• অণু গল্প

    অণুগল্প- সিক্রেট -৪

    সিক্রেট
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    আলোটা কয়েকবার দপদপ করে নিভে গেল। ঘরে এখন ঘনঘোর অন্ধকার। মোমবাতি ব্যাগের ভেতর আছে। ভুল হয়ে গেছে। ওটাই সবার আগে বের করে রাখা উচিৎ ছিল। টর্চ জ্বালিয়ে সেটা এখনই বের না করলেই নয়। টর্চের ব্যাটারি বেশী ক্ষয় করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওটা এখানে মানে পাহাড়ি জায়গায় অসময়ে বড্ড কাজ দেয় ।
    যুবতী বাথরুমে। ওখানে এখনই আলো চাই। ওর অন্ধকারে বড্ড ভয়।বাথরুমের দরজা খোলা। মোমবাতির আলো আঁধারি মায়ায় বিবস্ত্র জলভেজা যুবতী আরও আকর্ষণীয় আরও সুন্দরী।
    যুবক অস্থির মন, বাঁধন হারা।

    বারান্দায় পায়ের শব্দ। পাশের ঘরে আরও এক দম্পত্তির আনন্দ আগমন। উচ্ছ্বসিত হাসির ঝংকার।এঘরের যুবতীর কপালে ভাঁজ। চার পেগ হুইস্কি খাওয়া হয়ে গেছে। তবুও কান ঠিকঠাকই কাজ করছে।
    নাঃ, এই গলার আওয়াজ চিনতে ভুল হবে না কিছুতেই। কানের মধ্যে শব্দদূষণ হয়ে থাকবে, কে জানে কতকাল !

    কাল ভোরেই বেড়িয়ে যেতেই হবে। অন্যত্র।
    একই জায়গায়, একই হোটেলের পাশাপাশি ঘরে, আর যা-ই হোক। পরকীয়া অসম্ভব।
    বিদ্যুৎ এসে গেছে। কিন্তু না, মোমের আলো আঁধারিই থাক। এই ভালো। এখন জোরালো আলোয় ভয় করবে।
    আরও কয়েক পেগ চাই। বেহুঁশ হতে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সিক্রেট -৩

    সিক্রেট
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    পর্ব-৩

    অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলো। ডিভোর্স দিয়ে দেবার জন্য। উপার্জনশীল স্ত্রী। অকারণ বদমেজাজি মাতাল স্বামীর, নিত্যকার শারীরিক মানসিক নির্যাতনের টার্গেট বোর্ড হবার সত্যিই কোনও মানেই হয়না।
    ছ’বছর অতিক্রান্ত। বিয়ে হয়েছে। কিন্তু, সংসার কিছুতেই সন্তান ছাড়া পূর্ণতা পায়না।
    কার দোষ কে জানে।

    অশীতিপর বিধবা শাশুড়ীর অন্তিম চাহিদা। সংসার হলো, স্বামী স্ত্রীর শোয়া বসা সবই হলো । অথচ..বাঁজা বউ নির্ঘাত। নইলে এতসময় লাগে নাকি?
    অশীতিপর সময় সময় যৌবনবতী হয়ে ওঠে।
    মনে মনে। স্মৃতি।

    পাশের বাড়ির নব্য তরুণ। সদ্য গ্রাজুয়েট। ছাদে ঘোরাঘুরি। চোখ পরস্ত্রীর ঘরে, জানালায়, বারান্দায়, ছাদে, সর্বত্র। বয়সের ধর্ম। বাগ মানে না। বাঘ হতে চায়।

    ইদানীং বেশ ভাব জমেছে দুজনের। কামনার আকর্ষণ। মাকড়সার জাল। শিকার। ক্ষুধার্ত শিকারী।
    শাশুড়ীর অবিবেচক খোঁটা, বাঁজা বউ।
    হয়ে যাক পরীক্ষা সত্যা সত্যের।

    সেদিন দুপুরে। ধামসানো বিছানায় প্রবল ঝড়, বিধ্বস্ত এলোমেলো আলুথালু স্ত্রী। তারুণ্যের কালবোশেখী বৃষ্টি ঝরিয়ে চলে গেছে তরুণ। শুধু রেশটুকু রয়ে গেছে তখনও।
    রিংটোন বাজছে। অচেনা। তরুণ ফেলে গেছে ভুলে। স্ক্রিনে চেনা নাম জ্বলজ্বল করছে। ওপারে চেনা কন্ঠস্বর। স্বামী। কাজ সমাধা তরুণ?

    তরুণ ফিরে এসেছে। ফেলে যাওয়া ফোনের টানে।
    ফোন ফিরিয়ে দেবার ছলে। তরুণের হাত চেপে ধরে পরস্ত্রী এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করলো।
    ঔরস যারই হোক। শুধু মা হতে চাই। ঘুচে যাক বাঁজা বদনাম। রসাতলে যাক সাজানো সতীত্বের মূল্যহীন অহংকার।
    আমাকে অসতী মা করে দাও।

     

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সিক্রেট -২

    সিক্রেট
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    পর্ব-২

    বিকেল পড়ে আসছে। পশ্চিম দিগন্তে তারই রক্তিম আভাস। প্রিন্সেপ ঘাটের ধারে সাজানো বেঞ্চগুলো, প্রেমের আকুলতায় আচ্ছন্ন। একাকী যুবকটির হাতে কোল্ড ড্রিংকের খানিকটা শেষ করা বোতল। ওতে ভদকা মেশানো আছে। যুবতী আসবে। কথা সেই রকমই আছে।বোতলের আংশিক পানীয়ও তারই অপেক্ষায়।

    গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায় নেশা আরও গাঢ় হয়।বোতল খালি হয়ে গেছে। যুগলপ্রেমের আসক্তি অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও ঘনীভূত। নেশা লজ্জা কেড়ে নিচ্ছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে উন্মাদনা।

    একটু পাশেই, চুড়ান্ত এলোমেলো দুর্বার ঘনিষ্ট আরও দুজন। যুবক যুবতী। একজন বড্ড চেনা। পুরুষ।
    যুবতীর নেশায় ভাটা পড়া বিস্ফোরিত চোখ। ওদের পাশেও খালি হয়ে যাওয়া কোল্ড ড্রিংকের বোতল।
    আলগা হয়ে গেছে, সেই কবেই, সাত পাকের বাঁধন।

    মাঝ গঙ্গায় অন্ধকারে ভেসে যায় ডিঙি। টিমটিমে আলো আঁধার ঘোচাতে পারে না। চেনা অচেনার দাঁড় বেয়ে সময় বহে যায়। পুরাতন প্রেম, ঢাকা পড়ে না। সাজানো সংসার সাজে কৃত্রিমতায়।

    রাতের ডিনার টেবিলে কষা মাংস, পরোটা। নিদারুণ পরিতৃপ্তির মুখোশ। দারুণ রেঁধেছো মাংসটা। জবাব নেই।

     

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- সিক্রেট- ১

    সিক্রেট- ১
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    ডোরবেল বাজতেই বিছানায় লেপটে থাকা দুটি নারী পুরুষ আদিম শরীর, ছিটকে সরে গেল। পুরুষ শরীর লুকিয়ে গেল ব্যালকনির পর্দার আড়ালে। নারী শরীর কাপুড়ে সভ্যতায় সেজে, দরজা খুলে দিলো।

    চুড়ান্ত নেশায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন একটি অভিজাত শরীর, প্রবেশ করলো নিজস্ব ঠিকানায়।
    কিছু গোঙানির মতো শব্দ, তারপর পরিচিত বিছানায় পতন এবং অঘোর নিদ্রা।

    আদিম পুরুষ শরীর, পর্দার আড়াল সরিয়ে নির্ভয় নিশ্চিন্তে প্রকাশিত। কাপুড়ে সভ্যতায় শরীর ঢেকে সহাস্যে নিষ্ক্রান্ত। সিঁড়িতে স্বাভাবিক পদশব্দ।
    দরজায় খুশীর চাঁদপানা প্রেয়সী সুদর্শনা।
    কামুক আঙুলে আপাত বিদায়ের মৃদু দোলানী।
    উড়ন্ত চুম্বনে সিক্রেট পারফিউম গন্ধ।

    সংসার মেতেছে লুকোচুরি, চু কিত কিত খেলায়।
    কেউ বলবে সুখ। কেউ বলবে ব্যভিচার।

    ব্রেকফাস্ট টেবিলে আবারও উচ্ছ্বলতায় মাখানো মাখন টোস্ট। চিনি নাকি মরিচ?

     

  • রম্য রচনা

    রম্য- যৌবনোঃ ভবঃ 

    যৌবনোঃ ভবঃ
    -সুজিত চট্টোপাধ্যায় 

     

     

    যেই না কিনা বয়স ঢললো, অমনি কিনা দেহ গললো। দেহ যেন মোমবাতি। যেই জ্বলা শুরু, সেই গলা শুরু।
    সারা গা বেয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসছে সরু  সরু শিরার মতো মোমের ঝর্ণাধারা। মোমবাতি গলছে, গলিত মোম, বাতির গা বেয়ে নামছে আর বাতি ক্রমশঃ পুড়ে পুড়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছোট হচ্ছে।
    ক্রমশঃ বিদিকিচ্ছিরি, কুৎসিত চেহারা পাচ্ছে
    মসৃণ নিটোল মোমের গা। তারপর একসময়,
    আয়ু শেষ। জ্বলে পুড়ে আলো বিতরণ খতম।

    সেদিন এক বিখ্যাত অভিনেত্রীকে টিভিতে দেখলাম। হায় হায়! এ কি হাল! প্রথমে তো চিনতেই পারিনি, পরে যখন লাইফ টাইম এচিভমেন্ট পুরস্কার হাতে তুলে দেবার সময় নাম ঘোষণা হলো, তখন কপাল চাপড়ালাম। গালেও চড় খেতে ইচ্ছে করছিলো।
    চোখ কপালে তুলে, মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভাবছিলাম, হায়! মাগো, এই সেই নায়িকা। যাকে দ্যাখবার জন্যে, কলেজ কেটে, ব্ল্যাকে টিকিট কেটেছি। ওপেনিং ডে ওপেনিং শো মারবো বলে?
    হায় হায় রে…
    কোথায় সেই মনোমুগ্ধকর রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট করা দেহ পল্লব, কাজল নয়না হরিণী!
    এ তো, বাসর শেষের বাসি ফুলসজ্জা।  রংবাহারি ফুলের ফুলস্টপ।
    দেহপট সনে নট, সকলই হারায়..
    আরে ভাই, নট হোক বা নটী। পরিণতি একই। শুকনো ফুল, গোলাপও যা গাঁদাও তা।
    টুসটুসে রসালো ঝকঝকে আঙুর, কালের নিয়মে শুকিয়ে কিসমিস।

    ঠিক এ-ই জায়গায় এসে, বিশ্বাস করুন, ঈশ্বরকে খুব অবিবেচক মনে হচ্ছে। কেন জানেন, আমার মনে হয় এই ব্যাপারটা সত্যিই বড়ো হৃদয়বিদারক।

    শুঁয়াপোকা প্রজাপতি হয়ে উঠলে প্রফুল্লতা জাগে। রত্নাকর দস্যুবৃত্তি ছেড়ে জ্ঞানী ঋষি হলে, মনে প্রত্যয় জন্ম নেয়।
    কিন্তু ব্যাপারটা যদি উল্টো হয়ে যায়, মানে- প্রজাপতি যদি শুঁয়াপোকা হয়ে যায়, তাহলে কেমন লাগবে?
    ঠিক তেমনই একটি লাস্যময়ী হার্টথ্রব, যখন, আম শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়, বুক ভেঙে যায়।

    হে রূপ, তুমি কোথা হইতে আসো, কোথায় মিলাইয়া যাও? ঠিকানাটি দিয়া যাও।

    এই তো, আমাদের একজন অতি জনপ্রিয় সুন্দরী নায়িকা। ম্যাটিনি আইডল। দীর্ঘদিন যাবৎ নিজেকে চার দেওয়ালের আড়ালে,  ইচ্ছাকৃত বন্দীত্ব স্বীকার করে আটকে রাখলেন। কেন?
    আমি বলবো, এটা ঈশ্বরের নির্দয় নিয়ম নির্দেশের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ নির্বাক প্রতিবাদ। একটাই জোরালো প্রশ্ন.. দিলে যদি কেড়ে নিলে কেন?

    সেই পুরাণকাহিনী মনে আছে?
    রাজা যযাতি এক ঋষির অভিশাপে যৌবনের চেকনাই হারিয়ে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধতে রুপান্তরিত হয়ে গেলেন।
    নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে, হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে করতে ঋষির কাছে বারংবার নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমাভিক্ষা করে, পুনরায় লোভনীয় আনন্দদায়ক কাম উচ্ছ্বল যৌবন ফিরিয়ে দেবার কাতর প্রার্থনা করতে লাগলেন।
    অবশেষে ঋষির মন কিঞ্চিৎ নরম হলো। কিন্তু অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার জো নেই। তথাপি, তিনি এক উপায় বাৎলালেন-
    যদি কোনও যুবক, তার এই বার্ধক্য স্বেচ্ছায় নিজ শরীরে ধারণ করে, তাহলে রাজা পুনরায় যৌবন ফিরে পাবেন। অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ পলিসি।
    ঋষি তো নিদান দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। এদিকে মহা ফাঁপড়ে পড়লেন রাজা।
    কে এমন বোকার হদ্দ আছে! যে স্বেচ্ছায় নিজের যৌবনের বিনিময়ে জরাগ্রস্ত বার্ধক্য গ্রহণ করবে?
    নিজের যুবক পুত্রদের কাছেও লাজলজ্জার মাথা খেয়ে প্রস্তাব দিলেন।
    বুঝুন যৌবনের মায়া কী মারাত্মক।
    পিতা নিজের ঔরসজাত সন্তানের জরাগ্রস্ত বার্ধক্য কামনা করছে, শুধুমাত্র নিজে যৌবনের মিষ্ট রসাস্বাদন করবেন, সেই ইচ্ছায়।
    তারাও কম সেয়ানা নয়। স্বল্প আয়ুর মধুর সুখ হাতছাড়া করতে তাদের বয়েই গেছে।
    মজা লুটবে তুমি, আর আমরা মাথা গোঁজ করে বসে বসে খকখক করে কাশতে কাশতে হেঁপোরুগী হয়ে গলার কফ তুলবো?
    হাঁ করে ইল্লি বলো।
    সবাই মুখ ঘুরিয়ে কেটে পরলো। শেষে অনেক চেষ্টায় এক পুত্র রাজি হয়ে গেল। ব্যাস, চালাও ফুর্তির গড়ের মাঠ।
    যৌবনই উদ্দামতার উষ্ণ ফুয়েল। ফুয়েল শেষ লম্ফঝম্প শেষ। বেতো হাঁটুতে তাল ঠুকে গান ধরো.. ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো..’

    যাই হোক, অনেকদিন যৌবনের চরম আনন্দ লাভ করে, একদিন তিনি পুনরায় নিজের সেই পুত্রকে তার দান করা যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে, তার শাপগ্রস্ত জরাজীর্ণ দেহকে স্বীকার করে নিলেন।
    নিলেন বটে। কিন্তু তা স্ব-ইচ্ছায় এবং আনন্দ চিত্তে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

    এই জন্যেই বলছি, ঈশ্বর ইচ্ছে করলে, এই জায়গাটা নিয়ে আর একটু ভাবনা চিন্তা করে নিয়মটা চালু করলে, এইরকম বুকফাটা আফসোস কারুরই থাকতো না, একথা নির্দ্বিধায় হলফ করে বলা যায়।
    আসলে কী জানেন, মনের মৌবনে সদাই বসন্ত। সেখানে শীত ঋতু আসে না। হারামজাদা শরীর সেই সত্য বুঝতেই চায় না।
    আচ্ছা, কেমন নিয়ম হলে বুক ফাটতো না? সেলুউসন, আসুন দেখা যাক..

    প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মের পর থেকে পর্যায়ক্রমে শারীরিক পরিবর্তন অনিবার্য।
    ভালো কথা, হোক। কিন্তু এই পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে থেমে যাবে। সময়টা ধরা যাক ত্রিশ বছর।
    এইসময়ের পর থেকে শরীরের আর কোনও পরিবর্তন হবে না। বয়স বাড়বে। আয়ু কমবে। নির্দিষ্ট সময়ে মৃত্যুও হবে। কিন্তু ঐ রকম বদখদ চেহারায় নয়।
    যৌবনের জৌলুশ থাকুক আমৃত্যু।
    রাজপুত্র, অচেনা অজানা অনভ্যস্ত পথে বেরিয়ে দেখলেন  ব্যধি, বার্ধক্য, মৃত্যু।
    আশ্চর্য হলেন, ব্যথিত হৃদয়ে স্ত্রী, পুত্র, রাজপ্রাসাদ সবকিছু পরিত্যাগ করে চললেন বোধদয়ের সন্ধানে। হলেন বোধিবৃক্ষ এর নিচে বোধিসত্ত্ব। ভগবান বুদ্ধ।

    তাই বলি, ফুল ঝড়ুক, কিন্তু শুকিয়ে যাবে কেন? সে তার সৌন্দর্য নিয়েই যাক না। ক্ষতি কী?
    তাই, শুধু আয়ুষ্মান ভবঃ নয়, যৌবনোঃ ভবঃ
    এ-ই হোক  নব্য যুগের, নব্য আশীর্বাদ।

  • গল্প

    গল্প- পাঁচুদার সাধুসঙ্গ

    পাঁচুদার সাধুসঙ্গ
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    পাপী হইতে সাবধান। লাও ঠ্যালা। কীভাবে বুঝবো কে পাপী কে পুণ্যবান।
    কোনও চিহ্ন আছে কী? কেউ কপালে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখে না। বাসের সহযাত্রী। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কোন ফাঁকে সুযোগ বুঝে পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে হাওয়া। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ ব্যক্তিটি দুরাচারী ছিল, বুঝতে পারার উপায় কী?

    পাহাড়ের কোলে ধুনী জ্বালিয়ে বসে আছে সাধুবাবা। কনকনে ঠান্ডায় উদোম মহাসাধক, জটাজুটধারী, ইয়া বড় দাড়ি, মহাসাধনায় রত।
    সাধুবাবা মাত্রই ধুনী জ্বালে কেন কে জানে। মনে হয় গাঁজার ছিলিম সাজাতে আগুন পেতে সুবিধে হবে।
    এটা গেল এক, আর শীতে আগুন পোহাবার জব্বর ব্যবস্থা। কেউ কেউ রান্নার ব্যাপারটা ওতেই সারে। রোস্টেড আলু, বেগুন পোড়া মন্দ হয় না। দুমুঠো চালও সেদ্ধ করা যেতে পারে।
    সুতরাং বোঝা গেল, ধুনী আবশ্যিক। কিন্তু, এটা বোঝা গেল না, আধ্যাত্বিক সাধনার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক। আচ্ছা, এটাকে নেগেটিভ সাইন বলা যায় কী। হয়তো !

    গঙ্গার ধারে বিশাল সাধুর সমাবেশ। গন্তব্য ঠিকানা গঙ্গাসাগর। এখানে, নানান প্রান্ত থেকে এসে মিলিত হয়ে পুণ্যযাত্রা হবে। টিভিতে সেই খবর দেখে, পাঁচুদা চললো। একসঙ্গে এতো সাধু জমায়েত। না দেখলে আফসোস থেকে যাবে।
    পাঁচুদা হাজির। ব্যাপার স্যাপার দেখে, পাঁচুদা ভিরমি খাবার যোগাড়। চারিদিক ধোঁয়ায় ভর্তি। সারিবদ্ধভাবে বসে আছে, নানান চেহারার সাধুবাবা। কেউ ল্যাঙট পরিহিত, খালি গা। কেউ কেউ সম্পুর্ণ উদোম অবস্থা, নাগাবাবা। কিন্তু প্রত্যেকের সামনে ধূমায়িত ধুনী। পাশে রাখা ফুট তিনেক লম্বা চিমটে আর ত্রিশূল।
    ভক্ত সমাগম ভালোই হয়েছে। ভক্ত, নাকি, কৌতুহলী জনতা!
    একজন সাধুর সামনে অনেক লোকের ভীড় দেখে, পাঁচুদা সেই দিকেই গেল। ভীড়ের ফাঁক ফোকর খুঁজে ঠেলেঠুলে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে, একেবারে উলঙ্গ নাগাবাবা, সারা গায়ে ভস্ম মেখে জটাজুট নিয়ে চিমটে হাতে ধুনী জ্বালিয়ে বসে আছে।
    একেই বলে কপাল।
    সেই সাধুবাবার, নেশায় লাল হয়ে যাওয়া চোখ, বাঁইবাঁই করে চারিদিকে ঘুরছে। হঠাৎ পাঁচুদার চোখে চোখ পড়তেই, পাঁচুদার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। পাঁচুদাও সেই দিকে তাকিয়ে আছে।
    আচমকা, সাধুবাবা পাঁচুদার দিকে চিমটে উঁচিয়ে, চিৎকার করে কাছে ডাকলো।
    _ তু তু, হাঁ, তু..আজা মেরে সামনে আজা..
    সেই ডাকের মধ্যে কী ছিল কে জানে, পাঁচুদা ভীড় ঠেলে ধীর পায়ে সাধুবাবার সামনে গিয়ে বসলো। এতো লোক থাকতে, আমাকে কেন? কী দেখলো আমার মধ্যে, নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু দেখেছে, নইলে আমাকে ডাকবে কেন! পাঁচুদা মনে মনে শুধু গর্বিতই নয় রোমাঞ্চিতও বটে। সকলের চোখ এখন পাঁচুদার ওপর আটকে আছে। এবার কপাল খুলবে নির্ঘাত। যাক, এখানে আসা সার্থক।
    _ তেরা তকদির চমক রাহা হ্যায়..তু কৌন হ্যায় বেটা!
    পাঁচুদার চোখের পলক স্থির। মন, দোটানায় দুলছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল।
    _ আমি পাঁচু, প্রণাম বাবা..
    গলা কাঁপছে।
    _ তু, বহুত বড়া আদমি বনেগা, কোই নেহি রোক সকতা। বাবা ভোলেনাথ হ্যায় তেরে সংগ। ইয়ে লে, বাবা কা আশীর্বাদ, তেরে আচ্ছে দিন আগয়া..
    ধুনী থেকে একমুঠো ছাই নিয়ে, পাঁচুদার কপালে ঘষে দিলো। যা বেটা তেরা মন কা ইচ্ছা, তুরন্ত সফল হোনে বালা হ্যায়।
    পাঁচুদা কমপ্লিটলি ইম্প্রেসড। এতো লোকের মধ্যে থেকে, শুধুমাত্র তাকে ডেকেই বা সাধুবাবা আশীর্বাদ দিলেন কেন! নিশ্চয়ই তার মধ্যে এমন কিছু দেখেছেন, যা সাধারনের মধ্যে থাকে না, দিব্যদৃষ্টি দিয়ে সাধুবাবা নিশ্চয় তাই দেখেছেন এবং ডেকেছেন।
    ধন্য, ধন্য সাধুবাবা। তুমি অন্তর্যামী। তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম।
    সাধুবাবার পায়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ঠুকে, তার সামনে হাঁটু মুড়ে, হাতজোড় করে বসলো,
    সাধুবাবা কটমট করে তাকিয়ে, লম্বা সরু হাত বাড়িয়ে দিলো। হাতের তালু, ধুনীর ছাইয়ের মতো কালচে। পাঁচুদা বিহ্বল হয়ে বসে আছে, আরও ভবিষ্যবাণী শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু না। এবার এলো সাধুবাবার হুংকার,
    _ দে, তেরে পাশ যো কুছ ভি হ্যায় দে দে, নেহি তো ভোলেনাথ বিগড় যায়েঙ্গে, জলদি কর, দে দে, সবকুছ দে দে..
    পাঁচুদা ভয়ে ভয়ে, টাকা, ঘড়ি, সোনার আংটি, একে একে সব দিয়ে দিলো।
    সাধুবাবা মহাখুশি হয়ে, লম্বা চিমটেটা পাঁচুদার মাথায় তিনবার ঠেকিয়ে দিয়ে বললো,
    _ বহুত আচ্ছা বেটা, ভোলেনাথ খুস হুয়া,
    ইয়ে সব তেরা আচ্ছে দিন পানেকা দখছিনা হ্যায় বেটা, বোল বেটা, যো ইচ্ছা মাঙ, মাঙলে বেটা, মাঙ,,
    পাঁচুদার হঠাৎ কী হলো কে জানে, বললো, যা চাইবো দেবে তো?
    _ আরে বেটা মাঙ্ কর তো দেখ,
    _ ঠিক আছে, তাহলে এক্ষুনি তোমাকে যা যা দিয়েছি, সব ফেরৎ দাও।

    সাধুসঙ্গ করো, সৎসঙ্গে সঙ্গত করো। ঋষি বাক্য। আরে মান্যবর, আপনি তো বলেই খালাস। জ্ঞান দেওয়া আর জ্ঞান পালন করা, এককথা নয়।
    কে সাধু, কে সৎ, বুঝতে পারার উপায় কী? দয়াকরে একটু বুঝিয়ে দিন দেখি। বুঝবো ক্ষ্যামতা। এ দুনিয়া পালটি খেতে ওস্তাদ। কে কখন কোথায় কোন মওকায় ভোলবদল করবে, শিবের বাবাও টের পাবেনা।

    পাঁচুদা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধম্মে কম্মে মতি আছে। সুযোগ সুবিধে মতো তীর্থভ্রমণ করে। সেবার চলে গেল কেদারনাথ দর্শনে। অনেক দিনের ইচ্ছে-পূরণ হলো। পুজো আচ্চা দর্শন হলো। দর্শন হলো অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। দুপুরের দিকে হঠাৎই তার কি খেয়াল হলো, মন্দির চত্ত্বর ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলো সেই দিকে, যে দিকে সাধারণত কেউ যায় না। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অন্য কিছুর সন্ধানে যেন তার এই চলা। নিজেই জানে না কোথায় চলেছে, কেন চলেছে, কিসের সন্ধানে! কে জানে কার জন্যে কোথায় কি নৈবেদ্য সাজানো আছে। তার হদিস কেউ পায়, কেউ পায় না। এই মায়াময় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে কতই রহস্য রত্নভান্ডার। তার কতটুকুই বা উন্মোচিত হয়।

    একটা গুহা। মাথা অল্প নিচু করে সেই গুহামুখ দিয়ে গুহার ভেতর প্রবেশ করাই যায়। কিন্তু একটু রিস্ক থেকে যায়। বলা যায় না, এই জনমানবহীন পাহাড়ি গুহার অন্দরে কোনও বিপদ লুকিয়ে থাকা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। তবুও, মানুষের কৌতুহলী মন। বাগ মানতে চায় না। পাঁচুদার সঙ্গেও তাই হলো। পাঁচুদা ভেতরে ঢুকলো না, শুধু মুন্ডু বাড়িয়ে গুহার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা গেল না। প্রবল ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে কিছুক্ষণ গুহামুখের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এবার কেমন যেন ভয়ভয় করতে লাগলো। একে সম্পুর্ণ অজানা জায়গা। একেবারে নির্জন। কেউ এদিকে আসে না। আসবার কোনও কারণও নেই। না মন্দির, না দোকান, না হোটেল, আশ্রম বা ধর্মশালা। কিছুই নেই। আছে বিশাল হিমালয়, আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শুধুমাত্র তার টানে যদি কেউ আসে, তবে সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
    বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ তীর্থ বলতে বোঝে, মন্দির, দেবতাদের মূর্তি, পুজো, মানত, ইত্যাদি। এইসবের টানেই তীর্থে আসা। কিন্তু, এর বাইরেও যে অসীম দেবমাহাত্ব চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে, তার খবর ক’জন রাখে।
    প্রবল ঠান্ডা বাতাস বইছে। যতগুলো শীতের পোষাক এনেছিল সবই গায়ে মাথায় চাপানো হয়ে গেছে। তবুও মনে হচ্ছে আরও কিছু চাপাতে পারলে ভালো হতো। দরকার নেই বাপু, আশ্রমে ফিরে যাওয়াই মঙ্গল, কেন না, বিকেল হয়ে গেছে। পাহাড়ে ঝপ করে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করতে হলো পাঁচুদাকে।

    সেই গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক সাধু। তার শরীরে একটি সুতোও নেই। নাগাসাধু, জটাজুট ধারী, সাদা লম্বা দাড়ি। শরীরের প্রত্যেকটা হাড় এক দুই তিন চার করে গোনা যাবে। গাল দু’দিকে দুটো বাটির মতো। চোখ কোটরাগত। কিন্তু চোখের মনি দুঊটো সন্ধ্যা তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। বয়স আন্দাজ করা খুবই কঠিন। সত্তর কিংবা চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ, সবই সম্ভব।
    _ কৌন হো..
    গলার আওয়াজ ব্যক্তিত্বে ভরা। তবে শ্লেস্যাজনিত ঘড়ঘড়ে শব্দ মিশে আছে।
    পাঁচুদার পলক পড়ছে না। একি, অদ্ভুত দর্শন! সাধু, অনেক দেখেছে পাঁচুদা। কিন্তু এঁর মধ্যে অন্যরকম একটা আকর্ষণ আছে মনে হয়। নইলে পাঁচুদার হাত দুটো আপনা হতে জড়ো হয়ে বুকের কাছে উঠে আসবে কেন?
    _ প্রণাম, বাবা,
    পাঁচুদার এইটুকু উচ্চারণে গভীর ভক্তিভাব জাগ্রত হয়ে উঠেছিল।
    _ বাংগালী হো?
    _ হ্যাঁ বাবা, বাঙালি।
    পাঁচুদা বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকেই তাকিয়ে রইলো। আসলে, চোখ ফেরানো কঠিন। এতোগুলো গরম জামা কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে রাখা সত্বেও, পাঁচুদার সারা শরীর ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। অথচ সম্পুর্ণ উলঙ্গ এই মানুষটার কোনও হেলদোল নেই। সহজ স্বাভাবিক ভাবেই রয়েছেন। আচ্ছা, ওনার অনুভূতি বলে কোনও কিছু আছে তো? নাকি, বিকৃত মস্তিষ্ক! ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
    সংসারী মানুষ, সংসার বোঝাপড়ার বাইরে গেলেই দিশা হারায়, হতচকিত হয়। পাঁচুদা ব্যতিক্রমী নয়।
    _ আমিও বাঙালি ছিলাম ।
    _ ছিলাম, মানে, এখন আর নেই..!
    _ শুধু প্রাণ আছে, সেই প্রাণে একটাই নাম, ঈশ্বর। মুখে একটাই নাম, ঈশ্বর। একটাই বিশ্বাস, ঈশ্বর।আর কিচ্ছু নেই। সব ফাঁকা, সব ফাঁকি, সব মায়া প্রপঞ্চময়।
    হর হর মহাদেব, জয় শিবশম্ভু, জয় কেদারনাথ।
    _ আমি গুহাবাসী, তুমি গৃহবাসী। তোমার ভোগে সুখ, আমার ত্যাগে শান্তি। সুখ আর শান্তি, একঘরে বাস করে না। সুখের বাসনা ত্যাগ করলেই আসবে শান্তি। এই দেখ না, তুমি গরম পোষাকে সারা গা ঢেকেছো, কিন্তু নাক, কপাল, গাল, চোখ ঢাকো নি, কেন? কারণ, ওইটুকু জায়গায় ঠান্ডাকে বশে রাখবার ক্ষমতা তোমার আছে।
    আমাকে দ্যাখো। সম্পূর্ণ আবরণহীন। সারা দেহই আমার ঠান্ডাকে বশে রাখবার ক্ষমতা রাখে।
    গৃহবাসীও ত্যাগ করে, তবে তা নিতান্তই নগন্য। তোমার ওই মুখটুকু খুলে রাখার মতো। গুহাবাসী তপস্বীর সর্বস্ব ত্যাগ। বস্ত্র ত্যাগ প্রতীকী মাত্র।
    কথাগুলো বলেই উনি ধীর পায়ে গুহার ভেতর চলে গেলেন। মনে মনে হতাশ হলো পাঁচুদা। খুবই ভালো লাগছিলো ওনার কথা। বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিলেন। আরও কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে। এমন আচমকা উনি সভা ভঙ্গ করবেন বোঝা যায়নি। পাঁচুদা উপলব্ধি করলো, গৃহবাসী, পূর্ব মুহূর্তেও বুঝতে পারেনা, পর মুহূর্তে কী ঘটতে চলেছে। উনি আবার বাইরে আসবেন কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। কিছু বলে যাননি। যেমন আচমকা এসেছিলেন, তেমনই চলে গেলেন। এঁরা লৌকিকতার ধার ধারেন না। তথাকথিত সামাজিক সভ্যতা পালনের দায় এঁদের নেই। ত্যাগ অর্থে সর্বস্ব ত্যাগ। সমাজ, সংসার, নিয়ম, সংস্কার সব। এ এক অন্য জগৎ , যেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও দায় নেই। দলবাজির দৌরাত্ম্য নেই, রাজনীতির কুটকচালি নেই, ভোট নেই, ভোটার কার্ড নেই, আধার কার্ডের দুশ্চিন্তা নেই, আত্মীয় বিয়োগের ব্যথা নেই, সন্তানের দাগা দেওয়া নেই, প্রতিবেশীদের চুকলি নেই, ফাঁকিবাজি চাকরি নেই, অসৎ কারবারের জালিয়াতি নেই, অকেশনাল পুণ্যি পাবার আকুলিবিকুলি নেই, নাম যশের মোহ নেই, দূর্নীতি গ্রস্ত হয়ে গোয়েন্দা দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। ভক্তি আর বিশ্বাসে মোড়া এ জীবন, কেবল ঈশ্বরের কাছেই নত, আর কোথাও না।

    বিকেল ঘনীভূত হচ্ছে। পাঁচুদা এবার ফিরে যাওয়াই উচিৎ বলে মনে করছে, ঠিক তখনই তিনি আবার গুহার বাইরে এলেন।
    _ কী? কিছু বলবে? আমি কিন্তু হাতফাত দেখতে জানিনা। হা হা হা, ভেল্কি দেখাতে পারবো না।
    পাঁচুদা কুন্ঠিত গলায় বললো,
    _ না বাবা, সেসব নয়, আমার কিছু চাই না..
    কথা শেষ করার আগেই সাধুবাবা বললেন,
    _ কিছু চাই না, তাহলে এখানে এসেছিস কেন , কেদারনাথ এর কাছে। কী কামনা?
    _ কোনও কামনা নেই, বাসনা আছে বাবা। এইদেশে জন্মেছি, তাই এই দেশটা দেখতে চাই। পৃথিবীটাকে দেখবার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। তাই আমার জন্মভূমিকে দেখতে চাই।
    সাধুবাবা আরও গম্ভীর গলায় বললেন,
    _ বহুত আচ্ছা,
    গুহার পাশেই একটা পাথরের ওপর বসলেন। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুট। একটা কমলা রঙের হেলিকপ্টার ফটফট আওয়াজ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। অর্থবান আর ভি আই পি ভক্তরা তাতে সওয়ার হয়ে দেব দর্শনে আসছেন আবার ফিরে যাচ্ছেন।
    সাধুবাবা সেই দিকে তাকিয়ে বললেন,
    তুই কী করে এলি?
    পাঁচুদা হেসে বললো,
    হেঁটে। একদম গৌরীকুন্ড থেকে হেঁটে। খচ্চরের পিঠেও নয়। ওতে অনেক খরচ। আমি গরীব মানুষ বাবা।
    সাধুবাবা, একটু চুপ করে থেকে, কি যেন ভাবলেন। কপাল কুঁচকে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললেন,
    _ পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। কিন্তু একসময় তাও ছিল না। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাথুরে ভাঙাচোরা পথ। হিংস্র জন্তুর ভয়। এখানে খাবার পাওয়া যেত না। চাল আটা সঙ্গে করে আনতে হতো। থাকবার আস্তানা বলতে গুটিকয়েক চটি। খাটিয়া আর কম্বল মিলতো সেখানে। তবুও ভক্তজন আসতো।
    এবার চোখ খুললেন। লাল টকটকে। যেন চোখের তারায় আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে বললেন,
    তখন ছিল তীর্থস্থান, এখন মস্তিস্থান। মজা পেতে আসে। ব্যবসা ব্যবসা, চারিদিকে ব্যবসা। কত হোটেল, দোকান। বিজলী বাতির ঝলকানি। হেলিকপ্টার,,
    পাঁচুদা সাহস করে বললো,
    ভালই তো, বেশ উন্নতি হচ্ছে। মানুষ একটু আরাম করে আসছে থাকছে খাচ্ছে। ক্ষতি কী?
    _ ক্ষতি! বহুত ক্ষতি। দেবভূমিকে ব্যবসা ভূমি, মস্তি ভূমি বানিয়ে দেবে, ক্ষতি নয়?
    নাগাবাবা বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছেন। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
    _ তুমি কেন এসেছ? ভক্তি নাকি মস্তি?
    পাঁচুদা, নাগাবাবার ভৈরব মূর্তি দেখে একটু ভয় পেয়েছে। ঢোঁক গিলে, আমতা আমতা করে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু বলা হলো না। সাধুবাবা উত্তেজিত নাগাড়ে বলতে লাগলেন,
    তুমি কি মনে করো এইটা বিকাশ। হেলিকপ্টারে দেবদর্শন বিকাশ? এতো হোটেল, দোকানপাট, ব্যবসা, কিসের বিকাশ? ভক্তিহীন, বিশ্বাসহীন স্থান, কখনও দেবতার আবাস হতে পারে না। এখানে কোথাও দেবতা নেই। ওই মন্দিরে তিনি আছেন? নেই। ওই পাহাড়ে? নেই বরফচূড়ায়? নেই এই গুহায়? নেই, তিনি কোথাও নেই।
    তিনি আছেন মনে, আত্মায়, বিশ্বাসে আর ভক্তিতে।
    তুমি যাকে বলছ বিকাশ, আমি তাকে বলছি বিনাশ, বিনাশ, বিনাশ।
    দেবভূমি এখন নরক ভূমি। পাপ, লোভ লালসার লীলাভূমি। এর বিনাশ অনিবার্য। অনিবার্য বিনাশ।
    শুধু মন্দির আর দেবমূর্তি থাকবে, আগে যেমন আগে ছিল। বাকিসব ধ্বংস হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
    তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। নটরাজের প্রলয় নাচন আসন্ন প্রায়। পালাও পালাও সব। নইলে মরবে। সব মরবে, ভাগ যাও ভাগ যাও,
    প্রবল উত্তেজনায় তাঁর সারাশরীর থরথর করে কাঁপছিল। যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ছোঁয়া লাগলে ঝলসে যাবে সমগ্র জগৎ। জলন্ত আগ্নেয়গিরি প্রবল বেগে গুহার ভেতর চলে গেলেন।

    ওই জ্বালামুখ আগ্নেয়গিরির সামনে, পাঁচুদা নিজেকে আর নিরাপদ মনে করলো না। জনমানবশূণ্য সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশের বাইরে চলে আসাই শ্রেয়।
    সন্ধ্যা আসন্ন। আকাশে ঘনকালো মেঘের দুরন্ত আনাগোনা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা, সমস্ত পরিবেশকে যেন আরও ভয়াল করে তুলেছে।

    পাঁচুদা, কেদারনাথ মন্দিরের সামনে হাত জড়ো করে দাঁড়ালো। মন্দিরে তখন সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। কাঁপন ধরানো ঠান্ডায়, কয়েক’শ ভক্তের মাঝে দাঁড়িয়ে, কাঁসর ঘন্টা দুন্দুভি আর হর হর মহাদেব ধ্বনির মিলিত আওয়াজকে ছাপিয়ে, তার কানে ভেসে আসছে নাগাবাবার কন্ঠস্বর,
    পালাও পালাও সব, নইলে মরবে। সব মরবে।
    অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
    একি নিছক প্রলাপ, নাকি অভিশাপ? কিসের অশনিসংকেত?
    পাঁচুদা মনস্থির করেই ফেললো, কাল সকালেই পালাবে। এখানে আর কিছুতেই থাকা নেই।

    সন্ধ্যেবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টিভিতে খবর দেখা প্রায় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটা খবর দেখে চমকে উঠলাম। কেদারনাথে ভয়ঙ্কর হরপা বানে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। মন্দির আর দেবমূর্তি ছাড়া সবকিছুই প্রবল বানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ, বাড়ি ঘর জলের ধাক্কায় ভেসে গেছে।
    মন ভীষণ রকম ভারী হয়ে গেল। কেদারনাথ আমার বড় ভালোলাগার জায়গা। হঠাৎ বুকটা ধরাস করে উঠলো। আরে, পাঁচুদা কেদারনাথ গিয়েছে না? সর্বনাশ! চায়ের কাপ ফেলে লাফ দিয়ে উঠে ফোন করলাম। জয় কেদারনাথ। ফোন বাজছে।
    হ্যালো, কে পাঁচুদা। ওফ,
    ফোনের ওপারে পাঁচুদা হা হা করে হেসে বললো,
    না হে ব্রাদার মরিনি। কালকেই ফিরেছি। এ যাত্রায় খুব বাঁচান বেঁচে গেছি। এক মহান সাধুর দয়ায়।
    আমি অবাক হয়ে বললাম,
    সাধু? কে সাধু?
    ওপার থেকে পাঁচুদার উত্তেজিত কন্ঠস্বর,
    আছে আছে। সব বলবো। শুধু শুনে রাখ, পৃথিবীতে এখনো কিছু আসল মধুও আছে, সত্যি সাধুও আছে। সব ভেজাল নয়।
    অহংকার আর অভিমান ভরা জগতের পরিণাম দেখাচ্ছে টিভিতে। দেখছি আর শিখছি। দু’দিনের অতিথি রে ভাই, এ মায়া প্রপঞ্চময়, পারলে তুইও শেখ, রাখলাম।
    ফোন কেটে গেল। আমি হতবাক।

  • রম্য রচনা

    রম্য- শেষ সাক্ষাৎকার

    শেষ সাক্ষাৎকার
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

     

     

    দাশরথি দাশ আজ দুপুরে দেহ রাখলেন। বাহাত্তুরে বুড়োর জীবনাবসান। বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যাথা। শ্বাসকষ্ট। নিমেষে নিঃশব্দে এপার থেকে ওপার।
    নো হসপিটাল। নো নার্সিংহোম। নো সন্দেহজনক বাড়তি বিল। নো বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রাণান্তকর নরকযন্ত্রণা।
    আহা, কী চমৎকার শান্তিময় মৃত্যু। ওগো, সকলেরই কেন এমন করে মরণ আসে না?
    আবদার বোঝো…
    না, আসবে না। মরণের ধরন দেখে বোঝা যায়, মানুষটি কেমন ছিল। ভালো নাকি বজ্জতের একশেষ।

    পাড়া প্রতিবেশী আর গুটিকয়েক পরিচিত লোক, কাঁচ ঘেরা গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। নির্বিবাদী, ভাল মানুষের শেষ বিদায়। রোববারের ক্ষণিকের বৃষ্টি ভেজা গোধূলি বেলায়, সকলেই জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, মুখের এক্সপ্রেশনে যেন নিদারুন করুণ ভাব বজায় থাকে। কেননা এইটাই রেওয়াজ। তাছাড়া, যেকোনো মৃত্যুই দুঃখের, এইটুকু আপ্তবাক্য ছাড়া, দুঃখের আর কোনও কারণ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, কারোর পক্ষেই।
    সুতরাং মিনিট দশেকের দুঃখী অভিবক্তি চালিয়ে যাওয়া এমনকি কঠিন কর্ম।
    এ দুনিয়ায় কেইবা কার খবর রাখে। সবই স্বার্থের সম্পর্ক। সম্পর্ক হলো স্বল্প আয়ুর ভেজাল নাটিকা।
    যতক্ষণ প্রয়োজন, ততক্ষণ কাছে থাকা, খবরাখবর নেওয়া। আদিখ্যেতার জয়জয়ন্তী। প্রয়োজন মিটে গেলেই সটকে গিয়ে ভুলে যাওয়া।
    আচ্ছা, সত্যিই কী কেউ ভুলে যায় ! নাকি প্রয়োজন ফুরোলে দূরে সরে যায় ইচ্ছাকৃত ভাবে, নানান ছলে, বাহানায়, শুধুমাত্র দায়িত্ব কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চিত কারণে?
    এই বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে পি এইচ ডি করা চলে।

    দাশরথি বাবু বিপত্নীক। বছর দুয়েক আগে মিনতি দেবী ক্যান্সারে ভুগে চলে গেছেন। সন্তানাদি নেই। মানে, হয়নি। তেমন কোনও আত্মীয় পরিজনও নেই। সেই দিক থেকে বলতে গেলে, দাশুবাবু ভাগ্যবান।
    আত্মীয়ের মতো অবিশ্বাসী, পরশ্রীকাতর, হিংসুটে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর সন্তান? বিয়ে করার আগে আর বিয়ে করার পরে। আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরী হবে। সে পুত্রই হোক কিংবা কন্যা। তবে সবাই নিশ্চয় একইরকম নয়। সব জলাশয় এঁদো পুকুর নয়। কিন্তু গ্যারান্টি দেবার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই।
    বাজার থেকে দেখে শুনে বাছাই করে আম কিনে এনে, খাবার সময় সেটা দড়কচা বেরুলো। যাক,
    থাকার মধ্যে আছে এক শালা অর্থাৎ শ্যালক। শ্যামল সূর।
    “মহাপ্রস্থানের পথে” লেখা কাঁচ ঢাকা, রজনীগন্ধা ফুল আর চন্দন গন্ধ যুক্ত ধূপকাঠি জ্বালানো গাড়ি যখন, শ্মশানের দিকে গড়িয়ে গেল, একটুও অশ্রুপাত কোথাও ঘটলো না। শুধু দীর্ঘশ্বাস মেশানো একটি কন্ঠস্বর শোনা গেল, আহা, বড় পুণ্যবান মানুষ ছিলেন। একটুও কষ্ট পেলেন না। কাউকে কষ্ট দিলেনও না। কেমন নিঃশব্দে নীরবে চলে গেলেন। একেই বলে ভাগ্যবান মানুষ। হায় রে, আমাদের কপালে কী লেখা আছে কে জানে! আবারও দীর্ঘশ্বাস।
    এবারেরটা আরও বড় এবং গভীর। সম্ভবত সে বেচারি অনুমান করতে পেরেছে, শেষের সেদিন বড় ভয়ঙ্কর।

    শ্মশান যাত্রী মাত্র একজনই। শ্যালক, শ্যামল সূর।
    তাতে অবিশ্যি অসুবিধের কিছু নেই। কেননা, সেই প্রাচীন হরিধ্বনি দেওয়া, কিংবা মুঠো মুঠো খই ছড়ানো কেস বিদায় নিয়েছে। বাঁচা গেছে। যা দিনকাল আসছে, এবার হয়তো ভার্চুয়াল শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থা হবে।

    শ্মশানের যাবতীয় নিয়মাবলি শেষ করে, জামাইবাবুর মরদেহ, আধুনিক চুল্লীতে ঢুকিয়ে দিয়ে শ্যামল এসে বসলো শ্মশানের পাশেই নিরিবিলি গঙ্গা ঘাটের সিঁড়িতে।
    সামনে পবিত্র গঙ্গা, পিছনে অন্তিম গন্তব্য শ্মশান, মাঝখানে মানুষ। আহা, কী অসাধারণ কম্বিনেশন। এইতো জীবনের বাস্তব চিত্র।

    ঘড়িতে এখন রাত আটটা বেজে গেছে। কাজ সম্পূর্ণ করতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে।
    জায়গাটা কেমন যেন আলো আঁধারি মতন। একটা গা ছমছম ভাব। অবিশ্যি এটাই যে কোনো শ্মশানের চিরাচরিত আবহাওয়া।
    কেমন যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শরৎকাল। এমনই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পরক্ষণেই যেটা ঘটলো, সেটা কিছুতেই স্বাভাবিক নয়।
    শ্যামলের পাশে একটি লোক এসে বসলো। তাকে দেখেই চমকে উঠে অস্ফুট গলায় বললো,
    একি আপনি, মানে আপনি কী করে ? দাশুদা!
    হ্যাঁ, জামাই বাবুকে দাশুদা বলেই ডাকতো শ্যামল।
    দাশুবাবু চিরাচরিত অমাইক হাসিতে গাল ভরিয়ে বললেন, এলুম.. দেখলুম একা-একা বসে রয়েছো তাই..
    শ্যামলের এখনো ঘোর কাটেনি। কাঁপা গলায় অবিশ্বাসির দৃষ্টি নিয়ে বললো, কিন্তু..কিন্তু, আপনি তো এখন..
    হ্যাঁ, পুড়ছি। আধুনিক চুল্লীর ভেতর রগরগে আগুনে পুড়ছি। ভুল বললুম। পুড়ছে। আমার খোলসটা। আমি এখন এখানে, তোমার পাশে।
    বাঁচা আর মরার মধ্যে এইটুকুই ফারাক। বেঁচে থাকলে দেহ আর আত্মার একত্র বাস। মরে গেলে দেহ আর আত্মার বিচ্ছেদ। এখন আমি বিদেহী।
    শ্যামল হতবিহ্বল হয়ে শুনছে, তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।
    দাশুবাবু শ্যামলের চোখ মুখের অবস্থা দেখে আবারও হেসে বললেন, ওহে শালাবাবু, ঘোর কাটাও, স্বাভাবিক হও।
    এতই সহজ! স্বাভাবিক হও। কী করে হবো শুনি। এতদিনের ধারণা, বিশ্বাস, অবলীলায় ধুয়ে মুছে ফেলা যায়? ইয়ার্কি নাকি, ফাজলামো হচ্ছে?
    এই মশাই সত্যি করে বলুন তো কে আপনি? কেন মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছেন, কী মতলব?
    শ্যামলের গলায় মোটামুটি তেজ ছিল, তবুও কুন্ঠিত। ইদানিং কালের বাঙালি স্বভাবের মতো। ঘরে বাঘ, বাইরে নেংটি ইঁদুর।
    দাশুবাবু আবার হাসলেন। মুচকি হাসি। কেমন যেন কবি কবি হাসি। হাসি অথচ হাসি নয়। যেন ভাবের ঘোর।
    সেই এক কবি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। বললুম, ভাই চা খাবে একটু, চলো। কবি বন্ধু আমার উদাস কন্ঠে ওই রকম হেসে বললো, চা? ও..চা, মানে খেলেও হয়, না খেলেও হয়।
    যাইহোক, দাশুবাবু বললেন দ্যাখো শালা বাবু। তুমিই আমার অন্তিমকালের একমাত্র শেষ সঙ্গী।
    তাই আমার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সব তোমর নামে উইল করে দিয়েছি। সেই সবকিছুর এখন তুমিই মালিক।
    শ্যামল মনে মনে বললো, দুর মশাই, আমাকে ছাড়া আর কাকেই বা দিতেন। ত্রিভুবনে আছে কে আপনার?
    এই হলো মানুষের মন। কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। কেবল সৌজন্যের চাটুকারিতা আছে।
    তাই মুখে বললো, আমি তো আপনাকে বারণ করে ছিলাম দাশুদা। আমি কী ওসবের মর্যাদা দিতে পারবো। কোনও ভালো আশ্রম কিংবা মঠে দান করে দিলেই ভালো হতো।
    দাশুবাবুর ঠোঁটে আবারও সেই হাসি। বললেন, বেশ তো। তোমার যদি তাই মনে হয়, করবে। সে সুযোগ তো তোমার হাতে রইলোই।

    পথের মাঝে কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট, বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে প্রজাপতির ডানার মতো পিরপির করে নড়ছে। পড়বি তো পড় ন্যাপার চোখে। ব্যাস, আর যায় কোথায়। এদিক সেদিক আড়চোখে দেখে নিয়েই সটান পকেটে চালান। তারপরেই সদগতি।
    হালকা করে চুল্লু মেরে, খানিকটা মাংস কিনে, বউয়ের সামনে ফেলে দিলো, ঝপাৎ। বউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এ সব নিয়ে এলে, টাকা পেলে কোথায়?
    ন্যাপা দুলকি চালে বডি নাচিয়ে বললো, ভগবান দিয়েছে। যাও, মালটা কষে রাঁধো দেখি।
    এই হলো পোড়ে পাওয়া ষোলো আনা।
    পেলে ছাড়াছাড়ির কোনও সিন নেই। ভোগ করো , আয়েস করো। পরের ধনে পোদ্দারি করো। কিন্তু মুখে সাধু-সন্ত বুলি আওড়াও। ফোকটায় বাণী বিতরণ করো।
    তবেই তো তুমি মনুষ্য পদবাচ্য। সম্মানীয় জ্ঞানী। পাড়ার ক্লাবের নিষ্কর্মা সভাপতি।

    শ্যামল এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। জ্ঞানী মানুষের মতো ঠোঁট উল্টে বললো, ঠিকই বলেছেন। কী হবে এসব? সবই অনিত্য। এই আছে, এই নেই। খালি হাতে আসা, খালি হাতে যাওয়া। একটা দীর্ঘশ্বাস।
    দাশুবাবু আআড়চোখে, এক আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে শ্যামলের মুখের দিকে। ঠোঁটে সেই মায়াবী কবি কবি হাসি। তারপরেই আচমকা ধমকে উঠলেন, দূর শালা। মানে শালাবাবু, এসব বাজে কথা। আমি বলছি শোনো, লোটা নিয়ে আসা, কম্বল বগলে যাওয়া। লোটা কম্বল নাতিদীর্ঘ জীবন।
    শ্যামলের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী? মাথায় কিচ্ছু ঢুকলো না, তাই না? আরে বাবা অভিজ্ঞতা। এতো বচ্ছর যেখানে ছিলুম, সেইখান থেকেই অর্জন করা অমূল্য অভিজ্ঞতা।
    লোটা মানে পেট, মানে খিদে। ভোগ, লালসা, কামনার খিদে নিয়ে এসেছিলুম। আর অছেদ্দা, লাঞ্চনা, অপ্রাপ্তির ক্ষেদ দিয়ে বোনা কম্বল বগলে, করুণ সুরে ভক্তিগীতি গাইতে গাইতে নিষ্ঠুর প্রস্থান। হা হা হা..
    মন চলো নিজ নিকেতনে। কী হলো, মাথায় ঢুকেছে এবার?
    শ্যামলের পিঠে জোরে জোরে দু’টো চাপড় মেরে, আকাশ কাঁপিয়ে হা হা হা করে হাসতে হাসতে হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেলেন দাশরথি দাশ।

    শ্যামল চোখ খুলে দেখলো, সামনে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। বাবু কী ঘুমিয়ে গেলেন? কাম তো সারা হো গিয়া বাবু। ও ছাই ভসম জোলে দিবেন তো?
    আসুন আসুন, বহৎ দের লাগিয়ে গেলো, জলদি আসুন বাবু।
    শ্যামল বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, মনে মনে উচ্চারণ করলো, ঠিক বলেছ ভাই এক্কেবারে ঠিক বলেছ। দেরি হয়ে গেল, বড্ড দেরি।

  • রম্য রচনা

    রম্য- শাঁখের করাত

    শাঁখের করাত
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    হরিহর গোঁসাই প্রায় প্রতিদিনই হরিসংকীর্তন শুনতে যান মঠে। সেদিনও গেছেন, শুনছেন হরিনাম। কিন্তু আজকে যেন কিছুতেই মন বসছে না। উসখুস করছেন। বারবার পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকাচ্ছেন। চোখে মুখে ভক্তি ভাবের বদলে উৎকন্ঠা ভাব।
    পাশে বসে থাকা এক ভক্ত, আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ও হরিদা ব্যাপার কী? আজ তোমাকে বড্ড অমনোযোগী দেখছি। বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছো, কারুর কী আসবার কথা আছে নাকি?
    হরিদা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, না গো ভাইটি। বাইরে নতুন জুতোজোড়া ছেড়ে রেখে এসেছি কিনা, যদি চুরি হয়ে যায়?
    আমি চলি ভাই। কালকে সেই পুরনো ছেঁড়া চটি পড়েই আসবো।
    হরিবোল.. হরিবোল,
    সেই রামপ্রসাদের গান খানা মনে আছে?
    ‘সংসার ধর্ম বড়ো ধর্ম মা
    তাই পারিনে ছেড়ে যেতে।’

    জীবন কাটলো সংসারের দায় সামলাতে। শেষ বয়সে এসে, শেষ পাড়ানির কড়ি যোগারের মরিয়া চেষ্টা। কিন্তু অভ্যেস পিছু ছাড়বে কেন?
    অভ্যেস হলো পোষা বেড়াল। তিতিবিরক্ত হয়ে দূরে ছেড়ে দিয়ে এলেও, ঠিক গন্ধ শুঁকে শুঁকে ফেরৎ আসবে।
    সংসার জাল হলো মায়া সুতোয় বোনা। অভিমন্যুর চক্রবুহ্যে এনট্রি আছে এক্সজিট নেই।

    আসল কথা মন। যে রঙে রাঙাবে, মনে সেই রঙ ধরবে। সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এলেই মন কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে ওঠে। কামনা বাসনাগুলো কিচ্ছুক্ষণের জন্য হলেও নির্বাসনে যায়। বৈরাগী হতে চায় মন।
    মনে হয় এইতো প্রকৃত জীবন চেতনা। বৈভব ঐশ্বর্য সঞ্চয়, সুখ দিতে পারলো কৈ? শান্তি?
    চল মন বৈরাগী হই।
    আহা রে, যেন কতই সহজ। চল, লগা দিয়ে চাঁদ পেড়ে আনি গোছের ব্যাপার। যেন শিশুর হাতের চুষিকাটি।
    ঠাকুর বলেছিলেন, সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছ হয়ে। মাঝেমধ্যে সাধুসঙ্গ করবি। কিন্তু সাধু পাই কোথায়! ভন্ড আর ধর্ম বেচা কারবারি গিজগিজ করছে।
    গন্ধমাদন পর্বতের বুকে হাজারো আগাছার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে প্রাণদায়ী বিশল্যকরণী? চিনব কীভাবে, কে চিনিয়ে দেবে?

    উত্তরাখন্ডের কেদারনাথ মন্দিরের কিছুটা দূরে, এক নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে, আচমকাই সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম এক যোগী পুরুষের।
    তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি এখানে মানে কেদারনাথ মন্দিরে কেন এসেছি। বলেছিলাম, দর্শন করতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
    উনি বলেছিলেন, আজ এখানে আসা কত সহজ। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন এখানে আসতে অনেক কষ্ট, ক্লেশ স্বীকার করতে হতো। রাস্তা ছিল না। পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে, হিংস্র জন্তুর নজর এড়িয়ে, দিনের পর দিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থেকে পায়ে হেঁটে এখানে যারা শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারতেন, তারা ছিলেন নিরাসক্ত যথার্থই ভক্ত। দেবতার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতেই আসতেন তারা।
    সেসময় এখানে না ছিল ঠিকঠাক থাকার আশ্রয়, কিংবা ভোজনের ব্যবস্থা।
    পরোয়াই করতেন না তারা সেইসব বাধা। তাদের মুখে আর অন্তরে ছিল একটাই নাম,,,
    জয় শিবশম্ভু, জয় কেদারনাথ, জয় ভোলে নাথ।
    এই হলো বিশ্বাস। ভক্তি। পূজা নিবেদন।
    সেই তাদের সঙ্গে তোমাদের এখানেই পার্থক্য। তোমরা এসেছো প্রমোদ ভ্রমণে। অন্যরকম পরিবেশে ছুটি কাটাতে। একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য রেহাই পেতে। হাওয়া বদল করতে।
    হিমালয়ের অতুল সৌন্দর্যের অপরূপ মায়াবী পরিবেশে ধীরে ধীরে নেমে আসছিল সন্ধ্যার আঁধার। মন্দির থেকে ভেসে আসছিল মৃদু ঘন্টার ধ্বনি, আর নাম না জানা পাহাড়ি রাতজাগা পোকা পতঙ্গের রহস্যময় ডাক।
    জটাজুট ধারী প্রায় উলঙ্গ যোগী চলে গেলেন গুহাভ্যন্তরে। দেনাপাওনা, প্রত্যাশা, ভোগবাসনা হীন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। যেখানে ভোগবাদীদের কঠোর ভাবে প্রবেশ নিষেধ।

    রাতে হলিডে হোমের আরাম বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছে না। কেবলই সেই সাধুবাবার কথাগুলো মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন এসেছি এখানে?
    ভক্তি নেই, বিশ্বাস নেই, পুজো অর্চনা নেই, ঈশ্বরের প্রসাদ পাবার বাসনা নেই এমনকি তার কাছে কোনও প্রার্থনাও নেই। তাহলে? তাহলে এই দেবভূমিতে কেন, কেন?

    দু’টি হাত। একটি থাকুক সংসার দায়িত্ব কর্তব্য পালনে। অন্য হাত থাকুক ঈশ্বরের চরণে। কিন্তু হায়রে..তেমন হচ্ছে কৈ!
    দু:টি হাত দিয়েই মনেপ্রাণে আষ্টেপৃষ্টে ধরা আছে সংসারের মায়ার বাঁধন দড়ি। উপায় নেই, উপায় নেই। পালাবার উপায় নেই । এই তোমার অনিবার্য নিয়তি।

    আর মাত্র ক’দিন। ফিরতে হবে চিরাচরিত যাঁতাকলের সংসারে। ঘানিটানা ডাল ভাতের অফিস কাছারি জীবন। সেই খুঁটেই বাঁধা আছে মন।
    তা নাহয় হলো । কিন্তু শেষপর্যন্ত এই সংসার সব হিসেব চুকিয়ে দেবে তো? মূল্য দেবে তো? অন্তত শেষ বয়সের মর্য্যাদাটুকু? কে বলে দেবে?
    আমি মনের বশে নাকি, মন আমার বশে?
    কে বলে দেবে?
    প্রত্যাশায় ভরপুর মন, গভীর রাতে অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে বাঁশিতে সুর তোলে মালকোষ রাগে। সংসারী মনে শাঁখের করাত।
    হরি হরি করি নাকি পিষে মরি?
    মন বলে আমি মনের কথা জানি না। হায়রে,
    মন অতি বিষম বস্তু।

  • কবিতা

    কবিতা- নিরাপদ উঠোন

    নিরাপদ উঠোন
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    এই গাছটার নিচে না বসাই ভালো
    এই গাছের ওপর শকুনের বাসা।

    এই নদীর জলে পা না ডোবানোই ভালো
    এই নদীতে হিংস্র কুমিরের ঘরসংসার।

    এই জঙ্গলে চড়ুইভাতি না করাই ভালো
    এই জঙ্গলে দক্ষিণ রায়ের একছত্র রাজ।

    এই মরুভূমিতে প্রমোদ ভ্রমণ না করাই ভালো
    এই মরুভূমিতে মরুদ্যানের মায়াবী হাতছানি।

    এই তুষার পর্বতের প্রেমে মোহিত না হওয়াই ভালো
    এই তুষারপর্বতের খাঁজেখাঁজে অতলান্ত মৃত্যুফাঁদ।

    দুরছাই, এভাবে কী বাঁচা যায়?
    তবুও বাঁচতে হয়, নিরাপদ উঠোন খুঁজে খুঁজে
    যতক্ষণ জীবন।

  • কবিতা

    কবিতা- গঙ্গাফড়িং

    গঙ্গাফড়িং
    – সুজিত চট্টোপাধ্যায়

    বড্ড ইচ্ছে ছিল, বড্ড
    গঙ্গাফড়িং দেখবো, জ্যান্ত।
    যেমন দেখেছি ছবিতে,
    যেমন শুনেছি গল্পে, কৈশোরে,
    যেমন পড়েছি কবিতার অলংকারে, তেমনই,
    বড্ড ইচ্ছে ছিল, বড্ড

    নতুন পাতার মতো মায়াবী সবুজ সর্বাঙ্গে তার
    বুলিয়ে দেবো আদর মাখানো আলতো আঙুল।
    দুরন্ত ডানায় ছুঁইয়ে দেবো কোমল ঠোঁটের
    শব্দহীন প্রেম অনুভূতি চুম্বন,
    রাখবো তাকে আঙুল অঞ্জলিতে ক্ষণকাল!
    ইচ্ছে ছিল, বড্ড ইচ্ছে ছিল।

    একদিন সহসা দেখা পেলাম তার!
    প্রেয়সী সুদর্শণা সবুজ তরুণী গঙ্গাফড়িং আমার,
    না না, সেখানে নয়, সেখানে নয়,
    যেখানে পেতে চেয়েছিলাম তাকে, মনের গোচরে
    ফুলের কানন-ভাগে, সবুজ ধানক্ষেতে কিংবা
    চঞ্চলা গঙ্গার পবিত্র কিনারে কিনারে।
    হায়…
    পেলাম তাকে প্রাকটিকাল ক্লাসের চেরাই টেবিলে,
    নিথর বিবশ অসহায় অচঞ্চল সবুজ গঙ্গাফড়িং
    আমার স্বপ্ন ভালবাসার মৃতদেহ, গঙ্গাফড়িং।

You cannot copy content of this page