-
অণুগল্প- ঘোমটা
ঘোমটা
– শম্পা সাহানতুন বৌ দেখতে গ্রামের বৌ ঝি’রা ভিড় করেছে। চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের বৌ, আবার নাকি বিদেশী! তাই ভিড় যে দেখার মত তা বলাই বাহুল্য।
চৌধুরী গিণ্ণীও আজই ছেলের বৌ’কে প্রথম দেখবেন। ছেলে জানিয়ে ছিল বটে যে সে বিদেশী মেয়ে বিয়ে করতে চায়, ভিক্টোরিয়া না কি যেন নাম!
গিণ্ণী প্রথমে রাগ রাগ করলেও পরে মেনেও নিয়েছেন। বাব্বা, বিদেশী বৌমা বলে কথা! আশেপাশের দশ গাঁয়ে কাদের বাড়ি আছে বিদেশী বৌ? ছেলে বলেছে, এখন থেকে এখানেই থাকবে।
তবে এতো সহজে কি মানে, চৌধুরী বাড়ির লোকজন! সেদিন দিদি নাম্বার ওয়ান-এ দেখালো কেমন সুন্দর বিদেশী বৌ, ফর্সা টুকটুক করছে! তার মুখে আধো আধো বাংলা! আহা! আর ভিক্টোরিয়া নাম যখন তখন রানী ভিক্টোরিয়ার মতন সুন্দরী হবে!
বিদেশী বৌ গাড়ি থেকে নামলো। ওমা! শাড়ি পড়া! আবার ঘোমটা দেওয়া! রণ শিখিয়েছে নিশ্চয়ই। দেখি দেখি! মোটামুটি বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আর বৌ ঘাবড়ে গিয়ে ঘোমটা খুলে ড্যাবড্যাব করে দেখতো লাগলো চার পাশের লোকজন!
যেন বাজ পড়লো হঠাৎ। ফিসফিস, গুনগুন, চাপা হাসি, বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল! চৌধুরী গিণ্ণীর হাতের বরণ ডালা হাতেই রয়ে গেল, বরণের জন্য আর উঠলো না।
গিণ্ণীমা দাপাতে দাপাতে ফিরে চললেন বাড়ির ভেতর। নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে খিল দিলেন। বাইরে থেকে শোনা গেল চাপা কান্না আর গর্জন, “তুই এভাবে আমাদের ঠকালি?”
লোকজন বেশ স্থির, নড়তে চায় না। বড় বাড়ির এই রং তামাশা তো সহজে দেখা যায় না। গ্রাম্য জীবনে বেশ আলোড়ন ওঠার মত ঘটনা, বেশ কদিন রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে আলোচনার মত বিষয় পাওয়া গেছে!
রণ জানতো মা কালো একদম পছন্দ করে না, তবে এতোটা বাড়াবাড়িও আশা করেনি! এই জন্যই আগে থেকে বাড়িতে জানায় নি যে ভিক্টোরিয়া নাইজেরিয়ান, ওর কোনো ছবিও পাঠায়নি!
ভিক্টোরিয়াও বুঝতে পারছে না, হঠাৎ কি হল? “হোয়াই দে আর সো অফেন্ডড?” রণ তো বলেছিল, “এভরিথিং ইজ ওকে”!
রণ কি করে ভিক্টোরিয়া কে বলে, ওর গায়ের রং দেখার আগে পর্যন্ত, “এভরিথিং ওকে”- ই ছিল! কি করে বলে যে বিদেশী দুশো বছরের আগ্রাসন থেকে ওরা এখনো মুক্ত হতে পারেনি!
ভিক্টোরিয়ার মুখ থেকে ঘোমটা সরে যেন আমাদের নির্লজ্জ দাসত্বের মানসিকতাকে এক ঝটকায় বে-আব্রু করে দিল এক বিদেশীর সামনে।
-
অণুগল্প- অন্য এক চকলেট দিবস
অন্য এক চকলেট দিবস
– সুদীপা ধরআজ সোহমের খুব আনন্দ। গার্লফ্রেন্ডের সাথে মান অভিমানটা বোধহয় আজকেই শেষ হবে। দেখা করতে বলেছে সোহম, শ্বেতাকে। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর শেষ পর্যন্ত রাজি হয় শ্বেতা। বিকেল সাড়ে চারটায় দেখা করার কথা আউট্রাম ঘাটে।
ঝগড়াঝাঁটি হলেও সোহমকে শ্বেতা নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু অভিমানটা শ্বেতার একটু বেশি, বরাবর সোহমকেই ভাঙাতে হয়।
খুব সেজেছে শ্বেতা। ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে সোহম তাকিয়ে আছে শ্বেতার দিকে, কিন্তু গুরুগম্ভীর শ্বেতা তাকাচ্ছে না সোহমের দিকে। নদী বক্ষের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাই হোক সোহম ভালো করেই জানে এই মেয়ের অভিমান সহজে ভাঙে না, তাকেই ভাঙ্গাতে হবে। আলতো করে শ্বেতার হাত ধরে প্রথম কথা—
“শ্বেতা আর কতদিন এইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? কথা বলবে না তো? ঠিক আছে চলে যাচ্ছি তাহলে।”
ছলছল চোখে শ্বেতার জবাব “ঝগড়া করার সময় মনে থাকে না। আর এখন এত ভালোবাসা দেখাচ্ছ তুমি!”
“ওরে আমার অভিমানী মেয়ে, হয়েছে বাবা আর ঝগড়া করবো না। চলো এবার ওখানে গিয়ে একটু বসি।”
অদ্ভুত আনন্দে শ্বেতার মনটা ভরে যায়। ও ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই কদিন রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারে নি। যাইহোক অনেক কথা বলার পর সোহম এক বিরাট চকোলেটের বাক্স এগিয়ে দিল শ্বেতার হাতে।
“শুভ চকলেট দিবস। নাও তোমার সমস্ত প্রিয় চকোলেট এরৎমধ্যে সাজিয়ে এনেছি। অভিযোগ করার সুযোগ আমি আর দেব না।”
চকোলেট পেয়ে শ্বেতা হু হু করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল। থাকতে না পেরে সোহোম জড়িয়ে ধরলো শ্বেতাকে।
অনেক দূর থেকে একটি ছেলে লক্ষ্য করছিল। কাছে এসে দু’টো ভিক্ষা চাইল সোহমের কাছে। আধময়লা,ছেঁড়া জামা, উস্কোখুস্কো চুল কিন্তু চোখ দু’টো মায়ায় ভরা। সোহম ওর দিকে একশো টাকার একটা নোট বার করে দিলো। ছেলেটা পেয়ে খুব খুশি। চলে যাচ্ছিল হঠাৎ করে শ্বেতা ডাকলো —
“এই শোন। এদিকে আয় তো।”
ভয়ার্ত চোখে গুটি গুটি পায়ে ছেলেটা হাজির হলো শ্বেতার সামনে।
শ্বেতা বললো “আজকে কি দিন জানিস?”
ছেলেটি বললো, “না”
“চকলেট দিবস। বুঝেছিস।”
ছেলেটি বললো, “দোকানে সাজানো থাকে দেখেছি। কি সুন্দর দেখতে। কিন্তু কোনোদিন খেতে পাইনি তো, তাই জানতেও পারিনি জিনিসটা কি?”
শ্বেতা বললো, “তাইতো এটা তোর জন্য।”বিস্ফোরিত চোখে ছেলেটা একবার সোহম আর একবার শ্বেতাকে দেখছে। ও ভাবতেই পারছে না এই দুর্লভ বস্তুটা কোনোদিন ওর হাতে কেউ এভাবে দেবে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেটা চকলেটের বাক্সটা নিয়ে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি বলবে ছেলেটা নিজেই বুঝতে পারছিল না, কিছুক্ষণ পরে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো—
“তোমরা যে ভীষণ ভালো দাদা দিদি” বলেই দৌড়ে চলে গেল।
আজ এই দিনে অদ্ভুত এক আনন্দে আর গর্বে সোহমের বুকটা ভরে গেল শ্বেতার জন্য। শ্বেতার এইরূপ সোহম কোনদিন দেখে নি। বাচ্চা মেয়েটার অভিমানটাই খালি দেখেছে সোহম এতদিন, কিন্তু তার ভেতরে যে এত বড় হৃদয় আর একটা বিরাট মন লুকিয়ে ছিল, সোহম আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলো । সোহম ভাবল ও তার চলার পথের জীবনসঙ্গিনীটিকে ঠিক বেচেছে। এক অদ্ভুত আনন্দে সোহম শ্বেতাকে বুকে টেনে নিলো।
-
অণু গল্প- ত্রাণ
ত্রাণ
-বিশ্বদীপ মুখার্জীলাইনটা বেশ লম্বা। কতক্ষণে শেষ হবে তার নেই ঠিক। আকাশের রোদটাও বেশ কড়া হয়েছে ইতিমধ্যে। গত সপ্তাহের এক বিশাল ঝড়ের তাণ্ডবে নিজের প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে দেওয়া কিছু লোকেদের ত্রাণ সামগ্রী বিলি করতে এখানে আমার আসা। কিছু বন্ধুদের সাথে এসেছি। সাহায্যের জন্য সাথে আছে লোকাল পুলিশ। আমি প্রায় দেখছি লাইনের পিছন দিকে দাঁড়ানো এক গরীব বৃদ্ধ লোক সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। তাকে বলা হচ্ছে – ‘আপনি লাইনে দাঁড়ান। আপনাকেও দেওয়া হবে। আমরা এখানে আপনাদের সাহায্য করতেই এসেছি। কেউ বাদ যাবে না।’
কথা শুনে সেই বৃদ্ধ লোকটি আবার পিছনে চলে যায়। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার সে এগিয়ে আসে। প্রায় দু’ তিনবার এমন করার পর আমার এক বন্ধু একটু চড়া কন্ঠস্বরেই তাকে বলল – ‘আপনার অসুবিধেটা কী? আপনাকে বারবার বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন না? যদি আবার এমন করেন তাহলে কিন্তু আপনাকে কিছু দেওয়া হবে না।’
সেই বৃদ্ধ লোকটি শান্ত কন্ঠে বলল – ‘বাবা, আমি কিছু নিতে আসেনি, দিতে এসেছি।’
একথা বলে সে নিজের কোমরের কাছের ভাঁজ করা ধুতি থেকে বেশ কিছু কয়েন বের করে সামনের টেবিলে রাখলো।
‘গুনে নিও বাবা। পুরো দেড়শো টাকা হবে। এবার চলি। তোমরা ভালো থেকো। ঈশ্বর তোমাদের আশীর্বাদ দিক।’
লোকটি এই বলে চলে গেল। আমরা অবাক হয়ে সে দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঈশ্বরদর্শন কি এটাকেই বলে?*সমাপ্ত।*
-
অণু গল্প- দাহ
দাহ
-শক্তি পুরকাইতঅরিত্র ভুলতে পারছে না, যে মা নেই। অফিসে ফোনটা আসায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সকালে মা’কে দেখে বেরিয়েছিল। আর নেই। তার চোখ ছল ছল করে ওঠে। অরিত্র কাঁদতে চেষ্টা করে, পারে না । বুকটা খালি করতে। সে এগিয়ে যায়। একটা একটা লাশ দেখতে দেখতে। পাশে ট্রাক, আ্যম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। সামনেই চোখ পড়ে যায় মা’কে দেখে। সবুজ তুলসী পাতা দিয়ে ঢাকা চোখ। বোন অনুষ্কা মা’কে জড়িয়ে ধরে হাউ – হাউ করে কাঁদছে। প্রথম সারিতে মা। কিছুক্ষণ পরে চলে যাবে আগুনে। তাই অপেক্ষা করছে কয়েকটা মিনিট। মা’কে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অরিত্র থাকতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে, মা- আ! তখনও বাইরে থেকে ভেসে আসছে শব্দটা — বলো হরি , হরি বোল্ …