স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
-
রম্য- বেহালা টু বেনারস
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
বেহালা টু বেনারস
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়বেহালা টু বেনারস। এটাকি পাশের পাড়া, যাবো বললেই অমনি হুট ক`রে যাওয়া যায় ? সবেতে বাড়াবাড়ি ।
ছেলে কুন্তলের মেজাজি মার্কা কথা শুনেও বিনয় বাবু বিনীত সুরে বললেন ,, আহা,,রাগ করছিস কেন ? এমন কিছু বিদেশবিভুঁই তো নয় । বেনারস। প্লেনে মাত্র কিছুক্ষণের ব্যাপার। ফস ক`রে চলে যাবো।
টাকা একটু বেশি খরচ হবে , এ ই যা,, তা যাক। টাকা বড়কথা নয়। আসলে আমার আর তর সইছে না।
শিগগির শিগগির যেতে হবে রে।
নারায়নী দেবী এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন , এবার তিনি ঝলসে ওঠে বললেন,,, তর সইছে না , ফস ক`রে চলে যাবো,, আহা রে,, কী সখ,,
খালি নিজেরটা বোঝে। আরও যে মানুষ আছে , তারও যে ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে সে দিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই ওনার।
বিনয় বাবু বুঝলেন , টার্গেট তিনিই।
তাই খানিকটা অবাক হয়েই বললেন,, মানে,, এ কথার মানে কী?
নারায়নী দেবী সে কথায় পাত্তা না দিয়ে ছেলে কুন্তলের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার নাকের কাছে তর্জনী তুলে তর্জন ক`রে বললেন,,, খবরদার যদি প্লেনের টিকিট কেটেছিস, দেখিস আমি কী করি। যাওয়া ঘুচিয়ে দেবো।
বিনয় বাবুর অবাক হবার ঘোর কাটছে না। বললেন ,, আরে বাবা ব্যাপারটা কী ? প্লেনে কী হয়েছে ? অসুবিধে কী?
নারায়নী আরও ক্ষেপে গিয়ে বললেন,,,,
ন্যাকামি হচ্ছে ? যেন কিচ্ছুটি জানেনা । আমি হার্টের রুগী । ডাক্তার আমাকে নাগরদোলা চড়তে মানা করেছিল , মনে নেই?
বিনয় বাবু চোখ কপালে তুলে বললেন ,,,
বোঝো ঠ্যালা । তারপর নিজের কপালে চটাস ক`রে চাপর মেরে বললেন , কী সর্বনাশ,, নাগরদোলার সঙ্গে প্লেনের কী সম্পর্ক রে বাবা !
নারায়নী ঘুসি পাকানো হাত তুখোড় বিপ্লবীর মতো আকাশে ছুঁড়ে বললেন,,, অবশ্যই সম্পর্ক আছে। ডাক্তার বলেছে নাগরদোলা চড়বেন না,,, এর মানে কী ?
বিনয় বাবু ভ্যাবাচেকা খেয়ে চোখ গোলগোল ক`রে বললেন,,, কী ?
নারায়নী দেবী দাপটে উত্তর দিলেন,,, মানে,, মাটি থেকে আকাশে , আকাশ থেকে মাটিতে ঘুরপাক খাওয়া যাবে না। নাগরদোলা চড়াও যা, প্লেনে চাপাও তা , একই। মাটি আকাশ , আকাশ মাটি । আমি নেই। আকাশে দম আটকে মরতে চাই না। যা হবার মাটিতে হোক। এই মাটিতে জনম আমার , যেন এই মাটিতেই মরি।
বিনয় বাবু শুধরে দিতে উচ্চারণ করলেন ,,, ওটা মাটি নয়,, দেশ।
নারায়নী হারবার পাত্রী নয় , বললেন,, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। দেশ। আরেবাবা দেশ আর মাটি একই। দেশের মাটি। দেশ মাটি , মাটি দেশ। বুঝেছ ?
এবার হিটলার ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে বললেন ,,, দ্যাখো , বেশি চালাকি করবার দরকার নেই। খালি কথা ঘোরানোর ধান্দা ।
তারপরেই ছেলের দিকে ঘুরে , তাকে সাক্ষী রাখার মতো ক`রে বললেন ,,, কুনু ( কুন্তলের ডাক নাম ) তুই বল , ডাক্তারের কথা অমান্য করা কি উচিৎ ? হার্টের ব্যাপার । কিছু কি বলা যায় , যদি একটা খারাপ কিছু হয়ে যায় ? তখন তোদেরই তো হ্যাপা পোহাতে হবে বল,,।
হাসপাতাল,, ঘর,, হাসপাতাল,, ঘর,,, টাকার শ্রাদ্ধ , অশেষ ভোগান্তি ,,,,
বিনয় বাবু আর বিনয় রাখতে পারলেন না। চিৎকার ক`রে বললেন ,,
মূর্খতার একটা সীমা পরিসীমা থাকা উচিৎ । ডাক্তারের পরামর্শ । নিকুচি করেছে ডাক্তারের । ডাক্তার না ছাই। পরামর্শ তো তোমার হোমিওপ্যাথি হেঁপো মামার। উনি নাকি ডাক্তার ! দূর দূর,,, হোমিওপ্যাথি আবার ডাক্তার ।
আগুনে ঘৃতাহুতি । রণং মূর্তি ।
এই,, খবরদার বলেদিচ্ছি, মামা তুলে কথা বলবে না।
ডাক্তার ইজ ডাক্তার । হোমিওপ্যাথি বলে হ্যালাফ্যালা করবেনা একদম।
> একশোবার করবো । বেশ করবো। আমিও হাজারটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের নাম গড়গড় করে বলে যেতে পারি। ডাক্তারি ফলাচ্ছে।
বুড়িধারি মেয়েকে বলছে ,, নাগরদোলা চাপবে না , আইসক্রিম ছোঁবে না , ফুচকা খাবে না। ডাক্তার হয়েছে,, দূর দূর,, সামান্য একটুখানি সুগার বেড়ে গিয়েছিল সারাতে পারেনি ,, আবার বড়ো বড়ো কথা ।
>সামান্য একটুখানি ? কি মিথ্যুক রে,,। দ্যাখ দ্যাখ কুনু,, তোর বাবা কিরকম মিথ্যেবাদী দ্যাখ একবার। চারশো পাঁচশো সুগার নাকি একটুখানি !
এইবার মোক্ষম যুক্তির ঠ্যালায় , বিনয় বাবু চুপসে গিয়ে চুপ ক`রে গেলেন । সত্যিই তাই। দুবেলা ইনসুলিন নিতে হয়। খাওয়ার খুব ঝামেলা। এটা বাদ , সেটা বাদ। যাচ্ছেতাই জীবন। সবচেয়ে মুশকিল হলো , ডাক্তার যেগুলো খেতে বারন করেছে , সেই গুলোই বেশী ক`রে খেতে ইচ্ছে করে। অথচ উপায় নেই। নারায়নীর ত্রিনয়ন এড়িয়ে কিচ্ছুটি করার উপায় নেই । সর্বক্ষণ নজরদারি চালু আছে। আর সেই কারণেই স্ত্রী এখন স্বামীর চক্ষুশূল। অথচ তাকে ছাড়া চলে না। এ এক মহা গেড়ো। কাছে থাকলেও জ্বালা , না থাকলে মহাজ্বালা।
কুনু,, আমি বলছি ,, এক্ষুনি যা, বেনারসের টিকিট নিয়ে আয় , প্লেনেই যাবো।
বিদ্রোহিণী নারায়নী ঝংকার দিয়ে বললেন ,,
কখনোই নয়। তুই ট্রেনের টিকিট নিয়ে আয়। সারারাত কুউউ ঝিক ঝিক ক`রে শুয়ে শুয়ে দুলতে দুলতে যাবো , আহঃ কী মজা ,, যা কুনু বেরিয়ে পড়। দেরী হয়ে গেলে টিকিট ফুরিয়ে যাবে বাবা। আর শোন ভালো কথা,, আজকের ট্রেন যদি না পাওয়া যায় , কালকের নিবি,, যা যা বেরিয়ে পড়,,।
বিনয় বাবু শেষ চেষ্টা করার জন্যে বললেন,
আমার কিন্তু কোমরে স্পন্ডালাইটিস আছে । সারারাতের ট্রেনের ঝাঁকুনি তে যদি ব্যাথা বেড়ে যায় , দেখাবো তখন মজা ।
নারায়নী মুখ ভেংচে বললেন,,,,, ওরে আমার স্পন্ডালাইটিস রে। বয়সকালে অমন ব্যাথা সকলেরই হয়।ও জিনিস যাবার নয়। চিরসঙ্গী স্পন্ডালাইটিস ।
__ কেন , তোমার ডাক্তার মামা কে বলোনা,, ঐ সর্বরোগ হরণকারী সাদা সাদা ঝাঁজালো গুলি গুলি মহৌষধি সাপ্লাই দিক।
কুন্তলের এসব দেখা অভ্যেস আছে। সারাদিন , সারারাতেও এর মীমাংসা হবে না। তাই ঠান্ডা গলায় বললো৷,,
তোমরা আগে নিজেদের মধ্যে ফয়সালা ক`রে নাও , কী করবে,,, তারপর আমাকে বোলো।
কুন্তল চলে গেল।বিনয় বাবুদের একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রাণীর বিয়ে হয়েছে বেনারস এ। গতকাল রাতে জামাই ফোন ক`রে সুসংবাদটি দিয়েছে।
ইনুর (ইন্দ্রাণীর আদুরে নাম ) মেয়ে হয়েছে । এইমাত্র।
সেই সংবাদ শোনা মাত্রই বিনয় বাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন তিনি যাবেন বেনারস। নাতনীর মুখ দেখবেন। সুতরাং নারায়নীও গোঁ ধরলেন , তিনিও যাবেন।
মেয়ের তিন মাসের গর্ভাবস্থায় গিয়েছিলেন। সেবার অবিশ্যি ছেলেও সঙ্গে ছিল। ট্রেনেই গিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার অবস্থা ছিল অন্যরকম। হার্ট কিংবা সুগার নামক কোনও রোগ বালাই ছিলনা। হঠাৎই এই ছ মাসের ভেতর কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। মেয়েটার অতদূরে বিয়ে হবার কারণেই হয়তো। কি আর করা। ভালো মনমতো সুপাত্র পেলে , বাবা-মা এমন স্যাকরিফাইস তো করেই থাকেন। নতুন কথা কিছু নয়। তবু , মন মানে না। সেই পুরনো কথা মনে পড়ে। স্নেহ অতি বিষম বস্তু ।
এ যাতনা মেয়ের বাবা মায়ের একান্ত পাওনা।জয় হলো তোমার ভোলা । কার সাধ্য তোমায় হারাবে।
নাহ,,, এক্ষেত্রে ভোলার জয় হয়নি। বরঞ্চ উল্টোটাই হলো। জায়া র জয় জয়কার ।
পরের দিনই রাতের ট্রেনে জায়গা পাওয়া গেল। তবে এ সি তে নয়। সেসব অনেক আগেই নো ভ্যাকান্সি হয়ে বসে আছে। অগত্যা সেকেন্ড ক্লাস।
সেকেন্ড ক্লাস , থ্রি টায়ার । একটা আপার, একটা মিডল বার্থ।
নারায়নী ব্যাজার মুখে বললেন ,,,
হ্যাঁরে কুনু,,, এই নিচে একখানা পেলিনা, এতখানি ওপরে ওঠা , ওফঃ,, কী যন্ত্রণা বলো দেখি।
এইতো ফাঁক পাওয়া গেছে। আরকি ছাড়া যায়। লোপ্পা ক্যাচ। বিনয় বাবু কথাটা টুক করে লুফে নিয়ে বললেন ,,
এখন এসব কথা আসছে কেন ? আমার কথা তো তখন তেতো লেগেছিল , এবার কী মনেমনে আক্ষেপ হচ্ছে ? নাও, এবার গাছে চড়া প্রাকটিস করো।
নারায়নী চুপ করে রইলেন বটে , কিন্তু তার চোখ মুখের চেহারায় অতৃপ্তির ছায়া স্পষ্ট ।কুন্তল বাবাকে ওপরে , আর মাকে মিডল সিটে শোবার পরামর্শ দিলো। বিনয় তৎক্ষনাৎ সেই প্রস্তাব খারিজ ক`রে বললেন,,
অসম্ভব , আমি সুগার পেসেন্ট । বারবার উঠতে হয়। আমার লোয়ার হলেই ভালো হতো। যাক , হয়নি যখন , ঐ মিডিল দিয়েই চালিয়ে নেব।
এবার ভোলার জয় হলো। অকাট্য যুক্তি। জজে মানবে। সুতরাং হাঁচড়পাঁচড় ক`রে নারায়নী মগডালে চড়ে গেলেন।
চড়ে গেলেন নাকি চড়িয়ে দেওয়া হলো।
কুন্তল বয়সের তুলনায় লম্বা বেশি। সিক্স ফুট প্লাস। সে মা কে খানিকটা বাস্কেট বল খেলায় ঝুরিতে বল ফেলে গোল করার ঢং-এ টং য়ে তুলে দিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,,
সাবধানে নামিয়ে নিও। ওখান থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না। দেখো,, কেলেংকারী বাধিও না।
বিনয় বাবু ছেলেকে আস্বস্ত ক`রে বললেন,,
না না । চিন্তা নেই ।
জামাই কে হোয়াটসঅ্যাপ ক`রে কোচ নাম্বার , সিট নাম্বার সব দিয়ে দিয়েছি। সেই এসে শাশুড়ি কে পাঁজাকোলা ক`রে নামিয়ে দেবে। কোনও চিন্তা নেই।
ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। কুন্তল এ যাত্রায় যাবে না। ওর ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষা আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। ও ফিরে গেল। গাড়ি ছেড়ে দিলো।মাঝরাত্তির হবে তখন। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে উর্ধশ্বাসে ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। কামরার সাদা আলো গুলো সব নিভিয়ে দিয়ে যাত্রীরা ঘুমোচ্ছে। নীল বাতির আবছা আলোয় কামরার এমাথা থেকে ওমাথা যেন মৃত্যুপুরী।
আপার বাঙ্কে নারায়নী নাক ডাকছে। বিনয় বাবু মনে মনে গজরাচ্ছেন ,,, আশ্চর্য মহিলা যাহোক। এই দুলুনি খেতে খেতে কেমন নাক ডাকছে,,,
ওফ্ফ বলিহারি যাই বটে,,।
এই আক্ষেপের কারণ আছে।
সব্বাই ঘুমোচ্ছে , শুধু ওনার চোখে ঘুম নেই । এই নিয়ে বার পাঁচেক মিডল বার্থ থেকে নেমেছেন আর উঠেছেন।
ওনার সিটের নিচেই লোয়ার বার্থের যাত্রী ওনার এই বারংবার ওঠা নামায় যথেষ্ট বিরক্ত। তিনি আবার অবাঙালি। কিছুক্ষণ পরেই আবারও বিনয় বাবু নিচে নামলেন। এবার সেই অবাঙালি যাত্রী বিরক্ত স্বরে হিন্দি তে বললেন ,,,
বারবার উপর নিচ কর রহে হেঁ আপ , কেয়া বাত হ্যায় জী। চ্যায়েন নেহি হ্যায় কা,,!
বিনয় বাবুর হিন্দি তেমন আসেনা। তাই চ্যায়েন শব্দের অর্থ বুঝতে পারলেন না।
তিনি সরল মনে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে পরিস্কার বাংলায় বললেন ,,,
না না,, চেন তো আছে কিন্তু খুলছেনা।
বিচ্ছিরি ভাবে আটকে গেছে । তারপর অনুনয় ক`রে বললেন ,,
আপনি একটু হেল্প করতে পারেন ? আর যে পারছি না।
ভদ্রলোক , জয় রামজি কী, ব`লে পাশ ফিরে শুলেন।
হঠাৎ চোখ গেল ওপরে। নারায়নী উঠে বসে ড্যাবড্যাব ক`রে তাকিয়ে আছে। বিনয় বাবু অসহায় গলায় বললেন,,,
এয়ারহস্টেস রা এব্যাপারে যথেষ্ট এক্সপার্ট।
নারায়নী কোনও কথা না বলে গুটিগুটি ওপর থেকে নিচে নেমে আসার চেষ্টা করলেন। তাই দেখে বিনয় বাবু হা হা ক`রে বললেন,,,,,,
আরে আরে করছো কী,,, পড়ে যাবে যে,,,
কে কার কথা শোনে। নারায়নী তার জেদ বজায় রাখবেই। বিশেষ ক`রে ঐ এয়ারহস্টেস শোনার পরেই তার মাথায় আগুন জ্বলে গেছে । শয়তান ব্যাটাছেলে , সারাটা জীবন ধরে যার সেবা নিয়ে গেল , সে কিছু নয়,,,? বিমানসেবিকা ? বেইমান।
যে ভয় করা হচ্ছিল ঠিক সেটাই ঘটে গেল এবার । নামতে গিয়ে বেসামাল হয়ে একেবারে গড়িয়ে গেলেন।
বিনয় বাবু কোন রকমে দুহাত বাড়িয়ে জাপটে ধরতে গেলেন। কিন্তু পারলেন না। দুজনেই জরামরি করে ধরাস ক`রে মেঝেতে পরলেন।
নারায়নী মা গোওও বলে আর্তনাদ করে উঠলেন। বিনয় বাবু হতবুদ্ধি হয়ে মেঝেতে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে অনুভব করলেন , তার শরীর থেকে গরম জলস্রোত বেরিয়ে এসে তার প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে ।সকালে বেনারস ষ্টেশনে জামাই বাবাজী এলেন বটে কিন্তু শাশুড়ী কে আর ওপর থেকে পেড়ে আনতে হলোনা । কেননা তিনি নিজে থেকেই খসে পরেছেন। আর খসে পরেছে নারায়নীর দুপাটি বাঁধানো দাঁত। সিটের নিচ থেকে অবিরাম হেসে চলেছে।
-
কবিতা- সময়
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
সময়
-পাপিয়া ঘোষ সিংহঅতিমারীর প্রকোপে শিক্ষা স্থানচ্যুত,
বিবেক বিক্রিত খোলা বাজারে
চেতনা মাতৃহীন, বিপ্লব দেশদ্রোহী
সেই সুযোগে পুঁথিগত শিক্ষা অবলুপ্ত।বিপ্লবী বাজারে কিনতে পাওয়া যায়,
মনুষ্যত্বের অভাবে প্রাণহীন ধরিত্রী,
ধর্ম টনিক গলধ্যকরণে বিষাক্ত মনভূমি
তবুও মানুষ বাঁচে এক চিলতে সুখের আশায়।স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেন যাঁরা,
বিস্মৃত আজকের দেশপ্রেমীর মননে,
চেতনহীন অ—শিক্ষা মূর্তি ভাঙে মনীষীদের
আকাশ জুড়ে শুধুই কালো,অন্তরালে নক্ষত্ররা।সামাজিকতা দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে,
পড়শি’র অসুখে দরজায় উঠছে খিল,
মানসিক দূরত্বে স্বজনের মৃত্যুও গা- সওয়া
রোজ ভালোবাসা, আবেগ, স্বপ্ন মাথাকূটে মরছে।অন্ধকার বর্তমান কোন্ ভবিষ্যতের পথে?
দিশাহীন যুব- সমাজ লাশকাটা ঘরে,
ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জালে জড়িয়ে
মাথা ও হৃদয় শ্লথ,দিশাহীন গতিতে। -
প্রবন্ধ- মূল্যবোধের অবক্ষয়
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
মূল্যবোধের অবক্ষয়
-শিলাবৃষ্টিআজকে বড়ই লজ্জার বিষয় এটাই যে — বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক মূল্যবোধহীনতা!যে মানুষের মধ্যে আছে অনন্ত সম্ভাবনা,যা দিয়ে মানুষ পারে একটা স্বর্গ রচনা করতে– সেই মানুষই মনুষ্যত্বহীনতায়,মানহীনতায় ,হুঁসহীন হয়ে করছে একের পর এক জঘন্য অপরাধ।
পশুর সাথে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের আজ পার্থক্য কোথায়? লোভ তাদের গ্রাস করছে। মানুষ হয়ে উঠছে ক্রমশঃ স্বার্থপর। ভাবতে আজ অবাক লাগে — আমরা নাকি সেই বরেণ্য মহাপৃুরুষদের উত্তরসূরী! এই সেদিন যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন –আমরা তাঁদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে ! অথচ আমাদের দেশের একটি শিশুও আজ নিশ্চিত জীবন কাটাতে পারেনা — তাকেও পাশবিক বল প্রয়োগ করা হয়! সে হয় ধর্ষিতা।
ছোটরা শিখছে কথায় কথায় মিথ্যে বলতে,ভালো লাগা জিনিসটা চুরি করতে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে নানান কু কীর্তি করে বেড়াচ্ছে।
পণপ্রথা আইন করেও বন্ধ করতে পারেনি সরকার। বধূ হত্যা ,বধূ নির্যাতন সমাজে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।বিবাহ বিচ্ছেদ আজ তো কোন ব্যাপারই নয়! সম্পত্তি নিয়ে গৃহ বিবাদ, বাপ- ছেলের কলহ,খুনোখুনি লেগেই আছে। শিক্ষককে আজ সামান্য সম্মানটুকু দিতেও ছাত্রদের কৃপণতা। মানুষকে ঠকানোতেই মানুষের চরম আনন্দ লাভ।
আজ এই সবের কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে — যুবসমাজের উপর এখন পড়েছে উগ্র আধুনিকতার প্রভাব, একান্নবর্তী পরিবারের অভাব, সুবিধাবাদী নীতির ছড়াছড়ি, আদর্শের অভাব,পাঁচমেশালি সংস্কৃতির প্রভাবে বেপরোয়া মনোভাব। আর এসব কিছু একদিনে হয়নি – একদিকে এগিয়েছে সভ্যতা আর অন্যদিকে অবনমন ঘটেছে মূল্যবোধের।
মনে হয় সর্বাগ্রে চাই মানুষের মনে ন্যায় বোধের জাগরণ, তাহলে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটবে। মহাপুরুষদের জীবনীপাঠ এবং তাঁদের জীবন পথের অনুসরণ করা।ধ্বংসের পথে না এগিয়ে কিছু সৃষ্টির মনোভাব রাখা।কর্মমুখী চেতনা যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে না দিতে পারলে ভয়ানক এক দিনের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে হয়তো।বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতিশিক্ষার বা আদর্শচর্চার ক্লাস অবশ্যই রাখা উচিত। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আজ শৈশব বিপন্ন। প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা! তাই ছেলেবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা বড় নিঃসঙ্গ ,বড় একা ।
এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভয়াবহ এক সময়ের সামনে আসতে হবে। তাই চাই বিশ্বাস । মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস। কারণ মানুষের মধ্যেই আছে প্রকৃত সম্ভাবনা। মানুষের চারিত্রিক সম্পদের অনুসন্ধান মানুষকেই করতে হবে ।। -
গল্প- ডিভোর্স
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
ডিভোর্স
-অমিত কুমার জানাপ্রতিদিনের মতো সকাল সকাল বিভাসদার চায়ের দোকানে গিয়ে লাল চায়ে এক চুমুক দিয়েছি,এমন সময় বিভাসদার মোবাইলটা বেজে উঠলো। এক দু মিনিট কথোপকথন হওয়ার পর বিভাসদা আমাকে বললো, “বুঝলি ভাই, একটা সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি। আমার পাড়ার একটা ছেলেকে ডিভোর্স হওয়া থেকে বাঁচিয়েছি।” আমি কৌতূহলী হয়ে মজার ছলে বললাম,”তুমি কবে থেকে আবার সমাজ সেবা করছো গো? দোকান চালানোর সাথে সাথে আজকাল এইসব হিতকর কাজও করছো,বেশ ভালো কথা।”
বিভাসদা বললো, “আসলে আমাদের পাড়ার একটা ছেলে জিতেন, পাঁচ বছরের বিবাহিত। তিনদিন আগে স্ত্রী (কেকা)-র সাথে ওর প্রচণ্ড ঝগড়া হয় এবং ওর স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যায়। শুধু তাই নয়,জিতেন এবং কেকা উভয়েই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। জিতেনের শ্বশুর, শাশুড়ী এবং সম্বন্ধী সবাই ওর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সম্বন্ধী তো জিতেনের নামে বধূ নির্যাতনের মামলা করবে বলে হুমকিও দেয়। এদিকে জিতেন ও তার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে অনড়। গত পরশু রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে গ্ৰামের ক্লাবে ঢুকেছিলাম। ক্লাবের ভেতরে কয়েকটা ছেলে ক্রাম খেলছিল।
ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম ক্লাবের উঠোনের এককোণে জিতেন বসে বসে সুরা পান করছে। এ অবস্থাতেও তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। যে ছেলেটাকে আগে কখনো সুরাপান করতে দেখিনি,তাকে এমতাবস্থায় দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি হয়েছে। “
জিতেন এমনিতে মিতভাষী, কিছুক্ষণ পর ও বললো যে ওর পত্নীর সাথে ভীষণ ঝগড়া হয়েছে এবং রাগান্বিত হয়ে ও ওর উপর হাতও উঠিয়েছে। সেই থেকে কেকা বাপের বাড়ি পালিয়ে গেছে।বিভাসদা ওকে ঝেড়ে কাশতে বললো। জিতেন বলতে শুরু করলো, ” কেকার সাথে আমার বিয়ের কিছুদিন পর আমি কলকাতায় চলে আসি। কলকাতায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতাম। কিন্তু কেকা গ্ৰামের বাড়িতে একা একা ভীষণ বোর হয়ে যেত। তাই কিছুদিন পর ওকেও কলকাতায় নিয়ে চলে আসি। এখানে আমরা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। পাশের বাড়ির এক বৌদি খাবার রান্না করে খাবার পাঠিয়ে দিতেন। আমরা দুজনেই উনার রান্নার প্রশংসা না করে পারতাম না।
সকল দশটায় খাওয়া দাওয়া করে আমি চলে যেতাম ডিউটিতে,তারপর ফিরে আসতাম সন্ধেবেলায়। ও সারাদিন একা একাই থাকতো। এতেও ও বোরিং ফিল করতো। কেকা মাধ্যমিক পাশ। তাই ওকে বললাম ও যদি আর পড়াশোনা করতে চায় তবে ওকে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি করবো। ও রাজী হয়ে গেল। সেইমতো ওকে আবার নিয়ে এলাম গ্ৰামের বাড়িতে। পাশের গ্ৰামের একটা হাইস্কুলে ওকে ইলেভেনে ভর্তি করলাম। তারপর আমি কর্মসূত্রে কলকাতায় চলে এলাম। গ্ৰামের বাড়িতে ও আমার বাবা মায়ের সাথে থাকতো। এইভাবে মাসখানেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওর সম্বন্ধে যা শুনতে শুরু করলাম তাতে আমি বেশ টেনশনে পড়ে গেলাম। শুধু তাই নয় কেকার উপর আমার মনে ক্ষোভের আগুন জমা হতে লাগলো। আমি যতটা সম্ভব দ্রুত গ্ৰামের বাড়িতে ফিরে এলাম। বেশ কয়েকজন বন্ধুর মুখে শুনলাম যে কেকা ক্লাসের এক বন্ধুর সাথে পার্কে যায়। এককথায় কেকা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি ওকে বোঝালাম যে বিয়ের পর এসব করা ভদ্র মেয়েদের মানায় না।আমি এসব সহ্য করবো না। “
জিতেনের এসব কথা কেকা মোটেই সহ্য করলো না। শুধু তাই নয় সে বলতে শুরু করলো, “কলকাতায় যে বৌদি তোমাকে খাবার পাঠাতেন তুমি উনার যে সব অশ্লীল চ্যাট করতে তা আমি জানি। তুমি যদি অবৈধভাবে ঐ বৌদির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারো,তবে আমি কেন পারি না। আমি তোমার ফোনে হোয়াটস্ এপ ম্যাসেজ চেক করে এসব জানতে পারি।”
প্রত্যুত্তরে জিতেন বললো, “ও তুমি তাহলে গোয়েন্দাগিরি করতে আমার সাথে কলকাতায় গিয়েছিলে? ঐ বৌদির সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই,জাস্ট টাইমপাস ছাড়া কিছু নয়।”এইসব কথোপকথন হতে হতে এই যুবদম্পতির মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলো। একে অপরকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো। জিতেন
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কেকাকে সজোরে এক চড় লাগিয়ে দিল। অতঃপর জিতেন বললো,”আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েই ছাড়বো।”
কেকা উত্তেজিত হয়ে বললো, “তোমার সাথে কে থাকবে? আমিও ডিভোর্স চাইছি এখনই।”এই বলে কেকা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। এরপর বিভাসদা বললো, “পরদিন ক্লাবে জিতেনকে পরামর্শ দিলাম যে ডিভোর্স হতে বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু তোদের দুজনের ভবিষ্যৎটা কি হবে? তোর মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে? এক কাজ কর, তুই এখনই কেকাকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর যে ওকে নিয়ে আসতে গেলে ও ফিরে আসবে কিনা?”
জিতেন তখনই কেকাকে ফোন করলো এবং কেকাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফিরে আসতে রাজী হয়ে গেল।
বিভাসদা জিতেনকে বুঝিয়ে বললো, “তুই বেশ কিছু ফল মূল,মিষ্টি নিয়ে বিকেলের দিকে শ্বশুরবাড়ি চলে যা। আর হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে রাতে কেকার সাথে একসাথে সময় কাটিয়ে সকালে ফিরে আসবি।”
জিতেন তাই করলো। যদিও জিতেনের সম্বন্ধী তা মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু সকাল হতে না হতেই জিতেন এবং কেকা হাসিমুখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কেকার বাপের বাড়ির লোকজন তো একেবারে অবাক।সকালে বাড়িতে পৌঁছে জিতেই প্রথমেই বিভাসদাকে ফোন করে বলে, ” কি ভাষায় যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো বুঝে উঠতে পারছি না। তুমি আমার বিরাট একটা সমস্যার সমাধান করে বড়ো উপকার করলে। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।”
বিভাসদার মুখে এই সত্য ঘটনাটা শুনে ওকে করজোড়ে নমস্কার করে বললাম ,”সত্যিই তুমি এ সব মামলায় বস।”
বিভাসদা তখনই একজনকে ফোন করে বললো, “উকিল সাহেব গুড মর্নিং, আমি বিভাস। আপনার কাছে পাওয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমি একজনকে ডিভোর্স থেকে বাঁচালাম। আপনি গ্ৰেট,ভালো থাকবেন।”
এরপর বিভাসদা আমায় বললো, “ডিভোর্স আটকানোর এই কৌশলমূলক শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম এই উকিলের কাছে। এক বছর আগে দীঘা গিয়েছিলাম। আমি এবং আমার বন্ধুরা যে হোটেলে ছিলাম ,ঐ উকিল সাহেব সেই হোটেলের এক রুমে ছিলেন। দীঘা থেকে ফিরে আসার দিন সকালে উনার সাথে পরিচয় হয়। উনিই আমাকে বলেন যে এক দম্পতি ডিভোর্সের জন্য উনার কাছে এসেছিলেন। ওদের উনি বুঝিয়ে দীঘা নিয়ে আসেন এবং একরাতের জন্য দুজনকে এক রুমে রাত কাটানোর জন্য অনুরোধ জানান। যদিও উক্ত দম্পতি তাদের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। কিন্তু দীঘায় এক রাত কাটিয়ে সকালে উনারাই উকিল সাহেবকে বলেন যে তাঁরা ডিভোর্স চান না। এখন থেকে একসাথেই থাকবেন। আজকের দিনে এমন সমাজসেবী উকিল পাওয়া বড়ই দুষ্প্রাপ্য!”আমি বিস্মিত চোখে বিভাসদার দিকে তাকিয়ে বললাম ,”তুমিও কোন অংশে কম সমাজসেবী নও।”
আমি হাসতে হাসতে বলললাম,”আমার বা আমার পরিচিত কারও এ ধরনের সমস্যা হলে তোমার শরণাপন্ন হবো।” -
গল্প- রামুকাকুর ফুচকা
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
রামুকাকুর ফুচকা
-অঞ্জনা গোড়িয়াসেদিন যখন রামুকাকুর সাথে দেখা হলো মুখটা কেমন বিষন্ন লাগছিল ।রামুকাকুর সেই বিষন্ন মুখটা বারবার চোখে ভেসে উঠছে মুনিয়ার।
থমথমে সে চোখের দৃষ্টিতে একটা কষ্ট লুকিয়ে ছিল।যা মুনিয়ার চোখকে এড়াতে পারে নি ।
মুনিয়া মুখ ফুটে জানতে চেয়েছিল। কি হয়েছে কাকু? আজ এমন মন খারাপ?কথাটা না শোনার ভান করে বলেছিল, “আর দুটো বেশি করে ফুচকা বানিয়ে দিই মুনিয়া। পয়সা দিতে হবে না। আমি খুশি করে খাওয়াচ্ছি।
কি যে বলো কাকু। পয়সা না দিয়ে খাবো কেন? কত কষ্ট করে বানিয়েছ। যা দাম তাই দেব।বলো না কাকু কি হয়েছে?
কিছু হয় নি খুকি। তোকে দেখে আমার মেয়েটার কথা বড্ড মনে পড়ছে।
আমার মেয়েটা ঠিক তোমার মতো। কথায় কথায় শাসন করে আমাকে।
বলে কি জানিস , “দিন রাত এত খাটতে হবে না বাবা”
বয়স হচ্ছে তোমার। কিছু হলে,কে দেখবে আমাদের”?
পাগলি মেয়ে একটা। আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা।
আমার মেয়েটার খুব ইচ্ছে বড় হয়ে দিদিমনি হবে। তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
মুনিয়া বলেছিল বাহ তোমার মেয়ে তো গুনী মেয়ে। দেখবে খুব বড়ো হবে।
আর কী বলে জানিস, বলে আমার খুব নাম হবে। জশ হবে। সবাই বলবে ফুচকাওয়ালার মেয়ে দেখো দিদিমনি হয়েছে। গর্বে বুক ভরে যাবে।
তাই না মুনিয়া?
শুধু মাঝে মাঝে কেন যে এমন শরীর খারাপ করে মেয়েটার? তখনই কেমন ঝিমিয়ে যায়।
ও, তাই বুঝি তোমার মন খারাপ। ডাক্তার দেখিওছো কাকু?
চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে নিশ্চয় দিদিমনি হবে।
তুমি এত ভালো। তোমার মেয়ে আরও ভালো।
এক দিন আলাপ করবো কাকু। নিয়ে আসবে তোমার মেয়েকে।
রামু চাচু মুচকি হেসে বলল, ঠিক আছে মুনিয়া, পরের দিন মাকে বলে রেখো। আমার বাড়ি তোকে নিয়ে যাবো।
আমার মেয়ে তো আসতে পারবে না।
ওর খুব শরীর খারাপ।
তুই যাবে তো মুনিয়া?
সেদিনের পর আর যাওয়া হয় নি। আর আসতে ও পারে নি রামুকাকু । শুরু হলো লকডাউন।
রামু কাকুর কথাগুলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড্ড মনে পড়ছে।
মুনিয়ার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন বাড়িতে থাকে।প্রতিদিন মুনিয়াদের বাড়ির সামনে রামু কাকু ফুচকা নিয়ে আসত। মুনিয়া পাড়ার সবার সাথে তৃপ্তি করে খেত ফুচকা। রামু কাকুর হাতে নাকি জাদু আছে। আর অন্য কারোর বানানো ফুচকা ওর ভালো ই লাগে না। যেমন মুচমুচে খাসা তেমন ই সুস্বাদু।
সঙ্গে থাকে আলু-কাবলি, চানা মশলা। কত নামডাক রামুকাকুর।
আসলে রামুকাকুর ব্যবহার সবাই কে মুগ্ধ করত। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলে,তবে ই ফিরে যেত বাড়ির দিকে।সেই স্কুল জীবন থেকে মুনিয়া রামুকাকুর বানানো ফুচকা খায়। কত হাসি খুশি মেজাজ। সবার প্রিয় ফুচকাওয়ালা। শেষের ফুচকা টা রামু কাকু স্পেশাল করে বানিয়ে দিত।অনেক রকম মশলা দিয়ে।
একদিন যদি না আসে, মুনিয়ার সে কি অভিমান। পরের দিন এলে ই প্রশ্ন, কি ব্যাপার কাকু।কাল যে এলে না? কখন থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তবু তুমি এলে না। কেন শুনি?
রামুকাকু হাসতে হাসতে বলত,পাগলি মেয়ে একটা। আমার বুঝি শরীর খারাপ করতে পারে না? যদি আর আসতে না পারি, তখন কি করবে মুনিয়া ? কে বলতে পারে,কাল আর যদি না থাকি।
কথা গুলো শুনে ই মুনিয়া চেঁচিয়ে উঠে বলে ছিল, খবরদ্দার কাকু,এসব কথা আমার সামনে বলবে না। তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি না এলে ফুচকা খাবো কি করে? রোজ আসতে হবে। বুঝলে।তারপর ই লকডাউন। কতদিন থেকে মুনিয়া ছটপট করছে রামুকাকুর ফুচকার জন্য। রামুকাকুর জন্য।
রামুকাকুর মেয়েটা কেমন আছে? তাও জানা হলো না।
কাকুর হাসি মুখখানি ম্লান হয়ে গিয়েছিল কেন?খুব জানতে ইচ্ছে করছে । কেমন আছে এই লকডাউনে?
প্রায় এক মাস হয়ে গেল। রামুকাকু আসে না আর ফুচকা নিয়ে।
এক দিন মুনিয়া খাতা কিনতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল । অবশ্য মুখে ছিল মাস্ক।খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেল রামুকাকুর বাড়ি।
এক কামরা আধা মাটি আধা ইটের ঘর। রামুকাকু বলে হাঁক দিল। কেউ সাড়া দিল না। ফাঁকা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একজন । তাকে জিজ্ঞাস্য করল,রামুকাকু কোথায়? এটা ই রামুকাকুর বাড়ি তো?
ভদ্রলোক বললো, রামুর মেয়েটা আর বেঁচে নেই। মেয়েটা থেলাসেমিয়া রোগী। তিন মাস অন্তর রক্ত দিতে হতো।অনেক কষ্টে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল এত দিন।
লকডাউনে ফুচকা বিক্রি বন্ধ। সময় মতো রক্ত দিতে পারে নি। রক্তের সংকট দেখা দিল। দেরী হয়ে যাওয়ায় আর বাঁচানো যায় নি মেয়েকে।
মৃতদেহ গ্রামের আনলে কেউ দেখতে পর্যন্ত আসে নি। ছোঁয়াচে রোগটার ভয়ে। অনেক কষ্টে গ্রামের কয়েক জনকে নিয়ে পাড়ার শ্বশানে ই নিজের মেয়ের মুখাগ্নি করেছে।তারপর আর বাড়ি আসে নি রামু। কেউ জানি না রামু কোথায় এখন?বাকরুদ্ধ মুনিয়া। রামু কাকুর স্বপ্ন টা চিতার আগুনে ই শেষ।
মুনিয়া চোখ ভরা জল নিয়ে ফিরে এল বাড়ি।
লকডাউন শেষ। শুরু হয়েছে বাজার হাট। যদিও খুব সাবধানে। আবার বিক্রি হচ্ছে সব কিছু। পাড়ায় পাড়ায় আসছে ফেরিওয়ালা,সব্জিওয়ালা।আসছে ফুচকাওয়ালা।
তবু আর ইচ্ছে করে না ফুচকা খেতে। রামুকাকু আসে না। বারবার রামুকাকুর সেই মুখটা ভেসে আসে।হঠাৎ একদিন চেনা সেই হাঁক।
রামুকাকুর গলায়। ফুচকা খাবে মুনিয়া। আমি এসে গেছি। ডাক শুনে,ছুটে বেরিয়ে এল মুনিয়া। রামুকাকু ফুচকা নিয়ে হাজির।মুনিয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।কেমন আছো মুনিয়া? কত দিন দেখিনি তোমায়?
যত খুশি ফুচকা খাও,আজ আর তাড়া নেই বাড়ি ফেরার।
মুনিয়া বেটি মন দিয়ে পড়া কর। তোমায় দিদিমনি হতে হবে। আমি যেখানে ই থাকি ঠিক তোমার খবর রাখব। কেমন। আবার আসব ফুচকা নিয়ে।
মুনিয়া চুপ করে শোনে। কি বলবে। জানে না। চোখ ভরা জল নিয়ে মিলিয়ে গেল কাকু।সকালে ঘুম ভাঙতেই রাস্তায় মোড়ে একটা গুঞ্জন শুনতে পেল। আহারে এত ভালো লোক টার এই পরিণতি হলো।
সবাই গোল হয়ে শুনছে সেই মারাত্মক খবর। রামুফুচকাওয়ালা আর নেই। কাল রাতে ই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছে। মেয়ে মারা যাওয়ার পর পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতো এখানে সেখানে। মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
মুনিয়া কিছু তেই মানতে পারল না। চিৎকার করে ওঠে। রামুকাকু বেঁচে আছে।নিশ্চয় ফিরে আসবে ফুচকা খাওয়াতে। রামুকাকুর সাথে দেখা হবে আবার। -
কবিতা- মেয়েদের মন
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
মেয়েদের মন
– সঞ্জিত মণ্ডলমেয়েদের কতো জ্বালা আছে সেটা জানো-
ঘর- সংসার সামলানো বড়ো দায়,
স্বামী ছেলে মেয়ে শাশুড়ি ননদী আছে-
আয়ান ঘোষরা কম জ্বালাতুনে নয়।
সংসার তাকে টেনে রাখে চারিদিকে –
ঘুমাতে গেলেও বাঁশি যেন কে বাজায়,
নিদ্রা দেবীও মোটেই সদয় নয়-
বাঁশি কানে এলে কি করে ঘুমাবে বলো।মনের খোরাক তারও তো একটু চাই-
পুরানো স্মৃতিরা হারানো গল্প খোঁজে,
ইস্কুল আর কলেজের যত স্মৃতি –
গোলাপ ফুলের সৌরভ দিয়ে যায়।
ভালোবাসি কেউ কানে কানে বলেছিলো-
সে মধুর স্মৃতি আজও ব্যথা হয়ে ঝরে,
ভরা সংসারে স্বামী ও স্বজন আছে-
রিণরিণে ব্যথা হৃদয়ে হুল ফোটায়।এখনও কি আসে মনের দুয়ারে কেউ –
কপাট বন্ধ করে দেয় কতো নারী,
তবু যদি কেউ এসে কড়া নাড়া দেয়-
বসন্ত বায়ে কেঁপে যায় তার হৃদয়।
লজ্জা ও প্রেম জড়াজড়ি করে থাকে-
ক্লান্ত মনেতে ঝলক দখিনা বায়,
ইচ্ছেগুলো কে ধরে কে রাখতে পারে-
এমনি করেই প্রেম ভালোবাসা হয়।বিকেলে ভোরের ফুল ফুটে গেলে পরে-
অনিশ্চয়তা পদে পদে বাধা দেয়,
আশ্রয় টা যে পাখির বাসার মতো –
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়।
সমাজের ভয়, ভবিষ্যতের ও ভয়-
কুলটা বলবে শ্রী রাধাকে বলে কেহ,
কৃষ্ণ কালা যে কদম তলায় থাকে-
যখন তখন বাঁশি টা বাজায় প্রিয়।। -
গল্প- শাশুড়ির মৃত্যুর পর
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
শাশুড়ির মৃত্যুর পর
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীচুড়ির রিনিরিনি সেই শব্দটা বারবার কেন শুনতে পাই আমি? নিঃশব্দে শাশুড়ি অমলা বালার ছবির সামনে কাঁদতে কাঁদতে কথা টা বলে চলেছে অনুশ্রী।
আজ তার শাশুড়ির বাৎসরিক শ্রাদ্ধ শান্তির ক্রিয়া কর্ম।অমলা বালার আকস্মিক মৃত্যু টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অনুশ্রী।
তার শাশুড়ি মাতা রোজ ভোর বেলায় উঠে বাগানে ফুল তোলা টা সেরে ফেলতো। তারপর বৃদ্ধা তাদের কুলমন্দির গিয়ে মন্দির চত্বরে জল ছিটানো, গোবরের ছড়া দেওয়া, মন্দিরের ভিতরের লাল মেছে টা জল দিয়ে শুকনো করে মুছে দেওয়া, নিত্য পূজার কাঁসার বাসন গুলো তেঁতুল দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করা এইসব কাজ করতো।
তার এই রুটিনের কোনোদিন অন্যথা দেখেনি এই পনেরো বছরে অনুশ্রী।মন্দিরের পর্ব সেরে এসে অমলা বালা নিজের বাড়ির পূজার ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ধুনো জ্বালাতো। তারপর গোটা বাড়ির উপর নিচে ঘুড়ে ঘুড়ে ধুনো দেখাতো।আর তখন অমলা বালার চুড়ির রিনিরিনি শব্দ টা বেশ কানে আসতো অনুশ্রীর।
অমলা বালার হাতে থাকতো মোটামোটা শাঁখা পলা আর চার গাছা চার গাছা করে মোট আটা গাছা চুড়ি। আওয়াজ টা তাই মন্দ হতো না।অনুশ্রী তাড়াতাড়ি করে গায়ের চাদরটা দিয়ে কানটা বন্ধ করার চেষ্টা করতো।আর অমলা বালা ছেলে অরুনের তো কোনো অসুবিধা হতো না চুড়ির রিনিরিনি শব্দে।কারণ ছোট থেকেই তার কান দুটো ভোরবেলায় এই আওয়াজ শুনতে অভ্যস্ত।
ধুনো দেখানোর পর্ব সারা হলে অমলা বালা অনুশ্রীর ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে বৌমা কে ঘুম থেকে ওঠাতো।
যদিও অমলা বালার মেয়ে ছবি বহুবার তাকে বারন করেছে এই কান্ড কারখানা টা না করতে।
তখন অমলা বালা হেসে মেয়েকে উত্তর দিতো, দেখ ছবি তুই অফিস যাস না কিন্তু বৌমা তো অফিসে যায়। নটার মধ্যে ঘর থেকে না বেরোলে কি করে অফিস পৌঁছাবে দশটায়।
ছবি তখন মুখ বেঁকিয়ে বলতো যার অফিস তার হুশ নেই ।মহারানী বেলা সাতটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে নিদ্রা সারবেন আর তুমি তার জন্য চিন্তা করে মরবে!
_কি করবি বল দেখছিস তো এতগুলো বছর হয়ে গেল তবু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারল না। তবে সকালে ঘুম থেকে ওঠে না ঠিকই কিন্তু রাতে তো সবার শেষে ঘুমাতে যায় বৌমা।
আর অফিস যাওয়ার সময় আমি তো সেদ্ধ ভাত ছাড়া কিছুই রেঁধে দিতে পারি না। সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠেই বৌমা হাঁকুপাঁকু করে মেয়েকে স্কুলে পাঠাবার জন্য। আর রিম্পাকে তো চিনিস ।সে তো আরো ঘুমকাতুরে। আটটার মধ্যে মেয়েকে স্কুল ভ্যানে তুলে তারপর বৌমা কোনরকমে একটু লেবু দিয়ে লিকার চা দুটো বিস্কুট খেয়ে ছোটে স্নানঘরে। তুই বল কখন সে রাঁধবে?
আমি তো বাপু বেশ শক্ত পোক্ত আছি এখনো। তাই ভাতে ভাতটা বসিয়ে দিই। তা বলে যে বৌমা রান্না করতে জানেনা একথা তার চরম শত্রু কেউ বলতে পারবে না। বৌমার হাতের বিরিয়ানী, চিকেন চাপ, ডিমের চপ ওই যে কি বলিস ফিশ বল সেইসব তো তুমিও চেটেপুটে খাও মা।
থাক থাক আর করো না মা তোমার বৌমার রান্নার সুখ্যাতি। অরন্ধন এর সময় দু চারটে লোক বলতেও তোমরা আর পারো না আজকাল। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই কত ভালোবাসতো আমাদের বাড়ির অরন্ধন এ আসতে। সে সবে উঠেই গেছে তোমার বৌমা আসার পর থেকে।
শাশুড়ির পালন করা নিয়ম আচার-অনুষ্ঠান এইসব বৌমারাই আগে নিয়ে যায়। দেখো না আমাকে শাশুড়ীর পালন করা বার ,ব্রত, আচার অনুষ্ঠান এখন আমিই করি সব।
অমলা বালা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলতো, খুব ভালো করো মা। সংসারটা সংসারের মতই করা উচিত। বৌমা তো আর শুধু সংসার করে নাও তাকে অফিস টাও করতে হয়। তাই তাকে আমি কোনদিন জোর করে তার ওপর সংসারের নিয়ম, রীতিনীতি কিছু চাপিয়ে দিইনি।
এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনুশ্রীকে কাঁদতে দেখে ছবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার স্বর্গীয় মায়ের এইসব কথা মনে করছিল।
এবার সে একটু বিরক্ত হয়েই অনুশ্রী কে আওয়াজ দিল, অনেক হয়েছে কান্নাকাটি। জ্যান্ত থাকতে তো আর মানুষটার সেবা যত্ন করলে না। কোন ভোর থেকে উঠে বৃদ্ধ বয়সেও সংসারের হাল মা ধরেছিল এতদিন। এবার টের পাবে। কে তোমাকে অফিস যাওয়ার আগে মুখের সামনে ভাতের থালা তুলে দেয় এবার দেখবো?
অনুশ্রী তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বলে, সত্যি ছবি আমার জীবনের চরম ক্ষতি হয়ে গেছে এখন বেশ বুঝতে পারছি।
_ এখন আর বুঝে কি হবে বৌদি? মায়ের শরীরটা নিশ্চয়ই ভিতরে ভিতরে তখন খারাপ ছিল। সঠিক সময়ে ডাক্তার দেখালে হয়তো এইভাবে মা চলে যেত না একবছর আগে।
_কিন্তু ডাক্তার তো বলছে মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এটা তো আগে থেকে টের পাওয়া যায় না তেমন ছবি।
ছবি ঠেস মেরে বলে, দেখো আমি বাপু তোমার মতো এত অফিস কাছারি করি না, তোমার মতো বাইরে বাইরে ঘুরি না, আমি বাপু ঘরেই থাকি তাই আমার জ্ঞান তোমার থেকে আশাকরি কম হবে। তবু এটা জানি নিশ্চয়ই মায়ের বুকে কষ্ট হচ্ছিল কদিন আগে থেকেই।
ওদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে অনুশ্রীর মেয়ে রিম্পা এসে জানায় পুরোহিত ঠাকুর এসে গেছে। বারোটা বাজলেই কিন্তু শ্রাদ্ধ তে বসবেন উনি।
শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সারতে সারতে বেলা প্রায় তিনটে। মোটামুটি নির্বিঘ্নে অমলা বালা বাৎসরিক শ্রাদ্ধশান্তির সমস্ত ক্রিয়াকর্ম নিয়ম মেনে আচার মেনে সুসম্পন্ন করল তার ছেলে ও বৌমা।
শ্রাদ্ধশান্তি কাজ মিটে যাওয়ার পর ছবি শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় তার দাদার দুখানা হাত ধরে বলে, তোরা মাঝে মাঝে আমার শ্বশুর বাড়ি যাস দাদা। বৌদির তো অফিস আছে। আমার হয়তো সেরকম করে আর বাপের বাড়ি এসে থাকা চলবে না কথাটা পুরো শেষ না করেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো ছবি।
পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুশ্রী তার ননদের ব্যথা যন্ত্রণা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিল। সে বলে, কেন ছবি তোমার বাপের বাড়ি আসা কেন চলবে না? আমি নাইবা থাকলাম ঘরে সকালের দিকটায়, সন্ধ্যার পর থেকে তো ঘরেই থাকবো। তখন তোমার আর কোন অসুবিধা হবে না।
ছবি এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, দেখো বৌদি বাপের বাড়ি এসেও আমি হাত পুড়িয়ে খেতে পারব না। তোমার যেদিন ছুটিছাটা থাকবে সেদিন বল এক বেলার জন্য আসবো আনন্দ করবো তারপর চলে যাব। শ্বশুর বাড়িতেও খাটাখাটনি বাপের বাড়িতে ও খাটাখাটনি এতো আমি পারবো না বৌদি।
অনুশ্রী আর কথা না বাড়িয়ে ননদকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসে।
সন্ধ্যের দিকে অরুণ যে বৃদ্ধা মহিলাকে তাদের কুল মন্দিরের কাজকর্ম করার জন্য রেখেছিল সেই মহিলাটি আসে। তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল অনুশ্রী।সে এলে তার হাতে নতুন দুখানা শাড়ি আর হাজার টাকা দিয়ে অনুশ্রী বলে, আমাদের কালাশৌচ শেষ হয়ে গেল।আর তোমাকে কুল মন্দিরের কাজকর্ম করতে হবে না।
পাশেই ছিল অরুন।সে লাফিয়ে উঠে বলে, সেকি বন্ধ কেন করছো? এ আমাদের কুল মন্দির।দুই জেঠু বাইরে থাকে তাই সারা বছর আমাদের পালা থাকে। আর আমরা না পালন করলে এত দিনের মন্দির রক্ষা পাবে কি করে?
অনুশ্রী মৃদু হেসে বলে, চিন্তা করো না তোমাদের মন্দিরের কাজকর্ম বন্ধ হবে না আমি বেঁচে থাকতে। এবার থেকে মন্দিরের কাজকর্ম আমরা করবো।
_ সে কি করে সম্ভব!
_ সকালের নিত্য পূজার সমস্ত জোগাড় করেই আমি অফিস যাবো।আর সন্ধ্যা টা রিম্পা দেখিয়ে দেবে। আমাদের মন্দির যখন তার দায় ভার ও আমাদের।
আর এবার থেকে মা যে আচার অনুষ্ঠান গুলো করতেন তা আমি ও করবো।সামনেই তো ভাদ্র মাসের মনসা পূজা।আর আমাদের অরন্ধনের দিন।তাই আমি এইসময় দুটো দিন অফিস থেকে ছুটি নেবো।ছবির শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের এবার নেমন্ত্রন করবো।
রিম্পা আর অরুন একসাথে বলে ওঠে , তুমি একা হাতে পারবে এসব?
অনুশ্রী হেসে বলে,একা কোথায়! তোমরা তো থাকছো আমার সাথে। তুমি কিন্তু একটা দিন অফিস থেকে ছুটি নিও প্লিজ।
রিম্পা বলে ওঠে, আমার কিন্তু স্কুল থাকবে।
আমি কামাই করবো না।অনুশ্রী ধমকের সুরে বলে, একদিন স্কুল কামাই করলে তেমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
বাৎসরিক শ্রাদ্ধ শান্তির পর্ব মিটে গেল মানে এই নয় যে ঠাকুমা ফ্রেম বন্দী হয়ে গেল।তুই তো ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসিস তাই না।তাই আমাদের উচিত আমরা যাকে ভালোবাসি তার চিন্তা ধারা, তার কর্ম জীবন এই গুলোকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা। তবেই তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।এই একটা বছর ধরে অনুশ্রী কানে চুড়ির রিনিরিনি যে শব্দটা শুনতে পেতো তা আজকাল আরো তীব্র শোনায় যখন সে কুল মন্দিরের কাজকর্ম করে, বাড়িতে ধুনো দেখায় তখন। চুড়ির রিনিরিনি শব্দটা শুনতে পেলে আগে সে ভয় পেত কিন্তু এখন সে আর ভয় পায় না। বরং বেশ সাহস পায় তে তার শাশুড়ি সবার অলক্ষ্যে সমস্ত সাংসারিক কর্মের সঙ্গে আছে।
-
গল্প- পূর্বরাগ
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প।।
পূর্বরাগ
-শচীদুলাল পালগঙ্গা তীরবর্তী চন্দননগর শহরে এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্তশালী পরিবারের দেবেশবাবু তার ছেলে অরিত্র ও মেয়ে রুমিকে নিয়ে থাকেন।কলকাতায় সরকারি অফিসের কর্মচারী। স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। মেয়ের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মেয়েকে সম্পুর্ণ ভাবে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।ছেলে ক্লাস এইটের ছাত্র। একদিন দেবেশ বাবু বললেন ” দেখ মা রুমি! তোর মা গত হবার পর সংসারের হাল তোকে ধরতে হয়েছে। রান্না বান্না ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ তোকেই করতে হয়। তার মাঝে তোর ভাই অরিত্রর পড়াশোনায় সাহায্য করিস। তোর প্রতি অনেক অবিচার হচ্ছে।
রুমি — অবিচার আবার কি? এটা তো আমার কর্তব্য।
— তাছাড়া অরিত্র এখন অনেক উঁচু ক্লাসে। ওর জন্য একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যবস্থা করেছি।
অরিত্র– না বাবা। দিদি বেশ ভালোই পড়াই।
— জানি। দিদি পড়াশোনায় ভালো। মা মারা যাবার পর সব ওলোট পালট হয়ে গেলো। তোর দিদির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল।
তোর পড়াশোনা বন্ধ যাতে না হয়, ভালো রেজাল্ট করতে পারিস সেজন্যেই একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যবস্থা করেছি। দু একদিনের মধ্যে এসে যাবে। ব্রিলিয়ান্ট স্কলার ছেলে। নাম প্রিয়াংশু।
রুমি — ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর।
দেবেশ — লোকালের সময় হয়ে এলো এখন অফিসে চলি।
কিছুক্ষণ পর অরিত্রও স্কুলে চলে গেলো। রুমি রান্নাবান্না ঘর সংসারের কাজে ব্যস্ত হলো।
×××××××××××_
বিকেল বেলা।
রুমি একটা কিছু পড়ছিলো।হঠাৎ
কলিং বেলের আওয়াজ।
রুমি বই ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিয়ে দেখলো সামনে এক এক সৌম্যকান্তি যুবক।
যুবকটি একদৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
এভাবে কতক্ষন তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই।
হঠাৎ বাড়ির বাগানের এক পাখির শিশের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যুবকটি বলল—- আমি প্রিয়াংশু। এটি কি দেবেশ বাবুর বাড়ি?
— হ্যাঁ। দেবেশবাবু আমার বাবা। কিন্তু উনি তো এখন বাড়িতে নেই। অফিস থেকে এখনো আসেননি। ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যাবে।
— ও।তাহলে আজ আসি।
— কিছু দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন।
— ক্লাস এইটের একটা ছেলেকে টিউশন পড়ার কথা বলেছিলেন।
— ও আচ্ছা! স্টুডেন্ট আমার ভাই অরিত্র। আপনি ভেতরে আসুন। ভাই এখনি এসে যাবে।
প্রিয়াংশু আড়ষ্ট বোধ করলেও কেমন যেন এক অদৃশ্য টানে ভিতরে প্রবেশ করল।
রুমি যুবককে সোফায় বসতে বলল — আপনি বসুন। আমি চা করে নিয়ে আসি।
প্রিয়াংশু মেয়েটির চলে যাবার মরাল গতির সুন্দর ছন্দের দিকে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ হলো।
কি সুন্দর গোছানো পরিপাটি আসবাবপত্রে সজ্জিত ড্রয়িং রুম।
কিছুক্ষন পর রুমি এক কাপ চা ও তার সাথে প্লেট ভরতি জলখাবার এনে সামনে দাঁড়ালো।
বাইরে খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আলো অষ্টাদশী রুমির আপাদমস্তক দেহে ঠিকরে পড়ছে। ফর্সা গালে বিকেলের লাল আভায় রুমিকে মনে হচ্ছে যেন কোনো দেবী প্রতিমা।
যতই দেখছে তত যেন তার আকাঙ্খা আর মিটছে না।
অন্য কেউ হলে রুমি ঘরে ঢুকতে দিত না, বা দিলেও চায়ের প্লেট টেবিলে রেখে চলে যেতো।কিন্তু তারও কেমন যেন ভাল লেগে গেছে যুবকটিকে। অপরূপ, উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।
রুমি বলল — কি শুধু তাকিয়েই থাকবেন নাকি প্লেটটা ধরবেন?
প্রিয়াংশু লজ্জিত হয়ে বলল – সরি।
প্লেট টি হাতে নিয়ে ভাবলো। এর আগে সে তো অনেক মেয়ে দেখেছে। কিন্তু এরকম এক অনুভুতি তার কখনো আসেনি। নিজেকে আজ তার কেমন অপরাধী বোধ হতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর অরিত্র এসে গেলো।
— এই আমার ভাই, অরিত্র। আপনার ছাত্র।
অরিত্র তুই যা,তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আয়। আজ থেকেই উনি তোকে পড়াবেন। তোর মাষ্টার মশাই।
ঘন্টাদুয়েক পড়ানোর মাঝে রুমি আরেকবার চা দিয়ে চলে গেছে।
প্রিয়াংশু অরিত্রকে বললো, তোমার দিদিকে ডাকো। আমি এবার আসি। দিদি দরজার আড়ালেই ছিল। এগিয়ে এসে বলল—অরিত্র! স্যারকে প্রণাম কর।
প্রিয়াংশুকে অরিত্র প্রণাম করতেই বলল — আমি তোমাকে তোমার স্কুলের সেরা ছেলেদের মধ্যে একজনে পরিনত করব। তুমি কিন্তু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে যাবে।
আজ চলি।প্রিয়াংশু যতক্ষন না দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো রুমি অপলকে তাকিয়ে রইল।
তার হৃদয় তন্ত্রীতে এক অভূতপূর্ব সুরের ঝংকার ধ্বনিত হতে লাগলো।
প্রাইভেট টিউটার প্রিয়াংশু নিয়মিত আসতে লাগলো। পড়াশোনায় অনেক অনেক উন্নতি হলো অরিত্রর।
দেবেশ বাবু রেজাল্ট দেখে খুব খুশি।
রোজ নিয়মিত চা জলখাবার এগিয়ে দিত রুমি। মাঝেমধ্যে দুচার কথা। একদিন পড়ানো শেষে রুমি বলল আজ আপনি খেয়ে যাবেন।
— এইতো প্রতিদিন জলখাবার খাওয়াচ্ছ আবার কি!
— আজ আপনার জন্য কিছু স্পেশাল রান্না করেছি। আপনাকে খেতেই হবে।
— আচ্ছা।
রুমির হাতের রান্নার খাবার খেতে খেতে অভিভূত হয়ে
— বা! কি চমৎকার রান্না। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো।
— আপনার মা! আপনার বাড়িতে আর কে কে আছে?
— আমার মা ছিল। অনেকদিন আগেই দেহ রেখেছেন।
— আর কে কে আছেন।
— আমার মা বাবা ভাই বউ কেউ নাই। আমি শুধু একা থাকি।
— আর খাওয়া দাওয়া?
— দূরে একটা মেস কাম হোম ডেলিভারি আছে। সেখানেই খায়।
— আপনি বলবেন, যেদিন অসুবিধা হবে আমার কাছে খেয়ে যাবেন।
— খেতে পারি একটা শর্তে।
— শর্ত আবার কি?
— আমাকে আপনি বলা চলবেনা। আমাকে তুমি বলতে হবে।
রুমি মনে মনে ভাবলো এটাতো আমারও মনের কথা। মিষ্টি হেসে বলল
—- ঠিক আছে। আমাকেও আপনি বলা চলবেনা। তুমি বলতে হবে।
বাহ্। দুজনের হৃদয় তন্ত্রীতে এক সেতারের সুর ঝংকারিত হলো।
এভাবে তারা দুজনে দুজনের মনের কাছাকাছি পৌঁছাতে লাগলো। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিনত হলো। একদিন না দেখলে রুমির মন উদাস হয়ে যেতো।সব কিছু যেন বিবর্ণ মনে হতো। একেই কি ভালোবাসা বলে। তাই ভালোবাসার টানে, ছুটির দিনে সকালে দুপুরে রাতে সময়ে অসময়ে প্রিয়াংশু ছুটে আসতো রুমির কাছে।
একবার হঠাৎ দিনকয়েক প্রিয়াংশুর দেখা নেই। সে আর পড়াতেও আসেনা। প্রতিদিন প্রতীক্ষায় দিন কাটে।সে কেন আসছে না? নানান অশুভ চিন্তা তাকে গ্রাস করলো।
একদিন বাবার সামনে
বলল– বাবা তুমি কি প্রিয়াংশু দার বাড়ির ঠিকানা জানো?
একবার খোঁজ নিয়ে দেখো কেন সে আসে না।
—– আমি সেসব পারবোনা।
— তাহলে আমাকেই ঠিকানাটা দাও আমি অরিত্রকে পাঠিয়ে খোঁজ নেব।
ওর একটা বায়োডাটা দিয়ে বলল
— এই নে। সযত্নে রাখবি।
বায়োডাটা দেখে রুমির চোখ চড়কগাছ। ওরে বাপরে! এতো অনেক ইন্টেলিজেন্ট ছেলে। এম টেক ইন কম্পিউটার সাইন্স।প্লাস আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি র মতো অত্যাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এছাড়া আই টি’র অনেক প্রফেশনাল কোর্স করেছে।
এতো ভালো ছেলে অরিত্রকে পড়াতে আসতো। আমারতো বিশ্বাস হচ্ছে না।
— ছেলেটা আমাদের পাড়াতেই এক পুরানো বাড়ি কিনে এসেছে। কাছাকাছি টিউশানি চাইছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা ওকে আমাদের বাড়ির টিউটার হিসেবে পেয়েছি।
রুমি মনে মনে ভাবলো সে একাই যাবে প্রিয়াংশুর খোঁজে আজই।
ডিনার শেষে বাবা ও অরিত্র যখন ঘুমিয়ে পড়ল, রুমি বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে এলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টিপ টিপ বৃষ্টিও পড়ছে। রুমি ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টি বাড়তে বাড়তে মুষলধারে পড়তে লাগলো। বায়োডাটায় উল্লেখিত বাড়ির ঠিকানায় সঠিক স্থানে পৌঁছালো।
দরজায় কলিং বেল টিপতেই প্রিয়াংশু দরজা খুলে দেখলো সামনে রুমি দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
— কি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ভেতরে আসতে বলবে?
এবার প্রিয়াংশু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো — এত রাতে তুমি! আমি তো বিশ্বাস করতে পারছিনা। এসো রুমি। ঘরে এসো। একি তুমি এক্কেবারে সম্পুর্ণ ভিজে গেছো।
— তুমি কোথায় ছিলে? কেন যাওনি আমার কাছে? আমাকে কেন ভুলে গেলে? তোমার কি হয়েছিলো?…..
রুমি হাজার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলো।
আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ভিনরাজ্যে গিয়েছিলাম।
তাছাড়া তোমার বাড়িতে যাওয়াটা পাড়ার লোকেদের পচ্ছন্দ নয়।অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে।
— কেউ কিছু বলেছে।
— হ্যাঁ নানান চর্চা। বিভিন্ন ঠেকে বিভিন্ন ভাবে।
— তুমি তো খুব বীর পুরুষ। লোকে কিছু বলবে বলে তুমি আমাকেই ছেড়ে দেবে। আমিতো তোমাকেই ভালোবাসি।
রুমি এগিয়ে গিয়ে সিক্ত বসনে প্রিয়াংশুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না প্রিয়াংশুদা। প্রথম নারী স্পর্শ লাভে প্রিয়াংশু শিহরিত হলো।
— তুমি তো অনেক ভিজে গেছো। দাঁড়াও তোমাকে একটা শুকনো কাপড় এনে দিই। প্রিয়াংশু কিছু না পেয়ে একটা শুকনো বিছানার চাদর এনে দিয়ে বললো
— এই নাও এটা নিয়ে ওই ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড় গুলি চেঞ্জ করে এসো।
— না। আমি কোথাও যাবনা। তুমি আমারই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমারই।
রুমি একে একে সব ভিজা কাপড় প্রিয়াংশুর সামনে খুলে ফেলতে লাগলো।
প্রিয়াংশু অষ্টাদশী সুন্দরী ফর্সা রমনীয় রুমির রূপ লাবণ্যে মোহিত হলো। রুমির ঘনকালো মেঘের মতো কেশদাম,টিকলো নাক, পানপাতার মতো মুখ, বিম্ব ফলের মতো ওষ্ঠ, থরথর কম্পিত অধরপ্রান্ত, গুরু নিতম্ব,পীন পয়োধর বিভাজিকা, ক্ষীণ কটিদেশ, ত্বন্বী রুমির সুডৌল জঙ্ঘা অবলোকন করতে বাধ্য হলো। পুলকিত হলো। রোমাঞ্চিত হলো। আবেগ অনুভূতিতে দিগবিদিক জ্ঞান শুন্য হলো। হঠাৎ কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। রুমি ভয়ে উত্তেজনায় প্রিয়াংশুকে জড়িয়ে ধরল। বাইরে প্রকৃতি উত্তাল।প্রবল শব্দে ঝড় জল। শন শন আওয়াজে মুষলধারে বৃষ্টি।ভিতরে তাদের দুজনেরই মহাপ্রলয় ঘটে গেলো। প্রকৃতির নিয়মে তারা আরও ঘনিষ্ট
হলো।
রাতভর প্রবল বর্ষণ।তাদের এই মিলন ঈশ্বরের দান মনে করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সমর্পণ করল।সাক্ষী রইলো উত্তাল প্রকৃতি।
রাত শেষ হলো। ঘড়িতে চারটা বাজে। রুমি ধীর পায়ে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।ঘরে এসে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে পোশাক পরিবর্তন করে নিজের রুমের বিছানায় শুয়ে পড়লো। কাক পক্ষীটি টের পেলনা তার অভিসারের কথা। তার প্রস্ফুটিত নব যৌবনের জলতরঙ্গের সুমধুর সুর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
এরপর থেকে প্রিয়াংশু যখন খুশি আসতে লাগলো।একদিন দেবেশ বাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। সেসময় পাড়ার মাতব্বর ও ক্লাবের ছেলেরা বলল
—দেবেশ বাবু!এটা সম্ভ্রান্ত পাড়া। সবাই শিক্ষিত ও আভিজাত্যপূর্ণ। আপনার মেয়ের বেল্লেনাপনায় আমরা অতীষ্ট। টিউশনি টীচারটি যখন তখন আপনার ঘরে আসে। আপনি ওদের মেলামেশা বন্ধ করুন।
দেবেশ বাবু ঘাড় নেড়ে সহমত ব্যক্ত করল।দেবেশবাবু ঘরে এসে রুমিকে শাসন করতে করতে বলল— —এসব চলবেনা। প্রিয়াংশু কে বলে দিবি ও যেন না আসে। নির্লজ্জ বেহায়া। আমি তোর বিয়ে দিয়ে দেব। ছেলেও দেখে রেখেছি।
— আমি বিয়ে করব না বাবা। কেন করবি না।
তোর কি ভালোবাসার কেউ আছে?
— হ্যাঁ।
— কে সে?
— তাকে তুমি চেনো বাবা।
— কে সে প্রিয়াংশু! ওই বেকার ছেলেটা।
— আমি ওই বেকার ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেব না।
— সে এখন বেকার হলেও পরে ভালো চাকরি পেয়ে যাবে।
— ওই লম্পট ছেলেটাকে তুই বিয়ে করবি?
— না বাবা। ও লম্পট নয়। সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে।
— তোর মায়ের মৃত্যুর পর আমি তোকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি। মায়ের অভাব বুঝতে দিয়নি। আজ তুই আমাকে অবজ্ঞা করছিস।
— অবজ্ঞা কোথায় বাবা। আমি তো বলেছি আমি বিয়ে করবনা। তুমি না জোর করে আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে গলগ্রহ বিদেয় করতে উঠে পড়ে লেগেছো।
— কথার উপর কথা বলবি। তোর সাহস তো কম নয়।
কাল তোর মজা বের করছি।
— হ্যাঁ। তুমি যা-ই বলো বাবা আমি সব কিছু মেনে নেব কিন্তু প্রিয়াংশু ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।
দিন কয়েক পর
রুমি ঘরের জানলা দিয়ে দেখলো একটা ছেলে মোটর সাইকেলে হর্ণ বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন দিন কয়েক থেকে সময়ে অসময়ে ছেলেটি শিশ দিতে দিতে কখনো বা চীৎকার করে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে মোটর সাইকেলে চক্কর দিচ্ছে।
ছেলেটাকে রুমি চেনে। লিটন। লম্পট বদমায়েশ মাস্তান গুন্ডা ছেলেটা অনেক কিশোরী মেয়ের সর্বনাশ করেছে।
একদিন রুমি পাড়ার মুদীর দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরছে।দেখলো একটা নিরিবিলি জায়গায় লিটন রাস্তার পাশে বাইক রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমি কাছে আসতেই আকস্মিক তার হাত ধরে বললো — ডার্লিং। আই লাভ ইউ।
— হাত ছাড়ুন বলছি। নাহলে চীৎকার করে লোক ডাকব।
— কেন? আমিও তোমাকে ভালোবাসি সুন্দরী। তোমার প্রিয়াংশু মাষ্টারকে ঘরে ডেকে তোমার মধু পান করতে দিচ্ছ। আর আমার বেলায় অমন কেন করছো সুন্দরী? আমি তোমাকে বিয়ে করে ওই বেকার ছেলের চেয়ে অনেক ভালো সুখে রাখব।
—- ছাড়ুন।লম্পট।
কিন্তু লম্পটটা জোর করে তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরতে গেলে রুমি ওর হাতে কাঁমড় বসিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে দিয়ে পাশের সরু গলি দিয়ে চোঁচা দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল।
একদিন পর ঘরে এসে জানলা দিয়ে শাঁসিয়ে দিয়ে গেলো।
— আমার প্রস্তাব মেনে নে। না হলে বদলা নিয়ে নেব। আমার নাম লিটন মাস্তান। তোর ওই মাষ্টারকে মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাব।এবার রুমি ভয়ে একদম জড়োসড়ো হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো।
কদিন থেকে প্রিয়াংশুদাও আসছেনা। কি যে করে! মনে মনে ঠিক করল আজ সে প্রিয়াংশুর বাড়ি যাবে। সতর্ক করে দিয়ে আসবে।
ডিনার শেষে বাবা ও অতনু একটা ঘরে শুয়ে পড়েছে। ড্রয়িং রুমের পাশের ঘরে সে একা শোয়। মধ্য রাত্রি। একটা বাজে।ঘুম আসছে না। রুমি বিছানা ছেড়ে উঠলো। উঁকি মেরে দেখলো বাবা ও অতনু গভীর নিদ্রামগ্ন। দরজাটা ঠেকিয়ে সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। নিশুতি রাত। নিশাচর পাখির ডানা ঝটপটানির আওয়াজ। চারিদিক দেখলো রাস্তায় জনমানব নাই। গা ছমছম নিরবতা। ত্রস্তপায়ে প্রিয়াংশুদার বাড়িতে পৌঁছে দরজায় কলিং বেল
টিপলো।
প্রিয়াংশু দরজা খুলে ঘরে আসতে বললো। প্রিয়াংশুর ল্যাপটপ খোলা। সে কিছু একটা কাজ করছিল।
— তুমি আবার কদিন আমার কাছে যাওনি কেন?
— তুমি এসেছো।আজ আমার অনেক শুভদিন রুমি। আজ আমার মনস্কামনা পূর্ণ হলো।
— আমি কিন্তু তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। তুমি আর আমাদের বাড়ি যাবেনা।
— কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না।
রুমি লিটন গুন্ডার তার উপর
কুদৃষ্টি ও কুপ্রস্তাবের ঘটনাটা জানিয়ে বললো
— তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে না।লিটন আমাকে সম্ভোগ করতে না পেলে তোমাকে মেরে দেবে। ধমকি দিয়েছে।
—কিন্তু ওই লিটনের ধমকিতে ভয় পেয়ে তোমাকে হারাতে চাইনা।
— কিন্তু তুমি লিটনকে চেনোনা। ও যেটা বলে সেটা করেই দেখায়।
— যতই ও ফেরোশাস গুন্ডা হোক না কেন আমাদের প্রেমে, আমাদের মিলনে বাধা দিতে পারবে না। আমি হাইদ্রাবাদের যে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সেই চাকরিতে আমি সিলেক্টেড। এই দেখো
ই -মেলে এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেছে। আমি এবার জয়েন করে তোমাকে বিয়ে করেই এখান থেকে নিয়ে যাব।
—কই দেখি।
— এই দেখো।
— রুমি দেখে খুব আনন্দিত আপ্লূত হয়ে জিজ্ঞেস করবে ৯.৬ লাখ এটি কি?
— এটাই আমার বাৎসরিক বেতন সুন্দরী। পরে আরও বাড়বে।
খুশিতে রুমি গেয়ে উঠলো “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ুরের মতো নাচেরে।”
আনন্দের আতিশয্যে রুমি নাচতে শুরু করলো। আঁচল খুলে গেলো। জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে প্রিয়াংশুকে ব্যতিব্যস্ত করে দেবে। উত্তেজিত প্রিয়াংশু রুমিকে নিয়ে বিছানায়
ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এলো। সারারাত এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো । হঠাৎ রুমি এক নিশাচর পাখির ডাকে ধড়ফড় করে উঠে কাপড় পড়তে পড়তে বলবে—
—- এমা! সকাল হয়ে গেলো। জানাজানি হয়ে যাবে।
— হোক জানাজানি। কাল রবিবার। তোমার বাবা বাড়িতে থাকবেন। আমি সকালে যাব। তোমার বাবার কাছে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেব।
প্রায় ছুটতে ছুটতে রুমি ঘরের দিকে রওনা দিল। ঘরে ঢুকতেই বাবা চীৎকার করে বলবে—
— কলঙ্কিনী । কোথায় রাত কাটিয়ে এলি। নিশ্চয়ই ওই টিউশন টীচারের ঘরে গিয়েছিলি। হারামজাদি।
তোর জন্য আমি মুখ দেখাতে পারব না। রেলে মাথা দিয়ে মরবো।
— তোমাকে আর মরতে হবে না।
— কাল প্রিয়াংশুদা আসবে তোমার সাথে কথা বলতে।— ও আসার আগে আমি থাকব নাহলে ও থাকবে।
মনে হলো রুমি এই সময় খুলে সব বলে দেয়। কিন্তু প্রিয়াংশু এসে সাসপেন্স ভঙ্গ করে সারপ্রাইজ দেবে এই ভেবে চুপচাপ থাকলো।
🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔রবিবার, ছুটির দিন সকালবেলা। দরজার সামনে অপেক্ষারতা রুমি। প্রিয়াংশু আসতেই রুমি নিঃশব্দে চুম্বন দিয়ে প্রিয়াংশুকে অভ্যর্থনা জানালো।প্রত্যুত্তরে প্রিয়াংশু রুমির বুকে চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিলো।
ক্রুদ্ধ দেবেশ বাবু সোফায় বসে আছেন।
প্রিয়াংশু ঘরে ঢুকে দেবেশ বাবুকে প্রণাম করে বলল
—আমি আপনার মেয়ে রুমিকে বিয়ে করতে চাই।আমি চাই আপনার আশীর্বাদ।
— আমার এ বিয়েতে মত নাই।
আমি একজন বেকার ছেলের হাতে আমার মেয়েকে সমর্পণ করবো না।
—- আমি এখন আর বেকার নই স্যার। এই দেখুন গতকাল হাইদ্রাবাদ থেকে appointment letter এসেছে। আমি এক মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছি।
দেবেশ বাবু চিঠি পড়ে উচ্ছসিত হয়ে —-
— ওয়েল ডান। বেতনও ৯.৬ লাখ প্রতিবছর।
খুব খুশি। আমার স্বপ্ন পূর্ণ হলো। দেখলো
মিষ্টির প্লেট হাতে রুমি দাঁড়িয়ে।
সেখান থেকে একটা মিষ্টি তুলে দেবেশ বাবু প্রিয়াংশুর মুখে পুরে দিয়ে বলল
—- আয়ুষ্মান ভবঃ।
রুমি মিষ্টির প্লেট প্রিয়াংশুর হাতে দিয়ে বাবাকে প্রণাম করল।
বাবা দু হাত তুলে আশীর্বাদ করল
— সৌভাগ্যবতী ভবঃ।
রুমি — আজ দুপুরে আমাদের এখানে আমার হাতের রান্না খেয়ে যাবেন প্রিয়াংশুদা।
— আজ আমার অনেক অফিসিয়াল কাজ বাকী। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
তাছাড়া তোমার হাতের রান্নাই তো সারাজীবন খেতে হবে।এই বলে বিদায় নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। বারবার পিছন ফিরে রুমির দিকে তাকাতে তাকাতে
বাগান পেরিয়ে যেমনি বড় রাস্তায় পা দিয়েছে অমনি দূর থেকে লিটন গুলি চালালো। পরপর তিনটি। প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পরের দুটি প্রিয়াংশু কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো।
রু— মি ———— বলতে বলতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
রুমি দেবেশবাবু অরিত্র সবাই ছুটে এলো।
রুমির হাত ধরে অব্যক্ত যন্ত্রণায় চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালো।
বাইক স্ট্রার্ট করে লিটন গুন্ডা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️
সামনে দিয়ে একটা পুলিশ ভ্যান যাচ্ছিল রুমি হাত দেখিয়ে আটকালো। অত্যন্ত বিণীতভাবে সকরুন আবেদন জানালো
—-স্যার! আপনাদের পায়ে পড়ি আপনারা আমার প্রিয়াংশু কে বাঁচান। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চলুন। পুলিশের সহায়তায় ও সবাই মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে ভর্তি করল।
ICU তে।
সই করলো রুমি নিজে।
লিখলো রুমি মিত্র।
প্রিয়াংশু দত্তের বাগদত্তা স্ত্রী।
হাসপাতালের বেঞ্চে বিনিদ্র রজনী কাটলো রুমির।
দেবেশ বাবু বললেন
— সেই সকাল থেকে কিছুই খাসনি। কিছু একটা মুখে দে।
ইতিমধ্যে সার্জেন রুমি কে ডেকে বলেছে ৭২ ঘন্টা আগে কিছুই বলা যাবেনা। পেশেন্ট ইজ ক্রিটিক্যাল।— না বাবা। ৭২ ঘন্টা কিছুই খাবনা।
🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦অবশেষে ৭২ ঘন্টা অতিক্রান্ত হলে সার্জেন ডেকে পাঠালেন রুমিকে।
— মিস রুমি। প্যেশেন্ট ইজ আউট অব ডেঞ্জার।
একটা গুলি বগলের পাশে কাঁধের উপর আর একটা পায়ে লেগেছিল। আপনি একটু কথা বলতে পারেন। জ্ঞান ফিরে শুধু আপনার নাম করে ডেকেছে। সিস্টার বলল,শুধু ফ্যালফ্যাল করে
দরজার দিকে তাকিয়ে আপনারই প্রতিক্ষায় থেকেছে।রুমি ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো আই সি ইউ তে।
অপলকে প্রিয়াংশু রুমির দিকে তাকিয়ে রইলো । জলভরা চোখে রুমি এগিয়ে এসে প্রিয়াংশুর কপালে চুমু খেয়ে বলবে —-
প্রেমের দেবতা আমার প্রিয়াংশুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর কোনো শক্তি আমার প্রিয়াংশুকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবেনা।
বাইরে থেকে কোথাও সেই রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসছে।“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার,
আকাশ কাঁদে হতাশসম
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার,
পরানসখা বন্ধু হে আমার,
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার। “ -
গল্প- সাংসারিক (দ্য স্টোরি অফ এ ফ্যামিলি ভায়োলেন্স)
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
সাংসারিক (দ্য স্টোরি অফ এ ফ্যামিলি ভায়োলেন্স)
– উজ্জ্বল সামন্তসংসার একসাথে থাকার অঙ্গীকার। সং এবং সার শব্দের গভীর অর্থ রয়েছে। সেই সত্য যুগ থেকে চলে আসছে সাংসারিক নিয়ম। পরিণত বয়সের পর একটি যুবক যুবতী বিবাহবন্ধনে ,সামাজিক জীবনে আবদ্ধ হয়। দাম্পত্য জীবনে কলহ কখনো কখনো গার্হস্থ্য অশান্তির সূচনা হয়।
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স তিন ধরনের হতে পারে ১) শারীরিক ২) মানসিক ৩) অর্থনৈতিক।
শুধুমাত্র পণ নয়, কোনও অভিসন্ধি বা স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে কিংবা কোনও অপরাধ প্রবণতাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে কেউ যদি কারও উপরে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ভাবে অত্যাচার চালান বা কেউ যদি কোনও রকম যৌন হিংসার শিকার হন অথবা তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে কোনও অপরাধমূলক কাজে লাগানো হয়, তাহলে এই ধরনের অপরাধ প্রবণতাকে গার্হস্থ্য হিংসা বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হিসেবে গণ্য করা হয় Domestic Violence Act 2005 অনুসারে। ঘটনা কখনো চোখের সামনে আসে, কখনো আসে না।
আদালত চত্বরে অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ। মনটা ভারাক্রান্ত আজ তার জীবনের একটা অধ্যায় শুরু বা শেষ হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে অতীতের কিছু স্মৃতি ভিড় করে মনে। অনির্বাণ সৎ নির্ভীক পেশায় চাকুরীজীবী , বয়স বছর তিরিশের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে।
৪ বছর আগের কথা, অনির্বাণ বিবাহের জন্য অনলাইন ম্যাট্রিমনিতে একটি আইডি খোলে। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে একজন যুবতী বারবার ফোন করে। স্যার অফার চলছে। আপনি ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে ভিজিট করেছিলেন। কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর ৫০০০ টাকায় আপনার আইডিটি খুলে দিতে পারব যদি আপনি রাজি থাকেন। পুজোর পরে এরকম অফার আর থাকবে না। বাবা ৩০ বছর আগে মারা গেছেন , ওর তখন মাত্র ২ বছর বয়স ছিল। বর্তমানে সংসারে দুটি মানুষ মা ও ছেলে। আত্মীয়-স্বজন থাকলেও দূরে থাকে , তাই আত্মীয়তায় অনেক ব্যবধান থেকে গেছে।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে। দিন দুই পর ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট এ আইডি খুলে নেয়। ছবি কন্টাক্ট নম্বর সমেত অনেক বিবাহযোগ্যা মেয়ের প্রোফাইল দেখতে পায়। দিন সাতেকের মধ্যে একটি প্রোফাইল দেখে পছন্দ হয়, ফোন করে। ফোনে প্রাথমিক কথাবার্তা বলে । ব্যস্ততার কারণে রবিবার দেখে মেয়ে দেখতে যায়। দু’পক্ষের আলোচনার পর কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যবিত্ত ওই পরিবারে বিবাহ হয়। স্ত্রী শিক্ষিতা, সুন্দরী।
অনির্বাণ মনে মনে খুব খুশি। কিন্তু তাঁর সুখ স্থায়ী হল না। বিবাহের বর কনে বিদায়ের সময় সামান্য কারণে কিছু অশান্তি হয় অনির্বাণের আড়ালে। বিবাহের এক মাসের মধ্যেই সংসারের চরম অশান্তিতে তাসের ঘরের মতো স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়। ওর স্ত্রীর আচার-আচরণ খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না। সংসারের কোনো কাজকর্ম করত না। সারাদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কার কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতো । সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও ব্যস্ত থাকত। ফোনে কার সাথে কি কথা বলতো পাশ থেকে শোনা যায় না।বিয়ের আগে একটি ছেলের সঙ্গে ৪ বছরের বেশী সম্পর্ক ছিল নন্দিতার । ছেলেটির বাড়িতে যাতায়াত ছিল। বিয়েও ঠিক ছিল ওই ছেলের সাথে এমনকি বিয়ে বাড়ি ভাড়াও হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিবাহটি ভেঙে যায়।
সন্দেহবাতিক ,বদমেজাজী, স্বার্থপর,লোভী, কোন বিশেষণ ই যথেষ্ট ছিল না নন্দিতার জন্য।তাহলে কি মানসিক অসুস্থতা ছিল নন্দিতার?
সম্পর্কের কঙ্কালসার চেহারা প্রকাশ পায় নন্দিতার কটূ কথায়। তার বয়স্কা শাশুড়িকে নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে একদিন। রক্ত বের হয়ে আসে। অনির্বাণ থানায় এফ আই আর করতে পারতো । কিন্তু বাড়ির বউ , মান-সম্মান ইত্যাদি চিন্তা করে পিছিয়ে যায় পরিবার। হাসপাতালে মায়ের প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ।
এরপর অনির্বাণ স্ত্রী শুরু করলো মানসিক অত্যাচার । অনির্বাণ কে ভয় দেখাত , ৪৯৮ এ মামলা করবে, জেলে পুড়বে। কিন্তু কোনো দিন এমন কোনো আচরণ করেনি অনির্বাণ ,যে তাকে হাজতবাস করতে হয়। স্ত্রীর নিত্যনতুন আবদারে বিলাসিতায় অনির্বাণের হয়তো আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হচ্ছিল। কিন্তু তাও কোন রকমে এডজাস্ট করে সংসার করছিল। সাধ্যমত স্ত্রী দাবি দেওয়া মেটানোর চেষ্টা করছিল। তুচ্ছ কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। অনির্বাণ এর সব থেকে প্রিয় ছিল মান সম্মান।
নন্দিতা চেয়েছিল শাশুড়ী মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে। সংসার তাহলে পিছুটান বলে কিছু থাকবে না। ও স্বাধীন থাকবে নিজের মত। ইচ্ছে মত অনির্বাণ কে চালনা করবে। সংসারের মাথা হয়ে ছড়ি ঘোরাবে । কোন দায় দায়িত্ব নেবে না সংসারের। ইচ্ছে মত ঘুরতে যাবে, শপিং এ যাবে। যা খুশি তাই করবে। কিন্তু অনির্বাণ শিরদাঁড়া নোওয়া বার পাত্র নয়।
সম্মানহানি ও তাকে বিপদে ফেলতে নন্দিতা ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন সব রকম চেষ্টা করতে লাগল। ফ্যামিলি কাউন্সেলিং সেন্টার এ অভিযোগ করলো। নির্দিষ্ট দিনে সেখানে উপস্থিত হয়ে ঘন্টাখানেক সেশন শেষ করে বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু আবার সেই এক ঘটনা। একদিন কথাকাটিতে নন্দিতা অনির্বাণকে এক চড় মারল। অনির্বাণ হতভম্ব কি করবে বুঝতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ঘন্টা ২ পর বাড়ি ফিরল। কয়েকদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বাক্যালাপ থাকলো না। যোগাযোগ নেই এরকম আগে প্রায়ই হয়েছে । মাসে একবার করে বাপের বাড়ি যেত নন্দিতা। কখনো ১৫ দিন কখনো একমাস টানা থাকতো।
১ বছর এরকমই চললো। অবশেষে নন্দিতা থানায় মিথ্যা অভিযোগ করলো। এক সন্ধ্যায় থানা থেকে ফোন এলো, ইনভেস্টিগেশন অফিসার ডেকেছেন অনির্বাণকে ওর স্ত্রী অভিযোগে । প্রাথমিক কথাবার্তার পর কিছু তথ্য প্রমাণ ও সাক্ষী সামনে রাখলো অনির্বাণ । তদন্তকারী অফিসার তখন বললেন , মশাই আপনি কি অন্ধ হয়ে বিবাহ করেছিলেন? আপনার স্ত্রী অভিযোগ জানাতে এসেছিল। কয়েকমিনিট তাকে দেখে কথাবার্তা বলে তো সুস্থ মনে হলো না। অনির্বাণ বলল আমাকে গোপন করা হয়েছিল। কয়েক মিনিট দেখে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি যখন মেয়ে দেখতে যাই। সরল বিশ্বাসে ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন এর কথাবার্তায় আচার-আচরণে বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ঐরকম একটা মেয়ে ও জঘন্য পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে।
অনেক এডজাস্ট করার পরেও নিতান্তই নিরুপায় হয়ে অনির্বাণ এক সময় সম্পর্ক বিচ্ছেদের মামলার আবেদন করে এই মিথ্যা সম্পর্কের ইতি টানতে। বিগত কয়েক মাস হল ব্লাড প্রেসারের পেসেন্ট। । অনির্বাণ মন থেকে নন্দিতা কে ভালবেসে ছিল ,নন্দিতা ছিল তার স্ত্রীর থেকেও বেশি কিছু।
হঠাৎ অনির্বাণ সম্বিৎ ফেরে আর্দালির ডাকে, কেস নাম্বার… হাজির হো… কাঠগড়ায় উঠলো। মাননীয় বিচারকের সামনে দুপক্ষের উকিলবাবু জোরদার সওয়াল জবাব করলেন।
এর পর প্রায় তিন বছর যাবৎ বিবাহবিচ্ছেদের মামলার চললো। একসময় নন্দিতা মিচুয়াল ডিভোর্সে রাজি হয়ে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করলো খোরপোষ এর নামে। অনির্বাণ দাস ওর পৈত্রিক সম্পত্তি, বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়েছিল চড়া সুদে।
এই সমাজে নারীদের উপর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের ঘটনা অনেক শোনা যায় । সংবাদ পত্রিকায় ও টিভিতে বধূ নির্যাতনের নানা খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু পরিহাস এটাই যে স্ত্রী ইচ্ছা করলেই যখন তখন স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ (৪৯৮) কেস আনতে পারে। কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে স্বামী কিন্তু তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারে না। কিন্তু এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেখানে নিরীহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ওপর বৌমা অত্যাচার করে । স্বামীকে বাধ্য করে সম্পর্কের ইতি টানতে। খোরপোষ নিয়ে হয়তো কিছু অর্থ আদায় হয় ঠিকই কিন্তু সম্পর্ক ? সম্পর্কে তো আর ফিরে আসা যায় না? ভবিষ্যতেও হয়তো কারো সঙ্গে কারো দেখা হয় না। সম্পর্ক ভেঙে অচেনা হয় দুটি মানুষ চিরদিনের জন্য আর এটা চলতেই থাকে আধুনিক সমাজ জীবনে…
-
গল্প- “আসা যাওয়া গ্রামের পথে”
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
“আসা যাওয়া গ্রামের পথে”
-প্রদীপ দে— সত্যি বলছি মা –!
আমার স্কুলে যেতে একদমই ভালো লাগে না। স্কুল ছাড়িয়ে দাও না? আমি মাঠে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো, পুকুরে সাঁতার দেবো আর ঘুড়ি ওড়াবো।— হ্যাঁ রে তোর মাথাটা কি একদম গেছে রে? একটা ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলের মুখে এ কেমন কথা রে?
— সত্যিই বলছি মা! আমার ভাল্লাগে না!
— যা পারিস করগে! আমার অনেক কাজ আছে, মেলা তোর সঙ্গে বকবক করে লাভ নেই।
মা চলে গেল রেগে। আমি কি যে করি? কেউ আমার কথা বোঝে না। বাবা — সেতো আরো এক ভয়ানক রাগী লোক। তার সামনেই যাওয়া যায় না। একমাত্র কিছুটা বোঝে দাদু। কিন্ত মায়ের কাছে সে আবার চুপ। মা যে দাদুকেও বকে – এটা করবেন না, ওটা ধরবেন না, ওখানে যাবেন না, ওরা ভালো নয় – ইত্যাদি প্রভৃতি সব।
আমার জন্ম এই সরসীনীরে। এটা একেবারে অঁজ পাড়াগাঁ। গাছ পুকুর জঙ্গল ভরা আমার এই গ্রাম।
গাছে ফুল আছে ফল ভরে ঝুলে পড়ে, পুকুরে কত মাছ আর তাদের কি নাচানাচি – দাপাদাপি আর সত্যি কিনা জানিনা হয়তো বা মা ভয় দেখানোর জন্য একেবারে ছোটবেলা থেকে বলে আসছে ওই পুকুরের নিচে নাকি কুমির আর দৈত্য দানবেরা সব থাকে। এখন একটু বুদ্ধি হয়েছে তাও মায়ের কথায় মজা পাই আর রোমাঞ্চ হয় ,বেশ মজাই লাগে। ঠিক যেমনটা লাগে ছোটবেলায় মায়ের আর মাসির মুখে শোনা জঙ্গলে বাঘ ভালুকের কথা। আমি এখন মাঝেমধ্যে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের অপেক্ষা করতে খুব ভালোবাসি। হ্যাঁ একটা প্রধান কথা বলতে একদম ভুলে গেছি যেখানে গেলে আমার মন ভাল হয়ে যায় – না থুড়ি মন হারিয়ে যায় সেটা এক ফালি নদী – যা আমাদের গ্রামকে ছুঁয়ে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়েছে। বাউলেরা গান গেয়ে আর নেচে ওর পাড় ধরে চলে কি আনন্দই না পায়!— আচ্ছা দাদু, তুমি যখন ছোট ছিলে তখনও এই গ্রামটা কি এরকমই ছিল?
দাদুর বয়স বাহাত্তর। ভালো নাম ক্ষিরোদ বাড়ুর্জ্জে। দেখতে একেবারে ক্ষিরের পুতুলের মতোই। কিন্তু বেশ শক্তসামর্থ। সব কাজই করতে পারে। ভোর বেলা থেকে উঠে জপ ধ্যান করে বাগানের কাজ করে তারপর বাড়ির বাজার থেকে ফাইফরমাস – সবে একেবারে সিদ্বহস্ত! কিন্তু দাদুর একেবারে মনের কাজ হলো – সময় করে কবিতা লেখা।
দাদু আমার মাথায় হাত বুলায় আর বলে —
— দাদুভাই সময় বয়ে যায় আর সব কিছুই পাল্টায়। প্রকৃতির রূপ ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। তবু গাছ গাছই থাকে, পাখি একইভাবে উড়ে চলে।— দাদু আজ মাকে বলেছি আমি আর স্কুলে যাবো না।
— না -না ! দাদুভাই এটা ঠিক নয়। পড়াশোনা না করলে, না শিখলে, না জ্ঞান থাকলে জগৎকে তুমি ধরতে ছুঁতে পারবে না।
আমি বুচাই চেপে যাই। দাদুকে হাত ধরে টান মারি,আমরা দুজনে পিছনের খিড়কি দোর দিয়ে আলপথ ধরি, বাবাকে এড়িয়ে, স্কুল ফাকি মেরে।
দাদু কবিতা বলে আর আমি গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে পুকুরে নেমে যাই, মুঠো করে জল তুলে আকাশের পানে ছুঁড়ে দিই -কাঁদামাটি তুলে দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। দাদু ও আমার পিছনে ছোঁটে আর হাঁফিয়ে ওঠে। আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে, বুক ভরে হাওয়া গিলি!
দাদু নিঃশেষে আবৃত্তি করে —
অরন্য ঘর্মাক্ত গায়ে – আলপথ ধরে
কাশফুল হাওয়ায় পাখা মেলে ওড়ে
পাখিদের ডানা ভেজা নদী বয়ে চলে
স্নান সারে – নদীর নিংরানো জলে !যখন বাড়ি ফিরি তখন পাখিরা শেষ প্রদক্ষিণ শুরু করে দিয়েছে। একরাশ ঘন কালো অন্ধকার যেন ছুটে আসছে পুরো গ্রামটাকে গোগ্রাসে গিলে খেতে। চাঁদ বড় তাড়াতাড়ি করে সূর্য কে পাশ কাটাতে ব্যস্ত আর তারারা তখনও লুকিয়ে।
বাড়ির দরমার গেটে রেগে চোখ লাল করা যে একজন তিনিই একাধারে আমার বাপ অন্যধারে দাদুর ছেলে ………………
— বাবা, শেষ পর্যন্ত আপনি বুড়ো বয়সে যাবার সময়, আমার ছেলেটার মাথা খেয়ে যাবেন?মাও কম যায় কিসে? — লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে আর আপনি ওর দাদু হয়ে ছেলেটাকে উস্কাচ্ছেন?
অপমানিত অভুক্ত দাদু দাওয়ায় এলিয়ে বসে পড়ে। ক্রোদান্বিত কারোর নজরে আসে না, আমি দেখি দাদু বুক চেপে শুয়ে পড়ে -শেষ-শোয়া!
আমি জীবনে এই প্রথম এক মৃত্যুর আহবান অনুভব করলাম।অনেকদিন কেটে গেল। পড়াশোনা ছাড়তে পারিনি। একদিন নদীর ধারে বসে দাদুর কত কথাই ভাবি — প্রকৃতি তার নিয়মেই চলে শুধু রূপ বদলায়। গাছ পাখি নদ নদী সব আগের মতোই।
চিৎকার শুনে ঘোর কাটে।ছুটে যাই একটা দূরের কুটিরে, মহিলাদের হুল্লোড় কাটিয়ে বেড়ার জানালা দিয়ে উঁকি মারি — এক সদ্যোজাত ভুমিষ্ট সন্তানের প্রসবোত্তর জ্যান্ত ছবি আমার চোখে ধরা পড়ে।
দাদুর মৃত্যু – পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার স্বাক্ষী হয়েছিলাম আগেই। আর এখন আমি আমার জীবনে এই প্রথম পৃথিবীতে কারোর আগমন চাক্ষুষ করলাম।