ভৌতিক গল্প

  • ভৌতিক গল্প

    প্রতিশোধ

    প্রতিশোধ
    -রাখী চক্রবর্তী

     

    “পানকৌড়ি জলে দিচ্ছে ডুব ডুব ডুব,,,,
    তাই না দেখে ছোট্ট সোনা হাসছে খুব খুব ,,,”

    পুকুর ধারে বসে পাগলিটা এই ছড়াটা রোজ বলে।শোনা যায় এই পুকুরে নাকি পাগলির তিন বছরের বাচ্চা ডুবে মারা গেছিল। তারপর থেকেই পুকুর ধারটা ছিল তার বাসস্থান।অবশ্য একটা ভাঙ্গা বাড়ি আছে পাগলির।ওটা ওর জন্ম ভিটে। বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে সন্তান সম্ভবা মালতী বাপের ভিটেতেই এসে উঠেছিল। বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছে।
    মালতীর মা ও বেশি দিন বাঁচেনি। একমাত্র সন্তান এর নাম রেখে ছিল মালতী ‘অমর’।ছোট থেকেই অমর দুষ্টু। মালতী নাজেহাল হয়ে যায় অমরকে সামলাতে সামলাতে।মালতীর বাড়ির সামনেই একটা বিশাল পুকুর আছে। কত মাছ পুকুরে। অমর খুব লাফালাফি করত জলে মাছগুলোকে দেখে।পানকৌড়ি, মাছরাঙা জলে ডুব দিয়ে মাছ তুলছে। সেই দেখে ছোট্ট অমর কি হাসত। মালতী তখন এই ছড়াটা বলত-
    “পানকৌড়ি জলে দিচ্ছে ডুব ডুব ডুব
    তাই না দেখে ছোট্ট সোনা হাসছে খুব খুব “

    সে দিন দুপুর বেলায় মালতী অমরকে ঘরে বসিয়ে রান্না ঘরে ভাত এর ফ্যান গালতে গেছে ফিরে এসে দেখে অমর ঘরে নেই।খোঁজ, খোঁজ অমর কোথায় গেল?

    -ও বামুন মা, অমর কে দেখেছো?
    -না তো।
    এই ভর দুপুরে বাচ্চাটা কোথায় গেল। গাঁয়ের সব বাড়িতে খোঁজ চলল অমরের। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না অমরকে।
    বিকেলের দিকে অমরের খোঁজ মিলল। অমর এর ছোট্ট দেহটা ফুলে ফেঁপে পুকুরের জলে ভেসে উঠেছে ।

    মালতী এখন পাগলি নামেই খ্যাত। রোজ দুপুরে পুকুরের ধারে বেশ কিছুক্ষণ থেকে তারপর মালতী ঘরে ফেরে। বেশ কিছু দিন ধরে প্রমোটার মদনলাল এর দল মালতীর বাড়িটার ওপর থাবা বসিয়েছে। মালতী অমরের জন্মভিটেকে কিছুতেই কারোর হাতে তুলে দেবে না। কত স্মৃতি কত যন্ত্রণা কত আবেগ এই ছোট্ট বাড়িতে আছে। প্রমোটার মদনলাল ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। তবুও ছলে, বলে, কৌশলে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না পাগলিটাকে।
    সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা গুম ধরে আছে। মালতী পুকুর ধারে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে চিৎকার করে খুব কাঁদল। গাঁয়ের মানুষরা আর তেমন কানাঘুষো করে না মালতীর ব্যাপারে। সবাই জানে পাগলামির চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেলে মালতী বসে বসে কাঁদে।
    বিকেলের দিকে খুব ঝড় বৃষ্টি হল। তারপর আকাশ পুরো শান্ত হয়ে গেল। রাত বাড়ছে, মালতী তাও খিড়কিতে বসে আছে ঘুম তো কবেই চলে গেছে ওর জীবন থেকে। হঠাৎ দরজায় খুটখাট আওয়াজ শুনতে পেয়ে মালতী ঘরের বাইরে এসে দেখে মাখনলাল দাঁড়িয়ে আছে।কিরে পাগলি দরজাটা অর্ধেক ভাঙ্গা তো। তাই চলে এলাম রে। চল, লায়লা মজনু খেলি।

    মালতী বলল, তুই যা এখান থেকে। বাড়ি তুই পাবি না।
    মাখনলাল হাসতে হাসতে মালতীর কাপড় খুলতে খুলতে বলল, আজ তোর শেষ দিন। শুরু হল মালতীর ওপর পাশবিক অত্যাচার।
    মালতীর চিৎকার সেই রাতে গায়ের অনেকেই শুনেছিল। পাগলির বকবক ভেবে তেমন কেউ গা লাগাইনি।মাখনলাল মালতীকে ভোগ করার পর একটা দেশলাই কাটি জ্বালিয়ে ঘরে ফেলে দিয়ে চম্পট দিয়েছিল সে রাতে।
    সকাল বেলায় মালতীর পোড়া দেহ আর পোড়া বাড়ি দেখার জন্য গায়ের লোক থিকথিক করছে।

    মাখনলাল ছিল মালতীর দুর সম্পর্কের দেওর। আজ অনেক দিনের ইচ্ছে পুর্ণ হল ওর। মালতীকে ভোগ করল, এবার বাড়িটাও..

    চারতলা পাঁচতলা বিল্ডিং হবে। তাই সব সিমেন্ট, বালি, ইট পাথর আসছে। মাখনলাল ধুতির কোঁচা ধরে তদারকি করছে। বাড়িটার একতলার ঢালাই এর দিন মাখনলাল খুব ব্যস্ত। এবার এক এক করে দোতলা তিনতলা ঢালাই হবে ।
    মাখনলাল চা খাচ্ছে লেবার মিস্ত্রিদের সঙ্গে। হঠাৎ মাখনলাল চিৎকার করে উঠল তুই আবার এসেছিস। যা বলছি এখান থেকে।

    -কি হয়েছে দাদা আপনি এমন করছেন কেন?
    -ঐ দেখ, ঐ পাগলিটা এসেছে, বলছে- আমার শাড়িটা দে
    -কোথায় দাদা কেউ নেই তো এখানে। কোন পাগলি? মালতী..সে তো মারা গেছে

    -এই তো মালতী..
    মালতী তোকে অনেক কাপড় দেবো। তুই যা।
    -দাদা আপনি মালতীকে কাপড় দেবেন কেন? আপনার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেল?
    -মালতী আমাকে বাঁচতে দে। পালাও সব পালাও।
    গায়ের মানুষরা সব বলাবলি করছে মালতীর ভুতকে দেখছে মাখনলাল। নিশ্চয়ই কোন ব্যাপার আছে।
    মাখনলাল বিড়বিড় করে বলছে মালতী তোকে আবার আমি মারব। তোর পাগলামি আমি ঘোচাচ্ছি। বিশাল একটা লাঠি হাতে নিয়ে মাখনলাল মালতীর পিছু পিছু ছুটছে।তারপর এদিক ওদিক ছুটে মাখনলাল পুকুর ধারে এসে যেই বসেছে। তখনি ঝুপ করে একটা আওয়াজ হল। মাখনলাল জলে ঝাঁপ দিল না কি কেউ ঠেলা দিয়ে ফেলে দিল সেটা কেউ বুঝতে পারলো না। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে পুকুরের জলে তিন দিকে তিনটি বুদবুদ হচ্ছে। মাখনলাল তো তার পাপের শাস্তি পেয়ে গেল। মালতী তার নিজের ওপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিল।
    ঐ বাড়ির ত্রিসীমানায় আজ আর কেউ যায় না। ভর দুপুর বেলায় বা সন্ধ্যা বেলায় পুকুরের জল ঘুরতে থাকে। গাঁয়ের মানুষরা জানে মালতী আর অমর এর আত্মা ওখানেই আছে। তবে ওরা কারোর ক্ষতি করে না।
    নিশুতি রাতে মালতীর গান ঐ গাঁয়ের অনেক মানুষ আজও শুনতে পায়
    “পানকৌড়ি জলে দিচ্ছে ডুব ডুব ডুব..তাই না দেখে ছোট্ট সোনা হাসছে খুব খুব “

  • ভৌতিক গল্প

    “দোল দোল দুলুনি “

    “দোল দোল দুলুনি “

    -রাখী চক্রবর্তী

     

    অফিস যাওয়ার পথে রাস্তার মোড়ে দোলনার দোকান টার সামনে প্রায়ই অসিত কাকুর পা টা থমকে যায় ।বেশ কিছু দিন ধরে এই রকম হচ্ছে ।আর, কাকুর দোলনা কেনার লোভটা ও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন ।

    কাকু সেদিন সন্ধ্যা বেলায় কাকিমাকে বলল,”ছাদের ঘরের বারান্দায় দোলনা রাখার জায়গা হবে”?

    কাকিমা হেসে বলল,”তা বুড়ো বয়সে তোমার দোলনা চড়ার শখ হলো বুঝি”?
    অসিত কাকু বলল,ঐ আর কি অফিস থেকে ফিরে চা ,সিগারেট খেতে খেতে দোলনায় বসে খবরের কাগজ পড়ার মজাই আলাদা ।ও সব তুমি বুঝবে না।
    যাইহোক অসিত কাকু কাকিমা কে বলল,”সামনের রবিবার দোলনাটা কিনতে যাব “।
    শনিবার দিন হন্তদন্ত হয়ে অসিত কাকু বাড়ি ফিরল।কাকিমা কে বলল, আজই চলো দোলনা কিনতে।রবিবারের অপেক্ষা আর করতে পারছি না।কি সুন্দর সব দোলনা,, দোকানে গিয়ে কাকুর চোখ ঝলসে গেল।
    দোকানের কর্মচারী বলল,দাদা এই দোলনাটা নিন খুব টেকসই হবে।একটু সস্তা ও হবে ।অসিত কাকু কিনে নিল দোলনাটা।বাড়ি এসে দোলনাটা জায়গা মতো রেখে কাকু কাকিমা রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল।কিন্তু কাকুর চোখে ঘুম নেই ।রাত একটা বাজে।কাকু ওপরে চলে গেল দোলনা চড়তে।ওপরের দরজা খুলতেই কাকু চমকে গেল দোলনাটা কি ঘুরছে ।হয়তো বা খুব হাওয়া দিচ্ছে, কাকু কিছু একটা ভেবে দোলনায় গিয়ে বসলো ।এদিকে কাকিমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ।কাকু পাশে নেই দেখে কাকিমা মনে মনে বলল,ঠিক দোলনা চড়তে গেছে ।বুড়ো বয়সে যত ভীমরতি ।হাই তুলতে তুলতে কাকিমা ওপরে গিয়ে দেখল কাকুর পাতলা পুতলা চেহেরা একটা মেয়ের চেহারার মতো হয়ে গেছে।ওড়না ঝুলছে গায়ে, কি অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে ।এ দৃশ্য দেখে কাকিমা অজ্ঞান হয়ে গেল ।সকাল বেলায় ঘুম ভেঙে কাকিমা নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল।কাকুও পাশে শুয়ে আছে।অস্বাভাবিক কিছু নেই । কিন্তু রাতের সেই দৃশ্য কাকিমা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।কাজকর্ম সেরে কাকিমা রাতের জন্য অপেক্ষা করছে।আজ রাতে আড়াল থেকে সব কিছু দেখবে কাকিমা ।
    যথারীতি রাতের বেলায় কাকিমা ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল।কাকু ঠিক রাত দুটোর সময় ওপরে গিয়ে দোলনায় বসলো।কাকিমা সবকিছুই দেখছে আড়াল থেকে। নিমেষে কাকু একটি মেয়েতে পরিনত হল।ওড়নাটা উড়ছে হাওয়া তে।মুখটা আবছা দেখাচ্ছে ।কাকিমা শেষ দেখবে বলে ভয় পাচ্ছে না।হঠাৎ দোলনায় বসে থাকা মেয়েটি বলে উঠল,”আমি মুক্তি চাই ওকে শাস্তি দে”।
    ভোঁ ভোঁ করে দোলনাটা ঘুরছে ।কি বিকট কান্নার আওয়াজ ।গা শিউরে উঠল কাকিমার ।পরের দিন পাড়ার মিন্টুদা ও শিবুদাকে নিয়ে কাকিমা দোলনার দোকানে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল।
    সব শুনে দোকানের কর্মচারী বলল,দোলনাটা পুরনো ।দত্ত বাড়ির মেয়ে মীনা আত্মহত্যা করার পর ওর বাবা দোলনাটা বিক্রি করে দেয় আমাদের কাছে ।কিন্তু আমরা এত কিছু হবে ভাবিনি ।আজ রাতে মিন্টুদা ও শিবুদাকে কাকিমা থাকতে বলল।সবকিছু ওদের দেখাবার জন্য ।ঠিক রাত দুটোর সময় কাকু দোলনায় গিয়ে বসল ।আর সেই মেয়েতে পরিনত হল।কি বিকট কান্নার আওয়াজ ।শিবুদা তো ভয় পেয়ে গেল ভীষণ ।মিন্টুদা তান্ত্রিক তাই মেয়ে টিকে প্রশ্ন করল,কি চাও মা তুমি? মেয়ে টি গোঙ গোঙ করে বলল”,মুক্তি চাই”

    মিন্টু দা বলল,কিভাবে?
    মেয়ে টি বলল,”নরেনদা আমার ওপর অত্যাচার করে আমাকে মেরে ফেলেছে।ওর শাস্তি চাই”।
    শিবু দা সব কথা রেকর্ড করে রাখল।পরের দিন মিন্টুদা পুলিশের হাতে তুলে দিল সব রেকর্ড ও নরেনকে।অসিত কাকু দোলনাটা নিয়ে গেল মীনার বাড়িতে।দোলনাটা মীনার বাবাকে দিয়ে বলল,এটার মীনার শখের দোলনা ।এটা আপনাদের বাড়িতেই রেখে দিন ।বিক্রি করবেন না।অসিত কাকু মীনার ছবিটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। মীনা তৃপ্তির হাসি হাসছে। মীনার ঘর থেকে বের হতেই অসিত কাকু এই গানটা শুনতে পেল। কে গাইছে? কি করূণ সুরে “দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথায় চিরুনি “গানটা শুনে অসিত কাকুর মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মীনার আত্মা বোধহয় এবার শান্তি পেল।

  • ভৌতিক গল্প

    ফটোফ্রেম

    ফটোফ্রেম
    -রাখী চক্রবর্তী

     

    বিদুনদা কাঠের মিস্ত্রি। নতুন বাড়ি তৈরি হলেই বিদুনদার ডাক পড়ে।
    একদিন দুই কর্মচারীকে নিয়ে পাশের গ্রামে রওনা দিল বিদুনদা। খাট,জানলা, আলমারি সবই বানাতে হবে। দু’দিন থাকতেও হবে ওখানে ।
    যাইহোক,ওখানের পৌছেই যে যার মতো কাজে লেগে পড়ল।

    এবার বিদুনদা বাথরুমে যাবে হঠাৎ ই দেখল বাথরুমের সামনে 12-13 বছরের একটি রোগা পাতলা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বিদুনদা তাকে দেখে চমকে উঠল।
    কে কে তুমি?
    ছেলেটা বলল, একটা ছবির ফ্রেম বানিয়ে দাও। এইটাও আমার বাড়ি। সামনের বাড়িতে আমি থাকি।
    বিদুনদা বলল, ও তুমি প্রাণকেষ্ট বাবুর ছেলে? ছেলেটি বলল, হ্যাঁ।

    যথারীতি কাজ সেরে বিদুনদা ঘরে এসে দেখে কর্মচারি দু’টো নেই। ঐ ছেলেটা আবার এল, এসে জানলার পাশের দেওয়ালটাতে ফেমের মাপ দিয়ে বলল, এই মাপে ফ্রেম বানাও। আমার ছবি লাগাব।
    বিদুনদা হেসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, তা তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
    এর মধ্যে কর্মচারি দু’টো এসে বলছে, কি দাদা কার সাথে কথা বলছো?
    -এই দ্যাখ না প্রাণকেষ্ট বাবুর ছেলে বলতে বলতেই উধাও ছেলেটা।
    কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল।
    কর্মচারি বলল, কে এসেছিল, প্রাণকেষ্ট বাবুর ছেলে। ও আচ্ছা।

    দুপুরে খাবার খেয়ে ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে। আর বিদুনদা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। রান্নাঘরের ভেতর থেকে জলের শব্দ শুনতে পেয়ে ভেতরে গিয়ে বিদুনদা দেখল ছেলেটা বেসিনে হাত ধুচ্ছে। চোখ দু’টো যেন কেমন কেমন।
    যাইহোক বিদুনদা বলল, কি নাম তোমার? এই ফাঁকা বাড়িতে কি করছ? ছেলেটি বলল, সুরেশ আমার নাম। ফাঁকা বাড়িতে থাকতে আমার ভাল লাগে।
    বিদুনদা র কেমন যেন লাগছে ওর চোখ দু’টো লাল কেমন যেন।
    কাজ করে কর্মচারি দু’টো বিকেল বেলায় চা আনতে গেল ।
    ঠিক তখনই সুরেশ এসে বলছে, ফ্রেমটা এখনো বানালে না।
    বিদুনদা, কি মুশকিল আগে এগুলো করে নি কাল বানাবো তোমার ফটোফ্রেম ।
    সুরেশের চোখ যেন জ্বলে উঠল বেশ রেগেই বলল সন্ধ্যাবেলার মধ্যেই চাই।
    বিদুনদা ঘেমে চান হয়ে গেছে। ঘাম মুছতে মুছতে চোখ তুলেই দ্যাখে সুরেশ উধাও
    ওরা চা নিয়ে এল। সবাই চা খেল। ওরা ওদের মতো কাজ করছে। বিদুনদা খাটের পায়া লাগাচ্ছে একটু নিচের দিকে তাকাতেই বিদুনদা দেখল সুরেশ রক্ত বর্ণ চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আর বলছে এখুনি ফ্রেম বানাও, নইলে, বিদুনদার চিৎকার শুনে ওরা এসে বলল কি হয়েছে।
    বিদুনদা বলল, কি মুশকিলে পড়েছি। ছেলেটা জ্বালিয়ে মারছে।
    কর্মচারিটা বলল, কেউ তো এখানে নেই। কি ভুলভাল দেখছো।
    রাত সাতটার সময় প্রাণকেষ্ট বাবু এল। বিদুনদার সাথে দেখা করতে। এসেই বললেন,বিদুন এই ছবিটার জন্য একটা সুন্দর ফ্রেম বানিয়ে দাও।
    বিদুনদা বলল, হ্যাঁ যা তাড়া দিচ্ছে আপনার ছেলে। এই এখুনি বানাবো।
    প্রাণকেষ্ট বাবু বললেন মানে- বিদুনদা বলল, সেই সকাল থেকে আমার পেছনে লেগে আছে সুরেশ ফ্রেম বানানোর জন্য।
    প্রাণকেষ্ট বাবু অবাক হয়ে বলছেন কি বলছো?
    বিদুনদা বলল, সুরেশ বাড়ি চলে গেল? ও যে বলল ফ্রেমটা দেখে বাড়ি যাবে।
    প্রাণকেষ্ট বাবু চোখে জল নিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বললেন এক অজানা জ্বরে আট মাস আগেই সুরেশ মারা গেছে।
    বিদুনদা সেই যে অজ্ঞান হল ভোর বেলায় জ্ঞান ফিরে দ্যাখে সে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। গায়ে তার প্রবল জ্বর ।

  • ভৌতিক গল্প

    শাপমুক্তি

    শাপমুক্তি
    -পার্থসারথি ঘোষাল

    তথ্যমিত্র কেন্দ্রের বাইরে সেদিন রূপেনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো। রূপেন আমাদের কলেজের সবচেয়ে সেরা ছাত্র ছিলো। বর্তমানে ও থাকে গোয়ায়, গোয়ার সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে ফিজিক্সের অধ্যাপক। কসবায় ওর নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে যেখানে বর্তমানে ওর শালা অমলেশ সপরিবারে বাস করছে, অমলেশ একটা বেসরকারি কোম্পানির অডিট সেকশনে কাজ করে। পুজোর ছুটি কাটাতে কালীপুরে এসেছে রূপেন সস্ত্রীক। কালীপুরে ওদের সাবেকী বিশাল দোতালা বাড়ি, বৈঠকখানা, দেউড়ি ও গাড়ি বারান্দা ওদেরই কোনো এক পুর্বপুরুষ নাকি হেস্টিংস সাহেবের খুব নেক নজরে এসেছিলেন। ওদের সাতপুরুষের জমিদারী ছিলো এ তল্লাটে- এখন অবশ্য তার চিহ্নমাত্র নাই। তবুও পোষাকে আষাকে সেই জমিদারী মেজাজের রেশটুকু যেন রয়ে গেছে।চৌধুরী বংশের কুলপ্রদীপ হলো এই রূপেন।

    আমি প্রথমে রূপেনকে ঠিক চিনতে পারিনি, কারণ আজ থেকে প্রায় পাঁচবছর আগে বর্ধমানে দেখেছিলাম ওকে। তখন ওর মুখে কোনো দাড়িটাড়ি ছিলনা তাছাড়া স্বাস্থ্যও ভালো ছিলো তখন- তাই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম রাস্তার ওপারে মেছোবাজারের দিকে। রূপেনই এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, “কিরে বাদল, তুই আমাকে চিনতে পারলিনা মনে হচ্ছে! দেখেই অমন করে মুখটা ঘুরিয়ে নিলি কেন?”
    আমি আমতা আমতা করে বললাম,”ক-ক-ই–ই-না–না-তো!”

    রূপেন বললো, “হয় আমাকে তুই চিনতে পারিসনি, না হয় চিনেও চিনতে পারছিস্ না–কি রে? কোনটা?”

    আমি গলায় একটা দৃঢ় সুর এনে বললাম, “তোর প্রথম অনুমানটাই সত্যি, অর্থাৎ তোকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি ভাই। এই পাঁচবছরে তোর যে এতখানি পরিবর্তন তা যেন ভাবাই য়ায় না, তোর চেহারায় একটা আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে কোথাও। তোর স্বাস্থ্যেরও অনেক অবনতি হয়েছে বন্ধু।”

    রূপেন বললো, “তুই ঠিকই ধরেছিস্ ভাই?আজ থেকে বছর তিনেক আগে একটা ঘটনার পর থেকে আমি শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড টেন্সড্ আছি, তারই সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে আমার শরীরে ও মনে। যাইহোক, আমার কথা এখন থাক- তোর খবর কি? তূই এখন কি করছিস ?”

    আমি বললাম, “আমার স্টুডিও ও জোতিষীগিরি নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে।পেপার খুললেই বুঝতে পারবি আমার জ্যোতিষবিদ্যার প্রসার এখন কেমন!”

    রূপেন হো হো করে হেসে উঠে বললো,”বাজারে বেশ ভালোই নাম করেছিস তাহলে! কালেজে তুই তো আমাদের “মুশকিল আসান দাদা” ছিলি- তাই এখন এহেন জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা তারই পরিপূরক বলতে হবে! ঠিকই আছে,‌চালিয়ে যা।তবে আঁকাটা যেন ছাড়িস না। কলেজে নবীন বরণের দিন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুরারী বসু যখন তোকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলো তখনই তোর প্রতিভার আঁচ পেয়েছিলাম।”

    কলেজ লাইফে আমার নাম ছিলো “মুশকিল আসান দাদা” অর্থাৎ বন্ধু মহলে কারও কোনো অসুবিধা হলেই আমি বাৎলে দিতাম সমাধানের পথ।এই রূপেনেরই কত সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি; তাই নিজের সেই অতীত ব্যতিক্রমী গুণের কথা স্মরণ করতেই একটা অবাঞ্ছিত কৌতুহল আমাকে যেন পেয়ে বসলো। আমি আবার রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি যেন একটা ঘটনার কথা বলছিলি, যার জন্য তোর শারীরিক ও মানসিক ভাবে এতখানি পরিবর্তন?”

    রূপেন বললো, “আজ এখানে বলা সম্ভব নয়, একদিন আমার বাড়িতে আয় ওখানেই সব খুলে বলবো তোকে। এই রোববারই চলে আয় না সময় করে “আমি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।

    একদিন রবিবার প্রায় সন্ধ্যার সময় রূপেনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। আজকাল কালীপুরের এই বাগান পাড়ায় লোকজন খুব একটা আসেনা। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। কারণটা হলো এ পাড়ার চৌধুরীবংশে একমাত্র রূপেন ছাড়া আর কোনো শরিক নেই, হরনাথ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান হলো এই রূপেন। হরনাথ চৌধুরী বা তাঁর স্ত্রী কেউই আজ আর বেঁচে নেই। আর মল্লিকরা বা মজুমদাররা কেউ আর এ গ্রামে থাকে না। তারা হয় কেউ প্রবাসে কিম্বা ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরে উচ্চ সরকারী পদে আসীন এবং সেখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে সেটেল্ড হয়ে গেছে।তাই বাড়িগুলো জনহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবলমাত্র মাত্র বাগান পাড়ার কঙ্কালের মতো, প্রাণহীন একটা ভৌতিক অস্তিত্ব নিয়ে।

    বাড়ির গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দার কাছে আসতেই চোখ পড়লো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা চকচকে নীল রঙের হাউনদাই, এটাই রূপেনের নতুন প্রাইভেট কার মনে হয়! এবার চোখ পড়লো দোতালার ব্যালকনির দিকে, মনে হলো কোনো মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা তৃতীয়ার চা়ঁদের শোভা দেখছে।কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এক পুরুষের আভির্ভাব হলো এবং সেই পুরুষ মানুষটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “কিরে বাদল?আয় আয় ভেতরে আয়।”

    আমি বুঝতে পারলাম যে ঐ পুরুষটি হলো রূপেন ও মহিলাটি সম্ভবতঃ তার স্ত্রী। আমি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতেই রূপেন এসে হাজির হলো।
    আমাকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে গেলো।একটা লম্বা একটানা বারান্দা পেরোতে পেরোতে একতালার বন্ধ কক্ষগুলো নজরে পড়ছিলো। কতদিন যে তালা বন্ধ তা অনুমান করা প্রায় অসম্ভব, কারণ তালাগুলোতে মরচে ধরেছে। সাবেকী আমলের জমিদারবাড়ি। বাড়িটার চারদিকেই বড় বড় থামওয়ালা বারান্দা। সামনের একটানা লম্বা বারন্দার শেষপ্রান্তে দোতালায় ওঠার সিঁড়ি, আমি ও রূপেন দু’জনেই কথা বলতে বলতে দোতালায় উঠে গেলাম, দোতালার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা দু’জনেই।

    ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাগান পাড়ার মোটামুটি সামগ্রিক অংশই নজর আসছে।এখানে চারদিকে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম বাগান পাড়ায় ঢোকার পর থেকেই। তাছাড়া কৃষ্ণা তৃতীয়ার জ্যোৎস্নায় চারদিকটা যেন মূহুর্তে মুহুর্তে মোহময়ী হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ আমরা দু’জনেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।তারপর হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো রূপেন,”চল,চল ভেতরে চল। আর দেখে কি করবি! দেখার বিশেষ কিছু নেই, সেই ধ্যাড়ধেড়ে কাশীপুরের চৌধুরী পাড়া।”
    আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম ওর সঙ্গে।

    ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে সোফার উপর বসে পড়লাম, কারণ অনেকটা রাস্তা হেঁটে এসেছি।এবার আমার চোখ পড়লো ড্রয়িংরুমের চারদিকে টাঙানো নারী ও পুরুষের তৈলচিত্র গুলির উপর, রূপেন একে একে সকলেরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলো আমার কাছে- অর্থাৎ এইসব তৈলচিত্র হলো এই বংশের পুর্বপুরুষগণের যাদের সস্ত্রীক তৈলচিত্র বানানো হয়েছিলো একসময়। এবার রূপেন সামনের একটা সোফায় আরাম করে বসে পড়ে বললো, “কি কেমন দেখলি? এটাকে আমি ড্রয়িং রুম বানিয়ে নিয়েছি। এটা আসলে ছিলো আমার পিতামহ দেবের সভাকক্ষ। সরকারী আমলা থেকে আরম্ভ করে নায়েব, গোমস্তা সবাই এখানে বসেই আলাপ আলোচনা সারতো।অর্থাৎ তাঁর সময় পর্যন্ত জমিদারীর ক্ষীণ আবেশটুকু অস্তিত্বের লড়াইয়ে কোনো রকমে টিকে ছিলো আরকি!”

    আমি গম্ভীর ভাবে বললাম,”তৈলচিত্রগুলো একদম নিখুঁত হয়ে আছে এখনো। সত্যিই তুই বিরাট অভিজাত বংশের সন্তান- তোর দেহে বইছে জমিদারী রক্ত, তা তোর কথায় বার্তায় বেশ স্পষ্ট।”

    রূপেন হো হো করে হেসে উঠলো একবার তারপর বললো,”নাম কে বাস্তে আভিজাত্যের আর কিছুমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। এখন আমার নিজস্ব যা কিছু দেখছিস তা এক নূতন অধ্যায়ের নিদর্শন।”

    চৌধুরী বংশের অনেক ইতিহাসই শুনলাম রূপেনের মুখ থেকে। শুনে আমার খুব রহস্যময় মনে হলো। ইতিমধ্যে এক ভদ্রমহিলা চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো, রূপেন বললো, “এর সঙ্গে তো তোর পরিচয়ই হয়নি বোধহয়, এ হচ্ছে আমার স্ত্রী রোহিনী।” এবার রোহিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে রূপেন বললো, “আর রোহিনী,এ হচ্ছে আমার কালেজমেট বাদল সেন, বিখ্যাত আঁকিয়ে কাম জ্যোতিষী।”

    জ্যোতিষী কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রোহিনীর চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভ্রুকুটিকুটিল ভাব ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে দেখলাম।
    রোহিনী দেবী একটু মুচকি হেসে বললেন,”তা বেশ তো,খারাপ কি! এখন তো জ্যোতিষীদের রমরমা বাজার- কি ঠিক বলিনি বাদল বাবু?” আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম রোহিনীদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে। কারণ সে একজন তরুণী অথচ চোখে মুখে যেন সেই তারুণ্যের লেশমাত্র নেই, সে যেন বন্দিনী এক প্রাগৈতিহাসিক জরার অলৌকিক খাঁচায়। রোহিনীদেবীর মুখ যেন বিবর্ণ-পান্ডুর! খুব একটা স্বাভাবিক বলে আদৌ মনে হচ্ছিল না আমার। তার পায়ের মাংসল অংশের ভেতর থেকে যেন আবছা একটা কঙ্কালসার পায়ের ছবি অস্পষ্ট হলেও খুব নজর করে দেখলে বোঝা যায়। আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় যেন সজাগ হয়ে উঠতে চাইছে।

    রোহিনী দেবীর ঐ ধরণের অকস্মাৎ প্রশ্নে আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন, তবে সব জ্যোতিষী এক ক্লাসের নন গুণগত তারতম্যের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে।” রোহিনী দেবী আবার সেই মুচকি হেসে বললেন,”ঠিক আছে, আপনারা দুইবন্ধু গল্প করুন, আমি রাঁধুনি দিদিকে একটু গাইড করবো, কারণ এ বাড়িতে আপনি আজ প্রথম এসেছেন ত্রুটি হলে তো চলবে না।” কথাটা বলেই রোহিনীদেবী দরজার দিকে পা বাড়ালেন আর ঠিক তখনই আর একটা অদ্ভুত বিষয় আমার চোখে পড়লো। দেখলাম রোহিনীদেবীর সারাগায়ে একটা অশুভছায়া যেন কুয়াশার মতো লেপটে আছে। আমি রোহিনীদেবীর গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। সারাঘরটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে।

    হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে রূপেন বললো, “কি রে কি দেখছিস্ অমন করে ওদিকে চেয়ে?”

    আমি বললাম, “কই কিছু না তো।” আমি সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা একেবারেই চেপে গেলাম রূপেনের কাছে।

    রূপেন এবার বলতে লাগলো, “শোন তোকে যে জন্য এখানে ডেকেছি- আজ থেকে প্রায় বছর তিনেক আগে পুজার ছুটিতেই হবে! রোহিনী আর আমি পুজার ছুটি কাটাতে এখানে এসেছিলাম। আগেও ওকে এখানে নিয়ে এসেছি বার কয়েক, কিন্তু সেইবারেই ঘটলো সেই ভয়ংকর ঘটনাটা। এই রুমটার পাশেই অর্থাৎ বেডরুমে আমি এবং রোহিনী রাত্রে একটু লুডো খেলতে বসেছি। খেলাটা বেশ জমে উঠেছে এমন সময় বেডরুমের জানালার বাইরে রক্তচন্দনের গাছগুলোর মাথায় একটা দমকা বাতাস এসে ধাক্কা দিয়ে জানালার পাল্লা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে, সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে আর বাতাসের কোনো অস্তিত্বই টের পাওয়া গেলো না, পাঁচ দশ মিনিট পর আবার রুমের লাইট জ্বলে উঠলো, অর্থাৎ কারেন্ট এলো।আমাদের খেলাও গেলো থেমে। খাওয়া দাওয়া সেরে যথারীতি শুয়ে আছি দু’জনেই। লোডশেডিং হলো এবার কিন্তু আর তাড়াতাড়ি কারেন্ট এলো না। বাধ্য হয়ে চার্জার লাইটটা জ্বালালাম, রোহিনী ততক্ষণে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজায় একটা আন্দোলন লক্ষ্য করলাম এবং সেই সঙ্গে একটা খস্ খস আওয়াজ।ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে আমি আবার শুয়ে পড়লাম এবং কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা বলতে পারবনা। হঠাৎ কিছু একটা লোমশ জাতীয় জিনিসের স্পর্শ অনুভব করতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। তাছাড়া চিরদিনই ঘুমটা আমার খুব সেনসিটিভ্। ঘুম ভেঙে পাশ ফিরতেই দেখলাম রোহিনী পাশে নেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দেখলাম দরজাটা খোলা। মনে মনে ভাবলাম সে হয়তো বাথরুমে গেছে, তাই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম রোহিনী এলো না তখন বাথরুমে গেলাম; কিন্তু সেখানে রোহিনীকে দেখতে পেলাম না। তখন আমি বাইরে এসে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে রোহিনীকে ডাকতে আরম্ভ করলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না‌। বাধ্য হয়ে টর্চ হাতে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম গেটে যথারীতি তালা লাগানো রয়েছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ইতিকর্তব্য ঠিক করছি, এমন সময় কানে ভেসে এলো একটা মচ্ মচ্ শব্দ, শব্দটা আসছে বাগানের দিক থেকে। শুকনো পাতার উপর কেউ যেন হেঁটে চলেছে। আমি শব্দটা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম বাগানের দিকে, তারপর গাছের আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা বরফের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। দেখলাম- একটা ছায়ামূর্তি হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলের দিকে। আমি চিৎকার করে রোহিনী, রোহিনী বলে ডাকতেই সেই ছায়ামূর্তি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো- ও!কি ভয়ংকর! চোখদুটো থেকে একটা লালরশ্মি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আর মুখটা হাঁ করতেই দেখলাম দু’টো বীভৎস শ্বদন্ত। আমি যেন কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই।তারপর সেই ছায়ামূর্তি আবার মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগলো এবং একসময় মিশে গেলো পুকুরের কালো জলে। কিন্তু রোহিনীর কোনো খোঁজই পেলাম না সেখানে। সেখান থেকে এলাম দেউরির কাছে রামদিনের ঘরে, রামদিনকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলতেই রামদিন যা বললো তার মর্মার্থ হলো- ওটা নাকি প্রেতাত্মা প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার রাতে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, তারপর পুকুরের জলে মিলিয়ে যায়।” এই পর্যন্ত বলে রূপেন একটু থামলো।

    আমি বললাম, “তারপর রোহিনীকে পেলি কোথায়?”

    রূপেন আবার বলতে শুরু করলো, “ঐ পুকুরের পাড়ে একটা তেঁতুল গাছের নীচে অচেতন অবস্থায়। ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসা হলো বেডরুমে মোটামুটি আধঘণ্টা শুশ্রূষার পর রোহিনীর জ্ঞান ফিরে এলো কিন্তু ও কোনো কিছুই বলতে পারল না, অর্থাৎ কেমন করে সে ঐ তেঁতুল গাছের নীচে পৌছালো তারপর কি হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই থেকে রোহিনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। মাঝে মাঝে ওকে অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কথাও বলতে শুনেছি।”

    আমি বললাম, “তুই এখানে আর আছিস কতদিন?”

    রূপেন বললো, “আছি আরো দশদিন মতো, কিন্তু কেন বল তো?”

    আমি ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ,”তার মানে এই দশদিনের মধ্যেই কাজ হাসিল করতে হবে।”

    “কাজ হাসিল মা–নে?ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না?” রূপেন আমার মুখের দিকে চেয়ে বললো।

    আমি বললাম, “ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দিতে হবে। তার জন্য কিছু বাস্তুযাগের গুপ্ত কাজ করতে হবে। তবে তার আগে জানতে হবে ঐ প্রেতাত্মার উৎস কোথায়? এটা জানতে হলে আমাকে এখানেই থাকতে হবে কিছুদিন।অবশ্য কাল আমি একবার আমার তন্ত্রমন্ত্রের পুঁথি ও কিছু দ্রব্য নিয়ে আসবো আমার বাড়ি থেকে, কি রাজি আছিস তো?”
    রূপেন খুশি হয়ে বললো, “একশোবার!হাজারবার!–কিন্তু তুই কাজটা উদ্ধার করতে পারবি তো ভাই?”
    আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “দেখেই নে না এই বাদল সেন কি পারে আর কি পারে না? আর একটা কথা তোকে বলবো, ভয় পাবি না তো?”

    রূপেন বললো, “না না,বল কি বলবি।”

    আমি বললাম যে ঐ প্রেতাত্মা তার স্ত্রী রোহিনীর উপর ভর করেছে এবং সেদিন ঐ প্রেতাত্মাই রোহিনীকে সম্মোহিত করে নিয়ে গিয়েছিল বাগানের মধ্যে। সে রোহিনীকে দিয়ে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়–এবং যদি ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেওয়া না যায় তাহলে ওর স্ত্রীকে ঐ প্রেতাত্মা মেরে ফেলবে এবং গোটা বাড়িটা অধিকার করে বসবে তখন কারো সাধ্য নেই যে এ বাড়িতে একরাত বাস করে। ঘটনাটা জেনে রূপেনের চোখ একদম কপালে উঠলো।

    আমি বললাম, “রূপেন তোদের বংশের নিশ্চয় কোনো গোপন ইতিহাস আছে যা তোর পক্ষে জানা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সেই ইতিহাস আমাকে জানতেই হবে। আচ্ছা তোদের লাইব্রেরি রুমটা কোনদিকে, ওটা একবার খুলতে হবে।”
    রূপেন বললো, “আরে, ওটা তো আজ দীর্ঘকাল ধরে তালাবন্ধ, উইপোকাতেই অর্ধেক সাবার করে দিয়েছে মনে হয়।”
    “তবুও খুলতে হবে আমার মনে হচ্ছে
    ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে আসল রহস্য।” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
    যাইহোক খাওয়া দাওয়া সেরে সেই রাতে ড্রয়িং রুমে নরম গদি আঁটা সোফায় শুয়ে দিব্যি কেটে গেলো।

    পরেরদিন বিকালে আমি আমার জ্যোতিষির থলে ও পুঁথি নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম চৌধুরী বাড়িতে। রূপেন দেখলাম লনে পাইচারি করছে আমাকে গেট ঠেলে ঢুকতে দেখেই বলে উঠলো,”লাইব্রেরী খোলা হয়েছে, চলো এখনই একবার ঘুরে আসা যাক সেখান থেকে।”
    আমি রূপেনের কথায় রাজি হয়ে গেলাম এবং লাইব্রেরী রুমের দিকে পা বাড়ালাম দু’জনে। লাইব্রেরী রুমে ঢুকে রূপেন বললো, “দাঁড়াও, আমি একটা লাইট নিয়ে আসি।” বলেই রূপেন চলে গেলো সেখান থেকে।
    আমি ততক্ষণে আমার ব্যাগ থেকে ছোটো চার্জার টর্চটা বের করে লাইব্রেরির এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম। তবে রূপেনের অনুমানটা সত্য নয় অর্থাৎ উইপোকার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেলো না,পরিবর্তে দেখলাম মাকড়সার রাজ্য আর অসংখ্য টিকটিকি।হঠাৎ আমার চোখ পড়লো এক লালচামড়ায় বাঁধানো মোটা ডায়েরীর দিকে, ডায়েরীটা ধুলো ঝেড়ে ভরলাম ব্যাগের ভেতর। হঠাৎ রূপেন এসে হাজির হলো লাইট হাতে–আলোতে দেখলাম লাইব্রেরিতে দেশী বিদেশী অসংখ্য দামী বইয়ের সম্ভার। বইগুলো মোটামুটি খুলে দেখলাম তাতে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের সম্ভার যেমন রয়েছে, তেমনই চোখে পড়লো তন্ত্র মন্ত্রের বইয়ের সম্ভারও। একটা কোণে একটা পিতলে বাঁধানো ছড়ি চোখে পড়তেই রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম,”রূপেন ঐ ছড়িটা কার?”

    রূপেন বললো,”আমাদের একজন পুর্বপুরুষের যার নাম নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরী, প্রচণ্ড অত্যাচারী ছিলেন শুনেছি বাবার মুখে।তার মৃত্যুর পর থেকেই জমিদারীর মন্দা অবস্থা দেখা দেয় আর অস্বাভাবিক সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে–যা তোকে আগেই বলেছি।”
    আমি এবং রূপেন লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
    রূপেন হাঁক পাড়লো,”রা—ম—দি—ন ঘর টায় তালা লাগাও।”
    রামদিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে দরজায় তালা লাগিয়ে আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আমরা ততক্ষণে দোতালার সিঁড়ি বেয়ে ব্যালকনিতে পৌঁছে গেছি। রূপেন ভেতরে কি যেন দরকারে ঢুকে পড়লো আর আমি আসন্ন সন্ধ্যার রহস্যময়ী রূপ উপলব্ধি করতে লাগলাম। চারদিকে যেন পরীরানীরা তাদের ইন্দ্রজাল বিস্তার করেছে। বাগানের গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠছে। আমি মোহাবিষ্টের মতো চেয়ে রইলাম সেইদিকেই।

    সেদিন ছিলো মঙ্গলবার, রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমি রূপেনকে বললাম, “আজ তো মঙ্গলবার, আজ রাত ১২টার পর আমি বাগানে যাবো।” রূপেন আমার কথা শুনে মনে হলো একটু আতঙ্কিত হয়েছে।
    রূপেন কি যেন একবার ভেবে নিয়ে বললো, “বাদল তুই যাস না ওটা প্রেতাত্মা, শুনেছি প্রেতাত্মারা বহুরূপী হয় তোকে যদি কোনো জন্তু হয়ে আক্রমণ করে- তখন?”
    আমি বললাম, “পারবে না ব্রাদার পারবে না, আমি এতো কাঁচা খিলাড়ী নই।” রূপেন আর কিছু বললো না। আমি রূপেনেরর সঙ্গে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর রূপেন তার বেড রুমে চলে যেতেই আমি ব্যাগ থেকে সেই ডায়েরীখানা বের করে ঘাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ ডায়েরীর একটা পাতায় আমার চোখ দু’টো আটকে গেলো। দেখলাম একটা ধাঁধা জাতীয় কিছু লেখা রয়েছে, ধাঁধাটা এইরকম- “দামিনী চমকে ঘরের আলোকে, জাগায় তৃষ্ণা মনে পাপ।
    নিভলো দামিনী সকলই হারায়ে- রেখে গেলো এক মহাশাপ।”এটা নিছকই কোনো আবেগ তাড়িত কবিমনের প্রলাপ, না কৃত কোনো পাপের অনুশোচনার প্রকাশ! ভাবতে লাগলাম গভীরভাবে, ভাবনার মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি রূপেন কখন এসে ঘরে প্রবেশ করেছে- “কিরে বাদল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিস নাকি?”রূপেনের কথাতেই আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

    আমি বললাম, “না রে, আমি এতক্ষণ একটা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলাম।”

    রূপেন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,”কি ব্যাপারে বলতো?”

    আমি বললাম, “দামিনী কে? তুই জানিস এই দামিনী সম্বন্ধে কিছু?”

    রূপেন যেন আকাশ থেকে পড়লো, আমি তখন ডাইরীটা খুলে ওকে ধাঁধাটা দেখালাম।ধাঁধাটা দেখে রূপেন হো হো করে হেসে উঠে বললো, “ওটা নিছকই একটা কবিতার লাইন।”

    আমি রূপেনের হাসি থামিয়ে বললাম, “না ওটা নিছকই একটা কবিতার লাইন হতে পারেনা কারণ প্রতিটি লাইনকে লাল কালি দিয়ে আন্ডার লাইন করা আছে, এর অর্থ একটাই যে এই কয়টি লাইনের অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
    রূপেনের মুখের হাবভাব হঠাৎই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো, সে বললো, “তাহলে ওটা কি কোনো ধাঁধা, যার উত্তর আমাদের অনুমানের বাইরে।”
    “ঠিক তাই।” আমি একটু ভেবে বললাম।

    রূপেন বললো, “তাহলে এখন কি করা যাবে?”

    আমি রূপেনকে বললাম, “আমার মনে হচ্ছে এই ধাঁধার অর্থের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বিরাট একটা গুপ্ত ইতিহাস, যে করেই হোক আমাদের জানতেই হবে। কিন্তু কি করে–!কি–ন–তু! পেয়েছি।”

    রূপেন বললো,”কি পেয়েছিস্ ?”
    আমি ওর কৌতূহল নিরসন করার জন্য বললাম, “এই ধাঁধার উত্তর পাওয়ার উপায়..এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মাকে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আমাদের ডেকে আনতে হবে।”

    রূপেন খানিকটা অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মাকেই কেন?অন্য কেউও তো হতে পারে!”
    আমি গম্ভীর গলায় কিন্তু জোরের সঙ্গে বললাম, “না, হতে পারে না, কারণ ঐ লাইন কয়টির নীচে যার স্বাক্ষর দেখলাম তিনি নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীই।”
    ওয়ালক্লকটা ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো সন্ধ্যা সাতটা- ঠাকুরবাড়ির কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ শোনা গেলো। আমি হঠাৎ রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা রাঁধুনি দিদির বাড়ি কোথায়?”
    রূপেন বললো, “আরে পলাশের দিদিকে চিনিস না?”

    আমি বললাম, “ও পলাশের দিদি মানে ছায়াদি,তাই বল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোলকাতা থেকে লোক সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি।”

    রূপেন বললো, “ঐ তো ছায়াদি রান্নার কাজ সেড়ে বাড়ি যাচ্ছে।” বলেই হাঁক পাড়লো, “ও–ও ছা–য়া–দি এদিকে একবারটি এসো।” বলতে বলতেই ছায়াদি মানে ঘোষ পাড়ার ছায়া ঘোষ একমুখ হেসে বললো, “কি হলো গো দাদাবাবু?” তারপর আমাকে দেখেই বললো, “ও মা বাদলভাই তুমি এখানে? তা কি মনে করে?”

    আমি বললাম,”এই একটা বিশেষ কাজে এসেছি দিদি।।”

    হঠাৎ রোহিনী রূপেনকে ব্যালকনি থেকে ডাকলে রূপেন বললো, “তুই ছায়াদির সঙ্গে কথা বল আমি একটু আসি।” বলেই চলে গেলো।

    ছায়াদি রূপেনের গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ, তারপর চাপা গলায় আমাকে বললো, “বাদলভাই এ বাড়িতে ভুত আছে গো–ভুত!”

    আমি বললাম, “তুমি দেখেছো?”

    সে বললো, “দেখি নাই! তবে সে যে এ বাড়িতেই থাকে তা বেশ বুঝেছি।” এর জন্য সে যে মনে মনে শঙ্কিত তা তার চোখমুখ দেখেই বুঝলাম, তবুও পেটের দায়েই তাকে এ কাজ করতে হয়।

    ছায়াদির কাছ থেকে আরও অনেক অদ্ভুত ঘটনার কথাও জানা গেলো। আমি ছায়াদিকে বললাম, “ছায়াদি তুমি এবার এসো অনেক দেরী হয়ে গেলো তোমার।”
    ছায়াদি খানিকটা ইতস্ততঃ করেই পা বাড়ালো গেটের দিকে। আমিও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বারান্দার দিকে। এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম দোতালার ব্যালকনিতে এবং একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর সেখানে এসে হাজির হলো রোহিনী ও রূপেন, রোহিনীর হাতে চায়ের ট্রে রূপেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার পাশেই বসলো। রোহিনী আমাদের দু’জনের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা চেয়ারে বসলো। কিছুক্ষণ একদম নিস্তব্ধ চায়ের চুমুকের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিলো না কারোরই। রোহিনীই নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো,”আচ্ছা বাদলবাবু আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?”

    আমি বললাম, “বিশ্বাস করা বা না করার মধ্যে ভৌতিক অস্তিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।মৃত্যুর পর আত্মা যে এক অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করে–তা আমি বিশ্বাস করি। এ জগতের সমস্ত কিছুই অলৌকিক যার লৌকিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।”

    রূপেন বলে উঠলো, “ভুত বলে একটা কিছু আছেই।”
    রোহিনী হো হো করে হেসে উঠে বললো, “তুমিও শেষে-? ছিঃছিঃ তোমার শিক্ষা দীক্ষায় ধিক্! তুমি না বিজ্ঞানের একজন ভালো স্কলার?”
    আমি বললাম, “রোহিনী দেবী রূপেনের কথাটা ঐ ভাবে উড়িয়ে দেবেন না। রূপেন যা বলছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।”
    রোহিনী বলে উঠলো, “আমি কোলকাতার মেয়ে আমার বাবা বিখ্যাত বোটানিস্ট ডঃ নিরোদ বরণ ঘোষ, আমরা ছোটো থেকেই একটা বৈজ্ঞানিক পরিবেশে বড় হয়েছি।আমি নিজেও কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি করে গোয়ার একটা অন্য কলেজে পড়াই, তাই এই সব ভুতটুত মেনে নেওয়া আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।”
    আমি বললাম, “জানেন সেদিন আপনাকে নিশিভুতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?”
    রোহিনীর মুখে এবার যেন একটা ক্ষীণ ভয়ের আস্তরণ চোখে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িতে রাত্রি আটটার ঘন্টা পড়লো, দূরে কোথাও একটা শিয়াল ডেকে উঠলো- “হুক্কিহুয়া-উয়া–উয়া–উয়া!”।

    রোহিনী প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে রূপেনকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ঘড়িতে আটটা বাজছে বাদলবাবুকে নিয়ে ডাইনিং প্লেসে এসো।”

    রাতের খাওয়া শেষ করে আমি এবং রূপেন ড্রয়িং রূমে বসে সিগারেট খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। রূপেন বললো,”রাতে যেন বাগানে যাস না ভাই এটা আমার অনুরোধ।”
    আমি আমার ভেতরের অদম্য ইচ্ছা গোপন করে বললাম,”না,না বাগানে আমি যাচ্ছি না।সে তোর কোনো চিন্তা নাই।”রূপেন আশ্বস্ত হয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে ওর বেডরুমে চলে গেলো।
    আমিও দরজা বন্ধ করে নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম সোফার উপর। রাত তখন বড়জোড় ৯টা হবে। একটা চিন্তার মেঘ আমার মনের মধ্যে ক্রমশ জমে উঠতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা বলতে পারবো না, হঠাৎ একটা অদ্ভূত শব্দে ঘুমটা আমার ভেঙে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ১টা। শব্দটার উৎস সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়লাম, আস্তে আস্তে দরজা খুলে টর্চ হাতে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় তাতে কিছুই দেখতে পাওয়া গেলো না। এবার আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়িবারান্দা ছাড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম বাগানের রেলিং দেওয়া দরজার সামনে।একবার ভালো করে বুক পকেট পরীক্ষা করে দেখে নিলাম রূপোর তৈরী ভবাণীযন্ত্রমটা আছে কিনা! তারপর গেট খুলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সেই বিতর্কিত পুকুরটির দিকে, একসময় পেছনে ফিরে দেখলাম বাড়ির দোতালার চিলেকোঠাটা শুধু দৈত্যের মাথার মতো কালো হয়ে আছে।অর্থাৎ বাগানের এই পুকুরটা বাড়িটা থেকে প্রায় দেড়শো থেকে দুশো মিটার দূরে। আজ মঙ্গলবার অতএব সেই প্রেতাত্মা নিশ্চয় আজ বেরিয়ে আসবে। এইসব যখন ভাবছি হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো পুকুরের জলে।আমি একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর যা দেখলাম তাতে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়ত ভিরমি খেতো।
    দেখলাম পুকুরের জলের উপর থেকে বাঁধানো ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে একটা স্যিলুয়েট্ মূর্তি। ধীরে ধীরে সেই মূর্তি ঘাটের উপর উঠে এলো। এরপর যেন মনে হলো সে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো ভাবে দেখলো।
    তারপর আবার এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির দিকে। আমিও গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম, একসময় সেই সিলুয়েট মূর্তি বাগানের গেটের কাছে পৌঁছেই পিছন ফিরে তাকাতেই চোখ পড়লো আমার দিকে তারপর যে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটলো তাতে আমার সাড়া শরীর এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলো।
    হঠাৎ একটা একটানা খ্যানখ্যানে অট্টহাসিতে সমস্ত বাগানটা যেন ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো–কোথা থেকে একটা দমকা বাতাস এসে গাছগুলোকে যেন উপড়ে ফেলতে চাইলো।যেন পৃথিবীর গভীর তলদেশে শুরু হয়েছে বিধ্বংসী কোনো এক কম্পন। চারদিকে একটা অলৌকিক মোহগ্রস্ততা। কতক্ষণ যে এমনভাবে কাটলো তা বলতে পারবো না–হঠাৎ দেখি সেই ছায়ামূর্তির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একটা নারীমূর্তি তারপর সেটা নরকঙ্কালে পরিণত হয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে, আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলাম বাড়িটার দিকে কিন্তু কিসে যেন একটা হোঁচট খেয়েই পড়ে গেলাম। এবার সেই নরকঙ্কাল দেখলাম আমার প্রায় খুব কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছে আর তার দুই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছে আমার পা দু’টো।আমি বেশ বুঝতে পারলাম সে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে পুকুরের দিকে। নিশ্চিত মৃত্যু, সে আমাকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে। মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেলো ভবাণীযন্ত্রমের কথা- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে বার করে আনলাম সেটা। দেখলাম সেই নরকঙ্কাল আমার পা দু’টো ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে পুকুরের জলের ধারে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে সেই পৈশাচিক হাড়হিম করা হাসি,”হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ।”
    ভবাণীযন্ত্রম তুলে ধরতেই সেটা মিলিয়ে গেলো কালো জলে একটা বিকট শব্দ করে।
    আমার সাড়া শরীর যেন অবসন্ন হয়ে আসতে লাগলো আনিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মতো। বুঝতে পারলাম আজ ভবাণীযন্ত্রমের জন্যই বেঁচে গেলাম। ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যে আবার ফিরে এলাম ড্রয়িংরুমে কিন্তু সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

    পরেরদিন সকালে ব্রাশ করে ব্যালকনিতে চা খেতে খেতে রূপেন বললো,”কি রে বাগানে যাসনি তো?”
    আমি গতরাত্রির ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম,”পাগল হয়েছিস, জেনে শুনে কেউ ভুতের খপ্পরে পড়তে চায়, কাল নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি।”
    রোহিনী আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বললো, “আ্যলজেলাম্ খেয়েছিলেন নাকি?”
    আমি মৃদু হেসে বললাম, “তার দরকার হবে না ভাবীজি, নিদ্রাদেবী আমার উপর সদাপ্রসন্না।”
    কথাটা শোনামাত্র ওদের মধ্যে একটা হালকা হাসির তরঙ্গ বয়ে গেলো যেন।
    রোহিনীর মুখটা যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে- এ যেন আ্যনিমিক টেনডেনসি বলেই মনে হতে লাগলো আমার। রোহিনী এমনিতে যে খুব প্রাণোচ্ছল তা এই দু’দিনে বেশ বুঝতে পারলাম। ওর অজান্তে কোনো এক বিদেহী আত্মা ওর শরীর থেকে এক্টোপ্লাজমকে আশ্রয় করে সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং একটা দুর্নিবার অশরীরী আকর্ষণ ওর শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে ওকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
    আমি কেবলমাত্র রোহিনীর কথা ভেবেই সেইদিন রাত্রেই খাওয়া দাওয়ার পর প্ল্যানচেটে বসার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করলাম। ড্রয়িং রূমের দরজা জানালা বন্ধ করে একটা তেপায়া টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসে পড়লাম তিনজনে। ঘড়ি ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো- রাত এগারটা। সমস্ত ঘরটা অন্ধকার, কেবলমাত্র টেবিলের উপর জ্বলছে একখানা মোমবাতি।আমি, রূপেন ও রোহিনী তিনজনে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঠেকিয়ে নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর ছবি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম- চারদিকে জমাট নিস্তব্ধতা যেন সারা বাড়িটাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। হঠাৎ দরজাটা নড়ে উঠলো কেউ যেন নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো- সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম রূপেনের চোখমুখ কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। চোখদু’টো টকটকে লাল আর বিকৃত মুখ দিয়ে লালা ঝরছে- হঠাৎ রুমের ভেতর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরে রূপেন বলে উঠলো,”আ-মা-য়—কে-ন–ডা-ক-লি–ব-ল?”
    আমি বুঝতে পারলাম রূপেনের দেহ আশ্রয় করেছে নৃসিংহ প্রসাদের আত্মা এ কন্ঠস্বর রূপেনের নয় এটা নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মার পৈশাচিক কন্ঠস্বর- কি বীভৎস সেই কন্ঠস্বর মনে হলো যেন কোনো গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক জান্তব গর্জন।রোহিনী ভয়ে আমাকে চেপে ধরলো,আমি ইশারায় তাকে সাহস দিলাম। এবার আমি বললাম,”বলুন কে আপনি?”

    সেই আত্মা চিৎকার করে বলে উঠলো,”তু-ই—যা-কে–ডে-কে-ছি-স্—সে-ই-ই—আ-আ-মি——আ-মা-র—–খু-ব—ক-ষ্ট—হ–চ্ছে—ব-ল–কি– ব–ল–বি ব-ল?”

    আমি নির্ভয়ে বললাম, “আপনি যার দেহে এখন অবস্থান করছেন সে আপনারই বংশধর–অতএব এর জীবন ও সুখ-সমৃদ্ধি রক্ষা করতে আপনাকে আমাদের সাহায্য করতেই হবে।”

    আবার সেই আত্মা বলে উঠলো,”ব-ল—কি–প্র-য়ো-জ–নে—আ–মা–কে–ডা-ক-লি—আ-মি–বে–শী ক্ষ-ণ—থা-ক–তে—পা–র-ব–না—আ-মা-র—ক-ষ্ট—হ-চ্ছে।”

    আমি আবার বললাম, “আর একটু কষ্ট করে বসুন- আমি একটি ধাঁধা বলছি তার উত্তর আপনাকে বলে যেতে হবে- দামিনী চমকে ঘরের আলোকে, জাগায় তৃষ্ণা মনে পাপ।
    নিভলো দামিনী সকলই হারায়ে–রেখে গেলো এক মহাশাপ—–এর অর্থ কি? আজ আপনাকে বলে যেতেই হবে, তা নাহলে আপনার এই বংশধরের মহাবিপদ।”

    সঙ্গে সঙ্গে সেই আত্মা হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,”দা–মি–নী-হ-লো–এ-ক-জ-ন —বা-ই-জী।ও-র –রূ-পে —মু-গ্ধ হ-য়ে—-আ-মি—ও-কে—ভো-গ —ক-রি–এ-ব-ং—ব-দ-না-মে-র—ভ-য়ে—খু-ন— ক-রে– ফে-লি–এ-ব-ং—তা-র–লা-শ—ঐ—পু-কু-রে-র—পাঁ-কে—পুঁ-তে—ফে-লে-ছিলা-ম—-মৃ-ত্যু-র—আ-গে—সে—ব-লে-ছি-লো—এ-ই—বং-শে-র–উ-ত্তর—পুরু-ষ—সক-ল-কে—সে–মে-রে–ফে-ল-বে–মে-রে —ফেল-বে–কে-উ—বাঁচ-বে—না—ও-র—আ-ত্মা—শা-ন্তি—পা-ই নি—-শা-ন্-তি—-পা–ই–নি—–এ-বা-র—–আ–মা–য়–
    –ড়ে–দে—আ-মায়—এ-বা-র–ছে–ড়ে –দে-দে–দে।”

    আমি চিৎকার করে বললাম, “আপনি চলে যান- আপনার বংশধরের দেহ থেকে এবার আপনি চলে যান–চলে যান।”
    সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা বাতাসে জানালা গুলো খুলে যেতেই মনে হলো ঘর থেকে একটা ছায়া যেন বাইরের জমাট অন্ধকারে মিশিয়ে গেলো। রূপেন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপর। ওকে আমি তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম বেডরুমে খাটের উপর বিছানায়। তারপর ওর চোখে মুখে মন্ত্রপুত জলের ছিটে দিতেই ও আস্তে আস্তে চোখ খুললো বটে কিন্তু কথা বলতে পারলো না।ইশারা করে জল খেতে চাইলে আমি রোহিনীকে একটু গরম দুধ আনতে বললাম।রোহিনী দুধ নিয়ে এলে ওকে একটু একটু করে দুধ দিলাম মুখে। প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে গেলো ঐ ভাবেই, তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার হাতটা চেপে ধরেছে। আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম,”কি রে কিছু বলবি।”
    ও ধীরে ধীরে বললো,”রোহিনী কোথায়?”
    রোহিনী পাশেই দাঁড়িয়েছিলো বললো, ‘এই তো আমি, কোনো ভয় নেই সব ঠিক আছে।” মনে হলো ও যেন একটু হাসার চেষ্টা করলো।রোহিনীকে আমি শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলাম।

    পরেরদিন সকালে চায়ের আসরে রূপেন বললো, “এখন তাহলে আমাদের করণীয় কি?”
    রোহিনী বললো, “সে তোমাকে ভাবতে হবে না, বাদলবাবু সব ব্যবস্থা ভেবেরছেন।”
    আমি বললাম “চিন্তা নেই, এই শনিবার রাতেই হোম করবো ঐ পুকুরের বাঁধানো ঘাটে এবং ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেবো তন্ত্রমতে। তার জন্য যা যা দরকার আমি লিস্ট করে রেখেছি রামদিনকে দিয়ে জিনিসগুলো আনিয়ে নিতে হবে। সেদিন ওখানে রামদিনও থাকবে আমাদের সঙ্গে।”
    রূপেন ও রোহিনীর চোখমুখ দেখে মনে হলো তারা যেন দীর্ঘদিনের একটা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে চলেছে। রূপেন রামদিনকে ডেকে তার হাতে লিস্ট ও একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আজই এই জিনিসগুলো তার বাঙলার বাজারে গণেশ ভান্ডার থেকে নিয়ে এসো।”
    রামদিন জি হুজুর বলে বিদায় নিলে রূপেন আমাকে বললো, “ভাগ্যিস সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, তা নাহলে কি যে হতো!”
    আমি বললাম, “সত্যিই তাই। আসলে কি জানিস রাখে হরি তো মারে কে–আর মারে হরি তো রাখে কে!”

    দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেলো।আজই শনিবার। সকাল থেকেই আমরা তিনজনে মানসিক ভাবে হোমের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলাম। হোম শুরু হবে ঠিক রাত দশটায়- সেখানে থাকবো আমি, রূপেন, রোহিনী ও রামদিন। দিনে শুধু চা আর জল ছাড়া কিছুই খাওয়া যাবেনা, কারণ তিনজনকেই উপবাসে থাকতে হবে, এমনকি রামদিনকেও। রামদিনকে উপবাসের কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি, রূপেন ও রোহিনী বাড়ির লনে পড়ন্ত রোদে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে গল্পগুজবে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিলাম, তারই মাঝখানে রোহিনী আমাদের জন্য চা করে নিয়ে এলো। আমরা চা খেয়ে উঠে গেলাম বাড়ির ভেতরে।রোহিনী দেখলাম কিচেনে গেলো। মনে হয় ছায়াদিকে সাহায্য করতে, কারণ রাত্রে হোম শেষ করে নিরামিষ আহার গ্রহণই বিধেয়, তাই ছায়াদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে হয়তো লুচি ও নিরামিষ কোনো পদ বানিয়ে নেবে রাতের জন্য।

    রাত ঠিক সাড়ে নটায় সকলে জিনিস পত্র নিয়ে পৌঁছে গেলাম পুকুরের বাঁধানো ঘাটে।আমি মন্ত্র পড়ে সকলের গাত্রবন্ধন করলাম, আর গলায় পড়ে নিলাম রুদ্রাক্ষের মালা ও ভবাণীযন্ত্রম। দু’টো বড় চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আমি হোমের নিমিত্ত স্থন্ডিল প্রস্তুত করে কুশাসনে বসে পড়লাম বাকিরা অর্থাৎ রূপেন ,রোহিনী ও রামদিন বসে রইলো আমার কিছুটা পেছনে। আমি অশ্বত্থ কাঠ সাজিয়ে কুশ দ্বারা মন্ত্রপাঠ পুর্ব্বক অগ্নি সংযোগ করতেই যোগাগ্নি জ্বলে উঠলো। আমি সর্ব্বদেবদেবীকে একে একে মন্ত্রপাঠ করতে করতে ঘৃতাহুতি দিতে লাগলাম এবং যোগাগ্নিতে সমীধ যোগাতে লাগলাম কখনো সমন্ত্রক কখনবা অমন্ত্রক।একসময় পূর্ণাহুতির সময় এগিয়ে এলো আর ঠিক তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা! হঠাৎ রোহিনী চিৎকার করে খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠলো,”আঁমায় ছেঁড়ে দেঁ রেঁ আঁগুনেঁ পূঁড়িয়েঁ মাঁরিস নাঁ। ছেঁড়ে দেঁ, ছেঁড়ে দেঁ।” বলতে বলতে রোহিনী জলের দিকে দৌড়ে যেতে গেলে রামদিন ও রূপেন তাকে ধরে ফেললো। আর ঠিক তখনই পুকুরের মাঝখানে আভির্ভাব ঘটলো এক ছায়ামূর্তির তার অট্টহাসিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো- হঠাৎ একটা দমকা বাতাস সবকিছু যেন লন্ডভন্ড করে দিতে চাইলো- আমি আর দেরী না করে মন্ত্রপাঠ করে পূর্ণাহুতি দিলাম যোগাগ্নিতে- সঙ্গে সঙ্গে সব আবার আগের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো- আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেলো পুকুরের মাঝখানে সেই ছায়ামূর্তিটি আগুনে পুড়তে আরম্ভ করেছে আর খ্যান খ্যানে গলায় বিকট চিৎকার করে চলেছে। দেখতে দেখতে সেই ছায়ামূর্তির মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এলো একটা জলন্ত কঙ্কাল সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “আঁর আঁসবো নাঁ এঁখানে, আঁমাঁয় ছেঁড়ে দেঁ—ছেঁড়ে দেঁ—ছেঁড়ে দেঁ।” একসময় সেই নরকঙ্কাল পুড়ে ছাই হয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলীর সাথে মিশে গিয়ে উঠে যেতে লাগলো দূর আকাশে আর তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেলো দূরদিগন্তে।
    আমি সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলাম এতক্ষণ ।হঠাৎ রূপেনের হতাশাভরা কন্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পিছন ফিরে দেখি রোহিনী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বাঁধানো ঘাটের উপর– জল থেকে কিছুটা দূরে।

    আমি চিৎকার করে বললাম, “আর কোনো ভয় নেই প্রেতাত্মা মুক্তি লাভ করেছে। চলো ওকে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে।”

    রূপেন রোহিনীকে কোলে তুলে নিলো।রামদিন আলো হাতে আমাদের পথ দেখাতে লাগলো- আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম বাড়ির বারান্দায়। রোহিনীকে সোফার উপর শোয়ানো হলো, আমি তার মুখে মন্ত্রপুত জলের ছিটে দিতেই সে চোখ খুললো। আমি, রূপেন ও রামদিন সেখানেই আরোও ঘন্টা খানেক বসে রইলাম- রূপেন রোহিনীর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো।আমিও ভবাণীযন্ত্রম রোহিনীর মাথায় ঠেকিয়ে ভবাণীস্ত্রোত্র পাঠ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম রোহিনী ধীরে ধীরে উঠে বসেছে সোফার উপর।এখন আর চোখে মুখে সেই অশুভছায়ার প্রভাব নেই, পায়ের মাংসল অংশের ভেতরেও সেই অশরীরীর স্পর্শ কেটে গেছে। সারাগায়ে লেপ্টে থাকাসেই অশুভছায়ার কুয়াশাও উধাও–এ যেন রোহিনীর নবজন্ম। সেই রাত্রে সকলেই আমরা গরম দুধ খেয়ে কাটালাম।
    পরেরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন ৮টা। আমি ব্রাশট্রাশ করে ফ্রেস হয়ে আমার জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে রোহিনী ও রূপেনের সাথে চায়ের আড্ডায় যোগ দিলাম।গরম গরম লুচি ও আলুর দম সহযোগে প্রাতরাশ সারলাম—এবার আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম,”এবার তো আমায় ছেড়ে দিতে হবে বন্ধু।”

    রূপেন বললো,”তোর এই উপকার জীবনেও ভুলবনা ভাই।”

    রোহিনী বললো, “চলুন না একবার গোয়ায় মাসখানেক থেকে আসবেন।”

    আমি বললাম, “এবারে তা আর সম্ভব নয় ভাবীজি, নেক্সট টাইম চেষ্টা করে দেখবো।”

    আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নীচে, তারপর ধীরে ধীরে গেটের কাছে আসতেই রামদিন আমাকে সেলাম জানালো, ওর চোখে মুখে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ বেশ লক্ষ্য করলাম। একসময় গেট পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বড়রাস্তার উপর– সেখান থেকে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম রূপেন ও রোহিনী তখনও দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে–ওরা যেন এখন শাপমুক্তির আনন্দে বিহ্বল।একসময় দেখলাম চৌধুরী বাড়ির চিলেকোঠাটাও যেন ওদের দু’জনের মতোই আকাশের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাপমুক্তির আনন্দে শরতের রোদমেখে হালকা একটা বিমূর্ত হাসিতে মাথা দোলাচ্ছে।
    ——— সমাপ্ত——

  • ভৌতিক গল্প

    অতৃপ্ত বাসনা

    অতৃপ্ত বাসনা
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    স্টেশন লছমনপুর। বীরভূম ঝাড়খন্ড সীমান্ত। একটাই ট্রেন। সকালে যায় রাতে ফেরে। ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম লোকজন বিশেষ নেই। লছমনপুর গ্রামে যেতে হবে ক্যানসার আক্রান্ত বন্ধুকে দেখতে। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুর সাথে একবারই এসেছিলাম।
    নিশুতি রাত। মেঘে ঢাকা আকাশ। গা ছমছম। চাঁদ ওঠেনি। সরু মেঠো পথ। নিস্তব্ধ নিঝুম। শাল পিয়ালের বন। রাস্তা ভুলে গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালাম। ভুল পথে এসেছি। হঠাৎ একটা খসখস শব্দ।শুকনো পাতার উপর চললে যেমন হয়।স্পষ্ট দেখলাম একজোড়া নারী পুরুষ এগিয়ে আসছে। যুবক যুবতী। এগিয়ে এসে মেয়েটি বলল “আপনি কোথায় যাবেন?” আমি বললাম “লছমনপুর গ্রাম।” মেয়েটি বলল “আপনি ভুল করেছেন। এটা গ্রামে যাবার পথ নয়। আমাদের সাথে আসুন আমরা আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। আমরা ঐ গ্রামেরই। আমি ওদের অনুসরণ করলাম। ওরা দু’জনে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। মেঘের ফাঁকে একফালি চাঁদ। মাঝে মাঝে ওদেরকে দেখছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম “তোমরা কে?” মেয়েটি বলল “আমি পিয়ালি আর ওর নাম পলাশ।” আমরা দু’জনে দু’জনকে ভালবাসি। পথ চলতে চলতে আমরা একটা গ্রামের সামনে এসে পড়লাম। পিয়ালি বলল “কার বাড়ি যাবেন?” আমি আমার বন্ধুর নাম করতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তারপর বলল “আসুন”। বাড়ীটির কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না কোন দিকে গেলো। বাহির দরজায় টোকা দিতে বন্ধুর স্ত্রী দরজা খুলে দিল। বিশাল অট্টালিকা। অসুস্থ বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। রাতের খাবার খাইয়ে বন্ধুর স্ত্রী একটা ঘর খুলে বলল “এখানে আপনি ঘুমাবেন।”
    দক্ষিণ খোলা। আলো বাতাস পূর্ণ দোতলার ঘরটি বেশ মনোরম। কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে ওরা চলে গেলো। আমি দরজায় খিল এঁটে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। পথশ্রান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
    হঠাৎ একটা বীভৎস চিৎকারে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম। আলো জ্বেলে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার একটা অস্বাভাবিক শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর। স্বর্নলংকারে ভূষিতা একটা মেয়ে আমার পাশে বসে আছে। একফালি চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পড়লো। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম “কে তুমি?”
    মেয়েটি বেশ জোর গলায় বলল “আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি পিয়ালি”। ভয়ে উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো।নিজের হাতে দরজা বন্ধ করেছি কোথা থেকে সে এল? হঠাৎ পিয়ালির চোখ দু’টি বড়ো হয়ে গেল। আগুন ঠিকরে বেরতে লাগলো। ভয়ংকর বীভৎস মূর্তি। ঘরের আলো একবার জ্বলছে নিভছে। আকাশ বাতাস চিরে অট্টহাসি। আমার খাটটা দুলতে লাগল। একবার আলো একবার অন্ধকার। পিয়ালি কখনো খাটের উপর কখনো নীচে। কখনো এপ্রান্তে কখনো ওপ্রান্তে। সর্বত্র দেখছি পিয়ালি। হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি। কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। সামনে পলাশ। পিয়ালি পলাশ একসাথে আমাকে গ্রাস করতে আসছে। আমি চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালাম। সম্বিত ফিরে পেলাম কে বা কারা যেন বাইরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম বাইরে বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী । তারা ঘরে এসে বসল।জিজ্ঞেস করল “এত জোরে চেঁচাচ্ছিলে কেনো?” আমি বললাম “পিয়ালি পলাশ এসেছিলো, পিয়ালি কে?” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুটি বলল “পিয়ালি আমার বোন”।
    বন্ধু পত্নী যা বলল তা শুনতে শুনতে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল। “বহুকাল আগে পিয়ালি পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল। পলাশ ওকে জল থেকে তুলে বাঁচিয়েছিল। সেই থেকে ওরা একে অপরকে ভালবাসত।আমরা পিয়ালিকে ঘরে বন্দী করে রাখতাম। একদিন পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে পলাশকে বিয়ে করেছিল। পলাশ ছিল জাতে বাউরি।গরীব। আমরা মেনে নিইনি। একদিন ওরা আবার পালিয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে একটা পিয়াল গাছে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। সকালবেলা গ্রামের লোক বাড়ীতে খবর দেয়”। বলতে বলতে বন্ধু পত্নী অঝোরে কাঁদতে লাগলো।

  • ভৌতিক গল্প

    গেষ্টহাউসের সেই রাত

    গেষ্টহাউসের সেই রাত
    -পার্থসারথি 

     

     

    স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যখন নামলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। পশ্চিম দিগন্তে তাকিয়ে বুঝলাম সূর্যদেব অনেক আগেই বিশ্রাম নিতে চলে গেছেন তাঁর নিজের ডেরায়। মাঘমাসের শীতেমোড়া সন্ধ্যা। আমি যে জায়গায় এসে পৌছেছি তার চারপাশটা দেখে মনে হচ্ছে সবত্র যেন কয়েক শতাব্দীর প্রাচীনতা দাঁত কিড়মিড় করছে। ট্রেন থেকে নেমে শরীরের জড়তা কাটিয়ে উঠতে একটু আড়মোড়া ভাঙার মতো করে পেশীগুলোকে একটু চনমনে করে নিচ্ছি এমন সময় কে যেন পেছন থেকে ডাকলো-
    “এই যে ও মশাই? শুনছেন? ঘড়িতে এখন কটা বাজে বলুন তো?” দেখলাম প্ল্যাটফর্মের রেলিংয়ের ধারে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একটি লোক।
    আমি বললাম,”সাতটা।”
    লোকটা বললো,”অনেক দেরী হয়ে গেল মনে হচ্ছে।”
    আমি বললাম, “আপনি?”
    “আপনি তো বলরামপুরে যাবেন?” বললো লোকটি।
    আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম প্রথমে, তারপর ভাবলাম হয়তো এখানে যেসব যাত্রীরা নামে তাদের অধিকাংশের গন্তব্য বলরামপুরই হয়ে থাকে।
    “আমি জানি আপনি বলরামপুরে কোথায় উঠবেন?গেষ্টহাউসে, তাই না?” বলতে বলতে লোকটা উঠে এলো প্ল্যাটফর্মে।
    এবার কিন্তু অবাক হলাম যেন একটু বেশী। মনে মনে ভাবলাম,”এই লোকটা এতকথা জানলো কি করে?” পরমুহুর্তেই আবার ভাবলাম, “লোকটা গেষ্টহাউসের কোনো কর্মচারী টর্মচারী হবে হয়ত! যাক গে-! “আমি লোকটাকে প্ল্যাটফর্মের আলোতে দেখতে লাগলাম।
    লোকটার পরনে ছিলো একটা ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া কাপড়, খদ্দরের শার্ট ও সারা গায়ে একটা কালো চাদর জড়ানো, মুখটা বেরিয়ে আছে শিয়ালের মুখের মতো; চাদরের নীচে শার্টটা দেখা যাচ্ছে, তার চেহারায় লক্ষ্য করলাম যেন একটা পারলৌকিক ছলনা ছায়ার মতো ঘিরে রয়েছে, কঙ্কালসার শরীরের উপরে সৃষ্টিকর্তা যেন নিতান্ত অনীহার সঙ্গে একটা প্রকান্ড মাথা বসিয়ে দিয়েছে, চোয়াল দু’টোতে পতনোন্মুখীনতার অনিশ্চয়তা পোড়োবাড়ির ঝুলে পড়া কার্নিশের মতো, চোখগুলোতে যেন পাতালরহস্যের ইতিকথা। লোকটাকে দেখে আমার যেন কেমন একটা মনে হলো, মনের ভেতর একটা জমাট রহস্য যেন ফোঁস ফোঁস করছে। তবু আমি মনের ভাব চেপে রেখে বললাম,”তা আপনিও কি বলরামপুরে যাচ্ছেন?”

    “হ্যাঁ ওখানেই যেতে হবে” চাপাগলায় লোকটা বললো।
    বললাম, “তাহলে তো ভালোই হলো, একজন সঙ্গী পেলুম!- চলুন এখন একটু চা খাওয়া যাক। পরে রওনা হওয়া যাবে”
    “আজ্ঞে, আমি চা খাই না।আপনি চাইলে খেতে পারেন,আমি এখানেই রয়েছি –আপনি খেয়ে আসুন।”
    মনে মনে ভাবলাম,”কলিযুগের অবতার নাকি অপরের দয়া গ্রহণ করেন না।যাক্ গে—“ততক্ষণে ঠান্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পুরো এলাকাটাকে কবজা করেছে,ইতিমধ্যে সময়ও গড়িয়ে গেছে অনেকখানি। চারদিকে যেন একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ,আমার সঙ্গে যে দুচারজন যাত্রী নেমেছিল এখানে তারা অনেক আগেই যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়েছে। মাঘমাস উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বরফ ঢেলে চলেছে।শুক্লাচতুর্থীর ফ্যাকাশে জ্যোৎস্নায় চারদিক যেন মোহময়ী হয়ে উঠেছে।
    আমি পায়ে পায়ে স্টেশন চত্বরে একটা টি স্টলের দিকে এগিয়ে গেলাম।বেঞ্চে বসে চায়ের অর্ডার করতেই একটা ছেলে আমার হাতে মাটির ভাঁড় ধরিয়ে দিলো।চায়ে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করছিলাম আমার জন্য প্রতীক্ষিত লোকটি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে,মনে হচ্ছে তার মনের গভীরে যেন একটা কুটিল ইচ্ছা ক্রমশঃ জমাট বাঁধছে–অবশ্য এটা আমার বোঝার ভুলও হতে পারে।
    প্ল্যাটফর্মের পেছনে দেখলাম তখনও একজন রিক্সাওয়ালা চাদরমুড়ি দিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে,যাইহোক তারসঙ্গে কথাবার্তা বলে আমি এবং প্ল্যাটফর্মে দেখা হওয়া লোকটি আরও আধঘন্টার মধ্যে ঐ ভ্যান রিক্সায় চড়ে স্টেশন ছাড়িয়ে বলরামপুর অভিমুখে রওনা হয়ে গেলাম। দুধারে সোনাঝুড়ির জঙ্গল–চারদিকে একটা রহস্যময়তা যেন থাবা পেতে বসে আছে,তার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে যেন আমার সঙ্গের এই লোকটির পান্ডুর ভাবলেশহীন নিরবতা—-যাইহোক এখানে বলে রাখা ভালো আমার বলরাম পুরে আগমনের কারণটা–আমি কোলকাতায় একটি অডিট আফিসে চাকরি করি বলরামপুর যাচ্ছি অডিটের কাজে ওখানে একটা ইউকো ব্যাঙ্ক আছে সেখানেই আগামী পরশু থেকে অডিটের কাজ শুরু করতে হবে।ওখানকার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার কৌশিক রায় আমার থাকার ব্যবস্থা ওখানেই করেছেন অবশ্য কালকে আমার আর একজন সহকারীও এসে পৌঁছে যাবে।কৌশিক বাবুর নির্দেশ মতোই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে নেমেছি এই জনমানব শুন্য স্টেশনে।

    রিক্সা ভ্যান একটা একটানা ক্যাঁচড়,ক্যাঁচড় শব্দ তুলে চলছে তো চলছেই অবশেষে ঘন্টাখানেক পর আমরা আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম অর্থাৎ ভ্যান ওয়ালার পুর্ব কথা মতো– নন্দীপুরের আমবাগান। এখান থেকে বড়রাস্তার ডানদিকে আমবাগানের ভেতর হয়ে আরও ঘন্টাখানেকের হাঁটা পথে আমাদের অভীষ্ট সেই গেষ্টহাউস-এ পৌঁছে যেতে পারবো।
    ভ্যান ওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে আমি এবং স্টেশনের সেই লোকটি হাঁটা লাগালাম বাগানের ভেতরে রুক্ষ মাটির রাস্তা ধরে।আমার ডানহাতে ছিলো একটা অ্যাটার্চিকেশ ও কাঁধে লম্বা হাতলওয়ালা চামড়ার ব্যাগ।
    চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ র ডাক আর নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছেনা।কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমিই নিস্তব্ধতা ভেঙে লোকটিকে প্রশ্ন করলাম,”আপনার বাড়ি কি বলরামপুরেই ,না?–“
    সে বললো,”না”।আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,”তবে?”লোকটা আর কোনো উত্তর দিলো না।
    ঐটুকুই যা কথা হলো তার সঙ্গে ।আবার একটা জমাট নিস্তব্ধতা।আমি হাঁটছিলাম লোকটার পিছু পিছু কারণ লোকটাকে কেমন যেন আমার একটু একটু সন্দেহ হয়েছে প্রথম থেকেই তাই তার পেছনে পেছনে হ়াঁটাই সমীচীন বলে মনে হয়েছিল আমার।
    এবার লোকটাই হঠাৎ আমাকে বললো ,” আপনিতো ঐ গেষ্টহাউস এ থাকবেন?নাকি?
    আমি বললাম,”হ্যাঁ ওখানেই তো থাকার ব্যবস্থা হয়েছে,কেন বলুন তো?’মনে মনে ভাবলাম,”লোকটার আবার কোনো কুমতলব টতলব নেইতো!”
    লোকটি বললো,”জায়গাটা খুব একটা ভালো নয়,আপনার মতো অনেক সাহেব ও বাড়িতে এর আগে উঠেছিলেন কিন্তু একরাতের বেশী টিকতে পারেনি।”মনে মনে ভাবলাম ,”কৌশিক বাবুর কাছেতো তেমন কিছুই শুনিনি–গেষ্টহাউসের যে এমন একটা বদনাম আছে!—-অবশ্য কৌশিকবাবু তো মাসখানেক হলো বদলি হয়ে এখানে এসেছেন তারপক্ষে এতো ঘটনা জানাও বোধহয় সম্ভব নয়।”
    যাইহোক আমি একটা সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম একটু, ততক্ষণে দেখি লোকটা বাঁদিকে ঝোপের মধ্যে নেমে যাচ্ছে, আমিতো রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম এবং চিৎকার করে বলে উঠলাম,”ও মশাই!করছেন কি?ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?ওদিকে তো কোনো রাস্তা নেই,তবে?”
    লোকটা চাপা গলায় বললো,”এখান থেকে একটু আগেই গেষ্টহাউস পেয়ে যাবেন, চিন্তা নেই,চলে যান!আমি এ পর্যন্তই -তার বেশী যাওয়ার আমার উপায় নেই।”
    তারপর যা ঘটলো তা মোটেই কোনো প্রাকৃত ঘটনা নয়,দেখলাম ঐ ঝোপের মধ্যে একটা গাছের খ্যাংড়া ডালে একটা কাপড় মৃদু বাতাসে দুলছে।ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে একটু এগিয়ে গিয়ে ঝোপের উপর ফেলতেই যা দেখলাম তাতে আমার ভেতরটা যেন একটা অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলো– দেখলাম যে কাপড়টা দুলছে ওটা ঐ লোকটার আর মাটিতে যে শার্ট ও কালো চাদরটা পড়ে আছে সেগুলোও তারই ,কিন্তু লোকটা কোথায়?কৌতূহল বশে ঝোপের এদিক ওদিক টর্চ নিয়ে দেখতেই যা দেখলাম তাতে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে যেতে লাগলো।দেখলাম একটা মরার মাথার খুলি ও তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতকগুলো হাড় ।ব্যাপারটা এতক্ষণে আমার মাথায় ঢুকলো আমি সেখানে আর একটুও অপেক্ষা না করে হনহন করে এগিয়ে গেলাম গেষ্টহাউসের দিকে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম একদম গেষ্টহাউসের গেটে।
    গেটের এপার থেকে একবার হাঁক পারলাম,”ভে-ত-রে কে-উ আ-ছেন?আ-মি অ-ডি-ট-বা–বু!”
    দেখলাম ভেতরবাড়ির দরজা খুলে বেশ হৃষ্টপুষ্ট একটা লোক –এই গেষ্টহাউসের কেয়ারটেকারই হবে বোধহয়! হ্যারিকেন হাতে এগিয়ে আসছে। গেটের কাছে এসে ডানহাতটা কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানিয়ে বললো,”আসুন সার্।”বলে গেটের তালা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল।
    বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখলাম ভেতরটা বেশ সাজানো তবে আলোর অভাব ।একটা হ্যাজাক জ্বলছে বটে, তবে এই পেল্লাই সাইজের রুমের পক্ষে যথেষ্ট নয় ।সামনেই সোফার উপর বসে চারদিকটা বেশ ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলাম।ঘরের মধ্যে আসবাব পত্রের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো।সামনে একটা ছোট টি-টেবিলের উপর আমার ব্যাগ ও অ্যাটার্চিকেশটা নামিয়ে রাখলাম।একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম,পুরো গেষ্টহাউসটা ভালো করে একনজর দেখে নিলাম।গ্রাউন্ড ফ্লোরে এই মাঝের বড় রুমটা ছাড়াও রয়েছে আরও পাঁচ পাঁচটা রুম, সবগুলোই তালাবন্ধ, লম্বা একটানা বারান্দা,বারান্দার দেওয়াল প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু তার উপর দুফুট আন্দাজ ব্যবধানে লোহার গ্রিল বসানো।একদম মাঝখানে প্রধান দরজা,তারসামনে গাড়ি বারান্দা। কিছুক্ষণ পর আবার ভেতরে এসে সোফাটায় বসলাম এবং লক্ষ্য করলাম এই বড় রুমটার একপাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গ্রিলের দরজা।সবকিছুই ঠিকঠাক, একটা জিনিস চোখে পড়তেই একটু আশ্চর্য হলাম,দেখলাম সমগ্র বাড়িটায় ইলেক্ট্রিফিকেশনের সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তার ফল থেকে বাড়িটা যেন বঞ্চিত–গেটের বাইড়েও দেখলাম বৈদ্যুতিক তারের পোল তবে এ বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে না।মনে মনে একটা সদুত্তর পাবার চেষ্টা করছি এমন সময় দেখি এই গেষ্টহাউসের কেয়ারটেকার এসে হাজির।তাকে দেখেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম,”আচ্ছা এখানে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানো হয়না?সবই তো ব্যবস্থা রয়েছে দেখছি, তাহলে?”
    কেয়ারটেকার বললো,”এখানে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংযোগ নেই বাবু, তার চুরি গেছে বহু এলাকায় তাই।”
    বললাম ,”এরজন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ?”
    সে বললো,”বহুবার সংযোগ ঠিক করা সত্ত্বেও কোনো সুরাহা হয়নি বাবু,তার-চোরেরা বার বার তার চুরি করে নিয়ে চলে যায়।”
    কথায় কথায় জানতে পারলাম লোকটির নাম দ্বিজেন দাস, পাশের গ্রাম বিষ্ণুপুরে তার বাড়ি, আজ দশ পনেরো বছর সে এখানে কেয়ারটেকার গিরি করছে।বললাম,”দ্বিজেন একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারবে?”
    সে তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানিয়ে বাইরে চলে গেলো।আমি ততক্ষণে আমার অ্যাটার্চিকেশ থেকে ট্র্যাকস্যুট ,সাবান,হ্যান্ডওয়াশ ও টাওয়েল বার করে সামনের টি-টেবিলের উপর রাখলাম ।এটা অবশ্য আমার থাকবার রুম নয়,এটা সভাকক্ষ অর্থাৎ অনেকটা বৈঠক খানার মতো,বাইরে থেকে সরকারী আমলারা এলে এখানেই তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। ঘরটা বেশ বড় ।মাঝখানে বড়মাপের একটা গোলাকার দামীকাঠের টেবিল তার চারপাশে খান পঁচিশ গদিআঁটা চেয়ার সুন্দর ভাবে সাজানো,তাছাড়াও রয়েছে দেওয়াল ঘেঁষে একটা বড় সোফা ও ছোট ছোটো দুটো টি-টেবিল।

    একটু পরেই দেখলাম দ্বিজেন চায়ের ট্রেতে চা ও কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে এসে হাজির হলো।
    চা টা খেয়ে টেবিলের উপর জিনিসপত্র তুলে নিয়ে আমি দোতলায় স়িঁড়ি বেয়ে উঠে দেখলাম ডানদিকের একেবারে শেষ রুমটার আগের রুমটা আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে।দোতালার ঝোলাবারান্দায় দামীকাচের বড় বড় চার পাঁচটা জানালা।এককথায় গেষ্টহাউসের পুরো বিল্ডিংটা খুব সফিস্টিকেটেড্ ।আমার জন্য বরাদ্দ রুমটায় ঢুকে চারদিক বেশ ভালো করে দেখে নিলাম এবং জিনিস গুলি যথাস্থানে গুছিয়ে রাখলাম। দশ বাই দশ রুম ।রুমের পেছনে দুটো মাঝারি সাইজের জানালা তাতেও দামীকাচ লাগানো পাল্লা এবং ঝোলাবারান্দার দিকটায় একটা দামী কাঠের কারুকার্য করা দরজা, এই দরজা হয়েই সিঁড়ি বেয়ে একটু আগে ঢুকেছি আমার রুমে।দোতালায় ওঠার সিঁড়ির দরজা ঝোলাবারান্দার ঠিক মাঝের অংশে উন্মুক্ত। ঝোলাবারান্দার এই অংশটি বাইরের দিকে আরও একটু প্রশস্ত হয়ে একেবারে ঠিক গাড়িবারান্দার মাথায় চূড়ার মতো শোভা পাচ্ছে।আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম দোতলায় ঝোলাবারান্দার দুইপ্রান্তে অত্যাধুনিক কারিগরীবিদ্যার দৌলতে তৈরীকৃত দুটি টয়লেট।
    আমার জন্য বরাদ্দ রুমটির একধারে একটা লোহার খাট,পূর্ব থেকে পশ্চিমে সাজানো ,একটা আলমারী ও খান কতক ফাইবারের চেয়ার এবং ঘরের এককোনে একটা ছোটো টেবিল।এবং ঘরের দরজার ডান দিকের কোণে একটা কারুকার্য ক‍রা পাথরের কুঁজো।
    সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো যে জিনিসটা তা হলো ঘরটার নিট্ অ্যান্ড ক্লিন এমবিয়েন্স মানে একেবারে ঝকঝকে চেহারা।যে কোনো লোকের কাছেই ব্যাপারটা চোখে ধরার মতো।হঠাৎ দ্বিজেন ঘরে ঢুকে জানালো সে নন্দীপুরের বাসস্ট্যান্ড থেকে আমার রাতের খাবার নিয়ে এসেছে সাতটার সময়।
    আমি দ্বিজেনকে কাছে ডেকে স্টেশন থেকে আসার সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে জানাতেই দ্বিজেনের চোখে মুখে দেখলাম একটা ভয়ের আস্তরণ।
    একটু আসস্ত হয়ে দ্বিজেন বলতে লাগলো,”তবে শুনুন ঘটনাটা খুলেই বলি আপনাকে।আজ থেকে প্রায় ষোলো সতেরো বছর আগে এখানে এক ভদ্রলোক শহর থেকে জরিপের কাজে এসেছিলেন এই বলরামপুর অঞ্চলে এবং তিনি এই গেষ্টহাউসেই আস্তানা গেড়েছিলেন প্রায় দিন দশেকের জন্যে তার সঙ্গে আরও দুজন তার সহকর্মীও ছিলো। তারাও তার সঙ্গে এই গেষ্টহাউসেই থাকতো ।সারাদিন ধরে এ অঞ্চলের এখানে ওখানে জরিপের কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসতেন এখানে।এইভাবেই বেশ কয়েকটাদিন পার হলে তার সঙ্গের সহকর্মী দুজন কি একটা জরুরী কাজে কোলকাতা ফিরে গিয়েছিল।এবং দিন দুয়েকের মধ্যে তারা আবার যখন এখানে ফিরে আসে দেখে সেই ভদ্রলোক উধাও—তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কোনো হদিশ পায়নি।”
    আমি মাঝে দ্বিজেনকে থামিয়ে বললাম ,”পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি?”
    “পুলিশ কে খবর দেওয়া হয়েছিল এবং তারা সেই ঘটনার প্রায় দিনকুড়ি পড়ে ঐ ভদ্রলোকের ধূতি ,চাদর ও শার্ট অক্ষত অবস্থায় আবিস্কার করে নন্দী পুরের আমবাগানের একটি ঝোপের ধার থেকে এবং তার কিছুটা দূরেই পাওয়া গিয়েছিল তার পচাগলা লাশ ,পুলিশি তদন্তে জানা যায় তার মৃত্যু হয়েছে কোনো বন্যজন্তুর আক্রমনে।সেই থেকে রাতের বেলা আপনার মতো সাহেব সুবো লোক এই গেষ্টহাউসে যারাই এসেছে তারা ঐ একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে।”
    ঘটনাটা শুনে ভয় যে পেলাম না তা ঠিক নয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো।
    ভদ্রলোকের মৃত্যু যে বন্যজন্তুর আক্রমনে ঘটেনি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কারণ বন্য জন্তু আক্রমন করলে তার জামা ,কাপড় ও চাদর অক্ষত অবস্থায় থাকতো না ।পুলিশ মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশী ঘাঁটাতে চাইনি।আর তাছাড়া আজ থেকে ষোলো সতেরো বছর আগে পুলিশি তদন্তের ধরণ-ধারণও আজকের মতো এতটা কমপ্যাক্ট ছিলো না। তবে?তবে কি–!!
    যাহোক দ্বিজেন বললো ,”বাবু খাওয়া দাওয়া সেরে ভালো ভাবে দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন ,অনেকটা রাস্তা জার্ণি করে এসেছেন। আমি কাল সকাল ছটাতেই এসে হাজির হবো কোনো ভয় নেই।” আমি দ্বিজেনকে জিজ্ঞাসা করলাম ,”আচ্ছা দ্বিজেন এখান থেকে মাইল টেকের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই?”দ্বিজেন বললো এই গেষ্টহাউসের পূর্বদিকে একটা কুমোরপাড়া রয়েছে, ব্যাপারটা জেনে একটু আস্বস্ত হয়ে আবার বললাম,”তুমি এতো রাত্রে বিষ্ণুপুর যাবে?তোমার ভয় করবে না ?’
    দ্বিজেন জানালো যে সে আজ আর বিষ্ণুপুর যাবে না বলরামপুরেই থাকবে তবে এখানে নয় দাস পাড়ায় সেখানে তার শ্বশুর বাড়ি।তার স্ত্রী নাকি আসন্ন প্রসবা কখন যে পেন উঠবে বলা যায়! তাই তাকে সেখানে থাকতেই হবে।আমি দ্বিজেনকে বাইরের গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে যেতে বললাম।যাইহোক দ্বিজেন আমার কথামতো যথারীতি গেটে তালা লাগিয়ে তার সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে রওনা হয়ে গেলো তার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে।আমি ও গেষ্টহাউসের অভ্যন্তর ভাগের প্রধান দরজায় তালা লাগিয়ে আমার রুমে ফিরে এলাম এবং রুমের দরজা ভালো ভাবে বন্ধ করলাম।বলরামপুর গ্রামটা বেশ বড় গ্রাম এখান থেকে বর্দ্ধমান নাকি বেশ কাছেই কৌশিকবাবু ফোনে সেই রকমই জানিয়েছিলেন।
    রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারটা ,আমি যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম নিশীথিনীর সেই রহস্যময় রূপ।
    চারদিকে একটা জমাট নিস্তব্ধতা যেন নিশ্বাস ফেলছে। সমগ্র প্রকৃতি যেন হয়ে উঠেছে রূপকথার সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের কোনো অজানা অচেনা দেশ।সিগারেট খাওয়া শেষ করে বোতল থেকে একটু জল খেয়ে নিলাম।ঘুমানোর আগে আমার একটু গল্পবই পড়া অভ্যাস ,তাই একখানা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপরে রেখে বইটা পড়তে লাগলাম।কিছুক্ষণ পড়ার পর ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগলো দুচোখ তাই আর জেগে থাকতে পারলাম না শুয়ে পড়লাম খাটে লেপমুড়ি দিয়ে।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই হঠাৎ একটাশব্দে ঘুমটা ভেঙে যেতেই শুনতে পেলাম একটা চাপা গর্জনের মতো কিছু শব্দ।ধরমরিয়ে উঠে বসলাম বিছানার উপরে ভালোভাবে শুনতে লাগলাম এবং অনুধাবন করতে লাগলাম শব্দটার প্রকৃতি।শব্দের মাত্রা যেন ক্রমশঃ বাড়ছে।শব্দটা আর যাইহোক কোনো মানুষের বা বন্যজন্তুর হতে পারেনা।এ শব্দ যে করছে সে মানুষ বা জন্তুর মতো নয়,কারণ শব্দের মধ্যে একটা অতিপ্রাকৃতিক প্রভাব রয়েছে মনে হলো একসঙ্গে অনেক গুলো সিংহ ও হায়েনা চিৎকার করলে যেমন শব্দ হবে শব্দটা ঠিক তেমনই।এই অঞ্চলে সিংহ বা হায়েনার বাস যে থাকতে পারেনা তা দেখলেই বোঝা যায়।তাহলে এটা কোন জন্তুর গর্জন–আরো ভালো করে শুনতে লাগলাম এবং একসময় যা শুনলাম তাতে আমি শুধু অবাকই হলাম না ,ভয় ও পেয়ে গেলাম কিছুটা।আমি পরিস্কার শুনতে পেলাম ঐ গর্জনের মধ্যে জেগে উঠছে একটি নারীকন্ঠস্বর।কি ভয়ংকর সেই কন্ঠস্বর! সে যেন বলছে ,”বি-বি-বি-ব-ব-ব-স-স-স-ন-ন-ন হ-হ-হ আ-মি-শো-ষ-ণ-কা-রি-ণী-পি-শা-চি-নী।”
    যার মর্মার্থ হলো–“বিবসন হ আমি শোষণকারিণী পিশাচিনী।”এবার ঐ জরিপের কাজে এখানে আশ্রয় নেওয়া ভদ্রলোকের মৃত্যুর কারণ আমর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।
    আরো ঘন্টা খানেক কেটে যেতেই আর কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না,চারদিকে নরকের নিস্তব্ধতা।চাঁদ ডূবে গেছে প্রথম প্রহরেই; তাই চারদিকে প্রকৃতি যেন জমাট অন্ধকারে ডুবে আছে।জানালাটা একটু ফাঁক করতেই বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড়ে মধ্যে লক্ষ্য করলাম একটা মস্ মস্ আওয়াজ কেউ যেন হেঁটে চলেছে ভারী ভারী পা ফেলে–কতকগুলো কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠেই আবার চুপ করে গেলো।ব্যাপারটা কি আরো ভালোভাবে জানতেই টর্চটা হাতে নিয়ে আমার রুমের দরজাটা খুলে বাইরে এলাম এবং অবশেষে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে এসে দাঁড়ালাম একেবারে বারান্দার প্রধান দরজার সামনে।এবং সেখানে কান পেতে রইলাম।হঠাৎ গেট খোলার শব্দে সত্যিই আমি ভয় পেয়ে গেলাম।তারপর শুনলাম গেষ্টহাউসের খোলা লনে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে।প্রথমটায় দরজা খোলার আমার সাহস হলনা।বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম এখন আমার কর্তব্য কি?মানুষের মন বলে ষষ্ঠ জ্ঞানেন্দ্রিয়টি বড় অদ্ভুত যখন সে অবশ্যম্ভাবী কোনোকিছুর টের পায় তখন মরিয়া হয়ে ওঠে–আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলোনা।টর্চ হাতে দরজাটা খুলেই সোজা গেটের বাইরে চলে এলাম,আবার যখন টর্চ জ্বালানোর চেষ্টা করছি– দেখলাম টর্চটা আর জ্বলছে না।টর্চটা জ্যাকেটের পকেটে ভরে ক্ষীণ নক্ষত্রালোকে যা দেখলাম তা অত্যন্ত ভয়ংকর,দেখলাম একটা উলঙ্গ নারীমূর্তি একটা কুকুরের শরীর দাঁতে চেপে ধরে আছে তখনও কুকুরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে।আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না মনে মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতেই মনের ভেতর জেগে উঠলো একটা অসীম সাহস আর সেই সাহসের বলেই আমি বাঘের মতো চিৎকার করে উঠলাম,”কে তুই?”
    উলঙ্গ ঐ নারীমূর্তি ভয়ংকর এক নাকিসুরে বলে উঠলো,”হুঁ—আঁ—আঁ আ-মি-শোষণকারি পিশাচিনী ,আমাকে সৃষ্টি করেছে এক তান্ত্রিক ,পালা এখান থেকে।”
    আমার গলায় ছিলো মক্ষম মৃত্যুঞ্জয় কবচ ,আমি জানি এ কবচ যতক্ষণ আমার গলায় থাকবে ভুত-প্রেত-দানা-দৈত্য-পিশাচ আমার কুশপ্রমাণ বিঘ্নও ঘটাতে পারবে না।
    দেখলাম কি ভয়ংকর সেই পিশাচিনীর মূর্তি
    চুলগুলো সাপের মতো,সুতীক্ষ্ম স্তনবৃন্ত ,হাতের নখ গুলো যেন এক একটা ধারালো ছুরি আর মুখটা শিয়ালের মুখের মতো তাতে লকলক করছে একহাত প্রমাণ একটা জিভ আর দাঁত গুলো বেরিয়ে আছে তীরের ফলার মতো।চোখগুলো যেন আগুনের ভাঁটা।চারদিকে একটা পচা মাংসের গন্ধে বিষিয়ে উঠেছে সেখানকার বাতাস।আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম ,”কে সেই তান্ত্রিক যে তোকে সৃষ্টি করেছে?কি নাম তার?”
    পিশাচিনী হুংকার ছেড়ে বললো,”ধনানন্দ তান্ত্রিক।কিন্তু সে আর বেঁচে নেই ,হা-হা–হা–আমিই তার রক্ত শুষে মেরে ফেলেছি হা-হা–হা”
    কি ভয়ংকর সেই অট্টহাসি শুনলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে ওঠে।
    আমি আবার বললাম ,”কেন তুই এভাবে এই অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিস আর নিরীহ জীব হত্যা করে নিজের রক্তপিপাসা মেটাচ্ছিস।তুই কি কোনো দিনই মুক্তি পাবিনা?”
    এবার সে আমার উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হতেই আমি গলার মৃত্যুঞ্জয় কবচ খানা ছিঁড়ে হাতের মুঠোতে পুরে সামনে ধরতেই পিশাচিনী ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো।আমি যত এগোতে থাকি পিশাচিনী ততই পিছতে থাকে এভাবে কতটা পথ যে অতিক্রম করেছি মনে নেই একসময় দেখলাম একটা সূড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে আছে ঐ পিশাচিনী আর আমি তার সামনে। আমি আরও এগিয়ে গেলাম তার দিকে সেও ঐ মৃত্যুঞ্জয় কবচকে ভয় পেয়ে ঢুকে পড়লো সূড়ঙ্গের ভেতরে ,সঙ্গে সঙ্গে যেন দৈববাণীর মতো কিছূ একটা শুনলাম এবং বুঝতে পারলাম সুরঙ্গের মুখে পাশের ঐ বড় পাথরখানা চাপা দিয়ে তার সামনে একটা ত্রিশূল মাটিতে পুঁতে দিলে ঐ পিশাচিনী আর কোনোদিনই বেরিয়ে আসতে পারবে না। দেখলাম সত্যি সত্যিই একখানা বড় পাথর রয়েছে সুড়ঙ্গের ঠিক ডানদিকে এবং পাথরের নীচেই পড়ে রয়েছে একখানা মরচে ধরা ত্রিশূল।আমি দৈববাণীর নির্দেশমতো পাথরটা অত্যন্ত কষ্ট করে সুড়ঙ্গের মুখে চাপা দিয়ে তার ঠিক সামনে ত্রিশূলটা মাটিতে পুঁতে ফেললাম।

    হঠাৎ একটা ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ আমার কানে আসতে লাগলো। আমি সামনের একটা কি যেন গাছের দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম সত্যিই এক তান্ত্রিকের আবক্ষ মূর্তি যেন জ্বলজ্বল করছে।হঠাৎ ঐ তান্ত্রিকের জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেলুম –“আ–জ–থে–কে–স–ব–শা–ন্–তি,আ–র–ঐ–পি–শা–চি–নী–কা–র—ও–কো–নো–ক্ষ–তি–ক–র–তে–পা–র–বে–না–না–না।”কথাগুলো ঐ উন্মুক্ত বনপ্রান্তরে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে হতে অবশেষে মিলিয়ে গেলো দূরদিগন্তে।তারপর আবার সেই জমাট অন্ধকার আর অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা।কতক্ষণ যে সেখানে স্থানুর মতো দাঁড়িয়েছিলাম বলতে পারবো না,হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম একটা পাখির একটানা কর্কশ আওয়াজে।চারদিক ভালোকরে আর একবার চেয়ে দেখলাম–আঃ কি প্রশান্তি! বুকভরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম বারবার।দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো,আমি ক্লান্ত পায়ে ফিরে এলাম গেষ্টহাউসে।এসে দেখি গেট যথারীতি তালাবন্ধ, এবার বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হল না যে–কাল রাত্রে আমি কোনো এক অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে সম্মোহিত অবস্থায় গেট পেরিয়েছি বিনা বাধায়। অতএব বাধ্য হয়ে গেট পেরলাম ডিঙিয়ে এবং গেষ্টহাউসের ভেতরে প্রবেশ করলাম। এবং বুঝতে পারলাম কাল রাত্রে প্রায় মাইল চারেক পথ হেঁটে পিশাচিনী কে চিরবন্দিনী করে এসেছি।
    চারদিক একদম ফরসা হয়ে গেলো সকাল ছটার সময় দ্বিজেন যথারীতি এসে পৌছালো এবং বললো ,”রাত্রে ভয়টয় করেনিতো বাবু?ঘুম হয়েছিলো তো ঠিক?”
    আমি গতরাত্রির সমস্ত ঘটনা চিরদিনের জন্য হৃদয়বন্দী করে রেখে বললাম,”খুব ভালো ঘুম হয়েছিলো।”
    ———সমাপ্ত————
    বি.দ্র.:-গল্পে বর্ণিত স্থানাদি সম্পূর্ণ রূপে কাল্পনিক, একটা আপাত বাস্তবতা সৃষ্টির চেষ্টা মাত্র।

  • ভৌতিক গল্প

    মল্লিক বাড়ির গুপ্তধন

    মল্লিক বাড়ির গুপ্তধন
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)
    কলকাতা শহরের বেশ কিছু রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করে পুলিশ মহলে বেশ নাম করে ফেলেছে গোয়েন্দা গৈরিক সেন, এবং তার একমাত্র সহকারী তথা খুড়তুতো বোন, ঐন্দ্রিলা সেন ওরফে টুসু। সেদিন এক পরিচিত আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলো গৈরিক আর টুসু। ফিরতি পথে, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটে এসে হঠাৎ নিজের বাইক থামলো গৈরিক। পেছনে বসে থাকা টুসু জিজ্ঞাসা করলো,
    – কি গো গেরোদা, থামালে কেন? কি হল?
    গৈরিক নিজের হেলমেটটা মাথা থেকে খুলতে খুলতে বলে উঠলো,
    – আমার পাশের ওই ব্যাংকটাতে একটু কাজ আছে। তুই এখানে একটু অপেক্ষা কর, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি…
    গৈরিক চলে গেলে, টুসু সময় কাটানোর জন্য নিজের মোবাইল ফোনটা বার করে ডেটা অন করার সাথে সাথেই তার বন্ধুদের হাজারো হোয়াটসআপ মেসেজ এসে ভিড় করল তার ফোনে। সে মেসেজগুলো এক এক করে পড়ে দরকার মত প্রত্যুত্তর দিতে লাগলো।

    বেশ কিছুক্ষণ পর গৈরিক বেরিয়ে এলো সেই ব্যাংকের গেট থেকে, তবে তার সাথে ওই ছেলেটা আর মেয়েটা কে? টুসু একটু ভালো করে ওদেরকে দেখেই চিনতে পারলো! গৈরিকের আগের একটি কেস চলাকালীন টুসুর পরিচিতি হয়েছিলো এই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির সাথে। ছেলেটির নাম শৈবাল এবং মেয়েটির নাম লিলি।

    গৈরিক বলে উঠলো,
    – বুঝলি টুসু, শৈবালেরও এই ব্যাংকেই একাউন্ট আছে আমার মত, তাই আজ ওদের সাথে ব্যাংকে দেখা হয়ে গেল।
    কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শৈবাল হঠাৎ মৃদু হেসে বলে উঠলো,
    – তবে গৈরিকদা, আপনারা যে এখানে শুধু ব্যাংকের কাজেই এসেছেন আর গোয়েন্দাগিরির জন্য নয়, এই কথাটা কিন্তু খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না…
    টুসু এই কথা শুনে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
    – ঠিক বুঝলাম না তো কথাটার মানে! এখানে আবার গোয়েন্দাগিরি করার আছেটাই বা কি?
    লিলি অবাক হয়ে বললো,
    – সে কি! নিশ্চয় কিছুদিন ধরে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখনি, ঐন্দ্রিলা..তাই বোধহয় জানো না, যে এই তো, কাছেই একটা বেশ পুরোনো বনেদী বাড়ি আছে, মল্লিক বাড়ি…সেখানে নাকি বেশ কিছুদিন ধরে কোন এক ভূতের আনাগোনা শুরু হয়েছে!
    টুসু কপালে চোখ তুলে বললো,
    – সে কি!

    এবার শৈবাল বলে উঠলো,
    – শুধু কি ভূত! সকলে বলছে যে ওই বাড়িতে নাকি গুপ্তধনও লুকনো আছে!
    টুসু বিস্ময়ে আর কথা বলতে পারলো না।
    লিলি আবার বলে উঠল,
    – কে জানে ওখানে কি আছে বাবা! আমার তো এই সব পুরোনো দিনের বাড়িগুলো দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে!
    ওরা আর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই চলে গেল। টুসুর খুব ইচ্ছা করছিলো, যে একবার সেই মল্লিক বাড়ি গিয়ে এই ভূত আর গুপ্তধনের ব্যাপারে আরো বেশি করে খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু বিধি বাম, সেই বাড়ির থেকে কেউ তো আর তাদের ডেকে পাঠায়নি, তাহলে তারা সেখানে যাবেই বা কি করে! অগত্যা, টুসু আবার গৈরিকের বাইকের পেছনে চেপে বসল, নিজের বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। গৈরিক বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল টুসুর মনোবাসনা, এবং সেটা জেনে, সে হেলমেটের ভেতরে মুচকি মুচকি হাসছিল।

    (২)
    তবে ঈশ্বর যেন টুসুর মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন। কারণ সেদিন বিকালেই, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গৈরিকের জরুরি তলব এলো টুসুর কাছে। টুসু তখন সবে দুপুরের ভাত ঘুম দিয়ে উঠেছিলো, ঠিক তখনই গৈরিক ওকে ফোন করে বললো, “তাড়াতাড়ি একবার আমার অফিসে চলে আয়, বাকি কথা এখানেই হবে…” এই বলে সে ফোনটা দিল কেটে।

    উফ, কোন মানে হয়? ভাবল টুসু, গেরোদাটা সত্যিই মানুষকে এত সাসপেন্স-এ রেখে যে কি সুখ পায়, তা কে জানে! অগত্যা হুটোপাটি করে কোন ভাবে টুসু তখনই পৌঁছে গিয়েছিল রাসবিহারী মোড়ে অবস্থিত তার গেরোদার “সেন’স আই” নামক গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে। গৈরিক তাকে দেখেই বলে উঠলো,
    – আসুন ম্যাডাম, আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম…
    টুসু রাগী গলায় বলে উঠল,
    – ন্যাকামি না করে, বলো তো কিসের জন্য ডেকে পাঠালে আমায়…

    গৈরিক বেশ প্রফুল্লতার সাথে বলে উঠলো,
    – এখনই তোর মনের ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে রে, টুসু! আমাদের একবার মল্লিক বাড়িতে যেতে হবে!
    আনন্দে উত্তেজনায় টুসুর মুখটা লাল হয়ে উঠলো। সে অধৈর্য গলায় উৎসাহের সুরে বলে উঠলো,
    – কেন, সেখান থেকে কেউ বুঝি ডেকে পাঠিয়েছে আমাদের? ওই ভূত আর গুপ্তধনের রহস্যভেদ করার জন্য?
    গৈরিকের মুখটা কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে গেল সেই কথা শুনে, তারপর সে বললো,
    – শুধু ভূত বা গুপ্তধনই নয় রে, টুসু…একটা মৃত্যুর রহস্যও আমাদের ভেদ করতে হবে!
    টুসু এই কথা শুনে চরম উত্তেজনায় যেন আর কথা বলতে পারলো না।

    তাই, গৈরিকই বলে চললো,
    – হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস তুই, ওদের বাড়ি থেকে শ্যামাপ্রসাদ মল্লিক নামক এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আগেই ফোন করেছিলেন আমাকে। তিনি আমাদের তাড়াতাড়ি ওই বাড়িতে একবার যেতে বললেন। ওখানে নাকি সুজয় বলে একটি ছেলের মৃত্যু হয়েছে আজই সকালে, সেটা যে খুন কি না, তা তারাও ঠিক জানেন না! তবে ওখানে গেলে, বেশ কিছু কথা তিনি আমাদের বলতে চান, যা কিনা ফোনে বলা সম্ভব নয়!
    টুসুর যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছিল না গৈরিকের কথাগুলো, সে তখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল তার গেরোদার দিকে চেয়ে। এবার গৈরিক বেশ অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
    – নে নে, আর দাঁড়িয়ে থাকিস না…তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আমাদের…এখান থেকে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট কিন্তু বেশ কিছুক্ষণের পথ!

    (৩)
    আজ বিকালে কলকাতার রাস্তা-ঘাটে যেন একটু বেশিই যানজট। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে এসে, ট্রাফিক পুলিশের গ্রীন সিগন্যালের আশায় গেরোদার দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের পেছনে বসে থাকতে টুসুর যে কি বিরক্তি বোধ হচ্ছিল, তা কি বলবো। সত্যিই, তার গেরোদার বলা “বেশ কিছুক্ষণ লাগবে” কথাটা যে আদপে প্রায় দুই ঘন্টায় পরিণত হবে, এই কথা যেন টুসু আগে কখনো ভেবেই দেখেনি। বিকাল পাঁচটায় গৈরিকের রাসবিহারীর অফিস থেকে বেরিয়ে যখন ওরা সন্ধ্যা সাতটার সময় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের সেই মল্লিক বাড়ির কাছে পৌঁছলো, তখন টুসু গোয়েন্দাগিরি শুরু করার পক্ষে যথেষ্টই ক্লান্ত।

    তবে সেই মল্লিক বাড়ির প্রথম দর্শনেই যেন টুসুর সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এমন চেহারার জমিদার বাড়ি টুসু গৈরিকের আগের কেসগুলিতে অনেক দেখেছে। কলকাতার মত এত জন-প্রাচুর্যে ভরা শহরেও, এই পাঁচ মহলা দোতলা পুরনো আমলের তৈরি বাড়িটি যেন অন্য আশে-পাশের সকল বাড়ি ঘর থেকে একটু বেশিই দূরত্বে অবস্থিত। বিশাল বড় সিংহ-দ্বার আর বড় বড় থামওয়ালা এই বাড়িটার চারিদিকে বেশ বড় আমবাগান। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি মার্বেলের তৈরি জলের ফোয়ারা, কিন্তু এখন আর সেটা সচল অবস্থায় নেই। ভেতরের উঠোনের এক ধারে দুর্গা-দালান, তার চারিপাশে একটানা দোতলা বাড়িটার সারি সারি ঘর। এখনো অবধি পুরোনো কলকাতার সেই ল্যাম্প পোস্টগুলোও আছে তার চারি পাশে। তবে বাড়িটা অবশ্য যে দেখাশোনা বা মেরামতির অন্তরালে আছে, তা কিন্তু নয়। এমন বাড়ি দেখলেই কেমন যেন একটা “রহস্য রহস্য” ভাব জাগে মনে।

    বাড়িতে ঢোকার পর বাড়ির চাকর ওদের এনে বসালো নিচের বৈঠকখানায় একটি ঘরে। পরমুহূর্তেই সেই ঘরে প্রবেশ করলেন লম্বা, সুপুরুষ এবং আভিজাত্যে পরিপূর্ণ চেহারার অধিকারী এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক, পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। সেই ভদ্রলোক গৈরিক আর টুসুকে নমস্কার জানিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
    – নমস্কার মিস্টার সেন, নমস্কার ঐন্দ্রিলা! আমি হলাম শ্যামাপ্রসাদ মল্লিক, আপনাদের রহস্য-ভেদের অনেক গল্পই আমি পড়েছি খবরের কাগজের পাতায়, সেই জন্যই আজ আমি আপনাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি!
    ওরাও প্রতিনমস্কার জানিয়ে বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দিকে। না জানি, কোন রহস্যের সূত্রপাত ঘটাতে চলেছেন তিনি!
    ঠিক সেই সময় সকলের জন্য কফি, চানাচুর এবং বিস্কুটের ট্রে হাতে হাজির হল বাড়ির চাকর।

    ওদের সবার কফির ধূমায়িত মাগ হাতে নেওয়া হয় গেলে, শ্যামাপ্রসাদ বাবু বলতে শুরু করলেন,
    – বুঝতেই পারছেন মিস্টার সেন, আমাদের এই পরিবার এই অঞ্চলের মধ্যে বেশ পুরনো। এখানেই আমাদের সাত পুরুষের বাস।
    টুসু অবাক হয়ে বলে উঠলো,
    – আপনারা নিশ্চয় এখানকার জমিদার ছিলেন, তাই না?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু একটি ম্লান হেসে বললেন,
    – হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো, ঐন্দ্রিলা…আমাদের এক পূর্বপুরুষের ছিল বিশাল বড় আমদানি রপ্তানির ব্যবসা, যার মুনাফা থেকেই তিনি এই অঞ্চলের জমিদারি কিনেছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে…যাই হোক, সে সব অনেক প্রাচীন কথা, এখন শুধু এই বাড়িটাই যা পড়ে আছে, জমিদারির আর কিছুই নেই। এখন আপাততঃ এই এতবড় বাড়িতে থাকি শুধু আমি আর আমার দাদা নিত্যপ্রসাদ মল্লিকের পরিবার পরিজনেরা। বাকি সকলেই যে যার মত কেটে পড়েছে অন্যত্র। তবে, দাদা এই মুহূর্তে খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, তাই আমার সাথে তিনি এখন এখানে থাকতে পারছেন না।

    গৈরিক বলে উঠলো,
    – হুম, বুঝলাম, তবে শুনেছি নাকি এই বাড়িটা ঘিরে কোন ভূত আর গুপ্তধনের গল্প আছে স্থানীয় মানুষদের মনে…
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
    – বলবো, আপনাদের সেই সব কথা বলার জন্যই তো একটু কষ্ট দিয়ে ডেকে পাঠালাম। কারণ ফোনে এতকিছু বলা যেত না…
    কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, যেন ভেবে নিলেন কোথা থেকে বলা শুরু করবেন, তারপর আবার মুখ খুললেন,
    – আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের ঘটনা। সেই সময়, আন্দাজ ১৯১৬ সালে, আমাদের এক পূর্বপুরুষ, রমণীমোহন মল্লিক ছিলেন এখানকার ডাকসাইটে জমিদার। যেমন ছিল তার রূপ, তেমনই ছিল তার অর্থবল। শুনেছিলাম যে, রাজস্থানের কিষানগড়ের সেই সময়কার রাজা, মহারাজ ভানুপ্রতাপ সিংহ ছিলেন এই রমণীমোহনের বিশিষ্ঠ বন্ধু। যে সময় ভানুপ্রতাপ সিংহ কিষানগড়ের সিংহাসনে বসেন, সেই সময় তার রাজ্য খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল একটি খড়ার প্রভাবে। তখন রমণীমোহন তাকে অনেক আর্থিক সাহায্য করেন, তার কিষানগড়কে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। এরপর, একবার নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভানুপ্রতাপ সিংহ কিষানগড়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাঠান রমণীমোহন মল্লিককে, আর রমণীমোহনও খুব খুশি মনে রওনা হন রাজস্থানের উদ্দেশ্যে, তার বন্ধুর এই বিশেষ দিনে তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য।

    এইটুকু বলে কিছুক্ষণ থেমে একবার দম নিয়ে, আবার বলতে শুরু করলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু,
    – ভানুপ্রতাপ সিংহের জন্মদিনের খুশিতে তার রাজ দরবারে নাচ দেখানোর জন্য ডাকা হয় সেই সময়কার কিষানগড়ের সবচেয়ে সুন্দরী বাইজি, রূপমতীকে। এই রূপমতী ছিল ভানুপ্রতাপ সিংহের বাঁধা মেয়ে মানুষ, কিন্তু তারই প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন রমণীমোহন, আর রূপমতীও যেন একটু বেশিই সহৃদয় ছিল এই সুদর্শন বাঙালি জমিদারের প্রতি! তারপর এক দিন রাত্রে, রূপমতীকে নিয়ে এই কলকাতায় পালিয়ে এলেন রমণীমোহন…লোকের মুখে শোনা কথা, রূপমতী নাকি তার সাথে কোন এক মহা মূল্যবান বস্তু নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে! এবং সেটিকে সে রেখে দিয়েছিল এই বাড়ির নিচের তলার একেবারে উত্তর কোণে অবস্থিত তার ঘরে, তবে সেটা যে কি, তা আমরা এখনো কেউ জানি না। সেদিন থেকেই রটে গেল যে এই বাড়িতে নাকি গুপ্তধন আছে!…কিন্তু, এর কিছুদিনের মধ্যেই রূপমতী বোঝে, যে তার জন্য রমণীমোহনের মনে কোন ভালোবাসা নেই, আছে শুধু তাকে ভোগ করার বাসনা! সে কোনদিনই রূপমতীকে তার স্ত্রীর মর্যাদা দেবে না, তাকে দেওয়া রমণীমোহনের সকল কথাই ছিল মিথ্যা! তাই, একদিন ক্ষোভে দুঃখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে রূপমতী!…এর কিছুদিনের মধ্যেই ডাইরিয়া আর রক্তবমি হয়ে হঠাৎ মৃত্যু হয় রমণীমোহনের। আর এর পর থেকে, এই বাড়ির সম্বন্ধে, গুপ্তধনের কথার সাথে সাথেই রটে যায় রূপমতীর প্রেতাত্মার গল্প! অনেক পুজো আর্চা করে রূপমতীর ঘরের দরজা সারাজীবনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

    গৈরিক হঠাৎ বলে উঠলো,
    – রূপমতীর ঘরে রাখা সেই গুপ্তধন খোঁজার চেষ্টা কি কেউ করেছিল আগে?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু বললেন,
    – না, সেরকম চেষ্টা কেউই করে নি, কারণ সত্যি কথা বলতে ওই ঘরে ভূতের ভয়ে এই বাড়ির কেউ কখনো যেতেই চায়নি… আর তাছাড়া, এই গুপ্তধনের সুত্র হিসাবে রমনীমোহনের মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটা ধাঁধা আছে… তিনি বলে গিয়েছিলেন, যে এই পরিবারের যে সদস্য বুদ্ধি করে এই ধাঁধার অর্থ বুঝতে পারবে, সেই হবে সেই গুপ্তধনের মালিক! কিন্তু, আমাদের বাড়ির তেমন কেউই সেই ধাঁধার কোন মানে বার করতে পারেনি!
    টুসু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
    – কোথায় লেখা আছে সেই ধাঁধাটা…একবার দেখান…
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু মৃদু হেসে বললেন,
    – উনি লিখে তো গিয়েছিলেন উনার এক পুরনো ডাইরির পাতায়, কিন্তু সেটা নিয়ে আসার কোন দরকার নেই, কারণ এতদিন শুনে শুনে আমার সেটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। শোনো, বলছি…

    “পূর্ণতারার বেশে বানি,
    কলানিধির রঙে জানি,
    বুঝিতে যাহার পারিবে মন,
    তাহারই হইবে সকল ধন।”

    (৪)
    টুসু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলো সেই ধাঁধাটার সম্বন্ধে। শেষের দু’টো লাইন তো যে কেউ পড়ে বুঝতে পারবে, যে সেই জমিদার বলতে চেয়েছেন যে আগের দুটো লাইনের অন্তর্নিহিত অর্থ যে বুঝতে পারবে, সেই হবে এই গুপ্তধনের মালিক। কিন্তু মুশকিল তো এই আগের দু’টো লাইন “পূর্ণতারার বেশে বানি / কলানিধির রঙে জানি” নিয়ে। এই দু’টি বাক্যের মানে যে টুসুর একটুও বোধগম্য হচ্ছে না! ঠিক এমন সময়, গৈরিক প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো,
    – ধাঁধার কথা না হয় বুঝলাম, শ্যামাপ্রসাদ বাবু। তবে আপনি এই কথাও বলেছিলেন, যে এই বাড়ির কোন ছেলে নাকি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে…

    শ্যামাপ্রসাদ বাবুর সুন্দর ফর্সা মুখটা যেন বেদনায় ভরে উঠলো, তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন,
    – হ্যাঁ গৈরিক বাবু, সেটাই তো সবচেয়ে দুঃখ জনক ঘটনা এই বাড়ির। আসলে, বেশ কয়েক মাস ধরে এই বাড়ির একটা ঘরে সুজয় বোস নামক একটি ছেলে ভাড়া থাকছিলো। সে ছিল আমার দাদার ছেলে বসন্তের বন্ধু। সুজয় আর বসন্ত একসাথেই পদার্থবিদ্যা নিয়ে এম.এস.সি. করেছে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। তারপর দু’জনেই এই কলকাতার একটি বেশ বড় রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে পি.এইচ.ডি. করবার সুযোগ পায়। সুজয়ের পৈতৃক বাড়ি ছিল মেদিনীপুরের একটি মফস্বল গ্রামে, তাই সে আমাদের বাড়িতে ভাড়া থেকে নিজের রিসার্চের কাজ করতো। কিন্তু…

    এবার যেন কিছু বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু। গৈরিক বলে উঠলো,
    – কি হল? থামলেন কেন, বলুন…
    অস্ফুট স্বরে শ্যামাপ্রসাদ বাবু বলে উঠলেন,
    – ছেলেটা খুব ভালো ছিল জানেন মিস্টার সেন, আমাকে “কাকাবাবু, কাকাবাবু” বলে খুব সন্মান করতো, তাছাড়া পড়াশোনায়ও খুব ভালো ছিল। অতবড় একটা রিচার্স প্রতিষ্ঠানে পি.এইচ.ডি. করার সুযোগ পাওয়া যে মুখের কথা নয়, এ নিশ্চয় আপনি বুঝতেই পারছেন। কিন্তু তার একটা দোষ ছিল…ছেলেটা ছিল ভীষণ জেদি। সে যবে থেকে শুনেছিলো ওই রূপমতীর ঘরের ভূতের গল্পের কথা, তবে থেকেই সে সমানে আমার কাছে আব্দার করে চলেছিলো, তাকে সেই ঘরের চাবি দেওয়ার জন্য। সে সায়েন্সের ছাত্র, ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না, তাই তার খুব ইচ্ছা একবার ওই ঘরে ঢুকে প্রমাণ করে দেওয়ার, যে ওখানে কিচ্ছু নেই!…তাই, কয়েকদিন আগে, একরকম বাধ্য হয়েই আমি রূপমতীর ঘরের চাবিটা ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম…আর সেটাই ওর জীবনের কাল হয়ে গেল!

    টুসু অধীর আগ্রহে বলে উঠল,
    – কি হয়েছিল তারপর? সুজয় কি ওই ভূতের ঘরে গিয়েছিলো?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
    – হ্যাঁ ঐন্দ্রিলা, সে গিয়েছিলো, তারপর আবার অক্ষত শরীরে হাসিমুখে বেরিয়েও এসেছিলো সেই ঘর থেকে। কিন্তু সেই ভূতের প্রকোপ শুরু হল তার পর দিন থেকেই! সুজয়েরও জমিদার রমনীমোহন মল্লিকের মত ডাইরিয়া আর রক্তবমি হওয়া শুরু হল…আমরা ওকে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় একটা হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম, কিন্তু কোন ফল হল না! এত অল্প সময়ের মধ্যে ডাক্তাররা ওর অসুস্থতার সেরকম কোন কারণই বার করতে পারলেন না, এবং আজ সকালেই খবর এল, যে সেই তরতাজা ছেলেটা আর আমাদের মধ্যে নেই!
    একবার নিজের সুদৃশ্য সোনালী ফ্রেমের চশমাটা খুলে, নিজের দুই চোখ মুছলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, তারপর কান্না ভেজা গলায় বললেন,
    – ছেলেটা এই কটা দিনে যেন এই বাড়ির ছেলেই হয়ে উঠেছিল, গৈরিক বাবু…কেনই বা ওই ঘরে যাওয়ার ভূত চাপল ওর মাথায়, আর এ কি হয়ে গেল!
    টুসু যদিও বা ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না, তবুও ওর কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগলো এই কথা শুনে। সত্যিই তো, একটা জোয়ান ছেলের এই নিদারুণ পরিণতির কি কারণ হতে পারে? তাও আবার তার মৃত্যুটাও হয়েছে সেই লম্পট জমিদারের মতই!

    গৈরিক আবার প্রসঙ্গ পাল্টে, শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো,
    – সুজয়কে হত্যা করা বাদ দিয়ে, রূপমতীর প্রেতাত্মার এই বাড়িতে উপস্থিতির আর কোন প্রমাণ কি পেয়েছিলেন আপনারা?
    এবার যেন আরো ভয় পেয়ে গেলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে তিনি বললেন,
    – দাঁড়ান গৈরিক বাবু, আপনি সেই সব কথা একবার এই বাড়ির লোকেদের মুখ থেকেই শুনে নিন…
    এই বলে তিনি সেই বাড়ির চাকরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন,
    – যাও, একবার অপর্ণা দিদিমণি আর শ্রীতমা দেবীকে ডেকে নিয়ে আসো তো…এই বাবুরা ওদের সাথে কিছু কথা বলতে চান…
    এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরে প্রবেশ করলো দুইজন নারী। একজন হল বছর পঁচিশের এক সুন্দরী তরুণী, এবং অন্য জন হল এক সাধারণ চেহারার মাঝ বয়সী মহিলা। সেই অল্প বয়সী তরুণী এবার শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে বলে উঠলো,
    – কি গো বাপি, ডাকছিলে আমাকে…
    আর সেই মাঝ বয়সী মহিলাও বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দিকে।

    শ্যামাপ্রসাদ বাবু এবার ওদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠলেন,
    – আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ও হল আমার একমাত্র মেয়ে অপর্ণা। আর আপনাকে তো বলেই ছিলাম গৈরিক বাবু, যে আমার দাদা এখন মুমূর্ষ এবং শয্যাশায়ী, তার স্ত্রী গত হয়েছে প্রায় দুই বছর হল। তাই তার সারা দিনের দেখাশোনার জন্য আছেন ওই শ্রীতমা দেবী…উনি এই বাড়ির আয়া।
    তারপর তিনি অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবীকেও গৈরিক আর টুসুর পরিচয় দিয়ে বললেন,
    – ওনাদেরকে একবার বলো, যে এই বাড়িতে তোমরা কি কি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছো…
    সবার প্রথমে মুখ খুললো অপর্ণা, সে বেশ আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
    – আমার ঘরও এই বাড়ির নিচের তলায়…ওই ভূতের ঘরের কয়েকটা ঘর পরে…ওই ঘরে কোন অশরীরি শক্তির উপস্থিতির কথা সব থেকে বেশি আমিই উপলব্ধি করেছি, গৈরিক বাবু!
    গৈরিক বেশ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো,
    – বেশ, কি কি উপলব্ধি করেছেন তা একটু শুনি, অপর্ণাদেবী।
    অপর্ণা ভয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে উঠলো,
    – প্রায় রাতে ওই ঘরে কারোর চলা ফেরার আওয়াজ শুনতে পাই আমি…আর মাঝে মাঝে তো হালকা হালকা নুপুরের ধ্বনিও ভেসে আসে ওই ঘর থেকে!

    ওর কথা শেষ না হতেই শ্রীতমা দেবী আরো আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
    – আমি তো চব্বিশ ঘন্টা এই বাড়িতেই থাকি গৈরিক বাবু, কি বলব বলুন, নেহাত পেটের দায়ে এই কাজ করা, নাহলে কি থাকতাম এই ভুতুড়ে বাড়িতে! হ্যাঁ, তো যা বলছিলাম, এই কিছুদিন আগে রাত্রে একদিন ঘুম আসছিলো না, তাই বাড়ির নিচের তলার বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। বুঝতেই পারিনি, যে মনের ভুলে কখন ওই অভিশপ্ত ঘরটার কাছে চলে এসেছি! তবে বুঝতে পারলাম তখন, যখন কানে সেই নুপুরের শব্দর সাথে সাথে, কি যেন একটা ভাষায় একটা হালকা গানের আওয়াজও ভেসে এল! আমি সাহসে বুক বেঁধে একবার ওই ঘরের বন্ধ দরজার দুই পাল্লার ফাঁকে চোখ রাখলাম…অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম…স্পষ্ট দেখলাম যে, ওই ঘরের ভেতর একটা ছায়ামূর্তি এই দিক থেকে সেই দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে!…আমি তো কোন মতে রাম নাম করতে করতে দে ছুট!…পরে জেনেছিলাম, যে ওই গানের ভাষা ছিল রাজস্থানী! মানে, যে ভাষায় গান গেয়ে ওই বাইজি রাজ দরবারে নাচ দেখাত, আর কি!

    টুসু আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইল, এদিকে অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবী যেন দু’জনেই এক সাথে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো,
    – এই বাড়িতে কিছু আছে, গৈরিক বাবু…আমাদের সকলের উপলব্ধি কখনো ভুল হবে না…কিছু তো একটা আছেই এই বাড়িতে!

    ঠিক এমন সময় সকলের চিন্তার ঘোর কাটিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো শ্যামাপ্রসাদ বাবুর মোবাইল ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে কেমন যেন বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো তার ভ্রু। ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ কানে রেখে হঠাৎ স্থান কাল পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি,
    – আপনাকে তো বলেই দিয়েছি, যে আমি বা দাদা এই বাড়ি বিক্রি করতে রাজি নই, তাহলে কেন বার বার ফোন করে বিরক্ত করেন আপনি…না অত লাখ টাকা দিলেও নয়…কি বলছেন, আপনি কি আমায় থ্রেট করছেন নাকি মশাই…ঠিক আছে, আমার বাড়িতে ভূত আছে কি পেত্নী আছে, তা আমি বুঝে নেব, আপনার কি?
    এই রকম কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কাটলো কিছুক্ষণ, তারপর তিনি ফোনটা নামিয়ে রেখে, ঘরের বাকি সবাই-এর দিকে চেয়ে লজ্জিত গলায় বললেন,
    – কিছু মনে করবেন না, মিস্টার সেন…আসলে এই প্রমোটার-টার ফোন আসলেই মাথাটা গরম হয়ে যায়!
    গৈরিক জিজ্ঞাসা করলো,
    – যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে জানতে চাই, যে কে এই প্রমোটার আর কি চাইছে সে?
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন,
    – এই বদমাশটার নাম হল ঘনশ্যাম তিওয়ারী। ওর নজর আছে আমাদের বাড়িটার ওপর। দিনরাত শুধু আমাকে বলে বাড়িটা বিক্রি করার কথা, বলে নাকি ভালো দাম দেবে সে আমায়। তারপর এখানে একটা বহুতলী ফ্ল্যাট বানাবে…কি আস্পর্ধা দেখুন, বলছে যে ওই ভূতের বাড়িতে আপনারা আর ক’দিনই বা থাকতে পারবেন!…আমি তো স্পষ্ট ওকে মানা করে দিয়েছি…
    টুসু দেখল, যে গৈরিকের মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল এই কথা শুনে। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
    – ঠিক আছে, শ্যামাপ্রসাদ বাবু, বুঝলাম আপনাদের সব কথা। তবে এই কেসটাকে নিতে গেলে কিন্তু এই বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে।
    শ্যামাপ্রসাদ বাবু মিষ্টি হেসে বললেন,
    – সে আর বলতে, গৈরিক বাবু, এই বাড়িতেই আপনাদের থাকার সমস্ত বন্দোবস্ত আমি আগে থেকেই করে রেখেছি!

    (৫)
    মল্লিক বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিকের একেবারে কোণে যে বড় ঘরটা রয়েছে, সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে গৈরিক আর টুসুর। টুসুর একটু ভয় ভয়ই লাগছিল এই বাড়িতে তার প্রথম রাত কাটাতে। তবে যখন পাশের বিছানাতেই তার গেরোদা রয়েছে, আর যাই হোক, ভূত এই ঘরে ঢুকে তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই টুসু দেখল, যে তার গেরোদার বিছানা শূন্য, সে মনে মনে ভাবলো, যাহ বাবা, এত সকাল সকাল গেরোদা গেল কোথায়!…কিন্তু একটু পরেই ফিরে এলো গৈরিক, সে বেশ গম্ভীর মুখে সেই ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই টুসু জিজ্ঞাসা করলো,
    – কি গো, এত সকালে কোথায় গিয়েছিলে?
    গৈরিক সংক্ষেপে বলে উঠলো,
    – এই বাড়িটার আশে পাশের চারদিকটা একটু ঘুরে দেখে এলাম…
    টুসু বেশ অভিমানী স্বরে বলে উঠলো,
    – ও আচ্ছা, তা যাওয়ার আগে বুঝি আমাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যেতে নেই?
    গৈরিক মুচকি হেসে, গলায় কৃত্রিম উত্তেজনার ভাব এনে বলে উঠলো,
    – আজ সকালে তো সেরকম কিছুই হয় নি, কিন্তু কাল রাতে তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি যা দেখলাম…ওরে বাপ রে!
    টুসু উত্তেজনায় চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
    – ও মা, সে কি! কি দেখেছ তুমি কাল রাতে? বলো না…
    এবার গৈরিক আর ঠাট্টা ইয়ার্কি না করে, বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
    – অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবী কাল যা বললো, তা কিন্তু ভুল কথা নয় রে টুসু…ওই কারোর চলা ফেরা করার শব্দ, নুপুরের আওয়াজ, রাজস্থানী গান…এই সব কাল আমিও শুনেছি ওই ভূতের ঘরের দরজার বাইরে থেকে! এই কথা ঠিক, যে কিছু না কিছু অদ্ভুত জিনিস কিন্তু ঘটছে ওই ঘরের ভেতর!
    এবার টুসু প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
    – আর সেই ছায়ামূর্তি? তাকে দেখতে পেয়েছ তুমি?
    গৈরিক কোন উত্তর দিল না সেই কথার, কি যেন ভেবে চলল সে নিজের মনে।

    ঠিক সেই সময়, ওদের ঘরে এল ফর্সা, রোগা, মাঝারি উচ্চতার, বছর ছাব্বিস সাতাশের এক যুবক। সে হাসিমুখে ওদেরকে বলে উঠলো,
    – গুড মর্নিং গৈরিক বাবু আর ঐন্দ্রিলা, আপনাদের জুটির প্রশংসা তো আমি অনেকের কাছ থেকেই শুনেছি। ও বাই দা ওয়ে, আমি বসন্ত মল্লিক…আমাকে কাকাবাবু আপনাদের ডেকে পাঠাতে বললেন ব্রেক ফাস্ট-এর জন্য…
    ওর কথা শেষ না হতেই গৈরিক ওকে বলে উঠলো,
    – গুড মর্নিং বসন্ত বাবু, একটা কথা বলুন, এই সুজয় বলে ছেলেটা তো আপনার খুব ভালো বন্ধু ছিল, আপনারা এক সাথেই রিসার্চের কাজ করতেন…ওর মৃত্যুর পেছনে কি আপনার কারোর ওপর কোন সন্দেহ হয়?
    বসন্ত সকাল সকাল এই প্রশ্ন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, তাও সে একবার ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
    – কেন, আপনাদের কাকাবাবু বলেন নি, যে ওই বাইজির ঘর থেকে কি সব ভৌতিক আওয়াজ পাওয়া যায়…ওটা একটা অভিশপ্ত ঘর…আমাদের সকলের বারণ সত্ত্বেও সুজয় ওই ঘরে ঢুকেছিল, তাই হয়তো ওকে এই ভাবে মরতে হল!
    গৈরিক এবার দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,
    – সেই ভূতের আওয়াজ আমি গতকাল রাতে পেয়েছি, আর আজকে রাতেও একবার পেতে চাই, বসন্ত বাবু…কিন্তু তার আগে, আপনি একবার আপনার কাকাবাবুকে গিয়ে বলুন, যে সুজয়ের মতই, আমরাও একবার ওই রূপমতী বাইজির ঘরে ঢুকতে চাই, তাই সেই ঘরের চাবিটা যেন আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়!
    বসন্তের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল এই কথা শুনে, সে আর কোন কথা না বাড়িয়ে চম্পট দিল সেখান থেকে। কিছুক্ষম পর, সেই বাড়ির চাকর এসে কাঁপা কাঁপা হাতে গৈরিককে দিয়ে গেল সেই অভিশপ্ত ঘরের চাবি!

    অনেক দিনের পুরোনো মরচে পড়ে যাওয়া তালাটা খুলে, একটা বিকট শব্দ করে যখন গৈরিক সেই বাইজির ঘরের দরজার পাল্লা দু’টো খুলে ফেলল, তখন টুসুর হৃদ স্পন্দন একটু হলেও দ্রুত হয়ে উঠেছিলো! ঘরটা মাঝারি আকারের। তার ভেতরে ঘুলোর আস্তরণ আর মাকড়সার জাল দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো, যে এই ঘরে কত দিন কেউ পা মাড়ায়নি। ঘরের ভেতরে ছোট খাটো আসবাসপত্রের মধ্যে চোখে পড়ে একটা অবহেলিত সুবৃহৎ সেগুন কাঠের খাট। ধুলো ভর্তি ছেঁড়া তোষক আর চাদর এখনো রয়েছে তার ওপর। এর ওপরই বোধহয় রূপমতীর মৃতদেহটা পড়ে ছিল কোন এক কালে!…ভয়ার্ত চিত্তে ভাবল টুসু…আর তাছাড়া একটু দূরেই রাখা রয়েছে একটি তালা লাগানো লোহার সিন্দুক…এর মধ্যেই নিশ্চয় সে নিজের গহনা-গাটি রেখে দিতো, আবার ভাবল টুসু! কিন্তু সেই ঘরে সব চেয়ে দেখার মত বস্তু হল রূপমতীর একটা তৈলচিত্র, এত বছর পর, এত ধুলো বালি জমে গিয়েও, তার সৌন্দর্যে যেন একটুও ভাটা পড়ে নি! কে জানে, কে এঁকে ছিল এই ছবিটা, কিন্ত এই কথা ঠিক, যে অপূর্ব সুন্দরী ছিলো এই বাইজি! টুসু এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিল রূপমতীর রূপ দেখে, যে সে বুঝতেও পারলো না, যে গৈরিক সেই খাটের নিচ থেকে কি যেন একটা রূপোর মত জিনিস তুলে নিয়ে, গম্ভীর মুখে, সেটাকে নিজের পকেটে চালান করলো! কিছুক্ষণ পর ওরা দু’জনেই সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

    সেদিন সন্ধ্যে বেলায় টুসু মল্লিক বাড়ির দোতলায় বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে উদাস মনে রূপমতীর কথা ভেবে চলেছিলো, এমন সময় তার কাছে এলেন শ্রীতমা দেবী। তিনি ফিস ফিস করে টুসুকে বলতে লাগলেন,
    – শোনো ঐন্দ্রিলা, তোমাকে একটা কথা বলি…তুমি যেন আবার পাঁচ কান করো নাকো…
    টুসু অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
    – কি কথা বলুন তো?
    শ্রীতমা দেবী একবার দুই পাশটা দেখে নিয়ে, আবার ফিস ফিস করে বলে উঠলেন,
    – এই সুজয় ছেলেটা কিন্তু খুব একটা চরিত্রবান ছিল না…শ্যামাপ্রসাদ বাবু ওর সম্বন্ধে কিছুই জানেন না…জানো, কয়েকদিন আগে আমি গোপনে দেখেছিলাম, যে এই সুজয় আর বসন্তের মধ্যে সে কি ঝগড়া!
    টুসু বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো,
    – কেন? কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ওদের মধ্যে?
    শ্রীতমা দেবী বলে উঠলেন,
    – আরে, বসন্ত নাকি কোন ফাঁকে দেখে ফেলেছিল, যে সুজয় নাকি অপর্ণার সঙ্গে…

    কিন্তু সেই সময় হঠাৎ পেছন থেকে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে চুপ করে গেলেন শ্রীতমা দেবী। সেই পদ-ধ্বনি আর কারোর নয়, স্বয়ং গৈরিকের। গৌরিক বেশ খোস মেজাজেই শ্রীতমা দেবীকে বলে উঠলো,
    – সুজয় আর বসন্তের ঝামেলার কথা না হয় বুঝলাম, শ্রীতমা দেবী…কিন্ত আপনি এবার আমাকে একটা কথা বলুন, আজ দুপুরে আপনি বাড়ি যাওয়ার নাম করে ঠিক কোথায় গিয়েছিলেন এই বাড়ি ছেড়ে?
    শ্রীতমা দেবী ভয়ার্ত মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অগত্যা, গৈরিকই বলে উঠলো,
    – ঠিক আছে আমিই বলে দিই…বুঝলি টুসু, আমি আজ দুপুরে আবার সেই ব্যাংকে গিয়েছিলাম একটা কাজে…বেরনোর সময় দেখলাম, যে গুটি গুটি পায়ে শ্রীতমা দেবী বেরিয়ে এলেন পাশেই অবস্থিত প্রমোটার ঘনশ্যাম তিওয়ারীর অফিস থেকে! তা আপনার সেখানে যাওয়ার হেতু কি, শ্রীতমা দেবী?
    শ্রীতমা দেবী ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে, সেই মুহূর্তে সেখান থেকে কেটে পড়লেন!

    (৬)
    রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও, গৈরিক আর টুসু বেশ উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপমতীর ঘরের বাইরে, সেই ঘরের তালা বন্ধ দরজার কাছেই। সেই রাজস্থানী ভাষায় মেয়েলি কণ্ঠের গুঞ্জন আর নুপুর পায়ে কারোর নৃত্য করার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে! গৈরিক টুসুকে অবাক করে ছুটে গেল দরজার কাছে, তারপর ক্রমাগত দরজায় বারি মারতে মারতে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
    – রূপমতী ম্যাডাম, আমাদের কাছে কিন্তু এই ঘরের চাবি আছে, আমরা এখনই এই ঘরের দরজা খুলে ভেতরে আসছি! এই বাড়িতে এলাম আর দেখে যাবো না, যে আপনার কত সুন্দর রূপ ছিল!
    কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত আওয়াজ! টুসু ছুটে গিয়ে চাবিটা দিয়ে সেই ঘরের তালা খুলতে উদ্যত হলে, গৈরিক তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
    – ওই ঘরের ভেতর এখন আর কাউকে পাবি না…তবে সত্যিই যদি ওই সুন্দরীকে দেখতে চাস তাহলে আমার সাথে আয়!

    এই বলে গৈরিক ছুটতে লাগলো একতলার বারান্দা দিয়ে, যেতে যেতে মোবাইলে স্থানীয় থানার ওসির নাম্বারটা ডায়াল করে কানে রাখলো ফোনটা। তার পেছনে পেছনে ছুটে চললো টুসু! ওরা সোজা মল্লিক বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে একেবারে বাড়ির পেছনে, জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত একটি জায়গায় এসে, একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই, পেছনের একটা ভাঙা দেওয়ালের কাছ থেকে আসতে লাগল সেই নুপুরের আওয়াজ, তবে সেই গান কিন্তু এখন আর হচ্ছে না!…একটা ছায়ামূর্তি যেন সেই পোড়ো দেওয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে এই অন্ধকারে…সে একটু কাছে এলেই গৈরিক ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলো তাকে, এক টানে খুলে নিল তার মুখে জড়ানো চাদর…টুসু অবাক হয়ে দেখলো, যে সেই “রূপমতী” আর কেউ নয়, এই বাড়ির ছেলে বসন্ত!…এক হাতে সে ধরে আছে দু’টো রূপোর নুপুর, আর অন্য হাতে ধরা তার স্মার্টফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনে এখনো দেখা যাচ্ছে, যে মিউজিক প্লেয়ার-এ পস করা আছে একটি রাজস্থানী গানের টিউন!…এমনই সময় বাড়ির কাছেই শোনা গেল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ।

    পুরো টিম নিয়ে থানার ও.সি. এবং মল্লিক বাড়ির সকলেই সেখানে হাজির হলে, গৈরিক সকলকে নিয়ে গেল সেই ভাঙা দেওয়ালটির পেছনে। তারপর নিজের মোবাইলের ফ্লাশ লাইট অন করে, সেই দেওয়ালের নিচের দিকে, কয়েকটা আগাছাকে পা দিয়ে সরিয়ে দিতেই, সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! দেওয়ালের গোড়ার দিকে, ওই ঝোঁ
    ঝোপের পেছনে, আছে একটি ছোট সুড়ঙ্গের মুখ, তার ভেতর দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে সারি সারি সিঁড়ি! এর পর গৈরিকের নির্দেশে ওরা সবাই তখনই ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে, রূপমতীর ঘরে। তারপর গৈরিকের কথায়, চারজন পুলিশ কনস্টেবল সেই ঘরের সেগুন কাঠের খাটটিকে সরিয়ে ফেলতেই, সবাই আবার অবাক হয়ে গেল। যে জায়গায় খাটটা রাখা ছিল, ঠিক তার নিচে একটা বেশ বড় ফাটল, তারও নিচ দিয়েও নেমে গিয়েছে সিঁড়ি। কাছেই রাখা আছে একটি কাঠের চাকতি, যার রংটা পুরো ঘরের মেজের রং-এই! বোঝাই যাচ্ছে, যে সেই ফাটলের মুখের ওপর এই কাঠের চাকতিটি খাঁজে খাঁজে আটকে যাওয়ার পর, খুব একটা কেউ বুঝতেই পারবে না, যে এই ঘরের নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে!

    গৈরিক শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে বলে উঠলো,
    – এই ঘরের নিচে থাকা সুড়ঙ্গের অপর মুখ বাড়ির বাইরে, ওই ভাঙা দেওয়ালটির পেছনে, যা আপনারা একটু আগেই দেখে এসেছেন…এই ব্যাপারে না আপনি জানতেন, না রূপমতী, না বাড়ির অন্য কেউ…শুধু জানতে পেরেছিল বসন্ত! আর এই পথ দিয়েই সে বাইরে থেকে তালা বন্ধ ঘরটির ভেতরে ঢুকতো প্রায় রাতে…আর ওই নুপুরের ধ্বনি আর রাজস্থানী গানের আওয়াজের মত সস্তা বাজার চলতি পন্থাগুলো দিয়ে, সে যে কিভাবে আপনাদের ভয় দেখাতো, তা আর নিশ্চয় বলে বোঝাতে হবে না!
    বসন্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, শ্যামাপ্রসাদ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
    – কিন্তু কেন করতো ও এই সব?
    গৈরিক মৃদু হেসে বলে উঠল,
    – বসন্ত আর সুজয় রিসার্চের কাজ করতো তেজস্ক্রিয় ধাতু পোলোনিয়াম নিয়ে…এই কথা আমি ওদের রিসার্চ প্রতিষ্ঠান থেকে খোঁজ নিয়েই জানতে পেরেছি। ওদের রিসার্চ গাইড আমাকে বলেন, যে বেশ কিছুদিন থেকে ল্যাবে আনা পোলোনিয়াম-এর অধিকাংশই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না…এবং এই পোলোনিয়াম-এরই একটি টুকরো যখন আমি আজ সকালে এই ঘর থেকে পেলাম, আর বাড়ির পেছনের ওই সুড়ঙ্গটাকেও আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠে বাড়ির চার পাশটা দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, তখন আর আমার বুঝতে বাকি রইল না, যে বসন্তই ল্যাব থেকে পোলোনিয়াম চুরি করে, এই সুড়ঙ্গের পথে এসে সেগুলোকে রূপমতীর ঘরে লুকিয়ে রাখতো, ভূতের ভয়ে যাতে এই কথা আর কেউ জানতে না পারে। আর সেই ভয়কে আমাদের মনে আরো জোরালো করতে, সে আজকের মতই, প্রায় রাতে ওই পথ দিয়েই এই ঘরে ঢুকে এই ভাবে “ঘুমার” নাচন দেখাত…হা হা হা…তবে আমি আসার পর হয়তো সে চুরি করা মালের পুরোটাই সরিয়ে ফেলেছে এই ঘর থেকে, শুধু ভুল বশতঃ ফেলে রেখেছিল সেই ধাতুর একটি ছোট টুকরো! এই ধাতুকে এখন বিভিন্ন দেশে স্মাগল করা হচ্ছে, মূলতঃ নিউক্লিয়ার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর নিউক্লিয়ার অস্ত্রে এর ব্যবহারের জন্য…তবে, বসন্ত ল্যাব থেকে চুরি করে এই ঘরে লুকিয়ে রাখা পোলোনিয়াম কাদেরকে বেচতো, সেই কথা তার মুখ থেকে বার করার দায়িত্ব কিন্তু পুলিশের…আমার নয়!

    একটু থেমে, বসন্তের দিকে চেয়ে, আবার বলতে লাগলো গৈরিক,
    পোলোনিয়াম এমনই একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু, যা থেকে আলফা রশ্মি নির্গত হয়। এই আলফা রশ্মি মানুষের চামড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে না। তাই খুব একটা সুরক্ষা ছাড়া খালি হাতে এই ধাতুকে ধরলে তেমন কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে এই ধাতুর জলে দ্রাব্য কিছু লবন যেমন পোলোনিয়াম সাইট্রেট বা পোলোনিয়াম নাইট্রেট যদি মানুষের খাবারের সাথে তার শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত! আর সুজয়ের পোস্ট-মোর্টেমে সেই কথাই উঠে এসেছে, আমার বলে দেওয়া কিছু স্পেশাল টেস্ট করে!…সুজয়কে আপনি কেন খুন করলেন বসন্ত বাবু?
    বসন্ত মাথা নিচু করে, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
    – আমার অজান্তে, এই ঘরে ঢুকে ও দেখে ফেলেছিল এখানে রাখা ওই ধাতু…ওর আর কিছুই বুঝতে বাকি থাকে নি…ও আমার কাছ থেকে অনেক টাকা চাইছিলো মুখ বন্ধ রাখার জন্য। তাই সেদিন রাতেই আমি সবার চোখের আড়ালে ওর খাবারের মধ্যে পোলোনিয়াম সাইট্রেট মিশিয়ে দিই…
    ওর কথা শেষ না হতেই, অপর্ণা চিৎকার করে ছুটে গিয়ে সটান এক থাপ্পড় কষালো বসন্তের গালে! সেদিনই এরেস্ট করা হল বসন্তকে। ঠিক তখনই শ্রীতমা দেবী বলে উঠলেন,
    – আমার অসুস্থ স্বামীর অপারেশনের জন্য আমি দুই লাখ টাকা ধার করি ঘনশ্যাম তিওয়ারীর কাছ থেকে, সেই টাকা আমি তাকে মাসে মাসে শোধ করে যাচ্ছি….আজকে বিকালে সেই জন্যই গিয়েছিলাম তার অফিসে…আর অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য আমার যে ছিল না, তা এখন আপনার বুঝতেই পারছেন!

    (৭)
    এতক্ষন পর টুসু অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
    – কিন্তু গেরোদা, সেই ধাঁধা আর সেই গুপ্তধন…
    গৈরিক এবার একটু মৃদু হেসে বললো,
    – এর জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা আর জীববিদ্যা থেকে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। রাজস্থানের কিষানগড়ে মহারাজা সাওন্ত সিংহ নামক এক রাজা ছিল। তার দরবারে গান গাওয়া এবং কবিতা আবৃতি করার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়া নামক এক সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে আসেন সেই রাজার সৎ মা। সাওন্ত সিংহ তার প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ অবধি করেন। ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৪-এর মধ্যে, সেই রাজ দরবারের বিখ্যাত চিত্রকর নিহাল চাঁদ, রাজা সাওন্ত সিংহ-কে শ্রীকৃষ্ণের রূপে আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে শ্রীরাধিকার রূপে চিহ্নিত করে, তাদের অনেক ছবি আঁকেন। এই বিষ্ণুপ্রিয়াকে লোকে বলতো “বানি থানি”, রাজস্থানী ভাষায় যার অর্থ হল “প্রসাধনী আর অলঙ্কারাদিতে সুসজ্জিতা সুন্দরী নারী”।

    একটু থেমে একবার দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো গৈরিক,
    – এবার আসি ধাঁধায়… শ্রীরাধিকার এক হাজার নামের মধ্যে একটি হল “পূর্ণতারা”, “বানি” হল এখানে “বানি থানি” আর “কলানিধি” হল “চাঁদের” প্রতিশব্দ…তার মানে “পূর্ণতারার বেশে বানি / কলানিধির রঙে জানি” কথাটার অর্থ হল: নিহাল “চাঁদের” রঙে আঁকা “রাধার” বেশে “বানি থানি”-র ছবি। শুনুন সকলে, এই ঘরের দেওয়ালে আটকানো এই তৈলচিত্রটি কিন্তু রূপমতীর নয়, এটা বিখ্যাত চিত্রকর নিহাল চাঁদের আঁকা রাধার বেশে “বানি থানি”-র ছবি, যার আর্থিক মূল্যর থেকেও তার ঐতিহাসিক বা নান্দনিক মূল্য অনেক বেশি…ওটাই হল আপনাদের বাড়ির আসল গুপ্তধন যার কথা জমিদার রমণীমোহন মল্লিক এই ধাঁধার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন! আমার বিশ্বাস, যেহেতু “বানি থানি” বাইজি থেকে রাজার স্ত্রী হয়ে উঠেছিল, তাই সেই ছিল রূপমতীর অনুপ্রেরণা, আর তাই এই ছবিটাকে সে এখানে নিয়ে আসে সুদূর রাজস্থানের কিষানগড় থেকে। সে নিজেও চেয়েছিল বাইজি থেকে রমণীমোহনের স্ত্রী হয়ে উঠতে, কিন্তু সেটা বোধহয় তার ভাগ্যে ছিল না!

    টুসুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল এই কথা শুনে, সে ভাবলো, যে সাধে কি আর লোকে বলে, “অতি বড় সুন্দরী না পায় বর!”

    (সমাপ্ত)

  • ভৌতিক গল্প

    জন্মান্তর

    জন্মান্তর
    -পার্থসারথি ঘোষাল

     

     

    [বিঃদ্রঃ-এই গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনাবলী সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক।বাস্তবের সঙ্গে যদি কোনো যোগ থেকে থাকে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত ও সম্পূর্ণ রূপে কাকতালীয়।]

    মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি অজানাকে জানা, এই প্রবৃত্তি মানুষকে অনেক সময় নেশার মতো পেয়ে বসে।ইন্দ্রজিৎ বাবুরও প্রায় সেই রকম অবস্থাই হয়েছিল।ইন্দ্রজিৎ বাবু –মানে ডঃ ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী। ভদ্রলোক কোলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের জীববিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে অনেক নিগূঢ় অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। অবসর গ্রহণের পর তিনি চলে এসেছিলেন মেদিনীপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটে পালপাড়ায়। তিনি বিপত্নীক, অবশ্য তাঁর দুই ছেলে আছে, তারা দু’জনেই উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী–যে যার ফ্যামিলি নিয়ে ভিনরাজ্যে বাস করে। মাঝে সাঝে অবশ্য তারা যে বাবার খবর নিতে গ্রামের বাড়িতে আসে না –তা কিন্তু নয়; তবে তা খুবই বিরল। ইন্দ্রজিৎ বাবুর বয়স প্রায় সত্তর বছর; কিন্তু তাই বলে স্বাস্থ্য সেই অনুপাতে ভেঙে যায় নি। এ বয়সেও তিনি রীতিমতো ড্রিঙ্ক করেন তবে সবই বিদেশী জিনিস। আজকাল তাঁকে বাইরেও খুব একটা দেখা যায় না। এখানে ত়াঁর সঙ্গী বলতে রাঁধুনি হরি, আর ফাইফরমাস খাটার জন্য এই গ্রামেরই ছেলে–গজা এবং তাঁর অতি আদরের স্যামসন্(ডোবারমেন্ট)। বাড়িটা একটা বহুকক্ষবিশিষ্ট দোতালা বাড়ি। গ্রাউন্ডফ্লোরে ঠিক মাঝখানে চৌকো বারান্দা এবং তার চারপাশে কিচেন ও ভাঁড়ারের জন্য ব্যবহৃত দু’টি রুম, তাছাড়াও রয়েছে অ‍্যাটাচ্ বাথ দু’টি টয়লেট। একটা ঘর রাঁধুনি হরির জন্য বরাদ্দ, এবং আরও গোটা তিনেক ঘর যেগুলো সবই বর্তমানে আন্ডার লক্ অ্যান্ড্ কি। দোতালার যে ঘরে ইন্দ্রজিৎ বাবু থাকেন তার গায়েই বাথরুম ও টয়লেট। তাছাড়াও রয়েছে বারান্দা ও বারান্দার চারপাশে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি রুম, এবং আরোও গোটা তিনেক ঘর ও একটা মাঝারি সাইজের বাথরুম কাম টয়লেট যেগুলো তালা বন্ধই থাকে প্রায়। গ্রাউন্ডফ্লোরে যাওয়ার সিঁড়ির দরজা বারান্দার একদিকে তাতে দামী ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে। বাড়ির চারধারে প্রায় আটফুট উঁচু সারাউন্ডিং ওয়াল। প্রায় বিঘে তিনেক জায়গার উপর এই বাড়ি ও বাড়ি সংলগ্ন একটা বাগান যেখানে দেশী বিদেশী সব গাছই চোখে পড়বে। বাগানটা অবশ্য বাড়ির পেছনে, গ্রাউন্ডফ্লোরের একটা মাঝারি গেট দিয়ে ঐ বাগানে যাওয়া আসা করা যায়। অবশ্য, অন্য আর একটা পথও রয়েছে বাগানে যাবার– সেটা হলো বাড়ির ডানপাশে যে লম্বা পার্টিশন্ ওয়াল, বাগান এবং বাড়ির সম্মুখস্থ লন ও ফুলের বাগিচাকে পৃথক করেছে–তার গায়ে একটা ছোটো দরজা আছে। বাড়ির বামদিকে আরও একটা পার্টিশন্ ওয়াল রয়েছে তবে তা নাতিদীর্ঘ। অর্থাৎ বাড়িটা পুরো জায়গাটার মোটামুটি মাঝে। বাড়ির সামনে একদম ফটক পর্যন্ত প্রশস্ত লন, তার দু’পাশে গার্ড ওয়াল দিয়ে তৈরী ফুলের বাগিচা, কারণ ইন্দ্রজিৎ বাবু ফুল খুব ভালোবাসেন।বাড়ির কিচেন রুম সংলগ্ন একটা ইঁদারা, তাতে দামী পাম্পবসানো। দোতালার ছাদে একটা জাহাজ মার্কা জলের ট্যাঙ্ক। মোটকথা আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত হাউসিং পরিকাঠামোর প্রসাদ থেকে এ বাড়ির পরিবেশ যে বঞ্চিত নয়, তা সহজেই অনুমেয়। একটা দারোয়ান এবং দামী গাড়ির বোধহয় প্রয়োজন ছিল তবে কি কারণে যে এ দু’টি অনুপস্থিত তা বোঝা বড় শক্ত।

    আজ থেকে পাঁচ/ছয় বছর আগে ইন্দ্রজিৎ বাবুর কথায়-বার্তায় একটা প্রাণবন্ত মিশুকে ভাব লক্ষ্য করা যেত। বর্তমানে কি যেন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি যেন একটু অস্বাভাবিক মাত্রায় চুপচাপ; কারণ ছাড়া কথা বলেন না –এই আর কি! খুব ভোরে একবার দোতালা থেকে লনে একটু যা পাইচারি করেন, বাদবাকি দিনের অধিকাংশ সময়েই তিনি লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে কি যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে–তাঁর কাছে মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক আসেন। একদিন থেকে, তারপরের দিনই আবার ফিরে যান। ভদ্রলোকের নাম রমেন পুরকায়স্থ, জানা যায় উনিও নাকি ঐ সুরেন্দ্রনাথ কলেজেই ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতেন। তিনিও রিটায়ার করেছেন আজ বছর ছয়েক হলো।
    একদিন ল্যাবরেটরি রুমের সামনে ইন্দ্রজিৎ বাবুকে খুব চিন্তিত মনে হলো, হঠাৎ তিনি লাইব্রেরী রুমে ঢুকে টেলিফোনে কাকে যেন রিং করে  বললেন, “হ্যালো, বিভাস আমি স্যার বলছি। আমার একটা বিষয় তোমার কাছে জানার ছিলো–হ্যাঁ, আরে না না–আজকাল আর চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছি না।” টেলিফোনের ওপারে যিনি রয়েছেন অর্থাৎ বিভাস নামে লোকটি ব্যাপারটা মনে হয় জানতে চাইলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু তখন তাকে যা বললেন তার মর্মার্থ হলো —-মানুষ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি কোনো অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করে, এবং সেখান থেকে একটা নৈসর্গিক শক্তি মাধ্যমে ইহজগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে আবার পুনর্জন্ম লাভ করতে সমর্থ হয়? কিছুক্ষণ ধরে তিনি রিসিভারে কান রেখে খুব অভিনিবেশ সহকারে ঐ বিভাস নামে লোকটির কথা শুনলেন এবং অবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তাঁর চোখ মুখের ভাব দেখে মনে হলো তিনি যেন তাঁর কাঙ্খিত জবাব পেলেন না। রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলেন নীচে ,সঙ্গে তার একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু স্যামসন্। হরির তাঁর উপর চোখ পড়তেই বললো, “বাবু,আপনি এইসময় নীচে? কি মনে করে?” ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন কথাটা শুনতেই পেলেন না মনে হলো। ঘড়িতে তখন প্রায় বিকাল সাড়ে পাঁচটা। স্যামসন প্রাচীরে হনুমানের মতো কি একটা দেখে বাঘের মতো গর্জন করতে লাগলো, ইন্দ্রজিৎ বাবু তাকে শান্ত করলেন। হরি খানিকটা দ্রুত ওদিকে এগিয়ে গিয়ে হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,”হেই-হেই–যা-যা-যা-হুস্-হুস্-যা-যা।”প্রাচীরে বসে থাকা প্রাণীটি হরির ঐ অদ্ভুত আওয়াজে ভয় পেয়ে, সেখান থেকে বোধহয় পালিয়েই গেলো। ইন্দ্রজিৎবাবু স্যামসনকে মুখে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে হাত ইশারা করা মাত্র সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো একেবারে দোতালায়।

    এবার হরির দিকে মুখ ফিরিয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবু বললেন,”আচ্ছা হরি ,মানুষ মরলে কোথায় যায় জানিস্?” হরি মুখটা একবার আকাশের দিকে তুলে কি যেন ভেবে নিয়ে বললো,”সে তো জানিনা বাবু,তবে বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছি ভাল কর্ম করলে স্বর্গ লাভ হয় আর কুকর্ম করলে নরকে পচে মরতে হয়।”
    ইন্দ্রজিৎ বাবু বুঝতে পারলেন যে হরির লেখাপড়া যা একটু আছে সেইটুকুই যথাসম্ভব কাজে লাগিয়ে সে একটা তার মতো করে জবাব দিয়েছে ,এর বেশী আশা করা বোধহয় বাতুলতা; তাই কি যেন ভেবে একটু মৃদু হেসে চলে গেলেন ফুলের বাগিচার কাছে এবং ফুলের গাছগুলো পরীক্ষা করতে করতে হাঁক পাড়লেন,”গ-জা-জা-জা,এই গ-জা— কোথায় গেলি রে বদমাইশ?”
    হরি জানালো, “বাবু ,গজা আজ খেয়ে দেয়ে বিদেয় নিয়েছে। আজ পাশের গ্রামে পঞ্চরস দেখতে যাবে।আজ আর ও আসবে না, আবার কাল সেই সকাল আটটা না নটা! তার ঠিক ঠাহর নাই।”
    ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”কাল গজা এলে গাছগুলোতে জল দিতে বলবি, জলের অভাব হয়েছে মনে হচ্ছে।”
    হরি সম্মতি সূচক ঘাড়টা একবার ডানদিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে নুইয়ে দ্রুত চলে গেলো পেছনের বাগানে। ইন্দ্রজিৎ বাবুও ততক্ষণে পায়ে পায়ে উঠে এলেন দোতালার লাইব্রেরী রুমে। টেবিলের উপর তখনও একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে–বইটা আসলে হেনরী গ্রে’র লেখা– একটা হিউম্যান অ্যানাটমির বই। সেই বইটার একটা পাতার কতকগুলো লাইনকে ইন্দ্রজিৎ বাবু লাল কালি দিয়ে ভালোভাবে আন্ডার লাইন করে মনে হয় আবার পরবর্তী অংশে মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর বই থেকে মুখ তুলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে লাইব্রেরী রুমের চারদিকে একবার চোখ বোলাতে লাগলেন।

    লাইব্রেরী রুমের চারটে কাঠের আলমারীতে দেশী বিদেশী অসংখ্য দামী দামী বই। ঘরের মাঝখানে একটা সেক্রেটারিয়েট গোছের টেবিল। টেবিলের একপাশে দরজার দিকে মুখ করে একখানা দামী রিভলভিং চেয়ার ও আর একপাশে খানচারেক কাঠের বার্ণিশ করা চেয়ার। ঘরটার একদিকে অর্থাৎ বাগানের দিকটায় দু’টো বেশ বড় মাপের জানালা, তাতে দামী সবুজ কাঁচ লাগানো। ঘরটায় আপদকালীন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও রয়েছে।এই লাইব্রেরি রুমেই ইন্দ্রজিৎ বাবু অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন।
    এবার একটু ল্যাবেরেটরি রুমে উঁকি মারা যাক–দুটো স্টিলের বড় সাইজের আলমারী–তালা বন্ধ মনে হয়।
    এককোণে একটা নরকঙ্কাল—আসল না নকল তা দুর থেকে কিছুই বোঝা যায়না। তিনটে টেবিল পর পর সাজানো —তাতে দু’ তিনটে মাইক্রোস্কোপ বেশ দামী বলেই মনে হয়। একটা ট্রেতে কিছু ছুরি ও কাঁচি। একটা কোণে একটা ডাস্টবিন; তাছাড়াও দেওয়ালের চারদিকে নানা ধরণের গাছ গাছালি ও বিভিন্ন জীবজন্তুর লেমিনেটেড করা ছবি, সেখানে মানব দেহের ছবিও রয়েছে বেশ কয়েকটি। আলমারীর মাথায় রয়েছে ফাইলের পাহাড় কতদিনকার যে পুরনো তা বাইরে থেকে দেখে আন্দাজ করে ওঠা মুশকিল।কিন্তু একটা জিনিস দেখে একটু অবাকই হতে হয়, আর তা হলো দেওয়ালের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে টাঙানো একটা বড় পঞ্চকোণের ছবি। অবশ্য এই রকম আর একটা ছবিও চোখে পড়বে লাইব্রেরি রুমের দেওয়ালে রিভলভিং চেয়াটার সামনাসামনি দরজার ঠিক উপরের দেওয়ালে—এতক্ষণে ইন্দ্রজিৎ বাবুর চিন্তা বিহ্বল মানসিকতার মোটামুটি একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে—-আজকাল তিনি বিজ্ঞানের চর্চা থেকে খানিকটা সরে এসে তারই পরিপূরক হিসাবে হয়ত আর একটা বিষয়েও চর্চা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন আর তা হলো নেক্রোমেন্সি(কালাজাদু)ও ব্ল্যাকমাস(ডাকিনীবিদ্যা) নিয়ে খুব গভীর পড়াশোনা এবং হাতেকলমে এই গুপ্তবিদ্যার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া। এবং মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে হয়ত এই কারণেই কোনো কোনোদিন গভীর রাত্রে ল্যাবেরেটরির দরজা বন্ধ করে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবে ব্যাপারটা যে কি তা কারও পক্ষেই জানা বোধহয় সম্ভব নয়, একমাত্র হরি ছাড়া-তবে হরিকে দেখেও মনে হয়না যে, সে ঘটনাটা সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানে!

    ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকলেই একটা পচা গন্ধের অস্তিত্ব একটু গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায়।এর থেকে মোটামুটি এমনটাই অনুমান করা যেতে পারে যে ইন্দ্রজিৎ বাবু এখানে জীবিত অথবা সদ্যমৃত জীবজন্তুর দেহ কাটাছেঁড়া করেন এবং এইজন্যই টেবিলের উপর ট্রেতে দেখা গেল ছুরি কাঁচির উপস্থিতি–এবং সেইসব মৃতদেহের রক্ত ও মেদের অবশিষ্টাংশ পরিস্কার করে কোণের ঐ ডাস্টবিনে ফেলা হয়। হতে পারে এ গন্ধের উৎস সেখানেই। তবে সেইসব মৃতদেহ গুলি যে কোথায় ফেলা হয় তা অজ্ঞাত। হঠাৎ শোনা গেল কার যেন পায়ের শব্দ, চারদিকে তখন রীতিমতো অন্ধকার নেমেছে। দেখা গেলো ইন্দ্রজিৎ বাবু ল্যাবরেটরি রুমে সন্তর্পণে ঢুকলেন এবং দরজা বন্ধ করে একটা মৃদু আলো জ্বালালেন, মৃদু নীলচে আলোয় ঘরটার চারদিক একটা অতিপ্রাকৃত অবয়ব গ্রহণ করলো–ইন্দ্রজিৎবাবু দেওয়ালের ঐ পঞ্চকোণের (কালাজাদুর প্রতীক) ছবিটাকে একটা টৈবিলের উপর রাখলেন ও তারপর আলমারী খুলে কালো কাপড়ে জড়ানো মূর্তি জাতীয় কিছু একটা জিনিস বার করে আনলেন। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি ঐ মূর্তিটা কোলে নিয়ে বসলেন ছবির সামনে চেয়ারে। তাঁর ঠোঁট দুটোর মধ্যে খুব মৃদু আন্দোলন।এই অবস্থায় তিনি চোখ বুঝে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন, কিন্তু তাঁর ধ্যানে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো বাইরে স্যামসনের একটানা গম্ভীর –হাউ–হাউ চিৎকার। ইন্দ্রজিৎ বাবু বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন যে স্যামসন বাগানের দিকে কি যেন একটা দেখে তখনও চিৎকার করেই চলেছে। সাবেকী আমলের ওয়ালক্লক ঢং-ঢং আওয়াজ তুলে জানিয়ে দিলো রাত্রি আটটা। ইন্দ্রজিৎ বাবু স্যামসনকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু স্যামসন যেন আজ একটু বেশী মাত্রায় সন্দেহতাড়িত হয়ে হিংস্র হয়ে উঠতে চাইছে। ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখে মুখে একটা কুটিল চিন্তা যেন পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছে, তিনি একটা বিশেষ কৌশলে স্যামসনের মুখের সামনে হস্তসঞ্চালন করতেই স্যামসন যেন শান্ত হয়ে গেলো।দেখে মনে হলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর সেই বিশেষ কৌশলে হস্তসঞ্চালনার মধ্যে একটা অলৌকিক অথচ নিগুঢ় রহস্যময়তা বিরাজ করছে। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে ইন্দ্রজিৎ বাবু প্রায় প্রতিদিন একটা শ্মশানেও নাকি যাতায়াত করতেন,তবে কি জন্য যে তিনি শ্মশানে যেতেন সে কারণ জানা সম্ভব নয়। এখন অবশ্য বেশ কিছুদিন হলো সেই অভ্যাস থেকে তিনি বিরত রয়েছেন। যাইহোক স্যামসনের ঐ ধরণের আচরণে ইন্দজিৎবাবুর চেহারাতেও যেন একটা অস্বাভাবিক শক্তির প্রভাব ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠছে–যা লক্ষ্য করার মতো।ইন্দ্রজিৎ বাবুর হাবভাব দেখে মনে হলো বাগানের ঐ অন্ধকারেই যেন তাঁর চির আকাঙ্খিত কোনো কিছু তিনি খুঁজে চলেছেন মানসবিহারের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ শুনে ইন্দ্রজিৎ বাবু নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হরিই এতক্ষণ সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠছিলো। ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে দেখে বললেন,”ও! তুই? কিরে কিছু বলবি?”
    হরিকে দেখে মনে হলো সে যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখেছে, একটা আতঙ্ক মাখা চোখে চেয়ে রইলো ইন্দ্রজিৎবাবুর মুখের দিকে। ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে জিজ্ঞাসা করলেন “কিরে হরি? কি হলো? আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস?”
    হরি এবার ঢোক গিলে বললো,”বা-বু, বা-গা-নে সে-ই বি-দে-শী ফু-লগাছ-টার নী-চে?”
    “হ্যাঁ, কি হলো সেখানে?”ইন্দ্রজিৎ বাবু জানতে চাইলেন।
    হরি বললো,”এক-টা মুর্তি পা থেকে মা-থা প-র্যন্ত মেম-সাহেব-দের মত কালো বোর-খা পরা, হাতে এক-টা জ্ব-লন্ত লো-হার শিকের মত কিছু ছিলো, যার লাল রঙের আ-ভায় দেখ-লাম ঐ মুর্তির মুখটা– কি ভয়ংকর! চোখ ,মুখ,নাক কিচ্ছু নেই যেন একটা এবড়ো খেবড়ো পাথরের বড় টুকরো”
    ইন্দজিৎবাবু কৌতূহলী হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,”তুই ঠিক দেখেছিস?”
    হরি আরও জোর দিয়ে বললো,”মা কালীর দিব্যি বলছি বাবু! আমি যা দেখেছি একদম সত্যি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না আপনাকে।” ইন্দ্রজিৎ বাবু কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে যেন খুব উৎসাহ পেলেন এবং মনে মনে ভাবতে লাগলেন,”হুঁ-হুঁ বাবা,এতদিনের সাধনা, না এসে যাবে কোথায়!” এবার হরির পিঠে হাত রেখে বললেন,”বোকা কোথাকার! কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে!–ভয় নেই !ভয় নেই! ওসব কিচ্ছু না –তোর চোখের ভুল।”
    হরি বললো,”না বাবু চোখের ভুল নয় আমি দেখেছি–আমার খুব ভয় করছে বাবু।”
    ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে নিয়ে নিজের বেড রুমে প্রবেশ করলেন। তারপর হরিকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। তিনি নিজে হরির সামনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই কাগজে মোড়া কি যেন একটা জিনিষ ড্রয়ার থেকে বের করে হরির আপাদমস্তক কয়েকবার বুলিয়ে তারই কিছুটা অংশ একটা লাল কাপড়ে বেঁধে হরির ডান হাতে বেঁধে দিয়ে বললেন,”যা রে ক্ষ্যাপা তোর আর কোনো ভয় নেই,এই লালকাপড় যতক্ষণ তোর হাতে বাঁধা থাকবে দুনিয়ার কোনো অশুভ শক্তিই তোর চুল স্পর্শ করতে পারবে না। দেখবি এই লাল কাপড় যেন কখনো,কোনো অবস্থাতেই খুলে না যায়?”
    হরির মাথাতে বিন্দু বিসর্গ কিছূই ঢুকলো না, শুধু মাথা নেড়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো।

    তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে এখন হরির আর তেমন ভয় টয় করে না। হরি মনে মনে একটা বিরাট সাহস পেয়েছে–ঐ যে হাতে তার মন্ত্রপুত লালকাপড়ের টুকরো! হরি সারাদিনে কতবার যে ডানহাতের কনুইয়ের উপর বাঁধা ঐ লাল কাপড়ের টুকরোটি যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখে কে জানে! ওটিই যেন এখন তার প্রাণভমরা। তবে হরির মনে একটা ব্যাপার খুব খচ্ খচ্ করতে লাগলো; আর তা হলো তার মালিক অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর উপচিকিৎসাবিদ্যার উপর বিশ্বাস ও তা করায়ত্ত করার রহস্য। কারণ আজ প্রায় ছয়-সাত বছর হলো সে এখানে রাঁধুনির কাজ করে আসছে। বাবুর এ হেন গুণের পরিচয় সে ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন টের পায়নি,আর সেদিনকার মতো অমন অদ্ভুত ঘটনাও ঘটেনি এর আগে কোনোদিন-এতক্ষণ কুয়োর ধারে সুপারি গাছটায় হেলান দিয়ে এইসব কত কি যে সে ভাবতে লাগলো মনে মনে তার ইয়ত্তা নেই। ততক্ষণে গজা যে পা টিপে টিপে তার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরও পায়নি।
    হঠাৎ গজা বলে উঠলো,”কি গো হরিকা কি ভাবতেছ?কাকীমার কথা বুঝি?”
    হরি খেঁকিয়ে উঠে বললো,”দুর হ এখান থেকে!দুর হ! হতভাগা কোথাকার। কথার কেমন ছিরি দেখো?”
    গজা চোখ বড় বড় করে বললো,”কাকা, বাগানের বাঁধানো আমগাছে ভুত আছে গো!ভু–ত!”
    হরি একবার চারদিক দেখে নিয়ে বললো,”তুই দেখেছিস?”

    “দেখেছি মানে! ভুতের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেছি –ভুত আমাকে বলেছে ভর সন্ধ্যাবেলা তার কাছে গেলে সে এমনকি এই ফাগুনমাসেই পাকা আম খাওয়াবে।” কথাটা বলেই গজা হি-হি করে বিচ্ছিরি একটা হাসি হাসতে হাসতে এক ছুটে ফটকের বাইরে চলে গেলো।হরিরও যে হাসি পাইনি তা নয়, তবে হাসতে গিয়েই মুখ ফিরিয়ে দেখলো দোতালার জানালায় ইন্দ্রজিৎ বাবু–তাকেই যেন ইশারা করে ডাকছেন। হরি তৎক্ষণাৎ দোতালায় ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে দেখলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর হাতে একটা একহাত প্রমাণ কাঁচের পুতুল। পুতুলটা দেখেই হরির ভেতরে যেন একটা রহস্যের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো, সে মনে মনে ভাবলো, আরে! এ তো কয়েকদিন আগে অন্ধকারে বাগানের মধ্যে দেখা সেই ছায়ামূর্তিটারই অবিকল মূর্ত্ত প্রতীক–একদম হুবহু মিল। হরিকে দেখে ইন্দ্রজিৎ বাবু পুতুলটা একটা কালো কাপড়ে জড়িয়ে রেখে দিলেন আলমারীর ভেতরে। পুতুলটা দেখে হরির যে কোনোপ্রকার ভাবান্তর হতে পারে–তা একবারও মনে হলো না ইন্দ্রজিৎ বাবুর। তারপর হরির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,”হরি, আজ সন্ধ্যা বেলা রমেনবাবু আসবে,বুঝলি?” কথাগুলো শুনে মনে হলো আজ রমেন বাবুর এখানে আসার যেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।
    হরি কিছু একটা জিজ্ঞাসা করবে ভাবছিলো কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারলো না।মনে মনে একটা আতঙ্ক মিশ্রিত উদ্বেগ নিয়েই সে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলো।

    সন্ধ্যাবেলা যথারীতি রমেন বাবু এসে হাজির হলেন। ঘড়িতে তখন সাতটা ছুঁই ছুঁই। রমেন বাবুর কাঁধে দেখা গেল একটা শান্তিনিকেতন মার্কা সাইডব্যাগ আর ডান হাতে একটা চটের বড়থলে। থলেটার মধ্যে যে ভারী কোনো জিনিস আছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। গেট থেকে একটু দূরে রিক্সা থেকে নেমে এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে আসছিলেন। গেটের দরজায় এসে কড়া নাড়লেন —-হরি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে তাকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে এলো। রমেনবাবু বারান্দায় পা দিয়েই মনে হয় ইন্দ্রজিৎ বাবুর খোঁজ নিলেন, হরি হাত তুলে রমেন বাবুকে দোতালায় উঠে যাবার ইশারা করলো। রমেনবাবুও আর কোনো কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে গেলেন দোতালার বারান্দায়। ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন এতক্ষণ তাঁরই অপেক্ষা করছিলেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রমেনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন তাঁর বেডরুমে। তারপর সশব্দে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের ভেতর থেকে দু’জনেরই চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
    নিশ্চয় এমন কোনো গোপন আলোচনা, যা সাবধানতা অবলম্বন না করে আলোচনা করা যায় না।
    মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকপর ইন্দ্রজিৎ বাবুকে দেখা গেল দরজা খুলে বাইরে আসতে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে একদম হরির ঘরে এসে প্রবেশ করলেন। হরি তখন সবেমাত্র রান্নার কাজ শেষ করে –কার যেন একটা চিঠি পড়তে আরম্ভ করেছে। ইন্দ্রজিৎ বাবুকে ঢুকতে দেখেই হরি তক্তাপোষ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বললো,”আসুন বাবু আসুন।” বলেই সে চিঠি খানা বিছানার নীচে গুঁজে রাখলো। ইন্দ্রজিৎ বাবু বললেন,”কিরে কি পড়ছিলি?চিঠি নাকি? কার চিঠি?”
    হরি ঘাড় নাড়িয়ে যা বললো, তা অনেকটা এইরকম যে– তার স্ত্রী তাকে চিঠিতে একবার গ্রামের বাড়িতে দিন চারেকের জন্য যেতে লিখেছে। এভাবেই মাঝে মাঝে হরির চিঠি আসতো, আর চিঠি এলেই হরির কমসে কম দু/তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর হতো। কারণ মাঝে মাঝে হরির অনুপস্থিতিটা ইন্দরজিৎবাবুর বড় কাজে লেগে যেত। ইন্দ্রজিৎবাবু এবারও তাই হরির যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন এবং উপরের ঘরে রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার বরাত দিয়ে ধীরে ধীরে হরির ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠে গেলেন দোতালায়।
    যাই হোক রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে রমেনবাবুকে বন্ধ তিনটে ঘরের একটা খুলে দেওয়া হলো। এখানে এলে এই ঘরেই তিনি প্রত্যেকবার রাত কাটান। অতএব, তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করলেন না। এবার বলি রমেন পুরকায়স্থের এ বাড়িতে মাঝে মাঝে আসার কারণটা—ভদ্রলোক প্রচণ্ড বিষয়ী তাই পেনশন ছাড়াও দু’পয়সা উপরি কামাতে তিনি অনেক কিছুরই দালালী করে থাকেন। প্রয়োজনে কাস্টমারের বাড়িতেও অর্ডার মতো মাল পৌঁছে দেন। এমনকি তিনি কাজের লোকও মফস্বল বা গ্রাম থেকে জোগাড় করে দিতে পারেন।ইন্দ্রজিৎ বাবুকে তিনি মাঝে মাঝেই ব্যাঙ, সাপ, গিরগিটি, গিনিপিগ, খরগোশ ইত্যাদি প্রাণী কাঁচের জারে পুরে এনে দিতেন, তাছাড়া দামী দামী দেশী বিদেশী গ্রন্থ তো আছেই। সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসটি তিনি অত্যন্ত গোপনে গভীর রাতে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসতেন–তা হলো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের লাশ।এরজন্য অবশ্য মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর কাছ থেকে। এই কারণেই এবাড়িতে রমেন বাবুর এতো খাতির যত্ন। রমেন বাবু লোকটা যে একটা বাস্তুঘুঘু তা তার হাবভাবেই বোঝা যায়।

    যাইহোক, রমেনবাবু দরজা বন্ধ করে রুমের নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লেন। অনেকটা রাস্তা জার্ণি করে এসেছেন। শুয়ে শুয়ে কি যেন ভাবছেন।ঘড়ির ঘন্টা জানান দিলো রাত এগারটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। চারদিকে একটা জমাট নিস্তব্ধতা বাড়িটাকে যেন চেপে ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রেতপুরী,বাগানের ঘন অন্ধকারে যেন অসংখ্য অশরীরী এসে দাঁড়িয়েছে, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দে সাড়া বাড়িটা যেন দুলছে। হঠাৎ কিসের যেন একটা আওয়াজে রমেন বাবুর ঘুম ভেঙে গেলো। জলের বোতল থেকে একটু জল খেয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন শব্দটা কিসের?এর আগেও এ বাড়িতে তিনি রাত্রিবাস করেছেন। রাতে অনেক অস্বাভাবিক শব্দই তার কানে এসেছে; তবে আজকের শব্দটা যেন একটু আলাদা—তিনি কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন।মনে হলো কেউ যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ভারী ভারী পা ফেলে। এবার তিনি উঠে দরজার পাল্লাদুটো একটু ফাঁক করে যা দেখলেন —তাতে তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফের মতো ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে লাগলো—তিনি দেখলেন একটা আপাদমস্তক বোরখা পরা ছায়ামূর্তি বারান্দার অন্ধকার পেরিয়ে ল্যাবেরেটরি রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তিনি চিৎকার করতে যেতেই বুঝলেন তাঁর গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। তবুও তিনি চোখ সরালেন না। অবশেষে দেখলেন সেই ছায়ামূর্তি যেন দরজায় মিলিয়ে গেলো। তারপর সারারাত তিনি দুইচোখের পাতা এক করতে পারলেন না,অর্থাৎ সারারাত একরকম না ঘুমিয়েই কাটালেন।পরদিন সকাল বেলা চা খেতে খেতে ইন্দ্রজিৎ বাবুকে ঘটনাটা জানালেন–ইন্দ্রজিৎ বাবু ঘটনাটা রমেনবাবুর হেলুসিনেশন্ বলে উড়িয়ে দিলেও তিনি নিজে জানেন এ ঘটনার সূত্রপাত কোথায়? রমেন বাবুও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর রাস্তা ধরেই। একটু পর দেখা গেলো রমেন বাবু বাড়ির ফটক পেরিয়ে তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
    এই ঘটনার প্রায় সাতদিন পর ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে চারদিনের জন্য ছুটিতে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। গজা এই চারদিন হোটেল থেকে তাঁর জন্য দিনে ও রাতে খাবার নিয়ে আসবে, তেমন কথা হয়েছে গজার সঙ্গে হরির।
    পরের দিন গজা রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার পর ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন কোনো এক আগন্তুকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাতের খাবার পর্ব যেন-তেন প্রকারে সমাধা করলেন। রাত যখন বেশ গভীর হয়ে এলো –ওয়াল ক্লক আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো রাত একটা, তখন গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা অ্যাম্বাস্যাডার–ইন্দ্রজিৎ বাবু গাড়ির শব্দ শুনেই গেটের দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকলো রমেন পুরকায়স্থ সঙ্গে ছোট্ট একটা চার পাঁচ বছরের মেয়ে। মেয়েটির গায়ে শতছিন্ন একটা ময়লা ফ্রক ও পায়জামা গোছের কিছু একটা। তাকে প্রচণ্ড ভয় দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে –তা বোঝা গেল তার চোখে মূখে একটা আতঙ্কের আস্তরণ অনুভব করে। গাড়িটা গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে।মেয়েটাকে নিয়ে রমেন ও ইন্দ্রজিৎ বাবু একদম দোতালায় ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে গেলো। ল্যাবেরেটরির দরজা বন্ধ হলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু মেয়েটার ডানহাতে কোকেন জাতীয় চেতনা নাশক কোনো ইঞ্জেকশন্ প্রয়োগ করে মেয়েটিকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিলেন।আবার দরজা খুলে গেল, ততক্ষণে রমেন পুরকায়স্থ তার পাওনা বুঝে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যেতে লাগলো সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বাবু। তাদের দু’জনের চোখেই দেখা যাচ্ছিল হিংস্রতা। রমেন বাবু গাড়িতে চাপলেন ও ইন্দ্রজিৎ বাবুকে হাত ইশারা করলেন, ইন্দ্রজিৎ বাবু তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতেই গাড়িটা চোখের নিমেষে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু গেটটা ভালো ভাবে বন্ধ করে উঠে এলেন বারান্দায়। তারপর গ্রাউন্ডফ্লোরর দরজায় তালা লাগিয়ে উঠে গেলেন দোতালায়। ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। দেখলেন মেয়েটা টেবিলের উপর ততক্ষণে সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এবার এগিয়ে গেলেন আলমারীর দিকে, কালোকাপড়ে মোড়া সেই পুতুলটা বার করে নিয়ে এলেন এবং সেই পঞ্চকোণের ছবিটা। তারপর ওই দুটোকে সাজিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। হুইস্কির বোতল খুলে সমস্তটায় ঢেলে নিলেন গলায়—সারাঘর অন্ধকার কেবলমাত্র একটা মোমবাতি জ্বলছে টিমটিম করে, সারাঘরে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কয়ছে—হঠাৎ পঞ্চকোণটা রক্তের মতো লাল হয়ে উঠলো–পুতূলের পেছনে এসে দাঁড়ালো আর এক ছায়া মূর্তি তার হাতে জলন্ত লৌহশলাকা। গোটা বাড়িটা এখন প্রেতলোকের চাদর জড়িয়ে যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে–ইন্দ্রজিৎ বাবু টলতে টলতে হাতে তুলে নিলেন শাণিত ছুরি তারপর টেবিলের উপর শায়িত উলঙ্গ অচৈতন্য ছোট্ট মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। হঠাৎ এক সময় হিংস্র শ্বাপদের মতো বুক চিরে বার করে নিয়ে এলেন একটা মাংসপিন্ড—আবছা আলোয় দেখা গেলো মাংসপিণ্ডটা নড়ছে –ওটা হৎপিন্ড তখনও ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে আসছে ওটা থেকে।মেয়েটার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে আর সেই রক্তপান করে চলেছে সেই ছায়ামূর্তির সঙ্গে আরো অসংখ্য ছায়া মূর্তি। আজ এ বাড়িতে যেন শুরু হয়েছে প্রেতপার্বণ। অবশেষে হৃৎপিণ্ডটাও ইন্দ্রজিৎ বাবু তুলে দিলেন ঐ ছায়ামূর্তির হাতে। ছায়ামূর্তি সেই হৃৎপিণ্ড যেন লুকিয়ে নিলো নিজের ছায়াশরীরে। ঠিক তখনই বাইরে শোনা গেল প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রপাতের আওয়াজ। ঝড়ের দাপটে জানালার একটা পাল্লা খুলে যেতেই বিদ্যূতের একটা ঝলকানি জানালা দিয়ে ঢুকে মিলিয়ে গেলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর বুকে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মেঝের উপর। সময় ততক্ষণে গড়িয়ে গেছে অনেকটাই। হঠাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর জ্ঞান ফিরতেই তিনি দেখলেন সেই ঘরে পঞ্চকোণের ছবি এবং সেই পুতুলটা উধাও হয়ে গেছে। প‍রিবর্তে সেখানে পড়ে রয়েছে ইংরাজীর ওয়াই আকৃতির একটা রুপোর দণ্ড এবং একটা কালো চামড়ায় মোড়া বই। তিনি সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পারলেন। রুপোর দন্ড ও চামড়ায় মোড়া বইটা তুলে রাখলেন আলমারীর ভেতরে গোপন একটা জায়গায়। হঠাৎ তার নজরে পড়লো মেয়েটার লাশ। লাশটা দু’হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন একদম গ্রাউন্ডফ্লোরে তখনও চলছে ঝড় ও জলের তান্ডব। ইন্দ্রজিৎ বাবু অনেক কষ্টে বাগানের এক কোণে গর্ত খুঁড়ে নরম মাটির একদম গভীরে পুঁতে ফেললেন লাশটাকে। তারপর সেখান থেকে অতি দ্রুত উঠে এলেন ল্যাবরেটরি রুমে। এসে দেখলেন কোথাও এক ফোঁটা রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। চারদিক একদম আগের মতোই পরিস্কার। পরেরদিন সকালে ইন্দ্রজিৎ বাবু টের পেলেন যে তাঁর শরীরে যেন কি একটা অলৌকিক শক্তি এসে বাসা বেঁধেছে। আরও একটা ঘটনা তিনি সেদিনের পর থেকে লক্ষ্য করতে লাগলেন আর তা হলো স্যামসনকে নিয়ে। ইন্দ্রজিৎ বাবু প্রায়ই লক্ষ্য করতেন স্যামসন বাগানের সেই বিতর্কিত কোণটির এক পাশে চুপ করে বসে আছে আর কেউ যেন অদৃশ্য থেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তারপর স্যামসনকে অধিকাংশ সময়েই চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হতো দোতালার বারান্দায়–ইন্দ্রজিৎ বাবু লক্ষ্য করলেন ধীরে ধীরে স্যামসনের মধ্যে যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে আসছে।

    দু’দিন পরেই হরি ফিরে এসে দেখলো তার মালিকের বয়সটা যেন হঠাৎই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অনেকটা কমে গিয়েছে- চোখ দু’টোতে একটা নীলচে আভা। হরি মনে মনে ভাবলো এমন চেহারা সে আগেতো কোনো দিন দেখেনি–হরির ঘটনাটা রহস্যময় বলেই মনে হতে লাগলো।

    তারপর প্রায় একমাস কেটে গেছে এখন অবশ্য ল্যাবেরেটরি রুমটা তালা বন্ধই থাকে। ইন্দ্রজিৎ বাবু আর নীচে নামেন না বললেই চলে। ইন্দ্রজিৎ বাবু তাঁর সেই অলৌকিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত প্রকার ইন্দ্রিয়জ সুখ উপভোগ করতে লাগলেন নিশুতি রাতের নির্জনতাকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু সেদিন রাত্রে ঘটলো একটা আশ্চর্য ঘটনা—ইন্দ্রজিৎ বাবু খাওয়া দাওয়া সেরে তার বিছানায় চোখ মুজে শুয়ে আছেন, হরি আছে তার নিজের ঘরে–রাত তখন বারোটার বেশী হবে না বোধহয়! এখন প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘুম আসেনা। উনি ঘুমের ঔষধ ব্যবহার করেন মদের সঙ্গে তবুও অনেকক্ষণ জেগে থাকেন—জেগে থাকেন বললে ভুল হবে, কে যেন তাকে জোড় করে জাগিয়ে রাখে। ইন্দ্রজিৎ বাবুকে একটা কৌতূহল পেয়ে বসলো–তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরি রুমের দরজায়। পকেট থেকে চাবি বার করে খুলে ফেললেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সেই ল্যাবেরেটরি রুমটা। রুমটা খুলতেই তার নাকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে ভেতরটা গুলিয়ে দিলো। তারপর তিনি সেই অন্ধকারে যা দেখলেন তা অত্যন্ত ভয়ংকর, তিনি দেখলেন সেই মেয়েটি শুয়ে আছে টেবিলের উপর —ইন্দ্রজিৎ বাবু কিছুক্ষণ সেখানেই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ দ্রুত বাইরে বেরিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করেই তালাটা লাগিয়ে দিলেন। নিজের ঘরে দ্রুত ফিরে এসে দরজা বন্ধ করলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়লো ঘরের এককোণে রাখা টেবিলের দিকে দেখলেন সেখানেও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মেয়েটি, বুকটা একবারে হাঁ হয়ে আছে আর ফিং দিয়ে রক্ত ছুটছে, তিনি বেশীক্ষণ আর সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না –একটা বিকট চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন।
    এদিকে হরি মনে হয় তাঁর চিৎকার শুনতে পেয়েছিলো–সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে ঢুকতেই দেখলো তার মালিক ইন্দ্রজিৎ বাবু মেঝের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না হরি। একটু পর সে জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখে মুখে ছেটাতেই মনে হলো তাঁর ঠোঁটগুলো যেন একটু একটু নড়ছে।তারপর আরও একঘন্টা কেটে গেলো–এবার যেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখদুটো একটু খুললো। সে রাতটা ঐ ভাবেই কাটলো। পরের দিন ইন্দ্রজিৎ বাবু একটু বেলার দিকে যথারীতি সুস্থ হয়ে উঠলেও ঘুণাক্ষরেেও কাল রাতের ঘটনা হরিকে জানালো না। হরিকে তিনি তার ঐ অবস্থার কারণ স্বরূপ একটা আদত মিথ্যা কথা বললেন। সেইদিনই দুপুরে টেলিফোনে ইন্দ্রজিৎ বাবু একটা সুসংবাদ পেলেন–তাঁর ছোটো ছেলের স্ত্রী দীর্ঘদিন পর সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। ইন্দ্রজিৎ বাবুর আনন্দ আর ধরে না। এ সংবাদ বহু প্রতীক্ষিত।
    আনন্দে বিহ্বল হয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবু সেদিন বাইরে বেড়াতে গেলেন হরিকে সঙ্গে নিয়ে –শ্মশান ছাড়িয়ে খোলামাঠে দু’জনে অনেকক্ষণ গল্পগুজবে এত মশগুল রইলেন যে –কখন যে গুটি গুটি পায়ে সন্ধ্যা নেমেছে তা টেরই পেলেননা।হঠাৎ হরি বললো ,”বাবু, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন, ঐ দেখুন!মেঘ করেছে! এখুনি হয়তো ঝড় উঠবে।”
    তারা বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু বেশীদুর এগোতে পারলো না। শ্মশানের কাছাকাছি একটা পোড়ো বাড়ি ছিলো। অগত্যা তারা দু’জনে আশ্রয় নিলো ঐ বাড়িটার মধ্যে। চারদিকে ততক্ষণে শুরু হয়েছে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ও ঝড়–থেকে থেকে বজ্রপাতের চোখরাঙানি। হরি তো ভয়ে একেবারে আধখানা হয়ে গেছে। কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠলো দু’জনেই। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় ইন্দ্রজিৎ বাবু দেখলেন সেই পোড়ো বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে যেন একটা ছোট্ট মেয়ে, ইন্দ্রজিৎ বাবু আবার ভালোভাবে নজর করে দেখতেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সেই ছায়াশরীর। তিনি ঘটনাটা ততক্ষণে বুঝে গেছেন। হরি কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। সেদিন প্রায় অনেকটা রাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো ইন্দ্রজিৎ বাবু ও হরিকে। ইন্দ্রজিৎ বাবুর মনে শান্তি নেই।দিনের পর দিন তার সেই অলৌকিক শক্তির অপব্যবহারের ফলে কোনো এক বিপ‍রীত শক্তি তার শরীরকে যেন ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে—এটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিলেন। তাই চোখে মুখে একটা আতঙ্ক তাকে যেন গ্রাস করতে চাইছে।
    একদিন সন্ধ্যা বেলা হরি কি যেন একটা কাজে বাগানে যেতেই চোখ পড়লো বাগানের এককোণে। দেখলো একটা ছোট্ট মেয়ে যেন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটু এগিয়ে যেতেই যা দেখলো তাতে হরির প্রাণপাখি উড়ে যাবার জোগাড়। দেখলো দু’হাত মতো একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে বড় আমগাছের নীচে আর তাকে সেই লিকলিকে হাড়ের আঙ্গুল নাড়িয়ে ডাকছে। হরি ভয়ে পিছতে পিছতে শুনতে পেলো একটা হাড়হিম করা চাপা হাসি। সে প্রায় ছুটেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন।

    তারপর কেটে গেছে সাত সাতটা বছর। এখন আর এবাড়িতে রমেন বাবুও আসেন না। একদিন খবরের কাগজে একটা সংবাদ পাওয়া গেলো–সংবাদটা এইরকম যে গঙ্গা বক্ষে চলন্ত স্টীমার থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এক ভদ্রলোক, পুলিশ অবশেষে তার দেহটি খুঁজে পায় ও তার পরিচয় ও জানতে পারে–ভদ্রলোক সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ল্যাবরেটরি আসিস্ট্যান্ট ছিলেন, পুলিশ আরও জানিয়েছে যে ঐ ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, ভদ্রলোকের নাম–রমেন পুরকায়স্থ। এখন হরিও আর এ বাড়িতে রাধুঁনির কাজ করে না। সে চরম ভয় পেয়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে পালিয়েছে কাউকে কিছু না বলে।গ্রামের ছেলে গজাও কোথায় ভিনরাজ্যে ভালো বেতনের লোভে পাড়ি দিয়েছে ।আর স্যামসন?—একদিন রাতে স্যামসনের লাশ পাওয়া গেলো বাগানেরই একটা কোণে। স্যামসনের শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খারাপ যাচ্ছিল। সে নাকি প্রতিদিন রাত্রে বাগানের দিকে চেয়ে থাকতো আর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। ইন্দ্রজিৎ বাবু এখন একদম একা, একটা চরম পরিণতির জন্য যেন অপেক্ষা করে আছেন। তাঁর কাছে এখন থাকে একজন বিহারী রাঁধুনি সেই-ই সব দেখাশোনা করে।ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো ছেলে অরিজিৎ-ই একদিন ফোন মারফৎ সবকিছু অবগত হয়ে ঐ বিহারী যুবকটির হাতে তার বাবার সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলো। সেও আজ প্রায় সাত বছর আগের কথা।
    একদিন একটা বুলেরো গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়িটার গেটে। গাড়ি থেকে নামলো একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে তারই হাত ধরে নামলো একটি সুন্দরী যুবতী ও সৌম্যদর্শন এক যুবক। ঐ যুবকটি হলো অরিজিৎ, ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো ছেলে আর ঐ যুবতী হলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো পুত্রবধূ ইশিতা। ঐ যে ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি! ও হলো অরিজিৎ-এর একমাত্র কন্যা–“তৃষা”, অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর নাতনি।ছেলে, বৌ আর নাতনিকে কয়েক দিনের জন্য কাছে পেয়ে –ইন্দ্রজিৎ বাবুর বাঁচার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠলো–কি আনন্দ! কি আনন্দ!

    কিন্তু দুর্ঘটনাটা ঘটলো সেদিন বিকালে। অরিজিৎ ও ঈশিতা যখন ফুলের বাগিচার ধারে দাঁড়িয়ে গল্পগুজবে ও ঠাট্টা তামাশায় একবারে মশগুল। ততক্ষণে তৃষা গ্রাউন্ডফ্লোরর বারান্দার বাগানের দিকের গেটটা খুলে পৌঁছে গেছে বাগানের সেই কোনাটায়।
    এদিকে অনেকক্ষণ তৃষার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঈশিতার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতেই ব্যাপারটা অরিজিৎকে জানালো। তৃষার নাম ধ‍রে জোরে জোরে ওরা দু’জনেই ডাকতে লাগলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেলনা। ইশিতা তো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে রীতিমতো। অরিজিৎ ও সেই বিহারী রাঁধুনি রামলাল ততক্ষণে তৃষার খোঁজ আরম্ভ ক‍রে দিয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে দেখলো তৃষা পড়ে রয়েছে বাগানের একটা আমগাছের নীচে। সেখান থেকে অরিজিৎই কোলে করে নিয়ে আসে তৃষার অচৈতন্য দেহ। অরিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ চৌধুরীকে ফোন করলো। আধঘন্টার ভেতরে ডাঃ চৌধুরী এসে তৃষাকে পরীক্ষা করে জানালো ভয়ের কিছু নেই। তৃষা বাগানে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। একটু সাবধানে রাখলেই হবে এবং যাবার আগে ডাঃ চৌধুরী বললেন, “ওকে কোনো ভাবেই বাগানে যেতে দেবেন না যেন, কারণ ভয়ের উৎস ওখানেই কোনো জায়গায় লুকিয়ে রয়েছে।”
    সেদিন রাত্রে অরিজিৎ ও ঈশিতা দু’জনেই দুই চোখের পাতা এক করেনি। পরেরদিন সকাল থেকেই অবশ্য তৃষা বেশ আগের মতোই চনমনে হয়ে উঠলো। হঠাৎ ছুটে সে ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে গিয়ে হাজির হলো ইন্দ্রজিৎ বাবু অবাক হয়ে তৃষাকে দেখতে লাগলেন, আর মনে মনে বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন,”হ্যাঁ এই তো সেই! -এই তো সেই! –এসেছে!– আবার ফিরে এসেছে।” ইন্দ্রজিৎ বাবু ইশারায় তৃষাকে কাছে ডেকে তৃষার বুক খুলে দেখলেন বুকের উপর একটা লম্বালম্বি কালো দাগ–কেউ যেন বহুদিন আগে ছুড়ি দিয়ে কেটেছিলো জায়গটা। ইন্দ্রজিৎ বাবু নিজের ভবিতব্য বুঝতে পারলেন।তিনি একটা সাদা কাগজে কি যেন লিখে বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখলেন।
    আর সেই অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনাটাও ঘটলো সেদিন সন্ধ্যাতেই। অরিজিৎ ও ঈশিতা যখন কিচেনে ঐ বিহারী রাঁধুনিটিকে কি যেন বিদেশী রান্না শেখাচ্ছিলো। হঠাৎ তাদের কানে একটা চাপা গোঙানির শব্দ এসে পৌছালো–তারা সকলেই ছুটে দোতালায় ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে ঢুকেই দেখলো সেই ভয়ংকর দৃশ্য–দেখলো তৃষা প্রচণ্ড প্রতিহিংসায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ইন্দ্রজিৎ বাবুর গলা, তৃষার সে কি ভয়ংকর মূর্তি মনে হচ্ছে এ যেন তৃষা নয় ওর দেহে প্রবেশ করেছে কোনো অশরীরী শক্তি চোখগুলো মণিহীন–তাদের পা যেন সেই সিমেন্টের মেঝেতে আটকে গেছে, তারা অসহায়ের মতো দেখতে লাগলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর মৃত্যু যন্ত্রণা– দুই কান,নাক আর কষ বেয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কিছুক্ষণ পর ইন্দ্রজিৎ বাবুর দেহটা নিথর হয়ে গেলো। তৃষার দেহ থেকে একটা নীলচে আলো হঠাৎ বেরিয়ে এসে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো তীরের ফলার মতো তারপর মিলিয়ে গেলো বাগানের অন্ধকারে। তারা দেখলো তৃষা ইন্দ্রজিৎ বাবুর বুকের উপর পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে।ঈশিতা তৃষাকে সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।অরিজিৎ কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ বালিশের নীচ থেকে ইন্দ্রজিৎ বাবুর লেখা চিঠিটা খুঁজে পেলো অরিজিৎ।অরিজিৎ চিঠিটা খুলে দেখলো তাতে লেখা রয়েছে–“পরীক্ষিত সত্য! জন্মান্তরে প্রতিহিংসা শরীর ধারণ করে। আমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই এ চিঠি লিখছি। এরপরে এ বাড়িতে তোমরা আর কেউ থেকো না। এ বাড়ি একটা জলন্ত অভিশাপ।—ইতি আশীর্বাদক,তোমাদের হতভাগ্য পিতা।”
    সমস্ত ঘটনা গোপন করে ইন্দ্রজিৎ বাবুর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এ বাড়িতেই। তবে এই অনুষ্ঠানে ইন্দ্রজিৎ বাবুর বড়ছেলে শুভজিৎ অংশগ্রহণ করেনি, যদিও তার স্ত্রী, একছেলে ও দুইমেয়ে উপস্থিত ছিলো শেষপর্যন্ত।

    তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এখন এই অভিশপ্ত বাড়িতে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই।মহাকাল ধীরে ধীরে গ্রাস করে চলেছে এ বাড়ির অস্তিত্ব।অন্ধকার নামলেই শোনা যায় কালপেঁচা আর ঝিঁঝিঁর একটানা তীক্ষ্ণ ডাকের সঙ্গে অশরীরীদের হা হুতাশ।

  • ভৌতিক গল্প

    গুপ্তধন

    গুপ্তধন
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

    (১)
    কলকাতার একটি হাসপাতালের নামী কার্ডিওলজিস্ট, ডা: সুকল্যাণ বর্মণের চেম্বারে ভীত ত্রস্ত হয়ে বসেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব অসীম বাবু।

    অসীম বাবুর কুড়ি বছরের ছেলে শুভাশিস গত এক দুই দিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি। শুভাশিসের হৃদয়ে জন্ম থেকেই একটি ফুটো বিরাজমান, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় Atrial Septal Defect. ছোটবেলা থেকেই বেশ কয়েকবার নানা শারীরিক অসুস্থতার শিকার হতে হয় তাকে, তারপরই তার দেহে ধরা পড়ে এই ভয়াবহ রোগ। তবুও ওষুধপত্রের ওপর নির্ভর করে জীবনের বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত করলেও, দুই দিন আগেই মাত্র কুড়ি বছর বয়সী এই যুবকের হৃদ-যন্ত্র সাময়িক ভাবে বিকল হয়ে যায়। সেদিন থেকেই সে ভর্তি এই হাসপাতালে।

    ছেলেকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন অসীম বাবু। তাকে নিয়ে সে তার অনেক স্বপ্ন। তাই তো নিজে একজন সামান্য একটি বেসরকারী সংস্থার কর্মচারী হয়েও, যথাসাধ্য পয়সা খরচা করে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন একটি নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। অসীম বাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় চার বছর আগে, তার পরিবার বলতে শুধু ছেলে শুভাশিস এবং তার বিরাশি বছরের বৃদ্ধ পিতা কালীপদ বাবু। এদের নিয়েই উত্তর কলকাতার একটি রঙ চটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে সংসার তার।

    ছেলেকে নিয়ে নানা চিন্তায় ভোগেন অসীম বাবু। হৃদয়ের ওই রোগটা ধরা পড়ার শুভাশিসের কিছু মনস্তাত্বিক সমস্যাও শুরু হয়েছে।

    “জানো তো বাবা, তুমি আর দাদুকে ছাড়া এই বাড়িতে আমি মাঝে মাঝেই আরেকজন ব্যক্তিকে দেখতে পাই…সে সবসময় তোমার আশে পাশেই ঘোরে…কি যেন একটা কথা বলতে চায় তোমাকে!”

    প্রতিনিয়ত ছেলের এই কথাগুলো তার মনের নিরর্থক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিলেও, একবারের জন্যও যে তার গা ছমছম করে ওঠেনি, এমন নয়!

    “অসীম বাবু, আমার মনে হয় এভাবে আর শুভাশিসকে বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না…”, ডা: বর্মণের কথায় চিন্তার ঘোর কাটলো অসীম বাবুর, “এবার কিন্তু সার্জারিটা না করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে আপনার ছেলের!”

    “আপনি তো জানেনই স্যার, ওই সার্জারির জন্য দরকার দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা! কিন্তু আমার যা অবস্থা তাতে…”, সংকুচিত মুখে বলে উঠলেন অসীম বাবু, তবে কথাটা শেষ করার আগেই কান্নায় আটকে গেল তার গলা।

    “আমি জানি অসীম বাবু, কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও যে দেখতে পাচ্ছি না!” অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলেন ডা: বর্মণ, “ছেলেকে বাঁচাতে গেলে আপনাকে যে ভাবেই হোক টাকাটা জোগাড় করতেই হবে! সত্যি কথা বলতে গেলে এই যাত্রাই যে আমরা শুভাশিসকে বাঁচাতে পারবো, এটাই ছিলো আমাদের কল্পনাতীত! কয়েক ঘন্টার জন্য তো মনে হয়েছিলো যে সে আমাদের ছেড়ে চলেই গিয়েছে! কিন্তু খুব আশ্চর্যজনক ভাবে তারপরই আবার ওঠানামা করতে লাগলো ই.সি.জি-র স্থির হয়ে যাওয়া লাইন! এই ধরণের Near Death Experience কিন্তু খুব কম পেশেন্টদেরই হয়…”

    তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই চেম্বারে প্রবেশ করলেন একজন নার্স। তিনি জানালেন যে শুভাশিসের জ্ঞান ফিরেছে, এবং সে তার বাবার সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অগত্যা এই আলোচনার ইতি এখানেই টানতে হল। অসীম বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন তার ছেলের বেডের উদ্দেশ্যে।

    (২)
    চিকিৎসার জন্য দরকারী হাজারো সরঞ্জামের মাঝে, বিছানায় শুয়ে বড় বড় চোখ মেলে শুভাশিস চেয়েছিলো তার বাবার পরিশ্রান্ত মুখের দিকে। অসীম বাবু জল ভরা চোখে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন শুভাশিসের উস্কোখুস্কো চুলের মাঝে।

    “খোকা…কেমন আছিস খোকা?” কম্পিত গলায় বলে উঠলেন অসীম বাবু।

    “আমি আবার সেই লোকটাকে দেখেছি, জানো তো বাবা!”, উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দিলো শুভাশিস।

    এই সময় ছেলের মুখে সবার আগে এই কথা শোনা একেবারেই আশা করেননি অসীম বাবু। তিনি শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন শুভাশিসের মুখের পানে। কেন জানি না, তার মন তাকে বার বার বারণ করতে লাগলো এবারও তার এই কথাগুলো নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে।

    “কি দেখেছিস তুই, খোকা?” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন অসীম বাবু।

    “প্রথমে মনে হল একটা মস্ত বড় সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে একা একা চলেছি আমি…চারিদিকে ঘোর অন্ধকার!” উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো শুভাশিসের কন্ঠ, “কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম সুড়ঙ্গের ওই প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে চোখ ধাঁধানো আলো! আমি যেন দু’চোখ হাত দিয়ে ঢেকে আরো জোর কদমে ছুটে চললাম সেই দিকে। এরপর বুঝতে পারলাম ওই আলোর কারণ, যা আসছে সুড়ঙ্গের অপর মুখ থেকে। আমি এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম সুড়ঙ্গের বাইরে!…সেখানে তখন রৌদ্রজ্বল দিন, আমি যেন একটা জঙ্গলের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছি…”

    কিছুক্ষণ থামলো শুভাশিস। অসীম বাবু অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন আসন্ন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ছেলের এই কল্পনা শক্তি দেখে। সে আবার বলতে শুরু করলো।

    “সেই জঙ্গলের চারিধারে বড় গাছপালা থাকলেও, তার মাঝে আছে একটা জলাভূমি। পেছনে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটি পুরোনো আমলের তৈরি বিশাল বড় বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। সেই জলাভূমির মাঝে একটি সরু আলের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন তিনি! ঠিক যেমনটা আগে দেখেছি..লম্বা চওড়া চেহারা, এক মুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরণে ময়লা ধুতি জামা, কাঁধে একটা ঝোলা!…আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে তিনি বললেন…”

    “কি বললেন তিনি তোকে, খোকা!” চিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু।

    “বললেন যে, এই যাত্রায় তোমাকে তোমার বাবার কাছে ফেরত পাঠালাম। তবে বারবার কিন্তু তা করা যাবে না। তাই ফিরে গিয়ে তোমার বাবাকে বোলো এই স্থানে আসতে, কারণ এখানেই আমি লুকিয়ে রেখেছি এমন একটি ‘গুপ্তধন’-কে, যা শুধু তোমার বাবারই প্রাপ্য! তার সাহায্যেই তিনি যোগাতে পারবেন তোমাকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলার খরচ!…ব্যাস, এরপর আর কিছুই দেখতে পেলাম না আমি!”, এতটা বলে থামলো শুভাশিস।

    এই শীতের দুপুরেও আতঙ্ক আর উত্তেজনায় অসীম বাবুর সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠলো। তিনি কম্পিত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, “সেটা কোন জায়গা, খোকা? ওই ব্যক্তিই বা কে? আর কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন তিনি গুপ্তধন?”

    “তা তো আমি জানিনা, বাবা!” অসীম বাবুকে নিরাশ করে শুকনো গলায় বলে উঠলো শুভাশিস।

    (৩)
    পরদিন সন্ধ্যা বেলায় সাত পাঁচ নানা কথা ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন অসীম বাবু। পয়সার অভাবে বাইক কেনা হয়নি, ভরসা শুধু সেই আদ্দিকালের সাইকেলটা। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়, বৃষ্টি এলো বলে, ঝোড়ো হাওয়াও বইতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ ধরে। তাই অল্প সময়ে বাড়ি ফেরার জন্য তিনি একটা শর্টকাট রাস্তা ধরলেন। অন্য সময় হলে তিনি হয়তো এই রাস্তাটা ধরতেন না, কারণ এটা দিয়ে যেতে গেলে একটি ছোটখাটো শ্মশানের মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। মূলতঃ নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা তাদের প্রিয়জনদের শেষ কার্য সমাপন করবার জন্য এখানে আসেন।

    চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে, এদিকে হঠাৎ করেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। তার মাঝেই কাকভেজা হয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছিলেন অসীম বাবু। বৃষ্টির জলের ঝাপটার সাথে কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ আসতে লাগলো তার নাকে। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, এবং তাতেই তিনি দেখলেন যে রাস্তার ওপাশে একটি আধপোড়া চিতা সাজানো রয়েছে। বোধহয় বৃষ্টি হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই জ্বালানো হয়েছিলো মৃতদেহটিকে, এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখে আশে-পাশের লোকজনেরা কেটে পড়েছে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন অসীম বাবু, আরো দ্রুত গতিতে তিনি ঘোরাতে লাগলেন সাইকেলের প্যাডেল।

    ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকবার গর্জে উঠলো বজ্রবিদ্যুৎ, আর তার আলোতে পাশের চিতাটির দিকে তাকাতেই ভয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু। তাল সামলাতে না পেরে সাইকেল সমেত পড়ে গেলেন নীচে কাদাজলের মধ্যে। উঠে দাঁড়িয়ে দু’চোখ কোঁচলে আরেকবার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি চিতাটির দিকে…নাহ, এটা তার দেখার ভুল নয়! ওই তো, এখনো আধ-পোড়া মৃতদেহটা সটান উঠে বসে আছে কাঠগুলির ওপর! ধীরে ধীরে তার কালো ঝলসানো মুখমন্ডলটা যেন ঘুরে যাচ্ছে অসীম বাবুর দিকে…পোড়া ভ্রুর দুই ফাঁকের ভেতর চক্ষু কোটরে দৃশ্যমান তার সাদা মণিহীন চোখ!

    ভয়ে অসীম বাবুর স্বরযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ যেন বন্ধ হয়ে এলো, তিনি কোনো রকমে চিতাটির দিকে পেছন ফিরে ছুটতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে একটি গাছের গায়ে এসে হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা খেলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি পেছন ফিরে চেয়ে দেখলেন, যে মাটিতে চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে তার দিকেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে অর্ধ-দগ্ধ মৃতদেহটি। আতঙ্কের চোটে গাছটির গায়ে শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে সিঁটিয়ে রইলেন অসীম বাবু। ততক্ষণে এক লাফে মৃতদেহটি একেবারে তার সামনে চলে এসেছে।

    “মাগো!”, বলে তীব্র আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করলেন অসীম বাবু, পোড়া মাংসের গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠলো। ঠিক সেই সময় এক অচেনা পুরুষকণ্ঠের গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো তার কানে, বলা বাহুল্য তা বেরোচ্ছে সেই মৃতদেহটার মুখ থেকেই!

    “এখনো কি তুই অবিশ্বাস করবি যে আমি সব সময় তোর আশেপাশেই আছি? এখনো কি তোর ছেলের মুখ থেকে শোনা কথাগুলোকে উড়িয়ে দিবি কিশোর মনের নিছক কল্পনা ভেবে? তুই কি চাস না, যে সে সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে উঠুক?”

    “কে তুমি? কেন সাহায্য করতে চাও আমায়? কোন ‘গুপ্তধন’ লুকিয়ে রেখেছো তুমি আমার জন্য? কোথায় গেলে পাবো আমি সেটা?”, চোখ বন্ধ রেখেই কম্পিত গলায় চিৎকার করে উঠলেন অসীম বাবু।

    “এই সকল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আসে ইতিহাসের পাতায়! অতীতের কারাগারে যে বন্দি হয়ে রয়েছি আমি! সেখানেই এতো বছর ধরে আগলে রেখেছি সেই ‘গুপ্তধন’-কে। তার সাহায্যে সুস্থ করে তুলতে হবে তোর একমাত্র বংশধরকে, আর মুক্তি দিতে হবে আমায়! সেই বিপুল ধন-সম্পত্তি শুধু যে তোর, কারণ আমি হলাম তোরই এক পূর্বপুরুষ!”

    এই কথা শুনেই বিস্মিত হয়ে চোখ খুললেন অসীম বাবু। কিন্তু ততক্ষণে তার সামনে আর কেউই দাঁড়িয়ে নেই! বৃষ্টির তেজও অনেকটা ধরেছে। অদূরেই পড়ে রয়েছে তার সাইকেলখানা। সাইকেলের ওপর বসে আরেকবার চিতাটির দিকে তাকালেন তিনি। সেখানেও কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে পারলেন না তিনি। তাহলে এতোক্ষণ ধরে তিনি যা দেখলেন, যা শুনলেন, সবটাই কি তার মনের ভুল!

    (৪)
    সেদিন বাড়ি ফিরে সম্পূর্ণ ভেজা শরীরেই অসীম বাবু এগিয়ে গেলেন তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধ পিতা কালীপদ বাবুর ঘরে। ঝড় বৃষ্টি হবার দরুণ এখন বোধহয় লোড-শেডিং চলছে। অন্ধকার ঘরে ছোট্ট একটা কুপি জ্বলছে। নিজের বিছানায় শান্ত চিত্তে শুয়ে রয়েছেন বৃদ্ধ।

    “বাবা!” অসীম বাবুর ডাক শুনে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলেন কালীপদ বাবু।

    “বাবা, ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে অনেকবার যে প্রশ্ন করেও তোমার মুখে কোনো সদুত্তর পাই নি, সেই প্রশ্নই আবার করতে এসেছি! কারণ সেটা যে আজ আমার জানার খুব দরকার, বাবা…দরকার তোমার একমাত্র নাতীকে বাঁচানোর জন্য!” কান্নায় ধরে এলো অসীম বাবুর গলা। এরপর তিনি তার পিতার কাছে সব কথা এক এক করে খুলে বলতে শুরু করলেন। সব শুনে কালীপদ বাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন তার ছেলের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে।

    “তোমার বংশ পরিচয় কি, বাবা? তোমার পিতা মাতার নাম কি? কোথায় থাকতেন তারা? কেন তাদের একটিও ছবি এতো বছরেও আমার চোখে পড়েনি…বলো, আজ তোমাকে উত্তর দিতেই হবে এই প্রশ্নগুলোর!”, উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন অসীম বাবু।

    জানলার বাইরে থেকে আসা হাওয়ার দাপটে কেঁপে উঠলো কুপির অগ্নিশিখাটি, আলো আঁধারের এক অদ্ভুত রহস্যময়তা খেলে গেল কালীপদ বাবুর মুখে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন কালীপদ বাবু, তারপর ধরা গলায় বলে উঠলেন, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে আমার কাছেও নেই রে! এতদিন তোর খারাপ লাগবে ভেবে কিছু বলিনি, কিন্তু আজ আর কোনো কিছু গোপন করবো না!…আমি যে নিজেও জানিনা আমার পিতৃ মাতৃ পরিচয়, কারণ আমি যে শৈশব থেকে বড় হয়েছি কলকাতার এক অনাথ আশ্রমে!”

    গোটা আকাশটা যেন ভেঙে পড়লো অসীম বাবুর মাথায়, তিনি স্তম্ভিত মুখে শুধু চেয়ে রইলেন বৃদ্ধের দিকে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে চললেন কালীপদ বাবু।

    “সেই অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের মুখেই শুনেছি, নদীয়ার বীরনগর গ্রামের এক জঙ্গল থেকে আমাকে খুঁজে পায় এই আশ্রমেরই এক কর্মচারী। তখন কতই বা বয়স হবে আমার, দু-তিন মাস! সারা গ্রামে খোঁজ নিয়েও সে আমার পরিবারের কারোর হদিস পায় না। বাধ্য হয়েই সে আমায় কলকাতা নিয়ে এসে আশ্রমের হাতে সঁপে দেয়। এখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা, লেখাপড়া শেখা। তারপর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চাকরিটা পাবার পর, অনেক কষ্টে এই বাড়িটা তৈরি করলাম। বিয়ে করলাম, তুই এলি আমাদের কোলে…”

    আরো কত কিছু নিজের মনেই বলে চললেন কালীপদ বাবু, সে সব কথা যেন অসীম বাবুর কানেই ঢুকলো না। তিনি শুধু অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নদীয়ার বীরনগর গ্রাম! তার মানে সেখানে গেলেই কি আমি পাবো আমার সকল প্রশ্নের উত্তর?”

    ঠিক তখনই তার চোখ চলে গেল অদূরে, ঘরের দেওয়ালের দিকে। সেখানে কুপির কম্পমান আলোয় তার আর কালীপদ বাবুর ছায়া ছাড়াও আরেকটি তৃতীয় পুরুষমূর্তির ছায়া বিরাজমান! মনে হল যে যেন অসীম বাবুর এই নিজের উদ্দেশ্যে করার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো!

    (৫)
    পরদিন অসীম বাবু শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে রাত নটা নাগাদ পৌঁছলেন বীরনগর স্টেশনে। শুভাশিসের দেখা সেই জঙ্গল, জলাভূমি আর পরিত্যক্ত বাড়িটার বর্ণনা দিতেই, একজন স্থানীয় লোক বলে উঠলেন,
    “ওহ বুঝেছি…আপনি বোধহয় সেন বাড়ির কথা বলছেন! দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ওরা এখানকার জমিদার ছিলো। এখন ওদের বংশধরেররা সব অন্যত্র বসবাস করে। তাই ওই বাড়িতে এক বুড়ো কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ থাকে না… তা আপনি সেখানে কেন যেতে চান মশাই? জায়গাটা ভালো নয়, বুঝলেন!”

    এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি অসীম বাবু, শুধু সন্দিগ্ধ লোকটির কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন স্টেশন থেকে সেন বাড়ি যাওয়ার পথ-নির্দেশটা। শীতের রাতে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে তিনি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলেন গ্রামের শেষ প্রান্তে, একেবারে সমস্ত লোকালয়ের চিহ্নের অগোচরে।

    এই চাঁদের আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাঁচ মহলা জমিদার বাড়িটিকে। এখন এখানে আর তেমন কেউ বসবাস করে না, করার পরিস্থিতিও নেই। সামনের গেটের ওপরের সিংহের মূর্তিটা যেন এখনো জীবন্ত হয়ে তাকিয়ে আছে অসীম বাবুর দিকে। অধিকাংশই ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এই বাড়িটার কোথাও এতটুকু সিমেন্ট-বালি আস্ত নেই, তা কবেই খসে গিয়ে বুকের পাঁজরের মত বেরিয়ে পড়েছে পুরোনো ইঁটের সারি। বিশাল বড় উঠোনের চারিপাশে দোতলা বাড়িটার অধিকাংশ ঘরেরই ছাদ ধসে পড়েছে। সামনের পরিত্যক্ত ঠাকুর দালানটি কত বছর ধরে হয়তো বঞ্চিত ঢাকের আওয়াজ থেকে।

    “কাকে চায়!”, পেছন থেকে হঠাৎ এই কথা শুনে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন অসীম বাবু। কুপি হাতে, চাদর গায়ে আর মাথায় মাংকি টুপি পরিহিত এক বৃদ্ধ ব্যক্তি এগিয়ে এলো তার দিকে। এই হল এখানকার কেয়ারটেকার, বুঝলেন অসীম বাবু।

    “আসলে বড্ড মুশকিলে পড়েছি, মশাই”, কাকুতির স্বরে বলে উঠলেন অসীম বাবু, “এই গ্রামে এসেছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়িতে, ফিরতি পথে রাস্তা ভুল করে এখানে চলে এসেছি। এখন তো শেষ ট্রেনটারও ছাড়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে ফিরতেও পারবো কিনা সন্দেহ…যদি কিছু মনে না করেন, আজকের রাতটা কি এই বাড়িতে থাকা যাবে?”

    সেই বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন অসীম বাবুর দিকে, তারপর কুপির আলোয় তার মুখটা ভালো করে দেখে বললেন, “ঠিক আছে, আসুন!”

    রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে এই জমিদার বংশের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে চলড়ছিলো সেই কেয়ারটেকার। এমনই কথা প্রসঙ্গে সে বলে উঠলো, “আসলে কি জানেন মশাই, এই সব পয়সাওয়ালা মানুষদের পরিবারে কোনো না কোনো পাপ লেগেই থাকে। সেটা কোন সাল ছিলো যেন…হ্যাঁ, ১৯৩৮, তখন এই পরিবারের কর্তা রায়বাহাদুর কৃষ্ণমোহন সেন ছিলেন এই গোটা গ্রামের জমিদার। বলাই বাহুল্য, তিনি ছিলেন ইংরেজদের নেওটা। তার স্ত্রীর নাম ছিলো চারুলতা দেবী। শোনা যায়, যে এই মা ঠাকরুণের কোন এক দূরসম্পর্কের ভাই নাকি যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের দলে! কি যেন নাম ছিলো তার…হ্যাঁ, নিমাইচন্দ্র মিত্র। একবার দলের বেশিরভাগ লোক ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে, নিমাই নাকি এখানে পালিয়ে আসে এখানে। এখানেই কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকে সে, তার নাকি শারীরিক সম্পর্কও হয় এই বাড়ির এক সুন্দরী কাজের মেয়ের সাথে।”

    “তারপর?”, উত্তেজনার পারদ চড়া কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন অসীম বাবু।

    “তারপর আর কি! কৃষ্ণমোহনের কোনো এক বিশ্বস্ত লোক নাকি নিমাই-এর অনুপস্থিতিতে তার ঘর থেকে চুরি করে আনে বেশ কিছু চিঠিপত্র, যা থেকে কৃষ্ণমোহনের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিমাই-এর বিপ্লবী হওয়ার কথা! তিনি কিন্তু মাথা গরম করলেন না, শুধুমাত্র চুপিসারে সেই কথা জানিয়ে দিলেন ইংরেজদের কাছে। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, নিমাই-এর অজান্তেই পুলিশরা তাকে ধরতে এসে বিফল হলো, কারণ সেদিন রাত থেকে নিমাই হল নিরুদ্দেশ! সেদিন থেকে আজ অবধি আর কেউ তার কোনো খোঁজ খবর জানে না! কি অদ্ভুত কান্ড বলুন দেখি!”

    একটা মস্ত বড় পাথর যেন ধীরে ধীরে টলে উঠতে শুরু করেছে অসীম বাবুর বুক থেকে, তাও নিজের সকল উত্তেজনা যথাসম্ভব লুকিয়ে, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আর সেই কাজের মেয়েটির কি হয়েছিলো, যার সাথে নিমাই-এর শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়?”

    “আরে সে আরেক অভাগী, বুঝলেন মশাই”, বলতে লাগলো বৃদ্ধ কেয়ারটেকার, “তার পরিবারে ওই এক মাতাল বাপ ছাড়া আর কেউ ছিলো না। সেই বাপ বলেছিলো, এক রাতে প্রসব করতে গিয়ে মা আর সন্তান দু:জনেরই মৃত্যু হয়েছে। সৎকারের পয়সা না থাকায় দু’জনকেই গ্রামের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে!…অবশ্য এই সব কথা আমার ঠাকুরদার মুখে শোনা, তিনিও ছিলেন এখানকার এক কর্মচারী…যাক গে, এবার শুয়ে পড়ুন মশাই, রাত অনেক হল।”

    বৃদ্ধ সেই ঘর থেকে চলে গেলে, বিস্ফারিত চোখে অসীম বাবু মনে মনে বলে উঠলেন, “না, আর যাই হোক না কেন, সেই সন্তান মরেনি। হয়তো মেয়েটির মৃত্যুর পর, তার মাতাল পিতা এই অবৈধ সন্তানটির দায়িত্ব নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে, তাকে ফেলে এসেছিলো এই গ্রামের কোনো জঙ্গলে! তারপর সকলকে তার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দেয়…আর সেই সন্তানই হল আমার বাবা!”

    জল ভরা চোখে অসীম বাবু আবার দেখলেন দেওয়ালের গায়ে পড়া সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির ছায়াটিকে! এবারও সে যেন তার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো!

    (৬)
    রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিরে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে শেয়ালের চিৎকার এবং নাম না জানা কোনো রাতপাখির ক্রন্দন ধ্বনি! পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চুপিসারে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অসীম বাবু। তারপর সন্তর্পণে বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। তার সামনে দিয়েই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে সেই অশরীরি ছায়ামূর্তি। তাকে অনুসরণ করতে করতে অসীম বাবু পৌঁছলেন বাড়িটির পেছনে, জঙ্গলের ভেতর।

    ছায়ামূর্তিটি এখন অগ্রসর হচ্ছে সেই জলাভূমির মাঝ বরাবর সেই সরু আল দিয়ে, চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার অবয়ব। অসীম বাবুও ছুটে এগিয়ে গেলেন তার পিছু পিছু। কিন্তু সেই আলের কিছুটা পথ অতিক্রম করেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। এই অবস্থায় অবাক হয়ে অসীম বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিকে চাইতে লাগলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে, কেউ যেন সজোরে তাকে পেছন থেকে এক ধাক্কায় ঠেলে ফেলে দিলো পাশের জলাভূমির ভেতর!

    জলাভূমিটার জলের গভীরতা খুব বেশি না হলেও, অসীম বাবুর মনে হল কোনো এক অপার্থিব শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই জলকাদার আরো গভীরে। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, তার মানে কি এই সব কোনো অশরীরির প্রতারণা? সেই প্রেতাত্মা কি তাকে মিথ্যা ‘গুপ্তধন’-এর লোভ দেখিয়ে এত দূরে নিয়ে এলো, তাকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে? কিন্তু কেন? চারিদিকে ঘন কালো জল, নাকে মুখে জল ঢুকে যাচ্ছে তার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! এবার কি করবে সে? কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে?

    হঠাৎ, তার দু’চোখের অন্ধকারের সামনে একটি অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠলো…পাশ্ববর্তী জমিদার বাড়ির একটি ঘর! তবে সেই ঘরের অবস্থা এখনকার মত নয়! চারিদিকে সাজগোজ আর আভিজাত্যের রমরমা। সেই ঘরের বিছানার উপর শুয়ে আছে এক যুবক! ঠিক যেমনটা শুভাশিস বলেছিলো তেমনই দেখতে তাকে…’লম্বা চওড়া চেহারা, এক মুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরণে ময়লা ধুতি জামা’…তার মানে এই কি সেই নিমাই!

    ঠিক এমন সময় সেই ঘরের দরজায় তীব্র কড়াঘাতের আওয়াজ শোনা গেল। সেই শব্দ শুনে, ঘুম থেকে উঠে গিয়ে নিমাই ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা খুললো। সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন এক সুন্দরী সুসজ্জিতা নারী। অবাক কণ্ঠে নিমাই বলে উঠলো, “চারু দিদি, তুমি? এই সময়!”

    চারুলতা দেবী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো, “পালাও ভাই, পালাও!…উনি কোনো ভাবে জানতে পেরে গিয়েছেন তোমার বিপ্লবী হওয়ার কথা! আজ রাতে বাইজী বাড়ি থেকে মদ্যপ অবস্থায় ফিরে তিনি নিজে মুখে বলে ফেলেছেন আমাকে সেই কথা! আরো বড় উপাধি পাওয়ার লোভে তিনি সেই কথা জানিয়ে দিয়েছেন ইংরেজদের! আজ রাতেই ইংরেজ পুলিশরা তোমায় ধরতে আসছে, ভাই! এতক্ষণে বোধহয় গোটা বাড়িটাকে নিঃশব্দে ঘিরে ফেলেছে তারা…”

    এই কথা শুনে আর কোনো কথা না বলে সেই ঘর থেকে ছুটে বেরোতে উদ্যত হল নিমাই। ঠিক সেই সময় চারুলতা দেবী বলে উঠলেন, “দাঁড়াও ভাই…আমি জানি, এই সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকতে গেলে তোমার অনেক পয়সার প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থা আমি করেছি…গরিব মানুষদের ঠকিয়ে আদায় করা তাদের রক্ত জল করা এই পয়সার কিছু তো কাজে আসুক এই দেশের কাজ!…এই নাও আমার গহনার বাক্স! এতে যা সোনা আছে তা যদি এই দেশকে স্বাধীন করার কাজে লাগে, তাহলে আমি গর্বিত হবো…বন্দে মাতরম!”, এই বলে তিনি শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখা গয়নার বক্সটি ধরিয়ে দিলেন নিমাই-এর হাতে।

    দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো নিমাই-এর চোখ থেকে, তিনি মাতৃসম দিদির পায়ে নমস্কার করে বলে উঠলো, “বন্দে মাতরম!” তারপর গহনার বাক্সটিকে নিয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছিলো নিমাই। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলো না সে, কারণ ইংরেজ পুলিশেরা সত্যিই চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে তাকে। মাঝেই দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের চিৎকার এবং গুলিবর্ষণের আওয়াজ। নিমাই সেই জঙ্গলের মাঝে থাকা জলাভূমির আল বরাবর গহনার বক্সটি নিয়ে ছুটে চললো। কিছুটা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নাহ, শেষ রক্ষা বোধহয় হবে না। আজ সে কোনো মতেই এই গ্রাম ছেড়ে বেরোতে পারবে না। ইংরেজদের হাতে তাকে ধরা পড়তেই হবে, তারপর অকথ্য অত্যাচার করে তারা তার মুখ থেকে বার করে নেবে দলের অন্যান্যদের সম্পর্কে আরো খবর! নাহ, এ কিছুতেই হতে দেবে না নিমাই…কিছুতেই না!

    গহনার বাক্সটা এক হাত দিয়ে ধরে, ওপর কম্পিত হাতটা দিয়ে যে বার করলো কোমরে গোঁজা গোপন পিস্তলটি! তার কাছে যে বেশি সময় নেই, যদি এই গহনাগুলো তার কাছ থেকে পুলিশ পায়, তাহলে যে তার চারু দিদিকেও তাকে সাহায্য করবার জন্য গ্রেফতার করবে তারা! সেটা কিছুতেই হতে দেবে না সে। বিদ্যুৎ বেগে পিস্তলটি বার করে নিজের কানের পাশে লাগিয়ে গুলিবর্ষণ করে মৃত্যুবরণ করলো নিমাই! রক্তাক্ত অবস্থাতেও দুই বহু দিয়ে গহনার বাক্সটিকে আঁকড়ে ধরে সে শেষবারের মত বলে উঠলো, “বন্দে মাতরম!” তারপর সেই অবস্থাতেই সে ঝাঁপ দিলো জলাভূমির ভেতর!

    (৭)
    এতটা দেখেই নিজের দুই হাতে কোনো এক অদ্ভুত বস্তুর স্পর্শ পেয়ে চিন্তার ঘোর কেটে গেল অসীম বাবুর। কাদাজলের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সেটা যেন একটি মানুষের অবয়ব। শুধুমাত্র শরীরের হাড় কঙ্কালের ওপর যেন শক্ত কালচে চামড়া দিয়ে ডাকা একটা পুরোনো দেহাবশেষ! নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তিনি সেই মরদেহটিকে নিয়ে আলের কাছে শক্ত মাটির ওপর সাঁতরে এলেন। সেটাকে ডাঙ্গার ওপর তুলতেই আতঙ্কে কেঁপে উঠলো তার বুক!

    এটা তো একটা মমি! তার পূর্বপুরুষ বিপ্লবী নিমাইচন্দ্র মিত্রের মমি! শরীরের কাঠামো এক থাকলেও সংকুচিত হয়েছে শরীরের মাংসপেশী! কুচকুচে কালো চামড়ায় ঢাকা দেহাবশেষটির মুখের আকৃতি এখনো স্পষ্ট, এখনো বোঝা যাচ্ছে তার ডান কানের পাশে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ক্ষতচিহ্নটি! এবং বলা বাহুল্য, আজও সে একই ভাবে দু’টি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তার দিদির দেওয়া গহনার বক্সটি! তাহলে এটাই হল সেই ‘গুপ্তধন’!

    চোখে জল এসে গেল অসীম বাবু। তিনি যেটুকু পড়াশোনা করেছেন, তাতে হয়তো তার স্পষ্ট ধারণা নেই, যে যখনই কোনো মানব শরীর জলাভূমি বা ‘Bog’-এর ভেতর পতিত হয় তখন সেখানকার জলের ‘Humic Acid’, কম তাপমাত্রা এবং ‘Oxygen’-এর অনুপস্থিতির জন্য তাতে পচন ধরে না। দেহাবশেষটির ভেতর থেকে মাংসপেশী বা হাড়ের পরিমাণ কমে গেলেও তার আকৃতি অবিকৃত থাকে। শুধুমাত্র শরীরের চামড়াটি গভীর ভাবে ‘Tanned’ হয়ে গিয়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রঙ ধারণ করে। আমরা মমি বলতেই হয়তো মিশরের কথা ভাবি, তবে সেই মমিগুলো ছিলো মানুষ দ্বারা করা ক্রিয়াকলাপের ফল। কিন্তু প্রকৃতি যে নিজেও এক অতুলনীয় মমি-কারিগর, সেই কথা প্রমান করে দেশ বিদেশের জলাভূমি থেকে পাওয়া এই মমিগুলি, যাদেরকে বলা হয় “Bog Mummies”.

    সেই রাতেই জঙ্গলের ভেতর শুকনো ডাল পালা জমা করে, তাতে লাইটারের আগুন জ্বালিয়ে তিনি সৎকার করলেন তারই পুরপুরুষের আশি বছর পুরোনো এই দেহাবশেষটিকে। তিনি জানেন যে সেই গহনার বাক্সে যে সোনা আছে, তা দিয়ে তার ছেলের হার্ট সার্জারির খরচাপাতি খুব সহজেই চালাতে পারবেন তিনি।

    ভোরের সূর্য পুব আকাশে দেখা দিয়েই তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে, সেন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। এখন যে তাকে কলকাতা গিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। সেদিনের কলকাতাগামী প্রথম ট্রেনের জানলার ধারের একটি সিটে বসেছিলেন তিনি। ট্রেন ছেড়ে দিলো, ধীরে ধীরে মুছে গেল বীরনগর স্টেশনের সকল প্রতিচ্ছবি। নিজের ব্যাগের ভেতর রাখা গহনার বাক্সটিকে দুই হাত দিয়ে উপলব্ধি করতে করতে, নিজের সেই অচেনা বিপ্লবী পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাভরে তিনি বলে উঠলেন, “বন্দে মাতরম!”

    (সমাপ্ত)

  • ভৌতিক গল্প

    পাতাল ঘরের অশরীরি

    পাতাল ঘরের অশরীরি
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)
    সালটা ১৯৪৭। গোটা দেশ জুড়ে শোনা যাচ্ছে এত কাল ধরে চলে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যুদ্ধজয়ের দামামা। দেশভাগের রণক্ষেত্র লাল হতে শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষদের বুকের তাজা রক্তে। হিন্দু মুসলমান আজ একে অপরের প্রধান শত্রু। ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে চলেছে জমিদারি প্রথা। অতীতের বংশ গৌরব আর আভিজাত্যের ইতিহাস বুকে নিয়ে, আজ এই সকল বনেদী পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা সাধারণ মানুষের সমান।

    এমনই এক পরিবার হল পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, মোহনপুরের রায়চৌধুরীরা। স্বর্গীয় ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী ছিলেন এখানকার দাপুটে জমিদার। এই গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের আরো চার পাঁচটি গ্রাম জুড়ে ছিলো তার জমিদারি। মৃত্যুকালে তিনি তার সকল বিষয়সম্পত্তি সমান ভাবে ভাগ করে দিয়ে যান তার দুই ছেলে, ফণীভূষণ আর শশীভূষণের মধ্যে। তবে বড় ছেলে ফণীভূষণ সংসারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাউন্ডুলে প্রকৃতির, যাকে বলা হয় এই অভিজাত বংশের কলঙ্ক। বাপের জমিদারির ওপর উদাসীন ফণীভূষণ অবিবাহিত অবস্থাতেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। তাই বর্তমানে এই পরিবারের কর্তা হলেন ষাটোর্ধ্ব বিপত্নীক শশীভূষণ।

    শশীভূষণের একমাত্র ছেলে অমূল্যভূষণ ছোটবেলা থেকেই মা বাবার কাছ থেকে দূরে বিলেতে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। কয়েকমাস হল সে সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছে। বর্তমানে বিষয়সম্পত্তি যেটুকু আছে তা খুব খারাপ নয়, তবে জমিদারি থেকে আর তাদের তেমন আয় হয় না। তাই অমূল্যের ইচ্ছা দেশে ফিরে ওকালতি শুরু করার। তবে তার এখানে ফেরার পেছনে আরেকটি কারণও আছে।

    বাঁশবেড়িয়া নিবাসী ধনী ব্যবসায়ী সুকুমার মিত্র মহাশয় হলেন ফণীভূষণের ছাত্র জীবনের বাল্যবন্ধু। পরবর্তী ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, একদিন হঠাৎ করেই এই বাড়িতে আগমন ঘটে সুকুমার বাবুর। নিজের পুরোনো বাল্যবন্ধুকে এত দিন পর দেখে খুব খুশি হন ফণীভূষণ। তার যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি রাখলেন না তিনি। পরে অবশ্য সকলেই বুঝতে পারলো, সুকুমার বাবুর আগমনের প্রকৃত হেতু। তিনি চান তার একমাত্র মেয়ে, পারুলকে এই বাড়িতেই পাত্রস্থ করতে। অবিবাহিত ফণীভূষণ বন্ধুর এই আব্দার শোনালেন ভাই শশীভূষণের কাছে। দুই পক্ষেরই মতের মিল থাকায়, স্থির হয়ে যায় যে অমূল্যর পড়াশোনা শেষ হলেই তাকে দেশে ফিরে এসে বিবাহ বন্ধনে অবন্ধ হতে হবে পারুলের সাথে।

    এখনো সঠিক ভাবে এক সপ্তাহই হয়নি, পারুলকে বিয়ে করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে অমূল্য। মা বাবার জন্য মন কেমন করার সাথে সাথেই, কেমন যেন বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে পারুলের এই বাড়িতে। মাত্র আঠেরো বছর বয়সী পারুল হল অসামান্য সুন্দরী। তাই ফুলশয্যার রাত থেকে আজ অবধি অমূল্য যেন তাকে চোখে হারায়। সন্ধ্যা হতে না হতেই সে জরি পাড় ধুতি পরে, গায়ে আতর মেখে ঘুরঘুর করতে শুরু করে বিছানার কাছে।

    তবুও যেন দিনের বাকি সময়টা, যখন অমূল্য ওকালতির কাজে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়, তখন এই বাড়িতে থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করে পারুলের। এতবড় পাঁচ মহলা বাড়িতে লোকসংখ্যা কত? সে, তার স্বামী, শ্বশুরমশাই এবং এক দু’জন চারক বাকর! বাড়ির যেদিকে সে তাকায়, সেদিকেই যেন খা খা করে ওঠে! অতীতের প্রাচুর্যের তপবন যেন আজ পরিণত হয়েছে কোনো জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে!

    (২)
    এই বাড়ির পেছনে বেশ বড় আমবাগান, তার একপাশে বাঁধানো পুকুরঘাট। শীতের দুপুরের সময়টা ঘুম আসেনা পারুলের। এই সময় অমূল্যও বাড়ি থাকে না। তাই দুপুরের খাওয়া দাওয়া হতেই সে রোদ পোয়াতে চলে আসে পুকুরঘাটে। তারপর পাথরের সিঁড়িতে আরাম করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে এক মনে তাকিয়ে থাকে সামনের শ্যাওলায় ভরা পুকুরের সবুজ জলের দিকে। কিংবা কখনো কখনো এলোমেলো ভাবে ওল্টাতে থাকে কোনো গল্পের বইয়ের পাতা। কিন্তু পড়ায় মন বসে না। ছেলেবেলার কথা, বাবা মায়ের কথাই মনে পড়ে বেশি। তারপর সূর্য অস্ত যেতেই সে তড়িঘড়ি ফিরে আসে পড়ন্ত আলোয় দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ির ভেতরে।

    এমনই একদিন দুপুর বেলায় বেশ আনমনা হয়ে পারুল পুকুরঘাটে বসে তাকিয়ে ছিলো জলের দিকে। এমন সময় পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরলো তার,

    “ওমা আমার কি হবে! নতুন বউ নাকি? তা এমন ভর দোপর বেলা একলা একলা এই পুকুরপারে বসি থাকতে হয় বুঝি?”

    পারুল চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখে এক মাঝ বয়সী মহিলা, সাধারণ সাদা শাড়ি পরণে, এক হাতে একটা মাটির কলসী নিয়ে তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে।

    “আ…আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না…”

    “ওমা তোমি আমারে চিনবা কেমনে, নতুন বউ! তুমি এ গাঁয়ের নতুন মানুষ, এই অল্প কডা দিনে আমাদের চিনবা কি করে!…আমার নাম চাঁপা, গো চাঁপা…এই গাঁয়েই আমার বাস।”

    মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে আসে পারুলের দিকে। এক কালে যে খুব সুন্দরী ছিলো এই মহিলা, তা তার সাজগোজ বিহীন চেহারা আর সাধারণ পোশাকের ভেতর থেকেই ফুটে উঠছে। মহিলা প্রসন্ন চিত্তে বলে ওঠে, “বাহ, কেমন লক্ষী ঠাকরুনের মত বউ হয়েছে আমাগো ছোট দাদাবাবুর!”

    পারুল নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় চোখ নিচু করে, মহিলা পুকুরের জলের দিকে এগিয়ে যায় কলসীটাকে নিয়ে। পারুল জিজ্ঞাসা করে, “তা চাঁপা মাসি, তুমি কি রোজ এই পুকুর থেকেই জল নিতে আসো? কই, আগের কটা দিন তো দেখিনি তোমাকে? আর তুমি আমাকেই বা চিনলে কেমন করে?”

    “ওমা, ছোট দাদাবাবুর বৌভাতে যে আমরা সারা গাঁ খেয়ে গেলুম গো, তা তোমারে চিনবো না? তুমি হয়তো আমারে খেয়াল করো নাই…আর কিছু দিনের জন্য আমি যে কুটুম বাড়ি গিয়েছিলুম গো ভিন গাঁয়ে, তাই জল নিতে আসি নাই”, প্রত্যুত্তরে বলে মহিলা।

    এরপর থেকে পারুল আর চাঁপার বেশ ভাব হয়ে গেল। দু’জনেই প্রতিদিন দুপুরে পুকুরঘাটে এসে গল্পগুজব করে। চাঁপার বাড়ি এই গ্রামেই, অনেক ছোটবেলায় তার এক বৃদ্ধের সাথে বিবাহ হয় কৌলীন্য প্রথা রক্ষার্থে, আর তারপর তার বিধবা হতেও বেশি সময় লাগেনি। এই গ্রামের পূবদিকের একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে সে থাকে। বাপের রেখে যাওয়া অল্প কিছু জমিজমার ফসল আর কয়েকটি পোষ্য গরু ছাগলের দৌলতে তার পেট চলে যায়।

    একদিন কি মনে হতে হঠাৎ চাঁপা পারুলকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাগো নতুন বউ, তোমাগো ওই অত্ত বড় বাড়িডায় থাকতে কখনো ভয়ডর লাগে না তো?”

    পারুল বেশ অবাক হয়ে ওঠে এই কথা শুনে। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “কেন বলো তো মাসি? ভয় করবে কেন শুনি?”

    চারিদিকের পরিবেশকে থমথমে করে মহিলার মুখে নেমে আসে এক আতঙ্কের ছাপ, “ও ছাড়ো তাহলে…লোকের মুখে শোনা কথা কখনো সত্যি হয় নাকি…”

    আরো অবাক কণ্ঠে বলে ওঠে পারুল, “কি ছাড়বো শুনি? কি কথা লোকে বলে, মাসি? বলো…বলতেই হবে তোমায়…”

    “ও থাক বাছা, আমি এখন উঠি, কেমন?…এই সুয্যি ডুবলো বলে…”, প্রসঙ্গ পাল্টে কলসীটাকে কাঁখে করে তড়িঘড়ি উঠে পড়ে মহিলা।

    (৩)
    সেদিন রাতে ঘুম এলো না পারুলের। অমূল্যর কামোত্তেজিত আলিঙ্গনের মাঝেও এক নিথর ভোগ্যবস্তুর মতই নিস্তেজ হয়ে তার শরীর পড়ে রইলো বিছানার ওপরে। বিষয়টা অমূল্যও লক্ষ্য করে একটু অবাক হয়েছিলো, কিন্তু এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি সে পারুলকে। গভীর রাতেও দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না পারুল। ওপাশে অমূল্য নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, এদিকে পারুল তাকিয়ে আছে পাশের খোলা জানলার বাইরে, রাতের আকাশের দিকে।

    “তার মানে কি সত্যিই এই বাড়িতে এমন কিছু আছে, যাকে ভয় পাওয়াই উচিত! কোন কথা বলতে চেয়েছিলো চাঁপা মাসি? লোকের মুখে শোনা কথাটাই বা কি?”, এই প্রশ্নগুলোই ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিলো পারুলের মাথায়।

    তাই পরদিন দুপুরে পুকুরপারে চাঁপাকে পেয়ে পারুল নাছোড়বান্দা। আজ চাঁপাকে বলতেই হবে গতকাল সে কোন কথা বলতে চেয়েছিলো পারুলকে। উপায় না দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মহিলা। শীতের দুপুরের হিমেল হাওয়ায় এদিক ওদিকে উড়তে লাগলো তার রুক্ষ কেশরাশী। যেন বলতে গিয়ে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো তার ঠোঁটদুটি।

    “এ গাঁয়ের লোকেরা বলে, যে তুমার জ্যাঠা শ্বশুর নাকি যে সে লোক ছিলেন না! ছোটবেলা থেকেই তেনার জমিদারির কাজে মন ছিলো না গো…তেনার ওঠা বসা ছিলো এই গাঁয়ের শ্মশানে বাস করা তান্ত্রিকদের সাথে!…তেনাদের দীক্ষা নিয়েই নাকি পিশাচসিদ্ধ হয়েছিলেন তোমার ফণীভূষণ বটঠাকুর!”

    “পিশাচসিদ্ধ!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো পারুল।

    “হ্যাঁ গো হ্যাঁ”, বিস্ফারির চোখ মেলে বলে উঠলো চাঁপা, “সকলে বলে, তোমাগো বাড়ির নীচে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে, যেখান গিয়ে গেলে একটি ‘পাতাল ঘরে’ পৌঁছনো যায়…সেখানেই করতেন তিনি এই সব তন্তর মন্তর!”

    “তারপর?”, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো পারুল।

    “তারপর আর কি? সকলে বলে যে তিনি নাকি মন্তর বলে কোন এক প্রেতাত্মাকে নিজের বশে করেছিলেন! কিন্তু তাকে মুক্তি দেওয়ার আগেই হঠাৎ মারা গেলেন তোমার জ্যাঠা শ্বশুর! আর সেই আশরীরি আজ অবধি বন্দী হয়ে আছে তোমাগো বাড়ির ‘পাতাল ঘরে'”, এতটা বলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো মহিলা।

    একটা অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু করে উঠতে লাগলো পারুলের বুক!

    (৪)
    সেদিন রাতে বিছানায় তার শরীরটা ভোগ করতে এলেই, এক ঝটকায় স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় পারুল। বিরক্ত হয়ে অমূল্য কিছু বলে ওঠার আগেই, স্বয়ং পারুল নিজেই বলে উঠলো,
    “আপনার জেঠামশাই, শ্রী ফণীভূষণ রায়চৌধুরী কি তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন?”

    এমন দুর্বল মুহূর্তে এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ে অমূল্য। তবুও সে জানতে চায় এমন প্রশ্ন করার কারণ কি। পারুল তাকে খুলে বলে চাঁপার কাছ থেকে শোনা সমস্ত কথা। মুহূর্তের মধ্যে সকল কামোত্তেজনা উধাও হয়ে যায় অমূল্যের মধ্যে থেকে। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
    “জেঠু যে তেমন কোনো গুপ্তবিদ্যা শিখেছিলেন, সেই কথা কিছু কিছু আমিও শুনেছি…কিন্তু ওই পাতাল ঘরের কথা, বা তার ভেতর কাউকে আবদ্ধ করে রাখার কথা!…নাহ, এইসব তো কখনো শুনিনি আমি!…তাছাড়া ছোটবেলা জেঠুকে দেখেছিই বা কতটুকু, পড়াশোনার খাতিরে এই বাড়িতে থাকাই হয়নি তেমন…কে না কে কি বললো, আর তুমি আজকালকার মেয়ে হয়ে বিশ্বাস করলে সেই কথায়?”

    সেই রাতে আর বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। পারুল অমূল্যর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই তার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়েছিলো। অমূল্যও আর বেশি জোরাজুরি করেনি পারুলকে।

    তবে সেই রাত্রে দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না অমূল্য। তখন বোধহয় রাত এগারোটা হবে। বিছানায় উঠে বসলো অমূল্য। শীতের রাত্রির নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে গোটা বাড়ি জুড়ে। পাশের খোলা জানলা দিয়ে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে পারুলের ঘুমন্ত মুখের ওপর। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, এই মুহূর্তে তার প্রতি খুব একটা আকর্ষণ উপলব্ধি করতে পারলো না অমূল্য। সে ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে, আলতো হাতে ঘরের দরজা খুলে শয়ন কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলো। দ্রুত পায়ে ছুটে চললো তার বাবার ঘরে।

    শশীভূষণের ঘরে তখনো আলো জ্বলছে। অমূল্য জানে, যে তার বাবা অনেক রাত ধরে মদ্যপান করে, তারপর ঘুমোতে যান। সেই ঘরের ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো অমূল্য। কাঁচের টেবিলের ওপর রাখা রঙিন তরলের সকল সরঞ্জাম নিয়ে সেগুন কাঠের আরাম কেদারায় বসেছিলেন শশীভূষণ। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখলেন অমূল্যর দিকে। তার কিছু বলার আগেই অমূল্য বলে উঠলো,
    “এই সময় তোমাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি, বাবা…কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর যে এখনই না পেলে নয়…”

    “কি প্রশ্ন আছে তোমার?”, গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন প্রৌঢ়।

    “বাবা, এই কথা জানি যে জেঠু তন্ত্র মন্ত্র শিখেছিলেন! কিন্তু আমাকে বলো, এই বাড়ির নিচে কি কোনো গুপ্তকক্ষ আছে? সেখানে কি কোনো অশরীরিকে তন্ত্রমতে বন্দী করে রেখেছেন তিনি?”, চিৎকার করে বললো অমূল্য।

    চমকে উঠলেন শশীভূষণ, উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো তার দু’চোখের মণি। আতঙ্কের বশে তার হাতে ধরে রাখা কাঁচের পাত্র সমেত হুইস্কির অবশেষটুকু সশব্দে ছড়িয়ে পড়লো ঘরের মেঝের ওপর!

    (৫)
    “বৌমাআআআ….বৌমাআআআ….”

    ঘুমের মধ্যেই একটি অস্ফুট পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ কানে গেল পারুলের। “কে…কে ডাকে আমায়?”, ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো পারুল।

    “আমি তোমার জ্যাঠা শ্বশুর, বৌমা…স্বর্গীয় ফণীভূষণ রায়চৌধুরী!”, অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে প্রত্যুত্তর এলো সেই পুরুষকণ্ঠের।

    ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো পারুল। সে দেখলো সে গোটা ঘরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে এক দীর্ঘদেহী পেশীবহুল পুরুষের অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার চোখের সামনে। ঠিক তার বিছানার সামনেই তার দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। খালি গা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরণে কাপালিকদের লাল রঙের ধুতি। আবার শোনা গেল সেই অশরীরি কণ্ঠস্বর,
    “তুমি সঠিক জেনেছো, বৌমা…আমারই একটা ভুলের জন্য সে এতবছর ধরে বন্দী হয়ে আছে এই বাড়ির ‘পাতাল ঘরে’!…তার মুক্তি না হলে যে আমারও মুক্তি নেই, বৌমা…যাও, তাকে মুক্ত করো বৌমা, তাকে মুক্ত করো!”

    “কিন্তু সেই ‘পাতাল ঘর’ কোথায়? কিভাবে পৌঁছবো আমি সেখানে?”, চিৎকার করে উঠলো পারুল।

    “এই বাড়ির একতলার পূবদিকের প্রথম ঘরটাই ছিল আমার শয়নকক্ষ। এই ঘরে, আমার পালঙ্কের নীচেই পাবে সেই সুড়ঙ্গমুখে ঢোকার রাস্তা। তবে সেখানে ঢোকার আগে, আমার ঘরে রাখা সিন্দুকের ভেতর থেকে ‘পাতাল ঘরের’ দরজায় লাগানো তালার চাবির গোছাটা যেন নিয়ে যেতে ভুলো না!”, বলে উঠলেন ফণীভূষণ।

    “কে সেই অশরীরি? কাকে আবদ্ধ করে রেখেছেন আপনি ওই ঘরে? বলুন, আমার কথার জবাব দিন…”, আবার জানতে চাইলো পারুল।

    কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না ফণীভূষণ। শুধু তার মর্মভেদী কন্ঠস্বর শোনা যেতে লাগলো, “মুক্ত করো তাকে, বৌমা…মুক্ত করো!” পারুল দেখলো যে তার দেহটা স্থির থাকলেও, ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে তার মুন্ডুটা।কিছুক্ষণের মধ্যেই পারুলের দিকে মুখ করে সম্পূর্ণরূপে পেছনে ঘুরে গেল তার মুন্ডুটা! পারুল ভয়ার্ত দৃষ্টে চেয়ে দেখলো, যে ছবিতে দেখা তার মুখের সাথে এই মুখের কোনো পার্থক্য নেই, শুধু এই ক্ষেত্রে তার চক্ষু কোটরদুটি ফাঁকা!

    একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে বিছানায় উঠে বসলো পারুল। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো! দ্রুত গতিতে নিশ্বাস নিতে নিতে সে বিছানায় পাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হল, অমূল্যর জায়গা ফাঁকা! কোথায় গেল সে? কিন্তু সেই মুহূর্তে, অমূল্যর চিন্তার থেকে বেশি তাকে ভাবাচ্ছিলো স্বপ্নে শোনা ফণীভূষণের কথাগুলো। তার মানে তো চাঁপা ঠিক কথা বলেছে তাকে! সাহসে বুক বেঁধে মনে মনে সংকল্প নিলো সে, যেভাবেই হোক তাকে যেতে হবে সেই ‘পাতাল ঘরে’! মুক্ত করতেই হবে সেখানে বন্দী অশরীরিকে! বিছানা থেকে উঠে পড়ে পারুল, দ্রুত পায়ে এই ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে চলে ফণীভূষণের ঘরের উদ্দেশ্যে।

    রাতের অন্ধকারে, ফণীভূষণের ঘরের ভেজানো দরজা খুলে চোরের মত ভেতরে ঢুকে পড়লো পারুল। ফণীভূষণের মৃত্যুর পর বহুদিন ধরে ফাঁকা পড়ে আছে এই ঘর। তবে বাড়ির বহুদিনের পুরোনো চাকরটির গুণে আজও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঘরের চতুর্দিক। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে, পারুল ছুটে গেল অদূরে একটি টেবিলের ওপর রাখা সিন্দুকটার দিকে। সৌভাগ্যজনক ভাবে তাতে তালা দেওয়া নেই। মুহূর্তের মধ্যে তার ডালা খুলে ‘পাতাল ঘরের’ দরজার তালার চাবির গোছাটা বার করে নিতে খুব বেশি সময় লাগলো না পারুলের।

    সেই মুহূর্তে তার মনে হল, যেন কোনো অপার্থিব শক্তি এসে ভর করেছে তার দেহে। নাহলে সেই ঘরের অত ভারী পালঙ্কটির পায়া ধরে, এক ধাক্কায় সেটাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া তার মত মেয়েমানুষের কম্ম নয়! এরপরই সে নিজেই অবাক হয়ে গেল…পালঙ্কের নীচে মেঝের সাথে খাঁজে খাঁজে বসানো রয়েছে একটি লোহার ডালা। তার হাতলের একটি অংশে চাপ দিতেই সেটি খুলে গিয়ে বিকশিত করলো একটি আঁধারে ভরা সুড়ঙ্গপথের মুখ, যার ভেতর দিয়ে নেমে গিয়েছে সারি সারি সিঁড়ি!

    আর একটুও সময় নষ্ট না করে, হাতে চাবির গোছাটা নিয়ে, যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত পারুল অগ্রসর হতে লাগলো সেই সিঁড়ি দিয়ে। চারিদিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার, ওপরে ঘরের ভেতর চাঁদের আলো যেটুকু পড়েছিল, সেটাও এখানে নেই। তবে এই সুড়ঙ্গপথ যে বহুদিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, এমন কিন্তু নয়। খুব বেশি ধুলোবালি বা অপরিচ্ছন্নতা এখানে নেই, বোঝাই যাচ্ছে যে নিয়মিত এই পথ ধরে কারোর যেন যাওয়া আসা আছে! সিঁড়ির সারি শেষ হয়ে এলে, পারুল হাতড়ে হাতড়ে পৌঁছলো একটি সমতল জায়গায়। তার সামনেই রয়েছে একটি ঘরের তালাবন্ধ দরজা। চাবির গোছাটা ধরে সেদিকে এগিয়ে এলো পারুল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে, সেই ঘরের দরজার তালাটা হাত দিয়ে উপলব্ধি করে, এক এক করে চাবিগুলো ব্যবহার করে খোলার চেষ্টা করতে লাগলো তালাটা। এক সময় তার প্রচেষ্টা সফল হল, সশব্দে খুলে গেল তালাটা। সেটাকে দরজার হাতল থেকে খুলে নিয়ে, এক ঝটকায় পারুল সশব্দে খুলে ফেললো সেই ঘরের দরজাটা!

    সেই ঘরের ভেতর অগ্রসর হয়ে, জমাট অন্ধরারের মধ্যে সামনে চোখ রাখতেই যেন তার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো। সে অস্ফুট স্বরে নিজের মনেই বলে উঠলো, “একি!…এটা তো…এটা তো…”

    (৬)
    “ওই ঘরে কোনো অশরীরিকে আবদ্ধ করে রাখা নেই, খোকা…ওখানে বন্দী করে রাখা রয়েছে তোর আমার মতই একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষকে!”, কম্পিত গলায় শশীভূষণ বলে উঠলেন অমূল্যর উদ্দেশ্যে।

    বিস্মিত চোখে বাপের দিকে চেয়ে রইলো অমূল্য। তিনি বলেই চললেন, “ভালো হল তুই নিজে মুখেই এই কথা তুললি, খোকা…কারণ আমি নিজেই চাইছিলাম এই বিষয়ে তোদের বিস্তারিত জানাতে। দগ্ধে দগ্ধে মরছিলাম এতদিন এই পাপের কথা চাপা রেখে। শুধু কোন মুখে এই কথা তোদের জানাবো, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না এত দিন ধরে!”

    “সেই সময় তোর ঠাকুরদা ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী বেঁচেছিলেন। তোর জ্যাঠামশাই, মানে আমার দাদা, ফণীভূষণের সবে মাত্র মৃত্যু হয়েছে। এমন সময় এই বাড়ির কাজ থেকে ছুটির জন্য অনুরোধ করে এক অকালবিধবা সুন্দরী কাজের মেয়ে। পরে জানা যায় যে সে ছিলো অন্তঃসত্ত্বা! এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। কয়েকবছর পর, একটি দু’বছরের ছোট্ট ছেলেকে কোলে করে এই বাড়িতে প্রবেশ করলো এক বৃদ্ধ। সে বলে, যে এটি হল তার মেয়ের সন্তান, যে এই বাড়িতেই কাজের জন্য নিযুক্ত ছিল। ছেলেটির নাম সোমেশ্বর। দু’দিন আগেই কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যু হয়েছে সেই মেয়েটির, তবে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তার শেষ ইচ্ছা ছিলো, যে তার সন্তান যেন পায় উপযুক্ত পিতৃপরিচয়…সেই জন্যই তাকে এই বাড়িতে এনেছে সেই বৃদ্ধ…তার কারণ হল, ছেলেটির পিতা হল ফণীভূষণ!”

    এতটা বলে থামলেন শশীভূষণ, বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইলো অমূল্য। আবার বলতে শুরু করলেন তিনি।

    “কিন্তু বাবা তার কথা তো কানে তুললেনই না, বরং সেই বৃদ্ধকে এবং বাচ্চাটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। বৃদ্ধ যাওয়ার আগে চীৎকার করে জানিয়ে দিয়ে গেল, যে জমিদার বাড়ির এই কেচ্ছা সে গ্রামের সকলকে জানিয়ে দিয়ে যাবে!…তবে বাড়ির ফটকের বাইরে বেরোতে পারলোনা তারা, তার আগেই বাবার নির্দেশে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো চারজন লেঠেল!…লাঠির আঘাত মাথায় লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বৃদ্ধের। বেঁচে যায় ছেলেটি।”

    “তাকেও মারতে চলেছিলেন বাবা, কিন্তু আমি তার পা ধরে সেই যাত্রায় রক্ষা করলাম দাদার রেখে যাওয়া শেষ চিহ্নটাকে!…তবে বাবা আমাকে কথা দেওয়ালেন, যে এই অবৈধ সন্তানটি যেন এই বংশের বিষয়সম্পত্তির কোনো অংশের উত্তরাধিকার না পায়! তাকে প্রাণে বেঁচে থাকতে গেলে, সকলের চোখের অলক্ষ্যে থাকতে হবে!…আমি জানতাম দাদার তন্ত্রমন্ত্র করার গুপ্তকক্ষের ঠিকানাটা, তাই সেদিন থেকেই ছেলেটিকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য আমি রেখে এলাম সেখানে। বাড়ির এক বিশ্বস্ত চাকরের দ্বারা তার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হল…তবে বাবার মৃত্যুর পরও কেন জানিনা, তাকে দেওয়া কথা ফেলতে পারলাম না আমি। জনসমক্ষে আনতে পারলাম না দাদার সন্তানকে!…তবে আজ আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, এই পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ সোমেশ্বরকে দিয়ে যেতে চাই আমি!”

    এতক্ষণ শোনার পর প্রথম মুখ খুললো অমূল্য, “কে ছিলো সেই মৃত কাজের মেয়েটি, যে জেঠুর সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছিলো?”

    “চাঁপা…গাঁয়ের লোকেরা তাকে চাঁপা বলে ডাকতো!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন শশীভূষণ।

    ঠিক সেই সময় শশীভূষণের ঘর থেকে শোনা গেল একটি কান ফাটানো আর্তচিৎকার, আর সেই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তীব্র আওয়াজ!

    (৭)
    ‘পাতাল ঘরে’ ঢুকে পারুল ছুটে গেল সেই দীর্ঘদেহি সুপুরুষ যুবকটির দিকে, যাকে এতকাল ধরে এই ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। উস্কোখুস্কো চুল, একমুখ দাড়ি এবং মলিন বেশভূষা পরিহিত যুবকটি উবু হয়ে বসে ছিলো ঘরের মেঝের ওপর। সেও যেন খুব আশ্চর্য হল এই রাতের অন্ধকারে পারুলকে দেখে।

    “আপনি তো কোনো অশরীরি নন…আপনি একজন মানুষ!…আমাদের মতই মানুষ!…কে আপনি? বলুন কে?”, চিৎকার করে ওঠে পারুল।

    থরথর করে কেঁপে উঠলো যুবকের ঠোঁটদুখানি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। শুধু অস্ফুট কণ্ঠে নিজের নামটা বলে উঠলো সে, “স…সোমেশ্বর!” সেই মুহূর্তে পারুল সেই যুবকের হাত ধরে তাকে বার করে আনলো সেই ঘর থেকে, তারপর তাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে বেরিয়ে এলো বাড়ির বারান্দায়।

    “ও যেই হোক না কেন, ওকে বাঁচিয়ে রাখলে যে এই পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তি আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে, পারুল!…দেখো না, বাবাও যেন এই বুড়ো বয়সে দয়ার সাগর হয়ে উঠেছেন, বলছেন কিনা এখন প্রায়শ্চিত্ত করবেন!…দিয়েছি বুড়োর মাথায় পিস্তলের বাঁটের এক ঘা, এখন সে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে নিজের ঘরে, যার দরজা আমি বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছি!…হাহাহাহা!”

    কথাগুলো শুনে সচকিত হয়ে পারুল সামনে তাকিয়ে দেখলো, যে নিজের জেঠতুতো দাদার দিকে পিস্তল বাগিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অমূল্য, মুখে পৈশাচিক হাসি! অমূল্যের এই ধুর্তামির সাথে নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে রইলো পারুল। তারপর আচমকা সোমেশ্বরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিয়ে দৌড়ে উঠে গেল বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে, সোজা ছাদের উপর। অমূল্যও পেছন থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছুটে আসতে লাগলো তাদের পেছন পেছন।

    ছাদে উঠে কার্নিশের দিকে অগ্রসর হতেই দু’জনে বুঝলো, যে আর পালাবার কোনো জায়গা নেই! ওরা দু’জনেই পেছন ফিরে চেয়ে দেখলো, যে হিংস্র মুখে সোমেশ্বরের দিকে পিস্তল তাক করে সেদিকেই এগিয়ে আসছে অমূল্য। একটি বিকট হাসি হেসে পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দিতে গেল অমূল্য, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নিলো সোমেশ্বর! ঠিক সেই মুহূর্তে, অমূল্যের সামনে খোলা ছাদের মাঝে রাতের বাতাসের ধূলিকণাগুলো মিলেমিশে সৃষ্টি করলো এক নারীর আবছা অবয়বকে! ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো অমূল্য, পিস্তলটি পড়ে গেল তার হাত থেকে! পারুল জানে, এই অশরীরি আর কেউ নয়…সোমেশ্বরের মৃত মা, চাঁপা!

    নিজের ছেলেকে এই বন্দী দশা থেকে উদ্ধার করার জন্যই সে অশরীরি হলেও বন্ধুত্ব করেছিলো পারুলের সাথে। এই ‘পাতাল ঘরে’ কি আছে, সেটা জানার কৌতূহল সৃষ্টি করেছিলো সে পারুলের মনে। আর আজ এই মুহূর্তেও নিজের ছেলেকে মৃত্যুর মুখে থেকে সেই উদ্ধার করতে এসেছে!

    ধীরে ধীরে চাঁপার অপার্থিব দেহটি এগিয়ে চলেছে অমূল্যর দিকে, আতঙ্কে কম্পিত পায়ে সে এক পা দুই পা করে পিছিয়ে চলেছে। অমূল্য বুঝতেও পারলো না, সে ছাদের বিপরীত দিকের কার্নিশের কতটা নিকটে চলে এসেছে সে! কিন্তু চাঁপার প্রেতাত্মা তখনও একই গতিতে অগ্রসর হতে লাগলো তার দিকে…আর নিজের শরীরের ভার সামলাতে পারলো না অমূল্য…তাল সামলাতে না পেরে, শেষ আর্তচিৎকার করে তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল তার দেহ…নিচে পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিথর হয়ে গেল অমূল্যর রক্তাক্ত শরীরটা!…সেই মুহূর্তে চাঁপা পেছন ফিরে তাকালো আতঙ্কিত সোমেশ্বর আর পারুলের দিকে, মুখে প্রসন্নতার হাসি। এরপরই একটা দমকা হাওয়ার বাতাসের সাথেই চিরবিদায় জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল চাঁপার অবয়ব!

    (৮)
    এক মাস পরের ঘটনা:
    ———————————
    মাথায় লাগা আঘাতটা থেকে এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন শশীভূষণ। নিজের ছেলের জায়গাতেই তিনি বসিয়েছেন সোমেশ্বরকে। এখন সমস্ত বিষয় সম্পত্তির ভার তার ওপর। শশীভূষণ নতুন করে এই বাড়িতে পারুলকে ফিরে পেতে চান, সোমেশ্বরের স্ত্রী হিসাবে। স্বামীকে হারিয়ে কিছুদিনের জন্য ভেঙে পড়েছিলো পারুল, এখন সেও মত দিয়েছে সোমেশ্বরের সাথে নতুন করে বাঁচার। তবুও মাঝে মাঝে তার একটা কথাই মনে হয়:

    “অশরীরিদের কথা মনে হলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, যে তারাও মানুষের বন্ধু হতে পারে! আমাদের সাহায্য করতে পারে! আর সর্বোপরি, এই রক্ত মাংসে গড়া মানুষদের প্রবৃত্তিও অশরীরিদের থেকে আরো কত বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে!”

You cannot copy content of this page