমরা হতভম্ব। ভয়ে শিয়রে উঠলাম। বিধ্বস্ত চেহারায় কালু বটগাছের তলায় পড়ে গোঙাচ্ছে।
সাড়া শব্দ নাই। দু-চোয়াল বেয়ে বইছে সমুদ্রের ফেণার মত গ্যাঁজলা। শীতের চাদরটা গায়ে নাই, বটগাছের গোড়ার কিছুটা উপরে আটকানো। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি বিশু হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। পরনে শার্ট-প্যাণ্ট।বললাম–কোথায় গিয়েছিলি আর এখন কোথা থেকে আসলি?
কোন কথার উত্তর না দিয়ে বিশু দৌড়ে গিয়ে কালুর শীতের চাদরটাকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে
নেয় গাছ থেকে। তারপর পুকুর থেকে দুহাতের আঁজলা করে জল এনে কালুর চোখে মুখে
ছেটায়। গোঙানি বন্ধ হয়। কালু চোখ মেলে তাকায়। চোখে মুখে তার বিশাল আতঙ্কের
ছায়া।জিগ্যেস করি, কি হল?
আতঙ্কে আমায় চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। বলে, আগে আমায় এখান
থেকে তোরা নিয়ে চল। বাড়ী গিয়ে সব বলবো।বাড়ী এসে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হলে কালু বলতে আরম্ভ করলো–“তোদের কথা না
শুনে এঁড়েমি করে মস্ত বড় ভুল করেছি রে আমি। সত্যিই জায়গাটা বড় ভয়ংকর! ভূত, পেত্নী ব্রেহ্ম-
দত্যির এক্কেবারে আড়ত্। কেবল ওখানে ছোটাছুটি আর দাপাদাপির শব্দ। প্রাণ একেবারে শুকিয়ে যায়।
ভাগ্যিস তোরা আমার পিছু পিছু গিয়েছিলি, তাই এ-যাত্রায় বেঁচে গেলাম। নইলে মরে কাঠ হয়ে পড়ে
থাকতাম।”
বিশু আমাদের দিকে ঈষত্ বাঁকা চোখে তাকিয়ে কালুকে জিগ্যেস করে, “কি দেখলি, সেটা বল!”
কাঁপা কাঁপা গলায় কালু বলে, “বলতে পারবো না, ভয়ংকর দৃশ্য। ভাবলে এখনও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
তোর দেয়া লম্বা গজালটা বুড়ো বটগাছটায় পুঁতেছি কি–দেখি ছোটো খাটো একটা তালগাছের মতো
একটা ন্যাংটা ভূত বটগাছের উপর থেকে আমার
সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমি ভয়ে দৌড়ে পালাতে যাবো–দেখি কে যেন আমার চাদরটাকে
টেনে ধরেছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। ভিরমি খেয়ে ওখানেই পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু
আমার মনে নাই। সেটা তোরা বলতে পারবি।”বিশু গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করে, “এবার বল, ভূত আছে কি নাই ?”
নিজের দুই কান ধরে তড়িত্ গতিতে কালু উত্তর দেয়, রাম রাম রাম। সে আবার বলতে, ওনারা
আছেন। অবিশ্বাসের কোনো জায়গা নাই। নিজের চোখে আজ আমি ভূত দেখলাম।”অপারেশন সাকসেসফুল! বিশুর চোখে-মুখে যুদ্ধ জয়ের এক পরিতৃপ্ত হাসি।
সেদিন ছোটোখাটো তালগাছের মতো যে একটা ন্যাংটা ভূত কালুর সামনে হুমড়ী খেয়ে পড়েছিল, আসলে সেটা ভূতও নয়, পেত্নীও নয়, সেটা ছিল ডানপিটে ডাকাবুকো দুষ্টু পাজী অদম্য সাহসী ঐ যুবক বিশু। শীতের রাতে উদোম গায়ে অকুস্থলে কালু পৌঁছানোর আগেই সে ঝড়ের
গতিতে ওখানে পৌঁছে বটগাছের উপরে বসেছিল। কালু গজাল পোঁতার সময় হনুমানের মতো ওর
সামনে লাফিয়ে পড়েছিলো। আর কালুর শীতের চাদর কেউ টেনে ধরেনি।
কালু নিজের অজান্তেই চাদরের একপ্রান্ত নিজেই গজালের সাথে পুঁতে ফেলেছিলো। -
ভৌতিক গল্প- দুর্ভিক্ষের পরে
দুর্ভিক্ষের পরে
-ইন্দ্রনীল মজুমদার
“আমার নাম নীলকমল রায়চৌধুরী। আমার বাড়ি কলকাতার গড়িয়াহাটে। নানা অজ গ্রামে ঘুরে বেরানো বলা যেতে পারে আমার এক অভ্যাস। আমাকে ‘ভবঘুরে অভিযাত্রী’ ভাবলে চলবে না কারণ আমি ভবঘুরে নই। বাড়ির লোকের মুখে শুনেছিলাম যে পূর্বে আমরা জমিদার ছিলাম। তাই, বাংলার জমিদারের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সংকলন করা আমার এক নেশা। বলতে পারা যায়, এই বিষয়ে আমি একজন গবেষক। অন্তত দু’শোর মতো জমিদার বাড়ি দেখেছি দুই বাংলা জুড়ে। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে, অ্যাপের যুগে আমি যা তথ্য পেয়েছি এইসব যান্ত্রিক সহায়তায় তার থেকে বেশি পেয়েছি লাইব্রেরীতে পুরনো বই, কাগজপত্র, নথি ঘেঁটে। ভাবছি এরইমধ্যে ‘www.bengalizamindars.in’ নামে একটি ওয়েবসাইট বা জালাধান খুলব। পরে বছরের মধ্যে এই বিষয়ের উপর একটি বই প্রকাশ করব। প্রকাশকের সাথে কথা চলছে। বছর তিন-চারেক আগে শান্তিপুরের একটি জমিদার বাড়ির খবর পেয়েছিলাম বন্ধু স্বাগতর কাছে। গ্রামটি যে কোথায় তা ঠিক বোঝানো যাবে না। তবে কাঁথি থেকে অনেকটা গিয়ে তারপর এই গ্রাম পড়বে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে রওনা হয়েছিলাম। তা পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা হয়ে গেল। দেরি হয়ে গিয়েছিল কারণ ট্রেন মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সিগন্যালের গন্ডগোলের জন্য। তা একদিকে ভালোই হলো কারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা রাতে ভালো অনুভব করা যায়। তা জমিদার বাড়িতে যে রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটি এখন বলার অপেক্ষা। যাইহোক, প্লাটফর্মে নামলাম কোনোরকমে। কারণ ট্রেন থামতেই সমস্ত লোক হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। দেখলাম একটি মহিলা দোকান বন্ধ করছে। তার কাছে গেলাম। তাকে ডাকলাম, “এই যে শুনছেন….”। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আজ্ঞে। বলুন আমি এই দোকানের চাওয়ালি।”
– বেশ। তা এখনই দোকান বন্ধ করছেন।
– হ্যাঁ। রাত হয়ে গেছে। রাত্রি আটটার পর এতল্লাটে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলাম, “তা এত তাড়াতাড়িতে?”
– আজ বাবু জ্যোৎস্নার রাত। তাই……। তা আপনি যাবেন কোথায়?
-যোগীন্দ্রনাথ জমিদারের বাড়ি। শুনেছি বাড়িতে আজও আছে তাই সেটি দেখার বড়োই ইচ্ছে।
মহিলাটি হঠাৎ আচমকাই চমকে উঠে বললে, “রাম রাম। আর কোথাও যাবার জায়গা পেলেন না। শেষে কিনা…..” কথাটি শেষও করলো না তাড়াতাড়ি পালালো।
ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক মনে হলো। একটা পুরনো জমিদার বাড়ির নাম শুনে ওই মহিলার এরকম হলো কেনো? কে জানে? এরপর দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একটি আলো প্ল্যাটফর্মের ওদিকে দেখা যায়। আমি সেই আলোর দিকে এগোই এবং দেখি একটি ভ্যানরিকশা। আমি থামাবার ইঙ্গিত করি। সেটি থামে। দেখি অল্পবয়স্ক এক রিকশা চালক। সে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবেন বাবু?”
– আমি কলকাতার লোক। শুনেছি এখানকার এককালের ডাকসাইটে জমিদার শ্রীযোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাড়িটি আজও নাকি আছে।
চালকটি হঠাৎ ভয় ভয় ভাব নিয়ে বলে ওঠে, “তা তো আছেই। আপনাকে গাঁয়ে আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু খামোকা সেখানে যাবেন কেন?”
– এমনি দেখার জন্য এসেছি। তোমার নাম কি?
-যে আজ্ঞে অম্লান। অম্লান বারুই।
-তা বেশ। রাত্রি আটটার পর এখানে সব ফাঁকা হয়ে যায়। ব্যাপার কি? আর তোমার মুখ জমিদার বাড়ির নাম শুনে শুকিয়ে গেল যে!
অম্লান এবার হেসে বলল, “আজ পূর্ণিমার রাত কি না। আমিও ন’টার পর আর চালাব না।”
আমি হেসে বলি, “পূর্ণিমার রাত তো কি হয়েছে?”
-বুঝবেন বাবু, বুঝবেন। সময় হলে সব বুঝবেন। আমি মুখ্যু মানুষ। আমি আপনাকে আর কি বুঝাব? বরং এখানকার আর্য তরফদার বলতে পারবে।
-কে তিনি?
-গ্রামের বয়স্ক মানুষ। পণ্ডিত লোক। নিজের স্কুল আছে। নামী স্কুল। উনি অনেক পুরনো কথা জানেন।
রিকশা চলতে থাকে ক্ষেতের মাঝপথ দিয়ে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোই যা ভরসা। জব্বর সুন্দর দৃশ্য তৈরি করেছে এই জোৎস্না। এই ‘Romantic moments’-কে কিনা এরা দোষ দেয়। গাঁয়ের লোক হয়তো কুসংস্কারী। একটু পরে রিকশা থামে।
অম্লান বলে উঠলো, “বাবু, এইটে জমিদার বাড়ি। ত্রিশ টাকা দেন।”
আমি ভাড়া মেটাই।
অম্লান জিজ্ঞেস করে, “বাবু, এখানে থাকবেন কোথায়? এখানে তো কেউ থাকে না। এই রাত্তিরে টর্চ, দেশলাই, খাবার সব আছে তো?”
আমি হেসে জানাই যে-“সব আছে আর সঙ্গে কার্বলিক অ্যাসিড-ও আছে। এর ফলে সাপের কোনো ভয় থাকবে না।”
বাড়িটাকে দেখলাম এতক্ষণে। সর্বাঙ্গ ভেঙে পড়েছে এমনকি গেটটাও। বাড়িটা বড়োই রহস্যময় ও বিচিত্রময় বলে মনে হল কেন জানি না।
অম্লান বলে উঠলো, “এখানে রাত্রে দোকান পাবেন না তাই আমার বাড়িতে খাবেন না হয়।”
-আচ্ছা। আমার সার্ভে করতে ঘন্টাখানেক লাগবে। তারপর না হয় এসো।
-আচ্ছা বাবু। তবে যাই। সাবধানে থাকবেন। হরি হরি….
বুঝতে পারলাম না কেন অম্লান সাবধানে থাকতে বলল। হয়তো রাত বলেই। তা যাক গে। আমার কাজ শুরু করা যাক। বাড়িটাকে দেখলাম বেশ পুরনো বাড়ি। তাছাড়া কতকাল যে কারুর চরণের ধুলো পড়েনি তা কেবল ভগবানই জানেন। ক্যামেরা ছিল তা দিয়ে একখানা ছবি তুললাম বাড়িটার। এরপর গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। গেটে মরচে পড়ে গেছে। সামনের সিংহ মূর্তিগুলোও ভাঙ্গা। ভেতরে ঢুকলাম। এমনিতে অন্ধকার হলেও জ্যোৎস্নার আলোয় বাড়িটাকে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে। পেটের খিদের জ্বালাটা বেশ বেড়ে গিয়েছিল, তাই বাড়ির থেকে আনা টিফিন খেয়ে নিলাম। খেয়েও মনে হল খিদেটা এখনো মেটেনি। যাক অম্লানের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারা যাবে খন। তারপর সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর দরজায় অল্প ঠেলা দিতেই আচমকা একটা ‘খ্যাঁচ’ করা আওয়াজে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আমি অবাক। দেখলাম মোমবাতি রাখা আছে। মেঝেতে খান কয়েক বস্তা। আশ্চর্য ব্যাপার!
বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। এমন সময় হঠাৎ বাইরে কুকুরের তারস্বরে চিৎকার উঠলো। কি ব্যাপার? এমন সময় মনে হলো যে দমকা হাওয়া বাইরে থেকে এসে পেছনে লাগল। ঠিক তখনই রোম-খাঁড়া হয়ে যাওয়া এক ঘড়ঘড়ে গলায় অচেনা ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
– মহাশয়ের বুঝি কলকাতা থেকে আসা হয়?
আমি শিহরিত হয় চমকে পিছনে ফিরে বলি- “হ্যাঁ।”
দেখলাম অচেনা ব্যক্তিটি পৌঢ়। বয়স আনুমানিক ষাট। পরণে ধুতি-পাঞ্জাবী। পায়ে নাগরাই চটি। বেশভূষা তো জমিদারের মতোন। তবে কণ্ঠস্বর ভারী রহস্যময় এবং চোখ দুটো বড়ো বড়ো এবং রহস্যময় ও ভূতুড়ে ভাব স্পষ্ট।
আমি ভয় ভয় জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কে?”
-আমি এখানেই থাকি। আজ রাত্রে এলাম। আসলে পূর্ণিমা রাতে আমি আসি। আজ নয় বহুদিন…….
আমি কথা থামিয়ে ভয় ভয় জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু লোকে যে বলে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। অনেকদিন আগে জমিদার যোগীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। তাঁর পরিবারও কেউ নেই। আর থাকলেও আপনি কেবল পূর্ণিমার রাতে আসেন কেন?
-মায়ায়। হ্যাঁ, বড়ো মায়া। এই বাড়িতে লোক আছে। গাঁয়ের লোক সব বাজে কথা বলে। বিশ্বাস যদি না হয় তবে আসুন আমার সাথে। সব দেখলেই বুঝতে পারবেন।
লোকটির কথা বড়োই অদ্ভুত। আমি ওঁর সাথে বাইরে গেলাম। আর গিয়েই চমকে উঠলাম। একি! এ যে নতুন ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। সিংহমূর্তি দুটোও অক্ষত। বাইরে এক পুরোনো মডেলের গাড়ি। কোথায় সেই ভাঙা বাড়ি? কোথায় মরচে ধরা গেট? এই ভদ্রলোক কি জাদুকর? না আমারই মনের ভুল? না দিবাস্বপ্ন? দিবাস্বপ্ন যে আমি দেখছি না তা হলফ করে বলতে পারি।
-বুঝতে পারবেন না মশাই। যা দেখেছেন সবই সত্যি।
-বটে। (আশ্চর্য হলাম উনি আমার মনের কথা ধরতে পেরেছেন দেখে)
অচেনা ব্যক্তি এবার দুঃখের স্বরে বললেন, “কি জানেন আমার ছেলেটা আমারই সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আমার গুদামের সমস্ত চাল, ডাল বিলিয়ে দেয় কাঙাল বা না খেতে পারা লোকেদের।”
-কবে?
-কেন দুর্ভিক্ষের সময়, মন্বন্তরের দিনগুলিতে…..
আমি চমকে ঢোক গিলে বললাম, “মানে, ১৩৫০ বঙ্গাব্দে বা ১৯৪৩ সালে?আপনি এতোকাল আগে……
– ভাবছেন মশকরা করছি। সাহেবদের সাথে আমার ভালোই ওঠাবাসা ছিল। ওই বস্তাগুলিতে (বস্তার দিকে আঙুল করে) চাল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্যে। আমার ছেলেটি করেছিল কি ওগুলো এই গরীব কাঙালদের বিলিয়ে দিয়েছিল। আমার মান আর রাখলো কোথায়?
-ভালোই তো করেছিল। যারা খেতে পারছিল না তাদেরকে খেতে দিয়েছিল। এতে ক্ষতি কোথায়?
-সব শেষ হয়ে গেল। (কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বললেন) চলুন। একটু বাড়ির আশপাশটায় ঘুরে আসা যাক। একটু ওপরে চলি।
অতএব, চললাম দুজনে। এঘর-ওঘর দেখতে দেখতে ওপরে চলে এলাম। আসার সময় নানা ঘরে ভদ্রলোক দেখালেন এটা হুঁকো, এটা জমিদারের পাইপ, নানা অসাধারণ পেন্টিং, মূর্তি ও বিভিন্ন বিষয়ের দুষ্প্রাপ্য বই এবং শিকার করা বাঘ, হরিণের চামড়া ইত্যাদি। তারপর ওপরের কোণের একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, “এবার যা দেখবেন তা দেখে কোনোদিন আর এখানে আসার বাসনা থাকবে না আশা করা যায়।”
তাঁর কথাগুলো বেশ রহস্যময় শোনাল। আরও অবাক করার ব্যাপার হল এই যে দরজাটা যেন আপনি আপনি খুলে গেল। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। সামনের খাটের দিকে তাকালাম। ওপরের ঝাড়লন্ঠনের আলোয় বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে যা, তা দেখে আমার পিঠের ওপর দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। রক্ত যেন জল হয়ে এলো। একি! যে ভদ্রলোক এতক্ষণ কথা বলছিলেন তাঁরই মৃতদেহ খাটে পড়ে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে, হাতে বিষের বোতল, মুখ দিয়ে ফ্যানা বেরিয়ে আছে। এইরকম মর্মান্তিক দৃশ্য কি দেখা যায়? আর ঠিক তখনি সারা বাড়িময় জুড়ে “হা হা হা হা…….হা” করে বাঁজখাই হাসি যা কোনোদিনও ভোলার নয়।
কোথায় সেই ভদ্রলোক? পাশে তো কেউ নেই! এমন সময় দৌড়ে নীচে এসে দেখলাম যে ঘরটায় বস্তাগুলো রাখা ছিল, সেই ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে এক সু-পুরুষ চেহারার যুবক। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোগা-হাড় বেরানো, প্রায় বস্ত্রহীন কয়েকজন ‘না-মানুষ’ চেহারার মানুষ। একটি মহিলার কাঁধে একটি শিশু কাঁদছে আর বলছে- “মা খেতে দাও, খেতে দাও না।” তার মা তার পিঠ চাপড়ে বলছে- “এই তো বাবা, এইবারই খাওয়া হবে, আর কাঁদিসনি।” শিশুটি না খেয়ে প্রায় কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে।
সকলে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলছে, “শহরে গিয়ে কিছু পেলাম না বাবু। সব নিষ্ঠুর। না খেতে পেয়ে মরব। শহুরে বাবুরা ভাত তো নয়ই এমনকি ফ্যানও দিলে না। শরীর বড়োই অবসন্ন তাই লাইনে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই আর। তাছাড়া সেখানকার চাল,ডালও অতি অল্প, ভালো নয়। ভাত না দাও বাবা, অন্তত ফ্যান দাও।”
যুবক ওই অসহায় মানুষদের আশ্বস্ত করে বললেন, “গুদাম ঘর তো খোলা হয়েছে তোমাদেরই জন্যে। এখানে চাল,ডাল ভালোই পরিমাণে আছে তাই বেশি করে দিচ্ছি, পরিবারের সবার পেট পুরে খাওয়া হয়ে যাবে।”
এমন সময় ওপর থেকে ভেসে এলো সেই অচেনা ভদ্রলোকের তারস্বরে চিৎকার, “নাআআআআ…..”
আমি তখনই বাড়ি থেকে দৌড়াই। তখন আমার দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। ছুটতে ছুটতে রাস্তায় আসি। একটি ভ্যান-রিকশার সাথে ধাক্কা খাই। দেখি সেটার চালক অম্লান।
আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বলি,”চলো, চলো, নিয়ে চলো, শিগগির এখান থেকে।”
অম্লান বলল, ” তাড়াতাড়ি উঠে বসেন। ওই বাড়িতে আপনি কেন গেলেন বাবুমশাই? ওখানে কেউ যায় না। ওটা একেবারে অভিশপ্ত বাড়ি বুঝলেন কিনা।”
আমি আধো-আধো ভাবে ঘটনাটা বলার চেষ্টা করলাম।অম্লান চমকে উঠে বলে, “সর্বনাশ। আমার বাড়ি চলুন।”
রিকশায় উঠে দেখি কঙ্কাল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে আর বলছে, “ভাত না দাও, ফ্যান দাও। ভাত না দাও ফ্যান অন্তত দাও।” আমি ভয়ে আত্মহারা হয়ে যাই।
অম্লান বলে ওঠে, “ওদিকে তাকাবেন না বাবু। আপনি আমার দিকে মুখ করুন।” এই বলে সে দ্রুত রিকশা চালায়।
অবশেষে অম্লানের বাড়িতে পৌঁছলাম।অম্লানের ছেলে আমাকে দেখে বলে উঠলো, “মা, বাবা একজন কাকুকে নিয়ে এসেছে।”
অম্লান তার স্ত্রীকে সবকিছু বলল। বাড়িতে ছিলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তিনি আমাকে নমস্কার জানালেন। আমিও প্রতি নমস্কার জানালাম।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, “আমি আর্যবাবু- আর্য তরফদার। হরণাথ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলটা আমারই। অম্লানের মুখে আপনি ওই অভিশপ্ত বাড়িতে গেছেন শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। অম্লানকে ধমক দিয়ে আপনাকে তক্ষুনি নিতে পাঠাই। ওকে বলি, “আর পরে যেতে হবে না তুই এখনই যা, দেখ এরমধ্যে কোনো অঘটন না ঘটে যায়।” আর আমিও এখানে চলে আসি।”
আমি দু-গ্লাস জল খেয়ে একটু ধাতস্থ বোধ করি। কিছুক্ষণ পরে আমরা খেতে বসি। অম্লানের বউয়ের হাতের রান্না ভারি চমৎকার। তা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাড়ির উঠোনে বসে গল্প আরম্ভ করি।
অম্লানের স্ত্রী হেসে বলল,”ঠাকুরের কৃপায় বড়োজোর প্রাণ নিয়ে বেঁচে গেছেন।”
আমি হেসে জানাই, “সেই। ভাগ্যিস অম্লান তখন এসেছিল। অসংখ্য ধন্যবাদ অম্লানকে, আর্যবাবু সহ আপনাদের সবাইকে।”
আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া ওই ভৌতিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে আর্যবাবুকে জিজ্ঞেস করি, ” আর্যবাবু, আপনি প্রবীণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তা ঘটনার মূল কাহিনীটা কি? একটু যদি বলেন।”
আর্যবাবু গল্প আরম্ভ করলেন, “আমার আশীতিপর বয়স। আমি একজন ইতিহাসবিদ। গ্রামের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করি। ১৯৪৩ সালে এক ভয়াবহ ও প্রবল দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে গোটা বাংলা। জানেন তো তাতে ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এই দুর্ভিক্ষ আসলে এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। চাল,ডাল ভালো পরিমাণেই পাওয়া যেত অন্তত ১৯৪১, ১৯৪২-এর থেকেও। ব্রিটিশ সরকার ‘৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ সহ্য করতে না পেরে এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। তার সাথে যোগ দেয় এই যোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতো আড়তদার ও কালোবাজারিরা। সেই সময় বাংলার সব গ্রামের মতো এই গ্রামও জনশূন্য হয়ে যায়। বটতলায় সন্ধ্যেবেলায় আর আড্ডা বসে না, বাড়ির তুলসী-তলায় জল পড়ে না, চণ্ডীমণ্ডপ ফাঁকা, মন্দিরে পুজো বন্ধ এমনকি প্রদীপ জ্বালাবারও কেউ নেই। খেতে না পেয়ে রোগাটি হয়ে যায় সবাই। শহরে যায় কিন্তু সেখানে সামান্য ফ্যানটুকুও না পেয়ে গ্রামে ফিরে আসে। জমিদার যোগী বা যোগীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর বাড়িতে চাল, ডাল সবই ছিল তবে তা নিজেদের জন্যে বা সরকারি লোকেদের জন্যে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। তাঁর ছেলে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিদেশ থেকে শিক্ষালাভ করে দেশে এসে যখন দেখেন এই শোচনীয় অবস্থা অথচ বিদেশি সরকারের কোনো হেলদোল নেই। তারা যেন বিপ্লবীদের অন্যতম উৎপাদন ক্ষেত্র বাংলাকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর তখন তিনি কৌশলে গুদামের সমস্ত চাল,ডাল ওইসব মানুষের জাত-ভাইদের বিলিয়ে দেন। উপেন ছিলেন নিঃস্বার্থপর, সরল, উদার, সাহসী ও বুদ্ধিমান এক যুবক। কিন্তু ছেলের এরূপ আচরণ মেনে নিতে পারেননি পিতা যোগীন্দ্রনাথ। পরে সরকারের কাছে হেনস্থা হবার ভয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আর ছেলে উপেন্দ্রনাথ?”
-তিনি পরে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারান কিছু উগ্র অ-মানুষের হাতে। তবে বলা হয় তাঁকে চক্রান্ত করেই সরকার মেরেছিল কারণ তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বিপ্লবী।
-যাক, অশেষ ধন্যবাদ। আপনাদের কাছে আমি অনেক ঋণী। আপনাদের জন্যই আমি আজ রক্ষা পেলাম,সুস্বাদু খাবার পেট পুরে খেতেও পেলাম। কাল সকালেই আমি রওনা দেব। সত্যিই বলতে কি, এ এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হল যা কোনোদিনও ভোলা যাবে না। কথা দিচ্ছি, এখানে পরে আবার আসব তবে ওই বাড়িটার ত্রিসীমানা মারাবো না। আজ যদি অম্লান না আসত, তবে হয়তো……
আর্যবাবু হেসে বললেন, “তা তো নিশ্চয়ই। অম্লানই আপনাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। আপনি আমাদের অতিথি আর ‘অতিথি দেব ভব’। আর তাই বিপদগ্রস্ত অতিথির পাশে দাঁড়ানোই তো আমাদের প্রধান কর্তব্য। যাক,আপনি আবার আসলে ভালোই লাগবে।”
অম্লান বলল,” কাল বাবু, সূর্য উঠার পরই বেরিয়ে যাব।”
পরদিন সকালে অম্লানের স্ত্রী, ছেলে সবাই হাসিমুখে বিদায় জানাল। বারবার অনুরোধ করতে লাগলো তাদের বাড়ি আবার আসার জন্যে। আমিও অম্লানের পরিবারকে আমার কলকাতার বাড়িতে আহ্বান করি, সাথে আর্যবাবুকেও নিয়ে আসতে অনুরোধ করি। অম্লানে রিকশা করে এগোতে লাগলাম স্টেশনের দিকে। মাঝপথে সেই ভূতুড়ে জমিদার বাড়িটা দেখলাম। সেই জমিদার বাড়ি……
যাক, মনে মনে ভাবলাম, ‘ইতিহাস মানে তো অতীত। আর অতীত মানে তো ভূত। আজও কিছু মানুষ স্বার্থপর ও লোভী। তাদের বিপুল ধনসম্পত্তি থাকা সত্বেও তারা সমাজকে কিছু দেয় না, মানুষের কোনো উপকার করে না। অন্যের ক্ষতি দেখলেই তাদের যেন আনন্দ। অন্যকে খেতে না দিয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়াই যেন আজকের এইসব বর্বর লোকেদের কাজ। আর যেদিন এই শোষক শ্রেণী আরও চাইবে সমস্ত রক্ত চুষতে সেদিন সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে, তার জন্য কোন অ্যাটম বোমা লাগবে না।
রেল-স্টেশনে পৌঁছালাম। অম্লান ভাড়া নিয়ে বিদায় নিলো।
-ধন্যবাদ বাবু,আবার আসবেন।
আমি সেই চায়ের দোকানের কাছে গেলাম। চায়ের দোকানটা সবই খোলা হয়েছে। অম্লানের বাড়িতে চা খেয়েছি। তাই, আর চা পান করবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই চায়ের দোকানের মহিলাটি আমায় দেখে এক্কেবারে ‘থ’। হয়ত জীবিত যে দেখবে ভাবতে পারেনি।
সে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো একাধিক প্রশ্ন- “ভাল আছেন বাবু? কোনো অসুবিধা হয়নি তো? বেঁচে গেছেন তাহলে? যাক ভালোই হলো। ঠাকুর কৃপা করেছেন।” এইসব বলে সে দু-হাত উঠিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকল।
আমি হেসে বললাম, “দিব্যি আছি। বলতে পারো নতুন এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হলো…..”
এমন সময় ট্রেনের আওয়াজ হলো। আমি চায়ের দোকান থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আসার সময় ভাবতে লাগলাম যে বাড়িতে গিয়ে লিখে ফেলতে হবে জমিদার বাড়ির ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাটি। ওয়েবসাইটে দেবো- ‘A Haunted Zamindar House’ অর্থাৎ ‘এক ভূতুড়ে জমিদার বাড়ি’। ফেসবুকেও এর সম্বন্ধে লিখবো। সাথে ছবিটাও দেব। দেখি কটা ‘Like’, ‘Share’ ও ‘Comments’ পাওয়া যায়।
-
ভৌতিক গল্প- নর-কঙ্কাল
নর-কঙ্কাল
→ ইন্দ্রনীল মজুমদারঅমলেশবাবু বাড়িতে সোফায় বসে খবরের কাগজটা উল্টে-পাল্টে দেখছেন। বাইরে ঝম্ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, তাই কোথাও বেড়োনো যাবে না। তিনি রিটায়ার্ড মানুষ, তাই কোনও কাজকর্ম নেই। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন এবং মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামীর সাথে বিদেশে থাকেন। তাই বাড়িতে বলা যায় তিনি একলাই থাকেন। মাঝে মাঝে ও পাড়ার বন্ধু মানিকবাবু তাঁর সাথে আড্ডা মারতে আসেন। মানিকবাবু ছিলেন একজন সরকারি অফিসের চিফ্ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এখন বেশ কয়েক বছর হল অবসর নিয়েছেন। তিনি কাজের সূত্রে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। তাই অফুরন্ত তাঁর গল্পের স্টক,বিশেষ করে ভূত বা অলৌকিক গল্পের। মানিকবাবু আসলে আড্ডাটা বেশ জমে।অমলেশবাবুর কেমন বিশেষ বন্ধু-বান্ধব নেই। তাই, অমলেশবাবু খালি ভাবছেন যে, আজ এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে একটিবার যদি মানিকবাবু আসতে পারে তাহলে আড্ডাটা বেশ জমে। অমলেশবাবু বড্ড একাকীত্ব বোধ করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, বৃষ্টিটা বেশ ধরেছে, মানিকবাবু আসতেই পারেন। এইরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এমন সময় কলিংবেলের ঘন্টা বাজলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল হাসিমুখে মানিক চৌধুরীকে। তিনি একটি প্যাকেট তুলে বললেন, “বেগুনি ও আলুর চপ নিয়ে এসেছি মশাই। মুড়ি দিয়ে এই ওয়েদারে বেশ জম্পেশভাবে খাওয়া যাবে। এরসাথে চা হলে তো কোনো কথাই নেই।”
অমলেশবাবুও হেসে বললেন, “শুধু কি তাই? আপনার ভৌতিক গল্প শুনতে শুনতে বেশ জমে যাবে এই বৃষ্টি-বাদলার দিনটা। আমি তো খালি আপনার কথাই ভাবছিলাম আর ঠিক তখনই আপনি এসে হাজির। অনেক আয়ু আপনার মশাই।”
মানিকবাবু হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। ওদিকে অমলেশবাবুও রান্নাঘরে চা ও খাবার রেডি করতে লাগলেন। সব রেডি হয়ে ট্রেতে করে খাওয়ার যখন অমলেশবাবু
আনছিলেন তখন মানিকবাবু বলে উঠলেন, “আজ ঘুরঘুটিয়া গ্রামে কি সব ঝামেলা হয়েছে। খবরে তা বেরিয়েছে। পড়েছেন কি?
– হ্যাঁ, ওই আর কি সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। মারামারি, খুন, থানা,পুলিশ আরও কত কি!
মানিকবাবু খানিকক্ষণ থেমে বললেন, “এই ঘুরঘুটিয়ায় সেই ঘটনাটি ঘটেছিল।”
অমলেশবাবু বেশ কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন ঘটনা?”
– নর-কঙ্কাল নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর ভৌতিক ঘটনা। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় মশাই, রোম খাঁড়া হয়ে যায়।
অমলেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার মতো বিজ্ঞান মনস্ক লোক ভূতে বিশ্বাস করেন,ভৌতিক গল্পে জমাটি আড্ডা দেন, ভৌতিক গল্প ও উপন্যাস লেখেন- এসব বিশ্বাস করতে কেমন একটা যেন লাগে।”
মানিকবাবু হো হো করে বেশ খানিকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, “আগে একদমই করতাম না জানেন মশাই। এই ঘটনাটার পর থেকে করি। আসুন আপনাকে ঘটনাটা পুরোটা বলছি।”
এইবার অমলেশবাবু ও মানিকবাবুর ভৌতিক আড্ডা শুরু হবে। সাথে চলবে খাওয়া-দাওয়া। ওদিকে আবার বৃষ্টির বেগও বেড়েছে, সাথে শুরু হয়েছে ঝড়। গল্প শুরুর সময় কারেন্টও অফ গেল। বাধ্য হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভৌতিক আড্ডা শুরু করতে হল। অতএব পাঠকগণ বোঝাই যাচ্ছে একটা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আর এই পরিবেশেই মানিকবাবু ঘুরঘুটিয়ার গ্রামে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা শুরু করলেন।
– সে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা। সরকারের কোনো এক প্রজেক্টের কাজে ঘুরঘুটিয়ায় আমার পোস্টিং হয়। তখন ঘুরঘুটিয়া গ্রাম এতটা জমজমাট ছিল না। যাকে বলে অজ পাড়া-গাঁ সেরকম একটা ছিল আর কি। তা আমার পোস্টিং যেখানে হয় সেই জায়গাটা বেশ ফাঁকাই ছিল। ফাঁকা মাঠের মাঝে থাকার জন্য মেসবাড়ি টাইপের একটি বাড়ি বলা যায়। বাড়িটার উল্টোদিকে একটি পোড়ো বাড়ি টাইপের একটা বাড়ি ছিল। দেখে মনে হয় বিশেষ কেউ ওখানে থাকে না, বাড়িটা পরিতক্ত। যাইহোক, মেসে আমার সাথে আরেক জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার শ্রী বিমল মিত্র ছিলেন। শুরু থেকেই কেন জানি না আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল উল্টোদিকের ওই বাড়িটা। চারপাশে ঘন-জঙ্গল ও মাঠের মাঝখানে এই বাড়িটাকে কেমন যেন অন্যরকম মনে হত। বাড়িটা বহু পুরনো তাই হয়তো আমার আকর্ষণ আরও বেড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সকালে কোনোরকমে ব্রেকফাস্টে কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে যেতাম, সারাদিন অফিসের কাজ, প্রকল্পের কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরতাম। আমার পাশের রুমেই থাকতেন বিমলবাবু। এখানে বলে নিই আমাদের থাকার বাড়িটি ছিল একতলা, সেখানে ছিল মাত্র দুটোই ঘর। এই অজ গ্রামে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা না থাকার ফলে কর্মীরাও তেমন আসতেন না। আর সরকারি প্রকল্পও তেমন হত না। রাত্রে বাড়ি ফিরে আর রান্না করতে ইচ্ছে করত না তাই বাইরে কোথাও খেয়ে এসে শুয়ে পরতাম। যাই হোক, একদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করি। এমন সময় জানলার কাছে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম। উল্টোদিকের বাড়িটা সকালবেলা অফিস যাবার সময় দেখতাম অন্ধকার কিন্তু এখন দেখছি ওই বাড়ির উপরতলায় আলো জ্বলছে। একটা ছায়াও লক্ষ্য করলাম। তার মানে ওখানে কেউ থাকেন। কিন্তু সকালবেলায় বা এমনকি ছুটির দিনেও সারাদিন তো কাউকে ওখানে দেখা যায় না। কি ব্যাপার কে জানে? কৌতুহল নিয়েই জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এরকম অভিজ্ঞতা আরেক দিনেও হয়েছে। সেদিন অবশ্য অফিসের কাজের চাপ ছিল তাই রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। ঘুম আসছিল না। তখন একেই গরমকাল, তাই জানলা খুলে খাটে শুয়ে শুয়ে একটি বই পড়ছিলাম। মাঝে মাঝে চোখ যাচ্ছিল উল্টোদিকের ওই বাড়িটায়। না বাড়িটা তো অন্ধকারেই আছে। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে, চোখে ঘুম চলে এলো তাই বই বন্ধ করে ঘুমোতে যাব এমন সময় দেখি ওই বাড়িটার দোতলায় আলো জ্বলে উঠল। তাজ্জব ব্যাপার! যাই হোক, তখন বেশ ঘুম চলে এসেছিল তাই আর ওদিকে কৌতূহল না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল বিমলকে বলে দেখতে হবে। তা পরদিন অফিসের ক্যান্টিনে বিমলকে ঘটনাটা বলতেই, বিমলও দেখি বাড়িটার ব্যাপারে বেশ কৌতুহলী। বিমল জানালেন যে তিনিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। তিনি বললেন, “দাদা, ওই বাড়িটায় একটু নজর দেওয়া দরকার। কোনো সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি হতে পারে।
– একদম ঠিক কথা বলেছ। তাই হবে হয়তো।
– একদিন একটু ঢুঁ মারা দরকার।
– ক্ষেপেছ দাদা, ওদের হাতে অস্ত্রসস্ত্র থাকলে কি হবে?
– তা তো ঠিকই।
যাই হোক, সেদিন এর বেশি আর কথা এগোয়নি। আমরা দুজনেই কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকদিন পর বিমল অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল রাতে দেখেছ দাদা?”
– কাল রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কেন কি ব্যাপার বলতো?
– রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আর ঠিক তখন ওই বাড়িটায় চোখ পড়তে দেখি ছাদে একজন উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একেই অন্ধকার, তাই অত ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তাকে একটা ছায়ামূর্তি হিসেবেই দেখাচ্ছিল। স্পষ্ট না হলেও, গোটা বাড়িটা দেখলাম সম্পূর্ণ অন্ধকার। তাই, ওখানে একটিমাত্র লোক আছে বলেই মনে হয়।
– আচ্ছা। তাহলে একদিন তো যাওয়াই যায়। এই সামান্য ইনভেস্টিগেশন করতে।
– গেলে তো রাতেই যাব।(উৎফুল্ল হয়ে বললেন বিমল)
– তা তো বটেই। তুমি ওই লোকটাকে দেখেছো?
– না। সেটাই তো তোমাকে বললাম তাকে দেখতে পারিনি। সে একভাবে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমারও এদিকে ঘুম পেয়ে গিয়েছিল তাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
– আচ্ছা। তাহলে একদিন যাওয়া হচ্ছে।
সেদিন আর এ নিয়ে কথা হয়নি। পরে একদিন ঠিক হল যে সামনের শনিবার রাত দশটার সময় আমরা সেই বাড়িটায় যাব। তা সেই শনিবার টর্চ সমেত গেলাম সেই বাড়িটায়। বাড়িটার সামনে বাগান, বাগানে আগাছায় ভর্তি। অনেকদিন এই বাগানে কারুর পা যে পড়েনি তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ভেবেছিলাম টর্চ প্রয়োজন ছাড়া চালাবো না। কিন্তু যা অন্ধকার, তাই একদণ্ড টর্চ ছাড়া চলছিল না। অগত্যা টর্চটা জ্বালাতে হল। সামনে দড়ির মতো কি একটা চলে গেল না। বেশ ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিমল বললেন, “ওটা সাপ ছিল, ডানদিকে চলে গেছে, চলো পা টিপে টিপে সামনের দরজার দিকে এগোই।” সেভাবেই এগোচ্ছিলাম দরজার দিকে। বলা যায় না, কোথায় কি বিপদ লুকিয়ে আছে, তাই চারিদিকে টর্চ ফেলছিলাম। দরজার কাছাকাছি চলে এসেছি, বাঁদিকে টর্চ ফেলে হঠাৎ ভয়ে আত্মারাম খাঁচা হবার জোগাড় হল। ভয়ে হাত থেকে টর্চটা পড়েই গেল। দরজার কাছে ওই গাছের ডালে ওটা কে বসে? মনে হয় তার দুটো চোখ যেন লাল আগুনের গোলা। টর্চটা কোনোরকমে তুলবার সময় বিমল বললেন “ওটা একটা প্যাঁচা গো দাদা। ভয় নেই।”
– কিন্তু প্যাঁচা হলে ওর চোখটা যেন লাল আগুনের গোলা কেন?
– তাইতো দাদা, চলো তো দাদা গিয়ে দেখি।
আমরা প্যাঁচাটার দিকে এগোতে লাগলাম। কাছাকাছি আসতেই সেটি ‛ক্র্যাও ক্র্যাও’ করে ডেকে উড়ে চলে গেল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজায় তালা লাগানো নেই, তাই সহজেই সেখানে ঢোকা গেল। বাড়িটার দরজায় নামের প্লেটটা ভাঙা। তাই নামটা পড়া যাচ্ছিল না। সামনের আলোটাও ভাঙা। তাই আলোও থাকে না। পুরো বাড়িটাই এক অন্ধকারময় জগতে রয়েছে। তা দরজায় ঠেলা দিতেই সেটি খুলে গেল। ব্যাপারটা বড়োই আশ্চর্যজনক মনে হল। এ বাড়িতে কেউ কি থাকে আদৌ?একটু সন্দেহ হচ্ছিল। দরজার ঠিক ডানদিকের একটি ঘর খোলা। সেখানে টর্চ ফেলতেই দেখলাম উপরের সিলিং থেকে ঝুলে রয়েছে বাঁদুরের দল। তাদের দিকে টর্চ ফেলতেই তারা কিচিরমিচির করতে লাগল। বেশ কয়েকটা মাথার উপর দিয়ে উড়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়েও গেল। আমরা সেখান থেকে সরে এলাম। বিমল রসিকতা করলেন, “এখানে কি ভ্যাম্পায়ার আছে নাকি দাদা?” আমি শুধু বললাম, “কি জানি ভায়া থাকতেও পারে।” নীচের অন্যান্য ঘরগুলি বন্ধ। শুধু বাঁদিকে একটা বাথরুম খোলা ছিল, আর সেখান থেকে টপ্টপ্ করে আওয়াজ আসছিল। কাছে গিয়ে দেখি কল থেকে কিছু সময় অন্তর অন্তর জল কলের নীচে একটি বালতিতে পড়ছিল। বাথরুম থেকে কার যেন পায়ের ছাপ অন্য একটা বন্ধ ঘরের দিকে চলে গেছে। বেশ ভয় হল। ঘরের দরজা খুলে কোনো বিভীষিকা মূর্তি উপস্থিত হবে না তো? অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে। কিন্তু কেউ এলো না। আমরা এগোতে লাগলাম। বেশ একটা নিস্তব্ধতা অনুভব করছিলাম। আসলে, আমাদের দুজনের পায়ের শব্দ আর কথা বলার ফিস্ফিস্ ছাড়া আর বাথরুমের টপ্টপ্ করে জল পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছিল না।
খালি মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এখানে আদৌ কেউ থাকে? একটা কথা বলা হয়নি তা হল এই বাড়িতে আসার মূহুর্ত থেকেই মনে হচ্ছিল যে যেন এক অন্য জগতে চলে এসেছি। বেশ অসস্তি বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে, এই বাড়িতে না আসলেই ভালো হত। জানেন তো মশাই কোনো কিছুতে অতি কৌতূহল ভালো নয়। আমাদেরও তাই অবস্থা। যাইহোক, বিমল বললেন, “ওই তো সামনে একটা সিঁড়ি,চলো দাদা। উঠে দেখি তো।” সিঁড়িতে উঠতে মন চাইছিল না তবুও আমরা সেটা বেয়ে উপরে উঠলাম। অবশেষে দোতলার একটি ঘরে এলাম। ঘরটা ছিল ফাঁকা, তার দরজার সামনে বারান্দা। ওই বারান্দায় কেউ নেই তো? ভালোভাবে তো কিছু বোঝাই যাচ্ছে না। ভয়ে দুজনেই টর্চটা নেভালাম। আমরা ঘরেই অপেক্ষা করছিলাম। এরসাথে ঘরটাও পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সবকিছু ভালোমতোনভাবে দেখার জন্যে তাই টর্চের আলোটা আবার জালালাম।
ঘরটায় দুটো আলমারি রয়েছে। আলমারিগুলোতে ধুলো এতটাই জমে আছে যে আছে যে সেগুলোর ভেতর দেখা যাচ্ছিল না। দরজা জানালা সব বন্ধ, তাই ঘরটা বড্ড গুমোট। দেখলাম মেঝেতে একপুরু ধুলো জমে আছে, সামনে আলমারির কাঁচের দেরাজগুলোতে ধুলো জমে গিয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো পরিস্কার করে ভালোভাবে দেখার জন্যে যেই না একটু পা বাড়িয়েছি অমনি শুনতে পা খট্খট্ করে একটা পায়ের আওয়াজ- কে যেন সিঁড়ি বেয়ে এদিকে আসছে। তড়িঘড়ি করে আমরা নিজেদের টর্চটা নেভালাম। অপরদিকে একটা ঘর দেখলাম আর মাঝে একটা প্যাসেজ, সামনে বারান্দা। আমরা বারান্দার দিকে এগিয়ে ডানদিকে ওই ঘরটার সামনে গিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম। এমন সময় খট্খট্ আওয়াজটা বেড়ে গেল। এমনসময় বেশ কয়েকটি শেয়াল ও কুকুর যেন ডেকে উঠল। মনে হল ওরা কিছু একটা অশনিসংকেত জানান দিয়ে গেল। আমরা ভয়ে দরদর করে ঘামছি। ‘কি হয়, কি হয়’- একটা টেনশন কাজ করছে। লুকিয়ে সবকিছু নজর রাখছি। এমনসময় যা দেখলাম তাতে রক্ত হিম হয়ে গেল, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। একটা নর-কঙ্কাল সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। তার চোখ দিয়ে যেন ঠিঁকরে বেরোচ্ছে আগুন। সে আমরা যে ঘরটায় ছিলাম, সেখানে ঢুকল। বেশ অনেকক্ষণ সেখানে থেকে বোধহয় আমাদের খোঁজ করছিল। তারপর কাউকে না পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উপরের সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলে গেল। ভাগ্যিস এদিকে তাকায়নি। খুব জোর বেঁচে গিয়েছি। আমার তখন হৃদপিণ্ড হাতে চলে আসার মত অবস্থা বুঝলেন মশাই। আমি কোনোরকমে বিমলকে ফিস্ফিস্ করে বললাম, “চলো বিমল, আর এখানে নয়। ছাদ থেকে নেমে পড়ার আগে আমরা পালাই এই বাড়ি থেকে। বিমলেরও দেখি একই অবস্থা। আমরা কোনোরকমে দৌড় মারলাম মেসবাড়ির উদ্দেশ্যে। ওইদিকে কুকুর ও শেয়াল আবার ডাকা শুরু করেছে। যাইহোক, কিভাবে যে এক নিশ্বাসে দৌড়ে মেসে পৌঁছে ছিলাম তা আমরাই জানি। কোনোরকমে মেসবাড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাদের অবস্থা দেখে শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক আছে তো, বাবুরা? কোনও রকমে বলে উঠলাম, “খুব জোর বেঁচে গিয়েছি।যা দেখলাম তা আর এ জীবনে ভোলার নয়।” তখন আমাদের অবস্থা দেখে একজন বলে উঠল,“এই বাবুদের জল দে।” গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ তাই জল খেয়ে একটু স্বস্তি বোধ হল। তো আরেকজন বলে উঠল, “চলুন আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি।” আমরা বললাম, “থাক, থাক।” যাই হোক, কোনোরকমে ঘরে ঢুকলাম। সাথে ওই মানুষগুলোও ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “আমরা এই লোকাল ক্লাবের ছেলে। দূর থেকে এই ফটিক সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় আপনাদের দেখতে পায় ওই বাড়িতে ঢুকতে। তাই সে ক্লাবের সেক্রেটারি বিপনদাকে খবর দেয়। আমরা সবাই তা শুনেই ছুটে চলে এলাম। আপনারা ওই বাড়িতে ঢুকেছেন জানতে পেরে সবাই চলে এলাম আপনাদের বাঁচাতে। আসতেই দেখি ওই বাড়ি থেকে আপনারা এই অবস্থায় বেড়িয়ে আসছেন।”
–তা ভালোই করেছেন। আচ্ছা, ওই বাড়িটার ইতিহাস কিছু জানেন?
এবার একজন নেতা গোছের লোক এগিয়ে এলেন, ইনি মনে হয় বিপনদা। যাই হোক, তিনি বললেন, “নমস্কার, আমার নাম বিপন। আপনারা ওই বাড়িতে কেন যে গেলেন? আমরা তো ভুলেও এমন কি দিনের বেলাতেও ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যাই না। ওটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি।”
আমি আমাদের কৌতূহলের ব্যাপারটা বললাম। বিমল বললেন, “বাড়িটার ইতিহাস সম্পর্কে যদি একটু বলেন।”
তখন আমরা কোনোরকমে ধাতস্থ হয়েছি। আর এমনিতেও তো ওই বাড়িটার প্রতি একটা কৌতূহল ছিলই। তা বিপনবাবু বলতে শুরু করলেন,“সে অনেকদিন আগেকার কথা। আজ থেকে বছর দশ-পনেরো তো হবেই। ওই বাড়িতে থাকতেন এক দম্পতি। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। গৃহস্বামী খুব একটা সুবিধার লোক ছিলেন না। নানান জায়গায় ধারদেনা করে শোধ দিতে পারছিলেন না। এদিকে তিনি তেমন কিছু কাজও করতেন না। অসৎ সঙ্গে পড়ে প্রচুর টাকা নষ্ট করেছেন। লোকটার জুয়া ও মদেরও নেশা ছিল। তা একদিন, তিনি তাঁর বিপদের কথা তাঁর এক বন্ধুকে জানালেন। সেই বন্ধু ছিল বড়োই সাহায্যকারী, তিনি কলকাতায় কাজ করতেন। তা একদিন বন্ধুকে সাহায্য করার জন্যে ওই বাড়িতে আসেন। বেশ কিছু অর্থ ধার দেন বন্ধুকে। যতদূর শুনেছি ঐই ভদ্রলোকের হাতে ছিল একটি হীরের আংটি যা সোনা দিয়ে বাঁধানো। তা সেই আংটি দেখে ওই বাড়ির গৃহকর্তার ভারী লোভ হল। তিনি ভাবলেন ওই আংটি বাগাতে পারলে প্রচুর অর্থ পাওয়া যাবে। তাঁর মাথায় সবসময়ের শয়তানি বুদ্ধি গিজগিজ করত। তা সেই লোভে পড়ে একদিন তিনি তাঁর বন্ধুর খাওয়ারে বিষ মিশিয়ে দিলেন এবং তাঁর বন্ধু তা খেয়ে মারা গেলেন। ভদ্রলোক তখন আন্টিটা খুলে নিয়ে বন্ধুর লাশটি কোথাও একটা গায়েব করে দিয়েছিলেন। পুলিশি তদন্ত হয়েছিল পরে কিন্তু লাশ পাওয়া যায়নি। আসলে, তখন এখানে প্রচুর ডোবা ছিল আর শেয়াল, কুকুরেরও অভাব ছিল না। মানুষজন তো ছিল সামান্যই। তাই লাশ গায়ের করে দেওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। যাই হোক, তারপর থেকে শুরু হল এক উৎপাত। রোজ রাতে ওই বাড়িতে কঙ্কাল দেখা যেতে লাগল। বাড়ির ছাদে অনেকেই এক কঙ্কালকে চলতে-ফিরতে দেখেছেন। বাড়ির মালি একদিন সেই কঙ্কাল দেখে আতঙ্কে বাগানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। গৃহকর্ত্রীও একদিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে কঙ্কাল দেখে অজ্ঞান হয়ে যান,জ্ঞান ফিরলে স্বামীকে ভয় ভয় বলেন, “চলো এখান থেকে চলে যাই। এখানে কঙ্কালের উৎপাত শুরু হয়েছে। আজ আমিও দেখলাম, মনে হল তোমার সেই কলকাতার বন্ধু।” গৃহস্বামীও স্থির করেন বাড়ি ছাড়ার। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। পরদিন দেখা গেল বাড়ির সামনে দুটো লাশ পড়ে, ওই স্বামী-স্ত্রীর, তাঁদের জিভ বার করা ও চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। গলার দাগ দেখে মনে হল কেউ যেন গলা টিপে তাঁদের হত্যা করেছে। মনে হয়, ওই কঙ্কালই তার প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু এরপরেও কঙ্কালের উৎপাত থামেনি। রোজ রাতেই দেখা যায় সেই নর-কঙ্কাল এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলো জ্বালিয়ে কিছু একটা যেন খুঁজছে। ছাদে উঠে ঘুরতে দেখা যায়। আমাদের মনে হয়, সেই মৃত ব্যক্তিটিই আজও কঙ্কাল হয়ে খুঁজে চলেছেন তাঁর সেই হারানো আংটিটা। ওই কঙ্কাল এছাড়া কোনো অসুবিধা আজ পর্যন্ত কাউকে করেনি। আমরা ওই ভদ্রলোকের নাম জানতাম না। তবুও লোকাল তান্ত্রিক, ওঝা ও পুরোহিত ডেকে আমরা শান্তি স্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।তো, এই হচ্ছে গিয়ে ব্যাপার বুঝলেন দাদারা।”
ওনারা চলে যাবার পর, সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারিনি। বারবার মনে হতে লাগল মনে হতে লাগল ওই কঙ্কালটা আমাদের এই দরজায় এসে হয়তো ঠক্ঠক্ করবে। তাই, যে ভাবেই হোক এখান থেকে ছেড়ে চলে যেতেই হবে। পরদিন রবিবার ভয়ে ভয়ে কাটালাম। সোমবার আমরা বদলির চিঠি দিলাম এবং তা মঞ্জুরও হয়ে গেল। দুজনেই বদলি হয়ে গেলাম অন্য জায়গায়।তা এই ছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভৌতিক কাহিনী।কি মিঃ অমলেশ দে, ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?”
অমলেশবাবু শুনে কেবল বিস্মিত হয়ে হাঁ হয়ে রইলেন। আর ওদিকে বৃষ্টিও গেছে থেমে, কারেন্টও এসেছে চলে। অমলেশবাবু এবার কোনোরকমে স্বভয়ে বললেন, “আপনি এরপরে ওই জায়গাটায় গিয়েছিলেন?”
– হ্যাঁ মশাই। তা বছর পাঁচেক আগে ওই গ্রামের পাশের একটি গ্রামে একটি বিয়ে ছিল। সেই উপলক্ষ্যে একটা ফাঁকে ওই মেস ও ওই ভয়ঙ্কর বাড়িটা দেখার আগ্রহ দমন করতে পারিনি। কিন্তু হায় কপাল, গ্রাম তো একেবারে বদলে গেছে। লোকজন, গাড়ি-বাড়ি প্রচুর বেড়ে গেছে। দুঃখের বিষয় সরকারের কোনও প্রজেক্ট না থাকার দরুন ওই মেস দশ বছরের বেশি হয়ে গেল বন্ধই হয়ে আছে। ওখানে বিকেলে স্থানীয় বাচ্ছারা খেলা করে।”
অমলেশবাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আ-আ-আর ওই ভূতুরে বাড়ি? ওই কঙ্কাল?”
মানিকবাবু হেসে বললেন, “ওই বাড়ি? ওই বাড়ি এখন ভেঙে একটা হোটেল উঠেছে। আর বিপনবাবুদের কাউকেই খুঁজে পেলাম না। স্থানীয় ক্লাব এখন অন্য রকমের। পুরো ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিং হয়ে গেছে। ক্লাবের ছেলেরাও একেবারে অন্যরকম। তা, সেই ক্লাবের যিনি সেক্রেটারি তাঁকে ওই অভিশপ্ত বাড়ি ও কঙ্কালের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! বুঝলাম কঙ্কালের কথা কারোর আর মনে নেই কিংবা তার উপদ্রব আর নেই। তাহলে, অমলেশবাবু, আমার কথাটি ফুরোলো, বৃষ্টির দিনে ভুতুড়ে গল্পটি ভালোই জুড়ালো। কি বলেন?
অমলেশবাবু বেশ হেসেই বললেন, “তা তো বটেই, তা তো বটেই। আপনার গল্প বলে কথা ভয়েতে রোম খাঁড়া হয়ে গিয়েছিল মশাই।”
-আজ তবে উঠি। আবার গল্প হবে অন্য একদিন। -
ভৌতিক গল্প- ভূতের সন্ধানে
ভূতের সন্ধানে
-মানিক দাক্ষিতজঙ্গলের দীর্ঘ নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বাদুডের ডানার ঝটপটানি শব্দ। মুগ্ধ আবেশে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি রহস্যে ঘেরা ক্রমে ক্রমে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া জঙ্গলটার দিকে।
জঙ্গলটার বুক চিড়ে রওনা দেবো আজই সেই ভয়াবহ রোমাঞ্চকর জায়গাটিতে। ঠিক রাত বারোটায়। ভারী পায়ের শব্দে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি নন্দন।দুহাতে দুটো কফির পেয়ালা। মুখে তার একমুঠো অনাবিল জ্যোৎস্না হাসি।
—দেখছি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিস। নে, ধর্। কফি খা। খেয়ে ভেতরে চল। তোর সাথে জ্যেঠু কথা বলবে। এখানে বেশীক্ষণ বসে থাকলে বুনো ডেঁশো মাছির দল রক্ত চুষে ছিবড়ে করে ফেলবে!নন্দন শুধু আমার বাল্যবন্ধু নয়, কলেজের বন্ধুও। হরিহর আত্মা। কলেজে পড়তে পড়তে মামার দৌলতে নন্দন পেয়ে গেল পুরসভায় ক্লার্কের চাকরী আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে এখন একটা কলেজে অধ্যাপনায় রত। সাথে চলছে একটা বিষয়ের ওপর গবেষণা। গবেষণার বিষয়? ভাবছিলাম এই মূহুর্তে বলবো না। ঝেড়েই কাশি। গবেষণার বিষয় আমার ভূত। তারই খোঁজে সুদূর কলকাতা থেকে শতাধিক প্রাচীন বর্ধমানের গোপভূমির এই পুরোনো বাংলোয় নন্দনের সাথে আসা। যদি কিছু হাতে গরম তথ্য খুঁজে পাই। নন্দন ছাড়া এখানে আসা আমার মোটেই সম্ভব হতো না। কারণ বাংলোটির মালিক নন্দনের জ্যাঠামশাই দীনবন্ধু রায়ের। বেশ বিত্তশালী। পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। এলাকায় বেশ নামডাক। সকলেই সমীহ করে। বিপত্নীক। একটি মাত্র মেয়ে। নাম মল্লিকা। শুনেছি রূপসী ও বিদুষী। এখনও চোখে দেখিনি।
জ্যাঠামশায়ের জরুরী তলব। সন্ধ্যায় রাজকীয় জলযোগ সেরে নন্দনের সাথে জ্যাঠামশায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। আরাম কেদারায় আধশোয়া অবস্থায় উনি কি যেন একটা পড়ছিলেন। আমাদের
দেখামাত্র বইটা বন্ধ করে ভারী গলায় বললেন, “বসো, কথা আছে।” গভীর দৃষ্টিতে উনি আমার দিকে
তাকালেন।
–নাম কি?
–শিবেশ মল্লিক
–কি করো?
–আজ্ঞে অধ্যাপনা।
–লেখাপড়া?
–ট্রিপল এম.এ., বি.টি.
–কি কি বিষয়ে?
–বাংলা, ইতিহাস আর ইংরাজী।
–গুড। কলকাতার কোন জায়গায় থাকো?
–আজ্ঞে টালিগঞ্জ।
–বাড়ীতে কে কে আছেন?
–শুধু মা। বাবা খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।
–তা লেখাপড়া নিয়ে থাকলেই তো হতো। এ-সব
ভূত-প্রেত নিয়ে মাতামাতি কেন?আমি আমতা আমতা করতেই একগাল হেসে নন্দন বললো, “জ্যেঠু, শিবেশ আজ বছর তিনেক হলো
‘অশরীরী আত্মা’র ওপর গবেষণা চালাচ্ছে। তাই—“জাঁদরেল রাশভারী দীনবন্ধু রায় এবার খাড়া হয়ে বসলেন। ভরাট গলায় একটু উপদেশের সুরে বললেন, “তোমরা ভয়ানক দুঃসাহসিক এই অভিযানটা না করলেই মনে হয় ভাল করতে। লালগড় বড় ভয়ানক
খতরনক জায়গা। ওখান থেকে বেঁচে ফিরে আসাই মুস্কিল! আজ আবার ঘোর অমাবস্যা। পথ বড় দুর্গম। পদে পদে বিপদ। দুর্ভেদ্য গভীর জঙ্গলে কিভাবে কেমন করে তোমরা পৌঁছাবে, সেটাই বড় দুশ্চিন্তা!”আমি অবাক চোখে প্রশ্ন করলাম, “রাস্তা নাই?”
চোখ বন্ধ করে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন– “আছে, দড়ির মত সরু লম্বা পথ। কাঁটা ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা। দশ মিনিটের পথ ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। একবার জঙ্গলে ঢুকলে আবোড় লোকেদের পক্ষে ঐ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বড়ই কঠিন। বিষাক্ত পোকা-মাকড়, বিষধর সাপেদের অবাধ চলাফেরা। কখন কোনসময় কাকে কামড়াবে, ছোবল মারবে, কেউ জানে না। তাই বলছিলাম–ভাবনা চিন্তা করো।ঘণ্টাখানেক সময় দিলাম। সিদ্ধান্ত জানিও। যাও, ঘরে যাও।”
নন্দনের মুখ পাংশুবর্ণ। আমার হাতদুটো নিজের বুকে চেপে কাকুতি মিনতি করে–“গিয়ে কাজ নাই গুরু। বেঘোরে প্রাণটা যাবে। চল, ভালোয় ভালোয় বাড়ী ফিরে যাই! “
চোয়াল শক্ত হয়। নন্দনকে বলি, “ঠিক আছে, তোকে যেতে হবে না। আমি একাই যাবো।”
বিষ্ময়ে আকাশ থেকে পড়ে নন্দন। ম্লান মুখে বলে, “তুই ভাবলি কি করে, তোকে আমি একা ছেড়ে দেবো? চল, যা হবার হবে। মরলে দুজন একসাথেই মরবো।”
সিদ্ধান্তের কথা নন্দন তার জ্যাঠামশাইকে জানালে তিনি একটু মন:ক্ষুন্ন হলেন। বললেন, “তোমার বন্ধুটা বড্ড জেদী আর একরোখা। আচ্ছা, ঠিক আছে।”ঠিক রাত বারোটা। অকুস্থল লালগড়ে যাবার জন্য আমরা তৈরী। দায়িত্ববান জ্যাঠামশাই দীননাথ রায় আমাদের একা ছেড়ে দিতে মোটেই রাজী নন। আমাদের যতরকম নিরাপদ ব্যবস্থা দেওয়া যায়, দিয়েছেন। পায়ে আমাদের গামবুট, গায়ে কমফোর্ট মোটা ওভারকোট, হাতে দস্তানা, মাথায় টুপি। সঙ্গে দুজন কাঠুরে। হাতে তাদের কাটারি আর কুড়ুল। কাঁটার ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা সরু রাস্তা পরিস্কার করতে করতে ওরা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর আছে দৈত্যের ন্যায় বিশাল চেহারার চার লাঠিয়াল। তাদের প্রত্যেকের হাতে তেলচুকচুকে একটা করে পাকা লাঠি আর জোরালো টর্চ। নন্দনের পিঠব্যাগে জলের বোতল, দুফুটি মোটা লাঠি। আর আমার কোমরে পিস্তল, হাতে জোরালো চার্জার টর্চ। অনেকটা নিশ্চিন্ত। মনে হলো বেশ নিরাপদ। নন্দনের মুখ দেখে মনে হলো তার ভীতু মনটা অনেকটা সাহস পেয়েছে।
জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজের সাথে বহু নিশাচর প্রাণীর উদ্ভট শব্দের মেলবন্ধনে একটা গা ছমছমে ভাব। দু-পা এগোতেই পায়ের কাছে ধপাস করে ভারী কি একটা পড়ে নিমেষে মিলিয়ে গেল। কাঠুরে বললো, “বনবিড়াল”। বেশ কিছুটা এগিয়েছি। হঠাৎ মড়মড় শব্দ করে একটা গাছের মস্ত বড় ডাল আমাদের সামনে পড়ে রাস্তাটাকে আটকে দিলো। উপরের দিকে টর্চের আলো ফেলতেই দেখি একদল অদ্ভুত বিকটাকার প্রাণী গাছের ডালে মানুষের মত দাঁড়িয়ে দুপাটি দাঁত বার করে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। নন্দন ভয়ে আমাকে জাপটে ধরেছে। কোমর থেকে পিস্তল বার করতেই এক কাঠুরে সাবধান করলো–“খবরদার, গুলি চালাবেন না। রেগে গেলে ওরা আমাদের আস্ত রাখবে না। সব কটাকে হাত-পা ভেঙে ঘাড় মটকে এখানে ফেলে রাখবে। গায়ে ওদের ভীষণ জোর্। মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলাম, “ওরা কারা?”
চাপা গলায় উত্তর এলো –“ওরাং ওটাং”
কাঠুরিয়াদের নির্দেশমতো চুপচাপ আমরা পাশ কাটিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।রাত প্রায় একটা। আমরা শুকনো পরিখাঘেরা লালগড়ে পৌঁছালাম। বড় বড় গাছ ঘন ঝোপ- ঝাড়ে পরিবেষ্টিত দুর্গটির সেরকম কোন অস্তিত্বই নাই। শুধুই ধ্বংসস্তুপ। চারদিকে অসংখ্য নিম, বেল, অশ্বত্থ আর ঝুরিনামা বটগাছ। লোভ সামলাতে পারলাম না। নন্দনকে বললাম, চ, একটু ভেতরে যাই। অতি সন্তর্পণে পা ফেলে এগোতেই ‘ফোঁস’ শব্দে চমকে উঠলাম। টর্চের আলো ফেলতেই দেখি লেজের ওপর ভর করে প্রায় দু’ফুট মাটির ওপর ফণা তুলে প্রকাণ্ড দুটো বিষধর সাপ। নন্দন ভয়ে কাঠ। বলে, আর গিয়ে কাজ নাই।”
নন্দনকে নিয়ে ফিরে এসে সঙ্গীদের কাছে রাখি। ওদের নিষেধসত্ত্বেও আমি একা টর্চ জ্বেলে পরিত্যক্ত ভাঙা দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শোনা যায় থেকে থেকে একটা হাল্কা গোঙানির শব্দ। উপরে টর্চের আলো ফেলতেই মনে হলো বিশাল দীর্ঘকায় একটা ছায়ামূর্তি যেন সরে গেল। কোমর থেকে পিস্তলটা বার করতে যাবো হঠাৎ করে হাত ফসকে টর্চটা গেল পড়ে। জমাটবাঁধা ঘন অন্ধকারে উপুড় হয়ে টর্চটা খুঁজতে গিয়ে টের পাই ঘাড়ের ওপর কাদের যেন গরম নিঃশ্বাস। মনে হচ্ছে সাঁড়াশীর মত গলা টিপে এখুনি আমার দম বন্ধ করে মেরে দেবে। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। আমার পিস্তল থেকে গুড়ুম–গুড়ুম–গুড়ুম শব্দে বেরুলো তিনটে গুলি।নিমেষে আমার দলবল দৌড়ে এসে আমাকে এখান থেকে বার করে আনলো। লেঠেল সর্দার ভয়ানক উত্তেজিত। বললো, “বরাত জোরে বেঁচে গেছেন। অনেক হয়েছে। আর নয়। চলুন, বাড়ী ফিরি। আপনাদের মত ছেলে ছোকরাদের একটাই দোষ—নিজের চোখে না দেখলে আপনারা কোনো কিছুই বিশ্বাস করেন না। অথচ, তেনারা আছেন। বিশেষ খ্যানে অখ্যানে, তিথি নক্ষত্রে ওনাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আসুন। লেঠেল সর্দার দীঘির পাড়ে এক বিশাল বাঁশঝাড়ের কাছে নিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালো। টর্চ জ্বেলে দেখালো —“দেখতে পাচ্ছেন বাঁশগুলো কেমন ঝাড় থেকে দীঘির জলে নুইয়ে পড়েছে। ব্যাপারটাকে আমি সহজভাবে নিয়ে বললাম, “পড়তেই পারে। গোড়া ভেঙে গেলে বাঁশগুলোর তো এমনিভাবেই পড়ে থাকার কথা! সর্দার এবার রেগে আমার দিকে কটকট করে তাকালো। নীচে থেকে একমুঠো মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে মন্ত্রের মত কি যেন বিড়বিড় করে পড়ে বাঁশগুলোর ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললো, “দেখুন এবার কাণ্ডটা!” অবাক কাণ্ড! দীঘির জলে পড়ে থাকা বাঁশগুলো নিমেষে ‘হুশ’ করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাড়ের মধ্যে মিশে গেল। অজানা ভয়ে আমাদের বুকগুলো এবার সত্যিই কেঁপে উঠলো। লেঠেল সর্দার গুটি গুটি পায়ে আমাদের সকলকে বিশাল একটা নিমগাছের তলায় দাঁড় করিয়ে জিগ্যেস করলো, দেখুন তো, নাকে কোনো গন্ধ পাচ্ছেন কি-না?”
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম , “ধূপ ধূনোর গন্ধ!” সর্দার বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে।
—“এই জঙ্গলের পাঁচ সাত মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নাই। এবার বলুন আমাকে, এই ধূপ-
ধূনোর গন্ধটা কোথা থেকে আসছে ?”
সত্যিই ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। কথা বলার মত অবস্থা এখন আর কারোর নাই। কিছুদূর এগোতেই সর্দার থমকে দাঁড়ালো। চাপাস্বরে বললো, “এদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। চলুন,আমরা দীঘির ও-পাড় দিয়ে ঘুরে যাই।”
আমি বিস্ময়ে ‘কেন’ প্রশ্ন করতেই সর্দার বললো, “টর্চ জ্বালাবেন না। ভাল করে লক্ষ্য করুন। অন্ধকারেও দেখতে পাবেন। ঐ দূরের বেলগাছটার নীচে ধবধবে সাদা কাপড় পড়া একজন বামুন ঠাকুর বসে। বিস্ময়ে হতবাক হই।
–“বামুনঠাকুর!” টর্চটা বগলে ঢুকিয়ে পাকা লম্বা লাঠিটা বুকের সামনে মাটিতে দাঁড় করিয়ে হাতজোড় করে অবনতমস্তকে সর্দার বললো, “হ্যাঁ, বামুনঠাকুর, আপনারা যাকে বলেন বেহ্মদত্যি!’
এই দৃশ্য দেখে নন্দন ভিরমি খেয়ে বু-বু করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। মহা বিপদ! চোখে মুখে জল দিয়ে নন্দনের জ্ঞান ফিরলে আমরা সোজা বাড়ীর দিকে রওনা দিই।গভীর রাতে ক্লান্ত হয়ে বাংলোয় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নাই। হঠাৎ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। কানটা খাড়া করি। শুনতে পাই ঘরের মধ্যে কার যেন পায়চারির শব্দ। আজ পাশে নন্দন নাই। অসুস্থতার জন্যে তার আজ বিছানা জ্যাঠামশায়ের ঘরে। নিওন বাতির মৃদু আলোয় সব কিছু স্পষ্ট নয়, আবছা দেখা যাচ্ছে। উঠে বসতেই দেখি মাথার দক্ষিণদিকের গাড়ী বারান্দার দরজাটা হাট করে খোলা। হু হু করে বসন্তের মাতাল বাতাস তীরবেগে ঘরে ঢুকছে। অবাক হলাম। বেশ ভাল মনে আছে শোবার সময় সামনের এবং পিছনের দুটো দরজাই ভাল করে এঁটে শুয়েছিলাম। মশারীটা ফাঁক করে নীচে নেমে দরজাটা বন্ধ করতেই অমনি ঘরের আলোটা গেল নিভে। হয়তো লোড শেডিং। আবার শুনতে পাচ্ছি ঘরে কার চলাফেরার শব্দ। অন্ধকারে হাতড়ে বালিশের তলা থেকে টর্চটা বার করে জ্বেলে ঘরের চারদিক খাটের নীচটা ভাল করে দেখলাম। না, কোথাও কিছু নাই। নজর পড়লো দেয়ালে টাঙানো মস্ত বড় বাঁধানো ছবিটার ওপর। মধ্যবয়সী রূপবতী মহিলা। যেন জীবন্ত! ঠিক করলাম আর ঘুমাবো না। বাকী রাতটা জেগে কাটিয়ে দেবো। টেবিলে রাখা জগের জলটা ঢকঢক করে খেয়ে অনেকটা শেষ করলাম। পাওয়ার আসায় নিওন বাতিটা জ্বলে উঠলো। চুপ করে বিছানায় বসে থাকতে থাকতে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। শুয়ে পড়লাম। নানা উদ্ভট চিন্তায় ঘুম আসছে না। চোখ দুটো লেগেছে। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কিন্তু সজাগ। মশারীর একটা খসখস আওয়াজ–মনে হলো কে যেন মশারীটা তুলছে। চোখদুটো মেলতেই দেখি মশারী তুলে আমার মুখের কাছে মুখ এনে এক মহিলা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম “বাঁচাও আমাকে।”
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। গলা থেকে কোন আওয়াজ বেরুলো না। দরদর করে গা দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকালাম। অবিকল ঐ মুখ! খাট থেকে নামতে যাবো– দেখি সারা শরীর অবশ। বহু কষ্টে দেয়াল ধরে দরজায় ছিটকিনি খুলে ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলাম–“কে আছো, আমায় বাঁচাও! “
দড়াম করে একটা শব্দ হয়ে পুনরায় দখিনের দরজাটা খুলে গেল। খোলা দরজা দিয়ে উন্মত্ত একদল হাতির মত অনেকখানি ঝোড়ো বাতাস হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গোটা ঘরটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো।বাড়ীর কেয়ারটেকার ভজনলাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার চোখে মুখে জল দিতেই ধড়ে প্রাণ
এলো। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলি, “তোমরা আমায় কোথায় শুতে দিয়েছো? “
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ভজনলাল জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে দাদাবাবু ?” সবিস্তারে ঘটনাটা বললে ভজনলাল
হো- হো করে হেসে উঠলো। খুব সহজভাবে বললো, “এতে ভয়ের কি আছে! যাকে দেখেছেন, উনি আমাদের গিন্নিমা। এ-বাড়ীর এই ঘরেতেই থাকেন। আজ পর্যন্ত উনি কারোর ক্ষতি করেননি।”
ভজনলালের কথা শুনে মনে হলো আমি এবার নির্ঘাত মূর্চ্ছা যাবো। সারা দুনিয়া ঘুরছে।
–বলো কি! শুনেছি গিন্নিমা–
—হ্যাঁ, মারা গেছেন। প্রায় চব্বিশ বছর আগে।
মল্লিকা দিদিমণিকে হতে গিয়েই। গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। সারা রাত ঐ অশরীরীআত্মার সাথে আমি একা এই ঘরে ছিলাম ! মনে মনে ভীষণভাবে রুষ্ট হলাম ওদের এই অবিমৃষ্যকারীতায়। আবার খুশীতে রোমাঞ্চে শিহরিতও হলাম এক অশরীরী আত্মার অবয়কে চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে।একটু সকাল হতেই বাংলোর পরিবেশটা মনে হলো আজ যেন একটু অন্যরকম। পরিচারক পরিচারিকা থেকে শুরু করে পরিবারের প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে যেন একটা খুশীর হিল্লোল। মাঝে মাঝে শাঁখের আওয়াজ। মনে হলো আমাকে নিয়ে আজ যেন একটু বেশী আদিখ্যেতা শুরু হয়েছে। কি কারণ বোঝা গেল না। কারণটা নন্দনকে জিগ্যেস করলে ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে এ-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জানে না।
সাতসকালে এখন আমি আর নন্দন জ্যাঠামশাই দীনবন্ধু রায়ের ড্রয়িংরুমে। তিনি আমাদের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন এবং একটা সুখবর দেবেন। অধীর প্রতীক্ষায়। গতকাল রাতে লালগড়ের জঙ্গলে আমাদের অভিযানের কথা আদ্যপান্ত শুনলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোমরা ভয়ংকর ঐ জায়গা থেকে নিজেদের জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছো, তাতে আমি কল্যাণময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।”
কথাপ্রসঙ্গে গতকাল রাতের ঘটনা সম্পর্কে জিগ্যেস করলেন, “শুনলাম তুমি নাকি গতকাল রাতে আতঙ্কে ঘুমোতে পারোনি। বাস্তবিক কি ঘটেছিল বলোতো? “
—“জ্যেঠুমণি, গতকাল সারা রাত জুড়ে অনেক ভুতুড়ে ব্যাপার একটার পর একটা ঘটেছে। সবথেকে ভয়ংকর ব্যাপার ভোররাতে যখন এক মহিলা মশারী তুলে মুখের কাছে মুখ এনে আমায় পর্য্যবেক্ষণ করছেন। আমি হলপ করে বলছি –আমি যা দেখেছি তা সঠিক। এতটুকু ভুল অথবা স্বপ্ন নয়।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় জ্যেঠুমণি বললেন, “তুমি ঠিকই বলছো, এতটুকু মিথ্যে বলোনি। শোনো তাহলে বলি—গতকাল যে মহিলাকে দেখেছো, উনি আমার স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী। চব্বিশ বছর আগে আমার কন্যা মল্লিকাকে জন্ম দিতে গিয়ে হার্ট আট্যাকে মারা যান। সেই থেকে আজ অবধি তাঁর এই বাড়ীতেই অবস্থান। বলতে পারো তাঁর কন্যার প্রতি পরম মমত্ববোধে এ-বাড়ী ছাড়তে পারেনি। বাড়ীর লোক কখনও দেখতে পেলেও আমি এবং আমার কন্যা নিয়মিত তাঁকে দেখতে পাই। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তাঁর কথা আমরা শুনতে পাই। হয়তো এখানেও উনি আছেন। আমাদের কথা শুনছেন। সময়কালে ওনার অস্তিত্ব আমরা টের পাবো।”
চেয়ারটা টেনে নন্দন এবার আমার কাছে একটু ঘন হয়ে বসলো। মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। জ্যাঠামশাই দীনবন্ধু রায় বলতে আরম্ভ করলেন–কাজের কথায় আসি বাবা শিবেশ। কথাটা আমার মেয়ে মল্লিকাকে নিয়ে। মল্লিকা আমার একমাত্র মেয়ে। ভবিষ্যতে আমার স্থাবর এবং অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির সেই-ই মালিক। মামণির বিয়ের ব্যাপারে আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। প্রায় শতাধিক পাত্র দেখা হয়েছে। তাদের প্রায় সবার আমার মেয়েকে পছন্দ এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশ আমার পছন্দ হলেও আমার স্বর্গীয়া স্ত্রীর কোনটাকেই পছন্দ হয়নি। আর আসল কথা, তাঁর পছন্দ না হলে এ-বিয়ে সম্পন্ন হবার নয়।
বড় সুখবর, আমার স্ত্রীর তোমাকে ভীষণভাবে পছন্দ হয়েছে। এতদিনে ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। আমার পরিবারে সকাল থেকেই তাই আজ খুশীর হাওয়া। তোমারও একটা পছন্দের ব্যাপার আছে বাবা। আশা করি আমার মেয়েকে তোমার অপছন্দ হবে না। আমার মেয়ে বলে বলছি না। মেয়ে আমার অসামান্যা সুন্দরী, শিক্ষিতা, সংগীতজ্ঞা, মৃদুভাষী এবং সুরুচিসম্পন্না।”
জ্যাঠামশাই চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। আন্তরিকতার সুরে বললেন, তোমরা ব্রেকফাস্ট করে নাও। একটু
বাদেই আমার মল্লিকা মামণি এখানে আসবে। আমরা সকলে মিলে তার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবো।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এই সমস্ত কথা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি নন্দনের হাত দুটো ধরে বললাম, “ভাই, আর দেরী নয়। তল্পিতল্পা গোছানোই আছে। চ, এইবেলাতেই কেটে পড়ি। এই ভূতের বাড়ীতে আর এক মূহুর্ত থাকতে আমি রাজী নই।”
নন্দনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো! কপাল চাপড়িয়ে অবাক চোখে বলল, বলিস কি রে! তোর তো এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ! রাজকন্যার সাথে অর্দ্ধেক নয়, একেবারে গোটা রাজত্ব। বোনটাকে আমার একবার চোখের দেখাই দেখ না! দেখবি, চোখ ফেরাতে পারবি না!আমরা সকলে মিলে শুনছি মল্লিকার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। কি সুরেলা কণ্ঠ! শুধু কণ্ঠ! কি অপরূপ রূপ! রূপের বহ্নি! রূপের আগুনে মনে হচ্ছে যেন চোখ দুটো ঝলসে যাচ্ছে। কি করে একটা নারীর এত রূপ হয়! ভাবতেই পারছি না। এ-যে শিল্পীর রং তুলি দিয়ে আঁকা ছবিকেও হার মানাবে! পোষাকে মার্জিত রুচি। চোখে-মুখে সারা শরীরে যেন একটা লক্ষ্মীশ্রী ছাপ ফুটে উঠেছে। অবাক বিস্ময়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি লক্ষ্মী প্রতিমা মল্লিকার দিকে। আমি খেয়ালই করিনি ঘরভর্তি কতজোড়া চোখ আমার মুখের দিকে
কতক্ষণ আমার এই বেহায়াপনার দৃশ্য উপভোগ করেছে। খেয়াল হতেই ভীষণ লজ্জিত এবং নিজেকে বিব্রতবোধ করলাম।ইতিমধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর্। স্নান খাওয়া-দাওয়া সারা। আজ দুপুরেই বাড়ীর পথে আমরা রওনা দেবো। নন্দন নিজের ব্যাগ-পত্তর গোচাচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে জ্যাঠামশায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়াই। দেখি উনি অস্থিরভাবে পদচারণা করছেন।
–জ্যেঠুমণি!
–বাবা শিবেশ! এসো এসো। তোমরা কি বেরিয়ে পড়েছো? বলছিলাম কি, এই ভরদুপুরে না বেরিয়ে
কাল সকাল সকাল বেরুলে তো ভাল করতে! “
–আসলে আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে একটু জরুরী কাজ আছে, তাই—
–তাহলে তো যেতেই হবে।
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই জ্যাঠামশাই দু’হাত তুলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। একটু ইতস্তত: করে বিনয়ের সুরে বললেন, “বাবা শিবেশ, তোমার মতামতের ব্যাপারটা জানতে পারলাম না। যদি একটু জানাতে—“
আমি নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি হতাশার সুরে বলে উঠলেন, “আমার মেয়েকে কি তোমার পছন্দ
হয়নি বাবা? “
আমি ভীষণভাবে অস্বস্তিতে পড়লাম। বললাম,”এ-কি বলছেন আপনি! আপনার মেয়ে সর্বগুণে গুণান্বিতা। আমি আপনার মেয়ের যোগ্য কি-না সেটা নিয়েই আমি দ্বিধায় আছি। আপনাদের স্নেহে আমি ধন্য, আপ্লুত। এই মূহুর্তে আমি নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। আমার এ-ব্যাপারে কোনো অমত নাই। তবে আমার মায়ের মতামতের প্রয়োজন আছে। “
আমাকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে জ্যাঠামশাই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, “বড় শান্তি পেলাম বাবা। তুমি হীরের টুকরো! তোমাকে চিনতে আমার স্ত্রীর এতটুকু ভুল হয়নি বাবা। পছন্দের ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পেরে মনে হয় এবার আমার স্ত্রীর আত্মাও চিরশান্তি পাবে। শুভস্য শীঘ্রম। আর দেরী নয়। আমি সামনের সপ্তাহের প্রথমদিকেই কলকাতায় তোমাদের টালিগঞ্জের বাড়ীতে তোমার মায়ের সাথে দেখা করে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করবো।”বর্ধমান স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দেবার জন্যে গেটের সামনে গাড়ী দাঁড়িয়ে। গাড়ীতে উঠবার আগে ভেতর থেকে কিসের যেন একটা তাগিদে নন্দনকে বললাম,চ, জ্যেঠিমার ঘরে গিয়ে জ্যেঠিমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে একটু শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি। ঘরে ঢুকে দেয়ালে টাঙানো প্রতিকৃতির দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। যেন জীবন্ত! মায়াময়ী প্রসন্নাদৃষ্টি! ভক্তিভরে প্রণাম করতেই গোটা শরীরে আনন্দ-ভয়ে একটা শিহরণ জাগলো। মনে হলো মাথায় কার যেন মমতা-মাখানো একটা স্পর্শ, কপালে স্নেহবিগলিত স্নিগ্ধ- শীতল ছোঁয়া পেলাম। নিমেষে এক অনির্বচনীয় আনন্দে গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো।
গাড়ীতে উঠতেই লক্ষ্য করলাম অদূরে পরিবারের সমস্ত মানুষ একজায়গায় দাঁড়িয়ে পরম আন্তরিকতায় হাত নেড়ে জানাচ্ছে আমাদের বিদায় অভিনন্দন। মন ছুঁয়ে গেল। বড় হৃদয়গ্রাহী মনোরম দৃশ্য। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা পরিবারে কোথাকার এক অচেনা অজানা মানুষ ভূতের সন্ধানে এসে কেমন করে ঘটনাচক্রে সেই পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষ–একান্ত আপন হয়ে উঠলো, তা ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে।
গাড়ী ছুটছে স্টেশনের দিকে। হঠাৎ নন্দন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে চিৎকার করে ওঠে, “আ-রে, তোর কপালে চন্দনের ফোঁটা!”
নন্দনের দিকে মুখ ফেরাই। দেখি ওর কপালেও চন্দনের ফোঁটা। বললাম, “তোর কপালেও তো চন্দনের ফোঁটা!
নন্দন অবাক হলেও আমি বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না। বুঝতে পারি কখন কোন সময় মঙ্গলকামিনী
মা তাঁর সন্তানদের শুভ কামনায় মস্তক স্পর্শ করে কপালে চন্দনফোঁটা পরিয়ে তাদের যাত্রাপথকে মসৃন ও নিরাপদ করেছেন। চোখ বন্ধ করে দু-হাত বুকে রাখলাম। মন থেকে মুখ দিয়ে দু’টি শব্দ বেরিয়ে এলো—মা মা-ই-ই। -
ভৌতিক গল্প- প্লেগ
প্লেগ
→ ইন্দ্রনীল মজুমদারকরোনার আতঙ্কে গোটা শহর বা গোটা দেশ কেন গোটা বিশ্ব আজ কাঁপছে। বিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই মারণরোগে, মৃত্যু হচ্ছে কয়েক হাজারেরও বেশি মানুষের। গোটা কলকাতা শহর লকডাউন। কি করি, কি করি তাই এই লেখাটি লিখতে বসলাম। ও হ্যাঁ, এর ফাঁকে আমার পরিচয়টা দিয়ে রাখা ভালো। আমার নাম নীলকমল রায়চৌধুরী, ভৌতিক বা প্যারানরমাল বিষয় চর্চা করতে আমি বেশ আগ্রহী। যাই হোক, এবার মূল ঘটনাটায় আসি। বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। কলেজের সেমিস্টার পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন ছুটি পাওয়া গেল। সেই ছুটিতে এখনকারই মতো বাড়িতে বসে বোর হচ্ছিলাম। হঠাৎ, মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। ফেসবুকে “প্যারানরমাল বাংলা” বলে একটি গ্রুপ চালাই, সেখানে ভূত-সম্পর্কে বেশ কয়েকজন আগ্রহী বন্ধু আছেন। তা সেই গ্রুপে একটি পোস্ট দিলাম- “প্ল্যানচেট করার ইচ্ছা আছে? তাহলে সত্ত্বর আমার মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করুন আর ভূত নামাবার এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি লাভ করুন।” তো বেশ কথা। অনেকেই লাইক, কমেন্ট, রিঅ্যাকশন জানাল। কিন্তু মেসেঞ্জারে ম্যাসেজ এলো মাত্র চারজনের। বাকিরা কি তার মানে ভীতু? হবে হয়তো কিংবা এস্ক্যাপিস্ট। যাকগে, এই চারজনকে আমি আমার যোগাযোগ নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা দিয়ে রাখলাম। আর বলে রাখলাম বিকেল পাঁচটার সময় আসতে আসতে।
অধীর আগ্রহ থাকলে বাঙালিও হয়তো সাহেব বনে যায়। ঠিক পাঁচটার সময় কলিংবেল বাজল। কিছুক্ষণ আগেই লোডশেডিং হল। তাই আমিও অতিথিদের জন্য অধীর আগ্রহে বসেছিলাম। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখলাম চারজনের বদলে দু’জন হাজির। তাঁদের পরিচয়টা দিয়ে রাখি- একজন বিশ্বরূপ দাস তিনি পেশায় প্রাইভেট শিক্ষক ও অন্যজন হলেন গৌতম ঘোষ যিনি একজন রিটায়ার্ড সরকারি অফিসার বর্তমানে ভূত ও মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করেন। বাকি দুজন যাঁরা আসবেন বলেছিলেন তাঁরা বিশ্বরূপবাবুর চেনা। তাঁদের মধ্যে একজন অফিসের কাজে আটকে গেছেন আর অন্যজন প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে বলেছিলেন, “সর্বনাশ। এভাবে কি সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়?” বিশ্বরূপবাবু যদিও তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, “আরে মশাই, ভয় নেই, আমরা তো আছি। তাছাড়া উল্টোপাল্টা কাউকে নামাব না।” বোঝানো সত্ত্বেও তিনি আসেননি। আমি বললাম, “একদিকে ভালোই হল। কখন যে কি হয়ে যাবে তখন আমাদের ঘাড়েই দোষ পড়বে। আর তাছাড়া প্ল্যানচেটে তো তিনজন লোক লাগে। আমি ইচ্ছে করেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম। জানতাম, এইসব ব্যাপারে লোক কমই আসবে। বিশ্বরূপবাবু বললেন, “তা তো বটেই! আর তাছাড়া লোডশেডিং। শুনলাম কারেন্টের কাজ চলছে তা ঠিক করতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই। এরকম জমজমাট রোমহর্ষক পরিবেশ প্লানচেট করার পক্ষে বড়োই শ্রেয়।”
তা, আমরা তিন-পায়া টেবিল, মোমবাতি, কাগজ ও পেন্সিল নিয়ে ছাদের পাশের ঘরটিতে প্লানচেট করতে বসলাম। সমস্ত গুছিয়ে বসলেই তো আর হল না। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে ডাকব কাকে? রোজই তো কারুর না কারুর মৃত্যু ঘটছে। আর তাছাড়া ভালো কাউকে তো ডাকতে হবে। এই “ডাকব কাকে?”- হ্যাঁ এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যখন তখন গৌতমবাবু উপদেশ দিলেন, “একজনকে ডাকা যায়। শুনেছি এই অঞ্চলে তারাপদ চট্টোপাধ্যায় বলে একজন থাকতেন বহু বছর আগে। তিনি এক জায়গায় খুব সম্ভবত আত্মীয়র বাড়ি গিয়েছিলেন। তারপর আর ফিরে আসেননি। তাঁর মৃত্যুরহস্য কেউ জানে না। অতএব,চলুন তাঁকেই আহ্বান করা যাক।”
আমি উৎসাহের সাথেই বলে উঠলাম, “হুম্, তাই হোক। দেখা যাক তিনি আসেন কিনা।”
আমরা সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে বসলাম প্ল্যানচেটে। একমনে সময় তারাপদবাবুকে মনে মনে ডাকতে বা স্মরণ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ডাকার পর হঠাৎ দেখি বিশ্বরূপবাবু অস্বাভাবিকভাবে বিড়বিড় করে চলেছেন। বুঝলাম, তাঁর মধ্যে আত্মার আবির্ভাব ঘটেছে। আমি কাগজ ও পেন্সিল এগিয়ে দিলাম আর প্রশ্ন করলাম, “তারাপদবাবু এসেছেন?”
বিশ্বরূপবাবুর চোখ বন্ধ অথচ না দেখে লিখলেন, “হ্যাঁ।”
গৌতম বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মশাই, আপনাকে স্বাগত জানাই। আমরা জানতে চাই যে, আপনার মৃত্যু হয়েছিল কিভাবে? যদি একটু বলেন।”
এই প্রশ্ন শুনে আত্মা বিশ্বরূপবাবুকে মিডিয়াম করে যা লিখলেন, তা জাস্ট একটা রোমাঞ্চকর কাহিনী। আনুমানিক মিনিট পঁচিশ ধরে এই লেখা চলল। তারপর বিশ্বরূপবাবুকে ধাতস্থ ও স্বাভাবিক হতে দেখে বুঝলাম তারাপদবাবুর আত্মা চলে গেছেন। আমরা বিশ্বরূপবাবুকে প্রশ্ন করলাম, “কেমন লাগছে এখন?” বিশ্বরূপবাবু আস্তে আস্তে চোখ খুলে বললেন, “এখন একটু ভালো লাগছে। একটু জল হবে?।
“নিশ্চয়ই।” বলে এক গ্লাস জল দিলাম। বিশ্বরূপবাবু জল খেয়ে বললেন, “একটু আগে হঠাৎ শরীরটা বেশ ভারী লাগছিল আর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তাই কিছুই মনে নেই।”তখন সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কারেন্টও চলে এসেছিল। তাই, আলো জ্বালিয়ে কাগজের লেখাটি পড়লাম। তাতে লেখা আছে-
“২৩ শে মার্চ, ১৯২০।
তখন বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের পরে প্লেগ সারা বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করে এলো। কাতারে কাতারে লোক মরছে। মহামারীর আঁচ লাগল আমাদের দেশে। এখানেও শহরে, গ্রামে-গঞ্জে ছেয়ে গেল মহামারীতে। লোকে মরতে লাগল। এসবের মধ্যে আমাদের গ্রাম নিশ্চিন্দপুরেও হঠাৎ মহামারী প্লেগের আবির্ভাব হল। সেখানেও চিকিৎসার অভাবে কাতারে কাতারে লোক মরতে লাগল। আমার তিনকুলে কেউ ছিল না। কলকাতায় এক সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতাম। তা হঠাৎ একদিন গ্রামের ছেলেবেলাকার বন্ধু মৃন্ময় রায়ের কাছে থেকে চিঠি পেলাম। বন্ধু কেমন আছে?বা তার পরিবারের কোনো খবর চিঠিতে লেখা নেই। কেবল লেখা আছে- “এখানে আসতে হবে, বড়োই জরুরী।” তা ওইসময় প্লেগের দাপট একটু কমেছিল। বড়ো সাহেবকে ব্যাপারটা জানাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন। তা নিশ্চিন্দপুর রওনা দিলাম বন্ধুর সাথে দেখা করতে। নিশ্চিন্দপুর স্টেশনে যখন পৌঁছাই, তখন সেখানকার আবহাওয়ায় কেমন একটা থমথমে ভাব। প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে একটা গরুর গাড়ি ধরার জন্যে এগোলাম। কিন্তু একটা মানুষকেও দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যেবেলা অথচ কোথাও শঙ্খধ্বনির আওয়াজ নেই, মানুষের কোলাহল নেই। সব যেন ফাঁকা, জনমানব শূন্য। তা, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ রেল স্টেশনের দিকে আসছিলেন। তিনি আমাকে দেখে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাওয়া হবে?”
– আজ্ঞে, রায় বাড়ি।
– রায় বাড়ি! ও বাড়ির সকলেই তো……..পুরোটা শুনলাম না। গটগট করে হাঁটতে লাগলাম। একেই সন্ধ্যা নেমে গেছে তারউপর পথ পুরো ফাঁকা। যেভাবেই হোক, তাড়াতাড়ি বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতেই হবে। রায়বাড়ি কিছু হবে তা আমি বিশ্বাস করি না। বন্ধুর চিঠি যখন পেয়েছি তখন ওরা প্লেগে মারা যায়নি। তা বন্ধুর বাড়ির সামনে যখন এলাম তখন বেশ অবাকই হলাম। ধু-ধু করছে বাড়ির চারপাশ। বাগানে আগাছায় ভর্তি। মনে হচ্ছে, বাড়িতে কেউ নেই। অথচ মাস দুয়েক আগেই এসেছিলাম। বেশ ভালো অবস্থাই ছিল। বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলাম। দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল! যেন আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল এই যে, দরজার সামনে কেউ নেই! ভেতরে বেশ খানিকটা দূরে এক ঘোর অন্ধকারে বন্ধু, ওর মা-বাবা, দাদা-বৌদি ও বাড়ির কাজের লোক সবাই বসে আছে। যেন আমি আজই ও এই সময়টাতেই আসব আর সেজন্যেই সবাই অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বন্ধু অস্বাভাবিক ক্ষীণ গলায় বলল, “এসেছিস। আমি জানতাম তুই ঠিক আসবি।”
আমি বললাম, “তা তোদের দেখতে তো আসবোই। আরে! এভাবে অন্ধকারে এই সন্ধ্যেতে কেউ।বসে থাকে? আলোর ল্যাম্প জ্বালাসনি?”
বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ক্ষীণ গলায় বলল, “ল্যাম্পের আলো বা যেকোনো আলো এখন আর সহ্য হয় না রে।”
আমি সন্দেহবশতই জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা সবাই ঠিক আছিস তো? কিছু মনে করিস না এই বাড়িতে কেমন যেন একটা দুঃখের ছায়া।”
বন্ধু আমার কথায় উত্তর না দিয়ে বলল, “ওই টেবিলটাতে গিয়ে বস। তোকে কিছু খেতে দিই।”
অন্ধকারে আমি কাউকেই ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। বন্ধুর মা যখন আমার কাছে খাবার নিয়ে এলেন আর বলতে লাগলেন, “খা বাবা, অনেকদিন পর এলি যে!” তখন আমার পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওই অন্ধকারেই কাছ থেকে যেটুকু দেখা গেল তা হল বন্ধুর মা এক কঙ্কাল ও তাঁর চোখ থেকে ঠিঁকরে যেন আগুন বেরোচ্ছে। বাকিদের দিকে তাকিয়েও দেখি সবার একই অবস্থা। সবাই কঙ্কাল আর সবার চোখের কোটর থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে। আমি ভয়ে দৌড়াতে লাগলাম, পেছন থেকে শুনছিলাম, সবাই বলছিল,- “এই ধর, ধর, পালাচ্ছে, ধরে……।” আমি তো দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছি। ওদের ডাকার উদ্দেশ্যে তাহলে বোঝা গেল। কতক্ষণ দৌড়েছি তার খেয়াল নেই। এমন সময় কোনোরকমে প্লাটফর্মে এসে হাজির হলাম। তাড়াহুড়োতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে লাইনে আছড়ে পড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দেখি, বেশ ভালোই লাগছে, ভয়ও কেটে গেছে। কিন্তু সামনে কিছু লোকজন ও পুলিশ কেন?
এগিয়ে একজন কুলিকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে দাদা? ওখান ভিড় কেন? আবার পুলিশও দেখতে পাচ্ছি।”
তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, “কে একজন লাইনে পড়ে মাথা ফেটে মারা গিয়েছে। তাই পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল।”
আমার ভেতরটাহঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। একটু কাছে গিয়ে দেখি, আরে! এই রক্তমাখা দেহটা তো আমারই! এত রক্ত ভেসে আছে যে মুখটা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না। এমন সময় হঠাৎ ওপারে দূরে চোখ পড়তেই দেখি বন্ধু ও তার পরিবার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ওদের চেহারা কঙ্কালের নয় বা ওদের চোখ থেকে কোনো আগুনের গোলাও ঠিঁকরে বেরোচ্ছে না। ওরা যেন জ্যান্ত ছায়ামূর্তি। এই আমার মৃত্যু-কাহিনী। এবার আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি এখন আসি। আপনারা ভালো থাকবেন।
ইতি
তারাপদ চট্টোপাধ্যায়আজ যখন করোনা নামক মহামারী পৃথিবী কাঁপাচ্ছে তখনই মনে পড়ে গেল সেই প্ল্যানচেটের ঘটনা যেখানে উল্লেখ রয়েছে ঠিক একশো বছর আগের প্লেগ মহামারীর কথা।
(কোথাও একটা দেখছিলাম যে, পৃথিবীতে ১৭২০, ১৮২০, ১৯২০ আর ২০২০ অর্থাৎ একশো বছর অন্তর অন্তর মহামারী দেখা দিয়েছে। ব্যাপারটা বড়োই আশ্চর্যের না! এই কঠিন সময় সবাই সাবধানে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ও ঘরে থাকুন। সমস্ত সকারি নির্দেশিকা মেনে চলুন।)
-
ভৌতিক গল্প- নীল শরীর
নীল শরীর
– দেবস্মিতা ঘোষ“ধুর আজ আর না বেরোলেই ভালো হতো। গাইডটার আজই জ্বর হতে হয় বল।” হালকা বিরক্তি মুখে ফুটিয়ে বলল তুতুন।
“আরে ওইরকম করে বলিস না রে, জ্বর তো হতেই পারে।” মিতালী ওকে থামাতে যায়।তুতুন আর মিতালী দু’জন বন্ধু । চেন্নাই কলেজের তৃতীয় বর্ষের সাহিত্যের মোট আট জন বন্ধু বান্ধবী মিলে কেরালা ঘুরতে এসেছে তারা। দশ দিনের পরিকল্পনা। সাত দিন অতিবাহিত। আজ সকালে ওরা মুন্নার এসেছে। সারা সকাল ঘুরেছে। বিকেলের বেড়াবার প্ল্যানটা গাইডের অসুস্থতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বাকিরা হোটেলেই কফি সহযোগে আড্ডায় মেতে উঠলেও তুতুন আর মিতালী বেড়াতে এসে একদিনও নষ্ট করতে রাজি নয়। স্থানীয় লোকের থেকে খবর পেয়ে তারা মাত্র দু’ কিলোমিটার দূরে থাকা “বাতিস্তা” গ্রামের উদ্দেশ্য। প্রধান আকর্ষণ একটি পোড়ো হোটেল। গ্ৰুপের বাকি বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করে আটকানোর, কিন্তু ওদের আটকানো যায়না। ডিনারের অনেক আগে ফিরে আসবে কথা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা।
বাতিস্তা পৌঁছাতে ওদের মিনিট কুড়ি লাগে। গিয়ে দেখে শুধুই একটি সাধারণ গ্রাম। গ্রাম লাগোয়া একটি আধ ভাঙা বাড়ি জঙ্গলে জড়িয়ে পড়ে আছে, লোকে বলে না দিলে জানাই যেত না যে ওটা হোটেল।
স্থাণীয় চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালো মিতালী। তারপর দু’জন এগিয়ে গেল সেই হোটেলের দিকে। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল, যদিও জঙ্গলের জন্য বেশি কাছে যাওয়া যায় না।
“গাইডটার কি আজই জ্বর হতে হয় নাকি বলতো। এখানে এসে কি লাভটা হলো। কিছুই তো নেই।” বলল তুতুন।
“গাইড তো ওই 18 বছরের ছেলে, মানুষ তো রে জ্বর হতেই পারে। তবে এখানে আসার পরিকল্পনাটাও বেকার ছিল। ভেতরেই যেতে পারবো না যা জঙ্গল। আরে ওইদিকে একটা লোক বসে আছে না, জঙ্গলের মধ্যে চেয়ার নিয়ে বসে আছে কেন রে? ভূত নাকি” মিতালী হাত তুলে একটা জায়গা দেখাল।
“জঙ্গলের মধ্যে চেয়ার নিয়ে ভুত বসে থাকবে, বলিহারি তোর বুদ্ধি, চল গিয়ে দেখি”
ওরা লোকটার কাছে যায়। লোকটি মনে হয় ঝিমুচ্ছিলো, ওদের পায়ের আওয়াজে মুখ তোলে।
সাধারণ গ্রামীন পোশাক পরা বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ। ওরা এইখানে ঘুরতে এসেছে শুনে ভেতরে যাবার কথা বলে।
“পিছনের একটা রাস্তা আছে ওখান দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়। আমি ভেতরেই থাকি, দেখবে চল।”তুতুন, মিতালী একটু ইতস্তত করে শেষ অবধি চলে যায়। পিছনের দিকে জঙ্গল কেটে রাস্তা করা। হোটেলের ভিতরে ঢুকে তারা বুঝতে পারে এই হোটেলটা অগ্নিদগ্ধ। কোনো এক সময় আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। কোনার দিকে একটা ঘর পরিষ্কার করে জিনিসপত্র রাখা। মাদুর, স্টোভ, কিছু জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রী আরো কত কিছু যা দেখে বোঝা যায় বুড়ো সত্যিই এখানে থাকে। ওদের মাদুরে বসায়। ভালোই অন্ধকার এখানে, ইলেক্ট্রিসিটি থাকা সম্ভব নয় তা দেখেই বোঝা যায়। তুতুনকে টর্চ বন্ধ করতে বলে মোমবাতি জ্বালায় সেই বৃদ্ধটি।
“আপনি এই ভাঙা, পোড়া হোটেলে থাকেন কেন?” মিতালী জিজ্ঞাসা করে।
“আমার ঠাকুরদা এই হোটেলের দারোয়ান ছিলেন, সেইজন্য এখানেই থাকতেন। আর কোনো বাড়ি ছিল না। এই হোটেলের শেষ দিন অবধি তাই আমিও এখনে থাকব।”
“এই হোটেলটা কি ভৌতিক, আর এটার এরকম দশা হলো কিভাবে” তুতুন বলল।
“শুনতে চাও যখন বলছি তবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার তোমাদের ওপর। এই হোটেল ভৌতিক কিনা সেটাও পুরোটা শোনার পর বুঝতে পারবে।” একটু থেমে আবার শুরু করল ।
“আমার ঠাকুরদা তখন এই হোটেলের দারোয়ান। বাবা ও কর্মচারী। হোটেলের তখন জমজমাট অবস্থা। সেইরকম এক শীতকালে বেড়াতে এলো বীথি কুন্তল নামে এক দম্পতি। ঠিক চারদিন ছিল। ঠিক সেইসময় এই হোটেলে এসে উঠেছিল একটি স্কুলের দশ বারো জন ছেলে আর দু’জন শিক্ষক। সবই ঠিকঠাক ছিল। সমস্যা হল ফিরে যাওয়ার সময়। দুই দলেরই ট্রেন ছিল “কুন্তী” স্টেশন থেকে। কিন্তু ওই স্টেশনটা যে ভালো নয়, রাতের বেলা সেখানে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে সে কথা তাদের বোঝাতে পারেনি হোটেল কর্তৃপক্ষ। নীল শরীরের আক্রমণ থেকে ওদের বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিল হোটেলের লোকেরা।”
“নীল শরীর মানে?” তুতুন বলে।
“এই গ্রামের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্টেশন “কুন্তী”তে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল বিপ্লবীরা। মৃত সমস্ত লোক ফিরে এসেছিল যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে। ওদের এখনো দেখা যায় ওই স্টেশনে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে। আর কোনো মানুষ যদি ভুল করেও ওখানে যায় ট্রেন ধরতে তবে তাদেরও ওই নীল মানুষের ট্রেনে উঠতে হয়। তারাও হয়ে যায় নীল মানুষ। কেউ নীল শরীর নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামের মানুষ সবই জানে। তাই কোনো নীল শরীর দেখলেই ওরা পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে দিত। এখন আর নীল মানুষরা ফেরে না গ্রামে। তবে ওরা এখনো আছে।
যাই হোক, বীথিদের নিরস্ত করা গেলনা। ওরা সেই ওই স্টেশনেই চলে গেল। তবে শেষ বারের মতো ওদের বলে দেওয়া হয়েছিল স্টেশন মাস্টারের অনুমতি ছাড়া কোনো ট্রেনে না উঠতে। স্টেশনমাস্টার স্থানীয় লোক, তার কোনো ক্ষতি হয়নি কখনো। বিথীদের কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেদের দলটাও বেরোলো। ওদেরও একই কথা বলে দেওয়া হয়েছিল। বিথীদের ও ছেলেদের দলকে নিয়ে নিজে স্টেশনমাস্টার দাঁড়িয়েছিলেন প্লাটফর্মে। ধীরে ধীরে ওরা দেখে আরও মানুষের আগমন হচ্ছে। তাদের গায়ের চামড়া নীলচে। চোখ গুলি লাল। তারা সারা স্টেশন ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংখ্যায় অগুনতি। হঠাৎ একটি ট্রেন এলো কলেজের ছেলেরা কোনো বাঁধা না মেনেই উঠে গেল, ওরা এই পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারছিল না। ওরা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু নীল মানুষ ও উঠে পড়ল। আর কলেজের ছেলেদের ট্রেনে ওঠা দেখে জয়ের হাসি হাসতে লাগল তারা। হাসির দমকে কেঁপে উঠলো স্টেশন । বীথি কুন্তলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। স্টেশন মাষ্টারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে ওদের ফিরে যেতে আদেশ দিল। ওদেরও আর ট্রেনে ওঠার সাহস ছিল না। ওরা সেই রাত্রে হোটেলে ফিরে এসেছিল। কিছু না খেয়েই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বীথি ঘুমালে বাইরে আসে কুন্তল। রাত বারোটা নাগাদ কমন খাবার জায়গা মানে ডিনার রুমে থেকে হইহল্লা শুনে কুন্তল উঁকি মেরে দেখতে যায়। সে দেখে সেই ছেলেদের দল ওখানে বসে খাচ্ছে। ওকে দেখে তারা চমকে উঠে। হোটেলের বাকি কর্মচারীরাও ছিল ওখানে। কৈফিয়ত এর সুরে ওরা বলে পরের স্টেশনে নেমে গেছিল ওরা। সেখান থেকে এই হোটেলে চলে এসেছে। কুন্তল আবার রুমে ফিরে যায়। ও বীথিকে জাগিয়ে তোলে, সবটা বলে। বীথি বলে ওরা তো সাধারণ দেখতেই, তাহলে ওরা সত্যি বলছে। কুন্তল বলে, না সমস্যাটা হলো হোটেলের কর্মচারীদের গায়ের রং নীল লাগছে, ওরা সবাইকে নীল মানুষ করে দিয়েছে। আমি অভিনয় করছিলাম যেন আমি ওদের চিনি না। আমাদের যেভাবে হোক পালাতে হবে। বীথির মুখের রং সাদা হয়ে গেল ভয়ে। কিভাবে পালাবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা। শেষে ওরা বাথরুমের জানলা ভেঙে পালিয়ে যায়। গ্রামের মানুষদের ডেকে আনে, আগুনে পুড়িয়ে দেয় পুরো হোটেল। আমি বাদে কেউ রক্ষা পায়নি। আমার বয়স ছিল পনের বছর।সেই থেকে আমি একাই রয়েছি।”
” আপনাকে ওরা নীল মানুষ বানায়নি কেন?” মিতালী জিজ্ঞেস করল।
“বীথি কুন্তল ছিল একমাত্র মানুষ যারা নীল শরীরের হাত থেকে বেঁচে গেছে। তবে আমি জানতাম ওরা আবার আসবে, হয়ত অন্য রূপে তবে ওদের আসতেই হবে। সেই জন্য তো এতবছর অপেক্ষা করে আছি। প্রতিশোধ চাই আমার” বিড়বিড় করতে থাকে বুড়ো।
“আপনাকে ওরা নীল মানুষ বানায়নি!” আবার জিজ্ঞেস করে মিতালী।
“কে বলেছে বানায়নি.. ” মোমবাতির আলোটা নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে সে, তার চামড়া ধীরে ধীরে নীল হচ্ছে। চোখের রং বদলাতে শুরু করেছে, পাগলের মতো বিড়বিড় করছে সে, “আসতে তো তোদের হতই, এক রূপে না হয় অন্য রূপে.. আমার এত বছরের অপেক্ষা… নীল শরীরের নেশা বড় বিষাক্ত..তার হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারেনা….
পরদিন সকালে বাকি বন্ধুরা গিয়ে দেখে মিতালী আর তুতুন এর মৃতদেহ। কোনার ঘরে ফাঁকা ধুলো ভর্তি মেঝেতে, কি জানি কি কারণে দুজনের গায়ের রং পুরো নীল হয়ে গেছিল।
-
ভৌতিক গল্প- নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো
নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো
প্রলয় কুমার নাথ(১)
এই কাহিনীর পটভূমি হল ব্রিটিশ শাসনকালে অবিভক্ত বঙ্গদেশে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত একটি জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম, নাম নারায়ণগঞ্জ। কয়েকশো ঘর প্রজা এবং স্থানীয় জমিদারের পরিবারটি নিয়ে সুজলা সুফলা এই গ্রামে সুখ শান্তি এবং সমৃদ্ধি ছিলো সর্বদা বিরাজমান। সেই সময় অখিলেশ চৌধুরী ছিলেন জমিদার বাড়ির কর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং দানশীল ব্যক্তি, তাই প্রজাদের মধ্যে ছিলো না কোনো দুঃখ কষ্ট। সেই যুগেই অখিলেশ বাবু ছিলেন নারীশিক্ষার পক্ষে, তাই তার একমাত্র কন্যাসন্তান, মণিমালার গ্রামের স্কুলের গন্ডি পার হয়ে গেলে, তিনি তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠিয়েছিলেন।কলকাতার কলেজে বিদ্যার্জনের সময় থেকেই মণিমালার আলাপ হয় তার এক সহপাঠী সুদর্শন যুবকের সাথে, নাম শুভময় ব্যানার্জী। স্থানীয় এক উচ্চবিত্ত পরিবারের এই একমাত্র বংশধরটি খুব ছোটবেলাতেই নিজের মা বাবাকে হারিয়েছিলো। ক্রমে মণিমালার সাথে শুভময়ের সম্পর্ক প্রণয়ের রূপ নিতে থাকে, এবং তারা বিবাহ করবার সিদ্ধান্ত নেয়। অখিলেশ বাবুরও শুভময়কে জামাই হিসাবে খুব পছন্দ হয়, তাই খুব ধুমধামের সাথে তিনি চার হাত এক করার ব্যবস্থা করেন। বর্তমান সময়ে বিয়ের পর এই প্রথম বার শুভময় কিছুদিনের জন্য তার শ্বশুরালয়ে এসেছে, নারায়ণগঞ্জ গ্রামে। তাই জমিদার বাড়িতে আনন্দ উৎসব এবং নতুন জামাইকে দেখার জন্য গ্রামবাসীদের ভিড় লেগেই আছে।
সেদিন সকালে মণিমালা তার স্বামীর জলখাবারের জন্য সবে আসন পেতে লুচির পাত্রটি সামনে রেখে তাকে ডাকতে যাবে, এমন সময় বাড়ির উঠোনে কেমন যেন একটা কোলাহলের আওয়াজ শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলো তার মন। কৌতূহলী হয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সে নিচে নেমে দেখলো, সেখানে বাড়ির সকলেই উপস্থিত, এমনকি শুভময়ও। সকলের আকর্ষণের কেদ্রবিন্দু হল এই বাড়ির এক কাজের মেয়ে, হৈম। গায়ের রং কালো হলেও এই আঠেরো বছরের যুবতীটির দৈহিক গঠন বেশ আকর্ষণীয়। সে যেন হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে জমিদার গিন্নির উদ্দেশ্যে বলে চলেছে, “না গো কত্তামা, কত্ত খোঁজা হল তাকে!…পাশের জঙ্গলের ভেতর, দীঘির ধারে, নদীর পারে, ধানক্ষেতের মাঝে, এমনকি আশপাশের দু-একটা গাঁয়েও লোক পাঠানো হয়েছিলো…কিন্তু কোত্থাও পাওয়া গেল না তাকে!”
মণিমালা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কার কথা বলেছিস তুই হৈম? কাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
হৈমর হয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে তাকে উত্তর দিলেন স্বয়ং অখিলেশ বাবু, “আমার এক প্রজা শিবেনের বউ প্রতিমাকে! কাল সন্ধ্যের পর থেকে নাকি তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
“সে কি!” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো মণিমালা, ঠিক এমনই সময় তার চোখ গেল তার স্বামী শুভময়ের দিকে। সে যেন হাঁ করে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে হৈমর দিকে। এটা দেখে খুব অস্বস্তি লাগলো মনিমালার, কারণ তার বুঝতে বাকি রইলো না যে শুভময়ের মন প্রতিমার নিখোঁজ হওয়ার খবরের দিকে নেই, সে যেন হৈমর শরীরটাকে পা থেকে মাথা অবধি জরিপ করতেই ব্যস্ত।কিন্তু হৈম বোধহয় তা আন্দাজ করতে পারেনি, সে সরল মনে বলেই চলল, “খুব অভাগী ছিলো প্রতিমা দিদি, জানেন তো কত্তামা। শিবেন দাদার সাথে বিয়ের দু’বছর ঘুরতে চললো, এদিকে এখনো ওদের কোনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি…এই নিয়ে সারাদিন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কথা শোনাতো ওকে, বলতো নাকি ওর শরীরে খুঁত আছে, ও বাঁজা! সেই দুঃখেই কি ঘরছাড়া হল প্রতিমা দিদি!”
“আহা রে!” বলে উঠলেন জমিদার গিন্নি, “আমার তো মনে হয়, দোষ ওর কিছু নেই! অমন তালপাতার সেপাই-এর মত চেহারা শিবেনটার, দেখলেই মনে হয় দোষ যদি কিছু থাকে তা শিবেনের, প্রতিমার নয়!”শুভময় এখনো কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে হৈমর দিকে। আর সহ্য হল না মণিমালার, সে কোনরকমে এই কথোপকথনের ইতি টেনে, জলখাবারের অছিলায়, হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো শুভময়কে নিজের ঘরে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে, ক্রোধে ঈর্ষায় ফেটে পড়ে, শুভময়ের সামনে এক ঝটকায় নিজের শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে দিলো নিজের সেমিজ পরিহিত সুডৌল স্তনযুগলের ওপর থেকে। তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো, “নাও দেখো, চোখ ভরে দেখো…কার শরীরটা বেশি সুন্দর বল…আমার না হৈমর? ছি ছি, বাড়ির জামাই হয়ে লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে একটা কাজের মেয়েকে দেখে অমন ভাবে চেয়ে থাকতে পারলে তুমি!”
শুভময় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলো মণিমালার এই ব্যবহারে, সে দুই একবার ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করলো, “না না মণি…আমি তো…আমি তো শুধু…” কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও যেন সেটা তার মুখে এলো না!
(২)
রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে গোটা নারায়ণগঞ্জ গ্রাম। কোনো ঘরেই জ্বলছে না কোনো কুপির আলো, ভেসে আসছে না কোনো মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ। শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে গ্রামের রাস্তায় ঘোরা কুকুরগুলো বা পেছনের জঙ্গলে নৈশভোজে ব্যস্ত শেয়ালগুলোর ক্রন্দনধ্বনি। গ্রামের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি মাটির বাড়ির দরজা ঠেলে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো এক যুবতী। চাঁদের হালকা আলো এসে পড়লো তার দুই চোখের ওপর, যা এই মুহূর্তে গাঢ় রক্তবর্ণ রঙ ধারণ করেছে। যেন কোনো অকল্পনীয় অমোঘ আকর্ষণের বশীভূত হয়ে সে তীব্র গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো গ্রামের শেষ প্রান্তে, শ্মশানের রাস্তা ধরে।মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কোনো রাতপাখির কর্কশ ডাক, সাথে যুবতীর পায়ের নুপুরের মৃদু নিক্কন ধ্বনি। শ্মশানে যেন তার জন্যই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল এক দীর্ঘদেহি পুরুষ! তার কাছে আসতেই যুবতী নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরলো পুরুষটির দেহটিকে, তার নিঃশ্বাসের গতিবেগ হল আরো দ্রুত। শ্মশানের ছাইভস্মে ভরা মাটির ওপর খসে পড়তে লাগলো যুবতীর শাড়ি এবং সকল অন্তর্বাস। রাতের অন্ধকারের মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গেল দু’টি শরীর। নারীর শরীরের ওপর বিচরণ করে শুরু হল পুরুষের চিরাচরিত পরিশ্রম। দু’জনের মৃদু সুখপ্রাপ্তির শব্দে মুখরিত হল শ্মশানের আকাশ বাতাস।
“কত্তাবাবুউউউ…”
পরদিন সকালে গ্রামের জেলে হারান পালিতের এই মর্মভেদী কণ্ঠস্বরে সচকিত হয়ে বাড়ির উঠানে ছুটে এলেন অখিলেশ বাবু। মাছ ধরার জাল এবং সকল সরঞ্জাম মাটিতে ফেলে তখন বিস্ফারিত চোখে হাঁপাচ্ছে হারান। ততক্ষণে বাড়ির বাকি সকলেও ছুটে এসেছে উঠোনে।
“কি রে হারান…অমন করছিস কেন… কি হয়েছে?” বলে উঠলেন অখিলেশ বাবু।
“বাবু…বাবু গো…আজ সকালে নদীতে যাচ্ছিলাম মাছ ধরার জন্য। শ্মশান দিয়ে গেলে অল্প সময়ে লাগে, তাই সেদিক দিয়ে চলেছিলাম”, কম্পিত গলায় বলতে শুরু করলো হারান, “কিছুটা গিয়েই সেখানে একটা ঝোপের পাশে দেখলাম আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা পড়ে রয়েছে…কি যেন নামটা…হ্যাঁ, হৈম! শরীরে একটা সুতো অবধি নেই!…হৈম আর বেঁচে নেই বাবু, কেউ ওর সুখ নিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে কাল রাতে!” আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো হারানের সর্বশরীর।সেখানে উপস্থিত বাড়ির সকলের মাথার ওপর যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে গেল।
(৩)
প্রতিমার নিরুদ্দেশ হওয়া এবং হৈমর এই নিদারুণ পরিণতির জন্য যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা গ্রামে। এর মধ্যেই এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় থানা থেকে অপরাধীর সনাক্তকরণের বিষয়ে এখনো কিছুই জানানো হয়নি। তবে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য ইতিমধ্যেই পেয়েছে গ্রামের মানুষ, সেটা হল যে হৈমর শরীর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে তাকে কিন্তু ধর্ষণ করা হয়নি। সেই রাত্রে সে নিজের ইচ্ছায় কোনো পুরুষের সাথে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে, এবং তারপর তাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছে!হৈমর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই, পরের সপ্তাহে এই অনুরূপ আরেক যুবতীর হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক জোরালো হয়েছে নারায়ণগঞ্জ গ্রামে। এই গ্রামে সুশীল নাপিতের বহু পুরুষের বাস। তার স্ত্রী বাতাসীকে গ্রামের সকলেই চেনে। নাপিত পরিবারের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের থেকে একটু বেশিই সুশ্রী সে। সেদিনও সে জমিদার বাড়িতে এসেছিলো বাড়ির মহিলাদের নখ কেটে পা ঘষে আলতা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। হৈমর মত সেও যে শুভময়ের নজরে পড়েছে, এটাও টের পেয়েছে মণিমালা!
কিন্তু তখন কি আর কেউ বুঝেছিলো, যে সেই হবে এই গ্রামের ‘নারীখেকো’-র পরবর্তী শিকার। পরদিন সকালেই তারও সম্ভোগ করা মৃত শরীরটা আবিষ্কৃত হয়েছে গ্রামের পেছনের জঙ্গলের ভেতর থেকে। স্থানীয় এক কাঠুরে প্রথম দেখতে পায় বাতাসীর নগ্ন মৃতদেহটিকে, এবং সেই কথা জানায় জমিদার বাড়িতে। এই ক্ষেত্রেও পুলিশের একই বক্তব্য, বাতাসী স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষের সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়েছে, অতঃপর তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে!
দেখতে দেখতে কেটে গেল আর একটি সপ্তাহ। তবে এখনো ‘নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো’-র কোনো সন্ধান পায়নি পুলিশ। নায়েব মশাই-এর মেয়ে কল্পনা মণিমালার ছোটবেলার বান্ধবী। খুব অল্প বয়সেই পাশের গাঁয়ের এক ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলের সাথে বিবাহ হয় তার। তার স্বামী আপাততঃ কলকাতার কলেজে ডাক্তারি পাঠরত। মণিমালা আর শুভময়ের আসার খবর পেয়ে, ছেলেবেলার বান্ধবী এবং তার স্বামীর সাথে দেখা করতে বাপের বাড়ি এসেছে কল্পনা। পরীক্ষা এবং পড়াশোনার চাপে তার স্বামী আসতে পারেননি। তবে গ্রামে ফিরে এখানে ঘটে চলা নারীহত্যাগুলির কথা শুনে সেও যথেষ্ট ভীত-ত্রস্ত।
জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় সকলের সাথে কথা হচ্ছিলো কল্পনার। শুভময়ের সাথে তার আলাপ আগেই হয়েছে। তবে এই আনন্দের মুহূর্তগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা বিভীষিকা দানা বেঁধে আছে সকলের মনে। কল্পনা অখিলেশ বাবুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “আসলে উনি বলছিলেন, যে এই গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করা উচিত। আপনার কাছে সেই বিষয়ে পরামর্শ চাইতে বলেছিলেন, কাকাবাবু।”
অখিলেশ বাবু হেসে বললেন, “এতো অতি উত্তম প্রস্তাব। তুমি শুধু তাকে বোলো ডাক্তারিটা ভালোভাবে পাশ করে ফিরতে, বাকি সকল ব্যবস্থা আমিই করে দেবো…”এমন নানা কথার মাঝে, আবার মণিমালার চোখ চলে গেল শুভময়ের দিকে। এবারও সে যেন নিজের দৃষ্টি দিয়ে গোগ্রাসে গিলে খেতে চাইছে কল্পনাকে। স্বামীর এই চরিত্রহীনতা যেন দিনে দিনে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো মণিমালার কাছে। সেই মুহূর্তে সে অন্য কাজের অছিলায় বৈঠকখানা থেকে প্রস্থান করলো। শুভময়ও বোধহয় বিষয়টি আন্দাজ করেছিলো, তাই সেও উঠে এলো তার স্ত্রীর পিছু পিছু। মণিমালা আর নিজের মুখে কিছু বললো না শুভময়কে, তবে গোটা দিনটা যেন গুম মেরে রইলো তার প্রতি।
শেষ রাত্রের ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিলো মণিমালার চোখ থেকে। খুট করে বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেল তার। সে বিছানায় উঠে বসে অবাক হয়ে দেখলো, যে তার পাশে শুভময়ের শোবার জায়গা ফাঁকা! এমন সময় এই ঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে কার যেন ওপরে উঠে আসার পদশব্দ শোনা যাচ্ছে! ওপরে এসে সে যেন এই ঘরের দিকেই ক্রমাগত এগিয়ে আসছে! সাত পাঁচ ভেবে, মণিমালা তৎক্ষণাৎ বিছানায় নিজের জায়গায় শুয়ে ঘুমানোর অভিনয় করতে লাগলো। কপালের ওপর হাত রেখে তার ফাঁক দিয়ে আধবোজা চোখে তাকিয়ে রইলো ঘরের দরজার দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শরীরে সেই ঘরে প্রবেশ করলো শুভময়। সে ঘরে প্রবেশ করে আলতো করে পালঙ্কে উঠে শুয়ে পড়লো নিজের জায়গায়। কৌতূহল আর উত্তেজনায় ঘুম আসছিলো না মণিমালার চোখে। এমন সময় জানলা থেকে একটি দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে উড়িয়ে দিলো ঘুমন্ত শুভময়ের পিঠের ওপর থেকে চাদরখানি। চাঁদের আলোয় সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো মণিমালা। শুভময়ের পিঠ এবং ঘাড়ের চারিপাশে বেশ কিছু স্থান কেটে ছড়ে গিয়েছে। খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে এর কারণ হল কোনো মেয়েমানুষের নখের আঁচড়!
(৪)
পরের দিন সকাল বেলায় আবার গোটা গ্রামের ওপর যেন নেমে এসেছে শোকের কালো ছায়া। নায়েব মশাই-এর মর্মভেদী চিৎকারের মাঝে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জমিদার বাড়ির সকল সদস্য। তার কারণ, গতকাল রাত্রে এই গ্রামের অজানা নারীভুকের কাম-পিপাসার শিকার হয়েছে তার একমাত্র মেয়ে কল্পনা। আজ ভোরে প্রাতঃক্রিয়া সারার জন্য পুকুরপারে যায় গ্রামের জনৈক ব্যাক্তি। সেই সেখানে সর্বপ্রথম খুঁজে পায় কল্পনার বস্ত্রহীন মৃতদেহটি। এই ক্ষেত্রেও সে নিজেই গভীর রাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে যায় আততায়ীর সাথে সঙ্গমের ইচ্ছা নিয়ে। শরীরী খেলা মিটে যাওয়ার পর তাকেও হৈম এবং বাতাসীর মত গলা টিপে হত্যা করে আততায়ী!নায়েব মশাই জমিদার বাড়ির একটি থামের সাথে মাথা কুটতে কুটতে উন্মাদের ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠলেন, “কত্তাবাবু, যেভাবেই হোক এই শয়তানকে ধরার ব্যবস্থা করুন…তাকে শাস্তি দিন, কত্তাবাবু…শাস্তি দিন তাকে…”
এই পরিস্থিতি যেন আর সহ্য হচ্ছিলো না মণিমালার। সে শুভময়ের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের ঘরে। তারপর সশব্দে ঘরের দরজা বন্ধ করে তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো, “আমি জানি এইসবের পেছনে তোমার হাত আছে, শুভময়!…কারণ কাল রাতেই আমি তার প্রমাণ স্বচক্ষে দেখেছি!…ছি! ভাবতেই লজ্জা লাগছে আমার, যে আমি তোমার মত একজন নিকৃষ্টতম অপরাধীকে একদিন ভালোবেসেছি!…তবে আর নয়, আমি নিজেই তোমার অপরাধের কথা সকলকে বলবো, তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজেই মুছবো নিজের সিঁথির সিঁদুর…”কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মণিমালা। অত্যন্ত শান্ত অবিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো শুভময়, “হয়তো তোমাকে সব কিছু খুলে বলার সময় চলে এসেছে, মণি! তুমি কি ভাবছো, যে হৈম, বাতাসী আর কল্পনা…এদের দিকে আমি চেয়ে থাকতাম কারণ তাদের দেহের প্রতি আমি আকর্ষণ অনুভব করতাম? নাহ্…এদের দিকে আমি চেয়েছিলাম কারণ এই তিনজনেরই ওই নিদারুন পরিণতির আগের দিনগুলিতে এদের শরীরের চারিপাশে এক অতি-প্রাকৃত পিশাচিনীর ছায়া আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি!”
বিস্ফারিত চোখে শুভময়ের দিকে চেয়ে রইলো মণিমালা। সে বলেই চললো, “আমার জীবনের কয়েকটা কথা তোমার কাছ থেকে গোপন করেছিলাম আমি, তবে আজ সব কিছু খুলেই বলবো। তুমি তো জানো, যে খুব ছোটবেলায় আমি মা বাবাকে হারাই। আমি যেন ঠিক মেনে নিতে পারলাম না তাদের মৃত্যুটা। মরণের পরও তাদের নিজের কাছে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। তাই গোপনে যোগাযোগ করেছিলাম একজন তান্ত্রিকের সাথে। তার সাহায্যেই সিদ্ধ হয়েছিলাম নানা তন্ত্রবিদ্যায়। তবে এতে মা বাবার আত্মার সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছা ব্যর্থ হলেও, আমার মধ্যে জন্মেছিলো অশুভ অতি-প্রাকৃত শক্তিদের প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, যারা কোনো কারণ বশতঃ এই ইহলোক থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হয়নি!”
“তাই সেদিন যখন বুঝলাম যে প্রতি সপ্তাহে এক একটি যুবতী ওই আততায়ীর শিকার হচ্ছে এবং এবার কল্পনার পালা, আমি গতকাল রাতে ঘুমোতে পারলাম না। নায়েব বাড়ি এই মহলের অনতিদূরেই, তাই তুমি ঘুমোবার পর বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নজর রাখছিলাম সেই দিকে। দেখলাম যে সঠিক সময়ে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো কল্পনা। আমি ছুটে গিয়ে তার পিছু নিলাম। তার পথ আগলে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললাম।”
“কিন্তু সেই মুহূর্তে তার শরীরটা সম্পূর্ণরূপে সেই অজানা অশরীরির কবলে। খোলা চুল, রক্তবর্ণ নিষ্পলক দৃষ্টি, মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে একটি চাপা গর্জনের আওয়াজ…কল্পনার এই রূপ আমি কখনো দেখিনি। সে অকল্পনীয় পৈশাচিক শক্তি দিয়ে আমায় দূরে ঠেলে ফেলে দিলো। মাথায় চোট পেয়ে জ্ঞান হারালাম আমি। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে উপলব্ধি করলাম যে পিঠে এবং ঘাড়ের চারিপাশে অসহ্য যন্ত্রনা। বুঝতে পারলাম আমায় না মেরে, শুধুমাত্র আমার শরীরে নখের আঁচড় দেওয়ার পেছনে কল্পনার শরীরে ভর করা এই পিশাচিনীর একটাই উদ্দেশ্য…সকলের সন্দেহের দৃষ্টি আমার দিকে আনা!”
মন্ত্রমুগ্ধের মত স্বামীর কথাগুলো শুনছিলো মণিমালা, এবার অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, “তার মানে কোন গুপ্ত তন্ত্রবিদ্যার সাহায্যে ওই অশরীরিকে প্রবেশ করানো হচ্ছে এক একটি মেয়ের শরীরে, যাতে তারা নিজেই শয়তানটার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়! কিন্তু কে করছে এই কাজ? আর এটা কি ধরণের তন্ত্রসাধনা?”
“কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি, মণি…আজকের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি!” দৃঢ় কণ্ঠে বললো শুভময়।(৫)
শুভময়ের পা ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো শিবেন। তাদের চারিপাশে চারজন শক্ত-সামর্থ চেহারার লেঠেল দাঁড়িয়ে। তাদের প্রহারে শোচনীয় অবস্থা শিবেনের। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “ক্ষমা করে দিন…ক্ষমা করুন আমায় ছোট বাবু। আমি গ্রামের সকলের কাছে মিথ্যা কথা বলেছিলাম, যে প্রতিমা নিখোঁজ হয়েছে। আসলে আমার শরীরে খুঁত ছিলো, ছোট বাবু…বিছানায় কখনই সুখ দিতে পরিনি আমি প্রতিমাকে।”“এদিকে ও সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও ওর মাথায় আসছে বাঁজা হওয়ার অপবাদ, তাই সেই রাত্রে ওর সাথে আমার খুব ঝগড়া বাঁধে। ও বলছিলো যে আর এই অপবাদ নিজের ঘাড়ে নেবে না, সকলকে জানিয়ে দেবে আমার নপুংসক হওয়ার কথা। তাই বাধ্য হয়েই ওকে গলা টিপে খুন করি আমি সেই রাত্রে! তারপর নদীর জলে ভাসিয়ে দিই ওর লাশটাকে। সকালে ও নিখোঁজ বলে সকলের সামনে মায়া কান্না কাঁদি…কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ওর লাশটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি!”
“যাও গিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও”, লেঠেলদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো শুভময়। ওরা শিবেনকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল, শুভময়ের মুখে ছেয়ে গেল চিন্তার রেশ।
সেদিন ছিলো গ্রহণের রাত্রি। শ্মশানের এক কোণে, একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে একাকী ডাকিনী সাধনায় বসেছে শুভময়। শ্মশানের ভূমির বেশ কিছুটা স্থানের জঙ্গল সাফ করে গোবর জল লেপে দেওয়া হয়েছে। একটি কালো কাপড় পেতে তার ওপর মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে ছাগলের টাটকা কলিজা এবং মাংস। অপর একটি পাত্রে আছে সুগন্ধি দেশি মদ। ধুপ-ধুনোর সাথে ছাগলের চর্বির তেল দিয়ে জ্বালানো হয়েছে প্রদীপের মিটিমিটি আলো। অন্ধকার রাত্রে দক্ষিণ দিকে মুখ করে সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ডাকিনী মন্ত্র জপ করছিলো শুভময়, তার কপালে সিঁদুরের তিলক, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।
নিস্তব্ধ রাতের মাঝে হঠাৎ একটি মৃদু নারী কণ্ঠে নিজের নামটি শুনে চমকে উঠলো শুভময়। চোখ খুলে দেখলো, যে একটি অপরূপ সুন্দরী নগ্ন নারী তার সামনেই শুয়ে আছে, মুখে মৃদু হাসি। ক্রমে উঠে দাঁড়ালো সেই নারী, ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তার আরো কাছে। তার ঠাণ্ডি হাতের স্পর্শ পেলো শুভময় নিজের বুকে, পিঠে এবং পুরুষাঙ্গে। মেয়েটি হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “কিরে ভোগ করতে চাস না আমায়? আমি কি সুন্দরী নই…হাহাহাহা!”
তবুও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে একমনে মন্ত্র জপ করতে লাগলো শুভময়। এবার একটি হাড় হিম করা আর্তচিৎকারে শুনতে পেলো সে। সেই সুন্দরী রমণী কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আশেপাশের শুকনো পাতার ওপর কাদের যেন পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তারা যেন দল বেঁধে শুভময়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। রাতের শ্মশান মুখরিত হয়ে উঠলো ক্রমাগত বিকট চিৎকারের আওয়াজে, সাথে ভয়ঙ্কর কিছু প্রেতমূর্তি একজোট হয়ে শুভময়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লো। সকলেরই রক্তবর্ণ জ্বলন্ত চোখ, অর্ধদগ্ধ কঙ্কালসার বীভৎস শরীর। তারা নিজের দুই হাত দিয়ে নিজেদের মুণ্ডুগুলিকে একটানে নিজেদের ধর থেকে ছিঁড়ে ফেললো, তারপর নিজেদের মস্তক হাতে করে কবন্ধগুলি গোল করে ঘুরতে লাগলো শুভময়কে ঘিরে। তবুও অপার সাহস বুকে করে মন্ত্র জপ করে চললো শুভময়।
কিছুক্ষণ পর সকল প্রেতমূর্তিগুলি যেন আগের মতই হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। শুভময় চোখ খুলে দেখলো, যে তার সামনে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ উলঙ্গ এলকেশী নারী দাঁড়িয়ে আছে। সে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে রাখা মদ আর মাংসের দিকে। শুভময় বুঝতে পারলো যে অবশেষে ডাকিনী তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। সে ওই নারীকে মদ আর মাংস অর্পণ করলে, সে খুশি হয়ে বলে উঠলো, “তোর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়েছি আমি। বল, তোর জন্য কি করতে হবে আমায়?”
(৬)
গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে রাতের অন্ধকারে ডাকিনীর পিছু পিছু এগিয়ে চলছিলো শুভময়। অবশেষে তারা গ্রামের পুব কোণে একেবারে জঙ্গলের ধারে এসে পৌঁছলো। এই স্থানে খুব একটা জনবসতি নেই। ঝোপঝাড়ের মাঝে রয়েছে একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর। তার ভেতর থেকে মিটিমিটি জ্বলছে কুপির আলো। সেই দিকে আঙুলের ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে গেল ডাকিনী। অতি সন্তর্পণে শুভময় এগিয়ে গেল সেই দিকে। এই বাড়ির মালিককে গ্রামের সকলেই চেনে, কারণ সে হল এই গ্রামের পাঠশালার বহুদিনের শিক্ষক, সুকুমার পন্ডিত। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের সুকুমার বহু বছর ধরে বিপত্নীক। রোগা কালো কুৎসিত চেহারার মানুষটি সকল গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধার পাত্র তার ছাত্র পড়ানোর দক্ষতার গুণে।শুভময় কুঁড়ে ঘরটির পেছনের খোলা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ রাখলো ঘরের ভেতরে। ঘরের ভেতর খাটিয়ার ওপর বসে মদ্যপান করছে সুকুমার। খাটিয়ার নীচে মেঝের ওপর চোখ পড়তেই শিউরে উঠলো শুভময়। সেখানে রাখা রয়েছে একটি উলঙ্গ নারীর লাশ। পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে তার সর্বশরীরে লাগানো হয়েছে কোনো অজানা দ্রব্যের প্রলেপ। লাশটি আর কারোর নয়, শিবেনের মৃত স্ত্রী প্রতিমার!
ওদিকে মদের নেশায় অনর্গল বকে চলেছে সুকুমার, “কি ভেবেছিলিস তোরা? আমি কুৎসিত, বিপত্নীক, দরিদ্র…তাই কি আমার প্রেম করার কোনো অধিকার নেই? আমার মনে কি জাগতে পারে না নারীসঙ্গের লোভ? অনেক আশা করে তোদের তিনজনের কাছে এক এক করে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম আমি…কিন্তু তোরা আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিলি! আমায় অপমান করে বললি নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখতে! এত অহংকার তোদের!…এখন বুঝেছিস তো, তোদের কি অবস্থা করলাম আমি!…এখন বাকি রইলো শুধু একজন, সেও আমার প্রণয় নিবেদনকে অস্বীকার করেছিলো, পরের সপ্তাহে তার পালা…হাহাহা!”
পরদিন সকালে বাড়ি ফিরলে, মণিমালা উদগ্রীব হয়ে শুভময়ের কাছ থেকে জানতে চাইলো গতকাল রাত্রের সকল ঘটনা। শুভময় তাকে এক এক করে সব কথা বলে শেষে বলে উঠলো, “তন্ত্রশাস্ত্রে একটি ভয়ঙ্কর অনিষ্টকারী সাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রয়োগ করেছে সুকুমার পন্ডিত। একে বলা হয় ‘কাম পিশাচিনী’ সাধনা!”
“যে সকল নারী পুরুষের দেওয়া শারীরিক সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েই কোনো অপঘাতে মারা যায়, তাদের আত্মার মুক্তি হয় না। পুরুষের সাথে সম্ভোগ করার অতৃপ্ত বাসনার ফলে তারা প্রেতযোনিতে প্রবেশ করে ‘কাম পিশাচিনী’-তে পরিণত হয়। এরা সর্বদা সেই অপেক্ষায় থাকে, কখন কোনো পুরুষ এই সাধনা করে এদের ডেকে পাঠিয়ে প্রবেশ করাবে অপর কোনো জীবন্ত নারীর শরীরে। এই প্রেতাত্মার প্রকোপে সেই নারী নিজের ইচ্ছায় নিজের শরীরকে তুলে দেবে সাধকের হাতে!…এই ক্ষেত্রে এই পিশাচিনী হল প্রতিমার অতৃপ্ত আত্মা, এবং সুকুমার তাকে একে একে প্রবেশ করিয়েছে হৈম, বাতাসী আর কল্পনার শরীরে! সে নিশ্চয় সাধনার জন্য প্রতিমার দেহটিকে সেই রাত্রে নদীর জল থেকে সংগ্রহ করেছিলো!…কিন্তু সহবাসের শেষে মুহূর্তের মধ্যে নারী শরীর থেকে কাম পিশাচিনী বিদায় নেয়, ফিরে আসে নারীর নিজস্ব সত্তা। তাই এই তিনজন যাতে সুকুমারের কীর্তিকলাপ সকলের কাছে ফাঁস করতে না পারে, তাই ভোগ করার পর এদেরকে একে একে খুন করেছে সুকুমার!…যতদিন প্রতিমার মরদেহ অবিকৃত থাকবে, ততদিনই সে সাধনার ফলে এই অপরাধ চালিয়ে যাবে!”
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শুভময়ের দিকে তাকিয়ে কম্পিত গলায় বলে উঠলো মণিমালা, “সুকুমারকে তুমি পুলিশের হাতে তুলে দাও!”
“নাহ, আপাততঃ নয়”, বলে উঠলো শুভময়, “এই সপ্তাহের শেষেই ওর খেলা সমাপ্ত করার ব্যবস্থা করতে চাই আমি, শুধু জানতে হবে ওর চতুর্থ শিকার কে হতে চলেছে!”(৭)
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে পরবর্তী ছয়টি দিন। কল্পনার মৃত্যুর পর আজ এক সপ্তাহ পূরণ হতে চলেছে। সেদিন সকালে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো মণিমালা। অদূরে আরামকেদারায় সকালের চায়ের কাপ হাতে বসেছিলো শুভময়। হঠাৎ সশব্দে কাপ সমেত চা নীচে পড়ে গেল শুভময়ের হাত থেকে। সচকিত হয়ে মণিমালা আয়নার সামনে থেকে চোখ সরিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, যে সে বিস্ফারিত চোখে আরষ্ঠ হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।মণিমালা ছুটে আসতে গেল শুভময়ের কাছে, কিন্তু সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আরো দূরে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কারণ, তার চোখে মণিমালা শুধু একা নয়, একটি কুচকুচে কালো অতি-প্রাকৃত অবয়ব যেন নিজের দুই বহু দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে মণিমালাকে! এ আর কেউ নয়, সেই কাম পিশাচিনী!
“আজ রাতে তুমিই হতে চলেছো সুকুমারের চতুর্থ শিকার, মণি!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো শুভময়।কিছুক্ষণ আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইলো মণিমালা, তারপর কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো, “এই কথা জানতাম আমি…শুধু চক্ষুলজ্জার খাতিরে তোমাকে বলে উঠতে পারিনি। বিয়ের কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে কিছুদিনের ছুটিতে এখানে আসার পর, পাঠশালার একটি বাচ্চার হাত দিয়ে সুকুমার আমাকে প্রেমপত্র পাঠায়! তাকে যে শুধু আমি অস্বীকারই করিনি, বরং তাকে এই বাড়িতে ডেকে বাবা চরম অপমান করেন। বলেন যে অন্য কারোর সাথে এমন কাজ করলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দেওয়া হবে! এরই প্রতিশোধ নিতে চায় সুকুমার!”
কান্নায় ভেঙে পড়লো মণিমালা, শুভময় কুঞ্চিত ললাটে কি যেন ভেবেই চললো।সারাদিনের চিন্তা-ভাবনার মাঝে মধ্যরাতে দুইচোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিলো শুভময়ের। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার তন্দ্রা কেটে গেল, যখন মনে হল যে মণিমালা তার পাশ থেকে উঠে অতি সন্তর্পণে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে!
“দাঁড়াও, কোথায় যাচ্ছ তুমি?” চিৎকার করে উঠলো শুভময়।
মণিমালা তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো…সেই একই রক্তবর্ণ চোখ, হিংস্র চাহনি, খোলা চুল, ঠোঁটের কষ দিয়ে লালা ঝরছে, মুখ দিয়ে চাঁপা গর্জনের শব্দ!
“আমাকে যে যেতেই হবে তার কাছে…সে যে আমায় ডাকছে আমার দেহের আগুন নেভাবে বলে…আমাকে আটকানোর সাধ্য কোনো মনিষ্যির নেই!”, হুঙ্কার করে উঠলো মণিমালার শরীরে বসা পিশাচিনী।
“মানুষের সেই সাধ্য না থাকলেও ডাকিনীর তা আছে!” চিৎকার করে উঠলো শুভময়।ঠিক সেই সময় সশব্দে খুলে গেল ঘরের দরজাটা, আর অন্ধকারের মধ্যে সেই কৃষ্ণবর্ণ এলকেশী নগ্ন নারীর অবয়বটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ঘরের ভেতর। তাকে দেখে চমকে উঠলো মণিমালা রূপী পিশাচিনী। তারপর একটি বিকট হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে গেল তার কাছে। ডাকিনী নিজের ডান হাত প্রসারিত করে ধরে ফেললো মণিমালার গর্দন। শুরু হল দুই অতি-প্রাকৃত মানবীর মধ্যে অকল্পনীয় সংগ্রাম। তবে শুভময়ের পরিকল্পনাই সফল হল, কাম পিশাচিনীর থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ডাকিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিমালার শরীরটা তুলে ফেললো সম্পূর্ন শূন্যে। নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে, মণিমালার হাঁ করা মুখ দিয়ে কালো ধোঁয়ার মত বেরিয়ে এলো পিশাচিনীর প্রেতাত্মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের খোলা জানলা দিয়ে বিদায় নিলো সে। অতঃপর অদৃশ্য হল ডাকিনী। মণিমালার অচৈতন্য শরীরটা ঢলে পড়লো শুভময়ের কোলে।
পরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরে এলো মণিমালার, তখন আবার জমিদার বাড়ির আঙিনা লোকে লোকারণ্য। আজ ভোরেও গ্রামের জঙ্গলের সীমানায় একটি ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাত্ব মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এই লাশ কোনো যুবতীর নয়, তা হল গ্রামের সুপরিচিত সুকুমার পন্ডিতের! কেউই বুঝে উঠতে পারছে না যে কে তাকে এভাবে হত্যা করলো।
ওদিকে শুভময় মণিমালার কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “কাম পিশাচিনী সাধনার প্রধান শর্তই হল, যে প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে এই পিশাচিনীকে কোনো না কোনো নারীর দেহে প্রবেশ করিয়ে, সাধককে তার সাথে সহবাস করতে হবে। কোন একটি সপ্তাহে তা কোনো ভাবে না করতে পারলে, সাধকের শর্তভঙ্গের অপরাধের শাস্তি হিসেবে এই পিশাচিনীই হবে সাধকের হত্যাকারিণী!…যা এই ক্ষেত্রে ঘটেছে!”
একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মণিমালা আঁকড়ে ধরলো তার স্বামীর সুঠাম বুকের ছাতিটাকে।(সমাপ্ত)
-
ভৌতিক গল্প- গেস্ট হাউসের সেই রাত্রি
গেস্ট হাউসের সেই রাত্রি
– বেবী কারফরমাদু’হাজার চৌদ্দ কি পনেরো সালের ঘটনা। রাঁচিতে আমাদেরই এক পারিবারিক বন্ধুর ছেলের বিয়ে। পারিবারিক বন্ধুর নিজস্ব হসপিটাল ব্যাবসা রাঁচিতেই। বিশাল হসপিটাল তার সংলগ্ন পাঁচতলা গেস্টহাউস।
বিয়ের একদিন আগেই পৌঁছে গেলাম তাদের বাড়ীতে। বিশাল হৈ হৈ ব্যাপার, বাড়ীতে তিল ধারণের জায়গা নেই, একেই বিয়ে বাড়ি তার উপর বাড়ীর কর্তা যেহেতু প্রথম সারির কর্পোরেট তাই আমন্ত্রিত অথিতিগণও সব কর্পোরেট। মনে মনে ভাবছি দিনের বেলা তো কেটেই যাবে কিন্তু রাতে? কার সাথে যে রুম শেয়ার করতে হবে কে জানে, ভোর চারটে থেকে উঠে সব হুলস্থূল লাগালেই ঘুম মাটি, তারপর সারাদিন মাথার যন্ত্রণা উপরি পাওনা।
মেঘ না চাইতেই জল, ভাবী নিজেই বললেন “আভা, তুম গেস্টহাউস মে রহো, আলগ সে এক রুম লে লো, আরাম সে রহো।” আমিও ভাবলাম ব্যাপারটা মন্দ হবে না, রাজি হয়ে গেলাম। কেননা এর আগেও আমি একাধিক বার ওই গেস্ট হাউসে ছিলাম, তবে দোতলা অথবা তিনতলাতে।
যেহেতু বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে আসা, তাই দিনের বেলা বিয়ে বাড়িতেই হইহই করে কেটে গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ গেস্ট হাউসে গিয়ে দেখলাম মোটামুটি তিনটে ফ্লোর মহারাষ্ট্র ও বিহারের মন্ত্রী আর তাদের দেহ রক্ষীদের দখলে, তাঁরাও আমন্ত্রিতদের তালিকায়। কেয়ার টেকারকে বললাম “নিরিবিলি দেখে একেবারে পাঁচতলার কর্নার করে একটা ঘর খুলে দাও, যেখানে গাড়ির আওয়াজ পৌঁছাবে না”। কারন রাস্তার দিকের ঘরগুলোতে ভীষণ গাড়ির আওয়াজ হয়।
যে ঘরটায় আমি উঠলাম তার বাইরের দিকটা পরিত্যক্ত জলাভূমি ও কাঁটা জাতীয় ঝোপে ভর্তি তাছাড়া হসপিটালের একটা অংশ আমার ঘর লাগোয়া। সারাদিনে রাস্তার ধকল, তারপর বিয়ে বাড়ীর হইচই, ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল আর ঘুমও পেয়েছিল। ওই কোনোরকমে হাত মুখ ধুয়ে এসি চালিয়ে চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ বাঁ হাতের যেখানটা ঘড়ি পড়ি অর্থাৎ রিষ্টে কে যেন টোকা মারল। “কে”? বলেই তড়াক করে উঠে বসে পড়লাম, মাথার কাছেই টর্চটা রেখে ছিলাম, জ্বালালাম, দেখলাম কেউ কোথায় নেই। ভাবলাম সারাদিনের ধকল নির্ঘাত উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখেছি তারপর আস্তে আস্তে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে ঘুমিয়েও পড়লাম, আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার একটু ভয় পেলাম, বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালালাম, খাটের তলা, আলমারি খুলে, বাথরুমের দরজা খুলে দেখতে লাগলাম কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে নাকি। দেওয়ালগুলোতে টোকা মেরে মেরে দেখতে লাগলাম কোথাও কোন গুপ্ত দরজা আছে কিনা। কেমন যেন একটু ভয় ভয় করতে লাগল, এবার লাইট জ্বেলেই জেগে রইলাম। বেশ অনেকক্ষণ পর হয়ত একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন পায়ে হাত বোলাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে গেলো, দেখি কেউ কোথাও নেই।
না, এর পর আর ঘুম আসেনি, জেগে জেগেই সকাল হয়ে গেলো। ভোরের দিকে কর্তাই আগে ফোন করলেন ,বললেন নিচে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেড়িয়ে যেতে, কেননা ভোর থেকেই বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু। তাঁকে রাতের ঘটনাটা সব জানালাম, তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, বললেন পাঁচতলার কর্নারের ঘরটা আসলে হসপিটালের মর্গের পাশের ঘর। তাঁকে না জিজ্ঞাসা করে একা একা পাঁচতলায় থাকার জন্য ওই ভোরেই ফোনে ফোনে একতরফা ছোটোখাটো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন।
এবার কানে শুনে রাতের অন্ধকারে যত না ভয় করছিল, ভোরের হাল্কা আলোয় ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ঘরে অনেকগুলো ভূত ঘাপটি মেরে বসে আমায় পিটপিট দেখছে,শুধু আমিই তাদের দেখতে পাচ্ছি না।
না এরপর আর দেরী করিনি, টুকটাক ব্যাগ থেকে যা বের করেছিলাম সব ঢুকিয়ে নিয়ে সোজা লিফটে করে গ্রাউন্ড ফ্লোর।
এবছর মার্চে আবারও রাঁচি যেতে হয়েছিল কাজের জন্য ,তবে থাকার জন্য ঠিক হয়েছিল ওদেরই ইউনিয়নের গেস্ট হাউসে, হসপিটালের গেস্ট হাউসে নয়। যদিও এই গেস্ট হাউসটাও প্রথম সারির গেস্ট হাউসের মধ্যেই পড়ে। তবে এই গেস্ট হাউসের কিছুটা দুরেই কবরখানা। আমি সাথে সাথেই না করে দিয়ে ছিলাম। কেননা ওখানে ‘ওরা’ সংখ্যায় কম ছিল , এখানে যদি ‘তারা’ দল বেঁধে কেউ মাথায় , কেউ হাতে, কেউ পায়ে টোকা মারত, আর সটান মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত তাহলে বোধহয় পৈতৃক প্রাণ নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হতো না।