• গল্প

    গল্প- সিনেমার আড্ডাটা

    সিনেমার আড্ডাটা
    অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

    “ঠিক ১২ টাই আমতলায় চৌরাস্তার মোড়ে।
    মনে থাকবে যেন।মিস করিস না একদম।”
    কথা মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম আমতলার মোড়ে।
    নামটা শুনলেই মন ছুটে যায় সেই দিন গুলোর স্মৃতি পাতায়।

    ২-৫টা। ৫টা -৮ টা।এগুলো হয়তো কারোর মনে নেই।
    হাউসফুল, ব্লাকে টিকিট কাটা। ফাস্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস,ব্যাল্কনি শব্দ গুলোর সাথে একালের ছেলেমেয়েরা খুব একটা পরিচিত নয়।আমাদের সময়ে সিনেমা হলে গিয়ে, সিনেমা দেখার স্মৃতি কথা ।
    আমার এলাকার প্রতিটি সিনেমা হল আমার চেনা।
    দিনে তিন টাইম সিনেমা হতো।এখনো বেশ কিছু দামী সিনেমা হল খোলা আছে ঠিকই কিন্তু মানুষের তেমন ঢ্ল দেখা যায় না। সিনেমা পাগল দর্শক যারা আছেন,তারা হয় মোবাইলে ডাউনলোর্ড করে নিচ্ছে নয় তো টিভিতে, নেটে বা অন্য কোনো ভাবে দেখে নিচ্ছে।
    হলে বসে তিন ঘন্টা টানা সিনেমা দেখার সময় কারোর নেই।
    আর কেউ খবরই রাখি না।
    আশেপাশের অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গোনা যে কটি সিনেমা হল আছে তাও স্কুল কলেজ পালানো ছেলেমেয়েদের কাছে। অজানা অথবা গুরুত্বহীন। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে একটা স্মার্টফোন থাকলেই সব স্বপ্ন পূর্ণ। ফোনে সারা বিশ্ব দর্শন। সিনেমা দেখা হয়ে যায়। সিনেমা হলে যেতে লাগে না খুব একটা।

    আমাদের সময়ে নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পেলেই কোন হলে সিনেমাটা আসছে? কত সপ্তাহ থাকবে একেবারে মুখস্থ রাখত রোহিত, সুব্রত ঝুমা, কাকলি আমরা সবাই। উঃ কি রোমাঞ্চকর ছিল সেই দিন গুলি।
    যেদিন স্কুলে গিয়ে শুনি আজ ছাত্র ধর্মঘট । ব্যস ক্লাস বন্ধ। আন্দোলন করে ক্লাস বয়কট। কিন্তু কিসের জন্য কেন ধর্মঘট? ওসব জানার সময় ও নেই আর ইচ্ছে ও নেই। স্কুল বন্ধ মানেই সিনেমা দেখা। চারজনে মিলে দৌড় সিনেমা হলে। তখন পাঁচ দশ মিনিট বাকি। যার কাছে যা টাকা আছে টিফিন খাওয়ার কিংবা খাতা কলম কেনার। সব একত্রিত করে টিকিট কাটতে লাইন। রোহিত তো রীতিমতো ঝগড়া লাইনে দাঁড়িয়ে। কেন হাফ টিকিট দেওয়া হবে না? সব জায়গায় স্কুল ছাত্রের হাফ টিকিট বাসে অটোতে। আর সিনেমা দেখার বেলা ফুল। আসলে কিছু টাকা কম পড়ছিল। যদি একটু ম্যানেজ করা যায় আর কি।
    ঝুমা ও কম নয়। হলের কাউন্টারে গিয়ে কাউন্টারের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যদি বাকি টাকাটা না দিতে হয়। কাউন্টার কাকুও বুঝল স্কুল পালানো ছেলে মেয়ে এদের চটিয়ে লাভ নেই। বরং একটু কমিয়ে দিই। হলের সিটগুলো তো ভর্তি হবে।
    ঝুমা অবশ্য বলে আসত কাকুকে। আমার ভালো কাকু। সামনের দিন এলে সব মিটিয়ে দেব কেমন? তবে ব্যাল্কনিতে দিতে হবে সিট। হাজার হোক তোমার পাশের স্কুলের ছাত্র ছাত্রী আমরা। হলের বিপদ হলে আমরাই তো ছুটে আসব।
    দিব্যি বাড়ি না গিয়ে নতুন জুটির প্রসেনজিৎ জুহির “অমর প্রেম” সিনেমাটা দেখা হয়ে গেল। স্কুল জীবনে সিনেমা দেখা ছিল দারুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
    শারুখ খান কাজলের নতুন সিনেমা রিলিজ হলেই আর রক্ষে নেই। কতক্ষণ দেখব সিনেমাটা। আশেপাশের হলে ব্যাগের ভেতরে অন্যএকটা বাড়ির জামা লুকিয়ে আনতাম। তারপর সবাই একসাথে কোথাও দেখা করে স্কুলড্রেস গুলো বদলে নিতাম। চললাম মহানন্দে হলের দিকে। টিকিট কেটে একেবারে ব্যাল্কনির সিট। একটু আরামদায়ক নিরিবিলি। কিছুক্ষণ পরেই বাদাম ওয়ালা ঠোকায় ঠোকায় বাদাম বিক্রি করছে। ঝাল নজেন্স,ভুট্টা ভাজার প্যাকেট কিনে মুখে পুরে দিলাম। একটা করে বাদাম মুখে দিয়ে হইহই করতে করতে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে। রাহুল আর ঝুমার মধ্যে একটু খুনসুটি চলছিল,কারোর আর বুঝতে বাকি রইল না দুজনার অমরপ্রেমকাহিনীর কথা । সারা স্কুলের সেরা জুটি রাহুল ঝুমা।
    রোহিত সবার চেয়ে একটু বেশি ই দুষ্টু। ওদের একসাথে সিট দিত ইচ্ছে করে ই। দুজনার প্রেমের সুযোগ করে দিত।
    শেষ হওয়ার একটু আগেই বেরিয়ে আসতাম। দিনের আলোয় যাতে কেউ চিনতে না পারে। সবার চক্ষুর আড়ালে জনতার ভীড়ে নিজেরা লুকিয়ে ফেলতাম নিজেদের।
    সিনেমার আড্ডাটা আর নেই। হারিয়ে গেছে দিনগুলি। তবু বারে বারে মনে আসে সিনেমার আড্ডার স্মৃতি। মনে আসে ঝুমা রাহুলের প্রেম কাহিনি। বি এ পাশ করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দেখা সাক্ষাৎ বন্ধুত্ব সব অতীতের আড্ডা টুকু কেমন ধোঁয়াসে হয়ে যায় কর্মের ব্যস্ততায়। দীর্ঘ দশ বছর পর রাহুলের সাথে দেখা। সেই হাসি খুশি ছেলেটা কেমন বুড়িয়ে গেছে। পাথরের মতো স্থির কঠিন হয়ে গেছে। ঝুমার কথা উঠতেই এড়িয়ে গেল অন্য প্রসঙ্গে।
    শুনেছিলাম ওদের বিয়েটা হয় নি। রাহুল যে তখনো বেকার। এখনো বেকার বলা চলে। খবরের কাগজের দপ্তরের খবর সাপ্লাই দেয়। এমন ছেলের সাথে কে ই বা বিয়ে দেবে?
    ঝুমার গ্যাজুয়েশান শেষ করেই বিয়ে হয়ে গেল বিখ্যাত ব্যারিস্টারের সাথে। ঝুমা পারে নি রাজি করাতে বাবাকে।
    সিনেমা হলেই শেষ হয়ে গেল দুজনের অমর প্রেম।
    দিন গুলো বড্ড পিছু টানে।
    সেদিন হঠাৎ রোহিতের সাথে দেখা। আজও আগের মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সেই চাহনি সেই উজ্জ্বল দুটো চোখের ভাষায় কোথাও কোনো ভুল নেই। তবু স্বহাস্যে বুঝিয়ে দিল দিব্যি আছে খোশমেজাজে।
    যাবার সময় শুধু একবার প্রশ্ন করল, কিছুই কি মনে নেই?
    আমিও একগাল হেসে বুঝিয়ে দিলাম, রবি ঠাকুরের কথায়,রাতের সব তারারাই আছে দিনের আলোর অন্ধকারে।
    চলে গেল একমুখ তৃপ্তির হাসি হেসে।
    সিনেমার আড্ডাটা আজ আর নেই।
    আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- প্রতীক্ষা

    প্রতীক্ষা
    অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

     

     

    তুমি তো বললে ফিরে আসবে? কেন এলে না? বলো বলো কেন ফিরলে না?
    আমার সব অপরাধ । কেন পারলে না ক্ষমা করে দিতে। সত্যি বলছি এবার থেকে যা বলবে সব কথা শুনবো। সব কাজ করব। তুমি শুধু ফিরে এসো।
    ডেডবডির সামনে হাঁফুস নয়নে কেঁদে ফেলল জিত। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।
    এক একসপ্তাহ চুপটি করে ছিল। একফোঁটা ও কাঁদে নি। কেন এলে না ফিরে? উত্তর দাও মা? উত্তর দাও?
    চিৎকার করে কেঁদে ফেলল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে।
    মায়ের ডেডবডির সামনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। বাথরুমে গিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে অবাধ্য ছেলেকে ভয় দেখতে চেয়ে ছিল।
    ছুটির দিনে দুপুর বেলায় ছেলেকে বাড়ি থাকতে বলে ছিল।মায়ের কথা না শুনে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিছু বাজে ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
    তাই ছেলেকে ঘরে ফেরাতে এমন পদক্ষেপ নেবে,ছেলে ভাবতেও পারে নি। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। ছেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল। মায়ের গায়ে শুকনো কাপড় জড়িয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, সবাইকে খবর দেওয়া – সব ছেলে করে ছিল।
    তবু শেষ রক্ষা হয় নি।
    একটা অপরাধবোধে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে।
    মায়ের ডেডবডির সামনে ছেলের আকুতি – বলো মা বলো কেন আমাকে অপরাধী বানিয়ে চলে গেলে? ফিরে এসো মা।আর অবাধ্য হব না। একবার ফিরে এসো। মা —
    এভাবে আগুনে পুড়ে মারা যাবে,মা ছেলে কারোর জানা ছিল না। চিতার সামনে ছেলে উন্মাদ কান্নার শব্দে মৃত মায়ের চোখটা যেন জলে চিকচিক করে উঠলো। কেউ যেন বলে উঠলো, আবার আসব ফিরে। একটু শুধু অপেক্ষা।

  • গল্প

    গল্প – খেলাঘর

    খেলাঘর
    -অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

    এক কামরা ঘর তার ওপরে আর একটা ঘর।সরু বারান্দার একপাশে সিঁড়ি। দুকামরার দোতালা এই বাড়িতেই ছিল ছোটো একটা সংসার।সাজানো গোছানো একটা পরিকল্পিত পরিবার। সারা গ্রাম এত দিন তাই জানতো। সুখী দম্পতির সুখের সংসার। ভালোবাসার সংসার। আজ সেই দুকামরার শুন্য বাড়িটা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। ভয়ংকর সেইসব ঘটনাগুলির সাক্ষী হয়ে।
    বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পথ চলতি মানুষের একটাই প্রশ্ন মুখে মুখে। কি আবার হলো যার জন্য ছেলে মেয়েকে আর মাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো পুতুলকে?
    সুখের সংসারটা ভেঙে দিয়ে এক বুক হতাশা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল পুতুল।দীর্ঘ ২০ বছরের সংসার ভেঙে পাড়ি দিতে হলো অন্য কুলে অন্য কোনো সুখের সন্ধানে। পুতুলের খেলাঘর ভেঙে গেল তাসের ঘরের মতো।

    মানুষের গঞ্জনা অত্যাচার গুজবের নীরব সাক্ষী এখন এই বাড়িটা।
    বাড়িটা যদি কথা বলতে পারতো, যদি প্রতিবাদ করতে পারতো তাহলে হয়তো সব অত্যাচারের প্রতিবাদ করতো। অনেক আগেই মিটে যেত সব সমস্যা।
    আজ শুন্য বাড়িটা একা। বড়ো একা। ক্ষতবিক্ষত মনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
    এই বাড়িতেই জন্মেছিল ফুটফুটে একটা মেয়ে। চোখ দুটো টানা টানা। ঘনকালো লম্বা চুল। ঠিক যেন পুতুল। তাই নামটা ও রাখা হলো পুতুল।
    পাড়ার সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াতো। তখনই এপাড়ার নয়না কাকিমা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার ছোট ছেলের বউ করে আনব।এ মেয়েকে কোথাও যেতে দেব না।
    সবই ছিল কথার কথা অবশ্য।
    একদিন সেই কথায় যে সত্যি হবে,কে তা জানত? ছোট ছেলের প্রেমে পড়ল পুতুল। বিয়েটা ও লুকিয়ে হয়ে গেল।
    বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। সেই ছোট্ট মেয়েটা এত কম বয়সেই বউ হয়ে গেল।
    অদ্ভুত ব্যাপার হলো , এই বয়সে লুকিয়ে বিয়ে করায় নয়না কাকিমার চোখের বিষ হয়ে গেল।
    অত্যাচার এমন চরমে উঠলো যে শ্বশুর বাড়িতে থাকা দুস্কর।
    পুতুল ফিরে এসেছে নিজের বাড়িতে। জন্মদার্তী মায়ের কাছে। স্বামী সুকান্ত ও নিজের মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে এলো শ্বশুরবাড়িতে।
    কথা ছিল নতুন একটা বাড়ি ঠিক করে বউকে নিয়ে চলে যাবে।
    আপত্তি করল মেয়ের মা। পুতুলই তাদের একমাত্র সন্তান। একরত্তি মেয়ে বিয়ে করেছে বলে কি হাত পুড়িয়ে খাবে নতুন বাড়িতে? আদরের মেয়ে সেই থেকে মায়ের কাছেই থেকে গেল।
    শ্বশুর বাড়ি যাওয়া আর হলো না। এই বাড়িতে ই জন্মেছিল।এই বাড়িতে শুরু হলো নতুন সংসার জীবন। আবার এই বাড়িতেই জন্ম নিল পুতুলের মেয়ে। আরও চার বছর পর একটি ছেলে। কুড়ি বছরের সংসার জীবন পরিপূর্ণ হলো দুই সন্তান নিয়ে।
    একসময় মায়ের হাতে হাতে কাজ শিখে পাকা সংসারী হয়ে উঠলো।
    এখনই তো সুখের সংসার। সুকান্ত মাসে একবারই বাড়ি ফেরে কলকাতা থেকে। কয়েক দিন থেকে আবার ফিরে যায় কলকাতায়। খাওয়াপরার অভাব ছিল না। পুতুলের ও কোনো অভিযোগ ছিল না প্রেমিক স্বামীর বিরুদ্ধে। দিব্যি ছিল মিলেমিশে। অন্তত আমরা মানে পাড়াপ্রতিবেশি তাই জানত। সুখের সংসার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত যে অশান্তি কেউ তা জানতো না। পুতুল এখন আছে ভাড়া বাড়িতে মা আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে।
    বাড়িটা তালাবন্ধ।
    কিন্তু কেন এমন হলো? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভাব করেছিলাম পুতুলের সাথে। তারই বয়ানে লেখা আমার কাহিনি।
    সুকান্ত যখনই বাড়ি আসে। ব্যাগ ভর্তি বাজার সঙ্গে বিদেশি মদ। পুতুল সব জানতো।
    অল্প আদরু মদ সবাই খায় এখন। এটা তেমন দোষের নয়।সুকান্তও খেতো। পুতুল মেনেও নিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু যত আয় বাড়ে। তত বন্ধু -বান্ধব, ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। দাদারা এই সুযোগে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করতে ভাইকে তোয়াজ করে চলল। একসময় পুতুলের কোনো কথায় আর কানে ঢুকলো না। মদের গন্ধে বাড়িটা ম ম করতে থাকে। নীচের ঘরে মদের আসর বসালো। যতসব মাতাল বন্ধুবান্ধব এসে জুটলো এই বাড়িতে। ওপরের ঘরে ছেলে মেয়ে মাকে নিয়ে একপ্রকার জড়োসড়ো হয়ে পড়ে থাকতো। অপেক্ষা করতো কখন আসর ভাঙবে? তাতেও শান্তি নেই। ডাক আসে পুতুলের। সবার জন্য মদ পরিবেশন করতে।
    শান্তশিষ্ট পুতুল রাগে অপমানে গর্জে উঠল।
    মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে প্রত্যেকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল।
    তারপর থেকে সুকান্তের অত্যাচার চরমে ওঠে। “এত বড় সাহস আমারই খেয়ে আমারই বন্ধুদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া”।
    শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করল। ঠিক করল,এবাড়ি না ছাড়লে পুতুলকে জব্দ করা যাবে না।
    পুতুল সরল মনে তাই মেনে নিল। নতুন বাড়িতে নতুনভাবে সাজাবে সংসার। এত খুশির খবর।
    কিন্তু বাড়ির বড় দাদারা ততক্ষণে সব জায়গা জমি থেকে বঞ্চিত করে দিল সুকান্তকে। জায়গা কিনে ঘর বাধা আর হলো না।
    পুতুল বাড়ি ছাড়ল।
    মাকে সঙ্গে নিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল অন্য কোথাও।
    অনেক খোঁজ করে ও পুতুলদের আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
    কয়েক দিন পর পাড়ায় এল পুলিশ। সুকান্তকে ধরে নিয়ে যেতে।
    শুনলাম,পুতুল কেস করেছে স্বামীর বিরুদ্ধে।
    এখন সুকান্ত আদালতের কাঠগড়ায়।
    কতখানি যন্ত্রণা অত্যাচার করলে তবেই স্বামীর বিরুদ্ধে কেস করতে পারে কোনো প্রেমিকা বউ।
    প্রতিশোধের আগুনে পাষাণী হয়ে উঠলো পুতুল।
    যে মেয়ের মুখে সাড়া ছিল না এত গুলো বছর। স্বামীর সংসারে শান্তিতে ছিল বলে মনে হয়েছিল পথ চলতি মানুষের। সেই পুতুলই চরম নির্লজ্জতার কথা স্বীকার করল।
    স্বামীর হাতে ধর্ষিতা দুই নারীর যন্ত্রনার কথা বলতে বাধ্য হলো। এক স্ত্রী পুতুল আর এক নারী নবম শ্রেণিতে পড়া নিজের মেয়ের ওপর বাবার পাশবিক অত্যাচার।
    নিজের মেয়ের সামনে নিলজ্জের মতো পুতুলকে জড়িয়ে ধরে অসভ্যতা করা।
    পাড়ার একদল লোকের সামনে থেকে কোলে তুলে এনে ছেলে মেয়ের চোখের সামনে শুরু করত যৌন আদরের নামে নৃশংসতা। শেষ পর্যন্ত নিজের মেয়েকেও —
    তীব্র ঘৃণা আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ল পুতুল।
    মেয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করতে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে ছিল দেহ। চাই না এ খাবার। চাই না খেলনা৷ চাই না চকলেট।

    কাঠগড়ায় আসামি সুকান্ত। বধূ নির্যাতন, মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার আইনের চোখে অপরাধী এক স্বামী।।
    পরকীয়া নামক উপসংহারের তাজা মন্তব্য গুলি মুখে মুখে ঘুরছে এখন সারা পাড়া।
    ছি ছি ছি স্বামী যতই খারাপ হোক তাবলে বড় ছেলে মেয়েকে নিয়ে অন্যের হাত ধরে ঘর ভেঙে নতুন ঘর গড়া। একেমন কলংকিত মেয়ে।
    এ মেয়ে নির্ঘাত মরবে। কোনো দিনই সুখ পাবে না।
    কাঠগড়ার মুখোমুখি সুকান্ত আর পুতুল। কোনো কথা নেই। পুতুল হঠাৎ সোজা গিয়ে সুকান্তের গালে স্বজোরে চড় মারল। ঘর ভর্তি জনতা হাঁ করে দেখল। প্রতিবাদহীন সবাই। পুতুলকে ঠান্ডা করে বসিয়ে দেওয়া হলো আসনে।
    শুরু হলো বিচার।শেষ বিচারের আশায়। অর্ডার ওর্ডার সবাই অপেক্ষায়।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- পিতৃপরিচয়

    পিতৃপরিচয়
    -অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

     

     

    বয়স ৭,বছর। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের কোলে চলে এসেছিল দিদার বাড়ি। তারপর থেকে নিজের বাড়ি চোখে দেখে নি।
    বাবা কে? তার মনে নেই। কোনো দিন খোঁজও করে না। মা আবার একটা বিয়ে করেছে দোজবরে। এই বরেরও একটি ছেলে আছে। প্রথমে বলে ছিল, মেয়েকে নিজের করে নেবে। কিন্তু পরে বেঁকে বসে এ পক্ষের বর। সাফ জানিয়ে দিল, এই মেয়েকে বাপের বাড়ি রেখে এসো। মেয়ের আসল বাবাও আবার একটা বিয়ে করেছে। তাই বাপের বাড়ি রেখে আসতে চায় না মা। সেই থেকে দিদার বাড়িটাই তার ঘর। দিদাই তার মা -বাবা।
    এতদিন খিচুড়ি স্কুলে ছিল।এবার প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হবে। প্রয়োজন একটা পিতৃপরিচয়। মেয়েটির দু-দুটো বাবা। তবু সে পিতৃহীন।

    দিদার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট মেয়ে অহনা। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্যারের দিকে।
    দিদা বারবার কাকুতি মিনতি করছে স্কুলের হেড স্যারের কাছে। অহনার অভিভাবক হিসেবে দিদার নাম থাকুক স্কুলের খাতায়।
    প্রশ্নটা আপনাদের কাছে রাখলাম। বলুন মেয়েটির প্রকৃত অভিভাবক কে? দুটো বাবা থাকা স্বত্তেও কেউ দায়িত্ব ভার নিতে রাজি নয়। অথচ দিদা পরের বাড়িতে কাজ করে মানুষ করতে চায় ছোট্ট অহনাকে। কে হবে অহনার অভিভাবক?

    স্যার, সরকারি নিয়ম মেনে জানিয়ে দিলেন, পিতার নাম এবং জন্ম সার্টিফিকেট ও আঁধার কার্ড জমা দিলে তবেই ভর্তি করা সম্ভব।
    দিদা বেঁকে বসে। একটাই প্রার্থনা, আমি যখন মানুষ করছি, তখন আমার নামই থাকবে। যে বাবার অত্যাচারে জন্মের পাঁচ বছর পর ছোট মেয়েকে নিয়ে মাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে। সেই বাবার নাম কেন রাখব বলুন?
    মেয়ের মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় জন্ম সার্টিফিকেট ফেলে এসেছি।
    মেয়েকে সঙ্গে এনেছি, বলে আর দেবে না বলেছে।
    অসহায় অহনা, মা-দিদার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কি পড়া হবে না মা? আমি কি স্কুলে আসব না?

  • কবিতা

    কবিতা- নষ্ট মেয়ে বটে

    নষ্ট মেয়ে বটে
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    রাস্তায় অলিতে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকে
    আজ সে নষ্ট মেয়ে বটে,
    এখন রঙ মেখে দুচোখে ছবি আঁকে।
    মেয়েটা খারাপ ছিল না মোটে।
    আজ সে নষ্ট মেয়ে বটে।

    দুমুঠো ভাতের আশায় আজ রাস্তায়
    বাবুদের খুশিতে চলে সংসার।
    সারা রাতের কদর্য যন্ত্রণার বেদনায়
    সারা শরীরটা মূল্যহীন নিঃসাড়।
    আজ সে নষ্ট মেয়ে বটে।

    হৃদয়হীন ভালোবাসার বিছানায়
    নিজের লজ্জা রেখেছে বিছিয়ে
    মনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরালায়
    বাড়ি ফেরার পথে মুখ ফিরিয়ে–
    অজস্র ঘেন্নায় তাকায় ওরাই।
    আজ সে নষ্ট মেয়ে বটে।

    অস্পৃশ্য অপরাধী সবার চোখে
    বিসর্জন দিয়েছে একরাশ স্বপ্ন
    নীরবে সহেছে মানুষের ঠাট্টা-তামাশা
    নষ্ট মেয়ের স্বপ্ন হয়েছে ভগ্ন।
    তবু সে নষ্ট মেয়ে বটে।

    তবু তো মা টা বাঁচল বাবা দৃষ্টি পেল
    ভাইটা স্কুলে গেল বোনের বিয়ে দিল।
    সেদিনের অসহায় বাবার আত্মনাদ
    আজ সবাই গিয়েছে ভুলে
    হলো ই বা সে নষ্ট মেয়ে বটে।

    সেদিনের দুঃখ গিয়েছে ঘুচে
    সুখ এসেছে ফিরে
    সারা বাড়ি হাসি খুশি
    আড়ালে চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে
    হোক না মেয়ে নষ্ট মেয়ে বটে।

    আজ পরেছে বেগুনি রঙের শাড়ি
    ঠিক কোনো উড়ন্ত কোনো পাখি,
    ঠোঁটে লিপস্টিক কপালে বড় টিপ
    কাজল ভ্রমর দুটি আঁখি।
    এরাই তিলোত্তমা গোধূলিতে ফোটে
    আজ সে নষ্ট মেয়ে বটে।

  • গল্প

    গল্প- একগুচ্ছ চিঠি

    একগুচ্ছ চিঠি
    অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

    “তাকে “এখন রাখা হয়েছে মানসিক হসপিটালে। একটা অন্ধকার বন্ধ ঘরে। আলো দেখলেই তার দৌরাত্ম বেড়ে যায়।
    এম.এস.সি পাশ ছেলে।নাম কুন্তল।
    যার চোখে ছিল একরাশ স্বপ্ন।
    চাকরিটা পেলে, বোনের বিয়ে, ভায়ের পড়াশোনা, ডিভোর্সি দিদির ভবিষ্যৎ, বাবার চিকিৎসা করা – সব সম্ভব হবে।
    কিন্তু দিনের পর দিন চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত অবসন্ন।
    এমনই একদিন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল ট্রেনে। বেশ কিছু অপরিচিত মানুষ তার বন্ধু হয়ে ওঠে।
    সারাদিন ট্রেনের কামরায় গল্প আড্ডায় জমে ওঠেছিল আসর।
    কার মনে কী আছে কেউ জানে না।
    একসাথে ডিনার করার পর যে যার শুয়ে পড়ে।
    কিন্তু সকালে আর ঘুম ভাঙলো না কুন্তলের। জানি না কীভাবে কুন্তলের খাবারে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়ে ছিল।
    তাই কুন্তল অজ্ঞান হয়ে যায় ।
    সেই ফাঁকে বন্ধু বেশে মানুষ গুলো ততক্ষণে কুন্তলের কাছে যা কিছু ছিল সব কিছু নিয়ে ট্রেন ত্যাগ করেছে।
    কোনো এক সহানুভূতিশীল ব্যক্তি এই অবস্থা দেখে রেল পুলিশে জানান।
    তারাই কুন্তলকে হসপিটালে ভর্তি করেন।
    কুন্তল সাময়িক সুস্থ হলেও তারপর থেকে মাথার সমস্যা দেখা দেয়। যা কিছু সার্টিফিকেট কাগজপত্র ছিল,সবই সেদিন হারিয়ে ফেলে। তারপর থেকে আরও হতাশায় ভেঙে পড়ে।
    ভাবছেন এত কথা জানলাম কীভাবে?
    আসলে কুন্তলের বাড়ি আমার গ্রামে। আমার স্কুলের বিষ্টু মাস্টারের ছেলে। স্যারের ছেলেকে অনেক দিন থেকেই চিনি। শুধু চিনি বলব না, যে আমাকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবেসে ছিল। সেই কুন্তলই আমার বিবাহিত জীবনে ঝড় তুলে ছিল। অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল আমার জীবন। তার কারণ “একগুচ্ছ চিঠি”।

    কুন্তলের সাথে আমার পরিচয় চড়কের মেলায়। আমি তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।
    মুখ চেনা কিন্তু কখনো কথা হয় নি । এই প্রথম আলাপ।
    আমার কাছে এসে পরিচয় দিয়ে বলল,তুমি তো পড়াশোনায় ভালো। একটা ব্যাংকের চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে। তুমি কি দেবে? আমি সব ফর্ম ফিলাপ করে দেব। “ও “এমনই ছেলে। নিজে শুধু পরীক্ষায় বসে না,অন্যদের ও সুযোগ করে দেয়।
    তারপর থেকে প্রায় দেখা, কথা, গল্প হত।
    এরই মধ্যে আমার বেসিক ট্রেনিং শুরু।
    একবছরের জন্য চলে যেতে হলো মিশনে।ছুটি তেমন ছিল না।
    কুন্তল, বন্ধুত্বের হাতটা ধরে বলেছিল, তোমার যা কিছু নোটস লাগবে নির্দ্ধিধায় বলো।
    তখন থেকেই আমার সাথে ওর বন্ধুত্বটা আরও গভীর হল।
    মাঝে মাঝেই বৌদির হাতে পাঠিয়ে দিত চিঠি। অবশ্য পোস্ট কার্ডে।ক্রমশ চিঠির আকার বড়ো হতে লাগলো। মাঝে মাঝে চার – পাঁচ পাতার বিশাল একটা চিঠি বৌদির হাতে পাঠিয়ে দিত যত্ন করে।
    বিষয় ছিল খুব সাধারণ জ্ঞানের কথা, তবে পড়তে খুব ভালো লাগত ।
    আমিও লিখে দিতাম প্রতিটি চিঠির উত্তর।
    এভাবেই জমে গিয়েছিল একগুচ্ছ চিঠি।
    ফোন তো ছিল না। শুধু চিঠি আর চিঠি।
    যে কথা বলা যায় না মুখে,সহজেই লিখে ফেলা যায় চিঠিতে।আবেগে ভালো ভালো কথা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন সব লিখতাম মন খুলে। কুন্তলও খুব যত্ন করে লিখে পাঠাত শুধু জ্ঞানের কথা। আমাকে অনুপ্রেরণা দিত ওর লেখা চিঠিতে।
    জানি না কখন এই চিঠিই একদিন প্রেমপত্র হয়ে গেল।
    যেদিন প্রথম ও বলল, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি,সেদিনই ভয় পেয়েছিলাম।
    আমাকে নিয়ে স্বপ্ন! এমন ভাবে তো ভাবিনি কখনো।
    তাছাড়া আমার জেঠু কোনদিনও মেনে নেবে না এ সম্পর্ক। কারণ কুন্তল তখনো বেকার শিক্ষিত।তার চেয়েও বড় কথা ওরা নিচুশ্রেণীর।তাই আমার বাড়ি থেকে কিছুতেই মানবে না। আমার জেঠুর কথায় শেষ কথা।
    তবু ওর এই বন্ধুত্বটা হারাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
    নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও তাই পারিনি। ওর চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম।
    তবে চিঠির আর উত্তর দিতাম না।
    ট্রেনিং শেষ। বাড়ি ফিরলাম।
    একদিন দেখা আমতলার চারমাথায়। শুধু বলল,আমাকে পছন্দ করো না জানি, তাবলে অচেনা হয়ে যেও না। বন্ধুত্বটা রেখো।
    যেদিন মাস্টারী পাবে,সেদিন আমায় চিনতে পারবে তো?
    আমি চুপ করে ছিলাম। “ও “চলে গেল একরাশ বেদনা নিয়ে।
    ভালোবেসেছি কিনা জানি না, তবে ওর চোখদুটো দেখে সেদিন খুব কেঁদে ছিলাম। স্বার্থপরের মতো আমি ওকে শুধু ব্যবহার করেছি। তারপর আর খোঁজ রাখিনি।
    আমার লেখা চিঠিগুলো অনেকবার ফেরত চেয়েছিলাম ওর একবন্ধুর দ্বারা।কিছুতেই ফেরত দিল না।
    শুধু জানিয়ে ছিল এগুলোই আমাকে লড়াই করার শক্তি যোগাবে।

    দীর্ঘ দশ বছর পর–
    এখন আমি দুই ছেলের মা।সংসারী। স্কুল শিক্ষিকা। সুখের সংসার আমার।
    হটাৎ দেখা স্কুলের সামনে চায়ের দোকানে।
    উস্কোখুস্কো চুল,মুখ ভর্তি দাঁড়ি।
    সেই চোখ। সেই চুল।টিকালো নাক। পরনে ঢোলা চোস্তা-পাঞ্জাবি। প্রচন্ড ভয় পেলাম।
    আমি দ্রুত এগিয়ে এলাম স্কুলের দিকে।পিছন থেকে সাইকেল নিয়ে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো।
    হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলল, পড়ে দেখো। আমার ৩০ হাজার টাকা চায়।
    ভায়ের পড়ার জন্য। না পেলে তোমার লাশ পড়ে যাবে। তোমার লেখা সব চিঠি এখনো আমার কাছে। ”

    তারপর থেকে দিনের পর দিন আমাকে ভয় দেখিয়েছে।এ কুন্তল তো আমার সেই বন্ধু কুন্তল নয়। এত ভয়ঙ্কর হতে পারে কখনো ভাবতে পারিনি ।
    আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিল। কী করব? কাকে বলব? কিচ্ছু জানি না। স্বামীর কাছেও কিচ্ছু বলতে পারিনি।
    হঠাৎ একদিন আমার বাড়ির সামনে এসে হাজির।একই নাম ধরে ডাক দিল। ভয়ে আঁতকে উঠি।
    আমার স্বামী চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর কাছে গেল। কিছু বলার আগেই দু চার ঘা কষিয়ে দিল। সেই সঙ্গে বলল,
    এখুনি যদি চলে না যাও,পুলিশকে জানাতে বাধ্য হবো।
    সেদিন লোক জমে গিয়েছিল। সবাইকে জানালো টাকা ধার নিতে এসেছে, পাড়ার মেয়ের কাছে। দেবে না বলতেই রাগ দেখিয়ে উল্টো পালটা গালাগালি দিচ্ছিল। তাই গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হই।
    বালিশে মাথা গুঁজে তখনও কাঁদছি। আমার স্বামী কাছে এসে বলল,চিরকুটটা আমি পড়েছি। ভয় পেও না, পাশে আছি। তোমাকে বিশ্বাস করি। কার কাছে কী চিঠি আছে,তা এখন অতীত। তুমিই আমার বর্তমান। চোখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।

    জানি না স্যার কীভাবে খবর পেলেন? ঠিকানা খুঁজে ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে এলেন আমার বাড়িতে।
    আমাকে বললেন,আর চিন্তা করো না। ও আর আসবে না। নিশ্চিন্তে সংসার করো।
    পাঞ্জাবীর খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।
    স্যারের মুখেই শুনলাম শিক্ষিত বেকার পরোপকারী কুন্তলদার বাকি কাহিনী। আমি দশ হাজার টাকা দিয়ে বলেছিলাম, কুন্তলদার ভালো করে চিকিৎসা করান স্যার। এটা আমার গুরুদক্ষিণা ভেবেই গ্রহণ করুন। স্যার মুচকি হেসে বললেন,”ছেলের চিকিৎসার খরচ আমি একাই করতে পারব। তুমি ভালো থেকো মা। ”
    সে এখন মানসিক হসপিটালের ১৩ নম্বর রোগী।1

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- আনন্দধারা

    আনন্দধারা

    -অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

     

     

    প্রসব বেদনায় ছটপট করছে কমলা। ছোট ছেলেটা কাঁদছে । ভাত চায় ভাত। চালটা ফুটে উঠলেই হবে গরম ভাত । আর একটু ধৈর্য্য । নিজের যন্ত্রনাটুকু পেট চেপে ধরে আছে । বড়টা মাঠে । এখনো বাড়ি ফেরেনি । পোয়াতি গাভীটা ও কমলার করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে। রোদে শুয়ে এখন । সব ভাবনা কমলার ।
    কি করবে কমলা? আর যে সইতে পারছে না । বড় ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে হবে । খুঁজেই পাচ্ছে না । আরও একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে । ততক্ষনে খবর পেয়েছে পাড়ার দাইমা । হ্যালা,মাগী এবারেরটাকেও খাবি নাকি ? কি ভেবেছিস শুনি? চল্ আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ।
    -কি করব জ্যাঠি মা। সব একটু গুছিয়ে নিয়ে একাই চলে যাব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে । ঠিক সইতে পারব গো ।
    -খুব হয়েছে, কত করে বারণ করলাম, এবার ওষুধ খা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে শরীরটা ভালো করে দেখা । শুনলি না? মেয়ে নেবার বড্ড সখ তাই না?
    -না গো দাইমা, ওর বাপের মেয়ে নেওয়ার বড্ড সখ। দুটো ছেলে। এবার নিশ্চয় মেয়ে হবে। একটু কষ্ট হচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তাই না দাইমা?
    দাইমা, মুখ বাঁকিয়ে বললো, অভাবের সংসার তবু সখ ষোলোয়ানা ।
    কমলা হাসতে হাসতে বলল, বরকে বড্ড ভালোবাসি গো। আবদার করে মেয়ে চেয়েছে । আর আমি দেব না ?
    -আর যদি না হয়, কি করবি?
    -কত মান্যত করেছি গো দিদি । উপোষ ব্রত সব । ঠাকুর এবার ঠিক সহায় হবে গো।

    কমলা এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেডে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে অপেক্ষায় । একটা কান্নার রোল শোনার জন্য । দুই ছেলে কেঁদেই চলেছে মায়ের জন্য। গোধূলি লগ্নে শঙ্খ ধ্বনি বেজে উঠল । ঠিক তখনই শোনা গেল কান্নার আওয়াজ । আনন্দে আত্মহারা কমলার স্বামী।
    দাইমার কোলে কমলার মেয়ে । কিন্তু কমলা ? দাইমা চোখ মুছতে মুছতে মেয়েকে দেখিয়ে বলল, এই নে তোর লক্ষ্মী। লক্ষ্মী হারিয়ে লক্ষ্মী পেলি। খুশি তো?

    বরের চোখে আনন্দধারা ।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- আশির্বাদ

    আশির্বাদ
    অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

    হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। পাড়ার বৃদ্ধ বিষ্টু মাষ্টার। বাজারের ব্যাগটা শক্ত করে ধরলেন। তবু বয়স হয়েছে তো,মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। লাঠিটা ঠিকরে পড়ল দূরে। চশমার ফ্রেমটা গেল খুলে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিস। কত লোক। স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা পাশ দিয়েই ফিরছিল। কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। অদেখার ভান করে এগিয়ে গেল। স্যার, একবার ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু কি যেন ভেবে থেমে গেল।
    অন্যান্য যে যার কাজে ব্যস্ত।ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করলেন। কেউ একজন বাড়িয়ে দিল হাতটা। শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন স্যার। বৃদ্ধ স্যার একবার তাকাল ছেলেটার দিকে। চোখে চশমা নেই। বয়সের আড়ালে ঢাকা দৃষ্টি। ছেলেটা স্যারকে যত্ন করে তুলে ধরল। বাজার সামগ্রী ব্যাগে ভরে দিল। মাষ্টার মশাই বললেন, কে বাছা? ঠিক চিনতে পারছি না তো।
    সেই রকমই দুষ্টু হেসে বলল, স্যার আমায় চিনলে না? আমি আপনার ক্লাসের সেই বদমাশটা, বাদল। যার জ্বালাতনে সারা ক্লাস অতিষ্ঠ হয়ে যেত। যার জন্য আপনার কাছে কত বকুনি খেয়েছি। তা কি ভুলতে পারি?
    আমি সেই লাষ্ট বেঞ্চের লাষ্টবয় বাদল।
    মাষ্টার মশাই মনে করার চেষ্টা করলেন, মাথা মোটা একটা দুষ্টু ছেলে। সবার অপ্রিয় ছিল স্কুলে। বন্ধুদের সাথে মারামারি, গন্ডগোল এসব করতে ওস্তাদ।
    তাই যেদিন স্কুল থেকে বিদায় নিল বাদল, সব স্যারেরা একটু স্বস্তি পেয়েছিল।
    শুধু এই বিষ্টু স্যার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, বাদল এবার একটু মানুষ হও।
    বাদল মুচকি হেসে বলেছিল, আপনারা শান্তি পেলেন স্যার। আর জ্বালাতে আসব না।
    মাষ্টার মশায়ের আজ সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
    বাদল, শক্ত করে হাতটা ধরে স্যারের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল।
    স্যারও বাদলের হাতটা ধরে বলল, আবার এসো বাদল।
    বাদল মুচকি হেসে বলল, না স্যার,কথা দিয়েছিলাম আর জ্বালাতে আসব না। আজ বাধ্য হয়েই…তবে আপনি ডাকলে না বলতে পারব না স্যার।
    আপনার আশির্বাদ বিফলে গেছে সেকথা যাতে কেউ না বলে সেজন্য মানুষ হওয়ার একটু চেষ্টা করছি স্যার। আমি হতে পেরেছি কি স্যার?
    স্যার- চুপ হয়ে গেলেন। বাদল হাসতে হাসতে চলে গেল।

  • নাটক

    শ্রুতি নাটিকা -সম্বোর্ধনা

    শ্রুতি নাটিকা – সম্বোর্ধনা 

    – অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

    ঘরের পাশে চেয়ারে বসে পেন খাতা নিয়ে বিষ্টু মাস্টার–

    বিষ্টু স্যার—(মাথায় মুখে হাত দিয়ে) বলি শুনছ, আমার চশমাটা দেখেছ? কোথায় যে রেখেছি? খুঁজে দাও তো গিন্নি। খুব দরকার।
    গিন্নী —— চশমা? ভালো করে খুঁজে দেখো। তোমার কাছেই আছে। কি যে ভুলো মন হয়েছে তোমার?
    বিষ্টুস্যার– আমার কাছে? কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো?
    বিষ্টু স্যার—-পকেটে কী শুনি? পাঞ্জাবির পকেটে রেখে আর চারিদিকে চশমা খুঁজছো।
    স্যার — ও তাই তো। খেয়াল করিনি গো গিন্নী। মন দিয়ে ভাবছি তো। কত কথা। কত স্মৃতি। তারপর লেখাটি শেষ করব।
    গিন্নী —বলি কী এত লিখছ? যেদিন থেকে স্কুল থেকে অবসর নিলে, সেদিন থেকে লিখেই যাচ্ছো।
    স্যার– তুমি বুঝবে না গো গিন্নী। এসব দরদের কথা, আবেগের কথা কিচ্ছু বুঝবে না। বড্ড কষ্ট হয় গো। বাড়িতে একা একা থাকতে, খুব মন কেমন করে।
    গিন্নী— তাই বুঝি? বলি কাকে নিয়ে এত ভাবছ? বুড়ো বয়সে আবার প্রেমে পড়লে নাকি?
    বিষ্টু স্যার— কী যে বলো গিন্নী। এসব হেঁয়ালি করার এখন সময় আছে? যখন তখন ফাজলামি ভালো লাগে না।

    গিন্নী — তা,বেশ। আর বলব না।
    এবার বলো তো কী এত লিখছ?
    বিষ্টু স্যার— একটা বক্তৃতা। একটা বক্তব্য। বুঝলে গিন্নী বিদায়ী সম্ভাষণ লিখছি।
    দীর্ঘ ৩০ বছরের স্কুল জীবনের ভালো -মন্দ, সুখ দুঃখ,হাসি কান্না সব লিখছি এই খাতায়।
    গিন্নী— বক্তৃতা?
    স্যার—স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মনে পড়ে যাচ্ছে প্রথম দিনের সব কথা।
    .গিন্নী — — তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বসে বসে যত এসব মনে করবে, শরীর খারাপ হবে। আর এত বড় লেখা কেউ এখন শুনবে বলে মনে হয়?
    স্যার– কেন শুনবে না ? আমাদের জন্যই তো অনুষ্ঠানটা হচ্ছে। কত ভালোবাসে সবাই।
    আর আমার বক্তব্য শুনবে না। তা হয়?

    গিন্নী—- সবার জীবনের কাহিনিই বড়ো করুণ । শুধু কি তুমি একা? দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা সবাই যদি লিখতে বসো, একটা ইতিহাস হয়ে যাবে।
    স্যার– (আপন মনে) জানো গিন্নী, সময়টা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। স্কুলটা নিয়ে কত কিছু ভেবে ছিলাম। দুবছর লকডাউনে কিছুই করতে পারি নি শেষ সময়টা। স্কুলের ঘন্টা ধ্বনি এখনো কানে বাজে। ১১ টা বাজলেই মন ছুটে যায় স্কুলে।
    মেয়ে— —–
    তুমি তো যেতেই পারো স্কুলে। সুজয় কাকু তো বলেছে, একদিন করে স্কুলে যেতে। এখন তো উনিই ইনচার্জ।

    স্যার– তা বলেছে বটে। তবু কোথাও যেন একটা অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। দাবী আর করতে পারি না।
    মেয়ে—
    ও বাবা, তুমি এখনো এসব নিয়ে ভাবছ? এই তো সেদিন আমাদের বড়দি অবসর নিলেন। আমরাও প্রণাম করলাম। বড়দিকে জড়িয়ে ধরে কত মন খারাপ করলাম। বড়দি যত কাঁদে,আমরাও তত কেঁদে ফেলি। কী করব বলো। সময় হলে চলে যেতেই হবে। নতুনদের জন্য পদ ছেড়ে দিতে হবে বাবা। তুমি আর মন খারাপ করো না। শরীর খারাপ করবে।
    স্যার— দূর, বোকা। মন খারাপ করবে কেন? আমি বেশ ভালো আছি। শুধু মাঝে মাঝে —
    জানিস তো মা, যেদিন চলে এলাম স্কুল থেকে। ক্লাস ওয়ানের রিতিশা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আর মুখে বলছে, তুমি যাবে না স্যার। তুমি চলে গেলে কে গল্প শোনাবে? ভুতের গল্প, বাঘের গল্প, আর মজার মজার ছড়া।
    সব ছেলে গুলো গেট আটকে দাঁড়িয়ে ছিল। কী করে ভুলি রে মা? চোখের সামনে ভেসে উঠছে সব।
    মেয়ে— জানি বাবা। সব বুঝতে পারছি। এত কষ্ট পেলে তোমার প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করে ঘুমাও।

    গিন্নী — অনেক হয়েছে। এবার লেখা বন্ধ করো। বেশি রাত না করে ঘুমাও।
    স্যার— তোমরা যাও তো বাপু। বিরক্ত কর না এখন । আমার হাতে অনেক সময়। লেখাটি শেষ করে তবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।
    আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি গিন্নী।
    সামনেই ৫ই সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। ওই দিনই আমাদের বিদায় সম্বোর্ধন।
    মন দিয়ে লিখতে দাও। এখন যাও তো।

    দ্বিতীয় দৃশ্য —-

    অনুষ্ঠান শুরু- হচ্ছে।

    অনুষ্ঠান পরিচালক -/সঞ্চালক
    আজ ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। সেই উপলক্ষে একটি সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
    উপস্থিত বিদায়ী শিক্ষক শিক্ষিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হচ্ছে।

    স্যার– (বারবার কাগজটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। ভালো করে বলতে হবে।) কখন যে আমাকে ডাকবে? তার আগে আরও একবার পড়ে ফেলি।
    সঞ্চালক——
    প্রথমেই একটা সমবেত উদ্বোধন সংগীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করছি।
    পরবর্তী সংগীত শিল্পী প্রস্তুত থাকুন।
    শিল্পী — রমা চৌধুরী।
    তারপর আছে সমবেত নৃত্য। আপনারা শুনতে থাকুন আমাদের অনুষ্ঠান।
    স্যার—- এখন বাজে ১টা। নিশ্চয় একজনের নাচের পরই আমাকে ডাকা হবে। এত ঘাবড়ে যাচ্ছি কেন? না না আমাকে ঘাবড়ালে চলবে না। আমাকে সব বলতে হবে স্কুলের কথা।মন খারাপের কথা। স—— ব।
    সঞ্চালক– পরবর্তী কর্মসূচি এখুনি জানানো হবে। এখন পাঁচ মিনিটের টিফিন ব্রেক নেব। তারপর আবার অনুষ্ঠান শুরু হবে।

    স্যার– আবার ব্রেক!
    একে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কী যে করে এরা? বুঝি না। আমার যে আর তর সইছে না।

    সঞ্চালক—- আবার শুরু হচ্ছে অনুষ্ঠান। এখন আবৃত্তি করবেন– স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা।
    এছাড়া শিক্ষক – আরোহন বন্দোপাধ্যায়।
    স্যার– আর কত দেরী হবে? বুঝতে পারছি না। বেলা হয়ে যাচ্ছে।
    সঞ্চালক– এবার পরপর ডাকা হচ্ছে বিদায়ী শিক্ষক মহাশয়দের। প্রত্যেকের নাম ঘোষণা করছি। আপনারা প্রস্তুত থাকুন।
    স্যার– এই তো ঘোষণা হয়েছে। এবার আমার পালা। ঠিক বলতে পারব তো বলতে? চোখের পাতা মোটা হয়ে আসছে কেন? এরা তো সবাই আমার চেনা। তবু কেন এত কান্না পাচ্ছে?
    সঞ্চালক– প্রথমে ডেকে নেব মানপত্রের লেখাটি পাঠ করতে শিক্ষিকা নাজিমা খাতুন মহাশয়াকে।
    তারপর আরও একটা সমবেত সংগীত। তারপর চলে আসবেন পরপর।

    স্যার– হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। বেলা ৩ টে বাজে।
    দেখি কখন ডাকে আমায়?
    সঞ্চালক — দুঃখিত। সময় আর বেশি হাতে নেই। এবার বিদায়ী শিক্ষকদের উপহার ও বক্তব্য শুনবো আমরা। তারপরই অনুষ্ঠান শেষ করব।আপনারা একটু ধৈয্য ধরে বসুন। কেউ চলে যাবেন না। ওনাদের সম্মানিত করতে হবে। আপনাদের উপস্থিতিটা খুব দরকার।
    স্যার– একি সবাই চলে যাচ্ছে কেন? একটু থাকুন সবাই। আমার বক্তব্য আপনারা না শুনেই চলে যাবেন।
    সঞ্চালক– মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি বিদায়ী স্যার — মনোতোষ মন্ডল মহাশয়কে।
    স্যারের কানে কানে — একটু ছোট করবেন বক্তৃতা। বুঝতে পারছেন সময় হয়ে যাচ্ছে। পরপর চলে আসুন সবাই।
    পরবর্তী ও শেষ বিদায়ী শিক্ষক মহাশয় বিষ্টুপদ মল্লিক মহাশয়। আসুন স্যার স্টেজে আসুন।
    স্যার– থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলেন। সবে মাত্র পকেট থেকে কাগজটা বের করে পড়তে যাবেন। সঞ্চালক কাছে এলেন।
    সঞ্চালক– স্যার,কিছু মনে করবেন না। বুঝতে পারছেন তো। সময় খুব কম হাতে।
    ৪ টে বেজে গেছে। সবাই উঠে পড়ছে। আর সবার কাহিনি একই। এসব শুনলে সবাই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। তার চেয়ে মানপত্র আর উপহার তুলে দিই। কী বলেন স্যার?
    স্যার — (অবাক হয়ে) আমি কিছু বলব না? কেউ শুনবে না আমার কথা? আমি যে এত লিখে আনলাম । কেউ শুনবে না?
    বেশ। তাই হোক।
    কি—চ্ছু বলব না।
    সঞ্চালক — দুঃখিত স্যার। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন স্যারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মানপত্র সহ উপহার। স্যার খুব ভালো থাকুন। এভাবেই তো সবাইকে চলে যেতে হবে। দুঃখ পাবেন না। চলুন স্যার আপনাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিই।
    স্যার– (মুচকি হেসে) থাক। আমি একাই যেতে পারব। এখনো বুড়ো হয় নি। তোমরা অনুষ্ঠান শেষ করো।
    কাগজের টুকরো টা পকেটে গুজে নিয়ে হল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
    স্যার — কাগজটা ছিঁড়ে ফেলি। কী আর হবে রেখে? কেউ শুনল না আমার কথা। গিন্নী ঠিকই বলেছিল,কথাটা শুনলেই ভালো হতো।
    ছাত্রীরা—– স্যার স্যার ভালো আছেন? কত দিন পর দেখছি আপনাকে। আপনার কথা শুনবো বলে স্কুল ছুটি হতেই চলে এসেছি।
    আমি ময়না, মনে আছে স্যার। দশবছর আগে আপনার কাছে পড়েছি। এখন হাইস্কুলে পড়ি। আমি আপনার সেই দুষ্টু ছাত্রী ময়না।
    রাখি— আর আমি রাখি। এখন ক্লাস নাইনে পড়ি। চিনতে পারছেন স্যার।
    স্যার– ও তাই তো।
    চোখে তেমন দেখি না তো?
    চোখটা আবছা হয়ে আসছে।তবু তোমাদের ঠিক মনে রেখেছি।
    ময়না— কী করে দেখবেন স্যার? চোখে যে জল ভর্তি। কাঁদবেন না স্যার।
    চলুন স্যার, ওখানে বসি।
    আমরা শুনবো আপনার কথা। কাগজটা ছিঁড়বেন না স্যার।আমরা সব শুনবো। আপনি পড়ুন।
    রাখি —- আমাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রিয় বকুল ফুল। আমাদের বাগানে ফুটে ছিল শুধু আপনার জন্য।
    পছন্দ হয়েছে স্যার?

    রাখি— আর আমার আঁকা ছবি “রবীন্দ্রনাথ “আপনার জন্য। সারা রাত ধরে এঁকেছি। ভালো হয়েছে স্যার?
    স্যার– (বুকে জড়িয়ে ধরে) খুব খুব পছন্দ হয়েছে। আজ বড্ড খুশিরে। তোরাই তো আমার সব কিছু। তোরাই আমার শ্রেষ্ঠ উপহার। আয় আমার বুকে আয়।

  • গল্প

    গল্প- বৃষ্টি

    বৃষ্টি
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    বৃষ্টি এখন মানসিক কেন্দ্রে। চঞ্চল মেয়েটা কেমন যেন শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক শীতল ধীর সরবরের মতো। এখন সে অন্ধকার ঘরে বসে কি সব আঁকি বুকি আঁকে দেওয়ালে। আর তাকিয়ে থাকে বাইরের আকাশের দিকে।
    বৃষ্টির মা একবার বাড়িতে রঙীন পাখি পুষে ছিল। সময়ে খেত দিত খাঁচায়। বেশ মজা পেত বৃষ্টি । এক দিন দেখল, কিছু লোক এসে বড় পাখি গুলি বাক্স বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি ছুটে এসে মাকে নিষেধ করল। কিছুতেই শুনল না মা। বুঝিয়ে বলল বৃষ্টিকে, পাখি বিক্রি করেই তো দুটো পয়সা হবে সোনা। সেই জন্যই তো পুষেছি।
    বৃষ্টি চুপচাপ শুনল। কি একটা ভেবে চলে গেল। সকালে উঠে মা দেখে অবাক হয়ে গেল। একটা ও পাখি নেই খাঁচায়। বুঝতে আর বাকি রইল না। নিশ্চয় বৃষ্টির কাজ। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
    আমি আর বায়না করব না মা পুতুল কেনার জন্য। পাখি বেঁচে টাকা নিও না। আকাশই ওদের ঘর। কি আনন্দে ওরা উড়ে বেড়ায়,তাই না!
    মায়ের রাগ হলেও বৃষ্টির এমন কথার উত্তর দিতে পারল না। সে দিনের পর আর বাড়িতে কিছু পোষে না ।
    সেই বৃষ্টিই আজ বন্দী । বন্দী খাঁচা যার পছন্দ ছিল না।

    বৃষ্টি নাচে গানে পাড়ার সেরা মেয়ে। মাথা ভরতি কোঁকড়ানো চুল। জ্যাঠিমার কাছে বসে টান টান করে বেনি করত। লাল ফিতে দিয়ে ফুল করে নাচ দেখাত। দিন দিন চঞ্চল ছটপটে মেয়েটা কেমন ভয়ে আতঙ্কে শিউড়ে থাকত।
    একদিন ভোরে রেলস্টেশনের দিকে যেতে দেখল তাকে। ওই দিকেই পুলিশ স্টেশন। পাড়ার কিছু লোক এসে খবর দিল। বৃষ্টির বাবা ছুটতে ছুটতে গেল।
    দেখে, বৃষ্টি রক্ত মাখা ছুড়ি হাতে বসে আছে। বাবাকে দেখেও মুখে কোন সাড়া নেই। বার বার জানতে চাইল কী করেছ বৃষ্টি? ছুড়িটা দেখিয়ে বলল,খুন করেছি। ওই দুষ্টুলোকটাকে। তাই ধরা দিতে এসেছি।
    কে সেই লোক? কী করেছে? সবাই জানতে চায়লো।
    বৃষ্টি বলতে শুরু করল,
    পাড়ার মুদি দোকানদার, রতন কাকুকে খুন করেছি।প্রায় প্রতিদিনই স্কুলের ছোট মেয়েদের খাবারের লোভ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে যেত। আর ইচ্ছে মতো আদর করতো। খুব কষ্ট হতো।কী সব নোংরামো করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত। বাড়িতে বলতে বারন করতো। আমাকে ও প্রায় জোর করে চকলেট খাওয়ানোর লোভে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন টিভিতে এক নাটক দেখেই বুঝেছি । এসব খারাপ মানুষের বাজে কাজ। তাই আজ মেরেই ফেললাম। বড্ড জ্বালা দিত সবাইকে। রাগে মাথা গরম হয়ে গিয়ে ছিল। ছুড়িটা বসিয়ে দিলাম পেটে। ব্যাগে ভরে নিয়ে গিয়েছিলাম স্কুলে। ফেরার পথে বসিয়ে দিয়েছি পেটে।
    ওই সব দুষ্টু লোকদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। বলো বাবা, আমি ঠিক করেছি কি না?
    বাবার মুখে কোন কথা নেই। মেয়ের সাহসীকথায় গর্বে বুক ভরে গেল।
    রতন মারা যায় নি। পুলিশ আহত রতন কে তুলে নিয়ে আসে থানায়।
    কিন্তু বৃষ্টি আর ফিরতে পারে নি স্বাভাবিক জীবনে।
    খাঁচার ভেতর থেকে সে দেখে, আকাশের বুকে কেমন পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। তালি দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে আর
    বলে ওঠে,” যারে পাখি যা উড়ে যা”।

You cannot copy content of this page