ভৌতিক গল্প
-
রাতের অতিথি
রাতের অতিথি
-রাখী চক্রবর্তীকনকদা রাইস মিলের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। গাঁয়ের পথে আলোর ব্যাবস্থা নেই বললেই চলে। শুধু শহরের বাবুদের বাড়িতে আলো ঝলমল করে। তবে ওনারা যখন গাঁয়ের বাড়িতে আসেন তখনই।
কনকদা বেশ সাহসী। ভুতের ভয় সে পায় না। তবে চোর ডাকাতদের বিশ্বাস নেই। কখন দাঁ দিয়ে কোপ বসাবে ঘাড়ে স্বয়ং ভগবানের ও জানার সাধ্যি নেই। কনকদা নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে পালবাবুদের বাড়ির সামনে এসে পড়েছে তা নিজেই খেয়াল করেনি। হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে পালবাবুদের বাড়ির দিকে তাকাতেই নজর পড়ল বাড়ির সদর দরজাটা খোলা। কনকদা একটু অবাকই হল। এত রাতে সদর দরজা খোলা।
–কনকদা! ও কনকদা এসো না!
–কে কে ডাকল আমাকে।
কনকদা একটু সাহসের সাথে ভেতরে গিয়ে দেখল, টেবিলের ওপর দু পা ছড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে অনিমেষ পাল মানে ছোরদাবাবু। ছোড়দাবাবুকে সেই ছোট্ট থেকে দেখছে, ভুল হওয়ার কথা না।
-তা দাদাবাবু আপনি অন্ধকারে কেন? আলো জ্বালাননি কেন? এর মধ্যে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে দোতলার বারান্দা থেকে।
অনিমেষ বলল, অন্ধকারে থাকতে ভালো লাগছে তাই।
কনকদা বলল, দাদাবাবু আজ রাতে আমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করবেন। চলুন আমার সাথে।
অনিমেষ বলল, যেটা বলতে এসেছি সেটা তোমাকে বলে দিই। মা যদি এখানে না আসতে পারে তবে তুমি কিন্তু এ বাড়ির দ্যাখা শোনা কোরো।
-তা ঠিক আছে দাদাবাবু। আপনি আছেন তো।এই কথা বলতে বলতেই কনকদার চোখ ঝুল বারান্দার দিকে গেল। কুকুরের চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। যেন গিলে খাবে এক্ষুনি। হা করে আছে। কনকদা খুব ভয় পেল। চেয়ারে দেখল দাদাবাবু নেই। কোথায় গেল নিমেষের মধ্যে। কনকদার গা ছমছম করছে। বাড়িটাকে আঁধার গ্রাস করছে। নিস্তব্ধ নিঝুম। দাদাবাবু……… দাদাবাবু……..!
-এই তো আমি….!কনকদার সারা গা শিউরে উঠল। দাদাবাবুর পা শূন্যতে, হাত নেই। চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছে। আঁশটে গন্ধ। কনকদা মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
দে বাড়ির গিন্নিকে দাহ করে ফেরার সময় গায়ের ছেলেরা কনকদাকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাকে কিছুটা সুস্থ করে তুলল। ততক্ষণে পূবের আকাশে সূর্যি মামা উঁকি দিচ্ছে। কনকদা একটু সুস্থ হয়ে সবাইকে রাতের ঘটনাটা বলল। এর মধ্যে গ্রামে হৈচৈ পড়ে গ্যাছে , যে কাল বিকেল বেলায় পালবাবুর একমাত্র ছেলে ও পোষা কুকুর দুজনেই গাড়ি দূরঘটনায় মারা গেছে। কনকদা বুঝতে পারল যে কাল রাতে সে কাকে দেখেছে। এবার কনকদা স্বাভাবিক হতেই দাদাবাবুর ইচ্ছার কথা সবাইকে বললো। ছোড়দাবাবুর কথা মতো বাড়ি দেখাশোনা করে আজও কনকদা। কিন্তু বাগানের আনাচে কানাচে, ঝুল বারান্দায় দাদাবাবু ও কুকুর টাকে ঘুরতে দেখে মাঝে মধ্যে। -
জঙ্গলে আত্মা বদল
জঙ্গলে আত্মা বদল
-রাখী চক্রবর্তীবিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, করাত্ করাত্ বাজ পড়ছে। ঘন জঙ্গলে একাকী আমি। রাত বারোটা বাজে। ঠিক এখনি জঙ্গলের পাশের ডোবা থেকে একটা পদ্ম ফুল তুলে আনতে হবে আমাকে। তা না হলে আমার কার্য সিদ্ধি হবে না।আমাকে অমরত্ব লাভ করতেই হবে। তান্ত্রিক বাবা অভয় দিয়েছে। আমাকে কাজটা করতেই হবে।”,,,,,,কনাদ জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে। কনাদের মাথার পাশে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে। কনাদের মা মানে আমার ফুল কাকিমার তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। কি যে তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়েছে। এদিকে জ্বরটা ও নামছে না। রাত দুটো বাজে ভোরের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। পূব আকাশে সুর্য্যি মামার দেখা মিলতেই বাড়ির সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এখনই কনাদকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। কিন্তু কনাদ তো অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আর গায়ে জ্বরটা নেই। যাক, মা কালী সব রক্ষা করেছে। বাড়ির পরিবেশটা এখন বেশ ভালো। সামনে কালীপুজো তার জন্য অনেক কেনাকাটা আছে। আমরা সবাই রায়না যাবো মামার বাড়িতে।কালীপুজোর সময়। কনাদকে ব্যাগ গোছাতে দেখলাম।কি সব জিনিসপত্র নিচ্ছে বুঝি না বাবা।আমি ঘরে ঢুকতেই চমকে গেল কনাদ।
কাল সকালে রওনা দেবো।খুব মজা হবে।
রায়না পৌছতে আমাদের রাত্রি হয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে আমরা যে যার মতো শুয়ে পরলাম।
ঠুকঠুক আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি কনাদ একটা ঝোলা নিয়ে পেছনে বাগানের দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু না ভেবে আমি পিছু নিলাম ওর।শুনশান আলের পথ বেয়ে কনাদ যাচ্ছে পিছনে আমি।পথ চলতে চলতে ঘন জঙ্গলে আমরা প্রবেশ করলাম।আমার গা’টা ছ্যাৎ করে উঠল। সামনে বিশাল একটা ছায়া মূর্তি দেখে। তারপর ঝোপের আড়ালে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার শরীর পুরো ঠান্ডা হয়ে গেল।ছায়া মূর্তিটা একটা তান্ত্রিক-এর রূপ নিল। কনাদ ঝোলার থেকে একটা মাটির সরা বার করে তান্ত্রিককে দিল। তান্ত্রিক হিসু করে কনাদকে পান করতে বলল।কনাদ সেটা পান করল। আমার গা’টা ঘিনঘিন করে উঠল। কনাদ যেন একটা ঘোরে আছে। এবার জঙ্গলের পাশের ডোবার দিকে কনাদ গেল, জলে ঝাঁপ দিয়ে একটা পদ্ম ফুল তুলে যেই তান্ত্রিকের হাতে দিল ওমনি তান্ত্রিকটা সারা বিশ্ব কাঁপানো হাসি হাসলো। কনাদ এবার ঝোলার থেকে একটা ছুরি বের করে নিজের হাত কেটে রক্ত বের করে তান্ত্রিককে দিল আর নিজে নিজের রক্তর তিলক পড়ল। এবার কনাদ ক্রমশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তান্ত্রিকটা অট্টহাসি হেসে কনাদের দেহটা টুকরো টুকরো করে লাল সুতোয় বেঁধে নিজের গলায় পড়ল।আমি এ সব দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপরের ঘটনা আমার মনে নেই। চোখ খুলে দেখি আমার সারা শরীর ব্যান্ডেজ করা। কিন্তু সবাই আমাকে কনাদ বলে ডাকছে কেন? আমি তো বিট্টু। সবাই কি আমাকে ভুলে গেল? দরজার পেছনে কে কে উঁকি মারছে? আমি জিগ্যেস করতেই ফুল কাকিমা আমাকে বলল,”বিট্টু কাল রাতে কোথায় গেছিল জানিস।” বিটটু আর বেঁচে নেই রে। আমি চীৎকার করে বলছি, “আমি ই বিট্টু।কনাদ মারা গেছে।” ফুল কাকিমা বলল,”বিট্টুর আত্মা যেন শান্তি পায়। কনাদ,,, কনাদ করে আমি ডাকছি।কনাদ আমার কানে কানে বলল, “আমাকে কোনোদিন মৃত্যু স্পর্শ করতে পারবে না। হা হা হা। এক এক করে সবাইকে মেরে আমি তাদেরই দেহে নিজেকে ধারণ করে বাঁচবো বছরের পর বছর।”আমি চিরকার করে মাকে ডাকছি। মা আমি বেঁচে আছি। মা কেন কাঁদছে আমার ফটো নিয়ে? আমি কনাদ না। বিশ্বাস করো। কেউ আমার কথা শুনতে পেল না।
কাল অমাবস্যার রাতে ঘন জঙ্গলে যেতে হবে।ডোবার থেকে পদ্ম ফুল তুলতে লাগবে। কে জানে আমার পিছু কে নেবে,,,,,,,,,?? -
আত্মার প্রতিশোধ
আত্মার প্রতিশোধ
-রাখী চক্রবর্তীবাইরে বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। বসন্ত কাল। তাই আবহাওয়া ও বাদলবাবুর মন দু’টোই ফুরফুরে। আজ কাজে যাবে না ঠিক করেছে বাদলবাবু। বাদলবাবু স্ত্রী অর্চনা ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পৈতিক ভিটে ছেড়ে বছর তিন হল এই বাংলোতে বাস করছে। হৈ হট্টগোল নেই বেশ শান্ত পরিবেশ। এতটাই শান্ত যে দিনে দুপুরে খুন ডাকাতি হলে কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারবে না।বাদলবাবু মর্গে কাজ করে। তা বাড়ি ফিরতে তার বেশ রাত্রি হয়। ছেলেমেয়ে দুটো বেশ ডাকাবুকো। অত সাহস বাবা ভালো না। অর্চনা দেবী কিন্তু ভিতু মহিলা। গত পরশু দিনের ঘটনাটা বলছি। কি হয়েছিল সেদিন ,,,,,,,
কাজে যাবে না বলে বাদলবাবু ছেলেমেয়েকে জানিয়ে দিল। ওরা খুব খুশি। বাড়িতেই ওরা চারজন হৈ হুলোর করবে। ভাল ভাল খাবার খাবে কিন্তু রাত আটটার সময় মর্গের থেকে ফোন এল, যে করেই হোক বাদলবাবুকে রাতে ডিউটিতে যেতেই হবে। কি আর করা যাবে,,,, কাজ তো। অর্চনা দেবী ছেলেমেয়েকে নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ল। ঠিক রাত দুটোর সময় কলিং বেল বাজছে টিরং টিরং অর্চনা দেবী ভাবছে বাদলবাবুর তো নাইট ডিউটি তাহলে এখন কে বেল বাজাচ্ছে? লেন্স দিয়ে দেখে অর্চনা দেবী দরজা খুলে বাদলবাবুকে বলল,”শরীর ঠিক আছে তোমার এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?” বাদলবাবু হুম বলে নিজের ঘরে চলে গেল। বাদলবাবুর ছেলেমেয়ে কিছুই টের পেল না। রাত তিনটের সময় বাদলবাবুর ছেলে রন বাথরুমে যাবার সময় দেখল মেন গেটের পাশে বিশাল একটা ছায়া মূর্তি। কে,,, কে,,, ওখানে বলতেই ছায়া মূর্তিটা উধাও। যাইহোক বাথরুমে ঢুকেই রন চমকে গেল ওর বাবাকে দেখে। ওর বাবার সারা শরীরে ধারালো অস্ত্রের দাগ। কিন্তু কোন রক্ত নেই। রন ওর বাবার এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করতেই ওর বাবা দু’হাত বাড়িয়ে রনের গলাটা টিপে ধরেছে।রনের চিৎকার শুনে পিয়ালি রনের বোন ঘরের বাইরে এসে এদিক ওদিক দেখছে কিন্তু কাউকে দেখতে পারছে না। গোঁ গোঁ আওয়াজটা মনে হয় বাথরুম থেকে আসছে। পিয়ালি বাথরুমের সামনেই দেখল রন পড়ে আছে মুখ দিয়ে গেজলা বের হচ্ছে। মা, মা, করে ডাকতেই ওই ছায়া মূর্তিটা পিয়ালির গলাটা টিপে মাটিতে ফেলে দিল। অর্চনা দেবী এসবের কিছুই জানতে পারলো না। অর্চনা দেবী বিছানায় শুয়ে আছে বাদলবাবুর মুখে কোন কথা নেই ।পাশ ফিরে শুয়ে আছেন উনি।
কি গো,,, তুমি কোন কথা বলছো না। কি হয়েছে, ,,?অর্চনা দেবী কথাগুলো বলার সাথে সাথেই পাশ ফিরল বাদলবাবু ।ওমা,,,,আপনি কে? আপনি এখানে কি করে এলেন? বিকৃত মুখ দেখে চেনার উপায় নেই উনি কে।সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত। চোখ দুটো ঠিকরে আসছে ।অর্চনা দেবী ভয়ে কাঁপছে ।রন,,, পিয়ালি,,, তোরা কোথায়, ,,,,
কি বিকট হাসি হেসে ভয়ঙ্কর লোকটা বলছে,”সব শেষ করে দিয়েছি শুধু তুই বাকি।” কে কে আপনি?এর মধ্যেই ভুলে গেলি আমাকে। মনে কর একবছর আগের ঘটনা।
অর্চনা দেবী কাকুতি মিনতি করছে, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। ছেড়ে দাও। এই বাড়িটা আমি কালকেই ছেড়ে দেব। রতনদা তোমার বাড়িটা লোভে পড়ে আমরা নিয়েছি। কিন্তু ও তোমাকে মারতে চাইনি। গলাটা এতো জোরে টিপেছে ও তোমার। ও নিজেই বুঝতে পারেনি।রতনের আত্মা ছায়া মূর্তি ধারণ করে বলল, “বাদলদাকে গাড়িতে ধাক্কা মেরেছে। ও এখন মরগে আছে। তোর ছেলেমেয়েও আর নেই। এবার তোর পালা বলেই অর্চনা দেবীর গলাটা টিপে মাটিতে লুটিয়ে দিল রতনের ছায়া মূর্তি। রতন ছিল বাদলবাবুর দূর সম্পর্কের খুড়তুতো ভাই। রতনের আত্মা প্রতিশোধ নিল। আজ সে মুক্ত। বাংলোটা বাদলবাবুর খুব পছন্দ ছিল। রতন কিছুতেই বিক্রি করবে না।আর বাদলবাবুও ছাড়বে না। এই রকম অবস্থায় দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তিতে বাদলবাবুর হাতে মরতে হল রতনকে।পরের দিন সকাল বেলায় কাজের মেয়ে এসে দেখল মেন গেট খোলা তছনছ সব জিনিস পত্র। অর্চনা দেবীর জ্ঞান আসতেই রন আর পিয়ালির খোঁজ করছে। পুলিশ এসে রন আর পিয়ালির ডেড বডি বার করল। বাদলদার বডি পোস্টমটম হল।অর্চনা দেবী এখন মেন্টাল হসপিটালে আছেন। বাংলোটার আর কেউ দাবিদার রইল না। ভুতুড়ে বাংলো হিসাবে এখন সবাই চেনে।
-
সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ও জিন ভৌতিক গল্প
সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ও জিন
-সৌমেন সরকারসে অনেক বছর আগের কথা।
যখনকার কথা বলছি তখন আমি ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। মাধ্যমিক পাশ করার পর ভালো ছাত্রদের মধ্যে প্রায় সবাই রাখালদাস হাই স্কুল ছেড়ে অন্যান্য স্কুলে অ্যাডমিশন নিয়েছে। আমি আর আমার বন্ধু নিতাই পণ্ডিত থেকে গেছি। ক্লাস সেভেন থেকেই ওর সাথে আমার নিবিড় ও প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।
একদিন ওর বাবা নিমাই পণ্ডিত মহাশয়ের নিমন্ত্রণে গেলাম ওদের বাড়ী। ছয়ঘরিয়া অঞ্চলেই,তবে মেন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। এখন যেখানে সৎ সংঘের মন্দির ওখান থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ওখানে। নিমাই বাবু মানুষটি কিন্তু অমায়িক প্রকৃতির। পুরোটা সাধু-সন্ন্যাসী না হলেও মহারাজ ব্যক্তি। শিষ্যটিষ্য অনেক আছে শুনেছি। তবে তেমন জাঁদরেল পোশাক আশাক পরেননা। ওনার মতে,উনি একজন সাধারণ মানুষ।ভগবান আর আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করেন শুধু। সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবী পরেন।কপালে তিলক বৈষ্ণব স্টাইলে টানা, আর চুল একটু বড় বড়। আলাপ হল নিতাই এর মায়ের সাথেও।এককথায় পারফেক্ট ফ্যামিলি।
সেখানেই নিমাই বাবুর মুখে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের যে বিচিত্র ও আশ্চর্য কাহিনী শুনেছিলাম তা কোনদিনই ভুলবনা। আগে অবশ্য নিতাই এর কাছে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের নাম শুনলেও এতটা জানতাম না।
তখন রাত প্রায় দশটা। এখনকার মত অতটা আলোর ব্যবস্থা ছিলনা। তাই রাতে আমাকে বাড়ী ফিরতে দেননি। আমিও বাড়ী ফেন করে সেকথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। ডিনার শেষ করে আমরা সবাই ছাদে এসে বসলাম। সময়টা কালীপূজোর পর,অগ্রহায়ণ মাস। তাই শীত ততটা পড়েনি। চারদিক খোলা ছাদ হলেও বসা ও বিশ্রামের জন্য ছাউনি দেওয়া আছে। একটা খাটিয়াও পাতা আছে ছাউনির নীচে। অনায়াসেই তিনজন সেখানে বসা যায়। খাটিয়ার একপাশে নিমাই বাবু আর অন্যদিকে আমি আর নিতাই গায়ে গায়ে ঘেঁসাঘেসি করে বসেছি। তখনও কিন্তু আমি পুরোপুরি সাহিত্যিক হইনি। কিছু কবিতা আর গল্প প্রকাশিত হয়েছে মাত্র। আর “নীলাঞ্জণা” খানা শেষ করেছি সবেমাত্র।
যাক,সেসব কথা থাক। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক নিয়ে গল্প লিখতে বসে এটুকু ভূমিকা করে এবার আসা যাক মূল কাহিনীতে।
পরস্পরের পরিবারের কথা আলোচনা,কুশলপ্রশ্নাদি সমাপ্ত হলে নিতাই ওর বাবাকে জানিও দিল যে আমি লেখালিখি করি। আর প্যারানরমাল বিষয়ে আমার আকর্ষণ প্রবল। তাই শুনে নিমাই বাবু হাসিমুখে বললেন-“শোন বাবা সৌম্য! শুধু লিখলেই হয়না। যা লিখবে তার সাথে যদি বাস্তবের মিল না থাকে তবে পাঠক সেই লেখার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবেনা। আর প্যারানরমাল বা ভৌতিক গল্পের ক্ষেত্রে তো কথাটা আর জটিল।”-“কিরকম? ঠিক বুঝলাম না কাকু!” আমি প্রশ্ন করলাম।
উনি বললেন-“কোনো সত্যি ঘটনা থেকে গল্পের বীজ বপন করলে পরে তাতে রং চড়িয়ে লিখলেও কোন ক্ষতি হয়না। বরং তা আরও বাস্তব হয়ে ওঠে। আর ভৌতিক গল্পের ক্ষেত্রে শুধু কঙ্কাল,ভূত আর গয়ায় পিণ্ড দান করলেই গল্প হয়না। সেখানেও অজস্র জানার বিষয় আছে,আছে আজস্র নিয়ম কানুন। সব জানলে এত গল্প লিখতে পারবে যে কয়েকখানা বই বের করতে পারবে।”আমার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল। উনি একথা বলে একটু চোখটিপে হাসলেন। আমিও উদ্গ্রীব হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। উনিই আমার বড় নামখানা ছোট করে সৌম্য করে নিয়েছেন।আর এই নামটা নাকি আমার সঙ্গে ভালো যায়। আমার ভালো লাগল নতুন নাম পেয়ে।
ইতিমধ্যে নিতাই এর মা এসে সবাইকে একবাটি করে মিষ্টি দই আর গোটা পাঁচ-ছয়টা করে রসগোল্লা দিয়ে গেছেন। নিমাই বাবু ইশারায় সেগুলি খেতে বললেন।আমরা খাওয়া শুরু করলাম। আমার ঔৎসুক্য দেখে উনিও আর ভণিতা না করে বললেন-
“শোন তবে। আজ তোমাদের এমন একজনের কাহিনী শোনাব যাকে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে তিনি একজন পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক। আমরা তাঁকে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বলেই চিনতাম। তিনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু।
তখনও আমরা এদেশে আসিনি। থাকতাম কুমিল্লা থেকে চোদ্দ-পনের কিলোমিটার ভিতরে একটা গ্রামে।গ্রামের নামখানা এই মুহূর্তে মনে পড়বে না,কারণ তখন আমার বয়স আট কি দশ বছর। আমি তাঁকে খুড়ো বলেই ডাকতাম। থাকতেন আমাদের বাড়ী থেকে তিনটে বাড়ী পর পাল বাবুদের নীচের দুখানা ঘর ভাড়া নিয়ে।এখন এখানেই আছেন,উদয়পুরে। আমরা আলে আসার বছর খানেকের মধ্যে উনিও চলে আসেন।পরিবার বলতে এক ছেলে কিশোর,এক মেয়ে শকুন্তলা আর স্ত্রী পদ্মা,মানে পদ্মাবতী। তবে তারা কেউই বেঁচে নেই। ওনাদের প্রত্যেকের মৃত্যুর পশ্চাতে একটা করে ভয়ানক কাহিনী আছে! সেসব অন্যদিন বলব। তখন বয়স বত্রিশ কি তেত্রিশ হবে।
প্রায় ছয়ফুট লম্বা,ফর্সা,দীর্ঘ বলিষ্ট পেশিবহুল চেহারা।গলায় আর দুহাতের বাইসেপস ও ট্রাইসেপস জুড়ে আছে মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা। বড় বড় না কাটা চুল জটায় রুপান্তরীত হয়েছে। গোঁফদাঁড়ি লম্বা,তবে মাঝে মাঝে ছাঁটা হয়। দুচোখ জবা ফুলের মত টকটকে লাল! প্রথমদিকে ভয়ে বাবার কোলে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। কিন্তু পরে সে ভয় কেটে গিয়েছিল। উনি আমাকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসতেন,স্নেহ করতেন। তাঁর কোন শিষ্য বা চেলাচামুণ্ডা ছিলনা। একাই রেঁধে খেতেন। বেশ কিছু বছর পর থেকে আমি একাই ওখানে যেতে শুরু করলাম। বিভিন্ন গল্পের মধ্যে একদিন আমি বললাম যে আমারও তন্ত্রবিদ্যার প্রতি প্রবল আকর্ষণ। তা শুনে তিনি ধমক দিয়ে বললেন-“হতচ্ছাড়া! সংসারী হ! এপথে আসিসনা,পারবিনা। তোর কপালে যে সংসার সুখ আছে।”
কিন্তু আমিও ছাড়বার পাত্র নয়। শেষে আমার পীড়াপীড়িতে নিমরাজি হলেন। তবে তন্ত্রবিদ্যা যে আমার কপালে সইবেনা তা প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন।তিনি আমাকে কিছু সাধনপদ্ধতি শিখিয়েছিলেন পরে ধীরে ধীরে। যার জন্য আমি পরে এই মহারাজের জীবনযাপন করতে পারছি। গুরু হয়ে শিষ্যদের সঠিক পথ দেখাতে পারছি। সেসব কথা অন্যসময় বলবো।এখন আসল কথা শোন।একদিন আমায় ডেকে বললেন-
“শোন্ নিমাই, আগামী শনিবার মহাব্রত যোগ আছে।দুর্গাষ্টমী তিথিতে ঐদিন রাতে এক বিশেষক্ষণে জিন নামাবো! থাকিস,ভাল অভিজ্ঞতা হবে তোর। ভবিষ্যতে বিশেষভাবে উপকৃত হবি। আর তার সাথে সাথে তোর মাথা থেকে তন্ত্রবিদ্যার ভূতও হয়তো ঝেড়ে যাবে। বুঝবি এগুলো স্রেফ আগুন নিয়ে খেলা ছাড়া আর কিছুই না!”আমি বিষয়টাকে ততটা গুরুত্ব দিলাম না। জিন নামাবে!হয় নাকি কখনও? এসব গাঁজা আর কলকে ভেবে বেজায় হাসি পেল আমার। তবে যেতে তো হবেই। ভাবছি বাবাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। বাবাকে বলতেই তিনি জানালেন,সন্ন্যাসী খুড়ো তাকে আগেই সব জানিয়েছেন। আমরা একসাথেই যাব।
যতই ডানপিটে স্বভাব হোক না কেন জিন নামানোর মত এমন একটা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হবো একথা চিন্তা করেই সমস্ত শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।কি জানি কি হবে?
দুর্গাষ্টমীর সন্ধ্যা।
সময়টা শীত নয়। ঠিক কোন মাস তা খেয়াল নেই তবে গরমের ভাব তখনও কিছুটা আছে। আমি আর বাবা স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে শুদ্ধাচার মেনে চললাম খুড়োর বাড়ী। এই স্নান করা ও শুদ্ধাচারের প্রক্রিয়া অবশ্য উনি আগেই আমাদের বলে দিয়েছিলেন।
গিয়ে দেখি যজ্ঞ প্রস্তুত। ঘরের ঠিক মাঝখানে ইঁট,কাদা মাটি ইত্যাদি দিয়ে বেশ বড়ো একটা যজ্ঞের বেদী করা হয়েছে। তার একপাশে বসে খুড়ো শেষ বারের মত যজ্ঞের সবকিছু তত্ত্বাবধান করে নিচ্ছেন। যজ্ঞবেদীর অন্যপাশে পাঁচটা কাঠের পিড়ি পাতা,আর তার পিছনে প্রায় সারা ঘর জুড়ে খেজুর পাতার তৈরী পাটি পাতা আছে যাকে চাটাই বলে। বারান্দায়ও প্রায় সারা বারান্দা জুড়ে চাটাই পাতা। কিছুক্ষণ পর খুড়ো দুচোখ বুজে পদ্মাসনে বসলেন ও বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক এভাবে থাকার পর লাল টকটকে চোখ খুলে তীব্র ঝাঁঝালো বাজখায়ী কণ্ঠে বললেন-
“আজ দুর্গাষ্টমীর মহাব্রত তিথি। আমি জিনকে আহ্বান করব। গ্রামে যার যা সমস্যা আছে,যা রোগব্যাধি আছে একে একে এসে বলবে। সবাইকে সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে সে। সবাই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু সাবধান! কয়েকটা বিষয়ে কড়া ভাবে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখতে হবে। পাঁচজন করে পিঁড়িতে বসবে। তারা প্রত্যেকে পদ্মাসনে বসবে। পিঁড়ি বেশ বড় আছে,কোন সমস্যা হবেনা। এবার আসল বিধিটা শোন সবাই।”
আমরা ঘরেই ছিলাম। তবে একপাশে কোণের দিকে।খুড়োর দিকে কেউই থাকার নিয়ম নেই। একথা বলার পর চাপা উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি গ্রামের লোকর ভিড়ে ঘর-বারান্দা প্রায় ভরে গেছে। খুড়ো কোনো দিকে নজর না দিয়ে বলে চললেন-
“দুহাতের বুড়ো আঙুল দুটোকে বাকী আঙুলের মধ্যে আবদ্ধ করে মুষ্ঠী তৈরী করে হাঁটুর ওপর সোজা ভাবে রাখতে হবে। যাতে তেলোর দিকটা নীচে থাকে। বাকী যারা আছে সবাইকে বজ্রাসনে বসতে হবে। আর তারাও ঠিক একই ভাবে মুষ্ঠী করে একই ভঙ্গীতে বসবে।সাবধান! যতক্ষণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত না হয় এবং জিন বিদায় না হয় কেউই কিন্তু আসন ছেড়ে উঠতে পারবে না। উঠলেই চরম বিপদ! আর হাতের বদ্ধ মুষ্ঠী খুললে বসে থাকা পিঁড়ি বা যজ্ঞের বেদীর ইঁট সটান পড়বে মাথার ব্রহ্মতালুতে। খুব সাবধান! করে দিচ্ছি কিন্তু আগে থেকেই। যাদের সমস্যা আছে তারা শীঘ্রই এবাড়ীর সীমানার বাইরে চলে যাও। পরে কিন্তু কিছু হলে আমার কোন দায়বদ্ধতা থাকবেনা এই বলে দিলাম।”যাই হোক,ডানপিটে ডাকাবুকো হলেও বুক যে একটু দুরুদুরু করছিল তা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। বুকের মধ্যে যেন ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। তবুও কি হয় কি হয় এই প্রবল ইচ্ছাকে সেই বয়সেও দমিয়ে রাখতে পারলাম না। দেখাই যাক না কি ঘটে। চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য অবস্থা!অনেকে স্থানাভাব হেতু বাড়ি থেকে বসার জিনিস এনে স্থান দখল করেছে। বুঝলাম,এসব খুড়োর বুজরুকি নয় হয়তো। সকলেই জানেবও মানে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের ক্ষমতাকে। তাই স্বভাবতই আমার মনেও তার জন্য শ্রদ্ধার উদ্রেক হল। এবার আসল মুখ্য ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা যাক।
সবাই বসলাম খুড়োর নির্দেশ মত। তিনি ততক্ষণে যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন। যজ্ঞের বেদীর তিনটি পর্বে বা সারিতে চারিদিক ঘিরে প্রদীপ জ্বালানো। একটা বড় পিলসুজের ওপর বড় প্রদীপ জ্বলছে খুড়োর ডানপাশে।চারিদিকে যেন অপার্থিব নিস্তব্ধতা বিরাজমান। শুধু খুড়োর মন্ত্রপাঠ শোনা যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যিই কিন্তু আমার একটু ভয় করতে লাগল। ততক্ষণে এক অন্য বিপর্যয় শুরু হয়েছে। কোথাও ঝড় নেই,বাতাস নেই;তবুও যেন ঝড়ের মহা রণতাণ্ডব শুরু হয়েছে। আর সেই তাণ্ডব কেমন মাত্র খুড়োর বাড়ীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।গাছপালা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ছে। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তখনও চোখ বন্ধ করে মন্ত্রপাঠ থামিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে চলেছেন-
“কেউ ভয় পেয়ে হাত খুলবেন না বা আসন ত্যাগ করবেন না। আমি জিন আহ্বান করেছি,সে আসছে।একটু পরেই সব শান্ত হয়ে যাবে। যা বলছি তাই করো সবাই, নইলে তোমাদের সাথে সাথে বিপদ আমারও।জিন আহ্বান করে কোন কাজ না করিয়ে তাকে অপমান করলে সে যে কোন একজনকে মেরে তার আত্মাকে সঙ্গে করে বন্দী বানিয়ে নিয়ে যাবে। তাই গোলমাল না করে আর ভয় না পেয়ে শান্ত হয়ে বসো সবাই।”
দেখলাম ম্যাজিকের মত খুড়োর বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই সব ঝড়তুফান একেবারেই থেমে গেল। আবাক দৃষ্টিতে আর একটা ঘটনা দেখে আমার বুকের রক্ত নিমেশে শুকিয়ে গেল! দেখলাম ঝড় থামার সাথে সাথেই বেদীর তিন পর্বে সাজানো প্রদীপগুলো সব একসাথেই নিভে গেল। মনে হল যেন একটা ফুঁ দিয়ে কেউ প্রদীপগুলোকে নিভিয়ে দিয়েছে। আর তখনই আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে ভয়ে মেরুদণ্ড বেয়ে যেন বরফগলা জলের একটা স্রোত প্রবাহিত হয়ে গেল।দেখলাম একটা প্রকাণ্ড দেহধারী কি একটা জীব খুড়োর পাশে বসল। খুড়োর ডানপাশে পিলসুজের ওপর রাখা প্রদীপটা আশ্চর্যজনকভাবে তখনও জ্বলছে। তার মৃদু আলোয় সেই বিশাল লোমশ দেহটা বোঝা গেলেও তার মুখটা আঁধারে আবৃত ছিল।কারণ,তার দেহটা এতটাই বিশাল যে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের ছয়ফুট দেহের প্রায় দ্বিগুণ বলে মনে হল। তার বসার হাবভাব দেখে মনে হল যে সে খুড়োর বশবর্তী হয়ে কাজ করলেও স্বেচ্ছায় আসেনি। অর্থাৎ,কোন পান থেকে চুন খসা ঘটনা ঘটলেই মহাবিপদ! খুড়ো বললেন-
“জিন প্রস্তুত! তোমাদের যা যা সমস্যা তাড়াতাড়ি আমার বলা নিয়মমত জানাও। ওর হাতে সময় কিন্তু একদমই কম।”
পাঁচজন করে পিড়িতে বসে বলতে লাগল তাদের সমস্যা। এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে জিনের পাশে গোটা ডজন খানেক ফলের ঝুড়ি ছিল। জিন সেখান থেকে গবগব করে ফল খাচ্ছে আর একএককরে সমস্যা শুনে একটা করে ফল প্রত্যেকের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র বলে। খুড়ো তখন সেই ফল খাবার নিয়ম বলে দিচ্ছেন। প্রত্যেককে অনুরোধ করলেন পথে কারও সাথে কথা না বলতে আর বদ্ধ মুষ্ঠী একেবারে বাড়ী গিয়ে খুলে গঙ্গাজল দিয়ে শুদ্ধ হয়ে নিতে। কথার অন্যথা হলেই চরম বিপদ। সকলেই খুড়োর আদেশ মেনে মাথা নীচু করে ফল নিয়ে বাড়ীর দিকে যেতে শুরু করল।
প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন এভাবে চলে যাওয়ার পর কিন্তু হঠাৎ সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দপ্ করে খুড়োর ডানদিকে পিলসুজের ওপর জ্বলা বড় প্রদীপটা নিভে গেল। আর ওদিকে বিকট হুঙ্কার ছেড়ে জিনটা উঠে দাঁড়াল। সন্ন্যাসী খুড়ো তাড়াতাড়ি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন-
“সর্বনাশ! এখানে কেউ হাতের বুড়ো আঙুল খুলে জিনকে মুক্ত করেছে। কে এতবড়…”
শুধু এটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর যা ঘটতে শুরু করেছিল তা ভাবলেও আমি কথা হারিয়ে ফেলি। তার কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের মধ্যে মৃদু একটু টাইফুন বয়ে গেল যেন! খটাস্ খটাস্ খটাস্ করে তিনটে কিসের যেন আওয়াজ কানে এল। ওদিকে যারা বাকি ছিল তারা চেঁচামেচি করতে করতে ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে প্রাণের ভয়ে। কেউ পালিয়েছে,কেউ পালাচ্ছে কেউবা হোঁচট খেয়ে পড়ে আবার উঠে একদিনে চম্পট দিচ্ছে। সে এক বিচিত্র অবস্থা। পাশে থপাস করে কিসের একটা পতন হতেই বুঝলাম বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তখন ভয়ে আমার দেহে আর যেন এক ফোঁটা প্রাণও বাকী নেই। আমি জ্ঞান হারালাম অচিরেই।জ্ঞান হতে দেখলাম আমি কুমিল্লা সরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। না,আমার কোনরকম আঘাত লাগেনি। কিন্তু খবর পেলাম সন্ন্যাসী তান্ত্রিক আর বাবার মাথায় তিনটে করে সেলাই পড়েছে। আর পাশের গ্রামের একজন মারা গেছেন। ওই স্পট ডেড আর কি। পুরো ঘটনাটা জানলাম সপ্তাহ খানেক পর, যখন সকলে সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে এসেছে। বাবাকে নিয়ে খুড়োর বাড়ী গেলাম। আর সেখানে যা শুনলাম তাতে গায়ের সবকটা রোম আমার খাঁড়া হয়ে উঠল!খুড়ো বললেন-
“যখন জিনটা ওভাবে বিকট চিৎকার শুরু করেছিল তখনই বুঝেছিলাম কেউ শয়তানি করে বদ্ধ মুষ্ঠি খুলে জিনকে মুক্ত করেছে। বুঝতে পারলে না হয়তো। দাঁড়াও আর একটু খোলসা করে বলি। জিন আহ্বানের পর আমি সকলের মুষ্ঠী বন্ধ করে মন্ত্র পড়ে জিনকে আবদ্ধ করি। সঙ্গে সকলের গাত্রবন্ধনও করে দিই। তারপর সেবার কাজ সমাপ্ত হলে জিনলোকে পাঠিয়ে তারপর বন্ধন মুক্ত করি। তাইতো সকলকে বাড়িতে গিয়ে মুষ্ঠি খুলতে বলি। কিন্তু কেউ যদি তার আগেই শয়তানি কারে মুষ্ঠি খুলে ফেলে তাহলে সকলের ওপরেই ঘনিয়ে আসে চরম বিপদের কালো ছায়া। কি অঘটন ঘটে তা তো আগেই বলেছি।”আমি বললাম-“কিন্তু যে মারা গেল সেই বা কে? তাকে তো…”
খুড়ো হেসে বললেন-“ও হোলো কালু গুনিন। আমার গুরু ভাই ও চিরশত্রু! আমরা একগুরুর শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও ও কিছুই শেখেনি। আমার তন্ত্র সাধনার পথে বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।বহুবার আমার চরম ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হতে পারেনি। আর এবার হল হিতে বিপরীত।তাছাড়া আমি বুঝতে পারলেও কিছু করার আগে মাথায় ইঁটের খোঁচা খেলাম। ওটাকে হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে পড়ল তোমার বাবার মাথায়। ক্ষমা করে দিও,ক্ষমা করে দিও তোমরা। অন্ধকারে কিছু বুঝতেই পারিনি। চিনতেও পারিনি যে ওটাই হতচ্ছাড়া কালু গুনিন।”
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম-“আরে নানা,তার কোন দরকার নেই। বেঁচে আছি এই অনেক।”
বাবাও অনেক ধন্যবাদ দিলেন তাকে।”
তারপর নিমাই বাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন-“তারপর কোথায় যে তিনি চলে গেলেন! আর দেখা হয়নি। তার কিছুকাল পর এদেশে পাকাপাকিভাবে চলে আসি।”
কখন যে রাত এগারটা বেজে গেছে খেয়ালই করিনি।তেমন শীত না পড়লেও আমি আর নিতাই ঠকঠক করে কাঁপছি। নিমাই বাবু বললেন-“ঠিক আছে,অনেক রাত হয়েছে। এখন তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। আবার এসো সময় করে,এমনসব অনেক গল্প হবে।”
সেরাতে তেমন ঘুমই হয়নি। পরদিন সকাল কিছু খেয়ে নিয়েই সাইকেল নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে দৌড় দিই। যাকে ভালো বাংলায় চম্পট বলা যায়। যা শুনেছি হুবহু লিখলাম। এখন বিশ্বাস করা বা না করা পুরোপুরি তোমাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। তবে আমি ধোঁয়াশার আবরণে আবৃত সব কুহেলী এখন কিন্তু বুঝতে পেরেছি। আসলে কালু গুনিন সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে নিজের মত ভণ্ড আর উজবুক মনে করে তার কর্মকাণ্ডকে বুজরুকি বলে মনে করেছিল। তাই, বদ্ধ মুষ্ঠি খুলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছিল। -
পরিণতি
পরিণতি
-রাখী চক্রবর্তী“এতো রাতে ছাদের রেলিংএ বসে দিশা কি করছে,,,,,না,,,,হুম,, এই নিয়ে তিনদিন হল। মেয়েটা কি করে এত রাতে সুভাষদাকে বলতেই হবে”।রাতে বাথরুমে যাবার সময় সমীর গত তিনদিন ধরে এই দৃশ্য দেখছে। যথারীতি সকালে বাজারে যাওয়ার সময় সমীর সুভাষদাকে ডেকে বলল,সুভাষদা দিশা রোজ রাতে কি করে ছাদে ?
সুভাষদা তো অবাক হয়ে বলল,দিশা …ও তো এখানে নেই। ও তো মাসীর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। কেন বলতো সমীর কি হয়েছে? ছাদে ঘোরা নিয়ে কি যেন বলছিলে?
না না সুভাষদা ও কিছু না। কিন্তু সমীরের মনে একটা জিজ্ঞাসা থেকেই গেল। কৌতুহলের তো শেষ নেই সমীরের। যাইহোক রাতে আবার কি হয় দেখতে হবে।এইসব ভাবতে ভাবতে বাজার করে এসে সব কথা সমীর তার মিসেস সংযুক্তাকে বলল। রাত ঠিক দুটো সংযুক্তা আর সমীরের নজর সুভাষদার বাড়ির ছাদের দিকে। আজ ওরা দেখল দিশা রেলিং বেয়ে হাঁটছে। ভয়ে ভয়ে ওরা ঘরে চলে এল। দিশা তো মাসীর বাড়ি তাহলে এটা কে? পুরো দিশার মতো দেখতে। পরের দিন সকালে সংযুক্তা সুভাষদার বাড়ি গেল সুভাষদার মিসেস মানে মিতাদিকে কাল রাতের সব ঘটনা খুলে বলল।মিতাদি বলল,দিশা তো এক সপ্তাহ বাড়িতেই নেই। কি যাতা বলছ? সংযুক্তা আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে এল। সুভাষদা ও মিতাদি সোসাইটির কারোর সাথে কথা বলছে না। সুভাষদা অফিস যাচ্ছে না। মিতাদি খামোশ থাকে সবসময়। কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। সংযুক্তা মিতাদির কুশল জানার জন্য ওদের বাড়ি গেছে পরের দিন বিকেল বেলায়। কিন্তু মিতা দি চুপ করে বসে আছে।সংযুক্তা তো মাথামুণ্ডু কিছু ই বুঝলো না। যাইহোক রাত বারোটার সময় সুভাষদা ও মিতাদি পুরানো এলবাম নিয়ে দিশার ফটো দেখছে। হটাৎ দিশার মুখটা বেলার মুখে পরিণত হল নিমেষের মধ্যে। ভয়ে কাঁটা হয়ে গেল দুজনেই। এটা কি করে সম্ভব। এবার বেলার ফটো বার করতেই তাতে দেখল দিশার মুখ। হাত পা তাদের অসাড়। বোবা হয়ে গেল দুজনে। চলে গেল 20 বছর আগের ঘটনায়। তখন 22বছরের যুবতী বেলা সুভাষকে ভালোবেসে আত্মহারা হয়ে গেছে। সে আর কিছু চায় না সুভাষকে ছাড়া। এদিকে মিতা কিছুতেই এটা মেনে নেবে না। সুভাষের সন্তান তখন মিতার গর্ভে। বেলা সুভাষদের দুর সম্পর্কের আত্মীয়া।প্রেম পত্রের ভয় দেখিয়ে বেলা সুভাষকে কাছে পেতে চায়। কারণ বেলা জেনে গিয়েছে যে মিতা সুভাষকে ভালোবাসে। মিতা আর সুভাষ দুজনে ঠিক করল বেলাকে চিরঘুমের দেশে পাঠিয়ে দেবে।
তাতে সবদিকে রক্ষা পাবে। মন্দিরে সুভাষ ও মিতা বিয়ে করে ফেরার সময় বেলার সাথে ওদের মুখোমুখি হলে বেলা আবার ভয় দেখাতে শুরু করল। তখন সুভাষ বলল বেলাকে একটু ওদিকে চল তোমার সাথে কথা আছে। ওরা তিনজন আর শুনশান রেল লাইন।আচমকা ট্রেন আসতেই একটা ধাক্কা, ,?,ব্যাস, ,,,আপদ শেষ ।
টিরং টিরং হ্যালো মা,”আমার এখানে ভালো লাগছে না। আমি কাল বাড়ি আসব”। ফোনটা কেটে গেল।তোমার মোবাইলটা তো বললে খারাপ হয়েছে তাহলে,,,,, বেশ ভয়ে ভয়ে বলল মিতাদি সুভাষদাকে।সুভাষদা বলল, তাহলে এখন ঠিক হল। দাঁড়াও দিশাকে একবার ফোন করি,দিশা কেমন আছিস মা? দিশা বলল, কখন থেকে ফোন করছিলাম লাইন ই পাচ্ছি না কার সাথে এতো কথা বলো না,,, বুঝতে পারিনা। মিতাদি বলল ,তুই তো এই মাত্র ফোন করলি। দিশা বলল ,পাগল নাকি ,,,আমি শুয়েছিলাম। এখন রাখ আমি কাল বাড়ি আসছি। ফোন কেটে গেল। খুব সকালে দিশা বাড়ি ফিরলো। মা ,বাবা যেন হাতে প্রাণ পেল। বিকেলে খুব চিৎকার করে কার সাথে যেন দিশা ফোনে কথা বলছে। মিতাদি কিছুই বুঝতে পারছে না।মেয়ের মুখ গম্ভীর। কোনও কথা নেই। রাতে ডিনার না করে দিশা ঘরে চলে গেল। সুভাষদা ও মিতাদি চিন্তায় বিষণ্ণ হয়ে আছে। রাত্রি বেলায় একটু তন্দ্রা এলো সুভাষদা ও মিতাদি ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরবেলাতে সোসাইটির সবার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে দেখল দিশা রাস্তায় পড়ে আছে রক্তের বন্যা বইছে। পুলিশ এল এসে দিশার ঘর থেকে একা চিরকুট পেল তাতে লেখা ছিল, “বিবেক আমাকে ঠকালো মা।ও আমাকে ভালোবাসে না। ও অন্য কাউকে ভালবাসে।” সুভাষদা ও মিতাদি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে আর হয়তো মনে মনে ভাবছে পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। -
সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ও ভূত
সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ও ভূত
-সৌমেন সরকারপ্রায় বছরখানেক পর নিতাই পণ্ডিতের সাথে দেখা হল।
সবার আগে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার।নিতাইদের পদবি কিন্তু পণ্ডিত নয়,ওরা অধিকারী।আসলে ওর বাবা নিমাই বাবু মহারাজ ব্যক্তি বলে সবাই পণ্ডিত উপাধি দিয়েছে। তাই আমিও নিতাই পণ্ডিত বলে ডাকি।
এবার ওর আমাদের বাড়ীতে আসার কারণটা সম্পূর্ণ আলাদা যা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এসেই খাটের ওপর থপাস করে বসে পড়ে কোন ভূমিকা না করে বলল-“আমার ছোট মাসিকে চিনিস তো?”
আমি বললাম-“হ্যাঁ,ওই শুভররত্নপুর না জাঙ্গিপুর কোথায় যেন বাড়ী। নাম তো টুয়া। কেন কি হয়েছে ওর?”
-“সি ইজ পোজেজড্।”
শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড়! ওর কথার অর্থ হল এই যে,ওর টুয়া মাসিকে কোন এক প্রেতাত্মা নিজের বশে করে নিয়েছে। ওর পরবর্তী খবরটা শুনে আমি তড়াক করে ওর পাশে খাটের ওপর বসে পড়লাম। ওর মাসির ঘাড় থেকে ভূত নামাতে স্বয়ং সন্ন্যাসী তান্ত্রিক আসছেন!
আমি বললাম-“এই দাঁড়া দাঁড়া। তোর বাবা বলেছিল সেই জিনের ঘটনার পর থেকে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক নাকি বেপাত্তা হয়েগিয়েছিলেন। তাহলে ভদ্রলোক এখন হঠাৎ করে উদয়,হলেন কি করে?”
-“তা ছাই আমিও জানিনা। পরে শুনে নেব।”
আরও ভালো খবর পেলাম এই যে তিনি অম্বিকাপুরে জমি কিনে পাকাপাকি ভাবে ওখানেই বাস করছেন।ওদেশে আর যাবেননা। নিতাই বলল-
“মাসির ঘাড় থেকে ভূত হোক আর পেত্নী-শাঁকচুন্নী যাই হোক না কেন কান ধরে নামাবেন সন্ন্যাসী তান্ত্রিক।আমাদের সবারই ইচ্ছা আমাদের সাথে তুইও চল ওখানে।”
শুধু লেখক বা ওর বন্ধু বলে নয়,নিমাই বাবুর মতে আমার মন অতি পবিত্র,ঈর্ষা-বিদ্বেষহীন। তাই আমি থাকলে নাকি খুব ভাল হয়।
এসব কথা আমার মাথার প্রায় ওপর দিয়েই বেরিয়ে গেল। কি সব যাতা বলছে নিতাই! কোন কিছু অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মত্ত হয়ে তখনই হ্যাঁ বলে দিলাম। আমার পরিবার কখনও আমার কোন কাজে বাঁধা দান করেনা। পরদিন সকালেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
মিনিট তিরিশ মত লাগল যেতে। যখন পৌঁছলাম তখন সকাল দশটার বেশী বেজে গেছে। সময়টা পূজোর কিছু পর,সম্ভবতঃ কার্ত্তিক মাস। তাই শীত তখনও পড়েনি।নিতাই সকলের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিল।তারপর নিমাই বাবু যখন জানালেন যে আমার মধ্যে শুভ শক্তিকণা বর্তমান তখন সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ওর মামাবাড়িতে দুই মামা,দুই মামী,এক ভাই,এক দিদি,দিদিমা-দাদু আর ছোট মাসি আছে।সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তখনও এসে পৌঁছাননি। শুনলাম ছোট মামা তাকে আনতে অম্বিকাপুরে গেছেন। নিমাই বাবু অবশ্য কাল বিকালেই চলে এসেছেন। তখন আমি টুয়া মাসিকে একটু দেখতে চাইলাম। নিমাই বাবু বারণ করে বললেন-
“আগে স্নান করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র হয়ে এস।তারপর আমি মন্ত্র পাঠ করে তোমার গাত্রবন্ধন করে দেব। সাথে বাড়ীর সবার। তখন যেও দেখা করতে। আর দুষ্টু আত্মা সবসময় ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজবে।কিন্তু আমি কখনই তা হতে দিতে পারিনা। খুড়ো না আসা পর্যন্ত সবার দায়িত্ব আমার ওপর।”
সবটা না বুঝলেও খানিকটা পেরেছি এমন ভাব করে স্নানে গেলাম যদিও আমার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা কি সব হচ্ছে এখানে। স্নান সেরে এসে দেখি নিতাই আর পরিবারের সবাই স্নান সেরে এক্কেবারে রেডি।
ওদের তিনতলা বিরাট সাবেকি আমলের বাড়ী।একতলার উঃ পূঃ দিকের একটা ঘর খুললেন নিমাই বাবু। জানালেন কাল তিনি টুয়া মাসিকে মন্ত্র পড়ে বন্ধন করিয়ে ওই ঘরে আটকে বেঁধে রেখে গেছেন। একটা বিরাট যান্তব ক্যঁ-অ্যা-অ্যা-চ শব্দ করে দরজাটা খুলতে বুকের ভিতরটা কেন জানিনা নিজের অজান্তেই ধড়াস্ করে উঠল! খুট্ করে একটা শব্দে ঘরের সি.এল জ্বলে উঠল। দেখি একটা বড় খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে খাটের একপাশে কারুকাজ করা অংশে হেলান দিয়ে বসে আছে টুয়া মাসি। দুটো হাত আর দুটো পা টেনে খাটের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে টেনে বাঁধা রয়েছে যাতে কোন অঘটন ঘটাতে না পারে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। যদি সত্যিই টুয়া মাসি পোজেজড্ হয় তবে এসব করে কি কোন ফল হবে! মাথাটা সামনের দিকে বুকের ওপর ঝুকে পড়া।আর মাথার বন্ধনহীন এলোমেলো চুলের রাশি সামনের দিকে খাট পর্যন্ত ঝুলছে। তাই মুখ দেখা সম্ভব হয়নি তখন। তবে মাঝে মাঝেই একটা মরা পঁচা ভ্যাপসা গন্ধ পাচ্ছিলাম। আর একটা মৃদু গোঙানির মত আওয়াজ। গন্ধের উৎস না বুঝতে পারলেও গোঙানি যে টুয়া মাসির গলা থেকেই বেরোচ্ছে তা আমি নিশ্চিত।মুখটা তখন দেখা সম্ভব হয়নি। মিনিট পাঁচেক পরে তার মুখের গোঙানি হুঙ্কারের রূপান্তরিত হয়ে উঠল। দেখে ভয়ে বুকের সব সাহস নিমেষে যেন শুকিয়ে গেল আমার। ধীরে ধীরে মুখটা তুলল মাসি। সে মুখ কোন মানবীর নয়,কেন নরকের কীট যেন। ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। গলগল করে রক্ত ঝরছে। অবাক হয়ে দেখি জিভ দিয়ে সেই রক্ত চেটে চেটে খাচ্ছে টুয়া মাসি।চোখের তলায় কালীর মত গভীর অমাবস্যার চিহ্ন। পুরো মুখটা দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। হঠাৎ টুয়া মাসি তীব্র হুঙ্কার ছেড়ে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল-
“শয়তান! নরকের কীট! যাব না,আমি কিছুতেই যাবনা।মরবি,তোরা সব্বাই মরবি।যতই ঝাড়ফুঁক করিস না কেন আমাকে তাড়াতে পারবি না। আমি তোর মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবই। হা হা হা…”
সে কি অমানুষিক বিকট আওয়াজ! এর আগে আমি কখনও কোনদিন মনুষ্য কণ্ঠে এমন আওয়াজ শুনিনি।শুনলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। হাতে চাপ পড়তে তাকিয়ে দেখি নিতাই জোরে আমার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। ওর মুখ মৃত মানুষের মত অসম্ভব ফ্যাকাশে!
ওদিকে নিমাই বাবু অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করেছেন। মন্ত্র পাঠ করতে করতে পকেট থেকে একটা রুদ্রাক্ষমালা হাতে পেঁচিয়ে পরে নিলেন এবং তা মুঠো করে ধরে দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে দরজায় তিনবার বদ্ধ মুষ্ঠি দিয়ে আঘাত করলেন,তবে কিছু সময় অন্তর। প্রথমবার আঘাত করার পর মাসির মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা দিল। টুয়া মাসি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। দ্বিতীয় বার আঘাত করতেই চার হাত পা দিয়ে দেহটাকে যথা সম্ভব কুঁকড়ে চক্রাসনের ভঙ্গিতে নিজেকে তুলে ধরতে লাগল। বুকটাকে যতটা সম্ভব খাট থেকে শূন্যের দিকে তুলতে লাগল। আর তৃতীয়বার আঘাত করতেই দেহটা হঠাৎ নিষ্পন্দ হয়ে খাটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে গেল। তবে শেষবার করাঘাত করার সময় অকথ্য ভাষায় নিমাই বাবুকে আবার গালিগালাজ দিতে শুনলাম-
“শালা বেভুষ্যে আত্মা,আমাকে ভয় দেখানো! এবার বোঝ মজা! সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে আসতে দে,তোর সব রস মিটিয়ে দেবে দেখিস। তুই ছাড়বিনা তোর ঘাড় ছাড়বে। শয়তান আত্মা নরকের কীট কোথাকার!”
আত্মাটা আসলে কার সেটা বোঝা কিন্তু সম্ভব হল না।সন্ন্যাসী তান্ত্রিক না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।টুয়া মাসি বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। খারাপ লাগলেও সেদিকে যাওয়ার সাহস কারো হল না। নিমাই বাবাজীর নির্দেশ মত সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।তিনিও তারের ঘরের ছিটকিনি তুলে তালা লাগিয়ে ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন। দুপুরবেলা নামমাত্র খাওয়াদাওয়া হল সবার। ঠিক বেলা তিনটে নাগাদ ছোটমামা সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ঢুকলেন।বাড়ীতে ঢুকলেন বললে ভুল হবে। কারণ ঢোকার সময় গেটের মুখে হঠাৎই তিনি কি একটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়ীর ভিটের সীমানা অর্থাৎ প্রবেশদ্বার থেকে চার আঙুল দূরে বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল তুলে সেটাকে আড়াল করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাম হাতের তেলো বুকের কাছে উত্থিত ভঙ্গিতে ঠেকানো আর ডান হাত মুঠো করে বুড়ো আঙুল খুলে ওপর দিকে রেখে তেলোর ওপর বসানো।
মিনিট দশেক মত এভাবেই কোন ভাবলেশহীন হয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন বহু প্রশংসিত সন্ন্যাসী তান্ত্রিক। সেই সুযোগে আমি তাঁর আপাদমস্তক সম্পূর্ণ ভাবে নিরীক্ষা করে নিলাম।
দেখলাম নিমাই বাবু ভুল কিছু বলেননি তার সম্পর্কে।উচ্চতা ছয় ফুটের বেশী ছাড়া কম হবেনা।ফর্সা;সুদর্শন,সুদৃঢ় ও সুগঠিত শরীর। প্রায় ষাটের কাছে বয়স তা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই বয়সেও দারুণ পেশল চেহারা। বড় বড় চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে কিন্তু জটাধারী নন। গোঁফ-দাঁড়ির জঙ্গল থাকলেও তা নিয়মিতভাবে ছাঁটা। পরনে কালো আলখাল্লা পোশাক।কোমরে ওড়নার মত কাপড় টেনে জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা। কপাল ঘিরে একটা কালো কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে বাঁধা। গলায় ও দুহাতের কব্জিতে রুদ্রাক্ষের মালা। কাঁধে কালো রঙের একটা বড় ঝোলা।এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর দেখি বাম হাত উল্টো করে ধরে হাতের বুড়ো আঙুলটা বুকের নীচে যেখানে কড়া নামে ওখানে ঠেকালেন। ডান হাত ওপরে তুলে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাক ও চোখের সংযোগস্থলে মৃদু চাপ দিলেন। বাকি আঙুলগুলো শূন্যে প্রসারিত। ডান পায়ের পাতা বাম পায়ের গোড়ালির কিছুটা ওপরের অংশে ঠেকিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে কিসব মন্ত্র পাঠ করতে লাগলের যার এক বর্ণও কেউ বুঝতে পারলাম না। মিনিট খানেক পর হঠাৎ মৃদু কাঁপুনি দিয়ে দু-পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। হাত পা ততক্ষণে ছেড়ে স্বাভাবিক করে নিয়েছেন। ছোটমামা হাত বাড়িয়ে ধরার আগে তিনি অবশ্য নিজেকে সামলে নিলেন। ডান হাত তুলে তাকে বারণ করলেন। তারপর বললেন-
“সর্বনাশ ছোটবাবু! এ যে সাক্ষাৎ শয়তানীতে ধরেছে তোমার বোনকে! নিমাই বুদ্ধি করে ভিটে বাড়ী আর সকলের গাত্রবন্ধন করে দিয়েছে বলে রক্ষে। নাহলে ভীষণরকম ভয়ঙ্কর কিছু একটা সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে পারত।”
তারপর আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটু মৃদু হেসে বললেন-“একে এনে ভালোই করেছিস নিমাই।এ যে সাক্ষাৎ শুভ শক্তিরূপ কণিকা। এ সঙ্গে থাকলে ওই শয়তানী তেমন কেন বড় বিপদ ঘটাতে পারবে না।”আমি তো অবাক। তখন সন্ন্যাসী তান্ত্রিক আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন-
“ভয় পাবে না তো খোকাবাবু? নাম কি তোমার?”
-“সৌম্য,মানে সৌম্যজিৎ সরকার। আর আমি ভয় পেলে কি এখানে আসতাম নাকি!”
-“চল তবে,আমরা ভিতরে যাই। দেখি কতটা কি করতে পারি।”
উনি বাড়ীতে এসে সবার আগে ছোট মামার গাত্রবন্ধন করে দিলেন। তারপর সকলের আত্মশুদ্ধি করলেন।তারপর যাওয়া হল টুয়া মাসির ঘরে। বাড়ীর মহিলাদের ওঘরে যেতে বারণ করলেন তিনি। তাছাড়া যারা সাহসী পুরুষ কেবল তাদেরকেই সঙ্গে যেতে বললেন।আমি,নিতাই,ছোটমামার ছেলে বছর পনেরো ষোলোর সায়ন,দুই মামা,আর নিমাই বাবু ছাড়া কেউই সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারল না। অবশ্য অনেকেই টুয়া মাসির ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। যদি কোন প্রয়োজন হয় তাহলে সাহায্য করবেন তাই। তিনি আরও পরিষ্কার করে বললেন যে- “টুয়ার ঘাড়ে চেপে থাকা শয়তানী প্রেতাত্মা রোশের মুখে বাড়ীর অন্য কোন মহিলার ক্ষতি করতে পারে। তাই সকলে যেন চুল খুলে বসবেন না। ভাল করে চুল বেঁধে মাথায় ঘোমটা টেনে বসবে।”
নিমাই বাবু বললেন- “আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা।ওঘরের ভিতর প্রবেশের পূর্বে তা বলা দরকার। যদি ভয় লাগে বা ভয়ের কোন ঘটনা ঘটে তবে যেন কেউ পালানোর চেষ্টা করবে না। ওখানেই চোখ-মুখ বুজে বসে পড়বে। ভূত নামানো বা ঝাড়ানোর সময় ঘরের গণ্ডীর বাইরে বের হওয়া মানেই মহাবিপদ! সাক্ষাৎ মৃত্যু!”
-“ঘরের গণ্ডী মানে? কোথাও তো কোন…”
আমরা প্রশ্ন করে উঠলাম একসাথে। উত্তরে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক শুধু মৃদু হেসে বললেন-“ভুতরে চল,দেখ কি করি। সবই বুঝতে পারবে।”
দুরুদুরু বক্ষে সকলে প্রবেশ করলাম। নিতাই বেশ জোরের সঙ্গেই আমার বাম হাত চেপে ধরেছে। সায়নের বয়স আমাদের থেকে অনেক কম হলেও সাহস যে আমাদের থেকে অনেক বেশী তা বলতে কোন লজ্জা নেই। বাপকা ব্যাটা আর কি। সে একাই বাবার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে নিমাই বাবু আর সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে সাহায্য করছে। বড় মামাবাবু কিন্তু বেশ ভীতু। ঘরে ঢুকেই সন্ন্যাসী তান্ত্রিক চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এবার দুহাত মুঠো করে কেবলমাত্র তর্জনী খুলে তর্জনী দুটিকে কপালের দুপাশে সেনসেটিভ্ জায়গা দুটিতে চাপ দিলেন। আর একপাশে দাঁড়ালেন ঠিক বাড়ীতে ঢোকার মুখে যেমন ভঙ্গীতে ছিলেন। মুখে কিসব দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। মন্ত্র পাঠের উচ্চারণ যত তীব্র হচ্ছে ততই টুয়া মাসির দাপাদাপি,গালিগালাজ,হুঙ্কার বাড়তে লাগল। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বললেন-
“এবার কুমকুম আর হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে একটা পাত্রে রেখে তাতে কিছুটা সরষে আর লঙ্কার গুঁড়ো মেশাও। তারপর বাড়ীর কর্তাকে ডাকো।”
দাদু ভয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে প্রবেশ করলেন।টুয়া মাসি তাকেও গালিগালাজ করে হাসতে লাগল। দাদু তো ভয়ে সিঁধিয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বললেন-
“ভয় নেই আপনার। ও আবদ্ধ হয়ে আছে।চেঁচামেচি,গালিগালাজ ছাড়া ওর কোন ক্ষমতাই নেই।”
এবার দাদুর হাতে মিশ্রনের পাত্র দিয়ে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তাকে বললেন- “ঘরের গণ্ডী কাটব এবার। আপনি এই মিশ্রণ দিয়ে খাটের চারিদিকে একটা গণ্ডী কাটুন। আমি মন্ত্র বলতে বলতে আপনাকে স্পর্শ করে থাকব। এটা বাড়ীর কর্তাকেই করতে হবে।”
দাদু গণ্ডী কাটছেন আর তাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করছে টুয়া মাসি অকথ্য ভাষায়। এমন সময় দেখি সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তার ঝোলা থেকে একমুঠো লাল কিসের একটা গুঁড়ো নিয়ে চোখ বুজে কপালে ধরে মন্ত্র বলে ছুঁড়ে দিলেন মাসির দিকে। ভীষণ একটা আর্তনাদ করে মাসি নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল খাটে।তান্ত্রিক বললেন- “মন্ত্রপূত সিঁদুর ছুঁড়ে কিছুক্ষণের জন্য ওকে অজ্ঞান করে রেখেছি। এর মধ্যেই আমাদেরকে সব কাজ সেরে ফেলতে হবে। নিমাই,তুই এবার পাত্রের বাকি অংশ দিয়ে ঘরের ভিতর একটা গণ্ডী কেটে ফেল।ওর মধ্যে ঘরের সবাই থাকবে। কোন মতে ওর বাইরে যাবে না।”
নিমাই বাবু তাই করলেন। তান্ত্রিকের কপালের লাল তিলকটা এবার যেন আরও বেশী জ্বলজ্বল করে উঠল।ভয়ঙ্কর কোন দুর্যোগের ইঙ্গিত পেলাম বলে বুকটা হঠাৎ ধড়াস্ করে উঠল। গণ্ডী কাটা শেষ হলে ঝোলা থেকে একটা আসন বার করে খাটের চারিপাশ জুড়ে টানা প্রথম গণ্ডীর মধ্যে আসন পেতে বসলেন তিনি।এবার নিমাই বাবু বাদে বাকী সবাই আমরা প্রথম গণ্ডীর বাইরে কিন্তু দ্বিতীয় গণ্ডীর ভিতরে রইলাম। তিনি টুয়া মাসির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
সন্ন্যাসী তান্ত্রিক প্রথম বৃত্তের মধ্যে প্রথমে গোল করে বালি ছড়িয়ে তার ওপর বেলকাঠ সাজিয়ে,ছোট যজ্ঞের বেদী তৈরী করলেন। তাতে আগুন ধরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে ঘি ঢালতে লাগলেন তিনি। যজ্ঞের সামনে সেই আগের হলুদ ও সিঁদুর মেশান গুঁড়ো দিয়ে একটা চতুর্ভুজ আঁকলেন। তার আগে তার সাথে আরও একটু সিঁদুর মিশিয়ে নিয়েছেন। তারপর চতুর্ভূজের মধ্য একটা তারা চিহ্ন আঁকলেন। ঝোলা থেকে একটা মাটির পুতুল বার করে তারার মাঝখানে শুইয়ে রাখলেন। পুতুলটি একটা নারী মূর্তির। মূর্তিটাকে ঘিরে একটা জবা ফুলের ছোট মালা রাখলেন ঠিক বেড়া দেওয়ার মত। মন্ত্র পাঠ করতে করতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন মূর্তিতে। একটা ছোট বেতের লাঠি ঝোলা থেকে বার করে ওটার গায়ে মৃদু আঘাত করতেই টুয়া মাসি চেঁচিয়ে উঠল। তান্ত্রিক চেঁচিয়ে উঠল-“বল কে তুই? কেন এসেছিস ওর দেহে?কি চাস? কি করেই বা এলি? সব সবকিছু শুনব।আমাকে সব বলবি।”
ওদিকে বাজখাঁই কণ্ঠে উত্তর এল-“ভাগ শালা! তুই কিছুই করতে পারবি না। আমি ছাড়ব না,ছাড়ব না ওকে। আর কিছুই বলব না। ভাগ ভাগ শালা এখান থেকে।”
একথা বলেই ‘ওয়াক্ থু’ করে এক খাবলা থুতু সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের দিকে ছুঁড়ে দিল। ততক্ষণে গতিক সুবিধার নয় বুঝতে পেরে আগে থেকেই একটা সরা হাতের কাছে রেখেছিলেন। ওটাকেই সামনে এনে বর্মের মত ব্যবহার করলেন। ফলে থুতু গিয়ে পড়ল তাতে। দেখলাম থুতু নয়,জমাঁট বাঁধা একতাল টাটকা রক্ত।এবার টুয়া মাসিকে দেখলাম ভাল করে। আশ্চর্যরকম সুন্দরী তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনকার অবস্থা খুবই শোচনীয়। চোখের নীচে ও ওপরে কালো কালির মত গাঢ় প্রলেপ পড়েছে। ঠোঁট ও সারা মুখ আশ্চর্যরকম ফ্যাকাশে ও গ্রীষ্মের খরার মত ফুটিফাটা হয়ে গেছে।সেই ফুটিফাটা স্থানগুলো থেকে খানিকটা রক্ত ও মাঝে মাঝে কসও ঝরছে। তখন সন্ন্যাসী তান্ত্রিক একটা কাজ করলেন যা আমাদের সবাইকে অবাক করে দিল। গর্জে উঠলেন-“দাঁড়া মাগী! এবার তোর পিণ্ডি চটকাচ্ছি!”
এই বলে সেই রক্তমাখা সরার ওপর যজ্ঞ থেকে কিছু জ্বলন্ত কাঠ তুলে রাখলেন। কর্পূর দিলেন আর মন্ত্র বলতে বলতে ঘি ঢালতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর ঝোলা থেকে একটা মস্ত বড় সূঁচ বার করে মন্ত্র পাঠ করতে করতেই পুতুলটার পেটে ফুঁটিয়ে দিতে শুরু করলেন।ওদিকে টুয়া মাসি তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।বলল-“ওরে আর মারিস না,আর মারিস না। বলছি বলছি,আমি সব খুলে বলছি।”
-“বল শিগগির। নইলে এই পুতুলটা যজ্ঞের আগুনে ফেলে…”
-“আমি সব বলছি তো…করবেন না আমার এতবড় ক্ষতি। আমি চলে যাব কথা দিচ্ছি।
আমি প্রমীলা সেন,বাড়ী মাঝের গ্রাম। এই সুন্দরী মেয়েটা কোলকাতার আর.জি.কর হাসপাতালে কোন রুগীকে দেখতে গিয়েছিল হয়তো। আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিলাম। ও সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল আর স্ট্রেচারে করে আমার লাশ নামানো হচ্ছিল। আমার চোখ খোলা ছিল। চোখে চোখ পড়ল,ব্যাস্,ওকে বশে আনতে আমায় কোন বেগ পেতে হয়নি। একে ও কোন তাবিজ-মাদুলি ব্যবহার করত না। তার ওপর শনিবার অমাবস্যা ছিল।”
-“প্রথমে তো কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি। তবে ধরল কি করতে তোকে?”
নিমাই বাবুর দিকে তাকিয়ে টুয়া মাসি;না টুয়া মাসি নয় প্রমীলা সেনের প্রেতাত্মা বলল- “ওই হারামজাদার জন্য ধরা পড়ে গেলাম। ভাবলাম সারা জীবন ওর ঘাড়ে বসে সুখে খাব। কিন্তু এই মেয়েটা নিরামিষ খেত,তা আমি জানতাম না। মেয়েটা আর ওই হারামজাদা একসাথে খাওয়াদাওয়া করত এখানে এলে। একদিন ওই হারামজাদা এলে আমি অন্যদের মাংসের পাত্র থেকে মাংস তুলে খেতে শুরু করতেই শালা ধরে ফেলল। কি সাহস আর বুদ্ধি ওর। প্রথমে কাউকে কিছু বুঝতেই দেয়নি। কারণ, মাংস খাওয়াটা ও শুধু একলাই দেখেছিল। সময় বুঝে আমি কিছু করার আগে সকলের দেহ বন্ধ করে দিল আর আমাকে বন্দী করে এখানে আটকে রাখল।”
-“বেশ করেছে। এবার পালা এর দেহ ছেড়ে।”
-“খেঁপেছিস নাকি শালা হতচ্ছাড়া তান্ত্রিকের বাচ্ছা!আমি পাগল নাকি যে এত সুন্দর শরীর ছেড়ে যাব!”
-“আমি জানতাম এমন কিছু একটা বলবি। আগে তো বললি চলে যাবি। তা যাবি যখন বলেছিস তখন চলে তোকে যেতেই হবে। আমার হাত থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না। তুই যাবিনা তোর বাপ যাবে শালী শয়তানী!”
এই বলে সরাতে জ্বলন্ত বেলকাঠের ওপর লঙ্কা আর সরষে ছড়িয়ে দিয়ে মন্ত্র পাঠ করতে করতে তাতে ঘি ঢালতে লাগলেন। পুতুলের গায়ে সূঁচটা পুরো ফুটিয়ে পুতুলটাকে যজ্ঞের আগুনের কাছে আনতেই প্রেতাত্মা আবার পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করে দিল। সাথে সাথে বেত দিয়ে একবার সরাতে আঘাত করছেন,আবার কখনও পুতুলে।শেষে হার স্বীকার করল প্রমীলা সেনের শয়তানী প্রেতাত্মা। ওকে দিয়ে তিনসত্যি কাটিয়ে নিলেন তান্ত্রিক।তিনি বললেন-“তুই যে সত্যি সত্যি চলে যাবি তার কি প্রমাণ রেখে যাবি?”
-“ওই দূরের নিমগাছের মোটা ডাল ভেঙে দিয়ে যাব।”
-“আর শরীর ছেড়েছিস তার কি প্রমাণ রাখবি? জুতো নিবি? নাকি কলসী?”
-“কলসী দাও!”
-“যা,তোর আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে দেব।”
আমরা সবাই চক্ষু ছানাবড়া করে দেখলাম টুয়া মাসি অবলীলাক্রমে এককলসী জল দাঁতে করে নিয়ে উঠোনের এককোণ থেকে অন্য কোণে বয়ে নিয়ে গিয়ে কলসী সমেত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সেকেন্ড দশেক পর নিতাই এর মামা বাড়ী থেকে কিছুটা দূরে রেল লাইনের পাশের নিমগাছটার একটা প্রকাণ্ড মোটা ডাল মটমট করে ভেঙে পড়ল। অথচ কোথায় কোন ঝড়তুফান নেই। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বললেন-
“ব্যাস্ আর কোন ভয়ের কারণ নেই। আমি মন্ত্রপূত কবচ করে দিয়ে যাব, বাম হাতে ধারন করতে হবে। আর গৃহবন্ধন করে দিয়ে যাব চিরদিনের জন্য। কারণ এদের দিয়ে কোনই ভরসা নেই। তবে আর কোনদিন কেউই কোনরকম ক্ষতি করতে পারবে না।”
সকলে ততক্ষণে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রূষা শুরু করে দিয়েছে। গ্রামের পরাশর ডাক্তারকেও খবর দিয়ে এল সায়ন। পরে জেনে অবাক হলাম যে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক কোনো দক্ষিণা গ্রহণ করেন না। নিঃস্বার্থভাবে এইসব অপদেবতাদের বিরুদ্ধে এইভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যান। আমার মন তার প্রতি শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় ভরে উঠল। নিমাই বাবুকে ডেকে বললেন-
“চল্ নিমাই। তোর সাথে প্রয়োজন আছে।রাস্তায় যেতে যেতে কথা হবে।”