রম্য রচনা
-
রম্য- মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়
মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়
–সুনির্মল বসুআমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক আছেন, সব সময় তিনি ভুল ইংরেজিতে কথা বলেন। অথচ, মাতৃভাষায় কথা বলায় তাঁর প্রবল বিরক্তি। প্রায়ই বলেন, বাংলা ভাষাটা আমার ঠিক আসে না। পথে দেখা হলে, জিজ্ঞাসা করেন, তারপর, সব ভালো তো। উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে, এর পরেই বলেন, ঘড। আসলে, উনি যে গুড কে ঘড বলেন, এটা বুঝে নিতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।
পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ভদ্রলোক ভালো মন্দ যাই ঘটুক, সব সময় ইংরেজিতে ঘড বলে থাকেন। ইংরেজরা এ দেশ থেকে বহুদিন আগে চলে গিয়েছেন, ইংরেজিয়ানা যায়নি।
একটি খ্যাতনামা জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে আমার বাড়ি। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের স্ত্রীরা অনেকেই বলেন, আমাদের উনি ম্যানেজার হইছেন।
ম্যানেজার, সোল পুটিং ডিপার্টমেন্ট।পাড়ার বখাটে ছেলেরা বলে, ম্যানেজার, কথাটার ব্যাসবাক্য সহ সমাস কি হবে বলো তো?
নিজেরাই উত্তর দেয়, এরপর। বলে, মানে নেই যার।পূজোর কিছুদিন আগে ছাত্র পড়াতে অফিসার্স কলোনিতে গিয়েছি, কলিং বেল বাজলো।মিসেস চৌধুরী দরোজা খুলে দিলেন। আমি এ বাড়ীতে পারচেজিং ম্যানেজারের ছেলে বিক্রমকে পড়াই। শাড়ী বিক্রেতা কাঁধে প্রচুর শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস চৌধুরী গোটা পনেরো শাড়ি পছন্দমতো বেছে নিলেন। শাড়ি বিক্রেতা ভদ্রলোক তখনও বসে রয়েছেন।
মিসেস চৌধুরী বললেন, কি হলো, শাড়ি নিলাম তো, আপনি এখনো বসে রয়েছেন, ব্যাপারটা কি?
শাড়ি বিক্রেতা বললেন, মাইজি, আমি এই শাড়িগুলোর দাম চাইছি না, গতবছরের শাড়িগুলোর দাম যদি দেন!
মিসেস চৌধুরী খুব রেগে গেলেন। যখন তখন দাম চাইবে না, আমি কি তোমার টাকা দেবো না বলেছি?
এই সময়ের জন্য তৈল একটি অতি মূল্যবান বস্তু। আমার ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া বন্ধু জগন্ময় বাটা কোম্পানির এক ম্যানেজারের গাড়ি ধুয়ে এবং বাজার করে দিয়ে, বর্তমানে ম্যানেজার হয়েছে।
এখানে কর্মীদের সপ্তাহে বেতন। প্রোডাকশন বেশি হলে, খুশি হবার কথা।
কিন্তু আমার বন্ধুটি এই ঘটনায় রেগে যায়। কারণ, কর্মীদের একেক জনের সাপ্তাহিক বেতন কি হবে, সে অংকটা জগন্ময়ের জানা নেই।
আজকাল সুখ একটা দেখাবার বস্তু হয়ে গেছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে এই জিনিসটা খুব চোখে পড়ে। গিন্নীকে পটের বিবি সাজিয়ে মোটরসাইকেলে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে ভেসে-যাওয়াতে কী প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়, আমরা দুজন কত সুখী!
বর্তমানের দুনিয়াদারিতে দেখনদারিটাই আসল। আমার ফ্ল্যাট দ্যাখো, আমার গাড়ি দ্যাখো, আমার অফিস দ্যাখো, আমার স্ট্যাটাস দ্যাখো। সবই ভালো, তবে বৃদ্ধাশ্রম গুলি ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে এত গজিয়ে উঠছে কেন?
সুখটা ঠিক কোথায়, মনের শূন্যতা ওয়ালা মানুষগুলো সেটা ধরতেই পারছে না।
অনেক দিন আগের কথা। কলেজে পড়ি। পাড়ার ভবতোষ কাকু একটি পোস্ট কার্ড এনে বললেন,
আমি বলি, তুই লেখ্। আমি কাকুর ডিকটেশন লিখে চললাম। আর জায়গা নেই।কাকু বললেন, পুনশ্চ,
এখানে ইলিশ মাছ সস্তা হইয়াছে।পোস্টকার্ডের দাম উসুল করাই আঙ্কেলের লক্ষ্য।
একদিন সন্ধ্যায় কাকুর বাড়িতে প্রবল ঝগড়া। কাকু আর কাকিমার মধ্যে খন্ড যুদ্ধ চলছে। পরদিন কাকুর হাতে প্লাস্টার। বললাম, কি করে হলো?
কাকু বললেন, কুয়োতলায় সিলিপ কাইটা গেছিলাম।আমার বন্ধু হেবো ভালো ইনফর্মার। ও এসে বলল, কাকিমার সঙ্গে কাকুর মহা সংগ্রাম কালে কাকিমার হাতপাখার প্রবল আঘাতে এই দূর্ঘটনা।
মনের শূন্যতা, মনের দেউলিয়াপনা আজকাল যেমন যত্রতত্র দেখা যায়, এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি।
আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক মুখ পুস্তকে ছবি দেন। একদিন প্রশ্ন করায়, তিনি বললেন, আমার বাড়িতে আবার কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না, গিন্নির ইচ্ছায় সবকিছু হয়।
ও খুব লাইক কমেন্ট পছন্দ করে। আশ্চর্য হই, বাহাত্তর বছর বয়সে ভীমরতি!দু কলম লেখার জন্য আজকাল মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় ডাক পড়ে। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক জায়গায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য পাঠ ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এত চিল চিৎকার।
মনে হয়, ভুল করে কোনো চিটে গুড়ের আড়তে বাইচান্স ঢুকে পড়েছি। চারদিকে নিজস্বী তোলা চলছে। কোলে মার্কেটে কিংবা মানিকতলার বাজারে এত চিল চিৎকার নেই।
সাহিত্য সাধনা কাহাকে বলে!
আমাদের এক দাদা স্থানীয় কবি আছেন, যিনি দীর্ঘ কবিতা পড়ে দর্শক মন্ডলীকে অনুষ্ঠান থেকে ফুটিয়ে দেন, আজকাল তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, আমি পিছনে গিয়ে লুকোই।
ডজন দুয়েক ছবি তোলার পর, তাঁর দাবি, আমার একখান ভালো ফটো তুলে দাও, ভাইটি!
জিজ্ঞাসা করি, এত ছবি তুলে কি করবেন?দাদার সাফ জবাব, আমার ইস্তিরি বলে দেছেন, হ্যাঁগো, এই বয়সে তোমাকে তো নদের নিমাইয়ের মতো দেখতে, তুমি ছবি তুলে এনো, আমি মৌটুসীর মাকে দেখাবো।
এটা হল দেখনদারির যুগ। যে ছেলে বাবা মাকে চেনে না, ভাই বোনের সঙ্গে কোনো কালে সম্পর্ক রাখে নি, সে শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে রজনীগন্ধা ফুলের গোছা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ভাবা যায়। কী ডিউটিফুল জামাই!
বিয়ের পর মায়ের আঁচল ধরা ছেলে সেই যে লব কুশ করা বউকে নিয়ে লাপাতা হয়ে গেল, তারপর তাঁর আর দেখা নেই।
মুখ পুস্তকে তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে সে
লিখলো, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
সম্রাট শাহজাহান আজ বেঁচে থাকলে ,লজ্জিত হতেন। মমতাজের প্রতি এতদূর ভালোবাসা তিনি কি দেখাতে পেরেছিলেন?একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটি বি,এ ক্লাসের ব্যাচ পড়াতাম। একটি মেয়ে পড়তে এলো। সবে মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে শুরু করেছি, মিনিট পনেরো হয়েছে, মেয়েটি বলল, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, জামাইবাবুর সঙ্গে একটু মার্কেটে যেতে হবে, স্যার। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটল। মাসের শেষে ওর বাবা দেখা করতে এলেন।
মাষ্টারমশাই, ওকে কেমন বুঝলেন?
বললাম, ওকে তো পড়াবার অবকাশ পাই না। ও জামাইবাবুর সঙ্গে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়।
ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, আমার তো ওই এক মেয়ে। আমার আবার জামাই কোথায়?মনের দেউলিয়া পনার কত ছবি। কত গভীর শূন্যতা মনের মধ্যে থাকলে, চারদিকে মানুষ নয়, ফানুস ঘোরে।
ট্রামে বাসে ট্রেনে, সর্বত্র দেখবেন, এখন শ্রোতা কম। বক্তা বেশি। প্রত্যেকেই এখন এডমন্ড বার্কের ভায়রা ভাই। এখানের মানুষ ডায়লগবাজিটা ভালো রপ্ত করেছেন।
অফিসে স্যুটেড-বুটেড মানুষজন দেখে, তার পদমর্যাদা আন্দাজ করা যায় না। সবাই নাকি অফিসারের চাকরি করেন। তাহলে, sub-ordinate কারা।
আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওদেশ থেকে এদেশে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেন, গাছের ইলিশ মাছ আর পুকুরের আম এত খাইছি, এখনো মুখে সেই টেস লাইগ্যা আছে।
দূর্গা পূজার বিসর্জনের সময় কেপে কেঁপে নাচ আর ক্ষেপে ক্ষেপে গানের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতিক গরম মশালা পরিবেশন করা হয়। মুখোমুখি চারটে মাইকে চার রকম হিন্দি গান। কোনটার কথাই বোঝা যাবে না। এই না হলে পুজোর আনন্দ!
সরস্বতী পূজার সময় প্যান্ডেলের ঠাকুরের চেয়ে রাস্তার সরস্বতী দেখার জন্য তরুণ তুর্কিদের হামলে পড়া। সে ভারী দেখার মতো দৃশ্য!
আমাদের পাড়ার টোকনদা পড়াশুনোয় চতুর্থ শ্রেণীর সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন, ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারেননি। তিনি সব সময় ইংরেজী কাগজ বগলে নিয়ে ঘোরেন। রোববার সকালে দেখি, উনি শচীনের চায়ের দোকানে বসে আছেন। চোখ ইংরেজী কাগজের দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, কাগজে কি লিখেছে টোকনদা?
তিনি উল্টো করে কাগজ ধরেছেন।
maruti suzuki র অ্যাড ছিল। বললেন, গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে। চাকা উল্টে গেছে।আসলে, নিজের শূন্যতা ঢাকবার জন্য মানুষকে কত মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
একে বলে, দেউলিয়া মনের উদাস পণা।শূন্যতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আরকি!
আমাদের পাড়ার ভ্যাবলা যেদিন বিয়ে করতে গেল, সেদিন ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েতে তোর কোনো ডিমান্ড আছে?
ভ্যাবলা বলেছিল, সারকেল ছাড়া বিয়ে করবু নি!সমাজের পাঁজরে কবে যে এমন ক্যান্সার জন্মালো, আমরা প্রথমটা টের পাই নি। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের এই হৃদয়ের দীনতার ছবি প্রকটিত হচ্ছে।
এর শেষ কোথায়, আগামী দিন, আগামী সময় বলবে!
-
রম্য- যতো দোষ, নন্দঘোষ
যতো দোষ, নন্দঘোষ
– সুমিতা দাশগুপ্তসত্যি কথা বলতে কী, এই বিশ্বসংসারটি এক আজব জায়গা, এখানে প্রতিটি মানুষের একখানা করে বেচারি মানুষ লাগে, যার ঘাড়ে অনায়াসেই নিজের ছোটখাটো সমস্ত অপকর্ম, ত্রুটি বিচ্যুতির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও বিবেক দংশনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়, আরো অবাক করা কান্ডটি কি জানেন? রাজা গজা থেকে সংসারী মানুষ প্রত্যেকের কপালেই কিভাবে যেন একখানা করে নিরীহ, বেচারি ভালোমানুষ জুটেও যায়, যদিও সেই বেচারি মানুষটি কিন্তু বোকা নয় মোটেও, বরং উল্টোটাই, বুদ্ধিমান তো বটেই উপরন্তু সহনশীল এবং শান্তিপ্রিয়, সব বুঝেও মুখটি বুজে সবকিছু মেনে নেয়, নইলে জগৎসংসারই বা চলে কী করে!
সেই পুরাকালে ছিল, বেচারি নন্দবাবু,মানে নন্দঘোষ, বালকৃষ্ণের যাবতীয় দুষ্টুমির দায় মাথায় নিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর আমাদের সংসারে রয়েছি আমি। সত্যি কথা বলতে কী,আজকাল আমার নিজের মনেই একখানা দৃঢ় বিশ্বাস পাকাপাকি ভাবে জন্ম নিতে শুরু করেছে, এই জগৎসংসারে যেথায় যতো অনাসৃষ্টি কান্ড ঘটে চলেছে —ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে, ইউনিভার্সিটির অর্থসঙ্কট, আন্দোলনরত চাকুরিপ্রার্থীর হাতে পুলিশি কামড় থেকে পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপকদের লিষ্টিতে বঙ্গসন্তানদের অপ্রতুলতা, এইসব কিছুর জন্য এই আমাকেই কোনও না কোনওভাবে দায়ী করা গেলেও যেতে পারে।
এই যেমন একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন, আজ সকাল থেকে বৌদি গজগজ করেই চলেছে, ছেলের স্কুলবাসটা মিস হয়েছে বলে। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছে এর জন্য আমিই নাকি দায়ী। জুতোজোড়া পরাতে যদি দেরী না করতাম, অথবা বাসদাদাদের সঙ্গে দুমিনিট খেজুরে আলাপ করে, তাদের যদি একটু আটকে রাখতাম, তাহলে তো আর… কৈফিয়ৎ হিসেবে বলা যেতেই পারতো বাচ্চাটাকে যদি, আর একটু আগে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া যেত…. সে কথা বলে কার সাধ্যি।
ওদিকে বাবা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, এই তো বাচ্চাটা কিছুদিন আগেই জ্বর থেকে উঠলো, কোন আক্কেলে এই সাতসকালে তাকে বাইকে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যদি,আবার জ্বর আসে, যদি ফাইন্যাল পরীক্ষাটা দিতে না পারে … যদির বন্যায় ভাসতে ভাসতে বলা গেল না, এখন তাড়াতাড়ি না গেলে যে আজকের ক্লাশ টেষ্টটা মিস্ হয়ে যায়!
অফিস যাবার আগে খাবার টেবিলে বসে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো মায়ের গজগজানি ভেসে আসে ,ফুলের প্যাকেটে বেলপাতা মিসিং। ফুলওয়ালি যা দেয়,অন্ধের মতো তাইই হাতে নিয়ে চলে আসার আগে, আমারই কী উচিৎ ছিল না…ইত্যাদি ,ইত্যাদি ।
ওদিকে পাড়ার ইস্ত্রিওয়ালা বৌয়ের কামিজ ইস্ত্রি করে দিয়ে যায়নি, সকাল থেকে চাপা গজগজানি হাওয়ায় ভাসে, কারুর অর্থাৎ আমার যদি একটুও সহানুভূতি থাকত, তাহলে অনায়াসেই,দু পা এগিয়ে গিয়ে….,যেন আলমারি ঠাসা বাকি পোশাকগুলির,সবকটাই, অস্পৃশ্য,অশুচি।
বাবার নতুন চশমার ডেলিভারি দেবার ডেট তো কবেই পেরিয়ে গেছে, দাদার না হয় অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়, কেন আমার কী একটুও আক্কেল নেই? একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে চশমাটা নিয়ে আসা যায় না? লোকে মনে করাবে তবে আনব!
হায়রে ,যদি বলা যেত, সে কাজটা তো দাদাও করতে পারতো, তাছাড়া বৌদির না হয়, ছেলেপুলেদের স্কুল থেকে তুলে এনে বাড়ি ফেরার তাড়া, আমার স্ত্রী, তাঁদের আদরের নতুন বৌমাটিও তো আছেন, একদিন অফিসফেরত কী চশমার দোকানে ঢুঁ মারা যায় না! কিন্তু বোবার শত্রু নেই, এই নীতি মেনে চুপ থাকাই শ্রেয়।
ঐ শুনুন আমার নবতিপর ঠাকুমা চেঁচাচ্ছে…
জপ করতে করতে তাঁর নাকি চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, জেগে উঠে দেখে থালায় নাড়ু কম! কার কাজ সেকথা বুঝতে কি কারুর বাকি আছে! ছোট্টবেলা থেকেই সেই একইরকম রয়ে গেলাম, ইত্যাদি,ইত্যাদি, ভুলে যায় সেই বয়সটি আমি কবেই পেরিয়ে এসেছি, তবে হ্যাঁ ,আজ কিঞ্চিৎ দায় আমারও রয়েছে, আমিই ভাইঝিটাকে নাড়ু চুরি করতে হেল্প করেছি। বেশ করেছি , ঠিক কিনা আপনারাই বলুন! -
রম্য- প্রেম ডট কম
প্রেম ডট কম
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়চন্দ্র সেদিন রাতে মত্ত অবস্থায় তার বউ বিন্দুকে পরকীয়া প্রেমের অপরাধের শান্তি হিসেবে গলা কেটে খুন করে নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে গেল।
একটি অপ্রেম দাম্পত্য জীবনের নিদারুণ পরিসমাপ্তি।
এটা পাঁচশো বছরের পুরনো কথা।পাঁচশো বছর পরে পুনরায় চন্দ্রের নরলোকে আগমন এবং দৈবযোগে সঙ্গে বিন্দু । বিধাতার লিখনে তাদের আবারও মিলন কিন্তু পরিনতি ?
এবার ঘটনা এক্কেবারে বিপরীত। চন্দ্রর পরকীয়া প্রেমের অপরাধের শান্তি হিসেবে তাকে গলা কেটে খুন করে নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে গেল বিন্দু।
ব্যস হ’য়ে গেল এবারের মতো আপদের শান্তি ।আবারও পাঁচশো বছর পরে পুনরায় চন্দ্রর মর্তলোকে আগমন এবং সঙ্গে যথারীতি চিরসঙ্গী বিন্দু। বিধাতা বিগবসের অদ্ভুত খেল ।
এবারেও মিলন বিবাহ ঘরসংসার এবং পরকীয়া।
তবে এবার আর কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট না, কারণ দুজনেই দু’ জায়গায় মন দেওয়া-নেওয়ার পালায় মেতেছে। দু’জনেই খোস মেজাজে আছে। অপূর্ব সমঝোতা। যে যার পছন্দের ডালে বসে মনের সুখে দোল খাচ্ছে। তুমিও সুখী আমিও সুখী। অসাধারণ দাম্পত্য সুখ যাপন।জীবনের খেলাঘর। ইয়েস, খেলাঘর। যে যেভাবে পারো খেলে যাও। মানিয়ে নাও নয়তো মেনে নাও। আরে বাবা সুখ হলো দর্শনধারী। দেখানোতেই সুখ। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়দের কাছে
নৈনিতালের নাম করে নৈহাটির গঙ্গা দর্শন লজে দুর্বিষহ সাতদিন কাটিয়ে এলেই মিলন মধুর দাম্পত্যের অকাট্য দলিল প্রমাণ। যেমন দেখানো হবে, লোকে তেমনই দেখবে। পাক্কা খেলোয়াড়, ডুব সাঁতার মাষ্টার।ভালই চলছিলো চন্দ্- বিন্দুর মন কী খেল, কিন্তু ঐ-যে কথায় আছে,,
সুখের পরমায়ু বডই ক্ষণিকের। এই আছে এই নেই,,,
মুঠোয় ধরে রাখা বরফের মতো। ফাঁকা হাতের তালুতে জল লেগে আছে ঠান্ডা পরশ আছে কিন্তু বরফ নেই, সে আঙুলের ফাঁক গলে ফক্কা। শুধু স্মৃতি রেখে গেছে, সে নেই।
চন্দ্রর মন পাগল করা মানবী, পরিনতি বিহীন প্রেমের জালে হাঁসফাঁশ করতে করতে জাল ছিঁড়ে নতুন নৌকোর সওয়ারী হল। বাই জান,
সেই বিরহে বিরহী হয়ে চন্দ্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে বিবাগী হল।
বিন্দু এখন একা ঘরে আনন্দে ডগমগ । ভাবে, যাক ভালোই হল, বাঁচা গেল । হাত পা ঝাড়া। ওপেন সিক্রেট ছিল ঠিকই, দুজনের তরফেই ছিল, তবুও চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে, তাই একেবারে খুল্লামখুল্লা, কিন্তু এইবার?
এই তো পরকীয়া প্রেমের অবাধ আনাগোনার ভরপুর সুযোগ।
কিন্তু ঐ-যে কথায় আছে, সবার কপালে সুখ সয় না। বিন্দুতে বেশিদিন মন পোষালো না বিন্দুর মনের মানবের।
সে-ও নিজের সুখময় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন কোকিলার কুহুতানে মন মজিয়ে রাধাচূড়ার ফুলেল শাখে দোল খেতে চলে গেল।
বিন্দু দুঃখে আফসোসে দিশাহারা হয়ে কব্জির শিরা কেটে রক্তের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটালো।পাঁচশো বছর পরে তারা দুজনেই আবারও এলো ধরাধামে, মিলিতও হল কিন্তু কেউ-ই আর পরকীয়ার ফাঁদে হৃদয় গলালো না। কেন !
এমন হবার কারণ কী?
এবারে ওরা যৌথ ভাবে দেবতা বিগবসের কাছ থেকে বর চেয়ে এসেছে ,
‘যা ইচ্ছে তাই দাও শুধু প্রেমের ডোজ কম করে দাও।’ ওটা বড্ড জ্বালিয়ে মারে, লণ্ডভণ্ড করে দেয় জীবন। প্রেম কম, ঝামেলা কম।
এ জীবনে শুধুই প্রেম ডট কম।
এদিকে আপনাদের চুপিচুপি একটা কথা ব’লে দিই, এদের সঙ্গে কিন্তু ওদিকে সেই
মানব আর মানবীও জন্ম নিয়েছে। আরও সমস্যার কথা, ওদের সঙ্গে কিন্তু দেবতা বিগবসের কোনো চুক্তি কিংবা বর ইত্যাদি কিছুই হয়নি, সুতরাং ওদিকের রাস্তা খোলা।
কে জানে কী আছে বিগবসের মনে। চন্দ্র-বিন্দুকে, কে যে কখন আপন করে নেয় কে জানে?
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, হা হা হা হা -
রম্য- দেউলিয়া মনের উদাসপনা
দেউলিয়া মনের উদাসপনা
-সুনির্মল বসুআমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক আছেন, সব সময় তিনি ভুল ইংরেজিতে কথা বলেন। অথচ, মাতৃভাষায় কথা বলায় তাঁর প্রবল বিরক্তি। প্রায়ই বলেন, বাংলা ভাষাটা আমার ঠিক আসে না। পথে দেখা হলে, জিজ্ঞাসা করেন, তারপর, সব ভালো তো। উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে, এর পরেই বলেন, ঘড। আসলে, উনি যে গুড কে ঘড বলেন, এটা বুঝে নিতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল। পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ভদ্রলোক ভালো মন্দ যাই ঘটুক, সব সময় ইংরেজিতে ঘড বলে থাকেন। ইংরেজরা এ দেশ থেকে বহুদিন আগে চলে গিয়েছেন, ইংরেজিয়ানা যায়নি।
একটি খ্যাতনামা জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে আমার বাড়ি। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের স্ত্রীরা অনেকেই বলেন, আমাদের উনি ম্যানেজার হয়েছেন।
ম্যানেজার, সোল পুটিং ডিপার্টমেন্ট।পাড়ার বখাটে ছেলেরা বলে, ম্যানেজার, কথাটার ব্যাসবাক্য সহ সমাস কি হবে বলতো, নিজেরাই উত্তর দেয়, এরপর। বলে, মানে নেই যার।
পূজোর কিছুদিন আগে ছাত্র পড়াতে অফিসার্স কলোনিতে গিয়েছি, কলিং বেল বাজলো। মিসেস চৌধুরী দরোজা খুলে দিলেন। আমি এ বাড়ীতে পারচেজিং ম্যানেজারের ছেলে বিক্রমকে পড়াই। শাড়ী বিক্রেতা কাঁধে প্রচুর শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস চৌধুরী গোটা পনেরো শাড়ি পছন্দমতো বেছে নিলেন। শাড়ি বিক্রেতা ভদ্রলোক তখনও বসে রয়েছেন।
মিসেস চৌধুরী বললেন, কি হলো, শাড়ি নিলাম তো, আপনি এখনো বসে রয়েছেন, ব্যাপারটা কি,
শাড়ি বিক্রেতা বললেন, মাইজি, আমি এই শাড়িগুলোর দাম চাইছি না, গতবছরের শাড়িগুলোর দাম যদি দেন। মিসেস চৌধুরী খুব রেগে গেলেন। যখন তখন দাম চাইবে না, আমি কি তোমার টাকা দেবো না বলেছি।আজকাল সুখ একটা দেখাবার বস্তু হয়ে গেছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে এই জিনিসটা খুব চোখে পড়ে। গিন্নীকে পটের বিবি সাজিয়ে মোটরসাইকেলে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে ভেসে-যাওয়াতে কী প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়, আমরা দুজন কত সুখী।
বর্তমানের দুনিয়াদারিতে দেখনদারিটাই আসল। আমার ফ্ল্যাট দ্যাখো, আমার গাড়ি দ্যাখো, আমার অফিস দ্যাখো, আমার স্ট্যাটাস দ্যাখো। সবই ভালো, তবে বৃদ্ধাশ্রমগুলি ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে এত গজিয়ে উঠছে কেন। সুখটা ঠিক কোথায়, মনের শূন্যতাওয়ালা মানুষগুলো সেটা ধরতেই পারছে না।
অনেক দিন আগের কথা। কলেজে পড়ি। পাড়ার ভবতোষ কাকু একটি পোস্ট কার্ড এনে বললেন,
আমি বলি, তুই লেখ্। আমি কাকুর ডিকটেশন লিখে চললাম। আর জায়গা নেই। কাকু বললেন, পুনশ্চ,
এখানে ইলিশ মাছ সস্তা হইয়াছে।পোস্টকার্ডের দাম উসুল করাই আঙ্কেলের লক্ষ্য।
একদিন সন্ধ্যায় কাকুর বাড়িতে প্রবল ঝগড়া। কাকু আর কাকিমার মধ্যে খন্ড যুদ্ধ চলছে। পরদিন কাকুর হাতে প্লাস্টার। বললাম, কি করে হলো,
কাকু বললেন, কুয়োতলায় সিলিপ কাইটা গেছিলাম। আমার বন্ধু হেবো ভালো ইনফর্মার। ও এসে বলল, কাকিমার সঙ্গে কাকুর মহা সংগ্রাম কালে কাকিমার হাতপাখার প্রবল আঘাতে এই দূর্ঘটনা।মনের শূন্যতা, মনের দেউলিয়াপনা আজকাল যেমন যত্রতত্র দেখা যায়, এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি।
আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক মুখ পুস্তকে ছবি দেন। একদিন প্রশ্ন করায়, তিনি বললেন, আমার বাড়িতে আবার কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না, গিন্নির ইচ্ছায় সবকিছু হয়। ও খুব লাইক কমেন্ট পছন্দ করে। আশ্চর্য হই, বাহাত্তর বছর বয়সে ভীমরতি।
দু কলম লেখার জন্য আজকাল মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় ডাক পড়ে। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক জায়গায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য পাঠ ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এত চিল চিৎকার। মনে হয়, ভুল করে কোনো চিটে গুড়ের আড়তে বাইচান্স ঢুকে পড়েছি। চারদিকে নিজস্বী তোলা চলছে।
আমাদের এক দাদা স্থানীয় কবি আছেন, যিনি দীর্ঘ কবিতা পড়ে দর্শক মন্ডলীকে অনুষ্ঠান থেকে ফুটিয়ে দেন, আজকাল তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, আমি পিছনে গিয়ে লুকোই। ডজন দুয়েক ছবি তোলার পর, তাঁর দাবি, আমার একখান ভালো ফটো তুলে দাও, ভাইটি। জিজ্ঞাসা করি, এত ছবি তুলে কি করবেন। দাদার সাফ জবাব, আমার ইস্তিরি বলে দেছেন, হ্যাঁগো, এই বয়সে তোমাকে তো নদের নিমাইয়ের মতো দেখতে, তুমি ছবি তুলে এনো, আমি মৌটুসীর মাকে দেখাবো।
এটা হল দেখনদারির যুগ। যে ছেলে বাবা মাকে চেনে না, ভাই বোনের সঙ্গে কোনো কালে সম্পর্ক রাখে নি, সে শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে রজনীগন্ধা ফুলের গোছা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ভাবা যায়। কী ডিউটিফুল জামাই।
বিয়ের পর মায়ের আঁচল ধরা ছেলে সেই যে লব কুশ করা বউকে নিয়ে লাপাতা হয়ে গেল, তারপর তাঁর আর দেখা নেই।
মুখ পুস্তকে তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে সে লিখলো, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
সম্রাট শাহজাহান আজ বেঁচে থাকলে লজ্জিত হতেন। মমতাজের প্রতি এতদূর ভালোবাসা তিনি কি দেখাতে পেরেছিলেন।একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটি বি,এ ক্লাসের ব্যাচ পড়াতাম। একটি মেয়ে পড়তে এলো। সবে মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে শুরু করেছি, মিনিট পনেরো হয়েছে, মেয়েটি বললো, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, জামাইবাবুর সঙ্গে একটু মার্কেটে যেতে হবে, স্যার। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটল। মাসের শেষে ওর বাবা দেখা করতে এলেন।
মাষ্টারমশাই, ওকে কেমন বুঝলেন,
বললাম, ওকে তো পড়াবার অবকাশ পাই না। ও জামাইবাবুর সঙ্গে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়।
ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, আমার তো ওই এক মেয়ে। আমার আবার জামাই কোথায়।মনের দেউলিয়া পনার কত ছবি। কত গভীর শূন্যতা মনের মধ্যে থাকলে, চারদিকে মানুষ নয়, ফানুস ঘোরে।
ট্রামে বাসে ট্রেনে, সর্বত্র দেখবেন, এখন শ্রোতা কম। বক্তা বেশি। প্রত্যেকেই এখন এডমন্ড বার্কের ভায়রা ভাই। এখানের মানুষ ডায়লগবাজিটা ভালো রপ্ত করেছেন।
অফিসে স্যুটেড-বুটেড মানুষজন দেখে, তার পদমর্যাদা আন্দাজ করা যায় না। সবাই নাকি অফিসারের চাকরি করেন। তাহলে, sub-ordinate কারা।আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওদেশ থেকে এদেশে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেন, গাছের ইলিশ মাছ আর পুকুরের আম এত খাইছি, এখনো মুখে সেই টেস লাইগ্যা আছে।
আসলে, নিজের শূন্যতা ঢাকবার জন্য মানুষকে কত মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
একে বলে, দেউলিয়া মনের উদাসপনা।
শূন্যতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর কি।আমাদের পাড়ার ভ্যাবলা যেদিন বিয়ে করতে গেল, সেদিন ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েতে তোর কোনো ডিমান্ড আছে। ভ্যাবলা বলেছিল, সারকেল ছাড়া বিয়ে করবু নি।
সমাজের পাঁজরে কবে যে এমন ক্যান্সার জন্মালো, আমরা প্রথমটা টের পাই নি। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের এই হৃদয়ের দীনতার ছবি প্রকটিত হচ্ছে।
এর শেষ কোথায়, আগামী দিন, আগামী সময় বলবে। -
রম্য- হালুয়া
হালুয়া
–রীণা চ্যাটার্জী
বললেই নিন্দুকেরা বলবে- ‘বলছে..’ তাও একসময় বলতেই হয় জীবনটা যেন হালুয়া- হয়ে গেছে, মানে শুধু ওই হালুয়ার মতো চটচটে পাকটা থেকে গেছে আর কি! পাক দেওয়ার আগে অবশ্য বোঝা দায়- তখন গাওয়া ঘি আর মেওয়ার সুবাস, ঝরঝরে সাদা সুজি, তেল আর তেলানির অপূর্ব চকচকে মিশ্রণ। তারপর তাতে যখন আলোচনার চিনি মেশাবে, ব্যস ওতেই যত বিপদ। যত পাকাবে তত চটচট করবে। কত পাক, কেমন পাক তা ঠিক মতো বোঝার আগেই, প্যাঁচপ্যাঁচে ঘামের মতো গায়ে লাগাবেই, আর হাত লাগলেই চটচট করবে। ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও পারবে না। ঝাড়ু মেরে তাড়াবে যে তার উপায় নেই- চটচটে যে, আঠার মতো সেঁটে যাবে। যদি একটিবার ভরসা করে ঝাড়ান দিয়েছো তো আলোচনা-সমালোচনা থিকথিক করবে। হয়তো ঝাড়ুকেই তখন ‘লে হালুয়া’ বলে ঘরের বাইরে ফেলে দিতে হবে। শখের ঝাড়ুখানা না হয় ফেলা গেল- তাতেও রেহাই নেই। “বোবার শত্রু নেই” প্রবাদ ঘুচিয়ে দিয়ে মিথ্যের ডোবাজলে ঝাড়ু পচবে, দুর্গন্ধ ছড়াবে। নিজের নাকে নিজেই চাপা দিয়ে সেই দুর্গন্ধ সাফ করতে আবার নিজেকেই নামতে হবে। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ, না মরা অবধি শাস্তি নেই। পচা জলে নাকানিচুবানি খেতে হবে। নাকানিচুবানি খেতে খেতে ঝাড়ু খুঁজে তুলে দেখবে তাতে বেশ খানিকটা ঘ্যানঘ্যানে ছত্রাকের ভিড়- আনন্দে বাসা বেঁধেছে। মুখরোচক লাগে। পরের কথা সবসময় মুখরোচক, বিনে পয়সার হালুয়া যে- যত পচবে তত মিষ্টি। হালুয়ার পাক তখন রূপ বদলে চাটনি হয়ে গেছে। সেও চটচটে, মাখামাখি তাতে নতুন উপদ্রব মাছি উড়ছে, ভনভন করছে। ছিল হালুয়া, হয়ে গেল চাটনি- যেখানে পড়বে সেখানে জ্বালা- দূষিত জ্বালা।
তখন মনে হবে এর থেকে হালুয়া ভালো ছিল- শুধু তো গায়ে লেগে ছিল ঘামের মতো। একবার এই অভিজ্ঞতা হয়ে গেলেই পরের বার মন বলবে- চাটনি হয়ে কাজ নেই বাপু ‘হালুয়া’ হয়ে কাটিয়ে দে বাপ বাকি জীবনটা। শুধু বলিস না- কারা হালুয়া করলো তাহলেই চাটনি… মনে রেখে পথ চলো, ভাবখানা এমন রাখতে হবে যেন মন হালুয়ায় মাখামাখি, নেচে নেচে হরি বলো, প্রসাদ নিতে ভিড়ের অভাব হবে না, অভিযোগ থাকবে না। শুধু জীবন-হালুয়া কেঁদে কেঁদে বলবে- “ত্রাহি মাম ত্রাহি মাম…”
-
রম্য- ই যুগের ই স্নান
ই যুগের ই স্নান
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়প্রস্তর যুগ তাম্র যুগ লৌহ যুগ এইভাবে নানান যুগের হার্ডল রেস পেরিয়ে এখন ই`যুগে ঢুকে পড়েছি।
রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতের যুগকে অনেক পিছনে ফেলে ডাকহরকরাকে সরিয়ে টেলিগ্রামকে আদিম করে দিয়ে এখন, ই মেল @.com স্বাগতম।ই পোর্টাল, ই মানি লেন্ডিং, ই টেন্ডার, ঠিকই আছে। যুগের সঙ্গে সময়ের সঙ্গে চলাই জীবন। নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। তবে আমার খুব আশ্চর্য লেগেছে, ই স্নান। সত্যি বলতে হাসিও পেয়েছে খুব। ঘটনাটা বলি।
ঠাকুমার খুব ইচ্ছে, বলতে গেলে বিরানব্বই বছরের বৃদ্ধার অন্তিম ইচ্ছে শেষ বারের মতো গঙ্গা স্নান করে।
ডক্টরকে কথাটা জানাতেই তিনি হাঁ হাঁ করে লাফিয়ে ওঠার মতো ক`রে বললেন, আরে ওনার না-হয় বয়স হয়ে গিয়েছে ভুলভাল বলছেন, আপনারাও পাগল হলেন না-কি?
বললাম না না সেই স্নান নয়, একেবারে নিরাপদ পবিত্র নির্ভয় স্নান। ই স্নান।
ডক্টর স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন, ও তাই বলুন। ওকে, ই স্নান Absolutely lovely Idea. You may proceed.
ঠাকুমাকে আর সাত মাইল দূরে গিয়ে নাক টিপে ডুব দিয়ে পূণ্যলাভ করতে হবে না, ঘরে বসেই গঙ্গাস্নান। ই স্নান। ঠাকুমা আকাশ থেকে পড়লো।
সেটা আবার কী?
একটু সন্দেহ ছিল ঠাকুমার। স্বাভাবিক, পুরনো দিনের মানুষ, আধুনিকতার চাকচিক্যের প্রতি নাক সিঁটকানো অবিশ্বাস।
তাই বুঝিয়ে বলতে হলো, এই জল সাধারণ ঐ মাটি গোলা নোংরা গঙ্গাজল নয়। এ একেবারে হরিদ্বারের হর কী পৌড়ী ঘাটের জল। অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসতে হয়।
সেই কথা শুনে ঠাকুমার সেকি আনন্দ হাসি।
বলিস কি! এমনও হয়? বেশ বেশ, তাহলে সেই ব্যবস্থাই কর। হলো ব্যাবস্থা।ঠাকুমা আজ আর নেই। কিন্তু ক্যামেরায় ধ`রে রাখা তার সেই ফোকলা দাঁতের সরল হাসি, ই স্নান সমেত আজও ঘরের দেওয়ালে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে।
-
রম্য- ফুঁ বাবার ফুসমন্তর
ফুঁ বাবার ফুসমন্তর
–সুজিত চট্টোপাধ্যায়-ফুঁ বাবা, একটা প্রশ্ন ছিল।
-ক`রে ফ্যাল। ( ছিলিমে টান দিয়ে )
-বাবা, জীবন কী?
-হা হা হা হা হা, জীবন হলো সময়ের সীমাবদ্ধ কাল।
-আর একটু সহজ করে যদি বলেন। মানে জানেনই তো, ভেজাল খেয়ে খেয়ে একেবারে
-এককথায় আয়ু। আরও সহজ কথায় প্রাণবায়ু। কেউ বলে প্রাণ আত্মা নির্ভর, আমি বলি আত্মনির্ভর। (ধোঁয়া ছেড়ে )
-তফাৎ কী গুরুদেব?
-ওহে বৎস, আসলে তো বায়ু। নাসারন্ধ্রে প্রবেশ এবং বাহির। সেই গর্বিত বায়ু যতক্ষণ হাপড় টানবে আর ছাড়বে ততক্ষণ জীবন।
বায়ু ফুরলো জীবন জুরলো। ( আবার টান)
-বড়ই ক্ষণস্থায়ী গুরুদেব।
-আক্ষেপ থাকবে না, যদি এ-কে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারিস।
-কাকে ফুঁ বাবা, বায়ু কে?
-দূর বোকা। তাকে ব্যবহার করেই তো বেঁচে আছিস, আবার কী?
-তাহলে?
-জীবন, সুখের স্বর্গে বেঁচে থাকার পথ।
-কেমন করে ফুঁ বাবা? পথ দেখান প্লিজ। সত্যি কথা বলতে, নানা মুনির নানা মতের ধাক্কায় আমরা অর্বাচীনের দল একেবারে দিশেহারা। যখন যেটা শুনি সেটাই ঠিক মনে হয়। গোলকধাঁধার চক্কর। পথ বাৎলে দিন প্রভূ।
-দু’টো রাস্তা। একটা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর পথ, অন্যটা সর্বগ্রাসী ভোগের পথ।
– না না স্যার মানে গুরুদেব, আজেবাজে কথা বলে লাভ নেই, পেটে খিদে মুখে লাজ। ওসব সন্ন্যাসী টন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব নয়, মেন্টেইন করা যাবে না। অনেক ঝক্কি, নিয়ম কানুন আচার বিচার অমাবস্যা পূর্ণিমা জপ তপ পুজো, না না তার চাইতে ঐ ভোগের রাস্তার ব্যাপারটা যদি একটু খোলসা করেন কৃপা করে।
-আগে ভোগ পরে ত্যাগ, তাই তো? একেবারে সহজ মসৃণ পথ। শুধু বুদ্ধি খরচ করে দাপিয়ে চলো।
-নট ক্লিয়ার। মানে আর একটু যদি..
-কিচ্ছু নয় শুধু বারফট্টাই মারো, মিথ্যের বুলেট ট্রেন চালাও। লেঙ্গি দাও, অন্যের নামে চুকলি আর নিন্দেমন্দ করে নিজে প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠো। চামচা বাজি করে ধীরে ধীরে ওপরে চড়ে যাও, তারপর সুযোগ সুবিধে মতো গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে একটা ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে গিয়ে চোখ পাল্টাতে কতক্ষণ?
-তার মানে বেইমানি?
-ওরে, এপথে এটাই দস্তুর। কাজ ফুরলেই পাজি। শোন, গিরগিটি দেখেছিস তো? গায়ের রঙ বদল করে কিন্তু গিরগিটির স্বভাব চরিত্র বদলে যায় না।
– হ্যাঁ, এটা বেশ লাগদাই মনে হচ্ছে। চলবে। এরকম আরও দু’একটা অস্ত্রের সন্ধান দিন গুরুদেব।-অস্ত্রের শেষ নেই রে, কিন্তু এইসব দিয়ে কী হবে! লক্ষ্য কী?
-লক্ষ্য কী একটা প্রভূ। যতই প্রত্যাশা, ততই লালসা ততই লক্ষ্য।
-আরে মুর্খ প্রত্যাশার অন্ত নেই। অনন্ত কাল ধরেই অন্তহীন। শোন তবে, নেহাৎ সে যুগে অর্থোপেডিক্স সার্জারীর তেমন রমরমা ছিল না, নইলে ভীমের গদার গোঁতা খেয়ে ঊরুভঙ্গ দুর্যোধন ঊরুর বোন ফ্যাকচার সারিয়ে সেকেন্ড চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়ে যেতো। এতো সহজে হাল ছাড়ার পাত্র সে মোটেই ছিল না।
অতো অতো ধনসম্পদ, গোটা একটা রাজ্য হস্তিনাপুর সঙ্গে নবনির্মিত সুদৃশ্য ইন্দ্রপ্রস্থ, ঊরু উন্ডেড হলো বলে যাবতীয় বৈভব ফেলে রণে ভঙ্গ দেবে এটা বিশ্বাস করা মুশকিল নয় কী?
-ঠিকই তো,,,
-কামনা ফুরোয় না রে কামনা ফুরোয় না। ভাগ্যিস ফুরোয় না। কামনা ফুরোলে মন বাগিচার সতেজ পদ্ম শুকিয়ে একেবারে কড়কড়ে মড়মড়ে হয়ে মাটিতে নেতিয়ে পড়ে অবহেলায় গড়াগড়ি যেতো।
-এই তো মাথা সাফ হতে শুরু হয়েছে, সুতরাং বাঁচতে হলে ভেক ধরতে হবে, নাহলে বোকা বুদ্ধু হয়ে ভোটের বাজারে দেওয়াল দখলের সিজিনাল হিরো হয়ে যৌবনের শবযাত্রা দেখতে হবে। অতএব, মিথ্যের পিরামিড সাজাও। মনোলোভা মণিমাণিক্যের বাক্য বপন করো। নাই বা হলো কল্পনার কল্পতরু। নাই বা ধরলো তাতে মণিকাঞ্চন, বয়েই গেল। তোর কার্যসিদ্ধি হওয়া নিয়ে কথা।
-বুঝলুম। কিন্তু ঢপবাজি ধরা পড়তে কতক্ষণ, তখন? পাবলিক মেরে লাট করে দেবে না?
-ধুস, কিসসু হবেনা। পাবলিক এক অদ্ভুত প্রাণী। ওরা ভুলে যেতে ভালোবাসে। প্রতিশ্রুতির মেগা সিরিয়াল। আবার নতুন কেরামতি। পাবলিক হলো হাওয়া নিশানের মুরগী। যেদিকে হাওয়া সেদিকে চোখ। কি হলো, কী ভাবছিস? আরে বাবা পরের কথা পরে ভাববি। যখন যেমন তখন তেমন। এখন তো আখের গুছিয়ে সুখ ভোগ করে নে। দামী দামী স্যুট, কোট, নানান রঙের চোখধাঁধানো পোশাক। বহু মূল্যের বিলাসবহুল বিদেশি গাড়ি, অট্টালিকা, পারলে বিশ্বভ্রমণটাও সেরে ফেলিস। দুনিয়ায় সুখ ভোগের অণুসঙ্গ কি কম রে?
-কিন্তু!
-আবার সেই বোকার মতো কিন্তু কিন্তু করে, দ্যাখো! আরে বাবা সুখ পেতে সাহস চাই। বুকে বল আন, দেখবি সবই সহজ। তাছাড়া জানিসই তো… প্রতিশ্রুতির সহবাস আর পরকীয়াও বর্তমান আইন মোতাবেক অন্যায্য নয়। সুতরাং চালাও পানসি। চুটিয়ে ভোগ করো। নো রিস্ক নো গেইন। সাহসী হও। নির্ভীকতাই জীবনের উন্নতির সোপান।
গলাবাজিতে ফার্স্টক্লাস ফাস্ট হও। নাকের ডগায় কাঁঠাল পাতার টোপ ঝোলাও। লোভ মেশানো টোপ বড়ই কার্যকরী। বিষ মাখানো মাখন রুটি, নেংটি ইঁদুর মুখ দেবেই দেবে। প্রত্যাশার হাতছানি, রেহাই নেই। এ বড়ো সাংঘাতিক ছোঁয়াচে অসুখ। হে মানব জাতি ভুলিও না, যুগে যুগে এই সত্য। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা।শুটআউট ইজ দি বেস্ট পলিসি।রাইভ্যাল দেখলেই উড়িয়ে দাও। আগুন আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই বৎস। নদীচরের সোনালী বালি বালুকাবেলায় ট্রাক বোঝাই করে পাচার করো। নদী বাঁধের কাটামাটি কাঁচাটাকা হয়ে তোমার কালো আমানতের শ্রীবৃদ্ধি করুক। শ্রী-ঘরের খোদ কর্তার খোসামোদের পাত্র হও। সেই হবে তোমার পাড়ানির কড়ি। কামিনীকাঞ্চন মোক্ষম দাওয়াই। নীলসায়রে কালীয় ফনায় ত্রিভঙ্গ মুরারি হয়ে যদি বাঁশীতে সপ্ত সুরের মূর্ছনায় ভাসতে চাও তাহলে “শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান…” আচার বিচারের মাথায় চড়ে তাতা থৈথৈ নেত্য যদি করতে চাও, হাতজোড় নাটুকে জনহিতৈষীদের জন্যে অম্লমধুর আচারের সুবন্দোবস্ত করো। জেনো তারাই তোমার চৌকিদার। হাইলাইটেড হও।
নিজের ঢাক নিজেই পেটাও। টুইটারে অশ্লীল বাণীর বান শানাও তোমায় রোখে কার বাপের সাধ্যি?
টিভি চ্যানেলে তোমার মুখনিঃসৃত বাণীকে হেডলাইন বানিয়ে প্যানেলে চর্বিত চর্চার মুখরোচক বিতর্কের কফি ঝড় বইবে। পাবলিককে গেলানো হবে। তোমাকে সেলিব্রিটি বানানো হবে। তুমি রাতারাতি এলেবেলে থেকে সেলএবেল হয়ে যাবে।
হা হা হা আর কি চাই?
এইবারে “হাম হ্যায় রাজা” হয়ে সমাজের কেউকেটা হয়ে বুক চিতিয়ে ফুলিয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি করে ব্ল্যাক ক্যাটের ঘেরা টোপে ঘুরে বেড়াও। সুখ সুখ আর সুখ। চারদিকে সপ্ত রঙের অজস্র বুদবুদ উড়ছে ঘুরছে আহা কী বাহার। তুমি যথার্থই জনগনেশের ত্রাস থুড়ি ত্রাতা। নাও সব্বাই উঠে দাঁড়াও, এখন উল্টো পতাকা টাঙ্গিয়ে দেশভক্তিতে গদগদ হয়ে গান শুরু হবে। সমস্বরে বলো সবাই,
জয় ফুঁ বাবার ফুসমন্তর এর জয়। -
রম্য- জ্ঞাতি ধর্ম
জ্ঞাতি ধর্ম
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়গুরুদেব, কী করা যায় বলুন দেখি, আর যে পারি না। জ্ঞাতিগুষ্টির অত্যেচারের ঠ্যালায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।
-কী করতে চাস?
-কিচ্ছু করতে চাই না। শুদ্ধু রেহাই পেতে চাই।
-কী থেকে রেহাই! জ্ঞাতিগুষ্টি নাকি অত্যাচার?
-আজ্ঞে নাজেহাল অবস্থা থেকে।
-বড়োই মুশকিল;
-এই সেরেছে; কেন গুরুদেব! কিসে আটকাচ্ছে?
-দাঁতে। কচি পাঁঠার ঝোল ভাত খাওয়ালি যে, তারই টুকরো-টাকরা যাক গে, শোনো বাবা, আসলে ব্যাপার কী জানো, জাগতিক কারণেই জ্ঞাতি সর্বদাই দুর্যোধন গোত্রীয় যাঁতি ধর্মী।
-আহা, আহা, কী শোনালেন গুরুদেব। মধুর বাণী। এক্কেবারে ঠিক কথা। স্বভাব যায় না ম`লে।
-এই তো কেমন সুন্দর বুঝেছ। রতনে রতন চেনা কেস কিনা,
-মানে?
-সে তোমার জ্ঞাতি, অর্থাৎ তুমিও তার জ্ঞাতি, ঠিক কি না?
-তা অবিশ্যি ঠিকই, কিন্তু,
-আরে বাবা আমড়া গাছে কি আম ধরে? সেখান যে রক্ত তোমাতেও সেই একই রক্তধারা।
-তাহলে উপায়?
-উপায় যাঁতি। জ্ঞাতি ঠেকাতে যাঁতির জুরি নেই।
-ওভার বাউন্ডারি হয়ে যাচ্ছে গুরুদেব। জলবৎ তরলং হলে বুঝতে সুবিধে হয়।
-এ-ই হলো তোদের সমস্যা। টাকা আছে ষোল আনা, লোভ আছে আঠারো আনা, হিংসে আছে বত্রিশ আনা অথচ বিদ্যে নেই এক আনা।
-(মনে মনে) বিদ্যে নেই বলেই তো গুরুদেব পুষছি গাদা খানেক দানদক্ষিণা দিয়ে। সঙ্গে প্রণাম টোনাম সব উপরি। নেহাৎ পারিবারিক পুরনো পরম্পরা, নইলে কে পোঁছে তোকে…
(মুখে) তা-ও ঠিক। কিন্তু গুরুদেব সেই একই দোষ তো ওদিকেও রয়েছে, তাহলে?
-হা হা হা হা, দুই ষাঁড়ের লড়াই দেখেছিস কখনও। গোদা শরীর, আর মাথায় মোটা শিঙের ঠোকাঠুকিতে মরণপণ যুদ্ধ। একটা শুয়ে না পড়া পর্যন্ত রেহাই নেই।
-শান্তি কি নেই গুরুদেব?
-হা হা হা হা, একবার একজন শান্তিকামী সমাজকর্মী দু’টো যুদ্ধরত ষাঁড়ের কানের কাছে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি গানের কলি শোনাতে গেল-
“তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল..”
গোড়ায় গোড়ায় তেমন গা করেনি ষাঁড় দুটো। হঠাৎ শিঙ বাগিয়ে দিলো গুঁতো। ব্যস, এক গুঁতোতেই শান্তিকামীর চিরশান্তি প্রাপ্তি। হরিবোল হরিবোল।
-তাহলে লড়াই চলবে বলছেন?
-একপক্ষ শুয়ে না পড়া পর্যন্ত।
-তাহলে যাঁতির ব্যাপারটা?
-আরে এখনো বুঝলি না?
-যাঁতির দুটি অংশ। ওপর দিকে ধারালো অংশ নিচের দিকে ভোঁতা। ঐ দুয়ের মাঝখানে সুপুরি বসিয়ে যাঁতির ওপর আর নিচের হাতলে মার চাপ একসঙ্গে। কট আওয়াজ। কঠিন সুপুরি একেবারে দু’ফাঁক। আর বিবাদ নেই। ধারালো আর ভোঁতা এক হয়ে মিশে আছে। যাঁতি আর জ্ঞাতির স্বভাব, দু’ভাগ না করে বিশ্রাম নেবে না।
হরি হে মাধব, চান করবো না, গা ধোবো। -
রম্য- মিউউউউউ
মিউউউউউ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়শীতের দুপুর। ঠাকুমা সবে একটু রোদ পুইয়ে এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছে, ওমনি ছাদের কার্নিশে বসে একঘেয়ে মিউউউউ করে ডেকে চলেছে ভবঘুরে বেড়াল।
এ তো ভারী উৎপাত।
প্রথমে শুয়ে শুয়েই মুখে হুট হ্যাট আওয়াজ করে তাড়াবার চেষ্টা হলো কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সে তার মতো করে গলা সেধে যাচ্ছে, মিউউউ।
ঠাকুমা বিরক্ত হয়ে মনে মনে বেড়ালের রচনা সৃষ্টি করতে লাগলো। এ ব্যাটারা আসে কোত্থেকে! মাঝেমধ্যেই কেউ না কেউ এসে হাজির হয়। কখনো সাদা, কখনো কালো, কখনো সাদাকালো মেশানো। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ একটা ধুমসো হুলো ছাদে বারান্দায় সিঁড়ির চাতালে ঘুরঘুর করবে।
দু-একদিন বাদেই আবিষ্কার হলো হুলো একা নয় সঙ্গে দোকা মেনিও আছে। নিশ্চয়ই অন্য পাড়া থেকে ফুসলিয়ে এনেছে হুলো।
এই ফুসলিয়ে আনার ব্যাপারটা কিন্তু ভাববার আছে।
এপাড়ার মেনি ওপাড়ার হুলোর সাথে কেটে গেল এই মহাবিদ্যা মা ষষ্ঠীর একনিষ্ঠ বাহন শিখলো কোথায়! কার কাছে? মানুষের সঙ্গে নির্বিবাদে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে এই ব্যাপারটা বেড়াল সমাজে সংক্রামিত হলো, না-কি উল্টো? মানে মার্জার গোষ্ঠী থেকে মনুষ্য সমাজে?
ঠাকুমার রচনা ভাবনা এবার কিন্তু অসহ্য হয়ে উঠছে। এসপার উসপার মনোভাব নিয়ে খাট থেকে নেমে বাইরে এলো।
হুলো ততক্ষণে কার্নিশ ছেড়ে বারান্দার রেলিঙের ওপর উঠে গলার কাজ দেখাচ্ছে।
ঠাকুমা হাত তুলে মারবার ভঙ্গিতে বারকয়েক হুস হাস করলো কিন্তু আশ্চর্য, হুলো ঠাকুমার দিকে নিরীহ ভাবে তাকিয়ে স্পন্ডালাইটিস রুগীর মতো দু’বার ঘাড়ের ব্যায়াম ক`রে পুনরায় ডাক ছাড়লো- মিউউউ
ঠাকুমার মাথায় ভিসুভিয়াস ফাটছে। নগন্য বেড়ালের এই তাচ্ছিল্য কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। একটা লাঠি হাতের কাছে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এইসব জঞ্জাল প্রাণীদের কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় ভালোই জানা আছে।
আবারও সেই ডাক- মিউউউউউ। এবার আরও জোরে। ঠাকুমা কোমরে হাত রেখে কটমট ক`রে তাকিয়ে দেখলো। এই অবজ্ঞা কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব নয়।
মুঠো করে শাড়ির খুঁট উঁচুতে তুলে হুড়মুড় করে রেলিঙের দিকে যেতে গিয়ে একেবারে দুম। পড়ে গিয়ে আলুরদম।
পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দ আর ঠাকুমার চিৎকার শুনে যুবক তমাল ছুট্টে বাইরে এসে ঠাকুমাকে টেনে তোলবার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তখনই আবারও সেই ডাক
মিউউউউউ। সম্ভবত বুঝেছে এখানে কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। গোলগোল চোখ আরও বড়ো আর চকচকে হয়ে উঠেছে।
কালের নিয়মে ঠাকুমার এ সংসার থেকে আধিপত্য বিদায় নিয়েছে কিন্তু স্বভাব দোষ? সে তো যাবার নয়। স্বভাব সাসপেন্ড হতে পারে কিন্তু রিটায়ার করে না।
ঠাকুমা চিৎপটাং অবস্থাতেও জোয়ান নাতি তমালকে আঙুল দিয়ে বেড়ালের দিকে ইশারা করে ওটাকে তাড়াতে বললো।
তমাল এক হাতে ঠাকুমাকে ধরে রেখে অন্য হাতে বেড়ালের দিকে মারবার তাক করতেই সে এক লাফে পগার পার।
ঠাকুমা নাতির কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, ফাঁকা রেলিঙের দিকে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে বললো,
“নচ্ছার বেড়াল। ওফ্ফ… কী শয়তান।”
জোয়ান নাতির হাত ধরে ঘরে যেতে যেতে আক্ষেপের সুরে বললো,
” হায় রে, বয়স্ক লোককে একটা বেড়ালও ভয় পাওয়া তো দূর পাত্তাই দেয় না।”
ঠিক তখনই দূর থেকে একটা শব্দ হাড় পিত্তি জ্বালিয়ে ভেসে এলো,
মিউউউউউউউউ….
তমাল আর ঠাকুমা দু’জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো কয়েক সেকেন্ড, তারপরই দু’জনেই একসঙ্গে খুব জোরে আওয়াজ ক`রে হেসে উঠলো, হা হা হা হা হা হা হা হা… -
রম্য- তুমি আর আমি শুধু
তুমি আর আমি শুধু
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়সেই গানটা মনে আছে,
” তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভ`রে তুলবো,
যত ব্যথা দুজনেই ভুলবো ”
গায়ক শ্যামল মিত্র,
মনে আছে?
আচ্ছা, বলুন দেখি এখানে তুমি আর আমি বলতে কোন দু’জন কে বোঝানো হয়েছে? নিঃসন্দেহে বলা যায়, রোমান্টিক গান সুতরাং প্রেমিক প্রেমিকার ব্যাপার। এখানে বাবা মা ভাই বোন বা অন্য কেউ না শুধুই ভালোবাসার কপোত-কপোতীদের মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে।
“যত ব্যথা দুজনেই ভুলবো”
অর্থাৎ অন্য কারোর ব্যথায় ব্যথিত হবার কোনও দায় নেই। শুধুমাত্র দু’জন দু-জনের ব্যথায় ভোলিনি মলম বুলিয়ে ভুলিয়ে দেবো। দুনিয়া ভোগে যাক।
এ-ই যে যুগলবন্দী ঘুপচি প্রেম, এর স্থায়িত্ব সম্মন্ধে কেমন যেন সন্দেহ জাগে, তাই না?
তুমি আমার আমি তোমার মার্কা এই একবগগা প্রেম, ভ্যানিশ হতে খুব বেশি সময় নেয় না। তুমি আমির ন্যাকামি তখন ঘোর কাটিয়ে রণংদেহী। লাগ লাগ ভেলকি লাগ।
এবার একঘেয়েমির পালা। সেই একঘেয়েমির দমবন্ধ দশা কাটাতে তৃতীয় কারোর উপস্থিতি চাহিদা তুঙ্গে উঠতে লেগেছে।
সেইসময় ও-ই শ্যামল মিত্রের গান, মেশিনগান হয়ে বুকে শেল হয়ে বিধছে।বেশ, ধরা গেল ইচ্ছে হয়ে যে ছিল মনের মাঝারে সে সশরীরে এসে গেল এই ধরাতলে। এইবারে অনিবার্য ভাবেই যত প্রেম ভালোবাসা ভালোলাগা, উউম আউম চুউম চাউম সব গিয়ে জড়ো হলো সেই নবাগতের চারপাশে। এখন তাকে ঘিরেই যাবতীয় সব। ব্যথাও সেখানে সুখও সেখানে।
তাহলে শ্যামল মিত্রের গানের সেই গদগদ বাণী “তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর” তার কী হবে?
খেলাঘর এখন তৃতীয় প্রাণীর কব্জায়। জীবনের খেলাঘর এখন রাতজাগা আঁতুড়ঘর।
মনের লুকোনো কুঠুরিতে চাপা অনভিজ্ঞতার আক্ষেপ মাঝেমাঝেই সংলাপ হয়ে বেরিয়ে আসছে,
“দু’একজন বয়স্ক কেউ থাকলে ভালো হতো। ওরা সব জানে বোঝে কিনা।”
পুনরায় প্রমাণ হলো অভিজ্ঞতা বড়ই মহার্ঘ্য।
জীবনে চলার পথে অপরিহার্য। ভালোবাসায় না হোক স্বার্থের চাহিদায় তো বটেই।“জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভ`রে তুলবো।”
হায় রে, বাস্তব বড়ই কঠিন, নিষ্ঠুর। কপোত-কপোতীর মোহ ভাঙা জটিল হিসেবি মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে দু-একটি অতি পরিচিত অবহেলিত ভাঙ্গাচোরা মুখের ছবি।
“দেখা হয় নাই দুই পা ফেলিয়া ”
হায় ভবিতব্য, যারা ছিল তারা নেই।
যে ছিল না সে শুয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে।
অজানা ভবিষ্যৎ-এর দূত কাঁদছে।
এখন গাওয়া যেতেই পারে গানের অন্তরা,
“শুধু বলো তুমি কি গো জানতে
যেতে যেতে এই পথ
শেষ হবে কোনও মরুপ্রান্তে?”