• গল্প

    কলঙ্ক বাহিনী

    কলঙ্ক বাহিনী
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (পর্ব-১)

     

    বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়ে, বেশ কয়েক বছর বেকার হয়ে বাড়িতে বসে থাকার পরও, যেদিন শিক্ষকতার চাকরির নিয়োগ পত্রটা হাতে পেলাম, সত্যি বলছি, খুব যে খুশি হয়ে উঠেছিলাম, তা কিন্তু নয়! যদিও বা এখনকার দিনে সরকারি চাকরির মহিমা অনেক, তবুও যেন একটা পিছুটান লেগেই ছিল মনে। এর একমাত্র কারণ হল আমার হবু কর্মস্থলের অবস্থান। আমি নিযুক্ত হয়েছিলাম সুদূর বীরভূমের সোনাঝুড়ি গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে, বলাই বাহুল্য, যে সেটা কলকাতা থেকে এতটাই দূর, যে সেখান থেকে নিয়মিত যাওয়া আসা করা সম্ভব নয়। একবার মনে হয়েছিল, যে এতদিন যেমন বাড়িতে ছাত্রদের টিউশন পড়িয়ে কাটাচ্ছিলাম, সেরকমই চলুক না, এই আয়-ও তো স্কুল শিক্ষকের মাইনার থেকে খুব একটা কম নয়, তার কারণ গৃহ শিক্ষক হিসাবে আমি পাড়ায় বেশ ভালোই পসার জমিয়ে ফেলেছিলাম।

    কিন্তু, মা এই ব্যাপারে কোন নিজস্ব মতামত না দিলেও, বাধ সাধলেন আমার বাবা। তার সাফ কথা,
    – পাগল হয়েছিস নাকি, এমন সুখের সরকারি চাকরি কেউ ছেড়ে দেয়!……এই টিউশন পড়ানোর কোন নিশ্চয়তা আছে?……আমরা আর ক’দিন আছি, ছেলে শুধু টিউশন পড়ায়, এই কথা শুনলে কেউ মেয়ে দেবে আমাদের ঘরে!…….এই হয়েছে এখনকার ছেলেদের দোষ…..আরে, আজকালকার মেয়েরাও কত হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছে, আর তুই সেই কুয়োর ব্যাঙ হয়েই রইলি!
    বাপের এই অকাট্য যুক্তিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা বা সাহস, কোনোটাই আমার ছিল না, তাই অগত্যা একদিন লোটা-কম্বল গুটিয়ে বেরিয়েই পড়লাম নতুন কর্মস্থলে উদ্দেশ্যে। কিন্তু হ্যাঁ, সেদিন যদি বাবার কথা না মেনে, ওই “কুয়ো”-তেই পড়ে থাকতাম, তাহলে আমার আর্থিক অবস্থা এখনকার থেকে আলাদা হত কিনা বলা মুশকিল……তবে সেই অচেনা স্থানে গিয়ে যে অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, তা হয়তো আজ আপনাদের বলা হত না!

    বীরভূমের এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ভরপুর গ্রামটির কথা আপনারা অনেকেই নিশ্চয় শুনেছেন। এই গ্রামের থেকেও বিখ্যাত এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোপাই নদী……ছোটবেলা থেকেই অনেক পড়েছি এই নদীর সম্বন্ধে……ময়ূরাক্ষীর এই ছোট উপনদীটি বর্ষাকালে বানভাসি হয়ে উঠলেও, গ্রীষ্মকালে একেবারেই শুকিয়ে যায়। এই নদীর অববাহিকায় মাটির রং লাল। এই মাটিতে ভূমিক্ষয়ের ফলে যে ছোটো ছোটো খাত সৃষ্টি হয়েছে, তা খোয়াই নামে পরিচিত। এছাড়াও, এই নদীর বাঁকগুলি অনেকটা হাঁসুলির আকৃতিবিশিষ্ট…….এই সব অনেক কথা মনে পড়ে যায় কোপাই-এর নাম শুনলেই!……তবে, সেখানে থাকার জায়গা খুঁজতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। পুরো গ্রাম জুড়েই খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট মাটির বাড়ি, লাল মেঠো পথ আর শাল সেগুনের জঙ্গল…..আর হোটেল রিসোর্ট যা আছে, তাতে থাকা যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ। যাই হোক, ভাগ্য কিঞ্চিৎ ভালো থাকায় একেবারে নদীর ধরেই একটি বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেলাম। বেশ নিরিবিলি নিঝঞ্ঝাট জায়গা……আসে পাশে খুব একটা বাড়ি ঘর নেই। একতলা ছোট পাকা বাড়ি, বাড়ির মালিক তার কলকাতায় চাকুরিরত ছেলের কাছেই থাকেন। রান্নার কাজের জন্য ঠিক করা হল এই গ্রামেরই একজন বয়স্ক লোককে, যার আসল নাম আমি জানিনা, তবে গ্রামের সকলে তাকে “হাবুদা” বলে ডাকে, হয়তো সে একটু হাবা বোবা সেই জন্যই!

    সেই বাড়িতে প্রথম দিন সব কিছু গোছ গাছ করতে করতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার সময়, হঠাৎ, হাবা বোবা হাবু বেশ সবাক হয়েই, মুখটা কিঞ্চিৎ কাচু মাচু করে বলে উঠল,
    – কিছু মনে যদি না করেন…..তবে একটা কতা বলি বাবু…..
    আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম,
    – কি কথা বল…….
    হাবুর মুখে বেশ একটা আতঙ্কের ছাপ আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, সে কোনো মতে বলে উঠল,
    – আজ্ঞে, রাত বিরেতে খুব একটা বাইরে বেরোবেননি যেন, বাবু……এই জায়গাটা খুব একটা ভালো নয় কো!
    আমি আরো বিস্মিত হয়ে বলে উঠলাম,
    – কেন গো…..এত সুন্দর শান্ত পরিবেশ…..সামনেই নদী…..তাহলে কেন ভালো নয় এই জায়গাটা?
    হাবু যেন কিছু বলতে গিয়েও চেপে গেল, শুধু একবার ঢোক গিলে বলে উঠল,
    – না মানে…..তেমন কিছুই নয়….ওই অনেকেই অনেক কতা কয় কিনা……
    আমিও ছাড়বার পাত্র নই, সটান তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
    – কে কি কথা বলে এই জায়গাটার সম্বন্ধে…..সব কিছু স্পষ্ট করে বল হাবু…..
    কিন্তু হাবু যেন অস্থির হয়ে বলে উঠল,
    – সে সব কতা আমি এই ভর সন্দে বেলায় বলতে পারবুনি, কত্তা…..চলি আমি….আপনি দরজাখানা ভালো করে বন্দ করি দেন…..
    এই বলে সে চম্পট দিল। আমি দুই তিন বার তার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু সে পেছন ফিরে চাইল অবধি না…….ভারী আশ্চর্য তো! এই ভর সন্ধ্যা বেলায় সে কিসের ভয় দেখিয়ে গেল আমায়? মনে মনে ভাবলাম, কাল কাজে আসুক তো ও, তারপর হচ্ছে ওর!

    সেদিন তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে, ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় চলে গেলেও ঘুম এল না। এখন বর্ষা কাল, সেই বিকাল থেকে কিছুক্ষণ আগে অবধি বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তাই কোপাই নদী এখন বেশ স্রোতস্বিনী। কানে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক, আর নাকে ভিজে লাল মাটির সেই সোঁদা সোঁদা গন্ধটা যেন কিছুতেই ঘুমোতে দিচ্ছিল না আমাকে। এছাড়াও ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা বেশ গুমোট ভাব। তাই মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা হচ্ছিল, একবার দরজা খুলে বাইরে নদীর ধার থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু হাবুর সেই সতর্ক বার্তাও মনে পড়ে গেল……আর সেই জন্যই বোধহয় এই রাত্রিকালীন নদীর শোভাটা দেখে আসার মনোবাসনাটা আরো তীব্র হয়ে উঠল! আর অন্য কোন কিছু না ভেবে, আমি বিছানা থেকে উঠে, দরজা খুলে বেরিয়ে বেরিয়ে গেলাম ঘরের বাইরে!……প্রকৃতির এই স্নিগ্ধ রুপোলি নৈশ্য রূপ যেন আমি আর আগে কোথাও দেখিনি……পূর্ণিমার চাঁদের আলোর রেশ নদীর শান্ত দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশিকে কি অবর্ণনীয় শোভায় আলোকিত করে রেখেছে! নিজেকে খুব বোকা মনে হল আমার….ওই ফাজিল হাবুর কথা শুনে নিজেকে এতোক্ষণ ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার জন্য! তবে একটা কথা ভেবে একটু খটকা লাগল, যে প্রকৃতির এই মায়াবী রূপ পরিদর্শন করার জন্য আমি বাদে আর বোধহয় কোন জনপ্রাণীই ধারে কাছে নেই!

    সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, নদীর সামনের বাঁকেই বাধা রয়েছে একটি ছোট্ট কাঠের নৌকা, তবে তার ধারে কাছে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। একটা দুর্নিবার ইচ্ছা যেন তখুনি মনে জেগে উঠল আমার…..এই চাঁদনী রাতে খোলা হওয়ায় যদি একবার এই নৌকায় চেপে নদীর বুক থেকে ঘুরে আসা যায়, তাহলে কেমন হবে!…….কিন্ত, হায় রে, নৌকা তো আছে…..মাঝি কই! …..আমি বেশ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম, নদীর ঢালু পার দিয়ে বনঝোপ মাড়িয়ে সাবধানে হেঁটে, সেই নৌকাটার কাছে! কই, এখানেও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না!….কে এই নৌকার মালিক, কে জানে?…..ঠিক সেই মুহূর্তে, আমার মাথায় একটা বদ বুদ্ধি খেলে গেল, নেহাৎ মজা করার জন্যই, আমি এক লাফে চড়ে উঠলাম নৌকাটার ওপর। যদিও আমি নৌকা চালাতে জানি না, তবুও এই বেঁধে রাখা নৌকার ওপর উঠেও বেশ আনন্দ হচ্ছিল মনে। এমন সময়…….হঠাৎ……সেই নৌকাটার ছাউনির পেছন থেকে একটা বেশ ভারী পুরুষ কন্ঠ কানে এল,
    – বাবুর বোধহয় এই অঞ্চলে নতুন আসা হয়েছে?
    আমি চমকে উঠে ঘাড় ঘোরালাম পেছন দিকে!

    (পর্ব-২)

     

    এই জনমানবশূন্য নদীর পারে, এই মায়াবী রাতের অন্ধকারে, হঠাৎ এই কথা শুনে, কেন জানিনা, বুকটা বেশ শিউরে উঠল আমার। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখলাম, যে নৌকাটার ছাউনির পেছন দিক থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে একটি পুরুষের ছায়ামূর্তি! সে আমার একটু কাছে এলে, এই চাঁদের আলোয়, স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি তাকে…….সাধারণ লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত বেশ লম্বা মেদহীন সুঠাম চেহারার অধিকারী এই পুরুষটিকে। সে আবার হেসে আমায় বলে উঠল,
    – কি বাবু, আমাকে ভূত ভেবে ভয় পেলেন নাকি?……তবে আমি কিন্তু ঠিকই ধরিচি, আপনি এই গাঁয়ে নতুন মানুষ…….
    আমি নিজের বিস্মিত ভাবটাকে যথাসম্ভব লুকিয়ে, একটু কৃত্রিম ভাবে মৃদু হেসে বলে উঠলাম,
    – হ্যাঁ…..ঠিকই ধরেছ তুমি…..আমি এই গ্রামে নতুন এসেছি…..গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের চাকরি নিয়ে……তা তুমি কে ভাই?
    সে হাত জোড় করে আমায় প্রণাম ঠুকে বলে উঠল,
    – পেন্নাম হই কত্তা, পেন্নাম হই………..আমার নাম ছিদাম…..সবাই আমায় ছিদাম মাঝি বলেই চেনে…..
    এবার আমার কাছে স্পষ্ট হল পুরো ব্যাপারটা, আমি নিশ্চিন্ত মনে তাকে প্রশ্ন করলাম,
    – তা শ্রীদাম ভাই……আমার বাড়ির কাজের লোকটা বলছিল, যে এই জায়গাটা নাকি ভালো নয়……রাতের বেলা নাকি এই নদীর ধারে আসতে নেই…..এমন কেন গো?
    শ্রীদাম মৃদু হেসে বলল,
    – আসলে বুঝতেই পাচ্চেন কত্তা, এরা সবাই গ্রামের মুক্ষু সুক্ষু লোক…..রাতের বেলায় তো এই নদীর ধারে কেউ খুব একটা আসে না…..তাই নানা লোকে নানা কথা কইতে ভালোবাসে, তাছাড়া এই জায়গাটাতে রাতে সাপখোপের ভয়..…..আপনি এই সব নিয়ে ভাববেননি বাবু……

    ঠিক এমন সময় দেখতে পেলাম, যে নদীর পার দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটি নারীমূর্তি……সে এই নৌকার কাছেই এসে দাঁড়ালো! শ্রীদাম তাকে হাত ধরে নৌকার ওপরে তুলতেই, আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে এলো তার চেহারা। সেই নারীর শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর, এই সাধারণ আধ ময়লা শাড়িতেও তাকে বেশ চিত্তাকর্ষক লাগছে। তার হাতে একটা ছোট্ট কাপড়ের পুটলি, তবে অন্য হাত দিয়ে সে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে! সে যেন হঠাৎ আমার মত আরেকজন পুরুষের এই নৌকায় উপস্থিতি, এই সময়ে প্রত্যাশা করেনি…..হাতের পুটলিটা নৌকার ওপর রেখে, সে কেমন যেন থমকে চেয়ে রইল আমার দিকে। এমন সময় একটা তীব্র শীতল হওয়ার ঝাপটা এসে অস্থির ভাবে উড়িয়ে দিয়ে গেল সেই মহিলার মুখে ঢেকে রাখা শাড়ির আঁচলটাকে। তার মুখের দিকে চেয়ে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম……এই চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে তার মুখের বেশির ভাগ অংশই বীভৎস ভাবে পোড়া!…..এছাড়া, এতোক্ষণে আমি এটাও লক্ষ্য করলাম, যে শুধু তার মুখ নয়, তার শরীরের বিভিন্ন উন্মুক্ত অংশই আগুনে দগ্ধ!….আমি তার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, সে যেন এই কথা বুঝতে পেরে, আবার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে, অন্য হাতে পুটলিটা নিয়ে, নৌকার ওপর একটু দূরে গিয়ে বসল।

    এমন সময় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শ্রীদাম বলে উঠল,
    – হতভাগী আমার আমার ইস্তিরি, কত্তা…….ওর নাম ফুলন……আপনি ওকে দেখে ডরাবেননি……একদিন রান্না করতে গিয়ে, ইস্টোভ বাস্ট করে…….
    আমি এই ভয়ঙ্কর প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য, ওর কথা শেষ না হতেই বললাম,
    – ঠিক আছে, ঠিক আছে ভাই, বুঝলাম…….
    ততক্ষনে ফুলন পুটলি খুলে রুটি, তরকারি, পেয়াঁজ, লঙ্কা বার করে ফেলেছে। আমি বুঝলাম, যে এখন ওদের নৈশ ভোজের সময়। শ্রীদাম নিজের অকপট সরলতায় আমাকেও ওদের সাথে খেতে বলল, কিন্তু আমি মিষ্টি হেসে ওকে জানালাম, যে আমার রাতের খাবার হয়ে গিয়েছে। অগত্যা ওরা খাওয়া শুরু করল…..আর আমি মুগ্ধ চোখে ওদের দেখতে লাগলাম…….এই রাতের অন্ধকারে, নির্জন খোলা নদী পারে, এই ছোট্ট নৌকায় বসেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় এই দুটি মানুষের। আমরা যেন বৃথাই বাড়ি গাড়ি আর আর্থিক প্রতিপত্তির জন্য কঁকিয়ে মরি, এদের মত মানুষদের এই প্রকৃতি যা নিজের হাত খুলে দিয়েছে, তাই কি কম?……এটা ভাবতেই বেশ অবাক লাগল আমার……কই ওদের তো এই খোলা নদীতে এত রাতে কোন ভয় লাগেনা? এতোক্ষণ আমি ওই মিথ্যাবাদী হাবুর কথায় ভয় পেয়েছি ভেবে নিজেই নিজের মনে হাসলাম!

    ওদের খাওয়া হয়ে গেলে আমি ওদের বললাম,
    – তোমার বাড়ি কোথায় শ্রীদাম? আশেপাশে তো কোন ঘর বাড়ি দেখছি না আমি?
    সে হেসে বলল,
    – এই নাও-ই আমার বাড়ি ঘর……আমার সব কিছু, কত্তা……দূরে গাঁয়ের শেষের দিকে একটা ছোট কুঁড়ে ঘর আছে বটে…..তবে সেখানে নেহাৎ দরকার না পড়লে আমি যাই নাকো…..আমি এখানেই থাকি সবসময়….ওই ঘরে ফুলন শুধু রাঁধা বারার কাজ করে……
    এবার আমি নিজের মনের ইচ্ছার কথাটা দুম করে বলেই ফেললাম শ্রীদামকে,
    – শ্রীদাম ভাই, একবারটি আমায় এই রাত্রি বেলায় নদীর বুক থেকে তোমার নৌকা করে ঘুরিয়ে আনবে…..আমার অনেক দিনের শখ, এমন রাতের বেলায় নৌকা ভ্রমণ করার……তবে, ভেবো না আমি বিনা পয়সায় যাব, তোমায় আমি একশো টাকা দেব এর জন্য!
    শ্রীদাম বেশ খুশি হয়ে বলল,
    – কেন ঘোরাবনি কত্তা…..নিশ্চয় ঘোরাব…..আপনি আমাদের গাঁয়ের নতুন লোক……আপনার আব্দার রাখবনি, তাই কখনো হয়? তবে হ্যাঁ….আপনাকে ঘোরাবার দাম হল পঞ্চাশ টাকা….তার এক পয়সাও বেশি নেবনি আপনার কাছ থেকে…….
    কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকার বাঁধন খুলে দিল শ্রীদাম। নৌকার এক কোণে, ফুলনের কাছে বসে, সে দুই হাতে তুলে ধরল বৈঠা……সেই চাঁদের আলোয় রুপোলি নদীর জলের উপর দিয়ে ছলাক ছলাক আওয়াজ করে ধীর গতিতে নৌকা এগোতে লাগল নদী বক্ষে…..আর আমার মনে হল, যে পূব দিক থেকে আসা ঠান্ডা হওয়াটা যেন এখনই উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমায় এই নৌকার ওপর থেকে!…….সেই রাতের ওই স্বর্গীয় অনুভূতির কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

    সেই দিগন্ত বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে চেয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ চোখ গেল অদূরে বসে থাকা ফুলনের দিকে……শাড়ির আঁচলের ফাঁক থেকে বেরিয়ে থাকা তার জ্বলন্ত দুই চোখের দিকে……মেয়েটা যেন এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে, কি জানি, কিছু বলতে চাই কি সে আমাকে? অগত্যা, আমিই শ্রীদামকে বলে উঠলাম,
    – তোমাদের কত বছর আগে বিয়ে হয়েছে শ্রীদাম?
    সে যেন চমকে উঠল হঠাৎ এই কথা শুনে, তারপর ম্লান হেসে বলল,
    – বিয়া!…..আমাদের আর কি বিয়া হবে, কত্তা……আমরা যে হলাম এই গাঁয়ের……এই গাঁয়ের কলঙ্ক, কত্তা……কলঙ্ক!……এই নদী যে হল তার সাক্ষী…….এই নদীর জলের স্রোতে, এই নৌকার প্রতিটা কাঠের গায়ে লেগে আছে আমাদের কলঙ্কের ছিটা!
    আমি অবাক হয়ে বললাম,
    – সে কি! তুমি যে একটু আগে বললে ফুলন তোমার স্ত্রী…..আবার এখন বলছ যে তোমাদের বিয়ে হয় নি……এই কথার মানে কি?
    এতোক্ষণ পর মুখ খুলল ফুলন, সে বেশ বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই আমাকে হেসে বলল,
    – কাউকে ইস্তিরি মানতে গেলে সত্যিই কি কোন মরদকে তার সাথে মালা বদল করে বিয়া করতে হয় নাকি বাবু? তা না করে কি কেউ সোয়ামী ইস্তিরি হতে পারেনি?
    আমি অবাক হয়ে গেলাম এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে। আমার এই অবস্থা দেখে শ্রীদাম নিজেই বলে উঠল,
    – জানি, আপনি খুব অবাক হচ্ছেন বাবু…….আপনি এই কথার মানে বুঝতেন, যদি আমাদের জীবনের কথা শুনতেন……..সে কথা শোনার সময় কি আছে আপনার কাছে?
    আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত ওদের বলে উঠলাম,
    – হ্যাঁ…..বল…..আমি শুনব!

    (পর্ব-৩)

     

    দূরে নদীর পারে, কোনো গাছ থেকে হয়তো এক রাত জাগা পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। এছাড়াও, নদীর জল কেটে নৌকার এগিয়ে যাওয়ার শব্দও একটানা আসছিল কানে। চারিদিকে শুধু সেই রুপোলি জলের দিশাহারা উথাল পাথাল নৃত্য, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে নিকটবর্তী নদীর পার! সেই নৈশ্য অলৌকিক রাতের নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে, শুনতে পেলাম শ্রীদামের পুরুষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সে বলে যেতে লাগল তার আর ফুলনের কলঙ্কের কথা, যা এই রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মতই এই দুটি মানুষের জীবনকে জড়িয়ে রেখেছে কোন অমোঘ বাঁধনে!

    “সে প্রায় সাত বছর আগেকার কথা। তখন এই নদীতে আরো অনেক মাঝিই তাদের নৌকা নিয়ে যাত্রীদের পারাপার করে দিনপাত করত। সেই শীতের রাতের কথা এখনো মনে আছে শ্রীদামের। সেই সময় তার নৌকা ছিল এই নদীর অপর পারে। বাকি সমস্ত মাঝি ভাইরা যে যার নৌকা নদীর তীরে বেঁধে রেখে, নিজের নিজের ঘরে চলে গেল, শ্রীদামও ভাবছিল, আজকের মত এটাই শেষ বার……আর তো কোন যাত্রীও নেই……ওই পারে পৌঁছেই নৌকা বেঁধে রেখে বাড়ি ফিরে যাবে সে। নৌকার বাঁধন খুলতে উদ্যত হলে, হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল দুজন নারীমূর্তি। তার মধ্যে একজন বেশ আকুল স্বরে বলে উঠল,
    – মাঝি ভাই….লক্ষীটি আমার…..আজ এই পৌষকালীর মেলায় এসে বড্ড দেরি হয়ে গেল আমাদের…..সবাই নৌকা বেঁধে বাড়ি চলে গেল…..এখন তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা…..আমাদের ওপারে নিয়ে চল ভাই…..
    শ্রীদাম একবার ভালো করে চেয়ে দেখল ওই দুই নারীকে, এদের মধ্যে একজন মাঝ বয়সী……কিন্তু অন্য জন…..অন্য জনকে এই শীতের রাতে চাদর মুড়ি দেওয়া অবস্থাতে দেখেও যেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শ্রীদাম……সে আর কেউ নয়……ফুলন! ফুলনও যেন বুঝতে পারল শ্রীদামের মনের অবস্থা, তাই সে মুখ টিপে হেসে, অপর মহিলাকে ইয়ার্কি করে বলে উঠল,
    – ও বৌদিদি……তোমার মাঝি ভাই কি কালা নাকি…..শুধু হা করে চায়…..’হ্যাঁ’ বা ‘না’ যে কিছুই বলে না…….
    এর পর ওরা দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলে, শ্রীদামের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে তখনই হাসি মুখে বলে উঠল,
    – কেন নে যাব না….নিশ্চয় নে যাব……আসুন মা ঠাকরুন, আসুন…..
    এই বলে প্রথমে সে ফুলনের বৌদিকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করে, আর তারপর ফুলনকে……. সারাক্ষণ শক্ত কাঠের বৈঠা ধরা হাত দিয়ে, সে যখন ফুলনের নরম হাতটা স্পর্শ করে তাকে নৌকায় টেনে তোলে, তখন যেন তার সারা শরীরে একটা তীব্র তড়িৎ-এর তরঙ্গ খেলে যায়…..সে ওই রাতের অন্ধকারেও মুগ্ধ নয়নে শুধু দেখতেই থাকে ফুলনকে……এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, যেন সে নৌকা চালানোই ভুলে গিয়েছে! ফুলনেরও বোধহয় শ্রীদামের স্পর্শ পেয়ে এমনই সুখানুভব হয়……কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নারী সুলভ লজ্জাবোধে ছুটে গিয়ে তার বৌদির পেছনে মুখ লুকোয়, ওদের দুজনের মুচকি হাসি যেন কোন কোকিলের কুহুতান শুনিয়ে যায় এই রাত্রির অন্ধকারেও!”

    এতটা বলার পর একবার থামলো শ্রীদাম। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, আমি তাড়াতাড়ি নৌকার ছাউনির ভেতর ঢুকে বসলাম। তীব্র হওয়ার দাপটে, বৃষ্টির ঠান্ডা জলের ঝাপটা এসে পড়ছে আমাদের সকলের শরীরে। শ্রীদাম যেন বৃষ্টির জলে ভিজেই চলেছে, চোখ বন্ধ করে স্বাদ নিচ্ছে জলের প্রতিটা ফোঁটার। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের গায়ের ভিজে যাওয়া স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুলে ফেলল শ্রীদাম……বৃষ্টির জলের ঝাপটা লেগে ওর চৌরা কাঁধের পেশিগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে! মনে মনে বেশ একটা হিংসা বোধ জাগল আমার, ওর এই সুঠাম সুন্দর শরীর দেখে…….সত্যিই এই চেহারা দেখে শুধু ফুলন কেন, যে কোন মেয়েরই মনে জেগে উঠবে কামের আগুন! ফুলন এখনো কি অপার্থিব মুগ্ধতায় চেয়ে আছে শ্রীদামের দিকে। আবার বলা শুরু করল শ্রীদাম।

    “এরপর থেকে প্রায়ই নদী পারাপার করার অসীম চাহিদা জাগত ফুলনের মনে, বলা বাহুল্য, তা শুধু শ্রীদামের নৌকাতেই……আর শ্রীদামও যেন অপেক্ষা করে বসে থাকত, কখন নদীর পার থেকে ছুটে আসতে দেখবে ফুলনকে…..কখন পাবে সে ফুলনের রাঙা গোলাপের মত হাতের স্পর্শ…..কখন আলতো করে হাত বোলাবে তার কোমর ছোঁয়া ঘন কালো চুলের মধ্যে……কিংবা, কখন তাকে কাছে টেনে নিয়ে, তার ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট রাখতে গিয়ে, নিজের বুক দিয়ে অনুভব করবে ফুলনের সুডৌল স্তন যুগলকে……..তবে, কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিল শ্রীদাম, যে তাদের এই সম্পর্কের কোন পরিণতি নেই, কারণ ফুলনের বাবা মা তার মত একজন সাধারণ মাঝিকে কখনোই তাদের জামাই বলে মেনে নেবে না।……আর হলও তাই……..একদিন ফুলন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীদামের বুকে, তারপর অধৈর্য কণ্ঠে কেঁদে উঠে বলল,
    – বাপ মা আমার বিয়া ঠিক করছে গ্রামের চৈতন্য ঘোষালের ছেলের সাথে…..ওরা খুব পয়সাওয়ালা লোক, ছিদাম…….ওর ছেলে বিনোদ শহর থেকে ডাক্তারি পড়ে এসেছে, তারও খুব পছন্দ হয়েছে আমাকে…….ওরা আমাকে তোমার কাছ থেকে সারা জীবনের জন্য কেড়ে নেবে, ছিদাম …..তাই বলছি, আজ…..আজ রাতেই চল…..আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে চল ছিদাম…..পালিয়ে চল…….
    এই কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগল শ্রীদাম, তারপর সে ফুলনকে গম্ভীর গলায় বলল,
    – তুই চলে যা ফুলন….চলে যা এখান থেকে…..আর আসিসনি কখনো আমার নাও-এ…….আমার সাথে থেকে জীবনে অভাব অনটন ছাড়া আর কিছুই যে পাবিনি তুই……তোর বাপ মা যেথায় তোকে বিয়া দিতে চায়, তুই সেথায় বিয়া করে সুখী হো…..আর আসিসনি কখনো আমার কাছে…..
    এই কথা শুনে প্রথমে খুব অবাক হয়ে এই কথার বিরোধিতা করেছিল ফুলন। কিন্তু যখন শ্রীদাম তার সিদ্ধান্ত থেকে একটুও নড়ল না, তখন সে কষিয়ে মেরেছিল শ্রীদামের গালে এক চড়……আর তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেই নদীর পার থেকে ছুটে চলে গিয়েছিল, আর কখনো না ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করে।”

    আবার একবার বলা থামলো শ্রীদাম। আমাদের নৌকা এখন প্রায় মাঝ নদীতে চলে এসেছে। বৃষ্টিটা এখনো পড়ছে। এখন নদীর অপর পারের কালো গাছপালা আর বন ঝোপগুলোকে এই চাঁদের আলোতে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এবার আমাকে অবাক করে, শাড়ির আঁচলের ভেতর থেকে মুখ নেড়ে এই কাহিনীর পরবর্তী অংশ বলতে লাগল ফুলন!

    “সেদিনের পর থেকে আর কখনো শ্রীদামের মুখদর্শন করেনি ফুলন……এর পর একদিন উলু শঙ্খের ধ্বনির মাঝে, ছাদনাতলায় এক অজানা মানুষের গলায় মালা পড়াতে বাধ্য হয়েছিল সে……বাধ্য হয়েছিল নিজেই অন্যের কাছে নিজের দাসখতে সই করে এক অচেনা মানুষের দেওয়া সিঁদুর নিজের সিঁথিতে ধারণ করতে……কিন্তু এই এতটা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে একবারও নিজের বরের দিকে চেয়ে দেখতে ইচ্ছা হয়নি ফুলনের, তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসা অশ্রুর প্রলেপের মাঝে শুধু ভেসে উঠেছিল শ্রীদামের সুন্দর মুখশ্রী…….এর পর এল ওদের ফুলশয্যার রাত! ফুলে ফুলে সাজানো বিছানায় ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে, আত্মীয় স্বজনের সমস্ত ইয়ার্কি ফাজলামি মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছিল সে এতোক্ষণ। তারা সকলে চলে যেতেই, হঠাৎ খুলে গেল ঘরের দরজা…..আর প্রথম নারীসঙ্গের অভিপ্রায়ে সেই ঘরে উত্তেজিত হয়ে প্রবেশ করল বিনোদ। এতোক্ষণ পর, ঘোমটার ভেতর থেকে নিজের স্বামীর দিকে যেন প্রথম চেয়ে দেখল ফুলন……..ঠিক যেন দামি ধুতি পাঞ্জাবী পরা, এক অসুস্থ চেহারার রোগা কাঠের পুতুল, কোন রকমে মদের নেশায় টলতে টলতে আসছে ফুলশয্যার খাটের পানে……..”

    (পর্ব-৪)

     

    “কোনোমতে ধুতির কোঁচাটা সামলে বিনোদ ঢলে পড়ল ফুলনের গায়ে। খাটের ধারে ঝুলন্ত রজনীগন্ধার মালাগুলো হুড়মুড় করে ছিঁড়ে পড়ল অনেকটা। টাল খেয়ে, জাপটে ধরল বিনোদ ফুলনের বুকটাকে, তারপর নিজের নেশাগ্রস্ত লাল চোখ দু’টিকে অনেক কষ্টে খুলে একবার চেয়ে দেখল ফুলনের মুখের দিকে। মদের গন্ধে ফুলনের গা গুলিয়ে উঠল, কিন্তু সে জানত, যে তাকে সহ্য করতে হবে…….যুগ যুগ ধরে তো সব মেয়েকেই সহ্য করে আসতে হয়েছে পুরুষের এই ফুর্তির দাপট! খুব আশ্চর্য লাগছিল তার…..এই লোকটা যে তার স্বামী আর সে যে তার স্ত্রী, এই কথা যেন মনেই হচ্ছে না ফুলনের……সে যেন শুধুমাত্র এই মানুষটার ভোগ্য সামগ্রী! এই কি তবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক…..সাত পাকে ঘুরে মালা বদল করে শাস্ত্র মতে বিয়ে করা বউ বলে যাকে সমাজ?…….বিনোদ ধাক্কা মেরে বিছানায় শুইয়ে দিল ফুলনকে, এক ঝটকায় সে তার বুকের ওপর থেকে সরিয়ে নিল বেনারসীর আঁচল……তারপর ওকে খামচে ধরে নিজের শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে ঝুঁকে পড়ল ওর দেহের ওপর…….মনে মনে শ্রীদামের মুখটা কল্পনা করে চোখ বন্ধ করল ফুলন…….কিন্তু একি! কিছুক্ষণের মধ্যেই টলমল করতে লাগল বিনোদের দুই হাত!……ফুলন বুঝলো, যে পৌরুষ জাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ক্রমাগত বিফল হচ্ছে মদ্যপ মানুষটা! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলনের শরীরের ওপর থেকে সরে গিয়ে, তার পাশে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল বিনোদ!………”

    এবার আসতে আসতে নৌকা ঘোরাতে শুরু করেছে শ্রীদাম। রাতও বেশ গভীর হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিটা কিছুক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেলেও, ঠান্ডা হওয়ার দাপটে গা শিরশির করে উঠছে। ক্রমে আমরা আবার পরিচিত নদীর পারের দিকেই এগোচ্ছি………ফুলনের দগ্ধ মুখের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছিল ওর শাড়ির ফাঁক থেকে, তাতেই দেখতে পেলাম এক ফোঁটা জল ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর চোখের কোনায়……কিন্তু কোন লজ্জা শরম না করে প্রতিবাদী গলায় বলে উঠল সে,
    – প্রথমে তো আমি ভেবেছিলুম, সেই রাতে নেশা করেছিল সে…….নেশায় শক্তি ক্ষয় করে দেয়, আমি জানি…….কিন্তু তারপর……তারপর প্রতিটা রাতেই এই একই ঘটনা ঘটত……..আমি খুব ভালো করেই বুঝে গেছিলুম, যে ওর শরীরে খুঁত আছে…..মেয়েমানুষের শখ মেটানোর খামতা ওর নেইকো…..কিন্তু বাবু, বিশ্বেস করেন, আমি তাও ওর বউ হয়েই ছিলুম, কখনো কিছুই চায়নিকো ওর কাছ থেকে…….যতদিন না……যতদিন না……

    “এরপর বিয়ের দুই বছরে মধ্যেও যখন ওদের কোন সন্তান জন্মাল না, তখন বিনোদের পরিবারের সকলেই আঙ্গুল তুলতে লাগল ফুলনের ওপর,
    – বাঁজা…..বাঁজা……বাঁজা মেয়েছেলের সাথে বিয়া দিয়া হল আমার অমন সোনার চাঁদ ছেলের……হায় ভগবান……বার করে দে, বার করে দে ওই মাগীকে ঘর থেকে………
    শ্বশুর শাশুড়ী ননদ দেওরের এমন গঞ্জনা তো হয়ে উঠেছিল ফুলনের নিত্য দিনের সঙ্গী। কিন্তু সে কোনদিন তাদের বলেনি তার মা হতে না পারার আসল কারণ……সে জানে, যে এই পুরুষশাসিত অজ পাড়াগাঁয়ে কেউ মানবে না তার কথা……ওদের জব্দ করতে হবে অন্য ভাবে……যে রাস্তা ফুলন ভালোই জানে! আর তাই নিজের নারীত্বের প্রমাণ দিতে সে এত দিনের পর, আবার একদিন রাতে, সকলের অজান্তে, ছুটে এসেছিল শ্রীদামের নৌকায়। প্রথমে শ্রীদাম রাজি না হলেও, ফুলনের জোরাজুরিতে আর বেঁধে রাখতে পারেনি সে নিজের শরীর মনকে!……সেদিন এমনই এক বৃষ্টি মুখরিত রাতে, উত্তাল নদীর স্রোতকে সাক্ষী রেখে, এই নৌকার ছাউনির মধ্যেই এক হয়েছিল দুটো শরীর! অপার্থিব সুখে মুগ্ধ ফুলন সেদিন বুঝেছিল প্রকৃত পুরুষের স্পর্শ কাকে বলে! নিচে নদীর জলের ধারা আর ওপরের নিকষ কালো আকাশে ফুটে থাকা তারারা যেন বিস্ময় চোখে চেয়ে দেখল এই দুটি প্রাণের এক হয়ে যাওয়ার সঙ্গম দৃশ্যকে…….বলাই বাহুল্য, যা থেকে কিছু দিনের মধ্যেই ফুলনের দেহে সৃষ্টি হয়েছিল নতুন এক প্রাণের!…….একদিন তার শ্বশুর বাড়ির সকলের চোখে চোখ রেখে জানিয়েছিল সে, যে সে গর্ভবতী……আর এতেও যদি তাদের বিশ্বাস না হয়, তাহলে তারা অপেক্ষা করে দেখুক না আর কয়েকটা মাস! সেদিন সে দেখেছিল, তার স্বামীর অগ্নি দৃষ্টি……কোন ক্ষুধার্ত চিতা বাঘের গলায়, প্রথম গ্রাসেই যখন তার শিকারের কোন তীক্ষ্ণ হাড় আটকে যায়, যখন সে না পারে তাকে গিলতে আবার না পারে ওগলাতে……ঠিক সেই অবস্থায় মনে হচ্ছিল বিনোদকে দেখে! সে না তো বাড়ির সকলকে বলতে পারছিল নিজের অক্ষমতার কথা, না মনে মনে মেনে নিতে পারছিল ফুলনের গর্ভের সন্তানকে!…কিন্তু, এমন অবস্থায়, এই কথা জেনেও, যে বিনোদ যে কোন সময় তার ওপর প্রতিশোধের আঘাত হানতে পারে……ক্রমাগত একটা মস্ত বড় ভুল করতে থাকল ফুলন!”

    আমাদের নৌকা এখন নদীর সেই পুরোনো পারের অনেকটাই কাছে এসে পড়েছে……আমি বুঝলাম, যে শেষ হতে চলেছে আমার পঞ্চাশ টাকার নৌকা ভ্রমণের মেয়াদ……তবে এই কথা সত্যি, যে টাকাটা কিন্তু বিফলে গেল না, আমার অনেক দিনের সাধ আজ পূর্ণ করল শ্রীদাম। তবে খুব কৌতূহল হচ্ছিল জানার, যে এরপর কি হল ফুলন আর শ্রীদামের জীবনে? ফুলনকে জিজ্ঞাসা করতেই, সে উন্মাদের মত খিল খিল করে হেসে উঠল। তারপর এই রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে সে বলে উঠল,
    – তারপর, তারপর আর কি, বাবু…….একবার ছিদামের পরশ পেয়ে, আমি পাগলীর মত, যখনই সুযোগ পেতুম, তখনই ছুটে আসতুম ওর নৌকায়……সমস্ত লাজ লজ্জা, মান সম্মানকে পিছু থুয়ে…..এই নদীকে দেখছেন, এই নদীর জলের প্রতিটা স্রোত আমাদের কলঙ্ককে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিত এই নৌকা থেকে…….কিন্তু এই নদী আমাদের ক্ষমা করে দিলেও…..বিনোদ আমাদের ক্ষমা করলনি…..একদিন সমস্ত গ্রামবাসীদের এথায় নে এসে আমাদের হাতে নাতে ধরল সে…..সবার সামনে বলল সে, যে আমি কূলোটা…..আমি বেশ্যা…….সেদিনই গ্রামের সকলে ফয়সলা করল, যে পরপুরুষের সাথে শোয়ার জন্য, আমাকে আর কোন দিন ঘরে তুলবে না আমার সোয়ামী……আর ছিদামকেও একঘর করে দেওয়া হবে গাঁয়ে…….
    ফুলন থামলে, এতোক্ষণ পর মুখ খুলল শ্রীদাম, হো হো করে হেসে উঠে বলল,
    – সেই শাপে যেন আমাদের বর হল, বাবু…..সেই দিন থেকেই আমাদের এই ভাবে একসাথে পথ চলা……সারা গাঁয়ের মানুষের আমার দরকার নেই, কিন্তু ফুলনকে তো কাছে পেলুম……তাই তো আপনাকে বলেছিলাম বাবু……শুধু কি বিয়া করলেই সোয়ামী ইস্তিরি হওয়া যায়?
    নৌকাটাকে নদীর তীরে বাঁধতে বাঁধতে আরো কত কিছু বলে গেল শ্রীদাম, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে গেলাম ওদের সব কথা, কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারলাম না ওদের প্রশ্নের!…….একটু পরে যখন শ্রীদাম আমার কাছে নৌকা ভ্রমণের দাম চাইতে এল, আমি দেখলাম, যে আমার ওয়ালেটে আছে চারটেই একশো টাকার নোট…..শ্রীদাম হাসিমুখে আমার কাছ থেকে একটা একশো টাকার নোট নিয়ে, ওর লুঙ্গির গিঁটে বাঁধা, একটা বৃষ্টির জলে ভেজা পঞ্চাশ টাকার নোট আমায় ফেরত দিল……..আমি বাড়ি ফেরার আগে ওদের বলে এলাম,
    – তোমরা তো এই নদীতেই থাকো…..আমি কিন্তু মাঝে মধ্যেই ইচ্ছা হলে আসবো, তোমার নৌকায় চাপতে……
    ওরা হাসি মুখে চেয়ে থাকল আমার দিকে!

    (শেষ পর্ব)

     

    পরদিন সকালে হাবু এলে, একটা হেস্তনেস্ত না করে আমার শান্তি হচ্ছিল না। ওকে দেখা মাত্র আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
    – কাল তো বেশ মিথ্যা মিথ্যা ভয় দেখিয়ে গেলে আমায়……রাত্রের পর বাইরে বেরোবেন না, জায়গাটা ভালো নয়……আরো কত কথা…..আমি তো কাল সারাটা রাত ওই শ্রীদাম মাঝির নৌকা করে নদী থেকে ঘুরে এলাম…..কত কথা হল আমার ওর আর ওর বউ ফুলনের সাথে…..কই, ভয় পাওয়ার মত তো কিছুই দেখলাম না আমি?……আমাকে নতুন লোক দেখে, বোকা বানাতে ওই সব ভয় দেখানো কথা কাল বলে গেলে বুঝি?
    এই কথা শুনে, হঠাৎ, আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল হাবুর শরীর! সে কোন রকমে আমায় বলে উঠল,
    – ক…ক….কত্তা, আপনি…..আপনি ছি…ছি….ছিদাম আর ফু….ফু….ফুলনকে দেখতে পেয়েছেন!
    আমি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম,
    – মানে…..দেখতে না পাওয়ার কি আছে ওদেরকে? ওরা তো সারাক্ষণ ওই নদীর ওপর নৌকা নিয়েই থাকে…..এখনো আছে নিশ্চয়……
    এই বলে আমি কাল রাতে শ্রীদাম আর ফুলনের কাছ থেকে যা যা শুনেছিলাম ওদের সম্বন্ধে, তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলাম হাবুর কাছে।

    এই কথা শুনে, হাবু আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বার করে নিয়ে এল নদীর পারে। সকালের সোনালি রোদে ভরে উঠেছে নদীর জল, চারিদিকে সুন্দর সবুজ গাছপালার মধ্যে ডেকেই চলেছে কত নাম না জানা পাখির দল…….কিন্তু আশ্চর্য তো! শ্রীদামের নৌকাটা কোথায় গেল!……আমি ছুটে গেলাম নদীর আরো কাছে…..তবুও, চারিদিকে দিগন্ত বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে কোথাও চোখে এলো না ওদের নৌকাখানা! আমি একবার চিৎকার করে ডাকলাম ওদের নাম ধরে……কিন্তু, বলাই বাহুল্য, কেউ সাড়া দিলো না আমার ডাকে! হাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল আমার কাছে, তারপর আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে বলতে লাগল,
    – আ…আ….আপনার ভাগ্য ভালো কত্তা, যে আপনি কাল রাতে বেঁচে গেছেন…..এই জন্যই আমি আপনাকে কাল বলেছিলাম রাতে না বেরোতে, কারণ এই কথা সকলেই জানে, যে কোন অচেনা মানুষ দেখলে, ওরা তাকে দেখা দেয় কত্তা!…..নিজেদের মরার আগেকার গল্প শোনাতে থাকে!
    আমার বুকটা ভয়ে হিম হয়ে গেল এই কথা শুনে, এ কি বলছে হাবু! ওকে কোন কিছু জিজ্ঞাস করার ক্ষমতাও যেন আমার আর নেই…..কিন্তু সে বলেই চলল,
    – তবে, আপনার মত আর অন্য সকলকেই ওরা একটা মিছে কথা কয়……ফুলনের পেটে ছিদামের বাচ্চা আসার পর, ওর সোয়ামী ওকে ত্যাগ করেনি, কত্তা……ওকে…..ওকে….গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল…..ওই ওই ইস্টোভ বাস্ট করার কথাটাও মিথ্যা……আর সেই খবর পেয়ে ছিদামও এই নদীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করে…..এই কতা গাঁয়ের সবাই জানে কত্তা…….সবাই জানে!
    আমি আর সহ্য করতে না পেরে বসে পড়লাম নদীর পারে ঘাসের ওপর……তার মানে……তার মানে, আমি কালকের গোটা রাতটা দুজন প্রেতাত্মার সাথে গল্প করে কাটালাম!……আর ভাবতে পারলাম না আমি…..মনের মাঝে প্রবল ইচ্ছা হল একটা সিগারেট খাওয়ার, কিন্তু পকেটে যে সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে রয়েছে। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে, হাবুকে বলে উঠলাম,
    – হ….হ…হাবু, আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো তো…..তাড়াতাড়ি……
    হাবু পয়সা চাইতেই আমি ওয়ালেট হাতড়ে দেখলাম তিনটে একশো টাকার নোটের মাঝে পড়ে আছে একটাই পঞ্চাশ টাকার নোট…..সেটা বার করে হাবুকে দিতেই সে ছুটে চলে গেল আমার জন্য সিগারেট আনতে……কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার মনে হল, যে নোটটা কেমন ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে না?…….আতঙ্কে আবার নদী পারে বসে পড়লাম আমি……আরে, এই “কলঙ্ক বাহিনী” নদীর বুকে ওর নৌকায় ভ্রমণ করার পারিশ্রমিক নেওয়ার পর, এই নোটটাই তো কাল আমাকে শ্রীদাম দিয়েছিল একশো টাকা ভাঙিয়ে!

    (সমাপ্ত)

     

  • গল্প

    মুক্তি

    মুক্তি
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)

    মোবাইলে এস.এম.এস-এর ইনবক্সে আসা ঠিকানাটাকে আরেকবার পড়ে নিয়ে, রাস্তার সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি। হ্যাঁ, এই বাড়িটার ঠিকানাটাই তো সেই ভদ্রলোক আমাকে মেসেজ করে পাঠিয়েছেন। আর কিছু না ভেবে আমি গিয়ে কড়া নাড়লাম সেই বাড়ির সদর দরজায়। কিছুক্ষণ পর, দরজা খুলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে, এসে দাঁড়ালেন একজন রোগা চেহারার বয়স্ক ভদ্রলোক। উনি কিছু বলার আগেই, আমি বলে উঠলাম,
    – নমস্কার…..আমি সুবিনয় সেনগুপ্ত…..খবরের কাগজে আপনার দেওয়া বিজ্ঞাপনটা দেখে, আমি আজ সকালেই আপনাকে ফোন করেছিলাম, তখন আপনি এই ঠিকানাতে এসে দেখা করতে বলেন……আপনি নিশ্চয় রামচন্দ্রবাবু?
    এবার হাসি ফুটে উঠলো ভদ্রলোকের মুখে, তিনি প্রতিনমস্কার জানিয়ে, সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করে আমাকে বাড়িতে ভেতরে আসতে বললেন।

    বাড়ির ড্রইং রুমে বসে ভদ্রোলকের সাথে কথা হচ্ছিল আমার। কিছুক্ষণ আগেই ধূমায়িত কফি আর বিস্কুটের ট্রে আমাদের সামনে রেখে গিয়েছে বাড়ির চাকর। কফির মাগে সশব্দে চুমুক দিয়ে, বেশ আয়েশ করে, রামচন্দ্রবাবু আমাকে বলে উঠলেন,
    – তা মশাই-এর হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে বিষ্ণুপুরে যাওয়ায় মনোবাসনা হল কেন?
    আমি উত্তর দিলাম,
    – আসলে, আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পি.এইচ.ডি করছি, আমার গবেষণার বিষয়ের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রাচীন রাজবংশ তথা তাদের শিল্প-সংস্কৃতির কথা……তাই…….
    উনি বলে উঠলেন,
    – বাহ, বেশ, বেশ……ঠিক আছে, আমার বাড়িটা তো ওখানে ফাঁকাই পড়ে আছে বেশ কিছু বছর ধরে, যবে থেকে ছেলে বৌমার সাথে আমি এই কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছি…..তা, আপনি কত দিনের জন্য ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতে চাইছেন?
    আমি কফিতে একবার চুমুক দিয়ে বলে উঠলাম,
    – এই ধরুন পাঁচ-ছয় মাস…..তার মধ্যেই গবেষণার জন্য সমস্ত দরকারি তথ্য জোগাড় করা হয়ে যাবে, আশা করি……
    উনি প্রসন্নতার হাসি হেসে বললেন,
    -ভালো কথা…..বাড়ি ভাড়া আর সিকুরিটি ডিপোজিট , কতো তো আপনাকে ফোনেই বলেছি, আর তা নিয়ে আপনার কোন সমস্যা নেই, সেকথাও জানিয়েছেন……তবে মশাই, ভাড়ার টাকাটা কিন্তু প্রতি মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে দিতে হবে, মনে থাকে যেন….…আপনি কাল থেকেই ওখানে শিফট করে যেতে পারেন, তবে তার আগে আপনার যে কোন একটা পরিচয় পত্রের ফটোকপি…..
    আমি হেসে বলে উঠলাম,
    -অবশ্যই….আমি ভুলিনি সেই কথা….আজকেই নিয়ে এসেছি সিকুরিটি ডিপোজিট আর পরিচয় পত্রের কপি…..তো, আর কিছু বলার আছে আপনার আমাকে?

    এবার রামচন্দ্রবাবু বেশ গম্ভীর মুখে আমাকে বললেন,
    -তবে….তবে, ওই বাড়ির পাশের বাড়িতে একজন ভদ্রলোক থাকেন, নাম মহিতোষ নন্দী, রামানন্দ কলেজের অধ্যাপক …….ওনাকে একটু সমঝে চলবেন, মশাই……
    আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
    -কেন বলুন তো?
    রামচন্দ্র বাবু বেশ চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
    -আসলে, কয়েক বছর আগে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওনার স্ত্রী মারা যান…..তারপর থেকেই কেমন যেন খেপাটে স্বভাবের হয়ে গেছেন উনি…..কলেজের সময়টুকু বাদ দিয়ে সর্বক্ষণ বাড়ির ভেতরেই থাকেন, পাড়ার কারোর সাথে তেমন কথাবার্তাও বলেন না, তাছাড়া……তাছাড়া…..
    আমি কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলাম,
    -তাছাড়া…..তাছাড়া কি?
    রামচন্দ্র বাবু অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন,
    -তাছাড়া তার স্বভাব চরিত্রও তেমন ভালো নয়……পাড়ার অনেকেই, বেশ কিছু বার, অচেনা মেয়েদের ওনার ঘরে যেতে দেখেছে!
    আমি সহাস্য কণ্ঠে তাকে বলে উঠলাম,
    -না না, রামচন্দ্র বাবু…..পাশের বাড়িতে কে কি করছে, তাতে আমার কি? ওসব নিয়ে আমার কোন অসুবিধাই হবে না….আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন!

    (২)

    বিষ্ণুপুরে অত্যন্ত মনোরম স্থানে অবস্থিত রামচন্দ্রবাবুর দোতলা হলুদ রঙের ছোট্ট বাড়িটা। তবে জায়গাটা বেশ নির্জন, আশে পাশে আর সেরকম কোন বাড়ি ঘর চোখে পড়ে না, শুধু ওই এক মহিতোষ নন্দীর বাড়ি ছাড়া। এই বাড়ির সামনে একটা বেশ বড় পুকুর, অন্য দিকে একটি দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, আর পেছনে এবং আরেক দিকে মহিতোষবাবুর বাড়িটা ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে সুসুনিয়া পাহাড়ের পাথুরে জমি। দোকানপাট বা জনবসতি খুব একটা ধারে কাছে নেই, তার জন্য অনেকটা সময় ধরে হাঁটা পথ দিয়ে চলতে হয়……তাই বাজার হাট করাটা বেশ মুস্কিলের ব্যাপার এখানে। এই বাড়ির ডান দিকে, বাগানের কিছুটা অংশ পেরিয়ে গেলেই, শুরু হয়েছে মহিতোষ বাবুর বাড়ির জমির পাঁচিল। তার বাড়িটাও দোতলা, তবে বেশ বড় জায়গা জুড়ে অবস্থিত, পুরোনো আমলের বনেদি ধাঁচে গড়া। তবে, এখন তা খুব একটা দৃষ্টিনন্দন না হলেও, বেশ কিছু জায়গায় আধুনিক যুগের মেরামতির ছাপ লক্ষ্যনীয়।

    বিকালের দিকে, যখন আমি বাগানের ভেতর একটু পায়চারি করছি, সেই সময়ই প্রথম দেখা হল মহিতোষ বাবুর সঙ্গে। ভদ্রোলকের বয়স পঞ্চাশের কাছে হলেও, তার চেহারা অত্যন্ত ঈর্ষণীয়…..লম্বা সুঠাম মেদহীন ফর্সা শরীরে বনেদি আভিজাত্যের ছটা স্পষ্ট, চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা, এবং ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি যেন তার পুরুষালি গাম্ভীর্যে আরো মাধুর্য এনেছে। তিনি বোধহয় কলেজ থেকে ফিরলেন, বাড়ির সামনে নতুন তৈরি গ্যারেজে গাড়িটা ঢুকিয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই আমার সাথে চোখাচোখি হল ভদ্রোলকের। আমি মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করলেও, উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, তারপর কোন কথা না বলে, ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতর। আমিও মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভেতর ফিরে আসতে যাবো, এমন সময় হঠাৎ আমার চোখ চলে গেল মহিতোষবাবুর বাড়ির দোতলার একটি ঘরের পেছনের খোলা জানলার দিকে……..দূর থেকে দেখে, এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, যে সেই জানলার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাক পরিহিতা এক নারীমূর্তি! আমি চমকে উঠে আরেকবার ভালো করে চাইলাম সেই দিকে…..কিন্তু নাহ্…..এখন আর কাউকেই জানলার আড়ালে দেখতে পেলাম না! ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো আমার, মনে হলো হয়তো চোখের ভুল……তবে, রামচন্দ্রবাবুর কথা অনুযায়ী, বিপত্নীক মহিতোষ বাবুর বাড়িতে কোন মহিলার দেখা পাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়…..কিন্তু আমি যে নিজে চোখে দেখলাম, যে মহিতোষবাবু বাড়ির সদর দরজার তালা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন, আর সেই মুহূর্তে তার সাথে অন্য কেউ ছিলোও না…….তাহলে…..তাহলে কি উনি কোন মহিলাকে ওই বাড়ির ভেতরে রেখে, বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে বেরিয়েছিলেন! কিন্তু কেন?

    সেদিন এই নতুন জায়গায় পৌঁছে, সবকিছু গোছগাছ করতে করতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় একটি হোটেল থেকে রাতের খাবারটা কিনে এনেছিলাম। সমস্ত দিনের ট্রেন জার্নির ধকলে বেশ ক্লান্ত হয়ে, তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু জানিনা কেন, ঘুম আসছিলো না দুই চোখে……রাত একটু বেশি হতেই শুরু হয়ে গেল প্রবল বজ্র- বিদ্যুৎ সহ ভারী বর্ষণ। আমার ঘরের বাইরে রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে ক্রমাগত বৃষ্টির শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ফাঁকা বাড়িতে একা আমি, আর তাছাড়া আজ সারা দিন ধরে লোড-শেডিং……এমন আবহাওয়ার মধ্যে কেমন যেন গা ছমছম করছিল আমার। মহিতোষবাবুর বাড়ির জানলায় দেখা সেই মেয়েটির দৃশ্যটাও যেন বার বার ঘোরাঘুরি করছিল চোখের সামনে! আচমকাই বৃষ্টির তেজটা যেন একটু বেড়ে গেল বোধহয়……আমার পাশের জানলা দিয়ে আসা বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যেতে লাগল বিছানার চাদর। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলাম জনলার দুই পাল্লা।

    ঘুমটা কতক্ষণ  এসেছিল বলতে পারবো না, এমন সময় কিসের যেন একটা ঠক ঠক আওয়াজ শুনে খুলে গেল দুই চোখের পাতা। আরেকবার…..আরেকবার শুনতে পেলাম শব্দটাকে……বুঝতে বাড়ি রইলো না, যে শব্দটা আসছে ওই জানলার কাঁচের সার্সির বাইরে থেকে! কেউ যেন বাইরে থেকে ক্রমাগত আলতো হাতে ঠোকা মেরে চলেছে জানলার পাল্লার গায়ে! আতঙ্কে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল……আমি ধরফর করে বিছানা থেকে উঠে বসলাম…..তারপর ছুটে গিয়ে ব্যাগ হাতড়ে বার করলাম একটি মোমবাতি আর দেশলাই-এর বাক্স…..শব্দটা তখনও হয়ে চলেছে……আমি কম্পিত হাতে বেশ কয়েকটা দেশলাই-এর কাঠি নষ্ট করে, মোমবাতিটা জ্বালিয়ে ধরে একবার চেয়ে দেখলাম জনলাটার দিকে!……মোমবাতির কম্পমান আলো গিয়ে পড়ল বন্ধ জনলাটার গায়ে আর তাতে আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম……জানলার কাঁচের সার্সির বাইরে একটি হাতের ছায়া…..এই অন্ধকার ঘরের মোমবাতির ক্ষীণ আলোতেও দেখা যাচ্ছে তার সরু সরু পাঁচটা আঙুলের আকৃতি!……ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলে, আমি মোমবাতিটা হাতে করে, আরোষ্ঠ হয়ে দেওয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম!

    এবার এই হাতের তর্জনীটা ছাড়া অন্য আঙুলগুলো ভাঁজ হয়ে মুঠোর মধ্যে চলে এল…..ধীরে ধীরে তর্জনীটা স্পর্শ করল জানলার কাঁচের বাইরের পৃষ্ঠতলে…..তারপর যেন মনে হল, সেই বৃষ্টির জলে ভেজা কাঁচের বাইরে থেকে আঙ্গুল বুলিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছে সেই হাত!……আমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলাম সেই দিকে…..প্রথমে লেখা হল “ম”……তারপর “উ-কার”……তারপর “ক-এ ত-এ”…..এবং অবশেষে “ই-কার”……আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল সেই অশরীরি হাতের লেখা শব্দটি……”মুক্তি”!

    (৩)

     

    আমি কতক্ষন দেওয়ালের গায়ে এই ভাবে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, সম্বিত ফিরে এল, যখন হঠাৎ করে ঘরের আলোগুলো জ্বলে উঠল। তার মানে এতক্ষন পরে লোড-শেডিং-এর সমস্যা দূর হয়েছে। আমি সাহসে বুক বেঁধে, ছুটে গিয়ে তখনই খুলে দিলাম সেই জানলার দুই পাল্লা। বলাই বাহুল্য, জানলার বাইরে কাউকেই দেখতে পেলাম না। তবুও আমি হাল না ছেড়ে, তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম, পেছনের বাগানে, ঠিক ওই জনলাটার বাইরে। চারিদিকে নিশুতি রাতের গাঢ় অন্ধকার, বৃষ্টির দাপট অনেকটাই কমে গিয়েছে……এই বাড়ির পাশেই কষ্টি পাথরের তৈরি দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে আছে মহিতোষ বাবুর বাড়িটা! কিন্তু, নাহ…..আঁধারের মধ্যে যতদূর দুই চোখ যায়, কাউকেই তো দেখতে পেলাম না। আমি চারদিকে তাকাতে তাকাতে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম বাগানের মধ্যে দিয়ে, মহিতোষ বাবুর জমির পাঁচিলের খুব কাছে। হঠাৎ সেই রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে, কানে যেন একটা অস্ফুট পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল, “আহহ আহহ…..”

    আমার মনের কৌতূহল মাথায় একটি দুর্বুদ্ধি খেলিয়ে দিলো, আমি সন্তপর্নে পাঁচিল টপকে চলে এলাম মহিতোষ বাবুর বাড়ির খুব কাছে। তারপর সেই শব্দেকে অনুসরণ করে, তার বাড়ির একতলার একটি ঘরের পেছনের জানলার বাইরে দাঁড়াতেই সেই শব্দের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে এলো…..বন্ধ জানলার ট্রান্সলুসেন্ট কাঁচের সার্সির ভেতর থেকে, সেই ঘরের বিছানার ওপর শোয়ানো একটি নগ্ন নারীদেহের অস্পষ্ট আবছায়া দেখা যাচ্ছে, আর তার ওপর উপর হয়ে নিজের উলঙ্গ শরীরটাকে ক্রমাগত সামনে পেছনে দুলিয়ে চলেছে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষ…….বুঝতে বাকি রইল না, যে তিনি হলেন মহিতোষ বাবু, আর তার কন্ঠ থেকেই আসছে ওই শব্দ। আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে তারাতারি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। কিছুক্ষন আগেই সেই অশরীরির উপস্থিতির ভীতি যেন আমার মস্তিষ্কে আর নেই…..তার জায়গায় আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুতে যেন জমে উঠেছে কামোত্তেজনা! আমি কোন কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম….কিন্তু হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল…..সঙ্গমের সময় কি শুধু পুরুষের গলা দিয়েই সুখের শব্দ উৎপন্ন হয়? কই, ওখানে তো কোন নারীর কন্ঠস্বর আমার কানে আসেনি!

    (৪)

    পরদিন সকালের দিকে, বিষ্ণুপুরের প্রাচীন কয়েকটা মন্দিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ঘর থেকে সবে বেড়িয়েছি, এমন সময় আবার চোখ চলে গেল মহিতোষ বাবুর বাড়ির দিকে। নাহ, এবার কোন নারীমূর্তি নয়…..এবার দেখতে পেলাম একজন বেঁটে কালো চেহারার পুরুষকে, সে যেন ফিসফিস করে কিসব কথাবার্তা বলছে মহিতোষ বাবুর সঙ্গে, সেই বাড়ির সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে! কিছুক্ষন পর, সে বেরিয়ে এলো সেই বাড়ি থেকে, আর মহিতোষ বাবুও বোধহয় কলেজের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে, অপর ব্যক্তিটি বাড়ির সামনের গলিটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই বাড়ির সামনে এসে, আমাকে দেখে কেমন যেন থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও কৌতূহলী হয়ে তার কাছে যেতেই, সে দাঁত বার করে একটি কুচ্ছিত হাসি হেসে আমাকে বলে উঠল,
    – স্যারের কি এই বাড়িতে নতুন আসা হয়েছে নাকি?
    আমি বললাম,
    – হ্যাঁ, গতকাল থেকেই ভাড়া নিয়েছি একতলাটা……
    সে আবার হেসে, দুই হাত কচলে আমাকে বলে উঠল,
    – তা মশাই, বিয়ে-থা করেছেন, নাকি ব্যাচেলর?
    আমি বিরক্তি ভরে বলে উঠলাম,
    – না, বিয়ে করিনি…..কিন্তু প্রথমে বলুন আপনি কে? আর এই সব কেন জানতে চাইছেন?

    সে অস্ফুট স্বরে, বেশ লোভনীয় কণ্ঠে বলে উঠল,
    – স্যার, আমার নাম জগাই…..আ…আ….আমি, এই কাছেই, এখানকার এক রেড লাইট এলাকার দালাল……এই অঞ্চলের সবাই চেনে আমাকে……তাই, স্যার, বলছিলাম কি…..আমার হাতে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো ইয়ে আছে…..সবারই দুধে আলতা গায়ের রং…..আপনার লাগলে বলতে পারেন….
    প্রথমে আমি চমকে উঠলাম এই কথা শুনে, তারপর বুদ্ধি করে, প্রসঙ্গ পাল্টে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
    – তা মহিতোষ বাবু তোমার সার্ভিসে স্যটিসফায়েড তো?
    সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,
    – স্যটিসফায়েড বলে স্যটিসফায়েড……আরে মশাই, উনি তো আমার থেকেও আরো বড় দালাল……এই নিয়ে চারটে মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম ওনার ঘরে……উনি প্রচুর পয়সা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন তাদের…..তারপর তিনি বললেন, যে তিনি নাকি তাদের আরো বেশি দামে দুবাই-এর কোন এক ব্যবসায়ীর কাছে বেচে দিয়েছেন…..মেয়েগুলোর ভাগ্য সত্যিই ভালো স্যার, তারা তো ওখানে রাজরানী হয়ে আছে…..আর বোধহয় না এই দেশের মাটিতে কখনো পা ফেলবে তারা!
    আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
    – তারপর সেই মেয়েগুলোর সাথে কি আর কোনোদিন কথা হয়েছিল তোমার?
    সে হেসে বলল,
    – ধুর স্যার, কি যে বলেন…..আমি মাল দিয়েছি, পয়সা পেয়েছি, খেলা শেষ…..আর আমার কি দরকার তাদের খোঁজ নেওয়ার!
    আর কয়েকটা সামান্য কথাবার্তা বলে চলে গেল জগাই, যাওয়ার আগে আমাকে বার বার বলে গেল, যে “ইয়ের” দরকার হলে তাকে যেন অবশ্যই জানাই। আমি সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম তার দিকে!

    (৫)

    সেদিন বিকালের দিকে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, তখনও বুঝতে পারিনি, যে সেদিনই হবে এই নাটকের যবনিকা পতন…….আর যে ঘটনার সম্মুখীন আমাকে হতে হবে, তা সারা জীবন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে! সেদিন বাড়ির সদর দরজার তালা খুলতে যাবো, এমন সময় নাকে গেল, কেমন যেন একটা কেমিকেল আর আঁশটে গন্ধের মিশ্রণ! চারিদিকের হওয়া-বাতাসও যেন গুম মেরে গেছে, কেমন যেন একটা ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া চারিদিকে! কিন্তু বুকটা ধক করে উঠল তখন, যখন মহিতোষ বাবুর বাড়ির ছাদে দেখা মিলল, সেই গতকাল দেখা নারীমূর্তির! এবার কিন্তু সেই দৃশ্য পরমুহূর্তে অদৃশ্য হল না…..সেই মেয়েটি একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে উঠল!

    দুরু দুরু বুকে, আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিক পানে……এবার সেই মেয়েটি আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় সেই বাড়ির ছাদের নিজের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করল। সদিকে তাকাতেই, সেই বাড়ির দোতলার ঘরের একটি জানলা হঠাৎ খুলে গেল……আর সেখানে দৃশ্যমান হয়ে উঠল আর এক নারীমূর্তি। আমি অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম, যে এই দ্বিতীয় মেয়েটি তার হাতের ইশারায় আমাকে আবার নিচের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করছে!……আর ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেল, সেই বাড়ির এক তলার ঘরের আরেকটি জানলা। আমি আতঙ্ক সহ্য করবার পরীক্ষা দিতে দিতে দেখতে পেলাম, এই জানলার পেছনেও দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মেয়ে! এই তৃতীয় মেয়েটি আমাকে আবার ইঙ্গিত করল তার ডান দিকে তাকাতে। আর সেই মুহূর্তে, আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, যে সেই বাড়ির সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মেয়ে। এই চতুর্থ মেয়েটি মহিতোষ বাবুর বাড়ির তালাবন্ধ সদর দরজার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করল! আমি আর একটুও সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলাম সেদিকে…….. তারপর নিচ থেকে একটি পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে কয়েকবার তালাটার গায়ে আঘাত করতেই, সেটা সশব্দে খুলে পড়ে গেল দরজা থেকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই, পেছন ঘুরে আর দেখতে পেলাম না সেই মেয়েটিকে।

    আমি রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়লাম মহিতোষ বাবুর বাড়ির ভেতরে……তারপর সেই অদ্ভুত আঁশটে গন্ধটাকে অনুসরণ করে, সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উঠতে লাগলাম ওপরের দিকে…….এখানে সেই গন্ধটার তীব্রতা আরো বেশি, আমি রুমাল বার করে নাকে চাপা দিয়ে দোতলার একটি ঘরের ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে, সেই ঘরের দৃশ্য দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম!…….সেই ঘরের চারপাশে, চারটে বড় বড় তরল পদার্থে ভরা কাঁচের বাক্সের প্রতিটার মধ্যে রাখা রয়েছে একটি করে নগ্ন নারীর শরীর! দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে বহুদিন আগেই মারা গিয়েছে মেয়েগুলি, তাদের পেট কেটে থেকে নাড়িভুড়ি বার করে নিয়ে, তারপর সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের দেহ…..এবং সেগুলিকে ফরমালিন বা ওই জাতীয় কোন এমবালমিং তরলের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে, যাতে মরদেহে কোন পচন না ধরে! কিছুক্ষন বিহ্বল হয়ে থেকে, নিজের মনেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম আমি,
    – তার মানে…..তার মানে, মহিতোষ বাবু……একজন নে…নে….….
    ঠিক সেই মুহূর্তে আমার পেছন থেকে একটি গুরুগম্ভীর পুরুষকণ্ঠ ভেসে এলো,
    – নেক্রফিলিয়াক……তাই তো? হ্যাঁ, এই শব্দটাই ব্যবহার করা হয় তাদের জন্য, যারা মৃতদেহের সাথে সহবাস করে মানসিক শান্তি পায়!
    আমি পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, যে দুই হাত দিয়ে একটি রিভলবার ধরে, আমার দিকে সেটা তাক করে, মুখে ক্রুর হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মহিতোষ বাবু!

    আমি কিছু বলার আগেই তিনি উন্মাদের মত বিকট হেসে বলে উঠলেন,
    – আসলে কি জানেন তো মশাই, এইসব সুন্দরী মেয়েগুলোর রূপ যৌবন আর কতদিন থাকবে, বলুন? বয়স হলেই তো সব শেষ……তাই আমি ওদেরকে মেরে, ওদের শরীরগুলো এই ভাবে প্রিসার্ভ করে রাখি…..যাতে জীবন ভর ওদের শরীর একই রকম যুবতী অবস্থায় থাকে…..যাতে আমি সারা জীবন ওদের এই সুন্দর শরীরগুলো ভোগ করে যেতে পারি……এই কথা আর কেউ জানে না, শুধু এখন আপনি জেনে গেলেন……তাই, আপনাকেও আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না….কিছুতেই না……সো গেট রেডি টু ডাই…….হাহাহাহা…..
    উনি হিংস্র মুখে রিভিলবারের ট্রিগারে চাপ দিতে গেলেন……সাক্ষাৎ মৃত্যুকে নিজের সম্মুখে দেখে সভয়ে এক পা পিছিয়ে এলাম আমি…..ঠিক এমন সময়…..হঠাৎ জ্বলা নেভা করতে শুরু করল সেই ঘরের লাইট…..আর সেই ক্ষণিক আলো ক্ষণিক অন্ধকারের ছন্দের মধ্যেই, আমি দেখতে পেলাম……যে মহিতোষ বাবুর চারপাশে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই চার নারীমূর্তি! তারা রক্তহীন নিষ্পলক চোখে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে! ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে যেতে লাগলো তার কাছে…..আরো কাছে……আতঙ্কে একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলেন মহিতোষ বাবু, তার হাত থেকে নিচে পড়ে গেল রিভলভারটা…….কিন্তু তার চিৎকারকেও ছাপিয়ে গেল, সেই চার অশরীরি নারীর সমবেত কণ্ঠস্বর,
    – মুক্তি……মুক্তি চাই, মুক্তি!……মৃত্যুর পরেও, নিজের শরীরের ওপর এই নরপিশাচটার দেওয়া নরক যন্ত্রনার জ্বালা থেকে মুক্তি চাই……মুক্তি!

    আর দেরি করলাম না আমি, তখনই সামনে থেকে তুলে নিলাম, কোন শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি একটি ফুলদানি……তারপর ছুটে গিয়ে সেটাকে দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম সেই চারটে কাঁচের বাক্সের গায়ে….সঙ্গে সঙ্গে কাঁচ ভেঙে, ঘরের মেঝের ওপর ছড়িয়ে গেল বাক্সগুলির ভেতরে থাকা সেই তরল পদার্থ…..চারটে মেয়ের মৃতদেহও বেরিয়ে এলো বাক্সের ভেতর থেকে। আমি জানতাম, যে ফরমালিন থাকার দরুন, এই তরলটি খুব সহজেই আগুনে জ্বলে ওঠে! আমি ছুটে গিয়ে চলে গেলাম সেই ঘরের দরজার কাছে…..তারপর পকেট থেকে সিগারেট ধরাবার দেশলাই-এর বাক্সটা বার করে, একটি কাঠি ধরিয়েই, ছুঁড়ে দিলাম সেটা ঘরের মেঝে লক্ষ্য করে……সাথে সাথে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল গোটা ঘরটা…..মহিতোষ বাবু চেষ্টা করলেন ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু তাকে ঘিরে রাখা সেই চার প্রেতাত্মার বন্ধন তিনি ছিন্ন করতে পারলেন না! কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই চারটে লাশের গা থেকে, আগুন স্পর্শ করল তার জীবন্ত শরীরটাকে…..কিন্তু তখনও তাকে ঘিরে রেখেছে সেই চার প্রতিশোধকামী প্রেতাত্মা!……..আমি সেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলাম, দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার আগে, মহিতোষ বাবুর কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা শেষ আর্তনাদ! মনে মনে বলে উঠলাম আমি,
    – ওই চার নারীর প্রেতাত্মার সাথে সাথেই, আজ এই পৃথিবী থেকে মুক্তি পেল আরেকজন নররূপী দুরাত্মা!

    (সমাপ্ত)

  • গল্প

    স্বীকারোক্তি

    স্বীকারোক্তি
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)

    দু’পাশে বামনপোখারীর জঙ্গলে ঘেরা মেঠো পথ দিয়ে যেতে যেতে, হঠাৎ সচকিত হয়ে বাইকের ব্রেক কষে ধরল অনিকেত। তীব্র ঝাঁকুনির চোটে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো বাইকের পেছনে বসে থাকা, তার স্ত্রী রায়া। তাদের সামনে দিয়ে অতি সন্তর্পণে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে রাস্তা পারাপার করে চলে গেল এক জীর্ণ পোশাক পড়া বয়স্ক ভদ্রলোক। অনিকেত বুঝতেও পারেনি, যে এই জনমানবশূন্য স্থানেও, তার বাইকের সামনে হঠাৎ করে উদয় হবে এই ব্যক্তি……আর একটু হলেই তার শরীরের ওপর দিয়েই চলে যেত অনিকেতের বাইক! কিন্তু কাঠের বোঝা মাথায় ক্লান্ত লোকটির যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই! নতুন স্থানে এসে, বিকালে স্ত্রীকে বাইকে বসিয়ে একটু আশে পাশে ঘোরানোরও কি জ্বালা!

    কিছুক্ষণ পর আবার বাইকে স্টার্ট দিলো অনিকেত। পেছনে বসা রায়া আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কয়েক মাস আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাটার কথা আবারও মনে পড়ে গেল রায়ার! আজ ওই বয়স্ক লোকটি যে জায়গায় ছিল, সেদিন সে নিজেও ছিল একই স্থানে…..শুধু ঘটনাস্থলটা ছিল কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিট। সেদিন রায়া গিয়েছিল অনিকেতের অফিসে, সেখান থেকে সরাসরি সাউথ সিটি মলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুজনের….. তবে সেদিন কিন্তু তীব্র গতিতে আসা অচেনা এক বাইক আরোহী রায়াকে দেখে সঠিক সময়ে বাইকের ব্রেক কষার সুযোগ পায়নি, তাই শপিং-এর পরিকল্পনা বদলে গিয়ে, তাদের গন্তব্যস্থল হয় একটি নিকটবর্তী নার্সিং হোম! বাইকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়ে গিয়ে, মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ সেখানে ভর্তি ছিল রায়া!

    এমন সময়ই একটি অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন হতে হয় রায়াকে। মস্তিষ্কের বেশ কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে, ডাক্তারেরা ধরেই নিয়েছিলেন, যে আর বাঁচানো যাবেনা তাকে! চোখের জল চেপে রেখে, শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না অনিকেতের কাছে!……..এদিকে আই.সি.ইউ-র বেডে শায়িত অচৈতন্য রায়ার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠেছিল এক অদ্ভুত দৃশ্য!……যেন একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে সে…..আতঙ্কিত হয়ে সে ভাবছিলো, যে এই পথ শেষ হচ্ছেনা কেন? এই আঁধার ঘেরা পথ ধরে সে কি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ইহজগতের বাইরে?…….কিন্তু, কিছুক্ষণ পরেই তার চোখ ধাঁধিয়ে উঠেছিল দূর থেকে বিচ্ছুরিত তীব্র আলোর রশ্মিতে! তার সামনে দিয়ে, এক শুভ্র পোশাক পরিহিতা নারীমূর্তি যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে!

    সেই সুন্দরী নারীর হাসিমুখ এক ঝলক দেখেই তাকে চিনতে পেরেছিল রায়া……এ তো তার ঠাকুমা, মৃন্ময়ী দেবী! যিনি রায়ার জন্মের অনেক আগেই ত্যাগ করেছিলেন ইহলোকের মায়া! যার সুন্দর রূপের কদর রায়া তার পরিবারের অনেকের মুখেই শুনেছে! বাড়ির এ‌্যালবামের পুরোনো দিনের ছবিগুলোতে তাকে দেখতে দেখতে, মনে মনে সে ভেবেছে, ইস, তাকে স্বচক্ষে একবার দেখার সৌভাগ্য তার কেন হল না!……এখন যেন ছবিতে দেখা, সেই সুন্দরী যুবতী মেয়েটাই তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তাকে হেসে বলছে,
    – কি রে……তোর এতদিনের সাধ পূরণ করতে পারলাম তো আজ!
    ব্যাস, তারপর আর বেশি কিছু মনে নেই রায়ার। তবে খুব আশ্চর্যজনক ভাবেই তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো এর পর থেকে। ঈশ্বর যেন সত্যিই শুনলেন অনিকেতের প্রার্থনা, তিনি আবার রায়াকে সশরীরে ফিরিয়ে দিলেন তার কাছে।

    (২)

    এই ঘটনার কয়েকমাস পরে, একটি প্রাইভেট ব্যাংকে রুরাল মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত অনিকেতের বদলি হয় উত্তর বঙ্গের জঙ্গলে ঘেরা এই বামনপোখারী গ্রামে। এখানকার স্থানীয় এক ব্যবসায়ী, কৃষ্ণেন্দু বাবুর সুবিশাল বাড়ির নিচের তলাটা ভাড়া নিয়েছে সে। কৃষ্ণেন্দু বাবু তাদের মতই এখনো নিঃসন্তান এবং তার স্ত্রী অর্পিতার বয়স রায়ার মতই। তবে সাময়িক কিছু বাক্যালাপ ছাড়া, খুব বেশি একাত্ম বোধ নেই এই দুই পরিবারের মধ্যে।

    কিছুদিন পরের ঘটনা। সেদিন রাতে ঘুম আসছিলো না রায়ার। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে, ভালোবাসার আবেগে সে একবার জড়িয়ে ধরলো পাশে শুয়ে থাকা অনিকেতকে……পরমুহূর্তেই একটা খটকা লাগলো রায়ার! যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান পুরুষ অনিকেতের শরীরটা আজ এত শীর্ণ লাগছে কেন! তারপরেই তার মনে পড়লো, আরে, অনিকেত তো গত তিন দিন ধরে অফিসিয়াল টুরে গিয়েছে দিল্লিতে…….আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠল রায়ার!…..তাহলে……তাহলে তার পাশে এখন যে শুয়ে আছে, সে কে!……এক ঝটকায় নিজেকে সেই দেহ থেকে সরিয়ে নিয়ে চোখ খুলল রায়া……তার চোখের সামনে এখন খাঁ খাঁ করছে ফাঁকা বিছানা…….ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো তার, এর মানে কি সেই অনুভূতি তার মনের ভুল? কিন্তু সে তো এখন জেগেই আছে…..জেগে থেকে তো আর মানুষ স্বপ্ন দেখবে না!

    বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে ছুটলো রায়া। তারপর বেসিনের জলের কলটা খুলে, মুখে একবার জলের ঝাপটা দিতে গিয়ে…….নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে, ভয়ে একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলো সে!…..তার সারা হাতে লেগে রয়েছে জমাট বাঁধা কালচে রক্তের ছাপ!….কম্পিত শরীরে সে ভাবতে লাগলো, যে কোথা থেকে এলো এই রক্ত? তাহলে কি…..তাহলে কি, কিছুক্ষণ আগে যে পুরুষ শরীরের স্পর্শ সে ওই হাতে পেয়েছে, তার গায়ে লাগা ছিল এই রক্ত?……এমন সময় হঠাৎ জ্বলা নেভা করতে করতে বন্ধ হয়ে গেল বাথরুমের লাইট! আধো আলো আধো অন্ধকারে, বেসিনের সামনে রাখা আয়নায় চোখ যেতেই, সে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলো……যে তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে এক রোগাটে চেহারার তরুণের মূর্তি! তার কপাল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্তের ধারা! মণিহীন নিষ্পলক চোখে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রায়ার দিকে! তার রক্তমাখা শীর্ণকায় হাতটিকে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিচ্ছে সামনে……যেন এখনই স্পর্শ করতে চায় রায়ার কাঁধ!…….আরেকবার তীব্র আর্তচিৎকার করে, জ্ঞান হারিয়ে বাথরুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল রায়া……..

    (৩)

    পরদিন যখন হুঁশ ফিরে এলো রায়ার, তখন সকাল দশটা হবে। বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে আসছে পাখির কলরবের আওয়াজ। বাথরুমের ওপরে থাকা ঘুলঘুলি দিয়ে আসছে বাইরের সোনালী রোদের অলোক ছটা। সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে, তারপর একতলার ব্যালকনিতে গিয়ে খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালো। অনিকেতের আজকেই ফেরার কথা। সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে, যে অনিকেত ফিরলেই তাকে অন্যত্র বাসস্থান খোঁজার কথা বলবে…….সে নিশ্চিত, যে এই বাড়িতে কোন অশরীরির ছায়া আছে……কারণ গত রাত্রের ওই ঘটনাগুলো কখনো তার চোখের ভুল হতে পারে না!

    শরীরে বেশ অস্বস্তি নিয়েই রায়া বেরিয়ে পড়ল বাড়ির বাইরে, বাজারের উদ্দেশ্যে। কারণ আজ বিকালের ফ্লাইটেই দিল্লি থেকে ফিরতে চলেছে অনিকেত, আর এদিকে রান্নাঘরে বেশ কিছু রন্ধন সামগ্রী প্রায় শেষের দিকে। এই গ্রামের একমাত্র বাজারটিতে হাঁটা পথে যেতে বেশ সময় লাগে। আমিষ নিরামিষ সবকিছুই পাওয়া যায় একই স্থানে। মুদিখানার দোকানের দোকানকার ব্যক্তিটি রায়ার নির্দেশানুসারে কয়েকটি মশলাপাতি ওজন করে প্যাক করতে করতে তাকে বলে উঠলো,
    -দিদিভাইকে তো আগে এই গ্রামে দেখিনি…..এখানে নতুন এসেছেন বুঝি?
    হ্যাঁ, আসলে চাকরিসূত্রে আমার স্বামী বদলি হয়ে এখানে এসেছেন……

    -আচ্ছা, আচ্ছা…..তা এখানে উঠেছেন কোথায়?
    -কৃষ্ণেন্দু বাবুকে চেনেন নিশ্চয়…..ওনার বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়েছি আমরা……

    এই কথা শুনে একটু যেন বিস্মিত হল সেই ব্যক্তি, তারপর বলল,
    -ও, তো এই জন্যই বোধহয় প্রতীককে কয়েক মাস ধরে আর আসতে দেখিনা এই বাজারে……
    বেশ কৌতূহলী হয়ে রায়া বলে উঠলো,
    -প্রতীক কে?
    -কৃষ্ণেন্দু বাবুর কোন এক দূরসম্পর্কের ভাই হল প্রতীক…..বেশ ভালো ছেলে, রোগাটে চেহারা, ফর্সা রং…… ওর বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায়, কৃষ্ণেন্দু বাবু ওকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন, এখানকার একটি কলেজে তাকে ভর্তিও করিয়েছিলেন। ওনার বাড়ির এক তলায়, মানে এখন যেখানে আপনারা আছেন, সেখানেই থাকতো সে…….মাঝে মাঝে বাড়ির বাজার হাট করতে আসতো আমার দোকানে, তখনই ওর সাথে যা দু’চার কথা হত আমার……..তবে কয়েক মাস ধরে ওকে আর এদিকে আসতে দেখিনা। হয়তো পড়াশোনা শেষে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছে। তাই এখন কৃষ্ণেন্দুবাবু বাড়ির একতলাটা আপনাদের ভাড়া দিয়েছেন, বোধহয়……

    এই বিষয়ে আর কোন কথা না বাড়িয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাজার থেকে ফিরতি পথে হাঁটা লাগায় রায়া। তার আতঙ্কে ভরা বুকে যেন একটা কথাই বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলছিলো, “না, না…..প্রতীক নিজের বাড়ি ফিরে যায়নি!……নিজের বাড়ি ফিরে যায়নি সে!……তাকে কেউ খুন করেছে!….কেউ নৃশংশ ভাবে তাকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে!……আর এই কথাই যেন জানান দিতে চাইছে গত রাত্রে দেখা তারই প্রেতাত্মা!”

    (৪)

    বাড়ি ফিরেই রায়া ছুটে গেল ওপর তলায়। কৃষ্ণেন্দুবাবু তখন নিজের অফিসে গিয়েছেন, বাড়িতে শুধুমাত্র আছে তার স্ত্রী অর্পিতা। রায়া তার কাছে গিয়ে তাকে সটান চিৎকার করে বলে উঠলো,
    -তুমি কি কখনো এই বাড়িতে কোনো অশরীরির উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছো, অর্পিতা?…..বলো, বলো, আমার কথার জবাব দাও……
    এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে অর্পিতা বলে উঠলো,
    -মানে? এই সব কি বলছো কি তুমি? অশরীরি!….আমাদের বাড়িতে!
    এই বলে খিল খিল করে হেসে উঠলো অর্পিতা। তারপর বলল,
    -তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, রায়া…..কাল রাতে নিশ্চয় কোন হরর ফিল্ম দেখেছো…….
    কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই চিৎকার করে উঠলো রায়া,
    -না, অর্পিতা……আমার মাথা খারাপ হয়নি……খারাপ যদি কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তা হয়েছে প্রতীকের সাথে……কারণ কাল রাতে তার প্রেতাত্মাই দেখা দিয়েছে আমায়!

    এই বার যেন চমকে উঠলো অর্পিতা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে সে কম্পিত গলায় বলে উঠলো,
    -ত…ত….তুমি প্রতীকের কথা কোথা থেকে জানলে?
    -তার থেকেও বেশি জানার দরকার হল, যে কি হয়েছিল প্রতীকের সাথে….আর সেই কথা তোমাকে আমায় বলতেই হবে আজ…..
    আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অর্পিতা। ঠিক সেই ঘরে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। তিনি রায়াকে বললেন,
    -একটা দরকারি ফাইল নিতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, বৌদি…..আপনাদের সব কথাই আমি দরজার বাইরে থেকে শুনেছি। আপনি প্রতীকের ব্যাপারে জানতে চান, তাই তো? ঠিক আছে, বলছি আমি, শুনুন তাহলে…….

    কৃষ্ণেন্দু বাবু বলে চললেন,
    -আমার দূরসম্পর্কের ভাই হলেও, ওকে মায়ের পেটের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবসেছিলাম আমি……ওকে এখানে নিয়ে এসে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিলাম……কিন্তু কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, যে ও তার এই প্রতিদান দেবে! যে অর্পিতা ওকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতো, ও তার ইজ্জতের ওপরই হামলা করতে যাবে!
    এবার কাঁদতে কাঁদতে অর্পিতা বলে উঠলো,
    – হ্যাঁ রায়া…..কৃষ্ণেন্দু ঠিক কথা বলছে……একদিন রাতে যখন আমি ওর ঘরে রাতের খাবারটা রাখতে যাই, তখনই ও সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে…..আমার চিৎকার শুনে কৃষ্ণেন্দু ছুটে আসে নিচে, তারপর এক ধাক্কায় ঘরের দরজা খুলে, ভেতরে ঢুকে আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচায়……..সেই সময় রাগের মাথায় ওদের দুজনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়……তেমনই এক মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু ওকে ঠেলে দেয় দেওয়ালের দিকে…..প্রচন্ড জোরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে গিয়ে সেদিনই মৃত্যু হয় ওর!
    কৃষ্ণেন্দু বাবু বলে উঠলেন,
    -এরপর আমরা ওর লাশটা বাথরুমে নিয়ে গিয়ে রেখে আসি……পরদিন সকলকে বলি যে গত রাত্রে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রতীকের…….এখন আপনিই বলুন…..আপনিই বলুন বৌদি, এমন একজন মানুষ যে নিজের বৌদিকে ধর্ষণ করতে যায়……তাকে মেরে, তার থেকে নিজের স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচিয়ে, আমি কি খুব ভুল কাজ করে ফেলেছি?
    রায়া পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এই প্রশ্ন শুনে!

    (৫)

    সেদিন অনিকেত ফিরলে তাকে সব কথা খুলে বলল রায়া। প্রথমে তার কথা বিশ্বাস করতে চাইছিলো না অনিকেত, কিন্তু পরে কৃষ্ণেন্দু আর অর্পিতার স্বীকারোক্তির কথা শোনার পর সেও রাজি হয়ে গেল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি ত্যাগ করে অন্য বাসস্থান খুঁজতে।

    নাহ, সেদিন রাতে আর প্রতীকের প্রেতাত্মার দর্শন পায়নি রায়া। কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে, তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি অদ্ভুত স্বপ্ন!……এই ঘরটারই একটি দৃশ্য যেন ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে……সময়টা হয়তো কোন এক সকাল বেলা হবে। এই ঘরের মধ্যেই, পড়ার টেবিলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি বইয়ের মধ্যে যেন ডুবে রয়েছে এক যুবক……সে আর কেউ নয়, গত রাত্রেই যার প্রেতাত্মাকে দেখতে পেয়েছে রায়া……প্রতীক!…….এমন সময় চায়ের ট্রে হাতে সেই ঘরে প্রবেশ করলো অর্পিতা! প্রতীক যেন বেশ বিরক্তি ভরে তাকালো তার দিকে। তার সামনে চায়ের কাপ প্লেট রেখে, তার সাথে কয়েকটা সাধারণ কথাবার্তা বলতে শুরু করলো অর্পিতা, তবে প্রতীকের ব্যবহার দেখে বোঝা যাচ্ছিল, যে সে যেন অর্পিতার সান্নিধ্যে থাকতেই চায়না একেবারে।

    এরপর হঠাৎ নিজের ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা চিরকুট বার করলো অর্পিতা, তারপর মুচকি হেসে সেটা প্রতীকের হাতে ধরিয়ে দিয়েই, সলজ্জ ভঙ্গিতে সেখান থেকে কেটে পড়তে চাইলো। কিন্তু সে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই চিৎকার করে উঠলো প্রতীক,
    -দাঁড়ান বৌদি, দাঁড়ান….ছি, ছি……লজ্জা করে না আপনার…..লজ্জা করে না? আপনার দেওয়া এমন প্রতিটা চিঠিতে যে কথাগুলো লেখা থাকে, সেগুলো যদি আমি একবার দাদাকে দেখিয়ে দিই…..তাহলে আপনার কি হবে তা ভেবে দেখেছেন কখনো?
    এবার অর্পিতা ঘুরে দাঁড়ালো প্রতীকের দিকে, তারপর মুচকি হেসে বলে উঠলো,
    -ওই চিঠিগুলিতে কিন্তু আমি কোন মিথ্যা কথা লিখিনা, প্রতীক…..আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি প্রতীক…..একবার তাকিয়ে দেখো আমার দিকে…..বলো, আমি কি সুন্দরী নই?……আমাকে দেখে কি একবারও জেগে ওঠে না তোমার পৌরুষ বোধ? আমি যে তোমার দাদাকে নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নই, প্রতীক!……এদিকে তোমার দাদা প্রায়ই আমার মোবাইল ঘাটে, তাই বাধ্য হয়েই তোমাকে চিঠি লিখে মনের কথা জানাতে হয়!
    এই বলে শাড়ির আঁচলটা নিজের বুকের ওপর থেকে নিচে সরিয়ে ফেলল অর্পিতা!

    সেই মুহূর্তেই লজ্জায় সেই দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, তীব্র ঘৃণার সাথে বলে উঠলো প্রতীক,
    -আমি আজীবন দাদাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি, আপনাকেও দেখে এসেছি নিজের দিদি হিসাবে……আর আপনি কিনা! ছি……এই মুহূর্তে…..এই মুহূর্তে এই ঘর থেকে চলে যান আপনি…..আর কখনো আমার সামনে এই ভাবে দাঁড়াবেন না……
    কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই, সেই অবস্থায় অর্পিতা ছুটে গিয়ে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো প্রতীককে……নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতীক নিজেকে তার এই যৌনলিপ্সা ভরা আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে, তার গালে সপাটে কষিয়ে দিলো একটি চড়! কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে প্রতীকের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে, নিজের শাড়ির আঁচলটা সঠিক জায়গায় এনে, সেই মুহূর্তে সেই ঘর থেকে বিদায় নিলো অর্পিতা……যাওয়ার আগে তাকে বলে গেল,
    -আমি একজন মেয়েমানুষ হয়ে তোমাকে বিছানায় পেতে চাইছি…..আর তুমি কিনা আমাকেই উপেক্ষা করছো! এত দেমাক তোমার! আমার গায়ে হাত তুললে তুমি!…..এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে…..ভুগতে হবেই!

    এরপরের দৃশ্য, যা রায়ার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তার সময় বোধহয় আগের ঘটনার দিনই, রাত্রিবেলা। রাতের খাবার নিয়ে প্রতীকের ঘরে প্রবেশ করলো অর্পিতা। সকালের ঘটনার বশে প্রতীকের যেন তার দিকে চেয়ে দেখারও ইচ্ছা নেই এখন। কিন্তু খাবারের থালাটা টেবিলে রেখেই অর্পিতা করে বসলো একটি অভূতপূর্ব কাণ্ড! সে ছুটে গিয়ে সপাটে বন্ধ করে দিলো সেই ঘরের দরজা!…..তারপর নিজের গা থেকে একটানে যতটা সম্ভব পরনের শাড়িটা খুলে ফেলল!……নিজের দুই কাঁধের কাছে ব্লাউসের অংশগুলিকে খামচে ধরে এক টানে দিলো ছিঁড়ে……তারপর তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিলো,
    -কৃষ্ণেন্দু…….কৃষ্ণেন্দু, বাঁচাও আমাকে……বাঁচাও……
    অর্পিতার এই আকস্মিক আচরণে বাকরুদ্ধ হয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো প্রতীকের শীর্ণ দেহটি। এরপর অর্পিতা আবার চিৎকার করতে করতে প্রতীককে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়…….প্রতীক যেন শত চেষ্টা করেও ক্ষান্ত করতে পারলো না, নিজের যৌনলিপ্সায় সাড়া না দেওয়ার প্রতিশোধকামী এই উন্মাদিনীকে!

    এমন সময়, অর্পিতার চিৎকার শুনে, দরজা ভেঙ্গে সেই ঘরে প্রবেশ করলো কৃষ্ণেন্দু। এই পরিস্থিতিতে আসল ঘটনার আন্দাজ করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়! সে যেন আর কিছু বলার সুযোগই দিলো না প্রতীককে! রাগের মাথায়, তার উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে, তাকে মারতে মারতে, তার শীর্ণ শরীরটাকে ধাক্কা মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেওয়ালের গায়ে……বিদ্যুৎবেগে প্রতীকের মাথাটা সপাটে আছড়ে পড়ল দেওয়ালের গায়ে…….তার কপাল ফেটে গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্তধারা……একটা শেষ আর্তচিৎকার করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল প্রতীকের নিথর দেহ!…….ব্যাস, এতটা দেখেই ঘুম ভেঙ্গে গেল রায়ার!

    (৬)

    পর দিন সকালেই কৃষ্ণেন্দু আর অর্পিতাকে ডেকে, গত রাতে নিজের দেখা স্বপ্নের কথা সবিস্তারে জানালো রায়া। পুরোটা শোনার আগেই আপত্তির সুরে চিৎকার করে উঠলো অর্পিতা,
    -বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলাটা বেশ ভালোই শিখেছো, রায়া…….যদি ক্ষমতা থাকে তো প্রমাণ করে দেখাও…….প্রমাণ করে দেখাও যে তোমার স্বপ্নে দেখা ঘটনা সত্যি!
    এবার হঠাৎ মুচকি হেসে উঠলো রায়া, তারপর ছুটে দিয়ে বিছানায় বালিশের নিচ থেকে বার করলো কয়েকটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। তারপর সে খুশির সুরে বলল,
    – প্রমাণ হল এই চিঠিগুলি…….যেগুলোতে তুমি প্রতীককে নিজের শারীরিক চাহিদার কথা লিখতে…….এগুলো কিন্তু আমি এই ঘর থেকেই খুঁজে পেয়েছি, অর্পিতা!
    বিস্ফারিত চোখে উন্মাদের ভঙ্গিতে বলে উঠলো অর্পিতা,
    -সে কি! এ কি ভাবে সম্ভব! এ কি ভাবে……
    তার কথা শেষ না হতেই জোর দিয়ে বলে উঠলো রায়া,
    -হ্যাঁ, অর্পিতা….এগুলোই সেই চিঠি……স্বয়ং প্রতীকের প্রেতাত্মা আমাকে এগুলো দিয়েছে…….এগুলোই আমার স্বপ্নে দেখা ঘটনার সত্যি হওয়ার প্রমাণ!

    ধৈর্যের পরিসীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায়, চিৎকার করে বলে উঠলো অর্পিতা,
    -এ সম্ভব নয়……কোনোদিনও সম্ভব নয়……কারণ প্রতীকের মৃত্যুর পর, ওগুলোকে এই ঘর থেকে খুঁজে বার করে আমি নিজে হাতে পুড়িয়েছি…..মিথ্যা কথা বলছো তুমি রায়া, মিথ্যা কথা বলছো!
    কিন্তু এতটা বলার পরই যেন তার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হল! সে নিজেই বুঝতে পারলো, যে নিজের বিরুদ্ধেই কি ভয়ঙ্কর সত্য আজ সে নিজের মুখেই স্বীকার করে ফেলেছে! এমনই সময়, একটি বাঁকা হাসি খেলে গেল রায়ার ঠোঁটে, সে এক ঝটকায় সারা ঘরময় ছড়িয়ে ফেলে দিলো সেই কাগজগুলো……যেগুলো শুধুমাত্র সাদা কাগজ ছাড়া আর কিছু নয়! লজ্জায় দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লো অর্পিতা…….অবিশ্বাস, ঘৃণা আর বিদ্বেষ ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চুপ করে চেয়ে রইল কৃষ্ণেন্দু!

    এমন সময় রায়ার চোখ চলে গেল সেই ঘরের এক কোনে……সেখানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং প্রতীক! এখন তার মুখে নেই কোন বিভীষিকা, নেই কোন রক্তের ছাপ! এতদিন ধরে সে এটাই চাইতো, যে তার দাদা যেন জানতে পারে তার স্ত্রীর আসল পরিচয়! সে যেন বুঝতে পারে, যে তার হতভাগ্য ছোট ভাইটি ছিল সত্যিই নিরপরাধ! আর এটা প্রমাণ করাবার জন্যই সে সবাইকে ছেড়ে বেছে নিয়েছিল রায়াকে।

    এখন রায়াও জানে এর কারণ…….সেদিনের সেই বাইকের দ্বারা এক্সিডেন্টের পর, তার যে “Near Death Experience” হয়েছে……..তার ফলেই হয়তো অতীতের কথা জানতে পারার একটি অতি-প্রাকৃত ক্ষমতা চলে এসেছে তার মধ্যে, যাকে “Parapsychology”-র ভাষায় বলা হয় “Retrocognition”. এর ফলেই সে সর্বপ্রথম দেখতে পেয়েছিল তার মৃত ঠাকুমার সেই যুবতী রূপ! হয়তো তার আশীর্বাদেই রায়ার প্রাপ্ত এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা! আর, আজ তার এই ক্ষমতার জন্যই, নিজের ইচ্ছাপূরণ করে মুক্তি পেতে চলেছে প্রতীকের অতৃপ্ত আত্মা!

    (সমাপ্ত)

  • গল্প

    পরকীয়া

    পরকীয়া
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)

    সালটা ছিল ১৯৫০। তিন বছর আগে ইংরেজরা এই বঙ্গদেশ থেকে চিরতরে বিদায় নিলেও, করে গিয়েছে সর্বশেষ ষড়যন্ত্র। লুপ্ত হয়েছে এত বছর ধরে চলে আসা জমিদারি প্রথা। দেশভাগের দাবানলের রেশ যেন এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে দুই বাংলার মানুষজনকে। কত রাজা জমিদারের দল তাদের বংশ গৌরব এবং সম্পত্তির মোহ ত্যাগ করে, সর্বহারা হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছে কাঁটাতারের এই পারে। তবে এপার বাংলার জমিদার বংশগুলোর ভাগ্যের বৃহস্পতি এখনো কিছুটা হলেও অক্ষুন্ন রয়েছে, তাই জমিদারি উঠে গেলেও পূর্বপুরুষের জমানো ধনসম্পদের জোরে এখনো তারা বজাই রাখতে পেরেছে সেই হৃত আভিজাত্য বোধ। এই শ্রেণীর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল মুর্শিদাবাদের মহেশপুর গ্রামের চৌধুরীরা।

    অন্যান্য গ্রামের মতই শতাব্দী প্রাচীন জমিদার বাড়িটা জনবসতি থেকে একটু দূরে অবস্থিত। ক্ষমতার প্রতীক সিংহের স্তম্ভ দেওয়া প্রবেশ দ্বার আর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই সাত মহলা বাড়িটার দুই দিকে বেশ বড় আম বাগান। এক দিকে আছে এই বংশের দ্বারাই খনন করানো পরিবারের নিজস্ব দীঘি। এবং ওপর দিকে আছে শাল সেগুনের গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গলের ওপর প্রান্তে অবস্থিত মহেশপুর শ্মশান। সেদিন ছিল শ্রাবণ মাসের এক অন্ধকার রাত্রি, আমাবশ্যা না হলেও মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বুকে দৃশ্যমান নয় চাঁদ এবং তারারা। সাহসে বুক বেঁধে, রাতের জঙ্গলের ভয়াবহতার মাঝে, দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছিল এক যুবতী। এই এবড়ো খেবড়ো বন্য জমির কিছুটা দূরত্ব পার করতে পারলেই নিকটে আসবে তার গন্তব্যস্থল……..মহেশপুর শ্মশান!

    শাড়ির আঁচলে বাধা বস্তুটিকে হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে, জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এসেই তার নাকে প্রবেশ করলো শবদাহের তীব্র গন্ধ। কিছুক্ষন আগেই বোধহয় মড়া পুড়িয়ে গেছে কোন শবযাত্রীর দল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই, একটি বন্য ঝোঁপের আড়ালে দৃশ্যমান হল উজ্জ্বল অগ্নি শিখা। হ্যাঁ, তার মানে ঠিক স্থানেই এসেছে সে, ওই তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা রয়েছে মড়ার খুলি এবং হাড়গোর! ওই তো সেই অগ্নিকাণ্ডের কম্পমান অলোক রশ্মিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সেই অঘোরী তান্ত্রিকের ধ্যানে মগ্ন উলঙ্গ শরীরের অবয়বটিকে! তার কাছে সেই যুবতী অগ্রসর হতেই, তার পদশব্দের ক্ষীণ আয়োজে ধ্যান ভেঙে গেল সেই অঘোরীর, তার রক্তাভ চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো মেয়েটির মুখের ওপর।

    সেই মুহূর্তে গুরুগম্ভীর শব্দ করে আকাশে গর্জে উঠলো এক ফালি বিদ্যুতের ঝলক। তার আলোতে, এই রাতের অন্ধকারেও সেই তান্ত্রিকের ভয়ঙ্কর রূদ্র মূর্তি দেখে একটু হলেও ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সেই যুবতী। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুকে সাহস সঞ্চার করে সে শুনতে পেল সেই তান্ত্রিকের অস্ফুট কণ্ঠস্বর,
    – তোকে যা বলেছিলাম, তা নিয়ে এসেছিস তো তুই?
    মেয়েটি তার আঁচলে লুকিয়ে বেঁধে রাখা কয়েক গাছি চুল বার করে, তা এগিয়ে ধরলো তার দিকে। দুই আঙুলের ভেতর চুলগুলিকে নিয়ে, বলে উঠলো তান্ত্রিক,
    – বাহ…..এবার বল কি চাস তুই? এই দেহাংশ যার, তাকে কি পিশাচ দ্বারা হত্যা করতে হবে আমাকে?
    মেয়েটির মুখে খেলে গেল একটি শয়তানি হাসি, তান্ত্রিকের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে সে বলে উঠলো,
    – না, একেবারেই নয়…….তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আপনাকে…….কিন্তু জীবিতাবস্থাতেই তাকে যেন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যাতে সে প্রতিনিয়ত নিজেই খুঁজতে বাধ্য হয় মৃত্যুর রাস্তা…..হা হা হা হা!
    সেই যুবতীর পৈশাচিক অট্টহাসি শুনে যেন চমকে উঠলো সেই জঙ্গলের গাছের ডালের বাসায় ঘুমন্ত পাখিরা!

    (২)

    মহেশপুরের চৌধুরী পরিবারের একমাত্র বংশধর আমি, স্বর্গীয় জমিদার রাজবাহাদুর রামাদিত্য চৌধুরীর একমাত্র সুপুত্র, শ্রীযুক্ত শিলাদিত্য চৌধুরী। এত বড় বাড়ি এবং বিষয় সম্পত্তির মালিক আমি একা, তাই নেহাৎ বাপের ইচ্ছা রাখতেই কলকাতার কলেজ থেকে একাধিক প্রচেষ্টায় বি.এ পাশ করে গ্রামে ফিরে আসার পর আর অর্থ উপার্জন করার কথা ভেবে দেখিনি। বিবাহ করার কোন ইচ্ছা নেই, তবে তার মানে এই নয় যে নারী শরীরের প্রতি আমার অরুচি! মদ্যপান, বন্ধু-বান্ধব, বাঈজি সঙ্গ এবং দুই হাতে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমেই কাটছিলো আমার দিনক্ষণ।

    সেদিন সন্ধ্যা থেকেই রূপের সাগরে যৌবনের লহরী তুলে, সারেঙ্গির তালে তালে কোমর দুলিয়ে নেচে চলছিলো রত্না বাঈ। অত্যাধিক মদ্যপান করার জন্যই বোধহয় আমার চোখের সামনে রত্নার একটি আবছা অবয়বই ফুটে উঠেছিল, অথচ ঝাড়বাতির আলোয় এই জলসাঘরের কোনো কোণেই অন্ধকারের লেশমাত্র ছিলো না। মুজরায় আমন্ত্রিত আমার সকল বন্ধু বান্ধবেরা একে একে রত্নার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে টলতে টলতে বিদায় নিলে, আমি চিতাবাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম রত্নার শরীরের ওপরে। অবশ্য রত্নার তাতে কোনরূপ আপত্তি ছিলো না, কারণ একে তো আমি হলাম সুপুরুষ জমিদারপুত্র, আর তাছাড়া সে ভালো করেই জানে যে তার সাথে কাটানো প্রতিটা রাতেরই দ্বিগুন মূল্য দিতে সক্ষম আমি!……..শয়নকক্ষে রত্নার নগ্ন শরীরটা থেকে সমস্ত মধু শুষে নিয়ে, পরম স্বর্গসুখ উপলব্ধি করতে করতে কখন যে কেটে গেল রাত, তা আমার খেয়ালই নেই!

    সকালে ঘুম ভাঙলো হঠাৎ এই ঘরের দরজায় কারোর কড়াঘাতের আওয়াজ শুনে। তার সাথেই ভেসে আসছে এই জমিদারির বয়স্ক নায়েব মশাই, শঙ্কর বাবুর গলার আওয়াজ। বিছানায় উঠে বসে দেখলাম, যে ততক্ষনে রত্নাও ঠিক করে নিয়েছে নিজের পরণের পোশাক। শশব্যস্ত হয়ে শান্তিপুরী ধুতির ওপর কোনরকমে গেঞ্জিটা চড়িয়ে, তাড়াতাড়ি গিয়ে ঘরের দ্বার দিলাম খুলে। হন্তদন্ত হয়ে সে ঘরে প্রবেশ করলেন শঙ্কর বাবু, তারপর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে তিনি বললেন,
    – ছোট বাবু…….ছোট বাবু, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, ছোট বাবু……আপনি তাড়াতাড়ি চলুন আমার সাথে!
    রত্না কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে। আমিও আশ্চর্য হয়ে আর কথা না বাড়িয়ে, শঙ্কর বাবুর সাথে বেরিয়ে এলাম আমার শয়ন কক্ষ থেকে……

    আমরা ছুটে গেলাম এই বাড়ির বাইরের মহলের উদ্দেশ্যে। সেই মহলের ঘরগুলো মূলতঃ এই বাড়িতে আগত অতিথিদের নিবাসের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমারই অনুমতিতে, তেমনই একটি ঘরে কয়েক মাস ধরে বসবাস করছে, দেশ ভাগের পর সর্বশান্ত হয়ে প্রাণ হাতে করে ওপার থেকে এপার বাংলায় ছুটে আসা আমারই এক বাল্যবন্ধু, শশধর এবং তার স্ত্রী, নন্দিনী। সেই ঘরে ঢোকা মাত্র, সেখানকার দৃশ্য দেখে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল! ঘরের এক কোনে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে নন্দিনী, আমার মত একজন পরপুরুষের হঠাৎ আবির্ভাবেও যার কোন হুঁশ নেই!……আর……আর আমার সামনেই……আমার সামনেই ঘরের করিকাঠ থেকে ঝুলছে শশধরের গলায় দড়ি দেওয়া দোদুল্যমান মৃতদেহ!

    (৩)

    স্থানীয় থানা থেকে দারোগা বাবু তার দলবল নিয়ে এসে কিছুক্ষন আগেই নিয়ে গিয়েছেন শশধরের মৃতদেহ। এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়, আপাতদৃষ্টিতে সেই কথাই মনে হয়েছে সকলের। আজ সকাল থেকেই চারিদিকে অন্ধকার করে শুরু হয়েছে বৃষ্টির তান্ডব। কিছু দরকারি সই সবুত করতে গিয়েছিলাম কাছারি বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়িতে পা রাখতেই চোখ চলে গেল বাইরের মহলের সেই ঘরটির দিকে। এই সন্ধ্যার অন্ধকারেও যেন একটা ক্ষীণ আলোর আভাস আসছে তার ভেতর থেকে। নন্দিনী বৌঠান এখন কেমন অবস্থায় আছেন, মনে বড় কৌতূহল হচ্ছিলো সেই কথা জানার জন্য। তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই ঘরের দিকে, কিন্তু একটু গিয়েই কানে এলো নন্দিনী বৌঠান বাদেও অপর এক নারীর পরিচিত কণ্ঠস্বর। এই গলার আওয়াজ এই বাড়ির এক রাঁধুনি, সরমার। কোন এক কথায় পরিপেক্ষিতে, সরমা যেন উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
    – তন্তর মন্তর……কালা জাদু……এই সবে বিশ্বাস করিস লা? বল রে হতভাগী, জবাব দে আমার কথার?

    আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেই ঘরের দরজায় বাইরে এক কোনে। তারপর আড়ি পেতে শুনতে লাগলাম এই দুজনের কথা বার্তা। নন্দিনী সরমার দিকে বিস্ফারির চোখে শুধু চেয়ে আছে, তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ধারা! সরমা এবার নন্দিনীকে ধরে ঝাঁকিয়ে আবার চিৎকার করে উঠলো,
    – আমি নিশ্চিত রে, হতভাগী……আমি নিশ্চিত……তোর সোয়ামীর ওপর কোন অপদেবতার ছায়া পড়েছিলো…….নাহলে একজন সুস্থ সবল ভালো মানুষ কখনো অমন হয়ে যায়!
    নন্দিনী এবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,
    – এ….এ….এই সব কি বলছো তুমি, সরমাদি!…..না, না, আমি এই সবে বিশ্বাস করি না……বিশ্বাস করি না আমি!
    সরমার গলার স্বরটা কেমন যেন পাল্টে গেল এবার, সে সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠলো,
    – সত্যি কথা বল তো আমায়……জমিদার বাবুর রূপ, অর্থ…..এই সব দেখেও কি কোনদিন তোর মনে শখ হয়নি তার ইস্তিরী হবার!…..আর সেই জন্যই বোধহয় নিজের সোয়ামীর থেকে পিছু ছাড়াতে, তুই নিজেই…….
    সরমার কথা পুরোটা না শুনেই যেন আশ্চর্য হয়ে কি একটা বলতে চলছিলো নন্দিনী, ঠিক এমন সময় আর সহ্য করতে না পেরে আমি সশরীরে প্রবেশ করলাম এই দুই নারীর সামনে।

    আমার আগমনে সাথেই যেন দপ করে কেঁপে উঠলো অদূরে রাখা সন্ধ্যা প্রদীপের অগ্নি শিখাটি। আমাকে দেখেই যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলো ওরা দুজন, বিশেষত আমি সব কিছু শুনতে পেয়েছি, এই আশঙ্কায় যেন পাংশু বর্ণ হয়ে উঠলো সরামার মুখ। আমি দৃঢ় কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
    – কি বলছিলে তুমি সরমা? কি হয়েছিলো শশধরের? কেমন হয়ে গিয়েছিলো সে?
    সরমা ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলো,
    – আ….আ….আমি কি….কি…কিছু জানিনে, কর্তা বাবু…..আমি মুক্ষু সুক্ষু মানুষ……আমি কেমনে জানবো তেনার কি হয়েছিল!…..আমি হেঁসেলে যাই, কর্তা বাবু…..অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে সেখেনে……
    এই বলে সে পড়ি কি মরি করে ছুটে বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে!

    সেই মুহূর্তেই একটি দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিলো সেই ঘরের প্রদীপখানি। আকাশের বুকে ঝিলিক দিয়ে ওঠা একটি অকস্মাৎ বজ্রপাতের তীব্র গর্জনের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে নন্দিনী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমার দেহটাকে! এই সুন্দরী নারীর দুই সুডৌল স্তনের পরশে যেন আরো দ্রুত গতিতে বেজে উঠলো আমার হৃদস্পন্দনের ধ্বনি!……. কিন্তু পরমুহূর্তেই অপমান আর লজ্জা বোধ হওয়ায়, নিজেকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে, শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। শুনতে পেলাম তার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আওয়াজ! আমি আবার একই প্রশ্ন করে উঠলাম তাকে,
    – শশধরের কি হয়েছিলো বৌঠান? বলুন আমায়…..দয়া করে বলুন…..

    নন্দিনীর মাথা থেকে সরে গেল শাড়ির আঁচলের ঘোমটা। অন্ধকারের মধ্যে, আমার চোখে চোখ রেখে, অস্বাভাবিক বিদ্বেষ মেশানো কণ্ঠস্বরে সে বলে উঠলো,
    – তার শরীরে খুঁত জন্মেছিলো, ঠাকুরপো……নপুংসক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি…….কোন মেয়ে মানুষের শরীরে সুখ দেওয়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছিলো তার……শুনলেন তো আমার কথা…..পেলেন তো আপনার প্রশ্নের উত্তর!
    আবার যেন একটি বজ্রপাত ঘটলো আমার মাথায়, তবে তা নিঃশব্দে! নন্দিনী কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে উঠলো,
    – কয়েক মাস ধরে রোজ রাতে একই ভাবে বিফল হতে হতে, মানসিক অবসাদে ভেঙে পড়েছিলেন মানুষটা……আমি কিন্তু তাকে এই নিয়ে কিছু বলিনি…..কখনো কোন কটু কথা শোনায়নি……বুঝতেই পারিনি যে কাল রাতেও একই ঘটনা ঘটার পর, তিনি এতটাই ভেঙে পড়বেন, যে আমি ঘুমিয়ে পড়লে পরে তিনি…..তিনি……
    আর বলতে পারলোনা নন্দিনী। দলা পাকানো কান্নায় আটকে গেলো তার কণ্ঠস্বর। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম আমি!

    (৪)

    সেদিন সন্ধ্যায় আর ইচ্ছা করলো না রত্না বাঈ-এর মেহেফিলে যেতে। নিজের শয়ন কক্ষের আরাম কেদারায় বসে নিজেকে বুদ করে রেখেছিলাম বিদেশী হুইস্কির রঙিন স্রোত আর অম্বুরী তামাকের সুগন্ধের মাঝে। অন্যদিন এই সময় কোনো নারী দেহ ছাড়া আমার চোখে কিছুই মজে না, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আজ যে শুধুই একজন পুরুষের চিন্তা বিদ্ধস্ত করে চলেছে আমার মস্তিস্ককে! সে আর কেউ নয়……শশধর! কলেজে একসাথে পড়ার সময় ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ। শুনেছিলাম, যে তার বাড়ি ছিল পূর্ব বাংলার রাজশাহীতে। সেখানকার বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে ছিলো সে। পরপর তিনবার পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাস করি আমি, কিন্তু আমার মেধাবী বন্ধুটি এক বারেই পার করে দেয় তরী।

    ভাগ্যের কি পরিহাস, দেশ ভাগের পর, একদিন সেই ছেলেই তার নব বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় এসে পৌঁছলো আমাদের জমিদারিতে! ভাগ্যিস আমি ছিলাম, নাহলে যে কোথায় ভেসে যেত তারা, তা কে জানে! সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম আমি নন্দিনীকে……অমন ক্লান্ত বিদ্ধস্ত অবস্থায়ও এমন রূপের অধিকারিণী সে, যা উন্মাদ করে দিতে পারে যে কোন পুরুষকে! নাহ, সত্যিই স্বার্থক মনে হয়েছিলো ওদের দুজনের জুটি! শশধরকে দেখে মনে হচ্ছিল, যে আমার যেন সব থেকেও কিছু নেই। সত্যিই, নারী দেহ ভোগ করা…..সে তো যে কোন পুরুষই পারে, কিন্তু সারা জীবনের জন্য যে নারীর ভেতর নিজের আশ্রয় খোঁজে একজন পুরুষ, তেমন নারীকে নিজের সহধর্মিণী রূপে পাওয়াটা ভাগ্যবানের কথা!

    আর সেই ছেলেরই আজ এই নিদারুণ পরিণতি! একটা অজানা শিহরণ খেলে গেল আমার সমগ্র শরীরে……তার মানে কি সত্যিই কোন অতি-প্রাকৃত শক্তির দ্বারা নিজের পুরুষত্ব হাড়িয়েছিলো শশধর? কেমন করে এ সম্ভব? আর কেই বা চাইতে যাবে তার এমন দুর্গতি? এবং কেন? এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে এসেছিলো আমার, তা নিজেই বুঝতে পারিনি। হঠাৎ তন্দ্রা বোধটা ভেঙে গেল একটি যুবা কণ্ঠের আকস্মিক তীব্র আর্তচিৎকারে! মদের নেশাটা তখনও পুরোপুরি কাটেনি আমার……তাও আরাম কেদারা থেকে উঠে, টলমল পায়ে একবার ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমি……কই, এখন তো আর কিছু শোনা যাচ্ছে না! এই সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না থাকায়, তার বুকে পূর্ন রূপে বিকশিত হয়েছে চাঁদ। বেশ কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে, আর তেমন কোন অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর না শুনতে পেয়ে ঘরে ফিরে এলাম আমি। মনে, হল হয়তো ঘুমের ঘোরে দেখা কোনো দুঃস্বপের বশে আমি শুনতে পেয়েছি সেই আর্তনাদ!

    কিন্তু সেই আর্তনাদ যে আমার মনের কল্পনা দ্বারা উৎপন্ন নয়, এই কথা ভয়ঙ্কর ভাবে প্রমাণিত হল পরের দিন সকালে! আরো একবার গোটা জমিদার বাড়ি ঘিরে হুলস্থুল বেঁধে গেল! আতঙ্ক জমাট বেঁধেছে এই বাড়ির পেছনের দিকে লাগোয়া ছোট ছোট মোসাহেবখানার একটি ঘরে। সেই ঘরে বাস করতো এক বিশ পঁচিশ বছর বয়সের যুবক, নাম কালাচাঁদ। গায়ের রঙের সাথে যথার্থই সমার্থক ছিল তার নাম। এই বাড়ির পনেরো কুড়ি জন চাকরের মধ্যে সে একজন। আজ সকালেই তার ঘরের মেঝেতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার মৃতদেহ! তার হা করা মুখ এবং ঘরের করিকাঠের দিকে এখনো চেয়ে থাকা বিস্ফারিত দুই চোখের দৃষ্টি দেখেই মনে হচ্ছিল, যে গতকাল রাত্রেই কোন অজানা দৃশ্য দেখে প্রবল আতঙ্কের চোটে বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার হৃদ যন্ত্র!

    (৫)

    আরশির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গা থেকে একে একে গয়নাগাটি খুলে রাখছিলো রত্না। সম্পূর্ণ রূপে বিবস্ত্র হয়ে একবার আরশির বুকে ফুটে ওঠা নিজের নগ্ন দেহটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলো সে। এই দেহের জন্যই আজ তার এত নাম ডাক, পয়সা কড়ি!……নাহলে ওই সব নাচ গান তো কত মেয়েই করতে পারে, কিন্তু সকলে কি আর ডাক পায় জমিদার বাড়িতে মুজরা করতে আসার! খাস ছোট বাবু তাকে কলকাতা থেকে এই গ্রামে বায়না করে আনিয়েছেন, এই বাড়ির অন্দরমহলের একটি সুবিশাল ঘরে তার থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন! কলকাতার কত নাম জাদা বাইজি বেশ্যারা চাতকের মত হা করে আছে তার জন্য!……এই সব ভাবতে ভাবতেই নিজের শরীরটা একটি হালকা শাড়িতে আবৃত করে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালো।

    চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারের কালি মেখে সাক্ষাৎ দৈত্যপুরীর মত দাঁড়িয়ে আছে গোটা জমিদার বাড়িটা। বাড়ির চাকর বাকরেরাও ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়……নিভে গেছে সকল ঘরের বাতি। শোনা যাচ্ছে না কারোর কন্ঠ ধ্বনি। শুধু বাড়ির পেছনের ওই জঙ্গল থেকে আসছে শেয়ালের ক্রন্দন রব। কেমন যেন গা ছমছম করে উঠলো রত্নার। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বন্ধ করে দিলো নিজের দুই চোখ……আবার কত অন্যান্য চিন্তা ভিড় করে এলো তার মস্তিষ্কে……এই যে ছোট বাবু, যাকে সে এতো ভালোবাসে, তিনিও তো শুধু তার শরীরটাকেই চিনলেন! তার সাথে কাটানো প্রতিটা রাতের দাম তিনি কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নেন! একবার যদি তিনি বুঝতেন তার মনের কথা…..একবার যদি এক চিলতে সিঁদুর তিনি তুলে দিতেন তার কপালে!…..নাহ, আর ভাবতে পারলো না রত্না……তার বন্ধ চোখের পাতায় ভেতর থেকেই গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা অশ্রু ধারা!

    এমন সময় হঠাৎ নিজের কপালে যেন কিসের একটা স্পর্শ অনুভব করলো রত্না। চমকে উঠে, সে দু চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো, যে সেটা হল……এই রাতের অন্ধকারে……ঠিক তার ওপরে, সেই ঘরের করিকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত এক ছায়া মূর্তির পায়ের গোড়ালি!……বিস্ফারিত চোখে তেমন ভাবেই ওপরের দিকে তাকিয়ে রইল রত্না……আর পড়লো না তার চোখের পাতা…….নিঃশ্বাস নেবার জন্য আর ওঠা নামা করলো না তার বুক!

    (৬)

    পরদিন সকালে বিমর্ষ চিত্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাড়ির উঠোনের এক কোনে। ততক্ষনে থানা থেকে লোকজন এসে তুলে নিয়ে গিয়েছে রত্নার মৃতদেহ। একটি আত্মহত্যা, এবং পরপর দুটি মৃত্যু…….যা কিভাবে ঘটলো এখনো তা কেউ জানে না! চোখের সামনে সব কিছু যেন ঝাপসা মনে হচ্ছিলো আমার। মনে হচ্ছিলো, যে আমার বিবেকে থাকা বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝের গন্ডিটাকে কেউ হাতুড়ি মেরে গুড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত! তার মানে এই বাড়ির ওপর সত্যিই চেয়ে গেছে কোন অশরীরীর কালো ছায়া?…….চিন্তার ঘোর কাটলো, যখন দেখলাম, যে কাছারি বাড়ির সামনের উঠোনে কয়েকজন লেঠেলের মধ্যে যেন একটি জটলা বেঁধেছে। তারা যেন উত্তেজিত হয়ে কি সব বলে চলেছে, এদিকে নায়েব মশাই যেন তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন!

    আমি কৌতূহলী হয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই, তারা চুপ করে গেল, কিন্তু ততক্ষণে মুখ খুললেন শঙ্কর বাবু,
    – ছোট বাবু…….এরা সকলে আপনাকে একটা কথা বলতে চায়, ছোট বাবু…..
    আমি বললাম,
    – বেশ বলো…..কি বলতে চাও!
    লেঠেলদের সর্দার, কাল্লুর এদের মধ্যে সবচেয়ে তাগড়াই চেহারা। সে সমীহের সুরে করজোড়ে আমাকে বলে উঠলো,
    – হুজুর, অপরাধ নেবেন না, হুজুর……..কিন্তু আমাদের সকলের একটাই কথা মনে হচ্ছে……এই বাড়িতে যা কিছু অঘটন ঘটে চলেছে, তার পেছনে……তার পেছনে একজনেরই হাত থাকতে পারে……..
    আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
    – কে সে? কার কথা বলছো তুমি কাল্লু?
    কাল্লুর দীর্ঘকৃতি শক্ত পোক্ত শরীরটাও যেন কেঁপে উঠলো আতঙ্কের চোটে, সে অস্ফুট কণ্ঠে বলল,
    – এই গ্রামের শ্মশানে একজন অঘোরী তান্ত্রিকের বাস, হুজুর…….সে পিশাচ-সিদ্ধ……তন্ত্র মন্ত্র, কালা জাদু……এই সব…..এই সব জানে সে!

    কাল্লুর কথা শেষ না হতেই বাকি লেঠেলরাও তারস্বরে তাকে সমর্থন করে উঠলো। কাল্লু বলেই চলল,
    – আমাদের সকলের মনে হয়, এখনই একবার শ্মশানে গিয়ে ওই শয়তানটাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত……ওকে লাঠির বাড়ি মেরে ওর হাড় গোর ভেঙে ওকে গ্রাম ছাড়া করা উচিত……
    আবার বাকি জন গর্জে উঠলো কাল্লুকে সমর্থন করার সুরে। অগত্যা, আর কোন উপায় না দেখে আমি বললাম,
    – ঠিক আছে……তোমরা সেখানে যেতে চাইছো, তো যাও……কিন্তু তার গায়ে হাত তুলবে না কেউ, তোমাদের কাজ হবে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসা……আমি নিজে ওকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবো, তারপর ঠিক হবে ওর শাস্তির মাপকাঠি!

    ওরা সকলে আমায় প্রণাম করে চলে গেল শ্মশানের রাস্তায়। আমি উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলাম তাদের সেই অঘোরীকে নিয়ে ফিরে আসার। কিন্তু প্রতীক্ষার অবসান যে এতো বিভীষিকাময় হতে পারে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল! দুই ঘন্টার মধ্যেই ওরা ফিরে এলো সেই অঘোরীর প্রাণ হীন নগ্ন দেহটাকে নিয়ে!…….সেই একই রকম ওপরের দিকে চেয়ে থাকা তার বিস্ফারিত চোখ!……মৃত্যুর ক্ষণিক আগে উপলব্ধি করা তীব্র আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ছড়িয়ে আছে তার দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা মুখমণ্ডলে!…….মনে হল, যেন পায়ের নিচ থেকে মাটিটা সরে গেল আমার! নিস্তেজ হয়ে গিয়ে ধপ করে উঠোনে বসে পড়লাম আমি!…..ওরা সকলে লাশটিকে ফেলে শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো আমার কাছে………

    (৭)

    এরপর অতিবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। ক্রমাগত মৃত্যুগুলির আতঙ্কের রেশ অনেকটাই কেটে গিয়েছে আমার মন থেকে। এরই মধ্যে নন্দিনীর এই বাসস্থানের খোঁজ পেয়ে, তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তার এক দূরসম্পর্কের কাকা। সদ্য বিধবা সুন্দরী যুবতী, নন্দিনীর অসহায়ত্বের কথা ভেবেই বোধহয় তিনি সাহস করে একটি প্রস্তাব তোলেন আমার কাছে……হ্যাঁ, নন্দিনীকে নিজের স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার প্রস্তাব! বলাই বাহুল্য, সেই মুহূর্তে নন্দিনীর অশ্রু ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে, আমিও “না” করতে পারিনি সেই প্রস্তাবে!

    আজ গোটা জমিদার বাড়িতে সাজ সাজ রব। রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে সারা বাড়িময় জ্বলে উঠেছে আলোর নকশা। নহবৎখানা থেকে ভেসে আসছে সানাই-এর মধুর ধ্বনি। আজ আমার আর নন্দিনীর ফুলশয্যার রাত্রি! রত্নার সাথে সেদিনকার সহবাসের পর, আবার নারী সঙ্গ পেতে চলেছি আমি! সন্ধ্যে থেকেই আমার ঘরে লেগেই আছে ইয়ার দোস্তদের হৈ হুল্লোড় এবং তার সাথে মদ্যপান। সঠিক সময়ে তারাই আমার নেশাগ্রস্ত শরীরটাকে ধরে ধরে পৌঁছে দিল ফুলশয্যার ঘরের দরজার বাইরে। সেই দরজা খুলে ধীর পায়ে অগ্রসর হতে লাগলাম ফুলে ফুলে সাজানো পালঙ্ক-টার দিকে, যার মাঝে বেনারসী আর গহনায় সুসজ্জিতা হয়ে, ঘোমটার ভেতর নন্দিনীও বোধহয় অধীর চিত্তে প্রতীক্ষা করছে আমারই জন্য!

    বিছানায় এসে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম নন্দিনীর ওপর। নেশাগ্রস্ত কাঁপা কাঁপা হাতেই খুলতে লাগলাম তার একের পর এক পোশাক। নন্দিনীর মুখেও যেন ফুটে উঠলো পরম তৃপ্তির আভাস, যখন তার সম্পূর্ন নগ্ন শরীরটার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ সঞ্চারিত হতে লাগলো। আর একটুও সময় নষ্ট না করে, সেই ঘরের বাতি নিভিয়ে, প্রবল উত্তেজনায় খামচে ধরলাম নন্দিনীর শরীরটাকে। যেন ভেঙে গুড়িয়ে গেল তার নরম দুই হাতের তালু আমার শক্ত পুরুষালি হাতের মুঠোর ভেতর। তার শরীরের সমস্ত অংশ ভরিয়ে দিলাম আমি চুম্বনের মাদকতায়। মুখ রাখালাম আমি তার উন্মুক্ত দুই স্তনের মাঝে…….কিন্তু!……কিন্তু!……

    কিন্তু একি……আমারই চোখের সামনে, অন্ধকারের মধ্যে একটু একটু করে যেন বদলে যাচ্ছে নন্দিনীর শরীর…….যেন ক্রমশ লোমশ আর পুরুষালি হয়ে উঠছে তার সর্বদেহ! তার স্তন যুগলের জায়গায় যেন রয়েছে কোন পুরুষের পেশীবহুল বুকের অংশ! …….এ কি করে সম্ভব! কি করে!….এক নিমেষে আমার রক্তের সমস্ত কামোত্তেজনা যেন গলে জল হয়ে গেল!……মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো!……আমি এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিলাম এই “পুরুষের” দেহ থেকে…….তারপর খাট থেকে দূরে গিয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দেওয়ালের গায়ে!

    এতক্ষনে খাটের উপর উঠে বসেছে সেই “পুরুষের” মূর্তি। তার তীব্র পুরুষালি কণ্ঠের অট্টহাসিতে যেন কেঁপে উঠলো আমার সর্ব শরীর! এই কণ্ঠস্বর আমার খুব চেনা…….এ যে আমার বাল্যবন্ধু শশধরের গলার আওয়াজ!……আমি কম্পিত গলায় চিৎকার করে বলে উঠলাম তাকে,
    – ক্ষ….ক্ষ…..ক্ষমা…….ক্ষমা করে দে ভাই আমার….…মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে আমার……নন্দিনীর রূপ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি আমি…….
    হাড় হীম করা সুরে বলে উঠলো শশধরের কন্ঠ,
    – ক্ষমা চাইছিস এখন? ক্ষমা? মনে পড়ছে তোর অপরাধের কথাগুলো?…….তোর দ্বারা রত্নাকে অর্থের প্রলোভন দেখানো……তারপর সে হাত করলো বাড়ির চাকর কালাচাঁদকে……..সে আমাদের ঘর পরিষ্কার করতে আসার সময় লুকিয়ে সংগ্রহ করলো আমার চিরুনিতে লেগে থাকা কয়েক গাছি চুল…….সেই চুলের গাছি নিয়ে রত্না গেল শ্মশানের সেই অঘোরী তান্ত্রিকের কাছে, আমার দেহাংশ-এর সাহায্যে তন্ত্র মতে ধীরে ধীরে আমাকে নপুংসক করে তোলার জন্য……কি রে মনে পড়ছে তো সেই সব কথা?

    আমি আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। শশধরের প্রেতাত্মা বলেই চলল,
    – কালাচাঁদ, রত্না এবং সেই অঘোরী……এদের সকলের অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুই যথেষ্ট মনে হয়েছে আমার কাছে!…..কিন্তু তুই তো আমার বাল্যবন্ধু…..তুই কি করে পারলি আমার এমন সর্বনাশ করতে? শুধু মাত্র নন্দিনীকে পাওয়ার জন্য এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলি আমার সাথে?……নাহ, মৃত্যুর মত তাৎক্ষণিক শাস্তি তোর জন্য যথেষ্ট নয়, শিলাদিত্য!……আমি তোকে মরতে দেব না রে, আর না তো তোর শরীরেও প্রবেশ করাবো নপুংসকতার মত খুঁত!…….তবে তোর দেহে পুরুষত্ব অটুট থাকলেও, তুই কখনই পাবি না নারী সঙ্গের সুখ! আজ থেকে যখনই তুই কোন নারীর সাথে সহবাস করতে উদ্যত হবি, তখনই তার মধ্যে দেখতে পাবি আমাকে……..মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ হবে তো কামোত্তেজনা!……সারা যৌবন কাল ধরে তুই ছটফট করবি নারী সঙ্গ পাওয়ার জন্য, কিন্তু কিছুতেই তুষ্ট করতে পারবি না নিজেকে! তোর একমাত্র সঙ্গী হবে হস্তমৈথুন……হা হা হা হা!

    আমি ভয়ার্ত চিত্তে, কোনোমতে সেই ঘরের দরজা খুলে এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে…….তার পর জোর কদমে ছুটে চললাম যে দিকে দুই চোখ চায়……..কিছুক্ষনের মধ্যেই মনে হল, যে চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে গেল সব……নিজেও বুঝতে পারলাম না, যে কখন আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম নিচে!

    (৮)

    এই ঘটনার পর বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে। নন্দিনী অন্যত্র বিবাহ করে সুখে সংসার করছে। কলকাতার সব নাম জাদা মানসিক রোগের ডাক্তারগুলোও সুস্থ করে তুলতে পারেনি আমাকে! কেউ কেউ কি যেন একটা গাল ভরা ইংরাজি নাম দিয়েছে আমার এই রোগটার……হ্যাঁ মনে পড়েছে…….Fregoli delusion……. এই মানসিক রোগে নাকি রোগী সকল মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মানুষকেই খুঁজে পায়, সে মনে করে যে ভিন্ন ভিন্ন মানুষজন হল আসলে একটি নির্দিষ্ট মানুষেরই ছদ্মবেশে ধারণ করা রূপ!……..কিন্তু আমি এই সব মানি না। আমি নিশ্চিত, যে শশধরের প্রেতাত্মাই আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য এই কাজ করে চলেছে, এবং আমার সারা জীবন ভর সে একই ভাবে আমাকে এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে চলবে!

    আপনাদের কি মনে হয়?

    সমাপ্ত

  • গল্প

    পিতৃত্ব

    পিতৃত্ব
    -প্রলয় কুমার নাথ

     

     

    (১)

    সেদিন সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে, টিভিতে খবরের চ্যানেলটা খুলে সবে একটু বসেছি। আমার স্ত্রী, সুতপা কিছুক্ষণ আগেই এক কাপ চা আর মুড়ি মাখা রেখে গিয়েছে আমার সামনে টেবিলের ওপর। ঠিক সেই সময় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলো আমাদের আট বছরের একমাত্র ছেলে পিকন। নিতান্ত ছাপোষা চাকরি আমার একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে, মাইনেও সেরকম ভালো নয়। এই দুটো মাত্র ঘরের ভাড়া বাড়িতে, আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসারটাকে নিম্ন মধ্যবিত্তই বলা চলে। তবুও পিকনকে কলকাতার একটি নামী ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, সেখানকার সমস্ত খরচ জুগিয়ে নিতান্ত সঙ্কুচিত হয়েই চলে আমাদের এই জীবনযাপন। তবুও স্বপ্ন দেখি, যে পিকন ভালো স্কুলে পড়ে একদিন অনেক বড় হবে, তখন আর আমাদের কোন অভাব অনটন থাকতে দেবে না সে। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই স্বপ্নভঙ্গ হয় একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে……এমন স্বপ্ন তো আমার মা বাবাও দেখে থাকবেন আমাকে নিয়ে, কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে কি?

    এমন সময় পিকন স্কুলের ইউনিফর্ম ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়েই, ছুটে এসে আমাকে বলে উঠল,
    – জানো তো বাপি…..স্কুল ছুটির পর আজ যখন আমি বাসে উঠতে যাচ্ছি, তখন না একটা দাদু আমায় ডাকছিলো!
    আমি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম,
    – সে কি রে! তুই চিনিস সেই দাদুকে? কেন ডাকছিলো সে তোকে?
    পিকন তার ছোট্ট মাথাটা দুদিকে ঘুরিয়ে বলে উঠল,
    – না গো বাপি, আমি তাকে চিনি না……তবে সে আমাকে বার বার বলেছিলো, যে তোমার বাবাকে বলো তার নিজের বাড়ি যেতে……
    আমি চমকে উঠে ওকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় সুতপা বেশ রাগী গলায় ওকে পেছন থেকে বলে উঠল,
    – তোমাকে না বলেছি, রাস্তার কোন অচেনা লোকের সাথে কথা বলবে না……জানো না, রাস্তায় কত ছেলেধরা ঘুরে বেড়ায়……যাও পড়তে বসো, আর যেন কখনো না শুনি যে তুমি অচেনা কারোর সাথে কথা বলেছো!
    পিকন বেজার মুখে চলে গেল ওর ঘরে……জানি না কেন, আমি আর খুব বেশি কথা বাড়ালাম না এই বিষয়ে।

    আশ্চর্যজনক ভাবে, পরদিনও স্কুল থেকে ফিরে, আমার কানে ফিসফিস করে পিকন সেই এক কথা বলে গেল, যাতে সুতপা এই কথা শুনতে না পায়। আজও নাকি, স্কুল ছুটির পর রাস্তায় দাঁড়ানো বাসের কাছে আসতেই, পিকনের দেখা হয়েছে সেই অচেনা “দাদু”-র সাথে। তিনি আজও তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে সেই একই কথা বলেছেন, “তোমার বাবাকে বলো, তার নিজের বাড়ি যেতে”! মনে বেশ কৌতূহল জাগলো আমার…..কে এই ভদ্রলোক? আর কেনই বা তিনি আমাকে সেই স্থানে বার বার যেতে বলছেন, যা আমি দশ বছর আগেই সারাজীবনের জন্য ত্যাগ করে এসেছি? না, তিনি আর যেই হোন না কেন, আমার বাবা হতে পারেন না…..কিছুতেই না…….

    (২)

    এখনো চোখের সামনে, দশ বছর আগেকার সেই সমস্ত ঘটনার স্মৃতি জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে…..যার জন্য আমি বাধ্য হয়েছিলাম বংশ মর্যাদার ঔদ্ধত্য আর অর্থের অহংকার দিয়ে গড়া সেই রাজপ্রাসাদ থেকে সকল বাঁধন ছিন্ন করে, এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে! সেদিন নাড়ির টান যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার মনের টানের রাস্তায়, আর বলা বাহুল্য, আমি বেছে নিয়েছিলাম দ্বিতীয়টাকেই! কলেজে পড়ার সময়ই আমার সুতপার সাথে প্রথম দেখা, আর তারপর থেকে যেন কোন মেয়ের দিকেই আর চেয়ে দেখিনি আমি। জানি না কেন, সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শ্যমবর্ণ মেয়েটিই যেন জুড়ে ছিলো আমার হৃদয়ের সর্বাংশে। এদিকে ধনী বনেদী পরিবারের একমাত্র সন্তান আমি, আমাদের বাড়ির কোন ছেলেকেই পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে চাকরির খোঁজ কখনো করতে হয়নি। আমি জানতাম, যে প্রথম দেখাতে, সুতপাকে বাড়ির পুত্রবধূ হিসাবে কখনোই মেনে নেবেন না আমার দাম্ভিক পিতৃদেব। তবুও আশা ছিল, যে সন্তানের মন একদিন বুঝতে পারবেন তার পিতা!

    কিন্তু আচমকাই, একদিন সেই আশাতেও জল ঢেলে দিলেন আমার পিতৃদেব। হঠাৎ করেই একদিন তিনি আমায় জানালেন, যে তিনি আমার বিবাহ স্থির করেছেন, তার বিজনেস পার্টনার, দিলীপ বাবুর মেয়ে পাপিয়ার সাথে। দিলীপ কাকুর পরিবারের সাথে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অনেক দিনের, এই কথা আমি জানি……শুধু জানতাম না, আমাকে ব্যবহার করে, বাবার সেই সম্পর্ককে দীর্ঘজীবী করার সেই অভিসন্ধির কথা। সেদিন সুতপাকে সেই বাড়িতে নিয়ে এসে, স্পষ্ট ভাষায় বাবার চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমি,
    – পাপিয়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়…..কিছুতেই নয়…..কারণটা তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি সুতপাকে……
    মা হয়তো আমাকে সমর্থন করেই কিছু বলতে চলেছিলেন, তিনি বাবার রক্তচক্ষু দেখে থেমে গেলেন তিনি। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই, বাবা গর্জে উঠেছিলেন,
    – তাহলে ওই ছোটলোকের মেয়েটার সাথেই সংসার পেতে ফেলো তুমি……তবে তা এই বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে!
    সকলের প্রকাশ্যে এমন অপমানিত হয়ে, সুতপা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, ছুটে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছিল সেই বাড়ি থেকে, আমি ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে তাকে থামিয়েছিলাম। তারপর বাবার জ্বলন্ত চোখের সামনে, ওকে জড়িয়ে ধরে, ওর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলেছিলাম আমি,
    – শুধু তোমার জন্য….শুধু তোমার জন্য আমি এই বংশ গৌরব, ধন, দৌলত, ঐশ্বর্য…..এই সব কিছু আমি ছাড়তে রাজি…..এখন শুধু তোমার মতামত দরকার, সুতপা……বাপের কাছ থেকে ত্যাজ্যপুত্র হওয়া একটি মানুষের সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-এর উদ্যেশ্যে পাড়ি দিতে, তুমি রাজি হবে তো?
    সুতপা কোন উত্তর দেয়নি সেদিন, শুধু আমার বুকে থাকা জামার অংশটা ভিজিয়ে দিয়েছিলো নিজের চোখের জলে……আমি পেয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রশ্নের উত্তর!

    সেদিনই ছিল আমার সেই বাড়িতে শেষ দিন। মায়ের শত অনুরোধ উপেক্ষা করেও, আমি সুতপার হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই নিরাপদ আশ্রয়ের বাইরে। বাড়ির সদর দরজার বাইরে পা ফেলতে ফেলতেও শুনেছিলাম, মার কান্নার আওয়াজের সাথে, বাপের তীব্র ভৎসনা,
    – যা….যা…..বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে…..আজ থেকে আমি জানবো, যে আমার কোন ছেলে নেই…..আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি কোন অনাথ আশ্রমকে দান করে দেবো…..বাড়িয়ে যা তুই, বেরিয়ে যা……..
    তারপর থেকে আর কোন সম্পর্ক নেই আমার বাপ-মায়ের সাথে। এই দশ বছর ধরে আমাদের ফোনে লাগানো অন্য সিম কার্ড, যাতে তারা আর কোনো ভাবেই কথা বলতে না পারেন আমাদের সাথে। আমাদের ভাড়া বাড়ির ঠিকানাও তাদের অজানা। অবশ্য, এতদিন পরেও তাদের কাছ থেকে নিজেদের এতটা দূরত্বে রাখার পরামর্শটা কিন্তু সুতপার……তার কানে যেন এখনো বাজে, তার উদ্দেশ্যে বাবার বলা সেই কথাটা, “ছোটলোকের মেয়ে”!

    (৩)

    তাই পিকনের কথা শুনে, আমার মনের কৌতূহল যেন বেড়েই চলেছিল। পরদিন অনেক কষ্টে অফিসের বসকে রাজি করিয়ে, একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। ছুটে গিয়েছিলাম ছেলের স্কুলের গেটের বাইরে। নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল ছুটি হওয়ার পর, একে একে স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো কচি কাঁচাদের দল। তাদের মধ্যে পিকনও স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারপর আমাকে দেখে একটু থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
    – বাপি তুমি!…..ও বুঝেছি, তাহলে আজ তুমি আমাকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছো, তাই না বাপি?
    ওর কথার উত্তর দেওয়ার আগেই, পেছন থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত গলার গুরুগম্ভীর ডাক,
    – খোকা!
    আমি চমকে উঠে, পেছন ফিরে চেয়ে দেখলাম এক বয়সের ভারে ভেঙে পড়া বিদ্ধস্ত মানুষকে…….আমার সকল বিশ্বাসকে চূর্ণ করে মুর্তিমানের মত আমার সামনে যে আজ দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ নয়…..আমার বাবা! তার মানে তিনিই রোজ পিকনকে বলেছেন আমাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলতে…..কিন্তু তিনি জানলেন কি করে, যে পিকন এই স্কুলে পড়ে! সেই মুহূর্তে আমি পিকনের উদ্যেশ্যে বললাম,
    – না, আমি তোকে নিতে আসিনি রে, যা….যা তুই বাসে উঠে যা…..আমার অন্য কাজ আছে ……

    অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল বাসে পিকন উঠে গেলে, আমি বাপের দিকে ঘুরে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি বলে উঠলেন,
    – বাড়ি ফিরে চল, খোকা……আমার জন্য না হলেও, তোর মায়ের জন্য…..সে যে আজও বড্ড কান্নাকাটি করে তোদের জন্য……এই বয়সে তোদের ছাড়া আমাদের দেখার আর কে আছে, বল……
    আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, বিকালের পড়ন্ত রোদে বাবার চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে, তার সেই দাম্ভিক কণ্ঠস্বরে আজ বিনয়ের সুর! তার মানে কি বয়সের ভারে বিগলিত হতে শুরু করেছে তার পাথর সম হৃদয়!
    নিজের অজান্তেই, আমার কন্ঠ থেকে কে যেন বলে উঠেছিল,
    – আমি তো ফিরে আসতেই চাই, বাবা…..ফিরে আসতে চাই আমি…..কিন্তু সুতপা! তার মনে যে তোমার প্রতি ঘৃণা এই দশ বছরেও এতটুকু কমেনি, বাবা!
    চশমা খুলে নিজের দুচোখ মুছে, তিনি উৎসাহের গলায় বলে উঠেছিলেন,
    – তুই শুধু বৌমাকে একবার বাড়ি নিয়ে আয় খোকা……আমি আর তোর মা মিলে তাকে বোঝাবো খন……গুরুজন হয়ে না হয় দুটো কড়া কথা বলেই ফেলেছি তাকে, তাই নিয়ে কি এতবছর রাগ করে থাকলে চলে? আর….আর সে যদি নিতান্তই না মানে…..তাহলে…..তাহলে তার পা ধরে ক্ষমা……….
    বাবার কথা শেষ না হতেই, আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
    – ছি ছি, বাবা…….এ কি বলছো তুমি! এসব বললে যে আমাদের অমঙ্গল হবে!
    বাবা যেন এবার অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন,
    – তাহলে তুই বল….আমায় কথা দে….আমায় কথা দে, খোকা…..যে তুই বাড়ি ফিরে আসবি…..আমার কাছে কিন্তু বেশি সময় নেই…..আমায় কথা দে, খোকা!
    আমি নিজের অজান্তেই আবার বলে উঠলাম,
    – কথা দিলাম……কথা দিলাম যে কালই আমরা ও বাড়ি ফিরে যাবো, বাবা….. কথা দিলাম!
    সেই মুহূর্তেই তিনি হনহন করে চলে গেলেন সেই রাস্তা থেকে, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সময়টা অবধি দিলেন না তিনি! তখনই দেখলাম, যে পিকনদের স্কুল বাসটাও স্টার্ট দিলো ছাত্র ছাত্রীদের বাড়ি ফেরানোর উদ্দেশ্যে। দেখলাম, যে পিকনও বাসের একটি জানলার পাশে বসে, ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে আমাদেরই দিকে!

    (৪)

    সেদিন রাত্রি বেলা, সুতপার দুহাত চেপে ধরে, আমি তাকে এক নিঃশ্বাসে বলেছিলাম সমস্ত কথা। বলেছিলাম, যে এই নিয়ে তিনদিন ধরে বাবাই রোজ এসেছেন পিকনের স্কুলের কাছে, আমাদের ও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে। বলেছিলাম, যে আমি বাবাকে কথা দিয়েছি, যে তোমাকে রাজি করিয়ে কালই ও বাড়িতে ফিরে যাবো! সব শুনে কিছুক্ষন গম্ভীর হয়ে বসেছিল সুতপা। তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে আমাকে বলেছিল,
    – আমি শুধু এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম, তনয়…..যেদিন তোমার বাবা নিজে থেকে আমাদের কাছে এসে নিজের ভুল স্বীকার করবেন……মা বাবা তো আমারও আছে……নাহ, আমি আর তোমাদের বাপ-ছেলের সম্পর্কের মধ্যে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চাই না…….তাহলে, কালই আমরা যাচ্ছি তো ও বাড়িতে?
    ওর কথা শুনে একটা মস্ত বড় পাথর যেন সরে গিয়েছিল আমার বুকের ওপর থেকে!

    পরদিন সকালেই সুতপা আর পিকনকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সেই দশ বছর আগে ফেলে আসা পথ ধরে। সেই কোন কালে ফেলে আসা ওলি গলি, নিজের ঘরের বিছানা, মায়ের হাতের রান্না, পাড়ার রকে বসে বন্ধুদের ঠেক, বাবার সেই ব্যক্তিত্বে ভরা মুখশ্রী……এই সবকিছু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়! উত্তর কলকাতার সুবৃহৎ দোতলা বাড়িটা যতই দূর থেকে ভেসে আসছিল চোখের সামনে, ততই যেন বুকের ভেতর বেজে উঠছিল পূনর্মিলনের খুশির সুর! কাছে যেতে বুঝতে পারলাম, যে এই দশ বছরে বাড়িটার চেহারার যেন যথেষ্টই অবনতি হয়েছে। জায়গায় জায়গায় আগাছা আর দাঁত বার করা ইঁটের সারি স্পষ্টই প্রমাণ করছে মেরামতির ঘোর অভাব। তবে সেদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ না করে, আমি খুশির আমেজে মশগুল হয়ে, সুতপা আর পিকনকে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম বাড়ির খোলা সদর দরজা দিয়ে……..

    (৫)

    কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকেই, মনে হল চারিদিকের আবহাওয়া কেমন যেন থমথমে! বাড়ির নিচতলার বসার ঘর থেকে ভেসে আসছে বেশ কিছু মানুষের গলার আওয়াজ……আমি আশ্চর্য হয়ে বাবা মাকে ডাকতে ডাকতে, ওদের দুজনকে নিয়ে ছুটে গেলাম সেদিক পানে। কিন্তু সেই ঘরের মধ্যে ঢুকেই আমাদের তিনজনের চক্ষুস্থির হয়ে গেল! ঘরের ভেতর ভর্তি আত্মীয় স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড়……তাদের সকলের মাঝে রাখা রয়েছে, রজনীগন্ধার মালা জড়ানো বাবার একটি মাঝবয়সের ছবি! সেই ঘরের এক কোনে বিধবার বেশে হতভম্ব হয়ে বসে থাকা মাকেও দেখতে পেলাম এতক্ষণ পর! আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন, তারপর ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি,
    – এত বছর …..এত বছর পর, এখন আসার সময় হল তোদের…..এখন আসার সময় হল তোদের, খোকা! মানুষটা…..মানুষটা যে আমাদের সকলকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল রে, খোকা…….. চলে গেল…….
    বিস্ময়ে আমার গলা দিয়ে যেন কথা বেরোল না আর, আমি পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম, যে মা উন্মাদের মত কেঁদেই চলেছেন,
    – সারাটা জীবন…..সারাটা জীবন মানুষটা তোদের জন্যই অপেক্ষা করে গেল রে, খোকা…..…বলতো, যে দেখো একদিন না একদিন ঠিক খোকা বৌমাকে নিয়ে ফিরে আসবে এই বাড়িতে…….তুই তো জানিসই তোর বাবা কি ধাতে গড়া……ভাঙবে কিন্তু মোচকাবে না…….তাই মন থেকে তোদের ফিরে পেতে চাইলেও, কখনো আগ বাড়িয়ে তোদের খোঁজ খবর নিতে চাইনি সে……..তুই কি একটুও চিনলি না তাকে, খোকা……এই তোর আসার সময় হল……

    বাড়িতে উপস্থিত সমস্ত অতিথিরা যেন হতবাক হয়ে চেয়ে রয়েছেন আমাদের দিকে। কারোর মুখে কোন কথা নেই, এমন সময় অনতিদূর থেকে দিলীপ কাকু উঠে এলেন আমাদের কাছে। তারপর তিনি একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
    – তোমার মা সত্যি কথা বলছেন, তনয়……পুরো এক সপ্তাহ ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তোমার বাবা, গতকাল বিকালেই মারা যান তিনি…….তবে মৃত্যুর আগে অবধি তার শুধু একটাই ইচ্ছা ছিল, যে তোমরা যেন নিজে থেকেই ফিরে আসো এই বাড়িতে, আর সেই জন্যই তিনি কিছুদিন আগে উইল করে সমস্ত সম্পত্তি তোমার নামেই লিখে দিয়ে গেছেন…….কিন্তু তার সেই শেষ ইচ্ছা আর পূরণ হলো কই!
    আমি সম্পত্তির কথায় কর্ণপাত অবধি না করে, অস্ফুট স্বরে শুধু একটা কথাই বলে উঠলাম,
    – কি বললেন আপনি! এক সপ্তাহ ধরে বাবা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন! গতকাল বিকালেই তিনি মারা গিয়েছেন!……তাহলে…..তাহলে…..গত তিনদিন ধরে পিকনকে স্কুলের কাছে……..

    আমার কথা শেষ না হতেই, স্বয়ং পিকনই বলে উঠল,
    – ওফ ও বাপি……ওই দুদিন তো এই দাদুই আমার সাথে দেখা করে তোমাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলতে বলেছিলো……
    এই বলে সে দিলীপ কাকুর দিকে নিজের হাতের ছোট্ট আঙ্গুলটা দিয়ে ইঙ্গিত করল। এই কথা শুনে ম্লান হেসে দিলীপ কাকু বলে উঠলেন,
    – তোমার ছেলে ঠিকই বলছে, তনয়…….ও যে স্কুলে পড়ে, তার খুব কাছেই আমার জামাই (মানে পাপিয়ার স্বামী) ফ্ল্যাট কিনেছে…..পাপিয়া আমাকে বলেছিল, যে স্কুল বাস ছাড়াও, ও মাঝে মাঝে ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে তোমাকেই দেখেছে পিকনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে……তুমি হয়তো তাকে লক্ষ্য করনি……..এদিকে তোমার বাবার এই অবস্থা, আর তোমার কোন খোঁজ খবরও নেই, তাই আমি দুদিনের জন্য গিয়েছিলাম মেয়ের ওখানে……যদি তোমার সাথে একবারটি দেখা হয়ে যায়, কিন্ত তা আর হল না। তাই পাপিয়ার কথামত, স্কুল ছুটির সময় আমিই পিকনকে বলতাম তোমাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলতে……এছাড়াও তোমার খোঁজ খবর, ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বারও চেয়েছিলাম ওর কাছ থেকে, কিন্তু ও বাচ্চা ছেলে…..সে সব তো আমাকে বলতে পারলই না……বরং আমার কাছে আসতেই ভয় পেত ও, হয়তো ভাবতো আমি কোন ছেলে ধরা! তোমার বাবার যাই যাই অবস্থা শুনে, গতকাল সকালেই ফিরে এলাম এখানে! আর কাল বিকালেই…….

    আমি এবার পাগলের মত পিকনের দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলে উঠলাম,
    – আর তৃতীয় দিন……মানে গতকাল বিকালে…..সেদিন…..সেদিন যে আর এক দাদু আমাদের সাথে দেখা করে গেল, পিকন! তোর স্কুলের সামনেই! তুইও তো তখন ওখানেই ছিলিস…..বাসের জানলা থেকে তাকে নিশ্চয় দেখেছিলিস তুই…..বল, বল……আমার কথার জবাব দে……এ কি করে সম্ভব! কি করে…….
    আমার কথা শেষ না হতেই, পিকন বেশ কুণ্ঠার সাথে বলে উঠল,
    – সেদিন তো কোন দাদুই আমাদের সাথে দেখা করতে আসেনি, বাপি…..কেউ না, কাউকেই দেখিনি আমি……শুধু….শুধু বাসের জানলা থেকে তোমাকেই দেখেছিলাম নিজের মনে কথা বলতে……শুধু আমি নই, আমার ফ্রেন্ডরাও তোমাকে ওই ভাবে নিজে নিজে কথা বলতে দেখেছিলো……সবাই হেসে বলছিল “ইওর ড্যাড ইস ম্যাড”……আমি তোমাদের বকা খাওয়ার ভয়ে বাড়িতে এসে কাউকেই এই কথা বলিনি, বাপি!
    আমি আতঙ্কে আরোষ্ঠ হয়ে ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম বাবার মালা পড়ানো ছবিটার দিকে চেয়ে……এখনো যেন সেই ছবির ভেতর থেকে কানে ভেসে আসছে তার কণ্ঠস্বর,
    – তাহলে তুই বল….আমায় কথা দে….আমায় কথা দে, খোকা…..যে তুই বাড়ি ফিরে আসবি…..আমার কাছে কিন্তু বেশি সময় নেই…..আমায় কথা দে, খোকা!

  • গল্প

    কালচক্র

    কালচক্র
    -প্রলয় কুমার নাথ

    (১)

    জঙ্গলের এবড়ো খেবড়ো মাটির ওপর উবু হয়ে বসে ছিলেন বিনোদবাবু। মাথার মধ্যে কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। এক মুহূর্তের মধ্যে যে কি হয়ে গেল, তা এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠেছে চারি দিকে। বনের নাম না জানা গাছগুলোর মাথার ওপর, খোলা আকাশের বুকে, নিজের পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে বিকশিত হয়েছে চাঁদ। বাসায় ফিরতি পথে যেতে যেতে, আজকের মত শেষ বারের জন্য কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলো কোন এক অচেনা পাখির ঝাঁক। চাঁদের আলোর রুপোলী সাজে যেন সেজে উঠেছে গোটা জঙ্গলের সমস্ত গাছপালা। ভয়ার্ত চোখে চারিদিকে চেয়ে দেখার পর, জঙ্গলের মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন বিনোদবাবু। হঠাৎ পুব দিক থেকে ছুটে আসা দমকা ঝড়ো হাওয়ার দাপটে যেন কেঁপে উঠলো তার সর্বশরীর। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্যের মত তিনি এক পা দুই পা করে এগিয়ে যেতে লাগলেন বন্য গাছপালা মাড়িয়ে!

    মস্তিস্কের ওপর জোর খাটিয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি…… এখন কোথায় আছেন তিনি? কি করে পৌঁছলেন তিনি এখানে? কোথায়ই বা চলেছেন তিনি এখন? নাহ, ঝাপসা হয়ে আসা অন্ধকারের মাঝে ঝড়ো হাওয়ায় চারিপাশের গাছপালাগুলোর দুলে ওঠা ছাড়া আর কোন দৃশ্যই তো ভেসে উঠছে না তার চোখের সামনে! তার মানে কি আগেকার সমস্ত স্মৃতি লোপ পেয়েছে তার মস্তিস্ক থেকে? ঠিক সেই মুহূর্তেই কোন এক হিংস্র বন্য পশুর ক্ষুধার্ত গর্জনে যেন কেঁপে উঠলো আঁধারে ঘেরা জঙ্গলের চতুর্দিক! আর একটুও সময় নষ্ট না করে, কোনদিকে না তাকিয়ে, দ্রুত পায়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগলেন বিনোদবাবু! বেশ কিছুক্ষণ ছুটতে ছুটতে গলদঘর্ম হয়ে উঠলেন তিনি, তার হৃদকম্পন আর নিঃশ্বাসের গতিবেগ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠলো! হঠাৎ কোন বন্য লতার ঝোপে পা আটকে গিয়ে, মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি…… তীব্র যন্ত্রণা যেন দলা পাকিয়ে উঠতে লাগলো তার সমস্ত শরীর জুড়ে। সেই অবস্থাতেই তার দৃষ্টি আটকে গেল, তারই সামনে, অনতিদূরে ঘটতে থাকা একটি ভয়াবহ দৃশ্যের দিকে!

    সেই রাতের অন্ধকারের সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তার সামনের একটি সুবৃহৎ গাছের সমগ্র ডালপালা জুড়ে জ্বলে উঠেছে হলুদ অগ্নিশিখা! তার মানে দাবানল…… দাবানল লেগেছে এই বনে! মাটি থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন বিনোদবাবু। তিনি জানেন, যে এমন দাবানল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানের বন জঙ্গলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে! তার মানে কি তার জীবনের অন্তিম সময় এখন উপস্থিত? এই লেখা ছিল তার অদৃষ্টে! ঠিক এমন সময়, যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না বিনোদ বাবু! তিনি স্পষ্ট শুনতে পারছেন একজন পুরুষের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “বাঁচাও…… কে আছো, বাঁচাও আমায়…… বাঁচাও……” তার মানে কি এই জনমানবশূন্য গহীন বনে তার মত আরেকজন কোন মানুষ আছে? আরেকবার…… আরেকবার তিনি শুনতে পেলেন সেই অচেনা কণ্ঠস্বর, “বাঁচাও…… এই আগুনের তাপ থেকে রক্ষা করো আমায়…… আমি যে নড়তে পারছি না এই স্থান থেকে…… বাঁচাও……” ব্যাস, আর কোন সময় নষ্ট না করে সেই জ্বলন্ত গাছটির দিকে এক ছুটে এগিয়ে গেলেন বিনোদবাবু। আগুনের তাপে ভস্মীভূত হয়ে, জ্বলন্ত ডাল পালা খসে পড়তে শুরু করেছে গাছের নিচে। সেই গাছের নিচেই যেন কেউ একটা পড়ে আছে, সেই করে চলেছে নিজেকে আগুনের তাপ থেকে বাঁচানোর এই আকুল আর্তনাদ।

    বিনোদবাবু আরো দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন সেই দিকে। কিন্তু গাছটির নিচে আসতেই, তার নিচে পড়ে থাকা প্রাণীটাকে দেখে বিস্ময় আর আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। নাহ, এটাতো কোন মানুষ নয়! এটা তো…… এটা তো…… আর ভাবতে পারলেন না তিনি! ঠিক সেই সময় আবার তার কানে ভেসে এলো আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য সেই জীবটার কাতর আর্তনাদ! কি করবেন কিছুই বুঝে না উঠতে পেরে, বিনোদ বাবু এগিয়ে যেতে লাগলেন জ্বলন্ত গাছের নিচে অচল হয়ে পড়ে থাকা সেই প্রাণীটার দিকে!

    (২)

    পরপর পাঁচ বার মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে বাথরুমের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে চেয়ে রইল বলবন্ত। বলবন্ত ওরফে বলবন্ত সিংহ, কলকাতার একটি বিখ্যাত রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে সায়েন্টিস্ট পদে যোগ দেওয়া তরতাজা নবযুবক। সে জানে, যে এতক্ষন ধরে যে অস্থিরতার চোটে তার প্রায় উন্মাদের মত অবস্থা হচ্ছিল, সেটা তার অনেক দিনের সমস্যা। সেই যখন ক্লাস নাইনে পড়ে সে, তখন থেকেই সে প্রতি মাসে এক দুই বার ভোগ করে আসছে এই নরক যন্ত্রনা। বেসিনের ওপরে রাখা কাঁচের পাত্রের ভেতর ঘন তরল পদার্থটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে। এটার জন্যই তাকে প্রতিবার এই সাময়িক অস্থিরতার শিকার হতে হয়!

    জীবনের যে সময়ে নারী জাতির প্রতি প্রথম আকর্ষণ উপলব্ধি করে কোন তরুণ, সেই সময় থেকেই এই অদ্ভুত শারীরিক ঘটনার শিকার হয়ে চলেছে বলবন্ত। প্রথম প্রথম সে বুঝতে পারতো না এর কারণ। বাড়ির কাউকেই সে এখনো বলেনি এই কথা, কিন্তু গোপনে খোঁজ নিয়ে সে এখন জানে তার কারণ। সে জানে যে এই অদ্ভুত শারীরিক ক্ষমতাটা তার জন্মগত সূত্রেই পাওয়া, তাই হয়তো সারা জীবন তাকে সহ্য করে চলতে হবে এই অস্থিরতার দাপট! কাঁচের পাত্রের তরল পদার্থটিকে বেসিনের মধ্যে ফেলে দিয়ে, পাত্রটিকে ভালো করে ধুয়ে নিলো বলবন্ত। কে জানে, আবার কখন কাজে লাগবে সেটা। এখন তার শারীরিক অবস্থা অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছে। সে তোয়ালেতে মুখ মুছে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে এলো।

    এমন সময় সশব্দে বেজে উঠলো বিছানার ওপর পড়ে থাকা তার মোবাইল ফোনটা। নিজের কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলে তার স্ক্রিনের দিকে তাকালো। তারপর ফোনটা রিসিভ করে, কিছুক্ষণ আগেকার সেই ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি এনে, ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর বাংলা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,
    – হা ম্যাডামজি, বোলিয়ে কেয়া হাল চাল হে……
    ফোনের ওপার থেকে শ্রাবন্তী এক মুখ হেসে বলে উঠলো,
    – বস ভগবান কি কৃপা সে সব কুছ ঠিক ঠাক হে……কিন্তু শুধু আপনার খোঁজ খবর নেবার জন্যই ফোন করিনি আমি, অন্য একটা বায়নাও আছে আপনার কাছে আমার!

    বলবন্ত আর শ্রাবন্তী একই রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বলবন্ত প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগে, এবং শ্রাবন্তী সাইকোলজি বিভাগে। সেই সূত্রেই দুজনের আলাপ। শ্রাবন্তীর কথায় বলবন্ত আশ্চর্য হয়ে কিছু একটা বলতে চলেছিল, কিন্তু তার আগেই শ্রাবন্তী বলে উঠল,
    – আরে মশাই, আপনি তো আর এবার পুজোর ছুটিতে রাজস্থানে ফিরছেন না, তাই আসুন না, এই কয়েকটা দিন আপনি আমাদের সাথে কাটান!
    বলবন্ত রাজস্থানের জয়পুরের বাসিন্দা। কর্মসূত্রে সে কলকাতায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। প্রতি বছর পুজোর ছুটির সময় আরো বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়ে সে রাজস্থানে চলে যায়। তবে এবার কাজের চাপের জন্য, পুজোর কয়েকটা ছুটির দিন বাদ দিয়ে, অন্য কোন দিন সে আর ছুটি নিতে পারবে না। তাই এবার পুজোটা তাকে কলকাতাতেই কাটাতে হবে।

    বলবন্ত বলে উঠলো,
    – আপ লোগো কি সাথ মতলব?
    শ্রাবন্তী হেসে বলে উঠলো,
    – আমি আর আমার হাজব্যান্ড এবার বর্ধমানের চন্দ্রপুরে অবস্থিত আমার মামার বাড়িতে পুজোর ক’টা দিন কাটাবো ভেবেছি। তার থেকেও বড় কথা কি জানেন, আমার মামার বাড়িতে দশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্গা পুজো আবার শুরু করতে চলেছি আমরা……আপনি আসুন না আমাদের সাথে, খুব ভালো লাগবে আপনার!
    এবার মনটা বেশ প্রসন্ন হয়ে উঠলো বলবন্তের, সে হেসে বলে উঠলো,
    – বিলকুল, বিলকুল হাম জায়েঙ্গে আপকে সাথ! লেকিন এক সাওয়াল উঠ রাহা হে মন মে……আপ কি মামাজি কি ঘর মে দুর্গা পূজা দশ সালো সে বন্ধ কিউ থা?

    এই কথা শুনে যেন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেল শ্রাবন্তীর কন্ঠ। যেন এক মুহূর্তের মধ্যে একটি গম্ভীর চিন্তার রেশ ছড়িয়ে গেল তার মস্তিষ্কের মধ্যে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে হেসে বলে উঠলো,
    – সে অনেক কথা, মিস্টার সিংহ……আপনি আসুন না আমাদের সাথে, সব কিছুই পরে বলা যাবে আপনাকে। তাহলে অপনি কনফার্ম আসছেন তো?
    বলবন্ত বলে উঠলো,
    – জি হা, জরুর!

    (৩)

    পুজো এখনো এলই না, এদিকে চন্দ্রপুরে মনে হচ্ছে শীত কাল পড়ে গিয়েছে। এর সাথে শুরু হয়েছে ঝির ঝিরে বৃষ্টি। তাই এখানকার চাটুজ্যে বাড়ির কেয়ার-টেকার রমাপদর মনটা আজ বেশ খারাপ। কোনো মানে হয়, পুজোর আগে এমন বৃষ্টির! গোটা পুজোটাই মনে হয় মাটি হয়ে যাবে এবার। সুবিশাল চাটুজ্যে বাড়িতে এখন সেই একমাত্র মানুষ। এই বাড়ির নিচের একটি ঘরে, ছোট্ট দড়ির খাটিয়াটার ওপর কোন মতে গুটি সুটি মেরে শুয়ে ছিলো সে। ঠান্ডা লাগায়, এই শরৎ কালেও গায়ের উপর হালকা একটা কাঁথা চড়িয়ে রেখেছে এই বছর পঞ্চাশের মানুষটি। রাত বোধহয় সাড়ে দশটা হবে, তবুও ঘুম আসছিলো না তার চোখে।

    তার ঘরের এক পাশে খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো প্রবেশ করেছে গোটা ঘরে। তবে আকাশে চাঁদ থাকলেও বৃষ্টির কিন্তু বিরাম নেই। এই বাড়িটা পুরোনো আমলের বনেদি ধাঁচে গড়া, তাই এই গ্রামের লোকালয় থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থিত। রমাপদ এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল জানলার বাইরে, বাড়ির বাগানে অবস্থিত একটি বিশাল বড় পলাশ গাছের দিকে। কানে একটানা বৃষ্টির শব্দ আসছে, এছাড়াও ঝিঁঝিঁ পোকা আর পাশের পুকুর থেকে আসছে ব্যাঙের ডাকের আওয়াজ। এই বৃষ্টি স্নাত রাতের শীতল রুপোলি আমেজ উপলব্ধি করতে করতে অতীতের অনেক কথা মনে পড়ে গেল রমাপদর।

    চাটুজ্যে বাবুরা ছিলেন এই গ্রামের সবচেয়ে গণ্যমান্য পরিবার। সেই ইংরেজদের সময় থেকে গ্রামের তিন তিনটে রাইস মিলের মালিক ছিলেন তারা। তাই গ্রামবাসীরা এই পরিবারকে গ্রামের জমিদারের আসনেই বসিয়েছিলো। রমাপদরা বংশপরাক্রমে এই বাড়িতে কাজ করে এসেছে। তাই এই বাড়ির নাড়ি নক্ষত্র তার চেনা। আগে প্রতিবছর কত ধুমধাম করে দুর্গা পুজো করা হত এই বাড়ির ঠাকুর দালানে। বাবুরা দুই হাতে পয়সা খরচ করতেন, পুজোর চার দিনই গ্রামের সমস্ত গরিব দুঃখী মানুষজনের মধ্যে বিলি করা হত অন্ন এবং পোশাক। তারপর কালের নিয়মে হারিয়ে গেল সেই সব দিন। মিটি মিটি জ্বলা প্রদীপের একমাত্র সলতের মত শুধু রয়ে গেলেন এই পরিবারের একমাত্র বংশধর, তার ছোটবাবু, শ্রী বিনোদবিহারী চাটুজ্যে!

    রমাপদ জানে যে সদা হাস্যময় বিনোদবাবু ছিলেন পন্ডিত ব্যক্তি। কলকাতার কলেজ থেকে কত পড়াশোনা করে এত্ত বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। সেই সব নাম রমাপদর মত মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ মুখে আনতেও পারবে না। কোন একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন বিনোদ বাবু, সেটাও জানে না সে। তবে সে এই কাজ পাগল মানুষটাকে বার বার বিয়ে করার কথা মনে করিয়ে দিলেও, তিনি সেই কথা কানেও তুলতেন না। তবে একটা যা পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন বিনোদবাবু, আগেকার মত অত ধুমধাম না হলেও, প্রতি বছর দুর্গা পুজোটাকে সুষ্ঠ ভাবেই সম্পন্ন করতেন তিনি।

    কিন্তু তার পরে যে কি থেকে কি হয়ে গেল, তা ঈশ্বরই জানেন! হিমাচল প্রদেশের কোথায় যেন একটা গবেষণার কাজ নিয়ে গেলেন তার ছোটবাবু, কিন্তু সেই যাওয়াই হল অগস্ত্যযাত্রা! আর ফিরে এলেন না বিনোদ বাবু! কত থানা পুলিশ করলো রমাপদ এবং গাঁয়ের লোকেরা, কিন্তু কিছুতেই তার হদিস পাওয়া গেল না। এটা প্রায় আজ থেকে দশ বছর আগেকার কথা, তাই দশ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এই বাড়ির দুর্গা পুজো। কিন্তু এই বছর আবার শূন্য ঠাকুর দালান থেকে শোনা যেতে চলেছে ঢাকের বাদ্যি, কারণ এই বছর তার ছোটবাবুর একমাত্র ভাগ্নী, শ্রাবন্তী দিদিমণি এবং তার স্বামী অমলেন্দু দাদাবাবু আবার শুরু করতে চলেছেন দশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই বাড়ির পুজো! কাল দুপুরের মধ্যেই এসে পড়বেন তারা, তাদের ঘর দোর আগে থেকেই পরিষ্কার করে রেখেছে রমাপদ। তার মনে যেন আর আনন্দ ধরে না!

    এমন সময় হঠাৎ তার চোখ চলে গেল জানলার বাইরে ওই পলাশ গাছটার পেছনের ঝোঁপের ভেতর! তার যেন স্পষ্ট মনে হলো রাতের আবছা আলো আবছা অন্ধকারের মধ্যে একটি খর্বাকার চারপেয়ে জীবের ছায়ামূর্তি এদিক থেকে ওদিকে সরে গেল! বৃষ্টির শব্দের মাঝেও স্পষ্ট শোনা গেল জলে ভেজা ঝরা পাতার ওপর তার খস খস পদশব্দ! বেশ অবাক হয়ে বিছানা থেকে উঠে জানলার দিকে ছুটে গেল রমাপদ! নাহ, এটা তো তার চোখের ভুল নয়, এখনো হালকা হালকা দুলে উঠছে গাছের পেছনে ওই ঝোপটা! তার মানে কি শেয়াল ঢুকেছে বাড়ির ভেতরে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রমাপদ ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই ঝোপের দিকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে অনেক খোঁজার পরও কিছুই পেলো না সে। অগত্যা আবার ফিরে এলো সে তার নিজের ঘরে।

    ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, পেছন ফিরতেই আতঙ্কের চোটে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে লাগলো তার সর্বশরীর দিয়ে। খোলা জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার বিছানায়……আর সেই আলোতেই সে দেখতে পেল যে বিছানার এক প্রান্তে বসে আছে সেই প্রাণীটা……নাহ, এটা কোনো প্রাণী নয়….এটা কি? এটা কি কোন প্রেত মূর্তি? এবার বিছানার ওপর মানুষের মত দুই পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সেই অবয়বটি, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো রমাপদর কাছে! একটা চাপা গর্জন আসছে তার কানে!…..কম্পিত শরীরে দেওয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রমাপদ! সে নিজেও বুঝতে পারলো না, যে কখন জ্ঞান হারিয়ে ঘরের মেঝের ওপর ঢলে পড়লো সে!

    (৪)

    যখন চোখ মেলে তাকালো রমাপদ, তখন সে নিজের বিছানায় শুয়ে। আর সেই বিছানার চার পাশে উদ্বিগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রাবন্তী, অমলেন্দু, বলবন্ত এবং এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষ। কলকাতা থেকে এখানে আসতে আসতেই শ্রাবন্তীর মুখে বলবন্ত শুনেছে এখানে দশ বছর ধরে দুর্গা পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ। তবে রমাপদর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণ তাদের কাছে এখনো অজানা!

    একটু সুস্থ হয়ে উঠতেই রমাপদ ভয়ার্ত গলায় নিজের দুই চোখ বিস্ফারিত করে, শ্রাবন্তীর দুই হাত ধরে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
    – পিশাচ, দিদিমণি, পিশাচ……কোন অপদেবতার ছায়া পড়েছে এই গ্রামে!
    ব্যাস এটুকু বলেই ভয়ের চোটে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো সে। শ্রাবন্তী তাকে শান্ত করে, দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো,
    – না, রমাদা, সেটা কোন পিশাচ নয়…..কারণ যদি সেটা তেমন কিছু হত, তাহলে সে কি তোমাকে আস্ত ছেড়ে দিতো?
    এই কথা শুনে কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল রমাপদ। তারপর অস্ফুট কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,
    – কিন্ত আমি যে নিজের চোখে দেখেছি দিদিমণি……নিজের চোখকে কিভাবে অবিশ্বাস করবো বলুন! বেঁটে মত চারপেয়ে জীবটি, লাল টকটকে জ্বলন্ত দুই চোখের মণি, কালচে গায়ের রং, আমাকে দেখে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো এখানে…..এই এখানে!
    এই বলে রমাপদ উন্মাদের মত বিছানার সেই প্রান্তের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে লাগলো যেখানে সে প্রাণীটিকে দাঁড়াতে দেখেছিলো।

    সেখানে উপস্থিত সকলের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটি বরফগলা ভয়ের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। এমন সময় অমলেন্দু বলে উঠলো,
    – কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে এটা ওর চোখের ভুল, কি দেখতে কি দেখেছে সে……
    কিন্তু সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রমাপদ কিছু বলে ওঠার আগেই, কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলো সেখানে উপস্থিত এই গ্রামেরই এক বয়স্ক ব্যক্তি,
    – না বাবু, না…….ও ভুল বলছে না বাবু, ও ঠিক কথা বলছে! এই গ্রামের ওপর কোনো অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে বাবু!…..কারণ…..কারণ…..
    আশ্চর্য হয়ে অমলেন্দু বলে উঠলো,
    -কারণ কি? বলো, চুপ করে গেলে কেন?
    লোকটি এবার রমাপদর মতই বিস্ফারিত চোখে বলে উঠলো,
    – কারণ ও যাকে দেখেছে, কিছুদিন আগে সেই একই চেহারার একটি প্রাণীকে আমার মেয়েও দেখেছে, বাবু…..সেদিন রাতে আমার মেয়ে পুকুর পারে বাসন মাজতে গিয়েছিল, সেই সময় আর কেউ ছিল না সেখানে। একটু দূরে ঝোপের মধ্যে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে সে বাসন ছেড়ে ওখান থেকে বাড়ির দিকে ছুটে আসতে চায়, কিন্তু তখনই ঝোপ থেকে বেরিয়ে তার পথ আগলে ধরে ওই প্রাণীটা !….. মেয়ে ভয় পেয়ে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়! অনেক রাতেও সে বাড়ি ফিরছে না দেখে, আমি লোকজন নিয়ে পুকুর পারে গিয়ে……

    অমলেন্দু বোধহয় আবার কিছু একটা বলতে চলছিলো এই কথার বিপক্ষে, কিন্তু তাকে থামিয়ে শ্রাবন্তী বলে উঠলো,
    – না অমলেন্দু, আমার মনে হয় না এরা দুজনেই চোখে ভুল দেখেছে! কিছু একটা তো অবশ্যই আছে এই গ্রামে, আর এই কথাও মানতে হয়, যে প্রাণীটি কিন্তু কোন ক্ষতি করেনি রমাদা বা ওই মেয়েটিকে! তাহলে এটা কি ধরণের প্রাণী? আর এভাবে মানুষকে ভয় দেখানোর পেছনে তার উদ্দেশ্যই বা কি?
    সেখানে উপস্থিত সকলেই আতঙ্কিত মুখে স্তব্ধ হয়ে রইল শ্রাবন্তীর এই প্রশ্ন শুনে!

    (৫)

    চন্দ্রপুর গ্রামে এসে সব চেয়ে বেশি ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হয়েছে বলবন্তকে। নিজের সেই অদ্ভুত শারীরিক পরিস্থিতির কথা না হয় সে বাদই দিলো, কিন্তু এখানকার পরিবেশও যথেষ্ট রহস্যময়। সে রাজস্থানের বাসিন্দা হওয়ায় রাজপুত রাজাদের প্রাসাদ অনেক দেখেছে, কিন্তু এই চাটুজ্যে বাড়ির মত এত বড় বাঙালী ধাঁচে গড়া পাঁচ মহলা বাড়ি খুব কমই দেখেছে। রাজপুত রাজা মহারাজাদের যুদ্ধ বিদ্রোহ বা জীবনযাত্রা নিয়ে অলৌকিক গল্পও অনেক শুনেছে সে, কিন্তু এই পরিবারের মত রহস্যময় পরিস্থিতির কথা বোধহয় আর অন্য কোথাও শোনেনি। দশ বছর ধরে একটা মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেল, কেউ তার হদিস পেলো না, তিনি বেঁচে আছেন কি মারা গিয়েছেন এই কথাও কেউ জানে না! তারপর ওই রহস্যময় প্রাণীটির কথা তো আছেই!

    এই পরিবারের পুরোনো কুমোর মহা আনন্দে দুর্গা প্রতিমার মাটির শরীরের ওপর রং লাগাতে শুরু করেছে। একে একে ফুটিয়ে তুলছে প্রতিমার চোখ, নাক, ঠোঁট, ভ্রু…….শ্রাবন্তী, অমলেন্দু আর বলবন্ত বাড়ির ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে সেদিকেই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে ছিল। এমন সময় নীরবতা ভঙ্গ করলো বলবন্ত, সে শ্রাবন্তীকে জিজ্ঞাসা করলো,
    – আপকি মামাজি কিস বিষয় কো লেকে রিসার্চ কর রহে থে, ইয়ে পতা হে আপকো?
    শ্রাবন্তী পূর্বেকার স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
    – উনি পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, সম্ভবত তেমন কোন বিষয় নিয়েই গবেষণা করছিলেন হয়তো। আসলে শেষ বারের মত ওনাকে এই বাড়িতে যখন দেখেছিলাম, তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ছুটি কাটাতে এসেছিলাম এখানে…..মানুষটা বড্ড ভালো ছিলেন, জানেন। যেমন রাজপুত্রের মত চেহারা, তেমনই ভালো একাডেমিক রেকর্ড! শুধু কি তাই, হিন্দু শাস্ত্র যেমন পুরাণ, রামায়ণ এবং মহাভারত, এই সবেও তার বেশ ভালো জ্ঞান ছিলো…..মাঝে মধ্যেই এই মহাকাব্যগুলির কত অজানা ঘটনা সকলকে বলে চমকে দিতেন তিনি!

    অমলেন্দু জিজ্ঞাসা করলো,
    – দশ বছর আগে তিনি যে হিমাচল প্রদেশে যাচ্ছেন কোন রিসার্চের কাজ করতে, এই কথা কি ভাবে জানলে তোমরা? আর যদি জেনেও থাকো, তাহলে ওনার নিখোঁজ হওয়ার পর সেই স্থানে খোঁজ খবর নিয়ে কি জানতে পেরেছিলে?
    একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শ্রাবন্তী বলে উঠলো,

    – যতটা মায়ের মুখে শুনেছি, তিনি তার কাজ কর্ম নিয়ে কখনই বাড়ির কাউকে তেমন কিছু বলতেন না। তবে শেষ বারের মত বাড়ি থেকে বেরোবার আগে, নিজেই নাকি বলে গিয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশে যাওয়ার কথা। তারপর তার নিখোঁজ হওয়ার পর, সেখানেও অনেক খোঁজ খবর নেওয়া হয়, শুধু জানা যায় যে সেখানকার চাম্বা জেলার কোন একটা গ্রামে নাকি তাকে শেষ বারের মত দেখা গিয়েছে! শুধু সেখানেও নয়, কলকাতার যে রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন, সেখানেও অনেক খোঁজ খবর নেয় পুলিশ। সেখানকার কর্তৃপক্ষ নাকি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, যে অফিসিয়ালি তিনি এমন কোন বিষয়ে রিসার্চ করছিলেন না, যাতে তার হিমাচল প্রদেশে যাওয়ার দরকার হয়! ফলে বোঝাই যাচ্ছে, যে তিনি সেখানকার কাজ বাদেও এমন অন্য কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন, যা তিনি কাউকে জানাতে চাননি! এই বিষয়ে তার গবেষণার কাগজ পত্র থেকেও কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ!

    ওরা সকলেই আবার ম্লান মুখে তাকিয়ে রইল দুর্গা প্রতিমার দিকে। সেদিকেই তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো শ্রাবন্তী,
    – আমায় শক্তি দাও, মা, যাতে এই সকল রহস্যের সমাধান আমি তোমার বোধনের আগেই করে ফেলতে পারি।
    ওর মনে হল, যেন কেমন জ্বলজ্বল করে উঠলো দুর্গা প্রতিমার সদ্য আঁকা ত্রিনয়ন!

    (৬)

    সেদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিলো না শ্রাবন্তীর। তার পাশে শুয়ে অমলেন্দু নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। শ্রাবন্তীর মনে বিশ্বাস আছে যে বিনোদ বাবু এখনো বেঁচে আছেন! একটা রক্ত মাংসের মানুষ কিভাবে সকলের চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে? তাছাড়া আরেকটা সম্ভাবনাও তার মন থেকে যেতে চাইছিলো না। হোক না হোক এই অদ্ভুত জীবটার নিশ্চয় কোনো সম্পর্ক আছে বিনোদবাবুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাথে! কিন্তু এর আগমন তো ঘটলো তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার দশ বছর পর! এর আগে তো এই জীবটাকে কখনো কেউ দেখেনি এই গ্রামে! তাহলে? আর জীবটারই বা আসল পরিচয় কি? সেটা কি কোন ভিন গ্রহের প্রাণী! পলকের মধ্যে শ্রাবন্তীর মনে পড়ে গেল, যে পদার্থবিদ্যার একটি শাখা হল Astrophysics, যাতে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুগুলির নানা বৈশিষ্ঠ নিয়ে পড়াশোনা করা হয়! তার মানে কি বিনোদ বাবু এই বিষয়ের ওপরই গোপনে গবেষণা করছিলেন? তার আহ্বানেই কি অন্য কোন জগৎ থেকে এসেছে এই প্রাণী? এখানে আসার পেছনে কি উদ্দেশ্য তার? আর এই গবেষণার সাথে বিনোদ বাবুর হিমাচল প্রদেশে যাওয়ারই বা কি সম্পর্ক আছে?

    এতগুলো প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করেছিলো শ্রাবন্তীর। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছিলো সে ক্রমাগত। রাতের অন্ধকারে নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে গোটা গ্রাম। আজ রাতে অবশ্য বৃষ্টি পড়ছে না। তবে বিছানার পাশে খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলোয় সাথে আসছে ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া। ঘুম না আসায় শ্রাবন্তী বিছানা থেকে উঠে দোতলার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। এখান থেকে এই বাড়ির চারিপাশের বাগানটা খুব স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ে। চাঁদের রুপোলি আলোয় মনে হচ্ছে এ যেন এক অন্য জগৎ। এখানে দাঁড়িয়ে শ্রাবন্তী তার মামার ব্যাপারেই ভেবে চলেছিলো, হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে ধক করে উঠলো তার বুক! এই রাতের আলো আঁধারীতেও স্পষ্ট দেখেছে সে, যে একটি ছোট বাচ্চার আকৃতির খর্বাকার ছায়ামূর্তি যেন এক ঝাঁপে বাইরে থেকে একতলার পুবের ঘরের একটি খোলা জানলার ভেতরে ঢুকে গেল! মুহূর্তের মধ্যেই শ্রাবন্তীর মনে পড়ে গেল, যে এটা তো বহুদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা তার মামার ঘর!

    সাহসে বুক বেঁধে ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হতে লাগলো শ্রাবন্তী! তার মানে সেই জীবটা বিনোদ বাবুর ঘরে প্রবেশ করেছে! এই সময় বোধহয় লোড শেডিং চলছে, বাড়ির আলোর সুইচগুলো টেপা সত্ত্বেও কোনো আলোই জ্বলে উঠলো না। সেই অন্ধকারের মধ্যেই দুরু দুরু বুকে এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে তার মামার ঘরের দিকে যেতে লাগলো শ্রাবন্তী। নাহ, ভয় পেলে চলবে না তার, এই সুযোগেই করতে হবে এই প্রাণীটার রহস্যভেদ!

    বিনোদবাবুর ঘরের বাইরে থেকে বন্ধ দরজাটার সামনে এসে পৌঁছতেই আর একটুও সময় নষ্ট করলো না শ্রাবন্তী। সে নিমেষের মধ্যে সেই দরজা খুলে, এক ঝটকায় সশব্দে প্রবেশ করলো সেই ঘরের ভেতর! আতঙ্কিত দৃষ্টি দিয়ে সে চেয়ে রইল দশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা সেই অন্ধকার ঘরের চারিধারে। সব কিছু আগের মতই আছে যেমনটি সে দেখেছিলো, যখন সে এই ঘরে বসেই তার মামার মুখে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে বিস্মিত হত হিন্দু শাস্ত্রে বিনোদবাবুর জ্ঞান দেখে! শুধু প্রতিটা আসবাবপত্রের ওপর জমেছে মোটা ধুলোর আস্তরণ। কই সেই প্রাণীটাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না! তার মানে কি সে লুকিয়ে আছে এখন? অকস্মাৎ সুযোগ বুঝে আক্রমণ করবে বলে? ভয়ে নিঃশ্বাসের গতিবেগ আরো দ্রুত হয়ে এলো শ্রাবন্তীর।

    ঠিক এমন সময় তার চোখ চলে গেল ধুলো আর মাকড়সার ঝুলে ভর্তি বিনোদবাবুর পড়াশোনা করার টেবিলটার ওপর। সেখানে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে একটি ডায়েরি। তার ওপরেই রাখা রয়েছে একটি পেন। তার মানে কিছুক্ষণ আগেই কেউ কিছু একটা লিখে রেখেছে ওই ডায়েরির পাতায়। শ্রাবন্তী ছুটে গিয়ে টেবিল থেকে তুলে নিলো ডায়েরিটা, তার পর যতটা চাঁদের আলো পাওয়া যায়, তাতেই চেষ্টা করে পড়তে লাগলো কি লেখা আছে তার পাতায়। সেখানে লেখা আছে:

    “আমাকে দেখে ভয় পাসনি, শাবু। আমিই যে তোর হতভাগ্য মামা, শ্রী বিনোদবিহারী চাটুজ্যে! “কালচক্র”-এর অভিশাপে আটকে পড়ে আজ আমার এই অবস্থা! এই কথাই গ্রামের সকলকে বলতে চেয়েছি আমি, কিন্তু সকলেই আমাকে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে! ভালো করে দেখ আমাকে, মহাভারতের এমনই একটি চরিত্রের গল্প তোকে আমি অনেক বার শুনিয়েছি। বল দেখি, আজ আমি যে জীবে রূপান্তরিত হয়েছি, তার নাম কি?”

    ঠিক সেই সময় শ্রাবন্তী লক্ষ্য করলো, যে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে এই ঘরের সদর দরজার পর্দা। আর ঠিক তার পেছন থেকে ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে সেই খর্বাকার জীবটার দেহ। তার মানে শ্রাবন্তীর দরজা খোলার ঠিক আগে প্রাণীটা ডায়েরির পাতায় লেখা শেষ করে দরজার এক পাশে এসে লুকিয়ে পড়েছিলো। তারপর সে এই ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই জীবটি দরজার বাইরে গিয়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে যায়। সাহসে বুক বেঁধে শ্রাবন্তী আপাদমস্তক দেখতে লাগলো জীবটাকে, তারপর কম্পিত গলায় অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠলো,
    – বা…..বা…..”বাহুক”!

    (৭)

    এই অদ্ভুত জীবটাকে চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলো শ্রাবন্তী, অমলেন্দু, বলবন্ত এবং রমাপদ। অবিকল বিনোদবাবুর গলায় বলে উঠলো এই “বাহুক” নামক প্রাণীটি,
    – জানি তোমাদের সকলের মনে আজ অনেক প্রশ্নের ঝড়। তোমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, আমাদের প্রথমে যেতে হবে ঋষি দত্তত্রেয় দ্বারা পরশুরামকে বর্ণিত “ত্রিপুরা রহস্য” নামক এক সুপ্রাচীন গ্রন্থে উল্লিখিত একটি ঘটনার কথা। বঙ্গের এক রাজা, সুসেনের ভাই মহাসেনকে তঙ্গন ঋষির ছেলে খোঁজ দিয়েছিলেন এমন এক পাহাড়ের, যার ভেতরে গেলে পাওয়া যাবে এক সম্পূর্ণ অন্য জগতের ঠিকানা। “গন্ডশৈল” নামক সেই পাহাড়ের গুহায় ঢুকে তাদের সত্তা পৌঁছে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে বহুদূরে অবস্থিত সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহে। তারপর সেই পাহাড়ের বাইরে এসে তারা জানতে পারে, যে পাহাড়ের মধ্যে শুধু মাত্র একদিন কাটালেও, এই একই সময়ের মধ্যে বাইরের পৃথিবীতে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কিছু লক্ষ বছর!

    আচমকা চিৎকার করে উঠলো শ্রাবন্তী,
    – Einstein এর Theory of Relativity……Time Dilation…..এই বিষয়গুলো নিয়েই তুমি গবেষণা করছিলে, তাই না মামা?
    সেই প্রাণীটার গলা থেকে আবার শোনা বিনোদবাবুর কণ্ঠস্বর,

    – ঠিক বলেছিস, শাবু! Einstein বলেছেন যে সময়ের গতিবেগ ভিন্ন মধ্যাকর্ষণ শক্তি বিশিষ্ট বিভিন্ন জগৎগুলোর জন্য আলাদা। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে যে জগতের মধ্যাকর্ষণ শক্তি কম হবে, সেখানকার সময়ের গতিবেগ পৃথিবী থেকে বেশি হবে, এবং তদ্বিপরীত! এছাড়াও কোনো গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রেও সময়ের গতিবেগ কোন স্থির বস্তুর থেকে কম হবে! একেই বলে Time Dilation.

    একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো সেই প্রাণীটা,
    – Einstein এই কথাও বলেছেন, যে একটি জগৎ থেকে অন্য কোন জগতে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তাকে বলা হয় Wormhole. আমার মনে হয়, যে এই “গন্ডশৈল” পাহাড়টি হল এমনই একটি Wormhole! “ত্রিপুরা রহস্য” বইটি থেকে জানতে পারলাম যে, এই পাহাড়টি অবস্থিত পুরাকালের ইরাবতী নদীর তীরে, যে নদীকে এখন বলা হয় রবি। এই নদীর উৎস হল হিমালয় পর্বত থেকে, যা অবস্থিত হিমাচল প্রদেশের কাংড়়া জেলার মুলতানে। বেশ কয়েক মাস ধরে গোপনে এই পাহাড়ের সন্ধান করার পর তা পেয়ে গেলাম এই রাজ্যেরই চাম্বা জেলায়, যার Wormhole হবার পরিচয় হয়তো আগে কেউ পায়নি। আর এই পাহাড়ের গুহায় ঢোকার ফলই আমাকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে!

    এবার অমলেন্দু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
    – এই গুহার মধ্যে ঢুকে কোন জগতে প্রবেশ করেছিলেন আপনি? কি ভাবে হল আপনার এই পরিণতি?
    আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর শোনা যেতে লাগলো বিনোদ বাবুর কণ্ঠস্বর,
    – সেটা বোঝার আগে মনে করতে হবে হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত কাকভুষুণ্ডী নামক এক ঋষির কথা। তিনি বলেছেন যে সময় চক্রাকারে অতিবাহিত হয়। প্রথমে আসে সত্য যুগ, তারপর ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং অবশেষে কলি যুগ। কলি যুগ শেষ হলে আবার সময় পদার্পণ করে সত্য যুগে। একেই বলা হয় “কালচক্র”। কাকভুষুণ্ডীর কালচক্রের বাইরে থাকার ক্ষমতা ছিল, তাই তিনি রামায়ণ এবং মহাভারতকে যথাক্রমে এগারো এবং ষোলো বার ভিন্ন ভাবে ঘটে যেতে দেখেছেন। তবে দক্ষযজ্ঞকে দুবার একই ভাবে ঘটে যেতে দেখে, তিনি আর তৃতীয় বার দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।

    কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে উঠলো জীবটা,
    – আমি ওই পাহাড়ের গুহা থেকে যে জগতে ঢুকতে পেরেছিলাম, তাতে চলছিল দ্বাপর যুগ। সেখানে ঘটে চলেছিলো মহাভারতে বর্ণিত একের পর এক ঘটনা। আমি সেই জগতে এসে পদার্পন করি নিষাদ রাজ্যের জঙ্গলে, যা এখনকার মধ্য প্রদেশে অবস্থিত গোয়ালিওরে। হিমাচল প্রদেশের চাম্বা থেকে মধ্য প্রদেশের গোয়ালিওরে আমার এই যাত্রাটিকে বলা যায় Teleportation এর একটি উদাহরণ, যেখানে কোন বস্তু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে, এই দুটি জায়গার মধ্যেকার পথ অতিক্রম না করেই!…….সেই সময় মহাভারতে বর্ণিত, নারদ মুনির দ্বারা শাপিত হয়ে কর্কটক নাগ অচলাবস্থায় পড়ে ছিলেন একটি জ্বলন্ত গাছের নিচে। হিসাব মত, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে আগুনের তাপ থেকে রক্ষা করতে চলেছেন রাজা নল। কিন্তু তার আগেই আমি সেখানে পৌঁছে গিয়ে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হবার হাত থেকে বাঁচাই কর্কটককে!

    উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো শ্রাবন্তী,
    – আর এই উপকারের পুরস্কার হিসেবে, রাজা নলকে ছেড়ে, কর্কটক দংশন করলো তোমাকে! তার দংশনের পর রাজা নল যে “বাহুক”-এ পরিণত হয়েছিল, তা হল এখন তোমার পরিণতি, তাই তো? কিন্তু মহাভারত অনুযায়ী, কর্কটক নলকে একটি বস্ত্র দিয়েছিলেন, যেটা শরীরের ওপর রাখলেই তিনি আবার আগের শারীরিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন…..কিন্তু….কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে…….
    তার কথা শেষ না হতেই বলে উঠলেন “বাহুক”-রূপী বিনোদবাবু,
    – সেখানেই হল হল সমস্যাটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্কটক বুঝতে পারলেন, যে তিনি কত বড় ভুল করে ফেলেছেন, কারণ আমি রাজা নল নই! এদিকে সাময়িক ভাবে প্রাণে বাঁচলেও, তাকে দেওয়া নারদ মুনির অভিশাপ কিন্তু আমি খণ্ডন করতে পারবো না, পারবেন রাজা নল। তাই তাকে আরেকবার রাজা নলকে দংশন করতে হবে, এবং তাকেই দিতে হবে সেই দিব্যবস্ত্র! আমাকে তা দিলে চলবে না!……অনেক ভেবে কর্কটক আমায় বললেন,
    “সেই বস্ত্র তোকে আমি না দিতে পারলেও, আমার জাদু বলে এই জগৎ থেকে তোকে তোর নিজের জগতে, তোর নিজের গ্রামে, ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলাম। আর এই কথাও জেনে রাখ, তোকে আবার নিজের রূপে ফিরে আসতে সাহায্য করবে তোর জগতে থাকা আমারই এক বংশধর। তবে মনে রাখিস, তোর জগৎ আর এই জগতের সময়ের গতিবেগ এক নয়। যে স্বল্প সময়ে তুই এই জগতে কাটালি, তাতেই তোর জগতে অতিবাহিত হয়েছে দশ বছর!”
    এই বলে তিনিও সেখানে সৃষ্টি করলেন একটি Wormhole, যার সাহায্যে আমি সেখান থেকে আবার এই গ্রামে পদার্পন করলাম, তবে এর মধ্যেই কেটে গেল দশ দশটি বছর!

    অধৈর্য হয়ে শ্রাবন্তী বলে উঠলো,
    – এতটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু সেই কর্কটকের বংশধর! তার সন্ধান কি ভাবে পাবো আমরা?
    সকলের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত করে, এই প্রথম বার বলে উঠলো বলবন্ত,
    – মে হি হু বো নাগরাজ কর্কটক কি বংশজ!

    (৮)

    বলবন্তের চোখদুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো। একটি ম্লান হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটের পাশে। দৃশ্যমান হল তার গজদাঁত জোড়া, যা তার ফর্সা মুখের সৌন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি করেছে। সেখানে উপস্থিত সকল বিহ্বল শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে বলে উঠলো সে (যা আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে সম্পূর্ণ বাংলাতেই দেওয়া হল),
    – যে কথা আমি এতদিন কাউকে বলিনি, আজ তা বলার সময় চলে এসেছে। আপনারা হয়তো জানেন না, যে আমি হলাম রাজস্থানের “কারেয়া” (Karewa) প্রজাতির অন্তর্গত জাট (Jatt). শাস্ত্রমতে মনে করা হয়, যে এই প্রজাতির আদি পূর্বপুরুষ হলেন নাগরাজ কর্কটক! সেই জন্যই যুগ যুগ ধরে এই প্রজাতির সকলেই কর্কটকের পুজো করে আসছে। মনে করা হয়, যে এই প্রজাতির কারোর কারোর ওপর নাগরাজের সবচেয়ে বেশি আশীর্বাদ থাকে। তাই সেই সব বংশধরদের শরীরের মধ্যে সৃষ্টি হয় এমন এক বিষ, যা ছিল স্বয়ং কর্কটকের শরীরে!

    উত্তেজিত হয়ে শ্রাবন্তী বলে উঠলো,
    – আর আপনিও হলেন তেমনই এক কর্কটকের বংশধর! তাই তো?
    বলবন্ত বলে উঠলো,
    – হ্যাঁ, শ্রাবন্তী দেবী। ছোটবেলা থেকেই মাঝে মাঝে নিজের শরীরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা উপলব্ধি করতাম আমি। যখন আমাদের শরীরে জাগে বিবমিষা, তখন যেমন আমরা শরীরের মধ্যে উপস্থিত সকল অপাচ্য পদার্থ বাইরে বার না করা অবধি শান্তি পাই না, এই অস্বস্তিও তেমন। ক্রমে বুঝতে পারলাম যে এর উৎস হল আমার দুই গজদন্তের নিচে! একটি পাত্র দিয়ে দুই দাঁতের নিচে চাপ দিতেই সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ল বেশ কিছুটা গাঢ় তরল পদার্থ, যা মোটেই রক্ত নয়। সেদিন থেকেই বুঝতে পারলাম যে ঠিক যেভাবে সাপেদের দাঁতের নিচে বিষ উৎপন্ন হয়, আমার শরীরেও এই একই ঘটনা ঘটছে……বিষ!…..নাগরাজ কর্কটকের বিষ!

    একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো বলবন্ত,
    – তখন মনে হত, যে এটা নাগরাজের আশীর্বাদ না…..অভিশাপ! কিন্তু আজ আপনাদের সাহায্য করতে পারবো জেনে, আমার ধারণা পাল্টেছে! কারণ আপনারা তো জানেনই যে আমি গবেষণা করি টক্সিকোলজি বিভাগে, আর সকলের অজ্ঞাতে এই বিষ সংগ্রহ করে তার Antidote আমি কিছুদিন আগেই বানাতে সক্ষম হয়েছি! এই কাজ করতে শুরু করেছিলাম নিছকই নিজের কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে, কখনো ভাবিওনি যে তা এই ভাবে আপনাদের কাজে লাগবে। এই Antidote বিনোদ বাবুর শরীরে প্রবেশ করালেই তিনি আবার ফিরে পাবেন তার আগেকার চেহারা!
    বিস্মিত চোখে সেখানে উপস্থিত সকলে চেয়ে রইল বলবন্তের দিকে। সকলের অলক্ষ্যে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল “বাহুক”-এর রক্তের মত লাল দুই চোখ থেকে!

    পরদিনই বলবন্ত কলকাতায় গিয়ে চন্দ্রপুরে নিয়ে এলো সেই Antidote! “বাহুক” রূপী বিনোদবাবুর শরীরের রক্তে তা ইনজেক্ট করার সাথে সাথে সেই কদর্য খর্বাকার নীলচে কালো রঙের প্রাণীদেহটি যেন কোন জাদুবলে পরিবর্তিত হল একটি দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ সুপুরুষ শরীরে, যা বিনোদ বাবুর আসল রূপ!

    মা দুর্গার বোধনকালে, প্রতিমার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ছিলো বাড়ির সকলে: শ্রাবন্তী, অমলেন্দু, বিনোদ বাবু, বলবন্ত এবং রমাপদ। এছাড়াও দশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই চাটুজ্যে বাড়ির শারদোৎসব দেখতে সেখানে দূর প্রান্ত থেকে উপস্থিত হয়েছে এই গ্রামের অসংখ্য মানুষজন। শ্রাবন্তীর যেন মনে হল দুর্গা প্রতিমার মুখে খেলে গেল প্রশান্ত হাসি, তার মানে সত্যিই তার মনোবাসনা পূর্ণ করলেন স্বয়ং দুর্গতিনাশিনী! ওদিকে ধুপ ধুনোর গন্ধের মাঝে ভরে উঠেছে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ,
    “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা ।
    নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।”

    (সমাপ্ত – গল্পটিতে উল্লিখিত সমস্ত বৈজ্ঞানিক এবং পৌরাণিক তথ্য বাস্তবের সাথে যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করেছি, তবে তার সাথে মিশেছে আমার অতিকিঞ্চিত কল্পনা।)

You cannot copy content of this page