-
গল্প- প্যালারাম
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
প্যালারাম
-রাণা চ্যাটার্জী“পারবো না আর বাজার আনতে,যা জুটবে সেটাই ভাইকে রান্না করে খাওয়াবে”রেগে বলল প্যালারাম।যদিও আদুরী, স্বামীকে প্যাংলা ডাকতেই অভ্যস্ত, নয় নয় করে নয় বছরের প্রেম শেষে বিয়ে বলে কথা তাই কি এতদিনের অভ্যাস ছেড়ে ওগো হ্যাঁ গো করা যায়। তাছাড়া ওই আদরের ডাক ছাড়া আরনয়তো বলবে কি!ওই তো ছিরি,দু খানা হাড় ছাড়া শরীরে অবশিষ্ট কিছুই নেই!
বিয়ের পাকা কথা বলার সময় হবু জামাইয়ের চেহারা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল বাবার, মেয়ের ওই ডাগর শরীরের পাশে জামাইকে যদি পাট কঞ্চির মতো লাগে কি করে লোকজনকে পরিচয় দেবে! মা খান্তা দেবী অবশ্য ছেড়ে দেবার নন, মেয়ের মুখ চেয়ে একহাত নিয়েছিলেন স্বামীকে!”বলি হ্যাঁ গা,আদুরীর বাপ,বলি বিয়ের সময় পাহাড় প্রমাণ হুমদো তুমিটা তো তখন পুঁচকে আমি টাকে পটাতে দুবেলা ঘুর ঘুর,ঘুর ঘুর করতে তার বেলা আর এখন কিনা ব্যাঘাত দিচ্ছ!
যাই হোক বেশ ধুমধাম করেই চার হাতের মিলন হয়ে গেলো প্যলা ওরফে সুদর্শন ও আদুরীর। প্যালারামের শরীরের জুত না থাকলে কি হবে নামের মধ্যে বেশ জৌলুশ ছিল ওর। সত্যিই যেন সুদর্শন শব্দটাকে ব্যঙ্গ করতো ওর শরীর!এর জন্য অকালেই এই সুন্দর নাম হারিয়ে “প্যালা”তেই ডাক আটকে যায়, এ যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। হাড়ের ওপর চামড়া লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া দেখলে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যেন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট!ঠিক যেন ভগবান বড্ড তাড়াহুড়োয় শৈল্পিক হাতে ফিনিশিং টাচ দিতে ভুলে গেছে শ্রীমান প্যালাকে!আদুরীর ভাই অবশ্য বলে ছিল ওরে দিদি, এ যে জাম্বু তো এক্কেবারে কাক তাড়ুয়া !আড়ালে বললেও শ্যালক ও এক পাল শ্যালিকারা যে তাকে নিয়ে বেশ মজা পায় তা অল্প হলেও বোঝে দায়িত্ববান জামাই বাবাজীবন প্যালা।
” বাজার আনতে পারবে না মানে কি কথা শুনি? দশ টাকা সাইজের রসগোল্লার মতো চোখ পাকিয়ে ঝাঁজ নিয়ে বলল আদুরী। দিদির বাড়ি আসছে কিনা সাধের ভাই, আহারে আমার সোনাটা,ছটা বোনের পর হয়েছে। দশ টা নয় পাঁচটা নয় সাধের একটা মাত্র ভাই আমার, বাড়িতে কত আদর ওর জানো”?
“হম, হম আদরে বাঁদর করে ছেড়েছো ওটা কে আর এখন আমার পেছনে বাঁশ দিতে ঘটা করে কিনা অতিথি আপ্যায়ন..” ভেংচি কেটে থামলো প্যালা!কি বললে অতিথি!!আমার ভাই এবাড়ির ঘরের লোক তাকে এমন বেইজ্জত!কোমরে আঁচল গুঁজে দশাসই গিন্নি এগিয়ে আসতেই না জানি বিপদ বাড়বে ভেবে কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। মোক্ষম চড় যদি ভুল করে একটা ধেয়ে আসে বিছানায় শুয়ে সাতদিন গোঙাতে হবে এই দৃশ্য মনে ভাসতেই মুখ বেঁকিয়ে একখানা কটা চটা থলে ঝুলিয়ে বাজার চললো শ্রীমান প্যালা থুড়ি সাধের জাম্বো।বারান্দা থেকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে আদুরী আবদারে “অ্যাই শোনো,ওপরে তাকাও একবার”,এরপর গালে পান ঠেসে হাসি মুখে বলল ,”কই গো বলছি কি, গলদা চিংড়ি,ইলিশ আর ওই স্পেশাল দই এক কেজি এনো কেমন ফেরার পথে”।
মাঝে মাঝে বর টাকে আদুরীর বর্বর মনে হয়,আর লাগবে নাই বা কেন যেটা সে বলবে উনি ঠিক তাল কেটে তার উল্টো পথে হাঁটবে! কত্তা বাজার যেতেই মনটা ফুরফুরে হলো আদুরীর।ঘরের চাদর গুলো পাল্টে আর কুইন্টাল খানেক ময়লা বসা পর্দা গুলো টেনে নামালো।ভাবলো যাক আজ বর কে যা বলবো শুনবে মনে হচ্ছে ঝাড় খেয়েছে যা!
বউয়ের সামনে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ফুঁসছে প্যালা, এই তো সেদিন ভাইফোঁটায় এলো শ্যালক, গনডে পিনডে গিলে জামাইবাবুর বুক শুকনো করে পাঁচদিন কাটিয়ে গেল, আবার আসার কি আছে শুনি! যা হয় হোক বাড়িতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ লাগুক, কিছুই আনবো না বলে আড়াইশো চারা পোনা, কচু, লাউ শাক এইসব হাবিজাবি কিনে ব্যাগ ভরে ফিরলো।
বাথরুমে প্যালা হাত- পা ধুতে যেতেই বাজার দেখে তো আদুরীর চক্ষু ছানাবড়া। মাথায় ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছে তার ,কিন্তু না ওর মতো বেয়াদপ লোককে চিৎকারে মোটেও শায়েস্তা করা যাবে না, দিতে হবে মোক্ষম দাওয়াই ভেবে চুপচাপ বেডরুমে খিল তুলে দিলো। আদুরী আজ কত সখ করে বসে ছিল ভাইয়ের জন্য দুপুরেই দুটো পদ বানিয়ে রাখবে! সন্ধ্যায় ইউটিউব দেখে শেখা স্পেশাল টিফিন এর আয়োজন চলছিলো সব দিলো পণ্ড করে মর্কটটা,কিন্তু রাগ তো প্রকাশ করা তার ওপরই সাজে যে গুরুত্ব দেয়!দুঃখ হলেও মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো আদুরী।
“কই গো রাঁধবে না,বেলা যে যায় যায় গো, ও আমার আদুরী,সুর নরম করে হেঁকে চলেছে কত্তা। ভেতরে ভেতরে বেশ বুঝছে প্যালা, এই রে বেশ তো হলো দুপুরে কি খাওয়া জুটবে না,তবে তো কপালে বেশ দুঃখ আছে!ওদিকে বিকাল হলেই নাকি শালা বাবু হাজির হবেন আর ওর সামনে হাসিখুশি সুখী দম্পত্তির অভিনয় করতে হবে ভেবেই মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বেঁকে গেলো প্যালার। গিন্নির মুখ ঝামটা,অপমান যা কিছু সব হজম করতে পারলেও কিছুতেই খিদেটা সহ্য হয় না প্যালার কিন্তু উপায়ই আর কি তার!!
সব বুঝেও কিছুতেই সাড়া দিলো না আদুরী,দরজা তেমনই বন্ধ।যেমন হাড় জিরজিরে সোয়ামি তেমন হাড়কেপ্পন লোক ,নে এবার ঠ্যালা সামলা বলে বন্ধ ঘরে আগে থেকে মজুত রাখা চিড়ে,কলা, গুঁড়ো দুধ মেখে পেট পূজা সারলো আদুরী । মনে মনে ভাবলো যেমন হাবিজাবি জিনিস নিয়ে ফিরেছো আমায় জব্দ করতে এবার বোঝো কত ধানে কত চাল।বেকার চিৎকার ঝগড়া না করে এভাবেই শায়েস্তা করার রাস্তা বুদ্ধিমতীর মতো বেছেছে আদুরী।
খিদেতে পেট চুঁই চুঁই প্যালার।ধুস,মশার কামড় গোটা দুপুর জুড়ে,কেবল জল খেয়ে খালি পেটে কি ঘুম সম্ভব!একবার ভাবছে রান্না ঘরে যে কিছু বানিয়ে নেবে সে তো সামান্য গ্যাস পর্যন্ত জ্বালতে জানে না!পরক্ষনেই মায়া হচ্ছে আহারে আদুরী টা না খেয়ে পড়ে আছে অথচ কি আর সে করতে পারে ভেবে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো প্যালার!
“ও বউ খোলো দরজা, প্রমিস করছি,বাজার আনবো বিকালেই।এই বারটার মতো মাফ করো আমায়।কই গো,সাড়ে তিনটা যে বাজলো,সেই সাড়ে নটায় সামান্য শসা মুড়ি!তোমারও যে শরীর খারাপ হবে”!
তৃপ্তি করে খেয়ে ঘুমটা এসেছিল আদুরীর ,স্বপ্ন দেখছিল প্যালা এক খানা প্রিন্টেড লুঙ্গি কেটে ফতুয়া বানিয়ে নিজেকে ঘন ঘন আয়নায় দেখছে।ইস আদিখ্যেতা! একখানা হিরো হিরো লুক দিয়ে ঠোঁটের কোণে সে যে কি মুচকি হাসি!কিন্তু প্যা লা ওটা কি পড়েছে নিচে! খুব যেন চেনা লাগছে আদুরীর।কাছে গিয়ে যেই দেখছে তার হারিয়ে যাওয়া নতুন সায়াটাকে মহান প্যালারাম মাঝ বরাবর সেলাই করে পাজামা বানিয়েছে! দেখে তো আদুরীর মাথাটায় আগুনটা আবার জ্বলে উঠলো ! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বলে ঘুমের ঘোরেই ধরফর করে উঠে দরজা খুলে কলতলায় রাখা এক বালতি জল প্যালার মাথায় ঢেলে দেয় আদুরী।এই রে এ কি করলো সে, তার তো দরজা না খুলে তেজ দেখানোর পর্ব চলছিল! প্যালা তো তার কিনে দেওয়া বারমুডা তে !তবে কি ওটা স্বপ্ন দেখছিল আদুরী ভেবে লজ্জায় পড়লো।
খিদেতে কাতর ,ক্লান্ত আমআঁটির মতো শুকনো মুখে ঘুমিয়ে পড়া প্যালারাম রীতিমতো জলের ধাক্কায় ঘাবড়ে বাবাগো মেরে ফেললো আমায় বলে পাঁচিল টপকে দৌড়! বাইরে বেরিয়ে হকচকিয়ে ভাবছে প্যালা, বউ এই বুঝি আজ তাকে বালতি দিয়ে মাথা ফাটিয়েই দিতো!বড্ড অসহায় মুখে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে উঠলো সে।পাশের বাড়ির রাঙা ঠাম্মা ইয়ার্কি ছলে বলে উঠলো,” আহারে নাত বৌমা ভালোবাসায় বুঝি ভিজিয়ে দিলো প্যালা রামকে..”! বলেই ফিক কিরে হেসে উঠলো।দূর ছাই জীবনটা আলু ভাতের মতো চটকে দিলো সব্বাই,এমন মুখ করে কেন্নর মতো গুটি সুটি মেরে উঠানে ঢুকলো। হাত জোড় করে দরজা থেকে বলে ওঠলো,” মারিস নি রে বউ, দয়া করে মারিস নে, আমি আজই বিকালে বাজার করে আনবো”।আদুরীর ঘুম তো একদম চলে গেছে,সে হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছে না।একটু হলেও এবার তার প্যালার ওপর মায়া যে হচ্ছে না, তা নয় কিন্তু এখনই বেশি নরম হওয়া বুমেরাং হয়ে না যায় তাই গম্ভীর ভাব বজায় রেখে ঘরে ঢুকলো।
রাগ পুষে আদুরী ঘুমিয়ে যেতে স্বপ্ন যে হানা দিয়েছিল তার মাথায় বিলক্ষণ বুঝে ফিক করে হেসে ফেললো আপন মনে।এমন এক
উদ্ভট ড্রেসে তাবলে প্যালা কে কিনা দেখবে কোনোদিন ভাবেনি যে!এরপর রান্না ঘরে ঢুকে স্বামীর জন্য একটু গরম সুজি বানালো,বিকেল তখন গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নামার মুখে। প্যালা কোনো কথা না বাড়িয়ে সুরুৎ করে খেয়ে বাজারের ব্যাগ নিতে যাচ্ছিল দেখে চড়া গলায় আদুরী আদেশের সুরে বলে উঠলো:“ভাইকে তার পছন্দের যা যা খাবার খেতে চায় সেই মতো সব কিনে ঘর ঢুকতে বলেছি ,যা বিল হবে তোমার একাউন্ট থেকে অনলাইন ব্যাঙ্কিং করে আমি ওকে মিটিয়ে দেবো”
শুনে তো আত্মারাম খাচাঁছাড়া হওয়ার উপক্রম প্যালার! মনে মনে ভাবলো উফ কি জন্য যে অনলাইন ব্যাঙ্কিং না শিখে আদুরীর ওপর ভরসা করেছি,শুধুই শাড়ির অর্ডার আর লাইভ দেখার ধুম আর আজ কিনা আরও এক কদম ! অমনি চেনা গলায় ভূমিকম্পের মতো গম গম পুরুষ কণ্ঠের হাঁক,” দিদি, জাম্বো দরজা খোলো.”.!ওই শ্যালক হাজির তবে!…হাসি হাসি মুখের অভিনয় করে জাম্বো এক ছুটে দরজা খুলে দেখে একা নয়,তার সাধের ,পেছনে কাঠি দেওয়া শালা বাবু সঙ্গে মেয়েদের মতো এক মাথা ঘন লম্বা চুলে কানের দুলে সজ্জিত এক বন্ধুকেও দিদির বাড়ি হাওয়া বদল করাতে সটান হাজির করেছে।”উহু চোরের মতো মুখ করে ঘুরবে না একদম সামনে”আদুরী চাপা গলায় বলে ভাইয়ের কিনে আনা খাবারের বিল টা প্যালার হাতে গুঁজে দিলো।সারাদিন শসা মুড়ি আর বিকালে পাতলা সুজি খাওয়া প্যালার হৃৎপিন্ডটা বত্রিশ শো টাকার খাওয়ার বিল দেখে কেমন যেন চুপসে গেল!
-
গল্প- ভারতমাতা
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
ভারতমাতা
– রাণা চ্যাটার্জীশীতের জবুথবু আঁধার রাত। লম্বা বয়ে যাওয়া খাল পাড়ের পাশ দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ফুঁড়ে পথ হাঁটছিল রতন,পাশে তার কয়েক ঘণ্টা আগে পরিচয় হওয়া নতুন সঙ্গী হুকুম সিং। মাথায় পাগড়ী এমন ভাবে বেঁধেছে কেবল চোখদুটো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো জ্বলজ্বল করছে। বিপক্ষকে পায়ের প্যাঁচে জড়িয়ে টুঁটি ধরে কয়েক মুহূর্তে নাস্তানুবুদ করা তার বাম হাতের খেল।ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে যখন রতন অনুভব করলো পিঠে ভরসার হাত, উত্তেজনায় টগবগ করে উঠলো রক্ত।যে দায়িত্ব রতনের ওপর সঁপেছে স্বদেশী দলের নেতৃত্ব তা পালন করতেই হবে নীরবে নিস্তব্ধ অন্ধকারের মতোই ।এই সংকল্প মনে প্রাণে রতনকে এতটাই উত্তেজিত করে দিচ্ছে ,শুধু ভাসছে মনে ভারত মায়ের শৃঙ্খল মুক্তির হাসি।
দেশের সকল প্রান্তের মতো বাংলা সহ এ তল্লাটে লাল মুখো বাঁদর ইংরেজরা আধিপত্য কায়েম রাখতে লোভ দেখিয়ে নেমকহারাম এ দেশীয় কিছু মানুষকে হাত করেছে। এরা ইংরেজ দের দালাল রূপে নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য জাল ছড়িয়েছে। শুরু হয়েছে সাধারণ কৃষকদের জমি, মাটি,আম আদমির জীবন জীবিকা সর্বস্ব লুটেপুটে নেওয়ার অত্যাচার, শোষন রাজ।সকল দৃষ্টি এড়িয়ে এ দুইজনের ওপর দায়িত্ব পড়েছে সাত ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে নদীর ওপারে বাংলাদেশ সীমান্তে যে রেল স্টেশন তার সন্নিকট গোলা গুলি বারুদ সব জাগরণ মঞ্চের গোপন আস্তানায় পৌঁছানোর।কালকেই ট্রেনের মধ্যে যাওয়া অস্ত্র লুট করার মোক্ষম সুযোগ,সেটা ভেস্তে যাওয়া মানে মৃত্যুর সামিল রতনের কাছে। অন্ধকারে হোঁচটে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা উপড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই উফ বাবাগো করে বসে পড়লো রতন।মুহূর্তে দেশলাই জ্বালিয়ে নিজের খদ্দরের পাঞ্জাবির একদিকটা ফরাৎ করে ছিঁড়ে পায়ে বেঁধে দিয়ে হুকুম সিং বললো “উঠিয়ে বাঙালি দাদা, আভি বহুৎ কাম বাকি,উঠিয়ে”!
ভরসায় টগবগ করে পুনরায় রক্ত ফুটে উঠলো রতনের।তার থমকে যাওয়া মানা,থেমে যাওয়া মানে ভারত মায়ের অব্যক্ত যন্ত্রণার পাথর তারও বুকের ওপর যেন আরো জোরালো ভাবে বসানো।আজ জঙ্গলে সারা বিকাল, সন্ধ্যা জুড়ে মাস্টারদা’র জ্বালাময়ী ভাষণ দারুন উদ্দীপ্ত করেছে রতনকে। এখনো যেন চোখের মধ্যে ভাসছে স্বাধীনতার মুক্তির আকাঙ্খা,আরও জোড়ে পা চালায় দুই নও জওয়ান।
বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে গোয়াল ঘরের ভেতর অব্যবহৃত রাস্তায় পা টিপে নিজের কুঁড়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে অবাক হলো রতন। একি মা এখনো জেগে!রাস্তায় ঠায় লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে! তবে কি তার অপেক্ষায় গ্রাম বাংলার অভাবী হাড়ভাঙা পরিশ্রমের প্রতিবিম্ব তার জন্মদাত্রী মা এই রাত বারোটার সময়।”কি রে রতন এলি বাবা,আমি জানতুম তুই আসবি”বলে পথ ছাড়লো মা, এ যেন সাক্ষাৎ ভারত মাতা রতনের।সে মাতঙ্গিনির নাম শুনেছে,তার মা কোনো অংশেই কম সাহসী নয় এটাও মানে রতন।ইতিমধ্যে মায়ের ব্যবস্থায় রুটি,গুড় মাটির পাত্রে গরম দুধ হাজির দুজনের।
“ওঠ বাবা আর দেরি করিস না – কে”!ধরফর করে উঠে বসলো রতন।ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা।তবে কি মা ঘুমায় নি! মা কি আঁচ করতে পেরেছে নতুন সঙ্গী রাতে বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কিছু একটা দায়িত্ব রতন দের ওপর।জলদি রেডি
হয়ে মুখে কাপড় জড়িয়ে মায়ের পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে অন্ধকার পথে পা বাড়ালো দুই স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবক। ওদেরকে মা,গামছায় পোঁটলা করে চিঁড়ে মুড়কি বেঁধে ধরিয়ে দিতে ভুললেন না!পরদিন বিকালে ওঠানে রতনের নিথর দেহ এসে পৌঁছালো। স্থানীয় সংবাদে বারবার নিউজ বুলেটিন বলছে কুমার দহ স্টেশনের কাছে ট্রেনের চেন টেনে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় স্বদেশী ও পুলিশের মধ্যে প্রবল খণ্ডযুদ্ধ হয়।গোলাগুলির মাঝে পড়ে মৃত্যু হয় রতন বসু রায়ের।বিপ্লবীরা প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে তাদের মিশন সফল করেছে,শুরু হয়েছে কারফিউ,ধরপাকড়। গ্রাম বাংলার বয়স্ক মা তাকে তো কাঁদতে নেই ! তার পায়ের সামনে পড়ে রয়েছে তার সন্তানের নিথর দেহ । তার রতন তো ভারত মায়ের শৃঙ্খলা মুক্তির জন্য বলিপ্রদত্ত ,আর তিনি শহীদের মা, আপামর ভারতবাসীর জননী” ভারত মাতা”।একদল যুবক “বলো হরি হরি বোল” সুরে শ্মশান মুখে নিয়ে যাচ্ছিল রতনের দেহ। বয়স্ক মা ছেলের মাথায় আশির্বাদ দেওয়ার নামে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো অমর শহীদের।
-
গল্প- নৈশ প্রহরী
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নৈশ প্রহরী
-রাণা চ্যাটার্জী‘..কইগো ওঠো বাজার যাও পরশু জামাইষষ্ঠী, আর তোমার কোন হেলদোল নেই:!..ইয়ে মানে বলে প্রমথ জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে আয়নায় নিজের চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখে নিজেই চমকে উঠল।
ভালো সম্বন্ধ, ফেলে দেওয়া যায় না, মেয়ে রাজরানী হবে- চাপের মুখে পড়ে কয়েক লাখ টাকা পার্সোনাল লোনের বোঝায় কলেজ ছাত্রী মেয়েটার বিয়ে দিয়ে থেকে ওষ্ঠাগত প্রাণ!কাকে আর বলবে, তার সহধর্মিনীকে? সে তো প্রতিমুহূর্তে ত্যাগ স্বীকার করেই চলেছে। দুশ্চিন্তায় প্রেসার সুগার বাড়লে প্রমথের বিপদ উল্টে বাড়বে।
সমস্যা যতই থাক প্রথমবার জামাইষষ্ঠী বলে কথা, ভালো আয়োজন, উপহার সামগ্রী না দিলে সত্যি মান থাকে না । আরও একবার ফোন করে নিল মেয়েকে।” মিষ্টি মা আমার, তোর শাশুড়ি মাকে বলেছি, সকাল সকাল চলে আসিস কাল কেমন”।
“তোমায় একটা কথা বলবো মা,বলো কাউকে বলবে না। বলছি একটা গাড়ি পাঠিয়ে দেবে কাল”? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো শর্মিলার,:কেন তোদের অত বড় গাড়িটা কি হলো’?
“..আসলে মা,ওটা নিয়ে বেরুলে মিনিমাম দুহাজার টাকার তেল ভরতে হবে, ড্রাইভার ,টোল ট্যাক্স সহ আরও খরচ ! কি বলবো তোমায় ,লকডাউনে ওর চাকরিটা চলে গেছে মা!গাড়িটা খারাপ এটাই কিন্তু বলবে বাবাকে, নইলে সন্দেহ করবে”।
কই গো শোনো না এই প্রথম বছর মেয়ে -জামাই,, ষষ্ঠী করতে আসছে আমাদের বাড়ি,একটা মান সম্মান আছে তো নাকি নিজেদের, তাই বলছি পটাই কে বলো কাল যেন একটা গাড়ি ব্যবস্থা করে দিদি জামাইবাবু কে নিয়ে আসে ।
বলো কি গো,আমাদের কে তাবলে গাড়ি পাঠাতে হবে!?চোখ পাকিয়ে উঠলো শর্মিলা,” হ্যাঁ হবে,হবে তোমার মতো কে আছে যে একটা ভাঙা সাইকেল নিয়ে যখন খুশি শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়া!আহা হা গিন্নি তুমি তো জানো,উপার্জনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে মিষ্টির বিয়ের ঋণের সুদ গুণতে,বলতে গিয়েও না বলে শ্বাস নিয়ে বললো,চিন্তা করো না,দেখছি কি করা যায়।
জামাই ষষ্ঠী ভালোভাবেই মিটলো কিন্তু কিছুতেই ওরা ফেরার নাম উচ্চারণ করছে না।ওয়ার্ক ফ্রম হোম বাহানা দিয়ে সেই যে জামাই তিনতলার ঘরে ঢুকেছে!মেয়ে আর গিন্নি খাবার জল পৌঁছে দিয়ে আসছে সময়ে সময়ে।
“বাবাজীবন বলছিলাম শরীর ঠিক আছে তো তোমার?এসে থেকে বড্ড চুপ দেখছি কিনা”।প্রমথ প্রথম থেকেই একটু নিজেকে গুটিয়ে রাখতো আসলে সে নিজে একটা ছোট খাটো কাজ করে কিনা!বিয়ের সময় এমন একটা কথা ওর কানে এসেছিল, নামি কোম্পানির উঁচু পোস্টে কর্মরত জামাই নাকি শ্বশুরের সামান্য কাজ নিয়ে নাক সিঁটকে ছিল, মেয়ে কে ও কটাক্ষ করতে ছাড়ে নি!
কই গো ঘুমালে নাকি!শর্মিলা হালকা গুঁতো দিয়ে স্বামীকে কিছু বলতে গিয়ে বিছানা খালি দেখে চমকে উঠেছে। কি ব্যাপার তবে কি বাথরুম গেলো নাকি!কি যেন একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো তার অমনি জামাই- মেয়েকে নিয়ে চিন্তা আসছিল।সে তো হলো কিন্তু এমন গভীর রাতে স্বামী গেলো কোথায়!!অপেক্ষা করতে করতে ওষুধের প্রভাবে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল শর্মিলা। যখন ঘুম ভাঙলো প্রায় সাতটা।প্রমথ পাশে ঘুমাচ্ছে দেখে অবাক হয়ে ভাবলো তবে কি সে কাল স্বপ্ন দেখেছে!! কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।প্রতিদিনের মতো উঠে ঠাকুরের ফুল তুলে চা বানিয়ে স্বামীকে উঠিয়ে কথাটা তুললো। “জানো কাল স্বপ্নে দেখি তুমি পাশে নেই”। চোখ কপালে তুলে মুচকি হেসে প্রমথ উত্তর দিলো,”নেই মানে কি গো গিন্নি, আমি তো সব সময়ই পাশে তোমার”।
আরে না না সেই পাশে থাকা বলছি না, কাল রাতে দেখি পাশে শুয়ে নেই,কিন্তু ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি।রাত জাগা ক্লান্তির হাই তুলে বললো প্রমথ তুমি যেমন তোমার জামাইয়ের বিষয়ে আমায় আড়াল রেখেছো কিন্তু আমি সব বুঝতে পারি বুঝলে তাই রাতে একটা পার্ট টাইম জব নিলাম।বিস্ময়ে শর্মিলার চোখে জল,এই তুমি কি সব বলছো গো,এই বয়সে আবার রাত জেগে কাজ করে মরবে নাকি??
নাগো সেসব কিচ্ছু হবে না,আমি ঠিক সামলে নেবো,সংসারের যা খরচ বাড়ছে তারপর মেয়েটা..: বলে চোখ ছল ছল হলো প্রমথের। বাক রুদ্ধ শর্মিলা তখনো অবাক হয়ে পাশে! ওর এমন ঘোর ভাঙিয়ে প্রমথ বললো “হ্যাঁ গো একদম ঠিক বলছি শর্মিলা, ওই মোড়ের মাথায় যে এটিএম টা আছে ওখানে বিজ্ঞাপন দেখে আমি ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করি।ওরা আমায় নৈশ প্রহরী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দেখবে দাঁড়াও বলে দরজার পেছনে ঝোলানো ব্যাগ থেকে আই কার্ড বের করে হাতে দিলো শর্মিলার ।আক্সিস ব্যাঙ্ক লেখা নিরাপত্তা রক্ষীর অস্থায়ী জব লেখা একটা আই কার্ড সঙ্গে জীবনে হার না মানা হাসি মুখের ছবি “প্রমথ গাঙ্গুলী”। প্রমথ তখনো বলে চলেছে ,”ডিউটি টাইম রাত বারোটা থেকে সাড়ে পাঁচটা”।শর্মিলার চোখ থেকে বাঁধ না মানা জল ঝরে পড়লো।”কাঁদে না শর্মিলা, আমরা যদি কাঁদি আমাদের সন্তানরা কিভাবে ভরসা পাবে বলো!
-
কবিতা- এ তুমি অন্য তুমি
এ তুমি অন্য তুমি
-রাণা চ্যাটার্জীক্ষত বিক্ষত হয়েছি বহুবার…
কাঠের পাটাতনে গাঁথা পেরেক খোঁচা শব্দ বাণ
সময়ে অসময়ে ফালা ফালা করেও ভ্রুক্ষেপহীন তোমার সন্তুষ্টি আনতে পারে নি।কখনো হয়তো সামান্য উপলব্ধিটুকুই আসে না তোমার ব্যবহার,
শব্দ ঔদ্ধত্য অন্যের মনে ঠিক কতখানি মানসিক যন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!
খারাপ আচরণ অনেকটা বল্লমের মতো
অথবা ধনুক থেকে ধাবমান তীক্ষ্ম তীর…..
চামড়ার ঠোঁট থেকে বেরুনো কটু শব্দ একবার
বেরুলে তীরের মতোই সস্থানে ফেরানো যায় না।
ততক্ষণে তা অন্যদের মনে বিক্রিয়া, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া করে তছনছ তাণ্ডব।ওদিকে কারুর সাতে পাঁচে থাকি না ভাবনায় নিরালায় গিটারে তোলো মন উদাসী জল তরঙ্গ।
ক্রমশ দুর থেকে দূরে অলোক বর্ষ দূরে ছুঁড়ে কাছের মানুষগুলো এক এক করে যায় সরে….তবু শুধরাবে না পণ করে সময় পেলে শান দাও অন্যের দোষ খুঁজে বের করা তীক্ষ্ম শব্দ জনক।
-
কবিতা- না রাখা কথারা
না রাখা কথারা
-রানা চ্যাটার্জীকথা ছিলো কথা থাকে তবু কথারা পথ হারায়,
না বলা কথার ভিড়ে, চঞ্চল অস্থিরে।
শুধু মন হরণকারী কথা, শব্দ কোলাজ ঢেউ,
তবু হারিয়ে যায় কথা রাখা,খবর নেয় না কেউ!জলবিহীন শুষ্কতা সাক্ষী রেখে দিশাহীন নদী হয়ে,
বিলীনতার পথে আচমকা অস্তিত্ব বিলোপ!বৃষ্টি ভেজা যে পথে হাত ধরে হেঁটেছিল
ভালোবাসার আতর মাখা কপোত কপোতী,
কথা ছিল,বসত গড়ার স্বপ্ন সন্ধানী চোখ…
তবু অদৃশ্য কোনো নাগপাশে, কৌতূহলী ষড়যন্ত্রের
কুহেলীকায় আচ্ছন্ন কথারা স্তব্ধ গোলকধাঁধায়!প্রতিশ্রুতির ওপর ওড়েনি বিজয় পতাকা,
তবু কান পেতে শোনো কথা ছিল, কাছে থাকার,
পাশে রাখার সুখ দুঃখের ঘাত প্রতিঘাতে।পারে ক’জনা কথা দিয়ে তা বজায় রাখার মতো মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে চলতে, ফলপ্রসু করতে!
কথা দেওয়া আর সত্যিকার কথা রাখার
যোজন ফাঁকে যদি হারিয়ে যায় কথারা,
পড়ে থাকে কথা খেলাপী এড়িয়ে যাওয়া
বিশ্বাসঘাতকদের ভরসাহীন মুখাবয়ব কঙ্কাল!এভাবেই কথার পিঠে কথারা চেপে ভাসমান
ধাবমান মেঘ হয়ে পাড়ি দেয় কথা রাখা
না রাখার চির অভ্যস্ত স্রোতে, চঞ্চল ঠোঁটে! -
কবিতা- নিশিগন্ধা
নিশিগন্ধা
– রাণা চ্যাটার্জীতোমার ও আমার বন্ধুত্বে মধুর বিস্ফোরণ
পাশাপাশি-ঘেঁষাঘেঁষি কত আলো বিচ্ছুরণ!
মোবাইলে নিশাচর রাত জাগে,গুনগুন গীত,
আপনজনের স্বরূপ আয়নায় ফোটে কুৎসিত!জানি এটা বলে লোকে ফিসফাস কতকিছু ,
পরোয়া করি না ওসব, কথাদের ফেউ পিছু!
নিশিরাত বাঁকা চাঁদ ওঠে মনেরও ক্যানভাসে
প্রেম প্রীতি ভালোবাসা এভাবে হঠাৎ আসে।আকাশেতে চাঁদ ওঠে ভরায় জোছনায় মন
ভালবাসার নেশা জাগায় তুমুল আলোড়ন।
এই নিয়ে বসবাস উৎকণ্ঠারা আসে একরাশ
চুপচাপ কেউ আঁচ করে এই বুঝি সর্বনাশ!কার কি যায় আসে হৃদয় যদি প্রেমে ভাসে
মান অভিমান রাগ বলে কয়ে কি আর আসে!
এই ভাবে পথ চলা প্রাণ ভোমরা প্রিয় জুটিতে,
নতুন ভোর, জোর খবর নিশিগন্ধার খুনসুটিতে। -
কবিতা- প্রথম আলো
প্রথম আলো
-রানা চ্যাটার্জীআমি নারী, সৃষ্টিশীলতার প্রতীক..
সূর্যের প্রথম আলোয় উদ্ভাসিত স্বপ্ন সন্ধানী স্বত্তা।
যে হলকর্ষণে আমার উর্বর মৃত্তিকায়,
অঙ্কুরোদগমে শিশু কিশলয় মাথা তোলে,
তা শুধু পালন করি না, রক্ষা করি এ জগৎ সংসার।
আজন্মকাল হতে ভরসার পুরুষের বেঁধে দেওয়া
ঠুলি চোখে ধরি স্নেহ, মায়া, বন্ধন সমতা দাঁড়িপাল্লা।সূর্যালোকে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল আমি
কখনো বিশুদ্ধ প্রেম ভালোবাসার বন্ধনে
আবেগের বিচ্ছুরণে হই প্রেমিকের শ্রেষ্ঠ উপমা।
স্বপ্নচারিনী আমিটা কখন যে অজান্তে একবুক প্রত্যাশায় ভালোবাসার সমুদ্রে অবগাহনে মাতি
প্রেমিকের বাহুবন্ধনে মমতাজ হয়ে ওঠা সুখচরে।
সেরা ঝলমলে প্রাণ চঞ্চল প্রজাপতি,সেরা ফুলে
হঠাৎ কম্পন, দোষারোপের ঝড়ো হাওয়া।নিমেষে গুঁড়িয়ে যাওয়া ধেয়ে আসা অকল্পনীয় নিষ্ঠুর বাক্যবান তকমায় তছনছ দিশেহারা আমি..
এমন তো চাইনি, আলোর দিশায় চেয়েছি তাজা ফুল হয়ে ফুটতে, পূর্ণিমার নিটোল চাঁদ হতে,
কিন্তু ব্যবহার ও ভোগ্য পণ্যের পর ধেয়ে এসেছে
কলঙ্কের ক্ষতবিক্ষত খোঁচা!সম্ভোগ উপাচারের সকল কিছু মজুত থেকেও অভিযোগের বল্লম খোঁচায় কর্তৃত্বের হাত বদল
প্রথম পুরুষ প্রেমিক থেকে দ্বিতীয় পুরুষে! ক্ষমতার হস্তান্তরে দুমড়ে-মুচড়ে পদদলিত করার অদম্য প্রচেষ্টায় তবুও নারী স্বত্তাকে অঙ্গুলি হেলন।সমাজ-সংসার মায়াজালে স্রোতস্বিনী নদীরূপ নারী আমি আজও বহমান আপন মূল্যায়নে।
নিজ সম্ভ্রমকারী স্বত্তায় স্বকীয় মহিমায় পথ খুঁজি উপমা কলঙ্কের নুড়িপাথর জর্জরিত হয়েও,
এভাবেই যুগ যুগ ধরে প্রাণ পায় মানবী স্বত্তা।নারী যত তুমি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবে দায়িত্ব,
শান্তি সৃষ্টি শীলতায় সমাজ সুখ সংসার,
বারে বারে দোষারোপ আছড়েও কাছে পাওয়ার অদম্য আকাঙ্খায় প্রথম-দ্বিতীয় তৃতীয় এভাবেই
হাতবদলে সামিল পুরুষের আরোপিত কন্ঠ। -
কবিতা- শেকল মুক্তি
শেকল মুক্তি
-রাণা চ্যাটার্জীঅবাধ্য শব্দের সাথে “শেকল” মানান সই
তবুও তোমার অনুগত সুজনকে বেড়ি পড়ানোর চেষ্টায় অহেতুক বিড়ম্বনা জেনেও
আঁকড়াও কেন সে অস্থির পথ!বুঝেও না বুঝতে চাওয়ার জেদ,
আখেরে সম্পর্কে ফাটল ধরানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট।দুশ্চিন্তা তো আসবেই টালমাটালে পরিস্থিতিতে,
তাবলে স্থিতাবস্থায়”এই বুঝি ক্ষয়, কি হয় কি হয়!
অহেতুক চিন্তা আনে এক প্রকার ভালো থাকতে,
ভালো রাখতে না পারার মতিভ্রম।সব জেনেও পরিস্থিতি যখন আয়ত্বের বাইরে,
মান অভিমান ঘর্ষণে-বর্ষণে অনেকটা পথ চলা,তখন উপলব্ধিতে আসে শুদ্ধ বন্ধুত্ব অনেক
দামি, তাকে খবরদারিতে নষ্ট করা বোকামি।দূর হোক সন্দেহ নামক চড়া প্রলেপ আস্তরণ,
প্রখর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যখন অতন্দ্র পাহারায়,
অযথা চিন্তায় ভালো বন্ধুকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের
নিচে পরীক্ষা, বিশ্বাসের শিকড়ে কুঠারাঘাত।উপলব্ধিতে আসা বাঞ্ছনীয়
স্বাধীন প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু স্বত্তা, আপনজগৎ,
দায়-দায়িত্ব পরিচিতির স্বাভাবিক বাধ্যবাধকতা।ছিঁড়ে যাক অস্বস্তিকর শেকল পরিশুদ্ধ বন্ধুত্বের
গভীর গোপন রসায়নে,সন্দেহের ল্যাকটিক
অ্যাসিডে নষ্ট না হোক পবিত্র প্রেম। -
কবিতা- তুমি সবই জানো পুরুষ
তুমি সবই জানো পুরুষ
-রানা চ্যাটার্জী
হে পুরুষ,হে মনুষ্য কূলশ্রেষ্ঠ
নারী পুরুষের সমতার বাণী প্রচারক,
পুরুষ তন্ত্রের দম্ভের যাদুদন্ড হাতে সমাজের আজন্ম কাল হতে চলে আসা নিয়ম নীতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত দগ্ধ নারীদের গোপন
আখ্যান যদি তুমি জানতে!যদি জানতে কখনো কালাহান্ডির রুক্ষ গ্রামের পায়ে বেড়ি পড়া মহিলাদের দশ ক্রোশ পথ হেঁটে, পাথুরে খাদান থেকে প্রাণ হাতে মাত্র দু ঘড়া জল পরিবারের জন্য বয়ে আনার কি অসহনীয় ক্লান্তি।
জানার চেষ্টা করতে যদি বৃদ্ধ কামুক শ্বশুরের যৌন অত্যাচারে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া অতিষ্ঠ অষ্টাদশী বৌমার ,ভিন রাজ্যে কাজ করতে
যাওয়া স্বামীর প্রতীক্ষার গভীরতা।যদি জানতে চাইতে কোলিয়ারীতে কাজ পাইয়ে দেবার অন্যতম শর্ত হিসাবে আদিবাসী মেয়ের
মাসের পর মাস ধর্ষিতা হবার মানসিক গ্লানি।পুরুষ জানতে কি পারো বেশ্যালয়ে স্ফূর্তি করে আসা লম্পট স্বামীর চরিত্রহীনতার জন্য কটাক্ষ যখন রাস্তায় বেরুনো তার পতিব্রতা একনিষ্ঠ সহধর্মিনীর ওপর আছড়ে পড়ে সে তীব্রতা কতটা
এফোঁড় ওফোঁড় করে রক্তক্ষরণ ঝরায়?স্রেফ মেয়ে হবার অপরাধে বৃহৎ সংসারে এক সাথে বড়ো হয়ে ওঠা স্বত্বেও ভাই বোনের খাদ্য
তালিকার ফারাক,নিম্নমান হবার কুরুচি
মানসিকতার উৎস কোথা থেকে আসে,
কূলশ্রেষ্ঠ পুরুষ যদি একটু দৃষ্টি দিতে!তবু সব জানো তুমি পুরুষ…
অনিয়মের প্রতিটি রন্ধ্র, নিয়ম নীতির স্যাঁতস্যাঁতে
চোরাপথে প্রতিনিয়ত দোমড়ানো মোচড়ানো নারী স্বত্তা।সব জানো তবু ঠুলি পড়া চোখে,চুপ করে দেখো
অফিসে বসের লোভাতুর চোখ,
ভিড় বাসে ছুঁক ছুঁক নারী শরীর ছুঁতে আসা জোঁক,
ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারা নপুংসক দলের ভণ্ডামি,খালাসি কন্ডাক্টরের স্পর্শ সুখের কামনা।তবু সমতার প্রশ্নে পিঠ চাপড়ে বলো,
সাবাস সভ্যতা,সাবাস অগ্রগতি,যথার্থ ভারসাম্যতা।সত্যিই পুরুষ তুমি সব জানো,কখন চলতে হয়,থামতে কখন কড়া বেত্রাঘাতে প্রয়োজন অনুসারে সমাজ শুদ্ধিকরণের শান্তিজল কমুন্ডুল।
-
অণুগল্প- এসো মা লক্ষ্মী
এসো মা লক্ষ্মী
– রাণা চ্যাটার্জী“আহ্ রথীন, এই তো ঠেকে এলি, আরেকটু আড্ডা দেই, বোস।”
‘নারে ভাই, উঠি-ভর সন্ধ্যায় পোয়াতি বউমা একা ঘরে আছে। সন্ধ্যা দেবো, সময়ে একটু ঔষধ, টিফিন যদি না দেই অসুস্থ বৌমাকে এই বুড়ো বয়সে পাপ হবে ভাই’ বলে উঠে দাঁড়ালো তাদের বন্ধু রথীন।
রঞ্জন বললো, ‘কিন্তু বন্ধু রে তোরও তো বয়স বাড়ছে এতো চাপ নিস না রে।’
‘না না চাপ নয়, একটু শরীর চালনা আখেরে আমারই লাভ তাছাড়া ছেলেটা হাড়ভাঙা খাটুনি সেরে ফেরে সেই রাত এগারোটা। যতদিন পারি সংসারটাকে ঢাল হয়ে না হয় রক্ষা করি” বলে পরিতৃপ্তির হাসি হাসলো সত্তর ঊর্ধ বৃদ্ধ তাদের শুভাকাঙ্খী বন্ধু।
বাল্যবন্ধু প্রভাত বললো, “তুই নমস্য রে, গিন্নি মারা গেলো এক বছরও হয়নি। এতখানি মনের জোরে যেভাবে সংসার বুকে আগলে, বৌমার খেয়াল রাখিস, প্রণাম তোকে।”
চার পাঁচ জন বয়স্ক বন্ধু শীত হোক কি গ্রীষ্ম বা বর্ষা রেল পাড়ের এই বট তলায় চা দোকানের লাগোয়া বেদীটায় বসে ঘন্টা খানেক নানা আড্ডা গল্প গুজবে জীবনে বেঁচে থাকার রসদটুকু সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরে। এই চেনা ছবির খুব একটা অদলবদল হয়নি বিগত পঞ্চাশ বছরেও।লকডাউন তাদের মুষড়ে দিলেও পরস্পরকে তারা ফোনে যোগাযোগ রাখতো। প্রায়শই শোনা যায় একাকিত্ব ঘর বন্দি জীবন বাড়ির অনেক পৌঢ় সদস্য-সদস্যাদের প্রাণ কেড়েছে তবু এনাদের বাঁচার ইচ্ছেটা অনেকখানি বাড়িয়েছে সুস্থ বন্ধুত্ব।’
‘আমার নাতনি হয়েছে’-উচ্ছাসে সবাইকে ফোনে জানিয়েছে রথীন। খুশিতে বলেই চলেছে ‘জানিস, বাচ্চাটার একদম গিন্নির মুখ বসানো’।
চার প্রৌঢ় বন্ধু খুশিতে আজ রথীনের বাড়িতে নাতনি দেখতে হাজির। বহুদিন পর বৈকালিক আড্ডায় তারা বন্ধুর খুশির খবরে উৎফুল্ল।সকলকে দেখে খুশিতে ডগমগ রথীন, ‘দেখ দেখ আমার ঘর আলো করে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মীমা এসেছে।’