ভ্রমণ কাহিনী

  • ভ্রমণ কাহিনী

    ভ্রমণ কাহিনী- যো কুছ্ হ্যাঁয় সব তু হি হ্যাঁয়

    যো কুছ্ হ্যাঁয় সব তু হি হ্যাঁয় (তিরুপতি ভ্রমণ)
    সুনির্মল বসু

    কূপমন্ডুক আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবি নি, কোনদিন তিরুপতি দর্শনে যেতে পারবো। উদ্যোগটা নিয়েছিল আমার ভাইঝি মোহর এবং বাড়ীর মেজো জামাই সিদ্ধার্থ। মার্চের এক সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছলাম। সঙ্গে ছিলেন আমাদের বেয়াইন, মোহর, সিদ্ধার্থ, আমার গিন্নী ও আমি। আগে থেকেই সিদ্ধার্থ বিমানযাত্রার টিকিট সংগ্রহ করেছিল। বিমানে যাবার পদ্ধতি মেনে ইন্ডিগো প্লেনে উঠে বসলাম। একসময় রানওয়ে ছাড়িয়ে আকাশ সীমানায় পাড়ি দিল বিমান। আগে একবার পুরীতে যাবার সময় আমরা ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম বিমানে চড়ে। সেবারের যাত্রা ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। এবার কিন্তু পথটা অনেকটা দূর।

    দীর্ঘ যাত্রায় আকাশে মেঘেদের রঙ বদল দেখতে দেখতে চললাম। পৃথিবীটা কত সুন্দর, ঈশ্বর যে কত বড় মাপের শিল্পী, মনে-মনে সেটা অনুভব করেছিলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হলো। একসময় আমাদের গন্তব্য এয়ারপোর্টে এসে পড়ল।

    এয়ারপোর্টে নেমে আমরা একটি গাড়ি ধরে তিরুপতির দিকে এগিয়ে চললাম। সেখানে পৌঁছে আদর্শ রেসিডেন্সি নামে একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম।

    আগে থেকেই সিদ্ধার্থ এই হোটেলটি ঠিক করে রেখেছিল। হোটেল কর্মীরা আমাদের লাগেজ তুলে দিল। পাশাপাশি দুটি ঘরে আমরা রাত কাটালাম। পরদিন গাড়ি ভাড়া করে চললাম তিরুমালা পর্বতের দিকে। যাবার পথে এক জায়গায় চেকপোষ্টে প্রতিটি গাড়ি চেকিং করা হচ্ছিল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। চেকিং শেষ হলে আবার গাড়িতে উঠলাম।

    এখানকার পথঘাট এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। পথের দু’ধারে অজস্র ফুলের সমারোহ। চারদিকে ফুলেরা যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ডানদিকে পর্বতকে সাক্ষী রেখে আমরা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছিলাম।

    তিরুমালা পর্বতের উপরে রয়েছেন ভগবান তিরুপতি। সোনা দিয়ে সাজানো এই মন্দির। দর্শনার্থীদের ভীড় যথেষ্ট। জানতে পারলাম, এখানে প্রতিদিন কম করে এক লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে।
    এখানে অনেকেই চুল উৎসর্গ করেন।

    দর্শনার্থীদের লাইনে বিশাল ভিড়। বিভিন্ন দিক থেকে লাইন মূল মন্দিরের দিকে গিয়েছে। আমরা পাঁচশো টাকার টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। ভক্তেরা মাঝে মাঝে
    ভগবান তিরুপতির নামে জয়ধ্বনি করছিল।

    পরিবেশ এমন, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা পরিবর্তন টের পেলাম। মুগ্ধতা এবং ভক্তি একসঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছিল। লাইনে ভিড় ছিল, কিন্তু কোন অশান্তি, ঠেলাঠেলি দেখিনি।

    এক সময় আমরা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর তিরুপতি মন্দির এসে পৌছালাম। এক অপূর্ব অনুভূতি তখন মনের মধ্যে। বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যিই কি আমরা তিরুমালা পর্বতের উপর ভগবান তিরুপতি মন্দিরে ঈশ্বরের পাদমূলে উপস্থিত হয়েছি। একটা স্বপ্নের ঘোরের মত মুহূর্ত। সারা জীবন কাজ আর কাজ। পৃথিবীতে এমন শান্তিময় ভুবন নিয়ে কখনো ভাবি নি। ঈশ্বরের অপার করুণায় আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।

    মনে হল, শাশ্বত ভারতবর্ষের আসল ছবিটা দেখছি। কত অনাদিকালের ইতিহাস জমা হয়ে আছে এখানে।

    যাওয়া-আসার পথে আমাদের ড্রাইভার সাহেব কি সুন্দর করে এখানকার স্থান মাহাত্ম্যের কথা বলছিলেন। পুজো ও প্রণাম সেরে একসময় নিচে নেমে এলাম। চারদিকে এত অপার সৌন্দর্য দেখেছি, কোন ভাবেই আমার দুর্বল ভাষায় সেটা বোঝাতে পারবো না। ফেরবার পথে সারাপথ আমার মনে হচ্ছিল, ঈশ্বর তো পাহাড়ের চূড়োতেই থাকেন।
    আগে একবার অমরকন্টক যাত্রার সময় একজন সাধুবাবার সংলাপ মনে পড়ছিল,যো কুছ্ হ্যাঁয়, সব তুহি হ্যাঁয়।

    তবে এখানে ভাষা একটি প্রধান সমস্যা। এখানকার মানুষ তামিল, তেলেগু ও মালায়লাম ভাষায় কথা বলেন। ওখানে হিন্দি বা ইংরেজি বলে সুবিধা করতে পারেনি। ওদের ভাষা কিছু মাত্র বুঝিনা।

    আগের দিন রাতে লোকাল এরিয়া পরিদর্শন করতে বেরিয়ে, ওখানকার শপিংমলে ঘুরে পথের পাশে ডাব খেতে গিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে পেরেছিলাম, আমরা ডাব খেতে চাই।

    হোটেলের খাওয়া-দাওয়া ভালো। কিন্তু সবকিছুতেই
    টক বাধ্যতামূলক।

    সন্ধ্যেবেলায় পথের পাশে প্রচুর ফুল বিক্রি হয়। এখানকার মেয়েরা সন্ধ্যেবেলায় ফুল সাজে সজ্জিতা হন। সন্ধ্যেবেলায় পথে বেরিয়ে দেখেছিলাম, বড্ড মায়াময় এবং স্বপ্নের মতো লাগছিল এই অঞ্চলটিকে।

    লোকাল এরিয়া পরিদর্শনে গিয়ে ছিলাম তার পর দিন। তামিলনাড়ুর পথে কলকাতার চেয়ে ভীড় কম মনে হয়েছিল। কোথাও গাড়ির জ্যাম পাই নি।

    অবশ্য সন্ধ্যেবেলায় শপিংমলগুলোতে ভীড় প্রায় কলকাতার মতোন। অল্পস্বল্প কেনাকাটা করেছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করে হোটেলে ফিরেছিলাম।

    পরদিন খুব ভোরে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে চড়ে কলকাতা ফিরেছিলাম। সকালে বলতে গেলে, চা-বিস্কুট ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে খিদে পেয়েছিল খুব। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া বিমান সেবিকারা সেদিন আমাদের দুপুরে খুব সুন্দর একটা লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে মনে অজস্র ধন্যবাদ দিয়েছিলাম ওদের।

    নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতেই, দেখা পেলাম ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামীর। কথা হল, ছবি তোলা হলো।

    বাইরে বেরিয়ে এলাম, ট্যাক্সির অপেক্ষায়। মনোরম স্মৃতি নিয়ে ফিরে এসেছি। চোখ বুজে মাঝেমাঝে তিরুমালা পর্বত দেখি, দেখি সেখানে সমাসীন ভগবান তিরুপতিকে।

    ভগবান তিরুপতি হলেন আমাদের বিষ্ণুনারায়ণ। মনে মনে শতবার তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বলি, সবার মঙ্গল করুন, হে পরমেশ্বর।

  • ভ্রমণ কাহিনী

    ভ্রমণ কাহিনী-পদব্রজে জয়দেব কেঁদুলি

    পদব্রজে জয়দেব কেঁদুলি
    শচীদুলাল পাল

    ১৯৬৮ সাল।আমি তখন হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের বি এস সি (কেমিস্ট্রি অনার্স) প্রথম বর্ষের ছাত্র। একটি অতি উন্নত মানের কলেজ। ভারত সরকার দ্বারা স্টার কলেজের তখমাপ্রাপ্ত।
    আমার হোস্টেলের সামনে হাজার দুয়ারি,যেখানে গুপি বাইন বাঘা বাইন সিনেমার সুটিং হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলার ছাত্ররা আমাদের হোস্টেলে থাকতো। আমার হোস্টেলের ৩ নং রুমে আমি থাকতাম। ১১ ছাত্রের সিট।
    উপরতলা নীচতলা মিলিয়ে অনেক রুম ছিল।
    পূর্বে রাজাদের বাঈজী নাচমহল ছিল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কলেজকে প্রায় সব বিষয় সম্পত্তি দান করে দিয়েছিলো। আমাদের দ্বিতল হোস্টেলে সব বিশাল
    বিশাল রুম। প্রতিটি ঘরের উচ্চতা বর্তমান ঘরের প্রায় ডবল। চুন সুরকির কাজ। বীরভূমের প্রচন্ড গরমে দুপুর বেলাতেও গরম লাগতো না। বেশ মনোমুগ্ধকর বাতাবরণ। বড়ো বড়ো জানালা। বিশাল কাঠের সিঁড়ি। একসাথে পাশাপাশি পাঁচ – ছজন উঠতে পারতাম।
    আমার এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু রামদুলাল তেওয়ারি আমার পাশের সিটে থাকতো।
    দুপুর বেলায় একটা সময় যখন আমার ক্লাস থাকতো না। তখন দোতলায় আমি বাংলা ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলা প্রফেসরের ক্লাস লেকচার শুনতাম চুপিচুপি লুকিয়ে। খুব ভালো লাগতো।বড়োই মধুর। যদিও দেওয়ালের বাইরে থেকে খুব একটা শোনা যেতো না। কান পেতে শুনতে হতো। একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কখন যে দরজার পাশে চলে এসেছি খেয়াল নেই। স্যার আমাকে দেখে ফেলেছে। আমি চৌঁচা দৌড় লাগালাম। স্যার একটা ছেলেকে বললো
    — একটা ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে ধরে নিয়ে এসো।
    ছেলেটি আমাকে ধরে স্যারের কাছে নিয়ে গেলে আমি কাঁদতে লাগলাম।
    স্যার বললেন
    — মাঝে মাঝে দেখি তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো।কি জন্য?
    — আপনার লেকচার আমার খুব ভালো লাগে স্যার। আর এমন করবোনা। আমাকে ছেড়ে দিন।
    — না। তোমাকে শাস্তি দিতে হবে।তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
    — স্যার আমি এই কলেজের বি এস সি( কেমিস্ট্রি অনার্সের) প্রথম বর্ষের ছাত্র।
    — ঠিক আছে। তোমার শাস্তি তুমি সামনের সিটে বসবে,যখন তোমার ক্লাস থাকবেনা।

    সেদিন কবি জয়দেব প্রসঙ্গে বলছিলেন। জয়দেব – পদ্মাবতীর কাহিনি বললেন।
    আমি আমার অনান্য সাইন্স ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরে বন্ধুকে সব কথা বললাম।
    ভর দুপুরেও সেই জয়দেবকেই দেখতাম।
    বন্ধুটিকে বললাম। বন্ধু বললো
    –হেলুশিনেশন।
    একদিন বললাম
    – রামদুলাল! আগামীকাল জয়দেব কেঁদুলি যাবি?
    সে এক কথায় রাজি হয়ে গেলো।

    বৈশাখ মাস।
    আমরা দুজনে সকালবেলা বের হলাম। বাসস্যান্ডে গিয়ে দেখলাম বাস নেই। সেসময় বাসের সংখ্যাও কম ছিলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কখন বাস আসবে?
    — কোথায় যাবে?
    — জয়দেব কেঁদুলি।
    — আজ ও কাল বিয়ের দিন। বিয়ের দিনে সব বাস রিজার্ভ হয়ে যায়।
    — কিন্তু আমরা আজই যাবো ঠিক করেছি।আজ রবিবার।
    — পাশেই সাইকেলের দোকান। সেখানে যাও সাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়।
    অগত্যা দুজনে সাইকেল সারানোর দোকানে গেলাম। বললাম
    — আমাদের দুটো সাইকেল ভাড়া দেবেন? আমরা জয়দেব কেঁদুলি যাবো। আমরা হোস্টেলে থাকি।
    তখন মানুষের বিশ্বাস ছিল। আমরা অপরিচিত হলেও বলল
    — হ্যাঁ দেবো।কিন্তু দুটো তো হবেনা। একটা হতে পারে।
    — ঠিক আছে। একটাই দিন।
    আমরা একটা সাইকেলে একজন সামনের রডে বসে পালাপালি করে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ বিকট শব্দে সামনের
    টায়ারটি বাস্ট করে গেলো। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা সাইকেলের দোকানের দেখা পেলাম। সে খুলে দেখে বললো
    — এর টায়ার টিউব দুটোই বদলাতে হবে।কিন্তু আমার কাছে তো নতুন টায়ার টিউব নেই।
    মহা সমস্যায় পড়লাম। দুজনেই হাঁটছি। ফিরে আসার ইচ্ছে নেই।
    অনেক দূর গিয়ে দেখলাম একটা গ্রাম।সেই গ্রামে একজনের বাড়িতে সাইকেল রাখলাম। সে জিজ্ঞেস করল তোমাদের পরিচয় কি? কোথায় যাবে?
    আমরা আমাদের পরিচয় দিয়ে বললাম
    —জয়দেব কেঁদুলি যাবো।
    —সেতো অনেক দূর। এখান থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার। আমরা বললাম
    — আজ বাস নেই। আমরা হেঁটেই যাবো।ফেরার সময় সাইকেল নিয়ে যাবো।
    অগত্যা দুজনেই হাঁটতে লাগলাম। বৈশাখের রোদ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। ধু ধু মাঠ।রাখাল বালক গরু চরাচ্ছে। এঁদো ডোবার ধারে গাঁয়ের বধুরা বাসন মাজছে।তপ্ত দুপুরে লু বইছে। সারি সারি তালগাছ।গাছতলায় কেউ কেউ বসে তাড়ি খাচ্ছে। আর নেশার ঘোরে জীবন দর্শন বলছে।
    টাঁ টাঁ রোদে চাষিরা লাঙ্গল নিয়ে লাঙ্গল চালাচ্ছে। কাঠ কুড়ুনি দুটো সোমত্ত মেয়ে জ্বালানির কাঠ নিয়ে ঘরে ফিরছে।একদল আদিবাসী মেয়ে মহুয়া কুড়িয়ে ফিরছে।ধুঁ ধুঁ মাঠে সবুজের দেখা নেই।শুধু খেঁড়ো। লতানে ফসল এই খেঁড়ো আর কচু এ অঞ্চলের এই সময়ের সবজি।
    এদিকে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের তেষ্টায় প্রাণ ওষ্টাগত।খিদেতে পেট চুঁ চুঁ করছে।জল একটু জল জ-ল।আর কতদূর কতদূর।

    অনেক দূরে একটা গ্রাম অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাঁটছি তো হাঁটছি।অর্ধমৃতপ্রায়।
    গতিবেগ ধীরে ধীরে কমে আসলেও হাঁটা থামায়নি। “স্লো বাট স্টেডি উইন্স দি রেস।”
    ধীরে ধীরে গ্রামটি স্পষ্ট হলো। ওইতো একটা ঝুপড়ির দোকান। উনানের ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে। দোকানটির কাছে আসতেই মনে একটা বল ভরসা পেলাম।
    বন্ধুটি বললো
    — এতো মুসলিম দোকান!
    — তাতে কি হয়েছে। রামকৃষ্ণ বলেছেন”যতমত তত পথ।”
    কাজি নজরুল লিখেছেন ” মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান “।

    দোকানদারকে বললাম বড়ো তেষ্টা পেয়েছে।একটু জল দেবেন?
    দোকানদার বলল
    — ইনশাআল্লাহ। জরুর দেব। দুজনকে দু ঘটি জল দিল মাটীর কলসি থেকে।
    আমরা বললাম
    — দাদু! আপনার দোকানে কিছু খাবার পাওয়া যাবে?
    — জরুর।মুড়ি আর চপ আছে দিব?
    — হ্যাঁ তাই দিন।
    বৃদ্ধ দোকানদারটি শালপাতার ঠোঙা
    মতো করে আধসের করে মেপে মুড়ি
    দিল আর দুটো করে চপ দিল।মুড়ির উপর জল ঢাললে মুড়িগুলো যতটুকু জল নেবার নিয়ে বাদবাকী সব পড়ে যায়। আমরা আবার আধসের করে মুড়ি ও দু দুটি চপমুড়ি খেয়ে সর্বমোট চার আনা দিলাম।
    চপমুড়ি আর জল খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এই দীর্ঘ পদযাত্রা আমাদের কাছে প্রথম। বন্ধুটি বলল চল ফিরে যায়। আমি বললাম
    শ্রীচৈতন্যদেব পায়ে হেঁটে নব্দ্বীপ থেকে জগন্নাথ ধাম গিয়েছিলেন।
    আর আমরা এই কুড়ি× ২, = ৪০ কিমি হেঁটে যেতে আসতে পারবো না?
    অনুপ্রাণিত হয়ে দুই বন্ধু মিলে কয়েক কিলোমিটার গিয়ে দেখি এক মিষ্টির দোকান
    বিরাট বড়ো বড়ো রাজভোগ দুজনে চারটি নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কত দাম দিতে হবে?
    — চার আনা। ( এখন যার একটির দাম কুড়ি টাকা)
    এক প্যাকেট চারমিনার সিগারেট কিনলাম।
    দাম বলল
    — চারআনা।
    আমরা সব দাম দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
    সূর্য তখন মধ্যগগনে। প্রচন্ড লু বইছে।সারা শরীর জ্বালা করছে। শুনেছি অনেকে সানস্ট্রোকে নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। অনেকে মারাও যায়।

    চলতে চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। জয়দেব কেঁদুলি। পূর্বে নাম ছিল কেন্দুবিল্ব। জয়দেবের সেই কল্পিত পর্ণকুটির ধারে।সামনেই অজয়। অজয়ের জলে স্নান সারলাম। বালি সরিয়ে গর্ত খুঁড়ে জল বের হলে উপু হয়ে বসে মুখ ডুবিয়ে জলপান করলাম।অনেকেই এই পরিশ্রুত জল খাচ্ছে । কলসি ভরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।

    রাধামাধব মন্দিরে প্রণাম সেরে বসলাম
    সেই জয়দেবের বাসস্থানের ধারে। এক গাছের নীচে আশ্রয় নিলাম। ভরদুপুরে পথশ্রান্ত বন্ধুটি ঘুমিয়ে পড়লো। আমি জেগে রইলাম।
    মনে পড়তে লাগলো কলেজের বাংলা প্রফেসারের জয়দেব পদ্মাবতী কথা।
    মানসপটে দেখলাম —
    একদিন এমনি এক ভরদুপুরে জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনা করছেন। রাধাকৃষের প্রেমলীলা।
    কৃষ্ণ রাধাকে কয়দিন সাক্ষাৎ করেনি। তাই
    রাধার মান হয়েছে। তার মান ভঞ্জনের জন্য কয়েকটি শ্লোক লেখার পর লিখেছেন —

    “স্মরগরল খন্ডনম,মম শিরসি মন্ডনম”
    তারপর শ্লোকটি তার মনে আসলেও লিখতে পারছেন না। কি করে লিখবেন? শ্রীকৃষ্ণ তো অখিল ব্রহ্মাণ্ডপতি।
    এমন সময় জয়দেবের সহধর্মিণী পদ্মাবতী এসে বললেন
    — কতো বেলা হলো। এবার স্নান সেরে এসো।আমার রান্না প্রস্তুত।
    কবি জয়দেবের তন্ময়তা ভঙ্গ হলে লেখা ছেড়ে উঠে পদ্মাবতীকে বললেন।
    —আমায় তেল গামছা দাও আমি অজয়ে স্নান সেরে আসি। এই বলে জয়দেব গেলেন স্নানে দূরে অজয়ে।
    অল্প কিছুক্ষণ পরে জয়দেব এসে হাজির। বললেন
    আমি অজয়ে স্নান সেরে ছুটতে ছুটতে শীঘ্রই এসে গেলাম। আমার একটা শ্লোক মনে পড়ে গেলো। তুমি আমায় পান্ডুলিপি কালি ও লেখনী এনে দাও।শ্লোকটা লিখি।
    পদ্মাবতী এনে দিলে শ্লোক লিখে পান্ডুলিপি কালি লেখনী পদ্মাবতীর হাতে দিয়ে বললেন
    — যথাস্থানে রেখে আমায় খেতে দাও। আমি বড়োই ক্ষুধার্ত।
    পদ্মাবতী আজ্ঞা পালন করে অন্ন পরিবেশন করলেন। আর্ধেক অন্নগ্রহণ করে জয়দেব বললেন
    —আজ এই দুপুরে প্রচন্ড গরম,আমি যাই বিশ্রাম করতে।
    আর পদ্মাবতী জয়দেবের পাতে বসে উচ্ছিষ্ট অন্ন খেতে শুরু করেছেন,এমন সময় জয়দেব আসলেন। বললেন আজ একটু দেরি হয়ে গেলো। তারপর পদ্মাবতীকে দেখে
    অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন
    —- একি পদ্মাবতী! তুমি তো স্বামীর খাওয়ার আগে কোনোদিন খাওনা। আজ তুমি আমার আগেই খেতে বসে গেছো?
    পদ্মাবতী আরও আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললো
    — তুমি একটু আগে এসে বললে একটা শ্লোক মনে পড়ে গেলো, আমি খাতা-কলম এনে দিলাম। আপনি লিখলেন। তারপর অন্নগ্রহণ করে বিশ্রাম করতে গেলেন।
    — অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে কবি জয়দেব দেখলেন বিশ্রাম ঘরে কেউ নেই। তার খাতায় পরবর্তী শ্লোক অন্য হাতের লেখায় লিখিত পরবর্তী শ্লোক
    ” দেহি পদপল্লব মুদারম।”
    যে শ্লোকটি তিনি লিখতে পারছিলেন না। এজন্য যে কৃষ্ণ রাধাকে বলছেন, তোমার পদযুগল আমার মাথায় দাও।

    বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখলেন, আবেগে উচ্ছাসে
    পদ্মাবতীর কাছে এসে বললেন
    —তুমি ধন্য পদ্মাবতী। তুমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে চাক্ষুষ দেখেছো। তোমার উৎসর্গীকৃত অন্ন নিবেদন করেছো
    এবং সেই উচ্ছিষ্ট অন্ন তুমি খাচ্ছো।তুমিই কৃষ্ণ কৃপা লাভ করেছো। এসো আজ আমি ও তুমি একসাথে অন্ন গ্রহণ করি।
    এই বলে জয়দেব পদ্মাবতীর সাথে অন্নগ্রহণ করতে লাগলেন একই পাতায়।
    সেই থেকে জয়দেব কেঁদুলিতে এলে এখনো স্বামী স্ত্রী একসাথে এক পাতায় খাওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে।
    ধীরে ধীরে আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। গাছে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভেঙে গেলো। বন্ধুকে ডেকে বললাম
    — চল এবার বেরিয়ে পড়ি।
    বন্ধুটি বললো
    — যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। রাতে রাস্তায় খাবার তো দূরের কথা জলও পাওয়া যাবেনা।তাছাড়া আমরা পথক্লান্ত। এখানে রাতটুকু থেকে ভোর বেলা বের হবো।
    অগত্যা আমরা অজয় তীরে এক বৃক্ষতলে রাত্রিযাপন করলাম। শুক্ল পক্ষের অষ্টমীর চাঁদ উঠলো। কি অপরূপ লাগছে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো। মনে পড়লো সেই বাংলা স্যারের কথা।জয়দেব মকরসংক্রান্তিতে প্রতিবছর পায়ে হেঁটে কাটোয়ায় গঙ্গা স্নানে যেতো।একবার পদ্মাবতী পিত্রালয় গিয়েছিল।সে একা। এবার ঘর ছেড়ে কিকরে কাটোয়া যাবে? হঠাৎ স্বপ্নে দেখলো মা গঙ্গা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলছেন
    — আমি তোর নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট। তোকে কাটোয়ায় আসতে হবেনা। আমি নিজেই উজানে কেঁদুলি ঘাটে পৌছবো।দেখবি একটা পদ্মফুল অজয়ে ভেসে আসছে। বুঝবি আমি এসেছি।
    ভোরবেলায় সে দৃশ্য দেখে জয়দেব অজয়ে স্নান সারলো। সেদিন থেকে মকরসংক্রান্তিতে কবি জয়দেব কেঁদুলি ঘাটে অজয়ে স্নান করতো।
    তাই আজও সবাই মকরসংক্রান্তিতে কেঁদুলি ঘাটে স্নান সারে। প্রতিবছর এখানে মকরসংক্রান্তিতে মেলা বসে।লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়।
    আমরাও আজ দুজনেই অজয়ে স্নান সেরে রওনা দিলাম হেতমপুরের উদ্যেশ্যে।
    এবার একটা গ্রামের ভিতর গেলাম। উদ্যেশ্য যদি দোকান থেকে খাবার কিনে নেওয়া।পথমধ্যে খিদে পেলে খাওয়া যাবে।একজন গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে খাবারের দোকান কোথায়? আমরা পায়ে হেঁটে হেতমপুর যাবো। আমরা কলেজের ছাত্র।
    গ্রামবাসীটি বললো।
    —বাবাজীবন এতো সাতসকালে কোনো দোকান খুলবেনা।
    অগত্যা আমরা রওনা দিলাম।

    গ্রামপ্রান্তে এক মেঠো পথ দিয়ে চলেছি।হঠাৎ আমাদের পিছনে বোরখা পরা এক মুসলমান মেয়ে আমাদের ডাকছে। আমরা থেমে গেলাম। মেয়েটি কাছে এসে বললো
    — আমি এই গ্রামের বিবি। আপনারা যখন খাবারের দোকান খুঁজছেন ও লোকটির সাথে কথা বলছিলেন তখন আমি বারান্দা থেকে আপনাদের সব কথা শুনেছি।আমার এই গ্রামেই সাদি হয়েছে।আমার বাপের বাড়ি হেতমপুর। আমিও কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে সাদি দিয়ে দিল। পড়া আর হলোনা। আপনাদের যদি আমাদের খাবারে আপত্তি না থাকে তাহলে কিছু খাবার দিতে পারি।আমরা বললাম
    — আমরা ধর্মের ভেদাভেদ মানিনা।আপনি দিন।আমরা নিশ্চয়ই খাবো।
    মেয়েটি বোরখা খুলে খাবার বের করে আমাদের হাতে দিল।অষ্টাদশী মেয়েটি অপরূপা।সে আমাদের একটা পুটুলিতে বাঁধা বাদামভাজা, ছোলাভাজা আর চিঁড়েভাছা দিয়ে বললো
    — আপনারা আমার বাপের বাড়ির দেশের কলেজের ছাত্র। সেজন্য শ্রদ্ধাভরে দিলাম। খিদে পেলে খাবেন। তাহলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।মেয়েটির এই কথা শুনে, তার বিনয়ী আচরণ ও মানবিক মূল্যবোধ অনুভব করে তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
    মেয়েটি ধীরে ধীরে তার গ্রামের পথে চলে গেলো। আমাদের মনের মণিকোঠায় আজও সেই স্মৃতি বিরাজমান।

    আমরা পথ চলছি। ধীরে ধীরে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। চড়া রোদ। লু বইতে লাগলো। খরাপ্রবন অঞ্চল। কোথাও কোনো জনবসতি নেই। আমরা পথ ভুলে অন্য পথে যাচ্ছি।ভরদুপুরে জনমানবহীন রাস্তা।জলাশয় নেই।যতদূর দৃষ্টি চলে কোথাও কোনো বসতির লক্ষনমাত্র নেই। মনে পড়লো
    বঙ্গিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের সেই কবিতা টি।

    “দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
    আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্দ্ধারানিবদ্ধের কলঙ্করেখা॥”

    বন্ধুটি বললো
    আমাদের এই কষ্টের মধ্যে, দুঃখের মধ্যে কবিতা আসে কি করে?
    আমি বললাম
    রামদুলাল! মহর্ষি বাল্মিকী একদিন দুপুরে তমসা নদীতে স্নান করছিলেন সেইসময় একজোড়া পাখি যৌনসঙ্গমে রত ছিল। তখন এক ব্যাধ পুরুষ পাখিটিকে তীরবিদ্ধ করে নিহত করেছিল।
    তখন স্ত্রী পাখিটি মর্মান্তিক দুঃখে শোকাগত।

    মহর্ষি বাল্মিকীর মুখ থেকে এক শ্লোক বের হয়েছিল। মহর্ষি বাল্মিকীর অনেক দুঃখে এই মুখনিঃসৃত বাণী।এইটিই জগতের প্রথম কবিতা

    “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
    যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্”
    বাহ্। তুই সাইন্স স্টুডেন্ট হয়েও অনেক কিছু জানিস দেখছি।

    যাইহোক এখন আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে।
    “একটু জলপাই কোথায় বলতে পারিস?”
    আমি বললাম
    — জলপাই এখন কোথায় পাবো? কাঁচা আম চাসতো দিতে পারি।
    দুজনে এভাবে হাসতে হাসতে পথ চলেছি।
    এবার রাস্তার ধারে সত্যিই এক আমগাছের দেখা পেলাম।
    আমরা ঢিল মেরে আম পাড়ার চেষ্টা করছিলাম।
    যদি এই ভর দুপুরে কাঁচা আম খেয়ে তেষ্টা ও খিদে কিছুটা নিবারণ হয়!
    এমন সময় সেখানে হঠাৎ এক ঘোমটা মাথায় মহিলা উদয় হলেন। হাতে পূজার থালা। মাথায় সিঁদুর। আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
    আমরা পরিচয় ও গন্তব্য সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।
    মহিলাটি বললো
    — আমি পুত্রসন্তান কামনা করে সামনে এক শিব মন্দিরে পূজা দিয়ে ফিরছি।
    বলে তিনি থালার সব প্রসাদ ও গ্লাসের জল খাওয়ালেন।
    আমরা দুজনাই তৃপ্ত হলাম।বললেন সামনে ওই গ্রামে আমি থাকি।তোমরা চল আমার বাড়িতে। আমি তোমাদের দুপুরে ভাত খাওয়াবো।
    — আমরা বললাম। আমাদের দেরি হয়ে যাবে।
    — না দেরি হবেনা। যা রান্না করে এসেছি তাই তোমাদের দেব।

    খিদে তেষ্টায় আমরা কাতর।
    তপ্ত দুপুরের রোদে গা ঝলসে যাচ্ছে। দুজনে রাজি হয়ে গেলাম। মহিলার সাথে তার বাড়িতে গেলাম। প্রথমে বাতাসা দিয়ে জল দিলেন। বললেন –যাও কুঁয়াতে গিয়ে স্নান সেরে এসো। আমি ভাত বেড়ে রাখছি।আমরা স্নান সেরে এলে উনি আমাদের সাত তরকারি দিয়ে ভাত পরিবেশন করলেন। আমরা দুপুরে ভোজন করে তৃপ্ত হয়ে প্রণাম করে বললাম
    — আপনি সাক্ষাৎ দেবি।
    এবার আমরা আসি।তিনি আমাদের দুজনকেই রাস্তায় হাত খরচের জন্য দু টাকা করে দিলেন। আমরা অভিভূত হলাম।

    এবার ভাত খেয়ে শরীরে বল পেয়ে ভরদুপুরে রওনা হলাম।
    এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে পথ চলছি।
    বেলা প্রায় তিনটে। তিনটার সময় সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা হয়।
    গ্রীষ্মের দুপুর, তার সাথে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহে আমরা কাহিল।
    বিরামহীন পদযাত্রা।
    চরৈবতি।চরৈবতি।
    ঘন্টা দেড়েক হেঁটে আমরা পৌছলাম সেই গ্রামে যেখানে আমরা ভাড়া করা টায়ার ফাটা
    সাইকেলটি রেখেছিলাম।
    সেই ভদ্রলোকটি অতি অমায়িক। আমাদের সাইকেলটি বের করে আমাদের বললেন
    — এই নাও তোমাদের সাইকেল।আমি সামনের চাকার টায়ার টিউব বদলে নতুন লাগিয়ে দিয়েছি।আমরা তার কথা শুনে বললাম
    — কিন্তু কতটাকা আমাদের দিতে হবে?
    — তোমাদের কোনো টাকা দিতে হবেনা।
    আমরা আশ্চর্য হয়ে বললাম কিন্তু কেন?
    — তোমরা বিপদে পড়ে বিশ্বাস করে আমার কাছে সাইকেল রেখেছো।এইটুকু কর্তব্য করতে পেরে আমি ধন্য।
    — আমাদের কাছে সেই মহিলার দেওয়া টাকা ছিল।আমরা সব টাকা দিয়ে দিতে গেলাম কিন্তু কিছুতেই টাকা নিতে রাজি হলেননা। বললেন তোমাদের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দেখে বুঝেছিলাম তোমরা অনেক বড়ো হবে।
    — আমরা দুজনে সেই ভদ্রলোককে প্রণাম করলাম।
    তিনি আমাদের আশীর্বাদ করে বললেন
    — প্রকৃত বিদ্বান হও।
    ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ:
    এবার পালাপালি করে দুজনে সাইকেল চেপে সেই সাইকেল দোকানে পৌছলাম। বললাম
    —ভাড়া কতো দিতে হবে বলুন?
    সাইকেলের দোকানের মালিক বললো
    — সামনের চাকার টায়ারটি দেখছি নতুন।
    আমরা তখন সবিস্তারে সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে বললেন
    — তোমাদের টাকা দিতে তো হবেনা।কিন্তু আমাকে তোমাদেরকে টাকা দিতে হবে।
    আমরা বললাম
    — আপনাকেও কোনো টাকা দিতে হবেনা। তবে এই ভরদুপুরে প্রচন্ড গরমে আমাদের খুব তেষ্টা পেয়েছে।
    দু গ্লাস জল দিন।
    আমরা জলপান করে হেঁটে হেঁটে আমাদের হোস্টেলে ফিরে এলাম।
    ভরদুপুরের এক অভিযানের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি রয়ে গেলো আমাদের মনের মণিকোঠায়।

    1.  
  • ভ্রমণ কাহিনী

    ভ্রমণ কাহিনী- পায়ের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকা পথখানি যায়

    পায়ের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকা পথখানি যায়
    -সুনির্মল বসু

     

     

    গেস্ট হাউসের সামনে সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ যখন টো টো থেকে নামলাম, তখন গাছের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ। চারদিকে মৃদু ঠান্ডা বাতাস, মাইকে কোথাও কার্তিক পূজো উপলক্ষে গান বাজছিল। গেস্ট হাউসের কর্মীরা সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। দোতলা, তিনতলায় আমাদের থাকবার জন্য ঘর বরাদ্দ করা ছিল। সেখানেই আমরা বিশ্রামের জন্য পৌঁছলাম। চা-বিস্কুট এলো। পাখাটা হালকা করে চালিয়ে দিয়ে, আমরা নতুন জায়গাটা নিয়ে পর্যালোচনা এবং পরিকল্পনা জুড়ে দিলাম।

    ইতিপূর্বে হাওড়ার স্টেশনের আঠারো নম্বর প্লাটফর্ম থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চড়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতায় এসেছি।

    সব সুদ্ধ দশজন। যোগীজী বয়সে তরুণ। উত্তরপ্রদেশে জন্ম। ধ্যান, প্রাণায়াম শেখান। সাত্ত্বিক মানুষ।

    কলকাতার বাসিন্দা, বর্তমানে ঋষিকেশ নিবাসী চন্দ্রানী ট্রেনের ভেতর সকলের হাতে শর্মার বিখ্যাত খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।
    ট্রেনের ভেতর গল্প জমে উঠলো। সারাটা পথ কথা চললো, অপরিচয়ের দেওয়াল গেল সরে। যেন একে অন্যের কাছে কত দিনের পরিচিত।

    গেস্ট হাউসে রাতের খাবার একসময় পৌঁছে গেল। শীতের পোশাক আনা হয়েছিল। কিন্তু প্রথমদিকে এখানে পাখা চালাতে হয়েছিল। ভোররাতে অবশ্য পায়ের কাছে থাকা কম্বল টেনে নিতে হয়েছে।

    পরদিন সকাল বেলা যে যার পছন্দ মতো লুচি মিষ্টি
    খেয়ে গড়বেতার গভীর জঙ্গলে সদলবলে ঢুকে পড়লাম। পায়ের নীচে লাল মাটি, চড়াই উৎরাই পথ। পথের দু’ধারে ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলে মাঝে মাঝে হাতির দেখা মেলে।

    জলাশয়ের পাশে হাতির পায়ের ছাপ দেখা গেল। দেদার ছবি তোলা হলো। চারদিকে এত বর্ণময় সবুজের সমারোহ, লাল মাটির সোঁদা গন্ধ, বনফুলের বর্ণ সুষমা, গাছপালা ও বৃক্ষলতার জগৎ, মানুষের মনকে উদাস করে দেয়।

    মনে পড়ছিল, এমনই বিজন অরণ্যে হাঁটতে হাঁটতে একালের শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একদিন লিখেছিলেন, হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান।

    মনে পড়ছিল, কবি বীরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা,
    সারাজীবন পাতাঝরা বৃক্ষ তুমি…

    সারা জীবন পাতা ঝরা বৃক্ষ‌ তুমি,
    তুমি অকালে পাতাঝরার আগেই নিজেকে জেনেছিলে, এই থেকে ঘর তোমাকে দেখলে হেসেছে মাইকেল, কিন্তু মাইকেলের ছিল মাত্র চোদ্দ বছর,
    সারাজীবন পাতাঝরা বৃক্ষ তুমি,
    কবিতা, জানলে না।

    এই নিবিড় অরণ্য প্রচুর কাঁটা লতার জঙ্গল। বুনোফল ও বুনোফুলের সমাবেশ। চোর কাঁটার মতো কেমন যেন স্মৃতির মাঝে জড়িয়ে যায়। এই ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতিগুলো মনে থাকে। কখনো কখনো বিরল মুহূর্তে স্মৃতিগুলো কথা বলে ওঠে অনর্গল।

    আমার কবি অরুণ মিত্রের কবিতার লাইন মনে পড়ছিল,

    ফুল ফোটবার শব্দ তুমি শুনেছিলে,
    আমার হয়নি শোনা, আমার কি দোষ,
    মধ্যরাতে একা একা বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো লাগেনা আমার,
    যে অর্থে আমার তোমাকে চাই, সে অর্থে কবিতা ভালোবাসি আমি, তবু কেন ফেরাও আমাকে, ফুল ফোটবার শব্দ তুমি শুনেছিলে, আমার হয়নি শোনা,
    আমার কি দোষ।

    মহিলা সদস্যারা নিজস্বী তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
    একসময় বন জঙ্গল পেরিয়ে ১৭৯৭ সালে প্রতিষ্টিত শিব মন্দির দেখতে যাওয়া হলো। ভিন্ন ভিন্ন নামে ভোলা মহেশ্বরের নামে পরপর অনেকগুলো মন্দির।
    সযত্ন রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এই দেবভূমি ভক্তি পবিত্রতা ও সৌন্দর্যে আজও অনন্য হয়ে রয়েছে।

    এরপর যাওয়া হলো, সর্বমঙ্গলা মন্দিরে। এখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। ভিতরে অজস্র ভক্তমণ্ডলীর সমাবেশ।

    সবশেষে, গনগনিতে আসা হলো। পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলা হয়, এই অঞ্চলটিকে। এই ধরনের প্রেক্ষাপট একমাত্র ভারতবর্ষের চম্বল অঞ্চলে দেখা যায়। আমেরিকার কলোরাডো নদীর পাশে রয়েছে বিখ্যাত দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা অঞ্চলে এজাতীয় গিরিখাত রয়েছে। গনগনি নামে এই অঞ্চলে তার ব্যাপক প্রসিদ্ধি।
    লোক শ্রুতি আছে যে, জননী কুন্তীর মধ্যম পুত্র ভীম এর সঙ্গে বক রাক্ষসের লড়াই এই অঞ্চলে ঘটেছিল।
    এখানকার মাটির রঙ তাই লাল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। চম্বলের বেহড়ের মতো খানিকটা দুর্গম এখানকার চলার পথ। পাশেই শিলাবতী নদী প্রবহমান। এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। বাইরে থেকে এখানকার মাটিকে শক্ত মনে হলেও, আসলে অনেক জায়গায় মাটি একেবারে পলকা। কিছু কিছু জায়গায় যাওয়া দুষ্কর।

    সঙ্গী-সাথীরা অনেকেই নিচে নেমে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মাথার ওপর তখন গনগনে সূর্য।
    গনগনির গনগনে সূর্যের তেজ উপেক্ষা করে পর্যটকেরা বহুদূর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ালেন, প্রাণভরে ছবি তুললেন, ঐতিহাসিক জায়গার স্মৃতির আলোটুকু বুকের মধ্যে ধরে রাখবার জন্য সচেষ্ট হলেন।

    এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক পটভূমি, লৌকিক বিশ্বাস, প্রাচীন কাহিনী কিংবদন্তী সম্পর্কে অনেকেই সবিশেষ আগ্রহী। অনেকে বলেছিলেন, সকালে এখানে এলে, আরো ভালো হতো।

    সবচেয়ে কম বয়সী তরুণ সহযাত্রী, আমাদের সন্তান তুল্য ময়ূখ গনগনির অসম্ভব সুন্দর ভিডিও তুলে সকলের জন্য উপহার পাঠিয়েছে। তাঁর জন্য অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা।

    আসলে আমরা ইতিপূর্বে আরন্য ভূমি পেরিয়ে, দু-দুটো দেবভূমি দেখে এসেছি। সবটাই পথের সঞ্চয়।
    স্মৃতির সংগ্রহশালায় সবটাই জরুরী।

    দেখতে দেখতে যাবার সময় এসে গেলো। একটি মনোরম কুঠী বাড়িতে দুপুরের খাবার খাওয়া হলো। তারপর আরণ্যক এক্সপ্রেস ধরে সদলবলে আমাদের কলকাতায় ফেরার কথা।

    শালিমার স্টেশনে নেমে, সকলের মন খারাপ। আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় প্রত্যেকেই ভারাক্রান্ত।
    একজন বলছিল, মনে হচ্ছে আমরা অনেকদিন সবাই মিলে একসঙ্গে ছিলাম।
    সমগ্র ভ্রমণের পরিকল্পনা এবং আয়োজক ছিলেন
    তেনজিং ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস।
    যার উদ্যোগে এই আয়োজন, তিনি আমার সহৃদয় বন্ধু। তাঁর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, সে কথা স্মরণে রেখে, আমি নিজের কৃতজ্ঞতার কথা তাকে জানাচ্ছি না ,আমার হৃদয়ের গভীর ভালোবাসাটুকু তাঁর উদ্দেশ্যে উজাড় করে দিচ্ছি।

  • ভ্রমণ কাহিনী

    ভূ-স্বর্গ 

    ভূ-স্বর্গ
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    ভ্রমণ করতে কে না ভালোবাসে কিন্তু ভ্রমণ করাই মানে আনন্দ করা কোন মতেই যেন নিরানন্দ না আসে। সেই দিকটা খুবই খেয়াল রাখতে হবে। চলুন ঘুরে আসা যাক ভূ-স্বর্গ থেকে। ভূ-স্বর্গকে দু’টি ভাগে ভাগ করতে হবে। ১) কাশ্মীর ২) লে। দু’টি ভাগ দুই সময়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে দুই জায়গা ভ্রমণ করলে দু’টির মজা পাবেন না। কোন ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যাবেন কখনোই নিজেরা যাবেন না। সঙ্গে ভোটার কার্ড ও আঁধার কার্ড ও কয়েক কপি জেরক্স নিতে ভুলবেন না। ATM কার্ড সঙ্গে রাখবেন ক্যাস টাকা না দিয়ে পারলে দেবেন না। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নেবেন সঙ্গে।  “Diamox 250mg” দিনে দুবার খাবার পর খাবেন তিন দিন পাহাড়ে ঢোকার ঠিক আগে। এই ঔষধটি দেহে অক্সিজেন নিতে সাহায্য করে।” —-কথা গুলি বলেছেন লে’র সরকারি হসপিটালের ডাক্তার।
    কাশ্মীর সাধারনতঃ বরফের সময় যেতে হয় তা হলে বেশ মজা পাবেন। আগষ্ট নভেম্বর থেকে মার্চ এপ্রিল। তবে সারা বছরই যাওয়া যায়। জম্মু ষ্টেশনে নেমে ছোট ছোট বাস আছে তাতে করে শ্রীনগর (298 Km)। আর উচ্চতা 1530 মিটার সমুদ্র তল থেকে। শ্রীনগর শহর ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর কিনারাতে ব্যাট তৈরির কারখানা দেখতে পাবেন। শ্রীনগরে আট নয় দিন থাকলে প্রথমে ডাল লেকে ঘুরে নেবেন। এখানে খুবই বার্গেনীং হয়। শিকারায়  ছয় জন হলে 600 বা 300 টাকায় ফিট হয়ে যাবে। কাশ্মিরী মেয়ে বৌ ও বর সেজে ছবি তুলতে পারবেন। কেনা কাটায় সাবধান থাকবেন। হাউসবোটে রাত কাটাতে পারেন তবে অনেক টাকা খরচ হবে। এই ডাললেকে অনেক ছবির সুটিং হয়েছে।
    লাদাখ শব্দের অর্থ গিরিবর্ত্মের দেশ। এটি একটি জেলা। লাদাখের সদর শহর লে।  এর উচ্চতা 3505 মিটার। শ্রীনগর থেকে লের দূরত্ব 434 কিলোমিটার। মাঝে কারগিলে এক রাত থাকতে হয়। 900 বছরের প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তি যাবার সময় পথে দেখে নেবেন। লে থেকে ণুব্রা উপত্যকা যাবেন এটা হিমালয়ের মরুভূমি বলে। এখানে দুই কুঁজ উট দেখতে পাবেন। এক রাত তাঁবুতে থাকতে হয়।
    পরের দিন চলে যান প্যাংগং লেকে।”লে” শহর থেকে 222 কিলোমিটার দূরে। এখানে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ গাড়ি চলার রাস্তা চাংলা পাস পাবেন এর উচ্চতা 17350 ফুট। 14000 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই সরোবরের দৈর্ঘ্য 130 কিলোমিটার যার 40 কিলোমিটার ভারতের বাকি 90 কিলোমিটার চীন দখল করে নিয়েছে 1962 সালের যুদ্ধের পর থেকে। এই সরোবরটি এশিয়ার বৃহত্তম নোনা জলের লেক। এখানে রংয়ের বৈচিত্র খুবই সুন্দর জল সাতটি রংয়ের হয়। ব্রাক্ষ্মনী হাঁস ও সিগালের দল দেখতে পাবেন। এক রাত অবশ্যই এখানে থাকবেন তাঁবুতে।
    পরের দিন চলে যান সো-মোরিরি লেক লে শহর থেকে 225 কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদ এর পাস দিয়ে চলে যাবেন। পথে একটু দাঁড়িয়ে মারমট (খরগোসের মতো দেখতে) দেখে নিন । এই সরোবরের জলের রং নীল। হাঁস পাখি দেখতে পাবেন। এখানেও এক রাত তাঁবুতে থাকতে হয়। মনে রাখবেন জুলাই, আগষ্টে বর্ষা হলেও লাদাখের আবহাওয়া খুবই ভালো থাকে।
    শ্রীনগর থেকে লে যাবার পথে আর্যগ্রাম দেখে নিতে পারেন খুব সহজেই। আর্য গ্রাম প্রধানত পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ১) দা ২) বিমা ৩) হানু ৪) দারচিক ও ৫) গারকুন। তবে মনে রাখবেন কোন মতেই দারচিক ও গারকুনে যাবার অনুমতি নেই। প্রথম তিনটি গ্রাম ঘুরে দেখলে প্রান আনন্দে ভরে যাবে। এরা “দর্দ” জাতি বহু শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এরা কিন্তু একদম পাল্টায়নি। নিজেদের মধ্যেই বিবাহ হয়। তবে মেয়েরা একটু অন্য রকম। বিদেশীদের বেশি ভালোবাসে তবে তা গোপনে। মনে রাখবেন ওখানকার খাবার না খাওয়াই ভালো যে সব টুরিষ্টরা নিজেরা রান্না করে খাওয়ায় তাদের সঙ্গে যাবেন। এক মাত্র পোষ্ট-পেইড মোবাইল কাজ করে। স্থানীয় প্রিপেইড সিম তুলে নিতে পারেন। নেট ভালো কাজ করে না।  লে থেকে মানালী তারপর  চণ্ডীগর হয়ে ফিরে আসুন ।

You cannot copy content of this page