• অণু গল্প

    অণুগল্প- আশির্বাদ

    আশির্বাদ
    অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

    হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। পাড়ার বৃদ্ধ বিষ্টু মাষ্টার। বাজারের ব্যাগটা শক্ত করে ধরলেন। তবু বয়স হয়েছে তো,মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। লাঠিটা ঠিকরে পড়ল দূরে। চশমার ফ্রেমটা গেল খুলে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিস। কত লোক। স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা পাশ দিয়েই ফিরছিল। কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। অদেখার ভান করে এগিয়ে গেল। স্যার, একবার ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু কি যেন ভেবে থেমে গেল।
    অন্যান্য যে যার কাজে ব্যস্ত।ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করলেন। কেউ একজন বাড়িয়ে দিল হাতটা। শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন স্যার। বৃদ্ধ স্যার একবার তাকাল ছেলেটার দিকে। চোখে চশমা নেই। বয়সের আড়ালে ঢাকা দৃষ্টি। ছেলেটা স্যারকে যত্ন করে তুলে ধরল। বাজার সামগ্রী ব্যাগে ভরে দিল। মাষ্টার মশাই বললেন, কে বাছা? ঠিক চিনতে পারছি না তো।
    সেই রকমই দুষ্টু হেসে বলল, স্যার আমায় চিনলে না? আমি আপনার ক্লাসের সেই বদমাশটা, বাদল। যার জ্বালাতনে সারা ক্লাস অতিষ্ঠ হয়ে যেত। যার জন্য আপনার কাছে কত বকুনি খেয়েছি। তা কি ভুলতে পারি?
    আমি সেই লাষ্ট বেঞ্চের লাষ্টবয় বাদল।
    মাষ্টার মশাই মনে করার চেষ্টা করলেন, মাথা মোটা একটা দুষ্টু ছেলে। সবার অপ্রিয় ছিল স্কুলে। বন্ধুদের সাথে মারামারি, গন্ডগোল এসব করতে ওস্তাদ।
    তাই যেদিন স্কুল থেকে বিদায় নিল বাদল, সব স্যারেরা একটু স্বস্তি পেয়েছিল।
    শুধু এই বিষ্টু স্যার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, বাদল এবার একটু মানুষ হও।
    বাদল মুচকি হেসে বলেছিল, আপনারা শান্তি পেলেন স্যার। আর জ্বালাতে আসব না।
    মাষ্টার মশায়ের আজ সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
    বাদল, শক্ত করে হাতটা ধরে স্যারের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল।
    স্যারও বাদলের হাতটা ধরে বলল, আবার এসো বাদল।
    বাদল মুচকি হেসে বলল, না স্যার,কথা দিয়েছিলাম আর জ্বালাতে আসব না। আজ বাধ্য হয়েই…তবে আপনি ডাকলে না বলতে পারব না স্যার।
    আপনার আশির্বাদ বিফলে গেছে সেকথা যাতে কেউ না বলে সেজন্য মানুষ হওয়ার একটু চেষ্টা করছি স্যার। আমি হতে পেরেছি কি স্যার?
    স্যার- চুপ হয়ে গেলেন। বাদল হাসতে হাসতে চলে গেল।

  • নাটক

    শ্রুতি নাটিকা -সম্বোর্ধনা

    শ্রুতি নাটিকা – সম্বোর্ধনা 

    – অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ

    ঘরের পাশে চেয়ারে বসে পেন খাতা নিয়ে বিষ্টু মাস্টার–

    বিষ্টু স্যার—(মাথায় মুখে হাত দিয়ে) বলি শুনছ, আমার চশমাটা দেখেছ? কোথায় যে রেখেছি? খুঁজে দাও তো গিন্নি। খুব দরকার।
    গিন্নী —— চশমা? ভালো করে খুঁজে দেখো। তোমার কাছেই আছে। কি যে ভুলো মন হয়েছে তোমার?
    বিষ্টুস্যার– আমার কাছে? কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো?
    বিষ্টু স্যার—-পকেটে কী শুনি? পাঞ্জাবির পকেটে রেখে আর চারিদিকে চশমা খুঁজছো।
    স্যার — ও তাই তো। খেয়াল করিনি গো গিন্নী। মন দিয়ে ভাবছি তো। কত কথা। কত স্মৃতি। তারপর লেখাটি শেষ করব।
    গিন্নী —বলি কী এত লিখছ? যেদিন থেকে স্কুল থেকে অবসর নিলে, সেদিন থেকে লিখেই যাচ্ছো।
    স্যার– তুমি বুঝবে না গো গিন্নী। এসব দরদের কথা, আবেগের কথা কিচ্ছু বুঝবে না। বড্ড কষ্ট হয় গো। বাড়িতে একা একা থাকতে, খুব মন কেমন করে।
    গিন্নী— তাই বুঝি? বলি কাকে নিয়ে এত ভাবছ? বুড়ো বয়সে আবার প্রেমে পড়লে নাকি?
    বিষ্টু স্যার— কী যে বলো গিন্নী। এসব হেঁয়ালি করার এখন সময় আছে? যখন তখন ফাজলামি ভালো লাগে না।

    গিন্নী — তা,বেশ। আর বলব না।
    এবার বলো তো কী এত লিখছ?
    বিষ্টু স্যার— একটা বক্তৃতা। একটা বক্তব্য। বুঝলে গিন্নী বিদায়ী সম্ভাষণ লিখছি।
    দীর্ঘ ৩০ বছরের স্কুল জীবনের ভালো -মন্দ, সুখ দুঃখ,হাসি কান্না সব লিখছি এই খাতায়।
    গিন্নী— বক্তৃতা?
    স্যার—স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মনে পড়ে যাচ্ছে প্রথম দিনের সব কথা।
    .গিন্নী — — তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বসে বসে যত এসব মনে করবে, শরীর খারাপ হবে। আর এত বড় লেখা কেউ এখন শুনবে বলে মনে হয়?
    স্যার– কেন শুনবে না ? আমাদের জন্যই তো অনুষ্ঠানটা হচ্ছে। কত ভালোবাসে সবাই।
    আর আমার বক্তব্য শুনবে না। তা হয়?

    গিন্নী—- সবার জীবনের কাহিনিই বড়ো করুণ । শুধু কি তুমি একা? দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা সবাই যদি লিখতে বসো, একটা ইতিহাস হয়ে যাবে।
    স্যার– (আপন মনে) জানো গিন্নী, সময়টা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। স্কুলটা নিয়ে কত কিছু ভেবে ছিলাম। দুবছর লকডাউনে কিছুই করতে পারি নি শেষ সময়টা। স্কুলের ঘন্টা ধ্বনি এখনো কানে বাজে। ১১ টা বাজলেই মন ছুটে যায় স্কুলে।
    মেয়ে— —–
    তুমি তো যেতেই পারো স্কুলে। সুজয় কাকু তো বলেছে, একদিন করে স্কুলে যেতে। এখন তো উনিই ইনচার্জ।

    স্যার– তা বলেছে বটে। তবু কোথাও যেন একটা অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। দাবী আর করতে পারি না।
    মেয়ে—
    ও বাবা, তুমি এখনো এসব নিয়ে ভাবছ? এই তো সেদিন আমাদের বড়দি অবসর নিলেন। আমরাও প্রণাম করলাম। বড়দিকে জড়িয়ে ধরে কত মন খারাপ করলাম। বড়দি যত কাঁদে,আমরাও তত কেঁদে ফেলি। কী করব বলো। সময় হলে চলে যেতেই হবে। নতুনদের জন্য পদ ছেড়ে দিতে হবে বাবা। তুমি আর মন খারাপ করো না। শরীর খারাপ করবে।
    স্যার— দূর, বোকা। মন খারাপ করবে কেন? আমি বেশ ভালো আছি। শুধু মাঝে মাঝে —
    জানিস তো মা, যেদিন চলে এলাম স্কুল থেকে। ক্লাস ওয়ানের রিতিশা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আর মুখে বলছে, তুমি যাবে না স্যার। তুমি চলে গেলে কে গল্প শোনাবে? ভুতের গল্প, বাঘের গল্প, আর মজার মজার ছড়া।
    সব ছেলে গুলো গেট আটকে দাঁড়িয়ে ছিল। কী করে ভুলি রে মা? চোখের সামনে ভেসে উঠছে সব।
    মেয়ে— জানি বাবা। সব বুঝতে পারছি। এত কষ্ট পেলে তোমার প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করে ঘুমাও।

    গিন্নী — অনেক হয়েছে। এবার লেখা বন্ধ করো। বেশি রাত না করে ঘুমাও।
    স্যার— তোমরা যাও তো বাপু। বিরক্ত কর না এখন । আমার হাতে অনেক সময়। লেখাটি শেষ করে তবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।
    আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি গিন্নী।
    সামনেই ৫ই সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। ওই দিনই আমাদের বিদায় সম্বোর্ধন।
    মন দিয়ে লিখতে দাও। এখন যাও তো।

    দ্বিতীয় দৃশ্য —-

    অনুষ্ঠান শুরু- হচ্ছে।

    অনুষ্ঠান পরিচালক -/সঞ্চালক
    আজ ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। সেই উপলক্ষে একটি সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
    উপস্থিত বিদায়ী শিক্ষক শিক্ষিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হচ্ছে।

    স্যার– (বারবার কাগজটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। ভালো করে বলতে হবে।) কখন যে আমাকে ডাকবে? তার আগে আরও একবার পড়ে ফেলি।
    সঞ্চালক——
    প্রথমেই একটা সমবেত উদ্বোধন সংগীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করছি।
    পরবর্তী সংগীত শিল্পী প্রস্তুত থাকুন।
    শিল্পী — রমা চৌধুরী।
    তারপর আছে সমবেত নৃত্য। আপনারা শুনতে থাকুন আমাদের অনুষ্ঠান।
    স্যার—- এখন বাজে ১টা। নিশ্চয় একজনের নাচের পরই আমাকে ডাকা হবে। এত ঘাবড়ে যাচ্ছি কেন? না না আমাকে ঘাবড়ালে চলবে না। আমাকে সব বলতে হবে স্কুলের কথা।মন খারাপের কথা। স—— ব।
    সঞ্চালক– পরবর্তী কর্মসূচি এখুনি জানানো হবে। এখন পাঁচ মিনিটের টিফিন ব্রেক নেব। তারপর আবার অনুষ্ঠান শুরু হবে।

    স্যার– আবার ব্রেক!
    একে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কী যে করে এরা? বুঝি না। আমার যে আর তর সইছে না।

    সঞ্চালক—- আবার শুরু হচ্ছে অনুষ্ঠান। এখন আবৃত্তি করবেন– স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা।
    এছাড়া শিক্ষক – আরোহন বন্দোপাধ্যায়।
    স্যার– আর কত দেরী হবে? বুঝতে পারছি না। বেলা হয়ে যাচ্ছে।
    সঞ্চালক– এবার পরপর ডাকা হচ্ছে বিদায়ী শিক্ষক মহাশয়দের। প্রত্যেকের নাম ঘোষণা করছি। আপনারা প্রস্তুত থাকুন।
    স্যার– এই তো ঘোষণা হয়েছে। এবার আমার পালা। ঠিক বলতে পারব তো বলতে? চোখের পাতা মোটা হয়ে আসছে কেন? এরা তো সবাই আমার চেনা। তবু কেন এত কান্না পাচ্ছে?
    সঞ্চালক– প্রথমে ডেকে নেব মানপত্রের লেখাটি পাঠ করতে শিক্ষিকা নাজিমা খাতুন মহাশয়াকে।
    তারপর আরও একটা সমবেত সংগীত। তারপর চলে আসবেন পরপর।

    স্যার– হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। বেলা ৩ টে বাজে।
    দেখি কখন ডাকে আমায়?
    সঞ্চালক — দুঃখিত। সময় আর বেশি হাতে নেই। এবার বিদায়ী শিক্ষকদের উপহার ও বক্তব্য শুনবো আমরা। তারপরই অনুষ্ঠান শেষ করব।আপনারা একটু ধৈয্য ধরে বসুন। কেউ চলে যাবেন না। ওনাদের সম্মানিত করতে হবে। আপনাদের উপস্থিতিটা খুব দরকার।
    স্যার– একি সবাই চলে যাচ্ছে কেন? একটু থাকুন সবাই। আমার বক্তব্য আপনারা না শুনেই চলে যাবেন।
    সঞ্চালক– মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি বিদায়ী স্যার — মনোতোষ মন্ডল মহাশয়কে।
    স্যারের কানে কানে — একটু ছোট করবেন বক্তৃতা। বুঝতে পারছেন সময় হয়ে যাচ্ছে। পরপর চলে আসুন সবাই।
    পরবর্তী ও শেষ বিদায়ী শিক্ষক মহাশয় বিষ্টুপদ মল্লিক মহাশয়। আসুন স্যার স্টেজে আসুন।
    স্যার– থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলেন। সবে মাত্র পকেট থেকে কাগজটা বের করে পড়তে যাবেন। সঞ্চালক কাছে এলেন।
    সঞ্চালক– স্যার,কিছু মনে করবেন না। বুঝতে পারছেন তো। সময় খুব কম হাতে।
    ৪ টে বেজে গেছে। সবাই উঠে পড়ছে। আর সবার কাহিনি একই। এসব শুনলে সবাই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। তার চেয়ে মানপত্র আর উপহার তুলে দিই। কী বলেন স্যার?
    স্যার — (অবাক হয়ে) আমি কিছু বলব না? কেউ শুনবে না আমার কথা? আমি যে এত লিখে আনলাম । কেউ শুনবে না?
    বেশ। তাই হোক।
    কি—চ্ছু বলব না।
    সঞ্চালক — দুঃখিত স্যার। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন স্যারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মানপত্র সহ উপহার। স্যার খুব ভালো থাকুন। এভাবেই তো সবাইকে চলে যেতে হবে। দুঃখ পাবেন না। চলুন স্যার আপনাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিই।
    স্যার– (মুচকি হেসে) থাক। আমি একাই যেতে পারব। এখনো বুড়ো হয় নি। তোমরা অনুষ্ঠান শেষ করো।
    কাগজের টুকরো টা পকেটে গুজে নিয়ে হল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
    স্যার — কাগজটা ছিঁড়ে ফেলি। কী আর হবে রেখে? কেউ শুনল না আমার কথা। গিন্নী ঠিকই বলেছিল,কথাটা শুনলেই ভালো হতো।
    ছাত্রীরা—– স্যার স্যার ভালো আছেন? কত দিন পর দেখছি আপনাকে। আপনার কথা শুনবো বলে স্কুল ছুটি হতেই চলে এসেছি।
    আমি ময়না, মনে আছে স্যার। দশবছর আগে আপনার কাছে পড়েছি। এখন হাইস্কুলে পড়ি। আমি আপনার সেই দুষ্টু ছাত্রী ময়না।
    রাখি— আর আমি রাখি। এখন ক্লাস নাইনে পড়ি। চিনতে পারছেন স্যার।
    স্যার– ও তাই তো।
    চোখে তেমন দেখি না তো?
    চোখটা আবছা হয়ে আসছে।তবু তোমাদের ঠিক মনে রেখেছি।
    ময়না— কী করে দেখবেন স্যার? চোখে যে জল ভর্তি। কাঁদবেন না স্যার।
    চলুন স্যার, ওখানে বসি।
    আমরা শুনবো আপনার কথা। কাগজটা ছিঁড়বেন না স্যার।আমরা সব শুনবো। আপনি পড়ুন।
    রাখি —- আমাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রিয় বকুল ফুল। আমাদের বাগানে ফুটে ছিল শুধু আপনার জন্য।
    পছন্দ হয়েছে স্যার?

    রাখি— আর আমার আঁকা ছবি “রবীন্দ্রনাথ “আপনার জন্য। সারা রাত ধরে এঁকেছি। ভালো হয়েছে স্যার?
    স্যার– (বুকে জড়িয়ে ধরে) খুব খুব পছন্দ হয়েছে। আজ বড্ড খুশিরে। তোরাই তো আমার সব কিছু। তোরাই আমার শ্রেষ্ঠ উপহার। আয় আমার বুকে আয়।

  • গল্প

    গল্প- বৃষ্টি

    বৃষ্টি
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    বৃষ্টি এখন মানসিক কেন্দ্রে। চঞ্চল মেয়েটা কেমন যেন শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক শীতল ধীর সরবরের মতো। এখন সে অন্ধকার ঘরে বসে কি সব আঁকি বুকি আঁকে দেওয়ালে। আর তাকিয়ে থাকে বাইরের আকাশের দিকে।
    বৃষ্টির মা একবার বাড়িতে রঙীন পাখি পুষে ছিল। সময়ে খেত দিত খাঁচায়। বেশ মজা পেত বৃষ্টি । এক দিন দেখল, কিছু লোক এসে বড় পাখি গুলি বাক্স বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি ছুটে এসে মাকে নিষেধ করল। কিছুতেই শুনল না মা। বুঝিয়ে বলল বৃষ্টিকে, পাখি বিক্রি করেই তো দুটো পয়সা হবে সোনা। সেই জন্যই তো পুষেছি।
    বৃষ্টি চুপচাপ শুনল। কি একটা ভেবে চলে গেল। সকালে উঠে মা দেখে অবাক হয়ে গেল। একটা ও পাখি নেই খাঁচায়। বুঝতে আর বাকি রইল না। নিশ্চয় বৃষ্টির কাজ। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
    আমি আর বায়না করব না মা পুতুল কেনার জন্য। পাখি বেঁচে টাকা নিও না। আকাশই ওদের ঘর। কি আনন্দে ওরা উড়ে বেড়ায়,তাই না!
    মায়ের রাগ হলেও বৃষ্টির এমন কথার উত্তর দিতে পারল না। সে দিনের পর আর বাড়িতে কিছু পোষে না ।
    সেই বৃষ্টিই আজ বন্দী । বন্দী খাঁচা যার পছন্দ ছিল না।

    বৃষ্টি নাচে গানে পাড়ার সেরা মেয়ে। মাথা ভরতি কোঁকড়ানো চুল। জ্যাঠিমার কাছে বসে টান টান করে বেনি করত। লাল ফিতে দিয়ে ফুল করে নাচ দেখাত। দিন দিন চঞ্চল ছটপটে মেয়েটা কেমন ভয়ে আতঙ্কে শিউড়ে থাকত।
    একদিন ভোরে রেলস্টেশনের দিকে যেতে দেখল তাকে। ওই দিকেই পুলিশ স্টেশন। পাড়ার কিছু লোক এসে খবর দিল। বৃষ্টির বাবা ছুটতে ছুটতে গেল।
    দেখে, বৃষ্টি রক্ত মাখা ছুড়ি হাতে বসে আছে। বাবাকে দেখেও মুখে কোন সাড়া নেই। বার বার জানতে চাইল কী করেছ বৃষ্টি? ছুড়িটা দেখিয়ে বলল,খুন করেছি। ওই দুষ্টুলোকটাকে। তাই ধরা দিতে এসেছি।
    কে সেই লোক? কী করেছে? সবাই জানতে চায়লো।
    বৃষ্টি বলতে শুরু করল,
    পাড়ার মুদি দোকানদার, রতন কাকুকে খুন করেছি।প্রায় প্রতিদিনই স্কুলের ছোট মেয়েদের খাবারের লোভ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে যেত। আর ইচ্ছে মতো আদর করতো। খুব কষ্ট হতো।কী সব নোংরামো করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত। বাড়িতে বলতে বারন করতো। আমাকে ও প্রায় জোর করে চকলেট খাওয়ানোর লোভে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন টিভিতে এক নাটক দেখেই বুঝেছি । এসব খারাপ মানুষের বাজে কাজ। তাই আজ মেরেই ফেললাম। বড্ড জ্বালা দিত সবাইকে। রাগে মাথা গরম হয়ে গিয়ে ছিল। ছুড়িটা বসিয়ে দিলাম পেটে। ব্যাগে ভরে নিয়ে গিয়েছিলাম স্কুলে। ফেরার পথে বসিয়ে দিয়েছি পেটে।
    ওই সব দুষ্টু লোকদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। বলো বাবা, আমি ঠিক করেছি কি না?
    বাবার মুখে কোন কথা নেই। মেয়ের সাহসীকথায় গর্বে বুক ভরে গেল।
    রতন মারা যায় নি। পুলিশ আহত রতন কে তুলে নিয়ে আসে থানায়।
    কিন্তু বৃষ্টি আর ফিরতে পারে নি স্বাভাবিক জীবনে।
    খাঁচার ভেতর থেকে সে দেখে, আকাশের বুকে কেমন পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। তালি দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে আর
    বলে ওঠে,” যারে পাখি যা উড়ে যা”।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- উপহার

    উপহার
    অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

    ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ দু’হাতে দু’টো ঝোলা ব্যাগ নিয়ে শাড়ির দোকানে অপেক্ষায়। পকেটে হাত দিয়ে দেখেন সামান্য কিছু টাকা পড়ে আছে। কিছুতেই একটা শাড়ি কেনা যাবে না।
    মনোরমাকে প্রতি বছর এই দিনে একটা করে শাড়ি দেন। আজ হাতটা একেবারে খালি।
    দোকানদার বৃদ্ধের হাতে একটা শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল- গত দশ বছর ধরে আপনাকে দেখছি, এই দিনে শাড়ি কিনতে। শাড়িটি নিয়ে যান। সময় মতো শোধ দিয়ে দেবেন।
    কিন্তু উনি বাকিতে কিছুতেই নেবেন না। যদি না শোধ দিতে পারেন। তাই।
    নিজে হাতে যখন সংসার চালাতেন, হিসাব করেই সব কিছু সামলে নিতেন। এখন পুরো সংসারটা ছেলে বৌমার।
    তাছাড়া বয়স হয়েছে আর নিজের কাছে কিছুই থাকে না।
    টাকা চাইতে গেলেই অনেক অজুহাত আর একগুচ্ছ প্রশ্ন। কী হবে এই বয়সে টাকা? যা খেতে চাইবেন বলুন এনে দেব।
    বাজার করা, রেশন তোলা সব কাজ বৃদ্ধকে করতে হয়। ছেলে থাকে বিদেশে। তাই প্রথমে ভালোবেসে নিজেই বলেছিলেন, সব কাজ করব। কিন্তু এখন আর পেরে উঠছেন না। তবু না বলার উপায় নেই।

    বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলের বউ। বাজার নিয়ে বৃদ্ধকে ঢুকতে দেখে বৌমা গর্জে উঠলো। সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি, বাজার আনলে তবে ভাত চাপাবো। আর আপনি বাজারে আড্ডা দিচ্ছেন। এত দেরী হলো কেন শুনি?
    বৃদ্ধ সবে কিছু বলতে যাবে, সামনে এসে মুখে হাত চাপা দিল বৃদ্ধের স্ত্রী মনোরমা।
    অনেক বেলা হলো, এসো বাড়ির ভেতর এসো। এখনো টিফিন করোনি। পিত্তি পড়ে গেলে শরীর খারাপ করবে।
    বৌমা গজগজ করতে করতে বাজার নিয়ে চলে গেল।
    বৃদ্ধ মনোরমার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। আজ আর তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না গিন্নী। মনে আছে গিন্নী, আমাদের বড়খোকা আজকের দিনে নিজে হাতে… মনোরমা আর কিছু মনে রাখতে চায় না
    থামিয়ে দিল স্বামীকে। থাক না। এসব কথা আর শুনতে চাই না।
    মনোরমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, বুড়ি বয়সে এসে আর কিচ্ছু লাগবে না গো। এসো খাবে এসো।
    সন্ধ্যায় একজন ডেলিভারি বয় এসে একটা বাক্স দিয়ে গেল বৃদ্ধের হাতে।
    বাক্সটা খুলতেই দেখতে পেল বড়ো একটা কেক, মায়ের পছন্দের আলতা সিঁদূর আর লাল গরদের শাড়ি।
    একটা সুন্দর খামে লেখা আছে, “মা” আমি কিছু ভুলিনি এখনো। শুভ জন্মদিন
    মা। তোমার জন্মদিনের উপহার।

  • গল্প

    গল্প- নেপালের ঝুলন্ত ব্রীজ

    নেপালের ঝুলন্ত ব্রীজ
    -অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)

     

     

    দূরে দেখা যাচ্ছে একটা ঝুলন্ত দোলনা।
    দোলনা আবার এমন ঝুলে নাকি?
    গাড়ির কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওরা দুলছে। বাহ বেশ তো। তখন থেকেই ইচ্ছে করছে আমিও যাবো। কিন্তু গাড়িটা যে চলছে। থামানোর উপায় নেই।
    কী মজা তাই না! স্রোতস্বিনী নদী বয়ে চলেছে পাহাড়ের ধার বরাবর।
    পাশ দিয়েই পাথুরে রাস্তা। কোথাও উঁচুনিচু আবার কোথাও পিচের তৈরি রাস্তা।
    অনেক জায়গায় কাজ হচ্ছে রাস্তার। তাই আমাদের দোতলা গাড়িটা দুলতে দুলতে চলল।
    ভাবছ,কোথায় যাচ্ছি?
    আমরা যাচ্ছি নেপাল। আমাদের প্রতিবেশী দেশ।
    আমাদের গাড়িটা দোতলা। স্লিপার বাস। তাই খুব একটা কষ্ট হয় নি যেতে। তবে অনেকটা পথ। তাই কখনো শুয়ে কখনো বসে আবার কখনো দাঁড়িয়ে রাস্তার দুপাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি।
    তারই ফাঁকে চোখে পড়ল এই ঝুলন্ত দোলনা। পরে বুঝলাম এটা ঝুলন্ত রাস্তা।
    প্রথম দেখে কিছুটা অবাক হলাম। পাহাড়ের ওপারে যারা আছে তাদের এপারে আসার একমাত্র জলপথ। নেপালের কাঠমান্ডু যাওয়ার রাস্তায় পাশেই স্রোতস্বিনী নদী। যদিও খুব সরু খুব।কিন্তু বেশ গতি। পড়ে গেলেই আর উঠতে পারব কিনা জানা নেই। কিন্তু কাছে যাবো কীভাবে? এ যে অনেক দূরে।

    কিন্তু মনের ইচ্ছে থাকলে ঈশ্বর ঠিক সুযোগ করে দেয়।
    তখন সবে মাত্র গাড়ি থামিয়ে একটা হোটেলে দুপূরের খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। কাঠফাটা রোদে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন হোটেলে আবার কয়েকজন বাসেই বসে আছে। হঠাৎ একবয়স্ক জ্যাঠু বিরক্ত হয়ে বলল,চলো তো সবাই একটু আশপাশে ঘুরে আসি। চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকার চেয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখি।
    যারা রাজি হলো তাদের মধ্যে ছিলাম আমরা। ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার ধার দিয়ে যেতে যেতে খুঁজে পেলাম সেই ব্রিজটা। আরে,এই তো সেই ঝুলন্ত দোলনা। যেটা আমরা বারবার গাড়ি থেকে দেখে আসছি।আর মনে মনে ভেবেছি কখন গাড়ি থেকে নেমে একবার সামনাসামনি দেখব।
    সবাই দৌড়ে গেলাম দোলনার কাছে। নীচে দেখা যাচ্ছে সেই স্রোত। স্থানীয় কিছু মানুষ পিঠে বোঝা নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। হিন্দিতে বুঝিয়ে দিল এটা তাদের যাতায়াতের পথ। ওপারের মানুষের সঙ্গে একমাত্র সংযোগস্থাপন রাস্তা।এটা একটা সম্পূর্ণ তারের ব্রিজ। ব্রিজে পা রাখলেই ব্রিজটা দুলে উঠছে। একপা দুপা যেতে যেতে পৌঁছে গেলাম ওপারে। মনে হলো এভারেস্ট জয় করলাম।
    আসলে তেমন কিছু নয়। তবু ভীষণ আনন্দিত হলাম। এদিকে গাড়ি ছাড়বে, একজন খুঁজতে খুঁজতে এসে বলে গেল,তাড়াতাড়ি এসো। এখুনি গাড়ি ছেড়ে দেবে।
    আমি তখনও ওপারে। এবার ফিরতে হবে। সবাই চলে গেল। সেলফি আর ভিডিও করতে করতে বুঝতেই পারিনি আমি কখন একা হয়ে গেছি। ভীষণ ভয় করছে। ওই সময় একটু বেশী দুলছে মনে হলো। ওপার থেকে মালপত্র নিয়ে আসছিল অনেকে। তাই। একজন নেপালী মেয়ে বুঝতে পেরে হাতটা বাড়িয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল,আমি আছি চলে এসো। ভরসা পেলাম। হাতটা শক্ত করে ধরে ব্রিজ পার হলাম। আসার সময় মেয়েটির সাথে একটা সেল্ফি তুলতে ভুলিনি।
    ছবি তুলতে তুলতে একেবারে বাসের কাছে। কিন্তু বাসের বাকি সবাই রেগে আগুন। এত দেরি হওয়ার জন্য দুচারটি বাংলায় উত্তম-মধ্যম গালাগাল শোনালো। কিছু না বলে চুপচাপ বসে পড়লাম সিটে।তারপর পরিবেশ ঠান্ডা হতে ঝুলন্ত ব্রিজে ওঠার অভিজ্ঞতা সবার মাঝে বিলিয়ে দিতাম।
    বাকিরা শুনে ভীষণ আফসোস করছে। এত সুন্দর একটা স্পট ছিল,তারা জানতেই পারল না।
    আমাদের গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো। দূরে দেখা যাচ্ছে আরও একটা ঝুলন্ত ব্রিজ। আমাদের দোলনা।

  • গল্প

    গল্প- রক্তের দাম

    রক্তের দাম
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    স্বপ্ন দেখে ছিল টিয়া। ভাবতে শিখে ছিল টিয়া। সে অনেক বড়ো হবে। অনেক কিছু শিখবে।
    যখনি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, কি রে টিয়া তুই বড়ো হয়ে কী হতে চাস?
    মিষ্টি হেসে বলতো, কী আবার হবো? আমি তো ডাক্তার হতে চাই। কত মানুষের অসুখ সারিয়ে দেব। কারোর কোনো কষ্ট থাকবে না। আর-একটু বড়ো হই। অনেক পড়াশোনা করতে হবে। তারপর একদিন পড়তে পড়তে ডাক্তার হয়ে ফিরে আসব। কি গো মা আমায় পড়াবে তো ডাক্তারী? মেয়েকে আড়াল করে আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছে নিল বিমলা। টিয়ার মা।
    মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললো, হ্যাঁ রে মা তোকে ডাক্তারী পড়াবো। আমাদের তো এত টাকা নেই। তোকে ভালো করে পড়তে হবে। সরকারি স্কলারশিপ পেতে হবে। তবেই না ডাক্তার হতে পারবি।
    টিয়া হাসতে হাসতে বলল, আমি তো মন দিয়ে পড়ি মা। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন দূর্বল হয়ে যাই। গায়ে বল থাকে না। কিচ্ছু ভাল্লাগেনা তখন। ঠিক তখনই তুমি আমায় হসপিটালে নিয়ে যাও। আবার ছুটোছুটি করে রক্ত যোগাড় করো। আমার জন্য। আমাকে রক্ত দিলে তবে আমি সুস্থ হই।
    কেন মা আমাকে রক্ত দিতে হয়?
    আমার বড্ড কষ্ট হয়। কবে সুস্থ হবো? আর সবার মতো। কবে সবার সঙ্গে খেলাধূলা করবো? মন দিয়ে বই পড়বো? স্কুলে যেতে ক্লান্ত লাগবে না। বলো না মা আর কত দিন পর আমি ভালো হবো?
    মায়ের আশ্বাস বাণী, আর কয়েকটা মাস পরেই সুস্থ হয়ে যাবি সোনা।

    দিন যায় মাস যায়। ক্রমশ ঝিমিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট টিয়া। মায়ের শেষ সম্বল হাতের চুড়ি দুটো বন্ধক রেখেছে পাড়ার সেকরার দোকানে। তবু সমস্ত ব্লাডব্যাংক ঘুরে ঘুরেও টিয়ার গ্রুপের রক্ত পাওয়া গেল না।
    পাগলের মতো ছুটোছুটি করে চলেছে মা।
    এখনো চলছে লকডাউন। করোনা পরিস্থিতিতে সমস্ত ব্লাডব্যাংকে রক্তের আকাল। ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প সেভাবে হয় নি। তাই রক্তের চাহিদা বাড়ছে।
    যদি এক বোতল রক্ত দেওয়া হয় তবেই অন্য গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাবে। টিয়ার মা পাড়ায় জনে জনে হাতে ধরে অনুরোধ করেছে। যদি কেউ এক বোতল রক্ত দান করে। কারোর সাড়া পেল না।
    টিয়া এখন হসপিটালে ভর্তি। ঈশ্বরের পায়ে মাথা ঠুকে প্রার্থনা জানায়, বাঁচিয়ে দাও। আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দাও। ওর যে অনেক স্বপ্ন। ডাক্তার হবার স্বপ্ন। বড়ো হবার স্বপ্ন। কী করে বাঁচাবো টিয়াকে?

    নার্স ছুটতে ছুটতে এসে জানালো আপনার মেয়ে আপনাকে দেখতে চেয়েছে।
    কী হয়েছে আমার মেয়ের? ভালো আছে তো? বিমলা উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো ছুটে গেল কেবিনের দিকে।

    বুক ভরা হাসিতে কাছে ডেকে নিল মেয়ে। “আমি ভালো আছি মা”।
    মা অবাক হয়ে তাকিয়ে মেয়ের দিকে। কী করে সম্ভব হলো? কে দিল রক্ত ?
    ডাক্তারবাবু এসে জানালেন, পাশের কেবিনে শুয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, এই সমস্ত রক্তদাতা ভাই-বোনেদের জন্য এখনো থ্যালাসেমিয়া রোগীরা বেঁচে আছে। সুস্থ আছে। ইনি করিম ভাই। আপনার মেয়েকে রক্ত দিয়েছে। আজ তাই টিয়া ভালো আছে।
    টিয়ার মা হাতজোড় আশীর্বাদ করে বলে, এভাবেই তুমি সবার পাশে থেকো। রক্ত দিয়ে সবাইকে সুস্থ রেখো।
    আজ থেকে তুমি আমার সন্তান। টিয়ার বড়ো দাদা হয়ে থেকো।

  • গল্প

    গল্প- লাল্টু

    লাল্টু
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

    “শীতের মোজা! সোয়েটার গেঞ্জী রুমাল যা লাগবে তাই পাবে। চলে এসো বৌদিরা দাদারা। আমার চলন্ত ভ্যানের সামনে”।
    সেই সঙ্গে সুন্দর একটা গান ভেসে আসছে বক্সে। বাড়ির বাইরে এসে দেখি পাড়ার লাল্টু ভ্যান ভর্তি করে এনেছে শীতের পোশাক। একটু অবাকই হলাম। হাসতে হাসতে বললাম, এই লাল্টু কাল দেখলাম কুমড়ো তরমুজ ভ্যান ভর্তি। আজ আবার শীতের জামা। তোর আসল ব্যবসাটা কী বল তো?
    লাল্টুও মজায় মজে উত্তর দিল, বৌদিমনি যখন যা চাইবে তাই পাবে। আমি হলাম আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। বুঝলে। বেশ জমে উঠল ভীড়। কম দামে সুন্দর সুন্দর মোজা সোয়েটার কে না চায়?
    গানের তালে তালে গান করতে করতে চললো লাল্টু হাটের দিকে। সন্ধ্যার মধ্যেই গেঞ্জি বিক্রি করে খালি ভ্যানে বাড়ি ফিরলো হাসতে হাসতে।
    সকাল হতেই আবার সেই হিন্দি গান চালিয়ে লাল্টু এসে হাজির লেবু, শশা, কুল, আপেল যাবতীয় ফলের ভ্যান সাজিয়ে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি লাল্টু হাসতে হাসতে বলছে, ও বৌদি নেবে নাকি পাকা পাকা ফল। শরীর চাঙ্গা করতে আমি এসে হাজির তোমাদের দোরগোড়ায়।
    আবার অবাক হলাম। আজ সেই লাল্টু ফল সাজিয়ে। আমাকে কিছু বলতে হল না, নিজেই বললো যে দিন যা কম দামে বাজারে পাই, তাই কিনে এনে বিক্রি করি। মানুষের চাহিদা আর আমার মন যা চায় তাই বিক্রি করে আমি আনন্দ পাই।
    আজ ফল দেখছো গাড়িতে। কাল আনব ফুচকা, চানা, আলুকাবলি। ঠিক বিকাল চারটেয়। তোমরা রেডি থেকো কিন্তু। লাল্টুর ফুচকা যে একবার খেয়েছে তাকে আবার খেতে হবে। মুখে সব সময় তার হাসি লেগে আছে। ফলের গাড়িটা এগিয়ে গেল বাজারের দিকে।
    আবার একঘন্টার মধ্যেই বিক্রি করে হাসতে হাসতে লাল্টু বাড়ি ফিরলো।
    সপ্তাহে সাতদিনে সাতরকম জিনিসের বিক্রি। এ এক আজব ব্যবসা। লাল্টুর ব্যবহার, হাসি হাসি মুখ আর বিশ্বাসী মন লাল্টুকে আরও মানুষের মনের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। লাল্টুর ভ্যান ভর্তি যে কোন জিনিস তাই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।
    একদিন বাড়ির সামনে ফুলকপি, বাঁধাকপি, আরও সব্জি নিয়ে হাজির লাল্টু। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। প্রশ্নটা করেই ফেললাম। আচ্ছা লাল্টু এত রকম ব্যবসা কেন করিস? আর তোর যা বুদ্ধি দেখছি ভালো পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করতে পারতিস। এসব রকমারি ব্যবসা করে ক’টাকা পাস?
    লাল্টু ইংরেজিতে গড়গড় করে বললো, আমি মাধ্যমিক পাশ ছেলে বুঝলে বৌদি। কিন্তু তারপর আর স্কুলে যাই নি। কেন জানো বৌদি?
    আমার দাদা বি এ পাশ। একটা চাকরির জন্য ফাইল নিয়ে ছোটাছুটি করেছে এ অফিস থেকে ও অফিস। দিনের পর দিন পরীক্ষা ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে আজ মানসিক প্রতিবন্ধী। উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পায় নি। যেখানেই যায় নেতার দাদা কাকা আর টাকার বান্ডিল চায়। সাধারণ মানুষের জন্য চাকরি কে দেবে?
    বাবার তখন কারখানা বন্ধ। বিবাহযোগ্যা দিদি বাড়িতে। মা পরের বাড়ি কাজ করে আমাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব তুলে নিল।
    লজ্জায় অপমানে দাদা, একপ্রকার পাগল হয়ে ঘরের এককোণে বসে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে সবসময়। তাই আমি আর একমুহূর্ত ভাবিনি। মাধ্যমিকটা পাশ করেই বেরিয়ে পড়ি ব্যবসা করতে। পরের কেরানি গিরি না করে এই স্বাধীন ব্যবসায় অনেক সুখ গো বৌদি। মনে আনন্দ পাই। শান্তি আসে। কিছুদিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ভ্যানটা কিনে নিলাম। তারপর দিব্যি চলছে আমার রকমারি বিক্রি। আর একমাসের মধ্যে লোনটাও শোধ হয়ে যাবে। সামনে মাসে দিদির বিয়ে দিচ্ছি। মাকে আর পরের বাড়ি কাজ করতে দিই না। বাবা এখন খুব খুশি। আর দাদাকে… ভালো ডাক্তার দেখাচ্ছি।
    একমুখ হাসতে হাসতে বললো, এবার আসি গো বৌদি। কাল আনব নতুন ডিজাইনের চুড়িদার,ৎব্লাউজ শাড়ি। কী একটা নেবে তো বৌদি?
    আমি বললাম, তোর মুখের হাসি দেখতে আসতেই হবে তোর গাড়ির সামনে। আর না কিনে উপায় আছে! লাল্টুর সঙ্গে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলাম। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে লাল্টুর ভ্যানের সেই গানটা। “হাসতে হাসতে রোনা শেখো। রতে রতে হাসনা শেখো।”

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- অমূল্য স্মৃতি

    অমূল্য স্মৃতি
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    সত্যিই কিছু বলার ভাষা নেই। কিছু করার ছিল না। সারাজীবন একটা আফসোস থেকে গেল। আর দেখা হলো না।
    একবার আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন অথবা আমারও দেখার ইচ্ছে ছিল খুব। কিন্তু দেখা হয় নি। দেখা করতে পারি নি। বড়ো আফশোস থেকে গেল জীবনে। কেন দেখা করলাম না! কেন একবার দেখতে গেলাম না। সেই সোনা মাটির দেশে। যেখানে সুন্দর একটা স্কুল গড়েছেন। পথের মাঝে সারি সারি গাছ বসিয়েছেন। সবুজে সবুজে ভরিয়ে রেখেছেন।
    সেই সুন্দর এলাকাটা আর আমার সেই প্রিয় দাদাকে আর দেখা হলো না।
    শেষ বার কথা হয়েছিল যখন উনি কলকাতার টাটা হসপিটালে ভর্তি। নানান পরীক্ষা আর কেমো চলছে।
    অনেক দিন থেকেই দাদার সাথে ফোনে কথা হতো। ওনার কাজকর্ম শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। আমাকে একবার যেতে বলেছিলেন ওনার সুন্দর সাজানো সেই কাজরীতে। কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বড়ো আফশোস থেকে গেল।
    অনেক দিন ফেসবুকে দেখতে না পেয়ে মনটা খচখচ করছিল। একদিন সকালে ফোন করেই ফেললাম। আমার সেই ফেসবুক দাদাকে। ফোনের ওপার থেকে বলে উঠলেন, আমি ওনার ছেলে বলছি। বাবা আর বেঁচে নেই। আপনি অঞ্জনাদি?
    আমি বললাম, হ্যাঁ। ছেলে বললো, আপনার কথা খুব বলছিলেন বাবা। একদিন নাকি দেখতে আসবেন। বাবা আর নেই। গত সপ্তাহে মারা গেছেন।

    ফোনটা রেখেদিলাম। কিছু বলার ভাষা নেই। চোখদুটো আবছা হয়ে আসছে। আর দেখতে পাচ্ছি না। ভেসে উঠছে সেই হাসি হাসি মুখটা।
    কেন এমন হয়? চেনা মানুষগুলো এভাবে কেন হারিয়ে যায়?

    ফেসবুক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তার মধ্যে এই ভালো দাদাকে পেয়েছিলাম। আমাকে প্রথম সম্ভাষণ করেছিলেন “বোন” বলে। কী যে ভালো লেগেছিল। নম্র ভদ্র রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার মশাই।
    নামটা আর নাই বা বললাম। জানি না কেন আমাকে খুব পছন্দ করেছিলেন। আমার লেখা, আমার কাজ, আমার কথা নাকি দাদার খুব ভালো লাগে। একদিন পরিচয় করে আসতে চেয়েছিলেন আমার বাড়ি কিংবা আমার স্কুল।
    কিন্তু আনতে পারিনি সেই দাদাকে। লোকে ‘গাছদাদু” বলে ডাকে।
    গাছ পাগল এক দাদা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জীবনের সমস্ত টাকা ব্যয় করেছেন বীরভূমের সিউড়িতে। গাছ বাঁচাও গাছ লাগাও। সিউড়ির কাজরীতে পথে পথে গাছের সারি। আর এখানকার ছোটোদের নিয়ে মেয়েদের নিয়ে গড়ে গেছেন একটা স্কুল।
    নাচ গান ক্যারাটে লেখাপড়া আরও অনেক কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এখানকার মানুষের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। প্রতিদিনই একবার করে কথা হতো। মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম একদিন নিশ্চয় যাবো দেখতে। কিন্তু আর যাওয়া হয় নি।
    যেখানেই থাকো দাদা, ভালো থেকো। আর এই বোনটাকে ক্ষমা করো। নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কে সেই দাদা? কী তাঁর নাম?
    আমার সেই “গাছদাদু” আমার ভালো দাদার নাম উজ্জ্বল রায়। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ওখানকার আনন্দবাজার পত্রিকায় ওনার নাম বারেবারেই প্রকাশিত হয়েছে।
    প্রণাম দাদা। এভাবেই ফেসবুক অনেককেই আপন করে দেয়, আবার অনেককেই নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলি। তখন কেন এত কষ্ট হয়? কেন?

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- রং নম্বর

    রং নম্বর
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

    হঠাৎ একটা অজানা নম্বর থেকে কল। ফোনটা ধরতেই সেই চেনা ডাকে বলে উঠলো, প্রিয়া ভালো আছো? চমকে উঠলো। কে এ? সেই গলা, সেই বলার ধরন? কিছু জানার আগেই বললো, রং নম্বর। ফোনটা কেটে দিলো। তবু মনের মধ্যে একটা কুচিন্তা ঘুরতে লাগলো। তবে কি সে ফিরে এসেছে! নম্বরটা পেল কি ভাবে? ভীষণ ভয় করতে লাগলো প্রিয়ার।
    এ দিকে ওর শরীরটাও দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার কিছুই ধরতে পারছে না।কাজে মন লাগছে না। দিব্যি ভালোই চলছিলো সুখের সংসার। কদিনের জন্য বাইরে কাজে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বাড়ি এলো। সেই থেকে চিকিৎসা করা হচ্ছে, কোনো ভালো কিছু হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ঠিক তখনি বেজে উঠলো ফোনটা। সেই নম্বর থকে। ভরসা করে ধরলো, কে আপনি? বারবার ফোন করছেন? চিনতে পারছো না? নাকি অচেনার ভান করছো?
    চুপ করে রইলো প্রিয়া। সেই বললো, ভয় পেও না। নম্বরটা তোমার বরই দিয়েছে। দুটো নম্বর দিয়েছিল। মনে হয় ওরটা সুইচ অফ। ফোনটা ওকে দাও। ভয়ে ভয়ে বললো প্রিয়া, “কি বলার আমাকে বলো?”
    হা হা হা হেসে উঠলো। এখনো সেই ভীতুটা আছো। বিছানা থেকে বলে উঠলো স্বামী, “কার ফোন?” হাতে দিলাম ফোনটা। অট্টহাসিতে ঘরটা ভরে গেল, “কাল আসছে আমার এক বন্ধু। দেখবে তোমার ভালো লাগবে।”
    জানতে চাইলাম, কে আসছে?
    হাসি মুখে বললো, গাড়িতে কাল এক ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হলো। আমাকে চেনে মনে হয়। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। তোমাকেও চেনে।
    আমার অসুখের কথা শুনে আসতে চাইছে। ঠিকানা দিয়েছিলাম সঙ্গে ফোন নম্বর। দেখি, কি বলে একবার?
    ও জানেই না এই সেইজন। যাকে কথা দিয়েছিল, বিদেশ থেকে ফিরলে বিয়ে করবে প্রিয়া। কি উত্তর দেবে প্রিয়া? কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
    ও কি প্রতিশোধ নিতে আসছে? পুরানো কিছু চিঠি আজও ওর কাছে। সব কি জানিয়ে দেবে ও? ভাবতে ভাবতেই বেলটা বেজে উঠলো। শাড়িটা একটু পড়িপাটি করে পড়লো। মাথার অগোছালো চুলটা সুন্দর করে ছেনে খুলে দিল কাঁধের নীচে।
    জানি না কেন একটু সাজতে ইচ্ছা করছে। এখন ও কি ওর জন্য সেই টানটা- না না এসব কি ভাবছে?
    আস্তে আস্তে গেটটা খুলে দিল। চেয়ে দেখে, একজন সেবক। এ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে দাঁড়িয়ে।
    কাছে এসে বললো, স্যার পাঠিয়েছেন রোগীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্যারের নিজস্ব হসপিটালে। ওখানেই চিকিৎসা করবেন স্যার। প্রচন্ড রোগীর চাপ। তাই আসতে পারেননি। তার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। প্রিয়া মনে মনে বললো, তুমি ঠিক আগের মতই আছো ।

  • গল্প

    গল্প- জেদ

    জেদ
    -অঞ্জনা গোড়িয়া

    তানিয়াকে নিয়ে একেবারে প্রিন্সিপালের সামনে। ছটপটে মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেছে। মুখে কথা নেই।
    তবু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়ার বাবা। মুখে মৃদু হাসি। প্রিন্সিপ্যাল হতবাক।
    কী ব্যাপার? তানিয়ার এ কি অবস্থা? ওর কী হয়েছে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
    তানিয়ার বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হয় পরীক্ষা নিন। নয় তো উত্তীর্ণ করে দিন মেয়েকে। নাহলে ওকে বাঁচাতে পারবো না।
    দুজনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্ত থেকে অনড়।
    দুই মেয়ে। তানিয়া আর নাজিমা।
    পড়াশোনায় বেশ ভালো। গরীব বাবার স্বপ্নটা তারা পূরণ করবেই। বাবার স্বপ্ন মেয়েদের ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
    তাই অভাবের সংসারে থেকেও মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি। পড়াশোনায়ও খারাপ নয়।
    যদিও তিনি জানতেন, এই স্কুলে পড়াশোনা মানে বিশাল খরচ। কী করে সামলাবে?
    প্রিন্সিপ্যাল সব জেনে কিছুটা মাহিনা ছাড় দিয়েছিলেন।

    বাবার রোজকার বলতে পুরানো লোহা ভাঙা কাঁচ ভাঙা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সংগ্রহ করা। তা নিদিষ্ট দপ্তরে গিয়ে বিক্রি করা। সেই সঙ্গে বাসনপত্র বিক্রি করা। চলে যেত ভালোই।
    কিন্তু সমস্যা হলো করোনা আর লকডাউন। স্কুল বন্ধ হলো। কারবারও বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো অনলাইন ক্লাস। চাই একটা স্মার্টফোন। দু’টো মেয়ের জন্য দু’টো ফোন। কোথায় পাবে ফোন কেনার টাকা? আর কেনই বা কিনবে?
    এখানেই বাবার তীব্র আপত্তি। কিছুতেই মেয়েদের হাতে ফোন তুলে দেবে না।
    বাড়িতে এখন একটাই ফোন। তাও কি প্যাড। যদিও স্মার্টফোন একটা কিনে দিতেই পারে। তবু ফোন হাতে দেবে না মেয়েদের। বাবার কথায় শেষ কথা। মেয়েদের হাতে ফোন দেব না। ফোন যত সর্বনাশের মূল।
    স্কুলে অনলাইন ক্লাস শুরু। কিন্তু দুইবোনের অনুপস্থিতি। বাবাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত দুই বোন। বাড়িতে মেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় অনেক খানি শিখেছে। কিন্তু ক্লাস করে নি। তাই প্রত্যেকটা ক্লাসে অনুপস্থিতি। এমন কি অনলাইন পরীক্ষা তাও দেওয়া হলো না। বড় মেয়ে বারবার করে বললো, একটা ফোন কিনে দাও বাবা। দু’বোনে ভাগ করে ঠিক পরীক্ষা দেবো।
    বাবার জেদ কিছুতেই দেবো না ফোন। কেউ পরীক্ষা দিতে পারলো না। ক্লাস না করায় নিয়ম অনুযায়ী দুইবোনই ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো না। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে একবছর থাকা মানে বিশাল খরচ। তার ওপর ওরা বাড়িতে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়ে ছিল পরীক্ষার।
    যদি একবার অফলাইন পরীক্ষা দিতে সুযোগ পায় নিশ্চয় পাশ করবে। কিন্তু স্কুলের নিয়ম সবার জন্য এক।
    যেদিন মার্ক শিট দিল স্কুলে, ঘটে গেল সেই ভয়ানক ঘটনা। বড় মেয়ে কয়েকটা ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়ে ফেললো। আর ঘুম ভাঙলো না। ঘটে গেল বিপত্তি। হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে ঠিকই কিন্তু প্রাণ চঞ্চলা মেয়েটা কেমন ঝিমিয়ে গেল।
    ফাদার সব জেনেও নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। নিয়ম বিধি ভাঙতে পারবে না।
    বাবার এক কথা এভাবে স্মার্টফোন কিছুতেই দেবো না মেয়েদের। তারও কারণ ভয়ানক। আজও মনে পড়লে শিউরে ওঠে বাবা।
    স্মার্টফোনের কারণেই নিজের ছেলেকে বছর দুয়েক আগে হারিয়ে ফেলেছে। একটা কষ্ট করে স্মার্টফোন কিনে ছিল। সবার সুবিধার জন্য।
    ছোট ছেলে লুকিয়ে ফোনে গেম খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে গেল। একদিন ভয়ানক সেই খেলায় অসুস্থ হয়ে মারা গেল। বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুতেই মানতে পারে নি এই মৃত্যু। এর জন্য স্মার্টফোনকেই কাঠগোড়ায় তোলে বাবা।
    তারপর থেকে বাড়িতে নেই স্মার্টফোন। কোনোদিন কিনবেও না ফোন। তাই আর অনলাইন ক্লাসও করতে পারবে না দুই বোন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কায় বড়ো মেয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
    সব শুনে তানিয়ার জেদের কাছে মাথা নত করলো দুই ফাদার। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক স্কুল যত দিন না হচ্ছে এভাবেই ক্লাস করতে হবে মেয়েদের। বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা স্মার্টফোন দেওয়া হলো স্কুল থেকে। কিন্তু কড়া নির্দেশ ক্লাস আর নোট লেখার পর অফ রাখতে হবে ফোন।
    তানিয়া তাতেই রাজি।
    এখন দুই বোনে স্মার্ট ফোনেই ক্লাস করছে। এবছর অনলাইন পরীক্ষায় তারা সবচেয়ে ভালো ফল করেছে। তবে ফাদারের কথা মতো ক্লাস শেষে ফোনটা থাকে বাবার কাছে। তাতে কোনো আপত্তি নেই। স্মার্টফোন এখন ক্লাসরুম। স্মার্টফোন নিয়েই চলছে পড়াশোনা। তানিয়ার জেদের কাছে মাথা নত করলো বাবা।

You cannot copy content of this page