-
অণু গল্প- প্রতীক্ষা
প্রতীক্ষা
অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)তুমি তো বললে ফিরে আসবে? কেন এলে না? বলো বলো কেন ফিরলে না?
আমার সব অপরাধ । কেন পারলে না ক্ষমা করে দিতে। সত্যি বলছি এবার থেকে যা বলবে সব কথা শুনবো। সব কাজ করব। তুমি শুধু ফিরে এসো।
ডেডবডির সামনে হাঁফুস নয়নে কেঁদে ফেলল জিত। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।
এক একসপ্তাহ চুপটি করে ছিল। একফোঁটা ও কাঁদে নি। কেন এলে না ফিরে? উত্তর দাও মা? উত্তর দাও?
চিৎকার করে কেঁদে ফেলল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে।
মায়ের ডেডবডির সামনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। বাথরুমে গিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে অবাধ্য ছেলেকে ভয় দেখতে চেয়ে ছিল।
ছুটির দিনে দুপুর বেলায় ছেলেকে বাড়ি থাকতে বলে ছিল।মায়ের কথা না শুনে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিছু বাজে ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
তাই ছেলেকে ঘরে ফেরাতে এমন পদক্ষেপ নেবে,ছেলে ভাবতেও পারে নি। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। ছেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল। মায়ের গায়ে শুকনো কাপড় জড়িয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, সবাইকে খবর দেওয়া – সব ছেলে করে ছিল।
তবু শেষ রক্ষা হয় নি।
একটা অপরাধবোধে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে।
মায়ের ডেডবডির সামনে ছেলের আকুতি – বলো মা বলো কেন আমাকে অপরাধী বানিয়ে চলে গেলে? ফিরে এসো মা।আর অবাধ্য হব না। একবার ফিরে এসো। মা —
এভাবে আগুনে পুড়ে মারা যাবে,মা ছেলে কারোর জানা ছিল না। চিতার সামনে ছেলে উন্মাদ কান্নার শব্দে মৃত মায়ের চোখটা যেন জলে চিকচিক করে উঠলো। কেউ যেন বলে উঠলো, আবার আসব ফিরে। একটু শুধু অপেক্ষা। -
অণু গল্প- স্বপ্ন সন্ধানী
স্বপ্ন সন্ধানী
-রাণা চ্যাটার্জীঠেকে এলি কিন্তু এমন গুম হয়ে কি ভাবছিস বলতো অয়ন !!এত কিসের ভাবনা?
না রে কিছু না বলে সিগারেটে টান দিতেই পুলক পাশ থেকে প্রশ্ন ,’ কি ভাবছিস বল ভাই,তোর বাড়ি গিয়েও দেখছি কি সব কাগজে কি সব হিসেব আর ভেবেই চলছিস!
পল্টু ফুট কেটে বলল সবাই মিলে আয়নক্স যাই,ফিল্ম দেখে পিৎজা খেয়ে ফিরবো।
থাক না ওসব ,পুজো আসছে হাতে টান আছে,এসব পরিকল্পনা না হয় অন্য একদিন হবে।
কি বলিস রে অয়ন তুই।দিল দরিয়া তোর কিনা অর্থের টান!আগে প্রায় খাওয়াতিস তুই! এখন কি প্রেমে ইনভেস্ট করছিস,তাই চিন্তা মগ্ন!না রে ,পুজোর চার দিন কিছু ভিখারিকে ভিক্ষা করতে নিষেধ করেছি,ওদের নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা ছিল ।ওদের সংখ্যাটা আর কিছু যদি বাড়াতে পারতাম খুশি হতাম কিন্তু আমি নিরুপায়।
‘কি ভাবনা তোর শুনি?ভিক্ষা করতে মানা করলে ওদের চলবে কি করে?পুজোর দিন গুলোতে ওদের ভিক্ষা করতে বারণ করে ,কি প্লান তোর মাথায় আসছে না কিছু ‘বলে মাথা চুলকে সুকান্ত থামতেই শান্ত গলায় অয়ন বললো, বলছি দাঁড়া বলে আর একটান দিয়ে সিগারেটের আগুন জুতোয় নিভিয়ে বসলো।
“তেমন বিরাট কিছু ভাবিনি রে-পাড়ার একটা হোটেলে বলে দিয়েছি ওরা এলে যেন যত্ন করে খাওয়ায়,তাচ্ছিল্য না করে ,খাবারের বিল মেটাবো আমি । দেখলাম চল্লিশ টাকা করে মিল হিসাবে পাঁচ জনের দুবেলার খাবারের দায়িত্ব নেবার আটশো টাকা হাত খরচায় জমেছে আমার”।
কি দারুন ভাবনা রে বন্ধু!এত সুন্দর করে কজন ভাবে বল!আমরা সবাই একটু দায়িত্ব ভাগ করে নিলে এত অভাব থাকে না ওদের পূজার দিনে।
হম রে ভীষণ মানসিক শান্তি। ওদের নির্ভেজাল হাসি আসলে আশীর্বাদ স্বরূপ।অল্প হলেও
দায়িত্ব নিয়ে দেখ ভালো লাগবে। শুধু নিজে ঘুরবো-ঠাকুর দেখবো ,পূজায় আনন্দ,খাবো এসব না করে ওরাও কটা দিন একটু চিন্তা মুক্ত হয়ে ঠাকুর দেখুক।আমিও রাজি অয়ন। সামান্য টিউশানি করি তাই দুজনের দায়িত্ব নিতেই পারি। পল্টু বলল আমিও নেব।
বাহ,এভাবেই আমার ভাবনা যদি ছড়িয়ে পড়ে, খুশি গুলো বাঁটোয়ারা করতে পারি তবেই আমার শপথের সার্থকতা।তোদেরও খুব ভালো হোক।কথা দিলাম বিবেক পরিশুদ্ধ হয়ে দারুন কাটবে পূজা।
-
অণু গল্প- কালো সরকার
কালো সরকার
-সুবিনয় হালদারআমাদের পাড়ার কেলোদা- মানে কালো সরকার, রূপে গুনে এমনই যে অদ্ভুত- অতুলনীয়, কিম্ভুত কিমাকার ! কখনো হাসেনা আর হাসলে পরেই তার দাঁতগুলো যা একটু সাদা পরিষ্কার মনে হয় ! ইদানীং কালে সেটাতেও মরচে-ধরেছে দেখছি ! সবাই সব জানা স্বত্বেও এমন ভান করে-, যেন সেই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি একেবারেই সাধুপুরুষ ! যা কিছু সব ভালো তিনিই তার একমাত্র অধিকারী ! এহেন কালো সরকার যৌবনে প্রেম রোগে আক্রান্ত হয় এবং অনেক কষ্ট-কসরতের পর তার পরিণয় শেষ হয় ! কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার সেই রোগের ছন্দপতন ! বিচ্ছিন্ন ভাঙা সংসারে কালো সরকার তার যৌবন,জৌলুশ পুনরুদ্ধারে প্রাণপাত করে চলে ! সেই সঙ্গে তার শ্যাওলা-পড়া দাঁত-বের-করাটা আজকাল মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়েছে এবং সাথে-সাথে হাত,পা,নখগুলো পূর্বের চেয়ে বেশী মাত্রায় সর্বদা এগিয়ে– ; সম্মুখে পড়ছে ! মনে হয় তিনি কোন এক অশনিসংকেতের আশঙ্কা পাচ্ছেন। তাই তার বাহ্যিক আর আভ্যন্তরীণ চরিত্র টালমাটাল ! মানে অভিনয় সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে হিমসিম খাচ্ছে ! যাইহোক, কথায় আছে-না- “শেষ ভালো যার সব ভালো তার”, আমরা সবাই প্রকৃতপক্ষে এই সংসার সমরাঙ্গনের রঙ্গমঞ্চে প্রাণপাত করে চলেছি নিরন্তর ! কেউ সফল কেউবা……! আশা করি কালো সরকার মানে আমাদের কেলো’দা, সসম্মানে মরচে পড়া দাঁত, নখ, হাত, পা-এর মেকআপ খুলে পরিষ্কার শুদ্ধ শরীরে তার ভয়ঙ্কর অভিনয়ের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে এসে, কৃতি মানুষের পুরষ্কারটি গ্রহণ করবে- অসহায় দুস্থ মানুষের স্বার্থে !!
-
অণু গল্প- পিতৃপরিচয়
পিতৃপরিচয়
-অঞ্জনা গোড়িয়া সাউবয়স ৭,বছর। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের কোলে চলে এসেছিল দিদার বাড়ি। তারপর থেকে নিজের বাড়ি চোখে দেখে নি।
বাবা কে? তার মনে নেই। কোনো দিন খোঁজও করে না। মা আবার একটা বিয়ে করেছে দোজবরে। এই বরেরও একটি ছেলে আছে। প্রথমে বলে ছিল, মেয়েকে নিজের করে নেবে। কিন্তু পরে বেঁকে বসে এ পক্ষের বর। সাফ জানিয়ে দিল, এই মেয়েকে বাপের বাড়ি রেখে এসো। মেয়ের আসল বাবাও আবার একটা বিয়ে করেছে। তাই বাপের বাড়ি রেখে আসতে চায় না মা। সেই থেকে দিদার বাড়িটাই তার ঘর। দিদাই তার মা -বাবা।
এতদিন খিচুড়ি স্কুলে ছিল।এবার প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হবে। প্রয়োজন একটা পিতৃপরিচয়। মেয়েটির দু-দুটো বাবা। তবু সে পিতৃহীন।দিদার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট মেয়ে অহনা। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্যারের দিকে।
দিদা বারবার কাকুতি মিনতি করছে স্কুলের হেড স্যারের কাছে। অহনার অভিভাবক হিসেবে দিদার নাম থাকুক স্কুলের খাতায়।
প্রশ্নটা আপনাদের কাছে রাখলাম। বলুন মেয়েটির প্রকৃত অভিভাবক কে? দুটো বাবা থাকা স্বত্তেও কেউ দায়িত্ব ভার নিতে রাজি নয়। অথচ দিদা পরের বাড়িতে কাজ করে মানুষ করতে চায় ছোট্ট অহনাকে। কে হবে অহনার অভিভাবক?স্যার, সরকারি নিয়ম মেনে জানিয়ে দিলেন, পিতার নাম এবং জন্ম সার্টিফিকেট ও আঁধার কার্ড জমা দিলে তবেই ভর্তি করা সম্ভব।
দিদা বেঁকে বসে। একটাই প্রার্থনা, আমি যখন মানুষ করছি, তখন আমার নামই থাকবে। যে বাবার অত্যাচারে জন্মের পাঁচ বছর পর ছোট মেয়েকে নিয়ে মাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে। সেই বাবার নাম কেন রাখব বলুন?
মেয়ের মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় জন্ম সার্টিফিকেট ফেলে এসেছি।
মেয়েকে সঙ্গে এনেছি, বলে আর দেবে না বলেছে।
অসহায় অহনা, মা-দিদার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কি পড়া হবে না মা? আমি কি স্কুলে আসব না? -
অণু গল্প- নববর্ষ
নববর্ষ
-রাণা চ্যাটার্জীওরে তোরা ওঠবি কখন!আজ নববর্ষ! বাবার ডাকে তড়াক করে উঠে ঘুম জড়ানো বাসিমুখে দুইভাই বোন পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানালো ।স্নান সেরে ঠাকুর প্রণাম সেরে বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে রুমকি বললো,বাবা তুমি ভাইকে নিয়ে লক্ষীশ্রী, রায় ক্লথ যেও।আমি মায়ের সঙ্গে সন্ধ্যায় শ্রী বস্ত্রালয় যাবো হালখাতা করতে।
আনন্দে লাফিয়ে ভাই বলল নবদূর্গা, স্বর্ণ জুয়েলার্সও যাবো তো।আরে তাই তো,রূপক তোর যে পোয়া বারো বলে সবাই হেসে উঠলো।
এবছর সাতটা দোকান থেকে হালখাতার নিমন্ত্রণ পেয়ে উচ্ছসিত রূপক। শুধুই অপেক্ষার দিন গুনছিল ।নববর্ষ মানেই অদ্ভুত একটা আনন্দ আকাশে বাতাসে। সবে শেষ হাওয়া চৈত্র সেলে খান তিনেক নতুন জামা হয়েছে তার। সকাল থেকে প্রভাত ফেরি আয়োজন,রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাদকতা মেখে ছোট বড়ো সবাই মন্দির,রাস্তায় নেমেছে।
দিদি তুই তো গত বছর রায় ক্লথ যাস নি,কোল্ড ড্রিংকস,এত বড় প্যাকেট আর জানিস একটা চাবির রিং উপহার দিয়েছিল।জানি তো ভাই,ওই জন্যই তো তোকে পাঠাচ্ছি।এসে বলিস কিন্তু কি কি হলো।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলো রুমকির।মা বলে হেঁকে ফেলেছিল ভুলে। এ কি এতক্ষণ কি তবে সে স্বপ্নে পৌঁছে গেছিলো শৈশবের হালখাতা,নববর্ষ উৎসবে।!মা বাবা আজ কেউ বেঁচে নেই,ভাই স্কটল্যান্ডে সেটল।চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো রুমকির।আয়নায় নিজেকেই শুভ নববর্ষ শুভেচ্ছা জানিয়ে সংসারের কাজে মন দিলো।
-
অণু গল্প- বৃক্ষরোপণ উৎসব
বৃক্ষরোপণ উৎসব
-সুজিত চ্যাটার্জিকারা যেন বৃক্ষরোপণ করেছিল পৃথিবীকে সবুজ করে তোলবার অঙ্গিকারে।
সম্ভবত সেটা একটা কবি সাহিত্যিক গোষ্ঠী।
অনেকেই আমন্ত্রিত। হাজিরার সংখ্যা নেহাৎ মন্দ ছিল না যদিও সেটা ছিল প্রভাতী অনুষ্ঠান।
প্রভাত বলতে মেট্রো শহর অবিশ্যি দশটার আগে জাগে না।
তবুও রবিবার ব’লে রক্ষে।
ছুটির গন্ধ গায়ে মেখে স্নিগ্ধ সুষমায় পরিবেশ গড়ার ভাবনায় বিমোহিত হয়ে ,
কল্পজগতের ভাবুকতা সমেত সমবেত মণ্ডলীর সহাস্যমুখ বিজ্ঞান ভাষণের প্রাজ্ঞতায় সবিশেষ করতালি ধ্বনি মুখরিত হলো আকাশে বাতাসে।
যন্ত্রণার যন্ত্র মাইকের অমাইক ব্যবহারে লজ্জিত হলো শব্দদূষণ।
শহুরে ফুটপাতের কোল ঘেঁষে ভূমিষ্ঠ হলো শিশু বৃক্ষ পরম আদরে।
হলো জল সিঞ্চন। নিরাপদ লৌহ জালের বেষ্টনীর কঠিন বন্ধনে বাঁধা রইলো শিশু তরুর ভবিষ্যৎ ।
ফুটপাতের চা দোকানি কালি দা র ফোকলা মুখে চওড়া হাসি। তিনশো টাকার বাড়তি বিক্রির খুশিতে।
সেই খুশির বহর আরও চওড়া হলো বৎসরান্তে।
শিশু তরু র কৃষ্ণপ্রাপ্তি হয়েছে নিদারুণ অবহেলায় অচিরেই । তবুও অটুট আছে সেই লৌহ জালের কঠিন বেষ্টনী।
সেটি বর্তমানে ফুটপাতের চা দোকানি কালি দা র নিরাপদ হেফাজতে।
এঁটো চায়ের ভাঁড় ফেলার চমৎকার জায়গা রুপে ।। -
অণু গল্প- হেভেনিয়া
হেভেনিয়া
-শম্পা সাহাএকটা গোলাপি শহরের সরু মেঠো রাস্তা ধরে একটি মেয়ে একা হেঁটে চলেছে।হলদে গাছের মাথায় মাথায় সোনালী ফুল।চেনা নয় তবু সুন্দর।যা কিছু মন।ভালো করে তাই তো সুন্দর!তাই নয় কি?
গোলাপি কেন ?কারণ শহরের প্রতিটি বাড়ি ,রাস্তা, গম্বুজ, চার্চ, দোকান পাটে গোলাপি র উৎসব।অবাক লাগছে সুন্দর লাগছে ,নেশা ধরে যাচ্ছে।
মাথার উপরে চমকে তাকায়!আকাশ দেখি তো!নাঃ আকাশ এখানে নীল ই তবে স্বচ্ছ পরিস্কার, চাঁদটাও স্পর্শ। মেঠো হলদে পথ জ্যোৎস্না য় বড় মায়াময় রহস্য জনক।
বাড়ি ঘর গুলোও চেনা ধরনের নয়!স্বচ্ছ,যেন।কাঁচের তৈরি!ভেতরে মৃদু গোলাপি আলো আর সুগন্ধ বাতাস ,মনে হয় ওই সোনালী ফুল গুলোর।গন্ধটা অনেটা কাঁঠালি চাঁপার গন্ধের মত।সুন্দর কিন্তু নেশা ধরানো।
মানুষ জন রাস্তায় নেই, আকাশে চাঁদ।অদিতির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা রাত!কিন্তু সে এখানে এলো কি করে? কে নিয়ে এলো তাকে?
ওর পরনে রাত পোশাক।কাকতালীয় ভাবে এটাও একটা গোলাপি স্বচ্ছ গাউন।এটা বাপী ওর সতেরো বছরের জন্মদিনে এনে দিয়েছিল।
ক্লান্ত হয়ে বসলো একটা গাছে হেলান দিয়ে।একটু জল।পেলে মন্দ হতো না।ওমা!এই তো এক বোতল জল!হ্যাঁ জল ই তো।গোলাপি বোতলে সুগন্ধি জল।ভয়ে ভয়ে অদিতি নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখে।গোলাম জলের মত গন্ধ তবে অতটা তীব্র নয়।খাবো?খেয়েই নি?প্রথম এক ঢোক মুখে ঢালতেই ভালো লাগলো।এ চেনা গোলাপ জল নয়।মাকে মাঝে মাঝে বিরিয়ানি তে দিতে দেখেছে।একবার বেশী পড়ে যাওয়ায় তো কেউ খেতেই পারেনি।কিন্তু এ জল।বেশ সুস্বাদু অনেকটা রুহ আফজার মত।
কিন্তু ওখানে এলো কি করে?এ জায়গাটা অবশ্য একেবারে অচেনা নয়।চেনা চেনা।হ্যাঁ তাইতো।এই রকম এক দেশের গল্প ই তো ও রাতে শোবার আগে পড়ছিল।ওটা পড়তে পড়তেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ে।
ওখানেই তো এই রকম গোলাপি ঘরবাড়ি, হলুদ মাটি হলুদ গাছ,সোনালী ফুলের কথা লেখা ছিল।ও এক ভিন্ন গ্ৰহ হেভেনিয়া!কিন্তু ও এখানে কি করে?এতক্ষণে অদিতি বোঝে ও আসলছ স্বপ্ন দেখছে!জোরে চিমটি কাটে নিজের হাতে।উঁ….লাগছে যে! তাহলে এ স্বপ্ন নয়?
-
অণুগল্প- মাস্টারমশাই
মাস্টারমশাই
-মানিক দাক্ষিতমাঝরাতে ফোনটা বাজতেই ঘুমটা ভেঙে যায়।
একরাশ বিরক্তিতে ফোনটা ধরতেই শুনতে পাই কষ্টকর কম্পিত এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর।
-মাষ্টারমশাই, কি ব্যাপার এত রাতে ফোন! শরীর ভালো আছে তো?
– না বাবা, শরীরটা ভালো নাই। মনে হচ্ছে শেষ সময়। কথা কটা না বলে শান্তি পাচ্ছি না, তাই তোমায় রাতদুপুরে ফোন করলাম। বহুচর্চিত তোমার গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বঙ্গসংস্কৃতি’ আজ ডাকে পেলাম। বইটি তুমি আমায় উৎসর্গ করেছো। মনে-প্রাণে আনন্দের জোয়ার। সার্থক হলো জীবন।ফোনটা কেটে যায়।
স্মৃতিতে ভেসে ওঠে স্কুলজীবনের কত ছবি। অশ্রুসজল চোখে মনে মনে করজোড়ে বলি, “মাষ্টারমশাই, আপনিই তো সেই পঞ্চম শ্রেণীতে স্কুলের নতুন ম্যাগাজিনে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন একটা কবিতা ‘ভোরের আলো’।
-
অণুগল্প- মানু’র চোখে জল
মানু’র চোখে জল
–সুজিত চট্টোপাধ্যায়রাত প্রায় বারোটা।
এইমাত্র শবদেহ দাহ করে ফিরলো মানু। কথাটা মা’কেও জানালো না। মা জানলে এই শীতের রাতে তাকে স্নান না করিয়ে ছাড়বে না। মাথা খারাপ, জেনেশুনে সেই ভুল কেউ করে ?
অবিশ্যি এমন ঘটনা মানুর এই বাইশ বছরের জীবনে প্রথম ঘটলো এমন নয়। এটা যেন ওর নেশার মতো। খবর পেলেই ছুট। কত যে শবদাহ কাজে অংশ নিয়েছে মানু সে হিসেব কে-ই বা রাখে। ওর শুধু মনে হতো চলে যাওয়া মানুষটার শেষ যাত্রায় যাত্রী হয়ে তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। স্বজন হারা শোকার্ত পরিবারের পাশে সহমর্মিতা নিয়ে পাশে থাকা যায়। ভালো লাগে। নিজের অন্তরের পবিত্রতার পরশ পাওয়া যায়।
মানু র বাবা বলতেন,,,
আমার চার ছেলে। আমি মারা গেলে চার ছেলের কাঁধে চড়ে যাবো।সময় বড়ো দ্রুত পাল্টে যায়। পাল্টে যায় ব্যবহারিক গতানুগতিক ধারার জীবনের গতি।
কালের নিয়মে একদিন মানু মানে বর্তমানের মৃন্ময় মুখার্জি যিনি একটি বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের সি ই ও,, তার বাবা একাশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন।
এখন কেউ কাঁধে চড়ে যায় না। শেষ গন্তব্যের জন্য বিশেষ যানের ব্যবস্থা আছে। একেবারে সাজানো গোছানো মানে না ফেরার দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যেমনটি সাজগোজের নিয়মমাফিক প্রয়োজন তার সুচারু বন্দোবস্তো করাই আছে শুধু দাম ধরে দিলেই হবে।
নাহঃ,, বর্তমানের অন্তিম যাত্রায় খাট লাগেনা। কাঁধে গামছার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হাতে অগুরু সুগন্ধির যুগ আর নেই।
হরিধ্বনি তে ও গুরুগম্ভীর ভাব। সেই উচ্চস্বরের চঞ্চলতা কোথায় হারিয়ে গেছে। মৃতের পায়ের তলায় আলতা লাগিয়ে সাদা ফুলস্কেপ কাগজে ছাপ তুলে রাখার কথা কারোর মনেই আসেনা আর। বুক চাপড়ে কেঁদে দাঁতে দাঁত চেপে ফিট্ হয়ে যাবার দিন শেষ। এখন গম্ভীর মুখে ফিসফিস করে কথা আর হালকা করে নাকের সর্দি টানার মতো আওয়াজ করেই শোক প্রকাশ করা রেওয়াজ।
এক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হয়ে চলেছে।
” যেতে তো একদিন সকলকেই হবে, দু’দিন আগে কিংবা পরে। ”
এহেন দার্শনিক ধারার কথাবার্তা গুনগুন করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।রাত প্রায় বারোটা ।
মৃন্ময় মুখার্জি ( মানু ) একা ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,,
” বাবা, তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারলাম না। সময় পাল্টে গেছে বাবা। এখন সবাই বড্ড একা।
যাবার কালে তো অবশ্যই ।
ক্ষমা করে দাও বাবা,, ক্ষমা করে দাও,,,। ”
না না,, মৃন্ময় মুখার্জি নয় ,
মানু র চোখে জল ,, পরিতাপের।। -
অণু গল্প- গর্ভগৃহ
গর্ভগৃহ
-অঞ্জনা চক্রবর্তীশ্বশুরবাড়ি, সুবুচনী সত্যনারায়ণ পুজো। বাড়ি ভর্তি পাড়াপড়শী; আত্মীয় বন্ধু সমাগম।
বিবাহ পরবর্তী প্রথা বলে কথা-
বেনারসী-আর ধুতি জোড়ে বসেছে আবার নারায়ণ শিলার সামনে। বাড়ি ভর্তি ধূপ ধুনো কর্পূর গন্ধ।
আচমকা উঠতে গেল নতুন বউ- মহুয়া। মেঝেতে রক্ত। লেগেছে বেনারসী জুড়েও। সোমকের নতুন ধুতিতেও। সবাই চোখাচোখি -মা, পিসি, কাকিমা…আরো কত চোখ, পুজো ছেড়ে রক্ত অনুবীক্ষণ যন্ত্রে।
মহুয়াকে বলল শাশুড়ি- ফিসফিস করে, যাও বাথরুমে যাও।
-মা, পরে যাব, পুজো শেষ হোক আগে।
সমানুপাতিক একটু গলা চড়িয়ে বলল মহুয়া যাতে সবাই শুনতে পায়। শাশুড়ি একটু বিরক্ত।
আবার বসে পড়ল সোমকের পাশে।
সোমক হতভাগা হতোভম্ব।
কাকিমা এগিয়ে এসে বলল- মা, পুজোর সময় এই অবস্থায় বসতে নেই- থাকতে নেই- জানোই তো…
মহুয়ার উত্তর, আমার অসুবিধা হচ্ছে না কাকিমা। পুজো শেষ হলে ন্যাপকিন নিয়ে নেব।
-চুপ চুপ…আস্তে কথা বলো বৌমা- বাড়ি ভর্তি পুরুষ-
কথা বাড়ালো না মহুয়া। তবে গ্যাট হয়ে বসে রইল।
-কি হল বৌমা উঠলে না? শাশুড়ির ঝাঁজ।
-আমি তো বললাম পুজো শেষ হোক। আমার পুজো দেখতে ভালো লাগছে মা।
-নতুন করে কি নিয়ম শেখাতে হবে? বাড়ি ভর্তি কাকা দাদা…ঠেলা দিয়ে বলল শাশুড়ি। খানিক বিরক্ত- বৌমার রকম দেখে।
পুরুতমশাই মন্ত্র পড়ছে- আদিত্যং বিষ্ণুং সূর্যং ব্রহ্মানঞ্চ বৃহস্পতিম….
মহুয়ার কোলে এসে বসল পাঁচ বছরের দেওর আর্য্য। সাদা পাঞ্জাবী -ফর্সা টুকটুকে। একটু মৃদু হেসে উঠল মহুয়া। ততক্ষণে আদির পাঞ্জাবী জুড়ে বৌদির মাসিকের রক্ত -সেই দেখে ছুটে এসেছে আর্য্যর মা। আর্য্যকে কোল থেকে তুলে নিতে চায় আর ও যাবে না –টাগ অফ ওয়ার, শেষে মা পরাস্ত হয়ে হাল ছেড়েছে।
শুরু হয়েছে আর্য্যর প্রশ্ন- বৌদি তোমার কোথায় কেটে গেছে? কেন এতো রক্ত ঝরছে?
মহুয়ার উত্তর- ঠাকুরের গর্ভগৃহে গেছো? আমার গর্ভগৃহ প্রস্তুতি নিচ্ছে মাসে মাসে রক্তপাত হয়ে-জন্ম দেবে একটা প্রাণ তোমার মতোই…
আর্য্য- তবে কেন ওরা পুজো থেকে উঠিয়ে দিচ্ছে তোমায়?
– আসলে রক্ত পড়লে তো কষ্ট হয়। একটু বিশ্রাম -শুয়ে বসে থাকতে বলে –সব কাজ থেকে ছুটি এ ক’দিন। পুজোরও অনেক কাজ থাকে। তাই পুজোতে বসতে দিচ্ছে না।
সবাই থ। থমথমে পরিবেশ। ঠাকুর মশাই ততক্ষণে আরতি শেষ করে শান্তি জলে- ওঁম শান্তি, ওঁম শান্তি, ওঁম শান্তি…