• কবিতা

    কবিতা- ভুলে ভরা জীবন

    ভুলে ভরা জীবন
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    ভুলে ভরা এই সংসার সংশোধনের উপায় নেই আর।
    না ভেবে চিন্তে ভুল করে ছুঁড়লে তির ফিরবে না আর।

    জীবনের হিসাব বড়ো কঠিন ভুলত্রুটিতে ভরা,
    সাপ-সিঁড়ি লুডোর মতো জীবনটা চড়াই উতরা।

    অধ্যয়নে অনুশীলনেই ভুল পাবে কী কুল?
    ফিরবে না মুখনিঃসৃত কথন যদি হয় ভুল।

    ভুল প্রেমিকে প্রেম ভুলপথ চয়ন, পরিণাম মরণ।
    বিয়ের বাকদান দেহদান অস্বীকারে আত্মহনন।

    পিতার সর্বস্ব দান মালিক সন্তান পিতা গৃহহীন।
    উচ্চ আয়ের লোভে সন্তান বিদেশে মা সঙ্গীহীন।

    অপাত্রে দান, কন্যার নির্যাতন ভুলের পরিণতি।
    কলহ বিচ্ছেদ অশান্তি অন্তে আত্মাহুতি।

    ধর্ষণ হত্যার ভুলে ঘৃণ্য পরিবার- সমাজ কুলে।
    অসৎসঙ্গে সমাজবিরোধী নিজ ভুলে।

    অঙ্গ বিকল অচল ভুলভাল খাদ্যাভাসের ফল।
    ধন মান যৌবন ক্ষয় ভুলপথ চয়ন তাই অসফল।

    রিভিউ -রিপ্লে দেখে ভেবে আর নাই ফেরার উপায়
    শেষে নিজ ভুলে আউট হয়ে মৃত্যুসজ্জায়।

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- পূর্বরাগ

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প।।

     

    পূর্বরাগ
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    গঙ্গা তীরবর্তী চন্দননগর শহরে এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্তশালী পরিবারের দেবেশবাবু তার ছেলে অরিত্র ও মেয়ে রুমিকে নিয়ে থাকেন।কলকাতায় সরকারি অফিসের কর্মচারী। স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। মেয়ের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মেয়েকে সম্পুর্ণ ভাবে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।ছেলে ক্লাস এইটের ছাত্র। একদিন দেবেশ বাবু বললেন ” দেখ মা রুমি! তোর মা গত হবার পর সংসারের হাল তোকে ধরতে হয়েছে। রান্না বান্না ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ তোকেই করতে হয়। তার মাঝে তোর ভাই অরিত্রর পড়াশোনায় সাহায্য করিস। তোর প্রতি অনেক অবিচার হচ্ছে।
    রুমি — অবিচার আবার কি? এটা তো আমার কর্তব্য।
    — তাছাড়া অরিত্র এখন অনেক উঁচু ক্লাসে। ওর জন্য একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যবস্থা করেছি।
    অরিত্র– না বাবা। দিদি বেশ ভালোই পড়াই।
    — জানি। দিদি পড়াশোনায় ভালো। মা মারা যাবার পর সব ওলোট পালট হয়ে গেলো। তোর দিদির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল।
    তোর পড়াশোনা বন্ধ যাতে না হয়, ভালো রেজাল্ট করতে পারিস সেজন্যেই একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যবস্থা করেছি। দু একদিনের মধ্যে এসে যাবে। ব্রিলিয়ান্ট স্কলার ছেলে। নাম প্রিয়াংশু।
    রুমি — ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর।
    দেবেশ — লোকালের সময় হয়ে এলো এখন অফিসে চলি।
    কিছুক্ষণ পর অরিত্রও স্কুলে চলে গেলো। রুমি রান্নাবান্না ঘর সংসারের কাজে ব্যস্ত হলো।
    ×××××××××××_
    বিকেল বেলা।
    রুমি একটা কিছু পড়ছিলো।হঠাৎ
    কলিং বেলের আওয়াজ।
    রুমি বই ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিয়ে দেখলো সামনে এক এক সৌম্যকান্তি যুবক।
    যুবকটি একদৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
    এভাবে কতক্ষন তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই।
    হঠাৎ বাড়ির বাগানের এক পাখির শিশের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে যুবকটি বলল—- আমি প্রিয়াংশু। এটি কি দেবেশ বাবুর বাড়ি?
    — হ্যাঁ। দেবেশবাবু আমার বাবা। কিন্তু উনি তো এখন বাড়িতে নেই। অফিস থেকে এখনো আসেননি। ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যাবে।
    — ও।তাহলে আজ আসি।
    — কিছু দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন।
    — ক্লাস এইটের একটা ছেলেকে টিউশন পড়ার কথা বলেছিলেন।
    — ও আচ্ছা! স্টুডেন্ট আমার ভাই অরিত্র। আপনি ভেতরে আসুন। ভাই এখনি এসে যাবে।
    প্রিয়াংশু আড়ষ্ট বোধ করলেও কেমন যেন এক অদৃশ্য টানে ভিতরে প্রবেশ করল।
    রুমি যুবককে সোফায় বসতে বলল — আপনি বসুন। আমি চা করে নিয়ে আসি।
    প্রিয়াংশু মেয়েটির চলে যাবার মরাল গতির সুন্দর ছন্দের দিকে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ হলো।
    কি সুন্দর গোছানো পরিপাটি আসবাবপত্রে সজ্জিত ড্রয়িং রুম।
    কিছুক্ষন পর রুমি এক কাপ চা ও তার সাথে প্লেট ভরতি জলখাবার এনে সামনে দাঁড়ালো।
    বাইরে খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আলো অষ্টাদশী রুমির আপাদমস্তক দেহে ঠিকরে পড়ছে। ফর্সা গালে বিকেলের লাল আভায় রুমিকে মনে হচ্ছে যেন কোনো দেবী প্রতিমা।
    যতই দেখছে তত যেন তার আকাঙ্খা আর মিটছে না।
    অন্য কেউ হলে রুমি ঘরে ঢুকতে দিত না, বা দিলেও চায়ের প্লেট টেবিলে রেখে চলে যেতো।কিন্তু তারও কেমন যেন ভাল লেগে গেছে যুবকটিকে। অপরূপ, উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।
    রুমি বলল — কি শুধু তাকিয়েই থাকবেন নাকি প্লেটটা ধরবেন?
    প্রিয়াংশু লজ্জিত হয়ে বলল – সরি।
    প্লেট টি হাতে নিয়ে ভাবলো। এর আগে সে তো অনেক মেয়ে দেখেছে। কিন্তু এরকম এক অনুভুতি তার কখনো আসেনি। নিজেকে আজ তার কেমন অপরাধী বোধ হতে লাগলো।
    কিছুক্ষণ পর অরিত্র এসে গেলো।
    — এই আমার ভাই, অরিত্র। আপনার ছাত্র।
    অরিত্র তুই যা,তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আয়। আজ থেকেই উনি তোকে পড়াবেন। তোর মাষ্টার মশাই।
    ঘন্টাদুয়েক পড়ানোর মাঝে রুমি আরেকবার চা দিয়ে চলে গেছে।
    প্রিয়াংশু অরিত্রকে বললো, তোমার দিদিকে ডাকো। আমি এবার আসি। দিদি দরজার আড়ালেই ছিল। এগিয়ে এসে বলল—অরিত্র! স্যারকে প্রণাম কর।
    প্রিয়াংশুকে অরিত্র প্রণাম করতেই বলল — আমি তোমাকে তোমার স্কুলের সেরা ছেলেদের মধ্যে একজনে পরিনত করব। তুমি কিন্তু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে যাবে।
    আজ চলি।

    প্রিয়াংশু যতক্ষন না দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো রুমি অপলকে তাকিয়ে রইল।
    তার হৃদয় তন্ত্রীতে এক অভূতপূর্ব সুরের ঝংকার ধ্বনিত হতে লাগলো।
    প্রাইভেট টিউটার প্রিয়াংশু নিয়মিত আসতে লাগলো। পড়াশোনায় অনেক অনেক উন্নতি হলো অরিত্রর।
    দেবেশ বাবু রেজাল্ট দেখে খুব খুশি।
    রোজ নিয়মিত চা জলখাবার এগিয়ে দিত রুমি। মাঝেমধ্যে দুচার কথা। একদিন পড়ানো শেষে রুমি বলল আজ আপনি খেয়ে যাবেন।
    — এইতো প্রতিদিন জলখাবার খাওয়াচ্ছ আবার কি!
    — আজ আপনার জন্য কিছু স্পেশাল রান্না করেছি। আপনাকে খেতেই হবে।
    — আচ্ছা।
    রুমির হাতের রান্নার খাবার খেতে খেতে অভিভূত হয়ে
    — বা! কি চমৎকার রান্না। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো।
    — আপনার মা! আপনার বাড়িতে আর কে কে আছে?
    — আমার মা ছিল। অনেকদিন আগেই দেহ রেখেছেন।
    — আর কে কে আছেন।
    — আমার মা বাবা ভাই বউ কেউ নাই। আমি শুধু একা থাকি।
    — আর খাওয়া দাওয়া?
    — দূরে একটা মেস কাম হোম ডেলিভারি আছে। সেখানেই খায়।
    — আপনি বলবেন, যেদিন অসুবিধা হবে আমার কাছে খেয়ে যাবেন।
    — খেতে পারি একটা শর্তে।
    — শর্ত আবার কি?
    — আমাকে আপনি বলা চলবেনা। আমাকে তুমি বলতে হবে।
    রুমি মনে মনে ভাবলো এটাতো আমারও মনের কথা। মিষ্টি হেসে বলল
    —- ঠিক আছে। আমাকেও আপনি বলা চলবেনা। তুমি বলতে হবে।
    বাহ্। দুজনের হৃদয় তন্ত্রীতে এক সেতারের সুর ঝংকারিত হলো।
    এভাবে তারা দুজনে দুজনের মনের কাছাকাছি পৌঁছাতে লাগলো। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিনত হলো। একদিন না দেখলে রুমির মন উদাস হয়ে যেতো।সব কিছু যেন বিবর্ণ মনে হতো। একেই কি ভালোবাসা বলে। তাই ভালোবাসার টানে, ছুটির দিনে সকালে দুপুরে রাতে সময়ে অসময়ে প্রিয়াংশু ছুটে আসতো রুমির কাছে।
    একবার হঠাৎ দিনকয়েক প্রিয়াংশুর দেখা নেই। সে আর পড়াতেও আসেনা। প্রতিদিন প্রতীক্ষায় দিন কাটে।সে কেন আসছে না? নানান অশুভ চিন্তা তাকে গ্রাস করলো।
    একদিন বাবার সামনে
    বলল– বাবা তুমি কি প্রিয়াংশু দার বাড়ির ঠিকানা জানো?
    একবার খোঁজ নিয়ে দেখো কেন সে আসে না।
    —– আমি সেসব পারবোনা।
    — তাহলে আমাকেই ঠিকানাটা দাও আমি অরিত্রকে পাঠিয়ে খোঁজ নেব।
    ওর একটা বায়োডাটা দিয়ে বলল
    — এই নে। সযত্নে রাখবি।
    বায়োডাটা দেখে রুমির চোখ চড়কগাছ। ওরে বাপরে! এতো অনেক ইন্টেলিজেন্ট ছেলে। এম টেক ইন কম্পিউটার সাইন্স।প্লাস আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি র মতো অত্যাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এছাড়া আই টি’র অনেক প্রফেশনাল কোর্স করেছে।
    এতো ভালো ছেলে অরিত্রকে পড়াতে আসতো। আমারতো বিশ্বাস হচ্ছে না।
    — ছেলেটা আমাদের পাড়াতেই এক পুরানো বাড়ি কিনে এসেছে। কাছাকাছি টিউশানি চাইছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা ওকে আমাদের বাড়ির টিউটার হিসেবে পেয়েছি।
    রুমি মনে মনে ভাবলো সে একাই যাবে প্রিয়াংশুর খোঁজে আজই।
    ডিনার শেষে বাবা ও অরিত্র যখন ঘুমিয়ে পড়ল, রুমি বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে এলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টিপ টিপ বৃষ্টিও পড়ছে। রুমি ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টি বাড়তে বাড়তে মুষলধারে পড়তে লাগলো। বায়োডাটায় উল্লেখিত বাড়ির ঠিকানায় সঠিক স্থানে পৌঁছালো।
    দরজায় কলিং বেল টিপতেই প্রিয়াংশু দরজা খুলে দেখলো সামনে রুমি দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
    — কি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ভেতরে আসতে বলবে?
    এবার প্রিয়াংশু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো — এত রাতে তুমি! আমি তো বিশ্বাস করতে পারছিনা। এসো রুমি। ঘরে এসো। একি তুমি এক্কেবারে সম্পুর্ণ ভিজে গেছো।
    — তুমি কোথায় ছিলে? কেন যাওনি আমার কাছে? আমাকে কেন ভুলে গেলে? তোমার কি হয়েছিলো?…..
    রুমি হাজার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলো।
    আমি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ভিনরাজ্যে গিয়েছিলাম।
    তাছাড়া তোমার বাড়িতে যাওয়াটা পাড়ার লোকেদের পচ্ছন্দ নয়।অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে।
    — কেউ কিছু বলেছে।
    — হ্যাঁ নানান চর্চা। বিভিন্ন ঠেকে বিভিন্ন ভাবে।
    — তুমি তো খুব বীর পুরুষ। লোকে কিছু বলবে বলে তুমি আমাকেই ছেড়ে দেবে। আমিতো তোমাকেই ভালোবাসি।
    রুমি এগিয়ে গিয়ে সিক্ত বসনে প্রিয়াংশুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না প্রিয়াংশুদা। প্রথম নারী স্পর্শ লাভে প্রিয়াংশু শিহরিত হলো।
    — তুমি তো অনেক ভিজে গেছো। দাঁড়াও তোমাকে একটা শুকনো কাপড় এনে দিই। প্রিয়াংশু কিছু না পেয়ে একটা শুকনো বিছানার চাদর এনে দিয়ে বললো
    — এই নাও এটা নিয়ে ওই ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড় গুলি চেঞ্জ করে এসো।
    — না। আমি কোথাও যাবনা। তুমি আমারই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমারই।
    রুমি একে একে সব ভিজা কাপড় প্রিয়াংশুর সামনে খুলে ফেলতে লাগলো।
    প্রিয়াংশু অষ্টাদশী সুন্দরী ফর্সা রমনীয় রুমির রূপ লাবণ্যে মোহিত হলো। রুমির ঘনকালো মেঘের মতো কেশদাম,টিকলো নাক, পানপাতার মতো মুখ, বিম্ব ফলের মতো ওষ্ঠ, থরথর কম্পিত অধরপ্রান্ত, গুরু নিতম্ব,পীন পয়োধর বিভাজিকা, ক্ষীণ কটিদেশ, ত্বন্বী রুমির সুডৌল জঙ্ঘা অবলোকন করতে বাধ্য হলো। পুলকিত হলো। রোমাঞ্চিত হলো। আবেগ অনুভূতিতে দিগবিদিক জ্ঞান শুন্য হলো। হঠাৎ কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। রুমি ভয়ে উত্তেজনায় প্রিয়াংশুকে জড়িয়ে ধরল। বাইরে প্রকৃতি উত্তাল।প্রবল শব্দে ঝড় জল। শন শন আওয়াজে মুষলধারে বৃষ্টি।ভিতরে তাদের দুজনেরই মহাপ্রলয় ঘটে গেলো। প্রকৃতির নিয়মে তারা আরও ঘনিষ্ট
    হলো।
    রাতভর প্রবল বর্ষণ।তাদের এই মিলন ঈশ্বরের দান মনে করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সমর্পণ করল।সাক্ষী রইলো উত্তাল প্রকৃতি।
    রাত শেষ হলো। ঘড়িতে চারটা বাজে। রুমি ধীর পায়ে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।

    ঘরে এসে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে পোশাক পরিবর্তন করে নিজের রুমের বিছানায় শুয়ে পড়লো। কাক পক্ষীটি টের পেলনা তার অভিসারের কথা। তার প্রস্ফুটিত নব যৌবনের জলতরঙ্গের সুমধুর সুর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
    এরপর থেকে প্রিয়াংশু যখন খুশি আসতে লাগলো।

    একদিন দেবেশ বাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। সেসময় পাড়ার মাতব্বর ও ক্লাবের ছেলেরা বলল
    —দেবেশ বাবু!এটা সম্ভ্রান্ত পাড়া। সবাই শিক্ষিত ও আভিজাত্যপূর্ণ। আপনার মেয়ের বেল্লেনাপনায় আমরা অতীষ্ট। টিউশনি টীচারটি যখন তখন আপনার ঘরে আসে। আপনি ওদের মেলামেশা বন্ধ করুন।
    দেবেশ বাবু ঘাড় নেড়ে সহমত ব্যক্ত করল।

    দেবেশবাবু ঘরে এসে রুমিকে শাসন করতে করতে বলল— —এসব চলবেনা। প্রিয়াংশু কে বলে দিবি ও যেন না আসে। নির্লজ্জ বেহায়া। আমি তোর বিয়ে দিয়ে দেব। ছেলেও দেখে রেখেছি।
    — আমি বিয়ে করব না বাবা। কেন করবি না।
    তোর কি ভালোবাসার কেউ আছে?
    — হ্যাঁ।
    — কে সে?
    — তাকে তুমি চেনো বাবা।
    — কে সে প্রিয়াংশু! ওই বেকার ছেলেটা।
    — আমি ওই বেকার ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেব না।
    — সে এখন বেকার হলেও পরে ভালো চাকরি পেয়ে যাবে।
    — ওই লম্পট ছেলেটাকে তুই বিয়ে করবি?
    — না বাবা। ও লম্পট নয়। সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে।
    — তোর মায়ের মৃত্যুর পর আমি তোকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি। মায়ের অভাব বুঝতে দিয়নি। আজ তুই আমাকে অবজ্ঞা করছিস।
    — অবজ্ঞা কোথায় বাবা। আমি তো বলেছি আমি বিয়ে করবনা। তুমি না জোর করে আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে গলগ্রহ বিদেয় করতে উঠে পড়ে লেগেছো।
    — কথার উপর কথা বলবি। তোর সাহস তো কম নয়।
    কাল তোর মজা বের করছি।
    — হ্যাঁ। তুমি যা-ই বলো বাবা আমি সব কিছু মেনে নেব কিন্তু প্রিয়াংশু ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।
    দিন কয়েক পর
    রুমি ঘরের জানলা দিয়ে দেখলো একটা ছেলে মোটর সাইকেলে হর্ণ বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন দিন কয়েক থেকে সময়ে অসময়ে ছেলেটি শিশ দিতে দিতে কখনো বা চীৎকার করে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে মোটর সাইকেলে চক্কর দিচ্ছে।
    ছেলেটাকে রুমি চেনে। লিটন। লম্পট বদমায়েশ মাস্তান গুন্ডা ছেলেটা অনেক কিশোরী মেয়ের সর্বনাশ করেছে।
    একদিন রুমি পাড়ার মুদীর দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরছে।দেখলো একটা নিরিবিলি জায়গায় লিটন রাস্তার পাশে বাইক রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
    রুমি কাছে আসতেই আকস্মিক তার হাত ধরে বললো — ডার্লিং। আই লাভ ইউ।
    — হাত ছাড়ুন বলছি। নাহলে চীৎকার করে লোক ডাকব।
    — কেন? আমিও তোমাকে ভালোবাসি সুন্দরী। তোমার প্রিয়াংশু মাষ্টারকে ঘরে ডেকে তোমার মধু পান করতে দিচ্ছ। আর আমার বেলায় অমন কেন করছো সুন্দরী? আমি তোমাকে বিয়ে করে ওই বেকার ছেলের চেয়ে অনেক ভালো সুখে রাখব।
    —- ছাড়ুন।লম্পট।
    কিন্তু লম্পটটা জোর করে তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরতে গেলে রুমি ওর হাতে কাঁমড় বসিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে দিয়ে পাশের সরু গলি দিয়ে চোঁচা দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল।
    একদিন পর ঘরে এসে জানলা দিয়ে শাঁসিয়ে দিয়ে গেলো।
    — আমার প্রস্তাব মেনে নে। না হলে বদলা নিয়ে নেব। আমার নাম লিটন মাস্তান। তোর ওই মাষ্টারকে মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাব।

    এবার রুমি ভয়ে একদম জড়োসড়ো হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো।
    কদিন থেকে প্রিয়াংশুদাও আসছেনা। কি যে করে! মনে মনে ঠিক করল আজ সে প্রিয়াংশুর বাড়ি যাবে। সতর্ক করে দিয়ে আসবে।
    ডিনার শেষে বাবা ও অতনু একটা ঘরে শুয়ে পড়েছে। ড্র‍য়িং রুমের পাশের ঘরে সে একা শোয়। মধ্য রাত্রি। একটা বাজে।ঘুম আসছে না। রুমি বিছানা ছেড়ে উঠলো। উঁকি মেরে দেখলো বাবা ও অতনু গভীর নিদ্রামগ্ন। দরজাটা ঠেকিয়ে সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। নিশুতি রাত। নিশাচর পাখির ডানা ঝটপটানির আওয়াজ। চারিদিক দেখলো রাস্তায় জনমানব নাই। গা ছমছম নিরবতা। ত্রস্তপায়ে প্রিয়াংশুদার বাড়িতে পৌঁছে দরজায় কলিং বেল
    টিপলো।
    প্রিয়াংশু দরজা খুলে ঘরে আসতে বললো। প্রিয়াংশুর ল্যাপটপ খোলা। সে কিছু একটা কাজ করছিল।
    — তুমি আবার কদিন আমার কাছে যাওনি কেন?
    — তুমি এসেছো।আজ আমার অনেক শুভদিন রুমি। আজ আমার মনস্কামনা পূর্ণ হলো।
    — আমি কিন্তু তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। তুমি আর আমাদের বাড়ি যাবেনা।
    — কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না।
    রুমি লিটন গুন্ডার তার উপর
    কুদৃষ্টি ও কুপ্রস্তাবের ঘটনাটা জানিয়ে বললো
    — তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে না।লিটন আমাকে সম্ভোগ করতে না পেলে তোমাকে মেরে দেবে। ধমকি দিয়েছে।
    —কিন্তু ওই লিটনের ধমকিতে ভয় পেয়ে তোমাকে হারাতে চাইনা।
    — কিন্তু তুমি লিটনকে চেনোনা। ও যেটা বলে সেটা করেই দেখায়।
    — যতই ও ফেরোশাস গুন্ডা হোক না কেন আমাদের প্রেমে, আমাদের মিলনে বাধা দিতে পারবে না। আমি হাইদ্রাবাদের যে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সেই চাকরিতে আমি সিলেক্টেড। এই দেখো
    ই -মেলে এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেছে। আমি এবার জয়েন করে তোমাকে বিয়ে করেই এখান থেকে নিয়ে যাব।
    —কই দেখি।
    — এই দেখো।
    — রুমি দেখে খুব আনন্দিত আপ্লূত হয়ে জিজ্ঞেস করবে ৯.৬ লাখ এটি কি?
    — এটাই আমার বাৎসরিক বেতন সুন্দরী। পরে আরও বাড়বে।
    খুশিতে রুমি গেয়ে উঠলো “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ুরের মতো নাচেরে।”
    আনন্দের আতিশয্যে রুমি নাচতে শুরু করলো। আঁচল খুলে গেলো। জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে প্রিয়াংশুকে ব্যতিব্যস্ত করে দেবে। উত্তেজিত প্রিয়াংশু রুমিকে নিয়ে বিছানায়
    ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এলো। সারারাত এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো । হঠাৎ রুমি এক নিশাচর পাখির ডাকে ধড়ফড় করে উঠে কাপড় পড়তে পড়তে বলবে—
    —- এমা! সকাল হয়ে গেলো। জানাজানি হয়ে যাবে।
    — হোক জানাজানি। কাল রবিবার। তোমার বাবা বাড়িতে থাকবেন। আমি সকালে যাব। তোমার বাবার কাছে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেব।
    প্রায় ছুটতে ছুটতে রুমি ঘরের দিকে রওনা দিল। ঘরে ঢুকতেই বাবা চীৎকার করে বলবে—
    — কলঙ্কিনী । কোথায় রাত কাটিয়ে এলি। নিশ্চয়ই ওই টিউশন টীচারের ঘরে গিয়েছিলি। হারামজাদি।
    তোর জন্য আমি মুখ দেখাতে পারব না। রেলে মাথা দিয়ে মরবো।
    — তোমাকে আর মরতে হবে না।
    — কাল প্রিয়াংশুদা আসবে তোমার সাথে কথা বলতে।

    — ও আসার আগে আমি থাকব নাহলে ও থাকবে।
    মনে হলো রুমি এই সময় খুলে সব বলে দেয়। কিন্তু প্রিয়াংশু এসে সাসপেন্স ভঙ্গ করে সারপ্রাইজ দেবে এই ভেবে চুপচাপ থাকলো।
    🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔🔔

    রবিবার, ছুটির দিন সকালবেলা। দরজার সামনে অপেক্ষারতা রুমি। প্রিয়াংশু আসতেই রুমি নিঃশব্দে চুম্বন দিয়ে প্রিয়াংশুকে অভ্যর্থনা জানালো।প্রত্যুত্তরে প্রিয়াংশু রুমির বুকে চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিলো।
    ক্রুদ্ধ দেবেশ বাবু সোফায় বসে আছেন।
    প্রিয়াংশু ঘরে ঢুকে দেবেশ বাবুকে প্রণাম করে বলল
    —আমি আপনার মেয়ে রুমিকে বিয়ে করতে চাই।আমি চাই আপনার আশীর্বাদ।
    — আমার এ বিয়েতে মত নাই।
    আমি একজন বেকার ছেলের হাতে আমার মেয়েকে সমর্পণ করবো না।
    —- আমি এখন আর বেকার নই স্যার। এই দেখুন গতকাল হাইদ্রাবাদ থেকে appointment letter এসেছে। আমি এক মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছি।
    দেবেশ বাবু চিঠি পড়ে উচ্ছসিত হয়ে —-
    — ওয়েল ডান। বেতনও ৯.৬ লাখ প্রতিবছর।
    খুব খুশি। আমার স্বপ্ন পূর্ণ হলো। দেখলো
    মিষ্টির প্লেট হাতে রুমি দাঁড়িয়ে।
    সেখান থেকে একটা মিষ্টি তুলে দেবেশ বাবু প্রিয়াংশুর মুখে পুরে দিয়ে বলল
    —- আয়ুষ্মান ভবঃ।
    রুমি মিষ্টির প্লেট প্রিয়াংশুর হাতে দিয়ে বাবাকে প্রণাম করল।
    বাবা দু হাত তুলে আশীর্বাদ করল
    — সৌভাগ্যবতী ভবঃ।
    রুমি — আজ দুপুরে আমাদের এখানে আমার হাতের রান্না খেয়ে যাবেন প্রিয়াংশুদা।
    — আজ আমার অনেক অফিসিয়াল কাজ বাকী। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
    তাছাড়া তোমার হাতের রান্নাই তো সারাজীবন খেতে হবে।

    এই বলে বিদায় নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। বারবার পিছন ফিরে রুমির দিকে তাকাতে তাকাতে
    বাগান পেরিয়ে যেমনি বড় রাস্তায় পা দিয়েছে অমনি দূর থেকে লিটন গুলি চালালো। পরপর তিনটি। প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পরের দুটি প্রিয়াংশু কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো।
    রু— মি ———— বলতে বলতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
    রুমি দেবেশবাবু অরিত্র সবাই ছুটে এলো।
    রুমির হাত ধরে অব্যক্ত যন্ত্রণায় চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালো।
    বাইক স্ট্রার্ট করে লিটন গুন্ডা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
    ⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️⛑️
    সামনে দিয়ে একটা পুলিশ ভ্যান যাচ্ছিল রুমি হাত দেখিয়ে আটকালো। অত্যন্ত বিণীতভাবে সকরুন আবেদন জানালো
    —-স্যার! আপনাদের পায়ে পড়ি আপনারা আমার প্রিয়াংশু কে বাঁচান। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চলুন। পুলিশের সহায়তায় ও সবাই মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে ভর্তি করল।
    ICU তে।
    সই করলো রুমি নিজে।
    লিখলো রুমি মিত্র।
    প্রিয়াংশু দত্তের বাগদত্তা স্ত্রী।
    হাসপাতালের বেঞ্চে বিনিদ্র রজনী কাটলো রুমির।
    দেবেশ বাবু বললেন
    — সেই সকাল থেকে কিছুই খাসনি। কিছু একটা মুখে দে।
    ইতিমধ্যে সার্জেন রুমি কে ডেকে বলেছে ৭২ ঘন্টা আগে কিছুই বলা যাবেনা। পেশেন্ট ইজ ক্রিটিক্যাল।

    — না বাবা। ৭২ ঘন্টা কিছুই খাবনা।
    🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦

    অবশেষে ৭২ ঘন্টা অতিক্রান্ত হলে সার্জেন ডেকে পাঠালেন রুমিকে।
    — মিস রুমি। প্যেশেন্ট ইজ আউট অব ডেঞ্জার।
    একটা গুলি বগলের পাশে কাঁধের উপর আর একটা পায়ে লেগেছিল। আপনি একটু কথা বলতে পারেন। জ্ঞান ফিরে শুধু আপনার নাম করে ডেকেছে। সিস্টার বলল,শুধু ফ্যালফ্যাল করে
    দরজার দিকে তাকিয়ে আপনারই প্রতিক্ষায় থেকেছে।

    রুমি ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো আই সি ইউ তে।
    অপলকে প্রিয়াংশু রুমির দিকে তাকিয়ে রইলো । জলভরা চোখে রুমি এগিয়ে এসে প্রিয়াংশুর কপালে চুমু খেয়ে বলবে —-
    প্রেমের দেবতা আমার প্রিয়াংশুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর কোনো শক্তি আমার প্রিয়াংশুকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবেনা।
    বাইরে থেকে কোথাও সেই রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসছে।

    “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
    পরানসখা বন্ধু হে আমার,
    আকাশ কাঁদে হতাশসম
    নাই যে ঘুম নয়নে মম,
    দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
    চাই যে বারে বার,
    পরানসখা বন্ধু হে আমার,
    আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
    পরানসখা বন্ধু হে আমার। “

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- অতসীর প্রেম

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প।।

     

    অতসীর প্রেম

    -শচীদুলাল পাল

     

     

    আসনবনি গ্রামে একদিকে রেল লাইন অপর দিকে শস্যক্ষেত ও ঘন গাছপালার সবুজের সমারোহ। পুকুর পুস্করিণীতে ভরা এই গ্রামটিতে অধিকাংশ অধিবাসী কৃষি নির্ভরশীল। অনেকে জীবিকার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এমনকি অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে।
    সেই গ্রামের একান্নবর্তী মিত্র পরিবারের এক অপরূপা সুন্দরী কিশোরী অতসী পড়াশোনা খেলাধুলা গান নিয়ে বড়ো হচ্ছিল। মায়ের খুব আদুরে। মা তার কোনো কিছুতে বাধা দিতনা।
    গ্রামের হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। চোদ্দ বছরের অতসীর দেহসৌষ্ঠব চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয়। প্রস্ফুটিত পুষ্পের মতো বালিকাটি পরিবারের ও সারা গ্রামের সবার প্রিয় ছিল। বাড়ি থেকে কিছু দূরে এক সরোবর।
    নাম তার ভাগা বাঁধ। সেখানকার জল বড়ো স্থির। বাঁধের চারপাশে গাছের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া। অসংখ্য ছোট বড়ো মাছেরা খেলা করত। মনে হতো এই সামনে এসে ধরা দেবে। অতসীর এই সরোবরে স্নান করতে ভাল লাগতো। বিশাল জলাশয়ের একদিকে মেয়েরা, বিপরীতে ছেলেরা স্নান করতো।

    সেদিন ছিল ছুটির দিন। অতসী গ্রামের এক বৌদির কলসি নিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে অনেক দূর চলে গেছিল।
    হঠাৎ মাঝ সরোবরে অতসীর হাত থেকে কলসিটি ছিটকে হাতছাড়া হয়ে গেলো । বালিকা অতসী আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে, ক্লান্ত হয়ে আর পারছিল না। মনে হচ্ছিল সে আর পারবেনা।
    মরে যাবে। তলিয়ে যাবে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে প্রাণপণে চীৎকার করলো
    বাঁ চা ও। বাঁ—- চা —-ও।
    সরোবরে তীরে এক মহা সোরগোল পড়ে গেলো।
    অতসী ডুবে যাচ্ছে। মেয়েটা ডুবে গেলো। কেউ বাঁচাও ওকে।কিন্তু
    কেউ আর নামলো না। ডুবন্ত কাউকে বাঁচাতে গেলে তারই তো নিশ্চিত মৃত্যু। তাই কেউ সাহস করে নামলো না।
    নির্ঘাত মৃত্যুর কোলে অতসী নিজেকে সঁপে দিল।

    ওপারে একটি ছেলে চীৎকার শুনে নিজ জীবন বিপন্ন করে জলে ঝাঁপ দিল। দ্রুত সাঁতার কেটে মেয়েটির কাছে আসতেই দেখলো মেয়েটি তলিয়ে যাচ্ছে। সে ডুব সাঁতার দিয়ে খুঁজে বার করলো মেয়েটিকে। পিঠে চাপিয়ে জলের উপরে উঠলো।
    ডুবন্ত প্রাণী একটা খড়কুটো যা পাই সেটাকেই সে আঁকড়ে ধরে।এক্ষেত্রে জলমগ্ন অতসী
    ছেলেটির পিঠে উঠে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।
    ছেলেটা ঈশ্বরের অসীম কৃপায় দেখলো সামনে এক কলসি ভাসছে।
    এক হাতে কলসি, পিঠে অতসী দুপায়ে ও একহাতে সাঁতার কাটতে কাটতে মেয়েদের ঘাটে উপস্থিত হলো। দেখলো ঘাটে অনেক মেয়েদের ভীড়। সবাই তাকে বাহবা দিলো। অতসী চোখ মেলে ছেলেটির দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল। ইশারায় কাছে ডাকলো ছেলেটিকে। ছেলেটি কাছে আসলে অতসী জড়িয়ে ধরে দুচোখ বন্ধ করলো।
    গ্রাম থেকে গ্রামে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো।অতসীর পরিবার ও পাঁচ গাঁয়ের সবাই ছেলেটির প্রসংশায় পঞ্চমুখ হলো।
    দশম শ্রেণীর ছাত্র ষোলো বছরের বিপিন দাস বেশ লম্বা।নিকষ কালো গায়ের রঙ।ফুটবল দলের স্ট্রাইকার। পড়াশোনায় মন্দ নয়।শান্ত স্বভাবের বিপিন খুব নম্র ও ভদ্র। বিপিনদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল নয়। বাবা দিনমজুর। মা অন্যের ক্ষেত খামারে কাজ করে। দু’দুটো দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা নিঃস্ব।

    স্কুল ছুটির পর অতসী প্রতিদিন এক একেকটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে এক ঝলক দেখবে বলে। কিন্তু সাহস করে কথা বলতে পারে না। শুধু নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে।
    ঘরে গিয়ে রাতে শুধু ভাবে বিপিনের কথা। অনেকদিন ভেবে ভেবে রাত শেষে ভোর হয়ে যায়।
    একদিন স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে ফিরছিল। রাস্তায় বিপিনের সাথে দেখা। অতসী ইশারায় এক গাছের নীচে ডেকে বলল,
    — বিপিনদা। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। আমি তোমার কথা সবসময়ই ভাবি।
    — আমিও।
    অতসীর হৃদয় তন্ত্রীতে এক সুর ঝংকারিত হলো।
    আবেগে বিপিনকে জড়িয়ে ধরল।
    — আমি তোমার সাথে রোজ দেখা করতে চাই বিপিনদা।
    —-সেটা কি সম্ভব? আমরা অপ্রাপ্তবয়স্ক। গ্রাম্য সমাজ কি বলবে?
    — তাহলে ফোন করবে।
    — আমার তো ফোন নেই।
    আমরা ভীষণ গরীব।
    — আচ্ছা। আমি তোমাকে আমার একটা
    পুরানো ফোন দেব আর কিছু টাকা দেব। তুমি নতুন সিম কিনে আমার সাথে কথা বলবে।
    ভিডিও চ্যাট করবে।

    —-আমি এসব জানিনা।
    — আচ্ছা। কাল তুমি আমার ঘরের সামনে মাঠে সন্ধ্যায় আসবে। আমরা গাছের আড়ালে দেখা করব। আমি ভিডিও করাও শিখিয়ে দেব।

    এভাবে কিশোর কিশোরীর ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব এক গভীর ভালোবাসায় পরিনত হলো।
    তারা এখানে সেখানে দেখা করতে লাগলো।
    কাঁচা থেকে ডাঁসা।ডাঁসা থেকে সুপরিপক্ক সেই প্রেম দুজনের হৃদয়ে স্থায়ী বাসা বাঁধলো।
    দিনেরাতে ফোনে মেসেঞ্জারে সংগোপন সাক্ষাতে তাদের প্রেম ঘনীভূত হলো।
    এভাবে চলতে চলতে একদিন দুজনে বড়ো হলো। অতসী স্থানীয় কলেজ থেকে গ্র‍্যাজুয়েট ও বিপিন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলো।
    এখন কুড়ি বছরের উদ্ধত যৌবনা ফর্সা সুন্দরী ত্বন্বী অতসী একদিন বিপিনকে বললো
    — চলো একবার আমরা দুজনে তারাপীঠ ঘুরে আসি।
    — তারাপীঠ?
    — হ্যাঁ।সেখানে আমরা দুজনে মাকে দর্শন করবো। পুজা দেব।
    — কিন্তু তুমি আমি একসাথে গেলে তোমার বাড়ির কেউ কিছু বলবেনা?
    — না। আমি মিথ্যা বলে যাব।বান্ধবীদের সাথে যাচ্ছি বলব।
    — কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই এক্কেবারে। আমি ডিপ্লোমা পাশ। ইন্টারভিউ দিয়েছি অনেক। চাকরি হয়ে যাবে। তখন আমি নিজের টাকায় তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব।
    — ওরে বাবা। সে তখন কাছাকাছি নয়। দূরে অনেক দূরে নিয়ে যেতে হবে। এখন আমার ইচ্ছে তারাপীঠ যাব। তুমি রাজি কিনা বলো।
    — বেশতো। তুমি যা বলবে তাই। রাজি।
    — স্নান করে উপোস করে স্টেশনে আসবে। আমি টিকিট কেটে তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
    অনেক দেরি করে বিপিন এলো।

    —-কি হলো এত দেরি।
    —-কি করব!
    উঠানে পড়ে গিয়ে মায়ের কপাল কেটে গিয়েছিল।
    আমি হাস্পাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
    — এখন কেমন আছেন?
    — দুটো স্টিচ দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ।
    —-চলো তাড়াতাড়ি। শেষ লোকালের সময় হয়ে গেছে।

    লোকালে চেপে তারা যখন মন্দিরে পোঁছালো তখন সন্ধ্যারতি হচ্ছে।
    দুজনে ভীড় ঠেলে মন্দিরে প্রবেশ করতেই পুরোহিত বিপিনের কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বলল —
    — এই সিঁদুর মেয়েটির সিঁথিতে পরিয়ে দাও।
    — কিন্তু
    — কোনো কিন্তু টিন্টু নয়। চলো। ভীড় হটাও।
    ঘটনাচক্রে বিপিন পুরোহিতের দেওয়া সিঁদুর অতসীর সিঁথিতে দিতেই মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠলো।
    দুজনেই শিহরিত হলো।এক অপুর্ব আনন্দে আনন্দিত হলো।

    তারা ছুটতে ছুটতে স্টেশনে আসতেই শেষ লোকালও চলে গেলো। অগত্যা দুজনে মন্দির চত্ত্বরে ফিরে এসে রাত্রিযাপনের জন্য হোটেলের
    খোঁজ করলো।
    এক হোটেলে এসে যখন তারা বললো আমরা দুজনে দুজনকে ভালো বাসি। স্বামী স্ত্রী নই।কেউ রুম ভাড়া দিতে রাজি হলো না। তাদেরকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
    অগত্যা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্য হোটেলে রুম ভাড়া পাওয়া গেল। হোটেলে ঢুকে আলো জ্বালতেই দেখলো এক বিশাল আয়না। অতসির সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদূর। অপলক তাকিয়ে থাকলো দুজনে। ব্যাগ থেকে একজোড়া প্লাস্টিকের শাঁখা বের করে অতসী বলল
    —- এটা পরিয়ে দাও।
    — এখনই পরানোর সময় হয়নি অতসী।
    আমাকে চাকরি পেতে দাও।

    — সবই হবে। কিন্তু এই মুহূর্ত কখনো ফিরবেনা। তুমি মনে প্রাণে আমার স্বামী।
    জোর করে হাতে দিয়ে বললো পরিয়ে দাও।
    অগত্যা বিপিন বাধ্য ছেলের
    মতো অতসীর দুই হাতে শাঁখা পরিয়ে দিল।বাইরে তখন দূর গ্রামে কোথাও বিয়ে বাড়ির মন্ডপ থেকে শঙ্খ ও উলুধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে।
    অতসী আবেগে বিপিনকে জড়িয়ে ধরে ঘনিষ্ঠ হলো।বিপিনের পুরুষ্ট বুকে নিজেকে সমর্পণ করে বললো

    — এখন থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী।
    এসো আজকের এই রজনী আমরা এনজয় করি।

    বিপিন শিহরিত রোমাঞ্চিত হলো। বললো
    — আজ আমাদের বিবাহ রজনী
    দুটি অভিন্ন হৃদয় মন দেহ বারেবারে মিলিত হলো।

    রাত শেষে সকাল হলো। চোখে সূর্যের আলো পড়তেই বিপিনের ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো বিছানায় অতসী নিশ্চিন্তে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। আলু থালু প্রায় বিবস্ত্র বেশবাস। সূর্যরশ্মি অতসীর সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছে।অতসীর ফর্সা নিটোল দেহ থেকে এক রশ্মি যেন ঠিকরে বেরচ্ছে। অপুর্ব মোহময়ী লাগছে। সে তার দু’চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, এত সুন্দরী তার জীবনসঙ্গিনী!এতো সেই কল্পলোকের রাজকন্যা তার শয্যাসঙ্গিনী।
    বিপিন আলতো চুম্বন দিতে গিয়ে অতসীর ঘুম ভেঙে গেলো। তার এই চুরি করে দেখাতে ছেদ পড়লো। অতসী বিপিনের বুকে মাথা রেখে আবেশে জড়িয়ে ধরল।

    দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে দুজনে ধড়ফড় করে উঠলো।
    দরজা,খুলতেই দেখলো হোটেল বয় চায়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে।
    জিজ্ঞেস করল
    —- আজ আপনারা কি কি খাবেন? খাবার কি রুমে দিয়ে যাবো?
    বিপিন কিছু বলতে যাচ্ছিল, অতসি মেনু কার্ড দেখে খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল— —-খাবার রুমেই দিয়ে যাবে।
    এভাবে দিন তিনেক হোটেলে রাত্রিযাপন করে তারা ফিরে এলো। মাঝখানে মায়ের ফোন এসেছিল। অতসী মাকে বলে দিয়েছে সে বান্ধবী শিলার বাড়িতে আছে। একদিন বাদে ফিরবে।
    অতসী নিজের গ্রামের স্টেশনে পৌঁছে কলের জলে সিঁথির সিঁদুর মুছে ফ্রেস হয়ে আলাদা আলাদা পথ ধরে ঘরের দিকে রওনা দিল।

    বাড়িতে পৌঁছে একমাত্র মেয়ের মাথায় মুছে ফেলা হয়েছে এরূপ সিঁদুরের আভার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ হলেও কিছু বললো না মা মিতাদেবী।
    শুধু বললো বাইরে থেকে এসেছো যাও বাথরুমে শ্যাম্পু মেখে ভালো করে স্নান করে এসো।
    বাথরুমের আয়নায় অতসী নিজেকে দেখে শিউরে উঠলো।

    🎒🎒🎒🎒🎒🎒🎒🎒🎒

    যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক মায়ের মন ঠিক বুঝে নিতে দেরি হলো না।
    রাতে অতসীর বাবাকে বলে ঠিক হলো অতসীর বিয়ে দিয়ে দেবে। যথারীতি ঘটক নিযুক্ত করা হলো। অনেক সম্বন্ধ এলো, তার মধ্যে একটি খুব ভালো ছেলে। দূর সম্পর্কের আত্মীয়। স্বজাতি। পাশের গ্রামেই বাড়ি। কলেজের প্রিন্সিপাল। বয়স অল্প বেশি। সাড়ে সাঁয়ত্রিশ।অর্থাৎ সতেরো বছরের পার্থক্য।
    ছেলে ও বাড়ির সবাই কোনো এক অনুষ্ঠানে মেয়েকে দেখেছে।
    দুই বাড়ির সবার পচ্ছন্দ।

    বিয়ের কথাবার্তা অনেকটা এগিয়ে গেলে একদিন মা মিতাদেবী অতসীকে বললো

    — মা অতসী। তুই বি.এ পাশ করেছিস। দেখতে আরও অনেক সুন্দরী হয়েছিস। এবার তোর বিয়ে দিয়ে দেব।
    — না।
    — না কেন? মানে কি।
    —- মানে আমি এখন বিয়ে করবো না।
    — কেন?
    —- এমনি।
    — দেখ মা। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। ঠিক সময়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা পিতামাতার কর্তব্য।
    — কিন্তু আমি তো এখন কুড়ি।
    — হলোই বা। এত ভালো ছেলে!
    হাতছাড়া কেন করব।জানিস ছেলেটা কলেজের প্রিন্সিপাল । তুই এক প্রিন্সিপালের বউ হবি। গর্বে তোর ও আমাদের বুক ভরে যাবে।
    —- আমি বিয়ে করবই না।
    — কেন।
    — আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
    —- কি বলছিস তুই?
    — হ্যাঁ। হ্যাঁ। ঠিকই বলছি।
    হঠাৎ মিতাদেবীর সেইদিনের সিঁথিতে সিঁদুরের আভার কথা মনে পড়লো।
    দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করলো। কে সেই তোর বর?
    — এবার বলো তোমরা মেনে নেবে?
    — নামটা বল?
    — বলো মেনে নেবে?
    —- যদি কলেজ প্রিন্সিপাল মলয়বাবুর চাইতে ভালো হয় তাহলে মেনে নেব।
    — কার চেয়ে কে ভালো সেটা আমার দেখার দরকার নেই।
    — বেশতো। নামটা বল?
    —- ছেলেটাকে তোমরা কেন দশখানা গাঁয়ের সবাই চেনে।
    — কে সে? নাম কি?
    — নাম তার বিপিন দাস।
    — যে তোকে জল থেকে তুলে তোর প্রাণ বাঁচিয়েছিলো?
    —- হ্যাঁ হ্যাঁ।আমি তাকে মন দিয়েছি। সেই আমার জীবন সঙ্গী।
    —- হে ভগবান! কি বলছিস তুই। নিকষ কালো গায়ের রঙ।গরীব। নীচ জাত।বেকার।বাবা দিনমজুর, মা ক্ষেত খামারে কাজ করে। অশিক্ষিত পরিবার। কোনো দিক থেকেই সে তোর উপযুক্ত নয়।
    —- তোমার মেয়ে তো মরেই গেছিলো। ওইতো তোমার মেয়েকে তোমার কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজ সে অচ্ছুৎ! বাঃ।
    একটা কথা তোমরা ভালো করে শুনে রাখো বিয়ে করলে আমি বিপিনকেই বিয়ে করব। না হলে কাউকেই বিয়ে করব না।
    (যতই মিতাদেবী মুখে বলুক না কেন, অন্তরে বিপিনের উপর একটা টান জন্মে গিয়েছিল।তার একমাত্র কন্যার প্রাণদাতা।) তবুও বললেন

    — এই তোর শেষ কথা?
    — হ্যাঁ।
    — আমি তোর বাবা ও পরিবারের সবাইকে বলে দেখি।

    🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻

    বাবা কাকা জ্যাঠামশাইরা একে একে, একসাথে এসে অনেক বোঝালো। কিন্তু কোনো মতেই রাজি করা গেলো না।
    তারা হাল ছেড়ে দিল।
    অবশেষে বিপিন ও তার পরিবারেও কথাটা পৌঁছালো।
    বিপিনের মা বাবা আচ্ছা করে ধমকে দিয়ে বিপিনকে বললো
    —–বামন হয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিস। ওই সুন্দরী শিক্ষিত জমিদার পরিবারের মেয়েকে ঘরে আনবি। সমস্ত গ্রাম একঘরে করে দেবে। দুমুঠো খাচ্ছিলাম তাও বন্ধ করে দিবি তুই।
    যা এক্ষুনি গিয়ে মেয়েটাকে বলে আয়।
    বিপিন মোবাইলে অতসীকে ডেকে পাঠালো মিত্রদের বাগানে সেই পরিত্যক্ত কুয়ার ধারে।
    আকাশে মেঘের ঘনঘটা যেকোনো সময় বৃষ্টি আসবে।
    আলো আঁধারিতে বিপিনকে দেখতে পেয়ে অতসী জড়িয়ে ধরে বললো
    —- বাড়ি থেকে আমাকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছে।
    — বেশ তো?

    —- আমার বিয়েতে মত নেই।
    আমি তোমাকে আমার স্বামী বলে মনে করি। মায়ের মন্দিরে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

    — দেখো অতসী। তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমি বেকার। চাকরি পেলেও বিশাল কিছু বেতন পাবোনা। আমরা গরীব।
    তুমি আমাকে ভুলে যাও। আজ থেকে তোমার আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।

    —- তা হয়না।
    — আমি তোমাকে ভালবাসি।
    তাই তোমার কোনো ক্ষতি আমি চাইনা।

    বলতে বলতে বিপিন অতসীর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
    অতসী ডাকলো
    —– বিপিন দা ——-

    বিপিন ঘুরে দাঁড়াল।

    অতসী সামনে এসে বলল
    —- সামাজিকতা রক্ষার জন্য আমি বিয়ে করলেও তোমায় আমায় যোগাযোগ থাকবে। আমি বাপের বাড়ি আসলেই তোমাকে ডেকে পাঠাবো।
    তুমি আসবে।
    বিপিন মৌন থেকে সম্মতি জানাল।
    🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻🗻

    মহাধূমধামে পাশের গাঁয়ের কলেজ প্রিন্সিপাল মলয় বোসের সাথে অতসীর বিয়ে হয়ে গেলো।
    বহু নিমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে ও আপাদমস্তক স্বর্ণালংকারে ভূষিত হয়ে অতসী শ্বশুর বাড়ীতে এলো।
    সোহাগ রাতে বর এলো অনেক রাতে। এসে বলল।
    —আমাকে কালই জরুরী কাজে কলেজে যেতে হবে। আজ বড্ড টায়ার্ড।বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো।
    এই ঘটনা নিত্য ঘটতে লাগলো।
    একদিন গভীর রাতে অতসী লক্ষ্য করলো খাতায় কি সব লিখছে।
    কলম কেড়ে নিয়ে বলল
    —-আমি আপনার বউ।আজ প্রায় দু মাস হয়ে গেলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।
    আমি প্রতিদিন আপনার অপেক্ষায় থাকি।
    আপনি অনেক শিক্ষিত। আমি মনে হয় আপনার উপযুক্ত হতে পারিনি।
    _ নানা তেমন কিছু নয়। আমি নানান কর্মে ও চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। তোমার সঙ্গ দিতে পারিনা। তাছাড়া তুমি বিয়ের পর অনেকবার বাপের বাড়ি গিয়েছো। কোনো বাধা দিইনি। আর দেবোও না। তোমার কিছু দরকার হলে মাকে বলো। কাজের মেয়েটাও দীর্ঘদিন ধরে আছে। যা কিছু প্রয়োজন ওকে দিয়ে আনিয়ে নিও।
    এভাবে দিন চলে যায়।
    অতসী তার স্বামীর খুব খেয়াল রাখে। সকাল বেলা বেড টী থেকে জল খাবার লাঞ্চ প্যাক নিজে হাতে বানিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়া থেকে ফোন করে খোঁজ নেয় যে মলয় বাবু খাবার খেয়েছে কিনা? রাতে এসেও শুধু কাজ আর কাজ। বউকে আদর করার এক বিন্দু ফুরসৎ
    নেই। ফুরসত নেই বউয়ের সাথে কথা বলার। বিছানার যে কি আনন্দ সেতো অধরাই থেকে গেলো।
    এভাবে মাস দুয়েক কেটে গেলো। শাশুড়ী মা খুব ভালো বাসেন। খুব ভালো।
    ইদানীং একটা কেমন যেন সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো।
    তার স্বামীর তার প্রতি এত অনীহা কেন?
    গভীর ঘুমের ভান করে সে জেগে জেগে ফলো করল।
    দেখলে তার স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আসক্ত।

    একদিন অতসী বলেই দিল আমাকে যদি আপনার পছন্দ ছিলোনা তাহলে বিয়ে করেছেন কেন? আমাকে বাপের বাড়ি পৌছে দিয়ে আসুন।
    — সেতো যাচ্ছো আসছো।অবাধ স্বাধীনতা। এই দু-মাসে কতবার যাওয়া হলো গুনেছো?
    দেখো অতসী। তুমি আমার বউ। তোমার গর্ভে সন্তান হলে সেই হবে এই আমার বিষয় সম্পত্তির ওয়ারিশ।এই বাড়িতে সবকিছুতে পূর্ণ অধিকার তোমার।
    — আর ভালোবাসা?
    —-ভালোবাসা। ওসব ছেলে ছোকরাদের কাজ কারবার।
    এর বেশি আমার কাছ থেকে
    আশা করো না।
    — বুঝেছি। আমার মতো অসুন্দর মেয়েকে আপনার পছন্দ নয়।

    — না না। তা নয়। তুমি প্রকৃত সুন্দরী। রূপ লাবন্য ফিগার সত্যি প্রসংশার যোগ্য। আমি ও আমার পরিবার প্রতিমার মতো সুন্দরী বউ পেয়ে গর্বিত।তোমার মতো এক সুন্দরী বউ শিক্ষাজীবনে ট্রিপল এম.এ,
    ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, ডক্টোরেট সহ আমার অনেক সার্টিফিকেটগুলির চেয়েও মূল্যবান অলংকার।
    — আমাকে অলংকার ভেবে গলায় ঝুলিয়ে রাখা যায়, লকারে রাখা যায়, কিন্তু বিবস্ত্র করে ভোগ করা যায়না!
    অর্থাৎ আমি শো কেসের পুতুল। আমার সুন্দরতা নিয়ে গর্ব করা যায়, কিন্তু বিছানায় তাকে আনন্দ দেওয়া যায়না।
    আমাকে সুন্দরী বউ বলা যায় কিন্তু পার্টিতে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়না!

    — অনেকটা তাই।
    — আমি সব জানি। সব জেনেছি আপনার মোবাইল থেকে। আপনি শুধু আমাকে বঞ্চিত অবহেলিত করেননি। আপনি নিজেও পরকীয়ায় লিপ্ত। আপনার অন্য এক প্রেমিকা আছে। তার সাথে আপনার বিছানার সম্পর্ক আছে।
    — (কিছুক্ষন নিরুত্তর থেকে)
    যদি তাই হয় তাতে অসুবিধা কোথায়? পরকীয়া এখন বৈধ।সুপ্রিম কোর্ট তো রায় দিয়ে দিয়েছে।
    তুমি উচ্চশিক্ষিত নও তা সত্ত্বেও তোমাকে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি এবং দিয়ে যাব চিরদিন। তোমার হাজার খুঁত থাকলেও আমার স্ত্রীর মর্যাদা তুমি পাবে। এটা কী ভালোবাসা নয়?
    —-বেশ আমি আপনার সম্মানহানি করবো না।আপনি শিক্ষিত মহলের গর্ব। আমরা আপনাকে পেয়ে গর্বিত।
    দয়া করে আপনার এই কারাগার থেকে আমাকে মুক্তি দিন।
    —- মুক্তি মানে? ডিভোর্স?
    — না ডিভোর্স চাই না। আমি জানব আমার কোনো বিয়েই হয়নি।
    — তোমাকে আমি স্বাধীন করে দিলাম। তুমি আমার পথে বাধা দেবেনা।অনেক দায়িত্ব একটা কলেজ প্রিন্সিপালের।
    তুমি আমার স্ত্রী হয়ে থাকো।
    — আমাকে কালই নিজের গাড়িতে আমায় বাপের বাড়ি পৌছে দিন।
    এক ছুটির দিনে প্রিন্সিপাল জামাই শ্বশুর বাড়ি এলো। মিত্র পরিবারের বাড়িতে এক মহা ধুমধাম পড়ে গেলো।
    সবারই কাছ থেকে সমাদর গ্রহণ করে মলয়বাবু সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে ফিরে গেলো। দুটি পিঞ্জর-বদ্ধ বিহঙ্গ মুক্ত হলো।
    🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦

    নিরিবিলিতে অতসী ফোন করলো বিপিনকে।
    – বলো কেমন আছো অতসী?
    — আমি ভালো নেই। আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই আজ এই মুহুর্তে। মিত্র বাড়ীর বাগানে। সেই পরিত্যক্ত কুয়া তলায়।
    — তা হয়না অতসী। তুমি এখন অন্য কারোর বউ।আমি তোমার ভালো চাই। তুমি সুখে থাকো।
    জানাজানি হলে কেলেঙ্গারি হবে।
    — এর আগে তুমি আমি বিয়ের পর কতবার মিলিত হয়েছি। কতবার দেহ মিলন হয়েছে কই বাধা দাওনি।
    আমরা তো আমার বেডরুমেও মিলিত হয়েছি। মা দেখেওছে।

    — আমরা এক বিপদজনক কর্মে লিপ্ত। আমি আর আসব না।

    —-কি বললে? তুমি আসবেনা?
    বেশ তাহলে শুনে রাখো
    তুমি যদি না আসো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।

    —এরূপ অলক্ষুণে কথা বলবে না।


    রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে যখন মিত্র বাড়ির সবাই নিজ নিজ ঘরে বন্দী। কেউ টিভি দেখছে কেউ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সেই সময় অতসী ঘর থেকে বের হয়ে মিত্র বাগানে পরিত্যক্ত কুয়া তলায় পৌঁছে দেখলো বিপিন আগে থেকেই অপেক্ষা করছে।
    অতসী বিপিনকে দেখে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে বললো
    — আমি চলে এসেছি বিপিনদা।
    চলো আমরা পালিয়ে যায়।
    — কি বলছো তুমি। আমি বেকার ছেলে আমরা কি খাব?
    কোথায় থাকবো। বহু চেষ্টা করে চাকরি জোগাড় করতে পারিননি। ড্রাইভিংটা শিখেছি। এখানেই কোনো গাড়ি পেলে চালাব।

    — আর তোমার কি খবর?
    —- আমি আর শ্বশুর বাড়ি যাবনা। আমি ঠকে গেছি। তারপর একেএকে সব কথা বলে শোনালো।
    মলয়বাবুর সাথে তাদের কথোপকথনের ভয়েস টেপ
    ফরওয়ার্ড করে দিল বিপিনের মোবাইলে। শুনে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিও।
    —- শুনে তাজ্জব হয়ে বিপিন অতসীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
    — ঈশ্বর আছেন। তিনি আমাদের দুজনের পুনর্মিলন ঘটিয়ে দিলেন।

    —- হ্যাঁ। এবার তোমার কাছ থেকে একটা উপহার চাই।
    —- আমি গরীব মানুষ। আমার সামর্থ্য নেই।
    — যদি থাকে?
    — আমার সামর্থ্য থাকলে আকাশের চাঁদকে তোমার হাতে দিয়ে দিতে পারি। বলো কি চাই?
    — আমি চাই তোমার ঔরসজাত সন্তানের মা হতে।
    হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। সিক্ত বসনে তারা ঘনিষ্ট হলো।
    🎇🎇🎇🎇🎇🎇🎇🎇🎇

    এভাবে তারা সময়ে অসময়ে ঘরে বাইরে
    বাগানে,গাড়িতে,সরোবরে মন্দিরে সুরম্য স্থানে কখনো অন্দরমহলে সান্নিধ্য লাভ করতে লাগলো।
    ঘন ঘন মিলনে অল্পদিন পরেই অতসী গর্ভবতী হলো। মিতাদেবী নিজে গাড়ী করে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলেন।

    নিদিষ্ট দিনে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। মিত্র বাড়ি ও প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে খুশির বন্যা বইয়ে গেলো।
    ছেলেটি অবিকল দেখতে অতসীর মতো।
    মলয় স্যার শিশু পুত্র পেয়ে খুব খুশি। শিশুটির কপালে চুমু খেয়ে বললো
    — বোস বাড়ির উত্তরাধিকার।
    প্রিন্সিপাল ডঃ মলয় বোসের পুত্র।আমি তোমাকে অনেক অনেক শিক্ষিত করে তুলব।
    দেখো দেখো মায়ের অবিকল রূপ। দেহের গঠন সবকিছুই মায়ের মতো। তুমি মায়ের মতো অবিডিয়েন্ট হবে।
    ঠাকুমা এসে বললেন
    — মা গড়ানি ছেলে খুব সুখী হয়।

    🥦🥦🥦🥦🥦🥦🥦🎉🎉🎉🎉🎉🔔🔔
    মলয় স্যারের বাড়িতে আদরে সোহাগে লালিত পালিত হতে লাগলো শিশুটি।
    অতসী তার ছেলের নাম রাখলো অবিনাশ।
    অতসীর “অ” আর বিপিনের “বি” মিলিয়ে। ডাক নাম অবি।
    সারা দুনিয়া মলয় বোস, কলেজ প্রিন্সিপালের পুত্র জানলেও ,
    অতসী, বিপিন আর অতসীর মা শুধু জানলো শিশুটির জন্মদাতা পিতা হলো বিপিন।

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- অতৃপ্ত বাসনা

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার এর গল্প ।।

     

    অতৃপ্ত বাসনা

    -শচীদুলাল পাল

     

     


    স্টেশন লছমনপুর।বীরভূম ঝাড়খন্ড সীমান্ত। ভীমগড় থেকে পলাস্থলি রুটের একটাই ট্রেন। সকাল ৭ টায় যায় রাত আটটায় ফেরে।ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম লোকজন বিশেষ নেই। দুএকজন যদিওবা ছিল তারা দক্ষিনে দিকে চলে গেলো । আমাকে উত্তরদিকে লছমনপুর গ্রামে যেতে হবে ক্যানসার আক্রান্ত বন্ধুকে দেখতে। কলেজে পড়ার সময় আরও দুজন সহপাঠী বন্ধুর সাথে একবারই এসেছিলাম।
    বেশ অবস্থাপন্ন।
    বিশাল অট্টালিকা। ঘুরে ঘুরে ঘরগুলি দেখিয়েছিল বেশ গোলোক ধাঁধাঁর মতো ঘরগুলি। একবার যদি কোনো ডাকাত দল ঢুকে পড়লেও সে বেরতে পারবেনা। একবার এক ডাকাত দলকে দরজা বন্ধ করে আটকে রেখে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল।

    আজ আমি একা। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। নিশুতি রাত। মেঘে ঢাকা আকাশ। গা ছমছম। চাঁদ ওঠেনি। সরু মেঠো পথ।নিস্তব্ধ নিঝুম। শাল পিয়ালের বন।রাস্তা ভুলে গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে অনেকটা পথ চলে এসেছি। গভীর বনের শেষে এক পরিত্যক্ত মাটীর বাড়ি। পাশে ছোট নদী কুল কুল বয়ে চলেছে। থমকে দাঁড়ালাম। ভুল পথে এসেছি। আবার যে পথে এসেছি সে পথই ধরলাম। কিন্তু না কোথায় যাচ্ছি?একটা গোলোক ধাঁধায় পড়লাম।

    একটা পিয়াল গাছতলায় এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ ভাবলাম, মনে করার চেষ্টা করলাম।
    হঠাৎ একটা খসখস শব্দ।শুকনো পাতার উপর চললে যেমন হয়।স্পষ্ট দেখলাম একজোড়া নারী পুরুষ এগিয়ে আসছে। যুবক যুবতী। এগিয়ে এসে যুবতি মেয়েটি বলল “আপনি কোথায় যাবেন”? আমি বললাম “লছমনপুর গ্রাম “।মেয়েটি বলল” আপনি ভুল করেছেন। এটা গ্রামে যাবার পথ নয়।আমাদের সাথে আসুন আমরা আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। আমরা ঐ গ্রামেরই।আমি ওদের অনুসরণ করলাম। মেঘের ফাঁকে একফালি চাঁদ।
    কখনো আলো কখনো ছায়া। মাঝে মাঝে চাঁদের আলোয় ওদেরকে দেখছিলাম। মেয়েটি গান গাইছিল আর ছেলেটি বাঁশি বাজাচ্ছিল।

    জিজ্ঞেস করলাম “তোমরা কে”?মেয়েটি বলল ” আমি পিয়ালি আর ওর নাম পলাশ”।আমরা দুজনে দুজনকে খুব ভালবাসি।পথ চলতে চলতে আমরা একটা গ্রামের সামনে এসে পড়লাম। পিয়ালি বলল “কার বাড়ি যাবেন?” আমি আমার বন্ধুর নাম করতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তারপর বলল “আসুন”। বাড়ীটির কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না কোন দিকে গেলো। বাইরের দরজায় টোকা দিতে বন্ধুর স্ত্রী দরজা খুলে দিল। বিশাল অট্টালিকা। অসুস্থ বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। রাতের খাবার খাইয়ে বন্ধুর স্ত্রী দোতলায় একটা ঘর খুলে বলল “এখানে আপনি ঘুমাবেন”।
    দক্ষিণ খোলা।আলো বাতাস পূর্ণ দোতলার ঘরটি বেশ মনোরম। কিছুক্ষন কথাবার্তা শেষে ওরা চলে গেলো। আমি দরজায় খিল এঁটে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। পথশ্রান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
    হঠাৎ একটা বিভৎস চিৎকারে আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো।কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম।আলো জ্বেলে দেখলাম নাঃ,কেউ কোথাও নেই।আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।আবার একটা অস্বাভাবিক শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর। স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা একটা মেয়ে আমার পাশে বসে আছে। একফালি চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পড়লো। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম” কে তুমি “?
    মেয়েটি বেশ জোর গলায় বলল “আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি পিয়ালি”। ভয়ে উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো।নিজের হাতে দরজা বন্ধ করেছি কোথা থেকে সে এলো? হঠাৎ পিয়ালির চোখ দুটি বড়ো হয়ে গেল। আগুন ঠিকরে বেরতে লাগলো। ভয়ংকর বিভৎস মূর্তি।ঘরের আলো একবার জ্বলছে একবার নিভছে। আকাশ বাতাস চিরে অট্টহাসি। আমার খাটটা দুলতে লাগল। একবার আলো একবার অন্ধকার। পিয়ালি কখনো খাটের উপর কখনো নীচে।কখনো এপ্রান্তে কখনো ওপ্রান্তে। সর্বত্র দেখছি পিয়ালি।
    হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি।কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। সামনে পলাশ। পিয়ালি পলাশ একসাথে আমাকে গ্রাস করতে আসছে। আমি চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালাম। সম্বিত ফিরে পেলাম কে বা কারা যেন বাইরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম বাইরে বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী । তারা ঘরে এসে বসল।জিজ্ঞেস করল” এত জোরে চেঁচাচ্ছিলে কেনো? “।আমি বললাম “পিয়ালি পলাশ এসেছিলো, পিয়ালি কে?” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুটি বলল “পিয়ালি আমার বোন”।
    বন্ধু পত্নী যা বলল তা শুনতে শুনতে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল।

    —অনেকদিন আগে, দু দুবার চেষ্টা করেও এক কুখ্যাত ডাকাত এই বাড়িতে ডাকাতি করতে পারেনি।
    সেই আক্রোশে এগারো বছরের স্কুল ফেরতা পিয়ালি কে কিডন্যাপ করে জঙ্গলে এক পরিত্যক্ত ঘরে আটকে মুক্তিপন চেয়ে চিঠি লিখেছিল।
    লিখেছিল “পিয়ালিকে পেতে হলে দশ লাখ টাকা নিয়ে এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যা। তা নাহলে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব।
    পুলিশে জানালে তোদের সবাইকে শেষ করে দেব।”

    বাড়িতে এক বিমর্ষতা ও অন্ধকার ছেয়ে এসেছিল।
    পলাশ নামে একটি ছেলে এসে বলেছিল
    —আমি জানি পিয়ালিকে কে তুলে নিয়ে গেছে। আমি পিয়ালিকে উদ্ধার করে আপনাদের ফেরত দেব।
    আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে সেই রাতে চুপিচুপি সেই ডাকাতদের আস্থানায় ঢুকে ঘুমন্ত এক ডাকাতের বন্দুক চুপিসারে নিয়ে সেই ঘরে ডাকাত দলের সবকটাকে গুলি করে মেরে পিয়ালিকে উদ্ধার করেছিল।
    সেই থেকে পিয়ালি- পলাশ একে অপরকে ভালবাসত।কয়েক বছরের মধ্যে ভালোবাসা গভীর হলো।
    এখানে সেখানে তারা মিলিত হতো।আমরা পিয়ালিকে ঘরে বন্দী করে রাখতাম।
    কয়েক বছর পর একদিন পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে পলাশকে বিয়ে করেছিল।
    পলাশ ছিল জাতে বাউরি।গরীব। আমরা মেনে নিইনি।একদিন ওরা আবার পালিয়ে যায়।জঙ্গলের মধ্যে একটা পিয়াল গাছে গলায় দড়ি দিয়ে দুজনে একসাথে আত্মহত্যা করেছিল।সকালবেলা গ্রামের লোক বাড়ীতে খবর দিয়েছিল।” বলতে বলতে বন্ধু পত্নী অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
    আমার রক্তের ভিতরে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো।

  • কবিতা

    কবিতা- দিনলিপি

    দিনলিপি
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    দিন শেষে রাত্রি নামে ধরিত্রী কুলায়,
    দিনলিপি লিখি রোজ ডায়েরি খাতায়।
    সুখদুঃখ ভালো মন্দ হিসেব নিকেশ,
    ঘটমান বর্তমান থেকে যায় রেশ।
    আজকের বর্তমান কাল ইতিহাস,
    রোজনামচায় আছে তারই প্রকাশ।
    কলেরা বসন্তে কেড়ে নিল কার প্রাণ,
    প্লেগ যক্ষা স্পেনিস ফ্লু কখন প্রস্থান।
    তিনশ টাকা ভরি সোনাতে হলো কন্যাদান,
    আইএস অফিসার আশি টাকা বেতন।
    কিশোরীর প্রেমপত্রে মন উচাটন।
    আছে লেখা প্রেমে হলো কার প্রত্যাখ্যান।
    স্কুলে কম মার্কস পেয়ে হলো মনমরা,
    মাধ্যমিকে জেলাস্তরে প্রেমিকাই সেরা।
    এম.টেক. করে কবে কর্মে যোগদান,
    কত বিয়ের খরচ লোক সমাগম।
    সোহাগ রাতের সেই প্রথম মিলন,
    সে’রাতে বন্ধ দুয়ার ভাঁঙার বর্ণন।
    বিয়াল্লিশের আকালে ঘরে চাল নাই,
    বিনা ভাতে মরে লোকে ঘাস পাতা খায়।
    আটাত্তরে বন্যা জলে নিশ্চিহ্ন সম্বল,
    সাপ মানুষ একডালে কেটে যায় কাল।
    কলেরায় লোক মরে ঘর শুনশান,
    ভরে গেছে মাকড়সা জালেতে উনান।
    মশার কামড়ে হলো ম্যালেরিয়া ডেঙ্গি,
    অকালে জীবন দিলো কতশত সঙ্গী।
    মহাজাগতিক সূর্যগ্রহণ বলয় গ্রাসে,
    ফায়ার অব রিং দেখে স্মরণীয় দৃশ্যে।
    ভারতের চন্দ্রযান চাঁদের মাটিতে,
    মঙ্গলে মঙ্গলযান গর্বিত ভারতে।
    কাশ্মীর লাদাখ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,
    সত্তর বছর বাদে এক দেশে সঙ্গ।
    নোট বাতিলে লাভবান লক্ষকোটিপতি,
    হয়রান লবেজান দুস্থ চুনোপুঁটি।
    লিভ টুগেদার, সহবাস বিয়ে বিনে,
    সামাজিকতা বিলুপ্ত অতিমারী দিনে।
    পরকীয়া প্রেম বৈধ সুপ্রিম আইনে,
    প্রেমিক প্রেমিকা মুক্ত ভুলবে কেমনে।
    পাশ ফেল গেলো উঠে আনন্দে বিদ্যার্থী,
    শিক্ষা গেলো তলে, খর্ব জ্ঞানের পরিধি।
    মনের পাতার স্মৃতি যদি ভুলে যায়,
    ডায়েরি পাতায় পড়ে, মনে পড়ে যায়।

  • কবিতা

    কবিতা- চলো যাই মেলা

    চলো যাই মেলা
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    সমাজবদ্ধ নারীপুরুষ
    মিলনেচ্ছার মিলন,
    একত্রিত সমাগমে
    মেলা সমাজ বন্ধন।

    দড়িটানা রথযাত্রা
    বহু লোক সমাগম।
    ভেঁপু- বাঁশি পাঁপড়ভাজা
    বৃষ্টি এলো ঝম ঝম।

    পাটিসাপ্টা সরুচুগলি,
    পৌষসংক্রান্তি দুধপুলি।
    এসো সবাই যায় গো চলে
    জয়দেবের কেন্দুলি।

    অজয় নদে শুদ্ধাচারে
    করি ভোরবেলায় স্নান,
    সর্বত্যাগী বৈরাগীদের
    রাতভর বাউল গান।

    সাগরমেলা সাগরসঙ্গম
    পূণ্যার্জনে সিনান,
    কপিলমুনির মন্দির দর্শন
    মেলায় রাত্রিযাপন।

    নবকুমার হব আমি
    হও কপালকুণ্ডলা,
    প্রেমকাহিনী গড়বো আবার
    চলো সাগরমেলা।

    কিনে দেব রেশমি চুড়ি
    যেওনা বাপের বাড়ি।
    গ্রামীণ মেলায় নাগরদোলায়
    চলো বনবন ঘুরি।

    খাব মিঠাই রসগোল্লা
    চপ কাটলেট ঝালমুড়ি,
    কলকাতারই যাত্রাপালা
    ছয়রসে মন চুরি।

    ভেলকি ম্যাজিক সার্কাস কীর্তন
    ভাদু টুসু গানে,
    লোকসংস্কৃতি মনোরঞ্জন
    মেলার পীঠস্থানে।

    হরেকরকম জিনিসপত্রে
    মনহরে দোকানি,
    মনোহারি দোকানেতে
    ইচ্ছেমতো কিনি।

    আদিবাসীর ধামসা মাদল
    পুরুলিয়ার ছৌনাচ,
    কবি লড়াই বাউল গান
    উচ্চস্বরেরই আঁচ।

    দীর্ঘরাস্তা পদব্রজে
    শিবলিঙ্গে জল ঢালা,
    জনারণ্য তারকেশ্বর
    যাই শ্রাবণী মেলা।

    রাধাকৃষ্ণের দোলনদোলায়
    চলো যাই উখরায়।
    প্রথম প্রেমের প্রথম ছোঁয়া
    স্মৃতির ঝুলন মেলায়।

    শান্তিনিকেতন যাই চলো
    রঙবেরঙ পৌষ মেলায়,
    নানা রঙের সেই দিনগুলি
    মনেতে রয়ে যায়।

    রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত
    বসন্তোৎসবের দোল,
    নবযৌবন আনন্দেরই
    নাচ গান রঙে শোরগোল।

    প্রয়াগেতে কুম্ভমেলা
    অমৃতেরই সন্ধান,
    লক্ষলোকে জনারণ্য
    ত্রিবেণী পুণ্যস্নান।

    টুসুগানে সারা পৌষমাস
    মাতে বিটি ছিলা,
    সংক্রান্তির ভোরে চান সেরে
    মানভূম টুসু মেলা।

    অলৌকিক গুণসম্পন্ন
    সুফি পীর স্মরণে।
    পাথরচাপড়ির মেলা দাতা
    মেহবুব শাহ মননে।

    দুর্গা লক্ষী শঙ্কর কালি
    পুজায় মেলার চলন,
    বারো মাসে তেরো পার্বণ
    মেলা আবহমান।

    শিবথানে শিবরাত্রি
    চড়ক গাজন মেলা,
    শিবসম বরলাভে উপোস
    কুমারী নির্জলা।

    বইমেলাতে বইপোকারা
    পড়ে দেখে কেনে,
    সেরা বন্ধু পুস্তকেতে
    জ্ঞানী খুশি মনে।

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- হিংসা

    হিংসা
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    ষড়রিপুর মধ্যে মাৎসর্য এক রিপু। মাৎসর্য বিষে জর্জরিত হয়ে আসে পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা। আর ঈর্ষা থেকে জন্ম নেয় হিংসা।

    মানুষ সব সময় নিজেকে প্রথম স্থানে দেখতে চায়। এটা তার চাহিদা। কিন্তু যখন মানুষ এই স্থানে অন্য কাউকে দেখে তখন তার মনে একটা জেদ আসে। যতক্ষণ সে সেই জেদটা চেপে রাখতে পারে ততক্ষণ সেটা জেদ। আর যখন প্রকাশ পেয়ে যায় তখনই সেটা হিংসাতে পরিণত হয়।
    লোভ থেকেও হিংসার জন্ম হয়। মানুষ অন্যকে একটা কিছু পেতে দেখে নিজেও সেটা পেতে চায়। অন্যের উন্নতি সে দেখতে পারে না।
    সে বদলা নেবার প্রচেষ্টা করে। প্রথমে কারণে অকারণে তাকে অপমান করে নিচু দেখিয়ে মনের ঝাল, মনের জ্বলন মেটায়।
    যে ব্যক্তি অপমানিত হয় সে যদি ভাবে। আমাকে কেন অপমান করলো! তাতে সে দেখবে সে আমার স্থানে কোনোদিন আসতে পারবে না। তাই তার মধ্যে হিংসার বহিঃপ্রকাশ।

    কিন্তু যখন সে সেইটা পায় না তখন যেই ব্যক্তি ওই জিনিষটা পেলো তাকে সে হিংসা করা শুরু করে।

    মানবচরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকারক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষময় করে তোলে। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস করে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা-বাসনাকে হিংসা বলা হয়।

    হিংসা করলে যার প্রতি করা হয় তার কোনো ক্ষতি সাধারণত হয় না কিন্তু হিংসুক ব্যক্তি তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এর পেছনে ব্যয় করে যে নিজেরই ক্ষতি সাধন করছে তা বোঝার
    মত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে।

    সুযোগ খোঁজে কি করে অন্যের অনিষ্ট করবে। তার ঈর্ষানল প্রজ্বলিত হয়। রাগে অন্ধ হয়। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সে আঘাত করে বসে। পরিণাম সংঘর্ষ হানাহানি লড়াই। যুদ্ধ হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হয়।

    একটা দেশ একটা জাতি একটা গোষ্ঠী অন্য দেশ অন্য গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

    বিশ্ব ইতিহাস আজ কলুষিত এই হিংসার কারণে।
    ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার কুৎসা রটিয়ে নিজের জলন দূর করে হিংসার আর একটি বহিঃপ্রকাশ হলো ঠাট্টা বিদ্রুপ করা।

    প্রকৃত আদর্শবান ব্যাক্তি, মহান ব্যক্তি হিংসা দ্বেষ জলনকে উপেক্ষা করে।
    একটা দেশ জাতি গঠনে হিংসাহীন মানসিকতা কাম্য।

    ঘরে ঘরে পাড়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যেই দেখা যায় ভাইয়ে ভাইয়ে, জায়ে জায়ে প্রতিবেশীদের মধ্যেই হিংসা বেশি প্রকটিত হয়। কারোও ছেলেমেয়ে পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি করে উন্নতি করলে ভীষণ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের হিংসা বেশি হয়।
    ফলস্বরূপ জ্বলে পুড়ে মরে। এই যে জ্বলন সেখান থেকে হরমোনের ক্ষরণ হয়। ফলত এড্রিন্যাল গ্ল্যাড থেকে ক্ষরণ হয়। তাতেই ইন্ডাইজেশন, আলসার, ডায়াবেটিস, কিডনি লিভারের মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টি হয়।
    হিংস্র প্রাণীরা বেশিদিন বাঁচে না। পরন্তু কচ্ছপ, শান্ত নম্র ধীর অহিংসক প্রাণী প্রায় তিনশ বছর বাঁচে।
    ডাইনোসরাস হিংস্র প্রাণী লড়াই করে অন্যকে হত্যা করে নিজেদেরই ধ্বংস করেছিল।

    নারী সহীংসতা
    ———————-
    সহিংসতাঃ সহিংসতা বলতে আমরা বুঝি অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, অতিরিক্ত শাসন, যৌন হয়রানি বিবিধ। জন্মের পর থেকেই একটি শিশু বিভিন্ন ভাবে সহিংসতার  শিকার হয়।

    নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে সহিংস অপরাধগুলো যেগুলো প্রধাণত বা কেবলই নারী বা বালিকাদের উপরেই করা হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই ঘৃণাপূর্বক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়,
    যা নারী বা বালিকাদের উপর করা হয় কেননা তারা নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার খুব লম্বা ইতিহাস রয়েছে, যদিও এরকম সহিংসতার মাত্রা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল, এমনকি আজও বিভিন্ন সমাজে এগুলোর মাত্রা ও ঘটনার ধরণ বিভিন্ন হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই নারীকে সমাজে বা আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কে অধীনস্থ করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তি তার অধিকারপ্রাপ্তির বোধ, উচ্চস্থানের বোধ, নারীবিদ্বেষ, বা নিজের সহিংস প্রকৃতির জন্য নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করতে পারেন।

    নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান সমস্যা। সমগ্র বিশ্বজুড়ে তিন জন নারীর অন্তত একজনকে মারা হয়েছে, জোরপূর্বক যৌনক্রিয়া করতে বাধ্য করা হয়েছে, বা অন্য কোনোভাবে তার জীবনে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে যেখানে নির্যাতনকারী কোনভাবে তার পরিচিত ছিল।

    নারীর প্রতি সহিংসতাকে কয়েকটি বৃহৎ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এগুলোর মধ্যে “ব্যক্তির” দ্বারা সহিংসতা ও “রাষ্ট্রের” দ্বারা সহিংসতা উভয়ই রয়েছে। সহিংসতার কোন কোন ধরন আছে যা ব্যক্তির দ্বারা ঘটে যথা – ধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন, যৌনহয়রানি,  প্রজননগত জোর-জবরদস্তি,  কন্যাশিশুহত্যা, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত,  উচ্ছৃঙ্খলা জনতার দ্বারা সহিংসতা বা দাঙ্গা, রীতি বা আচারগত চর্চা যেমন সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনর কিলিং, যৌতুক সহিংসতা বা পণ মৃত্যু,  অপহরণপূর্বক বিবাহ বা জোরপূর্বক বিবাহ। আবার কিছু কিছু ধরনের সহিংসতার কর্তা হচ্ছে রাষ্ট্র, যেমন – যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা, সংঘর্ষের সময় যৌন সহিংসতা এবং যৌন দাসত্ব, বাধ্যতামূলক নির্বীজন, জোরপূর্বক গর্ভপাত, পুলিশ ও কর্তৃত্বকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দ্বারা সহিংসতা, পাথর ছুড়ে হত্যা বা চাবুক মারা। আবার অনেক ধরনের যৌন সহিংসতা সংঘটিত সংগঠিত অপরাধ চক্রের দ্বারা, যেমন – নারী পাচার এবং জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তি।

    নারীর জন্ম থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সকল পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ধরন নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে।

    সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে যেখানে বিভিন্ন সম্মেলন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন,বিভিন্ন ডিরেক্টিভ এর সাহায্যে আন্তর্জাতিক মাত্রায় এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চাচ্ছে, যেমন যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ডিরেক্টিভ, মানব পাচারের বিরুদ্ধে ডিরেক্টিভ।
     উল্লেখ্য, এখানে ডিরেক্টিভ বলতে কোন আন্তর্জাতিক সংঘের একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা লক্ষ্যমাত্রাকে বোঝানো হয় যেখানে সংঘটির সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে সেই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়, কিন্তু সেই লক্ষ্যপূরণের উপায় সেখানে বলে দেয়া থাকে না।

  • গল্প

    গল্প- বেকারের জ্বালা

    বেকারের জ্বালা
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    মুর্শিদাবাদ জেলার কোদলা গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। গ্রামের অন্যপ্রান্তে গঙ্গা। ১৮ কিমি দূরে শহর বহরমপুর।
    ২৭ বছর বয়সী চঞ্চল এম.এ. পাশ করে হন্যে হয়ে ঘুরে সরকারি, বেসরকারী কোনো চাকরি যোগাড় করতে পারেনি। বিশাল তার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। চাকরি তো পেলই না। সাধারণ কোনো আয়ের সন্ধান পায়নি।
    বাবা মা বেকার ছেলের প্রতি যে সহানুভূতি দেখাতো তাও কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বৌদি দিনরাত বেকার, কর্মহীন বলে খোঁটা দেয়। দাদা তো বৌদির কথায় ওঠ বোস করে।দাদা প্রথম প্রথম হাত খরচের দু’ পাঁচ টাকা হাতে দিত। এখন বৌদির প্ররোচনায় তাও বন্ধ। ভাইঝি ভাইপোরা মায়ের শেখানো “অকর্মণ্য” বলে কথা শোনায়। সবার তীব্র শ্লেষাত্মক কথার আঘাতে কর্মহীন যুবক চঞ্চল জর্জরিত।
    খেতে বসে একদিন চঞ্চল বললো- বৌদি একটু তরকারি বা ডাল দাও।
    বৌদি ঝেঁকিয়ে উঠে বললো- আর নেই বিধবা মেয়ের মতো বসে বসে খাচ্ছো, লজ্জা করে না!

    কাঁদো কাঁদো স্বরে দাদাকে জানালো সব কথা। দাদা মোটা বেতনের সরকারি চাকরি করে। অনেক দুনম্বরী ইনকাম।
    দাদা সব শুনে বললো- ঠিকই তো। দু’টাকা রোজগার করবার মুরোদ নেই, ভাতের সাথে তরকারি জুটবে কোথা থেকে। আমি আর তোর খাওয়া খরচের ভার সামলাতে পারছি না। আমরা ভাবছি অন্যত্র কোথাও চলে যাব।
    মা বাবাও আর আগের মতো নেই। বাবা বলেই দিল- লেখাপড়া শেখালাম, ভাবলাম কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিবি। বৃদ্ধ বয়সে মা বাবাকে দেখবি। সে আশায় জল ঢেলে দিলি।
    -বাবা আমাকে কিছু টাকা দিও ব্যাবসা করবো।

    -আবার টাকা! এস এস সি তে স্কুল টীচারের চাকরির জন্য ঘুস দিতে গিয়ে তোর জন্য অনেক টাকা ঢেলেছি। চাকরিও হলো না, টাকাটাও জলে গেলো। অপায়া কোথাকার। আমি আর টাকা বার করতে পারবো না।

    প্রাইমারি স্কুল থেকে ভাব। ভাব থেকে বিশাখার সাথে ভালোবাসা। এখন কুড়ি বছরের বিশাখা অনেক সুন্দরী, আকর্ষণীয় রূপ, লাবন্যময়ী। সেও আর পাত্তা দেয় না।
    একদিন পুকুর পাড়ে দেখা। জিজ্ঞেস করলো -আজকাল আর দেখা করো না কেন?
    বিশাখা- আমাকে তুমি ভুলে যাও চঞ্চলদা।
    -আমি কিন্তু তোমাকেই ভালোবাসি।তোমাকেই বিয়ে করব।
    -বাড়ি থেকে আমার অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে উঁচু বেতনের চাকরি করে। অনেক ধনী আভিজাত্যপূর্ণ পরিবার।
    তুমি আমাকে আর ডাকবে না। যেখানে সেখানে কথা বলবে না। কথাটা বলেই বিশাখা ত্রস্ত পায়ে বাড়ি চলে গেলো।

    একদিন সত্যি সত্যি বিশাখা বিয়ে করে চলে গেলো। চঞ্চলের দীর্ঘদিনের ভালবাসা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন, সবকিছুকে ধূলিস্যাৎ করে অন্যের অঙ্কশায়ী হয়ে গেলো বিশাখা।

    বিশাখার প্রত্যাখ্যান, বউদির অত্যাচার, পরিবারের সবার অবহেলায় জর্জরিত, নির্যাতিত বেকার চঞ্চল মনে মনে ঠিক করলো, এ জীবন সে রাখবে না।
    বিনিদ্র রজনী শেষে চঞ্চল ঘর থেকে বের হয়ে রেল লাইনের ধারে এসে বেঞ্চে বসে রইলো। ট্রেনের আসার আশায় অনেকক্ষণ কেটে গেলো। রাত শেষে ভোর হচ্ছে। ভোরের আলো এসে পাখিদের চোখে লেগে ঘুম ভেঙে কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত। প্রভাত সূর্যের লাল আভা ঠিকরে পড়েছে ঝিলের জলে। জলচর পাখিরা জলকেলিতে মগ্ন।যতদূর দৃষ্টি চলে শুধু সবুজের সমারোহ। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া ধান ক্ষেতে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। দূরে দুই বলদের মাঝে চাষা চাষে নিমগ্ন।
    প্রকৃতির এই অপুর্ব শোভায় সে উদাস হলো। প্রকৃতি কত সুন্দর। মনের পরিবর্তন হলো।কানের সামনে এক দৈববাণী হলো। “আত্মহত্যা কাপুরুষতা।”
    নাহ্ সে আত্মহত্যা করবে না। অনেকক্ষন পর একটা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে থামলো। ট্রেনটা সিগনাল না পেয়ে এসে থেমে গেছে। ট্রেনের অনেক দরজা খোলা। চঞ্চল একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লো।
    ট্রেন ছুটে চলেছে পূর্ণ গতিতে। চঞ্চলের মন ছুটে চলেছে দূর্বার গতিতে অজানার উদ্দেশ্যে। ক্ষুধার জ্বালায় ও অবসন্ন শরীরে কখন যে সে ট্রেনের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে পেতে দেখলো টিকিট কালেক্টর সামনে দাড়িয়ে আছে। টিকিট চাইছে। তার কাছে তো টিকিট নেই অগত্যা জরিমানা। কিন্তু তার কাছে কানাকড়ি নেই। অর্থাৎ নির্ঘাত জেল। তাকে জেলে পুরে দিল। অভুক্ত চঞ্চলের ভালোই হলো। খাবার পাওয়া গেল। খুব খুশি। কিন্তু তাও সইলো না। তাকে দিন কয়েক রেখে জেল থেকে বের করে দিল।
    জেল থেকে বের হয়ে কোথায় যাবে কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে স্টেশনেই ফিরে এলো।
    উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে বেড়ালো।
    ক্ষিদের জ্বালায় দু’ দিন কেটে যাওয়ার পর কোনো উপায় না দেখে ভিক্ষে করতে শুরু করলো।
    কিন্তু সুন্দর সুঠাম যুবককে ভিক্ষা কে দেবে? ভিক্ষাও জুটলো না। দু’দিন অনাহারে কাটলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।জীর্ণ পোশাক।
    অনাহারে পেটের জ্বালা। অবসন্ন শরীর। কোথাও খাবার না পেয়ে পেটের জ্বালায় এক চায়ের দোকানে গেলো।
    খাবার কেনার কোনো কানাকড়ি নেই।দেখলো একজন রুটি- সবজি খাচ্ছে। চঞ্চল এঁটো রুটি ছিনিয়ে নিয়ে দিল চৌঁচা দৌড়। পিছনে জনতা ছুটছে আর চীৎকার করছে
    -চোর চোর চোর …
    জনতার হাতে ধরা পড়ে বেদম মার খেয়ে অবসন্ন রক্তাক্ত চঞ্চল মাটিতে পড়ে বললো -আমি চোর নই। আমাকে মেরো না। কদিন থেকে কিছু খাইনি। মারমুখী জনতাকে হাতের রুটির টুকরো দেখিয়ে জ্ঞান হারালো।

    জ্ঞান হতে চঞ্চল দেখলো সে এক তক্তাপোশে শুয়ে আছে। সামনে পরিচর্যারতা এক মধ্যবয়সী মহিলা। চঞ্চল উঠে বসতে গেলে মহিলা বাধা দিয়ে বললো, -মারের চোটে সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখন কেমন লাগছে? তুমি জনতার হাতে মার খেয়ে পড়েছিলে। বাবু তোমাকে জনতার হাত থেকে বাঁচিয়ে এখানে আশ্রয় দিয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে আদর করে শুশ্রূষা করতে লাগলো।
    একটু সুস্থ হতে সে জানলো সে এক মাফিয়ার আশ্রয়ে। বিশাল বাড়ি। এখানে প্রবেশ করা যেমন কঠিন। বের হওয়া আরও অনেক কঠিন। এখানে সে প্রাণে বেঁচে আছে তাই নয়, সে বেশ আছে। এখানে থাকা খাওয়া দাওয়ার কোনো অভাব নেই। বস শিল্টুর নির্দেশ মেনে চলতে হয়। যখন যা বলবে তাই মেনে চলতে হয়। প্রভুভক্ত হতে হয়।

    সপ্তাহ শেষে বস, নাম শিলটু একদিন চঞ্চলকে তার দরবারে ডেকে পাঠালো। জিজ্ঞেস করল -কি নাম তোর?
    -চঞ্চল।
    -থাকিস কোথায়?
    -গাছতলায়।
    -বাড়ি কোথায়?
    -মূর্শিদাবাদের কোদলা।
    -বাড়িতে কে কে আছে?
    -মা বাবা, দাদা বউদি, ভাইপো ভাইঝি।
    -বাড়ি ফিরে যেতে চাস?
    -না।
    -কেন?
    -আমার কোনো আয় নেই। বেকার। তাই আমি সবার চোখের বিষ। সবার গলগ্রহ।
    -মা?
    -মা কেবল ভালোবাসে।
    -এখানে থাকতে তোর কেমন লাগে?
    -খুব ভালো।
    -এখানে থাকতে গেলে আমি যা বলবো তাই তোকে শুনতে হবে।
    -শুনবো।
    -পিস্তল রাইফেল চালানো শিখতে হবে। বোমা মারতে হবে। পারবি?
    -পারবো।
    -যাকে বলবো তাকেই মার্ডার করতে হবে। পারবি?
    -পারবো।
    -তোলাবাজি করতে হবে?
    -করবো।
    -নির্মম, নির্দয় হতে হবে। পারবি?
    -পারবো।
    -বিশ্বাসঘাতকতা করলে গুলি খেয়ে মরতে হবে।
    -মরবো।
    বস শিলটু ডেকে পাঠালো গালুকে।
    -গালু এই এক নতুন মাল। একে আজ থেকে তোর আন্ডারে পিস্তল, রাইফেল, একে ৪৭ চালানো, বোমা বাঁধা, বোমা মারা, সব রকমের গাড়ী, মোটর সাইকেল চালানো ইত্যাদি ট্রেনিং এর জন্য দিলাম। একে পাক্কা সাগরেদ তৈরি করবি। এর ক্ষিদে আছে।

    কিছু দিনের মাধ্যে চঞ্চল পাক্কা গুন্ডা হয়ে মাফিয়ার চামচা হয়ে গেল। ১২ টি মার্ডার ও ৩৬ টি সফল অপারেশন করে শিলটু বসের সেনাপতি হয়ে গেলো। এখন সে বসের ডানহাত। পুলিশের খাতায় মোষ্ট ওয়ান্টেড। মাথার দাম দশ লাখ টাকা।

    একদিন রাতে স্থানীয় এক মাফিয়া কাম ব্যাবসায়ীকে মার্ডার কেসে পুলিস শিলটুর বাড়ি রেড করলো। এনকাউন্টার। তুমুল লড়াই হলো। সেই লড়াইয়ে পুলিশের গুলিতে শিলটু বস একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।
    চঞ্চলের বাঁচার আর কোনো চান্স নেই। এবার পুলিশের দল তাকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছে।
    সে বিদ্যুৎ বেগে বুদ্ধি করে এক পুলিশের ঘাড়ে এক রদ্দা মেরে শুইয়ে দিল। টানতে টানতে পুলিসটাকে এক ঘরে ঢুকিয়ে তার ইউফর্ম খুলে নিজের সাথে বদল করে নিল। আর একটা মুখোশ পরে পুলিশের দলে ভীড়ে গেল।
    বিশাল বাড়িটি পুলিশ দিয়ে ঘেরা। চঞ্চল পুলিশের বেশে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো।বাইরে তখন গুলি বিনিময় চলছে। অন্দরমহলে এক বিলাসবহুল কামরায় দেখলো একটা মহিলা ঠকঠক করে ভয়ে কাঁপছে। মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো, -আমাকে বাঁচান। আমাকে মারবেন না। আমি বসের বিবি।
    চঞ্চল এগিয়ে গিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষন স্থির হয়ে গেলো। খুব চেনা চেনা লাগছে। জিজ্ঞেস করলো -কি নাম তোমার?
    -আমার নাম বিশাখা। আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করুন।
    চঞ্চলের মনে আর দ্বিধা রইলো না। সে মুখোশ খুলে বললো, আমি চঞ্চল।
    -আমি তোমার কন্ঠস্বরে আন্দাজ করেছিলাম। এখন আর কোনো সন্দেহ রইলো না। এখান থেকে বের হতে হবে। নাহলে আমার আরও দুটি সতীন বা পুলিশ আমাকে মেরে দেবে। নাহলে শিলটুর সঙ্গী সাথীরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। বা অসংখ্য লাশের ভীড়ে আমি হারিয়ে যাব। আমাকে বাঁচাও চঞ্চলদা।
    বাইরে তখন ক্রশ ফায়ারের আওয়াজ। সাথে লুটতরাজ।
    – তাইতো। কিভাবে বেরবো?
    -শোন চঞ্চলদা। এই ঘর সংলগ্ন এক সুড়ঙ্গ পথ আছে। সেটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে এক গুপ্তকক্ষ আছে সেখানে অনেক মুখোশ, পুলিশের পোশাক অস্ত্র আছে। আছে ধন দৌলত আর সাউন্ডলেশ মোটর সাইকেল।
    এখান থেকে বেরতে সফল হলে অনেক দূর দেশে গিয়ে তুমি আমি আবার নতুন করে ঘর বাঁধবো। কি পারবে?
    -সবই ভাগ্য। ভাগ্যচক্রে তোমাকে হারিয়ে আবার এই দূরদেশে খুঁজে পেয়েছি। আই লাভ ইউ বিশাখা। ভালোবাসার কখনো মৃত্যু হয় না। চলো।

    -গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিশাখার পরিকল্পনায় সফল হয়ে একেবারে মুক্ত বিহঙ্গের মতো দুজনে এক অজানার উদ্যেশ্যে পাড়ি দিল…

    অনেক দূর দেশে গিয়ে চঞ্চল-বিশাখা ঘর বেঁধে বসবাস করতে লাগলো। তারা বেশ সুখেই ছিল।
    একদিন মধ্যরাতে জেব্রা নামে এলাকার এক বেতাজ বাদশা একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে চঞ্চল বাধা দিল। গুলি বিনিময়ও হলো। জেব্রার পরিকল্পনা বানচাল করলো। তার এলাকায় অন্য কেউ মাস্তানী মারুক এটা তার সহ্য হয়নি।

    একদিন মধ্যরাত্রিতে দল বল নিয়ে চঞ্চলের উপর চড়াও হলো। মারপিট ধ্বস্তাধস্তি শেষে জেব্রা গুলি চালালো। বিশাখা চঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য বুক পেতে দিল। গুলি লাগলো বিশাখার বুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। চঞ্চল বিশাখাকে শুশ্রূষার জন্য এগিয়ে যেতেই জেব্রা তার সাঙ্গপাঙ্গরা অতর্কিতে চঞ্চলকে আঘাত করল চাকু ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে। দুটি হাত ও একটা পা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হলে চঞ্চল অত্যধিক রক্তক্ষরণের ফলে জ্ঞান হারালো।
    জ্ঞান যখন ফিরলো, দেখলো সে হাসপাতালের বিছানায়। চঞ্চলের এক হাত ও এক পা নেই। amputed. কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশাখা তাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছে।

    বেকার চঞ্চলকে এই সংসার ভালোভাবে বাঁচতে দিল না। আবার সে বিশ্ব নিখিলে এক বোঝায় পরিণত হলো।
    ভিক্ষা ছাড়া আর কিছু সম্বল রইলো না।
    পাড়ার মোড়ে সে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বসে থাকে। কখনো ট্রেনে ভিক্ষে করে ফেরে।
    কোনো দিন খাবার জোটে কোনো দিন জোটে না।
    কেউ ভিক্ষা দিলে, সে সবাইকে এক কথা বলে- “ভাগ্যম ফলতি সর্বত্রম, ন বিদ্যা ন পৌরুষম।” 
    ———— ———— ———-

  • গল্প

    গল্প- পরিবর্তনের পটভূমিতে

    পরিবর্তনের পটভূমিতে
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    অপরাজিতা মুখার্জি ডাক নাম অপু। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ক্লার্ক। বিটি রোডের মোতিঝিলে ব্যাঙ্ক লোনে ফ্ল্যাট কিনে বছর পাঁচেক হলো চলে এসেছে। সাথে হাসব্যান্ড দীপক, নয় বছরের মেয়ে লাবনী। বালিতে শ্বশুর শাশুড়ী থাকেন। এখান থেকে তার অফিস কাছেই হবে। দীপকের ( দীপু) সাথে প্রেম করে বিয়ে। দীপক আগে কম বেতনে এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতো। অবস্থা ভালো ছিল না। পরে নানান জায়গায় এপ্লাই, পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিতে দিতে অপরাজিতা ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেল। বছর খানেকের মধ্যে তাদের মেয়ে লাবনীর জন্ম হলো। বাচ্চার দেখভাল, অফিস, ঘর সংসার করা ভীষণ অসুবিধা। তাই অপরাজিতা একদিন দীপককে বললো, – তোমার চাকরি করার দরকার নেই। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি। ওই কটা টাকা বেতন। আমি যা বেতন পাই তাতে সংসার চলে যাবে। তুমি ওই চাকরিটা ছেড়ে দাও।
    -বেশি বেতনের চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। হয়নি। কি করবো বলো।
    -ও আর হবেও না। তার চেয়ে বরং লাবনীকে দেখভাল করো। ঘর সংসারের কাজকর্ম করো। আমাদের একমাত্র মেয়ে আদরে-যত্নে মানুষ হবে, বড়ো হবে। তাকে নিয়মিত স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা করো। আমাকে একটু অফিস থেকে এসে জিরোতে দাও।
    -বেতন কম হলেও মাসে মাসে টাকা কিছু তো ঘরে আসছে। সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।
    – তোমার বেতনের কথা আর বলো না। রান্নার লোককে তার চেয়ে বেশি দিতে হয়।
    দীপক হালকা প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অপরাজিতার ধমকে তাকে সায় দিতে বাধ্য হতে হলো।
    চাকরি ছেড়ে দীপক ঘর সংসারের কাজকর্ম দেখাশোনা, অপরাজিতা আর লাবনীর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করাতে মন দিল।

    চৈত্র মাসের গরমে ভোরের বেলাটা বড়ো স্নিগ্ধ, মিষ্টি। দক্ষিণ খোলা জানালায় মলয় বাতাস। আগের রাতে অনেকক্ষণ টিভিতে খেলা দেখায় শুতে দেরি হয়ে গেছিল। তাই দীপকের ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেছে আজ। ঘুম ভাঙলো দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে। দীপক ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে দেখলো ঘড়িতে- ৬ঃ৫৫।  দীপক দরজা খুলে দেখলো ঝন্টুর বাপ সদাই এসেছে।
    দীপক বললো, -সদাই, তুমি তাড়াতাড়ি বাসনগুলি মেজে দাও। আমি চায়ের জল বসিয়ে দিই।
    সদাই কাজের লোক। অপরাজিতাকে দিদি বলে আর দীপককে জামাইবাবু বলে।
    সে সিঙ্কে এক গাদা বাসন ধুতে ধুতে বললো, -জানেন জামাইবাবু, আজ একটু দেরী হয়ে গেলো। ভীষণ গা হাত পায়ে ব্যাথা।
    -কেন? কি হয়েছে?
    -কাল ঝন্টুর মা আমায় মেরেছে।
    -কেন। নিশ্চয়ই কিছু দোষ করেছো?
    -না। কাল এ বাড়ি সে বাড়ির কাজ শেষে ফেরার পথে ধর্ম বোনের বাড়ি গিয়েছিলাম দেখা করতে। ঝন্টুর মা ভীষণ সন্দেহবাতিক। ধর্মবোনের সাথে আমি নাকি লটঘট করি। বেলনা দিয়ে প্রচন্ড মারলো। সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
    -ঠিকই করেছে। অমন কাজ কেন করো?
    -এসব কথা কাউকে বলতে পারিনা। একমাত্র আপনাকে বললাম।
    -এসব কথা কি বলা যায়। লোকে হাসাহাসি করবে।
    দুরন্ত এক্সপ্রেসের গতিতে ঝন্টুর বাপ বাসন মেজে ঘর মুছে অন্য বাড়িতে কাজ করতে চলে গেল।
    -দীপক চা তৈরি করে কাপে ঢেলে অপরাজিতার বেডরুমে ঢুকে দেখলো মা-বেটিতে জড়াজড়ি করে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। দীপক গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো। অপু তোমার চা রেডি। অপু পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে বললো, -আমি আর একটু ঘুমাবো।
    -অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে।
    -না। আমি এখন উঠছি না। তুমি চা’টা ডাইনিং টেবিলে রেখে দাও।
    দীপক দেখলে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। কখন যে মেয়েকে রেডি করে স্কুলে, বউকে অফিসে পাঠাবে।
    গতকাল এমনি দেরি হওয়ায় অপুর ভালো করে স্নান খাওয়া হয়নি। সে একটা বুদ্ধি খাটিয়ে বললো -তোমাদের এবার পে স্কেল বৃদ্ধির টাকাটা দেবে লিখেছে কাগজে।
    -কোথায় দেখি।
    -ব্যালকনিতে পেপার আছে। পড়ো গিয়ে চা খেতে খেতে।
    অপরাজিতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠে পেপার পড়তে পড়তে বললো, -কই! কোথায়?
    মুচকি হাসি হেসে দীপক বললো, -মিথ্যে না বললে তুমি কি আর বিছানা ছেড়ে উঠতে! তোমরা দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি চট করে বাজার থেকে সবজি আর মাছটা নিয়ে আসি।
    দীপক আধঘন্টার মধ্যে ফ্রেশ সবজি, টাটকা, সামুদ্রিক মাছ, আর কিছু ছোট মাছ কিনে ঘরে যখন পৌঁছালো দেখলো অপু চা খেয়ে শুয়েই পড়েছে। লাবনী একবার চোখ মেলে আবার পাশ ফিরে শুয়েই পড়লো। দুজনকে আদর করে টেনে তুলে দিয়ে রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্রেকফাস্টে গরম গরম পরোটার সাথে বেগুন ভাজা আলুর দম, প্লেট ভর্তি ফল।
    অপরাজিতা এতসব দেখে বললো, -এতসব খেয়ে ভাত খাব কখন?
    একটা পরোটা খাব। তুমি বরঞ্চ ভাত ডাল মাছের ঝোল সবজি রান্না করে দাও শিগগির।

    দীপক রান্না ঘরে ওভেনে একটাতে ভাত অন্যটাতে ডাল বসিয়ে সবজি কাটতে ও মাছ ধুতে ধুতে ভাবছে, লাবনী স্নান করে আসলে তার জামা পরিয়ে দেওয়া, চুল আঁচড়ানো, ফিতে বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি কাজ করে স্কুটিতে করে স্কুল পৌঁছে দিতে যেতে হবে।
    সে হাত চালিয়ে সবজি আর মাছের ঝোল করে প্লেট সাজিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে মেয়ের ব্যাগ গোছাতে গেল। মেয়ের জুতার ফিতে বেঁধে স্কুলে পৌঁছে দিতে বেরোতে যাবে দেখলো অপরাজিতা ( অপু) মোবাইল নিয়ে চ্যাট করছে।

    দীপক বললো, মোবাইল রাখো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো কটা বাজে।
    -ওসব তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।
    মেয়ে বললো- বাপি। তাড়াতাড়ি চলো। দেরি হয়ে গেছে।

    দীপক গ্যারেজ থেকে স্কুটি বের করে মেয়েকে স্কুল পৌঁছাতে বেরিয়ে গেল। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ঘরে এসে দেখে অপু এখনো অফিসে বের হয়নি। সে বাথরুমে স্নান করছে। অপু ঝটপট বাথরুম থেকে বেরিয়ে তৈরী হতে হতে বলে,
    শাড়ীগুলো ইস্ত্রী করে রাখোনি কেন। পাট পাট শাড়ি ছাড়া আমিতো পরিই না তুমি জানো। আজ কোন শাড়ি পরে যাব?
    -আজ সালোয়ার স্যুট পড়ে যাও।
    -আমি কি পরে যাব সেটা আমি বলবো। তুমি এখনই এই শাড়ীটা ইস্ত্রী করে দাও। কাচা রুমাল দাও একটা।
    অগত্যা দীপক তাই করে, তার ভ্যানিটি ব্যাগ গুছিয়ে হাতে দিয়ে বললো, আর কি?
    -ওহো। টিফিনের খাবার প্যাক?
    -এই তো। ডাইনিং টেবিলে রেডি করে রেখে গেছি।
    -ওই সেই পরোটা আর আলুর দম খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেলো।
    -ঠিক আছে। কাল থেকে নতুন কোনো রেসিপি করে দেব। এগরোল, গাজরের হালুয়া, চিঁড়ের পোলাও। লুচি আর চিলি চিকেন। দইবড়া। স্যান্ডউইচ। লুচি ঘুঘনি। যা চাইবে তাই। আমি টি ভি দেখে অনেক রেসিপি শিখেছি। আসলে তোমার যা ভালো লাগে তা লাবনীর ভালো লাগে না। লাবনীর যা ভালো লাগে তা তোমার ভালো লাগে না।
    অপু মনে মনে ভাবলো, দীপু রান্নবান্নাটা ভালোই করে, যেকোনো পাক্কা গিন্নীকে হার মানিয়ে দেবে। তবু সে বললো,
    – তোমার রান্নার যা ছিরি? যাই হোক। এখন চলি।
    অপু অফিসে বেরিয়ে গেলে দীপু বাথরুমে গিয়ে দেখলো মেয়ের জামাকাপড় ও অপুর শাড়ি, গতকালের নাইটি, ব্লাউজ, অন্তর্বাস সব একপাশে ঢিপ হয়ে পড়ে আছে। এখন এগুলো সব কেচে মেলতে হবে। একবার বেরিয়ে নিউ মার্কেট থেকে কিছু ঘর সাজানো জিনিসপত্র কিনে আনতে হবে।
    এবাড়িতে অপুর কলিগ বন্ধু বান্ধবী যারা এসেছে তারা শুধু সুস্বাদু রান্নার নয়, সবাই ঘর গোছানো, টিপটাপের খুব প্রসংশা করেছে। অনেক বান্ধবী বলেছে, অপরাজিতার হাসব্যান্ড এত কাজের, এত সুন্দর রান্না করতে পারে আর আমাদের হাসব্যান্ডরা একদম যেন কেমন নাদুস নুদুস মার্কা। কুড়ের হদ্দ।

    ঝন্টুর বাপের ঘর মোছা তার একদম পছন্দ নয়। সে ঝন্টুর বাপ চলে গেলে আবার সব ঘর নিজে হাতে মুছবে। আজও তাই করলো। বিছানা ঠিকঠাক করতে গিয়ে দেখলো অপুর গলার একটা সরু চেন পড়ে আছে। এটাতো নতুন ঠেকছে। কখন কিনেছে কে জানে! গয়না পড়তে সব মেয়ে ভালবাসে কিন্তু অপু গয়না পড়েই অফিসে যায়। একটু বেশি সৌখিন। অফিস ফেরত জিমে যায়। শরীরটা বেশ ফিট রেখেছে। আকর্ষণীয় চেহারা। দীপু কখনো বাধা দেয়না। নিজের ইনকাম, যা খুশি তাই করবে।
    ঘর গুছিয়ে স্নান খাওয়া সেরে ব্যালকনিতে রোজকার মতো আড্ডা দেবে। সুখ দুঃখের কথা বলবে। আজ সৈকত আগে এসেছে। সেও শুধু ঘর সংসারের কাজ দেখাশোনা করে তার মিসেস চাকরি করে বেশ উঁচু পদে।দু-নম্বরী ইনকামও আছে। পার্টিতে ড্রিংক করে অনেক রাতে ঘরে ফেরে। বলতে গেলেই ঝগড়া।
    দীপু সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো, -কাল রাতে কি হয়েছিল? খুব চীৎকার চ্যাঁচামেঁচি হচ্ছিলো।
    -ও তেমন কিছু নয়। মিসেস মদ খেয়ে বন্ধুটির হাত ধরে টলতে টলতে ঘরে ঢুকলো। আমি চুপচাপই ছিলাম। দেখলাম বেডরুমে কাপড় বদল করার সময় এক অপ্রীতিকর জঘন্য দৃশ্য। তাই অবজেকশন করেছিলাম। তাই দুজনে মিলে আমাকে হেনস্থা করলো।
    -আপনি চুপচাপ থাকলেন?
    -দুজনের সাথে পেরে উঠা যায়! হেরে গেলাম। কিছুটা ইচ্ছা, কিছুটা অনিচ্ছায় হারতে বাধ্য হলাম। অবলা হয়েই আমাকে থাকতে হবে। আমি যে সুখে আছি সেই সুখ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। পাখির বাসাটা ভেঙে দিতে চাই না। এই যে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি বউয়ের টাকায় শুয়ে বসে আয়েস করছি। এতো গড গিফটেড। ব্যাঙ্ক শেয়ার সবই তো জয়েন্ট। বাগুইহাটিতে বিশাল জমির আমি মালিক। ইনকাম ট্যাক্স-এর ঝামেলা থেকে, ভিজিল্যান্স থেকে অব্যাহতি দিয়েছি।
    -তা বলে অনাচার সহ্য করবেন?
    -অনাচারের কথা বললে বলে, ডিভোর্স দিয়ে দেব। তার হুমকির কাছে ভয়ে আমি ঠিক করেছি আর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না।
    -তা বলে মদ খাওয়া?
    -সেখানেও আমি বাধা দিইনি। বলেছি বাইরে না খেয়ে খাবার জিনিস, ঘরেই তো খেতে পারো।তখন থেকে আমি নিজেই পেগ বানিয়ে দিই। মদের সাথে খাবার চিকেন পকোড়া, ফিস ফ্রাই, মাটন কষা আমি নিজের হাতে বানিয়ে দি।
    -আর আপনি? নিজে খান?
    -প্রথম প্রথম খেতাম। এখন খাই না। আমার ফ্যাটি লিভার। আর কিডনির সমস্যাও আছে।
    -আর ছেলে?
    -বি.এইচ.ইউ. তে পড়ে।
    -কি পড়ছে?
    -ফিজিক্সে এম.এস.সি।
    -আজ এ পর্যন্ত থাক। আমার সময় হলো স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাবার। সে তো অনেক দেরী।
    -আসলে একটু আগেই বেরিয়ে কয়েকটি সৌখিন জিনিসপত্র কিনতে নিউ মার্কেট যাব। কেনাকাটা সেরে মেয়েকে নিয়ে আসবো।

    এইভাবেই চলতে থাকে। অপু অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বারান্দায় বেতের চেয়ায়ে বসে গা এলিয়ে দেয়। সেদিন কস্টলি চা পাতার সুস্বাদু চায়ে চুমুক দিয়ে দীপুকে বললো, তোমাকে যে বলেছিলাম পান আনতে। এনেছো?
    -হ্যাঁ। এই নাও। পান দিয়ে বললো, আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত। আজ মাটন কষা আর লুচি হবে।
    কিছুক্ষণ পর অপু ডাকলো- দীপু! দীপু! কি শুনতে পাচ্ছ না?
    দীপু রান্না ঘর থেকে সাড়া দিল, -যাচ্ছি।
    -পানের জর্দা আর পিকদানিটা দিয়ে যাও।
    দীপু রান্নাঘর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে জর্দা আর পিকদানি দিয়ে গেল।
    ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করবে সে ভাষাও নাই। গতকাল সৈকতের কাছ থেকে তাদের পারিবারিক ঝামেলার কথা শুনে যা জানতে পেরেছে তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ।
    যদি ঐরকম ডিভোর্স করে দেবো বলে ধমকি দেয়, তাহলে কি উত্তর দেবে? কোথায় যাবে? কি করবে? এই বয়সে আরেকটা বিয়ে! এই অকর্মণ্য বেকার পুরুষকে কেউ করবে না। সেটা সে ভাল করেই জানে। সুতরাং অপু যা যা বলছে, সেগুলো মেনে চলা, ফাইফরমাশ খাটাটাই যুক্তিযুক্ত।
    ফিলজফিতে এম.এ. করে দু’ একটা কম্পিউটারের কোর্স করেছিল। চাকরির চেষ্টা করলে হয়ত হয়ে যেত। ধরে রাখলে বেতন হয়তো কিছু বাড়তো। আরও যাদের চলে তারও তাদের মতো চলতো। কিন্তু সে অনেকটা পথ চলে এসেছে। এখান থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই।
    রাত হলো। ঠিক দশটায় লাবনীর পড়া শেষে ডিনার সার্ভ করলো দীপু। মা বেটিতে একসাথে খেয়ে নিলে লাবনী শুয়ে পড়লো।
    সবকিছু গুছিয়ে দক্ষিণ খোলা এই ছোট্ট রুমটায় জানালার ধারে শুয়ে পড়েছে দীপক। সারাদিন খাটাখাটুনি শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে আসে। এই সময় অপরাজিতা হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করে। মাঝে মাঝে দেখেছেও। তাও আবার শরীর নিয়ে। দীপক মাথা ঘামায় না। তার আর কি বলার আছে। কাল সকাল থেকে অনেক কাজ। মেয়েকে সাঁতারের ক্লাবে নিয়ে যাওয়া।
    কিছু ড্রেস ম্যাটেরিয়াল কেনা সপিং মল থেকে। অপুর কাল সেকেন্ড স্যাটারডে ছুটি। ছুটির দিনে স্পেশাল ডিশ তৈরি করতে হবে। দুরের মার্কেট থেকে খাসির মাংস আনতে যেতে হবে।
    মাটন বিরিয়ানি করতে হবে। রাতে ইলিশ পাতুরি। কিম্বা ভাপা ইলিশ। অসময়ে ইলিশ চড়া দাম। তা যতই দাম হোক সাইজ যেন বড়ো হয় বলে দিয়েছে অপু। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে দীপক।
    হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেলো। জানলা দিয়ে চীৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কোথাও যেন ঝগড়া ঝাঁটি হচ্ছে। দীপু ঘুম থেকে উঠে দেখল অপু ও লাবনী গভীর ভাবে ঘুমাচ্ছে।
    দীপু পা টিপে টিপে ব্যালকনিতে এলো। এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তাদের মাথার উপরের ফ্ল্যাটে স্বামী- স্ত্রী সুমি-মদনের ঝগড়া। মাঝে মাঝেই মধ্য রাত্রিতে শোনা যায় ওদের কলহ। সুমিটা কি একটা কাজ করে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আর মদন একদম বেকার। খুব একটা শিক্ষিত নয়। সুমি যখন থাকে না সেইসময় সকালবেলা একটা মেয়ে আসে। সে নাকি পিসতুতো বোন। আর এই মেয়েটার আসার ব্যাপারটা ফ্ল্যাটে আসার সাথে সাথে সিকিউরিটি গার্ড মারফৎ সব জেনে সুমি ঝগড়া করে।
    আজ একেবারে রণং দেহি।
    -তোমাকে আজ মেরেই দেব।
    -আমি কি করেছি!
    -মেয়েটা কেন আসবে?
    -সে আমার পিসতুতো বোন। বোন আসলেও তুমি সন্দেহ করো।
    এক চড় মেরে- বোন! এক পবিত্র নামের অবমাননা করো না। মোবাইলে ভিডিও দেখবে। এই দেখো তোমাদের দুজনের অপকর্ম।

    -কই দেখি দেখি বলে মোবাইল কেড়ে নেয়। সাথে সাথে সুমি মদনকে ছড়ি দিয়ে পেটায়। মোবাইল ছিটকে পড়ে যাবার শব্দ হয়।
    -হারামি। আমার মোবাইল ভেঙে দিলি।কিনে দেবার মুরোদ নাই। পারবি এত দামী মোবাইল কিনে দিতে। আরও পেটায়।

    -ও মাগো। কে কোথায় আছো বাঁচাও। বলতে বলতে এক সময় চুপ হয়ে যায়।
    মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে দীপক শুতে চলে যায়। কাল তার অনেক কাজ। সকালে উঠতে হবে। কাজের লোক ঝন্টুর বাপ আসবে। তাকে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। আবার দীপক ঘুমিয়ে পড়ে।

    আজ দীপক বাইরের কাজ, কেনাকাটা, মেয়ের সুইমিং ক্লাব থেকে ফিরে ঘরের যাবতীয় কাজ শেষে রান্নাঘরে ব্যস্ত।
    অপরাজিতা ঘরেই মৌজ করবে। ছুটির দিন। সকাল থেকে শুধু ফোন। চ্যাট। গান শোনা। টিভিতে মুভি। একবার পার্লারে গিয়ে আপাদমস্তক ফেসিয়াল, হেয়ার রিমুভিং করে অবাঞ্ছিত রোম তোলার কাজ, পেডিকিওর চুলের ছাঁট, ম্যাসেজ করিয়ে এসেছে। সুন্দরী অপুকে আরও সুন্দরী লাগছে। আজ বাথ টাবে স্নান করতে নেমে দেখে বাথটাবের ফেনার স্পেশাল সোপ নেই।
    মেজাজ বিগড়ে সে দীপুকে আচ্ছা করে ঝেড়েছে। কি দেখো ঘরসংসারে।
    -ভুল হয়ে গেছে। এর পরে যখন যাব তখন এনে দেব।
    কতদিন থেকে বলছি, একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে দাও। তা গা করছ না কেন?
    -ওয়াশিং মেশিন কিনবো না। জামাকাপড়ের কালার ফেড হয়ে যায়। তাছাড়া তোমার গতর দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে। একটু গায়ে গতরে খাটো।
    -আমি তো উদয়াস্ত খাটছি। আর কত খাটাব।
    -কথায় কথায় তর্ক করবে না। গরমে পড়ার জন্য একটা ফিনফিনে কটন ট্রান্সপারেন্ট সামনে টিপ বোতাম নাইটি কিনতে বলেছিলেম। কিনেছো?
    -ভুলে গেছি।
    -খেতে তো ভোলনি। মনটা আজকাল কোথায় থাকে। যাও এখুনি কিনে নিয়ে আসো।
    -এখন কিনতে গেলে রান্নাবান্নার দেরি হয়ে যাবে।
    দীপু বাক্স ঘেঁটে একটা পুরানো ওইরকমই নাইটি বের করে বলে,দেখো তো এটা পচ্ছন্দ কিনা?
    -এটা কার? কোথায় পেলে?
    -এটা তোমারই। বিয়ের পর আমার ইনকাম থেকে আমি তোমায় কিনে দিয়েছিলাম। ট্রাস্পারেন্ট। পড়ো ভালো লাগবে।
    আয়নায় নিজেকে দেখে অপু খুব খুশি হলো মনে মনে। তাদের সেই পুরানো দিনের উচ্ছল উদ্দাম মিলনের স্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
    কিন্তু সে একি ভাবছে! অপু খুশিটা চেপে রেখে বললো, -তুমি কিনে দিয়েছো! হতেই পারে না। তোমার ওই তো ইনকাম ছিল। শ্বশুর শাশুড়ীর সামনে এগুলি আমি পড়তেই পারি না। তুমি মিথ্যা বলছো।
    -নাইটি। রাতেই শোবার সময় পড়তে।
    -যাই হোক আজকের মতো পড়ি, কালই আমার জন্য কিনে নিয়ে আসবে।
    দীপক আবার রান্না ঘরে ব্যস্ত হয়ে গেল। বাইরে কলিং বেল বেজে উঠলো। অপু দরজা খুলে দেখলে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে। অপুর দিকে তাকিয়ে আছে। গিলছে।
    -ম্যাডাম। আপনার হাসব্যান্ড স্কুটির চাবি স্কুটিতেই ছেড়ে চলে এসেছেন। এই নিন।
    পিছনে পিছনে দীপু।
    অপু চাবি নিয়ে দরজা বন্ধ করে দীপুকে আচ্ছা করে ঝাড়লো।
    -কি করো? কোন দুনিয়ায় থাকো? অকর্মণ্য আহাম্মক। কেউ যদি চুরি করে নিত তাহলে কি হত। এত দাম দিয়ে কিনে দিলাম। সেটাকে পর্যন্ত রক্ষা করার মুরোদ নেই।নিজের টাকায় কিনতে তাহলে বুঝতে।
    -সিকিউরিটি গার্ড আছে না।
    -তারা কি করবে? এই বিলডিং-এর কোনো আবাসিক যদি বার করে নিয়ে যেত রাতে, কিছু বুঝতে। ইডিয়ট। কমন সেন্স নেই।
    -ভুল হয়ে গেছে। স্বীকার করছি।
    -তোমার এই ভুলের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার গাড়ীটা চোরে নিয়ে পালাতো। তোমার কোন বাপ এনে কিনে দিত? শুনেছি মেয়ে দেখলেই ছুকছুক কর। আজ কোন মেয়ে ছিল?
    -আজেবাজে বলবে না। তুমি ছাড়া অন্য কাউকে আমি স্পর্শ করিনি। তা তুমি এই নাইটি পরে দরজা খুলতে কেন গেলে? আয়নায় দেখো সব দেখা যাচ্ছে। মনেই হচ্ছে না তুমি কিছু পরে আছো।
    -তুমি আমাকে বলবে? তোমার সাহস তো কম নয়। আমি কত্রী, মালকিন। যা খুশি তাই করবো। তোমার বাপের কি?
    এবার দীপু চুপ করে গেলো। রান্নাঘরে গিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলো।

    ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রান্না করে সার্ভ করলো। নানান উৎকৃষ্ট পদের রান্না। মা ও মেয়ের আলাদা আলাদা চয়েস মতো রান্না।
    ইলিশ পাতুরিতে একটু ঝাল বেশি হয়ে গেছে তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল। এত দামী মাছ। এ কী রান্না করেছো। না কি আমাকে টাইট করার জন্য। অপদার্থ। তলে তলে এত বুদ্ধি।
    লাবনী এবার চুপ থেকে বললো- কই দেখি মা তোমার ইলিশ পাতুরি চেখে।
    -কি সুন্দর ডেলিসিয়াস। খুব বেশি ঝাল হয় নি। তুমি মা অনর্থক বাপিকে বকছো।
    -তুই শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল?
    আমি এই বাড়ির মালকিন আমি যা বলবো তাই হবে। আমি যদি বলি ছয় তাহলে ছয়। যদি বলি নয়, তাহলে নয় বলবি দুজনে। বুঝলি। অগত্যা দুজনেই চুপ করল।

    দক্ষিণ দিকের ঘরে তার শোবার ঘরে এলো দীপক। মানসিক দিক থেকে খুব ভেঙে পড়েছে। ল্যাম্প নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিপু বিছানায় এলো। শরীর মনে বড়ো ক্লান্তি। মাথাটা টিপটিপ করছে। হঠাৎ অনুভব করলো অপু এসেছে তার বিছানায়।যখন তার মর্জি হয় তখন আসে নিজে থেকে। আজ এসে পাশে শুয়ে কাঁধ ধরে টানছে। দীপু এক ঝটকা দিয়ে সরে গেল।
    অপু জড়িয়ে ধরে- এখনো রাগ করে আছ?
    দীপু কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শুলো। জানো, গতকাল অফিসের হেড বস আমাকে খুব ধাতানি দিয়েছে।
    -ও এই ব্যাপার! আমি তো ডাস্টবিন। বাইরের যত রাগ অপমান আক্রোশ সব আমার গায়ে ছুঁড়ে দাও।
    অপু আরও ঘন হলো, নাইটির টিপ বোতাম সব খোলা। তপ্ত উদ্ধত নারী মাংস ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। সরীসৃপের মতো অপুর কোমল হাতের আঙ্গুলগুলি বুকের উপর খেলা করছে।
    দীপু ঝাঁঝালো স্বরে- আহ! ঘুমোতে দাও।
    -ওমন করছো কেন? এসো না।
    -আমার মাথা ব্যথা করছে। ভালো লাগছে না।
    অপু দীপুর চুলে হাত বুলিয়ে- ঠিক আছে অন্যায় হয়েছে আর বকবো না।
    -সত্যি মাথা ব্যথা করছে।
    -এসো টিপে দিচ্ছি।
    জোর করে নিজের দিকে মাথাটা ঘোরালো। কপালে ঠোঁটে চুমু খেতে লাগলো।
    আর উপায় নেই। মাথা ধরুক আর যাই হোক, সব শরীর খারাপ এখন শিকেয় তুলতে হবে। দীপুর ভালোলাগা মন্দলাগা, এখন সব মূল্যহীন।
    কাঁপা কাঁপা গলায় দীপু বললো- এত করেও তোমার মন পাইনা। উদয়াস্ত খাটছি তোমার সংসার ছাড়া কিছুই ভাবি না। কতদিন বাবা মাকে দেখতে যাইনি ।তবু তোমার মুখ ঝাপটানি।
    রাতের স্তিমিত আলোতে দেখলো এক বিবস্ত্রা সিংহিনী তার শরীরের উপর উঠে তাকে ন্যস্তনামুদ করে ছাড়ছে। তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। খলখল উচ্চকণ্ঠে হাসছে।
    দীপু যেন এক যন্ত্র। ঘরের আলো ছায়ায়
    হঠাৎ দীপু দেখলো তার সামনে শুধু অপু নয় অন্য অজস্র নারী খলখল করে হাসছে। তারা সমস্বরে বলছে—
    হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের অনেক সহ্যের কাল শেষ। এবার তোমাদের পালা।
    দেখো কেমন লাগে….

  • গল্প

    গল্প- বার্ধক্যে

    বার্ধক্যে
    -শচীদুলাল পাল

     

     

    মাস ছয়েক আগে নির্মল বাবু অবসর নিয়েছেন। কর্মোদ্যম মানুষটি কাজ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। শুধু কাজ আর কাজ। সেই মানুষটি এখন এই কয় মাসের মধ্যে অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। প্রেসার, সুগার বেড়েছে। কিডনি ঠিকঠাক কাজ করে না। প্রস্টেড গ্ল্যান্ডে সমস্যা।

    ঘরের সামনে এক পার্কে আসেন আর তার অনেকদিনের প্রতিবেশী বন্ধু তারাপদ বাবুর সাথে বেঞ্চে বসে তার সুখ দুঃখের কথা বলেন। স্মৃতিচারণ করেন। মনটা একটু হালকা করেন।
    আজ হন্তদন্ত হয়ে এসে তারাপদ বাবুর পাশে বসে গজরাতে লাগলেন।
    – আমি আর সংসারে থাকবো না।

    তারাপদবাবু বললেন, কেন কি এমন হলো? কি হয়েছে?
    -কোনো ভদ্রলোক সংসার করে?
    -বৌদির সাথে কিছু হয়েছে?
    -হয়েছে মানে উঠতে-বসতে বাপান্ত করছে। রিটারমেণ্টের পর ভেবেছিলাম ভালো ভালো গান শুনবো। বই পড়বো। শান্তিতে বই পড়তে গেলে হাত থেকে বই কেড়ে নেয়। গান শুনতে গেলে টেপ বন্ধ করে দেয়। ক্লাসিক্যাল গান শুনছি তো মুখের সামনে এসে ভ্যাংচাতে শুরু করলো।
    -সেকি কেন?
    -তার অনেক অভিযোগ। তাকে কোনো শখ আহ্লাদ করতে দিইনি।
    – যাই বলুন। বউদির কিন্তু রাগের কারণ আছে। অনেক অবহেলা করেছেন।
    – আপনি বলছেন এই কথা?
    – বয়স কম রাখার জন্য দামি দামি ব্রান্ডের ক্লিঞ্জার, টোনার, ময়শ্চেরাইজার কিনে দিয়েছি। আমি নিজে দামী কোনো শার্ট পরিনি। কখনো কোনো নেশা করিনি। নেশা বলতে এক চা। তাও দুধ চিনি ছাড়া। অফিসের পার্টিতে কতবার অফার করেছে ড্রিংকসের জন্য। আমি স্পর্শ করিনি।
    – কেন?
    -ওই বউ ছেলে মেয়ের জন্য। আমি বয়ে গেলে ওদের কি গতি হবে এই ভেবে। শুধু ওদের জন্যই চিন্তা। ওদের মাথার উপর যেন ছাদ থাকে। দু’মুঠো ডাল-ভাতের অভাব না হয়। অফিস থেকে লোন নিয়ে জমিটা কিনলাম কত কষ্ট করে একটু একটু করে বাড়িটা তুললাম কার জন্য বলুন? কাদের জন্য?
    -তা ঠিক। সবুরে মেওয়া ফলে। খাসা হয়েছে বাড়িখানা।
    – এত কষ্ট করে যাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিলাম তাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে থাকতে পারবো না। খুব শিক্ষা হয়েছে। আমি এবার সংসার থেকে বিদায় নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব।
    – যাব বললেই কি যাওয়া যায়?
    – না যাওয়ার কি কারণ?
    – পিছুটান বলে একটা কথা আছে।
    – পিছুটান। কাদের জন্য পিছুটান? বন্ধের দিন বা ঝড় জল ওয়াটার লকিং, বাস ট্রাম বন্ধ। সে অবস্থায় অফিসে গিয়েছি। বস বলতেন, এইরকম পরিস্থিতিতেও অফিসে এসেছেন? আমি বলতাম ঘরে বসে থাকলে সিক হয়ে যাব স্যার? সেই অফিসটাকেও মন থেকে ধুয়ে সাফ করে দিয়েছি। রিটায়ার-এর পর আমার ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগতো না। খিদে লাগতো না। ঘুম আসতো না। প্রথম প্রথম রিটায়ার্ডমেন্টের পরও অফিসে গিয়েছি। অফিসের সবাই সমীহ করতো। কাজকর্ম দেখতাম। চা-টা খেতেও দিত। এক দিন বস চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “কি নির্মলবাবু আপনার পাওনাগণ্ডা বাকি আছে নাকি?” আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার প্র‍য়োজন ফুরিয়েছে। ভাবছে অন্য কোনো মতলব আছে! ঘরে, অফিসে কেউ আর অবসর জীবনে সমীহ করে না। অন্য চোখে দেখে। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব।
    – যাবেন..।যাবেন বলছেন, কোথায় যাবেন?
    -রাঁচিতে আমার এক দিদি থাকে জামাইবাবুর মৃত্যুর পর দিদি বড় একা। কতবার ডেকেছে।
    দুজনে একসাথে থাকবো।
    -কদিন একটু ঘুরে আসুন। মনটা ভালো লাগবে।
    -কদিন নয়, জন্মের মতো চলে যাব।
    -ছেড়ে গেলে লোকে কি বলবে? বউদির কি হবে?
    -মহারানীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পি এফ, গ্র‍্যাটুয়িটির টাকা এম.আই.এস করে দিয়েছি। বসে বসে পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবে।
    এরপর অনেকদিন নির্মলবাবু আর পার্কে আসেনি। তারাপদবাবু ভাবলো সত্যিই চলে গেছে। সংসারী মানুষের শেষজীবন বড়োই প্যাথেটিক। মনে মনে বললেন, বিয়ে থা না করে বেশ আছি।

    হঠাৎ একদিন পার্কের বেঞ্চে নির্মলবাবু বসে আছে। তারাপদ বাবু বলেন, কি নির্মলবাবু আপনি রাঁচি যান নি?
    – না।
    -কেন?
    -ষড়যন্ত্র। কনসপিরেসি।
    -মানে?
    -যাব বলে সব ঠিকঠাক, ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে ফেলেছি ভোরের ট্রেন ধরবো বলে। আপনার বউদি আছাড় খেয়ে পড়লো বাথরুমে। তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। ডাক্তার দেখাও, এক্সরে করো।
    -হাড় ভাঙেনি তো?
    -লৌহমানবীদের হাড় ভাঙে না। বড়জোর মচকায়। বসে বসে মালিশ করার জন্য এই বান্দা ছাড়া আর কে আছে?
    -যাক আছাড় খেয়ে মান ভেঙেছে তাহলে? বউদিকে ক্ষমা করে দিলেন তাহলে?
    -না না। কখনো না। বলে কি জানেন আমি নাকি ইচ্ছে করে সাবানজল ফেলে রেখে দিয়েছিলাম। এইরকম বউয়ের সাথে থাকি?
    -যেতে দিন। রঙ্গ করেছে।
    – রঙ্গই বটে। ছেলেটাকেও কব্জা করে রেখে রেখেছে। এখন ছেলেকে দিয়েও অপমান করাচ্ছে।
    – আপনার ছেলে তো ভালো।
    – ভালো? জানেন ছেলে কি বলছে। বুড়ো ভাম। যাবে কোথায়? মক্ষিচোষ.. একটা ভালো জামা প্যান্ট কিনে দেয়নি। ভালো মন্দ খেতে দেয়নি। আমি বাপ নয়। চামার।
    – কি সব হয়েছে আজকালকার ছেলেরা।
    – বলুন। মিতব্যয়ী ছিলাম বলে একটু একটু করে বাড়ি করেছি। যার দাম এখন বিশ পঁচিশ লাখ হবে।
    -তা নিজে কামাচ্ছে। নিজের পয়সায় ফুটুনি করুক না?
    -সে গুড়ে বালি। মায়ের ট্রেনিং। যত ইচ্ছে বুড়ো গরুটাকে দুইয়ে যা। কিছু বলতে গেলেই মা ঝাঁপিয়ে পড়বে। বলবে ছেলের পয়সায় নজর দাও কেন? বাড়িতে এখনো এল.সি.ডি টিভি এলো না। পুরানো টিভিতে পোষায় না মা -ব্যাটার।
    -সত্যিই আপনার কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যাওয়া দরকার।
    -যাবই তো। গ্রামে আমার জ্যাঠতুতো ভাই থাকে। সেখানে থাকবো। ছিপ ফেলে পুকুরে মাছ ধরবো। নদীর ধারে বসে থাকবো। ফুরফুরে হাওয়া খাবো।
    -আমি একটা কথা বলি, মা ছেলেকে একটু টাইট দিন। টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিন।
    -তাহলে তো দিনরাত আরও গালমন্দ করবে। ছেলের হাত খরচা আছে। ওর ওই ইনকামে চলে না।
    -বুঝলাম স্নেহ অতি বিষম বস্তু।
    -এবার আমি চলেই যাব। বলতে বলতে নির্মলবাবু হাঁটা লাগালেন। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছেন। বয়স অনুযায়ী বেশি বুড়ো বলে মনে হয়। গাল ভেঙ্গে গেছে। হাত কাঁপে। বাতের ব্যথায় নেংচে নেংচে হাঁটছেন।

    এরপর মাস খানেক নির্মলবাবুর দেখা নেই। হঠাৎ একদিন তারাপদবাবুর ঘরে হাজির। তারাপদবাবুর বিশাল দোতলা বাড়ি। একাই থাকেন। কাজের মেয়ে থালাবাসন ধুয়ে দিয়ে যায়। রান্নার মাসি এসে রান্না করে রেখে যায়। কাজের মেয়ে লতিকা একদিন বললো, বাবু আপনার সেই বন্ধুটি এসেছে সাথে একটি ফুটফুটে বছর আটের মেয়ে। আমি তাদের সামনের ঘরে বসতে বলেছি।
    তারাপদ বাবু সামনের ঘরে এসে মেয়েটিকে আদর করে কেক চকলেট দিল।
    -কি নাম তোমার?
    -আমি তিতলি।
    বলেই তিতলি এ ঘর সে ঘর ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল।
    -বলুন নির্মলবাবু, কোথা থেকে ঘুরে এলেন? আপনার শরীর তো একদম ভেঙ্গে গেছে। কেমন যেন দুর্বল লাগছে।
    -আর যাওয়া হলো কই? ডেঙ্গুর আক্রমণের শিকার হলাম। ধুম জ্বর আসতো। শয্যাশায়ী। ভেবেছিলাম মরেই যাব। প্রচুর ওষুধ খেয়ে পনেরো দিন পর শয্যা ছেড়ে উঠেছি। এর মধ্যে মেয়ে এসে হাজির।
    -এটি মনে হয় মেয়ের মেয়ে। নাতনি?
    -হ্যাঁ। মেয়ে পাকাপাকি জামাইকে ছেড়ে চলে এসেছে। ওদের নাকি বনিবনা হচ্ছে না। আর বরের কাছে যাবে না। মাঝখানে একদিন জামাই এসেছিল। আমার সামনেই দুজনের তুলকালাম ঝগড়া।
    -মেয়ের কি অভিযোগ?
    -জামাই মারধর করে। কথায় কথায় ঝগড়া করে। আরএই যে বনিবনা হচ্ছে না, সব দোষ আমার। আমি নাকি ওকে হায়ার এডুকেশন দিইনি। আরও পড়াশোনা জানলে সে নাকি চাকরি পেত।আমি নাকি ফ্যামিলি দেখিনি। সুন্দর দেখতে বলে বিয়ে ঠিক করে দিয়েছি। যত দোষ নন্দ ঘোষ।
    -জামাই কি বলছে?
    -তিতলিকে নিয়ে টানাটানি। জামাই তিতলিকে নিয়ে যাবেই। মেয়ে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই তিতলিকে দেবে না।
    – ঠিকই তো। তিতলি মায়ের কাছেই থাকবে।
    – আমারও ওই একই মত।
    -আপনিও এক সাথী পেয়ে গেলেন।
    -এখন আমার সব ভালোবাসা ওই তিতলি।
    -ভালোবাসা নিম্নগামী ও বিতরণী, প্রথম জীবনে ভালোবাসে মা বাবাকে। পরে নেমে আসে স্বামী স্ত্রীতে। আরও নেমে ছেলেমেয়েতে। শেষবেলায় আরও নেমে নাতি নাতনিতে।
    -ঠিক বলেছেন।
    এমন সময় কাজের মেয়েটি দুজনকে দু’কাপ চা দিয়ে গেছে।
    নির্মলবাবু জাস্ট চায়ে চুমুক দিয়েছে হঠাৎ খেয়াল হলো তিতলি নেই। নির্মলবাবু তড়াক করে ছুটে এ ঘর সে ঘর ছুটোছুটি করে তিতলিকে দেখতে না পেয়ে চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগলেন।
    -আপনার ছাদে তো কার্নিশ খুব ছোট। বলেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠতে লাগলেন। তিনি আর বুড়ো নন। রুগ্ন নন। একদম তরতাজা যুবক। কোথায় গেল তার হাঁটুর ব্যথা। এখন তিনি আর জরাগ্রস্ত নন। পিছনে পিছনে তারাপদবাবু। অনেক কটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে। এ মাথা থেকে ও মাথা খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে লাগলেন। নিচের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে কার্নিশ প্রান্তে দেখলেন ফুলের মতো তিতলি ফুলেদের সাথে খেলা করছে। তিতলিকে পেয়ে জাপটে ধরে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিতে লাগলেন।
    -তুইই আমার শেষ বেলার সাথী। আমার নয়নের মণি। বেঁচে থাকার প্রেরণা। তোকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না।

    পিছনে পিছনে তারাপদবাবু। এই দৃশ্য দেখে আনন্দিত হলেন।
    জরাগ্রস্থ নির্মলবাবুর চোখে মুখে তারুণ্যের ছাপ। যেন তার বয়স অনেক কমে গেছে।

You cannot copy content of this page