-
সম্প্রীতি
সম্প্রীতি
-রেহানা দেবনাথবলে গেছেন জ্ঞানী গুণী লোকজন
ঈশ্বর আল্লাহ গড সবই একজন।
কেউ বলে জল,কেউ ওয়াটার কেউবা পানি
ডাক আলাদা হলেও জিনিস এক সবাই জানি।
পৃথিবীতে সবাই আসি একই ভাবে
মৃত্যুর সময় সবাই যাইও সেইভাবে
আলাদা হয় দেহ বিনষ্ট করার পদ্ধতি
তার কারণ আমাদের তৈরী ধর্মীয় রীতি!
সবকিছুর মূলে আছে মানুষের হাত
ভাঙাগড়া সমাজ ধর্ম কি জাতপাত!আমরা শুধু নই হিন্দু মুসলিম শিখ কি ইসাই
সবার আগে মনে রাখতে হবে আমরা মানুষ সবাই।
সবার শরীরে বহমান রক্তের এক রং লাল
ধর্ম জাতপাত ভাষা দিয়ে মনুষত্বকে করি আড়াল।
জনগন এক হলে নজর রাখবে দেশের উন্নয়ন
তাদের মাতিয়ে রাখতে বিভেদনীতি চালায় নেতাগন।
মারামারি খুনোখুনি দাঙ্গার সময় ভুলে যাই
এক সাথে বেড়ে ওঠা আমরা সব বোন ভাই!
আমরা সবাই সব কিছু জানি
তবুও অন্ধের মত অমানুষদের কথা শুনি!
হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি ভুলে
এস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলি। -
মৃত্যু
মৃত্যু
-রেহানা দেবনাথতুমি মোর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিলে
অনাগত হয়ে সময়ে অসময়ে বারংবার
অবুঝের মত মুখ লুকিয়ে ছিলাম প্রতিবার
আমার অনীহায় বাধ্য হয়ে ফিরে গিয়েছিলে!ভয়ার্ত চোখ খুলে যখন ধীরে ধীরে দেখেছি
তোমার অস্তিত্ব আর নেই কোনোখানে!
নতুন করে বাঁচার আনন্দে উচ্ছসিত হয়েছি
ভেবেছি এবারেও বেঁচে গেলাম প্রাণে!তুমি উপহাস করে অট্টহাসি হেসেছিলে
আমার মত ভোগ পিপাসুর কৃতকর্মের জন্য!
হয়তো ত্যাগের পরীক্ষা নিতে তুমি এসেছিলে
দম্ভের নেশায় ভুলে ছিলাম আমি অতি নগণ্য।জীবন সায়াহ্নে নশ্বর দেহ যখন জরাগ্রস্থ
প্রতিক্ষণে আজ বন্ধু তোমাকে স্মরণ করি!
শুধরে নিতে চাই ভুল যা করেছিলাম মস্ত
এসো মৃত্যু আলিঙ্গন কর! চির শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি। -
শাস্তি
শাস্তি
-রেহানা দেবনাথরায়ান সানার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সিটি হাসপাতালে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে আই.সি.ইউ. তে সানার চিকিৎসা চলছে। রায়ান এর দুচোখে জল চলে আসে সত্যিই তো সে চায়নি, সানাকে শাস্তি দিতে বা সে মারা যাক! সে শুধু সানার বাবাকে শাস্তি দেবার জন্য ঘটনাটি ঘটিয়ে ছিল। সে তো ভেবেই ছিল কয়েকদিন পর সব সত্য জানিয়ে দেবে কারণ সে সানাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে। হঠাৎ জামার কলারে টান পড়তেই রায়ান সম্বিৎ ফিরে পায়! দেখে সানার বাবা ওর জামার কলার ধরে টানতে টানতে হাসপাতালের বাইরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে “হারামজাদা তোর এত বড় সাহস আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলে আবার তাকে দেখতে এসেছিস! আজ তোকেও শেষ করে দেব।” রায়ান এক ঝটকায় কলার ছাড়িয়ে নেয় আর তার ঝটকার চোটে টাল সামলাতে না পেরে সানার বাবা মাটিতে পড়ে যায়।চেঁচামেচির আওয়াজে অন্য রোগীদের বাড়ির লোকজনদের সাথে সাথে হসপিটালের লোকজনও এসে পড়ে। ততক্ষণে রায়ান হসপিটালের বাইরের দিকে চলে এসেছে। পিছনে লোকজনের জোরে চিৎকারে যেই সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অমনি একটা রড তার মাথায় পড়লো আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়লো। রায়ান প্রচন্ড যন্ত্রনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো, কিছু বোঝার আগেই! রায়ান এর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা অনুভব করলো আর দেখলো তাকে ঘিরে দুজন ডাক্তার ও একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে।তারপর ক্ষণেই দু’জন পুলিশ দরজা ঠেলে ঢুকেই ডাক্তারদের উদ্যেশ্যে বললো”ওনার জবানবন্দি নেব।” একজন ডাক্তার বললো “পেশেন্টকে জোর জবরদস্তি করবেন না।এখন বিপদ কাটেনি।মাথার এম.আর.আই. এর রিপোর্ট এলে সব বোঝা যাবে।” না! না! আপনি চিন্তা করবেন না কিছু কথা বলেই ছেড়ে দেব।” পুলিশ অফিসার রায়ানের নাম, বাপের নাম, বাড়ির ঠিকানা সমস্ত লিখে নিয়ে সানার বাবার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক আর কেনই বা তাকে মারার চেষ্টা করেছে সেই বিষয়ে জানতে চাইলো আর সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলো যে উনি এখন লকাপে আছে। রায়ানের মাথার যন্ত্রণাটা আরো বেড়ে গেল পুরানো ঘটনাগুলোর কথা মনে করাতে। সে “আহ!আর পারছি না” বলে চিৎকার করে ওঠে। ওর চিৎকার শুনে ডাক্তারবাবু ইন্সপেক্টরকে বলে “আজ এই পর্যন্ত থাক, রোগীর অবস্থা খুব ভালো ঠেকছে না আপনার ওর বাড়ির লোকদের আনার ব্যবস্থা করুন।” ইন্সপেক্টর আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। নার্স ঘুমের ইনজেকশন দিতে রায়ান ঘুমিয়ে পড়ে। রায়ানের ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখলো কাঁচের দরজার বাইরে বাবা মা দাঁড়িয়ে তার দিকে করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। নার্স বাইরে গিয়ে বাবা মাকে ডেকে দিলো। ওর মা কাঁদতে কাঁদতে রায়ানের কাছে এসে বলল “এইসব কি করে হলো? আর ওই লোকটাই বা তোকে কেন খুন করতে চাইলো? সব কথা আমাদের বল বাবা। তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি নিয়ে বেঁচে থাকতাম!সোহমকে হারিয়ে তোকে আঁকড়ে ধরে আমরা বেঁচে আছি বাবা!” রায়ান একটা হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয়া।” ওই লোকটাকে আমি জেলে পচিয়ে মারবো।” রাগতস্বরে রায়ানের বাবা কথাটা বলে। রায়ান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে “ওনাকে যে শাস্তি দেবার তা আমি দিয়ে দিয়েছি! দাদাকে কষ্ট পেতে দেখে আর ওর হারিয়ে যাওয়ায় আমরা যে কষ্ট পাচ্ছি,সেই কষ্ট এখন উনি ভোগ করছেন!”
” তার মানে কি!” ওর বাবা বিস্ময়ের সুরে বলে। রায়ান উত্তেজিতভাবে বলে “তোমাদের হয়তো মনে আছে! পাঁচ বছর আগে দাদা যখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে তখন পাখি আর দাদার বন্ধুত্ব হয় ও পরে প্রেমে পরিণতি পায়। আমাকে যেবার দাদা কলকাতায় নিয়ে এসেছিল সেবার পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ওদের বাড়িও দেখায়। বিশাল জায়গা নিয়ে দোতলা বাড়ি। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে এত বড়লোকের মেয়েকে দাদার মতো গ্রামের সামান্য স্কুল শিক্ষকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে তো! আমার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল! এম.এ. কমপ্লিট করার পর পাখির বাবা পাখির বিয়ের ব্যবস্থা করে। পাখি সব কিছু জানালে প্রথমে উনি পাখি আর দাদার সম্পর্কটা মেনে নেন নি পরে দাদাকে ডেকে শর্ত দেয় মা বাবাকে ছেড়ে ঘর জামাই থাকতে হবে! দাদা ওনার প্রস্তাবে রাজি হয় নি ঠিকই কিন্তু পাখিকেও ভুলতে পারছিল না। দাদা আমাকে সমস্ত বিষয় জানিয়েছিল। এই টেনশনেই হয়তো দাদা অন্যমনস্ক হয়েছিল আর তাতেই রেল লাইন পার হবার সময় ট্রেনে দুর্ঘটনাটা ঘটে যায়। দাদার মৃত্যুর খবর দেবার জন্য পাখিদের বাড়ী গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের কাছে জানতে পারি যে ওরা দিল্লী গেছে সেখানে পাখির বিয়ে। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এর প্রতিশোধ আমি নেব। এরপর আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করে ইচ্ছে করেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই কারণ, খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম পাখির বোন সানা সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ে। তারপর থেকে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী ওকে আমার প্রেমের জালে ফাঁসাই! তারপর ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে আমি মেদিনীপুরের একজন বড়লোকের একমাত্র ছেলে তা বিশ্বাস করাতে পারি আমার এক বন্ধুর নাম আর আমার নাম এক হওয়ার জন্য। এরপর উনি সমস্ত আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আমাকে হবু জামাই বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এর ঠিক পরেই আমি মোক্ষম চাল চালি! বাড়ী থেকে গিয়ে সানাকে বলি যে আমার বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে পরের মাসে, আমার আর তার সম্পর্ক মেনে নেয় নি, আমি ওকে বিয়ে করার জন্য সব ছেড়ে দিয়েছি। ওর বাবা বলে যে একবার বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে তাই উনি নিজেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন!শহরের নামী দামী লোকেদের নেমন্তন্ন করেন। বিয়ের দিন যখন সব আয়োজন শেষ লোকজনের সমাগম হয়েছে ঠিক সেই সময় আমি সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি চলে আসি! অভিনয় করতে করতে সানাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলি তাই দু’দিন পরে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে,জানতে পারি সেদিনকার ঘটনায় সানা খুব আঘাত পায় ও মাথা ঘুরে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। সেই কারণে হসপিটালে ভর্তি আছে। তখন আর না থাকতে পেরে দেখতে চলে আসি আর তখনই ওর বাবা আমায় দেখে ফেলে চিৎকার করতে থাকে আমি বেরিয়ে আসি। তারপর কি ঘটলো কিছুই বুঝতে পারলাম না! ওর বাবা মা হাঁ করে ওর কথাগুলো শুনছিলো!” তুই এত কিছু করে ফেললি আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না! তুই একটা লোককে শাস্তি দিতে গিয়ে একটা নিষ্পাপ মেয়েকেও শাস্তি দিলি!আক্ষেপের সুরে ওর মা বলে ওঠে।”
“প্রতিশোধের আগুন সবকিছু জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়,এটা কি তুই কেন বুঝলি না বাবা” ওর বাবা বলতে থাকে এমন সময় ডাক্তার রুমে ঢুকে বললেন “আপনারা কাউন্টারে গিয়ে ফর্মালিটি পেপারগুলো সাইন করে দিন আধঘন্টা পর ওনার মাথার অপারেশন হবে।” রায়ান প্রশ্ন করে “ম্যাডাম অপারেশন সাকসেসফুল হবার চান্স কত পার্সেন্ট?” ডাক্তার বলে আমরা তো আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো, এরপর সব ঈশ্বরের ইচ্ছা!” রায়ান মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলে “মা সানা এই হসপিটালেই ভর্তি আছে। ওর সাথে একবার দেখা করে বলে দিও আমি ওকে ঠকাতে চাইনি।ভেবেছিলাম পরে ওকে সব সত্যি জানিয়ে দেব! জানিনা আর ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া হবে কিনা!” ওর মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রায়ান অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে দেখে বাবা মা এর সাথে সানা দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান সানার দিকে তাকিয়ে বলে “আমাকে ক্ষমা করে দিও!” সানা কাঁদতে কাঁদতে রায়ানের হাতটা ধরে বলে “আমি তোমার মায়ের কাছ থেকে সব ঘটনা জানতে পেরেছি।আমার বাবা তার ভুলের শাস্তি অনেক আগে থেকেই পাচ্ছে পাখি বিয়ের পর থেকে আর কোনোদিন আমাদের বাড়ি আসেনি এমন কি যোগাযোগ রাখেনি!এমকনকি বাবাকে বলে দিয়েছে যেদিন বাবা ওর বাড়িতে পা দেবে সেইদিন ই ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে! বাবা খবর নিয়ে জানতে পেরেছে ওর স্বামী খুব অত্যাচার করে তবুও ও ওখানেই পড়ে আছে শুধুমাত্র বাবাকে কষ্ট দেবার জন্য!” এবার ছাড়ুন পেশেন্টকে ভিতরে ঢোকাতে হবে”বলে নার্স ট্রলিতে ঠেলা দেয়।হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে সানা বলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, তোমায় ফিরে আসতে হবে। এবার ছেড়ে চলে গেলে আর কোনোদিনও ক্ষমা করবো না।” অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে রায়ানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় যে সে ফিরে আসবে।
-
সেরা উপহার
সেরা উপহার
-রেহানা দেবনাথ-“একই পাড়াতে বিয়ে হওয়ার জন্য দুজনে একটা গাড়ি বুক করে বাপের বাড়ি যেতে কত সুবিধা হয় বলতো দিদি,তা ছাড়া নিশ্চিন্তে দুই বোনে গল্প করতে করতেও যাওয়া যায়।” দেবযানী তার দিদি দেবললীনাকে গদগদ গলায় বলে।
-দেবলীনা মুখটা একটু বিকৃত করে বলে “সুবিধা না ছাই! ছোট একটা ট্যাক্সিতে ছয়টা বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আটজনে এক ঘন্টা এক সাথে যাওয়া কত যন্ত্রণার।”
-“সে কষ্টের হোক তবুও তো আনন্দ আছে, তা ছাড়া বড়দা আর মেজদা মিলে গাড়ির খরচটা দেয়, এর থেকে আর বেশি কি আশা করবো। বাস,ট্রেনে লোকের ধাক্কা খাওয়ার থেকে এটা তো ভালো!” উৎফুল্ল হয়ে দেবযানী বলে।
দেবলীনা রাগতস্বরে বলে-“তুই তো বলবিই! দাদাদের আদরের ছোটো বোন, তাদের চামচা!”
-“দেখ দিদি ভাইফোঁটার দিনে আর ঝগড়া করিস না! যদিও তোর স্বভাব আছে, প্রতি বছর গিফট নিয়ে যা রাগারাগি করিস” কঠোরভাবে বলে দেবযানী।
দেবলীনা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলে- “কেন ঝগড়া করবো না! বড়দা,মেজদা, সেজদা তবুও তো দামী দামী উপহার দেয়, আর ছোড়দা পঞ্চাশ কিংবা একশ টাকা হাতে ধরিয়ে দেয় প্রতিবছর। আগে ছেড়ে দিতাম, এখন ছাড়বো কেন! নিজের বউ শালা শালীদের নিশ্চয় দামী জিনিস দেয়। আমাদের বেলায় যত গরীবিপনা।”
-“দুই দাদার চেয়ে ছোটদা সত্যিই তো গরীব। তার উপর নতুন সংসার করেছে, ওর কথাও তো আমাদের ভাবতে হবে!’ কাতর সুরে বলে দেবযানী।
কিছুক্ষণ পর দেবলীনা বলে “বোনরে আমার কোমরের থেকে পা দুটো প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে।”
-এই ব্যথাটার কথা তো তুই আগের বছর থেকেই বলছিস! ডাক্তার দেখাস নি?” প্রশ্ন করে দেবযানী।
দেবলীনা দুই হাত দিয়ে কোমরটা চেপে ধরে বলে “না।ব্যথার ওষুধ খেয়ে কমে যায়। ভেবে ছিলাম পুজোর পর যাবো।”
দেবযানী দিদির পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে “আর একটু ধৈর্য্য ধর দিদি মিনিট দশেকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবো তখন পাড়ার গোপী ডাক্তার বাবুকে একবার দেখিয়ে নিবি।” গাড়ি বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেবলীনার ব্যাথা প্রচণ্ড বেড়ে যায়!যন্ত্রণার চোটে সে বাবারে মারে বলে কাতরাতে থাকে।দাদারা বোনের ওই অবস্থা দেখে কাছাকাছি নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা চলে। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যায়।তার ভিত্তিতেই ডাক্তারবাবু দেবলীনার বড়দাকে জানায় যে দেবলীনার দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিডনির ব্যবস্থা করা নয়তো রোগীকে বাঁচানো যাবে না। দেবলীনা কিছুই জানতে পারলো না সে শুধু জানলো যে রাতে তার অপারেশন হবে। তাই সে তার মাকে বলল “মা আমি দাদাদের এখানেই ফোঁটা দিতে চাই! যদি আর কোনোদিন দেবার সুযোগ না পাই।” বলতে বলতে দেবলীনা ও তার মা দুজনেই কাঁদতে থাকে। বিকেলে নার্সিং হোমে দুই বোনে মিলে দাদাদের ফোঁটা দিল। দুই দাদা যথারীতি দামী দামী উপহার দিলো, ছোটো দাদা এবার কিছুই দিলো না!
দেবলিনাও কিছু বললো না শুধু বললো “এটা হয়তো শেষ ফোঁটা হতে পারে! তাতেও ফাঁকি দিচ্ছিস।”ওর ছোট দাদা বললো “ফাঁকি নয় এবার তোর জন্য দামি ও সেরা উপহার আমিই দেব! একটু অপেক্ষা কর”, বলে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।দেবলীনা আশ্চর্য হয়ে গেল। অপারেশন হওয়ার পর পরের দিন দুপুরে দেবলীনার জ্ঞান ফেরে। বিকেলে বাড়ির সবাই দেখতে এলে সে সবাইকে দেখতে পায় ছোটদাকে ছাড়া! দুদিন পর দেবলীনা দেবযানীকে বলে”হ্যারে বোন দু দিন ধরে ছোটদা আমায় দেখতে এলো না! কোথাও কি গেছে নাকি আমাকে ভাইফোঁটার দামী উপহার দিতে হবে বলে দেখা করছে না।”
দেবযানী অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বলে “আর কত দামী উপহার নিবি! পৃথিবীতে এমন কোনো দাদা আছে কিনা আমার জানা নেই যে ভাইফোঁটায় তার বোনকে এত দামী উপহার দিয়েছে বলে!”
দেবলীনা আশ্চর্য হয়ে বলে- “আমাকে! কখন দিয়েছে!!”
-“তোর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ছোটদা নিজের একটা কিডনি দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছে আর নিজে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে ভিতরের রক্তপাত বন্ধ না হওয়ার জন্য” কথাটা বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে দেবযানী। দেবলীনা কি বলবে কি করবে বুঝতে পারে না! সে শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমাকে একবার ছোটদার কাছে নিয়ে চল, তার সেরা উপহার পেয়ে আমি কেমন খুশিতে আছি তাকে একবার দেখিয়ে আসি!!
-
ধর্ষিত
ধর্ষিত
-রেহানা দেবনাথবাঁশি আজ কালীপূজার দিন কিছুতেই ঘর থেকে বেরোয় না। তবুও বেরোতে হলো বাবার বুকে ব্যথায় হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার দরুন টাকাও কম নিয়েছিল তাই আবার বাড়িতে ফিরে এসে টাকা নিতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়।অন্ধকারে গ্রামের শেষে মাঠের মাঝখান দিয়ে সরু মাটির রাস্তাটায় পা রাখতেই বাঁশির সারা শরীর কেঁপে উঠলো,গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো।চোখের সামনে পাঁচ বছর আগের সেই কালীপূজার রাতের বীভৎসতার ছবি ভেসে উঠলো। সেদিন বিকেলে সৌরভ ব্যাঙ্গালোর চলে যায় কাজের সূত্রে ওকে না জানিয়ে। যখন ওদের বাড়িতে গিয়ে খবরটা জানতে পারে তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে তবুও সে সব ভুলে ছুট লাগায়। অমাবস্যার সন্ধ্যায় গ্রামের বাইরের চারিদিকটা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। গ্রামের শেষে সরু মাটির রাস্তা শেষে পাকা রাস্তায় ওঠার আগেই চারটে কালো মূর্তি তার দিকে এগিয়ে এলো সে কিছু বোঝার আগেই মুখ চেপে মাঠের মাঝখানে নিয়ে গেল। একজনে টান মেরে তার শাড়ি খুলে দিল, দুজনে মিলে ঘাসের উপর শুইয়ে দিল, আরেকজন তার মুখটা যেই বাঁশির মুখের কাছে আনলো তখনই বাঁশি সজোরে পা দিয়ে একজনকে লাথি মারলো আর জয় মা কালী বলেই জোরে হ্যাঁচকা দিয়ে দুটোকে ফেলে দেয়। গ্রামের ছেলেরা যখন ক্যারাটে শিখত তখন সে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে দেখত আর বাড়িতে এসে প্রাকটিস করত সেই সুবাদেই চারটেকে কাহিল করে দেয়। কিন্তু চারমূর্তির একজন পালাবার আগে ওর মাথায় লাঠি দিয়ে সজোরে মারে। বাঁশি অজ্ঞান হবার আগে দেখে যে চারমূর্তি দৌড়ে অন্ধকারে মিশে যায়। পরেরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে দেখে বাড়িতে শুয়ে আছে।একজন ডাক্তার মাথায় ব্যান্ডেজ করছে তার পাশে দুজন পুলিশ আর প্রতিবেশীরা ভিড় করে দরজায় উঁকি দিচ্ছে! পুলিশকে যখন সব ঘটনা জানায়। এরপর গ্রামের লোকজন আত্মীয় স্বজন সবাই আসে ওর থেকে ঘটনা জানতে চায় ও সত্যি কথা বলে কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চায় না! সন্দেহের চোখে তাকায়।গ্রামে রটে গেল বাঁশী ধর্ষিত হয়েছে। তার দুদিন পর সৌরভের বাড়ি থেকে বিয়েটাও ভেঙে দিলো। বাঁশির বাবা মা জায়গা জমি বেঁচে অন্য গ্রামে চলে যাবার কথা বলে কিন্তু বাঁশিই রাজী হয় নি।সে সৌরভের অপেক্ষা করতে থাকে। তার বিশ্বাস কেউ না বুঝলেও দু’ বছর পর ফিরে এসে সৌরভ তাকে ঠিক বুঝতে পারবে! আবার তারা একসাথে মিলে নতুন সংসার করবে। যতোই হোক ছোটবেলা থেকে দুজনে একসাথে বড় হয়েছে, ভালোবেসেছে তার সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে সৌরভ এলে। গ্রামের মানুষদের সহানুভূতি, কটূক্তি, সমালোচনা, অবহেলা, বক্র দৃষ্টি সব উপেক্ষা করে সে গ্রামে থেকেই গ্রাজুয়েশন শেষ করে। তারপর গ্রামের হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে আর গ্রামের গরীব ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়ায়। বিয়ের জন্য ওর বাবা কয়েকটি পাত্র দেখে তারা পাত্রী দেখতে আসার আগেই লোকেদের মুখে সব শুনে কেটে পড়ে! শুধুমাত্র স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক নবীন তাকে বিয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাঁশি রাজী নয়! সে বাবাকে বলে দিয়েছে “আমি বিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না, সৌরভের অপেক্ষা করবো।” কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাঁশি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। হঠাৎ একটা ছায়া মূর্তিকে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ঘেমে গেল। দ্রুত গতিতে মানুষটিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরও ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার করতে লাগলো “কে? কে ওখানে? কাছে আসবে না বলছি! ছায়া মূর্তিটি উত্তর দেয় “আমি সৌরভ, ঠাকুর মশাইয়ের ছেলে। তুমি কে? গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে!!” বাঁশি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এ কার দেখা সের পেলো! যার জন্য পাঁচটি বছর হয়ে গেল অপেক্ষা করে বসে আছে সেই সৌরভের।একটা কালীপূজার দিন যাকে হারিয়ে ফেলেছিল আজ আবার সেইদিনে তাকে ফিরে পেল! সৌরভ কাছে এসে বললো “বাঁশি! তুমি বেঁচে আছো! তবে যে পাঁচ বছর আগে বাবা বলেছিলো একটা দুর্ঘটনায় তুমি মারা গেছ!তার কারণেই আমি এতদিন গ্রামে ফিরতে পারিনি।শুধুমাত্র মায়ের জোরাজুরিতে বাবার এক বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি” বাঁশির কানে যেন কোনো কথাই ঢুকলো না। সে সৌরভকে পেয়ে আগে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ধাতস্থ হয়ে বাস রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সেদিনকার সব ঘটনা বলে। সৌরভ বিস্ময়ে বলে “তুমি সত্যি কথা বলছো! সেদিন চার চারটে লোক তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি! দেখো আমার কাছে কোনো কিছু লুকিও না,আমি তোমায় এখনো ভালোবাসি তাই তোমার সব কিছু জেনে শুনেও আমার বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। জানি এই ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে হলেও আমি কিছুটা দায়ী, তার প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে।”বাঁশি অবাক হয়ে সৌরভের দিকে চেয়ে থাকে! রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোয় ওর মুখটা কেমন অচেনা লাগছে। সৌরভের চোখ দুটোতে অবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। সৌরভ অবলীলায় বলতে থাকে “আচ্ছা ওরা তোমায় কেন ধর্ষণ করতে চাইলো? তুমি কি আগে থেকেই ওদের চিনতে? তুমি কি ঘটনার পর ডাক্তার দেখিয়েছিল? এই ঘটনার জন্যই কি তোমার কোথাও বিয়ে হয় নি?” বাঁশির বুকটা ফেটে যেতে লাগলো এই মানুষটার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করছিল যে এসে তার দু’চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে তার কষ্টটা ভাগ করে নেবে! বাঁশির গলার নীচে কষ্টগুলো দলা পাকাতে থাকলো। দু’চোখে জল এসে গেল অনেক কষ্টে চেপে রেখে সৌরভকে বললো “আমি ধর্ষিত হয়েছিলাম শুধুমাত্র সেদিন নয় আরও অনেকদিন ধরে।এখনও হই প্রতিনিয়ত! এরজন্য তোমার কোনো দোষ নেই। সবই আমার ভাগ্য! আর আমাকে তোমায় দয়া করে বিয়ে করতে হবে না! আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। তোমার আমার পথ আলাদা হয়ে গেছে, সেখানে আর একসাথে চলা হবে না। আমি পাঁচ বছর আগেই তোমার কাছে মরে গিয়েছিলাম তাই আমায় মৃত ভেবে যে কাজের উদ্যেশ্যে গ্রামে ফিরেছ, সেটাই আগে করো! আর আমিও আমার উদ্যেশ্যের পথে পা বাড়াই কারণ আমি আজ থেকে মুক্ত! কথাটা বলে বাঁশি অটোয় উঠে চোখের জল মুছে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়।
-
বোধন
বোধন
-রেহানা দেবনাথপঞ্চমীর রাত চারদিকে আলোয় ঝলমল করছে। শুধু মহামায়ার ঘরে অন্ধকার একটি লণ্ঠনের আলো টিম টিম করে জ্বলছে, তারমধ্যেই চার ছেলে মেয়ে একনাগাড়ে ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছে, “ও মা আমাদের নতুন জামা কবে হবে? বাবা কবে আসবে?” মহামায়ার দু’চোখে জ্বলের ধারা সে কি করে এই বাছাগুলোকে বোঝাবে যে তার পক্ষে চার চারটে বাচ্ছার জন্য নতুন জামা কেনা অসম্ভব। মাস ছয়েক হলো স্বামী নিখোঁজ হয়ে গেছে! থানা পুলিশ, নেতাদের ধরেও তার খোঁজ পায়নি সে। সংসার চালানো দায় হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিক বিলের টাকা জমা না দিতে পারায় তাও কেটে দিয়েছে।লোকের বাড়িতে রান্না করে আর ঘরে টুকিটাকি হাতের কাজ করে তবুও অভাবের সংসারে চারটে বাচ্ছার মুখে ঠিক মত পেটভরে খাবারটুকুও দিতে পারে না। স্বামী থাকতে কোনোরকমে চলে যেত। স্বামী তার আপন ভোলা মানুষ। কোনো কাজই বেশিদিন করতে তার ভালো লাগতো না তাই মাঝে মাঝেই কাজের জায়গার সঙ্গে সঙ্গে থাকার জায়গার পরিবর্তন করতে হতো। এই ধরনের পাগলামি মহামায়া প্রথম দিকে মেনে নিলেও দুটো বাচ্চা হবার পর থেকে অশান্তি শুরু হয়। মহামায়া মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তবে অভাব ছিল না। ওর স্বামী শিবরাম ছিল উচ্চবিত্ত ঘরের একমাত্র সন্তান তাই মহামায়ার যখন তেরো বছর বয়স তখন শ্বশুর মশাই সম্বন্ধ নিয়ে এলে ওর দাদু রাজী হয়ে যায়। ওর বাবার অমত ছিল কারণ খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে ছেলের বাপের অনেক সম্পত্তি থাকলেও ছেলে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবে মন ও চরিত্রের দিক দিয়ে ভালো। সব কথা জানার পরও দাদু ঠাকুমা বলে মহামায়া আর শিবরাম নাম দুটোর মধ্যেই ওদের ঐশ্বরিক জোট আছে, তাই ওই ছেলের সঙ্গেই নাতনির বিয়ে দেবেন।একপ্রকার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ওর বাবা বিয়েতে মত দেয়। বিয়েটা ভালোভাবে হয়েও যায়। বিয়ের একবছরের মধ্যে ওর শ্বশুর মশায় মারা যায় আর সব সম্পত্তি তার দুই খুড়তুতো স্বশুরেরা নিয়ে নেয়। শিবরাম সরল সিধে মানুষ তাই কোর্ট কাছারীর ঝামেলায় না গিয়ে বউকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে চলে যায় সব ছেড়ে দিয়ে। মহামায়ার বাবা সব জানতে পেরে মেয়ে জামাইকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আর বন্ধুর ব্যবসায়ের এক দায়িত্বপূর্ণ কাজে লাগিয়ে দেয়। বছর না ঘুরতেই সেই কাজ সে ছেড়ে দিয়ে ভবঘুরের মত ঘুরতে থাকে। এই বাউন্ডুলেপনা দেখে মহামায়ার বাবা আর থাকতে না পেরে জামাইকে ছোট বড় কথা শুনিয়ে দেয় সবার সামনে যা মহামায়া ও শিবরাম দুজনেরই খারাপ লাগে। তারপর তারা সে ঘর ছেড়ে কলকাতা শহরে চলে আসে কাউকে কিছু না বলে। এইভাবে দশটা বছর পার হয়ে গেছে। মহামায়া আর বাপের বাড়ি যায় নি। শহরে এসে দিনমজুর খেটে কোনো রকমে সংসার চলে যায় ওদের। চার ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখেই ছিল হঠাৎ শিবরামের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় সব উল্টো পাল্টা হয়ে যায়। মহামায়া অথৈই জলে পড়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে বাচ্ছাগুলোর ঘ্যানঘ্যানে কান্না তার মনকে আরও বিষাদে ভরিয়ে দিচ্ছিল। দূর থেকে ভেসে আসা পুজো প্যান্ডেলের গানের আওয়াজ তার কানে তীরের মত বিধতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রনা তার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে। এমন সময় দু’টি ছায়া মূর্তি তার দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। তাদের দেখে প্রথমে মহামায়া ভয় পেয়ে যায়। বাচ্ছাগুলোও তাকে এসে জড়িয়ে ধরে। ধীরে ধীরে লন্ঠনের আলোয় মূর্তিগুলো স্পষ্ট হলে মহামায়ার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। সমস্ত অভিমান ভুলে গিয়ে বাবা বলে বৃদ্ধ মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বাচ্ছাগুলো কান্না ভুলে গেল! তারা হাঁ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। তখন পাশের যুবকটি এগিয়ে এসে ছোট মেয়েদুটিকে কোলে নিয়ে বললো “আমি তোমাদের মামা” বলে বাচ্ছাগুলোকে আদর করতে লাগলো আর সঙ্গে আনা নতুন জামা কাপড়গুলো তাদের দিয়ে পড়তে বললো। এদিকে বাবা মেয়ের কান্না ও মান অভিমানের পালা সমাপ্ত হলে, মহামায়া বললো “বাবা মাস ছয়েক হবে তোমার জামাই নিখোঁজ হয়ে গেছে”। কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ওর বাবা বললো “আমি সব জানি।” বাবার মুখে কথাটা শুনে মহামায়া আশ্চর্য হয়ে যায়! ওর বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে সব জানতে পারবি। আগে তৈরী হয়ে নে, বাড়ী ফিরে চল রাস্তায় সব বলবো। শিবরাম আমাদের বাড়িতে আছে ভালো আছে। স্বামীর খোঁজ পাওয়া গেছে জেনে আর বাচ্ছাগুলো নতুন জামা পরে নাচছে দেখে মহামায়ার আনন্দে দুচোখ জলে ভরে গেল। ট্রেনে করে আসার সময় বাবার থেকে সে জানতে পারে শিবরাম যে বাসে করে কাজের জন্য কাকদ্বীপ যাচ্ছিল সেই বাসের এ্যকসিডেন্ট হয় নামখানার কাছে।সেখানকার সরকারি হাসপাতালে মাথায় চোট নিয়ে ভর্তি ছিল শিবরাম। একজন পরিচিত লোক ওকে চিনতে পেরে, মহামায়ার বাবাকে খবর দেয়। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে যে মাথায় খুব জোরে আঘাত লাগার জন্য শিবরামের মাথার অপারেশন হয় কথা বলার শক্তি চলে যায়। তার ফলে ওদের ঠিকানাও ওর বাবা জানতে পারেনি। এতদিনের চিকিৎসার ফলে শিবরাম কথা বলার শক্তি ধীরে ধীরে ফিরে পেয়েছে আর গত কাল রাতে তাদের খোঁজ খবর ঠিকানা দিয়ে পেরেছে। শিবরামকে বাড়িতে রেখে তাদের আনার জন্য ছুটে এসেছে। মহামায়ার কাছে সব স্বপ্নের মত লাগছে।তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী, ফেলে আসা পরিবারকে এভাবে ফিরে পাবে সে ভাবতেই পারেনি। মনে মনে মা দুর্গার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো। মহামায়া তার চার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবা ও দাদার সঙ্গে যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো তখন দেখলো মা বরণের থালা নিয়ে ছুটে আসছে তার সঙ্গে চেনা অচেনা অনেক মানুষ ওদের দিকে হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে। সেই সময় চারিদিকে বোধনের বাজনা বেজে উঠলো!
-
আত্মহত্যা
আত্মহত্যা
-রেহানা দেবনাথউমা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাই নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা নানা লোকে নানা কথা বলছে। ওর স্বামী ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। কানা ঘুষো চলছে বর প্রতিবন্ধী হয়ে বসে আছে প্রায় দু বছর হলো ও রান্নার কাজ করছে কলকাতায় গিয়ে। ওর প্রতিবেশী মহিমা বলে কত টাকা আর আয় হত যে দু’ ছেলেমেয়ের লেখা পড়ার খরচ, স্বামীর চিকিৎসা, সংসার খরচ হেসে খেলে চালাতো! আমাদের স্বামীরা কত বেশি টাকা আয় করে তাতেই সংসারে টানাটানি চলে! দেখ কোনো নাগর জুটিয়ে ছিল নাকি! রূপটা তো খারাপ ছিল না, ভ্রুকুটি কেটে রশিদা বলে। আহা বেচারা অসিত! ওর আর বাচ্ছা দুটোর কি হবে? সহানুভূতির সাথে শান্তি কাকিমা বলে। আমিনা ভাবি বলে কেন সবাই মিলে দেখে একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই হলো, সংসারটা চলে যাবে। রিটা বলে এক পা কাটা আয় করতে পারে না, এমন ছেলেকে কে বিয়ে করবে? হেমা আগ বাড়িয়ে বলে কেন আমার বোনের শ্বশুর বাড়ির ওখানে একটি মেয়ে আছে দেখতে ভালো গায়ের রঙটা একটু শ্যামবর্ণা, খুব গরীব, আমি বললে রাজি হয়ে যাবে।
বিজয় বলে সবাই জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে!শশ্মান যাত্রা শুরু করতে এবার আসিতদাকে বাইরে আনার চেষ্টা করো। নিশিকান্ত বলে বউ মরে গেছে তাই বলে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘরে ঢুকে শোক পালন করলে হবে! পুরুষ মানুষ একটা বউ মারা গেছে আরেকটি হবে। ধর্মদাস বলে ঠিক বলেছেন দাদু সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা! গাজী বলে তাও যদি বউয়ের চরিত্র ভালো হত, তাও একটা কথা ছিল! শুনে এলাম গ্রামের সবাই তো আলোচনা করছে বউটা নাকি কোনো খারাপ কাজে না কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে, না হলে কোনদিন আমাদের এলাকার বদনাম হয়ে যেত।
দড়াম দড়াম করে দরজার মেরে ও সবাই মিলে ডেকেও যখন আসিতের সাড়া পেলো না, তখন কয়েকজন মিলে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে বাঁ হাতের কাটা শিরা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ঘর ভেসে যাচ্ছে আর নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে আছে ডান হাতে উমার ছবি। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল! কিছুক্ষণের মধ্যে সবার মুখে একটা কথা ঘুরতে থাকে অসিত বউকে এত ভালোবাসত যে ওর মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি তাই সেও আত্মহত্যা করেছে! ঘন্টা খানেক পর পুলিশ এসে আসিতের লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য তুলতে তার দেহের নীচ থেকে একটা চিঠি পায়। সেই চিঠির বয়ান ছিল যে উমা বাইরে কাজ করে সংসার চালাচ্ছিল তারা সুখেই ছিল। হঠাৎ মাস ছয়েক আগে অসিতের বন্ধু মহিম ওদের বাড়িতে আসে তারপর থেকে নানা অছিলায় যাতায়াত বেড়ে যায়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে উমার ছুটির দিনে আসতে শুরু করে যা অসিতের কাছে অসহ্য লাগে কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারত না। এরপর মাস তিনেক পর থেকে উমা আর অসিতের মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। তার দিন পনের পর থেকে মহিমের আসাও কমে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে উমাও দেরী করে বাড়ি ফিরতে থাকে জিগ্যেস করলে বলেছিল এখন বেশি করে রান্না করতে হয় তাই দেরি হয়ে যায়।অসিতের মনে সন্দেহ জাগে কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছিল কারণ নিজে আয় করতে পারে না ওর বউয়ের উপার্জনের টাকায় সংসার চলে। সপ্তাহ খানেক আগে মহিম এসে জানায় যে উমা কলকাতার একটি হোটেলে দেহ ব্যবসার কাজ করছে এছাড়া ওকেও কুপ্রস্তাব দিয়েছিল তাই ও বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।অসিত প্রথমে মানতে চায়নি। পরে মহিম প্রমাণ করার জন্য পরের দিন ওকে গাড়ি করে নিয়ে যায় আর একটা মেস বাড়িতে যেখানে পুরুষদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে মোহিনী ঢুকছে দেখায়। অসিতের মাথায় রক্ত ওঠে। সে বাড়ি ফিরে রাগে, ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে আর কি করবে ভাবতে থাকে। পরে রাত করে উমা আসার আগে বাচ্ছাদের খাইয়ে দেয়, তারপর নিজে খেয়ে নিয়ে বাকি খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয় বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে। উমা প্রতিদিনের মতো বাড়ি ফিরে সব কাজ সেরে রাত একটার সময় খাবার খেয়ে শুতে যাচ্ছে তখন তার সারা শরীরে জ্বালা শুরু হয়। ছটকাতে থাকে অসিত ঘুমিয়ে থাকার ভান করে!তারপর উমা যখন জোরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখন অসিতের হুশ হয় রাগের মাথায় সে কি কান্ড ঘটিয়েছে। তখন চেঁচামেচি করতে থাকে পাশের বাড়ির লোকজনেরা ছুটে আসে ওই রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় উমাকে। দুদিন পরে জ্ঞান ফিরলে অসিতের সঙ্গে নানা কথা বলার পর জানায় যে মহিম ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল ও দেহ ব্যবসার কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিল রাজী হয়নি বলে ধমকি দিয়েছিল তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। উমা বলেছিল পারবে না কিন্তু আজ ভাগ্যের কি খেলা মৃত্যু আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কথাটা বলতে বলতে উমা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অসিত পাথরের মত বসে থাকে। কত সময় কেটে গেছে ওর হেলদোল নেই।আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী কয়েকজন মিলে হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে থাকে। এমন সময় তিনজন অল্প বয়সী ছেলে এসে উমার লাশ দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে অসিতকে জিগ্যেস করলো এটা কিভাবে হলো। গত তিন মাস ধরে দিদি আমাদের মেসে রান্না করছিল, সবাইকে খুব আদর যত্ন করতো, হাসি খুশি থাকত।আমরাও বড় দিদির মত মানতাম ও সন্মান করতাম।দুদিন মেসে না আসার কারণে দিদির ফোনে কল করে জানতে পারলাম যে উনি আত্মহত্যা করেছেন এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এখানে এসে আমরা তো অবাক হয়ে গেলাম বলতে বলতে চোখের জল মুছতে থাকে। অসিত হাঁ করে সব কথা শোনে তারপর বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে নিজের বিবেকের সঙ্গে লড়াই চালায় শেষে তার দংশনে জর্জরিত হয়ে হার স্বীকার করে নেয়।
অসিতের চিঠির বয়ান শোনার পর আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীরা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো! -
পেত্নীর আঁচড়
পেত্নীর আঁচড়
-রেহানা দেবনাথচাঁদনির আট বছরের মেয়ে সোনাই এর, পর একটি ছেলে হয়। শ্বশুর বাড়ির সবাই খুব খুশী কারণ ওদের বাড়িতে সবার মেয়ে এই প্রথম ছেলে হয়েছে। শাশুড়ি ও শ্বশুর মিলে ছেলের নাম রাখলো দীপ। সোনাইকে চাঁদনি, সৌমেন ও পরিবারের অন্য সবাই খুব ভালোবাসে। দীপ মাস ছয়েকের হবার পর থেকেই একটা বিপত্তি দেখা দিল! প্রতিদিন তার শরীরে অনেকটা লম্বা নখের আঁচড়ের দাগ দেখা গেল। বাড়ির সবাই খুব সাবধানে দীপকে কোলে নেয়। এতটা আঁচড় লাগার কোনো কারণও কেউ খুঁজে পেল না। তারপর থেকে বাচ্চাটির শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হলো না। প্রতিদিন হাতে, পায়ে, পেটে অথবা মুখে আঁচড়ের দাগ পড়তে থাকে।আত্মীয় স্বজনেরা প্রতিবেশীরা বলতে থাকে এই নিশ্চয় অশুভ আত্মার কাজ। সকলের পরামর্শে চাঁদনী ছেলেকে নিয়ে বাবা সদানন্দজীর কাছে গেলে, তিনি মন্ত্রশক্তির দ্বারা জানায় যে শাকচুন্নি পেত্নীর কান্ড। মোটা টাকার বিনিময়ে টোটকা, তাবিজ মন্ত্রপুত জল আরও কত কি দেয় কিন্তু তাতেও কিছু হয় না। পেত্নীর আঁচড়ের চিহ্ন বাড়তে থাকে। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা যে যেখানে বলেছে বাড়ির লোকেরা সেখানে ছুটেছে তবুও পেত্নীর আঁচড় থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে পারেনি। সব কিছু যখন ব্যর্থ হয়ে গেল তখন হঠাৎ একদিন চাঁদনি ঘুমন্ত ছেলের কাছে বসেছিল বাইরে একটা শব্দে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, কিছুটা যাবার পর তার মনে কি হলো সে ছেলের কাছে ফিরে এলো। ঘরে ঢুকে দেখে পেত্নী তার ছেলের মুখে আঁচড় বসাচ্ছে। চাঁদনিকে দেখতে পেয়ে ছুটে পালায় পাশের ঘরে। চাঁদনি প্রথমে হতভম্ভ হয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে পাশের ঘরে গিয়ে মেয়েকে শান্ত গলায় জিগ্যেস করে, সে কেন তার ভাইয়ের সঙ্গে এমন করছিল। তাতে সোনাই জানায় যে দীপ হবার আগে পরিবারের সকলে ওকে অনেক আদর করতো, ভালবাসতো কিন্তু দীপ হবার পর থেকেই ওকে নিয়ে মেতে থাকে ওকে কেউ কোলে নেয় না, আদর করে না, এমনকি মায়ের কাছেও থাকতে পারে না। সব কিছুর জন্য ও ভাইকে দোষী মনে করে শাস্তি দেয়।চাঁদনি বুঝতে পারে ছেলের শরীরের উপর আঁচড় দেখে তার কষ্ট সহজে বুঝতে পেরেছে কিন্তু তার মেয়ের মনের ভিতরে যে আঁচড় প্রতিনিয়ত সবাই মিলে কেটেছে তার কষ্ট কেউ বুঝতে পারে নি। তারপর থেকে সোনাইয়ের প্রতি আগের চেয়েও বেশি করে যত্ন শুরু করে আর তখন থেকে ছেলের শরীরে পেত্নীর আঁচড়ও আর পড়ে না।
-
বুমেরাং
বুমেরাং
–রেহানা দেবনাথজুলি আর তুলি দুই যমজ বোন। শরীরের ও মুখের মিল থাকলেও স্বভাবের মধ্যে পার্থক্য অনেক। বড়লোকের মেয়ে হলেও ওর বাবা ওদের সাধারণ ভাবে কড়া শাসনে মানুষ করেছে। জুলি খুব চঞ্চল আর তুলি শান্ত। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, দেদার খরচ করে বাবার কাছে বকা খাওয়া ওর রোজকার ব্যাপার আর তুলি ঠিক উল্টোটা বাবার কথামতো চলে। উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর ওদের সম্বন্ধ দেখা চলতে থাকে। এমন সময় কলকাতার এক বিশাল ব্যবসায়ী শ্যামসুন্দর জুলিকে দেখতে এসে তুলিকেও দেখে ফেলে। শ্যামসুন্দর জানতে পারে যে ওরা যমজ দুই বোন। তখন সে বলে যে আমার তো মেয়ে পছন্দ হয়েছে তবে আমি দুজনকেই কিছু প্রশ্ন করতে চাই তারপর আমার সিদ্বান্ত জানাবো। ওদের বাবা তাতে সায় দেয়। প্রথম প্রশ্ন:তোমাদের হাতে প্রচুর ধন সম্পদ দেওয়া হলে তোমরা কি করবে? জুলি চটপট উত্তর খরচ করে ফেলবো, শপিং, রেস্টুরেন্টে খেয়ে আর দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে। তুলি বললো আমি সব রেখে দেব আর আস্তে আস্তে খরচ করবো। দ্বিতীয় প্রশ্নঃ বিয়ের পর মেয়েদের নিজের সংসার নিয়ে ভাবা উচিৎ না নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে? জুলি বললো আগে নিজের কথা ভাবা উচিৎ তারপর অন্যের! তুলি বললো, না আগে সংসারের কথা ভাবা উচিৎ তারপর নিজের কথা।কিছুক্ষণ পর শ্যামসুন্দর জানায় যে সে খুব শান্ত স্বভাবের তাই তুলিকে তার নিজের জন্য পছন্দ হয়েছে আর তার প্রিয় বন্ধু চঞ্চলের জন্য জুলিকে পছন্দ করেছে। চঞ্চল চৌধুরী হচ্ছে উত্তর কলকাতার একজন ব্যবসায়ী।কথাবার্তা হয়ে যাবার পর শ্যামসুন্দর গাড়ী করে বাড়ি ফেরার পথে মনে মনে বলতে থাকে এবার চঞ্চলকে নাস্তানাবুদ করার সুযোগ পেয়েছি হাত ছাড়া করা চলবে না,সব বিষয়ে আমাকে টেক্কা দেওয়া! যেভাবেই হোক জুলির সঙ্গে বিয়ের জন্য রাজী করাতেই হবে।
শ্যামসুন্দর তার বন্ধুকে জুলির স্বভাব সম্বন্ধে উল্টোটা বলে, ও ছবি দেখায়। তাতে জুলিকে চঞ্চলের পছন্দ হয়ে যায়। মাসখানেকের মধ্যেই তিন বাড়ির মধ্যে সব দেখাদেখি, পাকা কথা হয়ে নিদিষ্ট দিনে একসাথে দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়।
দুই পরিবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। এরপর বিয়ের এক বছরের পর জামাইসষ্ঠীতে দুই বোনের পরিবার আবার একসাথে মিলিত হলো। চঞ্চল আর জুলি খুব আনন্দ করছে, ওদের মধ্যে ভালোবাসা আর খুশি দেখে শ্যমসুন্দরের ঈর্ষা হলো। চঞ্চলের সুখ শান্তি নষ্ট করার জন্য জুলির সাথে বিয়ে দিয়েছে কিন্তু উল্টোটা হলো কি করে! ভাবতে ভাবতে শ্যামসুন্দর বাড়ির বাইরের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ তার কানে এলো দুই বোনের কথা আর খিলখিল হাসি। শ্যামসুন্দর জানালার একপাশে দাঁড়িয়ে দেখে জুলি আর তুলি গল্প করছে। জুলি তুই যে বলেছিলিস তোর কাছে অনেক টাকা এলে তা খরচ করে শেষ করে দিবি তাহলে এখন কিভাবে বদলে গেলি, তুলি বিস্ময়ের সুরে বলে। জুলি বলে আরে তখন ওই উত্তরটা মাথায় এসেছিল তাই বলেছিলাম আর এখন ওর সম্পত্তি মানে তো আমার তাই অযথা খরচ না করে জমাতে শিখছি। তুলি ভ্রূ কুঁচকে বলে ধুর! জমানো ওসব আমার দ্বারা হবে না।বাবার ভয়ে যেগুলো করতে পারিনি তা এখন পুষিয়ে নিচ্ছি, রোজ শপিং, কিটি পার্টি, ক্লাব সব কিছুই করি দুহাতে টাকা ওড়াই! জুলি আশ্চর্য হয়ে বলে তুই যে টাকা জমানোর কথা বলেছিলিস! হুম! আমার তো মনে হয় তোর শ্যামদা ওই জন্যই আমাকে বিয়ে করেছে যা হিসেবি লোক, বলে হাসে তুলি। তারপর আবার বলে তোর শ্যামদা আমায় বলে কিনা এবার বাচ্চা নিয়ে নেবার কথা। আমার শাশুড়ি শ্বশুরের ইচ্ছে পরের বছরই নাতি নাতনির মুখ দেখবেন, আমিও বলে দিয়েছি আগে নিজে কিছু একটা করবো, লাইফটা এনজয় করবো, তারপর বাচ্চার কথা ভাববো। জুলি বলে চঞ্চল কিন্তু একটু অন্য ধরনের আমাকে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসার কাজে যুক্ত করেছে, বলেছে আগে নিজের পরিচয় বানাও তারপর সংসারে লোক বাড়ানোর কথা ভাববে। আমিও কেমন ওর বশ হয়ে গেছি বলে লজ্জায় মাথা নিচু করে জুলি। আমি আগে যা যা করতে পারিনি এখন তাই তাই করছি এই কদিন আগে দক্ষিণ ভারত ঘুরে এসেছি, আবার পরের মাসে উত্তর ভারত ঘুরতে যাব, বাচ্চা নেবার আগে লন্ডন, আমেরিকাও ঘুরে আসার প্ল্যান আছে উৎফুল্ল ভাবে তুলি বলতে থাকে। জুলি বলে আমাদের এখন বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয়নি তবে আত্নীয়দের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি ঘুরে এসেছি খুব ভালো লেগেছে। আপাতত বিদেশে ঘোরার কোনো প্ল্যান নেই। ওদের কথাবার্তা শুনে শ্যামসুন্দর মাথা চাপড়াতে থাকে আর বলতে থাকে এবারও চঞ্চলের কাছে হেরে গেলাম! ওর জীবনকে তছনছ করার জন্য যে কালবৈশাখীকে পাঠিয়ে ছিলাম তা ধীরে ধীরে শীতল বাতাসে পরিণত হয়ে গেল আর যে শান্তবায়ুকে নিজের জন্য প্রবাহিত করেছিলাম তা শক্তি সন্ঞ্চয় করে নিন্মচাপ হয়ে আমার জীবনকে ঘিরে থাকলো! এই কথা ভাবতে ভাবতে শ্যামসুন্দর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। -
উপলব্ধি
উপলব্ধি
-রেহানা দেবনাথআমি পুরুষ আমি লজ্জিত,
মেয়ের বাবা হয়ে খুব ভীত
ছেলের বাবা বলে উদ্বিগ্ন!
মানুষ আর মানুষ নেই আজ।
আমাদের নানা কুকর্ম দেখে
পশুরাও হয়তো করছে উপহাস!
হিংস্র জানোয়ার নয়, নরোখাদক।
মন তার বিকৃত কামনা বাসনায় পূর্ণ ।
লোভের থাবা বসাচ্ছে মেয়েদের গায়,
লক্ষ্য তার মেয়েদের শরীর,যৌনাঙ্গ।
শিশু,কিশোরী,মধ্য বয়স্কা কিংবা বৃদ্ধা
যেখানে সে ফলাবে তার বর্বর পুরুষত্ব
চোখে মুখে তার অদৃশ্য লোভ লালসা।
বিষ ঢেলেছে সব সম্পর্কের মাঝে
ভাই বোন,দাদু নাতনি, বাপ মেয়ের
আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীর সঙ্গে।
কলঙ্কিত হয়েছে আদর ভালোবাসা!
শোষণ করে শরীর করছে ছিন্নভিন্ন।
এ কেমন পুরুষ মানুষ আমরা, যারা
বিসর্জন দিচ্ছি মানবিকতা, মনুষ্যত্ব!
আমি আতঙ্কিত কিছু পুরুষের কর্মে,
মাথা পেতে নিচ্ছি তাদের বর্বরতার দায়
চুপ করে থেকে,দিয়েছি কুকর্মে সায়,
কালিমা লেপন করেছি নিজেদের গায়।
ভাবনার সময় এসেছে, কোন সে উপায়ে
ফিরে আসবে,আমাদের সভ্য ভদ্র মূর্তি!
সমস্ত নারীজাতি হবে সুরক্ষিত, নিরাপদ,
এমন সময় কি আনতে পারবো না আমরা?
যখন পুরুষ শুধু পুরুষ নয়, মানুষ হয়ে উঠবো!
নারীকে ভোগ্যবস্তু নয়, মানুষ বলে মানবো।
সেদিন হবো না আর লজ্জিত, হবো গর্বিত।