• গল্প

    গল্প -মুখের কথা

    মুখের কথা
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    পিকন রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় বসে পঁচিশ মিনিট মতো প্রার্থনা করে। শুধু ওর মা যেন ভালো থাকে। আর কিছু চাওয়ার নেই পিকনের ভগবানের কাছ থেকে।
    রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পিকন দেখে মা জলের বোতল, গামলা, হাঁড়ি সব রাস্তার কল থেকে ভরে নিয়ে আসছে। খুব কষ্ট হয় ওর। মা-র হাড়গিলে চেহারা, ব্লাউজের ঢলঢলে হাতা এতটাই বড় যে ওর মা’র দশটা হাত ঢোকালেও ঠিক হবে না। অচিন্ত্যর মা’র কি সুন্দর চেহারা। দেবী মনে হয়। আর আমার মা, খেংড়া কাঠি যেন। ভীষণ লজ্জা লাগে সবার মা কত সুন্দর।
    সুমির দিদির বিয়েতে মাকে নিয়ে গেছিলাম কি অপমানই না হতে হলো।
    “মা’র খাবারটাও তুই খাস নাকি পিকন। নিজে হাতী হচ্ছিস। আরে মা’র দিকটা দেখ একবার”।
    ঠাকুর কেন আমার মাকেই এমন!

    -“এই বাঁদর ছেলে, মা খেটে মরছে আর তুই বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছিস”
    বাবার শব্দ বাণে পিকন হুঁশে এল।
    যা জলের বালতি নিয়ে আয়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অফিসে না গেলে না, দানা পানি জুটবে না কপালে। খাচ্ছে দাচ্ছে আর বকবকম্ করছে।
    -মা জল বইতে বারণ করেছে।
    -ওহো..মা বারণ করেছে..
    -আহা ওকে বকছে কেন? সবে ঘুম থেকে উঠলো ছেলেটা। পিকনের মা জলের হাঁড়িটা নামিয়ে বললো।
    পিকন ওর মার হাতের রগগুলো দেখছে। শাঁখা পলা চুড়ি ঝুলছে হাতে।
    অচিন্ত্যর মার হাত লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো নিটোল।চুড়ি বালাতে মানানসই।

    পিকন আমি বাথরুমে গেলে আর ঢুকতে পারবি না। যা করার করে আয়।
    পিকন মাথা চুলকে বললো, মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না।
    পিকনের বাবা ছেলের কথা শুনে রান্না ঘরের দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো আবার বেশ কিছুক্ষণ।
    ওর মা’র চোখে জল। মাঝে মধ্যেই পিকন এমন কথা বলে।
    ভাতের হাঁড়ি উনুনে চাপিয়ে ওর মা বললো,
    সবই কপাল আমার। পিকনের বাবা বাথরুমে গেল।
    বি.এ. থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট পিকন। মা বাবার একটি সন্তান। পাড়া প্রতিবেশীরা নিজের ছেলেপুলেদের বলে পিকনের মতো হতে পারিস না। দেখ ভক্তি শ্রদ্ধা কাকে বলে। শেখ ওর থেকে শেখ ।
    পিকন বাড়ির বাইরে বাবা মার বাধ্য সন্তান। ঘরেও তাই। কিন্তু মাঝে মধ্যেই ওর মার ওপর খুব রাগ হয়। মুখে কিছু বলে না। তবে থেকে থেকে এই একটা কথাই বলে, মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না..
    গত মাসে পিকনের কলেজে বিশাল ঝামেলা হয়েছিল ইট পাটকেলের ঝড় উঠেছিল। পিকন মা’র কথা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। আচমকাই একটা থান ইট পড়লো পিকনের মাথায়। রক্ত আর রক্ত। হসপিটালে ভর্তি ছিল পনেরো দিন। পিকনের মা এক মুহূর্তের জন্যও ছেলের সঙ্গ ছাড়ে নি। ছেলে যেমনটিই হোক, মা তো মা।
    পনেরো দিন পর পিকন বাড়ি এল। জ্ঞান আসছে চলে যাচ্ছে। তবে ভয়ের কিছু নেই ডাক্তার বাবু বলেছেন।

    রাত দশটা বাজে পিকনের মাথার কাছে ওর মা বাবা বসে আছে। পিকনের মা ওর গায়ে মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
    “ঠাকুর আমার মাকে ভালো রেখো। কিছু তো চাই না আর। আমার মাকে একদম দেখতে ইচ্ছে করে না। আমার মা তো দেবী। দেবী কখনও হাড়গিলে হয়? মার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। প্রকাশ করতে পারি না। ভাবি এক আর বলি আর এক। কেন এমন হয় ঠাকুর? আমি বলতে চাই মার এই চেহারা ভালো লাগে না। মা কেন বেশি করে খায় না? কিন্তু বলতে গিয়ে বলি মাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। অন্তরের কথা প্রকাশ করতে পারি না। মুখের কথা সবাই শোনে। কিন্তু অন্তরের কথা কেউ বুঝতে পারে না। কেন ঠাকুর কেন? এই মা যেন প্রতি জন্মে পাই- দেখো ঠাকুর। আমার মাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করে। আমার ভালো লাগে না।”
    শোনো পিকনের মা ছেলের কথা শোনো।
    পিকনের মা চোখ মুছতে মুছতে বললো, “আমার সোনা। তুই সুস্থ হয়ে যা আমি নিজের যত্ন নেবো।সময় মতো খাবো।”
    পিকনের ঘুমের ঘোরে বলা সব কথা ওর মা বুকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সকালে পিকনের ঘুম ভাঙতেই ওর মা বললো, “জলের লাইন নেব, জলের ট্যাঙ্ক হবে বাবা, তোর মা আর কষ্ট করে জল তুলবে না। রাণীর মতো থাকবে তোর মা।কাজের দিদি আসবে কাল থেকে।”

    পিকনের বাবা বললো, “জানি তোমার খুব পরিশ্রম হয়। যা মাইনা পাই তোমাকে দু’দণ্ড ভালো রাখতে পারি না। কাজের লোক রাখলে তোমার তো একটু বিশ্রাম হতো।
    জানো তো আজকাল কেউ মানুষের মনের খোঁজ রাখে না। চেহারাটাই আসল। সত্যি বলতে আমারও তোমার হাড়গিলে চেহারা দেখতে ভালো লাগে না। ছেলের মনের কথা যখন জানতে পেরেছি। আর দেরি না।”

    -এই শোন না কাজের দিদিকে মাস গেলে দুশো টাকা দিতে হবে। সামলাতে পারবে তো মাসের শেষে? ছেলের লেখা পড়া সংসার খরচ!

    -আরে হ্যাঁ, পিকন ঠাকুরকে ডাকে তুমি যাতে ভালো থাকো। সংসার ঠিক চলে যাবে। তুমি বিশ্রাম নাও। নিজের যত্ন নাও। খাও বেশি বেশি করে। সেন বৌদিকে দেখিয়ে দেব।
    -সেন বৌদি কোথা থেকে এল?
    -না কিছু না। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, কাজে না গেলে না- দানা পানিও জুটবে না।
    পিকন বিছানায় শুয়ে মা বাবার কথা শুনে ফিকফিক করে হাসছে আর ভাবছে এবার বলি মা তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু যদি উল্টোটা বলে ফেলি। থাক কিচ্ছু বলবো না।অন্তরের কথা অন্তরে থাক। মুখের কথা মুখে থাক। কিচ্ছুটি বলার দরকার নেই। শুধু তুমি ভালো থেকো মা।

  • গল্প

    গল্প- পোষ্ট মাষ্টার

    পোষ্ট মাষ্টার
    – রাখী চক্রবর্তী

     

     

    ও মাস্টার আপনি নতুন এসেছেন। আগের মাস্টারকে দেখছি না। এখনও আসেনি বুঝি?
    ফুল বাগান পোস্ট অফিসের নতুন পোস্ট মাস্টার চায়ের ভাঁড়ে চমুক দিয়ে বললেন, না মাসিমা উনি ট্রান্সফার হয়ে গেছেন।
    -ও, আমি গত মাসে এসেছিলাম কথা হল মাস্টারের সাথে। কৈ কিছু বলল না তো।

    -মাসিমা দশ দিন হল উনি গেছেন। হঠাৎই হল।আচ্ছা আপনার কি দরকার বলুন?

    -এই হল আমার পাস বই। পাঁচশো টাকা তুলবো। আমাকে টাকা দিন।

    -মাসিমা আপনি পুরনো পাস বই নিয়ে এসেছেন।এতে এক টাকাও নেই।
    -আপনি ভুল বলছেন। আমার বইতে টাকা আছে।
    এর মধ্যে পোস্ট অফিসের ফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং..নতুন পোস্ট মাস্টার ফোন ধরলেন, হ্যালো কে বলছেন?

    -আমি ফুলবাগান পোস্ট অফিসের সাব পোস্ট মাস্টারের সাথে কথা বলতে চাই।

    -আমি বলছি। বলুন কি সাহায্য করতে পারি?
    -আমি সুভাষবাবু বলছি। পোস্ট মাস্টার সুভাষ দে।

    -ও স্যার বলুন..

    -কাউন্টারে সুবলা দেবী দাঁড়িয়ে আছেন তো !

    -হ্যাঁ স্যার, বইতে একটা টাকাও নেই অথচ..

    -পাঁচশো টাকা দিয়ে দিন। আর বলুন পরের মাসেও যেন মাসিমা আসেন। আমি মিনিট দশের মধ্যে আসছি। আপনাকে পাঁচশো টাকা দিতে।

    -আচ্ছা স্যার। অত তাড়াহুড়ো করবেন না। ধীরে সুস্থে আসুন।
    ফোনটা রেখে ফুলবাগান পোস্ট অফিসের সাব পোস্ট মাস্টার আকাশ দত্ত বললেন, মাসিমা এই নিন আপনার পাঁচশো টাকা।
    -তাহলে আমাকে যে বললে টাকা নেই!
    -বড় ভুল হয়ে গেছে। আপনি বাড়ি চলে যান। পরের মাসে আসবেন।
    -একটা কথা বলবো, তুমি খুব ভালো ওই আগের মাস্টারের মতো। আশীর্বাদ করি বাবা সুখে থাকো বলে সুবলা দেবী চলে গেলেন।
    ঠিক দশ মিনিট পরে সুভাষবাবু এলেন, নতুন পোস্ট মাস্টারের হাতে পাঁচশো টাকা দিতেই আকাশ বাবু বললেন কি ব্যাপার স্যার কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। সুবলাদেবীর পাসবই তো ফাঁকা তাহলে পাঁচশো টাকা কিভাবে?
    পোস্ট মাস্টার সুভাষবাবু বললেন, তাহলে শুনুন দুবছর আগের ঘটনা- সুখুর মা নামেই পরিচিত সুবলা দেবী। দশ বছর বয়সে সুখু কলেরাতে মারা যায়। এখন বেঁচে থাকলে সুখু পঁচিশ বছরের যুবক হত। সুবলা দেবী বড় মার মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে জীবনধারণ করেন। পরনের কাপড় শীতকালে কম্বল, চাদর সব মন্দিরের কমিটি দেয়। শুধু সুবলা দেবী কেন জনা তিরিশ অসহায় বৃদ্ধা এই সাহায্য পেয়ে থাকেন। অসহায়ের সম্বল বড় মা কালী।
    সুবলা দেবী দু’বছর আগে একটা পুরানো পাস বই নিয়ে এই ফুল বাগান পোস্ট অফিসে এসে আমাকে বললেন, আমার বইতে কত টাকা আছে মাস্টার?
    আমি সেই সময় পোস্ট মাস্টার ছিলাম। সুবলাদেবীর পাস বুক দেখে বললাম, এ তো পুরানো পাস বই। আর টাকাও নেই।
    সুবলা দেবী বিড়বিড় করে বললেন, কত আশা নিয়ে এসেছিলাম।
    -মাসিমা কোনও সমস্যা? বলতে পারেন।
    সুবলাদেবী বললেন, আমি ডাক্তারবাবুকে কথা দিয়েছি আমার পাস বুক থেকে পাঁচশো টাকা দেব।তাই দিয়ে গরিব বাচ্চাগুলোর জন্য ওষুধ তৈরি করবে ডাক্তার বাবু। ডাক্তার বাবু তার সাধ্য মতো সাহায্য করেন গরীব বাচ্চাগুলোকে। এখন আমি কি করব? কিন্তু আমার বইতে টাকা নেই কেন?
    আমার স্বামী মারা যাওয়ার সময় অনেক টাকা ছিল এই বইতে।
    আমি কিছু না ভেবেই বললাম, আপনি এই বইটি রেখে যান। কাল একবার আসুন।
    আসলে সুবলাদেবীর স্বামী মিথ্যে কথা বলেছেন ।ওনার পাস বই পুরো ফাঁকা। যাই হোক পরের দিন সকাল দশটার সময় সুবলাদেবী পোস্ট অফিসে এলেন। পাঁচশো টাকা দিয়ে বললাম, মাসিমা আপনি প্রতি মাসে এসে আপনার পাঁচশো টাকা নিয়ে যাবেন। সুবলা দেবী টাকা নিয়ে চলে গেলেন। আমার খুব গর্ব হল ওনার জন্য নিজে গরীব হয়েও গরিব বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে ডাক্তার বাবুকে সাহায্য করার জন্য চিন্তায় পড়ে গেছেন।
    সেই থেকে প্রতি মাসে এক তারিখে আমি পাঁচশো টাকা দিই মাসিমাকে। আর মাসিমা সেই টাকা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার রামলাল দত্তকে দিয়ে দেন।সেই টাকা দিয়ে ওষুধ তৈরির জিনিস কিনে পুরিয়া তৈরি করে রামলাল ডাক্তার বস্তির বাচ্চাগুলোকে দেয় জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটে ব্যাথা। আসলে রামলাল ডাক্তারের নিজের রোজগার বলতে কিছু নেই। একটু আদটু যা হয় তা দিয়ে আর সুবলা দেবীর পাঁচশো টাকা দিয়ে পুরিয়া তৈরি করেন।প্রায় সব গরীবই ওনার পেশেন্ট। তাই নিজের রোজগার খুব কম। রামলাল ডাক্তার সুবলা দেবী ওনাদের খুব ভক্তি করি আমি।
    আমি আপনাকে ফোন করতাম না। নিজে এসেই সবটাই বলতাম। কিন্তু ট্রেনের গণ্ডগোলের জন্য আমি অটো সট্যান্ডে এসে আপনাকে ফোন করলাম। যতদিন মাসিমা বেঁচে আছেন আমিও বেঁচে থাকবো ততদিন দিয়ে যাব যৎসামান্য টাকা।জানি এ টাকা দিয়ে আর কতটুকুই বা হবে।
    নতুন পোস্ট মাস্টার সুভাষবাবুর চরণ স্পর্শ করে বললেন, আমি নাস্তিক। ভগবানের ওপর খুব রাগ আমার। বিশ্বাস তো পরের কথা। ভগবানের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করি না আমি। কিন্তু আজ দর্শন করলাম জীবন্ত ভগবানের। আশীর্বাদ করুন স্যার আমিও যেন আপনার মতো দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি।
    এক সপ্তাহ পর রামলাল ডাক্তার সরকারি সাহায্য পেলেন। সরকার সমস্ত খরচা বহন করবে। পুরিয়া তৈরি হবে অনেক অনেক। বিনা চিকিৎসায় কেউ মরবে না। নতুন পোস্ট মাস্টার সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। ফুলবাগানে শত শত ফুল ফুটবে।অকালে কোনও ফুল ঝড়ে যাবে না। যতই ঝড় আসুক যতই বন্যা হোক সব ফুল হাসবে খিলখিল করে।

  • গল্প

    গল্প – সঙ্গী

    সঙ্গী
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    “মন তোর ভ্রম গেল না,
    ভবের খেলা সাঙ্গ হলে
    পরপারে যাবি,
    সুখ পাখিটা পাওয়ার আশায়
    আর কত রাত জাগবি।
    মন তোর ভ্রম গেল না।”

    বল হরি হরি বল..বল হরি হরি বল..
    ধ্বনি শুনতে পেয়ে সনাতন মাঝি গান থামিয়ে বললো, এই দিনটার অপেক্ষা তো আমাদের সবারই থাকে তবে আমার আমার করে লড়াই বিবাদ কেন?

    -ও মাঝি দাদা এটা কি শেষ? নাকি আরও একবার চলবে নৌকা।

    -না বাবুসাব আজ এই পর্যন্ত। শীতের রাতে মানুষজনের আনাগোনা খুব কম বাবু। জনা তিরিশ না হলে নৌকা চালিয়ে লাভ নেই। তা বাবুসাব আপনারে তো এই ঘাটে আগে কখনও দেখিনি। নতুন এয়েছেন বুঝি!

    -না, নতুন না। বহু বছরের সম্পর্ক এই জায়গার সাথে। তবে বাইশ বছর পর এই ঘাটে এলাম। সব কেমন পাল্টে গেছে। ভব মাঝির খোঁজ পেলাম না। সিধু মাঝিকে দেখতে পেলাম না। বড় ভালো ছিল সিধু দাদা। গঙ্গার ওপারে নিয়ে যেত একটা পয়সা নিত না। অবশ্য যা বায়না করতাম।
    -না বাবুসাব উধার রাখতে নেই। ঠিক শোধ দিতে হয় এ জন্মে না হয় পরের জন্মে। মা গঙ্গার বক্ষ পারাপার তো, এক পয়সা হলেও দিতে হয়। আর মাঝিদের জীবনতরী খুব কষ্টে ভাসে গো।

    -আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমার একটা উপকার করবে?

    -হ্যাঁ হ্যাঁ সাধ্যে কুলালে নিশ্চই করবো।

    -গঙ্গার ওপারে আমার সঙ্গী মুন্না থাকে। কাল ভোর হলেই তো তুমি নৌকা নিয়ে ওপারে যাবে।মুন্না বললেই সবাই চিনিয়ে দেবে। একমুঠো ছাই শুধু মুন্নার হাতে দিয়ে বলবে চন্দন পাঠিয়েছে। কপাল থেকে মাথার সিঁথি পর্যন্ত যেন টেনে নেয়।

    -ও আপনার নাম তাহলে চন্দন। তা এ কেমন ধারা কথা বাবুসাব! ছাই আবার সিঁথিতে উঠবে! চন্দন বাবুসাব কোথায় গেলেন? ঝড় শুরু হয়ে গেল তো।চন্দন বাবুসাব…চন্দন বাবুসাব ।
    সনাতন মাঝি চন্দন বাবুসাব বলতে বলতে শ্মশানের সামনে চলে এল। মরদেহের শরীর থেকে সাদা চাদরটা ঝড়ের দাপটে খুলে গেছে। শ্মশান যাত্রীরা শবদেহ রাখার ঘরের বারান্দায় চলে এসেছে। যা ঝড়ের দাপট। না এসে উপায় নেই।
    সনাতন মাঝি মরদেহের ওপর নজর পড়তেই চমকে উঠল এ তো চন্দন বাবুসাব। তাহলে আমার সাথে কথা বলছিল কে? না না ভ্রম, আমার সব ভ্রম। যাই ওদের জিজ্ঞাসা করে আসি ওরা মৃতদেহ এনেছে নিশ্চয়ই সব জানবে।
    সনাতন মাঝি ওদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসা করলো, কার মৃতদেহ বাবু এটা?

    -আপনি কি নাম বললে চিনবেন? এখানে আগে থাকতো। বাইশ বছর পর নিজের শহরে এল তাও আবার ডেডবডি হয়ে।

    -কি হয়েছে বলুন বাবু?

    -চন্দন সেন। সেন জুয়েলার্সের নাম শুনেছেন তো।সেন পরিবারের একমাত্র বংশধর চন্দন সেন। গতকাল রাতে দমদম বিমান বন্দর থেকে বাড়ি ফিরছিল নিজেদের গাড়িতেই। চন্দনের গাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষে এক মহিলাকে বাঁচাতে যায় তখনি চন্দনের গাড়ি উল্টে যায়। রাত তখন দুটো।খবর আসে আমাদের পাড়ায়। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় দেয়নি চন্দন। ড্রাইভার এখনও সঙ্কটজনক অবস্থায় আছে।
    থানা, পুলিশ, কাটাছেঁড়ার পর আজ রাতে দাহ করাতে নিয়ে এলাম চন্দনের মৃতদেহ। সেই ছোটবেলার বন্ধু আমাদের। দশ বছর যখন ওর বয়স তখন ওর বাবা ওকে পুনেতে ওর পিসির বাড়ি নিয়ে গেল। ওখান থেকেই লেখা পড়া করবে।বাইশ বছর পর চন্দন কোলকাতায় আসছে।খবরটা আমরা পাইনি অবশ্য। চন্দন দূর্ঘটনায় মারা গেল তখনই সব জানলাম।
    সনাতন মাঝি সব শুনে থ হয়ে গেল। মুন্নার কাছে যেতেই হবে। কি সম্পর্ক চন্দনের সঙ্গে মুন্নার?
    সঙ্গী বলল তো।
    জীবন সঙ্গী না জীবন মরনের সঙ্গী? ছাই মানে কি বলতে চেয়েছে চন্দন বাবুসাব। নিজের চিতার ছাই। হায় ভগবান! আমি অপেক্ষা করবো। চন্দন বাবুসাবের চিতার ছাই নিয়ে মুন্না দিদিমনির বাড়ি যাব ।সব জানবো, সওব,

    দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতার আগুন। সনাতন মাঝি মাথায় হাত দিয়ে ঘাটের এককোনে বসে আছে। ভোরের অপেক্ষা, চিতা নেভার অপেক্ষা, কথা রাখার অপেক্ষা।
    সকাল হতেই সনাতন মাঝি নৌকা নিয়ে চললো মুন্না দিদিমনির বাড়ি। চন্দন বাবুসাব ঠিক বলেছিল এক ডাকে সবাই চেনে মুন্না দিদিমনিকে।

    সনাতন মাঝি নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, চন্দন বাবুসাব আমাকে আপনার কাছে..
    মুন্না সনাতন মাঝির পুরো কথা না শুনে বললো, আপনাকে চন্দন পাঠিয়েছে?
    – দিদিমনি এই কাগজের প্যাকেটে যা আছে কপাল থেকে সিঁথি পর্যন্ত টেনে নিন। চন্দন বাবুসাব আর..

    মুন্না খুব রেগে বললো চন্দনের খুব শখ আমাকে সিঁদুর পড়ানোর, শেষ করে দেবো ওকে। জম্মের মতো শখ মিটে যাবে ওর।
    সনাতন মাঝি কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভাবল একবার জিজ্ঞাসা করি মুন্না দিদিমনিকে চন্দন বাবুসাবের বিষয়ে। না থাক,
    – দিদিমনি এইটা কি আগে তো দেখুন।
    – কি আবার সিঁদুরই হবে। আমাকে ও খুব ভালবাসে। আমিও।
    আমাদের বিয়ের দিনক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেল। আমি মনে ঘর সংসারের ছবি আঁকতে শুরু করলাম। তারপর..
    – তারপর কি? কি ভাবে পরিচয় হলো?

    – চাকরি সুত্রে আমি পুনেতে থাকতাম। চন্দনের সাথে দু’বছর আগে আমার আলাপ হয়েছিল।বন্ধুত্ব তার পর প্রেম। খুব ভালো ছেলে চন্দন। সৌন্দর্যের পুজারী ও। যা কিছু সুন্দর সব ওর প্রিয়। কুৎসিত, কালো, আঁধার ওর জীবন তোলপাড় করে দেয়।
    আমি সেই অর্থে সুন্দরী। তাই ও আমাকে পছন্দ করেছে। মেলামেশা শুরু হতে হতেই চন্দনের ভালোলাগা মন্দলাগার বিষয়ে জানতে পারি। আমি যদি কুৎসিত হতাম। গায়ের রঙ কালো হতো তাহলে চন্দন আমাকে ভালবাসা তো দুর ফিরেও চাইতো না আমার দিকে। যাক সে কথা। আপনি চন্দনের কে হন?
    -কেউ হই না। গতকাল রাতে আলাপ হয়েছিল।
    তাই সকালে দিতে চলে এলাম। তবুও বলবো আপনি চন্দন বাবুসাবকে বিয়ে না করে ভুল করেছেন।

    মুন্না গায়ে জড়ানো চাদরটা খুলে বললো, এবার বলুন আমি ঠিক করেছি না ভুল।
    সনাতন মাঝি চিৎকার করে বললো, দিদিমনি!

    -হ্যাঁ এই রূপ আমার। মুখটা দু’ দিনের মধ্যে কালো ছোপে ভরে যাবে। হাত পা গলাতে কালো ছোপ।ফর্সা তো তাই কালো ছোপটা উজ্বল দেখাচ্ছে।
    আমি পুনে থেকে চলে এসেছি। ও অবশ্য জানতো না। তবে জানতে আর দেরি হল না। ঠিক জেনে গেল যে আমি কোলকাতায় চলে এসেছি। আমাকে বিয়ে করবে বলে ও নিশ্চয়ই এখানে আসবে। তখন দুর দুর করে তাড়িয়ে দেব ওকে। তবে আমার কুৎসিত চেহারা ওকে দেখাবো না। ও আমাকে ঘেন্না করবে। ওর ঘেন্না নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। না না কিছুতেই না।

    সনাতন মাঝি চুপ করে বসে রইলো। কি বলবে এবার।
    মুন্না কাগজের প্যাকেটটা খুলতে যাবে তখন সনাতন মাঝি বললো, থাক মা ওটা খুলতে হবে না।আমাকে দিয়ে দাও। আমি চলে যাচ্ছি।
    -না না আমি চন্দনের পাঠানোর সিঁদুর পড়বো।সবার অলক্ষ্যে, কেউ জানবে না। চন্দনও না।
    মুন্না প্যাকেটটা খুলে বললো, ও গড.. এ তো ছাই।
    ও আমার জন্য ছাই পাঠালো। চন্দন তাহলে খোঁজ নিয়ে আমার সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আমি কুৎসিত হয়ে গেছি। আর সুন্দর নই আমি। ভালোই হলো। আর লুকিয়ে থাকতে হবে না আমাকে।
    সনাতন মাঝি মাথা নিচু করে বললো, চন্দন বাবুসাবের চিতার ছাই। টেনে নাও মা কপাল থেকে সিঁথি পর্যন্ত।
    মুন্না হতবাক হয়ে গেল সনাতন মাঝির কথা শুনে। 
    চন্দনের চিতা! মানে কি?
    -কোলকাতায় আসছিল বাবুসাব। গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে গতপরশু রাতে। গতকাল রাতে শ্মশানে আমার সাথে কথা হলো চন্দন বাবুসাবের। বিশ্বাস করো মা। কাল রাতেই ওর সঙ্গে আমি কথা বললাম। ও কিন্তু মৃত তখন। ওর ইচ্ছেতেই আমি তোমার এখানে এসেছি।
    মুন্না একদিন চন্দনকে বলেছিল, তুমি আমাকে ভালবাসা না ছাই। সেই ছাই সিঁথিতে তুলছে মুন্না কপাল থেকে সিঁথি পর্যন্ত টেনে। সনাতন মাঝি চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজ আর মন নেই নৌকা চালানোর।
    দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হল তারপর রাত। নৌকা ঘাটে বাধাই আছে। সনাতন মাঝি নৌকাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেই জানে না।

    “মন তোর ভ্রম গেল না
    ভবের খেলা সাঙ্গ হলে পরপারে যাবি”
    এ তো আমার গান, কে গাইছে?” চোখ ডলতে ডলতে বলল সনাতন মাঝি।

    সনাতন মাঝি চোখ খুলে দেখল চন্দন ও মুন্না একে অপরের হাত ধরে নৌকার ওপর বসলো। সারা শরীর কাঁপছে সনাতন মাঝির। বাবুসাব দিদিমনি আমার নৌকা থেকে নেমে পড়ুন। আমি নৌকা বাইতে পারবো না। ঠিক তখনই ঝুপ করে একটা শব্দ হল।
    সনাতন মাঝি দেখল নৌকা থেকে লাফ দিয়ে গঙ্গার জলে দুজনে একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। প্রথমে হাঁটু জল, তারপর কোমর জল, তারপর বুক জল তারপর মাথা জল। গঙ্গার জল জোয়ারে উথালপাথাল। সনাতন মাঝি শুধু দেখছে। বলার মতো ভাষা তার নেই ।
    সেই রাতের পর থেকে সনাতন মাঝি নৌকাতেই ঘুমায় নৌকাতেই খায়। কিন্তু গঙ্গায় নৌকা নিয়ে নামতে পারে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলে ডুবে যাবে, ওরা ডুবে যাবে। তবেু খুব ভালো আছে সনাতন মাঝি। দুবেলার খাবারের ব্যাবস্থা হয়ে যায়। কে দেয় তা সবার অজানা। আমরা চার বন্ধু এখন গঙ্গার ঘাটে আছি। সন্ধ্যে ছটা বাজে।সনাতন মাঝি তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বললো, আমরা শুনলাম। সন্ধ্যা নেমে এল। পাখিরা ঘরে ফিরছে।
    বিশ্বাস অবিশ্বাস যার যার মনের ব্যাপার। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না মুন্না কি আত্মহত্যা করেছিল না কি চন্দনের আত্মা মুন্নাকে নিজের কাছে টেনে নিল? সঙ্গী তো ! টানতেই পারে। সে যে সঙ্গীই হোক- জীবন সঙ্গী হোক বা জীবন মরনের সঙ্গী।

  • গল্প

    গল্প- হানিমুন

    হানিমুন
    -রাখী চক্রবর্তী

     

     

    ঘন কুয়াশায় মিঠুর বাড়ির বাগান ঢেকে গেছে। টুনি গেঁদার গাছটা ফুল ভর্তি হয়ে আছে। দেবেশ মিঠুকে কোলে তুলে নিয়ে বাগানের সামনে দিয়েই আসছে। গেটের বাইরে অটো দাঁড়িয়ে। কুমার আগেভাগে অটোতে বসে পড়েছে।
    – ‘মিঠু.. মিঠু তোমাকে এইভাবে সারাজীবন ধরে রাখব।’
    মিঠু চোখ পাকিয়ে দেবেশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তাই বুঝি! কোল থেকে নামাও কুমার চলে আসবে। এবারও মনে হচ্ছে ট্রেন আমাদের না নিয়েই পুরী ছুটবে। ছাড়ো, গত বছর তো এই করে পুরী যাওয়াই হলো না আমাদের।’
    গত বছর দেবেশ যে পুরীর টিকিট কাটেনি তা আজও জানে না মিঠু। ট্রেনের টাইম ভুল বলে বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিল দেবেশ মিঠু ও ওদের একমাত্র সন্তান কুমার ।
    টিকিট না কেটে পুরী যাওয়ার নাটক। সেই অপরাধ বোধ আজও দেবেশের মন কুড়েকুড়ে খায়।তাই অনেক কষ্টে তিলতিল করে টাকা জমিয়ে এবার সত্যি সত্যি পুরী যাচ্ছে ওরা।
    দেবেশ মিঠুর কথায় মৃদু হেসে বললো, ‘সে হচ্ছে না ম্যাডাম। তোমাকে কোলে করে গেট পর্যন্ত তাই তো নিয়ে যাচ্ছি।’
    -‘হুম.. নামাও না..’
    -‘মা জলদি আসো। ট্রেনের টাইম হয়ে গেল।’
    কু ঝিকঝিক ট্রেন ছাড়ল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সকাল সাতটা দশ মিনিটে।
    মিঠুর অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হলো আজ।সবচেয়ে কম খরচে পুরী যাওয়া যায় জগন্নাথ দেব দর্শনে। তাও সম্ভব হচ্ছিলো না দেবেশের। সংসার চালাতেই হিমশিম খায় দেবেশ। পকেটে একটা টাকা থাকে না মাসের শেষে। জমানোর কথা তো দেবেশ ভাবতেই পারে না। মিঠুকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল দেবেশ। মিঠুর গিন্নিপনা দেখবে বলে।কোমরে চাবির ছরা ঝুলবে। একগাল পান থাকবে গিন্নির মুখে মানে- মিঠুর মুখে। চওড়া করে সিঁথিতে সিঁদুর পড়বে মিঠু। সব ইচ্ছে মনেই রয়ে গেল দেবেশের। আলমারিতে মিঠুর দু’ চারটে শাড়ি পড়ে আছে। আর ইমিটিশনের কিছু গয়না। তার জন্য আবার চাবির ছরা! চোরের ভারি বয়ে গেছে ঐ কটা জিনিস চুরি করতে আসার। চোরদের কি আত্মসম্মান বলতে কিচ্ছু নেই ।
    ‘এই শোনো না আমি কিন্তু সমুদ্রে ঝাঁপাবো জিন্স টপ পড়ে। তুমি আমার পছন্দ এতো বোঝো। তা আট বছর ধরে কেন বোঝনি। আমি কি ড্রেস পড়তে ভালবাসি।’
    দেবেশ মাথা নিচু করে বললো, ‘আট বছরে প্রথম তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম।’
    -‘উহু হানিমুন বলো।’ মিঠুর বাঁকা ঠোঁটের হাসি দেবেশের ব্যঙ্গ মনে হল।
    কথা না বাড়িয়ে দেবেশ কুমারকে নিজের কোলে শুইয়ে ওর মাথায় চাপর দিতে লাগলো।
    মিঠু সানন্দা পত্রিকাতে মুখ গুঁজে রইলো।
    ট্রেন চলছে। এর মধ্যে চা খেয়ে নিল ওরা। টিফিন করে মিঠু জানলার দিকে তাকিয়ে আছে ।দেবেশের সাথে আর কোনও কথা বললো না মিঠু।
    ট্রেন থামল পুরীতে দুপুরের শেষে।
    কুমার বললো, ‘বাবা কুলিকে ডাকো না..’
    মিঠু বললো,’না সোনা আমাদের বেশি লাগেজ নেই, চলো চলো ।
    বেশ সস্তার হোটেল বুক করেছিল দেবেশ। তবে এতোটা সস্তা মিঠু ভাবতে পারেনি। হোটেলের ঘর তো না যেন গুমটি দোকান।

    ‘মিঠাই মা তাড়াতাড়ি নে গুমটির দোকানটা আজ রঙ করবো।’
    -‘হ্যাঁ বাবা চলো।’
    মিঠু ওর বাবার সাথে গুমটির দোকান চালাতো।তেল, লবণ, মশলাপাতি, লজেন্স, গুটখা, পানপরাগ। সিগারেট বিড়ি তো আছেই। কতো বদ ছেলের নজর ছিল মিঠুর দিকে। সুন্দরী মিঠুর একটু আধটু অহংকার ছিল। পাত্তা দিত না আলতু ফালতু ছেলেদের।
    বড়লোক ছেলে হলেই হবে। ব্যস আর কিছু চায়না মিঠু। গরীব মানেই ফালতু ছেলে। দৃষ্টিভঙ্গি ওর এমনই ছিল ।আট বছর আগে একদিন সন্ধ্যা বেলায় টাই স্যুট পড়ে এক বনেদি পরিবারের ছেলে সিগারেট কিনতে এসে ছিল ওদের দোকানে। তখন মিঠু একাই ছিল। কথা বলার ভঙ্গি বেশ ভালো ছেলেটার।মিঠুরও কথা বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর।হয়ে গেল আর কি..মিঠুর দোকানে মাঝে মধ্যেই আসতো বনেদি পরিবারের ছেলেটি।
    একদিন মিঠু নাম জিজ্ঞাসা করলো ছেলেটির
    -দেবেশ রায়
    -তোমার নাম কি ?
    -মিঠু দে
    মিঠুর বাবা একটু আঁচ করেছিল। একদিন মিঠুর বাবা দেবেশ রায়কে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কি কাজ করো করো বাবা? দেবেশ বললো, ‘ব্যান্ড বক্সে কাজ করি।’
    মিঠুর বাবা বললো, ‘তা ভালো বাবা, খুব নামী কোম্পানি তাই না?’

    দেবেশ বললো, ‘আমি মিঠুকে বিয়ে করতে চাই।’
    ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল ওদের।
    ‘এই মিঠু কি ভাবছো চলো পুজো দিতে যাব তো।’
    মিঠু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে।
    “হ্যাঁ, চলো।”
    জগন্নাথ দর্শন করে পুজো দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে আসে। রাতে বেশ খানেক ক্ষণ বিচে ছিল ওরা। কুমার বেলুন নিয়ে খেলতে থাকলো। তারপর রুটি তারকা নিয়ে হোটেলে ফিরে এল ওরা।
    মিঠু রাতে শোওয়ার আগে জিন্স টপটা ব্যাগ থেকে বের করে রাখলো। কতো দিন পর পড়বে মিঠু জিন্স টপ।
    মিঠুকে ওর বাবা বিয়ের দিন আশীর্বাদ করে বলেছিল, ‘যা যা স্বপ্ন মনে যত্ন করে তুলে রেখেছিলিস, সব সত্যি হবে এবার। সুখী হয় মা।’
    কখন হবে ভোর! চাদর জড়িয়ে দেবেশের হাত ধরে বিচে বসবে। সূর্য ওঠা দেখবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সূর্য ওঠা নাই বা দেখা হলো। এটাই বা কম কি। আসলে মন ভোলানো কথাতে নিজের স্বপ্নের সাথে মধ্যস্থতা করছে মিঠু।
    ভোর চারটে ঢেউয়ের গর্জনে গমগম করছে পুরীর সমুদ্রের বিচ। মিঠুর ভাবনা চিন্তা দেবেশের ওপর অভিমান রাগ সব ঢেউয়ের সাথে চলে গেল।দেবেশের ঘাড়ে মাথা রেখে মিঠু গুনগুন করে গান গাইছে। দেবেশকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। দেরিতে হলেও বেড়াতে নিয়ে এসেছে মিঠুকে। এটা ভেবেই দেবেশের ভালো লাগছে। তারপর ঘন্টা খানেক বিচে বসে ওরা হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিল।
    সকাল এগারোটা বাজে। মিঠু জিন্স টপটা পড়ে তৈরি হয়ে নিল সমুদ্রে স্নান করতে যাবে এবার।কুমার ওর মাকে দেখে বললো, ‘লুকিং নাইস্ মা।’
    দেবেশ হাঁ করে তাকিয়ে আছে মিঠুর দিকে। মিঠু বললো, ‘হ্যাংলাদের মতো কি দেখছো।’
    দেবেশ বললো, ‘চলো আমরা সমুদ্রে যাই।’

    সমুদ্রের জলে মিঠু পা দিয়েছে। জলের ঠাণ্ডা পরশ পেয়ে মিঠু চোখ বন্ধ করে দু’ হাত বাড়িয়ে আছে দেবেশের জন্য।

    -‘দেবেশদা তোমরা কবে এলে পুরীতে? বৌদি কোথায়?’

    দেবেশ বললো, ‘তোমরা কবে এলে অলি?’

    -‘পরশু এসেছি।’

    -‘অনির্বান কোথায়?’

    -‘অফিসের কাজে ব্যস্ত উনি।’
    -‘ও ও তাই বলো..’

    -‘দেখো না দেবেশদা আমাকে আজ ট্রেনে তুলে দিয়ে উনি কাজের জন্য এখানে থেকে যাবে আরও চারদিন। ভালো লাগে বলো?’
    -‘হুম ভেরি ব্যাড।’

    মিঠু চোখ খুলে পেছন ফিরে অলিকে বললো, ‘তুমি থেকে যাও অলি, আমাদের সাথে বাড়ি ফিরো।’
    অলি মিঠুকে দেখে হাঁ হয়ে গেল। ‘বৌদি তুমি কি ড্রেস পড়েছো!’
    অলি মিঠুর চারপাশে ঘুরছে। দেবেশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মিঠুকে ভালো করে পর্যবক্ষেণ করার পর অলি বললো, ‘দেবেশদা আমার জিন্স টপটা বৌদি পড়েছে? তুমি যে বললে আয়রন করতে দিয়েছো এক সপ্তাহ লাগবে। এটা তোমার থেকে আশা করিনি দেবেশদা। বলতেই পারতে বৌদির এই রকম ড্রেসের দরকার। দিতাম! এটা আমার সেরা গিফট বিবাহ বার্ষিকীর। ছি ছি..’ বলে অলি চলে গেল।

    ‘ব্যান্ড বক্স’ পাতি ভাষায় লন্ড্রির দোকানে কাজ করে দেবেশ। অলির জিন্স টপ পড়ে মিঠুকে সেদিন স্বপ্নে দেখেছিল দেবেশ। তখনই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল ওর মনে। এখন পরিস্থিতি বেশ গম্ভীর।মিঠু ঢেউয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিঠুর গায়ে সমুদ্রের নোনা জল আছাড় দিচ্ছে। চুল উড়ে যাচ্ছে..
    জিন্স টপ পড়ে বাঁশির সুরে তালে তাল মিলিয়ে দেবেশের বুকে মাথা রেখে মিঠু এক পা এক পা করে এগোচ্ছে সমুদ্রের অতলে।
    ‘মিঠু হচ্ছেটা কি!: বলে দেবেশ ধাক্কা দিতেই মিঠু বললো, ‘বাড়ি যাব এখনই।’
    দেবেশ জানে কতটা অপমানিত হতে হয়েছে মিঠুকে।
    কিন্তু কিছু করার ছিল না মিঠু একটা আবদার করেছিল সেটা যদি না রাখতে পারি..
    কুমার বললো, ‘বাবা আরও অনেক ক্ষণ থাকবো।’
    -‘না সোনা হোটেলে যাই এখন। বিকেলে আসব।
    হোটেলে ফিরে দেবেশ মিঠুকে জড়িয়ে ধরতেই মিঠু এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘আমার ইচ্ছে হয়েছিল জিন্স টপ পড়ে সমুদ্রে স্নান করবো। প্রয়োজন তো বলি নি। এতো ছোটো করলে আমাকে!’
    দেবেশ মাথা নিচু করে খাটের ওপর বসে রইলো। এ অন্যায়ের সাজা পেতেই হবে ওকে। দেবেশ আর কিছু ভাবতে পারছে না।
    সন্ধ্যা বেলায় কুমারের বায়না রাখতে মিঠু বিচে নিয়ে গেল কুমারকে। দেবেশ হোটেলে রইলো।কুমার পাপড়ি চাট খাচ্ছে। মিঠু চুপ করে বসে আছে। এর মধ্যে হাত ধরাধরি করে এক প্রেমিক প্রেমিকা মিঠুর সামনে এসে বসলো।
    অলির কথা বলছে ছেলেটা। মিঠু ছেলেটাকে ভালো করে দেখলো, এতো অনির্বান! চমকে উঠল মিঠু। অলি তো আজ সন্ধ্যা বেলায় হাওড়ার ট্রেনে উঠবে। আর অনির্বান অফিসের কাজের জন্য এখানে থেকে গেল। তাহলে এই মেয়েটা কে? কান পেতে শুনতে লাগলো মিঠু ওদের সব কথা।
    অনির্বাণ বলছে, ‘অলিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি এবার আমি নিশ্চিন্তে তোমার সাথে প্রেম করবো যুক্তামুখী। কি বোকাটাই না বানালাম অলিকে। হা হা মাই সুইট হার্ট। লাভ ইউ টু থ্রি ফোর ফাইব
    হানড্রেড।’
    মিঠু স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভাবতে থাকলো দেবেশ আমাকে বোকা বানালো। আমার খুশির জন্য। আর অনির্বাণ অলিকে বোকা বানালো নিজের খুশির জন্য।
    মিঠু আর এক মুহূর্ত দেরি না করে কুমারকে নিয়ে হোটেলে ফিরে গেল।
    দেবেশ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। মিঠু ঘরের আলো জ্বালিয়ে বললো, ‘হানিমুন করতে এসে বাবু ঘুমাচ্ছে। ওঠো চলো, ডিনার করবো ভালো রেস্টুরেন্টে। দেবেশের লালটুকটুক চোখে চোখ রেখে মিঠু বললো,’হানিমুন যদি ভালো না হয় তবে তোমাকে একটুও ভালোবাসবো না। এই বলে দিলাম।’
    দেবেশ মিঠুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘আই লাভ ইউ।’
    মিঠু বললো, ‘লাভ ইউ টু থ্রি ফোর ফাইব হানড্রেড।’
    দেবেশ মিঠুর হাত ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘কুমার আয় সোনা আমার হাত ধর।’ দেবেশ পরম তৃপ্তি বুকে নিয়ে ভালবাসার মশাল জ্বালিয়ে স্ত্রী সন্তানের হাত ধরে চলছে সমুদ্র সৈকতে। এ চলার সাক্ষী থাকল স্বয়ং জগন্নাথদেব। আর সমুদ্র।

  • কবিতা

    কবিতা- হেমন্তর বর্ণনা

    হেমন্তর বর্ণনা
    – রাখী চক্রবর্তী

     

     

    শরতের শেষে আসল হেসে
    হেমন্তের সকাল।
    হাল্কা হাওয়ায় গঙ্গা বক্ষে
    মাঝি তোলে পাল।

    আহা, গেঁদা ফুলের বাহারে
    কেমন ভরে যায় বাগান ,
    হৈমন্তীর চেনা সুরে শুরু পাখিদের কলতান ।

    হাল্কা শীতের চাদর মুড়ে
    দৈ ওয়ালা পাড়ে হাঁক,
    ঐ দেখো, দীঘির জলে খেলা করে রাজহাঁস এক ঝাঁক।

    রোদের কিরণ বড় শান্ত হেমন্তর দুপুরে
    শুনছো ! কোনও এক রুবি রায়
    সুর তোলে নুপুরে ।

    প্রেমিক প্রেমিকা ভিক্টোরিয়া স্বপ্ন কতো দেখে
    কেউ বা আবার আলিঙ্গনে মত্ত
    ফুলের রেণু মেখে ।

    হেমন্তের বিকেলে চাষীরা ঘরে আনে সোনার ফসল,
    গোধুলি বেলায় ঘরে ফেরে কাক, চড়ুই শালিকের দল।

    হেমন্ত কালে ঘরে ঘরে চলে নবান্নর উত্সব
    স্নেহ প্রীতি ভালবাসায় আবদ্ধ হয় পরিবারের সব।

    হেমন্তের রাতে ঠাণ্ডার আমেজ কার ঘুম কাড়ে
    কে জানে?
    শীতের পারদ মাপা যায় শুধু
    ভিখারির কম্পনে ।

  • গল্প

    গল্প- পেয়িং গেস্ট

    পেয়িং গেস্ট
    -রাখী চক্রবর্তী

    খবরের কাগজে পেয়িং গেস্টের বিজ্ঞাপন দেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল আবীর। ফুলবাগান থেকে অফিস যেতে মাত্র একঘন্টা সময় লাগবে।আবীর আর একটুও সময় নষ্ট না করে রেডি হয়ে নিল রুম দেখতে যাওয়ার জন্য। তার আগে অবশ্য ফোনে কথা বলে নিয়েছে।
    রবিবার অনেক কাজ থাকে ওর। তবুও এই কাজটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণনগর থেকে সল্টলেক আবীর আর ভাবতে পারছে না। অফিস থেকে ওর বের হতে যেদিন দেরি হয় সেদিন ওকে যা ভুগতে হয় তা ওই জানে।
    কৃষ্ণনগর সিটি লোকাল ট্রেনে চেপে আবীর বিধাননগর স্টেশনে নামলো। ট্যাক্সি নিয়ে ফুলবাগানে পৌছে গেল। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কলিং বেল বাজতেই এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। আবীর নিজের পরিচয় দিতেই উনি বললেন- আসুন আবীর বাবু আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
    আবীর বললো- আপনি পেয়িং গেস্টের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন?
    -হ্যাঁ, আমি বিহারীলাল দত্ত।
    -নমস্কার স্যার
    বিহারীলাল দত্ত বললেন- চলুল আবীর বাবু রুমটা একবার দেখে নিন।
    -হুম সিওর।

    বিহারীলাল দত্ত দোতলায় নিয়ে গেলেন আবীরকে।এই রুমটা আপনার জন্য বলে দরজার তালা খুলে আবীরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।

    আবীর রুমটা দেখে মনে মনে বললো, ওয়াও দক্ষিণে জানলা আবার ব্যালকনিও। জাস্ট দুধ জমে ক্ষীর ওয়াও ক্যায়া বাত আবীর। শান্তি শান্তি। যদি হয় আজ থেকেই এখানে..

    -কিছু তো বলুন আবীর বাবু।

    বিহারীলাল দত্তের কথা শুনে আবীর থতমত খেয়ে বললো- নাইস স্যার, আমার পছন্দ হয়েছে।
    -ব্যাস তাহলে আর কি। আজ থেকেই এই রুম আপনার।

    -কে কে থাকেন স্যার এই বাড়িতে?

    – আমার ওয়াইফ, ও হো আর আপনি আবীরবাবু

    -ওহো.. আবীর একগাল হেসে বললো।

    বিহারীলাল দত্ত বললেন- আবীর বাবু এবার কাজের কথায় আসি।

    -হ্যাঁ বলুন, কত দিতে হবে থাকা খাওয়া?

    – টাকা পয়সা! ও সব পরে হবে। সকাল ও রাতের হেবি খাবার। দু বার চা বা কফি। ছুটির দিন লাঞ্চ পাবেন। সপ্তাহে তিনদিন ভেজ বাকি দিন ননভেজ।ভালো তো।
    -যা বলার এখুনি বলুন খোলাখুলি। পরে ঝঞ্ঝাট ভালো লাগবে না। আর এ মাসের পেমেন্ট কবে দিতে হবে? আমি আজ থেকেই থাকবো। কাল অফিস আছে.. বলেই আবীর ঘড়ি দেখলো রাত্রি আটটা বাজে।
    – ও সিওর, চা না কফি?
    -চা..

    -হেমা..হেমা দু’ কাপ চা আর নাস্তা নিয়ে ওপরে আয়।

    আবীর বিহারীলাল দত্তের ব্যবহারে মুগ্ধ। চা নাস্তা করে আবীর একটু বাইরে বের হলো। কিছু কেনাকাটা করে রুমে ফিরলো। তখন রাত দশটা
    হেমা আবীরের রুমটা ঠিকঠাক করে সাজিয়ে রাখলো। আজ খুব ক্লান্ত আবীর। ডিনার করেই ঘুম দিলো।
    সোমবার আবীর সকালে এক ঘন্টার জন্য অফিস গেল। তারপর রুমে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে ঘুম, নিশ্চিন্তের ঘুম দিল আবীর।
    -দাদাবাবু দরজা খুলুন চা যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
    দরজায় ধাক্কা মারার শব্দে আবীরের ঘুম ভাঙলো । চায়ের কাপ নিয়ে আবীর ব্যালকনিতে এলো।আকাশে লালচে রঙে মেঘেরা খেলা করছে, একটা মেঘ ছুটে যাচ্ছে আর কতগুলো মেঘ আকাশের লালচে রঙে ডুব দিচ্ছে। পাখিরা সারি বদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরছে। ঠিক যেমন অফিস ফেরত আমরা বাড়ি ফিরি। মার জন্য খুব মন খারাপ লাগছে।কিন্তু কিছু করার নেই যে মা। স্টেশন থেকে বাড়ি যেতে দু’ ঘন্টা লেগে যায়। ক্লান্ত হয়ে যায় শরীর।তখন আর কিচ্ছু ভালো লাগে না।
    পিউ খুব খুশি হবে আমি কোলকাতায় শিফট্ হয়েছি শুনে। কিন্তু তিন মাস হয়ে গেল সেই যে মামার বাড়ি যাবে বলে পিউ আমার সাথে দেখা করলো। এখনো কি ওর মামার বাড়ির আদর খাওয়া শেষ হয়নি! ফোনেও পাচ্ছি না। নম্বরটা পাল্টে দিলো অথচ আমাকে জানালো না। আমার নম্বর তো ওর কাছে আছে।
    মিস ইউ পিউ। আমার মতো এততটা তোমাকে কে ভালবাসবে বলো তো ডার্লিং।
    পিউ আবীরের বর্তমান ভবিষ্যত। হ্যাঁ ও বলেছিল তো এই কথাই।
    পিউ বলেছিল ফুলবাগানে থাকে। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা সেভাবে নেওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম এর মধ্যে একদিন যাব ওদের বাড়ি। পিউ বলেছিল ওর বাবা নাকি খুব রাগী। মেয়ে প্রেম করছে জানলে কুপিয়ে মেরে ফেলবে দুজনকেই। না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশি ।

    নানান কথা ভাবতে ভাবতে বেশ রাত হয়ে গেল।আবীরের ডিনার নিয়ে হেমা এল। ততক্ষণে ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। দপদপ করতে করতে টিউব লাইট বন্ধ হয়ে গেল। মানে লোডশেডিং হয়ে গেল।ইনভাটার দু’দিন হল খারাপ হয়ে গেছে। পরশু দিন লাইট মিস্ত্রি ঠিক করতে আসবে। হেমা মোমবাতি জ্বালাতে জ্বালাতে বললো।
    আবীর বললো ঠিক আছে দিদি। কোনো অসুবিধা হবে না।
    রুটি তরকা খেয়ে মোমবাতি নিভিয়ে আবীর শুয়ে পড়লো।

    “চাঁদ ছুপা বাদলমে..শরমাকে মেরি জানাআ..”
    আবীরের ঘুম ভেঙে গেল গান শুনে। সুরেলা কণ্ঠ স্বর। জাদু আছে কণ্ঠে। পিউর গানের গলা ঠিক এই রকম। আবীরের প্রিয় গান বলে পিউর সাথে দেখা হলেই এই গানটাই গাইতো পিউ। আবীর কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। গানটাও থেমে গেল।মোবাইলে দেখল রাত আড়াইটে বাজে। বাথরুমে গেল আবীর। বাথরুম থেকে বেরিয়ে জানলার কাছে আসতেই ব্যালকনিতে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবীর চিত্কার করে উঠলো, ‘কে ওখানে.. কে?’
    বলতেই নিমেষে উধাও হয়ে গেল। পুরুষ না মহিলা বুঝতে পারলো না আবীর। চাদরে ঢাকা পুরো শরীর। তারপর সিগারেটে টান দিয়ে আবীর শুয়ে পড়লো।
    সকালে ঘুম থেকে উঠে দোতলাটা ভালো করে ছানবিন করছে আবীর। কটা ঘর আছে। পাশের ঘরে কে থাকে এইসব জানার চেষ্টা করছে।একতলায় বিহারীলাল দত্ত ও তার ওয়াইফ থাকে সেটা ও জানে। কিন্তু দোতলায় ওই ঘরটাতে কে থাকে সেটা জানার খুব ইচ্ছে আবীরের। কারণ গতকাল রাতে যাকে দেখেছিল আবীর নিশ্চয়ই সে ওই ঘরে থাকে। তা না হলে ঐ ঘরের সামনে ব্যালকনিতে সে দাঁড়াতো না অত রাতে।
    তিনতলায় যাবার সিঁড়ি খুব নোংরা। বোঝাই যাচ্ছে কেউ পা রাখে না এখানে।
    এবার আবীর ওই ঘরের সামনে এসে দেখলো দরজার পর্দাটা হাওয়াতে দুলছে। তাতেই ও দেখতে পেল বিশাল বড় তালা ঝুলছে দরজাতে।
    আচ্ছা তার মানে সকাল সকাল বেরিয়ে যান রাতে বাড়ি ফেরেন। কারণ কাল বিকেলে-রাতে ওনাকে তো দেখা যায় নি। আবীর অনেক কিছু তথ্য নিজেই সংগ্রহ করে নিজের রুমে চলে গেল।
    চা টোস্ট হেমা দিয়ে বললো, ‘দাদাবাবু স্নান করে নিন ভাত দিয়ে যাব।’
    আবীর বললো, ‘দিদি একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো।’
    -হ্যাঁ, বলুন..
    -আমার পাশের ঘরটিতে কে থাকে?
    -যাই মা। ওই মা ডাকছে আমাকে বলেই হেমা দে ছুট।
    আবীর চা খেয়ে স্নান করে ভাত খেয়ে অফিস চলে গেল।
    রুমে ফিরলো আবীর রাত নটার সময়। হাত মুখ ধুয়ে কফি খাচ্ছে ব্যালকনিতে বসে। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।
    আবার পিউর স্বপ্নতে মগ্ন আবীর। হবে নাই বা কেন সাত মাস প্রেমের বয়স ওদের। তারপর তিন মাস হলো কোনো খবর নেই পিউর। চিন্তার শেষ নেই আবিরের।
    রাত বারোটা বাজে আবীর মোবাইলে গেম খেলছে। হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে মোবাইলের সাউন্ডটা কম করে কান পেতে রইলো আবীর যদি আবার শুনতে পায় কান্নার শব্দ। না, কোথায় কোনো শব্দ নেই তো। আবীর এবার শুয়ে পড়লো। রাত বাড়ছে যত আবীরের ছটফটানি তত বাড়ছে।কিসের অপেক্ষাতে আছে যেন ও। তবে কি কাল রাতের গানের..

    আজ আর ও ঘুমাবে না রাতে ঐ ঘরে কে আসে দেখতে হবে ।চারদিক নিঝুম নিস্তব্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে গোটা পাড়ার মানুষ। জুতোর ঠকঠক শব্দ। মনে হচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে কেউ ওপরে উঠছে। আবীর নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে আসছে ওপরে।
    ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো দরজাটা যখন খুললো।আবীর মুখ বাড়িয়ে দেখলো, কালো স্কার্ট পড়া একটি মেয়ে হিল তলা জুতো পড়ে আছে। পা দু’টো ফর্সা কালো রঙ দারুণ খেলছে পায়ের ওপর।
    আবীর আস্তে আস্তে ঐ ঘরের সামনে গেল।
    -ভেতরে এসো আবী।
    পিউ কোথা থেকে এলো! একমাত্র পিউ ওকে আবী বলে ডাকতো!
    -কে..কে? আবীর থতমত খেয়ে বললো।

    -আমি, ভুলে গেলে?মেয়েটি চাদরটা মাথা থেকে সরিয়ে দিতেই আবীর বললো, ‘পিউ তোমার বাড়ি এটা। ও মাই গড।’
    -ভেতরে এসো।

    এতদিন পর পিউকে পেয়ে আবীর পিউকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কিছুতেই ছাড়ছে না। আজ আর কোনো কথা না। তোমাকে আর ছাড়ছি না। কালই বিয়ে করবো আমরা ।

    সকাল বেলায় আবীরের ঘুম ভাঙলো তখন দশটা। হেমা নাকি অনেক ডেকেছে চা নেওয়ার জন্য।
    আবীর বললো, ‘দিদি আজ অফিস ছুটি তাই একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম।’
    আবীর কাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছে। পিউ জল খেতে দিলো ওকে তারপর কিছু মনে নেই ওর।
    হেমা চা টোস্ট আবীরকে দিয়ে চলে গেল।।আবীর চায়ের কাপ নিয়ে দরজার সামনে আসতেই দেখলো হেমা পিউর ঘরের দরজা খুলছে।
    আবীর ভাবলো, পিউ তাহলে সকালেই বেরিয়ে গেছে। আবীর আর দেরি না করে পিউর ঘরে ঢুকলো। ঘর ভর্তি পিউর নানান পোজে সব ছবি ল্যামিনেশন করা। ঘরটার চারদিক দেখছে আবীর।গতকাল রাতে তো ভালো করে কিছুই দেখতে পারেনি। এর মধ্যে হেমা ফিসফিস করে বললো, ‘এই ঘরে কখ্খনো আসবেন না। দাদাবাবু জানতে পারলে গর্দান নেবেন।’

    আবীর মনে মনে বললো, জানি জানি পিউর বাবা পছন্দ করে না তার মেয়ের সাথে কোনো ছেলের সম্পর্ক থাকুক।
    আবীর বললো, ‘দিদি পিউ কোথায় যায় রোজ সকালে আর অনেক রাতে বাড়ি ফেরে।’
    হেমার হিচকি শুরু হয়ে গেল। ‘কি যাতা বলছেন দাদাবাবু..’
    -হ্যাঁ দিদি, কাল রাতেও তো অনেক রাত করে ঘরে ঢুকলো। তার আগের দিনও।
    -দাদাবাবু আপনি পিউ দিদিমনিকে চিনলেন কি করে?
    -চিনবো না আমি যে ওকে খুব..কিন্তু দিদি আপনি ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন?
    -কি খুব?
    -না কিছু না..
    হেমা দরজা বন্ধ করে তিনতলায় চলে গেল। আবীর ভাবল হেমা দিদি একতলায় গেছে।
    হেমা দিদি হেমা দিদি আবীর চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে একতলায় নেমে এলো।
    -কে তুমি বাবা? এখানে কি করে এলে?
    -আপনি কি পিউর মা? দু’দিন হলো আমি এসেছি আপনাকে দেখিনি তো?
    -পিউকে তুমি চেনো বাবা?
    -হ্যাঁ, আমি পিউকে খুব চিনি। কিন্তু তিন মাস পিউকে কতো খুঁজেছি। এখানে এসে পিউকে পেলাম।
    -মানে!
    -কাল রাতে পিউর সাথে আমার দেখা কথা সব হয়েছে। কিন্তু আন্টি আপনাকে পরশু থেকে একবারও দেখিনি। কোথায় ছিলেন আপনি?
    -তুমি আমাকে দেখোনি! কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
    -পিউর বাবা খবরের কাগজে পেয়িং গেস্টের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। আমি সেই বিজ্ঞাপন দেখে রবিবার সন্ধ্যা বেলায় এখানে আসি। তখন অবশ্য জানতাম না এটাই পিউর বাড়ি। তারপর থেকে বিহারীলাল দত্ত স্যারের সাথে দেখাও হয়নি আর আপনার সাথেও না। যাক ভালোই হল আন্টি।আমাকে আপনার ছেলে ভাবতে পারেন। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই বলবেন।
    -হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। ।খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখাতে পারবে?
    -হ্যাঁ। এক মিনিট আন্টি।
    হেমা দিদি, হেমা দিদি বলতে বলতে আবীর দোতলায় চলে গেল।

    কি বলছে ছেলেটা! হেমা, পিউর বাবা, পিউ?
    সুস্থ আছে তো ছেলেটা! পেয়িং গেস্ট! কি বলছে? আমি দুদিন বাড়ি ছিলাম না। শনিবার রাতে বাড়িতে তালা দিয়ে বোনের বাড়ি গেলাম আজ বুধবার বাড়ি ফিরলাম। তাহলে ছেলেটাকে বাড়িতে ঢুকতে দিল কে?

    -আন্টি আন্টি এই নিন খবরের কাগজ।বিজ্ঞাপনটা দেখে নিন।
    আবীর পিউর মা’র ঘরে ঢুকে বিহারীলাল দত্তের ছবিতে মালা দেখে চমকে উঠলো। বিহারীলাল দত্ত স্যারের গলায় রজনীগন্ধার মালা কেন? পিউ কোথায় যায় রোজ? হেমা দিদিকে কত করে ডাকছি সারা দিচ্ছে না।
    পিউর মা বললো, ‘তুমি এখানে বসো, কোথায় পেয়িং গেস্টের বিজ্ঞাপন?’
    -এই পেজই তো আছে।
    আবীর খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কোথাও পেল না ফুলবাগানের পেয়িং গেস্টের বিজ্ঞাপন। আবীরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আবীর মোবাইলে কল লিস্ট চেক করতে গিয়ে দেখলো সব ডিলিট হয়ে গেছে। ফোনে কোনো নম্বর নেই। ক্লিন ফোন।আবীরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
    পিউর মা বলতে লাগলো, ‘তিন মাস আগের ঘটনা
    পিউর বাবা পিউর বিয়ে ঠিক করেছে। পিউ জানতে পেরেই ওর বাবাকে বলে দিয়েছে ও অন্য কাউকে ভালবাসে। ওর বাবা রেগে বললো, তোমাকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দেবো। আমি শর্মাকে কথা দিয়েছি।’
    -না বাবা আমি যাকে ভালবাসি তাকেই বিয়ে করবো।
    হেমা চিৎকার করে ডাকলো আমায়, ‘বৌদিমনি শিগগির আসুন দাদাবাবুর সাথে দিদিমনির কথা কাটাকাটি হচ্ছে।’ আমি তড়িঘড়ি করে ওপরের ঘরে ঢুকে দেখি সব লণ্ডভণ্ড পিউর ঘরে।
    ওর বাবা চাবুক দিয়ে পিউকে মারছে। আমার কথা শুনলো না ওর বাবা। পিউর নজর গেল টেবিলে রাখা কাঁচির দিকে। নিমেষে কাঁচি নিয়ে নিজের হাত পেটে কোপাতে লাগল পিউ। কিছুক্ষণ পর ওর রক্তাক্ত শরীর মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। ডাক্তার আসতে আসতে সব শেষ। এই ঘটনার পাঁচ দিনের মধ্যে পিউর বাবা গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলো। হেমা ওর দাদাবাবুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও পুড়লো। হসপিটালে দুজনকেই ভর্তি করলাম। তিনদিন পর দুজনেই মারা গেল। সেই থেকে আমি একা থাকি এই বাড়িতে। তবে শনিবার বিকেল থেকে সোমবার পর্যন্ত আমি এ বাড়িতে থাকি না। রবিবার পিউর মৃত্যু হয়েছিল। সোমবার হেমা আর পিউর বাবার মৃত্যু হয়ে ছিল। অভিশপ্ত এই দুটো দিন আমার কাছে।’
    আবীর অবাক হয়ে রইলো। পিউকে কাছে পাওয়া ওর গায়ের সুবাস এখনও ওর নাকে লেগে আছে।সব কি পিউর আত্মার। আমাকে এখনও পিউ ভালবাসে। আমি ওর জন্য চিন্তা করি ওকে বিয়ে করবো। আমার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে খুব কষ্ট হয়। পিউ একদিন বলেছিল, কলকাতায় পেয়িং গেস্ট থাকো। তারপর আমরা বিয়ে করে আমার বাবার বাড়িতেই থাকবো। অনেক বড় বাড়ি আমার। কত ভয়ে ছিল পিউ। ওর বাবা যদি জানতে পারে আমাদের সম্পর্কের কথা তাহলে মেরে ফেলবে আমাদের। ঠিক পিউকে মরতে হলো। কিন্তু উনি আমাকে পিউর আত্মার শান্তির জন্য নিয়ে এলেন এখানে। মানুষ বেঁচে থাকতে যদি ভুলগুলো শুধরে নেয় তাহলে অকালে কাউকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় না।
    আবীর বললো, ‘আন্টি পিউকে আমি এখনও ভালবাসি। আমি পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকবো।আপনি এই বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না।
    পিউ রাতে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায় গান গায়।
    ‘চাঁদ ছুপা বাদলমে..শরমাকে মেরি জানাআআ..’
    আবীর পিউর ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। প্রতি রাতে পিউ আবীরের ঘরে আসে।ঘরকন্নার সাধ পূর্ণ করে ভোর বেলায় মেঘের আড়ালে চলে যায়। রাত হলে আবার ফিরে আসে পিউ নিজের সংসার সামলাতে। আবীর আর পিউর মতো সুখী পৃথিবীতে বোধহয় আর কেউ নেই।

  • কবিতা

    কবিতা- প্রার্থনা

    প্রার্থনা
    – রাখী চক্রবর্তী

     

     

    আকাশে সাদা মেঘ সারি সারি
    কাশ শিউলির ছড়াছড়ি
    কচিকাঁচাদের হুড়োহুড়ি
    মা আসছে বাপের বাড়ি।

    যুদ্ধ হিংসা মারামারি
    আয়,খারাপ নেশা সব ছাড়ি
    অনেক হল আড়ি আড়ি
    এবার সব ভাব করি।

    বাবা মা পরিবার সব ছাড়াছাড়ি
    তবে কি লাভ থেকে বাড়ি গাড়ি
    ভালবাসায় যে আনন্দ ভারি
    ক’জনে আর বুঝতে পারি।

    কন্যা ভ্রণ হত্যা করি
    পুত্র সন্তান মানত করি
    মন্দিরে মন্দিরে পুজো করি
    ওঁম শান্তি ওঁম হরি।

    আয় সব, মনে মঙ্গল ঘট স্থাপন করি
    সব পূর্ণিমার চাঁদ হোক কোজাগরী
    শুধু প্রতিমা নয় প্রতি মাকে ভক্তি ভরে পুজো করি
    আজ থেকে,পুজিত হোক দেশের সকল নারী।

  • নাটক

    নাটক- শান্তির বার্তা

    শান্তির বার্তা
    – রাখী চক্রবর্তী

     

     

    চরিত্রায়ণে– যোগীরাজ,
    ডিমপি ও তার মা বাবা এবং
    আম্রপালী

    আবহ সংগীত

    আম্রপালী: সকাল থেকে হরিদ্বারের পথে পথে ঘুরছি “প্রেম নগর” আশ্রম তো চোখে পড়লো না, নতুন বাবু তো বলেছিলেন এই আশ্রমে থাকার ব্যাবস্থা আছে, আর একটু এগিয়ে যাই, তেষ্টাতে গলা ফেটে যাচ্ছে..যে ভাবে বেরিয়ে এসেছি ওদের কবল থেকে, এখনও ভাবলে গায়ে কাটা দিচ্ছে। ঐ তো, বড় বড় অক্ষরে লেখা “প্রেম নগর আশ্রম”।
    যাই ভেতরে যাই, বাহ্ মন জুড়িয়ে গেল। যোগীবাবার এত মধুর কণ্ঠ স্বর

    যোগীরাজ: হরি ওমঃ হরি ওমঃ গোবিন্দা, শান্তি, শান্তি ,শান্তি
    শান্তি পাবে সবখানে
    মনটা যদি পবিত্র রাখো
    ভক্তি শ্রদ্ধা যদি করো গুরুজনে
    লোভ, হিংসা, লালসা
    বাদ দিয়ে স্মরণ করো পরমেশ্বরকে
    তবেই শান্তি পাবে।

    আম্রপালী: বাবা আমার মন অশান্ত থাকে সবসময়। পারিনা অতীতকে ভুলতে। তোমার চরণে ঠাঁই দাও বাবা।

    যোগীরাজ: আমার না, ভগবানের চরণে ঠাঁই নে। সব ব্যথা ভুলে যাবি। ঐ যে গঙ্গার ঘাট দেখছিস। কতো মানুষ দেখতে পারছিস,
    ওরা শান্তির খোঁজে এসেছে এখানে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে দেহ মন শুদ্ধ করছে, যা একবার যা.. গঙ্গায় ডুব দিয়ে আয়। দেখ, মনটা কি বলে তোর, যা যা।

    আম্রপালী: গঙ্গায় ডুব দিলেই কি মনে শান্তি ফিরে আসবে বাবা। ওরা সবাই শান্তি পাবে কি? যারা এখন গঙ্গায় ডুব দিচ্ছে।

    যোগীরাজ: আমার আশ্রমে যারা প্রথম আসে তাদের সবাইকে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসতে বলি, শুধু তুই না মা।

    আম্রপালী: বাবা তোমার আশ্রয়ে যারা আসে তারা সবাই নাকি শান্তি পায়। তবে আমি কেন কষ্ট পাই। নাচে গানে প্রতিটা সন্ধ্যা, রাত আমি মাতিয়ে রাখি ওদের।আম্রপালীর কোঠায় যখন খদ্দেররা টাকার বৃষ্টি ওড়ায় আমার মন তখন চঞ্চল হয়ে ওঠে। টাকার নেশায় তো আমি নাচনেবালী হইনি। আমি তো লেখা পড়া শিখে সমাজে মাথা উঁচু করে মা বাপিকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। তোমার ভগবান সেটাও মঞ্জুর করলো না বাবা।

    যোগীরাজ: অনেক কিছু হারিয়েছিস তাই না মা..

    আম্রপালী: বাপিকে হারিয়েছি, স্বপ্নগুলো হারিয়েছি। বাপির সাথে সাথে সুখ শান্তিকেও হারিয়েছি। অর্থ অনেক উপার্জন করলাম।আলমারি ভর্তি টাকা গয়না, কিন্তু মনটা খালি আছে বাবা। আজ আমি অর্থ-ঐশ্বর্য সব ছেড়ে তোমার আশ্রয়ে এসেছি। নতুন জীবন শুরু করবো বাবা।

    যোগীরাজ: তবে যা গঙ্গায় ডুব দিয়ে আয়।

    আম্রপালী: না, না বাবা কিছুতেই আমি গঙ্গায় ডুব দিতে পারবো না। দম বন্ধ হয়ে আসবে আমার। সেবার বাপির সাথে গঙ্গায় স্নান করতে গেছিলাম। বাপি আর ফেরেনি আমার সাথে। আমি বাপির হাত ধরে এক ডুব দিলাম, দুই ডুব দিলাম তারপর তিন ডুব দেওয়ার সময় বাপি আমার হাত ছেড়ে দিল দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। জল থেকে মাথা তুলে দেখি বাপি নেই। কতো খুঁজলাম.. কোথাও পেলাম না বাপিকে! তারপর পনেরো বছর কেটে গেল। খুঁজে চলেছি আজও বাপিকে।

    যোগীরাজ: তোর মার কথা কিছু বললি না তো?

    আম্রপালী: আমার মার জীবন যাত্রা অন্য রকম ছিল। পার্টি করে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতো মা। বাপি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত। ঘুমের ভান করে আমি চোখ বুঝে বিছানায় শুয়ে থাকতাম। মা নেশা করে খুব গালিগালাজ করতো বাপিকে। সারা রাত বাপি সোফায় বসে থাকত। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোর বেলায় চোখ খুলে দেখি বাপি সোফায় ঘুমিয়ে আছে। টাকাপয়সা সম্পত্তি বাড়ি গাড়ি সব ছিল আমাদের। শুধু শান্তি ছিল না।
    একদিন মা বাপিকে বললো, ডিমপিকে নিয়ে গঙ্গায় স্নান করে এসো তারপর কালীঘাটের মন্দিরে যাবো আমরা সবাই।
    বাপি বললো তুমিও চলো। একসঙ্গে স্নান করবো গঙ্গায়।
    মা বললো, আমার খুব ভয় লাগে গঙ্গায় স্নান করতে। তোমরা যাও।
    আমার তখন চোদ্দ বছর বয়স। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন আমার আর বাপির।
    সকাল দশটার সময় গঙ্গার ঘাটে গেলাম আমি আর বাপি। খুব বেশি লোকজন ছিল না গঙ্গার ঘাটে। বাপি আমার হাত শক্ত করে ধরে গঙ্গার জলে নামালো। আমি সেদিন প্রথম গঙ্গার জলে নামলাম। খুব ভয় করছিল আবার আনন্দও হচ্ছিল, মা ভালো হয়ে গেছে এই ভেবে। কতো স্বপ্ন দেখছিলাম সেই মুহূর্তে। আমি, বাপি আর মার হাত ধরে ঘুরছি, আনন্দ করছি। কত্তো ভালোলাগা আমার চারপাশে। আমি দু’চোখ ভরে দেখছি। জল উচলাচ্ছি দু’হাতে। এমন সময় বাপি বললো, চল মা এবার ডুবকি লাগাই। আমি বললাম, না বাপি আমার খুব ভয় করছে। বাপি বললো, আরে মা আমি আছি তো। ভয় কি মা..তখন মনে হল তাই তো বাপি আছে ভয় কিসের।
    প্রথম ডুব, দ্বিতীয় ডুব দিলাম তারপর ডুব দিতেই বাপি আমার হাত ছেড়ে দিল। দম বন্ধ হয়ে গেছিল আমার। বাপি বাপি করে কত্তো ডাকলাম। বাপি ফিরলো না।
    অনেক খোঁজ চললো গঙ্গার জলে। বাপির দেহ পুলিশ পেল না। মা বললো বাপি নাকি গঙ্গার জলে তলিয়ে গেছে। আমি একা হয়ে গেলাম, খুব একা!
    এই ঘটনার এক মাসের মধ্যে মা আরো পাল্টে গেল। নানান রকম লোকজন জমায়েত হতে লাগল আমাদের বাড়িতে।তিন মাস এভাবেই চললো। তারপর এক রাতে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অজানা অচেনা বিছানায় শুয়ে আছি এক পুরুষের সাথে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, কি করে সম্ভব হল এটা! আমি তো মার কাছে শুয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম মা নাকি বিক্রি করে দিয়েছে আমাকে। যেই বাড়িতে ছিলাম ওরাই বলছিলো। ডিমপি থেকে আম্রপালী হলাম। পড়ুয়া থেকে নাচনেবালী হলাম। মা থাকতে অনাথ হলাম।টাকা পয়সা সম্পত্তি হল তবে শান্তি পেলাম না। অনেক কষ্টে আম্রপালী কোঠা থেকে বেরিয়ে এসেছি। আর ফিরবো না ওখানে।তোমার আশ্রয়ে থাকবো। থাকতে দেবে তো বাবা?

    যোগীরাজ: আমি আজ খুব খুশি মা তোকে পেয়ে..চল মা আমার সাথে আশ্রমটা ঘুরে দেখবি।

    আম্রপালী: বাবা ঐ মহিলা কে? মাটির পুতুল গড়ছে আর ভাঙছে।

    যোগীরাজ: দেখতো মা ভালো করে। চিনতে পারছিস কি?

    আম্রপালী: খুব চেনা চেনা লাগছে। মাথা ভর্তি লাল চুল। কিন্তু মুখটা লালচে হয়ে গেছে। চোখ দু’টো তো খুব চেনা। ঠিক আমার মায়ের মতো। টানা টানা চোখ। না..না মা কি করে হবে। মা তো টাকার পাহাড়ে বসে আছে। সে কেন এই আশ্রমে আসবে!

    যোগীরাজ: ঝড় বৃষ্টির একরাতে আমার শিষ্যরা ওনাকে নিয়ে আসে, রাস্তায় বসে কাতরা ছিলেন উনি, আমি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম তোর মাকে।

    আম্রপালী: আমার মা! তুমি কে বাবা?

    যোগীরাজ: জানিস মা, আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের খোঁজ পেতে আমি এই আশ্রমে আগত সব মায়েদের মেয়েদের বলি গঙ্গায় ডুব দিয়ে এসো আগে।
    আমার মেয়ে হলে ঠিক ভয় পাবে জলে নামতে। আজ আমি পরম শান্তি পেলাম ডিমপি মা আমার..

    আম্রপালী: বাপি,তুমি আমার বাপি! কিন্তু তোমার একি অবস্থা হয়েছে! কি হয়েছিল বাপি সেদিন?

    যোগীরাজ: তিনবার ডুব দিয়ে যখন উঠতে যাব ঠিক তখনি তোর মার পাঠানো ছেলেটা আমার গলা টিপে ডুব সাঁতার দিয়ে আমাকে নিয়ে গেল। তারপর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো দেখি এক পরিত্যক্ত গঙ্গার ঘাটে আমি পড়ে আছি। মাটিতে সারা শরীর ভর্তি।সারা রাত ঐ ভাবেই পড়ে ছিলাম ।ভোর বেলায় এক সন্ন্যাসী আমাকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ওনার লোকেরা আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। দৃষ্টি শক্তি আমার লোপ পেয়েছিল। চোখের ডাক্তার বললেন বাম চোখ ক্ষতি হয়েছে। বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে আমার। কালো চশমা পড়ে থাকি দিনের বেলায়। চশমা খুললাম। দেখতো মা চিনতে পারিস কিনা?

    আম্রপালী: হ্যাঁ, তুমি আমার বাপি। এই তো আমার বাপি, কিন্তু ওই মহিলা কি আমার মা? মাকে কি ওরা ঠকিয়ে ছিল, মার সব কিছু নিয়ে মাকে বাড়ি থেকে পথে বের করে দিয়ে ছিল ওরা?

    যোগীরাজ: সে সব জানি না মা, তবে দশ বছর ধরে তোর মা এখানে আছে। আমাকে চিনতে পারে না। বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে।কুকর্ম ফলের ফল ভোগ করছে তোর মা।আমি তোর জন্য উতলা হয়ে ছিলাম মা। কত চেষ্টা করেছি আমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে তোর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য।কিন্তু পাই নি মা তোর কোনও খবর। কত্তো বড় হয়ে গেছিস মা। আমিও তোকে চিনতে পারিনি।

    আম্রপালী: বাপি আজ আমি খুব খুশি, তোমাকে পেলাম, শান্তি পেল আমার মন।

    যোগীরাজ: আমি আর তুই আজ থেকে শান্তির বার্তা নিয়ে হরিদ্বারের পথে পথে ঘুরবো, মানুষের মনে শান্তির বার্তা পৌঁছাবো।

    আম্রপালী: মাকে সুস্থ করতে হবে বাপি, মার স্মৃতি শক্তি ফেরাতে হবে।

    যোগীরাজ: হরি ওম, হরি ওম, গোবিন্দা,
    শান্তি, শান্তি, শান্তি

  • নাটক

    নাটক- অভিমান

    অভিমান
    – রাখী চক্রবর্তী

     

     

    চরিত্র-মনিকা ও ওর বাবা-মা
    রাজ ও রাজের মা

    প্রথম দৃশ্য

    (মঞ্চের পর্দা উঠল। মঞ্চের ওপর লাল আলো পড়েছে। ঘড়িতে রাত এগারোটা,
    মনিকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে)

    মা -চুপিচুপি কাঁদতে নেই রে।আমাকে বল? কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা বল। আমাকে বল। আমি যে তোর মা..

    (মনিকা উঠে বসলো)

    মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবলো, মা কোথা থেকে এল? আমি তো মাকে না বলে চিরকালের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।অসহ্য লাগছিল মাকে। দিনের পর দিন একই নাটক,পাগলামি, কতদিন সহ্য করবো! আফটার অল আমিও একজন রক্ত মাংসের মানুষ। শখ আহ্লাদ সব আছে আমার।
    মৃত ছেলেকে নিয়ে তার এত ভাবনা, জীবিত মেয়ের প্রতি তার কোনও দায় নেই। তাই আমিও ভাববো না তার কথা। সেই ছোট্ট থেকে হাসির পাত্রী হয়ে বেঁচে আছি, আর না। স্কুলে যেতাম বন্ধুরা বলতো তোর মা একটুও তোকে ভালবাসে না। শুধু বিতান বিতান করে। তোর দাদা মরেও তোকে ভালোবাসা পেতে দেবে না। কপাল দেখ তোর দাদার। ছবিও কত আদর পায়, আর তুই, মাথা নিচু করে ওদের সব কথা শুনতাম, ছোট তো আমিও ছিলাম, তারপর সকাল সন্ধ্যায় যখন তখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়তো মা,ছোট ছোট ছেলেগুলো ইট ছুঁড়ে মারতো মাকে, আমার বাচ্চা মন কি করে এত কিছু সহ্য করতো তা আমিই জানি, তাই মনটা আমার গুমরে থাকত সব সময়। কলেজে পড়ার সময়-ও মা ওই একই কাজ করতো।
    দাদার টিফিন, ব্যাগ সব নিয়ে আমার কলেজে হাজির হয়ে যেত। নতুন নতুন বন্ধু- কতজনকে বলবো আমার মা পাগল, মানসিক ভারসাম্য হীন, বিতান ছাড়া কিছু জানে না সে, আমি মেয়ে হয়েও কেউ না মা’র, তোরা কিছু মনে করিস না। অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েছে বাবা। সব ডাক্তারদের এক মত পুত্র সন্তান জন্ম দিলেই মার পাগলামি সেরে যাবে। কেন ডাক্তাররা বললো না, মেয়েকেই ছেলে ভাবুন মনিকাই আপনার ছেলের মতো কাজ করবে। বৃদ্ধ বয়সে ওই দেখবে আপনাকে। না, এসব ফালতু কথা ওনাদের কাছে। তাই আমি গত পরশু দিন বাবা মা’কে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। মুম্বাইতে পেয়িং গেস্ট হয়ে আছি। চাকরি পেয়েছি ভালো কোম্পানিতে। কোম্পানির মালিক আমার থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। বাঁচবো.. প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেবো। কোনো দুঃখকে কাছে ঘেঁষতে দেব না। আমি একা–একাই বাঁচবো।

    বিছানা থেকে নেমে টিউব লাইটটা জ্বালালো মনিকা। এক গ্লাস জল খেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে দেখছে মনিকা।
    (স্বগোতক্তি)
    হ্যাঁ, কপালে মা হাত দিয়েছে। গালটাও ধরলো। চোখের কোনে জলটা এখনও আছে। কিন্তু আমি কাদঁছিলাম কেন! আমি তো স্ব-ইচ্ছায় এই ডিসিশনটা নিয়েছি। আর মা তো আমার জন্য কোনদিন চোখের জল ফেলেনি। আদরও করেনি, ক্লাস এইটে পড়ার সময় একদিন আমি রিক্সা থেকে পড়ে গেছিলাম। পাড়ার ছেলেরা আমাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে এল। মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, বিতানের খুব লেগেছে না। আহারে, ছেলে আমার কত কষ্ট পেয়েছে বলেই দাদার ছবিতে হাত বুলাতে লাগলো।
    আমি চিত্কার করে কেঁদে বললাম, মা আমার লেগেছে আমার। একটু আদর করো মা আমাকে। মা আমার কোনও কথা শোনেনি সেদিন। আজ এত বছর পর, সব ফালতু-স্বপ্ন, ইমোশন।
    মনিকা বিছানায় শুতে চলে গেল।

    (দ্বিতীয় দৃশ্য )

    মনিকা সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা
    করে শপিং করতে যাবে এমন সময় বস্ রাজ রায় এসে হাজির।
    হুকুম দিলেন বস্ ওনার সাথে যেতে হবে।
    রাজ – চলুন একবার আমার সাথে বেরোতে হবে।
    {স্বগোতক্তি- অগত্যা কিছু করার নেই। চাকরিটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো।}

    মনিকা সেজেগুজে বস্এর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। রেস্তারাঁয় খাওয়া হল। শপিংও করলো টুকটাক। এবার অনুরোধ করলেন,

    রাজ- কাছেই আমার বাড়ি একটু ঘুরে আসবেন চলুন।
    মনিকা আমতা আমতা করেও চললো বস্ এর বাড়িতে। রাজ রায় মানুষটা কি চায়। ভাবতে ভাবতে রাজ রায়ের বাড়িতে পৌছে গেল মনিকা।

    দরজা বরাবর বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে বছর পঞ্চাশের এক মহিলা পরিচয় করিয়ে বললেন,
    রাজ- ইনি আমার মা।
    (বস্ এর মার দিকে তাকিয়ে)
    মণিকা- স্যার আপনি যে বলছিলেন আপনার বাবা নেই‌। তাহলে শাঁখা সিঁদুর.. আপনার মা…

    রাজ -আমার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, আমি তখন দশ বছরের। বাবার ডেড বডি দেখে মা অজ্ঞান হয়ে যায়। চারদিন পর জ্ঞান ফিরল মা’র। কিন্তু মা তখন থেকে জানে বাবা বেঁচে আছে। বাবার মঙ্গল কামনায় রোজ সিঁদুর পড়ে মা। মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই বলে আমি হাল ছাড়িনি। ভালবাসার পরশ দিয়ে মাকে আগলে রেখেছি। সবাই বলে আমার মা পাগল তবে এখনও আশা রাখি মা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। মায়ের আদর পেলাম না। সেই যে দশ বছর বয়সে যা পেয়েছি তাই নিয়ে আজও হাসিমুখে মার যত্ন করি। একদিন মা ঠিক আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে, “আয় বাবা খেয়ে নে”।
    (মনিকার দু’চোখ জলে ভরে গেল। রাজের প্রতিটা কথা তীরের মতো বিধছে ওর বুকে,
    অভিমান করে মার কাছ থেকে দুরে দুরে থেকে গেছি। একবারও ভালবেসে মাকে জড়িয়ে ধরিনি। কেন কেন!
    মনিকা মাথা নিচু করে ভাবলো মাকে বঞ্চিত করেছে ও। একটু ভালবাসার হাত যদি মা’র মাথায় বুলিয়ে দিত তাহলে মাও নিশ্চয়ই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসত। মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা পাগলামি সব তো ভালবাসা দিয়ে সারিয়ে তুলতে হয়, এই ছোট কথা বুঝতে আমার এতো দেরি হলো,
    মনিকা বিড়বিড় করে বললো, এখনও সময় আছে যা ছুটে যা ।)
    মণিকা- স্যার আজ আমি যাই। অন্য একদিন আসবো। আন্টিকে প্রণাম জানাই। দেখবেন আন্টি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।

    রাজ- মিস মনিকা কালই জয়েনিং ডেট। মনে আছে তো।
    মনিকা- স্যরি স্যার, আজকের ফ্লাইটে কলকাতায় যেতে হবে আমাকে।
    রাজ -এনি প্রবলেম?

    মণিকা- স্যার,আমার মাকে সারিয়ে তুলতে হবে। বাই স্যার..টেক কেয়ার।

    তৃতীয় দৃশ্য

    (মঞ্চ আলোয় আলোকিত)

    {রাজ রায় ওর মাকে জড়িয়ে ধরে}
    রাজ- ব্যাস..এইটুকুইতেই শান্তি তাই না মা?
    মা দেখো মিস মনিকার মা এবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
    রাজের মা- হ্যাঁ রে, মনিকা ভেতর থেকে একা রে। ভগবান ওর সহায় হোক।
    মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের খুব কষ্ট রে।

    রাজ- হ্যাঁ মা,মনিকার সমস্ত ঘটনা শুনলাম কোলকাতার দীপকের মুখে, মনে আছে তো দীপককে তোমার?

    রাজের মা- হ্যাঁ রে, মনে নেই আবার, তোর কলকাতার ব্যবসা পত্র তো ঐ দেখে।
    রাজ- তারপরই আমাদের নাটক জমে ক্ষীর হয়ে গেল মা হা হা হা..
    রাজের মা -আমার সোনা ছেলে,উমমমা..

    চতুর্থ দৃশ্য

    {মনিকা বাড়ি ফিরে দেখল ওর মা বিতানের ছবিতে ভাত খাওয়াচ্ছে। আর ওর বাবা মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে আছে।
    মনিকা বাবার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে)

    মণিকা- বড় ভুল করেছি বাবা, আর না.. বলেই মনিকা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ওমা আমাকে খাইয়ে দাও। যেমন করে দাদাকে খাইয়ে দিচ্ছ।
    মণিকার মা -তোকে খাইয়ে দেব? কিন্তু ওর যে এখনও খেতে অনেক সময় লাগবে,
    মণিকা -হ্যাঁ মা, দুই ছেলে মেয়েকে একসাথে খাওয়ায় আজ, কতদিন খাইনি তোমার হাতে ভাত মাখা।
    মণিকার মা -চোখে জল কেন তোর!
    মণিকা – তুমি তো আমাকে ভালবাসো না..
    মণিকার মা -পাগল মেয়ে দাদা যে কতদিন না খেয়ে আছে সেটা ভাব।

    {স্বগোতক্তি: মণিকা মা’র করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করলো, তোমাকে কেউ আর পাগলি বলে ক্ষেপাবে না মা। আমি তোমাকে সারিয়ে তুলবো। মনিকা ওর ডান হাত মা’র হাতে দিয়ে বললো}
    মণিকা- এটা বিতান আর বাম হাত দিয়ে বললো, এটা মনি। তোমার দুই সন্তান ভালবাসা পাবে আজ থেকে।

    শেষ দৃশ্য

    {মণিকা গান শুরু করলো, মাকে জড়িয়ে}

    “তোমার সুখ যে আমার সুখ মা
    বুঝিনি তো আগে
    দুরে গিয়ে পেলাম ফিরে
    আমার সোনা মাকে
    তোমার এক চোখেতে দাদার বাস
    অন্য চেখে আমি
    তোমার নিশ্বাসে আমি বাঁচি
    মাগো তোমায় পেয়ে ধন্য আমি”।

    (এক এক করে সব আলো জ্বলে উঠলো মঞ্চে)

    মণিকার এক কাঁধে ওর বাবার মাথা আর অন্য কাঁধে ওর মার মাথা, নতুন জীবন ফিরে পেল মণিকার মা বাবা এবং মণিকা নিজে।

  • অণু কবিতা

    অণু কবিতা- চন্দ্রিমার আঙিনা

    চন্দ্রিমার আঙিনা
    – রাখী চক্রবর্তী

    গোধুলি লগ্নে সিঁদুর মাখা মেঘে চেয়ে থাকি আনমনে,
    অরণ্যের সারি, নাকি ভালবাসার আড়ি
    চন্দিমার আঙিনায়
    স্থান পেয়েছে কে জানে?
    ভাঙা ভাঙা আঁধারি আলো আছড়ে পড়েছে আমার
    শূন্যতাবিহীন এ জীবনে
    কত স্মৃতি, কত আবেগে মাখা ছিল আমার রাতের আকাশ,
    আজ হাহাকার মূর্ছনা গ্রাস করেছে
    আমার প্রতিক্ষণের উল্লাস।

You cannot copy content of this page