মুক্ত গদ্য

  • মুক্ত গদ্য

    এ নদী সব‌ই জানে

    এ নদী সব‌ই জানে 

    -রাখী সরদার

     

     

    জলের পাড়ের ওপর ঝোপে কেন পতঙ্গরোদ্দুর চুপ করে বসে থাকে,প্রাচীন লতা টুকরো করতে করতে রামি চণ্ডীদাসের চোখে কী দেখেছিল ,কোন পথে ঘুরে ঘুরে গাছে বাসা বেঁধেছিল গর্ভবতী মেঘ এ নদী সব‌ই জানে ।যার যখনই দেয়াল ভেঙেছে, একলা বাতাসে উড়ে গেছে সম্পর্কের টান সে তখনই এ নদীর জলে চিবুক ডুবিয়ে নিজেকে মেপেছে।ঝাপসা চোখে বলে গেছে এক একটা মিহিন চাঁদ রাতের কথা ।

    এই যেমন হলুদ ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটি দুহাতে ঢেউ সরিয়ে সরিয়ে খুঁড়েছিল বালি।সে শুনেছিল তার মায়ের ভাঙাচোরা ছায়া নাকি সেখানে কোথাও পোঁতা আছে।প্রতি এপ্রিলে বাবার কাছে আব্দার
    করে –‘ঢেউ দেখবো,ঢেউ দেখবো।’প্রতিবার বাবা নিয়ে যায়।হলুদ রোদ্দুর যতক্ষণ সমুদ্রের গায়ে
    হেলান দিয়ে থাকে মেয়েটি মুঠো মুঠো বালি খোঁড়ে।
    প্রথমে নখ,তারপর আঙুল,তারপর কব্জি চিৎকার করে –‘আর নয়, রেহাই দাও,ফিরে চলো’ক্ষুধার্ত মন
    নিয়ে ফিরে যায়,ফিরে যায় মুঠো মুঠো নুন ফেনা আর স্বপ্নে দেখা মায়ের ভাঙা শাঁখার টুকরো নিয়ে।
    তারপর কবে কবে হলুদ ফ্রক লাল হয়,নীল হয়,ক্রমে ফ্যাকাসে।একদিন লুকানো সন্ধেয় মেয়েটি
    চলে আসে এ নদীর কাছে।উদ্ভট উপাখ্যান জলে ভাসিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নখ নিয়ে ফিরে যায় খুঁটিনাটি
    জীবনে ।

    এইতো তের‌ই বৈশাখে খাঁ খাঁ দুপুর মাথায় করে পোড়ো ভিটের ঘুঘুটি উড়ে এলো নদীর তীরে।সূর্য তখন গলে গলে পড়ছে।উড়তে উড়তে ঘুঘুর ঠোঁটে কালচে ধোঁয়া পাক খাচ্ছে, ডানা গেছে ছড়ে ।চোখের রক্তাভ লাল পোড়া শালপাতার মতো জ্বলছে।নদীর বুক ঠুকরে দু ফোঁটা জল নিতে গেল বেচারা ঘুঘু,পারলনা স্খলিত বীর্যের মতো টুপ করে নদীর জিনিস নদীতে ফিরে গেল।শেষে নদী মোচড় মেরে ঢেউ তুলে ঘুঘুর ঠোঁটে দিল সফেদ মিস্টি ফেনা। প্রাণ পেল ঘুঘু।নদীর কাঁধে হাত রেখে বলে গেল নকশা জীবনের কথা —-

    একদিন অন্ধকারের সাথে ঝগড়া করে লাল বাড়িতে বাঁধি বাসা।চোরা প্রেমের টানে পেটে ডিম আসে।লাল বাড়ির খোকা খুকির মতো লালচে ডিম।হাল্কা রোঁয়া ওঠা দুটো বাচ্চা।সারাদিন শসাখেতে সবুজ ফড়িংয়ের পিছুপিছু।দেখতে দেখতে ওরা বড় হয়,ডানা নাড়ে,একে একে উড়ে
    যায় গাছগাছালির বাঁকে। পুরোটাই স্বপ্ন ,লাল বাড়ির খোকা খুকি ভাঙা গল্পের মতো ভেঙে ফেলে ডিম দুটি।বড় মায়া।ছেড়ে যেতে পারিনা ওদের।দিন যায়।প্রতিদিন ফরি যাই সেই অন্ধকার গুহায়।থাকতে পারিনা, সূর্যের পিছন পিছন চলে আসি লালবাড়ির ছোট্ট সেই বাসায়।রাতে সবথেকে বড় তারাটির সাথে খুনসুটি সেরে ঘুমিয়ে পড়ি।একদিন ভোরে স্পষ্ট দেখি খোকা খুকি ভিজে পাতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।ডানা ঝাপটাই যেওনা।শোনেনি ওরা।কত বিকেল দেখেছি কার্ণিশে ঝুলে ঝুলে ক্লান্ত হয়েছে।দেয়াল থেকে বালি,সিমেন্টর চাঙড় আলগা হয়ে পা টিপে টিপে নেমে গেছে ঝোপে ঝাড়ে।তবুও জীর্ণ বাসায় বসে থেকেছি।খোকা খুকি ফিরে আসবে ।ওরা আমার সেই লালচে ডিয যে।আজ নিচের চাতালে হঠাৎ সবশুদ্ধ নেমেআসি।পোড়ো ভিটে সাফ চলছে।ডানায় যেটুকু সুর ছিল তাও শেষ…

    কিছু কিছু কথা গোপনে পা ফেলে নদীর কাছে হেঁটে আসে।সারাদিন শুকনো ঝাঁটিঘাসের ঝোপের আড়ালে চুপ হয়ে থাকে।রাতে বিশাল আকাশে বুক চিতিয়ে চাঁদ উঠলে জল ঘেঁষে দীর্ঘ শ্বাস পড়ে। ঘুমহীন শহর থেকে তখন কোন মৃতপ্রায় সৈনিক এসে বসে নদীর কোলে।সৈনিকের ঘাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে যায় রক্তের স্রোত।বলিষ্ঠ উরু বুলেটের অবিশ্বাস্য হাসিতে ফেটে পড়ছে।কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সৈনিকের।অতীত ও বর্তমানের মাঝের ব্রিজটা নড়তে থাকে।সৈনিক ব্রিজের মাঝ বরাবর গিয়ে না এগোতে পারে না পিছিয়ে আসতে পারে।কোন এক সুকোমল বিকেলে দেখা হয়েছিল প্রিয় বন্ধুর সাথে। হাসি,গল্প,সিগারেটের ধোঁয়ায় মনের অন্ধকার পর্দা উড়িয়ে দিয়েছিল।প্রেমিকার হিমজল ছোঁয়া কালো তিলের ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলার কথাও বলেছিল।তারপর প্রবল ঢেউ এর মতো ডাক আসে।ফিরে যেতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।চিন্ময় বসন্ত ফেলে চলে যেতে হয়।একটা একটা শত্রু পক্ষের গুলি ছুটে আসতো আর নির্ভীক সৈনিক শেষ চুম্বনের কথা মনে রেখে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ফিরিয়ে দিত শত্রু পক্ষের বুকের ক্ষেতে।একদিন সাদাকালো বৃষ্টির ভিতর একটা চিঠি এসে পড়ে ——“পুরনো ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে ফেলেছি।”সৈনিক এর ভিতরটা ভেঙে যাওয়া বাবুইয়ের বাসার মতো হয়ে পড়ে।টুকরো টুকরো ঘাস পাতা উড়ে যায়। ভৌতিক দাবানল আছড়ে পড়ে শরীরে যখন শোনে বন্ধুর উষ্ণতায় তার প্রেমিকা আহত।মুহূর্তে সমস্ত হাড়ের খিলান নড়ে ওঠে। ভাঙাচোরা একজোড়া মুখ চোখের সামনে অশ্লীল ভঙ্গিতে নাচতে থাকে।আঁকাবাঁকা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দুকের তীক্ষ্ম আলো।সৈনিক বিবর্ণ ল্যাম্পপোস্টের মতো পড়ে যায় ।তারপর অনেক গুলো নিরক্ষীয় গ্রীষ্ম পার হয়ে যায় । আবার যুদ্ধ শুরু।বারবার মৃত্যুর জাল বুনতে থাকে,পারেনা। পৃথিবী যেন বিষাদের পালকে পোড়ার জন্য সৈনিক কে দানপত্র হিসেবে এই অগম্য পথে ফেলে রেখেছে।বিয়োগফলের মতো কাটাকুটি খেলতে
    খেলতে এসে পড়েছে এ নদীর কাছে।চোখের কুয়াশা ঘন হয়ে ওঠার আগে ব্রিজ পেরোতে চেয়েছে।নদীর জলে স্মৃতির সজ্জা ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে নিঃসঙ্গ সৈনিক।

    এক বর্ষার সন্ধ্যায় নদী একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছিল,সারাটাদিন মেঘ বৃষ্টির পাগলামিতে অস্থির হয়ে পড়েছিল।কখনো জলকে হিজিবিজি আলপনা আঁকতে হচ্ছিল তো কখনো দুঃসাহসী মেয়ের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাতালপুরির অসুররাজের দিকে ঢেউ ছুটিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। সারাদিন পর বাঁকা চাঁদের ফালির সাথে একটু প্রেমালাপে ব্যাস্ত এমন সময় চাপা কান্নার আওয়াজ আসে।কুমুদ চাঁদ বলে ওঠে —‘ওগো নদী, দেখো দেখো ওই যে দূরে কে ভেসে আসে ।’ একটা আধপোড়া চিতাকাঠ ভেসে আসছে।সমস্ত শরীর পুড়ে ছাল উঠে আছে।বুকের কাছে খাঁ খাঁ শূন্য। বড় করুণ অবস্থা।দাহচুল্লী থেকে কোনরকমে ঝাঁপিয়ে নদীতে পড়েছে।পালিয়ে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা যে।প্রতিদিন পোড়া মাংসের গন্ধ আর কত সহ্য করা যায়।কচি বাচ্চার নাভি,অবুঝ ছেলেটির মায়ের কোমল হাত,অষ্টাদশীর পদ্মস্তন
    এ সব সব কিছু চিতাকাঠের বুকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হত।কষ্ট হচ্ছে বললেও কেউ শুনতো
    না,সেই যবে থেকে শশ্মান সংসারে ঘর পেতেছে তবে থেকেই শুরু হয়েছে এ যন্ত্রণা।কালো অভিশাপ সবসময় ছায়ার মতো পিছু পিছু ঘোরে।কত মা যে তাকে রাক্ষুসী বলে গালাগালি দিত প্রতিদিন তার
    ঠিক নেই।আর পারলাম না।ভেসে পড়লাম।তারপর ক্ষয় হতে হতে একদিন ঘুমিয়ে পড়বো নদীর ভিতরপানে সেই কাদা বালির দেশে…আরও আরও কতজনের গভীর আর্তনাদ নিঃশব্দে বয়ে নিয়ে চলেছে নদী নিজেই জানেনা।জানবেই বা কিভাবে।এ নদী প্রতিদিন নিজের জলকণার পৃষ্ঠায় লিখে চলেছে শত কান্নার আঁকিবুকি।যার যখনই কষ্ট হয়েছে এসে বসেছে নদীর পাশে।স্তব্ধ একতারায় সুর তুলে নিদারুণ মুহুর্তকে ভুলতে চেয়েছে…অনেক যাতনা পেরিয়ে চলে আসি। ছিঁড়ে ফেলি তুমুল দুঃখ যে কোমল আগুনে যতটুকু পুড়েছি বাকিটা বাঁচানোর ইচ্ছেয় জলে নামি, মাঝরাতে আকাশ ফুরিয়ে গেলেও পাশে থাকে উৎসুক ঘন জল । স্পষ্ট বুঝতে পারি আর কেউজানুক বা না জানুক এ নদী সব‌ই জানে…

  • মুক্ত গদ্য

    নতুন ছন্দে ছন্দে লিখবো আমার পথের দিশা

    নতুন ছন্দে ছন্দে লিখবো আমার পথের দিশা
    -পলি ঘোষ

     

     

    অলি গলিতে সন্ধ্যায় ঘরের সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ঘুরে ঘুরে ফিরে একই রকম ভাবে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে থাকা প্রচুর পরিমান কিছু কিস্তিবন্দী কথা অমৃত বাণী নিভৃতে অভিমানে কেঁদে আজ আমি উপলব্ধি করতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে আত্মার সীমাহীন সুখে অবগাহন এক যান্ত্রিক জীবনদর্শন হয়েছি।
    আমি আজ হিমশীতল শীতের কুয়াশা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সমর্থক আজ সত্যি সত্যি ইতি টানতে এক নীড় বেঁধেছি। যেতে চাই আমি আরো অনেক ভালো এক সুবিশাল কক্ষ আশা করে নিজের মতো কেউ আমাকে একটা সুন্দর অসাধারণ কবিতা লিখে দোয়েল পাখির মিষ্টি গানের সুর বাজিয়ে মিষ্টি এক নতুন এক সকাল উপহার দেওয়ার জন্য এগিয়ে সরবে অপেক্ষা করবে।
    সতত মোরে ডাকিবে। দেখি আমি শ্যাওলা পড়া শেষ করে নিজের জীবন অপূর্ণ রয়ে যাওয়া সময়টুকু আজকালকার ভালো একক ভাবে যদি গড়ি মন্দ কি তাতে। আমি আছি তোমার জন্যে এক সুবিশাল জনসমুদ্র হাতছানি আশা হয়ে। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতে আমি শুধুই কল্পনা ভেসে ঊষাকে আগমনী বার্তা পৌছে দিলাম উপহার। আমি আছি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা হয়ে। আজ কলম হাতে তুলে ধরা পড়ে থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে নিজের কাছে কোন পথ চলার সাথী হয়ে। আমি আজ বিকালে মেঠো পথের মাঝে কেবল মাত্র এক ধূমকেতু।

  • মুক্ত গদ্য

    স্বপ্ন ভেঙে যাবার সাতকাহন

    স্বপ্ন ভেঙে যাবার সাতকাহন
    -সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

     

    প্রায়শই মনে আসে স্বপ্ন দেখার স্বপ্নগুলো– সাতকাহন শোনাবে কীভাবে? ভাবনাটা কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলে। আসল সত্যিগুলো স্বপ্নেই রয়ে যায়। মনের ভিতরে, ভাবনার অতলগর্ভে বিকট ঘন অন্ধকার! কে আছে ওখানে? স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প! আর্তনাদ! অস্বীকার! কিছুই বোঝা যায় না।
    আজকের প্রজন্মের পুত্র সন্তানেরা ভাবতেই বেসামাল— স্বপ্ন ভাঙ্গার মজলিসে। তবু ঘটনা পরম্পরায় সেটাই কাপড়েচোপড়ে হবার মত অবস্থায়। সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া ছেলেকে আর না পড়িয়ে পয়সা রোজগারের মেশিন বানানো– তার মেধাকে উপেক্ষা করা।
    মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া তার স্বপ্ন ভাঙ্গার ইতিবৃত্ত। মা ও মেয়ে যেভাবেই কথা বিলি করিনা কেন ক্যালসিয়াম, আয়রণ, ফলিক এ্যসিড দিয়ে যত্ন- বেলুন চুপসে যাবেই। দেখে শুনে নারীদের স্ট্রেস বাড়ে বই কমে কি??
    মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়— গলা মোম নিচে জড়ো হয়। ধূপ পুড়তে পুড়তে ছাই হয়-মেয়েরাও যেমন সংসারএর নুন- ঝালমসলা, কাপড় চোপড় এর হিসেব রাখতে রাখতেই শেষ। কলেজ ফি জমা দেয়ার মত নিত্যদিন মুখঝামটা আর উপেক্ষার শিডিউল তার ভাগ্যে।
    নালিশ করবে কাকে? নালিশটা যেন তার ন্যাকামি! ভালোবাসা, আদর প্রেসার মাপার যন্ত্রের লো- প্রেসার, কিং বা ফুচকার মত সহজেই চুপসে থুবড়ে মসলা আর টকজলেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বিবাহিত স্বামী পুরুষটি যেন ট্যুরিস্ট দলের একজন অন্যতম প্রধান সদস্য। মেয়েটিই হয় দায়ী নিখুঁত বিনি পয়সার হাউজহোল্ড কর্মচারী। স্বপ্নভেঙে সাতকাহন গল্প রচিত হয়।

  • মুক্ত গদ্য

    বিজয়া স্মৃতি

    বিজয়া স্মৃতি
    -রাণা চ্যাটার্জী

     

     

    দশমীর সকাল,ঘুম ভাঙতেই এক রাশ বিষণ্নতা গ্রাস করতো। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল মন চাইতেই ফোন করার ধুম, দিন রাত কি করি, কি করি করে মোবাইলেকে কি পোষ্ট দিলো তার ছিল না উঁকি ঝুঁকি। তবু যেন বেশ ছিল সেই সব পূজা পার্বণের দিনগুলো। আন্তরিকতা, গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে সন্ধ্যায় বিসর্জনের পরে প্রণাম ও আশীর্বাদ আদান প্রদানের মধুরতা। তিলের নাড়ু, সিড়ির নাড়ু, নিমকি কত কি কাঁচের বয়ানে বানিয়ে রাখার তোড়জোড়। কোনো কোনো বাড়িতে ঘুগনি, কিনে আনা মতিচুর লাড্ডু পেলে তো আহা খুশিতে ডগমগ, মামার বাড়িতে আমার সেই শৈশব।

    সব কিছু সেরে হ্যারিকেনের আলোতে এক গোছা পোস্টকার্ড নিয়ে দিদার সঙ্গে বসা, কাকে কাকে চিঠিতে বিজয়া আশীর্বাদ পাঠাবেন তার আলোচনা সেরে নিতাম উঠানে অন্ধকার আর ঝিঁ ঝিঁ শব্দ সঙ্গী করে।পুরানো ডাইরি ঘেঁটে ঠিকানা উদ্ধার করে তা দিদার নির্দেশ মতো লিখে ফেলার মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা,পোষ্টম্যানের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, চিঠির এক প্রান্তে দিদার কাঁপা কাঁপা হাতে আশীর্বাদ বার্তা, আর ঠিকানায় আমার অপরিপক্ক হাতের লেখনী সম্বলিত।

    আজ বিজয়ার বিষাদ ভরা দিনে মনে পড়ছে পুরানো স্মৃতি। গ্রামে কাজের পাহাড় ভরা সংসারের এতো কাজ সামলে, ক্লান্ত ঘর্ম দেহে, একটু যে বিশ্রাম নেবে তা নয়, দুপুরে,রাত্রে একটু ফুরসৎ পেলেই গল্পের বই নিয়ে দিদার পড়তে বসা, আরো জানার আগ্রহ দেখতাম আর অবাক হতাম। আত্মীয় স্বজন, নাতি নাতনি, বেয়াই বেয়ান যে যেখানে আছে বিজয়া প্রণাম আসুক আর না আসুক দিদা কিন্তু আপন কর্তব্য সাবলীল ভাবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হাসিমুখে পালন করে গেছে।

    আজ শিক্ষা সংস্কৃতিতে বহুগুণ পারদর্শী হয়ে আমরা বিজয়া প্রণাম করতে, জানাতে ইতস্তত বোধ করি। ভুলে যাই ঘরের গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিতে, পাছে ওনারা যদি কিছু ভাবেন এই ভেবে। কেউ যদি কাঁচের বয়ান থেকে গুড়ের নাড়ু বের করে এনে দেয়, চোখ চাওয়া চাওয়ি করে মুখ টিপে হাসি, আদতে দিন কালের সাথে সাথে আমরা কেমন যেন একটু একটু করে কৃত্রিম হয়ে উঠছি বিজয়া দশমীর আধুনিকতা গন্ধ গায়ে মেখে।

  • মুক্ত গদ্য

    ময়না মতি

    ময়না মতি
    -রাণা চ্যাটার্জী 

    আমি ময়না মতি ,
    বড় আদরে শৈশব থেকে ডালপালা মেলে
    বড়ো হয়ে ওঠা এক যুবতী নারী।
    ছোটো বেলায় দাদার মুখে শোনা, রামু চাচা
    একটা ময়না পাখি এনে দিয়েছিলো!
    সেটাই ছিলো দাদার ধ্যান জ্ঞান।

    এক ঝড়ের রাতে, ভুল করে দরজা বন্ধ থাকায় মর্মান্তিক পরিণতিতে, আশ্চর্য্যজনক ভাবে খুবলে খেয়েছিলো কোনো দস্যি, হুলো বেড়াল !

    তার কিছু দিন পরেই ক্লাস ফোরে পড়া
    দাদা,পূর্বাভাস পায় “আমি আসছি “।

    ভাই না বোন তা নিয়ে,খুব একটা মাথাব্যাথা ছিলনা দাদার, কেবল ছিলো এক রাশ আনন্দ,
    যখন গভীর রাতে মা, প্রথম বাবাকে জড়িয়ে
    আমার আগমনের বার্তা দিয়েছিলো।

    আদরের ময়না হারিয়ে, দাদার সেই চোখে চোখে রাখা, আর মা বাবার পরম স্নেহে,
    আমার ময়না মতি হয়ে ওঠার দিনযাপনের শুরু।

    আড়ালে কখনো কখনো ঠাকুমার হাপিত্যেশ শুনতাম,
    কলতলায় যখন গোবর কুড়ানী ও পাড়ার খুড়িমা দুদণ্ড জিরোতে আসতো দুপুরে আমাদের বাড়ির পেছন দাওয়ায়।
    আর একটা পুত্র সন্তান নেবার চাপ, অবশেষে সুখের দিনে নজর লাগালো অচিরেই ।

    এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডার বৃষ্টি বাদলার ভোর রাতে,
    গ্রামের উঁচু নিচু এবড়ো খেবরো জল-ডাঙ্গা রাস্তায় ভ্যানের ঝাঁকুনিতে তীব্র প্রসব বেদনায় বার বার জ্ঞান হারিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ!

    খুব সামান্য চাহিদায়,বড়ো স্নেহে দুই ছেলে মেয়ে, আর স্বামীর একটু আদর, অবজ্ঞাতেই খুশির স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, সরলমনা আমার মা।

    মায়ের মুখটা মনে করতে করতে ঘুম ভাঙ্গা সকালে হঠাৎ জল ভর্তি মগের আচমকা হাত থেকে পড়ে যাওয়া,
    ছ্যাঁক করে বুকের মাঝে যেন কিছুর বার্তা দিলো !

    সহজ পাঠ বইয়ের আঁকিবুঁকির মাঝেও শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা,”এই বুঝি বাবা এলো “!

    দুপুরে বাবা এলেন,গ্রামের কিছু গ্রামের মাতব্বর সঙ্গে, সেই অপূর্ব সরলতা মাখা আমার মা হিমশীতল ডেডবডি হয়ে উঠোনে আমাদের সামনে!
    বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাক্স প্যাটরায় মায়ের শখের দু চার খান শাড়ি,সোনার জল ধরানো গয়না গায়ে উঠলো আমাদের সৎ মায়ের।

    বাবা সোহাগে পায়ের মল গড়িয়ে দিলেন,সেই মিষ্টি ছম ছম নূপুর ধ্বনি বড়ো বেমানান সুরে বাজতো আমার কানে! আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের সাথে দু দণ্ড গল্প করার নীরবতা বাধ সাধতো মুহূর্তে।

    দাদার ঠাঁই হলো,দশ ক্রোশ দূরের আনন্দমার্গ স্কুলের হোস্টেলে।

    ময়নামতির সেই অভাগীর দিন শুরু …!
    নাম কা ওয়াস্তে,বইগুলো নিয়ে বসতাম আর, নতুন মায়ের ফাই ফরমাশ খেটে দিন গুজরান হতো।
    মাঝ রাতে দাওয়ার কঞ্চি ঘেরা এক চিলতে চৌকিতে শুয়ে বালিশ ভেজানোর কতো রাত জাগা!
    মা ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতেন স্বপ্নে, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে এলে আমায় নিয়ে যাবার বায়নায় বলে উঠতাম, “মা গো আমায় কি নিয়ে চলো না মা, তোমার কাছে !”
    কখনো ঘোরে চিৎকার করে ‘ওরে দাদা ,আয়না রে ,আমায় নিয়ে চল।’
    আমার প্রিয় ঘর, ছিঁটে বেড়া দেওয়াল, আর খাঁ খাঁ উঠোন আমায় গিলতে আসতো !

    কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে উঠলো আমার শরীর,
    পাড়া প্রতিবেশী, গ্রামের ফচকে ছোঁড়া, বুড়ো কেউই আড় চোখে আমার ডাগর শরীরের বেড়ে ওঠা দেখতে ছাড়তো না।

    মাতব্বরেরা বিধেন দিলেন হেঁকে, ‘ওরে ময়নার বাপ্, মেয়ে তো দিন কে দিন ডাল পালা মেলছে গতি কর জলদি’
    মনে মনে হেসেছিলাম, দাদার আদরের ময়না মতীর একটা হিল্লের জন্য এই পুরুষ কুলের কতো চিন্তা !

    জানলাম না, চিনলাম না, গ্রামের দুগ্গা তলায় সিঁদুর দান সম্পন্ন হলো এক ভিনদেশি পুরুষের সাথে!
    নব বধূর সাজে আমি ময়নামতী, ফুলশয্যার রাতেই বুঝলাম, আমার বাপের বয়সী, এক পোড়া কাঠ কয়লা হয়েছে আমার জীবনের সোহাগ।

    বিয়ের এক মাসের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেলো, মোটা অঙ্কের খেলায় নতুন মা, আমার সত্গতি করেছেন নপুংসক এই আধবুড়োর সঙ্গে।

    প্রতি রাতে, ঘুমানোর ভান করে কান্নায় কেঁপে ওঠা আমার মন মায়ের কাছে, দাদার কাছে যখন আশ্রয় খুঁজতো, উপলব্ধি করতাম এক জান্তব লোমশ হাত আমার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাপ নেবার খেলায় মাতে!

    মাত্র উনিশটা বসন্ত পার হওয়া আমি এখন ঠাঁই পেয়েছি হাসপাতালের ফিমেল বার্নিং ওয়ার্ডের বেডে,
    একটা কাক সেই কখন থেকে কর্কশ ভাবে ডেকেই চলেছে কার্ণিশে!
    সারা শরীর আমার অর্ধ দগ্ধ, জ্বলে গিয়েছে বুক, পেট তলপেট,নিম্নাঙ্গ!
    এক উন্মত্ত ঝড়ো রাতে মদ্যপ স্বামীকে ঠেলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি।

    ময়না পাখি হয়ে শেকল কেটে বাঁচতে চেয়েছিলাম!
    ভেবেছিলাম এক ছুটে দাদাকে খুঁজে সব বলে হালকা হবো,বলবো “দাদারে তোর ময়না মতীকে বাঁচা “।
    রাত জাগা সকালে উঠে সে সুখ আর হয়নি !

    পৌরুষে আঘাত লাগা মদ্যপ যে ক্ষ্যাপা বাঘের চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তার নজির পেয়েছি আমি হাতে নাতে!
    প্রকৃতির ডাকে ঘুম চোখে ভোরবেলায় বাইরে আসতেই, কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আমার সর্বাঙ্গ!
    ঠোঁটে দেশলাই কাঠি চেপে, ‘আমার নাকি রূপের গরব ,’ আর সেটাকেই পুড়িয়ে দিতে পারার উল্লসিত দেঁতো পুরুষতন্ত্রের হাসির মুখরিত ধ্বনি আজও কানে ভাসছে।

    হাসপাতালের বেডে পরম যত্নে আমার চোখের জল, মুছিয়ে দেবার আপ্রাণ চেস্টায় রত আমার নার্স আর দেখভাল করা মাসি ।
    মন তখনো আকুতি নিয়ে বলছে, আয় না রে দাদা, একটি বার, এসে দেখে যা তোর ময়নামতি কেমন একটু একটু করে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে!

  • মুক্ত গদ্য

    কবির স্বপ্ন

    কবির স্বপ্ন
    – কুমার প্রনবেশ

    আমরা হাতে গোনা কয়েকজন সাহিত্যিক চিনি বা জানি ,
    পরিচিতি– ভালো লেখেন |
    তাই বুকসেলে ওনাদের কাব্য উপন্যাস চোখে পড়বেই ,
    গ্রাম, আধা শহরের পাঠাগারে
    এমন কি সাম্যবাদের ঘোর শত্রু
    সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তির আলমারীতে
    মার্ক্স -এর বিজ্ঞান সন্মত দ্বন্দ্বমুলক বস্তুবাদ ;

    আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না —
    অনেকেই আছেন বই কেনেন
    বসার ঘরে আলমারীতে সাজিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ,
    বছরের দু-তিনবার কাজের লোক দিয়ে
    পরিষ্কার করেও রাখেন |
    অনেকটা স্যোসাল মিডিয়ায় সাহিত্যিকদের লেখায়
    লাইক দেওয়ার মতো অবস্থা,
    আপনাকে বলতেই হবে– এটা একটা ফ্যাসান |

    আমার পরিচিত একজনকে দেখেছি
    চায়ের দোকানে গিয়ে খবরের কাগজে
    তন্নতন্ন করে সবার প্রথমে চোখ বোলাতে ,
    ভুল ভাঙল সেদিন, ভদ্রলোকের ছোট্ট নাতিন

    সাত সকালে চায়ের দোকানে এসে বল্লে —
    দাদু ,তুমি তো সব জায়গায় বুড়ো আঙুলে কালি লাগাও ! ——-
    ও বুঝেছি! তুমি ছবি দেখো !

    লজ্জিত চায়ের দোকানের ছবি দেখা ভদ্রলোক
    তারপর, সন্ধ্যা হলেই হ্যারিকেন নিয়ে
    নিরক্ষতা দুরীকরন সাইনবোর্ড সাটা ইস্কুলে যায়,
    আজ তিনি কবিতা লিখেন—-
    মা যদি হয় স্বাক্ষর
    সন্তান হয় না নিরক্ষর |
    এবার নিশ্চয় আপনি খবরের কাগজে ছবি দেখা,
    ——— ফ্যাসান বলবেন না |

    সাহিত্যিকদের লেখায় লাইক দিতে দিতে
    একদিন তিনি নিজেও লিখবেন বা লিখেছেন ,
    এরকম উদাহরণ হয়তো কোন সাহিত্য সভায়
    মাইক্রোফোন হাতে কোন খ্যাতনামা লেখক বা কবি বলবেন বা বলেছেন ;
    বই আলমারীতে সাজানো ব্যাপারটা যদি এমন হয় !

    অথবা ঐ ভদ্রলোক কোন বই মেলা উদ্বোধন করে
    বুক স্টলে স্টলে ঘুরে অনেক গুলি বই কিনে
    রাখলেন বসার ঘরে বুকসেলে ;
    আপনার বইও যদি থাকে
    রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের একি তাকে একি সাথে
    আপনি আপ্লুত হবেন !
    এবার নিশ্চয়ই আপনি বই কেনা ফ্যাসান বলবেন না |

    মজার ব্যাপার হলো বিয়ের নেমন্ত্রণ কার্ড আজকাল কেউ পড়েন না,
    নেমন্ত্রণ করতে আসা করতে আসা ব্যক্তির কাছে
    জেনে নেন তারিখটা ,
    ঠিক সেরকমি, আমার মতো লেখকের বই কেউ পড়তে চান না
    প্রচ্ছদ পছন্দ হলে দাম জিজ্ঞেস করে|

    বাগানে ফোঁটা অজস্র নাম হারা ফুলের মতোই,
    আমি লিখি ,—–
    শহরের এক কোণে অন্ধকার গলির অন্ধকার ঘরে
    অত্যাচারিত মেয়ের জীবন কাহিনী
    নাবালিকা বিবাহ বন্ধে কন্যাশ্রী|

    আমার মতো অনেকে আছেন স্কুল,কলেজে,চাকরি করেন না

    অথবা ছুটির দিনগুলো কাটতে চায়-না এমন নয়,
    অথচ সারাদিন টিউশনের ধকল ক্লান্ত শরীর রাত জেগে লেখেন ,—-
    গল্প ,কবিতা !

    আপনার পান্ডূলিপি প্রকাশকের হাত বদল হয়ে
    নকল টাকার মত এবার আপনার কাছে,
    আপনি এবার পোস্ট অফিসে জমান শেষ সম্বলে
    বই ছাপলেন,
    অথচ খরচের টাকাটা উঠলো না
    দুঃখ এখানে, —-
    আপনার বয়সে অনেক বড় অথচ
    আপনাকে দেখলে কবি-দা বলে তাচ্ছিল্য করে |

    আপনি ততক্ষণে ভোরের স্বপ্ন দেখছেন
    সুকান্ত,জীবনানন্দ আমৃত্যু লেখাই বের করতে পারলেন না,
    কখন জানি বেড়ার ফাঁক গলে উল্টানো কালির দোয়াতের মত গলগল করে সূর্যের আলো চোখে মুখে,

    আপনি ঘুম থেকে উঠে ভাবছেন
    ভোরের স্বপ্ন বাস্তব হয় !

  • মুক্ত গদ্য

    মেয়েরা- সেকাল একাল

    মেয়েরা- সেকাল একাল
    জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য (ত্রিবেদী)

     

    আমি যেদিন জন্মালুম দিনটা ছিলো কোজাগরী পূর্ণিমা, ভরসন্ধ্যে বেলা ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।
    আঁতুর ঘর থেকে সুতীব্র কান্নার আওয়াজ,  সাথে সাথেই ঠানদির চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা– ও দাইমা, কি হয়েছে?

    সাথে পিসি ঠাম্মার ও একই জিজ্ঞাসা, ও দাই দিদি , বলো না,,, ছেলে হলো?
    দাইমা সসংকোচে একটু গলা তুলে বললেন,-ঘরে নক্ষী এয়েছে গো —!!

    —- এবার ও..! গলায় নুন দিয়ে শেষ করো। আর কতো লক্ষী আসবে? অলুক্ষুণে অপয়া বৌ জুটেছে একখান ! বছর বছর মেয়েই বিয়োচ্ছে । কতোবার কইলুম বিশেরে, বাবা, আর এক খান বৌ আন। ওই শাঁখারি পাড়ার ভূবন চক্কোত্তির মেয়ে, আহা রূপে গুণে সাক্ষাৎ লক্ষী ঠাকরুন। ও মেয়ে দেখলিই বোঝা যায়, পুত্রবতী নিয্যস । কিন্তু, সে ছেলে আমার শুনলে তো..!
    কয় কি, একটার বেশী বে করবো না, তাতে ছেলে হয় বেশ, না হয় তাও বেশ…শোনো দিকি ছেলের কতা,
    আর এ বেটীরে দেখো ! এ তো বছর বছর… হায় আমার পোড়া কপাল…। এখন বংশ রক্ষে হবে কি করে গো..! মরে এক ফোঁটা জলও পাবোনি…!

    আমি মায়ের পঞ্চম কন্যা সন্তান, অবশ্য এখন আমরা সংখ্যায় চারজনই, কারণ আমার আগেরটিকে আঁতুড় ঘর থেকেই শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে, আমার অসুস্থ, দূর্বল মায়ের ক্ষণিক অসাবধানতায়।।

    আর আজ সত্তর /৭০ বছর পর ও… একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের দোরে কড়া নাড়ছি যখন, তখনও সেই একই ছবি দেখি—

    সেদিন পেপারে পড়লাম, এক মা তার সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করেছেন।  অদ্ভুত আশংকায়,ঘৃণায় বুক কেঁপে উঠলো… এরা কি মা…!!

    আরো শুনলাম, এক স্বামী, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ডক্টর এর কাছে গিয়ে বলছেন, আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, সোনোগ্রাফিতে জেনেছি গর্ভে কন্যা সন্তান, দয়া করে অ্যাবরশন…
    ডাক্তার তো এই মারে কি সেই মারে। কিন্তু কারণ শোনার পর, তিনিও নিশ্চুপ ক্ষণিক।
    তাদের বক্তব্য, মেয়ে হলে বড়ো সমস্যা, এই নির্মম পিশাচ সমাজ এর হাত থেকে তাকে রক্ষা করবো কেমন করে?
    ছোটোবেলায় হয় তাকে কাকা, মামা, তুতো দাদারা, অথবা পাড়ার বড়ো কেউ আদরের ছুতোয় খোবলাবে। আর একটু বড় হলে, শহরে হায়নার অভাব নেই!

    আমি কর্মসূত্রে থাকি বাইরে, মাসে দু মাসে বাড়ি আসি। গৃহে আমার বৃদ্ধা মা আর স্ত্রী। কে সামলাবে ? রক্ষা করবে বলুন ওই কোমল,কচি প্রাণ ? তার চেয়ে অঙ্কুরেই বিনাশ …!

    কিছুদিন আগে একটি মেয়েকে বলতে শুনেছি, মেয়ে সন্তান লালন করা যার তার কর্ম নয়। অনেক বুকের পাটা লাগে, প্রচুর সাহস না থাকলে….!  কিন্তু সত্যি সাহস থাকলেই কি রক্ষা হয়..?  আসলে দিন যতোই বদলাক সমাজ উন্নত থেকে উন্নততর হোক— কিন্তু মেয়েরা তো সেই একই আছে। নারী শরীর — নরম, লোভনীয়, সুস্বাদু–
    কথায় আছে, “অপনা মাসে হরিনী বৈরী” — এতো তাই..
    হরিণ যেমন নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্যই শিকারীর লালসার শিকার হয়, মেয়েরাও তাই…! সুস্বাদু নারী মাংসের লোভেই তো যতো অপকীর্তি।  তাই তো ছাড় পায় না সাত মাসের শিশু বা সত্তর এর বৃদ্ধাও। হোক না সে মাংস একটু কম স্বাদু, তবু নারী মাংস তো…!

    পায় না ছাড় H.S. Topper ও… হরিয়ানার শহরতলীর সেই রোগা,কালো,শান্ত,মেধাবী ছাত্রীটি,, সন্ধ্যেবেলা টিউশন পড়ে ফিরছিলো, মুখ চেপে মাঠে টেনে নিয়ে গিয়ে বারো জন মিলে —না না, এক বা দু ঘন্টা নয়, আটচল্লিশ ঘন্টা, পুরো দুটি দিন,
    নরখাদকগুলো আঁচড়ে কামড়ে, চিবিয়ে চুষে খেলো…. কি আশ্চর্য, তাতেও সে জ্যান্ত…
    কথায় আছে না, কৈ মাছের জান,, মেয়েরা নাকি তাই…! কি অসীম সহ্যশক্তি ওই ঊনিশ বছরের দুবলা পাতলা মেয়েটির । এতো কিছুতেও নিঃশেষ হয়নি তার প্রাণশক্তি।।

    আসলে আমরা মেয়েরা তো তাই ! অসীম সহ্যশক্তি নিয়েই আমরা আসি এই ধরায়, বিধাতা হয়তো এমন বিষম অত্যাচার সহ্য করার জন্যই এতো সহ্যশক্তি দিয়ে পাঠান। মোদ্দা কথা এই সত্তর বছর আগেও মেয়েরা যা ছিলো, আজ এই একবিংশ শতাব্দীর অতি আধুনিক, উন্নত, শিক্ষিত এক সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়েও– মেয়েরা সেই একই অবস্থায়–অবাঞ্ছিত, দূর্বল, শুধুমাত্র সুস্বাদু লোভনীয় মাংসের তাল… পুরুষের চোখে আজ ও…

  • মুক্ত গদ্য

    গৃহবধূর মনের কথা

    গৃহবধূর মনের কথা
    -সোনালী গুপ্ত

    ” সারাদিন ত বাড়িতে রয়েছ বুঝবে কি করে বাইরে বেরিয়ে পয়সা রোজগার করার কষ্ট কত? আমার পয়সায় ফুটানি করছ লজ্জা করেনা? এখন ত তোমাদের কত সুবিধা আর আমাদের মায়েদের কত কষ্ট করতে হয়েছে।” যে কোন গৃহবধূ কে এই কথাগুলি জীবনের কোন না কোন সময়ে শুনতে হয়। প্রতিবাদ করলেই অশান্তি। কারোর কারোর কপালে না হয় দুটো চড় থাপ্পড় জুটল। শিক্ষিত সমাজের মানুষ দের মনে হয়না গৃহবধূর সংজ্ঞা এখন বদলে গেছে। এখন আমরা শুধু বাড়িতে রান্নাঘরে বন্দী থাকিনা। আমাদের বাইরে বেড়োতে হয়। সংসার টা চালানোর জন্য আমাদের অনেক রূপ ধারণ করতে হয়। কখনো নার্স, কখন শিক্ষিকা কিংবা সংসারের বাজেট মন্ত্রী। এখন শিক্ষিতা পূত্রবধূ ঘরে আনা হয়। যে তার সন্তানের প্রথম শিক্ষিকা। অনেক কটুকথার মধ্য দিয়ে, অনেক না ভাললাগাকে মনের অনিচ্ছায় ভাল লাগিয়ে একটা অন্য পরিবারের অচেনা মানুষদের আপন করে নেয়। আগেকার গৃহবধূ দের এখনকার গৃহবধূদের মত অত বাইরে বেড়োতে হত না। এখন আমরা সন্তানের স্কুল, ব্যাংক, বাজার দোকান করা সব কাজ করি এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে বরের অফিস পার্টিতেও যাই। এবার আসি বরের পয়সাতে ফুটানীর কথায়। প্রতিটা দিন সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে, সুস্বাস্থ্যর অধিকারী হয়ে স্বামীরা যে অফিসে যান তার জন্য সারাবছরে অন্তত একটা ধন্যবাদ আমাদের পাওনা। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই গৃহবধূরা চেষ্টা করেন তাদের স্বামীরা যেন ঠিকমতো খেয়ে সঠিক সময়ে অফিস যেতে পারেন। কর্তা বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ না হয়ে যান সেদিকে ও আমাদের নজর সর্বদা। ” ঠিক আছে তুমি শান্তিতে কাজ কর আমি ছেলের স্কুল মিটিং এও যাব এবং কালকে শাশুড়ি মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছেও যাব।” আজকালকার দিনের শিক্ষিত গৃহবধূরা প্রায় সময় এই কথা বলেন কর্তাদের। সেই জীবন সঙ্গীর পয়সাতে কি তার স্ত্রীর কোন অধিকার নেই? তাহলে কেন আমাদের এখন শুনতে হয় আমরা বরের পয়সাতে ফুটানী করছি? আমাদের কোনদিন ছুটি নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, গ্র‍্যাচুইটি নেই, নেই কোন পেনশন। আছে শুধু একটি তুলনা মূলক গঞ্জনা “অমুক বাড়ির বৌদি কত কিছু করতে পারে আর তুমি কিছুই পারনা।”

  • মুক্ত গদ্য

    যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

    যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
    -রাণা চ্যাটার্জী

     

     

    এ এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার অথচ, তেমনভাবে দেখলে, অনেকে হয়তো ভাববে,” আমি মরছি নিজের জ্বালায়,মোবাইল থেকে কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে উড়ে গেছে আমার যাবতীয় কন্টাক্ট নাম্বার ,আর উনি কিনা রোমাঞ্চিত হয়ে অ্যাডভেঞ্চার গল্প শোনাচ্ছেন”!

    মাকড়শাকে ভীষণ সিম্বলিক মনে হয় আমার। কি সুন্দর নিশ্চিন্তে, একটা অদৃশ্য জাল বুনে, অবস্থান করে । কাছে গেলে বা আলো ফেললে,বোঝা যায় কি অসাধারণ দক্ষতা নিপুণতা এই জাল তৈরিতে।আমরাও এখন পরিচিত হয়ে গেছি এই বৃহৎ ওয়েবজালে, সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানুষ নয় এক একটা আইডি ,প্রোফাইল , ডিপিতে,কোড পরিচয়ে।

    মেসেঞ্জারে কথা বলতে বলতে এই অদৃশ্য টানের আপন আত্মার আত্মীয় বন্ধুদের প্রায়শই বলি,”আচ্ছা যদি হঠাৎ করে মারা যাই, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কিভাবে সবাই জানবে !স্ট্যাটাস আপডেট তো পাবে না “! সত্যিই এই ভাবনা আমায় ভাবায় !

    এত্ত অপরিচিত মানুষ জন ইন্টারনেটের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ কি সুন্দর মিশে গেছে। সামনে এসে পরিচিত হবার সুযোগ নাই বা হলো তবু যান্ত্রিক জীবনে অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে মিশে,এক পারিবারিক বন্ধন। হঠাৎ মোবাইল বিগড়ে, মেমোরি ,হোয়াটসআপ কন্টাক্ট, মুছে গেলে নিজেকে বড় অসহায় লাগে ! মনের মধ্যে একটা ছবি ভাসে যেন এক নির্জন দ্বীপে একলা হয়ে গেছি আর জলে নুড়ি পাথর ছুঁড়ছি।
    “কহ না প্যায়ার হ্যায়” সিনেমার ঋত্বিক,আমিশা হঠাৎ ঘুম ভেঙে,এমন নির্জন দ্বীপে এসে পড়ে ছিলো!ঋত্বিকের না হয় আমিশা ছিল। কন্টাক নম্বর হারিয়ে যে আমি ,তুমি হয়ে যাই বড় একা!

    এই ভাবেই হঠাৎ করে মোবাইল বিট্রে করলে বড় জ্বালা ,মাকড়শার জাল ছিঁড়ে গেলে যেমন মাকড়শা ঘাবড়ে পরিত্রাণের কথা ভাবে,আমরাও আবার বোনা জালে নিজেকে প্রবেশ করিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হই।

    না জুটুক দুমুঠো ভাত,রুটি
    কমতি পড়ুক চাল-আটা,
    হে সৃষ্টিকর্তা ,বিধাতা দেখো
    যেন পাই নিরবিচ্ছিন্ন”নেট ডাটা”

You cannot copy content of this page